খাদেমা এসে জানালো যারিয়াব এসেছে। মুদ্দাসসিরার ভ্রু কুচকে উঠলো। ব্যাপার কি এ লোক এখন কেন আসলো? এবং মুদ্দাসসিরার কাছে তার কি দরকার?
তারপরও মুদ্দাসসিরা দরজায় গিয়ে তাকে স্বাগত জানালো।
শাহে উন্দলুসের প্রতীক্ষায় তোমার দিনকাল কেমন কাটছে মুদ্দাসসিরা?
শাহে উন্দলুস নয় আমীরে উন্দলুস বলুন! মুদ্দাসসিরা বললো, ইসলামে কোন বাদশাহ নেই। জনাব যারিয়ার! আপনি তো বড় বিদ্যান, জ্ঞানী। আপনি এতটুকু বুঝতে পারছেন না। একজন আমীরকে কে বাদশাহ বানালো? খলীফাও তো বাদশাহ নন। বাদশাহী তো একমাত্র আল্লাহরই আচ্ছা। আজ হঠাৎ এ দিকে? আবার এ সময়?
যে যারিয়াব যে কোন মানুষের হৃদয়ের মুকুটহীন বাদশাহ ছিলো সে লোকটি মুদ্দাসসিরার কথায় তার স্বপ্রতিভাতা হারিয়ে ফেললো। কেমন নিষ্প্রভ হয়ে গেলো। রূপ ও ব্যক্তিত্ব মুদ্দাসসিরার সুলতানার চেয়ে কম নয়। যারিয়াবের কাছে সুলতানার চেয়ে মুদ্দাসিরাকেই অধিক আকর্ষণীয় মনে হলো।
যারিয়াব যখন এই কামরায় ঢুকে তখন তার হাবভাব ছিলো এমন যেন মুদ্দাসসিরা আমীর উন্দলুসের নয় বরং তারই স্ত্রীদের অতি সাধারণ এক স্ত্রী। আর যারিয়ার এই কামরায় এসে তার ওপর অনুগ্রহ করেছে। কিন্তু মুদ্দাসসিরার সপ্রতিভ ভঙ্গি এবং আত্মবিশ্বাস দেখে যারিয়ার অনুভব করলো, সে নিজে এতো বিশাল কোন ব্যক্তিত্ব নয় যতটা সে নিজেকে মনে করে।
আপনি কি মেহেরবানী করে বসবেন না? মুদ্দাসসিরা বললো।
এখান দিয়ে যাচ্ছিলাম তাই তোমার কাছে একটু বসে গেলাম। যারিয়াব বসতে বসতে বললো।
জনাব যারিয়াব! মুদ্দাসসিরা অকপটে বললো, আপনার বুদ্ধিমত্তা, দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতার সামনে তো আমি কিছুই নই। সূর্যের সামনে সাধারণ প্রদীপ যেমন আমি তেমনও নই। কিন্তু কিছু না কিছু তো অবশ্যই বুঝি। আপনার চোখের ভাষা বলছে, আপনি এখান দিয়ে যাওয়ার সময় এমনি এমনি উদ্দেশ্য ছাড়া এখান দিয়ে আসেননি।…
আপনি আমার কাছেই এসেছেন। বলুন, আমি আপনার কী সেবা করতে পারি? আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। আমি হরমের কোন মেয়ে নই। আমার একজন স্বামী আছে। আমীরে উন্দলুসের স্ত্রী আমি।
যারিয়াব হেসে উঠলো। বললো,
সুন্দরী মেয়েদের কোন পুরুষ এক পলক দেখলেই ওরা মনে করে ভিন্ন দৃষ্টিতে বুঝি ওকে দেখেছে। তুমি এতটুকু ঠিকই বলেছে যে, আমি এমনি এমনি আসিনি। কিছু বলতেই এসেছি। কিন্তু এটা তোমার অমূলক ধারণা যে, তোমার স্বামীর অবর্তমানের সুযোগ নিয়ে অন্য কোন মতলবে তোমার কাছে এসেছি। যারিয়ার কিছুক্ষণ চিন্তা করে তারপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো।
***
সুলতানের সঙ্গে আমার ততটুকুই ঘনিষ্ঠতা রয়েছে যতটুকু রয়েছে তোমার সঙ্গে। অবশ্য তোমাদের দুজনের মধ্যে একটা পার্থক্যও আছে। আমি এটাও বুঝি
এত ভূমিকার কি প্রয়োজন জনাব যারিয়াব? মুদ্দাসসিরা কিছুটা চড়া গলায় বললো, আপনি কেন বলে দিচ্ছেন না, আমার সুলতানা ও আমীরে উন্দলুসের মাঝখানে দেয়াল হওয়া উচিত নয়। সুলতানা বড়ই রূপময় এক কবিতা।…..
সে আপনার গানের স্বপ্নময় কলি। যেই তা শুনে মাতাল হয়ে যায়। আর আমি এক বাস্তব নারী। বাস্তবতা জাদু ও অচৈতন্যকে সমূলে শেষ করে দেয়। আমীরে উন্দলুস আমার স্বামী ঠিক; কিন্তু তিনি আমার মালিকানা ভুক্ত নন। প্রথমে তিনি আমীরে সালতানাত। তারপর কারো স্বামী বা কারো প্রেমিক।…….
তাই সালতানাত, খেলাফত বা প্রশাসনের দায়িত্বের ব্যাপারে তাকে আমি অবহেলা করতে যদি দেখি তাহলে আমার এই দায়িত্ব আমি অবশ্যই পালন করবো যে, আমি তাকে তার দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেবো। তারপরও যদি তিনি তার দায়িত্বজ্ঞানহীনতার মধ্যে ডুবে থাকেন তাহলে তাকে আমার নিজের ওপর হারাম মনে করবো।
যারিয়াবের ওপর সুলতানা ও মদের যে নেশা ছিলো সেটা এতক্ষণে অনেকটাই নেমে গেছে।
আমার মতো সুলতানার ওপর এমন কোন দায় দায়িত্ব নেই। মুদ্দাসসিরা আবার বললো, সে তো আপাদমস্তক ভোগ বিলাসের এক প্রতিমূর্তি। ভোগ মত্ততার বড় মায়াবী এক উপকরণ সুলতানা।
আর এটাই তার শক্তি। যারিয়াব বললো, ওর রূপ এক বিধ্বংসী অস্ত্র। সে যে ফেতনা ফাসাদ সৃষ্টি করতে পারবে সেটা তুমি পারবে না। তোমার ব্যক্তি-সত্বার ওপর আমার বেশ আগ্রহ বা দুর্বলতা রয়েছে। আমি যেটা বলতে এসেছি সেটা হলো, সুলতানার সঙ্গে শত্রুতা রাখার মতো ঝুঁকি তুমি নিয়ো না।..
সুলতানা চায়, আমীরে উন্দলুস যেন যুদ্ধের ময়দানে ময়দানে এভাবে ঘুরে না বেড়ান। তিনি ফ্রান্সের ওপর হামলার জন্য ফৌজ পাঠাচ্ছিলেন। এখানে তাঁর প্রশাসনিক বহু কিছু দেখার ছিলো। আর সে মুহূর্তে তুমি তাকে এমনভাবে উস্কে দিয়েছে যে, তিনি ফৌজের নেতৃত্ব নিজ হাতে নিয়ে নিয়েছেন এবং চলে গেছেন। আমরা তাঁকে জীবন্ত দেখতে চাই।
***
আমি আমার স্বামীকে সে অবস্থায় জীবিত দেখতে চাই না যে, আমাদের ফৌজ ফ্রান্স, গোথাক মার্চ ও শত্রুদের সম্মিলিত বাহিনীর বিরুদ্ধে জীবন মরণ লড়াইয়ে আহত নিহত হতে থাকবে আর আমার স্বামী রাজ মহলে এক গায়কের গানে ও এক রূপসীর রূপে অচেতন হয়ে পড়ে থাকবে।
মুদ্দাসসিরা তেজদীপ্ত গলায় বললো, মুসলিম মেয়েদের কাছে নিজেদের প্রিয়জন নয়। আপন জাতির ইজ্জত সমই সবচেয়ে মূল্যবান বিষয় হয়ে থাকে।
মুদ্দাসসিরা! যারিয়াব বললো। আমি তোমার এই আবেগ অনুভূতিকে মন থেকে সম্মান করি। আমি বলতে চাচ্ছি, আমাদের কাছে বড় বড় এবং দুর্ধর্ষ বহু সালার জেনালের আছে। উবাইদুল্লাহ ইবনে আব্দুল্লাহকে তুমি কী মনে করো? তিনি কি আমীরে উন্দলুসের নেতৃত্ব ছাড়া নিজে ফৌজের নেতৃত্ব দিতে পারবেন না? অবশ্যই পারবেন।
সালার মূসা ইবনে মুসা, সালার আব্দুর রউফ, সালার ফারতুন ঐতিহাসিক সব লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাহলে এসব অভিযানে আমীরে উন্দলুসের যাওয়ার কী প্রয়োজন?
যারিয়াব কথা বলছে আর মুদ্দাসসিরা উঠে কামরায় পয়চারী করছে। তার চলনে অভিব্যক্তিতে সমীহ পাওয়ার মতো অসাধারণ এক ব্যক্তিত্ব ফুটে উঠেছে। সে পায়চারী করতে করতে একেবারে যারিয়াবের কাছে চলে এলো। যারিয়াবের ওপর একটু ঝুঁকে আবার সোজা হয়ে নিজের জায়গায় গিয়ে বসলো।
আপনার শ্বাস-প্রশ্বাস থেকে মদের কুট গন্ধ বেরোচ্ছে। আর আপনার শরীর থেকে আসছে সুলতানার সুগন্ধি। মুদ্দাসসিরা মুচকি হেসে বললো, যে কথা আপনি আমাকে বলতে এসেছেন সেটা সুলতানার নিজের এসে বলা উচিত ছিলো। কিন্তু সে আসবে না। ওর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। আপনি এক মহান মানুষ। আল্লাহ তাআলা আপনাকে অনেক উঁচু আসন দিয়েছেন। কিন্তু এক নারীর রূপযৌবন আপনার বুদ্ধিবলের ওপর পর্দা ফেলে রেখেছে।…..
মুহতারাম যারিয়ার! আপনি তো আপনার কথা বলেছেন। এখন আমার জবাব শুনুন। সুলতানার মতো আমার আমীরে উন্দলুসের মন জয় করার প্রয়োজন নেই। আমার প্রতি তার ভালোবাসা না থাকলে আমাকে তিনি বিয়ে করতেন না। হেরেমের অন্যান্য মেয়েদের মতো বা সুলতানার মতো বৈবাহিক সম্পর্ক ছাড়া বা রক্ষিতা বানিয়ে রাখতেন।….।
এই একজন মানুষের সঙ্গেই শুধু আমার সম্পর্ক নয়, পুরো মুসলিম জাতির সঙ্গেই আমার প্রাণের সম্পর্ক রয়েছে। উন্দলুসে যে একের পর এক বিদ্রোহ হয়ে আসছে এর পিছনে ফ্রান্সের শাহলুই এবং আলফাঁসের হাত রয়েছে। এরা ইসলামকে সমূলে উৎখাত করতে চায়। মারীদায় এরা তখন বিদ্রোহ করিয়েছে যখন আমাদের ফৌজ ফ্রান্সের ওপর চূড়ান্ত এক হামলা করতে যাচ্ছিলো। এটা ছিলো পরিস্কার এক ষড়যন্ত্র।
ঐ কাফেররা মারীদার বিদ্রোহ উস্কে দিয়ে ফ্রান্সকে বাঁচিয়ে নিয়েছে। এখন শাহ লুই ও আলফাসো মারীদায় ব্যর্থ হওয়ার মূল্য ঠিকই উন্দলুসের খ্রিষ্টানদেরকে কড়ায় গন্ডায় উসুল করার ব্যবস্থা করে দেবে। অন্য কোথাও বিদ্রোহ করাবে। আমার নজর তো এসব অবস্থা ও পরবর্তী পরিস্থিতির ওপর।
নিজের ব্যক্তিগত অবস্থঘার ওপরও একটু খেয়াল রাখে মুদ্দাসসিরা! যারিয়াব বললো।
মুহতারাম যারিয়াব! মুদ্দাসসিরা বললো, আমার মনে আপনার যে একটা সম্মানজনক আসন আছে সেটাকে আপনি ক্ষতবিক্ষত করছেন। আমি বলেছিলাম, আপনার মুখ থেকে মদের ও শরীর থেকে সুলতানার আতরের গন্ধ আসছে। আর আপনার কাঁধে লম্বা এক চুল দেখা যাচ্ছে যা কাঁধ থেকে নিয়ে আপনার বাহু জড়িয়ে আছে। যেন সুলতানা আপনাকে জড়িয়ে রেখেছে। এটা কি সুলতানার মাথার চুল নয়?
যারিয়ার চমকে উঠে প্রথমে নিজের ডান তারপর বাম কাঁধে চোখ বুলালো। তার ধবধবে সাদা কাপড়ে বাদামী রঙের লম্বা একটি চুল যেন তাকে ভ্রু কুটি করছে। চুলটি তার আঙ্গুলে পেঁচিয়ে কুন্ডলীর মতো করে মাটিতে ছুঁড়ে দিলো। তার চরম বিব্রত চোখমুখ দেখে মুদ্দাসসিরা আর কিছু বললো না।
তিনি আগামীকাল আসছেন। মুদ্দাসসিরার গলা এখন বেশ ধরা এবং গম্ভীর। তার সঙ্গে আমাদের ফৌজ আসছে। শহীদদের লাশ ও আহত মুজাহিদদের কাফেলাও আসছে। এর মধ্যে অনেক মায়ের সন্তান থাকবে না। অনেক বোনের ভাই, অনেক মেয়ের বাবা এবং বহু নারীর স্বামী থাকবে না। যুদ্ধের ময়দানেই ওরা চির বিদায় নিয়েছে।….
