৭. ফ্লোরা এখন নজরবন্দি

ফ্লোরা এখন নজরবন্দি অবস্থায়ও বেশ শান্ত। প্রহরায় নিযুক্ত তিন মহিলা বেশ দুশ্চিন্তামুক্ত। ফ্লোরা তাদেরকে কোন পেরেশান করছে না। ওদেরকে এই মেয়ে সম্পর্কে যা বলা হয়েছে এতে ওরা ভেবেছিলো, এই মেয়ে ভয়ংকর কোন পাগল। যাকে কেউ সামলাতে পারছে না।

তুমি কী অপরাধ করেছে ফ্লোরা? একদিন প্রহরী এক মহিলা তাকে জিজ্ঞেস করলো।

আমাকে আমার বাপ এক বুড়োর সঙ্গে বিয়ে করাতে চেয়েছিলো। ফ্লোরা বললো, এ লোক শুধু বুড়োই নয়, মদখোর, নারীবাজ। আমার বাপ ঐ বুড়োর সঙ্গে সওদা করে নিয়েছে। আমি তো সেটা মানতে পারি না। অস্বীকার করে দিয়েছি। এমন বুড়োর কাছে তোমরা কি কেউ বিয়ে বসতে পারবে?…

আমি রাজি হইনি বলে আমার ভাই আমাকে মারপিট করেছে। তারপর আমার বাপও আমাকে মেরেছে। আমি ওদেরকে গালি গালাজ করেছি। বাপ আমাকে ধরে আদালতে নিয়ে গেছে। আর বলেছে, আমার মেয়ে ইসলাম ধর্মের অবমাননা করেছে। তাই আমি রেগে গেছি। আমার জায়গায় তোমরা হলে কি চুপ করে বসে থাকতে? রাগে আমি তখন কাঁপতে থাকি। তখন আমার বাপ ও বিচারককে দুকথা শুনিয়ে দিই।…..

বিচারক ফায়সালা দেন, এ মেয়ে বড় ঠোঁট কাটা, বড় বেয়াদব। একে পৃথক ঘরে নজরবন্দি করে রাখো। তাকে মহিলাদের প্রহরায় রাখতে হবে। ওকে শিষ্টাচার শেখাতে হবে।

তোমার ভাই কেন এসেছিলো? এক মহিলা বললো।

এটাই বলতে আমি যেন ঐ বুড়োকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যাই। আমার ভাই আমাকে লোভ দেখিয়েছে, আমি রাজি হলে আমাকে ছেড়ে দেবে। ফ্লোরা বললো।

তুমি নাকি ইসলামের নামে অবমাননাসূচক কথা বলেছো? এজন্য তোমাকে নজরবন্দি করা হয়েছে। আরেক মহিলা বললো।

ফ্লোরা সুযোগ পেয়ে গেলো। আদালতের বিচারকের ব্যাপারে উল্টাপাল্টা সমালোচনা করতে শুরু করলো। বলতে লাগলো,

তোমরা ঐ বিচারককে ফেরেশতা মনে করো। বিচারক আমাকে যে দৃষ্টিতে দেখেছে আমিও যদি জবাবে তার দিকে সে দৃষ্টিতে তাকাতাম তাহলে আমার বাপের কথা একটাও শুনতো না। আমাকে কোন শাস্তিই দিতো না।…….

আর কার কথা বলবে, বিচারক, আমীরে উন্দলুস? সবাই মুখে ইসলামের কথা বলে আর ভেতরে ভেতরে মদ আর নারী নিয়ে পড়ে থাকে। অপরাধ করবেন তারা, আর শাস্তি পাবো আমরা।…..

সুন্দরী মেয়েদের রূপই তাদের জন্য বড় বিপদ টেনে আনে। তোমার দুর্ভাগ্য হলো তুমি একে তো যুবতী তারপর আবার দারুণ সুন্দরী। শাহে উন্দলুস তোমাকে দেখলে তো তার হেরেমে নিয়ে যাবে। তৃতীয় মহিলা বললো।

এমন হলে সেদিন হবে আমার শেষ দিন। ফ্লোরা বললো।

তোমার তো বাবা মারা গেছেন। মাও তোমার বোনকে নিয়ে এ বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন। মুক্ত হলে কোথায় যাবে তুমি?

আমি তোমাদেরকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি, এখান থেকে কখনো আমি পালানোর চেষ্টা করবো না। ফ্লোরা বললো, আমি তোমাদেরকে থোকা দেবো না। আমি জানি, আমি পালালে শাস্তি ভোগ করতে হবে তোমাদের। মেয়ে হয়ে আরেক মেয়েকে আমি এমন থোকা কখনো দিতে পারবো না।

তোমরা তিনজন কিছু সময়ের জন্য এখান থেকে চলে গেলেও ফিরে এসে আমাকে এখানেই পাবে। আর মুক্ত হওয়ার পর কোথায় যাবো সেটা এখনও ভেবে ঠিক করিনি। তবে সবার আগে তোমাদের তিনজনের কাছে আমার মিনতি, তোমাদের কেউ একজন আমাকে আশ্রয় দাও না?

***

প্রহরী মহিলারা ফ্লোরার ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হয়ে গেলো। ফ্লোরা পালিয়ে যাবে এমন আশংকা তাদের আর রইলো না। প্রহরায়ও তারা নমনীয় হয়ে এলো। তা ছাড়া ফ্লোরা মিথ্যা কৌশলে নিজের মজলুম জীবনের গল্প শুনিয়ে শুনিয়ে ওদের মনে নিজের ব্যাপারে সহানুভূতি সৃষ্টি করে নেয়।

একদিন ফ্লোরার বন্দিখানার দরজায় ৪০/৪৫ বছরের এক আলেমে দ্বীন এসে আওয়াজ দিলো। পরনে তার সবুজ আলখেল্লা। মাথায় পাগড়ি। হাতে দুটি কিতাব। প্রহরী এক মহিলা দরজা খুলে দিলো।

লোকটি সরকারি একটি কাগজ বের করে দেখালো। তাতে লেখা, এ লোক একজন আলেমে দ্বীন। ফ্লোরাকে ধর্মীয় দীক্ষা দিবে।

আলেম লোকটিকে ফ্লোরা পা থেকে মাথা পর্যন্ত এক নজর দেখলো। ফ্লোরার চেহারায় ঘৃণার ভাব ফুটে উঠলো। কিন্তু ফ্লোরা সেটা মুচকি হেসে মুছে ফেললো।

তুমি নাকি ইসলাম ধর্ম নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করেছো? আলেম লোকটি বললেন, কিন্তু এজন্য তোমাকে এমন শাস্তি দেয়া উচিত হয়নি। আসল অপরাধী তো প্রথমে তোমার বাপ তারপর তোমার মা। বসো এখানে।…

নিজের মন থেকে সব বোঝা নামিয়ে ফেলো। তোমার বয়স কম। এই বয়সে অনেকেই খোদাকে বাঁকা চোখে দেখে। কিন্তু আমার তো মনে হচ্ছে, নিজের রূপ যৌবন নিয়ে তুমি এতই গর্বোদ্ধত যে, ধর্মকে কিছুই মনে করছে না। আমার ধারণা কি সত্যি?

না। ফ্লোরা মুখের ঘৃণার ছাপকে মুচকি হাসিতে লুকিয়ে বললো, এই আমি প্রথম কোন পুরুষ দেখছি, যে আমার রূপ সম্পর্কে আমাকে নতুন কথা শোনালো। কিন্তু আমি এখনো কিশোরী। নিজেকে যুবতী মনে করি না। আমাকে কি আপনার কাছে বাচ্চা মনে হচ্ছে না?

হ্যাঁ, তুমি এখনো বাচ্চাই। সেই আলেম বললেন, এজন্যই আমি শুরুতে বলেছি তোমার অপরাধ ক্ষমার যোগ্য। তোমার বয়স বিবেচনা করে বিচারকের শাস্তি দেয়া উচিত হয়নি। যা হওয়ার হয়েছে। আমার ওপর নির্দেশ হলো, ইসলামী শিক্ষা-দীক্ষায় তোমাকে আলোকিত করে তুলি যেন। তুমি কি মন থেকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করবে?

ফ্লোর বয়স যত স্বল্প তার বোধ-বুদ্ধি তত স্বল্প নয়। বরং বুদ্ধি ও চতুরতার দৌড়ে ফ্লোরা বয়স্ক মানুষের চেয়ে অনেক এগিয়ে।

সে ভাবছে, নিজের রূপ দিয়ে এক তাগড়া যুবককে দুনিয়া থেকে বিদায় করে দিয়েছি। দেখা যাক, একে নিয়ে কী করা যায়। তবে এ যেহেতু আপদমস্তক ধার্মিক, তাই একে রূপের মায়ায় খুন করতে কিছুটা সময় লাগতে পারে। লাগুক সময়।

আমি মন থেকে ধর্ম গ্রহণ করবো কি না এটা নির্ভর করছে তার ওপর যিনি ধর্মগ্রহণ করাতে এসছেন তিনি আমার কাছে গ্রহণযোগ্য কি না! ফ্লোরা স্মিত হেসে বললো।

লোকটা কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। এ ধরণের কথার জন্য তিনি প্রস্তুত ছিলেন না।

আপনিই যদি প্রতিদিন আসেন, তাহলে আপনি যা বলবেন তা আমি আগ্রহ নিয়ে গ্রহণ করবো। ফ্লোরা বললো, তবে শর্ত হলো, শক্ত ও কঠিন কথা আমাকে বলা যাবে না। এটা ভুলে যাবেন না, আমি সেই বন্দি পাখির মতো, যে শূন্যে উড়ে বেড়াতে অভ্যস্ত। এ অবস্থায় আমার মনে বিরক্তি খুব দ্রুত আসতে পারে।

তুমি কি মনের মতো উড়ে বেড়াতে চাও?

না, আমি মন ভরে হাসতে চাই, খেলতে চাই। বাধ্য বাধকতাকে ভয় পাই। আমার মনের বিরুদ্ধে কোন কিছু আমার ওপর চাপিয়ে দিতে চাইলে কোন ধর্মই আমি গ্রহণ করতে পারবো না।

এই আমার সাথে তুমি হাসতে খেলতে চাও?

আমার এই প্রয়োজন যদি আপনি পূরণ করে দেন তাহলে আমাকে আপনার দাসীও বানিয়ে নিতে পারেন। আর আপনি আমাকে যে শিক্ষাই দেবেন সেটা আমার রক্তে মিশে যাবে। ফ্লোরা বললো।

শিক্ষক লোকটি হেসে ফেললো। বললো,

তুমি খুবই বুদ্ধিমতী মেয়ে! আমি তোমার হাসি খেলার প্রয়োজন পূর্ণ করার সুযোগ দেবো। এর বিনিময়ে আমি তোমাকে যা বলবো তার প্রতিটা শব্দ তোমার অন্তরে বসাতে হবে। আমার সামনে বসে যাও।

***

হাকিম হুররানী! আমীরে উন্দুলুস আব্দুর রহমান ছানীর আমলের শাহী বিকিৎসক। ইতিহাসের পাতায় তার পূর্ণ নাম পাওয়া যায়নি। শুধু হামিক হুররানী লেখা রয়েছে। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, ফার্মাসিস্ট ও গবেষক চিকিৎসক হিসাবে তিনি কর্ডোভায় খুব অল্প বয়সেই সুনাম অর্জন করেন।

অত্যাশ্চার্য কিছু ঔষধও তিনি আবিস্কার করেন। তাই তাকে শাহী দরবারের চিকিৎসকের মর্যাদায় ভূষিত করা হয়।

হুররানী শুধু বিদ্যাগত চিকিৎসকই ছিলেন না। অনেক বড় পন্ডিত আলেমও ছিলেন। কিন্তু আব্দুর রহমান তাকে কেবল চিকিৎসক হিসাবেই জানতেন। তার জ্ঞান বিদ্যার পান্তিত্য সম্পর্কে তার কোন ধারণা ছিলো না।

হুররানী একদিন বেশ পেরেশান হয়ে যারিয়ারের সাথে সাক্ষাৎ করেন। আমীরে উন্দলুসের সঙ্গে ব্যক্তিগত বিষয়ে কোন কথা বলতে যারিয়াকে মধ্যস্ততাকারী হিসাবে মেনে নিয়েই এবং তার সুমতি মিললেই কেবল আমীরে উন্দলুসের সঙ্গে সাক্ষাত ঘটতো। তার সুপারিশ দ্বারা আমীরে উন্দুলুসকে দিয়ে যা ইচ্ছা তাই করানো যেতো।

আমি শাহী দরবারের চিকিৎসক! হুররানী বললেন, সরাসরি আমার তার কাছে যাওয়া উচিত ছিলো। কিন্তু হুকমত বিষয় আপনি ততটা বুঝেন যতটা আমি ডাক্তারি বিষয় বুঝি। আমাকে কিছু একটা পরামর্শ দিন। আমি খুবই পেরেশান?

ডাক্তার যদি পেরেশান হয়ে যান তাহলে রোগীর কী দশা হবে? দয়া করে বলুন আমি আপনার পেরেশানী কি করে দূর করতে পারি।

সুলতানা মালিকায়ে তরূব আমাকে বলেছেন, আমি যেন আমীরে উন্দলুসের মনে এটা ঢুকিয়ে দিই যে, তিনি দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ছেন। হুররানী বললেন, মালিকায়ে তরুব চাচ্ছেন আমীরে উন্দলুস যেন কোন অভিযানে বের না হন। আর আমি তার মনের মধ্যে এমন রোগের অনুভূতি যেন ঢুকিয়ে দিই যেটা আসলেই তার মধ্যে নেই।

আপনি তাকে কী জবাব দিলেন?

আমি উনাকে বলেছি, আমার পেশা অত্যন্ত পবিত্র। হুররানী বললেন, আমি আমার দুশমনকেও ধোকা দিতে পারবো না। যে আমার রোগী নয় তার সঙ্গেও আমি মিথ্যা কথা বলতে পারবো না। আর ইনি তো আমীরে উন্দলুস। তার আনুগত্য করা আমার ওপর ফরজ। তা ছাড়া আমি তার চিকিঙ্ক। আমি মালিকাকে বললাম, আমি এ পাপ করতে পারবো না।

তিনি বললেন, এটা পাপ হলে এর মধ্যে পূণ্যও আছে একটা। তা হলো, আমীরে উন্দলুস আব্দুর রহমান অত্যন্ত মূল্যবান মানুষ। তিনি রণাঙ্গনে সেনাদলের নেতৃত্ব দিতে দিতে এবং লড়তে লড়তে যখমী হয়ে মারা না গেলেও অবিরাম ক্লান্তি ও রাত্রি জাগরণ ইত্যাদি কারণে অসুস্থ হয়ে সময়ের আগেই খতম হয়ে যাবেন।

আর যদি এমন ঘটে তাহলে তো উন্দলুসের জন্য এমন শাসক আর দ্বিতীয় জনকে পাওয়া যাবে না। আমি মালিকায়ে সুলতানাকে বললাম, তাকে এতটুকু বলতে পারি যে, তিনি লড়াইয়ের ময়দান থেকে যেন দূরে থাকেন এবং নিজের স্বাস্থ্যের প্রতি খেয়াল রাখেন। এ ছাড়া কোন মিথ্যা কথা তাকে বলতে পারবো না।

আপনি কি আব্দুর রহমানের কাছে সুলতানার ব্যাপারে অভিযোগ করতে চান? যারিয়াব জিজ্ঞেস করলো।

এটাই তো আপনাকে জিজ্ঞেস করতে এসেছি। হুররানী বললেন, কথা এখানেই শেষ হয়নি। আমি অস্বীকার করায় সুলতানা বিগড়ে গেলেন।………

তিনি বললেন, মুহতারাম হাকীম! আমীরে উন্দলুসের জন্য প্রয়োজনে আরো অনেক চিকিৎসক পাওয়া যাবে। কিন্তু আরেকজন সুলতানা পাওয়া যাবে না। তার ওপর আমার যে প্রভাব আছে এর সিকিভাগও আপনার নেই।……..

আমার এক ইশারায় আপনাকে আমীরে উন্দলুসের নজর থেকে আতঁকুড়ে নিক্ষেপ করতে পারবো। আমাকে ক্ষেপালে আপনার পরিণাম শুধু এটাই হবে যে, লোকে বলবে, এখানে হুররানী নামে একজন চিকিৎসক ছিলো। তিনি আর নেই। আপনাকে আমি যা বলছি তা আপনি করুন। দেখবেন আপনাকে দুহাত ভরে বখশিশ দেয়া হবে।….

মুহতারাম যারিয়ার! আমার ভালো করেই জানা আছে, আমীরে উন্দলুসের চোখে সুলতানার যে অবস্থান তার অর্ধেক ও আমার নেই। ডাক্তার তো আছে অনেক। কিন্তু সুলতানা তো ঐ একজনই। কিন্তু আমি আমার বিবেককে কী করে থোকা দেবো?

মুহতারাম হুররানী! যারিয়াব বললো, আপনাকে তা করতেই হবে যা সুলতানা আপনাকে বলেছে। আর না করলে আপনার পরিণাম কী হবে হবে সেটা আমি বলতে পারছি না।

ও আপনাকে আমীরে উন্দলুসের দৃষ্টি থেকে শুধু নিক্ষেপই করবে না। আপনার ওপর ভয়াবহ অপবাদ আরোপ করে আপনাকে সেসব কয়েদীদের সাথে কয়েদ করাতে পারবে যাদের শরীরের হাড়-মাংস প্রচন্ড আগুনের তাপে গলে গলে পড়ছে। আর তারা মরছেও না এবং বেঁচেও থাকতে পারছে না। তবে আপনি আপনার মতো করে কৌশলেও আমীরকে সুলতানার কথাগুলো বলতে পারেন।….

আমিও মানি, আমীরে উন্দলুস আব্দুর রহমান যেমন আরেকজন সুলতানা পাবেন না তেমনি উন্দলুস এমনকি খেলাফতও দ্বিতীয় আব্দুর রহমানও পাবে না। উন্দলুসের সার্বভৌমত্বের জন্য বরং সালতানাতে ইসলামিয়ার স্থায়িত্বের স্বার্থে আপনাকে মিথ্যা বলতেই হবে। এটা আমিও চাই।

হুররানী স্তব্ধ হয়ে গেলেন।

আমার আরো কিছু বলার ছিলো। হুররানী বেশ কিছুক্ষণ পর চরম আহত গলায় বললেন, তবে বলবো না। আপনাকে বলে লাভও নেই। তবে যা আমার করা উচিত নয়, সেটাই করতে হবে।

***

ডাক্তার মিথ্যা বলতে চাচ্ছিলেন না। ওকে আমি রাজি করিয়েছি। যারিয়াব সুলতানাকে বলছিলো।

ডাক্তার আসছে সুলতানা বললো। ওকে আমি খবর দিয়েছি। শাহে উন্দলুসকেও বলে এসেছি, আপনার চেহারা মলিন দেখাচ্ছে এবং আপনার দৃষ্টির উজ্জলতাও স্নান হয়ে যাচ্ছে। আমি ডাক্তার নিয়ে আসছি।

তোমার আর কতদিন বাকি? যারিয়াব জিজ্ঞেস করলো।

এক মাসেরও কিছু কম। সুলতানা বললো, আমি একটি ছেলে জন্ম দিতে পারবো বলে আশা করছি। আর এ হবে আব্দুর রহমানের সিংহাসনের উত্তরাধিকারী। এখন তো আমার খ্রিষ্টানদের সাহায্য আরো বেশি দরকার। আর তোমার সাহায্যও।

এসময় খবর এলো হামিক হুররানী আসছেন। হুররানীকে সুলতানা তার কামরায় বসালো। আরেকবার তাকে মনে করিয়ে দিলো আমীরকে কী বলতে হবে।

ওদিকে আব্দুর রহমানের শাহী কামরায় একই সময়ে আব্দুর রহমানের কাছে গিয়ে বসলো মুদ্দাসসিরা। আব্দুর রহমান মুদ্দাসসিরার ব্যাপারেও বেশ প্রভাবান্বিত। মুদ্দাসসিরা তাকে ফ্লোরার ঘটনা শোনালো।

এমন মেয়েকে তো মৃত্যুদন্ড দেয়া উচিত ছিলো। আব্দুর রহমান বললেন।

আপনি কয়জনকে মৃত্যুদন্ড দেবেন? মুদ্দাসসিরা বললেন, ক্রুশের পূজারীদের ফেতনা আজ চারদিক থেকেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। আপনার নিজ হাতে এখন এ ব্যাপারটার বিহিত করা দরকার। সালাররা তো ময়দানের ব্যাপারেই ভালো সিদ্ধান্ত দিতে পারেন। কিন্তু এ ব্যাপারে ফায়সালা আপনাকেই। করতে হবে। ফ্রান্সের ওপর হামলা করতে হবে। বিদ্রোহীদের মদদ ওখান থেকেই আসছে।

আমার অভিযানের সব আয়োজন তো এ উদ্দেশ্যেই। আব্দুর রহমান বললেন।

আমি তো লক্ষ্য করেছি, আপনি কোন অভিযানে গেলে আপনার শরীর স্বাস্থ্য তরতাজা থাকে। মুদ্দাসসিরা হাসতে হাসতে বললো, এখানে পড়ে থাকাটা আপনার স্বভাব বিরুদ্ধ ব্যাপার।

শুধু আমার নয়, মুসলমানদেরও স্বভাব বিরুদ্ধ ব্যাপার এটা যে, দুশমন কোথাও বসে মুসলমানদের ধ্বংসের নীলনকশা তৈরি করছে আর মুসলমানরা হাত গুটিয়ে বসে থাকবে। আমি জিহাদে আমার প্রাণ বিসর্জন দিতে প্রস্তুত। বার্ধক্যের দুর্বলতায় যখন আমার হাত কাঁপতে থাকবে তখনও আমার হাতে তলোয়ার থাকবে এবংআমার ঠিকানা হবে তখন ঘোড়ার পিঠ।

দৈহিকভাবে মুদ্দাসসিরার রেশম কোমল চুল, তার ডাগর ডাগর চোখ, রাঙা ঠোঁটে লেগে থাকা মিষ্টি হাসি এবং তার দারুণ আকর্ষণীয় শারীরিক গঠন আব্দুর রহমান দারুণ ভালোবাসতেন।

তার শুধু অসাধারণ রূপই নয়, তার মধ্যে এমন স্বচ্ছ-স্বাধী প্রাণময়তা সবসময় সমুজ্জ্বল থাক যে, আব্দুর রহমান তাকে দেখলে মুগ্ধ না হয়ে পারেন না।

তোমার মধ্যে ও সুলতানার মধ্যে কেমন একটা পার্থক্য আমি অনুভব করি। কিন্তু প্রকাশ করতে পারবো না সেটা। আব্দুর রহমান ঘোরলাগা গলায় বললেন, তুমি কি জানো এ পার্থক্যটা কী?

কখনো জানতে চেষ্টা করিনি। মুদ্দাসসিরা বাচ্চাদের মত খিল খিলিয়ে হেসে বললো। কখনো নিজের মাথায় এ চিন্তা আসতে দেয়নি যে, আমিই একমাত্র আপনার এবং আপনি শুধু আমারই। সুলতানা আর আমার মধ্যে পার্থক্য ততটুকুই যতটা বিভিন্ন ফুলের মধ্যে থেকে থাকে। প্রত্যেক ফুলেরই নিজস্ব সৌন্দর্য ও সুগন্ধি রয়েছে। আমি কখনো এমন করে ভাবিনি, আমি সেই ফুল যা পুরো বাগানে একাই কর্তৃত্ব করে।

এমন রোমাঞ্চ জাগানো পরিবেশে দরজায় হালকা শব্দ হলো। এই শব্দের ধরণ যেমন আব্দুর রহমান চিনেন তেমনি চিনে মুদ্দাসসিরাও।

এটা কি ওর আসার সময় হলো? আব্দুর রহমান বললেন।

আসতে দিন। মুদ্দাসসিরা আব্দুর রহমানের বাহুমুক্ত হয়ে উঠতে উঠতে বললো, ওরও তো আসতে হয়।

মুদ্দাসসিরা দরজা খুলে দিলো।

 সুলতানা ভেতরে ঢুকেই কর্তৃত্বের সুরে বললো,

হাকিম হুররানী এসেছেন। সুলতানার পেছনে যারিয়াব ও তার সঙ্গে হুররানী। হুররানী এসেই আব্দুর রহমানের হাতের কব্জি ধরলেন এবং চোখে-মুখে একটা চিন্তার ছাপ ফোঁটালেন। তারপর আব্দুর রহমানের পেট, বুক, হাতে মৃদু চাপ দিয়ে দিয়ে পরীক্ষা করলেন। দুচোখ আঙ্গুল দিয়ে খুলে দেখলেন।

হুররানী! আমীরে উন্দলুস বললেন, আপনি মনে হয় দেখতে এসেছেন আমি কেন অসুস্থ হচ্ছি না। তিনি হেসে উঠে বললেন, আল্লাহ তাআলা আমার ভেতরে অতিরিক্ত একটা রগ দিয়েছেন সেটা যেকোন ধরনের রোগ ব্যাধিকে তার জন্মকালেই শেষ করে দেয়। হঠাৎ করে আপনার কেন সন্দেহ হলো যে, আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছি, হুররানী?

আমরা এটাই দেখতে এসেছি আমাদের সন্দেহ কতটা ঠিক। যারিয়াব হেসে বললো, খেলাফত ও উন্দলুসের সুস্থ এক আব্দুর রহমানের প্রয়োজন।

আব্দুর রহমান তো অনেক আছে, আপনার সমতুল্য তো কেউ হবে না।

সুলতানা মুখে মায়াবী এক হাসি ছড়িয়ে বললো, যুদ্ধের ময়দান থেকে ফিরে আসার পর কত দিন হয়ে গেলো কিন্তু এখনো আপনার চেহারা থেকে ক্লান্তির ছাপ গেলো না। জনাব হুররানীকে এ ব্যাপারে জানালে তিনি বললেন, আপনার হার্ট দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। তিনি যুদ্ধের ময়দানে যাওয়া থেকে বিরত না হলে তার হার্ট এ্যাঁটাক হয়ে যাবে।

তোমাদের দেখার মধ্যে এত পার্থক্য কেন? আব্দুর রহমান দ্বিধান্বিত গল বললেন, মুদ্দাসসিরা আমাকে দেখে সুস্থ সবল। যুদ্ধের ময়দানে থাকলে আমার শরীর স্বাস্থ্য তরতাজা থাকে। আর তোমরা বলছো, আমার হার্ট এ্যাঁটাক হয়ে যাবে।

সুলতানা চোখ ঘুরিয়ে মুদ্দাসসিরার দিকে তাকালো।

আমীরে উন্দুলুসের দীর্ঘ এক বিশ্রামের প্রয়োজন। হুররানী ঘোষণা দেয়ার মতো বললেন, হৃদযন্ত্র অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। আপনার শাহরগ বলছে, রক্তের চলমান গতি ধীর হয়ে আসছে। আরো দ্বিগুণ- দ্রুততর হতে হবে।

হুররানী! মুসলমানদের রক্ত ঘরে বসে আরাম করলে দ্রুততর হয় না। আমীরে উন্দলুস বললেন, রক্তের গতি কেবল যুদ্ধের ময়দানেই ক্ষিপ্রতর হতে পারে।

আপনার স্বাস্থ্যের প্রতি আরেকটু গুরুত্ব দেয়া উচিত আমীরে উন্দলুস! সুলতানা বললো, কোন তোষামোদকারী যদি বলে আপনার স্বাস্থ্য খুবই ভালো তাহলে সে নিশ্চয় আপনার মঙ্গল চায় না। মুহতারাম হুররানী! আপনি ঔষধ বানিয়ে পাঠিয়ে দিন। আমি তাঁর বিশ্রামের ভার নিচ্ছি।

বিশ্রামও এত বেশি করা যাবে না যে, রক্তের বর্তমান যে গতি রয়েছে তাও শ্লথ হয়ে যায়। মুদ্দাসসিরা বললো, কোন দরবারী চাটুকারদের দল যদি বলে উনি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন এর মধ্যেও কম চাটুকারিতা থাকে না। সঠিক সিদ্ধান্ত ডাক্তারই দিতে পারেন। আর সময়ই বলে দেবে, কে আমীরে উন্দলুসের মঙ্গল চায় আর কে তাকে কালনাগিনীর মতো দংশন করতে চায়।

হুররানী অপ্রতিভ আর অপ্রস্তুত সুরে এমনভাবে কথা বলতে লাগলেন যেন কথা তিনি বলছেন না, বলছে অন্য কেউ।

আমি প্রয়োজনী ঔষধ পাঠিয়ে দিচ্ছি। আমীরে মুহতারামের বিশ্রামে থাকা উচিত। হুররানী একথা বলে অনুমতি নিয়ে চলে গেলেন।

চলে গেলো মুদ্দাসসিরাও।

যারিয়াব ও সুলতানা এমনভাবে আব্দুর রহমানকে বুঝালো যে, তার মধ্যেও এ সন্দেহ বসে গেলো যে, তিনি সুস্থ নন এবং তার শুধু বিশ্রামে থাকলেই হবে না। নারী-সঙ্গও বর্জন করে চলতে হবে। এসব কথায় সুলতানার আসল উদ্দেশ্য হলো, তাকে ছাড়া যেন কোন নারী আব্দুর রহমানের কামরায় না আসে।

***

তিন-চারদিন পরের কথা। মুদ্দাসসিরা হাকিম হুররানীর পয়গাম পেলো যে, তিনি তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চান। কিন্তু মহলে আসতে সাহস পাচ্ছেন না। মুদ্দাসসিরা পয়গামের জবাব দিলো, আগামীকাল তাকে সংবাদ দেয়া হবে যে, মুদ্দাসসিরার পেটে ভীষণ ব্যথা। সংবাদ পেতেই হুররানী যেন চলে আসে।

পরদিন হুররানীকে মহল থেকে সংবাদ দেয়া হলো, মুদ্দাসসিরার পেটে ভীষণ ব্যথা। হুররানী তখনই এসে উপস্থিত হলো। মুদ্দাসসিরা তার কামরায় শোয়া ছিলো। খাদেমকে সে বাইরে পাঠিয়ে দিলো।

আমার বিশ্বাস, আপনার সঙ্গে আমি কথা বলতে পারবো। হুররানী বললেন, আমার বিবেকের ওপর অপরাধের এক বোঝা চেপে আছে। যেটা আমি একমাত্র আপনার সামনেই ব্যক্ত করতে পারি।

সম্ভবত আমি জানি, সেই বোঝাটা কী? মুদ্দাসসিরা স্মিত হাস্যে বললো, আমীরে উন্দলুসের হৃদযন্ত্রে কোন রোগ-ব্যাধি নেই। আপনি বাধ্য হয়ে তাকে অসুস্থ বানিয়েছেন।

হুররানী বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে গেলেন। অসম্ভব রূপবতী এবং যৌবনবতী একটি মেয়ের ভাবনার দৃষ্টির এতটা গভীরে পৌঁছতে পারে সেটা তিনি কল্পনাও করেননি।

আপনি কি এটা আমীরে উন্দুলুসকে বলতে চান?

আমি শুধু তার ভেতরের সন্দেহ দূর করতে পারি। মুদ্দাসসিরা বললো, তবে এটা আমি বলবো না যে, সুলতানা ও যারিয়াব তার মনের মধ্যে এই দ্বিধা-দন্দ্ব সৃষ্টি করছে, তাকে মানসিকভাবে স্থবির করে দিতে চাচ্ছে। ওরা দুশমনের হাত শক্তিশালী করছে, এসব কথা আমি আমীরে উন্দলুসকে বলবো না। যদি বলি তাহলে তিনি ওদেরকে বিজ্ঞেস করবেন। তারপর ওরা দুজন আমার ওপর যে কোন মূল্যে প্রতিশোধ নিবে।

তারপর আমি এই লড়াইয়ের একটি পক্ষ হয়ে যাবো। এর ফলে আমার চিন্তা ভাবনা হয়ে যাবে ষড়যন্ত্র আর চক্রান্ত প্রবণ। আমি আমার চিন্তা-ভাবনা ও দৃষ্টিভঙ্গিকে এমন নোংরা মানসিকতায় সীমাবদ্ধ করতে চাই না। আপনি আপনার বিবেককে বোঝামুক্ত করে ভালো করেছেন এবং আপনি সুলতানার কথা মেনেও ভালো করেছেন। যদি তা না করতেন তাহলে ও আপনাকে সত্যিই কোন এক আস্তাকুঁড়ে নিয়ে ফেলতো।

সত্যিই আপনি এক মহীয়সী নারীর আসন্ন অলংকৃত করার যোগ্য এক নারী। হুররানী পরম সম্মান প্রদর্শনের কণ্ঠে বললেন, আপনি সত্যিই আমার বিবেক ও হৃদয়ের ভারী বোঝা নামিয়ে দিলেন।

হুররানী চুপ করে গেলেন। এদিক ওদিক তাকিয়ে নিচু গলায় বললেন। আমি একটি পাপ আপনার পায়ে পেশ করছি।

কাল রাতে কোন এক সময় আপনার এক খাদেমা আপনাকে একটি দুধের পাত্রে দুধ দিয়ে বলবেন, এর মধ্যে মিসরের সেই মধু মিশানো হয়েছে যা কোন সৌভাগ্যবানই পান করতে পারে। এ মধু মানুষের যৌবনকে আজীবন ধরে রাখে। আর রক্তের মধ্যে সবসময় এমন চাঞ্চল্য সৃষ্টি করতে থাকে যে, সুখের লাবন্য-রূপ দিন দিন উজ্জল হতে থাকে।…..

খাদেমা আপনাকে বলবে, এই অমূল্য মধু সে কোত্থেকে পেয়েছে। আপনি এ দুধ আমীরে উন্দলুসের কাছে নিয়ে যাবেন। তাঁকে বলবেন, শাহী মহলের আস্তাবলের সবচেয়ে শক্তিশালী ঘোড়ার মুখে এখান থেকে মাত্র এক ঢোক দুধ যেন পান করানো হয়।

আমার জন্য এই চমৎকার বিষ নিশ্চয় সুলতানার পক্ষ থেকে আসছে?

আর কার পক্ষ থেকে আসতে পারে? হুররানী বললেন, সে আমাকে ডেকে নিয়ে এমন বিষ বানিয়ে তোমাকে দিতে বলে এবং শাসিয়ে দেয়, তোমার কাছে। সবচেয়ে মারাত্মক যে বিষ আছে সেটা তোমার হাতে পান করতে হবে, যদি না তুমি এ কাজটা না করো…।

আপনি কি এখনো আমীরে উন্দলুসকে কিছু বলবেন না?

না, মুদ্দাসসিরা মুচমি হেসে বললো, যদি বলে দিই তাহলে উন্দলুসের এই কালনাগিনী সবার আগে আপনাকে দংশন করবে। আপনি এই মহিলাকে এখনো ভালো করে চিনেননি। তার রূপ-যৌবন, অভিনয় শক্তি, উপস্থাপনার মধ্যে এমন বিষয়ে রয়েছে যে, যা পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী ঘোড়াকে মুহূর্তেই ধ্বংস করে দিতে পারে। আপনি কি ওর হাতে সেই বিষ তুলে দিয়েছেন?

হ্যাঁ, তুলে দিতে হয়েছে, হুররানী এতই প্রভাবান্বিত ও মুগ্ধ হলেন যে, মুদ্দাসসিরার জামার এক প্রান্ত খামচে ধরে তাতে চুমু খেয়ে বললেন, দয়া করে আমীরে উন্দলুসকে এই বিষের কথা বলে দিন। আমি এখন এটাই চাইবো যে, সুলতানা আমাকে জল্লাদের হাতে তুলে দিক। আমি আর বেঁচে থাকতে চাই না।…….

খোদা আমাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের জ্ঞান ভান্ডার দান করেছেন তার রোগগ্রস্ত বিপদগ্রস্ত বান্দাদেরকে তারই ইশারায় তারই হুকুমে সুস্থ করে তুলতে। কিন্তু তারই এক বান্দি এই বিদ্যা দিয়ে অন্যকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে

বলতে বলতে তিনি আরো পেরেশান হয়ে চাপা কণ্ঠে বললেন, আমি এখান থেকে চলে যেতে চাই। আমি আর এখানে থাকতে চাই না।

না, আপনাকে কোথাও যেতে হবে না। মুদ্দাসসিরা বললো, আপনার এখানে অনেক প্রয়োজন রয়েছে। আমি তো সে সময়টাও আমার অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে লেখতে পাচ্ছি, যখন এই বিষই আপনার হাতে দুধ শরবতে মিশিয়ে কারো মাধ্যমে আমীরে উন্দলুসের সামনে পেশ করা হবে। আপনি যেভাবে আমাকে জানিয়ে দিয়েছেন সেটা আমীরে উন্দলুসকেও জানিয়ে দেবেন।

কখনো ইচ্ছা হয়, এই বিষ সুলতানার গলায় ঢেলে দিই। কিন্তু আমি মৃত্যুদূত নই, মানুষের সুস্থতার প্রতীক।

আপনি অস্থির হবেন না। সুলতানার বিশ্বস্ত হয়ে থাকুন। মুদ্দাসসিরা বলল।

আমি তো হয়রান হচ্ছি, সে এই শাহী মহলে বসে ইসলামের দুশমনের হাতকে শক্তিশালী করছে। তাদের সঙ্গ দিচ্ছে।

না। মুদ্দাসসিরা বললো, কালনাগিনী কখনো কারো সঙ্গীনী বা সহমর্মী হয় না। সে যা কিছু করছে নিজের জন্য করছে। সে তো এখন এ আশায় বুক বেঁধে আছে যে, সে সিংহাসনের উত্তরাধিকারকে জন্ম দিচ্ছে। খ্রিষ্টানদের সহযোগিতায় সে এক অঙ্গ রাজ্যের রানী হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। আমীরে উন্দলুসের বিশ্বস্ত রক্ষিতা হয়ে নিজের বাচ্চাকে সে উন্দলুসের সিংহাসনে বসানোর স্বপ্ন দেখছে।…..

আর আমীরে উন্দলুসের বিচক্ষনতাও এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে যে, তিনি এই মহিলার মানব বিধ্বংসী মন মানসিকতা বুঝে উঠতে পারছেন না। আমি তাকে অন্যকোনভাবে বুঝতে চেষ্টা করছি। আপনি আমার ওপর অনুগ্রহ করেছেন। আমি এর প্রতিদান অবশ্যই দেবো। আপনি মুখ বন্ধ রাখুন এবং নিশ্চিন্ত থাকুন।

হুররানী সেখান থেকে নিশ্চুপ হয়ে চলে এলেন। কিন্তু তার চেহারা ও চলার ভঙ্গি বলে দিচ্ছিলো, দুশ্চিন্তা তাকে অনেকটাই কাবু করে ফেলেছে।

***

পরদিন হেরেমে এক খাস খাদেমা মুদ্দাসসিরার কামরায় এলো। মুদ্দাসসিরা ওকে ভালো করেই জানে। মেয়েটি দারুণ চতুর এবং বেশ সপ্রতিভও।

খাদেমা মুদ্দাসসিরাকে বললো, তার এক ভাই মিসর থেকে এসেছে। ওখান থেকে এমন এক ধরনের মধু নিয়ে এসেছে যা ওখানকার এক বিশেষ এলাকায় পাওয়া যায়। বলা হয়ে থাকে, এই মধু ফেরাউনের যুগ থেকে পাওয়া যায়। এ শুধু তাদের শাহজাদাদের স্ত্রীদেরকে পান করানো হতো।

এই মধুর বৈশিষ্ট্য হলো, এতে মেয়েদেরকে বহু বছর পর্যন্ত সজীব রাখে এবং বিশেষ অঙ্গসমূহকে যেড়ষী যুবতীদের মতো সতেজ রাখে। এই মধু এখনো ফেরাউনের যুগের পোড়া এলাকার কথাও কোথাও পাওয়া যায়।

আপনি চাইলে এই মধু দুধের সাথে মিশিয়ে আপনার জন্য নিয়ে আসবো খাদেমা বললো, খুব সামান্যই আছে। তবে দুধের সাথে মিশিয়ে খেলে ওই সামান্যই অনেক দিন কাজ করে।

নিয়ে এসো। এখনই নিয়ে আসো।

খাদেমা গিয়ে সঙ্গে সঙ্গেই এক পেয়ালা দুধ নিয়ে এলো।

নিন মালিকা! এখন এটা আরাম করে পান করুন।

 মুদ্দাসসিরা দুধের পাত্র হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

সুলতানা তোমাকে এই দুধ দিয়ে কী বলেছে? আমাকে দুধ দিয়ে এখান থেকে চলে যেতে, না দুধের প্রতিক্রিয়া কী হয় সেটা দেখতে?

খাদেমা ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

আপনি এসব কি বলেছেন? মালিকায়ে তরূবের তো এই দুধের সাথে কোন সম্পর্ক নেই।

আচ্ছা বখশিশ যা পাওয়ার সেটা কী নিয়ে নিয়েছে, না দুধের প্রতিক্রিয়া দেখার পর এর জন্য বখশিষ পাবে?

এতো এক খাদেমা। যত চালাকই হোক আমীরে উন্দলুসের এক স্ত্রীর সামনে সেটা আর কতক্ষণ ধরে রাখতে পারবে? সে স্পষ্ট বুঝলো, আমীরে উন্দলুসের এরই রূপবর্তী স্ত্রী বিষের ব্যাপারটা টের পেয়ে ফেলেছে।

খাদেমা ভয়ে কাঁপতে শুরু করলো। মুদ্দাসসিরা হো হো করে হেসে উঠলো। খাদেমা এবার ভয়ে কুঁকড়ে গেলো।

ভয়ো পেয়ো না মেয়ে। শুধু এটা স্বীকার করো যে, এই বিষয় মিশ্রিত দুধ তোমাকে সুলতানাই দিয়েছে। মুদ্দাসসিরা গম্ভীর গলায় বললো।

হ্যাঁ, উনিই দিয়েছেন। খাদেমা কম্পিত কণ্ঠে বললো এবং এগিয়ে গিয়ে হাত জোড় করে বললো, আমিই এই দুধ পান করবো। আমাকে দিন। যে শাস্তি ও যন্ত্রণা আমার জন্য অপেক্ষা করছে, এর চেয়ে এটা পান করে এখনই মরে যাওয়া অনেক ভালো।

মেয়েটি হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। কাঁদতে কাঁদতে বললো,

তার হুকুম না মানলেও আমার জন্য বড় শাস্তির ব্যবস্থা করে রেখেছিলো। এখন হুকুম মেনেও এর চেয়ে বড় শাস্তির সামনে পড়তে হবে।

মুদ্দাসসিরার পায়ে পরে গেলো খাদেমা এবং মাথা তার পায়ে রেখে বললো,

আমার সন্তানদের ওপর রহম করুন রানীজি! আমাকে এখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিন। মহল থেকে আজীবনের জন্য চলে যাবো। কর্ডোভা থেকে বেরিয়ে যাবো।

তুমি মহলেই থাকবে। মুদ্দাসসিরা বললো, তোমাকে কোন শাস্তি দেয়া হবে না। বাইরে দাঁড়িয়ে আমার ফিরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করো। কারো সাথে কোন কথা বলতে পারবে না।

মুদ্দাসসির দুধের পাত্র নিয়ে খাদেমাকে ওখানেই রেখে বেরিয়ে গেলো।

***

হেরেমের মেয়েদের দিন শুরু হয় বাইরে সূর্যাস্তের পর থেকে। সুলতানার কামরায় রঙবেরঙের অসংখ্য ফানুস জ্বলছে। দিনের আলোর চেয়ে ঘর উজ্জল হয়ে আছে। পুরো ঘর এমন সুগন্ধিতে ভরে আছে, সাধারণ মানুষ তা কল্পনাও করতে পারবে না।

সুলতানা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সাজগোজ করছে আর নিজের রূপের ছটা দেখে নিজেই মুগ্ধ হচ্ছে।

মুদ্দাসসিরা চাপা পায়ে কামরায় ঢুকলো। আয়নায় মুদ্দাসসিরাকে দেখে সুলতানা চমকে উঠলো। পেছনে ফিরে কয়েক মুহূর্ত শুধু ওর দিকে হা করে তাকিয়ে থাকলো। ওকে এখন সে এখানে মোটেও আশা করেনি। মুদ্দাসসিরার দুঠোঁটে মুচকি হাসি।

আরে মুদ্দাসসিরা! কিভাবে এলে? সুলতানা উঠে দাঁড়িয়ে ওর দিকে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো, এই পাত্র কিসের?

এর মধ্যে দুধ আছে। আর এর সঙ্গে এমন মধু মেশানো আছে যা কেবল মিসরেই পাওয়া যায়। তাও ফেরাউনের যুগের কোন কোন পোড়া এলাকায়। মুদ্দাসসিরা দুধের পেয়ালা দারুন সুদৃশ একটি টেবিলের ওপর রাখতে রাখতে বললো,

এই দুধের বৈশিষ্ট্য হলো, দুধের মধ্যে সামান্য একটু মিশিয়ে কোন মেয়ে পান করলে তার রূপ কয়েখগুণ বেড়ে যায়। আর কিশোরীদের মতো হয়ে উঠে তার শরীর, রূপ-লাবন্য। হেরেমের এক খাদেমার ভাই এটা মিসর থেকে নিয়ে এসেছে।…..

খাদেমা দুধে মিশিয়ে আমার জন্য নিয়ে এসেছে। আমি পান না করে তোমার জন্য নিয়ে এসেছি। তোমার রূপ লাবন্য ও যৌবনের সঙ্গে আমীরে উন্দলুসের যে প্রেম রয়েছে আমি চাই সেটা আজীবন অটুট থাকুক। আমি আমার স্বামীকে আনন্দময় দেখতে চাই। নাও, তুমি পান করে নাও। আমার দেহের প্রতি তো আর ওর এত আকর্ষণ নেই।

সুলতানার চোখ-মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। সে কিছু একটা বলতে চাইলো। কিন্তু মুখ দিয়ে কোন শব্দ বেরোলো না। তার রূপের ঝাঁঝ যেন নিমিষেই উবে গেলো। সে জানে সে এক ভয়াবহ অপরাধ করেছে।

সুলতানা! মুদ্দাসসিরা বললো সুলতানার মুখের দিকে তাকিয়ে। লোভ, মোহ, নোংরা, প্রতিদ্বন্ধিতা আর বিদ্বেষ মানুষকে একদিন না একদিন সেখানে নিয়ে দাঁড় করায় যেখানে আজ তুমি দাঁড়িয়ে আছে। তোমার মুখের অদৃশ্য রেখাগুলো বলছে, এই বিষের পেয়ালা তুমি নিজেই পান করবে একদিন। এখনো কি তুমি তোমার অবস্থান কোথায় সেটা বুঝতে পারোনি?

আমি আমীরে উন্দলুসের স্ত্রী আর তুমি তার রক্ষিতা! তুমি এখন এমন এক অপরাধে অপরাধী যে তোমার অলীক স্বপ্ন, তোমার ভাগ্য, তোমার গর্বের সন্তানের ওপর কালিমার মোহর মেরে দিয়েছো। তোমার চরম উগ্রতা, ঝড়ের মতো দাপট, নদীর বানের মতো উচ্ছলতা, রূপের চরম অহংকার এখন কোথায় গেলো?

সুলতানার যেন মাথা ঘুরে গেছে। ধরাম করে সে খাটের ওপর বসে পড়লো আর নির্জবী চোখে মুদ্দাসসিরার দিকে তাকিয়ে রইলো।

এখন কেন বলছো না এই বিষের পেয়ালা তুমি পাঠাওনি। মুদ্দাসসিরা বিদ্রুপাত্মক হেসে বললো, মিথ্যার ওপর যার গোটা জীবনের অস্তিত্ব তার কেন মিথ্যা বলতে এত দ্বিধা! যার হাতে তুমি বিষের পেয়ালা পাঠিয়েছে সে আমারই খাদেমা। নিজেও সে বেঁচে থাকতে চায় এবং তার সন্তানদেরও জীবিত দেখতে চায়। তোমার অবৈধ বখশিশের লোভ এবং তুমি এখানে যে প্রেতাত্মার মূর্তি বানিয়ে রেখেছে তার ভয়ে সে তোমার কথা মানতে বাধ্য হয়।…

কিন্তু আমি যখন ওর সঙ্গে স্নেহের সুরে দুচারটি কথা বলি তখন তার কয়েদখানার জাহান্নামের কথা মনে পড়ে যায়, যেখানে তাকে আজীবন পঁচে মরতে হবে। তার সন্তানের কথা মনে পড়তেই সে আমার পায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। সে এই বিষের মূল্যবান কাহিনীর পুরোটাই আমাকে বলে দেয়। আমাকে নয়: তুমি নিজেকে নিজে জিজ্ঞেস করো, তোমার অবস্থান আস্তুকুড়ের কতটা নিচে?

এখানকার কোন খাদেমা, কোন খাদেম এমনকি কোন রক্ষিতাও আজ পর্যন্ত শাহী খান্দানের কাউকে কোন ধোঁকা দেয়নি। সত্য-মিথ্যা কোনটাই বলার সাহস নেই তোমার মধ্যে। ফায়সালার ভার তোমার ওপর ছেড়ে দিচ্ছে। যদি বলো, এখনই তোমার জীবনের শেষ রাত বানিয়ে দেবো, আর চাইলে তোমাকে তোমার প্রাণও ভিক্ষে দিতে পারি। এই রূপ যৌবন তোমার আর কোন কাজে লাগবে?

ঘরের এই শীতল পরিবেশেও সুলতানার মুখায়ব ঘামে চিক চিক করে উঠলো। টানা টানা চোখ দুটো লাল হয়ে উঠলো। তারপর তার দুচোখ বেয়ে অশ্রু ঝরতে লাগলো। সে আচমকা উঠে দাঁড়িয়ে খপ করে বিষের পেয়ালা হাতে উঠিয়ে নিলো। ফুপাতে ফুপাতে বললো,

আমি আর এখন বেঁচে থাকতে চাই না।

এই বলে পেয়ালা মুখের দিকে নিয়ে গেলো। মুদ্দাসসিরা একটি হাত লম্বা করে ওর ঠোঁটের ওপর রাখলো এবং অন্য হাতে পেয়ালাটি নিয়ে নিলো।

এর অর্থ হবে আমি তোমাকে বিষ দিয়ে মেরেছি। মুদ্দাসসিরা মুচকি হেসে বললো এবং পেয়ালাটি আগের জায়গায় রেখে দিলো।

সুলতানা দিশেহারা হয়ে মুদ্দাসসিরার দুহাত জড়িয়ে ধরে তার সামনে হাঁটু মুড়ে বসে গেলো।

তুমি যদি শাহী খান্দানের স্ত্রী হয়ে থাকো এবং আমার চেয়ে তোমার অবস্থান অনেক উঁচু হয়ে থাকে তাহলে দয়া করে এর প্রমাণ দাও। সুলতানা ভিক্ষা চাওয়ার ভঙ্গি করে বললো, জানি আমার এ পাপ ক্ষমার অযোগ্য। তবুও আমাকে ক্ষমা করে দাও। শাহে উন্দলুসকে যদি তুমি এটা বলে দাও তিনি আমাকে কি বাঁচিয়ে রাখবেন?

***

হ্যাঁ, মুদ্দাসসিরা বললো, তিনি তোমাকে অবশ্যই বাঁচিয়ে রাখবেন। এত সহজে তোমাকে মারবেন না। তবে কয়েদখানার সে অংশে তোমতার বসবাস হবে যেখানে ভয়ংকর সব পোকা মাকড়ের বসবাস।

সুলতানা মুদ্দাসসিরার দুহাটু জড়িয়ে ধরলো। আর হাউ মাউ করে কাঁদতে লাগলো।

আমি তোমাকে এই রসহস্যময় জীবেনর মঞ্চে বাঁচিয়ে রাখবো। মুদ্দাসসিরা বললো, আমীরে উন্দলুস তোমাকে ভালোবাসেন। আমি জানি, যা আমি বলছি আমার ধর্ম-বিবেক সেটাকে গুনাহই মনে করে।……..

কিন্তু আমার মাথা কখনো আমার ব্যক্তি স্বার্থ নিয়ে চিন্তা করে না। গর্ব করেই বলতে পারি আমি। আমার চিন্তা-চেতনায় আছে প্রসারতা এবং মনে আছে গভীরতা। আমি আমার নয়; উন্দলুসের স্বার্থ নিয়ে সবসময় চিন্তা করি। উঠো। খাটে উঠে বসো।

সুলতানা উঠলো এবং জানোয়ারের মতো খাটের ওপর গিয়ে বসলো। মুদ্দাসসিরা তার বুকে টোকা দিয়ে বললো,

শোন সুলতানা! মনোযগো দিয়ে শোনা! এই পেয়ালা ভেঙ্গে যাবে। এই বিষ মিশ্রিত দুধ মাটি খেয়ে ফেলবে। তারপর সময় তার আপন গতিতে চলতে থাকবে। বছরের পর বছর কেটে যাবে। কিন্তু তোমার এই অপরাধ না কোন মাটি ঢেকে নেবে। আজকের সময় কখনো বিস্মৃতিতে চলে যাবে। বিকের এই পেয়ালা তোমারা ঠোঁটের ওপর ঝুলতে থাকবে। যেখানেই তুমি একটু অসাবধান হবে সঙ্গে সঙ্গে অদৃশ্য এক হাত বিবেকর সেই পেয়ালা তোমার গলায় উপুড় করে ঢেলে দেবে।…..।

তোমার এই অপরাধ আমি হজম করার চেষ্টা করবো। কিন্তু আমার কয়েকটা শর্ত শুনে নাও। জীবনের কোন এক সময়ও যদি কোন একটা শর্তের বরখেলাপ করো তাহলে ভেবে দেখো কী ভয়ংকর পরিণাম হবে তোমার!

প্রথম কথা হলো, খ্রিষ্টানদের সঙ্গে সব ধরণের সম্পর্ক ছিন্ন করে দাও। আমারও অতি বিচক্ষণ ও অভিজ্ঞ গুপ্তচর আছে। যা আমাকে সবসময় সবধরনের সংবাদ দিয়ে থাকে।

তুমি যদি স্বপ্ন দেখে থাকো, এই খ্রিষ্টানরা, ক্রুশের পূজারীর তোমাকে কোন অঙ্গ রাজ্যের সম্রাজ্ঞী বানিয়ে দেবে এই চিন্তা এখনই দূর করে দাও। ওরা তোমাকে ধোঁকা দেয়া ছাড়া আর কিছুই দেবে না। এই কাফেরদের যে হোতা আছে ওদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করো। ইউগেলিস ও ইলওয়ারকে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলল। হ্যাঁ, ওদেরকে যদি ধোকা দিতে পারো কিংবা ওদেরকে গ্রেফতার করতে পারো তাহলে এটা তোমার জন্য একটা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

তোমার প্রতিটি শর্তই মেনে নেবো। সুলতানা হাতজোড় করে বললো, আমাকে ক্ষমা করে দাও। শাহে উন্দলুসকে কিছুই বলল না বোন!

ঠিক আছে বলবো না। ভবিষ্যতে কখনো আমীরে উন্দলুসকে বলবে না যে, তার চেহারায় ক্লান্তি রয়েছে। তাঁকে এই নয়া শরবত পান করাবে না আর। সালতানের কোন বিষয়ে এবং আমীরে সালতানাতের কোন ফায়সালায় কখনো হস্তক্ষেপ করবে না। তুমি একজন রক্ষিতা ছাড়া কিছুই নও। এটা মনে রেখে মহলে চলাফেরা করবে। নিজের ধর্মে ফিরে আসার চেষ্টা করো। যারিয়াবকে ব্যবহার করা ছেড়ে দাও।

কিন্তু মুদ্দাসসিরা! সুলতান বললো, যারিয়াব তো আমার প্রেমে দেওয়া না।

তুমিও ওর প্রেমে দেওয়ানা হয়ে যাও। মুদ্দাসসিরা বললো, তোমার সবকিছু ওর সত্বায় সমর্পন করে দাও। কোন অসুবিধা নেই। কিন্তু আমীরে উন্দলুসকে মহলের কয়েদী বানাবে না কখনো সুলতানা! তোমার নজর শুধু এই আজকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তোমার জীবনের একমাত্র নীতি হলো, আজ ভোগ করে নাও।….

কিন্তু আমার দৃষ্টি ভবিস্যৎ পর্যন্ত প্রসারিত। আমার নয়, মুসলিম জাতির ভবিষ্যৎ এটা। আমার ইতিহাস সেই নন্দিত ইতিহাসের ওপর রচিত হচ্ছে যা মৃত্যুর পর লেখা হবে। আমি সেই ইতিহাসকে আলোকিত করতে চাই, যার আলোয় পরবর্তী প্রজন্ম নিজেদের পথ চিনে নিতে পারবে।

হয়তো আমার কথাগুলো তোমার উপলব্ধির উর্ধ্বে চলে যাচ্ছে। তোমার মাথায় বুদ্ধি আছে জানি। কিন্তু সেটা অনবরত পাপ আর নোংরা চক্রান্তে প্রায় অন্ধ হয়ে গিয়েছে। তবুও বুঝতে চেষ্টা করো।…..

কিছু তো বুঝতে পারছি মুদ্দাসসিরা! তোমার সব শর্তই মাথা পেতে নিলাম। সুলতানা ফুপাতে ফুপাতে বললো।

আমি তো তোমাকে একথা বলছিনা যে, আমার ও আমার স্বামীর মাঝখান থেকে সরে দাঁড়াও। মুদ্দাসসিরা বললো, আমি সেই মহান ঝান্ডার মর্যাদার কথা বলছি, যা মহলের ওপর পতপত করে উড়ছে এবং ফৌজ সেটা নিয়ে যুদ্ধের ময়দানে দুশমনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।

যাও সুলতানা! তোমাকে আমি এবারের মতো মাফ করে দিলাম।

মুদ্দাসসিরা দুধের পেয়ালাটি হাতে নিয়ে ছন্দোবদ্ধ পায়ে কামরা থেকে বেরিয়ে গেলো। তারপর এই পেয়ালা রাতের অন্ধকারে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো।

আর সুলতানার অবস্থা সেই নাগিনীর মতো হয়ে গেলো, যার বিষ কালের ঝড়ে উড়ে গেছে।

***

ফ্লোরা সেই পৃথক বাড়িতেই নজরবন্দি হয়ে আছে। ধর্মীয় পন্ডিত তাকে নিয়মিতই তালীম দিয়ে যাচ্ছেন। ফ্লোরার চাপাচাপিতে পন্ডিতকে প্রতিদিনই কিছু না কিছু সময় বাড়িয়ে সেখানে থাকতে হচ্ছে। ফ্লোরা তার সাথে এখন অসংকোচ ঘনিষ্ঠতা গড়ে তুলেছে। পন্ডিতের আসতে সামান্য বিলম্ব হলেই ফ্লোরা অনুযোগের সুরে বলে,

আপনার অপেক্ষায় থাকতে থাকতে আমার চোখ দুটো ক্লান্ত হয়ে যায়। মাথা ধরে যায়। অন্য কেউ যদি আমাকে নিয়ে এমন অবহেলা করতো আমি তার কোনো কথাই মনোযোগ দিয়ে শোনতাম না। কিন্তু আপনি যতই অবহেলা করুন আমাকে; আপনাকে দেখার পর আমার সব দুঃখ কষ্ট হতাশা শেষ হয়ে যায়।

ধর্মীয় পন্ডিত এখন দীক্ষায় দেয়ার চেয়ে ফ্লোরার প্রত্রিই বেশি মনোযোগী। ফ্লোরার সঙ্গে তিনি এমনভাবে কথা বলেন যেন ওরা পরস্পর গভীর বন্ধু। গল্প গুজব করার পর তাকে সবক দেন। এতদিন ফ্লোরা তার সামনে বসতো। তারপর তার সাথে এসে বসতে শুরু করে।

একদিন বইয়ের ওপর ফ্লোরা এমনভাবে ঝুঁকে পড়ে যে, ফ্লোরার চুল পন্ডিতের গালে স্পর্শ করে। ফ্লোরা একটি হাত পন্ডিতের কাঁধের ওপর রাখে।

পন্ডিতও যেন তার অনিচ্ছায় একটি হাত ফ্লোরার কোমরে নিয়ে রাখে। ফ্লোরা তার দিকে তাকিয়ে এমনভাবে ফিক করে হেসে ফেলে যেন পন্ডিত তার এক গোপন ইচ্ছা পূরণ করে দিয়েছেন।

আপনি আমাকে বলেন, মনে যেন খোদার ভালোবাসা সৃষ্টি করি। ফ্লোরা তার ধর্মীয় পন্ডিতকে বললো, কিন্তু আমার মন তো আপনার ভালোবাসায় ব্যকুল হয়ে যায়। এটা কি পাপ?

না।

ফ্লোরা নিজের গাল পন্ডিতের গালের সঙ্গে লাগালো। পন্ডিত যেন তার জীবনের সব শিক্ষা-দীক্ষা ভুলে গেলেন। কিন্তু ফ্লোরা সঙ্গে সঙ্গেই একটু দূরে সরে গেলো। সে তো পন্ডিতের ভেতর আগুনের সলতে জ্বালিয়ে দিয়েছে।

পরের কয়েক দিন ফ্লোরা পন্ডিতের সাথে প্রেমের এমন উম্মত্ত অভিনয় করলো যে, পন্ডিতের মন-মগজে ফ্লোরা চরম এক নেশা হয়ে সওয়ার হলো। একদিন ফ্লোরা ধর্মীয় পন্ডিতকে বললো,

আপনি চলে যাওয়ার পর সারা দিন এমন একা আর নিঃস্ব লাগে যে, ইচ্ছা করে মরে যাই। যদি মোটা একটা রশি পেতাম তাহলে ঐ উঠোনের গাছগুলোতে রশি বেঁধে দোলনা বানিয়ে নিতাম। ছোটকাল থেকেই দোলনা খেলা আমার দারূণ পছন্দ। দোলনা পেলে আমি খাওয়া দাওয়াও ভুলে যাই। আমার জন্য বড় সড় একটা রশি নিয়ে আসবেন?

অবশ্যই। তুমি বললে তোমার জন্য কূহে নূর থেকেও তোমার চাহিদা পূরণ করে দেবো।

পরদিন ধর্মীয় পন্ডিত বেশ শক্ত আর অনেক লম্বা একটা রশি নিয়ে এলেন। প্রহরী মহিলারা একটু আপত্তি করলো যে, এই মেয়ে তো এই রশির সাহায্যে পালিয়ে যেতে পারে। পন্ডিত তাদেরকে বললেন, তোমরা নিজের হাতে বাড়ির আঙ্গিনায় কোন একটা গাছে রশি বেঁধে দোলনা বানিয়ে দাও। তাহলে তো আর সে ওখান থেকে রশি খুলে নিতে পারবেন।

প্রহরী মহিলাদের আর আপত্তি রইলো না। ওরা তাই করলো। আর ফ্লোরার প্রতি ওরা বেশ সন্তুষ্ট। মেয়েটি বেশ সাধা-সিধা এবং এখন পর্যন্ত এমন কোন আচরণ করেনি যাতে করে ওকে সন্দেহ করা যায়।

ফ্লোরা সে রাতেই সেই দোলনার রশির সাহায্যে তার কয়েদখানা থেকে পালালো। এর আগে প্রহরী এক মহিলাকে গলাটিপে অজ্ঞান করে নেয়।

.

ফ্লোরা পালিয়ে কোথায় যাবে এটা তার জানা ছিলো। কর্ডোভায় এক খ্রিষ্টান সন্ত্রাসীর বাড়ি আছে। এ বাড়িতে প্রায়ই খ্রিষ্টান সন্ত্রাসীদের গোপন আড্ডা বসে। এর নাম জনসন। ফ্লোরার মা এর বাড়িতে তাকে নিয়ে অনেকবার এসেছে। ইউগেলিস ছদ্মবেশে যখন কর্ডোভায় আসে তখন এই জনসনের বাড়িতেই উঠে।

ফ্লোরা জনসনের বাড়ির দরজার কড়া নাড়লো। জনসন দরজা খুললো, এত রাতে ফ্লেরকে দেখে তো তার মুখ হা হয়ে গেলো। তার হাত ধরে ভেতরে টেনে নিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো। ফ্লোরা তাকে জানালো, সে কি করে পালিয়ে এসেছে।

কে জানে তোমাকে আবার আমার ঘরে কত দিন বন্দি হয়ে থাকতে হয়? জনসন বললো, তবে সকালে আমি আমাদের লোক দিয়ে কেন্দ্রে খবর পাঠিয়ে দেবো। ওখান থেকে এক সময় কেউ এসে তোমাকে কর্ডোভা থেকে নিয়ে যাবে।

আমার আম্মুর কী খবর?

তোমার ভাই বদর তোমার মা ও তোমার বোন বালদীকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। দুই দিন আমার এখানে ছিলো। ওদেরকে অনেক দূরে এক নিরাপদ স্থানে পাঠিয়ে দিয়েছি। কর্ডোভা থেকে তুমি বের হলেই তুমি কোথাও না কোথাও এদের দেখা পেয়ে যাবে। আমাদের গুরু ইউগেলিস দুচার দিন পর কর্ডোভা আসছেন। উনি এখানেই উঠবেন। তোমার সাথে দেখা হয়ে যাবে।

ইউগেলিস…. উহ … ইউগেলিস ফ্লোরা বাচ্চাদের মতো আনন্দে লাফিয়ে উঠলো প্রায়। আমার আম্মু ওর ব্যাপারে কত গল্প শুনিয়েছে আমাকে। নিজের যৌবন জীবন আবেগ ভালোবাসা সব ইসলামের ধ্বংস ও খ্রিষ্টবাদের বাদশাহী প্রতিষ্ঠায় ওয়াকফ করে দিয়েছেন তিনি।

ইউগেলিস তো খুবই সুদর্শন এক যুবক। জনসন বললো, তিনি বিয়ে করবেন না বলে কসম করেছেন। ঈসা মাসীহের আসল দেওয়ানা তিনি। আমীরে আব্দুর রহমানের হেরেমের হীরা সুলতানা মালিকায়ে তরূব এবং শিল্পী যারিয়াব তোতা তার জন্য পাগল পারা।

এই দুজন যদি সবসময় তার হাতে থাকে তাহলে তো আমরা খুব তাড়াতাড়ি সফল হবো। ফ্লোরা বললো।

না, জনসন তাকে বাঁধা দিয়ে বললো, এ দুজনের ওপর আমাদের পুরোপুরি বিশ্বাস নেই। কারণ, যত কিছুই হোক ওরা মুসলমান! তাছাড়া একজন গায়ক আর আরেকজন সুলতানা কেবল একজন রক্ষিতা। এরা আসলে দরবারী চাটুকার। চরম স্বার্থপর। ওদের সাথে আমরা খুব সাবধানে কথা বলি।

আমি তোমাকে বলছিলাম, সুলতানার রূপ যৌবন অতুলনীয়। এমন সুন্দরী এক মেয়ে তারই জায়গীরে ইউগেলিস একলা রাত কাটিয়েছে; কিন্তু সুলতানা এই পাথরকে মোমে পরিণত করতে পারেনি।

ফ্লোরার রূপও অতুলনীয়। কিন্তু একজন রূপবর্তী মেয়ে যেমন একজন রূপদর্শন পুরুষের স্বপ্ন বুকে নিয়ে রাত দিন কাটিয়ে দেয়, ফ্লোরার মধ্যে সেই স্বাভাবিক বোধটাই নেই। এ ধরণের মেয়েরা তো কোন প্রেম কাহিনীর নায়িকা বা কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়।

এক মুসলিম ঐতিহাসিক ইবরাতনামায়ে উন্দলুস নামক গ্রন্থে লিখেছেন,

ফ্লোরা নিজেকে নিজে নারীই মনে করতো না। খ্রিষ্টবাদ তার ওপর এক উন্মাদনা ও উম্মত্ততা হয়ে সাওয়ার হয়। কখনো মনে হতে কোন অদৃশ্য কিছু তাকে এক ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে।

পরদিন কর্ডোভায় এক হুলুস্থুল পড়ে গেলো। কয়েদী মেয়েটি নজরবন্দী থেকে পালিয়েছে। তার কামরায় এক প্রহরী মহিলার লাশ পাওয়া গেছে। বাড়ির ছাদের পিলারের সঙ্গে ঝুলন্ত একটি লম্বা রশি পাওয়া গেছে। সেটা লাগায়ো রাস্তা পর্যন্ত নেমে গিয়েছে।

বাকি দুই প্রহরী মহিলাকে পুলিশী হেফাজতে নিয়ে নেয়া হলো। তাদের থেকে জানা গেলো, যে ধর্মীয় পন্ডিত ফ্লোরাকে দীক্ষা দিতে যেতেন তিনিই রশি নিয়ে আসেন। পন্ডিতকে গ্রেফতার করা হলো।

পন্ডিত তখনই বুঝতে পারলেন, ফ্লোরা যেমন সুন্দরী এর চেয়ে কয়েকগুণ বেশি চতুর। সে আসলে প্রেম-ভালোবাসার জাদু চালিয়ে তাকে বোকা বানিয়ে পালানোর পথ তৈরি করে নিয়েছে। বেচারার অনুতাপের আর শেষ রইলো না। অপরাধের উপলব্ধি তাকে এমন আঘাত করলো যে, তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেললেন।

তাকে কাঠগড়ায় যখন দাঁড় করানো হলো তখন দেখা গেলো, তিনি কখনো নিজের কাপড় খামচে ছিঁড়ছেন, কখনো নিজের হাত কামড়াচ্ছেন। কখনো প্রহরীদের দিকে তেড়ে যাচ্ছেন। আদালত তাকে পাগল সাব্যস্ত করলো এবং মুক্তি দিয়ে দিলো।

আর যে মেয়েকে সুপথে আনতে গিয়ে সরকারের একজন মহিলা প্রহরী হারাতে হয়েছে এবং এক ধর্মীয় পন্ডিতের পাগল হতে হয়েছে সে মেয়ের পেছনে ছুটে আর লাভ নেই। সে নিজেই তার ধ্বংসের পথ বেছে নিয়েছে। ফ্লোর ব্যাপারে রাষ্ট্রপক্ষের দায়ের করা সমস্ত মামলা আদালত খারিজ করে দিলো।

কয়েক দিন পর উস্কখুস্ক চুলের এক পাগল দেখা গেলো কর্ডোভা শহরে। সে কখনো রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়ে, সূর্যের দিকে আঙ্গুল তাক করে বিড় বিড় করে কি যেন বলে। এদিক ওদিক মাথা নাড়িয়ে হতাশা প্রকাশ করে। কিছুক্ষণের মধ্যে অনেক পথচারী তার আশে-পাশে জমা হয়ে যায়।

পাগলের কান্ড কারখানা দেখে তারা কৌতুক বোধ করে। কিন্তু পাগল ভিঢ় এড়িয়ে এক গলিতে ঢুকে পড়ে। তিন চারটা গলির মোড় ঘুরে ঘুর এক গলির একটি বাড়ির দরজায় গিয়ে দাঁড়ায়।

তারপর এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে নেয় কোন মানুষ আছে কিনা। না, গলিতে কেউ নেই। কোন শব্দ না করে দরজার ভেতরে ঢুকে পড়ে এবং নিজেই ভেতর থেকে দরজার শিকাল চড়িয়ে দেয়।

ফ্লোরা এ বাড়িতেই থাকে।

বাড়ির মালিক জনসন দৌড়ে আসে এবং পাগলকে ব্যকুল হয়ে জড়িয়ে ধরে বলে, ইউগেলিস! আপনার অপেক্ষাতেই ছিলাম।

ইউগেলিসও তাকে আলিঙ্গন করে।

ইউগেলিস নিজের ছদ্মবেশ পাল্টালো। গোসল করে ধূলোবালি পরিস্কার করলো। জনসন তাকে ফ্লোরা ব্যাপারে জানালো। আদালতে বিচারকের সামনে ইসলামের বিরুদ্ধে সে যে নোংরা কটুক্তি করেছে সেটাও জনসন ইউগেলিসকে শোনালো।

এখনই আমাকে ওর সামনে নিয়ে চলো। এ তো কুমারী মরিয়মের পবিত্র আত্মা মনে হচ্ছে। ইউগেলিস ব্যকুল কণ্ঠে বললো।

ফ্লোরা ও ইউগেলিস দুজন যখন মুখোমুখি হলো দুজনই দুজনের মনে ধাক্কার মতো খেলো। কয়েক মুহূর্ত পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইলো। ফ্লোরা ধীরে ধীর ইউগেলিসের দিকে এগিয়ে গেলো। তার হাটু চুমু খেতে ঝুলতে গেলো। ইউগেলিস তার অজান্তেই ফ্লোরাকে উঠিয়ে তার বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরলো।

তুমি এক নিষ্পাপ মেয়ে। ইউগেলিস তাকে পৃথক করে তার মুখটি নিজের দুহাতের করোটিতে রেখে বললো।

মরিয়মও এমনই নিষ্পাপ ছিলেন। হযরত ঈসা (আ.)ও ছিলেন খুব সাধা সিধা। কিন্তু ক্রুশবিদ্ধ হয়ে ছিলেন। তুমিও ক্রুশ বিদ্ধ হবে। শূলিতে ঝুলানো হবে তোমাকে।

আমি এ জন্যই জন্মগ্রহণ করেছি। ফ্লোরা আবেগী গলায় বললো, আমার কুমারিত্বকে অটুট রেখেই আমি শূলিতে ঝুলবো। আপনি কি আমাকে এই নিশ্চয়তা দিতে পারবেন যে, আমার প্রাণ আমার ধর্মের জন্য কোন কাজে লাগাবে? আরব থেকে আসা ঐ দুশমনদের শাহরগে কি আমার রক্ত মরণ বিষ হয়ে ঝড় তুলতে পারবে?

ইচ্ছা, দৃঢ়তা, সংকল্প এবং একচ্ছত্র আবেগ থাকলে কোন কাজটা অসম্ভব? ইউগেলিস ওকে তার কাছে বসাতে বসাতে বললো, তুমি বিচারকের সামনে ইসলাম ও তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে গালমন্দ করে আমার সামনে নতুন এক পথ খুলে দিয়েছে। আমি আমার আন্দোলনকে এপথেই চালাব। আমি এমন জানবার্য তৈরি করবো যারা জন সম্মুখে দাঁড়িয়ে ইসলামকে। গালমন্দ করবে। ওদেরকে পাকড়াও করা হবে। শাস্তি দেয়া হবে। সেদিনই এভাবে বিভিন্ন জায়গায় আরো কয়েজন একই কাজ করবে।

এতে কী লাভ হবে? জনসন জিজ্ঞেস করলো।

এদেরকে যখন ধর্মীয় কারণে শাস্তি দেয়া হবে তখন খ্রিষ্টানদের মধ্যে প্রতিশোধের এক নতুন স্পৃহা জেগে উঠবে। ইউগেলিস বললো, আমরা গির্জাগুলো থেকে গুজব ছড়িয়ে দেবো, গ্রেফতারকৃত খ্রিষ্টানদেরকে এমন কঠিন শাস্তি দেয়া হচ্ছে যা কোন মানুষ সহ্য করতে পারবে না।

এভাবে আমরা খ্রিষ্টান জাতির মধ্যে এমন আগুনের অঙ্গার উস্কে দেবো যে, সেটা এক ঝড় আর মহাপ্লাবন হয়ে দেখা দেবে। এই প্লাবন মুসলিম মহল ও হুকুমতকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। আমাদেরকে সব ধরনের ফেতনা-ফাসাদ ছড়িয়ে দিতে হবে।

তবে হুকুমতের বিরুদ্ধে লাগাটাও সহজ কাজ নয়। ফ্লোর বললো, মারীদর লোকেরা বিদ্রোহ করে কি পরিমাণ ক্ষয়-ক্ষতির স্বীকার হতে হয়েছে ওদের? অধিকাংশ খ্রিষ্টানদের ঘর বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। আমরা কি নিয়মিত ফৌজ বানিয়ে লড়তে পারি না?

***

এখনই নয়। ইউগেলিস বললো, যদিও আমরা অনেক প্রাণ বিসর্জন দিয়েছি, তবুও বিদ্রোহের ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ণ রাখবো। আমরা যদি বিদ্রোহকে আমাদের জন্য ক্ষতিকর মনে করে মুসলমানদেরকে নিশ্চিন্তে ভাববার সুযোগ দিই তাহলে এরা ফ্রান্সের ওপর হামলা করে আমাদের আসল শক্তি শেষ করে দেবে।…….

তারপর সারা ইউরোপে ইসলামের বিজয় আর কেউ রুখতে পারবে না। উন্দলুসের ইতিহাস দেখো। কিছু দিন আগেও ফ্রান্সের ওপর হামলা হয়েছিলো। প্রথম আব্দুর রহমান ফ্রান্স প্রায় জয় করে নিয়েছিলো। দ্বিতীয়বার সেটা আর ঘটতে দেবো না।

ফ্রান্স কি এখন আমাদেরকে সাহায্য করছে? ফ্লোরা জিজ্ঞেস করলো।

ফ্রান্সের একক সাহায্যে সব ধরনের বিদ্রোহ সংঘটিত হচ্ছে। ইউগেলিস বললো, বর্তমান আমীর যে নিজেকে শাহে উন্দলুস বলে থাকেন, ফ্রান্সের বিরুদ্ধে অভিযানে বের হচ্ছিলেন। আমরা মারীদায় বিদ্রোহ করে আমীর ও তার সালারদের বাধ্য করলাম রাস্তা থেকে যেন মারীদা চলে যায়। ফ্রান্সকে এভাবে আমরা বাঁচিয়ে নিলাম। ফ্রান্স আমাদের যুদ্ধশক্তি এবং ধর্মের কেন্দ্রী উৎস।

এখন আমাদের কাজ কী হবে? জনসন জিজ্ঞেস করলো।

এ উদ্দেশ্যেই আমি কর্ডোভা এসেছি। ইউগেলিস বললো, কিছু লোকজন আছে, ওদেরকে কাজ বুঝিয়ে দিতে হবে। এখন আমরা টলয়টায় বিদ্রোহ করাচ্ছি। বরং এখান থেকেই আমাদের বিদ্রোহাত্মক যুদ্ধ শুরু হচ্ছে। আমাদের জানবাযরা কর্ডোভার ফৌজের কোন টহল দল বা ছোটখাট ইউনিট দেখলেই তাদের ওপর আচমকা গেরিলা হামলা চালিয়ে বন জঙ্গলে বা কোন উপত্যকায় অদৃশ্য হয়ে যাবে। ওখানে এটা শুরু হয়ে গেছে।

ওখানকার গভর্ণর মুহাম্মাদ ইবনে ওসীম। তিনি এসব গেরিলা হামলাকে এখন তেমন গুরুত্ব দিচ্ছেন না। তিনি হামলাকারীদেরকে ডাকাত বা লুটেরা মনে করছেন। আমাদের সামরিক দুর্বলতা হলো, টলয়টার শহরবাসী এখনো বিদ্রোহের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত হয়নি। এর কারণ হলো, মারীদার বিদ্রোহীদের মধ্যে যারা প্রাণ নিয়ে পালাতে পেরেছে তাদের অনেকেই টলয়টায় গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে।…..

এরা ওখানকার লোকদেরকে খুবই ভয়ংকর কাহিনী শুনিয়েছে। মুসলিম ফৌজকে দৈত্য-দানবের সাথে তুলনা করে লোকদের মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে দিয়েছে। এমন কথাও বলেছে যে, কোন পাপ করতে চাও করে নাও, কিন্তু বিদ্রোহ করতে যেয়ো না। সাধারণ খ্রিষ্টানদের মানসিক এই দ্বিধা-দন্দ আমাদের জন্য একটা সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। ওখানে আমাদের কিছু লোক আছে যারা টহল ফৌজের ওপর নৈশ হামলা চালিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে।…

এখন প্রয়োজন হলো, মারীদার মতো টলয়টার সব লোক একবারে বিদ্রোহে জ্বলে উঠা। সবাই কর ইত্যাদি দিতে অস্বীকার করে বসা এবং গভর্ণর ইবনে ওসীমকে তার বাসভবনে হামলা করে গ্রেফতার করে নেয়া। শহরের শাসন ক্ষমতা তখন সহজেই খ্রিষ্টানরা নিয়ে নিতে পারবে। এসব একবারে না ঘটলে আমাদের চক্রান্ত সফল হবে না।….

শাহলুই বলেছেন, তিনি তার ফৌজ শহরবাসীর ছদ্মবেশে টলয়টায় পাঠিয়ে দেবেন। কিন্তু তাকে এই নিশ্চয়তা দিতে হবে, মারীদার মতো এখানকার লোকজন অস্ত্র ফেলে পালাবে না। আমার এখন বড় সমস্যা হলো, টলয়টার লোকদের ব্যাপারে শাহলুইকে আমি কোন জামানত দিতে পারছি না।

হাশিম কামার তো ওখানে চলে গেছে। সে কি লোকদেরকে বুঝাতে পারছে না? জনসন জিজ্ঞেস করলো।

সে তার কাজ করে যাচ্ছে। গেরিলা বাহিনী তো সেই বানিয়েছে। সে বড় ধরনের কৃতিত্বের কাজ করছে ইউগেলিস বললো, তার নামও আমরা পরিবর্তন করতে দেয়নি। তাকে বলে দেয়া হয়েছে যারা তাকে মুসলমান মনে করে তাদের কাছে যেন সে মুসলমানই থাকে। খ্রিষ্টানরা তো জেনেই ফেলেছে সে অনেক বড় খ্রিষ্টান এবং নামে মাত্র মুসলমান।

এখানে আমি এবার অন্য কোন পরিকল্পনা নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু ফ্লোরা আমাকে নতুন এক পথ দেখালো। এটা আমি কাজে লাগাতে চাই। এতে সবচেয়ে বড় কাজ এটাই হবে যে, কর্ডোভার প্রশাসন তখন এখানে এটা নিয়েই পড়ে থাকবে। পুরোপুরি মনোযোগ তারা টলয়টায় দিতে পারবে না।

সন্ধ্যার পর জনসনের এই বাড়িতে এক এক করে তিনজন ঝান্ডা মার্কা লোক এলো। ইউগেলিসের সঙ্গে এরা দীর্ঘ সময় কথা বার্তা বলে চলে গেলো।

কয়েক দিনের মধ্যে এরা নতুন এক মিশন বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে।

***

জনসনের বাড়িটি মোটামুটি বড়। জনসন ইউগেলিসের জন্য এক কামরা এবং ফ্লোরার জন্য এক কামরা প্রস্তুত করে নিজে অন্য কামরায় গিয়ে শুয়ে পড়লো। ওরা দুজনে বসে কথা বলতে লাগলো।

তাদের ধর্ম এবং ইসলামের বিরুদ্ধে ভায়াবহ ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে ইউগেলিস ও ফ্লোরা কথা বলতে লাগলো। এক পর্যায়ে দুজনে দুজনের ব্যক্তিগত কথাবার্তাও জিজ্ঞেস করলো।

ফ্লোরা ইউগেলিসের কাছে জানতে চাইলো, সে কি তার মিশনের কারণে বিয়ে করেনি, না তার পছন্দের মেয়ে এখনো সে পায়নি।

আমি একজন রক্ত-মাংসের মানুষই ফ্লোরা! ইউগেলিস বললো, কোন মানুষ এটা দাবী করতে পারবে না যে, সে তার কামনা বাসনার উর্ধ্বের উঠে গেছে। তবে আমি এমন দাবী করে থাকি। কিন্তু আমার এই দাবি সত্য নয়। তুমি সদ্য যুবতী মেয়ে ফ্লোরা! এখনই হয়তো তুমি আমার সব কথা বুঝবে না। সবাই নিজের প্রাণ বিসর্জন দিতে পারে। কিন্তু কামনা-বাসনা, রিপুর তাড়না খুব কম মানুষই বিসর্জন দিতে পারে।….

ধর্মের ব্যাপারে আমি এমন উন্মাদ আর আপোষহীন যে, আমার কাছে দুনিয়ার আর কিছু ভালো লাগে না। তিন সুন্দরী মেয়ে আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে, কিন্তু ওদের প্রস্তাব আমার কাছে মনে হয়েছে এক বন্দি জীবনের জন্য নিজের গলায় শিকল পরে নেয়া। একবার যদি এই শিকল উঠে তাহলে হয়তো আমি আমার গন্তব্যে পৌঁছতে পারবো না।

ফ্লোরা ইউগেলিসের দিকে এমনভাবে তাকিয়ে রইলো যার মধ্যে যেমন আস্থার প্রতিফলন আছে তেমন আছে সহানুভূতি এবং এমন উপলব্ধির ছায়াও ফ্লোরার চোখে মুখে দেখা গেলো যেন সে ইউগেলিসের মধ্যে নিজেকে দেখতে পাচ্ছে।

যেন ওদের দেহ মন কোথাও গিয়ে একাকার হয়ে যাবে।

আমি আমার ভেতরের কান্না শোনাচ্ছি না ফ্লোরা! ইউগেলিস বললো, বাস্তব কথা হলো, বড় কোন লক্ষ্য উদ্দেশ্য সফল করতে হলে এমন এমন ত্যাগ স্বীকার করতে হয় যেটা দেখলে তুমি বলবে কোন মানুষ এমন ত্যাগ দিতে পারে না। আগুনের অঙ্গার গলায় পুরতে হয়। বিষ পান করতে হয়। এবং নিজের হাতে নিজের গলা টিপে দিতে হয়।…।

আমি এই সবক পেয়েছি মুসলমানদের থেকে এবং শিক্ষাও অর্জন করেছি তাদের থেকে। আমি খুব ভালো করে কুরআন পড়েছি এবং ওদের বিখ্যাত কয়েকটা তাফসীরও পড়েছি। এসব পড়ে আমি এতই ইসলামের প্রতি মুগ্ধ হয়ে পড়ি যে, মুসলমান হয়ে যাওয়ার ফায়সালা করে বসি। কিন্তু একটা বিষয় আমার মধ্যে বিদ্বেষের আগুন জ্বালিয়ে দেয় যে, যে আমাদের ইঞ্জীল কেন ওদের কুরআনের মতো এমন পূর্ণাঙ্গ আর এতে মনোমুগ্ধকর নয়?

আসলে খোদার ইচ্ছা আমার কাছ থেকে অন্য কোন কাজ নেয়া। তাই আমি ইসলামের বিরুদ্ধে চলে যাই…। তোমাকে আমি একটা কথা বলছি, মনোযোগ দিয়ে শোনো। যতদিন মুসলমানরা নিজেকের ধর্মের প্রতি পূর্ণ অনুগত ছিলো ততদিন তাদের ধর্ম চার দিকে বিজয়-কেতন উড়িয়েছে। ওরা যে দেশেই গিয়েছে ওদের চরিত্র মাধুরী দেখে সেখানকার লোকেরা তাদের প্রতি মুগ্ধ হয়ে তাদের ধর্ম বুকে টেনে নিয়েছে।…..

কিন্তু কোন এক সময় সুযোগ বুঝে আমাদের পূর্বপুরুষরা মুসলমানদের মধ্যে নারীর রূপ-সৌন্দর্য, সম্পদ ও ক্ষমতার লোভ খুব কৌশলে ঢুকিয়ে দেয়। তখন থেকেই তাদের পতন শুরু হয়ে যায়। উন্দলুসের এখনো ইসলাম শুধু এ কারণে আছে যে, ইসলামের জন্য নিজের প্রাণ ও সবধরণের কামনা-বাসনা বিসর্জন দেয়ার মতো লোক এখনো এখানে আছে।

যেমন কর্ডোভার ফৌজের সালাররা এবং আরব থেকে আসা কিছু নারী যারা নিজেদের ধর্মের জন্য নিজের জান বাজি রেখে বসে আছে।….

আর না হয়, সুলতান, আমীর উমারা এবং শাহী খান্দানের লোকেরা তো সেই কবেই ইসলামের শিকড় ছিবড়ে করে ফেলেছে। আমি ওদের থেকে এই শিক্ষা গ্রহণ করেছি যে, জান ও জযবা বিসর্জন দাও তো সফলতা তোমার পায়ে এসে চুমু খাবে।……

আমার কামনা-বাসনা ছিলো বড়ই তৃষ্ণার্ত। কারণ, শৈশবেই আমার মা বাবা মারা যায়। ভালোবাসার রূপ রঙ কী এর সঙ্গে আমার পরিচয় নেই ফ্লোরা! আমি যখন কোথাও ক্লান্ত হয়ে একাকি থাকি তখন এক আশ্চর্য ধরনের তৃষ্ণা অনুভব করি।……

এটা সম্ভবত! আমার আত্মার তৃষ্ণা। তখন আমি এক ধর্মীয় পন্ডিত ও নেতা থেকে সাধারণ মানুষের স্তরে নেমে আসি এবং অস্থির হয়ে যাই যে, আমার এমন কোন জিনিসের প্রয়োজন যা আমি জানি না।….

কখনো শুয়ে শুয়ে আমার অজান্তেই হাত দুটো আমার বিছানার চার দিকে ঘুরে বেড়ায়। নিজের সঙ্গে ঝগড়া করি। নিজেকে গাল-মন্দ করি এবং এক সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসি। তখন ভাবতে থাকি, ইসলামের শিকড় কি করে উপড়ে ফেলা যায়। উঁহু ফ্লোরা! তোমার তো মনে হচ্ছে ঘুম আসছে। উঠো। তোমার কামরায় গিয়ে শুয়ে পড়ো।

ফ্লোরা কোন কথা না বলে উঠে পড়লো।

ইউগেলিস তার কামরায় শুয়ে পড়লো। কিন্তু ফ্লোরার ঘুম এলো না। তার মাথায় ক্ষণে ক্ষণে ইউগেলিসের কথাগুলো গুন গুন করতে লাগলো। নিজেই স্বগোতিক্তের মতো বলে উঠলো,

আহা, লোকটি বড়ই তৃষ্ণার্ত। অথচ তৃষ্ণা মেটানোর সহজ সুযোগ পেয়েও তা কাজে লাগচ্ছে না। কত বড় ত্যাগ স্বীকার করছে। আহা প্রেম-ভালোবাসা কি তা জানে না। কত প্রেম নিবেদন ফিরিয়ে দিয়েছে।

ফ্লোরা উঠে বসলো। অন্ধকারে ঘুরতে লাগলো। ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলতে লাগলো। মনে হলো তার দম বন্ধ হয়ে আসবে। এমন অনুভূতির সমুমখীন সে কখনো হয়নি।

সে ইউগেলিসের কামরার দিকে দ্রুত হাঁটতে লাগলো। দরজায় হাত রাখতেই দরজা খুলে গেলো। চৌকাঠ পেরিয়ে পা ঘেষটাতে ঘেষটাতে সে সেদিকে এগিয়ে গেলো যেদিকে ইউগেলিসের খাট রয়েছে।

হঠাৎ সে খাটের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে ইউগেলিসের খাটের ওপর পড়ে গেলো। তার দেহের অর্ধেক পড়লো ইউগেলিসের ওপর। ইউগেলিস ধড়মড় করে উঠে বসলো। ফ্লোরা ইউগেলিসের মুখটি হাতে ধরে নিজের দিকে আকর্ষণ করলো।

কে? ফ্লোরা? ইউগেলিস ফিস ফিস করে জিজ্ঞেস করলো।

হ্যাঁ, ফ্লো।

কেন এসেছ।

তোমার কুরবানীর স্থলে নিজের কামনা বাসনা কুরবানী দিতে। ফ্লোরা ব্যকুল কণ্ঠে বললো, তোমাকে আমি এভাবে তৃষ্ণায় ছটফট করতে করতে মরতে দেবো না ইউগেলিস!

আমি যেই হই তোমার প্রেম-ভালোবাসা পাওয়ার জন্য ছটফট করবো না। তোমার পায়ের শিকল হবো না। নিজের গোলাম বানাবো না তোমাকে। আমাকে ক্ষণস্থায়ী এক মনযিল মনে করে একটু বিশ্রাম করে নাও।

ইউগেলিস ওকে দুবাহু দিয়ে জড়িয়ে ধরলো। তখনই সে অনুভব করলো, যে জিনিসের তৃষ্ণায় সে ছটফট করে, যার গোপন সন্ধানে সে ব্যকুল হয় এ সেই রক্ত মাংসের অপরূপ হীরক খন্ড।

দাঁড়াও। ঘরে আগে আলো জ্বালাই। তোমাকে দুচোখে দিয়ে ভালো করে দেখতে চাই। ইউগেলিস বলে উঠে পড়লো।

কামরা প্রদীপের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠলো।

এক ইংরেজ ঐতিহাসিক এসপিস্টাক দুই ঐতিহাসিক আরবাসী ও কুন্ড এর উদ্ধৃতিতে লিখেছেন,

ইউগেলিস ও অপরূপা ফ্লোরার প্রথমবার সাক্ষাত হয় নির্জন এক ঘরে এবং প্রথম সাক্ষাতেই ফ্লোরা নিজেকে ইউগেলিসের কাছে সমর্পণ করে দেয়। সে বড় এক ত্যাগের উদ্দেশ্যে ইউগেলিসের শয়ন কক্ষে ঢুকেছিলো। কিন্তু তার মনে ইউগেলিসের জন্য এমন প্রেমের ঝড় উঠলো যার উদাহরণ সে যুগে খুব একটা পাওয়া যায়নি। ওরা বিয়ে করেনি। কিন্তু পরস্পরের অস্তিত্ব অনুভব করে ওরা বাঁচার মন্ত্রণা পেতো।

ফ্লোরা নিজের প্রাণ, যৌবন এবং কুমারিত্ব এক ইউগেলিস ও খ্রিষ্টবাদের জন্য ওয়াকফ করে দিলো।

ওরা তিন চার দিন সেই বাড়ির একই কামরায় রইলো। প্রতিদিনই নেতৃস্থানীয় কিছু খ্রিষ্টান ও পাদ্রী ইউগেলিসের কাছে আসলো। নতুন এক পরিকল্পনা যখন চূড়ান্ত তখন ওরা দুজন একদিন ছদ্মবেশে কর্ডোভা থেকে বেরিয়ে গেলো।

***

এর পরের রবিবারে খ্রিষ্টানরা যে গির্জাতেই গেলো পাদ্রীদের মুখে একই বক্তৃতা শুনলো। সব পাদ্রী একই কথা বললো। হযরত ঈসা (আ.) কে শূলিতে ঝুলানো হয়েছিলো এখন এখানে প্রত্যেক খ্রিষ্টানকে শূলিবিদ্ধ করার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

এক খ্রিষ্টান মেয়ে ফ্লোরাকে বন্ধি করা হয়েছে। সে আদালতে ইসলামের বিরুদ্ধে মন্তব্য করায় তাকে কয়েদখানায় বন্দি না করে এক বাড়িতে বন্দি করে।

কারণ, সে অপরূপ সুন্দরী। তাকে ব্যবহার করছে মুসলিম নেতারা। এখন বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, এই মেয়ে নিখোঁজ। ওকে কোথাও গায়েব করে দেয়া হয়েছে। ওদের সব অপকর্ম ফাঁস করে দেবে এ আশংকায় মনে হয় ফ্লোরাকে মেরে ফেলা হয়েছে।

গির্জায় যারাই উপাসনা করতে এলো এমন বিকৃত বক্তৃতার মাধ্যমে তাদেরকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে উস্কে দেয়া হলো।

পাদ্রীরা এও বললো, প্রত্যেক খ্রিষ্টানের ওপর ফরজ হলো, ফ্লোরার পথে চলা এবং সে যে অপরাধ করে কয়েদির শাস্তি পেয়েছে প্রত্যেককে একই অপরাধ করে দেখিয়ে দেয়া যে, আমরা ওদের নির্যাতনকে ভয় পাই না। এটাই এখন একমাত্র প্রতিবাদের ভাষা।

গির্জার এসব গুজব সত্য খবরের মতো সারা শহরে ছড়িয়ে পড়লো। ভয়ংকর একটা গুজব ছড়িয়ে দেয়া হয় যে, যে বাড়িতে ফ্লোরাকে রাখা হয়েছিলো সে বাড়িতে প্রতি রাতে বড় বড় হাকিমরা যাতায়াত করতো।

এ গুজবও ছড়ানো হয় যে, ফ্লোরাকে আমীরে উন্দলুস তার হেরেমে নিয়ে এখন ব্যবহার করছে।

অসত্য ও অবান্তর গুজব ছড়ানো খ্রিষ্টান সন্ত্রাসী দলের একটা মিশন ছিলো। কর্ডোভার প্রত্যেক খ্রিষ্টানদের ঘরে এসব গুজব পৌঁছে যায়।

এরপর আন্দোলকারীদের দ্বিতীয় কর্মসূচী বাস্তবায়ন শুরু করে পারফেকটিস নামক এক পাদ্রী। সে বাজারে কিছু একটা কিনতে যায়।

ফ্লোরার ব্যাপারে ছড়ানো গুজব এত দিনে মুসলমানদের কানেও পৌঁছেছে। কয়েকজন মুসলমান পাদ্রী পারফেকটিসের কাছে এসব গুজব সম্পর্কে জানতে চায়। তারা বলে, ইসলামে কোন নারীকে এমন শাস্তি দেয়ার বিধান নেই যে, তাকে পৃথক কোন বাড়িতে আটকে রেখে হাকিমরা তার কাছে যাবে।

পাদ্রী উত্তরে খ্রিষ্টবাদের ব্যাপারে প্রশংসা ও ইসলামের বিরুদ্ধে কুৎসা রটাতে শুরু করলো। ঐতিহাসিকরা লিখেছেন, তার কথাগুলো ছিলো এরকম,

হযরত ঈসা আ. কে আমরা খোদা ও খোদার পুত্র মনে করি। হযরত ঈসা (আ.) বলেছেন, আমার পরে যত নবী আসবে তারা সবাই (নাউযুবিল্লাহ) মিথ্যাবাদী হবে।

পারফেকটিস রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে স্পষ্টতই মিথ্যা নবী (নাউযুবিল্লাহ) বলে চরম ধৃষ্টতা প্রদর্শন করে।

এমন কথা শোনার পর কোন মুসলমান তো সেটা সহ্য করতে পারে না। মুসলমানরা তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। কিন্তু বয়োজৌষ্ঠ কিছু মুসলমান এই বলে তাকে ছাড়িয়ে নেয় যে, এর অপরাধের বিচার করবে আইন। কেউ নিজের হাতে আইন তুলে নেবে না।

তাকে প্রথকে কতোয়ালে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখান থেকে আদালতে।

আদালতে বিচারক তাকে জিজ্ঞেস করলো, সে নিজের পক্ষে কিছু বলতে চায় কিনা? সে মিথ্যা বললো, এ ধরনের কোন কথা সে বলেনি। অসংখ্য সাক্ষী তার অপরাধ প্রমান করে দিলো।

আদালত তাকে ৪০৯ ধারা মোতাবেক মৃত্যুদন্ড দিলো।

৮৫০ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ এপ্রিল ঈদগাহে ঈদের নামাজ আদায়ের পর পাদ্রী পারফেকটিসের ফাঁসি দেয়া হলো।

এর একদিন পর জানইট নামের এক ব্যবসায়ী একই আচরণ করলো। সে বাজারে দাঁড়িয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও পবিত্র কুরআনের নামে কসম খাচ্ছিলো। মুসলমানরা তাকে বাধা দিয়ে বললো, সে যেহেতু মুসলমান নয় তাই তাদের রাসূল ও কুরআন নিয়ে সে কসম খেতে পারে না। জবাবে সে বললো,

কুরআন ও তোমাদের রাসূল মিথ্যা। তাই আমি মিথ্যা ধর্মের কসম খাচ্ছি।

তাকেও আদালতে পেশ করা হলো। আদালতের কাছে সে ক্ষমা প্রার্থনা করলো। তাই তাকে কয়েক মাসের কারাদন্ডের সাজা দেয়া হলো।

ইউগেলিস ছদ্মবেশে একদিন জান ইট এর সাথে সাক্ষাৎ করতে কয়েদ খানায় যায়। সেখানে এমন গুজব ছড়িয়ে দেয়, কয়েদখানায় জানকে শিকল দিয়ে বেঁধে রেখেছে এবং তাকে সারাক্ষণই মারপিট করছে।

প্রতিটি গির্জায়ও ইউগেলিস এই প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে দেয়। খ্রিষ্টানরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে আরো তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো।

ইসহাক নামে আরেক পাদ্রী একই পথ ধরলো। সে আদালতের অনুমতি নিয়ে বিচারকের কাছে আবেদন করলে তাকে যদি প্রমাণাদি দ্বারা বুঝাতে পারে ইসলাম সত্যধর্ম তাহলে সে মুসলমান হয়ে যাবে। তবে সেও তার প্রমাণাদি পেশ করতে পারবে। আদালত তার আবেদন মঞ্জুর করলো।

বিচারক তার সামনে অকাট্য এবং সর্বজন বিদিত প্রমাণাদি পেশ করতে লাগলেন। বিচারক বলা শেষ করতেই ইসহাক ইসলামের ব্যাপার উল্টা-পাল্টা বকতে লাগলো। এ উদ্দেশ্যেই সে আদালতে এসেছে।

বিচারক তাকে গ্রেফতারের নির্দেশ দিলেন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে কোন শাস্তি শোনালেন না। বিচারক আব্দুর রহমানের কাছে চলে গেলেন।

খ্রিষ্টান পাদ্রী ও ধর্মগুরুরা তো ইসলামের অবমাননাকর নতুন পদ্ধতি চালু করেছে। এদের শাস্তি কুরআন হাদীসের দৃষ্টিতে কী হওয়া উচিত?

মৃত্যুদন্ড। আব্দুর রহমান হুকুম দিলেন। এমন অপরাধ যেই করবে তাকে জন সম্মুখে ফাঁসি দেয়া হবে। আর তার লাশ কয়েকদিন ওখানে ঝুলিয়ে রাখতে হবে। কারণ, এ শুধু ইসলামের বিরুদ্ধে অবমাননা নয়, পুরো জাতিকে বিপথগামী করে ইসলাম ও ইসলামী সালতানাতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে উস্কে দেয়া। এজন্য তাদের লাশ তাদের পরিবারের কাছেও দেয়া হবে না। সমুদ্রে ভাসিয়ে দেয়া হবে।

ইসহাককে ফাঁসি দেয়া হলো। কিন্তু ইসলামের অবমাননার নতুন এই ধারা বন্ধ করা গেলো না। একদিন দুই দিন পর পর কোন এক খ্রিষ্টান বাজারের ভিড়ে দাঁড়িয়ে ইসলামের বিরুদ্ধে কুৎসা রটাতো আর তাকে জনসম্মুখে ফাঁসি দেয়া হতো। দুই মাসে এগারজন পাদ্রীকে এই অপরাধে শাস্তি দেয়া হলো।

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *