অধ্যায় ৯০
ডা: এলিজাবেথ সিনস্কি যখন ল্যাংডন, ব্রুডার আর হতভম্ব গাইড মিসরাতকে নিয়ে হাজিয়া সোফিয়া থেকে বের হয়ে এলো তখন অঝোরে বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে।
অনুসরন করে চলে যাও ঐ ডুবন্ত প্রাসাদের সুগভীরে, ভাবলো সিনস্কি।
শহরের জলাধার ইয়েরেবাতান সারায়ি নীল মসজিদের ঠিক পেছনে, একটু উত্তরে অবস্থিত।
মিসরাত তাদেরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এখন।
এই তুর্কির কাছে সিনস্কি সব খুলে বলেছে। তারা কারা এবং সম্ভাব্য এক মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে কাজ করছে তাদের দলটি। এছাড়া আর কোনো উপায় ছিলো না বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার পরিচালকের।
“এই দিকে!” তাদেরকে অন্ধকারাচ্ছন্ন একটি পার্কের দিকে যেতে বললো। তাদের পেছনে হাজিয়া সোফিয়া পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়ে আছে, আর নীল মসজিদের রূপকথার মিনারগুলো একটু দূরেই জ্বলজ্বল করছে যেনো। সিনস্কির পাশে হন্তদন্ত হয়ে যেতে যেতে ফোনে কথা বলছে ব্রুডার, এসআরএস টিমকে আপডেট জানাচ্ছে সে, তাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছে যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব জলাধারের সামনে চলে যাবার জন্য। “মনে হচ্ছে জোবরিস্ট শহরের পানি সাপ্লাইকে টার্গেট করেছে,” হাফাতে হাফাতে বললো ব্রুডার। “আমার দরকার ঐ জলাধারের ভেতর-বাইরের সব ধরণের নক্সা, ডায়াগ্রাম। আমরা পুরোপুরি ‘আইসোলেশন অ্যান্ড কন্টেইনমেন্ট প্রটোকল পরিচালনা করবো। জায়গাটা খালি করার সাথে সাথে ফিজিক্যাল আর কেমিকেল ব্যারিয়ারেরও দরকার হবে।”
“দাঁড়ান, মিসরাত বললো তাকে। “আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন। ঐ জলাধারটি এখন আর এ শহরের পানি সাপ্লাইয়ের কাজ করে না। একদমই না!”
ফোনটা নামিয়ে কটমট চোখে গাইডের দিকে তাকালো ব্রুডার। “কি?”
“বহু আগে জলাধারটি পানি সরবরাহের কাজ করতো, মিসরাত পরিস্কার করে দিলো। কিন্তু এখন আর সেটা করে না। আমাদের পানি সাপ্লাই ব্যবস্থা এখন বেশ আধুনিক হয়েছে।”
ব্রুডার একটি গাছের নীচে এসে দাঁড়ালে সবাই তার কাছে চলে এলো।
“মিসরাত,” সিনস্কি বললো, “আপনি নিশ্চিত, ওখানকার পানি কেউ পান করে না?”
“কী যে বলেন, মিসরাত জবাব দিলো। “ওখানকার পানি কে পান করতে যাবে। ওখানে এমনি পানি জমে থাকে…আস্তে আস্তে মাটির নীচে চলে যায় সেগুলো।”
সিনস্কি, ল্যাংডন আর ব্রুডার একে অন্যের দিকে তাকালো। সিনস্কি বুঝতে পারছে না কথাটা শুনে স্বস্তি বোধ করবে নাকি আতঙ্কিত হবে। এই পানি যদি কেউ ব্যবহারই না করবে তাহলে জোবরিস্ট কেন এরকম জায়গা বেছে নিলো জীবাণু ছড়িয়ে দেবার জন্য?
“কয়েক দশক আগে আমরা যখন পানি সরবরাহ ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ করি,” মিসরাত বলতে লাগলো, “ওই জলাধারটি তখন পরিত্যাক্ত হয়ে পড়ে, মাটির নীচে একটি বিশাল পুকুর হয়ে ওঠে।” কাঁধ তুললো সে। “আজকাল ওটা পর্যটকদের আকর্ষণীয় জায়গা ছাড়া আর কিছু না।”
মিসরাতের দিকে ঘুরলো সিনস্কি। পর্যটকদের আকর্ষণীয় জায়গা? “দাঁড়ান…লোকজন ওখানে যেতে পারে? মানে ওই জলাধারে?”
“অবশ্যই,” বললো সে। “প্রতিদিন হাজার হাজার দর্শনার্থী ওখানে যায়। জায়গাটি দেখার মতো। পানির উপরে কিছু ব্রডওয়াকও আছে…এমনকি ছোটোখাটো একটি ক্যাফেও। অল্পবিস্তর ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা থাকলেও বাতাস একটু গুমোট আর আদ্র, তারপরও জায়গাটা বেশ জনপ্রিয়।”
ব্রুডারের দিকে স্থিরচোখে চেয়ে রইলো সিনস্কি। ভালো করেই জানে, সে আর প্রশিক্ষিত এসআরএস এজেন্ট একই জিনিস ভাবছে-অন্ধকারাচ্ছন্ন, স্যাঁতস্যাঁতে গুহা, জমাটবদ্ধ পানিতে ভরপুর, যেখানে প্যাথোজেন অর্থাৎ জীবাণুগুলো বৃদ্ধি পাচ্ছে। দুঃস্বপ্নের ষোলো কলা পূরণ করার জন্য পানির উপরে ব্রডওয়ে দিয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটকের আসা-যাওয়ার ব্যবস্থাও আছে।
“সে একটা বায়োঅ্যারোসল তৈরি করেছে,” ব্রুডার জানালো।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে সায় দিলো সিনস্কি।
“মানে?” ল্যাংডন জানতে চাইলো।
“মানে,” জবাবটা ব্রুডারই দিলো, “ওটা বাতাসেও ছড়িয়ে পড়তে পারবে।”
চুপ মেরে গেলো ল্যাংডন, সিনস্কি বুঝতে পারলো প্রফেসর এখন সঙ্কটটির সত্যিকারের ভয়াবহতা উপলব্ধি করতে পারছে।
বাতাসবাহিত প্যাথোজেনের ভাবনাটি সিনস্কির মনে এর আগে কিছুটা সময়ের জন্য উদয় হয়েছিলো, তবে শহরের পানি সরবরাহের জলাধারের কথা। শুনে সে আশা করেছিলো জোবরিস্ট হয়তো পানিবাহিত জীবাণু বেছে নিয়েছে। পানিবাহিত ব্যাকটেরিয়া খুব শক্তিশালী এবং আবহাওয়া-সহ্য করার ক্ষমতাসম্পন্ন। হয়, কিন্তু তারা খুব ধীরগতিতে ছড়ায়।
বাতাসবাহিত জীবাণু ছড়ায় দ্রুতগতিতে।
খুবই তীব্রগতিতে।
“এটা যদি বাতাসবাহিত হয়ে থাকে,” বললো ব্রুডার, “তাহলে এটা ভাইরাল।”
একটি ভাইরাস, একমত হলো সিনস্কি। জোবরিস্ট দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাওয়া প্যাথোজেনই বেছে নেবে।
বাতাসবাহিত ভাইরাস পানিতে রিলিজ করাটা একটু অস্বাভাবিকই বটে, কিন্তু এটাও ঠিক অসংখ্য জীব তরলের মধ্যে জন্ম নিয়ে বাতাসে টিকে থাকে-মশা, এককোষী প্রাণী, ব্যাকটেরিয়া, মাইকোটক্সিন, রেড টাইড, এমনকি মানুষ। তিক্ততার সাথেই সিনস্কি দেখতে পাচ্ছে জলাধারের পানিতে ভাইরাসটি বংশবৃদ্ধি। করছে…তারপর জীবাণু ভর্তি পানির কণা গুমোট উঠে আসছে বাতাসে।
মিসরাত এখন রাস্তার ট্রাফিক জ্যামের দিকে ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। সিনস্কি তার দৃষ্টি অনুসরণ করে একটি লাল-সাদা ইটের ভবনের দিকে তাকালো, এটার একমাত্র দরজাটি খোলা, সেটা দিয়ে একটি সিঁড়ি দেখা যাচ্ছে। বাইরে একদল লোক ছাতা মাথায় দাঁড়িয়ে আছে ভেতরে ঢোকার অপেক্ষায়।
এটা কি আন্ডারগ্রাউন্ড ডান্সক্লাব নাকি?
ভবনের গায়ে সোনালি রঙের অক্ষরগুলোর দিকে তাকিয়ে সিনস্কির বুক ধরফর করে উঠলো। এই জায়গাটা জলাধার হলে, এবং এটার নির্মাণ ৫২৩ খৃস্টাব্দে হয়ে থাকলে মিসরাতের চিন্তিত হবারই কথা।
“ডুবন্ত প্রাসাদ, মিসরাত ক্ষুব্ধস্বরে বললো। “মনে হচ্ছে…আজরাতে এখানে একটি কনসার্ট হবে।”
অবিশ্বাসে তাকালো সিনস্কি। “এখানে কনসার্ট হবে?!”
“জায়গাটা বিশাল একটি ইনডোর,” জবাবে বললো সে। “এটাকে প্রায়ই সাংস্কৃতিক সেন্টার হিসেবে ব্যবহার করা হয়।”
ব্রুডার আর বেশি কিছু শোনার অপেক্ষা করলো না। আলেমদার এভিনুর ট্রাফিকের মধ্য দিয়ে ভবনের দিকে ছুটে গেলে সিনস্কিসহ বাকিরাও প্রায় দৌড়ে তাকে অনুসরণ করলো।
জলাধারে প্রবেশপথের কাছে চলে এলে দেখতে পেলো দরজার সামনে কিছু কনসার্ট দেখতে আসা দর্শক ভেতরে ঢোকার জন্য অপেক্ষা করছে-বোরকা পরা তিন মহিলা, একজোড়া পর্যটক হাতে হাত ধরে আছে আর একজন টাক্সিডো পরা লোক। তারা সবাই বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচার জন্য দরজার কাছে জড়ো হয়ে আছে।
নীচ থেকে ক্লাসিক্যাল মিউজিক ভেসে আসতে শুনলো সিনস্কি। বারলিওজ, অর্কেস্ট্রার সুর শুনে আন্দাজ করলো সে। তবে সেটা যা-ই হোক না কেন, এরকম সঙ্গিত ইস্তাম্বুলের পথেঘাটে খুবই অদ্ভুত লাগলো।
দরজার কাছে যেতেই সিনস্কির মনে হলো নীচ থেকে গরম বাতাস উঠে আসছে উপরে। সেই বাতাসে কেবলমাত্র বেহালার সুরই ভেসে এলো না, ভেসে এলো অসংখ্য মানুষের ঘামেভেজা ভ্যাপসা গন্ধও।
সিনস্কির মনে যে আশংকা জমতে শুরু করেছে সেটা আরো গাঢ় হলো এবার।
একদল পর্যটক নীচ থেকে বেরিয়ে এলে অপেক্ষায় থাকা আরেকটি দলকে ঢোকার সুযোগ দিলো প্রহরী।
ব্রুডার সঙ্গে সঙ্গে ঢোকার চেষ্টা করতেই প্রহরী তাকে হাত তুলে বাধা দিলো। একটু দাঁড়ান, স্যার। নীচের ক্যাপাসিটি ভরে গেছে। আরো কিছু লোক বের না হয়ে এলে ঢুকতে দেয়া যাবে না। একটু অপেক্ষা করুন। ধন্যবাদ।
ব্রুডার জোর করে ঢুকতে যাবে এমন সময় সিনস্কি তার কাঁধে হাত রেখে তাকে বিরত করে একপাশে ডেকে নিলো।
“দাঁড়ান,” আদেশের সুরে বললো সে। “আপনার টিম আসছে। আপনি তো আর একা একা এতো বড় জায়গা তল্লাশী করতে পারবেন না। ওরা আসুক, তখন ঢোকা যাবে।” এ বলে দরজার পাশে একটি ফলকের দিকে ইশারা করলো।
নীচের জায়গাটি সম্পর্কে ওখানে কিছু তথ্য দেয়া আছে প্রায় দুটো ফুটবল খেলার মাঠের মতো আয়তন-একলক্ষ বর্গফুটের মতো ছাদ আর ৩৩৬টি মার্বেলের কলাম।
“এটা দেখুন, কয়েক গজ দূরে দাঁড়ানো ল্যাংডন বললো। “আপনারা বিশ্বাসও করতে পারবেন না।”
সিনস্কি তার দিকে ফিরলো। দেয়ালে একটি কনসার্ট পোস্টারের দিকে ইঙ্গিত করছে সে।
হায় ঈশ্বর।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার পরিচালক মিউজিকটা শুনে ঠিকই বুঝেছিলো ওটা কোনো ক্লাসিকেল সঙ্গিতই হবে কিন্তু সেটা বারলিজের নয়-অন্য একজনের কম্পোজ করা সুর-ফ্রানৎজ লিৎজ।
আজ রাতে মাটির নীচে ইস্তাম্বুল স্টেট সিম্ফোনি অর্কেস্ট্রা ফ্রানঞ্জ লিৎজের বিখ্যাত দান্তে সিম্ফোনি’টি পরিবেশন করছে। যে সঙ্গিতের অনুপ্রেরণা দান্তের নরক ভ্রমণ থেকে ফিরে আসার উপাখ্যান।
“এটা প্রায় এক সপ্তাহ ধরে এখানে পারফর্ম করা হচ্ছে, পোস্টারটা ভালো করে দেখে ল্যাংডন বললো। “বিনেপয়সার কনসার্ট। অজ্ঞাত এক ব্যক্তির অনুদানে এটা হচ্ছে।”
সিনস্কি অনুমাণ করতে পারলো অজ্ঞাত ব্যক্তিটি কে হতে পারে। বারট্রান্ড জোবরিস্ট বেশ ভালোই নাটকীয়তা তৈরি করেছে। মনে হচ্ছে একটি নির্মম বাস্তব কৌশল। এক সপ্তাহের ফ্রি কনসার্ট দেখতে হাজার হাজার পর্যটক আসবে এখানে, মাটির নীচে গাদাগাদি করে তারা কনসার্ট দেখবে…ওখানকার জীবাণুবাহিত বাতাস নেবে নিঃশ্বাসে, তারপর ফিরে যাবে যার যার দেশে।
“স্যার?” প্রহরী বললো ব্রুডারকে। কয়েকজন ঢুকতে পারবে এখন।”
সিনস্কির দিকে তাকালো এজেন্ট। “স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে ডেকে আনুন। নীচে আমরা যা-ই খুঁজে পাই না কেন তাদের সাপোর্টের দরকার হবে। আমার টিম এসে পৌঁছালে তাদের সাথে ওয়্যারলেসে যোগাযোগ করে আমি আপডেট জানাবো। নীচে গিয়ে আমি দেখি জোবরিস্ট কোথায় তার জিনিসটা রাখতে পারে। অন্তত ধারণা করা তো যাবে।”
রেসপিরেটর ছাড়াই ঢুকবেন?” সিনস্কি জিজ্ঞেস করলো। “আপনি তো জানেন না.ঐ ব্যাগটি অক্ষত আছে কিনা।”
ব্রুডার ভুরু তুললো। হাত তুলে দরজার দিকে দেখালো সে। “বলতে চাই, কিন্তু বাধ্য হচ্ছি। এই জীবাণু যদি ছড়িয়ে পড়ে তাহলে এ শহরের সবাই আক্রান্ত হবে।”
সিনস্কিও এটা জানে কিন্তু ল্যাংডন আর মিসরাতের সামনে এ কথা বলতে চায় নি।
“তাছাড়া, ব্রুডার আরো বললো, “ওখানকার লেকজনের ভীড়টা যদি আমারদেরকে হ্যাঁজম্যাট সুট পরে ঢুকতে দেখে তাহলে মারাত্মক আতঙ্ক সৃষ্টি হবে। পায়ে পিষ্ট হয়ে মানুষ মারা যাবে।”
সিনস্কি তর্ক করতে চাইলেও নিজেকে বিরত রাখলো কেননা ব্রুডার একজন স্পেশালিস্ট হিসেবে এ ধরণের পরিস্থিতি আগেও মোকাবেলা করেছে।
“আমাদের বাস্তব অপশনটি হলো,” ব্রুডার তাকে বললো, “ওই জায়গাটি নিরাপদ আছে ধরে নিয়ে ওটাকে কন্টেইন করার চেষ্টা করতে হবে।”
“ঠিক আছে,” সিনস্কি বললো। “তাহলে তাই করুন।”
“আরেকটা সমস্যা আছে,” ল্যাংডন তাদের কথার মধ্যে ঢুকে পড়লো। “সিয়েনার কি হবে?”
“তার কি হবে?” ব্রুডার জানতে চাইলো।
“ইস্তাম্বুলে তার উদ্দেশ্য যা-ই হোক না কেন সে কিন্তু অনেক ভাষায় কথা বলতে পারে। সম্ভবত অল্পবিস্তর তুর্কিও তার জানা আছে।”
“তো?”
“সিয়েনা কবিতার ঐ ‘ডুবন্ত প্রাসাদ’-এর রেফারেন্সটি সম্পর্কে জানে,” বললো ল্যাংডন। “আর তুর্কি ভাষায় এর অর্থ…” আঙুল তুলে দেখালো সে। “…ইয়েরেবাতান সারায়ি। “
“তা ঠিক,” চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো সিনস্কি। “সে হয়তো এটা বুঝতে পেরে হাজিয়া সোফিয়ায় না গিয়ে সরাসরি এখানে চলে আসতে পারে।”
দরজার দিকে তাকিয়ে আক্ষেপে নিঃশ্বাস ফেললো ব্রুডার। “ঠিক আছে, আমরা জীবাণুগুলো কন্টেইন করার আগে যদি ওই মেয়েটা নীচে গিয়ে ব্যাগটা ফাঁটানোর পরিকল্পনা করে থাকে তাহলে সে ওখানে বেশিক্ষণ ধরে নেই। এটা খুবই বড় একটি এলাকা। তার নিশ্চয় কোনো ধারণা নেই কোথায় ওটা খুঁজতে হবে। আর এতো লোকজনের মধ্যে সবার অগোচরে পানিতে ডাইভ দেয়াও তার পক্ষে সম্ভব হবে না।”
“স্যার?” দরজার প্রহরী আবারো ডাকলো ব্রুডারকে। “আপনি কি ভেতরে যাবেন এখন?”
ব্রুডার দেখতে পেলো একদল তরুণ-তরুণী রাস্তা পার হয়ে এদিকেই আসছে ঢোকার উদ্দেশ্যে। প্রহরীর দিকে তাকিয়ে এজেন্ট মাথা নেড়ে বোঝালো সে এখনই ঢুকবে।
“আমি আপনার সাথে যাবো,” ল্যাংডন বললো তাকে।
ব্রুডার তার দিকে ফিরে সরাসরি বলে দিলো, “প্রশ্নই ওঠে না।”
ল্যাংডন দমে গেলো না। দৃঢ়তার সাথে বললো সে, “এজেন্ট ব্রুডার, আমরা সবাই এই পরিস্থিতিতে একসাথে আসার একটি কারণ হলো সিয়েনা আমার সাথে সারাটা দিন খেলেছে। আর আপনি তো বললেনই, আমরা সবাই হয়তো এরইমধ্যে আক্রান্ত হয়ে গেছি। আপনি চান আর না চান আমি আপনাকে সাহায্য করবো।”
কয়েক মুহূর্ত তার দিকে চেয়ে রইলো ব্রুডার তারপর হাল ছেড়ে দিলো সে।
ব্রুডারের পেছন পেছন সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় নীচ থেকে ভ্যাপসা বাতাসের ঝাঁপটা টের পেলো ল্যাংডন। সেই বাতাসে লিৎসজের দান্তে সিম্ফোনির সুরও ভেসে এলো।
হঠাৎ করে ল্যাংডন অদ্ভুত আর ভুতুরে এক অনুভূতিতে আক্রান্ত হলো, যেনো লম্বা লম্বা অদৃশ্য আঙুলগুলো মাটি ফুড়ে বের হয়ে তার মাংস খুবলে নিচ্ছে।
সঙ্গিত।
সিম্ফোনি কোরাস-শত কণ্ঠের শক্তি-এখন গাইছে বহুল পরিচিত একটি দান্তের প্যাসেজ, উচ্চারিত করছে দান্তের লেখার প্রতিটি ধ্বণি।
“লাসিয়েতে অগনে স্পেরানজা,” তারা এখন গাইছে, “ভই চেন ত্রাতে।
এই ছয়টি শব্দ-দান্তের ইনফার্নোর সবচাইতে বিখ্যাত একটি লাইন-সিঁড়ির নীচ থেকে মৃত্যুর গন্ধের মতো উঠে আসছে উপরে।
তার সাথে ট্রাম্পেটের মূৰ্ছনা, হর্ন আর শত কণ্ঠের কয়্যার যেনো সতর্ক করে দিচ্ছে আবার।
“লাসিয়েতে অগনে স্পেরানজা ভই চেন ত্রাতে!”
এখানে যে প্রবেশ করবে তার সমস্ত আশা তিরোহিত হবে!
.
অধ্যায় ৯১
লালচে আলোয়য়াত ভূ-গর্ভস্থ গুহাটি নরক-অনুপ্রাণিত সঙ্গিতে রীতিমতো কাঁপছে-অজস্র কণ্ঠের উল্লাস, বেহালার সুর আর ড্রামের বজ্রনিনাদ মাটির নীচে সৃষ্টি করছে ভূমিকম্প।
ল্যাংডনের চোখ যতোদূর গেলে দেখতে পেলো মাটির নীচের এ জায়গাটির মেঝে কাঁচের শিটের মতো পানিতে পরিপূর্ণ-গাঢ়, স্থির আর সমৃণ-যেনো নিউ ইংল্যান্ডের পুকুরের কালচে পানি বরফে জমে গেছে।
যে জলাধারে প্রতিফলিত হয় না আকাশের তারা।
সেই পানি থেকে জেগে উঠেছে শত শত কলাম। প্রত্যেকটির উচ্চতা ত্রিশ ফুটের মতো। এগুলো সম্মিলিতভবে গুহার বিশাল আয়তনের ভন্টেড ছাদটাকে ধরে রেখেছে। কলামগুলোর নীচে লাল আলোর স্পটলাইট জ্বালিয়ে দেবার ফলে এক ধরণের পরাবাস্তব আবহ তৈরি হয়েছে সেখানে।
ল্যাংডন আর ব্রুডার সিঁড়ির নীচে এসে কয়েক মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়ালো, তাদের সামনে লালচে আবহের গুহাটি দেখে নিলো ভালো করে।
এখানকার বাতাস তার ধারণার চেয়েও অনেক বেশি ভারি, তাই ল্যাংডন টের পেলো নিঃশ্বাস নিতে একটু কষ্ট হচ্ছে।
তাদের বাম পাশে লোকজনের ভীড়টা দেখতে পেলো। কনসার্ট অনুষ্ঠিত হচ্ছে বহু দূরের একটি দেয়ালের কাছে। শ্রোতারা বসে আছে বিশাল একটি প্লাটফর্মের উপর। অর্কেস্ট্রার চারপাশে যে কনসেন্ট্রিক রিংটা আছে সেটাকে ঘিরে বসে আছে কয়েক শ’ আর তাদের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে আরো এক শ’র মতো। আশেপাশে ব্রডওয়াকেও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে উপভোগ করছে বেশ কিছু শ্রোতা। রেলিংয়ে ঝুঁকে আছে অনেকেই। তাদের সবার দৃষ্টি নীচের কনসার্টের দিকে।
ল্যাংডন লালচে আলোয় দেখতে লাগলো আবছায়া অবয়বের সমুদ্রটি। এদের মধ্যে থেকে সিয়েনাকে খুঁজে বেড়াতে লাগলো তার চোখ। তাকে কোথাও দেখতে পেলো না। টাক্সিডো, গাউন, আলখেল্লা, বোরকা আর শর্টস, সোয়েটশার্ট পরা কিছু পর্যটককেও দেখতে পেলো। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বিভিন্ন জাতির লোকজন জড়ো হয়েছে এখানে। ল্যাংডনের মনে হলো এটা এক ধরণের ধর্মীয় অনুষ্ঠান।
সিয়েনা যদি এখানে থেকে থাকে, বুঝতে পারলো সে, তাহলে তাকে খুঁজে বের করাটা প্রায় অসম্ভব।
ঠিক এমন সময় মোটাসোটা এক লোক তাদের সামনে দিয়ে কাশতে কাশতে সিঁড়ি দিয়ে বের হয়ে গেলো। চট করে ঘুরে তাকে দেখে নিলো ব্রুডার। ল্যাংডনের মনে হলো তার গলার কাছে গিট পাকিয়ে গেছে। নিজেকে আশ্বস্ত করলো এটা তার মনের ভয়।
একটা ব্রডওয়াকের দিকে এগিয়ে গেলো ব্রুডার। চারপাশটা ভালো করে দেখে নিচ্ছে সে। তাদের সামনে যে পথটা আছে সেটা যেনো দানবদের গোলকধাঁধার প্রবেশপথ। একটা ব্রডওয়াক হঠাৎ করেই তিনটি শাখায় বিভক্ত হয়ে গেছে। পানির উপরে, কলামগুলোর মাঝখান দিয়ে চলে গেছে অন্ধকারে।
জীবনভ্রমণের মধ্যখানে এসে সহজ-সলর পথটি হারিয়ে, ভাবলো ল্যাংডন, দান্তের মাস্টারওয়ার্কের প্রথম ক্যান্টোটি মনে পড়ে গেলো তার। নিজেকে খুঁজে পেলাম এক অন্ধকার অরণ্যে।
ওয়াকওয়ের রেলিং আর পানির দিকে তাকালো ল্যাংডন। প্রায় চার ফুটের মতো গম্ভীর হবে, আর অবাক করা ব্যাপার হলো পানি বেশ স্বচ্ছ। মেঝের পাথরের টাইলগুলো দেখা যাচ্ছে। ব্রুডারও দ্রুত দেখে নিলো। তার ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে সে কিছু বুঝে উঠতে পারছে না।
“আপনি কি এমন কোনো জায়গা দেখেছেন যেটা জোবরিস্টের ভিডিও’র সাথে মেলে?”
সবজায়গাই ওরকম, মনে মনে বললো ল্যাংডন। তাদের চারপাশে খাড়া স্যাঁতস্যাঁতে দেয়ালগুলো ভালো করে দেখে নিলো। বহু দূরে, যেখানে অর্কেস্ট্রা টিম বাজাচ্ছে সেখানকার দেয়ালের দিকে ইঙ্গিত করলো সে। “আমার মনে হচ্ছে ওখানে কোথাও হবে।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো ব্রুডার। “আমিও সেরকমই ভাবছি।”
তারা দু’জন ব্রডওয়াকের উপরে উঠে গেলো, বেছে নিলো ডান দিকের একটি শাখা। ওটা চলে গেছে লোকজনের ভীড় থেকে একটু দূরে, ডুবন্ত প্রাসাদের দিকে।
যেতে যেতে ল্যাংডন ভাবলো এখানে লুকিয়ে থাকাটা কতোই না সহজ। কেউ খুঁজে বের করতে পারবে না। জোবরিস্ট এখানে খুব সহজেই ভিডিওটি তৈরি করতে পেরেছে। এক সপ্তাহের জন্য ফ্রি কনসার্টের অনুদান যে দেবে সে যদি এ জায়গায় কিছুটা সময় একান্তে থাকতে চায় তাহলে সেটা সহজইে পাবে।
এতে আর এখন কিছুই যায় আসে না।
ব্রুডারের হাটার গতি বেশ দ্রুত, যেনো অবচেতন মনে সিম্ফোনির দ্রুতলয় ঢুকে পড়েছে তার মধ্যে। এ মুহূর্তে সিম্ফোনির সেমিটোনগুলো দ্রুতলয়ে অবরোহন করছে।
দান্তে আর ভার্জিল প্রবেশ করছে মাটির নীচের নরকে।
দূরের ডান দিকের খাড়া আর স্যাঁতস্যাঁতে দেয়ালগুলো ভালো করে দেখে নিলো ল্যাংডন, তার দেখা ভিডিও’র সাথে ওগুলোর কতোটুকু মিল আছে খতিয়ে দেখলো। লোকজনের ভীড় থেকে আরো দূরে চলে গেলো তারা। এটা এখানকার একটি কনার। কতোটা পথ পেরিয়ে এসেছে সেটা দেখার জন্য পেছনে ফিরতেই ল্যাংডন অবাক হলো। অনেকটা পথ চলে এসেছে।
এখন যেখানে আছে সেখানে হাতেগোণা কিছু লোকজন থাকলেও আরেকটু ভেতরে যেতেই কাউকে দেখতে পেলো না।
ব্রুডার আর ল্যাংডন ছাড়া আর কেউ নেই।
“সবই একই রকম দেখছি,” ব্রুডার হতাশ হয়ে বললো। “কোত্থেকে খোঁজা শুরু করবো আমার?”
ল্যাংডনও তার মতো হতাশ। ভিডিওটার দৃশ্য তার ভালোই মনে আছে কিন্তু এখানে এমন কোনো জায়গা দেখতে পেলো না যার সাথে মিল খুঁজে পাবে।
ব্রডওয়ে দিয়ে যাবার সময় ল্যাংডন দেখতে পেলো কতোগুলো তথ্য নির্দেশিকা সাইন জ্বলছে মৃদু আলোতে। একটাতে বলা আছে এই জায়গায় একুশ মিলিয়ন গ্যালন পানি ধারণ করতে পারে। একটি বেখাপ্পা পিলারের গায়ে সাইন লেখা, তাতে বলা আছে কন্ট্রাকশনের সময় এই পিলারটি লুট করা হয়েছিলো। আরেকটি জায়গায় কান্নারত মুরগির চোখের সিম্বল। এই জায়গাটি নির্মাণ করতে গিয়ে যেসব দাস মারা গেছে তাদের জন্য এই কান্না।
কিন্তু একটা সাইন দেখে থমকে দাঁড়ালো ল্যাংডন।
ব্রুডারও তার দেখাদেখি থামলো। “কি হয়েছে?”
সাইনটা দেখালো প্রফেসর।
সাইনে একটি তীর নির্দেশক দেয়া আছে, আর যে নামটা লেখা আছে সেটা কুখ্যাত আর ভীতিকর এক নারী দানবের।
মেডুসা
সাইনটা পড়ে কাঁধ তুললো ব্রুডার। “তো কি হয়েছে?”
ল্যাংডনের হৃদস্পন্দন বেড়ে গেলো। সে জানে মেডুসা নিছক মাথায় অসংখ্য সাপের দানব নয়, যার চোখের চাহনিতে যে কেউ পাথর হয়ে যায়। গ্রিক প্যাহিয়েনের ভূ-গর্ভস্থ একজন দানবও বটে…থানিক দানবদের অন্তর্ভূক্ত সে।
অনুসরন করে চলে যাও ঐ ডুবন্ত প্রাসাদের সুগভীরে…
ওখানে অন্ধকারে থানিক দানব প্রতীক্ষায় আছে।
মেডুসা পথ দেখিয়ে দিচ্ছে, বুঝতে পেরে ল্যাংডন ব্রডওয়াক দিয়ে এতো দ্রুত ছুটতে লাগলো যে ব্রুডারই তার পেছনে পড়ে গেলো। মেডুসার সাইন দেখে একেবেঁকে ছুটতে লাগলো সে। অবশেষে ব্রডওয়াকের শেষমাথায় একটি ভিউয়িং প্লাটফর্মে চলে এলো।
তার সামনে একটি অবিশ্বাস্য দৃশ্য।
পানির মধ্য থেকে বিশালাকৃতির খোদাই করা মার্বেলের ব্লক বের হয়ে আছে-মেডুসার মাথা-তার মাথার চুলগুলো এক একটি সাপ। এখানে তার উপস্থিতি আরো বেশি ভীতিকর আর উদ্ভট, কেননা তার মাথাটা ঘাড়ের উপর উল্টো করে রাখা।
শাস্তি হিসেবে উল্টো করে রাখা হয়েছে, বুঝতে পারলো ল্যাংডন। তার চোখে ভেসে উঠলো বত্তিচেল্লির ম্যাপ অব হেল এবং ম্যালেবোজেসে উল্টো করে পাপীদের মাটিতে পুঁতে রাখা।
দম ফুরিয়ে ল্যাংডনের পাশে এসে দাঁড়ালো ব্রুডার। উল্টো করে রাখা মেডুসার দিকে বিস্ময়ে চেয়ে রইলো সে।
ল্যাংডনের সন্দেহ হলো এই খোদাই করা মাথাটি অন্য কোথাও থেকে লুট করে আনা হয়েছে এখানে। মেডুসাকে উল্টো করে রাখার কারণ যে একটি কুসংস্কার তাতে তার মনে কোনো সন্দেহ নেই। মনে করা হয় উল্টো করে রাখলে এই দানবীর সমস্ত অপশক্তি উধাও হয়ে যাবে। তারপরও ভীতিকর একটি চিন্তা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারলো না ল্যাংডন।
দান্তে’র ইনফার্নো। শেষ অধ্যায় অধ্যায়। পৃথিবীর কেন্দ্রবিন্দু। যেখানে মধ্যাকর্ষণ শক্তি উল্টে যায়। যেখানে উপর হয়ে যায় নীচ।
ভয়ে তার গা কাটা দিয়ে উঠলো। ভাস্কর্যের মাথাটার চারপাশে যে লালচে আলো আছে সেটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো ল্যাংডন। মেডুসার মাথার বেশিরভাগ সাপগুলো পানির নীচে ডুবে আছে। তবে তার চোখ দুটো পানির উপরে। মুখটা বাম দিকে ঘোরানো, তাকিয়ে আছে জলাধারের দিকে।
ভীতসন্ত্রস্ত ল্যাংডন রেলিং থেকে ঝুঁকে ভাস্কর্যের দৃষ্টি অনুসরণ করে ডুবন্ত প্রাসাদের পরিচিত ফাঁকা কর্নারের দিকে তাকালো।
সঙ্গে সঙ্গেই বুঝে গেলো সে।
এটাই সেই জায়গা।
জোবরিস্টের গ্রাউন্ড জিরো।
.
অধ্যায় ৯২
এজেন্ট ব্রুডার রেলিং থেকে আস্তে করে নেমে পড়লো বুকসমান পানিতে। সে খুব সতর্ক। সাবধানে চলাফেরা করছে। জলাধারের ঠাণ্ডা পানি তার শরীরে লাগতেই পেশীগুলো আড়ষ্ট হয়ে গেলো। বুটের নীচে টের পেলো এই জলাধারের মেঝেটা বেশ পিচ্ছিল, তবে বেশ শক্তও বটে। কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে চারপাশের পানিগুলো থিতু হতে দিলো সে।
ব্রুডারের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেলো কিছুক্ষণের জন্য। আস্তে আস্তে এগোও, নিজেকে বললো। পানি যেনো উছলে না যায়। তার উপরে ব্রডওয়াকে দাঁড়িয়ে
ল্যাংডন চারপাশে কড়া নজর রাখছে।
“সব ঠিক আছে, ফিসফিসিয়ে বললো সে। “কেউ আপনাকে দেখছে না।”
উল্টো করে রাখা মেডুসার মাথার দিকে তাকালো ব্রুডার। লাল রঙের স্পটলাইটের কারণে বেশ লালচে দেখাচ্ছে ওটা। পানিতে নামার পর এই দানবীকে আরো বেশি বড় মনে হচ্ছে এখন।
“মেডুসার দৃষ্টি অনুসরণ করে এগিয়ে যান,” চাপাস্বরে বললো ল্যাংডন। “সিম্বলিজম আর নাটকীয়তা জোবরিস্টের মজ্জাগত স্বভাব…মেডুসার দৃষ্টি যেখানে সেখানেই যদি ওটা রেখে থাকে তাহলে আমি মোটেও অবাক হবো না।”
মহান ব্যক্তিরা সবাই একইভাবে চিন্তা করে। আমেরিকান প্রফেসর তার সাথে জোর করে আসার জন্য ব্রুডার মনে মনে কৃতজ্ঞ বোধ করলো। ল্যাংডনের সাহায্য ছাড়া এই জায়গাটি এতো দ্রুত খুঁজে বের করা সম্ভব হতো না।
দূর থেকে দান্তের সিম্ফোনির সুর ভেসে আসছে। ব্রুডার তার ওয়াটারপ্রুফ টোভাটেক পেনলাইটটি বের করে পানির নীচে ডুবিয়ে জ্বালিয়ে দিলো। তীব্র হ্যালোজেন রশি পানির নীচটা আলোকিত করে ফেললো সঙ্গে সঙ্গে। স্পষ্ট দেখতে পেলো জলাধারের মেঝেটা। আস্তে, নিজেকে বললো ব্রুডার। সাবধানে এগোতে হবে।
আর কোনো কথা না বলে আস্তে আস্তে পানির নীচে এদিক ওদিক আলো ফেলে ফেলে এগোতে লাগলো সে।
রেলিংয়ে দাঁড়ানো ল্যাংডন অস্থির হয়ে পড়লো ভেতরে ভেতরে। গলার কাছে একটা গিটও পাকিয়ে গেলো তার। এখানকার ভ্যাপসা বাতাসে দম বন্ধ হয়ে আসার জোগার হলো। ব্রুডার পানি ভেঙে ধীরে ধীরে এগোতে লাগলে প্রফেসর নিজেকে আশ্বস্ত করলো এই বলে যে, সব কিছু ঠিকঠাক মতোই আছে।
আমরা সময়মতোই চলে এসেছি।
ওটা পুরোপুরি অক্ষত আছে।
তারপরও নিজের ভেতরে অস্থিরতা কমাতে পারলো না সে। আজীবন ক্লস্ট্রোফোবি ল্যাংডন জানে এখানে যদি সে এমনি এমনি বেড়াতেও আসততা তার দম বন্ধ হবার জোগার হতো। মাথার উপরে হাজার হাজার টন মাটি…কতোগুলো পুরনো আর ক্ষয়িষ্ণু পিলারের উপর ভর করে আছে।
মাথা থেকে এসব চিন্তা বাদ দিয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখলো কেউ উঁকি মেরে তাদেরকে দেখছে কিনা।
কেউ নেই।
কিছুটা দূরে অন্য ব্রডওয়াকের উপর দাঁড়িয়ে কনসার্ট উপভোগ করছে একদল পর্যটক। তাদের সবার নজর অর্কেস্ট্রা দলের উপর, কেউ এদিকটা ফিরেও তাকাচ্ছে না। ব্রুডার ধীরে ধীরে জলাধারের এক কোণে চলে যাচ্ছে পানি ডিঙিয়ে।
এসআরএস টিম লিডারের দিকে ফিরে তাকালো ল্যাংডন, তার পেইনলাইটের আলো অদ্ভুতভাবে আলোকিত করছে পানির নীচটা।
ল্যাংডন আশেপাশে তাকাতেই হঠাৎ করে কিছু একটা টের পেলো বাম দিকে-কালো আর ভুতুরে একটি অবয়ব পানি নীচ থেকে ব্রুডারের সামনে উঠে আসছে। সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে সেদিকে তাকালো সে। অন্ধকারে বোঝা না গেলেও কিছু একটা পানির উপরে উঠে আসতে দেখলো।
ব্রুডার থেমে গেলো, বোঝা যাচ্ছে তার চোখেও কিছু একটা ধরা পড়েছে।
দূরের এককোণে কালো আকৃতির কিছু একটা নড়াচড়া করছে দেয়ালের ত্রিশ ফিট উপরে। এই ভুতুরে অবয়বটি দেখতে অনেকটা জোবরিস্টের ভিডিওতে দেখা প্লেগ ডাক্তারের মতোই।
একটা ছায়া, বুঝতে পেরে হাফ ছাড়লো ল্যাংডন। ব্রুডারের নিজের ছায়া।
ব্রুডারের ছায়াটি দেয়ালে এমনভাবে পড়েছে যে দেখে মনে হয়েছে। ভিডিওতে দেখা জোবরিস্টের ছায়ার মতো।
“এটাই সেই জায়গা,” ব্রুডারের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বললো ল্যাংডন। “আপনি কাছাকাছি এসে পড়েছেন।”
মাথা নেড়ে সায় দিয়ে আবারো ধীরে ধীরে এগোতে লাগলো ব্রুডার। রেলিং দিয়ে তার সাথে সাথে এগোতে লাগলো ল্যাংডন। একটু পর আবারো অর্কেস্ট্রা দলের দিকে ফিরে তাকালো সে, কেউ ব্রুডারকে দেখছে না নিশ্চিত হবা জন্য।
দেখছে না।
ল্যাংডন জলাধারের দিকে আবার তাকাতেই এক ঝলক আলো তার চোখে ধরা পড়লো, পায়ের কাছে তাকাতেই দেখতে পেলো লাল তরলের ছোট্ট বিন্দু।
রক্ত।
অদ্ভুত ব্যাপার, ওটার উপর ল্যাংডন দাঁড়িয়ে আছে।
আমার কি রক্তপাত হচ্ছে?
তার অবশ্য কোনো যন্ত্রণা হচ্ছে না, তাপরও উদভ্রান্তের মতো নিজের শরীরে খুঁজে বেড়ালো কোনো ক্ষত তৈরি হয়েছে নাকি বাতাসে বিষাক্ত কিছুর কারণে এমনটি হচ্ছে। নাক, আঙুল আর কান পরীক্ষা করে দেখলো ওখান থেকে রক্তপাত হচ্ছে কিনা।
রক্তটা কোত্থেকে পড়ছে বুঝতে পারলো না সে, চারপাশে তাকালো, নিশ্চিত হতে চাইলো ফাঁকা ওয়াকওয়ে’তে সে একাই আছে।
পায়ের কাছে আবারো তাকালো ল্যাংডন। রক্তের ফোঁটার মতো কিছু পড়ে আছে ব্রডওয়াকে। তার কাছে মনে হচ্ছে উপর থেকে এগুলো পড়ছে।
উপরে আহত কেউ একজন আছে, বুঝতে পারলো সে। চট করে ব্রুডারের দিকে তাকালো, এতোক্ষণে জলাধারের মাঝখানে চলে গেছে।
লাল ফোঁটাগুলো অনুসরণ করে ব্রডওয়াক ধরে এগিয়ে গেলো সে। শেষপ্রান্তে আসার পর দেখতে পেলো ফোঁটাগুলো আরো বড় হয়ে উঠেছে। প্রচুর পরিমাণে পড়ছে এখন। এসব কী হচ্ছে? দেয়ালের দিকে তাকালো, যেখানে ব্রডওয়াকটি শেষ হয়ে গেছে।
অন্ধকারে সে দেখতে পেলো বিশাল একটি পুকুরের মতো জায়গা লাল রঙে রঞ্জিত, যেনো কাউকে ওখানে জবাই করা হয়েছে।
ঠিক তখনই ল্যাংডন দেখতে পেলো লাল ফোঁটাগুলো চুঁইয়ে চুঁইয়ে ব্রডওয়াক থেকে নীচের জলাধারে পড়ছে। সঙ্গে সঙ্গে সে বুঝতে পারলো তার ধারণা ভুল।
এটা রক্ত নয়।
বিশাল এই জায়গার লাল আলোর সাথে ব্রডওয়াকের লালচে আভা মিলেমিশে এবটি বিভ্রম তৈরি করেছে, ফলে এইসব ফোঁটাগুলোকে লালচে রক্তের ফোঁটা বলে মনে হচ্ছে তার কাছে।
এগুলো পানির ফোঁটা।
কিন্তু এটা বোঝার পর স্বস্তির বদলে তার মধ্যে হঠাৎ করে জেঁকে বসলো প্রচণ্ড ভীতি। ব্রডওয়াকের পাটাতনে এখন পায়ের ছাপ দেখতে পাচ্ছে সে।
কেউ পানি থেকে উপরে উঠে এসেছে।
ল্যাংডন ঘুরে ব্রুডারকে চিৎকার করে ডাক দিতে গেলো কিন্তু এজেন্ট অনেকটাই দূরে চলে গেছে সে, তাছাড়া দান্তের সিম্ফোনি এখন অতিনাটকীয় আবহে বেজে চলেছে কানফাটা শব্দের সাথে। আচমকা ল্যাংডনের মনে হলো তার পেছনে কেউ আছে।
আমি এখানে একা নই।
আস্তে করে ব্রডওয়াকের শেষমাথার দিকে ঘুরে তাকালো ল্যাংডন। দশ ফিট দূরে দেয়ালের কাছে গিয়ে ওটা শেষ হয়ে গেছে, ওখানে অন্ধকারের চাদর গায়ে কেউ দাঁড়িয়ে আছে, শুধু বুঝতে পারলো বিশাল আর কালো রঙের পাথরের আলখেল্লার মতো কিছু একটা দাঁড়িয়ে আছে, জলাধারের পানি পুরোপুরি ভেজা। অবয়বটি নড়ছে না।
তারপরই ওটা নড়ে উঠলো।
মাথাটা নীচু থেকে উপরে উঠে আসতেই অবয়বটি যেনো লম্বা হয়ে উঠলো কিছুটা।
কালো রঙের বোরকা পরে কেউ দাঁড়িয়ে আছে, বুঝতে পারলো ল্যাংডন।
ইসলামিক এই আবরণটি সমস্ত শরীর ঢেকে ফেলে, কিন্তু ঘোমটা দেয়া মুখটি ল্যাংডনের দিকে ফিরতেই দুটো কালো চোখ দেখতে পেলো। মুখের উপর ছোট্ট একটি ফোকর দিয়ে স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে আছে তার দিকে।
মুহূর্তে সে চিনে ফেললো।
সিয়েনা ব্রুকস লুকানো জায়গা থেকে উঠে এসেছে। ল্যাংডনের দিকে ছুটে আসতে লাগলো, ঝাঁপিয়ে পড়ে ব্রডওয়াকের উপর তাকে ফেলে দিলো সে।
.
অধ্যায় ৯৩
জলাধারের মধ্যে এজেন্ট ব্রুডার থমকে দাঁড়িয়েছিলো। তার পেনলাইটের আলো পানির নীচে মেঝেতে ধাতব কিছু খুঁজে পায়। মেঝে থেকে সেটা একটু বের হয়ে আছে।
এক পা সামনে এগিয়ে ভালো করে দেখে নেয় ব্রুডার, সতর্ক থাকে কোনোরকম যেনো নড়াচড়া না হয়। স্বচ্ছ পানির নীচে সে দেখতে পায় মেঝেতে আয়তক্ষেত্রের একটি টাইটানিয়াম ফলক পোর্তা আছে।
জোবরিস্টের ফলক।
পানি এতোটাই পরিস্কার যে উপর থেকেই সে ফলকের লেখাগুলো পড়তে পারলো :
এই জায়গায়, আজকের দিনে এ বিশ্ব চিরতরের জন্য বদলে গেছিলো।
আবারো ভাবো, মনে মনে বলে ব্রুডার। তার আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। আগামীকাল আসার আগে আমাদের হাতে বেশ কয়েক ঘন্টা সময় আছে।
জোবরিস্টের ভিডিওটার কথা স্মরণ করে পেনলাইটটা ফলকের বাম দিকে সরিয়ে নিলো সে। প্লাস্টিকের ব্যাগটা ওখানেই থাকার কথা। কিন্তু আলো ফেলার পর তার চোখ কুচকে গেলো।
কোনো ব্যাগ নেই।
আরো বামে পেনলাইটের আলো ফেললো এবার। ভিডিওতে ঠিক এখানেই ব্যাগটা দেখা গেছিলো।
নেই।
কিন্তু…ওটা তো এখানেই ছিলো!
ব্রুডারের চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো, আরো এক পা এগিয়ে গেলো সামনের দিকে। চারপাশে আলো ফেলে দেখে নিলো ভালো করে।
ব্যাগের কোনো চিহ্নই নেই! শুধু ফলকটি দেখা যাচ্ছে।
কয়েক মুহূর্তের জন্য ব্রুডার এক ধরণের আশাবাদী হয়ে উঠলো, ভাবলো এই হুমকিটা আজকের অনেক কিছুর মতোই একটি বিভ্রম ছাড়া আর কিছু না।
তাহলে কি এটা ধোঁকাবাজি ছিলো!
জোবরিস্ট কি আমাদেরকে ভয় পাইয়ে দিতে চেয়েছিলো?!
তারপরই ওটা তার চোখে পড়লো।
ফলকের বাম দিকে জলাধারের মেঝেতে চিকন একটা তার পড়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে প্রাণহীন কোনো কৃমি।
তারটার একটু দূরেই তারটার এক মাথায় স্বচ্ছ ব্যাগটার কিছু অংশ লেগে আছে। ব্রুডার সেটার দিকে চেয়ে রইলো।
সত্যটা অনুধাবন করতে কয়েক মুহূর্ত লেগে গেলো তার।
আমরা দেরি করে ফেলেছি।
পানিতে ডুবে থাকা ব্যাগটি ফেটে যাওয়ার ছবি ভেসে উঠলো তার চোখে…ওটার ভেতরে থাকা প্রাণঘাতি জীবাণু মিশে যাচ্ছে পানিতে…বুদবুদ হয়ে জলাধারের পানি থেকে উঠে আসছে উপরে।
কাঁপতে থাকা হাতে পেনলাইটটি কাঁপতে লাগলো। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ। চিন্তাভাবনা গুছিয়ে নেবার জন্য।
দ্রুত সেটা প্রার্থনায় রূপান্তরিত হলো।
ঈশ্বর আমাদের সহায় হোন।
.
“এজেন্ট ব্রুডার, রিপিট!” জলাধারে যাবার সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে নামতে সিনস্কি ওয়্যারলেসে চিৎকার করে বলতে লাগলো। “আমি আপনার জবাব পাচ্ছি না!”
এসআরএস টিম এসে পৌঁছেছে একটু আগে, ভবনের পেছনে তারা হ্যাঁজম্যাট সুট পরেছে যাতে করে কারো নজরে না পড়ে। তারা এখন অপেক্ষা করছে ব্রুডারের কাছ থেকে সংকেত পাবার জন্য।
“…ব্যাগটা ফেটে গেছে…” সিনস্কির ওয়্যালেসে ব্রুডারের কণ্ঠটা শোনা গেলো এবার। “…ওগুলো…মিশে গেছে।”
কি?! সিঁড়ি দিয়ে আরো নীচে নামার সময় সিনস্কি মনে মনে এই প্রার্থনা করলো, সে যা শুনছে ভুল শুনছে। আবার বলেন!” সিঁড়ির প্রায় গোড়ায় এসে আদেশের ভঙ্গিতে বললো সে। অর্কেস্ট্রার বাজনা বেশ জোরে শোনা যাচ্ছে এখন।
ব্রুডারের কণ্ঠটা এবার আরো পরিস্কার শোনালো। “… আবারো বলছি… জীবাণুগুলো…ছড়িয়ে পড়েছে!”
আরেকটুর জন্য সিনস্কি প্রায় হুমরি খেয়ে পড়েই যাচ্ছিলো। এটা কিভাবে হলো??
“ব্যাগটা ফেটে গেছে,” চিৎকার করে বললো ব্রুডার। “জীবাণুগুলো এখন পানিতে!”
চোখের সামনে ভূ-গর্ভের নীচে বিস্তৃত এলাকাটি দেখে ডা: এলিজাবেথ সিনস্কির শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল একটি প্রবাহ বয়ে গেলো। লালচে আলোতে দেখতে পেলো বিশাল এই জায়গাটিতে পানি আর শত শত কলাম। তারচেয়েও বড় কথা প্রচুর লোকজন আছে এখানে।
কয়েকশত হবে।
নিরীহ লোকগুলোর দিকে তাকালো সিনস্কি, তারা সবাই জোবরিস্টের আন্ডারগ্রাউন্ড মৃত্যু-ফাঁদে আটকা পড়ে আছে। দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখালো সে। “এজেন্ট ব্রুডার, এক্ষুণি উপরে চলে আসুন। আমাদেরকে এ জায়গাটি খালি করতে হবে দ্রুত।”
জবাব দিতে ব্রুডারের একটুও দেরি হলো না। “প্রশ্নই ওঠে না! দরজাটা সিল করে দিন! এখান থেকে কেউ বাইরে যাবে না!”
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার পরিচালক হিসেবে এলিজাবেথ সিনস্কি কোনো প্রশ্ন না করে তার আদেশ পালিত হচ্ছে, এটা দেখতেই অভ্যস্ত। কয়েক মুহূর্তের জন্য তার মনে হলো এসআরএস এজেন্টের কথাটা বোধহয় ভুল শুনেছে সে। দরজা বন্ধ করে দেবো?!
“ডা: সিনস্কি!” সঙ্গিতের চড়া আওয়াজের মধ্যে চিৎকার করে বললো ব্রুডার। “আপনি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন?! ঐ বালের দরজাটা বন্ধ করে দিন!”
ব্রুডার আবারো কথাটা বললো কিন্তু তার কোনো দরকার ছিলো না। সিনস্কি জানে তার কথাই ঠিক। সম্ভাব্য মহামারির মুখোমুখি হলে কন্টেইনমেন্টই হলো সবচাইতে কার্যকর অপশন।
সিনস্কি আনমনেই তার লাপিস লাজুলিটা ধরে ফেললো শক্ত করে। অল্প কয়েকজনকে বলি দিয়ে অনেককে বাঁচাও। কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো সে। ওয়্যারলেসটা ঠোঁটের কাছে তুলে ধরলো। “ঠিক আছে, এজেন্ট ব্রুডার। আমি দরজা বন্ধ করার অর্ডার দিচ্ছি।”
সিনস্কি যেই না পুরো এলাকাটি সিল করে দেবার অর্ডার দিতে যাবে অমনি হঠাৎ করে লোকজনের মধ্যে হৈহুল্লোর টের পেলো।
খুব বেশি দূরে নয়, একটি জনাকীর্ণ ব্রডওয়াক দিয়ে কালো বোরকা পরা এক মহিলা লোকজনদের ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়ে দৌড়ে আসছে তার দিকে। বোরকা পরা মহিলা সিনস্কি এবং সিঁড়ির দরজার দিকে আসছে বলেই মনে হচ্ছে।
তার পেছনে কেউ ছুটে আসছে, সিনস্কি বুঝতে পারলো। মহিলার পেছনে যে লোকটা ছুটে আসছে তাকে দেখতে পেলো এবার। বরফের মতো জমে গেলো সে। এটা তো ল্যাংডন!
তার দিকে ছুটে আসতে থাকা বোরকা পরা মহিলার দিকে এবার তাকালো সিনস্কি। দৌড়ে আসার সময় ব্রডওয়াকে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজনকে তুর্কিতে কিছু বলছে সে। সিনস্কি তুর্কি ভাষা বোঝে না কিন্তু আতঙ্কিত লোকজনের প্রতিক্রিয়া দেখে ধারণা করলো মহিলা কী বলতে পারে। “আগুন!”
লোকজনের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লো। বোরকা পরা মহিলা আর ল্যাংডনের সাথে সাথে তারাও ছুটে আসতে লাগলো দরজার দিকে। বলতে গেলে প্রায় সবাই।
ঘুরে দাঁড়ালো সিনস্কি, চিৎকার করে তার টিমকে বলতে লাগলো, “দরজা বন্ধ করে দাও! জলাধারটি বন্ধ করে দাও! এক্ষুণি!”
ল্যাংডন যখন সিঁড়ির কাছাকাছি চলে এসেছে সিনস্কি তখন সিঁড়ির মাঝপথে, চিৎকার করে দরজা বন্ধ করার হুকুম দিচ্ছে আর সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে সে। সিয়েনা ব্রুকস তার ঠিক পেছনেই। ভেজা বোরকা নিয়ে দৌড়াতে বেগ পাচ্ছে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে। তাদের দিকে ছুটে যাবার সময় ল্যাংডন টের পেলো তার পেছনে ভীতসন্ত্রস্ত জনস্রোত পাগলের মতো ধেয়ে আসছে।
“বের হবার পথ বন্ধ করো!” সিনস্কি আবারো চিৎকার করে বললো।
ল্যাংডনের লম্বা পা দুটো দ্রুত চলছে, সিয়েনার নাগাল পেয়ে যাচ্ছে সে। সিঁড়ির উপরে চেয়ে দেখলো জলাধারের ভারি দরজাটার দুটো কপাট আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
খুবই আস্তে।
সিয়েনা পেছন থেকে সিনস্কির কাঁধ ধরে হেচকা টান মেরে তাকে ফেলে দিয়ে দরজার দিকে ছুটে গেলো। তার প্রিয় লাপিস লাজুলি নেকলেসটি সিঁড়িতে পড়ে দু টুকরো হয়ে গেলো সঙ্গে সঙ্গে।
পড়ে থাকা সিনস্কিকে সাহায্য করবে নাকি সিয়েনার পিছু নেবে এই দ্বন্দ্বে পড়ে গেলেও শেষ পর্যন্ত সিঁড়ির উপরেই ছুটে গেলো ল্যাংডন।
সিয়েনা এখন তার থেকে মাত্র কয়েক ফিট দূরে, প্রায় নাগালের মধ্যে, কিন্তু দরজাটা এখনও বন্ধ হয় নি, যেটুকু ফাঁক আছে সিয়েনার জন্য যথেষ্ট। সে তার দৌড় না থামিয়েই কাঁধটা একটু অ্যাঙ্গেল করে সেই ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়লো।
দরজা দিয়ে বের হবার সময় তার ভেজা বোরকাটা হাতলের সাথে লেগে গেলে থমকে দাঁড়াতে বাধ্য হলো সে। জোর করে বের হবার চেষ্টা করলো সে কিন্তু ল্যাংডন এসে ধরে ফেললো তার বোরকার একটি অংশ। শক্ত করে ধরেই টান মেরে তাকে থামানোর চেষ্টা করলো সে। কিন্তু সিয়েনা বেপরোয়া। বোরকা থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো দ্রুত। ল্যাংডনের হাতে রয়ে গেলো সেটা।
দরজাটা বন্ধ হলে অল্পের জন্য ল্যাংডনের হাত রক্ষা পেলো, তবে বোরকাটা আটকে রইলো দুই কপাটের মাঝখানে। ল্যাংডনের পক্ষে আর বের হওয়া সম্ভব। হলো না। দরজার সামান্য ফাঁক দিয়ে সে দেখতে পেলো ব্যস্ত রাস্তা দিয়ে দৌড়ে পার হয়ে যাচ্ছে সিয়েনা। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় তার ন্যাড়া মাথাটা চকচক করছে। তার পরনে সেই নীল রঙের জিন্স প্যান্ট আর সোয়েটার। আজ সকাল থেকেই এটা পরে ছিলো সে। ল্যাংডনের মধ্যে প্রচণ্ড ক্ষোভ তৈরি হলো, নিজেকে মনে হলো বিশ্বাসঘাতকতার শিকার।
তার এই অনুভূতিটার স্থায়িত্ব হলো মাত্র কয়েক মুহূর্ত। আচমকা জনস্রোতের ঢেউ আছড়ে পড়লো ল্যাংডন আর দরজার উপরে।
সিঁড়িটা ভরে উঠলো শত শত লোকে, তারা আতঙ্কিত হয়ে চিৎকার করছে, সিম্ফোনিটাও বেসুরো হয়ে উঠেছে এখন। ল্যাংডন টের পেলো দরজার সাথে তাকে পিষে ফেলছে জনস্রোত। বুকের হাঁড় ভেঙে যাবার উপক্রম হলো।
তারপরই দরজাটা হুট করে খুলে পড়লে শ্যাম্পেনের কর্কের মতো ছিটকে সামনের ফুটপাতের উপর পড়ে গেলো ল্যাংডন। তার পেছনে ধেয়ে আসা জনস্রোত।
এসআরএস টিম আতঙ্কিত লোকজনের চিৎকার আর দরজা ভাঙার শব্দ শুনে ভবনের পেছন থেকে বেরিয়ে এলো। তাদের পরনে হ্যাঁজম্যাট পোশাক। এ দৃশ্য দেখে লোকজনের মধ্যে আতঙ্ক আরো বেড়ে গেলো।
ল্যাংডন ঘুরে রাস্তার ওপারে সিয়েনার দিকে তাকালো। যানবাহন আর লাইট ছাড়া কিছু দেখতে পেলো না।
তারপরই তার বাম দিকে রাস্তার ওপারে এক ঝলক দেখতে পেলো ন্যাড়া মাথার সিয়েনাকে। লোকজনের ভীড় ঠেলে ফুটপাত দিয়ে দৌড়ে মোড় নিয়ে নিলো সে।
আশেপাশে সিনস্কি, পুলিশ কিংবা হ্যাঁজম্যটা সুট না পরা কোনো এসআরএস এজেন্ট আছে কিনা দেখলো।
কেউ নেই।
ল্যাংডন জানে কারোর জন্য অপেক্ষা করা যাবে না।
দ্বিধা না করে উঠে দাঁড়ালো সে, দৌড়ে ছুটে চললো সিয়েনার পেছনে।
.
এদিকে নীচের জলাধারের গভীরে এজেন্ট ব্রুডার কোমর সমান পানিতে একা দাঁড়িয়ে আছে। আতঙ্কিত পর্যটক আর দর্শনার্থীরা সব হুরমুর করে বের হয়ে গেছে, এমন কি অর্কেস্ট্রা দলটিও তাদের সঙ্গিত থামিয়ে উধাও হয়ে গেছে সিঁড়ি দিয়ে।
দরজাটা বন্ধ করা যায় নি, আতঙ্কের সাথেই ব্রুডার বুঝতে পারলো। কন্টেইনমেন্ট ব্যর্থ হয়েছে।
.
অধ্যায় ৯৪
রবার্ট ল্যাংডন কোনো দৌড়বিদ নয় কিন্তু বহু বছর ধরে নিয়মিত সাঁতার কাটার কারণে তার পা দুটো বেশ শক্তিশালী হয়ে উঠেছে, আর সেগুলো লম্বা হবার সুবাদে ভালো দৌড়াতে পারছে এখন। মুহূর্তেই সে চলে এলো সিয়েনা যেখানে মোড় নিয়েছিলো সেই কর্নারে। ওখানে এসে দেখলো তার সামনে বিশাল একটি এভিনু। ফুটপাতে তার চোখ খুঁজে বেড়ালো।
ও এখানেই আছে!
বৃষ্টি থেমে গেছে, ফলে সামনের রাস্তার সবটাই পরিস্কার দেখতে পাচ্ছে সে। লুকানোর কোনো জায়গা নেই এখানে।
তারপরও সিয়েনার টিকিটাও দেখা যাচ্ছে না।
কোমরে দু’হাত রেখে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে লাগলো ল্যাংডন। বৃষ্টিভেজা রাস্তাটা ভালো করে দেখে নিলো আবার। দূরে একটি পাবলিক বাস ছাড়া আর কিছু চোখে পড়লো না। ইস্তাম্বুলে এগুলোকে অটোবাস বলা হয়ে থাকে। এভিনু ছেড়ে ওটা বেরিয়ে যাচ্ছে দ্রুত।
সিয়েনা কি ঐ বাসে উঠে পড়েছে?
এটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে হচ্ছে। সে যখন জানে সবাই তাকে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে তখন এরকম একটি বাসের ভেতরে নিজেকে ফাঁদে ফেলতে চাইবে। তবে সে যদি মনে করে কেউ তাকে এখানে আসতে দেখে নি তাহলে বাসে ওঠাটা তার দিক থেকে ঠিকই আছে।
সম্ভবত।
বাসের উপরে ওটার গন্তব্যের নাম লেখা আছে-গালাতা।
ল্যাংডন আরেকটু সামনের দিকে এগিয়ে গেলো, পথের পাশে একটি রেস্তোরাঁ থেকে বের হয়ে আসছে বয়স্ক এক লোক, তার পরনে নক্সা করা টানিক আর সাদা রঙের পাগড়ি।
“এক্সকিউজ মি,” তার সামনে এসে হাফাতে হাফাতে বললো ল্যাংডন। “আপনি কি ইংরেজি জানেন?”
“অবশ্যই জানি,” ল্যাংডনের মধ্যে প্রচণ্ড তাড়াহুড়ার ভাব দেখলেও নির্বিকার ভঙ্গিতে বললো লোকটি।
“গালাতা?! ওটা একটা জায়গার নাম না?”
“গালাতা?” জবাবে বললো লোকটি। “গালাতা ব্রিজ? গালাতা টাওয়ার? নাকি গালাতা বন্দর?”
অপসৃয়মান অটোবাসটির দিকে আঙুল তুলে দেখালো ল্যাংডন। “ঐ বাসটি কোথায় যাচ্ছে?”
পাগড়ি পরা লোকটি একটু ভেবে নিলো। “গালাতা ব্রিজ,” অবশেষে বললো সে। “পুরনো শহর ছেড়ে ওটা চলে যাবে নদীরধারে।”
উদভ্রান্তের মতো রাস্তার আশেপাশে তাকালো ল্যাংডন। দূর থেকে সাইরেনের শব্দ ভেসে আসছে।
“কি হয়েছে?” পাগড়ি পরা লোকটি চিন্তিত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলো। “সব ঠিক আছে তো?”
দৃষ্টির আড়ালে চলে যাওয়া বাসের দিকে তাকিয়ে ল্যাংডন ভাবলো ওটার পেছনে ছুটে যাওয়া মানে একটা জুয়া খেলা। কিন্তু এছাড়া তো আর কিছু করারও নেই।
“না, স্যার,” জবাব দিলো সে। “একটা ইমার্জেন্সি…আপনার সাহায্য লাগবে আমার।” কাছেই একটি বেন্টলি গাড়ি পার্ক করা আছে, সেটার দিকে ইঙ্গিত করলো সে। “এটা কি আপনার গাড়ি?”
“হ্যাঁ, কিন্তু—”
“গাড়িটা আমার দরকার,” বললো ল্যাংডন। “আমি জানি আমাদের মধ্যে কোনো পরিচয় নেই। কিন্তু মারাত্মক একটি ঘটনা ঘটে গেছে। এটা জীবন মরণের ব্যাপার।”
পাগড়ি পরা লোকটি কয়েক মুহূর্ত ল্যাংডনের চোখের দিকে চেয়ে রইলো তার কথার সত্যতা খোঁজার জন্য। অবশেষে মাথা নেড়ে সায় দিলো সে। “চলুন।”
বেন্টলিটা রাস্তা দিয়ে ছোটার সময় ল্যাংডন শক্ত করে সিটে বসে রইলো। বোঝাই যাচ্ছে গাড়ির মালিক খুবই দক্ষ ড্রাইভার। তারচেয়েও বড় কথা রাস্তার যানবাহন পাশকাটিয়ে দ্রুতগতিতে ছুটে যেতে এক ধরণের চ্যালেঞ্জ অনুভব করছে সে। যেনো বাসটা ধরতে পারলে নিজের পৌরুষ জাহির করা যাবে।
তিন ব্লক পরেই অটোবাসটির নাগাল পেয়ে গেলো তারা।
সামনের দিকে ঝুঁকে বাসের পেছন দিক দিয়ে ভেতরটা দেখার চেষ্টা করলো ল্যাংডন। ভেতরের লাইট খুবই মৃদু আলোতে জ্বলছে। যাত্রিদের আবছায়া অবয়ব। ছাড়া আর কিছু দেখা যাচ্ছে না।
“প্লিজ, বাসের সাথে সাথে থাকুন,” বললো সে। “আপনার কাছে কি ফোন আছে?”
কোনো কথা না বলে পকেট থেকে ফোন বের করে তার হাতে দিয়ে দিলো লোকটি। ল্যাংডন তাকে আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানালো কিন্তু কাকে ফোন করবে তা জানে না। সিনস্কি কিংবা ব্রুডারের কোনো নাম্বার তার কাছে নেই। সুইজারল্যান্ডে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার অফিসে ফোন করলে অনন্তকাল পার হয়ে যাবে।
“স্থানীয় পুলিশকে কিভাবে ফোন করবো?”
“এক-পাঁচ-পাঁচ,” লোকটা জবাব দিলো। “ইস্তাম্বুলের যেকোনো জায়গা থেকে এ নাম্বারে ফোন করলেই হবে।”
নাম্বারটা ডায়াল করে অপেক্ষা করলো ল্যাংডন। বেশ কয়েকবার রিং হবার পর রেকর্ড করা একটি কণ্ঠ তুর্কি আর ইংরেজিতে বলতে শুরু করলো। সে ভাবলো লাইন পেতে দেরি হবার কারণ জলাধারের সঙ্কটটি কিনা।
ডুবন্ত প্রাসাদটি সম্ভবত এ মুহূর্তে নারকীয় অবস্থায় পৌঁছে গেছে। ব্রুডারের কথা ভাবলো সে। নিশ্চয় ওখানে সে কিছু একটা খুঁজে পেয়েছে। কিন্তু কি পেয়েছে সেটাও ল্যাংডন জানে।
তাদের আগেই সিয়ে সিয়েনা পানিতে নেমেছিলো।
তাদের সামনে একটা স্টপেজে থামলো বাস। পঞ্চাশ ফিট দূরে তাদের বেন্টলি গাড়িটা। এখান থেকে যাত্রিদের ওঠা-নামা দেখতে পেলো স্পষ্ট। মাত্র তিনজন লোক বাস থেকে নামলো-তাদের সবাই পুরুষ। তারপরও ওদেরকে ভালো করে দেখলো ল্যাংডন, কারণ সে জানে সিয়েনা ধোঁকা দিতে কতোটা দক্ষ।
তার চোখ আবারো গেলো বাসের পেছনের জানালার দিকে। এবার ভেতরের বাতির আলো বেশ উজ্জ্বল, আর সেই আলোতে যাত্রিদেরকে ভালোভাবে দেখতে পেলো সে। আরো সামনের দিকে ঝুঁকে সিয়েনাকে খুঁজে গেলো।
আমি কোনো জুয়া খেলি নি। ভুল বাসের পেছনে লাগি নি!
তারপরই তাকে দেখতে পেলো।
মাথা ন্যাড়া, চওড়া কাঁধ। তার দিকে পেছন ফিরে আছে।
এটা অবশ্যই সিয়েনা।
বাসটা চলতে শুরু করলে ভেতরের আলো আবারো কমে এলো। বাতি নিভে যাবার ঠিক আগ মুহূর্তে ঘুরে জানালার দিকে তাকালো ন্যাড়া মাথাটা।
নিজের সিটে নীচু হয়ে বসে পড়লো ল্যাংডন। ও কি আমাকে দেখতে পেয়েছে? পাগড়ি পরা লোকটি এরইমধ্যে বাসের পিছু পিছু চলতে শুরু করে দিয়েছে আবার।
রাস্তাটা নীচু হয়ে নদীর পাড়ে চলে যাচ্ছে এখন। সামনের দিকে তাকিয়ে ল্যাংডন দেখতে পেলো পানির উপরে একটি ব্রিজ। যানবাহনের প্রচণ্ড ভীড় ব্রিজের উপর। সব গাড়ি থেমে আছে। সত্যি বলতে পুরো এলাকাটিই ট্রাফিক জ্যামে স্থবির হয়ে পড়েছে এ মুহূর্তে।
“মসলার বাজার, লোকটা বললো। “বৃষ্টির রাতে খুব ভীড় হয় এখানে।”
নদীর তীরে একটি অবিশ্বাস্য সুন্দর স্থাপনার দিকে আঙুল তুলে দেখালো লোকটি। একটি মসজিদ-ল্যাংডন জানে এটি নতুন একটি মসজিদ। মসলার বাজারটি যেকোনো আমেরিকান মলের চেয়ে বেশ বড়। ল্যাংডন দেখতে পেলো প্রচুর লোকজন ওখানে ঢুকছে বের হচ্ছে।
“আলো?!” গাড়ির ভেতরে একটা কণ্ঠ বলে উঠলো। “আসিল দুরুন! আলো?!”।
হাতের ফোনের দিকে তাকালো ল্যাংডন। পুলিশ।
“হ্যাঁ, বলছি!” কানে নিয়ে বললো সে। “আমার নাম রবার্ট ল্যাংডন। আমি বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার সাথে কাজ করি। আপনাদের শহরের জলাধারের বিরাট একটি সমস্যা দেখা দিয়েছে। কাজটা যে করেছে আমি এখন তাকে ধাওয়া করছি। মসলার বাজারের কাছে একটি বাসে আছে সে। যাচ্ছে
“একটু দাঁড়ান,” অপারেটর বললো। “আপনাকে আমি ডিসপ্যাঁচে কানেক্ট করে দিচ্ছি।”
“না!” ততোক্ষণে কলটা আবারো হোল্ড করা হলো।
বেন্টলির ড্রাইভার ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে তার দিকে তাকালো। “জলাধারে সমস্যা দেখা দিয়েছে মানে?!”
লাংডন ড্রাইভারকে বলতে যাবে মাত্র তখনই দেখতে পেলো বাসটা আবার থেমে যাচ্ছে।
ব্রেক লাইট!
ড্রাইভার সঙ্গে সঙ্গে সামনের দিকে তাকিয়ে বাসের পেছনে এসে থামলো গাড়িটা। বাসের ভেতরের লাইট জ্বলে উঠলে এবার সিয়েনাকে স্পষ্ট দেখলো ল্যাংডন। পেছনের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে। ইমার্জেন্সি স্টপের কর্ডটা ধরে জোরে জোরে টান মারছে বাসটা থামানোর জন্য।
ও আমাকে দেখে ফেলেছে, বুঝতে পারলো ল্যাংডন। সন্দেহ নেই গালাতা ব্রিজের ট্রাফিক জ্যামটা সিয়েনার চোখেও পড়েছে। সামনে এগোলেই তার বাসটা আটকে যাবে। সে পড়ে যাবে ফাঁদে।
চটজলদি গাড়ির দরজা খুলে নেমে পড়লো ল্যাংডন কিন্তু সিয়েনা তার আগেই বাস থেকে নেমে দৌড়াতে শুরু করে দিয়েছে। সেলফোনটা গাড়ির মালিককে দিয়ে দিলো সে। “পুলিশকে বলে দিয়েন কি হয়েছে! তাদেরকে বলবেন পুরো এলাকাটি যেনো ঘিরে ফেলে!”
ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পাগড়ি পরা লোকটি কোনোমতে সায় দিলো।
“আর আপনাকে অনেক ধন্যবাদ!” চিৎকার করে বললো ল্যাংডন। “তেসেক্কুরলের!”
এ কথা বলেই সিয়েনার পিছু নিলো সে। মেয়েটা সোজা দৌড়ে যাচ্ছে। মসলার বাজার
.
অধ্যায় ৯৫
ইস্তাম্বুলের তিনশত বছরের পুরনো মসলার বাজারটি এ বিশ্বের সবচাইতে বড় বাজার। ইংরেজি L অক্ষরের আকৃতিতে এটা বানানো হয়েছে। প্রায় আটাশিটা ঘর আছে এখানে, সেখানে শত শত স্টলে বিক্রি হয় নানা জাতের মসলা, ফলমূল, ভেষজ জিনিস আর ইস্তাম্বুলের সবত্র যে ক্যান্ডিসদৃশ্য মুখরোচক খাবারটি পাওয়া যায় সেই টার্কিশ মিষ্টি।
বাজারের প্রবেশপথটি বিশালাকারের পাথরে তৈরি গোথিক খিলান। এই বাজারের অবস্থান চিচেক পাজারি আর তাহমিস স্ট্রিটের মাঝখানে। বলা হয়ে থাকে প্রতিদিন এখানে তিনলক্ষ লোক আসে বাজার সদাই করতে, নয়তো এমনি এমনি ঘুরে বেড়াতে।
আজরাতে ওখানে ঢুকতেই ল্যাংডনের মনে হলো তিনলক্ষ লোক ঝুঝি একসাথেই এসে পড়েছে। এখনও সে দৌড়াচ্ছে, তার চোখ সিয়েনার উপর নিবদ্ধ। এক মুহূর্তের জন্যও মেয়েটার উপর থেকে চোখ সরায় নি। তার থেকে মাত্র বিশ গজ দূরে আছে সে। বাজারের ভেতরে ঢুকে পড়ছে সিয়েনা। থামার কোনো লক্ষণই নেই।
লোকজনের ভীড় ঠেলে একেঁবেঁকে দৌড়ে চলছে সিয়েনা। বাজারের ভেতরে কিছুটা গিয়েই একঝলক পেছন ফিরে ল্যাংডনের দিকে তাকালো সে। যেনো ভীতসন্ত্রস্ত ছোট্ট মেয়ের চোখ। ভয় পেয়ে পালাচ্ছে…মরিয়া এবং নিয়ন্ত্রনহীন।
“সিয়েনা!” চিৎকার করে বললো সে।
তার কথার কর্ণপাত না করে সোজা ঢুকে পড়লো জনস্রোতের ভেতরে।
মানুষের গায়ে ধাক্কা খেয়ে, হোঁচট খেয়ে কোনোমতে সামনে এগিয়ে ল্যাংডন তাকে দেখতে পেলো। বাজারের পশ্চিম দিকে মোড় নিয়ে চলে যাচ্ছে।
বাজারের দু’পাশে সারি সারি মসলার ঝুড়ি-ভারতীয় মসলা, ইরানের জাফরন, চীনের ফ্লাওয়ার চা-নানান রঙের আর বর্ণের সামগ্রী। প্রতিটি পদক্ষেপে নতুন নতুন সুগন্ধী নাকে এসে লাগলো ল্যাংডনের। সেই সাথে মানুষের ভীড়ে তার দম বন্ধ হবার জোগার হলো।
হাজার হাজার লোক।
ক্লস্ট্রোফোবিয়া পেয়ে বসলো তাকে। ব্যাপারটাকে আমলে না নিয়ে বাজারের আরো ভেতরে ছুটে চললো সে। সামনেই সিয়েনাকে দেখতে পাচ্ছে।
কয়েক মুহূর্তের জন্য ল্যাংডনের মনে হলো মেয়েটার পেছনে সে ছুটছে কেন।
তাকে ধরে বিচার করার জন্য? যে কাজ সে করেছে ধরা পড়লে তার কী শাস্তি হতে পারে সে ব্যাপারে ল্যাংডনের কোনো ধারণাই নেই।
নাকি ভয়াবহ জীবাণু ছড়িয়ে পড়া থামানোর জন্য? কিন্তু যা হবার তাতো হয়েই গেছে।
জনসমুদ্রের মধ্য দিয়ে ছুটে চলার সময় ল্যাংডন বুঝতে পারলো আসলে কেন তার পেছনে এভাবে ছুটে বেড়াচ্ছে সে।
আমি তার কাছ থেকে জবাব চাই।
মাত্র দশ গজ দূরে একটি দরজা দেখা গেলো, এটা দিয়ে পশ্চিম দিকে বের হওয়া যায়। সিয়েনা সেটা দিয়ে ঢুকে পড়লো সোজা। ঢোকার আগে আবারো পেছন ফিরে চকিতে ল্যাংডনকে দেখে নিলো। এতোটা কাছে চলে এসেছে বলে তার মধ্যে আতঙ্ক দেখা গেলো এবার। দরজা দিয়ে ঢোকার পর পরই হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলো সে।
নিজের পতন ঠোকাতে কোনো কিছু ধরার জন্য হাত বাড়িয়ে সামনে এক ঝুড়ি পেস্তা বাদামের উপর থাবা মেরে বসলো, সঙ্গে সঙ্গে ঝুড়ির সমস্ত বাদামসহ পড়ে গেলো মেঝেতে।
এক দৌড়ে ল্যাংডন ওখানে এসে দেখলো মাটিতে বাদাম ছড়িয়ে আছে, কিন্তু সিয়েনার টিকিটাও দেখা যাচ্ছে না।
দোকানদার পাগলের মতো চিৎকার করে গালি দিচ্ছে।
মেয়েটা গেলো কোথায়?!
দ্রুত চারপাশটা দেখে নিলো ল্যাংডন। বুঝতে পারলো মেয়েটা আসলে ইচ্ছাকৃতভাবে পড়ে গেছিলো। ওটা কোনো দুর্ঘটনা ছিলো না।
দরজা দিয়ে বের হয়ে একটি খোলা চত্বরে চলে এলো সে। এখানেও লোকজনের কোনো কমতি নেই। জায়গাটা ভালো করে দেখে বুঝতে পারলো এভাবে মেয়েটাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না।
তার সামনে কয়েকটি লেনের হাইওয়ে, তাদের একটা চলে গেছে গালাতা ব্রিজের দিকে। তার পাশেই আছে নতুন মসজিদটি। দুটো মিনার খোলা চত্বরের শেষে দাঁড়িয়ে আছে। তার বামে খোলা চত্বর ছাড়া আর কিছু নেই…লোকজনে ভরপুর।
যানবাহনের হর্নের শব্দে ল্যাংডনের দৃষ্টি চলে গেলো হাইওয়ের দিকে। পানি আর চত্বরটির মাঝখান দিয়ে চলে গেছে সেটা। সিয়েনাকে দেখতে পেলো প্রায় একশ’ গজ দূরে, যানবাহনের ভীড়ে ছুটে চলছে, আরেকটুর জন্য দু দুটো ট্রাকের সামনে পড়ে যেতো সে। সমুদ্রের দিকে যাচ্ছে মেয়েটি।
ল্যাংডনের বামে গোল্ডেন হর্নের তীরে ফেরি, অটোবাস, ট্যাক্সি আর টুরবোট ভীড় করে আছে।
হাইওয়ের দিকে ছুটে গেলো ল্যাংডন। প্রতিটি লেন গার্ড-রেলিং দিয়ে সুরক্ষিত, তবে সেগুলোর উচ্চতা তিন ফিটের বেশি হবে না। ছুটে চলা যানবাহনের মধ্য দিয়েই, কখনও থেমে কখনও দৌড়ে একে একে গার্ড রেলিংগুলো টপকে চলে এলো সমুদ্রের তীরে।
সিয়েনাকে সে দেখতে পেলেও এতোক্ষণে অনেক দূরে চলে গেছে সে। ডকের দিকে দৌড়ে যাচ্ছে মেয়েটি। ওখানে বিভিন্ন ধরণের নৌকা, স্পিডবোট আর নৌযান ভীড়ে আছে। ওপারের গোল্ডেন হর্নের পূর্ব দিকে আলোকিত শহরটাও দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট। ল্যাংডনের মনে কোনো সন্দেহ নেই, একবার ওপারে চলে যেতে পারলে সিয়েনার নাগাল পাওয়া যাবে না। হয়তো চিরতরের জন্যই।
ওয়াটারফ্রন্টে এসেই বাম দিকের ব্রডওয়াক ধরে এগোতে লাগলো ল্যাংডন। এভাবে দৌড়ে যেতে দেখে পর্যটকেরা অবাক চোখে চেয়ে আছে তার দিকে।
বহু দূরে সিয়েনাকে দেখতে পাচ্ছে সে। এখন আর দৌড়াচ্ছে না। অনেকগুলো প্রাইভেট পাওয়ারবোট ভীড়ে আছে এমন একটি ডকের উপর দাঁড়িয়ে আছে, একজন মালিকের কাছে অনুনয়-বিনয় করছে তাকে বোটে তোলার জন্য।
তাকে উঠতে দেবেন না!
এদিকে ছুটে যাবার সময় ল্যাংডন দেখতে পেলো সিয়েনা এবার পাওয়ারবোটের হুইল ধরে থাকা এক তরুণের সঙ্গে কথা বলছে। ঐ বোটটা মাত্র ডক ছেড়ে চলে যাবার প্রস্ততি নিচ্ছে।
তরুণ মাথা ঝাঁকিয়ে দ্রভাবে হেসে না করছে তাকে কিন্তু সিয়েনা হাল ছাড়ছে না। তরুণ আর কথা না বলে বোটটা ঘোরাতে শুরু করলো এবার।
ল্যাংডন আরো কাছে এগিয়ে যেতেই সিয়েনা তার দিকে ফিরে তাকালো, তার চোখেমুখে বেপরোয়া মনোভাব। তার নীচে বোটটা আওয়াজ করতে করতে ঘুরে চলে যাচ্ছে।
হঠাৎ করেই শূন্যে লাফ দিয়ে বোটটার ফাইবার গ্লাসের উপর আছড়ে পড়লো সিয়েনা। বোটের ড্রাইভার অবিশ্বাসে চেয়ে রইলো তার দিকে। থ্রটল টেনে বোটটা থামিয়ে রেগেমেগে সিয়েনার দিকে তেড়ে গেলো সে। বোটটা এখন ডক থেকে কমপক্ষে বিশ গজ দূরে পানির উপরে আছে।
লোকটা সিয়েনার কাছে আসতেই চট করে তার হাতের কব্জি ধরে ফেললো, এক হ্যাঁচকা টানে তাকে বোটের উপর থেকে ফেলে দিলো পানিতে। কয়েক মুহূর্ত পরই সে পানির উপর মাথা বের করে প্রচণ্ড ক্ষোভের সাথে তুর্কি ভাষায় গালাগালি দিতে লাগলো।
নির্বিকারভাবে সিয়েনা বোটের উপর রাখা একটি বয়া ফেলে দিলো পানির উপরে, লোকটার খুব কাছেই। তারপর হুইলটা ধরে আবারো ছুটতে শুরু করলো
ডকের উপর দাঁড়িয়ে আছে ল্যাংডন। দম ফুরিয়ে হাফাচ্ছে। চেয়ে চেয়ে দেখছে সাদা রঙের বোটটা পানি দিয়ে ছুটে চলেছে ওপারে। আস্তে আস্তে সেটা অন্ধকারে হারিয়ে গেলো। দূরের অন্ধকার সাগরের দিকে তাকালো ল্যাংডন। সে জানে সিয়েনা যে কেবল ওপারে যেতে পারে তা-ই না, বরং কৃষ্ণসাগর আর ভূ মধ্যসাগরেও চলে যেতে পারে ইচ্ছে করলে।
চলে গেছে সে।
কাছেই বোটের মালিক পানি থেকে উপরে উঠে এলো। দেরি না করে পকেট থেকে মোবাইলফোন বের করেই পুলিশকে জানাতে লাগলো সে।
চুরি করা বোটের আলো ফিকে হয়ে এলে নিজেকে খুব একা মনে হলো ল্যাংডনের। তবে বোটের ইঞ্জিনের শব্দটা এখনও শুনতে পাচ্ছে।
তারপরই আচমকা ইঞ্জিনের শব্দ থেমে গেলো।
দূরের অন্ধকারে চোখ কুচকে তাকালো ল্যাংডন। ও কি ইঞ্জিন বন্ধ করে দিয়েছে?
বোটের লাইটও বন্ধ, নৌযানটি এখন গোল্ডেন হর্নের পানিতে ঢেউয়ে ভাসছে। অজ্ঞাত কোনো কারণে সিয়েনা ব্রুকস থামিয়ে দিয়েছে সব।
বোটের গ্যাস কি ফুরিয়ে গেছে?
কানে হাত দিয়ে শোনার চেষ্টা করলো ল্যাংডন। এবার ইঞ্জিনের মৃদু গুঞ্জন তার কানে গেলো। গ্যাস যদি শেষ না হয়ে থাকে তাহলে সে কি করছে?
অপেক্ষা করলো ল্যাংডন।
দশ সেকেন্ড। পনেরো সেকেন্ড। ত্রিশ সেকেন্ড।
তারপর হঠাৎ করেই ইঞ্জিনটা আবার গর্জে উঠলো। ল্যাংডনকে বিস্মিত করে। দিয়ে বোটের লাইট জ্বলে উঠলো, দেখা গেলো ঘুরে যাচ্ছে সেটা। ছুটে আসছে তার দিকে।
ও ফিরে আসছে।
বোটটা কাছে আসতেই সিয়েনাকে হুইলে দেখতে পেলো সে। উদাসভাবে সামনের দিকে চেয়ে আছে।
ত্রিশগজ দূরে গতি কমিয়ে দিলো সিয়েনা, আস্তে আস্তে সেটা এগিয়ে আসতে লাগলো ডকের দিকে। তারপর ইঞ্জিন বন্ধ করে দিলো।
নিঃশব্দ।
ডকের উপর থেকে ল্যাংডন অবিশ্বাসে চেয়ে রইলো তার দিকে।
সিয়েনা তার দিকে তাকিয়ে নেই।
দু’হাতে মুখ না ঢেকে সিয়েনার হাত দুটো কাঁপতে লাগলো। তার কাঁধটাও ঝুলে পড়েছে। অবশেষে ল্যাংডনের দিকে তাকালো সে। তার দু’চোখে জল।
“রবার্ট,” ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বললো। আমি আর পালাতে পারছি না। আমার কোথাও যাবার জায়গা নেই।”
.
অধ্যায় ৯৬
ওটা ছড়িয়ে পড়েছে।
জলাধারে যাবার সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে একটু আগে ফাঁকা হওয়া ভূ-গর্ভস্থ জায়গাটার দিকে তাকালো এলিজাবেথ। এখন সে রেসপিরেটরি পরে আছে মুখে তাই শ্বাস নিতে একটু কষ্ট হচ্ছে। যদিও নীচে যে জীবাণুই থেকে থাকুক না কেন এরইমধ্যে সে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে, তারপরও হ্যাঁজম্যাট সুট পরে এসআরএস টিমের সাথে নীচে নেমে আসার সময় স্বস্তি বোধ করলো। তাদের সবার পরনে। সাদা জাম্পসুট, মাথায় এয়ারটাইট হেলমেট। দেখে মনে হতে পারে একদল নভোচারি ভিনগ্রহের কোনো স্পেসশিপ থেকে নেমে এসেছে।
সিনস্কি জানে উপরের রাস্তায় শত শত কনসার্টের দর্শক আর সঙ্গিতজ্ঞ বিভ্রান্ত হয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে। অনেককেই পদপিষ্ট হবার কারণে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে এখন। অনেকেই এলাকা ছেড়ে উধাও হয়ে গেছে। হাটুতে সামান্য ছিলে যাওয়া আর নেকলেসটা ভাঙা ছাড়া তার কোনো ক্ষতি হয় নি বলে নিজেকে সৌভাগ্যবতী মনে করলো।
জীবণুর চেয়েও দ্রুতগতিতে একটা জিনিস ছড়াতে পারে, ভাবলো সিনস্কি। আর সেটা হলো আতঙ্ক।
উপরতলার দরজা এখন তালা মারা, বায়ুরোধকভাবে সিল করা আছে, সেখানে পাহারা দিচ্ছে স্থানীয় পুলিশ। তারা আসার পর সিনস্কি আশংকা করেছিলো তাদের সাথে হয়তো এখানে আসার আইনগত বৈধতা নিয়ে তর্কবিতর্ক শুরু হয়ে যাবে কিন্তু সেটা আর হয় নি, এসআরএস টিমের সদস্যদের হ্যাঁজম্যাট সুট দেখে আর সিনস্কির কাছে থেকে সম্ভাব্য প্লেগের সতর্কতা শুনে তারা চুপসে যায়।
এখন আমরা আমাদের মতো কাজ করবো, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার ডিরেক্টর ভাবলো। জলাধারের শত শত কলামের অরণ্যের দিকে চেয়ে আছে সে। এখন আর কেউ নীচে আসতে চাইবে না।
তার পেছনে দু’জন এজেন্ট বিশাল বড় একটি পলিইউরিথিন শিট খুলে ওগুলো হিটগান দিয়ে দেয়ালে লাগিয়ে দিচ্ছে। আরো দু’জন ব্রডওয়াকের পাটাতনের উপর ফাঁকা একটি জায়গা খুঁজে পেয়েছে, তারা এখন ইলেক্ট্রনিক গিয়ার দিয়ে ক্রাইমসিন পরীক্ষা করে দেখছে।
এটা আসলেই একটি ক্রাইমসিন, মনে মনে বললো সিনস্কি।
এখান থেকে দৌড়ে পালিয়ে যাওয়া ভেজা বোরকা পরা মহিলার কথা ভাবলো আবার। সব দেখে মনে হচ্ছে, সিয়েনা ব্রুকস নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার জীবাণু কন্টেইনমেন্ট করার প্রচেষ্টাকে স্যাবোট্যাজ করে জোবরিস্টের পরিকল্পনা বাস্তাবায়ন করেছে। মেয়েটা এখানে এসে ঐ ব্যাগটা ফাটিয়ে দিয়েছে…
ল্যাংডন মেয়েটার পেছন পেছন কোথায় যে গেছে সেটা জানে না সিনস্কি। তাদের দুজনের কি হয়েছে সে সম্পর্কে এখনও কোনো খবর পায় নি।
আশা করি প্রফেসর ল্যাংডন নিরাপদে আছে, মনে মনে বললো সে।
এজেন্ট ব্রুডার পানি থেকে উঠে ব্রডওয়াকের উপর দাঁড়িয়ে আছে, তার দৃষ্টি। উল্টো করে রাখা মেডুসার মাথার দিকে।
একজন এসআরএস এজেন্ট হিসেবে ব্রুডারের মাইক্রো-কসমিক স্তরে চিন্তা করার প্রশিক্ষণ আছে। দীর্ঘ মেয়াদে যতোদূর সম্ভব বেশি সংখ্যক মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য নিজের ব্যক্তিগত চিন্তা আর নৈতিক প্রশ্নগুলোকে দূরে সরিয়ে রাখতে অভ্যস্ত সে। এ মুহূর্তের আগে পর্যন্ত নিজের স্বাস্থ্যের ঝুঁকি নিয়ে সে মোটেও ভেবে দেখে নি। আমি ঐ জীবাণুভর্তি পানিতে নেমেছি, মনে মনে বললো। এরকম ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করার জন্য নিজেকে গালমন্দ করলো সে, যদিও না করে তার কোনো উপায়ও ছিলো না। আমাদের দরকার ছিলো তাৎক্ষণিক মূল্যায়ন।
এখন কি করতে হবে সেটা নিয়ে ভাবার চেষ্টা করলো ব্রুডার-এখন প্ল্যান বি নিয়ে কাজ করতে হবে। দুভাগ্যের ব্যাপার হলো কন্টেইনমেন্ট সঙ্কটের সময় প্ল্যান বি মানে : পরিধি বাড়িয়ে নেয়া। এরকম মারাত্মক সংক্রামক জীবাণুর সাথে লড়াই করা বনের দাবানলের সাথে যুদ্ধ করার শামিল : কখনও কখনও যুদ্ধে জেতার জন্য তোমাকে একটু পিছিয়ে যেতে হয়, আত্মসমর্পন করতে হয়।
এখনও পরিপূর্ণ কন্টেইনমেন্ট করা যে সম্ভব সেই আইডিয়া ব্রুডার বাতিল করে দেয় নি। মনে হচ্ছে লোকজনের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ার কয়েক মিনিট আগে সিয়েনা ব্রুকস ঐ ব্যাগটা ফাটিয়ে দিয়েছে। এটা মেনে নিলেও একটা কথা থেকে যায়। কনসার্ট দেখতে আসা সাধারণ লোকজন আর পর্যটকেরা জীবাণুর উৎস থেকে বেশ দূরে ছিলো। পানিতে জীবাণু ছড়িয়ে পড়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই তো তারা এখান থেকে দৌড়ে চলে গেছে। তাদের কেউ সংক্রমিত হয়। নি।
তবে ল্যাংডন আর, সিয়েনা বাদে, বুঝতে পারলো ব্রুডার। তারা দুজনেই এই গ্রাউন্ড জিরো’তে ছিলো, এখন শহরের কোথাও আছে তারা।
ব্রুডার আরেকটি ব্যাপার নিয়ে চিন্তিত-বলা যেতে পারে এটা একটা ফাঁক। যুক্তির ফাঁক। পানিতে সে ঐ ব্যাগটি দেখে নি। ওটা যদি সিয়েনা ফাটিয়ে দিয়ে থাকে-লাথি মেরে কিংবা যেভাবেই হোক-তাহলে ব্যাগের ভগ্নাবশেষ খুঁজে পেতো আশেপাশে। কিন্তু ব্রডার সেরকম কিছু পায় নি। মনে হচ্ছে ব্যাগের ভগ্নাবশেষও উধাও হয়ে গেছে। ব্রুডারের সন্দেহ সিয়েনা ঐ ব্যাগটি সঙ্গে করে নিয়ে গেছে, সেক্ষেত্রে ওটা আর তেমন ক্ষতিকারক কিছু থাকবে না।
তাহলে ওটা গেলো কোথায়?
ব্রুডারের মধ্যে একটা অস্বস্তি কাজ করছে, এখানে কিছু একটা মিসিং আছে। তারপরও নতুন করে একটি কন্টেইনমেন্ট স্ট্র্যাটেজি নিয়ে ভেবে গেলো। কিন্তু এক্ষেত্রে একটি জটিল প্রশ্নের জবাব জানতে হবে।
বর্তমানে জীবাণু সংক্রমণের পরিধিটি কি?
ব্রুডার জানে কয়েক মিনিটের মধ্যেই এ প্রশ্নের জবাব পাওয়া যাবে। তার টিম ব্রডওয়াকের উপর থেকে শুরু করে জলাধারের চারদিকে বেশ কয়েকটি ভ্রাম্যমান ভাইরাস-ডিটেকশন ডিভাইস সেটআপ করেছে। এইসব ডিভাইস পিসিআর ইউনিট নামে পরিচিত, পলিমিরেজ চেইন ডিটেকশন ব্যবহার করে সংক্রমিত ভাইরাসের উপস্থিতি চিহ্নিত করতে পারে।
এসআরএস এজেন্ট এখনও আশাবাদী। পানিতে কোনো নড়াচড়া না করলে আর অল্প সময়ের মধ্যে পিসিআর ডিভাইস জীবাণুর উপস্থিতি চিহ্নিত করতে পারলে তারা দ্রুত সাকশন ব্যবহার করে পানিগুলো তুলে নিয়ে কেমিক্যালের সাহায্যে জীবাণুগুলো নষ্ট করে ফেলতে পারবে।
“প্রস্তত?” মেগাফোনের সাহায্যে একজন টেকনিশিয়ান তাকে বললো।
জলাধারের চারপাশে থাকা এজেন্টরা বুড়ো আঙুল তুলে সায় দিলো একসঙ্গে।
“স্যাম্পলগুলো রান করো,” মেগাফোনের কণ্ঠটা বলে উঠলো এবার।
পুরো জলাধার জুড়ে অ্যানালিস্টরা নিজেদের কাছে থাকা পিসিআর ডিভাইস নিয়ে কাজে নেমে পড়লো। এ কাজ যখন চলছে তখন নীরবতা নেমে এলো, চাপা উৎকণ্ঠা আর আশংকায় সবাই অস্থির ভেতরে ভেতরে। একটাই প্রার্থনা করছে, যেনো সবুজ বাতি জ্বলে ওঠে।
তারপরই ওটা ঘটলো।
ব্রুডারের কাছে যে মেশিনটি ছিলো সেটার ভাইরাস-ডিটেকশনের লাল বাতিটা জ্বলে উঠলো। তার পেশী আড়ষ্ট হয়ে গেলো সঙ্গে সঙ্গে। পরের মেশিনটার দিকে চোখ গেলো তার।
ওটারও লাল বাতি জ্বলে উঠলো।
না।
জলাধারের ভেতরে চাপা উৎকণ্ঠা আর দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শোনা যেতে লাগলো এবার। সুতীব্র ভয়ের সাথে ব্রুডার দেখতে পেলো সবগুলো পিসিআর মেশিনের লাল বাতি জ্বলে উঠছে একের পর এক। জলাধারের প্রবেশপথের সামনে থেকে। পুরোটা এলাকায়।
হায় ঈশ্বর…মনে মনে বলে উঠলো সে। জ্বলতে-নিভতে থাকা লাল বাতিগুলো ভয়াবহ একটি আবহ তৈরি করেছে চারপাশে।
জীবাণু সংক্রমণের পরিধি খুবই ব্যাপক।
পুরো জলাধারটিই ভাইরাসে পরিপূর্ণ।
.
অধ্যায় ৯৭
রবার্ট ল্যাংডন সিয়েনার দিকে চেয়ে আছে। সে একটু আগে যা দেখেছে সেটা এখনও বুঝে উঠতে পারছে না।
“আমি জানি তুমি আমাকে ঘৃণা করছো,” ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বললো মেয়েটি। তার চোখ বেয়ে অশ্রু পড়ছে।
“ঘৃণা করবো তোমাকে?!” বিস্মিত হলো লাংডন। “আমার তো ন্যূনতম ধারণাই নেই তুমি কে! তুমি আমার সাথে শুধু মিথ্যেই বলে গেছো!”
“আমি জানি,” আস্তে করে বললো সে। “সেজন্যে আমি দুঃখিত। আমি ঠিক কাজটা করার চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম।”
“প্লেগ ছড়িয়ে দিয়ে?”
“না, রবার্ট। তুমি বুঝবে না।”
“অবশ্যই বুঝি!” জবাব দিলো ল্যাংডন। “আমি ভালো করেই জানি তুমি পানিতে নেমে ঐ ব্যাগটা ফাটিয়ে দিয়েছো! কেউ ওটা কন্টেইন করার আগেই তুমি জোবরিস্টের ভাইরাস ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলে!”
“ব্যাগ?” বুঝতে না পেরে বললো সিয়েনা। “আমি জানি না তুমি কী বলছো। রবার্ট, আমি ওখানে গেছিলাম বারট্রান্ডের ভাইরাসটা চুরি করে চিরতরের জন্য গায়েব করে ফেলতে…যাতে কেউ ওটা নিয়ে স্টাডি করতে না পারে, এমনকি ডা: সিনস্কি এবং বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থাও।”
“চুরি করতে গেছিলে? বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার কাছ থেকে কেন ওটা দূরে রাখতে চেয়েছো?”
লম্বা করে নিঃশ্বাস নিলো সিয়েনা। “অনেক কিছু আছে যা তুমি জানো না। কিন্তু এখন সব হয়ে প্রকাশ হয়ে গেছে। আমরা অনেক দেরি করে ফেলেছি, রবার্ট। সময় মতো এখানে আসতে পারি নি।”
“অবশ্যই সময় মতো এসেছিলাম! আগামীকালের আগে তো ভাইরাসটা রিলিজ করার কথা ছিলো না! এই দিনটা জোবরিস্ট নিজেই বেছে নিয়েছিলো, তুমি যদি পানিতে—”
“রবার্ট, আমি ভাইরাসটা রিলিজ করি নি!” চিৎকার করে বললো সিয়েনা। “আমি ওখানে গিয়ে ওটা খোঁজার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু বড় দেরি হয়ে গেছে। ওখানে ব্যাগটা ছিলো না।”
“আমি তোমার কথা বিশ্বাস করি না,” বললো ল্যাংডন।
“সেজন্যে তোমাকে দোষও দেই না আমি।” পকেট থেকে একটা দোমড়ানো মোচড়ানো প্যালেট বের করে দেখালো। “হয়তো এটা পড়লে তুমি বুঝতে পারবে।” কাগজটা ল্যাংডনের হাতে দিলো সে। “জলাধারের পানিতে নামার আগে এটা আমি পেয়েছি।”
কাগজটা পড়ে দেখলো সে। জলাধারে দান্তের সিম্ফোনিটি সাত দিনব্যাপী পরিবেশন করা হবে।
“তারিখটা দেখো,” মেয়েটি বললো।
তারিখটা পড়লো ল্যাংডন, পর পর দু’বার। কাগজের লেখাটা পড়ে হতভম্ব হয়ে গেলো সে। কোনো একটা কারণে ল্যাংডন ভেবেছিলো আজকের রাত থেকে সপ্তাহব্যাপী পারফর্মেন্সের শুরু-চলবে টানা সাতদিন। যাতে করে প্রচুর সংখ্যক মানুষ ভাইরাসে সংক্রমিত হয়। কিন্তু এই প্রোগ্রামটা ভিন্ন কথা বলছে।
“আজরাতে অনুষ্ঠানটির শেষ শো ছিলো?” কাগজ থেকে চোখ তুলে জানতে চাইলো ল্যাংডন। “অর্কেস্ট্রা দলটি পুরো সপ্তাহ জুড়ে পারফর্ম করে গেছে?”
সায় দিলো সিয়েনা। “তোমার মতো আমিও অবাক হয়েছি।” একটু থামলো সে। তার চোখ দুটো দ্যুতিহীন। “ভাইরাসটা অনেক আগেই ছড়িয়ে পড়েছে, রবার্ট। প্রায় এক সপ্তাহ ধরে।”
“এটা সত্যি হতে পারে না,” একমত হতে পারলো না ল্যাংডন। “আগামীকাল ছিলো সেই দিন। জোবরিস্ট এমনকি একটি ফলকে ওটা লিখে রেখে গেছে।”
“হ্যাঁ, আমিও পানির নীচে ফলকটি দেখেছি।”
“তাহলে তুমি জানো সে আগামীকালের দিনটি ঠিক করে রেখেছিলো।”
দীর্ঘশ্বাস ফেললো সিয়েনা। “রবার্ট, আমি বারট্রান্ডকে অনেক ভালো করে চিনি। সে একজন বিজ্ঞানী ছিলো, রেজাল্ট-অরিয়েন্টড মানুষ। এখন আমি বুঝতে পারছি ফলকে যে তারিখটা লেখা আছে সেটা ভাইরাস ছাড়ার তারিখ নয়। এটা অন্য কিছু। তার উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ কিছু।”
“আর সেটা কি…?”
সিয়েনা বোট থেকে উপরে ডকের দিকে তাকালো। “এটা বিশ্বব্যাপী-ছড়িয়ে পড়ার তারিখ-এই দিনের পর তার ভাইরাস সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়বে-প্রতিটি মানুষকে সংক্রমিত করবে। জোবরিস্ট এটা হিসেব করে রেখেছিলো।”
কথাটা শুনে ল্যাংডনের ভেতরে ভয়ের শীতল একটি প্রবাহ বয়ে গেলো, তবে মেয়েটা মিথ্যে বলছে বলেও সন্দেহ করতে লাগলো সে। তার গল্পে মারাত্মক খুঁত আছে। সিয়েনা ব্রুকস ইতিমধ্যেই প্রমাণ করেছে সে সব কিছু নিয়েই মিথ্যে বলতে পারে।
“একটা সমস্যা আছে, সিয়েনা,” তার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো সে। “এই প্লেগের ভাইরাস যদি সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে থাকে তাহলে লোকজন অসুস্থ হয়ে পড়ছে না কেন?”
মুখ সরিয়ে নিলো সিয়েনা। চোখে চোখে রাখতে পারছে না যেনো।
“এক সপ্তাহ ধরে যদি এই প্লেগটা ছড়িয়ে পড়তে থাকে তাহলে লোকজন মারা যাচ্ছে না কেন?”
আস্তে করে তার দিকে তাকালো মেয়েটি। “কারণ…” কথাটা বলতে গিয়ে। তার গলা ধরে এলো। “বারট্রান্ড কোনো প্লেগ সৃষ্টি করে নি।” আবারো তার দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগলো। “সে যেটা সৃষ্টি করেছে সেটা আরো বেশি বিপজ্জনক।”
.
অধ্যায় ৯৮
রেসপিরেটরি দিয়ে অক্সিজেনের প্রবাহ থাকলেও এলিজাবেথ সিনস্কির মনে হলো তার মাথাটা হাল্কা হয়ে গেছে। ব্রুডার আর তার টিম ভয়ঙ্কর সত্যটা জানার পর পাঁচ মিনিট চলে গেছে।
কন্টেইনমেন্ট করার সুযোগটি বহু আগেই হাতছাড়া হয়ে গেছে।
বোঝা যাচ্ছে ঐ জীবাণু ভর্তি ব্যাগটি পানিতে মিশে গেছে আরো এক সপ্তাহ আগে, কনসার্টের শুরুর রাতে। সিনস্কি এখন জানতে পেরেছে ওরা সাতদিন ধরেই পারফর্ম করছিলো। যে তারের সাথে ঐ ব্যাগটি আটকানো ছিলো সেটাতে ব্যাগের অল্প কিছু ভগ্নাংশ লেগে ছিলো, তার কারণ তারটা ব্যাগের যে অংশে আঠা দিয়ে আটকানো ছিলো সেই অংশটা পানির সাথে মিশে যেতে পারে নি।
এক সপ্তাহ ধরে জীবাণুগুলো ছড়িয়ে পড়েছে।
এখন আর জীবাণুর বিস্তার এবং সংক্রমণ রোধ করার কোনো সম্ভাবনা নেই দেখে এসআরএস টিম ভাইরাসের নমুনা সংগ্রহ করে ল্যাবে নিয়ে পরীক্ষা করে দেখবে এটার কার্যকারীতা কিরকম-বিশ্লেষণ, শ্রেণীকরণ এবং হুমকির মাত্রা নির্ধারণ। এখন পর্যন্ত পিসিআর ইউনিট একটিমাত্র তথ্য বের করতে পেরেছে, আর সেটা কাউকে বিস্মিত করে নি।
ভাইরাসটি এখন বাতাসবাহিত হয়ে পড়েছে।
ব্যাগের ভেতরে থাকা ভাইরাসগুলো পানির বাষ্পের সাথে উপরে উঠে বাসাতেও ছড়িয়ে পড়েছে। খুব বেশি সময় নেয় নি, সিনস্কি জানে। বিশেষ করে এরকম আবদ্ধ জায়গায়।
একটি ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়া কিংবা রাসায়নিক প্যাথোজেনের মতো নয়-মানুষের মাঝে বিস্ময়কর গতিতে ছড়িয়ে পড়তে পারে। পরজীবি হিসেবে ভাইরাসগুলো প্রাণীদেহে প্রবেশ করে কোনো কোষের মধ্যে আস্তানা গাড়ে। তারপর ওগুলো নিজেদের আরএনএ কিংবা ডিএনএ প্রবেশ করায় হোস্ট কোষের মধ্যে। দখল করে নেয়া কোষকে বাধ্য করে জ্যামিতিক হারে তাদের প্রতিরূপ তৈরি করতে। যথেষ্ট পরিমাণে প্রতিরূপ তৈরি হবার পর তারা সম্মিলিতভাবে কোষকে মেরে ফেলে, কোষের প্রাচীর ভেদ করে ঢুকে পড়ে নতুন হোস্ট কোষে। এভাবে একই কাজ করে যেতে থাকে তারা।
আক্রান্ত প্রাণী তখন দুর্বল হয়ে পড়ে, শ্বাস-প্রশ্বাস কিংবা হাঁচির মাধ্যমে শরীরের ভেতরে থাকা ভাইরাস নির্গত করে দেয় বাইরে। এইসব ভাইরাস বাতাসে ভেসে বেড়ায় যতোক্ষণ না অন্য কারোর নিঃশ্বাসের মাধ্যমে শরীরে ঢুকে পড়ে। একবার ঢুকতে পারলে সেই একই কাজ শুরু করে দেয় আবার।
জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি, সিনস্কি মনে মনে বললো। জোবরিস্ট যে তাকে জনসংখ্যার বৃদ্ধির ব্যাপারে এটা বলেছিলো সে কথা মনে পড়ে গেলো। জোবরিস্ট ভাইরাসের জ্যামিতিক হারের বৃদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে জনসংখ্যার জ্যামিতিক হারের সাথে লড়াই করেছে।
জ্বলন্ত প্রশ্নটি হলো : এই ভাইরাসটি কিরকম আচরণ করবে?
বাস্তবিক বলতে গেলে : প্রাণীদেহে এটা কিভাবে আক্রমণ করবে?
ইবোলা ভাইরাস রক্তের সক্ষমতাকে দুর্বল করে দিয়ে জমাট বাধিয়ে দেয়, ফলে অপ্রতিরোধ্যভাবে রক্তক্ষরণ হতে থাকে শরীর থেকে। হানটা ভাইরাস ফুসফুসকে অচল করে দেয়। অনকোভাইরাস নামে পরিচিত আরেকদল ভাইরাস ক্যান্সারের জন্ম দেয়। এইচআইভি ভাইরাস আক্রমণ করে রোগপ্রতিরোধক ক্ষমতাকে, ফলে এইডস-এর মতো মরণঘাতি রোগের জন্ম হয়। চিকিৎসাবিদ্যার দুনিয়ায় এটা সবাই জানে, এইচআইভি ভাইরাস যদি বাতাসবাহিত হতো তাহলে ব্যাপকহারে প্রাণহানি ঘটতো।
তাহলে জোবরিস্টের ভাইরাস আসলে কি করবে?
সে যা-ই করুক না কেন, কিছুটা সময় লাগার কথা এটা জানতে…আশেপাশের হাসপাতালগুলোতে এরকম প্রাণঘাতি ভাইরাসে আক্রান্ত কোনো রোগির সন্ধান পাওয়া যায় নি।
জবাব পাবার জন্য অধৈর্য হয়ে ল্যাবের দিকে পা বাড়ালো সিনস্কি। সিঁড়ির কাছে ব্রুডারকে দেখলো সে, সেলফোনে মৃদু সিগন্যাল পেয়েছে বলে মনে হলো। চাপাকণ্ঠে সে কারো সাথে কথা বলছে।
“ঠিক আছে, বুঝতে পেরেছি,” বললো ব্রুডার, তার অভিব্যক্তিতে অবিশ্বাস আর আতঙ্কের ছাপ প্রকট। “আবারো বলছি, এই তথ্যটি খুবই গোপন রাখতে হবে। এক্ষেত্রে শুধু আপনিই জানবেন। আর কেউ না। নতুন কিছু জানতে পারলে আমাকে কল দিয়েন। ধন্যবাদ।” ফোন রেখে দিলো সে।
“কি হয়েছে?” জানতে চাইলো সিনস্কি।
গভীর করে নিঃশ্বাস ফেললো ব্রুডার। “আমি আমার এক পুরনো বন্ধুর সাথে কথা বলছিলাম। সে আটলান্টার সিডিসি’তে একজন ভাইরোলজিস্ট হিসেবে কাজ করে।”
চটে গেলো সিনস্কি। “আপনি আমার অনুমতি ছাড়া সিডিসি’কে জানিয়ে দিয়েছেন?”
“এটা আমি নিজ দায়িত্বে করেছি,” জবাব দিলো সে। “যার সাথে কথা বলেছি সে এসব ব্যাপার নিয়ে কারো সাথে কথা বলবে না। এই ভ্রাম্যমান ল্যাব থেকে যে ডাটা পাবো তারচেয়ে ভালো কিছু আমাদের দরকার।”
এসআরএস এজেন্টদের দিকে তাকালো সিনস্কি। পানি থেকে নমুনা সংগ্রহ করছে তারা। সে ঠিকই বলেছে।
“আমার সিডিসি কন্ট্যাক্ট, ব্রুডার বলতে লাগলো, “এ মুহূর্তে অত্যাধুনিক একটি মাইক্রোবায়োলজি ল্যাবে আছে। সে এরইমধ্যে জানিয়েছে এমন একটি শক্তিশালী প্রাণঘাতি ভাইরাসের অস্তিত্ব পেয়েছে যা এর আগে দেখা যায় নি।”
“দাঁড়ান!” সিনস্কি বলে উঠলো। “আপনি ওর কাছে কিভাবে এতো দ্রুত নমুনা পাঠালেন?”
“আমি কিছু পাঠাই নি,” কঠিনভাবে বললো ব্রুডার। “ও নিজের রক্ত পরীক্ষা করে জেনেছে।”
কথাটার মানে বুঝতে মাত্র কয়েক মুহূর্ত লাগলো সিনস্কির।
এরইমধ্যে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে।