৭-৮. অজিতদা আর রাণুদির প্রেম

অজিতদা আর রাণুদির প্রেমের মতন, এমন প্রবল, প্রচণ্ড প্রেম আর কেউ কখনো দেখেছে কিনা সন্দেহ। দু-তিন দিনের মধ্যেই এমন হলো যে কেউ কারুকে যেন এক নিমেষের জন্যও দৃষ্টিছাড়া করতে পারে না। অবশ্য টানটা রাণুদির দিকে থেকেই যেন বেশী। রাণুদির এ এক নতুন পাগলামি।

ঘুম থেকে ওঠেই রাণুদি জিজ্ঞেস করেন, অজিত কোথায়?

অজিতদা থাকেন একা। একজন লোক ওঁর বাড়িতে রান্না করে দেয়। সেখানে রাণুদির সব সময় যাওয়াটা ভালো দেখায় না বলে রাণুদির মা অজিতদাকে ডেকে পাঠান তাদের বাড়িতে। রাণুদির কোনো ইচ্ছেতে বাধা দেওয়া যায় না।

অজিতদা যে বাড়িতে থাকেন, সে বাড়ির আগের মালিককে চিনতেন বড়মামা। বছরখানেক হলো বাড়িটা বিক্রি হয়ে গেছে। নতুন মালিককে বড়মামা দেখেন নি। অজিতদার জামাইবাবু কিনেছেন, কিন্তু এর মধ্যে আসেন নি একবারও। অঝিতদাদা দিল্লির লোক, সেখানে অজিতদা ডিফেন্স ডিপার্টমেন্টে কাজ করেন, কিছু দিনের জন্য ছুটি নিয়ে তিনি জামাইবাবুর নতুন বাড়িটায় থেকে যাবার জন্য এসেছেন। সেই সঙ্গে বাগান টাগানগুলো পরিষ্কার আর কিছু কিছু সারানোর কাজও করে যাবেন।

অজিতদার ব্যবহারও খুব ভদ্র। রাণুদির সঙ্গে তিনি এমনভাবে মেশেন যাতে কোনোক্রমেই রাণুদির মনে আঘাত না লাগে। অজিতদার সঙ্গে থাকলে রাণুদি একদম ভালো হয়ে যান।

আমাদের বাড়িটাই হয়ে গেল কেন্দ্রস্থল।

রাণুদির মা আর কোনো ব্যাপারে আপত্তি না করলেও রাণুদিকে একা একা অজিতদার বাড়িতে পাঠাতে চান না। কখনো রাণুদি নিজে থেকে যেতে চাইলেও তখন সঞ্জয় আর অভিজিৎ সঙ্গে যাবেই। এদিকে রাণুদিদের বাড়িতেও অজিতদা রাণুদির সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করতে অস্বস্তি বোধ করেন।

সেইজন্যই আমাদের বাড়িটা বেছে নেওয়া হয়েছে। একতলার বসবার ঘরে কিংবা বাগানের বেঞ্চে ওদের দুজনকে সারাদিনের প্রায় যে-কোনো সময়েই দেখতে পাওয়া যাবে। আগে যেমন রাণুদি ঘন্টার পর ঘণ্টা চুপ করে বসে থাকতেন এক জায়গায়, এখন ঠিক সেইরকমই তার চেয়েও বেশী সময় গল্প করেন অজিতদার সঙ্গে। কী যে অত গল্প কে জানে।

সঞ্জয় আর অভিজিৎ খেলতে আসে আমাদের বাড়িতে। এমন কি, দিদিকে পাহারা দেবার জন্যই কিনা কে জানে, ঝুমাও আসতে শুরু করেছে। ঝুমা ব্যাডমিন্টন খেলতে ভালোবাসে। কদিন ধরেই আকাশ পরিষ্কার। আমরা ব্যাডমিন্টনের একটা টুর্নামেন্টে শুরু করে দিয়েছি।’

এক এক সময় অজিতদা আর রাণুদিও এসে যোগ দেন আমাদের খেলায়। ওঁরা। দু’জন পার্টনার। তখন পাশাপাশি দু’জনকে চমৎকার মানায়। অজিতদা বেশ লম্বা আর মক্কার শরীরের গড়ন, মুখে অল্প অল্প দাড়ির জন্য ওঁকে দেখায় সিনেমার নায়কের মতন। আর রাণুদির তো রূপের কোনো তুলনাই নেই। বিশেষত, রাণুদির মুখখানা যখন হাসি মাখানো থাকে, তখন রাণুদিকে কোনো স্বর্গের দেবী বলেই মনে হয় ঠিক।

ভাস্কর আমাদের দলের নেতা হিসেবে খানিকটা ভারিক্কি ধরনের। ওর সঙ্গে সঞ্জয়ের বড়মামা অনেক কিছু আলোচনা করেন। ভাস্করের মুখ থেকে আমরা অনেক খবর পেয়ে থাকি।

অজিতদা আর রাণুদির এমন উদ্দাম মেলামেশা নিয়েও বাড়িতে অনেক কথাবার্তা হয়েছে। বড়মামাই রাণুদির মাকে বুঝিয়েছেন যে রাণুদির ওপর এখন জোর করা ঠিক হবে না। তাতে ফল আরও খারাপ হতে পারে। গত তিন চার দিন যে একবারও রাণুদির ব্যবহার কোনোরকম অস্বাভাবিক কিছু দেখা যায় নি, সেটা ভালো লক্ষণ।

আর আগে অনেকবারই ওঁরা রাণুদির বিয়ের কথা চিন্তা করেছেন। কিন্তু ডাক্তাররা বিয়ে না দেবারই পরামর্শ দিয়েছেন ওঁদের। মেয়ে পাগল জানলে কেউ জেনে শুনে বিয়ে করবে না। আবার না জানিয়ে, এই ব্যাপারটা গোপন করে বিয়ে দিলে তার ফল খুবই খারাপ হতে পারে। তা ছাড়া রাণুদির মা বলেছেন, আমি যার তার হাতে আমার মেয়েকে দেবো না, তার চেয়ে বরং সারা জীবন ও আমার কাছেই থাকবে।

ভাস্করের কাছ থেকে আমরা আর একটা খবরও পেলাম। রাণুদির মা একদিন অজিতদাকে আলাদা ডেকে কয়েকটা কথা বলেছেন, সে কথা ভাস্কর শুনে ফেলেছে।

দশ্যটা এরকম।

অজিতদা আর রাণুদি বসেছিলেন ওঁদের বাড়ির বাগানে একটা বেঞ্চের ওপর। সন্ধেবেলা। এক সময় রাণুদি, একটু আসছি’ বলে উঠে গিয়েছিলেন বাড়ির ভেতরে, খুব সম্ভবত বাথরুম-টাথরুম করবার জন্য। সেই সময় রাণুদির মা তাড়াতাড়ি চলে এসেছিলেন অজিতদার কাছে।

রাণুদির মা বলেছিলেন, বাবা অজিত, তোমাকে দু একটা কথা বলবো?

অজিতদা সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে বিনীতভাবে বলেছিল, হ্যাঁ, বলুন, মাসিমা!

রাণুদির মা বলছেন বসো, তুমি বসো। রাণু তোমাকে খুব পছন্দ করে, তা দেখে আমার খুব ভালো লাগে। রাণু তোমার সঙ্গে যতক্ষণ থাকে,খুব ভালো থাকে, কদিন ধরেই খুব ভালো আছে, এজন্য আমি যে কী শান্তি পেয়েছি, তা তোমাকে কী বলবো! তুমি আমাদের অনেক উপকার করেছে।

অজিতদা বললেন, আমার মনে হয়, ও পুরোপুরিই ভালো হয়ে যাবে।

–তা যদি হয়তো তার থেকে আনন্দের তো আর কিছু নেই। দেখেছো তো? মেয়েটা এমনিতে কত ভালো, ওর মনে কত দয়ামায়া, তোমাকে একটা কথা বলি, মেয়েটা খুব সরল, অনেক কিছুই বোঝে না, তোমার কাছে আমার অনুরোধ, তুমি দেখো, ওর যেন শেনো ক্ষতি না হয়।

–আমি ওর ক্ষতি করবো?

–সে কথা বলছি না। আমরা বড় দুঃখী, এ মেয়েটার জন্য আমার এক মুহূর্ত শান্তি নেই, তাই বলছি, তুমি পুরুষ মানুষ, দুদিন পর ছুটি ফুরোলে তোমাকে তো চলে যেতেই হবে, শুধু দেখো, ওর যেন কোনো ক্ষতি না হয়, ও তো কিছুই বোঝে না।

অজিতদা তখন রাণুদির মায়ের পা ছুঁয়ে বলেছে, মাসিমা, আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি, আমার দ্বারা ওর তো কোনো ক্ষতি হবেই না বরং আমি রাণুর ভার নিতে চাই, আমার কাছে ও ভালো থাকবে। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, রাণু আমার কাছে কোনো দিন কষ্ট পাবে না।

ভাস্কর খুব কাছাকাছি থেকে এটা দেখেছে ও শুনেছে; এই ঘটনা জেনে অজিতদার প্রতি শ্রদ্ধায় আমাদের মন ভরে যায়। রাণুদির জীবনে যে হঠাৎ এই পরিবর্তন আসবে, তা আমরা স্বপ্নেও ভাবি নি।

রাণুদির বাবা প্রত্যেক শনিবার আসেন শুনেছিলাম। কিন্তু তাকে আমরা দেখিনি। তিনি আগের শনিবার আসেন নি, টেলিগ্রাম করে জানিয়েছেন যে আগামী সপ্তাহেও আসতে পারবেন না। উনি এলে আমরা সবাই এক সঙ্গে একদিন গিরিডি যাবো ঠিক করেছিলাম। এবার ঠিক হলো, আমরা নিজেরাই যাবো। অজিতদাও যেতে রাজি হয়েছেন, তার মানে রাণুদিও যাবেন।

রাত্তিরবেলা খাওয়া-দাওয়া হয়ে যাবার পরও রাণুদি আর অজিতদা বাগানে হাত ধরে বেড়ান। আমি ছাদ থেকে দেখতে পাই,চাঁদের আলোয় ওদের সামান্য ছায়া পড়েছে, সেই ছায়া সঙ্গে নিয়ে ওঁরা আস্তে আস্তে হাঁটছেন। আমার একটুও ঈর্ষা হয় না। আমি রাণুদিকে ভালোবাসি। অজিতদার প্রতি আমি সাঙ্ঘাতিক কৃতজ্ঞ বোধ করি।

বড়মামা রাত্তিরের দিকে আজকাল আমাদের বাড়িতেই তাস খেলতে আসেন। ইচ্ছে করেই আসেন বোঝা যায়। খেলা ভাঙলে তিনি বাগানে দাঁড়িয়ে অনুচ্চ কণ্ঠে বলেন, রাণু, এবার বাড়ি চল মা, ঘুম পায় নি?

রাণুদি বলে, চলো বড়মামা, যাচ্ছি।

আজও তিনি অজিতদাকে ছাড়বেন না। অজিতদাও ওঁদের সঙ্গে রাণুদিদের বাড়িতে যাবেন। তারপর অজিতদা একটু ক্ষণ গল্প করবেন বড়মামার সঙ্গে। তাবপর রাণুদি শুয়ে পড়লে, অজিতদা তার ঘরে গিয়ে মাথায় হাত দিয়ে মিষ্টি করে বলবেন, এবার ঘুমোও রানু। আমি আবার কাল সকালেই আসবো!

এর আগে, প্রত্যেক রাতে রাণুদিকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়াতে হতো। এখন অজিতদার স্পর্শই রাণুদির ঘুমের ওষুধ।

অজিতদা দারুণ গল্প করতে পারেন। খুব জমিয়ে দিলে ট্রেনের কামরায়। অজিতদার শখ হচ্ছে খুঁজে খুঁজে নানা সাধু-সন্ন্যাসী বার করে তাঁদের সঙ্গে কথা বলা। এইজন্য তিনি হরিদ্বার লছমনঝোলা থেকে শুরু করে কাশী, উজ্জয়িনী এইসব জায়গাতেও ঘুরেছেন। কতরকম অভিজ্ঞতা। সেই সব গল্প শুনতে ট্রেনের পথটা যে কখন পার হয়ে গেল, খেয়ালই করিনি।

রাণুদির মাকেও আমরা সঙ্গে এনেছি। উনি অবশ্য আসতে চাইছিলেন না, আগে দু তিনবার গিরিডি ঘুরেছেন, কিন্তু রাণুদিই জোর করে বলেছিলেন, চলো মা, চলো, চলো।

রাণুদি মাকে খুব ভালোবাসেন। তার এমন খুশীর সময় রাণুদি মাকেও ছাড়তে চান না। অজিতদাও বলেছেন হ্যাঁ, আপনিও চলুন, মাসিমা। সবাই যাচ্ছি, আপনি কেন একলা থাকবেন!

বড়মামা অবশ্য আসেনিন, তার পুজো আছে। তিনি সতীশবাবুকে পাঠিয়েছেন সব কিছু ব্যবস্থা করবার জন্য। এই বেড়ানোটা আমাদের অন্যরকম হলো। অনেকটা যেন বাড়ি বাড়ি মতন, মা মাসি পিসিদের সঙ্গে।

গিরিডি থেকে উশ্ৰী ফলস দেখতে যাবার জন্য টাঙ্গা ভাড়া করা হলো তিনখানা। একটা টাঙ্গায় শুধু অজিতদা আর রাণুদি, ওদেরটাই চললো আগে আগে। যেন দুই দেশের কুমার ও ও রাজকুমারী, আমরা সবাই অনুচর। আমরা শুনলাম, ঐ টাঙ্গ: থেকে গানের সুর ভেসে আসছে। আগে কক্ষোনো রানুদির গান শুনিনি।

ঝুমা বললো, দিদি এক সময় খুব ভালো গান গাইতো!

রাণুদির মা বললেন, কত বছর বাদে ও গাইছে বল তো? অন্তত তিন বছর না?

বলতে বলতেই ওর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে এলো।

উশ্ৰী ফলসে গিয়ে রাদি আমাদের সঙ্গে কোরাসে গাইলেন অনেকগুলো গান। সব ব্যাপারেই রাণুদির দারুণ উৎসাহ। আঁচলটা কোমরে জড়িয়ে নিয়ে হুটোপুটি দৌড়োদৌড়ি করছেন। প্রতিটি মুহূর্তেই যেন রাণুদিকে দেখে চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে। এ এক অন্যরকম রাণুদি।

জায়গাটায় বেশ ভিড়। আমাদের রবিবারে বদলে অন্য কোনো একদিন আসা উচিত ছিল। কয়েকটা ছেলে জলপ্রপাতের ওপর থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে পড়ছে নিচে। দেখলে ভয় করে। জল যেন টগবগ করে ফুটছে সেখানে, তবু তারই মধ্যে লাফিয়ে পড়ে ছেলেগুলো সাঁতার কেটে যাচ্ছে অবলীলাক্রমে। ইস, এখনো আমার সাঁতারটা শেখা হলো না।

রাণুদি অজিতদাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি ওরকম পারবে?

অজিতদা হেসে বললেন, তা পারবো বোধহয়!

সঙ্গে সঙ্গে অজিতদা জামার বোতাম খুলতে লাগলেন। অজিতদা সুইমিং ট্রাঙ্ক পরেই এসেছিলেন, প্যান্ট আর শার্ট খুলে ফেলার পর তার মেদহীন শরীরটা যেন ঝকঝক করে উঠলো। তিনি জলপ্রপাতের কাছে গিয়ে উঁচু করে দাঁড়ালেন।

তখন মত পাল্টে ফেললেন রাণদি। তিনি এসে অজিতদার হাত ধরে বললেন না, তোমাকে লাফাতে হবে না, তুমি নিচে গিয়ে সাঁতার কাটো।

অজিতদা বললেন, তা কখনো হয়…তুমি বললে, এখন যদি না লাফাই, তুমি ভাববে, আমি পারবো না।

রাণুদি বললেন, না, আমি তা ভাববো না। আমি জানি, তুমি পারবে।

রাণুদির মা-ও এসে বললেন, না, না, এত উঁচু থেকে লাফাবার দরকার নেই বাপু। দেখলেই ভয় লাগে।

অজিতদা বললেন, কোনো ভয় নেই, মাসিমা। আমার অভ্যেস আছে।

রাণুদি চেঁচিয়ে উঠলেন, না।

তার আগেই অজিত লাফিয়ে পড়েছেন।

হ্যাঁ, নায়কদেরই এইরকম মানায়। অত ওপর থেকে ঠিক যেন পাখির মতন উড়ে অজিতদা গিয়ে পড়লেন নিচের উত্তাল জলের মধ্যে। কয়েক মুহূর্তের জন্য হারিয়ে গেলেন একেবারে, তারপরই মাথা ঝাঁকিয়ে তাকালেন ওপরে।

রাণুদির মুখখানা নিভে গিয়েছিল, আবার আলো জ্বলে উঠলো। রাণুদি তরতরিয়ে দৌড়ে চলে গেল নিচের দিকে।

ভাস্কর বললো, আমিও এখান থেকে লাফাতে পারি।

আশু ওপর কাঁধে হাত রেখে গম্ভীরভাবে বললো, না, দরকার নেই। চল, নিচে চল। ভাস্কর তবু লাফাতে চাইছিল, আশু ওকে টেনে নিয়ে গেল জোর করে।

আশু কেন ভাস্করকে বারণ করলো, তা বুঝতে আমার একটু অসুবিধে হলো না। এইমাত্র অজিতদা লাফিয়ে পড়ে যে কৃতিত্ব দেখিয়েছে, এখন ভাস্করও সেইরকম লাফালে ঐ কৃতিত্বটা অনেকটা ম্লান হয়ে যাবে। আমার সন্দেহ হলো, আশুও বোধ হয় লাফাতে পারে।

ওরা সবাই চলে গেল নিচে স্নান করতে। অভিজিৎ আর সঞ্জয়কে পাহারা দেবার জন্য আমি থেকে গেলাম ওপরে। ঝুমাও সাঁতার জানে না, বেড়াতে এসেও সে সঙ্গে একটা বই এনেছে, একটা গাছে হেলান দিয়ে বই পড়তে লাগলো। আমি ওপর থেকে দেখতে লাগলাম ওদের সকলের জলখেলা। ঠিক সিনেমার মতন লাগে।

রাণুদির মা প্রচুর রুটি আর মাস আর সন্দেহ আর কমলালেবু এনেছেন। গোল হয়ে সবই মিলে বসে খেয়ে নিলাম। প্রথমে ভেবেছিলাম, এত খাবার শেষ করা যাবে না, একটু পরেই মনে হলো আর কিছু থাকলে মন্দ হতো না।

টাঙ্গাওয়ালাদের আমরা দাঁড় করিয়ে রেখেছি। কিন্তু খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ফিরে যাওয়ার মানে হয় না, খানিকটা বেড়াতে হবে। অজিতদা একলা একলা একটু জঙ্গলের দিকে এগিয়ে যেতেই রাণুদিও চলে গেলেন সেদিকে।

রাণুদির মা জিজ্ঞেস করলেন, ওরা কোথায় যাচ্ছে?

আমার মনে হলো, অজিতদা মাসিমার সামনে সিগারেট খেতে পারছেন না বলেই একটু আড়াল খুঁজছেন।

মাসিমা বললেন, তুমি একটু ওদের সঙ্গে যাও না নীলু।

আমার খুব অস্বস্তি হলো। এরকমভাবে যাওয়া যায়? মাসিমা কেন যেতে বলছেন, তাকি আর আমি বুঝি না। কিন্তু এরকম পাহারাদারের ভূমিকা আমার মোটেই পছন্দ হয় না। সঞ্জয় কিংবা অভিজিৎ গেলেই তো পারতো।

মাসিমার মুখের ওপর না-ও বলতে পারি না! মাসিমা চোখ দিয়ে আমায় অনুসরণ করছেন, অন্যদিকে যে কেটে পড়বো, তারও উপায় নেই। যেতে হলো ওদিকেই।

ওরা তন্ময় হয়ে কথা বলছিলেন, ত, অজিতদা আমার পায়ের শব্দ শুনতে পেলেন, পেছনে ফিরে বললেন, এসো নীলু একটু ঘুরে আসা যাক এদিকটা থেকে।

আমার দিকে সিগারেটের প্যাকেকটা এগিয়ে দিয়ে বললেন, তুমি খাও নাকি?

আমি লজ্জায় কুঁকড়ে গিয়ে বললাম, না, না।

রাণুদি বললেন, কতদিন পর বেড়াতে এলাম। মধুপুর আসার পরে থেকে একদিনও আমি কোথাও যাই না।

অজিতদা বললেন, এরপর একদিন আমরা ঝাঝা কিংবা শিশুলতলার ওদিকে যাবো। শিমুলতলাও খুব সুন্দর জায়গা।

আমরা যেদিকে এগোচ্ছি সেদিকটায় পাতলা জঙ্গল। মাটিতে কাঁচের মতন চকচকে কিছু জিনিস মাঝে মাঝে ছড়িয়ে আছে। আমি নিচু হয়ে কয়েকটা তুলে নিলাম। পাশগুলো চাকের মতন ধারালো নয়, চাপ দিয়ে মুড়মুড় করে ভেঙে যায়। অজিতদা বললেন, এগুলো অভ্র। গিরিডিতে অভ্রের খনি আছে।

আমি আগে কখনো অভ্র দেখিনি।

হাঁটতে হাঁটতে আমরা বেশ খানিকটা দূরে চলে এসেছিলাম। রাণুদি অজিতদাকে জিজ্ঞেস করলেন, এবার ফিরবে না?

অজিতদা বললেন, আর একটু যাই। তোমার ভালো লাগছে না?

অজিতদা আমার হাতে একা, গোপন চাপ দিলেন। ইঙ্গিতটা আমি বুঝে গেলাম। আমি বললাম, আমি এখানে একটু বসছি, খুব সুন্দর ছায়া। আপনারা ঘুরে আসুন। জায়গাটা সত্যি খুব সুন্দর। শুকনো পাতা খসে পড়ে তলাটা বেশ বিছানার মতন হয়ে গেছে। ইচ্ছে হয় শুয়ে পড়ি। কিন্তু হাত দিয়ে দেখলাম তলাটা ভিজে ভিজে, বোধহয় রাত্তিরেই এখানে বৃষ্টি হয়েছে। আমার আগেও এখানে কারা যেন এসে বসেছিল, অনেকগুলো সিগারেটের টুকরো, খালি প্যাকেট আর একটা কালো রঙের চুলের কাটা পড়ে আছে!

এর একটা মুহূর্ত যেন এক একটা ঘণ্টা! কত দূরে চলে গেলেন ওঁরা? আমি একলা একলাও ফিরতে পারি না। মাসিমা আমাকে প্রহরী হিসেবে পাঠিয়েছেন? অতিদা আমার হাত টিপে আমাকে থেকে যেতে বললেন কেন? নিশ্চয়ই নিরালায় গিয়ে রাণুদিকে আদর করবেন।

এই কথাটা মনে আসা মাত্রই আমার শরীরে রোমাঞ্চ হলো। কান দুটো গরম গরম লাগলো। কী আদর করছ অজিতদা, কোথায় কোথায়? ওরা কি শুয়ে পড়েছে? আমাকে দেখতেই হবে।

 অরণ্যচারী প্রাণীর মতন আমি নিঃশব্দে এগিয়ে চলোম। জুতো জোড়া খুলে রেখে গেলাম এক জায়গায়। মাঘ মাসের শীতের মতন আমি কাঁপছি। আমার শরীরে এখন উত্তেজনা।

খুব বেশী যেতে হলো না। রাণুদি একটা উজ্জ্বল লাল রঙের শাড়ি পরে এসেছেন, গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে সেই রং স্পষ্ট দেখা যায়। পা টিপে টিপে আমি চলে এলাম খুব কাছে।

না, ওরা মাটিতে শুয়ে পড়েনি।

খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে অজিতদা দুহাতে ধরে আছেন রাণুদির মুখখানা। দুজনের দৃষ্টি স্থির। তেমনভাবে আর কেউ তাকাতে পারবে না। যেন দুজনের চোখের মধ্যে তৈরি হয়ে গেছে একটা অদৃশ্য সেতু। অজিতদা বললেন, একবার?

রাণুদি ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি আমাকে কোনো দিন ছেড়ে যাবে না, বলো।

অজিতদা বললেন, কোনোদিন না। তুমিও আমায় ছেড়ে যাবে না তো রাণু?

–না, না, না—

অজিতদা রাণুদিকে বুকে টেনে নিয়ে রাণুদির ঠোঁটে ঠোঁট ডোবালেন।

আমি সঙ্গে সঙ্গে চোখ বুজে ফেললাম। অজিতদা নয়, আমিই রাণুদিকে চুমো খাচ্ছি। একবার নয়, অনেক বার।

.

০৮.

সকালবেলা রাণুদি এসে বসে আছেন আমাদের বাড়িতে। অজিতদা তখনো আসেন নি।

সকালবেলায় চা-টা আজকাল সবাই আমাদের বাড়িতেই খায়। আমাদের খাওয়া দাওয়ার মোটামুটি একটা ফেঁথ ব্যবস্থা হয়ে গেছে। চায়ের পর ন’টা সাড়ে নটার সময় জলখাবার আসে রাণুদিদের বাড়ি থেকে। দুপুরে খাওয়াও বলতে গেলে প্রায়দিনই রাণুদিদের বাড়িতে, দু-এক দিন অবশ্য আমাদের বাড়িতেও সবাই মিলে রান্না করি।

অজিতদামুগী কিনে আনেন। নিজেই তিনি মুর্গী ছাড়ান এবং রান্না করেন। বেশ ভালো। রান্নার হাত অজিতদার।

পরী এসে চা দিয়েগেল। একটা ট্রেতে করে খালি কাপ বড় টি-পট বেশ যত্ন করে সাজিয়েও আনে। আজ কাল আর পরী রাত্তিরের দিকে মহুয়ার নেশা করে হল্লা করে না, সন্ধের পরই ও কোথায় যেন চলে যায়, কখন ফেরে টের পাই না। সকালবেলায় ও শান্তশিষ্ট ভালোমানুষ।

আশু পট থেকে চা ঢালছিল, আমি রাণুদির মুখের দিকে চেয়ে বললাম, অজিতদা তো এখনো এলেন না।

রাণুদি বললেন, ঘুম থেকে ওঠেনি বোধহয়।

–চা যে ঠাণ্ডা হয়ে যাবে!

রাণুদি সঞ্জয়কে বললেন, এই টুকুন, ই ডেকে নিয়ে আয় না!

সঞ্জয় কদিন ধরেই উৎপলের কাছে কাছে দারুণ উৎসাহে তাসের ম্যাজিক শিখছে। সে এখন যেতে চায় না। সে বললো, দাঁড়াও না, বাবা, আসবে।

ভাস্কর বললো, অজিতদা এলে আবার এক রাউণ্ড চা খাওয়া যাবে। এটা শেষ করে ফেলা যাক।

নটা বেজে গেল, তখনো.অজিতদা এলেন না।

এরকম তো হয় না। এখানে বেশী বেলা পর্যন্ত কেউই ঘুমোয়না। ভোর হতে না হতেই জানলা দিয়ে চোখে এসে আলো পড়ে, আর কতরকম পাখির ডাক। চোখ মেলার পরই মনে হয়, আঃ কী সুন্দর দিনটা। আমরা তো রাত্তির বারোটা সাড়ে বারোটা পর্যন্ত আড্ডা দিয়ে আবার ছটা বাজতে না বাজতেই উঠে পড়ি।

আমাদের খাবার ঘরের একপাশে একটা পুরোনো আমলের ইজিচেয়ার আছে। আগে আমাদের চারজনের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা ছিল, কে প্রথমে দৌড়ে এসে চেয়ারটা দখল করবে। এখন অবশ্য সেই ইজিচেয়াটা রাণুদির জন্যই রিজার্ভ করা। রাণুদি পা মুড়ে বসতে ভালোবাসেন।

আমরা কথাবার্তায় মশগুল হয়ে ছিলাম বলে সময়টা খেয়াল করিনি। কিন্তু রাণুদি একেবারে চুপ করে বসে আছেন। মুখ দেখলেই বোঝা যায় মনটা খারাপ হয়ে গেছে। রাণুদির মন খারাপ আমার একদম সহ্য হয় না।

আমি পাজামা আর গেঞ্জি পরে ছিলাম, চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, প্যান্টটা পরে আসি, অজিতদাকে ধরে আনতে হবে।

ভাস্কর বললো, যা পরে আছিস, ঐ পরেই যা না। এখানে তোকে আর কে দেখছে।

কেউ একজন ঐটুকু বললেই হলো। সত্যি তো, পাজামা গেঞ্জি পড়ে এখানে রায় বেরোলে ক্ষতি কী? এ তো আর শহর নয়। সঞ্জয়কে বললাম, এই, তোর সাইকেলটা আনিস নি?

রাণুদি বললেন, চলো, আমিও তোমার সঙ্গে যাই।

কর্তব্যপরায়ণ ভাইয়ের মতন সঞ্জয় আর অভিজিৎ তাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো। তখন আমি বললাম, চল না, আমরা সবাই মিলে ঘুরে আসি। খানিকটা হাঁটাও হবে।

আশু আর উৎপল আলস্য করে রয়ে গেল। বাকি আমরা সবাই বেরিয়ে পড়লাম। গেটের মুখেই দেখা হলো ঝুমার সঙ্গে। ভাস্কর তাকে বললো, চলো, আমরা নদীর ধারটায় যাচ্ছি। তুমি যাবে?

ঝুমার সঙ্গে ভাস্করের বেশ জমে গেছে। প্রায়ই ওরা আলাদা কথা বলে। রাত্তিরবেলা শুয়ে শুয়ে এই নিয়ে আমরা তিনজন ভাস্করকে খুব পাক দেই। তবে আমি যে রাণুদিকে কতটা ভালোবাসি, সে কথা আর কেউ জানে না। রাণুদিও কি জানে?

অজিতদার বাড়ি খুব কাছে নয় অন্তত পৌনে এক মাইল হবেই। তবে এই সব ফাঁকা জায়গায় দূরকে দূর বলে মনে হয়না।

বাড়ি থেকে একটা চিঠি পেয়েছি। বাবা একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছে বলে মা আমাকে তাড়াতাড়ি ফিরে যাবার জন্য লিখেছেন। অথচ ভাস্কররা আরও কয়েকদিন থেকে যেতে চায়। আমাকে হয়তো একলাই ফিরে যেতে হবে। এইসব ছেড়ে ফিরে যাওয়া যায়? এই ক’দিন তো ভুলেই গিয়েছিলাম যে কলকাতায় আমার বাবা, মা, কলেজ, কফি হাউস এসব আছে। বাবার অসুখ করলে আমিই বা কী করবো, দাদারাই তো রয়েছে। তবু জানি, মা লিখেছেন যখন, তখন যেতেই হবে, না এলে বাবা দারুণ রাগারাগি করবেন।

অজিতদার বাড়ির কাছাকাছি এসে রাণুদি হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে বললেন, আমি জানি, ও বাড়ি নেই।

আমারও সেই কথা মনে হচ্ছিল। কদিন ধরেই অজিতদা বলছিলেন, আমাকে একবার জসিডি যেতে হবে, কয়েকটা কাজ আছে। রানুদি যেতে দিচ্ছিলেন না। অজিতদা প্রায়ই জসিডি যান।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কি করে জানলেন? আপনাকে কাল কিছু বলে গেছেন?

–না। তবু আমার মনে হচ্ছে।

আমার মনে হচ্ছে বাড়তে হয়তো মিস্তিরি-টিস্তিরি এসেছে।

–না দেখো, ও বাড়িতে নেই।

ভাস্কর গেট দিয়ে ঢুকলো না। সে বললো, তোরা অজিতদাকে ডাক, আমি একটু ঝুমাকে নিয়ে নদীর ধারটা ঘুরে আসছি।

আমি মনে মনে বললাম, ঐ নদীটা আমার। কিন্তু আজকের জন্য ভাস্ক আর ঝুমাকে আমি আমার নদীটা দিয়ে দিলাম। ইচ্ছে করলে, ভাস্কর, তুই আমার গাছ থেকে কদমফুল পেড়ে ঝুমাকে দিতে পারিস।

অজিতদা সত্যি বাড়ি নেই।

বাগানে একজন মাল কাজ করছিল, সে বললো, বাবু তো বাহার গিয়া–

–কখন?

–বহুত সুবা মে।

আমি রাণুদিকে বললাম, অজিতদা নিশ্চয়ই কোনা কাজে বেরিয়ে গেছেন, অত সকালে আমাদের বাড়িতে গিয়ে দেখেছেন, আমরা কেউ ঘুম থেকে উঠিনি, তাই খবর দিতে পারেনি।

রানুদি আমার দিকে চেয়ে রইলেন একদৃষ্টে।

মালিকে আমি জিজ্ঞেস করলাম, কাঁহা গিয়া কুছ বোলা?

সে জানালো যে সে বিষয়ে সে কিছু জানে না। লোকটি একটু গম্ভীর ধরনের,বেশী কথা পছন্দ করে না।

পাহাড়গুলোর কাছে সাধুবাবার ডেরায় অজিতদার সঙ্গে প্রথম আলাপ হয়েছিল, অজিতদা বলেছিলেন, উনি প্রায়ই ঐ সাধুর কাছে যান। আজও সেখানে যাননি তো? আমরা পরে অজিতদাকে অনেকবার সেই সোনা তৈরির ব্যাপারটা জিজ্ঞেস করেছি। অজিতদা বলেছিলেন, কিছুতেই শেখাতে চাইছে না আমাকে কিন্তু সাধটি সতি জানে। সাধু সন্ন্যাসীর ওপর অজিতদার খুব বিশ্বাস।

রাণুদি একটা পাহাড়ের ওপর উঠতে চেয়েছিলেন। অজিতদার খোঁজে আজই রাণুদিকে ঐ পাহাড়ে নিয়ে গেলে হয়। আমি এক্ষুনি রাজী আছি।

কিন্তু আগে রাণুদির মা আর বড়মামার অনুমতি নিতে হবে। তাছাড়া অতদূরের রাস্তা, এতখানি কি রাণুদিকে হাঁটানো উচিত? অজিতদা সঙ্গে থাকলেও না হয় কথা ছিল।

নদীর ধারে ভাস্করকে ঝুমার সঙ্গে নির্জনে বেড়ানোর সুযোগ দেওয়া গেল না। অভিজিৎ আর সঞ্জয় সেদিকে দৌড়ে গেল।

আমিও রাণুদিকে বললাম, একটু ওখানে গিয়ে বসবেন। রাণুদি বললেন, না, ভালো লাগছে না।

আমরা ফিরে চলোম। রানুদি আর আমাদের বাড়িতে ঢুকলেন না, চলে গেলেন নিজেদের বাড়িতে। আমি ক্ষীণভাবে বলবার চেষ্টা করলাম, দেখুন, একটু বাদেই নিশ্চয়ই

অজিতদা এসে যাবেন। রাণুদি সে কথার কোনো মূল্য দেননি।

দুপুরের মধ্যেও অজিতদার পাত্তা পাওয়া গেল না। দুপুরে ও বাড়িতেই খাওয়ার জন্য বড়মামা আমাদের ডেকে পাঠালেন। রাণুদি নিজের ঘরে শুয়ে আছেন। একবারও এলেন আমাদের সঙ্গে কথা বলতে।

বড়মামা আর রাণুদির মায়ের মুখে চিন্তার রেখা পড়েছে।

রাণুদির মা একবার বললেন, একটা কিছু খবর দিয়ে গেল না কেন?

বড়মামা বললেন, নিশ্চয়ই কোনো কাজে গেছে। আগে থেকে বললে রাণু কি ওকে যেতে দিত? রাণু যে ওকে সর্বক্ষণ আঁকড়ে থাকতে চায়।

মাসীমা বললেন, রাণু আগেও কয়েকটি ছেলে-টেলেদের সঙ্গে মিশেছে। আমি কোনোদিন ওতে বাধা দিইনি। কিন্তু রাণুর এরকম অবস্থা তো আগে কখনো হয়নি?

বড়মামা বললেন, আগেকার অবস্থা আর এখনকার অবস্থা তো এক নয়। এ ছেলেটিকে তো আমার বেশ ভালোই মনে হয়।

মাসীমা বললেন, কিন্তু হঠাৎ যদি চলে যায়।

টেবিলে খাবার দেওয়া হয়েগেছে, তবু আমি বললাম, আমি একবার চট করে ঘুরে আসছি।

সাইকেলটা নিয়ে তক্ষুনি বেড়িয়ে পড়লাম। সকালবেলা অজিতদার বাড়ির মালিকে একটা জরুরী কথাই জিজ্ঞেস করা হয়নি। অজিতদা কোনো মালপত্র নিয়ে গেছেন কি না। এমনি খালি হাতে গেলে তো কখনো না কখনো ফিরে আসবেনই। অবশ্য অজিতদা সম্পর্কে এরকম সন্দেহ করার কোনো মানে হয় না। হঠাৎ মালপত্র নিয়ে আমাদের কিছু না বলে উনি উধাও হয়ে যাবেনই বা কেন? উনি যেতে চাইলে তো ওঁকে কেউ জোর করে আটকে রাখতো না। তাছাড়া রাণুদিকে উনি কথা দিয়েছেন, আমি নিজের কানে শুনেছি।

বাগানের গেটটায় তালাবদ্ধ। মালি, মালি বলে কয়েকবার চেঁচিয়ে ডাকলাম। কোনো সাড়া নেই।

সাইকেলটাকে দেয়ালের গায়ে দাঁড় করিয়ে রেখে, কাঠের গেটটা বেয়ে উঠে টপকে নামলাম ওদিকে। খুবই সোজা ব্যাপার! মালির ঘরটাও বন্ধ। সে কোথায় গেছে কে জানে! আমাদের বাড়ির মালির মতন এ বাড়ির মালি বৌ-ছেলে নিয়ে থাকে না। অজিতদার ঘরেও তালা ঝুলছে। তবু দরজাটা একটু ফাঁক করে ভেতরটা দেখবার চেষ্টা করলাম। ভিতরটা অন্ধকার, আলো দেখা যায় না, তবু মনে হলো ভেতরে জিনিসপত্র কিছু রয়েছে।

আমাকে এই অবস্থায় কেউ দেখলে নির্ঘাত চোর ভাববে। আর চোরের মতন যখন ঢুকেছিই তখন দু’একটা জিনিস চুরি না করারও কোনো মানে হয়। এ বাড়িতে দু’তিনটে গন্ধ লেবুর গাছ রয়েছে। কয়েকটা লেবু ছিঁড়ে পকেটে ভরে নিয়ে আবার গেট পেরিয়ে চলে এলাম বাইরে।

বিকেলের দিকে রাণুদির মনে আবার প্রতিক্রিয়া শুরু হলো। আমরা সবাই এই ভয়ই পাচ্ছিলাম।

আমরা বসেছিলাম কালী মন্দিরের সামনের চাতালে। মাসীমা ফলটল কাটছেন বড়মামা পুজোয় এক্ষুনি বসবেন। হঠাৎ বাড়ির মধ্য থেকে ছুটে বেরিয়ে রাণুদি চলে গেলেন গেটের দিকে। আমরাও সবাই পেছন পেছন দৌড়োলাম।

গেটটা খোলার আগেই ধরে ফেললাম রাণুদিকে।

ভাস্কর জিজ্ঞেস করলো, রাণুদি কোথায় যাচ্ছেন?

রাণুদি বললেন, জানি না। ছাড়ো আমাকে।

আমি বললাম, রাণুদি অজিতদা খবর পাঠিয়েছেন, একটু বাদেই আসবেন।

রাণুদি ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, অজিতদা? অজিতদা কে?

–আমাদের অজিতদা! সত্যি খবর পাঠিয়েছেন।

–আমার একটা জিনিস হারিয়ে গেছে। আমি খুঁজতে যাচ্ছি।

বড়মামা এসে পড়ে বললেন, রাণু, কোথায় যাচ্ছিস মা? আমি পুজোয় বসবো এখন পুজো দেখবি না?

রাণুদি বললেন, আমার একটা জিনিস হারিয়ে গেছে। আমার কী হারিয়েছে তোমরা বলতে পারো। আমার মনে পড়ছে না?

বড়মামা এক গাল হেসে বললেন, ওমা, দেখো মেয়ের কাণ্ড! এক কানে দুল পরেছিস, আর একটা কোথায় গেল? কোথায় হারালি? বাড়ির মধ্যেই কোথাও পড়েছে। দ্যাখ।

সত্যিই রাণুদির এক কানে দুল নেই। আমরা আগে লক্ষ্য করিনি।

রাণুদি বললেন, দল? আমি দল হারিয়েছি? না তো?

বড়মামা রাণুদির হাত ধরে সেই হাতটা ওর দুলহীন কানে চুঁইয়ে বললেন, এই বালিশের পাশে–

এতে বেশ কাজ হলো। রাণুদির চোখ অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে গেল যেন, আপন মনে বললেন, ও, দুল নেই, তাহলে বিছানায় বালিশের পাশে–

রাণুদি আমাদের সঙ্গে ফিরে এলেন। সঞ্জয় দৌড়ে গিয়ে রাণুদির দুলটা খুঁজে নিয়ে এলো। রাণুদি সেটা পরে নিয়ে বললেন হ্যাঁ, আমি পুজো দেখবো। আমি এইখানে বসবো?

খুব কাতর গলায় রাণুদি বড়মামাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি দৌড়ে গিয়েছিলুম বলে আমায় কেউ বকবে না তো?

দু’তিনজনে মিলে একসঙ্গে বলে উঠলো, না, না, কেউ বকবে না। বকবে কেন?

আমার খুব রাগ হলো অজিতদার ওপর। এরকম একটি মেয়েকে ছেড়ে কেউ চলে যায়? অজিতদার কি হৃদয় নেই?

আমরা সবাই সতর্ক, আমরা সবাই পাহারাদার। রাণুদি কখন কী করে বসবেন কোনো ঠিক নেই।

রাণুদি কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন। তারপর একসময় আমার দিকে ঝুঁকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলেন, এই তুমি আমার নাম জানো?

আমি বললাম, হ্যাঁ! আপনি তো রাণুদি!

–না, আমার আর একটা নাম আছে না? কী আমার ভালো নাম বলো তো?

–মাধুরী!

–হ্যাঁ, মাধুরী। তুমি ঠিক বলেছো। তুমি সব জানোঃ আচ্ছা বলো তো, আমার কী হারিয়ে গেছে?

–ঐ দেখুন রাণুদি, বড়মামা পুজো করছেন।

রাণুদি উঠে দাঁড়িয়ে খানিকটা আচ্ছন্নর মতন চলতে চলতে কলী প্রতিমার কাছে গিয়ে বললেন, আমি পুজো করবো?

কালী প্রতিমার পাশে রাণুদিকে দারুণ সুন্দর দেখালো। রাণুদিও কক্ষনো চুল বাঁধেন না, মস্তবড় চুল পিঠের ওপর ছড়ানো, মুখখানা চকচক করছে, আমি যেন একমুহূর্তের জন্য রাণুদিকেও নগ্ন দেখলাম। ঠাস করে আমার নিজের গালে চড় মারবার ইচ্ছে হলো। আমি চোখ ফিরিয়ে নিলাম অন্যদিকে।

বড়মামা মন্ত্র পড়া থামিয়ে রাণুদির দিকে ঝুঁকে তাঁর হাত ধরে বললেন হ্যাঁ, রাণু, পুজো করবে। তুমি বসো আমার পাশে।

রাণুদি বললেন, আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পুজো করবো না? আমায় ফুল দাও।

মাসীমা বললেন, রাণু, লক্ষ্মীটি এদিকে সরে এসো। ঠাকুরের গায়ে হাত দিতে নেই।

বড়মামা বললেন, দিক। ওর যা ইচ্ছে করুক।

রাণুদি কালীঠাকুরের গলা থেকে জবা ফুলের মালাটা ছিঁড়ে নিলেন। তারপর প্রতিমার বিশাল স্তনের ওপর হাত রেখে বললেন, আঃ কী ঠাণ্ডা!

মাসীমা চোখ বুজে মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, না, না, পাপ হবে পাপ হবে। কেউ ওকে ওখান থেকে ধরে নিয়ে এসো।

আমি তড়াক করে উঠে গিয়ে রাণুদির হাত ছুঁয়ে বললাম, চলুন রাণুদি, বেড়াতে যাবেন?

রাণুদি জবাফুলের মালাটা চাবুকের মতন ধরে সপাং করে মারলেন কালীমূর্তির মুখে।

এতটা বাড়াবাড়ি রাণুদি আগে কক্ষনো করেন নি। বড়মামাও উঠে দাঁড়িয়ে রাণুদিকে টেনে সরিয়ে আনলেন সেখান থেকে। মৃদু ধমক দিয়ে বললেন, ছিঃ রাণু, ওরকম করতে আছে? সবাই দেখছে।

রাণুদি বললেন, ও তো পাথর, ওর তো লাগে না।

বড়মামা বললেন, হোক পাথর, তবু আমরা পুজো করি তো। যাকে আমরা পজো করি, তাকেক্ষনো অপমান করতে নেই।

–ওর কি কোনো জিনিস হারিয়েছে? তুমি বলো, বড়মামা, কালীঠাকুরের কোনো জিনিস হারায়?

–না, ওঁর হারায় না! উনি সবাইকে দ্যান। তোমাকেও দেবেন।

–মিথ্যুক কোথাকার।

-–যাও রাণু এখন গিয়ে শুয়ে থাকো। পুজোটা সেরে নিই, তারপর তোমায় ইঞ্জেকশান দেবো।

–আমি শোবো না। আমি বসবো।

অজিতদা নেই, আমিই যেন অজিতদা। আমি সাহস করে রাণুদির হাত ধরে বললাম, চলুন রাণুদি, আমরা বাগানের ঐ বেঞ্চটায় বসি।

আপত্তি না করে আমার সঙ্গে চলে এলেন রাণুদি। বেঞ্চটায় বসে গভীর বিস্ময়ভরা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, এটা কি সেই নদীর ধারের পাথর? তুমি জানো, এটা সেই পাথর?

–না, পাথর কেন হবে। এটা বেঞ্চ। আপনাদেরই বাড়িতে।

–তা হলে আজ আমি পাগল হইনি, না?

–না!

–তাই তো বলছি, আমি পাগল হইনি। আমি ভালো আছি। অথচ আমি ভাবছিলাম ঝড় হচ্ছে। সত্যিসত্যি ঝড় হচ্ছে না?

–হ্যাঁ, হয়েছে একটু আগে।

–তুমি বেশ সব জানো।

–রাণুদি, আমি আপনাকে ভীষণ ভালোবাসি।

রাণুদি খিলখিল করে হেসে উঠে বললেন, আর একটা কথা মনে পড়েছে। আমার একটা পোষা বেড়াল ছিল, খুব ভালোবাসতাম তাকে। দ্যাখো, এই কথাটাই ভুলে গিয়েছিলাম। এখন মনে পড়েছে, তাহলে আমি পাগল হইনি, পাগল হলে তো কিছু মনে থাকে না।, রাণুদি অজিতদার কথা এবারও বলছে না। অজিতদাকে ভুলে গেছেন হয়তো। এই বিস্মরণের মূল্য কী সাঙ্ঘাতিক!

রাণুদির মুখখানা ফুরফুরে হাসি মাখানো। যেন ভেতরে ভেতরে কিছু একটা নিয়ে মজা করছেন। এমনও মনে হতে পারে, যেন সবটাই ওঁর অভিনয়। শুধু কালী প্রতিমাকে ফুলের মালার চাবুক মারার সময় মুখখানা যেমন অদ্ভুত হয়ে গিয়েছিল, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠা অভিনেত্রীও সেরকম মুখের ভাব ফোঁটাতে পারবেন কি না সন্দেহ।

রাণুদি বললেন, আমার আরও একটা কথা মনে পড়ে গেছে, আমি যখন জাপান গিয়েছিলাম….আমি জাপান গিয়েছিলাম তুমি জানো তো, সে অনেক দিন আগে, কত বেড়ালাম, কত জায়গা দেখলাম….কিন্তু সেই জাপানে গিয়েও আমার অনেকগুলো জিনিস হারিয়ে গেল।

আমি চুপ করে রইলাম। পরে শুনেছিলাম, রাণুদি কখনো জাপানে যাননি। অথচ কী বিশ্বাসযোগ্যভাবে কথাগুলো বলছিলেন। কেন মাথায় হঠাৎ জাপান এলো, কে জানে।

–তুমি জাপানে গিয়েছো?

–না, যাইনি।

–আমি তোমায় নিয়ে যাবো। আমি সব চিনি, রাস্তা-টাস্তা সব, তবে, ওখানে বড় জিনিস হারিয়ে যায়….আমার কী কী হারিয়ে গেছে ঠিক মনে নেই…শুধু জাপানে কেন, আমি যেখানেই যাই, অনেক জিনিস হারিয়ে যায়। তোমার কিছু হারিয়ে যায়?

–হ্যাঁ, যায় মাঝে মাঝে।

–আমি যখন ইস্কুলে পড়তাম, তখন কিন্তু আমার কিছু হারাতো না, হ্যাঁ, সত্যি বলছি, কোনোদিন কিছু হারায়নি, তখন জিনিসগুলো খুব হালকা হালকা ছিল তো, খুব। হালকা।

কথা বলতে বলতেই রাণুদি উঠে দাঁড়ালেন।

আমি ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় যাচ্ছেন!

–বাঃ যাবো না? সেই যে,যেগুলো হারিয়ে গেছে, খুঁজবো না?

রাণুদিকে উঠে দাঁড়াতে দেখে ভাস্কররা এগিয়ে এলো ওদিকে। ওরা ঠিক নজর রেখেছে। রাণুদি হঠাৎ দৌর মারলে সবাই মিলে ধরে ফেলতে হবে।

তাহলে কি রাণুদিকে এখন থেকে ঘরে আটকে রাখতে হবে? অজিতদাই এ জন্য দায়ী।

পুজো শেষ হয়ে গেছে, বড়মামা ইঞ্জেকশানের সিরিঞ্জটা হাতে নিয়ে এলেন। রাণুদি আগে ইঞ্জেকশান নিতে একটুও আপত্তি করতেন না। আজ বড়মামাকে দেখেই রীতিমতন চিৎকার করে বললেন, না।

তারপর দৌড় লাগালানে। সে এক রীতিমতন চোর চোর খেলার মতন শুরু হলো। আমরা সবাই মিলে নানাদিক থেকে ছুটতে লাগলাম রাণুদিকে ঘিরে। রাণুদি মাথা নিচু করে তীব্র বেগে হঠাৎ ঘুরে যাচ্ছেন। এমনিতে এখনো হাসছেন রাণুদি, কিন্তু আমরা কেউ ওঁকে একবার ধরে ফেললেই উনি কেঁদে কেঁদে চেঁচিয়ে উঠছেন, না, না আমায় ছেড়ে দাও আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। আমরা ওঁকে ধরে রাখতে পারছি না।

একবার রাণুদি আছাড় খেয়ে পড়ে গেলেন, খুব জোরে। আবার উঠে পড়বার আগে আমরা সবাই গোল হয়ে ওঁকে ঘিরে দাঁড়ালাম।

বড়মামা নরম গলায় বললেন, লেগেছে, রাণু?

রাণুদি দুহাতে কান চাপা দিয়ে বললেন, আমি কিছু শুনতে পাচ্ছি না। তোমরা আমায় কিছু বলো না।

কী করুণভাবে রাণুদির সেই মাটিতে বসে থাকা। আমরা কেউ ওঁকে ধরে তোলবারও চেষ্টা করলাম না।

–তোরা আমায় মারবে? আমি কি পাগল হয়ে গেছি? আজ তো আমি পাগল হইনি? আমি আজ ভালো আছি।

বড়মামা বললেন, না, না রাণু, তোমায় মারবো কেন? তুমি ওঠো, চলো, বাড়ির ভিতরে চলো।

–আমায় নার্সিং হোমে পাঠিয়ে দেবে? দিও না! আমাকে ভীষণ ব্যথা দেয়, আমার খুব একলা একলা লাগে।

–না, নার্সিংহোমেও পাঠাবো না। তুমি বাড়িতেই থাকবে। ইঞ্জেকশানটা দিয়েনি? ঘুমিয়ে পড়লেই ভালো লাগবে।

–না! আমার ভালো লাগার দরকার নেই।

রাণুদি আবার উঠে দাঁড়াতেই দু তিনজন ওঁকে চেপে ধরলো। আমি অবশ্য গেলাম না। রাণুদি কষ্ট পাচ্ছেন, আমি আর দেখতে পারছি না।

বড়মামা ভাস্করদের বললেন, রাণুদির হাত শক্ত করে ধরে থাকতে। তারপর তিনি ইঞ্জেকশানের সূচটা ফুটিয়ে দিলেন।

ঠিক তখনই কাঁচ করে শব্দ হলো বাগানের গেটে। সেখানে দেখা গেল অজিতদার লম্বা চেহারাটা।

তক্ষুনি আমার মনে হলো, অজিতদার অন্তত আর এক মিনিট আগে আসা উচিত ছিল। সেটাই হতো ঠিক নাটকীয় মুহূর্ত।

অজিতদা প্রায় দৌড়ে এসে উপস্থিত হলেন, আর আমাদের ঠেলে সরিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন কী হয়েছে রাণু? কী হয়েছে?

রাণুদি মুখটা তুলে অকৃত্রিমভাবে অবাক হয়ে বললেন, ইনি কে? ইনি কি সত্যময়ের ভাই?”।

অজিতদা বললেন আমি এসেছি, রাণু, আমি। আমার দিকে তাকাও!

রাণুদি তাকালেন, কিন্তু দৃষ্টিতে কোনো পরিচয় প্রকাশ পেল না। ফিসফিস করে কী বললেন, বুঝতে পারলাম না আমরা।

অজিতদা ভাস্করদের বললেন, তোমরা ওর হাত ধরে আছো কেন? ছেড়ে দাও, ও এক্ষুনি ঠিক হয়ে যাবে।

তারপর বড়মামার দিকে ফিরে বললেন, কাল অনেক রাত্তিরে আমার বাড়িতে একটা আর্জেন্ট টেলিগ্রাম এসেছিল, দিল্লি থেকে। অফিসের একটা জরুরী ফাইল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, তাই জামাইবাবু আমায় ফিরে যেতে বলেছেন। আজ সকালেই টেলিগ্রামের একটা উত্তর দেওয়া দরকার….এখানে,মধুপুরের পোস্ট অফিসে টেলিগ্রাফ যন্ত্রটা খারাপ, তাই জসিডি যেতে হয়েছিল।

আমি একটু ভেবে বললাম, জসিডি থেকে আসতে এত সময় লাগলো?

অজিতদা আমাকে একটু ছোট বকুনি দিয়ে বললেন জসিঁড়িতে আমার জন্য দু-একটা কাজও ছিল।

রাণুদি এবার একটু জোরে বললেন, জাপানে…একটা জঙ্গলের মধ্যে…আমার অনেক কিছু হারিয়ে গেছে…কেউ জানে না!

অজিতদা বললেন, আমি একটু রাণুর সঙ্গে একলা কথা বলতে চাই।

বড়মামা বললেন, কিন্তু ও তো এক্ষুনি ঘুমিয়ে পড়বে, ইঞ্জেকশান দিলাম যে, ঐ যে দ্যোখো না চোখ বুজে আসছে।

রাণুদি টেনে টেনে সুর করে বললেন, তা-র-প-র খুব-বৃষ্টি-পড়-লো! কত জল! ঢেউ-এর প-র ঢেউ! খালি ঢেউ..উঁচু উঁচু, ঠিক যেন মা-নু-ষে-র মতন এক একটা ঢেউ, জ্যা-ন্ত! হ্যাঁ।

অজিতদা বললেন, তাহলে এখনই একটা দরকারি কথা বলি। রাণু, তুমিও একটু মন দিয়ে শোনো। আমাকে শিগগিরই দিল্লি ফিরে যেতে হবে, আমি রাণুকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চাই। রাণুর বাবা কবে আসবেন?

বড়মামা কোনো ব্যাপারেই সহজে অবাক হন না। তিনি গম্ভীরভাবে বললেন, এই শনিবারেই তো আসবার কথা।

অজিতদা বললেন, তারও তো আর চারদিন বাকি। আপনাদের যদি আপত্তি না থাকে, আমি রাণুকে বিয়ে করতে চাই। আমার দৃঢ় বিশ্বাস আমি রাণুকে সারিয়ে তুলতে পারবো। অবশ্য, রাণুর মতামতটাও জানতে হবে। ও যদি রাজি থাকে।

রাণুদি এত বড় একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার কিছুই বুঝলেন না বা শুনলেন না। তিনি তখন অভিজিতের কাঁধে ভর দিয়ে ঢুলছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *