ভীষণ অপমান লাগল জগন্নাথের। কিন্তু কিছু বলল না। কারণ জগন্নাথ বুঝেছে লোকটার সঙ্গে গায়ের জোরে লড়াই করা তার কম্ম নয়!
লোকটা জগন্নাথের কানে টেনে এক হ্যাঁচকা মারল! উঃ! কী ভীষণ লেগেছে জগন্নাথের। জগন্নাথকে টেনে চ্যাংদোলা করে তুলে বাঁদরকে বলল, ‘এই ধর।’ বলে বাঁদরের দিকে তোল্লাই ছাড়ল। বাঁদর আলুগপ্পা লোফার মতো জগন্নাথকে লুফে নিয়ে দুম করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। এতক্ষণ পর্যন্ত পাখিটা কোনো ক্যাঁচর-ম্যাচর করেনি। বাঁদর ঘর থকে বেরিয়ে যেতেই চেঁচিয়ে উঠল, ‘দিলে না কেন ছেলেটার তুবড়ি ফাটিয়ে! উঃ কী ঘেঁচড়া ছেলে রে বাপ! সাতজন্মে দেখিনি।’
বাঁদরটা জগন্নাথকে নিয়ে এল আর একটা ঘরে। পাশেই ঘরটা। ঘরে নিয়ে এসে বলল, ‘এখানেই থাকতে হবে তোকে। পুজোর পয়সা না ছাড়লে, তোর ছাড়ান নেই। ভুল করলি, পয়সা ছাড়লে তো আর এত ঝামেলা হত না!’
জগন্নাথ এবার ভীষণ চটিতং। বলল, ‘তোকে এখানে কে নিয়ে আসতে বলেছিল। তখন থেকে বলছি আমার কাছে পয়সা নেই, তবু ভ্যাজাড়ং ভ্যাজাড়ং করেই চলেছে! তোদের মগজে কি কিচ্ছু ঢোকে না!’
বাঁদর ফট করে বলে বসল, ‘টংকা মানেই লবডংকা।’
কথাটা যে কেন বলল, জগন্নাথ বুঝতে পারল না।
তারপরে বাঁদরটা আবার বলল, ‘এইখানে বসে-বসে ধ্যান কর। যদি মা-লক্ষ্মীর দয়া হয় বেঁচে যাবি। নইলে এইখানেই খাবি খেতে-খেতে অক্কা পাবি।’ বলে বাঁদরটা একটা বিচ্ছিরি নোংরা ঘরে জগন্নাথকে ফেলে রেখে চলে গেল।
জগন্নাথ হন্তদন্ত হয়ে ডাক দিল, ‘এই বাঁদর, শোন, শোন।’ বাঁদর সাড়া না দিয়েই ভোঁ-কাট্টা।
ঘরটা সত্যিই যা-তা। স্যাঁতস্যাঁতে! আলো-বাতাস কিছু নেই। ঝুল আর মাকড়সার জালে এ-কোণ, ও কোণ ছেয়ে আছে। কী বিচ্ছিরি বোঁটকা গন্ধ! ঘরের মধ্যিখানে একটা ছেঁড়া চাটাই পাতা। অবিশ্যি দরজাটা খোলা, এই যা! চাটাইয়ের ওপর ফুটোর মতো দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে জগন্নাথ ভাবতে লাগল, এখন সে কী করবে। পালাবার ইচ্ছে থাকলেও পালাতে পারছে না। কেননা, একেবারে অচেনা জায়গা। কোনখান দিয়ে সে এখানে এল, আর কোনদিক দিয়ে যে সে বেরিয়ে যাবে, কিছুই ঠাওর করতে পারছিল না। অগত্যা ছেঁড়া চাটাইয়ের ওপর বসে পড়ল। ভয় তার মোটেই পাচ্ছিল না। শুধু পা দুটো ভারি টনটন করছিল। পায়ের আর দোষ কী! কাল রাত থেকে যা ধকল যাচ্ছে! জগন্নাথ বলে তাই। অন্য কেউ হলে এতক্ষণে ফুট-কড়াই হয়ে যেত!
জগন্নাথের চোখদুটো যেন ছলছল করছে! কাঁদছে নাকি জগন্নাথ? ও তো সে-ছেলে নয়! অত সহজে তো সে মুষড়ে পড়ে না!
কিন্তু বলো, বাবার জন্যে কার না মন কেমন করে? ও নিজের চোখে দেখেছে, ঘোড়ার পিঠ থেকে বাবা ছিটকে পড়েছে। জগন্নাথও পড়েছিল। তবে জগন্নাথের একটুও লাগেনি। কিন্তু আর উঠতে পারেনি ওর বাবা। তারপর ওর বাবার যে কী হল, কিছু জানে না জগন্নাথ। ভাবতে-ভাবতে সত্যিই ওর চোখ দুটি ছলছলিয়ে উঠেছে। চাটাইয়ের ওপর মুখ গুঁজে শুয়ে পড়ল জগন্নাথ। হয়তো কেঁদে ফেলল। তারপর ঘুমিয়ে পড়ল।
হঠাৎ ঘুম ভাঙতেই ধড়ফড়িয়ে উঠে পড়েছে। চমকে গেছে। কখন যে দিন ফুরিয়ে রাত ঘনিয়ে এসেছে, সে কিছুই জানতে পারেনি। কী ঘুম দেখো!
উঃ কী জমাট অন্ধকার! চোখ মেলে কিছুই দেখা যায় না! এই অন্ধকার ঘরে মানুষ থাকে! এটা মানুষের বাসা, না চামচিকির আড্ডাখানা বোঝাই দায়! ঝাঁকে-ঝাঁকে চামচিকি ঘরের চারপাশে গোঁত্তা মেরে উড়ে বেড়াচ্ছে! চাটাই ছেড়ে উঠে দাঁড়াল জগন্নাথ। কী মনে হল, দরজা ডিঙিয়ে ঘর থেকে চুপিসাড়ে বেরিয়ে এল। উঁকি মারল। কাউকে দেখতে পেল না। জগন্নাথ বুঝতে পেরেছে অনেক রাত হয়েছে। কিন্তু সকলেই ঘুমিয়ে পড়েছে কি না, সেটা জানতে পারছে না। সকলে বলতে তো সেই বাঁদরটা, পাখিটা আর তাল-ফুলুড়ি মামা। তাছাড়া অন্য কাউকে তো সে এখানে দেখেনি! কিন্তু বলো, তাল-ফুলুড়ি মামা লোকটা কী রকম পয়সা পিশাচ। কিছুতেই কৌটোটা দেখাল না। জেনেশুনে জগন্নাথের মতো একটা ছোট্ট ছেলের কাছে অমন হ্যাংলাপনা করতে তোর একটু বাধল না? তা যেমন মানুষের ছিরি, তার চাল-চলনও তো তেমনি হবে! ওদের আবার লজ্জাশরম! নাই থাক। কিন্তু ওই কৌটোটা জগন্নাথের চাই-ই চাই। ওই কৌটোটার মধ্যে সত্যিই ওদের বাড়ির রাস্তাটা দেখা যায় কি না, ও দেখবে! দেখবে কৌটোর মধ্যে সত্যিই ভেলকি আছে না, লোকটা ভড়কি মারছে! বিশ্বাস নেই কিছুই। যতই হোক বাঁদরের মামা তো!
যদিও অন্ধকারটা বাইরেও ঘুটঘুট করছিল, কিন্তু ঘরের মতন অমন জমাট না। জগন্নাথ ঠুকঠুক করে পা বাড়িয়ে এগিয়ে এল। দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগল কোনদিকে যাবে, কোনদিকে সেই তাল-ফুলুড়ি মামার ঘরটা! সত্যি অন্ধকারে সব ধাঁধিয়ে যাচ্ছে!
অবিশ্যি এটা তো আর গড়ের মাঠ নয় যে, এ-পার থেকে ও-পার যেতে ঘড়ির কাঁটা ঝুলে পড়বে। তাই অন্ধকারে দেওয়াল হাতড়ে, আলতো পায়ে ডিঙি মারল! না, কাছে-পিঠে কোনো নজরদারই জগন্নাথের নজরে পড়ছে না। তাই আরও এগিয়ে চলল।
কিন্তু হঠাৎ যে এমন হাত ফসকে আলটপকা হুমড়ি খাবে জগন্নাথ, বুঝতে পারেনি। অন্ধকারে একটা অন্য ঘরের ভেজানো দরজায় হাত পড়ে গেছে। হাট হয়ে দরজাটা খুলে যেতেই জগন্নাথ টাল খেতে-খেতে বেঁচে গেছে। ভাগ্যিস ডিগবাজি খায়নি! তাহলে আবার যে কী কাণ্ড হত, কে বলতে পারে!
দরজাটা হাট হয়ে খুলে যেতেই, ঝট করে আড়ালে লুকিয়ে পড়েছে জগন্নাথ। নিঃসাড়ে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। না, মনে হচ্ছে কেউ টের পায়নি। উঁকি মারল জগন্নাথ। ঘরের ভেতরে টিমটিম করে লম্ফ জ্বলছে। কিন্তু কাউকে দেখতে পাচ্ছে না। ঘরে কেউ নেই। কিন্তু বুঝতে তার কষ্ট হচ্ছে না, এইটাই সেই তাল-ফুলুড়ি মামার ঘর। এই ঘরেই সেই কৌটোটা আছে! জগন্নাথের বুকের ভেতরটা ঢিপঢিপ করে নেচে উঠল। হয়তো ওই কৌটোটার কথা ভেবে, আনন্দে! তবু হুট করে ঘরে ঢুকতে সাহস হল না। আরও কিছুক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়ে রইল জগন্নাথ ঘাপটি মেরে।
ঘরে যে কেউ নেই, ও ঠিক বুঝতে পেরেছে। থাকলে কি এতক্ষণ জগন্নাথকে ছেড়ে কথা বলত! ঘাড় ধরে টানতে-টানতে কখন জেলখানায় পাঠিয়ে দিত। যে-মানুষের ল্যাজ গজায় তার কাছে আবার দয়া-মায়া!
