স্বপ্নের জাদুকরী – ২

কিন্তু একদিন হীরালাল শিউরে উঠেছিল। একদিন গভীর রাতে তার আচমকা ঘুম ভেঙে গেছল! রাতের আকাশটা জানলায় মুখ ঝুঁকিয়ে উঁকি দিচ্ছে। আকাশ-ভরতি তারাদের ঝিকিমিকি। বাইরে, গাছের অন্ধকারে জোনাকিরা টুপটাপ আলো জ্বেলে, উড়ে-উড়ে কী যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে। চারিদিক ভারি নিশ্চুপ, থমথমে। ছোট্ট একটি গাছের পাতা মাটিতে পড়ে খসখসিয়ে উঠলে মনে হয়, কী ভয়ংকর তার শব্দ! এমন সময় হঠাৎ মনে হল, কে যেন আলতে-পায়ে চুপি-চুপি এদিকেই এগিয়ে আসছে। আর বলব কী, ঠিক তক্ষুনি ওর ঘুম-ভাঙা চোখ দুটির দৃষ্টি কেমন যেন আপনা থেকে ওই মড়ার মাথাটার ওপর গিয়ে পড়ল। উঃ! হঠাৎ যেন মনে হয়, কী বীভৎস সেটা! যেন হীরালালকে দেখে সেটা হেসে উঠেছে! মাথাটা চোখের খাবলা-খাবলা গর্ত-দুটো খুলছে আর বন্ধ করছে! ফোকলা মুখটা হাঁ করছে বার-বার! মনে হচ্ছে, কী যেন গেলার জন্যে খাবি খাচ্ছে আর ঢোঁক গিলছে! বলব কী, ঠিক তক্ষুনি একটা পেঁচা ডেকে উঠল ক্যারকেরে গলায়, ক্যাঁক-ক-ক, ক্যাঁক ক

ধড়ফড়িয়ে উঠে পড়েছে হীরালাল, ভয়ে। সঙ্গে-সঙ্গে ওর কানে বেজে উঠল নূপুরের রিনিঝিনি। তারপরেই আবার সে শুনতে পেল সেই মেয়েটির গলা, সেই মিষ্টি ডাক, হী-রা-লা-ল!’

ওই ডাক শুনে হীরালালের তক্ষুনি-তক্ষুনি নিজের ভুলে-যাওয়া নামটা মনে পড়ল কি না জানি না। কিন্তু হীরালাল কেমন হতভম্ব হয়ে গেল। চোখের পাতা দুটি থমকে স্থির। বোবার মতো চুপটি করে ঘরের চারপাশটা দেখতে-দেখতে সে নিজের মাথার বালিশটা খামচে ধরল।

আবার সে ডেকে উঠল, হীরা-লা-ল!’

মাথাটা ঝিমঝিম করছে হীরালালের।

হী-রা-লা-ল!’ আবার ডেকেছে।

 বাইরে একটা তক্ষক ‘তোক খোক, তোক খোক’ করে দুবার ডেকে থেমে যেতেই আবছা-আবছা একটা ছবি হীরালালের মনের ভেতর ভেসে উঠছে আবার হারিয়ে যাচ্ছে। কী ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার। কিছুই মনে করতে পারছে না সে। যেটুকু মনে পড়ছে, সেটুকুও ধরে রাখতে পারছে না। আর থাকতে পারল না হীরালাল। বালিশে মুখ গুঁজড়ে ফুঁপিয়ে উঠল।

অবিশ্যি সে-ডাক সে আর শুনতে পায়নি। শুনতে পায়নি সেই নূপুরের রিনিঝিনি। ওই মড়ার মাথাটাও আর হাসছে না। চোখও মটকাচ্ছে না। তবুও হীরালালের চোখে আর ঘুম এল না। বাকি রাতটুকু জেগে জেগে সে ছটফট করতে লাগল! আর ভাবল, এ কোথায় সে এসেছে!

সকাল হয়েছিল যখন, তার অনেক আগেই হীরালাল বিছানা ছেড়ে উঠে পড়েছে। ও যখন উঠেছে তখনও ম্যাজিকঅলার অর্ধেক রাত। লোকটা তেড়ে ঘুম দিচ্ছে আর ফোঁসফোঁসিয়ে নাক ডাকাচ্ছে! বিছানা ছেড়ে ওই জানলাটার ধারে একটু দাঁড়াল হীরালাল। এখনও কালো রাতের আবছা ছায়া আকাশের দিকে মুখ বেঁকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তবে আর বেশিক্ষণ থাকতে হবে না। একটু পরেই মানে-মানে সরে পড়তে হবে।

আহা! কাল রাতেরবেলা ওই নূপুরের রিনিঝিনি কে বাজাল!

হাওয়ায় দুলে-দুলে কার পায়ের নূপুর এমন করে বাজে! এ কি স্বপ্নের পরি কোনো! না কি আর কেউ!

 হীরালাল ঘরের দরজার কাছে এসে দাঁড়াল। খুব সাবধানে খিলটা সে খুলে ফেলল। তারপর আলতো পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নেমে এল। ছুটতে গেল, পারল না। তখন আর এক বিপদ! জানতে পারেনি হীরালাল, সেই তিনটে লোক তাকে ধরবে বলে ভোরের আলো-ছায়ার অন্ধকারে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে আছে। তাই যেই হীরালাল ছুটতে গেছে, সঙ্গে-সঙ্গে ধরে ফেলেছে। তারপর তাকে চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে কোথায় যে ছুটল কেউ জানতেও পারল না।

 হ্যাঁ, ছুটল তারা এক পাহাড়ের গুহায়। হয়তো তারা হীরালালকে মেরে এই পাহাড়ের গুহায় ফেলে রেখে যাবে। কেউ টেরও পাবে না। কেননা ছেলেটা জেনে ফেলেছে তারা সৈনিক। কথাটা আরও পাঁচ কান হয়ে ছড়িয়ে পড়লে তাদেরই প্রাণ রাখা দায় হয়ে যাবে!

কিন্তু না, তারা প্রথমেই মারল না হীরালালকে। তাকে ভালো করে দেখল তারা। হীরালালও কী বলবে, কিছু ভেবে না পেয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল তাদের মুখের দিকে। কারণ সে চিনতে পেরেছে এই লোক তিনজনকে। এখন বেশ মনে পড়ছে তার, এরাই তো সেই জঙ্গলে পোশাক পালটে ছদ্মবেশ পরেছে।

এই তিনজনের মধ্যে যে পালের গোদা সে-ই হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, ‘এই ছেলেটা, তুই কেমন করে জানলি আমরা সৈনিক?’

হীরালাল চুপ করে রইল।

 সে ধমক মারল, ‘চুপ করে থাকলে ওই পাহাড়ের ওপর থেকে নীচে ফেলে দেব।’

হীরালাল মুখটা কাচুমাচু করে বলল, ‘দেখুন, আমি তো কাউকে কিছু বলিনি।’

বলিসনি মানে!’ সে আবার ধমক দিল।

 হীরালাল জিজ্ঞেস করল, ‘কবে বলেছি বলুন তো! আমার তো মনে পড়ছে না।’

‘আবার মিথ্যে কথা বলছিস! সে তেমনি তেড়ে কড়কে উঠল। হীরালালের গলাটা টিপে ধরে বলল, ‘বল, নইলে গলা টিপে মেরে ফেলব।’

হীরালাল কথা বলতে পারল না। ওই লোকটার হাতের চাপে ওর দম আটকে আসছে। চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। হীরালাল ছটফটিয়ে উঠল।

হয়তো আর-একটু হলেই ওর সত্যিই দম আটকে যেত। ঠিক সেই সময় আচমকা যেন সেই মেয়েটির গলার স্বর চিৎকার করে উঠল, ‘শয়তান, তোমরা ওকে মারছ কেন?’

 থমকে গিয়ে চমকে উঠেছে সেই তিনটে লোক! এই রে! এই সময়ে এই অন্ধকার গুহার হদিস কে পেল! কে জানল, এখানে ছেলেটাকে ওরা ধরে এনেছে! হীরালালকে মারা তো দূরের কথা, এখন তারা পালাতে পারলে বাঁচে! আর তারা সত্যিই হীরালালকে ছেড়ে ভোকাট্টা!

সেই মেয়েটির গলার স্বর আবার চেঁচিয়ে উঠল, ‘পালাচ্ছে, তিনটে সৈনিক পালাচ্ছে।’

তার গলার স্বরটা স্পষ্ট হচ্ছে যতই, ততই তাদের বুক কাঁপছে। দৌড়, দৌড়, একেবারে গুহার ভেতরে, অনেক ভেতরে তারা দৌড় মারল। কিন্তু যতই ছুটছে তারা, সেই মেয়েটির গলার স্বর ততই তাদের কানের ভেতরে ভয়ংকর শব্দে চিৎকার করে উঠছে!

ছুটতে-ছুটতে তারা হাঁপাচ্ছে। আর বুঝি তাদের বাঁচার রাস্তা নেই। এবার তাদের নির্ঘাত মরণ!

 না, হঠাৎ থেমে গেল সেই চিৎকার। ভয়-পাওয়া বুকের কাঁপুনিটা তবু থামতে চায় না তাদের। তবু ছুটছে। তারা। তারপর সত্যিই যখন সেই চিৎকার ছুটে-ছুটে আর তেড়ে আসছিল না, তখন তারা দাঁড়াল। অন্ধকার গুহার পাথরের মধ্যে চটপট গা-ঢাকা দিয়ে লুকিয়ে পড়ল।

তারা অনেকক্ষণ লুকিয়ে ছিল। অনেকক্ষণ পর যখন মনে হয়েছিল, হয়তো আর কেউ নেই এখানে, তখন তারা পাথরের আড়াল থেকে চুপিসারে বেরিয়ে এসেছিল। অসহ্য কষ্ট এখানে! গুহাটা যেমন ঘুরঘুট্টি অন্ধকারে ছমছম করছে, কষ্টে ওদের মুখগুলোও তেমনি শুকিয়ে চুপসে গেছে! ভীষণ তেষ্টা পেয়েছে ওদের। এই সময় কেউ যদি ওদের একটু জল দেয়! একটু খাবার জল। একটু জলের জন্যে এই নিস্তব্ধ গুহাটা ওদের দম-ফাটা নিশ্বাসের শব্দে চমকে উঠছে! একজন হাঁপাতে-হাঁপাতেই আর্তনাদ করে উঠল, ‘একটু জল, একটু জল।’

আর একজন বলল, ‘বাইরে যেতে হবে।’

 কিন্তু বাইরে যাবে কেমন করে! এই গুহার ভেতর থেকে কোন পথ দিয়ে তারা বাইরে যাবে? সে তাদের জানা নেই। তার ওপর বাইরে গেলে যদি ধরা পড়ে যায়। তাই শেষজন বলল, ‘না, বাইরে গেলে আরও বিপদ হতে পারে। আমরা ধরা পড়ে যাব।’

‘তবে কি আমরা এখানেই মরব!’ রেগে উঠল প্রথমজন।

শেষজন বলল, ‘অত ব্যস্ত হলে চলে না। এই গুহার আরও ভেতরে চ। নিশ্চয়ই পথ খুঁজে পাব। আর একটু কষ্ট করলে হয়তো আমরা বাঁচতে পারি!’

‘বেশ, তাই সই।’

 তিনজন গুহার আরও ভেতরে পাথর টপকে হাঁটা দিল।

হাঁটতে-হাঁটতে হঠাৎ এ কী হল!

 এই ঘুরঘুটি অন্ধকারটা যেন একটু-একটু ফ্যাকাশে হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে, অন্ধকার কালোটা একটু একটু বেগুনি-বেগুনি আলো হয়ে উঠছে! সত্যিই তো! তবে কি আর একটু হাঁটলেই বাইরে আলো দেখতে পাবে! তিনজনের মুখেই হাসি ফুটল! আঃ! কী আনন্দ!

না তো! হঠাৎ গুহার সেই বেগুনি আলোর রং সবুজ হয়ে উঠল যে! যেদিকে চাও, শুধু সবুজ আর সবুজ। গুহার ভেতরটা সবুজ। পাথরের গায়ে-গায়ে সবুজ। ওদের পায়ে-পায়ে সবুজ, যেন চলছে, ফিরছে, থমকে থমকে থেমে পড়ছে!

থেমে পড়ল তিনজনা। সবুজ আলোর ধাঁধায়, ওদের চোখ ঝলসে উঠেছে। হঠাৎ ঝরনার মতো টুংটাং শব্দ করে কত বাজনা বেজে উঠল শোনো! এই গুহার সবুজ আলোয় যেন কাদের পায়ে নেচে উঠল সুরের বুনুঝুনু! দেখ, দেখ সেই সবুজ আলো গুহার দেওয়ালে কত ছবি এঁকে দিয়েছে। সেই ছবিদের কেউ নাচে, কেউ গান গায়, কেউ মৃদঙ্গ বাজায়। অবাক চোখে চেয়ে থাকে তিনজন লোক।

 কিন্তু হঠাৎ এ কী দেখল ওরা!

কী দেখল?

এ তো আঁকা ছবি নয়। এ ছবিরা তো জীবন্ত হয়ে ওদের চোখের সামনে দুলছে। ওই তো, ঠান্ডা জলের পাত্র হাতে ওই জীবন্ত ছবিরা যেন ডাকছে ওই তিনটে লোককে! আঃ! ওদের তৃষ্ণা যেন বেড়ে যায়! তিনজনেই হাত বাড়িয়ে ছুটে গেল।

কিন্তু কই জল! ওই দেওয়ালের ছবির মানুষেরা ওই তিনটে লোককে ছুটে আসতে দেখে যেন লুকিয়ে পড়ল!

না, লুকোয়নি। ওই তো তাদের দেখা যাচ্ছে একটু দুরে! দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে হাতছানি দিচ্ছে।

আবার ছুটে গেল তিনজন সেইদিকে।

 এবারও ফুস-মন্তরের মতো তারা হারিয়ে গেল! দেখা দিল আবার আর-একদিকে।

তারপর তিনটে লোক এদিক ছোটে, ওদিক ছোটে! আর দেওয়ালের ছবি এ-পাশ আসে, ও-পাশ পালায়! শেষে একটু তৃষ্ণার জলের জন্যে ছোটাছুটি আর লুকোচুরি শুরু হয়ে গেল। ছুটতে-ছুটতে প্রাণান্ত তাদের। এবার তারা ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। আর তাই মাটি থেকে তুলে নিল পাথর। ছুঁড়ে দিল ওই ছবির মানুষের দিকে! পাহাড়ের গায়ে শব্দ উঠল, ঠং! ঠক! ঠাস!

কিন্তু এ কী! পাথর ছোঁড়ার সঙ্গে-সঙ্গে সেই ছবির মানুষেরা যে উবে গেল! সেই ছবির মানুষের জায়গায় তো কটা ছবির জন্তু দেখা যাচ্ছে! কটা গাধা! কটা ছাগল! কটা শুয়োর!

ওই জন্তুগুলোকেই মারবে বলে ক্ষিপ্ত হয়ে ওই তিনজন মানুষ আবার পাথর ছুড়ল। অমনি চক্ষের নিমেষে সেই গাধা, ছাগল, শুয়োরের দল পাহাড়ের গায়ে আঁকিবুকি ছড়িয়ে দৌড় মারল। লোক তিনটেও লাগাল তাড়া।

.

ছুটছে জন্তুরা

ছুটছে তিনটে লোক।

 হঠাৎ সেই ছুটন্ত জন্তুদের তালে-তালে বেজে উঠল দামামা, ডিড্ডিম-ডিম-ডিম! ডিড্ডিম-ডিম-ডিম!

বাজনা বাজছে। এখনও বাজছে।

 জন্তু ছুটছে। এখনও ছুটছে!

হঠাৎ থেমে গেল বাজনা

যাঃ! চক্ষের পলকে জন্তুগুলো উধাও! সঙ্গে-সঙ্গে শোনা গেল, ঝিরিঝিরি ঝিরিঝিরি! গুহার পাথরের গা বেয়ে পাহাড়ি ঝরনার জল গড়িয়ে পড়ছে।

ঝিরিঝিরি! ঝিরিঝিরি!

আঃ! জল! চারিদিকে জল! আর তর সইল না সেই তিনটে লোকের। ছুটে গেল তারা। আঁজলা ভরে জল তুলে নিল। তারপর মুখে দিল। প্রাণ ভরে চুমুক দেয় আর গায়ে ছড়ায়! আঃ! তবু যেন শান্তি নেই। যত পারে খাক!

কিন্তু দেখ, দেখ জল খেতে-খেতে ওরা কেমন যেন পালটে যাচ্ছে! ওদের তো আর মানুষের মতো দেখতে লাগছে না! যেন মনে হচ্ছে, একটা গাধা, একটা ছাগল আর একটা শুয়োর!

হ্যাঁ, ঠিক তাই!

আচ্ছা আজব কাণ্ড তো!

তবে তো হীরালাল ম্যাজিকের খেলা দেখাতে-দেখাতে সেদিন ঠিকই বলেছিল, বাবুরা একদিন চার পায়ে হাঁটবে!

হ্যাঁ, আজবই তো! ওই দেখ-না, নিজেরাই নিজেদের দেখতে-দেখতে আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠছে! ছাগল, শুয়োর, গাধার ডাকে গুহার গহ্বর গমগম করে উঠল। প্রাণের ভয়ে তারা ছুট দিল অন্ধকারের ভেতর থেকে গুহার বাইরে।

ঝিরিঝিরি!

 সেই পাহাড়ের গা গড়িয়ে সেই জলের শব্দ এখনও শোনা যাচ্ছে। তিন জন্তু ছুটছে!

জলের শব্দ তবু শোনা যাচ্ছে, ঝিরিঝিরি!

গুহার অন্ধকার হালকা হচ্ছে। আলো আসছে। ওরা বাইরের রাস্তা দেখতে পেল। গুহায় যখন ঢুকেছিল, তখন ওরা ছিল তিনজন মানুষ। আর এখন যখন বাইরে এল,

একটা গাধা, লম্বা কান।

একটা ছাগল, শুকনো দাড়ি।

একটা শুয়োর, ছুচকো মুখ।

 এ ওর দিকে চায়। কান নাড়ে। ঠ্যাং ছোড়ে। ল্যাজ নাচায়। কিন্তু কথা কয় না। ফ্যালফেলিয়ে চেয়ে থাকে!

