৫. ভারতে কৃষিশ্রমের বাজার: মজুরি শ্রমিক ও পারিবারিক শ্রমিক

পঞ্চম অধ্যায়

ভারতে কৃষিশ্রমের বাজার
মজুরি শ্রমিক ও পারিবারিক শ্রমিক

পুঁজিবাদী উৎপাদন-সম্পর্কের একটি প্রধান লক্ষণ হল মজুরির বিনিময়ে শ্রমের বাজার থেকে কেনা কৃষি-শ্রমিকের শ্রমের ওপর নির্ভরশীল উৎপাদন। মালিক তার পূর্ব-সঞ্চিত আর্থিক পুঁজি দিয়ে অন্যান্য উপকরণের সঙ্গে দৈনিক নির্দিষ্ট কয়েক ঘণ্টার জন্য শ্রমিকের শ্রম কেনে। পুঁজিবাদী উৎপাদন যতই প্রসারিত হয় ততই মালিকের হাতে উৎপাদিত উদ্বৃত্ত পুঁজির আকারে জমা হয় ও কৃষিতে শ্রমনির্ভর উৎপাদন ততই প্রসারিত হয়। বিপ্লব-পূর্ব রাশিয়ার কৃষিতে পুঁজিবাদ বিকাশের প্রক্রিয়া সংক্রান্ত তথ্য থেকে জানা যায়, রাশিয়ার কৃষিতে ক্ষুদ্র জোতে নিবিড় চাষের মাধ্যমে, অধিক পরিমাণে স্থির পুঁজির প্রয়োগ ঘটিয়ে ও মজুরি-শ্রমিক নির্ভর আধুনিক চাষপদ্ধতির সাহায্যে পুঁজিবাদী উৎপাদন-সম্পর্কের বিকাশ ঘটানো হয়েছিল। এই বিষয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে লেনিন ছোট জোতে অধিক পরিমাণ স্থির পুঁজির প্রয়োগ করে মজুরি-শ্রমিক নির্ভর নিবিড় চাষ ও অধিক পরিমাণ মজুরি-শ্রমিক নিয়োগ করে চাষকে পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্কের বড় লক্ষণ বলে বর্ণনা করেছেন।

আমরা আগেই উল্লেখ করেছি যে, ভারতের মতো পিছিয়ে পড়া অর্থনীতির অন্তর্গত কৃষিক্ষেত্রে এখনও বিভিন্ন ধরনের প্রাক্পুঁজিবাদী ধরনের প্রতিষ্ঠান ক্রিয়াশীল থেকে ঋণের বাজার, জমি ও অন্যান্য উপকরণের বাজার ও শ্রমের বাজারের স্বাধীন কার্যকারিতার পথ বন্ধ করে রাখে। ভারতে কৃষি-শ্রমের বাজার তেমনই একটি প্রতিষ্ঠান। এটি শ্রমের জোগান নিয়ন্ত্রণে বিশেষভাবে কাজ করে। সেচের ব্যবস্থা অপ্রতুল হওয়ায় ভারতের কৃষি অধিকাংশ স্থানেই বৃষ্টিসেবিত। অনেক স্থানেই বছরের একটা সময়ে চাষবাস বন্ধ থাকে, ফলে ঠিকা শ্রমিকের সামনে কাজ পাওয়ার সুযোগ থাকে সীমিত। তাকে তার নিয়োগকারী বড় চাষির ওপর ঋণের জন্য নির্ভর করতে হয়। বড় চাষি তাকে ব্যস্ত মরশুমের বর্ধিত মজুরির চেয়ে কম মজুরিতে শ্রমের জোগান সুনিশ্চিত করার শর্তে ঋণ দেয়। অর্থাৎ ঋণের বাজারের সঙ্গে শ্রমের বাজার যুক্ত হয়ে নিয়োগ ক্ষেত্রে শ্রমের স্বাধীন চলাচলের পথে বাধা সৃষ্টি করে। ব্যস্ত মরশুমে শ্রমের দাম অর্থাৎ মজুরি অস্বাভাবিক বাড়ে। শ্রমের বাজারের স্বাভাবিক ক্রিয়া ব্যাহত হয়।

ভারতীয় কৃষিতে স্বাধীন মজুরি-শ্রমিক নিয়োগ করে চাষ করার ব্যবস্থা কতটা প্রসারিত হয়েছে, কতটা মজুরি-শ্রমনির্ভর উৎপাদন প্রসারিত হচ্ছে, এই প্রশ্নগুলি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ সম্পর্কে প্রাপ্ত পরিসংখ্যান থেকে মজুরি-শ্রমিক নিয়োগের প্রকৃত অবস্থা ধারণায় আনা সম্পূর্ণত সম্ভব নয়। তার কারণ হল, চাষে নিযুক্ত শ্রম সংক্রান্ত তথ্যে স্বাধীন শ্রমিক ও ঋণবন্ধকি শ্রমিকের মধ্যে কোনও প্রভেদ করা যায় না। ফলে কৃষিতে স্বাধীন শ্রমের বাজারের অবস্থাটাও পরিষ্কার হয় না। এই প্রসঙ্গে আমরা প্রথমত ভারতীয় কৃষিতে মজুরি-শ্রমিক নিয়োগ করে চাষের সম্ভাব্যতা কতটা সে বিষয়ে আলোচনা করতে পারি।

গোটা ভারতে মোট কৃষকের সংখ্যার তুলনায় কৃষিতে নিযুক্ত শ্রমিকের সংখ্যা থেকে বোঝা যায়, নিজ জমিতে চাষ করা প্রান্তিক চাষির সংখ্যা এতই বেশি যে জোত-পিছু শ্রমিকের গড় সংখ্যা বাড়তে পারে না। শ্রমিক নিয়োগের তথ্যগুলো অবশ্যই অপেক্ষাকৃত বড় জোতগুলি সম্বন্ধে প্রযোজ্য।

সারণি ৫.১ মোট নিযুক্ত ও কৃষিতে নিযুক্ত শ্রমিকের সংখ্যা (মিলিয়ন)

সারণি ৫.১ মোট নিযুক্ত ও কৃষিতে নিযুক্ত শ্রমিকের সংখ্যা (মিলিয়ন)

Source: NSSO (61st & 68th Round) {FICCI Research Report}

কিন্তু এই তথ্য থেকে কৃষিতে নিযুক্ত মজুরি-শ্রমিক সম্পর্কে কোনও ধারণা করা যায় না। এ থেকে শুধু বোঝা যায় যে, কৃষিতে কর্মরত মানুষের সংখ্যা এবং সেইসঙ্গে মোট কর্মরত মানুষ ও কৃষিতে কর্মরত মানুষের অনুপাত ক্রমশ কমেছে। কিন্তু উল্লিখিত শ্রমদায়ী মানুষের সংখ্যার মধ্যে মজুরি-শ্রমিক, পারিবারিক শ্রমিক, ঋণ-বন্ধকি শ্রমিক, চাষি পরিবার ইত্যাদি নানা প্রকার শ্রমদায়ী মানুষের সংখ্যা ঢুকে আছে। সুতরাং মজুরি-শ্রমিক বলতে যা বুঝি সেই বিশেষ ধরনটির পরিমাণ বা অনুপাত সম্বন্ধে এখান থেকে কোনও সিদ্ধান্তে আসা শক্ত। নীচে কৃষি-শুমারি বিভাগের ‘একনজরে কৃষি পরিসংখ্যান ২০১৬’ থেকে আমরা কৃষিতে কর্মরত মানুষের মধ্যে কৃষক ও কৃষি-শ্রমিক এই দু’টি বিশেষ অংশের ওপর তথ্য পাই

সারণি ৫.২ কৃষিতে কর্মরত মানুষের সংখ্যা (মিলিয়ন), মোট কর্মরত মানুষের মধ্যে কৃষিতে কর্মরত মানুষের অনুপাত (শতকরা), কৃষক ও কৃষি-শ্রমিক (মিলিয়ন) ও কৃষিতে কর্মরত মানুষের মধ্যে এদের অনুপাত (শতকরা)

সারণি ৫.২ কৃষিতে কর্মরত মানুষের সংখ্যা (মিলিয়ন), মোট কর্মরত মানুষের মধ্যে কৃষিতে কর্মরত মানুষের অনুপাত (শতকরা), কৃষক ও কৃষি-শ্রমিক (মিলিয়ন) ও কৃষিতে কর্মরত মানুষের মধ্যে এদের অনুপাত (শতকরা)

*বন্ধনীর মধ্যে মোট কৃষিতে কর্মরত মানুষের মধ্যে কৃষক ও কৃষি-শ্রমিকের অনুপাত (শতকরা)

**বন্ধনীর মধ্যে মোট কর্মরত মানুষের মধ্যে কৃষিতে কর্মরত মানুষের অনুপাত (শতকরা)

উপরের ৫.১৫.২ সারণি দু’টির তুলনা করলে আমরা দেখি, ২০১১–১২ সালে কৃষিতে কর্মরত মানুষের সংখ্যা যেখানে ২২৮ মিলিয়ন, সেখানে কৃষি শ্রমিকের সংখ্যা ১৪৪.৩ মিলিয়ন। এই পরিসংখ্যান থেকে যেটি অনুমান করা যায় তা হল, ২০১১–১২ সালে কৃষিতে ৮৩.৭ মিলিয়ন কৃষক পারিবারিক শ্রমিক হিসাবে কাজ করত। আবার ১৯৯৯–২০০০ সালে কৃষিতে কর্মরত মানুষের সংখ্যা ছিল ২৩৮ মিলিয়ন। এর সঙ্গে ২০০১ সালের কৃষি-শ্রমিকের সংখ্যাটি তুলনা করা যেতে পারে– সংখ্যাটি ১০৬.৮ মিলিয়ন। সুতরাং এই সময়ে, অনুমান করা যেতে পারে, পারিবারিক শ্রমিকের সংখ্যা ছিল প্রায় ১৩২ মিলিয়নের কাছাকাছি। অর্থাৎ সেই সময়ে সারা ভারতে পারিবারিক কৃষি শ্রমিকের সংখ্যা ছিল কৃষি-শ্রমিকের চেয়ে বেশি। ১৯৯৯–২০০০ সাল থেকে ২০১১–১২ সাল এই দশ বছরে পারিবারিক শ্রমিকের সংখ্যা কমেছে প্রায় ১৩২ মিলিয়ন থেকে ৮৩.৭ মিলিয়নে।

ওপরের সারণি ৫.২ থেকে আরও দেখা যাচ্ছে, ২০০১ সাল অবধি কৃষকের সংখ্যা কৃষি-শ্রমিকের সংখ্যার থেকে বেশি ছিল। ২০১১ সালে প্রথম কৃষি-শ্রমিকের সংখ্যা কৃষকের সংখ্যাকে ছাড়িয়ে গেছে। দেখা যাচ্ছে, ২০০১ সালেও কৃষকের সংখ্যা কৃষি-শ্রমিকের সংখ্যার ১.১৯ গুণে দাঁড়ায়। কৃষকের সংখ্যার তুলনায় কৃষি-শ্রমিকের সংখ্যার অপ্রতুলতা থেকে চাষ শ্রমিকনির্ভর হয়ে উঠেছে এই কথা বলা যাচ্ছে না। ২০১১ সালে কৃষি-শ্রমিকের সংখ্যা প্রথম কৃষকের সংখ্যাকে ছাড়িয়ে গেলেও কৃষকের সংখ্যার তুলনায় কৃষি-শ্রমিকের সংখ্যা যথেষ্ট বাড়েনি। ওই সময় কৃষি-জোতের প্রতিটির জন্য শ্রমিকসংখ্যা ছিল গড়ে ১.২১। ২০১১তে কৃষিজোতের গড় মাপ ছিল ১.১৫ হেক্টর। সেই হিসেবে প্রতি ১.১৫ হেক্টর জমির জন্য গড়ে ১.২১ জন শ্রমিক নিযুক্ত হতে পারত, বা প্রতি একর জমি চাষের জন্য শ্রমিক সংখ্যা ছিল গড়ে মাত্র ০.৩৫। অর্থাৎ বিপুলসংখ্যক ও ক্রমবর্ধমান প্রান্তিক চাষি পারিবারিক শ্রমনির্ভর চাষব্যবস্থার মধ্যেই রয়েছে, এই চাষিরা অতি ব্যস্ত মরশুমে, অথবা বিশেষ ক্ষেত্রে, সামান্য পরিমাণে মজুরি-শ্রমিকের শ্রমের ওপর নির্ভর করে থাকে। এই প্রান্তিক চাষিরা তাদের নিজ জমি চাষ থেকে তাদের জীবিকা অর্জন করতে পারে না। পরিবারের ভরণপোষণের জন্য তারা উপরন্তু অন্য জমিতে আংশিক কৃষি শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে বাধ্য হয়। আবার কিছু কৃষি শ্রমিকের যৎকিঞ্চিৎ জমি থাকতে পারে, এই জমি মূলত পরিবারের অন্য সদস্যদের শ্রমে চাষ হয়। আমরা জাতীয় সমীক্ষা রিপোর্ট থেকে ২০১২–১৩ কৃষি-বৎসরে কৃষিতে যে-উৎপাদন ব্যয় হয়েছে তার হিসাব পাই। নীচের সারণিতে রয়েছে বিভিন্ন কৃষি উপকরণের মধ্যে শ্রমিকের ওপর ব্যয়ের হিসাব।

ওপরের সারণি থেকে দেখা যাচ্ছে, ১ হেক্টরের নীচে পর্যন্ত প্রান্তিক ও অতি-প্রান্তিক চাষিরাও মজুরি শ্রমিক নিয়োগ করেছে। চাষিদের অবস্থার ওপর জাতীয় নমুনা সমীক্ষার রিপোর্ট থেকে দেখা যায়, এই ক্ষুদ্র ও অতি ক্ষুদ্র চাষিরা পশুপালন, অথবা অন্য অ-কৃষি ব্যবসা বা ছোট উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত। অনেক সময় চাষবাস ভিন্ন অন্য কাজই এদের আয়ের মূল উৎস। এরা এইসব কাজে শ্রমিক নিয়োগ করে থাকে। এদের শ্রমিকের ওপর ব্যয় কৃষি-ভিন্ন অন্য কাজে ব্যয়ের একটি অংশ। যাদের জমির পরিমাণ ১ হেক্টরের ওপর থেকে ২ হেক্টরের নীচে এবং ২ হেক্টরের ওপর থেকে ৪ হেক্টরের নীচে— এমন ছোট ও আধা-মাঝারি চাষিরা ব্যস্ত মরশুমে যথেষ্ট সংখ্যক ঠিকা শ্রমিক নিয়োগ করে থাকে। সারা বছরই এরা স্থায়ী শ্রমিক নিয়োগ করে। এই স্থায়ী শ্রমিকরা বছরের যে-সময়ে কৃষিকাজের চাপ কম থাকে তখন কৃষি-ভিন্ন অন্যান্য বাড়ির কাজও করে। কৃষি-শ্রমিক বলতে এই স্থায়ী শ্রমিকদেরও বোঝায়। বড় চাষিরা কৃষি-শ্রমিকের ওপর সম্পূর্ণত নির্ভরশীল বলেই অনুমান করা যেতে পারে। কিন্তু কৃষিতে যন্ত্রনিবেশের ফলে শ্রমের নিয়োগ নিশ্চয়ই কিছুটা হ্রাস পেয়ে থাকবে। যন্ত্রের ওপর খরচ যথেষ্ট বেশি হওয়ার কারণে মোট উৎপাদনব্যয়ের মধ্যে শ্রমিকের ওপর ব্যয়ের অনুপাত অপেক্ষাকৃত ছোট চাষিদের তুলনায় কম। এই একই কারণে পঞ্জাবের কৃষিতে শ্রমের ওপর খরচের অনুপাত অন্যান্য সব রাজ্য থেকে কম।

সারণি ৫.৩ শ্রমের খরচ ২০১২–১৩ কৃষিবর্ষ

সারণি ৫.৩ শ্রমের খরচ ২০১২–১৩ কৃষিবর্ষ

Source: Key Indicators of Situation of Agricultural Household in India (NSSO 70th Round)

পঞ্জাব ভারতে কৃষি উৎপাদনের নিরিখে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা রাজ্য। এখানে সবচেয়ে বেশি আধুনিকীকরণ হয়েছে এবং পুঁজিবাদী ধরনের উৎপাদনশীল বিনিয়োগ হয়েছে। এই রাজ্যের কৃষিতে মজুরি শ্রমিকের নিয়োগ সংক্রান্ত তথ্য থেকে আমরা ভারতের গড়পড়তা কৃষি উন্নয়ন হয়েছে যেসব অঞ্চলে, সেখানকার মজুরি-শ্রমিক নিয়োগের কিছুটা আন্দাজ পেতে পারি। ১৯৮৫–৮৬ থেকে ২০০৬–০৭ সালের মধ্যে পঞ্জাবের কৃষিতে ধানের চারা পুনঃরোপণের কাজটি ছাড়া অন্য সমস্ত ধরনের কাজে যন্ত্রপ্রয়োগের মাত্রা যথেষ্ট বেড়েছে। পরিণামে কৃষিতে নিয়োগের মাত্রা কমেছে। সেই তথ্য থেকে এই সময়ে কৃষিতে বিভিন্ন ধরনের শ্রমিকের নিয়োগের মাত্রা সম্বন্ধে জানা যেতে পারে। পঞ্জাবে কৃষিতে যথেষ্ট যন্ত্রপ্রয়োগ সত্ত্বেও ২০০৬–০৭ সালে কী পরিমাণে পারিবারিক শ্রমিক নিযুক্ত হত সে সম্বন্ধে তথ্য পাই।

নীচের সারণি ৫.৪ থেকে দেখা যাচ্ছে, কৃষি উৎপাদনে নিয়োজিত শ্রমের সবচেয়ে বড় অংশই পারিবারিক শ্রম। যদিও ’৮৫–’৮৬ সাল থেকে ২০০৬–০৭ সাল– এই ১০/১১ বছরে পঞ্জাবের কৃষিতে যন্ত্রপ্রয়োগের মাত্রা বিপুলভাবে বেড়ে যাওয়ার ফলে সামগ্রিক ভাবে শ্রমনিবেশ কমেছে, ফলে পারিবারিক শ্রমের অনুপাতও কমেছে। তবুও ২০০৬–০৭ সালেও এই অনুপাতটি যথেষ্ট বেশি – শতকরা ৩৮ ভাগ। বাকি শতকরা ১৮ ভাগ স্থায়ী শ্রমিক – এরা সবসময় মুক্ত শ্রমিকশ্রেণির অন্তর্ভুক্ত নয়, অনেক সময়েই এরা ঋণ-বন্ধকি শ্রমিক, যারা শ্রমের বাজারে স্বাধীনভাবে অংশ নিতে পারে না।

সারণি ৫.৪ পঞ্জাবের কৃষিতে গম ও ধান চাষের ক্ষেত্রে সংযুক্ত শস্য কাটার যন্ত্র ব্যবহারের পরিণতিতে মনুষ্য শ্রম ব্যবহারের সংকোচন

সারণি ৫.৪ পঞ্জাবের কৃষিতে গম ও ধান চাষের ক্ষেত্রে সংযুক্ত শস্য কাটার যন্ত্র ব্যবহারের পরিণতিতে মনুষ্য শ্রম ব্যবহারের সংকোচন

Source: Dynamics of Labour Demand and its Determinants in Punjab Agriculture; Punjab Agriculture University 2013

ওপরের সারণি থেকে দেখা যাচ্ছে, ১৯৮৫–৮৬ সালে কৃষি-উৎপাদনে অন্যান্য সব ধরনের শ্রমের তুলনায় পারিবারিক শ্রমের অনুপাত যথেষ্ট বেশি। ২০০৬–০৭ সালে এই অনুপাত কমেছে, ও সেই তুলনায় অস্থায়ী শ্রমের মাত্রা বেড়েছে। কিন্তু তবুও, যন্ত্রীকরণের মাত্রা যথেষ্ট বাড়া সত্ত্বেও, পারিবারিক শ্রমের তুলনামূলক অনুপাত ২০০৬–০৭ সালেও যথেষ্ট বেশি ছিল।

