সুলতানা মালিকায়ে তরুবের সন্তান ভূমিষ্ট হলো।
শাহে উন্দলুসের আরেকটি সন্তানের জন্য মোবারকবাদ! যারিয়াব আব্দুর রহমানকে মোবারকবাদ দিতে দিতে বললো,
বাচ্চা আপনার চেহারা এবং মায়ের রূপ নিয়ে দুনিয়ায় এসেছে। উৎসবের জন্য তো প্রস্তুতি নিতে হবে। আর উৎসব হতে হবে অতুলনীয়। মালিকায়ে তরূবেরও খাহেশ, তার প্রথম ছেলের জন্মের আনন্দ যেন উন্দলুসের মানুষ সারা জীবন মনে রাখে।
উৎসব হওয়া দরকার। তবে আমি কিছু চিন্তা ভাবনা করে নিই। আব্দুর রহমান বললেন।
আমি প্রস্তুতি নেয়া শুরু করে দিচ্ছি। যারিয়াব একথা বলে চলে গেলো।
মহলে খবর ছড়িয়ে পড়লো, সুলতানার ছেলের জন্মের উৎসব করা হবে। শাহী মহলের উৎসব তো শাহী মহলের মতোই হয়। বখশিশ আর উপহার-উপটৌকনের ছড়াছড়ি।
সরকারি ধনভান্ডার থেকে কোটি কোটি টাকা শুধু নাচ-গান, গায়ক, শিল্পী, নর্তকী ও আনন্দ বিনোদানকারীদেরকে দেয়া হয় বখশিশ আর নজরানা হিসাবে। আর চলে মদ আর শরাব পানের প্রতিযোগিতা। দরবার ও রাষ্ট্রের কার্যক্রম কয়েক দিন বন্ধ থাকে।
মুদ্দাসসিরা তার মহলে সালারে আলা উবাইদুল্লাহ ইবনে আব্দুল্লাহ ও ওযীর হাজিব আব্দুল করীমকে দাওয়াত করলো।
আমি নিজে যদি এ ব্যাপারে আমীরের সঙ্গে কথা বলি তাহলে তিনি মনে করবেন আমি হিংসা করে এসব বলছি। মুদ্দাসসিরা তাদের দুজনকে বললো, আপনারা নিশ্চয় শুনেছেন সুলতানার ছেলের জন্মকে উপলক্ষ্য করে বিশাল উৎসব করা হচ্ছে। আমীরের সঙ্গে কথা বলে তাকে কি এ থেকে আপনারা বাঁধা দিবেন?
আমরা নিজেরা এ বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করেছি। সিপাহসালার বললেন, আমাদের কেউ এই উৎসবের পক্ষে নয়।
আর এটা উৎসব পালনের সময়ও নয়। হাজিব আব্দুল করিম বললেন, শহর জুড়ে অস্থিরতা আর বিশৃঙ্খলা দেখা দিচ্ছে। এক দুই দিন পর পর কোন না কোন খ্রিষ্টানের লাশ খোলা ময়দানে ঝুলন্ত দেখা যাচ্ছে।
আপনাদের যদি উনার সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছা থাকে তাহলে আর এখানে কেন আমরা সময় নষ্ট করছি। আপনার এখনই আমীরে উন্দলুসের কাছে চলে যান। মুদ্দাসসিরা বললো।
সিপাহশালার উবাইদুল্লাহ ইবনে আব্দুল্লাহ ও হাজিব আব্দুল করীম যখন আমীর আব্দুর রহমানের কামরায় প্রবেশ করলেন তখন যারিয়াবও সেখানে বসা। সে আব্দুর রহমানকে বলছিলো, শহরের পরিস্থিতি খুবই শান্ত ও নিরাপদ। অন্যান্য প্রদেশেও কোন সমস্যা নেই।
আমীরে মুহতারাম! সালারে আলা বললেন, এক জন্মোৎসবের আয়োজনের কথা শুনছি আমরা এ ব্যাপারে কথা বলতে এসেছি।
ফৌজেও কি উৎসব পালনের প্রস্তুতি চলছে? যারিয়াব জিজ্ঞেস করলো।
ফৌজে প্রস্তুতি চলছে পরবর্তী অভিযানে যাওয়ার জন্য। হাজিব বললেন, শহরে যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী গুজব চলছে ফৌজের নজর তার ওপর রয়েছে। বিদ্রোহের আগুন এখানেও উস্কে দেয়া হচ্ছে।
আমীরে মুহতারাম! উবাইদুল্লাহ বললেন, আমরা এ হুকুমও নিতে এসেছি যে, ফৌজ কি উৎসব পালনের প্রস্তুতি নিবে না টয়টা যাওয়ার প্রস্তুতি নিবে? আজ না হয় কাল ওখান থেকে পয়গাম আসবেই যে, দ্রুত সেনাসাহায্য পাঠাও।
কিন্তু উৎসবে আর কয়দিন সময় লাগবে! কয়েক দিনের প্রস্তুতি আর এক রাতের উৎসব! যারিয়াব বললো।
উড়ন্ত ঝান্ডা গড়িয়ে পড়তেও সময় লাগে না যারিয়াব! উবাইদুল্লাহ তির্যক কণ্ঠে বললেন।
আর সেই সালতানাতের ঝান্ডা গড়িয়ে পড়তে তো কোন সময়ই লাগে না যার শাসকের উপদেষ্টা হয় কোন দরবারী গায়ক! যারিয়াব! তোমার জানা নেই, শহরে কী হচ্ছে? হাজিব যারিয়াবকে ধমকে উঠে বললেন।
যারিয়ার মাথা নিচু করে ফেললো।
আমীর আব্দুর রহমানের চোখে-মুখে বিদ্রুপের ছায়া ফুটে উঠলো। তিনি অস্থির হয়ে উঠলেন। বলেলেন,
আমাকে আসল পরিস্থতি সম্পর্কে বলা হচ্ছে না কেন? যারিয়াব তো আমাকে বলেছে পরিস্থিতি শান্তই আছে। তিনি কিছুটা রাগত কণ্ঠে বললেন।
***
শহরে প্রায় প্রতিদিনই একটা না একটা খ্রিষ্টানের লাশ ঝুলে থাকতে দেখা যাচ্ছে। হাজিব আব্দুল করীম বললেন, এসব আত্মহত্যাকারীরা যে ইসলামের অবমাননা করে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলছে এতে তাদের ব্যক্তি-বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা নয়। এটা এক চক্রান্ত। যার ওপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ নেই। এটাই তো এক সময় বিদ্রোহের রূপ নেবে।
আমরা তো খুব দ্রুতই বিদ্রোহ দমন করে ফেলবো। যারিয়াব বললো।
বিদ্রোহ নাচ-গান আর অপ্রয়োজনীয় উৎসব দিয়ে দমন করা যায় না যারিয়াব। সালার আলা উবাইদুল্লাহ বললেন, তোমার ভোগ প্রিয় মাথা হয়তো এটা বুঝবে না যে, বিদ্রোহ আর নাশকতামূলক কাজের পেছনে কি হয়? আমীরে মুহতারাম! উন্দলুসের মাটি এখন বিদ্রোহীদের পদভারে কাঁপছে।
আর এ ধরণের বিদ্রোহের উদ্দেশ্য তো শুধু এটাই যে, আমরা উন্দলুসের মধ্যে ব্যস্ত থাকি। আব্দুর রহমান বললেন, এবং ফ্রান্স বড় ধরনের যুদ্ধ শক্তিতে পরিণত হয়। তারপর ওরা উন্দলুসের ওপর হামলা করে আমাদেরকে ধ্বংস করার চমৎকার সুযোগ পেয়ে যাবে। আমার মাথা থেকে এখনো এটা দূর হয়নি যে, ফ্রান্সের ওপর হামলা এবং সে দেশটাকে উন্দলুসের সালতানাতে অন্তর্ভুক্ত করা আমার ওপর একটা ঋণের মতো চেপে বসে আছে। এখন আমাকে তা পরিশোধ করতেই হবে।
কিন্তু….. তিনি কিছুটা ভেবে নিয়ে বললেন, উৎসব পালন করলে কী এমন হবে?
কিছুই হবে না। হাজিব বললেন, কোষাগারের কিছু অংশ খালি হয়ে যাবে। লোকদের ওপর উৎসবের উন্মাদনা কিছু দিন সওয়ার হয়ে থাকবে। এতো জানা কথাই। হরমে যেহেতু নারী আছে তাই ওদের থেকে বাচ্চা ভূমিষ্ট হবেই।
কিন্তু এভাবে চলতে থাকলে একদিন উৎসব আর বখশিশের এ প্রথা আমাদেরকে ডুবাবে। সময় ও অর্থের প্রয়োজন এখন এমন হয়ে দেখা দিয়েছে, আর কখনো এতটা অনুভূত হয়নি।
এধরণের উৎসব পালন তো আমাদের জন্য কোনোভাবেই শোভনীয় নয়। সিপাহসালার উবাইদুল্লাহ বললেন। আমাদের চরিত্র ও ধর্মীয় অবস্থানের বিবেচনায়ও তো এ উৎসব পালন কোনো মতেই আমাদেরকে মানায় না। আমাদের অনাগত সন্তানদের জন্য তো আমাদের এমন ইতিহাস রেখে যেতে হবে যা উন্দলুসের সীমানাকে দূর দিগন্তে প্রসারিত করবে। কিন্তু আমরা কোন কীর্তি রেখে যাচ্ছি?
আমীরে মুহতারাম! এ বাচ্চা ভূমিষ্ট হয়েছে সেই নারীর পেট থেকে যে আপনার বিবাহিতা নয়। হেরেমে যেহেতু অবিবাহিত নারীদের রাখার বিষয়টি প্রথায় পরিণত হয়েছে তাই এটা শহী মহলের বৈধ সংস্কৃতিতের অংশ হয়ে গেছে।
এটা যদি আমাদের ধর্মের দৃষ্টিতে দেখা হয় তাহলে ভেবে দেখুন বিধর্মীরা একে কী বলবে? এটাই বলবে যে, আমীরে উন্দলুস তার অবৈধ সন্তানের জন্মোৎসব করছেন। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম কী বলবে?
আমীরে মুহতারাম! হাজিব বললেন, সঠিক পরিস্থিতি তো আমরাই বলতে পারি এবং আমারাই বলে থাকি। যদি আপনার পছন্দের এক গায়ক উপদেষ্টার কথা ও পরামর্শ ভালো লাগে তাহলে ওকেই আপনার কাছে বসিয়ে রাখুন। কিন্তু আমাদেরকে আমাদের দায়িত্ব স্বাধীনভাবেই পালন করতে দিন। আমরা এ ব্যাপারে কোন ত্রুটি করতে পারি না। আমাদের ঈমান থেকে আমরা মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারি না।
স্বাধীনতা আমাদেরকে অন্যরকম চেতনায় উজ্জীবিত করে।
***
সিপাহসালার উবাইদুল্লাহ ও হাজিব আব্দুল করিমের মুখে এ ধরণের কথা শুনে আব্দুর রহমান খুট একটা বিচলিত হলেন না। কারণ, এসব কথা শোনা তার জন্য নতুন কিছু নয়। এদের দুজনের চেয়ে তিনি অনেক অসম সাহসী, বিজ্ঞ এবং অভিজ্ঞও। কিন্তু সুলতানা ও যারিয়াব তার সব প্রতিভা-গুণকে এবং তার ভেতরের অসম সাহসী রণাঙ্গণীয় জযবাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখে।
সিপাহসালার ও ওযীরসহ অন্যান্য সালাররাও জেনে গেছেন, এ ধরণের তিক্ত ও জোশেলা কথা বলেই আব্দুর রহমানকে জাগাতে হয়। এভাবেই তারা তার ভেতরের ঘুমন্ত নির্ভীক মুজাহিদকে অচেতনের নিদ্রা থেকে জাগিয়ে তুলতেন।
তারা কয়েকবার এটাও ভেবে দেখেছেন যে, যারিয়াব ও সুলতানাকে গুম করে ফেলবে। কিন্তু এ আশংকাও তাদেরকে ভাবিয়ে তুললো যে, ওদের ব্যাপারে আমীরের যে নেশা গড়ে উঠেছে সেটা যদি তিনি না পান তাহলে নেশাভঙ্গ মানুষের মতো বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়বেন। তখন তো তিনি কারো কথাই শুনবেন না। আর এটা উন্দলুসের ধ্বংসের কারণ হয়ে উঠবে।
আব্দুর রহমান উঠে দাঁড়ালেন এবং এটা বলে কামরায় পায়চারী করতে লাগলেন, টলয়টার খবর কী? যারিয়াব! তুমি যেতে পারো। উৎসব হবে না। সবাইকে বলে দাও।
টলয়টার খবর মোটেও আশাপ্রদ নয়। কামার হাশিম ওখানে বিভিন্ন নাশকতামূলক কাজ করাচ্ছে তাদের সন্ত্রাসী দল দিয়ে। ওদের মাধ্যমেই গড়ে তুলছে বিদ্রোহী দল। নির্ভরযোগ্য ইতিহাসগন্থগুলোতে হাশিমের ব্যাপারে লেখা হয়েছে,
হাশিমের পেশায় কামার হলেও টলয়টায় হাজারো বিদ্রোহীর এমন নেতা বনে যায় যে, তার ইঙ্গিতে খ্রিষ্টানরা জান কুরবান করতো। তার মুখে ছিলো মধুর বর্ষণ। দুকথাতেই মানুষকে তার ভক্ত করে তুলতো। সে ইউগেলিসের ডান হাত বনে গেলো।
হাশিম কামারের সন্ত্রাসী দলের পান্ডারা মুসলিম সেনা ইউনিট যারা রাতে বিভিন্ন গ্রাম ও উপশহরে টহল দিয়ে থাকে তাদের ওপর প্রায়ই নৈশ হামলা চালায় এবং দুএকজনকে আহত করে চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে যায়।
দিন নি এ সন্ত্রাসীদের দলীয় সদস্য সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
এর কৃতিত্ব সব হাশিমের। সেই যুবকদের সংগঠিথ করছে। এসব যুবকদের অধিকাংশের বাপ-দাদারা ত্রিশ বছর আগের এক বিদ্রোহে জড়িত থাকায় বিদ্রোহ দমনকারীদের হাতে মারা পড়ে।
হাশিম কামার এসব যুবকের মনে সেসব স্মৃতি তাজা করে দিয়ে তাদের পিতৃপুরুষদের প্রতিশোধ স্পৃহা জাগিয়ে তুলে তার দলে ভেড়াচ্ছে।
টলয়টায় একটা খবর ছড়িয়ে পড়েছে যে, টলয়টায় করবস্থানে রাতে এক দরবেশকে দেখা যায়। সে সশব্দে ঘোষণা দেয়ার মতো করে বলতে থাকে,
ঈসা মাসীহের পূজারীরা! জেগে উঠো তোমরা। তোমাদের ওপর কেয়ামত নেমে আসছে। টলয়টা রক্তের বন্যায় ভেসে যাবে।
লোকেরা বলাবলি করতে লাগলো, এটা কোন মৃত পাদ্রীর আত্মা। নতুন এক পয়গাম দিচ্ছে। গির্জায় গির্জায় এ ব্যাপারে আলোচনা চলতে লাগলো। গির্জার পাদ্রীরা বলতে লাগলো, এ ধরনের আত্মাকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এধরনের আত্মা নাজাতের নতুন পথ দেখিয়ে থাকে।
কয়েকদিনে পর খবর ছড়িয়ে পড়লো। কবরস্থানে রাতের বেলায় প্রদীপের আলো বাতাসে উড়ে যায় এবং আওয়াজ আসে,
তোমাদের নিদ্রা-বিশ্রাম বিসর্জন দাও। জেগে উঠো। সবাইকে জাগিয়ে তোলো। তোমাদের দিকে সে কেয়ামত ধেয়ে আসছে, সেটাকে প্রতিরোধ করো।
একটু থেমে আবার আওয়াজ উঠে,
না হলে ধ্বংস অনিবার্য।
মৃত্যুর নদী এগিয়ে আসছে।
খ্রিষ্টানরা প্রেতাত্মা এবং মৃত মানুষের ভূত-প্রেত হয়ে যাওয়ার ওপর বিশ্বাস রাখে। ওদের বিশ্বাস, মন্দ আত্মা ক্ষতি করে এবং পূণ্য আত্মা ভালো কোন কথা বা মুক্তির ইঙ্গিত দিয়ে যায়।
এজন্য খ্রিষ্টানরা দলে দলে রাতে কবরস্থানে যেতে লাগলো। কবরস্থানে বেশ বড়। এর কোথাও সমতল কোথায় অসমতল জায়গা রয়েছে। আবার টিলা টক্করও রয়েছে কিছু।
লোকেরা কবরস্থানের বাইরে দাঁড়িয়ে মৃত আত্মার কথা শুনে এবং এক ধরনের আলো বাতাসে উড়তে দেখে।
এক রাতে কবরস্থানের বাইরে অনেক লোকের সমাবেশ হলো। সেদিন গির্জাগুলো থেকে এ ঘোষণা মুখে মুখে খ্রিষ্টানদের কাছে পৌঁছে গেলো যে, আজ রাতে মৃত আত্মা নিশ্চয় কোন পয়গাম নিয়ে আসবে।
তাই লোকরা সে রাতে দলে দলে কবরস্থানে গিয়ে জমা হতে লাগলো।
টলয়টার ফৌজ তাদের ব্যারেকে তখন ঘুমুচ্ছে। আর গভর্ণর ইবনে ওসীম কোন এক সেনা ব্যারেক পরিদর্শনে সীমান্ত অঞ্চলে সফর করছেন।
খ্রিষ্টানদের এই ভেল্কি বাজি কোন সরকারি কর্মখর্তা দেখতে পেলো না।
পুরো কবরস্থান গভীর অন্ধকারে ডুবে আছে। লোকদের মধ্যে কবরস্থানের অজানা ভয় ছেয়ে আছে। পুরো পরিবেশটাই রহস্যময় এবং গা ছমছম করা।
লোকজন নীরব-নিস্তব্ধ। নিঃশ্বাস ফেলার শব্দও শোনা যাচ্ছে না।
আচমকা কবরস্থান থেকে এক পুরুষালী ফ্যাসফ্যাসে গলা শোনা গেলো। সমবেত খ্রিস্টানরা ভয়ে কেঁপে উঠলো।
নিজেদের প্রিয় ধর্মকে নিজেদের বুকে জাগ্রত করে নাও। কল্পনায় কুমারী মরিয়মের কথা চিন্তা করো এবং এদিকে দেখো।
সমবেত লোকেরা এক ধর্মীয় সঙ্গীত গাইতে শুরু করলো। যেটা এক ছন্দায়িত গুঞ্জরণের মতো শোনাচ্ছে এবং গা ছমছম পরিবেশকে আরো গাঢ়তর করে তুলছে।
হঠাৎ কবরস্থানের মাঝখান থেকে একটা আগুনের শিখা ওপরের দিকে উঠতে লাগলো। যেন কেউ আগুন জ্বালিয়েছে ওখানে। এর সঙ্গে সঙ্গে সাদাটে ধোঁয়ার এক বাদল সেখানটায় ছেয়ে গেলো। যেটা ক্রমেই ঘনীভূত হতে হতে আবার হালকা হতে শুরু করলো। আর এর সাথে সাথে এক মেয়ের দৈহিক আকৃতি স্পষ্ট হতে লাগলো। আগুনের শিখা এসময় আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।
সমবেত ক্রুশের পূজারীরা দেখলো, যেখানে ধোয়ার মেঘ দেখা গিয়েছিলো ওখানে স্বর্গীয় রূপ নিয়ে এক যৌবনবতী মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার মাথায় রুমাল বাঁধা। চুলগুলো কাঁধ পর্যন্ত ছড়ানো।
লোকেরা যেন নিঃশ্বাস ফেলতেও ভুলে গেছে। অনেকেই হাঁটু মুড়ে বসে হাত জোড় করে প্রার্থনার ভঙ্গিতে বসে রইলো। আত্মা বলে উঠলো,
পাপের প্রায়শ্চিত্ত আদায় করো। সবাই উঠো এবং খোদার পুত্রের শাসন প্রতিষ্ঠা করো। আর যদি তা না করো তাহলে আমি খোদার গজব হয়ে তোমাদেরকে ছারখার করে দেবো।
এই কুমারী মরিয়মের আত্মা ছিলো ফ্লোরা।
একটু পরই আগুন নিভে গেলো। কবরস্থান অন্ধকারে ছেয়ে গেলো।
পরদিন এঘটনাই টয়টায় বিদ্রোহের আগুন হয়ে দেখা দিলো।
***
৮২৯ খ্রিষ্ট সেপ্টেম্বরের এক রাত। আমীরে উন্দলুস তার খাস কামরায় আধো ঘুম আধো জাগরণ এ অবস্থায় আছেন। যারিয়াব মন মাতাল করা এক রাগ-সঙ্গীত ধরেছে। সুলতানা আব্দুর রহমানের কাছে এমনভাবে বসে আছে যেন সে আমীরে উন্দলুসকে তার কোলের গীতরে ঢুকিয়ে ফেলবে।
আমীরে উন্দলুস যখন সুলতানার দিকে তাকান সুলতানার হাসি আরো মাদকীয় হয়ে উঠে এবং তার চোখে দুটোকে নেশাকাতর করে তুলে। এক সন্তান ভুমিষ্ট করে সুলতানার রূপ-যৌবন যেন আরো বেড়ে গেছে।
দরজা হঠাৎ ধীর ধীরে খুলে গেলো। রেশমী পর্দা একটু দুলে উঠলো। সুলতানা কট কটে চোখে ওদিকে তাকালো। দারোয়ানকে দাঁড়ানো দেখতে পেলো। সুলতানা উঠে দরজা পর্যন্ত গেলো।
কোন হ্যায়? আব্দুর রহমান নেশাকাতর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন।
দারোয়ান! সুলতানা বললো বিরক্তভরা কণ্ঠে, বলছে টলয়টা থেকে পয়গামবাহক এসেছে।
গানের ছন্দে ছেদ পড়েছে। কামরায় নিঃস্তব্ধতা নেনে এলো। আব্দুর রহমান হাই তুললেন।
আমীরে উন্দলুস! যারিয়াব বললো, পয়গামবাহক সকালেও দেখা করতে পারবে। পয়গাম জরুরি হলেও ঘন্টা দুঘন্টা পরে এলেও সমস্যা নেই। আমীরে উন্দলুস তো কারো বন্দি নন।
বলে দাও সকালে আসতে। আব্দুর রহমান ঢুলতে ঢুলতে বললেন।
পয়গাম বাহককে বলে দাও, আমীরে উন্দলুস সকালে পয়গাম শুনবেন। যারিয়াব বললো।
দারোয়ান চলে গেলো। পয়গামবাহকও চলে গেলো। যারিয়ার ও সুলতানা দুজনে দুজনের দিকে তাকালো। দুজনের ঠোঁটে এক অর্থময় হাসি ফুটে উঠলো।
কামরা আবার সুরের ঝংকারে গম গম করে উঠলো।
এই পরিবেশ খুব বেশি সময় স্থায়ী হলো না। হঠাৎ দরজা খুলে গেলো। এবার পর্দা দুলে উঠলো না, বরং এক দিকে স্যাঁৎ করে সরে গেলো। আমীরে উন্দলুস, যারিয়াব ও সুলতানা তিনজনই চমকে উঠে ওদিকে তাকালো।
এখন যারিয়াব ও সুলতানার ভাব সম্পূর্ণ অন্যরকম। দুজনই থতমত খেয়ে গেছে। কারণ, এখন বিনা অনুমতিতে যে কামরায় এসেছে সে আমীরে উন্দলুসের ছেলে উমাইয়্যা। বিশ/একুশ বছরের এই যুবক নায়েবে সালার।
আমি কি আপনাকে সম্মানিত পিতা বলবো, না আমীরে উন্দলুস বলবো? উমাইয়া তীক্ষ্ম কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো।
কী হয়ে গেলো তোমার উমাইয়্যা? আব্দুর রহমান উঠতে উঠতে বললেন, এতো রেগে আছো কেন?
টলয়টার বিদ্রোহী সন্ত্রাসীদেরকে কি এই খরব পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে যে, ওরা যেন কাল সকাল থেকে বিদ্রোহ আর সন্ত্রাসী কর্মকান্ডা শুরু করে? কারণ, এখন আমীরে উন্দলুস গান আর রাগ-সঙ্গীতের নেশায় বুঁদ হয়ে আছে। টলয়টা থেকে পয়গামবাহক এসছে, তাকে বলা হয়েছে ওকে সকালে এসে পয়গাম শোনাতে?
আরবের পবিত্র ভূমি তো এমন বেয়াদব সন্তানকে জন্ম দেয় না। তুমি কি আদব কায়দা ভুলে গেছো? আব্দুর রহমান উন্মা প্রকাশ করলেন।
আপনাকে আদব কায়দা দেখানোর সময় এটা নয়। আমার সামনে এখন সে আদব রয়েছে যা দুশমনকে দেখাতে হবে। যুদ্ধের ময়দানের আদব। মুহতারাম আব্বাজান! আমার এজন্য কোন অনুতাপ হচ্ছে না যে, আমি আপনার সামনে ভদ্রতা বজায় রেখে কথা বলতে পারছি না।……..
কিন্তু আমি অনাগত ইতিহাস ও আমার স্বাধীনতার পবিত্র চেতনার সঙ্গে অভদ্রতা করতে পারবো না। আপনার মৃত্যুর পর মানুষ আমার দিকে আঙ্গুল উঠিয়ে বলবে, এই ছেলের বাপ সালতানাতে উন্দলুসের অস্তিত্বের শিকড়…. দুর্বল করে দিয়ে গেছে।
তুমি আসলে কী বলতে এসেছো? উমাইয়াকে জিজ্ঞেস করলেন আব্দুর রহমান ঝাঝালো গলায়।
উমাইয়া কামরার বাইরে গেলো। পর মুহূর্তেই সঙ্গে এক লোক নিয়ে আসলো। তার কাপড় চোপড় ও চোখে মুখে ধূলোর আস্তরণ জমে আছে। তার মাথা মাঝে মধ্যে ঝুলে পড়ছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, ক্লান্তিতে সে দাঁড়াতে পারছে না।
আপনারা এখান থেকে চলে যান। উমাইয়্যা যারিয়াব ও সুলতানাকে বললো।
মুহতারাম আব্বাজান! উমাইয়্যা এবার কিছুটা নরম গলায় বললো, এই পয়গাম বাহক টলয়টা থেকে এসেছে। এক্লান্তিতে এবং চরম হতাশায় ভেঙ্গে পড়তে পড়তে আমার কাছে এসেছে। বলেছে, আমীরে উন্দলুস অতি জরুরি এক পয়গাম শুনতে চাচ্ছেন না। লোকটি এত দ্রুত এসেছে যে, রাতেও ছুটন্ত ঘোড়ার পিঠে কাটিয়েছে।…..
নিজের অতি প্রয়োজনীয় বিশ্রামও সে বিসর্জন দিয়েছে। একটি ঘোড়া তো তাকে নিয়ে অবিরাম ছুটতে ছুটতে মরেই গেছে। এক মুসাফিরের ঘোড়া ধার করে নিয়েছে। চরম ক্ষুধা আর তৃষ্ণা নিয়ে সে এখানে পৌঁছেছে। অথচ এখানে এসে … ওর পয়গাম আগে শুনুন।
সংক্ষেপে তোমার পয়গাম শোনাও। আব্দুর রহমান পয়গাম বাহককে বললেন।
টলয়টার খ্রিষ্টানরা বিদ্রোহ করে বসেছে। পয়গাম বাহক বললেন, একে তো আমাদের ফৌজ অতি কম। তারাও সেসব ফৌজি চৌকি দূরদূরান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এবং যেগুলোতে সৈন্য সংখ্যাও নেহায়েত কম। সে গুলোর ওপর হঠাৎ খ্রিষ্টান সন্ত্রাসীরা নৈশ হাশলা চালানো শুরু করে। ফৌজি রসদের কাফেলার ওপর হামলা হতে থাকে।…..
এমনকি দিনের বেলাও টহল সেনাদলের ওপর গেরিলা হামলা চালাতে থাকে খ্রিষ্টান সন্ত্রাসীরা। ওদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেয় হয়। কিন্তু নৈশ হামলা ও ওদের লুটপাট বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। তাদের এসব নাশকতামূলক কর্মকান্ড চলতেই থাকে।…….
কয়েকদিন আগে খ্রিষ্টানদের কবরস্থানে এক ভেল্কি বাজির খেলা দেখায় তারা। বোকা, মুখ খ্রিষ্টানরা এটাকে মনে করে কুমারী মরিয়ম তাদেরকে কিদ্রোহ করার পয়গাম দিয়ে গেছে।
এই ঘটনাই টলয়টার খ্রিষ্টানদেরকে আগুন উত্তপ্ত করে দেয়। পরিণামে সেখানে এখন সশস্ত্র বিদ্রোহ চলছে। কৌশল হিসেবে বেছে নিয়েছে ওরা নৈশ হামলা ও গেরিলা হামলা। পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে, বিদ্রোহীদের নেতৃত্ব অভিজ্ঞ কোন সেনা কর্মকর্তার হাতে রয়েছে। মারীদার মতো পুরো শহরবাসী অন্ধের মতো বিদ্রোহ করে বসেনি। ওরা খুব সতর্ক ও ভেবে চিন্তো পা ফেলছে।….
এতটুকু জানা গেছে যে, হাশিম কামার নামে এক লোক আপাতত এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিচ্ছে। তার নির্দেশেই বিদ্রোহীরা সামনের দিকে পা ফেলছে।
তবে সে কেথায় আছে, কোথায় তার অবস্থান এটা জানা যায়নি। জানা গেছে। ফ্লোরা নামের অতি সুন্দরী এক যুবতী খ্রিষ্টানদের রক্তে আগুন ধরিয়েছে।
তাকে ওরা মরিয়ম ছানী বলে থাকে। শহরের খ্রিষ্টানরা রীতিমতো ফৌজ বনে গেছে। কারো কথাই ওরা শুনছে না। আমাদের ফৌজি দল দেখলে ওরা ঘরে চলে যায়। কিন্তু পেছন থেকে হামলা করে বসে। একাকি কোন ফৌজ পেলে তো ওরা তাকে শেষ করে দেয়।
বিদ্রোহীরা কি রাষ্ট্রীয় কোষাগার লুট করার চেষ্টা করেছে? আব্দুর রহমান জিজ্ঞেস করলেন।
না আমীরে উন্দলুস।
ওরা কি নিয়মিত ফৌজের মতো সুশংখল?
না আমীরে উন্দলুস! সুশৃঙ্খল ডাকাতদল ও লুটেরা দলের মতো ওদের কৌশল?
আব্দুর রহমান পয়গামবাহকে আরো কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করে তাকে শাহী মেহমান খানায় পাঠিয়ে দিলেন। তারপর দারোয়ানকে ডেকে বললেন,
এখনই সিপাহসালার উবাইদুল্লাহ ও ওযীর হাজিব আব্দুল করীমকে আসতে বলো।
দারোয়ান কামরা থেকে বেরিয়ে গেলো।
***
টলয়টা থেকে দুই তিন মাইল দূরের এক পাহাড়ি এলাকা। যেখানে ঘন ঘন জঙ্গল রয়েছে। কোথাও কোথাও চোরা ভূমিও রয়েছে। এর মধ্যে পাহাড়ে ঘেরাও করা কিছু জায়গা রয়েছে। সেখানকার পথ-ঘাট অতি কঠিন। ওখানে বিশাল বিশাল পর্বতগুহাও রয়েছে।
একটি গুহা বেশ আলোকিত। প্রদীপ বা মশাল জ্বলছে ভেতরে। কামার হাশিমের হেড কোয়ার্টার। গুহায় এক লোক বাইরে থেকে এসে ঢুকলো। তাকে দেখে এদিক-ওদিক থেকে কয়েকজন একত্রিত হলো। ওদের মধ্যে একজন মেয়েও আছে। সে হলো ওদের কাছে মরিয়াম ছানী- ফ্লোরা।
বিদ্রোহীদের মনোবল তুঙ্গে আছে তো? কী খবর নিয়ে এসেছ?
আমাকে শুনতে দাও আগে। ফ্লোরা বললো।
ফ্লোরা তাড়াহুড়া করো না। কামার হাশিম বললো, তুমি এখনো বয়সে অপরিণত। বিদ্রোহ ও লড়াইয়ে আবেগ কোন কাজে লাগে না? সে আগন্তুক লোকটিকে জিজ্ঞেস করলো, বলো কী খবর নিয়ে এসেছো?
সবকিছু ঠিকঠাক মতোই চলছে। লোকটি বললো, আপনার দিক নির্দেশনা প্রতিটি ঘরে পৌঁছে দেয়া হয়েছে। তাজা খবর হলো, মুসলমানদের এক পয়গামবাহক কর্ডোভা চলে গেছে। ওখান থেকে ফৌজ তো অবশ্যই আসবে। টলয়টায় যে সেনাদল আছে সেটা তো আমরা তাড়াতাড়িই শেষ করে দিতে পারবো। কিন্তু কর্ডোভার ফৌজ এলে তো মুশকিল হয়ে পড়বে।
আমাদেরকে ফৌজের মতো সুশৃংখল হতে হবে। কামার হাশিম বললো, আমরা লোকদের কাছে এখনই পয়গাম পৌঁছে দিচ্ছি, সবাই যেন অস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত থাকে। হুকুম পেলেই যেন ফৌজের মতো ঘর থেকে বেরিয়ে আসে এবং দুশমনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।
গুহায় হাশিমের আরো যেসব লোক ছিলো তাদেরকে বললো,
টলয়টার বাইরে অনেক সশস্ত্র বিদ্রোহীকে প্রস্তুত রাখতে হবে, যাতে কর্ডোভার ফৌজকে টলয়টা থেকে অনেক দূরে থাকতেই বাঁধা দেয়া যায়।
কয়েক দিনের মধ্যেই টলয়টার বাইরে এক ফৌজ তৈরি হলে গেলো।
টলয়টার গভর্ণর মুহাম্মাদ ইবনে ওসীমেরই দায়িত্ব শহরের নিরাপত্তা রক্ষা করা এবং নৈশ হামলা ও গেরিলা হামলাকারীদের পাকড়াও করানোও তার দায়িত্ব।
মুহাম্মাদ ইবনে ওসীমের হেড কোয়ার্টার শহরের কাছেই এক সুদৃশ্য জায়গায়। তার কাছে খবর পৌঁছেছে, টলয়টা থেকে দুই তিন মাইল দূরে খ্রিষ্টানরা রীতিমতো এক ফৌজ তৈরি করে নিয়েছে। সম্ভবত: এরা টলয়টার ওপর হামলা করে বসবে।
যদি ওরা হামলা করে তাহলে টলয়টার শহরবাসী ওদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ভয়ংকর নাশকতার সৃষ্টি করবে। তখন পুরো টলয়টা বিদ্রোহীরা দখল করে বসবে।
মুহাম্মাদ ইবনে ওসীমের কাছে খুব স্বল্প সংখ্যক ফৌজ রয়েছে। হাতে গোনা কয়েকটি ইউনিট মাত্র। তিনি হুকুম দিলেন,
এখনই ফৌজের পূর্ণ এক ইউনিট প্রস্তুত হয়ে যাও।
সেনা ইউনিট প্রস্তুত হয়ে গেলো। ইবনে ওসীম নিজের হাতেই নিলেন ফৌজের নেতৃত্ব। খ্রিষ্টানরা যেখানে ফৌজ তৈরি করে বসে আছে সেদিকে কোচ করা হুকুম দিলেন।
ইবনে ওসীমকে খুব এটা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মনে হলো না। কারণ, তিনি এই আত্মতুষ্টিতে রয়েছেন যে, তিনি সাধারণ বিদ্রোহীদের দমন করতে যাচ্ছেন।
তিনি যখন বিদ্রোহীদের দলের সামনে পড়লেন তখনো দেখলেন এর সংখ্যা অনেক কম। তিনি হুকুম দিলেন একটাও যেন জীবিত পালাতে না পারে।
তার ইউনিটের সৈন্যরা সেদিকে ঘোড়া ছুটিয়ে দিলো। বিদ্রোহীরা কিছুক্ষণ বেশ জমে লড়ে গেলো। তারপর পিছু হটতে লাগলো। মুসলিম ফৌজও তাদের পিছ ধাওয়া করলো। আচমকা মুসলিম সেনাদের ওপর এক পার্শ্ব থেকে এবং পেছন থেকে এক দল খ্রিষ্টান ফৌজ হামলে পড়লো। অর্থাৎ তারা এতক্ষণ লুকিয়ে ছিলো। মুসলমানদেরকে পিছু হটার কৌশল নিয়ে লোভ দেখিয়ে তাদেরকে ঘেরাওয়ের মধ্যে নিয়ে এসেছে।
মুহাম্মাদ ইবনে ওসীম এ অবস্থা দেখে তার ফৌজকে পিছু হটার নির্দেশ দিলেন। তার সৈন্যরা লড়তে লড়তে পিছু তো হটতে পারলো, কিন্তু অর্ধেকই ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেলো। তিনি বেশ কষ্টে প্রাণ নিয়ে ফিরে আসতে পারলেন।
এই রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের আগেই তিনি কর্ডোভায় পয়গামবাহক পাঠিয়ে ছিলেন। কিন্তু আজকের এই হঠাৎ লড়াইয়ে নেমে তিনি টের পেলেন, এখানে তার ও তার ফৌজের পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেছে অনেক আগেই।
***
এই লড়াই থেকে মুসলিম সেনা ইউনিটের দুই সিপাহী অক্ষত অবস্থায় বেরিয়ে যেতে পারলো। কিন্তু তাদের বেশ পেছন থেকে বিদ্রোহীদের কিছু সন্ত্রাসী পিছু নিয়েছে সেটা তারা প্রথমে টের পেলো না। পেছন থেকে ওরা তীর ছুঁড়তে শুরু করতেই ওরা টের পেলো কী ঘটতে যাচ্ছে।
কাছেই রয়েছে পাহাড়ি এলাকা। ওরা সেখানে খুব দ্রুত ঢুকে পড়লো। বিদ্রোহীদের ছোঁড়া তীরগুলো লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো।
মুসলিম সিপাহীরা পাহাড়ি এলাকার নিরাপদ আড়াল পেলেও ওদের সন্দেহ হলো, ওরা এই পাহাড়ি এলাকার গোলাক ধাঁধাপূর্ণ পরিবেষ্টন থেকে বের হতে পারবে কি না। লুকানোর সুবিধা ও নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তার জন্য ওরা ঘোড়া ছেড়ে দিলো এবং এদিক-ওদিক লুকোতে চেষ্টা করলো।
ওরা রয়েছে এখন ঘন গাছপালার আড়ালে। বিদ্রোহীরা যে দেরকে খুঁজে বেড়াচ্ছে এটার আওয়াজ ওরা পেয়ে গেলো। ওরা পাহাড় বেয়ে ওপরে চলে গেলো। যাতে নিচে ভালো করে দেখতে পায়।
একটু পরই ওরা ওদের বেশ নিচের রাস্তায় দেখতে পেলো ওদেরকে যারা খুঁজছে তাদের চার জনের দলটিকে। ওরা থেমে থেমে চলছে। ওদের একজন বললো,
বেটারদেরকে এখন খুঁজে পেয়ে যমের বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া দরকার। ওরা না আবার আমাদের হেড কোয়ার্টারে পৌঁছে যায়।
দেখো দেখো, আরেকজন বললো, ওরা না আবার আরো এগিয়ে গিয়ে আমাদেরকে ছেড়ে চলে গেছে। ওরা যদি সে জায়গাটা দেখে ফেলে তাহলে কিন্তু পরিণাম ভয়াবহ হবে।
দুই মুসলিম সিপাহী তো ওদের জান বাঁচানোর ফিকিরে আছে। কিন্তু ওরা যখন ওদের কথা শুনলো তখন একজন বললো,
এরা সম্ভবত সে জায়গার কথা বলছে যে জায়গার ব্যাপারে শোনা গিয়েছে, ওখানে ওদের নেতা রয়েছে। ওখান থেকেই সেই ব্যাটা বিদ্রাহ ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ড পরিচালনা করে।
শুনেছি ওদের কুমারী মরিয়ম যাকে কবরস্থানে দেখা গিয়েছে সেও নাকি ওদরে ওখানেই থাকে। দ্বিতীয় সিপাহী বললো।
আমাদের কমান্ডারকে বলতে শুনেছি, বিদ্রোহের নেতৃত্ব কামার হাশিম নামে এক লোকের হাতে; প্রথম সিপাহী বললো,
অবিশ্বাস্য এক সুন্দরী মেয়ে রয়েছে তার সঙ্গে। এই মেয়েকে ওরা পবিত্র সত্ত্বা মনে করে।
তাহলে বন্ধু আল্লাহর নাম নাও। দ্বিতীয় সিপাহী বললো, সে জায়গাটা খুঁজে বের করো। যদি মরতে হয় কিছু একটা করে মরো। এরা নিজেদের মিথ্যা ধর্মের জন্য যদি প্রতারণা আর ধোকাবাজি করতে পারে তাহলে আমরা আমাদের সত্য ধর্মের জন্য সেই ধোকাবাজিকে ধ্বংসও করতে পারবো। এদের একজন বলছিলো, আমরা যেন এগিয়ে যেতে না পারি। চলো, আরো আগে গিয়ে দেখি কি আছে?
ওদের খুঁজে চার বিদ্রোহী এতক্ষণে অনেক এগিয়ে গিয়েছে। মুসিলম দুই সিপাহীর পালানোর রাস্তা একেবারে পরিস্কার ছিলো। কিন্তু ওরা পাহাড়ের ওপরে থেকেই লুকিয়ে ছাপিয়ে নিঃশব্দ পায়ে সেদিকে এগিয়ে যেতে লাগলো, যেদিকে বিদ্রোহী সাওয়াররা গিয়েছে। নিচ থেকে ওরা আবার কথার আওয়াজ পেলো, সিপাহীরা নিচের দিকে তাকালো। ঐ চার বিদ্রোহীর একজন বলছে,
একজন একজন করে ছড়িয়ে পড়ো, ওদের খোঁজো।
ওখান থেকেই ওরা এক এক করে কয়েক দিকে ছড়িয়ে পড়লো। ওখানেই পাহাড়ি প্রান্তর আপাতত শেষ। যেদিকে সিপাহীরা লুকিয়ে লুকিয়ে এসে পৌঁছেছে। বিদ্রোহী সাওয়াররা ওখান থেকে অদৃশ্য হতেই দুজন ওখন থেকে নেমে গেলো এবং সামনের প্রান্তরে চড়তে লাগলো।
ওদের কোথাও নিচে নামতে হলো, কোথাও ওপরের দিকে উঠতে লাগলো। এরপর ওরা এমন এক জায়গায়, পৌঁছে গেলো যেখান থেকে নিচের দিকে আর কোন রাস্তা নেই। সামনে উঁচু একটি পাহাড়।
ওরা এদিক-ওদিক তাকালো। ঘন ঝোঁপ ঝাড় নজরে পড়লো। এর নিচ দুজন লোককে একটি গুহা থেকে বেরিয়ে আসতে দেখলো। এরপর পরই এক রূপসী মেয়েকে বেরিয়ে আসতে দেখলো। এদের মনে হলো এর রূপে চারপাশ আলোকিত হয়ে গেছে।
হ্যাঁ, এরাই হবে। এক সিপাহী বললো, এই দুর্গম বন জঙ্গলে আর কে হতে পারে!
এসময় ঘোড়ার এক খুর ধ্বনি শোনা গেলো। এক সাওয়ার নজরে পড়লো। দূর থেকেই শ্লোগানের মতো বললো,
মোবারকবাদ, মোবারকবা! দুশমকে চরম শিক্ষা দিয়ে এসেছি। মুসলমানদের অর্ধেক সৈন্য খতম করে দিয়ে এসেছি।
গুহা থেকে আরো কিছু লোক বের হলো। সবাই খুশিতে নাচতে লাগলো। মুসলিম সিপাহী দুজন দৃষ্টি বিনিময় করলো। চোখে চোখে ওরা পরস্পরকে সমর্থন করলো, ওরা দুশমনের আসল আড্ডখানা পেয়ে গেছে।
সূর্যাস্ত হচ্ছে। ওরা খুব সন্তর্পনে ওখান থেকে সরে পড়লো। একটু দূরে গিয়ে ওরা দাঁড়িয়ে পড়লো। অন্ধকার গম্ভীর হয়ে গেলে ওরা রওয়ানা করবে। তখন ধরা পড়ার আশংকা অনেকটাই কমে যাবে।
***
কর্ডোভা থেকে এখনো কোন সেনাসাহয্য এলো না। মুহাম্মাদ ইবনে ওসীম তার মহলের হলরুমে ক্রোধে এদিক-ওদিক পায়চারী করছেন। এই পরাজয় তিনি মেনে নিতে পারছেন না। তার সামনে কয়েকজন সেনা কমান্ডার বসে আছে। ওসীম বললেন,
পয়গামবাহক বেটাও এখনো ফিরে এলো না। চরম ভোগ-বিলাসপ্রিয় আমীর আব্দুর রহমান তো নিশ্চয় যারিয়াবের গান শুনছেন আর ঐ সুলতানা ডাইনিকে বগলদাবা করে বসে আছেন।
কর্ডোভা থেকে সেনা সাহায্য আসার অপেক্ষা না করে আমরা কেন খ্রিষ্টান নেতাদেরকে ডেকে ওদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করছি না? এক কমান্ডার বললো, ওদেরকে জিজ্ঞেস করুন, ওরা কী চায়?
ওরা যদি দাবী করে, টলয়টার পুরো প্রদেশ আমাদের হাতে তুলে দাও তাহলে এই দাবী কি আমরা মেনে নেবো? ইবনে ওসীম উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন, তোমরা কি এটা বলতে চাচ্ছে যে, আমরা পরাজয় স্বীকার করার পর আমাদের দুশমনের সাথে সন্ধির জন্য ভিক্ষা চাইবো? পবিত্র কুরআনের নির্দেশের বিরুদ্ধে চলবো?…..
পবিত্র কুরআন কী বলেছে জানো? যে পর্যন্ত কাফেরদের ফেতনা ফাসাদ চলতে থাকবে সে পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ চালিয়ে যাও। ঐ কাফের সন্ত্রাসীদেরকে আমি অনুমতি দিতে পারি না যে, কাফের সন্ত্রাসীরা তাদের সন্ত্রাস আমার ঘরের চৌকাঠ পর্যন্ত বিস্তার করুক।
আমার উদ্দেশ্য এটা নয়, কামন্ডার বললো, বিদ্রোহীদের সঙ্গে আমি কোন সন্ধি–সমঝোতা করতে বলছি না। আমরা কিছু সময় কালক্ষেপণ করতে চাচ্ছি। সেনা সাহায্য আসার আগ পর্যন্ত এমন কোন চাল চালতে হবে যাতে বিদ্রোহীদের তৎপরতা কিছুটা বন্ধ রাখা যায়।
আমরা যদি সন্ধি-সমঝোতা এবং চুক্তি করার ব্যাপারে এক পা আগে বাড়াই, সেটা আমরা একটা চাল বা কৌশল হিসাবে করলেও আমাদের আমীর একেই নিজের রীতি বানিয়ে নেবে। মুহাম্মাদ ইবনে ওসীম বললেন,
ভোগ বিলাস করে বাদশাহী করার উত্তম পদ্ধতি হলো, বন্ধুকে শত্রু এবং শত্রুকে বন্ধ বলো এবং দেশবাসীকে থোকার মধ্যে রাখো। আর নিজেকে এমন প্রতারণায় ডুবিয়ে রাখো যে, আমরা আল্লাহর সিপাহী এবং ইসলামের জন্য নিবেদিত প্রাণ।
এমন এক সময় আসবে যখন আমাদের মুসলমান জাতি দুশমনের সামান্য হুমকিতেই ভয়ে কুকড়ে যাবে। এ নিয়ে বেঁচে থাকতে আপ্রাণচেষ্টা করবে। আর জাতির শাসকরা ইসলামের বীরত্বগাথা ইতিহাস নিয়ে মিথা গর্বে বুকে ফোলাবে।
এ সময় দারোয়ান এসে জানালো, এক কমান্ডার সাক্ষাৎ করতে এসেছে।
এতে অনুমতির কী প্রয়োজন? ওসীম বললেন, কাউকেও বাঁধা দিয়ো না। যে কেউ আমার সাক্ষাতে আসবে সোজা ভেতরে পাঠিয়ে দেবে। আমি বাদশাহও নই। উন্দলুসের আমীরও নই।
কমান্ডার ভেতরে এলো। তার কাপড় রক্তে লাল।
তুমি কি যখমী?
আমি আমার যখম দেখাতে আসিনি। কমান্ডার বললো, আমি এক শত সিপাহীর একটি দল নিয়ে এক চৌকির সাহায্যে যাচ্ছিলাম। পথে বিদ্রোহীরা আমাদেরকে ঘিরে ফেলে। ওদের সংখ্যা এর চেয়ে কিছুটা বেশি ছিলো। আমার সিপাহীরা যে বীরদর্পে লড়ে যায় তা স্বচক্ষ্যে না দেখলে শুধু বলে বোঝানো যাবে না। তবে আমি আমার সিপাহীদের বীরত্বগাঁথা শোনাতে আসিনি।….
এটা শোনাতে এসেছি যে, আমার এক শ থেকে প্রায় এক ষট্টিজন সিপাহী শহীদ হয়ে গিয়েছে। তবে ওরা প্রায় একশত জন দুশমনকে শেষ করে দিয়ে ওদের ঘেরাও ভেঙ্গে গেছে। আর বাকিরা তাদের সঙ্গীদের লাশ ফেলে রেখে, যখমীদেরকে উদ্ধার না করে নিকটস্থ চৌকিতে গিয়ে পৌঁছে।
সে চৌকিকে কি বাঁচানো গিয়েছে?
না, কমান্ডার বললো, সে চৌকিতে অল্পসংখ্যক জোয়ান ছিলো। এর বিপরীতে বিদ্রোহীদের বিশাল একদল চৌকিকে অবরোধ করে। আমরা গিয়ে দেখি সে চৌকি ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। আমার যেটা বলা উদ্দেশ্য সেটা হলো, বিদ্রোহীরা সংখ্যায় অনেক অনেক বেশি। সে তুলনায় আমাদের সৈন্য সংখ্যা নেহাতই কম।
আরেকটা খবর হলে, টলয়টা থেকে কিছু দূরের পাহাড়ি এলাকায় কিছু একটা রয়েছে। বিদ্রোহীদের সাহায্য সহযোগিতা ও দিক-নির্দেশনা ওখান থেকেই আসছে। হাশিম কামার ও রূপসী মেয়ে ফ্লোরা খ্রিষ্টানদের পবিত্র ব্যক্তিত্ব হিসাবে আভির্ভূত হয়েছে। এরা দুজন সম্ভবত: ওই পাহাড়ি অঞ্চলের কোথাও গোপন আস্তানা গেড়েছ। তাই এক জানাবায বাহিনী তৈরি করে খ্রিষ্টান সন্ত্রাসীদের ঐ মহা সন্ত্রাসী ও জঙ্গিদেরকে ধরতে হবে এবং খতম করে দিতে হবে। এটা আমার শেষ আকুতি।
ঐ পাহাড়ি এলাকা সম্পর্কে আমার জানা আছে। মুহাম্মাদ ইবনে ওসীম বললেন, ওখানে কাউকে খুঁজে বের করা সম্ভব নয়। প্রথমে দুজন গুপ্তচর পাঠিয়ে ওদের আস্তানাটা চিহ্নিত করতে হবে। তারপর জানবায বাহিনী পাঠাতে হবে।
আমি গোস্তাখী মাফ চাচ্ছি। কমান্ডার এবার ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলে কাঁপা কণ্ঠে বললো, আপনি এখনো সম্ভব অসম্ভবের ভাষায় কথা বলছেন। আমাদেরকে তো অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখাতে হবে। কর্ডোভার প্রতীক্ষায় আর থাকা যাবে না। নিজেদের জযবার ওপর ভরসা রাখতে হবে। যে পর্যন্ত বিদ্রোহী দলের মূল হোতাদেরকে খতম করা না হবে সে পর্যন্ত বিদোহীদের দুর্বল করা যাবে না। আমাদেরকে জান কুরবান করতে হবে… আপনি অধিক প্রতীক্ষায় থাকলে…
কমান্ডার আর কিছু বলতে পারলো না। তার শরীর থর থর কেঁপে উঠলো এবং সে পড়ে গেলো। মুহাম্মাদ ইবনে ওসীমসহ সবাই ছুটে গেলো তার দিকে।
দেখা গেলো তার পেট একাধিক কাপড়ে ভাজ করা অবস্থায় ফুলে ফেঁপে আছে। পুরোটায় রক্তে চপচপে। কাপড় সরানো হলো। দেখা গেলো, পুরো পেটের মাঝখানে গর্ত করা। কাপড়ের ভাজ দিয়ে নাড়ি-ভুড়ি এতক্ষণে আটকে রেখে ছিলো আল্লাহর এই মহা সৈনিক।
এই জানবায এখানে যখন আসে তখনও জীবিত ছিলো না। ওসীম বললেন, ওর রূহ ওকে এখানে নিয়ে এসেছে। অনেক আগেই শহীদ হয়ে গেছে। আমাদেরকে মূল্যবান তথ্য দেয়ার জন্য ওর রূহ এতক্ষণ দুনিয়ার জগতে ছিলো। কিন্তু ইবনে ওসীম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
জাতির এই আত্মত্যাগ আর পবিত্র আবেগ ভালোবাসা শাসকদের চৌকাঠে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে। সেখানে এসব কথা অর্থহীন আর গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। কর্ডোভা থেকে এখনো পয়গাম বাহক ফিরে এলো না। আমাদের আমীর তো বুঝতেই পারেননি এখানে কী অবস্থায় আমরা আছি।…….
তিনি না বুঝলেও আমরা তো বুঝি। তিনি সালতানাত আর নেতৃত্বের পূজারী। আমরা স্বাধীনতাকামী মুজাহিদ। উন্দলুস তার বাপের তো পৈতৃক জায়গীর নয়। আমরা যতদিন বেঁচে আছি আমাদের দায়িত্ব আমরা পালন করে যাবো। মরলে তা পালন করেই মরবো। কিন্তু হাশিম কামারকে কে চিহ্নিত করবে?
ইবনে ওসীম আকাশের দিকে হাত তুলে কান্না ভেজা কন্ঠে বললেন, তোমার নামে, তোমার এক মাত্র সাহায্যেই। আমাদেরকে ভুলে যেয়ো না রাব্দুল আলামীন।
***
আল্লাহ তাআলা মুক্তিকামী বান্দা স্বাধীনতার জন্য আত্মত্যাগকারী মুক্তিযোদ্ধা আর মুজাহিদদেরকে ভুলেন না। তবে ভুলে গিয়েছে কর্ডোভার মসনদধারীরা যে, খ্রিষ্টান সন্ত্রাসীরা ইসলামের জন্য কত বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কুফরের তুফান সবকিছু তছনছ করে কেমন ঝড়ো গতিতে এগিয়ে আসছে। যে আব্দুর রহমান ফ্রান্সের ওপর হামলার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকেন সেই তিনিই টয়টার বিদ্রোহকে কোন গুরত্বই দিচ্ছেন না।
তার ছেলে সাময়িকের জন্য তাকে যারিয়াব ও সুলতানার মাদকীয়তা থেকে তো বের করে নিয়েছিলো। কিন্তু তাকেও পিতা আব্দুর রহমান ভুল বুঝেছেন।
আব্দুর রহমান তার প্রধান সেনাপতি উবাইদুল্লাহ ও ওযীর হাজিব আব্দুল কারীমের সঙ্গে আলোচনায় বসলেও তাদেরকে কথা বলার সুযোগ খুব কমই দিয়েছেন তিনি।
ইবনে ওসীমকে আমি চিনি। আব্দুর রহমান বললেন, খুব দ্রুত ঘাবড়ে যায়। টলয়টার খ্রিষ্টানদের তো এত বড় মাপের বিদ্রোহ করার সাহসই নেই। আমার ধারণা, এটা ডাকাত সরদারদের লুটেরা দল। যারা নৈশ হামলা চালিয়ে বেড়াচ্ছে। সেনাসাহায্য পাঠানোর ব্যাপারে আপনার কি আমাকে পরামর্শ দেবেন? এখানে কর্ডোভার পরিস্থিতিও যে আমাদের অনুকূলে নয় সেটাও তো আপনারা মমে মনে অনুভব করছেন।
সত্যিই যদি ওরা ডাকাত বা লুটেরা দল হয়ে থাকে তাহলে তো মুহাম্মাদ ইবনে ওসীমের ঘাবড়ানো উচিত নয়। কিন্তু আমাদের কোন ঝুঁকিও নেয়া উচিত হবে না। ওখানকার প্রকৃত অবস্থা কী সেটাও আমাদের তদন্ত করে দেখা উচিত। উবাইদুল্লাহ বললেন।
***
ওদিকে মুহাম্মাদ ইবনে ওসীমের কামরা থেকে শহীদ কমান্ডারদের লাশ উঠানো হয়েছে। তিনি তার স্বল্প সংখ্যক সৈন্যকেই অধিক কার্যকরী পদ্ধতিতে ব্যবহার করার কথা ভাবছেন। ইতিমধ্যে তার কাছে আরো তিন চারটি রিপোর্ট এসেছে।
এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর রিপোর্ট হলো, টলয়টা শহর এখন কার্যত বিদ্রোহীদের দখলে চলে গেছে। এখন তো ইবনে ওসীমের জন্য টলয়টা বিদ্রোহীদের হাত থেকে উদ্ধার করা অসম্ভব ব্যাপার হয়ে উঠেছে।
ইবনে ওসীম কামরায় পায়চারী করছেন। এ সময় কর্ডোভা থেকে কাসেদ ফিরে আসে। ঐতিহাসিকদের মতে আমীরে উন্দলুস জবাবী পয়গামে লিখেন,
কী ব্যাপার! তোমার কাছে এতো ফৌজ থাকতে সাধারণ ডাকাত ও লুটেরাদের বিরুদ্ধে হিমশিম খাচ্ছো? এদের সঙ্গে যদি কয়েকশ বিদ্রোহীও মিশে যায় তাহলেও তোমার ফৌজের সাথে পেরে উঠার কতা নয়। তুমি এসব কাপুরুষ সিপাহীদেরকে ওদের বিরুদ্ধে পাঠাচ্ছো অথচ তারা ডাকাতদের বিরুদ্ধে পা জমিয়ে লড়তে পারছে না। নিজে বাইরে বের হও এবং ঐ বে আইনী কর্মকান্ডের হোতাদেরকে পায়ে পিষে মারো।
ইবনে ওসীমের রক্ত যেন টগবগিয়ে উঠলো। তার সামনে পরিস্থিতি এতই ঘোলাটে হয়ে উঠেছে যে, তিনি যদি বিদ্রোহীদের সামনে অস্ত্র ফেলে আত্মসমর্পন করতেন তবুও এটা আশ্চর্যজনক বিষয় হতো না। কিন্তু তিনি নিজের মধ্যে অন্যরকম এক জিদের আগুন অনুভব করলেন। তিনি জীবনের শেষ বাজিটা খেলার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন।
এ সময় দুই সিপাহী ভেতরে এলো।
তোমরা আবার কী খবর নিয়ে এসোহা ওসীম তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, আমাদের কতগুলো চৌকি ধ্বংস হয়েছে এবং বিদ্রোহীরা কি কি সাফল্য পেয়েছে এই খবর নিয়ে এসেছো?
এ ধরনের কোন সংবাদ আমাদের কাছে নেই। দুই সিপাহীর একজন বললো, আমরা সেদিন লড়াইয়ের ময়দান থেকে বের হতেই বিদ্রোহীদের চার সাওয়ার আমাদের পিছু নেয়। আমরা দ্রুত সামনের পাহাড়ি এলাকায় চলে যাই। এবং এক জায়গায় লুকিয়ে পড়ি। যে পাহাড়ে আমার লুকাই কিছুক্ষণ পর সে চারজন সে পাহাড়ের নিচে এসে দাঁড়ায়। ওদের কথায় বুঝতে পারলাম এসব পাহাড়ের কোথাও বিশেষ কোন জায়গা আছে।
ওরা সামনের দিকে এগিয়ে যায়। আমরা ইচ্ছা করলে এ সুযোগে সেখান থেকে সরে পড়তে পারতাম। কিন্তু আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম তাদের এই গোপন জায়গাটা দেখতে হবে আমাদের। এবং সেটা আমরা দেখেও এসেছি।
ওখানে কী দেখেছো?
ওখানে একটা পর্বতগুহা আছে যার ভেতর থেকে কয়েকজন লোক বেরিয়ে আসে। আরেক সিপাহী বললো, তারপর ভেতর থেকে অতি সুন্দরী এক মেয়ে বের হয়।
হা, সেটাই, মুহাম্মাদ ইবনে ওসীম আবেগরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন, যা খুঁজছিলাম তাই। তোমরা জানো না কত বড় গোপন তথ্য তোমরা উদ্ধার করে এনেছে। এটাই বিদ্রোহীদের আত্মা- বুক বা প্রাণ। আমি সেই বুকে খঞ্জর বসিয়ে দেবো।
তিনি তখনই তার কমন্ডারদের ডাকলেন।
আমার মাত্র পনের জন এমন জানব আর আত্মত্যাগী সিপাহী প্রয়োজন, যাদের মধ্যে জাতীয়তাবাদের উম্মত্ততা আছে এবং আছে বিচক্ষণতাও। ওসীম তাদেরকে বুললেন।
একটু পরই পনের জন জানবার্য নির্বাচন করে উপস্থিত করা হলো। ইবনে ওসীম তাদেরকে খুব ভালো করে যাচাই-বাছাই করলেন। তিনি তাদেরকে বললেন,
এই দুই সিপাহীর সাথে তোমরা পাহাড়ি এলাকায় যাবে। এক গুহায় নৈশ হামলা চালাতে হবে। ওখানে কাউকে পালাতে দেবে না এবং কাউকে জীবিত পাকড়াও করবে না। শুধু যুবতী একটি মেয়েকে জীবিত পাকড়াও করবে। খ্রিষ্টানদেরকে আমরা দেখিয়ে দেবো, এই যে তোমাদের কুমারী মরিয়াম। যে কবরস্থানে আত্মপ্রকাশ করেছিলো।
তিনি কমান্ডারদেরকে আরেকটি নির্দেশ দিলেন,
আমাদের যত ফৌজ আছে সবগুলোকে এক জায়গায় একত্রিত করো। এর উদ্দেশ্য হলো, বিদ্রোহীরা মনে করবে টলায়টার ফৌজ পালাচ্ছে। তারপর বিদ্রোহীদের প্রস্তত করা সৈন্যদের ওপর সুযোগ বুঝে চূড়ান্ত হামলা করা হবে।
***
রাতের অন্ধকারে দুই সিপাহীর পথ নির্দেশনায় পনের জানবায সেই পাহড়ি এলাকায় পৌঁছে গেলো যা এক দীর্ঘ এবং প্রশস্ত কেল্লার রূপ নিয়ে তাদের শত্রুদেরকেই সুরক্ষা দিচ্ছে। ওরা এক সঙ্গে পথ চলছে না। প্রত্যেকে একটু ব্যবধান রেখে পথ চলছে।
আরে কে রে? ওদের কানে আচমকা এই শব্দ পৌঁছলো।
সবাই নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। যে আওয়াজ দিয়েছে সে এক জানবাযের সামনে এসে পড়লো। আচমকা তার পেছন থেকে জানাবায তার ঘার ধরে সজোরে মটকে দিলো এবং পরক্ষণেই তার বুকে আমুল খঞ্জর বিদ্ধ করে করে দিলো। নৈশ হামলাকারীদের তার লাশ একটা গর্তে ফেলে দিলো।
ওরা আবার আগের নিয়মে চলতে লাগলো। দুই পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে যাওয়ার সময় আবার কেউ একই ধরনের আওয়াজ করলো। অর্থাৎ এখানেও কেউ প্রহরা দিচ্ছে। সবাই নিঃশব্দে গাছ বা ঝোঁপ ঝাড়ের পেছনে চলে গেলো। শুধু দুই জানবার্য সামনে এগিয়ে গেলো।
তুমি কে ভাই! এক জানবায কণ্ঠ কাতর করে বললো, আমি তো যখমী, পানি খুঁজে ফিরছি। যে আওয়াজ দিয়েছিলো সেও এসে গেলো। তক্ষণে এক জানবার্য একটি গাছের আড়ালে কোনোকোনি ভাবে প্রস্তুত হয়ে গেছে। সে সামনে আসতেই তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো এবং তার বুকের নরম জায়গায় খঞ্জর বসিয়ে দিলো।
এ পর্যন্ত দুজন বিদ্রোহী দলের প্রহরীকে খতম করা গিয়েছে।
এর অর্থ হলো, প্রহরার ব্যবস্থা ওরা বেশ নিচ্ছিদ্র রেখেছে। জানবাস দলের কমান্ডার বললো।
আরেকটু সামনে গিয়ে আমরা এই পথ থেকে সরে পড়বো, সিপাহীদের একজন বললো, আমাদেরকে অতি দুর্গম রাস্তা দিয়ে যেতে হবে। তোমাদের সবাইকে একেবারে নীরবতা অবলম্বন করতে হবে। একটি পাতা মাড়ানোর শব্দও যেন কোথাও না হয়।
জায়গাটি মজবুত কোন কেল্লার চেয়ে কম নয়। ওরা এক পাহাড়ের ওপর উঠলো। একটু দুরে আলো দেখা গেলো। দুই জানবার্য পা টিপে টিপে সামনে এগিয়ে গেলো। ওখানে দুই লোক একটি গর্তে আগুন জ্বালিয়ে আগুন পোহাচ্ছে।
নৈশশ হামলাকারীরা ওদেরকেও চোখের পলকে যমের বাড়ি পাঠিয়ে দিলো।
তারপর ওদেরকে এই পাহাড় থেকে নেমে আরেক পাহাড়ে চড়তে হলো। সেই পাহাড় থেকে নেমে সবাই অনুভব করলো তাদের পা চোরা বালিতে দেবে যাচ্ছে। পথ নিদের্শক সিপাহীরা বললো, সম্ভবত: অন্য কোন পথ আছে। কিন্তু তরা এ রাস্তাই চিনে।
চোরা বালি গভীরতর হচ্ছে। জানবার্যরা একে অপরের হাত শক্ত করে ধরে চোরা বালির পথটুকু পার হয়ে গেলো। ঠান্ডায় ওদের পা জন্মে যাওয়ার উপক্রম হলো। কিন্তু ওরা হাটা থামালো না।
একটু পর ওরা একাধিক কণ্ঠের আওয়াজ শুনতে পেলো। এক জানবা পা টেনে টেনে হামাগুড়ি দিয়ে সেদিকে এগিয়ে গেলো।
***
ফিরে এসে সেই জানবায জানালো। সে খুব কাছ থেকে ওদের কথা শুনে এসেছে। ওদের কথায় জানা গেছে, ফ্লোরা এখানে নেই। আজ সন্ধ্যার আগে শহরের কোন গির্জায় চলে গেছে। গুহায় ভেতরে বিশ জনের কম লোক হবে না।
ওগুলো সব সন্ত্রাসী। ভেতর থেকে মদের গন্ধ আসছে। গুহার ভেতরে আলো জ্বালানো আছে। গুহার মুখটি বেশ চওড়া।
কমান্ডারের কথায় জানবাজরা সবাই এগিয়ে গেলো। দেখা গেলো, গুহার মুখে তিনজন লোক বসা আছে তীর ধনুক নিয়ে। ওদেরকে ভেতরের লোকেরা দেখতে পাচ্ছে না।
ওরা বিদ্রোহ আর সন্ত্রাস নিয়ে বেশ তাড়িয়ে তাড়িয়ে গল্প করছে। মদ ও পান করছে। তিনটি তীর আচমকা তিনজকে বিদ্ধ করলো এবং তিনজনের তীক্ষ্ণ আর্তনাদ শোনা গেলো।
আরো তিনজন লোক গুহামুখে আসলো। ওদেরও একই পরিণত হলো। গুহার ভেতরে এখনো বিশজনের মতো লোক আছে। গুহার ভেতরটা অনেক বড় ও প্রশস্ত হলেও সমতল নয়।
গুহার দেয়ালের সাথে বড় বড় পাথর রয়েছে। এগুলোর পেছনে একজন করে লোক লুকিয়ে বসে থাকতে পারবে। গুহার লোকগুলো ঐ পাথরগুলোর দিকে ছুটে গেলো। কিন্তু গুহামুখ থেকে তিনটি তীর এসে আরো তিনজনকে ফেলে দিলো।
এবার ভেতর থেকে তীর ছুটে আসতে লাগলো। কিন্তু এদের এতটুকু হুশ নেই যে, ভেতরের আলো নিভিয়ে দিলে ওদের পজিশন বেশ মজবুত হয়ে যেতো। কিছুক্ষণ তীর বিনিময় হতে লাগলো।
নৈশ হামলাকারীরা এমন দুঃসাহস দেখালো যে, চার জানবার্য হামাগুড়ি গিয়ে গুহার ভেতরে চলে গেলো। ওদেরকে বাকি জানবাযরা কভার দিতে লাগলো।
পাথরের পেছন থেকে বিদ্রোহীরা এদের দিকে তীর ছুঁড়তেই গুহা মুখ থেকে বাইরের জানবাযরা তীর ছুঁড়ে জবাব দিয়ে দিলো যে, ওরা একা নয়, আরো অনেকেই আসছে তোমাদের যমদূত হয়ে।
একটু পর একে একে জানবাদের সবাই গুহার ভেতর চলে গেলো। পাথারগুলোর পেছন থেকে বিদ্রোহী সন্ত্রাসীরা উঠে দাঁড়ালো। এবার তলোয়ার আর বর্শার সংঘর্ষ শুরু হয়ে গেলো। একটু পরই এ লড়াই খতম হয়ে গেলো।
ভেতরের সবাই মারা পড়লো। কয়েকজন গুরুতর যখমী হলো। তিন জানবায শহীদ হলো এবং দুজন হলো যখমী। জানবায়দের কমান্ডার এক আহত বিদ্রোহীকে জিজ্ঞেস করলো, তোমাদের নেতা হাশিম কামার কোথায়?
হাত দিয়ে ইঙ্গিত করলো একটি লাশের দিকে। তার দেহে দুটি তীর বিদ্ধ হয়েছে। তার লাশ টেনে বাইরে বের করা হলো।
মাঝরাত পেরিয়ে গেছে অনেক আগেই। ইবনে ওসীম বেশ অস্থির হয়ে আছেন। তিনি বার বার জানালা দিয়ে বাইরে তাকাচ্ছেন। তার সামনে তিন কমান্ডার রয়েছে। বাইরে ফৌজ প্রস্তুত হয়ে বিশ্রাম করে নিচ্ছে।
অবশেষে প্রতীক্ষার প্রহর শেষ হলো। ঘোড়ার খুর ধ্বনি শুনতে পেয়েই মুহাম্মাদ ইবনে ওসীম ওদিকে দৌড়ে গেলেন। বাইরে দশজন নৈশহামলাকারী ও পথ নির্দেশক দুটি সিপাহী দাঁড়িয়ে আছে।
তাদের সামনে শোয়ানো তিন শহীদের লাশ ও দুই যখমী। এদের একটু দূরে আরেকটি লাশ পড়ে আছে।
এটাই কি হাশিম কামারের লাশ। ইবনে ওসীম জিজ্ঞেষ করলেন।
হ্যাঁ, টলয়টার সন্ত্রাসীদের হোতা ছিলো এই হাশিমই।
এর লাশ শহরের দরজার সঙ্গে ঝুলিয়ে দাও। ইবনে ওসীম হুকুম দিলেন, যাতে সব খ্রিষ্টান ও ওদের সন্ত্রাসীরা দেখতে পায়। ভোরের আগেই এর লাশ ঝুলিয়ে দিয়ে আসে। তারপর আমরা ফ্লোরাকে দেখবো।
হাশিমের লাশ একটি ঘোড়ায় উঠানো হলো। এক অভিজ্ঞ গুপ্তচর তার লাশ নিয়ে যাচ্ছে। সে খ্রিষ্টানদের ছদ্মবেশ নিয়েছে। সে বিদ্রোহীদেরকে বলবে, সেও বিদ্রোহীদের একজন। অনেক দূর থেকে এসেছে।
এই গুপ্তচরের দ্বিতীয় কাজ হলো, সে বিদ্রোহী ফৌজের মধ্যে এটা ছড়িয়ে দেবে যে, কামার হাশিমের লাশ শহরের দরজায় ঝুলছে। রাতে কর্ডোভা থেকে বড় শক্তিশালী এক ফৌজ এসেছে। কিন্তু এরা কোথায় তাঁবু ফেলেছে এটা কারো জানা নেই।
***
টলটায় সকাল হচ্ছে। এর মধ্যে বিদ্রোহীদের ঘরে এ খবর পৌঁছে গেছে যে, তাদের আধ্যাত্মিক নেতা ও বিদ্রোহের আসল প্রাণ কামার হাশিমের লাশ শহরের ফটকের সামনে একটি গাছে ঝুলে রয়েছে।
যে লোক লাশ ঝুলিয়েছে, তাকে বলা হয়েছিলো, শহরের ফটকে লাশ ঝুলাতে। কিন্তু সে এসে দেখে ফটকে প্রহরী রয়েছে। তাই সে তোক নিঃশব্দে গাছের মধ্যে লাশটি ঝুলিয়ে দেয়।
বিদ্রোহীদের মধ্যে এখন আর আগের সেই স্বতঃস্বচূর্ততা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
ফ্লোরার ব্যাপারে গুজব ছড়িয়ে দেয়া হলো, সে মরা গেছে। ফ্লোরার সাথে যার প্রেমের সম্পর্ক রয়েছে সে তার লাশ এখান থেকে উঠিয়ে নিয়ে গেছে।
এটাও ছড়িয়ে দেয়া হলো, ফ্লোরা আসলে একটা থোকা ছিলো। সে বিয়ে ছাড়াই এক লোককে তার স্বামী বানিয়ে নিয়েছে। এর আগে তার সাথে আরেক পুরুষের সম্পর্ক ছিল। সেই হিংসার বশবর্তী হয়ে ফ্লোরাকে হত্যা করেছে।
মুহাম্মাদ ইবনে ওসীম খ্রিষ্টানদের ছদ্মবেশে কিছু লোককে শহরে পাঠিয়ে দেন। সকাল হতেই তারা ইবনে ওসীমকে জানায়, তার এই পরিকল্পনাকে মহান আল্লাহ সফল করে দেখিয়েছেন।
শহরের বাইরে বিদ্রোহীদের অর্ধেক লশকর তাঁবু ফেলে অবস্থান করছিলো। এরা হাশিমের লাশ দেখতে চলে গেছে। শহরের দরজার বাইরে এরা লাশ দেখার জন্য বিশাল ভিড়েরর সৃষ্টি করেছে। কেউ এদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।
মুহাম্মাদ ইবনে ওসীম তার সামান্য সংখ্যক ফৌজ প্রস্তুত রেখেছেন। রাতে ইবনে ওসীম ফৌজের উদ্দেশ্যে বলেন,
তোমরা আল্লাহর সিপাহী। নিজেদের ও দুশমনদের সংখ্যার দিকে তোমরা দৃষ্টি দিয়ো না। আল্লাহর রাসূল কখনো দেখেননি, মুসলমানদের চেয়ে কাফেরদের সৈন্য সংখ্যা কম না বেশি। কাফেরদের সংখ্যা সবসময়ই বেশি ছিলো আর জয় হয়েছে মুসলমানদেরই। আজ রাসূলে খোদার মহান রূহ নিজেদের বুকে জাগ্রত করে নাও।…
এটা মনে করো না খ্রিষ্টানরা তোমাদের ওপর বিজয় লাভ করছে। বরং আসল ব্যাপার হলো, খ্রিষ্টানরা ইসলামের ওপর বিজয় লাভ করছে। এটা দেখছো না যে, কর্ডোভার মহলগুলো ভোগবিলাসে ডুবে আছে। শাসকরা কী করে বেড়াচ্ছে? এরা দুনিয়ার পূজারী। এই দুনিয়াকেই সবকিছু মনে করে। কিন্তু তোমরা আল্লাহর প্রিয় পাত্র হওয়ার জন্য ব্যকুল।….
তোমাদের প্রকৃত জীবন তো এই জীবনের পর শুরু হবে। বিদ্রোহীদের কাছে আমরা একবার পরাজিত হয়েছি। সে পরাজয়কে পরম বিজয়ে রূপান্তরিত করতে হবে আমাদের। টলয়টা এখন ঐ কাফের সন্ত্রাসীদের দখলে। ওরা মুসলমানদেরকে যে হিংস্রতার টার্গেটে পরিণত করেছে সেটা তোমরা আজ হারে হারে টের পাচ্ছে। তাই তোমরা কি এই চরম অপমানের প্রতিশোধ নেবে না?
আমরা প্রতিটি রক্তের ফোঁটার প্রতিশোধ নেবো। আমরা লড়বো, মরবো। ফৌজ শ্লোগান দিয়ে উঠলো, কর্ডোভা থেকে সাহায্য না এলে কর্ডোভার সিংহাসন উল্টে দেবো। আল্লাহর হুকুমত প্রতিষ্ঠা করবো। আমাদের শহীদ ভাইদের রক্তের হিসাব চুকিয়ে দেবো।
এরপর আর মুহাম্মাদ ইবনে ওসীম কিছু বলতে পারলেন না। কারণ, খবর এসেছে! কামার হাশিমের লাশ দেখতে বিদ্রোহীরা লাশের কাছে ভিড় করছে।
তিনি ফৌজকে তৎক্ষণাৎ কোচ করার হুকুম দিলেন।
ব্যবধান বড় জোড় দুই মাইল। তিনি তার ফৌজকে ছড়িয়ে দিলেন। এখন ফৌজ এক মাইল লম্বা সারিতে সারিবদ্ধ হয়ে এগুচ্ছে। ঘোড়ার গতি পদাতিক সিপাহীর সমান রাখা হলো। হামলার নেতৃত্ব রইলো মুহাম্মাদ ইবনে ওসীমের হাতে।
পথে পড়লো বিদ্রোহী লশকরের তাবুর শিবির। শিবির পুরোটাই খালি। সকাল হওয়াতে নাস্তা তৈরির জন্য আগুন জ্বলছে। হুকুম পেয়ে সিপাহীরা পুরো শিবিরে আগুন লাগিয়ে দিলো। বিদ্রোহীর সৈন্যরা শহরের সামনে প্রচন্ড ভিড় করে আছে। এই ভিড় থেকে হৈ চৈ করে আওয়াজ উঠলো,
আসছে… হামলা আসছে। ফৌজ আসছে। এতে কর্ডোভার ফৌজ, কর্ডোভার ফৌজ আসছে।
লোকদের মধ্যে হুলুস্থুল পড়ে গেলো। দিশেহারা হয়ে একে অপরকে মাড়িয়ে দিক-বিদিক হতে লাগলো।
মুহাম্মাদ ইবনে ওসীম হামলে পড়ার হুকুম দিলেন। ফৌজ ছড়ানো ছিটোনো বিন্যাস অক্ষুণ্ণ রেখেই সপাটে ছুটে আসতে লাগলো। বিদ্রোহী সন্ত্রাসলীরা এদিক-ওদিক পালাতে শুরু করলো। কিন্তু পালানোর সময় নেই, আর পালানোর পথও ফৌজ আটকে দিয়েছে। এটা ভোলা এবং সমতল এক ময়দান।
যে সব বিদ্রোহীর কাছে অস্ত্র রয়েছে তারা লড়াইয়ে নেমে গেলো। আর যারা শহরের দরজা দিয়ে ভেতরে যেতে পারলো তারা ভেতরে চলে গেলো। এর মধ্যে বেশ কয়েকজন ভিড়ের চাপে পায়ের নিচে পড়ে পিষ্ট হয়ে গেলো।
বিদ্রোহী যারা লড়তে এলো তারা বেশ দৃঢ়তার সঙ্গেই লড়লো। কিন্তু বেশিক্ষণ টিকতে পারলো না। সবগুলো মারা পড়লো। ইতোমধ্যে শহরের ভেতর থেকে বিদ্রোহীরা শহরের ফটক লাগিয়ে দিলো। আর প্রাচীরের ওপর থেকে শুরু হয়ে গেলো তীর বৃষ্টি।
ইবনে ওসীমের এই ফৌজ যেমন চারদিকে ধুলো উড়িয়ে তুফানের মত আসছিলো তেমনি তুফানের মতোই পিছু হটে গেলো।
সন্ত্রাসীদের অর্ধেক সৈন্য মারা পড়েছে। কিন্তু মুহাম্মাদ ইবনে ওসীমের কাছে এত বড় শহরকে অবরোধ করার মতো তো সৈন্যবল ছিলো না।
***
মুহাম্মাদ ইবনে ওসৗম এক গাছতলায় বসে আল্লাহর দরবারে হাত তুলে হাউ মাউ করে কাঁদতে লাগলেন। আল্লাহ তাআলা তার দুআ শুনলেন।
ইতিহাসে একে অলৌকিকতা বলে আখ্যা দেয়া হয়েছে। দ্বিতীয় দিনই সংবাদ এলো, আব্দুর রহমানের ছেলে উমাইয়্যার নেতৃত্বে সেনা সাহায্য আসছে। ইবনে ওসৗম ঘোড়া সাওয়ার হয়ে তাকে সংবর্ধনা দিতে চলে গেলেন।
ইতিহাসে এটা উল্লিখিত হয়নি যে, উমাইয়্যা আব্দুর রহমানের কোন স্ত্রীর ছেলে। মুদ্দাসসিরা তখনো যুবতী। উমাইয়্যার বয়স তখন বিশ একুশ বছর।
উমাইয়্যা তার ফৌজ নিয়ে যথা সময়ে পৌঁছে গেলো। মুহাম্মদ ইবনে ওসীম তাকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। অনেক সময় আলিঙ্গনাবদ্ধ রাখলেন। যেন হারানো সন্তানকে খুঁজে পেয়েছেন তিনি। সেখানে দাঁড়িয়েই আকাশের দিকে হাত তুলে কান্নাভেজা কণ্ঠে ফুপাতে ফুপাতে বললেন,
রাব্বল আলামীন! জানতাম, তোমার এই বান্দা পাপিষ্ঠ হলেও তাকে তুমি তোমার অফুরন্ত সাহায্য থেকে বঞ্চি করবে না।
আব্বাজানকে বাধ্য করার পরই তিনি কিছু ফৌজ নিয়ে আমাকে টলয়টা পাঠিয়েছেন। উমাইয়্যা জানালো ইবনে ওসীমকে।
ইবনে ওসীম এখানকার আসল পরিস্থিতি সম্পর্কে উমাইয়্যা জানালেন। সে রাতেই টলটা অবরোধ করা হলো। শহরের দরজায় হামলা করা হলো। কিন্তু প্রাচীরের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা তীরান্দাজরা কোন চেষ্টাই সফল হতে দেয়নি। প্রাচীরের নিচ দিয়ে সুড়ঙ্গ করার চেষ্টা করা হয়। এটাও ব্যর্থ হয়।
অবরোধ অনেক দিন রইলো। কিন্তু সফল হলো না। উমাইয়্যা অবরোধ উঠিয়ে নেয়ার হুকুম দিয়ে দিলো। বিদ্রোহীরা এটা দেখে হয়রান হয়ে গেলো যে, কর্ডোভার ফৌজ শুধু অবরোধই উঠালোই না, ফৌজ ফিরে যাচ্ছে।
বিদ্রোহীদের নেতারা হৈ চৈ করে বলে উঠলো, এই ফৌজকে জীবিত ফিরে যেতে দেয়া হবে না। এদের পিছু ধাওয়া করো।
শহরের ফটক খুলে দেয়া হলো। হাজারো অশ্বারোহী ও পদাতিক এমনভাবে বের হলো যেন নদীর বাঁধ ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে।
কর্ডোভার ফৌজ ততক্ষণে কাট্রাড নামক পাহাড়ি এলাকার কাছে পৌঁছে গেছে। পেছনে পেছনে বিদ্রোহী সন্ত্রাসীদের আসতে দেখে উমাইয়্যা তার ফৌজকে পালানোর হুকুম দিলো।
ফৌজ পালানোর জন্য দ্রুত ছুটতে শুরু করলো এবং পাহাড়ি এলাকায় ঢুকে দ্রুত ছড়িয়ে পড়লো। বিদ্রোহীরা তো এবার বাঘের মতো দুঃসাহসী হয়ে উঠলো। তাদের সওয়াররাও সপাটে ছুটে পাহাড়ে ঢুকে পড়লো।
যখন দুশমনের পুরো বাহিনী পাহাড়ে ঢুকে পড়লো তখন তাদের ওপর পাহাড়গুলোর ওপর থেকে তীরের বর্ষণ শুরু হলো।
মায়সারা নামে এক নওমুসলিমের পরামর্শে উমাইয়্যা বিদ্রোহী সন্ত্রাসীদের জন্য এই মরণঘাতের জাল বিস্তার করে।
খ্রিষ্টানরা জয়ের নেশায় বড়ই বোকামি করে বসলো এবং কমান্ডার মায়সারা ও উমাইয়্যার জালে পা দিলো। মায়সারার তীরান্দাযরা তাদেরকে বেছে বেছে মারতে শুরু করলো।
এরা পেছন দিকে ভাগতে চাইলে উমাইয়্যার সৈন্যরা শুরু করলো তীর আর পাথর বর্ষণ।
ঐতিহাসিকরা লিখেন,
কালট্রাডের পাহাড়ি এলাকায় খ্রিষ্টান বিদ্রোহী সন্ত্রাসীদের এত বেশি রক্ত ঝরেছে যে, ঘোড়ার খুরাঘাতে রক্তের ছাট উটতে লাগলো। হাতে গোনা দুচারজন বিদ্রোহী ছাড়া আর কেউ প্রাণ নিয়ে পালাতে পারেনি।
মায়সারা তখনো পাহাড়ের উচ্চতা থেকে তার ইউনিটের সেনাদের নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছিলো। মায়সারা একজন প্রবীণ কমান্ডার হওয়ার পরও এত বেশি রক্ত ও লাশ দেখে এক পর্যায়ে অচেতন হয়ে পড়ে যায়। আর তিন দিন পর মারা। যায়।
পরিকল্পনা মতো মুহাম্মাদ ইবনে ওসীম তার বিজয়ী ফৌজ নিয়ে শহরে প্রবেশ করেন। টলয়টা শহর এখন নীরব, শান্ত এবং সন্ত্রাসী ও জঙ্গিমুক্ত।
সুলতানা মালিকায়ে তরূবের বয়ষ এখন পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই। আব্দুর রহমানের বয়স ষাট ছুঁই ছুঁই। যারিয়াবেরও একই বয়স। সুলতানার একমাত্র ছেলে আব্দুল্লাহ উনিশ বিশ বছরের যুবক।
আব্দুর রহমানের চিন্তা-ভাবনা ও স্বভাবে কিছুটা পরিবর্তন এসেছ। যারিয়াবের মধ্যেও আগের সেই ধার ও তীক্ষ্মতা নেই।
আমীর আব্দুর রহমান হলেও কিছুদিন তো কার্যত: বাদশাহী করেছে যারিয়াব। তার মুখের জাদু আর সুরের মুগ্ধতা দিয়ে আমীর আব্দুর রহমানকে বাদশাহ বানিয়ে দিয়েছে। তার মাথায় শাহেন শায়িতের ভূত সাওয়ার করে দিয়েছে।
উন্দলুসের ফৌজে ছিলো কিছু ইসলামী গণতন্ত্রকামী এবং স্বাধীনতাকামী সেনা কর্মকর্তা। যারা আব্দুর রহমানের মাথা থেকে কোন এক সময় বাদশাহী এর ভূথ নামাতে সক্ষম হয়। আর না হয় আব্দুর রহমানের শাসনামলেই উন্দলুস খ্রিষ্টানদের দখলে চলে যেতো।
যারিয়াবের তীক্ষ্ম মেধার প্রশংসা সব ঐতিহাসিকই করেছেন। সে বেশ কয়েক বছর পর এটা উপলব্ধি করতে পারে যে, এখানে সালারে আলা উবাইদুল্লাহ ইবনে আব্দুল্লাহ, হাজিব আব্দুল করীম, সালার আব্দুর রউফ, মুসা ইবনে মুসা, সালার ফারতুন এবং আব্দুর রহমানের ভাই মুহাম্মাদের মতো। বিচক্ষণ মর্দে মুজাহিদদের সঙ্গে আর বেশি দিন পেরে উঠবে না। মহলে তার যে অবস্থান সেটা থেকেও সে বঞ্চিত হয়ে যাবে।
সে তো তার অবস্থান এতো উর্দুতে নিয়ে গিয়েছিলো যে, যাকে সে চাইতো তাকে আমীরে উন্দলুসের চোখে আকাশে উঠিয়ে দিতে এবং যাকে খুশি তাকে আস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করতো।
কিন্তু তার উপলব্ধি হওয়ার পর নিজ থেকে সে তার অবস্থান কিছুটা নিচে নামিয়ে ফেলে। সে তার সুর সঙ্গীতে মগ্ন হয়ে যায়। তবে সুলতানার প্রেম সে তার মন-মস্তিষ্ক থেকে কখনো নামাতে পারেনি। সুলতানা তার জন্য ছিলো এক উম্মাদনার নাম।
আমার সুর ছন্দে সেই প্রাণ ও সেই আয়েশ আমি খুঁজে পাই না যা তোমার রূপের মাধুরীতে আমি অনুভব করি। যারিয়ার সুলতানাকে সবসময় বলতো। আমি এখনো তোমার হাসির জলতরঙ্গ আমার সুর তরঙ্গে সৃষ্টি করতে পারিনি।
যারিয়াবের সামনে সুলতানা থাকলে তার চেতনার জগতই যেন লোপ পেয়ে যেতো। সুলতানা তখন তাকে বলতে শুরু করতো, তুমি এখন বিয়ে করে নাও।
আমার মনে ও আমার জীবনে অন্য কোন মেয়ে আসতে পারবে না। যারিয়াব একদিন তাকে শেষ সিদ্ধান্ত শুনিয়ে দেয়। এটা পঁচিশ বছর আগের কথা। সে তখন বলে, তুমি থাকলে আমার সবকিছু আছে।
কিন্তু আমি তো আমীরে উন্দলুসের। সুলতানা তাকে বলতো, তুমি তো আমাকে হেরমের চার দেয়াল থেকে ছিনতাই করে নিতে পারবে না। তোমার সাথে আমি পালিয়ে যেতে পারি। কিন্তু পালিয়ে যাবো কোথায়? কোথাও গিয়ে আশ্রয় নেয়ার আগেই ধরা পড়ে যাবো আমরা। তখন আমাদের পরিণাম কী হবে। সেটা তো তুমি ভালো করেই জানো।…
আমাকে নিয়ে ঘর-সংসার বাঁধার স্বপ্ন তাই তুমি মন থেকে দূর করে দাও। কিন্তু আমাকে সবসময় তোমারই মনে করো। আমি কি তোমাকে শত সহস্রবার আমার জায়গীরে নিয়ে যাইনি? দিনে কিংবা রাতের নির্জনতায় তোমার ও আমার দেহের মাঝখানে আর কাউকে আমি রেখেছি? না কখনো কল্পনা করতে পেরেছি? তোমার কাছেই আমি আমার কাংখিত আনন্দ আর তৃপ্তি পাই। এটাই আমাকে বাঁচার প্রেরণা দেয়।
এক সময় তো সবার জীবনেই পরিবর্তন আসে। সাবই বদলে যায়। পরিবর্তন আসে স্বভাবে চরিত্রে এবং চিন্তা-ভাবনাতেও। এর মধ্যে উন্দলুসের নদীগুলোর ওপর দিয়ে বয়ে গেছে বহু পানি। উন্দলুসের অলি-গলি, ময়দান ও উপত্যকায় ঝরে গেছে বহু রক্ত। কিন্তু সুলতানার স্বভাবে কোন পরিবর্তন আসেনি।
তার জীবেন শুধু এতটুক পরিবর্তন এসেছে, সে এক সন্তানের মা হয়েছে। সে উন্দলুসের সম্রাজ্ঞী হওয়ার স্বপ্ন দেখতো। তার এই স্বপ্ন এক মারিচিকা ছাড়া কিছুই প্রমাণিত হয়নি। এজন্য সে খ্রিষ্টান নেতাদের সাথে সবসময় সম্পর্ক রেখেছে। তাদের প্রতিটি ষড়যন্ত্রে তার কালো হাত রয়েছে সবসময়।
আব্দুররহমানের সিংহাসন উল্টানোরও চেষ্টা করেছে। কিন্তু সফল হয়নি। ভয়ংকর কালনাগিনীর চরিত্র কখনো বদলায়নি। পঞ্চাশে এসেও তার এই রূপ কখনো ধারবিহীন হয়নি।
আসলে সুলতানা তার বয়সকালকেই মেনে নেয়নি।
এখনো সুলতানা নিজেকে যুবতীই মনে করে। তার রাজকীয় জীবনে তো কোন দুশ্চিন্তা বা পিছুটান নেই। চোখ মুখের সজীবতা এতটুকু ম্লান হয়নি। কমেনি মাথার চুলের উজ্জলতা।
একদিন তার এক খাদেমা তার মাথা আচড়ে দিচ্ছিলো। খাদেমা চিরুনি রেখে একটি চুল মাথ থেকে উঠালো, সুলতানা, উফ করে উঠলো। সে খাদেমাকে জিজ্ঞেস করলো,
কী ব্যাপার? মাথায় কি করেছো?
একটা পাকা চুল মাথা থেকে উপড়ে ফেলেছি।
মিথ্যা কথা। এখনই পাকা চুল? সুলতানা বললো।
বৃদ্ধা খাদেমা হেসে উঠলো এবং রূপালী বর্ণের চুলটি তার সামনে এনে রাখলো।
একটাই নয় মালিকা! খাদেমা বললো, আরো বেশ কয়েকটা আছে। আপনি তো স্বর্ণাকেশী। তাই পাকা চুলগুলো ভালো করে নজরে পড়ে না। এই তো এখানে কয়েকটা আছে।
কয়েকটা আছে? সুলতানা এমনভাবে বললো যেন তাকে তার কোন প্রিয়জনের মৃত্যুর সংবাদ দেয়া হয়েছে।
হ্যাঁ, মালিকায়ে তরূব! খাদেমা বললো, কয়েকটি পাকা চুলে এত বিস্ময়! আপনি এত ঘাবড়ে গেলেন কেন? চুল তো সাদা হবেই। একদিন মৃত্যুও হবে। যৌবন তো আমিও দেখেছি। আর এমন রূপ ছিলো আমার যে, আমীর, ওযীর, সালাররা থ হয়ে দাঁড়িয়ে আমাকে দেখতে।
বর্তমান আমীরে উন্দলুসের বাপ আল হাকাম আমাকে দেখে তো তাঁর ব্যক্তিগত আস্তাবল থেকে আমার বাপকে একটি আরবী ঘোড়া যিনসহ এবং একটি তলোয়ারও দেন। যার বাটে ছিলো দুটি জ্বলজ্বলে হিরা। তারপর আমার বাবাকে বিশেষ মর্যাদাও দান করেন। আর আমাকে তার জন্য নিশ্চিত করেন।….
আমিও মনে করতাম, রূপ যৌবনের কোন ক্ষয় নেই। আমার মাথার প্রথম পাকা চুলটি আমাকে ক্ষ্যাপিয়ে দিয়ে ছিলো। আমি চুলটি আক্রোশে ছুঁড়ে মারি। কিন্তু কিছু দিন পরই মানতে বাধ্য হই, যে চুল আমীরে উন্দলুসের শিকলের মতো পেচিয়ে ধরেছিলো সে চুল সাদা হয়ে এখন অর্থহীন হয়ে যাবে। এটা মেনে নিই যে, আমার রূপের চমক আর কোন দিন কাউকে আকর্ষিত করবে না।….
মালিকায়ে তরূব! তখন থেকে আমি মহলের বোঝা হয়ে গেলাম। হেরেমের আস্তকুড়ে আমাকে নিক্ষেপ করে। সে সব মেয়ের দিনও দেখেছি যাদের চারপাশে সখিরা ঘুরেছে। আমীর পুত্ররা তাদের পানি গ্রহণের জন্য তাদের কাছে ছুটে এসেছে। তাদের ইশারায় পুরো মহল নাচতো। সেই তারাও অচল মুদ্রা হয়ে গেছে। আমার বয়স পোত্তর হয়ে গেছে। আমি হেরমের প্রতিটি মেয়ে, নর্তকী ও গায়িকাদের জন্য এক শিক্ষনীয় উদাহরণ।
মালিকা! আপনি এই বাস্তবতাকে গ্রহণ করে নিন যে, আপনার সময় শেষ হয়ে গেছে। আমীরে উন্দলুস আব্দুর রহমানও প্রায় বৃদ্ধ হয়ে গিয়েছেন। এখন কোন রূপবতী যুবতী মেয়েই তার মধ্যে সেই আবেগ আর যৌবনের আমেজ জাগিয়ে তুলতে পারবে না।
সুলতানা তার অতীতে হারিয়ে গেলো। উদাম চোখে ঘরের জানালার দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর নিঃশব্দে উঠে কামরায় পায়চারী করতে লাগলো।
মালিকায়ে তরূব! খাদেমা বললো, আপনি এত বিচলিত হয়ে পড়েছেন কেন? আপনি সৌভাগ্যবতী যে, আমীরে উন্দলুস আপনাকে এখনো আপনার সেই অবস্থান থেকে বঞ্চিত করেননি। আমি তো আপনার প্রতি সহানুভূতিশীল। আপনি সবসময় আপনার মনের কথা আমাকে বলেছেন। এজন্য আমি আপনাকে বাস্তব কথাটা বলে দিয়েছি। আপনাকে আমি পেরেশান করতে চাইনি।
আমি জানি! সুলতানা বললো, তোমার আন্তরিকতা নিয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই। আমীরে উন্দলুস আমাকে আমার অবস্থান থেকে ছুঁড়ে মারেননি। তবে বছর খানেক হয়ে গেলো তিনি আমাকে তার কাছে যেতে আর আগের মতো ডাকাডাকি করেন না। আমি নিজ থেকে কখনো উনার কাছে গেলে তিনি কোন ব্যস্ততার কথা তুলে আমাকে চলে আসতে বলেছেন। এখন আমার নিঃসঙ্গ জীবন কাটছে। যারিয়াব না থাকলে হয়তো আমি বেঁচে থাকতে পারতাম না।
আপনার ছেলে সদ্য যুবক। তাকে খোদা দীর্ঘজীবন দান করুন। খাদেমা বললো, ওর জন্যই এখন আপনার বাকি জীবনটুকু বিলিয়ে দিন। তাকে সিংহাসনের উত্তরাধিকার হিসাবে গড়ে তুলুন। আমীরে উন্দলুস বৃদ্ধ বয়সেও প্রতিটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করছেন। যে কোন সময় তাঁর মৃত্যু হতে পারে।
অবশ্যই, অবশ্যই। আমি তো গত বিশ বছর ধরে এ চেষ্টাই করে যাচ্ছি। কিন্তু আমীরে উন্দলুস এ ব্যাপারে কখনো কোন কথা বলেননি। এর অবশ্য কারণও আছে। আমার ছেলে স্বভাব-চরিত্রে বিগড়ে গেছে। আমি তো ওকে শাহজাদা বানিয়েছি। কিন্তু ও আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। ওকে আমি শাহসাওয়ারী ও তীরান্দাজী শিখতে সেরা উস্তাদের কাছে পাঠিয়েছি। কিন্তু সে ফাঁকি দিয়ে কোথাও চলে গেছে। টাকা-পয়সা উড়ানো ছাড়া আর কিছুই শিখেনি সে।
যে টাকা-পয়সা উড়াতে জানে না সে আবার কিসের শাহজাদা! আমীরে উন্দলুসের পয়তাল্লিশজন ছেলে রয়েছে। এর মধ্যে বিলাসী আর অপব্যয়কারী তো সবাই।
সুলতানা আয়নার সামনে গিয়ে বসলো। আরেকটি পাকা চুল তার নজরে পড়লো। মুখটা যেন অভিমানে ফুলে উঠলো।
তুমি যাও। যারিয়াব যদি ব্যস্ত না থাকে ওকে বলো সুলতানা ডেকেছে। সুলতানা খাদেমাকে বলে আবার আয়নার দিকে মনোযোগ দিলো।
খাদেমা চলে যাওয়ার পর সুলতানা প্রথমে আয়নার সামনে গেলো। নিজের চেহারা মনোযোগ দিয়ে দেখলো। তারপর বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো।
একটু পর কামরায় পায়ের আওয়াজ শুনতে পেলো। যারিয়াব হাসি মুখে কামরায় ঢুকলো। কিন্ত সুলতানার মুখে সেই হাসি নেই।
চিন্তিত মনে হচ্ছে সুলতানা! যারিয়াব বললো এবং তাকে দুই বাহুতে জড়িয়ে টেনে এনে পালংকে বসিয়ে দিলো বললো, আমার মুখটা এভাবে মনোযোগ দিয়ে দেখছো কেন?
গতকাল যখন তুমি আমার কাছে এসেছিলে তখন তো তোমার চেহারায় এমন বার্ধক্যের ছাপ দেখিনি। আজ সেটা দেখা যাচ্ছে। সুলতানা চিন্তিত মুখেই বললো।
তোমার খাদেমা আমাকে বলেছে তুমি আজ বেশ পেরেশান। যারিয়াব বললো, সে এর কারণও বলেছে যে, তোমার মাথা থেকে আজ পাকা চুল উদ্ধার করেছে। এই পাকা চুল আবিস্কারের আগে তুমি তোমাকে এবং আমাকে যুবকই মনে করতে। নিজের বার্ধক্যের অনুভূতি-উপলব্ধি তোমার ভেতরটা এমনভাবে ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছে যে, তোমার চোখে এখন আমাকেও বুড়ো লাগছে।……
আমরা সত্যিই বার্ধক্যের উপনীত। এতে তো দুশ্চিন্তার কোন কিছু নেই। বার্ধক্য মানুষের ব্যক্তিত্ববোধকে শুধু বাড়ায়ই না তীক্ষ্মও করে। বার্ধক্য আসার আগে তো মানুষ পুর্ণাঙ্গ মানুষ হতে পারে না। আমি কিন্তু বার্ধক্যে পৌঁছে নিজের মধ্যে পূর্ণতা অনুভব করছি।
সুলতানা আরো পেরেশান আর অস্থির হয়ে গেলো। তার মাথা যারিয়াবের বাস্তব দর্শন গ্রহণ করছে না। সে যারিয়ারের কাছেই শুনতে চায়, সে বয়স্কা হয়নি। তার প্রয়োজন সান্ত্বনার।
তুমি কি আমাকে একটু ভালো ভালো কথা শোনাতে পারো না? সুলতানা কিছুটা চাপা অসন্তোষ নিয়ে বললো, তুমি তো আমার কাছে এসে এই জগৎ থেকে অন্য জগতে চলে যেতে। এখন কি আর আমার প্রতি সেই ভালোবাসা নেই?
আগের চেয়ে অনেক বেশি আছে। যারিয়ার বললো, কিন্তু সে সময়টা আমরা অতীত করে এসেছি যে সময়তে আর ফিরে যেতে পারবো না। সে সময়ের জন্য আক্ষেপ করাটা অনেক বড় বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়। তোমার এই ভয়াবহ দুশ্চিন্তার কারণ হলো, সময় এগিয়ে যাচ্ছে আর তুমি পেছন দিকে পালানোর পথ খুঁজছে। অধরা অতীতকে ভুল যাও সুলতানা! যে মুহর্তগুলো তোমাকে ছেড়ে যাচ্ছে তা থেকেই শান্তির পরশ খুঁজে নাও।
হা যারিয়াব! সুলতানা বললো, তুমি হেয়ালি করলেও এটা ঠিক যে, আমি হারানো দিনে পালিয়ে যেতে যাচ্ছি। অতীতের মায়াজাল থেকে বেরোতে চাচ্ছি না আমি। আগের মতো রূপসী না থাকলেও রূপমা, স্মৃতি আর কল্পনা দিয়ে নিজেকে রূপবর্তী করে রাখবো।…
নিঃসঙ্গতা আমাকে দংশন করে যাচ্ছে। অজানা এক ভয় আমাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। আগের রূপ নিয়ে আমার সাথে কথা বলো যারিয়াব। তোমার কাছে তো শব্দের ভান্ডার আছে। শব্দের ওপর বহন করে আমাকে অতীতে নিয়ে চলো।….
তোমার সুঠাম বাহুতে কি সেই শক্তি নেই যারিয়াব? আমাকে একটু শক্ত করে ধরছো না কেন? আমার মনের মধ্যে কমপক্ষে এটা ঢুকিয়ে দিয়ো না যে, আমি এক ঝরে যাওয়া শুকনো ফুল; গাছের ছায়ায়ও যার আশ্রয় নেই।
তোমার এই শরীর সর্বস্ব মনমাসকিতা থেকে কি তুমি মুক্ত হতে পারো না? যারিয়াব বললো, নিজের ভেতরের আত্মাকে জাগিয়ে তোলো। দেহের বার্ধক্য আত্মার যৌবন নিয়ে আসে। আমি আমার দেহের শক্তিকে আত্মায় বহন করে নিয়েছি।
সুলতানা ভীতু শিশুর মতো যারিয়াবের বুকে লুকাতে চেষ্টা করলো। কিন্তু যারিয়ার উঠে দাঁড়ালো।
তুমি মিথ্যা আশ্রয় খুঁজছে। গতকালের স্মৃতিকে আকড়ে ধরে আজকের বাস্তবতা থেকে নিজেকে আড়াল করতে চাইছে। নিজের মেধা আর বুদ্ধিকে তার আসল ঠিকানায় প্রয়োগ করো। তারপর আমি তোমার সাথে অতীতের কথা বলবো।
এক পেয়ালা শরাব পান করার পর সুলতানার যৌবন আবার যেন ফিরে এলো। তার অঙ্গ-ভঙ্গি আবার আবেদনময়ী হয়ে উঠলো। দুহাতে যারিয়াবের গলা জড়িয়ে ধরলো।
যারিয়াব! আমি তোমার দাসী! সুলতানা কাতর কণ্ঠে বললো। একমাত্র তুমিই আমাকে মন থেকে ভালোবেসেছে। আমি আমীরে উন্দলুসকে এতটুকু সন্দিহান হতে দেইনি যে, মুসলমানদের সবচেয়ে বড় দুশমন ইউগেলিসের সাথে আমার গভীর সম্পর্ক রয়েছে। আর আমি তার সিংহাসন উল্টানোর চেষ্টা করেছি সব সময়। কিন্তু তোমর বিরুদ্ধে আমার সব সময় এ অভিযোগ ছিলো যে, এ কাজে তুমি আমাকে অতটা সঙ্গ দাওনি।
আমি সঙ্গ দিলেও তুমি ও ইউগেলিস কখনো সফল হতে না। আমি পঁচিশ বছর আগে আমার বিবেক আমি এজন্য পরিস্কার করে নিই যে, বার্ধক্যে পৌঁছে যেন আমি অনুতপ্ত ও লজ্জাবতন না হই। এর পরিণামেই আজ আমি অনেকটাই নিশ্চিন্ত এবং ভারমুক্ত।
যারিয়াব সুলতানার হাত থেকে শরাব নিয়ে এক ঢোক পান করে পাত্রটি রেখে দিলো। তার মাথার চুলেও কোথাও কোথাও পাক ধরেছে। কিন্তু এই বয়সেও সে সুলতানাকে আগের মতোই ভালোবাসে।
***