পুরনো একটি কথা আমার মনে পড়েছে। সুলতানা বাচ্চা মেয়েদের মতো কল কল করে বলে উঠলো, ফ্লোরার কথা তোমার মনে আছে না? আমি ওকে মাত্র একবারই দেখেছিলাম। অসাধারণ সুন্দরী মেয়ে। একদিন আমি আমীরে উন্দলুসকে বলেছিলাম, ফ্লোরাকে আপনি উঠিয়ে আনুন বা ওকে কিনে নিন এবং আপনার হেরেমে রেখে দিন। তোমাকে অবশ্য আমি কখনো একথা জানাইনি আমি।…..
ফ্লোরা আমীরে উন্দলুসের কাছে এলে তোমার অবস্থান আকাশ থেকে মাটিতে নেমে আসতো। ফ্লোরা বয়সে তোমার চেয়ে কম ছিলো এবং রূপসীও ছিলো এমন, যে কাউকে হতভম্ব করে দেয়ার মতো। আমীরে উন্দলুস ওকে পেলে তো পাগল হয়ে যেতেন। তুমি আমীরে উন্দলুসকে এ ধরনের কথা কেন চলেছিলে! তাঁকে খুশি করার জন্য?
না সুলতানা বললো। তাকে পাগল বানানোর জন্য। আমার পরিকল্পনা ছিলো ফ্লোরা হেরেমে এসে গেলে আমরা দুজন মিলে আমীরে উন্দলুসকে আমাদের জালে জড়িয়ে ফেলতাম। এভাবেই আমার উদ্দেশ্য পূরণ হতো।…..
এক রাতে আমি ইউগেলিসকে আমার জায়গীরের ডেকে ছিলাম। আমি তাকে বললাম, আমীরে উন্দলুস আবার ময়দানের এক লড়াকু মুজাহিদ হয়ে যাচ্ছেন।…..
তাঁর সবচেয়ে ছোট স্ত্রী মুদ্দাসসিরার কথায় তিনি এখন সবকিছু করেন। ফ্লোরা হেরেমে এসে গেলে আমরা দুজনে মিলে আমীরকে আবার আমাদের জাদুর জালে জড়িয়ে ফেলবো। ইউগেলিস আমার কথা মানলো না। সে ফ্লোরাকে অতি পবিত্র মেয়ে মনে করে।……
সে বললো, হেরেমে গিয়ে সে শুধু অপবিত্রই হবে না, সেখানকার ভোগবিলাসী জীবন পেয়ে সে তার কুরবানী দেয়ার জীবনের কথা ভুলে যাবে। তারপর আমার তোমার সব গোপন কথা আমীরে উন্দলুসের কাছে ফাঁস করে দেবে।
তুমি তো জানোই, সে আমার সাথে ওয়াদা করেছিলো, আমাকে ও তোমাকে কোন বিশাল প্রদেশের সম্রাট আর সম্রাজ্ঞী বানিয়ে দেবে। তার ইশারাতেই তো আমি নাচতাম। কিন্তু সে তার মিশনকে এতই পবিত্র মনে করতো যে, আমার কথার কোন গুরুত্ব দিলো না।
আমি রেগে গেলাম। ইউগেলিসের ওপর মদের প্রভাব ছিলো তখন। আমার ক্ষুদ্ধতাও তাকে বেশ নাড়া দিয়েছিলো। তার মিশন সফল করার জন্য আমি অনেক কিছুই করতে পারতাম এবং করেছিও। তাই সে আমাকে অসন্তুষ্ট করতে চাইলো না।…..
সে বললো, তোমাকে আমি এড়িয়ে যাচ্ছি না সুলতানা। আমার এই মিশনের কারণে তোমার প্রতি আমার অন্যরকম একটা ভালোবাসা আছে। আমি বিয়ে করিনি শুধু এ কারণে যে, তখন আমি শিকলে বাঁধা পড়ে যাবো। আমার মিশনের জন্য আমি বেকার হয়ে যাবে।
তারপর ফ্লোরা আমার মিশনে এক ধ্রুব তারার মতো এসে যোগ দিলো। এক রাতে আমরা এক ঘরে কাটিয়েছি। এক পাদ্রী আমাদেরকে ওখানে লুকিয়ে রেখেছিলো। ফ্লোরা যখন জানতে পারে, ইসলামকে ধ্বংস করার জন্য নিজেকে আমি নারী বঞ্চিত রেখেছি তখন সে আমার সাথে অনেক কথা বলে। আমি আশা করিনি এমন সুন্দরী একটি মেয়ে এমন বুদ্ধিমত্তার সাথে কথা বলতে পারে। ওর কথায় আমি নতুন জীবনের স্বাদ অনুভব করি।
ইউগেলিস আমাকে জানালো!, ফ্লোরার ব্যাপারে তার মনে এমন তীব্র এক ভালোবাসা জন্মায় যে, সে তার আর নিয়ন্ত্র করতে পারেনি। দুজন দুজনের কাছে পরস্পরকে সমর্পন করে দেয়। তাদের দুই দেহ এক দেহে পরিণত হয়।
তুমি সম্ভবত জানো না ইউগেলিস ও তার মিশনের পরিণাম কি হয়েছিলো? যারিয়াব বললো।
জানি। সবই জানি।
তুমি হয়তো ওদের দুজনের মৃত্যুর ব্যাপারে জানো, যারিয়ার বললো, কিন্তু তুমি হয়তো জানো না, ওরা ওদের মিশন কিভাবে চালিয়েছিলো। আর নিজের ওপর এক মেয়ের ছায়া নিয়ে ইউগেলিস ধীরে ধীরে কিভাবে বাতিল হয়ে গিয়েছিলো?
***
যারিয়াব অতীতের একটি পর্দা সরালো। বললো,
ঈসা মাসীহের বাদশাহী প্রতিষ্ঠা ও উন্দলুস থেকে মুসলমানদেরকে উৎখাতের জন্য ফ্লোরা তার জীবনকে উৎসর্গ করে দিয়েছিলো। সে তার রূপ যৌবনের আবেগ ভালোবাসা এই মিশনের জন্য বিসর্জন দিয়েছিলো।
সে পাদ্রী বা নান হয়ে যায়। খ্রিষ্টানরা তাকে মরিয়ম ছানী বলে ডাকতে থাকে। খ্রিষ্টানদের পাদ্রীরা রাতে কবরস্থানে ধোয়ার ভেতর থেকে ফ্লোরাকে বের করে সাধারণ মানুষের চোখে ভেল্কি লাগিয়ে দেয়।
এভাবে তাকে খ্রিষ্টানরা মরিয়ম ছানী বলে বিশ্বাস করতে শুরু করে। খ্রিষ্টানরা এসব ধোঁকাবাজি করে টয়টা ও মারীদায় দুবার বিদ্রোহ করায় এবং এতে হাজার হাজার খ্রিষ্টান মারা যায়। অগণিত লাশ ছাড়া ওদের আর কোন অর্জন কি হয়েছে? হয়নি!
মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল জব্বারের মতো মুসলমানদেরকে ওরা ধোঁকা দিয়ে ওদের দলে ভিড়িয়ে নেয়। আর এদিকে তুমি আমীরে উন্দলুসকে যে কোন অভিযানে যাতে না যায় এজন্য সব রকম চেষ্টা করে ব্যর্থ হও। কখনো কখনো আমাকেও তোমার সঙ্গ দিতে হয়। কিন্তু…..
কিন্তু মুদ্দাসসিরা আমীরে উন্দলুসের ওপর যাদু চালিয়ে তাকে সুলতানা বললো।
শুধু মুদ্দাসসিরা নয়। যারিষাব সুলতানাকে থামিয়ে দিয়েবসলো, আব্দুর রহমানকে তার সালাররাই মরণ ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলে। আর মুদ্দাসসিরা তোমার বিছানো ষড়যন্ত্রের জালকে ছিন্ন করে। সেই জাগরণকে মর্দে মুজাহিদে পরিণত করে। মুদ্দাসসিরা সত্যিই ইতিহাসে তার নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখিয়ে নিয়েছে।…..
আর সালারদের ঈমান সময় দৃঢ় ছিলো বলেই এটা সম্ভব হয়েছে। তাদের ঈমান এজন্য মজবুত ছিলো যে, উন্দলুসের মাটিতে শহীদ হওয়া পূণ্যত্মাকে সবসময় তাদের স্মৃতিতে প্রাণময় রেখেছে তারা। যারা উন্দলুসকে জয় করেছে। যারা নিজেদের রক্ত ঢেলে কাফেরদের বুকে ইসলামের ঝান্ডা উড়িয়েছে। তুমি তো জানোই, সালাররা কিভাবে আমীরে উন্দলুসকে তোমার কজা থেকে মুক্ত করে!
তুমিও কি ফ্লোরাকে আমার চেয়ে বেশি সুন্দরী মনে করো? সুলতানা যেন নেশার ঘোরে কথা বলে উঠলো।
আমি কাকে কি চোখে দেখি সেটা আমাকে জিজ্ঞেস করো না। যারিয়াব বললো, তুমি আমার কাছে অতীতের কথা শুনতে চেয়েছো যখন তোমার রূপ ও তার যাদুতে যৌবনের তীব্রতা ছিলো। আমাকে অতীতের পর্দাগুলো তাই একটু একটু করে সরাতে দাও।…….
আমি নিজেই তো তোমার ভালোবাসায় বন্দি হয়ে খ্রিষ্টানদের হাতে খেলতে শুরু করি। তুমি তোমার জায়গীরে যার বাগানও তোমার মতোই সুন্দর ছিলো ওখানে ইউগেলিসের সাথে আমার সাক্ষাৎ করাও।….
ওতো কোনো দরবেশের ছদ্মবেশে এসেছিলো সেদিন। তোমার প্রেম আমাকে অন্ধ করে রেখেছিলো বলে আমি বুঝে উঠতে পারিনি কি করতে যাচ্ছি। ইউগেলিস আমাকে বলে, আরব থেকে আসা ঐ মুসলমানদের সভ্যতা সংস্কৃতি বদলে দাও। আর তোমাকে বলে উন্দলুসের সিংহাসন উল্টে দিলে তোমাকে বিশাল এক রাজ্যের সম্রাজ্ঞী বানিয়ে দেবে। আমি হবো তার বাদশাহ।….
তোমার প্রেম আর আমার সুর ছন্দ যা তোমার প্রেমের ফসল ছিলো সেটা আমাকে এক ঘোরলাগা জীবনে নিয়ে যায়। এই স্বপ্নও আমার বোধ-বুদ্ধিকে আচ্ছন্ন করে রাখে যে, তুমি হবে সম্রাজ্ঞী আর আমি হবো তোমার স্বামী।….
আমি আমার মেধা, মুখের ভাষা ও বিষয়জ্ঞানের যাদু দিয়ে শাহী দরবারে প্রভাবশালী এক পদ অধিকার করে নিই। সবার জন্য আমি এক দৃষ্টান্ত হয়ে যাই। আরবীয় শাসক শ্রেণীর জীবন-যাপন, আবাস ভবন, পোশাক-আশাক এমন কি চুলের মধ্যেও বিধর্মী ইউরোপীয়ানদের সংস্কৃতি ঢুকিয়ে দিই। মুসলিম উমারাদের মেয়েদেরকে এমন পোশাকে সুসজ্জিত করি যে, ওদের পর্দা ব্যবস্থা নামমাত্র রয়ে যায়।…….
ইউগেলিস বলতো সৈন্য আরও অস্ত্র দিয়ে বিজয় অর্জিত হয় না। সুলতানা বললো, সুনিপুন কৌশলে এবং মায়াজাল বিস্তার করে কোন জাতির আবাস-ভবন, সভ্যতা, সংস্কৃতি, আচার ব্যবহার, সামাজিকতা ইত্যাদি তোমার মতো করে বদলে দাও। দেখবে সে জাতিকে খুব সহজেই তুমি জয় করে নিতে পারবে।
***
আমি অল্প সময়ের মধ্যেই বুঝতে পারি। আমার প্রতি তোমার কোন ভালোবাসা নেই। যারিয়াব বললো, বুঝতে পারি সুলতানা! তুমি আমাকে নিয়ে একটি খেলা খেলছো। কিন্তু আমার পুরো সত্বা তোমার ভালোবাসায় এমন বন্দি ছিলো যে, এ থেকে আমি মুক্ত হতে পারিনি এবং আমি আমার ধর্ম ও জাতির রগ রেশায় ক্রুশের বিষ ছড়াতে থাকি।
আমি স্বীকার করছি, প্রেমের নামে তোমাকে আমি ধোকা দেয়ার চেষ্টা করে গেছি। সুলতানা বললো, কিন্তু আমার ভালোবাসায় তোমাকে দেওয়ানা হতে দেখে আমি নিজেই নিজের ধোকার শিকার হয়ে গেছি। কিছুদিন পরই জীবনের প্রথমবার সেই ভালোবাসার পরম স্বাদ আমি অনুভব করি যা আমার আত্মার গভীর পর্যন্ত শিকড় গেড়ে বসে।….
আমি ইউগেলিসকে বলে দিয়েছিলাম, যারিয়াবকে আমি আর থোকা দিতে পারবো না। ভালোবাসাকে এক খেলা মনে করে ওর নিষ্পাপ আবেগের সাথে আমি আর খেলতে যাবো না।
সুলতানা! আমার ভালোবাসার আর আবেগের চেতনায় এখনো সেই উষ্ণতা আছে যা তোমার যৌবন কালে ছিলো। যারিয়াব বললো, আজো তুমি তোমার জন্য যত বড় ত্যাগ চাইবে আমি স্বীকার করতে পারবো। ভালোবাসার গভীরতা থাকা সত্বেও তুমি যেমন আমাকে অনেক কথা বলোনি তেমন আমারও এমন অনেক কথা আছে যা তোমাকে আমি বলিনি। আজ সেটা শুনে নাও।….
আমি যখন ফ্লোরার কথা শুনি এবং জানতে পারি সেও এক মুসলমানদের মেয়ে হয়েও খ্রিষ্টানদের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করে দিয়েছে তখন ওকে দেখার জন্য আমার মনে বেশ কৌতূহল জন্মালো। কিছু গোয়েন্দা দল আছে প্রশাসনের! কিছু আছে ফৌজের এবং আমারও ব্যক্তিগত ছোট একটা গোয়েন্দা দল ছিলো। এতে হেরেমের দুই সুন্দরী এবং তীক্ষ্ম মেধার দুটি মেয়েও ছিলো।….
ফ্লোরা কোথায় আছে এবং ওকে কিভাবে আমি দেখতে পাবো এটা আমি জেনে নিলাম। একদিন আমাকে জানানো হলো, ফ্লোরা ও ইউগেলিস একটি গ্রামে রয়েছে। কর্ডোভা থেকে সেটা একদিনের পথ। আমি সেদিকে রওয়ানা হয়ে গেলাম।
সেই গ্রামে গিয়ে আমার এক বিশেষ লোক দিয়ে গোপনে ইউগেলিসের কাছে খবর পাঠালাম যে, যারিয়াব ফ্লোরা ও তার সঙ্গে সাক্ষাতে এসেছে। গ্রামের অনেকেই আমাকে দেখেছে। কিন্তু কারো এতটুকু সন্দেহ হলো না যে, এই অপরিচিত মুসাফির কর্ডোভার বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ, শিল্পী- যার সঙ্গীত খ্রিষ্টানদের সঙ্গীতকেও সমৃদ্ধ করেছে।
সুলতানা যারিয়াবের কথা বড় মনোযোগদিয়ে শুনছে। এখন আর সে শরাব পানের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে না। যারিয়াব বলে যাচ্ছে,
আমাকে এক পোড়া বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হলো। এমন কামরায় নিয়ে দাঁড় করানো হলো যার ছাদ থেকে মাকড়সার অগণিত জাল ঝুলছে। চার দিকের দেয়ালগুলো ঝুর ঝুরে অবস্থা। আমি ভাবছিলাম এটা কি কোন চাল কিনা। কিন্তু তখনই ইউগেলিস এসে গেলো। বলতে লাগলো,
কর্ডোভার মহান সঙ্গীত শিল্পী কি বলতে পারবেন এত দূরে সফরের কষ্ট কেন স্বীকার করতে গেলেন?
***
আমার আসাটা সে সন্দেহের চোখে দেখলো। আমি বললাম, তোমার বিস্ময়টা অমূলক কিছু নয় ইউগেলিস! এক কৌতূহল আমাকে এখানে নিয়ে এসেছ। আমি কি আজ পর্যন্ত তোমাকে কখনো ধোকা দিয়েছি? আর থোকা দিতে হলে তো তোমার এখানে আসার আগে অন্য কেউ এসে তোমাকে ও ফ্লোরাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যেতো। আমি তোমাদের সাথী।
সে জিজ্ঞেস করলো, বন্ধু! কোন কৌতুল আপনাকে এখানে নিয়ে এসেছে?
আমি বললাম, আমি ফ্লোরাকে দেখতে এসেছি। ফ্লোরা যারিয়াবের সুর ছন্দের চেয়ে অনেক বেশি মুগ্ধতায় আচ্ছন্নকারী এবং তার সংকল্প কঠিন শিলা পাথরের চেয়েও মজবুত। ইউগেলিস আমার সাথে আরো কিছু কথা বললো। যখন সে নিশ্চিত হয়ে গেলো ওকে আমি ধোকা দিতে আসিনি আমাকে তখন আরেকটি বাড়িতে নিয়ে গেলো এবং একটি কামরায় বসিয়ে দিলো।
একটু পরই এক যুবতী মেয়ে কামরায় প্রবেশ করলো। ওর রূপ আমাকে বিস্ময়বিস্ট করে ফেললো। সুলতানা! তুমিও যৌবনকালে বিস্ময়কর সুন্দরী ছিলে। সম্ভবত: ফ্লোরার চেয়ে সুন্দরী ছিলে….; কিন্তু ঐ মেয়ের মধ্যে তীব্র এক আকর্ষণই নয়, এক ধরনের সম্মোহন করার মতো যাদুমুগ্ধতা ছিলো। ওর দৈহিক অবকাঠামোটাই প্রেমের জগতে তোলপাড় সৃষ্টি করে দেয়ার মতো। ওর চোখের উজ্জলতার সামনে খুব কম মানুষই টিকতে পারবে।
ইউগেলিস ফ্লোরাকে বললো, ফ্লোরা! এই সেই মহান ব্যক্তিত্ব, শাহী মহলে যার সবচেয়ে বেশি প্রভাব রয়েছে। ইনি আমাদের জন্য ওখানকার মাটি সমতল করে দিচ্ছেন।
ফ্লোরা এগিয়ে এসে আমার ডান হাতটি তার দুহাতের করোটিতে রেখে চুমু খেলো। তারপর তার বুকে রাখলো এবং তার মুখে যে হাসির ঝলক এলো সেটা আমাকে কাঁপিয়ে দিলো। আমার সন্দেহ হলো, এ কোন দেহ নয়, এ কেবল এক আত্মার প্রতিকৃতি সুলতানা! ফ্লোরা ফুল নয়, ছিলো কলি।
আমি ওকে বললাম, তুমি এত সুন্দরী আর যৌবনবতী কিন্ত তুমি কি করতে পারবে ফ্লোরা! তুমি কি তোমার যৌবন নষ্ট করছো না?
ফ্লো বলে উঠলো, শুনেছি, আপনি এক মহান জ্ঞানী ব্যক্তিত্ব! কিন্তু আপনার তো এটাও জানা নেই, কিছু করার জন্য দৈহিক শক্তির প্রয়োজন নেই। মানুষ তার বিশ্বাস ও চিন্তা চেতনায় দৃঢ় হলে তার আত্মার শক্তি জেগে উঠে।
ও যখন তার ধর্ম বিশ্বাস নিয়ে কথা বলতে শুরু করলো তখন এই মেয়ে যাকে আমি অন্য দৃষ্টিতে দেখছিলাম আমার চোখে সে পবিত্র এক সত্বা হয়ে ধরা দিলো। ইউগেলিস এও জানালো, মারীদা ও টয়টার বিদ্রোহের আগুন ফ্লোরাই জ্বালিয়ে দিয়েছিলো।…..
পথে-ঘাটে, বাজারে বিচারকের আদালতে ইসলামের অবমাননার যে ফেতনা খ্রিষ্টানরা শুরু করেছিলো সে পথের পথ প্রদর্শক ছিলো এই ফ্লোরাই। রূপের ঐশ্বরিক শক্তি থাকা সত্বেও একটি মেয়ে যখন তার রূপ, যৌবন, জীবনের সব চাহিদাকে বাতিল এক ধর্মের জন্য বিসর্জন দিতে দেখলাম, আমার মধ্যে এ উপলব্ধি জেগে উঠলো যে, আমি কী করছি?
আমি একজন পুরুষ। লোকে আমাকে জ্ঞানী বুদ্ধিমান বলে। অথচ আমিই ওদের হাতের খেলানার পুতুল। আমার ধর্ম বিশ্বাসের কথা মনে পড়লো। লজ্জার তীক্ষ্ম ফলা আমাকে জর্জরিত করতে লাগলো। তখনই আমার চিন্তা-ভাবনায় এক বিপ্লব অনুভব করলাম।…..
আমি মুখে মুখে ফ্লোরা ও ইউগেলিসকে নিশ্চয়তা দিলাম যে, আমি ওদের সাথেই আছি। কিন্তু মনে মনে কসম খেলাম, আর এক মুহূর্তও ওদের সঙ্গে নয়। আমি ফিরে এলাম। বেশ কয়েকবার ভাবলাম, তোমাকে বলি ওদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে দাও।…
কিন্তু ইউগেলিসকে কেন্দ্র করে যে স্বপ্ন-সাধ তোমার মনে তুমি লালন করে যাচ্ছো সেই অলীক জগৎ থেকে তোমাকে যে বাস্তবতার জগতে ফিরিয়ে আনতে পারবো না এটাও তখন নিশ্চিত হয়ে গেলাম। আমি নীরব রইলাম আর তুমি স্বপ্ন দেখতে লাগলে। ফ্লোরা তার মিশন নিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলো।……
আমার কাছেও ওর সব তৎপরতার খবর নিয়মিত বিরতিতে আসতে লাগলো। তোমার হয়তো মনে আছে এর মধ্যে কতগুলো বিদ্রোহ হয়েছে এবং সবগুলোই দমন করা হয়েছে। খ্রিষ্টানরা প্রতিবারই ব্যর্থ হয়েছে। সন্ত্রাসীদের পাইকারি দরে হত্যা করা হয়েছে।…..
অল্প বয়স্কা সুন্দরী মেয়ে মরিয়ম। সে গির্জার নান হয়ে যায়। ফ্লোরা সাথে তার সাক্ষাৎ হয়। মরিয়মের এক ভাই পথে ঘাটেপ জন সম্মুখে ইসলাম ও মুসলমানদের গালিগালাজ করতে থাকে। তাকে ধরে বিচারকের আদালতে পেশ করা হয়। বিচারে তাকে জল্লাদের হাতে তুলে দেয়া হয়।…
***
মরিয়ম তখন ডাকিনীর বেশে গির্জা থেকে বের হয়ে ইসলাম ও উন্দলুসের প্রশাসনের বিরুদ্ধে নতুন করে তৎপরতা শুরু করে। আদালত তখন ফ্লোরা ও মরিয়মকে গ্রেফতারের পরোয়ানা জারি করে।
ওদরেকে খুঁজে বের করার জন্য গোয়েন্দা ও সরকারি সোর্সদেরকে জরুরি নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু ওদেরকে খুঁজে পাওয়া এত সহজ ছিলো না। বারবারই গোয়েন্দাদের বিছানো জাল ছিন্ন ভিন্ন করে ওরা বেরিয়ে যায়।
সুলতানা নির্বাক হয়ে শুনছে। আর যারিয়াব অবিরত বলে যাচ্ছে।
একদিন এক লোক আমার সাথে গোপনে সাক্ষাৎ করলো। সে আমাকে ইউগেলিসের পয়গাম দিলো। ইউগেলিস কাছেরই একটি গ্রামে আমার অপেক্ষায় আছে। রাতে আমি ওখানে চলে গেলাম। ইউগেলিস সাক্ষাতে বললো, ওদের বিদ্রোহগুলো একের পর এক ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে।
ফ্রান্স থেকেও জঙ্গি সাহায্য পাচ্ছে না ওরা। কারণ, আমীরে উন্দলুস আব্দুর রহমান সীমান্ত এলাকায় সৈন্যদেরকে খুবই তৎপর রেখেছেন। আর ছোট ছোট গেরিলা দল রাত দিন ঘোড়ায় চরে সীমান্ত এলাকা উত্তপ্ত করে রাখছে।…
আমি ওক জিজ্ঞেস করলাম, এখন সে কী চাচ্ছে? আমাকে ডেকেছে কেন? সে বললো,
আমি এবার কর্ডোভায় বিদ্রোহ করাতে চাচ্ছি। কিন্তু এর সূচনা হবে এভাবে যে, বিদ্রোহ একেবারে শাহী মহল থেকে শুরু হবে। আমীরকে বন্দি করা হবে এবং সব সালারকে তৎক্ষণাৎ হত্যা করে দেয়া হবে। আমি আমার মতো করে চেষ্টা করে গেছি ফৌজের মধ্যে আমার কোন সহযোগি তৈরি করা যায় কিনা। কিন্তু সালাররা প্রত্যেকটা সৈন্যকে এমন ধর্মভীরু বানিয়ে রেখেছে যে, কেউ তার ধর্ম ও দেশের বিরুদ্ধে কথা বলতে বা শুনতে রাজি নয়।…..।
সে আমাকে তখনো তার বন্ধুই মনে করছিলো। আমিও ওকে বন্ধুত্বের থোকা দিয়ে গেছি এবং জিজ্ঞেস করেছি এখন আমাকে কী করতে হবে? ইউগেলিস বললো, সালারদের মধ্যে চরম দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে দিবেন। ওদের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি করে দিবেন।…..
নায়েবে সালার ও কমান্ডারদের মধ্যে এমন কিছু লোককে হাত করে নিবেন যাদেরকে দিয়ে গৃহযুদ্ধ করানো যাবে। ওদেরকে আমরা এত বেশি সোনা ও টাকা পয়সা দেবো যে, ওরা জীবনেও তা দেখেনি। আপনার ও সুলতানার সাথে আমাদের কৃত প্রতিশ্রুতি অক্ষুণ্ণই আছে। আপনাদেরকে পৃথক এক রাজ্য উপহার দেয়া হবে। যেখানে চলবে একমাত্র আপনার ও সুলতানার রাজত্ব।……
আমি তাকে বললাম, উন্দলুস থেকে ইসলামের অস্তিত্ব বিনাশে তোমরা সফল হয়ে গেলে তখন তো আমাকে এক পৃথক রাজত্ব দান করবে। কিন্তু সেটাও তো হবে ইসলামী রাজত্ব। সেটার অস্তিত্ব তোমরা কি করে সহ্য করবে? সে বললো,
পুরস্কার স্বরূপ দেয়া ভুখন্ডে যে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হবে সেটার ব্যাপারে আর কোন আপত্তি আমাদের থাকবে না। আমি জানি, আপনি ও সুলতানা যে ভূখন্ডের শাসক হবেন সেটা কেবল নামে ইসলামী রাষ্ট্র হবে। আমার বিশ্বাস, আপনারা দুজন ইসলাম ত্যাগ করে খ্রিষ্টবাদে দীক্ষিত হয়ে যাবেন।….
তবে এসব অনেক পরের কথা। আপনি যা চাইবেন তাই হবে। সবার আগে আপনি আপনার প্রভাব প্রতিপত্তি ও ক্ষমতাকে আমাদের স্বার্থে প্রয়োগ করুন। বিদ্রোহ বা গৃহযুদ্ধের জন্য আমাদের ষড়যন্ত্রের জাল কর্ডোভায় বিস্তার করে দিন। যে পরিমাণ সম্পদ আপনার প্রয়োজন হবে আমরা সেটা যোগান দিয়ে যাবো।
ইউগেলিস কথা বলছিলো আর মদ পান করছিলো। কিন্তু আমি মদ একটুও ছুঁয়ে দেখিনি। কারণ, আমার হুশ জ্ঞান আমি ঠিক রাখতে চাচ্ছিলাম। ওখানে তখন ফ্লোরা ও মরিয়মও ছিলো। এই দুই মেয়ের রূপ যৌবনও আমাকে অনেক খানি আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো। তবে নিজেকে আমি এক সময় এ থেকে মুক্ত করে নিই। ওদের কাজ করে দেবো বলে আমি উঠে দাঁড়ালাম।
ইউগেলিস বললো, যারিয়াব! আমি আশা করব আপনি আমাদেরকে ধোকা দেবেন না। আর ধোকা দিলেও সেটা আপনার জন্য ভালো হবে না।
আমি রেগে গেলাম। আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, এটা আমার জন্য ভালো হলে কী হবে আমার?
সে বললো, আপনি এই দুনিয়ায় থাকবেন না।
আমি বললাম, আমার একটা শর্ত আছে। সেটা পূর্ণ করে দিলে মহলে আমি বিদ্রোহ করিয়ে দেবো। চার সালারকে ঘুমন্ত অবস্থায় শেষ করে দেবো। ইউগেলিস আমাকে শর্ত জিজ্ঞেস করলো। আমি ঠোঁট টিপে হাসলাম। ওরা তিনজন পরস্পরের দিকে তাকালো।…
ফ্লোরা ও মরিয়মের চেহারায় আমি ক্ষুদ্ধতা বা আনন্দ কোনোটারই ছায়া দেখলাম না। তবে ওদের ঠোঁটে যে হৃদয় কাড়া হাসি ছিলো সেটা অদৃশ্য হয়ে গেলো। ইউগেলিস আমাকে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে বলে দুজনকে নিয়ে অন্য কামরায় চলে গেলো। একটু পর সে একা ফিরে এলো।
আমাকে বললো, ঐ মেয়েদের মনে মুসলমানদের ব্যাপারে এমন ঘৃণা জমে আছে যে, ওরা কোন মুসলমানের দৈহিক স্পর্শ সহ্য করতে পারবে না।….
আমাকে মনে হয় বাচ্চা মনে করছিলো ইউগেলিস। ইউগেলিসের কথার ভঙ্গি দেখেই আমি বুঝে গেছি সে কী বলতে চাচ্ছে। ফ্লোরাকে তো ওরা মরিয়ম ছানী বানিয়ে রেখেছিলো। আর মরিয়ম নিজেই ছিলো গির্জার নান। যাদের ওপর বিয়ে হারাম। ভুলেও যদি কোন পুরুষের সঙ্গে ওদের দৈহিক স্পর্শ ঘটে ওরা সঙ্গে সঙ্গে গোসল করে গির্জায় গিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকে। কিন্তু আমি এও জানতাম, এ দুজনের দেহ ইউগেলিসের জন্য বৈধ ছিলো।…..
***
যারিয়াবের এসব কথা সুলতানার জন্য একেবারেই নতুন। তাই সুলতানা ফ্লোরা ও মরিয়মের ব্যাপারে যারিয়ারে এধরনের প্রস্তাবের কথা শুনে চমকে উঠলো।
তুমি কি একেবারে হৃদয়-মন থেকে চাচ্ছিলে ঐ দুই মেয়ে তোমার কাছে আসুক? তুমি তো আমার ভালোবাসার দাবী করো। সুলতানা জিজ্ঞেস করলো।
না, যারিয়াবের হেসে বললো, মুসলিম জাতির আত্মমর্যাদাবোধ আমার মধ্যে তো আগইে জেগে উঠেছে। এখন ইউগেলিস যখন আমাকে হত্যার হুমকি দেলো তখন ওর ধর্মীয় আত্মমর্যাদাকে নিয়ে একটু খেলার ইচ্ছা জাগলো। ইউগেলিস যখন বললো, ফ্লোরা ও মরিয়মের মনে মুসলমানদের ব্যাপারে ঘৃণায় পূর্ন তখন ও দেরজপাতে আমারমনে যতটুকু সম্মানছিলো সেটাও আমারমন থেকে বেরিয়ে গেলো। ইউযালিস আমাকে পরের রাতে আসতে বলোল।..
ইউগেলিস যখন আমাকে পরের রাতে আসতে বললো তখনই ওর হাবভাব আমি পড়তে পেরেছি। পরের রাতে ও আমার সাথে অন্য কোন খেলা খেলতে চায়। এটা আমার সন্দেহ ছিলো। হতে পারে মেয়ে, দুজন দেহ দানে রাজি হয়ে গিয়েছিলো। কারণ, ওদের চরিত্র তো আমি জানি।……
ইহুদী খ্রিষ্টানদের মেয়েরা নিজেদের জাত ধর্মের জন্য নিজেদের সতীত্ব ও দেহ অনায়াসে আরেকজনের হাতে তুলে দিতে পারে। কিন্তু আমার মাথায় তখন অন্য চিন্তা। ইউগেলিসকে আমি বললাম, আগামীকাল রাতে আমি এসে বিদ্রোহের সব পরিকল্পনা করে ফেলবো। বোকার মতো আমি ওর জালে ফেঁসে গেছি এমন একটা বিশ্বাস ওর মধ্যে সঞ্চারিত করে চলে এলাম।…….
সকাল হতেই পুলিশ চীফ মনসুর ইবনে মুহাম্মদের কাছে গেলাম। তাকে বললাম, ইউগেলিস, ফ্লোরা ও মরিয়ম অমুক গ্রামের অমুক বাড়িতে আছে। আজ রাতেই ওদেরকে গ্রেফতার করা যায়। আমি ওখানে গিয়েছিলাম একথা মনসুরকে বললাম না। শুধু বললাম, বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পেরেছি। ওরা তিনজন আজ রাতে ওখানে থাকবে।…..
মনসুর ইবনে মুহাম্মাদ অতি দূরদর্শী পুলিশ চীফ। সে তখনই তার এক সোর্সকে ভিখারীর ছদ্মবেশে সেখানে পাঠিয়ে দিলো। বলে দিলো, ওখানে গিয়ে ভিক্ষা করবে এবং একজন পুরুষের সাথে দুটি মেয়েকে দেখলে তাদের পিছ নিবে এমনভাবে যে, ওদের যেন কোন সন্দেহ না হয়। ফিরে এসে আমাকে জানাবে ওরা কোথায় গিয়েছে। রাতে মনসুর সে গ্রামে পুলিশের একটা দল পাঠিয়ে দিলো।
পরদিন সকালে খবর আসে, ফ্লোরা ও মরিয়মকে গ্রফতার করা হয়েছে। কিন্তু ইউগেলিস বেরিয়ে গেছে। পুলিশের ঝটিকা বাহিনীর সাথে এমন দুজন লোক ছিলো যারা ইউগেলিস ও মরিয়মকে চিনতো। পুলিশের লোকেরা যখন সে বাড়িতে গিয়ে উঠে সেখানে তখন ইউগেলিস লুকিয়ে ছিলো। পুলিশকে দেখে ঘরের লোকেরা এমনকি অন্যান্য মেয়েরাও পুলিশের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো এবং চিৎকার চেঁচামেচি জুড়ে দিলো।…
গ্রামের খ্রিষ্টানরা ঘুম থেকে উঠে এদিকে দৌড়ে এলো। দলের সাথে যে ইনস্পেক্টর ছিলো সে সাথে সাথে ঘোষণা করে দিলো, তারা কে? এবং কী জন্য এসেছে। কেউ যদি ওদের সাথে লড়তে আসে তাহলে পুরো গ্রাম ধ্বংস করে দেয়া হবে।
কিন্তু ফ্লোরা ও মরিয়ম চিৎকার করে করে গ্রামের লোকদেরকে উত্তেজিত করছিলো, ওরা যাতে ওদেরকে মুসলিম সিপাহীদের হাত থেকে মুক্ত করে। কিন্তু কেউ ওদের কাছে আসার সাহস পায়নি।….
ওদের দুজনকে যখন টেনে হেচড়ে বের করা হলো, ফ্লোরা তখন উঁচু আওয়াজে বলছিলো, ক্রশের পূজারীরা! তোমাদের আত্মমর্যাদাবোধ কোথায় গেলো? এই মরিয়ম নান কে দেখে কি তোমাদের অন্তর কেঁদে উঠছে না? তোমরা কি করে সহ্য করছো? মুসলমানরা তাকেও ধরে নিয়ে যাচ্ছে। খোদার পুত্রের আত্মার কাছে কী জবাব দেবে?
***
মনসুর ইবনে মুহাম্মাদের জানা ছিলো, যারা অসংখ্যবার বিদ্রোহ করেছে তারা পুলিশ দেখলেই লড়াইয়ে নেমে পড়বে। মনসুর তাই পুরো এক ব্যটালিয়ন পুলিশ পাঠিয়ে দিয়েছিলো। গ্রামের মাঝখানে কিছু ফাঁকা জায়গা ছিলো। ফ্লোরা ও মরিয়মকে সেখানে আনা হলো। কয়েকটি মশাল জালানো হলো। ইনস্পেক্টর কিছু পুলিশ গ্রামের বাইরেও রেখে এসেছিলো। যাদেরকে প্রয়োজনের সময় কাজে লাগানো যেতো।…..
ফাঁকা জায়গা থেকে ঘোষণা করা হলো, কেউ ঝামেলা করতে এলে পুরো গ্রাম ধ্বংস করে দেয়া হবে। লোকেরা এটা শুনে পিছিয়ে গেলো। কিন্তু সাত আটজন খ্রিষ্টান অস্ত্র শস্ত্রে সজ্জিত পুলিশের দিকে ধেয়ে আসতে শুরু করলো। অসংখ্য তীর ওদের দিকে ছুটে গেলো। ওরা মাঝখানেই যমদূরেত সাক্ষাৎ পেয়ে গেলো।….
আরেক দলে খ্রিষ্টান আরেক দিক থেকে তেড়ে আসতে লাগলো। এ সময় গ্রামের বাইরে থেকে ঘোড় সাওয়ার পুলিশরা ঘোড়া নিয়ে গ্রামে ঢুকেই ওদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো ঘোড়া নিয়ে। এতে কিছু খ্রিষ্টান ঘোড়ার পায়ের নিচে পিষ্ট হলো। আর বাকিরা পালিয়ে গেলো। পুলিশ বাহিনী ফ্লোরা ও মরিয়মকে নিয়ে সেখান থেকে রওয়ানা হয়ে গেলো।
আমি নিশ্চিত দুজনে পথে ইনস্পেক্টররকে ওদের রূপের লোভ দেখিয়ে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করছিলো। সুলতানা বললো, ধন সম্পদ এবং নিজেদের দেহেরও লোভ দেখিয়েছিলো ওরা।
না, সুলতানা! যারিয়ার বললো, তুমি হলে হয়তো এই নারীত্ব ব্যবহার করার চেষ্টা করতে। কিন্তু কোন কোন মেয়ের মানসিক শক্তি পুরুষের চেয়ে বেশি থাকে।…
এ ধরনের মেয়েকে সে নারীই বুঝতে পারবে যার চরিত্র ও বিশ্বাসে দৃঢ়তা আছে। ওরা দুজন পথে কাউকেই কোন ধরনের লোভ-লালসা দেখায়নি। বরং ওরা দুজনই ইসলামকে গালমন্দ করতে থাকে এবং চ্যালেঞ্জ করতে থাকে। ওরা উন্দলুসে মুসলমানদের কখনোই নিশ্চিন্ত ও সুস্থিরভাবে থাকতে দেবে না।
তুমি বিস্মিত হচ্ছো সুলতানা! কারণ, তোমার কোন ধর্ম বিশ্বাস নেই। নিজের বিলাসমত্ত প্রবৃত্তিকেই তুমি ধর্ম বানিয়ে রেখেছে। এমন নারীও ছিলো যারা তারিক ইবনে যিয়াদ ও সেসব মুজাহিদদেরকে জন্ম দিয়ে ছিলো যারা উন্দলুসকে জয় করে ছিলো….।
আরেক ধরনের নারী আছে যারা সেসব উমারাদেরকে জন্ম দিয়েছে যাদের কাছে বাদশাহী আর ক্ষমতাই সবচেয়ে প্রিয়। তাদের বংশে যে নারীই সন্তান জন্ম দেয় তার একমাত্র চাওয়া পাওয়া হয় তার ছেলে সিংহাসনের উত্তরাধিকার হবে। তুমি দ্বিতীয় শ্রেণীর নারীদের অন্তর্ভূক্ত। এজন্য তুমি হয়রান হচ্ছে, ওরা দুজন কেন মুক্ত হওয়ার জন্য নিজেদের দেহের লালসা দেখায়নি। ওদের সাথে তোমার অনেক বড় পার্থক্য রয়েছে।…।
সারা রাস্তায় ওরা ইসলাম ও মুসলমানদেরকে গালিগালাজ করেছে। পরের দিন ওদেরকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়। বিচারক ফ্লোরাকে বলেন,
তোমার শাস্তির ব্যাপারে আমি এজন্য নমনীয় হচ্ছি যে, তুমি এক মুসলমান পিতার কন্যা। আশা করি তুমি বন্দিত্ব দশা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবে এবং সরল পথে ফিরে আসবে।
তবুও ফ্লোরা তার উগ্রতা ছাড়লো না। দুজনকে কয়েদ খানায় পাঠিয়ে দেয়া হলো। একদিন এক শুভ্রকেশী পাদ্রী ওদের সাক্ষাতের জন্য কয়েদ খানায় হাজির হলো। তাকে সাক্ষাতের অনুমতি দেয়া হলো। কিন্তু কয়েদখানার প্রধান কর্তা সেই পাদ্রীকে কয়েদকানা থেকে বের করে দিলো। কারণ, সে ফ্লোরা ও মরিয়ামকে বলছিলো, দৃঢ় থাকবে। কারণ, পরে তোমাদেরকে মহলের হেরেম ঢুকানো হবে।
অনেক পর আমি এক সূত্রে জানতে পারি, সেই শুভ্রকেশী পাদ্রী ছিলো ধূর্ত ইউগেলিস। ফ্লোরা ও মারিয়মকে কয়েদখানায়ও ইসলামের নামে অনবতর কুটুক্তি করতে থাকে। তাদেরকে আরেকবার বিচারকের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়। বিচারক যখন দেখলেন, এদের মনোভাব আগের চেয়ে আরো ভয়ংকর হয়ে উঠেছে তখন তিনি আইনের সঠিক ব্যবহার করলেন এবং দুজনকেই মৃত্যুদন্ড দিলেন।
দুজনকে মরণ ঘুম পাড়িয়ে দেয়া হলো। ইউগেলিস ফ্লোরা ও মরিয়মের শোকে আরো হিংস্র হয়ে উঠলো। প্রতিশোধের আগুন তাকে পোড়াতে লাগলো। সে তার জঙ্গি তৎপরতা আরো বাড়িয়ে দিলো। খ্রিষ্টানরা এবার প্রকাশ্যে ইসলাম ও প্রশাসনকে গালমন্দ করতে লাগলো। সন্ত্রাসী কর্মকান্ডা আরো বাড়িয়ে দিলো।
আমীরে উন্দলুস হুকুম দিলেন, যারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করবে এবং ইসলামের বিরুদ্ধে কটুক্তি করবে তাদের শাস্তি সোজা মৃতুদন্ত। এ হুকুমের পর কয়েখ মাসের ব্যবধানে আট হাজার খ্রিষ্টান সন্ত্রাসীকে হত্যা করা হলো। ইউগেলিস তার মিশনের ব্যর্থতা ও ফ্লোরার শোকে প্রায় পাগল হয়ে গেলো। এ অবস্থাতেই সে ধরা পড়লো এবং জন সম্মুখে তাকে ফাঁসি দেয়া হলো।
সুলতানা উদাস কণ্ঠে বললো,
যারিয়াব! তোমাকে বলেছিলাম, আমাদের সেই সোনালী অতীতের কথা শোনাও। যা আমাকে আবার যৌবনে নিয়ে যাবে। কিন্তু তুমি আমার মন আরো উদাস করে দিলে।
সুলতানা মদের সুরাহী নিয়ে মদ ঢালতে উদ্যত হলো। যারিয়াব তার হাত থেকে মদের সুরাহীটা নিয়ে নিলো। তারপর সেটা দূরে রেখে দিলো।
সুলতানা! জীবনের এই শেষ দিকে এসে আমারও ইচ্ছে করে কেউ আমার সাথে আমার যৌবনকাল নিয়ে যদি কথা বলতো। তুমিও এটা চাও। কিন্তু তোমার ও আমার চাওয়ার মধ্যে কিছুটা পার্থক্য আছে। তুমি এই বার্ধক্যে এসে যৌবনবতী হতে চাচ্ছো। এজন্য তুমি যৌবনের স্মৃতির আশ্রয় নিচ্ছে। এটা আসলে নিজের জীবন থেকে পালানো।…
বার্ধক্যকে গ্রহণ করে নাও। তাকে অভিবাদন জানাও। কারণ, তুমি অতীতে এক ব্যর্থ জীবন রেখে এসেছে। এখন বাস্তব জীবনের ফিরে এসো।….
আমার যৌবনকালে তুমি তো কমপক্ষে এতটুকু বলতে যে, আমাকে তুমি হৃদয়ের গভীর থেকে ভালোবাসো।
তা তো এখনও বলি। যারিয়াব বললো, এখন তো অনুভব করি, তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা এত অধিক হয়ে উঠেছে যে, আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়তে বললেও আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়বো নির্দ্বিধায়। কিন্তু আজ রাতে অতীতের সেসব কথা শুনে নাও যা আমি শোনাতে চাই।
মনে হচ্ছে তুমি পাক্কা মুসলমান বনে গেছো। সুলতানা হাসতে হাসতে বললো, আমীরে উন্দলুস মনে হয় তোমাকে একটু বেশিই এনআম আর বখশিষ দিয়েছেন।
আমীর আব্দুর রহমান আমাকে সবচেয়ে বড় পুরস্কার এই দিয়েছেন যে, আমি আসল মুসলমান হয়ে গেছি।
আমার মতে তুমি কখনোই এই চেষ্টা করোনি যে, তিনি খাঁটি মুসলমান হয়ে যান। সুলতানা বললো, তুমি তো তাকে নারী ও মদে ডুবিয়ে রাখতে চাইতে।
হ্যাঁ, সুলতানা! যারিয়াব বললো, আমি আমীরে উন্দলুসকে ভোগ-বিলাসে মত্ত রাখতে চেয়েছি। আমার যৌবন তত তোমার সামনেই রয়েছে। এসব আমার পাপ ছিলো এবং আমি এসব থেকে তাওবা করে নিয়েছি।
আজ আমি সেসব কথাই স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যা তুমি শুনতে চাও না। হ্যাঁ, সুলতানা! একটা পাপ আমি করে যাচ্ছি, এ থেকে হয়তো আমি তাওবা করবো না। এটা হলো, তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা। এটা ছাড়া আমি টিকতে পারবো না।
ভালোবাসাকে তুমি পাপ মনে করো? সুলতানা বললো।
এটা এর ওপর নির্ভর করে তুমি কাকে ভালোবাসছো এবং কিভাবে ভালোবাসছো। তুমি তো জানোই আমাদের ভালোবাসা কোন ধরণের? আমীর আব্দুর রহমান তোমাকে হেরেমের হীরা বলে এবং আমিও তোমাকে আমার হীরা বলি। যারিয়াব বললো।
অন্য কোন কথা বলো যারিয়াব!
না সুলতানা যারিয়াব দুঃখভরা গলায় বললো, তুমি অতীতের পর্দা উঠিয়ে দিয়েছে। তাই তুমি শুনতে না চাইলেও আমার না বলা কথা তোমায় শুনতে হবে। তারপর আমি তোমার কথা শুনবো।
আমার এখন একটি কথাই রয়ে গেছে। আমার ছেলে আব্দুর রহমানের স্থলাভিষিক্ত হবে। প্রভাবশালী তিন চারজন উমারাকে আমার হাতে নিয়ে নিয়েছি। এখন আমি আমীর আব্দুর রহমানের মৃত্যুর অপেক্ষা করছি। তার তো এখন মরে যাওয়া উচিত। তুমি কি আমার ছেলের পক্ষে নেই?
আগে সময় আসুক। যারিয়ার বললো, আমীর আব্দুর রহমানের পয়তাল্লিশ জন পুত্র। এর মধ্যে কিছু তো তার বিবাহিতা স্ত্রীদের সন্তান। অধিকাংশই হেরেমের মেয়েদের পেটের সন্তান। এর মধ্যে এক সন্তান তোমার। আমি চাই আব্দুর রহমান মৃত্যুর আগে যেন তার স্থলাভিষিক্ত নির্বাচন করে যান। আর তা না করে গেলে তার মৃত্যুর সময় পুরো মহলে রক্তের বন্যা বইবে।….
আর এমন ঘটলে ধর্মদ্রোহী সন্ত্রাসী খ্রিষ্টান দলগুলোর ওপর সবার দৃষ্টি অন্যদিকে সরে যাবে। সালতানাতে উন্দলুস তখন ভয়াবহ অবস্থায় পড়বে। ভেবে দেখো সুলতানা! এক্ষেত্রে মুদ্দাসসিরার মতামতকেও আমীর গুরুত্ব দিবেন। মুদ্দাসসিরার মতো প্রভাব কিন্তু তোমার নেই। সে চাইলে তোমাকে মহল থেকেও বের করে দিতে পারবে।
সুলতানা গভীর চিন্তায় হারিয়ে গেলো।
তুমি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলে আমীরে উন্দলুসকে পাক্কা মুসলমান কে বানিয়েছে? যারিয়ার বললো, আমাকে তুমি বিদ্রূপও করেছিলে। তবে পাক্কা মুসলমান আমি নই মুদ্দাসসিরাই এ অবদানের সবচেয়ে বড় দাবীদার। ইসলামের খাঁটি প্রেম রয়েছে ওর মধ্যে। আর আমীরে উন্দলুস আব্দুর রহমানের মধ্যেও আত্মমর্যাদাবোধ কিছুটা অবশিষ্ট ছিলো।…
তিনি ভোগ বিলাসের জীবন থেকে মুক্ত হওয়াতে ইসলাম উন্দলুস কিছুটা হলেও মজবুত শিকড় গাড়তে পেরেছে। তার শাসনামলের শুরুতে মনে হচ্ছিলো খ্রিষ্টানরা উন্দলুসের শিকড়ে দাঁত বসাতে যাচ্ছে।…..
কারণ, এ লোক তোমার মতো সুন্দরীদের বেহেশতে হারিয়ে গিয়েছিলো। তোমার কি মনে নেই, তোমার রূপ যৌবন এবং আমার সুর সঙ্গীত আমীর আব্দুর রহমানকে সালতানাতের সব ধরনের ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে বেপরোয়া করে দিয়েছিলো।..
***
কোন শাসক যখন অযোগ্য হয়, নির্বোধ বা ভোগ বিলাসপ্রিয় হয় তখন সে চাটুকার ও তার দেশের শত্রুদের জন্য বেশ কার্যকর শাসক বনে যায়। সে সব উপদেষ্টা আর পরামর্শই তার কাছে ভালো লাগে যারা তাকে এই উপলব্ধি দেয় যে, সে নির্বোধ ও অযোগ্য নয়। যারিয়াব অক্লান্ত বলে যাচ্ছে।
তাহলে আমি আমীরে উন্দলুসের চাটুকার! সুলতানা গাল ফুলিয়ে বললো।
আমি ও তুমিও। দুজনই আমরা তাকে ধ্বংশের দ্বার প্রান্তে নিয়ে গিয়েছিলাম। এর ফলেই তার শাসনকালেই উন্দলুসের ইতিহাসে খ্রিষ্টানরা সবচেয়ে বেশি বিদ্রোহ করেছে। ধর্মদ্রোহীদের আন্দোলন তার যুগেই সবচেয়ে বেশি সাফল্য লাভ করেছে। সুলতানা! মনে করে দেখো! সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ও রক্ত তার আমলেই ঝরেছে।….
আবার তার যুগেই কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী ও প্রতিভাবানরা সবচেয়ে বেশি সম্মান ও পুরস্কার পেয়েছে এবং পৃষ্ঠপোষকতাও। আবার তার কালেই দুশমন মাত্রাতিরিক্ত দুঃসাহসিক হয়ে উঠেছে। তবে এটা আমীরে আব্দুর রহমানের প্রবল ব্যক্তিত্ব দীপ্ত ঈমানের পরিচায়ক যে, তিনি এক সময় শরাবের পেয়ালা ছুঁড়ে ফেলেছেন। আমার প্রিয় গিটারের তার ছিঁড়ে দিয়েছেন। আর তোমার রূপের জাদুর জাল ছিন্ন করে বেরিয়ে এসেছেন।…
এসবের পেছনে অবশ্যই এক নারী ও কয়েকজন বীর পুরুষের অবদান আছে। ইচ্ছে করে নির্জনে বসে যাই এবং উন্দলুসের সেসব ইতিহাস নিজের চোখের সামনে হাজির করি যা আমীর আব্দুর রহমানের কর্মজীবনে রচনা করেছেন। খ্রিষ্টান সন্ত্রাসীদের মরণ বিষ এ লোক যেভাবে অকার্যকর করে দিয়েছে, অতীতের কোন আমীর তা পারেনি।…….
তুমি জানা সুলতানা! এই আব্দুর রহমানের কাছেই তার দুশমনরা বন্ধুত্ব ও সাহায্যের ভিক্ষা চাইতে এসেছিলো। বার্য নাটাইনি, মোকয়েলি এসেছিলে, থিয়োক্লাস এসেছিলো। এমনকি উন্দলুসের সবচেয়ে বড় দুশমন ফ্রান্সের শাহলুই যখন তারই ছেলের বিদ্রোহে ঘাবড়ে গিয়ে ছিলেন তখন তিনি তার এক দূত গোপনে আমীরের কাছে এই আবেদন প্রার্থনা করে পাঠান যে,
উন্দলুসে যে খ্রিষ্টানরা বিদ্রোহ করছে এদের আমি কোন সাহায্য করবো না। এর বিনিময়ে আপনি ফ্রান্সের ওপর হামলা করবেন না। এই অনুগ্রহের জন্য বিনিময় হিসাবে যদি আপনি কিছু চান এবং যা কিছুই চাইবেন আপনার দরবারে সেটা পৌঁছে যাবে।
আমীরে উন্দলুস এই জবাব পাঠান যে, ঠিক আছে। তোমার দেশে হামলা করবো না। এর বিনিময়ে শুধু এতটুকু চাই যে, কখনো উন্দলুসের সীমান্তে এলাকার দিকে চোখ উঠিয়ে তাকাবে না। যদি উন্দলুসের কোন বিদ্রোহী তোমার এলাকায় চলে যায় তাহলে তাকে ঘোড়ার পিঠে বেঁধে এদিকে তাড়িয়ে দিবে। ব্যাস, আর কিছু চাই না।….
আর সুলতানা! এই আমীর আব্দুর রহমানই যিনি সমুদ্রে রাজত্ব করেছেন। সেখানেও তার তলোয়ার ঝলক দেখিয়েছেন। তুমি তো ছিলে এক রহস্যময় দুনিয়ার নারী। তুমি সবসময় চেষ্টা করেছে, আমীর আব্দুর রহমান যেন যুদ্ধের ময়দানে গিয়ে নেতৃত্ব না দেন।….
কারণ, আমি এটা কখনো চাইতে পারি না যে, যাকে আমি ভালোবাসি সে যুদ্ধের ময়দানে গিয়ে মারা পড়ুক। সুলতানা বললো।
সুলতানা! যারিয়াব আক্ষেপের সুরে বললো, এই বয়সে এসেও যদি তুমি মিথ্যা বলা থেকে তাওবা করে নাও, তবুও তুমি দেখবে দারুণ আত্মিক শান্তি অনুভব করছো। তোমাকে তো উন্দলুসের দুশমনরা নির্দেশ দিয়েছিলো, ওদেরকে এ সাহায্য করতে হবে যে, আব্দুর রহমানকে যুদ্ধের ময়দানে কিংবা কোথাও বিদ্রোহ দমন করার ব্যাপারে যেতে দেবে না। কারণ, আব্দুর রহমানের রণাঙ্গনে নেতৃত্ব দেয়ার যে জাদুকরী যোগ্যতা রয়েছে এর সামনে দুনিয়ার কোন যুদ্ধ শক্তিই টিকতে পারবে না।….
এ ছাড়াও আমীরে উন্দলুস যখন নিজে ফৌজের সাথে থাকেন তখন তো সালার থেকে নিয়ে সাধারণ সিপাহীরা পর্যন্ত প্রাণ বিসর্জন দিয়ে লড়াই করে। কিন্তু তুমি তাকে বেশি দিন আটকে রাখতে পারোনি। মুদ্দাসসিরা পবিত্র কুরআনের আয়াত পড়ে একটি তলোয়ারে ফুক দিয়ে তার হাতে তলোয়ার তুলে দেয় এবং বলে, যাও আমার মাথার মুকুট! আল্লাহ তোমার সঙ্গে আছেন। বিজয় তোমারই হবে।
***
যারিয়াব সুলতানার সামনে অজানা আরেক কাহিনীর দ্বার উন্মোচন করলো। বললো,
আমীরে উন্দলুস নারী ও ভোগ বিলাসপ্রিয় এটা জেনে অগ্নিপূজক ডাকাত ও লুটেরা দলও আব্দুর রহমানের আত্মমর্যাদাবোধকে চ্যালেঞ্জ করে। উন্দলুসের পূর্ববর্তী আমীরদের ব্যাপারেও অগ্নিপূজকরা সমুদ্র পথে কেয়ামতের বিভিষিকা নামিয়ে দিয়েছিলো। ওদেরকে সামুদ্রিক ফৌজ বললেও সঠিক হবে। শক্তিশালী এবং বিশাল এক ব্যটালিয়ান ছিলো ওদের।…।
ওরা অন্যান্য অনেক দেশের শক্তিশালী নৌ বাহিনীকে ধ্বংস করে দিয়েছে। এরা মূলত: জার্মানীর লুটেরা দল। যারা খোদ জার্মানিতেই বিতাড়িত। সমুদ্রে পছন্দ মতো শিকার না পেলে উপকূলে এসে বসতিগুলোতে লুটপাট চালায়। সাকেন্ড নিওয়া নামক উপকূলে ওদের আড্ডা। ওখানে সমুদ্র এতই বিপদজনক ও ভয়ংকর হয়ে থাকে যে, কোন নাবিকই সেদিকে জাহাজ নিয়ে যেতে দুঃসাহস দেখায় না।…
অগ্নিপূজকদের এই জলদস্যুরা এতই হিংস্র ও রক্ত পিপাসু যে, সমুদ্রের উত্তাল ঝড়ও যেন ওদেরকে সমীহ করে চলে। যে কোন ধরনের নৌযান চালনায় ওদের দক্ষতা অতুলনীয়। সাধারণ ডিঙ্গি নৌকা নিয়েও ওরা বিক্ষুদ্ধ সাগরে বেরিয়ে পড়ে।
কয়েক বছর আগের ঘটনা। আমীর আব্দুর রহমান কিছুটা ক্লান্ত হয়ে কামরায় আধশোয়া অবস্থায় ছিলেন। আমাকে বাদ্যযন্ত্র নিয়ে যাওয়ার হুকুম পাঠালেন। আমাকে দেখে বললেন,
যারিয়াব! ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। বুড়ো হয়ে গেছি না? কিছু একটা শোনাও যারিয়াব! বড় উদাস সুরে।
আমি গিটার বাজাতে শুরু করলাম, গুন গুন করে গান ধরছিলাম। এ সময় দারোয়ান এসে জানালো, সালারে আলা উবাইদুল্লাহ ইবনে আব্দুল্লাহ কিছু মুসাফির পাঠিয়েছেন। এরা মনে হচ্ছে বড় মাজলুম। এদের সাথে কয়েকজন নারীও আছে।…..
আমি বলতে যাচ্ছিলাম, আমীর এ সময় কারো সাথে সাক্ষাৎ করবেন না। কিন্তু আমীর সোজা হয়ে বসলেন এবং আমাকে বললেন, বাদ্যযন্ত্র দূরে সরিয়ে রাখো। এরা যদি মজলুম মুসাফির হয় তাহলে এদের কাছে বাদ্যযন্ত্রের আওয়াজ ভালো লাগবে না।
তিনজন লোক ভেতরে এলো। এদের সাথে একজন মধ্যবয়স্কা মহিলা ও দুইজন যুবতী মেয়ে ছিলো। ধূলো মলিন কাপড় চোপড়েও মেয়ে দুজনকে বেশ সুন্দরী লাগছিলো। মহিলা ও মেয়ে দুজনের চোখ অশ্রু ভেঝা। এরা সবাই মেঝেতে হাঁটু মুড়ে বসে পড়লো এবং হাত জোড়ে রইলো। বুঝাই যাচ্ছিলো এরা মুসলমান নয়।…..
আমীর আব্দুর রহমান ওদেরকে আরাম করে বসতে বললেন এবং দারোয়ানকে ডেকে ওদের জন্য সেই শরবত নিয়ে আসার জন্য বললেন যা তিনি নিজে পান করে থাকেন।
ওদের সামনে ফল ফুটের স্তুপ্ত এনে রাখা হলো। তারপর তাদেরকে জিজ্ঞেস করা হলো, ওরা কি ফরিয়াদ নিয়ে এসেছে? মধ্য বয়স্কা মহিলা গ্রাম্য ভাষায় বললো,
আমাদেরকে সেসব হিংস্র-জঙ্গলীদের অনুগ্রহের ওপর এজন্যই কি আপনি ছুঁড়ে ফেলে ছেন যে, আমরা মুসলমান নই? আমরা কি মানুষ নই?
তার সাথে বসে থাকা এক লোক তাকে কনুই দিয়ে গুতো মেরে বললো, আরে ভদ্রভাবে কথা বলো। ইনি তো বাদশাহ।
আব্দুর রহমান গর্জে উঠে বললেন, আরো ক্ষুদ্ধ কণ্ঠে কথা বলো। এখানে কেউ বাদশাহ নয়। আমরা অবশ্যই তোমাদেরকে সাহয্য করবো। সেই হিংস্র আর রক্তলুলুপ জঙ্গী কারা?
সেই মহিলা বললো, ওরা জার্মানি দস্যুদল। এদেরকে নারমানও বলা হয়। ওরা আমাদের বসতিগুলো উজাড় করে দিয়েছে। ফসল ছাড়া আমাদের কাছে কিই বা আছে? ওরা ফসল, গবাদি পশু নিজেদের সাথে করে নিয়ে যায়। সুন্দরী মেয়ে ও শিশুদেরকেও ওরা উঠিয়ে নিয়ে যায়। তারপর তাদেরকে সমুদ্র তীরবতী দেশগুলোতে বেঁচে দেয়।….
আমরা যাবোই বা কোথা? ওদের চামড়ার ডিঙ্গি নৌকাগুলো আমাদের উপকূলে একবার নোঙ্গর করার পর আমাদের লোকেরা সব পালিয়ে যায়। এই মেয়ে দুজন আমারই মেয়ে। ওদের নিয়েই সবচেয়ে দুশ্চিন্তা ছিলো।……
ওদেরকে নিয়ে জঙ্গলে গিয়ে লুকাই। সাথে ছিলো ছোট একটি বাচ্চা। রাতে এমন ভয়ংকর ঠান্ডা পড়ে যে, বাচ্চাটি তাতেই মারা যায়। আমি তো পাগল হয়ে যাই। আমার স্বামী বলে, চলো আমরা কর্ডোভায় যাই।
জানি না ক্ষুধা-তৃষ্ণায় মরতে মরতে পড়তে পড়তে কতদিনে এখানে এসে পৌঁছেছি আমরা। আপনার তলোওয়ার যদি ওই জলদস্যুদের বিরুদ্ধে কোষমুক্ত না হয় তাহলে কমপক্ষে আমাদের মেয়ে দুটোকে আশ্রয় দিন। আমরা শুনেছি, নারীর সম্ভ্রম রক্ষায় মুসলমানরা প্রাণপর্যন্ত দিয়ে দেয়।….
সুলতানা! আমীর আব্দুর রহমানের চেহারায় তখন যে রঙ ধারণ করেছিলো আজো আমার সেটা মনে আছে। তিনি দারোয়ানকে ডেকে বললেন,
এদের সবাইকে শাহী মেহমানখানায় নিয়ে রাখে। এদেরকে গোসল করিয়ে নতুন কাপড় দাও। শাহী খাবার খাইয়ে এদেরকে সুস্থ করে তোলো। আর সালারে আলাকে এখনই আমার কাছে পাঠিয়ে দাও।
আমি দেখলাম আব্দুর রহমানের বৃদ্ধ চেহারায় যৌবনের ঝলক ভেসে উঠলো। তিনি বললেন, আল্লাহ তাআলা আমার ওপর এই ফরজ দায়িত্বও আরোপ পরেছেন। এ দায়িত্ব আমি অবশ্যই পালন করবো। তাঁর উদাস ভাব ও বয়সের ভার যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে তখন।
***
রাত বাড়ছে। যারিয়ারের কথা বলায়ও যেন স্পৃহা বেড়ে যাচ্ছে। সে বলে যাচ্ছে,
সালারে আলা উবাইদুল্লাহ এলে আব্দুর রহমান তাকে বললেন,
আপনার পাঠানো মজলুম ও মজলুমা নারী পুরুষরা আমার কাছে এসেছিলো। আমাদের কাছে অগ্নিপূজক জার্মান দস্যুদের মতো মজবুত জলযান নেই। কিন্তু আমি ওদের বিরুদ্ধে লড়াই করে হলেও ওদেরকে খতম করতে চাই।
সালারে আলা বললেন, আমাদের কাছে বড় বড় কিছু নৌকা ও ছোট ছোট কিছু জাহাজ আছে। এসব দিয়ে আমরা সামুদ্রিক লড়াইয়ে টিকতে পারবো না। আপনি হুকুম দিলে বড় জাহাজ বেশ কয়েকটা বানানো যাবে। এ সময়ের মধ্যে আমাদের পর্যাপ্ত পরিমাণ সৈন্য সেই উপকূল অঞ্চলে পাঠিয়ে দেয়া হবে। যেখানে জলদস্যুরা এসে লুটপাট চালায়।
তৎক্ষণাৎ ফৌজকে কোচ করার হুকুম দেয়া হলো। জলদস্যুদের দুঃসাহস এত বেড়ে গেলো যে, এরা ডিঙ্গি নৌকা দিয়ে নদীতে এসেও আশে পাশের গ্রামে লুটপাট চালাতে শুরু করে।
কর্ডোভার পাঠানো ফৌজের প্রথম সংঘর্ষ হয় ওয়াদিল কাবীর নামক এক উপত্যকা দিয়ে নদী অতিক্রম করার সময়। জলদস্যুরা লড়াই নদী থেকে উপকূল পর্যন্ত নিয়ে আসে। তারা নৌযান থেকে এমন শিলা বৃষ্টির মতো তীর বর্ষণ করে যে, ফৌজের পিছু হটতে হয়।…..
খুব দ্রুত নৌযান জাহাজ প্রস্তুত হতে লাগলো। কিছু প্রস্তুতকৃত জাহাজও পাওয়া গেলো। উপকূল এলাকার অনেক জায়গাতেই ফৌজ মোতায়েন করা হলো। লুটেরাদের সাথে বেশ কয়েক জায়গায় তাদের লড়াই হয়। এতে উপকূল অঞ্চলে লুট কমে গেলো। এরা সমুদ্রে চলে গেলো। অন্যান্য দেশের জাহাজের ওপর এবার হামলা চালাতে শুরু করলো।
আমীর আব্দুর রহমান ওদেরকে চির দিনের জন্য খতম করে দেয়ার অঙ্গিকার করলেন। তিনি ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানে যুদ্ধজাহাজ প্রস্তুত করালেন। বড় জাহাজ পনেরটি। এর সঙ্গে ছোট জাহাজ ও বড় পাল তোলা নৌকাও আছে অনেক গুলো। নৌপথে লড়াইয়ের জন্য ফৌজ তৈরি করা হলো।
বেশ কয়েক মাস তাদেরকে সমুদ্রে রেখে সামুদ্রিক আবহাওয়ায় অভ্যস্ত করানো হলো। তারপর উপকূলের পাশ ঘেষে বড় বড় বুরুজ নির্মাণ করানো হলো। ওখানে সব সময় প্রহরা নিয়োজিত থাকতো।……
ওরা দূর থেকে জাহাজ বা নৌযানগুলোকে দেখতে পেতো। কোন জাহাজ উপকূলের দিকে আসতে থাকলে এবং সন্দেহজনক হলে বুরুজের ঘোড়সাওয়ার পয়গাম বাহক নৌবাহিনীকে সংবাদ দিয়ে আসতো।….
নারমান জলদস্যুরা একবার তাদের সব যুদ্ধ নৌযানগুলোকে সমুদ্রে একত্রিত করে তাদের যুদ্ধশক্তির প্রদর্শন করলো। আমীর আব্দুর রহমান এ সংবাদ পেয়েই তিনি উপকূলে পৌঁছে যুদ্ধ জাহাজাগুলোর নেতৃত্ব নিজের হাতে নিয়ে নিলেন। তারপর খোলা সাগরে বেরিয়ে পড়লেন। তিনি তার বাহিনীকে এর আগে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়েছেন।…
জলদস্যুদের কখনো কারো সঙ্গে বড় ধরণের লড়াই হয়নি। এখন লড়াই এক নিয়মিত ফৌজের সঙ্গে। লড়াইয়ের কয়েক মিনিটের মধ্যেই জার্মান জলদস্যু বাহিনীর টনক নড়লো যে, তারা আজ নিশ্চিত মরণ ফাঁদে পড়েছে।
ঘন্টাখানেকের মধ্যে তাদের নৌযানগুলো জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে সমুদ্রে মিশে গেলো। কয়েকটি জাহাজ মাত্র ওরা অক্ষত রাখতে পারলা। এরপর অগ্নিপূজক জলদস্যুদের কেবল নামই রয়ে গেলো। উন্দলুসের উপত্যাকা এবং দূর দূরান্ত পর্যন্ত সাগর নিরাপদ হয়ে গেলো।
সুলতানা যারিয়াবের কথা শুনতে শুনতে ক্লান্তির শেষ সীমায় পৌঁছে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে বিরক্তও হলো। সে ভেবেছিলো, যারিয়াব এসে তার পাকা চুল দেখে বলবে, সে এখনো পঁচিশ বছরের যুবতীর মতো রূপসী এবং সতেজ। কিন্তু যারিয়াব তাকে বাস্তবতার নিরেট আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
নিজের আত্মপ্রবঞ্চনা থেকে মুক্ত না হলে যে কোথাও সে দুদন্ড শস্তি পাবে না এটা তার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।
সুলতানা আরো ভেবেছিলো, তার ছেলে আব্দুল্লাহর জন্য সিংহাসনের পথ পরিস্কার করতে যারিয়াবের প্রভাবকে কাজে লাগাবে। যারিয়াব তার সেই আশায় সোজা পানি ঢেলে দিয়েছে। তাই যারিয়াব চলে যেতেই সুলতানা ঘৃণাভরে বলে উঠলো,
শালা বুড়ো অকর্মা! এখন যখন কোন নারীর যোগ্য তো দূরের কথা নিজের জন্যও যখন অযোগ্য হয়ে পড়েছে তখন বেটা ওয়ালিআল্লাহ বনে গেছে। এখন আমীরে উন্দলুসের মুরিদ হয়ে গেছে। এই বুড়োর চেয়ে আমার ক্ষমতা এখন অনেক বেশি।
পুরো প্রশাসনে ঝড় বয়ে দিতে পারে এমন লোকও আমার হাতে আছে। আমি এক দিক থেকে শুরু করবো, প্রথম আব্দুর রহমানই। তারপর মুদ্দাসসিরা। তারপর…
তার রগ-রেশায় আনন্দের বন্যা বয়ে গেলো। তার ভেতরের সব শয়তানী শক্তি জেগে উঠলো।
আমীর আব্দুর রহমানের এক মুক্তিপ্রাপ্ত কৃতদাস নসর। এর উল্লেখ দেখা যায় ইতিহাসে। সে খুব তীক্ষ্ম মেধার অধিকারী ছিলো। আব্দুর রহমান তাকে শুদু গোলামি থেকে মুক্তই করেননি দরবারেও তাকে এক উঁচু পদ দান করেন। নসরের এক দিক ছিলো শয়তানিতে পূর্ণ। সুলতানা এটা বুঝতে পেরে শুরু থেকেই নসরকে তার গোলাম বানিয়ে নেয়।
সুলতানা আব্দুর রহমানের কাছে সব সময় তার অনেক প্রশংসা করতো। সুলতানা তাকে অনেক ধন-সম্পদও দান করে। নসর এখন যারিয়াবের মতো প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছে গেছে। এখনো সে সুলতানার অনুগত।
পর দিন সূর্য মাথার ওপর উঠে আসার পর সুলতানার চোখ খুললো। ঘুম ভাঙ্গতেই সে খাদেমাকে ডেকে বললো,
নসরকে ডেকে নিয়ে আসো। আসার সময় যেন কারো নজরে না পড়ে।
নসর আসতেই তাকে পালংকের ওপর বসালো। নিজে তার সঙ্গে লেগে বসলো। কিছুক্ষণ অতীতের কথাবার্তা বলে তরল ধরণের রসিকতা শুরু করলো।
বুড়ো নসর যখন গরম হয়ে উঠলো তখন তার কানের সাথে নিজের মুখ লাগিয়ে ফিস ফিস করে কি যেন বললো। নসরের দুচোখ বড় বড় হয়ে উঠলো।
এই পাপও আমার হাতে করাবেন? নসর হয়রান হয়ে বললো।
হ্যাঁ, নসর! এই পাপও তোমার হাতে করাবো। সুলতানা নাগিনীর মূর্তি ধারণ করে বললো, সেই সুন্দর সুন্দর পাপগুলোর কথা স্মরণ করো যা আমার বখশিশের লোভে তুমি করে এসেছে। এর মধ্যে কিছু পাপ তো এমন আছে যা আজো তোমাকে জল্লাদের হাতে তুলে দিতে পারে।…….
তুমি কি জানো না, জল্লাদের তলোয়ার আমার ইশারায় চলবে? আমার এ কাজটি করে দাও। তাহলে আমার ছেলে হবে আমীরে উন্দলুস। আর তোমার ছেলে হবে ফৌজের প্রভাবশালী সালার।
নসর যেন শিকলে বাঁধা পড়লো। সে জানে, সুলতানা নাগিনী। যাকে ছোবল দেবে সে শেষ হয়ে যাবে। তার সন্তানের ভবিষ্যৎ কল্পনার চেয়ে উজ্জল। সে হেসে বললো,
আমি না করলে এ কাজ আর কে করবে?
অনেক্ষণপর নসর সুলতানার ঘর থেকে বের হয়ে শাহী ডাক্তার হুররানীর কাছে গেলো। হুররানী এখন অশীতপর বৃদ্ধ। নসরের কথা শুনে হুররানীর আপদমস্তক কেঁপে উঠলো।
আপনার জন্য দুটি পথ খোলা রয়েছে। নসর হুররানীকে বললো, একটা হলো, এই বয়সে কয়েদখানার সেসব ভয়ংকর নির্যাতন ভোগ করা যা সদ্য যুবক। কোন লোকও সহ্য করতে পারবে না।……….
আপনি জানেন, আমার মুখ থেকে আপনার বিরুদ্ধে যে অভিযোগই বের হতে তা কোন প্রমাণ ছাড়াই সত্য বলে সাব্যস্ত হবে। তখন আপনার বাকি জীবনটা কয়েদখানায় কাটাতে হবে। আরেকটা পথ হলো, এই দুনিয়াতেই আপনি বেহেশত দেখতে পাবেন। হীরা জহরতের স্তূপ থাকবে আপনার সামনে, আপনি ভেবে দেখুন।
হুররানী ভয়ে এতটুকু হয়ে গেলেন। নিজের পরিণাম সম্পর্কে এমনভাবে ঘাবড়ে গেলেন যে, কাঁপা হাতে বিষের একটা ট্যাবলেট নসরের হাতে তুলে দিলেন। ইতিহাসে এর নাম লেখা হয়েছে, লিবয়ানুল মানুক।
এ বিষ মুহূর্তের মধ্যেই প্রাণ নাশ করে দেয়। নসর তাকে এটা বলেনি যে, বিষ কার ইঙ্গিতে নিয়ে যাচ্ছে।
আব্দুর রহমানের স্ত্রী মুদ্দাসসিরার বয়স সুলতানার চেয়ে কম। তবুও প্রৌঢ়ত্বের প্রচ্ছন্ন ছায়া তার মধ্যেও পড়তে শুরু করেছে।
একদিন সন্ধ্যায়, ডাক্তার হুররানীর পক্ষ থেকে এক মহিলার মাধ্যমে মৌখিক পয়গাম পেলো মুদ্দাসসিরা যে, যে কোন অসুস্থতার অজুহাত ধরে আমাকে ডেকে পাঠান। একটু পর মুদ্দাসসিরা খাদেমাকে ডেকে বললো,
আমার পুরো শরীরে ব্যথা ছাড়িয়ে পড়েছে। এখনই শাহী হাকিমকে ডেকে আনো।
খাদেমা ছুটে গেলো এবং হুররানী এসে গেলো।
মালিকায়ে আলিয়া! হুররানী মুদ্দাসসিরাকে বললো, আজ আমার সে দিনের কথা মনে পড়ছে যেদিন সুলতানা আমার কাছ থেকে বিষ নিয়েছিলো আপনাকে হত্যা করার জন্য এবং আমি আপনাকে সাবধান করে দিয়েছিলাম, সুলতানার পক্ষ থেকে কোন খাদেমা আপনাকে কোন দুধ বা শরবত দিলে সেটা আপনি পান করবেন না। কারণ, তাতে থাকবে বিষ।
হা, মুহতারাম! মুদ্দাসসিরা বললো, কত বছর আগের কথা। অথচ মনে হচ্ছে গত কালের ঘটনা। আমারও মনে আছে, মানসিকভাবে আপনি এতই ভেঙ্গে পড়েছিলেন যে, এখান থেকে চলে যেতে চাচ্ছিলেন। আমি আপনাকে বলেছিলাম, আপনি যাবেন না। হতে পারে, একদিন আমীরে উন্দলুসকে দেয়ার জন্যও আপনার কাছ থেকে বিষের পুরিয়া নিতে পারে কেউ।
তখন আপনি তাকে সতর্ক করে দেবেন। জানি না তখন কেন এ কথা বলেছিলাম… সেই ঘটনা এখন কেন স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন? আপনি কি আমাকে বিশেষ কিছু বলতে চাচ্ছেন?
আপনি যেহেতু পুণ্যবতী এক নারী তাই আল্লাহ তাআলা আপনাকে আপনার অজান্তে অনাগতগ কোন কোন ঘটনার ইঙ্গিত আগেই দিয়ে দেন। হুররানী বললেন, আজ আমীরে উন্দলুসের সেই গোলাম যাকে তিনি দরবারে উচ্চ পদে। সমাসীন করেছিলেন, সেই নসর আমার কাছ থেকে বিষ নিয়ে গেছে। সে এটা আমীরে উন্দলুসের ওপর প্রয়োগ করবে।
হুররানী মুদ্দাসসিরাকে বিস্তারিত জানালো। নসর তাকে কিভাবে হুমকি দিয়েছে এবং কি কি লোভ লালসা দেখিয়েছে।
আপনি কি আমার অপারগতা বুঝতে পারছেন?
কেন বুঝবো না! কিন্তু নসর কি এটা বলেনি কার ইঙ্গিতে সে এত বড় অপরাধ করতে যাচ্ছে? মুদ্দাসসিরা জিজ্ঞেস করলো।
না, আমি বেশ কয়েকবার জিজ্ঞেসও করেছি। কিন্তু সে বলেনি। আপনি আমীরে উন্দলুসকে সতর্ক করে দিন। নসর বা কোন খাদেমার হাতে তিনি কোন কিছু যেন না খান। আপনি আমাকে অনুমতি দিন। আমি যথাসম্ভব আমার দায়িত্ব পালন করেছি।
ঠিক আছে আপনিও বিষয়টা গোপন রাখবেন।
অবশ্যই। অবশ্যই।
অবিরাম-বিশ্রামহীন যুদ্ধের ময়দানে কাটানোর কারণে এবং সর্বশেষ নৌপথের যুদ্ধে দীর্ঘসময় অসম্ভব খাটুনির কারণে আমীর আব্দুর রহমানের শরীর অনেক খানিই ভেঙ্গে পড়েছে। তার ওপর বার্ধক্যের চাপ তো আছেই। তাই নিয়মিতই তাঁর কোন না কোন ঔষধ সেবন করতে হয়।
একদিন তাঁর অতি বিশ্বস্ত পরামর্শক নসর তাঁর কাছে এলো। তার হাতের একটা কৌটা দেখিয়ে বললো, এতে এমন এক আশ্চর্য জীবন সঞ্জীবনী আছে যে, তা সেবন করলে যৌবনের শক্তি শরীরে ফিরে আসে। দূর দেশের এক হাকিম থেকে আমি এটা আনিয়েছি।
তুমিও তো অনেক বুড়ো হয়ে গেলো নসর! আব্দুর রহমান কাষ্ঠ হেসে বললেন, বার্ধক্যকে যৌবনের রূপান্তর করে দেয়ার মতো সঞ্জিবনী তোমার বরং অধিক প্রয়োজন। আমি তো অনেক ঔষধই খাচ্ছি। এটা তুমি খেয়ে নাও।
না, না, এটা তো আমি আপনার জন্য নিয়ে এসছি। নসর জোর হেসে বললো।
নসর। আব্দুর রহমান বাদশাহী গাম্ভীর্যভরা গলায় গর্জে উঠলেন।
আমি তোমাকে হুকুম দিচ্ছি, এ ঔষধটুকু এখনই তুমি তোমার মুখে পুরে নাও।
ঘামে নসর প্রায় গোসল করে ফেললো। এ হুকুম পালন না করা ছাড়া তার উপায় নেই। সে বিষের পুরিয়াটি মুখে পুরে নিলো। আব্দুর রহমান তখনই তাকে চলে যেতে বললেন।
ঐতিহাসিকরা লিখেছেন, নসর দৌড়ে বাইরে বের হয়ে হুররানীর কাছে ছুটে গেলো। তাকে বললো, যে বিষ সে আমীরে উন্দলুসকে খাওয়াতে গিয়েছিলো সেটা তাকে খাইয়ে দেয়া হয়েছে। খোদার দিকে চেয়ে কিছু একটা করুন।
তাড়াতাড়ি গিয়ে বকরির দুধ পান করে নাও। হুররানী তাড়া দিলেন।
নসর দৌড়াতে শুরু করলো। কিন্তু বিষ তার যা কাজ করার সেটা করে ফেলেছে। পথেই সে আধোমুখো হয়ে পড়ে গেলো।
ঐতিহাসিকরা লিখেছেন, আমীর আব্দুর রহমান মরণ বিষ থেকে তো বেঁচে গেলেন এবং বিষ প্রয়োগকারীও সে বিষ খেয়ে শেষ হয়ে গেলো।
কিন্তু যে গোলামকে তিনি স্নেহ করে এত বড় পদ দিয়েছেন যাকে এত বিশ্বাস করেছেন সে তাকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করতে চেয়েছিলো, এই চিন্তা তাঁকে এমনভাবে আহত করলো যে, সাত আট দিন পর পুরো উন্দলুসবাসীকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে চলে গেলেন।
সেটা ছিলো ২২ সেপ্টেম্বর ৮৫২ খ্রি.।
বহুদিনপর এ তথ্য ফাঁস হয় যে, সুলতানা মালিকায়ে তরুবের কথায় নসর আমীর আব্দুর রহমানকে বিষ পান করাতে চেয়েছিলো।
আমীর আব্দুর রহমানের মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে মুহাম্মাদ তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। আর উন্দলুসের কালনাগিনী সুলতানা ও তার ছেলে আব্দুল্লাহ ইতিহাসের অন্ধকার পাতায় হারিয়ে যায়।
আর নান্দনিকতায় অমর ইতিহাস হয়ে থাকে দেহ-মন সর্ব দিক দিয়ে রূপসী মুদ্দাসসিরা।
সমাপ্ত
১৩-৫-২০১০
রাত ২টা
কালনাগীণিরা আজো বিদ্যমান,,
আন্দালুসিয়ার সমুদ্র সৈকত ওপেন হচ্ছে না কেন?
হয় তো, এটা প্রথম অধ্যায় – https://www.ebanglalibrary.com/102410/