 এখন ঝরনার ঝিরিঝিরি শব্দের সুরটা কেমন পালটে গেছে। বাইরে এখন রিনিঝিনি রিনিঝিনি করে কার যেন পায়ের নূপুর বাজছে।

ওরা বাইরে এসে কান পাতল। এদিক দেখছে, ওদিক দেখছে। তারপর হাঁটা দিল। হাঁটতে-হাঁটতে ছোটা দিল। ছোটা দিল পাহাড়ের ওপরে! গাধা উঠতে গিয়ে ছ বার পড়ে। ছাগল পড়ে ক বার। শুয়োর গড়ায় ন বার। তারপর তিনটে জন্তুই থমকে যায়! চমকে দাঁড়ায়! আরে, সেই ছেলেটা না!

হ্যাঁ, হীরালাল। পাহাড়ের পাথর ডিঙিয়ে-ডিঙিয়ে সে হাঁটছে। হাঁটতে-হাঁটতে কাকে যেন খুঁজছে!

সেই তিনটে জন্তু ঝটপট লুকিয়ে পড়ল। উঁকি মেরে দেখতে লাগল হীরালালকে।

হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে হীরালাল কথা বলল, ‘আর কতদূরে যেতে হবে? তুমি আমায় কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?’

 কার সঙ্গে যে কথা বলল ছেলেটা, তিনটে জন্তু বুঝতেই পারল না। কিন্তু তারা শুনতে পেল সেই মেয়েটির গলার স্বর। সে জিজ্ঞেস করল হীরালালকে, ‘কেন, কষ্ট হচ্ছে?

হীরালাল উত্তর দিল, ‘না, কষ্ট আমার হচ্ছে না। কিন্তু তুমি আমার সঙ্গে এমন লুকোচুরি খেলছ কেন? তুমি আমায় ডাকছ, কিন্তু দেখা দিচ্ছ না। তোমার ডাক শুনতে-শুনতে কোথায় চলে এসেছি বল তো! তুমি দেখা দিচ্ছ না কেন?’

সে বলল, ‘দেখতে পাবে।’

‘কবে?’

 ‘একদিন।’

‘কোনদিন।’

 সে হাসল।

 হীরালাল জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি হাসছ যে!

তবু সে হেসে উঠল খিলখিল করে। তার হাসির রেশটা ওই পাহাড়ের গায়ে-গায়ে ভেসে-ভেসে হারিয়ে গেল।

অভিমানে গলা ভার হয়ে গেল হীরালালের। সে বলল, ‘খালি-খালি তুমি হাসছ কেন? তুমি যদি দেখা না ই দেবে, তবে আমায় ওই গুহার ভেতর থেকে কেন বাঁচালে! কেন আমায় ডেকে আনলে! তোমার ডাক শুনে, আমি পথ ভুলে গেছি! হয়তো আমার মা কাঁদছে আমার জন্যে।

হাসতে-হাসতে থামল সে হীরালালের কথা শুনে। তারপর একটুখানি চুপ করে রইল।

 হীরালাল জিজ্ঞেস করল, ‘চুপ করলে যে!’

তার গলাও ভার হয়ে গেল। সে বলল, হীরালাল, আমিও যে তোমার জন্যে কেঁদে-কেঁদে ঘুরে বেড়াচ্ছি। আমার যে ভারি ইচ্ছে করে হীরামন তোমাকে আদর করতে!’

হীরালাল অবাক হয়ে গেল। জিজ্ঞেস করল, ‘এ কী! তুমি আমার ওই নামটা জানলে কী করে? মা বলেছে, হীরামন বলে দিদি আমায় ডাকত! ডেকে-ডেকে আমায় আদর করত।

হঠাৎ সে আবার খিলখিল করে হেসে উঠল। হাসতে-হাসতে বলল, ‘আমি জানি, সব জানি।

হীরালাল অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কে?’

সে বলল, ‘আমি কেউ না। সামনে দেখ, আমি ওইটা।’

 হীরালাল ব্যস্ত হয়ে সামনে চাইল। কাউকে দেখতে পেল না। জিজ্ঞেস করল, ‘কই? কোনটা?’

 ‘ওই পাথরটা!’

 ‘তুমি পাথর?’

সে তখন বলল, ‘বিশ্বাস করতে পারছ না বুঝি? আচ্ছা, এক কাজ কর, তোমার সামনে ওই যে টুকরো পাথরটা দেখতে পাচ্ছ ওই পাথরটা দিয়ে একটা মস্ত গোল আঁকো!’

হীরালাল দোনোমোনো করল।

সে আবার বলল, ‘আঁকছ না?’

 হীরালাল জিজ্ঞেস করল, ‘কী হবে এঁকে?’

‘আমায় দেখতে পাবে।’

হীরালাল বলল, ‘ধ্যাত! তাই বুঝি আবার হয়!

 ‘আঁকলেই বুঝতে পারবে।’

‘বেশ, তুমি যখন বলছ, আঁকছি!’ বলে হীরালাল পাহাড়ের গায়ে ওই পাথরের টুকরো দিয়ে একটা মস্ত গোল আঁকল।

কিন্তু কই?

আবার সে খিলখিল করে হেসে উঠে বলল, ‘আমি ওই!

হীরালাল বলল, ‘কী মিথ্যে কথা বলো তুমি। এটা তো একটা মস্ত বড়ো শূন্য!’

সে উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ, ঠিক বলেছ, আমি শূন্য। ওই দেখ, দেখ, তোমার আঁকা গোল শূন্যটা কী হয়ে গেল দেখ!’

বলতে না বলতেই ঠং-ঠুং ঠং করে আওয়াজ তুলে পাহাড়ের পাথরে কী যেন গড়িয়ে গড়িয়ে ঠিকরে পড়ে বেজে উঠল। চকিতে ফিরে তাকাল হীরালাল। এ কী কাণ্ড! সেই শূন্যটা যে একটা সোনার মোহর হয়ে গড়িয়ে পড়ল!

ওই দেখ, সেই তিনটে জন্তুও পাহাড়ের ওপরে উঠে এসেছে। পাথরের আড়াল থেকে সেই তিনটে জন্তুও এটা দেখে ফেলেছে। তারাও যে থ!

হীরালাল অবাক গলায় বলল, ‘এ যে সোনা!’

‘এই তো আমি। তুমি আরও অনেক শূন্য আঁকো, আরও সোনা হবে। তারপর সেই সোনা দিয়ে তোমার স্বপ্ন গড়ে উঠবে।

‘সত্যি? খুশি হয়ে জিজ্ঞেস করল হীরালাল।

সে বলল, ‘সত্যি?’

তখন হীরালাল আবার একটা গোল আঁকল। ওটাও সোনা হয়ে গেল।

আবার আঁকল।

আবার সোনা।

আবার আঁকল।

সোনা–সোনা–সোনা। হাজার-হাজার সোনার মোহর ছড়িয়ে পড়ল সেই পাহাড়ের আনাচে-কানাচে।

তাই না দেখে, সেই তিনটে জন্তুর তো চক্ষুস্থির। লোভে চোখগুলো তাদের জ্বলে উঠল। কিন্তু করবে কী! যখন মানুষ ছিল, তখন এক কথা! এখন তো ওরা জন্তু!

হীরালাল মোহরের আড়াল থেকে মুখ উঁচিয়ে বলল, ‘বাব্বা! এত সোনা, আমি যে চাপা পড়ে যাচ্ছি।’

 ‘না, চাপা কেন পড়বে। ওই দেখ, পাহাড়ের চুড়ার দিকে তাকাও।’

হীরালাল চেয়ে দেখল। তারপরেই চমকে উঠল! এ আশ্চর্য কাণ্ড তো! মস্ত পাহাড়ের আকাশ-ছোঁয়া চূড়াটার ঠিক ওপর, স্বপ্নের রং বুলিয়ে, সেই সোনার মোহর সাজিয়ে ছোট্ট একটি প্রাসাদ গড়ে উঠেছে!

জন্তু তিনটে এবারও হাঁ!

 হীরালাল মুগ্ধ চোখে সেই প্রাসাদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আঃ! এমন সুন্দর প্রাসাদ! এ কার?’

সে বলল, ‘সবটা তোমার। একটুখানি আমার।’ হীরালাল জিজ্ঞেস করল, ‘এখানে তুমি থাকো?’

সে উত্তর দিল, ‘আমার সঙ্গে তুমিও।’

“কিন্তু তোমায় তো এখনও দেখতে পাচ্ছি না!’

সে বলল, ‘পাবে, পাবে, দেখতে পাবে। দেখতে পাবে পূর্ণিমায়, যেদিন চাঁদ উঠবে।’

অমনি দেখতে-দেখতে পাহাড়-চূড়ার রঙিন প্রাসাদের সিংদরজা খুলে গেল।

 সে বলল, ‘ভেতরে এস।’

হীরালাল দরজা ডিঙিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল।

হীরালাল ভেতরে ঢুকে যেতেই বেরিয়ে এল সেই গাধাটা ছাগলটা আর শুয়োরটা–পাথরের আড়াল থেকে।

আহা! কী চমৎকার প্রাসাদের ভেতরটা! চারিদিকে ফুল। ফুলে ফুলে মৌ। রং-রং ছবি। ছবি-ছবি পাখি। আর এখানে ফোয়ারা, ওখানে রঙিন মাছ। অবাক হয়ে দেখছে হীরালাল। দেখতে-দেখতে সে বাগান পেরিয়ে দালানে উঠতেই, টুং-টাং করে বাজনা বেজে উঠল। কী মিষ্টি তার সুরটা! থমকে দাঁড়িয়েই পড়ল হীরালাল।

সে জিজ্ঞেস করল, ‘দাঁড়ালে যে?’

 হীরালাল বলল, ‘কী মিষ্টি বাজনা বাজছে!’

সে উত্তর দিল, ‘জলতরঙ্গ।’

‘কোথা বাজছে?’

‘জলের নীচে।’

‘কী সুন্দর!

 হীরালাল দালান ছেড়ে ঘরে ঢুকল। এ-ঘরটা ছবির ঘর। দেওয়াল-ভরতি রঙিন ছবি। একটা হাঁস, তো একটা বাঘ। একটা ফড়িং, তো সাতটা ফানুস। একটা নদী, তো পাঁচটা নৌকো। একটা সূর্য, একটা চাঁদ।

সে জিজ্ঞেস করল, ‘ভালো লাগল?’

হীরালাল বলল, ‘খুব ভালো।’

 এবার এই ঘরটা খেলার ঘর।

বাঁদর-ছানা ন্যাজ ঝুলিয়ে দুলছে।

মেম-পুতুলটা ঘাগরা পরে নাচছে।

মোটরগাড়ি পিপ্পি-পিপ্পি ছুটছে।

কাঠের ঘোড়া টগবগ টগবগ হাঁটছে।

 সে জিজ্ঞেস করল, ‘কেমন লাগল?’

 হীরালাল বলল, ‘কী সুন্দর!’

খেলা-ঘরের পরের ঘর পোশাক-ঘর।

এই পোশাকটা নীল।

ওই পোশাকটা লাল।

ওই জামাটা আকাশি।

ওইটা দেখতে ফ্যাকাশি।

 এটার গায়ে ফুলের ছাপ।

 ওটার গায়ে লতার দাগ।

 সে জিজ্ঞেস করল, ‘কোনটা পরবে?’

 হীরালাল বলল, ‘লালটা পরব।’

এর পরে পাখির ঘর।

ময়নাটা গাইছে।

লালমন চাইছে।

 টিয়া ঠোঁট ঠুকছে।

 বুলবুলি উড়ছে।

সে জিজ্ঞেস করল, ‘কেমন লাগছে?’

পাখির-ঘর ছাড়িয়ে, একটি-একটি সিঁড়ি পেরিয়ে, একেবারে ওপরে, ঠিক রূপকথার রাজপুত্রের মতো ঝলমল একটি রঙিন-ঘর।

সে-ঘরে সোনার পালঙ্ক সাজানো। তাতে মখমলের বিছানা পাতা। রেশমি পর্দা হাওয়ায় উড়ে-উড়ে নীল আকাশের মুখটা একবার ঢেকে দিচ্ছে আবার এঁকে দিচ্ছে। এখনই আকাশে তারা ফুটবে। তারপর সোনার পালঙ্কে হীরালাল শুয়ে পড়বে। সে গান গাইবে। আঃ! শোনো, শোনো, কী নরম গলা তার! এ তো গান না। মনে হবে, বুঝি-বা ফুলের পাপড়িতে শিশিরের ফোঁটারা দোল খাচ্ছে।

ঘুমিয়ে পড়ল হীরালাল। আহা! ঘুমাক। একটি হালকা পশমি চাদর দিয়ে সে ঢাকা দিয়ে দিল হীরালালের গা-টি। পাহাড়ের হাওয়ায় ভেসে-ভেসে ফুলের গন্ধ এসে সেই চাদরের ওপর লুটোপুটি খাচ্ছে!

ঘুমিয়ে পড়েছে হীরালাল। কেন এমন একদৃষ্টে হীরালালের মুখের দিকে চেয়ে আছে সে? সে বুঝি হীরালালের মাথায় হাত রেখেছে। চুলগুলি সরিয়ে দিয়ে কপালে চুমু খাবে। তারপর হয়তো চোখ দুটি ওর ছলছলিয়ে উঠবে। হ্যাঁ, ওই তো কাঁদছে সে! শুনতে পাচ্ছ না, এই শান্ত, নিস্তব্ধ রাত্রে, এই ঘরে তার কান্নার অস্পষ্ট শব্দ!

হ্যাঁ, আজ ও কাঁদবে। অঝোর ধারায় চোখের অদৃশ্য জলে ভেসে যাবে তার গাল দুটি। হীরালালকে এমন করে কাছে পেয়ে তার যত আনন্দ, তত ভয়।

ভয় কেন?

কেননা, যেদিন পূর্ণিমা আসবে, পূর্ণিমায় আকাশে চাঁদ উঠবে, সেদিন যে সে শেষবারের মতো হীরালালকে দেখতে পাবে। সেদিনই তো হীরালাল জেনে ফেলবে, সে কে!

সত্যি, সে কে? কে এই অদৃশ্য মেয়েটি? এমন নিছক একটা পাথরে আঁকা শূন্য মোহর হয়ে যায় কার হাতের ছোঁয়ায়? কোন মায়াবলে এমন এক সোনা-ঝলমল প্রাসাদ গড়ে তোলে সে এই পাহাড়ের চূড়ায়? কেন, কেন, সে হীরালালকে এমন আদর করে? আদর করে কেন সে ডেকে এনে গান শোনায় তাকে? সে কি জানে না, হীরালালের মা হীরালালের জন্যে কত কাঁদছে?

হ্যাঁ, জানে সে। কিন্তু তবু সে হীরালালকে না দেখে পারে না। কতদিন সে আঁতিপাঁতি করে খুঁজছে হীরালালকে। কতদিন সে নদীর তীরে-তীরে ছুটে-ছুটে হীরালালের পিছু নিয়েছে। বনের ছায়াঘেরা পথে পথে একা-একা ঘুরেছে একটিবার ওর মুখখানি দেখার জন্যে। আজ সে কাছে পেয়েছে হীরালালকে। আজ প্রাণ ভরে ওকে আদর করবে। ওর যত সাধ ছিল মনে-মনে, আজ সব উজাড় করে দেবে হীরালালের জন্যে!

এখন সোনায় গড়া স্বপ্ন-প্রাসাদে হীরালাল ভারি নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। নিজঝুম এই পাহাড়-চূড়ায় আজকের রাত নিথর হয়ে ঝিমিয়ে পড়ল। শুধু জেগে রইল সেই ছাগল, সেই শুয়োর আর গাধাটা।

হ্যাঁ, ওরা জেগে আছে। ওই তো কেমন নিঃসাড়ে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে আসছে। এখন তারা পাহাড়ের পাথর ডিঙিয়ে-ডিঙিয়ে ওপরে উঠবে। ওই চূড়ায়, ওই প্রাসাদে! কেন, কী মতলব তাদের?

আকাশে তারার ঝিলিমিলি। আর নীচে, প্রাসাদের গায়ে-গায়ে মণিমুক্তার ঝকমকি! দেখতে-দেখতে তিন জন্তুর চোখ ঝলসে গেল! হায় রে, এই প্রাসাদটা যদি তাদের হত! হলই বা তারা জন্তু, এই প্রাসাদে একবার রাজা হয়ে বসতে পারলে মানুষই তাদের সেলাম ঠুকবে! দৌলত যার, শক্তিও তার! সুতরাং এ প্রাসাদ তাদের চাই-ই। এটা পাওয়াই বা এমন কী শক্ত! মালিক তো ওই একটা পুঁচকে ছেলে! ছেলেটাকে মারতে মারতে এই পাহাড়ের ওপর থেকে একবার নীচে ওই খাদে ফেলে দিতে পারলেই হল! হুর-র-র-রে! তখন এ প্রাসাদ হবে তাদের।

 হ্যাঁ, এই কথা ভাবতে-ভাবতে, অনেক কষ্ট করে, পাহাড়ের পাথর ঘসটাতে-ঘসটাতে তারা সত্যিই প্রাসাদের সামনে এসে দাঁড়াল। আ-হা-হা! সোনা, চারিদিকে শুধুই সোনা। থরেথরে সাজানো। সারে-সারে ঝকমকি জৌলুস। ওরা পারল না আর দাঁড়িয়ে থাকতে। সামনের ঠ্যাং ওপরে তুলে সেই সোনা কেউ আঁকপাঁকিয়ে আঁকড়ে ধরে। কেউ সোনার ওপর জিব দিয়ে চাটে। কেউ গোঁত্তা মেরে মাথা খোঁড়ে!

আরে! আরে! এ কী! গাধার পিঠের ঠেলা লেগে যে সত্যি-সত্যি প্রাসাদের সিংদরজা হাট হয়ে খুলে গেল! তা বেটপকা দরজাটা অমন খুলে গেলে একটু ভড়কে যেতে হয় বইকী! চাইকি, ভয় পেয়ে একটু ঘাবড়েও যেতে হয়!

হ্যাঁ, তা-ঠিক, তিন জন্তু একটু ভড়কাল বটে, তবে ঘাবড়াল না। একটু এদিক-ওদিক দেখে নিয়ে তিন জন্তু চটজলদি প্রাসাদের মধ্যে ঢুকে পড়ল। আঃ! খুশির মতো এক ঝলক আকাশি নীল আলো ছড়িয়ে পড়েছে প্রাসাদের মাথার ওপর। খুব মিঠে হালকা সুরে বাজনা বাজছে। আর মনে হচ্ছে, ফিনফিনে সাদা তুষারের মতো ঝুরুঝুরু কী যেন ভেসে বেড়াচ্ছে হাওয়ায়-হাওয়ায়।

তিন জন্তু এগিয়ে গেল।

 সেই সাদা তুষার যেন ধীরে-ধীরে জমাট বাঁধছে!

তিন জন্তু চেয়ে দেখল।

সেই সাদা তুষার যেন ফ্যাকাশে হয়ে ছাইরং ধরল।

হ্যাঁ, জমাট-বাঁধা তুষারের ছাই-রং হঠাৎ এবার ভুসোর মতো কালো হয়ে গেল। তারপর সেই কালো ভুসো জমাট বাঁধতে-বাঁধতে একটা ইয়া লম্বা দত্যির মতো ছড়িয়ে পড়ল সেই তিন জন্তুর সামনে। সেই কালো কুচকুচে দত্যি হাত বার করল! প্যাট-প্যাট করে চেয়ে দেখল! দাঁত ছরকুট্টে হেসে উঠল! আর অমনি সঙ্গে-সঙ্গে হালকা সুরের বাজনাটা দামামার মতো দমাদম দমাদ্দম করে গর্জে উঠল! তাই না দেখে, তিন জন্তুর আত্মারাম খাঁচা-ছাড়া! কী করি কী করি ভেবে দে পিঠটান!

অমনি, একেবারে চক্ষের নিমেষে সেই কালো ভুসোর মতো দত্যিটা খপাত করে গাধার কানটা ধরে ফেলল! আর এক হাত বাড়িয়ে ছাগলটার একটা ঠ্যাং খামচে ধরল! শুয়োরের ঘাড়টা পা দিয়ে চেপটে দিল! তারপর দুহাত দিয়ে গাধাটাকে আর ছাগলটাকে কান-ঝোলা আর ঠ্যাং-ঝোলা করে দোলাতে লাগল। শুয়োরটার ঘাড়ে পায়ের নোখ দিয়ে খামচি মেরে চিমটোতে লাগল।

তারপর কী চেল্লাচেল্লি, ‘ও বাবা গো, ছেড়ে দাও গো! ও বাবা গো, ঘাট হয়েছে গো! ও বাবা গো, আর কক্ষনো করব না গো!’

এখন আর এসব কথা বলে গলা ফাটালে কী হবে! তখন মনে ছিল না! দত্যির শুনতে বয়ে গেছে এ সব কথা! সে দোলাবে আর খিমচোবে!

দোলাতে-দোলাতে হল কী, খচাং করে গাধাটার কান ছিঁড়ে গেল। কান ছিঁড়ে গাধাটা পড়ল গিয়ে পাঁচিলের ওপারে একেবারে প্রাসাদের বাইরে!

খটাং করে ছাগলটার ঠ্যাং ভেঙে গেল। ছাগলটা ছিটকে পড়ল গাধাটার ঘাড়ের ওপর।

ফটাং করে শুয়োরটার পেট ফেটে গেল। ফাটা পেট হাঁসফাঁস করতে-করতে সে মুখ থুবড়ে পড়ল গিয়ে ছাগলটার পিঠের ওপর। তারপর কী সাংঘাতিক বাজখাঁই গলায় হা-হা-হা করে হেসে উঠল দত্যিটা! ওমা! দেখ, হাসতে-হাসতে দত্যিটা কেমন ঝুরঝুর করে ঝরে পড়ছে! ঝরতে-ঝরতে হাওয়ার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে! দেখতে-না-দেখতে ওই তো, উবে গিয়ে হারিয়ে গেল!

আঃ! আবার খুশির মতো এক ঝলক নীল আলো সেই সোনালি প্রাসাদের মাথার ওপর ছড়িয়ে পড়ল। দামামার সেই গুরুগুরু গর্জনটা আবার যেন সেই তেমনি হালকা মিষ্টি সুরে বেজে উঠেছে। আহা! রূপসি সোনার প্রাসাদটা আবার শান্ত এখন।

যাই বলো তাই বলো, মারের গুঁতোয় বেচারিদের প্রাণ রাখা দায়! কান-কাটা, ঠ্যাং-ভাঙা, পেট-ফাটা তিন জন্তু যন্ত্রণায় ছটফটাচ্ছে। একে বলে দুর্দশার একশেষ! ছিল মানুষ হল জন্তু! কী কুক্ষণেই না তারা পাহাড়ের গুহার মধ্যে পালিয়েছিল। পালিয়েছিল, পালাক। কিন্তু এটা কেমন ভেলকি যে, তেষ্টার জল মুখে দিতেই তারা জন্তু হয়ে গেল! তাও না হয় সই, কিন্তু এখন একটা পুঁচকে ছেলের পাল্লায় পড়ে তাদের যে ঠ্যাং ভাঙল, কান ছিঁড়ল, পেট ফাটল, একে তুমি কী বলবে? না, না, তারা এর বিহিত না করে কিছুতেই ছাড়বে না। কত বড়ো ছেলে একবার দেখে নেবে তারা! দত্যি দিয়ে অপমান। ছিঃ! ছিঃ! অপমানের শোধ যদি না নিতে পারে তো জন্মই বৃথা!

হ্যাঁ, কান-কাটা গাধা কাঁদতে-কাঁদতে পাহাড়ের ওপর থেকে নামতে শুরু করল। ঠ্যাং-ভাঙা ছাগলটা লেংচে-লেংচে পাথরের ওপর থেকে নীচে হাঁটতে শুরু করল। আর পেট-ফাটা শুয়োরটা পেটে হাত চেপে ওদের পিছু নিল।

সকাল হবার আগেই তিন জন্তু পাহাড় ডিঙিয়ে নীচে নামল। নীচে নেমে শুয়োরটাই প্রথম কথা বলল, ‘এখন কী করা?’।

গাধা বলল, ‘লুকিয়ে থাকা।’

ছাগল বলল, ‘লুকিয়ে কেন থাকব! আমাদের চিনছে কে! এখন আমাদের সেই ম্যাজিকঅলার কাছে যেতে হবে! তাকে সব খুলে বলতে হবে।’

‘তাতে লাভটা কী?’

 ছাগল বলল, ‘লাভ কী, গেলেই বুঝবি।’

 ছাগলের কথা শুনে গাধা বলল, ‘ক্ষতি না হলে, আপত্তি করি না।’

তিন জন্তু ম্যাজিকঅলার খোঁজে চলল।

.

ম্যাজিকঅলার বাড়ি কোনদিকে, সে তো আর ওদের অজানা নয়। তাই খুঁজতে হল না। বাড়ির দোরগোড়ায় এসে তিনজনে চোখ চাওয়া-চাওয়ি করল। তারপর তিনজনেই একসঙ্গে হাঁক পাড়ল :

‘ম্যাজিকঅলা, ম্যাজিকঅলা বাড়িতে আছ কী,
তোমার জন্যে জবর খবর সঙ্গে এনেছি!’
ম্যাজিকঅলা ডাক শুনে সাড়া দিল, ‘কোন ডাকতা?’
 ‘আমরা ডাকি, আমরা ডাকি ছাগল, শুয়োর, গাধা
দয়া করে একটু যদি বাইরে আসেন দাদা!’

 ম্যাজি অলা দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়াতেই চক্ষু কপালে! আরে, আরে! সত্যিই তো তার ঘরের দোরে তিনটে জন্তু! ‘এ তো ভারি তাজ্জব বাত আছে! গাধা কোথা বোলছে!’

ছাগল বলল, ‘দেখুন ম্যাজিকবাবু, আপনি আমাদের দেখে ভুল বুঝবেন না। দেখুন, আমরা সত্যিকারের ছাগল, গাধা, শুয়োর নই। আমরা মানুষ। আপনার সঙ্গে সেই যে ছেলেটা ম্যাজিক দেখাত, সে আমাদের জন্তু করে দিয়েছে।’

ম্যাজিকঅলা চমকে উঠে ধমকে বলল, ‘ছেলেটা!’

তিন জন্তু একসঙ্গে চেঁচিয়ে বলল, ‘আজ্ঞে হুজুর।’

‘কিধার আছে ও ছেলেটা?’

শুয়োর বলল, ‘আজ্ঞে আছে তো অনেকদূর! কিন্তু–’

ম্যাজিকঅলা রেগেমেগে বলল, ‘কিন্তু-মিন্তু জানতা নেহি, আগে বোলো কিধার হ্যায় ও লেড়কা!’ ছাগল বলল, ‘দেখুন বাবু, অত ব্যস্ত হলে সব ভেস্তে যাবে। ব্যাপারটা তো খুবই সাংঘাতিক। রাস্তায় দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে আপনাকে সব বলি কী করে! একটু আড়ালে না গেলে!’

‘বাত তো ঠিকই আছে। তব ঘরমে আও।’ ম্যাজিকঅলা ঘরের ভেতর ডেকে নিল। তিন জন্তু ঘরে ঢুকতেই দরজায় হুড়কো এঁটে দিল ম্যাজিকঅলা।

ঘরে ঢুকে ছাগল ইনিয়ে-বিনিয়ে সত্যি-মিথ্যে জড়িয়ে-মড়িয়ে বলল, ‘দেখুন, আপনাকে তো আর সব কথা বলতে বাধা নেই। দেখুন, আমরা হলুম গিয়ে ধনকুবেরের তিন পুত্তুর! আমরা নানান দেশ ভ্রমণ করে এখন নিজের দেশে ফিরছিলুম। আমাদের সঙ্গে ছিল অমূল্য সব হিরে-জহরত, সোনাচাঁদি! তা বলব কী, আপনার ওই ছেলেটি আমাদের ভেলকি মেরে, আমাদের জন্তু বানিয়ে, সর্বস্ব লুঠ করে নিল। শুনলুম নাকি ওই ছেলেটা আপনার কাছেই ভেলকি শিখেছে। শিখুক, সে তো ভালো কথা। কিন্তু তাই বলে আমাদের এই দশা করে ছাড়বে! শুধু তাই নয়, আমাদের সর্বস্ব নিয়ে সে এখন সোনার প্রাসাদ গড়ে দিব্যি আরামে আছে।’ বলে ছাগলটা ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। তাকে দেখে গাধা-শুয়োরও কান্না জুড়ে দিল।

ম্যাজিকঅলা ছাগলের কথা শুনে আরও রেগে উঠল। জিজ্ঞেস করল, ‘ও প্রাসাদ কিধার আছে?’

‘আজ্ঞে তাও বলব। আপনাকে সঙ্গে করে নিয়েও যাব। কিন্তু দেখুন, আমাদের জন্তু করেও তার সাধ মেটেনি। সঙ্গে-সঙ্গে আমার ঠ্যাংটাও ভেঙে দিয়েছে।’

গাধা চেঁচিয়ে উঠে বলল, ‘আমার কানটা ছিঁড়ে দিয়েছে।’

‘আজ্ঞে আপনি দয়া করে আবার মন্ত্র পড়ে, আমাদের মানুষ না করে দিলে আমাদের গঙ্গায় ডুবে মরতে হবে!’ বলতে-বলতে তিন জন্তু এবার খুব জোরে কেঁদে উঠল।

আসলে জন্তুকে যে কেমন করে মানুষ করতে হয়, সে তো আর ম্যাজিকঅলা জানে না। তবু মিথ্যে-মিথ্যে তাকে তো একটা কিছু বলতে হয়। তা না হলে, এরা ছেলেটার খোঁজ সত্যি-সত্যি জানলেও, বলবেই না। তাই ম্যাজিকঅলা ভান করে বলল, ‘দেখ ভাই, হামি সব ঠিক করে দেবে। লেকিন ও ছেলেটাকে তো পয়লে পাকড়াতে হোবে। ও হামার ঘর থিকে হাজার আদমি কো জানোয়ার বানাবার জাদু চুরি কোরে ভেগেছে। হামাকে আভি-আভি সেখানে লিয়ে চোলো, দের হোনেসে সব গড়বড় হয়ে যাবে।

ম্যাজিকঅলার কথা শুনে ছাগল কাঁদতে-কাঁদতেই জিজ্ঞেস করল, ‘ঠিক তো, আপনি আবার আমাদের মানুষ করে দেবেন তো?’

ম্যাজিকঅলা ছাগলের দাড়িতে হাত বুলিয়ে আদর করে বলল, ‘ঠিক বলছে, ঠিক বলছে!

গাধা নাকি-সুরে বলল, ‘ঠিক তো, আপনি আমার কাটা কানটা জোড়া দিয়ে দেবেন তো?’

 ম্যাজিকঅলা গাধার গোটা কানটায় সুড়সুড়ি দিয়ে বলল, ‘দিবে, দিবে, ঠিক দিবে।’

শুয়োরটা ফাটা-সুরে বলল, ‘ঠিক তো, আপনি আমার ফাটা পেটটা গোটা করে দেবেন তো?’

ম্যাজিকঅলা শুয়োরের ফাটা পেটে হাত বুলিয়ে বলল, ‘দিবে দিবে, সব দিবে।

 ‘তবে চলুন আমাদের সঙ্গে।’

.

আহা! সকালবেলা সোনা রোদের আলোয় হীরালাল আজ ছোট্ট একটি সাদা রঙেরটাট্টু ঘোড়ার সওয়ার হয়ে কেমন পাহাড়ের গায়ে-গায়ে ছুটে বেড়াচ্ছে! রেশমি পোশাক পরেছে। মাথায় পালক আঁটা পাগড়ি। পায়ে জরি-বসানো নাগরা। কী মিষ্টি দেখতে লাগছে! আর ওই দেখ, ওর সঙ্গে আরও কত ঘোড়সওয়ার! ওমা! ঠিক যেন পল্টনের দল। হ্যাঁ, পল্টনই তো। হীরালাল খেলবে আর ওই সোনার প্রাসাদের পল্টনরা তাকে দূর থেকে দূরে, আরও দূরে নিয়ে যাবে। যেখানে এই পাহাড়টা শেষ, সেখানে। সেখানে দূর-পাহাড়ের গা বেয়ে কত উঁচু থেকে নীচে রাশি-রাশি জল লাফিয়ে পড়ছে। পড়তে-পড়তে পাথরের ফাঁকে-ফাঁকে নেচে-নেচে ছুটে যায়! আর নয়তো এই পাহাড়ে ওই যেখানে নীল আকাশে মেঘের সঙ্গে আলোর লুকোচুরি খেলা হচ্ছে, কিংবা নানা-রং পাখা মেলে ওই যেখানে প্রজাপতিরা ফুলের সঙ্গে মিতালি পাতাচ্ছে, সেখানে ছুটে যায় হীরালাল। তারপর ছুটতে-ছুটতে মেঘের ফাঁকে, নয়তো ফুলের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে। তারপর চেঁচিয়ে ডাকে, ‘তোমায় বলে টুকি!’

খিলখিল করে হেসে ওঠে সে। সেই মেয়েটি হাসতে-হাসতে বলে, ‘টুকি তো আমি তোমায় দেব। তুমিই তো আমায় দেখতে পাচ্ছ না!’

হীরালাল জিজ্ঞেস করল, ‘আমি মেঘের আড়ালে লুকিয়ে থাকলেও তুমি দেখতে পাও?’

সে বলল, ‘হ্যাঁ।’

 হঠাৎ কেন হীরালালের ঘোড়াটা ডেকে উঠল, ‘চি-হি-হি!’ ঘোড়ার পিঠে পল্টনরা সজাগ হয়ে চোখ ফিরিয়ে দেখতে লাগল।

তাইতো! ঘোড়া কেন ডাকে! দেখা গেল একটা গোদা চিল আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে। কে যেন চেঁচিয়ে উঠল :

শঙ্খচিলের ঘটি বাটি,
 গোদা চিলের দাঁতকপাটি!

চিলটা উড়তে উড়তে ওইখানে পাক মারছে কেন? আকাশের ওইখানটায়?

ওইখানে, পাথরের আড়ালে ম্যাজিকঅলা আর সেই তিন জন্তু ঘাপটি মেরে লুকিয়ে আছে। লুকিয়ে-লুকিয়ে দেখছে হীরালালকে। দেখছে সেই সোনার প্রাসাদ। যতই দেখছে, ততই বেবাক হয়ে যাচ্ছে।

চিলটা উড়তে-উড়তে যখন আকাশ পেরিয়ে চোখের বাইরে চলে গেল, তখন পল্টনরাও হীরালালকে নিয়ে প্রাসাদের ভেতরে ঢুকে গেল। তারপর সিংদরজা বনধ!

এইসব এলাহি কাণ্ড দেখে ম্যাজিকঅলার আর কী সাহস হয় হীরালালের কাছে যাওয়ার! একবার যদি দেখে ফেলে পল্টনরা তা হলে আর রক্ষে নেই। গুঁতোর চোটে ঠুটো করে ছেড়ে দেবে।

হঠাৎ ছাগলটা চাপা গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘কী করবেন ম্যাজিকবাবু? এইখানে বসে থাকবেন?’

ম্যাজিকঅলা তার গলার স্বর আরও নামিয়ে, একেবারে প্রায় ফিসফিসিয়ে বলল, ‘বাত বহুত মুশকিল আছে। এ তো তোমি-হামি পারবে না। ও ব্যাটা পল্টন লোগ তরোয়ালসে কাটকে হামাদের পাহাড়কা উপরসে নীচে ফেলে দিবে।’

‘তাহলে?’

 ‘লড়াই কোরতে হোবে। চোলো পাহাড়সে নীচে চোলো। রাজাকা পাশ হামলোগ যাবে। রাজাকে সব বলব!’

ছাগল, গাধা, শুয়োর তিনজনে বললে, ‘তা ঠিক। সেই ভালো।’

আজ পূর্ণিমা। আজ খই ফুটবে চাঁদের আলোয়। আজ দূর আকাশে সোনায় গড়া একটি নিটোল টিপের মতো চাঁদ উঠবে। আর তারপরেই হীরালাল সব জানতে পারবে। জানতে পারবে কে এই মেয়েটি। কেননা, সে বলেছে, যেদিন পূর্ণিমার চাঁদ উঠবে, সেদিন সে দেখা দেবে। তাই হীরালাল আজ বারবার আকাশে চেয়েছে আর ভেবেছে, রাত আসতে কত দেরি! তাই ও ছুটে গেছল পাখির ঘরে। ন্যাজঝোলা পাখি বলেছিল, ‘রাত আসবে দিন গড়ালে

ফুলবাগানের ফুল বলেছিল, ‘রাত আসবে রাতের বেলা।’

হ্যাঁ, রাতের বেলা রাত এসেছিল ঠিকই, কিন্তু আশ্চর্য, চাঁদ তো উঠল না। আজকের রাত এত অন্ধকার কেন? আজ সাদা মেঘের দল ঘুম দেবার জন্যে নেমে আসেনি পাহাড়ের গায়ে-গায়ে! আজ তারা ছাই-ছাই পোশাক পরে কালো মেঘের সঙ্গে দল বেঁধেছে। আকাশে আজ মেঘ করেছে। তবে কি সত্যিই মেঘের আড়ালে আজ লুকিয়ে থাকবে চাঁদ দেখা দেবে না?

হীরালালের মুখেও আজ খুশি নেই। ও দূর-আকাশের দিকেই চেয়ে ছিল আর দেখছিল, কখন জ্যোৎস্নার আলো ওই কালো মেঘের মুখ রাঙিয়ে এই প্রাসাদের সোনার ওপর গড়িয়ে পড়ে।

হঠাৎ নূপুর বেজে উঠল! সেই মেয়েটি আসছে বুঝি! হীরালাল জানে, এই নূপুর বাজিয়ে-বাজিয়ে সে আসে তার কাছে। হ্যাঁ, এসেছে সে। হয়তো সে হীরালালের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখছে এখন। আজ মুখখানি ভারি শুকিয়ে গেছে হীরালালের। সে জিজ্ঞেস করেছিল হঠাৎ, কী ভাবছ, হীরালাল?’

হীরালাল একবুক নিশ্বাস নিয়ে হতাশ সুরে বলেছিল, ‘আজ বোধহয় চাঁদ উঠবে না।’

 ‘মন খারাপ লাগছে?’

 হীরালাল উত্তর দিয়েছিল, ‘আজ পূর্ণিমার চাঁদ উঠলে তুমি আমায় দেখা দেবে বলেছ। চাঁদ না উঠলে তোমায় যে জানতে পারব না!’

সে চুপ করে ছিল একটুক্ষণ। তারপর সে কথা বলেছিল। হাওয়ায় ঝুরুঝুরু পাতার মতো তার গলাটি কেঁপে উঠেছিল কান্নায় ভিজে। তারপর জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কেন, আমায় নাই-বা দেখতে পেলে? আমি তো তোমার কাছে-কাছেই আছি হীরালাল?’।

হীরালাল বলেছিল, ‘এ আবার কী থাকা? আমার মা যখন আমার কাছে থাকে, তখন মা তো তোমার মতো হারিয়ে থাকে না! মাকে আমি ছুঁতে পাই। মা আমায় ছুঁয়ে-ছুঁয়ে আমার দিদির গল্প বলে!’

হয়তো সে এবার ডুকরে কেঁদে ফেলত। সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কী গল্প হীরালাল?’

‘সে অনেক। জানো, দিদি আমায় গান শোনাত!’

 ‘কেন আমিও তো শোনাই।’

 ‘দিদি আমায় কত আদর করত!’

‘কেন, আমি বুঝি করি না?’

পুজোর সময় নতুন পোশাক পরে দিদি আমায় ঠাকুর দেখতে নিয়ে যেত! মা বলেছে, দিদি যখন নতুন পোশাকে সাজত, কী সুন্দর দেখতে লাগত দিদিকে!

সে চুপ করে গেল।

‘চুপ করলে যে!’ হীরালাল জিজ্ঞেস করল।

তবু সে কথা বলল না।

হীরালাল আবার জিজ্ঞেস করল, ‘কথা বলবে না? আমার দিদির গল্প শুনে তোমার রাগ হয়েছে বুঝি?’

সে কথা বলল না। শুধু তার নূপুর দুটো হঠাৎ মেন ব্যস্ত হয়ে ছটফটিয়ে বেজে উঠল। সে বোধহয় চমকে উঠেছে।

চমকেই তো উঠেছে সে। কেননা, আকাশের কালো মেঘ সরে গেছে। ওই প্রাসাদের স্বপ্নরাজ্যের ছোট্ট ঘরে আলো ছড়িয়ে পড়েছে। চাঁদের আলো! এবার তাকে কথা রাখতে হবে! দেখা দিতে হবে হীরালালকে!

হীরালাল আনন্দে হাসিতে চিৎকার করে উঠল, ‘চাঁদ, চাঁদ।

 গুড়ুম! গুড়ুম! গুড়ুম!

এ কী! এত সৈন্য কখন চুপিসারে এই পাহাড়ের চূড়ায় উঠে এসেছে! অসংখ্য সৈন্য পাহাড়ের গায়ে থিক-থিক করছে। তাদের হাতে বন্দুক। তারা পাহাড়ের মাথায় টেনে তুলেছে কামান!

গুড়ুম! গুড়ুম! গুড়ুম!

সেনারা তিনদিক থেকে প্রাসাদ ঘিরে ফেলেছে! ওই তো ওদের সঙ্গে দেখা যাচ্ছে সেই ম্যাজিকঅলাকে। ওই তো সেই তিন জন্তু! সেনারা কামান দেগে এগিয়ে চলেছে, গুড়ুম! গুড়ুম!

হীরালাল শিউরে উঠল, ‘কে? কীসের শব্দ?

সে শান্ত গলায় বলল, ‘কিছু না। তোমার কিচ্ছু ভয় নেই।

তুমি এসো আমার সঙ্গে।’ তার পায়ে-চলার নূপুর বেজে উঠল।

 হীরালাল সেই নূপুরের শব্দ শুনে তার পিছু নিল।

গুড়ুম! গুড়ুম! কামানের গোলা উড়ে এসে ওই অমন সুন্দর সোনা দিয়ে গড়া প্রাসাদের গায়ে ছিটকে পড়ছে।

সে বলল, ‘হীরালাল, তাড়াতাড়ি এসো।’

তার নুপুরের শব্দ শুনে মনে হল, সে ছুটছে।

হীরালালও ছুটল।

 মনে হল মেয়েটি প্রাসাদের পিছনের দ্বার দিয়ে বাইরে চলে এল।

 হীরালালও সেই পথে তার পিছু নিল।

 সৈন্যরা স্রোতের মতো ধেয়ে আসছে প্রাসাদের দিকে। সোনার প্রাসাদের মাথার ওপর জ্যোৎস্নার আলো উছলে পড়েছে। সৈন্যরা প্রাসাদের সিংদরজা ভেঙে ফেলল। সোনার ঝলমলানি ঠিকরে-ঠিকরে চমকে উঠছে। সেনাদের চোখ ঝলসে যায়। তারা দেখতেই পেল না, তাদের চোখের সামনে দিয়েই একটি ছোট্ট ছেলে ছুটে যাচ্ছে। দেখতে পেল শুধু গাধাটা। সে একাই চিৎকার করে উঠল ‘পালাচ্ছে।’

এত হট্টগোলে কে শুনছে তার কথা! অবিশ্যি শুনতে পেয়েছিল ম্যাজিকঅলা। শুনেও সে চেঁচিয়ে উঠল, ‘যানে দেও। অন্দর মে সোনে আছে।’ বলে সে রাজার সৈন্যদের সঙ্গে হুড়মুড় করে প্রাসাদে ঢুকে পড়ল।

যুদ্ধ করতে এল সৈন্যরা। যুদ্ধ করে তারা ছেলেটাকে বন্দি করবে। কিন্তু এখন নিজেরাই যুদ্ধ ভুলে সোনার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। যত পার এখন সোনা নাও। দু হাত ভরে তুলে নাও। তারা ভাঙতে শুরু করে দিল প্রাসাদের সোনার পাঁচিল। টুকরো-টুকরো হয়ে সোনা ছিটকে পড়ছে চারিদিকে। অসংখ্য সৈনিক সেই সোনার টুকরোর ওপর লাফিয়ে পড়ে চিৎকার করছে আর লুটে নিচ্ছে। তাদের সাধ মিটছে না। তারা চায়। আরও চায়। আরও ভাঙো। আরও কামান দাগো। গুড়ুম! গুড়ুম! প্রাসাদটা ভেঙে চুরমার করে দাও। ধড়-ধড়-ধড় ধড়াস! দুম-দাম!

হঠাৎ কী ভয়ানক কানফাটা শব্দ শোনা গেল! তারপর আর্তনাদ করে উঠল কারা, ‘বাঁচাও, বাঁচাও!

এ কী সর্বনাশ! প্রাসাদটা যে ভেঙে চুর-চুর হয়ে মাটির সঙ্গে মিশে গেল! প্রাসাদের ধবংসস্তূপের তলায় ওই তো সেনার দল চাপা পড়ে আর্তনাদ করছে। ওই তো চিৎকার করছে ম্যাজিকঅলা আর তিন জন্তু। না, এখন কেউ নেই এখানে ওদের বাঁচাবার। কেউ শুনতে পাবে না ওদের কান্না। ওই প্রাসাদের সোনার চাপে একটু পরেই ওদের বুকের ধুকধুকি নিস্তব্ধ হয়ে যাবে। তখন আর এই সোনা লুঠ করার জন্যে ওরা চিৎকার করে লাফাবে না। দু-হাত বাড়িয়ে ছুটবেও না।

.

দেখ, দেখ! হঠাৎ কেমন চাঁদের আলো ঢেউ খেলছে! দেখ, ঢেউয়ের ওপর দুলতে-দুলতে কে যেন তার সাদা পোশাকখানি উড়িয়ে দিয়ে ছুটে যায়। মেঘবরন চুলের রাশি তার মুখখানি ঢেকে দেয়, আবার সরিয়ে নেয়! এই তাকে দেখা যায়, আবার আলোর ঢেউয়ে হারিয়ে যায়। তাকে হীরালাল দেখতে পেয়েছে। হীরালাল কিছু বলার আগেই সে হাত বাড়াল। বলল, ‘হীরালাল, তাড়াতাড়ি আমার হাত ধরো।’

হীরালাল তার হাত ধরল। হীরালালের হাত ধরে পাহাড়ের পাথর ডিঙিয়ে হাওয়ার মতো ছুটে গেল সে। অনেকদূর চলে এসেছে তারা। পাহাড়ের ওপরে, আরও ওপরে।

ছুটতে-ছুটতে সে জিজ্ঞেস করল, ‘হীরালাল, আমায় দেখতে পাচ্ছ?’

হীরালাল বলল, ‘তোমায় ছুঁতে পারছি।’

‘আমায় ছুঁয়ে-ছুঁয়ে আরও ছুটতে হবে, পারবে?’

হীরালাল জিজ্ঞেস করল, ‘কত দূর?’।

‘ওই পাহাড়ের ওপারে!’

 ‘ওখানে কী আছে?’

সে বলল, ‘ওখানে ছোট্ট নদী আছে। নদীর বুকে নৌকো আছে। কাশফুলের ঢেউ আছে। শিউলি ফুলের গন্ধ আছে। ছোট্ট মাটির ঘর আছে। মা আছে আর লক্ষ্মী আছে।’

‘আর তুমি?’

এবার তার গলার স্বর কেঁপে উঠল। ছুটতে-ছুটতে কাঁপা স্বর হাওয়ায় ভেসে হীরালালের কানে এল, ‘আমি তো নেই, আমি হারিয়ে গেছি!’

হীরালাল হেসে ফেলল। বলল, ‘তুমি কী মিথ্যে বলো! কই তুমি হারিয়ে গেছ? এই তো, আমি তোমায় ছুঁয়ে ছুঁয়ে ছুটছি। আমি তোমায় দেখতে পাচ্ছি!

জ্যোৎস্নায় আঁকা ওর আঁচলখানি হাওয়ায় উড়ে এসে হীরালালের কপালখানি ছুঁয়ে গেল! হীরালালের চোখের তারা হঠাৎ আলোয় চমকে উঠল। অবাক হয়ে হীরালাল জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কে?’

সে বলল, ‘আমি পূর্ণিমা।’

‘ওমা! আমার দিদির নামও তো ছিল পূর্ণিমা। মা বলেছে, দিদি আমার মেঘের দেশে চলে গেছে। জানো, যেদিন থেকে দিদি চলে গেছে, সেদিন থেকে হীরামন নামটাও আমার হারিয়ে গেছে। আর ও-নামে কেউ ডাকে না আমায়।’

সে ছুটছে। ছুটতে-ছুটতে সে ডেকে উঠল, ‘হীরা-ম-ন।’

আঃ! কী মিষ্টি সে ডাক। পাহাড়ের গায়ে-গায়ে সেই ডাকে যেন গানের সুর ছড়িয়ে গেল! সেই সুরে সুর মিলিয়ে জ্যোৎস্নার আলোয় একটি পাখি ডেকে উঠল, হীরা-ম-ন!’

ছুটতে-ছুটতে আনন্দে শিউরে উঠল হীরালাল।

সে আবার ডাকল, ‘হীরা-ম-ন!’

চাঁদের আলোর সঙ্গে লুটোপুটি খেতে-খেতে বাতাসেরা হেসে উঠল, ‘হীরা-ম-ন!’

হীরালাল খুশিতে আরও জোরে তার হাতখানি চেপে ধরল।

সে ছুটে যায়। হীরালালের খুশি দেখে সে আবার ডাক দিল, হীরা-ম-ন!’

আর থাকতে পারল না হীরালাল। কী তার মনে হল, সেই সুরে সুর মিলিয়ে হীরালালও ডেকে ফেলল, ‘দিদি’। তবে কি হীরালাল জেনে ফেলেছে এখন, যার হাত ধরে সে ছুটে যায়, সে-ই তার দিদি! হবেও বা।

আনন্দে-খুশিতে হীরালাল এখন দিদির হাত ধরে ছুটবে। ছুটতে-ছুটতে হাসবে। না-হয় জ্যোৎস্নার আলোর মতো হাওয়ায় ঢেউ তুলে নেচে উঠবে।

কিন্তু হঠাৎ এ কী হল! হীরালাল হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল যেন। হ্যাঁ, ওই তো হীরালালের পা পিছলে গেল পাথরের ওপর। দিদির হাত ফসকে সে যে ওই অনেক উঁচু পাহাড়ের ওপর থেকে নীচে পড়ে যাচ্ছে! কী সাংঘাতিক! ও হয়তো খুশিতে ছুটতে-ছুটতে দেখতে পায়নি, যেখানে সেই মস্ত উঁচু পাথরে লাফিয়ে লাফিয়ে রাশি-রাশি জল নীচে গড়িয়ে পড়ছে, সেখানে পিছল। পড়তে-পড়তে ভয়ে চিৎকার করে উঠল হীরালাল, ‘দিদি-ই-ই-ই!’

 কই দিদি! যেদিকে চাও শূন্য। দিদি নেই, কেউ নেই, কিছু নেই। শুধু এক ঝলক দমকা হাওয়া তোলপাড় করে একটি ছোট্ট মেয়ের মতো কান্নায় ভেঙে পড়ল, হীরা-ম-ন-ন-ন।’

কাঁদতে-কাঁদতে সেই হাওয়া পাথরে-পাথরে মাথা কুটতে লাগল। সেই হাওয়া গাছে-গাছে ঝড় তুলল। সেই হাওয়া আকুল হয়ে আর্তনাদ করে উঠল।

 পাহাড়ের ওপর থেকে ওই রাশি-রাশি জল কেমন পাথরে-পাথরে লাফ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে। গড়িয়ে গড়িয়ে নীচে কেমন একটি ছোট্ট নদীর মতো ঝুমঝুম করে ঝুমঝুমি বাজিয়ে বয়ে যাচ্ছে! ওই দেখ-না পূর্ণিমার চাঁদটি নদীর জলে ছায়া মেলে দোল খাচ্ছে!

হীরালাল পাহাড়ের ওপর থেকে ওই নদীর বুকে পড়ল বোধহয়! সে পড়ল, কিন্তু আশ্চর্য, সে তো অতল তলে তলিয়ে গেল না। জলের ছায়ায় ওই পূর্ণিমার চাঁদটি যেন কোল পেতে ওকে কাছে টেনে নিয়েছে। না, চাঁদ ওকে ডুবতে দেবে না। হীরালাল নদীর জলে ভেসে যায়। চাঁদও ভাসতে-ভাসতে জলের দোলায় দোল খায়।

দুলতে-দুলতে ঘুমিয়ে পড়ল হীরালাল। তারপর কোথায় হারিয়ে গেল, কেউ দেখতে পেল না। খুব সকালে ঘুম ভেঙে গেল হীরালালের। চোখ চেয়ে অবাক হয়ে গেল হীরালাল। আরে! কী সুন্দর ছোট্ট একটি নৌকোতে শুয়ে আছে সে! ধড়ফড় করে উঠে পড়ল হীরালাল। ও মা! এ যে তাদেরই সেই ছোট্ট নদী। তাদের গ্রামের ভেতর দিয়ে তিরতির করে বয়ে যাচ্ছে। ওই তো দূরে বন! এই তো তাদের ঘরে যাওয়ার রাস্তা!

নৌকো থেকে নদীর ঘাটে নেমে পড়ল হীরালাল। নদীর জলে নিজের মুখখানি একবার দেখে নিল। আকাশে চাইল। নীল আকাশে সোনালি সূর্য সকালের খুশি ছড়িয়ে দিয়েছে। হাঁটা দিল হীরালাল।

আর একটু হাঁটলেই তাদের ছোট্ট ঘরখানি। ছোট্ট ঘরে মা কাঁদছে হীরালালের জন্যে। ঘরে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে, মায়ের চোখের জল মুছিয়ে দিল সে। তারপর বলল, ‘কেঁদো না মা। আমি তোমার হীরালাল। এই তো তোমার কাছে ফিরে এসেছি।’ বলতে-বলতে সে-ও কেঁদে ফেলল। হঠাৎ কোত্থেকে লক্ষ্মীর বাচ্চাটা ছুটে এসে ওর পিঠে মুখ ঠেকিয়ে ওকে আদর করল। সে হয়তো বলল, ‘কেঁদো না হীরালাল। আমার সঙ্গে খেলবে এস।’

হীরালাল বুঝবে কি তার কথা? না সে কাঁদবে, এখনও?

হ্যাঁ, হীরালাল কাঁদবে আর চমকে-চমকে ভাববে, ওই যেন তার পায়ের নূপুর বেজে উঠছে!

ওই যেন সে হাত দুলিয়ে ডাকছে তাকে! বুঝি তার গলার স্বরে সোনা ঝরছে, হীরা-ম-ন! হীরা-ম-ন!

 এ-ডাক তুমিও শুনতে পাবে। শুনতে পাবে, পূর্ণিমার জ্যোৎস্না-নিঝুম রাতে যদি একমনে কান পেতে শোনো। শুনবে, এখনও সে কাঁদছে। ফোঁটা-ফোঁটা কান্নায় যেন বেজেবেজে উঠছে, হীরা-ম-ন! হীরা-ম ন!

সমানানুপাতি

 সমানানুপাতী