ওরা যখন দুশমনের আঘাতে জর্জরিত হচ্ছে, ওদের লাশ ঘোড়ার পায়ের নিচে পিষ্ট হচ্ছে তখন আপনার মুখ থেকে মদের গন্ধ, আপনার শরীর থেকে আসছে এক নারীর সুগন্ধি এবং আপনার বাহুমূলে সে নারীর অসংলগ্ন চুল। যখন ইসলামের ঝান্ডাধারীরা রক্তে ডুবে যাচ্ছে তখন আপনি রূপ যৌবন নিয়ে খেলায় মত্ত এক নারীর বাহুলগ্ন হয়ে এ চিন্তায় মগ্ন যে, আমীর উন্দলুস কোন্ নারীর দখলে থাকবে।
মুদ্দাসসিরা! যারিয়াব অধৈর্স গলায় অনেকটা ব্যকুল হয়ে বললো। তুমি অনেক বেশি আবেগী। আমি তোমাকে বলতে এসেছিলাম, সে তোমাকে আমীরে উন্দলুসের চোখের কাটা করে তুলবে। ও অনেক কিছুই করতে পারে।
***
এতো ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই আমার মুহতারাম যারিয়াব। মুদ্দাসসিরা বিষণ্ণ হেসে বললো। কী বলতে যাচ্ছেন আমি সেটা বুঝে গেছি। আমাকে আসলে আপনার সরাসরি হুমকি দেয়া উচিত ছিলো। আমাকে কেন সরাসরি সাবধান করে দিচ্ছেন না। আপনাদের দুজনের পরিকল্পিত পথ থেকে সরে না দাঁড়ালে আমাকে মেরে ফেলা হবে।
আসলে সরাসরি হুমকি দিচ্ছেন না একারণে যে, আপনি অনেক বুদ্ধিমান। অনেক বেশি চতুর। ধূর্তও। আপনার মুখের কথায় জাদুর প্রভাব রয়েছে। তাই আপনি বেশ সাজিয়ে গুছিয়ে কথা বলেন। কিন্তু মুহতারাম যারিয়াব! জাদু তার ওপরই প্রভাব বিস্তার করতে পারে যার চরিত্রে ঈমানের দীপ্তি নেই।
যারিয়াব মুদ্দাসসিরার মুখের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকালো। সুলতানার চেয়ে তাকে এখন আরো অনেক বেশি সুন্দরী মনে হচ্ছে। এতো আসলে মুদ্দাসসিরার ভেতরের রূপ-সৌন্দর্য, যার তেজদীপ্ততা যারিয়াব সহ্য করতে পারছে না। এতক্ষণে যারিয়াবের মনে হচ্ছে, সুলতানার কথায় তার মুদ্দাসসিরার কাছে আসা উচিত হয়নি।
কারো ভয়ে আমি ভীত নই। মুদ্দাসসিরা নির্ভয়ে বললো, যে পরিণামের ব্যাপারে আপনি আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন আমি তাতে শংকিত নই। ইসলামের জন্য আমি আমার জীবন উৎসর্গ করে দিয়েছি। সেই আমীর যিনি আমার স্বামী, তার প্রতি আমি সে পর্যন্ত অনুগত থাকবো যে পর্যন্ত তিনি ইসলামের প্রতি অনুগত থাকবেন।………
আপনি অনেক জ্ঞানী মানুষ মুহতারাম যারিয়াব! আপনি নিজেই তো বুঝতে পারছেন। মুসলিম মেয়েরা যদি এভাবে একে একে সুলতানায় রূপান্তরিত হতে থাকে তাহেল সালতানাতে ইসলামিয়া সংকুচিত হতে হতে খানায়ে কাবায় গিয়ে আশ্রয় নেবে। কাবাই তখন ইসলামের এক মাত্র স্মৃতি স্তম্ভ হয়ে থাকবে।….
তারপর একটা সময় আসবে, যখন অমুসলিমরা বলবে, এটা সে জাতির স্মৃতি, যে জাতির মেয়েরা নিজেদের সভ্যতা-সংস্কৃতিকে ছুঁড়ে মেরে উলঙ্গপনাকে বরণ করে নিয়েছিলো।
শালীনতা, নৈতিকতা, পর্দা আর সতীত্বকে বিসর্জন দিয়ে পরপুরুষের আনন্দ- সামগ্রীতে পরিণত হওয়াকে গভ অনুভব করতো। আর ওদের মাতৃজাতি থেকে যে সন্তানদের জন্ম দিয়েছিলো ওরা, ওরা তো আত্মর্যাদাবোধ কী, আত্ম সমকী সে সম্পর্কে সামান্যতম জ্ঞান রাখতো না। আসলে ওরা ছিলো মূর্খ।
তুমি যা বলছো সেটা কী নিজে বুঝতে পারছো মুদ্দাসসিরা?
যিনি আমাকে এসব কথা বলেছিলেন তিনি আমাকে বুঝিয়েও দিয়েছিলেন, মুদ্দাসসিরা বললো, তিনি ছিলেন আমার বাবা। আমার শ্বশুর আলহাকামের যুগে তিনি তুলাইতার যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন।
মুহতারাম যারিয়াব! আপনি আপনাকে আরো কিছু বলতে চাই। আপনি শুধু অসাধারণ একজন সঙ্গীতজ্ঞই নন, আল্লাহ তাআলা আপনাকে আরো কিছু শক্তি-সামর্থও দান করেছেন। যার দিকে আপনি পূর্ণ দৃষ্টিতে দেখেন সে তো পাথর হয়ে যায়। আল্লাহ তাআলা আপনাকে অতুলনীয় জ্ঞান-বুদ্ধি ও দূরদর্শিতা দিয়েছেন।….
আল্লাহ তাআলা যেহেতু আপনাকে অন্যকে জাদুমুগদ্ধ করার বিশেষ প্রতিভা দিয়েছেন তাই সেটা ব্যক্তি স্বার্থের জন্য অন্যের ওপর প্রয়োগ করবেন না। অসাধারণ প্রতিভা, বিচক্ষণতা যখন আল্লাহ তাআলা আপনাকে দিয়েছেন অন্যকে পথভ্রষ্ট করার জন্য সেটা ব্যবহার করবেন না।
আল্লাহ ধন-সম্পদ দিলে অনাথ দরিদ্রকে কীটপতঙ্গ মনে করো না। খোদা শাসন ক্ষমতা দিলে তার বান্দাদেরকে গোলাম মনে করে নিজেদের পায়ের তলায় পিস্ট করো না। আল্লাহ তাআলা ইযযত-সম্মান দিলে অন্যকে তাই হেয় প্রতিপন্ন করতে নেই।
তুমি আমাকে এসব দার্শণিক কথা বার্তা কেন শোনাচ্ছো মুদ্দাসসিরা! যারিয়াব ঝাঝালো কণ্ঠে বললো। আমি তোমাকে জটিল কোন কথা বলিনি। সুলতানার ব্যাপারে তোমাকে সাবধান করতে এসেছিলাম।
আমি তো আপনার চোখে-মুখে যেন চাপা অস্থিরতা আর দ্বিধাদ্বন্দ দেখতে পাচ্ছি। মুদ্দাসিরা হেসে বললো, আমি আপনাকে এ নিশ্চয়তা দিচ্ছি যে, এ ব্যাপারে আমীরে উন্দলুসের সঙ্গে আমি কোন কথাই বলবো না।
আমি তোমাকে হুমকি দিতে আসিনি। যারিয়াব এবার নরম গলায় বললো। আমার মনে আপনার সম্মান সহানুভূতি উভয়টিই আছে। আল্লাহ হাফেজ?
যারিয়াব চলে গেলো।
***
শহরের লোকেরা তাদের ফৌজকে স্বাগত জানানোর জন্য শহর থেকে বেশ দূরে চলে যায়। এর মধ্যে মুসলমান খ্রিষ্টান সবই আছে।
কর্ডোভায় আগেই খবর পৌঁছেছে, মারীদার বিদ্রোহ দমন করে এবং কঠিন যুদ্ধে জয় লাভ করে তাদের ফৌজ আসছে। শহরবাসী উট ও ঘোড়ার ওপর সওয়ার হয়ে শ্লোগান দিতে দিতে তাদের ফৌজের সঙ্গে শহর প্রবেশ করছে।
ফৌজ যখন শহরে প্রবেশ করলো পুরো শহর তাদের প্রশংসায় শ্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠলো। মেয়েরা বাড়ির ছাদে, ব্যলকনিতে, বারান্দায়, চওড়া-কার্ণিশে দাঁড়িয়ে ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে দিচ্ছে।
আমীরে উন্দলুস আব্দুর রহমানের ঘোড়ার পেছনে সুলতানা, শিফা, জারিয়া পৃথক পৃথক ঘোড়ার গাড়িতে করে মহলের দিকে আসছে।
রেওয়াজ অনুযায়ী এই চারজন আমীরে উন্দলুসকে স্বাগত জানানোর জন্য কর্ডোভা শহর থেকে দুই আড়াই মাইল দূরে চলে গিয়েছিলো। যারিয়াব ও অন্যান্য দরবারীরা ঘোড় সাওয়ার হয়ে পেছন পেছন আসছে।
কোন বিশেষ কথা বা বিশেষ ঘটনা? আব্দুর রহমান মুদ্দাসসিরাকে জিজ্ঞেস করলেন।
কিছুই ঘটেনি। মুদ্দাসসিরা আনত কণ্ঠে বললো, দুআ করতে করতে করাতে করাতে দিন কেটে গেছে। ঐ সব গাদ্দারদের নেতা ইউগেলিস, ইলওয়ার ও মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল জব্বার কি ধরা পড়েছে?
হাত থেকে বেরিয়ে গেছে। ওদেরকে গ্রেফতার করাটা এত সহজ নয়। খ্রিষ্টানরা ওদেরকে লুকিয়ে শহর থেকে বের করে দিয়েছে। শহরের অধিকাংশ লোক যদি মুসলমান হতো তাহলে ওদেরকে ধরাটা সহজ হতো। যারিয়ার ও সুলতানা কেমন ছিলো?
ওদের দিকে নজর দেয়ার ফুরসত মিলেনি মুদ্দাসসিরা বললো, আমার মন মগজ সবসময় ছিলো ঐ যুদ্ধের ময়দানে।
যারিয়াবদের ঘোড়া সুলতানার শাহী গাড়ি থেকে সামান্য দূর দিয়ে যাচ্ছে। সুলতানা যারিয়াবের দিকে তাকালো। যারিয়াবও এদিকেই তাকিয়ে আছে। সুলতানা ইংগিতে ওকে তার কাছে ঘোড়া নিয়ে আসতে বললো। যারিয়াব তার ঘোড়া সুলতানার শাহী গাড়ির কাছে নিয়ে গেলো।
দেখছো যাররী? সুলতানা আব্দুর রহমান ও মুদ্দাসসিরার দিকে ইংগিত করে প্রায় ফিস ফিস করে বললো, ঐ শয়তানীটা এখন থেকেই তার কান ভারী করা শুরু করে দিয়েছে। আর তুমি বলছো, ওর পক্ষ থেকে আমাদের জন্য কোন ভয় নেই!
দুজনের কানাঘুষা আব্দুর রহমান দেখতে পেলো না। আব্দুর রহমান নজর এখন মুদ্দাসসিরার দিকে।
বিদ্রোহের আশংকা কি একেবারেই নির্মূল করা গেছে? মুদ্দাসসিরা আব্দুর রহমানকে জিজ্ঞেস করলো।
না! এরা আমাদেরকে উন্দলুস থেকে উৎখাত করতে চাচ্ছে। এজন্য ওরা নজিরবিহীন ত্যাগ তিতিক্ষাও দিচ্ছে। ওরা এত সহজে কাবু হওয়ার নয়।
যদি এখানকার মুসলমানদের মধ্যে এ ধরণের ত্যাগী মানসিকতা গড়ে উঠতো তাহলে তো যে কোন ধরণের ষড়যন্ত্র, বিদ্রোহ বা নাশকতার ঘটনা আগ থেকেই জানা যেতো। মুদ্দাসসিরা বললো।
আমাদের সবচেয়ে বড় আশংকা হলো সেসব মুসলমানের ব্যাপারে, যারা মাত্র কিছু দিন আগে মুসলমান হয়েছে। এরা দুমুখো সাপ। আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় ধোকা। আমীরে উন্দলুস বললেন।
ওরা নিজেদের সুন্দরী মেয়েদেরকে অন্যভাবে ব্যবহার করছে। আপনি অনুমতি দিলে মুসলমান মেয়েদেরকে শহরের ভেতর গুপ্তচর হিসাবে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। গোপনে ওদেরকে সৈনিকি প্রশিক্ষণও দেয়া যায়। মুদ্দাসসিরা বললো।
না।
কেন? আপনি তো আহত সৈনিকদের শশ্রুষা ও তাদের দেখভাল করার জন্যও মেয়েদেরকো কেন অভিযানে নিয়ে যান না। কেন? মুদ্দাসসিরা জিজ্ঞেস করলো।
এতে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা তৈরি হয়। আব্দুর রহমান বললেন এবং শ্লোগানদাতাদের দিকে ঘুরে তাদের উদ্দেশ্যে হাত নাড়তে লাগলেন।
দুই তলার একদালান বাড়ি। দুই তলা হলেও চার তলার সমান উঁচু। বাড়ির দুই তলার এক খোলা জানায়াল একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দারুণ রূপাবর্তী। যৌবনে টাইটুম্বর। জানালা গারদবিহীন। ওদিকে যাদেরই চোখ যাচ্ছে সেই আমীরে উন্দলুস ও তার বাহিনী থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এই মেয়ের ওপরই চোখ আটকে যাচ্ছে।
প্রতিটি বাড়ির জানালা বা ব্যলকনিতে দুএকজন করে নারী দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটির দিকে যার চোখই যাচ্ছে তার চোখ ওখানেই বাঁধা পড়ে যাচ্ছে।
মেয়েটি এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে যেন কোন প্রতিমূতি। নির্বিকার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। যেন কোন কিছুই তাকে স্পর্শ করছে না। অন্যান্য নারীরা আমীরে উন্দলুস ও ফৌজকে দেখে হাত নাড়ছে কিংবা শ্লোগান দিচ্ছে। মেয়েটি যখন আমীরে উন্দলুসকে দেখলো তার দুচোখে ঘৃণা ফেনিয়ে উঠলো।
সে তার কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ পেলো। লোকদের শ্লোগানমুখর ভারি শব্দ, ঘোড়ার খুর ধ্বনি ইত্যাদির মধ্য থেকে তার কানে ভেসে এলো,
ফ্লোরা।
মেয়েটি ঘাড় ফিরিয়ে দেখলো, তার মা দাঁড়িয়ে আছে।
তুমি ফুল ছিটাচ্ছো না কেন? তার মা তাকে বললো, তুমি হাতও নাড়ছে না।
ফ্লোরা! এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে চাইলে ওখান থেকে সরে আসো। তোমার বাবা নিচে দাঁড়িয়ে আছেন। উনি যদি দেখেন তুমি ফুলও ছিটাচ্ছো না এবং শাহে উন্দলুসের উদ্দেশ্যে হাতও নাড়াচ্ছো না তখন উপরে এসে তো উনি কেয়ামত ঘটিয়ে দেবেন।
আমি তো এসব লোকের ওপর আমার থুথুও ফেলতে লজ্জাবোধ করি। ফ্লোরা বললো, এই লোক ও তার ফৌজের ওপর আমি ফুল ছিটাবো কি করে যারা খ্রিষ্টানদেরকে সমূলে হত্যা করে এসেছে। খ্রিষ্টধর্মের নিরাপত্তার জন্য কি ইসলামকে স্পেনের মাটি থেকে আমাদের উৎখাত করার অধিকার নেই?
ভুলে যেয়ো না, তোমার বাবা মুসলমান। ফ্লোর মা বললো, তোমার বাবার যদি সামান্যতম সন্দেহ হয় আমি কেবল নামেই মুসলমান এবং তোমাকে আমি খ্রিষ্ট শিক্ষাই অতি গোপনে দিয়ে এসেছি তাহলে উনি আমাদের দুজনকেই মেরে ফেলবেন।
কেন? ফ্লোরা ঝাঝালো গলায় বললো, আমাকে তাহলে কেন খ্রিষ্টবাদের শিক্ষা দিলে? আর আজ মুসলমানদের ব্যাপারে ঘৃণা প্রকাশ করতে বাধা দিচ্ছো? আমার বাপ যদি তোমার স্বামী না হতো তাকে আমি হত্যা করে ফেলতাম। তিনি তোমার স্বামী এই সত্যটা আমাকে কাটার মতো বিদ্ধ করে যায় প্রতিনিয়ত।….
মুসলমানের মেয়ে হয়েও যে আমি ঈসা মাসীহ এর নামে জীবন বিসর্জন দেয়ার জন্য গোপন সংকল্প করেছি এই সত্য আমি বড় কষ্টে বুকের মধ্যে চেপে রেখেছি। মনে রেখো, আমার জীবন আমি খ্রিষ্টবাদের জন্য ওয়াকফ করে দিয়েছি। আমার বাপের প্রতি তোমার ভালোবাসার দায়বদ্ধতা তোমাকে শিকলে বন্দি করে রেখেছে। কিন্তু আমি স্বাধীন।
হা ফ্লোরা! তোমার বাবার প্রতি এখনো আমার ভালোবাসা রয়েছে। কিন্তু আমি আমার ধর্মের ভালোবাসাও মন থেকে দূর করতে পারিনি। ফ্লোরার মা উদাস গলায় বললো।
***
ফ্লোরার মার বয়স তখন আঠার বছর। উন্দলুসের আমীর তখন আলহাকাম। উন্দলুসের এক উপ শহর ক্যথলিনায় ওরা থাকতো। ক্যথলিনার লোকজনের প্রায় নিরানব্বই জনই খ্রিষ্টান।
এখানকার লোকজন খুব দাঙ্গা-ফাসাদ ও ষড়যন্ত্রপ্রবণ। সৈন্যরা কখনো কখনো ওখানে টহলে যেতো। কিন্তু ক্যথলিনার লোকেরা তিন চারবার অযথাই সেনাদের ওপর অতর্কিতে হামলা চালায়।
ক্যথলিনা এভাবে উন্দলুসের বিরুদ্ধে চক্রান্তকারী ও বিদ্রোহীদের গোপন আড্ডার কেন্দ্র হয়ে উঠে।
মাসরূর নামে এক গোয়েন্দা সোর্স একদিন কর্ডোভার এমন এক তথ্য পাঠায় যে, তথ্যের সূত্র ধরে অনেক বড় মানব- বিধ্বংসী এক ষড়যন্ত্রের মুখোশ উন্মেক্ত করে দেয়। মাসরূর খ্রিষ্টানদের ছদ্মবেশে ধারণ করে তাদের চক্রান্তের খুঁটিনাটি সব জেনে নিয়ে কর্ডোভায় গিয়ে সবকিছু জানিয়ে দেয়। কর্ডোভার প্রশাসন কাল বিলম্ব না করে তখনই এর বিরুদ্ধে এ্যকশনে নামে।
মাসরূর পথ দেখিয়ে সশস্ত্র সেনাদল নিয়ে আসে। ষড়যন্ত্রের আসল হোতাদেরকে গ্রেফতার করে। শহরের প্রতিটি লোকের কাছে তখন একাধিক অস্ত্র ছিলো। ওরা খবর পেয়ে সশস্ত্র হয়ে সেনাদলের ওপর হামলে পড়ে।
সৈন্যরা এ হামলার জন্য প্রস্তুত ছিলো না। ওখানে মেয়েরাও মুসলিম সৈন্যদেরকে বাড়ির ছাদ থেকে পাথর আর জ্বলন্ত অঙ্গার ছুঁড়ে মারতে শুরু করলো। বেশ কিছু সৈন্য এভাবে আহত হলো।
কমান্ডার এ অবস্থা দেখে ফৌজকে হুকুম দিলো, কয়েকটি বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দাও। যাতে এরা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে আত্মসমর্পন করে।
শহরের লোকদের লড়াইয়ের ক্ষিপ্রতা দেখে মনে হচ্ছিলো, এরা বুঝি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নিয়মিত ফৌজ। তখনই ব্যাপারটা পরিস্কার হলো। শহরবাসীর পোষাকে আসলে অসংখ্য ফ্রান্সী ফৌজ লড়াই করছে। যারা আগ থেকেই শহরে এসে গোপন আস্তানা গেড়েছিলো।
মুসলিম ফৌজ যখন কয়েকটি বাড়িতে আগুন লাগানোর হুকুম পেলো তখন তাদের আক্রমণ আরো বেড়ে গেলো। সমানে ওরা আগুন লাগাতে শুরু করলো। অল্প সময়ের মধ্যেই দেখা গেলো, অর্ধেক এলাকা ধাউ ধাউ করে জ্বলছে।
লোকদের তাৎক্ষণিক তৎপরতায় শিশু-বাচ্চারা আগুনের হাত থেকে রেহাই পেলেও নাশকতার কাজে যারা লিপ্ত ছিলো তারা রেহাই পেলো না। সন্ত্রাসী আর চক্রান্তকারীদের অনেকেই আগুনের খেরাক হয়ে গেলো। অধিকাংশ লোকই শহর থেকে পালিয়ে গেলো।
ছদ্মবেশী ফ্রান্সী সৈন্যদের একটাকেও রেহাই দেয়া হলো না।
***
দু তিনদিন পরের ঘটনা। এ অভিযানের সাফল্যের নায়ক মাসরূর শহর থেকে কোন একটা কাজে বের হলো। পাহাড়ি পথ ধরে সে যাচ্ছে। এসময় এক নারী কণ্ঠের চিৎকার ধ্বনি ভেসে এলো। যে দিক থেকে আওয়াজ এসেছে তার ঘোড়ার রুখ সেদিকে করে নিলো মাসরুর। তিন খ্রিষ্টান ঝান্ডা মার্কা লোককে দেখতে পেলো সে।
তিনজন অতি রূপসী এক যুবতীর কাপড় ধরে টানাটানি করছে। তার সম্ভ্রমহানির চেষ্টা করছে। তিন জনের ঘোড়া ওদের পাশেই দাঁড়িয়ে নির্বাক হয়ে এ দৃশ্য দেখছে।
এই তিনজন ফৌজের লোক না হলেও লড়াইয়ে যে বেশ দক্ষতা আছে সেটা দেখেই বুঝা গেলো।
মাসরূর তলোয়ার কোষমুক্ত করে নেয় এবং ওদের দিকে ঘোড়া ছোটায়। তিন জনই রূপসী মেয়েকে বিবস্ত্র করার ব্যাপারে এতই মগ্ন ছিলো যে, এক ঘোড়সাওয়ারের সশব্দে ছুটে আসার কোন শব্দই পেলো না।
ঘোড়া একেবারে ওদের কাছে যাওয়ার পর ওরা টের পেলো। কিন্তু ঘোড় সাওয়ারের তলোয়ারের ফলা ততক্ষণে একজনের বুকে গেঁথে গেছে। মাসরূর তার তলোয়ার বর্শার মতো করে মেরেছিলো।
তারপর মাসরূর ঘোড়া একটু সামনে নিয়ে গিয়ে আবার ঘোরালো। অন্য দুজন মেয়েটিকে ছেড়ে ঘোড়ার কাছে চলে এলো এবং তলোয়ার কোষমুক্ত করে নিলো।
মাসরূর তার ঘোড়া নিয়ে ওদের কাছে যেতেই ওরা ওর ডানে বামে গিয়ে তাকে ঘেরাওয়েরে মতো পরিবেষ্টান করে ফেললো।
মাসরূর একজনকে তো তার তলোয়ার দিয়ে সর্বশক্তিতে আঘাত করতে পারলো। কিন্তু অন্যজন তার পিঠে তলোয়ার দিয়ে এত জোরে মেরে বসলো যে, তার মনে হলো, দেহ বুঝি দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেছে। পড়তেও পড়তেও সে নিজেকে সামনে নিলো।
মাসরূর টলতে টলতে তার ঘোড়া এর কাছে থেকে একটু দূরে নিয়ে গেলো। তারপর দুজনের তলোয়ার পরস্পরের ওপর হামলে পড়লো। মাসরূর তো আগেই মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে। তাই সে ক্রমেই কোণঠাসা হতে লাগলো। মনে হলো তার মৃত্যু অবধারিত।
তারপর ঘোড়া থেকে পড়ে গেলো। সেই সওয়রও ঘোড়া থেকে লাফিয়ে নামলো। ইতোমধ্যে মেয়েটি মৃত খ্রিষ্টানের একজনের তলোয়ার হাতে নিয়ে সে লোকের পিঠের ওপর সজোরে আঘাত করলো।
তিন খ্রিষ্টান জাহান্নামে চলে গেলো। কিন্তু মেয়েটিকে যে বাঁচিয়েছে সে মারাত্মকভাবে আহত। মেয়েটি তার বিশাল উড়নিকে কয়েক টুকরো করে তার বিভিন্ন ক্ষত স্থান বেঁধে দিলো।
ফোঁপাতে ফোঁপাতে মেয়েটি শংকিত কণ্ঠে জানালো, সে একজন খ্রিষ্টান মেয়ে। তার ঘরের লোকেরা কর্ডোভার ফৌজের ওপর বিনা উস্কানিতে হামলা চালিয়ে ছিলো। এ অপরাধে তাদের বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে। সে ছাড়া সেই বাড়ির আর কেউ জীবিত নেই। কর্ডোভার সৈনিকরা তাকে নিঃসঙ্গ-নিরুপায় পেয়েও তার দিকে হাত বাড়ায়নি। তাকে ছেড়ে দেয়।
রাতেই সে তাদের এলাকা থেকে পালিয়ে আসে। কোথায় এসেছে কোথায় আশ্রয় নিয়েছে রাতের অন্ধকারে এর কিছুই সে ঠাহর করতে পারে না
ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে তার রাতটা কেটে যায়। সকালের আলোয় সে দেখতে পায় এই বিজন পাহাড়ি এলাকায় সে একা। উদ্দ্যেশহীনভাবে সে হাঁটতে থাকে আর হু হু করে কাঁদতে থাকে। তারপরই এক সময় হঠাৎ করে এই তিন খ্রিষ্টান পান্ডা তার ওপর এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
***
মাসরূর তাকে তার নাম জিজ্ঞেস করলো।
লিজা আমার নাম। মেয়েটি উত্তর দেয়।
তুমি এখন কোথায় যেতে চাও? মাসরূর তাকে জিজ্ঞেস করে।
কোথায় যাবো এ প্রশ্ন তো আমারও। আমার যে কোন ঠিকানা নেই। লিজা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললো।
তুমি যেখানেই যেতে চাও তোমাকে সেখানে পৌঁছে দেবো।
লিজা একথায় মোটেও ভরসা পেলো না। তার মানসিক আত্মবিশ্বাস একেবারেই ভেঙ্গে পড়েছে। সে মাসরূরের পায়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো।
দয়া করে আমাকে একটা আশ্রয় দিন।
দেখো! আমি একজন মুসলমান। তুমি খ্রিষ্টান মেয়ে। তোমাকে তো আমার সঙ্গে কোথাও নিয়ে যেতে পারি না। বড় জোর তোমাকে কোথাও আমি পৌঁছে দিতে পারি। বলো, তুমি কোথায় যেতে যাও।মাসরূর অসহায় গলায় বললো।
মেয়েটি তবুও জিদ ধরলো। ওকে তার সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে।
আমার কাছে আমার দেহ ছাড়া আর অন্য কিছু নেই। লিজা কাঁদতে কাঁদতে বললো। আমি তোমার সানে এটাই রাখতে পারি। এর বিনিময়ে আমাকে তোমার সঙ্গে নিয়ে চলো। তুমি কোথাও আশ্রয় দিতে না পারলে আমাকে কোন গির্জার পাদ্রীর কাছে হাওলা করে দাও।
তুমি কোন পাপের উপকরণ নও মেয়ে! তুমি এক পবিত্র আমানত। মাসরূর বললো, তুমি অসহায় এবং সঙ্গীহীন মেয়ে। ভয়ে-শংকায় তুমি মরে যাচ্ছে। এ অবস্থায় তোমাকে আমি কোনোভাবেই গ্রহণ করতে পারবো না। তুমি এক অসহায় মেয়ে হয়েও যদি তোমাকে স্বত:স্ফূর্তভাবে আমার হাতে তুলে দিতে তাহলে তোমাকে গ্রহণ করতে পারতাম না আমি। বরং তোমাকে তখন ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করতাম।…….
কিন্তু তুমি এখন নিঃসঙ্গ এবং বিপদগ্রস্ত এক মেয়ে। তোমাকে সহযোগিতা করাও আমার ওপর ফরজ। এখন একমাত্র উপায় হলো, তুমি যদি আমার ধর্ম ইসলাম গ্রহণ করো তাহলেই তোমাকে আমার স্ত্রী হিসেবে আমার সঙ্গে রাখতে পারবো। তবে ইসলাম গ্রহণ করতে হবে তোমার নিজ ইচ্ছায়, স্বত:স্ফূর্তভাবে। নিরুপায় হয়ে ইসলামের প্রতি তুমি মুগ্ধ হলেই তুমি ইসলামে দীক্ষিত হতে পারো না।
লিজা চিন্তায় পড়ে গেলো। কিছুক্ষণ ভাবার পর তার চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। সে বললো,
হ্যাঁ, আমি স্বত:স্ফূভাবেই ইসলাম গ্রহণ করছি এবং তোমার মতো পুরুষের হাতেই আমাকে আমি সানন্দে তুলে দিতে পারি। বরং তোমার মতো পুরুষের স্ত্রী হওয়াটা অনেক বড় ভাগ্যের ব্যাপার। আমার মতো এমন সুন্দরী যুবতী মেয়েকে এভাবে পেয়েও যে নির্লোভ নির্বিকার থাকতে পারে তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ আর কে হতে পারে? যে কোন শর্তে আমি আজীবন তোমার দাসী হয়ে থাকবো।
মাসরূর দেখলো, লিজার গলায় একটা ক্রুশ ঝুলে আছে। সে কুশটাকে হাতে ধরে এক ঝটকায় তার গলা থেকে ছিঁড়ে নিলো। তারপর সেটা দূরে ছুঁড়ে মারলো। লিজা শুধু একবার তার দিকে তাকালো। কিন্তু কিছু বললো না।
মাসরূর বললো, হ্যাঁ, এখন আমার সঙ্গে তোমার যেতে কোন বাধা নেই। চলো।
মৃত তিন খ্রিষ্টানের ঘোড়া ওরা নিয়ে নিলো। লিজাকে একটির ওপর সওয়ার করিয়ে বাকি দুটো সঙ্গে নিয়ে ক্যথলিনার দিকে রওয়ানা দিলো।
ঘোড়ায় চড়ার পর মাসরূরের যখম থেকে আবার রক্ত পড়তে শুরু করলো। তার জ্ঞান হারানোর মতো অবস্থা হলো। ক্যথলিনায় পৌঁছতে বেশি সময় লাগলো না। সেখানে এক শল্যচিকিৎসক তাকে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিলো।
লিজা জন্মগত সূত্রে খ্রিষ্টান ছিলো। খ্রিষ্টান ধর্মের প্রতিও তার পরিবার ছিলো একান্ত অনুগত। কিন্তু হঠাৎ এক ঝড় তার জীবনের সবকিছু উলটপালট করে দেয়।
এক নিরুপায় অবস্থায় স্বধর্ম ছেড়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে এক মুসলিম সেনার স্ত্রী হয়ে যায়। মুসলমান হলেও তার মন থেকে খ্রিষ্টবাদ মুছে যায়নি বরং খ্রিষ্টধর্মের প্রতি সুক্ষ্ম এক টান ক্রমেই বাড়তে থাকে। সঙ্গে এই মাসরূর নামক মুসলিম পুরুষটির প্রতিও তার ভালোবাসা গড়ে উঠে।
যে তার প্রাণ বাজি রেখে তাকে বাঁচিয়েছে তার প্রতি এক ধরণের অদম্য আকর্ষণ শুরু থেকেই গড়ে উঠে। দুই ভালোবাসার টানাপোড়েন তাকে কখনো স্থির হতে দেয়নি। তাছাড়া তার পরিবারের প্রতিটি লোক যে মুসলমানের হাতে আগুনে পুড়ে ভস্ম হয়েছে এই দগদগে ক্ষতও সে কখনো ভুলতে পারেনি।
ক্যথলিনা শহরের লোকেরা এমনকি আট পৌড়ে খ্রিষ্টান মেয়েরাও যে অসংখ্য মুসলমান হত্যা করেছে এটা তার মনে একবারও রেখাপাত করলো না। ইসলাম তার মনে তাই কখনোই স্থান পায়নি। তবে তার মুসলমান স্বামীকে তার হৃদয়ের গভীরেই সে স্থান দিয়েছে।
***
লিজা অবশ্য অনেক চেষ্টা করেছে ইসলামকে মনে প্রাণে মেনে নিতে; কিন্তু সে এটা পারেনি। সে দুমুখো হয়ে রইলো।
এক বছর পর তার একটি মেয়ে হলো। বাবা মাসরূর মেয়ের অন্য কোন নাম রেখেছিলো। সে নাম ইতিহাসের কোথাও পাওয়া যায়নি। মা নাম রাখে ফ্লোরা। তবে বাপ এজন্য কোন প্রশ্ন বা অভিযোগ তুলেনি।
বাপের ধারণা, মা আদর করে তাকে ফ্লোরা ডাকে। ইতিহাসে ফ্লোরা নামেই সে পরিচিত পেয়েছে।
ফ্লোরাকে নিয়ে অনেক ড্রামা-নাটক লেখা হয়েছে। ইংরেজী ও উর্দু সাহিত্যেও মুসলিম শাহজাদা ও সালাররা তার প্রেমে হাবুডুবু খেয়েছে বলে দেখানো হয়েছে। কেউ কেউ তো তাকে কুলুপতরার সঙ্গে তুলনা করেছে।
তবে বাস্তব ইতিহাসের সঙ্গে এ সবের সম্পর্ক কমই। অসংখ্য অমুসলিম ঐতিহাসিক এবং মুসলিম ঐতিহাসিকও লিখেছেন, ফ্লোরা সেই মেয়ে যে ইসলামের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও বিদ্বেষ উস্কে দেয়ার এক অপরূপ দেহসর্বস্ব হাতিয়ার।
যে উন্দলুসের খ্রিষ্টানদের দুমুখো আন্দোলনে নতুন প্রাণের সঞ্চার করে। ফ্লোরা হয়ে উঠে খ্রিষ্টানদের এক উম্মাতাল আদর্শ।
অল্প সময়ের মধ্যে তার জঙ্গী উস্কানিতে হাজারো খ্রিষ্টান অসংখ্য মুসলমানকে হত্যা করতে গিয়ে নিজেরা আত্মহত্যা করে।
ফ্লোরা যখন লিজার গর্ভে তখন এক রাতে লিজা ঘুম থেকে চিৎকার দিয়ে উঠে পড়ে। তার স্বামী মাসরূর তাকে জড়িয়ে ধরে। পবিত্র কুরআন শরীফের একটি আয়াত পড়ে তাকে খুঁকে দেয়। তাকে দিয়েও কিছু পড়ায়।
আগুন লেগে গেছে, আগুন। লিজা দুহাতে তার গাল চেপে ধরে ভীত কণ্ঠে বড় বড় চোখ করে বললো, উঠে দেখো, কেউ ঘরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। মানুষের পোড়া গোশতের গন্ধ পাচ্ছো না তুমি? আহা জ্বলে পুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে।
যখন তার ঘুমের ঘোর কাটলো তখন সে তার স্বামীর কোলে শুয়ে হিচকি তুলে কাঁদছে। মাসরূর তাকে বললো,
গর্ভবর্তী হলে প্রথম প্রথম মেয়েদের অবস্থা এমনই হয়। প্রায়ই দুঃস্বপ্নে তার ঘুম ভেঙ্গে যায়। তখন সে ভয়ে প্রলাপ বকতে থাকে।
ফ্লোরার মা লিজা এই ব্যাখ্যা মেনে নিলো। সে এই স্বপ্ন দেখাকে গর্ভবর্তী জনিত দৈহিক পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়া বলে ধরে নিলো।
এর তিন চার রাত পর সে স্বপ্নে গির্জার ঘন্টা ধ্বনি শুনতে পেলো। ঘন্টা ধ্বনি থেকে কেমন মাতম আর শোকের সুর ভেসে আসছে। এই আওয়াজ থেকে ক্রমেই এক আগুনের শিখা বের হচ্ছে। শিখার আলোয় আকাশ কেমন ধূসর রঙা হয়ে উঠেছে। সেটাও ধীরে ধীরে ক্রুশে রূপান্তরিত হলো।
লিজা আগুনের শিখার দিকে হাঁটা দিলো। হাঁটতে হাঁটতে তার বুকে হাত রাখলো। সেখানে রূপার এক ক্রুশের অস্তি টের পেলো। কুশটাকে সে হাতে নিয়ে পরম মমতায় বুকে চেপে ধরলো।
এ সময় তার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। দেখলো তার একটি হাত তার বুকের ওপর থির থির করে কাঁপছে। সেখানে ক্রুশ নেই।
তার কয়েক মাস আগের কথা মনে পড়লো। তার স্বামী মাসরূর যখন তাকে তিন খ্রিষ্টান গুন্ডাদের হাত থেকে রক্ষা করে তখনই তার গলা থেকে ঝুলন্ত কুশটি খুলে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে। তার কাছে মনে হলো, নিজ হাতেই সে কুশকে অপদস্থ করেছে।
তার সেই স্বামী আজ তার পাশে শুয়ে আছে। এ লোক যদি তাকে জোর জবরদস্তি করে বিয়ে করতো তাকে, তাহলে এই ঘুমন্ত অবস্থাতেই হত্যা করে দিতো। তারপর কোন গির্জায় চলে যেতো। কিন্তু এ লোকের বিরুদ্ধে সে অঙ্গুলিও নাড়াতে পারবে না। তার বিবেকই তাকে সবচেয়ে বড় বাধাটি দিবে।
এখান থেকেই তার ভালোবাসা আর স্বপ্নের জগত দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেলো।
সেদিন থেকে সে সিদ্ধান্ত নেয়, সে মুসলমান নয়, খ্রিষ্টান। তবে তাকে মুসলমানের ছদ্মবেশেই থাকতে হবে। কারণ, সে তার স্বামী মাসরূরকে হারাতে চায় না।
মাসরূরের মতো এমন জীবন সঙ্গি খ্রিষ্টসম্প্রদায়ের মধ্যে পাওয়া বড় দুষ্কর। ওর স্বামী যখন ওকে সামান্য সময়ের জন্যও ভালোবাসে তখন সে সবকিছু ভুলে যায়। তার বিশ্বাস, এমন করে কোন পুরুষ কোন নারীকে মাসরূরের মতো ভালো বাসতে পারবে না।
***
মাসরূর কর্ডোভার গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তা। কাজের জন্য তাকে অধিকাংশ সময়ই বাইরে থাকতে হয়। সে ঘরে থাকলে তো তার স্ত্রী লিজা নামায পড়ে। তার কাছে কুরআন শরীফের শিক্ষা নেয়। কিন্তু সে বাইরে থাকলে লিজা গির্জার ইবাদত করে।
ওদের বাড়ি থেকে সামান্য দূরেই রয়েছে গির্জা। গির্জার ঘন্টা ধ্বনি ভালো করেই শোনা যায়। গির্জার ঘন্টা বাজলে খোলা জানালায় গিয়ে লিজা দাঁড়াতো এবং চোখ বন্ধ করে কল্পনায় সে গির্জায় চলে যেতো।
মাসরূরের দুটি তাগড়া ঘোড়া সবসময় বাড়ির আস্তাবলে থাকে। একটি ঘোড়ার খুঁড়ে কিছু সমস্যা হয়েছে। মাসরূর এক সফরে যাওয়ার সময় লিজাকে বলে যায় কোন সহিসের কাছে যেন ঘোড়াটিকে নিয়ে যায় এবং নতুন খুড় লাগিয়ে আনে।
হাশিম নামে এক লোক কামারের কাজ করে। তলোয়ার, খঞ্জর, বর্শার ফলা ইত্যাদি সে বানায়। সে একজন ভালো সহিসও। মধ্যবয়স্ক। শক্ত-সামর্থ গায়ের গঠন। বেশ সুঠাম দেহী। যদিও কিছুটা খাটো। বেশ মজা করে কথা বলতে পারে। শহরের সবার মধ্যেই তার জনপ্রিয়তা আছে।
লিজা হাশিমের বাড়িতে গেলো ঘোড়া নিয়ে। হাশিম লিজাকে দেখে অমায়িক হেসে চাপা গলায় জিজ্ঞেস করলো, ঈসায়ী?
না। লিজা দ্বিধান্বিত কণ্ঠে বললো।
নও মুসলিম?
হ্যাঁ।
হাশিম ঘোড়া ঠিক করার কাজে লেগে গেলো। কাজও করছে কথাও বলছে। লিজা দেখলো, তার হাতের চেয়ে মুখই চলছে বেশি। দারুণ জমিয়ে কথা বলতে পারে। একটু পরই লিজার মনে হলো, এর কথায় সে দারূণ প্রভাবান্বিত হয়ে পড়ছে। যেন সে তাকে অনেক দিন ধরে চিনে।
ধর্ম সম্পর্কে সে কথা বলছে। যেন সে তার মনের কথাই বলছে। হাশিম কামারের কথায় তার মধ্যে বেশ একটা আলোড়ন অনুভব করলো।
তার ভালবাসা যে এখন দ্বিধা বিভক্ত এটা সে হাশিমকে প্রায় বলেই ফেলছিলো; কিন্তু সে তার মুখের লাগাম টেনে ধরলো। কারণ, হাশিম মুসলমান।
আঠারো বছর তুমি খ্রিষ্টান ছিলে, হাশিম বললো, ভিন্ন এক ধর্ম গ্রহণ করে তোমার কাছে কেমন লাগছিলো? তুমি কি সঙ্গে সঙ্গেই ইসলাম গ্রহণ করেছো?
হ্যাঁ, কেন নয়?
তোমার থেকে আমি কোন গোপন কথা বের করছি না মেয়ে। হাশিম বললো, কঠিন এক অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ছে আমার। আমিও খ্রিষ্টান ছিলাম। যে কোন কারণে আমি মুসলমান হয়েছি। অনেক আগের কথা এটা। মুসলমান তো হয়েছি। কিন্তু খ্রিষ্টবাদকে মন থেকে নামাতে পারছিলাম না। বহু কষ্টে নতুন ধর্ম মন মগজে ঢুকিয়েছি। রাতে চোখ বুজলেই গির্জার ঘন্টা কানে বাজতে থাকতো।
আমি এখন এই অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। লিজা বললো, আমার দুশ্চিন্তা হলো, আমার পূর্ব ধর্মের টান মন থেকে দূর করতে পারছি না।
হাশিম তার স্বামী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলো। মেয়েটি বড় আনকোড়া। এ ধরণের মানুষের পাল্লায় সে কখনো পড়েনি।
তার স্বামী তাকে কোন একদিন বলেছিলো তার পেশা সম্পর্কে যেন কেউ জানতে না পারে। গোয়েন্দা বৃত্তির পেশা সাধারণ মানুষের কাছে গোপনই রাখা হয়। সে গোয়েন্দা হলেও লোকে তাকে সরকারি তথ্যলেখক বলে জানতো।
স্বামীর বারণ এই হাশিমের সামনে এসে ভুলে গেলো। সে বলে দিলো, তার স্বামী সরকারি গোয়েন্দা খ্রিষ্টানদের।
ক্যথলিনিয়ার বিদ্রোহ আমার স্বামীর গোয়েন্দা অভিযানই ব্যর্থ করে দেয়। আমীরে উন্দলুস তাকে অনেক বড় পুরস্কারও দেন। লিজা গর্বিত কণ্ঠে বললো।
এটা কেন বলছো না ক্যথলিনিয়া খ্রিষ্টানদের নির্বিচারে হত্যা ও বাড়ি ঘরে আগুন দেয়ার কাজ তোমার স্বামী করিয়েছে? হাশিম বললো।
এটাই তো হওয়ারই ছিলো। লিজা বললো, সাধারণ খ্রিষ্টানরা ফৌজের বিরুদ্ধে অস্ত্র নিয়ে নেমে পড়েছিলো। মেয়েরাও দালান কোঠার ছাদে চড়ে মুসলিম ফৌজের ওপর জ্বলন্ত কাঠের লাকড়ি ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারছিলো। সঙ্গে সঙ্গে জ্বলন্ত অঙ্গার ও পাথারও নিক্ষেপ করেছিলো। অনেক ফৌজ আমাদের হাতে আহত নিহত হয়। তাহলে কেন ওরা খ্রিষ্টানদেরকে ওপর হামলা চালাবে না?
তুমি তো দেখি মুসলমানদের পক্ষেই বলছে।
***
হ্যাঁ, লিজা বললো, মুসলমানদের বিরুদ্ধে তো আমি কথা বলতে পারি না। কারুণ, তুমিও মুসলমান। তাছাড়া আমার স্বামী আমাকে তিন হিংস্র খ্রিষ্টানের হাত থেকে রক্ষা করেছিলো। তা না হলে ধর্ষিতা হয়ে তাদের হাতে আমাকে মরতে হতো।
লিজা হাশিমকে পুরো ঘটনা শুনিয়ে বললো,
আমার ইযযত-আবরু বাঁচাতে সে তার জীবন বাজি রেখে ওদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো। তারপর যখন আমি নিজে আমার ইযযত তার সামনে পেশ করলাম সে আমার দেহের দিকে চোখ তুলে তাকালো না; আমাকে গ্রহণ করবে তো দূরের কথা। বলতে লাগলো, তুমি তো এখন আতংকগ্রস্ত এক অক্ষম মেয়ে। আমার সঙ্গী হতে চাইলে তোমাকে আমার পরিণয়ে আবদ্ধ করতে পারি। আমি তাকে মন-প্রাণ দিয়ে গ্রহণ করে নিয়েছি।
ও তো মনে হয়ে তোমাকে তার দাসীর চেয়ে বেশি কিছু মনে করে না।
না, তার মনের রানী আমি। আমি স্বপ্ন দেখে ভয় পেলে ও আমাকে বুকের সঙ্গে এমনভাবে চেপে ধরে যেমন শিশু কালে ভয় পেলে মা সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ধরে। লিজা বললো।
স্বপ্নে কেন ভয় পাও? হাশিম জিজ্ঞেস করলো, আমি যখন নতুন মুসলমান হই আমিও স্বপ্নে ভয় পেয়ে যেতাম। প্রথম প্রথম এমনই হয়। দুই ধর্ম নিয়ে মানুষ তখন দিশেহারা হয়ে যায়। আমার মনে হয় তুমি এখন তেমন অবস্থার ভেতর দিয়েই যাচ্ছে।
হ্যাঁ, আমি সে অবস্থার ভেতর দিয়েই যাচ্ছি।
আমার সঙ্গে কথা বলতে অযথা ভয় পেয়ো না। আমি মুসলমান তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু আমি মানুষও। সব মানুষের মনই এক রকম হয়ে থাকে। সে মুসলমান হোক বা খ্রিষ্টান হোক। আমাকে যদি সাধারণ একজন কামারই মনে না করে থাকো তাহলে তোমার মনের দুঃখ আমার সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারো।…..
আমি যদি আমার সম্পর্কে কিছু বলি তাহলে হয়তো তুমি আমাকে বিশ্বাস করবে। ঘর যেমন তোমার জ্বলেছিলো তেমন আমারও জ্বলেছিলো। এটা টলয়টার ঘটনা। তখন বর্তমান আমীরে উন্দলুসের পিতা আলহাকাম ছিলেন আমীরে উন্দলুস।
এটা ৮১৩ খ্রিষ্টাব্দের কথা। টলয়টার খ্রিষ্টানরা বিদ্রোহ করে বসে। আলহাকাম বড় কঠোর হুকুম জারি করেন। সারা শহরে আগুন লাগিয়ে দেন।
ক্যথলিনিয়ায় তোমাদের সঙ্গে যা হয়েছিলো এখানেও তাই হয়। সৈন্যরা শহরের বাড়ি-ঘরগুলোতে আগুন লাগাতে শুরু করলো। আমার ঘরে যখন আগুন লাগাতে আসলো আমি তাদেরকে বললাম, আমি মুসলমান। নওমুসলিম। তারা বললো, তুমি মুওয়াল্লিদ।
মুওয়াল্লিদের অর্থ জানো? আরবী শব্দ। অর্থ দুমুখী। অর্থাৎ যে এক ধর্ম ছেড়ে অন্য ধর্ম গ্রহণ করে; কিন্তু গোপনে পূর্ব ধর্মের প্রতি অনুগত থাকে। আমি সৈনিকদেরকে বললাম, আমার বাড়ি তল্লাশি করে দেখো। কুরআন শরীফ ছাড়া ভিন্ন ধর্মের কোনো চিহ্নও খুঁজে পাবে না।
কিন্তু ওরা আমার কথা বিশ্বাস করলো না। আমার ঘরের বাইরে বিদ্রোহীদের হাতে লেখা একটা লিফলেট পেলো। এতেই ওরা নিশ্চিতভাবে ধরে নিলো আমি শুধু মুওয়াল্লিদই নয়, বিদ্রোহীও।
অনেক নওমুসলিমই মুওয়ালিদ ছিলো এবং এটাও ঠিক যে, ওরাই বিদ্রোহের আগুন উস্কে দিয়েছে। সৈনিকরা আমার ঘরেও আগুন দিলো। আমার স্ত্রী ও দুই সন্তান ঘর থেকে বের হলেও ছুটন্ত ঘোড়ার পায়ের নিচে পড়ে চরমভাবে আহত হয়। পরে আর ওদেরকে মুসলিম ডাক্তাররাও শত চেষ্টা করে বাঁচাতে পারেনি।
ঘর হারা-স্বজনহারা এক নিঃস্ব মানুষ হয়ে গেলাম আমি। তারপর এ আশায় কর্ডোভায় এলাম, কোন হাকিমের মাধ্যমে আমীরে উন্দলুসের দরবারে গিয়ে আমার অসহায়ত্বের কথা জানাবো। তাকে আমি ফরিয়াদ জানিয়ে বলবো, আমার প্রতি জুলুম করা হয়েছে। কিন্তু মহল পর্যন্ত পৌঁছার কোন প্রভাবশালী মাধ্যম আমি পেলাম না।
আল হাকাম ছিলেন বিলাসপ্রিয় বাদশাহ। তার দরবার ভরে থাকতে চাটুকারদের দলে। গায়করা গান করলে তারই প্রশংসাগীত গাইতো। কবিরা কবিতা রচনা করতো তাকে খোদার স্তরে পৌঁছে দিয়ে। প্রজারা বাঁচুক মরুক তাতে তার কিছু আসে যায় না। আমাকে বেঁচে থাকতে হতো। কামারের কাজ জানতাম, তাই এটাই শুরু করে দিলাম।
এখন তোমার অবস্থা কী? তুমি এখন কী চাও? লিজা জিজ্ঞেষ করলো।
দেখো মেয়ে! আমাকে আমার ব্যাপারে বেশি প্রশ্ন করো না। তুমি এক গোয়েন্দা কর্মকর্তার স্ত্রী। তোমার স্বামীর কানে যদি আমার কথা সামান্য পৌঁছে তাহলে আমাকে গ্রেফতার করা হবে।……..
চার দিকে চক্রান্ত ও বিদ্রোহ দানা বাঁধছে। যাকেই সামান্যতম সন্দেহ হয় তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। একটা কথা মনে রেখো, তোমার স্বামীর গোয়েন্দার কথা আমাকে বলে তুমি খুব ভুল করেছে। গোয়েন্দারা নিজেদেরকে পর্দার আড়ালে রাখে।….
তুমি আমাকে তোমার স্বামী সম্পর্কে বলে দিয়েছো খবরদার সেটা কিন্তু তাকে আবার বলতে যেয়ো না। অন্য কাউকেও জানাবে না এসব কথা। আমি তোমাকে বলছিলাম, সেসব কথা তোমার স্বামীকে বলতে পারছে না সেগুলো আমাকে বলতে পারো। তোমাকে আমি আমার মেয়ে বা বোনের মতোই দেখবো। আমি যেহেতু ক্ষত-বিক্ষত মনের মানুষ তাই তোমার মনের দুঃখ আমিই বুঝতে পারবো।
তুমি তো আবার আমার স্বামীকে বলে দিবে না তার ব্যাপারে তোমার সঙ্গে আমি আলাপ করেছি?
না, আমি তোমাকে ধোঁকা দেবো না। তোমাকে আমি পরামর্শ দিচ্ছি, তুমি নিয়মিত আমার কাছে আসা যাওয়া করো। আমি একাই থাকি। দুনিয়ায় আমার আর কেউ নেই। সত্য বলতে কি আমার কোন ধর্মও নেই।
মুসলিম সেনারা আমার সঙ্গে যা করেছে তা হয়তো আমি কোন দিন ভুলতে পারবো না। দেখা যায়, ধর্মের সব বাধ্যবাধকতা প্রজাদের জন্যই। শাসকরা এ থেকে নিজেদেরকে মুক্ত-স্বাধীন রাখেন। মুসলমানদের মধ্যে এখন এসবই ঘটছে। উন্দলুস বিজয়ীরা বলেছিলো, ইসলামকে পুরো ইউরোপে ছড়িয়ে দেবে। কিন্তু এখন এরা উন্দুলুসেও টিকতে পারে না।
লিজা তার ঘরে ফিরলো এই অনুভূতি নিয়ে হাশিম শুধু কামার নয়, তার কাছে এমন কিছু আছে যা সাধারণ মানুষের মধ্যে নেই।
***
উন্দলুসের প্রায় সব ঐতিহাসিকদের লেখাতেই হাশিমের উল্লেখ আছে। মধ্য অবয়বের লোক হলেও তার মা ছিলো বেশ উচ্চ বুদ্ধির। সে প্রথমে মুওয়াল্লিদ ছিলো না। তবে মুসলমানদের অনৈসলামিক কার্যকলাপ তাকে ইসলাম থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।
তার কাছে খ্রিষ্টান মুসলমান সব ধরণের ক্রেতাই আসতো।
সে বেশ কিছু খ্রিষ্টানের সঙ্গে ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে নেয়। তাদেরকে নিয়ে সে এক গোপন দল গড়ে তুলে। এরা ক্রমেই মুওয়ালিদ আন্দোলনকারীদের অন্যতম বাহুতে পরিণত হতে লাগলো।
হাশিম তার দলের প্রত্যেক সদস্যকে লিজার স্বামী সম্পর্কে সতর্ক করে দিলো। তার কাছ থেকে দূরে থাকতে হবে। না হয়, যে কোন সময় ধরা পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
লিজা এখন নিয়মিতই হাশিমের ওখানে যাচ্ছে। সে একদিন হাশিমকে বললো,
আমার স্বপ্ন শুধু স্বপ্নই নয়, এটা বড় স্পষ্ট এক ইশারাও।
হ্যাঁ, এটা সত্যিই এক খোদায়ী ইশারা। তবে তোমার স্বামী যেন টের না পায় যে, তোমার মনে ইসলামের কোন ভালোবাসা নেই। হাশিম বললো, তুমি এখন আর এই স্বামী থেকে মুক্ত হতে পারবে না। মুক্ত হতে চেষ্টা করলে মারা পড়বে।
আমি আমার স্বামী থেকে মুক্ত হতেও চাই না। লিজা বললো। খ্রিষ্টবাদকে আমি যতটুকু ভালবাসি, মাসরূরকেও আমি ততটুকুই ভালোবাসি। আমি আমার স্বামীর সঙ্গে থেকেই খ্রিষ্টবাদের জন্য কিছু একটা করতে চাই। নইলে এই স্বপ্ন আমাকে পাগল করে দেবে।
তুমি তোমার সন্তান জন্ম দিতে যাচ্ছে। সে মেয়ে হোক ছেলে হোক, যেভাবেই হোক লুকিয়ে ছাপিয়ে ওকে ঈসায়্যিাতের শিক্ষা দেবে। হাশিম গম্ভীর গলায় বললো, ওর মনে মুসলমানদের বিরুদ্ধে চরম ঘৃণা সৃষ্টি করে দেবে এবং তাকে সব ধরণের স্বাধীনতা দেবে। তবে এরপরে কোন সন্তান জন্মালে তাকে আবার এ শিক্ষা দেয়ার ঝুঁকি নেবে না। তাহলে ওর বাবা সেটা জেনে যাবে। সেটা নিশ্চয় তোমার জন্য ভয়াবহ ব্যাপার হবে।….
যে সন্তানকে তুমি খ্রিষ্টবাদের শিক্ষা-দীক্ষা দেবে সে নিজের রাস্তা নিজেই তৈরি করে নেবে। সেটাই তোমার মনের প্রশান্তির খোরাক জোগাবে।..
তুমি কিছু করতে চাইলে এটা করতে পারো তোমার স্বামীর কাছ থেকে যতটা পারো গোয়েন্দা তথ্য কলা কৌশলে জেনে নিতে পারো। ওকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে যাও। আমাদের ব্যাপারে কোন তথ্য যদি জানতে পারো সেটা যত দ্রুত সম্ভব আমাদের কানে পৌঁছে দেবে।
লিজার স্বামী মাসরূরের মতো এমন অভিজ্ঞ গোয়েন্দা- যার দৃষ্টি মাটির গভীরতাকেও ভেদ করে যেতো তারও এতটুকু সন্দেহ হলো না যে, তারই ঘরে তারই ভালোবাসার পর্দার আড়ালে ইসলামের এক চরম ঘাতিনী-কালনাগিনী পরিপালিত হচ্ছে।
ফ্লোরার জন্ম হলো! তার বাবা যে তার ইসলামী নাম রেখেছিলো সেটা ইতিহাসের কোথাও পাওয়া যায় না। তার মা-ই তার নাম রাখে ফ্লোরা। ফ্লোরা যখন কিছুটা বুঝতে শিখলো তখন থেকেই তার মা তাকে বুঝাতে শুরু করলো, সত্য ধর্ম একমাত্র ঈসা মাসীহের ধর্ম। আর ইসলাম কোন ধর্মই নয়।
ফ্লোরার এক বছর হতেই তার আরেকটি ভাই হলো। তার নাম রাখা হলো বদর। বদর শৈশব থেকেই তার বাবার প্রভাব গ্রহণ করা শুরু করলো।
তের চৌদ্দ বছর বয়সে ফ্লোর মন মুসলমানদের বিরুদ্ধে এমন ঘৃণা পূর্ণ হয়ে গেলো যে, সে তার বাপকে বাপ এবং ভাইকে ভাই মনে করা ছেড়ে দিলো।
খ্রিষ্টান মায়েরা তাদের সন্তানদেরকে খ্রিষ্টানদের ওপর মুসলমানদের অত্যাচারের আজগুবি গল্প-কাহিনী শোনাতো। ফ্লোরার মা লিজা এগুলো শোনাতো তার মেয়েকে।
তবে মা ফ্লোরাকে বাইরে বের হতে দিতো না। ভয় হলো, সে তার মার দুমুখো মুখোশের কথা ফাঁস করে দিবে।
ফ্লোরা এখন আঠার বছরের আগুন ধরা অতি রূপবর্তী এক মেয়ে। খোলা জানালায় দাঁড়িয়ে আমীরে উন্দলুস আব্দুর রহমান ও তার ফৌজের বিজয় রথ দেখছে। বহু লোকের দৃষ্টি ফ্লোরার রূপসী মুখে আটকে গেছে।
তার চোখে ঘৃণা আর ক্ষোভ গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। মা তাকে বারবার বলছে। সে যেন অন্যান্য মেয়েদের মতো নীচে ফুল ছুঁড়ে দেয়, হাত নাড়ে। ফ্লোরা মায়ের কথায় তার দিকে আগুন চোখে তাকালো। সব রাগ ঘৃণা মায়ের ওপর ঢেলে দিয়ে বললো,
যারা মারীদার খ্রিষ্টানদের পাইকারী দরে হত্যা করেছে তাদের ওপর আমি ফুল বর্ষণ করবো?
তোমার রাগ নিয়ন্ত্রণে আনতে চেষ্টা করো ফ্লোরা। মা বললো।
মা! আমি আর এখন এই ঘরে থাকতে পারবো না। ফ্লোরা জানালার কপাট বন্ধ করতে করতে বললো।
আরে বোকা! তুমি যাবেই বা কোথায়? মা বললো।
কোন গির্জায় চলে যাবো। আমি যদি এই বাড়িতে থাকি তাহলে যেকোন সময় আমার বাপ-ভাইকে হত্যা করে ফেলবো। ফ্লোরা বললো উত্তেজিত কণ্ঠে।
মা তার মুখে সজোরে চড় মারলো এবং বললো,
আমি তোকে খ্রিষ্টবাদের শিক্ষা কি এজন্য দিয়েছি যে, তুই তোর বাপ-ভাইকে কতল করার কথা মুখে আনবি।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, ফ্লোরা ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বললো, এ শিক্ষা আমাকে তুমিই দিয়েছে যে, মুসলমানরা অতি হিংস্র এবং লুটেরা। ওরা খ্রিষ্টানদের চির শত্রু।
মায়ের দুচোখ অশ্রুতে ভরে গেলো। নিজের ভুলের উপলব্ধি তার একটু একটু করে অনুভূত হতে লাগলো।
আমি তো তোকে খ্রিষ্টান এজন্যই বানিয়েছি যে, তোকে কোন খ্রিষ্টান ছেলের হাতে গোপনে তুলে দেবো। সে তোকে বিয়ে করে পালিয়ে যাবে। মা বললো, আমি তো শুধু আমার এক সন্তানকেই খ্রিষ্টান বানাতে চেয়েছিরাম। আর তুই তো আমাকে তোর বাপ থেকে চিরতরে বিচ্ছিন্ন করে ছাড়বি।
আমি খ্রিষ্টান মা! খ্রিষ্টান আমি। এটা মুসলমানের বাড়ি। এই বাড়িকে আমি ঘৃণা করি। ফ্লোরা বললো উত্তপ্ত কণ্ঠে।
এসময় কামরায় এক পুরুষ কণ্ঠের গর্জন শোনা গেলো, কি বললি তুই? তুই খ্রিষ্টান?
মা মেয়ে চমকে উঠে দরজার দিকে তাকালো। সেখানে ফ্লোরার ছোট ভাই বদর দাঁড়িয়ে ফনা তোলা সাপের মতো ফুঁসছে। সে যে সিঁড়ি ভেঙ্গে ওপরে এসেছে সেটা মা মেয়ে কেউ টের পায়নি। সে মায়ের কোন কথা শুনতে পায়নি। ফ্লোরার কথা আমি খ্রিষ্টান শুধু এতটুকুই শুনেছে।
বদরের বয়স সতের বছর। এই বয়সেই বাপের মতো বিশালকায় হয়ে উঠেছে। দেখতে বেশ তাগড়া সুদর্শন যুবক। সে মা ও মেয়ের মাঝখানে এসে দাঁড়ালো।
ও অন্য কারো কথা বলছিলো বেটা! আমি তোমাকে বলছি। মা বদরকে বললো।
আমি ওকে বলছি ফ্লোরা বললো, তুমি মিথ্যা বলছো মা? সে বদরের দিকে ফিরে বললো, আমি সত্যিই খ্রিষ্টান। আমি আমার ধর্মের হত্যাকারীদের ধর্ম কখনোই গ্রহণ করতে পারবো না।
একথা বলে ফ্লোরা ইসলামের বিরুদ্ধে অতি অপমানসূচক কিছু কথা বলে ফেললো। বদর রাগে লাল হয়ে উঠলো। ফ্লোরার মুখে এত জোড়ে চড় বসিয়ে দিলো যে, সে ছিটকে গিয়ে ঘরের দেয়ালের সঙ্গে ধাক্কা খেলো এবং পড়ে গেলো।
মেয়েদের মতো ইনিয়ে বিনিয়ে কান্নাকাটি বা অভিমান কিছুই করলো না সে।
ফ্লোরা সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালো এবং অন্য কামরার দিকে দৌড়ে গেলো। সে কামরার একটি তলোয়অর ও দুটি বর্শা রাখা আছে।
বদর ও তার পিছু পিছু সে কামরায় ছুটে গেলো। ফ্লোরা খাপ থেকে তলোয়ার বের করছিলো। বদর তার হাত থেকে তোয়ার কেড়ে নিয়ে এমন শক্ত পিটুনি দিলো যে, ফ্লোরা খাটের ওপর গড়িয়ে পড়লো। মা ও ফ্লোরার আরেক বোন যার বয়স পনের, দুজনে মিলেও বদরকে নিরস্ত্র করতে পারলো না। ফ্লোরা প্রায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে রইলো। তার মা হাউমাউ করে তার ওপর গড়িয়ে পড়লো।
***
বদর তার মাকে সেখান থেকে টেনে তুললো এবং মাকে নিয়ে কামরা থেকে বেরিয়ে এলো। তারপর দরজায় শিকল চড়িয়ে দিলো। অন্য ঘরে গিয়ে মাকে সামনে বসালো।
মা! খ্রিষ্টবাদের ব্যাপারে ওর মনে এমন গোঁড়ামি কোত্থেকে আসলো? বদর জিজ্ঞেস করলো, তুমি নিশ্চয়ই জানো মা! মা মেয়ের সবকিছুই জানে।
বদর তার বোনকেও জিজ্ঞেস করলো,
তুমি কিছু বলতে পারবে?
ওর ছোট বোন কিছুই জানে না বলে বললো। মাও একই জবাব দিলো।
তুমি কিছুই জানো না এতটুকু জবাব দিয়েই কি বাবাকে তুমি সন্তষ্ট করতে পারবে মা! বদর বললো, নিশ্চয় গোপনে কোন খ্রিষ্টানের সঙ্গে ওর সাক্ষাত হয়েছে। কোন মুসলমানের সঙ্গে ওর সম্পর্ক থাকলে সে নিশ্চয় বলতো, খ্রিষ্টানদেরকে কেন এভাবে হত্যা করা হয়েছে? আর এটা পাইকারি দরে হত্যা নয়, বরং এটা ছিলো দুপক্ষের যুদ্ধ। ওরা ওদের ধর্মের পক্ষে লড়াই করেছে। মুসলমানরাও নিজেদের ধর্মের পক্ষে লড়াই করেছে।
ওদের কাছে যেমন অস্ত্র আছে তেমনি আমাদের সেনাবাহিনীর কাছেও অস্ত্র আছে। মারীদায় কী হয়েছিলো? তোমার জন্মভূমি ক্যথলিনিয়ার কাহিনী আমাকে শুনিয়েছিলে। ওখানে আগে কারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড শুরু করেছিলো? টলায়টায় কী হয়েছিলো?…..
আমরা মুসলমান মা! মুসলমানের দায়িত্ব হলো, ইসলামকে সবার কাছে বিস্তার করা। পবিত্র কুরআন মুসলমানদেরকে হুকুম দিয়েছে, কুফুরের ফেতনা খতম করতে লড়াই করে যাও যে পর্যন্ত ওদরে তৎপরতা অব্যহত থাকবে।
কান্না ছাড়া ওর মা আর কোন জবাব দিলো না।
আব্লু কাল সকালেই আসছেন। এর আগ পর্যন্ত ও ওখানেই বন্ধি থাকবে। বদর তার মাকে বললো।
সে রাতের ঘটনা। ফ্লোরা সে কামরায় বন্ধ। রাতে ওর ছোট বোন খাবার নিয়ে গিয়েছিলো। ফ্লোরা খাবার খায়নি। সে বলে দেয়, এ বাড়ির খাবার তো দূরের কথা পানিকেও সে হারাম মনে করে। ওর মাও একবার চেষ্টা করে দেখেছে। ফ্লোরা খায়নি।
রাতে সে ঘুমায়নি। মাঝ রাতের দিকে উঠে বন্ধ দরজায় কান লাগালো। সে কামরায় তার মা বোন ও পাশের কামরায় তার ভাই ঘুমুচ্ছে। তাদের ভারি নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে। ফ্লোরা ঘরের জানালার পাল্লা খুললো। পাল্লায় লোহা বা কাঠের গারদ।
এটা দ্বিতীয় তলা। এখান থেকে নিচে নামা ওর জন্য বেশ কঠিন ব্যাপার। জানালা বরাবর সোজা নিচের দিকে একটু পর পর কিছু ইট বেরিয়ে আছে। বাড়তি ইটের মধ্যে পুরো পা রাখা যাবে না। বাড়তি ইটে পায়ের পাতা মাত্র রাখা যাবে।
ফ্লোরার এখন আর মরার ভয় নেই। সে তো মুসলমানদের বিরুদ্ধে জানবাজি রাখার সংকল্প করে নিয়েছে। সে খুব সাবধানে অতি ধীরে ধীরে খাজ কাটা ইটগুলোতে পা রেখে রেখে এবং দেয়ালের খাজে ধরে ধরে নিচের দিকে নেমে যেতে লাগলো।
একেবারে লাগোয়া বাড়িটি এক তলা। সে এবাড়ির ছাদে পৌঁছে গেলো। এখন কাজ হলো এখান থেকে নামা। সে ওপর থেকে বাড়ির উঠানের অবস্থা দেখে নিলো। কাঠের একটি সিঁড়ি রয়েছে। পূর্ণ চাঁদনী রাত। চাঁদের আলোয় এ সিঁড়ি দিয়ে সহজেই নিচে নামা যাবে। তারপর উঠোন পেরিয়ে গেট খুলে বাইরে চলে যাওয়া যাবে।
এই বাড়িতে এক বৃদ্ধ মুসলমান ও তার স্ত্রী এবং তার এক যুবক ছেলে থাকে। ভয় এই যুবক ছেলেটিকে নিয়ে। ফ্লোরা তার জামার নিচে একটি খঞ্জর নিয়ে নিয়েছে। কিন্তু এটা দিয়ে এমন তাগড়া যুবকের বিরুদ্ধে লড়া প্রায় অসম্ভব।
হঠাৎ তার সামনে থেকে মূর্তিমান এক আতংক উঠে আসতে লাগলো। এই যুবক ছেলে সম্ভবত ছাদে কারো পায়ের আওয়াজে জেগে উঠেছিলো। কিংবা বিনা কারণেই হয়তো সে ছাদে আসছে। যুবক সিঁড়ির কাছে আসতেই ফ্লোরা পিছু হটতে গেলো।
কিন্তু যুবক তাকে দেখে ফেললো। যুবকটি এও দেখেছে এ কোন পুরুষ নয়, মেয়ে। সে দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসতে লাগলো। ফ্লোরার মাথাটা ঘুরে গেলো। পালানোর কোন পথ নেই।
আচমকা একটা কথা তার সাহস বাড়িয়ে দিলো। যুবক সিঁড়ি বেয়ে আসছে। ফ্লোরা পা টিপে টিপে দ্রুত সিঁড়ির কাছে চলে গেলো। সিঁড়ির হাতল ধরে মুখ ও মাথা ঝুঁকিয়ে ফিস ফিস করে বললো,
বেশি শব্দ করো না। আমি ফ্লোরা?
ফ্লোরা? নামটা শুনেই লোকটা চমকে উঠলো। এসময় তুমি এখানে কী করছো?
ওপরে এসো বেওকুফ! মুখ বন্ধ রাখো। ফ্লোরা ফিস ফিস করে বললো।
ফ্লোরা জানে সে অসম্ভব রূপবর্তী একটি মেয়ে। এধরনের ছেলেরা তাকে দেখলে আর চোখ ফেরাতে পারে না। এই যুবক তো ওকে এর আগে অনেকবারই দেখেছে। তবে দূরে থেকে।
এই প্রথম ওকে এত কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছে। যুবকের চোখে মুখে চরম ক্ষুধার ভাব ফুটে উঠলো। এই মধ্য রাতে একলা ফ্লোরা তো তার দয়ার ওপরই বেঁচে থাকবে।
কেন এসেছো?
তোমার সাথে দেখা করতে। ফ্লোরা বললো এবং যুবকের ডান হাত তার দুহাতে তুলে নিয়ে চুমু খেলো এবং আবেগী গলায় বললো, নিজের মনে অনেক পাথর চাপা দেয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু তোমার ভালোবাসাকে চাপা দিয়ে রাখতে পারিনি।
এই মাত্র ঘুমে তোমাকে স্বপ্নে দেখেছি। চোখ খুলেই টের পাই ভীষণ ঘাবড়ে গেছি। জানি না কিসে আমাকে ওই জানালা দিয়ে নামিয়ে তোমাদের ছাদের ওপর রেখে গিয়েছে। এসো কাছে এসো।
ফ্লোরার রূপ যৌবনের তীব্র আচ এই উঠতি যুবক কি করে সহ্য করবে। তার সব বোধ বুদ্ধি নিমিষেই উড়ে গেলো। ফ্লোরাকে সে দুহাতে জড়িয়ে ধরলো। ফ্লোরা তাকে বললো,
চলো, বাইরে চলো। আমাদের বাড়ির কেউ জেগে উঠল বড় বিপদ সামলাতে হবে। আর তোমার বাড়ির লোকজনের সামনেও পড়া যাবে না। তাই তাড়তাড়ি চলো।
দুজনে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলো।
যুবক খুব সাবধানে বাড়ির প্রধান দরজা খুললো। তার বৃদ্ধ মা-বাবা মোটেও টের পেলো না। দুজনে বের হয়ে গেলো। সে আগে এবং ফ্লোরা পেছনে।
কোথায় যাবে? যুবক জিজ্ঞে করলো।
ঐ দিকে। ফ্লোরা একদিকে হাত দিয়ে ইঙ্গিত করলো।
যুবক সেদিকে হাটা দিলো। ফ্লোরা তার এক দুই কদম পেছনে। সে খাপ থেকে খঞ্জর বের করে নিলো। তারপর একটু এগিয়ে গিয়ে তার কাঁধে আলতো করে হাত রেখে তার দিকে ঘোরালো। যুবক ভেবেছে, মেয়েটি বুঝি তাকে ভালবেসে তার দিকে আকর্ষণ করেছে। এজন্য সে ফ্লোরার স্পর্শ পেতেই আবেগে চোখ বন্ধ করে ফেললো।
কিন্তু ফ্লোরা বিলম্ব না করে তার কাজ সেরে ফেললো। যুবকটি তার দিকে ঘুরতেই খঞ্জরটি সজোরে তার বুকে বিদ্ধ করে দিলো। এত জোড়ে খঞ্জর তার বুকে বিদ্ধ করেছে যে সেটা টেনে খুলতে ফ্লোরার বেশ জোর প্রয়োগ করতে হলো।
যুবকের মুখ থেকে একটু ভোঁতা শব্দ ছাড়া আর কোন আওয়াজ বেরোলো। সে বুকে হাত রেখে উপুড় হয়ে পড়ে গেলো।
তোমাদেরকে আমি ঘৃণা করি, ঘৃণা… ঘৃণা…।
ফ্লোরা রক্ত ভেজা খঞ্জরটি মাটিতে ঘষতে ঘষতে বললো এবং লাশের গায়ে লাথি মেরে দ্রুত ছুটতে শুরু করলো।
***
আমীরে উন্দলুসের মহলে এই মধ্য রাতেও যেন রাত নামেনি। ভেতরে রঙবেরঙের ফানুস আর চোখ ধাঁধানো আলোক সজ্জা রাতকে দিনে রূপান্তরিত করেছে। প্রথমে তিন কবি পালা করে আমীরে উন্দলুসের নামে কবিতা আবৃত্তি করলো। তাকে সপ্ত মহাদেশের বাদশাহ বানিয়ে দিলো। তার তলোয়ারকে হযরত আলী র. এর তলোয়ারের সঙ্গে তুলনা করা হলো।
বলা হলো, ইহুদী-খ্রিষ্টান তো আপনার সামনে কীটপতঙ্গ ছাড়া আর কিছুই নয়, তাদেরকে আপনি পায়ে পিষ্ঠ করে এগিয়ে চলেছেন দূরন্ত গতিতে।
একজন বললো, আপনার সামনে যে মাথা তুললো তার মাথা ধড় থেকে আলাদা হয়ে গেলো। যদি আপনার প্রতিমূর্তি পেতাম তাহলে আমারা তার ইবাদত করতাম।
তারপর চাটুকার আমীর-উমারারা তোহফা পেশ করলো। তার হাত চুম্বন করলো। কেউ তার জুতাকেও চুমু খেলো। তারপর অর্ধউলঙ্গ নর্তকীরা নৃত্য পরিবেশন করলো। এর সঙ্গে চললো যারিয়াবের উম্মাতাল করা সঙ্গীত।
আব্দুর রহমানের ডান দিকে সুলতানা এবং বাম দিকে মুদ্দাসসিরা বসেছে। তাদের পেছনে অন্যান্য স্ত্রী ও হেরেমের রূপসী কিছু মেয়ে বসে আছে। এই উৎসব সভায় সেনাবাহিনীর সব সালারও আছে। তারা অপলক চোখে তাদের আমীরকে দেখছে। তাদের কাছে মনে হচ্ছে এই আব্দুর রহমান অন্য কোন মানুষ।
এই লোককে আমাদের সবসময় রণাঙ্গনেই ধরে রাখতে হবে। সালার আব্দুর রউফ তার সঙ্গী সালারদেরকে বললেন।
তার মতো ইসলামী সালতানাতের আমীরের এভাবে ভোগমত্ততয়ায় ডুবে থাকা কখনো বৈধ হতে পারে না। সিপাহসালার উবাইদুল্লাহ ইবনে আব্দুল্লাহ বললেন, এসব কবি আর চাটুকাররা এই একজন মানুষের ওপর নিজেদের অসংখ্য শব্দ জাদু দিয়ে নেশাগ্রস্ত করছে আর ইসলামী সালতানাতের শিকড় উপড়ে ফেলছে। তোমরা দেখো গিয়ে আমাদের দুশমনরা পরিকল্পনা করছে, কিভাবে প্রতিশোধমূলক আঘাত হানা যায়। ওরা মদ আর নর্তকী নিয়ে মাতলামি করছে না।
আমার তো মনে হচ্ছে, এবার টয়টায় খ্রিষ্টানরা মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে। সালার মূসা ইবনে মুসা বললেন, এখন থেকেই আমাদের পরিকল্পনা প্রস্তুত করে রাখতে হবে। বিদ্রোহ হলে কী উপায়ে তা দমন করা হবে।
এরা মাথা চাড়া দিয়ে যাতে না উঠতে পারে এর জন্য এখনই ব্যবস্থা নিতে হবে। সিপাহসালার উবাইদুল্লাহ ইবনে আব্দুল্লাহ বললেন, এর একমাত্র উপায় হলো, ফ্রান্সের ওপর হামলা। শাহ লুইকে খতম করা। সেই উন্দলুসের খ্রিষ্টানদেরকে গোপনে মদদ জুগিয়ে যাচ্ছে। সেই উন্দলুসকে খন্ড বিখন্ড করার ঘৃণ্য চক্রান্তের জাল এখানে বিস্তার করে চলেছে। এদেরকে এক জায়গায়, দমন করা হলে আরেক জায়গায় গিয়ে মাথা তুলে।
***
এ দিকে যখন আমীরে উন্দলুসের দরবারে মদমত্ত নতৰ্কীদের উদ্দাম নৃত্য চলছে তখন হাশিম কামারের দরজার কড়া নড়ে উঠলো। হাশিম কামার এখন প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছে গেছে। তবে তার মাথা এখন আরো তীক্ষ্ম হয়ে উঠেছে।
তার গোপন সন্ত্রাসীদল এখন আরো বড় ও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। মারীদার বিদ্রোহ দমনের পরই তার সন্ত্রাসী বাহিনীর এক অংশকে সে টলয়টায় পাঠিয়ে দিয়েছে।
দরজায় আওয়াজ শুনে হাশিম চমকে উঠলো। বিছানার নিচ থেকে খঞ্জর বের করে সাবধানে দরজা খুললো। গভীর রাতে তার দরজায় এক যুবতী মেয়েকে দেখে হকচকিয়ে গেলো।
আমি ফ্লোরা হাশিম! ফ্লোরা একথা বলে ভেতরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে বললো,
পাশের বাড়ির এক মুসলিম যুবককে খুন করে এসেছি। আর ঘর থেকেও পালিয়ে এসেছি। এখন বলো কী করবো?
সে হাশিমকে পুরো ঘটনা শোনালো।
ফ্লোরা বহুবার হাশিমের বাড়ি এসেছে। ওর মা লিজা ওকে এখানে নিয়ে আসতো। ওকে হাশিম খ্রিষ্টবাদের শিক্ষা দিতো এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণার বিষ ঢুকিয়ে দিতো। ওর ভেতরে এখন ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই নেই। আবেগ-ভালোবাসা এসবের যেন অস্তিত্বই নেই ওর ভেতরে। খ্রিষ্টবাদের সাথে ওর সম্পর্ক কোন ভালোবাসার নয়; বরং উন্মাদনার!।
আমি তোমাকে আমার কাছে রাখতে পারবো না। সকাল হতেই এখানে লোকজন বিভিন্ন কাজে আসা শুরু করবে। তোমাকে এক পাদ্রীর কাছে নিয়ে যাবো। তোমার মা তাকে চিনে। চলো। হাশিম বললো।
পাদ্রীর দরজায় শব্দ হলো। পাদ্রী ভয়ে কেঁপে উঠলেন। এত রাতে কে আসতে পারে? মারীদার বিদ্রোহের কারণে খ্রিষ্টান নেতাদের ধড়পাকড় চলছে। কাঁপা হাতে পাদ্রী দরজা খুললেন।
হাশিমকে দেখে পাদ্রী প্রাণ ফিরে পেলো। তার সঙ্গে সুদর্শন এক যুবক। পাদ্রীর অপরিচিত। ভেতরে গিয়ে ফ্লোরা পুরষালী আলখেল্লা খুলে ফেললো। মাথায় টুপি পরা ছিলো সেটাও নামিয়ে ফেললো।
এ হলো ফ্লোরা। হাশিম পাদ্রীকে বললো। এই মেয়ে আজ ওর বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে এবং আসার সময় এক মুসলিম যুবককে কতল করে এসেছে।
হাশিম পাদ্রীকে সেদিনের পুরো ঘটনা শোনালো।
বুড়ো পাদ্রী ফ্লোরার রূপ দেখে কোথায় যেন হারিয়ে গেলেন।
তুমি রূপের এক বিস্ময়কর নমুনা। পাদ্রী বললেন, উন্দলুসের ঐ মুসলিম বাদশাহদের ধ্বংসের ব্যাপারে তুমি তো অনেক বড় অবদান রাখতে পারবে। তুমি সালারদেরকে একে অপরের শত্রু বানাতে পারবে। তোমার একটু মুচকি হাসি মুসলিম সালারদেরকে যুদ্ধের ময়দান থেকে আমাদের কাছে বন্দি করে নিয়ে আসতে পারবে।…
বর্তমান শাহে উন্দলুস আব্দুর রহমান তোমার মতো রূপবর্তী মেয়ে দেখে তো পুরো উন্দলুস মন থেকে দূর করে দেবে। এটা তার এক দারুণ দুর্বলতা। তুমি তার ও সালারদের মধ্যে দ্বন্ধ সৃষ্টি করতে পারবে….। কিন্তু তোমাকে তোমার….
আমাকে আমার সম্ভ্রম বিসর্জন দিতে হবে। ফ্লোরা পাদ্রীর কথা কেড়ে নিয়ে বললো। কিন্তু মনে রাখবেন আমি আজীবন কুমারী থাকতে চাই। আমি মরিয়ম কুমারীর দাসী। আমি জানি, মুসলমান উমারা, রঈস ও ওযীরদের মধ্যে অনেক বড় ত্রুটি হলো, ওরা সুন্দরী মেয়ে দেখলে নিজেদের সব দায়-দায়িত্ব ভুলে যায়। কিন্তু আমি কোন মুসলমানের গন্ধও সইতে পারবো না।
আমাদেরকে ভাবতে দাও ফ্লোরা! পাদ্রী বললেন, এখানে তুমি সব দিক থেকে নিরাপদ থাকবে। মনের উত্তেজনাকে দূর করো। জযবায় উম্মাতাল হওয়া ভালো নয়। তিনি হাশিমকে জিজ্ঞেস করলেন, আর কোন খবর?
লোহা এখনো গরম আছে। হাশিম বললো, আমি লোহার মিস্ত্রী কামার। লোহা কখন শীতল হবে সেই প্রতীক্ষা আমি করি না। উত্তপ্ত থাকতে লোহা দিয়ে যা ইচ্ছা তাই বানানো যায়। মারীদা থেকে অনেক খ্রিষ্টান পালিয়ে টলয়টায় পৌঁছে গেছে। আমার লোকজন ওখানে চলে গেছে। ওরা আমাকে ওদের নেতৃত্ব দিতে চাচ্ছে। আমি ভাবছি।
এত ভাববার সময় নেই হাশিম। পাদ্রী বললেন, পরিকল্পনার সবটাই যেহেতু তোমার, নেতৃত্বও তোমার হওয়া উচিত। আমি জানি, তুমি লড়াইয়ের নেতৃত্ব দিতে পারবে না। কিন্তু যে বুদ্ধিমত্তা ও তীক্ষ্মতা তোমার রয়েছে সেটা আর অন্য কারো মধ্যে নেই।
ভীত সন্ত্রস্ত মানুষের মনোবল ও জযবায় তুমি যেভাবে প্রাণ সঞ্চার করতে পারো সেটা আর অন্য কেউ পারে না। তুমি টয়টা থেকে ঘুরে আসো। ওখানে ইউগেলিস ও ইলওয়ারকে যে কোন ছদ্মবেশে পেয়ে যেতে পারো।
সামান্য কিছু সময় আগে আমার কাছে খবর পৌঁছেছে যে, আমীরে উন্দলুস আনন্দ-উৎসবে মতোয়ারা হয়ে আছে। পাদ্রী বললেন, আর সুলতানা আজ রাতে নতুন শরবতের উপকরণ দিয়ে তাকে প্রথম বারের মতো শরাব পান করাতে যাচ্ছে। আমীরে উন্দলুস অতি ভোগ বিলাস প্রিয়। কিন্তু শরাব পান করে না।
আমাদের দুশ্চিন্তার বিষয় হলো, আমীরে উন্দলুসের ওপর তার সবচেয়ে রূপসী স্ত্রী মুদ্দাসসিরা বেশ প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে। সুলতানা আজ রাতে ঐ বিশেষ ধরণের শরবত পান করিয়ে সেই প্রভাব নামিয়ে ফেলবে।
এই আমীরের ব্যাপারে আমাদের কোন ভয় নেই। হাশিম বললো, আমাদের ভয় হলো ঐ সালারদেরকে নিয়ে। এই সালাররা এমন যে, ওদের সামনে সোনার স্তূপ রেখে দাও, ফ্লোরার মতো সুন্দরী মেয়েদেরকে ওদের শয়নকক্ষে ঢুকিয়ে দাও, ওই হতভাগারা শিলাপাথরের চেয়ে কঠিন হয়ে যাবে। স্বাধীনতার চেতনাকে ওরা ওদের ঈমান বানিয়ে নিয়েছে।
এসব সালারদের মধ্যে যদি সিংহাসন আর নেতৃত্বের লোভ ঢুকিয়ে দেয়া যায় তাহলে ওদের ফৌজকে অল্প সময়েই ময়দান থেকে তাড়িয়ে দেয়া যাবে। পাদ্রী বললেন, কোন সালার যখন সিংহাসনে বসতে পারে তখন সে পুরোপুরি বাদশাহ বনে যায়। নিজের বাদশাহী স্থায়ী করার জন্য শত্রুকেও বন্ধু মনে করে। যা ইচ্ছা তাই করে বেড়ায়। তারপর আর তার কোন ধর্ম বা জাতীয়তাবোধ থাকে না।…
যে কোন জাতিকে ধ্বংস করতে হলে তার নেতা-নেতৃ ও ধর্মগুরুদের মধ্যে হুকুমতের লোভ ঢুকিয়ে দাও। ওরা পরস্পরকে হত্যা করতে দ্বিধা করবে না। তাদের জাতি না খেয়ে মরুক, চরিত্রহীনতার আস্তকুড়ে গিয়ে পড়ক, আত্মমর্যাদাবোধহীন হয়ে উঠুক এতে তাদের কোন মাথা ব্যথা নেই।
এখন এ দিকে মনোযোগ দিন। হাশিম বললো, এখনই আমি টলয়টায় যাচ্ছি। লোহা আরো উত্তপ্ত করে তুলতে হবে। এখন এই মেয়েকে সামলে রাখুন। আমি যাচ্ছি।
***
ফ্লোরার যুবক প্রতিবেশী তো তার ঘরে এসে গেলো। কিন্তু জীবিত নয়। তার লাশ আবাদীর মাঝখানে কোথাও পাওয়া যায়। এক লোক তাকে আবিস্কার করে। তার বুকের মাঝখানে তখন গভীর যখম। সে তোক তার লাশ ঘরে পৌঁছে দেয়।
বৃদ্ধ মা-বাবা তাকে দেখে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। চারপাশের বাড়ি ঘরে গভীর শোক নেমে আসে। কিন্তু কারো সন্দেহেও এটা আসার কথা নয় যে, ফ্লোরা তাকে হত্যা করতে পারে।
পরদিন সকালে ফ্লোরার বাপ ঘরে আসলে বদর তাকে গতকালের সব ঘটনা খুলে বললো, কাল গভীর রাতে ফ্লোরা পালিয়েছে।
ওর এভাবে পথভ্রষ্টতা আর পালানোর ব্যাপারে নিশ্চয় তোমার হাত রয়েছে। ফ্লোরার বাবা তার মাকে বললো। মনে হচ্ছে তুমি মুয়াল্লিদ-দুমুখো। বিশ বছর ধরে আমাকে ধোকা দিয়ে আসছে।
না, না। লিজা হাত জোড় করে স্বামীর পায়ের আছড়ে পড়লো এবং কাঁদতে কাঁদতে বললো, আমাকে এভাবে অপবাদ দিয়ো না। আমি কখনো তোমাকে ধোকা দিতে পারবো না। আমাকে তোমার হাতে কতল করে দাওঃ কিন্তু আমার ভালোবাসা নিয়ে সন্দেহ করো না।
ও মনে হয় খ্রিষ্টান মেয়েদের সাথে উঠাবসা করেছে এবং ওরাই ওর মাথা বিগড়ে দিয়েছে। বদর ওকে জালিমদের মতো অনেক মেরেছে। এজন্যই ও পালিয়েছে। হায় ও না আবার নদীতে ডুবে আত্মহত্যা করে বসে।
আমি ফ্লোরাকে বেশ কিছু দিন থেকে লক্ষ্য করেছি। বাবা মাসরূর বললো, এ মেয়ে আমার অন্য দুই মেয়ে থেকে একেবারেই অন্যরকম। ওকে আমি কখনোই নামাজ পড়তে দেখিনি।
মাসরূর খানিক চিন্তা করে বললো, আমি একজন গোয়েন্দা। আমি জানি সে কোথায় গিয়েছে?
মাসরূর ছেলে বদরকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে গেলো। দুজনে দুই ঘোড়ায় সাওয়ার হলো। তারপর সেনা ব্রাকে গিয়ে সঙ্গে চারজন সেনা সদস্য নিয়ে নিলো। একটু পরই এক গির্জায় রেড করলো তারা। মাসরূর গির্জায় পাদ্রীকে বললো,
গতকাল রাতে আপনার এখানে এক যুবতী মেয়ে এসেছ। ওকে এখনই বের করুন।
আপনি গির্জা ও আমার ঘরে তল্লাশি চালিয়ে দেখুন। কোন যুবতী মেয়ে দিয়ে আমার কী কাজ? পাদ্রী কিছুটা উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন।
পাদ্রীকে সেনা কর্মকর্তারা তাদের হেফাজতে নিয়ে নিলো। তারপর কর্ডোভার আরেকটি গির্জায় গেলো ওরা। কর্ডোভায় তখন দুটি গির্জায় ছিলো। এ গির্জার বৃদ্ধ পাদ্রীকে ফ্লোরা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে পাদ্রী কিছু জানে না বলে জানালেন।
আমরা জানি এসব গির্জা চক্রান্ত আর ষড়যন্ত্রের এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের আচ্ছা ছাড়া কিছুই নয়। ফ্লোরার বাপ বলো।
কিন্তু কোন মেয়ের সাথে তো আমার কোন সম্পর্ক নেই। পাদ্রী ধমকের সুরে বললেন।
ওকে টেনে হেচড়ে নিয়ে চলো। এক ফৌজি কমান্ডার বললো।
দুজনকেই গ্রেফতার করে তাদের হেফাজতে নিয়ে নিলো। দুজনকে যখন ধাক্কা দিয়ে বললো এসো, তখন এক নারী কণ্ঠোর আওয়াজ ভেসে এলো।
আমার ধর্মপিতাকে ছেড়ে দাও। আমাকে গ্রেফতার করো।
সবাই তাকিয়ে দেখলো, ফ্লোরা গির্জার দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। অতি কঠিন সুরে বললো,
উনাদের এই অপমান আমি সয্য করতে পারবো না। আমি নিজেই এখানে এসেছি।
***
বদর ফ্লোরার ওপর টুটে পড়লো। মারতে মারতে আধামরা করে ফেললো। কিন্তু ফ্লোরা কাঁদলো না। চিৎকার করলো না। শুধু বলতে থাকলো,
আমি খ্রিষ্টান। খ্রিষ্টবাদ আমার প্রাণ। আমি কুমারী মরিয়মের দাসী। এসব বলে বলে ইসলামের বিরুদ্ধে অবমাননাসূচক অনেক কিছুই বলে ফেললো।
থামো বদর! ফৌজি কমান্ডার বললো, ধর্ম তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। এ ব্যাপারে শাস্তি দেয়ার বিধান আমাদের এখানে নেই। তবে সে ইসলামের ব্যাপারে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করায় ইসলাম অবমাননার দায়ে সে অপরাধী। তাকে আমরা বিচারকের আদালতে পেশ করবো।
তাকে যখন বিচারকের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হলো তখন সে চিৎকার করে করে ইসলামের বিরুদ্ধে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করতে করতে এক পর্যায়ে বললো,
আমার লজ্জা স্থান থেকে যা বের হয় ইসলাম তার চেয়ে নোংরা?
এজলাসে বসা মুসলমান খ্রিষ্টান প্রত্যেকে ছিঃ ছিঃ করে উঠলো। অনেকে দুআঙ্গুল দিয়ে কান বন্ধ করে বিস্ফোরিত চোখে ফ্লোরার দিকে তাকিয়ে রইলো।
কেউ কল্পনাও করতে পারেনি এমন রূপসী একটি মেয়ের মুখ দিয়ে এমন কদর্য কথা বেরোতে পারে।
বিচারক তখন ফায়সালা শোনালেন,
তুমি মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার উপযুক্ত কাজ করেছে। আর তোমার মতো এমন রূপসী মেয়েকে মুক্ত করে দিলে সেটা অনেক বড় ধ্বংসজ্ঞের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
মৃত্যুদন্ডের কথা শুনে ফ্লোর বাপ মাসরূরের মনে করুণার ঢেউ উঠলো। সে বিচারকের আদালতে আর্জি পেশ করলো,
আদালত যদি তাকে এবারের মতো ক্ষমা করে দেয় তাহলে আমি ওর দায়িত্ব নিতে পারি। এ আমার সন্তান। আমি ওকে সঠিক পথে আনতে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাবো।
আদালত আবেদন মঞ্জুর করছে। বিচারক রায় শোনালেন, তবে এক বছরের জন্য ওকে ঘরের এমনভাবে নজরবন্দি করে রাখতে হবে যেখানে শুধু মহিলারাই প্রহরায় থাকবে। সঙ্গে সঙ্গে তাকে ইসলামের সঠিক শিক্ষা দেয়া হবে।
বিচারকের হুকুম অনুযায়ী ফ্লোরাকে আলাদা এমন এক ঘরে রাখা হলো, যেখানে নিশ্চিদ্র নিরাপত্তা রক্ষা করা যাবে। তিনজন বিশ্বস্ত মহিলাকে ফ্লোরার বাপ ফ্লোরার প্রহরায় নিযুক্ত করলো।
বাপের অতি প্রিয় মেয়ে ছিলো ফ্লোরা। তাকে বাপ বেশ শান্ত মেয়ে মনে করতো। তার মাকে বলতো, মেয়েটি বেশ লাজুক। আমার সাথেও পর্দা করে। বাপ কখনো জানতে পারেনি, মা তার বাচ্চাকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে এক রূপসী কালনাগিনীরূপে গড়ে তুলছে।
বিচারককে মৃত্যুদন্ডের কথা শুনে ফ্লোরার বাপের মনে হলো, তার কলিজার একটি টুকরো কেউ কেটে নিয়েছে। মাসরূর ছট ফট করে উঠলো। সবচেয়ে আঘাত পেলো মাসরূর তার মনে। যে মেয়েকে এমন লাজুক, আর নিষ্পাপ মনে করতো, যাকে অন্যান্য সন্তানদের তুলনায় অধিক ভালোবাসতো সে মেয়ে এত বড় ইসলামের শত্রু!
তার মতো এমন বিচক্ষণ এক মুসলিম গোয়েন্দার কোলে এতদিন ধরে লালিত-পালিত হয়ে আসছে এক কালনাগিনী!
ফ্লোরার বাপ এই আঘাত আর সইতে পারলো না। এরপর দিনই তার মুখ ভরে রক্ত বমি হলো। চিকিৎসক পৌঁছার আগেই ফ্লোরার বাপ মাসরূর দুনিয়া ছেড়ে চলে গেলো।
বদর ক্রোধে অগ্নিমূর্তি ধারণ করে ফ্লোরার কাছে গিয়ে বললো, তোমার ব্যাপারে দুঃখ আর মানসিক আঘাত সইতে না পেরে আজ আমার বাবা মারা গেলেন।
দুঃখে শোকে আরো বহু মানুষই তো মারা যায়। ফ্লোরা তাচ্ছিল্যের সুরে বললো। সে মারা যাওয়াতে আমার এজন্য আফসোেস হচ্ছে যে, সে আমার বাপ ছিলো। কিন্তু যখন ভাবি সে একজন মুসলমান ছিলো তখন আমার আফসোস আর অবশিষ্ট থাকে না।
এর অর্থ হলো, তুমি সোজাপথে আসবে না। বদর রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললো।
আমি সোজা পথেই যাচ্ছি। ফ্লোরা তিক্ত হেসে বললো। তোমরা এক বছর অপেক্ষা করে কী করবে? আজ আমার মুখ থেকে যা শুনছো এক বছর পরও তাই শুনবে। যদি শুনতাম আমাকে ফাঁসিতে ঝুলানো হবে তাহলে এটা আমার জন্য বড়ই সৌভাগ্যের ব্যাপার হবে। আমি সরল পথের সন্ধান পেতে মৃত্যুর জন্য ব্যকুল হয়ে আছি।
এত সহজে তুমি মরবে না ফ্লোরা! বদর ক্রোধ যথাসম্ভব চেপে রেখে বললো। সেই মৃত্যু তোমার কখনো ঘটবে না যার জন্য তুমি ব্যকুল হয়ে আছো। তোমার জীবন এখন থেকে কাটবে বন্দি অবস্থায়। আমি তোমার ভাই। আমি এটা ফরজ মনে করছি যে, নিজের বোনকে তার মনের মধ্যে এটা গেঁথে দেয়া যে, বাতিলকে বুকে ধারণ করে তুমি দুনিয়াতেও শাস্তি পাবে এবং পরকালেও পাবে আরো কঠিনতর আযাব।
দুনিয়ার শাস্তিই আমাকে পরকালের শাস্তি থেকে বাঁচাবে। ফ্লোরা গর্বের সুরে বললো এবং প্রহরারত মহিলাদেরকে ডেকে বললো, তোমাদেরকে কি নির্দেশ দেয়া হয়নি যে, এ ঘরে যাতে কেউ না আসে। ও কিভাবে এলো?
আরে মেয়ে এ তোমার ভাই এবং সেই তোমার বর্তমান অভিভাবক। ও তো যে কোন সময় এখানে আসতে পারবে।
ও আমার জন্য বেগানা পুরুষ। ফ্লোরা বললো, কোন মুসলমান কোন খ্রিষ্টানের ভাই বা বোন হতে পারে না। ওকে এই ঘর থেকে বের করে দাও।
পাগল মেয়ে এসব কী বলছো তুমি? এই ঘরের মালিক তো এখন তোমার এই ভাই! তাকে আমরা বের করবো কিভাবে?
বদর আর কিছু না বলে থমথমে মুখে ওখান থেকে চলে এলো।
বদর ওখান থেকে সোজা তার মায়ের ঘরে গেলো।
মা! বদর তার মাকে বললো, আমার তো মনে হচ্ছে ফ্লোরার মাথা তুমিই নষ্ট করেছে। বাবা আমাকে বলে গেছেন তুমি তাকে এত বছর থোকা দিয়ে এসেছে।
শোন বদর! মা বললো, আমি তোমার বাবাকে কোন ধোকা দেইনি। সে আমাকে কিছু মানবরূপী হিংস্র প্রাণী থেকে বাঁচিয়ে ছিলো। আমার কোন ঠিকানা ছিলো না। কোন আশ্রয় ও সহায় ছিলো না। তোমার বাপ আমাকে আশ্রয় দিয়েছে। আমার ঠিকানা হয়েছে। তাই তাকেই আমি ভালোবেসেছি। এক দিকে ছিলো তার ভালোবাসা, আরেকদিকে আমার পূর্বপুরুষদের ধর্মের ভালোবাসা।..
এই উভয় ভালোবাসাই আমার বুকে ধারণ করে এই জীবনটা পার করে দিলাম। আর এর মধ্যে এক ভালোবাসা আমার মেয়ে ফ্লোরার হৃদয়ে গেঁথে দিয়েছি। এখন তোমার বাবা চলে গেছে। এই ঘরে আমার আর এখন কোন কিছুই যেন নেই। আমি তোমার ছোট বোন বালদীকে সঙ্গে নিয়ে চলে যাচ্ছি।
কোন মা কি তার সন্তানকে এভাবে ছেড়ে যেতে পারে? সারা দুনিয়ায় এর কোন নজির আছে? তোমার বিকৃত ধর্মই তোমাকে এ অন্যায় কাজ করতে উৎসাহিত করছে। ধর্ম তো মানুষের সম্পর্কের বন্ধনকে আরো দৃঢ় করে। যে ধর্ম মানুষের সম্পর্ককে ছিন্ন করে, এমনকি মা সন্তানকে পৃথক করে সে ধর্ম অভিশাপ ছাড়া কিছুই না।
আমি এত কিছু বুঝি না। আমার সাথে থাকতে চাইলে আমার ধর্মে এসে যাও। মা বললো, আমি আমার ধর্মের জন্য আমার সন্তানকে বিসর্জন দিতে পারি।
তাহলে তো আমি আমার ধর্মের জন্য আমার মা ও দুই বোনকে বিসর্জন দিতে পারি। বদর চ্যালেঞ্জের সুলে বললো, যেতে চাইলে চলে যাও। আমার ঘরে আমি কালনাগিনীদের পালতে পারবো না। এমন নিষ্ঠুর মা বোনদের মুখও আমি দেখতে চাই না।
বদর অশ্রুসজল চোখে বেরিয়ে গেলো। পেছনে মায়ের মুখে বিদ্রুপের হাসি ছড়িয়ে পড়লো।
রাতে যখন সে ঘরে ফিরলো, তখন পুরো বাড়ি শূণ্য- খা খা করছে।
***