৫-৬. দেওঘর বেড়াতে গিয়ে

দেওঘর বেড়াতে গিয়ে ফিরতে ফিরতে আমাদের অনেক রাত হয়ে গেল। মধুপুর স্টেশনে এসেই নামলা রাত ন’টায়। মাত্র একটাই টাঙ্গা, যেন ঠিক আমাদের জন্যই অপেক্ষা করছিল। আমরা ভেতরে বসলাম,উৎপল টাঙ্গাওয়ালার পাশে বসে গান গাইতে লাগলো। তারপর আমরাও যোগ দিলাম সেই গানে।

আমাদের বাড়ির কাছাকাছি এসে রাস্তার ওপরে বেশ কিছু লোকের গলার আওয়াজ পেলাম। তারপর গেলাম সঞ্জয়ের বড় মামাকে। তিনি জামা গায়ে দিয়েছেন। আমাদের দেখে তিনি বললেন, টাঙ্গাটা পাওয়া গেছে, ভালো হয়েছে। এটা নিয়েই তা হলে আমি থানায় যাই।

উৎপল জিজ্ঞেস করলো, থানায় কেন?

বড়মামা বললেন, সন্ধে থেকে রাণুকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

আমরা টাঙ্গা থেকে লাফিয়ে নেমে পড়লাম।

এই তিন চারদিনে রাণুদির সঙ্গে আমাদের বেশ ভাব হয়ে গেছে। তাঁর ব্যবহারে আমরা পাগলামির সামান্যতম চিহ্নও খুঁজে পাই নি। মাঝে মাঝে তিনি শুধু চুপ করে বসে থাকেন। তখন কারুর সঙ্গে কথা বলেন না। অন্য সময় একদম স্বাভাবিক।

এদিক সেদিকে যে-কয়েকটা বাড়ি ছড়িয়ে আছে, সেই সব বাড়ির মালি ও চৌকিদাররা বেরিয়ে এসেছে। সব জায়গায় খুঁজে দেখা হয়েছে এর মধ্যে, রাণুদি কোথাও নেই।

আমার প্রথমেই মনে পড়লো আমাদের বাড়ির পুকুরটার কথা। তা ছাড়া রাণুদি একদিন কয়োর মধ্যে নামতে চেয়েছিলেন।

বড়মামা বললেন, না, ও জলে ডুবে যাবে না। রাণু সাঁতার জানে। তা ছাড়া সব কটা বাড়ির কুয়োও দেখা হয়েছে।

টাঙ্গা নিয়ে বড়মামা চলে গেলেন থানায় যাবার সময় বিড় বিড় করে বলে গেলেন, থানায় গিয়ে কী লাভ হবে কে জানে! তবু দিদি বলছে বারবার।

আমরা প্রথমেই সঞ্জয়কে ধরে পুরো ব্যাপারটা জেনে নিলাম।

আমরা সকালবেলা দেওঘর যাবার সময়ও দেখেছিলাম রাণুদিকে। উনি খুব ভোরে উঠে পুজোর জন্য ফুল তোলেন, আমাদের দেখে হাসিমুখে হাত নেড়েছিলেন দূর থেকে।

সঞ্জয় বললো, দুপুর থেকেই দিদির মেজাজ খারাপ হয়েছিল। একটাও কথা বলছিল না কারুর সঙ্গে। মা কতবার ডাকলেন, কতবার বিকেলের চা খাবার জন্য সাধাসাধি করলেন, দিদি একবারও মুখ ফেরায়নি পর্যন্ত। দুপুর থেকে ঠিক এক জায়গায় বসে ছিল অন্তত চার পাঁচ ঘণ্টা–

এরকম আমরা দেখেছি। এক জায়গায় ঠায় চার পাঁচ ঘণ্টা একটু না নড়াচড়া করে বসে থাকতে যে কেউ পারে, তা রাণুদিকে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। অথচ অত সময় রাণুদি বেশ ছোটাছুটিও করতে পারেন। এই তো কাল সকালেই রাণুদি আমাদের সঙ্গে ব্যাডমিন্টন খেললেন।

সঞ্জয় বললো, ঐ রকমভাবে দিদি মাঝে মাঝেই বসে থাকে বলে মা আর ডাকেন নি। হঠাৎ সন্ধের পর দেখলাম, দিদি নেই! তারপর থেকেই তো সবাই মিলে খুঁজছি–

আমরা পাহাড় দেখে এসে খুব গল্প করেছিলাম। রাণুদি তাই শুনে বলেছিলেন, ইস, তোমরা আমায় নিয়ে গেলে না? আমার খুব ইচ্ছে করে যেতে। আমায় কেউ কোথাও বেড়াতে নিয়ে যায় না, আমি পাগল না! আমরা তক্ষুনি বলেছিলাম, আর একদিন আমরা রাণুদি আর সঞ্জয়দের সবাইকে নিয়ে ঐ পাহাড়ের ধারে পিকনিক করতে যাবো।

রাণুদি এই অন্ধকারে একা একাই সেই পাহাড়ের দিকে চলে যান নি তো? অথবা প্রথম দিন যে দেখেছিলাম, দুপুরবেলা রাণুদি মাঠের মধ্যে একটা গাছে হেলান দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছেন, সেই রকম এই অন্ধকারে মাঠের মধ্যে যদি কোথাও বসে থাকেন, তা হলে খুঁজে পাওয়া খুবই শক্ত।

কিন্তু রাণুদিকে পেতেই হবে। আমরা চারজন চারদিকে ছড়িয়ে পড়লাম।

আমার টর্চ নেই, শুধু চোখ দিয়েই যেন অন্ধকার কুঁড়তে লাগলাম। অবশ্য খুব বেশী অন্ধকার ছিল না, পাতলা পাতলা জ্যোৎস্না ছিল আকাশে। সেই আলোতে অসুবিধেও হয় অনেক, ছোট ছোট গাছ বা পাথরের স্তূপকেও মানুষ বলে মনে হয়। সত্যি কথা বলতে কি, আমার একটু ভয় ভয় করছিল। রাত্তিরবেলা একলা একলা মাঠের মধ্যে ঘোরা তো আমার অভ্যেস নেই। হঠাৎ এক একটা গাছ দেখে সন্দেহ হয়, এই গাছটা কি দিনের বেলা ছিল এখানে? অথবা অধিকাংশ গাছকে ঘোমটা পরা বউ বলে মনে হয় কেন? এক এক সময় সত্যিই তাই মনে হয়। আমি থমকে গিয়ে ফিসফিস করে ডাকি, রাণুদি! রানুদি!

কেউ কোনো উত্তর দেয় না।

পরীক্ষার সময় যেমন ভগবানকে ডাকতে হয়, ঠিক সেই রকমই ব্যাকুলভাবে আমি মনে মনে বলতে লাগলাম, হে ভগবান, রাণুদিকে যেন আমি খুঁজে পাই। অন্য কেউ না আমিই আগে রাণুদিকে দেখবো।

ছুটতে ছুটতে কত দূর গিয়েছিলাম জানি না। এক সময় মনে হলো, এবার আমিই বুঝি রাস্তা হারিয়ে ফেলবো।

আমার আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হলো না, অন্যরাই আগে রাণুদিকে খুঁজে পেল। এক সঙ্গে অনেকগুলো গলার আওয়াজ শুনলাম, পাওয়া গেছে। এই তো রাণুদি। তারপরেই কয়েকটা জোরালো চর্টের আলো। আমিও দৌড়ে গেলাম সেদিকে।

রাস্তাটা যেখানে ছোট নদীটায় মিশে শেষ হয়ে গেছে, তার পাশে যে বড় পাথরটায় আমি একদিন এসে বসেছিলাম, ঠিক সেখানেই বসে আছেন রাণুদি। তাঁকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে সঞ্জয়, ঝুমা, আশু, উৎপল আর সতীশ নামে বড়মামার এক কর্মচারী। এদের সকলের মাথা ছাড়িয়েও দেখা যায় অজিতদাকে। তিনিই এখানে রাণুদিকে প্রথম দেখতে পেয়ে সঞ্জয়দের খবর দিয়েছেন। কাছেই অজিতদাদের বাড়ি।

অজিতদা একা এত রাত্তিরে একটি মেয়েকে ওখানে বসে থাকতে দেখে অনেকবার ডাকাডাকি করেছিলেন, রাণুদি কোনো উত্তর দেননি।

সঞ্জয় বললো, এই দিদি, ওঠো! এখানে বসে আছো যে? মা চিন্তা করছেন।

রাণুদির যেন শ্রবণশক্তি নেই। দেহে প্রাণ আছে কি না তাতেই সন্দেহ জাগে, এমন স্তব্ধ নিশ্চল মূর্তি।

আমরা সবাই মিলে ডাকতে লাগলাম, সঞ্জয় ওঁর হাত ধরে টানতে লাগলো তবু কোনো হুঁশ নেই।

এই সময় অভিজিতের সঙ্গে রাণুদির মা-ও এসে পড়লেন। তিনি দৌড়ে গিয়ে রাণুদিকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ও রাণু, রাণু! এ কী করছিস মা? এমনভাবে আমাদের চিন্তায় ফেরতে আছে?

রাণুদি এবার মুখ ফিরিয়ে খুব শান্তভাবে বললো, মা চুপ করো। ঐ দ্যাখো, ভগবান!

রাণুদি আঙুল দিয়ে একটা বুনো গাছ দেখালেন।

অমনি তিনচারটি টর্চের আলো পড়লো সেই গাছটার ওপরে। কী আর দেখা যাবে, মাঠে কিংবা নদীর ধারে সাধারণ গাছ যেমন থাকে, সেই রকম একটা।

রাণুদির মা বললেন, তুই এখানে বসে আছিস কেন? চল, বাড়ি চল।

রাণুদি ঠিক সেই একই গলায় বললেন, ভগবান আমাকে ডেকে এনেছেন। তোমরা দেখতে পাচ্ছে না?

বড়মামার সাগরেদ শতীশবাবু বললেন, রাণুদিদি তো ঠিকই বলছে। সব কিছুর মধ্যেই ভগবান আছেন। যে-কোনো জীব, এমন কি গাছপালার মধ্যেও।

রাণুদি বললেন, ভঘবান আমার দিকে চেয়ে আছেন।

মা বললেন, ইস, মাথার চুল সব ভিজে! আজ তো বৃষ্টি হয়নি, তুই কোথাও চান করেছিস নাকি?

রাণুদি বললেন মা, তোমরা এত কথা বলছো কেন? ভগবান আমায় ডাকছেন, শুনতে পাচ্ছে না?

রাণুদির মা কেঁদে ফেললেন। সতীশবাবু বললেন, রাণুদিদি, ভগবান তো সব জায়গায় দেখতে পান। বাড়িতে গেলেও ভগবান তোমাকে দেখবেন, তোমার সঙ্গে কথা বলবেন।

রাণুদি বললেন, আমার একটা কী যেন জিনিস হারিয়ে গেছে, মনে করতে পারছি …আমার কী হারিয়েছে তোমরা বলতে পারো?

অভিজিৎ বললো, দিদি, তোমার কিছু হারায়নি তো!

রাণুদি বললেন, তোরা জানিস না, তোরা কেউ জানিস না, উঃ, মা, আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। আমি আর পারছি না।

অজিতদা সতীশবাবুকে বললেন, একে জোর করে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া উচিত। এর পক্ষে এখন বেশী কথা না বলাই বোধহয় ভালো।

রাণুদির মা, অভিজিৎ, সঞ্জয়, ঝুমারা দু’পাশ থেকে রাণুদিকে জোর করে ওঠাবার চেষ্টা করলো। আমরাও হাত লাগাবো কি না বুঝতে পারছিলাম না। আমরা একটাও কথা না বলে চুপ করে দাঁড়িয়েছিলাম।

রাণুদি কান্না কান্না গলায় বললেন, আমাকে ছেড়ে দাও। ছেড়ে দাও তোমরা। ভগবান রাগ করবেন।

এমন সময় একটা অদ্ভুত ব্যাপার হলো। রাণুদি যে গাছটা দেখিয়েছিলেন, সেটার মধ্যে সরসর করে একটা শব্দ হলো। অমনি গাছটার ওপর আবার টর্চের আলো পড়তেই দেখা গেল, সেখানে রয়েছে একটা গিরগিটি। এরকম গিরগিটি এখানে খুবই দেখা যায়, এত লোকজন দেখে বেচারা খুবই ঘাবড়ে গিয়ে ড্যাবডবে চোখে তাকিয়ে আছে।

রাণুদি সেদিকে তাকিয়ে উত্তেজিতভাবে বললেন ঐ যে, ঐ যে দ্যাখো, ঐ যে ভগবান!

অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমরা হো হো করে হেসে উঠলাম। এমন কি যে সতীশবাবু একটু আগে বললেন, সব কিছুর মধ্যেই ভগবান আছেন, তিনিও না হেসে পারলেন না।

উৎপল বললো, একটা খাটা-টাচা থাকলে এক্ষুনি ভগবনকে ধরে ফেলা যেত।

আমাদের হাসি শুনেই বোধহয় রেগে গেলেন রাণুদি। হঠাৎ সকলের হাত ছাড়িয়ে দৌড় মারলেন নদীটার ধার ঘেঁষে।

বেশীদূর যেতে পারলেন না অবশ্য, তার আগেই অজিতদা লম্বা লম্বা পায়ে ছুটে গিয়ে ধরে ফেললেন ওঁকে। আমরাও ছুটে গিয়েছিলাম, অবশ্য, কিন্তু অজিতদার আগে পৌঁছোতে পারিনি।

অজিতদার হাত ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করলেন রাণুদি। পারলেন না। অজিতদা ধীর গম্ভীর গলায় বললেন, বাড়ি চলুন।

রাণুদি জিজ্ঞেস করলেন, তুমি…তুমি কে? তুমি কি সত্যময়ের ভাই?

অজিতদা বললে, না, আমার নাম অজিত রায়। আপনি আমাকে চিনবেন না।

রাণুদি হঠাৎ আবার কেঁদে ফেললেন, আমার জিনিসটা তোমরা কেউ খুঁজে দেবে না, শুধু শুধু তোমরা আমায় কষ্ট দিচ্ছো কেন?

অজিতদা আমাদের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, নিয়ে চলো!

আমরা রাণুদিকে জড়িয়ে ধরে ঠেলতে লাগলাম, অজিতদা শক্ত করে ধরে রইলেন এক হাত। রাণুদি ছটফটিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলেন, ছেড়ে দাও, আমাকে ছেড়ে দাও, আমি যাবো না, আমার একটা জিনিস হারিয়ে গেছে ছেড়ে দাও।

সেই অবস্থাতেই আমরা জোর করে নিয়ে আসছিলাম, রাস্তার ওপর উঠে হঠাৎ রাণুদি আবার শান্ত হয়ে গেলেন। শরীর শক্ত করে দাঁড়িয়ে বিস্ময়ের সঙ্গে বললেন, তোমরা সবাই মিলে আমায় ঠেলছো কেন? আমি কি হাঁটতে পারি না। আমাকে নিজে নিজে যেতে দাও, প্লীজ।

আমরা রাণুদিকে ছেড়ে দিয়ে গোল করে ঘিরে রাখলাম। রাণুদি কিন্তু আর পালাবার চেষ্টা করলেন না। রাণুদি এদিক ওদিক তাকিয়ে নিজের মাকে খুঁজে পেয়ে এগিয়ে গিয়ে মায়ের হাত ধরলেন। তারপর খুব কাতর গলায় বললেন, মা, আমি পারছি না, খুব চেষ্টা করছি, কিন্তু এক এক সময়…মা আমি পাগল হতে চাই না, আমি পাগল হতে চাই না….

সে কথাটা শুনে আমারও কান্না পেয়ে গেল। রাণুদির তো কোনো দোষ নেই। ওঁদের বংশে কে একজন পাগল ছিল, সেই জন্য ওঁকেও পাগল হয়ে যেতে হবে? এই কি ঈশ্বরের নিয়ম? তাহলে কী করে মানবো যে ঈশ্বর বলে কিছু আছে?

বাকি রাস্তাটা রাণুদি নিজেই স্বাভাবিকভাবে হেঁটে এলেন, আমরাও ফাঁক ফাঁক হয়ে গেলাম। খানিকবাদে একটা টাঙ্গার ঝমঝম আওয়াজ পেলাম। বড়মামা ফিরে এসেছেন। থানায় খবর দেওয়া হলেও পুলিশ কেউ সঙ্গে আসেনি, তারা পরে যা হয় ব্যবস্থা নেবে বলেছে।

বড়মামা খুব স্নেহের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছিল রাণু? কোথায় গিয়েছিলি?

রাণুদি বললেন, জানি না বড়মামা, আমি কিছু জানি না।

 –তুই আজ সন্ধেবেলা মায়ের প্রসাদও খাসনি! আয়–

সবাই মিলে গিয়ে বসলাম মন্দিরের সামনের চাতালে। রাণুদির মা আমাদের প্রসাদ দিতে লাগলেন। অজিতদাকে অবশ্য আর দেখতে পেলাম না। অজিতদা গেটের বাইরে থেকেই নিশ্চয়ই চলে গেছেন।

রাণুদির মাও খোঁজ করলেন অজিতদার। তিনি নেই দেখে আফসোস করে বললেন, চল গেল? অনেক উপকার করেছে ছেলেটি! অতদূর…নদীর ধারে পাথরের আড়ালে বসেছিল রাণু….ঐ ছেলেটি না দেখলে সারা রাত ওকে খুঁজেই পাওয়া যেত না….কী যে হতো।

আমরা সবই অজিতদার কৃতিত্ব মেনে নিলাম। সত্যি, ওঁর জন্যই আজ রাণুদিকে ফিরে পাওয়া গেছে। কাল সকালেই একবার অজিতদাকে গিয়ে ধন্যবাদ দিয়ে আসতে

হবে।

রাণুদির মা বললেন, তোমরা চেনো ছেলেটিকে? ওকে একবার ডেকে এনেনা তো আমার কাছে।

রাণুদি মা বেশ শক্ত মহিলা। ওঁর এক মেয়ের তো এই অবস্থা, কয়েকদিন আগে অভিজিৎ জলে ডুবে গিয়েছিল–এসব সত্ত্বেও ওঁকে কখনো একেবারে ভেঙে পড়তে দেখিনি। মাঝে মাঝে কেঁদে ফেলেন বটে, আবার একটু বাদেই নিজেকে সামলে নেন।

বড়মামা ভেতর থেকে একটা ইঞ্জেকশানের সিরিঞ্জ হাতে নিয়ে বেরিয়ে এলেন। রাণুদির পাশে এসে বললেন, একটা ইঞ্জেকশান দিতে হবে যে? দিই?

রাণুদি ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ জানালেন।

বড়মামা বললেন, এখানেই দেবো, না ভেতরে গিয়ে শুবি?

–এইখানেই দাও।

সেই ইঞ্জেকশানটা দেবার প্রায় দশ মিনিটের মধ্যেই রাণুদির চোখ ঘুমে ঢুলে এলো। তখন আমরাও চলে এলাম আমাদের বাড়িতে।

সারাদিন জসিডি-দেওঘরে ঘোরাঘুরি করেও আমরা একটুও ক্লান্ত হইনি, কিন্তু রাণুদিকে খোঁজাখুঁজি করার পর্বটার জন্যই আমরা যেন বেশ অবসন্ন বোধ করলুম। রাণুদির কথাটা ভাবলেই মনটা ভাল হয়ে যায়। রাণুদি হঠাৎ হঠাৎ এখানে সেখানে চলে যান। এরপর থেকে কি ওরা রাণুদিকে ঘরে আটকে রাখবে?

পরদিন সকালে অজিতদার বাড়ি আর যেতে হলো না আমাদের। অজিতদাই এসে হাজির হলেন। আমাদের তখন সদ্য ঘুম ভেঙেছে, পরীর ডাকাকাকি শুনে নিচে গিয়ে ওঁকে দেখতে পেলাম।

অজিতদা বললেন, তোমাদের কাছে একটু চিনি ধার করতে এলাম। আমার চিনি ফুরিয়ে গেছে। বাজার থেকে চিনি এনে চা করতে অনেক দেরি হয়ে যাবে, সেই জন্য

ভাস্কর বললো, আপনি আমাদের এখানেই চা খেয়ে যান না।

শুধু চা নয়। দেওঘর থেকে দু’বাক্স প্যাড়া এনেছিলাম আমরা। সেই প্যাড়াও জোর করে খাওয়ালাম ওঁকে। আমরা চারজনে যেন রীতিমত একটা সংসার চালাচ্ছি। কোন বেল কী রান্না হবে, তা আমরাই বলে দিই। এমনকি, বাড়িতে অতিথি এলেও আমরা মিষ্টি খেতে দিতে পারি।

ভাস্কর জিজ্ঞেস করলো, আপনি অন্ধকারের মধ্যে ঐ জায়গায় রাণুদিকে দেখতে পেলেন কী করে?

অজিতদা বললেন, রাত্তিরে খাওয়া-দাওয়ার পর আমার খানিকক্ষণ বাইরে হাঁটা অভ্যেস। সেই হাঁটতে হাঁটতে ঐ কেন্ট নালাটার দিকে গিয়েছিলাম, হঠাৎ শুনলাম কে যেন কাঁদছে….বেশ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না!

আমি জিজ্ঞেস করলাম, রাণুদি কাঁদছিলেন?

হ্যাঁ। আমি তাই থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। প্রথমে ভেবেছিলাম কোনো আদিবাসী মেয়ে-টেয়ে হবে। সেই বা কাঁদছে কেন জানার জন্য কৌতূহল হলো। তারপর শুনলাম, মেয়েটি ঐ নালাটা থেকে আঁজলা করে জল তুলে মাথায় দিচ্ছে আর বিড়বিড় করে বলছে, আমার মাথা শান্ত করে দাও, হে ভগবান, আমি তো তোমার সব কথা শুনি, তবু কেন আমি পারি না…পারি না…। এসব শুনে খুবই অবাক হলাম। তখন আমি একটু গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কে? আপনি এখানে বসে আছেন কেন? ব্যস, আমি কথা বলা মাত্রই মেয়েটি একেবারে চুপ! আর আমি যত কথাই জিজ্ঞেস করি, কোনো উত্তর নেই। আমি বাড়ি ফিরেই যাচ্ছিলাম, তবু মনে হলো, ভদ্রঘরের মেয়ে, ওখানে একা বসে থাকা ঠিক নয়, তারপর এদিকে গোলমাল শুনতে পেয়ে বুঝলাম। সতেরো বছর বয়েসে-৩

একটুক্ষণ চুপ করে থাকার পর ভাস্কর বললো, রাণুদি কিন্তু এমনিতে খুব ভালো।

অজিতদা বললেন, হুঁ!

আশু বললো, রাণুদির মা আপনাকে একবার ওবাড়িতে নিয়ে যেতে বলেছেন।

উৎপল বললো, এখুনি চলুন না একবার ঘুরে আসবেন।

আমি বললুম, সেই ভালো। রাণুদিকেও একবার দেখে আসা যাবে।

অজিতদা বললেন, অন্য এক সময় যাবো। আমার একটু দরকার আছে, এখুনি একবার বেরুতে হবে।

ভাস্কর বললো, চলুন না, কতক্ষণ আর লাগবে?

অজিতদা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, যাবো। কাল রাত্তিরে ওর পর আর কোনো গণ্ডগোল করেনি তো মেয়েটি?

আমি বললাম, তারপরই তো ওকে ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া হলো। সেইজন্য সকালবেলা একবার দেখতে যাবো।

এই সময় সঞ্জয় এসে উপস্থিত হলো। ওর মা ওকে পাঠিয়েছে। সকাল বেলা ওদের বাড়িতে আমাদের সকলের জলখাবারের নেমন্তন।

অজিতকে দেখে সঞ্জয় বললো, আপনিও চলুন!

অজিতদা হেসে জিজ্ঞেস করলেন, জলখাবারে কী কী আইটেম?

সঞ্জয় বললো, লুচি আর আলুর দম আর মালপো।

অজিতদা বললেন, বাঃ শুনলেই জিভে জল আসে, কিন্তু আমি ভাই এখন যেতে পারছি না যে, একবার জসিডি যেতেই হবে, ন’টা চল্লিশে ট্রেন…

অজিতদাকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আমরা চলে এলাম সঞ্জয়দের বাড়িতে। শুনলাম; রাণুদি তথনো ঘুমোচ্ছেন।

রাণুদির বদলে মা আজ তুলছে পুজোর ফুল। ফুল তুলবার সময় বোধহয় শাড়ি পরতে হয়, কেন না, এর আগে কক্ষনো শাড়ি পরা অবস্থায় দেখিনি, সে স্নকস আর পাঞ্জাবি পরতে ভালবাসে। শাড়ি পরে তাকে অন্যরকম দেখাচ্ছে।

ঝুমার সঙ্গে আমাদের ভাব হয়েছে এর মধ্যে, তবু এখনো একটু অহঙ্কারী অহঙ্কারীভাবে তাকায়। যেন আমরা ওর তুলনায় ছেলেমানুষ। আমাদের মধ্যে একমাত্র ভাস্করই ঝুমার সঙ্গে একটু বেশী আগ্রহ নিয়ে কথা বলে।

পুজো করার সময় বড়মামা গায়ে একটা লাল চাদর জড়ানো থাকে। গম্ভীর গলায় সংস্কৃত মন্ত্র পড়ছেন আর এক হাতে ঘণ্টা বাজাচ্ছেন। ইনিই আবার কাল ইঞ্জেকশান দিলেন রাণুদিকে। খুব সংকটের সময় ইনি কালীঠাকুরের চরণামৃতের বদলে ওষুধপত্রের ওপরেই নির্ভর করেন।

বাগানে কুড়ি, পঁচিশজন দেহাতী নারী পুরুষ আছে! আজ শনিবার, আজ বড়মামা বাইরের লোকদের ওষুধ দেন।

পুজো শেষ করেই বড়মামা একটি সিগারেট ধরালেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর হাতে এক কাপ চা এনে দেওয়া হলো। আমাদের দেখে তিনি বেশ উফুলুভাবে বললেন এসে। গেছো? আজ আর কোথাও বেড়াতে যাওনি বুঝি? আর যে কত দেখবার জায়গা বাকি রয়ে গেল।

ভাস্কর বললো, কাল গিরিডি ঘুরে আসবো ঠিক করেছি।

বড়মামা বললেন, বেশ তোমরা খাবার-টাবার খেয়ে নাও। আমি ততক্ষণ রুগী দেখে নিই।

বড়মামা রাণুদি সম্পর্কে কোনো কথাই বললেন না। কালকের রাত্তিতের ঘটনায় আমরা এখনো উত্তেজিত হয়ে আছি, ওঁর মধ্যে তার চিহ্ন নেই কোনো! এর আগেও অভিজিৎ যেদিন জলে ডুবে গিয়েছিল, সেদিই দুপুরের পর থেকে তিনি ঐ ঘটনা আর উল্লেখ করেন নি একবারও। আমাদের কাছে এগুলো এক একটা সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার, বারবার মাথায় ঘুরে ফিরে আসে। অবশ্য আমাদের জীবনে এসব অভিজ্ঞতা নতুন,বড়মামা নিশ্চয়ই এরকম অনেক দেখেছেন। কিংবা বয়স বাড়লে মানুষ সব কিছুকেই অবশ্যম্ভাবী বলে ধরে নেয়?

বড়মামা যখন রুগী দেখতে লাগলেন, আমরাও দাঁড়িয়ে রইলাম। উনি বসলেন বাগানেই একটা চেয়ার টেবিল পেতে। কী দারুণ যত্ন করে উনি প্রত্যেকটি রুগীকে দেখেন। বিনা পয়সাতে যে কত আন্তরিকভাবে চিকিৎসা করা সম্ভব, কে জানতো! প্রত্যেকটি রুগীকে প্রশ্ন করে করে তিনি ওদের নাড়ী নক্ষত্র জেনে নিচ্ছেন। ওদের কথা শুনছেন মন দিয়ে। কারুর কারুর হাতে ওষুধ তুলে দেবার পর বলছেন, আগের বারের মতন এবারও যদি শুনি তুই এক সঙ্গে সব কটা ওষুধ খেয়ে ফেলেছিস, তাহলে তোর মাথা গুড়ো করে দেবো!

বড়মামা যেন এখন অন্যমানুষ। ইনিই ভক্তি করে কালীপুজো করেন। আবার কালীর সামনেই সিগারেট খান, ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাস খেলে কাটান, আবার তিনিই এখন গরীব দুঃখী মানুষদের জন্য অন্তর ঢেলে দিচ্ছেন।

এক এক সময় আমার মনে হয়, একজন মানুষের মধ্যেই অনেকগুলো মানুষ থাকে।

দুপুরবেলা উৎপল যাবে বড়মামার সঙ্গে তাস খেলতে। আমি যেতে চাইলাম না। ওরা কোনোদিনই আমাকে চান্স দেয় না, পাশে বসিয়ে রাখে। তার থেকে বাড়িতে শুয়ে থাকা ভালো।

উৎপল বললো, চল না, শুধু শুধু ঘুমিয়ে কাটাবি কেন দুপুরটা।

ভাস্কর বললো, ও বাড়িতে গিয়ে ঝুমার সঙ্গে প্রেম করতে পারিস, আমরা তো থাকবো না, বেশ একা-একা।

আমি বললাম, আমায় খেলতে দে আর তুই বুমার সঙ্গে প্রেম কর গিয়ে।

উৎপল বললো, ধ্যাৎ! তুই এখনো ফোর ক্লাবস-এর পর কা নো ট্রামপস ডাকতে হয় সেটাই শিখতে পারলি না, তোকে কেউ খেলতে নেয়।

আমি বললুম, আমি শুয়ে শুয়ে বই পড়বো, সেই ঢের ভালো। যা তোরা ঘুরে আয়।

দুপুরবেলা ঝুমাও নিজের ঘরে বসে পড়ে। দু-একবার সেখানে গিয়ে ওর সঙ্গে কথা বলতে গেছি, কিন্তু কেন জানি না, ও যেন আমাকেই বিশেষ করে পাত্তা দেয় না। আমার খুব রোগা চেহারা বলে? আর একটা ফুল প্যান্ট আমি ধার করে পরছি, সেটাতে আমাকে যথেষ্ট ভালো দেখায় এখন।

যাই হোক, এতে আমারও কিছু যায় আসে না। ওরকম উঁটিয়াল মেয়েদের আমিও পছন্দ করি না মোটেই।

ওরা চলে যাবার পর আমি শুয়ে শুয়ে বই পড়তে লাগলাম। এত বড় বাড়িটাতে আমি এখন একা। এই কথাটা ভাবলেই একটু অন্যমনস্ক হয়ে যেতে হয়। কলকাতার তুলনায় এখানকার দুপুরগুলো কী অসম্ভব নিস্তব্ধ। এই বাড়িটা শহরের বাইরের দিকে বলে প্রায় একটা গাড়ি ঘোড়ার আওয়াজ শুনতে পাওয়া যায় না। এখান থেকে টাঙ্গা ধরতে হলে প্রায় এক মাইল হেঁটে যতে হয়।

একটা কাক শুধু একটানা কা-কা করে ডেকে যাচ্ছে। সেই ইষ্টকুটুম পাখিটাকে যে প্রথম দিনই এসে দেখেছিলুম, তারপর আর একদিনও দেখতে পাই না। ওর কাজ কি শুধু অতিথি এসেছে কি-না দেখে যাওয়া?

প্রায় ঘণ্টাখানেক বই পড়ার পর একটু ঝিমুনি এসে গেল। তাড়াতাড়ি উঠে বসলাম। ফাঁকা বাড়িতে একলা ঘুমিয়ে পড়ার কোনো মানে হয় না। নিচের দরজাটা খোলা, যদি কোনো চোর ফোর ঢুকে পড়ে?

উঠে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে আসতেও আলস্য লাগছে।

এক সময় সিঁড়িতে ধুপধাপ করে পায়ের শব্দ হলো।

আমি প্রথমে একটু চমকে গেলেও, পরের মুহূর্তেই বুঝে গেলাম। কোনো বয়স্ক লোক এভাবে সিঁড়ি দিয়ে ওঠে না।

সঞ্জয় দরজার পাশ দিয়ে উঁকি মেরে বললো, নীলুদা, তুমি ঘুমোচ্ছো?

আমি বই মুড়ে রেখে বললাম, না। এসো।

–তবে যে ভাস্করদারা বললো, গিয়ে দেখবি নীলুদা ভোঁসভোঁস করে ঘুমোচ্ছে? আবার সিঁড়িতে পায়ে শব্দ। এবার অভিজিৎ।

সে বললো, তুমি তো লেগেই আছে। ব্যাডমিন্টনের সেটটা একটু দেবে, আমরা খেলবো। তুমি খেলবে?

সঞ্জয় বললো, এই, তুই দিদিকে একলা রেখে এলি?

অভিজিৎ বললো, র‍্যাকেটগুলো তুই নিয়ে আয়। দেরি করছিস কেন?

আমি জিজ্ঞেস করলাম, কোন দিদি? রাণুদি?

সঞ্জয় বললো, হ্যাঁ। মা বলেন, দিদিকে কখনো একলা ছাড়া হবে না, যেখানে যাবে, আমরাও যাবো।

ব্যাডমিন্টনের নেটটা ওদের দেখিয়ে বললাম, চলো, নিয়ে চলো। তরতর করে আমি চলে এলাম নিচে।

রাণুদি আমাদের বাড়ির সামনেই একটা গাঁদা ফুলের গাছের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে আছেন। একটু দূরে দাঁড়িয়ে পরী ওকে তির্যকভাবে দেখছে।

রাণুদি আমার দিকে চোখ তুলে বললেন, ওরা তোমার ঘুম ভাঙিয়ে দিল বুঝি?

আমার সারা শরীরে একটা আনন্দের শিহরণ হলো। রাণুদি আজ ভালো মুডে আছেন। ওঁর মুখের একটা কথা শুনলেই বোঝা যায়, এখন আর কোনো গোলমাল হবে না।

অভিজিৎরা সব কিছু নিয়ে নেমে এসেছে।

একদিকে শুধু একটা বাঁশ পুঁততে হয়েছে, আর একদিকে বেশ সুবিধেমতন জায়গায় একটা পেয়ারা গাছ আছে। সেখানেই বেশ কায়দা করে নেটটা বাঁধা যায়।

আমি জিজ্ঞেস করলুম, রাণুদি আপনি খেলবেন? রাণুদি বললেন, না! তোমরা খেলো। আমার একটু একটু মাথা ব্যথা করছে। আমি তবু জোর করে বললুম, একটু খেলুন না, দেখবেন মাথা ব্যথা সেরে যাবে।

অনিচ্ছার সঙ্গে রাণুদি একটা র‍্যাকেট হাতে তুলে নিলেন। আমি আর সঞ্জয় একদিকে এসে দাঁড়ালাম। ওদিকে রাণুদি আর অভিজিৎ।

র‍্যাকেট চালানো দেখলেই বোঝা যায়, রাণদি বেশ ভালোই খেলতে পারতেন। কিন্তু আজ মন নেই। একটু বাদেই বললেন, নাঃ তোমরা খেল,আমি পারছি না।

কিছুক্ষণ আমি পেটাপেটি করলাম ওদের সঙ্গে। সঞ্জয় আর অভিজিৎ একদিকে আর আমি একলা। কিন্তু এসব কাচ্চাবাচ্চার সঙ্গে খেলে সুখ নেই। একটা চাপ তুলতে পারে না। ওর ক্যারামে আমায় হারিয়ে দিতে পারে বটে কিন্তু ব্যাডমিন্টনে আমার তুলনায় পিঁপড়ে।

আমিও দাঁড়িয়ে বললাম, এবার তোমরা দুজনে একটা গেম খেলো। আমি আসছি।

রাণুদি সেখানে নেই। আমি আগেই লক্ষ্য করেছিলাম, রাণুদি বাড়ির ভেতরে গেছেন। নিচের তলার ঘরগুলোর উঁকি মেরে দোতলায় উঠে এলাম।

রাণুদি আমাদের ঘরের খাটে শুয়ে আছেন, চোখ বোজা, দু’ আঙুল দিয়ে টিপে ধরে আছেন কপালটা।

আমার পায়ের শব্দ শুনেই রাণুদি চোখ মেরে উঠে বসলেন।

আমি বললুম, শুয়ে থাকুন না! খুব বেশী মাথা ব্যথা করছে?

–হ্যাঁ।

আমি দুরুদুরু বক্ষে জিজ্ঞেস করলাম, আমি আপনার মাথা টিপে দেবো। রাণুদি একটুক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। তারপর বললেন না!

খাট থেকে নেমে এসে বললেন, তোমরা যে আমাকে পাহাড়ে নিয়ে যাবে বলেছিলে? গেলে না?

–নিশ্চয়ই যাবো। আপনি কবে যাবেন বলুন?

আমার খুব কাছে এসে, প্রায় আমার মুখের কাছে মুখ এনে রাণুদি অদ্ভুত কাতর, শূন্য গলায় বললেন, জানো, নীলু, মাথা ব্যথা করলেই আমার ভয় হয়। যদি আমি পাগল হয়ে যাই আবার!

আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম, না, না, আপনার কিছু হবে না!

–আমায় এক বছর নার্সিং হোমে রেখেছিল। সেখানে যে আমার কী খারাপ লাগে। আমার মরে যেতে ইচ্ছে করে। ওরা আমায় খুব কষ্ট দেয়, জানো? খারাপ কথা বলে। আমি বাবাকে বলেছিলাম, বাবা, তোমার পায়ে ধরছি, আমাকে নার্সিংহোমে বন্দী করে রেখো না, আমি ভালো হয়ে যাবো, কথা দিচ্ছি, ভালো হয়ে যাবো।

–আপনি তো ভালই হয়ে গেছেন রাণুদি।

–কাল রাত্তিরে যে আবার পাগল হয়ে গিয়েছিলাম! আচ্ছা নীলু, কাল কি আমি খুব বেশী পাগল হয়ে গিয়েছিলাম? খুব?

–না, না।

–তাহলে তোমরা সবাই মিলে আমায় ঠেলছিলে কেন? পাগলকেই তো লোকে ওরকম করে।

এই কথার আর কী উত্তর দেবো, আমি মাথা নিচু কের রইলাম।

–কাল আমি একা একা কোথায় চলে গিয়েছিলাম। আমার কিছু মনে নেই। সেই জায়গাটা আমায় দেখাতে পারো?

-হ্যাঁ।

–চলো তো?

–অনেকটা দূরে কিন্তু। আপনি হাঁটতে পারবেন? আপনার মাথা ব্যথা করছে। মাথা ব্যথা করার সময় শুয়ে থাকলেই আমার বাড়ে।

–কোনো ওষুধ খাবে না?

–আমার সব ওষুধ শেষ হয়ে গেছে। তুমি যাবে?

নিচে এসে দেখি অভিজিৎ আর সঞ্জয় লাফিয়ে লাফিয়ে র‍্যাকেট ঘঘারাচ্ছে। আমি বললুম, আমি একটু রাণুদিকে নিয়ে ঘুরে আসছি। তোমরা খেলো। বৃষ্টি এলে সব ভেতরে তুলে দিও কিন্তু।

অভিজিৎ আর সঞ্জয় খেলা থামিয়ে শতকে দাঁড়ালো। তাকালো পরস্পরের দিকে। আমি বুঝতে পেরে বললাম, ভয় নেই, আমিই তো সঙ্গে যাচ্ছি। ঠিক ফিরিয়ে নিয়ে আসবো।

তারপর ওদের কাছে গিয়ে নিচু গলায় বললাম, কাল রাত্তিরের সেই নদীটার কাছে যাচ্ছি। তোমরাও একটু বাদে ওদিকে চলে আসতে পারো।

রাণুদি ততক্ষণে গেটের কাছে চলে এসেছেন। আমি দৌড়ে এসে ওঁকে ধরে ফেললাম।

রাণুদি আজ পরে আছেন নীল রঙের একটা শাড়ি। ওঁর ফর্সা শরীরের সঙ্গে নীল রঙটা বেশ মানায় চুলগুলো সব খোলা। রাণুদিকে আমি কখনো খোঁপা বাঁধতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না।

এই যে আমি রাণুদির পাশে হেঁটে যাচ্ছি, এতেই আমার অসম্ভব আনন্দ হচ্ছে। এটা যেন আমার দারুণ সৌভাগ্য।

আনন্দে মশগুল হয়ে আমি চুপচাপ ছিলাম। তারপর এক সময় মনে হলো, রাণুদিকেও চুপচাপ থাকতে দেওয়া উচিত নয়। চুপ করে থাকাই তো রাণুদির প্রধান অসুখ। কথা বললেই রাণুদি ভালো হয়ে যাবেন।

রাণুদি, আপনি কোন কলেজে পড়তেন?

–ব্রেবোর্ণে।

–তাই নাকি? আমার দু’জন মাসিও ওখানে পড়ে। আমার আর মাসির নামও রাণু। সে অবশ্য ইউনির্ভাসিটিতে পড়ে এখন।

–আমিও ইউনির্ভাসিটিতে ভর্তি হয়েছিলাম কিন্তু আর পড়া হলো না….তখন থেকেই আমার বেশী মাথা খারাপ হলো, খুব ভীষণ পাগল হয়ে গেলাম।

–রাণুদি, ও কথা আর বলবেন না। আপনি তো এখন ভালো হয়ে গেছেন।

–আমি ভালো হয়ে যাই নি, নীলু। আমি জানি। কিন্তু আমি ভালো হতে চাই। জানো, ইউনিভার্সিতে একদিন আমি ক্লাসের মধ্যে এমন হয়ে গেলাম হঠাৎ নাচতে আরম্ভ করলাম একদম স্যারের সামনে। বলেই রাণুদি ফিক-ফিক করে হাসতে আরম্ভ করলেন। আমার কাঁধে একটা চাপড় মেরে বললেন, ভাবো তো, ক্লাসের মধ্যে কোনো ছাত্রী যদি নেচে ওঠে একেবারে ধেইধেই করে…সব ছেলেমেয়েরা দারুণ চ্যাঁচামেচি করতে লাগলো…..তারপর কী হয়েছিল আমার মনে নেই—

–সে কতদিন আগেকার কথা?

–তিন বছর। তারপর ছ’মাস বাদে আমি আবার ভালো হয়ে গিয়েছিলাম। আবার ভাবলাম পড়বো, পরীক্ষা দেবো…হলো না, তিন মাস পরই অজ্ঞান হয়ে গেলাম একদিন। যখন জ্ঞান হলো, নিজের নামটাও মনে করতে পারি না….আচ্ছা নীলু, তুমি আমার নাম জানো? বলো তো।

–আপনার নাম রাণু।

–ভালো নাম কী?

–তা তো জানি না।

–মাধুরী। মাধুরী সেনগুপ্ত। মনে রাখবে। আমার যদি হঠাৎ মনে হয়, আবার আমার নাম ভুলে যাচ্ছি, তোমাকে জিজ্ঞেস করে নেবো।

রাণুদির মুখে এসব কথা শুনলেই একটু ভয়-ভয় করে। আমি রাণুদিকে নিজের দায়িত্বে নিয়ে এসেছি আমাকেই ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে। বাবাও নি যাওয়া কী সাঙ্তিক কথা। নিশ্চয়ই তখন রাণুদির খুব কষ্ট হয়েছিল।

খানিকটা দূর যাবার পর রাণুদি আবার জিজ্ঞেস করলেন, তুমি যে আমার সঙ্গে এলে, তোমার নিশ্চয়ই খারাপ লাগছে।

–না, খারাপ লাগবে কেন?

–আমি তো পাগল, তোমার ভয় করে না? অনেকেই তো আমায় ভয় পায়।

–না রাণুদি। আমি আপনাকে একটুও ভয় পাই না। আমার খুব খুব ভালো লাগছে, আপনি বিশ্বাস করুন, দারুণ ভালে লাগছে।

রাণুদি ব্যাকুলভাবে বারবার বলতে লাগলেন, তোমার ভালো লাগছে, নীলু? সত্যি ভালো লাগছে? সত্যি?

এবার অদূরেই আমার সেই কদমগাছটা দেখতে পেলাম। আজও সেটা ফুলে ভরা। এই গাছ ভর্তি সমস্ত ফুল আমার। আমি সব রাণদিকে দিয়ে দিতে পারি।

রাণুদি দৌড়ে জলের কাছে নেমে গেলেন। আজ যেন একটু বেশী জল এই নদীটায়। তবে সেইরকমই স্বচ্ছ জল, ভেতরে কয়েকটা পুঁচকে পুঁচকে মাছ দেখতে পাচ্ছি।

–ঐ যে ঐ পাথরটা, ওখানে আপনি বসেছিলেন।

রাণুদি পাথরটার পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। রাত্তিরবেলা ওখানে কোনো মানুষ বসে থাকলে রাস্তা থেকে দেখতে পাওয়া খুবই শক্ত।

–আমার কিছু মনে নেই, নীলু। মনে হচ্ছে, এ জায়গাটা আমি আগে কখনো দেখিই নি। আমি একটু বসবো এখানে।

-হ্যাঁ, বসুন না!

–বসলে…আমি যদি আবার পাগল হয়ে যাই?

–আঃ, রাণুদি, ও কথা বলবেন না। আপনি তো ভালো হয়ে গেছেন।

রাণুদি পাথরটার ওপর বসলেন পা ঝুলিয়ে। লাল রঙের চটি জোড়া ছুঁড়ে দিলেন এক পাশে, তারপর জলে পা ডোবালেন। পাথরের কাছেই যে জলের ঘূর্ণিটা, সে যেন রাণুদির পা দুখানি নিয়ে খেলা করতে লাগলো খুব খুশী হয়ে।

আমিও রাণুদির কাছেই বালির ওপর বসে জলের মধ্যে পা রাখলুম।

—আমি এখানে বসে কী করছিলুম, নীলু?

–আপনি চুপ করে বসেছিলেন শুধু। আপনি বলেছিলেন, ভগবান আপনাকে এখানে ডেকে এসেছেন।

–সত্যি বলেছিলাম?

–হ্যাঁ।

–কী জানি। আমি যখন পাগল হয়ে যাই, তখন বোধ হয় দেখতে পাই ভগবানকে। এমনিতে অন্য সময় তো পাই না। অন্য সময় কিছু মনে হয় না :

–আপনি আর একটাও মজার কথা বলেছিলেন। এই যে গাছটা এখানে একটা গিরগিটি বসেছিল, আপনি সেটাকে দেখিয়ে বললেন, ঐ যে ভগবান!

নদীর স্রোতের মতনই কুলকুল শব্দে হেসে উঠলেন রাণুদি। হাসতে হাসতেই বলতে লাগলেন একটা গিরগিটিকে….এমা…..একটা গিরগিটিকে ভগবান! পাগল হলে মানুষ কত অদ্ভুত কথা বলে! নীলু, তুমি আগে কোনো পাগল দেখেছো?

–না।

–আমিও দেখিনি। মানে, রাস্তায় দেখেছি, কিন্তু চেনাশুনো কারুকে দেখিনি…শেষে কিনা আমি নিজেই পাগল হলাম! আমি বুঝতে পারি, অজনো, এক এক সময় আমি আগে থেকেই টের পাই যে আমার মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে, ঠিক যেন একটা ঝড় ওঠে, বাইরের সব শব্দ একটু একটু করে মুছে যায়; সেই ঝড়ের শব্দ ছাড়া আমি আর কিছু শুনতে পাই না…আমি চেষ্টা করি, ভীষণভাবে চেষ্টা করি নিজেকে সামলাবার, আমার তখন সাঙ্ঘাতিক কষ্ট হয়।

রাণুদি দু হাতে মুখ ঢেকে ফেললেন। কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগলো ওর শরীর। একটু বাদে যখন হাত সরালেন, ওর দু’চোখে তখনও জল। আঁচল দিয়ে চোখ মুছে ফেললেন।

আমার বুকটা যেন গুঁড়িয়ে যেতে লাগলো। আমি কি কিছুতেই রাণুদির দুঃখ দূর করতে পারি না? একটা যদি কোনো মন্ত্র পেতাম, সেই মন্ত্রের জোরে আমি দুনিয়ার সব মানুষের দুঃখ ঘুচিয়ে দিতে পারতাম যদি।

সেরকম কোনো মন্ত্র আমি জানি না, কিন্তু বদলে আর কী দিয়ে আমি রাণুদির মন ভোলাতে পারি? এই নীটা আমি দিতে পারি রাণুদিকে, এই আকাশ।

–রাণুদি আপনি কদমফুল ভালোবাসেন?

–হ্যাঁ। আমি সব ফুল ভালোবাসি।

–দাঁড়ান, আমি আসছি।

দৌড়ে গিয়ে কদমগাছটায় চড়ে বসলাম। বেশ তাড়াহুড়োতে একটা পাতলা ডালে পা দিতেই সেটা মড়াৎ করে ভেঙে গেল, আমি পড়ে যাচ্ছিলাম আর একটু হলে। গাছটাকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলাম, নিই? তোমার থেকে ফুল নিই? ফুল তো পরের জন্যই। তোমার ফুলের এর চেয়ে বেশী ভালো ব্যবহার হতে পারে না।

প্রায় কুড়ি পঁচিশটা ফুল ছিঁড়ে এনে ফেলে দিলাম রাণুদির কোলের ওপর।

রাণুদি খুব খুশী হয়ে বললেন, এত?

তখনই রাণুদিকে মনে হলো দেবীর মতন। আমি যেন রাণুদিকে পুজো করছি। রোদ্দুরের একটা রেখা এসে পড়েছে রাণুদির পিঠের ওপর ছড়ানো ঝলক। নিটোল চিবুকটা নুইয়ে রাণুদি ফুলগুলো গন্ধ নিচ্ছেন, রাণুদির বুক, কোমর ও উরুতে যেন মাধুর্যের চুম্বক বসানো, গ্ন পা দুটি খেলা করছে জলে। আমার ইচ্ছে হলো, রাণুদির পা দুটি আমার বুকে জড়িয়ে ধরি।

আমি টের পেলাম, আমার পুরুষাঙ্গ উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। আমি এক পলকের জন্য পোশাকের নিচে রাণুদিকে আসল শরীরটা মনশ্চক্ষে দেখে নিলাম, রাণুদি যেন সম্পূর্ণ নিরাবরণ হয়ে বসে আছেণ ঐ পাথরটার ওপর। আমার নিশ্বাস গরম হয়ে গেল।

রাণুদি নিশ্চয়ই আমাকে ভাবছেন একটা বাচ্চা ছেলে। কিন্তু আমি তখন রাণুদিকে মনে মনে সব জায়গায় দারুণভাবে আদর করছি। আর মনে মনেই বারবার বলছি, রাণুদি, আমি তোমায় ভালবাসি, ভীষণ ভালবাসি, কত ভালবাসি তুমি জানো না।

রাণুদি জিজ্ঞেস করলেন, নীলু, আমায় তোমার মনে থাকবে?

–আপনাকে কোনোদিন ভুলবো না, রাণুদি।

কিন্তু আমি যদি তোমায় ভুলে যাই কিছু বিশ্বাস নেই, আমি হয়তো ভুলে যেতে পারি, আমার অনেক কিছুই মনে থাকে না… তোমার সঙ্গে এসে কিন্তু আমার মাথার ব্যথাটা অনেকটা কমে গেল।

রাণুদি একটা ফুল ছুঁড়ে দিলেন জলে। সেটা দুলতে দুলতে ভেসে চললো। আমরা দু’জনেই সেদিকে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। কিছুই না, জল দিয়ে একটা ফুল ভেসে যাচ্ছে–অথচ এক এক সময় তা দেখতেই কত ভালো লাগে।

রাণুদি জিজ্ঞেস করলেন, এই ফুলটা কোথায় যাবে? অনেক দূর, তাই না? যেখানে এই নদীটা গিয়ে মিশেছে……আমরা তো ইচ্ছে করলেই গিয়ে দেখতে পারি, এই নদীটা কোথায় গেছে। যাবে, নীলু?

–হ্যাঁ চলুন।

–এই নদীটা নিশ্চয়ই অন্য আর একটা নদীর সঙ্গে মিশিছে। আমরা কোন দিকে যাবো, নদীটা যেখান থেকে জন্মেছে, সেদিকে না নদীটা যেখানে গিয়ে পড়েছে?

–যেদিকে আপনার ইচ্ছে।

–কিন্তু কোনটা কোনদিকে আমরা বুঝবো কী করে?

–যেদিকে স্রোত, সেইদিকে যাই চলুন।

–না, আমি স্রোতের উল্টো দিকে যাবো।

ঠিক যেন একটা বাচ্চা মেয়ের মতন আবদার করা গলায় রাণুদি বললেন, এই কথাটা। তারপর হেসে উঠলেন। আবার বললেন, আমি তো পাগল, তাই সব সময় উল্টো কথা বলি।

রাণুদির মুখে ‘পাগল’ শব্দটা শুনতে আমার একটুও ভালো লাগে না।

রাণুদি পাথর থেকে নেমে জলের ওপর দাঁড়ালেন। শাড়ির পাড়টা ভিজে যাচ্ছে বলে একটু উঁচু করলেন শাড়িটা। গোড়ালি থেকে এক বিঘৎ ওপরে। ঠিক মাখন দিয়ে তৈরি রাণুদির পা। ইচ্ছে করে, জিভ দিয়ে চাটি।

রাণুদি আমার কাঁধে একটা হাত রেখে বললেন, চলো, আমরা জলের ভেতর দিয়েই যাবো কিন্তু।

রাণুদি আমাকে ছোট ভাইয়ের মতন ভেবে কাঁধে হাত রাখলেন খুব অনায়াসে। কিন্তু উনি জানেন না যে, যেখানে ওঁর হাতটা ছুঁয়েছে, আমার কাঁধের সেই জায়গাটা সঙ্গে সঙ্গে গরম হয়ে উঠলো। আমি রাণুদির শরীরের গন্ধ পাচ্ছি। আমার দুর্দান্ত ইচ্ছে করছে, রাণুদির বুখে আমার মাথাটা পাগলের মতন ঘষি।

কিন্তু আমাদের নদী উৎস বা মোহনা দেখতে যাওয়া হলো না। দূরে দেখলাম, সঞ্জয় আর অভিজিৎ ছুটে আসছে।

ওরা কোনো খবর আনছে ভেবে আমি থমকে দাঁড়ালাম। না, কোনো খবর নেই, অনেকক্ষণ ব্যাডমিন্টন খেলার পর হঠাৎ কর্তব্যবোধ জেগে উঠেছে ওদের।

রাণুদি বললেন, না, এখন যাবো না। তোরা যা।

ওরা দু’জনেই জলের মধ্যে নেমে এলো। সঞ্জয় বললো, এই নীলুদা, মা কিন্তু রাগ করবে!

আমি বললাম, রাণুদি, তা হলে আজ বাড়ি চলুন।

–না।

রাণুদি একা একাই এগিয়ে গেলেন খানিকটা। অভিজিৎ আর সঞ্জয় দু’জনে দু’দিক থেকে রাণুদিকে হাত চেপে ধরে বললো, এই দিদি!

–বলছি না যাবে না!

রাণুদি ওদের এমন জোরে ঠেলে দিলেন যে বেচারা দু’জন জ্বলে পড়ে জামা-প্যান্ট ভিজিয়ে ফেললো।

রাণুদির চোখ বিস্ফারিত, শরীরটা শক্ত হয়ে গেছে। অসম্ভব রাগীভাবে তাকালেন আমার দিকে। আমি রানুদিকে ধরতে সাহস পেলাম না।

রাণুদি আমায় জিজ্ঞেস করলেন, তুই যাবি না আমার সঙ্গে

আমি কোনো উত্তর দিলাম না।

সঞ্জয় আর অভিজিৎ জল থেকে উঠে আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাণুদির এরকম চেহারা আমি আগে দেখিনি। ওঁর পাগলামি মানে তো শুধু চুপ করে থাকা।

একটুক্ষণের মধ্যেই রাণুদি আবার সহজ হয়ে গেলেন। খুব বিস্মিতভাবে দুই ভাইকে জিজ্ঞেস করলেন, এই তোরা ভিজে গেলি কী করে?

সঞ্জয় মিনমিন করে বললো, দিদি, বাড়ি চলো।

রাণুদি বললেন, চল, বাড়ি যাচ্ছি! তোরা বড় ইয়ে, জল দেখলৈই অমনি জল ঘটতে হবে! নীলুকে দ্যাখ তো, কীরকম প্যান্ট গুটিয়ে নিয়েছে।

আমি একা স্বস্তি নিশ্বাস ফেললাম। জল থেকে ওপরে উঠে এসে রাণুদি বললেন, আমরা অনেকক্ষণ এখানে বসে আছি, তাই না? ইস, বড্ড দেরি হয়ে গেছে। চল, চল বাড়ি চল।

তারপর আমার দিকে চোখ কুঁচকে একটা ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত করে হাসিমুখে বললেন, আমরা চুপি চুপি, আর একদিন…এই নদীটা দেখতে…

তারপর কদমগাছটার কাছে এসে বললেন, আমায় এই গাছটা থেকে ফুল পেড়ে দিয়েছিলে? রোজ আমাকে কদম ফুল দেবে?

-হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।

অভিজিৎ বললো, আমিও গাছে উঠতে পারি।

রাণুদি বললেন, তুই গাছে উঠবি না। নীলু এনে দেবে, ও তোর চেয়ে বড়।

আমি বললাম, তা ছাড়া আমার এটা নিজস্ব গাছ।

রাণুদি হেসে ফেলে বললেন, তাই নাকি? ওমা, তোমার নিজস্ব গাছ আছে। আমার নেই কেন! আমার নিজস্ব কোনো জিনিসই নেই। আমার ছিল, আগে অনেক ছিল, কিন্তু সব হারিয়ে গেছে। আমার কী কী হারিয়েছে জানিস, খোকন, মিন্টু।

অভিজিৎ আর সঞ্জয় আমার দিকে তাকাল। রাণুদি মুখটা কুঁচকে ফেললেন। মনে হলো, তিনি নিজেকে সামলাবার চেষ্টা করছেন।

আমার দিকে চেয়ে আবা স্বাভাবিক গলায় জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা নীলু, সত্যি করে বলো তো, কাল রাত্তিরে যে পাথরটায় বসেছিলাম, আজ তো আবার সেই পাথরটাতেই আমি বসলাম, তাহলে আজও কি আমি কোনো পাগলামি করেছি?

–না, একটুও না।

–আমার মনে পড়ছে না। সত্যি করে বলো।

–সত্যি বলছি, আপনি খুব ভালো আছেন।

রাণুদি যেন খুব নিশ্চিন্ত হয়ে গেলেন। হাসিমুখে বললেন, তাহলে চলো।

একটুখানি গিয়ে অজিতদার সঙ্গে আমাদের দেখা হয়ে গেল। উনি বোধহয় ফিরছিলেন স্টেশন থেকে। আমাদের দেখে নিজের বাড়ির গেটের কাছে থমকে দাঁড়ালেন।

সঞ্জয় বললো, ঐ তো অজিতদা।

অজিতদা হাত তুলে নমস্কার করলেন রাণুদিকে।

রাণুদি বললেন, আমার নাম মাধুরী সেনগুপ্ত। এরা আমার ভাই। বোঝাই যাচ্ছে, কাল রাত্রে অজিতদাকে যে দেখেছেন, তা রাণুদির মনে নেই।

অজিতদাও নিজের নাম বললেন।

রাণুদি বললেন, আপনাকে আগে কোথায় দেখেছি মনে হচ্ছে।

অজিতদা মৃদু হেসে বললেন, তা হতে পারে। আপনাদের বাড়ির সামনে দিয়ে তো আমি প্রায়ই যাই।

–আপনি কি সত্যময়ের ভাই?

–না। আমার কোনো দাদা নেই। সত্যময় বলে তো কারুকে আমি চিনি না।

–আমাদের সঙ্গে সত্যময় বলে একজন পড়তো, খুব চেহারার মিল আপনার সঙ্গে। এই রকম ছোট ছোট দাড়ি…এই বাড়িটা আপনার?

–আমি এই বাড়িতে থাকি। আসুন না, ভেতরে এসে একটু বসবেন? তোমরাও এসো।

সঞ্জয় বললো, কিন্তু মা চিন্তা করবেন যে! মা বিকেলে বাড়ি ফিরতে বলেছেন।

রাণুদি বললেন হ্যাঁ, সত্যিই মা আমাকে বেশীক্ষণ থাকতে বারণ করেছেন। এমনিতেই দেরি হয়ে গেল….বাঃ আপনার বাগানে তো অনেক ফুল।

আসুন না, একটু বসে চা খেয়ে যাবেন, কতক্ষণ আর লাগবে।

সঞ্জয় বললো, আমি কাজ করি। আমি বাড়ি চলে যাচ্ছি, মাকে খবর দিয়ে দেবো।

সেটাই খুব ভালো ব্যবস্থা। সঞ্জয় দৌড়ে চলে গেল।

অজিতদা গেট খুলে দিলেন। সেখানে ঢুকতে গিয়েও শতকে দাঁড়িয়ে রাণুদি হাসতে হাসতে বললেন, আপনি জানেন, আমি পাগল?

অজিতদাও হেসে বললেন, আমি এমন ওষুধ জানি, যাতে সব পাগলামি সেরে যায়।

সেই গেট পেরিয়ে বাড়ির মধ্যে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে রাণুদির জীবনে একটা নতুন পর্ব শুরু হলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *