৩. স্বাধীনতা-পরবর্তী ভারতের কৃষি: বিংশ শতাব্দীতে পুঁজিবাদী দুনিয়ায় ক্ষমতার বিন্যাসে নতুন শক্তির উৎপত্তি ও ভারতীয় কৃষি

তৃতীয় অধ্যায়

স্বাধীনতা-পরবর্তী ভারতের কৃষি
বিংশ শতাব্দীতে পুঁজিবাদী দুনিয়ায় ক্ষমতার বিন্যাসে নতুন শক্তির উৎপত্তি ও ভারতীয় কৃষি

আমরা আগেই দেখেছি, উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলিতে পুঁজিবাদের সূচনাপর্বে আদিম পুঁজিসঞ্চয়ন প্রক্রিয়ার দু’টি আবশ্যিক শর্ত পূরণ হয়েছিল কৃষিক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পরিবর্তনের মাধ্যমে: এই শর্তগুলি হল, একদিকে বাণিজ্যিক ও মহাজনি বিনিয়োগের মাধ্যমে আর্থিক পুঁজির সঞ্চয়ন, অন্যদিকে কৃষির বাণিজ্যিকীকরণ, গিল্ডের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে ছোট হস্তশিল্পগুলির স্বাধীন উৎপাদন-ক্ষেত্রে পরিণত হওয়া ও সামন্ততান্ত্রিক নিয়মের নিগড় থেকে মুক্ত হয়ে ছোট চাষিদের স্বাধীন ছোট উৎপাদকে পরিণত হওয়া। গোটা ইউরোপে সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যেই এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। এর পরবর্তী স্তরে এইসব ছোট উৎপাদক জমি ও উৎপাদনের উপকরণ থেকে উচ্ছেদ হয়ে শ্রম ও জমিসহ উৎপাদনের উপকরণের মুক্তবাজার গঠন করে। একই সঙ্গে এই আর্থিক পুঁজি, মুক্ত শ্রম ও উপকরণের সংগ্রহে বিনিয়োজিত হয়ে উৎপাদনশীল পুঁজিতে পরিণত হয়। এই আদিম পুঁজিসঞ্চয়ন প্রক্রিয়ার গতিকে মসৃণ রাখার প্রয়োজনে তাই পুঁজিবাদী উৎক্রমণ প্রক্রিয়ায় স্থিত অপেক্ষাকৃত উন্নত দেশগুলির প্রয়োজন ছিল সস্তা শ্রম ও সস্তা কাঁচামালের জোগান অব্যাহত রাখা। সে জন্য বিশ্বের পিছিয়ে পড়া দেশগুলি থেকে এইসব অত্যাবশ্যক উপকরণের সরবরাহ সুনিশ্চিত রাখা তাদের কাছে জরুরি হয়ে উঠেছিল, একই সঙ্গে তাদের উৎপাদনক্ষেত্রে উৎপাদিত সামগ্রীর ক্রমবর্ধমান বাজার খুঁজে বের করা ছিল একটা দায়। কাজেই, অপেক্ষাকৃত অনুন্নত দেশগুলিকে যাতে বাজার হিসেবে গড়ে তোলা যায় সেই দিকে তাকিয়ে এইসব দেশে উপযুক্ত পরিকাঠামো ও যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রয়োজন পড়েছিল তখন। পুঁজিসঞ্চয়ন প্রক্রিয়ার দ্বিতীয় স্তরে ক্রমশ সঞ্চিত উৎপাদনশীল পুঁজির লাভজনক বিনিয়োগের ক্ষেত্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য শুধু যে অনুন্নত দেশের অর্থনৈতিক সংগঠনে ও পরিকাঠামোতে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনার প্রয়োজন হয় তাই নয়, এই সব অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে পড়া দেশের সামাজিক-রাজনৈতিক ও আইনি ব্যবস্থায়ও পরিবর্তন আনার প্রয়োজন পড়ে। এই কারণে আমরা দেখেছি ষোড়শ, সপ্তদশ শতকে ভারতীয় কৃষিপণ্যের বহির্বাণিজ্যে ব্রিটিশ বাণিজ্যিক-মহাজনি পুঁজির আধিপত্যের মধ্য দিয়ে ক্রমে অষ্টাদশ শতকে গোটা ভারতীয় অর্থনীতির ওপর ব্রিটিশ পুঁজিবাদী স্বার্থের বাহক ব্রিটিশ রাষ্ট্রের আধিপত্যের সূচনা হল। ভারতীয় অর্থনীতিকে ব্রিটিশ পুঁজিবাদের স্বার্থে পরিচালিত করার জন্য নানাপ্রকার পরিবর্তন আনা হল। কিন্তু ব্রিটিশ পুঁজিবাদ ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন পুঁজিবাদী দেশ সেই সময় পুঁজির আদিম সঞ্চয়নপ্রক্রিয়ায় সস্তার শ্রম, কাঁচামাল ও বাজার খোঁজার প্রয়োজনে অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে পড়া দেশগুলিকে নিজ নিজ প্রভাবাধীন অর্থনীতিতে পরিবর্তিত করার প্রতিযোগিতায় রত ছিল। এরই পরিণামে বিংশ শতকের শুরুতেই ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূত্রপাত। এই যুদ্ধের পরিণতিতে পুঁজিবাদী দুনিয়ার কিয়দংশকে বিশাল ক্ষয়ক্ষতি বহন করতে হয়, বিভিন্ন পুঁজিবাদী দেশ তাদের পণ্যের পূর্বতন বাজার হারায়, এবং বিভিন্ন দেশের ওপর যে-বিশাল আর্থিক চাপ সৃষ্টি হয়, তা পণ্য ও পুঁজির আন্তর্জাতিক চলাচল ব্যবস্থায় বিশৃংখলা নিয়ে আসে। এসবের পরিণতিতে আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় বিনিয়োগ ও নিয়োগের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়, শেষপর্যন্ত পুঁজিবাদী দুনিয়াকে গভীর আর্থিক সংকটে পড়তে হয়। গোটা পুঁজিবাদী দুনিয়ায় বেকারত্ব, অতি উৎপাদন, চাহিদার অ-প্রতুলতা ও গভীর অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। এই সংকট আবার নতুন নতুন বাজার ও বিনিয়োগ ক্ষেত্র তৈরির আবশ্যিকতা এবং সেইসূত্রে তীব্রতর প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করে, ফলে ১৯৩৯ সালে দেখা দেয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর আন্তর্জাতিক ক্ষমতার বিন্যাসে নতুন শক্তি হিসেবে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের উত্থান এবং সংযুক্ত জাতিসংঘ (ইউ এন ও), বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার, ও ‘শুল্ক ও বাণিজ্য সংক্রান্ত সাধারণসম্মতি সংস্থা’র (গ্যাট-এর) প্রতিষ্ঠা ইউরোপীয় পুঁজিবাদী দুনিয়ার সর্বব্যাপক আধিপত্যের জায়গায় আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যের সূচনা করে। বেশ কয়েকটি ঔপনিবেশিক দেশ কোনও না কোনও পশ্চিম ইউরোপীয় দেশের সরাসরি রাজনৈতিক ও সামাজিক অধীনতা থেকে মুক্তি পায়। জাপান সহ অন্যান্য যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ ছাড়াও ইউরোপের আধিপত্যাধীন তৃতীয় বিশ্বের সদ্য স্বাধীন হওয়া পূর্বতন উপনিবেশগুলির অর্থনীতিকে নতুন ভাবে সংগঠিত করার জন্য এইসব আন্তর্জাতিক সংস্থা ও আমেরিকা, নতুন নতুন নীতি, পদ্ধতি, নির্দেশ ও পরামর্শ দেওয়ার ও প্রয়োগ করার প্রক্রিয়া শুরু করে।

ভারত ১৯৪৭-এ স্বাধীনতা লাভের পর, প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার কালে, কৃষি-অর্থনীতির পুরনো পিছিয়ে পড়া বৈশিষ্ট্যগুলি দূর করে কৃষিকে একটি বিকাশমান উৎপাদন-ক্ষেত্রে পরিণত করার উদ্দেশ্যে আমূল ভূমি সংস্কারের ঘোষিত উদ্দেশ্য সামনে রেখে কর্মসূচি সাজায়। ১৯৬৫ সালের পর আমেরিকার বিশেষজ্ঞের পরামর্শে কৃষি উৎপাদন-ব্যবস্থায় পুরনো প্রকৌশলের জায়গায় আধুনিক উৎপাদন-বর্ধক প্রকৌশল প্রয়োগের কথা ওঠে ও সেই অনুযায়ী কৃষির উৎপাদন-কৌশলে আমূল পরিবর্তন আনার কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। জাপানে পিছিয়ে পড়া উৎপাদন-সম্পর্কের অবশেষগুলি নির্মূল করার উদ্দেশ্যে ১৯৪৬ সালে আমেরিকান অকুপেশন অথরিটির সরাসরি হস্তক্ষেপে যে-ভূমিসংস্কার কর্মসূচি নেওয়া হয়েছিল তাতে পুঁজিবাদী কৃষি-অর্থনীতির বিকাশ ত্বরান্বিত হয়েছিল। জাপানের এই ভূমিসংস্কারের দু’টি আশু উদ্দেশ্য ছিল: ভাগ-চাষ প্রথার অবসান ও পূর্বতন ভাগ-চাষিদের মালিকানা স্বত্ব কিনে নেওয়ার প্রথম সুযোগ দেওয়ার শর্তে মালিকদের নিজ তত্ত্বাবধানে মাঝারি মাপের জোতে চাষের জন্য মালিকানা ও দখলি স্বত্ব প্রদান। দ্বিতীয়ত, খুব বড় ও খুব ছোট জোতের অবসানকল্পে ও মাঝারি জোতে নিজ তত্ত্বাবধানে চাষ পদ্ধতি চালু করার উদ্দেশ্যে জমির মালিকানা ও দখলি স্বত্বের ওপর ঊর্ধ্বসীমা প্রয়োগ। ১৯৪৭-এর পর ভারতের কৃষিতে সর্বোচ্চ স্তরের মধ্যস্বত্বভোগী— যেমন জোতদার-জমিদার-জায়গিরদার, যারা ছিল গ্রামীণ অর্থনীতিতে ব্রিটিশ শাসকদের প্রধান সামাজিক ভিত্তি— তাদের উচ্ছেদ করার চেষ্টা চলে এবং মাঝারি মাপের চাষে নিজ তত্ত্বাবধানে চাষব্যবস্থা চালু করার জন্য জোতের ঊর্ধ্বসীমা নির্ধারণ ও তা প্রয়োগ করা শুরু হয়। কিন্তু জাপান আর ভারতের ভূমিসংস্কার কর্মসূচির গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্যটা এইখানে রয়ে গেল যে, ভারতে ভাগ-চাষি বা স্থির খাজনার চাষ ব্যবস্থার অবসান করা এবং এই উদ্দেশ্যে পূর্বতন ভাগ-চাষি বা স্থির খাজনার চাষিদের সাধারণভাবে মালিকানা বা দখলি স্বত্ব কিনে নেওয়ার সুযোগ দেওয়ার কোনও উদ্দেশ্য এই ভূমিসংস্কার কর্মসূচির সামনে ছিল না। উপরন্তু এই কর্মসূচির বাস্তব প্রয়োগে ছিল দৃঢ় প্রত্যয়ের অভাব এবং কৃষিতে পুঁজিবাদী উৎপাদন-সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার কোনও প্রেরণা এই ভূমিসংস্কার কর্মসূচি বা এর প্রয়োগকে প্রভাবিত করেনি। উচ্চতম স্তরের মধ্যস্বত্বভোগীদের ক্ষমতার অবসান ঘটানো ব্যতীত গোটা মধ্যস্বত্বভোগীর উপর নির্ভরশীল ছিল যে-ব্যবস্থা, তাতে কোনওরকম পরিবর্তন আনা এই কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত ছিল না। দেখা গেল, এই সংস্কার কর্মসূচি ও নতুন প্রকৌশলগত পরিবর্তনের কর্মসূচিগুলি কিন্তু বাস্তবে জাপানে যেমনটা ঘটেছিল তেমনভাবে ভূমিব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনতে পারেনি। ভারতীয় কৃষিব্যবস্থা তার সনাতন, গভীর ও সর্বব্যাপক জাড্য কাটিয়ে নতুন প্রগতিশীল ব্যবস্থায় প্রবেশ করতে পারে না। পরবর্তীতে, ২০০৫ সালে বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে কৃষিপণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারে ভারতের প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানকে জোরালো করার জন্য নতুন চাষ ব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এতে জোর দেওয়া হয়েছিল সনাতন জলাপেক্ষী দানাশস্যের জায়গায় ব্যাপকভাবে অধিক মূল্যযুক্ত হালকা পণ্যের চাষের ওপর। কিন্তু ভারতীয় কৃষি এইসব পরিবর্তন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তার সনাতন পিছিয়ে পড়া অবস্থান থেকে কতটা বেরিয়ে আসতে পেরেছে সেটা একটা প্রশ্ন। পরবর্তী অধ্যায়গুলিতে আমরা এই প্রশ্নটি সামনে রেখে এগোব। প্রথমত আমরা বোঝার চেষ্টা করব যে, ভারতের কৃষিকে তার সনাতন পিছিয়ে পড়া উৎপাদন-সম্পর্ক ও পুরাতন প্রকৌশলগত বৈশিষ্ট্য থেকে মুক্ত করে গতিশীল পুঁজি বিনিয়োগ ও সঞ্চয়নভিত্তিক উৎপাদন-ব্যবস্থায় পরিণত করার এবং পুঁজিবাদী উৎপাদন-সম্পর্কের আওতায় নিয়ে আসার উদ্দেশ্য এই প্রকল্পগুলির সামনে আদৌ ছিল কি না, থাকলে কতটা। দ্বিতীয়ত, এই প্রকল্পগুলির রূপায়ণ পদ্ধতি কী পরিমাণে এই উদ্দেশ্যসাধনে সফল হওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে।

এই অধ্যায়ে আমরা ভারতীয় কৃষিতে ভূমিসংস্কার কর্মসূচির আলোচনা করব। পরবর্তী অধ্যায়গুলিতে থাকবে সবুজ বিপ্লব, শস্যবৈচিত্র ইত্যাদি বিষয়গুলি সমেত ভারতীয় কৃষির নানা দিক নিয়ে আলোচনা।

ভারতীয় কৃষিতে ভূমিসংস্কার কর্মসূচির ব্যর্থতা: উৎপাদন সম্পর্কে পিছিয়ে পড়া বৈশিষ্ট্যের ব্যাপক উপস্থিতি

আমরা দেখেছি, ক্ষমতা হাতে নেওয়ার পর ব্রিটিশ সরকার জমি থেকে আসা আয় আরও সুনির্দিষ্ট ও নিয়মিত করার উদ্দেশ্যে ভারতের কয়েকটি প্রদেশে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করে। ফলে পুরনো জমিদাররা নির্দিষ্ট বাৎসরিক খাজনা দেওয়ার শর্তে ভূস্বামীতে পরিণত হয়। উৎপাদনের পরিমাণ যাই হোক না কেন, জমির পরিমাণ অনুযায়ী জমিদারকে টাকার অঙ্কে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ খাজনা দিতে হত। এই ব্যবস্থায় জমিদার তার নিজের আয় ঠিক রাখার জন্য চাষির ওপর যথেচ্ছ খাজনার ভার চাপাত। অতিরিক্ত খাজনার ভারে পিষ্ট চাষির উৎপাদন-ক্ষমতার ওপর পড়ত ক্ষতিকারক প্রভাব, সে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ত। আবার বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বা যথেষ্ট ফসল না হলে জমিদার খাজনা দিতে অপারগ হলে তার জমি নিলামে উঠানো হত ও শেষপর্যন্ত জমিদারের হাত থেকে সেই জমি চলে যেত অন্য কোনও নতুন সৃষ্ট জমিদারের হাতে। কিন্তু এই ব্যবস্থা দীর্ঘকালীন বিচারে ব্রিটিশ সরকারের স্বার্থের অনুকূল ছিল না। টাকার দাম কমে গেলে খাজনা থেকে আয়ের প্রকৃত মূল্য কমে যেত। জমিদারের মোট আদায়ে সরকারের খাজনার অংশ কমে গিয়ে জমিদারের আয়ের অংশ বাড়ত। এই কারণে পরবর্তীতে নতুন জমিদারি স্থাপন করার সময় এই ব্যবস্থাকে অস্থায়ী করা হয়, ভূমি-খাজনার পরিমাণ নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে নতুন করে হিসাব করার নিয়ম চালু করা হয়। কোনও মধ্যস্বত্বভোগী ছাড়াই চাষির সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক রক্ষার জন্য আর একটি নতুন ব্যবস্থা আসে: রায়তওয়ারি ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থায় রায়তের কাছ থেকে সরাসরি একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ খাজনা আদায় করা হয়, নির্দিষ্ট সময়ের পর সেই খাজনা পরিবর্তন করার জন্য নতুন করে হিসেব করা হত। খাজনার গোটা অংশই সরকার পায়, কোনও অংশই কোনও মধ্যস্বত্বভোগী পায় না। এই নতুন ব্যবস্থা প্রথমে তৎকালীন মাদ্রাজে ও পরে ভারতের প্রায় অর্ধেক স্থানে চালু করা হয়। ব্রিটিশরাজের অবসানের মুহূর্তে ভারতে তিন ধরনের ভূমিব্যবস্থা চালু ছিল। ক) চিরস্থায়ী জমিদারি ব্যবস্থা, খ) অস্থায়ী জমিদারি ব্যবস্থা, গ) রায়তওয়ারি ব্যবস্থা।

আমাদের দেশে সামন্ততান্ত্রিক প্রভুরা স্থানীয় অর্থনীতিতে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় থাকলেও তারা অর্থনীতিতে নীতিনির্ধারকের ভূমিকায় ছিল না। তারা এদেশে বিদেশি শাসকদের অর্থনৈতিক স্বার্থরক্ষার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হত। বিদেশি শাসনের অবসান হওয়ার আগে থেকেই ধীরে ধীরে অর্থনীতিতে এদের প্রভাব ক্ষীয়মাণ ছিল। নতুন একটি জোতদার শ্রেণির উদ্ভব ঘটছিল, যে-শ্রেণিটির হাতে ধীরে ধীরে জমা হচ্ছিল বাণিজ্যিক ও মহাজনিপুঁজি। এদের মধ্যে মুষ্টিমেয় কিছু বণিক-মহাজন ছোট ছোট বিভিন্ন শিল্পোদ্যোগে বিনিয়োগ করে বাণিজ্যিক পুঁজিকে উৎপাদনশীল পুঁজিতে পরিবর্তন করার সুযোগ ব্যবহার করছিল, দু’-একজন সফল ব্যবসায়ী সুতি বস্ত্রশিল্পে বিনিয়োগের মাধ্যমে নিজেদের কিছুটা গুরুত্বের জায়গায় নিয়ে যাচ্ছিল। অন্যদিকে টাটা-পরিবার বস্ত্রব্যবসায়ে সফল হওয়ার পর বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে, অর্থাৎ ব্রিটিশ শাসন অবসান হওয়ার অল্প সময় আগে, লৌহ ও ইস্পাত শিল্পে পুঁজি-বিনিয়োগের মাধ্যমে অর্থনীতিতে কিছুটা গুরুত্বের জায়গায় যাচ্ছিল। কিন্তু তদানীন্তন এই ছোট শিল্পপতির শিল্পগুলির অস্তিত্ব পুরোপুরি বিদেশ থেকে আমদানিকৃত যন্ত্রপাতি ও উৎপাদন-কাঠামোর সুলভতার ওপর নির্ভর করে টিকে থাকত। লৌহ ও ইস্পাতের দেশীয় বাজার পাওয়াও ব্রিটিশ শাসকদের বদান্যতার ওপর নির্ভর করত। বস্ত্রশিল্পের দেশীয় বাজার অবশ্য ভারতীয় হস্তশিল্পে উৎপাদিত পণ্যের বাজার হিসেবে বহুদিন থেকেই চালু ছিল। সব শিল্পপণ্যের বৈদেশিক বাণিজ্যই পুরোপুরি বিদেশি কোম্পানির নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল। কয়েকজন দেশি ব্যবসায়ী বিদেশি বাণিজ্যিক কোম্পানির এজেন্ট হিসেবে কাজ করে সমৃদ্ধি লাভ করেছিলেন। এইভাবে দেখা যায় ভারতের বাণিজ্যিক পুঁজিপতিদের একটি বড় অংশ, যাদের মধ্যে নতুন শিল্প-বিনিয়োগকারীরাও ছিলেন, তখনও অবধি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে একটা স্বতন্ত্র শ্রেণি হিসেবে নিজেদের সামিল করার অবস্থায় ছিলেন না। এদের সামন্ততন্ত্র-বিরোধী অবস্থানও তত দৃঢ় ছিল না। চলতি অর্থনৈতিক কাঠামোর চৌহদ্দির মধ্যে তারা নিজেদের অস্ত্বিত্ব টিকিয়ে রেখে ধীরে ধীরে নিজেদের ক্ষমতা ও গুরুত্ব বাড়ানোর চেষ্টা করছিল। এইসব বাণিজ্যিক পুঁজিপতি তথা উঠতি বুর্জোয়া-শ্রেণি ছিল ক্ষমতায় দুর্বল, ও নির্ভরশীল। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে কোথাও কোথাও তাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অবদান থাকলেও একই সঙ্গে অর্থনৈতিক-সামাজিক বিপ্লব সংগঠিত করে, পুরনো সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যগুলিকে সমূলে উৎপাটিত করে, নতুন পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিকাশ ঘটানোর লক্ষ্য নিজেদের ঐক্যবদ্ধ দৃঢ় উদ্যোগ, প্রয়াস বা ক্ষমতা কোনওটাই ছিল না।

১৯৪৭ সালের ক্ষমতা হস্তান্তরের ঘটনায় দেশীয় যে-নেতাদের অগ্রণী ভূমিকার কথা সর্বজনবিদিত, তাঁদের কোনও একটি বিশেষ সামাজিক শ্রেণির মুখপাত্র হিসেবে দেখা যায় কি না তা নিয়ে ভারতীয় বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে বিস্তর আলাপ-আলোচনা ও বিতর্ক হয়েছে। সপ্তদশ শতকের ব্রিটেনের ‘গৌরবময় বিপ্লব’, অষ্টাদশ শতকের ফরাসি বিপ্লব, জার্মানিতে ১৮৪০ সালের বিপ্লব ইত্যাদি ঘটনার মধ্য দিয়ে যে-পরিবর্তন এসেছিল তার অভিমুখ ছিল স্পষ্টতই প্রাক্‌পুঁজিবাদী ব্যবস্থা থেকে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় উত্তরণের দিকে। এই পরিবর্তন এসেছিল মানুষের সামাজিক অবস্থানের ধরনে ও সাংস্কৃতিক চিন্তার বৈশিষ্ট্যে। সামন্ততান্ত্রিক যুগের রাজতন্ত্র-জমিদারতন্ত্রের উচ্চতর কর্তৃত্বের কাছে সর্বাত্মক বশ্যতার জায়গায় এসেছিল ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী সংস্কৃতি ও ব্যক্তিস্বাধীনতার ধারণা, সেটা অর্থনীতি-সমাজনীতির বৈশিষ্ট্যে আমূল পরিবর্তন আনে। ইউরোপের দেশগুলিতে এই পরিবর্তনের নায়করা শ্রেণি-অবস্থানের দিক থেকে ছিল পুঁজিপতি শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত, অথবা তারা পুঁজিপতিদের মুখপাত্র হিসেবে কাজ করেছিল। এদের কার্যকলাপ ও নীতিতে এদের শ্রেণি-অবস্থান অত্যন্ত স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। অর্থনীতির ভিতরে ঘটে চলা পরিবর্তন সম্পর্কে এদের দৃষ্টিভঙ্গী যা ছিল, ভূমিসংস্কারের যেসব কার্যক্রম বা কৃষি-সম্পর্কিত এরা নীতি গ্রহণ করছিল, তার সবগুলিই ছিল সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার উচ্ছেদ ও পুঁজিবাদী উৎপাদন-সম্পর্ক বিকাশের অনুকূল।

ভারতের স্বাধীনতা লাভের পর স্বদেশি আন্দোলনের নেতারা রাজনৈতিক দল হিসেবে মূলত কংগ্রেস, সেইসঙ্গে অংশত ছোট ছোট অন্যান্য দলের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তাদের মাধ্যমেই দেশের শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। এই শাসকবর্গের শ্রেণিচরিত্র স্পষ্ট জানা না গেলেও সাধারণভাবে বলা যেতে পারে যে, প্রধান প্রভাবশালী নেতাদের অধিকাংশ ছিলেন পুরনো জমিদার বা বণিক পরিবারের উত্তরসুরি, নব্যশক্ষিত উদারপন্থী চিন্তার ধারক, উচ্চ মধ্যবিত্ত বা ধনী অভিজাত শ্রেণিভুক্ত। ভূমিসংস্কার, শিল্পনীতি বা বৈদেশিক বাণিজ্য, অথবা বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবহার সংক্রান্ত নতুন নীতিগুলো রূপায়ণের ক্ষেত্রে অনেক সময়েই তাঁদের দোদুল্যমান অবস্থান ধরা পড়ে। বিভিন্ন সুবিধাভোগী শ্রেণি সম্বন্ধে তাদের দৃষ্টিভঙ্গী, সমাজে ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় যে-শ্রেণিগুলির প্রভাব প্রকটভাবে বজায় ছিল, যে-শ্রেণিগুলির স্বার্থ বজায় রাখার জন্য রাষ্ট্রের নায়কদের উদ্বেগ প্রকাশ পেত তার ধরন থেকেই এই আঁচ পাওয়া যায় শাসকবর্গের শ্রেণিচরিত্র কী ছিল। কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি প্রণীত যে-ভূমিসংস্কার কর্মসূচি বিভিন্ন সংশোধন ও পরিবর্তনের পর ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে রূপায়িত হয়েছিল, তার মূলগত চরিত্র বিশ্লেষণ করলেও শাসকবর্গের শ্রেণি-অবস্থান স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই প্রসঙ্গে একই ইঙ্গিত জোগায় পুরনো আমলের সুবিধাভোগী শ্রেণি সম্বন্ধে শাসকশ্রেণির দৃষ্টিভঙ্গীও। সাধারণভাবে ভারতীয় ভূমিসংস্কার কর্মসূচি এতাবৎ সুবিধাভোগী শ্রেণিগুলির, অর্থাৎ ভারতে ব্রিটিশ শাসনের স্থায়িত্ব রক্ষায় বিশেষ যত্নশীল শ্রেণিটির কায়েমি স্বার্থকে সম্পূর্ণ উচ্ছেদ করার লক্ষ্যে রচিত বা রূপায়িত হয়নি। একটি উদীয়মান পুঁজিবাদী ধরনের অর্থনীতির পক্ষে তার শিল্পোন্নয়নের স্বার্থে বা পুঁজিবাদী বিকাশের স্বার্থে কৃষিকে যে-রকম সহায়ক ভূমিকায় রাখা উচিত ছিল সেদিকে তাকানো হয়নি, এবং কৃষিকে সেই ভূমিকা পালনে সমর্থ করে তোলার লক্ষ্য সামনে রেখে যেভাবে ভূমিসংস্কার কর্মসূচি প্রণয়ন উচিত ছিল তা করা হয়নি। পুরনো ভূমিব্যবস্থার মূলগত চরিত্রকে পরিবর্তন করারও তেমন কোনও উদ্দেশ্য এই কর্মসূচির মধ্যে ধরা পড়ে না। কী ধরা পড়ে? ধরা পড়ে সুবিধাভোগীদের শ্রেণিস্বার্থের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা, দেখা যায় পুরনো ভূমি-ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যগুলো টিকিয়ে রাখার চেষ্টা। আমরা এই অধ্যায়ে ভূমিসংস্কার কর্মসূচি বিশ্লেষণ করে বোঝার চেষ্টা করব, ওই কর্মসূচির বা কৃষি-নীতির প্রণয়ন ও রূপায়ণের পদ্ধতি কী পরিমাণে ভারতীয় অর্থনীতিতে ঐতিহাসিকভাবে থেকে যাওয়া কাঠামোগত দুর্বলতাগুলিকে দূর করার লক্ষ্যে পরিচালিত হয়েছিল এবং এই কর্মসূচির বাস্তব প্রয়োগ সেই লক্ষ্যসাধনে কতটা অনুকূল ভূমিকা নিয়েছিল।

ভূমিসংস্কার বিষয়ে আলোচনা করার আগে ব্রিটিশ শাসকদের প্রবর্তিত জমিদারি ও রায়তওয়ারি ব্যবস্থায় ভূমিব্যবস্থার স্বরূপ কী ছিল সেটি জানা জরুরি। জমিদারি ব্যবস্থায় প্রকৃত উৎপাদক চাষির পক্ষে চাষের উন্নতির জন্য কোনও উদ্যোগ নেওয়ার অনুকূল অবস্থা ছিল না, তারা ছিল বিশাল খাজনার ভারে পিষ্ট। চাষে তার কোনও উৎসাহ ছিল না, তার কারণ শুধু এই নয় যে, তাকে জমিদারকে ফসলের ভাগ দিতে হত। কালক্রমে উদ্ভূত ভূমিব্যবস্থা প্রকৃত উৎপাদকের স্বার্থের প্রতিকূল তো ছিলই, তা ছিল সামগ্রিকভাবে কৃষি উৎপাদন-ব্যবস্থার পক্ষে ক্ষতিকর। এর কারণ, বহু সংখ্যক মধ্যস্বত্বভোগীর দাবি মেটানোর পর প্রকৃত উৎপাদকের হাতে উৎপাদনের যে-সামান্য অংশ থাকত তাতে কোনও প্রকৃত উৎপাদকের বেঁচে থাকা ছিল অসম্ভব। রায়তরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিজে জমি চাষ করত না, নানা স্তরের মধ্যস্বত্বভোগীর মধ্য দিয়ে সেই জমি প্রকৃত উৎপাদকের কাছে পৌঁছাত। অনেক সময়ে রায়ত ঠিক সময়ে খাজনা দিতে না পারলে জমি বন্ধকি দিয়ে মহাজনের কাছে চড়া সুদে ঋণ নিতে বাধ্য থাকত, মহাজন এই জমি অন্য কোনও চাষিকে দিয়ে চাষ করাবার ব্যবস্থা করত। আবার এই ব্যক্তিও অবস্থাবিশেষে জমিটি অন্য কাউকে দিয়ে চাষ করাতে পারত। এইভাবে অনেকগুলি স্তর পার হয়ে জমি যেত প্রকৃত উৎপাদকের হাতে। এমনকী কোথাও কোথাও প্রকৃত উৎপাদক ও জমিদারের মধ্যে ৫০ জনের বেশি মধ্যস্বত্বভোগী তৈরি হয়ে যেত। এইভাবে জমিদারি ব্যবস্থা হয়ে পড়েছিল অত্যন্ত অনুৎপাদনশীল ও প্রকৃত উৎপাদক চাষির পক্ষে চরম ক্ষতিকারক। রায়তওয়ারি ব্যবস্থা যদিও রাষ্ট্রের সঙ্গে সরাসরি প্রকৃত উৎপাদক রায়তের সংযোগ রক্ষার জন্য প্রবর্তিত হয়েছিল, কিন্তু কালক্রমে চড়া সুদে মহাজনি ঋণ ও বন্ধকি ব্যবস্থার প্রচলন এ ক্ষেত্রেও প্রকৃত উৎপাদক ও চাষির মধ্যে বহু মধ্যস্বত্বভোগীর জন্ম দিয়েছিল। এই ব্যবস্থাও, জমিদারি ব্যবস্থার মতোই, চাষের ও চাষির পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকারক রূপ নেয়। কিন্তু তৎসত্ত্বেও জমিদারি ব্যবস্থার সঙ্গে এই ব্যবস্থার একটা মূলগত পার্থক্য ছিল এবং সেটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জমিদারি ব্যবস্থায় চাষিদের ওপর একজন জমিদার থাকত, চাষিদের কাছ থেকে খুশিমতো খাজনা আদায়ের অধিকার ছিল তার। শুধু তাই নয় তাদের সামাজিক জীবন নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতাও তার ছিল। আর সব থেকে বড় দায়িত্ব ছিল ব্রিটিশ শাসকদের স্বার্থরক্ষা। রায়তওয়ারি ব্যবস্থায় তেমন কোনও বড় মধ্যস্বত্বভোগীর অস্তিত্ব ছিল না।

গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে ভূমিসংস্কারের কর্মসূচি রূপায়িত হতে থাকে। ভূমিসংস্কারের কর্মসূচি গ্রহণ করার আগে কংগ্রেস কৃষি-সংস্কার কমিটি ভূমিসংস্কারের যে-উদ্দেশ্যগুলি নিয়ে আলোচনা করেছিল সেগুলির মধ্যে ছিল: ক) কৃষি-অর্থনীতি কৃষকদের ব্যক্তিত্ব বিকাশের অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি করবে। খ) উৎপাদন সবচেয়ে বেশি দক্ষ হয়ে উঠবে। গ) একশ্রেণি কর্তৃক অন্য শ্রেণিকে শোষণ করার কোনও পরিস্থিতি যেন না থাকে। ঘ) ভূমিসংস্কার কর্মসূচিটিকে অবশ্যই বাস্তবানুগ হতে হবে। এই উদ্দেশ্যগুলি সামনে রেখে ভূমিসংস্কারের মধ্য দিয়ে কোন ধরনের কৃষি-অর্থনীতি গড়ে তোলা হবে সে সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য কয়েকটি বিকল্প ব্যবস্থার তুলনামূলক প্রযোজ্যতা আলোচনায় ওঠে। এই বিকল্প ব্যবস্থাগুলি হল: ক) পুঁজিবাদী খামার। খ) রাষ্ট্রপরিচালিত খামার গ) যৌথ উৎপাদনভিত্তিক খামার ঘ) ব্যক্তিগত মালিকানায় চাষ ব্যবস্থা। ঙ) সমবায় ব্যবস্থায় চাষ। এই কমিটি পুঁজিবাদী খামার সম্বন্ধে স্পষ্টত এক বিরোধী মত প্রকাশ করেছিল। বলা হয়েছিল, পুঁজিবাদী খামারব্যবস্থা গ্রহণযোগ্য নয়, কারণ এই ব্যবস্থা চাষিদের জমির অধিকার খর্ব করে ও তাদের শুধুমাত্র মজুরি শ্রমিকে পরিণত করে। এছাড়া এ ব্যবস্থায় খাদ্যের মতো অত্যাবশ্যক একটা পণ্যের জোগানের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয় পুঁজিবাদী নিয়ন্ত্রণ, জমি থেকে চাষির উচ্ছেদ ঘটিয়ে নতুন সমস্যার সৃষ্টি করে। সুতরাং এই পুঁজিবাদী খামার-ব্যবস্থায় উত্তরণের নীতিটি একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। দ্বিতীয় বিবেচ্য বিকল্পটি ছিল, রাষ্ট্র-পরিচালিত খামার-ব্যবস্থা। এ বিষয়ে কমিটির মত ছিল: প্রাথমিক স্তরে পতিত জমি উদ্ধার ও সেই জমি ভূমিহীনদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে। এই সব নতুন ভূমিমালিক-চাষিরা যাতে ঠিকমতো চাষবাস করতে পারে সে জন্য প্রাথমিক ভাবে সবরকম সহায়তা জোগাতে হবে সরকারকে। এই নতুন মালিকরা চাষের ব্যাপারে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা অর্জন করলে এক-একটি অঞ্চলের কৃষি-খামার নিয়ে যৌথ চাষব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। এই যৌথ চাষব্যবস্থার কথা বলা হলেও তার যথার্থ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ বা সেই ব্যবস্থায় পৌঁছানোর জন্য বাস্তবসম্মত কোনও পরিকল্পনা নিয়ে কোনও আলোচনা করা হয়নি।

ব্যক্তিগত মালিকানায় চাষ করার প্রশ্নে কমিটির মত ছিল, যথোপযুক্ত মাপের জমিতে ব্যক্তিগত মালিকানায় চাষই প্রকৃতপক্ষে ভূমিসংস্কারের উদ্দেশ্য সফল করতে পারবে, এবং এই ব্যবস্থাতেই চাষিদের মধ্যে চাষ বিষয়ে ও উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রকৃত উৎসাহ সঞ্চার করা সম্ভব হবে। এই ব্যবস্থা জমি ও কৃষি আয়ের বণ্টনে অসমতার অবসান ঘটাবে, ফলে একশ্রেণি কর্তৃক অন্য শ্রেণিকে শোষণ করার সমস্ত বাস্তব ভিত্তির অবসান ঘটবে। উপরন্তু এই ব্যবস্থায় চাষি যদি জমিতে ও চাষে কোনও উন্নত পদ্ধতি প্রয়োগের উদ্যোগ নেয়, তবে তার সমস্ত সুফল চাষির কাছেই যাবে, অন্য কোনও মধ্যস্বত্বভোগীর কাছে নয়। এই নিশ্চয়তা সৃষ্টি করতে পারলে এই ব্যবস্থা চাষিকে উন্নত ধরনের চাষে উৎসাহ দেবে।

কংগ্রেস কৃষি-সংস্কার কমিটির বক্তব্য থেকে এটা পরিষ্কার যে, এই কমিটি দেশের জন্য ব্যক্তিগত মালিকানায় চাষ, যেখানে প্রকৃত উৎপাদকই জমির মালিক, তাকে সবথেকে উপযুক্ত বলে মনে করেছিল ও পুঁজিবাদী ধরনের খামার-ব্যবস্থায় চাষের সম্পূর্ণ বিরোধী ছিল। কিন্তু এর সঙ্গে সঙ্গে কমিটি এই মতও ব্যক্ত করেছিল যে, কোনও একটি বিশেষ ভূমিব্যবস্থা সারা দেশে অবস্থা অনুযায়ী সমস্ত প্রয়োজন মেটাতে পারে না, কাজেই কৃষি-ব্যবস্থাকে প্রয়োজন অনুযায়ী যথেষ্ট নমনীয় হতে হবে। কমিটির মতামত দেওয়ার ধরন থেকে এটা খুবই স্পষ্ট যে কোনও একটি বিশেষ ধরনের ভূমি-ব্যবস্থা সারা দেশে চালু করার মতো দৃঢ় সিদ্ধান্ত নেওয়ার পক্ষে তাঁরা ছিলেন না।

কৃষি সংস্কার কমিটির এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ধরন থেকে এটা খুবই স্পষ্ট যে, তারা কৃষি সংস্কারের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সঠিক অবস্থানে ছিলেন না। এর কারণ, জমিতে ব্যক্তিগত মালিকানায় চাষের পদ্ধতিকে উৎসাহিত করলে, যদি মুক্ত প্রতিযোগিতার অবস্থা বজায় থাকে, তাহলে অচিরেই অপেক্ষাকৃত বড় জোতগুলি বৃহদায়তন উৎপাদনের সুবিধা নিয়ে বাজার থেকে ছোট জোত-নির্ভর চাষিদের হটিয়ে দিয়ে বড় জোতের প্রাধান্য কায়েম করবে। ফলে ঋণ, উপকরণ ও পণ্য ইত্যাদির বাজারগুলির মুক্ত চলাচলের পথে কোনও বাধা যদি না থাকে তাহলে এই অবস্থা ধীরে ধীরে উৎপাদন ব্যবস্থায় পুঁজিবাদী বৈশিষ্ট্য যোগ করবে। ব্যক্তি-মালিকানায় চাষের ওপর কোনও বাধা নিষেধ বা জমির মালিকানার কোনও ঊর্ধ্বসীমা দৃঢ়ভাবে না চাপানো থাকলে অচিরেই এই ব্যবস্থা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার জন্ম দেবে। পুঁজিবাদী উৎপাদন-সম্পর্কের সূচনাকে ঠেকিয়ে রাখার আর-একটি বিকল্প ও যুক্তিসঙ্গত পন্থা হল কৃষিতে সমবায় ও যৌথ মালিকানায় চাষ ব্যবস্থা গড়ে তোলার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা সামনে রেখে প্রাথমিকভাবে ছোট আকারে ব্যক্তিগত মালিকানায় চাষকে উৎসাহ দেওয়া। যদিও কৃষিতে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা চালুর বিপক্ষে তারা এই দৃঢ় মত ব্যক্ত করেছিল যে, এই ব্যবস্থা অনৈক্য ও শোষণকে উৎসাহিত করে সুতরাং আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়, তবু তাদের সামনে সমাজতান্ত্রিক সমবায় বা যৌথ মালিকানায় চাষ প্রবর্তনের দীর্ঘকালীন পরিকল্পনাও ছিল না। এই পরিকল্পনা না থাকলে ব্যক্তিগত মালিকানায় চাষ খোলামেলা প্রতিযোগিতার মুখে পড়ে এবং শেষ পর্যন্ত পুঁজিবাদী ধরনের ব্যবস্থারই সূচনা ঘটায়। অবশ্য পুঁজিবাদী উৎক্রমণের এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া চালু হতে পারে কেবল পুঁজিবাদ বিকাশের অন্যান্য শর্তগুলি কার্যকর থাকলে। এই শর্তগুলির মধ্যে প্রধানতমটি হল, কৃষি পণ্য, কৃষি উপকরণ ও কৃষি শ্রমিকের মুক্ত বাজার গড়ে ওঠা। এই শর্তপূরণের অবস্থা বজায় না থাকলে মহাজনি ও বাণিজ্যিক পুঁজির মিলিত কার্যকারিতা প্রকাশ পায় না। কৃষি-উদ্বৃত্ত উৎপাদনের রাস্তায় না গিয়ে সেই পুঁজি তখন আবদ্ধ থাকে অনুৎপাদক ব্যবসায়ী-মহাজনি কারবারের মধ্যে, এবং কৃষিকে ক্রমগত ক্ষয়ের দিকে নিয়ে যায়। ঋণের ওপর, অথবা জমির মালিকানার ওপর, ঊর্ধ্বসীমা বসানো থাকলে এই ব্যবস্থা শেষপর্যন্ত উৎপাদনের সামগ্রিক বৃদ্ধির পথ রুদ্ধ করে তাকে বন্ধ্যাত্বের দিকে নিয়ে যাবে। এই দুই বিকল্প সম্ভাব্য পরিণতির কথা সংস্কার কমিটির চিন্তায় ছিল না। চিন বা রাশিয়ার মতো সমাজতান্ত্রিক দেশে বিপ্লবের অব্যবহিত পরে যদিও প্রথমে জমি অধিগ্রহণ ও পুনরায় ছোট জোতে ব্যক্তিগত মালিকানায় বিভাজনের মধ্য দিয়ে ছোট জোতে চাষ শুরু করার নীতি নেওয়া হয়েছিল, তবু ক্রমশ এই ছোট চাষ-নির্ভর কৃষি থেকে ধীরে ধীরে ব্যক্তিগত মালিকানার অবসান ঘটিয়ে বড় যৌথ মালিকানা-নির্ভর চাষ-ব্যবস্থায় উত্তরণের দীর্ঘকালীন কর্মসূচি নেওয়া হয়। অপরপক্ষে জাপানে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে প্রথমে যদিও মাঝারি মাপের জোতে ব্যক্তিগত উদ্যোগে চাষ শুরু হয়, তবু পরে পুঁজিবাদী খোলামেলা প্রতিযোগিতা ও সব ধরনের বাজারের স্বাধীন ক্রিয়ার পথ উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়, ফলে পুঁজিবাদী বৃহৎ জোতনির্ভর চাষের বিকাশের পথে সমস্ত বাধাগুলি হঠে যায়। ভারতীয় ভূমিসংস্কার কর্মসূচিতে জাপান বা চিন-রাশিয়ার ভূমিসংস্কারের মতো দীর্ঘকালীন পরিকল্পনার ছাপ ছিল না। ভূমিসংস্কারের গৃহীত আশু কর্মসূচিগুলি দীর্ঘ সময় বাদে কোন পরিণতির দিকে এগোবে সে সম্বন্ধেও কোনও ধারণা বা প্রস্তুতি ছিল না। খুব হালকাভাবে ভবিষ্যতে সমবায় ব্যবস্থায় চাষ, পণ্য ও উপকরণের সংগঠিত প্রয়াসের পরিকল্পনা ব্যক্ত করা হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু কোনওদিনই গুরুত্ব দিয়ে সমবায় নিয়ে চিন্তাভাবনা করা হয়নি।

প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা রূপায়ণের মধ্যেই ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে ভূমিসংস্কার আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ করা হয়। এই আইনগুলির ঘোষিত উদ্দেশ্য ছিল: ১) মধ্যস্বত্ব ব্যবস্থার বিলোপ। ২) ভাগ-চাষ প্রথার সংস্কার ৩) জোতের আয়তনের ওপর ঊর্ধ্বসীমা স্থির করা। ৪) কৃষি শ্রমিকদের অবস্থার উন্নতিসাধন ৫) সমবায় চাষ-প্রথা ও গ্রামের সমবায়ভিত্তিক পরিচালনাকে শেষ পরিণতি হিসেবে সামনে রাখা। চিরস্থায়ী জমিদারি বন্দোবস্ত ও সাময়িক জমিদারি ব্যবস্থা চালু ছিল এমন এলাকাগুলিতে প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা শুরু হওয়ার আগেই মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবস্থার বিলোপ সংক্রান্ত আইনটির দ্রুত প্রণয়ন ও প্রয়োগ ঘটে। উত্তরপ্রদেশে ১৯৫০ সালের মধ্যেই জমিদারি ব্যবস্থার বিলোপ ঘটিয়ে ভূমিসংস্কার আইন প্রণীত হয়, কিন্তু ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত এই আইনটিকে বার বার সংস্কার করা হতে থাকে। পশ্চিমবঙ্গে জমিদারি এস্টেট অধিগ্রহণ আইনটি ১৯৫৫ সালে প্রণীত হয়। বিহারে ১৯৫০ সালে প্রণীত হয় বিহার ভূমিসংস্কার আইন এবং ওডিশাতে জমিদারি এস্টেট ব্যবস্থা বিলোপের আইন প্রণীত হয় ১৯৫১ সালে। রাজস্থানে ভূমিসংস্কার ও জায়গির পুনর্দখল আইন প্রণীত হয় ১৯৫২ সালে, অন্ধ্রপ্রদেশে জায়গির এস্টেট বিলোপ আইনটি ১৯৪৯ সালেই প্রণীত হয়।

মধ্যস্বত্বভোগীদের মালিকানায় ও নিয়ন্ত্রণে থাকা বিভিন্ন ধরনের জমিগুলি হল: ১) গ্রামের সাধারণ ব্যবহারের জমি, ২) মধ্যস্বত্বভোগীর নিজস্ব অধিকারে থাকা গৃহ-সংলগ্ন পারিবারিক জমি। যে-জমি হয় এরা নিজেরাই লোক নিয়োগ করে চাষ করাত অথবা ভাড়াটে কিংবা ভাগ-চাষিকে দিয়ে চাষ করাত। ৩) গৃহ-সংলগ্ন পারিবারিক জমি ছাড়াও তাদের ব্যক্তিগত নিজস্ব চাষের জমি। ৪) মধ্যস্বত্বভোগীর কাছ থেকে সরাসরি যে-সব জমি খাজনাদাতা প্রকৃত চাষির হাতে গেছে। ৫) যেসব জমি সরাসরি খাজনাদাতার কাছ থেকে প্রকৃত উৎপাদক চাষির হাতে হস্তান্তরিত হয়েছে।

আমরা জানি, মধ্যস্বত্বলোপী আইন জমিদার-জায়গিরদারের খাজনা আদায়ের জমিদারি বা জায়গিরদারি অধিকারের বিলোপ ঘটিয়েছিল। কিন্তু এই আইন জমিদারি এলাকার পতিত জমি, জঙ্গল, আবাদি জমিসংক্রান্ত বিষয়ে প্রযোজ্য ছিল না। এই ধরনের জমির ক্ষেত্রে যে-আইন প্রণীত হল সেটিও মূল জমিদারি জায়গিরদারি বিলোপ আইনের অনুরূপ। এই সব পতিত জমি-জঙ্গল ইত্যাদির ওপর মধ্যস্বত্বভোগীর অধিকারের বিলোপ ঘটিয়ে সরাসরি সরকারি মালিকানা ও সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হল। জমিদার-জায়গিরদারের গৃহসংলগ্ন বিশাল জমি ইত্যাদি এবং তার নিজস্ব ব্যক্তিগত চাষের জমি সম্বন্ধে এক-এক প্রাদেশিক সরকার এক-একরকম আইন প্রণয়ন করেছিল। পশ্চিমবঙ্গে যে-আইন প্রণীত হল, তাতে খাস-জমি (নিজস্ব ব্যক্তিগত অধিকারের জমি)-র ওপর একটা নির্দিষ্ট সীমা অবধি একজন চাষি সরকারের ভাড়াটে চাষি হিসেবে তার অধিকার পেল। তাদের খাস জমির এই অংশের জন্য তারা রাষ্ট্রের কাছে রাজস্ব-দাতা ভাড়াটে চাষি হিসেবে গণ্য হল। এদের অধীন পূর্বতন ভাড়াটে চাষিদের কোনও অধিকার এই আইন স্বীকার করে না। খাস-জমির রায়তি স্বত্ব স্বীকার করা হয়েছিল সর্বোচ্চ ২৫ একর জমির ওপর। ২৫ একরের ওপর সব খাস-জমি সরকার অধিগ্রহণ করে। উত্তরপ্রদেশে জমিদারি বিলোপ ও জমি অধিগ্রহণ আইনে জমিদারি এস্টেটের সব জমি সরকার অধিগ্রহণ করেছিল। এই জমির পূর্বতন চাষিরা সরাসরি সরকারের অধীনস্থ ভূমিখাজনা-দাতা ভাড়াটে চাষিতে পরিণত হল। তবে চাষিদের এই জমি কিনে নেওয়ারও সুযোগ দেওয়া হয়, সেজন্য চলতি খাজনার দশ গুণ দাম দিতে হত। পূর্বতন মধ্যস্বত্বভোগীদের ক্ষতিপূরণ দিয়ে তাদের খাস-জমির ওপর অধিকার সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করা হয়। সমগ্র মধ্যভারতের জায়গিরদারি অঞ্চলে, আজমিরে ও ভোপালেও একইরকম আইন প্রবর্তিত হয়েছিল। রাষ্ট্রকে সমস্ত ক্ষতিপূরণ বহন করতে হয়।

মধ্যভারতের জমিদারি অঞ্চলে ও রাজস্থানে অবশ্য এই খাস-জমি সংক্রান্ত নীতিতে কিছুটা পার্থক্য দেখা যায়: এইসব অঞ্চলে মধ্যস্বত্বভোগীদের খাস-জমি তারা নিজস্ব মালিকানায় আগের মতোই রেখে দিতে পারত। মধ্যভারতে অবশ্য এইসব জমির পূর্বতন খাজনাদাতা প্রকৃত চাষিদের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল যাতে তারা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ক্ষতিপূরণের বিনিময়ে জমির মালিকানা কিনে নিতে পারে। রাজস্থানে খাস-জমির পূর্বতন খাজনা-দাতা প্রকৃত চাষিরা শ্রমের খরচের ওপর ১২০০ টাকা অবধি আয় হয় এমন পরিমাণ জমি কিনে নেওয়ার অধিকার পায়। দিল্লিতে খাস-জমির পূর্বতন ভাড়াটে চাষিরা খাজনার ২০ থেকে ৪০ গুণ দাম দিয়ে খাস-জমির মালিকানা কেনার সুযোগ পায়। অবশ্য অনেক প্রদেশে নিজস্ব চাষের অধীনে থাকা খাস-জমিরও একটা সর্বোচ্চ সীমা ধার্য করা হয়েছিল। যেমন, পশ্চিমবঙ্গে এই ধার্য সীমা হল ২৫ একর। অপরপক্ষে কোনও কোনও রাজ্যে আবার পূর্বতন মধ্যস্বত্বভোগীরা তাদের খাস-জমির এলাকার ওপর আরও খানিকটা জমি ব্যক্তিগত চাষের জন্য রেখে দেওয়ার অধিকার পায়।

সাধারণভাবে জমিদার বা জায়গিরদারদের এস্টেটে জমিদারি ও জায়গিরদারি অধিকার বিলোপ করা হয়েছিল, কিন্তু তাদের অধীনে থাকা বড় মাপের ও প্রথম স্তরের প্রধান খাজনা-দাতা ভাড়াটে চাষিদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন আইন প্রবর্তন করা হয়। সবক্ষেত্রেই এদের রাষ্ট্রের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কে আনা হয়। কিন্তু বিভিন্ন রাজ্যে তাদের অধিকার-সংক্রান্ত আইনে পৃথক পৃথক ব্যবস্থা চালু হয়। বিভিন্ন প্রদেশে মধ্যস্বত্বভোগীদের জন্য ক্ষতিপূরণের পরিমাণেও পার্থক্য ছিল। যেমন, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ওডিশা, অসম, ভোপাল ও বিন্ধ্য প্রদেশে এই প্রথম স্তরের প্রধান অধিকারভোগীরা কোনও ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বাধ্যবাধকতা ছাড়াই জমির ওপর স্থায়ী হস্তান্তরযোগ্য অধিকার পায়। উত্তরপ্রদেশে জমিদারদের ঠিক নীচে অবস্থানকারী এই প্রধান দখলদারি অধিকারভোগীরা কোনও ক্ষতিপূরণের বাধ্যবাধকতা ছাড়াই জমির ওপর স্থায়ী, বংশানুক্রমিক অধিকার পেয়েছিল, কিন্তু জমি হস্তান্তরের অধিকার তাদের ছিল না। অবশ্য খাজনার দশগুণ মূল্য দিয়ে তারা হস্তান্তরের অধিকার কিনতে পারত।

আমরা আগে উল্লেখ করেছি, জমিদারি ও জায়গিরদারি এলাকায় জমিদার বা জায়গিরদারদের নীচে স্তরে স্তরে অনেক মধ্যস্বত্বভোগীর সৃষ্টি হয়েছিল। এদের মধ্যে জমিদার বা জায়গিরদারের ঠিক নীচে অবস্থানকারী প্রধান মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণিটি, তাদের নীচে থাকা আরও অনেক দখলদারি অধিকার ভোগকারী মধ্যস্বত্বভোগী সমেত বিস্তীর্ণ জমিদারি এলাকার ওপর খাজনা আদায়ের অধিকার ভোগ করত। ভূমিসংস্কার আইন জমিদার ও জায়গিরদারদের ক্ষমতা নাশ করে এই প্রধান মধ্যস্বত্বভোগীদের অধিকার আইনসঙ্গত ভাবে প্রতিষ্ঠা করে। ফলে পূর্বতন ব্রিটিশরাজের স্বার্থবাহী জমিদার-জায়গিরদার শ্রেণিটির অবলুপ্তি ঘটলেও আসলে মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবস্থার অবসান হয় না। এই বিরাট ক্ষমতাসম্পন্ন মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণিটির অধিকার এতে আরও দৃঢ় হয় এবং এর বিনিময়ে এদের কোনওরকম ক্ষতি স্বীকার করতে হয় না। ভূমিসংস্কার সামন্ততান্ত্রিক ভূমিব্যবস্থায় কোনও আঘাত হানে না।

এইসব বৃহৎ প্রাক্তন মধ্যস্বত্বভোগীরা এখন সরাসরি রাষ্ট্রের অধীনে চলে এলেও এদের নীচে অনেক খাজনাদাতা প্রজাস্বত্বভোগী চাষি বা ভাগ-চাষি, বা তাদেরও নীচে এদের ভাড়া করা, এদের খাজনা দেওয়া ভাগ-চাষি বা প্রজাস্বত্ব পাওয়া চাষি ছিল। ভূমিসংস্কার আইন প্রবর্তনের আগে এইসব দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্তরের ভাড়াটে চাষিদের কোনওরকম দখলদারি অধিকার ছিল না। ভূমিসংস্কার প্রবর্তিত হওয়ার পর এদের প্রথম পাঁচ বছরের জন্য দখলদারি অধিকার দেওয়া হল এবং তারপর এদের সুযোগ দেওয়া হল চলতি খাজনার ১৫ গুণ দাম দিয়ে মালিকানা অধিকার কিনে নেওয়ার। যারা এই দাম দিতে অপারগ, জমির ওপর তাদের কোনওরকম মালিকানা বা দখলদারি অধিকার আইনত স্বীকার করা হল না। এদের মধ্যে যারা ছিল ভাগ-চাষি, আইনত তাদের ভাড়াটে প্রজা-চাষির স্বীকৃতি দেওয়া হল না। অর্থাৎ আইন এদের কোনওরকম অধিকার স্বীকার করল না। আবার একেবারে প্রথম স্তরের রায়তরা তাদের ব্যক্তিগত চাষের অধীনে আইনমাফিক একটা ঊর্ধ্বসীমার মধ্যে জমি রাখতে পারত। কোনও কারণে তারা ব্যক্তিগতভাবে চাষবাস চালাতে না পারলে তাদের ব্যক্তিগত চাষের জমি লিজে নিয়মিত খাজনা পাওয়ার শর্তে ভাড়াটে প্রজা-চাষিকে দিতে পারত। এইসব ভাড়াটে প্রজা-চাষির দখলদারি বা মালিকানা, কোনও অধিকারই থাকত না, কারণ যে-কোনও সময় মালিক এদের উচ্ছেদ করে এদের চাষ করা জমি তার ব্যক্তিগত চাষের আওতায় নিয়ে আসতে পারত।

যেসব চাষি ব্যক্তিগতভাবে জমি চাষ করত, তাদের মালিকানার ওপর ভূমিসংস্কার আইনে জমির একটা ঊর্ধ্বসীমা চাপানো হল। তার বেশি জমি থাকলে সরকার তা অধিগ্রহণ করবে ও এই অধিগৃহীত জমি ভূমিহীনদের মধ্যে ভাগ করা হবে, এটাই আইনত স্থির হল।

জাপান, পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলি ও বিপ্লব-পরবর্তী চিন ও রাশিয়ার ভূমিসংস্কারের স্পষ্ট উদ্দেশ্য ছিল কৃষি থেকে প্রাক্-পুঁজিবাদী বৈশিষ্ট্যগুলি নির্মূল করে কৃষিতে ব্যক্তিগত উদ্যোগের পথ উন্মুক্ত করা। বিপ্লব-পরবর্তী চিন ও রাশিয়ার ভূমিসংস্কার একেবারে প্রাথমিক স্তরে কৃষি থেকে প্রাক্‌পুঁজিবাদী বৈশিষ্ট্যগুলি নির্মূল করতে চেয়েছিল। তারা কৃষি থেকে পুরনো ভূস্বামীর কর্তৃত্বের সম্পূর্ণ উচ্ছেদ ঘটিয়ে কৃষি-জমিগুলো ক্ষতিপূরণ ছাড়াই অধিগ্রহণ করে প্রকৃত উৎপাদক ভূমিহীন চাষির হাতে তুলে দেয়। একই সঙ্গে যে-সমস্ত মুষ্টিমেয় কৃষিকাজে শ্রমদাতা চাষি মূলত ব্যক্তিগত উদ্যোগে চাষ করত ও প্রয়োজনে কিছু কিছু কৃষিশ্রমিক নিয়োগ করত সাময়িক ভাবে ও শর্তাধীনে, তাদের ব্যক্তিগত উদ্যোগের রাস্তায় কোনও বাধা দেওয়া হয় না। বিপ্লবের অব্যবহিত পরেই এই ব্যবস্থা নিলেও এর ঘোষিত কর্মসূচির মধ্যেই স্পষ্টভাবে বলা ছিল এই পদক্ষেপগুলির রূপায়ণের পরবর্তী স্তরের কর্মসূচি কী হবে। এটা একটা ক্রমিক প্রক্রিয়া। সেখানে বলা হয় যে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নূতন সৃষ্ট ব্যক্তিগত চাষের আওতায় থাকা কয়েকটি করে জোত একত্রিত করে ক্রমান্বয়ে পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে চাষ শুরু করা হবে, তারপর সমবায় ব্যবস্থায় চাষ ও পরে অঞ্চলভিত্তিক যৌথ মালিকানায় বৃহৎ চাষব্যবস্থা চালু করা হবে। এই দেশগুলির রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য ছিল কৃষিতে সমাজতান্ত্রিক উত্তরণ ঘটানো। অপর পক্ষে জাপান ও বিভিন্ন ইউরোপীয় দেশের ভূমিসংস্কারের উদ্দেশ্য ছিল প্রাথমিক স্তরে কৃষিতে ব্যক্তি-উদ্যোগে চাষের রাস্তা প্রস্তুত করা ও সেই সঙ্গে কৃষি-জমি, কৃষিপণ্য, কৃষি উপকরণ ও কৃষি শ্রমের মুক্ত বাজার-প্রক্রিয়া গঠনের পথে সমস্ত আইনগত ও পরিকাঠামোগত বাধা অপসারণ করা। এর মাধ্যমে তারা পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন-সম্পর্কের বিকাশকে অবাধ করতে চেয়েছিল। কিন্তু ভারতীয় ভূমিসংস্কার আইনের ঘোষিত উদ্দেশ্য থেকে এটা আদৌ স্পষ্ট নয় যে, কৃষিতে শেষ পর্যন্ত কোন ধরনের উৎপাদন-সম্পর্কের বিকাশ ঘটাতে চাওয়া হয়েছিল। তার কর্মসূচি থেকে এটুকু স্পষ্ট যে, এই ভূমি সংস্কারের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সবচেয়ে উপরতলার যে-মধ্যস্বত্বভোগীরা এদেশে ব্রিটিশের স্বার্থরক্ষাকারী ছিল, তাদের কর্তৃত্বের অবসান ঘটানো। কিন্তু ভাগ-চাষ প্রথা বা স্থির খাজনায় ভাড়াটে চাষিকে দিয়ে চাষের পদ্ধতির অবসান ঘটানোর কোনও উদ্দেশ্য এই সংস্কারের ছিল না। স্থির খাজনায় চাষের আওতায় থাকা জমিতে পুঁজিবাদী বিনিয়োগের অবস্থা সৃষ্টি করার, পুঁজিবাদী প্রথায় চাষপদ্ধতি বিকশিত করার, এবং তার মধ্য দিয়ে স্থির খাজনাকে পুঁজিবাদী কৃষি খাজনায় পরিণত করার কোনও উদ্দেশ্য এই কর্মসূচির পিছনে ছিল না। অথবা এই সব জমি অধিগ্রহণ করে এই চাষিদের জোতে ব্যক্তিগত চাষের মাধ্যমে চাষ চালু করে জমিতে উৎপাদনশীল বিনিয়োগের রাস্তা বাধাহীন করাও এই সংস্কার প্রচেষ্টার ঘোষিত উদ্দেশ্য ছিল না। বিপরীতে এই সংস্কারের উদ্দেশ্য ছিল ভাগ-চাষ বা স্থির খাজনার চাষ-ব্যবস্থার সংস্কার-পূর্ব অবস্থা বজায় রেখে কেবলমাত্র স্থির খাজনার চাষিদের দখলদারি অধিকার আরও জোরদার করা, ও খাজনার পরিমাণ নির্দিষ্ট করা। অর্থাৎ পূর্বতন প্রধান মধ্যস্বত্বভোগীদের ঠিক নীচে অবস্থানকারী মধ্যস্বত্বভোগী, যারা স্থির খাজনা ব্যবস্থায় থাকা জমির মালিক, তাদের পূর্বতন কর্তৃত্ব বা পূর্বতন ব্যবস্থার মূল চরিত্রে কোনও পরিবর্তন আনার উদ্দেশ্য ভূমি সংস্কার আইনে পাওয়া যায় না।

আমরা আগেই দেখেছি, ঊনবিংশ শতকের শেষদিক থেকে বিংশ শতকের প্রথম চার দশকে জমিবন্ধকি ও জমি হস্তান্তর সহজতর হওয়ার ফলে ব্যবসায়ী মহাজন শ্রেণি-জোতদার শ্রেণির উদ্ভব ও বৃদ্ধি ঘটে। ফলে ইতিমধ্যেই গ্রাম-সমাজের ওপর জমিদার ও জায়গিরদার শ্রেণির কর্তৃত্ব কমছিল ও জোতদার শ্রেণির কর্তৃত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছিল। ভূমিসংস্কার এই জোতদার শ্রেণির মহাজনি ও বন্ধকি কাজকর্মের ওপর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনও বাধা সৃষ্টি করল না। পূর্বতন রায়তদের মধ্য থেকে এরা যে বিপুল সংখ্যক ভাগ-চাষির জন্ম দিয়েছিল, সংস্কার আইন সেই ভাগ-চাষিদের সম্বন্ধেও সম্পূর্ণ উদাসীন ছিল। জাপান বা ইউরোপিয়ান দেশগুলি এবং চিন-রাশিয়ার মতো দেশগুলির সঙ্গে তুলনা করলে সামন্ততান্ত্রিক ভূমিব্যবস্থার অবসান বা কৃষিতে পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্কের বিকাশের দিক থেকে ভারতীয় ভূমিসংস্কার আইনের সীমাবদ্ধতা খুবই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। জমির ঊর্ধ্বসীমা জারি করে সীমা-বহির্ভূত জমি ভূমিহীন কৃষি-শ্রমিকদের মধ্যে ভাগ করে দিয়ে ছোট ছোট জমিতে ব্যক্তি-উদ্যোগে চাষব্যবস্থা গড়ে তোলা ছিল এই আইনটির উদ্দেশ্য। কিন্তু আমরা জাপানের ক্ষেত্রে দেখেছি কৃষি পণ্য, জমি, কৃষি-শ্রমিক ও কৃষি-ঋণের মুক্ত বাজার যদি উপস্থিত থাকে এবং বাধাহীনভাবে পুঁজির বিনিয়োগ যদি সম্ভব হয়, তবে চাষিদের মধ্যে জমির পরিমাণে অসাম্যের জন্য অপেক্ষাকৃত ছোট ও বড় উৎপাদকদের মধ্যে বাজার দখলের জন্য প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হয়। এবং দেখা যায় অপেক্ষাকৃত বড় উৎপাদকদের পুঁজি বিনিয়োগ থেকে লাভের হার ছোট উৎপাদকদের থেকে বেশি, তাদের মুনাফার হারও বেশি। এরা পুঁজি পুনর্বিনিয়োগের মাধ্যমে এগিয়ে যায় ও ছোট উৎপাদকরা ক্রমশ পিছু হটতে থাকে। এই প্রক্রিয়ায় কৃষি অর্থনীতি ক্রমশ বড় জোতে পুঁজিবাদী চাষের দিকে অগ্রসর হয়। আমাদের দেশে কৃষিসংস্কার প্রক্রিয়ায় জমির ঊর্ধ্বসীমা আইনটি প্রবর্তনের সময় এই ধরনের পরিণতি সম্পর্কে সংস্কার-কর্তাদের স্পষ্ট কোনও ধারণা ছিল না। তাঁরা কৃষি-শ্রমিক সহ কৃষি-উপকরণ ও কৃষি-ঋণের মুক্ত বাজার-প্রক্রিয়া গড়ে তোলার বিষয়ে কোনও পদক্ষেপ নেননি। কৃষিপণ্যের বাজার, কৃষি-ঋণের বাজার ও কৃষি উপকরণের বাজারের নিয়ন্ত্রক ব্যবসায়ী-মহাজন শ্রেণিটির প্রভাব থেকে কৃষি অর্থনীতিকে মুক্ত করার জন্য কোনও কার্যকর পদক্ষেপ সেই সময়কার কৃষি-কর্মসূচির মধ্যে ছিল না। ফলে সংস্কার আইনগুলি প্রয়োগ করার সঙ্গে সঙ্গে এই বাজার-প্রক্রিয়াকে মুক্ত করার কোনও পরিকল্পনা তাঁরা করেননি। কীভাবে সংস্কারের মাধ্যমে কৃষিতে উপস্থিত প্রাক-পুঁজিবাদী উপাদানগুলি নির্মূল করা যায় তার কোনও পরিকল্পনা তঁদের ছিল না।

অন্যদিকে এই সংস্কার আইনের বিভিন্ন উপবিভাগগুলি প্রয়োগের ক্ষেত্রেও যথেষ্ট তৎপরতার অভাব দেখা যায়। ভাড়াটে, খাজনাদাতা প্রজাদের জমির ওপর দখলদারি স্বত্বের কোনও নিশ্চয়তা তৈরি হল না, শুধু তা-ই নয়, জমির ঊর্ধ্বসীমা আইনটিও ব্যাপক ভাবে লঙ্ঘিত হল। কৃষিতে প্রাক-পুঁজিবাদী কর্তৃত্বকারী শক্তির উপস্থিতি অগ্রাহ্য করে এই আইনগুলির যথাযথ প্রয়োগ সম্ভব ছিল না। জোতদাররা জমির প্রকৃত পরিমাণ গোপন করে বিভিন্ন ভাবে বেনামে ঊর্ধ্বসীমার থেকেও বেশি জমি অধিকারে রেখেছিল। ঋণের ভারে জর্জরিত কৃষক-সমাজের ওপর ব্যবসায়ী-মহাজন-জোতদারদের কর্তৃত্ব ছিল অসীম। সেইসঙ্গে স্থানীয় প্রশাসন ব্যবস্থাতেও এদের কর্তৃত্ব জারি ছিল, ফলে এদের পক্ষে এই আইন ফাঁকি দেওয়া কঠিন ছিল না। শুধুমাত্র জমির মালিকানার ঊর্ধ্বসীমা জারি করে এই কর্তৃত্ব রোধ করা যায়নি, বিভিন্ন বাজারে এদের নিয়ন্ত্রক ভূমিকার অবসান ঘটানোর জন্যও উপযুক্ত পদক্ষেপের প্রয়োজন ছিল।

সংস্কার-পরবর্তী কয়েক বছরে ভারতীয় কৃষি যে-অবস্থায় গিয়েছিল তা থেকে ভারতীয় কৃষিসংস্কারের ব্যর্থতার কিছু প্রমাণ পাওয়া যায়। ভূমিসংস্কার কর্মসূচি রূপায়ণের পর, ১৯৬০-৬১ সালে, জমির বিন্যাস ব্যবস্থা কেমন ছিল তা নীচের সারণি থেকে স্পষ্ট হবে।

সারণি ৩.১ মালিকানাধীন জোত ও কৃষিজমির বিন্যাস (শতকরা)

সারণি ৩.১ মালিকানাধীন জোত ও কৃষিজমির বিন্যাস (শতকরা)

Source: NSSO 17th, 26th, 37th, 48th Round

দেখা যাচ্ছে ১৯৬০–৬১ সালে মোট জোতের মধ্যে প্রান্তিক জোতের অনুপাত ছিল শতকরা ৬০ ভাগের বেশি ও ক্ষুদ্র জোতের অনুপাত ছিল শতকরা ১৫ ভাগের কিছু বেশি। অর্থাৎ প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকের জোতের (<২ হে মাপের) মোট অনুপাত ছিল শতকরা ৭৫ ভাগেরও বেশি। এবং মোট জমির শতকরা ২০ ভাগ জমি এদের চাষের আওতায় ছিল। মাঝারি ও সর্ববৃহৎ অর্থাৎ ৪ হেক্টরের বেশি মাপের জোত ছিল শতকরা প্রায় ১২ ভাগ মাত্র এবং মোট জমির শতকরা ৫৫.৪৭ ভাগ এদের চাষের আওতায় ছিল [শতকরা ২.৮৫ ভাগ জোত ছিল অতি বৃহৎ, ১০ হেক্টরের বেশি বা ৩০ একরের বেশি মাপের, ও এই জোতের আওতায় ছিল মোট জমির শতকরা ২৪.২৪ ভাগ। শতকরা ৩১.২৩ ভাগ জমি ছিল মাঝারি জোতের আওতায় (৪–<১০ হেক্টর)]। এর বাইরে ২০.৫৪ ভাগ জমি আধা-মাঝারি (২–<৪ হেক্টর মাপের) জোত ছিল মোট জোতের শতকরা ১২.৮৬ ভাগ। শতকরা ২৪.২৪ ভাগের বেশি বৃহৎ জোতের জমির মালিক ছিল জোতদার শ্রেণি, পূর্বতন সবচেয়ে উচ্চে অবস্থানকারী মধ্যস্বত্বভোগীদের ঠিক নীচে যাদের অবস্থান ছিল এবং যারা মূলত স্থির খাজনায় বা ভাগচাষে জমি চাষ করতে দিত। দেখা যাচ্ছে, ভূমিসংস্কারের পরও ১০ হেক্টর বা ৩০ একরেরও বেশি মাপের জমি কিছু চাষির অধিকারে ছিল এবং তাদের মালিকানায় ছিল মোট জমির প্রায় একচতুর্থাংশ জমি। অর্থাৎ তাদের ক্ষেত্রে ২৫ একরের সীমার অতিরিক্ত জমিগুলো অধিগৃহীত হয়নি। এছাড়াও মাঝারি চাষি, যাদের জমির মাপ ৮.৬০ থেকে <১০ হেক্টর, তাদের বেলাতেও ২৫ একরে বেঁধে দেওয়া নীতি লঙ্ঘিত হয়েছে। এটি ভূমিসংস্কার আইনটির প্রয়োগে চরম ব্যর্থতার প্রমাণ। আবার উপরের তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে, জাপানের মতো ভারতের কৃষি অর্থনীতিতে অপেক্ষাকৃত বড় জোতে জমির কেন্দ্রীভবনের কোনও প্রবণতা দেখা যায়নি। উপরের সারণি থেকে দেখা যাচ্ছে, ১৯৬১ সালের পর থেকে দশকের পর দশক বড় জোতের (৪ হেক্টর থেকে ১০ হেক্টরের বেশি) আওতায় জমির শতকরা ভাগ কমতেই থেকেছে। ১৯৮১–৮২ সাল থেকে ১৯৯০–৯১, এই দশকটিতে বড় জোতের আওতায় থাকা মোট জমির শতকরা ভাগ কমেছে সবচেয়ে বেশি— মোট জমির শতকরা ৪৮.০৫ ভাগ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে শতকরা ৩১.৫৭ ভাগে। বড় জোতে জমির কেন্দ্রীভবন হওয়ার পরিবর্তে বড় জোতের আওতা থেকে জমি কমে যাচ্ছে। দশকের পর দশক বড় জোতের সংখ্যার অনুপাতও কমছে দ্রুত। অনেকে বড় জোতের এই দ্রুত হ্রাস পাওয়ার ঘটনাটিকে ১৯৭৭ সালের পর পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থী সরকার প্রতিষ্ঠার সঙ্গে যুক্ত করে দেখেন, পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে মনে করা হয় এটি ভূমিসংস্কারে বাম সরকারের সাফল্যের নিদর্শন। কিন্তু জমির খণ্ডীকরণের এই চিত্রটি যে শুধু পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে সত্যি তা নয়, এটি গোটা দেশেরই চিত্র।

অন্যদিকে এটা দেখা যেতে পারে যে, পূর্বতন জমিদারি এলাকা অধ্যুষিত রাজ্যগুলি, যেমন, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ওডিশা, আসাম, উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান এবং মধ্যপ্রদেশ— এই রাজ্যগুলি জমিদারি ব্যবস্থার অবসানের পর ১৯৬১ সালেও পূর্বতন রায়তওয়ারি ব্যবস্থার রাজ্যগুলি থেকে কৃষি উৎপাদন বা কৃষিতে উৎপাদন-কুশলতার দিক থেকে যথেষ্ট পশ্চাদপর ছিল। এই রায়তওয়ারি রাজ্যগুলি— পঞ্জাব, কেরালা ও মহারাষ্ট্র, ১৯৬১ সালে কৃষি উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতার দিক থেকে অন্যান্য সব রাজ্যের তুলনায় অনেক এগিয়ে ছিল। আর-একটি রাজ্য, মাদ্রাজ, কিয়দংশে জমিদারি এলাকা অধ্যুষিত হলেও, কৃষিতে অগ্রগামী ছিল।

সারণি ৩.২ শস্য উৎপাদনে শতকরা বৃদ্ধি ১৯৫২–৫৩ থেকে ১৯৬৪–৬৫

সারণি ৩.২ শস্য উৎপাদনে শতকরা বৃদ্ধি ১৯৫২–৫৩ থেকে ১৯৬৪–৬৫

Source: Ministry of Food and Agriculture

উৎপাদনের হার সংক্রান্ত তথ্য এবং স্থির খাজনা ও ভাগ চাষ সংক্রান্ত তথ্য ১৯৬১ সালের সেনসাসের ভিত্তিতে উপরে সারণি ৩.২তে উপস্থিত করেছি।

উল্লিখিত তথ্য থেকে আমরা কয়েকটি বিষয়ে ধারণা করতে পারি।

আমরা দেখছি, অধিকাংশ রাজ্যে ভূমিসংস্কার-পরবর্তী ১০/১২ বছরে বার্ষিক বৃদ্ধির হার শতকরা ৪ ভাগের নীচে ছিল। এদের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ, অসম, কেরালা ও উত্তরপ্রদেশে বৃদ্ধির হার ছিল শতকরা ৩ ভাগেরও নীচে। বৃদ্ধির হার সবচেয়ে বেশি ছিল গুজরাত, পঞ্জাব, মহীশূর ও মাদ্রাজে। যে সমস্ত এলাকা ভূমিসংস্কার আইন প্রয়োগের ১০ বছর পর গড় বার্ষিক বৃদ্ধির হারের তুলনায় যথেষ্ট এগিয়ে রয়েছে, তার মধ্যে মাদ্রাজ বাদে, পঞ্জাব, গুজরাত ও মহীশূর স্বাধীনতার আগে ছিল রায়তওয়ারি এলাকাভুক্ত। এমনকী মাদ্রাজও অংশত রায়তওয়ারি এলাকাভুক্ত ছিল। বৃদ্ধির হার যেসব অঞ্চলে সব থেকে নীচে, সেই অঞ্চলগুলোর সব ক’টিই ছিল জমিদারি এলাকাভুক্ত। ভূমিসংস্কার পূর্বতন জমিদারি এলাকাগুলোর পশ্চাদপদতা কাটাতে খুব সাহায্য করেনি। ভূমিসংস্কারের ১০/১২ বছর পরেও জমিদারি ও রায়তওয়ারি প্রদেশগুলির মধ্যে কৃষি উৎপাদনে প্রকট তফাত ছিল।

একদিকে জোতগুলোর ক্রমহ্রাসমান গড় পরিমাপ, অন্যদিকে বিভিন্ন প্রদেশের মধ্যে কৃষি উৎপাদনের মাত্রার অসাম্য সেই সময়ে ছিল ভারতীয় কৃষির বৈশিষ্ট্য। ভূমিব্যবস্থার দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য ছিল, ভাগ-চাষ ও স্থির খাজনায় চাষের ব্যাপকতা। ভারতের কোনও কোনও প্রদেশে ভাগ-চাষের আওতায় জমির পরিমাণ ছিল শতকরা ৪০ ভাগের বেশি, অনেক প্রদেশে শতকরা ৩০ ভাগের বেশি। উপরের সারণি থেকে আর-একটি তথ্যের হিসাব দেখা যাচ্ছে, তা হল, ভাগ-চাষ বা স্থির খাজনায় চাষ যে সবসময় নিজস্ব জমিতে নিজে চাষ পদ্ধতির তুলনায় কম উৎপাদনশীল, বা তাতে বৃদ্ধির হার কম ঘটে এমন নয়।

১৯৫০-এর দশকে পূর্বোল্লিখিত ভূমিসংস্কারের সঙ্গে সঙ্গে লিজব্যবস্থায় ভাড়াটে চাষিদের অবস্থা উন্নতির জন্য টেনান্সি আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ হয়। কিন্তু ১৯২৮-এর বেঙ্গল টেনান্সি আইন ও পরবর্তীতে এই আইনের যে-বিভিন্ন সংস্কার হয়েছে তার কোনও ধারাতেই বর্গাদার বা ভাগচাষিদের জমির ওপর দখলি অধিকার স্বীকার করা হয়নি, যদিও স্থির খাজনার চাষের চাষিদের দখলদারি স্বত্ব স্বীকার করা হয়েছিল।

১৯৪৬–৪৭ সালে তৎকালীন অন্ধ্রপ্রদেশের তেলেঙ্গানায় ও বাংলার বিভিন্ন রাজ্যে তেভাগা আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। এই আন্দোলনের মূল দাবি ছিল ভাগ-চাষ প্রথার সংস্কার। তেভাগা আন্দোলনের ঘোষিত মূল উদ্দেশ্য ছিল ভাগ-চাষি বা বর্গাদারদের জন্য মোট ফসলের মূল্য থেকে উৎপাদন ব্যয় বাদ দিয়ে বাকি অংশের তিন ভাগের দুইভাগ ফসল বর্গা-চাষিদের অধিকারে রাখা। এই আন্দোলন ভূমিব্যবস্থায় বা বর্গা-ব্যবস্থায় কোনও মূলগত পরিবর্তন আনতে না পারলেও গ্রামীণ ভূমি-সম্পর্কে পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা স্পষ্ট করে তুলেছিল। ১৯৫০-এর দশকের ভূমিসংস্কার আইনের পরে ১৯৫৫ সালে এল টেনান্সি সংস্কার আইন। সেই আইনবলে স্থির খাজনার চাষিদের দখলদারি স্বত্ব স্বীকৃত হল, সেই সঙ্গে জমির মালিক ও ভাড়াটে চাষিদের মধ্যে শ্রম ছাড়া অন্যান্য উৎপাদন উপকরণের খরচের দায় ভাগাভাগি করে নেওয়ার ব্যবস্থা হল, খাজনার পরিমাণও স্থির করা হল সেই অনুযায়ী। কিন্তু সেখানেও ভাগ-চাষি বা বর্গাদারদের আইনত কোনও দখলদারি অধিকার স্বীকার করা হয়নি, মালিক ইচ্ছা করলে যে-কোনও সময়ে তাদের উৎখাত করতে পারত। ভারতের কোনও কোনও প্রদেশে অবশ্য প্রথম ভূমিসংস্কার আইন প্রণীত হওয়ার সময়েই তারা খাজনার দশ গুণ অর্থ দিয়ে এই অধিকার কিনতে পারত। কিন্তু ভূমিসংস্কার আইনের যথাযথ প্রয়োগ ব্যর্থ হয়েছিল এবং তার ফলে গোটা দেশেই সামাজিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় জমিদারি ধরনের শোষণে কোনও পরিবর্তন আসেনি। শুধুমাত্র সবচেয়ে ওপরের তলার ভূমি-রাজস্ব আদায়কারী জমিদার শ্রেণি তাদের পূর্বতন অবস্থান থেকে বিচ্যুত হয়েছিল, কিন্তু জমিদারের নীচের স্তরে যেসব জোতদার-জমিদার-মধ্যস্বত্বভোগী ও ব্যবসায়ী-মহাজন ছিল তাদের তীব্র শোষণের শিকার হওয়া থেকে ছোট চাষি ও ভূমিহীন চাষিদের নিষ্কৃতি মেলেনি। চাষিদের ঋণগ্রস্ততা ও দারিদ্র চাষ-ব্যবস্থাকে পশ্চাদপদ করে রেখেছিল।

এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমবঙ্গের নকশালবাড়ি আন্দোলন সমাজজীবনে গভীর ও ব্যাপক প্রভাব ফেলে। এই আন্দোলনের মূল প্রক্রিয়া ছিল জোতদারদের হাতে থাকা সীমা-বহির্ভূত বিরাট জমি বলপূর্বক অধিগ্রহণ ও পুনর্বণ্টন, জমির মালিকানা সংক্রান্ত আইনি কাগজপত্র ধ্বংস করা, ঋণের বিপরীতে জমিবন্ধকি ব্যবস্থাগুলিকে বাতিল করা ও ঋণের ওপর সুদ দেওয়া বন্ধ করা। ১৯৬৭ থেকে ’৭০ সালের মধ্যে জমির আইন-নির্দিষ্ট ঊর্ধ্বসীমার উপরে থাকা জমির একটি বড় অংশ অধিগ্রহণ করে বর্গাদার ও ভূমিহীন চাষিদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়। তৎকালীন বাম-বাংলা কংগ্রেস যুক্তফ্রন্ট সরকার ও এই সরকারের পতন হলে কংগ্রেস সরকার, নির্মমভাবে এই আন্দোলনকে দমন করে। আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীরা ব্যাপক দমন-পীড়নের সম্মুখীন হয়; তাঁদের বেশিরভাগই কারারুদ্ধ ও নির্মম অত্যাচারের শিকার হয়, নতুবা সরকারের নির্দেশে পুলিশ এদের মিথ্যা সংঘর্ষের নামে ব্যাপকভাবে হত্যা করে। ১৯৭০ থেকে ’৭৭-এর মধ্যে অধিগৃহীত জমিতে জমির মালিকরা আবার তাদের মালিকানা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে। কিন্তু তৎসত্ত্বেও এই আন্দোলন দীর্ঘদিন ধরে জোতদার জমিদার ও মহাজনের চাপানো সামন্ততান্ত্রিক শাসনে পিষ্ট কৃষক জনগণের মধ্যে আত্মমর্যাদা বোধের উন্মেষ ঘটায়, তাদের অধিকার সম্বন্ধে সচেতন করে, অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সাহস জোগায়। ফলে এই আন্দোলন ব্যর্থ হলেও সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক মননে তা বিরাট পরিবর্তন আনে। ফলে সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবর্তনের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। অন্যদিকে মালিক-শ্রেণি ও তাদের রাজনৈতিক মুখপাত্ররাও উপলব্ধি করে যে, কৃষক জনগণের ক্ষোভ প্রশমিত রাখার জন্য ভূমিসংস্কার আইনের আরও ব্যাপক প্রয়োগ সুনিশ্চিত করা দরকার।

পশ্চিমবঙ্গে ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকার গঠিত হওয়ার পর বর্গাদারদের সংগঠিত বর্গা আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রণীত হল বর্গা আইন। এই প্রথম বর্গাদারদের দখলদারি অধিকার আইনত স্বীকার করা হল। এই অধিকারের বিপরীতে মালিকদের বিভিন্ন ধরনের প্রতিরোধ কাটানোর জন্য সম্মিলিত বাম দলগুলি বর্গাদারদের নাম নথিভুক্ত করার জন্য ব্যাপক অভিযান শুরু করে। এর ফলে আইনত বর্গাদারদের দখলদারি স্বত্ব প্রতিষ্ঠিত হলেও বর্গাদারদের অবস্থার খুব বেশি পরিবর্তন হয় না। জাপান ও ইউরোপের দেশগুলি কৃষিতে ব্যক্তিগত উদ্যোগের দ্বার খুলে দেওয়ার নীতি নিয়েছিল ও সেই লক্ষ্যে খাজনার বিনিময়ে চাষ ও ভাগ-চাষ ব্যবস্থার সম্পূর্ণ বিলোপ ঘটানোর পথে এগিয়েছিল। চিন ও রাশিয়ার মতো সদ্য সমাজতন্ত্রে পা-রাখা দেশগুলি প্রাথমিকভাবে ব্যক্তিগত উদ্যোগে চাষ ও পরবর্তীতে সমবায় ব্যবস্থা ও যৌথ মালিকানায় চাষ ব্যবস্থার পত্তন ঘটিয়েছিল। এদিকে অপারেশন বর্গা সমেত ভারতের ভূমিসংস্কার আইন ছিল ভাগ-চাষি বা স্থির খাজনার চাষিদের জমির মালিকানা দেওয়ার নীতি থেকে অনেক দূরে, বরং এই নীতিগুলো ছিল তাদের বর্গা অধিকার বা স্থির খাজনার চাষি হিসেবে আইনগত পরিচয়কেই দৃঢ়তর ও স্থায়ী করার উদ্যোগ।

ভূমিসংস্কার আইনের প্রয়োগ সম্পর্কে প্ল্যানিং কমিশনের এক সমীক্ষায় ধরা পড়েছে যে, জমি-চাষ পদ্ধতির সংস্কার ঘটাতে চাওয়া আইনগুলিতে কয়েকটা বিশেষ ত্রুটি থাকার দরুন ভাড়াটে চাষিদের অবস্থার কোনও পরিবর্তন ঘটেনি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে টেনান্সি আইন লঙ্ঘিত হয়েছে কারণ টেনান্সি চুক্তিগুলি আইনসম্মত পদ্ধতি মেনে করা হয়নি। বেশিরভাগ সময়েই চুক্তিগুলো ছিল মৌখিক। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই খাজনার পরিমাণ ছিল আইন-নির্দিষ্ট পরিমাণের তুলনায় অনেক বেশি। টেনান্টদের কোনও দখলি স্বত্ব ছিল না এবং তাদের কাজের স্থায়িত্ব ছিল সম্পূর্ণভাবে মালিকের ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল। উলফ লাদেজিন্সকি তাঁর পর্যবেক্ষণ থেকে সিদ্ধান্ত করেছেন, জমির ওপর খাজনায় নিযুক্ত ভাড়াটে চাষিদের দখলিস্বত্ব নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রণীত আইনটি বিশেষভাবে ব্যর্থ হয়েছে। একইভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে জমির ঊর্ধ্বসীমা আইন, সীমা-বহির্ভূত জমি ক্ষতিপূরণের বিনিময়ে অধিগ্রহণ ও ভূমিহীন বা ক্ষুদ্র চাষির মধ্যে তা পুনর্বণ্টনের আইন। ভূমিসংস্কার আইনের প্রয়োগ ও কার্যকারিতা সম্বন্ধে অনুসন্ধানের জন্য প্ল্যানিং কমিশন ১৯৭২ সালে যে টাস্ক ফোর্স নিয়োগ করেছিল তার প্রতিবেদনেও আছে অনুরূপ পর্যবেক্ষণ। অশোক রুদ্র উল্লেখ করেছেন, ধারাবাহিকভাবে প্রত্যেকটি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার শুরুতে ভূমিসংস্কার আইনগুলির অন্তর্গত দুর্বলতা এবং এগুলির প্রয়োগের ব্যর্থতা স্বীকার করা হত এবং আশা ব্যক্ত করা হত যে ভবিষ্যতে এই আইনগুলিকে ত্রুটিমুক্ত করার জন্য আইনটিতে প্রয়োজনীয় সংস্কার আনা হবে ও যথাযথ প্রয়োগ করা হবে।১০ ভূমিসংস্কার আইনের, বিশেষ করে সীমাবহির্ভূত জমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বণ্টন আইন প্রয়োগের, পরবর্তী ধাপ হওয়া উচিত ছিল সমস্ত ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক জোতের মালিকের জন্য সমবায় ব্যবস্থায় চাষপদ্ধতি গড়ে তোলা। তার জন্য যথাযথ পদক্ষেপের স্বার্থে যেসব আইনি ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল তা বরাবর অবহেলিত থেকে গেছে। সমবায় ব্যবস্থায় কৃষি-উৎপাদনের বিষয়টি আলোচনা থেকেই অন্তর্হিত হল। সমবায় কার্যকর রইল একমাত্র কৃষিঋণ ও কৃষিপণ্যের বাজার-ব্যবস্থায়। গ্রামাঞ্চলে কৃষকের ঋণ পাওয়া ও যথাযথ দামে পণ্য বাজারজাত করার ক্ষেত্রে যত সমস্যা ঘটে এর ফলে তার অতি সামান্য অংশ সমাধানের কিছুটা সুবিধা মিলেছে।

পশ্চিমবঙ্গে ১৯৭৭ সালে ক্ষমতায় এল বামজোট— সংসদীয় পথ বর্জন করা বিপ্লবী বামগোষ্ঠীগুলি বাদে অন্যান্য দলের সমষ্টি। এই সরকার ভূমি সংস্কারের কর্মসূচি নিল। এর আগেই, ১৯৫৫ থেকে ১৯৬৯-এর মধ্যে কংগ্রেসি শাসনের অধীনে ১৯৫৫-র ভূমিসংস্কার আইন বেশ কয়েকবার সংশোধিত হয়েছিল। এই সংশোধনগুলির সূত্রে বর্গাদার সংক্রান্ত আইনের প্রধান ধারাগুলিতে অন্তর্ভুক্ত কয়েকটি বিষয় ছিল এরকম: ১) ভূস্বামী যদি লাঙ্গল, বলদ, সার, বীজ ইত্যাদি উপকরণ সরবরাহ করে তাহলে মোট উৎপাদিত শস্য ভূস্বামী ও বর্গাদারের মধ্যে আধাআধি ভাগ হবে। ভূস্বামী উৎপাদন ব্যয়ের কোনও অংশ বহন না করলে মোট উৎপাদিত শস্যের শতকরা ৪০ ভাগ পাবে, শতকরা ৬০ ভাগ পাবে বর্গাদার। ২) উভয় পক্ষের সম্মতিক্রমে ধান ঝাড়ার জায়গা স্থির হবে। ৩) মালিকের বর্গা দেওয়া জমি ও নিজস্ব চাষের জমির মোট পরিমাণ বর্গাদারের মোট জমির দুই-তৃতীয়াংশের কম হলে মালিক বর্গাদারকে উচ্ছেদ করে বর্গা দেওয়া জমি পুনরায় নিজস্ব চাষের আওতায় আনতে পারে। এ ছাড়া অন্যান্য রাজ্যের মতো পশ্চিমবঙ্গেও জমির মালিকানায় ২৫ একরের ঊর্ধ্বসীমা বহাল থাকবে। এইসব সংশোধন ছাড়াও ১৯৭৫ সালে গৃহ-সংলগ্ন জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত একটি আইন প্রণীত হয় এবং সরকার তা রূপায়ণের জন্য পদক্ষেপ করে। এই আইন অনুযায়ী নিজ গৃহ-সংলগ্ন জমির পরিমাণ ০.৮ একরের বেশি হলে উদ্বৃত্ত জমি ভূমিহীন বর্গাদার ও কৃষি শ্রমিকদের মধ্যে বণ্টিত হবে, ও এই ভূমি অধিগ্রহণ করার জন্য ভূস্বামীকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে।

কিন্তু বর্গাদারদের জমির ওপর সীমিত দখলদারি থাকার ফলে ব্যাপকভাবে জমি অধিগ্রহণ চলতে থাকে। ব্যক্তিগতভাবে চাষ করার নামে বর্গাদার উচ্ছেদ করে বর্গাদারি জমি অধিগ্রহণ শুরু হয়। এই প্রবণতা রোধ করার জন্য ১৯৭৭ সালে বর্গাদারি আইনের সঙ্গে একটি নতুন ধারা যোগ করা হল, ব্যক্তিগতভাবে নিজে চাষ করার প্রয়োজনে বর্গাদার উচ্ছেদ করার অধিকারটি পুনরায় নতুনভাবে সংজ্ঞাবদ্ধ করা হয়। এই নতুন ধারা অনুযায়ী বর্গাদারকে তখনই উচ্ছেদ করা যাবে যখন ১) ভূস্বামী বর্গাদারি জমির এলাকাতেই বাস করে, ২) ভূস্বামী নিজেই, অথবা তার পরিবারের কোনও ব্যক্তি, জমি চাষ করে, ৩) জমি থেকে উপার্জনই তার আয়ের প্রধান উৎস। ৪) এই জমি অধিগ্রহণের পরে ন্যূনতম ২/৫ একর জমি বর্গাদারের হাতে থাকে।

এছাড়া আইনের সাহায্য নেওয়ার পথে পশ্চিমবঙ্গে ভাগ-চাষিরা যেসব প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়ত তা দূর করার লক্ষ্যে ভাগ-চাষি হিসেবে তাদের নাম রেজিস্ট্রি করার উদ্যোগ নেওয়া হল রাজ্যব্যাপী অপারেশন বর্গা কর্মসূচির মাধ্যমে। এটি ছিল আসলে বর্গাদারদের জন্য আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করার একটি পদক্ষেপ।

ওপরের আলোচনায় বিভিন্ন দেশের ভূমিসংস্কারের সঙ্গে ভারতীয় ভূমিসংস্কারের তফাত স্পষ্ট ধরা পড়ছে। জাপানের ভূমিসংস্কারের থেকে এর তফাত এইখানে যে, এর কোথাও দেশের কৃষি-অর্থনীতিকে প্রাক্‌পুঁজিবাদী বৈশিষ্ট্য থেকে মুক্ত করে তাকে পুঁজিবাদী উৎক্রমণের উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হয়নি। ব্রিটিশ শাসনে গ্রামাঞ্চলের সামাজিক ভিত্তি ছিল যে জমিদার-শ্রেণি, তার অবস্থানে আঘাত হানা হলেও পুরনো প্রাক্‌পুঁজিবাদী ভূমি-সম্পর্ক ও এই ভূমি-সম্পর্কের ধারক মহাজন-ব্যবসায়ী শ্রেণি থেকে উদ্ভূত জোতদার শ্রেণির প্রভাব-প্রতিপত্তি ভাঙার উপযোগী কোনও ব্যবস্থা এতে ছিল না। জমির ঊর্ধ্বসীমা ও সীমা-বহির্ভূত জমির অধিগ্রহণ ও পুনর্বণ্টনের কর্মসূচি রূপায়ণের ক্ষেত্রে দৃঢ়তার অভাব ছিল। অর্থাৎ ভারতের কৃষি-অর্থনীতিকে একটি প্রগতিশীল উৎপাদন ব্যবস্থায় পরিণত করার পথে যেসব বাধা ছিল তা অপসারণের জন্য সংস্কারকদের বিশেষ আগ্রহ ছিল এমন কোনও প্রমাণ মেলে না। মহাজনি ও ব্যবসায়িক পুঁজির দাপট থেকে কৃষি উৎপাদন-ব্যবস্থাকে মুক্ত করে তাকে স্বাধীন ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করার উপযুক্ত কোনও কর্মসূচি নেওয়া হয়নি। দীর্ঘকাল ধরে জমির ঊর্ধ্বসীমা বেঁধে রেখেও ছোট অসংগঠিত কৃষিকে সমবায় সংগঠনের মাধ্যমে বড় চাষের সুবিধা জোটানো যায়নি। ক্ষুদ্র কৃষি-অর্থনীতিকেও স্বাধীনভাবে চলতে দেওয়ার জন্য যে-সরকারি সহযোগিতার প্রয়োজন ছিল তা ধীরে ধীরে কমানো হয়েছে। সরকারি ঋণ প্রদান ব্যবস্থা, কৃষিপণ্যের সরকারি বিপণন, কৃষি উপকরণের সরকারি জোগান, সব ব্যবস্থাকেই ধীরে ধীরে সংকুচিত করে আনার নীতি নেওয়া হয়েছিল। ক্ষুদ্র চাষ-নির্ভর কৃষি-অর্থনীতি ছিল দুর্বল। তাই সহজেই তা কৃষি-উপকরণের জোগানদাতা পণ্যের, কৃষি-উপকরণের ও ঋণের বাজারের সম্মিলনে উদ্ভূত শোষণের শিকার হয়, কর্পোরেট পুঁজির সামগ্রিক কর্তৃত্ব তাদের শোষণ করতে থাকে। তার উৎপাদিত উদ্বৃত্তের একটি বড় অংশ এই প্রক্রিয়ায় কৃষির বাইরে চলে যেতে থাকে।

কৃষি উপকরণের অস্বাভাবিক দাম, তুলনায় ফসলের দাম যথেষ্ট না মেলায় কৃষি ক্রমশ অলাভজনক উৎপাদন ক্ষেত্রে পরিণত হয়। উপরন্তু খোলা বাজার-অর্থনীতির নিয়মে ভারতীয় কৃষি বাইরে থেকে আমদানি করা, ভরতুকি সংবলিত, সস্তার পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ক্রমশ হঠে যেতে থাকে। আমরা পরবর্তী অধ্যায়গুলিতে এই বিষয়গুলির অবতারণা করব।

তথ্যসূত্র

১. Simon Commission Report 1928, H. D. Malavy Land Reforms In India. Indian National Congress. New Delhi. 1955.

২. Report of the committee of the Panel of Land Reforms, under the agrarian reform committee.

৩. “…no single uniform method of land utilisation can meet the requirements of the situation” and “…the future pattern of the agrarian economy shall be flexible” – Reports of the committee of the Panel of Land Reforms.

৪. Ladejinsky, W. (1972) “Land Ceiling and Land Reform.” Economic and Political Weekly. vol 7 no 5/7.

৫. Planning Commission task Force report 1973.

৬. Rao, S. K. 1971. “Inter-Regional Variations in Agriculture Growth, 1952–53 to 1964–65: A tentative Analysis in Relation to Irrigation.” EPW. vol 6, no 7.

৭. Sharma, P. S. 1965. “A Study of Structural and Tenurial Obstacles of Rural India on the basis of 1961 census.” Indian Journal of Agriculture Economics.

৮. Ladejinsky, W. (1972) “Land Ceiling and Land Reform.” Economic and Political Weekly. vol 7 no 7.

৯. Planning commission Taskforce report 1973.

১৹. Rudra, A. 1992. A Political Economy of Indian Agriculture. K.P Bagchi & Company.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *