২. হাজিব ও উবাইদুল্লাহ

হাজিব ও উবাইদুল্লাহ তাদের দুই গুপ্তচর নিয়ে আবদুর রহমানের মহলে চলে গেলেন।

আবদুর রহমানকে খবর দেয়া হলো প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান সেনাপতি কোন বিশেষ কাজে দেখা করতে এসেছেন। এটা শুনেই সুলতানা মালিকায়ে তরূব বেরিয়ে এলো। গায়ে তখন তার এমন সংক্ষিপ্ত পোষাক যে, তাকে উলঙ্গ বললে অপরাধ হবে না। তার চোকে মুখে অসন্তুষ্টি আর বিরক্তি।

আপনারা কি দিনের বেলা দরবারে উনার সঙ্গে দেখা করতে পারেন না? সুলতানা প্রজা শাসনের গলায় বললো, তিনি এই মাত্র যারিয়াবকে ডাকিয়েছেন। এসময় শাহে উন্দলুস দেখা করতে পারবেন না।

আমাদের এখনই উনার সঙ্গে দেখা করতে হবে। উবাইদুল্লাহ তাকে পাত্তা দিয়ে বললেন, আমরা হুকুম গ্রহণ করবো তার কাছ থেকে, তোমার কাছ থেকে নয়। তাকে গিয়ে বলো তার সঙ্গে দেখা না করে আমরা এখান থেকে। যাবো না।

আর আমিও আপনাদের দুজনকে তার সঙ্গে দেখা করতে দেবো না। সুলতানা ঘাড় বাঁকা করে এক রোখা কণ্ঠে বললো।

এমন অপমানের পরও তুমি এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে? হাজিব উবাইদুল্লাহকে বললেন।

আমি এখানে দাঁড়য়ে থাকবো না। কিন্তু ফিরেও যাবো না। ভেতরে যাবো। হেরেমের এক মেয়ে মুখে মুখে সম্রাজ্ঞী বনে বসে আছে। ওর মতো ছুড়ির সন্তুষ্টি অসন্তুষ্টিতে আমার কিছুই যায় আসে না। সেনাপতি উবাইদুল্লাহ তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন।

শাহে উন্দলুসের খাস কামরা থেকে যারিয়াবের সুরের গুঞ্জরণ ভেসে আসছে। এই গুঞ্জরনের ভেতর থেকে আবদুর রহমানের আওয়াজ ভেসে এলো।

সুলতানা! কোথায় গেলে! ওদেরকে বলো কাল আসতে।

উবাইদুল্লাহ আর দেরি করলেন না। আবদুর রহমানের কামরায় চলে গেলেন। হাজিব আবদুল করীমও তার পেছন পেছন গেলেন। এর পেছনে কামরায় ঢুকলো সুলতানা। আবদুর রহমান আধশোয়া হয়ে আছেন। চোখ দুটি নেশাকাতর-অর্ধ খোলা।

শাহী মহলের আদব সম্পর্কে কি ওদের জানা নেই? সুলতানা রাগত কণ্ঠে বললো।

কোন জরুরি কথা হবে হয়তো সুলতানা! আবদুর রহমান আচ্ছন্ন গলায় বললেন, এত তাড়াতাড়ি রেগে যেয়ো না। এসো, আমার পাশে বসো।

তারপর হাজিব ও উবাইদুল্লাহর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

আরে, এমন কোন কেয়ামতের বিভীষিকা নেমে এসেছে যে, তোমরা রাতটা পার হওয়ার অপেক্ষা করলে না? তোমাদেরকে বলাও হয়েছে, আমি এখন দেখা করতে পারবো না, তারপরও ভেতরে এসে গেলে! তোমরা কি তোমাদের পদাধিকার ও অবস্থানের কথা ভুলে গেছো?

হ্যাঁ, আমীরে উন্দলুস! উবাইদুল্লাহ বললেন, আমরা আমাদের পদ মর্যাদা ও অবস্থানের কথা ভুলে গেছি। এই পবিত্র ভূমির বিজয়ী বীর সেনানীরা এখানে কোন পদ মর্যাদা ও সম্মান লাভের স্বার্থে এদেশ জয় করেননি। যেসব শহীদরা এই এলাকায় আল্লাহ ও তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অপরাজেয় ঝাণ্ডা উড়াতে গিয়ে নিজেদের রক্ত ঢেলে শহীদ হয়েছেন তারা প্রতিদানে কি পেয়েছেন?….

এর প্রতিদান কি এটাই যে, এক অর্ধ উলঙ্গ রক্ষিতা শহীদদের এই পবিত্র মাটিতে দাঁড়িয়ে এক সালার ও এক ওযীরকে হুকুম দেয়- তোমরা এখান থেকে চলে যাও?

উবাইদুল্লাহ! আবদুর রহমান আচ্ছন্নতা ভেঙ্গে প্রায় গর্জে উঠে বললেন, কি হয়ে গেছে তোমার? তুমি কি বলছো এসব?

তিনি আধশোয়া থেকে সটান উঠে বসলেন। তার নেশাতুর চোখ পুরোপুরি খুলে গেলো। যারিয়াবের গান বাদ্যও নীরব হয়ে গেলো। সুলতানা একটু দূরে দাঁড়িয়ে দাঁত পিষছে। আবদুর রহমানের চেহারা রক্তবর্ণা হয়ে উঠলো। না, ক্রোধের বর্ণ নয় এটা। এটাই তার প্রকৃত পুরুষালী বর্ণ।

তার দৃষ্টি উবাইদুল্লাহ, হাজিব, যারিয়াব ও সুলতানার ওপর একে একে ঘুরে এলো। যেন আচমকা ঘুম থেকে জেগে উঠে সবাইকে দেখছেন। তার দৃষ্টি ক্রমেই স্বাভাবিক হয়ে এলো।

***

তোমরা দুজন কি বসবে না? আবদুর রহমান হাজিব ও উবাইদুল্লাহকে জিজ্ঞেস করলেন এবং যারিয়াব ও সুলতানাকে বললেন, তোমরা দুজন পাশের কামরায় গিয়ে বসো। মনে হচ্ছে কোন জরুরি ব্যাপার ঘটেছে। না হয় এরা দুজন এভাবে আসতো না যেমন আজ কোন অনুমতি ছাড়া ভেতরে চলে এসেছে।

তার কণ্ঠে ক্ষমা প্রার্থনার ভঙ্গি স্পষ্ট হয়ে উঠলো।

যারিয়াব ও সুলতানা চলে গেলো। উবাইদুল্লাহ ও হাজিব বসে পড়লেন।

আবদুর রহমান যেভাবে যারিয়াব ও সুলতানার সামনে ক্ষমাপ্রার্থনা ভঙ্গি করলেন সেটা প্রধানমন্ত্রী ও সেনাপতিকে হতভম্ব করে দিলো। তারা একে অপরের দিকে তাকালেন। যেন চোখে চোখেই ঠিক করে ফেললেন, আজ চূড়ান্ত কথা বলে যেতে হবে।

বলল, কি কথা তোমাদের? আবদুর রহমান বললেন।

আপনাকে খলীফা উন্দলুসের আমীর নির্বাচিত করেছেন, উবাইদ্রাহ বললেন, কিন্তু দরবারের স্বার্থান্বেষীরা, তোষামোদকারীরা এবং পা চাটা চামচারা আপনাকে শাহ উন্দলুস বলতে শুরু করেছে। আর আপনিও বাদশাহ হয়ে বসে আছেন।

তুমি কি বলতে চাও উবায়েদ! আবদুর রহমান বাদশাহী মেজাজে বললেন, তুমি নিজেকে সবসময় যুদ্ধের ময়দানে রেখে কথা বলো। তোমার চিন্তা ভাবনা ও সব কিছুর মধ্যেই লড়াই বেঁধে থাকে। তুমি কি শান্ত হয়ে সে কথাটা বলতে পারো না যেটা বলতে এসেছে এই গভীর রাতে।

না, শান্ত হয়ে কথা বলার মতো অবস্থায় নেই আমি। উবাইদুল্লাহ প্রায় ধমকে উঠলেন, যেদিন আমার চিন্তা ভাবনা থেকে লড়াই দূরে সরে যাবে সেদিন আপনার সিংহাসনের নিচ থেকে মাটি সরে যাবে। উন্দলুসের আকাশ থেকে খসে পড়বে ইসলামী ঝাণ্ডা। নীরব-নিস্তব্ধ হয়ে যাবে আযানের পবিত্র সুরধ্বনি।….

সালাররা দরবারী লোক হয় না। সালার সিংহাসন ও রাজমুকুটের জন্য মোহগ্রস্ত থাকেন না।…..সালারের জায়গা হলো রণাঙ্গন।…..কুফুরের বিরুদ্ধে রণাঙ্গন।

রণাঙ্গন বাতিলের বিরুদ্ধে,…..আপনিও এক সালার-সেনাপতি। রণাঙ্গনের সিংহ আপনি। কিন্তু আপনাকে জাগাতে হয়েছে আমাদের এসে। শুধু এ কারণে যে, আল্লাহর তলোয়ার আপনি সিংহাসনের নিচে ছুঁড়ে দিয়েছেন।…..

গান, নৃত্য আর নারীর রূপযৌবনে গড়ে উঠা বেহেশতে মগ্ন হয়ে পড়েছেন আপনি। আপনি তো মেধা, বুদ্ধি ও বিচক্ষণতা এবং বিজ্ঞতায় অতুলনীয় ছিলেন। কিন্তু এক রূপসী ও সুরতরঙ্গকে আনি আপনার ওপর চুম্বকের মতো লেপ্টে রেখেছেন। যা আপনাকে এই বাস্তবতা থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে যে, যে বেহেশতে আপনি মজে আছেন সেটাই দোযখের প্রধান দরজা।

কিন্তু ঘটনা তো এ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকে না। হাজিব আবদুল করীম বললেন, যে জাহান্নামের দিকে উবাইদুল্লাহ ইংগিত করেছে তাতে বাদশাহ একাই যান না। বাদশাহর পাপ পুরো জাতিকে সেই জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত করে। বাদশাহর অপরাধের শাস্তি ভোগ করতে হয় পুরো জাতিকে। শত্রুর ব্যাপারে যে বাদশাহ অসচেতন থাকেন সে বাদশাহর অধীনস্থ জাতির ভাগ্য লিখে দেয়া হয় শত্রুর গোলামি।

আপনার মাথা থেকে সিংহাসন ও রাজমুকুট দূরে সরিয়ে রাখুন আমীরে মুহতারাম! সালারে আলা উবাইদুল্লাহ বললেন, এখন তো সাধারণ মানুষ আপনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে উঠতে যাচ্ছে। কিন্তু কাল আপনার ফৌজই আপনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে উঠবে।

বিদ্রোহ? আবদুর রহমান হয়রান ও হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস কররেন, কিসের বিদ্রোহ? কোন ফৌজ বিদ্রোহী হয়ে উঠবে? আমি তো জানি না কিছুই। আমাকে বলো। খুলে বলল।

আপনি এজন্য জানেন না যে, আপনার চোখ ও কান এই দরবারীরা বন্ধ করে রেখেছে। হাজিব বললেন, আপনার চোখে তাকেই দেখেন যে আপনাকে তোষামোদ করে এবং বাস্তবতা থেকে আপনার চোখ অন্য দিকে সরিয়ে রাখে।

ঐ সুন্দরী পরিচারিকারা, এই নয়া রক্ষিতা, আর আপনার সুকণ্ঠী যারিয়াব আপনার ভেতরের সিংহ পুরুষকে হত্যা করে ফেলেছে। এটা বীর বিক্রম আর অদম্য সিংহ পুরুষদের পবিত্র ভূমি। আপনি শুধু এর আমীর নন, আমীন-বিশ্বস্ত রক্ষকও।

না হাজিব! আবদু রহমান ঘাবড়ানো গলায় বললেন, সুলতানা আমাকে ধোকা দিতে পারে না। যারিয়াব আমার অকৃতজ্ঞ হতে পারে না।

আমরা আপনার ব্যক্তিকে নিয়ে কথা বলছি না আমীরে মুহতারাম! আপনাকে কেউ ধোকা দিক, আর কেউ আপনার অকৃতজ্ঞ হোক, এতে আমাদের কোন আগ্রহ নেই। আমরা ইসলামী সালতানাত উন্দলুসের কথা বলছি। আমরা বাতিলের সেসব নষ্ট পূজারীদের কথা বরছি যারা সালতানাতে ইসলামিয়া উন্দলুসকে ধোকা দিচ্ছে। আর যারা আল্লাহর সেই পবিত্র শাসন ব্যবস্থার সঙ্গে বেঈমানী করছে তাদের কথা বলছি। কথাগুলো একটু মনযোগ দিয়ে শুনুন আমীরে মুহতারাম।

উবাইদুল্লাহ দুই গোয়েন্দা কমান্ডারকে ভেতরে ডেকে পাঠালেন। তারা এলে তাদেরকে বললেন, আমীরে উন্দলুসকে বিস্তারিত রিপোর্ট শোনাও। তারা বিস্তারিত শোনালো। হাজিব ও উবাইদুল্লাহ সেই রিপোর্টে আরো বর্ধিত অংশ যোগ করলেন।

আবদুর রহমান অনেকটাই জেগে উঠলেন।

***

পাশের কামরায় সুলতানা ও যারিয়াব বসে রাগে-ক্রোধে দাঁতে দাঁত পিষছিলো। সুলতানা বেশ কিছুক্ষণ আবদুর রহমানের খাস কামরায় কান লাগিয়ে ভেতরের কথাবার্তা শুনে ফেলে।

ঐ গোঁয়ার লোক দুটি তো ওকে জাগিয়ে তুলছে। সুলতানা যারিয়াবকে বললো, ওরা যদি একবার ওকে যুদ্ধের ময়দানে নিয়ে যেতে পারে তাহলে আমাদের হাত থেকে ছুটে যাবে। আমরা ব্যর্থ হয়ে যাবো।

ইউগেলিস বলেছিলো, বিদ্রোহ করার সবকিছুই প্রস্তুত হয়ে গেছে। ওদিকে ফ্রান্সের শাহ লুই-এর মদদে বার্সেলোনা ও গোথাক মার্চের দিক থেকেও হামলার দিনক্ষণ করা ঠিক হয়ে গেছে। এটা ওরা টের পেয়ে গেছে। তাই ময়দানে নামার হুকুম নিতে এসেছে।

ইউগেলিসকে সতর্ক করে দিতে হবে যে, উন্দলুসের সৈন্যরা তৎপর হয়ে উঠেছে। যারিয়াব বললো, সঙ্গে যে দুজন লোক এসেছে এরা মনে হয় গোয়েন্দা।

হ্যাঁ, এরা বড় বড় গোয়েন্দা। ওদেরকে খতম করে দেয়া জরুরী। সুলতানা বললো।

যারিয়াব বুদ্ধিমান লোক। সে বাধা দিয়ে বললো

কতল করে কোনই লাভ হবে না। ওদের স্থলে আরো দুজন এসে যাবে। এদের চেয়ে ভালো ও যোগ্যরাও তাদের শূণ্যস্থান পূরণ করতে পারে। এদেরকে আমরা লোভ দেখিয়ে এমনভাবে ব্যবহার করবো যে, প্রকাশ্যে এরা সরকারি গুপ্তচর হয়ে থাকবে, আর গোপনে ইউগেলিসের হয়ে কাজ করবে। এরা সেনাপতি ও প্রধানমন্ত্রীকে ধোকা দিতে পারবে অনায়াসে।

ওদেরকে রাজি করানো গেলে পুরস্কারস্বরূপ হেরেম থেকে সুন্দরী দুটি মেয়েও ওদেরকে দিতে পারবো। এ পুরস্কার ওদেরকে গোলাম বানিয়ে রাখবে। সুলতানা বললো।

সুলতানা আবার দরজায় কান লাগালো। তার চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেলো।

ফ্রান্সীস কাউন্ট এ্যবলুস ও কাউন্ট ইসনিয়ারস পাম্পালুনার ওপর ফৌজি হামলা চালিয়েছে। উবাইদুল্লাহ আবদুর রহমানকে বলছিলেন আর সুলতানা তার যারিয়াব কান লাগিয়ে শুনছিলো, আপনাকে বলা হয়েছিলো, এই ফৌজ ফিরে যাচ্ছিলো। সংকীর্ণ উপত্যকা দিয়ে যাওয়ার সময় সেখানকার স্থানীয় মুসলমান ও মুসলমানদের যে ছোট সেনা ইউনিট ছিলো তার ওপর হামলা চালায় ওরা।…..

তাদের ওপর অকথ্য নির্যয়াতন চালায়। অসংখ্য লোককে গ্রেফতার করে নিয়ে যয়। তাদের সবকিছু ছিনিয়ে নিয়ে যায়। এখন বার্সেলোনা থেকে হামলার সমূহ আশংকা রয়েছে।

তোমরা এ ব্যাপারে কি চিন্তা ভাবনা করেছো? আবদু ররহমান জিজ্ঞেস করলেন, আগে ওখান থেকে ভালো করে খোঁজ খবর নিয়ে নাও। দেখো, এ খবরগুলো কতটা সঠিক? সংবাদ ভুলও তো হতে পারে।

আমার ও হাজিব আবদুল করীমের নিরাপত্তা আপনার হুকুম বাস্তবায়ন করার মধ্যেই নিহিত রয়েছে। উবাইদুল্লাহ বললেন, আপনার বর্তমান হুকুম তো এমনই হবে যে, গোয়েন্দা দূত পাঠিয়ে দিয়ে নিজেরা এখানে মন্ত্রী আর সেনাপতির গদিতে আরামে বসে থাকো। আমাদের অধীনস্ত লোকেরা আমাদেরকে সালাম করতে থাকবে।

কিন্তু আমীরে মুহতারাম! আমরা আমাদের দায়িত্ব পালনে মোটেও কার্পণ্য করবো না আমাদেরকে কেউ থোকাও দিতে পারবে না। শত্রুর ব্যাপারে আপনি যদি এমন শিথিল মনে চিন্তা ভাবনা করেন তাহলে আমরা আপনার হুকুম না নিয়েই দুশনের বিরুদ্ধে এমন ব্যবস্থা নেবো, যা ইসলাম ও উন্দলুসের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য জরুরি মনে করা হবে।

আপনি আমাদেরকে আপনার শাহী মহল ও সিংহাসনের সুরক্ষার জন্য ব্যবহার করবেন না…..শত্রু সবসময়ই শত্রু। তার বন্ধুত্বও শক্রতা।…..আমরা সীমান্ত এলাকায় সৈন্য তৎপরতা শুরু করতে চাই। এর নেতৃত্ব থাকবে আমার হাতে। আমরা আপনার কাছে যা চেয়েছি তা আমাদেরকে দিয়ে দিন।

কাল সকালে আমি তোমাদেরকে বিস্তারিত জানাবো। আবদুর রহমান বলরেন, আজ একটু ভাবতে দাও।

কাল সকালে আমরা রওয়ানা হয়ে যাবো। আবদুর রহমান বললেন, অর্ধেক ফৌজ কর্ডোভায় থাকবে। এর নেতৃত্বে থাকবে হাজিবের হাতে। আপনি তো জানেন হাজিবও একজন দক্ষ সালার। আমার অনুপস্থিতিতে এখানে বিদ্রোহ মাথাচাড়া দিয়ে উঠলে এর বিরুদ্ধে হাজিব ফৌজকে ময়দানে নামাবে।

আমি আমীরে মুহতারামকে এটা জানিয়ে রাখা জরুরি মনে করছি যে, আমার ব্যবস্থাপনা কিন্তু খুব ভদ্রোচিত হবে না। হাজিব আবদুর রহমানকে বললেন, আমি বাতিলের সেই পূজারীদের খতম করে দেবো, যারা তোক দেখানো মুসলমান হয়ে পর্দার আড়ালে ইসলামের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ করে দেশকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। এরা মুআল্লিদীন-দুমুখী সাপ। আমি এদেরকে রক্তে গোসল করিয়ে এদের লাশ ও ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেবো।

সুলতানা তখনো দরজায় কান লাগিয়ে রেখেছে। তার কানে আবদুর রহমানের আওয়াজ পৌঁছালো।

তোমরা দুজনে প্ল্যান প্রোগ্রাম-পরিকল্পনা ঠিক করো। এজন্য যত সেনা প্রয়োজন তাদেরকে প্রস্তুত করে নিয়ে যাও।

উবাইদুল্লাহ ও আবদুল করীম কোন জবাব না দিয়ে চলে গেলো।

ওরা চলে গেছে। সুলতানা যারিয়াবকে বললো, ওদেরকে শাহে উন্দলুস হুকুম দিয়ে দিয়েছেন, সীমান্ত এলাকায় সৈন্য নিয়ে যেতে।

আমরা তো আর ওদেরকে বাধা দিয়ে রাখতে পারবো না, যারিয়াব হতাশ গলায় বললো। আর খেয়াল রেখো সুলতানা! শাহ উন্দলুসকে এটা বুঝতে দিয়ো না যে, আমরা তার ফয়সালায় খুশি নই। কথা আমাকে বলতে দিয়ো।…..আগামীকাল ইউগেলিসকে খবর পাঠিয়ে দিয়ো। সেই ভালো জানে এ অবস্থায় তাকে কি করতে হবে।

এর দ্বারা এটাও জানা হয়ে গেলো, শাহে উন্দলুসের ওপর আমাদের প্রভাব এখনো পুরোপুরি কাজ দেয়নি। সুলতানা বললো, তার ভেতরের মুসলমানি সত্বা এখনো মরেনি।

আবদুর রহমান তাদেরকে ডেকে পাঠালেন। দুজনে সঙ্গে সঙ্গে কামরায় ঢুকে পড়লো। সুলতানা আবদুর রহমানকে জিজ্ঞেস করলো, সালারে আলা ও ওযীর কেন এসেছিলেন। আবদুর রহমান তাদেরকে সব কথা বলে দিলেন।

জিন্দাবাদ শাহে উন্দলুস! যারিয়াব বড় আওয়াজে বললো, আপনি ফৌজকে কোচ করার হুকুম দিয়ে অনেক বড় দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। ওরা সেই কাফেরের গোষ্ঠিকে পিষে মারবে। ইতিহাসে আপনার পবিত্র নাম সোনার হরফে লেখা থাকবে।

সুলতানা আবদুর রহমানের গলা দুহাতে জড়িয়ে ধরে গাল তার গালের সঙ্গে লাগিয়ে বললো,

আমাদের শাহে উন্দলুস মুমিন পুরুষ এবং স্বাধীনচেতা বীর পুরুষ। আপনার এই স্বাধীনচেতা ও পুরুষোচিত মনোভাবের কারণেই আমি আপনার শিষ্য হয়ে গেছি। আমি আপনার মতোই এক মুসলিম বাপের মেয়ে। আমার তো ইচ্ছে করে তলোয়ার হাতে নিয়ে আরবী ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে জিহাদের ময়দানে চলে যেতে।

তুমি কেন যাবে? আবদুর রহমান তাকে নিজের কোলে বসিয়ে বললো, তোমার ওপর আমার পুরো ফৌজ কুরবানী করতে পারবো।

শাহে উন্দলুস আরেকবার বাস্তব দুনিয়া থেকে অচিন জগতে হারিয়ে গেলেন।

***

যার দেশের জন্য ভালোবাসা আছে। নিজের ধর্মের জন্য দায়িত্ববোধ আছে। সে নিজেকে যেমন চিনে তেমন তার শত্রুকেও চিনে। তারা নিজেরাও শান্তি ও নিশ্চিন্তে বসে থাকতে পারে না, শত্রুকেও দুদণ্ড শান্তিতে বসে থাকতে দেয় না। ইউরোপীয়ানদের অবস্থাও এমনই।

তাদের বুকে অর্থাৎ স্পেনে যখন মুসলমানরা ইসলামী ঝাণ্ডা গেড়ে বসেছে তখনই তারা শঙ্কিত হয়ে উঠে যে, ইসলাম সারা ইউরোপে না আবার ছড়িয়ে পড়ে। সেদিন থেকে তারা নিজেদের ওপর আরাম হারাম করে নেয়। তারা উন্দলুসের সীমান্ত এলাকাগুলোয় হামলা চালাতে শুরু করে। সীমান্তের মুসলিম জনপদগুলো তাদের ধ্বংসলীলার শিকার হতে থাকে।

উন্দলুসের সেনাবাহিনী তাদেরকে প্রতিরোধ করতে গিয়ে, জবাবী হামলা চালাতে গিয়ে নিজেদের সৈন্য সংখ্যা কমাতে থাকে। এসব দেখেও মুসলিম শাসক শ্রেণীর লোকেরা পরম আরামে হেরেমের জীবনে গা ভাসিয়ে দেয়। শত্রুকে বন্ধু ভাবতে শুরু করে।

তবুও প্রত্যেক যুগেই কিছু স্বাধীন বীরপুরুষ আল্লাহ তাআলা পাঠিয়ে দেন, যারা ইসলামের পড়ন্ত ঝাণ্ডাটি অতি দৃঢ়-দামাল হাতে সাফল্যের শীর্ষ চূড়ায় তুলে ধরে। এদের মধ্যে একজন সালার উবাইদুল্লাহ ইবনে আবদুল্লাহ বালান্সী এবং আরেকজন হলেন হাজিব আবদুল করীম।

তাদের অধীনে কিছু ঈমানদীপ্ত প্রাণপুরুষও ছিলো যারা তাদের শাসকদের ভোগবিলাসের জীবনে মত্ত দেখে নিজেদের দায়িত্ব পালনের সামান্যতম ত্রুটি করেনি।

সালারে আলা- প্রধান সেনাপতি উবাইদুল্লাহ রাতে রাতেই তার সেনা ইউনিটগুলোর কমান্ডার ও পদস্থ কর্মকর্তা ও সহযোগীদের ডেকে তুললেন। তাদেকে জরুরি গলায় জানালেন, সারা দেশে বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়তে যাচ্ছে। এ থেকে আমদের মনযোগ সরানোর জন্য আমাদের সীমান্ত এলাকায় দুশমন হামলা চালাচ্ছে।

প্রচণ্ড এক ঝড় আমাদেরকে লণ্ডভন্ড ও ধ্বংস করে দিতে উঠে আসছে। সালারে আলা উবাইদুল্লাহ সবার উদ্দেশ্যে বলতে শুডরু করলেন, এটা ঠিক যে সৈন্যদের যে কোন হুকুম মানতে হয়। পাহাড়, পর্বত, নদী-সমুদ্র, উত্তপ্ত মরুভূমি পাড়ি দিয়ে যেখানেই তাদেরকে যেতে নির্দেশ দেয়া হয় সেখানে তাদের যেতে হয়। লড়তে হয়। অকুণ্ঠ চিত্তে প্রাণ দিয়ে দিতে হয়। কিন্তু আল্লাহর সৈনিকরা তো অন্যান্য জাতির সৈনিকদের থেকে একেবারেই ভিন্নতর।……

তারা পবিত্র এক উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে লড়াই করে। কোন ব্যক্তি মানুষ, কোন খান্দান বা গোষ্ঠির শাসন ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য তারা লড়াই করে না। একমাত্র আল্লাহর শাসন মানবজাতির হৃদয়রাজ্যে প্রতিষ্ঠার জন্য আল্লাহর সৈনিকরা লড়াই করে। আমরা তো পবিত্র কুরআনের সেই হুকুমের ওপর অটল থেকে লড়াই করি যে,

যে পর্যন্ত কুফরের কর্মতৎপরতার মূলোৎপাটন না হবে সে পর্যন্ত তোমাদের ওপর অবিরাম জিহাদ ফরজ।…..

নিজেদের সৈনিকদের মনে এ কথাটা ভালো করে গেঁথে দাও যে, উন্দলুসের পূর্বপুরুষ বীর সেনানীরা এখানে যে মহান আদর্শ প্রতিষ্ঠা করেছিলো তা জীবন্ত রাখতে হবে। তাদেরকে বলবে, এই পবিত্র মাটি সেসব শহীদ আত্মাদের আমানত যারা খুব স্বল্প সংখ্যকের একটি দল হয়ে এখানে এসেছিলো। তারপর তাদের নৌযানগুলো পুড়িয়ে ফেলে। যাতে কারো মনে ফিরে যাওয়ার কল্পনাও না আসে। ….

আজ আমাদের প্রয়োজন এমন হার না মানা জযবা- ঈমানদীপ্ত চেতনার। আর আমি যে সব কথা তোমাদেরকে বলছি তা তোমাদের সৈনিকদেরকে বলো আর না বলো, নিজেরা গভীর মনে শুনে রাখো, কিছুকাল ধরে খলীফার পক্ষ থেকে উন্দলুসে এমন আমীর নিযুক্ত হচ্ছে যারা নিজেদেরকে বাদশাহ বলতে পছন্দ করেন। এটা তো অনৈসলামিক রীতি-নীতি। ইসলামে কোন রাজা-বাদশাহ নেই।…..

কিন্তু আমাদের ওপর এমব বাদশাহ চেপে বসেছেন, যিনি আল্লাহ ও রাসূলের নাম নেন ঠিক, কিন্তু তার প্রতিটি কাজ আল্লাহ ও রাসূলের বিধি বিধানের পরিপন্থী। তিনি হেরেমও আবাদ করেছেন। যাতে অতি রূপসী কালনাগিনী প্রতিপালিত হচ্ছে। আমাদের বর্তমান আমীরও তেমন।…..

আমি জানি, তোমাদের অনেকর মনে এই অনুযোগ রয়েছে, নিজেদের আমীরের চেহারাখানি কোন দিন দেখোনি। তিনি নিজে কখনো এসে দেখেননি, তোমাদের কি অবস্থা? তোমরা এখানে কেমন আছো?

তোমাদের অনেকেই হয়তো জানো, আমদের আমীর গান-বাদ্য ও ভোগ-বিলাসে ডুবে আছেন। হয়তো এ কারণে কারো মনে এটাও আসতে পারে, নিজেদের আমীর যখন এমন তাহলে আমাদের জানবাজি রেখে, যখমী হয়ে লড়াইয়ের কী দরকার?

এমন ভাবনা মনে আসলে তা ঝেটিয়ে দূর করে দাও। এটা আল্লাহর রাজত্ব। কোন বাদশাহ বা আমীরের নয়। তোমরা এর আমীন-বিশ্বস্ত রক্ষক। প্রত্যেককে যার যার কবরে গিয়ে শুতে হবে, বাদশাহকেও তারই নির্ধারিত কবরে নামানো হবে। আমি আরেকবার মনে করিয়ে দিচ্ছি, যে দেশে কুরআনের শাসন চলে সেখানে কোন এক ব্যক্তি বা তার খান্দানের জায়গীর হয় না, সেটা সে দেশের জনগণের সবার দেশ। আমাদের সবার দেশ। আমাদেরকে বাদশাহর সামনে না, আল্লাহর সামনে জবাবদিহি করতে হবে……

এজন্য মুসলমান কোন রাজা-বাদশাহ, আমীর উমারা, সালার, সিপাহসালার বা কমান্ডারদের জন্য লড়াই করে না। মুসলমান লড়াই করে একমাত্র আল্লাহর পথে। আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য। মুসলমান লড়াই করে বিজয়ের জন্য। পরাজয়ের জন্য মুসলমান লড়ে না। পরাজয়ের চেয়ে মুসলমানের কাছে মৃত্যুই। শ্রেষ্ঠ।

নারায়ে তাকবীর-আল্লাহু আকবার। উপস্থিত সবার ধ্বনিত শ্লোগানে রাতের নিস্তব্ধতা খান খান হয়ে গেলো।

উবাইদুল্লাহ সালার ও কমান্ডারদেরকে হুকুম দিলেন ফজরের পরেই সেনাদল নিয়ে বেরিয়ে পড়তে।

***

কোচ করার গতি ছিলো অতি তীব্র। তাই সূর্যোদয়ের আগেই ফৌজ শহর থেকে বেরিয়ে গেলো।

আবদুর রহমানের ঘুম ভাঙ্গতেই তিনি তার সচিবকে ডেকে বললেন, প্রধান সেনাপতিকে যেন পয়গাম পাঠানো হয়, শাহে উন্দলুস ফৌজকে বিদায় জানাতে ফৌজের সঙ্গে কিছু দূর এগিয়ে যাবেন।

ফৌজ শহর থেকে বেরিয়ে গেছে শাহে উন্দলুস! সচিব জবাব দিলো। বাইরে প্রধানমন্ত্রী আবদুল করীম আপনার অপেক্ষায় আছেন।

তাকে ভেতরে পাঠিয়ে দাও। আবদুর রহমান হুকুম দিলেন।

হাজিব ভেতরে আসতেই আবদুর রহমান একটু ক্ষুণ্ণ গলায় জিজ্ঞেস করলেন,

উবাইদুল্লাহ কি এতটুকু অপেক্ষা করতে পারলো না যে, ফৌজ আমাকে বিদায়ী সালাম জানিয়ে যাবে?

না, আমীরে মুহতারাম? হাজিব আবদুল করীম নির্বিকার ভঙ্গিতে বলরেন, দুশমন এটা কখনো দেখে না যে, তাদের বিরুদ্ধে যে ফৌজ আসছে তারা কি তাদেরকে বাদশাহকে বিদায়ী সালাম জানিয়ে এসেছে কি না। এখন সেলামী প্রথা পালনের সময় না আমীরে উন্দলুস! এর চেয়ে অনেক বড় দায়িত্ব হলো, কর্তব্য পালনের ডাকে সাড়া দেয়া।

তাহলে তুমি বলতে চাচ্ছো, রাষ্ট্রীয় সব নিয়ম কানুন ও প্রথা-প্রচলন উঠে যাবে? আবদু রহমান বিরক্ত গলায় বললেন।

মহান আল্লাহ ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে নিয়মনীতি আমাদেরকে দিয়েছেন তাই বহাল থাকবে। আর মানব রচিত সব নিয়মকানুন, প্রথা-প্রচলন রহিত হয়ে যাবে। আমরা দাবী করবো ইসলামী সালতানাতের আর তাতে চলবে সব অনৈসলামিক কার্যকলাপ তো চলতে দেয়া যাবে না। হাজিব আবদুল করীম এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বললেন।

আবদুর রহমান যেন কিছুটা অসন্তুষ্ট হলেন। তারপর হাজিবের সঙ্গে খ্রিষ্টানদের বিদ্রোহ বিষয়ে কথা বলতে লাগলেন।

সীমান্ত এলাকায় পাম্পালুনা নামক একটা জায়গা আছে। কিছু দিন আগে এর ওপর ফ্রান্সীয় দুই কাউন্ট হামলা করে এবং শহর ও গ্রামে লুটপাট চালায়। তারা অনেক মুসলমানকে বন্দি করে ওদের সঙ্গে নিয়ে যায়। তারপর তাদের সঙ্গে জন্তু-জানোয়ারের মতো আচরণ করে। গাধার মতো খাটায়।

উবাইদুল্লাহ অল্প কয়েক দিনেই পাম্পালুনা পৌঁছে গেলেন। সেখানকার স্থানীয় লোকদের কাছ থেকে সীমান্তের বাইরের এলাকাগুলো সম্পর্কে খোঁজখবর নিলেন। তিনি জানতে পারলেন, সীমান্ত এলাকার সঙ্গে একেবারে লাগোয়া অবস্থায় খ্রিস্টানরা কেল্লা গড়ে তুলেছে। এই কেল্লার পরিবেষ্টন যে মুসলমানদের প্রতিহত করার জন্য এটা বুঝতে সময় লাগলো না উবাইদুল্লাহর।

উবাইদুল্লাহ আবদুর রহমানের কাছ থেকে এ অনুমতি নেননি যে, তিনি সীমান্ত ছেড়ে এর বাইরে গিয়ে শত্রু সীমানায় হামলা চালাবেন। প্রয়োজন মনে করলে ওখানে গিয়ে হামলা চালাবেন এ মর্মে কোন অনুমতি নেয়ার প্রয়োজনও বোধ করেননি উবাইদুল্লাহ।

উবাইদুল্লাহ যখন তার ফৌজ নিয়ে সীমান্ত এলাকা পাড়ি দিলেন তখন মাঝ রাত পার হয়ে গেছে। তার সঙ্গে স্থানীয় গাইড ছিলো। সে তাদের শত্রু সীমান্তের সবচেয়ে বড় কেল্লার দিকে নিয়ে যেতে লাগলো। চলার গতি ত্ৰুত থাকায় রাতের শেষ প্রহরে সেখানে পৌঁছে গেলো মুসলিম সেনাবাহিন।

সেখানে পৌঁছেই কেল্লা অবরোধ করে ফেললো উবাইদুল্লাহর সেনাদল। অবরোধ কাজ পূর্ণ হতেই মিনজানীক দ্বারা কেল্লার ভেতর পাথর নিক্ষেপ শুরু হয়ে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে আগুনের জ্বলন্ত তীরও কেল্লার ভেতর ছুঁড়তে শুরু করলো। মিনজানীক ও জ্বলন্ত তীর আরবদের এমন হাতিয়ার ছিলো যা শত্রুপক্ষকে ক্ষতিগ্রস্ত করতোই, সঙ্গে সঙ্গে তাদের মধ্যে আতংকও ছড়িয়ে দিতো।

অপরাধী খ্রিষ্টানরা কেল্লার ওপর থেকে বৃষ্টির মতো তীর ছুঁড়তে শুরু করলো। কিন্তু উবাইদুল্লাহর সৈন্যরা যেমন চাঙ্গা মনোবলে উদ্দীপ্ত ছিলো, কমান্ডাররাও ছিলো ক্রোধের আগুনে উত্তপ্ত। ওরা তীর বৃষ্টির মধ্যেই কেল্লার ফটকের দিকে দৌড়ে যেতো এবং তীর খেয়ে খেয়ে আহত হতো। এভাবে চললো কিছুক্ষণ।

তারপর একবার কয়েকজন দুঃসাহসী সৈনিক তীর বৃষ্টি উপেক্ষা করে ফটকের দিকে ছুটে গেলো এবং দশ বারটা কুড়াল দিয়ে দরজার ওপর আঘাত করতে করতে দরজা ভেঙ্গে ফেললো। তার পর বড় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হলো।

মুসলিম সেনারা বাঁধভাঙ্গা জলোচ্ছাসের মতো ভেঙ্গে ফেলা ফটক দিয়ে ভিতরে চলে গেলো। সামনের কয়েকজন অবশ্য শত্রুর ছোঁড়া তীর আর বর্শার। আঘাতে শহীদ হয়ে গেলো। কিন্তু পুরো মুসলিম সেনাদল তাদেরকে টপকে খুনী খ্রিষ্টানদের ওপর পাহাড়ের মতো ভেঙ্গে পড়লো।

এরপর যা হলো তা হলো, উবাইদুল্লাহ ফৌজ যে লড়াইয়ে যোগ দিলো তা ছিলো এক কথায় ইসলাম ও উন্দলুসের দুশমনদের পাইকারি দরে হত্যা।

মুসলিম কয়েদিরা এই কেল্লাতেই ছিলো। তাদের পায়ে লোহার কড়া দিয়ে রেখেছিলো নরপিশাচের দল। রাতে এই কড়ার সঙ্গে শিকল বেঁধে দেয়া হতো। তাদেরকে পশুর খোয়াড়ে রাখতো। তাদের সবাইকে মুক্ত করা হলো।

তারপর অন্যান্য কেল্লাগুলোও এভাবে অবরুদ্ধ করা হলো। অবশ্য সে কেল্লাগুলো ছোট ছোট ছিলো। একে একে কেল্লাগুলো বালুর স্তূপের মতো মাটিতে ধ্বসে গেলো।

উবাইদুল্লাহ যখন তার সেনাদের নিয়ে ওখান থেকে ফিরতি পথ ধরলো, তখন দুশমনদের বসতিগুলো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিলো এবং কেল্লাগুলো থেকে ধোয়া উঠছিলো।

***

উন্দলুসের পবিত্র মাটি বিদ্রোহ আর ষড়যন্ত্রের এক কেন্দ্রভূমি হয়ে উঠলো। একের পর এক শাসক দাফন হতে লাগলো আর তাদের স্থলে খলীফার পক্ষ থেকে নতুন নতুন শাসক নিযুক্ত হতে লাগলো।

ওদিকে খেলাফতের গদিতে নতুন নতুন খলীফার পালাবদল ঘটতে লাগলো। সঙ্গে সঙ্গে মুসলিম দেশগুলোতে চক্রান্ত আর বিদ্রোহ দ্বিগুণ আকারে দানা বাঁধতে শুরু করলো।

উন্দলুসের শাসকরা তো মূলতঃ খলীফার পক্ষ থেকে আমীর হিসেবে নিযুক্ত হতেন। কিন্তু তারা নিজেদরকে বাদশাহ বলতে লাগলেন। ইসলামের মহান পয়গাম তারা সিংহাসনের নিচে ছুঁড়ে মারেন। সেসব শহীদদের ভুলে যান যাদের রক্তের বিনিময়ে সালতানাতে ইসলামিয়া উন্দলুসের প্রতিষ্ঠা হয়েছিলো।

বিদ্রোহ ও ষড়যন্ত্র মূলতঃ পরাজিত খ্রিষ্টানরাই করছিলো। আর তাদেরকে মদদ যোগাতে থাকে পার্শ্ববর্তী খ্রিষ্টান অঙ্গরাজ্যগুলো। কিন্তু এ কারণে ওদেরকে গালমন্দ করা উচিত হবে না। ওরা তো ঘোষণাই দিয়েছে, ইউরোপ থেকে ইসলামকে ঝেটিয়ে বিদায় করেই তারা দম নেবে।

তারা একে পবিত্র ধর্মযুদ্ধ বলে ঘোষণা করে। এভাবেই উন্দলুস অদৃশ্য এক যুদ্ধের ময়দানে পরিণত হলো।

এ পরিপ্রেক্ষিতে উন্দলুসের আমীর উমারাদের প্রথম ফরজ কর্তব্য তো ছিলো, ইসলামের পৃষ্ঠপোষকতা করা। ইসলামের প্রচার প্রসারে সর্বাধিক মনোযোগ ঢেলে দেয়া। কিন্তু তারা তাদের নেতৃত্বের পৃষ্ঠপোষকতা শুরু করলো। পরিণামে কি হলো?

একজন শাসক মরতেই উত্তরাধিকারের দাবি নিয়ে কয়েকজন দাঁড়িয়ে যেতো। গদিতে তো বসতো একজন। আর তার আপন সন্তান, চাচাতো ভাই বোন, রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়রা তার নিচ থেকে মাটি সরানোর ষড়যন্ত্রে শরীক হয়ে যেতো।

এই সুযোগে উন্দলুসের দুশমনরা সীমান্ত এলাকায় বিশৃংখল ও অরাজক পরিবেশ সৃষ্টি করে নেয়। দেশের ভেতরে বিদ্রোহ দানা বাঁধা শুরু করে। কিন্তু দরবারী তোষামোদকারীরা তাদের বাদশাহকে রিপোর্ট দেয়, সবকিছু ঠিক আছে। এভাবে তার চোখ, কান ও বিবেক বুদ্ধির ওপর পর্দা ফেলে রাখে। তোমাদকারীরা।

পুরস্কারস্বরূপ এসব তোষামোদকারীরা অনেকে শাসকদের কাছে বেশ গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠে। কথার জাদুতে তারা শাসকদেরকে বশ করে রাখে। শাসকরা তাদেরকে দেশের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়ে দেয়। যেখানে বসার নূন্যতম যোগ্যতাও তাদের থাকে না। কারণ, দেশের প্রতি আন্তরিকতা, চিন্তা ভাবনার গভীরতা, জাতীয়তাবোধ ও ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এসব কিছুই তাদের মধ্যে। দেখা যায় না।

মুখে মধু, অন্তরে বিষ এই যোগ্যতাই তাদের পদ প্রাপ্তির প্রধান হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা হতো।

ইতিহাস লেখকনরা মোটা দাগের জিনিসগুলো দিয়েই ইতিহাস রচনা করেছে। পূর্বপুরুষরা যারা তোষামোদকারীদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছে তারা পরবর্তী প্রজন্মের প্রতি এই জুলুমও করে গেছে যে, তাদের রচিত ইতিহাসে এমন কোন কথা, এমন কোন তথ্য বা ঘটনা খুব কমই লিপিবদ্ধ হতে দিয়েছে যা শাসকদের বিরুদ্ধে যায়।

উন্দলুসের কিছুটা সঠিক ইতিহাস লাতিন ভাষায় পাওয়া যায়। ইউরোপীয় কিছু ঐতিহাসিকও সেসব খ্রিষ্টানদের উল্লেখ করতে গিয়ে সঠিক ইতিহাস রচনার চেষ্টা করেছেন যারা উন্দলুসে মুসলিম শাসকদের বিরুদ্ধে সবসময় চক্রান্ত করে গেছে।

প্রসঙ্গক্রমে তারা উন্দলুসের সেসব বীর সেনানীর ইতিহাসও লিপিব্ধ করেছে যাদের আত্মত্যাগে উন্দলুসে ইসলামী শাসন ছিলো শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে।

ঐতিহাসিকদের বিশ্লেষণ অনুযায়ী জানা যায়, উন্দলুসের শাসকদের বিরুদ্ধে অতি সংগোপনে ষড়যন্ত্র ও বিদ্রোহের আগুন সর্বপ্রথম সবচেয়ে বেশি ছড়ায় আবদুর রহমান ছানী ইবনে আলহাকাম এর শাসনামলে।

আবদুর রহমান তার দরবারে সবচেয়ে ভয়ংকর মানুষ যাকে রাখেন সে হলো সঙ্গীতজ্ঞ ও গায়ক যারিয়াব। ইতিহাস তার ব্যাপারে লিখেছে,

যারিয়াব তার গানবাদ্য যখন কর্ডোভার দরবার কক্ষে উপস্থাপনা করলো তখন সেখানে শুধু তার ভক্তই ছিলো না, সমালোকচকও ছিলো। কিন্তু তাদের বিস্ময়ের সীমা রইলো না, যখন তারা দেখলো, যারিয়াব আবদুর রহমানের মন মানসে স্থায়ী আসন গেড়ে ফেলেছে এবং আবদুর রহমান তার একান্ত শিষ্য বনে গেছেন। …..

গান বাদ্য ছাড়াও মুখের ভাষায় জাদু ও মধু প্রয়োগে যারিয়াবের সমতুল্য সে যুগে কেউ ছিলো না।……

তার সৃজনশীল শক্তি ও অসাধারণ যোগ্যতা শুধু সঙ্গীত পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিলো না। পোশাক আশাকের ক্ষেত্রেও তার উদ্ভাবনী রুচি ছিলো। নানান ধরনের বিভিন্ন রঙের কাপড়ে বিচিত্র কারুকাজ করা এবং মেয়েদের জন্য এমন সুক্ষ্ম রেশমী কাপড়ের উদ্ভাবন করে যারিয়াব যে, সেগুলো পড়লে শরীরের ভাঁজগুলোও দেখা যেতো। সে মুসলিম সমাজের বিনোদনের জন্য অনেক কিছুই আবিষ্কার করে। যা কেবল অমুসলিমদেরই সংস্কৃতির অংশ ছিলো।…..

উন্দলুসের মুসলিম সোসাইটিতে আরবদের কৃষ্টি কালচারের প্রাধান্য ছিলো। কিন্তু যারিয়াব তাদের মধ্যে নতুন কালচারের বিপ্লব ঘটায়। আরবদের মতো মুসলমানরা মাথায় লম্বা চুল ও মুখে লম্বা দাড়ি রাখতো। যারিয়াব এমন লাইফ ষ্টাইলের প্রচলন ঘটালো যে, লোকে চুল কেটে ইউরোপীয়ানদের মতো টেরিকাট রাখতে লাগলো এবং দাড়িও ছাটতে শুরু করলো।

এ ছাড়াও নারীদের জন্য বহু ধরনের ফ্যাশনের প্রচলন করে যারিয়াব। এর মধ্যে কিছু ছিলো সরাসরি উলঙ্গপনার নামান্তর।

***

জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে যারিয়াব ছেয়ে যায়। এমনকি মানুষের বাসস্থান, ঘরবাড়ি, দালানকোঠাতেও আধুনিকতার ছাপ এনে দেয় যারিয়াব। বিচিত্র রকমের সুগন্ধিও আবিষ্কার করে। তার কথাবার্তা, বিভিন্ন উক্তি জনশ্রুতি ও জনরোলে পরিণত হয়।

তার মন-মস্তিষ্ক সব সময় নতুন পরিকল্পনা, নতুন আবিষ্কারের চিন্তায় বিভোর থাকে। এসব কারণে বহু মানুষ তার একেবারে শিষ্য হয়ে যায়। কেউ বলতো, ওর প্রতি কুযুর্গ, মনীষী এবং আধ্যাত্মিক পুরুষদের আশীর্বাদ আছে। যারা স্বপ্নযোগে তাকে এই বিচিত্র আবিস্কারের উপাদান দিয়ে গেছেন।…..

কেউ কেউ বলে, তার অনুগত জিন বা অশরীরি কেউ আছে। যাদের কাছ থেকে সে এই অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হয়েছে। আর না হয় বাদশাহ এমন উন্মাদের মতো কারো গোলাম হতেন না…..

কি আমীর উমারা, কি সাধারণ মানুষ যারিয়াবের প্রভাব সবার ওপরেই ছিলো। বাদশাহ তো যেন তার আশেক ছিলেন। যারা সরাসরি বাদশাহর কাছে যেতে পারতো না, তাদের জন্য একমাত্র ভরসা ছিলো যারিয়াবই।

এর কারণে যারিয়াব সব আলেম, কামেল, পন্ডিত, মন্ত্রী, সচিব হাকিম, শাহজাদা, শাহজাদী এবং দরবারীদের অতি প্রিয় এবং গুরু বনে গিয়েছিলো। আবদুর রহমান তো তাকে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টার পদমর্যাদা দান করেন।…..

যারিয়াব নিজে কারো প্রতি দুর্বল ছিলো না। একমাত্র মালিকায়ে তব সুলতানা ছাড়া। সুলতানা যখন প্রথমে তার সঙ্গে ভালোবাসার অভিনয় করলো তখন দেখা গেলো, যারিয়ার আগে থেকেই সুলতানার প্রতি আসক্ত হয়ে আছে। তার মাথা নত হলে তা হতো একমাত্র সুলতানার সামনে। তার এই অন্ধ প্রেম-ভালোবাসার পেছনে ছিলো ইসলামের ভয়ংকর দুশমন ইউগেলিসের হাত। যারিয়াব সেটা বুঝতে পারেনি। অবশ্য একসময় সুলতানাও ধীরে ধীরে যারিয়াবের প্রতি আসক্ত হয়ে উঠে।…..

আবদুর রহমান কখনো অনুভবই করেননি, যে সুলতানা তার সবচেয়ে প্রিয় রমণী, সে যারিয়াবকেই ভালোবাসে। তার সঙ্গে শুধু ভালোবাসার অভিনয় করে।

সুলতানার এই ভালোবাসার পেছনে যে মুসলমানদের অনেক বড় শত্রু ইউগেলিসের হাত রয়েছে, যারিয়াব সেটা বুঝতে পারেনি।

***

আবদুর রহমানের রাজ দরবারে প্রচলিত সভ্যতা, সংস্কৃতি, বিনোদন এমনকি স্থাপত্যত্ত নির্মাণশৈলীতে ও যারিয়ার আবিস্কৃত বিপ্লবের ছোঁয়া তখন এসে গিয়েছিলো।

আবদুর রহমানের সালরে আলা উবাইদুল্লাহ ইবনে উবাইদুল্লাহ তখন পাম্পালুনা অঞ্চলে খ্রিষ্টান বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করছিলেন।

ইতিমধ্যে উবাইদুল্লাহ ইবনে উবাইদুল্লাহ দুই ফ্রান্সীয় কাউন্টকে চরমভাবে পরাজিত কেরেছেন। যারা উন্দলুসের পাম্পালুনা অঞ্চলে হামলা করে লুটপাট চালিয়েছিলো।

তিনি তার কাজ শেষ করে ফিরতি পথ ধরলেন। কিন্তু ফেরার ব্যাপারে তাড়াহুড়া করলেন না। ফিরতি পথের ডান বাম ও আশেপাশের এলাকার অবস্থা দেখভাল করতে করতে আসছিলেন।

এসব এলাকার অধিকাংশই পাহাড়ি ও বন্য। উবাইদুল্লাহর জানা আছে, এসব এলাকার জায়গায় জায়গায় খ্রিষ্টান সন্ত্রাসীদের আস্তানা রয়েছে। যেখানেই তার সন্দেহ হলো সেখানেই তিনি ওদের অড়াখানা আবিস্কার করে করে সমূলে ধ্বংস করে দিতে লাগলেন।

এসব ছোটখাটো অপারেশনে থাকায় রাজধানীতে ফেরাটা তার বেশষ ধীরগতির ছিলো।

প্রধান সেনাপতি যে এখনো ফিরে আসছেন না রাজধানী কর্ডোভায়, এ নিয়ে যেন আবদুর রহমানের কোন মাথা ব্যথাই ছিলো না। তবে প্রধানমন্ত্রী হাজিব আবদুল করীম ও এক সালার আবদুর রউফের পেরেশানী-দুশ্চিন্তা দিন দিন বাড়তেই থাকে। অবশ্য তারা পত্রদূত পাঠিয়ে খবরাখবর নিতে থাকেন।

আমার তো আশংকা হচ্ছে, আমীর আবদুর রহমান এই সালতানাতকে ধ্বংস না করে ক্ষান্ত হবেন না। একদিন সালার আবদুর রউফ হাজিব আবদুল করীমকে বললেন, এর কি কোনই প্রতিকার নেই?

আমরা আমীর আবদুর রহমানকে হত্যা করাতে পারি। আবদুল করীম বললেন, আমরা যারিয়াব ও সুলতানাকেও হত্যা করাতে পারি। কিন্তু ওতে অবশেষে লাভটা কি হবে? আবদুর রহমানের খান্দানের কেউ একজন তার সিংহাসনে বসে যাবে। তারপর তো এ রেওয়াজ দাঁড়িয়ে যাবে, হত্যা করো আর গদি দখল করো। ধীরে ধীরে খেলাফত দুর্বল দুর্বল হতে ভেঙ্গে যাবে এবং একদিন এর নাম নিশানাও মিটে যাবে। তাই আমাদেরকে আমাদের দায়িত্ব পালন করে যেতে হবে।

আমি তো আমীরে উন্দলুস আবদুর রহমানকে একটা কথা বলতে চাই, সালার আবদুর রউফ ক্ষোভ মেশানো কণ্ঠে বললেন, তাকে বলবো, রাজত্ব করো আর ইসলামের নাম বেঁচা ছেড়ে দাও। তিনি তো আমাদেরকে থোকাই দিচ্ছেন। কারুকার্যময় সুন্দর সুন্দর মসজিদ নির্মাণ করাচ্ছেন। কুরআন শরীফের উদ্ধৃতি দিয়ে কথা বলছেন। এটা কি পাপ নয়?

এখন আমি বুঝতে পারছি। সালতানাতে উন্দলুস শুধু দুর্বলই নয় একে ধ্বংসের পথে ঠেলে দেয়া হয়েছে। হাজিব আবদুল করীম বললেনু, শাসকরা যখন সঙ্গীতজ্ঞ, গায়ক ও তোষামোদকারীদের মায়াবী ভাষার জালে আটকে পড়েন তখন সালতানাতের খুঁটি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে একেবারে শেকড় থেকে

দুর্বল শত্রুরাও ধীরে ধীরে বড় যুদ্ধশক্তিতে পরিণত হয়। আর আবদুর রহমানের মতো শাসকরা নিজেদের চরম শত্রুর সঙ্গে বন্ধুত্ব করার হীন পথ-পদ্ধতি বের করতে থাকে। কারণ, তাদের সিংহাসন ও ক্ষমতার নিরাপত্তা এর মধ্যেই তারা নিহিত দেখতে পায় যে, দুশমনকে শক্তিশালীর মর্যাদা দিয়ে তাদেরকে বলবে, এসো আমরা বন্ধু হয়ে যাই। আর পরস্পরের বিরুদ্ধে আমরা তলোয়ার উঠাবো না।…..

আবদুর রউফ! তোমরা নিজেদের দায়িত্ব পালন করে যাও। পরবর্তী প্রজন্ম তোমাদেরকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। হতে পারে তোমাদের রেখে যাওয়া অবদান, অক্লান্ত পরিশ্রম, রক্তাক্ত পদক্ষেপ, ঈমানদীপ্ত জযবা তাদের জন্য পথের আলোকবর্তিকা হবে।

আজ যদি তোমরা যারিয়াবের আমদানী করা সভ্যতা ও সংস্কৃতির নামে অপসংস্কৃতিতে ডুবে যাও তাহলে তোমরা তোমাদের সন্তান ও তাদের আত্মজদের প্রতি অনেক বড় জুলুম করবে;…..।

ওদের পর্যন্ত যখন কালের এই পরিণতির অশুভতা পৌঁছবে তখন ইসলাম কেবল একটা নামসর্বস্ব বিষয় হয়ে যাবে। মানুষ যাকে ভুলে যাওয়া, হারিয়ে যাওয়া কোন ধর্ম বা কিছু লোকের ধর্মবিশ্বাস বলা ছাড়া আর কিছু বলতে চাইবে না। এজন্যই আমাদেরকে ইসলামের এই প্রদীপ্ত দীপশিখাকে আলোকিত রাখতে হবে। সেটা নিজেদের রক্তের বিনিময়ে হলেও প্রদীপ্ত রাখতে হবে …..

মানবতার শত্রু কুফরের অশুভ ঝড় ক্রমেই তীব্রতর হয়ে উঠছে। তারপরও আমাদের রক্তমাখা এই দীপ্ত শিখার সলতে প্রজ্জ্বলিত রাখা যাবে শুধু ত্যাগের মাধ্যমে। হয়তো এমন এক প্রজন্ম আসবে যারা এই টিমটিমে প্রদীপটি নিজেদের উষ্ণ রক্ত ধারায় এমন বিপুল আলোয় উদ্ভাসিত করে তুলবে যেমন আমাদের প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সোনালী যুগে স্বর্ণাভা হয়ে জ্বলতো।

সালার আবদুর রউফের চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। তার চোখ পবিত্র আভায় পূর্ণ হয়ে গেলো। এ আসলে তার জাগ্রত আত্মার বিভা, যা তার চেহারায় খেলে গিয়েছে। তিনি তো স্বাধীনতার ত্যাগী সৈনিক। পদমর্যাদা ও ক্ষমতার জন্য উন্মাদ নন।

***

যারিয়াবের চেহারায়ও আজকাল এ ধরনের উজ্জলতা দেখা যায়। এমনিই তো সে দারুন সুদর্শন। কিন্তু সুলতানাকে দেখলেই অন্যরকম এক আভা তার চোখে মুখে ঝলকে উঠে।

সুলতানা যখনই তার জায়গীরে যেতো যারিয়াবকেও নিয়ে যেতো। কয়েক দিন পর পরই আবদুর রহমানের কাছে এসে অজুহাত দাঁড় করাতো মহলের বদ্ধ পরিবেশে দম আটকে আসছে। একটু মুক্ত আবহাওয়ায় ঘুরে আসতে চায়। আবদুর রহমান নিষেধ করার সাহস পেতেন না।

প্রথম প্রথম তো সুলতানা যারিয়াবকে লুকিয়ে ছাপিয়ে নিয়ে যেতো। পরবর্তীতে আবদুর রহমানকে এই বলে সঙ্গে করে নিয়ে যেতো, সে যারিয়াবকে একাকিত্বের সঙ্গী হিসেবে নিয়ে যাচ্ছে।

চাঁদের স্নিগ্ধ আলোর নরম চাদর। ফুলের মনকাড়া সৌরভ। মখমলের মতো বিছানো ঘাস। এর মধ্যে দুজন বসে আছে। নিঃশব্দ রাত।

এই নিঃশব্দ-মায়াময় পরিবেশে যারিয়াবের গিটারের মৃদু লয়ের আওয়াজ এক কল্পজগত সৃষ্টি করেছে। গিটার যারিয়াবের সবচেয়ে প্রিয় রাগ-সঙ্গীত। গিটার যন্ত্রে যারিয়াব পঞ্চতারের সংযোগনী এনে বাদ্যযন্ত্রে এক বিপ্লব ঘটিয়েছে। বড় বড় সঙ্গীতজ্ঞ যারিয়াবকে গিটারযন্ত্রের আবিষ্কারকও বলতে শুরু করে।

যারিয়াব গিটারের তারে শৈল্পিক হাতের কাজ দিয়ে দারুণ মনোমুগ্ধকর সুর তরঙ্গ সৃষ্টি করতে পারে। এ ব্যাপারে তার জুড়ি নেই কোথাও। সুলতানাও এই সুর তরঙ্গে পাগলপারা হয়ে যেতো। গিটারের সুরতরঙ্গ আর যারিয়াবের সুক্ষ্ম গলার গান সুলতানার একেবারে অন্তরমূলে আঘাত করছিলো আজ। কিন্তু সুলতানা নিজের মধ্যে এমন বিচলতা অনুভব করছিলো যেন বাদ্যযন্ত্রের এই তরঙ্গাভিঘাত থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছিলো।

তুমি আমার কাছে থাকলে মনে হয় আমার সব ব্যক্তিত্ব শেষ হয়ে গেছে। যারিয়াব সুলতানাকে বললো, আমি যেন তোমার অস্তিত্বের মধ্যে হারিয়ে যাই।

সে সুলতানার বাহু ধরে তাকে টেনে কাছে আনতে গেলো, কিন্তু সুলতানা তার কাছে না এসে দূরে সরে গেলো। যারিয়াব মৃদু হেসে বললো,

তুমি তো জানো, আমি কতটা তৃষ্ণার্ত। দূরে সরে যেয়ো না সুলতানা?

খোদা তোমাকে অনেক জ্ঞান বুদ্ধি, বিচক্ষণতা দান করেছেন যারিয়াব! সুলতানা একরোখা গলায় বললো, কিন্তু ভালোবাসার মর্মভেদ তুমি বুঝতে পারবে না…..তুমি কি এই পাওয়ার অতৃপ্তিতে এই তৃষ্ণায় দারুণ ভালোলাগাকেই অনুভব করছো না?

আর তুমি কি মিলনের স্বাদ সম্পর্কে জানো? না…. তুমি জানো না। যারিয়াব বললো।

মিলনের ব্যাকুলতায় আর ছটফটানিতে যে স্বাদ আর উপভোগ্যতা রয়েছে সেটা কিন্তু মিলনের মধ্যে নেই। সুলতানা বললো, তুমি জানো না, শাহে উন্দলুসের চোখে আমি কখনো আমার প্রতি প্রেম দেখিনি। তার প্রেম ভালোবাসা আমার দেহের সঙ্গে। তার এই ভালোবাসার বয়স ততদিন যতদিন আমার সৌন্দর্য আর যৌবনের সঞ্জীবতার বয়স থাকরে। যেদিন সে আমার প্রতি আর আকর্ষণ বোধ করবে না সেদিন আমি হেরেমে নিক্ষেপিত এক বঞ্চিত নারী হয়ে যাবো।…..।

আমি চাই না, তুমি আমার দেহের স্বাদ উপভোগ করো। তাহলে তুমিও একদিন বিতৃষ্ণ হয়ে পড়বে। এখনো আমি এক মায়াময় রহস্য। এই রহস্য ফাঁস হয়ে গেলে তোমার প্রেমের ব্যাকুলতা মুহূর্তেই শেষ হয়ে যাবে। তুমি যদি আমাকে তোমার আনন্দ বিনোদনের খেলনা বানাতে চাও তাহলে আমি তোমাকে আমার এক গ্রাহক মনে করবো। যারিয়াব! আমাকে তোমার পূজা করতে দাও।

যারিয়াব মুখে মিটি মিটি হাসি ধরে রেখেই তার হাত পেছনে নিয়ে গেলো। এসব কথা সুলতানা যারিয়াবকে এই প্রথমই নয়, আরো কয়েকবার বলেছে। সে যারিয়াবের মধ্যে তৃষ্ণার এই ব্যাকুলতা খুব ভেবে চিন্তেই উস্কে দিচ্ছে। এমন অস্থিরতা আবদুর রহমানের মধ্যেও সে জাগিয়ে তুলেছিলো।

আবদুর রহমান তো মুদ্দসসিরা, জারিয়া ও শিক্ষার জন্য পাগলপ্রায় ছিলেন। সুলতানা ওদেরকে দিয়ে আবদুর রহমানকে ভোগমত্ত জীবনে ডুবিয়ে রাখতো। আর নিজে তার বাহুবেষ্টনীতে থেকেও মাঝেমধ্যে দূরে থাকতো।

***

ঘোড়ার ছুটে আসার শব্দ শোনা যাচ্ছে।

মনে হয় ইউগেলিস! যারিয়াব বললো।

 হ্যাঁ, সেই হবে। তুমি এখানে বসো। আমি ওকে নিয়ে আসছি। সুলতানা বলে সেখান থেকে চলে গেলো।

সুলতানা ইউগেলিসের ঘোড়াটি এক সহিসকে দিয়ে তাকে একটু দূরে নিয়ে গেলো। তাকে জানালো যারিয়াবও এখানে আছে।

আমি তো এক সমস্যায় পড়েছি ইউগেলিস! সুলতানা বললো, এটা তো তুমি জানো, যারিয়াব আমার প্রেমে কেমন দেওয়ানা হয়ে আছে। আমিও তাকে এটা বুঝাচ্ছি যে, ওকে আমি এর চেয়ে বেশি ভালোবাসি এবং ওর প্রতি আরো দেওয়ানা আমি। দেখো ইউগেলিস! আমি তোমার কথা মতো ওর জন্য দারুণ মনকাড়া মরীচিকা হয়ে এ অবস্থা করেছি ওর। আর সেও আমার পেছন পেছন ছুটে আসছে।……

কিন্তু আজ আমি এই সত্যকে লুকোতে পারছি না যে, জানি না কাল থেকে কখন আমার হৃদয় জুড়ে ওর ভালোবাসায় ভরে উঠেছে। মনে হচ্ছে ও নয়, আমিই ওর দিকে চুম্বকের মতো লেপ্টে যাচ্ছি।………

এখন আমি বুঝতে পারছি ওর মধ্যে কোন জাদু আছে যা দিয়ে সে আবদুর রহমানের মতো দূরদর্শী, জ্ঞানী ও রণকুশলী বাদশাহকে নিজের শিষ্য বানিয়ে নিয়েছে। শুধু তাই নয়, ও তো পুরো এক জাতির সভ্যতা ও সংস্কৃতি পর্যন্ত বদলে ফেলেছে।

প্রেম ভালোবাসা পাপ নয় সুলতানা! ইউগেলিস বড় বিচক্ষণ কণ্ঠে বললো, কিন্তু যাদের ব্যক্তি মহিমার উপলব্ধি আছে, সে তার উদ্দেশ্য, লক্ষ্য ও ব্যক্তিত্বকে সামান্য প্রেম ভালোবাসার জন্য বিসর্জন দেয় না। তোমাকে সম্রাজ্ঞী বানাচ্ছি সুলতানা! তোমার মধ্যে আমি সম্রাজ্ঞীর এক মহিমা দেখেছি। কিন্তু সে পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছতে তোমাকে এক নাটকের ভূমিকায় থাকতে হবে।…..

এর মধ্যে অন্যতম একটি নাটক এটাও যে, যারিয়াবকে তোমার প্রেমের শেকলে বেঁধে রাখবে। ওর ওপর তোমার যৌবনের জাদু ছেয়ে রাখো। ওকে ওর আসল অবস্থায় জাগতে দিয়ো না। ওকে রূপ ও প্রেমের নেশায় মাতাল থাকতে দাও।…..।

আমি জানতে পেরেছি, ও, আমাদের অনক বড় বিশাল কাজ করে দিয়েছে। কিছু আরব দেখেছি আমি, যারা কথা বলে আরবী ভাষায়, কিন্তু পোষাক আশাক ও চুল রাখার স্টাইল এবং চালচলন সব আমাদের মতো। আমাদের সংস্কৃতিই ওদের সংস্কৃতি হয়ে গেছে।

তুমি তাহলে অনেক কম দেখেছো। সুলতানা বললো, আমরা এর চেয়ে আরো অনেক বেশি সফল হয়েছি এখানে তোমাদের তুলনায়।

চলো, ও আমাদের অপেক্ষায় আছে, ওর কোন সন্দেহ যেন না হয়। তোমাকে আমি আরেকবার বলছি, নিজেকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখো। যারিয়াবের মতো এমন সক্ষম পুরুষকে তোমার অবশ্যই ভালো লাগা উচিত। ওর মধ্যে দারুণ আকর্ষণ রয়েছে। কিন্তু ওকে চরম তৃষ্ণার্ত অবস্থায় রাখো।

ইউগেলিস সুলতানার মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো। যেন ও তাকে আশীর্বাদ করছে।

যারিয়াব যেখানে একা বসে রয়েছে সেখানে পৌঁছে গেলো ওরা।

***

যারিয়াব! আমার এত সময় নেই যে, লম্বা চওড়া কথা শুনবো এবং শোনাতে বসে যাবো এখানে। ইউগেলিস বললো ব্যস্ত গলায়, আমি জানি তোমাকে যে কাজ দিয়েছি সেটা বেশ সাফল্যের সঙ্গেই করে যাচ্ছে। আমার উদ্দেশ্য তুমি নিশ্চয় বুঝে গেছো। আমি শাসন ক্ষমতার লোভী নই। আর এটাও বলবো না নিজের ধর্মবিশ্বাস ছেড়ে তুমি খ্রিষ্টান বনে যাও।…..

আমার চোখে ধর্ম কোন তাৎপর্যের বিষয় নয়। আমি মানবতার মুক্তির দাবীদার। তোমরা দুটি মানব-মানবী। যদি সুলতানা এত সুন্দরী না হতো, আর তুমিও এত উচ্চ পর্যায়ের একজন শ্রেষ্ঠ গায়ক না হতে তাহলে এখন আবদুর রহমানের দরবারে তোমাদের যে বিশাল অবস্থান তা কি তোমরা হাসিল করতে পারতে?

আবদুর রহমান যে এত বড় এক রাজ্যের শাসক হয়ে বসে আছে, তুমি কি ওকে এর যোগ্য মনে করো? শাসক হওয়ার যোগ্যতা রয়েছে আসলে তোমার। তোমাকে সেই অবস্থান নিজেকেই অর্জন করতে হবে।

তুমি যে বলেছো আবদুর রহমান এত বড় রাজ্য শাসন করার যোগ্য নন এটা একেবারেই ভুল বলেছো, যারিয়াব ইউগেলিসকে বললো, তার শাসন ক্ষমতার যোগ্যতার কথা আশেপাশের খ্রিষ্টান বাদশাহরাও স্বীকার করেন। তুমি কি এটা ভুলে গেছো, তার বাবা আলহাকাম যখন আমীরে উন্দলুস ছিলেন সালতানাতের প্রশাসনিক সব ক্ষমতা আবদুর রহমানের হাতে ছিলো? আবদুর রহমান না থাকলে আলহাকাম উন্দলুসকে কবে ধ্বংসের অতলে ডুবিয়ে দিতেন।…..

এটা আমার ও সুলতানার যে অনেক বড় কৃতিত্ব সেটা তোমাকে স্বীকার করতেই হবে। আমরাই তার উদ্যমী মানসিক শক্তি ও অসামান্য প্রশাসনিক যোগ্যতাকে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছি। এ লোকের মধ্যে যদি নারীপূজা ও গানবাদ্যের প্রতি এমন উন্মত্ততা না থাকতো তাহলে আজ উন্দলুসে কোন খ্রিষ্টানের সহস হতো না যে, সে বিদ্রোহের কথা বলে,…..।

আজ যদি কেউ ওকে ঘুম থেকে জাগিয়ে দেয় তাহলে তোমাদের পাতা ষড়যন্ত্রের জাল কয়েক দিনেই ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যাবে। কিন্তু এটা আমার একক কৃতিতু যে, আমি এখানকার নকশা, জীবন যাপন অন্যরকমভাবে বদলে দিয়েছি। আমি শাহী খান্দান ও এর সঙ্গে যারা উঠাবসা করে তাদের মধ্যে ইউরোপীয় সংস্কৃতি ও জীবন যাপন রীতির প্রচলন করে দিয়েছি। তুমি যেমন বলেছো, তোমার দৃষ্টিতে ধর্ম কোন অর্থবোধক বিষয় নয়, আমার কাছেও ধর্ম অর্থহীন জিনিস।

যারিয়াব বাস্তবেই অর্থহীন মনে করতো ধর্মবিশ্বাসকে। কিন্তু ইউগেলিসের আপাদমস্তক খ্রিষ্ট ধর্মে ডুবন্ত ছিলো। যারিয়াবের মতো অসম্ভব দূরদর্শী ও বিচক্ষণ লোকও বুঝতে পারলো না, ইউগেলিস তাকে যা বলেছে নিজের ব্যাপারে সেটা একেবারেই মিথ্যা এবং থোকা।

যারিয়াব তো বলতো, আবদু ররহমানের বড় দুর্বলতা হলো, তিনি নারী ও গানবাদ্য বলতে বেহুশ। কিন্তু সে নিজে বুঝতে পারেনি, সুলতানা নামের এক ভয়ংকর সুন্দরি নারীকে তার মন-মস্তিষ্কে সওয়ার করে রেখেছে। সঙ্গে সঙ্গে সে তার ধর্ম ও দেশের শত্রুদের দাবার অর্থ খুঁটিতে পরিণত হয়েছে।

সে রাতে ওরা ওদের মিশন নিয়ে অনেক কথা বললো। ওদের সবার মিশনই তো এক। তবে ইউগেলিস সতর্ক লোক। সে যারিয়াব ও সুলতানার কাছে অনেক কিছুই চেপে গেলো।

প্রধান সেনাপতি উবাইদুল্লাহ ইবনে উবাইদুল্লাহ পাম্পালুনার সফল অভিযান শেষ করে ফিরে আসার সময়ও ছোট ছোট খ্রিষ্টান সন্ত্রাসী দলগুলোকে গুঁড়িয়ে দিতে দিতে আসছিলেন। তিনি কয়েকটি ছোট ছোট ইউনিটও তৈরি করে নেন, যারা আচমকা আশেপাশের এলাকায়, ঘন বনজঙ্গলে কিংবা উঁচু নিচু উপত্যকায় হানা দিতে এবং শক্রর আস্তানা আবিস্কার করে তা গুঁড়িয়ে দিতো।

সিপাহসালার উবাইদুল্লাহর সেনাদল এক ময়দানে তাঁবু ফেলেছে। এর আশেপাশে পাহাড়ি প্রান্তর ও বনজঙ্গলে ভরা। সন্ধ্যা এখনো নামেনি। এসময় দুজন ঘোড়সওয়ার এলো। দেখে ওদেরকে সাধারণ মুসাফির বলেই মনে হচ্ছিলো। দুজনের অবস্থাই ধূলো মলিন।

ওরা জানালো, ওরা খ্রিষ্টান ছিলো। ইসলাম গ্রহণ করেছে। সিপাহসালারের সঙ্গে সাক্ষাত করতে চায়। বলতে লাগলো, বিশেষ এক গোপন কথা আছে, সেটা একমাত্র সিপাহসালারকেই বলা যাবে। ওদের দেহ তল্লাশী করা হলো। না, ওদের কাছে কোন অস্ত্রশস্ত্র পাওয়া গেলো না। তারপর তাদেরকে সিপাহসালারের কাছে নিয়ে যাওয়া হলো।

হতে পারে এটা আমাদের কেবল সন্দেহই, দুজনের একজন সিপাহসালার উবাইদুল্লাহকে বললো, কিন্তু আমরা যা দেখেছি সেটা আপনার পর্যন্ত পৌচানো নিজেদের একান্ত কর্তব্য বলে মনে করি। আমরা ইসলাম গ্রহণ করেছি। এর অর্থ হলো, ইসলামের প্রতি আমাদের হৃদয়ে ভালোবাসা ও আন্তরিকতা আছে। ইসলামকে যোগ্য মনে করেছি বলেই আমরা এর জন্য খ্রিষ্টধর্ম ত্যাগ করেছি।

ওরা এ ধরনের গুরুগম্ভীর ও দীর্ঘ ভূমিকা ছাড়ার পর বললো; এক প্রান্তর দিয়ে ওরা যাচ্ছিলো। একটি পোড়া বাড়িতে চারপাঁচজন মহিলাকে ঢুকতে দেখলো ওরা। মহিলাদের ওপর ওদের কিছুটা সন্দেহ হলো। কারণ, ওদের পোশাক এ এলাকার লোকদের মতো নয় এবং এই পোড়া ও নির্জন এলাকায় ওরা একা সফর করতে পারে না।

তারা জানালো যে, তারা দুজন পোড়া দালানের ভেতর চলে গেলো। এটা প্রাচীন কোন গির্জার ধ্বংসাবশেষ। ওরা দুজন মহিলাদেরকে জিজ্ঞেস করলো ওরা কারা? কোত্থেকে এসেছে এবং কোথায় যাচ্ছে?

ওরা বললো, ওরা নওমুসলিম। মুসলিম সেনাদল থেকে একটু দূরে দূরে থেকে ওরা এই সেনাদলের সঙ্গে যাচ্ছে।

আমরা এই সেনাদলের প্রধানের সঙ্গে কথা বলতে চাই, মহিলারা এই লোক দুজনকে বলেছিলো, কিন্তু আমরা তো নারী। এজন্য সৈনিকদের কাছে যেতে ভয় পাচ্ছি। আমাদের কাছে কিছু গোপন তথ্য আছে সেটা শুধু সালারকেই বলতে চাই। তিনি আমাদের সঙ্গে কথা বলতে না চাইলে আমরা ফিরে যাবো। তিনি কষ্ট করে এখানে আসলে তাকে সব কথা বলে দেবো।

উবাইদুল্লাহর ঠোঁটে হাসি খেলে গেলো।

আমাকে তোমরা বেকুব বানাতে এসেছো? উবাইদুল্লাহ বললেন।

এত বড় দুঃসাহস কি আমরা দেখাতে পারি? দুজনের একজন বললো, ওরা পুরুষ হলে ওদেরকে আমরা সঙ্গে করে নিয়ে আসতাম। মহিলাদেরকে তো আমাদের সঙ্গে আসতে বাধ্য করতে পারি না আমরা। তবুও বলেছিলাম আমাদের সঙ্গে আসতে। কিন্তু ওরা মানলো না। ওদের মধ্যে দুজন তো কাঁদতে শুরু করলো। জানি না, ওরা কি বলতে চায়। মেয়েদেরকে আপনার কিসের ভয়? তবে আপনি যেতে না চাইলে সেটা আপনার মর্জি। আমরা মুসাফির। আমাদের পথে আমরা নেমে যাবো।

ওরা এমনভাবে কথা বললো উবাইদুল্লাহর সঙ্গে যে, তিনি ওদের সঙ্গে রওয়ানা হয়ে গেলেন। তার সঙ্গে নিলেন মাত্র দুজন মুহাফিজ। এসব এলাকায় তিনি তার ফৌজের মাধ্যমে এমন আতংক ছড়িয়ে দিয়েছেন যে, তাকে কেউ ধোকা দেবে এমন দুঃসাহস করাও অসম্ভব ব্যাপার।

সেই পোড়া গির্জা এখান থেকে প্রায় তিন মাইল দূরে প্রান্তরভাগের মধ্যে। দুই ঘোড়সওয়ার সবার আগে, তার পেছনে উবাইদুল্লাহর ঘোড়া, এর পেছনে মুহাফিজদের ঘোড়া।

পোড়া গির্জার কাছে যেতেই ভেতর থেকে নারী কণ্ঠের কান্নার শব্দ শোনা যেতে লাগলো। সামনের দুই ঘোড়সওয়ার দাঁড়িয়ে পড়লো।

আর সামনে যাবেন না সিপাহসালার! মুহাফিজদের একজন উবাইদুল্লাহকে বললো, এদেরকে মানুষ মনে হয় না। কোন জিনটিন হবে। কারণ, ওদের তো কান্নার কোন কথা ছিলো না। এরা তো আমাদের সঙ্গে এমন কিছু বলেনি যে, এরা মজলুম নারী।

ভেতর থেকে ভয়ার্ত চিৎকার শোনা যেতে লাগলো, বাঁচাও, ওই জালিমদের হাত থেকে বাঁচাও।

***

দুই ঘোড়সওয়ার তলোয়ার বের করে ঘোড়া থেকে নেমেই গির্জার দিকে ছুটে গেলো। উবাইদুল্লাহও ঘোড়া থেকে নেমে সেদিকে ছুটলেন। মুহাফিজরাও তার পেছন পেছন দৌড়াতে লাগলো।

সহসাই লোক দুজন বেরিয়ে এলো। ওরা হাসছিলো। নারী চিৎকার এখন আর নেই। ওরা উবাইদুল্লাহ ও মুহাফিজ দুজনকে বাইরে দাঁড় করিয়ে বললো, তেমন কোন ব্যাপার নয়। কয়েকটি ঘোড়ার আওয়াজ শুনে ভেবেছে, ওদেরকে বুঝি সৈন্যরা পাকড়াও করতে এসেছে। আমাদেরকে দেখে শান্ত হয়ে গেলো।

আপনার মুহাফিজরা বাইরে থাকুক। শুধু আপনি ভেতরে আসুন। ওরা শুধু আপনার সঙ্গেই কথা বলতে চায়। আর কারো সঙ্গে নয়।

মুহাফিজ দুজন বাইরে রয়ে গেলো। উবাইদুল্লাহ ভেতরে চলে গেলেন। এটা একটা দেউরীর মতো দালান। ছাদ বেশ নিচু। বেশ ছমছমে পরিবেশ। দুর্গন্ধও নাকে আসছে। উবাইদুল্লাহ সামনের একটি কামরায় গিয়ে ঢুকলেন। কোন মহিলাকে দেখতে পেলেন না। ততক্ষণে তিনি তার তলোয়ারও কোষবদ্ধ করে কোমরে ঝুলিয়ে ফেলেছেন।

কামরার চারটি দরজা। একটি দরজা খোলা। দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি। এ সময় পেছন থেকে মৃদু পায়ের আওয়াজ পেলেন। তিনি পেছনে ফিরে তাকালেন।

ততক্ষণে তিনি ছয়জন দীর্ঘদেহী শক্তিশালী মানুষর ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়ে গেলেন। সবার হাতে উদ্যত বর্শা। তাদের চোখে ক্রোধ আর ঘৃণা।

এরা যে খ্রিষ্টান এতে কোন সন্দেহ রইলো না উবাইদুল্লাহর এবং তিনি যে অনেক বড় ভুলের মধ্যে পা দিয়েছেন সেটা দেরিতে হলেও তিক্তভাবে অনুভব করলেন। এই দুই ঘোড়সওয়ারের কথায় এত তাড়াতাড়ি বিশ্বাস করা ঠিক হয়নি।

তোমরা কি চাও? তিনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন।

 আমরা যা চেয়েছি তা পেয়ে গেছি। ছয়জনের একজন বললো।

সিপাহসালার! তোমার দুই মুহাফিজকে আমরা খতম করে দিয়েছি। দেউরী সংলগ্ন দরজা থেকে আওয়াজ এলো।

উবাইদুল্লাহ সেদিকে তাকালেন। তার দুই মুহাফিজ ঘোড়সওয়ার দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলো। তাদের হাতে তরোয়ার ছিলো। দুজনের তলোয়ারই রক্তে লাল। ওদেরকে তাহলে ওদের তলোয়ার দিয়েই হত্যা করা হয়েছে।

তুমি এখন আমাদের কয়েদী একজন বললো, ভয় পেয়ো না। আমরা তোমাকে হত্যা করবো না।

তোমার ভাগ্যের ফয়সালা করবেন শাহে ফ্রান্স লুই।

আর আমরা তোমাকে বলবো তুমি সে রক্তের কি মূল্য দেবে যা তুমি বিদ্রোহ দমনের নামে খ্রিষ্টানদের শরীর থেকে ঝরিয়েছে। তাদের একজন বললো।

এর মূল্য কি তাও শাহে লুই বলবেন। দীর্ঘকায় আরেকজন বলরো। তোমার তলোয়ারটি আমার হাতে হাওলা করে দাও। একজন এগিয়ে আসতে আসতে বললো।

সিপাহসালার উবাইদুল্লাহ তার তলোয়ারের বাট শক্ত করে ধরে বললেন,

প্রাণ দিয়ে দিতে কুণ্ঠিত হবো না; কিন্তু তলোয়ার দেবো না। তোমরা আটজন আর আমি একলা। তবুও লড়তে ভয় পাচ্ছি না। তোমাদের বর্শার ফলাগুলো যখন আমার দেহে ঢুকে যাবে এবং আমার দেহ থেকে আত্মা বেরিয়ে যাবে তখন তোমরা তলোয়ার নিয়ে নিয়ো।

বাস্তবায় ফিরে এসো উবাইদুল্লাহ। তাদের মধ্যে নেতা গোছের একজন বললো, আমরা তোমাকে হত্যা করতে পারবো না। জীবিত নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু লড়াই করে আমাদের হাত থেকে বেরিয়ে যেতে চেষ্টা করলে মারা যেতে পারো।

আমি এজন্য প্রস্তুত। আমার লাশই শাহ লুইয়ের কাছে নিয়ে যেতে পারবে।

আমরা ক্রুশের পূজারী। আরেকজন বললো, ডাকো তোমাদের রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে; তোমাকে আমাদের হাত থেকে মুক্ত করে নিয়ে যেতে। …..আমরা তোমার কাছে তলোয়ার চেয়েছি।

তলোয়ার আমার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকেই দেবো। উবাইদুল্লাহ কঠিন গলায় বললেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রকৃত অনুসারী দুশমনের হুমকিতে তলোয়ার ছেড়ে দেয় না।

এ সময় হঠাৎ বাইরে অনেকগুলো ঘোড়ার খুরধ্বনি শোনা গেলো। কাছে। এসে শব্দ থেমেও গেলো।

দেখো তো বাইরে কে? সাবধানে দেখবে। নেতা গোছের খ্রিষ্টানটি বললো।

তাদের একজন পা টিপে টিপে বাইরে বের হলো এবং শরীর লুকিয়ে উঁকি মেরে বাইরে তাকালো এবং একইভাবে ভেতরে চলে এলো।

ওকে মেরে ফেলে এখান থেকে বেরিয়ে যাও। লোকটি তাগাদা দিলো সবাইকে।

উবাইদুল্লাহ বুঝে গেলেন বাইরে তার লোকজনই এসেছে। ওরা তাঁরই সেনাদলের একটি ইউনিট।

এতে প্রায় বিশজন ঘোড়সওয়ার রয়েছে। এরা আশপাশের এলাকায় টহল দিয়ে ফিরে যাচ্ছিলো। এই পোড়া গির্জার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দেখে বাইরে চারটি ঘোড়া দাঁড়িয়ে আছে। দলে কমান্ডার দাঁড়িয়ে গেলো। তারপর দেখলো দুটি লাশ পড়ে আছে।

ঘোড়া থেকে নেমে কাছে গিয়েই চিনতে পারলো সিপাহসালারের মুহাফিজ ছিলো ওরা। বাইরে যে ঘোড়াগুলো দাঁড়িয়ে আছে এর সওয়ার যে ভেতরে রয়েছে এটাও নিশ্চিত হয়ে গেলো তারা।

দলীয় কমান্ডারকে যে লোকটি বাইরে উঁকি দিয়ে সেনা ইউনিটকে দেখে ভিতরে গিয়ে বলেছিলো উবাইদুল্লাহকে মেরে ফেলল। তার পিছু পিছু মুসলিম কমান্ডারও ভেতরে ঢুকে পড়লো। সবাই কমান্ডারের দিকে তাকালো।

এই সুযোগে উবাইদুল্লাহ তলোয়ার বের করে তার একেবারে কাছে দাঁড়িয়ে থাকা খ্রিষ্টান সন্ত্রাসীর ঘাড়ে সজোরে আঘাত করলেন। একটুর জন্য মাথাটি ধড় থেকে আলাদা হলো না।

সঙ্গে সঙ্গে তিনি চিৎকার করে কমান্ডারকে বললেন, সবাইকে ভেতরে ডাকো।

কমান্ডারও চিৎকার করে তার লোকদের ভেতরে আসতে বললো। কয়েকজন সন্ত্রাসী বাইরের দিকে ছুট দিলো। আর দুজন উবাইদুল্লাহর ওপর বর্শা চালালো।

যারা বাইরের দিকে দৌড়াতে লাগলো তাদেরকে পথেই মুসলিম সৈনিকরা পথরোধ করে দাঁড়ালো এবং এরা পালাতে চেষ্টা করলো না। তারা লড়াই শুরু করে দিলো।

উবাইদুল্লাহ ওদিকে দুই বাধার বিরুদ্ধে একাই লড়তে লাগলেন। বর্শা তো বেশ লম্বা। এজন্য উবাইদুল্লাহর তলোয়ার বর্শাধারী পর্যন্ত পৌঁছছিলো না।

তার সৈন্যরা বাইরে রক্তক্ষয়ী লড়াই লড়ছিলো।

উবাইদুল্লাহ তলোয়ারের আঘাতে আঘাতে একটি বর্শা ভেঙ্গে ফেললেন। এর মধ্যেই দুজন সৈন্য ভেতরে এসে গেলো। ওরা একজন বর্শাধারীকে নিমিষেই যমের বাড়ি পাঠিয়ে দিলো। আরেকজনকে জীবিত গ্রেফতারের নির্দেশ দিলেন উবাইদুল্লাহ।

উবাইদুল্লাহ বাইরে বের হয়ে দেখলেন, ক্রুশের পূজারীরা জাহান্নামে চলে গেছে। তার সৈন্যদেরও তিনজন শহীদ হয়ে গেছে। সন্দেহ নেই, এই খ্রিষ্টান সন্ত্রাসী দলটি বেশ সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই করে প্রাণ দিয়েছে।

তোমরা আসলে কী চাইছিলে? তোমাদের উদ্দেশ্যই বা কী ছিলো? যাকে পাকড়াও করা হয়েছে তাকে জিজ্ঞেস করা হলো।

আপনি যদি মনে করেন আমার প্রাণের ভয়ে আপনাকে সবকিছু বলে দেবো তাহলে এই ধারণা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন। পাকড়াও করা খ্রিষ্টানটি বললো, আমার নাম সিলওয়াস। আমরা আপনাকেই অপহরণ করে নিয়ে যেতে এসেছিলাম। আমদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো, আপনি কোন ঝামেলা করলে কতল করে ফেলতে। এটা তো বলাই হয়েছে, আপনাকে ধরে নিয়ে ফ্রান্সের শাহ লুইয়ের কাছে নিয়ে যেতাম আমরা। এর অতিরিক্ত আমি আর কিছুই বলবো না।

তোমাকে তো এটা বলতে হবে তোমাদের এই সন্ত্রাসী দল আর কোথায় কোথায় আছে? উবাইদুল্লাহ জিজ্ঞেস করলেন, আর কোন কোন মসলমান তোমাদের সঙ্গে আছে?

এটা তো কোনভাবেই বলবো না। সিলওয়াস বললো, আমরা শক্ত কসম করে এসেছি, কোন ধরনের তথ্য কাউকে দেবো না। প্রাণ গেলেও না। আমরা আত্মউৎসর্গকারী- জানবায, আমাদের খ্রিষ্টধর্মের জন্য নিজেদের প্রাণ উৎসর্গ করে রেখেছি।

সেনা ইউনিটের কমান্ডার তলোয়ার উঠিয়ে তার দিকে এগিয়ে গেলো এবং ক্রুদ্ধ হয়ে বললো, তোকে আমাদের সিপাহসালারের প্রশ্নের উত্তর অবশ্যই দিতে হবে।

সিপাহসালার উবাইদুল্লাহ সিলওয়াস ও কমান্ডারে মাঝখানে এসে দাঁড়ালেন।

অত্যন্ত সম্মান পাওয়ার যোগ্য এই লোক যে নিজের ধর্মের জন্য নিজের প্রাণ বিসর্জন দিয়ে দেয়ার সংকল্প করেছে। উবাইদুল্লাহ বললেন, আমি ওর ওপর সামান্যতম কঠোরতাও করবো না। সিলওয়াস! তোমাকে আমি এ অধিকার দিচ্ছি, তুমি তোমার গোপনীয়তা গোপনই রাখো। আমি তোমাকে ছেড়ে দেবো। আর আমাদের কাছে এটা কোন বীরত্বের বিষয় নয় যে, আমরা এতগুলো মানুষ মিলে তোমাকে একা কতল করে দেবো।…..

শাহ লুইয়ের কাছে যাও এবং আমার পয়গাম দাও যে, আমাকে অপহরণের জন্য যেন তিনি নিজে আসেন। তোমরা তো কিছু লোককে নিজেদের ধর্মের জন্য জানবায বানিয়েছে। এখানে আমরা সবাই-সিপাহসালার, সালার থেকে নিয়ে সাধারণ সিপাহী পর্যন্ত ইসলামের জানবার্য।…..

যাও, সিলওয়াস! তাকে বলবে, উবাইদুল্লাহ ইবনে উবাইদুল্লাহ একা অসহায় কোন কাফেরের ওপর তলোয়ার চালায় না।

আর সিলওয়াস! তোমার কোন এক সঙ্গী কিছুক্ষণ আগে আমাকে বলেছিলো যে, তোমার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ডাকো, তিনি তোমাকে মুক্ত করে নিয়ে যাবেন।- দেখেছো তোমরা, আমার রাসূরুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ আমাকে কীভাবে উদ্ধার করেছেন?

ওরা পোড়া বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো। সবাই শোকতপ্ত হয়ে সংক্ষিপ্ত এই লড়াইয়ে নিহতদের পাশে দাঁড়িয়ে গেলো।

***

আপনি যদি আমাকে ধোকা না দেন তাহলে আপনাকে দু একটি কথা আমি বলতে চাই। সিলওয়াস বললো।

কোন ধোকা নয় সিলওয়াস! উবাইদুল্লাহ বললেন, যা বলতে চাও নির্ভয়ে বলো। আমাকে গালি দিতে চাইলে গালি দাও। তুমি এখন মুক্ত।

আমি নির্ভীক মানুষ সালারে আলা! সিলওয়াস বললো, কিন্তু গালি দেয়াকে আমি ঘৃণা করি। প্রকৃত জানবাযের মুখ নয়, তলোয়ারই চলতে স্বাচ্ছন্দবোধ করে…

আমি আপনার এই অসাধারণ চরিত্রমাধুরীকে এবং আমার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের সামান্য কিছু মূল্য দিতে চাই। আপনি জিজ্ঞেস করেছেন কোন কোন মুসলমান আমাদের সঙ্গে আছে?…….

আমি নাম তো বলবো না এবং দুএকজন ছাড়া কারো নাম জানিও না। শুধু এতটুকু বলবো, সালতানাতে উন্দলুসের খুঁটি তার ভিত্তিপ্রস্তর থেকে খসে পড়েছে। আপনারা উন্দলুসের এই মাটিতে বেশি দিন আর টিকতে পারবেন না। আপনাদের মুসলমানরাই সালতানাতকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে। এটা কোন গোপন তথ্য নয়, আপনারা নিজেরাই তো সব দেখতে পাচ্ছেন।…..

আপনারা এই ঘুণপোকা মারতে পারবেন না। হাজার হাজার খ্রিষ্টান ইসলাম গ্রহণ করেছে। কিন্তু এরা এবং যারা আরব থেকে এসেছে তাদের সবাইকে তো আপনারা পাক্কা মুসমান মনে করেন। আসলে এরা নামসর্বস্ব মুসলমান হয়ে গেছে। মুখের ভাষায় যে কাজ হয় সেটা তলোয়ারে সম্ভব হয় না। আর যে জাতি তাদের সভ্যতা ও শিক্ষা বদলে দেয় তাদের তলোয়ার ভোতা হয়ে যায়।

কাবার রবের কসম! তুমি ভাড়াটে খুনি নও। উবাইদুল্লাহ স্বগোতক্তি করে উঠলেন, তোমার কথায় বুদ্ধির ঝলক আছে। তুমি চিন্তাভাবনা করার মতো যোগ্য লোক।

যে সিপাহী মেধা-বুদ্ধি খাটাতে পারে না সে তত ভাড়াটে খুনীই। সিলওয়াস বললো, সেই বর্শাই দুশমনের বুক দিয়ে ঢুকে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে যায় যার পেছনে সিপাহীর বাহুবল নয়, কোন ধর্মের জ্যবাদীপ্ত শক্তি থাকে। আমরা আপনার কওমের সেই জযবা-সেই চেতনাকে সমূলে ধ্বংস করে দিচ্ছি।

আর তোমরা এতে কখনো সফল হতে পারবে না। সিপাহসালার বললেন।

আমাদের দীক্ষাগুরু বলেছেন, কোন জাতিকে একদিন, সপ্তাহ, মাস বা বছরে মারা যায় না সিপাহসালার! সিলওয়াস বললো, আপনার অসাধারণ আদর্শ আর চমৎকার ব্যবহারই আমাকে এভাবে এবং এ ধরনের কথা বলতে বাধ্য করেছে। না হয় আমি এ সম্পর্কে কিছুই বলতাম না। …..দীক্ষা গুরু বলতেন, তোমার শত্রু-জাতিকে অধঃপতনের পথে নামিয়ে দাও। এটাই তোমাদের সফলতা।…..

নিজেদের পরবর্তী প্রজন্মকে এটা মাথায় ঢুকিয়ে দাও যে, এই মিশনকে তাদের অনেক দূর নিয়ে যেতে হবে। নিজেদের সন্তানদের বলে যাও, তাদের পূর্বপুরুষরা এই মিশনে বহু প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে। ধর্ম, জাতি ও দেশের জন্য নিহতদের কাহিনী শোনাও ওদেরকে।…..

তারপর এই সন্তানরাই এই মিশনকে অগ্রগামী করবে এবং এমন এক সময় আসবে যে, তোমাদের শত্রু জাতি এমনভাবে কালের হাওয়ায় উড়ে যাবে যেমন প্রখর রৌদ্রে ভেজা শিশির উড়ে যায়। হ্যাঁ, আমরা আপনাদেরকে অধঃপতনের পথে নামিয়ে দিয়েছি।

আমাদের সেনাবাহিনী সম্পর্কে তোমাদের ধারণা কি? উবাইদুল্লাহ জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কি আমাদের সেনাবাহিনীকেও অধঃপতনের পথে নিয়ে যেতে পারবে? ওদেরকে পরাজিত করতে পারবে?

যে জাতির বাদশাহ বা শাসকরা নিজেদের সিংহাসন আর রাজমুকুটের হেফাজতের জন্য স্বজাতিকে ধোকা দিতে পারে এবং শত্রুকে বন্ধু মনে করে। গানবাদ্য আর যৌন-বিলাসকে নিজেদের ওপর ছায়ার মতো সওয়ার করে রাখে,নিজের বিবেক বুদ্ধিকে কোন সুন্দরী নারী বা গায়কের হাতে বন্ধক রাখে…..

সে জাতির সেনাবাহিনী যত শক্তিশালী আর দুর্দান্ত হোক না কেন ওরা এক সময় বেকার হয়ে যায়। আপনাদের সেনাবাহিনীর অবস্থাও তাই হবে। যখন শাসক ও সেনাবাহিনীর চিন্তা-ভাবনা বিপরীতমুখী হয়ে যায় তখন স্বজাতি জীবিত থাকতে পারে না। জীবিত থাকলেও তাদের ভাগ্যলিপিতে কারো গোলামি লিখে দেয়া হয়।

সালারে আলা! সেনা ইউনিটের কমান্ডার উবাইদুল্লাহকে বললো, এ লোক ভাড়াটে খুনি বা সন্ত্রাসী নয়। এতো সন্ত্রাসী দলের বড় নেতা মনে হচ্ছে। একে জীবিত রাখা মানে ভয়ংকর এক জঙ্গি গ্রুপকে জীবিত রাখা। ওকে আপনি হত্যা করছেন না কেন?

না, সালারে আলার দৃষ্টি তখন সিলওয়াসের চেহারায় নিবদ্ধ এবং তার ঠোঁটে মুচকি হাসি, তিনি বললেন, ওকে হত্যা করা আমার ওপর ওয়াজিব নয়। আমি এমন শত্রুকে সম্মান করি।

আর আমিও আপনাকে শ্রদ্ধা করি। সিলওয়াস উবাইদুল্লাহকে বলে কমান্ডারকে উদ্দেশ্য করে বললো, হত্যা করতে হলে নিজেদের বাদশাহকে হত্যা করো আমার বন্ধু। আর তাকে নিজেদের বাদশাহ বানাও যে নিজের ব্যক্তিগত ভোগবিলাসে মত্ত নয়।

একটু পর সিলওয়াস ঘোড়ায় চড়ে একদিকে ঘোড়া ছুটিয়ে দিলো।

***

এতে তো কোন সন্দেহ নেই, সালতানাতে উন্দলুসকে অনেক আগেই চক্রান্তকারী খ্রিষ্টানরা অধঃপতনের পথে নিয়ে গেছে। পুরো খ্রিষ্টান জাতির মধ্যে এক ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করে দেয়া হয়েছে।

ইউগেলিস, ইলওয়ারের মতো নেতা ও পাদ্রীরা এমন সুক্ষ্ম বিষয়ের ওপর খ্রিষ্টান জাতিকে উস্কে দিলো, যার মধ্যে মুসলিম সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়া থেকে এবং লড়াই এড়িয়ে যাওয়ার চমৎকার কৌশল রয়েছে।

তাদের আসল হামলা ছিলো ইসলামী আদর্শ ও সংস্কৃতির ওপর এবং মুসলমানদের মন-মানসের ওপর। যাতে ভোগ, বিলাস, বিনোদন আর প্রেম ভালোবাসার সহজ অস্ত্র ব্যবহার করা হয়।

একদিকে রইলেন উবাইদুল্লাহ ইবনে উবাইদুল্লাহর মতো সালার, যিনি ইসলামের জন্য রাতের ঘুম হারাম করে দিয়েছেন। আর অন্যদিকে শাহী মহলের কোন নারী কণ্ঠের অট্টহাসি বা কোন গায়কের মায়াভরা সুর-তরঙ্গ।

আবদুর রহমানের দরবারে নারী, নর্তকী, গায়কদেরই প্রাধান্য ছিলো না, কবিয়াল গোষ্ঠিরও বড় দখল ছিলো। আবদুর রহমান কাব্য কবিতার প্রতিও দারুণ ভক্ত ছিলেন। কিন্তু সেসব কবি ও গীতিকারদেরই দরবার পর্যন্ত যাতায়াত ছিলো যারা দরবারের উপদেষ্টা ও আমীর উমারাদের পছন্দের হতো। সর্ব দরবারী কবিরাই পরবর্তীতে উন্দলুসে ইসলামের পতনের সবচেয়ে বড় কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

বাদশাহর সামান্য আপত্তি আছে এমন কোন কথাই এরা এদের কাব্যে রাখতো স্থান দিতো না। এভাবে ওরা বাদশাহদেরকে শব্দের আফিম খাইয়ে মাতাল করে রাখতো।

তারীখুল উম্মত এর উদ্ধৃতি এরকম,

 বনী উমাইয়ার ওযীর, নাযীর, আমীর উমারাদের নির্বাচনে ব্যক্তিগত পছন্দ ও সুপারিশই সবচেয়ে বড় নীতি ছিলো। বীরত্ব ও শৌর্যবীর্যের কোন অভাব ছিলো না তাদের। যথেষ্ট পরিমাণেই ছিলো, কিন্তু তার সঠিক প্রয়োগ খুব কমই হতো। ওযীর ও আমীর ততক্ষণেই ওযীর আমীর থাকতো যতক্ষণ তারা বাদশাহর দৃষ্টিতে মনোনীত থাকতো।

যার ওপর থেকে বাদশাহর দৃষ্টি সরে যেতো তার সব পদমর্যাদা, সব অর্জন মাটিতে মিশে যেতো। এমন অদূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গি ও চরম স্বার্থপরতাই অধিকাংশ যোগ্য ও প্রতিভাবান নেতৃত্বকে অংকুরেই নষ্ট করে দেয়।…..

এসব শাসকদের আসল লক্ষ্য যেহেতু ছিলো নিজেদের ঘরানায় ও খান্দানে পূর্ণ সালতানাত কায়েম করা, এজন্য বিভিন্ন শক্তিধর গোত্র ও ব্যক্তির ওপর নিজের প্রাধান্য ও প্রভাব বিস্তার করে রাখা খুবই জরুরি ছিলো।

আর তাদেরকে এভাবে হাতের মুঠোয় রাখতে গিয়ে দেশের রাষ্ট্রীয় কোষাগারের ডালা সবসময় উন্মুক্ত রাখতো। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে তারা কাড়ি কাড়ি সম্পদ খরচ করতো। আমীর-উমারা ও সরদাররা ছাড়াও খতীব, কবি, গীতিকার, গায়ক, সুন্দরী নারীদের পেছনে বিশাল অংকের অর্থ ব্যয় করা হতো। আর যারা বাদশাহদের তোষামোদ করতো, প্রশংসা-গুণকীর্তন করতো তারা তো হয়ে উঠতো একেকজন সম্পদের মনুষ্য পর্বত।

উন্দলুসের ইতিহাস সেসব দরবারী কবি-সাহিত্যিকরাই লিখেছেন যারা তাদের কালের শাসকদের শিল্প ও ছন্দের ভাষায় চরম আত্মতুষ্টিতে মগ্ন রাখতো। তাদের সেসব লেখাই তো পরবর্তী প্রজন্মের কাছে ইতিহাস হয়ে পৌঁছেছে। যার মধ্যে শাসক শ্রেণীর গুণকীর্তন আর তাদের অবদানের কথাই উঠে এসেছে বেশি, তাদের অযোগ্যতা, ভুল-ত্রুটি, ক্ষমতার লোভ, অপকর্মের কথা তারা জেনে শুনেই চেপে গেছে।

উত্থান আর সাফল্য সে জাতির কপালেই চুম্বন করে যারা তাদের পূর্বসুরীদের বিচ্যুতিকে পথের আলোকবর্তিকা বানিয়ে পথ চলে এবং সুখ স্মৃতিকে উদ্দীপনার উৎস ছাড়া আর কিছুই মনে করে না। কিন্তু দরবারী ঐতিহাসিকরা পরবর্তী প্রজন্মকে সেই ইতিহাসই দিয়েছে, যা বিজয় আর সুকীর্তির কাহিনীতে পূর্ণ।

চারদিকে একটি খবর ছড়িয়ে পড়লো। কর্ডোভা থেকে পাঁচ ছয় মাইল দূরের এক উপত্যকায় হযরত ঈসা (আ) এর এক খাস শিষ্য আত্মপ্রকাশ করেছে। সেখানে এক পাহাড়ি প্রান্তরের ওপর একটি গাছে একটি নক্ষত্র চমকে উঠে। তারপর তার শিষ্যের আওয়াজ শোনা যায়।

সেখানে এক প্রাচীন গির্জার ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। গির্জা বেশ উঁচুতে নির্মাণ করা হয়েছিলো। কোন এক যুগে এসে সেটা পরিত্যক্ত হয়ে যায়।

খ্রিষ্টানরা বলতে শুরু করেছে, এখন সেখানে গির্জার ভেতরে বহু অশরীরি এসে বাসা বেঁধেছে। ভয়ংকর সব কাহিনী শোনানো হতো। কেউ কেউ বলতো, এগুলো অশরীরী নয় বরং হযরত ঈসা (আ) এর যুগের পূণ্যাত্মা।

কিছুদিন ধরে খ্রিষ্টানদের মধ্যে এই গির্জার আলোচনা একটু বেশিই হচ্ছে। অবশেষে একটা খবর ছড়িয়ে পড়লো, ঈসা (আ)-এর এক শিষ্য আত্মপ্রকাশ করেছে। মানুষ তো ভয়ে ওদিকে যেতো না। কিন্তু বিভিন্ন চার্চ ও গির্জায় যখন পাদ্রীরাও এ বিষয়ে কথা বলতে শুরু করলো তখন সন্ধ্যার পর লোকজন জটলা। বেঁধে ওদিকে যেতে শুরু করলো।

ওদিকে যখন লোকেরা ভিড় করতে শুরু করলো তখন থেকেই পোড়া গির্জার পাশের একটি গাছে নক্ষত্র চমকে উঠতে লাগলো। সেখানে কিছু স্বেচ্ছাসেবকের মতো লোক দর্শকদেরকে দুই প্রান্তরভাগের মাঝখানে দাঁড় করিয়ে দিতো এবং তাদেরকে বলতো, ভয় পাবে না। তারকা চমকে উঠলে ঈসা মসীহকে স্মরণ করবে।

এমনই এক রাতে লোকদেরকে দুই প্রান্তরভাগের মাঝখানে দাঁড় করিয়ে দেয়া হলো। অন্ধকার রাত। মাঝ রাতের পর চাঁদ উঠবে। লোকজনের সামনে একটি শূন্য প্রান্তর। এর পেছনে উঁচু পাহাড়। পাহাড়ের ওপর ঘন বৃক্ষ লতায় ছাওয়া। এই বৃক্ষ লতায় গন ঝোঁপের উচ্চতায় সেই গির্জা।

ওপরে যাওয়ার একটি রাস্তা আছে অবশ্য। কিন্তু কত যুগ সে রাস্তা ব্যবহার করা হয় না কে জানে। এজন্য রাস্তাটা ঘাস ও ঝাড়ের মধ্যে মুখ লুকিয়ে আছে। পাহাড়ের মাঝখানে কোন কালে ঝর্ণার পানিতে প্লাবিত কোন ঝিল ছিলো। এখন সেখানে কাদাময় চোরা ভূমি এবং পানিও আছে। আর পানিতে আছে কুমীর। লোকজনের সে পথ না মাড়ানোর এটাও একটা কারণ।

এর আশপাশেও গাছপালায় ভরা একাধিক পাহাড় রয়েছে।

লোকজন পাহাড়ের নিচের প্রান্তরে দাঁড়িয়ে আছে। এত অন্ধকার যে, কেউ কাউকে দেখতে পাচ্ছে না। ভিড় থেকে লোকজনের কথাবার্থার মৃদু গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। আচমকা সবাই এমন নিঃশব্দ হয়ে গেলো যেন সব মরে গেছে।

সামনের পাহাড়ের ঢালের একটি গাছের ওপর একটি নক্ষত্র চমকাতে দেখা গেছে। আকাশের নক্ষত্রের মতো সেটা ঝলমল ঝলমল করছে।

আজো কোথাও হযরত ঈসা (আ) বা তার কোন শিষ্যের আত্মপ্রকাশের গুজব শোনা গেলে কোন এক গাছে বিদ্যুৎচমকের মতো নক্ষত্র চমকানোর কথা। অবশ্যই শোনা যাবে।

এনময় গির্জার দিক থেকে কয়েকজন মানুষের সুরেলা আওয়াজ শোনা যেতে লাগলো। কোন প্রার্থনার সঙ্গীত গাইছে তারা। নিঃস্তব্ধ রাতে এই সঙ্গীত সমবেত মানুষের ওপর জাদুর মতো ছেয়ে গেলো। সবাই যার যার বুকে ডান ও বাম হাত রেখে ক্রুশের আকৃতি বানিয়ে এই সঙ্গীত গাইতে লাগলো।

নক্ষত্র স্থির নয়। এদিক ওদিক হেলছে দুলছে। এর আলো সামান্য কিছু জায়গায় ছড়িয়ে পড়ছে।

ক্রুশের পূজারীরা! এক গম্ভীর-ভারী গলার আওয়াজ শোন গেলো, ক্রুশ ও ঈসা মাসীহের অনুসারীরা! আমি পয়গাম নিয়ে এসেছি। আমি আসতেই থাকবো। ধ্বংস তোমাদের দিকে ধেয়ে আসছে। সেটা তোমরা থামাও। সেটা থামানোর শক্তি তোমাদের আছে।….

ঈসা মাসীহের হাত ও পায়ের কাটা যখমে মুসলমানদের আযানের শব্দ নুনের ছিটা দিচ্ছে। হযরত ঈসা (আ) কুষ্ঠরোগীদের আরোগ্য দান করতেন। কিন্তু তিনি কুষ্ঠরোগী বানাতেও পারেন। যারা খ্রিষ্টধর্ম ছেড়ে ধর্মান্তরিত হয়েছে তারা স্বধর্মে ফিরে এসো। না হয় সবাই কুষ্ঠ রোগী হয়ে যাবে।

নক্ষত্র অস্তমিত হয়ে গেলো। আবার সব অন্ধকারে ডুবে গেলো। লোকজনের নিঃশব্দতা আরো গম্ভীর হয়ে গেলো। তারপর ফিসফিসানি শুরু হয়ে গেলো। যেটা বাড়তে বাড়তে গুঞ্জনের রূপ নিয়ে শোরগোলে পরিণত হলো। গির্জার দিকে থেকে আবার আওয়াজ ভেসে এলো,

এখন তোমরা চলে যাও। নিজেদের কাজ কর্মে সতর্ক থেকো, …..আগামীকাল এসো। হয়তো তিনি আবার আত্মপ্রকাশ করতে পারেন।

লোকজন ভয়ে আতংকে নিজেদের বাড়ির পথ ধরলো।

***

গুটি কয়েক মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকার মতো ঘটনা নয় এটি। সেটা তো এক পশ্চাদপদ যুগ। কোথাও শিক্ষার আলো নেই। সাধারণ মানুষ রহস্যজনক ও বিচিত্র সব ঘটনাকে দিনের সূর্যের চেয়ে সত্য মনে করতো। এসব দারুন উপভোগ করতো। যখন পরস্পরকে কোন ঘটনা শোনাতো তখন নিজেদের পক্ষ থেকেও কিছু কাহিনী যোগ করে লোকজনকে শোনাতো।

হযরত ঈসা (আ) এর কোন শিষ্যের আত্মপ্রকাশ এক নক্ষত্রের মাধ্যমে; এমন অলৌকিক ঘটনা যে কেউ দেখতে চাইবে। এর মধ্যে অনেক মুসলমানও রাতে সেই পরিত্যক্ত গির্জা যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে লাগলো।

মসজিদে মসজিদে এ খবর পৌঁছে গেলো। মুসল্লীরা ইমাম ও মাওলানা সাহেবদেরকে জিজ্ঞেস করলো, এ ঘটনা কতটা সত্য?

এটা ভণ্ড খ্রিষ্টানদের বানানো কাহিনী। ধর্মীয় নেতারা তাদের প্রশ্নের উত্তরে বললো, এ ঘটনা সত্য বলে কোন মুসলমান যেন বিশ্বাস না করে। এটা কুফরী। খ্রিষ্টানরা মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত করার জন্য এ অহেতুক, অর্থহীন ও ভিত্তিহীন কাহিনী বানিয়ে গুজব ছড়াচ্ছে।

মসজিদে মসজিদে এ কথা ঘোষণা করে দেয়া হলো।

ইয়াহইয়া ইবনে ইয়াহইয়া সে যুগের একজন বিখ্যাত আলেম ও আইনজ্ঞ। আমীরে উন্দলুস আবদুর রহমান ও প্রধান বিচারপতির ওপর তার তখন একচ্ছত্র প্রভাব। তিনি ফতোয়া দিলেন,

হতে পারে এটা কোন ভেল্কিবাজি; এ ঘটনাকে সত্য বলে মানা এবং এ ঘটনা আবার কখনো ঘটবে তা দেখতে যাওয়া মুসলমানদের জন্য শিরিকী পাপের নামান্তর।

এই ফতোয়া দেয়ার উদ্দেশ্য হলো, কোন মুসলমান যদি অনুসন্ধানী মন নিয়ে সেদিকে যেতে চায় তারা যেন আর না যায়। কারণ, প্রকৃত মুসলমান যার মধ্যে কুরআন হাদীসের জ্ঞান আছে সে তো অবশ্যই এগুলোকে বিস্বাস করবে না। সে অনুসন্ধান চালাতে গিয়ে ভেল্কিবাজি বের করে ফেলবে।

ইয়াহইয়া ইবনে ইয়াহইয়ার ব্যাপারে ইতিহাসে লেখা আছে,

ইয়াহইয়া ইবনে ইয়াহইয়া মালিকী মাযহাবের বড় ফকীহ ছিলেন। তবে দরবারী আলেম ছিলেন তিনি। এ কারণে শাহী খান্দানে ও শাহী দরবারে তার ভীষণ প্রভাব পড়ে। কারণ, উন্দলুসে মালিকী মাযহাবেরই প্রসার ছিলো বেশি। সালতানাতের বড় কোন বিষয় তার পরামর্শ ছাড়া গৃহীত হতো না।…..

আর এই প্রভাব ও মর্যাদাকে ইয়াহইয়া রাজনৈতিক উত্থানের কাজে লাগান। প্রশাসনিক ব্যাপারে তিনি হস্তক্ষেপ করতে থাকেন। আবদুর রহমানের পিতা আলহাকামের যুগে ইয়াহইয়া বড় রাজনৈতিক শক্তি হয়ে উঠেন এবং আলহাকামকে গদিচ্যুত করতে ব্যর্থ হন। তবে আবদুররহমান তার শাসনামলে তাকে বাবার দরবারের আগের পদমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেন।

সালতানাতে উন্দলুসের পতনের ব্যাপারে ইয়াহইয়ার পরবর্তী বংশধররা অতি ঘৃণ্য সব চক্রান্ত চালিয়ে দেশময় বিশৃংখলা সৃষ্টি করে রাখে।

হযরত ঈসা (আ) এর কোন শিষ্য কেন আত্মপ্রকাশ করতে যাবেন? এই ঘটনা কি কোন ভেল্কিবাজি, না এর কোন বাস্তবতা আছে? এসব প্রশ্ন কোন কোন মুসলমানের মনে ঠিকই জাগে। কিন্তু ইহইয়া ও অসচেতন ইমাম ও খতীবদের ফতোয়া তাদের প্রশ্নের সত্যতা যাচাই বাছাই করার ব্যাপারে একেবারেই দমিয়ে রাখে।

সিপাহসালার উবাইদুল্লাহ এখনো কর্ডোভা ফিরে আসেননি। সালার আবদুর রউফ ও প্রধানমন্ত্রী হাজিব আবদুল করীম এ ব্যাপারে কিছুটা আলোচনাও করেছেন।

ব্যাপারটা কি এটা আসলে দেখা উচিত। হাজিব বললেন, খ্রিষ্টানদেরকে উস্কে দিতে ও মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত করতে কোন ভেল্কিবাজিরও আশ্রয় নেয়া হতে পারে!

ব্যাপার যাই হোক, শাহ উন্দলুসের সঙ্গে কথা বলার আগে আমাদের নিজেদের ব্যাপারটা দেখে নেয়া উচিত। সালার আবদুর রউফ বললেন।

খ্রিষ্টানরা এমন ব্যবস্থা করে রেখেছে, পুরো শহর, উপ শহর এবং গ্রামেগ ও এটা ছড়িয়ে পড়ছে যে, আজ রাতে ঈসা মসীহের শিষ্যের দেখা মিলতে পারে।

আবদুল করীমের দুজন বেশ তৎপর ও উদ্যোগী গোয়েন্দা আছে। রহীম গাজ্জালী ও হামিদ আরাবী।

আজ রাতে দলে দলে খ্রিষ্টানরা সেই পাহাড়ি প্রান্তরে যাবেই যেখানে নক্ষত্রের চমক দেখা যায়। রহীম গাজ্জালী ও হামিদ আরাবীও ওদের সঙ্গে গেলো।

এত মানুষের ভিড়ে মনে হয় না কোন মুসলমান আছে। কারণ, মসজিদগুলোতে ঘোষণা করে দেয়া হয়, খ্রিষ্টানদের এসব ভেল্কিবাজি দেখা গুনাহ এবং যে মুসলমানই দেখবে তার অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে।

আজকের রাতটিও অন্ধকার। পাহাড়ের নিচে দুই প্রান্তর ভাগের মাঝখানে অন্ধকার আরো গভীর। সবাই ব্যাকুল হয়ে আছে। ধীরে ধীরে প্রার্থনা সঙ্গীতের গু রণ উঠতে লাগলো। পুরো সমাবেশ নীরব হয়ে গেলো।

একটু পরেই পাহাড়ের উঁচু ঢালুতে নক্ষত্র চমকে উঠলো। বহু কণ্ঠ এককণ্ঠী হয়ে পবিত্র গজল গাইতে লাগলো। এই গজল খ্রিষ্টানরা গির্জায় গেয়ে থাকে।

হঠাৎ নক্ষত্রের চমক অদৃশ্য হয়ে গেলো। তারপর এমন এক চমক সবাইকে চমকে দিলো যে, সবার দম বন্ধ হয়ে এলো। এই চমক পরিত্যক্ত গির্জার মিনারের ওপর দেখা গেলো। যেখানে কাঠের ক্রুশ ঝুলানো থাকে। চমক দৈর্ঘ্যে প্রস্থে দুই আড়াই গজ পরিধির হবে। চমকানো আলোর মধ্যে অনেক বড় ক্রুশ দেখা গেলো এবং এর সঙ্গে ঝুলন্ত হযরত ঈসা (আ)কে দেখা গেলো।

ভিড়ের মধ্যে কান্না ও হেচকি তোলার আওয়াজও শোনা গেলো। আবারো সেই পবিত্র গজলের বহু কণ্ঠী সুর গুঞ্জন করে উঠলো। এবারে আওয়াজে অন্যরকম এক আবেগ ও তরঙ্গ রয়েছে।

দর্শকরা সব হাঁটু মুড়ে বসে পড়লো। সবাই হাত জোড় করে পবিত্র গজল গাইতে লাগলো। রহীম গাজ্জালী ও হামিদ আরাবীর লোমগুলো দাঁড়িয়ে গেলো। ওরা ফিসফিস করে একে অপরকে বলতে লাগলো, এটা ভেল্কিবাজি হতে পারে না।

ওরা এমন প্রভাবান্বিত হয়ে পড়লো যে, ওরাও খ্রিষ্টানদের মতো হাত জোড় করে হাঁটু মুড়ে বসে পড়লো। যেন অদৃশ্য কোন শক্তি ওদেরকে বসিয়ে দিয়েছে।

ওরা খ্রিষ্টানদের গাওয়া গজল বা পার্থনা সঙ্গীত তো জানে না; কিন্তু তবু চুপ থাকলো না। কালেমায়ে তায়্যিবার জপ শুরু করে দিলো।

গজলের গুঞ্জন আস্তে আস্তে থেমে গেলো। তারপর সে চমকও নিভে গেলো যাতে হযরত ঈসা (আ)-কে দেখা গিয়েছিলো।

এই অস্থির-অতৃপ্ত আত্মা তোমাদের সবাইকে সতর্ক করছে, দূর থেকে একটি আওয়াজ ভেসে এলো, তোমাদেরকে সতর্ক করে দিচ্ছে, তোমরা যেন। নিজেদের ধর্ম না ছাড়ো। তোমরা কি জানো না, এই পাপের শাস্তি কি? যে মাটিতে গির্জা পরিত্যক্ত হয়ে যায় সে মাটিতে মানুষ আবাদ থাকতে পারে না। শুধু ধ্বংস হয়ে যায়।…..।

সবাই যার যার এলাকার গির্জায় যাও। সেখানে তোমাদেরকে বলা হবে, তোমাদের ওপর কি কি বিপদ আসছে। ঐক্য ও সংহতি দৃঢ় করো। তোমাদের ঐক্যের কাতার বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। যারা মুসলমান হয়ে গেছে তারাও গির্জায় যাও। নিজেদের পাপ মোচনের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো। নিজেদের পবিত্র মাটিতে ঈসা মসীহের নূর ছড়িয়ে দাও।

*****

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *