সতেরো বছর বয়সে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
০১.
আমার একটা নদী ছিল। আমার একটা পাহাড় ছিল। আমার একটা নিজস্ব আকাশ ছিল। তখন আমার বয়েস সতেরো।
মেয়েদের ফ্রক ছেড়ে শাড়ি পরার মতন আমারও তখন হাফ প্যান্ট ছেড়ে ফুলপ্যান্ট পরার বয়েস। আমার প্রথম ফুল প্যান্টটি ছিল ঘি রঙের ওপর খয়েরি ডোরা কাটা, হায়ার সেকেণ্ডারী পরীক্ষায় সসম্মানে থার্ড ডিভিসানে পাস করার জন্য আমার মা তার লক্ষ্মী পূজার কৌটোর জমানো পয়সা দিয়ে সেটি কিনে দিয়েছিলেন। এছাড়া দুর্গাপূজার সময় মামাবাড়ি থেকে পেয়েছিলাম একটা নীল রঙের বুশ শার্ট, এক জোড়া ছাই রঙের কেডস আমার আগে থেকেই ছিল। এইসব পরে সেজেগুজে আমাকে রীতিমত একটি শৌখিন যুবকের মতন দেখাতো। সিঁথি কাটার বদলে সেই প্রথম চুল ওল্টাতে শুরু করেছি। অবশ্য, অনেকেই তখন আমায় যুবক বলে স্বীকার করতো না, ছেলেটা, ছেলেটা বলেই উল্লেখ করতো।
আমাকে সেবার গেঞ্জি কিনে দেবার কথা মনে পড়েনি আমার মা, বাবার। একদিন দারুণ বৃষ্টি ভিজে দৌড়াতে দৌড়োতে ঢুকে পড়েছি ভাস্করদের বাড়িতে। বৈঠকখানার দরজা খুলে ভাস্কর বললো, জামাটা খুলে ফ্যাল। পাখার তলায় একটু কাঁপতে কাঁপতে বলছিলাম, ঠিক আছে, ঠিক আছে। ভাস্কর জোর করেই শেষ পর্যন্ত জামাটা গলালো। তারপর বড়দা বড়দা ভাব করে এক ধমক দিয়ে বললো, দ্যাখ সব কিছুরই সীমা আছে। তুই কি রাত্তিরের দিকে কয়লা গুদোমে কাজ করিস নাকি? খোল, শিগগির ওটাও খোল।
আমার গেঞ্জিটা ছিল সত্যিই খুব ময়লা আর পেঁজা পেঁজা, একটু টানাটানি করলেই পুরপুর করে ছিঁড়ে যায়। প্রত্যেকবার কাঁচার সময় একটু বেশী করে ঘেঁড়ে বলে আমি আর ওটা কাঁচাকাচির ঝামেলায় যেতাম না। সেটা খুলতেই ভাস্কর এক সট মেরে সেটাকে ফেলে দিল রাস্তার হাঁটু জলে। আমার কষ্ট হয়েছিল গেঞ্জিটার জন্য, প্রিয় বিচ্ছেদের মতন।
ভাস্কর ওর নিজের একটা গেঞ্জি এনে পরতে দিয়েছিল। ধপধপে ফর্সা, ধোপাবাড়িতে কাঁচা ও ইস্তিরি-করা। গেঞ্জিও যে আবার ইস্তিরি করা যায়, সেই ব্যাপারটাই আমি জানতাম না তখন।
ওঃ, সেই কৈশোর যৌবনে কী দারুণ বড়লোক ছিলাম আমি! অফুরন্ত ধন সম্পদ, কী করে খরচ করবো, তার ঠিক ছিল না। আকাশ ভেঙে বৃষ্টি পড়ছে, তখন মনে হয়, এই সব বৃষ্টি আমার, যার খুশী স্নান করে নাও। শুকনো জমিতে আর কোনো মলিন কৃষকের তো চোখের জল ফেলবার দরকার নেই, এই তো আমি বৃষ্টিজলে সব ভিজিয়ে দিচ্ছি। মধুপুরের লাল রঙের রাস্তাটা যেখানে ঢালু হয়ে নেমে গেছে নদীর দিকে, সেখানে একটা খুব বড় কদমফুলের গাছ। কদমগাছের ডাল নরম হয়, তবু আমি তরতর করে বেয়ে উঠে যেতে পারি। এত ফুল, ইচ্ছে করলে এ সবই তো আমার। গাছটার প্রায় ডগার কাছে উঠে দাঁড়িয়ে এমন একটা অদ্ভুত ভালো লাগার অনুভূতি হয়েছিল যে ভেবেছিলাম, এখন আমি অনায়াসেই এখান থেকে লাফিয়ে পড়ে মরে যেতে পারি। এমন সুখী মৃত্যু কোনো মানুষের হয় না। আবার এক একদিন রাত্তির বেলা ছাদে গিয়ে একা দাঁড়িয়ে হঠাৎ মনে হতো, বুকের মধ্যে এতখানি ভালোবাসা আছে যে দশখানা পৃথিবী ভর্তি মানুষকে সেই ভালোবাসা দিলেও ফুরোবে না।
মধুপুরে গিয়েছিলাম ভাস্করদের সঙ্গে। আমার জীবনের প্রথম ফুলপ্যান্ট ও বুশ শার্ট পরে সেই প্রথম ভ্রমণ অভিযান। সদ্য স্কুল ছেড়ে কলেজে ঢোকার ফলে তখন আমাদের একা একা বাইরে বেড়াতে যাবার অধিকার জন্মেছে।
প্রথমে ঠিক ছিল, ওরা তিনজন যাবে, ভাস্কর, আশু আর উৎপল। ভাস্করের এক আত্মীয়ের একটা বাড়ি মধুপুরে এমনিই একলা একলা খালি পড়ে থাকে। সুতরাং থাকার জায়গা সম্পর্কে নিশ্চিন্ত, এবং ওটুকু হলেই বাবা মা’দের সহজে রাজি করানো যায়। কিন্তু তিনজনে বাইরে বেড়াতে যাবার নানান অসুবিধে। সাইকেল রিকশা ভাড়া নিতে হয় দুটো, এর মধ্যে কে একটাতে একা চড়বে, তা নিয়ে গণ্ডগোল হয়। ক্যারাম কিংবা তাস তিনজনে খেলা যায় না। তাছাড়াও তিনজন একসঙ্গে থাকলে হঠাৎ হঠাৎ ঝগড়া বেধে যায়। এটা আমরা একবার ডায়মণ্ডহারবার বেড়াতে গিয়েই বুঝেছি। সেইজন্যই ভাস্কর আমায় বললো, নীলু, তুই শুধু ট্রেন ভাড়াটার ব্যবস্থা কর, তাহলেই তোকে আমরা নিয়ে যেতে পারি।
মধুপুরের ট্রেন ভাড়া তখন যাওয়া আসা চোদ্দ টাকা আমি তার চেয়ে অনেক বেশী, তেইশ টাকা যোগাড় করে ফেললাম। বলেছি না, অভাব কাকে বলে তাইই জানতাম না সেই সময়। মার কাছ থেকে তিন টাকা, কাকার কাছ থেকে তিন টাকা, বড় মামার কাছ থেকে পাঁচ টাকা, আমার তিন কলেজে পড়া মাসী–প্রত্যেকের কাছ থেকে দু’টাকা করে এর মধ্যে সবচেয়ে ছোট ঝুনু মাসীই আপত্তি তুলেছিল খানিকটা, তবু শেষ পর্যন্ত দিয়ে দেয়, এছাড়া স্কুলের জ্যামিতি বাক্সটা বিক্রি করে এক টাকা, আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পাওয়া মেডেলটা বেচে আড়াই টাকা, পর পর দু’সপ্তাহের রেশন তোলবার সময় একটু বেশী ঝুঁকি নিয়ে মোট এক টাকা বারো আনা করে সরিয়ে ফেলা, এইরকমভাবে আরও উঠতে পারতো, কিন্তু যথেষ্ট হয়েছে ভেবে থেমে গেলাম। দাদার কাছ থেকে টাকা চাইনি, চাইলেও পেতাম না, তবে দাদাকে ধরেছিলাম বাবার কাছ থেকে অনুমতিটা আদায় করে দেবার জন্য। অম্লানমুখে মিথ্যে কথা বলার দাদার জুড়ি নেই।
রাত্তিরবেলা বাবার সঙ্গে দাদার কথা হয়, আমি ঘুমের ভান করে ঘাপটি মেরে পড়ে থাকি।
বাবা জিজ্ঞেস করলেন, কার সঙ্গে যাবে?
দাদা বললো, ভাস্করদের হোল ফ্যামিলি যাচ্ছেন। ভাস্করের বাবা আমাকে বললেন, ওদের তো ফার্স্ট ইয়ারের পরীক্ষা হয়ে গেছে, এমনিতেই এখন পড়াশুনা করবে না, সেই জন্যই নিয়ে যাচ্ছি বাইরে।
বাবা বললেন, আমার এখন হাত খালি, টাকা পয়সা দেওয়া আমার পক্ষে এখন সম্ভব নয়।
দাদা বললো, মেসোমশাই তো টাকা পয়সা কিছুতেই দিতে দেবেন না। উনি বললেন, নীলু আমার ছেলের মতন, ওর জন্য আবার টাকা পয়সা কী লাগবে? তাও আমি জোর করে ট্রেনের রিটনি টিকিট কেটে দিতে চেয়েছি আমার টিউশানির টাকা থেকে, তাছাড়াও আরও দশটা টাকা দিতে পারি হাত খরচ হিসেবে।
বাবা বললেন, কিন্তু নীলু সাঁতার জানে না, ওকে কি একা একা বাইরে পাঠানো উচিত?
দাদা বললো, মধুপুরে তো পুকুর-টুকুর বিশেষ নেই। শুকনো জায়গা। যদি পুরী যেত, তাহলে না হয় ভয় ছিল। নীলুর প্রায়ই জ্বর হয়, মধুপুরের জল হাওয়া ভালো। আমার মনে হয় কিছুদিন থেকে এলে ওর ভালোই হবে। এমনিতে তো সহজে সুযোগ পাওয়া যায় না।
বাবা তখন জিজ্ঞেস করলেন মায়ের মতামত। মা বললেন, সে তোমরা যা ভালো বুঝবে। বাবা একবার আমার নকল ঘুমন্ত মুখের দিকে চাইলেন।
শেষ পর্যন্ত দাদাকে বাবা বললেন, ওকে তিন চারখানা পোস্ট কার্ড কিনে দিস। গিয়ে যেন নিয়মিত চিঠি লেখে।
সে কথা শুনে আমি বড় বড় নিশ্বাস ফেলতে লাগলুম।
পরদিন সকালে দাদা আমায় জিজ্ঞেস করলো, আমি যে তোর পারমিশান আদায় করে দিলুম, তার বদলে তুই আমায় কি দিবি?
আমি দাদাকে বলতে পারতাম, তুমি কি চাও, বলো? তুমি তৈমুরলঙের পুরো সাম্রাজ্যটা চাও, আমি তোমায় লিখে দিতে পারি। তুমি ট্রেজার আয়লারে গুপ্তধন নেবে? কিংবা আকাশের একটা জলভরা মেঘ?
তার বদলে দাদা অতি সামান্য জিনিস চাইলো। সে বললো, ফিরে এসে টানা তিন মাস তুই আমার গেঞ্জি-আণ্ডারওয়্যার কেচে দিবি!
আমি একবাক্যে মেনে নিলাম। আমাদের বাড়িতে প্রত্যেকের জামা কাপড় কাঁচা নিজের নিজের। আমার মায়ের তখন স্বাস্থ্য খারাপ ছিল।
ট্রেনে আমরা চারজন সদ্য যুবক সম্পূর্ণ স্বাধীন। আমাদের শাসন করবার কেউ নেই। যে-কোনো স্টেশনে ট্রেন থামলে আমরা ইচ্ছে করলেই প্ল্যাটফর্মে নেমে একটু ঘোরাঘুরি করতে পারি। কালি ছোলা আর আদা কিংবা ঝালমৃড়ি কিংবা গুলাবি রেউড়ি যত খুশী কিনে খেতে পারি। ভাস্কর এক একটা স্টেশনে নামে আর সিটি দিয়ে ট্রেন ছাড়বার পর দৌড়ে লাফিয়ে কায়দা করে ওঠে।
সহযাত্রীদের মধ্যে কয়েকজন উপযাচক হয়ে আমাদের অভিবাবক সাজতে চায়। তারা উপদেশ দেয়, ও ভাই, খোলা দরজার পাশে দাঁড়িয়ো না, ও খোকা জানলা দিয়ে অতখানি মাথা ঝুঁকিও না! আমরা এসবে অবশ্য কর্ণপাতও করি না। যতই অন্যরা আমাদের খোকা, ছেলেটা বা ভাই বলে সম্বোধন করুক, আমরা নিজেদের যুবক বলেই দাবি করতে পারি অনায়াসে। চাণক্য শ্লোকে পড়েছি, প্রাপ্তেতু ষোড়শ বর্ষে পুত্রমিত্র বদাচরেৎ। বদাচরেৎ মানে বদ ব্যবহার নয়। মিত্রবৎ অর্থাৎ ষোলো বছর বয়েস হয়ে গেলে ছেলের সঙ্গে বন্ধুর মতন ব্যবহার করবে। থার্ড ডিভিশন পেলে কী হয়, আমি সংস্কৃত বেশ ভালো জানি। ট্রেনের লোকগুলো নিশ্চয়ই চাণক্য শ্লোক পড়েনি।
শক্তিগড় স্টেশনে আমি নেমে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়েছিলাম। এবার আমার পালা। দৌড়ে চলন্ত ট্রেনে ওঠার প্রতিযোগিতায় আমিই বা ওদের কাছে হেরে যাবো কেন? তেমন কোনো তেষ্টা না পেলেও আমরা চার ভড় চা খেয়ে নিলাম। তারপর বাড়গুলো একটা ল্যাম্প পোস্টের দিকে টিপ করে করে ছোঁড়া হলো, আশু চাড়া লাগাতে পারলো না কেউই।
আমি ট্রেনের গায়ে এক হাতের হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি বাইরে। ট্রেন ছাড়তে একটু দেরি হলেই বড় উতলা লাগে। কতক্ষণে মধুপুরে পৌঁছাবো? হঠাৎ হঠাৎ মনে হচ্ছে, মাঝরাস্তায় যেন কোনোক্রমে আমাদের যাওয়া বন্ধ হয়ে যেতে পারে। যদি কেউ বলে ওঠে, এ ট্রেন আর এগোবে না, আবার ফিরে যাবে হাওড়ায়? কোনোক্রমে একবার মধুপুর পর্যন্ত যেতে পারলে হয়।
পচাৎ করে একজন পানের পিক ফেললো জানলা দিয়ে, একেবারে আমার প্যান্টের ওপরে। ঠিক যেন খুন খারাবি রং। আমি শিউরে উঠলাম। আমার একমাত্র ফুল প্যান্ট। এখন আমি কি করবো? আমার সঙ্গে আর দুটো পা জামা, একটা হাফ প্যান্ট আর দুটো শার্ট আছে। বাইরে বেরুবার সময় সবসময় এই ফুল ফ্যান্টটা দিয়েই চালাবো ভেবেছিলাম। আমি জানলায় সেই লোকটির কাৎলা মাছের মতন মুখখানার দিকে তাকিয়ে রইলাম স্তম্ভিত হয়ে।
আমি দৌড়ে গিয়ে টিউবওয়েলটায় সবেমাত্র হাত দিয়েছি, অমনি বেজে উঠলো ট্রেনের সিটি। তিনবন্ধু সমস্বরে চেঁচাতে লাগলো আমার নাম ধরে। আমি দু’এক মুহূর্তের জন্য ভ্যাবাচাকা খেয়ে আবার ছুটলাম পেছন ফিরে। জীবনে অত জোরে আগে ছুটিনি! আমিও ছুটছি, ওরাও চাচাচ্ছে। ওরা বলতে চাইছে, যে-কোনো কামরায় উঠে পড়তে। কিন্তু সে কথা আমার মাথায় ঢুকছে না। বন্ধুদের মধ্যে চলন্ত ট্রেনে ওঠার প্রতিযোগিতায় আমি অনিচ্ছাকৃতভাবে ফার্স্ট হয়ে লাফিয়ে পড়লাম নিজেদের কামরার মধ্যে। ততক্ষণে আমার কান্না পেয়ে গেছে।
আশু, উৎপল, ভাস্কর সেই পিক-ফেলা লোকটাকে বকুনি দিতে লাগলো দারুণভাবে। আরও অনেক লোক লাগছিল আমাদের দিকে। কিছু লোক হাসতে লাগলো।
সেই লোকটি বোধহয় একবর্ণও বাংলা বোঝে না। ফ্যালফ্যাল করে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো। যদিও তার গোল কালো এবং বড় আকৃতির কাৎলা মাছের মতন মুখ ঠিকই, তবু এরকম মুখেও সরল অসহায়তা ফুটে ওঠে। যাই হোক, পানের পিক গায়ে ফেলার জন্য তো একটা লোককে মারা যায় না, বড় জোর পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়া যেতে পারে, যেখানে পান খাওয়া নিষিদ্ধ।
লোকটিকে প্রচুর বকুনি দিয়ে গায়ের ঝাল মিটিয়ে নেবার পর ভাস্কর বললো, নীলু প্যান্টটা খুলে ফ্যাল!
ভাস্করের কথা শুনে আমার রাগ ধরে। যখন তখন যেখানে সেখানে প্যান্ট বা শার্ট খুলে ফেলা যায় নাকি?
আমি জেদের সঙ্গে বললাম, না। আশু বললো, এক্ষুনি ধুয়ে না ফেললে কিন্তু ঐ দাগ আর উঠবে না।
আমার ঘি রঙের প্যান্টে সেই টকটকে লাল পানের পিক একেবারে গাঢ় হয়ে মিশে গেছে। ও আর উঠবে না আমি বুঝেছি। এইটুকু অভিমান নিয়ে আমি বললাম, উঠবে না তো উঠবে না, আমি এটাই পরে থাকবো।
উৎপল বললো, প্যান্টটা খুলে ফেলে শিগগির বাথরুমে নিয়ে গিয়ে ভিজিয়ে দে। তোর ঘেন্না করছে না?
ভাস্কর বললো, কেন পাগলামি করছিস। নিচে আণ্ডার প্যান্ট পরিস নি? প্যান্টটা খুলে ফ্যাল।
–বলছি তো খুলবো না।
তখন তিনবন্ধু চেপে ধরলো আমাকে। যেন ওরা মজা পেয়েছে, কামরার অন্য লোকরা আরও বেশী মজা পেয়ে হাসতে লাগলো। ভাস্কর আমার কোমরে সুড়সুড়ি দিতে বলতে লাগলো, খোল, শিগগির খোল।
আমার জীবনের প্রথম ভ্রমণযাত্রাটি কি সুন্দর হতে পারতো না? এত লোক থাকতে শুধু আমার প্যান্টেই কেন দাগ লাগবে? এত লোকজনের সামনে প্যান্ট খুলে ফেলার চেয়ে. মরে যাওয়া ভালো নয়?
কোনোক্রমে ওদের হাত ছাড়িয়ে আমি ছুটে গেলাম বাথরুমের দিকে।
আমি যে মধুপুরের কথা লিখবো, সেরকম মধুপুর পৃথিবীতে এখন আর কোথাও নেই। সেইরকম মধুপুর মাত্র কয়েক বছরের জন্য থাকে আবার উধাও হয়ে যায়। আমি শত চেষ্টা করলেও সেই মধুপুরে এখন আর যেতে পারবো না। শুধু সতেরো বছর বয়েসেই সেই মধুপুর আমাদের জন্য অপেক্ষা করে থাকে।
আমাদের বাড়িটা ছিল টুকটুকে লাল রঙের। সেই একরকম বাড়ি থাকে, বাইরের দেয়ালে প্রাস্টার থাকে না, ইটের ওপরই রং করা, প্রতিটি ইট বেশ স্পষ্ট দেখা যায়। বাড়িটা দোতলা, সামনে একটি বড় গাড়ি বারান্দা। আসলে চতুর্দিকে দেয়াল ঘেরা একটি প্রকাণ্ড বাগানের মধ্যে বাড়িটা বসানো। রেল স্টেশন থেকে সাড়ে তিন মাইল দূরে।
ভাবা যায় কি, গোটা একটা বাড়ি শুধু আমাদের? একতলায় চারখানা ঘর, দোতলায় চারখানা। তার মধ্যে শুধু দোতলার একটি ঘরের চাবি আমাদের দেওয়া হয়নি। সে ঘরে কী আছে আমরা জানি না। আমাদের চারজনের যদিও একটা মাত্র ঘরই যথেষ্ট।
বাডিটি পাহারা দেয় একজন সাঁওতাল। এখানকার বাগানের ফল ফুল সে-ই ফলায়, সে-ই বিক্রি করে। সে বাবুদের কাছ থেকে আগেই চিঠি পেয়েছে, সুতরাং আমাদের দেখে খাতির করে গেট খুলে দিল। সে লেখাপড়া জানে না, চিঠি পেলে অন্য লোকের কাছে গিয়ে পড়িয়ে নেয়। কুচকুচে কালো, রীতিমতন লম্বা ও বলশালী এই মানুষটির নাম পরী। এরকম একজন পুরুষের নাম পরী হতে পারে? নাম শুনেই আমরা হেসে উঠি এবং বারবার ওকে ওর পুরো নাম জিজ্ঞেস করি। ও নিজেও হাসে। পরী ছাড়া ওর অন্য নাম নেই। ওর পদবী মাঝি। পরী কথাটা যে কিসের অপভ্রংশ তা আমরা কিছুতেই বার করতে পারি না। আরও আশ্চর্যের ব্যাপার, সাঁওতালরা কেউ কখনো নৌকো চালায় না, এদিকে তার সুযোগই নেই, তবু ওদের অনেকের পদবী মাঝি হয়।
ওর পরী নামটা শুনে প্রথমে যতই অদ্ভুত লাগুক, দু’তিন দিন ঐ নামে ওকে ডাকতে ডাকতে তারপর সেটা খুব স্বাভাবিক হয়ে যায়। তখন পরী বললে আর ডানা লাগানো মেয়ের ছবি চোখে ভেসে ওঠে না, ঐ শক্ত সবল, কালো লোকটিকেই মনে পড়ে।
মানুষের যেটুকু শুধু প্রয়োজন, তার থেকে অতিরিক্ত কিছু পেলেই মনটা অন্যরকম হয়ে যায়। কলকাতায় আমাদের ছোট ছোট বাড়িতে ঠাসাঠাসি করে থাকতে হয়, মধুপুরে আমাদের চারজনের জন্য গোটা একটা বাড়ির সাতখানা ঘর, অতবড় বাগান, তারপরেও দিগন্ত জোড়া মাঠ ও সীমাহীন আকাশ, এসব পেয়ে আমরা যেন সম্পূর্ণ বদলে গেলাম। আমরা প্রত্যেকেই যেন এক একজন রাজপুত্র।
কোনো নির্বাচনের প্রয়োজন হলো না, ভাস্কর নিজে থেকেই আমাদের দলের নেতা হয়ে গেল। তার কারণ, আমরা চারজনে মিলে যদি এক সঙ্গে চাচাতে শুরু করি, তাহলে ভাস্করই শেষ পর্যন্ত জিতবে, ওর গলার জোর সবচেয়ে বেশী। চারজনেই আমরা সমবয়েসী হলেও আশু একটু বেশী লম্বা, কিন্তু তার ভালোমানুষ-স্বভাবের জন্য দলের নেতৃত্বটা সে বিনা দ্বিধায় ভাস্করকে ছেড়ে দিল। উৎপলের বুদ্ধি অত্যন্ত তীক্ষ্ণ তাই সে স্বেচ্ছায় নিয়ে নিল বিরোধী পক্ষের নেতার ভূমিকা। আমি এলেবেলে।
ভাস্কর তক্ষুনি চাল, ডাল, মুর্গী, আলু-পেঁয়াজ, তেল, মশলা আনবার জন্য টাকা দিয়ে দিল। বাড়িটার পেছন দিকে একটা টালির ঘরে পরীর স্ত্রী আর ছেলে মেয়েরা থাকে, তারাই রান্না করে দেবে। ভাস্কর নিজে এসেছে প্রচুর বিস্কুট, কণ্ডেসড মিল্ক আর চায়ের প্যাকেট নিয়ে, সুতরাং আমাদের খাওয়া-দাওয়ার কোনো ভাবনা নেই।
জিনিসপত্র নামিয়ে রেখেই আমি বাগানটা দেখতে বেরিয়ে পড়লাম। এক সময় অনেক ভাল ফুল গাছ ছিল বোঝা যায়, কিন্তু সেগুলির তেমন যত্ন নেই। আর রয়েছে প্রচুর আতা আর পেয়ারা গাছ। আতা গাছের প্রায় জঙ্গলই বলা যায়। একটা চমৎকার বুনো গন্ধ, যেমনন্ধ কলকাতায় কেউ কখনোপায় না। পাঁচিলের ধার ঘেঁষে অযত্নে ফুটে থাকা অসংখ্য বনতুলসী। একটা এগিয়ে আমি দেখতে পেলাম পরপর দুটি সফেদা গাছ। তাতে সফেদা ফলে আছে পর্যন্ত। তার একটি গাছে বসে আছে একটি চকলেট রঙের বড় ল্যাজ-ঝোলা পাখি। সেই পাখিটা একমনে আমাকে দেখছে।
এই পাখিটাকে আমি চিনি। দমদমে আমাদের মামা বাড়ির অতিথি আসে। এখানে তো আমরাই অতিথি। এই ইষ্টকুটুম পাখিটা নিশ্চয়ই আমাদেরই স্বগতম জানাবার জন্য এখানে বসে আছে।
আমি জিজ্ঞেস করলুম, কেমন আছো?
পাখিটা ডানা ঝটপটিয়ে উড়ে গেল। আমরা যে এসেছি, সেটা দেখে যাওয়াই যেন ওর কাজ ছিল।
আর একটুখানি এগিয়ে আমি আর একটা জিনিস আবিষ্কার করে ফেললুম। এই বাগানের মধ্যে একটা পুকুরও রয়েছে। পুকুরটা বেশী বড় নয়। কিন্তু বেশগভীর বলেই মনে হয়, জলের রং কালচে ধরনের,মাঝখানে ফুটে আছে কয়েকটা লাল রঙের শালুক। আর তখন আমি শালুক পদ্মের খুব একটা তফাত জানতুম না। তাই প্রথমে পদ্মই ভেবেছিলাম, পরে উৎপল আমার ভুল ভাঙিয়ে দেয়।
দাদা বলেছিল, মধুপুরে জলের ভয় নেই, সে কথা সত্যি নয়। এই তো আমাদের বাড়ির সঙ্গেই একটা পুকুর। কিন্তু আমার একটুও ভয় করলো না, পুকুরটা দেখেই আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। এবং তক্ষুনি মনে মনে সেটাকে ‘আমার পুকুর’ বলে ঘোষণা করে দিলাম। যা কিছু সুন্দর দেখি, সবই আমার একেবারে নিজস্ব করে নিতে ইচ্ছে করে।
পুকুরটার একপাশে একটা পাথর বাঁধানো ঘাট রয়েছে। এমন নির্জন ছিমছাম পুকুরটা দেখলে অনেকক্ষণ এরপাশে বসে থাকতে ইচ্ছে হয়। আমি ঘাট দিয়ে জলের কাছে নেমে একটু জল ছুঁলাম। দারুণ ঠাণ্ডা। আমার ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস পড়লো। ভাস্কর আর উৎপল ভালোই সাঁতার জানে। আশুও জানে বোধহয় এরা নিশ্চয়ই আমার এই পুকুরে নেমে দারুণ দাপাপাপি করবে। যাক, আমিও এখানেই চট করে সাঁতার শিখে নেবো।
এবার পুকুরটার চারপাশ একবার ঘুরে দেখলেই বাগানটা দেখা সম্পূর্ণ হয়। যিনি এই বাড়িটা প্রথম বানিয়েছিলেন, তিনি খুব শৌখিন মানুষ ছিলেন নিশ্চয়ই। বাগানের মাঝে মাঝেই রয়েছে সাদা পাথরের বেঞ্চ, তার দু’একটা ভেঙে গেলেও কয়েকটা এখনো আস্ত আছে। কারুর যদি ইচ্ছে হয় এই বাগানে খানিকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার, সেই জন্যই বুঝি ঐ বেঞ্চের ঠিক ওপারেই একটা পেয়ারা গাছের ডাল ঝুঁকে আছে, ওর ওপর উঠে দাঁড়ালেই হাত বাড়িয়ে পেয়ারা পাড়া যায়। দেখা রইলো এখন থাক। প্রত্যেকটা বেঞ্চ আমি হাত দিয়ে একবার ছুঁয়ে গেলাম, কোনো কারণ নেই, এমনিই।
বেলা প্রায় একটা বাজে, মাথার ওপর ঝকঝকে রোদ। নতুন জায়গায় এলেই দারুণ খিদে পায়। পরী চাল ডাল কিনে এনে রান্না চাপাতে কত দেরি করবে কে জানে। ঐ পেয়ারাগুলোরই সদ্ব্যবহার করতে হবে। তার আগেই বাগানের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত ছুঁয়ে না এলে বন্ধুদের আগেই পুরো বাগানটা আমার হবে না যে।
বাগানের চারদিকের যে পাঁচিল, তার একটা জায়গা ভাঙা মনে হয়,বাইরের লোকেরা কেউ ইচ্ছে করে ঐ জায়গাটা ভেঙে বাগানের মধ্য দিয়ে যাতায়াতের একটা রাস্তা বানিয়েছে।
সেই ভাঙা জায়গাটা দিয়ে আমি একটু বাইরে উঁকি দিয়েই দারুণ চমকে উঠলাম। আমার বুক কাঁপতে লাগলো।
বাইরেটা ফাঁকা মাঠের মতন, এখানে সেখানে দু’একটা ছাড়া ছাড়া গাছ। সেই রকম একটা বড় গাছে হেলান দিয়ে একজন মহিলা দাঁড়িয়ে রয়েছেন। অসম্ভব ফর্সা গায়ের রং, খোলা চুল পিঠে ছড়ানো, একটা হলুদ শাড়ি পরা,লাল রঙের ব্লাউজ, বয়েস চব্বিশ-পঁচিশ মনে হয়, এই আমার বড় মাসী অর্থাৎ রাণু মাসীর সমানই হবেন বোধহয়। এরকম একজন মহিলাকে দেখে আমি ভয় পাবো কেন? তবু ভয় করতে লাগলো। ফাঁকা মাঠের মধ্যে এরকম দুপুরবেলা একজন মহিলা একটা গাছে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, এতে ভয় পাবার কিছু না থাকলেও ওঁর চোখের দৃষ্টি দেখেই ছমছমিয়ে উঠেছিল আমার গা। উনি এক দৃষ্টিতে এদিকেই চেয়ে আছেন, আমাকে দেখতে পেয়েছেন নিশ্চয়ই, অথচ আমাকে দেখতে পাবার কোনো ভাবই ওঁর মুখে ফোটে নি। হঠাৎ কারুকে দেখতে পেলে কেউ ওরকম এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকে না, মনে হয় যেন ঐ মহিলার দৃষ্টি আমার শরীর ফুড়ে যাচ্ছে।
আমি বলবার চেষ্টা করলুম, কে? কিন্তু বলতে পারলুম না। আমার মনে হলো, এই দুপুরবেলা…..ইনি বোধহয় মানুষ নন….
পেছন ফিরেই আমি একটা দৌড় লাগালাম। বাগানের গাছপালা ভেঙে এক ছুটে সোজা বাড়ি।
.
০২.
বিকেলবেলা আমরা বেরুলুম মধুপুর পরিদর্শন। খেতে খেতেই আমাদের চারটে হয়ে গিয়েছিল, তারপর ঘণ্টাখানেক শুয়ে শুয়ে গুলতানি করে কেটেছে। কী অসম্ভব ভালো মুর্গীর ঝোল বেঁধেছিল পরীর বৌ। ডাল, ভাত,আলু সেদ্ধ ঘি আর মুর্গীর মাংস। আমরা কেউই আগে কখনো এতখানি ভাত খাইনি। এখন থেকে প্রত্যেক দু’বেলা আমরা কী খাবো, তা আমরা নিজেরাই ঠিক করবো! বাড়ির মতন নয় যে হঠাৎ খেতে বসে দেখবো ট্যাংরা মাছের ঝোল!
মধুপুর শহরে দোকানপাট যা কিছু সব স্টেশনের ধারেই। আসবার সময় আমরা দেখে এসেছি। সেদিকে আর যাবার ইচ্ছে নেই। বাগানটা ঘুরে বাড়ির পিছন দিকের মাঠেই ঘুরে আসার ইচ্ছে প্রকাশ করলো বন্ধুরা। পাথরের বেঞ্চটায় উঠে কয়েকটা পেয়ারা পেড়ে নেওয়া হলো তার আগে। এই পেয়ারাগুলোর জাতই আলাদা, ভেতরটা লাল।
বাগানের বাইরে এসে আমি সেই বড় গাছটার দিকে আড়চোখে তাকালাম। এখন সেখানে কেউ নেই। আমি লজ্জা বোধ করলুম। আমার কি চোখের ভুল হয়েছিল? না, না, তা হতেই পারে না, আমি কলকাতার রাস্তায় প্রায় এক মাইল দূর থেকে বাসের নম্বর পড়ে ফেলতে পারি। কিন্তু দিনের বেলা একজন মহিলাকে দেখে ভয় পেলাম? ছি, ছি, আমি এমনিতেই ভুতের ভয় পাই না কখনো। বন্ধুদের কাছে কথাটা বলতে গিয়েও চেপে গেছি শেষ পর্যন্ত। ওরা শুনলে আর আমার রক্ষে রাখতো না।
কিন্তু কাছাকাছি কোনো বাড়ি নেই, দুপুরবেলা একজন ভদ্রমহিলা ওখানে একা দাঁড়িয়ে কী করছিলেন? কোথা থেকেই বা এলেন। আমি বাজি রেখে বলতে পারি, ভদ্রমহিলার চোখের দৃষ্টিতে অস্বাভাবিক কিছু একটা ছিল।
দূরে ছোট ছোট দু একটা পাহাড়ের রেখাচিত্র দেখা যায় আকাশের গায়ে। আমি বন্ধুদের বললাম, চল ওর একটা পাহাড় থেকে ঘুরে আসি।
উৎপল হেসে বললো, ওখানে যেতে আসতে কতক্ষণ লাগবে জানিস? পুরো চব্বিশ ঘন্টা। অথবা তার বেশীও হতে পারে। পাহাড়গুলো দেখে মনে হয় কাছে, কিন্তু আসলে–
ভাস্কর বললো, গত বছর আমরা দার্জিলিং-এ গিয়েছিলাম। তখনও উৎপল ভেবেছিল আমরা পাহাড়ে আসিনি। কারণ ওর মতে সব পাহাড়ই দূরে।
উৎপল বললো, ঐ পাহাড়গুলো কত দূরে তুই বলতে চাস? ভাস্কর বললো, বড় জোর এক ঘণ্টা!
উৎপল বললো, তোর মাথা খারাপ। আমি বাজি ফেলে বলতে পারি। ভাস্কর সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করলো, কত বাজি? আশু বললো, তার আগে ঠিক হয়ে যাক হেঁটে না দৌড়ে।
ভাস্কর তক্ষুনি স্টার্ট করতে চাইছিল, কিন্তু আশু বললো যে, ঐ ব্যাপারটা কাল সকালে করলেই ভালো হয়, কারণ আজ একটু বাদেই সন্ধে হয়ে যাবে, তখন পাহাড়ে গিয়েও কোনো লাভ নেই।
আমরা এমনিই হাঁটতে লাগলাম সামনের দিকে। এর মধ্যেই সামনে যতদূর দেখা যায় আকাশটা হলিউডের ওয়েস্টার্ন ছবির আকাশের মতন লাল টকটকে হয়ে গেছে।
খানিকটা দূরে গিয়েই দেখি একটা সরু পাতলা নদী, আর তার ধারে দাঁড়িয়ে দুটি ছেলে রিং নিয়ে খেলছে। দুটি ছেলেই আমাদের চেয়ে ছোট, তেরো থেকে পনেরোর মধ্যে বয়েস, নিশ্চয়ই স্কুলে পড়ে। আমার স্কুলের ছেলেদের একেবারেই দুগ্ধ পোষ্য নাবালক মনে করি।
ভাস্কর সাঁ করে দৌড়ে গিয়ে রিংটা ধরেই ছুঁড়ে দিল ওপরের দিকে। এত জোরে যে মনে হলো সেটা আকাশেই মিলিয়ে যাবে। সেটা নিচের দিকে নামতেই আশু সেটা লুফে নিল, আর সঙ্গে সঙ্গে ছুঁড়ে দিল আমার দিকে। আমার চারজন অনেক দূরে ছড়িয়ে পড়লাম। ফটাফট করে রিং ছোঁড়াছুড়ি হতে লাগলো, ছেলে দুটি দাঁড়িয়ে রইলো অবাক হয়ে। তারা এত জোরে রিং খেলা তার আগে দেখেনি।
নদীটায় জল বেশী নেই, ভাস্কর ছপছপিয়ে ওপারে চলে গিয়ে বললো, এদিকে দে, এদিকে।
আমি একবার রিংটা হাতে পেয়ে সেই ছেলে দুটির দিকে দিয়ে বললাম, নাও, ধরো।
ওরা ধরতে পারলো না, রিংটা গড়িয়ে গিয়ে পড়লো নদীতে। আশু সেটা কুড়িয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, তোমাদের নাম কী ভাই?
ছেলে দুটির নাম অভিজিৎ আর সঞ্জয়। ওরাও এসেছে কলকাতা থেকে, হেয়ার স্কুলে পড়ে। ওদের বাড়ি কোথায় জিজ্ঞেস করতেই ওরা পেছন দিকে দেখিয়ে বললো, এই তো।
আমরা অবাক। সেখানে কোনো বাড়ি আছে বোঝাই যায় না, সেদিকে রীতিমতন বড় বড় গাছের একটি জঙ্গল। আসলে সেটিও একটি বাগান এবং তার ভেতরের বাড়িটি একতলা বলে বাইরে থেকে দেখা যায় না।
অভিজিৎ আর সঞ্জয় এখানে এসেছে দশ দিন আগে। ওরা দেওঘর পর্যন্ত ঘুরেও এসেছে।
এই সব জায়গায় লোকে বেড়াতে আসে সাধারণত বিশেষ সীজনে।
পুজোর কিছু আগে থেকে শুরু হয় সেই সীজন, তারপর সারা শীতকালটা চলে। আনাজ জিনিসপত্র নাকি খুব সস্তা থাকে এখানে এবং জলের এমন গুণ যে পাথর খেলেও হজম হয়ে যায়। আমরা এসেছি ঘোর বর্ষায়। আমাদের ফার্স্ট ইয়ারের পরীক্ষা হয়ে গেছে, কলেজে বি এ পরীক্ষার সীট পড়েছে বলে আমাদের এমনিতেই ছুটি। কিন্তু স্কুলগুলো তো এখন বন্ধ নয়। স্কুল নষ্ট করে অভিজিৎ সঞ্জয় এখানে বেড়াতে এসেছে। কেন? সে কথা জিজ্ঞেস করা যায় না।
ছেলে দুটির নিয়ে আমরা কিছুক্ষণ বেড়ালুম। একটু বাদেই ঝুপঝুপ করে অন্ধকার নেমে এলো। আমাদের কারুর কাছেই টর্চ নেই। আকাশে পাতলা পাতলা মেঘ, চাঁদের কোনো চিহ্ন নেই।
অভিজিৎ বললো, এখানে কিন্তু সাপ আছে।
সঞ্জয় বললো, আমাদের বাগানে একটা বড় সাপ বেরিয়েছেল পরশুদিন!
সাপের কথা শুনেই আমার পা সুলসুল করে উঠলো। সাপ জিনিসটা আমি একদম পছন্দ করি না। তার চেয়ে বাঘ, সিংহ অনেক ভালো।
ভাস্করও বললো, চল, ফেরা যাক।
অন্য কেউই আপত্তি করলো না।
ফেরার পথে আমরা ছেলে দুটিকে ওদের বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে দিয়ে এলাম। বাড়িটার ভেতরে ঝনঝন করে পুজোর ঘণ্টা বাজছে। ছেলেদুটি জানালো যে ঐ বাড়ির মধ্যে একটা কালী মন্দির আছে, রোজ সেখানে পুজো হয়। আমাদের ওরা ভেতরে যেতে বললো, কিন্তু আমরা রাজি হলাম।
অভিজিৎ বললো আপনারা ক্যারাম খেলতে জানেন? আমাদের বাড়িতে ক্যারাম বোর্ড আছে।
উৎপল ক্যারামে চ্যাম্পিয়ন। একবার স্ট্রাইকার হাতে পেলে সে ন’ খানা গুটি ফেরে দেয়। সে একটু অবজ্ঞার সঙ্গে বললো, কার সঙ্গে খেলবো? তোমাদের বাড়িতে কেউ ভালো খেলতে পারে?
সঞ্জয় বললো, আমরা পারি!
–ঠিক আছে, পরে একদিন এসে দেখবো তুমি কেমন খেলো!
আশু বললো, আমরা ব্যাডমিন্টনের সেট এনেছি, তোমরা যদি খেলতে চাও, কাল সকালে এসো আমাদের বাড়িতে।
ঘন গাছপালার ভেতরে বাড়িটা প্রায় অন্ধকার। এক জায়গায় মিটমিট করে একটা লণ্ঠন জ্বলছে শুধু। ছেলেদুটি সেই গাছপালার মধ্যে দিয়ে মিলিয়ে গেল।
আমাদের বাড়িতেও যে ইলেকট্রিসিটি নেই, সেটা আমরা আগে খেয়ালই করিনি। ফিরে এসে দেখি আমাদের বাড়িটাও ঘুটঘুঁটে অন্ধকার।
বাড়ির ভেতর ঢুকে আমরা পরী পরী বলে চেঁচাতে লাগলাম। পরী এলো বেশ দেরি করে। চোখ দুটো লালচে ধরনের, মুখে অদ্ভুত হাসি। হাতে একটা ছোট্ট মোম।
আমরা জিজ্ঞেস করলাম, আলো জ্বালো নি কেন?
সে সংক্ষেপে উত্তর দিল, আলো কোথায় পাবো?
–কোথায় পাবো মানে? আলো নেই?
–বাবুরা তো এধারে বিজলিবাতি আনে নি!
মধুপুর শহরে ইলেকট্রিসিটি থাকলেও এ বাড়িটা শহর থেকে বেশ দূরে। আর যেহেতু বাড়ির মালিকরা বছরে একবার মাত্র আসে কয়েক দিনের জন্য, তাই খরচ করে ইলেকট্রিক আনে নি।
দিনের বেলা পরী ছিল অতি বিনীত ও নরম প্রকৃতির। রাত্তির-বেলা সে যেন। খানিকটা বদলে গেছে। বাবু বলে আমাদের খাতির করতে চাইছে না। আমরা কি অন্ধকারে থাকবো? আমাদের জন্য যে একটা আলোর ব্যবস্থা করতে হবে, সে চিন্তাই যেন ওর মাথায় নেই।
পরপর দু’রাত্তির পরীর এই রকম ব্যবহার দেখে আমরা রহস্যটা বুঝেছিলাম। সে দিনেরবেলা এক রকম থাকে আয় রাত্তিরবেলা বদলে যায়। আসলে সন্ধে হলেই সে মহুয়া খেয়ে নেশায় টং হয়ে থাকে।
ভাস্কর একটু কড়া গলায় বললো, বিজলি বাতি নেই তো লণ্ঠন টণ্ঠন কী আছে জ্বালো?
পরী জানালো যে বড় বড় হ্যাঁজাক লণ্ঠন বাবুরা দোতলার একটা ঘরে তালা বন্ধ করে রেখে গেছে। সে ঘরের চাবি তার কাছে নেই।
–তাহলে আমরা কি অন্ধকারে থাকবো নাকি সারা রাত?
—আপনারা মোমবাতি আনেন নি?
আমরা কি কলকাতা থেকে মোমবাতি কিনে আনবো নাকি? দুপুরে যখন বাজারে যায়, তখন পরীরই আনা উচিত ছিল খেয়াল করে। রান্না ঘরে একটা মাত্র হারিকেন আছে। সেটাও পরী আমাদের দিতে পারবে না,কারণ তা হলে রান্না হবে কী করে? তার কাছে ঐ টুকরো কোনক্রমে সিঁড়ি পার হয়ে ওপরে এসে ভাস্কর আরও আশু ওদের সুটকেশ থেকে দুটো টর্চ বার করলো। তারপর ভাস্কর পরীকে একটা পাঁচ টাকার নোট দিয়ে বললো, যাও, অনেকগুলো মোমবাতি নিয়ে এসো বাজার থেকে।
পরী সেই যে গেল, রাত দশটার আগে আর ফিরলো না।
আমাদের দলের মধ্যে শুধু উৎপলের হাতেই একটা ঘড়ি আছে। ওটা ওর নিজের। দলের নেতা হিসেবে ভাস্কর ঐ ঘড়িটা নিজের হাতে পরতে চেয়েছিল, উৎপল রাজি হয় নি।
সর্বক্ষণ টর্চ জ্বেলে বসে থাকা যায় না। আবার টর্চ নেভালেই নিচ্ছিদ্র অন্ধকার। কেউ কারুর মুখ দেখতে পাই না। চতুর্দিক দারুণ নিস্তব্ধ, তবু এরই মধ্যে ছাদের কাছে একটা প্যাচা হঠাৎ ডেকে উঠলেই আমার বুক কেঁপে ওঠে। অথচ, আমরা কেউই ভীতু নই। নতুন জায়গায় অন্ধকার মানিয়ে নিতে একটু সময় লাগে, তার আগে ভয় ভয় ভাবটা যায় না।
আমার বারবার মনে পড়তে লাগলো, দুপুরবেলা দেখা সেই মহিলার কথা। এখন সেই মূর্তিটিকে আরও অবাস্তব মনে হচ্ছে। যেন হঠাৎ গাড়ি বারান্দার কাছে হঠাৎ আবার দেখতে পাবো। সেই কথাটা বলার জন্য বুকের মধ্যে আকুলি বিকুলি করছিল, তবু কিছুতেই মন ঠিক করতে পারিনি। শেষ পর্যন্ত যে বলিনি, তাতেই আমি জিতে গেছি।
আমাদের সতেরো বছর বয়েসে কলাতায় লোড শেডিং নামে কিছু ছিল না। ঘুমের মধ্যে ছাড়া,একটানা বেশীক্ষণ অন্ধকার দেখার অভিজ্ঞতা আমাদের কারু নেই। অন্ধকারের মধ্যে গল্পও জমে না।
ভাস্কর একসময় বলে উঠলো, ধুৎ ভালো লাগছে না। আয় তো আমার সঙ্গে।
টর্চ জ্বেলে আমরা বারান্দায় অন্য প্রান্তে বন্ধ ঘরটার সামনে এসে দাঁড়ালাম। মস্ত বড় পেতলের তালা। এই ঘরের মধ্যে রয়েছে বড় বড় হ্যাঁজাক! তার একটা জ্বালতে পারলেই আলোর কোনো সমস্যা হতো না। নাড়া চাড়া করে করে দেখা গেল তালাটা খোলা সহজ নয়।
ভাস্করদের যে আত্মীয়দের বাড়ি এটা, তাদের একটি ছেলের নাম নৃসিংহ। তাকে আমরাও সবাই চিনি। নৃসিংহ কেন আমাদের এই ঘরটার চাবি দেয় নি? আমরা কি ওদের জিনিসপত্র নিয়ে নিতাম।
ভাস্কর বেগে দরজাটার গায়ে একটা লাথি মেরে বললো, তোদের মধ্যে কেউ যদি এই তালাটা খুলতে পারিস তা হলে আমি তার পায়ের ধুলো নেবো।
ভাস্করকে আমাদের পায়ের ধুলো দেবার জন্য আমি আর আশু খুব চেষ্টা করলাম। কিছুই লাভ হলো না। উৎপল শুধু বললো, একটা পেরেক পেলে আমি খুলে দিতাম।
সেই অন্ধকারে তাকে অবশ্য পেরেক যোগাড় করে দেওয়া গেল না।
পরী ফিরলো রাত দশটার পর, খুব চেঁচিয়ে গান গাইতে গাইতে। তার হাতে সরু সরু তিনটে মাত্র মোম, পাঁচ টাকা দিয়ে সে ঐ মোম তিনটে কিনতে পেরেছে। মধুপুরে যে মোমে এত দাম, তা তো আমরা জানতাম না। পরীকে সে কথা জিজ্ঞেস করতে সে বললো, হ্যাঁ, বাবু, ইয়ে মধধুপুর হ্যাঁয়, সব চীজ মাঙা। তারপরই সে হেসে উঠলো হাহা করে।
তার সঙ্গে আর তর্ক করা গেল না। রাত্তিরের খাওয়া অতি সাধারণ, নিরামিষ, ভাত, ডাল, আলু ভাজা আর বেগুন পোড়া। তবে, এখানকার ঘিতে ভারী চমৎকার গন্ধ।
ওপরে উঠে এসেই আমরা শুয়ে পড়লুম। এত সরু মোমের আলোয় বই পড়া যাবে, তাসটাসও খেলা যাবে না। এতক্ষণে আকাশে জ্যোৎস্না ফুটলো না দেখে আমি একটু মনঃক্ষুণ্ণ হলুম। আমার মেঘ ভালো লাগে, কিন্তু রাত্তিরবেলা আকাশ মেঘলা থাকলে আকাশটাই দেখা যায় না, সেটা ভালো লাগে না।
ঘরে দু’খানা খাট ছিল, আমরা সে দুটোকে টেনে এনে জুড়ে দিয়ে সবাই এক সঙ্গে শুয়েছি। ঠিক সামনেই একটা জানলা। একটুক্ষণ শুয়ে থাকার পর আশু বললো, ঐ জানলাটা বন্ধ করে দেবো।
উৎপল বললো, হঠাৎ বৃষ্টি আসে?
–সে যখন বৃষ্টি আসবে তখন দেখা যাবে। এই গরমের মধ্যে জানলা বন্ধ করার কোনো মানে হয়?
আশু তখন সরল ভাবে কাচুমাচু গলায় বললো, ভাই, সত্যি কথা বলছি, ঐ জানলাটার দিকে তাকালে আমার একটু ভয় করছে। মনে হচ্ছে, এক্ষুনি যেন একটা মুখ দেখতে পাবো। যতই অন্য কথা ভাবছি–
একজন কেউ ভয়ের কথা বললেই অন্যরা সাহসী হয়ে যায়। আমরা সবাই মিলে অমুকে রাগাতে লাগলুম। আশু বললো, ঠিক আছে বাবা, আমি উপুড় হয়ে শুচ্ছি!
আবার খানিক বাদে উৎপল উঠে দাঁড়িয়ে গম্ভীর ভাবে বললো, আমার ছোট বাথরুম পেয়েছে, কেউ আমার সঙ্গে যাবি?
বাথরুমটা একতলায়, ইঁদারার পাশে। আমিও খাওয়ার পর হিসি করতে ভুলে গেছি, বেশ পেয়েছে, কিন্তু অন্ধকারে ঐ অতদূর যেতে হবে বলে চেপে যাচ্ছিলুম। এবার উৎপলের সঙ্গে যাবার জন্য উঠে বসতেই ভাস্কর উৎপলকে বললো, কেন, তুই ভয় পাচ্ছিস বুঝি? একলা যেতে পারছিস না?
উৎপল বললো, কেন ভয় পাবো? আমি জিজ্ঞেস করছিলাম আর কেউ যাবে কিনা!
উৎপল ফিরে এলো বড্ডই তাড়াতাড়ি। এত কম সময়ে একতলায় গিয়ে বাড়ির বাইরে বাথরুম থেকে ঘুরে আসা যায় না।
ভাস্কর বললো, তুই না করেই ফিরে এসেছিস।
উৎপল বললে, বাঃ, গেলুম আমি আর অমনি অমনি ফিরে আসবো?
আশু বললো, ও নিচে যায় নি। পাশের ছাদে–
উৎপল বললো, ভ্যাট।
আশু পাশ ফিরে উৎপলের পেটটা দু’হাত দিয়ে টিপে ধরে জিজ্ঞেস করলো, সত্যি করে বল।
তখন আমরাও ঝাঁপিয়ে পড়লু উৎপলের ওপর। সারা খাট জুড়ে হুটোপুটি। প্রচণ্ড কাতুকুতু পেয়ে উৎপল স্বীকার করতে বাধ্য হলো।
আমি লাফিয়ে উঠে বললুম, আমিও তাহলে পাশের ছাতে যাবো। সঙ্গে সঙ্গে এলো, ভাস্কর আর আশু।
একটু একটু ভয়েঙ্করী চমঙ্কার শিরশিরে নেশা। ভয় পাবার মতন আমরা কিছুই দেখিনি, কিছুই হয়নি তবু, শরীরটা ছমছম করে। দূরে কোথায় টি ট্রি টি ট্রি করে একটা রাত পাখি ডাকছে। এ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই।
ফিরে এসে একটু বাদেই আমরা ঘুমিয়ে পড়লাম। মাঝ রাতে এমনিই বিনা কারণে একবার ঘুম ভেঙে গেল। সামনের খোলা জানলাটার দিকে তাকিয়ে দেখি, আকাশের মেঘ কেটে গেছে, বোধহয় চাঁদও উঠেছে, ঝকঝক করছে অসংখ্য তারা। আকাশ যে আমার মনের কথাটা বুঝেছে, এ জন্য দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে একটা ধন্যবাদ দিয়ে, পাশ ফিরে সুখী হৃদয়ে আমি আবার ঘুমিয়ে পড়লাম।
সকালবেলা জেগে উঠেই মনে হলো, ইস, সারা রাতটা শুধু ঘুমিয়ে এমনি এমনিই কেটে গেল? কোনো ঘটনা ঘটলো না? একটা ভূত টুত এলে মন্দ হতো না!
আশু আর উৎপল আগেই উঠে গেছে, আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই ওরা হাসতে লাগলো, তারপর ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বললো, চুপ!
আমি ঘুমন্ত ভাস্করের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলাম। ভাস্করের নাকের নিচে কার্তিক ঠাকুরের মতন পুরুষ্টু গোঁফ, গালে দাড়ি। ভাস্করের ফর্সা মুখটায় ঐ কালো রং খুলেছে বেশ ভালো। এখন ওকে একটা ময়ূরের পিঠে বসিয়ে কাঁধে তীর ধনুক ঝুলিয়ে দিলেই হয়।
ভাস্করকে না জাগিয়ে আমরা পাশের ছাদে গিয়ে খুব হাসতে লাগলুম।
দারুণ সুন্দর সকাবেলাটা। ঝকঝক করছে রোদ। দূরের সেই জঙ্গলের মতন বাগান বাড়িটা থেকে টুং টুং শব্দ আসছে পুজোর ঘণ্টার। সামনের রাস্তা দিয়ে একটা গোরুর। গাড়ি যাচ্ছে কাঁচ কোচ শব্দ করে। এক ঝাক শালিক ঝগড়া করছে সামনের বাগানে। এই সব শব্দই যেন এক তারে বাঁধা।
বাগান থেকে পরী জিজ্ঞেস করলো, চা দেবো?
আমরা শোওয়ার ঘরে বসেই চা খেতে লাগলুম। নিচের ডাইনিং হলে যেতে আসন্য লাগছে। ভাস্করের দিকে তাকিয়ে আমরা হাসি চাপতে পারছি না, মাঝে মাঝে দম ফাটা হাসি বেরিয়ে আসছে। ভাস্কর অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, কী হয়েছে?
আমরা বললাম, কিচ্ছু না তো!
ভাস্কর গম্ভীর হয়ে গেল। চারজনের মধ্যে আমরা তিনজনে একদলে গিয়ে ওকে আলাদা করে দিয়েছি ভেবে ও রাগতে লাগলো ভেতরে ভেতরে। একবার ও গালটা চুলকালো, কিন্তু ওর আঙুলে যে রং লেগে গেছে, তা টেরও পেল না।
খানিকটা বাদে আমরা নিচে নেমে দারার পাশে গিয়ে মুখ ধুলাম। আয়না তো নেই যে বাস্কর নিজের মুখে দেখতে পাবে। উৎপল দারার ধারে গিয়ে মুখ ঝুঁকিয়ে বললো, এটা কত গভীর রে? দ্যাখ দ্যাখ ভাস্কর।
ভাস্কর এক পলক মাত্র ইঁদারাটা দেখলো। অনেক নিচে জলের ওপর ওর মুখের ছায়া পড়লেও তাতে দাড়ি গো বোঝা যায় না। ভাস্করের এখনো ভালো করে ঘুম কাটে নি, সে বললো, দারুণ খিদে পেয়ে গেছে। তোদের পায়নি। পরীকে বল ডিম ভাজা আর পরোটা করতে!
চোখ মুখ ধোওয়ার পর ভাস্করের মুখের কালি সামান্য মাত্র উঠেছে, গোঁফটা পুরোপুরি অক্ষতই আছে।
ডাইনিং রুমে এসে আমরা বসেছি, হঠাৎ বৃষ্টি নামলো। এই আকাশ পাস্কার ছিল, কোথা থেকে এসে গেল মেঘ। এই সব শুকনো জায়গায় হঠাৎ হঠাৎ বৃষ্টি হয়। আজ সকালে আমাদের পাহাড় দেখতে যাবার কথা ছিল, বৃষ্টি কখন থামবে কে জানে।
এই বৃষ্টির মধ্যেই ক্রিং ক্রিং করে সাইকেলের বেল বাজিয়ে সেই কালকের ছেলে দুটি হাজির। গায়ে ঝকঝকে নীল রঙের রেইন কোট। শালপাতায় মোড়া একা ঠোঙা হাতে ভেতরে ঢুকে তারা বললো, আপনাদের জন্য প্রসাদ এনেছি।
তারপরই ভাস্কারের দিকে তাকিয়ে হি-হি করে হাসতে হাসতে বললো, ওমা, আপনার মুখে।
আমি, আশু আর উৎপল হাসতে হাসতে পেট চেপে মাটিতে বসে পড়লাম, কিছুতেই হাসি থামাতে পারি না, হাসতে হাসতে বুঝি মরেই যাবো!
এত তুচ্ছ কারণে এত অফুরন্ত পরিষ্কার হাসি বুঝি শুধু সতেরো বছর বয়সেই সম্ভব।
ভাস্কর অতি স্মার্ট ছেলে। প্রথমে একটুক্ষণ ভুরু কুঁচকে রইলো। তারপর দৌড়ে ওপরে গিয়ে সুটকেশ থেকে নিয়ে এলো ঘোট আয়না, আসল ব্যাপারটা বুঝেও ও কিন্তু তক্ষুনি মুখ মুছলোও না বা রাগও করলো না। নানা রকম মুখ ভঙ্গি করে ও ছেলে দুটিকে আরও মজা দেখাতে লাগলো। কখনো চোখ পাকিয়ে অসুর সাজছে, কখনো ঠোঁট বেঁকিয়ে হেসে জেনারেল কারিয়াপ্লা!
বৃষ্টি আরও জোরে এসে গেল। আজ সকালে আর বেড়াতে যাবার আশা নেই। ডিম ভাজা অবশ্য গেল না, তবে পরোটা আর বেগুন ভাজা দিয়ে আমার ব্রেক ফ্রাস্ট সারা হলো।
ভাস্কর বললো, একটা সাইকেল থাকলে এখানে খুব সুবিধে। নিজেরাই বাজার থেকে অনেক কিছু কিনে আনতে পারি।
উৎপল বললো, বিশেষ করে আজ আলোর কিছু ব্যবস্থা করা দরকার। পাঁচ টাকার তিনটে সরু সরু মোমবাতি দিয়ে আমাদের পোষাবে না।
অভিজিৎ বললো, আপনারা ক্যারাম খেলবেন বলেছিলেন, আমাদের বাড়িতে চলুন না।
উৎপল বললো, এই বৃষ্টির মধ্যে কী করে যাবো ভাই?
আশু বললো, বরং তোমাদের সাইকেলটা একটু দেবে? আর তোমাদের একজনের রেন কোটটাও একটু ধার নিচ্ছি, আমি চট করে একবার শহরের দিক থেকে ঘুরে আসছি।
আমাদের সকালের খাবার দাবার দিয়ে গেছে পরীর বউ, আর একটি সাতআট বছরের বাচ্চা ছেলে! পরীর আর পাত্তা নেই। বোধহয় কাল রাত্তিরের ব্যবহারের জন্য লজ্জা পেয়েছে।
ভাস্কর শার্টের পকেট থেকে মানি ব্যাগ বার করে কিছু টাকা আশুকে দিয়ে বললো, ডিম ফিম কিনে আনতো। সকাল বেলা ডিম না খেলে আমার মনে হয় কিছু খাওয়াই হয় নি।
আশু ফিরে এলো খুব তাড়াতাড়ি। পথেই তার সঙ্গে পরীর দেখা হয়ে গেছে। এই বৃষ্টির মধ্যেই ভিজে পরী হাতে একটা বড় মাছ ঝুলিয়ে নিয়েছে, আর একটা পুটলিতে এক ডজন ডিম। এসবই সে এনেছে ধারে।
পরীর মুখে ঠিক কালকের মতন বিনীত, নরম হাসি। মাছ আর ডিমের দাম যা বললো, একেবারে অবিশ্বাস্য রকমের শস্তা। আমরা তখুনি ঠিক করে ফেললাম, পরীকে দিয়ে আমরা যা কিছু বাজার করার দিনের বেলাই করাবো। রাত্তিরের দিকে ওর হাতে একদম টাকা দেওয়া হবে না।
ভাস্কর বললো, লাগাও ডিম ভাজা আর আর এক রাউণ্ড চা!
উৎপল এর মধ্যে এক প্যাকেট তাস এনে অভিজিৎ আর সঞ্জয়কে নানারকম ম্যাজিক দেখিয়ে অবাক করছিল। আশুকে ফিরতে দেখেই বললো, এবার কিন্তু ব্রীজ খেলা হবে।
উৎপলটা একেবারে তাসের পোকা। হায়ার সেকেণ্ডারি পরীক্ষার পরের ছুটিতে আমরা ব্রীজ খেলা শিখেছি। বাইরে বেড়াতে এসে আমার তাশ খেলতে ইচ্ছে করে না। এমনকি বৃষ্টি ভিজে ভিজে বেড়াতেও আমি রাজি। কিন্তু উৎপল কিছুতেই ছাড়বে না। তাশ খেলার চার নম্বর সঙ্গ হবার জন্যই তো ওরা আমায় এনেছে।
অভিজিৎ আর সঞ্জয় খানিকক্ষণ উৎস হয়ে বসে রইলো আমাদের পাশে। কিন্তু কতক্ষণ আর ওদের ধৈর্য থাকবে। ওরা বেচারিরা এসেছিল আমাদের সঙ্গ পেতে। কিন্তু ব্রীজ খেলার মাঝখানে কোনো কথা চলেনা, শুধু টু হার্টস আর থ্রি নো ট্রাম্পস। আর একটা খেলা শেষ হলেই তর্ক। কুক্ষণে আমি উৎপলের পার্টনার হয়েছিলাম, প্রায়ই ভুল ডাক দিয়ে বকুনি খেতে লাগলাম।
অভিজিৎ আর সঞ্জয় কখন উঠে গেছে পাশ থেকে খেয়াল করিনি। হঠাৎ বাইরে গলা ফাটানো চিৎকার। সাঘাতিক ভয় পেয়ে সঞ্জয় আমাদের ডাকতে ডাকতে আসছে।
আমরা তাশ ফেলে হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে পড়লাম। সঞ্জয় এত ভয় পেয়ে গেছে যে খালি বলছে, দাদা, আমার দাদা!
সে হাত দিয়ে দেখাচ্ছে বাগানের পেছনের দিকটা, আমরা সেদিকে ছুটতে শুরু করতেই সঞ্জয় বললো, দাদা জলে ডুবে গেছে।
ভাস্কর, আশু, উৎপল ঝপাঝপ লাফিয়ে পড়লো পুকুরে। আমার ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, শিগগির আমি সাঁতার শিখে নেবোই নেবো।
অভিজিৎকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। কতক্ষণ আগে সে ডুবে গেছে কে জানে! আমি ভয়ে চোখ বুজে ফেললাম। আমি এ পর্যন্ত কোনো মৃত্যু দেখিনি। আমি দেখতেও চাই না।
পরক্ষণেই আমার অনুতাপ হলো। ছিঃ, আমি এত স্বার্থপর। আমি মৃত্যু দেখতে চাই না বলে চোখ বুঝে আছি। তার মানে আমি ধরেই নিয়েছি অভিজিৎ বাঁচবে না। অভিজিতের বদলে যদি আমি জলে ডুবে যেতাম, তাহলে কি আমিও মরতাম?
ঠাকুর দেবতার কথা আমার খুব একটা মনে পড়ে না। তবে পরীক্ষা দেবার সময় সরস্বতীর কাছে প্রার্থনা জানাই প্রত্যেকবার। জলে-ডোবা মানুষকে উদ্ধার করার জন্য সরস্বতী ঠিক যোগ্য দেবী কি না সে কথা বিচার না করে আমি চোখ খুলে ব্যাকুলভাবে বলতে লাগলাম, হে স্বরস্বতী, বাঁচিয়ে দাও, সব বাঁচিয়ে দাও!
চেঁচামেচি শুনে পরীও এসে পড়লো এবং লাফিয়ে পড়লো। ভাস্কর আর আশু এর মধ্যেই অভিজিতকে খুঁজে পেয়েছিল, পরী দক্ষ হাতে ওপরে তুলে আনলো তাকে।
অভিজিতের চোখ খোলা, শরীরটা মৃগী রুগীর মতন কাঁপছে। ওকে উপুড় করে শুইয়ে ওর পেটে চাপ দেওয়া হতে লাগলো, পরী দুর্বোধ্য হিন্দীতে কাকে যেন গালাগালি দিয়ে চলেছে।
আমরা সবাই দারুণ বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলাম, কিন্তু ভাস্কর এই সময় দলনেতার ভাবযুক্ত একটা কথা বললো।
ভাস্কর বললো, আশু, উৎপল ওকে তোল, ওকে এক্ষুনি ওর বাড়িতে নিয়ে যেতে হবে ডাক্তার ডাকা দরকার।
সঙ্গে সঙ্গে ওরা অভিজিতকে তুলে নিয়ে ভাঙা পাঁচিলের রাস্তা দিয়ে বেরিয়ে গেল। আমি সঞ্জয়ের হাত চেপে ধরে বললাম, এসো। সঞ্জয় কান্না থামিয়ে এখন বোরা হয়ে গেছে।
ছুটতে ছুটতে মাঠটা পেরিয়ে সঞ্জয়দের বাড়িতে এসে পৌঁছোতে আমাদের বেশী সময় লাগলো না। আমরা ঢুকলাম পেছন দিক দিয়ে।
বড় বড় গাছগুলোর মধ্য দিয়ে যেতে যেতে আমাদের আর একবার থমকে দাঁড়িয়ে পড়তেই হলো।
একটা লিচু গাছের নিচে একটা কাঠের বেঞ্চির ওপর বসে আছেন এক মহিলা। স্থির, যেন পাথরের মূর্তি। চোখ দুটি সামনের দিকে, মনে হয় যেন পলকও পড়ছে না।
কোনো সন্দেহ নেই, কাল দুপুরে আমি এই মহিলাকে দেখেছিলাম আমাদের বাড়ির কাছে। সেই হলদে শাড়ি, কালো ব্লাউজ।
আমরা গাছ-পালা ভেদ করে হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে আসছি, তবু সেই মহিলা একবারও তাকালেন না আমাদের দিকে, এক গোছা রঙীন ফুলের দিকে তার দৃষ্টি নিবদ্ধ। যেন তিনি ধ্যান করছেন। বৃষ্টি এখন খুব ঝিরিঝিরি করে পড়লেও একেবারে থামে নি। মহিলা বৃষ্টিতে ভিজছেন, তবু যেন হুঁশ নেই। আমি সঞ্জয়কে জিজ্ঞেস করলাম, উনি কে?
সঞ্জয় বললো, আমার দিদি।
কিন্তু এতবড় একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাও সঞ্জয় তার দিদিকে জানানোর প্রয়োজন মনে করলো না। আবার আমরা ছুটে গেলাম ওদের বাড়ির দিকে।