নবম অধ্যায়
কৃষি-উন্নয়নে শিল্প ও কৃষির আন্তঃসম্পর্ক
আধুনিক যুগেও দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রক্রিয়াকে মসৃণ রাখতে গেলে অ-কৃষি ক্ষেত্রের সম্প্রসারণের সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রেখে কৃষিতে উন্নতি ঘটানো জরুরি। কৃষি-উদ্বৃত্ত শুধু যে অ-কৃষি ক্ষেত্রকে খাদ্য ও শিল্পের জন্য কাঁচামালের জোগান দিয়ে বঁচিয়ে রাখে তাই নয়, শিল্পজাত দ্রব্যের বাজারও তৈরি করে। সামগ্রিকভাবে শিল্পের ওপর বিনিয়োগ করলে শ্রমের নিয়োগ বাড়ে, ফলে খাদ্যের সঙ্গে সঙ্গে শিল্পজাত ভোগ্যপণ্যের চাহিদাও বাড়ে। এই অতিরিক্ত চাহিদা ভোগ্যপণ্য উৎপাদন শিল্পেও বিনিয়োগ বাড়ানোর অবস্থা তৈরি করে। ফলে দ্বিতীয় স্তরে শ্রমের নিয়োগ বাড়ে। এই দুই স্তরের মিলিত ক্রিয়ায় একদিকে শিল্পজাত পণ্যের বিপুল জোগান বাড়ে, অন্যদিকে খাদ্যশস্যের চাহিদা বাড়ে। কিন্তু পাশাপাশি কৃষি উৎপাদন না বাড়াতে পারলে খাদ্যশস্যের দাম বাড়ে। ন্যূনতম খাদ্য কিনতেই শ্রমিক ও দরিদ্র মানুষের আয়ের বড় অংশ চলে যায়। ফলে শিল্পজাত পণ্যের ওপর মানুষের ব্যয় করার ক্ষমতা সীমিত হয়ে পড়ে, বাজারে শিল্পজাত দ্রব্যের চাহিদা কমে, শিল্পে বিনিয়োগ কমে, উৎপাদন কমে যায়। উন্নয়নের গতি বজায় রাখতে হলে একদিকে শিল্পজাত পণ্যের বাজারের সম্প্রসারণ প্রয়োজন, অন্যদিকে খাদ্যের জোগানও যথেষ্ট বাড়ানো দরকার। কিন্তু খাদ্যের জোগান বাড়ার ফলে খাদ্যের দাম কমে গেলে কৃষকের আয় কমে যেতে পারে, ফলে কৃষিক্ষেত্র থেকে শিল্পজাত পণ্যের চাহিদা কমার প্রবণতা দেখা দিতে পারে। অন্যদিকে শিল্পোৎপাদন বাড়লে সেই শিল্পজাত দ্রব্য বিক্রির জন্য ও শিল্পে উন্নয়ন আনার জন্য দেশীয় অভ্যন্তরীণ বাজারের সীমাবদ্ধতা যে-সমস্যা তৈরি করে তার পরিপ্রেক্ষিতে কৃষি-আয়ের নিয়মিত বৃদ্ধি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই কৃষি-উৎপাদন বাড়ানোই যথেষ্ট নয়, এই বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কৃষিপণ্যের যথাযথ বিপণন দরকার যাতে কৃষিপণ্যের দাম কমার প্রবণতা ও কৃষকের আয় কমার প্রবণতা নিয়ন্ত্রণে থাকে। এ জন্য সরকারি হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হতে পারে। উন্নয়নশীল দেশে বিশাল সংখ্যক মানুষের আয় আসে কৃষি থেকে। তাই এইসব দেশে কৃষি শিল্পজাত পণ্যের বাজার তৈরিতে বিশেষ ভূমিকা নেয়। উন্নয়নশীল আধুনিক অর্থনীতিতে কৃষি-উন্নয়নের প্রক্রিয়া, কৃষিতে নিযুক্ত বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে কৃষি-আয়ের বণ্টন ও এর সঙ্গে শিল্পজাত পণ্যের চাহিদার আন্তঃসম্পর্ক একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং জটিল বিষয়।
দেশীয় অভ্যন্তরীণ বাজার হিসেবে কৃষির গুরুত্ব নির্ভর করে কৃষি-উন্নয়নের ফলে কোন শ্রেণির হাতে কৃষি-আয়ের অধিকাংশ জমা হচ্ছে, তার ওপর। কৃষি-আয়ের অধিকাংশ যদি একটি মুষ্টিমেয় সম্পন্ন শ্রেণির হাতে জমা হয় তাহলে এই উন্নয়ন সাধারণ শিল্পজাত ভোগ্যপণ্যের চাহিদা যথেষ্ট বাড়াতে পারে না। এর কারণ, আয় বাড়লেও এই শ্রেণিটি তার সামান্য অংশই সাধারণ ভোগ্যপণ্যের ওপর ব্যয় করে। অন্যদিকে কৃষির বর্ধিত আয়ের বেশির ভাগ যদি অসংখ্য ছোট চাষির আয় বাড়ায় তাহলে সাধারণ শিল্পজাত ভোগ্যপণ্যের বাজার সম্প্রসারিত হতে পারে, কারণ এই শ্রেণিভুক্ত ব্যক্তিরা তাদের আয়ের অধিকাংশই সাধারণ ভোগ্যপণ্য কিনতে ব্যয় করে। উন্নয়নশীল দেশে বিশাল সংখ্যক মানুষের আয় আসে কৃষি থেকে, তাই এইসব দেশে শিল্পজাত পণ্যের বাজার তৈরিতে কৃষি এক বিশেষ ভূমিকা নেয়।
অর্থনীতির অনুন্নত স্তরে থাকা কোনও দেশে অর্থনীতিতে শিল্পায়নের সূচনা হওয়ার আগে, সামগ্রিক উন্নয়ন-প্রক্রিয়ার প্রাথমিক পর্যায়ে, কৃষি যে-ভূমিকা পালন করে তা নিয়ে আলোচনা করেছেন ডবলিউ এ লুইস।১ লুইস অবশ্য উন্নয়ন বলতে আধুনিক শিল্পায়নকেই বুঝেছেন। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গীতে উন্নয়ন তথা শিল্পায়ন শুরুর আগে দেশটি প্রধানত সনাতন ন্যূনতম বেঁচে থাকার সামগ্রী উৎপাদনের উপযুক্ত অনুন্নত উৎপাদন কাঠামোর ওপর নির্ভর করে। সনাতন উৎপাদন-ক্ষেত্র বলতে প্রধানত কৃষি ও ছোট অ-কৃষি ক্ষেত্র বোঝানো হয়েছে। এই উৎপাদন-ক্ষেত্রগুলিতে ন্যূনতম প্রয়োজন মেটানোর মতো সর্বনিম্ন মজুরি-হারে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি সংখ্যক মজুরি শ্রমিক নিযুক্ত থাকে। অর্থাৎ এই সনাতন ক্ষেত্রে শ্রমিকের মাথাপিছু গড় উৎপাদনের পরিমাণ তার মজুরির হারের সমান। এই মজুরি-হার একটি শ্রমিকের ন্যূনতম বেঁচে থাকার প্রয়োজনের সমান। শিল্পায়ন শুরু হওয়ার স্তরে স্বল্প বিনিয়োগযোগ্য পুঁজি নিয়ে দেশটি উন্নয়নের পথে যায়। নতুন কিছু শুরু করার জন্য শিল্পোৎপাদন-ক্ষেত্র সনাতন উৎপাদন-ক্ষেত্র থেকে তার প্রয়োজনীয় মজুরি শ্রমিক পায়। সনাতন ক্ষেত্র থেকে শিল্পোৎপাদন-ক্ষেত্রে মজুরি শ্রমিক টেনে আনার জন্য এই নতুন গড়ে উঠতে থাকা শিল্পক্ষেত্রের মজুরি-হার রাখা হয় ন্যূনতম স্তরের তুলনায় সামান্য উঁচুতে। উৎপাদন-প্রক্রিয়া শুরু হলে আধুনিক শিল্পক্ষেত্র সনাতন ক্ষেত্র থেকে মজুরি-শ্রমিক ও অত্যন্ত কম মূল্যে প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য ইত্যাদি পেতে পারে। আধুনিক শিল্পক্ষেত্র সনাতন ক্ষেত্র থেকে ততক্ষণই শ্রমিক টেনে এনে নিয়োগ করে, যতক্ষণ না শ্রমিকের প্রান্তিক উৎপাদন তার মজুরির সমান হয়। এই বিশ্লেষণ প্রাথমিক যে-অনুমানের ওপর তৈরি হয়েছে তা হল, উৎপাদনের অন্যান্য উপকরণের নিয়োগ স্থির রেখে যদি শ্রমিকের নিয়োগ বাড়ানো হতে থাকে, তাহলে প্রতি এককে উৎপাদন তার পূর্ববর্তী এককের উৎপাদনের থেকে কম হতে থাকে। এইভাবে পরপর শ্রমিক নিয়োগ করে যেতে থাকলে একসময় প্রতি এককে উৎপাদন কমতে কমতে শ্রমিকের মজুরির সমান হয়ে গেলে আর বেশি শ্রমিক নিয়োগ করা হয় না, কারণ সেই স্তরের উৎপাদন-মূল্য শ্রমিকের মজুরির থেকে কম। এই স্তরে পৌঁছানোর ঠিক আগের স্তর, যেখানে শ্রমিকের উৎপাদন তার মজুরির সমান, সেই স্তরের উৎপাদনকে বলে প্রান্তিক উৎপাদন। এই প্রান্তিক উৎপাদনের স্তরে পৌঁছানোর আগের প্রত্যেক এককে শ্রমিকের মজুরির থেকে তার উৎপাদন বেশি থাকে। ফলে শ্রমিককে মজুরি দেওয়ার পর মালিকের হাতে উদ্বৃত্ত জমা হয়। মালিক সেই উদ্বৃত্ত উৎপাদন-ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করে। এইভাবে শ্রমিকের উৎপাদিত উদ্বৃত্ত পুঁজিতে পরিণত হয়, যা কাজে লাগিয়ে মালিক শুধু যে উৎপাদন সম্প্রসারণ করে তাই নয়, মালিক উৎপাদনে ব্যবহারের যন্ত্রপাতিও তৈরি করতে পারে। এইভাবে সনাতন ক্ষেত্র থেকে আধুনিক ক্ষেত্রে শ্রমিকের বহির্গমন হতে থাকলে একসময় সনাতন ক্ষেত্রে প্রয়োজনের অতিরিক্ত যত উদ্বৃত্ত শ্রমিক ছিল, তা নিঃশেষ হয়ে যায়, এবং সনাতন ক্ষেত্রের পক্ষে আর সস্তায় শ্রমিক জোগান দেওয়ার সুযোগ থাকে না। ফলে সনাতন ক্ষেত্রে শ্রমিকের মজুরি বাড়ে। সনাতন ক্ষেত্রে শ্রমিকের মজুরি ও নিয়োগ আর আগের মতো শ্রমিকের গড় উৎপাদন দিয়ে ঠিক হয় না, ঠিক হয় প্রান্তিক উৎপাদনের নিরিখে। অর্থাৎ কৃষিতেও শিল্পের অনুরূপ পুঁজিবাদী উৎপাদন-সম্পর্ক চালু হয়। অন্যদিকে শিল্পও আরও বেশি পুঁজিঘন প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করে, শিল্পেও আরও আধুনিক, কম শ্রমনির্ভর, বেশি মাত্রায় মূলধনি উপাদান-নির্ভর প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ে।
এইভাবে লুইস দেখিয়েছেন, প্রাক্পুঁজিবাদী উৎপাদন-সম্পর্কের ওপর দাঁড়ানো কৃষি-নির্ভর অর্থনীতিও কৃষিতে বিদ্যমান উদ্বৃত্ত শ্রম উৎপাদনশীল ভাবে কাজে লাগিয়ে শিল্পায়নের পথে অগ্রসর হতে পারে ও কৃষিতেও উন্নত পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্কের সূচনা করতে পারে। কিন্তু লুইসের এই বিশ্লেষণটি স্বল্পোন্নত অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য সংক্রান্ত কিছু কিছু প্রাথমিক অনুমানের ওপর নির্ভর করে নির্মিত হয়েছে, সেই অনুমানগুলি স্বল্পোন্নত দেশের প্রাক্শিল্পায়ন যুগের বাস্তব অবস্থার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। একটি স্বল্পোন্নত দেশ, যেখানে বেশির ভাগ মানুষের জীবিকার প্রধান উৎস কৃষি ও ক্ষুদ্র পারিবারিক শিল্প, সেখানে শিল্পায়নের অভাবে অর্থনীতিতে নানা পিছিয়ে-পড়া বৈশিষ্ট্য বিরাজ করে। এই সমস্ত পিছিয়ে-পড়া অর্থনীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য হল উপযুক্ত পরিকাঠামোর অভাব, জমি ও উৎপাদনের উপকরণের সুসংগঠিত বাজার-ব্যবস্থার অনুপস্থিতি ও উৎপাদন-কাঠামোতে নানাপ্রকার পিছিয়ে পড়া বৈশিষ্ট্যের সমাবেশ। এইসব অর্থনীতিতে প্রায়শই দেখা যায়, ছোট উৎপাদকরা জমি ও অন্যান্য উপকরণের সঙ্গে দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ রয়েছে। শিল্পায়নের একেবারে প্রাথমিক স্তরে শিল্পে ন্যূনতম মজুরির ওপর স্বল্প বেশি মজুরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি সহজে গ্রাম থেকে শহরে শ্রমিকের বহির্গমন ঘটাতে পারে না। শ্রমের ও জমিসহ অন্যান্য উপকরণের সঙ্গে, ও তার সাবেক বাসস্থানের সঙ্গে, শ্রমিকের অভিন্ন আত্মিক যোগ কেবলমাত্র অর্থনীতির এই নিয়মে ছিন্ন হয় না। এর জন্য প্রয়োজন পুঁজিবাদের অনুকূলে দৃঢ় প্রত্যয়ী ও শক্তিশালী একটি রাজনৈতিক-সামাজিক ও আইনগত ব্যবস্থা, যা কৃষকের পূর্বতন আয়ের উৎস থেকে ছোট চাষিকে উচ্ছেদ করে, এবং এই উপকরণগুলিকে পুঁজিবাদ বিকাশের স্বার্থে নতুন ভাবে কাজে লাগানোর পরিস্থিতি তৈরি করে। আমরা দেখেছি ইংল্যান্ডে ১৬৮৮-’৮৯-এর বিপ্লব তার মূল চরিত্রের দিক দিয়ে ছিল বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব, যা নতুন একটি রাজনৈতিক-সামাজিক ব্যবস্থার পত্তন করেছিল এবং পরিবর্তন আনার জন্য প্রয়োজনীয় পূর্বশর্ত মেটানোর অবস্থা তৈরি করেছিল। জমি ও আদি বাসভূমি থেকে শ্রমজীবী মানুষকে মুক্ত শ্রমিকশ্রেণিতে পরিণত করার উপায় ছিল বলপ্রয়োগ ও সেই পদ্ধতির অনুকূলে বিস্তৃত আইন ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল। লুইস স্বল্পোন্নত প্রাক্শিল্পায়ন যুগের যে-অর্থনীতি নিয়ে আলোচনা করেছেন, সেই দেশগুলির অধিকাংশই দীর্ঘদিনের সাম্রাজ্যবাদী শাসনের অধীনতা কাটিয়ে সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশ। শিল্পায়নের প্রক্রিয়ায় কৃষির যে-ভূমিকা লুইস তাঁর তত্ত্বে অনুমান করেছেন, এইসব দেশের কৃষি-অর্থনীতিতে বিদ্যমান নানা ধরনের প্রাক্-পুঁজিবাদী উপাদান ও জাড্যর কারণে বাস্তবে কৃষি সেই ভূমিকা পালন করতে পারে না। আমূল ভূমি-সংস্কারের মাধ্যমে ভূমি-সম্পর্ক পরিবর্তনের যথাযথ কর্মসূচি তৈরি করা হলেও তার রূপায়ণের মাধ্যমে ভূমি-সম্পর্কে কেবল ততটুকুই পরিবর্তন আনা সম্ভব, যেটুকুতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার শীর্ষে থাকা শ্রেণিগুলির স্বার্থ বিপন্ন না হয়। অনেকসময় কৃষির উৎপাদন-ক্ষমতার তুলনায় কৃষিতে উদ্বৃত্ত মানুষের চাপ অত্যধিক বেড়ে গেলে দেখা যায় কৃষি ছেড়ে মানুষ শহরাঞ্চলে বিকল্প জীবিকার সন্ধানে বহির্গমন করে। কিন্তু শিল্প-উন্নয়নের স্বল্প বিকাশের দরুন কৃষি থেকে উচ্ছিন্ন এই অতিরিক্ত মানুষের জন্য শিল্প যথেষ্ট অর্থকরী নিয়োগের ব্যবস্থা করতে পারে না। এই বিশাল সংখ্যক উদ্বৃত্ত মানুষ হয় শহরে বেকারত্বের পরিমাণ বাড়ায়, অথবা অসংগঠিত সংস্থা বা স্বনিযুক্তি সংস্থার বিপুল প্রসার ঘটায়। এই অবস্থা ভারতের মতো অর্থনীতির বাস্তবতাকেই প্রকাশ করে।
পোল্যান্ডের অর্থনীতিবিদ এম কালেস্কি২ (M Kalecki) এরকম এক বাস্তব পরিপ্রেক্ষিতকে বিচারে এনে স্বল্পোন্নত দেশের উন্নয়ন-প্রক্রিয়ায় কৃষির ভূমিকা সম্পর্কে যে-তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করেছেন তা আমাদের মতো দেশের সমস্যার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রযোজ্য। আমরা এখানে কালেস্কি-র তাত্ত্বিক বিশ্লেষণটি আলোচনা করে আমাদের দেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী চার দশকের সামগ্রিক উন্নয়নে, বিশেষ করে কৃষি-উন্নয়নে, যে-নীতি নেওয়া হয়েছিল তার পর্যালোচনা করেছি।
কালেস্কি (Kalecki) তাঁর বিশ্লেষণের ক্ষেত্র হিসেবে একটি উন্নয়নশীল দেশের উদাহরণ নিয়েছেন। এখানে শিল্পক্ষেত্রে হয় অব্যবহৃত উৎপাদন-ক্ষমতা উপস্থিত, অথবা স্বল্প বিনিয়োগের মাধ্যমে সেই ক্ষমতা বাড়ানো সম্ভব। সুতরাং শিল্পে স্বল্প বিনিয়োগের মাধ্যমেই অব্যবহৃত উৎপাদন-ক্ষমতা ব্যবহার করে সহজে উৎপাদন বৃদ্ধি সম্ভব। দ্বিতীয়ত, এই স্বল্পোন্নত অর্থনীতিতে কৃষিক্ষেত্রে পিছিয়ে-পড়া উৎপাদন-সম্পর্ক ও বহু ধরনের কাঠামোগত পশ্চাদপদ প্রাতিষ্ঠানিক বৈশিষ্ট্য উপস্থিত থাকায় কৃষি-উৎপাদনে স্বল্পকালের মধ্যে যথেষ্ট বৃদ্ধি সম্ভব নয়।
কালেস্কি তাঁর বিশ্লেষণে এমন একটি অর্থনীতির কথা বলেছেন যেখানে তিনটি শ্রেণির অস্তিত্ব আছে। প্রথমত, ধনী মালিক-শ্রেণি। দ্বিতীয়ত, ছোট উৎপাদক, যাদের মধ্যে রয়েছে ছোট চাষি যারা নিজেদের জমি নিজেরাই চাষ করে, ও ছোট কারিগর। এবং তৃতীয়ত, শ্রমিক-শ্রেণি। সমগ্র অর্থনীতিটি দু’টি ভাগে বিভক্ত। বিনিয়োগযোগ্য মূলধনি দ্রব্য ও এই মূলধনি দ্রব্য উৎপাদনের বিভিন্ন স্তরে যে-দ্রব্যগুলি কাজে লাগে সেই সব কিছুর উৎপাদন-ব্যবস্থা নিয়ে রয়েছে প্রথম বিভাগ। এই বিভাগে অন্তিম স্তরে পণ্যদ্রব্যগুলির মোট মূল্য দেশের মোট বিনিয়োগের সমান। দ্বিতীয় বিভাগে উৎপন্ন হয় ভোগ্যপণ্য, যার মধ্যে কৃষি-উৎপাদন, বিশেষ করে খাদ্য উৎপাদন-ক্ষেত্রটি প্রধান স্থান অধিকার করে আছে। এই বিভাগে অন্তিম স্তরে উৎপন্ন দ্রব্যের মোট মূল্য দেশের মোট ভোগের সমান। প্রত্যেক বিভাগে উৎপন্ন দ্রব্যের মূল্য ভোগ ও সঞ্চয় এই দু’ভাগে ভাগ হয়। প্রথম বিভাগের মালিক-শ্রেণি ও শ্রমিক-শ্রেণি মোট যত মূল্যের ভোগ্যপণ্য ভোগ করে সেটি দ্বিতীয় বিভাগের মোট সঞ্চয়ের মূল্যের সমান, কারণ দ্বিতীয় বিভাগে উৎপন্ন ভোগ্যপণ্যের মূল্যের যে-অংশ দ্বিতীয় বিভাগ সঞ্চয় করে, প্রথম বিভাগ সেই মূল্যের সমান ভোগ্যপণ্যই তার ভোগের জন্য পেতে পারে। অর্থনীতিতে উৎপাদনের ক্ষেত্রে কোথাও কোনও প্রয়োজনাতিরিক্ত কিছু উৎপন্ন হচ্ছে না ধরে নিলে আমরা বলতে পারি, প্রথম বিভাগের মোট ভোগের মূল্য দ্বিতীয় বিভাগের মোট সঞ্চয়ের মূল্যের সমান। এই অবস্থা অর্থনীতির ভারসাম্য বোঝায়। কারণ দ্বিতীয় বিভাগের মোট সঞ্চয়ের সঙ্গে প্রথম বিভাগের সঞ্চয় যোগ করলে দেশের মোট সঞ্চয় পাওয়া যাবে, যার মূল্য প্রথম বিভাগের মোট ভোগের মূল্য ও মোট সঞ্চয়ের মূল্যের যোগফল, অর্থাৎ তা প্রথম বিভাগের মোট উৎপাদন-মূল্যের সমান হবে। অর্থাৎ দেশের মোট সঞ্চয় মোট বিনিয়োগের মূল্যের সমান হবে। বিষয়টি বোঝার জন্য আমরা কয়েকটি সাংকেতিক চিহ্ন ব্যবহার করেছি (বস্তুত চিহ্নগুলি কালেস্কি নিজেই তাঁর বইতে এইভাবে ব্যবহার করেছেন)।
ধরা যাক, প্রথম বিভাগের ভোগ ও সঞ্চয়ের মূল্য যথাক্রমে
C1 এবং S1
ও দ্বিতীয় বিভাগের মোট ভোগ ও সঞ্চয়ের মূল্য যথাক্রমে
C2 এবং S2
এবার, যেহেতু প্রথম বিভাগের মোট ভোগের মূল্য দ্বিতীয় বিভাগের মোট সঞ্চয়ের মূল্যের সমান, আমরা লিখতে পারি:
C1 = S2
সমীকরণটির বাম, ডান উভয় পার্শ্বে S1 যোগ করে পাই
C1+S1 = S1+S2
=> I = S
অর্থাৎ প্রথম বিভাগের মোট উৎপাদনের মূল্য দেশের মোট সঞ্চয়ের মূল্যের সমান। আবার, আমরা জানি, প্রথম বিভাগের মোট উৎপাদনের মূল্য দেশের মোট বিনিয়োগের মূল্যের সমান। সুতরাং উপরোক্ত শেষ সমীকরণটি বিনিয়োগ-মূল্যের সঙ্গে সঞ্চয়-মূল্যের সমতা বোঝাচ্ছে, যা স্বল্পকালের মেয়াদে দেশের মোট চাহিদার সঙ্গে মোট জোগানের ও সার্বিকভাবে আর্থিক ভারসাম্যের অবস্থা বোঝায়। এবার উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে যদি বিনিয়োগ বাড়ানো হয় তাহলে প্রথম বিভাগে উৎপাদন ও শ্রমিকের নিয়োগ বাড়বে। এর ফলে প্রাথমিকভাবে খাদ্যের চাহিদা বাড়বে। সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয় বিভাগ অর্থাৎ কৃষিবিভাগ খাদ্যের উৎপাদন বাড়াতে পারবে না। কারণ দ্বিতীয় বিভাগ, যার মূল অংশ কৃষি, নানারকম কাঠামোগত পশ্চাদপদতার শিকার। ভূমি-সম্পর্কে রয়ে গেছে নানা জাড্য, যার ফলে খাদ্যের উৎপাদন স্বল্পকালে বাড়ানো সম্ভব হয় না। খাদ্যোৎপাদন ও খাদ্যের জোগানে এই জাড্যের পরিপ্রেক্ষিতে খাদ্যের চাহিদা বাড়তে থাকলে খাদ্যের দাম বাড়ার প্রবণতা দেখা দেবে। ফলে শ্রমিকের প্রকৃত আয় কমবে। কিন্তু খাদ্যের চাহিদা কমবে না, কারণ খাদ্য নিত্যপ্রয়োজনের সামগ্রী তাই খাদ্যের চাহিদা অস্থিতিস্থাপক, গরিব মানুষ খাদ্য কেনা কমাতে পারে না। ফলে তাদের খাদ্যের ওপর ব্যয় বাড়বে, যদিও তাদের প্রকৃত আয় কমেছে। খাদ্যশস্যের মূল্যবৃদ্ধির ফলে ছোট উৎপাদকের আয় বাড়বে না, বরং বড় উৎপাদক ও কৃষিজ দ্রব্যের ব্যবসায়ীদের আয় বাড়বে, ফলে সামগ্রিকভাবে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের চাহিদা কমবে, কারণ বড় চাষি ও ব্যবসায়ীরা তাদের আয়ের সামান্য অংশই এই ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় সাধারণ দ্রব্য কিনতে খরচ করে থাকে। খাদ্যের ওপর খরচ বাড়ার ফলে ছোট উৎপাদক, কৃষি-শ্রমিক ও শিল্প-শ্রমিকরা খাদ্য ছাড়া অন্য যেসব সাধারণ ভোগ্যপণ্য ভোগ করে থাকে সেগুলির ওপর খরচ কমাতে বাধ্য হবে। অর্থাৎ এইসব সাধারণ অ-কৃষিজাত ভোগ্যপণ্যের চাহিদা কমবে এবং সেসবের উৎপাদন কমাতে হবে, ফলে এইসব সাধারণ সামগ্রী উৎপাদনের জন্য যেসব মূলধনি দ্রব্য দরকার হয়, তাদের চাহিদাও কমবে। ফলে উৎপাদন-চক্রের দ্বিতীয় স্তরে মূলধনি পণ্যের উৎপাদন, যা মূলত প্রথম বিভাগে উৎপাদিত হয়, সেগুলির চাহিদা কমে যাবে। একদিকে খাদ্যের দাম বাড়ার প্রতিক্রিয়ায় সব বিভাগে শিল্প-শ্রমিকের আর্থিক মজুরি বাড়বে, ও অন্যান্য সামগ্রীর দামও বাড়বে, অন্যদিকে একই সঙ্গে ভোগ্যপণ্য, এমনকী মূলধনি পণ্যেরও উৎপাদন কমবে ও উৎপাদন-ক্ষেত্রগুলিতে শ্রমিকের নিয়োগ কমবে। এই অবস্থাকে কালেস্কি ‘স্ট্যাগফ্লেশন’ বলে বর্ণনা করেছেন, যা মন্দা ও মুদ্রাস্ফীতির মতো বিপরীতধর্মী অর্থনৈতিক অবস্থার সহাবস্থান। এই পরিস্থিতির উদ্ভব রোধ করতে হলে কৃষিকে কাঠামোগত জড়ত্ব থেকে মুক্ত করে কৃষিপণ্যের জোগানে স্থিতিস্থাপকতা বাড়ানো প্রয়োজন। কালেস্কির মতে, এইসব দেশে উন্নয়নের প্রক্রিয়ায় কৃষিকে তার যথাযথ ভূমিকায় স্থাপন করতে হলে কৃষি-উৎপাদন বাড়ানোর জন্য আমূল ভূমিসংস্কার কর্মসূচির প্রণয়ন চাই, একই সঙ্গে তার যথাযথ রূপায়ণও চাই। কৃষি-উৎপাদন বাড়ানোর বিকল্প পদ্ধতি হিসেবে অনেক সময়েই প্রকৌশলগত উন্নতির ওপর জোর দেওয়া হয়। কিন্তু প্রকৌশলগত উন্নতির সাহায্যে কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর রাস্তায় কৃষিপণ্যের অসম বণ্টন ঘটে। এই পদ্ধতিতে বড় চাষি ও কৃষিপণ্যের ব্যবসায়ীর আয় বাড়ে, অন্যান্য শ্রেণিগুলির আয় বাড়ে না। উপরন্তু কৃষি উৎপাদন কম শ্রমনির্ভর হয়ে পড়ায় শ্রমিকের নিয়োগ কমে। এইভাবে শ্রমিক ও ছোট উৎপাদকের বিপক্ষে ও বড় উৎপাদক ও ব্যবসায়ীদের সপক্ষে কৃষি-আয়ের পুনর্বণ্টন ঘটবে। অন্যদিকে পুরনো অ-সংস্কৃত কৃষি-কাঠামো বজায় রেখে প্রকৌশলের উন্নয়ন কৃষি-উৎপাদনের বৃদ্ধিকে দীর্ঘস্থায়ী করতে পারবে কি না সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ থাকবে। যাই হোক, প্রকৌশলের উন্নতি তাৎক্ষণিকভাবে কৃষি-উৎপাদন বাড়াবে ঠিকই, কিন্তু ছোট চাষি ও ছোট উৎপাদকের আয় না বাড়ায় প্রকৌশলগত উন্নতির সাহায্যে কৃষি-উৎপাদন বাড়ানোর এই পদ্ধতিতে সাধারণ শিল্পজাত ভোগ্যপণ্যের চাহিদার সংকট ও মূল্যবৃদ্ধি বা স্ট্যাগফ্লেশনের সমস্যাকে রোধ করতে পারবে না। ফলে স্বল্পোন্নত দেশে শিল্পে বিনিয়োগ বাড়ানোর মাধ্যমে স্ট্যাগফ্লেশনের মতো সমস্যা এড়িয়ে উন্নয়নের কার্যক্রম সফল করতে হলে প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে আমূল ভূমিসংস্কারের মাধ্যমে কৃষি-আয়ের পুনর্বণ্টন মারফত সাধারণ শিল্পজাত ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বাড়াতে হবে। শিল্পে বিনিয়োগ বাড়ানোর কর্মসূচি রূপায়ণের আগে কৃষিতে আমূল কাঠামোগত সংস্কার করে ছোট উৎপাদক ও কৃষি-শ্রমিকের পক্ষে আয়ের বণ্টন সুনিশ্চিত করে কৃষি আয়ের অপেক্ষাকৃত সুষম বণ্টনের মাধ্যমে কৃষিতে শিল্পপণ্যের অন্তর্দেশীয় বাজার প্রসারিত করা যায় ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে শিল্পোন্নয়নের কর্মসূচি সফলভাবে রূপায়ণ করা যায়।
একথা ঠিক, সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন অ-কৃষি উৎপাদন-ক্ষেত্রের প্রসার ঘটে। উন্নত দেশে যেমন জাতীয় আয় ও কর্মসংস্থানের দিক থেকে কৃষির তুলনামূলক অবদান, উন্নয়নশীল দেশের তুলনায়, যথেষ্ট কম। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রসার ঘটলে শিল্পোন্নয়নের পথে অভ্যন্তরীণ বাজারের সীমাবদ্ধতা যে সমস্যা তৈরি করে তা অনেকটা কমে। তখন শিল্পোন্নয়নের জন্য শিল্পজাত দ্রব্যের দেশীয় বাজার গড়ে তোলা ও প্রসারিত করা ও এ জন্য কৃষি-আয় বৃদ্ধির ভূমিকা আর আগের মতো গুরুত্বপূর্ণ থাকে না। শিল্পোন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে কৃষিজাত দ্রব্য, বিশেষ করে খাদ্যশস্য ও ফলমূল, শাকসবজি ইত্যাদির চাহিদায় যে-বৃদ্ধি ঘটে তার জন্য এবং সেইসঙ্গে বহির্বাণিজ্যে কৃষির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্যও উন্নত দেশগুলিতে কৃষি গুরুত্বপূর্ণ। কৃষিপণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারে উন্নত দেশগুলির নিয়ন্ত্রক ভূমিকা লক্ষ করলেই এই দেশগুলিতে কৃষির বিশাল গুরুত্বের আঁচ মেলে। চাল-গমের মতো অত্যাবশ্যক খাদ্যপণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারে অতি উন্নত দেশগুলিই প্রধান রফতানিকারক দেশ। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের কিছু দেশ, যেমন ফ্রান্স, কিছুকাল যাবৎ খাদ্যশস্যের আন্তর্জাতিক বাজারে তীব্র প্রতিযোগিতায় রত। যা থেকে বোঝা যাচ্ছে, আজকের ইউরোপে উন্নত দেশগুলির অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে কৃষির তুলনামূলক গুরুত্ব কমে গেলেও এসব দেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে রফতানি-দ্রব্য হিসেবে কৃষি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে।
স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে মোট ভৌগোলিক আয়তনের শতকরা পঁয়তাল্লিশ ভাগে রয়েছে কৃষিজমি, শতকরা বাইশ ভাগ জঙ্গল। ২০১৫ সালে ভারতের মোট ভৌগোলিক আয়তন ছিল ৩২৯ মিলিয়ন হেক্টর, এর মধ্যে নিট কর্ষিত জমির পরিমাণ ১৪১ মিলিয়ন হেক্টর অর্থাৎ শতকরা ৪২.৮৫ ভাগ। একই জমিতে একাধিক বার চাষের হিসেবকে ধরলে গ্রস কর্ষিত জমির পরিমাণ দাঁড়ায় ১৯৫ মিলিয়ন হেক্টর। ১৯৫০ সালে মোট জনসংখ্যার শতকরা ৮২ ভাগ ছিল গ্রামীণ জনসংখ্যা। কৃষিতে কর্মরত মানুষের অনুপাত ছিল মোট কর্মরত মানুষের শতকরা ৭০ ভাগ। ২০১৩ সালে এই সংখ্যাগুলি নেমে এসেছে যথাক্রমে শতকরা ৬৬ ও ৫০ ভাগে। কৃষিজমির প্রায় আশি ভাগে খাদ্যশস্য উৎপাদন হয়।
এই সমস্ত পরিসংখ্যান বাদ দিয়েও স্বাধীনতা-উত্তর ভারতীয় অর্থনীতির উন্নয়নের ধারা লক্ষ করলে ভারতীয় অর্থনীতিতে কৃষির গুরুত্ব সহজেই বোঝা যায়। ভারতে দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় ১৯৫৫ থেকে ১৯৬০ সালের মধ্যে শিল্পক্ষেত্রে বিপুল পরিমাণে বিনিয়োগ বাড়ানো হয়। দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের পরিকল্পনা-মডেলটি রূপায়িত করা হয়। সোভিয়েত রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিকে গড়ে তোলার জন্য ১৯২১ সালে ফেল্ডম্যান একটি পরিকল্পনা মডেল নির্মাণ করেন। অধ্যাপক মহলানবিশের পরিকল্পনাটি অনেকাংশে ফেল্ডম্যান মডেলের অনুরূপ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার পর সোভিয়েত দেশকে একটি শিল্পসমৃদ্ধ শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত করার উদ্দেশ্যে উন্নয়ন-মডেলের এই বিশেষ রূপটি অনুসরণ করা হয়, যা অচিরে সোভিয়েত রাশিয়াকে একটি শিল্পসমৃদ্ধ শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল। অধ্যাপক মহলানবিশ ফেল্ডম্যান মডেল সংক্রান্ত ধারণা ব্যতিরেকে আমাদের দেশকে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে শিল্পসমৃদ্ধ করে তোলার যে-মডেলটি নির্মাণ করেন তার মূল বৈশিষ্ট্য হল, কৃষি ও অন্যান্য ক্ষেত্রের তুলনায় শিল্পে অধিক বিনিয়োগ, যেখানে এই বিনিয়োগের বড় অংশ যাবে সাধারণ ভোগ্যপণ্যের তুলনায় ভারী মূলধনি শিল্প ও পরিকাঠামো নির্মাণ-শিল্পে। তুলনায় সাধারণ ব্যবহারের নিমিত্ত প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য উৎপাদন-শিল্পে, ও কৃষিতে, মোট বিনিয়োগের সামান্য অংশই ধার্য করা হয়। এসবের ফলে ’৬০ থেকে ’৬৫ সালের মধ্যে শিল্পোৎপাদনে অভূতপূর্ণ বৃদ্ধি ঘটে। ওই সময়ের মধ্যে মোট শিল্পোৎপাদনে বৃদ্ধির হার ছিল শতকরা ৮ ভাগ। মূলধনি দ্রব্যে বৃদ্ধির হার ছিল প্রায় শতকরা ১২ ভাগেরও বেশি। অপরদিকে সাধারণ মানুষের ভোগ্যপণ্য শিল্পে উৎপাদন বৃদ্ধির হার তেমন বাড়েনি। ভারতের মতো দেশে যেখানে ব্যাপক বেকারত্ব ও তীব্র দারিদ্র মানুষের জীবন অস্থির করে তুলছিল, সেখানে শিল্পদ্রব্যের বিনিয়োগে ও জোগানে যে-বৃদ্ধি ঘটানো হয় তা অন্তর্দেশীয় চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করতে পারছিল না। এর সঙ্গে ষাটের দশকে তীব্র খাদ্যাভাবের ফলে খাদ্যের দাম অভূতপূর্ব মাত্রায় বাড়ে। শিল্পোৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কৃষিপণ্যের ও অন্য ভোগ্যপণ্যের জোগান বৃদ্ধি না পাওয়ায় সমস্ত ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ে। শিল্পক্ষেত্রে এই ভারসাম্যহীন বিনিয়োগে বৃদ্ধির ফলে ’৬৫ থেকে ’৭০ সালের মধ্যে শিল্পোৎপন্নের হার কমে শতকরা ৪-এ এসে দাঁড়ায়। ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে সত্তরের দশক জুড়ে ভারতের শিল্পক্ষেত্রে মন্দা দেখা দেয়। তার একটা বড় কারণ, শিল্প-বিনিয়োগের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কৃষি-উৎপাদন বাড়ানোর কাজে যথেষ্ট উদ্যোগের অভাব। শিল্পে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেলে কৃষিজাত পণ্য, বিশেষ করে খাদ্যের চাহিদা বাড়ে। এর সঙ্গে তাল রেখে কৃষিজাত পণ্যের উৎপাদন স্বল্পকালের ব্যবধানে বাড়ানো সম্ভব হয় না। পঞ্চাশের দশকের পর থেকে ষাটের দশকের মাঝামাঝি অবধি কৃষি-উৎপাদনের হার যথেষ্ট নীচে থাকায় চাহিদা বৃদ্ধির কারণে খাদ্যে মূল্যবৃদ্ধি ঘটে। দরিদ্র কৃষকের প্রকৃত আয় কমে যায় কিন্তু খাদ্যের মতো অতি প্রয়োজনীয় সামগ্রীর চাহিদা অ-স্থিতিস্থাপক হওয়ার কারণে খাদ্যের চাহিদা সেই তুলনায় কমে না। ফলে গরিব ছোট উৎপাদক ও কৃষি-শ্রমিকের মোট আয়ের যে-অংশ খাদ্যের জন্য ব্যয় হয় সেই অংশ পরিমাণে বাড়ে। তাদের অ-কৃষিজাত ভোগ্যপণ্যের ওপর ব্যয় করার ক্ষমতা কমে। ফলে সাধারণ ভোগ্যপণ্য উৎপাদন-শিল্পে চাহিদার অভাবের কারণে কালেস্কি বর্ণিত ‘স্ট্যাগফ্লেশন’ নামক বিশেষ অবস্থা তৈরি হয়। এইসময় শিল্পক্ষেত্রে ব্যবহৃত মূলধনি দ্রব্যেরও চাহিদা কমে ও উৎপাদন কমানো হয়। মধ্য ষাটের দশকে শিল্পোৎপাদনের হার নেমে আসে। শিল্পে একই সঙ্গে মন্দা ও মুদ্রাস্ফীতির অবস্থা তৈরি হয়। মুদ্রাস্ফীতি হয়ে ওঠে ভারতীয় অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য। গোটা ’৭০-এর দশক ‘স্ট্যাগফ্লেশন’-এর কবলে পড়ে। কৃষিতে উন্নয়ন বৃদ্ধি ও বেকারত্ব কমানো তখন আশু কর্তব্য হিসেবে দেখা দেয়। যে-মূলধনি ভারী শিল্পগুলিতে বিনিয়োগ বাড়ানো হয়েছিল সেইসব ক্ষেত্রে নিয়োগ বাড়লেও এইসব শিল্পগুলি বিদেশ থেকে আমদানি করা অত্যন্ত বেশি মূলধন-ঘন প্রকৌশলের ওপর নির্ভরশীল ছিল। ফলে শ্রমে নিয়োগবৃদ্ধির হার ছিল প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল, বেকারত্বের পরিমাণে হ্রাসের হার ছিল অকিঞ্চিৎকর। সুতরাং কৃষি-উৎপাদন ক্ষেত্রের সম্প্রসারণ ও কৃষি-উৎপাদন বৃদ্ধি ছিল একেবারে প্রাথমিক প্রয়োজন। কালেস্কি দেখিয়েছেন, কৃষি-উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কৃষিতে আধুনিক প্রকৌশলের ব্যবহার এ ক্ষেত্রে মোটেই কার্যকর নয়। কারণ এই পদ্ধতিতে কৃষি-আয়ের পুনর্বণ্টনে দরিদ্র মানুষের পরিবর্তে অবস্থাপন্ন বড় চাষি ও কৃষিপণ্যের ব্যবসায়ীদের আয় বাড়ে অনেক বেশি। ফলে দেশের অভ্যন্তরে শিল্পের বাজার তৈরির সমস্যার কোনও সমাধান হয় না। আমরা দেখেছি, ভারতের কৃষিতে ভূমিসংস্কারের কাজটি যথাযথ সম্পন্ন না হওয়ায় কৃষি-উৎপাদনের পশ্চাদপদ বৈশিষ্ট্যগুলি তার দ্রূত বৃদ্ধির পথে কঠিন অন্তরায় হিসেবে থেকে গেছে। কিন্তু কৃষি-উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য জরুরি ছিল যেটা, সেই ভূমি-সংস্কারের অসমাপিত কাজ সম্পন্ন না করেই মধ্য-ষাটের পর কৃষিতে প্রকৌশলগত উন্নতির জন্য সবুজ বিপ্লবের কর্মসূচি নেওয়া হয়। সত্তরের দশকে সেই কর্মসূচি রূপায়ণের সময় থেকেই চাল ও গমের হেক্টর-পিছু উৎপাদন বাড়ে। কৃষিপণ্যে আমদানির ওপর নির্ভরতা কমে। ফলে বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডারে কৃষিখাতে ব্যয় কমে ও উন্নয়নের জন্য অন্যান্য অতি প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে বিদেশি মুদ্রার ব্যবহার সহজ হয়। একই সঙ্গে খাদ্যশস্যের জোগান বাড়ার ফলে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সহজ হয়। শিল্পোন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় অন্তর্দেশীয় বাজারের কিছুটা সম্প্রসারণ ঘটে। কিন্তু এই বৃদ্ধিও শিল্পের চাহিদা সংক্রান্ত সংকট নিরসনের পক্ষে যথেষ্ট ছিল না। কৃষিতে প্রকৌশলগত উন্নয়নের ফলে নিয়োগ কমে, নতুন কর্মসংস্থানের উপায় সৃষ্টি হয় না, গ্রামীণ শিল্পজাত পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধির সমস্যা বা বেকারত্বের সমস্যা সমাধানের উপায় সৃষ্টি হয় না। অসংগঠিত উৎপাদন-ক্ষেত্রে নিযুক্তির পরিমাণ ক্রমাগত বাড়লেও কৃষিক্ষেত্রে অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ কমাতে পারে না, ১৯৫০–’৫১ সাল থেকে ২০১১ সাল অবধি মোট গ্রস অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে কৃষির অংশ শতকরা ৫২ ভাগ থেকে শতকরা ১৪ ভাগে নেমে এলেও না। এই তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে, অন্যান্য উৎপাদন-ক্ষেত্রের তুলনায় কৃষির উৎপাদনশীলতা যথেষ্ট কম। ওই সময়ের মধ্যে মোট কর্মনিযুক্তিতে কৃষির অংশ কমেছে তুলনায় সামান্যই, শতকরা ৭০ থেকে শতকরা ৫৫ ভাগে। অ-কৃষি অসংগঠিত শিল্পক্ষেত্রে মোট নিযুক্তির অনুপাত ১৯৮৫–’৮৯-এ ছিল মোট অ-কৃষি ক্ষেত্রে নিযুক্তির শতকরা ৭৬ ভাগ, তা ২০০৫–’১০ সালের মধ্যে বেড়ে দাঁড়ায় শতকরা ৮৪ ভাগে। একুশ শতকের প্রথম দশকে এই অ-কৃষি অসংগঠিত ক্ষেত্রে উৎপাদন ছিল মোট অ-কৃষি উৎপাদনের শতকরা ৪৬ ভাগ।
সারণি ৯.১ গ্রামীণ অসংগঠিত ক্ষেত্রে ও কৃষিতে মোট নিযুক্তির ভাগ
Source: Charms, Jacques. 2012. “The Informal Economy Worldwide; Trends and Characteristics.” Margin: The Journal of Applied Economic Research. 6;2(2012) 103–132
গ্রামীণ অসংগঠিত ক্ষেত্রে ১৯৯৯–২০০০ থেকে ২০১০–’১১-র মধ্যে গ্রামীণ অসংগঠিত উৎপাদন প্রতিষ্ঠানে কর্মনিযুক্তি ছিল মোট কর্মনিযুক্তির শতকরা ১.৩৪ ভাগ, যা ২০১০–’১১ সালে বেড়ে দাঁড়ায় শতকরা ২.৫১ ভাগে। ওই সময়ের মধ্যে অসংগঠিত স্বচালিত ছোট সংস্থায় নিয়োগ মোট নিয়োগের ৮.৪০ ভাগ থেকে বেড়ে শতকরা ৯.১৬ ভাগে দাঁড়ায়। উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, কৃষি-উৎপাদনে ওই সময়ে নিযুক্তি মোট নিযুক্তির শতকরা ৬১.০১ থেকে কমে শতকরা ৫১.৯৩-এ নেমে আসে। উল্লেখ্য, ওই সময়ের মধ্যে গ্রাম-শহর মিলিয়ে অসংগঠিত ক্ষেত্রে মোট নিযুক্তি শতকরা ১৯ ভাগ থেকে বেড়েছে শতকরা ২২ ভাগে।
প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, তাহলে কি কৃষি-উৎপাদন ক্ষেত্র থেকে উচ্ছেদ হওয়া গ্রামীণ মানুষ শহরে সংগঠিত শিল্পে নিযুক্ত না হয়ে গ্রামীণ অসংগঠিত স্বনিযুক্তি ক্ষেত্র গড়ে তুলছে, বা অসংগঠিত প্রতিষ্ঠানে নিযুক্ত হচ্ছে? এই অসংগঠিত ক্ষেত্রগুলিতে কৃষি-উৎপাদন ক্ষেত্রের তুলনায় উৎপাদনশীলতা অনেক কম, যা আমরা মোট গ্রস অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে কৃষির অংশ ও অসংগঠিত শিল্পের অংশের মধ্যে তুলনা করে দেখতে পারি।
সারণি ৯.২ গ্রামীণ অসংগঠিত সংস্থা ও কৃষিতে মোট নিট আয়ের ভাগ
Source: Charms, Jacques. 2012. “The Informal Economy Worldwide; Trends and Characteristics.” Margin: The Journal of Applied Economic Research. 6;2(2012) 103–132
এইভাবে কৃষি থেকে মানুষ সরে গিয়ে অসংগঠিত ক্ষেত্রে নিযুক্ত হওয়ার অর্থ সামগ্রিকভাবে উৎপাদনশীলতার হ্রাস, মানুষের দুর্দশা ও দারিদ্র বৃদ্ধি। অন্যদিকে এটাও লক্ষ করতে হবে যে, অসংগঠিত ক্ষেত্রে যতই নিয়োগ বাড়ুক কৃষিক্ষেত্রে বাঁধা পড়ে থাকা বাড়তি মানুষদের এই ক্ষেত্র থেকে খুব বেশি সরিয়ে আনা যায়নি। কৃষিতে এখনও অনেক সংখ্যায় উদ্বৃত্ত মানুষ থেকে গেছে। কৃষি থেকে সরে গিয়ে যারা অসংগঠিত ক্ষেত্রে যুক্ত হয়েছে তাদের উৎপাদনশীলতা যথেষ্ট কম। ফলে শিল্পজাত পণ্যের চাহিদা-বৃদ্ধির সমস্যা ও বেকারত্বের সমস্যা সমাধানের দিক থেকে বড় কোনও সুবিধা সৃষ্টি হয়নি। তবে বিভিন্ন পর্যায়ে কৃষি-উৎপাদন হারের হ্রাস-বৃদ্ধি, কৃষিপণ্যের আমদানি ও রফতানির বৃদ্ধি নানাভাবে ভারতের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নকে প্রভাবিত করেছে। সবুজ বিপ্লব কর্মসূচি রূপায়ণের সময় ১৯৬২–৬৫ থেকে ’৭০–’৭৩-এর মধ্যে গড় বার্ষিক কৃষি-উৎপাদন বৃদ্ধির চক্রবৃদ্ধি হার ছিল শতকরা ২.০৮, ১৯৭০–৭৩ থেকে ১৯৮০–৮১-র মধ্যে ওই হার দাঁড়ায় শতকরা ২.৩৮, ’৮০-র দশকে তা শতকরা ৩-এর সীমা অতিক্রম করে শতকরা ৩.৪০-এ এসে দাঁড়ায়। ১৯৫১ সালে চাল পাওয়া যেত গড়ে মাথাপিছু বাৎসরিক ৫৮.০ কেজি। প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বেশ কিছু কর্মসূচি নেওয়া হয়। এর পরিণামে ’৫১ সাল থেকে ’৬১ সালের মধ্যে চাল লভ্য হয় গড়ে মাথাপিছু ৭৩.৪ কেজি, মোট খাদ্যশস্যের ক্ষেত্রে এর মান ছিল ১৭১.১ কেজি। কিন্তু দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা শেষ হওয়ার পর থেকে ’৬০-এর দশকের মাঝামাঝি চালের মাথাপিছু পরিমাণ কমে দাঁড়ায় ৫৯.১ কেজি, সমস্ত খাদ্যশস্যের মাথাপিছু গড় পরিমাণ হয় ১৪৯.০ কেজি। পরবর্তীকালে হ্রাস-বৃদ্ধির বিভিন্ন পর্যায় পেরিয়ে ২০০১ সালে এই দু’টি গড় রাশি দাঁড়িয়েছিল যথাক্রমে ৬৯.৫ কেজি ও ১৫১.৯ কেজিতে, এবং ২০১১ সালে যথাক্রমে ৬৬.৩ কেজি ও ১৭০.৯ কেজিতে। অর্থাৎ খাদ্যশস্য সুলভ হওয়ার ক্ষেত্রে কোনও উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটেনি। ’৬১ সালের পর থেকে এত বছর পেরিয়ে এসেও খাদ্যশস্যের সুলভতা কখনও ওই বছরটির মান অতিক্রম করতে পারেনি, ব্যতিক্রম কেবল ’৮০-র দশক। যদিও গমের সুলভতার ক্ষেত্রে এই সময়ে খুব ধীরে কিন্তু ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি ঘটেছে। অন্যান্য নিকৃষ্টতর খাদ্যশস্য যা দরিদ্র মানুষ ভোগ করতে অভ্যস্ত ছিল, সেসব খাদ্যশস্যের ক্ষেত্রে মাথাপিছু লভ্য পরিমাণ অবশ্যই কমেছে। ফলত সামগ্রিকভাবে খাদ্যশস্যের মাথাপিছু সুলভতায় কোনও উন্নতি দেখা যাচ্ছে না।
ভূমিসংস্কার কর্মসূচির যথাযথ প্রণয়ন ও রূপায়ণ ছাড়া কৃষিতে কাঠামোগত পরিবর্তন সম্ভব হয় না, কৃষি তার সামন্ততান্ত্রিক জড়তা কাটিয়ে উঠতে পারে না। আমাদের দেশে কৃষিতে ভূমিসংস্কার কর্মসূচি যথাযথ প্রণয়ন ও রূপায়ণ সম্পন্ন হয়নি। পুরনো ভূস্বামীদের রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্তৃত্বের সম্পূর্ণ অবসান হয়নি। বিপুলসংখ্যক মানুষ কৃষির ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকে। কৃষিতে প্রান্তিক চাষির সংখ্যা বাড়তে থাকে, প্রান্তিক কৃষি-খামারের আওতায় জমির পরিমাণ ও অনুপাত বাড়ে অথচ প্রান্তিক চাষে নিযুক্ত খামারগুলির গড় আয়তন কমে। ক্ষুদ্র প্রান্তিক চাষি আরও ক্ষুদ্র হয়, তার দুর্দশা আরও বাড়ে। এই কাঠামোগত অবস্থার ওপরই নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয়। ভারতের বিস্তীর্ণ কৃষিনির্ভর অঞ্চলে দেশীয় পদ্ধতিতে সনাতন সেচ-প্রযুক্তির তুলনায় এই নতুন প্রযুক্তির কার্যকারিতা কতটা তা নিয়ে অর্থনীতিবিদদের মধ্যে যথেষ্ট মতবিরোধ আছে। ছোট জোতে দরিদ্র চাষির পক্ষে সঠিক মাত্রায় এই প্রযুক্তি ব্যবহারের অসুবিধা, এবং এই প্রযুক্তিতে উৎপন্ন ফসলের অতিরিক্ত রোগপ্রবণতা থেকে উদ্ভূত ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তার মতো নানা বিষয় আমাদের দেশের কৃষিতে এর কার্যকারিতা নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে রাসায়নিক সারের অধিক প্রয়োগ জমির উর্বরতার ওপর বিপরীত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, ফলে প্রাথমিকভাবে এই প্রযুক্তি সুফল দিলেও দীর্ঘদিন তা ধরে রাখা নিয়ে সন্দেহ দেখা দেয়। পরবর্তীকালে রাসায়নিক সারের অধিক প্রয়োগ পরিবেশের ওপর কুপ্রভাব ফেলছে দেখে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের বদলে জৈব সার, কীটনাশক ইত্যাদি ব্যবহার করে দ্বিতীয় সবুজ বিপ্লবের কর্মসূচি আনা হয়। সবুজ বিপ্লবের কর্মসূচি প্রাথমিকভাবে একর-পিছু উৎপাদন বাড়ায়, দেশ খাদ্যে স্বয়ংভরতা অর্জন করে। কিন্তু বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে সবুজ বিপ্লব কর্মসূচি ভারতীয় কৃষির দীর্ঘকালীন স্থবিরত্ব দূর করতে পারেনি। পরিসাংখ্যিক রিগ্রেশন সমীকরণটি নবম অধ্যায়ের সংযোজনে দেওয়া হল।
সারণি ৯.৩ক দীর্ঘকালীন বৃদ্ধির হার (১৯৫০ থেকে ২০১৭)
উৎপাদন | উৎপাদনশীলতা | |
শস্য | বৃদ্ধির হার% | বৃদ্ধির হার% |
ধান | ২.৪২% | ১.৮৮% |
গম | ৪.৩৭% | ২.৬৪% |
আখ | ২.৮৮% | ১.২৪% |
তুলা | ৩.২৩% | ২.৬২% |
সারণি ৯.৩খ খাদ্যদ্রব্যের লভ্য পরিমাণ (গ্রাম, মাথাপিছু প্রতিদিন) [দশকের গড়]
Source: Directorate of Economics and Statistics, DAC&FW website
সারণি ৯.৪ মাথাপিছু খাদ্যশস্যের দৈনিক লভ্য পরিমাণের প্রতি দশকে বৃদ্ধির হার
Source: Directorate of Economics & Statistics
১. Lewis, W. A. 1954. “Economic Development with Unlimited Supplies of Labour.” Manchester School. 22(2).
২. Kalecki, M. 1976. Essays on Developing Economies, Humanities Press.
ক। দীর্ঘকালীন বৃদ্ধির হার (১৯৫০ থেকে ২০১৭)