কৃষি-উৎপাদন ব্যবস্থা ও পুঁজিবাদী ধরনের উৎপাদন-ব্যবস্থার নিরিখে ভারতের সবথেকে এগিয়ে থাকা রাজ্যগুলির মধ্যে একটি হল পঞ্জাব। ২০০৬–০৭ সালে যন্ত্রায়ণের মাত্রা যথেষ্ট হওয়া সত্ত্বেও এবং পঞ্জাবে জোতের গড় আয়তন সারাদেশের গড় আয়তনের তুলনায় বেশি হওয়া সত্ত্বেও সেখানে যে-পরিমাণে পারিবারিক শ্রমের উপস্থিতি ছিল তা থেকে অনুমান করা যায়, এদেশের তুলনামূলক ভাবে পিছিয়ে পড়া রাজ্যগুলিতে যেখানে যন্ত্রীকরণের মাত্রা কম, এবং কৃষি-জোতের গড় মাপ সারা দেশের তুলনায় কম, সেখানে পারিবারিক শ্রমের উপস্থিতি আরও বেশি। জাতীয় নমুনা সমীক্ষা সংগঠনের ১৯৮৩–’৮৪, ১৯৯৩–’৯৪, ১৯৯৯–২০০০ এবং ২০০৪–’০৫-এর নিয়োগ সংক্রান্ত নমুনা সমীক্ষার তথ্য থেকে দেখা যায়, এই সময়কালে সারা ভারতে কৃষিতে নিয়োগের অনুপাত শতকরা ৬৩ ভাগ থেকে কমে শতকরা ৫৪ ভাগে এসে দঁড়িয়েছে। অর্থাৎ ২১ বছরের দীর্ঘ সময়ের তুলনায় শতকরা মাত্র ১০ ভাগ নিয়োগ হ্রাস পেয়েছে। এই হ্রাসের পরিমাণ ও হ্রাসের গতিবেগ চিন ও অন্যান্য দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দ্রুত উন্নয়নশীল দেশগুলির তুলনায় যথেষ্টই কম। এই তথ্যসূত্র থেকে আরও দেখা যায়, এই মাপ অনুযায়ী ভারতে সমস্ত কর্মক্ষম শ্রমশক্তির মাত্র শতকরা ১৪ ভাগ ‘নিয়মিত নিযুক্ত’ হিসাবে কর্মে নিয়োজিত, এবং অর্ধেক কর্মক্ষম মানুষ (শতকরা ৫৩ ভাগ) স্বনিযুক্ত। এর মধ্যে স্বনিযুক্ত মানুষদের বড় অংশ কৃষিতে নিযুক্ত। অর্থাৎ ভারতীয় কৃষির মজুরি-শ্রমিক নির্ভরতার বিষয়টি সম্বন্ধে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ আছে।

পারিবারিক শ্রম কৃষি উৎপাদনের একটি বহুমাত্রিক উপাদান, এই অর্থে যে, কোনও পারিবারিক শ্রম পুরোপুরি নিজ জমিতে স্বনিযুক্ত শ্রম, আবার কোনও পারিবারিক শ্রমের জোগানদার অন্যের জমিতে মজুরি শ্রমিক, আবার পারিবারিক জমিতেও তারা চাষের যে-কোনও ধরনের কাজে অংশ নেয় না। পারিবারিক শ্রমিক বাইরের জমিতে বা অন্য কোনও কাজে মজুরি শ্রমিক হিসেবে কাজ করবে কি না, অথবা সে চাষের কোন কাজে অংশ নেবে বা কোন কাজে অংশ নেবে না তা সাধারণত জাতপাত, ধর্ম, চিরাচরিত প্রথা বা সামাজিক আচরণবিধির ওপর নির্ভর করে। চাষের বিভিন্ন কাজে নারীশ্রমের অংশগ্রহণ যতটা না বাজার দ্বারা প্রভাবিত, তার থেকেও বেশি প্রভাবিত জাতপাত ও সামাজিক আচরণবিধি ইত্যাদি বাজার-বহির্ভূত উপাদানের দ্বারা। পারিবারিক শ্রমিকের জোগান ও চাহিদা মজুরি শ্রমিকের জোগান ও চাহিদার মতো মজুরির ওঠানামার সঙ্গে বাড়ে কমে না। মজুরি শ্রমিকের নিয়োগ শ্রমের প্রান্তিক উৎপাদনশীলতা ও মজুরির পরিমাণের ওপর নির্ভর করে, কিন্তু পারিবারিক শ্রমের নিয়োগ বিষয়ে প্রান্তিক উৎপাদন ও মজুরির তফাতের কোনও প্রভাব নেই। এর কারণ পারিবারিক শ্রমিক বাজার-চলতি মজুরির হারকে তার মজুরির পরিবর্ত ব্যয় হিসেবে মনে করে না। বর্তমান কাজটি না করলে তাকে ওই সময়ের জন্য বিনা কাজেই থাকতে হত। এর একাধিক কারণের মধ্যে প্রধান হল: ক) বাজারে পরিবর্ত কাজের অভাব, খ) অর্থনীতির নিয়ম-বহির্ভূত নানা বিষয়ের ওপর মজুরির হারের নির্ভরশীলতা, গ) সনাতন সামাজিক বাধানিষেধ, জাতপাত ইত্যাদি নানা বিবেচনায় ঘরের বাইরে পারিবারিক শ্রমিকের কাজ নেওয়ার অপারগতা। এইসব নানা কারণে পারিবারিক শ্রমিক ও মজুরি শ্রমিকের জোগান ও চাহিদা সংক্রান্ত রেখা এক হয় না। আমাদের দেশের বিভিন্ন রাজ্যে এখনও পারিবারিক শ্রমের যথেষ্ট গুরুত্ব আছে। একটি পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক উৎপাদন-সম্পর্কের অধীন উৎপাদন-ব্যবস্থায় উৎপাদন ক্রিয়া সাধারণত মজুরি শ্রমিকের শ্রমেই চলে। এই শ্রম জোগান-চাহিদার টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে বাজার-নির্ধারিত মজুরিতে কেনা-বেচা করা হয়। বাজারে প্রতিযোগিতার ফলে মজুরি ন্যূনতম জীবিকানির্বাহের স্তরে থাকে এবং এই স্তরের মজুরিতে মালিক উৎপাদনের উপকরণ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন শ্রমশক্তি ক্রয় করে যে-উৎপাদন কাজ চালায় সেই প্রক্রিয়া থেকেই উদ্ভূত উৎপাদনের মোট মূল্য হল শ্রমিকের পূর্ণ শ্রমশক্তি ব্যয়ের অবদান। এই অবদানের মাত্র একটি ক্ষুদ্র অংশের অর্থমূল্য শ্রমিকের কাছে মজুরির আকারে ফিরে যায়। বাকি অংশ উদ্বৃত্ত মূল্যের আকারে মালিকের হাতে থাকে, যা সে আবার উৎপাদন-প্রক্রিয়ায় বিনিয়োগ করে এবং আবার শ্রমিকের শ্রমশক্তির মোট অবদানের বড় অংশের ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ রাখার সুযোগ পায়। প্রাক্-পুঁজিবাদী উৎপাদন-সম্পর্কের আওতায় উদ্বৃত্ত মূল্য সর্বাধিক শোষণ করার এই প্রক্রিয়াটি চালু হয় না। প্রাক্-পুঁজিবাদী উৎপাদন-সম্পর্কের নানা রূপ থাকতে পারে। প্রাক্‌-পুঁজিবাদী সম্পর্কের একটি বিশেষ অবস্থায় উৎপাদন প্রক্রিয়ায় বাণিজ্যিক ও মহাজনি পুঁজির নিয়ন্ত্রণ থাকতে পারে; এমনকী পুঁজিবাদী উৎপাদন-সম্পর্কের সরল পুনরুৎপাদন স্তরের বৈশিষ্ট্যগুলি আংশিক ভাবে অর্জিত হলেও বাণিজ্যিক ও মহাজনি পুঁজির প্রাধান্য থাকতে পারে। এর অর্থ, এই স্তরে বাণিজ্যিক ও মহাজনি পুঁজির প্রাধান্যের কারণে উদ্বৃত্তকে ক্রমাগত উৎপাদন ক্ষেত্রে পুনর্বিনিয়োগের মাধ্যমে শ্রমিকের শ্রমশক্তির অবদানের ওপর পুঁজির নিয়ন্ত্রণ বিস্তৃত করার যে-প্রক্রিয়াটি থাকতে পারত, তা অনুপস্থিত। ফলে মুনাফাকে সর্বাধিক করার উপায় সীমিত হয়, অর্থাৎ পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার গতিময়তা থাকে অনুপস্থিত এবং উৎপাদন-ক্ষেত্রগুলির প্রসারের পথও হয়ে পড়ে সীমিত। উৎপাদন ক্ষেত্রগুলি পুঁজির শক্তিতে সমৃদ্ধ হতে পারে না, বাণিজ্যিক পুঁজি মহাজনি পুঁজির দাপটের নীচে খর্ব হয়। পুঁজিবাদী েস সম্পর্কের চলমানতার বৈশিষ্ট্য হল, ক্রমাগত মুনাফার সর্ববৃহৎ অংশ পুনর্বিনিয়োগের মধ্য দিয়ে শ্রমশক্তির মোট অবদানের একটি বড় অংশের ওপর পুঁজির নিয়ন্ত্রণ বিস্তৃত করা। সেই চলমানতা প্রাক্পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্কে অনুপস্থিত। পুঁজির একটি বড় অংশ উৎপাদনে বিনিয়োজিত না হয়ে বাণিজ্যিক ও মহাজনি পুঁজির আকারে অনুৎপাদনশীল প্রক্রিয়ায় আবদ্ধ থাকে। অপর পক্ষে মুনাফাকে সর্বাধিক স্তরে নিয়ে যাওয়ার এবং ক্রমাগত পুনর্বিনিয়োগের মাধ্যমে শ্রমিকের শ্রমশক্তির অবদানের ওপর পুঁজির নিয়ন্ত্রণ ক্রমাগত বাড়িয়ে যাওয়াই পুঁজিবাদী উৎপাদন প্রক্রিয়ার অন্তিম লক্ষ্য। মজুরি শ্রমিক নিয়োগের মাধ্যমে উৎপাদন প্রক্রিয়া চালিয়েই একমাত্র এই লক্ষ্যটি পূরণ করা যায়। ভারতের কৃষি কী পরিমাণে মজুরি শ্রমিক-নির্ভর হয়ে উঠেছে তা বুঝতে হলে ভারতীয় কৃষি উৎপাদনে কতটা মজুরি শ্রমিকের অবদান আছে সেটি একটি জরুরি তথ্য হয়ে দেখা দেয়। ভারতীয় কৃষিতে যত বিভিন্ন ধরনের শ্রমিকের অবদান রয়েছে তার মধ্যে পারিবারিক শ্রমিকের অবদান অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক বলে মনে করি। কারণ উৎপাদনে ব্যবহৃত মোট শ্রমের মধ্যে পারিবারিক শ্রমের অবদান প্রান্তিক স্তরের থেকে অতিরিক্ত হয়ে পড়লে বিনিয়োগযোগ্য উদ্বৃত্তের সর্বাধিক সঞ্চয়ের পথ ব্যাহত হয়। নীচের সারণিগুলি ভারতীয় কৃষিতে পারিবারিক শ্রম ব্যবহারের অনুপাতের ওপর আলোকপাত করবে:

সারণি ৫.৫ থেকে দেখা যাচ্ছে প্রতি হেক্টর জমিতে ব্যবহৃত মোট শ্রম-ঘণ্টায় পারিবারিক শ্রম-ঘণ্টার শতকরা ভাগ কেরল রাজ্যে সবচেয়ে কম, যদিও কেরালায় সর্ববৃহৎ জোতের সংখ্যা অত্যল্প, হাজারে ৫টির কম। এর পরই গুজরাতের স্থান। গুজরাত রাজ্যে মোট শ্রম-ঘণ্টায় পারিবারিক শ্রম-ঘণ্টার অনুপাত শতকরা ২২.৯০ ভাগ। গুজরাত রাজ্যে সর্ববৃহৎ জোতের সংখ্যা হাজারে ১০টির কম। যে-রাজ্যগুলিতে মোট শ্রম-ঘণ্টায় পারিবারিক শ্রম-ঘণ্টার অনুপাত শতকরা ৩০-এর বেশি, ৪০-এর কম, সেই রাজ্যগুলি হল মহারাষ্ট্র, অন্ধ্রপ্রদেশ ও কর্ণাটক। এই রাজ্যগুলির মধ্যে কর্ণাটকে বৃহৎ জোতের সংখ্যা মোট জোতের প্রতিহাজারে ১০টির নীচে; মহারাষ্ট্রে ও অন্ধ্রপ্রদেশে ৫টিরও নীচে। যে-রাজ্যগুলিতে মোট শ্রম-ঘণ্টায় পারিবারিক শ্রম-ঘণ্টার অনুপাত শতকরা ৪০-এর বেশি, ৫০-এর কম, সেগুলি হল বিহার, পঞ্জাব ও হরিয়ানা। এদের মধ্যে পঞ্জাব ও হরিয়ানায় মোট জোতে সর্ববৃহৎ জোতের ভাগ হাজারে ২০ বা তার বেশি। অর্থাৎ এই দু’টি রাজ্যেই সর্ববৃহৎ জোতের সংখ্যা অন্য সব রাজ্যের থেকে বেশি, অথচ বিহারে সর্ববৃহৎ জোতের অনুপাত হাজারে মাত্র ৫-এর নীচে। অর্থাৎ যেসব রাজ্যে মোট জোতে সর্ববৃহৎ জোতের অনুপাত সবচেয়ে কম তাদের মধ্যে বিহার একটি হলেও বিহারে মোট ব্যবহৃত শ্রম-ঘণ্টায় পারিবারিক শ্রমের অনুপাত পঞ্জাব হরিয়ানার মতো সর্ববৃহৎ জোত অধ্যুষিত রাজ্যের মতোই, শতকরা ৪০-এর বেশি, ৫০-এর নীচে। যেসব রাজ্যে মোট ব্যবহৃত শ্রম-ঘণ্টায় পারিবারিক শ্রম-ঘণ্টার অনুপাত ৫০-এর বেশি এবং ৭০-এর কম তাদের মধ্যে বেশির ভাগ রাজ্যেই বড় জোতের শতকরা অনুপাত সবচেয়ে নীচে, অর্থাৎ হাজারে ৫-এর কম। এরা হল ওডিশা, উত্তরপ্রদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ। এছাড়া মোট শ্রম-ঘণ্টায় পারিবারিক শ্রমের অনুপাত শতকরা ৫০-এর বেশি, ৭০-এর কম এমন আরও দু’টি রাজ্য ঝাড়খণ্ড ও ছত্তীসগঢ়ে মোট জোতে সর্ববৃহৎ জোতের অনুপাত হাজারে ৫-এর বেশি ও ১০-এর কম। মোট ব্যবহৃত শ্রম-ঘণ্টায় পারিবারিক শ্রমের অনুপাত যথেষ্ট বেশি— শতকরা ৭০-এর বেশি ও ৯০-এর কম এমন মাত্র দু’টি রাজ্য রয়েছে, এগুলি হল অসম ও মধ্যপ্রদেশ। কিন্তু অসমে যেখানে মোট জোতের মধ্যে সর্ববৃহৎ জোতের অনুপাত হাজারে ৫ বা তার নীচে, সেখানে মধ্যপ্রদেশে মোট জোতে সর্ববৃহৎ জোতের অনুপাত ১০-এর বেশি এবং ১৫-র নীচে। সবথেকে বেশি পারিবারিক শ্রম ব্যবহৃত হয় যে-রাজ্যটিতে সেটি হল হিমাচল প্রদেশ, এখানে মোট ব্যবহৃত শ্রমে পারিবারিক শ্রমের অনুপাত শতকরা ৯৩.৭০ ভাগ। এই রাজ্যে মোট জোতের মধ্যে সর্ববৃহৎ জোতের অনুপাত হাজারে ৫-এর কম। মোট ব্যবহৃত শ্রমে পারিবারিক শ্রমের অনুপাত সবথেকে কম কেরালায়, শতকরা মাত্র ১৩.৮২ ভাগ। এখানে সর্ববৃহৎ জোতের উপস্থিতি হিমাচল প্রদেশের মতোই, হাজারে মাত্র ৫টি বা তার থেকে কম।

সারণি ৫.৫ মোট শ্রম-ঘণ্টায় পারিবারিক শ্রম-ঘণ্টার শতকরা ভাগ [শস্য: ধান]

সারণি ৫.৫ মোট শ্রম-ঘণ্টায় পারিবারিক শ্রম-ঘণ্টার শতকরা ভাগ [শস্য: ধান]

Source: Directorate of Economics and Statistics, GOI DAC&FE Website

*এমন কোনও রাজ্য নেই যেখানে মোট জোতের প্রতি হাজারে সর্ববৃহৎ জোতের সংখ্যা ১৫ থেকে <২০-এর মধ্যে

দেখা যাচ্ছে, বড় জোতের আধিক্য থাকা সত্ত্বেও প্রায় সব রাজ্যেই ধান চাষে পারিবারিক শ্রমের ব্যবহার যথেষ্ট। পঞ্জাব ও হরিয়ানার মতো এগিয়ে থাকা রাজ্যে যেখানে কৃষিতে আধুনিক উন্নত ধরনের সার, বীজ এবং যন্ত্রপাতির ব্যবহার যথেষ্ট বেশি, সেখানেও মজুরি-শ্রম নিয়োগের প্রয়োজনীয়তা অনেক কম। কারণ শতকরা ৪০ ভাগ বা তারও বেশি পারিবারিক শ্রমের ব্যবহার। সেই সঙ্গে পরিবারের সঙ্গে যুক্ত স্থায়ী শ্রমিকের ব্যবহারও পঞ্জাবের কৃষিতে মুক্ত মজুরি-শ্রমিকের ব্যবহার যথেষ্ট কমিয়ে রেখেছে। শুধু পঞ্জাবে নয়, সব রাজ্যেই ধান গম আলু তুলা সব ধরনের চাষে পারিবারিক শ্রমের বিপুল ব্যবহার মুক্ত মজুরি-শ্রমিকের চাহিদা কমিয়ে রাখে, তার প্রভাব অবশ্যই কৃষি-শ্রমিকের মুক্ত বাজার-প্রক্রিয়াকে বিঘ্নিত করে, কৃষি-মজুরির নিম্ন হার শ্রমের প্রকৃত চাহিদাকে প্রতিফলিত করে না। গম চাষের ক্ষেত্রেও যেসব রাজ্যে বড় জোতের সংখ্যা বেশি, এমনকী সেই সব রাজ্যেও পারিবারিক শ্রমের প্রাধান্য। পঞ্জাবের ক্ষেত্রে ২০১৫–১৬ সালে পারিবারিক শ্রমের অনুপাত শতকরা ৫৮.৮৬ ভাগ।

অন্যদিকে মজুরি-শ্রমিকের মধ্যেও নানা ধরন আছে। মজুরি-শ্রমিক নিয়োগের চুক্তিতে বিভিন্ন শর্ত থাকে: কাজের স্থায়িত্ব (দিন, মাস, বছর) অনুযায়ী স্থায়ী শ্রমিক বা অস্থায়ী শ্রমিক; এদের মধ্যে মজুরির ধরন অনুযায়ী পার্থক্য (যেমন, কাজের ধরন-বিশেষে একটি কাজ সম্পন্ন করার জন্য কাজের ওপর মজুরি), বিভিন্ন ধরনের কাজে কাজের সময় (ঘণ্টা, দিন, মাস, বছর) অনুযায়ী মজুরি, দ্রব্যের মাধ্যমে মজুরি (যেমন খাদ্যের বিনিময়ে কাজ অথবা ধান-চালের বিনিময়ে কাজ); অথবা টাকার অঙ্কে মজুরি। আবার নিয়োগকর্তার সঙ্গে শ্রমিকের সম্পর্কের তফাত থাকতে পারে। যেমন নিয়োগকর্তার ওপর তার নির্ভরতা থেকে জন্ম নেওয়া কর্তৃত্ব ও অধীনতার সম্পর্ক, যার ফলে অন্য নিয়োগকর্তার কাছে কাজ করার স্বাধীনতা না থাকা। উল্টো দিকে সে সম্পূর্ণ স্বাধীনও হতে পারে, সেক্ষেত্রে বাজার-নির্ধারিত মজুরির শর্তে তার নিযুক্তি ঘটবে; এরকম বিভিন্ন শর্তেই শ্রমিক নিয়োগ হতে পারে। শ্রমিকের নিয়োগের নানা প্রকার ব্যবস্থার মধ্যে মজুরি-শ্রমিক নিয়োগ ব্যবস্থার গুরুত্বের তফাতটি উল্লেখযোগ্য। টাকার অঙ্কে মজুরি— যে-মজুরি নির্ধারিত হচ্ছে বাজারে শ্রমিকের জোগান ও চাহিদার টানাপোড়েনের মাধ্যমে, সেই মজুরি নির্ধারণে শ্রমিক মালিকের ব্যক্তিগত কর্তৃত্ব ও অধীনতার সম্পর্কের কোনও গুরুত্ব থাকে না। বাজার নামক একটি নৈর্ব্যক্তিক প্রতিষ্ঠানই এখানে মজুরির হার ও শ্রমিক নিয়োগের শর্তাবলি স্থির করে দেয়। পুঁজিবাদী কৃষিতে বাজারের সর্বব্যাপক প্রাধান্য; মজুরি নির্ধারণের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র শ্রমিকের দক্ষতা ও শ্রম-সময় ভিন্ন অন্য কোনও মানদণ্ড কার্যকর নয়। এখানে শ্রমিকের শ্রমশক্তি বাজারে ক্রয়বিক্রয়যোগ্য একটি পণ্য। ভারতীয় কৃষিতে শ্রমিকের মজুরি নির্ধারণে শ্রমিক মালিকের মধ্যেকার বিভিন্ন ধরনের ব্যক্তিগত বোঝাপড়া ও পূর্বনির্ধারিত কর্তৃত্ব ও অধীনতার সম্পর্কের প্রভাব থাকে। শ্রমশক্তি এখানে একটি সমসত্ত্ব বাজারে ক্রয়-বিক্রয়যোগ্য পণ্য হিসাবে শ্রমিকের অধিকারে থাকে না, যা সে শ্রমের বাজারে শুধুমাত্র বাজার-নির্ধারিত মজুরির বিনিময়ে বিক্রয় করতে পারে।

সারণি ৫.৬ মোট শ্রম-ঘণ্টায় পারিবারিক শ্রম-ঘণ্টার শতকরা ভাগ [শস্য: গম]

সারণি ৫.৬ মোট শ্রম-ঘণ্টায় পারিবারিক শ্রম-ঘণ্টার শতকরা ভাগ [শস্য: গম]

Source: Directorate of Economics and Statistics, DAC&FW website

স্থায়ী ও ঠিকা শ্রমিক

আমরা দেখেছি ভারতীয় কৃষি-শ্রমের বাজারের চরিত্র শিল্প-শ্রমের বাজারের থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। এখানে শ্রম বা শ্রমিক এমন কোনও সমসত্ত্ব পণ্য নয় যা শুধুমাত্র দক্ষতার পরিমাণ অনুযায়ী বা কাজের ধরন অনুযায়ী বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত। এখানে কৃষি-শ্রম একটি বহু ভাগে বিভক্ত পণ্য। আবার কৃষি-শ্রমের একটি বড় অংশ পণ্যের রূপ নেয় না, নানা কারণে ভারতীয় কৃষিতে কৃষি-শ্রম অনেক ক্ষেত্রেই বাজারে স্বাধীনভাবে কেনাবেচা হয় না। যেমন, কৃষি-শ্রমের বড় অংশ পারিবারিক শ্রম, অনেক সময় শ্রমিক পারিবারিক ভাবে মালিক পরিবারের সঙ্গে ঋণের দায়ে বাঁধা পড়ে থাকে। ফলে কৃষি-শ্রম আবদ্ধ শ্রম হিসেবে মালিক বা ঋণদাতার চাপানো শর্তাবলির অধীনে এবং বাজার-চলতি মজুরির তুলনায় কম মজুরিতে কাজ করতে বাধ্য হয়। এইসব ক্ষেত্রে কৃষি-শ্রমের বাজারের একটা অংশ নৈর্ব্যক্তিক বাজার-ব্যবস্থার দ্বারা পরিচালিত না হয়ে শ্রমিক-মালিকের ব্যক্তিগত সম্পর্কের নিরিখে ঠিক হয়।

এছাড়া মজুরি-শ্রমিক দু’ধরনের হতে পারে, অস্থায়ী ঠিকা শ্রমিক ও স্থায়ী শ্রমিক। অস্থায়ী ঠিকা মজুরি-শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি সরকার আইন করে নির্দিষ্ট করে দেয়। অবশ্য ব্যস্ত মরশুমে মজুরি-শ্রমের চাহিদা বাড়ার ফলে খোলাবাজারে মজুরি বাড়ে। কিন্তু বাস্তবে ভারতের মতো দেশের কৃষি-শ্রমিকের মজুরি শ্রমের মুক্ত বাজারে চাহিদা-জোগানের ওঠাপড়ার ওপর সবসময় নির্ভর করে না। ঋণ-বন্ধকি শ্রমিক ব্যস্ত সময়ের বর্ধিত মজুরি পায় না। ঋণের শর্ত অনুযায়ী পূর্বনির্ধারিত কম মজুরিতে তারা কাজ করতে বাধ্য হয়। আবার স্থায়ী শ্রমিকের ক্ষেত্রে মজুরির একটা অংশের মধ্যে শ্রমিকের খাওয়া-পরা-থাকার খরচ লুকানো থাকে, অপর অংশটি টাকায় দেওয়া হয়। স্থায়ী শ্রমিকদের নিয়োগের অনিশ্চয়তা কম; নিয়োগের তুলনামূলক স্থায়িত্বের কারণে স্থায়ী শ্রমিকরা ঠিকা শ্রমিকদের তুলনায় কম মজুরিতে কাজ করতে রাজি থাকতে পারে। কিন্তু এ বিষয়ে তথ্য ও অর্থনীতিবিদদের পর্যবেক্ষণগুলি বিভিন্ন। এই শ্রমিকদের একটি অংশ ঋণ-বন্ধকি শ্রমিকও হতে পারে।

ঠিকা শ্রমিক ও স্থায়ী শ্রমিকের মধ্যে কাজের ও দায়িত্বের চরিত্র ভিন্ন। ঠিকা শ্রমিকরা সাধারণত এমন কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকে যার ফল সহজেই চোখে পড়ে। এর কারণ তাদের কাজের সময় উত্তীর্ণ হওয়ার পর ফসল ওঠার পরই সাধারণত তারা কতটা ভালভাবে কাজ করেছে তা বোঝা যায়। তাদের কাজের ত্রুটি বা কাজে অবহেলা তাদের কাজের সময়কালের মধ্যে না-ও ধরা পড়তে পারে। ফলে কাজে ত্রুটির জন্য তাদের কোনওভাবে শাস্তি পেতে হয় না। এই কারণে সাধারণ রুটিনমাফিক কাজই তাদের দিয়ে করানো হয়। তাই অস্থায়ী ঠিকা শ্রমিকদের আগাছা পরিষ্কার, বা ফসল কাটার মতো কাজগুলি দেওয়া হয়। অন্যদিকে স্থায়ী শ্রমিকরা দীর্ঘক্ষণ স্থায়ীভাবে কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকে বলে তাদের আরও দায়িত্বের কাজগুলি করতে দেওয়া হয়। যেমন সার দেওয়া, জমিতে জলসিঞ্চন করা, কীটনাশক প্রয়োগ ইত্যাদি যেসব কাজের ওপর ফসলের পরিমাণ নির্ভর করে সেগুলিই তাদের করতে দেওয়া হয়। এছাড়া স্থায়ী শ্রমিক মালিকের সঙ্গে ঠিকা শ্রমিকের নিয়োগ ও ঠিকা শ্রমিকের কাজের তদারকিতে যুক্ত থাকে।

ঠিকা শ্রমিকরাও কোনও সমসত্ত্ব বিভাজন নয়। এরা কাজ ও দায়িত্বের চরিত্র অনুযায়ী বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত। কৃষিক্ষেত্রে বিভিন্ন ঋতুতে কাজের চরিত্র বিভিন্ন। ফলে বিভিন্ন ঋতুতে বিভিন্ন ধরনের কৃষিকাজে নিযুক্ত কৃষি-শ্রমিকের মজুরিও বিভিন্ন।

মজুরিও নানা রূপ নেয়। কখনও কখনও মজুরির একটা অংশ টাকায় ও অন্য অংশ খাদ্যের মাধ্যমে দেওয়া হয়। এসব ক্ষেত্রে প্রায়ই মজুরি নির্ধারণে বাজারের চাহিদা-জোগানের প্রভাবের তুলনায় ব্যক্তিগত সম্পর্কের প্রভাব বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়।

ভারতের কৃষিতে কৃষি-শ্রমিকের বাজারের ওপর অর্থনৈতিক বিশ্লেষণে কৃষি-শ্রমের বাজারের এইসব বৈশিষ্ট্য প্রায়শই অবহেলিত থাকে। পারিবারিক শ্রমিক ও মজুরি শ্রমিক এবং স্থায়ী শ্রমিক ও ঠিকা শ্রমিক, এই বিভিন্ন বিভাগগুলির অন্তর্ভুক্ত শ্রমের মজুরি-হারের সঙ্গে জোগান ও চাহিদার পরিবর্তনের ধরন ভিন্ন। অর্থনৈতিক তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের যে-পদ্ধতি চালু আছে তাতে এই ভিন্নতাকে বিবেচনায় আনা হয় না। সমস্ত ধরনের শ্রমিক বা শ্রমকে একই বাজারি পণ্য হিসাবে ধরা হয়। প্রথমত, শ্রমের নিয়োগের সময়কালের গুরুত্ব বিবেচনায় আনা হয় না। দ্বিতীয়ত, এই বিশ্লেষণে শ্রম-ঘণ্টা ও শ্রমিকের সংখ্যার মধ্যে পার্থক্যকে বিবেচনায় আনা হয় না। অস্থায়ী ঠিকা শ্রমিকদের সেই কাজেই যুক্ত করা হয় যে-কাজগুলি সহজে দেখা যায়, কিন্তু স্থায়ী শ্রমিকরা দীর্ঘ সময়ের কাজগুলি করার শর্তে নিয়োজিত হয় বলে তারা অনেক সময়ে চুক্তি অনুযায়ী কাজ না-ও করতে পারে। সনাতন অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ পদ্ধতিতে এই চুক্তি ফাঁকি দেওয়ার মতো অনৈতিক আচরণজনিত সমস্যাগুলি বিবেচনার বাইরে থেকে যায়। একজন শ্রমিক তার চুক্তি অনুযায়ী কাজ করার ক্ষেত্রে ফাঁকি দিলে শ্রমের জোগানের ওপর তার যে-প্রভাব পড়ে তা বিবেচনায় আনা হয় না। এই আলোচনায় ধরে নেওয়া হয় যে, যা-ই চুক্তি করা হোক না কেন, শ্রমিক নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে সেই চুক্তি অনুযায়ী দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করবে। তৃতীয়ত কৃষি উৎপাদন ঋতুগত অনিশ্চয়তার শিকার। মজুরি ও শ্রমের চাহিদার সর্ম্পক, অর্থাৎ শ্রমিকের চাহিদা-রেখা ঋতু অনুযায়ী পালটায়। কৃষি-উৎপাদনের ব্যস্ত সময়ে একই পরিমাণ শ্রম পাওয়ার জন্য বেশি মজুরি দিতে হয়। এই কারণে ঋতু অনুযায়ী উৎপাদন ধরনের থেকে কৃষিশ্রমিকের যে চাহিদা-রেখা পাওয়া যায় তাতে এবং মজুরির ওঠানামায় এই অনিশ্চয়তার প্রভাব পড়ে। সনাতন তত্ত্বে এই অনিশ্চয়তার প্রভাবকে বিবেচনায় আনা হয়, কিন্তু এর কারণে যে শ্রমিকের শ্রমের জোগান প্রভাবিত হয় সনাতন আলোচনায় তাকে স্থান দেওয়া হয় না। শ্রমিক এমন একটি চুক্তি পছন্দ করতে পারে যেখানে মজুরি ঋতু অনুযায়ী বা অন্য কোনও অনিশ্চয়তার কারণে ওঠানামা করবে না, বরং সারা বছর ধরে একটি গড় মজুরির সমান মজুরি নিশ্চিত থাকবে। যে-নিয়োগকর্তা এই ধরনের মজুরি দিতে স্বীকৃত হবে শ্রমিক তার কাছেই কাজ করতে রাজি থাকতে পারে। সনাতন আলোচনা পদ্ধতিতে এই বিষয়গুলি আলোচনায় আনা হয় না।

কৃষিতে যন্ত্র ব্যবহার ও প্রকৌশলগত উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে কৃষিশ্রমের বাজারের চরিত্রে ও বিভিন্ন ধরনের শ্রমের মধ্যে মজুরির বিন্যাসে পরিবর্তন ঘটেছে। প্রথমত, আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগের ফলে যেমন একদিকে স্থায়ী ও ঠিকা শ্রমিকের নিয়োগে তুলনামূলক গুরুত্বের পরিবর্তন হয়েছে ও বারে বারে একই জমিতে চাষ সম্ভব হওয়ায় শ্রমিকের মোট চাহিদা বেড়েছে, তেমনই আবার নতুন প্রযুক্তি প্রয়োগের ফলে সাধারণ কৃষি-শ্রমিকের বিশেষ ধরনের দক্ষতা থাকা জরুরি হয়ে উঠেছে এবং সাধারণ ভাবে অদক্ষ কৃষি-শ্রমিকের চাহিদা ও নিয়োগ কমেছে। এর প্রভাব পড়েছে কৃষি-মজুরির ওপর। সামগ্রিকভাবে বিভিন্ন শস্যের তুলনামূলক উৎপাদন ব্যয়ের ওপর এর প্রভাব লক্ষণীয়।

ভারতীয় কৃষি উৎপাদন ও কৃষিতে শ্রমের চাহিদা ঋতু ও বৃষ্টিপাতের পরিমাণের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। তাছাড়া চাষের বিভিন্ন পর্যায়ে ভিন্ন ভিন্ন দক্ষতার শ্রমিকের চাহিদা বিভিন্ন। কোনও শ্রমিক বছরের সবসময় নিযুক্ত নাও থাকতে পারে, কম সময়ের জন্য বা বেশি সময়ের জন্য নিযুক্ত থাকতে পারে। এই কারণে কৃষিতে বেকারত্ব ও শ্রমের নিযুক্তির ধারণা ও পরিমাণ মাপার পদ্ধতিটি বেশ জটিল।

কৃষি-শ্রমিকের মজুরি নির্ধারণ প্রক্রিয়া সম্পর্কে নানা অনুমানের ভিত্তিতে নানা তত্ত্ব গড়ে উঠেছে। কৃষি-শ্রমের বাজারে নিয়োগকর্তাই ঋণদাতা হিসেবে হাজির হলে কীভাবে বিশেষ ক্ষেত্রে ঋণদান ও শ্রমের নিয়োগের যুক্ত প্রক্রিয়া একই সঙ্গে সুদ ও মজুরি নির্ধারণ করতে পারে, বিভিন্ন অনুমানের ওপর নির্ভর করে তাত্ত্বিক মডেল নির্মাণ করে তা দেখানো হয়েছে।

বিভিন্ন ধরনের কৃষি-শ্রমিকের মজুরি নির্ধারণ

ক) স্থায়ী শ্রমিক ও অস্থায়ী ঠিকা শ্রমিকের মজুরি নির্ধারণ

মজুরি-শ্রমিকও কোনও সমসত্ত্ব বিভাগ নয়। মজুরি-শ্রমিকের দু’টি প্রধান উপবিভাগ হল স্থায়ী শ্রমিক ও অস্থায়ী বা ঠিকা শ্রমিক। এই দু’টি উপবিভাগের মধ্যে প্রধান তফাত হল, স্থায়ী শ্রমিকরা বাৎসরিক ভিত্তিতে নিযুক্ত হয় আর অস্থায়ী শ্রমিকরা দৈনিক ভিত্তিতে নিযুক্ত হয়। স্থায়ী শ্রমিকের মজুরির একটি বড় অংশ বছর শেষে দেওয়া হয়, আর একটি অংশ বছরের বিভিন্ন সময়ে চাহিদা অনুযায়ী দেওয়া হয়। অপরপক্ষে ঠিকা শ্রমিকরা দিনের হিসেবে নিযুক্ত হয়, মজুরিও পায় দৈনিক হিসেবে। এই দুই ধরনের মজুরি শ্রমিকের মধ্যে নিয়োগের শর্তাবলিতে একাধিক পার্থক্য থাকে। অন্যদিকে যে-কাজের সঙ্গে এই দুই প্রকার শ্রমিক দায়িত্ববদ্ধ, বড় ফারাক থাকে সেই কাজগুলির ধরনেও।

অস্থায়ী ঠিকা শ্রমিকের মজুরি

পিছিয়ে পড়া অর্থনীতিতে অস্থায়ী ঠিকা শ্রমিকের বাজারে সর্বদা চাহিদা-জোগানের ওঠানামার মধ্য দিয়ে মজুরি নির্ধারিত হয় না। ঠিকা শ্রমিকের মজুরিতে শুধুমাত্র ঋতু অনুযায়ী ও অঞ্চল অনুযায়ী পার্থক্য হয় তা নয়। একই ঋতুতে ও একই স্থানে কৃষিকাজের বিভিন্ন পর্যায়ে মজুরির বিভিন্ন হার চালু থাকে। মজুরি হারে এই পার্থক্য ঘটার যুক্তিগ্রাহ্য কারণ হল, কৃষিকাজের বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন প্রকার দক্ষতা ও ক্ষমতার চাহিদা।

এছাড়া কৃষি-শ্রমিকের মজুরি সর্বদা টাকার অঙ্কে দেওয়া হয় না, কখনও কখনও বিভিন্ন জিনিসপত্র, বা খাবারের মাধ্যমে মজুরি দেওয়া হয়। কখনও টাকা এবং খাবার উভয়ের বিভিন্ন অনুপাতের মিশ্রণে মজুরি দেওয়া হয়। আবার কখনও কখনও একটি বিশেষ কাজ সম্পন্ন করার জন্য মজুরি দেওয়া হয়, কখনও দেওয়া হয় কাজের সময় অনুযায়ী। এর ফলে মজুরি নির্ধারণের প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মগুলি প্রায়শই ভারতীয় কৃষি-শ্রমিকের মজুরি নির্ধারণে কাজে লাগে না। কৃষি-শ্রমিকের মজুরি নির্ধারণ বিষয়ে তাত্ত্বিক আলোচনায় পুষ্টির মাপকাঠিতেও মজুরি নির্ধারণের কথা বলা হয়।

স্থায়ী শ্রমিকের মজুরি নির্ধারণ

যদি অস্থায়ী ঠিকা শ্রমিকের মজুরি প্রতিযোগিতামূলক বাজারে তাদের জোগান ও চাহিদার কার্যকারিতার ওপর নির্ভর করে, সেক্ষেত্রে স্থায়ী শ্রমিকের মজুরি কীভাবে স্থির হয় সেটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। আমরা এই অংশে সেই প্রশ্নটি নিয়েই আলোচনা করব। এটা ভাবা যুক্তিসঙ্গত যে, স্থায়ী শ্রমিকের কাজে যেহেতু দায়িত্ব বেশি এবং স্থায়ী শ্রমিককে অনেক বেশি সময় ধরে কাজে লিপ্ত থাকতে হয়, তাই স্থায়ী শ্রমিকের মজুরি অস্থায়ী ঠিকা শ্রমিকদের চেয়ে কিছুটা বেশি হওয়া স্বাভাবিক। অতিরিক্ত দায় বহন করার জন্য অস্থায়ী শ্রমিকদের চেয়ে স্থায়ী শ্রমিকদের মজুরি কতটা বেশি হওয়া উচিত সেটি নির্ধারণ করার জন্য অনেক সময় স্থায়ী শ্রমিকদের চুক্তি অনুযায়ী কাজ করার সঙ্গে অসৎভাবে ফাঁকি দেওয়ার বিষয়টিও বিবেচনায় থাকে। মজুরি নির্ধারণের বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অনুমান করা হয়, স্থায়ী শ্রমিকরা সবসময় কিছুটা অসততার সুযোগ নিয়ে অন্য কোথাও ঠিকা শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে পারে এবং সেই সময়ের জন্য ঠিকা শ্রমিকের মজুরি উপার্জন করতে পারে। তাই স্থায়ী শ্রমিকের মজুরি ঠিকা শ্রমিকের মজুরির চেয়ে এতটাই বেশি হওয়া প্রয়োজন যাতে তার কাজে ফাঁকি দেওয়ার লাভ স্থায়ী শ্রমিক হিসেবে অতিরিক্ত আয়ের চেয়ে বেশি না হয়। অর্থাৎ স্থায়ী শ্রমিকের মজুরি এমন হতে হবে যাতে তার ভাবনা অনুযায়ী যতটা সময় সে স্থায়ী শ্রমিক হিসেবে কাজে যুক্ত থাকবে সেই সময়ে ঠিকা শ্রমিকের চেয়ে যে-অতিরিক্ত আয় সে পাবে, তা যেন তার কাজে ফাঁকি দিয়ে পাওয়ার মতো প্রত্যাশিত লাভ পূরণ করে দিতে পারে। কারণ তার ফাঁকি ধরা পড়ে গেলে সে স্থায়ী শ্রমিক হিসেবে কাজটি হারাবে ও ঠিকা শ্রমিক হিসেবে শ্রমের বাজারে নিজেকে উপস্থিত করতে বাধ্য হবে। সুতারাং যতটা সময় সে স্থায়ী শ্রমিক হিসেবে কাজে লিপ্ত থাকতে পারত বলে তার মনে হবে, সেই সময়ের অতিরিক্ত আয় যেন তার কাজে ফাঁকি না দেওয়ার জন্য সে যে পরিমাণ ক্ষতি হবে বলে মনে করবে সেই ক্ষতি পূরণ করতে পারে। যদি বাজারে ঠিকা শ্রমিকের মজুরি বাড়ে তাহলে তার কাজে ফাঁকি দেওয়ার সম্ভাব্য লাভ একই অনুপাতে বাড়বে, সুতরাং তাকে কাজে ফাঁকি দেওয়া থেকে বিরত করতে হলে তার স্থায়ী কাজের মজুরিকেও তার ঠিকা মজুরির সমান অনুপাতে বাড়াতে হবে।

অসৎভাবে কাজে ফাঁকি দেওয়ার সমস্যাটি বাদ দিয়েও এটা অনুমান করা স্বাভাবিক যে, স্থায়ী শ্রমিকের মজুরি সবসময়েই অস্থায়ী ঠিকা শ্রমিকের মজুরির দ্বারা প্রভাবিত হবে। আসলে স্থায়ী শ্রমিকের কাছে ঠিকা শ্রমিকের বাজার সবসময়ই একটি বিকল্প নিয়োগের সুযোগ হিসেবে বিরাজ করে। স্থায়ী শ্রমিকের কাছে ঠিকা শ্রমিকের মজুরি স্থায়ী শ্রমিকের মজুরির পরিবর্ত সুযোগের ব্যয় (অর্থাৎ ওই সময়ে কৃষি-শ্রমিক অন্য কোনও পরিবর্ত কাজে যে-মজুরি পেতে পারত। এটাকে বলে পরিবর্ত বা বিকল্প সুযোগের ব্যয়) হিসেবে দেখা দেয়। কিন্তু ঠিকা শ্রমের বাজারে কাজ পাওয়া অত্যন্ত অনিশ্চিত। যেহেতু কৃষি উৎপাদনের সঙ্গে আবহাওয়া-সম্পর্কিত অনিশ্চয়তা ছাড়াও ঋতুগত ও অন্যান্য নানা ধরনের অনিশ্চয়তা জড়িত থাকে তাই ঠিকা শ্রমিকের চাহিদা বহুল পরিমাণে অনিশ্চয়তায় পূর্ণ। তাই স্থায়ী শ্রমিকের কাছে ঠিকা শ্রমের বাজারে তার প্রত্যাশিত মজুরি স্থায়ী কাজ ছাড়ার সময় তার ঠিকা শ্রমের বাজারে কাজ পাওয়ার সম্ভাব্যতার ওপর নির্ভর করে। স্থায়ী শ্রমিক কাজ ছাড়ার সময় তার সঙ্গে সঙ্গে ঠিকা শ্রমের বাজারে কাজ পাওয়ার সম্ভাব্যতা বিষয়ে একটা অনুমান করে। ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তার কথা মাথায় রাখলে তার পরের পর্বে এবং পরপর যতদিন সে স্থায়ী কাজে নিযুক্ত থাকতে পারত ততদিন ধরে সব কৃষি-উৎপাদন পর্বগুলিতে তার ঠিকা কাজ পেয়ে যাওয়ার সম্ভাব্যতা ক্রমশ কমবে। এই প্রারম্ভিক অনুমানটি সামনে রেখে আমরা স্থায়ী কাজের মজুরি নির্ধারণ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছি।

ধরি স্থায়ী শ্রমিকের মজুরি = wp এবং অস্থায়ী শ্রমের মজুরি = wc

Wp>Wc

যেহেতু স্থায়ী কাজে দায়িত্ব বেশি, জটিলতা বেশি, এবং অস্থায়ী কাজের তুলনায় স্থায়ী কাজে দীর্ঘ সময় একজন শ্রমিককে যুক্ত থাকতে হয়, wp সাধারণত wc এর তুলনায় অনেক বেশি থাকে। কিন্তু বেশি দায়িত্ব নিতে হয় বলে ও অস্থায়ী শ্রমিকের নিয়োগে ও অস্থায়ী শ্রমের তদারকি করার দায়িত্বের জন্য অস্থায়ী শ্রমিকের তুলনায় তার মজুরি বেশি হলেও একজন স্থায়ী শ্রমিক তার মজুরির সঙ্গে অস্থায়ী শ্রমিকের মজুরি তুলনা করার সময় তার কাজের জটিলতার কথা মাথায় রেখে এই জটিলতা বহনের ক্ষতি হিসেবে সর্বদা তার মজুরি থেকে একটা অংশ বাদ দিয়ে হিসেব করে। আমরা ধরে নিচ্ছি স্থায়ী শ্রমিকরা স্থায়ী শ্রমিক হওয়ার মূল্য হিসেবে তাদের মজুরি থেকে যে-পরিমাণ টাকা বাদ দিয়ে ধরে তার পরিমাণ হল:

α wp (0 < α < 1)

সুতরাং তার নিট আয় হল: wp – α wp

এখন, ধরি সে ভাবছে তার স্থায়ী শ্রমিক হিসেবে কাজটির স্থায়িত্ব N (N ≥ 1) সময়

সুতরাং যদি তার মোট ধরে নেওয়া আয় N(wp – α wp) অন্তত পক্ষে তার বিকল্প আয়ের সমান হয়, তাহলে সে তার বর্তমান কাজটি ছেড়ে যেতে চাইবে না। আমরা মনে করি, স্থায়ী শ্রমিক হিসেবে সে যতদিন কাজ পেতে পারত বলে মনে করে, অর্থাৎ যে-সময় ধরে ছেদহীন ভাবে স্থায়ী শ্রমিক হিসেবে সে কাজ করতে পারবে বলে মনে করবে, অস্থায়ী শ্রমিক হিসেবে সেই সময়ের জন্যই সে ঠিকা কাজ না পেলে তার বর্তমান কাজটি ছেড়ে যেতে চাইবে না। আবার অস্থায়ী শ্রমিক হিসেবে যে-সময়ের জন্য ঠিকা কাজ সে চাইবে, তা যত লম্বা হবে ততই তার কাজ পাওয়ার সম্ভাব্যতা কমতে থাকবে। আমরা মনে করি তার N সময় ধরে বিকল্প অস্থায়ী কাজ পাওয়ার সম্ভাব্যতা = pN (p ≤ 1) সুতরাং স্থায়ী শ্রমিক হিসেবে তার কাজ ছাড়ার প্রবণতা বন্ধ করতে হলে তার মজুরি Wp এমন স্তরে স্থির হওয়া প্রয়োজন যাতে করে যতটা পরিমাণ আয় সে স্থায়ী শ্রমিক হিসেবে কাজ ছাড়ার ক্ষতি বলে মনে করবে সেই তার মনে করা ক্ষতির পরিমাণ অন্তত পক্ষে তার অস্থায়ী ঠিকা শ্রমিক হিসেবে প্রত্যাশিত আয়ের চেয়ে কম না হয়। এর অর্থ Wp এমন স্তরে বেঁধে দিতে হবে যাতে N (wp – α wp) ≥ PN . NWc হয়, অর্থাৎ,

বা NWp (1 – α) ≥ N PN . Wc

বা Wp (1 – α) ≥ PN . Wc Wp ≥ PNWc/(1 – α)

Wp/Wc ≥ PN/(1 – α)`

তার স্থায়ী কাজের স্থায়িত্ব (N) যত বেশি বলে তার মনে হবে, স্থায়ী কাজ ছেড়ে অস্থায়ী কাজ নেওয়ার প্রবণতা বন্ধ রাখার জন্য অস্থায়ী মজুরির তুলনায় তার স্থায়ী মজুরি তত কম বাড়লেও চলবে। তার স্থায়ী কাজের জটিলতা (α) যত বেশি বলে সে মনে করবে, তাকে স্থায়ী কাজ ছেড়ে অস্থায়ী কাজ নেওয়া থেকে বিরত করতে হলে অস্থায়ী মজুরির তুলনায় স্থায়ী মজুরিকে ততই বেশি হতে হবে। অস্থায়ী শ্রমের বাজারে অনিশ্চয়তা যত বেশি, অর্থাৎ অস্থায়ী কাজ পাওয়ার সম্ভাব্যতা যত কম, অস্থায়ী বাজারের মজুরির তুলনায় স্থায়ী মজুরি ততই সামান্য বেশি হলে শ্রমিককে কাজ ছাড়া থেকে বিরত রাখা সম্ভব হবে। যাই হোক স্থায়ী কাজের জটিলতা, অস্থায়ী কাজের অনিশ্চয়তা ও স্থায়ী কাজের সময় একই থাকলে অস্থায়ী কাজে মজুরি যত বেশি হবে স্থায়ী কাজের মজুরিও ততই বেশি হওয়ার প্রয়োজন হবে। স্থায়ী শ্রমিকের কাজের স্থায়িত্ব যদি খুব বেশি হয় তাহলে অস্থায়ী কাজের তুলনায় তার আয় সামান্য বেশি হলেও সে স্থায়ী কাজ ছাড়তে উৎসাহিত হবে না। কারণ, একটি স্থায়ী কাজ হারানোর ক্ষতি তার কাছে এত বেশি মনে হবে যে, মজুরির সামান্য তফাত কোনও প্রভাব সৃষ্টি করতে পারবে না। স্থায়ী কাজের মজুরি যেমন অস্থায়ী বাজারের অনিশ্চয়তার ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল, তেমনই, ভারতের মতো পিছিয়ে পড়া অর্থনীতিতে বিরাট পরিমাণ উদ্বৃত্ত শ্রমের ও বেকারত্বের উপস্থিতিতে কাজের স্থায়িত্ব একটি বড় বিষয় হিসেবে দেখা যায়, সেক্ষেত্রে সামান্য মজুরির তফাতেই শ্রমিক দীর্ঘ সময় কাজে টিকে থাকে।

আমাদের মতো স্বল্পোন্নত দেশের কৃষি-অর্থনীতিতে অপ্রাতিষ্ঠানিক বাজার-বহির্ভূত ব্যক্তিগত সম্পর্ক ও পারস্পরিক বোঝাপড়া শ্রমিকের কাজে অনৈতিক ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা রোধ করে। তাছাড়া কাজের চুক্তিতে বিবৃত কাজের নিয়ম-কানুন ও শর্তাবলি অনেক সময়েই ব্যক্তিগত প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন ব্যক্তির নিরিখে বিভিন্ন হয়। যেমন স্থায়ী শ্রমিকের কাজের শর্তে ব্যক্তিগত কাজের জন্য বিশেষ সময়ের ব্যবস্থার কথা বিবৃত থাকতে পারে: শ্রমিকের যদি একখণ্ড জমি থাকে তবে সেই শ্রমিকের কাজের শর্তে জমি চাষ করার মতো সময়ের সুযোগ দেওয়া থাকতে পারে। সেখানে মালিক-শ্রমিকের পারস্পরিক সম্পর্ক তার কাজে ফাঁকি দেওয়ার প্রয়োজন কমিয়ে আনতে পারে। কিন্তু এসব সত্ত্বেও অস্থায়ী ঠিকা শ্রমের বাজারের উপস্থিতি তার কাছে একটি পরিবর্ত কাজের সুযোগ হিসেবে থাকে, তাই স্থায়ী কাজের সঙ্গে শ্রমিককে ধরে রাখতে হলে অস্থায়ী বাজারের মজুরির সঙ্গে সবসময়েই স্থায়ী শ্রমের বাজারের মজুরির ধনাত্মক সম্পর্ক থাকা দরকার। শুধু তাই নয়, অস্থায়ী বাজারের শ্রমিকের মজুরির বাড়ার সঙ্গে স্থায়ী বাজারের মজুরি আনুপাতিক হারে বাড়ানো দরকার।

আমরা আগেই দেখেছি, কৃষিতে বিপুল পরিমাণ পারিবারিক শ্রম ও বিভিন্ন রকম শর্তে নিযুক্ত মজুরি শ্রমিকের উপস্থিতির কারণে মুক্ত কৃষি শ্রমিকের চাহিদা বাড়তে পারে না। ফলে কয়েকটি রাজ্যে মজুরির হার খুব বেশি বাড়তে পারেনি। সারণি থেকে দেখা যাচ্ছে, দক্ষ ও অদক্ষ উভয় ধরনের শ্রমিকের আর্থিক মজুরি সবক্ষেত্রেই যথেষ্ট বেড়েছে। যেহেতু মজুরির আর্থিক মূল্য সেই বছরের দামে স্থির হয়, তাই ২০১০–১১ থেকে ২০১৫–১৬ এই পাঁচ বছরের কৃষিপণ্যের দামের অস্বাভাবিক বৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে এই আর্থিক মজুরির পরিমাণে।

ঋণ-আবদ্ধ শ্রমিক

ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে স্থায়ী ও ঠিকা, দু’ধরনের শ্রমিকের মধ্যেই ঋণ-আবদ্ধ শ্রমিকেরা উপস্থিত। অনেকেই ঋণ শোধ করতে না পেরে ঋণ-আবদ্ধ স্থায়ী শ্রমিকে পরিণত হয়। অপ্রতুল সেচ ব্যবস্থার কারণে ভারতের কৃষি এখনও অনেকটা পরিমাণে বৃষ্টিনির্ভর। ফলত বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বৃষ্টিসেবিত অঞ্চলগুলিতে সব ঋতুতে কৃষি শ্রমিকের কাজ থাকে না, তারা ঋণ নেয়। ঋণদাতা অধিকাংশ ক্ষেত্রে তার নিয়োগকর্তা চাষি। এই ঋণদাতা সেই সুযোগে ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে কৃষি-উৎপাদনের ব্যস্ত সময়ে বাজারের বর্ধিত মজুরির তুলনায় স্বল্প মজুরিতে কাজ করার প্রতিশ্রুতি আদায় করে। এই ব্যস্ত সময়ে স্বল্প মজুরিতে কাজ পাওয়ার শর্তই তার ঋণ পরিশোধের নিশ্চয়তা, যার ওপর দাঁড়িয়ে চাষি তার মজুরি-শ্রমিককে সারা বছর তার কাছে বেঁধে রাখে। ফলে শ্রমিকটি স্বাধীনভাবে শ্রমের বাজারে অংশ নেওয়ার পথে বাধা পায়। অনেক সময় ঋণ-বন্ধকির পরিণতিতে ঠিকা চাষি দীর্ঘদিন একই মালিকের কাছে কম মজুরিতে কাজ করতে বাধ্য থাকে। এই পদ্ধতিতেও স্থায়ী শ্রমিকের বাজারের একটি অংশে মজুরি নির্ধারণে নৈর্ব্যক্তিক বাজারের প্রভাবের তুলনায় মালিকের ইচ্ছার ওপর অনেকটা নির্ভর করে। সেখানে ঠিকা শ্রমিকের বাজার-চলতি মজুরি মালিকের বিবেচনায় কোনও প্রভাব সৃষ্টি করে না। এই বহুধাবিভক্ত শ্রমের বাজার শুধু আদর্শ প্রতিযোগিতামূলক বাজারের নিয়মের বাইরে কাজ করে তাই নয়, পুঁজিবাদী বাজার ব্যবস্থার অস্তিত্বের ন্যূনতম শর্তগুলি, যেমন শ্রমের চাহিদা ও জোগানের টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে মজুরি নির্ধারণ, এবং শ্রমের বাজারে শ্রমের স্বাধীন চলাচল, কেনা-বেচা, ইত্যাদি শর্তগুলিও এখানে কার্যকর হয় না। এসবের পরিণামে যারা কৃষিতে উদ্যোগী ও বিনিয়োগে উৎসাহী, এমন চাষিদের কাছে বাজারদরে শ্রমের স্বাভাবিক জোগান একটি সমস্যা হয়ে দেখা দেয়। পুঁজিবাদী বিনিয়োগের পথ অমসৃণ হয়ে পড়ে।

সারণি ৫.৭ কৃষিতে দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিকে মজুরি।

সারণি ৫.৭ কৃষিতে দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিকে মজুরি।

Source: Directorate of Economics and Statistics, Department of Agriculture and Co-Operation, Ministry of Agriculture

কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে উচ্চফলনশীল সার-বীজের সঙ্গে যন্ত্র ব্যবহারের মাত্রাও বৃদ্ধি পায়। আমরা আগেই দেখেছি, পঞ্জাবের কৃষিতে কীভাবে যন্ত্র ব্যবহারের মাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে শ্রমিক নিয়োগের মাত্রা উল্লেখযোগ্য ভাবে কমেছে। সারা দেশের কৃষিতে, বিশেষ করে কয়েকটি অঞ্চলে, যেখানে কৃষিতে যন্ত্র ব্যবহারের মাত্রা অস্বাভাবিক বেড়েছে, সেখানে কৃষিতে নিযুক্তির পরিমাণে উল্লেখযোগ্য হ্রাসের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু কৃষি থেকে উচ্ছেদ হওয়া কৃষক জনগণ জীবিকা নির্বাহের উপায় হিসেবে স্বনিযুক্তির সাহায্যে বিভিন্ন সহায়ক উৎপাদনক্ষেত্র গড়ে তুলতে আগ্রহী হয়েছে। ফলে স্বনিযুক্তির ওপর নির্ভরশীল ছোট উৎপাদন সংস্থার উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি ঘটেছে। কৃষি থেকে উৎখাত হওয়া মানুষ সম্পূর্ণ বেকার হয়ে পড়ার আগে বেঁচে থাকার তাগিদে স্বনিযুক্ত সংস্থা গঠন করে কোনওভাবে বেঁচে থাকার চেষ্টা করে। একথা মনে করার কোনও কারণ নেই যে, নিযুক্তি হ্রাস শুধুমাত্র কৃষিক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ। ২০১২-র পর থেকে সংগঠিত শিল্পক্ষেত্রেও নিযুক্তির হার চূড়ান্ত কমেছে। তার অর্থ, কৃষি থেকে উচ্ছেদ হওয়া মানুষ সংগঠিত শিল্পক্ষেত্রে স্থান পাচ্ছে না। পুঁজিবাদের বিকাশ পর্যায়ে কৃষি থেকে ও ছোট শিল্পক্ষেত্র থেকে উচ্ছিন্ন হয়ে মানুষ সংগঠিত শিল্প ক্ষেত্রে নিযুক্ত হয়। কিন্তু ভারতের অর্থনীতিতে প্রাথমিক উৎপাদন ক্ষেত্র কৃষিতে ব্যাপক কর্মহীনতাকে ভারতীয় অর্থনীতিতে কাঠামোগত পরিবর্তনের প্রকাশ বলে ধরা যাচ্ছে না। কৃষি ও অসংগঠিত ক্ষেত্র থেকে উচ্ছিন্ন মানুষ শিল্পক্ষেত্রেও নিযুক্ত হতে পারছে না, কারণ ২০০৫ সালের পর থেকে নিযুক্তির হারে যে-মন্দা দেখা যাচ্ছিল, ২০১২-র পর থেকে অসংগঠিত শিল্পের পাশাপাশি সংগঠিত শিল্পক্ষেত্রেও বেকারত্ব বৃদ্ধির প্রবণতা বেড়ে চলেছে। কৃষি থেকে উচ্ছিন্ন মানুষ বেকার মানুষের সংখ্যাই বৃদ্ধি করছে। জাতীয় নমুনা সমীক্ষা, লেবার ব্যুরো ও লেবার ব্যুরোর দ্রূত হিসাব, এই তিন ধরনের তথ্য ব্যবহার করে ভিনোজ আব্রাহাম এই সামগ্রিক নিযুক্তি-হ্রাসের চিত্রটি তুলে ধরেছেন। ভারতে বেকারত্বের হারের যে-পরিসংখ্যান তিনি উপস্থিত করেছেন তা আমরা নীচের সারণিতে দেখিয়েছি।

দেখা যাচ্ছে, ২০১১–১২ সালের পর বেকারত্বের হার বেড়েছে এবং পুরুষের তুলনায় মহিলাদের মধ্যে বেকারত্বের হার আরও বেশি বাড়ছে।

সারণি ৫.৮ প্রতি হাজারে বেকারত্বের হার (জাতীয় নমুনা সমীক্ষা)

সারণি ৫.৮ প্রতি হাজারে বেকারত্বের হার (জাতীয় নমুনা সমীক্ষা)

Source: Abraham, V. (2017) “Stagnant Employment Growth.” Economic and Political Weekly. 52(38).

সারণি ৫.৯ প্রতি হাজারে ১৫ বছর বয়সের ঊর্ধ্বের মানুষের মধ্যে বেকারত্বের হার

সারণি ৫.৯ প্রতি হাজারে ১৫ বছর বয়সের ঊর্ধ্বের মানুষের মধ্যে বেকারত্বের হার

Source: Abraham, V. (2017) “Stagnant Employment Growth.” Economic and Political Weekly. 52(38).

কৃষিক্ষেত্রে এই বেকারত্বের বৃদ্ধি বিকাশমান অর্থনীতিতে প্রত্যাশিত গঠনগত পরিবর্তনের ফল নয়। কৃষিতে মোট উৎপাদন কমার জন্য উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে কম পরিমাণে শস্য নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে, ফলে কৃষি-উৎপাদনের বিভিন্ন স্তরে মানুষের শ্রমের প্রয়োজনীয়তা হ্রাস পেয়েছে। প্রাপ্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী আলোচিত সময়ের মধ্যে ২০১৩–১৪তে কৃষি থেকে উৎপাদিত মোট মূল্য বছরে শতকরা ৫.৫৭ হারে বেড়েছিল, ২০১৪–১৫ সালে এই হার কমে –০.১৯-এ দাঁড়ায়।

তথ্যসূত্র

১. Roy, Debraj. 1998. Development Economics. 1st Edition. Princeton University Press.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *