৯-১০. রাণুদি ঘুমিয়েই কাটালেন

পরদিন দুপুর পর্যন্ত রাণুদি ঘুমিয়েই কাটালেন। এরমধ্যে তাকে কিছু খাওয়ানো যায় না। বিকেলের দিকে জেগে উঠেও রাণুদি চিনতে পারলেন না অজিতদাকে। তখন তার সেই একদম চুপচাপ থাকার অবস্থা, কেউ হাজারটা কথা বললেও উত্তর দেবেন না।

তবে, অসীম ধৈর্য অজিতদার। রাণুদি জেগে ওঠার পর তিনি সর্বক্ষণ বসে রইলেন রাণুদির কাছে। রাণুদি প্রগাঢ় স্তব্ধতা ভাঙবার জন্য তিনি একাই কথা বলে যেতে লাগলেন অনর্গল।

আমাদের সবারই মন ভার হয়ে আছে। সবাই ঠিক একটা কথাই ভাবছি, রাণুদি কি আগের অবস্থায় ফিরে আসবেন? অথবা, হঠাৎ অজিতদার কাছ থেকে আঘাত পেয়ে মনটা একেবারে বিকল হয়ে গেছে। যদিও অজিতদার খুব বেশী দোষ নেই, মাত্র একটা দিন সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত ছিলেন। মানুষের তো এরকম কাজ থাকতেই পারে। অজিতদা কোনো খবর দিয়ে যান নি রাণুদিকে। সেটা ওঁর বোঝার ভুল। উনি ভেবেছিলেন, খবর দিতে এলে রাণুদি ওঁকে ছাড়বেন না। আর আমাদের কাছে কোনো খবর দিয়েও বোধহয় কোনো লাভ হতো না, রাণুদি আমাদের কথা বিশ্বাস না করতেও পারতেন। তা হলেও এই একই অবস্থা হতো! ফেরার পর থেকে অজিতদা যে-রকম যত্ন করেছেন, তাতে আমরা ওকে ক্ষমা করে দিয়েছি।

সারাদিন আমাদের কোনো খেলা-টেলা জমলো না। আমরা একবারও চেঁচিয়ে কথা বলিনি বা হাসি-ঠাট্টা করিনি।

সন্ধের পর অনেকক্ষণ আমরা রাণুদিদের বাড়িতেই কাটালাম। বড়মামাও আজ বেশ গম্ভীর। নিয়মমতন পুজো করলেন ঠিকই, তারপর আমাদের পাশে বসে একটার পর একটা সিগারেট টানতে লাগলেন, চোখ দুটো উদাস। এই বংশে আগে একজন পাগল হয়ে গিয়েছিল বলে রাণুদিকেও সেই রোগে ধরলো। সম্পূর্ণ বিনা দোষে।

বড়মামা এক সময় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, তোমরা কিন্তু আজ এখানে খেয়ে যাবে।

আমরা একবাক্যে না, না, বলে উঠলাম। এ বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া মানেই একটা দারুণ হৈ-চৈ-এর ব্যাপার। বিশেষ যে-কদিন রাণুদি ভালো ছিলেন, ওঁর উপস্থিতিই আমাদের অন্তত আমাকে তো খুব বেশী আকৃষ্ট করতো। আজ এই নিরানন্দ পরিবেশে আমাদের একেবারেই খেতে ইচ্ছে করবে না।

আমাদের বাড়িতে রান্না হয়ে গেছে বলে আমরা উঠে পড়লাম। অজিতদার কাছ থেকেও বিদায় নিলাম না, অজিতদা রাণুদির ঘরে রয়েছেন, এখন আর ডিসটার্ব করার দরকার নেই।

মাঠ ভেঙে ফেরার পথে উৎপল বললো, রাণুদিকে পাগল জেনেও অজিতদা বিয়ে করতে চাইছেন, অজিতদার সত্যি দারুণ সাহস। আর পাগল মানে তো আর একটু আধটু পাগল নয়।

ভাস্কর বললো, এ বিয়ে হবে কি না খুব সন্দেহ হচ্ছে।

–কেন?

–রাণুদির মা রাজি নন। বড়মামা আমাকে বলেছেন। মাসিমা বলছেন, দিল্লি, ঐ অতদূরে রাণুদিকে পাঠিয়ে তিনি শান্তিতে থাকতে পারবেন না। তিনি রাণুদিকে নিজের চোখের কাছে রাখতে চান। অজিতদা কলকাতার ছেলে হলে কোনো আপত্তি ছিল না।

–অজিতদা ট্রান্সফার নিতে পারেন না?

–ট্রান্সফার নেওয়া কি অত সোজা? অজিতদা অবশ্য বলেছেন, উনি খুবই চেষ্টা করবেন, সম্ভবত পেয়েও যাবেন এক বছরের মধ্যে। যাই হোক, এখন সব কিছুই নির্ভর করছে রাণুদির বাবার ওপরে।

আমরা সবাই জানি, রাণুদির বাবাকে লম্বা টেলিগ্রাম পাঠানো হয়েছে। ওঁকে অনুরোধ করা হয়েছে খুব তাড়াতাড়ি চলে আসবার জন্য।

সাড়ে ন’টার মধ্যেই আমাদের খাওয়া হয়ে গেল। এখানে এসে এত তাড়াতাড়ি আর একদিনও খাইনি। এরপর উৎপল কিছুক্ষণ তাস খেলার প্রস্তাব দিল, সে বিষয়ে খানিকটা মতভেদ দেখা দিল আমাদের মধ্যে। আমরা ছাদে গিয়ে দাঁড়ালাম। সারাদিন বেশ গরম ছিল, এখন চমৎকার ঠাণ্ডা হাওয়া। এই এক অদ্ভুত আবহাওয়া এখানে, দিনের বেলা যতই উত্তাপ থাকুক, শেষ রাত্তিরের দিকে গায়ে চাদর দিতে হয়।

দূরে কার যেন চাচামেচি শুনতে পেলাম। আমরা উৎকর্ণ হয়ে একটুক্ষণ শুনেই বুঝতে পারলাম, রাণুদিদির বাড়ি থেকে সঞ্জয় বা অভিজিৎ কেউ ভাস্করদা, নীলুদা বলে ডাকছে।

এক মুহূর্ত দেরি না করে আমরা যে অবস্থায় ছিলাম সেইভাবেই সিঁড়ি দিয়ে নেমে ছুটতে লাগলাম। এমনকি একটা চর্টও আনিনি, মাঠ ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। নিশ্চয়ই ও বাড়িতে খুব একটা কিছু বিপদ হয়েছে।

গেট দিয়ে যাবার ধৈর্য নেই, পাঁচিল ডিঙিয়ে গাছপালার মধ্য দিয়ে ছুটলাম।

সঞ্জয় তখনো ডেকে চলেছে। কাছেই বড়মামা দাঁড়িয়ে, তার হাসি মুখ।

বড়মামার মুখ দেখেই আমাদের যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে গেল। বড়মামা আমাদের দেখে বললে, দেখেছো ছেলেটার কাণ্ড! এত করে বললাম, কালকে খবর দিলেই হবে, তা শুনলো না।

সঞ্জয় খুব উত্তেজিতভাবে বললো, দিদি ভালো হয়ে গেছে।

এই খবর দেবার জন্য সঞ্জয় আমাদের ডেকে এনেছে বলে আমরা তক্ষুনি ওর প্রতি কৃতজ্ঞ বোধ করলাম।

বড়মামা ঠাট্টা করে বললেন, এদিকে সাহস নেই, অন্ধকারের মধ্যে তোমাদের বাড়ি গিয়ে খবর দিতে ভয় পায়, তাই এখান থেকে চাচাচ্ছে।

ভাস্কর জিজ্ঞেস করলো, রাণুদি কোথায়?

বড়মামা বললেন, চলো, দেখা করে আসবে। সত্যি অজিত ছেলেটা বোধহয় মন্ত্র টন্ত্র জানে। আর যাই হোক, ছেলেটির মনের জোর আছে সাঙ্ঘাতিক। একথা স্বীকার করতেই হবে। মেডিক্যাল সায়েন্স যেখানে হার মেনে যায়, সেখানেও মানুষ মনের জোরে জিততে পারে।

রাণুদি আর অজিতদা এক সঙ্গে খেতে বসেছেন। মাসিমা এমনভাবে পরিবেশন করছেন, যেন ঠিক মেয়ে জামাইকে খাওয়াচ্ছেন। পরে শুনেছিলাম, রানুদি স্বাভাবিকভাবে কথা বলার পর মাসিমা অজিতদার হাত ধরে কেঁদে ফেলেছিলেন, আনন্দের কান্না। অজিতদাকে তিনি বলেছিলেন, বাবা, তুমি সত্যিই অসাধ্য সাধন করতে পারো। নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না।

.

রাণুদি আমাদের দেখে হাসি মুখে জিজ্ঞেস করলেন, কি হে, ফোর মাস্কেটিটয়ার্স, আজ সারাদিন তোমাদের দেখা নেই কেন?

অজিতদা আমাদের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপলেন।

আমি মনে মনে প্রথমে রাণুদি তারপর অজিতদা, তারপর যত রাজের ঠাকুর দেবতা, সব ক’জন ভগবান এবং গোটা পৃথিবী এবং স্বর্গকে ধন্যবাদ দিলাম। রাণুদির ভালো হবার জন্য যারা সামান্যমাত্রও দায়ী, তাঁরা সকলেই আমাকে ক্রীতদাস করে রাখতে পারে।

ভাস্কর বললো, আমাদের ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্টে কাল খেলা আছে কিন্তু! সক্কালবেলা যেতে হবে!

রাণুদি বললেন, আমি ঠিক যাবো। আর্শিই তোমাদের ডেকে তুলবো দেখো। তোমরা এখানে খেয়ে যাও।

–আমাদের খাওয়া হয়ে গেছে।

–ওমা, এর মধ্যে খাওয়া হয়ে গেল? যাঃ! একটা করে মাছ ভাজা খাও অন্তত, অনেক মাছ ভাজা আছে। মা, ওদের দাও না!

রাণুদি কিছুতেই শুনলেন না। সেই ভরা পেটেই আমাদের আবার মাছ ভাজা খেতে হলো।

আমরা গান গাইতে গাইতে বাড়ি ফিরে এলাম। আবার আমাদের জীবনটা চমৎকার হয়ে গেল। শুধু একটু মন খারাপ লাগতে লাগলো আমাদের। বাড়ি থেকে আর একটা কড়া চিঠি এলেই আমায় ফিরে যেতে হবে। বাবা এখন কেমন আছেন কে জানে। ক্লাণুদি আর অজিতদার বিয়েটা বোধহয় আমার দেখা হবে না।

এর পরের দুটো দিন আমাদের খুব আনন্দে কাটলো। শুধু আমরা নয়, রাণুদির মা-ও এখন বুঝে গেছেন যে অজিতদার সঙ্গে বিয়ে হলেই রাণুদি বেঁচে যাবেন। অজিতদা যতক্ষণ সঙ্গে থাকেন, ততক্ষণ রাণুদি একেবারে স্বাভাবিক। রাণুদি শুধু দেখতে সুন্দর নন, এমনিতে ওঁর মনটা খুব নরম আর দয়ালু, অন্য কারুর কষ্ট উনি কিছুতেই সহ্য করতে পারেন না।

একবার হোঁচট খেয়ে আমার পা কেটে গেল আর তার জন্যই কী দারুণ ব্যস্ত হয়ে পড়লেন রাণুদি। এমন করতে লাগলেন, যেন কেঁদেই ফেলবেন। আমার বাঁ পায়ের বুড়ো আঙুলের নোখের খানিকটা অংশ উড়ে গিয়ে রক্ত পড়ছিল বেশ, আমার খুবই ব্যথা লেগেছিল, কিন্তু অন্যদের সামনে তো আর তা প্রকাশ করা যায় না, সেইজন্য কিছুই হয়নি, কিছুই হয়নি বলছিলাম। রাণুদি আমাকে জোর করে এনে বসালেন আমাদের বাড়ির বারান্দায়। রান্নাঘর থেকে গরম জল আনিয়ে আমার ক্ষতস্থানটা পরিষ্কার করে দিলেন। ততক্ষণে রাণুদির হুকুমে সঞ্জয় দৌড়ে বাড়ি থেকে ডেটল, তুলো, মারকিওরোক্রোম আর ব্যাণ্ডেজ নিয়ে এসেছে। ওষুধ মাখিয়ে আমার পা-টা লাল করে দিতে দিতে রাণুদি বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগলেন, খুব লেগেছে, তাই না? ইস, খুবই লেগেছে।

….এমন মানুষও পাগল হয়? এটা পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ অন্যায় নয়?

রাণুদি আমার পায়ে হাত দিচ্ছেন বলে আমার লজ্জাও করছিল আবার রাণুদির ছোঁয়ায় আমায় ব্যথাও যে কমে গিয়েছিল একেবারে। রাণুদি আমার এত কাছে, আমি রাণুদির চুল ও শরীরের গন্ধ পাচ্ছি, একেবারে রাণুদির নিজস্ব গন্ধ, ব্লাউজের ফাঁক দিয়ে রাণুদির বুকের আভাস, ঠিক যেন সোনার….. আমি মনে মনে আবার অজিতদা হয়ে গিয়ে রাণুদিকে খুব আদর করতে লাগলাম। আমার অদৃশ্য দুটি হাত খেলা করতে লাগলে রাণুদির শরীরে।

আমি মনে মনে প্রার্থনা করতে লাগলাম, যেন এই পায়ের ব্যথাটার জন্য আমার খুব জ্বর হয়, তাহলে আমি সারাদিন বিছানায় শুয়ে থাকবো, রাণুদি আসবেন আমার কাছে, আমার শিয়রের কাছে বসবেন, আমার গায়ে হাত দেবেন, তখন আমিও রাণুদিকে–

কত লোকই তো বাইরে বেড়াতে যায়, সাধারণভাবে কয়েকদিন আনন্দ ফুর্তি করে, আবার ফিরে আসে। কোনো অন্যরকম ঘটনা ঘটে না। কিন্তু সেবার মধুপরে ঐ কয়েকটা দিনেই কত কী যে ঘটেছিল! অবশ্য, আমি যতবারই বাইরে কোথাও বেড়াতে গেছি, প্রত্যেকবারই অনেক নতুন নতুন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছে। সামান্য ছোটখাটো টুকিটাকি ব্যাপারও কত মর্মস্পর্শী হয়ে ওঠে। তবে, জীবনে সেই প্রথসবার গুরুজনদের সঙ্গে ছাড়া স্বাধীনভাবে বেড়াতে যাওয়ার কোনো তুলনাই হয় না অন্য অভিজ্ঞতার সঙ্গে।

এরপর, আমাদের মধুপুর-প্রবাসের দিনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সাম্রতিক ঘটনাটি ঘটলো।

আমাদের ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্ট খেলাটা বেশ জমে উঠেছিল। বড়মামা একটা কাপও ডিক্লেয়ার করে দিয়েছেন। সিঙ্গলস-এর খেলায় উৎপল, রাণুদি, ঝুমা আর ভাস্কর জমিয়ে দিয়েছে খুব, আমিও এই খেলাটা তেমন খারাপ খেলি না। নেহাত পায়ে এই চোটটা লাগবার পর খোঁড়াতে হচ্ছে, ভালো দৌড়তে পারছি না, এই যা! ডাবলস্-এর খেলায় রাণুদির পার্টনার অজিত, কিন্তু অজিতদার আর যত গুণই থাক, ব্যাডমিন্টনটা খেলতে পারে না মোটেই, সুতরাং রাণুদি আর একলা কত সামলাবেন। আমি আর উৎপল রাণুদিদের টিমকে যা-তা ভাবে হাতিয়ে দিলাম। যদিও তাতে আমার খুব একটা আনন্দ হলো না, রাণুদিকে হারিয়ে আমার মায়া হতে লাগলো। রাণুদির মন ভালো রাখবার জন্য ওঁকে সব ব্যাপারেই জিতিয়ে দেওয়া উচিত, কিন্তু খেলতে নেমে আর সে-কথা মনে থাকে না।

রাণুদি অবশ্য খুব একটা ভেঙে পড়লেন না। অজিতদাকে বললেন, আমরা এবার কয়েকদিন প্র্যাকটিস করে নিয়ে, দেখো, পরের বছর ওদের সবাইকে হারিয়ে দেবো।

অজিতদা হাসতে হাসতে বললেন, ঠিক আছে, পরের বছরও আমরা সবাই মধুপুরে আসবো। কী, কথা রইলো তো?

ভাস্কর বললো, নিশ্চয়ই।

বৃহস্পতিবার দিন বিকেলে দারুণ হাওয়া উঠে আমাদের খেলাটা ভেস্তে গেল। অবশ্য, এই কদিনও আমরা খেলেছি জোর করেই। শীতকাল ছাড়া ব্যাডমিন্টন খেলা জমে না। হাওয়াতে সার্ভিস ঠিক থাকে না, মারলাম একদিকে, কর্ক চলে গেল অন্য দিকে।

সেদিন খেলা বন্ধ করে নেট গুটিয়ে আমরা মাঠের ওপরেই বসলাম গোল হয়ে। পরী সেখানেই আমাদের চা দিয়ে গেল। মধুপুরে এসে আমরা দুবেলা চা খাওয়ায় খুব রপ্ত হয়ে উঠেছি। কলকাতায় মাঝে মাঝে সকালে শুধু এক কাপ চা খেতাম। এখানে এসে আমরা যেন পুরোপুরি বয়স্ক হয়ে উঠেছি।

আস্তে আস্তে সন্ধে নেমে এসেছে, আমরা অজিতদার কাছে দিল্লির গল্প শুনেছি। দিল্লি সম্পর্কে রাণুদির আগ্রহই বেশী। অন্য মেয়েরা নিজের বিয়ের প্রসঙ্গ তুলতে লজ্জা পায়, কিন্তু রাণুদি তো সাধারণ মেয়েদের মতন নন।

রাণুদি এক সময় বললেন, আমি জানি, দিল্লিতে গেলে আর আমার কোনোদিন অসুখ করবে না। আমি একদম ভালো হয়ে যাবো।

অজিতদা বললেন, তুমি তো ভালোই হয়ে গেছ, রানু।

রাণুদি বললেন, দিল্লি থেকে তুমি আমাকে একবার হিমালয় পাহাড় দেখাতে নিয়ে যাবে? আমার খুব পাহাড় দেখতে ইচ্ছে করে।

অজিতদা বললেন, নিশ্চয়ই।

সেই সময় একটা গাড়ির শব্দ হলো।

এই রাস্তায় গাড়ি প্রায় আসেই না, তাই আমরা সবাই কথা বন্ধ করে সেদিকে তাকালাম। তাহলে বোধহয় কাছাকাছি কোনো বাড়ির লোক এলো।

আমাদেরই বাড়ির গেট ঠেলে ঢুকলো কয়েকজন পুলিশ।

আমরা অবাক। হঠাৎ পুলিশ এখানে? সেই যে রাণুদি, একদিন হারিয়ে যাবার পর বড়মামা পুলিশের খবর দিয়েছিলেন, তারপর আর পুলিশ সে ব্যাপারে কোনো খোঁজও নেয়নি একবারও। এতদিনে বুঝি সেই কথা মনে পড়েছে। পুলিশের ব্যাপারই আলাদা।

পুলিশকে দেখার সঙ্গে সঙ্গেই অজিতদা বিদ্যুতের মতন উঠে দাঁড়িয়ে ছুটলেন বাগানের দিকে।

একজন পুলিশ অফিসার চিৎকার করে বললেন, হল্ট! অর আই উইল ফায়ার।

অজিতদা না থেমে পৌঁছে গেলেন পাঁচিলের কাছে। সেখানে একবার ফিরে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে বার করলেন একটা কী যেন। আবছা অন্ধকারে ভালো দেখা যাচ্ছে না অজিতদাকে।

পরের মুহূর্তেই গুলির শব্দ হলো।

আমরা বিমূঢ় হয়ে বসেছিলাম। ভাস্কর চেঁচিয়ে উঠলো, শুয়ে পড়, সবাই শুয়ে পড়।

হাত ধরে জোর করে টেনে সে রাণুদিকেও শুইয়ে দিল।

আমার বুকের মধ্যে ধড়াস ধড়াস করে শব্দ হচ্ছে। স্কুল থেকে একবার স্ট্রাইক করে মিছিল নিয়ে আমরা গিয়েছিলাম ওয়েলিংটন স্কোয়ারে, তখন পুলিশ গুলি চালিয়েছিল। খুব কাছ থেকে সেই প্রথম আমি গুলির শব্দ শুনি, আর এই এবার দ্বিতীয়বার।

কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস হলো, এবার গুলি চালিয়েছে অজিতদা। তার মানে অজিতদার কাছে সব সময় একটা রিভলভার থাকে।

রোমাঞ্চে আমার সারা শরীর কাঁপতে লাগলো। বিপ্লবী! অজিতদা নিশ্চয়ই একজন বিপ্লবী! গোড়া থেকেই অজিতদার ব্যবহারে একটু অন্যরকম কিছু ছিল। একজন সত্যিকারের বিপ্লবী আমাদের সঙ্গে এত সহজভাবে মিশেছেন।

অজিতদার জন্য রাণুদির নিশ্চয়ই এখন আরও বেশী গর্ব হবে। আমি মনে মনে বলতে লাগলাম, হে ভগবান, অজিতদা যেন ধরা না পড়েন। কিছুতেই না।

অনেকগুলো পুলিশ আমাদের বাগানের ফুলগাছ মাড়িয়ে দৌড়োদৌড়ি করছে আর চ্যাঁচাচ্ছে। কয়েকজন ধস ধপাস করে পার হয়ে গেল পাচিল। আরও দু’বার গুলির শব্দ হলো। নিশ্চয়ই কারুর গায়ে লাগেনি, কারণ কেউ তো ব্যথায় চেঁচিয়ে ওঠেনি।

আমি মনে মনে ভগবানকে ডেকেই যাচ্ছি। তখনো যে অজিতদা ধরা পড়েন নি, তা বোঝা যায়। এই অন্ধকারের মধ্যে অজিতদা বহুদূর চলে যেতে পারবেন।

তখন রাণদির কান্নার শব্দ পেলাম।

 মাটিতে মুখ চেপে রাণুদি বলছেন, বাঁচবে না, আমি জানি, ও বাঁচবে না!

.

১০.

মাঝ পথে পুজো থামিয়ে বড়মামা সতীশবাবুকে টর্চ নিয়ে হাতে চলে এলেন এ বাড়িতে। গুলির শব্দ তিনিও শুনতে পেয়েছেন।

পুলিশরা কেউ আর নেই বাগানে। আমরাও সবাই মাঠ ছেড়ে চলে এসেছি বারান্দায়। বড়মামাকে দেখে আমরা প্রথমে সবাই মিলে এক সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলাম, তাতে উনি কিছুই বুঝতে পারলেন না।

তারপর ভাস্কর নেতৃত্ব নিয়ে সবাইকে থামিয়ে ঘটনাটা জানালো।

বড়মামা ভুরু কুঁচকে বললেন, পুলিশ? আমি অন্যরকম ভেবেছিলাম। এ বাড়িতে একটা বন্দুক আছে আমি জানি। ভাবলাম, তোমরাই কেউ ছেলেমানুষী করে সেটা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে–

কথা থামিয়ে বড়মামা রাণুদির দিকে তাকালেন। রাণুদির ব্যবহারে খুব অস্বাভাবিক কিছু এখনো প্রকাশ পায়নি।

রাণুদির মুখখানা বিবর্ণ, তিনি শুধু জিজ্ঞেস করলেন, পুলিশরা ওকে মেরে ফেলবে, তাই না? ওকে মারবার জন্য এসেছে।

বড়মামা বললেন, কী ব্যাপার, কিছুই তো বুঝতে পারছি না।

পুলিশের গাড়িটা তখনো দাঁড়িয়ে আছে গেটের কাছে। ভাস্করকে নিয়ে বড়মামা এগিয়ে গেলেন সেই গাড়িটার কাছে। যাবার সময় বললেন, রাণু, তুমি ব্যস্ত হয়ো না। একটু চুপ করে বসে থাকো, আমি সব খবর জেনে আসছি।

কোথা থেকে কিছু লোক এসে এর মধ্যেই গাড়িটার পাশে ভিড় করে দাঁড়িয়েছে। আমারও খুব ইচ্ছে করছিল ওখানে যাবার, কিন্তু সবাই মিলে চাঞ্চল্য দেখানো রাণুদির। সামনে উচিত হবে না।

আমি রাণুদিকে জিজ্ঞেস করলাম, অজিতদা আপনাকে একবারও বলেন নি যে উনি বিপ্লবী?

রাণুদি দু’দিকে মাথা নেড়ে বললেন, না।

এত বড় একটা ব্যাপারে আমরা দারুণ বিচলিত হয়ে পড়লেও সেই তুলনায় রাণুদি যেন অনেক শান্ত। কোন ঘটনার প্রতিক্রিয়া যে কীভাবে ওর মনের মধ্যে দেখা দেবে, তার কোনো ঠিক নেই।

ভাস্কর আর বড়মামা একটু বাদেই ফিরে এলেন। বিশেষ কিছু খবর পাওয়া যায় নি। গাড়িতে রয়েছে শুধু ড্রাইভার আর একজন রোগা মতন পায়জামা শার্ট-পরা লোক। তারা বিশেষ কিছু বলতে পারেনি কিংবা বলতে চায়নি। শুধু বলছে, ডাকু পাকড়ানে আয়া!

ভাস্কর বললো, ঐ রোগা পায়জামা শার্ট পরা লোকটাকে চেনা চেনা মনে হলো। খুব সম্ভবত ও দু-একদিন ডিম বিক্রি করতে এসেছিল।

উৎপল বললো, ঐ ব্যাটাই স্পাই।

বড়মামা বললেন, তোমরা এখানে বসে কী করবে। চলো, সবাই আমাদের ওখানে চলো। দিদিকেও খবরটা দিতে হবে।

আশু বললো, আমরা দু-একজন এখানে থাকি। গাড়ি যখন রয়েছে, পুলিশরা তো এখানে ফিরে আসবেই, তখন খবরটা পাওয়া যাবে।

বড়মামা বললেন, ড্রাইভারকে বলেছি, ইন্সপেক্টর এলে আমাকে একবার খবর দিতে। আমি এখানকার পুরোনো লোক, পুলিশের লোকেরা সবাই চেনে। আয় রাণু।

রাণুদি বললেন, ওরা যদি ওকে মেরে ফেলে, তারপর আমাদের দেখতে দেবে? বড়মামা বললেন, মেরে ফেলবে মানে? মারা অত সহজ নাকি?

আমার ইচ্ছে করলো, মাঠের মধ্যে যেদিকে পুলিশরা অজিতদাকে তাড়া করে গেছে, সেই দিকটায় গিয়ে একবার দেখে আসি। চুপি চুপি দূর থেকে দেখবো–

সে কথা উচ্চারণ করা মাত্রই সবাই ধমকে দিল আমাকে। গুলি গোলা চালিয়েছে, তার মধ্যে যাওয়া মানে বিপদকে আরও ডেকে আনা।

রাণুদি আপত্তি করলেন না, বড়মামার পাশে পাশে হাঁটতে লাগলেন। বাগানে আমার চায়ের কাপ ডিসগুলো এখনো পড়ে আছে। মাত্র পনেরো কুড়ি মিনিট আগেও আমরা এখানে কী সুন্দর গল্প করছিলাম, এরমধ্যে কত কী হয়ে গেলো। ওরা অজিতদাকে ধরতে পারবে?

ও বাড়ির চাতালে গিয়ে আমরা কলকোলাহল করে এই ঘটনাই আলোচনা করতে লাগলাম। বড়মামা এর মধ্যে অসমাপ্তপূজো সেরে নিলেন।

আশ্চর্য ব্যাপার, অজিতদাকে পুলিশ তাড়া করেছে শুনে মাসিমা ধপ করে বসে পড়ে অজ্ঞানের মতন হয়ে গেলেন, চোখ দুটো কী রকম যেন হয়ে গেল। আর তখন রাণুদিই সেবা করতে লাগলেন মা-কে। মা তোমার কী হলো, কী হলো? বলে তিনি তাড়াতাড়ি কুয়োর কাছ থেকে এক মগ জল এনে মায়ের চোখ মুখে ছিটোতে লাগলেন।

পুলিশ ফিরে এলো প্রায় এক ঘণ্টা বাদে।

কনস্টেবলরা বসে রইলো গাড়িতে, ইন্টপেক্টরের মতন পোশাক পরা তিনজন পুলিশ গেট খুলে ভেতরে এলো জুতো মশমশিয়ে। কালীমন্দির দেখে তারা ভক্তিভরে প্রণাম করলো প্রথমেই।

আমাদের মধ্যে বড়মামাই শুধু কথা বলবেন। পুলিশদের দিকে সিগারেটের প্যাকেটটা এগিয়ে দিয়ে বড়মামা জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপারটা হলো বলুন তো! কিছুই তো বুঝতে পারছি না।

একজন পুলিশ অফিসার বিশ্রী একটা গালাগালি দিয়ে বললো, ব্যাটা এবারেও ভেগে পড়লো। নটোরিয়াস ক্রিমিন্যাল মোশাই, আপা নাদের ভি সর্বনাশ করে দিত।

রাগে গা জ্বলে গেল আমার। এরা অতি তাকে গালাগাল দিচ্ছে। এরা বিপ্লবীদেরও ক্রিমিন্যাল বলে।

বড়মামা চাতালটা দেখিয়ে দিয়ে পুলিশ তিনজকে বললেন, বসুন না। বৈঠিয়ে আপলোগ সিংজী, সব ব্যাপারটা খুলে বলুন তো!

পুলিশ তিনজন বসে পড়লো চাতালে। একজন জিজ্ঞেস করলো, জুতা খুলনে হোগা?

বড়মামা বললেন, না, ঠিক আছে।

সিংজী যার নাম সেই পুলিশটি পকেট থেকে একটা ছবি বার করে বললো, ইয়ে দেখুন, শিবনাথ পাণ্ডে। ডাকু আর খুনী। পাটনায় তিন তিনটে কেস ঝুলছে। এরকম ডেঞ্জারাস আদমি আপনার বাড়িতে ঘুষেছিল।

আমরা হুমড়ি খেয়ে পড়ে ছবিটা দেখলাম। অজিতদারই যে ছবি তাতে কোনো সন্দেহ নেই। মুখে দাড়ি নেই শুধু তবু চিনতে অসুবিধে হয় না।

কিন্তু অজিতদার আসল নাম শিবনাথ পাণ্ডে? অজিতদা একটা ছদ্মনাম নিলেও উনি বিহারী হয়ে বাঙালী সাজবেন কী করে। ওঁর বাংলায় তো কোন খুঁত নেই। নিশ্চয়ই কোনো ভুল হয়েছে। পুলিশ একজনের দোষ অন্যের নামে চাপায়।

বড়মামাও অজিতদাকে বাঙালী বলয় সিংজী বললো, হ্যাঁ, হাঁ, ওর মা বাঙালী, বা বিহারী। লেকিন, বাঙালীদের সঙ্গেই ওর বেশী কারবার। আউর ভি দেখুন।

সিংজী আরও তিন-চারখানা ছবি বার করে দেখালো। সব কটাই অজিতদার।

বড়মামা বিহ্বলভাবে বললেন, আপনাদের কোনো ভুল হয়নি তো?

সিংজী বললো, আরে নেহি, ডাক্তারবাবু! দু’জন পাটনা থেকে এসেছেন, ইনারা খুব ভালো করে চিনেন। একবার ধরাও পড়েছিল শালা।

বড়মামা বললেন, রাণু, তুমি ভেতরে যাও। খোকন, দিদিকে ভেতরে নিয়ে যা তো!

রাণুদির পাশেই ছিলাম আমি। রাণুদি ঠোঁটটা শুধু কামড়ে ধরেছিলেন, আর কোনোরকম অসুস্থতার চিহ্ন প্রকাশ পায় নি। তিনি শান্তভাবে বললেন, না, আমি এখানেই থাকবো। আপনারা কি ওকে মেরে ফেলেছেন?

সিংজী রাণুদির আপাদমস্তক দেখে দুঃখের সাথে মাথা নেড়ে বললেন, ইনাকেও। আমার ইন্টারোগেট করতে হবে। ত আপনার নসীবসে বেঁচে গেছেন। ও বহুৎ ডেঞ্জারাস ক্রিমিন্যাল। নিজের শালার উ, ওয়াইফের ভাইয়ের যে ইস্তিরি, তাকে ও পহেলা খুন করে।

সেখানে একটা বোমা পড়লেও আমার এতটা বিস্মিত হতাম না। আমি তার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত অজিতদাকে বিপ্লবী বলেই ভাবছিলাম। কিন্তু অজিতদা বিবাহিত? একজন মহিলাকে তিনি খুন করেছেন? কোনো খুনী অন্যদের সঙ্গে এমন ভালো ব্যবহার করতে পারে?

আমার মুখ থেকে আপনিই বেরিয়ে এলো, মিথ্যে কথা!

একজন পুলিশ আমার দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, এ ছোরা কে আছে?

বড়মামা ব্যস্ত হয়ে বললেন, ওরা পাশের বাড়িতে থাকে, ওরা কিছু জানে না। এই তোমরা এখন সব ভেতরে যাও!

এতেও কিন্তু রাণুদির মধ্যে কোন ভীষণ কিছু ব্যাপার ঘটলো না। তিনি ধীর পায়ে চলে গেলেন বাড়ির দিকে। আমরা দুরু দুরু বুকে সেদিকে চেয়ে রইলাম। রাণুদি গতি বাড়ালেন না একটুও, যেন কিছুই হয়নি, এইভাবে ঢুকে গেলেন নিজের ঘরে।

পুরো ঘটনাটা আমরা এর পরে শুনলাম। অজিতদা ওরফে শিবনাথ পাণ্ডে মোটামুটি লেখাপড়া শিখে পাটনায় একটা চাকরি করতেন। বিয়ে দিয়ে করে সংসারীও হয়েছিলেন সাধারণ লোকের মতন। তারপর নিজের শ্যালকের স্ত্রীর সঙ্গে একটা অবৈধ ঘটনায় জড়িয়ে পড়ে শেষ পর্যন্ত তাকে খুন করে ফেলেন রাগের মাথায়। সেই থেকে ফেরার বছর দেড়েক ধরে ফেরার থাকার সময় খরচ চালাবার জন্য গোটা দুয়েক ডাকাতি করেছেন, তার মধ্যে মজঃফরপুরে এক ব্যাঙ্ক ডাকাতির সময় একজন ক্যাশিয়ার খুন হয়, সে খুনের ব্যাপারেও অজিতদাই দায়ী বলে পুলিশ সন্দেহ করে।

মধুপুরের বাড়িটা মোটেই ওর জামাইবাবুর নয়। মালির কাছ থেকে অজিতদা ওটা ভাড়া নিয়েছেন। এখানকার অনেক ফাঁকা বাড়িই মালিরা গোপনে ভাড়া দেয়। এইসব জায়গায় লুকিয়ে থাকার খুব সুবিধে। একবার কলকাতায় পুলিশ ওকে প্রায় ধরে ফেলেছিল, একটুর জন্যে ফস্কে যায়। মধুপুরে প্রায় চার মাস ধরে ও লুকিয়ে আছে, ওর কিছু সাকরেদও নিশ্চয়ই আছে আশেপাশে। এখান থেকেই কাছাকাছি কোনো জায়গায় আবার ডাকাতির ফন্দি আঁটছিল, পুলিশের এরকম সন্দেহ।

সেইদিনই প্রথম আমরা চারজনে একসঙ্গে এক ঘরে শুতেও ভয় পেলাম। যদি অজিতদা হঠাৎ ফিরে আসে? অজিতদার মুখখানা মনে পড়লেই এখন ভয় করছে।

আর কেউ আপত্তি করতে পারলুম না। বন্দুক নিয়ে আসা হলো সেই বন্ধ ঘর থেকে। তবু যেন একটা বন্দুক দেখলে একটু সাহস জাগে।

উৎপল বললো, অজিতদা কোথায় লুকুতে পারে, সেটা বোধহয় একমাত্র আমরাই জানি।

ভাস্কর বললো, হ্যাঁ, সেই আসল সাধু নয়। ডাকাতের মতন চেহারা। আমি তখনই সন্দেহ করেছিলুম।

আশু বললো, সে কথা আগে বলিস নি কেন?

উৎপল বললো, বলিনি, মানে বলে কী হবে, এই ভেবেছিলুম। আমি অজিতদাকে তো সন্দেহ করিনি। তোদেরও লক্ষ্য করা উচিত ছিল, সাধুটা ভাত রাঁধছিল। বিহারী সাধুরা আ৩ খায়?

ভাস্কর বললো, ওর মুখের হিন্দীটাও যেন কেমন কেমন! ঐ লোকটাও নিশ্চয়ই বাঙালী।

আশু বললো, আমার একবার মনে হয়েছিল, পুলিশের কাছে ঐ সাধুটার কথা বলবো কি না!

ভাস্কর বললো, আমাদের কী দরকার? অজিতদা তো আমাদের কোনো ক্ষতি করেনি! আমরা ওকে ধরিয়ে দিতে যাবো কেন?

আশু বললো, তবুও এটা আমাদের ডিউটি পুলিশকে সাহায্য করা। তাছাড়া রাণুদিকে নিয়ে অজিতদা কী করতে চেয়েছিল কে জানে? বোধহয় গয়নাগাটি সমেত রাণুদিকে এখান থেকে নিয়ে গিয়ে পরে খুন করে ফেলতো!

ভাস্কর বললো, কী দারুণ লোক মাইরি! একদম বুঝতে পারিনি।

আশু বললো, তারা কি বলিস? কাল সকালে পুলিশের কাছে ঐ পাহাড়ের কথাটা আমাদের জানিয়ে আসা উচিত নয়?

উৎপল বললো, চুপ! কার যেন পায়ের শব্দ শুনলাম!

আমরা কান পেতে রইলাম। আর কোনো শব্দ শোনা গেল না। আশু আর ভাস্কর সাহস করে একবার বাইরেটা উঁকি দিয়ে দেখে এসে বললো, ধুৎ কোথায় পায়ের শব্দ। কেউ তো নেই!

উৎপল বললো, আমার বার বার মনে হচ্ছে, অজিতদা যেন ফিরে এসে লুকিয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের সব কথা শুনছে।

ভাস্কর বললো, অত ভয় পাবার কিছু নেই! ঘরের দরজা-জানলা বন্ধ, সব আজ বন্ধ থাকবে। তোরা ঘুমিয়ে পড়লেও আমি একলা আজ রাতটা জেগেই কাটিয়ে দেব।

উৎপল বললো, পুলিশ ফুলিসে আমাদের খবর দেবার কোনো দরকার নেই। তারপরও যদি অজিতদা ধরা না পড়ে আর আমাদের ওপর রিভেঞ্জ নেয়?

ভাস্কর বললো, অত সোজা নয়। তাছাড়া আমরা তো চলেই যাবো এখান থেকে। আর থাকতে ভালো লাগছে না।

আশু বললো, রাণুদির কী হবে? উৎপল বললো, আজ কিন্তু খুব চমৎকার সামলে নিয়েছে।

ভাস্কর বললো, আর একটা কথা ভেবে দেখেছিস? মনে কর, কাল কোনো এক সময় অজিতদা যদি চুপিচুপি ফিরে এসে রাণুদিকে নিয়ে যেতে চায়? রাণুদি যদি রাজি হয়ে যায়? রাণুদিকে এমনভাবে জাদু করেছে যে রাণুদি বোধহয় এখনো রাজি হবে।

উৎপল বললো, লোকটার মেয়ে পটাবার ক্ষমতা আছে। একটা পাগল মেয়েকে পর্যন্ত…

ভাস্কর বললো, রাণুদিকে নিতে চাইলে কী হবে বল না?

আশু বললো, আমরা আটকবো। আমরা চার জনে মিলে ওকে বেঁধে ফেলতে পারবো না?

উৎপল বললো, ওর কাছে রিভলবার আছে।

ভাস্কর বললো, আমাদেরও বন্দুক আছে। তোরা বিশ্বাস করছিস না, কিন্তু আমি সত্যিই বন্দুক চালাতে পারি। অন্তত ভয় দেখাতে তো পারবো।

আশু বললো, নীলুটা ঘুমিয়ে পড়েছে নাকি রে?

উৎপল বললো, কী জানি, সাড়া শব্দ তো পাচ্ছি না। উপুড় হয়ে মুখ খুঁজে শুয়ে আছে।– ভাস্কর বললো, সেই যেদিন সারাদিন ছিল না অজিতদা, সন্ধের পর জসিডি থেকে ফিরলো, সেদিন আমি লক্ষ্য করেছিলাম, ওর প্যান্টে চোরকাঁটা লেগে আছে। জসিডিতে গেলে প্যান্টে চোরকাঁটা ফুটবে কোথা থেকে! সেদিনও মিথ্যে কথা বলেছিল, নিশ্চয়ই ঐ সাধুটার কাছেই গিয়েছিল মাঠ ভেঙে।

আশু বললো, কেন, ঐ টেলিগ্রামের ব্যাপারটা? মধুপুরের যন্ত্র খারাপ, সেইজন্য জসিডিতে যেতে হয়েছে, এটাও তো গুল। পরদিন রাণুদির বাবাকে টেলিগ্রামটা তো আমিই সঞ্জয়কে নিয়ে সাইকেলে গিয়ে পাঠিয়ে এলাম মধুপুর থেকে। ওরা বললো, কই না তো, আগের দিন তো যন্ত্র খারাপ ছিল না। আমি অবশ্য তখন ভেবেছিলাম, কোনো কারণে ওর জসিডি যাবার দরকার ছিল। রাণুদিকে ভোলাবার জন্য মিথ্যে কথা বলেছে।

ভাস্কর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, রাণুদির এবার কি হবে বল তো?

সে কথার কেউ উত্তর দিল না।

একটু পরে ওরা তিন জনেই আমার দিকে ফিরে ব্যস্ত হয়ে বললো, এই নীলু, তুই কাঁদছিস কেন?

আমি কিছুতেই কোনো কথা বলতে পারলাম না, অকূল কান্না যেন আমায় ভাসিয়ে দিতে চাইছে। রাণুদির ওপর এতখানি অন্যায় সহ্য করা আমার পক্ষে যেন অসম্ভব। অথচ, আমি কীই বা করতে পারি!

পৃথিবীতে অনেক ডাকাত-বদমাইশ আছে, আমি জানি। কিন্তু সত্যিকারের কিছু ভালো লোকও তো আছে। রাণুদির জন্য অজিতদা নামের লোকটি কি একটি খাঁটি ভালো লোক হতে পারতো না? যে মানুষটির জন্য রাণুদি নিজের মনটাকে ফিরে পাচ্ছিলেন, সেই মানুষটার আসলে কোনো হৃদয় নেই। এ অন্যায়, বিষম অন্যায়, অসহ্য অন্যায়।

ওরা কেউ আমাকে সান্ত্বনা দিতে পারলো না। চুপ করে রইলো।

ভেবেছিলাম, সকালবেলা উঠে দেখবো, আবার সব ঠিকঠাক হয়ে গেছে। অজিতদা চা খেতে এসেছেন আমাদের বাড়িতে, রাণুদি ব্যাডমিন্টন খেলছেন……পুলিশ, রিভলবার, গুলি এ সবই একটা দুঃস্বপ্ন।

কিন্তু তা হলো না। পুলিশ অনবরত ঘোরাঘুরি করতে লাগলো, আমাদেরও জেরা করলো অনেকক্ষণ ধরে। অজিতদাকে ওরা এখনো ধরতে পারে নি, কিন্তু অজিতদা সম্পর্কে আরও খবর শুনতে লাগলাম নানা রকম।

পরের দু’দিন রাণুদি একটা অদ্ভুত অবস্থার মধ্যে কাটালেন। ঠিক পাগলামি নয়, একটা যেন ঘোর লাগা ভাব। হাঁটছেন, কথা বলছেন, সবই ঠিক আছে, অথচ বোঝা যায় কিছুই ঠিক নেই। কখনো দাঁড়িয়ে থাকছেন একটা ফুল গাছের পাশে, কখনো কালী মূর্তির সামনে বসে গুনগুন করে গান গাইছেন আপন মনে।

একবার আমাদের ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, কী, তোমরা আর ব্যাডমিন্টন খেলছে

আমরা সাগ্রহে বললাম, হ্যাঁ খেলবো। আপনি খেলবেন আমাদের সঙ্গে?

রাণুদি একটুক্ষণ যেন চিন্তা করে বললেন, না তোমরাই খেল, আমার ইচ্ছে করছে না।

রাণুদির কোনো কথাই অসংলগ্ন নয়। কিন্তু এক মিনিট দু’মিনিটের মধ্যে প্রসঙ্গ বদলে ফেলছেন।

আমরা অজিতদার নাম রাণুদির সামনে একবারও উচ্চারণ করিনি। উনি নিজেই অন্তত দুবার জিজ্ঞেস করলেন ও ধরা পড়েছে? ওকে ওরা মেরে ফেলেছে?

অজিতদার কথা রাণুদি ভুলে যাননি বলেই, ওঁর স্বাভাবিক চেতনা রয়েছে। অথচ এটাও স্বাভাবিক নয়। খুব গভীর দুঃখ বোধ বা আঘাত পাবার কোনো চিহ্ন নেই ওর ব্যবহারে।

আমি সর্বক্ষণ রাণুদির কাছাকাছি রইলাম এই দু’দিন। কিন্তু আমি তো অজিতদা নই। আমি রাণুদিকে সম্পূর্ণ সুস্থ করে তোলার মন্ত্র জানি না। রাণুদির চোখে আমি তো একটা বাচ্চা ছেলে, আমি আর ওর কতখানি সঙ্গী হবো?

রবিবার সকালে ঘুম থেকে উঠেই ভাস্কর বললো, আর ভালো লাগছে না, চল আজই ফিরে যাই।

কেউই আপত্তি করলো না। আমাদের এখানে স্বস্তি চলে গেছে। অজিতদার কোনো খবর নেই। পুলিশ মহল চুপচাপ। এদিকে সর্বক্ষণ রাণুদির কী হয়, কী হয় চিন্তা! রাণদিকে দেখলে মনে হয়, যে কোনো মহর্তে কী হয়, উনি ভেঙে পড়বেন। এক এক সময় কথা বলতে বলতে রাণদি দাঁতে দাঁত চেপে চুপ করে যান, মুখের রং রক্তবর্ণ হয়ে যায়, বোঝা যায় উনি প্রাণপণে নিজেকে সামলে নিতে চাইছেন। রাণুদি কিছুতেই হার স্বীকার করতে চান না।

ওরা যেতে না চাইলেও আমাকে আজ কালের মধ্যে একলা চলে যেতেই হতো। বাড়ি থেকে আবার চিঠি এসেছে। সুতরাং ভাস্করের প্রস্তাবে হতো। বাড়ি থেকে আবার চিঠি এসেছে। সুতরাং ভাস্করের প্রস্তাবে আমি কৃতজ্ঞ বোধ করলাম। জিনিসপত্র গোছগাছ করে নিলাম তখনই। ট্রেন অবশ্য রাত্রিবেলা।

চা-টা খেয়ে আমরা গেলাম রাণুদিদের বাড়ি বিদায় নিতে। প্রথমেই দেখা হলো বড়মামার সঙ্গে। তিনি আমাকে কথা শুনে খুব একটা আশ্চর্য হলেন না। গম্ভীরভাবে বললেন, কলেজ-টলেজ খুলে যাচ্ছে বুঝি? আজ রাণুর বাবা আসছে, তোমরা ও বেলা এসে একবার দেখা করে যেও অন্তত।

সঞ্জয় আর অভিজিৎ চেঁচামেচি করলো খানিকটা। তারপর ঠিকানা দেওয়া নেওয়া হলো। ঝুমা বললো, এবার বাবার সঙ্গে আমিও ফিরে যাবো। আমার আর একটুও পছন্দ হচ্ছে না এ জায়গাটা।

মুস্কিল হলো, রাণুদির কাছ থেকে কীভাবে বিদায় নেওয়া হবে? রাণুদি কথাটা কীভাবে গ্রহণ করবেন, তার তো ঠিক নেই। চারজনের মধ্যে আমার সঙ্গেই রাণুদির একটু বেশী ভাব বলে, ওরা বললো, নীল, তুই-ই খবরটা জানিয়ে দে রাণুদিকে।

আমি তাতে রাজি নই। যদি আমাদের কথা শুনলে রাণুদি অন্য রকম হয়ে যান? তার চেয়ে রাণুদিকে কিছু না বলে যাওয়া, বরং ভালো।

আমি ঠিক করলাম, রাণুদিকে একটা চিঠি লিখে সবাই মিলে সই করে সেটা রেখে যাবো ঝুমার কাছে। রাণুদি কাল যদি আমাদের খোঁজ করেন, তখন সেটা দেখানো হবে।

রাণুদির সঙ্গে দেখা হলো আমাদের। রাণুদি বাগানে ঘুরছেন চঞ্চলভাবে। সেই ঘন্টার পর ঘণ্টা এক জায়গায় চুপ করে কথা না বলে বসে থাকার অবস্থাটা এখন আর নেই। বরং ওকে যেন বেশ অস্থির বলে মনে হয়।

একবার আমাদের কাছে এসে হঠাৎ বললেন, তোমরা কিন্তু আমাকে সেই পাহাড়ের কাছে বেড়াতে নিয়ে গেলে না।

আমরা ঐ পাহাড়ের কথা শুনে চমকে উঠলাম। খুব সম্ভবত ওখানেই লুকিয়ে আছে অজিতদা। এখন ঐ পাহাড়ের কথা ভাবলেই ভয় করে।

–আজ যাবে? চলো না!

আমি আড়ষ্টভাবে বললাম, আজ!

রাণুদি বললেন, কেন, আজ তো বেশ ভালো দিন, বেশী রোদ্দুর নেই।

ভাস্কর বুদ্ধি করে বললো, ওখানে যাওয়া খুব মুস্কিল এখন। নদীর ওপর একটা সাঁকো ছিল, সেটা ভেঙে গেছে।

রাণুদি বললেন, কেউ কথা রাখে না।

পর মুহূর্তেই প্রসঙ্গ পাল্টে তিনি বললেন, কিছু কিছু ফুল দিনের বেলা ফোটে। তার কিছু ফুল ফোটে রাত্তিরবেলা, কেন এমন হয়?

তারপরই আবার বললেন, কিছু ফুল সূর্যকে ভালবাসে, কিছু ফুল চাঁদকে দেয়।

সঞ্জয় গেটের কাছ থেকে ছুটতে ছুটতে এসে আমাকে একটু আড়ালে ডেকে নিয়ে বললো, নীলুদা, কয়েকটা লোক কী বলাবলি করতে করতে গেল জানো? ওরা বলছে, অজিতদার বাড়ির সামনে নাকি একটা পুলিশের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে ভোর থেকে।

আমি বললাম, তোমার সাইকেলটা নিয়ে এসো তো!

আশু এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো, কী হয়েছে রে?

আশু সাইকেলে একজনকে ক্যারি করেও খুব সহজে চালাতে পারে। সুতরাং ভাস্করের দিকে চোখের ইশারা করে আমরা দুজনেই সাইকেলটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।

একখানা নয়, দু’খানা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে অজিতদার সেই বাড়ির সামনে। বহু আদিবাসী ভিড় করে আছে সেখানে। এইসব নিরালা জায়গায় পুলিশের গাড়িও একটা দর্শনীয় ব্যাপার।

বাইরে থেকেই আমরা দেখতে পেলাম হ্যাঁণ্ড-কাফ বাধা অজিতদা আর সেই সাধটিকে। পুলিশ ওদের কাঁধ খিমচে ধরে ঘোরাচ্ছে। বোঝা গেল পুলিশ সার্চ করছে। পুরো বাড়িটা আর বাগান। অজিতদার চুলগুলো রুক্ষ, জামাটা ছেঁড়া, চোখ দুটো লালচে। চেহারাটা একেবারেই যেন বদলে গেছে।

আশু আর আমি চোখাচোখি করলাম। এখানে দাঁড়িয়ে থেকে আর কোনো লাভ নেই, খবরটা এক্ষুনি অন্যদের জানানো দরকার।

বড়মামা তখন পুজোয় বসেছেন। আমরা ব্যাকুলভাবে অপেক্ষা করতে লাগলাম। এক মুহূর্তও দেরি করতে পারছি না যেন। খবরটা যদি কোনোক্রমে রাণুদির কানে যায়? তার আগেই কিছু একটা করা দরকার না!

মন্ত্র পড়া শেষ করে বড়মামা মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করছেন। এই প্রণাম সারতেও অনেকক্ষণ লাগে। ভাস্কর চটি খুলে কাছে এগিয়ে গিয়ে বড়মামার কাছে ফিসফিস করে খবরটা জানালো।

বড়মামা মুখ তুলে ভাস্করের দিকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। দেখতে দেখতে তার দু’চোখ জলে ভরে গেল। তারপর চোখ মুছে ফিসফিস করে বললেন, নিয়তি! সবই নিয়তি!

ভাস্কর বললো, পুলিশ যদি ওকে নিয়ে এ বাড়িতে আসে?

বড়মামা বললেন, তা আসবে বোধহয়!

ভাস্কর বললো, রাণুদিকে এখন বাড়ির মধ্যে পাঠিয়ে দেওয়া যায় না?

বড়মামা বললেন, জোর করতে গেলে কোনো লাভ হবে কী? ও যদি নিজের ইচ্ছেতে যায়–

মাসিমা ব্যাপারটা শোনার পর রাণুদিকে দু-একবার ডাকলেন। রাণুদি বাড়ির মধ্যে যাবেন না। তিনি এখন বাগানের প্রতিটি গাছের কাছে গিয়ে ফুলগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছেন।

কেউ কিছু ঠিকঠাক না করলেও আমরা সবাই এসে গেটের কাছাকাছি দাঁড়িয়েছি। পুলিশের গাড়িগুলো এখান দিয়েই যাবে। আমরা তখন রাণুদির দৃষ্টি থেকে গাড়িগুলোকে আড়াল করে রাখবো।

পুলিশের এমনই বুদ্ধি, গাড়ি দুটো ঠিক আমাদের গেটের কাছে এনেই দাঁড় করালো। সিংজী চেঁচিয়ে বললো, ও ডাক্তারবাবু, এবার শালে কো পাকড় লিয়া! কালী মাতা কি দয়া! একবার কালী মাইকে পরনাম করে যাই।

দারোগা গাড়ি থেকে লাফিয়ে নামলো। আমাদের মুখে নীরব ব্যথা! এই খবরটা এত চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে না বললে চলতো না? প্রথম গাড়িটার মধ্যে বসে আছে অজিতদা, হাতকড়া বাঁধা, দু পাশে দুজন পুলিশ। অজিতদা তাকিয়ে আছে আমাদের দিকেই, কিন্তু স্থির দৃষ্টি। আমাদের চিনতে পারার কোনো চিহ্ন নেই।

চট করে পেছন ফিরে দেখলাম, রাণুদি ধীর পায়ে এগিয়ে আসছেন এদিকে, যেন নিছক অলস কৌতূহলে।

একটা কিছু করা দরকার, এক্ষুনি একটা কিছু দরকার, আমরা সবাই ভাবলাম, কিন্তু কেউ কিছু করতে সাহস করলাম না। কেউ কি এখন জোর করে রাণুদিকে ফেরাতে পারে?

রাণুদি গেটের কাছে এসে সরলভাবে জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে এখানে?

তারপরই অজিতদার সঙ্গে রাণুদির চোখাচোখি হলো।

অজিতদা ঠিক আগেকার মতন গলায় জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছো, রাণু? এখন ভালো আছো?

রাণুদি বললেন, হ্যাঁ ভালো আছি। কেন ভালো থাকবো না?

ব্যাস শুধু এই দুটি কথা, আর কিছু না।

এরপরই রাণুদি পেছন ফিরে অহংকারের সঙ্গে চিবুকটা উঁচু করে রাণীর মতন। ভঙ্গিতে আবার হেঁটে যেতে লাগলেন। গর্বে বুক ফুলে উঠলো আমার। রানুদি অজিতদাকে মুখের মতন জবাব দিয়েছে। বদমাইশটা বুঝুক, ওকে বাদ দিয়েও রাণুদি ভালো থাকতে পারে।

রাণুদি বোধহয় এই মুহূর্তটার জন্যই ওঁর মনের শেষ জোরটুকু ধরে রেখেছিলেন। পুলিশের গাড়ি ছেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাণুদি দৌড়তে লাগলেন, বাড়ির দিকেই। আমরাও সবাই ছুটে গেলাম রাণুদির পেছনে পেছনে।

প্রথমে মাসিমা আটকালেন রাণুদিকে। রাণুদি মায়ের হাত ধরে হাহাকার করে বললেন, মা, ও কে? ও কে জিজ্ঞেস করলো, আমি ভালো আছি কি না! ওকে তো আমি চিনি না!

তারপরই মাকে ছেড়ে রাণুদি চলে গেলেন কালী প্রতিমার সামনে। অসম্ভব জোরে চিৎকার করে বললেন, ও কে? মা, ও কে? আমি তো।–

কথার মাঝখানে রাণুদি দড়াম করে আছড়ে পড়ে গেলেন কালী ঠাকুরের পায়ের কাছে। ও রকম সোজাসুজি কোনো স্বাভাবিক মানুষ পড়তে পারে না। রাণুদি কপাল ফেটে গলগল করে রক্ত বেরিয়ে এলো…।

.

তারপর কতবছর কেটে গেছে।

রাণুদির সঙ্গে তারপর আর কখনো দেখা হয়নি। ইচ্ছে করলে দেখা করতে পারতাম, করিনি। ভাস্করের সঙ্গে এর পরও ঝুমার বছর দু-এক যোগাযোগ ছিল চিঠিপত্রে। অভিজিৎ এখন একটা ব্যাঙ্কে কাজ করে, দেখা হয়েছে কয়েকবার। রাণুদির খবর ওর কাছেই শুনেছি, রাণুদিকে বছরে প্রায় দু-মাস রাখতে হয় নার্সিং হোমে। বাকি দু-মাস কিছুটা ভালো অবস্থায় বাড়িতেই থাকেন। পুরোপুরি স্বাভাবিক অবস্থা আর কখনো আসে না। বাড়িতে থাকতে থাকতে যখন আবার বাড়াবাড়ি শুরু হয়, জিনিসপত্র ভাঙতে শুরু করেন, সেই সময় আবার নার্সিং হোমে দিতেই হয়।

রাণুদির চেহারা নিশ্চয়ই এখন অনেক বদলে গেছে। দেখলে চিনতে পারবো কি-না সন্দেহ। না দেখাই ভালো। বাইরে যাদের সঙ্গে আলাপ হয়, কত অন্তরঙ্গতা হয়, পরে কলকাতায় এসে তাদের সঙ্গে সম্পর্কটা আবার ফিকে হয়ে যায় আস্তে। শুধু সতেরো বছরের সেই তীব্র বেদনাবোধ আমার এখনো যায়নি। আমার জীবনে আমি প্রথমে সত্যিকারের যে নারীকে ভালোবাসি, তিনি রাণুদি। যে ভালোবাসায় মানুষ একজনের জন্য জীবন দিয়ে দিতে পারে। আমার জীবন দিয়েও তো আমি রাণুদির কোনো উপকার করতে পারতাম না।

শুধু বেদনাবোধই নয়, আর একটি স্মৃতিও আমার মনে জ্বল-জুল হয়ে আছে। সেই যে একদিন দুপুরবেলা রাণুদিকে নিয়ে গিয়েছিলাম ছোট নদীটার ধারে। স্বর্গের দেবীর মতন রাণুদি বসেছিলেন পাথরটার ওপরে, অনেকগুলি কদম ফুল আমি এনে দিয়েছিলাম রাণুদির কোলের ওপর। আমার নিজস্ব নদী, আমার নিজস্ব কদম গাছ, আমার নিজস্ব রাণুদি। সেদিনই রাণুদির সামনে বসে, রাণুদির রূপের পূজারী হয়ে আমি কৈশোর ছাড়িয়ে যৌবনে পৌঁছেছিলাম।

আমার সতেরো বছরের সেই বেদনা ও আনন্দে মেশা ছবিটি একটি সোনার ফ্রেমে বাঁধানো রয়েছে। আমি মরে গেলেও সেই ছবিটি থেকে যাবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *