টোরা আর বাদশা – ৩

এদিকে বাদশার চেঁচামেচিতে বুড়ির ঘুম গোল্লায় গেল। আঁকপাকিয়ে উঠে পড়ল। তরতরিয়ে তেড়ে এল। আর যেই না বুড়িকে দেখা, বাদশাও মার ছুট/

বুড়ি তো আর বাদশার মতো ছুটতে পারে না/ তাই ধরতেও পারে না। তার ওপর কোমরে কনকনানি টনটনাচ্ছে। তাই দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়েই চেঁচিয়ে উঠল, ‘চোর, চোর, ধর, ধর/’।

বাদশা তখন কোথায় চলে গেছে। কত দূরে। আর ধরতে হচ্ছে না। বাদশা হাওয়ার চেয়ে আগে ছুটেছে।

 তখন বুড়ি আর কী করবে, ঘরের চৌকাঠে ঠ্যাং ছড়িয়ে চিল্লা-চিল্লি করতে-করতে মাথা খুঁড়তে লাগল।

 ছুটছে বাদশা। ডাকছে দিদিকে, খুঁজছে দিদিকে, ‘দিদি, দিদি, কই তুই?’ সেই ডাক অন্ধকারকে খানখান করে ফিরে-ফিরে ঘুরছে।

হঠাৎ এ কী/ সেই অন্ধকারটা যেন আরও অন্ধকার হয়ে গেল/ হ্যাঁ সেই আরও অন্ধকারে, আবার সেই কালো-ডানার দানো-পাখিদের ভয়-জাগানো পতপতানি আওয়াজ বাতাসে ভেসে আসছে। ওরা দেখতে পেয়েছে বাদশাকে। ওরা বাদশাকে ধরবে।

বাদশা সেই পতপতানি শব্দ শুনে দাঁড়িয়ে পড়ল। আকাশের দিকে চাইল। কিন্তু এবার ভয় পেল না বাদশা। সেই ভয়ঙ্কর পাখিগুলোর দিকে হাত উঁচিয়ে সে বললে, ‘ওরে দানব, ভয় দেখাবি কাকে? আমাকে? আমাকে যে ভয় দেখায়, সে এখনও জন্মায়নি।’

পাখিগুলো নেমে আসছে।

না, আজ আর কিছুতেই ধরা দেবে না বাদশা। বাদশা স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে আছে তাদের দিকে।

এবার পাখিগুলো বাদশাকে ছোঁ মারবে।

বাদশাও ঘুষি পাকালে

পাখিগুলো ছোঁ মারল।

বাদশা লড়াই শুরু করে দিলে। অসংখ্য পাখি আর বাদশা একা/

বাদশা লড়ছে। ওরা মস্ত-মস্ত ডানার খোঁচা দিয়ে ঝাঁপটা মারছে বাদশাকে। বাদশা রুখছে সে মার

ওরা খোঁচা-খোঁচা ঠ্যাং দিয়ে খামছে দিচ্ছে বাদশাকে।

বাদশা ওদের ঠ্যাংয়ের আঙুলগুলো মচকে দিচ্ছে।

ওরা লম্বা-লম্বা ঠোঁট দিয়ে ঠুকরে দিচ্ছে বাদশার মাথা, বাদশার হাত, বাদশার পিঠ। তখন দারুণ লড়াই শুরু হয়ে গেল।

যে ডানা মারে, তার ডানা ছিঁড়ে টুকরো-টুকরো করে দেয় বাদশা। যে খামচে দেয়, তার ঠ্যাং ভেঙে দেয় বাদশা। যে ঠোক্কর মারে, তার ঠোঁট উপড়ে ফেলে বাদশা। কেউ মরল, কেউ ছটফটিয়ে কাতরাতে লাগল। নয়তো মারের চোটে বৃন্দাবনে পালাল। কিন্তু ওই দানবের দল তো ছোটো নয়, একটা যায় তো দশটা আসে। আসুক/ বাদশার সঙ্গে আজ কেউ পারবে না। বাদশা সবাইকে আজ খতম করে ছাড়বে। দে মার, দে মার/ কী বাহাদুর ছেলে, দ্যাখো/

সত্যি/ শেষকালে পালা-পালা। দানব-পাখিগুলো বাদশার মারের চোটে যে যেদিকে পারল রণে ভঙ্গ দিয়ে একদম ভাগলবা/।

বাদশা জিতে গেছে/ বাদশার গা কেটে গেছে। রক্ত পড়ছে। পড়ক। জয়ের আনন্দে ওর বুকটা ফুলে উঠেছে। কিন্তু দিদি? দিদি কোথা? দিদি নইলে তার এই বীর ভাইকে কে আদর করবে? গায়ের রক্ত মুছে দেবে?

বাদশা আবার ডাকল, ‘দিদি

তখন দিদি অনেক দূরে। দিদি অনেক দূরে ওই পাহাড়ের পাথর ডিঙিয়ে সেই চূড়ায় যাবে। সেখানে প্রদীপের আলো জ্বলছে। তার হাতের এই প্রদীপটি টোরা জ্বালবেই সেই প্রদীপের আলোতে

কিন্তু টোরা যে জানে না, আর এক ভয়ঙ্কর বিপদ তার সামনে ওঁত পেতে দাঁড়িয়ে আছে/ কে জানত দানো-পাখিদের সেই যে সর্দার, সে তার পিছু নিয়েছে। ওই তো সে টোরার মাথার ওপর উড়ে-উড়ে এগিয়ে আসছে ওর হাতের প্রদীপটির দিকে লক্ষ রেখে। দেখতে পায়নি টোরা। দেখা সম্ভবও না। কেননা, রাতের কালোর সঙ্গে, দানোর ডানার কালো মিশে একাকার হয়ে আছে।

 কত উঁচু পাহাড়টা/ ওর ছোট্ট-ছোট্ট পা দুটি পাথরের গায়ে-গায়ে লাফ দিয়ে কত কষ্টে এগিয়ে আনমনে চলেছে। কত সাবধানে, সোনার প্রদীপে কান্নার জলটি সে সামলে রেখেছে। যেন চলতে গিয়ে ছলকে পড়ে না যায়/ যেন তার পা দুটি হোঁচট খেয়ে ছিটকে না পড়ে। চোখ তার সেই দিকেই সজাগ। না, অসাবধানী সে আর হবে না। কিছুতেই না।

অনেক উঁচুতে উঠে এসেছে টোরা। এখন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে, ওই দূরে পাহাড়ের চূড়ায় একটি ছোটো মন্দির। মন্দিরের ভেতর সেই প্রদীপের আলো জ্বলছে। ছোট্ট একটি প্রদীপ, কিন্তু তার আলোর ঝিলিমিলি উছলে ছড়িয়ে পড়েছে পাহাড়ের গায়ে। টোরার দৃষ্টি এখন ওই আলোর দিকে। ওই আলোয়, প্রদীপের শিখাঁটি ও জ্বেলে নিলেই অদৃশ্য টোরা ফিরে পাবে নিজেকে। নিজেকে ফিরে না পেলে ভাইকে সে কেমন করে ফিরে পাবে।

আঃ/ কী শান্ত নিশ্চুপ চারিদিক। নিশ্চুপ আর ভারি স্থির ওই নীল আকাশের চাউনিটাও। ওই আকাশ যেন পাহাড়কে ডাকছে চোখ টিপে। আর পাহাড় মুখ বাড়িয়ে হাতছানি দিচ্ছে আকাশকে। একাকী জ্বলতে জ্বলতে পাহাড়ের এই প্রদীপটি তা-ই দেখে দুলছে, নাচছে। নাকি হাসছে?

দাঁড়াল টোরা। তার অদৃশ্য চোখ দুটি স্থির হয়ে। দেখে। ধীরে-ধীরে এগিয়ে হাঁটু গেড়ে বসল টোরা। হাতের সোনার প্রদীপটা পাহাড়ের সেই জ্বলন্ত প্রদীপের শিখায় ছোঁয়াল। দ্যাখো-দ্যাখো ওই তো/ প্রদীপ জ্বলে উঠেছে/

দকী আশ্চর্য, প্রদীপ জ্বালার সঙ্গে-সঙ্গে টোরার শরীরটাও তো আবার ফুটে উঠেছে/ ওই তো আলোয় তাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে/ ওই দেখা যাচ্ছে, মুখটি/ ওই তার চোখ দুটি/ প্রদীপটি হাতে নিয়ে ওই তো টোরা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে/

আনন্দে বুকের ভেতরটা তোলপাড় করে নেচে উঠল টোরার। সে নিজেকে দেখতে পেয়েছে। এ কেমন করে হয়/ একি জাদু? না দেবতার বর/

এত আনন্দেও এবার কিন্তু টোরা একটুও অসাবধানী হল না। জ্বলন্ত প্রদীপের শিখাঁটি সে বুক দিয়ে আড়াল করে রাখল। না, এ-প্রদীপ সে আর নিভতে দেবে না। কিছুতেই না। এ প্রদীপ যে-দেবতার, তার পায়ের কাছে সে আবার রেখে আসবে।

শেষবারের মতো দেবতাকে প্রণাম করে বেরিয়ে এল টোরা মন্দিরের দরজা পেরিয়ে। বাইরে, এই পাহাড়ের চূড়ায়-চূড়ায় ধীরে ধীরে হাওয়া বইছে। সেই হাওয়ার দোলায় প্রদীপের শিখাঁটির মতো টোরার মনটিও দুলছে। এবার ওকে ফিরতে হবে। ফিরতে হবে, এই পাহাড়ের পায়ের কাছে, সেই গুহার মন্দিরে। পা বাড়াল। কিন্তু টোরা দেখতে পেল না। সামনে তার কে দাঁড়িয়ে/ কিসের বিপদ।

থতমত খেয়ে আচমকা চিৎকার করে উঠেছিল টোরা/ দেখতে পেয়েছে টোরা। একটা ভয়ঙ্কর জীব। থুপসি মেরে উপুড় হয়ে পড়ে সে তার দিকে চেয়ে আছে। টোরা স্পষ্ট দেখছে, তার আটটা ঠ্যাং। সাপের মতো কিলবিল করছে। তার বুকের একটা গর্তের ভেতর থেকে কালো মেঘের মতো ধোঁয়া বেরুচ্ছে। সেই ধোঁয়া টোরার মুখে-চোখে লেগে কেমন যেন সব ঝাপসা করে দিচ্ছে। তারপর সেই আটটা ঠ্যাং নড়ে উঠল। নড়তে-নড়তে টোরার দিকে এগিয়ে এল। হয়তো এক্ষুনি সে তার ওই আটটা ঠ্যাং দিয়ে টোরাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জাপটে ধরবে/ তাহলে টোরা কী করবে তখন?

 টোরা ভীষণ ভয়ে কাঁপতে-কাঁপতে চিৎকার করে বলে উঠল, ‘আমায় মেরো না।’

সেই আট-ঠ্যাঙে তখন আটটা ঠ্যাং নাচিয়ে নাচিয়ে হেসে উঠল, হা-হা-হা। তার হাসির শব্দে পাহাড়ের পাথরগুলো টলতে টলতে ছিটকে পড়ল। মেঘ ডেকে উঠল গুড়গুড় করে/

টোরা প্রদীপটা হাতের আড়ালে লুকিয়ে বলল, ‘আমার এ-প্রদীপ তুমি নিভিয়ে দিয়ো না/’।

এবার সেই আট-ঠ্যাঙে কথা বলল, ‘তুই কার হুকুমে মন্দিরে ঢুকেছিস? এই মন্দির আমার/ তার গলার শব্দ শুনে মনে হচ্ছে, কে যেন ঢাক পেটাচ্ছে তার গলার ভেতর।

টোরা বললে, ‘মন্দির তো দেবতার। সেখানে তো সবাই যেতে পারে।’

এবার সে গর্জন করে উঠল। বলল, “আমি মন্দিরের দেবতাকে রক্ষা করি। যারা মন্দিরে চুরি করতে ঢোকে, তাদের আমি পাহাড়ের ওপর থেকে নীচে ফেলে দিই।’

‘আমি তো কিছু চুরি করিনি।’ উত্তর দিলে টোরা।

 ‘তুই আলো চুরি করেছিস। প্রদীপের আলো।’

 ‘আলো কি চুরি করা যায়? তা তো আমি জানতুম না। টোরা কাঁদো-কাঁদো গলায় বললে, ‘আমি আর কখনো করব না। এবারটি আমায় ছেড়ে দাও।’

‘না।’ সেই আট-ঠ্যাঙে এবার হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে আসছে। টোরা শেষবারের মতো কেঁদে উঠল, ‘আমায় ছেড়ে দাও, আমায় দয়া করো।’

এতক্ষণ আর কে তাকিয়ে ওই আকাশের দিকে। ওই দ্যাখো সেই দানো-পাখিটা টোরার মাথার ওপর পাক খাচ্ছে। তার কালো ছায়াটা হঠাৎ টোরার মুখের ওপর ছড়িয়ে পড়ল। পড়ার সহেগ সঙ্গে ছোঁ মারল পাখিটা। সে টোরার হাত থেকে প্রদীপটা ছিনিয়ে নেবে। কিন্তু পারল না। দেখে ফেলেছে পাহাড়ের এই আট-ঠ্যাঙে জন্তুটা আকাশের ওই কালো-ডানার দানোটাকে। ছোঁ মারার সঙ্গে সঙ্গে সে-ও তার আটটা ঠ্যাং দিয়ে ধরে ফেলেছে দানোটার কালো ডানা। আর দানোটা অমনি তার মস্ত ধারালো ঠোঁট দিয়ে ঝাড়লে এক বোম্বাই ঠোক্কর আট ঠ্যাঙের গর্দানে। তারপর যা লেগে যা ঝটাপটি। আট-ঠ্যাঙের গায়ে যত ক্ষমতা, দানোর গায়েও তত শক্তি। আট-ঠ্যাঙে তার ঠ্যাং দিয়ে জড়িয়ে ধরে দানোটাকে যতই চটকাচ্ছে, দানো-পাখিটাও ততই ঠুকরে-ঠুকরে রক্তারক্তি করে ছাড়ছে। কী ভীষণ লড়াই। আর কী প্রচণ্ড আর্তনাদ পাহাড়ের মাথার ওপর। যেন একশোটা ঢাকের শব্দ কান ফাটিয়ে একসঙ্গে বেজে উঠছে। তাদের ধস্তাধস্তিতে পাহাড়, কাঁপছে।

টোরা তো দেখেশুনে থ। এতক্ষণ আড়ষ্ট হয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে ছিল টোরা। তারপর যখন ভয়ানক তাণ্ডব শুরু হয়ে গেল, তখন ভাবল, এই সুযোগ। টোরা ওদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে পাহাড়ের ওপর থেকে তরতর করে নামতে শুরু করে দিলে।

কিন্তু এই যাঃ/ দানব-পাখিটা দেখে ফেলেছে/ তার সেই মস্ত-মস্ত ডানা দুটোর বেদম এক ঝটকায় আট ঠ্যাঙেকে কুপোকাত করে সে ছুটল টোরার দিকে। টোরাকে পেছন থেকে আঁকড়ে ধরলে। ততক্ষণে আট ঠ্যাঙেও সেখানে হাজির। সে আবার ঝাঁপিয়ে পড়ল দানো-পাখির ঘাড়ে। তারপর পাহাড়ের ওপর টোরাকে নিয়ে টানামানি করতে করতে শুগু হল সে আবার আর এক লড়াই। পাহাড়ের ওপর থেকে তিনজনেই, এই পড়ে, কি সেই পড়ে/ আর ওই রকম সাংঘাতিক টানামানি করলে টোরাই বা কেমন করে সামলাবে তার হাতের প্রদীপ/ বেমক্কা হল কী, প্রদীপের আগুনে দানো-পাখির ডানায় লেগে গেছে ঘেঁকা/ সঙ্গে সঙ্গে ডানাটা দাউদাউ করে জ্বলে উঠেছে। দানোটা পুড়তে-পুড়তে বিকট চিৎকার করে উঠল। চিৎকার করে টোরাকে মারল এক ধাক্কা। টোরা টাল সামলাতে পারল না। পিছলে পড়ল সে পাহাড়ের চূড়া থেকে নীচে, পাহাড়ের খাদে। খাদ থেকে সে আরও অন্ধকারে হাবুডুবু খেতে খেতে-পড়তে আরও গভীরে ডুবে গেল টোরা।

.

কিন্তু আশ্চর্য/ পা ফসকে আছাড় খেয়ে পড়ল না টোরা। কোনো আঘাত তো তার লাগল না/ কে যেন ধীরে ধীরে ওকে নামিয়ে নিয়ে এল এই অন্ধকার গহ্বরে/ না, আঘাত তার লাগবে না। তার হাতে যে দেবতার জ্বলন্ত প্রদীপ। এত বিপদেও সে তার হাতের প্রদীপটি শক্ত হাতে ধরে রেখেছে। সে নিভতে দেয়নি তার শিখাঁটি। আঃ/ এই গভীর অন্ধকারে এ-প্রদীপটি যেন টোরার বন্ধু। ওকে পথ দেখাবে/

তবু ভীষণ ভয় লাগছে টোরার। গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। কেউ নেই, কিছু নেই। এ-কোথায় পড়ল সে। এখান থেকে ও কেমন করে উদ্ধার পাবে/ পৃথিবীর নীচটা কী ভয়ানক অন্ধকার/

না, সে হয়তা আর পারবে না, পারবে না বাঁচতে। এই জমাট অন্ধকার গহ্বরে সে বুঝি তিলেতিলে শুকিয়ে মরবে/ ভয়ে বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল টোরার। ওর মনে হচ্ছে, এখনই খুব চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। কিন্তু পারল না। মনের ভেতরটা ছটফট করে উঠলেও ওর গলা কথা বলতে পারছে না। অথবা মনে হয়, ও যেন কথা বলতে ভুলে গেছে/ সত্যিই, কথা বলতে ভুলে যাওয়ারই কথা। এখানে আকাশ নেই, আকাশের আলো নেই। গাছ নেই, পাখি নেই। শুধু অন্ধকার। টোরার যেন দম আটকে আসছে। আর মনে হচ্ছে, ওর হাতের প্রদীপ-শিখায় ওর নিজেরই ছায়াটা যেন একটা ভয়ঙ্কর মূর্তি হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে কটমট করে।

হঠাৎ কেমন যেন শিউরে উঠল টোরা/ অমন চমকে কার দিকে চাইল সে/

টোরা দেখতে পেল, অন্ধকারে কালো-কালো ছায়ার মতো কারা যেন এদিক-ওদিক থেকে ছুটে পালাচ্ছে/ মনে হল, গহ্বরের আশে-পাশে, এবড়ো-খেবড়ো গর্তগুলোর মধ্যে তারা ঢুকে পড়ল। টোরার চোখে ধাঁধা লেগে গেছে/ তুমি দেখলে কী করতে জানি না। কিন্তু টোরা ভয় পেল না। বরঞ্চ মনে ভরসা পেল। হয়তো ভাবল, এই নিথর অন্ধকারে ও শুধু একা নয়। এখানেও প্রাণ আছে। কে বলতে পারে, এ বিপদ থেকে ওই প্রাণ টোরাকে রক্ষা করবে না/

‘শি-স-স-স।’ ঝড় উঠলে যেমন শিস বেজে ওঠে, ঠিক তেমনি ভীষণ শব্দ শুনতে পেল টোরা হঠাৎ। তারপর কী ভয়ঙ্কর জোরে সেই শিসের সঙ্গে সত্যি-সত্যি ঝড় উঠল সেই অন্ধকার গহ্বরে। এলোমেলো ধাক্কা দিয়ে সেই ঝড় ছুটে আসছে টোরার দিকে। এই বুঝি তার হাতের প্রদীপ নিভে যায়/ এইরে, কী করবে টোরা/ না-বলে, না-কয়ে এমন ঝড় ওঠে কোত্থেকে, এই গহ্বরে। ঝড়ের ধাক্কায় নিজেই টাল সামলাতে পারছে না, প্রদীপ সামলাবে কেমন করে/ এ কী বিপদ আবার/ মনে হচ্ছে, এক্ষুনি সে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাবে। কিংবা হুস করে শুকনো পাতার মতো শূন্যে উড়ে যাবে/ টোরার আর কোনো নিস্তার নেই। রাক্ষুসী ঝড় হাঁ বাড়িয়ে তেড়ে-মোড়ে ছুটে আসছে। তাকে গিলে খাবে/ টোরা পালাতেও পারছে না। যেদিকে ও পা বাড়ায়, সেদিকেই ঝড়। ও যদি সমান যায়, ঝড়ও আসে সমানে থেকে। ও যদি পিছন হাঁটে, ঝড়ও হাঁটে পিছন দিকে। নাস্তানাবুদ হয়ে গেল টোরা। টোরা আর দাঁড়াতে পারল ন। বসে পড়ল। তারপর দু-হাতের মুঠি দিয়ে আড়াল করলে প্রদীপের শিখাঁটি। কিন্তু কে শুনছে, কার কথা/ হুস-স-স, হুস–স-স। ঝড় বইবে, ঝড় বইছে।

হঠাৎ থরথর করে কেঁপে ওঠে ওর চোখের পাতা দুটি/ আঁতকে ওর বুকের ভেতরটা যেন থমকে যায়/ টোরা সেই প্রদীপের আলোছায়ার অন্ধকারে দেখে কী, অগুনতি ভাঁটার মতো লাল টকটকে চোখ তার দিকে প্যাটপ্যাট করে চেয়ে আছে। কী ভয়-জাগানো তাদের চোহারা/ তারা যেন না-মানুষ, না-জন্তু। টোরা প্রদীপের আলোয়, স্পষ্ট দেখল তাদের মাথাগুলো হাঁড়ির মতো হেঁড়ে। ঝুলের মতো ছন্নছাড়া চুলের ছিরি/ ঠ্যাঙগুলো সব ধনুকের মতো বেঁকাবেঁকা। হাতগুলো নাটা-নাটা, খাটো-খাটো/ নীচের ঠোঁট, নীচের দিকে ঝুলে আছে। নাল গড়াচ্ছে। আর ডাববা-ডাববা নাকের গর্তগুলো হাঁপাতে হাঁপাতে হাঁসফাঁস করছে। তাদের মুখ দিয়েই তো ঝড় ছুটছে/ বাবা/ তারা দিচ্ছে ফু, উঠছে ঝড়। এবার টোরা ঠিক দেখতে পেয়েছে। তারা ফুয়ের ঝড় বইয়ে প্রদীপটা নিভিয়ে ফেলতে চাইছে। সর্বনাশ তো তাহলে/

না, সর্বনাশ না। আশ্চর্য ব্যাপার/ তারা যতই ফুঁ দিচ্ছে, প্রদীপ নেভা দূরে থাক, ততই তার আলোর রোশনাই বাড়ছে। প্রদীপ যেন আলোয় আলো করে দিচ্ছে সেই অন্ধকার।

নিজেই অবাক হয়ে যাচ্ছে টোরা, এ কেমন করে হয়। ঝড় উঠলে, গাছ পড়ে, ঘর ভাঙে, তুফান ওঠে, গাঙ ছোটে, জাহাজ ডোবে, হাতি মরে। অথচ তার হাতে তো একটা সামান্য প্রদীপ। সে তো নিভছে না। উলটে আরও যে সে ঝলমল করে ওঠে।

সত্যিই/ প্রদীপ আর নিভবে না। টোরা তো জানে না, ওই পাহাড়-চূড়ার মন্দিরে যে প্রদীপ জ্বলছে, সেই জ্বলন্ত প্রদীপের স্পর্শে আর-একটি প্রদীপ জ্বলে উঠলে সে আর কোনোদিন নেভে না। আর তাই শত চেষ্টা করেও সেই না-মানুষ, না-জন্তুরা তাদের ঝড়ের মতো ফুয়ের তেজে নেভাতেই পারছে না প্রদীপের আলো।

আচ্ছা, থাকলেই বা আলো। অন্ধকারে আলো জ্বললে ভালোই তো/ ওদের মতলবটা কী বলো তো? টোরার হাতের প্রদীপ নিভিয়ে দিয়ে ওকে কি মারবে? নাকি, অন্ধকারে যারা থাকে, তাদের অন্ধকারটাই আলো আর আলোটা অন্ধকার হবেও বা।

সেই হাঁড়ির মতো হেঁড়ে-হেঁড়ে মাথাগুলো এবার হেলে-হেলে টোরার দিকে এগিয়ে আসছে। টোরাও ভয়ে চোখ ঘুরিয়ে দেখছে তাদের। তারপর তারা যখন খুব কাছে চলে এসেছে, লাফিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, ‘না, তোমরা আমার প্রদীপ নিভিয়ে দিয়ো না।

নিমেষের মধ্যে ফুয়ের ঝড় থেমে গেল। থামতেই সব ভোঁ ভাঁ/ কোথায় গেল সেই মুখগুলো? লাল-টকটক চোখগুলো? টোরা দেখতে পাচ্ছে না তো/ কোথায় মিলিয়ে গেল?

ধড়ফড় করে দাঁড়িয়ে পড়ল টোরা। এখন প্রদীপের আলো জ্বলজ্বল করছে। চারিদিক নিস্তব্ধ। টোরার চোখে ভয়-জড়ানো অবাক চাউনি। তার চোখ খুঁজছে। আলতো-আলতো পা ফেলে হাঁটছে। কিন্তু আশ্চর্য, কেউ নেই। এগিয়ে যায় টোরা। উঃ বাবা/ গহ্বরের গায়ে-গায়ে এবড়ো-খেবড়ো গর্তগুলো যেন রাক্ষসের মতো হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছে। এই গর্তগুলোর মধ্যে লুকিয়ে পড়েনি তো/ কে জানে/ দেখি/ উঁকি মারলে টোরা। আর ঠিক তক্ষুনি তার যেন মনে হল, ভয়ঙ্কর এই গর্তগুলোর ফাঁকে-ফাঁকে ভয়-জড়ানো রহস্য তাকে চোখ টিপে ডাকছে। কেঁপে উঠল টোরার বুকখানা। কিন্তু এখন ভয় পেলে তো চলবে না তার। এই বিপদে টোরাকে সাহসে বুক বাঁধতে হবে। এই ভয়ঙ্কর না-মানুষ না-জন্তুগুলো যদি তাকে মারতে চায়, মারুক। তবু এ-প্রদীপ টোরা প্রাণ থাকতে নিভতে দেবে না।

হঠাৎ থতমত খেয়ে গেলে টোরা। সে একটা গর্তের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়ল কেন চট করে? ওই তো/ তারা যেন ওকে দেখে এই গর্তের সুড়ঙ্গ দিয়ে চোঁ-চাঁ দৌড় দিচ্ছে।

টোরা গর্তের সুড়ঙ্গে ঢুকে পড়ল। সামনে খাদ। কোথাও উঁচু, কোথাও নিচু। বিশ্রী খানা-খন্দ। লাফ মারল টোরা। হ্যাঁ, এখন টোরা দেখবে ওরা কারা। তাই লাফাতে-লাফাতে গভীর অন্ধকারে হারিয়ে গেল/ টোরা একবার ভাবলও না, ঢুকছে তো, কিন্তু অন্ধকার থেকে বাইরে সে বেরুবে কেমন করে/

 ‘আঃ–/’ ঠিক যা ভেবেছি তাই/ বেসামাল হয়ে টোরার পা পিছলে গেছে। ঈশ, মেয়েটা একেবারে মুখ থুবড়ে পড়েছে। যা লাগান লেগেছে না/ প্রদীপটা গেল নাকি? না, সেটি তার হাতছাড়া হয়নি। উঠতে গেল টোরা।

‘গ্যাঁও, গ্যাঁও’ হঠাৎ অমন বিশ্রী সুরে দারুণ জোরে গোঙাচ্ছে কারা? গোঙাচ্ছে, না টোরাকে ভেঙাচ্ছে/

টোরা তাড়াতাড়ি উঠে পড়েছে।

ওঠার সঙ্গে-সঙ্গে যন্ত্রণায় ভীষণ আর্তনাদ করে উঠল, ‘উঃ/’ খুব লেগেছে ওর কপালে।

 এ কী/ হঠাৎ ওর কপালে ঢেলা ছুঁড়ে মারল কে। টোরা ঘুরে দাঁড়াল। সঙ্গে-সঙ্গে চাঁই চাঁই ঢেলা চারিদিক থেকে ঝাঁকে-ঝাঁকে উড়ে আসছে। ওর গায়ে লাগছে, মাটিতে ছড়িয়ে পড়ছে। টোরা প্রাণপণে সামাল দিচ্ছে। কিন্তু পারবে কেন/ সামলাতে না পেরে টোরা চেঁচিয়ে উঠল, ‘আমায় মেরো না।’

টোরার মিষ্টি গলার প্রতিধবনি কাঁপতে-কাঁপতে গহ্বরের অন্ধকারের মধ্যে কার কানে পৌঁছয় কে জানে/ সাত্যিই, নিমেষের মধ্যে বন্ধ হয়ে গেল সেই ঢেলা ছোঁড়া। আবার নিঝুম চারিদিক। সারা গায়ে আঘাত লেগেছে টোরার। কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু এ নিঝুম অন্ধকারে ও কাকে ডাকবে। ওর যে বড্ড জল তেষ্টা পেয়েছে।

‘আলোটা নিভিয়ে ফেল/’ হঠাৎ গম্ভীর গলায় হুংকার ছেড়ে কে ডেকে উঠল/ টোরার চোখ দুটি চনমন করে এদিক ওদিক তাকাল। সঙ্গে-সঙ্গে আরও অনেক গলা চেঁচিয়ে উঠল, ‘আলোটা নিভিয়ে ফেল।’

‘নিভিয়ে ফেল/

‘নিভিয়ে ফেল/’

 ‘নিভিয়ে ফেল/

চেঁচানিতে টোরার কান ঝালাপালা হয়ে যায়। সইতে পারছে না টোরা সে- চিৎকার। টোরা তারস্বরে ডেকে উঠল, ‘থামো/”

আশ্চর্য/ আবার সব নিশ্চপ/ গলার সেই অদ্ভুত আর ভীষণ শব্দগুলো থেমে যেতেই, ভয় মেশানো সেই কালো অন্ধকারে প্রদীপের আলো কেমন যেন থমথম করছে। টোরা এগোতে পারছে না। পিছনে কিছু দেখতেও পাচ্ছে না। ওর হাত-পাগুলো থরথর করে কেঁপে-কেঁপে চমকে উঠছে। তারপর ওর অজান্তেই চোখের পাতা বেয়ে জল গড়ায়। টোরা বোধহয় কাঁদছে। কাঁদছে কার জন্যে? কাঁদছে বাদশার জন্যে? না, মা আর বাবার জন্যে? আজ সবার জন্যে কাঁদবে টোরা। এখন যেন সবার কথা আপনা থেকে ওর মনে এসে বাসা বাঁধছে। টোরা জানে, আর কাউকে সে দেখতে পাবে না। কোনোদিনও না।

‘গ্যাঁও-গ্যাঁও-গ্যাঁও/ ‘

হঠাৎ আবার কর্কশ-গলার হুংকার শোনা যায়/ কে ও? আগুনের ভাঁটার মতো জ্বলজ্বলে চোখ জ্বেলে টোরার দিকে চেয়ে আছে?

‘কে?’ টোরার গলায় ভয়-মেশানো স্বর।

সেই কর্কশ-গলার হুংকার বললে, ‘আলোটা নিভিয়ে ফেল, নইলে তোকে মেরে ফেলব/’। টোরা সেই আগুনের ভাঁটার মতো জ্বলন্ত চোখ দুটোর দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলে, ‘কেন নিভিয়ে ফেলতে বলছ, আলোর কী দোষ?’।

‘আমাদের চোখ জ্বলে যাচ্ছে, আমরা অন্ধ হয়ে যাচ্ছি। আলো আমাদের শত্রু।

 ‘তোমরা কারা?’

 “আমরা এই অন্ধকারে থাকি। পৃথিবীতে থাকতে-থাকতে আমাদের দিন শেষ হয়ে গেলে, এই মাটির নীচে আমরা চলে আসি। সবাই বলে এর নাম মৃত্যুপুরী। আমরা বলি অন্ধকার। দেখছি, তুই তো মরিসনি/ তুই এখানে এলি কেমন করে? তুই কেন আলো এনেছিস? এক্ষুনি নিভিয়ে ফেল। আমরা সহ্য করতে পারছি না।” সে বললে

 টোরা উত্তর দিলে, ‘এ দেবতার আলো। এ আলোয় কেউ অন্ধ হয় না।’

এবার যেন সেই কর্কশ-স্বর গর্জন করে উঠল, ‘ফের কথা বলছিস/’

 টোরা বলল, ‘দেবতার আলো নেভাতে নেই।’

 টোরার কথা শুনে সে রেগে জ্বলে উঠেছে। সে লাফ মারল টোরার সামনে। টোরা এবার স্পষ্ট দেখতে পেল, একটা বিকট চেহারার, কিম্ভুতকিমাকার সেই না-মানুষ না-জন্তুটাকে। টোরার সামনে দাঁড়িয়ে সাংঘাতিক জোরে সে ফুঁ দিল প্রদীপের শিখায়/ নিভছে না প্রদীপ। আলো আরও ঝলমলিয়ে উঠছে।

যখন সে প্রাণপণে ফুঁ দিয়েও নেভাতে পারল না প্রদীপের আলো, তখন ধাঁই করে ধাক্কা মেরেছে টোরার প্রদীপে। আর দেখতে আছে/ প্রদীপের শিখা ঝলকে উঠে ওই না-মানুষ না-ভাটার মুখের ওপর ছিটকে পড়ল। আগুনের জ্বালায় প্রচণ্ড চিৎকার শুরু করে, দশ হাত দূরে সে সরে দাঁড়াল।

টোরা তাই দেখে নিজেই কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে। কিন্তু আর দেরি নয়। এখানে আর দাঁড়ানো উচিত নয়। কিম্ভুত জীবটার হাত থেকে বাঁচতে হলে ওকে পালাতে হবে। কিন্তু কোথায় পালাবে? টোরা পিছন ফিরল।

সর্বনাশ/ পিছনে এই দ্যাখো একটা কত বড়ো সাপ/ ফোঁসফোঁস করে এগিয়ে আসছে। সাপটাও কি মরা? সেও কি এই মৃত্যুপুরীর বাসিন্দা/ তা যদি হয়, মরে গেলে তো সব শান্ত হয়ে যায়/ এমন নিষ্ঠুর কেন ওরা? সাপটার জলজ্যান্ত ফণাটার দিকে তাকিয়ে টোরা হতাশ হয়ে ভাবলে, এইবার তার শেষ। শেষকালে বোধহয় সাপই তাকে খাবে/

একপাশে দাঁড়িয়ে টোরা থরথর করে কাঁপছে। সাপ সড়সড় করে টোরার দিকে এগিয়ে আসছে। টোরা ভয়ে পাথর হয়ে গেল। সাপ টোরার সামনে ফণা তুলে খাঁড়া দাঁড়িয়ে পড়ল। টোরার মুখের কাছে মুখ এনে ফোঁসফোঁস করে বললে, ‘কথা কানে নিচ্ছিস না কেন/ আলোটা নিভিয়ে ফেল/’ সাপটা যেন ধমক মারছে।

টোরা তাড়াতাড়ি প্রদীপটা তার পিছনে আড়াল করে লুকিয়ে রেখে, ভয়ে-ভয়ে বললে, ‘না।’

শেষ হয়নি টোরার মুখের কথা। তার আগেই সাপটা লাফিয়ে উঠে টোরাকে জড়িয়ে ধরল। জড়িয়ে ধরে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেললে টোরাকে। টোরার দম আটকে আসছে। মনে হচ্ছে, বাঁধনের চাপে ওর হাড়গোড় গুঁড়িয়ে টুকরো-টুকরো হয়ে যাবে এক্ষুনি। ও আর পারছে না। ও চেঁচিয়ে কাউকে ডাকবে, সে-শক্তিও আর নেই তার। এই বুঝি তার শেষ/

না, শেষ কেন হবে/ ও তো কোনো অন্যায় করেনি। আর তা ছাড়া দেবতা তার সঙ্গে আছেন। তার হাতে দেবতার প্রদীপ জ্বলছে। ওর কে ক্ষতি করবে/ তাই টোরার ওই ছোট্ট প্রাণটুকু প্রচণ্ড ক্ষমতায় ঝলকে উঠল। জ্বলন্ত প্রদীপের শিখাঁটি সে ঠেকিয়ে দিল, সাপের মুখে। দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল তার মুখখানা। যন্ত্রণায় দিকবিদিকজ্ঞান হারিয়ে টোরাকে ছুঁড়ে ফেলে দিল সেই সাপটা গহ্বরের গর্তে। টোরা প্রাণপণে আগলে ধরল প্রদীপটা দু-হাত দিয়ে/ প্রদীপ রক্ষা পেল, কিন্তু টোরা সামলাতে পারল না তার মাথাটি। গহ্বরের পাথরে ধাক্কা খেয়ে টোরা নিস্তেজ হয়ে পড়ে গেল।

তুমি হয়তো ভেবেছিলে, এই অন্ধকারের অন্ধকূপে টোরার চোখ দুটি চিরদিনের মতো নিভে গেছে। ওর হয়তো আর কোনো দিন ঘুম ভাঙবে না।

কিন্তু না। ওই দ্যাখো, নিস্তেজ ওর হাতের আঙুলিগুলি ধীরে ধীরে কেমন কাঁপছে আবার। ক্লান্ত চোখ দুটি কেমন অনেক কষ্টে জেগে উঠেছে। চোখের পাতা দুটি মেলে ধরার চেষ্টা করছে টোরা। ওই তো টোরা চাইল

কিন্তু এ কী/ এত আলো এল কোত্থেকে? যে অন্ধকার গহ্বর এতক্ষণ কালো অন্ধকারে ঢাকা ছিল হঠাৎ তার এ কী রূপ/ আলোয় ঝলমল করছে চারদিক। উঠে বসল টোরা। কই তার প্রদীপ? এই তো/ দ্যাখো, দ্যাখো, প্রদীপের শিখাঁটি আলোয় আলো ছড়িয়ে, এই গহ্বরের অন্ধকারকে চোখ মটকে যেন ঠাট্টা করছে। এত কষ্টেও খুশিতে উছলে পড়ল টোরার মন। উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করল টোরা। ওর মাথার ভেতরটা ঝিমঝিম করছে। পা দুটি টলেটলে পড়ে যাচ্ছে। তবু দাঁড়িয়ে উঠে প্রদীপটি হাতে তুলে নিল। হঠাৎ একটি ঝুনঝুনি বেজে উঠল, ঝুনঝুন, ঝুনঝুন।’

ভারি মিষ্টি তো ওই শব্দটি। কে আবার পায়ে মল বাজিয়ে নাচছে এখানে?

আঃ/ কী ভালো লাগছে/ আনন্দে প্রাণভরে নিশ্বাস নিল টোরা। না, এখন সাপও নেই, সেই কিম্ভুতকিমাকার না-মানুষ না-জন্তুও নেই।

কিন্তু কে বাজাচ্ছে? আশে-পাশে তো কাউকে দেখতে পাচ্ছে না টোরা।

তাহলে তো দেখতে হয়।

একটি-একটি পা ফেলে, এক-পা এক-পা এগিয়ে যায় টোরা। এগিয়ে যাচ্ছে প্রদীপটি হাতে নিয়ে। ফিরে ফিরে এদিক ওদিক মিটিমিটি চাইছে আর গহ্বরের আরও গভীরে নেমে যাচ্ছে।

চলতে-চলতে হঠাৎ থমকে যায় টোরা। দাঁড়িয়ে পড়ে। আরে/ আরে/ একটি পাখি কেমন ঝুনঝুনি বাজিয়ে দোলনায় দুলছে/ ও/ টোরা তাহলে এতক্ষণ দোলনায় বাঁধা এই ঝুনঝুনির শব্দটাই শুনতে পাচ্ছিল। হ্যাঁ। এখন পাখিটা, দোলনাটা আলোয় স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে টোরা। পাখিটা কি তার দিকে চেয়ে-চেয়ে হাসছে? বুঝতে পারে না টোরা।

‘টোরাদিদি। হঠাৎ দোলনা থামিয়ে পাখিটা ডাকল।

 চমক ভাঙল টোরার। তাইতো, পাখিটা তার নাম জানল কেমন করে

‘আমাকে চিনতে পারছ?’ পাখি জিজ্ঞেস করলে।

 টোরার মুখে কথা ফুটল না।

 ‘আমি ময়না।’

ময়না/ টোরার বুকটা ছমছম করে ওঠে। গায়ে কাঁটা দেয়।

‘মাকে খুশি করার জন্যে তোমায় কত কষ্ট করতে হল বলো তো?’ পাখি বললে।

টোরা ফ্যালফ্যাল করে চেয়েই রইল পাখির দিকে। চেয়েচেয়ে অবাক হয়ে ভাবতে লাগল, একি সত্যি/ তাদের ময়না তার সঙ্গে কথা বলছে/

‘মায়ের জন্যে এই পাতালের গহ্বরে তুমি বন্দি হয়ে আছ। তোমার ভয় করছে না?’ পাখি জিজ্ঞেস করলে।

এবার টোরা কথা বললে। অস্ফুট স্বরে জিজ্ঞেস করলে, ‘আমি বন্দি?’

 পাখি বলল, হ্যাঁ, তুমি বন্দি। যেমন আমায় বন্দি করে রেখেছিলে তোমাদের খাঁচায়।’

‘আমরা তো তোমাকে বন্দি করিনি। আমরা তো তোমাকে ভালোবেসেছি। আদর করেছি। বন্দিকে কেউ আদর করে, ভালোবাসে?’ টোরা উত্তর দিলে।

পাখি বললে, “আচ্ছা ধরো, তুমি যদি আর কোনোদিন এ গহ্বর থেকে বেরিয়ে যেতে না পার? আর কোনোদিন মাকে দেখতে না পাও? দেখতে না পাও তোমার ওই ছোট্ট ভাই বাদশাকে বা তোমার বাবাকে? যদি তুমি কোনোদিন মাকে আর তোমাদের বাড়ির জানলায় মুখ বাড়িয়ে কু ঝিক ঝিক রেলের শব্দ শুনতে না পাও? কিংবা ওই শব্দ শুনতে শুনতে তুমি গান গাইলে, তোমার গলায় গলা মিলিয়ে তোমার সঙ্গে বাদশা গান না গায়? তোমার সঙ্গে বাদশা খেলে না করে? রাতেরবেলা মোমের আলো জ্বেলে তোমার কাছে গল্প না শোনে? তার বদলে চিরদিন তুমি যদি এখানে বন্দি থাকো, আর আমরা সবাই তোমাকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসি, তোমাকে আদর করে, গান শোনাই, তোমার ভালো লাগবে?

‘কেন একথা বলছ?’ কেমন ভয়-জড়ানো গলায় জিজ্ঞেস করলে টোরা।

 ‘কেন বলছি জানো? আমি মানি তোমরা আমাকে খুব ভালোবাসতে। তোমার নরম মিষ্টি হাতের আঙুল আমার মাথায় ঠেকিয়ে তুমি রোজ আমায় কত আদর করতে। তুমি কত যত্ন করে আমায় খাবার দিতে। কিন্তু তুমি কি দেখেছিলে কোনোদিন আমার চোখ দুটিং দেখেছিলে আমার চোখে জল? তুমি তো কোনোদিন দেখনি আমি মায়ের জন্যে কাঁদি কিনা। তোমার মতো আমারও ভাই আছে টোরাদিদি। তোমার মতো আমিও তাদের গান শোনাতুম। তাদের সঙ্গে কত খেলা করেছি। ভোরের আকাশে সূর্যের ঝিকিমিকি আলোয় ডানা মেলে কতদিন আমি আমার ভাইয়ের সঙ্গে উড়ে বেরিয়েছি। ওই খোলা আকাশই যে আমাদের বাড়ি।’

 পাখির কথা শুনতে-শুনতে টোরার চোখের পাতা দুটি ছলছল করে উঠল। টুপ করে এক ফোঁটা জল মাটিতে পড়ল

পাখি বলল, ‘কাঁদছ টোরাদিদি?’

 টোরা বলল, ‘তোমাদের যে এত দুঃখ, সে তো আমি জানতুম না।’

‘টোরাদিদি, নিজে দুঃখ না-পেলে, অন্যের দুঃখ বুঝবে কেমন করে? পাখি উত্তর দিলে।

টোরা কাঁদতে-কাঁদতেই বললে, ‘পাখি, আমি যখন তোমায় দুঃখ দিয়েছি, তখন তুমি আমায় শাস্তি দাও/’

 পাখি বলল, ‘না টোরাদিদি, তোমার কোনো দোষ নেই। তুমি যা করেছ সে তো তোমার মাকে সুখী করার জন্যে। তুমি এই যে এত কষ্ট করলে, সেও তো তোমার মায়ের জন্যে। মাকে সুখী করার জন্যে যে এত কষ্ট সহ্য করে, সে কখনো শাস্তি পায়? সে সবার ভালোবাসা পায়।’

‘তাহলে তুমি আমায় ভালোবাস?’ জিজ্ঞেস করল টোরা।

হ্যাঁ টোরাদিদি, আমি তোমায় ভালোবাসি? ভালবাসি বলেই তোমাকে আমি এখান থেকে বেরিয়ে যাবার পথ দেখিয়ে দেব।’

টোরার মুখখানা খুশিতে উছলে গেল। বললে, ‘পাখি, তুমি যে এত ভালো, আমি তা বুঝতে পারিনি।’

পাখি বললে, ‘টোরাদিদি, তোমার হাতে প্রদীপ। তাই তোমাকে যাবার আগে একটি কাজ করতে হবে, পারবে?

টোরা জিজ্ঞেস করলে, কী কাজ, পাখি?

 ‘ওই দ্যাখো, তোমার মাথার ওপর একটি লণ্ঠন দুলছে।

চকিতে চোখ তুলল টোরা। জিজ্ঞেস করল, ‘আমায় কী করতে বলছ?’

 ‘তোমার ওই প্রদীপের আলো দিয়ে ওই লণ্ঠনটি জ্বালিয়ে দাও। অন্ধকারে থাকতে আমার বড় কষ্ট হয়।

 ‘কেন, তুমি আমার সঙ্গে যাবে না? আমি কথা দিচ্ছি পাখি, তোমাকে আর আমি বন্দি করব না।’

পাখি উত্তর দিল, ‘না টোরাদিদি, আমি তো এখান থেকে আর যেতে পারব না। আমি তো মরে গেছি। এখন আমি এই অন্ধকার গহ্বরেই থাকব। এই অন্ধকার গহ্বরই এখন আমার স্বর্গ এখান থেকে আর আমি কোথাও যাব না। তুমি আলোটা জ্বেলে দাও। ওই আলোই হবে আমার বন্ধু।’

পাখির কথা শুনে টোরার বুকটা কেমন ভার হয়ে গেল। হ্যাঁ, সত্যিই তো/ ওরই তো হাতের মুঠির চাপে পাখি প্রাণ হারিয়েছে/ আড়ষ্ট চোখে পাখির মুখের দিকে চাইল টোরা/ চোখ সরিয়ে ধীরে ধীরে ওপরে

তাকাল। ওই ঝুলন্ত লণ্ঠনটার দিকে। না অনেক উঁচু না। সামনে ওই পাথরের চাঁইটার ওপর দাঁড়ালেই ওর হাত যাবে। ওখানে দাঁড়িয়ে টোরা হাত বাড়িয়ে, তার হাতের প্রদীপের আলো দিয়ে লণ্ঠনের আলো জ্বালাতে পারবে।

টোরাকে অমন চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পাখি জিজ্ঞেস করল, ‘কী ভাবছ? জ্বালবে না?’

টোরা উত্তর দিল, ‘হাঁ, জ্বালব।’

টোরা হাত বাড়ল। ওর প্রদীপের শিখাঁটি দুলতে-দুলতে লণ্ঠনের শিখাঁটি ছুঁয়ে গেল। লণ্ঠন জ্বলে উঠল। ভেসে গেল সেই গহর আলোর বন্যায়। যেখানে যত আলো ছিল সব যেন ছড়িয়ে পড়েছে সেই অন্ধকার গহ্বরে। স্বর্গের রঙিন ছবির মতো সেই গহ্বর ঝলমলিয়ে উঠল। পাখির মনের অনেক, অনেক সুখ ওর দু’চোখের পাতায় ছড়িয়ে পড়েছে। পাখি আনন্দে বলে উঠল, ‘আঃ/”

হঠাৎ টোরা দেখে কী, গহ্বরে সেই রঙিন স্বর্গে ঝাঁকে-ঝাঁকে প্রজাপতি উড়ে আসছে। ফুল ফুটেছে। মৌমাছি নাচছে। ফুলে ফুলে গান গাইছে। টোরা অবাক হয়ে গেল। জিজ্ঞেস করলে, ‘এরা কোথায় ছিল? এরা কারা?’

‘এতদিন অন্ধকারে এরা অন্ধ হয়ে ছিল। এরা আমার বন্ধু। আমার আনন্দ।’ পাখি খুশিতে উছলে উঠে বলল।

টোরা বললে, ‘আমিও এদের সঙ্গে আনন্দ করব।’

পাখি উত্তর দিলে, ‘না টোরাদিদি, না। তোমার আনন্দ তোমার বাড়িতে। তোমার আনন্দ তোমার মা, তোমার বাবা, তোমার ভাই। তোমার আনন্দ এই গহ্বরের অন্ধকারে নয়, ওই নীল আকাশের নীচে। সে আনন্দ তোমায় ডাকছে।’

পাখির কথা শুনে টোরার দু-চোখ আবার জলে ভরে গেল।

পাখি বলল, ‘এখানে কাঁদতে নেই টোরাদিদি।

 টোরা তাড়াতাড়ি তার চোখ দুটিতে আঁচল চাপা দিলে। বলল, ‘না পাখি, আমি কাঁদছি না। তোমায় দেখছি।’

পাখি বলল, ‘টোরাদিদি, এবার তোমার যাওয়ার পালা/ ওই দ্যাখো তোমার পথ।

‘কই?’

‘ওই যে পাথরের দরজা খুলে গেছে।’

টোরা অবাক হয়ে চাইল। হ্যাঁ, সত্যিই তো/ জিজ্ঞেস করল, ‘ওখান দিয়ে আমায় যেতে হবে?’

 ‘ওখান দিয়ে তোমায় ওপরে উঠতে হবে। এই পাথরে পাথরে পা ফেলে।

 ‘তবে আমি যাই পাখি।

পাখি আবার সেই দোলনায় দুলতে দুলতে, দোলনার ঝুনঝুনিটা বাজাতে-বাজাতে বললে, ‘টোরাদিদি, তুমি সুন্দর।’

টোরা দুহাত বাড়িয়ে পাখিকে বললে, ‘তুমি আরও সুন্দর।’

পাখি আনন্দে টুটুর-টুটুর করে ডেকে উঠল। অমনি সুন্দর সেই আলো-ঝলমল গহ্বরের স্বর্গে অনেক, অনেক আনন্দ একসঙ্গে গান গেয়ে উঠল। আর সেই গান শুনতে শুনতে টোরা গহ্বরের দরজা ডিঙিয়ে পা ফেললে, একটি একটি পাথরের ওপর। একা-একা সে এগিয়ে চলল। গহ্বর থেকে আকাশের দিকে। তার সঙ্গী শুধু তার হাতের এই প্রদীপ। আর সঙ্গী তার এই প্রদীপের আলোয় নিজের ছায়া।

তারপর হঠাৎ মুখ ফেরাল টোরা তার পিছনে। দেখে, এ তো শুধু তার ছায়া নয়। ওর পিছনে-পিছনে ওরা কারা আসছে দল বেঁধে/ সেই কিম্ভুতকিমাকার না-মানুষ না-জন্তুগুলো না? ওরাই তো ওকে ঢেলা মেরেছিল/ ওরা কি আবার তাকে মারবে?

না। টোরা যে-পথ দিয়ে যাবে, সে-পথে ওরাও যাবে। টোরা যদি পথে বিপদে পড়ে, ওরা সে-বিপদ দূর করবে। তারপর টোরা যখন এই পাথরের পাহাড় পেরিয়ে ওপরে উঠে যাবে তখন ওরা বলবে হয়তো, ‘আমরা জানতুম না, তুমি এত লক্ষ্মী। তাই তোমার গায়ে আমার হাত দিয়েছি। তোমায় মেরেছি। তুমি আমাদের ক্ষমা করো।’ তারপর পাথরের ওপর গড়াতে-গড়াতে ওরা আবার গহ্বরে নেমে আসবে। তখন কেউ জানতেও পারবে না, প্রাণহীন সেই পাখির সঙ্গে আরও কত প্রাণহীন জীবন গহ্বরের স্বর্গে, আলোর নীচে বসে-বসে টোরা নামে একটি মেয়ের জন্যে কাঁদছে। কেননা, সে যে তাদের জন্যে অন্ধকারে আলো জ্বেলে গেছে।

 টোরা পৌঁছে গেল। পৌঁছে গেল পাতালের অন্ধকার থেকে পাহাড়ের পায়ের কাছে। আকাশের দিকে চাইল টোরা। আঃ/ শেষ রাতের আকাশ ভারি শান্ত। কে যেন খুব সাবধানে শান্ত আকাশের গা থেকে তারার চুমকি গাঁধা ওড়নাখানি ধীরে ধীরে সরিয়ে নিচ্ছে। একটু পরেই ভোরের মুখখানি দেখতে পাবে টোরা।

ঘন্টা বেজে উঠল। কোথায়? ভারি গম্ভীর সেই ঘন্টার ধবনি। সেই গম্ভীর সুর হাওয়ায় যেন কেঁপে কেঁপে নাচতে-নাচতে, দূরে আরও দূরে ছড়িয়ে যাচ্ছে। শিউরে উঠল টোরা। হয়তো আনন্দে কিংবা ভাবনায়/ তাড়াতাড়ি পা ফেলল টোরা। ওকে যে এখুনি পৌঁছুতে হবে দেবতার কাছে। যতক্ষণ না এ-প্রদীপ তাঁর সামনে রাখতে পারছে টোরা, ততক্ষণ ওর নিস্তার নেই। ঠাকুর বলেছেন, তারপরেই টোরা সব ফিরে পাবে।

এসে গেছে টোরা। দেবতার সেই গুহার সামনে এসে দাঁড়াল। ওহহা/ ঘন্টা যে গুহার ভেতর থেকেই ভেসে আসছে/ তা হলে এ তো দেবতার ঘন্টা/

হ্যাঁ, দেবতার ঘন্টা। এই ঘন্টা যেন ডাক দিচ্ছে টোরাকে। বলছে, ‘এসো। এখানে তোমার জন্যে আনন্দ লুকোনো আছে/

ধীরে ধীরে ঢুকে গেল টোরা গুহার মন্দিরে। তারপর দেবতার সামনে এসে দাঁড়ায় টোরা। ওই সেই দেবতা। দেবতার মুখের দিকে তাকিয়ে টোরার গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল দু’চোখ দিয়ে। টোরা সোনার প্রদীপটা দেবতার পায়ের কাছে রাখলে। তারপর হাঁটু গেড়ে বসে হাতজোড় করে বললে, ‘ঠাকুর, আমি তোমার কথা রেখেছি। ফুলের চোখের জল দিয়ে তোমার সোনার প্রদীপ আবার জ্বেলে এনেছি। এবার তুমি আমার ভাইকে ফিরিয়ে দাও। বলে টোরা মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে ঠাকুরের পায়ে প্রণাম করল। আর ঠিক তক্ষুনি ঘন্টার বাজনা নিস্তব্ধ হয়ে গেল।

টোরা বুঝতে না-বুঝতেই কে যেন ওর গায়ে হাত দিল/ গায়ে হাত দিয়ে ডাকল, ‘দিদি’

চমকে উঠল টোরা। এ কী/ এ যে বাদশার গলা

হ্যাঁ, বাদশাই আবার ডাকল, ‘দিদি’

 দিদি চকিতে মাথা তুললে। তার চোখ দুটি অবাক-বিস্ময়ে চেয়ে রইল বাদশার মুখের দিকে।

 ‘দিদি, আমি।’

 ‘বাদশা/’ হঠাৎ চিৎকার করে উঠল টোরা। এমন চিৎকার সে যেন জীবনে আর কোনোদিন করেনি। জড়িয়ে ধরল বাদশাকে। তারপর কেঁদে ফেলল, হাউহাউ করে।

বাদশা দিদির চোখের জল মুছতে-মুছতে বললে, ‘কাঁদিস না দিদি। আমি জানতুম তুই এখানে আসবি। ঠাকুর আমায় বললেন যে। বললেন, ঘন্টা বাজাতে। ঘন্টা বাজালেই তুই শুনতে পাবি। তাইতো, আমি সারারাত ঘন্টা বাজিয়েছি।

সারারাত/’ টোরা বাদশার চিবুকটি ধরে অস্ফুট স্বরে জিজ্ঞেস করলে।

 ‘তাতে কী হয়েছে। ঘন্টা বাজাতে আমার বেশ লাগছিল/’

দিদি জিজ্ঞেস করল, ‘তুই এখানে কেমন করে এলি বাদশা?’

 ‘তোকে খুঁজতে-খুঁজতে।’

 ‘‘আহা/ কত কষ্ট হল তোর/

‘না রে/ আমার একটুও কষ্ট হয়নি। দ্যাখ, না, আমি কি তোর মতো কাঁদছি? কষ্ট হলে তো মানুষ কাঁদে।

টোরা বাদশার কপাল থেকে এলোমেলো চুলগুলি সরিয়ে দিল ভারি যত্নে। তারপর ভাই-বোন শেষবারের মতো ঠাকুরের পায়ে প্রণাম করল। উঠে দাঁড়াল। সোনার প্রদীপের আলোয় ওরা এবার স্পষ্ট দেখতে পেলে ঠাকুরের মুখখানি। ঠাকুরের চোখ দুটিতে হাসি ফুটেছে।

দিদির হাত ধরল বাদশা। ধীরে ধীরে গুহার মন্দির থেকে বাইরে বেরিয়ে এল দুজনে। বাইরে, আকাশে রাত কেটে আলো এসেছে।

বাদশা দিদির চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলে, ‘বাড়ি যাবি না?’

দিদি বললে, ‘চ’।

 ‘কোনদিকে?’

 ‘ওই তো, ওই দিকে।’ আঙুল দেখাল টোরা, ‘ওই যেদিক দিয়ে রেলগাড়ি যায়, ওই পথ ধরে হাঁটব।’

যেদিকে দিদি আঙুল দেখাল, সেইদিকে বাদশা চোখ তুলে দেখলে। তাই তো/ ওই দ্যাখো, পাহাড়ের গা বেয়ে-বেয়ে রেল লাইনটা কেমন এঁকেবেঁকে চলে গেছে/ ছুটে গেল বাদশা সেই দিকে। লাইনের ওপর দাঁড়িয়ে হেঁকে উঠল, ‘কু-কু, ঝিক-ঝিক। তারপর চেঁচিয়ে দিদিকে ডাক দিয়ে বলল, ‘দিদি, আজ আমি নিজেই রেলগাড়ি হয়েছি। তোকে বাড়ি নিয়ে যাব। ছুটে আয়, নইলে গাড়ি ইসটিশান ছেড়ে যাবে।’

বাদশার কথা শুনে খিলখিল করে হেসে উঠল টোরা। তারপর সত্যিই ছুটে গেল। বাদশার হাত ধরলে। গাড়ি ছুটল কু-কু, ঝিক-ঝিক।

 ভোরের সোনার আলোর মতো, যেন দুটি সোনার টুকরো গড়িয়ে যাচ্ছে পাহাড়ের গা বেয়ে। দুটি ভাই বোন, টোরা আর বাদশা।