আবু ও দস্যু-সর্দার – ১

আবু ও দস্যু-সর্দার – শৈলেন ঘোষ

একদিন আমার মা আমার চিবুক ছুঁয়ে আদর করতে-করতে আমার বাবাকে বলছিল, ‘দেখো, দেখো, আবু আমার কত বড়ো হয়ে গেছে!

বাবা আমার মুখের দিকে চেয়ে হো-হো করে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে বলল, ‘হ্যাঁ, তাই তো! দেখতে-দেখতে সত্যিই কত বড়ো হয়ে গেছে আবু। আর কদিন পরে পাশার পিঠে চেপে আবুও আমার মতো কাজে বেরোবে।’

সে-কথা শুনে, সত্যি বলছি, আমি আনন্দে শিউরে উঠেছিলুম। কেননা, আমি যে এই স্বপ্নই দেখি। স্বপ্ন দেখি, দিনে-রাতে, ওই বালির সমুদ্র যেন আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকছে। এ-সমুদ্রের শেষ নেই। বালি, বালি, যেদিকে চাইবে, দেখবে শুধু বালি। ওই দূরে, অনেক দূরে, আকাশ যেখানে পৃথিবীর বুকে নেমে এসেছে, সেখানে এই সমুদ্রও হারিয়ে গেছে। সূর্যের কিরণে এ-সমুদ্র জ্বলন্ত আগুন। মন বলে, বারবার বলে, পাশার পিঠে চেপে আমিও হারিয়ে যাই ওই জ্বলন্ত আগুনের মধ্যে।

হ্যাঁ, এখন আমি সত্যিই বড়ো হয়েছি। জানি না, তোমার চেয়ে বড়ো কি না। তবে এখন আমি জানি, এই যে রাশি-রাশি বালির রাজত্ব, এই যে ধু-ধু মরুভূমি, এইখানেই আমার দেশ। আমি জানি, ওই যে লম্বা-চওড়া রোদে-পোড়া মানুষগুলি, যারা দুঃখ আর কষ্টের সঙ্গে লড়াই করে প্রতিদিন উঠের পিঠে চেপে নানান কাজে ওই সমুদ্রে পাড়ি দেয়, তারা আমার দেশের মানুষ। এই মানুষেরা কেউ আপন, কেউ পর। কেউ দূরের, কেউ কাছের।

তুমি হয়তো ভাবছ পাশা কে!

পাশা আমাদের উট।

আমি বড়ো হয়েছি বলে এখন আমি পাশার পিঠে চেপে রাশি-রাশি বালির ওপর দিয়ে খানিকটা বেড়িয়ে আসতে পারি। এখন পাশার পিঠে বসে, পড়ন্ত সূর্যের সামনে দাঁড়িয়ে আমার দেখতে ভালো লাগে বালির ওপর রক্ত-আলোর দোলন। এখন আমি জানি, মাথার পাগড়িটা কেমন করে মুখে-নাকে জড়িয়ে নিলে সূর্যের ঝলসানো আগুনে আমার কিচ্ছু হবে না। এই সূর্য, এই বালি, এই আকাশ, সব আমার চেনা। আমার আপনার। ওই যেখানে একটুখানি জায়গা ঘিরে খেজুর-গাছের ছায়ারা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে, ওই ছায়ার নীচে আমাদের ঘর। তুমি আমাদের ঘরটা যদি একটু দূর থেকে দেখ, তোমার মনে হবে, যেন একটি চৌকো-মতো খেলনার বাক্স। এরকম ঘর পর-পর তোমার আরও নজরে পড়বে। তবে যারা বড়োলোক, যাদের পাঁচ-দশটা উট আছে, তাদের ঘরগুলো সব ভেড়ার চামড়া দিয়ে তৈরি। ভারি সুন্দর দেখতে।

শুনি তোমরা খুব সুখে আছ। আমাদের মতো তোমাদের কোনো কষ্টই নেই। আমি শুনেছি, তোমাদের মাঠ ভরতি সবুজ গাছগাছালি। শুনেছি, সে-গাছে ফুলে-ফলে ছড়াছড়ি। কত নদী-নালা। বর্ষার দিনে মেঘে মেঘে আকাশ ছেয়ে যায়। ঝমঝমিয়ে বিষ্টি নামে। মাঠ-ঘাট সব জলে-জলে থই থই! অবাক হয়ে যাই একথা শুনে। কেননা, এখানে এসব কিছু নেই। তবে হ্যাঁ আমি কী আর বলছি এখানে বিষ্টি হয় না। হয়, এখানে হঠাৎ যেমন আকাশ ভেঙে বিষ্টি নামে, তেমনি আবার হঠাৎ-ই থামে। হলে কী হবে। মরুর এই আগুনের রাজ্যে আকাশের ওই জলটুকু কিছু কাজে লাগে না। রাক্ষুসে বালি যেন তেষ্টায় হাঁ করে পুঁকছে! জল একবার পড়লে হয়। নিমেষের মধ্যে ঢকঢক করে গিলে খেয়ে ফেলবে! তাই দেখে ভাবি, মরুর তেষ্টা বুঝি কোনোদিন মেটে না। মিটবেও না।

কিন্তু আমার সবচেয়ে অবাক লাগে পাশার কথা ভেবে। আমি দেখেছি, পাঁচ-পাঁচটা দিন এক ফোঁটা জল মুখে না দিয়েও দিব্যি আছে! পিঠে ভারী-ভারী মাল-পত্তর নিয়ে, দিনের পর দিন ওই বালির ওপর দিয়ে হেঁটে চলেছে। তবু তেষ্টা নেই! অথচ আমাদের? জল না হলে আর রক্ষে আছে! কী ছটফটানি!

রক্ষে, আমাদের ঘর থেকে দু-পা এগোলেই জলের উঁদারা। তোমাদের যেমন পাতকুয়ো, তেমনি। এখানে এই একটিই ইঁদারা। তারপর তুমি মাইলের পর মাইল খুঁজে বেড়াও, একটু জল পাবে না। আমি দেখি রোজ কত মানুষ এখানে আসে। কত দূর-দূরান্ত থেকে। সঙ্গে সারি-সারি উট। তাদের পিঠে কত কী জিনিসপত্তর। এই মরুর সীমানা পেরিয়ে বাণিজ্য করতে চলেছে। একটু জলের জন্যে ওরা এখানে থামবে। তাঁবু ফেলবে। বিশ্রাম নেবে। তারপর আবার চলো। চলো ওই মরুর জাহাজে চড়ে। জাহাজ? অবাক হলে? জানো না বুঝি আমরা উটকে বলি জাহাজ? ওই যে উট, দেখো না কেমন চলেছে দলে-দলে সার বেঁধে দুলতে-দুলতে ওই বালির সমুদ্রের ওপর দিয়ে!

আমার বাবাও এই কাজ করে। পাশার পিঠে বেঁধে নিয়ে যায় কত দামি-দামি সওদা। সার বেঁধে চলে বালির ওপর দিয়ে। মাথার ওপর সূর্য। কী অসহ্য তার তেজ। শরীর যেন জ্বলে-পুড়ে খাক হয়ে যায়। তবু থামলে চলবে না। একটু ছায়ায় যে জিরিয়ে নেবে, সেই ছায়াই বা কই এই শূন্য মরুভূমিতে! যেদিকে চাইবে, খালি বালির ঢেউ আর ভয়ংকর নিস্তব্ধতা! ওই নিস্তব্ধতা ভেঙে শুধু চলেছে ওরাই, ওই বোবা উটের দল। বালির ওপর ওদের পায়ের শব্দ ভারি নরম, ভারি অস্পষ্ট।

আমার বাবার পোশাকটা দেখলে তোমার ভালো লাগবে কি না জানি না। একদম পায়ের নীচ অবধি একটা লম্বা জামা। সেই জামা কোনোটা নীল, কোনোটা সাদা। কোমরে আঁটসাঁট বাঁধা একটা শক্ত কাপড়ের বেল্ট। সেই বেল্টে গোঁজা একটা ঝকঝকে ছোরা। কোমরের বাঁ পাশে তরোয়াল ঝোলানো। মাথায় পাগড়ি আর পায়ে চপ্পল।

আমার পোশাকও এমনি। তবে, আমার একটা এত সুন্দর নীল ডোরাকাটা জামা আছে যে, দেখলেই তোমার ভালো লাগবে। তোমার ইচ্ছে হবে এখুনিই গায়ে দাও। আমি মনে-মনে ভাবি আমি যেদিন প্রথম বাবার মতো একা-একা পাশার পিঠে চেপে মরুতে পাড়ি দেব, সেইদিনই ওই জামাটা গায়ে পরব।

আমি জানি তুমি ঠিক ভাবছ, আমার বাবার কোমরে কেনই-বা ছোরা আঁটা আর কেনই-বা তরোয়াল ঝোলানো। এই কথাটা তোমরা জিজ্ঞেস করতেই পারো। কারণ তোমরা তো মরুভূমির মানুষ নও। ধরো, তুমি চলেছ তোমার উটের পিঠে চেপে একা-একা ওই মরুভূমির ওপর দিয়ে নির্জন দুপুরে কিংবা গভীর রাত্রে। হয়তো তোমার সঙ্গে রয়েছে এমন কিছু মূল্যবান ধনরত্ন যেগুলি কালই তোমাকে এই মরুভূমি পেরিয়ে শহরে পৌঁছে দিতে হবে। তুমি চলেছ, তোমার উটের গলায় ছোট্ট একটি ঘন্টা বেজে যায়, টিং-লিং, টিং-লিং। সেই শব্দ মরুভূমির নিস্তব্ধতা ভেঙে যতই বেজেবেজে উঠছে, ততই যেন ওই রাশি-রাশি বালির বুকেও শিহরণ জাগছে।

ঠিক এমনই সময়ে তুমি যদি হঠাৎ দেখতে পাও, দূরে, তোমার চোখের সামনে বালির মেঘ উড়িয়ে একদল ঘোড়সওয়ার ছুটে আসছে! যদি দেখ তাদের চোখে-মুখে কালো কাপড় ঢাকা! তাদের হাতে ঝকঝকে তরোয়াল! তবে তোমার কি বুঝতে বাকি থাকবে যে ওরা এই মরুর দস্যু! ওরা তোমার এই ধনরত্ন লুঠ করবে! তখন বলো, তুমি কী করবে? ভীতুর মতো কাঁপতে-কাঁপতে ওদের হাতে ধনরত্ন তুলে দিয়ে নিজে বাঁচবে? না, তোমার ওই কোমরে-বাঁধা চকচকে ছোরা হাতে নিয়ে মুখোমুখি রুখে দাঁড়াবে?

আমরা মরুর দেশে বাস করি। বুক্ষ মরুভূমি আমাদের সাহসী হতে শিখিয়েছে। শিখিয়েছে বিপদের মুখোমুখি কেমন করে দাঁড়াতে হয়। ওই সূর্যের ঝলসানো আগুন মাথায় নিয়ে আমরা বড়ো হয়েছি। আমরা জানি, কষ্টকে যে জয় করতে পারে সে-ই তো বীর

সত্যি, তুমি আমার বাবাকে দেখলে, একথা বিশ্বাস না করে পারবে না। কী সাহস আমার বাবার! তুমি তরোয়াল নিয়ে লড়াই করতে বলো, বাবা পিছপা হবে না। তুমি তির-ধনুক ছুঁড়তে বললো, চোখের নিমেষে

দূরের লক্ষ্য ভেদ করে দেবে। বাবার কাছে কষ্ট-টষ্ট কিছু না। দিনের পর দিন ওই মরুভূমির ওপর দিয়ে চলেছে বাবা। কত ঝঞ্ঝা, কত বিপদ, কত কালো অন্ধকার মাথার ওপর দিয়ে চলে গেছে। বুক পেতে সব সহ্য করেছে। ভয়? ভয় পেলে চলে! বিপদকে নিয়েই তো আমরা বেঁচে আছি! আর সত্যি বলছি, বিপদ না থাকলে বাঁচার মজাই নেই!

কেমন করে তির-ধনুক ছুঁড়তে হয়, আমিও শিখে ফেলেছি। আমি শিখে ফেলেছি, কেমন করে তরোয়াল ঘোরালে শত্রু আমার ধারেকাছেও ঘেঁষতে পারবে না। ওই সূর্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এখন আমি গান গাইতে পারি। আগুনের গান। আর এই গান, এই আনন্দ, এই হাসি, আর দুঃখ নিয়ে মরুর মানুষ আমরা, আমি, আমার মা, আমার বাবা!এই পৃথিবীতে তোমাদেরই মতো।

আজ ঘুম থেকে উঠে আমি তোমাদের আনন্দের কোনো খবর দিতে পারছি না। ভালো লাগার কোনো কথা আমার মুখে আজ শুনতে পাবে না তুমি। মনটা যেন আপনা থেকে থমকে গেছে। চমকে গেছি আমি এখনও বাবাকে বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখে। মা কেন বসে আছে বাবার মাথার কাছে? আমি দরজা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলুম, ‘কী হয়েছে মা?’

বাবা ভারি কষ্টে হাতটি নেড়ে আমায় কাছে ডাকল।

আমি ছুটে গেলুম, ‘কী হয়েছে বাবা?’ বাবার কপালে আমার হাত রাখলুম। ইশ! বাবার জ্বর! গা যে পুড়ে যাচ্ছে। আমি তো কক্ষনো বাবার জ্বর হতে দেখিনি। হঠাৎ কেন হল!

হঠাৎ-ই। কারণ কালও বাবা সারাদিন ধরে সাত-পাঁচ কত কাজ করেছে। করতেই হয়েছে। কেননা, আজ বাদে কাল বাবাকে শহরে যেতে হবে। শহরে যেতে হবে উট-পাখির পালক নিয়ে। শহর মানে সে কোথায়! এই মরুর বালি ভাঙতে-ভাঙতে সেই শেষ প্রান্তে। যেতে দশদিন, আসতে তদ্দিন। আমি জানি এই পালক যদি ঠিক দিনে না পৌঁছয়, মুখ রক্ষা হবে না বাবার। কেননা, বাবা যে কথা দিয়েছে পালকের সওদাগরকে! এখন কী হবে? যা হোক হবে। আগে তো মানুষের শরীর। তারপর কাজ। কিন্তু সে-কথা শোনার মানুষ নয় আমার বাবা। এই তো এখনও আমি দেখছি কষ্ট হচ্ছে, তবু বাবা হাসছে আমায় দেখে। আমি জিজ্ঞেস করছি, ‘বাবা তোমার কষ্ট হচ্ছে?’

বাবা ঘাড় নাড়ছে। ঘাড় নেড়ে বলছে, ‘আমার কিছু হয়নি। কাল সকালে শহরে যাব আমি।’

আমি বললুম, ‘কাল না-ই বা গেলে। দুদিন পরে একটু ভালো হয়ে তারপরে যাবে।’

বাবা আমার চোখের দিকে চাইল। ধীরে-ধীরে হাতটি আমার মুখের কাছে তুলে, আমার গালের ওপর হাতটি রেখে বলল, ‘আমি যে কথা দিয়েছি আবু।’

‘কিন্তু এই জ্বর-গায়ে তোমার কষ্ট হবে বাবা। তুমি পারবে না।’

 ‘পারব।’ বাবার গলায় কঠিন স্বর

আমি জানি, বাবাকে রাজি করানো কারো সাধ্য নয়। কিন্তু যে মানুষটার অসুখ, তাকে আমরাই বা ছাড়ি কোন সাহসে! না জানি কোন অজানা বিপদ বুঝি এগিয়ে আসে! এই ভয়ে আজ সারাদিন আমি বাবার কাছছাড়া হইনি। বাবার বিছানার পাশটিতে বসে সারাদিন আমি বাবার গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছি। আর নয়তো কপালে হাত রেখে বলেছি, ‘বাবা, পালকগুলো অন্য কাউকে দিয়ে পোঁছে দিলে হয় না?

আমার মুখের কথা শেষ হবার আগেই বাবার ঠোঁট দুটি ভারি কষ্টে কেঁপে উঠল। তারপর বলল, ‘যার কাজ তাকেই যে করতে হয় বাবা। আমার বোঝা অন্যের কাঁধে চাপালে আমি যে শান্তি পাব না।’

আমি আর কিছু বলিনি। এরপর আমার বলারই বা কী আছে! হ্যাঁ, আমি বলতে পারতুম যদি আমি আরও একটু বড়ো হতুম। তখন আমি পাশার পিঠে পালকের বোঝা চাপিয়ে নিজেই পাড়ি দিতুম ওই বালির ওপর। বাবা বিছানায় শুয়ে-শুয়ে শুনত পাশার গলার ঘন্টা বাজছে, আর নয়তো ঘরের ওই জানলাটায় মুখ ঠেকিয়ে দেখত, তার ছেলে বাণিজ্যে চলেছে। দেখত, দূর থেকে দূরে পাশা হেঁটে চলেছে। তার মস্ত উঁচু মাথাটা দুলছে খুশিতে। আমি তার পিঠে বসে দুলতে-দুলতে হারিয়ে যাচ্ছি বালির রাজ্যে। আহা! সত্যি যদি এমন হত! সত্যি-সত্যি যদি আমি ওই আগুনের সমুদ্রে হারিয়ে যেতুম! যদি আমি সত্যি-সত্যি পারতুম ওই উটপাখির পালক পাশার পিঠে বেঁধে শহরে পৌঁছে দিতে!

 কে বলেছে আমি পারি না। কে বলেছে ওই আগুনের সমুদ্রে হারিয়ে যেতে আমার ভয় করে! না, আমি ভয় পাই না। আমি যদি চিৎকার করে বলে উঠি, হ্যাঁ, আমি পারি। যদি বলি, ওই পালকের বোঝা পাশার পিঠে বেঁধে আমি পৌঁছে দিতে পারি শহরে, সেকথা কি শুনবে কেউ? শুনবে আমার মা? আমার বাবা? জানি না। শুধু জানি, আমি তাদের একমাত্র ছেলে। এই একমাত্র ছেলেকে নিয়ে তাদের মনে হয়তো কত স্বপ্ন। হয়তো তারা দেখতে পাচ্ছে, সে-স্বপ্নের মণিমুক্তাগুলি যেন আমার গলায় ঝিকমিকিয়ে উঠছে। হয়তো তাদের স্বপ্নের রাজপুত্তুর হয়ে উঠছি আমি!

না, রাজপুত্তুর হবার ইচ্ছা আমার নেই। আমি চাই না, আমাদের এই চৌকো ঘরখানা আজ, এখনই রাজপ্রাসাদ হয়ে গড়ে উঠুক। আমি যেন আমার মা আর বাবাকে বলতে পারি, ‘আমি যা আছি সেই তো ভালো! তোমাদের ওই হাসি, ওই আদর, এই ভালো, এই মন্দ নিয়ে আমাকে তোমাদের কাছে-কাছে রাখো। মা আর বাবার চেয়ে আমার কাছে কী-ই বা সুন্দর! কে-ই বা বড়ো!’

হ্যাঁ, বাবার কষ্ট দেখে তাই আজ সারাদিন আমি ছটফট করেছি। তবু পারিনি আমার মনের কথা বলতে। পারিনি বলতে, ‘বাবা, এই দেখো, তোমার আবু বড়ো হয়েছে। তোমার আবু পারবে, ঠিক পারবে ওই উটপাখির পালক শহরে পৌঁছে দিতে। তোমার জ্বর হয়েছে বাবা! তুমি কদিন এই ছোট্ট ঘরের ছায়ায় শুয়ে বিশ্রাম নিলে, তোমার ছেলে কি তোমায় দেখবে না? নাকি, সে পারবে না তোমার বোঝা বইতে?’

 কিন্তু কেন একথা আমি বাবাকে বলতে পারিনি। কারণ, একথা শুনলে বাবা যে খুশি হয়ে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরবে না, তা আমি জানি। আমি ঠিক জানি, একথা শুনলেই বাবা বিছানা ছেড়ে উঠে পড়বে। যত কষ্টই হোক পাশার সামনে গিয়ে ওর পিঠের ওপর পালকের বস্তা ঝুলিয়ে হাসতে-হাসতে বলবে, ‘আমি ভালো হয়ে গেছি। আমি চললুম শহরে।’ তখন শত চেষ্টা করেও যে কেউ বাবাকে রুখতে পারবে না!

এই ভয়েই বোবা হয়েছিলুম সারাদিন। ভীষণ কষ্টে মনটা আমার বারবার শিউরে উঠছিল, তবু কাউকে বলতে পারছি না আমার মনের কথা। শেষে, কিছুতেই থাকতে না পেরে আমি ছুটে গেছি পাশার কাছে। বসে ছিল পাশা। ওর পিঠের ওপর লুটিয়ে পড়লুম। আমার দু-হাত দিয়ে ওর গলাটা জড়িয়ে ধরলুম। তারপর জিজ্ঞেস করলুম, ‘পারবি না পাশা, পারবি না আমায় শহরে নিয়ে যেতে? পারবি না ওই পালকের বোঝা শহরে পৌঁছে দিতে?’

পাশা আমার কথা শুনল। কী বুঝল জানি না। ঘাড় হেলিয়ে আমার দিকে চাইল। তারপর ভীষণ জোরে মাথাটা নাড়তে-নাড়তে আমাকে পিঠে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর হাঁটা দিল। ক-পা দূরে খেজুর গাছটার সামনে দাঁড়িয়ে সে মুখ বাড়াল। এক থোকা পাকা খেজুর মুখে ছিঁড়ে এনে আমার দিকে ঘাড় ফেরাল। যেন সে বলতে চাইল, ‘খাও!’ আমি আনন্দে চিৎকার করে লুফে নিলুম সে খেজুর। মুখে দিলুম। সঙ্গে-সঙ্গে পাশা হাঁটল। ফিরল সে ঘরের দিকে। আমার মায়ের মুখের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল পাশা। মা জিজ্ঞেস করল, ‘কী রে?’

বসে পড়ল পাশা। পাশার পিঠ থেকে লাফিয়ে নেমে মায়ের কাছে ছুটে গেলুম। মাকে জড়িয়ে ধরলুম। মায়ের গায়ের চাদরে আমার মুখখানা হারিয়ে গেল।

মা অবাক হল। মা আমার মুখখানা চাদরের আড়াল থেকে সরিয়ে এনে জিজ্ঞেস করল, ‘কী বলছিস?’

আমি বললুম, ‘মা, তুমি তো বলেছ আমি এখন বড়ো হয়ে গেছি!’

 মা বলল, হ্যাঁ, আমার সেই সেদিনের ছোট্ট আবু এখন কত বড়ো!

 ‘তুমি তো জানো মা, এখন আমি তির ছুঁড়তে পারি। তরোয়াল ঘোরাতে পারি।’

‘হ্যাঁ, আবু যে আমার বীর ছেলে।

 ‘তুমি তো দেখেছ মা, একটু-একটু করে এখন কত দূর অবধি পাশার পিঠে চেপে আমি বালির ওপর হাঁটতে পারি!’

মা বলল, ‘এরপর আবু আমার বালি পেরিয়ে শহরে যাবে। শহরে গিয়ে আমার জন্যে রেশমি সুতোর কামিজ আনবে।’

আমি লাফিয়ে উঠলুম। মায়ের হাত দুটি আরও জোরে চেপে ধরে চেঁচিয়ে উঠলুম, ‘আনব, আনব মা, তুমি যা চাইবে তাই-ই আনব। তবে মা শহরে আমায় এখনই যেতে দাও,’ বলে মাকে আবদার করে জড়িয়ে ধরলুম।

মা চমকে উঠল। আমায় আরও কাছে টেনে নিয়ে বলল, ‘এ কী সববনেশে কথা!’ ভয়ে মায়ের গলা কেঁপে উঠল।

আমি বললুম, ‘না মা, সববনাশ নয়! বাবার অসুখ। তুমিই বলো, বাবার কি এখন ওই বালি ভেঙে শহরে যাওয়া ঠিক হবে। আমি যাব। আমি পারব। আমি ওই উটপাখির পালক শহরে পৌঁছে দিয়ে আসব।’

আমার কথা শুনে মায়ের বুকটা কেঁপে উঠছিল কি না আমি জানি না। কিন্তু মায়ের হাত দুটি আমার মাথা ছুঁয়ে অস্থির হয়ে শিউরে উঠছিল। মা কেমন অদ্ভুত চোখে চাইল আমার মুখের দিকে। তারপর মায়ের চোখ দুটি নিমেষে সামনের ওই খেজুর গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে, দূরে ওই সোনা-রং বালির রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ল। মা কথা বলল না

আমি মায়ের চোখ দুটির দিকে তাকিয়ে খুব নরম সুরে জিজ্ঞেস করেছিলুম, ‘যাব না মা?’

 মা আমায় টেনে নিয়েছিল তার কাছে, আরও কাছে। তারপর অস্ফুট স্বরে বলেছিল, ‘যাবি।

ইচ্ছে হল আমি আনন্দে চিৎকার করে উঠি। কিন্তু পারিনি। হঠাৎ আমার নজর পড়ল মায়ের চোখ দুটি যেন ছলছলিয়ে উঠেছে। চোখ দুটিকে লুকিয়ে নিয়ে মা ছুটে গেছল বাবার কাছে। আমি অবাক হয়ে গেলুম! ভাবলুম, মা আমার কাঁদছে কেন! মা কি আমার কথায় দুঃখ পেল!

না, হয়তো ছেলের কথা শুনে মায়ের বুকখানা গর্বে ভরে উঠেছিল। হয়তো মা ভেবেছিল, যাদের এমন ছেলে ঘর আলো করে, তাদের বুঝি দুঃখ থাকে না কোনোদিন।

আমি তো জানি, মা আমার কথা বাবাকে বলবে। বাবা শুনলে, যদি রাজি না হয়! এই কথা ভাবতে ভাবতে সারাদিন আমি ছটফট করেছি। সারাদিন আমার চোখ দুটি মায়ের পিছু-পিছু এ-ঘর ও-ঘর করেছে। আমি ভেবেছি মা কখন আমার কথা বাবাকে বলবে! কখন?

বলেছিল মা। বলেছিল, যখন দিনের আলো ছিল না। রাতের অন্ধকারটা তখন নিঃসাড়ে গুটিগুটি নেমে এসেছিল। নেমে এসেছিল ওই বালির ওপর, ওই খেজুর গাছের ছায়ায়, আমাদের এই ছোট্ট ঘরে। রাত কত গভীর আমি জানি না। শুধু জানি, আজ আর আমার চোখে ঘুম ছুঁই-ছুঁই করছে না। এই যে ঘরের ভেতর ছোট্ট ঘরটা দেখছ, এটা আমার। ঘরের দেওয়ালে ওই যে আঁকাবাঁকা লাইনটানা ছবিটা দেখছ, ওটা আমি এঁকেছি। ছবির আকাশে এক ফালি চাঁদ। কটা তারা। নীচে বালির পাহাড়। এক পাশে তাঁবু। পাশে দুটো উট। ছবিটা কতদিন আগে এঁকেছি, এখনও একটুও আবছা হয়ে যায়নি। তবে, আমার আঁকা এই ছবিটা দেখলে যে তোমরা না-হেসে থাকতে পারবে না, তা আমি জানি। কিন্তু জানো, এখন ওই রাত্রে চুপটি করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওই ছবিটাই আমার এত দেখতে ভালো লাগছিল। দেখতে-দেখতে আমার মনে হচ্ছিল, সত্যি যেন ওই ছবির চাঁদ আলোয় ভরিয়ে দিয়েছে আমার এই ছোট্ট ঘরখানা। মনে হচ্ছিল, ওই ছবির তারারা বুঝি এখন স্পষ্ট হয়ে কোনোদিনই ঝলমলিয়ে ওঠেনি। ভালো লাগছে, হয়তো এই কারণে যে, আজ আমি বলতে পেরেছি, বাবার কাজ আমি মাথা পেতে নিতে পারি। বাবার বয়েস বাড়ছে, এবার বাবা আয়েস করুক। আমি ছেলে। ছেলে যদি বাপ-মাকে না দেখে, কে দেখবে?

কিন্তু জানো, এই মুহূর্তে আমার সমস্ত স্বপ্ন যেন এক ঝটকায় ভেঙে গুঁড়িয়ে তছনছ করে দিল কে! সে কথা বলতে আমার বুকের পাঁজরগুলো দুমড়ে-মুচড়ে উঠছে। সে-কথা আমি কেমন করে বলি তোমাদের! শোনো না, ওই তো বাবাকে আমার কথা বলছে মা। শুনতে পাচ্ছ আমার মায়ের গলা? আমি পাচ্ছি। শোনো শোনো, ওই তো মা বলছে, ‘আবু বলছে তোমার গায়ে জ্বর। এই জ্বর নিয়ে শহরে যাওয়া তোমার ঠিক হবে না। কাজটা যখন খুব দরকারি, উটপাখির পালকগুলো যখন তাড়াতাড়ি পৌঁছে না-দিলেই নয়, তখন, ও বলছিল, তুমি যদি বলো, তবে আবুও পাবে তোমার এই কাজটা করে দিতে।’

মায়ের মুখে ওই কথা শুনে বাবা থমকে গেছল কি না জানি না। কিন্তু কিছুক্ষণের জন্যে সারা ঘরখানা কেমন যেন থমথম করে কাঁপছিল?

প্রচণ্ড উত্তেজনায় আমি কান পেতে আছি। কিন্তু কথা নেই, শব্দ নেই। তবে কি বাবা মায়ের কথার কোনো উত্তর দেবে না? নাকি মায়ের কথা শুনে বাবার শরীর আরও মুষড়ে পড়ল।

না, বাবা কথা বলেছিল। হঠাৎ নিস্তব্ধ ঘরে বাবার গলা কেঁপে উঠেছিল। কাঁপতে-কাঁপতে সেই স্বর মাকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কী বলছ তুমি? এ যে আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। আমার আবু তোমাকে এ-কথা বলেছে! গর্বে যে আমার বুকখানা ফুলে উঠছে। আমার যে চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে, হ্যাঁ, হ্যাঁ আমি আমার আবুকে আমার মতো করে গড়ে তুলতে পেরেছি। হ্যাঁ, আবু আমারই ছেলে।’ বলে বাবা থামল। একটুখানি চুপ। তারপর বাবার গলার স্বর যেন অনেক, অ-নে-ক দিন আগের কোনো এক হারানো দিনে ফিরে গেছে। বাবা জিজ্ঞেস করল মাকে, ‘তোমার সেদিনের কথা মনে আছে?’

মা বলল, ‘সে-কথা কি ভোলার কথা। আমার বোনের বিয়েতে তুমি আর আমি গেছি শহরে, আমাদের বাড়িতে। বিয়ের পর ফিরে আসছি। তখনও মাঝ-বরাবর পথে আমরা। রোদ ঝাঁঝাঁ দুপুর। বালির ওপর বালি। হাওয়া নেই। শুধু গরম হলকা বইছে মরুর ওপর দিয়ে। মাথার পাগড়িটা খুলে ফেলে তুমি মুখে চোখে জড়িয়ে ফেলেছ। আমি তোমার পেছনে পাশার পিঠে বসে আছি। তোমার পিঠের ছায়ায় আমার মুখখানা আড়াল করেছি। আড়াল থেকে দেখছি, আর কত দূর? কোথায় গেলে একটু জল পাব! আর যে পারছি না!’

মায়ের মুখের কথা যেন কেড়ে নিয়ে বাবা বলে উঠল, ‘হ্যাঁ এমন সময়, ঠিক এমনি সময়ে শুনতে পেলুম কান্না।’

হ্যাঁ, হ্যাঁ, কান্না! কে যেন কাঁদছে!’ মা বলে উঠল।

বাবা বলল, ‘এ যে নিতান্ত নরম কচি একটি শিশুর কান্না! আমি নিমেষে পাশার পিঠ থেকে লাফিয়ে পড়লুম। লাফিয়ে ছুটলুম। বালির ওপর ছুটতে-ছুটতে কখনো আমি হুমড়ি খাই। কখনো আমি থমকে দাঁড়াই। চিৎকার করি, কে কাঁদে? কার ছেলে কাঁদে? কাউকে দেখতে পেলুম না। তারপর হঠাৎ আমার নজরে পড়ল, সামনে রক্ত-মাখা একটা তরোয়াল! তারপর দেখলুম বালির ওপর এদিক-ওদিক ছড়ানো-ছেটানো জুতো, জামা, পাগড়ি! তারই পাশে ওই তো শুয়ে-শুয়ে হাত-পা ছুঁড়ে কাঁদছে একটি শিশু! একেবারে এইটুকু। আমি ছুটে গিয়ে তাকে বুকে তুলে নিলুম। তপ্ত বালির ঝাঁপটা লেগে তার মোমের মতো নরম গায়ে ফোঁসকা পড়ে গেছে। আমি ছুটে এসে তোমার কোলে তাকে তুলে দিলুম।’

বলতে-বলতে বাবা থামল। বাবার কথার রেশ টেনে মা এবার বলল, ‘হ্যাঁ, তাকে আমি বুকে তুলে নিলুম। আহা রে! তার সারা গায়ে চোখে-মুখে বালি। চোখ দুটি চাইতে তার যেন কত কষ্ট হচ্ছে! যেন এতক্ষণ বালিতে ডুবে-ডুবে সে হাবুডুবু খাচ্ছিল। আমি আমার ওড়না দিয়ে ভারি আলতো করে ওকে জড়িয়ে নিলুম। তখনও কাঁদছে! তুমি ছুটলে ওর মাকে খুঁজতে!’

বাবার গলায় এবার ক্লান্ত স্বর। বাবা বলল, ‘ওর মাকে আমি খুঁজলুম। সেই শূন্য মরুভূমির এ-প্রান্ত ও প্রান্তে আমি দিগবিদিক জ্ঞান হারিয়ে ছুটেছি। ওর মাকে আমি দেখতে পাইনি। দেখতে পেয়েছিলাম সেই রক্তমাখা তরোয়ালটা। তুলে এনেছিলুম সেটা। ভারি ক্লান্ত তখন আমি। তোমার কাছে যখন ফিরে এসেছিলুম, তখন তোমার কোলে ও ঘুমিয়ে পড়েছে। যেন সূর্যের আলোয় নিস্তেজ একটি ফুলের মতো তার মুখখানি। আঃ! তোমার কোলে যেন ছড়িয়ে আছে সেই ফুলের রং-ছোঁয়া পাপড়িগুলি! আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছিলুম, ‘এখন কী করবে?’ তুমি বলেছিলে, ‘এখানে তো করার কিছু নেই। এ যে নির্জন মরুভূমি। চলো ফিরে যাই।’ আমরা ফিরে এসেছিলুম। কিন্তু কেউ ফিরিয়ে নিতে এল না আমাদের কুড়িয়ে-পাওয়া ছেলেকে। তাকে আমরা বুকে নিয়ে বড়ো করেছি। তাকে রোদের সঙ্গে রোদ হয়ে, বালির সঙ্গে বালি হয়ে লড়াই করতে শিখিয়েছি। দেহটাকে তার লোহার মতো শক্ত করেছি। তাকে শিখিয়েছি কেমন করে ভালোবাসতে হয় বন্ধুকে। কেমন করে রুখে দাঁড়াতে হয় শত্রুর বিরুদ্ধে।’

আমি শুনতে পেলুম মা কাঁদছে। কান্নার ফোঁটাগুলি মায়ের কথা হয়ে যেন বেজেবেজে ঝরে পড়ছে। মা বলছে, ‘তাই সে আজ শিখেছে কেমন করে মা-বাবার দুঃখ ঘোচাতে হয়। তাই বুঝি তোমার দুঃখ ঘোচাতে সে এগিয়ে এসেছে তোমার কাজের বোঝা কাঁধে নিতে!’

বাবা বুঝি আর থাকতে পারল না। আমি শুনতে পেলুম, বাবা চিৎকার করে উঠেছে, ‘শাবাশ! শাবাশ আবু! এই তো চাই। হ্যাঁ, হ্যাঁ, আবু যাবে। উটপাখির পালক নিয়ে ও শহরে যাবে। আমি জানি ও পারবে! আমার ছেলে কখনো হারবে না। হারতে পারে না।’ বলেই বাবা, ভীষণ জোরে হাঁক দিল, ‘আবু-উ-উ!

আমি চমকে উঠলুম। এতক্ষণ মা আর বাবার কথা শুনতে শুনতে আমি যেন নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলুম। বাবার ডাক শুনে সামলে নিলুম নিজেকে। তাড়াতাড়ি দরজা পেরিয়ে বাবার ঘরে ঢুকলুম। বাবার মুখের দিকে চেয়ে দেখি, চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে। আমি শান্ত হয়ে দাঁড়ালুম বাবার সামনে। অনেক কষ্টে নিজের চোখের জল সামলে নিলুম। কিন্তু কথা বলতে গিয়ে গলা আমার কথা বলতে পারে না। ধরা গলায় আলতো-স্বরে জিজ্ঞেস করলুম, ‘ডাকলে বাবা?’।

বাবা বিছানায় শুয়ে-শুয়েই হাত দুটি আমার দিকে বাড়িয়ে দিল। বলল, ‘হ্যাঁ, আমার কাছে আয়।’

আমি এগিয়ে গেলুম।

বাবা জড়িয়ে ধরল আমায়। জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কেঁদে উঠল। কাঁদতে-কাঁদতে বলল, ‘তুই আমার সাত রাজার ধন এক মানিক। তুই আমার ছেলের মতো ছেলে।’

আমি বাবার বুকের মধ্যে মুখ লুকিয়ে ডুকরে-ডুকরে কেঁদে উঠলুম। কোনো কথাই বলতে পারলুম না।

 তুমি শুনলে হয়তো অবাকই হবে, আমার জীবনে আমি আজই প্রথম বাবাকে কাঁদতে দেখলুম। আর সে কান্না দেখে আমারও বুকের কান্না চোখের জলে আজই প্রথম উপচে পড়েছিল।

আজ আমি সারা রাত ঘুমোইনি। ঘুমোতে পারিনি। তুমি কি বিশ্বাস করবে, আজ সারা রাত আমি কেঁদেছি একা-একা। কাঁদব না? এতদিন আমি যাদের মা আর বাবা বলে জেনেছি, তাদের যে আমি কুড়িয়ে-পাওয়া ছেলে! আমি এদের পর। এদের দয়ায় আমি বেঁচেছি। তাহলে কে আমার সত্যিকারের বাবা? কে আমার মা? এই কথা ভাবতে-ভাবতে আমি ছটফট করেছি আর ভেবেছি, সেদিন যারা এই বালির সমুদ্রে আমায় ফেলে গেছল, তারাই বুঝি আমার মা? আমার বাবা?

শুনতে পাচ্ছ, আর কোনো শব্দ? না, এখন রাত গভীর। ছেলে তার বাপের বোঝা কাঁধে নিতে চেয়েছে, এ ভেবে বাবা ভারি শান্তিতে খুমিয়ে পড়েছে! না এখন বুঝি আর কোনো ভাবনা নেই তার। তাই কষ্টও নেই। আমি একা। একা আমি অন্ধকারে। অন্ধকারের সঙ্গেই এখন আমি লড়াই করছি। কেননা, এই অন্ধকারেই যে আমি হারিয়ে গেছি। হারিয়ে গিয়ে ভাবছি শুধু আমি কে? কে আমি? কে উত্তর দেবে? ওই বোবা অন্ধকারটা?

ঘুম না পেলে রাত তো আর তোমার জন্যে ঘুমের কাজল হাতে নিয়ে বসে থাকবে না। সে সময় হলেই পগার পার। তার পেছনে ছুটতে-ছুটতে ভোরের আলো যখন পৌঁছে যাবে মাটিতে, তখন কোথায় ঘুম আর কোথায় রাত!

 চোখে ঘুম ছিল না বলেই আজ খুব সকালে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিলুম। খুব সকালে বাবার ঘরে উঁকি মেরে দেখেছিলুম, তখনও ঘুমুচ্ছে বাবা। ঘুমোক। মা তো অনেক আগেই উঠেছে। মায়ের মুখখানা ঘুমের আমেজে তখনও ফুলে আছে। কে জানে কেন, মাকে দেখে আজ আমি খুশিতে হাসতে পারলুম না। আমি বুঝি হারিয়ে ফেলেছি আমার হাসি, আমার কথা, আমার আনন্দ! আমি কি বোবা হয়ে গেলুম?

মায়ের চোখকে আমি ফাঁকি দিতে পারিনি। হয়তো আমার মুখে হাসি না দেখেই মা আমাকে হঠাৎ জিজ্ঞেস করেছিল, ‘আবু, মান খারাপ করছে?’

আমি বললুম, ‘মন? কেন খারাপ করবে?’

 মা বলল, ‘তবে কথা বলছিস না?’

আমি ও-কথায় আর কথা না বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলুম, বাবা কেমন আছে মা?

 ‘ঘুমোচ্ছে।’

‘আমি তবে শহরে যাবার জন্যে তৈরি হই মা?’

মা কথা বলল না। ঘাড় নাড়ল।

আমি সেজে নিলুম। আমার সাদা পায়জামার ওপর সেই নীল ডোরাকাটা জামাটা গায়ে দিতে দিতে আমি ভাবছিলুম, কবে থেকে আশা করে আছি যেদিন প্রথম মরুতে পাড়ি দেব, সেইদিন এই জামাটা পরব। আজ সেইদিন এসেছে। নীল পাগড়িটা এখন মাথায় দিয়েছি বটে, কিন্তু খানিক পরে সে কি আর মাথায় থাকবে। নাকে মুখে নেমে আসবে। উটপাখির পালকগুলো দুটো টুকরিতে সাজিয়ে, আলতো করে বেঁধে পাশার পিঠের দু-পাশ দিয়ে ঝুলিয়ে দিলুম। তারপর খেতে দিলুম পাশাকে, খানিকটা শুকনো কাটা ঘাস। অনেকটা খেজুর পাতা। আর বেশ খানিকটা জল। কারণ ক-দিন উপোস করে থাকতে হবে কে জানে! তোমরা শুনলে অবাক হবে, পাশা দিনের পর দিন না খেয়েও থাকতে পারে! পিঠের ওপর ওই যে কুঁজটা দেখছ, দেখো এখন কত মোটাসোটা! চর্বিতে ভরতি। মরুভূমির গভীরে চলে গেলে, ক-দিন পরে দেখবে কুঁজটা শুকিয়ে একেবারে চিপসে গেছে। কেন বলো তো? কুঁজের ভেতরে যে পাশা খাবার ভরে রাখে। বিশ্বাস হচ্ছে না তো? তা হলে বলছি শোনো। পাশা খাবার খায় তো মুখ দিয়ে। যতই খায় ততই চর্বি জমে ওই কুঁজের মধ্যে। তারপর যখন খাবার জোটে না, জল পায় না, তখন ওই কুঁজের চর্বি গলে গলে পেটের খিদে মেটায়, তেষ্টা মেটায়। কী মজা বলো তো?

হ্যাঁ, একথা শুনতে তোমাদের মজাই লাগবে। কিন্তু আমার? অন্যদিন এই সকালে এই বাড়ি আমার। একেবারে আমার নিজের। আমার রাজত্ব। এখানে আমি হাসব, খুশিতে নাচব। নয়তো খেলব, গান গাইব। কিছু না পারি, মায়ের গলা জড়িয়ে দোল খাব।

কিন্তু আজ? দেখবে এসো না একবার আমাকে? আমি আজ অন্য মানুষ! একেবারে অন্য। এ-মানুষটার আজ আর কোনো পরিচয় নেই। আজ আমি শীতের রাতের মতো থমকে আছি। কেন? ভয়ে? না। আমি যে আজ বিশ্বাস করতে পারছি না, যাদের আমি এতদিন মা আর বাবা বলে জেনেছি, তারা আমার কেউ না, কেউ না!

‘আবু-উ-উ!’ বাবার ঘুম ভেঙেছে। ডাকল আমায়। এমনিতে বাবার গলাটা খুব গম্ভীর। তার মানে এই নয়, সেই গলার আওয়াজ শুনলে তুমি ভয় পাবে। ভারি আদর-মাখানো সেই ডাক। ওই ডাক শুনলে আমার মতো তুমিও হয়তো ভাববে, তোমার খুব কাছের মানুষ, এক আপনজন ডাকছে। সে-ডাকে সাড়া না দিয়ে তুমি থাকতে পারবে না। সেই ডাক শুনে তুমি নিশ্চয়ই ছুটবে। ছুটতে-ছুটতে সাড়া দেবে, ‘যাই-ই-ই।’

আমিও তাই করি।

 কিন্তু আজ? না, পারলুম না ছুটতে। আমার পা-দুটি আজ আনন্দে লাফিয়ে উঠল না। ধীরে-ধীরে বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়ালুম। বাবা বিছানায় বসে আছে। বাবার মুখের দিকে তাকালুম। বাবার ঠোঁট দুটিতে হাসি ছড়িয়ে পড়ল। আজ বোধহয় বাবা ভালো আছে। কিন্তু মুখখানি বড্ড শুকিয়ে গেছে। আমি জিজ্ঞেস করলুম, ‘ভালো আছ বাবা?’

বাবা হেসে উঠল হো-হো করে। হাসতে-হাসতে বলল, ‘হ্যাঁ, ভালো আছি, খুউব ভালো।

আমি আবার তেমনি শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলুম, ‘আমায় ডাকলে, কিছু বলবে?’

 ‘হ্যাঁ বলব।’ বলে বাবা একটু চুপ করে রইল। যেন কিছু ভাবল। তারপর ভাবনায় ডুবে থাকা চোখ দুটি আমার দিকে ফিরিয়ে বলল, ‘আবু, তোমার মতো বয়সে আমিও আমার বাবার কাজ মাথায় নিয়ে ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে পড়েছিলুম। আমার বাবা আমায় শিখিয়েছিল কেমন করে বিপদ মাথায় নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়। আজ আমিও তোমায় সেই কথাই বলতে ডেকেছি আবু।’

‘আমি তোমার কথা শুনব বাবা।’ খুব আলতো গলায় উত্তর দিলুম আমি। বাবার মুখখানি খুশিতে উছলে পড়ল। বলল, ‘তা আমি জানি।’ বলে আমায় কাছে টেনে নিল বাবা। আমার পিঠে হাত রাখল। তারপর আবার বলল, ‘আমি আর তোমার মা তোমাকে বুকে-পিঠে করে মানুষ করেছি। আমাদের কষ্টের দিন এসেছে, তোমাকে সে কষ্ট ছুঁতে দিইনি। আমাদের দুঃখ এসেছে, সে-দুঃখ তোমাকে বুঝতে দিইনি। তোমাকে আমরা সব সাধ্য দিয়ে গড়ে তুলেছি আবু!’

আমি তেমনি নরম-সুরে জিজ্ঞেস করলুম, ‘কেন একথা বলছ বাবা, আমি কি তোমাদের কোনোদিন দুঃখ দিয়েছি?’

হঠাৎ মায়ের মুখখানি আমি দেখে ফেলেছি। ছলছল করছে। চোখের কান্না সামলে নিয়ে মা বলল, ‘না বাবা, দুঃখ কেন দেবে! যে-ছেলে দুঃখ দেয়, তুমি তো সে-ছেলে নও।’

 বাবা আবার বলল, ‘তুমি তো জানো আবু, এই মরুর সঙ্গে যুদ্ধ করে আমাদের বেঁচে থাকতে হয়। মরুর তপ্ত আগুনের ভেতর দিয়ে কখনো আমরা ছুটি, কখনো বসি, কখনো ঘুমোই। এর নিশ্বাসে-নিশ্বাসে বিপদ। আজ প্রথম মরুর বুকে তুমি পাড়ি দিচ্ছ। তাই তোমাকে বলি, ভয় পেয়ো না বাবা। বুক ফুলিয়ে দাঁড়াবে বিপদের সামনে। যে বীর তাকে দেখলে শয়তানেরও যে বুক কাঁপে!

আমি বললুম, ‘বাবা, তুমি আমাকে তোমার বীর ছেলের মতো গড়েছ। তুমি আমাকে সাহসী হতে শিখিয়েছ। অন্যায়ের সামনে মাথা তুলে দাঁড়াতে শিখিয়েছ। যতই বিপদ আসুক, সে-বিপদ আমি জয় করবই। যত কষ্টই আসুক, আমি বুক পেতে দেব।’

বাবা আনন্দে চেঁচিয়ে উঠল, ‘শাবাশ! শাবাশ!’

আমি বললুম, ‘এবার বিদায় নিই বাবা।’

বাবা বলল, ‘আবু, যাবার আগে তোমাকে আমি একটি জিনিস উপহার দেব।’ বলে বাবা মাকে বলল, ‘সিন্দুক থেকে সেই তরোয়ালটা এনে দাও তো আমায়!’

মা তরোয়ালটা বার করে নিয়ে এল। খাপে ঢাকা। বাবা তরোয়ালটা হাতে নিয়ে, খাপ থেকে সেটা বার করতেই আমার চোখ ঝলসে গেল। আমি বুঝতে পেরেছি, এই সেই তরোয়াল। সেই রক্তমাখা তরোয়াল। সেই যেদিন আমায় কুড়িয়ে পেল বাবা, সেইদিনই তো এই তরোয়ালটাও কুড়িয়ে পেয়েছে। অবিশ্যি এখনও কি আর রক্ত লেগে আছে! না, না। তরোয়ালের ঝকমকি জৌলুস ঠিকরে পড়ছে চারদিকে।

 বাবা তরোয়ালটা হাতে নিয়েই বলল, ‘আবু, তুমি যখন খুব ছোটো, তখন এই তরোয়ালটা আমি কুড়িয়ে পাই। এতদিন যত্ন করে তুলে রেখেছিলুম। মনে-মনে ভেবে রেখেছিলুম, যেদিন তুমি বড়ো হবে, যেদিন তুমি একা একা ওই মরুর পথে পাড়ি দেবে, সেদিন তোমার হাতে তুলে দেব এই তরোয়াল। আজ আমার সেই স্বপ্নের দিন এসেছে, আবু। নাও।’

আমি বাবার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে দু-হাত তুলে সেই তরোয়াল হাতে নিয়ে মাথা হেঁট করলুম, ‘এবার তবে আসি বাবা?’

বাবা আমার চিবুকে হাত দিল। আমার কপালে চুমু খেয়ে বলল, ‘এস।

আমি মায়ের কাছে গেলুম। মায়ের বুকের ওপর মাথা রেখে এবার আমি কেঁদে ফেললুম। কাঁদতে-কাঁদতে বলে ফেললুম, ‘মা, বিদায়!’

 মা আমার মুখখানি নিজের মুখের কাছে টেনে নিয়ে বলল, ‘বিদায়।’ বলে মাও আমার কপালে চুমু খেল। তারপর কেঁদে ফেলল।

আমি তরোয়ালটা খাপের মধ্যে ঢুকিয়ে, কোমরে বেঁধে, অনেকটা কাঁদতে-কাঁদতে, খানিকটা ভাবতে ভাবতে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লুম। তারপর পাশার পিঠে চেপে কোন না-দেখা জগতের দিকে এগিয়ে চললুম

তুমি হয়তো ভাবছ, আমি বুঝি একাই চলেছি। বুঝি একাই পাশাকে নিয়ে মরুতে পাড়ি দেব! না, না, তা কেন হবে। আরও অন্তত তিরিশটা উটের পিঠে মাল বোঝাই করে, আরও তিরিশ জন চলেছে শহরে। চলেছে মাল কেনাবেচা করতে। এমনি করে দল বেঁধেই তো যেতে হয়। এমনি করে দল বেঁধে যেতে-যেতে মরুর ওপর কেটে যায় দিনের পর দিন। দল বেঁধে না গেলে, কে বলতে পারে কার কখন কী বিপদ আসে। ওই শোনো উটের গলায় ঘন্টা বাজছে, টিং-লিং, টিং-লিং! সার বেঁধেছে ওরা। সারে-সারে আকাশে ঘাড় উঁচিয়ে, পা ফেলছে। দেখলে তুমি চোখ ফেরাতে পারবে না। এত ভালো লাগবে! মনে হবে উটের পিঠে চেপে তুমিও মরুতে পাড়ি দাও!

 আমি চলেছি। আমি এখনও দেখতে পাচ্ছি, মা আমার অনেক দূরে দাঁড়িয়ে আছে আমার দিকে চোখ মেলে। দেখতে পাচ্ছি, বাবাও বিছানা ছেড়ে উঠে এসেছে। একটি হাত ওপরে তুলে বাবা আমায় বিদায় জানাচ্ছে। আমি এতদূরে চলে এসেছি যে ঠিক দেখতে পাচ্ছি না, যে-হাতটা তুলে আমায় বিদায় জানাচ্ছে, সে হাতটি বাবার কাঁপছে কি না। তবু যতক্ষণ পারলুম, আমিও হাত তুলে রইলুম। তারপর দুজনেরই চোখের দৃষ্টি থেকে দুটি হাত হারিয়ে গেল। আমার চোখের ওপর ভেসে উঠল বালি আর বালি। আমাদের মাথার ওপর খোলা আকাশ, নীল। আগুনের গোলার মতো সূর্যের তেজ। এই সময় তুমি এখানে থাকলে তোমার মন বলত, আকাশটা যদি শুধুই আকাশ হত! আকাশের গায়ে যদি ওই জ্বলন্ত সূর্যটা না থাকত!

কতদূর চলে এসেছি! কত দূর! এখন পাশার পিঠে দুলতে দুলতে বারবার আমার চোখে নেমে আসছে কাল রাতের না-ছোঁয়া ঘুমটা। তা বলে ঘুম আমায় জড়িয়ে ধরতে পারছে না। কেননা, যতবারই সে আমার চোখের পাতায় বসি-বসি করছে, ততবারই যেন আমার বুকটা চমকে-চমকে উঠছে। মন বলছে, কেমন করে মনে করি এই পৃথিবীতে আমার কেউ নেই।

আমরা বোধহয় কয়েক ঘন্টা হেঁটেছি। আকাশের সূর্য এখন ঠিক আমাদের মাথার ওপর। ওই দেখো, দুরে দেখা যাচ্ছে মরূদ্যান! ওখানে দারা আছে। ওখানে আমরা থামব! যার সঙ্গে তাঁবু আছে, সে তাঁবু খাটাবে। ইঁদারার জল চোখে-মুখে দিয়ে কিছু খেয়ে নেব আমরা। মা আমার জন্যে কত খাবার যে দিয়েছে, একা খেয়ে শেষ করতে পারব না। খেয়ে-দেয়ে একটু বিশ্রাম নেব। তারপর সূর্য যখন পশ্চিম আকাশে মাথা হেলাবে, আমরা আবার চলব

এমনি চলতে-চলতে দুদিন কেটে গেল আমাদের। দুদিনে আমরা কতখানি পথ চলে এসেছি। কত অজানা মানুষের সঙ্গে আমার কত পরিচয় হল। ওরা গল্প বলে। কত না-জানা কথা শোনায়। কত নিশ্চিন্ত আমি। ভাবলুম, বুঝি এমনি করেই পৌঁছে যাব শহরে।

কিন্তু হল না। তিনদিনের দিন পথে আবার আমরা হাঁটা শুরু করলুম। শুরুতে কি জানতাম এক ভয়ংকর বিপদ আমাদের মাথার ওপর ওত পেতে আছে। আমরা অনেকটা এসেছি। এতক্ষণ পর্যন্ত দেখেছি ঝরঝরে আকাশ। হঠাৎ দেখি কোথাও কিছু নেই, আকাশ মেঘে ছেয়ে যাচ্ছে। উটের পিঠের মানুষরা আতঙ্কে চুপসে গেল।

ওরা চেঁচিয়ে উঠল, থামো, থামো, ঝড় উঠবে!

সে-চিৎকার শুনে ভয়ে বুক শুকিয়ে গেল আমার। ঝড় উঠবে! কী হবে তা হলে! তোমরা তো জানো না মরুর বুকে ঝড় ওঠা মানে এক সাংঘাতিক ব্যাপার! আমাদের মাথার ওপর ঝড়ের মেঘ! এখন মরুভূমির এই শূন্য ভূমিতে কোথাও আশ্রয় নেই যে সেখানে ছুটে যাবে।

 হ্যাঁ, সত্যি-সত্যি ঝড় উঠল। ওই দ্যাখো রাশি-রাশি অসহ্য গরম বালি ঝড়ের ঝাঁপটায় উড়ে আসছে! নিমেষের মধ্যে বেগুনি নীল অন্ধকারে ঢেকে গেল সারা দিগন্ত। মনে হচ্ছে, ওই রাশি-রাশি বালি যেন এক একটা আগুনের ফুলকি! ঝাঁকে-ঝাঁকে গায়ে-মুখে ছিটকে আসছে। ওঃ! জ্বলে যাচ্ছে শরীর! যন্ত্রণায় ছটফট করতে-করতে আর সবার মতো আমিও সারা মুখ ঢেকে ফেললুম! তপ্ত হাওয়ায় যেন ফুটন্ত লোহার ঘেঁকা! কোথায় পালাব! একটু যদি আশ্রয় পাই! আশ্রয় কোথা এখানে! আমি লাফিয়ে পড়লুম পাশার পিঠ থেকে। নিজেকে ওই ঝড়ের হাত থেকে বাঁচাবার জন্যে বালির ওপরই মুখ গুঁজে শুয়ে পড়লুম। তবু নিস্তার নেই। চেয়ে দেখি, ভয়ে কুঁচকে সবাই শুয়ে পড়েছে ওই বালির ওপর। যত মানুষ, যত উট, সব। আমার মতো সবাই কাতরাচ্ছে বালির ওপর। হঠাৎ ঝড়ের প্রচণ্ড শোঁ-শোঁ শব্দ! আচমকা চোখ মেলে চেয়ে দেখি, রাশি রাশি বালি যেন এক বিরাট জাল বিছিয়ে শূন্যে উড়তে-উড়তে ভেসে আসছে। আমি চিৎকার করে উঠলুম! আমি দেখতে পাচ্ছি, ওই জাল যেন কাঁপতে-কাঁপতে ধেয়ে আসছে আমারই দিকে! আমি ঝড়ের সঙ্গে ঝড় হয়ে ছোটা দিলুম! কোনদিকে ছুটব! আর কেমন করেই বা ছুটব! পা যেন ছুটতে পারছে না! আমার সমস্ত শক্তি ওই আগুনের তেজে যেন ছাই হয়ে গেছে! তবু ও শেষ শক্তিটুকু উজার করে পালাচ্ছি আমি। কিন্তু না। পারলুম না। চক্ষের নিমেষে ওই বালির জাল আমার ঘাড়ের ওপর ছিটকে পড়ল। আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠতে গেলুম, ‘বাঁচাও, বাঁচাও। কিন্তু স্বর বেরোল না আমার। আমি বালির জালে চাপা পড়ে গেলুম। মনে হল, কে যেন আমায় আগুনের গহ্বরে ঠেলে ফেলে দিল। আমি তারপরে আর জানতেও পারলুম না, সেই গহ্বরে তখন আমি বেঁচে আছি কি না। কেননা, আমি তখন জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছি!

অনেকক্ষণ পর, কতক্ষণ পর বলতে পারি না, আমার নিজেরই নিশ্বাসের শব্দটা আমার কানে ভেসে এসেছিল। আমি তখনও বুঝতে পারিনি, আমি বালির নীচে মুখ থুবড়ে পড়ে আছি। আমার সারা দেহ বালির নীচে চাপা পড়েছে। রক্ষে এই, মুখখানা কেমন করে যেন বেঁচে গেছে! যদি মুখখানাও বালিতে চাপা পড়ত, তখন আমিও শেষ হয়ে যেতুম! তখন এই গল্প কি আর তোমাদের বলতে পারতুম আমি! মরুর শেয়াল হয়তো বালি খুঁড়ে বেরিয়ে এসে আমার দেহটা নিয়ে ভোজ বসাত!

আমি বাঁচলুম। অনেক কষ্টে ওই বালির গহ্বর থেকে বেরিয়ে এলুম। কিন্তু আমার চোখে যেন সব ঝাপসা ঠেকছে! এখনও হামাগুড়ি দিচ্ছি। দাঁড়াতে পারব কি না বুঝতে পারছি না। নিশ্বাস নিতে ভারি কষ্ট হচ্ছে। আমার। দম আটকে আসছে। বালির ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে, ওই বালির ওপরই আরও কিছুক্ষণ শুয়ে থাকতে পারতুম যদি!

হঠাৎ আমার খেয়াল হল, আরে! দলের আর কারও গলা শুনছি না কেন! তাই তো! এত নিস্তব্ধ কেন চারদিক! ওই তো ঝড় থেমেছে! ওই তো আবার রোদ উঠেছে! তবে কি সবাই আমার মতো বালির ভেতর চাপা পড়েছে।

আতঙ্কে শিউরে উঠলুম আমি। ঝাপসা চোখেই চেয়ে দেখলুম এদিক-ওদিক, চারদিক। কই, কেউ তো নেই! দেখি চারদিকে শুধু উঁচু-উঁচু বালির পাহাড় খাড়া হয়ে আছে। এতক্ষণ যে জায়গাটা খোলামেলা ছিল এখন সেখানে শুধু বালির পাহাড়। কী শক্তি ওই মরুর ঝার! চক্ষের নিমেষে স্তূপ-স্কুপ বালি উড়িয়ে এনে পাহাড় তৈরি করে ফেলেছে। কিন্তু পাশা! পাশা কোথা? দেখতে পাচ্ছি না তো! আমি প্রায় লাফিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছি! খুব জোরে চিৎকার করে হাঁক পাড়লুম, ‘পাশা-আ-আ-।’

কোনো সাড়া নেই। শুনতে পেলুম না আমি পাশার গলার সেই ঘন্টার চেনা শব্দ! কী ভীষণ ভয় পেয়ে গেছি! বুকের ভেতরটা ঢিপঢিপ করে কেঁপে উঠল! নিমেষের মধ্যে আমার কষ্ট-টষ্ট যেন হাওয়ায় উবে গেল। আমি বালির ওপর চেঁচিয়ে-চেঁচিয়ে দিশেহারা হয়ে ছোটাছুটি লাগিয়ে দিলুম। আকাশ ঝকঝকে নীল। সূর্য আবার তেমনি ভয়ংকর! মরু আবার আগুনে ঝলসাচ্ছে! কিন্তু যে-কষ্টে এতক্ষণ আমি নিস্তেজ হয়ে পড়েছিলুম, যে-কষ্ট এতক্ষণ আমায় দগ্ধে মারছিল, এখন যেন সে-কষ্ট আর কষ্টই নয় আমার কাছে। কেননা, পাশাকে যে আমি দেখতে পাচ্ছি না। তবে কি পাশাও ডুবে গেছে বালির তলায়!

আমার ভীষণ ধাঁধা লেগে গেল! আমি যে বাবাকে কথা দিয়েছি, যেমন করে তোক ওই উটপাখির পালক শহরে পৌঁছে দেব। কিন্তু এখন কী হবে!

আমি স্তূপ স্তূপ বালির পাহাড়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লুম। দুহাত দিয়ে খামচাতে লাগলুম ওই বালি। খামচে খামচে খুঁজতে লাগলুম পাশাকে। আমি এ-পাহাড় থেকে ও-পাহাড়ে যাই। এদিক থেকে ওদিক। কিন্তু কই, পাশা তো নেই! ভয়ে আমার হাত-পা যেন সিঁটিয়ে গেল! কী করি আমি! কোনদিকে যাই! আমার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। আমি ক্লান্ত! উঃ! কী ভীষণ তেষ্টা পাচ্ছে! একটু জল দাও! তোমরা আমায় একটু জল দাও! আমি যে আর পারছি না! কিন্তু কে দেবে জল! এখানে কেউ নেই। চিৎকার করে মরে গেলেও কেউ আমার কথা শুনতে পাবে না। শুন্য! চারদিক শূন্য! খাঁ-খাঁ! কই, আকাশে একটা কাক-পক্ষীও যে দেখা যায় না!

তেষ্টার জ্বালায় এখন আমি ওই বালিগুলোকেই মুঠো-মুঠো চেপে ধরছি! নিঙড়ে নিঙড়ে একফোঁটা যদি জল বার করতে পারি! ভুলে গেলুম আমি এগুলো শুধুই বালি! রোদে পোড়া ঝলসানো পাথরের গুড়ো! এর বুকে জল নেই, জল নেই!

হঠাৎ চোখের ওপর ভেসে উঠল, জলের ঢেউ! চিকচিক করছে? তখন আমি বুঝতে পারলুম না এ মরীচিকা! এ আমার চোখের ভুল! মরীচিকা আমি কত দেখেছি! মরীচিকা দেখে আমি কত হেসেছি। আমি জানি, বালির ওপর রোদের এ ঝিলিমিলি শুধুই হেঁয়ালি! কিন্তু আজ আমার মনে হল, এ সত্যি! এ তেষ্টার জল! একফোঁটা জলের জন্যে যখন মানুষের বুকের ভেতরটা ছটফটিয়ে ওঠে, তখন বুঝি মরীচিকা মানুষকে বোকা বানায়! তার বুদ্ধি কেড়ে নিয়ে তাকে ছোটায় তারই দিকে!

আমিও ছুটলুম, দু-হাত বাড়িয়ে ছুটলুম। ভাবলুম ছুটলে বুঝি নাগাল পাব ওই জলের! কিন্তু না, নাগাল আমি পেলুম না। শুধু ছুটছি আর হাঁপাচ্ছি। আমার প্রাণ বুঝি বেরিয়ে যায়! গলায় আমার কথা নেই! হারিয়ে গেছে! পা আমার চলছে না! টলছে যেন! আমার চোখের পাতা বুজে এল। পড়ে গেলুম।

বেশ কিছুক্ষণ পরে আমার যেন মনে হল, কাদের গলার শব্দ আমি শুনতে পাচ্ছি। মনে হল, কারা যেন অনেকদূর থেকে এদিকেই আসছে। আমি খুব সম্ভব অসহ্য যন্ত্রণায় গোঙাচ্ছিলুম। মনে হচ্ছিল, এখনই আমার নিশ্বাস বুঝি ফুরিয়ে যাবে

হ্যাঁ, স্পষ্ট শুনছি ওরা ছুটে আসছে বালির ওপর দিয়ে, ঘোড়ায় চেপে। ওরা আমায় দেখতে পেয়েছিল। থামল। ওদের কাছে জল ছিল। আমায় কাতরাতে দেখে তাড়াতাড়ি আমার মুখে জল দিল। আঃ! যেন প্রাণ ফিরে পেলুম। আমি চোখ চাইলুম। হাত বাড়ালুম। ওরা আমায় তুলে ধরল। বসতে পারলুম আমি। তারপর ওদের অস্পষ্ট গলায় বললুম, ‘আমায় বাঁচান।’

ওদের কেউ-ই আমার সঙ্গে কথা বলল না। এমন কী নিজেদের মধ্যেও কোনো কথা কইল না। ওরা আমায় ধরাধরি করে দাঁড় করাল। আমি হাঁটতে পারলুম। ওরা আমায় ঘোড়ার পিঠে বসিয়ে আমাকে নিয়ে ছুটল। বসেছি আমি একজনের পেছনে, তাকে জড়িয়ে ধরে। হয়তো তখন আমি বিশ্বাস করতে পারছিলুম, আমি বেঁচে আছি। কে জানে এরপর আমার কী হবে! যতবারই ভাবছি সে-কথা, ততবারই যেন শিউরে উঠছিলুম।

হঠাৎ আমি চমকে উঠছিলুম এই ঘোড়াসওয়ারদের দেখে। হ্যাঁ দেখছি আটটা কালো ঘোড়ার পিঠে চেপে আটটা লোক ছুটছে। কোমরে তাদের তরোয়াল আর ছোরা আঁটা। পোশাকগুলোও কালো। এই কালো পোশাকের আড়ালে কী মতলব লুকনো আছে আমি জানি না। তবু আমার কেমন যেন সন্দেহ হচ্ছিল। আচ্ছা, মরুর দস্যু নয় তো! এ-কথা মনে হতেই আমার বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল। কেননা, আমি জানি এরা ভীষণ নির্দয়, ভয়ংকর হিংস্র! বাবার মুখে এদের কত গল্প আমি শুনেছি। শুনেছি অতর্কিতে এরা মরুযাত্রীদের আক্রমণ করে তাদের সর্বস্ব লুঠ করে নেয়। তবে কি এরাও তাই! এরাও কি তবে লুঠ করে ফিরছে! সামনে ওই যে লোকটা চলেছে, ওর কোলে-বাঁধা ওই পুঁটলিটাতে কী আছে! তবে কি কারো লুঠের মাল! হবেও বা! কিন্তু তাহলে আমায় কোথায় নিয়ে যাচ্ছে এরা! এরা তো মানুষকে খুন করে! তবে কি আমাকেও খুন করবে!

করুক খুন। আমি এত ভীতু! আমার কোমরেও তরোয়াল আছে। আমাকে মারার আগে ওদেরও ছেড়ে দেব না আমি! কাপুরুষের মতো ওদের তরোয়ালের সামনে মাথা পেতে দেব, তেমন ছেলে আমি নই। আমিও জানি দুশমনকে কেমন করে শায়েস্তা করতে হয়!

কিন্তু ছিঃ ছিঃ, আমি এ-কথা আগেই কেন ভাবছি। ওরা যদি অতই নিষ্ঠুর হয় তবে আমায় বাঁচাবে কেন! ওই বালির ওপর একটু জলের জন্যে আমি যদি ধুঁকতে-ধুঁকতে মরি তাতে দস্যুর কী! এদের মনে দয়া কেন হবে?

হ্যাঁ, আমি তো মরেই গেছলুম! আর একটু দেরি করে এই ঘোড়সওয়ারের দল এখানে যদি আসত! ওরা যদি আমায় দেখতে না পেত! অবিশ্যি আমি মরলেই বা কী! এখন তো আমি জানি এই মরুভূমিতে আমি কুড়িয়ে-পাওয়া এক অনাথ ছেলে! আমি জানি না, নিজের বাবা-মা কেমন হয়। কিন্তু এরা? যাদের আমি এতদিন মা বলে ডেকেছি বাবা বলে জেনেছি, তারা? কোনোদিনই তো জানতে পারিনি এরা আমার কেউ নয়! কুড়িয়ে-পাওয়া ছেলেকে যারা আপন করে নিতে পারে, তারা কি শুধুই মানুষ না মহাপুরুষ!

হঠাৎ মায়ের মুখখানি আমার চোখের সামনে কেমন ভেসে উঠল! আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি মাকে! দেখতে পাচ্ছি, মা আমার মুখের দিকে চেয়ে হাসছে। আমি ওই মুখখানি জড়িয়ে ধরে কতদিন যে খেলা করেছি। মায়ের গলায় দু-হাত রেখে দুলতে-দুলতে মাকে কত আদর করেছি। না এ হতে পারে না। মা আমার পর না। কক্ষনো না। আমার মা আমারই। আমার আপনার!

‘এ খোকা, এখানে কোত্থেকে এসেছিস?’ হঠাৎ আমি যার ঘোড়ার পিঠে বসেছিলুম সে গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করল।

আমি প্রথমটা থতমত খেয়ে গেছলুম। তারপর ভয়ে-ভয়ে উত্তর দিলুম, ‘আমি এখানে আসতে চাইনি। আমার সঙ্গে আমার উট ছিল। আমি উটপাখির পালক নিয়ে শহরে যাচ্ছিলুম। ঝড় উঠে আমি হারিয়ে গেছি।

‘কোথা থাকিস?’

‘জানজি।’ আমি বললুম। অবিশ্যি তোমাদেরও বলতে ভুলে গেছি, আমরা যেখানে থাকি, সে-জায়গাটার নাম জানজি।

সে জিজ্ঞেস করল ‘বাড়ি যাবি?’

আমি বললুম, ‘আমার বাবাকে বলে এসেছি, শহরে উটপাখির পালক পৌঁছে দিয়ে ফিরব।’

‘পালক পাবি কোথায়?’

‘আমার উটের পিঠে বাঁধা আছে।’

আমার কথা শুনে লোকটা কোনো কথা বলল না। বিচ্ছিরি সুর করে হেসে উঠল। আমি জিজ্ঞেস করলুম, ‘হাসলেন কেন?’

সে বলল, ‘আজ প্রথম বেরিয়েছিস?’

আমি বললুম, ‘হ্যাঁ।’

 ‘একা-একা?’

‘আমার বাবার যে অসুখ করেছে!

‘তোর বাবার আক্কেল নেই।’

এ-কথা শুনেই আমার যেন গায়ের রক্ত গরম হয়ে উঠল। আমি প্রতিবাদ করে উঠলুম, ‘এ-কথা কেন বলছেন? তিনি তো আপনার কোনো ক্ষতি করেননি।’

আমার এই কথায় লোকটা যে অমন হুট করে চটে উঠবে, আমি বুঝতে পারিনি। হঠাৎ ঘোড়ার লাগাম ধরে সে ঝপ করে থেমে দাঁড়াল। ঘোড়ার পিঠের ওপর বসে-বসেই আমার বুকের জামাটা খামচে ধরে টান মারল। চেঁচিয়ে উঠল, ‘কী বলছিস?’

আমি ভয়ে কুঁকড়ে গেলুম!

লোকটা আবার হাঁক পাড়ল, কী বলছিস, আর একবার বল! বলেই ঘোড়ার পিঠ থেকে আমায় নীচে ফেলে দিল। আমি কী করি, কী বলি ভাবতে-ভাবতেই লোকটা তার কোমরে ঝোলানো খাপ থেকে তরোয়ালটা বার করে ফেলেছে। সঙ্গে-সঙ্গে দেখি, তার আরও সাতজন সঙ্গী দাঁড়িয়ে পড়েছে। আমি কিছু বলার আগেই লোকটা আমাকে মারবার জন্য তরোয়াল তুলল। লোকটা যে এমন তুচ্ছ কথায় হঠাৎ চটে উঠে আমাকে একেবারে কেটে ফেলার জন্যে তরোয়াল তুলেছে, সত্যি বলছি, এটা আমি বিশ্বাসই করতে পারিনি। আসলে আমি তো রেগে যাবার মতো অন্যায় কথা বলিনি। উলটে লোকটাই তো বলল, আমার বাবার আক্কেল নেই! তোমরাই বলো, বাবার নামে এমন কথা বললে কোন ছেলে সহ্য করে!

আমায় ঘিরে ফেলল ওরা। ওরা আটজনই একসঙ্গে তরোয়াল বার করল। কোথা থেকে যে কী হল, তখন আমার কোত্থেকে যে সাহস এল, বলতে পারব না। আমিও ঝটপট খাপ থেকে তরোয়াল বার করে ফেললুম। আমি মনে-মনে ভাবলুম, মরতে হয় মরব, তবু ভীরুর মতো কেন মরব! তাই, যেই ওরা তরোয়াল চালিয়েছে, ওদের তরোয়ালের বুকে ঘা মেরে আমার তরোয়ালও ঝনঝনিয়ে উঠল। আমি আটজনের সঙ্গে একাই মুখোমুখি লড়াই শুরু করে দিলুম। তুমি যদি তখন আমায় দেখতে, হলপ করে বলতে পারি, তুমি অবাক হয়ে যেতে। আমি তখন আর সে আবু নই। তখন আমি যোদ্ধা। এই নিঃশব্দ, নিজঝুম বালির সমুদ্রে আমি এখন একা-একা যুদ্ধ করছি আটজন দস্যুর সঙ্গে। জানি না, কে আমায় এত শক্তি দিল। একটু আগে যে-আমি মরতে-মরতে বেঁচেছি, সে-ই আমি এখন শত্রুর তরোয়ালের আঘাত আটকাবার জন্যে কখনো সামনে লাফাচ্ছি। পেছনে হাঁটছি। ঘুরে দাঁড়াচ্ছি। প্রচণ্ড শব্দে তরোয়াল বেজে উঠছে, ঝনাত, ঝনাত!

কিন্তু এ তো অসম্ভব ব্যাপার! একা আমি এতজনের সঙ্গে কতক্ষণ লড়ব? আমি জানি, এক্ষুনি আমার হাতের মুঠির থেকে তরোয়াল ছিটকে পড়বে। আমি জানি, আমার মরণ নিশ্চিত! এখনই আমার বুক দিয়ে রক্ত গড়াবে। তারপর হয়তো আমার ক্ষত-বিক্ষত দেহটা এইখানে ফেলে রেখে ওরা দুরন্ত বেগে ছুটে পালাবে। তখন এই তপ্ত বালির ওপর দেহটা পড়ে-পড়ে শুকিয়ে-শুকিয়ে শেষ হয়ে যাবে!

না, আমি আর পারছি না। আমার হাতটা অবশ হয়ে আসছে। আমি ঘুরন্ত চরকির মতো ছিটকে পড়ছি। নিমেষের মধ্যে আবার উঠে দাঁড়াচ্ছি। লাফাচ্ছি, কিন্তু টাল খাচ্ছি। বালির ওপর আমার পা স্থির রাখতে পারছি না। ঠিক এমন সময় হঠাৎ আটটা তরোয়ালই এক সঙ্গে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমি শেষবারের মতো লাফিয়ে উঠেছি। কী বলব, কোত্থেকে যে শক্তি পেলুম জানি না। চোখের পলকে আমি একজনের পেটে তরোয়াল চালিয়ে দিয়েছি। লোকটা চিৎকার করে ওঠার সঙ্গে-সঙ্গে দেখি, সবাই থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে। একজন প্রাণের ভয়ে চেঁচিয়ে উঠল, ‘ভাগো, ভাগো, ওরা আসছে।’

আমিও চমকে গেলুম। একেবারে চোখের পলক পড়তে-না পড়তেই দেখি, লোকগুলো পিছু ফিরেছে। আমিও পিছু ফিরেছি। দেখি, দূরে বালির ধুলো উড়িয়ে আর-একদল লোক ঘোড়ার পিঠে ছুটে আসছে। আর দেখতে! এরা সঙ্গে-সঙ্গে আহত লোকটাকে ঘোড়ার পিঠে তুলে নিয়ে তির-বেগে ছুট মারল। আমি তো থ। কিছু ভেবে না পেয়ে, একবার এদের দিকে আর একবার ওদের দিকে তাকিয়ে-তাকিয়ে দেখতে লাগলুম! আমার হাতে তরোয়াল রক্তমাখা। তাড়াতাড়ি সেটা খাপে পুরে ফেললুম। বলব কী, সঙ্গে-সঙ্গে অন্তত পঞ্চাশটা ঘোড়সওয়ার আমার সামনে এসে দাঁড়াল। আমি তাদের কিছু বলার আগেই একজন ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে ঝটপট আমার মুখখানা একটা কালো কাপড় দিয়ে বেঁধে ফেলল। তারপর একটা শক্ত দড়ি দিয়ে আমার হাত দুটো আর কোমরটা আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ঘোড়ার পিঠে চাপল সে। আমার কোমরে দড়ি বাঁধা, আমি বালির ওপর দাঁড়িয়ে। আমার কোমরে বাঁধা লম্বা দড়িটা লোকটার হাতে। লোকটা ঘোড়ার ওপর বসে। ঘোড়া ছুটল। আমার দড়িতে টান পড়ল। আমিও ছুটলুম বালির ওপর দিয়ে ঘোড়ার পিছু-পিছু। কিন্তু তোমরা তো জানো ঘোড়ার সঙ্গে ছোটা আমার সাধ্য নয়। যতই টান খাচ্ছি, ছুটতে ছুটতে উলটে পড়ছি। উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করছি। কখনো পারছি, কখনো হারছি। শেষে লুটিয়ে পড়লুম বালির ওপর। ঘষটাতে ঘষটাতে গড়িয়ে চললুম। আমি বুঝতে পারছি আমার গা-হাত-পা ছড়ছে। আমি জ্বলে যাচ্ছি। রোদের জ্বালার চেয়ে এ যে আরও ভয়ংকর! আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না, লোকগুলো আমাকে এমনি করে বাঁধল কেন! এমন করে বেঁধে টানতে টানতে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে! ওরা কি বালির ওপর ঘষতে-ঘষতে এমনি করে আমায় মেরে ফেলবে! আমি তো কোনো দোষ করিনি। আঃ! আমি যে আর পারছি না। একটার পর একটা বিপদ এসে কেন বারবার আমায় জড়িয়ে ধরছে! আমার এখন চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে, ‘হে মরু, তুমি আমায় বাঁচাও! একদিন তোমার বুকে জানি না কারা আমায় ফেলে যায়! তুমি আমায় বাঁচিয়ে রেখেছিলে বলেই না আমি পৃথিবীর আলোয় চোখ মেলে দেখেছি, কী সুন্দর এ পৃথিবী! দেখেছি তাদের, ওই যারা তোমার বুক থেকে তুলে এনে, তাদেরই বুকের ছায়ায় আমায় বড়ো করেছে। আমি জেনেছি, এরাই আমার মা, আমার বাবা। এই সুন্দর পৃথিবীতে এরা যে আমার কাছে আরও সুন্দর। আরও আপন। হে মরু, যারা আমাকে প্রাণ দিল, তাদের কথা ভেবে, আমার প্রাণ তুমি কেড়ে নিও না! আমি যদি মরে যাই কে তাদের দেখবে! হে মরু, বলো তুমি, ছেলে যদি মা-বাবাকে না দেখে কে দেখবে?’

ঘোড়া ছুটতে-ছুটতে থামল। আমিও থামলুম। কিন্তু দাঁড়াতে পারলুম না। ওরা নেমে এল ঘোড়ার পিঠ থেকে। আমার মুখের কালো কাপড়ের ঢাকনাটা আর হাতের বাঁধনটা ওরা খুলে ফেলে দিল। আমার চোখে অন্ধকার! ওরা আমার ঘাড়টা ধরে টান মারল। আমি উঠতে গিয়েও পড়ে গেলুম। কিন্তু ওরা ছাড়বে না। আমাকে দাঁড়াতেই হবে। অনেক কষ্টে কাঁপতে-কাঁপতে আমি দাঁড়ালুম। কী প্রচণ্ড যন্ত্রণা আমার সারা দেহে।

ওরা আমার কোমরের দড়ি ধরে টানতে-টানতে নিয়ে চলল। কোথায় নিয়ে চলল, জানি না। শুধু জানি, আমার চোখের সেই কালো অন্ধকারটা ধীরে-ধীরে সরে যাচ্ছে। আমি একটু-একটু করে চাইতে পারছি। মনে হচ্ছে, হয়তো বা মরুভূমির বালির কোলে আর এক নতুন জায়গায় এসেছি আমি। কেননা, আমি এখন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি আমার সামনে একটা পুরোনো বাড়ির ভাঙা ফটক। কেমন যেন রহস্য-ঘেরা! ওর আমায় টানতে টানতে ফটকের মধ্যে নিয়ে গেল। আমি একটা শান-বাঁধানো ঘরের মধ্যে ঢুকলুম। একটা সুন্দর পালঙ্ক। মখমলের গদির ওপর ভেলভেটের বালিশে হেলান দিয়ে যে লোকটা বসে আছে, তার মাথায় লম্বা চুল। দাড়ি আর গোঁফের সঙ্গে চুলে পাক ধরেছে। তবু তীক্ষ্ণ তার চোখের দৃষ্টি। লম্বা আর শক্ত সমর্থ মানুষ। ওরা আমায় তার সামনে দাঁড় করাল। আমি বুঝলুম ইনিই বোধহয় পালের গোদা! ইনিই বোধ হয় সর্দার! বিদ্যুৎ যেমন চমকে যায় তেমনি তার চোখ দুটো হঠাৎ ঝলসে উঠল আমার মুখের ওপর। তারপর স্থির আর গম্ভীর তার গলার স্বর বলে উঠল, ‘এই বাচ্চাটাকে কোত্থেকে ধরে আনলে?’

আমায় যারা ধরে এনেছিল তাদের পান্ডা যে লোকটা, সে বলল, ‘হুজুর ছেলেটা দলে ছিল।’

আবার সে বলল, ‘এত কম বয়সে দস্যুগিরিতে নেমেছে! ছেলেটার কাছ থেকে লুঠের মাল কিছু উদ্ধার করতে পারলে?’

‘আজ্ঞে না। ছেলেটাকে ফেলে রেখে ওরা মাল নিয়ে ভাগল!

এবার রেগে যেন সেই সর্দার গর্জন করে উঠল, ‘তোমরা এতগুলো লোক কী করছিলে? এতজনের চোখের ওপর দিয়ে ভাগে কেমন করে?’

এবার আর কোনো উত্তর বেরোল না তার মুখ দিয়ে। মনে হল ভয় পেয়েছে।

 সর্দার আবার জিজ্ঞেস করল, ‘ছেলেটার কাছে কিছুই পাওয়া গেল না?’

 ‘আজ্ঞে না।’

সর্দার তখন আমার দিকে আবার ফিরে চাইল। ধমক দিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায় তোদের আস্তানা?’

আমি অনেক কষ্টে কথা বলতে পারলুম, ‘জানি না।’

সে অমনি সঙ্গে-সঙ্গে চিৎকার করে উঠল, ‘না বললে মরবি!’

আমি আবার বললুম, ‘আমি দস্যু নই। আমি জানি না।’ লোকটার তীক্ষ্ণ চোখের চাউনি এবার কেমন ভয়ানক চকচক করে জ্বলে উঠল। সে আরও চড়া গলায় চেঁচিয়ে উঠে জিজ্ঞেস করল, ‘কোনখানে তোদের আস্তানা?’

আমি তেমনি শান্ত গলায় উত্তর দিলুম, ‘আমি দস্যুগিরি করি না।’

লোকটা এবার হো-হো করে হেসে উঠল। কী হিংসুটে সে হাসির শব্দ। হাসতে-হাসতে আচমকা থেমে পান্ডাকে বলল, ‘চাবুক লাগাও!’

এ-কথা যদি আমার আপনজন কেউ বলত, তবে নিশ্চয়ই আমার দু-চোখ বেয়ে জল গড়াত। কিন্তু এই লোকটার হুকুম শুনে মাথা তুলে, বুক ফুলিয়ে চিৎকার করে বলে উঠলুম, ‘কেন তোমরা আমায় চাবুক মারবে? আমি মিথ্যে বলি না। খবরদার! আমার গায়ে হাত তুলবে না!’

লোকটা বোধহয় থতমত খেয়ে গেছল আমার কথা শুনে। শুধু এই লোকটা কেন যে-লোকটাকে চাবুক মারতে বলেছিল সে-ও বোধহয়। কেননা, তার হাতের চাবুক হাতেই থমকে গেছল। কিন্তু নিমেষের মধ্যে নিজেকে সামলে নিয়ে চাবুক হাতে লোকটা আমাকে মারবে বলে যেই আবার চাবুক তুলেছে, সঙ্গে সঙ্গে সেই সর্দার পালঙ্ক ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে উঠল, ‘থামো!’

চাবুক আমার পিঠে না পড়ে, মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। এবার সে নিজেই চাবুকটা ছিনিয়ে নিয়ে, আমাকে ভয় দেখাবার জন্যে প্রচণ্ড জোরে সেই চাবুক শূন্যে ঘোরাল। কিন্তু তার আগেই আমি আমার কোমরে বাঁধা তরোয়ালটা খাপ থেকে বার করে চাবুকের ওপর চালিয়ে দিয়েছি। চাবুকের দড়ি ছিঁড়ে ছিটকে পড়ল। আমার হাতের তরোয়াল খাপের মধ্যে ঢুকে গেল। লোকটা তার হাতের চাবুকের ভাঙা টুকরোটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে পাগলের মতো লাফিয়ে উঠে আমার গলাটা দু-হাত দিয়ে চেপে ধরল। কিন্তু আশ্চর্য! আমার চোখের ওপর তার চোখ পড়তেই লোকটা যেন কেমন চমকে গেল। তাড়াতাড়ি আমায় ছেড়ে দিল। তারপর আমার মুখের দিকে ফ্যালফাল করে বেবাক তাকিয়ে রইল। কেন যে লোকটা এমন করল, কেন যে আমায় মারতে মারতেও ছেড়ে দিল, আমি বুঝতে পারলুম না। আমি কেন, ঘরসুদ্ধ অত লোক সবাই ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেছে।

লোকটা কেমন হাঁপাতে লাগল। হাঁপাতে-হাঁপাতে চেঁচিয়ে উঠে বিছানায় ছুটে গেল। মাথার বালিশটাকে খামচে ধরে হুকুম করল, ‘ছেলেটার কোমর থেকে তরোয়ালটা কেড়ে নাও। ছেলেটাকে বন্দি করে রাখো। যাও, নিয়ে যাও ওকে আমার সামনে থেকে।’

ওরা আমায় টানতে-টানতে ঘরের বাইরে নিয়ে চলে গেল। তারপর আমার কোমর থেকে তরোয়ালটা কেড়ে নিয়ে, আমাকে একটা গরাদ-আঁটা ঘরে ঠেলে ঢুকিয়ে দিয়ে, ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিল। আমি কয়েদ হয়ে রইলুম। আমি জানি না, আমার ভাগ্যে এখন কী আছে। তবে একথা ঠিক, এখন আমি ভয়ংকর কিছুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি। দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে ভাবছি, তবে কি এবার এরা আমায় মেরে ফেলবে।

হ্যাঁ, এখন আমি কয়েদ হয়েই আছি। আমি ভয় পেয়েছি কি না জানি না। কিন্তু আমার মা আর বাবার মুখ দুটি বারবার আমার চোখের ওপর ভেসে উঠছে। আর যখনই ভাবছি, হয়তো আমি আর তাদের দেখতে পাব না, তখনই আমার চোখ দুটি ছলছলিয়ে উঠছে। আমি জানি, আমার নিস্তার পাওয়ার আর কোনো রাস্তা নেই। হয়তো বেঁচে আছি কিছুক্ষণের জন্যে। কিন্তু সে কিছুক্ষণ যে কতক্ষণ, তা জানি না।

ঘরটা অন্ধকার। আমি যেন অন্ধকারে ডুবে আছি। ভাবছি, আমার মা আর বাবা এখনও হয়তো ঘুমোচ্ছে। হয়তো ঘুমিয়ে-ঘুমিয়ে আমারই স্বপ্ন দেখছে। কিংবা জেগে-জেগে ভাবছে, আজকের রাত কি কালকের চেয়েও বড়ো! তা না হলে, এ-রাত কাটে না কেন! শেষ হয় না অন্ধকার! এমন মানুষ ক-জন হয়। পথের ছেলেকে ঘরে তুলে এনে, নিজের ছেলে বলে বুকে তুলে নিতে পারে ক-জন! আমি তাদের কাছে যা চাইনি, তাই-ই পেয়েছি। মা-েমানে যা চেয়েছি, তাও যে আমার চাইবার আগেই তারা ভালবেসে আমার হাতে তুলে দিয়েছে। তাই আজ এই কয়েদখানার অন্ধকারে বসে-বসে মন আমার বারবার কেঁদে-কেঁদে বলে উঠছে, আমি যদি কোনো দোষ করে থাকি, তোমাদের যদি কষ্ট দিয়ে থাকি, সে-দোষ তোমরা নিয়ো না। আমায় ক্ষমা কোরো!

হয়তো এখন গভীর রাত্তির। মনে হচ্ছে, ঠান্ডা হাওয়ার আমেজ বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। আমার তরোয়ালটা এরা কেড়ে নিয়েছে। বাঁচোয়া, আমার গায়ের ছেঁড়া জামাটা আরও ছিঁড়ে দেয়নি। তুমি এখন এই অবস্থায় আমায় দেখলে, ঠিক বলছি, ‘ছিঃ ছিঃ করে উঠবে। কারণ রোদে আর বালিতে, ঝড় আর ঝক্কায় আমার যা অবস্থা হয়েছে। আমার গায়ে কত জায়গা যে কেটেছে, না দেখলে বুঝতে পারবে না। সঙ্গে-সঙ্গে পোশাকগুলোও ফর্দাফাঁই হয়ে ঝুলঝুল করছে। এ তবু ভালো। ছিড়ক। গায়ে তো আছে। কিন্তু মাথার পাগড়িটা যে কোথায় গেল, আমি খেয়ালই করতে পারছি না।

এরা আমায় খেতে দিল না। না-ই দিক। এখন কী আর খিদের কথা মনে আসে। আমার ভারি ক্লান্ত লাগছিল। তাই ঘুম পাচ্ছিল। চোখ দুটো যেন আপনা থেকে ঘুমে ঢুলে পড়ছিল। আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, সেখানেই বসে পড়লুম। বসে-বসে আমার মুখখানা দুটো হাঁটুর মধ্যে চেপে ঢুলতে লাগলুম। তারপর যে কখন আমি আপনা-আপনি লুটিয়ে পড়েছিলুম ঘরের মেঝেয়, জানি না। এখন আমি বলতে পারব না, কখন আমার চোখ দুটি অঘোরে ঘুমিয়ে পড়েছিল।

হঠাই হয়তো ঘরের দরজাটা খুলে গেছল। হঠাই ঝনাত করে একটা আলতো শব্দ আমার কানে বেজে উঠেছিল। আমার ঘুম ভেঙে গেল। আমি চমকে চিৎকার করে উঠেছিলুম, ‘কে?’

আলো। কার হাতে যেন আলো জ্বলছে। আমি আলো দেখছি, কিন্তু যার হাতে আলো তাকে দেখছি না। আলো-ছায়ায় দেখছি, পা থেকে মাথা অবধি একটা কালো জোববায় সে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছে। আমার দিকে সে এগিয়ে আসছে। আমি ভাবলুম, আর ভয় পেয়ে, চিৎকার করে কিছু লাভ নেই। এবার বোধহয় আমায় এই লোকটার হাতেই মরতে হবে। তাই লোকটা আমার মুখের সামনে এসে দাঁড়াতেই, আমি তাকে আর অন্য কোনো কথা না জিজ্ঞেস করে বললুম, ‘তুমি বুঝি আমায় মারবে?’

সে তখনই কোনো কথা বলল না। হয়তো ওই কালো কাপড়ের আড়াল থেকে আমার মুখের দিকে চেয়ে চেয়ে দেখছিল। ভয়ে যেন নিথর চারদিক। শুধু নিজেদের বুকের নিশ্বাস ছাড়া কোনো সাড়া নেই। আমি হাত বাড়ালুম তার দিকে। অস্ফুষ্ট স্বরে বললুম, ‘চলো। কোথায় নিয়ে যাবে আমায়।’

দেখলুম লোকটার হাত কাঁপছে। তার হাতের ওই আলোর শিখাঁটিও কাঁপতে-কাঁপতে নিভুনিভু হয়ে আবার জ্বলে উঠছে।

আমার কথা শুনে সে কথা বলল। খুব চাপা সে গলার স্বর। সে বলে উঠল, ‘তোকে আমি মরতে দেব না।’ বলেই একটা হাত আমার মাথায় রাখল। আমি অবাক হয়ে গেলুম। অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করলুম, ‘কে তুমি?’

আমার মাথায় রাখা তার হাতটা যেন গড়িয়ে-গড়িয়ে আমার গাল দুটির ওপর নেমে এল। তার হাতের পুরুষ্টু আঙুলগুলো আনন্দে আমার গালের ওপর নাচতে লাগল। আর তখনই আমি তার মুখখানি দেখার জন্যে ছটফটিয়ে উঠলুম। কিন্তু দেখতে পেলুম না। সে আবার তেমনি চাপা-স্বরে বলল, ‘আহা! তোর খুব লেগেছে, না?’

আমি বললুম, ‘কই, না!’

সে তখন আমার গাল থেকে হাতটি সরিয়ে এনে, প্রদীপের আলোয় আমার ক্ষত জায়গাগুলি হাত বুলিয়ে দেখতে লাগল। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে যেন আপন মনেই বলে ফেলল, ‘ভারি নিষ্ঠুর আমরা, ভারি নির্দয়!’

আমার আরও অবাক লাগছে। এই অন্ধকারে কোনো মানুষ যে আমায় আদর করতে পারে, এ আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না। আমি তো এদের হাতে বন্দি। আমাকে নিশ্চয়ই আদর করার জন্যে এরা বন্দি করে রাখেনি। কিন্তু এ লোকটা তাহলে কে? আমায় আদর করে এমন সব অদ্ভুত কথা বলছে। আমি তাই আবার তাকে জিজ্ঞেস করলুম, ‘তুমি কে? অমন করে নিজেকে কাপড়ের আড়ালে লুকিয়ে রেখেছ কেন? তোমার মুখখানা আমায় দেখতে দিচ্ছ না কেন?’

 সে বলল, ‘না, দেখিস না, দেখিস না এ-মুখ। আমি বড়ো পাপী! কিন্তু তুই বিশ্বাস কর, আমি পাপ করতে চাই না। আমি দস্যু হতে চাইনি। একদিন আমার সব ছিল। আমার ছেলে ছিল, আমার মেয়ে ছিল, আমার ঘর-সংসার সবই ছিল। একে-একে সব চলে গেছে। মানুষ বড়ো নিষ্ঠুর। বড়ো হিংস্র! তারাই আমার সব কেড়ে নিয়েছে। আজ তাদের জন্যেই আমি একজন খুনি দস্যু!’

আমি চুপ করে গেছি। মনে-মনে ভাবছি, যে হাত দিয়ে মানুষ খুন করে, সেই হাত দিয়ে আবার আদরও করে! তাই আমি তাকে আবার বললুম, ‘তুমি আমাকে এত কথা বলছ কেন?’

সঙ্গে-সঙ্গে সে আমার একটা হাত চেপে ধরল। চেপে ধরে বলল, ‘তুই আমাকে বাঁচা। তোকে দেখে আমার মন বলছে, আমি আর দস্যু হয়ে থাকতে চাই না। এদের কবল থেকে আমায় তুই মুক্ত করে নিয়ে যা। এদের জালে জড়িয়ে গেছি আমি। এরা আমায় ছাড়বে না।’

আমি বললুম, ‘তুমি তো ভারি আশ্চর্য কথা বলছ। আমি তো নিজেই বন্দি

হঠাৎ সে চুপ করে গেল। ‘ওই শোন, বাইরে কারা যেন ফিসফিস করে কথা বলছে।’ তাড়াতাড়ি সে প্রদীপটা নিবিয়ে ফেলে আমার মুখখানা তার হাত দিয়ে চেপে ধরল। তারপর আমার হাত ধরে টানতে টানতে ঘরের বাইরে নিয়ে চলল।

আমি জিজ্ঞেস করলুম, ‘কোথায় যাব?’

সে বলল, ‘বাইরে।’

 ‘কেন?’

‘ওরা আসছে।’

 ‘এলেই বা।’

সে জিজ্ঞেস করল, ‘মরতে তোর ভয় করে না?’

আমি বললুম, ‘না।’

ততক্ষণে ওর হাত ধরে অনেকটা ছুটে এসেছি। ছুটতে ছুটতেই লোকটা আমার উত্তর শুনে বলল, ‘তুই মরে গেলে তোর বাপকে দেখবে কে?’

আমার বুকটা দুরুদুরু করে কেঁপে উঠল। সত্যিই তো, আমি মরে গেলে আমার বাবাকে দেখবে কে? কে দেখবে আমার মাকে। আর তখনই আমার মনের মধ্যে যেন কে চেঁচিয়ে উঠল, না, আমি মরব না, কিছুতেই না। আমাকে বাঁচতেই হবে আমার বাবার জন্যে, আমার মায়ের জন্যে। এ-কথা মনে হতেই আমি তার হাত ধরে আরও জোরে ছুট দিলুম। ছুটতে-ছুটতে জিজ্ঞেস করলুম, ‘কোনদিকে যাবে? আমি তো কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।’

সে বলল, ‘তোকে দেখতে হবে না। আমি দেখছি। আমার হাতটা ভালো করে ধরে থাক। আমি তোকে বাইরে নিয়ে যাব।’

আমি তার কথামতো, তার হাতটা ভালো করে জাপটে ধরলুম। তারপর ছুটতে-ছুটতে ফটক পেরুতেই সে বলল, ‘এসে গেছি।’

‘কোথায়?’ আমি জিজ্ঞেস করলুম।

বাইরে।’ বলে হাঁপাতে-হাঁপাতে লোকটা আবার জিজ্ঞেস করল, ‘আলো দেখতে পাচ্ছিস?’

 আমি বললুম, ‘ঘরের চেয়ে এখানে কম অন্ধকার।

 সে জিজ্ঞেস করল, ‘এবার যেতে পারবি?’

 আমি বললুম, ‘পারব।’

বলতে-বলতেই আমি শুনতে পেলুম, কারা যেন চেঁচিয়ে উঠল, ‘ভাগল, ভাগল।’

সে যেন ভয় পেল। আমায় আড়াল করে সে বলল, ‘ওরা তোকে দেখতে পেয়েছে!’

আমি জিজ্ঞেস করলুম, ‘কী করব?’

সে আমার হাতটা ছেড়ে দিয়ে তেমনি চাপা-গলায় বলল, ‘লুকিয়ে পড়।’ বলেই সে কোথায় গা ঢাকা দিল। বোধহয় সেও লুকিয়েই পড়ল। কেননা, আমি তাকে আর দেখতেই পেলুম না। সে যে চট করে এইটুকু সময়ের মধ্যে লুকিয়ে পড়তে পারে, তা আমি ভাবতেই পারিনি। কিন্তু এখন আমি কী করব! কোথায় লুকোই! আর ভাববার সময়ই নেই। তাই আমিও ঝটকরে সামনের ফটকটার আড়ালেই ঢুকে পড়লুম। উঃ! কী ভাগ্য আমার! আর একটু হলেই ওরা দেখে ফেলত। আমার বুকটা কী প্রচণ্ড উত্তেজনায় ধক-ধক করছে। বুকটাকে দুহাত দিয়ে চেপে ধরে ফটকের আড়ালে পাথরের মতো চুপটি করে দাঁড়িয়ে রইলুম।

হঠাৎ আমি আঁতকে উঠেছি। আমার গায়ের ওপর কী যেন একটা ছিটকে পড়ল! বোধহয় একটা পোকা। সুড়সুড় করে উঠতেই আমি ঝটপট হাত দিয়ে সরিয়ে ফেলতে গেছি। তক্ষুনি আমার হাতে ঠকাস করে কী একটা ঠেকল। চেপে ধরেছি। টান পড়তেই আমার মনে হল, আমার গলায় যেন কী একটা ঝোলানো। আশ্চর্য তো! কোত্থেকে এল। আমার গলায় তো কিছু ছিল না। আমি তো কিছুই পরিনি। তবে? তবে কি সেই লোকটা কিছু পরিয়ে দিল আমার গলায়?

আমি অন্ধকারেই সেটা পরখ করছিলুম। করতে-করতে ভাবছিলুম, এটা আমার গলায় রাখব, না ছুঁড়ে ফেলব! কিন্তু হঠাৎ আমার চোখ দুটো ঝলসে উঠল। চোখের ওপর এক ঝলক রুপোলি আলো ঠিকরে পড়ল আমার। নিমেষে চোখ বুজে ফেলেছি। আমি থ হয়ে গেছি! একটু পরে ভয়ে-ভয়ে আবার চোখ খুলে ভাবছি, এ কি তবে এক টুকরো হিরে! আমার গলায় মালা হয়ে ঝুলছে! ঝুলতে ঝুলতে অন্ধকার ঝলমলাচ্ছে! আমি আবার দেখলুম! বারবার দেখলুম। তারপর চমকে উঠলুম! কেননা ওরা হল্লা করতে-করতে ছুটে আসছে। পাছে আমার বুকের এই আলোটা ওরা দেখতে পায় তাই চটপট আমি মালাটা আমার জামার ভেতর বুকের মধ্যে গলিয়ে ফেললুম। গলিয়ে ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে রইলুম।

একটু পরে যখন আর ওদের গলার স্বর শোনা গেল না, যখন মনে হল, লোকগুলো বোকা বনে গেছে, তখন আমি এই ফটকটার আড়াল থেকে একবার উঁকি মেরেছিলুম। কাউকে দেখতে পেলুম না। আরও একটু নিশ্চিন্ত হওয়ার জন্যে আর একবার উঁকি মেরেছি। না, সত্যিই কেউ নেই। আমি বেরিয়ে পড়েছি। ছুট দিয়ে পালাতে গেলে যদি নজরে পড়ে যাই, তাই না-ছুটে, ডিঙি মেরে পা ফেললুম। একটাই ভয়। সামনেটা শুনসান ফাঁকা। ঝট করে কারও নজরে পড়ে যেতে পারি! একবার দেখে ফেললে কী হতে পারে সে তো তোমরা বুঝতেই পারছ। তার ওপর আমার তরোয়ালটাও ওরা কেড়ে নিয়েছে। ধরতে এলে বুঝব কেমন করে! খালি হাতে কি লড়াই করা যায়! অগত্যা দু-হাত তুলে ওদের হাতে আবার ধরা দিতে হবে!

এমনি করে ডিঙি মেরে দু-চার পা হেঁটেছি হয়তো। হয়তো, থেমে-থেমে দু-একবার এপাশ ওপাশ দেখেছি। হঠাৎ আমার গা-টা কেমন শিরশির করে উঠল। পেছনে শত্রু। এমনি করে হাঁটলে ধরা পড়তে কতক্ষণ! সুতরাং ছোটো! আর বলতে। আমি ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে শুরু করে দিলুম!

বালির ওপর ছুটতে গিয়ে আমার পা ফসকাচ্ছে! হোঁচট খাচ্ছি। গায়ের কাটা-ছেঁড়ার ব্যথাগুলো টনটন করে উঠছে। তবু ছুটছি। আমি জানি, এখন বাঁচতে গেলে ছুটতেই হবে।

 অনেকটা ছুটে এসেছি। না, মনে হচ্ছে, আর দেখতে পাবে না। গাঢ় অন্ধকারে চারিদিক ঢেকে আছে। সেই অন্ধকারের মধ্যে দূর থেকে দূরে আমি যতই ছুটে যাচ্ছি, ততই যেন হারিয়ে যাচ্ছি। অবিশ্যি আকাশে যদি পূর্ণিমার চাঁদ থাকত, চাঁদের আলো যদি ছড়িয়ে পড়ত মরুভূমির ওপর, তখন যদি আমায় দেখতে, তবে তোমার নিজেরই এত ভালো লাগত! দেখতে আকাশের ওই আলোর ঝর্নায় ভাসতে-ভাসতে একটি ছোট্ট ছেলে হারিয়ে যাচ্ছে দূর থেকে দূরে একটি বিন্দুর মতো।

কিন্তু ওরা কি দেখে ফেলেছে? শুনতে পাচ্ছি, ঘোড়ার পিঠে কারা যেন ছুটে আসছে। পিছু ফিরে দেখলুম। হ্যাঁ, সত্যি তো! কী করি এবার! ওই তো সামনে বালির পাহাড়। উঁচু-নীচু পাহাড় থরেথরে দাঁড়িয়ে আছে। আমি জানি বাঁচার আর কোনো পথ নেই। তাই পড়ি-মরি বালির পাহাড়ের আড়ালেই আমি লুকিয়ে পড়লুম!

কিন্তু দস্যুর চোখকে তো আর ফাঁকি দেওয়া যায় না। তার ওপর একজন হলে কথা ছিল। অতজন! আমি যে কোথায় লুকিয়ে পড়লুম, তারা ঠিক দেখে ফেলেছে!

সুতরাং এই বালির পাহাড়ের সামনেই তাদের ঘোড়া থামল। ঘোড়ার পিঠ থেকে ঝটপট নেমেই আমায় খুঁজতে শুরু করে দিল। সত্যি বলতে কী, এই আঁধার রাতে বালির পাহাড়ে তখন তাদের সঙ্গে আমার লুকোচুরি খেলা শুরু হয়ে গেল। ওরা বাঁয়ে গেলে, আমি সামনে পালাই। ওরা সামনে গেলে আমি ওপরে উঠি। মজা কী, আমি ওদের স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু আমি যে কোথায় আছি, ওরা টেরই পাচ্ছে না। দেখতে না-পাওয়ার কারণও তো আছে! তোমাদের বললুম বটে বালির পাহাড়, কিন্তু তোমরা হয়তো বুঝতেই পারছ না, সে-পাহাড় কেমন পাহাড়। সে-পাহাড় মরুর ঝড়ে গড়ে ওঠে। একদিন নয়, দুদিন নয়, দিনের পর দিন ঝড়ের বালি জমে-জমে এই পাহাড় গড়ে উঠেছে। কোনোটার মাথা উঁচু, কোনোটা নীচু। কোনোটা বড়ো, কোনোটা ছোটো। কোনোটা শক্ত, কোনোটা আবার বালির মতোই ঝুরঝুরে। সুতরাং আমার লুকিয়ে পড়তে কষ্ট নেই।