জগন্নাথ সুড়ত করে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল। দেখতে পেল না, তার পেছনে একটা ছায়া। জগন্নাথ লম্ফটা তাড়াতাড়ি হাতে নিল। খুব সাবধানে পা ফেলে-ফেলে সেই কৌটোটা খুঁজতে লাগল। জগন্নাথের পেছনে পেছনে সেই ছায়াটাও নড়ে-নড়ে ঘুরছে। ঘরের মধ্যে ছিল একটা উঁচু চৌকি, একটা কাঠের দেরাজ, কতকগুলো কাঁচের গেলাস, কাঁচি, ছুরি আরও সাতসতেরো নানান জিনিস। জগন্নাথ দেরাজের হাতলটা ধরে টান দিল। চাবি আঁটা। উঁচু চৌকিটার নীচের দিকে একটা তোরঙ্গ। টেনে বার করল। তার ভেতর ছেঁড়া-ময়লা কাপড়-চোপড়। দেরাজের মাথায় একটা মাটির হাঁড়ি উলটে পড়ে আছে। কৌটোটা ওর ভেতর লুকানো থাকলেও থাকতে পারে। জগন্নাথ উঁচু চৌকিটার ওপর দাঁড়িয়ে হাত বাড়াল। অমনি আচমকা–ঠকাস! জগন্নাথের পিঠে যেন কে খোঁচা মারল। চমকে হাত ফসকে লম্ফটা মাটিতে পড়েই দপ করে নিভে গেল। জগন্নাথ ধড়ফড়িয়ে উঠেছে! চৌকি থেকে তড়াং করে লাফিয়ে পড়েছে। পালাতে যাবে কি, দেখে দুটো ভাটার মতো জলজ্যান্ত চোখ অন্ধকারে জ্বলছে। জগন্নাথ বুঝতে পারেনি, এটা সেই ঢ্যাপসা-ঢুপসো পাখির চোখ। পাখিটা এতক্ষণ জগন্নাথের অজানতে, ছায়ার মতো ওর দিকে নজর রেখে যে ঘুরছে, জগন্নাথ সেটা টেরই পায়নি।
আচমকা একেবারে ঝপ করে পাখিটা ডানা দিয়ে জগন্নাথকে জাপটে ধরল। ঝাড়লে ঠোঁটের বাড়ি এক ঠোক্কর! উফ! আর একটু হলেই চোখটা খাবলে দিয়েছিল। একটি ঘায়েই কুপোকাত জগন্নাথ! মাথাটা ঝনঝন করে উঠেছে। সামলাতে-না সামলাতে পাখিটা মারল আর এক ঘা! এবারে জগন্নাথের মুখের ওপর। আর রক্ষে আছে! জগন্নাথ মরিয়া। জগন্নাথের হাত দুটো যদিও পাখির ডানার মধ্যে জাপটানো ছিল, কিন্তু পা দুটোর তো কিছু হয়নি। জগন্নাথ তেড়েমেড়ে লাফিয়ে উঠে, নিজের পা দিয়ে দিয়েছে পাখিটার ঠ্যাং মাড়িয়ে। এমন মাড়ান মাড়াল যে, পাখির ঠ্যাং চেপটে চিড়ে চ্যাপটা! যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠে, পাখি ডানার ভেতর থেকে জগন্নাথকে ছেড়ে দিতেই, জগন্নাথ চোখের পলকে পাখিটাকে জড়িয়ে ধরেছে। ধরেই চিৎপটাং! কিন্তু পাখিও কি ছাড়বার পাত্তর! ফড়ফড়িয়ে লাফিয়ে উঠে জগন্নাথের সঙ্গে ঝটাপটি লাগিয়ে দিল। পাখিও ছাড়ে না, জগন্নাথও হারে না। পাখির অপলকা পালকগুলো জগন্নাথের হাতের টানে ছিঁড়ে ফড়-ফড় করে উড়ে পড়ছে! তবু কি গোঁ ছাড়ছে!
কিন্তু যতই হোক, পাখি তো! তার কত ক্ষমতা! কতক্ষণ যুঝবে জগন্নাথের সঙ্গে! মানুষের কাছে দমে পারে! হাঁপিয়ে গেছে। তাল পেয়ে জগন্নাথও ধরেছে পাখির গলাটা টিপে! পাখি আর ট্যাঁও করতে পারে না, টুও করতে পারে না! জগন্নাথ তখন রাগ দেখিয়ে চাপা গলায় দাঁত কড়মড় করতে-করতে বলল, ‘এবার তোকে কে বাঁচায়? বল সেই কৌটোটা কোথায়?’
পাখিটা জগন্নাথের হাতের রামটিপুনি খেয়ে বলল, ‘লক্ষ্মীটি, আমায় মারিসনি বাপ! একটা তুচ্ছ কৌটোর জন্যে একটা পাখির প্রাণ নিসনি! আমায় ছেড়ে দে! আমি তোকে কৌটো দেব।
জগন্নাথ পাখিটার গলায় আর একটা টেনে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, ‘মিথ্যে বলছিস?’
পাখির চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে এল। ঢোঁক গিলে উত্তর দিল, ‘কক্ষনো না! হরে-কেষ্ট! আমি মিথ্যে বলি না।’
ঠাকুর-দেবতার নাম করলে, কে আর অবিশ্বাস করে! জগন্নাথও পাখির কথায় বিশ্বাস করে, ওর গলাটা ছেড়ে দিল। বেশ সাহসের সঙ্গে বুক ফুলিয়ে বলল, বার কর কৌটো!’
জগন্নাথের কোঁতানি খেয়ে বেচারা পাখি একদম ঠান্ডা! বয়েস যে হয়েছে, তা দেখলেই বোঝা যায়। কোঁকাতে-কোঁকাতে জগন্নাথকে বলল, ‘আয় বাছা, ইদিকে আয়।’
জগন্নাথ জিজ্ঞেস করল ‘কোনদিকে?’
পাখি উত্তর দিল, ‘ইদিকে।’
জগন্নাথ সেদিকে গেল।
পাখি বলল, ‘এইখানে হাঁটু মুড়ে বস।’
জগন্নাথ সেইখানে হাঁটু মুড়ে বসল।
পাখি বলল, ‘এইটারে ধরে প্যাঁচা।
জগন্নাথ সেইটারে ধরে প্যাঁচাল। হুস-স-স!
দেওয়ালের গায়ে একটা আংটা। জগন্নাথ পাখির কথা শুনে আংটাটা প্যাঁচাতেই চিচিং ফাঁক। দেওয়ালের ভেতর সুড়ঙ্গ! পাখি ঢুকে পড়ল সুড়ঙ্গের ভেতরে! ঢুকতে-ঢুকতে জগন্নাথকে বলল, ‘ঝটপট চলে আয়!’
জগন্নাথ প্রথমটা দোনোমননা করেছিল। কারণ ভেতরটা ভীষণ অন্ধকার! কিন্তু ভয় পেলে চলবে কেন! কৌটো তার চাই-ই চাই। তাই অন্ধকারের ভেতর দিয়ে জগন্নাথও সুড়ঙ্গে সেঁদিয়ে গেল!
জগন্নাথ সেঁদিয়ে গেলে পাখি জিজ্ঞেস করল ‘ভয় করছে?’
জগন্নাথের একটু-একটু গা-ছমছম করলেও জানতে দেবে কেন পাখিকে! গলায় বেশ জোর দিয়েই বলল, ‘না।’
তখন পাখি বলল, ‘দেখ জগন্নাথ, তোর সাহস দেখে আমি খুব খুশি হয়েছি! তুই যে আমায় গায়ের জোরে কাত করে দিয়েছিস এতে আমার একটুও লজ্জা নেই। আমি যদিও পাখি, কিন্তু জানিস, এককালে বাঘা-বাঘা দত্যি-দানো গায়ের জোরে আমার কাছে কানা হয়ে ঘরে ভেগেছে। অবিশ্যি এখন আমি বুড়ো হয়ে গেছি। বয়েস হয়ে গেছে তো! এই আজকে আমার বয়েস হল সাতশো সাতান্ন বছর আট দিন।’
পাখির বয়স শুনে অন্ধকারেও হাঁ করে জগন্নাথ পাখিটার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
পাখি আবার শুরু করল, ‘আসলে কী জানিস, আমি এখানে চাকরি করি! চাকরি করি মানে, এই যে কৌটোটা চাইছিস, সেইটার নজরদারি করা। দেখ, কৌটোর দিকে নজর রাখতে-রাখতে আমার নিজের নজরটাও এত ছোটো হয়ে গেছে যে, মনে হয় এই পৃথিবীটাই বুঝি একটা কৌটো! এখন আমার মনে হচ্ছে। আমি তোর সঙ্গে পালাই!’
জগন্নাথ বলল, ‘চলুন।’
এতক্ষণ জগন্নাথ পাখিটাকে ‘তুই-তুই’ করছিল। হঠাৎ চলুন বলতে পাখি বলল, ‘ভদ্রতা করলি বুঝি?
জগন্নাথ উত্তর দিল, ‘দেখুন, আমার বয়েস সবে সাত পেরিয়ে আটে পড়েছে। আর আপনার সাতশো সাতান্ন বছর আট দিন। এ-কথা তো মানতেই হবে, বয়েসে আমি আপনার কড়ে আঙুলেরও যুগ্যি নই! আপনার বয়েসটা আগে জানতুম না বলেই তখন তুই-তোকারি করে ফেলেছি!’
‘এই নে। পাখির ঠ্যাংঙে কৌটো!
আরে! এ যে সেই কৌটোটা। অন্ধকারে জ্বলজ্বল করছে। কৌটোটা হঠাৎ কোত্থেকে বার করল পাখি? জগন্নাথের চোখ দুটি কৌটো দেখে চকচক করে উঠল। হাত বাড়াল জগন্নাথ। কিন্তু হাত পৌঁছল না কৌটো পর্যন্ত। থমকে গেছে জগন্নাথের হাত। কেন? হঠাৎ যেন দুটো হিংসুটে জ্বলন্ত চোখ অন্ধকারে ড্যাবড্যাব করে লক্ষ করছে তাদের দিকে! জগন্নাথ স্পষ্ট দেখল, একটা চকচকে ছুরি! আরি সববনাশ! এ যে তাল-ফুলুড়ি মামা! ছুরি উঁচিয়ে এগিয়ে আসছে! পাখি চিৎকার করে উঠল, ‘জগন্নাথ, পালা!’
জগন্নাথ তাপ্পি খেতে-খেতে জিজ্ঞেস করল, ‘কো-কো কোন দি-ই-ই কে?’
পাখি চেঁচিয়ে বলল, ‘এইদিকে।’
এইদিক মানে সেইদিকে দেওয়ালের ভেতর দিয়ে সুড়ঙ্গ পথে বেরিয়ে যাওয়ার রাস্তা যেদিকে! জগন্নাথ পাখির ঠ্যাং থেকে কৌটোটা ছোঁ মেরে ছিনিয়ে নিয়ে দে ছুট! মামা তাই দেখে ছুরি উঁচিয়ে, ধাঁ করে দেওয়ালের গর্তে সেঁদিয়ে পড়ল। সঙ্গে-সঙ্গে ধপাস। পাখি মামার ঠ্যাং-এ মেরেছে এক লেংগি! মামা চিৎপটাং! তারপর লেগে গেল ঝটাপটি! পাখি মামার ঠ্যাং ধরে টানে, তো মামা পাখির ল্যাজ ধরে ঝোলে! টেনে-ঝুলে, গড়িয়ে-শুয়ে মামাতে-পাখিতে মারামারি লেগে গেছে! আর এদিকে ততক্ষণে জগন্নাথ হাওয়া!
অবিশ্যি হাওয়া হব বললেই হাওয়া হওয়া যায় না। কেননা, সুড়ঙ্গটা পেল্লাই লম্বা! শেষ হয় না। জগন্নাথ ভেবেছিল এক ছুটেই কেল্লা ফতে করে ফেলবে। কিন্তু শেষ হওয়া তো দূরের কথা, যেন বেড়েই চলেছে। বাবা! যেন ধাঁধা!
না, ধাঁধা নয়! ও যতই ছুটছে সুড়ঙ্গের অন্ধকার ততই একটু-একটু করে কেটে যাচ্ছে। অন্ধকার থেকে ও যখন বাইরে পৌঁছল, তখন রাত গড়িয়ে আকাশে সকালের আলো ফুটছে! দিন আসছে।
জগন্নাথ যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল! ও এখন থামল। ভাবল, হয়তো আর বিপদ নেই। রাস্তা-ঘাটে লোকজন চলাফেরা করছে। অনেক লোকের মুখ দেখে ওর বুকের ভারটাও যেন অনেক হালকা হয়ে গেছে। এখন ও নিশ্চিন্তে বাড়ি ফিরতে পারবে। যদিও সে এদিককার রাস্তা-ঘাট কিছুই চিনতে পারছে না, তবু তার ভাবনা নেই। কেননা, তার হাতে কৌটো। কৌটোর ভেতরে যন্তর-মন্তর। এতক্ষণে কৌটোটা ভালো করে দেখার সুযোগ পেয়েছে জগন্নাথ। কৌটোটা এমন কিছু বড়ো না। হাতের মুঠোর মধ্যে লুকিয়ে রাখতে কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু ওই কৌটো দিয়ে কী করতে হয়, তাতো জানে না জগন্নাথ। ও বাবার কাছে গল্প শুনেছে, আরব দেশের ছেলে আলাদিন মাটিতে এক আশ্চর্য প্রদীপ ঘষল, অমনি এক বিরাট দত্যি বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, ‘হুজুর, হুকুম তামিল করার জন্যে আমি হাজির। আজ্ঞা করুন কী করতে হবে?’ এই কৌটোটাও বোধ হয় তেমনি। প্রদীপের মতো। কৌটোর মধ্যে হয়তো জাদু আছে। তবে তখন সে নিজের কানে শুনেছে, তাল-ফুলুড়ি মামা নাড়া দিতেই, কৌটোর ভেতর টুংটুং করে ঘন্টা বেজে উঠছিল। জগন্নাথেরও ইচ্ছে হচ্ছিল এখনই নাড়া দিয়ে ঘন্টা বাজায়। কিন্তু সাহস হল না। কেননা, এই এত সব লোকজনের সামনে ঘন্টা বাজালে, আবার যদি কিছু অঘটন ঘটে যায়! কে বলতে পারে!
একটা খুব নিরিবিলি জায়গা খুঁজে বার করল জগন্নাথ। এদিকে কেউ নেই। মনে হয়, কেউ আসবেও না। একটা গাছের নীচে দাঁড়িয়ে ভালো করে কৌটোটা পরখ করল। দেখল, কৌটোটা কাঠের। চেপে বন্ধ করা। ঢাকনিটা টান দিল জগন্নাথ। খুলল না। আবার চেষ্টা করল তবু খুলল না। এঁটে গেছে, না চাবি আঁটা জগন্নাথ বুঝতে পারে না। তখন মনে-মনে ভাবে, নেড়ে দেখি, ঘন্টা বাজে কি না! হাত ঝাঁকাল জগন্নাথ।
হাত ঝাঁকাতেই, হো-হো-হো!
চমকে গেছে জগন্নাথ। কে যেন হেসে উঠল! হাসি শুনে আর দাঁড়ায় জগন্নাথ! পাঁই-পাঁই করে মারল ছুট!
ছুট দিতেও, হাসিটা থামল না। তেমনি হো-হো- করে গড়িয়ে-গড়িয়ে জগন্নাথের কানে তাড়া লাগাল। তারপর দম ফুরিয়ে গেলে কলের-পুতুল যেমন করে হঠাৎ থেমে যায়, তেমনি করে হঠাৎ আবার হাসিটা থেমে গেল!
জগন্নাথও থামল। ব্যাপার-স্যাপার দেখে একদম হাঁদা হয়ে গেছে সে। ও বুঝতেই পারল না, কোত্থেকে হাসি এল! কেউ তাকে দেখে হাসল না কেউ হাসতে-হাসতে তাকে দেখল, এ-কথা ও ভেবেই পাচ্ছে না। সুতরাং ও আবার হাঁটল। ভাবল, এক জায়গায় বোকার মতো বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে লোকের তো সন্দেহ হতে পারে! কী বিপদ দেখ! কোথায় ও এতক্ষণে ঘরে পৌঁছে যাবে, তা না, খালি একটার পর একটা বাধা আসছে! নিরিবিলি জায়গার আর দরকার নেই। সামনে একটা ফাঁকা জায়গা। জগন্নাথ এবার সেইখানেই দাঁড়াল। আর ভাবল, এবার কৌটোটা নাড়া দেওয়া যেতে পারে।
এবার সত্যি-সত্যিই জগন্নাথ কৌটোটায় ঝাঁকানি দিল। কিন্তু আশ্চর্য, ঘন্টা বাজা দূরে থাক, কৌটোর ভেতর থেকে ফুট-ফাট কি খুট-খাট একটু আওয়াজ পর্যন্ত বেরুল না। জগন্নাথ ঘাবড়ে গেছে। কীরে বাবা! শেষকালে পাখিটা কি তার সঙ্গে হুড়কুষ্টি করল! এ-কথা মানতে মন চায় না জগন্নাথের। মানতে মন চায় না যে, পাখিটা তার হাতে একটা নকল কৌটো ধরিয়ে দিয়ে তাকে ধাপ্পা দেবে! তা যদি হত তাহলে মামা যখন অন্ধকার সুড়ঙ্গের মধ্যে ছুরি নিয়ে তেড়ে এল, তখন ইচ্ছে করলে তো পাখি তাকে মামার হাতে মার খাওয়াতে পারত! তবে বাবা কার ভেতর কী আছে, কে বলতে পারে! মানুষের কথাই মানুষ বলতে পারে না, তো পাখি! সে তো একটা তুচ্ছ জীব!
পাখিকে এত বিশ্বাস করেছে বলেই জগন্নাথ আরও কবার চেষ্টা করে কৌটোটা নাড়ল, উলটে-পালটে দেখল। ঢাকনিটা নিয়ে টানাটানি করল। কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। তখন ভীষণ মনমরা হয়ে জগন্নাথ ভাবল, ভালো মনে বিশ্বাস করলে, এই ফল! দূর ছাই, এই জঞ্জাল থাকার চেয়ে, যাওয়াই ভালো! কৌটোটা ছুঁড়ে ফেলে দিল জগন্নাথ। কৌটোটা ছোঁড়ার সঙ্গে-সঙ্গে কে যেন চেঁচিয়ে উঠল, ‘ফেলিস না, ফেলিস না।
জগন্নাথ থতমত খেয়ে গেছে। বারণ করলে কী হবে! ততক্ষণে তো ফেলা হয়েই গেছে! কিন্তু কথা বললে কে? কাছে-পিঠে কাউকে দেখা যাচ্ছে না, আড়ালে বা আশে-পাশে কেউ যে লুকিয়ে থাকবে, এটা তেমনও জায়গা নয়! তবে কি কৌটোটার ভেতর থেকে কেউ চেঁচাল!
ছুট্টে গিয়ে কৌটোটা কুড়িয়ে নিল জগন্নাথ। অবাক হয়ে কৌটোটার দিকে তাকিয়ে কী করি, কী করি’ ভাবতে-না-ভাবতেই জগন্নাথ শুনতে পেল কৌটোটার ভেতর থেকেই কে যেন কথা বলল। বলল, ‘জগন্নাথ, আমার নাম কর্বুর। আমার হাত নেই, পা নেই, মাথা নেই, ধড় নেই। আমি শুই না, জাগি না। খাই না, ফেলি না। কিন্তু আমি জানি, যারা একটুতেই ভেঙে পড়ে, তারা যা চায়, তা পায় না।’
জগন্নাথের বুকের ভেতরটা কীরকম ছটফট করে উঠল। ভয়ে না আনন্দে কিছুতেই বুঝতে পারছে না। তার খালি মনে হচ্ছে, তবে কি সে-ও আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের মতো, একটা আশ্চর্য কিছু পেয়েছে। সে-কথাটা মনে হতেই বুক ফুলিয়ে দাঁড়াল জগন্নাথ। বেশ গম্ভীর গলায় উত্তর দিল, ‘শোনো কর্বুর, আমার নাম যদিও জগন্নাথ, আমার দুটো হাত, দুটো পা। একটা মাথা, একটা ধড়। আমি রোগা যত, ছোট্ট তত। আমার খিদে পায়, ঘুমও পায়। আমি খেলতে পারি, পড়তে পারি। আমি জানতে চাই, আমার বাড়ি কোনদিকে? আমার বাবা কোথায়?’
কৌটোর ভেতর থেকে তখন সেই কর্বুর উত্তর দিল, ‘কোনো কাজ কঠিন নয়, কোনো কাজ সহজ নয়। যে-রাস্তা লম্বা যত, সে-রাস্তা খাটো তত। কোনো চেষ্টা নিষ্ফল নয়, কোনো কাজই বিফল নয়। তবে এখনও অনেক বাধা পেরুতে হবে, অনেক কাঁটা ভাঙতে হবে।’
জগন্নাথ কর্বুরের কথা শুনে কেমন যেন চাঙ্গা হয়ে বলল, ‘আমি বাধা পেরুব, আমি কাঁটা ভাঙব, তুমি আমায় সাহায্য করবে?’
‘তোমার মুখখানা আমি একবার দেখব।’ কর্বুর বলল।
‘কেন, দেখতে পাচ্ছ না? তুমি আমার নাম জানতে অথচ মুখটা কেমন জানতে না?’ জগন্নাথ উত্তর দিল।
কর্বুর আবার বলল, ‘জগন্নাথ, আমার নাম কর্বুর। নাম আমি সবার জানি। কিন্তু মুখ কারো দেখতে পাই না। দেখা সম্ভবও নয়। এই কৌটের মধ্যে আমি বন্দি হয়ে আছি। চারিদিকে জমাট অন্ধকার। এখান থেকে কিছু দেখা যায় না।’
‘কিন্তু আমিও তো এই কৌটোটা খুলতে পারি না।’
কর্বুর বলল, ‘জগন্নাথ, আমি তো তোমায় আগেই বলেছি, কোনো কাজ কঠিন নয়, কোনো কাজ সহজ নয়! তাই খোলা যত সহজ, ঠিক তত কঠিন।’
‘কেন?’
‘কেননা, তুমি ভালো করে দেখনি, কৌটোটা প্যাঁচ দিয়ে আটকানো। চাকার মতো ঘুরুলেই যে খুলে যাবে, এটা তুমি জানবার চেষ্টা করনি।’
জগন্নাথ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘তাই না কি! তাহলে এতক্ষণ আমি হাঁদার মতো কৌটোটা টানামানিই করেছি!’
যারা দেখেশুনে, বুঝেসুঝে কাজ করতে চায় না, তারা কাজ নিয়ে টানামানিই করে।
‘আচ্ছা কর্বুর, আমি যদি কৌটোটা খুলে দিই, তুমি পালিয়ে যাবে না তো?’
.
‘আমি পালাবও না, পালালে হারাবও না।
কর্বুরের এই কথাটা শুনে জগন্নাথের কেমন যেন সন্দেহ হল। বলল, ‘তুমি এমন হেঁয়ালির মতো কথা বলছ কেন? তোমার মতলবটা খুলে বল তো!’
‘আগের কথা আগে, পরের কথা পরে।’
‘আগের কথাটা কী শুনি? সোজা কথা সোজাসুজি না বললে, আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।’
‘মনে বিশ্বাস রেখে আমায় যদি তোমার মুখখানা দেখবার জন্যে এই কৌটোটা খুলে দাও, তবে তোমার ভালো হবে।’
‘ঠিক বলছ?’
কর্বুর কখনও বেঠিক বলে না।’
‘বেশ খুলে দিচ্ছি।’ বলে, জগন্নাথ কৌটোটার প্যাঁচ পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে খুলতে লাগল। খুলতে-খুলতে ভাবতে লাগল, ‘কী জানি বাবা, ভেতরে আবার কী দেখি!
প্যাঁচ খুলে গেল। জগন্নাথ কৌটোর ঢাকনিটা টেনে তুলতেই, ঝনঝন করে ঝংকার দিয়ে এক ভয়ংকর বাজনা বেজে উঠল। তারপরেই জগন্নাথের চোখ ঝলসে সেই ছোট্ট কৌটোটার ভেতর থেকে এক ঝলক রঙের ধোঁয়া বেরিয়ে এল। কত রকমের রং, লাল, নীল, হলদে, সবুজ। সেই রঙের ধোঁয়া হাওয়ার সঙ্গে মিশে জগন্নাথের মাথার ওপর ঘূর্ণি খেয়ে ভাসছে! ভাসতে ভাসতে জগন্নাথের চোখের সামনে এক ময়ূরকণ্ঠী রঙের মূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল! জগন্নাথ চেঁচিয়ে উঠেছে, ‘তুমি কে?’
মূর্তি বলল, ‘আমি কর্বুর।’
‘তুমি এত সুন্দর?’
‘জগন্নাথ, আমি তোমারই জন্যে সুন্দর হয়েছি। তুমি আমায় মুক্তি দিয়েছ। আমি সাতশো আটান্ন বছর আট দিন এই কৌটোর মধ্যে বন্দি ছিলুম। আজ আমার ছুটি।’
‘তুমি এই কৌটোর মধ্যে আর থাকবে না?’
‘না।’
‘তাহলে তুমি আমায় মিথ্যে বললে?’
না, জগন্নাথ। এই কৌটোর মধ্যে না-থাকলেও আমি তোমার সঙ্গে আছি। তোমার যখন বিপদ হবে, আমি আসব।’
জগন্নাথ বলল, ‘আমার এখনই তো বিপদ! আমার বাবা কোথায়, বাড়ি কোথায় খুঁজে পাচ্ছি না। এর চেয়ে বড়ো বিপদ মানুষের আর কী আছে?’
কর্বুর উত্তর দিল, ‘জগন্নাথ, বলেছি তো অত সহজে মুষড়ে পড়লে চলবে না। পথ হাঁটতে আরও কত বিপদ আসবে। বিপদের মধ্যে সাহসে বুক বেঁধে যারা হাঁটে, তাদের জয় হবেই। আমি তোমার মনের ভেতরটা দেখতে পেয়েছি। তুমি সাহসী, বীর, সৎ আর সুন্দর। যারা সৎ তারা কখনও হার স্বীকার করে না। তারা এগিয়ে চলে। তোমাকেও এগিয়ে যেতে হবে।’
‘কোথায়?’
‘সামনে।’
‘আর তুমি?’
‘তুমি আমায় দেখতে পাবে, আকাশের ওই নীলে, কিম্বা কালো মেঘের জটায়, রঙিন ফুলের পাপড়িতে অথবা সবুজ পাখির পালকে!
‘তোমায় ডাকব কেমন করে?’
‘শোনো জগন্নাথ, দেখ, ওই কৌটোর মধ্যে রেশমি সুতোয় বাঁধা ছোট্ট একটা ঘুঙুর আছে। ওইটা বার করে তোমার কাছে রাখো। ওই ঘুঙুর তুমি বাজালেই বাজবে না। ঠিক সময়ে, ঠিক দরকারে যদি নাড়া দাও, ওই ঘুঙুর বাজবে। আর তখনই আমি আসব। আমি জানি, তুমি ঠিক বুঝবে, কখন ওটিতে নাড়া দিতে হবে। জেনো, যারা বার-বার নাড়া দেয়, তারা ভীরু! বিপদকে জয় করতে তারা পারে না। তবে একটা কথা শুনে রাখ জগন্নাথ, যারা অন্যের উপকার করার জন্যে, অন্যের ভালোর জন্যে ওই ঘুঙুর বাজায়, তাদের কাছে আমি আসি। যারা অন্যের ভালো করতে চায় তাদের সঙ্গে আমি সব সময় আছি। তুমি এগিয়ে চল জগন্নাথ, এগিয়ে চল।’ বলতে-বলতে সেই রঙিন ময়ূরকণ্ঠী মূর্তি জগন্নাথের চোখের সামনে থেকে ধীরে-ধীরে মিলিয়ে গেল। জগন্নাথ অবাক হয়ে চেয়ে রইল সেইদিকে। তারপর সেই ছোট্ট কাঠের কৌটোর ভেতর হাত দিয়ে দেখল, সত্যি তার ভেতর রেশমি সুতোয় বাঁধা একটা সোনার ঘুঙুর। ঝকঝক করছে। জগন্নাথ চটপট সেটা বার করে কোঁচড়ে বেঁধে ফেলল। ফেলে দিল কৌটোটা। হাঁটা দিল জগন্নাথ। এগিয়ে চলল আর মনে-মনে ভাবতে লাগল, আশ্চর্য প্রদীপের মতো এও যেন আর এক আশ্চর্য সোনার ঘুঙুর।
তারপর অনেকদিন কেটে গেছে। কর্বুরের কথামতো সে অনেক পথ হেঁটেছে। অনেক কাঁটা সে পথের থেকে সরিয়ে দিয়েছে। কিম্বা ভেঙে ফেলেছে। এমনি হাঁটতে-হাঁটতে একটা গ্রীষ্ম গেছে, বর্ষা এসেছে। শরৎ কাটল। তবু সে বাবাকে খুঁজে পায়নি। সে হয়তো কেঁদেছে। কিন্তু জগন্নাথের সেই চোখের জল কেউ দেখেনি কোনোদিন। পথ হারিয়ে ও একা-একা কাজ করেছে। হাত পাতেনি কারো কাছে। বিপদ এসেছে। কিন্তু বিপদের কাছে হার মানেনি জগন্নাথ। কর্বুর বলেছে বিপদের মধ্যে সাহসে বুক বেঁধে যারা হাঁটে তাদের জয় হবেই। তাই কর্বুরের কথায় বিশ্বাস করেই জগন্নাথ ওর কোঁচড়ে বাঁধা সোনার ঘুঙুর কোনোদিনই বাজায়নি। ও বাজাবে সময় এলে। কিন্তু সে সময় কবে আসবে?
সেই সময় এল না। কিন্তু শীত এল।
সেদিন যখন সেই শীতের রাতে একা-একা হাঁটছিল জগন্নাথ, তখনই সে কোয়াকে কুড়িয়ে পেয়েছিল। কোয়াকে বুকে নিয়ে সে হাঁটছিল। খুঁজেছিল একটু আশ্রয়, নিজের জন্যে নয়, ওই ছোট্ট কুকুরছানা কোয়ার জন্যে।
.
‘ঘেউ, ঘেউ!’ হাঁটতে-হাঁটতে অনেকক্ষণ পর একটা না-চেনা জায়গায় এসে হঠাৎ কোয়া এমন করে ডেকে উঠল কেন? এতক্ষণ তো শীতে কিউ-কিউ করছিল। এমন কেন রাগ-রাগ তার ডাক?
কোয়া আবার ডাকল, ‘ঘেউ, ঘেউ!’ ডাকতে-ডাকতে জগন্নাথের কাঁধের ওপরে ছটফটিয়ে উঠল।
জগন্নাথ জিজ্ঞেস করল, কী রে, কী হল? শিকার দেখেছিস?’
জগন্নাথ কাঁধ থেকে নামিয়ে কোয়াকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরল। কিন্তু যা ছটফট করছে! যদি মুখ থুবড়ে পড়ে!
তারপরে হঠাৎ তো জগন্নাথ নিজেই থতমত খেয়ে গেছে! দাঁড়িয়ে পড়ল জগন্নাথ! কান পেতে কী যেন শুনছে! হ্যাঁ, হ্যাঁ, অনেকগুলো বেড়াল একসঙ্গে কাঁদলে যেমনশোনায়, তেমন যেন কান্না শুনতে পাচ্ছে জগন্নাথ!
কোয়া আবার চেঁচাল, ‘ঘেউ, ঘেউ।’
বেড়ালও কাঁদছে, ‘ম্যাঁও-ও মিও-ও, মিউ-উ!
জগন্নাথ ভাবল, ‘এ আবার কী। এত বেড়াল কাঁদে কোথায়!’
সামনে হাঁটা দিল জগন্নাথ। যত হাঁটছে, কান্না তত বাড়ছে। অথচ এদিক-ওদিক, আশে-পাশে বেড়াল ছেড়ে একটি টিকটিকিও নজরে পড়ছে না। জগন্নাথ ভাবলে, শীতে কাচ্চা-বাচ্ছা ছেড়ে বেড়াল-মা বোধহয় ভেগেছে! দেখদিকিনি, এক কুকুরছানা নিয়েই সে ব্যতিব্যস্ত, আবার বেড়াল! শেষে কি কুকুর-বেড়াল নিয়েই তাকে ঘর করতে হবে! কি হটাৎ চমকে তাকায় জগন্নাথ! মনে হচ্ছে সামনে একটা কোঠাবাড়ি! কুয়াশায় ঢেকেছিল বলে এতক্ষণ দেখতে পায়নি জগন্নাথ। জগন্নাথের ঠিক মনে হল, বেড়ালের কান্না ওখান থেকেই ভেসে আসছে! ওইদিকেই চলল জগন্নাথ। কোয়ার মুখের কাছে হাত রেখে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘চেঁচাস না।’
কোয়া কী বুঝল কে জানে! সত্যিই আর চেঁচাল না।
বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়াল জগন্নাথ। ও দেখল, ওই ওপরে একটা খুপরি। সেখান দিয়ে আবছা-আবছা আলো আসছে। বেড়ালের কান্না যে এই বাড়ির ভেতর থেকেই শোনা যাচ্ছে, তাতে আর সন্দেহ নেই। মনে হচ্ছে, কে যেন বেড়ালগুলোকে মারছে আর ওরা প্রাণপণে চেঁচাচ্ছে!
জগন্নাথ ওই ওপরের খুপরিটার দিকেই চাইল। ইচ্ছে, ওখান দিয়েই উঁকি মারে! কিন্তু কথা হচ্ছে, দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে তো জগন্নাথ নাগাল পাবে না খুপরিটার। ব্যস্ত হয়ে উঠল জগন্নাথ। বাড়ির দরজাটা কোনদিকে দেখতে হয় তো!
দরজা সামনেই। মস্ত উঁচু আর পেল্লাই। লোহার কপাট। বন্ধ। বন্ধ কপাটে ধাক্কা দিল জগন্নাথ। দরজা নড়ে না, খোলেও না। খুব জোরে ঠেলা দিল। লোহার কপাট শক্ত আর স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কোয়াকে কাঁধ থেকে নামিয়ে বলল, ‘তুই এখানে চুপটি করে বস। কোথাও যাসনি!’
কোয়া বাড়ির দেওয়াল ঘেঁষে, চুপটি করে বসে, জগন্নাথের দিকে জুলজুল করে চেয়ে রইল।
জগন্নাথ বেশ করে জামা-প্যান্ট এঁটেসেঁটে লাফ দিল। লাফ দিল ওই উঁচু খুপরিটার দিকে। মতলব, লাফিয়ে কুপরির ওপরে উঠবে। কিন্তু হাত ফসকে গেল। আবার লাফাল, পারল না। কাছে-পিঠে কিছু দেখতেও পাচ্ছে না যে, তার ওপর পা রাখবে! জগন্নাথ আবার লাফ দিল। এবার খুপরির খাঁজটা ধরে ফেলেছে! দেওয়ালের গায়ে পা ঘষতে-ঘষতে জগন্নাথ খুপরির মধ্যে মাথাটা সেঁদিয়ে দিল। বুকটা একটু ছড়ে-ছিড়ে গেল বটে, তবু ঘাবড়াল না। খুপরি দিয়ে উঁকি মেরেই জগন্নাথের চক্ষুস্থির! একি! ঘরের মধ্যে একটা ল্যাংচা মার্কা ছেলে, একটা লাঠি দিয়ে বেদম বেড়াল ঠেঙাচ্ছে! কেন? তা-ও কি এক-আধটা বেড়াল! গোনাগুনতি সাত-সাতটা। বেড়ালগুলো ঠেঙানি খাচ্ছে, প্রাণের ভয়ে চেঁচাচ্ছে, লাফাচ্ছে, আর ঘরের মধ্যেই চরকি খাচ্ছে। একটা ভুসো-কালি-ভরতি ঝোলা-লণ্ঠনের আবছা আলোয় জগন্নাথ যদিও দেখতে পাচ্ছে ঘরটা বড়ো, তবুও ওদিকটা এত অন্ধকার যে, কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ওই অন্ধকারের মধ্যে কী আছে, কে আছে, কে জানে!
কিন্তু আর দেখতে পাচ্ছে না জগন্নাথ! ঈশ! ছিঃ ছিঃ! বেড়ালগুলোকে বুঝি মেরে ফেলবে! কী জল্লাদ ছেলে রে বাবা!
খুপরির ভেতর থেকেই জগন্নাথ চেঁচিয়ে ধমকে উঠল, ‘এই ছেলেটা, বেড়ালগুলোকে মারছিস কেন রে!’
ছেলেটার বয়েই গেছে। জগন্নাথের কথা কানেই নিল না।
ব্যাপারটা তো ভালো ঠেকছে না। থাকতে পারল না জগন্নাথ।
ওর দেহটা খুপরির মধ্যে গলিয়ে দিল। তারপর ওই ওপর থেকে ঘরের মধ্যে মারল লাফ! লাফ মেরেই ছেলেটাকে ধরে ফেলল। জগন্নাথকে দেখে ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেছে সেই ল্যাংচা-মার্কা ছেলেটা।
জগন্নাথ ছেলেটাকে টেনে ধরে বলল, ‘খবরদার বলছি মারবি না!’
ছেলেটা জগন্নাথের মুখের দিকে ড্যাবডেবিয়ে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠল, ‘ছেড়ে দে আমায়।’ বলে ছেলেটা জগন্নাথকে এমন এক ধাক্কা মারল, জগন্নাথ চিৎপাত! অমন ল্যাংচা-মার্কা দেখতে হলে কী হবে, ছেলেটার গায়ে কী ক্ষমতা রে বাবা!
জগন্নাথ উঠে পড়েছে। উঠতেই ছেলেটা আচমকা জগন্নাথের মাথায় ধাঁই করে লাঠিটা দিয়ে এক ঘা বসিয়ে দিল। জগন্নাথের মাথাটা ঝনঝন করে উঠল। কিন্তু জগন্নাথও কি দাঁড়িয়ে মার খাবার পাত্র! নিজেকে সামলে নিয়েই ছেলেটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ছেলেটার হাতের লাঠি হাত থেকে ছিনিয়ে নিতে গেল জগন্নাথ। কিন্তু তার আগেই ছেলেটা জগন্নাথের পেটে টেনে ঘুষি কষিয়ে দিল। জগন্নাথ জাপটে ধরল ছেলেটাকে। বেড়াল ছেড়ে শেষে জগন্নাথ আর সেই ছেলেটার মধ্যে মারামারি লেগে গেল।
বোঝা যাচ্ছে, ছেলেটার গায়ে জোর বেশি। যতই হোক, জগন্নাথের চেয়ে ও মাথায় বড়ো। তবু বলতে হবে বাহাদুর ছেলে জগন্নাথ। বেড়ালগুলোকে বাঁচাবার জন্যে লড়ে তো যাচ্ছে! বেড়ালগুলো ভয়ে কী কাঁপান কাঁপছে দেখ!
পারল না জগন্নাথ। ছেলেটা ওকে চিত করে ফেলেছে। জগন্নাথের মুখে, পিঠে, হাতে, বুকে যেখানে পাচ্ছে কিল, চড়, ঘুষি চালাচ্ছে। কী সববনাশ! মেরে ফেলবে নাকি জগন্নাথকে! ওর কাছে তো কর্বুরের আশ্চর্য জাদু আছে। এখন তো সে সত্যি-সত্যি বিপদে পড়েছে। দিক না সেই জাদুর ঘুঙুর বাজিয়ে!
বাজাল না জগন্নাথ। ঘরের মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে কেমন যেন নিস্তেজ হয়ে গেল। ওর কি দম আটকে গেছে!
না, ওর ভীষণ লেগেছে। ওর চোখের পাতা দুটি আঘাত সইতে না-পেরে বুজে গেছে। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে ওর। নিস্তেজ হয়ে পড়েই রইল জগন্নাথ।
.
হঠাৎ যখন চমকে উঠে জগন্নাথ চোখ দুটি আবার চাইল, তখনও বুঝতে পারল না কতক্ষণ সে এমনি করে পড়েছিল। চোখ চাইতেই সে অবাক হয়ে গেছে। একী! সেই ছোট্ট-ছোট্ট বেড়ালগুলো কেমন আদর করে জগন্নাথকে জড়িয়ে আছে! আঃ! নরম তুলোর মতন তুলতুল করছে! জগন্নাথের সারা শরীরে আঘাত লেগেছে! কষ্ট পাচ্ছে! ওরা যেন কষ্ট পেতে দেবে না জগন্নাথকে।
ওরা ভালোবাসবে জগন্নাথকে। ছেলেটার হাত থেকে ওদের বাঁচাবার জন্যেই তো জগন্নাথের এই বিপদ। ওর কপালে রক্ত! সে রক্ত পড়তে দেয়নি ওই ছোট্ট বেড়ালগুলো। ওরা মুছে দিয়েছে। জগন্নাথের কপালের রক্ত ওদের গায়ে মুছে-মুছে ছড়িয়ে পড়েছে!
ধড়ফড় করে উঠে বসল জগন্নাথ। সঙ্গে-সঙ্গে তড়বড় করে এদিক-ওদিক ছুটে পালাল বেড়ালগুলো। দূরে দূরে দাঁড়িয়ে কেমন যেন ছলছল চোখে তাকিয়ে রইল জগন্নাথের দিকে। জগন্নাথও থ হয়ে গেছে। ওর দৃষ্টি থমকে-থমকে ওই বেড়ালগুলোর চোখের কাছে এসে স্থির হয়ে যাচ্ছে। বেড়ালগুলো কাঁদছে নাকি! এতক্ষণ কি ওরা জগন্নাথের বুকের ওপর মাথা রেখে কাঁদছিল!
হ্যাঁ, কাঁদছিল। আর সেই ছেলেটা? সে কোথা গেল?
ওই তো ছেলেটা!
কী করছে ওখানে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে?
সে-ও কাঁদছে।
জগন্নাথের নজরটা হঠাই পড়ল ছেলেটার দিকে! দাঁড়িয়ে ছিল, একটু দূরে। তাকিয়ে ছিল জগন্নাথের মুখের দিকে।
কাঁদছে কেন ছেলেটা?
দাঁড়াবার জন্যে চেষ্টা করছে জগন্নাথ। এখনও ব্যথা করছে। পারছে না। ছেলেটা ছুটে এল। জগন্নাথের হাত দুটি জড়িয়ে ধরেছে। ছেলেটার চোখের জল ফোঁটা-ফোঁটা হয়ে জগন্নাথের হাতের ওপর ছড়িয়ে পড়ল। কেমন শিউরে উঠল জগন্নাথ। কী করবে বুঝতে পারছে না। জগন্নাথ ভাবছে, কাঁদছে কেন ওরা! ছেলেটাও কাঁদছে, বেড়ালগুলোও কাঁদছে। কী হয়েছে ওদের?
ছেলেটাই কথা বলল, ‘আমার নাম মাকু।’ কান্নায় ভিজে আছে ওর গলার স্বর। জগন্নাথের চোখের দৃষ্টি ওর মুখের ওপর নরম হয়ে ছড়িয়ে পড়ল। ছেলেটা আবার বলল, ‘আসলে আমার নাম মানিক। আমায় সবাই মাকু বলে ডাকে। তোর?’
জগন্নাথ ছেলেটার মুখের দিকে চেয়েই রইল। কোনো উত্তর দিল না।
বলবি না?’
এবার অভিমানে জগন্নাথ মুখ ঘুরিয়ে নিল।
‘তোর খুব লেগেছে?’
জগন্নাথ উঠে দাঁড়াল।
ছেলেটা বলল, ‘দেখ, সত্যি বলছি আমি তোকে মারতে চাইনি। আমি–আমি’, বলতে-বলতে সব বলা হল না। হাউহাউ করে কেঁদে ফেলল।
ওর কান্না দেখেই বোধহয় জগন্নাথ এতক্ষণে কথা বলল, ‘আমি যাব।’
‘কোথায়?’
‘বাইরে। রাত হয়েছে, শীত বাড়ছে। বাইরে যাবার দরজাটা কোনদিকে?’
ছেলেটা জগন্নাথের মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, ‘তোর মা আছে?’
‘আমার কে আছে, না-আছে, সে দেখবার তোর কী দরকার!’
একটু বিরক্ত হয়েই উত্তর দিল জগন্নাথ।
‘তুই রাগ করেছিস, না?’
‘কার ওপর রাগ করব?’
‘আমার?’
‘না।’
‘সত্যি বলছিস? কিন্তু জানিস, আমাদের কথা শুনলে তোর একটুও রাগ হবে না।’ বলে ছেলেটা চুপ করে গেল। জগন্নাথ ঘরের যেদিকটা অন্ধকার, সেইদিকে কেমন যেন সন্দেহের চোখে তাকাল একবার। থমথম করছে সেই অন্ধকারটা। থমথম করছে সারা ঘরটা।
ছেলেটা আবার বলল, ‘ওই যে বেড়ালগুলোকে দেখছিস, ওদেরও যেমন মা আছে, আমারও তেমনি মা আছে। কিন্তু জানিস, আমরা হারিয়ে গেছি। আর একটু পরে তোরও সব কিছু হারিয়ে যাবে।’ বলে ছেলেটা যেন ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
কথাটা কেমন অদ্ভুত ঠেকল জগন্নাথের কানে। জিজ্ঞেস করল, ‘মানে?’
‘মানে, এখান থেকে তুই আর বেরিয়ে যেতে পারবি না। তুই এখন এখানে বন্দি। একটু পরে তুইও বেড়াল হয়ে যাবি।’
ভীষণ অবাক হয়েগেল জগন্নাথ। মানুষ আবার বেড়াল হবে কী করে?
‘সত্যি। ওই যে বেড়ালগুলো দেখছিস, ওরা সব মানুষ। তোর মতো, আমার মতো মানুষ। ওদের ধরে এনেছে। আমাকেও ধরে এনেছে!’
বলবার সঙ্গে-সঙ্গে বেড়ালগুলো জগন্নাথের মুখের দিকে চেয়ে একসঙ্গে চিৎকার করে কেঁদে উঠল। কাঁদতে-কাঁদতে জগন্নাথের পায়ের কাছে হুমড়ি খেয়ে লুটিয়ে পড়ল। জগন্নাথের বুকটা কেমন যেন ভার হয়ে গেল। বেড়ালগুলোকে পায়ের কাছ থেকে তুলে নিল। জিজ্ঞেস করল, ‘কে ধরে এনেছে?’
ছেলেটা বলল, ‘জানি না।’
‘তাকে দেখিসনি?’
‘না। ওই অন্ধকারে সে লুকিয়ে থাকে। ওই অন্ধকারটা যেমন অন্ধকার, সেই মূর্তিটাও তেমনি অন্ধকার! অন্ধকারে অন্ধকার হয়ে সে গর্জন করে। তাকে দেখতে পাই না।’
‘এখনও সে ওই অন্ধকারে আছে?’
‘না, এখন সে নেই। একটু পরে আসবে।’
‘তাহলে তুই বেড়ালগুলোকে মারছিলি কেন?’
‘আমাকে হুকুম করে গেছে ওই বেড়ালগুলোকে মেরে রাখতে। সে এসে খাবে। তুই বেড়াল হলে তোকেও খাবে। আমাকেও খাবে।’ বলতে-বলতে ছেলেটা জগন্নাথের হাত ধরল। বলল, ‘আয় আমার সঙ্গে। জগন্নাথকে টানতে-টানতে ওই অন্ধকারে নিয়ে গেল। অন্ধকার থেকে আরও অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। একটা মস্ত গর্তের সামনে এসে দাঁড়াল ছেলেটা। বলল, ‘এই যে গর্তটা দেখছিস, তোকে চ্যাংদোলা করে তুলে এনে এই গর্তে ফেলে দিয়ে ওই পাথরটা চাপা দিয়ে দেবে। তারপর তোকে যখন তুলবে, তুই তখন একটা বেড়াল হয়ে গেছিস! শুনে তোর ভয় করছে না?’
জগন্নাথ বলল, ‘না, ভয় পাই না আমি।’
‘তুই তো জানিস তুই আর বাঁচবি না, তবু তোর ভয় করছে না?
জগন্নাথ তখন বুক ফুলিয়ে বলল, ‘তোর নাম যদি মানিক হয়, আমার নাম জগন্নাথ। কোনো বিপদই আমার কাছে বিপদ নয়। কেননা, কোনো ভয়কেই আমি ভয় বলে মনে করি না। আমায় কেউ মারতে পারবে না। যারা ভিতু, তারাই তো মরে!’
‘তুই তো এখন ধরের মধ্যে বন্দি।’
‘তাতে কী হয়েছে! বেড়ালগুলোতে আরও বিপদে পড়েছে। আমি ওদের বাঁচাব।’
‘কেমন করে?’
‘সাহস থাকলে সব হয়।
‘আর আমাকে?’
জগন্নাথ বলল, ‘দেখ মানিক, তুই আমায় মেরেছিস, তাই বলে আমি প্রতিশোধ নেব, একথা যেন ভাবিস না। মানিক, আমার মাকে আমার মনে পড়ে না। আমি যখন খুব ছোট্ট, আমার মা হারিয়ে গেছে। আজ তোর মা তো আমারই মা। মানিক, তুই আমার ভাই। চ আমার সঙ্গে।’ বলে, জগন্নাথ মানিকের হাত ধরে অন্ধকার থেকে আবার সেই ঘরে ফিরে এল।
কী জানি কেন, হঠাৎ দেখি বেড়ালগুলো যেন কত খুশি হয়ে উঠেছে। মানিকের হাত ধরে জগন্নাথ সেইখানে এসে দাঁড়াতেই বেড়ালগুলো লাফিয়ে লাফিয়ে জগন্নাথকে আদর করতে লাগল। জগন্নাথ ওদের জড়িয়ে ধরল। মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘পারবি, আমি যা বলব তাই করতে?’
বেড়ালগুলো একসঙ্গে ‘ম্যাঁও, ম্যাঁও’ করে চিৎকার করে উঠল।
জগন্নাথ বলল, ‘তবে আয়।
এগিয়ে গেল জগন্নাথ। এগিয়ে গেল ঘরের সেই দরজাটার দিকে। লোহার দরজা। লোহার খিল আঁটা। অনেক উঁচু। ওখানে হাত যাবে না জগন্নাথের। গেলেও একা জগন্নাথ পারবে না ওই খিল খুলতে। জগন্নাথ বলল, ‘মানিক, তুই আমার কাঁধে বোস।’
তারপর বেড়ালগুলোকে বলল, ‘আমার ঘাড়ে, পিঠে চাপ।
মানিক কাঁধে বসল। বেড়ালগুলো লাফিয়ে-ছুটে ঘাড়ে-পিঠে উঠে পড়ল। জগন্নাথ বলল, ‘এখন তোরা সবাই মিলে খিলটা ঠেলে-ঠেলে খোল।’
তারপর মানিক হাত দিয়ে আর বেড়ালগুলো মাথা লাগিয়ে সেই ইয়া পেল্লাই লোহার খিলটা ঠেলতে ঠেলতে খুলতে লাগল। কী সাংঘাতিক ভারী! কিন্তু লোহাই হোক আর ভারীই হোক, ওরা আজ কিছু মানবে না। ওরা হারবে না। ওরা আজ সবাই এক। সবাই মিলে ওরা আজ এই অন্ধকার থেকে আলোয় যাবে। ওরা বাঁচবে!
হঠাৎ একটা গর্জন শোনা যাচ্ছে। হাজার-হাজার ভীমরুল একসঙ্গে ডেকে-ডেকে উড়ে এলে যেমন শুনতে লাগে, গর্জনটা তেমনি যেন ছুটে-ছুটে উড়ে আসছে।
মানিক চেঁচিয়ে উঠল, ‘জগন্নাথ, সে আসছে!’
জগন্নাথও চেঁচিয়ে উত্তর দিল, ‘আসতে দে। আমাদের দরজা খুলতেই হবে। জোরে-জোরে, আরও জোরে হাত লাগা।’
মানিক আর বেড়ালগুলো চেঁচিয়ে উঠল, হেঁই-হো, ম্যাঁও-হো! ওরা যতই জোরে সেই লোহার খিলে ঠেলা মারছে, ভীমরুলের মতো আওয়াজ করে সেই গর্জনটাও ততই যেন দূর থেকে কাছে এগিয়ে আসছে। জগন্নাথের কানে তালা লেগে গেল! গর্জনটা ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। ভূমিকম্প হলে যেমন ঘর-দোর সব কেঁপে ওঠে, সেই গর্জন ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়তেই তেমনিই দুরুদুরু সব কাঁপতে লাগল।
মানিক চেঁচিয়ে উঠল, ‘জগন্নাথ!’
জগন্নাথের গলা সেই ভয়ংকর গর্জন ছাপিয়ে চিৎকার করে উঠল, ‘ভয় নেই মানিক! আমরা সবাই এক। আমরা জিতব, জিতব, জিতব।’
অমনি ঝনঝনঝনাৎ! সেই লৌহ কপাটের লোহার খিল ভেঙে মাটিতে ঠিকরে পড়ল। ওরা আনন্দে চিৎকার করে উঠল। কিন্তু তারপরেই থতমত খেয়ে গেল। কে যেন ওদের ধাক্কা মারল। জগন্নাথের কাঁধ থেকে, পিঠ থেকে এ-ধার ও-ধার ছিটকে পড়ল ওরা সবাই। জগন্নাথকে অন্ধকারে কে যেন ছোঁ মেরে ছিনিয়ে নিয়ে মিলিয়ে গেল। মানিক চেঁচিয়ে উঠল, ‘জগন্নাথ!
জগন্নাথ অন্ধকার থেকে উত্তর দিল, মানিক, ভয় নেই। আমরা আজ এক হয়েছি। আমরা জিতবই–’
জগন্নাথের কথা শেষ হল না। হয়তো তার আগেই কে যেন ওর মুখটা চেপে ধরল। চেপে ধরে সেই অন্ধকার গর্তটার মধ্যে ফেলে দিয়ে পাথর চাপা দিয়ে দিল।
অন্ধকারটা যত জমাট, গর্জনটা ততই ভয়ংকর। ভয়ংকর গর্জন এবার মানিকের দিকে এগিয়ে আসছে। মানিক ভয় পেল না। মানিক হেঁকে উঠল, ‘গর্জন, তোমায় আমরা ভয় পাই না। আমরা এক।’
গর্জনটা এগিয়ে আসছে অন্ধকারের ভেতর থেকে, আর বেড়ালগুলো গুঁড়িগুড়ি আলতো পায়ের ডিঙি মেরে ডুব দিচ্ছে অন্ধকারের ভেতরে। আজ আর ওদের ভয় নেই। অন্ধকার তো ওদের কোনোদিন অন্ধ করে দিতে পারে না। ওরা আজ জিতবেই! ওদের শত্রু একটাই। আর তা হল–
গর্জনটা হঠাৎ একেবারে ওদের সামনে এসে পড়ল। ওরা দেখে ফেলেছে। দেখল, ভয়ংকর দুটো চোখ। লাল টকটকে। ঠিকরে বেরিয়ে এসে ঝুলছে আর অন্ধকারে জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। নেকড়ের মুখের মতো মুখটা হিংস্র! জিবটা লকলক করছে। বাদুড়ের মতো দুপাশে ডানা। তার হাত দুটো ডানার সঙ্গে উঠছে নামছে। ঠিক যেন একটা রাক্ষুসে-বাদুড়! এক্ষুনি খুঁচিয়ে শেষ করে দেবে ওই বেড়ালগুলোকে!
একেবারে আচমকা একটা বেড়াল লাফ মারল। লাফ মারল ওর চোখের ওপর! খামচে ধরল। টেনে উপড়ে ফেলল চোখ দুটোকে। রাক্ষুসে-বাদুড়টা যন্ত্রণায় হুংকার ছেড়ে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে তুলকালাম শুরু করে দিল। সেই তক্কে আর একটা বেড়াল ওর ঘাড়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর লকলকে জিবটা হ্যাঁচকা-মেরে ছিড়ে ফেলল। সঙ্গে-সঙ্গে আর সকলে খামচে-ছিড়ে, কামড়ে-আঁচড়ে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ল রাক্ষুসে বাদুড়টাকে। বাদুড় তখন অন্ধকারে অন্ধ হয়ে মাটিতে চিৎপাত! তবু ওরা ছাড়ছে না। লৌহ কপাটের লোহার খিলটা টেনে এনে, ওর মুণ্ডুটার ওপর ধাঁই করে পিটিয়ে দিল। মুণ্ডু গুঁড়িয়ে চ্যাপটা হয়ে গেল। আর কোনো গর্জন নেই, কোনো হুংকার নেই। সেই রাক্ষুসে-বাদুড় মরার আগে শেষবারের মতো ছটফটিয়ে হাত-পা ছুঁড়ে ঠান্ডা মেরে গেল! শেষ হয়ে গেল তার শয়তানি। বাদুড় মরল।
এবার ছুটল ওরা সেই অন্ধকার গর্তে। অন্ধকার গর্তে সেই রাক্ষুসে-বাদুড় জগন্নাথকে ফেলে দিয়েছে। তাকে উদ্ধার করবে মানিক আর সাত-বেড়াল। তাই তারা গর্তের সামনে এসে একসঙ্গে হাত লাগাল। গর্তের মুখ থেকে সরিয়ে ফেলল সেই মস্ত ভারী পাথরটা। হাত বাড়াল মানিক। মানিকের হাত ধরে উঠে এল জগন্নাথ।
একী! সে তো বেড়াল হয়নি! জগন্নাথ তো জগন্নাথই আছে।
হ্যাঁ, জগন্নাথ যেমন ছিল, তেমনি আছে! কর্বুরের দেওয়া জাদু যে তার কোঁচড়ে বাঁধা। কর্বুর তো বলেছে, তার কোনোদিন বিপদ হবে না!
জগন্নাথ মানিকের হাত ধরে সেই গর্ত থেকে উঠে আসতেই সাতটা বেড়াল আর মানিক ওকে জড়িয়ে ধরল আনন্দে। মানিক বলল, ‘জগন্নাথ, আমরা জিতে গেছি।’
জগন্নাথ উত্তর দিল, ‘না মানিক, আমরা এখনও জিতিনি! আরও কাজ আছে। আয় আমার সঙ্গে।’ বলে সেই রাক্ষুসে-বাদুড়টাকে টানতে-টানতে নিয়ে গেল অন্ধকার গর্তটার সামনে। ঠেলা মেরে ফেলে দিল সেই মরা বাদুড়টাকে গর্তের মধ্যে। তারপর পাথর চাপা দিয়ে দিল। কাজ শেষ হলে জগন্নাথ বলল, ‘এক্ষুনি আমাদের এখান থেকে চলে যেতে হবে।
মানিক জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায়?’
জগন্নাথ উত্তর দিল, ‘বাইরে।’
ওরা সবাই মিলে হাত লাগিয়ে, অন্ধকার ঘরের, মরচে ধরা লোহার কপাট ঠেলতে-ঠেলতে খুলে ফেলল। অন্ধকার থেকে ওরা আলোয় বেরিয়ে এল।
‘কোয়া, কোয়া, আ-তু-তু!’ জগন্নাথ ডাকল কোয়াকে।
ওহো, ভুলেই গেছি। কোয়া তো এতক্ষণ বাইরের ছিল। জগন্নাথ ডাকতেই কোয়া ছুটে এল। জগন্নাথ ওর মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বলল, ‘আয়! আমাদের সঙ্গে।’ বলে জগন্নাথ সাত-বেড়াল আর মানিককে সঙ্গে নিয়ে, তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে এগিয়ে চলল। পায়ে-পায়ে কোয়াও চলল। অবশ্য আড়চোখে বেড়ালগুলোর দিকে তাকিয়ে-তাকিয়ে। কোয়া বলে তাই। অন্য কুকুর হলে এতক্ষণে ঘেউ-ঘেউ করে বেড়ালগুলোর পেছনে তাড়া লাগিয়ে দিত!
আকাশে যদিও এখনও ভোরের ছোঁয়া লাগেনি, তবু রাত কাটছে। আর একটু পরে উজাড় করে আলো উপছে পড়বে ওই আকাশ থেকে মাটিতে।
মানিক জগন্নাথকে জিজ্ঞেস করল, ‘এ-পথে কোথায় যাচ্ছিস?’ জগন্নাথ উত্তর দিল, ‘এবার থামব।’
‘কোথায়?’
‘সামনে।’
সামনে এসে থামল জগন্নাথ। থামল সাতটা বেড়াল, মানিক আর কোয়া। জগন্নাথ বলল, ‘মানিক, যে-পথে আমরা এসেছি, সে-পথ এখানে শেষ হয়ে গেছে। এবার আমাদের বিদায় নেবার সময় এসেছে!’
এই কথা বলার সঙ্গে-সঙ্গে ওই সাতটা বেড়াল কেমন যেন করুণ চোখে জগন্নাথের সুখের দিকে চাইল। ছলছল করছে ওদের চোখ।
ওরা কাঁদছে।
জগন্নাথ সাত-বেড়ালের সামনে হাঁটু গেড়ে বসল। ওদের কাছে টেনে নিল। আদর করল, তারপর বলল, ‘আমি তোদের চিনি না, আমি তোদের জানি না। তবু তোদের দুঃখ, আমারও দুঃখ! তোদের সে-দুঃখ আজ শেষ হবে। আমরা অন্ধকারকে জয় করেছি। এবার দুঃখকে জয় করব। আমরা আবার জিতব।’ বলে, জগন্নাথ উঠে দাঁড়াল।
এতক্ষণে জগন্নাথ কর্বুরের দেওয়া রেশমি-সুতোয় বাঁধা সেই সোনার ঘুঙুরটা কোঁচড় থেকে বার করল। নিজের অনেক বিপদের মধ্যেও জগন্নাথ কোনোদিনই মনে করেনি, এই ঘুঙুর বাজাতে হবে। আজ মনে হয়েছে। মনে হয়েছে বলেই রেশমি-সুতোয় সে দোলা দিল। ঘুঙুর বেজে উঠল।
সমুদ্রের অনেক ঢেউ একসঙ্গে তোলপাড় করে যেমন গর্জে ওঠে, তেমনি ভীষণ শব্দে চারিদিক কেঁপে উঠল। ভয় পেয়ে গেল মানিক, ভয় পেল সাতটা বেড়াল আর ছোট্ট কোয়া। তারপর ধীরে-ধীরে সেই শব্দ মিলিয়ে গেল। ধীরে-ধীরে সকলের চোখের সামনে, শূন্যে ছড়িয়ে গেল, রং রং আর রং! সেই রং দিয়ে কে যেন আলপনা এঁকে দিল ওই শূন্যে। সেই আলপনা ছুঁয়ে-ছুঁয়ে ময়ূরকণ্ঠী রঙের সেই মূর্তি ভেসে উঠল। সকলে অবাক হয়ে চেয়ে রইল সেই মূর্তির দিকে। আঃ! কী সুন্দর!
মূর্তি কথা বলল, ‘জগন্নাথ, আমি কর্বুর! আমি এসেছি। বল, তুমি কী চাও?’
জগন্নাথ উত্তর দিল, কর্বুর, আমি তোমার কথা রেখেছি। আমি বিপদে পড়েছি, তবুও তোমায় ডাকিনি। আজ আমি বিপদ জয় করে তোমায় ডেকেছি। কেন ডেকেছি, সে তো তুমি জানো কর্বুর! তুমি এই বেড়ালদের আবার মানুষ করে দাও!’
কর্বুর উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ জগন্নাথ, তোমার সাহস দেখে আমি আবার খুশি হয়েছি। তোমার ইচ্ছাই পূর্ণ হবে।’
বলার সঙ্গে-সঙ্গে শূন্যের সেই রং হঠাৎ ওঠা দমকা হাওয়ায় ঘূর্ণি খেতে-খেতে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। ছড়িয়ে-ছড়িয়ে সেই সাত-বেড়ালকে ঢেকে ফেলল। গাঢ় রঙের জমাট ধোঁয়ায় আর দেখা যায় না তাদের। বেড়ালগুলো রঙের মধ্যে ডুবে গিয়ে যেন হারিয়ে গেছে!
একটু পরেই আবার ধীরে-ধীরে সরে গেল সেই রঙের ঝিলমিল। ধীরে-ধীরে কর্বুরের রঙিন মূর্তি আবার শূন্যে ভেসে উঠল। ছুটে গেল জগন্নাথ বেড়ালগুলোর দিকে আনন্দে! একী বেড়াল তো আর বেড়াল নেই। তারা যে মানুষ! ছোট্ট-ছোট্ট সাতটি ফুটফুটে ছেলে-মেয়ে, সাদা ধবধবে পোশাক পরে দাঁড়িয়ে আছে। অবাক হয়ে গেল জগন্নাথ, অবাক হয়ে গেল মানিক। খুশিতে কোয়া ডেকে উঠল, ‘ঘেউ-ঘেউ।’
কেঁদে ফেলল তারা। সেই ফুটফুটে সাতটি ছেলেমেয়ে। কাঁদতে-কাঁদতে জগন্নাথকে জড়িয়ে ধরল। বলল, ‘জগন্নাথ, তুমি আমাদের সত্যিকারের বন্ধু।’
জগন্নাথ ওদের চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে উত্তর দিল, ‘তোমরাও আমার বন্ধু।
কর্বুর আকাশের ওপর থেকে এবার বলল, ‘জগন্নাথ, তোমার ইচ্ছা পূর্ণ হয়েছে। তোমার আর কি কিছু চাইবার আছে? তুমি আর কী চাও?’
‘কর্বুর, আমি বাবার কাছে যাব।’
‘এসো আমার সঙ্গে।’
কর্বুর আকাশে রং ছড়িয়ে ভেসে চলল। জগন্নাথ, মানিক, ওদের সাত বন্ধু আর কোয়া সেই রং দেখে দেখে পথ হাঁটল।
একটি পাখি ডাকল।
আকাশে ভোর আসছে।
কর্বুর দাঁড়াল। কর্বুর বলল, ‘জগন্নাথ এবার দাঁড়াতে হবে।’
ওরা দাঁড়াল।
দুটি পাখি ডাকল।
আকাশে ভোর এসেছে।
কর্বুর জিজ্ঞেস করল, ‘জগন্নাথ, তোমার বাবাকে দেখতে পাচ্ছ?’
জগন্নাথ বলল, কই না!’
অনেক পাখি ডেকে উঠল।
ভোরের আকাশ রঙিন হল।
কর্বুর বলল, ‘সামনে এগিয়ে এস।’
জগন্নাথ এগিয়ে গেল। সূর্য উঠল। সূর্যের রঙের ছটায় চোখ মেলে সামনে চাইতেই স্থির হয়ে গেল জগন্নাথের চোখ দুটি। ওই ওপরে পাথরের বেদিতে ঘোড়ার পিঠে কে বসে আছে! কার মূর্তি ওই পাথরের বেদির ওপর! জগন্নাথের মুখ দিয়ে অস্ফুট স্বর বেরিয়ে এল, ‘আমার বাবা!’
কর্বুর উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ জগন্নাথ, তোমার বাবা। আর ওই তাঁর ঘোড়া বাদামি। শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে তোমার বাবার একটি পা নষ্ট হয়েছে। আর নিরীহ মানুষকে লুঠেরাদের হাত থেকে বাঁচিয়ে তিনি প্রাণ দিয়েছেন। তোমার বাবা বীর। তাই এদেশের মানুষ সেই বীরের মূর্তি গড়ে ওই বেদির ওপর তাঁর আসন করে দিয়েছে। দেখ, তিনি ওই নীল আকাশে মাথা তুলে আছেন। যে বীর, যে দেশকে ভালোবাসে, দেশের মানুষকে আপন করে নেয়, তার মৃত্যু নেই। তোমার বাবাও বেঁচে আছেন জগন্নাথ। বেঁচে থাকবেন চিরদিন। কোনো দুঃখ করো না জগন্নাথ। দুঃখ করতে নেই। তুমি এগিয়ে চল, এগিয়ে চল, তোমার জয় হবে।’ বলতে-বলতে কর্বুরের সেই রঙিন মূর্তি সোনালি সূর্যের ছটায় হারিয়ে গেল।
জগন্নাথ ওপর দিকে চাইল, ওর বাবার মুখের দিকে। তারপর উঁচু বেদির একটি-একটি সিঁড়ি ডিঙিয়ে ওপরে ও বাবার পায়ের কাছে পৌঁছে গেল। বাবার পায়ে সে মাথা ঠেকাল। তারপর কেঁদে ফেলল। কাঁদতে কাঁদতে দুটি জলভরা চোখে বাবার মুখের দিকে চেয়ে বলল, ‘বাবা, আমিও তোমার মতো হব।’ বলতে বলতে ডুকরে উঠল।
ধীরে-ধীরে মানিক উঠে এসেছে ওর কাছে। সঙ্গে সাত বন্ধু আর কোয়া। মানিক ওর হাতটি ধরে ডাক দিল, ‘জগন্নাথ।
জগন্নাথ উঠে দাঁড়াল।
মানিক বলল, ‘চ।’
জগন্নাথ জিজ্ঞেস করল, ‘কোথা?’
‘বাড়িতে।
‘আমার তো বাড়ি নেই।’
‘আছে জগন্নাথ। আমার বাড়িই তোর বাড়ি। তুই তো বলেছিস, আমার মা তোর মা। মায়ের কাছে চ।
জগন্নাথ চোখের জল মুছে ফেলল। কোয়াকে বুকে তুলে নিল। তারপর সাত বন্ধুর সঙ্গে, মানিকের হাত ধরে এগিয়ে চলল।
তখন রোদ উঠে গেছে। শীতের সকালে ফুটন্ত ফুলের পাপড়ির ওপর শিশির ছড়িয়ে আছে। রোদের আলোয় হাজার-হাজার মুক্তা আনন্দে দোল খাচ্ছে। সেই দুলন্ত আলোর ছচাগুলি জগন্নাথের মুখের ওপর ঠিকরে পড়ছে। ওরাও যেন খুশি আজ। কেননা, জগন্নাথ যে মায়ের কাছে যাচ্ছে!