দশম অধ্যায়
অর্থনৈতিক সংস্কার, বিশ্বায়ন ও ভারতীয় কৃষি
অর্থনৈতিক সংস্কার
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মিত্রশক্তির অন্তর্ভুক্ত সবচেয়ে বড় ইউরোপীয় দেশগুলি ১৯৪৪ সালে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ব্রেটনউডস সম্মেলনে মিলিত হয়ে একটি নতুন আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সূচনা করে। দু’টি বিশ্বযুদ্ধই প্রমাণ যে, বিশ্বের সবচেয়ে বড় পুঁজিবাদনির্ভর ক্ষমতাগুলির মধ্যে বাজারের জন্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্র খুঁজে পাওয়ার জন্য তীব্র প্রতিযোগিতা এত বিপজ্জনক চেহারা নিতে পারে যে তা শেষপর্যন্ত হিংস্র বিরোধিতার রূপ নেয়, চরম রাজনৈতিক বিরোধ ও সশস্ত্র উপায় ছাড়া সমাধানের অন্য কোনও পথ থাকে না। এই অভিজ্ঞতা এটাও দেখিয়েছিল যে, যুদ্ধ হোক বা শান্তি, কোনও দেশের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক নীতিগুলি মূলত সবচেয়ে শক্তিশালী পক্ষের স্বার্থরক্ষার্থেই রচিত হয়ে থাকে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে প্রধান ইউরোপীয় দেশগুলি এবং জাপান বিরাট ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়ে, আমেরিকা বৃহত্তম শক্তিধর দেশ হিসেবে পুঁজিবাদী দুনিয়ার ভবিষ্যৎ পুনর্গঠনের ও পুঁজিবাদী ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা রক্ষার্থে উপযুক্ত নীতি গ্রহণের দায়িত্ব নিয়ে নেতৃত্বব্যঞ্জক ভূমিকায় আত্মপ্রকাশ করে। একটি শক্তিশালী, দৃঢ়সংযুক্ত, অধিক ভারসাম্য যুক্ত পুঁজিবাদী ব্যবস্থার প্রয়োজন অনুভূত হতে থাকে। তখন মাঝারি অর্থনৈতিক অবস্থায় থাকা সমস্ত পুঁজিবাদী দেশকে বা প্রাক্পুঁজিবাদী, সদ্য স্বাধীন হওয়া এশিয়া-আফ্রিকা-লাটিন আমেরিকার দেশগুলিকে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার চৌহদ্দির মধ্যে বেঁধে রেখে আন্তর্জাতিক পুঁজির প্রভাবাধীন অঞ্চল সৃষ্টি করা এবং তাকে টিকিয়ে রাখার প্রয়োজন দেখা দেয়। এই প্রেক্ষাপটে উদ্ভূত অবস্থার দাবি মেটাতে গিয়ে আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার ও বিশ্বব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে শৃংখলা বজায় রাখার প্রয়োজনে উপযুক্ত প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো নির্মাণের ঘোষিত উদ্দেশ্য নিয়ে ১ জানুয়ারি ১৯৪৮-এ ‘শুল্ক ও বাণিজ্য সংক্রান্ত সাধারণ সম্মতি’ বা ‘গ্যাট’ তৈরি হয়। বিশ্বায়ন কর্মসূচির দু’টি প্রধান দিক আছে। প্রথমত এটি আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার ও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা নির্দেশিত আর্থিক ভারসাম্য রক্ষা ও অর্থনীতির কাঠামোগত উদারীকরণ কর্মসূচি। এটি অর্থনীতির বিশ্বায়ন ঘটায় ও সেই পরিপ্রেক্ষিতে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির ক্ষেত্রে খোলা-বাজার নীতিকে অনুসরণ করার নির্দেশ দেয়। এর দ্বিতীয় অঙ্গ হল বাণিজ্য সংক্রান্ত নানা নীতি, যার প্রণেতা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা, এবং তা এর অন্তর্ভুক্ত সভ্য দেশগুলির ওপর প্রযোজ্য। এর মধ্যে প্রথমটি, অর্থাৎ বিশ্বায়ন কর্মসূচি এবং কৃষির ওপর এই নতুন বিশ্বায়ন কর্মসূচির প্রভাব নিয়ে আমরা এই অধ্যায়ে আলোচনা করব, দ্বিতীয় দিকটি অর্থাৎ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার জারি করা বাণিজ্য সংক্রান্ত নীতিগুচ্ছ এবং ভারতীয় কৃষি অর্থনীতির ওপর তার প্রভাব নিয়ে আলোচনা থাকবে পরবর্তী অধ্যায়ে।
ভারতে স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রথম চার দশকের উন্নয়ন ছিল সরকারি সহযোগিতার উপর নির্ভরশীল। পরিকল্পিত উন্নয়নের নীতি মেনে ভারী ও বুনিয়াদি শিল্প, মূলধনি দ্রব্য-উৎপাদন শিল্প, মূল ধাতু প্রক্রিয়া-করণ শিল্প এবং তার সঙ্গে শিল্পের জন্য উপযুক্ত পরিকাঠামো নির্মাণ, কাঁচামাল প্রস্তুত ইত্যাদি যা-কিছু শিল্প উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য, সেসবের উন্নতিতে সরাসরি নিয়ন্ত্রণ ও সরকারি বিনিয়োগ চালু ছিল। পঞ্চাশের দশকের শুরুতে প্রথম পরিকল্পনাকালে গ্রামীণ উন্নয়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মসূচি নেওয়া হয়েছিল। একই সঙ্গে ভূমিসংস্কারেরও সূচনা করা হয়। দ্বিতীয় পরিকল্পনা কর্মসূচিতে সরকারি বিনিয়োগে ও সরকারি উদ্যোগে ভারী শিল্পগুলির পত্তন ও সম্প্রসারণ হয়। এর সঙ্গে কৃষি-উন্নয়নের জন্য ভারী সেচ প্রকল্পগুলির সূচনা ও উন্নয়নের কর্মসূচিগুলি রূপায়িত হতে থাকে। কিন্তু এ সত্ত্বেও ভারী সেচ এলাকাগুলির বাইরে বিস্তীর্ণ এলাকা চাষের জন্য বৃষ্টির ওপরই নির্ভরশীল থাকে। এরপর ষাট ও সত্তরের দশকে অর্থনীতির সমস্ত ক্ষেত্রে সরকারি নিয়ন্ত্রণ বিস্তৃত হতে থাকে। পরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মসূচি রূপায়ণের স্বার্থে বিভিন্ন পর্যায়ে সরকারি নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা জোরদার করার প্রয়োজন পড়ে ও নানা প্রকার আইনি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। সেগুলি হল: একচেটিয়া কারবার ও ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ আইন ও লাইসেন্সিং ব্যবস্থা, দেশের মধ্যে এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে পণ্যের স্বাভাবিক চলাচলের ওপর বাধানিষেধ, বিভিন্ন কৃষিপণ্যের – বিশেষ করে খাদ্যের, বাজার-চালিত কেনা-বেচার ওপর আংশিক নিয়ন্ত্রণ রেখে সরকার কর্তৃক ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের বিনিময়ে খাদ্যপণ্যের সংগ্রহ, তাকে গুদামজাত করে রেশনিং ব্যবস্থার মাধ্যমে বিতরণ ব্যবস্থা, বৈদেশিক বাণিজ্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখার জন্য বিদেশি মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইন, শুল্ক আইন ইত্যাদি। বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আমদানির ওপর নির্ভরতা কমানোর জন্য নানা নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা রূপায়িত হয়েছিল, যেমন, অভ্যন্তরীণ উৎপাদন-ব্যবস্থার সাহায্যেই ভেতরকার চাহিদা মেটানোর জন্য দেশে জোগান আছে এমন পণ্যের আমদানির ওপর কড়া নিয়ন্ত্রণ রাখা হয়, বিশেষ বিশেষ পণ্য আমদানির ঊর্ধ্বসীমা বেঁধে দেওয়া হয়। দেশের প্রধান প্রধান বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলিকে জাতীয়করণের মাধ্যমে কৃষি-সহ কয়েকটি বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে ঋণদানের পদ্ধতি সহজতর করা হয়। এইভাবে অর্থনীতির বিভিন্ন দিকে সরকারি নিয়ন্ত্রণ ও সরকারি নিয়ন্ত্রণের আওতায় উন্নয়নই ছিল স্বাধীনতা-উত্তর ভারতের প্রথম চার দশকের অর্থনৈতিক বৈশিষ্ট্য। কিন্তু এই বন্ধ-দ্বার অতিরিক্ত সরকারি নিয়ন্ত্রণের ওপর গড়ে ওঠা অর্থনীতিতে প্রথমে অতিরিক্ত জোর ছিল মূল ও ভারী শিল্পের ওপর। পরে ’৮০-র দশক থেকে, ইতিপূর্বে বিদেশ থেকে আমদানি করা হত যেসব বিলাসদ্রব্য সেগুলির উৎপাদনের ওপর জোর পড়ে। এগুলি উচ্চপ্রযুক্তি-নির্ভর, উচ্চ আয়ের মানুষের ব্যবহারের জন্য নির্মিত এবং তুলনামূলকভাবে স্থায়ী। একই সঙ্গে কৃষি ও সাধারণ মানুষের নিত্যব্যবহার্য শিল্পজাত ভোগ্যপণ্যের উৎপাদন অবহেলিত হতে থাকে। এর পরিণামে দেশে খাদ্যাভাব ও মূল্যবৃদ্ধি দেখা দেয়, পরপর সরকারি বাজেটে বিপুল ঘাটতি প্রকট হয়, দেশের বৈদেশিক মুদ্রাভাণ্ডারেও ঘাটতি ধরা পড়ে। এই পরিস্থিতি সরকারের বৈদেশিক ঋণের বোঝা বাড়িয়ে তোলে। সুদ ও ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা বাইরে বেরিয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত ’৯০-এর দশকের গোড়ায় দেশের অর্থনৈতিক পরিচালনা সংক্রান্ত নীতিগুলির মূল বৈশিষ্ট্যে পরিবর্তন ঘটানোর শর্তে এবং ঘাটতি ব্যয় কমানো, টাকার অবমূল্যায়ন ইত্যাদি কয়েকটি শর্ত মেনে নিয়ে ভারত সরকার আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডারের কাছে বিপুল ঋণ নেয়। ভারতে এতদিন ধরে মেনে আসা নীতিগুলো আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডারের নির্দেশে বদলে ফেলার প্রভাব দেশের অর্থনীতিতে কীভাবে এসে পড়ল তা বোঝার আগে আমরা দেখব অভ্যন্তরীণ কোন পরিস্থিতিতে এই নতুন নীতিগুচ্ছ অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল।
স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে যে-বৈচিত্রপূর্ণ ও বিস্তৃত সনাতন শিল্পভিত্তি গড়ে উঠেছে তার মূলে ছিল পূর্ববর্তী বন্ধ-দ্বার নীতির সঙ্গে গৃহীত সরকারি বিনিয়োগ ও সহযোগিতার নীতি। কিন্তু দেশে যে-উন্নয়ন পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল তা দেশের অবস্থার সাপেক্ষে আদৌ সাযুজ্যপূর্ণ ছিল না। ইস্পাতশিল্পের মতো বুনিয়াদি ধাতুশিল্পগুলি এবং ভারী যন্ত্রপাতি নির্মাণের ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পের প্রসারের ফলে কৃষি থেকে কিছু পরিমাণ মানুষের বহির্গমন ঘটে ও শহরে কিছু মাত্রায় কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়, কিন্তু বেকারত্বের বিপুলতার তুলনায় এর সুযোগ এতটাই কম ছিল যে, তা বেকারত্ব নিরসনে তেমন ফল দেয়নি। দ্বিতীয়ত, একটি শ্রমিক-উদ্বৃত্ত দেশে, যেখানে পুঁজির অভাব আছে, যেখানকার বাজারে শ্রমিকের মজুরি কম, তুলনায় পুঁজির দাম বা সুদ বেশি, সেখানে শ্রম ও পুঁজির আনুপাতিক ব্যবহার কাম্য, এবং শ্রম-ঘন উৎপাদন-প্রক্রিয়া অনুসরণ করে শ্রমনির্ভর উৎপাদন-কাঠামো গড়ে তোলার নীতিই শ্রেয়। আমাদের দেশের সরকার এই শ্রম-ঘন উৎপাদন-কাঠামো গড়ার কোনও পরিকল্পনা নেয়নি। পরিবর্তে তারা একদিকে অত্যন্ত পুঁজি-ঘন উৎপাদন প্রক্রিয়া অনুসরণ করে পুঁজিনির্ভর মূলধনি পণ্য উৎপাদন করতে নামে, সে জন্য বিশাল উৎপাদন-কাঠামো গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেয় ও পাশাপাশি গ্রামীণ ছোট উৎপাদন-ক্ষেত্র গড়ে তুলে বেকার সমস্যার সমাধান করতে চায়। দেশের মধ্যে বিশেষ বিশেষ মূলধনি পণ্যগুলির জোগান সস্তায় সুনিশ্চিত করার জন্য আমদানি শুল্ক কমিয়ে মূল যন্ত্রপাতি ও উৎপাদন-কাঠামোর অংশ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানির কর্মসূচি নেওয়া হয়। অন্যদিকে ন্যূনতম মজুরি সুনিশ্চিত করার জন্য সরকারের ওপর বিশাল ভরতুকির বোঝা চাপে। এসবের পরিণামে একদিকে বৈদেশিক বাণিজ্যে ঘাটতি দেখা দেয় ও বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডারে চাপ পড়তে থাকে। অন্যদিকে সরকারের বার্ষিক আয়-ব্যয়ের হিসাবে ঘাটতি পূরণের ব্যয় বাড়তে থাকে, ফলে দেশে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়। একই সঙ্গে শিল্পোৎপাদনে অতিরিক্ত জোর দেওয়া ও কৃষি-উৎপাদনের সমস্যাগুলির দিকে তুলনায় কম নজর পড়ায় কৃষি ও শিল্পের মধ্যে সাযুজ্যের অভাব ঘটে, কৃষিজ পণ্যের চাহিদার তুলনায় জোগান অপ্রতুল হয়ে পড়ে। একদিকে বিদেশ থেকে আমদানি করা পুঁজি-ঘন যন্ত্রপাতির ব্যবহারে তৈরি বুনিয়াদি স্থির পুঁজি-কাঠামো (Basic fixed plant and machinery), অন্যদিকে দেশে পাওয়া যায় এমন যন্ত্রাংশ বা ছোট যন্ত্রপাতির ব্যবহার। ‘দেশে পাওয়া যায় সুতরাং বিদেশ থেকে আমদানি করা যাবে না’— এই নীতির ফলে দেশে ক্ষুদ্রায়তনে তৈরি প্রতি ইউনিট যন্ত্রপাতি অত্যন্ত ব্যয়বহুল হয়ে ওঠে। এর ফলে দেশে একটি ব্যয়বহুল শিল্প-কাঠামোর সৃষ্টি হল, এবং সেই শিল্পে তৈরি পণ্য আন্তর্জাতিক বাজারে লভ্য পণ্যের তুলনায় অত্যধিক ব্যয়সাপেক্ষ হওয়ায় সেসব রফতানির সুযোগও সীমিত হয়ে থাকল। দেশের ভেতর ব্যবহারের ফলে ব্যয়বহুল উৎপাদন কাঠামোটি আরও অদক্ষ কাঠামোতে পর্যবসিত হল। আবার বিদেশ থেকে আমদানিকৃত বিশাল মূল শিল্প-কাঠামোর ভারী যন্ত্রপাতিগুলির উৎপাদন-ক্ষমতা অত্যন্ত বেশি, অথচ আমাদের দেশে তখনও অবধি ভারী ইস্পাতশিল্পে প্রস্তুত বড় বড় পণ্যের চাহিদা তৈরি হওয়ার মতো যথেষ্ট ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প গড়ে না ওঠায় বড় বড় মূল ভারী শিল্পগুলিতে যে-স্থির পুঁজি-কাঠামো তৈরি হল তার উৎপাদন-ক্ষমতার বেশির ভাগ অংশই রইল অব্যবহৃত। ফলে ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পে ব্যবহারের জন্য যেসব যন্ত্রপাতি তৈরি হত সেগুলির ক্ষেত্রে একক-পিছু স্থির ব্যয় দাঁড়াত অত্যন্ত বেশি। এই যন্ত্রগুলোর বাজার-দাম ছিল বেশি, এবং বন্ধ-দ্বার নীতির কারণে এই ব্যয়বহুল যন্ত্রপাতিগুলোই শুধু ব্যবহার করা যেত, বিদেশ থেকে আমদানি করা সম্ভব কোনও অপেক্ষাকৃত সস্তার যন্ত্র আমদানি করা যেত না। এইভাবে ভারতে সামগ্রিকভাবে একটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল শিল্পকাঠামো তৈরি হল। অনেকে মনে করেন এটি ভুল আমদানি নীতি এবং শিল্পনীতি অনুসরণ করার ফল। অন্যদিকে ভারী শিল্পে ব্যবহারের মূল কাঠামোর সঙ্গে যুক্ত ভারী যন্ত্রগুলি বিদেশ থেকে আনতে গিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডারে জমে ওঠে বিশাল ঋণ। প্রতিবছর ঋণের ওপর সুদ ও আসলের অংশ মেটানোর বাধ্যবাধকতার ফলে দেশ থেকে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা বাইরে চলে যেতে থাকল।
অতি দ্রুত একটি শক্ত শিল্পভিত্তির ওপর ভারতীয় অর্থনীতিকে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যকে রাখা হয়েছিল সবার সামনে। ফলে একদিকে কৃষি-উৎপাদনে পরিবর্তন আনার প্রয়োজন রয়ে গেল অবহেলিত, অন্যদিকে শহরাঞ্চলে খাদ্যের চাহিদা বাড়ল। এইসময়েই আমেরিকার পিএল ৪৮০ নীতি অনুসারে সাহায্য হিসেবে যে-খাদ্য দেওয়া হচ্ছিল তা বন্ধ হয়, ফলে তীব্র খাদ্যাভাব দেখা দেয়। এসবের পরিণামে দ্রুত খাদ্যের দাম বাড়ে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সবুজ বিপ্লব কর্মসূচি আংশিকভাবে কিছু বিশেষ শস্য, যেমন গমের ক্ষেত্রে উৎপাদন যথেষ্ট বাড়ালেও প্রাথমিকভাবে এর প্রভাব ছিল সীমিত। দেশের সব অঞ্চলে সব শস্যের ক্ষেত্রে এর কোনও প্রভাব ছিল না। ’৬০-এর দশকের শেষভাগ থেকে ’৭০-এর দশকের মধ্যভাগ অবধি শিল্পক্ষেত্রে একই সঙ্গে মন্দা, মুদ্রাস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডারে দ্রুত ক্ষয় শুধু ভারত নয় গোটা তৃতীয় বিশ্বের অর্থনীতিকে প্রভাবিত করে। অবশ্য ইতিমধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিতে ভারতের রফতানি বাড়ায়, বিশেষ করে ভারতের শ্রমিকেরা ওই দেশে প্রচুর সংখ্যায় পাড়ি দেওয়ার ফলে বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডারে প্রচুর পেট্রো ডলারের আগমন ঘটে। ’৭০ দশকের গোড়ায় মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে দেনা-পাওনার খাতে আমাদের দেশ বহুদিন পর অপেক্ষাকৃত সুবিধার জায়গায় এসেছিল। কিন্তু এই অবস্থা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। দ্বিতীয় ও তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় অনুসৃত শিল্পনীতির প্রধান উপাদান বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্পগুলির সঙ্গে যুক্ত বৈদেশিক সাহায্য হিসেবে কিছু বিদেশি মুদ্রা এসেছিল বটে, কিন্তু বিদেশ থেকে বড় শিল্প-কাঠামোর যে-অংশগুলি আমদানি করা হয়েছিল পরবর্তী অনেক বছর ধরে, সেই খাতে বিদেশি মুদ্রা বেরিয়ে যেতে থাকে। ক্রমে বাণিজ্য-ঘাটতি বিপুল আকার ধারণ করলেও দেশে যেহেতু ইতিমধ্যে আমদানি-নির্ভর উৎপাদন-কাঠামো তৈরি হয়ে গেছে, তা সচল রাখার স্বার্থেই বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবহার কমানো সম্ভব ছিল না। ফলে বিপুল পরিমাণ ডলারের সংস্থানের জন্য দেশকে নির্ভর করতে হচ্ছিল আন্তর্জাতিক মুদ্রা ভাণ্ডারের কাছে। এর পরিণাম হল এই যে, আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডারের নির্দেশে দেশের মুদ্রার সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বদলে ফেলে ভারতীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন ঘটাতে হল এবং ’৮০-র দশকের গোড়ায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা ভাণ্ডারের কাছ থেকে পাওয়া বৈদেশিক মুদ্রার বিপুল পরিমাণ ‘সাহায্য’ এবং তার সঙ্গে যুক্ত শর্তাবলি দেশে অনুসৃত শিল্প ও বৈদেশিক বাণিজ্য-সংক্রান্ত নীতিকে প্রভাবিত করল। ’৮০-র দশকের মাঝামাঝি থেকে এমনকী রাসায়নিক এবং ইলেকট্রনিক বিলাসপণ্যগুলি, বা এইসব শিল্পে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতিগুলিও বিদেশ থেকে আমদানির ক্ষেত্রে বাধানিষেধ শিথিল করা হয়। দেশে মূল ও ভারী শিল্পগুলির জায়গায় মোটর গাড়ি উৎপাদন এবং রেফ্রিজারেটর, বা টেলিভিশনের মতো বিলাস-দ্রব্যের উৎপাদন বহুল পরিমাণে বাড়ানো হয়, এইসব শিল্পে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি বিদেশ থেকে আমদানির পরিমাণ বহুগুণ বৃদ্ধি পেতে থাকে। ’৭০-এর দশকের শেষ থেকে ’৮০-র দশক জুড়ে সবুজ বিপ্লবের বহু বিলম্বিত ফল পাওয়া যেতে থাকে, ফলে কৃষি-উৎপাদনে লক্ষণীয় বৃদ্ধি ঘটে। এর আগেই ভারত কৃষিতে স্বয়ংভরতা অর্জন করেছিল। কৃষিক্ষেত্রে এই পরিবর্তন শিল্পক্ষেত্রে বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে সহায়তা করল, কিন্তু সরকারি বাজেটে বিপুল পরিমাণ ঘাটতি এড়ানো সম্ভব ছিল না। একই সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডার আবার দ্রুত ক্ষয় হতে থাকে। ’৫০, ’৬০, ’৭০-এর দশকে যদিও মূলধনি উৎপাদনশীল ভারী শিল্পে বিনিয়োগের ফলে দেশের শিল্পভিত্তি নির্মিত হয়েছিল, কিন্তু ’৮০-র দশকের মূল বিনিয়োগ ঘটল ভারী বিলাস-দ্রব্য, মোটর গাড়ি, ইলেকট্রনিক দ্রব্যের নির্মাণে। এই শিল্পগুলি পুনরায় বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ার মতো মূলধনি পণ্যের জোগান বাড়ায় না। উচ্চবিত্ত ধনীর ভোগ্যপণ্য বাড়ায় কেবল। এই নতুন প্রসারিত শিল্পকাঠামো অধিক আয়ের মানুষের ভোগের জন্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের উৎপাদনে ব্যবহৃত হতে থাকল। দেশের উৎপাদন-উপকরণ এবং দুর্মূল্য বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়ে বিদেশ থেকে আমদানি করা উপাদান ব্যবহার করে তৈরি এই শিল্প-কাঠামোতে অধিক শ্রম ও দেশীয় সাধারণ যন্ত্রপাতি-নির্ভর পণ্যের উৎপাদন অবহেলিত থেকে গেল, যে-পণ্য হয়তো দরিদ্র মানুষের ভোগের উপযোগী হত। ভারী শিল্প-কাঠামোটি দেশের ব্যবহার্য সম্পদের তুলনায় অত্যধিক মূলধনি বিনিয়োগ-নির্ভর বিলাস-দ্রব্যের উৎপাদনে অত্যধিক জোর দেওয়ায় সাধারণ মানুষের ব্যবহার্য পণ্যের চাহিদাও থাকে সীমিত। নতুন শিল্পপণ্যগুলির অধিকাংশের উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন কেমিক্যালস ও ইলেকট্রনিক্স এবং তা বিদেশি মূলধন ও প্রযুক্তি-কাঠামোনির্ভর, ফলে তা দেশের অভ্যন্তরে শ্রমের যথেষ্ট নিয়োগ ঘটায় না। এর ফলে এইসব পণ্যের উৎপাদন ব্যবস্থার প্রসারের সঙ্গে চাহিদা-কাঠামোও বিস্তৃত হয় না। একদিকে, মুষ্টিমেয় ধনী ব্যক্তির চাহিদার বিস্তার সীমাবদ্ধ থাকে, অন্যদিকে দেশের অধিকাংশ মানুষের ভোগের উপযোগী পণ্যের চাহিদার ক্রমাগত বৃদ্ধির পথও থাকে সীমাবদ্ধ। ফলে অভ্যন্তরীণ বাজারের ক্রমবর্ধমান বিস্তারের সুযোগ তৈরি হয় না, এবং শিল্পোৎপাদন বৃদ্ধিতে অভ্যন্তরীণ বাজারের সীমাবদ্ধতা একটি বড় বাধার সৃষ্টি করে। কৃষিতে উদ্বৃত্ত মানুষ নিযুক্ত থাকায় মাথাপিছু আয় খুব কম থাকে, ফলে কৃষিক্ষেত্রেও যথেষ্ট পরিমাণে শিল্পোৎপাদিত পণ্য বিক্রির মতো অবস্থা তৈরি হয় না এবং অভ্যন্তরীণ বাজারের প্রসার ঘটে না। আবার শিল্পোৎপাদিত পণ্যগুলির উৎপাদন-ব্যয় বেশি, কাজেই আন্তর্জাতিক বাজারে ভারতের শিল্পপণ্যের প্রতিযোগিতার ক্ষমতা কম। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে ভারতের নতুন শিল্পজাত পণ্যগুলি বিক্রির সুযোগও সীমিত। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, কৃষিক্ষেত্র থেকে মানুষকে শিল্পক্ষেত্রে সরিয়ে আনার সুযোগ সীমিত। কৃষিপণ্যের দাম বাড়তে পারে না, অথচ কৃষিতে ব্যবহৃত শিল্পোৎপাদিত উপকরণের দাম বাড়ে। কৃষিতে ব্যবহৃত রাসায়নিক সার, বীজ, কীটনাশক ব্যবসায়ীদের প্রভাব বাড়ে। এই অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্যেই বিপুল সরকারি ব্যয়ের বৃদ্ধি ও স্থায়ী ভোগ্যপণ্য বা ভারী বিলাস-দ্রব্য উৎপাদনে ব্যবহৃত আধুনিক প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতির আমদানি বৃদ্ধির ফলে একদিকে সরকারি বাজেটে ঘাটতি ব্যয়ের পরিমাণে, অন্যদিকে বৈদেশিক বাণিজ্যের লেনদেনে বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতির পরিমাণে বিপুল বৃদ্ধি ঘটে। সরকারকে নানা উৎস থেকে ঋণ নিয়ে এই ঘাটতি পূরণের চেষ্টা করতে হয়। সমস্ত সরকারি উৎসগুলি নিঃশেষিত হওয়ায় এমনকী বাণিজ্যিক উৎসগুলি থেকেও সরকার চড়া সুদ ও অসুবিধজনক শর্তে ঋণ নিতে বাধ্য হয়। ক্রমে ঋণের পরিমাণ এত বাড়ে যে, দেখা যায় কোনও উৎস থেকেই ঋণ পাওয়া অসম্ভব। এই অবস্থায় আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডারের নির্দেশে ভারত সরকার আবার দেশি মুদ্রার অবমূল্যায়ন করতে বাধ্য হয় এবং দেশের অর্থনীতি ও আর্থিক ব্যবস্থাপনার ব্যাপারে নতুন শর্তাবলি মেনে নেওয়ার শর্তে ১৯৯১ সালের জুলাই মাসে আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডারের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ঋণ পায়। বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার যে-বিশ্বায়নের কর্মসূচি চালু করার শর্ত জারি করে তার মূল কথা ছিল অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে অর্থনীতির প্রতিটি বিভাগে বেসরকারিকরণের নীতি ও খোলামেলা বাজার-অর্থনীতির প্রয়োগ। সেইসঙ্গে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য-নীতির ক্ষেত্রে মুক্ত-বাণিজ্যের আবহাওয়া এনে বৈদেশিক বাণিজ্য ও বৈদেশিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সমস্ত ধরনের বাধানিষেধের অবসান ঘটানো এবং তার মাধ্যমে একটি রফতানিমুখী অর্থনীতি চালু করা।
’৮০-র দশক থেকেই সারা বিশ্বের প্রধান প্রধান পুঁজিবাদী দেশগুলি ‘ওয়াশিংটন মতৈক্য’ নামক নতুন নীতিগুচ্ছ অনুসরণ করে আসছিল। তাদের প্রভাবাধীন অপেক্ষাকৃত কম উন্নত এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার দেশগুলিকেও এই নীতিগুচ্ছ চালু করার পক্ষে আনার উদ্যোগ চলেছিল। এই নীতির মূল কথা ছিল, অর্থনীতিতে ব্যক্তিগত ও বেসরকারি উদ্যোগের রাস্তা খুলে দেওয়া, বাজার-অর্থনীতির ভূমিকাকে আরও ব্যাপক ও গভীর করে তোলা। ভারতের অর্থনীতি ’৮০-র দশকের শেষে যে-সংকটের মধ্যে পড়েছিল, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পিছিয়ে-পড়া দেশগুলি কিছু সময়ের ব্যবধানে একইরকম অবস্থায় পড়ে। এইসব দেশ তাদের অর্থনীতির কাঠামোর সবদিকে পরিবর্তন আনার জন্য যে-সংস্কার কর্মসূচি নিয়েছিল তারও মূল কথা একই: সরকারি উদ্যোগ কমিয়ে ব্যক্তিগত ও বেসরকারি উদ্যোগের পথ খুলে দেওয়া। বৈদেশিক বাণিজ্য ও বৈদেশিক বিনিয়োগের পথ প্রশস্ত করা, বিদেশি পুঁজির যাতায়াতের রাস্তার বাধাগুলি দূর করে এই আদানপ্রদানের প্রক্রিয়াকে যতটা সম্ভব মসৃণ করা এবং এইভাবে উদারীকরণের মধ্য দিয়ে প্রতিটি দেশের অর্থনীতিকে বিশ্ব-বাজারের সঙ্গে যুক্ত করা।
বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডারের নির্দেশে অর্থনৈতিক উদারীকরণের মধ্য দিয়ে বিশ্বায়নের কর্মসূচি রূপায়িত করার এই পথটি পৃথিবীর প্রায় সব দেশকেই প্রভাবিত করে। ভারতে ১৯৯১ সালে এই নীতি গৃহীত হয় ও তারপর তা বিভিন্ন দফায় রূপায়িত হতে থাকে। অর্থনৈতিক সংস্কার ভারতীয় কৃষিতে বিশেষ প্রভাব ফেলে। এই সংস্কারের দু’টি প্রধান কর্মসূচি ছিল, কাঠামোগত পরিবর্তনের সূচি ও আর্থিক ভারসাম্য বজায় রাখার সূচি। প্রথম কর্মসূচিটির মূল নীতি ছিল, প্রথমত সরকারি ব্যয় হ্রাস, দ্বিতীয়ত অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারি হস্তক্ষেপ কমানো ও বেসরকারি উদ্যোগের ওপর বাধানিষেধ ধীরে ধীরে কমিয়ে এনে বেসরকারি উদ্যোগকে মদত দেওয়া। তৃতীয়ত, বৈদেশিক বাণিজ্যের ওপর বাধানিষেধ কমানো এবং বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়-হার নির্ণয় সংক্রান্ত প্রশ্নগুলিকে পুরোপুরি বাজারের হাতে ছেড়ে দেওয়া। সেইসঙ্গে ব্যাংক-ব্যবস্থাকে আরও প্রতিযোগিতামূলক করে তোলার জন্য ব্যাংকগুলিকে কৃষক ও জনগণের সহায়ক হিসেবে কাজ করার চেয়েও এক-একটি লাভজনক দক্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার ওপর বেশি জোর দেওয়া হয়। কৃষিক্ষেত্রে এই নতুন নীতির অর্থ ছিল, কৃষির উন্নয়নে সরকারের মূলধনি ব্যয় কমিয়ে বেসরকারি বা ব্যক্তিগত উদ্যোগের ওপর বেশি জোর দেওয়া। কৃষির ওপর সরকারি ভরতুকি ও নানাপ্রকার কৃষি-উন্নয়নের কাজে সরকারের ব্যয় কমানো। সরকারি উদ্যোগে বীজ উৎপাদন ব্যবস্থার সংকোচন ঘটানো। এসবের পরিণামে কৃষি-উপকরণের দাম বাড়ার প্রবণতা দেখা দেয়। সার কারখানার ওপর নিয়ন্ত্রণ তুলে দেওয়ার ফলে কৃষি-উৎপাদনের ব্যয় আরও বৃদ্ধি পায়। বিশেষ করে কৃষিতে সরকারি বিনিয়োগ কমার ফলে সেচের ক্ষেত্রে অসুবিধা সৃষ্টি হয়, জলের দাম বাড়ে। চাল-গম ইত্যাদি অধিক জলনির্ভর শস্যের ক্ষেত্রে অন্যান্য উপকরণের সঙ্গে জলের দাম বাড়ায় উৎপাদন-ব্যয় বিশেষভাবে বাড়ে।
অর্থভাণ্ডার-বিশ্বব্যাংক নির্দেশিত পথে সরকারি ব্যয়হ্রাসের কর্মসূচি কৃষির ওপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে। কৃষিতে পুঁজি-গঠনের প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়, আমাদের দেশে স্বাধীনতা-পরবর্তী কয়েক দশক উৎপাদন-ক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রগতির সূচনা করেছিল। পুঁজিগঠনে মোট পরিমাণ হ্রাস, বিশেষ করে সরকারি বিনিয়োগ হ্রাস, কৃষির উৎপাদন-ক্ষেত্রে অবশ্যই ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলেছে। সেচের উন্নতিতে সরকারি উদ্যোগ ও সরকারি ব্যয় কমানোর ফলে অধিক জলনির্ভর সনাতন খাদ্যশস্য, যেমন চাল-গম ইত্যাদির উৎপাদনশীলতার ওপর প্রভাব পড়ে। যদিও পুঁজিগঠনে সরকারি ব্যয় হ্রাসের সঙ্গে সঙ্গে বেসরকারি মূলধনি ব্যয়ের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু সরকারি ব্যয়ের হ্রাস মূলধন গঠনের চাহিদার তুলনায় যে-অভাব সৃষ্টি করেছে, বেসরকারি বিনিয়োগ দিয়ে এই অভাব পূর্ণ হতে পারেনি। সামগ্রিকভাবে কৃষিতে পুঁজিগঠন কমেছে, ফলে কৃষি থেকে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের মূল্যবৃদ্ধির হার কমেছে।
১৯৫০–৫১ থেকে ২০০৫–০৬ অবধি মোট মূলধন গঠনের পরিমাণের মধ্যে কৃষি থেকে মোট মূলধন গঠনের শতকরা ভাগটি ১৯৫০–৫১ সালে ২৬ থেকে ১৯৫৩–৫৪ সালে ৩১.১০-এ দাঁড়ায়, কিন্তু তারপর ক্রমাগত ধীরে ধীরে কমতে থাকে। ১৯৬৫–৬৬ সালে তা মোট মূলধন গঠনের শতকরা ১৫.৯৮ ভাগে নেমে আসে। এরপর গোটা সময়ের মধ্যে ক্রমাগত কমতে থাকে ও শেষ পর্যন্ত ২০০৫–০৬ সালে শতকরা ৭.৩৬ ভাগে দাঁড়ায়। দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের মূল্যে কৃষিতে গঠিত হওয়া মূলধনের মূল্য সমস্ত সময় জুড়ে শতকরা ৩–৪ ভাগে থাকার পর ২০০০ সালের পর থেকে লক্ষণীয় ভাবে কমে ও ২০০৫–০৬ সালে শতকরা ২.৫ ভাগে দাঁড়ায়। মোট মূলধন গঠনের মধ্যে কৃষিতে গঠিত মোট মূলধনের শতকরা-ভাগ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এইভাবে নেমে আসার কারণ সহজেই বোঝা যায়। এই ঘটনার পিছনে সবচেয়ে বড় কারণ নয়া অর্থনৈতিক নীতির প্রয়োগ। এই নতুন নীতি অনুসরণ করে ভারত সরকার কৃষিতে বিনিয়োগের পরিমাণ লক্ষণীয়ভাবে কমিয়েছে। সরকারি উদ্যোগ ও সরকারি ব্যয় কমানোর নীতি গ্রহণ করে তা কৃষির ক্ষেত্রে প্রয়োগের ফলে দেখা যায় দেশের মোট উৎপাদন-মূল্যে সরকারি ব্যয়ে কৃষিতে মূলধন গঠনের শতকরা-ভাগ ১৯৮০–৮১-তে ২.০৫ থেকে ’৯৮–’৯৯-এ দাঁড়ায় শতকরা ০.৪৭ এবং এরপর সামান্য বাড়া-কমার মধ্য দিয়ে ২০০৫–০৬-এ শতকরা ০.৬০-এ পৌঁছয়। এইসময়ে দেশের মোট উৎপাদন-মূল্যে বেসরকারি ব্যয়ে মূলধন গঠনের শতকরা ভাগ ১৯৮০–৮১-তে ২.৩৯ থেকে ২০০৫–০৬ এ শতকরা ১.৯১-এ দাঁড়ায়। দেখা যায়, ২০০৫–০৬ সালে কৃষিতে গঠিত মোট মূলধনের শতকরা ৭৫ ভাগেরও বেশি বেসরকারি ব্যয়ে নির্মিত হয়েছে এবং শতকরা ২৫ ভাগের কম হয়েছে সরকারি ব্যয়ে।
চিত্র ১০.১ কৃষিতে মোট মূলধন গঠনের সঙ্গে, কৃষির অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ও মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের সঙ্গে তুলনা।
Source: Central Statistics Office (CSO)
সারণি ১০.১ কৃষিতে সরকারি ও বে-সরকারি স্তরে পুঁজিগঠন
Source: Central Statistics Office (CSO)
চিত্র ১০.২ কৃষক ও অ-কৃষকের মধ্যে পণ্যের বিনিময় হার, সরকারি ও বেসরকারি কৃষি মূলধন গঠন।
Source: Agricultural Statistics at a Glance 2017
চিত্র ১০.৩ কৃষি ও অ-কৃষি ক্ষেত্রের মধ্যে পণ্যের বিনিময় হার, সরকারি ও বেসরকারি কৃষি মূলধন গঠন।
Source: Agricultural Statistics at a Glance 2017
ওপরের সারণি ও ছবি থেকে এটা স্পষ্ট যে, ২০০৪–০৫-এর পরবর্তী সময়ে কৃষিতে বেসরকারি স্তরে পুঁজিগঠনের পরিমাণ সরকারি স্তরে পুঁজিগঠনের তুলনায় অনেকটাই বেশি এবং সরকারি পুঁজিগঠন বৃদ্ধির হারের তুলনায় বেসরকারি পুঁজিগঠন বৃদ্ধির হার অনেক বেশি ছিল। ১৯৮০–৮১ সাল থেকে ’৯৮–’৯৯ সাল অবধি প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী এইসময়ের মধ্যে বেসরকারি স্তরে পুঁজিগঠনের পরিমাণ পরপর প্রতি বছর বেড়েছে, এবং একই সঙ্গে সরকারি স্তরে ওই বছরগুলিতে পুঁজিগঠনের পরিমাণ কমেছে। একই সঙ্গে দীর্ঘদিন কৃষি ও অ-কৃষি ক্ষেত্রের মধ্যে বিনিময় হার কৃষির বিপক্ষে থাকার পর ’৮৮–’৮৯-এর পর থেকে ধীরে ধীরে কিছুটা কৃষির পক্ষে উন্নীত হয়। ২০০৪–০৫ অবধি প্রাপ্ত হিসাব অনুযায়ী সরকারি স্তরে কৃষিতে পুঁজিগঠনের পরিমাণ কমেছে ও বেসরকারি স্তরে বেড়েছে। ভারতীয় কৃষি অর্থনীতির ওই কালপর্বের গতিপ্রকৃতি পর্যালোচনা করে কোনও কোনও পর্যবেক্ষক মনে করেছেন, ওই সময়ে বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধির পিছনে যে-উৎসাহব্যঞ্জক উপাদানটি কাজ করেছিল তা হল, কৃষি ও শিল্পের মধ্যে বিনিময়-হারে কৃষির অনুকূলে উন্নতির প্রবণতা।১ কিন্তু এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ’৮৮–’৮৯ থেকে ’৯৮–’৯৯ অবধি কৃষি ও অ-কৃষি ক্ষেত্রের পণ্যের বিনিময়-হার আগের তুলনায় কৃষির অনুকূলে এলেও ওই সময়ের মধ্যে কখনই তা ১ বা ১-এর বেশি ছিল না। অর্থাৎ বিনিময়-হার তুলনামূলক ভাবে কৃষির বিপক্ষে, অকৃষি ক্ষেত্রের পক্ষেই ছিল। ২০০৫–০৬ ও তার পরবর্তী বছরগুলিতে ২০১৫–১৬ সাল অবধি কৃষক ও অ-কৃষকের কেনা-বেচার পণ্যে বিনিময়-হার দু’/একটি বছর বাদে সব বছরেই কৃষকের বিপক্ষে ছিল। কৃষি ও অ-কৃষি ক্ষেত্রের মধ্যে যে-পণ্য বিনিময় ঘটে সেখানেও ২০১২–১৩ সাল অবধি এই হার ছিল কৃষির বিপক্ষে। অবশ্য ’১৩–’১৪, ’১৪–’১৫ ও ’১৫–’১৬, এই তিন বছরেই বিনিময়-হার কৃষির পক্ষে ছিল। ২০১৬–১৭-র প্রাথমিক হিসাবেও দেখা যায়, এই হার কৃষির পক্ষে। কিন্তু ২০০৫–০৬ থেকে প্রথম আট বছর এই হার কৃষির বিপক্ষে থাকা সত্ত্বেও সরকারি-বেসরকারি উভয় দিকের উদ্যোগেই কৃষিতে পুঁজিগঠন বাড়তে থাকে, অর্থাৎ কৃষিতে মোট পুঁজিগঠনের পরিমাণ বেড়েছে, এবং একই সঙ্গে সরকারি পুঁজিগঠনের পরিমাণও বেড়েছে। যদিও বেসরকারি পুঁজিগঠনের পরিমাণ সর্বদাই সরকারি পুঁজিগঠনের তুলনায় অনেকটা বেশি ছিল। ’৮০–’৯০-এর দশক থেকে ২০০৪–০৫ অবধি সরকারি বিনিয়োগের সঙ্গে বেসরকারি বিনিয়োগের যে-বিপরীতগামী সম্পর্ক ছিল, ২০০৫–০৬ ও তার পরবর্তী বছরগুলিতে এই দু’টি ক্ষেত্রে পুঁজিগঠনের প্রক্রিয়ার মধ্যে তা দেখা যায়নি। কৃষি ও অ- কৃষি ক্ষেত্রের অথবা কৃষক ও অ-কৃষকের ব্যবহৃত পণ্যের বিনিময়-হারের সঙ্গে বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধির কোনও নিশ্চিত সরাসরি সম্পর্ক দেখা যায় না। বেসরকারি ও সরকারি উভয় বিনিয়োগ বৃদ্ধির পিছনে অন্য কোনও উৎসাহ প্রদানকারী উপাদানের প্রভাব ছিল কি না সেটা আলাদাভাবে অনুসন্ধান করা প্রয়োজন।
আমরা পরবর্তী একাদশ অধ্যায়ে দেখব, কৃষিতে প্রতি হেক্টর জমিতে নতুন বীজ, সার ইত্যাদির প্রয়োগ বাড়ার ফলে, এবং একই সঙ্গে এইসব উপকরণের দাম বাড়ার ফলে, প্রতি হেক্টর চাষের খরচ ও প্রতি কুইন্টাল উৎপাদনের খরচ অত্যধিক বেড়েছে। চাষির হাতে নিজস্ব পরিবারের দৈনন্দিন খরচ মিটিয়ে উদ্বৃত্ত থাকছে যথেষ্ট কম, ফলে চাষির পক্ষে উৎপাদনশীল বিনিয়োগ করার ক্ষমতা যথেষ্ট কমেছে। আমরা দেখেছি, কৃষিতে মোট পুঁজিগঠনের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, বিশেষ করে বেসরকারি বিনিয়োগ অতি দ্রুত উচ্চহারে বেড়েছে। এই বাড়ার পিছনে আছে খোলা-বাজারে উৎপাদনশীল কৃষি-উপকরণগুলির দামের অত্যধিক বৃদ্ধি। কৃষি-উৎপাদন ব্যবস্থা পুরোপুরি নতুন অত্যধিক দামি বীজ, সার ইত্যাদির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। আবার এই উপকরণগুলির জোগান অনেকাংশেই কমিশন এজেন্টের ওপর নির্ভরশীল। চাষি ঋণের জন্য ও পণ্য বিক্রির জন্যও এদের ওপর অনেকসময়ে নির্ভর করে। ফলে ঋণ, কৃষি উপকরণ ও পণ্যের সংযুক্ত বাজার-ব্যবস্থার মধ্যে পড়ে চাষি অত্যধিক উৎপাদন-ব্যয় বহন করতে বাধ্য হচ্ছে। এই অত্যধিক ব্যয়ভার বহন করার জন্য চাষিকে বিপুল পরিমাণে প্রাতিষ্ঠানিক ও বিশেষ করে অ-প্রাতিষ্ঠানিক উৎস থেকে চড়া সুদে ধার নিতে হচ্ছে এবং ঋণের বোঝা বেড়েই চলেছে।
ভারতের কৃষিক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি সংক্রান্ত প্রধান প্রধান সরকারি নীতিগুলির মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল প্রধান শস্যগুলির জন্য ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নির্ধারণের ব্যবস্থা, ও সহায়ক মূল্যে সরকারের তরফে শস্য সংগ্রহের ব্যবস্থা। সেইসঙ্গে আছে কৃষি-উৎপাদনের বিভিন্ন উপকরণ যেমন, সার, কৃষিতে ব্যবহার্য বিদ্যুৎ ও সেচের জলের ওপর ভরতুকি। বীজের উৎপাদন ও সরবরাহ বিষয়ে ভারত সরকার বিশেষ করে উচ্চফলনশীল বীজ আসার পর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ভারতীয় বীজ শিল্প গঠিত হয়েছে সরকারি ও বেসরকারি বীজ উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থার দ্বারা। জাতীয় বীজ উৎপাদন সংস্থা গঠিত হয় ১৯৬৩ সালে। এরপর রাষ্ট্রীয় বীজ উৎপাদন সংস্থা ১৯৬৯ সালে সবুজ বিপ্লবের সূচনার পর গঠিত হয়। এছাড়াও বহুসংখ্যক বেসরকারি কোম্পানি বীজ উৎপাদন ও সরবরাহের কাজ করে। বীজ পরীক্ষার জন্য বীজ প্রত্যয়িত করণের এজেন্সি তৈরি হয়েছে, বীজ পরীক্ষার জন্য গবেষণাগার তৈরি হয়েছে। অনেক ক’টি বেসরকারি বীজ কোম্পানিই বহুজাতিক সংস্থার অঙ্গ, তাদের নিজস্ব গবেষণা ও উন্নয়নের ব্যবস্থা আছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নীতিগুচ্ছ এই বেসরকারি বহুজাতিক সংস্থাগুলিকে ভারতীয় বীজের বাজারে আরও বেশি করে সহজে অনুপ্রবেশের সুযোগ করে দিয়েছে। আমরা এ বিষয়টি পরবর্তী অধ্যায়ে আরও বিস্তৃতভাবে আলোচনা করব।
সরকারি হস্তক্ষেপে ভরতুকি সম্পর্কিত বিশেষ বিশেষ জায়গাগুলি নতুন অর্থনৈতিক নীতি বা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নির্দেশে খুব বেশি প্রভাবিত হয়নি, কারণ কৃষির ওপর সরকারি ভরতুকির সামগ্রিক পরিমাণ এতই কম যে তা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার প্রস্তাবিত ছাড়ের সীমা লঙ্ঘন করেনি। কিন্তু নয়া অর্থনৈতিক নীতি প্রয়োগের ফলে সার ও বীজের উৎপাদন ও তা কৃষকদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কাজে সরকারি প্রভাব কমে বেসরকারি প্রভাব বৃদ্ধি পায়। এর ফলে অবশ্যই কৃষি-উপকরণের দাম বাড়ে। অন্যদিকে ১৯৯১ সালের আগে অভ্যন্তরীণ বাজারে কৃষিক্ষেত্রে প্রস্তুত পণ্যের সঙ্গে অ-কৃষি ক্ষেত্রে প্রস্তুত পণ্যের বিনিময়-হার কৃষির বিরূদ্ধে ছিল। এর কারণ ’৮০-র দশকে শিল্পে বিনিয়োগ বাড়ানোয় উৎসাহ দিতে গিয়ে শিল্পপণ্যগুলি বেশি বাজার-দাম রাখার কাজে সরকারি সহযোগিতার সুবিধা পেয়েছিল, অথচ কৃষিপণ্যের উৎপাদন-ব্যয় অত্যধিক হওয়া সত্ত্বেও কৃষিপণ্যগুলিকে যে সরকারি সহযোগিতা জোগানো হচ্ছিল তা ছিল প্রয়োজনের তুলনায় অত্যল্প। শুধু তাই নয়, সরকারের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের হারও ছিল অত্যন্ত কম। ফলে শিল্পজাত পণ্যের সঙ্গে বিনিময়-হারে কৃষি যথেষ্ট অলাভজনক অবস্থায় ছিল। ’৮০-র দশকে সরকার শিল্পপণ্যের দাম ঊর্ধ্বসীমায় বজায় রাখার জন্য যে-সংরক্ষণ নীতি অনুসরণ করেছিল, ১৯৯১-এর পর তা বর্জন করে এবং শিল্পকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত বাজার-প্রক্রিয়ার ওপর ছেড়ে দেয়। ফলে কৃষি-শিল্পের বিনিময় হার আবার তুলনামূলক ভাবে কৃষির পক্ষে বাড়তে থাকে। অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করেন, কৃষিতে মূলধন গঠনে বেসরকারি বিনিয়োগ যে বেড়েছে, তার পিছনে হয়তো আছে কৃষি-শিল্পের বিনিময়-হার কৃষির অনুকূলে যাওয়ার ঘটনা।
কিন্তু ’৯০-এর দশকে কৃষিতে মোট উৎপাদনের বৃদ্ধি-হারে যে ক্রমাবনতি ও দীর্ঘকালীন স্থবিরত্ব দেখা যায়, কৃষি-উৎপাদনের তুলনামূলক দামের ক্ষেত্রে এই সুবিধাজনক অবস্থানের সঙ্গে এটি সঙ্গতিপূর্ণ নয়। ওপরের চিত্র ১০.১-এ দেখা যাচ্ছে, মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে মোট কৃষি-উৎপাদনের শতকরা-ভাগের দীর্ঘকালীন ক্রমাবনতি অতি স্পষ্ট। ভারতের কৃষি-উৎপাদনের দীর্ঘকালীন জাড্য নয়া আর্থিক নীতি প্রয়োগের সময়ে আরও স্পষ্ট হয়েছে। একই সঙ্গে আমরা দেখেছি, ১৯৯১-এর নয়া আর্থিক নীতি প্রযুক্ত হওয়ার আগে ও পরে মোট অভ্যন্তরীণ কৃষি-উৎপাদন বৃদ্ধির দীর্ঘকালীন প্রবণতার হার ছিল যথাক্রমে শতকরা ৩.০২ (১৯৮১–৯২) ও ২.৫৯ (১৯৯৩–২০০৬)। অর্থাৎ স্পষ্টতই দু’টি কালপর্বের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কৃষি-উৎপাদন বৃদ্ধির হার কমেছে।
সারণি ১০.২ নয়া আর্থিক নীতি ও কৃষিজ উৎপাদনের বৃদ্ধি/হ্রাসের হার
শস্য | নয়া অর্থনৈতিক নীতি প্রয়োগের আগে (১৯৬৯–৭০ থেকে ১৯৯২–৯৩) | নয়া অর্থনৈতিক নীতি প্রয়োগের পরে (১৯৯৩–৯৪ থেকে ২০১৬–১৭) |
বৃদ্ধির হার | বৃদ্ধির হার | |
ধান | ২.৯১ | ১.৩১ |
গম | ৪.৬০ | ১.৯২ |
খাদ্যশস্য | ২.৬৭ | ১.৬৮ |
আখ | ২.৯০ | ১.৩০ |
তুলা | ২.৫৮ | ৬.৪৪ |
Source: Agricultural Statistics at a Glance 2017, Own Calculation
উপরের সারণি থেকে দেখা যাচ্ছে, নয়া আর্থিক নীতি প্রয়োগের আগের ২৩ বছরের তুলনায় নয়া আর্থিক নীতির পরের ২৩ বছরে খাদ্যশস্য, গম, ধান ও আখ উৎপাদনের বৃদ্ধি-হার কমেছে, একমাত্র তুলার উৎপাদন-বৃদ্ধির হার বেড়েছে। নয়া আর্থিক নীতি প্রয়োগের আগের তিরিশ বছরে তুলার বৃদ্ধি-হার অন্যান্য পণ্যের উৎপাদনের বৃদ্ধি-হারের তুলনায় কিছুটা কম ছিল। আমরা জানি, ’৯০-এর দশকের শেষ থেকে এই শতাব্দীর প্রথম দশকে অন্ধ্র, মহারাষ্ট্র ও অন্যান্য কয়েকটি রাজ্যে গম ও তুলার ক্ষেত্রে চাষিরা যে-আত্মহত্যার পথ নিয়েছিল তার কারণ একদিকে ছিল তুলাচাষে উৎপাদন-ব্যয়ের অত্যধিক বৃদ্ধি, অন্যদিকে এই উৎপাদন-ব্যয়ের তুলনায় সরকারের ঘোষিত সহায়ক মূল্যের অপ্রতুলতা। গমের ক্ষেত্রে আমেরিকা ভরতুকি-যুক্ত সস্তার পণ্য এদেশের বাজারে অঢেল পরিমাণে জোগান দিয়ে এদেশের চাষিকে অসম প্রতিযোগিতার মধ্যে ফেলে দেয়। ফলে এদেশের তুলাচাষিরা আত্মহত্যার পথ নিতে বাধ্য হয়। নয়া আর্থিক নীতি প্রয়োগের সময় তুলাচাষে যে-প্রযুক্তিগত উন্নতি ঘটানো হয়েছিল তার ফলে তুলার উৎপাদন অনেকটা বৃদ্ধি পায়। আমরা বিভিন্ন পণ্যের উৎপাদনে উৎপাদনশীলতা বা হেক্টর-পিছু উৎপাদন-বৃদ্ধির হারে কয়েক বছরের হ্রাস-বৃদ্ধির প্রবণতা নিয়ে আলোচনা করেছি। পরিসাংখ্যিক রিগ্রেশন সমীকরণগুলি দশম অধ্যায়ের সংযোজনে দেওয়া হল।
সারণি ১০.৩ নয়া আর্থিক নীতি প্রয়োগের আগে ও পরে বিভিন্ন শস্যের উৎপাদনশীলতায় হ্রাস-বৃদ্ধির প্রবণতা
শস্য | নয়া আর্থিক নীতি প্রয়োগের আগে (’৭০–’৯৩) | নয়া আর্থিক নীতি প্রয়োগের পরে (’৯৩–’৯৪–২০১৬–’১৭) |
%বৃদ্ধি হার | %বৃদ্ধি হার | |
ধান | ২.৩৫ | ১.৩৬ |
গম | ৩.১৩ | ১.০১ |
খাদ্যশস্য | ২.৬১ | ১.৬০ |
আখ | ১.৪০ | |
তুলা | ২.৭৮ | ৪.৪৩ |
উৎস: নিজস্ব হিসাব
এই শতাব্দীর শুরু থেকেই ফল ও সবজি চাষে বিশেষ প্রাধান্য দেওয়া হয়। ফল প্রক্রিয়াকরণ শিল্প প্রসারিত হয়, শস্য বৈচিত্রকরণের মাত্রা বাড়ে। ২০০১–০২ থেকে ২০১৭–১৮ অবধি সবজি ও ফল উৎপাদনের বৃদ্ধি-হারটি আমরা নীচের প্রবণতা সমীকরণের সাহায্যে মাপার চেষ্টা করেছি, পরিসাংখ্যিক রিগ্রেশন সমীকরণগুলি দশম অধ্যায়ের সংযোজনে দেওয়া হল।
সারণি ১০.৪ সবজি ও ফল উৎপাদনে বৃদ্ধির হার
শস্য | ২০০১–০২ থেকে ২০১৭–১৮ |
বৃদ্ধির হার | |
সবজি উৎপাদন | ৫.১৭% |
ফল উৎপাদন | ৫.৪১% |
দেখা যাচ্ছে, যেখানে অর্থনৈতিক সংস্কার প্রযুক্ত হওয়ার শুরু থেকে সাম্প্রতিক কাল অবধি মূল খাদ্যশস্যের উৎপাদন বৃদ্ধির হার অত্যন্ত নীচে নেমে গেছে, সেখানে ফল-সবজির মতো উচ্চমূল্যের হালকা ফসলের উৎপাদন অতি উচ্চহারে বৃদ্ধি পেয়েছে।
আমরা আগে দেখেছি, ধান, গম ও খাদ্যশস্যের মতো প্রধান কৃষিজাত পণ্যগুলির উৎপাদনশীলতায় দীর্ঘকালীন ক্রমাবনতির প্রবণতা অত স্পষ্ট না হলেও ১৯৯১ সালের আগে যে-বৃদ্ধি-হার ছিল, পরে তা কমেছে। বৃদ্ধির হার কমার পিছনে একটি বড় কারণ হতে পারে সরকারি বিনিয়োগের অধোগতি। কৃষিতে সরকারি বিনিয়োগের একটি বড় অংশ বৃহৎ সেচপ্রকল্পগুলিতে ব্যয় হয়। সরকারি মূলধনি ব্যয় কমার অর্থ, বড় সেচ ব্যবস্থার উন্নয়নের ক্ষেত্রে অবহেলা, যার অর্থ ধান-গমের মতো অধিক জলনির্ভর শস্যগুলির ক্ষেত্রে সীমিত বিকাশের সম্ভাবনা। যদিও সরকার এইসব অধিক জলনির্ভর শস্যের পরিবর্তে ফল-সবজির মতো উৎপাদন-ক্ষেত্রকে বেশি উৎসাহ দিচ্ছে এবং তার ফলে খাদ্যের চাহিদা ও জোগানে বৈচিত্র সৃষ্টি হচ্ছে, কিন্তু এর ফলে কৃষিতে উৎপাদিত জাতীয় উৎপাদনের অংশে উল্লেখযোগ্য উন্নতি দেখার মতো পরিবর্তন এখনও আসেনি। এছাড়া সনাতন খাদ্যশস্যের মতো পণ্যগুলির উৎপাদনশীলতায় স্থবিরত্বের আর একটি কারণ, কৃষকরা একদিকে মহাজন-ব্যবসায়ী, কমিশন এজেন্ট-ব্যবসায়ীদের এড়িয়ে অভ্যন্তরীণ বাজারে অধিক দামের সুযোগ গ্রহণ করতে পারে না, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে এবং অন্তর্দেশীয় বাজারেও উন্নত দেশগুলির জোগান দেওয়া অতিরিক্ত ভরতুকি-যুক্ত পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারে না। বিশ্বের উন্নত খাদ্যশস্য রফতানিকারী দেশগুলি বিশাল ভরতুকির সাহায্যে কৃষিপণ্যের দাম যথেষ্ট কমিয়ে রেখে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রাধান্য করে। এর ফলে বিশ্বায়নের বাধ্যবাধকতায় আমাদের মতো দেশগুলিকেও চাল, গম, তুলা ও সুতি বস্ত্রের মতো পণ্যের ক্ষেত্রে দাম কম রাখতে বাধ্য হতে হচ্ছে। সরকারের ধার্য করা ন্যূনতম সহায়ক মূল্যও কৃষকের চাষের খরচ মেটানোর পক্ষে যথেষ্ট হচ্ছে না। এই বিষয়গুলি সামগ্রিকভাবে কৃষিতে দীর্ঘকালীন স্থবিরত্বের সৃষ্টি করেছে।
আমরা অভ্যন্তরীণ কৃষি-উৎপাদনে সামগ্রিকভাবে বৃদ্ধি-হারে হ্রাস দেখতে পাচ্ছি। উপরের সারণি থেকে দেখা যাচ্ছে, বাৎসরিক গড় অভ্যন্তরীণ উৎপাদন যথেষ্ট বাড়লেও ১৯৯২-এর পর প্রতি বছরের বৃদ্ধি-হার গড়ে কমেছে। ২০০২-এর পর এই কমার প্রবণতা আরও বেড়েছে। কাজেই আমাদের প্রবণতা সমীকরণে বৃদ্ধি-হার কমার যে-প্রবণতা আমরা দেখতে পাচ্ছি, তা আমাদের সারণিতে উপস্থিত তথ্যেরই প্রতিফলন। আমাদের এই পর্যবেক্ষণটি গুলাতি ও বাথলা (২০০১)-র পর্যবেক্ষণ থেকে ভিন্ন সিদ্ধান্তে আমাদের নিয়ে যাচ্ছে। গুলাতি ও বাথলা যে কালপর্ব দু’টি তুলনার জন্য বিবেচনা করেছেন, সেগুলি হল ১৯৮০/৮১ থেকে ১৯৮৯/৯০ এবং ’৯০/’৯১ থেকে ’৯৮/’৯৯ । তাঁরা এই দু’টি পর্বের মধ্যে অভ্যন্তরীণ মোট কৃষিজ উৎপাদনে সামগ্রিকভাবে উৎপাদন বৃদ্ধির হারে সামান্য উন্নতি দেখেছেন [যথাক্রমে শতকরা ৩.০৩ (’৮০-র দশকে) ও শতকরা ৩.৩১ (৯০-এর দশকে)]। আমরা ১৯৮১–৮২ সাল থেকে ’৯১–’৯২ সাল ও ’৯২–’৯৩ সাল থেকে ২০০৫–০৬ সাল, এই দু’টি কালপর্ব নিয়েছি। সংস্কার-পরবর্তী সময়ে বৃদ্ধি-হারে উন্নতি বা অবনতির বিষয়টি দেখার উদ্দেশ্য, মোট কৃষি-উৎপাদনের ওপর সংস্কারের প্রভাব দেখা। ১৯৯০–৯১ সাল এবং ’৯১–’৯২ সাল সংস্কারের নীতিগুচ্ছ সরকারি স্তরে ঘোষণার বছর। সংস্কার চালু হওয়া ও অর্থনীতির ওপর তার প্রভাব পড়তে অবশ্যই অন্তত একবছর লাগতে পারে। সুতরাং সংস্কারের প্রভাব দেখার জন্য আমরা সংস্কার-পরবর্তী পর্বটি ধরেছি ’৯২–’৯৩ সাল থেকে। এই বছর থেকে শুরু করে পরবর্তী পর্বে কৃষি ও সহকারী উৎপাদন-ক্ষেত্রে একত্রে উৎপাদন-বৃদ্ধির হার দেখা হয়েছে। আমাদের হিসাবে সংস্কার-পরবর্তী বছরগুলিতে উৎপাদন বৃদ্ধির হার সংস্কার-পূর্ববর্তী কালপর্বের তুলনায় অনেকটাই নেমে এসেছে। এর কারণ হতে পারে, আমরা আগেই যেমন উল্লেখ করেছি, প্রথমত কৃষি-অর্থনীতির মধ্যে শুধু শস্য উৎপাদন ক্ষেত্রটিকে অন্তর্ভুক্ত করলেই চলবে না, শস্যবিভাগ ছাড়াও কৃষি-উৎপাদন বলতে কৃষির নানা সহায়ক শাখার কথাও ধরা হয়ে থাকে। দ্বিতীয়ত, আমরা দেখেছি, বিভিন্ন খাদ্যশস্যের উন্নতিহারে নিম্নমুখী প্রবণতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে এবং মোট কৃষিপণ্যের একটি বড় অংশ যেহেতু উৎপন্ন শস্য, তাই মোট কৃষিপণ্যের বৃদ্ধি-হারে শস্যের বৃদ্ধি-হারে হ্রাসের প্রভাব পড়ে থাকতে পারে। যাই হোক, অন্যান্য পর্যবেক্ষণগুলির সঙ্গে আমাদের পর্যবেক্ষণের কতটা পার্থক্য হচ্ছে সেটি বোঝার জন্য আমরা অভ্যন্তরীণ কৃষি ও সহায়ক ক্ষেত্রের মোট উৎপাদন বৃদ্ধি/হ্রাস বিষয়টি ওই একই কালপর্বে রেখেছি, অর্থাৎ ১৯৭৮–৭৯ থেকে ১৯৮৮–৮৯ পর্যন্ত ও পরে ১৯৮৯–৯০ সাল থেকে ’৯৮–’৯৯ সাল পর্যন্ত। এই দুই কালপর্বের মধ্যে অভ্যন্তরীণ মোট কৃষি ও সহায়ক উৎপাদন-ক্ষেত্রে বৃদ্ধি-হার শতকরা ৩.৩ ও শতকরা ৩.২। অর্থাৎ বৃদ্ধিহারে সামান্য হ্রাস ঘটেছে। আমরা এ বিষয়ে আরও পরিষ্কার ধারণা পাওয়ার জন্য ধান, গম, অন্যান্য খাদ্যশস্য এবং আখ ও তুলা চাষের বৃদ্ধি-হার দেখেছি। আমরা দেখেছি, একমাত্র তুলা ছাড়া বাকি সব ক্ষেত্রেই বৃদ্ধি-হার দু’টি পর্বের মধ্যে কমেছে। বিভিন্ন প্রধান খাদ্যশস্য এবং মোট খাদ্যশস্যের (অপেক্ষাকৃত নিকৃষ্ট কম মূল্যের খাদ্যশস্য সমেত) উৎপাদনের ও উৎপাদনশীলতার বৃদ্ধি-হার কমেছে। যদিও ফল-সবজি উভয় ক্ষেত্রে এবং তুলার ক্ষেত্রে এই দ্বিতীয় পর্বে উৎপাদনের বৃদ্ধি-হার যথেষ্ট বেশি ছিল। এছাড়া এই পর্বে সম্ভবত কৃষির সহায়ক অর্থাৎ পোলট্রি ও দুধ, মাংস ইত্যাদি ক্ষেত্রে উৎপাদন-বৃদ্ধির হার ওপরে ওঠার কারণে মোট অভ্যন্তরীণ কৃষিজ ও সহায়ক ক্ষেত্রে হ্রাসের পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে। শুধুমাত্র সনাতন শস্য-উৎপাদন ক্ষেত্রকে আলাদা করে দেখলে সেখানে প্রথম পর্বের তুলনায় দ্বিতীয় পর্বের মধ্যে বৃদ্ধি-হার যথেষ্ট কমেছে, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ থাকছে না।
সারণি ১০.৫ কৃষি-উৎপাদনের দীর্ঘকালীন প্রবণতা
Source: CSO
সারণি ১০.৬ অভ্যন্তরীণ কৃষি ও সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের উৎপাদন
১৯৮১–৮২ থেকে ১৯৯১–৯২ | ১৯৯১–৯২ থেকে ২০০৫–০৬ | |
%বৃদ্ধির হার | %বৃদ্ধির হার | |
মোট অভ্যন্তরীণ কৃষি ও সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের উৎপাদন | ৩.০১% | ২.৫৯ |
সামগ্রিক ভাবে কৃষি-অ-কৃষির বিনিময়-হার এবং কৃষক ও অ-কৃষিজীবী মানুষদের মধ্যে কেনাবেচা হয় এমন পণ্যের বিনিময়-হারে ২০১৩-র পর সুনির্দিষ্টভাবে উন্নতির প্রবণতা স্পষ্ট। এমনকী কৃষি-অ-কৃষি ক্ষেত্রের বিনিময় হার ’১৩–’১৪-র পর কৃষির পক্ষে চলে এসেছে, যদিও কৃষক ও অ-কৃষকের ব্যবহৃত পণ্য সামগ্রীর বিনিময়-হার কৃষকের পক্ষে আগের তুলনায় উন্নত হলেও এবং হারটি মাঝে দু’-এক বছর অ-কৃষকের বিপক্ষে, কৃষকের পক্ষে গেলেও, বাকি সব সময়েই কৃষকের বিরুদ্ধে, অ-কৃষকের পক্ষে থেকেছে। কৃষিতে এই সময়ে বেসরকারি বিনিয়োগের হার বৃদ্ধির সঙ্গে বিনিময় হারে হ্রাস/বৃদ্ধির তেমন কোনও স্পষ্ট সম্পর্ক আমরা দেখতে পাচ্ছি না। আমাদের মনে হচ্ছে, কৃষিতে বেসরকারি বিনিয়োগ-বৃদ্ধির যে-তথ্য আমরা পাচ্ছি, তা নতুন উচ্চফলনশীল অতিরিক্ত ব্যয়বহুল বীজ সার যন্ত্রপাতি ইত্যাদি উপাদান সামগ্রীর খাতে কৃষকের ওপর অতিরিক্ত ব্যয়ের বোঝাকেই প্রতিফলিত করছে। আমরা উপরের সারণিগুলিতে দেখেছি অনেক সময়েই এই ব্যয়ের বোঝা মিটিয়ে কৃষকের নিট আয় ঋণাত্মক হয়ে পড়ে। বিশেষ করে জমিতে কৃষকের পরিশ্রমের ওপর আরোপিত আর্থিক মূল্যকে মোট ব্যয়ের অন্তর্ভুক্ত করলে কৃষকের হাতে তার ওপর কোনও উদ্বৃত্তই থাকে না। শুধু তাই নয়, কৃষকের হাতে তার পরিশ্রমের দামটুকুও অবশিষ্ট থাকে না। কিন্তু এই বিশাল ব্যয়ভার বহন করার জন্য তাকে বিপুল পরিমাণে ঋণ নিতে হয়। সংগঠিত ঋণের বাজারে জটিল ঋণ প্রদানের নিয়মকানুন ও জমি বন্ধক রাখার ব্যবস্থার কারণে তার পক্ষে অনেকসময় সংগঠিত ঋণ নাগালের বাইরেই থেকে যায়। বেসরকারি পুঁজিগঠনের দ্রুত বৃদ্ধির পিছনে যে-তথ্যটি লুকানো রয়েছে তা এই বিনিয়োগের উৎস-সংক্রান্ত। বিপুল যে-অসংগঠিত ঋণ প্রান্তিক, ছোট ও মাঝারি চাষিদের একটি অংশের হাতে জমা হয় তা তাদের চাষের অস্বাভাবিক খরচ মেটাতে কাজে লাগে এবং এই তথ্যই বেসরকারি বিনিয়োগ হিসেবে উপস্থিত হয়। এই অসংগঠিত ঋণের একটি বড় উৎস হল কমিশন এজেন্ট, ও কৃষি উপাদানের বিক্রেতারা। এবং অসংগঠিত ঋণের বাজারের একটি অংশ কৃষি-উপাদান ও কৃষিপণ্যের বাজারের সঙ্গে সংযুক্ত। এই বাজারে কমিশন এজেন্টরা ও কৃষি-উৎপাদনের উপকরণের জোগানদাররা উৎপাদনের অত্যন্ত ব্যয়বহুল উপকরণগুলি প্রয়োজনের তুলনায় আরও অধিক পরিমাণে জোগান দেওয়ার সুযোগ পায়। এইসব উপকরণের জোগান অনুযায়ী ‘জোগান তাড়িত বাজার’২ তৈরি হয়, যার ফলে এই জোগানদাতা কমিশন এজেন্ট বা ব্যবসায়ীর ওপরেই তাকে শেষপর্যন্ত ঋণের জন্য নির্ভর করতে হয়। এই নির্ভরতাকে কাজে লাগিয়ে দামের হেরফের করে, অথবা চড়া সুদের সাহায্যে, ব্যবসায়ী-কমিশন এজেন্টরা কৃষি উদ্বৃত্তের বড় অংশ আত্মসাৎ করে।
কৃষি-উন্নয়নের বিভিন্ন সূচক পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে, বিশ্বায়নের কর্মসূচি কৃষি-উৎপাদন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কোনও উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারেনি। সাধারণ খাদ্যশস্য ও আখের ক্ষেত্রে এই পর্যবেক্ষণটি সত্যি। নয়া আর্থিক নীতি প্রযুক্ত হওয়ার পর একমাত্র তুলার ক্ষেত্রে উৎপাদন-হার বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা পরবর্তী অধ্যায়ে দেখব, বিশেষ করে ’৯০-এর দশকের পর কৃষিক্ষেত্রে বৈচিত্রের মাত্রা যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। ফল-সবজি চাষ ছাড়াও কৃষির অন্যান্য দিকে, যেমন পশুপালন, ও পোলট্রির ক্ষেত্রে উৎপাদনের অনেক বিস্তৃতি ঘটেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও কৃষি ও সহায়ক উৎপাদনের বিভাগে একত্রে সামগ্রিক উৎপাদন বৃদ্ধির হার নেমেছে।
সারণি ১০.৭ সরকারি ও বেসরকারি স্তরে পুঁজি গঠন ও কৃষি-পণ্য ও অ-কৃষি পণ্যের বিনিময় হার
Source: Agricultural Statistics at a Glance 2017
* Estimated
তথ্যসূত্র
১. Gulati, A. and Seema Bathla. 2001. “Capital Formation in Indian Agriculture: Re-visiting the debate.” Economic and Political Weekly. vol 36 no 20.
Hoda, A., A. Gulati. 2008. WTO Negotiations on Agriculture and Developing Countries. Oxford University Press.
২. Mishra, S. 2006. “Farmers’ Suicides in Maharashtra.” Economic and Political Weekly. vol 41 no 16.
“The farmer now depends on the input dealer for advice leading to supply-induced demand and on informal sources of credit which result in a greater interest burden. In short, farmer is faced with yield, price and weather uncertainties”
সংযোজন
ক। নয়া অর্থনৈতিক নীতি প্রয়োগের আগে ও পরে বিভিন্ন ফসলের উৎপাদনের হ্রাস/বৃদ্ধি।
Agriculture Statistics at a Glance (GOI) এর পরিসংখ্যান থেকে গৃহীত নিজস্ব পরিমাপ।
খ। নয়া আর্থিক নীতি প্রয়োগের আগে ও পরে বিভিন্ন ফসলের উৎপাদনশীলতার হ্রাস/বৃদ্ধি
Agriculture Statistics at a Glance (GOI) এর পরিসংখ্যান থেকে গৃহীত নিজস্ব পরিমাপ।
ঘ। মোট অভ্যন্তরীণ কৃষি ও সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের উৎপাদন।