ডাক্তার ডাকতে হয়নি, সঞ্জয়ের বড় মামা অভিজিতকে শুইয়ে দিলেন কালীমূর্তির সামনে। তারপর নিজেই চিকিৎসা করতে লাগলেন।
আধঘণ্টার মধ্যেই অভিজিত বললো, মা!
সঞ্জয়ের বড়মামাকে দেখলে ভক্তিও হয়,ভয়ও জাগে একটু। মিশমিশে গায়ের রং, বিশাল লম্বা। বাঙালীর মধ্যে অত কারো আমি আগে কখনো দেখিনি। একটা গেরুয়া
লুঙ্গি পরা, সম্পূর্ণ খালি গা, দুই বাহুতে রুদ্রাক্ষের মালা। দেখলে ঠিক সিনেমার কাঁপালিকের মতন মনে হয়, কিন্তু তিনি মা কালীর সামনেই সিগারেট খাচ্ছিলেন, সেটাই যেন একটু বিসদৃশ। কাঁপালিকেরা তো গাঁজার কলকে টানে।
তিনি আমাদের বললেন,যাক,ছেলেটার একচা জলের ফাড়াছিল, আজ কেটে গেল কতবার বারণ করেছি ও বাড়িতে যেতে, ওখানে পুকুর আছে। তা শুনবেই বা কেন, জলই তো ওকে টেনেছিল। তোমাদের মধ্যে কে ওকে বাঁচিয়েছো?
উৎপল কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই আশু বললো, আমাদের বাড়ির যে চৌকিদার, পরী, সে-ই ওকে তুলেছে।
কোনো ব্যাপারে গর্ব করা একদম আশুর ধাতে নেই।
বড়মামা বললেন, তোমরা তখন পুকুরে চান করছিলে বুঝি?
এবার উৎপল বলে ফেলো, না, আমরা তাশ খেলছিলাম, হঠাৎ সঞ্জয়ের চিৎকার শুনে আমরা গিয়ে জলে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। আমিই প্রথমে ওকে জলের তলায় পেলাম।
আশা আবার বললো, পরী ঠিক সময় এসে না পড়লে, কী যে হতো বলা যায় না। ছেলেটা কখন একলা গিয়ে পুকুরে নেমেছে।
বড়মামা বললেন, ঐ যে বললাম, ফাড়া ছিল, জল তো ওকে টানবেই। ও বাড়িটা তো সারা বছর খালি পড়ে থাকে, ভাগ্যিস তোমরা ছিলে! যাক, আর কোনো চিন্তা নেই। দ্য ডেঞ্জার ইজ ওভার। তোমরা বসো, তোয়ালে দিচ্ছি, মাথাটাথা মুছে ফেল।
জলে ঝাঁপিয়ে পড়বার আগে ভাস্করই একমাত্র ঝট করে নিজের শার্টটা খুলে ফেলেছিল। আশু আর উৎপলের পুরো পায়জামা শার্ট পরা। এক্ষুনি সব ছেড়ে ফেলা দরকার। কিন্তু ওঁরা জোর করে আমাদের মিষ্টি খাওয়াবেনই। আমরা খানিকটা আগেই এক গাদা খাবার খেয়েছি, তবু চারটে করে সন্দেশ খেতেই হলো।
অভিজিতের মা প্রথম দিকটায় খুব কান্নাকাটি করছিলেন। এখন শান্ত হয়ে গেছেন। অভিজিৎকে তিনি গরম দুধ খাওয়াচ্ছেন।
ওর মায়ের বেশ মা মা চেহারা। মুখে একটা স্নিগ্ধভাব আছে। একটা চওড়া লাল পাড়ের সাদা শাড়ি পরা। ছেলের সেবা করতে করতেই উনি বারবার বলতে লাগলেন, বাড়ির তৈরি সন্দেশ, খাও, একটাও রাখবে না….তোমরা না থাকলে আজ কী যে হতো!
অভিজিৎ উদ্ধার পর্বে আমার যদিও কোনো ভূমিকা নেই, তবু আমাকেও সন্দেশ খেতে হলো। অবশ্য, আমি যে সরস্বতাঁকে ডেকেছিলাম, তাতেও তো কাজ হতে পারে। সরস্বতীও তো জলেরই দেবী, এতক্ষণে আমার মনে পড়েছে, ওর নমের মানেতেই তো বোঝা যায়।
এত কাণ্ডের মধ্যেও সঞ্জয়ের দিদিকে একবারও খবর দেওয়া হলো না কিংবা কেউ তার কথা উল্লেখই করছে না দেখে আমি ক্রমশ দারুণ অবাক হচ্ছিলাম।
অভিজিৎ আর সঞ্জয়ের আর এক দিদি আছে। সে প্রায় আমাদেরই বয়সী, তার নাম ঝুমা। পরে জেনেছি, সেও ফাস্ট ইয়ারে পড়ে, কিন্তু সেদিন সে আমাদের সঙ্গে কোনো কথা বললো না।
একটুক্ষণ কথাবার্তাতেই আমরা জানলাম যে সঞ্জয়ের বড়মামা এখানে বারো মাসই থাকেন। তিনিই এই কালীমন্দিরের পূজারী। মাঝে মাঝে ওঁর মুখে ইংরিজি কথাবার্তা শুনে মনে হয়, উনি বেশ লেখাপড়াও জানেন, নিছক গ্রাম্য কাঁপালিক নন। উনি খুব ঘন ঘন চা আর সিগারেট খান। সঞ্জয়রা এখানে বেড়াতে এসেছে, সঞ্জয়ের বাবার অফিসে খুব জরুরী কাজ আছে বলে তিনি ওদের ওখানে রেখে ফিরে গেছেন কলকাতায়, তবে প্রত্যেক সপ্তাহে একবার করে আসেন।
আমরা বসেছিলাম মন্দিরের টাকা দালানে। বৃষ্টি থেমে গেছে। এই সময় সেখানে এলেন সেই যুবতী। অসহ্য সুন্দর তার রূপ। ঠিক যেন জ্যান্তদেবী সরস্বতী। শুধু মুখখানায় বিষাদ মাখানো। এমন সুন্দর অথচ এমন দুঃখী মুখ আমি কখনো দেখিনি।
তিনি সেখানে দাঁড়াতেই সঞ্জয়ের মা আস্তে করে বললেন, আয় রাণু, বোস।
মহিলা আমাদের দিকে একপলক শুধু তাকিয়ে দেখলেন, তারপর জিজ্ঞেস করলেন, খোকনের কি হয়েছে মা? ও ঠাকুরে সামনে শুয়ে আছে কেন?
মা বললেন, খোকন যে জলে ডুবে গিয়েছিল। এই ছেলেরা ওকে বাঁচিয়েছে।
অভিজিতের দিদি মুখখানা একেবারে বদলে গেল। দারুণ ভয় পেয়ে বললেন, আঁ, জলে ডুবে গিয়েছিল? খোকন, খোকন!
মহিলাটি একেবারে যেন অভিজিতের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে তুলে নিতে গেলেন। মা তাকে বাধা দিয়ে বললেন, থাক, থাক, রাণু ও এখন একটু শুয়ে থাক।
তিনি হাটু গেড়ে বসে রইলেন অভিজিতের সামনে।
আমি একদৃষ্টে শুধু ঐ মহিলাকেই দেখছিলাম, অন্য কিছু খেয়াল করিনি, ভাস্কর আমার হাত ধরে টেনে, বললো, চল, বাড়ি যাবি না। আমাদের জামা কাপড় ছাড়তে হবে।
আশ্চর্য ব্যাপার, সঞ্জয়ের দিদি আমার রাণু মাসীর বয়েসী, আর এঁর নামও রাণু। অবশ্য রাণু মাসীর সঙ্গে এর চেহারার কোনো মিল নেই।
আমি উঠে দাঁড়ালাম। সঞ্জয়ের বড়মামা আমাদের সঙ্গে এলেন খানিকটা। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কদিন থাকবে?
ভাস্কর বললো, আট দশ দিন।
তিনি বললেন, তোমরা বললে, তোমরা তাশ খেলছিলে। ব্রীজ জানো নাকি?
উৎপল সঙ্গে সঙ্গে বললো, হ্যাঁ। অকশান, কনট্রাক্ট দুটোই জানি।
বড়মামা বললেন, আমারও খুব তাশ খেলার শখ। এখানে সব সময় সঙ্গী পাই না। দুপুরে দিকে চলে এসো না; খেলা যাবে।
উৎপল সঙ্গে সঙ্গে সম্মতি জানালো।
ওবাড়ি ছাড়িয়ে মাঠটা পেরিয়ে আসতে আসতে আমি বললাম, সঞ্জয়ের দিদি কী রকম একটু অদ্ভুত না? কতক্ষণ পরে এলেন, তারপর আমাদের সঙ্গে একটাও কথা বললেন না।
ভাস্কর বললো, উনি তো পাগল!
আমি চমকে উঠে বললাম, পাগল? যাঃ! তুই কি করে জানলি?
ভাস্কর বললো, ও তো চোখের দিকে তাকালেই বোঝা যয়। দেখলি না কী, রকম ফাঁকা ফাঁকা দৃষ্টি। আহা, এত সুন্দর দেখতে!
আমি কিছুতেই মানতে চাইছিলাম না। কিন্তু দেখা গেল আশু আর উৎপলও ভাস্করের কথাই বিশ্বাস করছে।
আমার মনটা যেন মুষড়ে গেল। পাগল শুনলেই ভয় হয়। কোনো পাগল সম্পর্কে আগে আমার অন্য কোনো অনুভূতি হয় নি, এই প্রথম বেদনা বোধ করলাম।
আমাদের বাগানে ঢুকে পুকুরটার পাশ দিয়ে হাঁটতে লাগলাম আমরা। পুকুরের জল এখন শান্ত, নিথর, মাঝখানের লাল শালুকগুলোর ওপর কয়েকটা ফড়িং ওড়াউড়ি করছে। দেখলে বোঝাই যায় না যে একটু আগে একটা কী সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার ঘটতে যাচ্ছিল। একটা সুন্দর প্রাণ সামান্য কারণে নষ্ট হয়ে যেত।
ভাস্কর বললো, পুকটা ছোট হলে কী হয়, বেশ গভীর আছে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ভাস্কর, মানুষ কেন পাগল হয় রে?
ভাস্কর বললো, কী জানি? আমি অন্য বন্ধুদের দিকে তাকালাম। ওরাও জানে না।
পুকুরের এ পাশে একটা ইউক্যালিপটাস গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে রাখা আছে অভিজিতের সাইকেলটা। সেটা দেখেই সেদিকে আমরা এক সঙ্গে দৌড় লাগালাম। উৎপল সবচেয়ে আগে গিয়ে সেটা ছুঁয়ে ফেললেও আমি বললাম, এই দ্যাখ, তোদের জামা কাপড় ছাড়তে হবে, শুধু আমারই সব শুকনো-আমাকে আগে চড়তে দে। আমার পরেই, উৎপল, তোকে দেবো।
উৎপল আপত্তি করলো না, ওরা বাড়ির ভেতরে চলে গেল, আমি সাইকেলটা নিয়ে প্রথমে বাগানের মধ্যেই কয়েকবার চক্কর দিলাম। আর আপন মনে বারবার বলতে লাগলাম, মানুষ কেন পাগল হয়? কেন পাগল হয়?
কয়েকবার পাক দিয়ে আমার কিছুটা আত্মবিশ্বাস জাগলো। পাড়ার শিবুদার দোকান থেকে পচাত্তর পয়সা ঘন্টা হিসেবে ভাড়া নিয়ে সাইকেল চড়া শিখেছিলাম বছর দু এক আগে। তারপর আর প্র্যাকটিস নেই। সেই জন্য ঠিক ভরসা ছিল না পারবো কি না। কিন্তু বেশ পেরে যাচ্ছি। সেই জন্য ইচ্ছে হলো একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসতে।
ওদের কিছু না জানিয়ে বেরিয়ে গেলাম গেট দিয়ে। বাঁদিকে গেলে মধুপুর শহর ডানদিকে কী আছে জানি না। আমি বেঁকলাম ডানদিকেই। অনেক পরে পরে দুএকটা বাড়ি। সব বাড়িগুলোই ফাঁকা মনে হয়। হয়তো পুজোর সময় এই সব বাড়ি ভর্তি হয়ে যাবে।
রাস্তাটা লাল রঙের। কিছুদূর এগোবার পর আর বাড়ি নেই। রুখু উদলা মাঠ। রাস্তাটা খানিক পরেই ঢালু হতে শুরু করলো। তখনই আমি আবিষ্কার করলাম সেই কদমফুল গাছটা। ফুলে একেবারে ভরে আছে। দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়, অবাকও লাগে। এতদূরে ফাঁকা মাঠের মধ্যে গাছটা এমন সুন্দর সাজে সেজে আছে কার জন্য? কেউ তো দেখতে আসবে না।
সাইকেল থেকে নেমে আমি গাছটায় চড়তে লাগলাম। ইচ্ছে করলে আমি এই গাছটার সূব ফুল পেড়ে ফেলতে পারি। কিন্তু তার দরকার কি, এই গাছটাই তো আমার। আমি ছাড়া তো আর কেউ ওর কাছে থামেনি। একটা ফুলের ওপর হাত রেখে আমি গাছটিকে জিজ্ঞেস করলাম, নিই? একটা নিই এখন?
নরম তুলোর বলের মতন কদমফুল। গালে ছোঁয়ালে ভারী আরাম লাগে। এত সুন্দর একটা জিনিস বিনা পয়সায় পাওয়া যায়। কথাটা ভাবলেই সারা শরীরে একটা ভালো লাগার অনুভুতি হয়। পরক্ষণেই মনে পড়ে, যারা পাগল, তাদেরও কি একটা কদম ফুলের গা দেখলে ভালো লাগে?
রাস্তাটা ঢালু হয়ে গিয়ে একটা নদীতে পড়েছে। নিতান্তই ছোট মেঠো নদী, কারণ এই বর্ষাকালেও তাতে জল বেশী নেই, বড় জোর হাঁটু সমান। স্বচ্ছ জল, তলার বালি স্পষ্ট দেখা যায়। কাল বিকেলে যে নদীটা দেখেছিলাম, সেটাই ঘুরে এদিকে এসেছে, না এটা অন্য কোনো নদী, তা অবশ্য জানি না।
রাস্তা থেকে বাঁ পাশে খানিকটা দূরে নদীর ধারে একটা বড় পাথর। সেটার ওপর গিয়ে বসলাম। জলে স্রোত আছে, পাথরটার গায়ে ধাক্কা খেয়ে জলটা ঘুরছে সেখানে। কী পরিষ্কার জল, ইচ্ছে করলেই চুমুক দিয়ে খেয়ে ফেলা যায়। এই ছোট্ট নদীটাকে আমার দারুণ পছন্দ হয়ে গেল। আমি সাঁতার জানি না, যাতে আমি জলে ডুবে না যাই সেইজন্য এই নদী বেশী গম্ভীর হয়নি। আমি এটা অনায়াসে পার হতে পারি। পাথর থেকে নেমে পাজামাটা গুটিয়ে আমি চলে গেলাম ওপারে। মাঝখানটায় প্রায় কোমর সমান জল। জীবনে এই প্রথম আমার একটা নদী পার হওয়া। যতই ছোট হোক, নদী তো,স্রোত আছে যখন। সেই নাম-না-জানা নদীটার সঙ্গে আমার খুব বন্ধুত্ব হয়ে গেল, আমি মাঝে মাঝেই এখানে আসবো।
আশ্চর্য, আমি এতক্ষণ আছি, অথচ এই রাস্তা দিয়ে আর একটাও গাড়ি চলেনি, কোনো মানুষও দেখিনি। কেউ যায় না। অথচ একটা রাস্তা এমনি এমনি হয়েছে। রাস্তাটাও এই নদীতেই শেষ। নদীর অন্য পাড়ে যতদূর দেখা যায় শুধু মাঠ আর দূরে আকাশের গায়ে পাহাড়। কোনো রাস্তাকে এরকম হঠাৎ শেষ হতে আমি দেখেছি কি আগে? কলকাতায় অনেক বন্ধ গলি আছে, সেগুলো কোনো দেয়ালে গিয়ে ধাক্কা খায়। আর এই রাস্তাটা এসে ডুব দিয়েছে নদীতে, আর ওঠেনি। চমৎকার না?
ফেরবার সময়, যে-সব বাড়িগুলোকে জনহীন ভেবেছিলুম, তারই একটা বাড়িতে একজন খুব লম্বা লোককে দেখতে পেলুম। লোকটি একটা লাঠি হাতে একটা কুকুরকে তাড়া করছেন। কুকুরটা কী কারণে যেন লোকটির দিকে ছুটে ঘেউঘেউ করছে। লোকটি মুখে অল্প অল্প দাড়ি, তবু তাঁকে বাঙালী বলেই মনে হয় বাঙালীদের মুখে কী একটা থাকে, দেখলেই ঠিক চেনা যায়। আমি আর সেখানে সাইকেল থামালুম না।
বাড়িতে এসে দেখি, ওপরতলাটা একদম চুপচাপ। ওরা সব গেল কোথায়? আমাকে ফেলেই কোথাও চলে গেল নাকি? ওপরে এসে দেখলাম, ওরা তিনজন খুব মনোযোগ দিয়ে সেই বন্ধ ঘরের তালাটা খোলার চেষ্টা করছে। কোথা থেকে একটা বড় পেরেক যোগাড় করেছে ভাস্কর, সেটা দিয়ে উৎপল নানারকম কায়দা দেখাতে ব্যস্ত। পেরেক দিয়ে তালা খোলা যায়, তা আমি কখনো শুনিনি।
পেছনে দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণ দেখে আমি বললাম, তালা খোলার সবচেয়ে ভালো উপায় কী জানিস? দড়ির গিট খোলার যা উপায় তাই।
আশু জিজ্ঞেস করলো, কী উপায়?
–আলেকজাণ্ডার পারস্যদেশ জয় করার পর সেখানকার বুড়ো লোকরা একগোছা বিরাট জট পাকানো দড়ি তাঁর সামনে এনে বলেছিল, এই গিট না ছাড়ালে পারস্যের রাজা হওয়া যায় না।
উৎপল বললো, আঃ এখন বকবক করিস না, কনসেনট্রেশন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আশু বললো, আলেকজাণ্ডার খুলতে পারলেন?
–আলেকজাণ্ডার বললেন, গিট খোলার সবচেয়ে সহজ উপায়টা আমি আপনাদের দেখিয়ে দিচ্ছি। এই বলে তিনি তলোয়ারটা বার করে এক কোপে সব দড়িগুলো কেটে ফেললেন! সেই রকম তালা খোলার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো তালাটা ভেঙে ফেলা।
উৎপল ওর রাগী মুখখানা ফিরিয়ে বললো, তুই ভাঙ দেখি তালাটা। দেখি তোর কত ক্ষমতা।
ঠিক জায়গা মতন গল্পটা বলতে পেরে আমার একটু গর্ব হয়েছিল। সুতরাং দমে না গিয়ে বললাম, একটা হাতুড়ি নিয়ে আয়, এক্ষুনি ভেঙে দিচ্ছি।
উৎপল বললো, দ্যাখ!
সে একটা টান মারতেই তালা খুলে গেল, আমরা চমকে উঠলাম।
ভাস্কর উৎপলের কাঁধ চাপড়ে বললো, তুই আর কষ্ট করে লেখাপড়া করছিস কেন? চুরি-ফুরির লাইন যথেষ্ট উন্নতি করতে পারবি।
উৎপল বললো, ওসব কথা পরে হবে, আগে আমার পায়ের ধুলো নে।
সায়েন্টিফিক ব্রেন থাকলে সব কিছুই করা যায়।
ভাস্কর নিচু হয়ে সত্যিই উৎপলকে প্রণাম করলো। উৎপল তাতেও খুব সন্তুষ্ট না হয়ে আমার আর আশুর দিকে তাকিয়ে বললো, তোরাও পায়ের ধুলো নে।
আশু বললো, যাবার দিন তুই যদি তালাটা আবার বন্ধ করতে পারিস সেদিন পায়ের ধুলো নেবো আমি।
দরজা ঠেলে আমরা ঘরের মধ্যে ঢুকলাম। জিনিসপত্রে একেবারে ঠাসা। অনেক দিন জানলা-টানলা খোলা হয়নি বলে ভেতরে একটা ভ্যাপসা গন্ধ।
সত্যিকথা বলতে কি, তালাটা খুলে ফেলায় আমি একটু নিরাশাই বোধ করলুম। যতক্ষণ ঘরটা বন্ধ ছিল, ততক্ষণ মনে হচ্ছিল ঐ ঘরে যেন কিছু একটা রহস্য আছে। অনেক বন্ধ ঘর দেখলেই এরকম মনে হয়। কিন্তু এ ঘরটাতে কোনো রহস্যই নেই, নিছকই কাজের জিনিসপত্র, থালাবাসন, লেপ, তোশক, দু’খানা ইজিচেয়ার, এইসব। একটু ভালো করে দেখার পর অবশ্য একটা রোমাঞ্চকর জিনিস চোখে পড়লো। ঘরের কোণে ক্যাম্বিসের পোশাক পরানো একটা দোনলা বন্দুক। তখন বুঝতে পারলুম, এই জিনিসটার জন্যই এ ঘরের চাবি আমাদের দেওয়া হয়নি।
দু’খানা হ্যাঁজাক তুলে নিয়ে উৎপল বললো, ব্যাস, আলোর প্রবলেম সলভড।
ভাস্কর বন্দুকটা হাতে নিয়ে পোশাক ছাড়িয়ে ফেললো। তারপর পাকা শিকারীর ভঙ্গিতে দু’হাতে সেটা বাগিয়ে ধরে বললো, গুলি টুলিও আছে নিশ্চয়ই।
আশু বললো এই ওটা রেখে দে। বন্দুক নিয়ে ঘাটাঘাটি করার দরকার নেই। ভাস্কর বললো, আমাদের বাড়িতে বন্দুক আছে, আমি বন্দুক চালাতে জানি।
–তবু, রেখে দে!
উৎপল বললো, এই ঘর আমি খুলেছি, এ ঘরের দায়িত্ব আমার। ভাস্কর, বন্দুক নিয়ে ইয়ার্কি আমি পছন্দ করি না।
হ্যাঁ, উৎপল ঠিকই বলেছে, এই ঘরটা এখন থেকে উৎপলের। ভাস্কর খানিকটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও বন্দুকটা যথাস্থানে রেখে দিয়ে বললো, যাক, একটা বন্দুক আছে যখন জানা গেল; তখন আর কোন ভয় নেই? ডাকাত-ফাঁকাত এলে…
তারপরই বিছানার বাণ্ডিল থেকে সে একটা তাকিয়া বার করে নিয়ে বললো, এটাও খুব কাজে লাগবে, একটা কান-বালিশ না থাকলে আমার ঠিক ঘুম হয় না।
প্রায় মুহূর্তের মধ্যেই ভাস্কর বন্দুকের বদরে একটা বালিশ নিয়ে খুশী হয়ে গেল।
দুপুরের খাওয়া-দাওয়া হয়ে গেল খুব তাড়াতাড়ি। খাওয়া শেষ হতে না হতেই উৎপল বলে উঠলো, আজ আর কিন্তু ঘুমোনো-টুমোননা চলবে না, বড়মামা তাস খেলার নেমন্তন্ন করেছেন।
অভিজিৎদের বড়মামা এর মধ্যেই আমাদেরও বড় মামা হয়ে গেছেন। ওঁর নামটা তো আমরা জানি না।
পরীকে আমরা জিজ্ঞেস করলাম, ঐ দিকে যে বাড়িটাতে কালী মন্দির থাকে, সেই বাড়ির বাবুকে তুমি চেনো?
পরী বললো, ডাগদারবাবু বহুত আচ্ছা আদমী।
আমরা বললুম, যিনি কালীপুজো করেন, তিনি ডাক্তারবাবু?
পরী বলল, হাঁ। বহুত আচ্ছা দাওয়াই দেন। পয়সা লেন না!
পরে জেনেছিলুম অভিজিতের বড়মামা সত্যিই এম বি বি এস পাস অ্যালোপ্যাথিক ডাক্তার। কিছুদিন পাটনা শহরে প্র্যাকটিসও করেছিলেন, পরে সব ছেড়েছুঁড়ে এখানে কালীপূজো করেন ও গরীব দুঃখী লোকদের ওষুধ দেন।
ও বাড়িতে পৌঁছে আমরা একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখলুম। মন্দিরের ঠিক সামনেই কুয়োতলায় অভিজিতের দিকিকে স্নান করানো হচ্ছে। অতবড় একজন মহিলাকে অন্য কেউ চান করিয়ে দেয়, আগে দেখিনি। একজন স্ত্রীলোক ওঁর হাত ধরে আছেন শক্ত করে, আর অভিজিতের মা বালতি করে জল ঢেলে দিচ্ছেন ওঁর মাথায়।
অভিজিতের দিদির ব্যবহারে কিন্তু পাগলামির কোনো লক্ষণই নেই। খুব নরম কাতর গলায় তিনি বলছেন, মা আমায় ছেড়ে দাও না। আমি নিজেই তো চান করতে পারবো!
মা বললেন, আর এই তো হয়ে গেল।
দিদি বললেন, কেন তোমরা আমার ওপর জোর করো, আমি কি নিজে কিছু করি না?
মা বললেন কেন পারবি না। শুধু একটু বুঝেসুঝে বলতে হবে? তুই কুয়োর মধ্যে নামতে গিয়েছিলি কেন? কুয়োর মধ্যে কেউ নামে? সর্বনাশ হয়ে যেত না একটা?
দিদি যেন খুবই লজ্জা পেয়ে বললেন, আর কোনো দিন নামবো না!
আমরা খুবই অস্বস্তির মধ্যে পড়লুম। একজন যুবতী মহিলাকে স্নান করানোর দৃশ্য বোধহয় আমাদের দেখে ফেলা উচিত না। কিন্তু আমরা তো হঠাৎ এসে পড়েছি। এখন ফিরে যাবো কি?
আমরা চারজন ঘেঁষাঘেঁষি করে আড়ষ্টভাবে দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম। অভিজিতের মা আমাদের দেখতে পেয়ে বললেন, খাওয়া হয়ে গেছে? এসো, ভেতরে গিয়ে বসো!
আশু জিজ্ঞেস করলো, অভিজিৎ এখন কেমন আছে?
–ভালো, খেয়ে নিয়ে ঘুমিয়েছে।
এই সময় সঞ্জয় বেরিয়ে আমাদের দেখতে পেয়ে দৌড়ে এলো।
বড়মামা তখন খেতে বসেছেন। এ বাড়িতে দেরি করে খাওয়া দাওয়া হয়, আমরা অসময়ে এসে পড়েছি। আমাদের বসানো হলো ভেতরের একটি ঘরে। সে ঘরটির দেয়ালগুলো জুড়ে বড় বড় র্যাক, তাতে নানারমের বই ঠাসা। ঘরটিতে চেয়ার টেবিল নেই, একটা লাল রঙের কার্পেট পাতা, তার ওপর ছড়ানো কয়েকটা তাকিয়া। একেবারে যেন তাসের আসর পাতা রয়েছে।
খাওয়া সেরে বড়মামা মস্ত বড় একটা পানের ডিবে হাতে নিয়ে সে ঘরে এসে বসলেন। নিজে এক সঙ্গে দুটি পান মুখে পুরে আমাদের দিকে ডিবেটা এগিয়ে দিয়ে বললেন, খাও।
আমরা কেউ পান খাই না। তবু যেন শুধু ভদ্রতা রক্ষার জন্যই ভাস্কর এক খিলি পান তুলে নিল। ভাস্কর বনেদী বাড়ির ছেলে, ও এইসব আদবকায়দা জানে। আমরা আর কেউ নিলুম না।
খুব দামী, প্লাস্টিকের দু’প্যাকেট তাস বার করলেন বড়মামা, তারপর খুব কায়দার সঙ্গে শাফল করতে করতে বললেন, কী খেলবে, অকশান? না কন্ট্রাক্ট?
পাঁচজনের মধ্যে একজনকে বাদ দিতেই হবে। আমার কোনো মতামত না নিয়েই উৎপল বললো, নীলু, তুই তা হলে একটু বোস। আমরা তিনজন খেলি বড়মামার সঙ্গে।
আমাকে ওরা সবচেয়ে কাঁচা খেলোয়াড় মনে করে। তাস খেলা থেকে বাদ পড়ায় আমার খুব আপত্তি ছিল না, কিন্তু খেলার পাশে চুপচাপ বসে থাকা একটা অসহ্য ব্যাপার। তাস খেলা তো আর ফুটবলের মতন নয় যে দর্শকরাই বেশী উত্তেজিত হবে।
খেলার ফাঁকে ফাঁকে টুকরো টুকরো কথায় বড়মামা আমাদের পরিচয় জেনে নিলেন। নিজের সম্পর্কেও বললেন দু’একটা কথা। এখন আর ওঁকে কাঁপালিকের মতন মনে হয় না। তবে মানুষটি নিশ্চিত খানিকটা অসাধারণ। এমনিতে ডাক্তার, তার ওপর কালীপুজো করেন,ঘরে রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র থেকে শুরু করে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব বসুর বইও রয়েছে। সিগারেট, পান, চা-তিনটেরই খুব নেশা।
কথায় কথায় উনি বললেন, আমার দিদির বড় মেয়েটিকে দেখেছো তো তোমরা? একটু মাথায় দোষ দেখা দিয়েছে। আমার জ্যাঠামশাই পাগল ছিলেন, আমার এক খুড়তুতো ভাইও…আমাদের বংশে একটু পাগলামির ধারা আছে, সেইজন্যেই ও বেচারা…..রাণু পড়াশুনোয় খুব ভালো ছিল, বি এ তে হিস্ট্রি অনার্সে ফার্স্ট হয়েছিল, তারপর থেকেই–
ভাস্কর আমার দিকে আড়চোখে তাকালো, ভাবখানা এই, দেখলি তো আমি আগেই বলেছিলুম কিনা।
বড়মামা আবার বললেন, অনেক রকম চিকিৎসা হয়েছে, ও বেচারীর তো কোনো দোষ নেই, নিজেই বুঝতে পারছে, কোনো চিকিৎসাশাস্ত্র এখনো রংশানুক্রমিক পাগলামি সারাতে পারে না……এখানে এনে রেখেছি যদি মায়ের দয়াতে কিছু হয়….
আমি জিজ্ঞেস করলুম, সারবে না?
বড়মামা বললেন, মা যদি দয়া করেন, নিশ্চয়ই সারবে। কখনো আশা ছাড়তে নেই। এখানকার কুয়োর জল খুব ভালো…কত লোকের কত রোগ সেরে গেছে। দূর দূর জায়গা থেকে লোকে আমাদের বাড়ির কুয়োর জল নিতে আসে।
একটু বাদে সঞ্জয় এসে আমাকে বললো, নীলুদা, আপনি তো তাস খেলছেন না, আপনি আমার সঙ্গে ক্যারাম খেলবেন?
সেটাই ভালো মনে করে, আমি সঞ্জয়ের সঙ্গে উঠে গেলাম পাশের ঘরে। সেখানে সঞ্জয়ের ছোড়দি ঝুমা খাতা খুলে খুব মন দিয়ে পড়ছে।
ঝুমা আমার দিকে একবার চেয়ে দেখলো, কোনো কথা বললো না। মেয়েটা যেন অহঙ্কারে একেবারে মটমট করছে? ওর কি ধারণা ও আমাদের চেয়ে ইংরিজি বেশী জানে? একবার ভাস্করের সঙ্গে চ্যালেঞ্জ দিয়ে দেখুক না। আমি যদিও পরীক্ষায় ইংরিজিতে কম নম্বর পেয়েছি, কিন্তু ইংরিজি গল্পের বই আমি নিশ্চয়ই ঢের বেশী পড়েছি ওর থেকে।
আমরা মেঝেতে ক্যারাম বোর্ড পেতে বসতেই ঝুমা তার ছোট ভাইকে ধমক দিয়ে বললো, এই এখানে খেলা চলবে না। দেখছিস না আমি পড়ছি।
সঞ্জয় বললো, আমরা কোথায় খেলবো? এক ঘরে দাদা ঘুমোচ্ছে, দিদির ঘরে মা যেতে বারণ করেছে।
–বারান্দায় যা।
সঞ্জয় একটুক্ষণ তর্ক করে হার মেনে ক্যারাম বোর্ড নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। ঝুমা আর একবার অবজ্ঞার দৃষ্টি দিল আমার দিকে। যেন সে বোঝাতে চায়, আমরা এলেবেলে খেলাধুলো নিয়ে সময় নষ্ট করি, কিন্তু সে শুধু পড়াশুনো ভালোবাসে!
সঞ্জয়ের সঙ্গে খেলতে শুরু করেই আমি চমকে উঠলুম। ওরে বাবা, এ যে বিচ্ছু ছেলে একেবারে! সাঘাতিক খেলে। একমাত্র উৎপলই এর সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবে।
সুতরাং মান বাঁচাবার জন্য আমাকে বলতেই হলো, অনেকদিন প্রাকটিস নেই, টিপ নষ্ট হয়ে গেছে, তবে দেখবে, একটা রিবাউণ্ড মার দেখাবো?
কিন্তু আমি যতই রিবাউণ্ড মারের কায়দা দেখাই, তাতে কোনো সুবিধে হলো না, পর পর দুটি গেম সঞ্জয় আমাকে যা-তা ভাবে হারিয়ে দিল। এবং এত সহজভাবে হারাবার ফলেই সে আর খেলায় বেশী উৎসাহ পেল না। আমি দেখলুম, ঘুমে তার চোখ দুলে আসছে।
ওকে বললাম, তুমি ঘুমোতে যাও, সঞ্জয়!
আমি আর তাস খেলার জায়গায় ফিরে না গিয়ে বেরিয়ে এলাম বাইরে। আজও আকাশ মেঘলা করে আছে। বিকেলের দিকে বোধহয় বৃষ্টি নামবে। আকাশের একদিক কালো হয়ে আছে। আমি কালো রং এমনিতে খুব পছন্দ করি না। একমাত্র কালো মেঘই আমার ভালে লাগে। এরইরকম কালো মেঘ আকাশকে কী গম্ভীর করে দেয়! এক এক সময়, মেঘ দেখলে মনে হয়, আকাশের গায়ে হেলান দেওয়া হিমালয়কে দেখতে পাচ্ছি।
চাতালে উঠে আমি কালীমূর্তির সামনে গিয়ে দাঁড়ালুম। মূর্তিটি বেশ বড়, কালো পাথরের। আমার সতেরো বছরের জীবনে ঠাকুর দেবতারা আমাকে ভীষণ ভাবে আলোড়িত করেছে। ভগবান বলে কি সত্যিই কিছু আছে? এই আকাশের নীল যবনিকার আড়ালে থাকেন দেবতারা? যখন আরও ছোট ছিলাম,এই সব বিশ্বাস করতে খুব ভালো লাগতো, রামায়ণ, মহাভ রতের গল্প পড়ে মনে হতো, হঠাৎ হয়তো আমিও কোন দেব দেবীর দেখা পাবো। খুব বৃষ্টির পর আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতাম ব্যথভাবে, আমার আশা ছিল, সব মেঘ সরে গেলে আমি হঠাৎ একদিন এক চিলতে স্বর্গের দৃশ্য দেখতে পাবো।
কিন্তু সতেরো বছরে পৌঁছে, ঐ সব চিন্তাকে ছেলেমানুষি বলে ভাবি। এমন কি কালী ঠাকুরের মূর্তির দিকে সোজাসুজি চাইতে আমার লজ্জা হয়।
ঈশ্বর আছেন কি নেই, এই চিন্তা ছাড়া আর যে দ্বিতীয় চিন্তাটি আমায় বিব্রত করে, তা হচ্ছে নারী সম্বন্ধে। আমার চোদ্দ বছর বয়েস থেকেই আমি দীপান্বিতাকে চিঠি লিখি, সেও আমাকে লেখে। সপ্তাহে অন্তত একবার দীপান্বিতাকে না দেখলে আমার মন খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু একটা জিনিস কিছুতেই বুঝতে পারি না, কেন এই দেখা করবার ইচ্ছেটা। কেন ব্যাকুলতা। কেন দীপান্বিতার হাতটা ধরলেই আমার বুক কাঁপে? শুধু হাত ধরা কেন, দূর থেকে ওকে দেখলেই আমার বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ শব্দ আমি নিজেই শুনতে পাই। কেন, এরকম হয়, প্রেম ভালোবাসার অনেক গল্পের বই আমি পড়েছি, তবু নিজের জীবনে সেটা কিছুতেই পরিষ্কারভাবে বোঝা যায় না। কেন কোনো শাড়ি বা ফ্ৰকপরা মেয়েদের দেখলেই একটা দুরন্ত কৌতূহল জাগে, ঐ সব পোশাকের মধ্যে ওদের শরীরটা দেখতে কেমন? ছবিতেই তো দেখেছি অনেক, তবু কেন প্রত্যেকের সম্পর্কে আলাদা এই উগ্র কৌতূহল। এমনকি কোনো মহিলার পায়ের গোড়ালি থেকে সামান্য একটু শাড়িটা উঁচু হয়ে গেলে সেদিকে লোভীর মতন চোখ চলে যায়। কেন? অথচ, আবার দৈবাৎ বেশী দেখে ফেললেও দারুণ লজ্জা হয়।
সেই জন্যই মা কালীর দিকে ভালো করে তাকাতে পারি না। মা কালীর শরীরে কোনো পোশাক নেই, তিনি অত্যন্ত বেশী রকমের নারী, তাঁর দিকে তাকালে আমার একই সঙ্গে লজ্জা, শিহরণ, ভয় এবং পাপবোধ জাগে।
আমার পাশে একটা ছায়া পড়লো।
সেদিকে তাকিয়ে আমি সত্যিকারের ভয় পেয়ে গেলাম। অভিজিতের দিদি, সেই রাণুদি কখন নিঃশব্দে এসে আমার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছেন।
আমি প্রথমেই হাত জোড় করে ফেললাম। যেন, আমি কালীঠাকুরকে প্রণাম করবার জন্যই এখানে দাঁড়িয়েছি। এবং রাণুদিকে বলতে চাইছি, আমায় ক্ষমা করুন, আমায় ছেড়ে দিন, এক্ষুনি চলে যাচ্ছি।
আমার গলা শুকিয়ে গেছে, কোনো কথা বলতে পারছি না। আমার এক ছুটে এখান থেকে পালিয়ে যাওয়া উচিত, অথচ পা দুটো যেন গেঁথে গেছে মাটির সঙ্গে। পাগলদের সঙ্গে কী রকম ব্যবহার করতে হয়, তা আমি কিছু জানি না।
বেশ কিছুক্ষণ রাণুদি সেই রকমভাবে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। তারপর বললেন, তোমার নাম কী?
আমি অতিকষ্টে খানিকটা সামলে নিয়ে আমার নামটা বললাম।
উনি বললেন, তোমরাই আজ খোকনকে বাঁচিয়েছো?
এক্ষেত্রে আশুর মতন বিনয় করবার কোনো মানেই হয় না বলে আমি তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলাম হ্যাঁ।
–বাঃ তোমরা কলকাতায় কোথায় থাকো? কোন কলেজে পড়ো? তোমরা বুঝি বন্ধুরা মিলে প্রায়ই কোথাও বেড়াতে যাও?
আশ্চর্য ব্যাপার, রাণুদির গলার আওয়াজে কিংবা কথায় কোনো রকম পাগলামির ভাব নেই। আমার মাসীরাও এই রকম কথা বলে। রাণুদির কণ্ঠস্বরও খুব মিষ্টি। আর আমার সব মাসীদের চেয়ে অন্য যত মহিলা আগে দেখেছি, তাদের চেয়ে রাণুদি বেশী সুন্দর।
রাণুদি বললেন, কী সুন্দর আজকের দিনটা! মেঘলা মেঘলা, ছায়া ছায়া। এইসব দিনে ইচ্ছে করে না অনেক দূরে বেড়াতে যেতে?
আমি বললুম, হ্যাঁ।
–প্রত্যেকটা দিন প্রত্যেকটা দিনের চেয়ে আলাদা, তাই না।
–হ্যাঁ।
—আমার ইচ্ছে করে একলা একলা কোনো পাহাড়ে উঠতে। একদম ওপরে, আর কেউ থাকবে না, শুধু আকাশ আর আমি…..হবে না! কোনো দিন হবে না! কোনো দিন হবে না! তুমি পাহাড়ে উঠেছে, নীলু?
–হ্যাঁ।
–তোমার বুঝি খুব ভক্তি, তুমি ঠাকুরের সামনে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে আছো?
–হ্যাঁ।
এমনকি রাণুদি যদি জিজ্ঞেস করতেন, তুমি বুঝি নাকের শিকনি চেটে চেটে খাও? তাহলেও আমি হা বলতুম। রাণুদির কোনো কথার প্রতিবাদ করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।
রাণুদি একটু কাছে এগিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, একি, তোমার প্যান্টে রক্তের দাগ?
সেই পানের পিকের ছোপ। ভালো করে ওঠে নি। আমি লজ্জায় সেখানটায় হাত চাপা দিলাম।
বাড়ির ভেতর থেকে রাণুদির মা বেরিয়ে এসে রাণুদিকে লক্ষ্য করছিলেন, এবার তিনি ডেকে বললেন, ও রাণু, তুই একটু ঘুমিয়ে নিবি না?
রাণুদি বললেন, হ্যাঁ, মা, যাচ্ছি।
তারপর যেন আমার কাছ থেকে অনুমতি নেবার ভঙ্গিতে রাণুদি বললেন, আমার মা ডাকছেন, আমি যাই।
আমি মাথা হেলালুম।
ঠিক যেন একশো পাঁচ ডিগ্রী জ্বর হঠাৎ ছেড়ে গেল, রাণুদি চলে যাবার পর সেইরকম মনে হলো আমার। অথচ, রাণুদি তো কোনো রকম খারাপ ব্যবহার করেন নি। পাগলামির কোনো চিহ্নই নেই। আমি শুধু রাস্তায় পাগলদের দেখেছি; যারা লাঠি নিয়ে তাড়া করে আসে, কিংবা খুব খারাপ ভাষায় গালাগালি দেয়। রাণুদির এত সুন্দর, এত নরম ব্যবহার, তবু কেন ওঁকে পাগল বলা হচ্ছে।
চাতাল থেকে নেমে আমি কুয়োটার পাশে এসে দাঁড়ালাম। আমাদের বাড়িটার চেয়েও এই কুয়োটা অনেকটা বড়, ওপারে একটা চৌকো কাঠের ঢাকনা, সেটাও আবার তালা দিয়ে আটকানো। শুধু একটা বালতি গলার মতন ফাঁক আছে।
রাণুদি এই কুয়োর মধ্যে নামতে চেয়েছিলেন। সেটাই কি ওঁর পাগলামি? সব কুয়োর মধ্যেই ছোট্ট ছোট্ট লোহার সিঁড়ি থাকে। আমাদের বাড়ির কুয়োটা প্রথম থেকেই আমার মনে হয়েছিল, ঐ সিঁড়িগুলো দিয়ে তলা পর্যন্ত নামলে মন্দ হয় না! শুধু ইচ্ছে হওয়াটাই পাগলামির চিহ্ন? আমার তো কত রকম অদ্ভুত ইচ্ছে হয়! তাহলে, আমিও কি পাগল?
.
০৪.
পরদিন সকালবেলা আর কোনো কথা নয়, আমরা বেরিয়ে পড়লাম পাহাড়ের উদ্দেশ্যে। সঞ্জয় আমাদের সঙ্গে যাবার জন্য আবদার ধরেছিল, কিন্তু অনেক ভেবে চিন্তেই তাকে আমরা বাদ দিলাম। অভিজিৎ এখনো দুর্বল, তাকে নেওয়া যাবে না, সঞ্জয় গেলে সে দঃখ পাবে। তা ছাড়া আমরা কখন ফিরবো না ফিরবো কিছু তো ঠিক নেই।
সঞ্জয়ের বড়মামা অবশ্য আমাদের নিরন্ত করার অনেক চেষ্টা করেছিলেন। উনি বললেন, ওগুলো তো পাহাড় নয়, মাঠের মধ্যে ছোট ছোট টিলা। শুধু শুধু মাঠ ভেঙে অতখানি যাবে কেন? পাহাড় দেখতে চাও, ট্রেনে করে দেওঘর চলে যাও, তারপর টাঙ্গা ভাড়া নিয়ে ক্রিকূট দেখে এসো। কিন্তু টাঙ্গা চড়ে পাহাড় দেখতে যাওয়ার চেয়ে আমার পায়ে হেঁটে একটা পাহাড়কে আবিষ্কার করতে চাই!
বেশ ভোর ভোর আমরা বেরিয়ে পড়লুম, সঙ্গে রইলো কিছু রুটি আর ডিমসেদ্ধ। আশুর ওয়াটার বটল আছে। শুধু বৃষ্টি এলে আমাদের ভিজতে হবে, বেশ তো, ভিজবো!
পাহাড়ের রাস্তা চেনার তো কোনো অসুবিধে নেই। সোজা সামনে তাকিয়ে হাঁটলেই হয়। কিন্তু আমরা যতই সামনের দিকে স্থির লক্ষ্য রেখে যাই, পাহাড়গুলো যেন ডানদিকে সরে যায়।
পাথুরে মাঠ, পাছপালা কম, আমরা পথে দুটো নদী আর দু’তিনটে সাঁওতালদের গ্রাম পেরিয়ে গেলাম। গ্রামের লোকরা আমাদের দিকে এমনভাবে তাকাচ্ছে, যেন আমরা ছাড়া আর কোনো প্যান্ট-শার্ট পরা মানুষ এদিকে আগে আসেনি।
আমরা লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে, কখনো গাছের ডাল ভেঙে, কখনো পাথরের টুকরো নিয়ে লোকালুপি করতে করতে এগুতে লাগলাম আর মাঝে মাঝেই মনে হচ্ছে, রুটি আর ডিমসেদ্ধগুলো এবার খেয়ে ফেললেই হয়! কিন্তু উৎপল ওর ঘড়ি দেখে সময়ের হিসেব রাখছে। আগেই ঠিক করা হয়েছে, নটার আগে কিছুতেই খাওয়া হবে না। কেন না, তা হলে একটু বাদেই আবার খিদে পেয়ে যাবে।
কালকের দুপুরের সেই কালো মেঘ এখনো থমকে আছে। রাত্তিরে খুব জোর বৃষ্টি হয়ে গেলে আমাদের উপকারে লাগতো তার বদলে, যে কোনো সময় বৃষ্টি হবার সম্ভাবনটা আঁকা রয়েছে আকাশে! ঐ মেঘের জন্যই প্রমোট, খুব গরম লাগছে হাঁটবার সময়। জামাগুলো ঘামে ভিজে যাওয়ার ফলে আমরা সবাই জামা খুলে হাতা দুটো কোমরে জড়িয়ে গিঁট বেঁধে নিলাম। ভাস্কর আড়চোখে দেখে নিল আমার গেঞ্জিটা। ও ভুলে গেছে যে এটা ওরই গেঞ্জি। আশু গেঞ্জি পরে বাধার সম্মুখীন হলাম। একটা বেশ বড় নদী। এ নদী হেঁটে পার হওয়া যাবে না। ঘোলা রঙের জল।
ভাস্কর নেমে গিয়ে নদীর জল ছুঁয়ে দেখে বললো, স্রোত খুব একটা বেশী নেই। সাঁতরে পার হওয়া যাবে।
আশু বললো, জামা প্যান্ট সব ভিজিয়ে?
ভাস্কর বললো, তাতে কী হয়েছে? একটু বাদেই শুকিয়ে যাবে আপনা আপনি। এত দূর এসে তো আর ফেরা যায় না!
উৎপল বললো, তোরা সবাই জামা প্যান্ট খুলে একটা পুঁটলি বেঁধে ফ্যাল, আমি সেই পুঁটলিটা এক হাতে উঁচু করে নিয়ে আর এক হাতে সঁতরে চলে যাবো। এ আর কতখানি!
উৎপল সেটা পারলেও পারতে পারে ভেবে আশু আর ভাস্কর কোনো আপত্তি করলো না। তাছাড়া, উৎপল যদি কোনোক্রমে পুঁটলিটা ভিজিয়ে ফ্যালে, তাহলে সেই উপলক্ষে অনেকক্ষণ ওর পেছনে লাগা যাবে। ভাস্কর প্যান্টের বোতাম খুলতে শুরু করলো।
আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলাম। এখানে কোনো কথা বলার অধিকার নেই।
আশু আমার দিকে চেয়ে বললো, কিন্তু নীলু? ও কী করে পার হবে?
ভাস্কর বললো, তাই তো, নীলুটা যে আবার সাঁতার জানে না? এই জন্য তোদের বাইরে কোথাও নিয়ে যাই না। সাঁতারটা শিখে রাখতে পারিস নি? তোকে কতবার বলেছি, হেদোয় ভর্তি হ!
আমি অভিমানের সঙ্গে বললাম, তোরা যা। আমি এখানেই বসে থাকবো।
উৎপল একটু চিন্তা করে বললো, দুজনের মিলে নীলুকে ধরে ধরে নিয়ে যাওয়া যায়।?
আশু বললো, সেটা রিস্কি। যে একদম সাঁতার জানে না…… হঠাৎ ভয় পেয়ে জড়িয়ে ধরলে।
সেরকমভাবে আমি যেতেও চাই না! আমি দৃঢ়ভাবে বললাম, বলছি তো, তোরা যা, আমার জন্য চিন্তা করতে হবে না।
আশু সঙ্গে সঙ্গে বললো, ঠিক আছে, আমি নীলুর সঙ্গে এখানে থাকছি। তোরা দুজন ঘুরে আয়। পাহাড় তো এখান থেকেই দেখা যাচ্ছে।
এরকম সময় কারুর সমবেদনাতেও সান্তনা পাওয়া যায় না। আমি আশুকে এক ধমক দিয়ে বললাম, তোকেও থাকতে হবে না, আমি একাই থাকতে পারবো।
ভাস্কর বললো, হু! তাহলে ব্যাপারটা ভালো করে চিন্তা করা যাক। কিন্তু তার আগে রুটি আর ডিম-ফিমগুলো খেয়ে ফেললে হয় না?, উৎপল ঘড়ি দেখে বললো, ন’টা বাজতে এখনো চল্লিশ মিনিট বাকি। তোরা নিজেরাই ঠিক করেছিলি…
আশু বললো, তা বলে তো আর ওগুলো জলে ভেজাবার কোনো মানে হয় না। যদি আমরা সতরেই যাই।
একটা বড় শাল গাছের তলায় বসা হলো। জায়গাটা বেশ পরিষ্কার। পিকনিক করতে হলে এরকম জায়গাতেই আসা উচিত! আমার অভিমান এমনই তীব্র হলো যে খিদেটাও
যেন চলে গেল। আমি বললাম, আমি খাবো না, তোরা খেয়ে নে।
উৎপল বললো, খা, খা, আর ন্যাকামি করতে হবে না। তুই কাল সকাল থেকে আমার কাছে সাঁতার শিখবি।
আটখানা ডিম ও বারোখানা রুটি প্রায় চোখের নিমেষেই শেষ হয়ে গেল। আর ওয়াটার-বটল থেকে সবাই এক ঢোক করে জল খেয়ে নেবার পর ভাস্কর বললো, এবার যাবে!
আমার চোখ তখন নদীর ওপারে।
সাঁতার না জানারও যে একটা উপকারিতা আছে, সেটা সেদিন টের পেলাম। সাঁতার জানতুম না বলেই সেদিন একটা চমৎকার অভিজ্ঞতা হলো।
ওপারে দেখা গেল আট দশটা মোষ আর কয়েকটা সাঁওতাল ছেলে। তারা নদীর পারে এসে এক মুহূর্তও দেরি করলো না। মোষসমেত হুড়মুড়িয়ে জলে নেমে পড়লো। মোষগুলো জন্ম থেকেই সাঁতার জানে। সেই মোষের পিঠে চেপে সাঁওতাল ছেলেগুলোও দিব্যি চলে এলো এপারে।
আমি উঠে গিয়ে একটি সাঁওতাল ছেলেকে জিজ্ঞেস করলাম, এই ভাইয়া, ইধার নদী পার হোনে কা কই ব্রীজ হ্যাঁ? সেতু?
সে কী বুঝলো কে জানে। সে বললো, নেহি হ্যাঁয়।
আমি আবার বলবার তোমার একঠো মোষের মানে ভাইস কা পিঠি মে হামকো পার কর দেগা।
সে কোনো উত্তর দিল না।
আমি আবার বললাম,আট আনা পয়সা দেখা।
সে কোনো উত্তর দিল না।
আমি আবার বললাম, আট আনা পয়সা দেখা।
ছেলেগুলো খুব হাসতে লাগলো। আমি সে হাসি গ্রাহ্য না করে একটা বেশ জোয়ান চেহারার লোকের পাশে দাঁড়িয়ে বললাম, গুঁতায় গা নেহি তো?
কাছের ছেলেটি বললো, নেহি। আপ উঠিয়ে গা।
সেই আমাকে সাহায্য করে মোষটার পিঠে চাপিয়ে দিল।
মোষটা দিব্যি শান্ত, কোনো আপত্তিই করলো না।
আমি সগর্বে বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে বললাম, দেখলি? আমি নিজেই নিজের ব্যবস্থা করতে পারি কিনা?
ওরা তিনজনই চুপ।
আমি আবার বললাম, ইচ্ছে করলে তোরাও মোষের পিঠে আসতে পারিস।
উৎপল বললো, ফালতু আট আনা পয়সা খরচা করতে যাবো কেন।
ওদের প্যান্ট শার্টের পুঁটলিটা আমার হাতে দিয়ে ওরাও নেমে পড়লো জলে। আমি নিজের প্যান্ট না খুলেই মোষের পিঠে চড়ে বসেছি। আর নামার কোনো মানে হয় না।
বেশী কায়দা দেখাবার জন্য, মোষটা জলে নামতেই আমি আস্তে আস্তে বসা অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়ালাম। শুধু আমার প্যান্টটাই বা ভেজানো কেন?খুব ব্যালেন্স করে থাকতে হবে।
সাঁতার কেটে আবার মোটা খুব কাছে চলে এসে ভাস্কর একবার মুখটা তুলে দারুণ ধমক দিয়ে বললো, এই, বোস। বেশী ইয়ার্কি না? একবার পড়ে গেলে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।
নির্বিঘ্নে এপারে এসে পৌঁছালাম। মোষের সঙ্গী সাঁওতাল ছেলেটি মোষের ল্যাজ ধরেই চলে এসেছে। আমি তাকে একটা আধুলি দিতেই সে সেটা একটা কানের মধ্যে ফিট করে ফেললো আবার মোষটাকে নিয়ে নেমে পড়লো জলে। পয়সা সম্পর্কে যেন ওর কেনো লোভ নেই।
কিছুক্ষণ আগেকার অভিমানটা কেটে গিয়ে আমি বেশ একটা জয়ের আবেগে উৎফুল্ল। বন্ধুদের কাছ থেকে আমি কখনো দয়া নিতে চাই না।
ভাস্কর এপারে উঠে বললো, আগে জানলে তোয়ালে নিয়ে আসতাম। মাথাটা ভিজে থাকবে।
আমি বললাম, মনে কর না বৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টি পড়লে তো ভিজতেই হতো।
উৎপল বললো, নীলুকে দেখছি পাহাড়েই রেখে আসতে হবে। কেন না, ফেরার সময় তো আর ওর জন্য মোষ রেডি থাকবে না?
আমি বললাম, আমি গ্ল্যাডলি পাহাড়ে থেকে যেতে রাজি আছি।
সেখান থেকে পাহাড় আর বেশী দূর নয়ামরা পৌনে এক ঘন্টার মধ্যেই পৌঁছে গেলাম।
দূর থেকে একটা পাহাড় মনে হলেও আসলে রয়েছে পর পর ককেটা। মাঠের মধ্যে দুম করে এই পাহারগুলো উঠেছে। খুব বেশী বড় নয়, বেশ ছোটখাটো, ছিমছাম, এখানেও গাছপালা বেশী নেই।
আমি বিস্মিতভাবে বললাম, দেখেছিস একটা জিনিস? ঠিক পাশাপাশি চারটে পাহাড় রয়েছে।
আগু বললো, ঠিক।
আমি বললাম, তাহলে আমরা প্রত্যেকেই একটা করে পাহাড় নিয়ে নিতে পারি। কোনো ঝগড়া হবে না। কে কোনটা নিবি বল?
ভাস্কর উদারভাবে বললো, তুই আগে বেছে নে।
একেবারে ডানদিকের পাহাড়টা আমার প্রথম দেখেই পছন্দ হয়েছিল। বেশ গোল ধরনের, মাথার ওপরে একটা একলা গাছ।
আমি বললাম, আমি ভাই ঐ পাহাড়টা নিচ্ছি। আমার পাহাড়ে আমি একলাই যাচ্ছি, তোরা কেউ আসিস না।
দৌড়ে চলে গেলাম সেদিকে। আমি একটা পাহাড় জয় করতে যাচ্ছি। আমার নিজস্ব পাহাড়। শরীরে দারুণ উত্তেজনা।
ভেবেছিলাম এক দৌড়েই উঠে যেতে পারবো। কিন্তু যত ছোট মনে হয়, তত ছোট নয় পাহাড়টা, আস্তে আস্তেই ওঠা উচিত ছিল। দৌড়াবার জন্য হাঁপিয়ে গেলাম, একেবারে চুড়ায় উঠে নাম-নাজানা গাছটাকে ধরে দম নিতে লাগলাম। গরমের চোখে শরীরের প্রতিটি রন্ধ্র যেন জ্বালা করছে।
খানিকক্ষণ দাঁড়াবার পর বাতাসে শরীর জুড়োলো। নিচের গাছপালাগুলো খুব ছোট ছোট দেখাচ্ছে, দূরে সেই নদী। একটা সাদা ফিতের মতন। আমার জীবনের প্রথম পাহাড় চূড়া। আমি সত্যি সত্যি উঠেছি। স্বপ্ন নয়। আমি ভাস্কারদের মতন দার্জিলিং এ যাই নি, দার্জিলিং-এর মতন উঁচু না হোক, তবু এই পাহাড়ই আমার প্রিয়।
হঠাৎ মনে পড়লো রাণুদির কথা। উনি একলা একটা পাহাড়ে উঠতে চান। বলেছিলেন, কখনো হবে না। কেন হবে না? রাণুদিকে এখানে নিয়ে আসা যায় না? আমি সঞ্জয়ের বড়মামাকে আজই বলবো। রাণুদি চান পাহাড়ের ওপর একলা দাঁড়াতে, যেখানে আকাশ ছাড়া আর কিছুই থাকবে না। এই রকম একটা পাহাড়ের ওপর দাঁড়ালে, রাণুদির মনের অসুখ সেরে যেতে পারে।
রাণুদির জন্য আমার দারুণ ব্যাকুলতা বোধ হলো। তক্ষনি খুব ইচ্ছে হলো রাণুদিকে দেখতে। দীপান্বিতাকে দেখার ইচ্ছে যেমন হয়, কিংবা তার চেয়েও বেশীক্ষণ আমার এরকম হচ্ছে। রাণুদি আমার চেয়ে বয়েসে কত বড়। রাণু মাসীকে দেখার জন্য তো এমন তীব্র ইচ্ছে হয় না। রাণুদিকে না দেখলে আমিই বুঝি পাগল হয়ে যাবো!
আ-আ-ও-ও-ও, টার্জানের মতন এই রকম আওয়াজ শুনে আমি পেছনে ফিরে তাকালাম।
আমার ঠিক পাশের পাহাড়টার চূড়ায় উঠে ভাস্কর ঐ রকম ডাক ছাড়ছে আর নিজের জামাটা পতাকার মর্তন ওড়াচ্ছে। অন্য দুটো পাহাড়ের ওপরেও আও আর উৎপল উঠে এসেছে। আমরা গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে লাগলাম পরস্পরকে জানান দেবার জন্য।
আমরা চারজন যেন এই পৃথিবীর রাজা। আমাদের মাথায় আকাশের মুকুট, আর পায়ের তলা পড়ে আছে পৃথিবী।
অন্য চিৎকার বন্ধ করে ভাস্কর বলতে লাগলো, ধোঁয়া! ধোঁয়া!
আমি বুঝতে পারলাম না। জিজ্ঞেস করতে লাগলাম, কী, কী?
ভাস্কর একদিকে হাত দেখিয়ে ইঙ্গিত করছিল। সেদিকে তাকিয়ে দেখলাম, দুটো পাহাড়ের মাঝখানের জায়গাটায় খানিকটা ঝোঁপ মতন, সেখান থেকে সত্যিই ধোয়া বেরুচ্ছে।
সুতরাং আর একটা আবিষ্কারের জিনিস পাওয়া গেল। আমি আর ভাস্কর হু-হু করে নামতে লাগলাম নিচের দিকে। আশু আর উৎপলকে ইঙ্গিত করলাম ঐ দিকে আসতে।
নিচে নামবার সময় কোনো পরিশ্রম হয় না। কিন্তু বেশী তাড়াতাড়ি করতে গিয়েই আমি আছাড় খেলাম বেশ জোরে। আর একটু হলে গড়িয়ে অনেক নিচে পড়তাম, তাহলে আর আমার একটা হাড়ও আস্ত থাকতো না। সামলে নিলাম কোনোক্রমে। বা পায়ের হাঁটুর কাছটায় চোট লেগে, প্যান্টটা ছিঁড়ে পা কেটে রক্ত বেরিয়ে গেল। পা কাটে কাটুক, কিন্তু প্যান্টটা ছিঁড়ে গেল বলে যেন আমার বুক ফেটে যাবার উপক্রম হলো। নাঃ, ফুল প্যান্ট পরা আমার ভাগ্যে নেই।
ইস, আমি কী বোকাঁপাহাড়ে চড়বার জন্য তো হাফ প্যান্টই ভালো, আমি কেন হাফ প্যান্টটা আজ পরে আসিনি। জানবোই বা কী করে, আগে তো কখনো পাহাড়ে চড়িনি।
ভাস্কর আমার থেকে অনেক আগেই পৌঁছে গেছে। একটুক্ষণের মধ্যেই আশু আর উৎপলও এসে গেল।
নিচের সমতল জায়গাটায় ঝোঁপের মধ্যে একটা ছোট বাঁশের ঘর। দেখেই মনে হয়, নতুন তৈরি করা হয়েছে। ধোঁয়া বেরুচ্ছে ঘরটা সামনে থেকেই।
পাথর-টাথর সাজিয়ে সেখানে একটা চুল্লি বানানো হয়েছে, তার ওপরে একটা মাটির হাঁড়ি বসানো। গন্ধতেই বোঝা যায়, ভাত ফুটছে। গেরুয়া পোশাক পরা মুখ ভর্তি দাড়ি গোঁফওয়ালা একজন লোক সেখানে বসে। আর ঘরের দরজার পাশে প্যান্ট শার্ট পরে একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে পকেটে হাত দিয়ে। দুজনেই খানিকটা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে।
প্যান্ট-শার্ট পরা লোকটিকে আমি চিনতে পারলাম। সেদিন সাইকেল নিয়ে বেড়াতে গিয়ে একে আমি দেখেছিলাম একটা বাড়িতে। একটা লাঠি নিয়ে কুকুর তাড়াচ্ছিল।
আমরা চারজন চারদিক থেকে নেমে এসে পাশাপাশি দাঁড়ালাম। গেরুয়া পরা লোকটি বললো, লেড়কা লোগ ঘুমনে আয়া।
প্যান্ট-শার্ট পরা লোকটি হেসে আমাদের জিজ্ঞেস করলো, তোমরা এখানে অ্যাডভেঞ্চার করতে এসেছে বুঝি? তোমরা তো মুঘুরে শিব-নিবাস বাড়িটায় উঠেছে, তাই না?
ভাস্কর দলনেতা হিসেবে উত্তর দিল, হ্যাঁ।
লোকটি বললো, আমিও তোমাদের কাছাকাছিই আছি। এই সাধুজী, আত্মারামজী এখানে থাকেন, আমি মাঝে মাঝে এখানে ওঁর সঙ্গে দেখা করতে আসি।
সাধুজী বললেন, বৈঠো, তুমলোগ বৈঠো। পানি গিওগে? ইধার এক ঝর্ণা হ্যাঁয়, পানি বহুৎ আচ্ছা, একদম মিঠা–
আশু গিয়ে ঝপ করে সাধুবাবার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে ফেললো। অগত্যা আর উপায় কী, আমরাও প্রণাম করলাম। উনি বিড়বিড় করে কী যেন আশীবাদ করলেন আমাদের মাথা ছুঁয়ে।
হাঁড়িতে ভাত ফুটে ঢাকনাটা লাফাচ্ছে। সেই গন্ধে বেশ চনমনে খিদে পেয়ে গেল। আমরা কখন ফিরবো কৈানো ঠিক নেই, সারাদিন আর খাওয়া জুটবে না। কেন যে আরও বেশী করে খাবার আনিনি।
পেতলের চকচকে ঘটিতে সাধুজী জল এনে দিলেন, সেই জলই খেয়ে নিলাম পেট ভারে। প্যান্ট-শার্ট পরা লোকটি জিজ্ঞেস করলো, আমরা কোন দিকে দিয়ে এসেছি। ভাস্কর সবিস্তারে কাহিনীটি বললো। আমি মোষের পিঠে চড়ে নদী পার হয়েছি শুনে সে হো-হো করে হেসে উঠলো, সাধুজীর ঠোঁটেও মুচকি হাসি দেখা দিল।
প্যান্ট-শার্ট পরা লোকটি জানালো যে আমরা অনেক ঘুর পথে এসেছি। আমাদের লেগেছে সাড়ে তিন ঘণ্টা, কিন্তু মধুপুর থেকে মাত্র দু’ঘণ্টাতেই এখানে পৌঁছোনো যায়, গ্রামগুলোর মধ্য দিয়ে সংক্ষিপ্ত পথ আছে আর ঐ নদীটার ওপরে সাঁকোও আছে এক জায়গায়।
আমরা পাহাড়কে চোখের সামনে রেখে সোজা এগিয়ে এসেছি, তবু সেটাও ঘুর পথ হলো? আশ্চর্য ব্যাপার!
উৎপল বললো, আমরা এবার যাই। আপনি আমাদের সেই শর্টকাটের রাস্তাটা একটু দেখিয়ে দেবেন?
প্যান্ট-শার্ট পরা লোকটির নাম অজিত রায়। আমরা তাঁকে অজিতদা বলে ডাকতে লাগলুম। তিনি সাধুজীকে বললেন, বাবা আপ ভোজন কর লিজিয়ে। মায় আভি আ রাহা
তারপর তিনি এলেন আমাদের একটু এগিয়ে দিতে। আমি বললাম, কিন্তু ঝর্ণাটা আমরা একবার দেখবো না? ঝর্না না দেখেই ফিরে যাবো?
অজিতদা বললেন, এ ঝর্ণাটা দেখবার মতন কিছু না। তোমরা গিরিডি গেছো? সেখানে সুন্দর একটা জলপ্রপাত আছে। উশ্রী ফল্স। খুব বিখ্যাত। দেখোনি? তাহলে কালই চলে যাও!
আমি বললাম, তর এই ঝর্ণাটা আমি একবার দেখবোই!
অজিতদা এক জায়গায় থমকে দাঁড়িয়ে ডান হাত তুলে বললেন, ফেরার সময় তোমরা এদিক দিয়ে গেলেই রাস্তা পেয়ে যাবে। আর ঝর্ণাটা এই দু’নম্বর পাহাড়টার পেছনে। আমি ভাই সাধুবাবার কাছে যাচ্ছি। ওনাকে কদিন ধরে খুব জপাচ্ছি। এই সাধু একটা দারুণ জিনিস জানেন। অ্যালকেমি কাকে বলে জানো? সোনা তৈরি করা ফমূলা। কিছু কিছু সাধু এখনো সেই বিদ্যে জানে না। সেই জন্যই তো আমি প্রায়ই এসে এনার পায়ের কাছে পড়ে থাকি।
ভাস্কর জিজ্ঞেস করলো, সত্যিই সোনা তৈরি করতে জানেন? আপনি প্রমাণ পেয়েছেন?
অজিতদা বললেন, ই, একদিন আমার চোখের সামনে এক টুকরো তৈরি করে দেখিয়েছেন। কিন্তু কিছুতেই কায়দাটা শেখাচ্ছেন না আমাকে। বলছেন, ওতে নাকি মানুষের লোভ বেড়ে যায়। আচ্ছা, চলি ভাই!
আমরা ঝর্ণার দিকে খানিকটা এগোবার পর উৎপল বললো, আমাদের ছেলেমানুষ ভেবে খুব গুল ঝেড়ে গেল লোকটা। সোনা আবার কেউ তৈরি করতে পারে নাকি?
আশু বললো, পারতেও তো পারে। গাটি সাধু সন্ন্যাসীদের তো অনেক অলৌকিক ক্ষমতা থাকে।
উৎপল বললো, ওসব সাধুদের স্রেফ ম্যাজিক।
ভাস্কর বললো, আমরাও এই সাধুর কাছে একটু ম্যাজিক দেখতে পারতাম!
ঝর্ণা খুঁজে পেতে অনেক সময় লাগলো। একটা খুব সরু জলের ধারা, তবে জলটা বেরুচ্ছে মাটি খুঁড়ে। মাটির নিচে জল আছে, আমরা সবাই সে কথা জানি, টিউবওয়েল পুঁতলেই তো জল বেরোয় তবু, মাটি ভেদ করে জল উঠতে দেখলে অবাক লাগে। আপন মনে, অবিরাম জল বেরিয়েই আসছে। কোনোদিন কি এ জল ফুরোয় না?
সবারই খিদে পেয়ে গ্যাছে, কেউ আর বেশীক্ষণ থাকতে চায় না। ভাস্কর বললো, শুধু শুধু এই একটা ছোট্ট ঝর্ণা দেখার জন্য আরও অনেক দেরি হয়ে গেল। এই নীলটার জন্যই তো! ঝর্ণা দেখবো, ঝর্ণা দেখবো! কী দেখলি? এটা না দেখলে কী ক্ষতি হতো?
একটা ঝর্ণা না দেখলে কী ক্ষতি হয়? কিছুই না। শুধু, একটা ঝর্ণা না দেখলে সেই ঝর্ণাটা না-দেখা থেকে যায়।
ভাস্কর ‘ইয়ারো ভিজিটেড’ কবিতাটা আবৃত্তি করতে লাগলো। কবিতাটা আমাদের কলেজের পাঠ্য। ইয়ারো নামে একটা ঝর্ণা ছিল, কবি বলেছেন, সেটা দেখার চেয়ে না দেখাই ভালো ছিল।
কিন্তু এ পৃথিবীর সব ঝর্ণা আমার দেখতে ইচ্ছে করে।