একটু পরেই আমার চোখের ঝাপসা ভাবটা কেটে যেতে আমি ধড়ফড়িয়ে উঠে বসতে গেছি। পারিনি। উঠতে গিয়ে পিঠের ওপর এমন একটা প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করলুম যে, ওঠা তো দূরের কথা, মনে হল আমার পিঠের শিরদাঁড়াটা বুঝি ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। অন্য সময় হলে নিশ্চয়ই ওই ব্যথার চোটে ককিয়ে উঠতুম। কিন্তু এখন এই অসহ্য যন্ত্রণাতেও আমার মুখ ফুটে টু শব্দটি পর্যন্ত বেরুল না। আসলে এই মুহূর্তে আমার মুখ দিয়ে কথা না ফোঁটারই কথা! কারণ আমার জ্ঞান ফিরে আসার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে একটা মিষ্টি শব্দ যেন আমার কানে ভেসে এল। মনে হল, বুঝি বা আমার ব্যানডুররিয়ার তারে-তারে কার যেন। আলতো হাতের ছোঁয়া লাগছে! তারগুলো টুংটাং করেবেজে উঠছে। তুমি হয়তো ভাবতে পারো, আমি এখনও সেই জঙ্গলেই পড়ে আছি, আর আনাতিদাদা আমার পাশে বসে বসে ব্যানডুররিয়ার তারে টান দিচ্ছে! এ তো আনাতিদাদা হতেই পারে না! আনাতিদাদার হাতে অমন সুরে ব্যানডুররিয়া কখনোই বাজতে পারে না। সুতরাং চোখদুটোকে আরও একটু ভালো করে মেলে ধরলুম। আমি স্পষ্ট দেখতে পেলুম, এ জঙ্গলের ঝোপঝাড় নয়, আমি একটা ঘরের মধ্যে শুয়ে আছি। সেই ঘরে আমার সামনে একটা ছোট্ট মেয়ে বসে আছে। দেখে মনে হচ্ছে, সে আমার চেয়েও ছোট্ট। তারই হাতে আমার ব্যানডুররিয়া। আমি চোখ মেলে তার দিকে চেয়ে দেখতেই, তার বাজনা থামল। সে হাসল। ঠোঁটের হাসির সঙ্গে তার অবাক চোখের চাউনিটি আমার চোখ এড়াল না। সে বাজনা রেখে আমার কাছে এগিয়ে এল। আমি তাকে এখন আরও কাছ থেকে দেখলুম। অবাক হয়ে গেছি। কারণ তার পরনের এ-রকম সাজ এর আগে আমি আর কখনো দেখিনি। সে পরেছিল, কোমর থেকে হাঁটু অবধি লম্বা একটা ফুল-আাঁকা গোল ঘাঘরা। দু-হাতের নীচ দিয়ে টান-টান করে এমন একফালি রঙিন কাপড় গায়ের ওপর জড়িয়ে রেখেছে যে, দেখলেই তোমার মনে হবে পাখির ডানা। তার সেই গোল ঘাঘরাটার কোমর ঘিরে পাখির পালক সাজানো, মাথায় তার নানান রঙের বুনো ফুল। গায়ের রংটা তার তামাটে বলে, হাসতে হাসতে তার দাঁতগুলি যখনই হঠাৎ-হঠাৎ ঠোঁটের ফাঁকে ঝিলিক। দিচ্ছিল, মনে হচ্ছিল, একঝলক জলের ফেনা ঝকঝক করে উঠছে! সে আমার গায়ে হাত রাখল। তারপর সেই হাতটি আমার কপাল ছুঁয়ে মাথায় উঠে এল। আমি তাকে দেখে অথবা তার আদর-মাখা হাতের স্পর্শ পেয়ে কিছুই বুঝে উঠতে পারলুম না। সুতরাং এবার আমি আগের মতো ধড়ফড়িয়ে ওঠবার চেষ্টা না করে, খুব সাবধানে হাতের ওপর ভর দিয়ে মাথা তোলবার চেষ্টা করলুম। মেয়েটি আমায় উঠতে দেখে এমন ব্যস্ত হয়ে চেঁচিয়ে উঠল যে, সেই চিৎকারে হয়তো-বা মেয়েটির মা-ই হবে, বাইরে থেকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এল আমার কাছে। আমায় উঠতে দিল না। আবার শুইয়ে দিল। তারপর মুখে কী-সব অদ্ভুত শব্দ করে কী যে বলল, তার ঠিক-ঠিক মানে আমি খুঁজে পেলুম না। তবে হাবেভাবে বুঝতে পারলুম, আমায় উঠতে বারণ করছে। সুতরাং আমি হতভম্বের মতো আবার শুয়ে পড়লুম, আর অবাক হয়ে ভাবতে লাগলুম, কে এরা? এই ছোট্ট মেয়েটি আমায় শুতে দেখে আবার খুব নিশ্চিন্তে হেসে ফেলল। আর এই ছোট্ট মেয়েটির মা চোখের পলকে কোথায় যে চলে গেল। অবশ্য বেশিক্ষণ না। নিমেষে একটা পাত্র করে কিছু নিয়ে এল। আমায় অত্যন্ত সাবধানে নিজের কোলের কাছে টেনে নিল। সেই পাত্রটা আমার মুখের কাছে ধরে আদর করে কিছু বলল। আমি বুঝতে পারলুম, পাত্রের মধ্যে যা আছে, সেটা আমায় খেতে বলছে। আমি তার মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলুম। আমি এদের কাউকে চিনি না। কেমন করে এখানে এলুম জানি না। সুতরাং ওই পাত্রে মুখ ঠেকিয়ে ওই খাবারটা খেতেও আমার মন সরল না। আমি মুখ সরিয়ে নিলুম। কিন্তু আশ্চর্য! আমি অবাধ্য হলে আমার মা যেমন একটুখানি গলার স্বর তুলে ছোট্ট করে বকে দিত, ওই মেয়েটির মা-ও আমাকে ঠিক তেমনি করে বকল! তারপর সে হয়তো বলল, না খেলে কষ্ট হবে। আমার মুখখানা তার কোলের কাছে আর একটু টেনে নিয়ে আমার মুখে সেই পাত্রের খাবার ধীরে-ধীরে ঢেলে দিল। আমি খেয়ে ফেললুম। কিন্তু কী খেলুম, বুঝতে পারলুম না। কেননা, এটা যে দুধ নয়, তা বুঝতে আমার দেরি হল না। আমি সেটা খেয়ে নিতেই সে আমার মুখটা মুছিয়ে দিয়ে এমন স্বস্তির সঙ্গে নিশ্বাস ফেলল যে, তাই দেখে তার মেয়ের মুখখানিও খুশিতে উছলে উঠল। খুশি হয়ে তার মা আমার কপালে চুমু খেল। তাকে চুমু খেতে দেখে, মেয়েটিও আমার কপালে তার হাতটি রেখে, হাতের আঙুলগুলি আমার মাথায় নামিয়ে আনল। তারপর চুলের মধ্যে বিলি কাটতে-কাটতে কত কথা যে বলতে লাগল তার একটা অক্ষরও বোঝে কার সাধ্য! আসলে এখন আমি বুঝতে পারছি, আমি যেখানে এসেছি তাদের ভাষা আমার ভাষা নয়। সুতরাং তাদের কথার মানে বোঝার কথাই উঠতে পারে না।
এখন আমি শুয়ে-শুয়ে বেশ দেখতে পাচ্ছি, এটা একটা ঘর। ওপরে গাছের পাতা বিছিয়ে ছাত হয়েছে। চারপাশে গাছের ডাল গেঁথে দেওয়াল হয়েছে। আমি শুয়ে আছি ঘরের ভেতর একটা গাছের ছালের বিছানায়। এতদিন তাঁবুতে শুয়ে-শুয়ে এমন অভ্যেস হয়ে গেছে যে, এই গাছের পাতা-ছাওয়া ঘরে শুতে আমার অস্বস্তি লাগারই কথা। কিন্তু আপাতত আমার তেমন কিছু হচ্ছে না। ঘরের মধ্যে দু-দিকে দুটো বড়ো জানলা। সেখান দিয়ে সকালের সূর্যের আলো ঘরের মধ্যে যতটা ছড়িয়ে পড়ছে, তার চেয়েও বেশি ছড়িয়ে পড়ছে সূর্যের আলোর সঙ্গে গাছের ছায়া। হ্যাঁ, ওই জানলার দিকে চোখ রেখে যেটুকু দেখতে পাচ্ছি, তা খালি গাছ আর গাছ। সুতরাং আমি বুঝতে পারলুম, এ বোধ হয় সেই জঙ্গলের মধ্যেই কোনো-এক জঙ্গলের মানুষের ঘর। আমি শুনেছি, এখনও এমন অনেক মানুষ আছে, যারা গভীর জঙ্গলে বাস করে। শহরের আলো-বাতাসের খবর তাদের জানা নেই। অন্তত এদের দেখে আমার তাই মনে হচ্ছে। ছোট্ট মেয়েটির পোশাক, তার সাজগোজ, তার মায়ের পোশাক, নাকে একটা এত বড়ো পাথরের নাকচাবি, হাতে পোড়া মাটির চুড়ি, পায়ে পাতাবাহারের মল, এমনকী মাথায় চুলের বেণী দেখলেও এ-কথাটা তোমাদেরও বিশ্বাস হবে। এদের দেখে, তাই, এখনই আমার যেটা মনে হল তা হচ্ছে, বাইসনের আক্রমণে আহত অবস্থায় জঙ্গলে পড়ে থাকতে দেখে এরা আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে। শুনেছি, গভীর জঙ্গলের মানুষ ভীষণ হিংস্র হয়। অনেক জঙ্গলের মানুষের পরনে কাপড়জামা কিছু থাকে না। তির-ধনুক বানিয়ে বনের জন্তু শিকার করে তারা খায়। এমনও শুনেছি, অনেক বন্য-মানুষ তো মানুষের মাংস পেলে আর কিছু চায় না। এই কথাটা মনে হতেই আমার বুক দুরুদুরু করে কেঁপে উঠল। আর ঠিক তক্ষুনি এপাশ ওপাশ তাকিয়ে আমি আঁতকে উঠেছি! তাই তো, আনাতিদাদাকে দেখছি না তো! ঘর আর কতটুকু। ঘরের মধ্যে আনাতিদাদা থাকলে এতক্ষণে আমার চোখ ঠিক দেখতে পেত। আনাতিদাদাকে দেখতে না-পেয়েই আমি আবার ধড়ফড়িয়ে উঠতে গেছি। ঠিক সেই সময়ে সেই ছোট্ট মেয়েটি গলায় সুর টেনে-টেনে মুখ দিয়ে এমন সব অদ্ভুত শব্দ বার করে চেঁচিয়ে উঠল যে, তাই শুনে আমি একেবারে হতবাক! সেই শব্দের মাথামুণ্ডু আমি কিছু বুঝতে না পারলেও, সে যে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে গান গাইছে, সেটা ধরে নিতে আমার বেশি সময় লাগল না। গানের তালে তার ঢুলুঢুলু চোখ দেখে, মাঝে-মাঝে মুচকি-মুচকি হাসি আর থেকে-থেকে গানের ফাঁকে আঃ! আঃ! করে ধমকে উঠার শব্দ শুনে, আমি আরও কেমন ভয় পেয়ে গেলুম। আমার মনে হল, একটা জলজ্যান্ত মানুষ হাতে পেয়ে ছোট্ট মেয়েটা পর্যন্ত খুশি! আমাকে মেরে ভোজ বসাবে বলেই হয়তো আনন্দে গাওনা শুরু করে দিয়েছে। এই কথাটা মনে হতেই আমি আর স্থির থাকতে পারলুম না। আমার মাথা থেকে ছোট্ট মেয়েটার হাত এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে উঠে বসলুম। পিঠে যদিও ব্যথা প্রচণ্ড, তবু প্রাণের চেয়ে এ ব্যথা নেহাতই তুচ্ছ! আমার হাতের ঝটকা খেয়ে মেয়েটির গলার গান থেমে যেতেই আমি চিৎকার করে হেঁকে উঠলুম, ‘আনাতিদাদা—
মেয়েটা হাঁদার মতো ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল আমার দিকে। আমি আবার ডাক দিলুম, ‘আনাতিদাদা
সাড়া পেলুম না। সুতরাং দাঁড়াবার জন্যে অতি কষ্টে পায়ে ভর দিলুম। টাল খাচ্ছি। খেতে-খেতে প্রায় যখন পড়ি-পড়ি মেয়েটা আমায় দু-হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল। তারপর এমন চোখ-মুখ করে কাকুতি-মিনতি করতে লাগল যে, আমি বুঝতে পারলুম, সে আমাকে উঠতে বারণ করছে। কিন্তু এখন তার এ-সব কাকুতি-মিনতি আমার কানে ঢুকবে না। কেননা, এখন আমার মনের ভেতরটা গুমরে-গুমরে কেঁদে উঠছে, ‘আনাতিদাদা তুমি কই?’।
আমি যেন চোখে সব-কিছু শূন্য দেখছি। তবে কি আনাতিদাদা আমাকে এই জঙ্গলের মধ্যে ফেলে রেখে পালাল? আনাতিদাদা কি ভাবল, বাইসনের আক্রমণে আমি মরে গেছি? না কি, বাইসনটা আনাতিদাদাকেই মেরে ফেলেছে? যতই ভাবছি, আমার বুকের ভেতরটা হু-হুঁ করে উঠছে। আমার এ কী বিপদ হচ্ছে একের পর এক। আমি এখন কী করব, কোথা যাব? কে বাঁচাবে আমাকে এই জঙ্গলের মানুষের হাত থেকে?
আমি দাঁড়াতে পারলুম না। নিঃশব্দে আবার বসে পড়লুম। আমি বসে পড়তেই মেয়েটাও ক-পা পিছিয়ে গেল। তারপরই আমি তার মুখের দিকে চেয়ে থ হয়ে গেছি! যে-মেয়েকে এতক্ষণ আমার মনে হচ্ছিল, জঙ্গলের এক ভয়ংকর হিংস্র মানুষের মেয়ে, হঠাৎ দেখি, তার চোখ দুটি জলে টলমল করছে। সে কাঁদছে। আমার অবাক হবারই কথা। কেননা, এই তো একটু আগেই সে আমার দিকে চেয়ে হাসছিল! আমার মাথায় হাত রেখে গাইছিল! হঠাৎ সে কাঁদে কেন? আমার সব যেন কেমন গোলমাল হয়ে গেল! এ তো আচ্ছা ধাঁধা! মেয়েটাকে যে কিছু জিজ্ঞেস করব, তারও তো উপায় নেই। আমার কথা বুঝতেই পারবে না। তবে কী করব এখন? আমার আর কী করার আছে? যা করার মেয়ের মা-ই করবে। মা তো আছে!
না, মা ছিল না তখন। আমাকে খাইয়ে সে যে কোথায় গেছে, আমি আর দেখতে পাচ্ছি না। কাছেপিঠে থাকলে কি আর ছুটে আসত না? কারণ, আমি তখন ভীষণ চিৎকার করেই আনাতিদাদাকে ডাক দিয়েছি। তবে কি ঘাতককে ডাকতে গেছে। একটু পরেই বুঝি সে আসবে। এসে আমায় মেরে ফেলবে।
হ্যাঁ, এল। একজন নয়, একদল। জানি না এরা ঘাতক কি না! তাদের সঙ্গে এল মেয়েটার মা আর বাবাও। আমার একেবারে মুখের সামনে এসে যে দাঁড়াল, সে-ই বোধ হয় আমাকে হত্যা করবে। বোধ হয় দলের পাণ্ডা। কেননা, তার সাজগোজ রংচং দেখলে এটাই তোমার মনে হবে। লোকটা একটা ছোট্টমতো গাছের ছালের চাটাই কোমরে জড়িয়েছে। গায়ে তার নানান রকম উল্কি আঁকা। মুখে ছাই-ছাই মাটি মেখেছে। চোখ আর নাকের পাশে মোটা কালো-কালো দাগ! মাথায় লম্বা-লম্বা পাখির পালক গাঁথা টুপি। টুপিটা এত বড়ো যে, একেবারে ঘাড় অবধি নেমে এসেছে। হাতে গলায় নানান রকমের গয়না। কোনোটা কাঠ কেটে-কেটে সুন্দর করে বানানো। আবার কোনোটা পাথর ঘষে-ঘষে তৈরি। লোকটার হাতে একটা কাঠের নল। অনেকটা বড়ো তালপাতার বাঁশির মতো দেখতে। মানুষ মারার-অস্ত্রের বদলে, কেন যে লোকটা অমন একটা নল হাতে করে নিয়ে এসেছে, আমি বুঝতে পারলুম না। এরই একফাঁকে আমার হঠাৎ নজর পড়ল সেই মেয়েটার দিকে। এ কী কাণ্ড। যে-মেয়ে এতক্ষণ চোখের জলে ভেসে যাচ্ছিল, চেয়ে দেখো, তার মুখে হাসি। এমনকী, ওই যে লোকগুলো সঙ্গে এসেছে তারাও খুশিতে চিৎকার করে নিজেদের মধ্যে এমন কথাবার্তা চালাচ্ছে যে, তা শুনে কানে তালা লেগে যাবার গোত্তর! কিন্তু অত চেঁচামেচি সত্ত্বেও আমার কানে যেন শব্দ ঢুকছে না। যত শব্দ যাচ্ছে তার চেয়েও বেশি ভয়ে থিরথির করছে আমার চোখ দুটো। কারণ, পাণ্ডামতো লোকটার ষণ্ডামার্কা চেহারাটা ও সেইসঙ্গে তার কিম্ভূত সাজের বহর দেখলে, তোমার মনে হবেই, লোকটা একটা আস্ত খুনি।
এইবার লোকটা এগিয়ে এল। আমার ভয়-পাওয়া চোখ দুটোর দিকে ভয়ংকর দৃষ্টি হেনে আর প্রচণ্ড চিৎকার করে আমায় কিছু জিজ্ঞেস করল। আমি যেমন বোবা, তেমনিই বোবা! লোকটা আমার কোনো উত্তর না-পেয়ে, একইভাবে, একই সুরে আবার চেঁচিয়ে উঠল। বোকার মতো তার মুখের দিকে চেয়ে থাকা ছাড়া, এখন আমি আর কী করতে পারি! মনে হয়, আমার এই বোকা-বোকা চাউনি দেখেই সব কটা লোক একসঙ্গে বিচ্ছিরি ঠাট্টার সুরে হেসে উঠল। যেন আমি নেহাতই কুকুর-ভেড়া। সুতরাং ভেতরে-ভেতরে ভীষণ জ্বলে গেলুম। এখন সত্যি বলছি, মরতে আমার ভয় নেই। আমি প্রস্তুত। আমি মরে গেলে কেউ কাঁদবেও না, কেউ মনেও রাখবে না। কিন্তু তাই বলে, মরার আগে আমাকে নিয়ে কেউ ঠাট্টা-তামাশা করবে, এ আমি কিছুতেই সহ্য করব না। আশ্চর্য, সেই ছোট্ট মেয়েটা কিন্তু হাসল না! সে সবার মুখের দিকে এক ঝলক দৃষ্টি হেনে আমার মুখের দিকে এমনভাবে চাইল, বুঝতে কষ্ট হল না, সে-ও এ-হাসি সহ্য করে না। ওর মাকেও হাসতে দেখলুম। কিন্তু লক্ষ করলুম, সে-হাসিতে কেমন যেন একটা অদ্ভুত দরদ-মাখানো।
কিন্তু সে যাই হোক, হঠাৎ ওই হাসির মধ্যেই পাণ্ডামতো লোকটা আবার বাজখাঁই গলায় হেঁকড়ে উঠল। অমনি চোখের পলকে লোকগুলো আমাকে সাঁড়াশির মতো জাপটে ধরল। আমি সঙ্গে-সঙ্গে তাদের হাত থেকে নিস্তার পাবার জন্যে প্রাণপণে যুদ্ধ লাগিয়ে দিলুম। কিন্তু পারব কেন? ওই বন্য লোকগুলোর শক্তির কাছে আমার ক্ষমতা তো নেহাতই একটা টুনটুনি পাখির মতো। সুতরাং আমি যতই ধস্তাধস্তি করি ওদের সঙ্গে পারি না। ওরা অনায়াসে আমার হাত-পাগুলো চেপে ধরে আমাকে চ্যাংদোলা করে তুলে নিল। প্রায় ঝুলিয়ে দুলিয়ে সেই ঘরটার ভেতর থেকে বাইরে টেনে আনল। আমার আর অবিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই যে, আমাক খতম করবে বলেই বাইরে নিয়ে যাচ্ছে। অতএব এখন আমি ‘বাবা গো’, ‘মা গো’ বলে গলা ফাটিয়ে মরাকান্না কাঁদলেও এরা আমায় নিষ্কৃতি দেবে না। এখন এদের হাত থেকে ছাড়ান পাবার জন্যে আমার ধস্তাধস্তি করে আর কী লাভ! মরতে যখন হবে, চুপচাপ মরাই ভালো।
একটা অদ্ভুত ভাবনা, ঠিক এই সময়ে আমার মাথায় যে কোত্থেকে এল কে জানে! মনে হল, আচ্ছা, একটুপরে মরলে আমার কী হবে? কোথায় যাবে আমার প্রাণটা? আমি কি তখন সব দেখতে পাব? দেখতে পাব এই আলো, এই আকাশ, এই বন, এই সবুজ গাছ, পাখি–সব-কিছু? শুনতে পাব বন্দুকের আওয়াজ? বোমা? পিস্তল? বা হিংস্র মানুষের চিৎকার? আমি মরে গেলে তখন কি কেউ আমাকে বলবে, যাযাবর মানেই শয়তান, শঠ, চোর অথবা ঠগবাজ? নাকি তখন মানুষ ভাববে, যাক একটা শত্রু নিপাত হল। শত্রু মরলে মানুষ কি হাঁপ ছেড়ে বাঁচ? না কি তারা আরও শক্ত খুঁজে বেড়ায়? কে জানে!
হ্যাঁ, আমাকে বাইরে নিয়ে এসে একটা গাছতলার সামনে শুইয়ে দিল। কাঠকুটো দিয়ে আগুন জ্বালা হয়েছে। গনগনে আগুন দাউদাউ করে জ্বলছে। ছোট্ট মেয়েটার মা প্রায় ছুটে এসেই আমার মাথার গোড়ায় বসল। বসে আমার মাথাটা তার কোলের ওপর তুলে নিল। আমি অবাক হয়ে তার মুখের দিকে চাইতে না চাইতে দেখি, সেই ছোট্ট মেয়েটাও এসে গেছে! সে-ও ঠিক আমারই পাশে হাঁটু-গেড়ে বসল। সে আমাকে যতটা না-দেখছে, তারচেয়ে বেশি দেখছে সেই পাণ্ডামতো লোকটাকে। পাণ্ডা-লোকটা এরই ফাঁকে আমার কাছে এগিয়ে এসেছে। দেখি, যে-লোকগুলো আমাকে চ্যাংদোলা করে এখানে নিয়ে এসেছে, তারা একটু তফাতে পিছিয়ে যাচ্ছে। দাঁড়িয়ে পড়েছে সার বেঁধে। আরও দেখি কী, দুটো লোক দু-দুটো মস্ত ঢাকের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এই ঢাকগুলোকে ওরা বলে থুম্বা। আমার গলায় যখন খাঁড়ার কোপ বসাবে, তখন হয়তো বিকট শব্দ করে থুম্বা দুটো বেজে উঠবে ওদের হাতের তালে। তারপর এই বনের মানুষগুলো আমার রক্ত নিয়ে আনন্দে মাখামাখি করবে। কিন্তু আমায় যে কোন অস্ত্র দিয়ে হত্যা করা হবে, তা কিন্তু এখনও পর্যন্ত আমি দেখতে পাইনি। এখন, এই মুহূর্তে সেইটা দেখার জন্যেই আমার চোখদুটো ছটফটিয়ে উঠল। সেটা কি খাঁড়া, না আর কিছু? কিন্তু ধারালো অস্ত্র তো ধারে-কাছে নজরে পড়ছে না! তবে কি আমায় ওই আগুনে ঝলসিয়ে মারা হবে? মেরে আমার দেহের ঝলসানো মাংস দিয়ে তারা ভোজ বসাবে?
এমনি নানান চিন্তা যখন আমায় পেয়ে বসেছে, তখনই হঠাৎ পাণ্ডা-লোকটা একটা বিকট চিৎকার করে উঠল। সঙ্গে-সঙ্গে কান-ফাটানো আওয়াজ তুলে সেই থুম্বা দুটো গুড়গুড় করে বেজে উঠেছে। বাজনার তালে তালে সামনে দাঁড়ানো লোকগুলো হাত-পা ছুঁড়ে বীভৎস ভঙ্গি করে নাচতে শুরু করে দিল। আমি ভাবলুম, বন্য-মানুষেরা বুঝি শিকার ধরে ভোজ বসাবার আগে এমনি করেই আনন্দ-উৎসব করে। তোমরাও নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ, সেই সময়ে আমার মনের অবস্থা কী হয়েছে!
দেখলুম, সেই পাণ্ডা-লোকটা তার হাতের সেই ফুটো-ফোঁপরা নলটা নিয়ে এগিয়ে গেল গনগনে আগুনটার কাছে। তারপর আগুনের সামনে দাঁড়িয়ে ফুটো নলটা মুখে তুলে নিল। তুলে নিয়ে ফুঁ দিতেই সেটা একটা অদ্ভুত আওয়াজ করে বেজে উঠল। সেটা বাজাতে-বাজাতেই পাণ্ডাটা আগুনের চারপাশে চরকি খেতে লাগল। থুম্বা বাজছে, লোক নাচছে, আর পাণ্ডাটা নল ফুকে চরকি খাচ্ছে, সে যেন এক ভয়ংকর দৃশ্য! অন্তত এখন আমার চোখে।
হঠাৎ পাণ্ডাটা করল কী, তার সেই মুখের নলটা মুখ থেকে সরিয়ে এনে চট করে আগুনের মধ্যে চেপে ধরল। নলের মুখটা দাউদাউ করে জ্বলে উঠল। সেই জ্বলন্ত আগুন নিয়ে পাণ্ডাটা আমার কাছে এগিয়ে এল। একেবারে আমার মুখের সামনে। এবার আমার শেষ! মুখের সামনে আগুন ধরে পাণ্ডাটা হাঁকতে শুরু করে দিল। আমি বুঝতে পেরেছি, মন্ত্র পড়ছে। আমি জানি মন্ত্র পড়া শেষ হলেই ওই আগুন আমার গায়ে ধরিয়ে দেবে। আমি পুড়ে মরব। পুড়ে মরার যে কী জ্বালা আমার জানা নেই। আর জানি না বলেই বোধ হয় সেই সময় আমার মনের ভেতরে একটা অদ্ভুত সাহস ভর করল। মনে হল, এক্ষুনি যখন সব শেষই হয়ে যাবে, তখন আর মিছিমিছি ভয় পেয়ে কী লাভ! ইচ্ছে করলে আমি তো আর পালাতে পারব না। সুতরাং লক্ষ্মী ছেলের মতো মরণের জন্যে অপেক্ষা করা ছাড়া এখন আমি আর কী করতে পারি। কিন্তু মৃত্যুর জন্য এখন আর কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে আমায়? এরা এখনও কেন আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে না আমার দেহে?
আশ্চর্য ব্যাপার! হঠাৎ লোকটা আমার মুখের সামনে থেকে আগুনটা সরিয়ে নিয়ে শূন্যে বাঁই-বাঁই করে ঘোরাতে লাগল। ঘোরাতে লাগল আমার চারপাশে। ঘোরাতে-ঘোরাতে থুম্বার তালে-তালে ওই লোকগুলোর সঙ্গে নিজেও নাচতে লাগল। তারপর শুরু হয়ে গেল গান। তোমায় কী বলব, যেই গান শুরু হয়েছে, দেখি, ছোট্ট মেয়েটা আর তার সঙ্গে তার মা-ও উঠে পড়েছে। তারাও গাইতে শুরু করে দিল। এমনকী, দু-চারবার নেচে-নেচে পা-ও তাদের ছটফটিয়ে উঠল। আমি থ। সে এক অবিশ্বাস্য দৃশ্য। আগুন জ্বলছে গনগন করে।
কাঠকুটোর পোড়া গন্ধ নাকে এসে লাগছে। হাওয়ায় দোলা খেয়ে ধোঁয়া লাগছে চোখে। সেই আগুন আর ধোঁয়াকে থোড়াই কেয়ার করে নাচতে-নাচতে, গাইতে-গাইতে সবাই যেন উন্মাদ। আর আমি বোকার মতো চুপটি করে পড়ে-পড়ে দেখছি, আমার মৃত্যুর আগে তাণ্ডব-নৃত্য!
কিন্তু নাচ আর গান যেন শেষ হয় না। বলতে কী, সেইসময় আমার সেইভাবে শুয়ে থাকতে ভীষণ অস্বস্তি লাগছিল। মনে হচ্ছিল, এখন বোধ হয় এভাবে শুয়ে থাকার আর কোনো মানে হয় না। আমি উঠেই বসলুম। বসে-বসে ফ্যালফ্যাল করে ওদের নাচ দেখতে লাগলুম। কী জানি কেন, আমার পিঠের ব্যথাটা আর তেমন করে চাগাড় দিল না! মরণ যখন সামনে হাতছানি দিচ্ছে, তখন কি আর ওই ব্যথা-ট্যথার কথা মনে থাকে! আশ্চর্য, আমি উঠে বসলুম, অথচ এবার কেউ আমায় সামাল দিতে এল না! উলটে তারা যেন দ্বিগুণ জোরে গেয়ে উঠল! বন্য-নাচে মেতে উঠল।
আমি আরও কিছুক্ষণ অমনি হাঁদার মতোই বসে রইলুম। কিন্তু এমনি করেই বা মানুষ কতক্ষণ বসে তাকতে পারে! যা থাকে বরাতে, আমি উঠে দাঁড়ালুম। এবারও আমার কষ্ট হল না। কিন্তু অন্য আর একটা কাণ্ড হল। সেই ছোট্ট মেয়েটা আমার কাছে ছুটে এল। আমার হাত ধরল। আমায় টানতে-টানতে ওই নাচের দলে নিয়ে চলল। তারপরে আমাকেও নাচার জন্যে ইশারা করল। আমি হতবাক! এই একটু আগে আমি নড়তে পারছিলুম না। পড়েছিলুম মাটিতে। এখন উঠে দাঁড়াতে পেরেছি। এখন ইচ্ছে করলে আমি হয়তো নাচতেও পারি! এ কেমন করে সম্ভব হল! এরা কি তবে এতক্ষণ ধরে আমার ব্যথা সারাবার জন্যে এতসব কাণ্ডকারখানা করেছে। তবে কি ওই পাণ্ডামতো লোকটা ডাকিনীবিদ্যে জানে! হ্যাঁ, আমি শুনেছি এই ডাকিনীবিদ্যের জোরেই মরা-মানুষের প্রাণ ফিরিয়ে দিতে পারে এই বনের মানুষেরা! আর সেই বিদ্যের জোরেই বুঝি বাইসনের গুতিয়ে দেওয়া আমার পিঠের ব্যথা এই লোকটা ভালো করে দিল! তবে কি এরা আমায় মারবে না! এরা আমার বন্ধু!
আমার বুকের ভেতরটা দুরন্ত আনন্দে লাফিয়ে উঠল। আমার পা দুটোও ওদের পায়ের তালে নেচে উঠল। ওই বন্য-মানুষগুলোর সঙ্গে এই মুহূর্তে আমিও বন্য হয়ে গেছি! তাই, আমি ওদের গানের ভাষা না বুঝলেও, ওদের সুরে সুর মিলিয়ে চিৎকার করে উঠলুম। আর মনে-মনে ভাবতে লাগলুম, শহর যখন হিংস্র মানুষের গুলির শব্দে তটস্থ, তখন বনের এই মানুষগুলো নাচ আর গানের বন্যায় সেই শহরেরই একটা ছোট্ট ছেলের প্রাণ ফিরিয়ে দিয়েছে! আশ্রয় দিয়েছে! আশ্চর্য মানুষ এরা!
.
হ্যাঁ, আমায় আশ্রয় দিল এরা। অন্তত বলতে পারি, এরা যদি আমায় বনের ভেতর থেকে উদ্ধার করে না আনত, তবে ওইখানেই বাইসনের গুঁতো খেয়ে আমি পড়ে-পড়ে মরতুম। আর না-হয়তো, বনের অন্য কোনো হিংস্র জন্তু আমার রক্ত-মাংসে পেট ভরাত!
এত বিপদে পড়েও আমার ব্যানডুররিয়াটা যে বেহাল হয়ে পড়েনি, এ-কথা শুনলে তোমরাও বোধ হয়। আমার মতো অবাক হবে! সত্যিই! ব্যানডুররিয়াটা আমার অটুট আছে! বাইসনের গুঁতো খেয়েও যে কেমন করে সেটা রক্ষা পেয়েছে, এ-কথা ভাবলেই আমি আশ্চর্য হয়ে যাই। আমার বড় প্রিয় ওই ব্যানডুররিয়াটা। আমি জানি, এখন ওই ব্যানডুররিয়াটা ছাড়া আমার সবই গেছে। তাই, ব্যানডুররিয়াটা যদি হারিয়ে যেত, কিংবা ভেঙে খানখান হয়ে এই জঙ্গলের জঞ্জাল হয়ে পড়ে থাকত, তবে আমার দুঃখের কি শেষ থাকত।
হ্যাঁ, আর একজনও নিশ্চয়ই দুঃখ পেত, সে আনাতিদাদা। মানুষটা যেন ম্যাজিকের মতো কোথায় উবে গেল। আমার মা আর বাবার কথা, সে তো আমার অজানা নয়। আমারই চোখের সামনে আমার মাকে হত্যা করেছে ওই পুলিশের গুলি। সে-দৃশ্য আমার চোখের ওপর ভেসে উঠলে আমার বুকের রক্ত গরম হয়ে ওঠে। তবু নিজেকে সামলে নিতে হয়। কেননা, প্রতিশোধ নেবার ক্ষমতা তো আমার এখনও হয়নি। সময় যখন আসবে আগুন হয়ে ঝলসে উঠে সেই হিংসার সামনে রুখে দাঁড়াব। ওই হত্যাকারীদের আমি জিজ্ঞেস করব, বিনা কারণে নিরীহ মানুষের প্রাণ নেবার অধিকার তোমাদের কে দিয়েছে? ধিক তোমাদের! বারুদের তৈরি গুলি একদিন যে তোমাদের বুকেও আঘাত করতে পারে, সে কি তোমরা জানো না?
আপাতত আমি এই জঙ্গলেরই বাসিন্দা। গভীর জঙ্গলের মধ্যিখানে এই বন্য মানুষগুলির সঙ্গে আমি এখন যেখানে আছি, দেখলে তুমি ভয় পাবেই। মনে হবে, এই বুঝি বাঘ-ভাল্লুক লাফিয়ে পড়ল ঘাড়ের ওপর! হ্যাঁ, বাঘ তো আছেই। মাঝে-মাঝে একটু দূরে জঙ্গলের আরও গভীরে তারা যখন গর্জে ওঠে, কী-রকম দুরুদুরু করে কেঁপে ওঠে আমার বুকের ভেতরটা! তবু নিজের ভয়টা নিজের মধ্যেই চেপে থাকি! কারণ, আমি জানি, এখান থেকে পালিয়ে যাবার পথ আমার জানা নেই। পালাতে গিয়ে যদি জঙ্গলের মধ্যে আমি চিরদিনের মতো হারিয়ে যাই, তখন কী হবে? তখন হয়তো বাঘের পেটেই যেতে হবে। তাহলে কী এখানে আমায় সারা জীবনই থাকতে হবে? কে জানে!
ওই ছোট্ট মেয়েটা আমায় যে কী ভালোবাসে, সে তোমরা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাসই করতে পারবে না। ওর কোনো ভয় নেই। ভয় নেই বাঘ-ভাল্লুক কিছুরই। কী-রকম দুঃসাহসে একা-একা জঙ্গলের মধ্যে ছুটে যায়। অবশ্য এখন আর একা-একা যেতে হয় না। এখন আমি ওর সঙ্গী। আমায় এখন সে কলকল করে যে কত কথা বলে, কে বোঝে সে-সব কথার মানে! ও হাসে, গান গায়, আর যখনই ওর মন চায়, আমার হাত ধরে ছুট দেয়। আমিও যে কথা বলি না, তা নয়। আমার কথা বোঝে না একবর্ণও। নইলে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকবে কেন আমার মুখের দিকে! ওর দুটি চোখের দৃষ্টি ভারি মিষ্টি! ওর চোখ দুটির দিকে তাকালে আমার মুখ যেন আপনা থেকে কথা কয়ে ওঠে।
এতদিনে শুনতে-শুনতে আমি ওর নামটা জেনে ফেলেছি, ওতিয়া। একদিন যখন ‘ওতিয়া’ বলে ডাক দিয়েছি আমি, কী বলব তোমায়, একঝলক হাওয়ার মতো উড়ে এসে আমার গলাটি জড়িয়ে ধরল সে। তারপর অঝোরে হাসতে-হাসতে সে আমায় বুঝিয়ে দিল, কী খুশিই না সে হয়েছে। হাসতে-হাসতেই সে যখন আমার বুকে হাত রেখে ইশারা করল, তখন আমার বুঝতে বাকি রইল না, সে আমারও নাম জিজ্ঞেস করছে! আমিও হেসে ফেললুম। তার চোখের দিকে তাকিয়ে বললুম, ‘আমার নাম ইসতাসি৷’।
ইসতাসি!’ মুখে একটা অদ্ভুত শব্দ করে আমার নামটা যখন সে উচ্চারণ করল, তারপর ছুটতে-ছুটতে তার মায়ের কাছে গিয়ে আমার নামটা বার বার বলতে লাগল, তখন কী মিষ্টি শোনাচ্ছিল তার গলার স্বর। এমন খুশি তাকে আমি আর কোনোদিনই দেখিনি। সে যেন ভেবেই পাচ্ছে না, কী করবে এই মুহূর্তে। শুধু একটাই শব্দ তার মুখে। সে শুধু ডাকছে, ‘ইসতাসি, ইসতাসি।’ সে সেই শব্দটাকে সুরের মতো গেয়ে-গেয়ে, আনন্দে আত্মহারা হয়ে আমার ব্যানডুররিয়াটা হাতে করে নিয়ে এল। আমার হাতে তুলে দিল। ইশারা করল। মুখে শব্দ করল। যার মানে, ‘বাজাও।’ এখন মুখে যে-শব্দটা করল হয়তো এইটাই তার আবদারের ভাষা। সুতরাং আমি তার আবদার না-রেখে কেমন করে পারি? বাজাতে শুরু করে দিলুম। ওতিয়া হাততালি দিল।
এখনও ওতিয়া অবাক হয়ে চেয়ে থাকে আমার বাজনার দিকে। আমি যখনই বাজাই, ওর চোখের দিকে তাকালে আমার মনে হয়, বুঝি বা আমার বাজনার শব্দের মধ্যে কোনো জাদুমন্ত্রের আঁচ পেয়েছে সে। তাই মাঝে-মাঝেই আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় ও জঙ্গলের ভেতরে। জঙ্গলের ভেতরে এইখানে, এই যে গাছে-গাছে ছাওয়া নিরিবিলি জায়গাটা, এইখানে সে আমায় নিয়ে আসে। তারপর আমার নাম ধরে ডাকে, আমার ব্যানডুররিয়াটার ওপর হাত রাখে। আমার চোখের দিকে তাকায়। ঘাড় নাড়ে। আমার হাতের বাজনা বেজে ওঠে। এই নির্জন জঙ্গলের গভীরে সেই বাজনার সুর শুনতে-শুনতে ওতিয়ার চোখ দুটি অবাক হয়ে চেয়ে থাকে আমার হাতের দিকে। তারপর ছুটতে ছুটতে নাচতে থাকে। আর নয়তো গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে সুর করে গান গায়। গানের মানে না বুঝি, কী যে ভালো লাগে! খুব ভালো!
এখন এত ভালো লাগে ওতিয়াকে। ভালো লাগে ওর মাকে, বাবাকে। ওরা যেন আমাকে ওদেরই আপনজন ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারে না। কেমন যেন আমারই অজান্তে আমিও ওদের একজন হয়ে গেছি। ওদেরই মতো বন্য আর আনন্দে উচ্ছল। যদিও আমার পরনে সেই লম্বা প্যান্ট আর জামাটা এখনও আছে, ক-দিন পরে এ-দুটোর যখন আর পরবার মতো হাল থাকবে না, তখন আমি জানি, ওদেরই মতো আমায় গাছের ছালের নামমাত্র পোশাক পরতে হবে। তখন হয়তো এরা আমার গায়ে উল্কি এঁকে দেবে। আর নয়তো নানা রঙের আঁকিজুকি। কপাল জুড়ে গাছের লতা জড়িয়ে তাতে এঁটে দেবে পাখির পালক। তারপর রাতের বেলা জ্বলন্ত আগুন ঘিরে ওদের সঙ্গে নাচতে হবে আমায়। ভয়ংকর যুদ্ধের নাচ। অথবা শত্রুকে জয় করার উল্লাসনৃত্য!
সত্যি এরা নাচে। রোজই নাচে। সারাদিন জঙ্গলে-জঙ্গলে ঘুরবে। শিকার খুঁজে এনে রাতের বেলা এক জায়গায় সবাই জমায়েত হয়ে আগুন জ্বালায়। গুরু-গুরু শব্দে ঘুম্বা বাজায়। মুখে অদ্ভুত শব্দ করে নৃত্যে মেতে ওঠে। ওই আগুনে তারা শিকার ঝলসে নেয়। তারপর ভোজ বসায়। সে-ভোজে আমাকেও ভাগ বসাতে হয়। ভারি আনন্দের সে-ভোজ। ভারি তৃপ্তির।
প্রথম-প্রথম যখন আমার কিছু ভালো লাগত না, শুধু মনে পড়ত মাকে, বাবাকে, আনাতিদাদা অথবা আমাদের সেইদলের সবাইকে, তখন কোনো খাবারই রুচত না আমার মুখে। তখন ওতিয়ার মা কতদিন আমার নিজের মায়ের মতো আমাকে আদর করে খাইয়ে দিয়েছে। মাঝে-মাঝে যখনই আমার চোখ ছলছলিয়ে উঠেছে, আমায় ভালোবেসে কাছে টেনে আমার চোখের জল মুছিয়ে দিয়েছে। চুমু খেয়েছে। তখনই আমার মনে হয়েছে, এ মা তো শুধু ওতিয়ার মা নয়, এ যেন আমারও মা। এই বন্য মায়ের মুখখানি আমার মায়ের কথা বার বার মনে পড়িয়ে দিচ্ছে। আমার মন বলছে, সব মায়ের বুকের মধ্যে আছে একই আদর, একই ভালোবাসা। মা যদি হয় বনের, কী শহরের, তফাত কোথায়?
.
আচ্ছা, ওতিয়া বুঝি আমাকে ছাড়া আর কিছু জানে না। আমাকে নিয়ে সারাক্ষণ এত ব্যস্ত! কী যে করবে, যেন ভেবেই পায় না। আমার মুখে হাসি না-দেখলে, তার মুখখানিও শুকিয়ে যায়। দেখে আমারই কষ্ট লাগে। তাই হাসতেই হয় আমাকে। অন্তত তার জন্যে। তার গান শুনতে হয়, নাচ দেখতে হয়, আর বার বার হাতে তালি দিয়ে তারিফ করতে হয়। তার ওপর, যখনই সে আমার হাতে ব্যানডুরিয়াটা তুলে দেবে, তখনই বাজাতে হয়। না বাজালে কী রাগ!
ভারি মায়া লাগে মেয়েটাকে দেখলে। না আছে দামি জামা-কাপড়, না আছে খেলনা-পুতুল। ওর কানে ওই যে কাঠের দুল দুটি দুলছে, কিংবা গলায় কাঠের তৈরি ওই যে মালাটি, ওই কাঠের গয়না দুটিই যেন ওতিয়ার কাছে সাত রাজার ধন। ও জানে না, সোনা কাকে বলে। ও কোনোদিনই চোখে দেখেনি। তাই ভাবতেই পারে না, সোনা পরলে তাকে আরও কত সুন্দর দেখতে লাগবে।
ওতিয়া এই জঙ্গলের সবুজ ছায়ার মতোই ঠান্ডা আর শান্ত। হাসিখুশিতে ভরা ওই ছোট্ট মেয়েটা সত্যিই সুন্দর। এই বনের মতোই সুন্দর। ওকে ছেড়ে যাবার কথা আমি এখন ভাবতেই পারি না। এখন আমি সত্যিই ওতিয়ার মতো বন্য হয়ে গেছি। তোমরা ওকে আমার আপনজন বলে স্বীকার না-করলেও, আমি মনে-মনে জানি, ও আমার বোন। আমি ওতিয়ার ভাই। আমাদের খেলাঘর এই বন আর জঙ্গল।
ওতিয়ার কথা এখন আমি একটু-একটু বুঝতে পারি। যত কথা বুঝতে পারি, তার চেয়েও না-বোঝার কথা অনেক বেশি। যে-কথাগুলো আমি বুঝতে পারি না, ওতিয়া বোবা মুখে হাত-পা নেড়ে এমন করে বুঝিয়ে দেবে, বা দেখিয়ে দেবে যে, তা আমার কাছে জলের মতো সোজা হয়ে যায়। ও এমনি করে একদিন বুঝিয়ে দিয়েছিল, গভীর জঙ্গলে একটি গুহা আছে। গুহার পাশে একটা জলপ্রপাত পাথর ডিঙিয়ে অঝোর ধারায় ছিটকে পড়ছে নীচে, চারিদিকে। সেই জলপ্রপাতের বিন্দু-বিন্দু জলের কণা যখন রোদের আলোয় দোল খায়, তখন রঙে-রঙে ছড়িয়ে যায় চারিপাশ। সে ভারি সুন্দর, ভারি অদ্ভুত। আভাসে ইঙ্গিতে ওতিয়া আমাকে জানিয়েছে, সেই জলপ্রপাত সে আমায় একদিন দেখাতে নিয়ে যাবে। আর বলতে কী, একদিন ওতিয়া সত্যিই আমায় নিয়ে গেছল সেই জলপ্রপাত দেখতে। সেই গভীর, আরও গভীর জঙ্গলে। তারপর? সেই কথাই এখন বলতে হবে আমায়! বলতে গিয়ে আতঙ্কে বুক কেঁপে ওঠে। মনটা ভীষণ দুঃখে মুষড়ে পড়ে।
কথামতো সেদিন আমি আর ওতিয়া সেই গভীর জঙ্গলে জলপ্রপাত দেখতে চলেছি। অবিশ্যি মা আর বাবাকে বলে এসেছে ওতিয়া। আমিও। ওরা বারবার সাবধান করলেও অমত করেনি। গভীর জঙ্গল যত সুন্দর, তত ভয়ংকর, এ-কথাটা যে কত সত্যি, এতদিনে আমিও তা বুঝে গেছি। তবে হ্যাঁ, আগে যেমন ভয়ে গা-ছমছম করত, এখন তা করে না। এখন এই জঙ্গলই আমার সবকিছু। এই জঙ্গলের সঙ্গে আমিও এখন জংলি ইসতাসি! এখানে আমি যাযাবর নই। ঘুরে-ঘুরে, দেশে-দেশে ঘর বাঁধার দিন আমার ফুরিয়ে গেছে। আমার সেই স্বপ্নের দিনগুলি হারিয়ে গিয়ে আর-এক নতুন জীবন শুরু হয়েছে। আমি ভাবি, কোনটা ভালো, সেই পথে-পথে ঘর বেঁধে নানান মানুষের দেশে ঘুরে বেড়ানো, না, এই গভীর জঙ্গলে বনের মানুষের সঙ্গে বন্য হয়ে জীবন কাটানো!
সেদিন ওতিয়ার সঙ্গে হাঁটতে-হাঁটতে আমি জঙ্গলের যতই গভীরে চলেছি, ততই অবাক হয়ে ভাবছি, এই ছোট্ট মেয়েটার কাছে জঙ্গলটা যেন কিছুই নয়। এর পাতা-ঝরা পথ, সবুজ গাছের সারি, এর আলো কিংবা বাতাস, সবই ওতিয়ার আগপাছ জানা। ভয় নেই মনে। আমার তবু ভয় করে। কেননা, একবার যদি এই জঙ্গলের গোলকধাঁধায় হারিয়ে যাই, তবে পথ আর খুঁজে পেতে হচ্ছে না। তোমাদের বলতে ভুলে গেছি, ওতিয়া সঙ্গে একটা তির-ধনুক নিয়েছে। জঙ্গলের গভীরে যখন যেতে হয়, সঙ্গে তির-ধনুক নিতেই হয়। আমি অবিশ্যি এখনও ঠিক-ঠিক তির-ধনুক ছুঁড়তে পারি না। একেবারে পারি না বললেও ভুল হবে। আমিও তির ছুড়ি, কিন্তু ওতিয়ার মতো অত ওস্তাদ এখনও হতে পারিনি। ওস্তাদই বলব। কারণ, এই বয়সেও এক টিপে একটা নিশানা ও ঠিক ছিটকে দেবে। ওর ওই কেরামতি দেখলে অবাক না-হয়ে উপায় আছে। আমি অবাক হলে কী হয়েছে! তির ছোঁড়াটা এই বন্য মানুষগুলির কাছে জলভাত! সঙ্গে আমিও অবিশ্যি একটা তির-ধনুক নিতে চেয়েছিলুম। কিন্তু ওতিয়া নিতে দিল না। তার বদলে, আমার হাতে সে ব্যানডুররিয়াটাই তুলে দিল। আমি ভাবলুম, জঙ্গলের গভীরে যাচ্ছি–বাজনা কী হবে! যদি কোনো ভয়ংকর জন্তুর সামনা সামনি পড়ি, তখন তাকে ব্যানডুররিয়া শোনালে সে কি লক্ষ্মীছেলের মতো বাজনা শুনে আমাদের বাহবা দেবে! না, আমাদের আক্রমণ করে মুণ্ডপাত করবে! এখন অবিশ্যি আমিও তেমন জঙ্গলের জন্তু দেখলে ভয় পাই না। সয়ে গেছে। এখন রাত্তিরে বাঘের গর্জন যতই শুনি, আগের মতো দুরুদুরু করে বুক কাঁপে না। ওতিয়া চলতে-চলতে কলকল করে কত কথা বলছে। হা ভগবান! আমি যে কত বুঝছি! তোমাদের তো আগেই বলেছি, এদের সঙ্গে থাকতে-থাকতে সব কথা না-বুঝলেও, কিছু-কিছু কথা এখন বুঝতে পারি। তাই এখন ওতিয়ার অনেক কথার ফাঁকে-ফাঁকে যে-কথাগুলির মানে আমি জানি, তাতে আমার বুঝতে অসুবিধা নেই, ওতিয়া আমায় গল্প শোনাচ্ছে। গল্প শোনাচ্ছে আগুনের। আগুনকে ওরা মনে করে সব দেবতার সেরা দেবতা। ওরা ভাবে, এই বন্য মানুষের মনে যখন পাপ বাসা বাঁধে, তখন আগুনের দেবতা রুষ্ট হন। আর তখনই তিনি নিজমূর্তি ধারণ করে সব ধবংস করে দেন। এইরকমই একবার হয়েছিল। আর ওতিয়া এখন সেই গল্পটাই শোনাচ্ছে। শোনাতে-শোনাতে কখনো তার চোখদুটো এত বড়ো হয়ে যাচ্ছে! নয়তো ঠোঁটটা উলটে যাচ্ছে! মুখখানা ভয়ে সিঁটিয়ে যাচ্ছে! তখন যা ভালো লাগছিল ওতিয়াকে!
হ্যাঁ, সত্যিই একবার আগুন লেগেছিল এই জঙ্গলে। শুধু জঙ্গলে কেন, এই জঙ্গলের মাঝে-মাঝে এই যে গাছপাতা-ছাওয়া ঝুপড়িগুলো, আগুন লেগেছিল তাতেও। প্রাণের ভয়ে, সেই আগুন-দেবতার হাত থেকে নিস্তার পাবার জন্যে, ওরা আর্তনাদ করে লুটিয়ে পড়েছিল এই জঙ্গলেরই মাটিতে। দেবতা ওদের কথা শোনেননি। দেবতা তাদেরও আগুনে ছাই করে দিয়েছিলেন। কেননা, তখন সারা জঙ্গলের সমস্ত মানুষই হয়ে উঠেছিল পাপী, না-হয় অত্যাচারী! শুধু বেঁচেছিল চারজন। দুই বুড়ো-বুড়ি, তাদের এক ছোট্ট নাতনি আর একটি বালক। ওই বুড়ো-বুড়ি তাদের নাতনিকে বড়ো করেছিল। তারপর বিয়ে দিয়েছিল ওই বালকটির সঙ্গে। ক্রমে-ক্রমে আবার জন্ম নিল নতুন জীবন। আবার গড়ে উঠেছিল, নতুন মানুষের নতুন যুগ। তাই, এখনও ওরা মনে করে, আগুনই তাদের সব দেবতার শ্রেষ্ঠ দেব। তাই এখনও ওরা পুজো করে তাঁর। বনের অপদেবতার হাত থেকে বাঁচার জন্যে রাতের বেলা তাদের ঘরের চারপাশে জ্বেলে রাখে আগুন। আর সে আগুনের ভয়ে অপদেবতাই শুধু নয়, ঘেঁষতে পারে না বনের বাঘ-ভাল্লুকও।
আমরা এগিয়ে এসেছি অনেকটা বনপথ। অবিশ্যি এখনও পর্যন্ত তেমন কিছু জন্তু-জানোয়ার দেখতে পাইনি। মাঝে-মাঝে দু-একটা বুনো খরগোশকে এদিক থেকে ওদিকে ছুটে যেতে দেখেছি। একবার একটাকে ধরবার জন্যে ওতিয়া এমন এক ছুট দিয়েছিল। পারেনি। পারবে কেমন করে? ওরা তোমার চেয়েও চালাক! ধরতে যাও, এমন ভড়কি দিয়ে ঝোপের আড়ালে সুড়ত করে লুকিয়ে পড়বে যে, তোমার আর সাধ্যি নেই তাকে খুঁজে পাও!
হাঁটতে-হাঁটতে হঠাৎ ওতিয়া গান ধরল। এমন হঠাৎ-হঠাৎ গান গেয়ে ওঠে ওতিয়া যে, আমি নিজেই ভ্যাবাচাকা খেয়ে যাই। গাইতে-গাইতে সে আমার হাত ধরল। আমাকেও গাইতে বলল। আমি অবিশ্যি এখন ওদের সঙ্গে একটু একটু গাইতে পারি। শুনতে-শুনতে আমারও এখন গানের কলিগুলো সব মুখস্থ হয়ে গেছে। মানে-টানে সব না বুঝলেও সেই গান গাইতে আমার এত মজা লাগে! তার ওপর ওতিয়ার গলায় যদি সে-গান শুনি, তাহলে তো আর কথাই নেই। দারুণ ভালো লাগে। এমন আধো-আধো সুরে গাইবে! আমি হলপ করে বলতে পারি, সে-গান শুনলে তোমারও মেয়েটাকে ভীষণ আদর করতে ইচ্ছে হবে।
এতক্ষণ আমরা বনের এবড়ো-খেবড়ো পথ ধরে হাঁটলেও সে-পথ ছিল সমান। কিন্তু হঠাৎ যেন পথটা কেমন উঁচু-নীচু ঠেকছে। মনে হচ্ছে, আমরা যেন ওপরে উঠতে-উঠতে নীচে নামছি। এখানে মাটির চেয়ে পাথর বেশি। সেই পাথরের ফাঁকে-ফাঁকে দেবদারু, পাইন আর ইউক্যালিপটাস গাছগুলো খাড়া দাঁড়িয়ে আছে। আমি ওতিয়াকে জিজ্ঞেস করলুম, ‘এদিকে কোথায় যাবে?
ওতিয়া বলল, ‘নীচে। নীচে গভীর খাদ। কী অন্ধকার!’
জঙ্গলের মধ্যে অন্ধকার খাদের ভেতর যেতে হবে শুনলে কোন মানুষ না ভয় পায়? আমি তো কোন ছার! আশ্চর্য, আমি কিন্তু ওতিয়ার মুখে ভয়ের কোনো লক্ষণই দেখতে পেলুম না! পাছে আমার মনের ভয়টা ওতিয়া জেনে ফেলে, তাই ওতিয়া এতক্ষণ যে-গানটা গাইছিল, আমিও এখন এই পাথর টপকাতে-টপকাতে সেই গানটাই গেয়ে উঠলুম। ওতিয়া কী খুশি! আমার হাত ধরে আমার সঙ্গে গলা মিলাল সে। সে-গানের যা মানে দাঁড়ায়, সেটা তোমাদের শোনাবার লোভ সামলাতে পারছি না
এই যে বন, এই যে পথ
এই যে বনের গাছ-গাছালি,
ওই যে বাঘ, কিম্বা ভালুক,
বন্ধু মোদের পাখ-পাখালি।
আর একটু নীচে নামতেই আমি জলের শব্দ শুনতে পেলুম। আমার গান থেমে গেল। আরও একটু এগিয়ে যেতেই দেখি ওই নিচু জায়গাটার মাঝ দিয়ে গাঢ় নীল রঙের জল উপচে একটা ঝরনা বয়ে যাচ্ছে। দুপাশে খাড়া উঁচু পাথরের ফাঁকে-ফাঁকে কত গাছ! কোথাও নানান রঙের বুনো ফুলের গাছ! ওই উঁচু-উঁচু পাথরের ফাঁক দিয়ে আকাশটা যখন দেখছি, কী আশ্চর্য লাগছে! ঝরনার ওপর ওই আকাশ ছায়া ফেলে দোল খাচ্ছে! আমি দেখতে পেলুম, ওতিয়া ওই ঝরনার ধার ঘেঁষে, পাথরের ওপর পা ফেলে-ফেলে ওপরে উঠছে। উঠতে-উঠতে চেঁচিয়ে আমার নাম ধরে ডাকল, ইসতাসি–।’ তাকে জোরেই ডাকতে হল। কেননা, তার চিৎকারের চেয়ে জলের ছলাতকারের শব্দ আরও তীব্র। আমি অবশ্য শুনতে পেয়েছি। এমন একটা চমৎকার দৃশ্য দেখে আমার মনটা এত খুশি যে, সঙ্গে সঙ্গে আমিও গলা ছেড়ে ওতিয়ার নাম ধরে ডেকে উঠেছি। দেখতে পেলুম, ওতিয়া পাথর ভেঙে ওপরে উঠতে-উঠতে আমার ডাক শুনে থেমে পড়ল। হাতছানি দিয়ে আমাকে ওপরে ডাকল। সত্যি বলতে কী, ওতিয়ার মতো অত সহজে আমি উঠতে পারছি না। ওতিয়া যেন একটা ছোট্ট হরিণ। তরতর করে এমন অনায়াসে পা ফেলে ওপরে উঠছে যে, দেখে আমি নিজেই অবাক হয়ে যাচ্ছি। এদিকে আমি কোনোরকমে সামলে-সুমলে পাথর উপকাচ্ছি। ওপরে কোথায় যাচ্ছে ওতিয়া, আমি জানি না। ও যতই ওপরে উঠছে, দেখে আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে! একবার যদি ফসকায়, তাহলে যে কী কাণ্ড হবে, সে আর কাউকে বলে দিতে হবে না!
আর একটু ওপরে উঠতেই আমি দেখতে পেলুম, সেই ঝরনার জল দল বেঁধে ওপর থেকে ঝর-ঝর করে নেমে আসছে। পাথরের ফাঁকে-ফাঁকে যেন জলতরঙ্গের সুর তুলে নাচছে। আমি চোখ ফেরাতে পারি না। স্থির চোখে চেয়ে থাকি সেইদিকে।
ইসতাসি–’ আবার ডাক দিল ওতিয়া।
আমি এবার ওকে ধরবার জন্যে আরও চটপট পা ফেলতে লাগলুম। আর মাঝে-মাঝে যখনই টাল খাচ্ছি, সামনে যা পাচ্ছি তাই-ই ধরে ফেলছি। হাঁপিয়ে গেলুম। অবাক কথা, ওতিয়ার ওসব নেই। হাঁপাচ্ছেও না, টালও খাচ্ছে না। ওতিয়া বোধহয় বুঝতে পেরেছে, আমার কষ্ট হচ্ছে। তাই দেখি, এবার দাঁড়াল। আমার ওপরে ওঠার করসত দেখে খিলখিল করে হেসে উঠল। আমিও ওতিয়ার মতো হাসতে পারলুম না বটে, কিন্তু হাসি শুনতে-শুনতে ওর কাছে পৌঁছে গেলুম। ওতিয়া আমার হাতটা ধরে ফেলল। টানতে-টানতে যেদিকে নিয়ে চলল, সেদিকটা তত উঁচু-নীচু না। কিন্তু এদিকে পাথরের ফাঁকে-ফাঁকে জলের অজস্র ধারা। সেই জলের ধারা ছলকে-ছলকে পাথর ডিঙিয়ে ওইদিকের ঢালুপথে নেমে যাচ্ছে।
এতক্ষণ আমরা পাথর ভেঙে ওপরে উঠেছি। এবার উলটোদিকে নীচে নামব আমরা। আমার হাত ধরে ওতিয়া আমায় জিজ্ঞেস করল, ‘খুব কষ্ট হচ্ছে তো?’
আমি কষ্টটাকে নিজের মধ্যে লুকিয়ে ফেলে বললুম, না-না!’
ওতিয়া আমার হাঁসফাঁসানি দেখে আবার বলল, ‘তবে হাঁপাচ্ছ যে!’
আমি উত্তর দিলুম, ‘অনেকটা উঁচু তো!’
সত্যি, কত উঁচুতে উঠেছি। এখান থেকে নীচের দিকে চাইলে মনে হচ্ছে, জঙ্গলের মস্ত বড়ো গাছগুলো যেন ছোট্ট-ছোট্ট চারাগাছ। পৃথিবীর দেহটা কে যেন সবুজ মখমলে ঢেকে দিয়েছে। এখান থেকে শুনতে পাচ্ছি, জলের একটানা মৃদু শব্দ এখন দুরন্ত হয়ে উঠেছে। দেখতে পাচ্ছি, ঝরনার সবকটা স্রোতের ধারা একই দিকে ছুটে চলেছে। একই সঙ্গে এই ওপর থেকে নীচে প্রচণ্ড বেগে ঝরে পড়ছে। অসংখ্য জলকণা ঠিক যেন কুয়াশার মতো জমাট বেঁধে সেই জলধারার মাথার ওপর ভেসে বেড়াচ্ছে। যতই দেখছি, অবাক হয়ে থমকে যাচ্ছি। ওতিয়া আড়ে-আড়ে আমার দিকে দেখছে, আর হয়তো মনে-মনে বলছে, ‘কী, কেমন লাগছে?’
এর আগে আমি তো আরও কত দেশ ঘুরেছি, না-দেখা কত কী দেখেছি! কিন্তু সত্যি বলতে কী, আমি কখনো জলপ্রপাত দেখিনি! সুতরাং দেখতে-দেখতে অবাক হয়ে যাচ্ছি। ভাবছি, যে-পৃথিবী এত সুন্দর, যে পৃথিবীর বুকে এত আনন্দ, এত জাদু, তার কোলে জন্ম নিয়ে আমরা কেন এত নিষ্ঠুর, নির্দয় আর হিংস্র!
একটা পাথরের ওপর বসে পড়ল ওতিয়া। তার ওই মুখখানি জলের শব্দের মতোই উচ্ছল হয়ে উঠেছে। তারই পাশে আর-একটা বড় পাথরের ওপর বসবার জন্যে সে আমাকে ইশারা করল। বসব কী, ওই কুয়াশার মতো উড়ন্ত জলের বিন্দুগুলি গায়ে মুখে মাথায় চোখে ছড়িয়ে-ছড়িয়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে। ওতিয়ার মুখের ওপর ওই বিন্দুগুলি ছড়িয়ে পড়ে কী সুন্দর দেখতে লাগছে।
আমি বসলুম। ওতিয়া ওই পাথরটার ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে নীচের দিকে চেয়ে রইল। জল পড়ছে অঝোর ধারায়। একটানা তার শব্দ। আর সব নিশ্চুপ, নিস্তব্ধ। এমনকী ওতিয়া। তার সঙ্গে আমিও। এখন চুপ করে থাকার সময়। এখন শুধু দেখার সময়। এই বন, এই পাথর-ঘেরা ঝরনা অথবা জলপ্রপাত। আর সেই জলের বিন্দুভরা কুয়াশার ওপর সূর্যের আলোয় রামধনু-রঙের বাহারি ছটা। চোখ ফেরাবে কে!
আমিও ওতিয়ার মতো হেঁট হয়ে নীচের দিকে চাইলুম। উঃ, কী ভীষণ গভীর! এই ওপর থেকে নীচের ওই গভীরে জলের ধারা লাফিয়ে পড়ে এমন তোলপাড় শুরু করেছে যে, তা দেখতে-দেখতে আমি বিভোর যাই!
হঠাৎ উঠে দাঁড়াল ওতিয়া। আমার গায়ে হাত দিল। আমার চমক ভাঙল। আমিও উঠে পড়েছি। আমার হাত ধরল ওতিয়া। নীচের দিকে নামতে লাগল। কেমন থরেথরে সিঁড়ির মতো পাথরের সারিগুলি সাজানো রয়েছে! দেখলেই মনে হবে, কে যেন খুব যত্ন করে ওই পাথরে পা ফেলে নীচে যাবার পথটি পরিষ্কার করে রেখেছে। লাফিয়ে-লাফিয়ে আমরা নামতে লাগলুম। নীচে নেমে দেখি, ওই জলরাশি যেখানে পড়ছে, সেখান থেকে সামনে জঙ্গলের মধ্যে তার স্রোত বয়ে চলেছে। ওতিয়া আমাকে ওই স্রোতের দিকেই নিয়ে চলল। কী ভয়ংকর সেই স্রোতের তেজ! আমি বলতে পারি, একবার যদি বেসামাল হয়ে সেই স্রোতে কেউ পড়ে যায়, তবে আর তাকে খুঁজে পেতে হচ্ছে না!
ওই স্রোতের তীর ধরে ওতিয়া আর আমি আরও গভীর জঙ্গলে চলেছি। আমি দেখলুম, ওই জলধারা ছুটতে-ছুটতে এখন যেন একটি নদীর রূপ নিয়েছে। আমরা আরও দেখলুম, ওই নদী সামনে অন্ধকার এক গুহার মধ্যে ঢুকে পড়েছে। হয়তো গুহার জমাট অন্ধকারে লুকোচুরি খেলতে-খেলতে ওপাশ দিয়ে ছুটে পালাচ্ছে। ওতিয়ার সঙ্গে আমি ওপাশেই ছুটলুম। এখন আমরা যতই দূরে চলে যাচ্ছি, ততই জলপ্রপাতের শব্দ ধীরে ধীরে অস্পষ্ট হয়ে আসছে। শুধু শোনা যাচ্ছে, এই পাহাড়ি নদীটির জলের বাজনা। গুহার ভেতরে যেন জলের পরিরা নূপুর-পায়ে নাচছে।
আমরা যখন গুহার এপাশ থেকে ওপাশে পৌঁছুলুম, তখন সত্যি কী অদ্ভুত লাগছিল। মনে হচ্ছিল, গুহার মুখ থেকে যেন গলন্ত রুপো ঝলক-ঝলক করে বেরিয়ে আসছে। গাছের পাতায় হাওয়ার ঢেউ, জলের শব্দ, দু-একটি পাখির ডাক, আমাকে কেমন আনমনা করে দিল। আমি ব্যানডুররিয়াটা হাতে নিলুম। তারে-তারে সুর বেঁধে বাজাতে শুরু করলুম। সেই গানটা বাজাতে এখন আমার ভালো লাগছে। ভয়ংকর সেই রাতে যেদিন মা আমার শেষবারের মতো যে-গানটি গেয়েছিল। আর আমি যেদিন প্রথমবার মায়ের সুরে সুর মিলিয়ে ব্যানডুররিয়া বাজিয়ে সবাইকে চমকে দিয়েছিলুম। এই নির্জন জঙ্গলে, এই পাহাড়ি নদীর সামনে দাঁড়িয়ে সেই সুর বাজাতে-বাজাতে আমার চোখ ছলছলিয়ে উঠল। দেখে ফেলল ওতিয়া। কী ভাবল আমি জানি না। জানি না, এখন আমার এই বাজনার শব্দ তার শুনতে ভালো লাগছে কি না! এখন হয়তো অবাক হয়ে ওতিয়া ভাবছে, এত আনন্দেও আমি কাঁদছি কেন! ও কি বুঝতে পারে আমার মনের কথা? হয়তো পারে। নইলে, ধীর পায়ে এগিয়ে এসে আমার সামনে দাঁড়ায় কেন সে? আমার যে-হাতটি বাজনার সুর তুলছে, সেই হাতটি ছুঁয়ে থামিয়ে দিল। তারপর নরম-সুরে জিজ্ঞেস করল, ‘ভালো লাগছে না ইসতাসি?’
আমি তাড়াতাড়ি নিজের চোখের জল সামলে নিয়ে বললুম, ‘না না। খুব ভালো লাগছে।’
‘তবে কাঁদছ?’
‘কই না।’
বুঝতে পেরেছি। মাকে আর বাবাকে মনে পড়ছে বুঝি?’
আমি চুপ করে রইলুম।
ওতিয়া বলল, ‘তুমি এত সুন্দর বাজনা বাজাও।’
‘তুমিও তো খুব সুন্দর গান গাও।’
ওতিয়া যেন লজ্জা পেল। লজ্জা পেয়ে ওতিয়া যখন মুখখানি নিচু করে নেয়, তখন এত ভালো লাগে দেখতে! এখন যেন আরও ভালো লাগল। আকাশ থেকে সূর্যের ঝকঝকে আলোর মুক্তাগুলি ওর চোখে-মুখে ছড়িয়ে পড়েছে। কী সুন্দর দেখতে লাগছে। আমি মনের দুঃখটা মনের ভেতর চেপে রেখে ওতিয়ার কাছে এগিয়ে গিয়ে বললুম, ‘ওতিয়া, তুমি একটা গান গাইবে? আমি বাজনা বাজাব।
ওতিয়া আমার মুখের দিকে চাইল।
আমি আবার বললুম, ‘গাও!’।
ওতিয়া ছুটে পালিয়ে গেল। ওতিয়া পাথরের গায়ে লাফাতে-লাফাতে মস্ত একটা পাথরের আড়ালে হারিয়ে গেল। তারপর দেখতে পেলুম, পাথরের গায়ে যে সবুজ গাছটা নদীর দিকে মুখ হেঁট করে দাঁড়িয়ে আছে, সেখান থেকে উঁকি মারল ওতিয়া। আমি না-দেখার ভান করলুম। ওতিয়া আমার নাম ধরে ডাকল, ই-স-তা সি।’
আমি মুখে সাড়া না দিয়ে আমার ব্যানডুররিয়ার সুরে বাজিয়ে দিলুম, ‘ও-তি-য়া।’
ওতিয়া হেসে উঠল। তারপর গেয়ে উঠল। গাইতে-গাইতে ওই পাথরের আড়াল থেকে আর-এক পাথরের ওপর লাফিয়ে পড়ল। তারপর এই পাথর থেকে ওই পাথর, সেখান থেকে আর-এক পাথর, লাফিয়ে নেচে গাইতে লাগল। আমি বাজাতে লাগলুম।
তুমি যদি তখন সেই দৃশ্য দেখতে, তোমার সাধ্যি ছিল না, চোখ ফেরাও। ওতিয়া এমন মজা করে গান গাইছিল! তেমনি মজার কথায়-ভরা সেই গান। আমার তো হাসতে-হাসতে পেটে খিল লেগে যাবার গোত্তর! আমি জানি না, সে সময় তুমি ওতিয়ার সামনে থাকলে কী করতে! কে জানে, তোমার হাসি পেত কি না! কিন্তু এখন হাসি পাক চাই না-পাক ওতিয়ার সেই গানের কথাগুলো শুনতে তো কোনো দোষ নেই। সেই গান অনেকটা এমনি
এক্ষুনি যদি এক ভাল্লুক,
রেগে বলে, এই দ্যাখ হাঁচছি,
তারপর পায়ে দিয়ে বুট-শ্য
ধিন-ধিন নেচে বলে নাচছি!
তখন কী মজা হয় বলো তো?
এক্ষুনি যদি এক নেকড়ে,
কেঁদে বলে, পেটে ব্যথা মরছি,
ওরে বাপ দে-না ডাক বদ্যির
মাথা খুঁড়ে তোকে গড় করছি।
তখন কী মজা হয় বলো তো?
এই যে গানটা শুনলে, এটা আমি ওতিয়ার গলায় শুনে মোটামুটি একটা মানে দাঁড় করিয়েছি। দেখছ, গানের এক জায়গায় আছে, ‘পায়ে দিয়ে বুট-শ্য’। আসলে, ওতিয়ার গানে ‘বুট-শ্য’ কথাটা ছিল না। ছিল অন্য আর-একটা শব্দ। সেই শব্দটার মানে করতে না-পেরে অগত্যা ‘বুট-শ্য’ কথাটা আমিই জুড়ে দিয়েছি। অবিশ্যি মানের যে খুব একটা গোলমাল করে ফেলেছি, তা মোটেই ভেবো না যেন!
গানটা গাইতে গাইতে ওতিয়া যেন কী দেখে হঠাৎ থমকে গেছল। আমিও ওর মুখের দিকে চেয়ে হকচকিয়ে গেছি। ওতিয়ার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ছিলুম বলে, আমি ঠিক বুঝতে পারিনি, আমার পেছনে কী দেখে, ওতিয়ার মুখখানা এমন ভয়ে কুঁচকে গেল! আমি নিজে পেছন ফিরে দেখার আগেই ওতিয়া চিৎকার করে উঠেছে, ইসতাসি!’
আমি চোখের পলকে পিছনে তাকিয়েছি। তাকিয়ে ভয়ে আঁতকে উঠেছি আমি! আমার পেছনে একটা দাঁতালো শুয়োর! কী বিচ্ছিরি আর কিম্ভুতকিমাকার দেখতে শুয়োরটাকে! কুতকুতে চোখ দুটো পিটপিটিয়ে দেখছে আমাদের। আমি কী করব, ভাবতে না ভাবতেই দেখি, শুয়োরটা তার বিটকেল মুখটা উঁচিয়ে, দাঁত খিঁচিয়ে আমার দিকে তেড়ে আসছে। আমি পালাতে যাব, এমন সময় ওতিয়া ঝট করে এগিয়ে এসে আমায় আড়াল করে দাঁড়িয়ে পড়ল। ধনুকটা কাঁধ থেকে নামিয়ে তির জুতল। বুনো শুয়োরটাকে তাক করল। আমি নিশ্চিত জানি, সেই সময় বুনো শুয়োরের সামনে পড়লে, আমার মতো তুমিও প্রাণের ভয়ে কাঁপতে। কারণ, তার চেহারাটা সত্যিই এমন বীভৎস আর ভয়ংকর যে, আচমকা দেখলে যে-কোনো মানুষের বুদ্ধি-বিবেচনা সব কোথায় উবে যাবে! কিন্তু আশ্চর্য, ওতিয়া ভয় পেল না। বুনো শুয়োরটা তার নাকের পাশে বাঁকানো খড়গ দুটো খাড়া উঁচিয়ে তীব্র গতিতে ছুটে আসছে। ওতিয়া মুখে একটা প্রচণ্ড আওয়াজ করল। সে আওয়াজে ছিল একটা ভীষণরকমের ধমক। কিন্তু সেই জন্তু শোনেনি ওতিয়ার ধমক। সে তেড়ে এসেছিল। ওতিয়া চেঁচিয়ে উঠে আমাকে বলেছিল, ‘ভয় পেয়ো না ইসতাসি।’ বলেই তির ছুঁড়ে দিয়েছিল সেই বুনো শুয়োরের কপালের মাঝখানে। আমি জানতুম, ওতিয়ার তিরে ছিল বিষ মাখানো। তির কপালে বিধে যেতেই সেই বুনো শুয়োর প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে লাফিয়ে পড়ল আমাদের সামনে। ওতিয়া চিৎকার করে উঠল, ইসতাসি ছুট দাও!’ বলে ওতিয়া নিজেই আমার হাত ধরে সেই পাথরের ওপর ছুটতে লাগল। আমার তো অত অভ্যেস নেই। তবু প্রাণের ভয়ে পড়ি-মরি ছুটতে লাগলুম।
বেশ খানিকটা ছুটে এসেছি। পিছনে ফিরে দেখি, শুয়োরটা ছুটছে না। একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়ে লাফাচ্ছে। যন্ত্রণায়। তার কপাল দিয়ে রক্তের বান বয়ে যাচ্ছে। আমি দূর থেকে স্পষ্ট দেখতে পেলুম, তার বুকটা হাঁসফাঁস করছে। হাঁপাচ্ছে সে। মনে হল, বিষের তেজ ওর রক্তে মিশে ওকে কাবু করে ফেলেছে।
সত্যিই তাই। সেই বুনো শুয়োরটা লাফাতে-লাফাতে কেমন ধীরে ধীরে ঝিমিয়ে পড়ছে। দেখতে পেলুম, যেখানে সেটা লাফাচ্ছিল, সেইখানেই মুখ গুজড়ে পড়ে গেল। পড়ে মুখে কীরকম একটা শব্দ করতে-করতে নির্জীব হয়ে গেল। ওতিয়া হেসে উঠল হাততালি দিয়ে। ওতিয়ার মুখে হাসি দেখে আমিও হেসে উঠলুম।
ওতিয়া বলল, ‘খতম হয়ে গেছে।’ বলেই ছুটে গেল সেখানে। আমিও ছুটলুম। জয়ের আনন্দে ওতিয়ার মুখখানা খুশিতে যতটা উছলে উঠছে, বুকখানা গর্বে ফুলে উঠছে তারও বেশি! আমি কাছে গিয়ে দেখলুম, সেটা তখনও ধুকছে। আমি জানি, এখনই ওর বুকের ধুকপুকুনি থেমে যাবে। বাছাধনের সময় হয়ে আসছে।
ওতিয়া হাতের ধনুকটা পাশে রেখে আমাকে বলল, ইসতাসি, এসো, শুকনো কাঠপাতাগুলো ওর গায়ের ওপর বিছিয়ে দিই।’ বলে এ-ধার ওধার থেকে চটপট করে শুকনো কাঠপাতা কুড়তে থাকল। আমিও হাত লাগালুম। যদিও বুঝতে পারছি, এই শুকনো গাছপালা আর পাতা ছড়িয়ে ওর গায়ে আগুন লাগিয়ে দেবে, কিন্তু বুঝে উঠতে পারছি না ওতিয়া এখানে আগুন পাবে কোথায়! তাই জিজ্ঞেস করে ফেললুম, ‘শুধু-মুধু ওর গায়ে এগুলো চাপিয়ে কী করবে ওতিয়া?
‘দাহ করব।’
‘আগুন?’
‘দেখো-না।’
দেখতে বেশিক্ষণ হল না। সামনে থেকে দুটো পাথর কুড়িয়ে নিয়ে এল ওতিয়া। অবাক হয়ে দেখলুম, সেই পাথর দুটো তার ছোট্ট দুটি হাত দিয়ে ঠুকতে লাগল। আগুনের চকমকি ছড়িয়ে পড়ছে। সত্যিই, হঠাৎ সেই চকমকির ফুলকি ছিটকে ঝরাপাতায় ঝপ করে আগুন ধরে গেল। তারপরই দাউদাউ করে জ্বলে ধোঁয়ায় ভরে গেল চত্বরটা। খুশিতে চিৎকার করে উঠল ওতিয়া!
আমি এখন সত্যিই অবাক হয়ে যাচ্ছি, ওই একটা ছোট্ট মেয়ে ওতিয়ার অমন দুর্দান্ত সাহস আর বুদ্ধি দেখে! জঙ্গলের মানুষ যারা, তাদের বুঝি এমনিই সাহসী হতে হয়! হ্যাঁ, সারাজীবনই তো বিপদ মাথায় নিয়ে বেঁচে থাকতে হয় তাদের। মনে সাহস আর বুকে তেজ না থাকলে উঠতে-বসতে মরতে হবে না!
ধোঁয়া উড়ছে, আগুনও জ্বলছে। এরই মধ্যে শুয়োরের পোড়া মাংসের গন্ধ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। আমি জানি, একটু পরেই মাংসটা বেশ কিছু ঝলসে গেলে, ওতিয়া ওই শুয়োরটার ঘাড় থেকে খানিকটা পোড়া মাংস ছিঁড়ে এনে আমায় দেবে। নিজেও নেবে। তারপর সেই আগুনে ঝলসানো মাংস মুখে দিয়ে আঃ, উঃ করবে। করতে-করতে কত কথাই না কইবে!
কিন্তু তা হল না। হল যা, তা আর এক ভয়ংকর কাণ্ড! একটা ভয়াবহ বিপদ যে ওই ধোঁয়ার আড়ালে এতক্ষণ ওত পেতে বসে আছে, আমরা তা একেবারেই টের পাইনি! কিন্তু আশ্চর্য মেয়ে ওতিয়া! ও যেন হাওয়ার স্পর্শ পেলে বলে দিতে পারে, কোথায় বিপদ উঁকি মারছে। কী সতর্ক দৃষ্টি ওতিয়ার চোখে! অথচ আমি? বুঝতেই পারি না কিছু! ওতিয়া যখন প্রায় লাফিয়ে উঠে ছোঁ মেরে সেই ধনুকটা আবার মাটি থেকে তুলে নিল, তখনই আমার টনক নড়ল। চোখের পলকে তার পিঠে বাঁধা তূণ থেকে একটা তির টেনে নিল সে। ছিলায় আটকে চেঁচিয়ে উঠল, ‘ইসতাসি সাবধান!
আমার বুকটা ধক করে আঁতকে উঠেছে। সত্যি বলছি, আমি এতক্ষণ মরা শুয়োরটার পোড়া গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে মনে-মনে ভাবছিলুম, মাংসটা দারুণ জমবে! মিথ্যে বলব না, নোলায় দু-এক ফোঁটা জলও উঁকি-ঝুঁকি দিচ্ছিল। কিন্তু ওতিয়ার অমন চিৎকার শুনে নোলার জল নোলায় শুকিয়ে গেছে! পিছন ফিরে দেখি, ওতিয়া যেদিকে তির উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে, সেদিকের ঘন জঙ্গলের আড়ালে কমসেকম দশ-পনেরোটা বুনো শুয়োর দাঁত খিঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রেগে তাদের ল্যাজগুলো সব খাড়া! তাক করে আছে আমাদের দিকে। বুঝতে বাকি রইল না, এবার ওরা একসঙ্গে আমাদের আক্রমণ করবে।
ওতিয়া হেঁকে উঠল, ‘ইসতাসি, শিগগির আমার পেছনে চলে এসো।’
আমি দেখেশুনে এমনই ঘাবড়ে গেছি যে, ওতিয়ার কথা যেন আমার কানেই ঢুকল না। ভয়ে আমার পা নড়ছে না। তখন ওই একটা শুয়োরের বিদঘুটে মূর্তি দেখেই আমার কালঘাম ছুটে গেছল। এখন একসঙ্গে অতগুলো। একবার যদি খড়গ দিয়ে পেটের ভেতর ঢু লাগায়, তবে যে কী হবে, সে-কথা তোমাদের না বললেও চলবে।
হয়তো ওদের ভাবগতিক দেখে ওদের যে কী মতলব ওতিয়ার বুঝে নিতে একচুল দেরি হয়নি। শুয়োরগুলো আমাদের আক্রমণ করার আগেই ওতিয়া নিজেই তেড়ে গেল। আমি থতমত খেয়ে গেছি। আর্তনাদ করে ডাক দিয়েছি, ‘ওতিয়া!’।
ওতিয়া দৃঢ় গলায় সাড়া দিল, ‘ভয় নেই ইসতাসি। তুমি এসো না। ওইখানেই দাঁড়িয়ে থাকো! শত্রু আক্রমণ করার আগে, তাকেই ঘায়েল করতে হবে।’
ওতিয়া আরও এগিয়ে গেল। এগিয়ে গেল, একেবারে শুয়োরগুলোর মুখোমুখি। ভয়ে আমার গায়ের নোম খাড়া! কী দুর্দান্ত সাহস ওতিয়ার!
কিন্তু তার চেয়েও আর এক দুঃসাহসী দৃশ্য আমার জন্যে অপেক্ষা করছিল। দেখলুম, ওতিয়া সাঁই-ই-ই করে একটা তির ছুঁড়ে দিল শুয়োরের দঙ্গলে। একটার পিঠে গিয়ে প্যাঁট করে বিধে গেল সেই তির। বাছাধন কাত। বলব কী, তাই দেখে শুয়োরের পাল ভয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে মার ছুট! আশ্চর্য! ওতিয়া কিন্তু ওদের পালাতে দেখে পিছু হটে এল না। আমি দেখলুম শুয়োরগুলোকে তাড়া করতে-করতে ওতিয়া জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়ছে। শুনতে পেলুম, জঙ্গলের মধ্যে ঘোঁত-ঘোঁত শব্দ আর ডালপালা ভেঙে পড়ার মড়মড়ানি! আমি বুঝতে পারলুম, ওতিয়া শুয়োরগুলোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। শেষ না করা পর্যন্ত ছাড়বে না। তোমরাই বলো, এইরকম অবস্থায় আমার কি এখানে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা সাজে? কে বলতে পারে কোথা থেকে বিপদ আসে! আমার এখনই উচিত ওর সাহায্যে এগিয়ে যাওয়া। বিপদ হোক! হলে দুজনারই হবে। তবু তো কেউ বলতে পারবে না, একটা ছোট্ট মেয়েকে মরণের মুখে ঠেলে দিয়ে আমি এখানে লুকিয়ে বসে স্বার্থপরের মতো গা বাঁচাচ্ছি!
আর মুহূর্তের জন্যেও অপেক্ষা করলুম না। থাক-না ব্যানডুররিয়াটা হাতে। আমি বাজনা নিয়েই চেঁচিয়ে উঠলুম, ‘ওতিয়া, দাঁড়াও, আমি আসছি।’ বলতে-বলতে ছুট দিলুম।
কিন্তু ওতিয়ার সাড়া পেলুম না। এমনকী, এতক্ষণ চারিদিকে ডালপালা ভাঙার যে-সব পটাং-পটাস শব্দ শুনতে পাচ্ছিলুম, সেই শব্দও আর শুনছি না। হঠাৎ কেমন যেন সব নিথর, নিশ্চুপ হয়ে গেল। তবু আমি ছুটে গেলুম। ছুটতে-ছুটতে ডাক দিলুম, ‘ওতিয়া!’
সাড়া পেলুম না।
এবার আমি আমার গলায় যত জোর ছিল, প্রাণপনে তত জোরে চিৎকার করে উঠলুম, ‘ওতিয়া, তুমি কোথায়?’
এবারও সাড়া পেলুম না।
জলপ্রপাতের ক্ষীণ শব্দ, সেই শব্দের ফাঁকে-ফাঁকে জঙ্গলের একটা অদ্ভুত নির্জনতা আমাকে কেমন যেন অসহায় করে দিল। মাথায় আসছে না, কী করি! যদিও আমি এখন এই জঙ্গলেরই মানুষ, তবু তার সব রহস্য তো আমার এখনও জানা হয়নি। হয়তো জঙ্গলের সব রহস্য কেউ কোনোদিন জানতে পারে না। হলেই-বা ওতিয়া এই জঙ্গলেরই একজন। সে-ও যে এই ছোট্ট বেলায় সবকিছু জেনে ফেলেছে, এ আমি কেমন করে বিশ্বাস করতে পারি। কে জানে, ওই জন্তুগুলো হয়তো ওই ছোট্ট মেয়েটাকে রহস্যের জালে জড়িয়ে ফেলেছে এতক্ষণে। হয়তো ওতিয়া বাইরে বেরিয়ে আসার পথ হারিয়ে ফেলেছে। এ-কথা ভাবতে ভাবতে আমার মন ভীষণ ছটফট করে উঠল। আমার কী যে হল, আমিও ওতিয়াকে ডাকতে-ডাকতেই জঙ্গলের গভীরে ঢুকে পড়লুম। কখনো জোরে, কখনো অস্পষ্ট স্বরে ডাকতে লাগলুম, ‘ওতিয়া, ওতিয়া।’ তার দেখা পাওয়া দুরে থাক, সাড়া পর্যন্ত পেলুম না। এ যেন ভোজবাজি! চোখের পলকে হারিয়ে গেল! নাকি, শুয়োরগুলো তাকে আক্রমণ করেছে! তাহলে চিহ্ন তো থাকবে! কোথায়, তেমন তো কোনো চিহ্ন দেখতে পাচ্ছি না!
আমি আবার ছুটলুম পিছনদিকে। কিন্তু এ যে আবার আর এক সর্বনাশের কাণ্ড ঘটে গেছে। আমার অজান্তেই আমি নিজেই হারিয়ে গেছি! হারিয়ে ফেলেছি আমার পথ এই জঙ্গলের গোলকধাঁধায়। খেয়ালই করতে পারছি না, কোন পথ দিয়ে এখানে এসেছি! একবার এদিক, একবার ওদিক ছোটাছুটি করতে-করতে মাথা গোলমাল হয়ে গেল। ভীষণ ঘাবড়ে গেলুম। ঠিক-ঠিক চিন্তা করার শক্তি পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেছি। অবশেষে চিৎকার শুরু করে দিলুম, ‘ওতিয়া, আমায় বাঁচাও, আমায় বাঁচাও।’ চেঁচাতে-চেঁচাতে ঝোপ-জঙ্গল টপকাতে লাগলুম। জঙ্গলের চক্করে চরকি খেতে-খেতে দম শেষ হয়ে যাচ্ছে। হাত-পা অবশ হয়ে আসছে। আমি বোধ হয় এক্ষুনি মুখ থুবড়ে পড়ে যাব! আঃ! ভারি তেষ্টা পাচ্ছে! গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। আমার কি মরণের সময় ঘনিয়ে আসছে। আমি আর থাকতে পারলুম না। ঠোক্কর খেলুম। ছিটকে পড়লুম। বুঝতে পারলুম, প্রচণ্ড লেগেছে। কিন্তু তারপর সব যেন কেমন হয়ে গেল। আমি যেন আমাকে আর ধরে রাখতে পারছি না। আমি হারিয়ে যাচ্ছি। আর সত্যিই আমার জ্ঞান হারিয়ে গেল। আমি পড়ে রইলুম এইখানে। যেখানে পড়ে থাকলে আমি মরে গেলেও কেউ কোনোদিন জানতে পারবে না।
.
আমার আবার জ্ঞান ফিরে এসেছিল হঠাৎ-ই। কতক্ষণ পড়েছিলুম, তা আমার খেয়াল থাকার কথা নয়। হয়তো হবে অনেকক্ষণ। অবাক লাগছে, এতক্ষণ পড়েছিলুম, অথচ এখনও আমি বেঁচে আছি! বাঘে তো খেতে পারত! কিংবা অন্য কোনো হিংস্র-জন্তু! বলতেই হবে, এ আমার ভাগ্য!
কিন্তু ওতিয়া! ওতিয়া কোথায়? ওতিয়ার কথা মনে পড়তেই ছ্যাঁক করে উঠল আমার বুকটা। আমি চকিতে উঠে দাঁড়ালুম! সত্যিই তো, কোথায় গেল মেয়েটা! আমি ব্যস্ত-পায়ে ঘুরে দাঁড়ালুম। মুখ ফেরালুম। ওতিয়া নেই। কিন্তু আমার চোখের সামনে ওটা কী দাঁড়িয়ে আছে।