অধ্যায় ৭০
ইতিহাসের সবচাইতে বিখ্যাত পরিব্রাজক মার্কো পোলোর নামানুসারে ভেনিসের বিমানবন্দরের নামকরন করা হয়েছে। সেন্ট মার্কস স্কয়ারের লাগুনা ভেনেতার উত্তর দিক থেকে মাত্র চার কিলোমিটার দূরে এটি অবস্থিত।
প্রাইভেট এয়ারজেটে করে ভ্রমণের কারণে এলিজাবেথ সিনস্কি দশ মিনিট আগে নতুন করে পরিকল্পনাটি সাজিয়ে নিতে পেরেছে। ইতিমধ্যেই অজ্ঞাত পরিচয়ের কলারের পাঠানো ফিউচারিস্টিক একটি হেলিকপ্টারে করে তারা যাচ্ছে এখন।
প্রভোস্ট।
সারাটা দিন কালো ভ্যানের পেছনে সঙ্কীর্ণ একটি জায়গায় পড়ে থাকার পর সমুদ্রের বাতাসে নিজের প্রাণশক্তি যেনো দ্বিগুন ফিরে পেলো সিনস্কি। নোনা বাতাস মুখে এসে লাগতে দিলো সে, সাদাচুলগুলো বেধে পেছনে ঝুটি করে রেখেছে। দুই ঘণ্টা আগে তাকে শেষবারের মতো ইনজেকশন দেয়া হয়েছিলো। এখন তার মধ্যে কোনো ঘোর ঘোর ভাবের লেশটুকু নেই। গতরাতের পর এই প্রথম নিজেকে পুরোপুরি ধাতস্ত মনে হচ্ছে।
এজেন্ট ব্রুডার তার টিমের সাথে বসে আছে। তারা কেউ কোনো কথা বলছে না। এই অদ্ভুত সাক্ষাতের ব্যাপারে তারা যদি চিন্তিত হয়ে থাকে তাহলে সেটা একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক কেননা তারা জানে সিদ্ধান্ত নেবার মালিক তারা নয়।
তাদের কপ্টারটি ছুটে চললে বিরাট একটি দ্বীপ দেখতে পেলো নীচের ডান দিকে। দ্বীপের উপকূলে ইটের তৈরি কতোগুলো ভবন আর চিমনি দাঁড়িয়ে আছে। মুরানো, বুঝতে পারলো এলিজাবেথ। কাঁচের ফ্যাক্টরিগুলো চিনতে পারলো সে।
আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না আবার এখানে ফিরে আসতে পেরেছি, মনে মনে বললো সে। সেইসাথে সুতীব্র এক বেদনাও অনুভব করলো।
অনেক বছর আগে মেডিকেলে পড়ার সময় তার বাগদত্তাকে নিয়ে এলিজাবেথ ভেনিসে বেড়াতে এসেছিলো, তখন এইসব কাঁচের জাদুঘরগুলো ঘুরে ঘুরে দেখেছিলো তারা দু’জন। তার বাগদত্তা একটি কাঁচ ফোলানোর পাইপ নিয়ে বলেছিলো তাদের যখন বাচ্চা হবে তখন তার ঘরে এরকম একটা ঝুলিয়ে রাখবে। কথাটা শুনে এলিজাবেথ তীব্র বেদনায় আক্রান্ত হয়েছিলো তখন, কারণ তার প্রেমিক জানতো না সে কখনও মা হতে পারবে না। শেষ পর্যন্ত এলিজাবেথ যখন কথাটা বললো তখন সবকিছু নিমেষে পাল্টে গেলো। এই ভেনিসেই আবিষ্কার করলো নিজেকে এনগেজমেন্ট রিং ছাড়া!
ঐ হৃদয়বিদারক ভ্রমণের একমাত্র সাক্ষী হয়ে আছে তার লাপিস লাজুলি নেকলেসটি। আসক্লিপিয়াসের দণ্ডটি চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রতীক হিসেবে একেবারে উপযুক্ত-তিক্ত স্মৃতি লেগে থাকলেও সেই দিন থেকে এটা তার গলায় শোভা পাচ্ছে।
আমার অমূল্য নেকলেস, মনে মনে বললো সে। যে মানুষটি চেয়েছিলো তার সন্তান ধারণ করবো আমি তার তরফ থেকে বিদায়ী উপহার।
আজ ভেনিসকে দেখে তার মধ্যে কোনো রোমান্স জেগে উঠছে না, বরং একসময় যে ব্ল্যাক ডেথের ছোবলে এ শহরটি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে গেছিলো সেই দুঃসহ স্মৃতিটাই এখন চরম বাস্তব হয়ে দেখা দিয়েছে।
তাদের হেলিকপ্টারটি আইসোলা সান পিয়েত্রো অতিক্রম করে গেলে এলিজাবেথ বুঝতে পারলো এটা এখন নীচে নোঙর করে রাখা বিশাল আকারের ধূসর রঙের ইয়টের উপর স্থির হয়েছে।
এই ধাতব রঙের জাহাজটি দেখে তার মনে হলো আমেরিকান মিলিটারির স্টিলথ বিমানের মতো। ইয়টের পেছন দিকে বড় করে লেখা আছে এর নামটি।
মেন্দাসিয়াম?
তাদের হেলিকপ্টারটি যতো নীচে নামতে লাগলো জাহাজটির আকার যেনো ততোই বড় হতে থাকলো। এলিজাবেথ নীচে তাকিয়ে দেখতে পেলো পেছনের ডেকে একজন দাঁড়িয়ে আছে-ছোটোখাটো, তামাটে বর্ণের একজন পুরুষ। বায়নোকুলার দিয়ে তাদেরকে দেখছে। কপ্টারটি ডেকে ল্যান্ড করামাত্রই সেই মানুষটি সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে এলো তাদেরকে অভ্যর্থনা জানাতে।
“ডা: সিনস্কি, আপনাকে এখানে স্বাগতম।” রোদেপোড়া লোকটি ভাবে করমর্দন করলো তার সাথে। “আপনি আসাতে আমি অনেক খুশি হয়েছি। দয়া করে আমার সঙ্গে আসুন।”
তাদের দলটি নীচের কয়েকটি ডেক দিয়ে নেমে যাবার সময় সিনস্কি একঝলক দেখতে পেলো কতোগুলো কিউবিকল, আর সেখানে লোকজন কাজে ব্যস্ত রয়েছে। অদ্ভুত একটি জাহাজ, প্রচুর লোকজন আছে কিন্তু কাউকেই রিল্যাক্স দেখাচ্ছে না-তারা সবাই কাজ করে যাচ্ছে।
কিসের কাজ করছে এরা?
একটু পরই জাহাজের বিশাল ইঞ্জিনটি চালু হলে সেটার গর্জন শুনতে পেলো সিনস্কি। টের পেলো বিশাল ইয়টটি আস্তে আস্তে চলতে শুরু করেছে।
আমরা কোথায় যাচ্ছি? অবাক হয়ে ভাবলো সে, বেশ সতর্কও হয়ে উঠলো।
“আমি ডা: সিনস্কির সাথে একান্তে কথা বলতে চাই,” সৈনিকদেরকে বললো লোকটি, তারপর ডাক্তারের দিকে ফিরে বললো, “আপনার কোনো সমস্যা নেই তো?”
সায় দিলো এলিজাবেথ।
“স্যার,” জোর দিয়ে বললো ব্রুডার। “ডা: সিনস্কিকে আমাদের জাহাজের ডাক্তার দিয়ে পরীক্ষা করিয়ে নেয়া দরকার বলে মনে করছি আমি। উনার কিছু শারিরীক সমস্যা–”
“আমি ঠিক আছি,” কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে বললো সিনস্কি। “সত্যি বলছি। আর আপনাকে ধন্যবাদ।”
ব্রুডারের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে প্রভোস্ট একটি টেবিলের দিকে ইঙ্গিত করলো। ওটাতে খাবার-দাবার আর পানীয় রয়েছে। “শক্তি সঞ্চয় করো। এটা তোমার দরকার হবে। কিছুক্ষণ পরই তোমাকে আবার উপকূলে ফিরে যেতে হবে।”
আর কোনো কথা না বলে সিনস্কিকে নিয়ে প্রভোস্ট চলে গেলো স্টেটরুমে। ঢোকামাত্রই দরজা বন্ধ করে দিলো সে।
‘ড্রিঙ্ক করবেন?” বারের দিকে ইঙ্গিত করে বললো প্রভোস্ট।
মাথা ঝাঁকিয়ে জবাব দিলো সিনস্কি। চারপাশের অদ্ভুত সব জিনিস দেখে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। এই লোকটি কে? সে এখানে কি করে?
থুতনী চুলকাতে চুলকাতে প্রভোস্ট তাকে দেখে যাচ্ছে এখন। “আপনি কি জানেন আমার ক্লায়েন্ট বারট্রান্ড জোবরিস্ট আপনাকে সব সময় সাদা-চুলের ডাইনী’ বলে সম্বোধন করতো?”
“আমাকে ডাকার জন্য তার কাছে অবশ্য খুব বেশি নামও ছিলো না।”
লোকটা নির্বিকার ভঙ্গিতে বুকশেলফের কাছে গিয়ে বিরাট সাইজের একটি বই নামিয়ে আনলো। “আমি চাই আপনি এটা দেখুন।”
বিশাল বইটার দিকে তাকালো সিনস্কি। দান্তের ইনফার্নো? কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্সে জোবরিস্ট তাকে যেসব ভয়ঙ্কর ছবি দেখিয়েছিলো সে-কথা মনে পড়ে গেলো আবার।
“দু’সপ্তাহ আগে জোবরিস্ট এটা আমাকে দিয়েছিলো। এখানে কিছু কথাও লেখা আছে।”
টাইটেল পৃষ্ঠায় হাতেলেখা কিছু কথা পড়লো সিনস্কি। জোবরিস্টের স্বাক্ষর দেয়া আছে তাতে।
আমার প্রিয় বন্ধু, আমার পথ খুঁজে নিতে সাহায্য করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
এই পৃথিবীও আপনাকে ধন্যবাদ দেবে।
সিনস্কি টের পেলো তার গায়ের পশম দাঁড়িয়ে গেছে। “কোন্ পথ খুঁজে নিতে আপনি তাকে সাহায্য করেছেন?”
“আমার কোনো ধারণাই নেই। সত্যি বলতে, মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে এটা আমি জানতামই না।”
“আর এখন?”
“এখন প্রটোকল ভেঙে বিরল একটি নজির সৃষ্টি করে আপনার সাথে আমি যোগাযোগ করেছি।”
বহুপথ পাড়ি দিয়ে এসেছে সিনস্কি, এইসব ঘোরপ্যাঁচ কথাবার্তায় তার কোনো আগ্রহ নেই। “স্যার, আমি জানি না আপনি কে, কিংবা এই জাহাজে আপনি কী করে বেড়ান, তবে আমাকে আপনার অনেক কিছুই ব্যাখ্যা করতে হবে। আমাকে বলুন, যে লোককে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছিলো তাকে কেন আপনার মতো লোক আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে গেছে দিনের পর দিন।”
সিনস্কির কথায় ঝাঁঝ থাকলেও ভদ্রলোক আস্তে আস্তে জবাব দিলো : “আমি বুঝতে পারছি আপনি আর আমি অনেকদিন একে অন্যের বিরুদ্ধে কাজ করে গেছি। তবে আমি বলবো সেইসব অতীতের কথা ভুলে যান। অতীত অতীতই। আমার মনে হয় এখন সময় এসেছে সামনের দিনগুলো নিয়ে ভাবা। এবং সেটা সময় নষ্ট না করেই।”
এ কথা বলেই লাল রঙের ছোট্ট একটি ফ্ল্যাশড্রাইভ বের করে কম্পিউটারে ঢোকালো, ডাক্তারকে ইশারা করলো চেয়ারে বসার জন্য। “বারট্রান্ড জোবরিস্ট এই ভিডিওটি তৈরি করেছে। সে চেয়েছিলো আগামীকাল আমি এটা রিলিজ করে দেবো।”
সিনস্কি কিছু বলার আগেই মনিটরটি সচল হয়ে উঠলো। পানির ছলাৎ ছলাৎ শব্দ শুনতে পেলো সে। কালো পর্দায় ভেসে উঠলো একটি দৃশ্য…পানিভর্তি একটি গুহা…অনেকটা ভূ-গর্ভস্থ পুকুরের মতো। অদ্ভুত ব্যাপার হলো পানিগুলো যেনো নীচ থেকে লালচে আলোয় জ্বল জ্বল করছে।
ক্যামেরা আস্তে আস্তে পানির নীচে চলে গেলো এবার। পানির নীচে যে মেঝেটা আছে সেখানে গিয়ে থামলো সেটা। মেঝে থেকে একটু বের হয়ে আছে। আয়তক্ষেত্রের ফলক, তাতে কিছু কথা, নাম আর তারিখ লেখা।
এই জায়গায়, আজকের তারিখে, এ বিশ্ব চিরতরের জন্য বদলে গেছিলো।
তারিখটি আগামীকালের। নামটা বারট্রান্ড জোবরিস্ট।
এলিজাবেথ একটুখানি কেঁপে উঠলো। “এটা কোন জায়গা?!” জানতে চাইলো সে। “জায়গাটা কোথায়?”
এর জবাবে এই প্রথম প্রভোস্ট একটুখানি আবেগ দেখালো-গম্ভীর হতাশার দীর্ঘশ্বাস। “ডা: সিনস্কি,” আস্তে করে বললো সে, “আমি ভেবেছিলাম আপনি এই প্রশ্নের জবাবটি হয়তো জানবেন।”
.
এক মাইল দূরে, রিভা দেগলি শিয়াভোনির ওয়াটারফ্রন্ট ওয়াকওয়ে থেকে সমুদ্রের দৃশ্যটা একটুখানি বদলে গেলো। কেউ যদি ভালো করে দেখে তাহলে বুঝতে পারবে পশ্চিম দিকে ধূসর রঙের একটি ইয়টের আর্বিভাব হয়েছে। ওটা এখন সেন্ট মার্কস স্কয়ারের দিকে এগিয়ে আসছে।
মেন্দাসিয়াম, সুতীব্র ভীতির সাথেই এফএস-২০৮০ বুঝতে পারলো।
ওটার ধূসর রঙের খোলটি দেখে ভুল হবার কোনো অবকাশ নেই।
প্রভোস্ট আসছে…আর সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে দ্রুত।
.
অধ্যায় ৭১
সাপের মতো এঁকেবেঁকে ল্যাংডন, সিয়েনা আর ফেরিস রিভা দেগলি শিয়াভোনির জনস্রোতের মধ্য দিয়ে সেন্ট মার্কস স্কয়ারের দক্ষিণ দিকের সীমানায় পৌঁছে গেলো। এখান থেকে পিয়াজ্জাটি মিশে গেছে সাগরে।
এ জায়গায় পর্যটকদের ভীড় এতোটাই বেশি যে ল্যাংডনের রীতিমতো ক্লস্ট্রোফোবিয়া অনুভূত হলো। প্রবেশদ্বারের বিশাল দুটো কলামের পাশে দাঁড়িয়ে সবাই ছবি তোলার জন্য হুমরি খেয়ে পড়ছে।
এটাই এ শহরের অফিশিয়াল প্রবেশদ্বার, পরিহাসের সাথেই ভাবলো ল্যাংডন। সে ভালো করেই জানে অষ্টাদশ শতকেও এই জায়গাতে প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হতো।
প্রবেশদ্বারের একটি কলামের উপর সেন্ট থিওদোরের উদ্ভট একটি মূর্তি রাখা আছে, গর্বসহকারে তার হাতে বধ হওয়া ড্রাগনের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। ল্যাংডনের কাছে অবশ্য ড্রাগনটাকে দেখে বড়সড় কুমির বলেই মনে হলো।
দ্বিতীয় কলামের উপর ভেনিসের বহুল পরিচিত সিম্বলটি দাঁড়িয়ে আছে-ডানাবিশিষ্ট সিংহ।
এ শহরের সর্বত্রই এই ডানাবিশিষ্ট সিংহের দেখা পাওয়া যাবে। তার এক পা গর্বিতভাবে একটি ভোলা বইয়ের উপর রাখা। সেই বইতে লাতিনে লেখা পাক্স টিবি মার্সি, ইভানজেলিস্টা মিউজ (তোমার উপর শান্তি বর্ষিত হোক, মার্ক, মাই ইভানজেলিস্ট)। কিংবদন্তী বলে সেন্ট মার্কস ভেনিসে পদাপন করার পর পরই এক অ্যাঞ্জেল এ কথাগুলো বলেছিলো, সেইসাথে এরকম ভবিষ্যৎবাণীও করেছিলো যে, তার মরদেহ একদিন এখানেই সমাহিত হবে। পরবর্তীতে আলেকজান্দ্রিয়ার কবর থেকে তার কঙ্কাল তুলে এনে ভেনিসের সেন্ট মার্কস ব্যাসিলিকায় সমাহিত করার কাজটাকে জায়েজ করার জন্য এই প্রশ্নবদ্ধি কিংবদন্তীটাকে ব্যবহার করা হয়। আজকের দিনেও ডানাবিশিষ্ট সিংহ এ শহরের সিম্বল হিসেবে সুপরিচিত হয়ে আসছে। শহরের প্রতিটি মোড়েই এটা দেখা যাবে।
ডান দিকে মোড় নিয়ে কলামগুলো পেরিয়ে সেন্ট মার্কস স্কয়ারের দিকে চললো ল্যাংডন। “আমরা যদি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই তাহলে ব্যাসিলিকার সামনের দরজার কাছে চলে যাবে।”
স্কয়ারের ভেতরে উওজ’দের প্রাসাদের পশ্চিম দেয়াল ধরে এগোতে লাগলো তারা। লোকজনের ভীড়ের কারণে দ্রুত হাঁটতে পারছে না। ভেনিসের কবুতরগুলোকে দানা খাওয়ানো নিষেধ করার আইন আছে, তা সত্ত্বেও কবুতরের ঝাঁক ঘুরে বেড়াচ্ছে সবত্র। পর্যটকদের দেয়া খাবার খাচ্ছে তারা।
এই বিশাল পিয়াজ্জাটি ইউরোপের অন্যান্য পিয়াজ্জার মতো বৃত্তাকারের নয় বরং ইংরেজি L আকৃতির। ছোটো বহুটি-পিয়াজেত্তা নামে পরিচিত-সাগরের সাথে সেন্ট মার্কসের ব্যাসিলিকাকে সংযুক্ত করেছে। তারপর স্কয়ারটি নব্বই ডিগ্রি বাঁক নিয়ে মিশেছে বড় বাহুর সাথে, ওটা ব্যাসিলিকা থেকে চলে গেছে মিউজিও কোরার-এর দিকে।
সামনের দিকে এগোতেই ল্যাংডন দেখতে পেলো বহু দূরে দাঁড়িয়ে আছে সেন্ট মার্কসের ঘড়ির টাওয়ার, ওটার নীল রঙের কাঁচের ডায়ালটি জ্বল জ্বল করছে-এই ঘড়িটিই জেমস বন্ড সিরিজের মুনরেকার সিনেমায় দেখানো হয়েছিলো-ভিলেনকে ওখান থেকে ফেলে দেয় নায়ক।
এর আগে ল্যাংডন এখানে বেশ কয়েকবার এলেও আজই ধরতে পারলো এ শহরের সবচাইতে অনন্য বৈশিষ্টটি, আর এটাই অন্য যেকোনো শহর থেকে ভেনিসকে আলাদা করে রেখেছে।
শব্দ।
বলতে গেলে কোনো ধরনের মোটরগাড়ি নেই এখানে, ভেনিস নগর সভ্যতার ট্রাফিক, সাইরেন, হর্ন আর সাবওয়ের কোলাহল থেকে পুরোপুরি মুক্ত। শুধুমাত্র মানুষের শব্দ, কবুতরের ডাক আর ক্যাফে’তে বেজে চলা বেহালার সুর কানে আসছে। পৃথিবীর আর কোনো শহরে এরকম শব্দ শুনতে পাওয়া যাবে না।
বিকেলের সূর্য উঁকি মারছে সেন্ট মার্কসের পশ্চিমাকাশে, দীর্ঘ ছায়া ফেলেছে টাইলসের স্কয়ারে। ক্যাম্পানিলির মিনারের দিকে তাকালো ল্যাংডন, স্কয়ারের উপর মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে সেটা। ভেনেশিয়ান আকাশে রাজত্ব করছে যেনো। টাওয়ারের উপরের দিকে বেলকনিতে কমপক্ষে একশ’ লোকের ভীড়। ওখানে ওঠার কথা ভাবলেই ল্যাংডনের কাঁপুনি শুরু হয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে নীচের দিকে হাজার হাজার মানুষের ভীড়ের দিকে তাকালো।
সিয়েনা খুব সহজেই ল্যাংডনেরে সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটতে পারছে কিন্তু ফেরিস অনেকটা পিছিয়ে পড়ার কারণে সেও তার হাটার গতি কমিয়ে বার বার পেছন ফিরে দেখে নিচ্ছে ভদ্রলোককে। তার মধ্যে অধৈর্য ভাব ফুটে উঠলো। ফেরিস নিজের বুকের দিকে ইঙ্গিত করে বোঝালো তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। তাকে ইশারা করলো তার জন্য পিছিয়ে না পড়ে ল্যাংডনের সাথে সাথে চলতে।
সিয়েনা সেটাই করলো। দ্রুত চলে গেলো ল্যাংডনের কাছাকাছি। লোকজনের ভীড় ঠেলে সামনে এগোবার সময় তার মনে হলো ফেরিস ইচ্ছে করেই পিছিয়ে পড়তে চাইছে…যেনো তাদের দুজনের থেকে একটু দূরত্ব তৈরি করতে চাইছে সে।
অনেক আগেই সে তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়কে বিশ্বাস করতে শিখেছে, আজও তাই করলো। আস্তে করে ছায়া ঢাকা একটি অ্যালকোভে লুকিয়ে সেখানে থেকে লোকজনের ভীড়ের মধ্যে ফেরিসকে দেখলো।
কোথায় গেলো লোকটা?!
মনে হচ্ছে সে তাদের পেছন পেছন আসে নি। লোকজনের ভীড়ের মধ্যে তাকে খুঁজতে লাগলো সিয়েনা। অবশেষে ফেরিসকে দেখতে পেলেও অবাক হলো। এক জায়গায় থেমে একটু নীচু হয়ে ফোনে কী যেনো টাইপ করে যাচ্ছে!
সে বলেছিলো তার ফোনের ব্যাটারির চার্জ শেষ হয়ে গেছে।
সঙ্গে সঙ্গে অজানা এক আতঙ্ক গ্রাস করলো তাকে।
এই লোক আমার সাথে মিথ্যে বলেছিলো ট্রেনে।
তাকে দেখে সিয়েনার মনে হতে লাগলো : সে করছেটা কি? লুকিয়ে লুকিয়ে কাউকে মেসেজ পাঠাচ্ছে? তার অগোচরে সার্চ করছে? ল্যাংডন আর সিয়েনার আগে জোবরিষ্টের কবিতার রহস্যের সমাধান করার চেষ্টা করছে?
এ ব্যাপারে তার যুক্তি যাইহোক না কেন, তার সাথে সে মিথ্যে বলেছে।
আমি তাকে বিশ্বাস করতে পারছি না।
সিয়েনার ইচ্ছে হলো লোকটার কাছে ছুটে গিয়ে তাকে হাতেনাতে ধরে ফেলতে কিন্তু দ্রুত সে ইচ্ছেটা বাদ দিয়ে লোকজনের ভীড়ের সাথে আবার মিশে গেলো যাতে ফেরিস তাকে দেখে না ফেলে। ব্যাসিলিকার দিকে সে এগোতে লাগলো ল্যাংডনের খোঁজে। তাকে সতর্ক করে দেয়া দরকার ফেরিসের কাছে যেনো কোনো কিছু না বলে।
ব্যাসিলিকা থেকে যখন মাত্র পঞ্চাশ গজ দূরে তখনই টের পেলো পেছন থেকে কেউ তার কাঁধে হাত রেখেছে।
ঘুরতেই ফেরিসের মুখোমুখি হলো সে।
লোকটা দম ফুরিয়ে হাফাচ্ছে। লোকজনের ভীড়ের মধ্য দিয়ে নিশ্চয় তাকে দৌড়ে চলে আসতে হয়েছে সিয়েনার পেছন পেছন। লোকটার মধ্যে যে একধরণের উন্মাদগ্রস্ততা আছে সেটা প্রথমবারের মতো দেখতে পেলো সিয়েনা।
“সরি,” কোনোমতে বললো। নিঃশ্বাস নিতে বেগ পাচ্ছে। “আমি লোকজনের ভীড়ে হারিয়ে গেছিলাম।”
তার চোখের দিকে তাকিয়েই সিয়েনা বুঝে গেলো।
সে কিছু লুকাচ্ছে।
সেন্ট মার্কসের ব্যাসিলিকায় পৌঁছে পেছন ফিরে তার দু’জন সঙ্গিকে দেখতে না পেয়ে অবাক হলো ল্যাংডন। আরো অবাক হলো চার্চে ঢোকার যে লাইনটা আছে সেখানে কোনো পর্যটক দেখতে না পেয়ে। তারপরই বুঝতে পারলো এখন প্রায় বিকেল, বেশিরভাগ পর্যটকই খিদের কাছে পরাস্ত হয়ে ঐতিহাসিক দৃশ্য দেখা বাদ দিয়ে খাবারের সন্ধানে নেমে পড়েছে।
ল্যাংডন জানে সিয়েনা আর ফেরিস যেকোনো সময়ই এসে পড়বে তাই এইফাঁকে তার সামনে থাকা ব্যাসিলিকার প্রবেশদ্বারের দিকে তাকালো। ভবনটির নীচের ফ্যাকেইডে পাঁচটি খিলানসদৃশ্য প্রবেশদ্বার আছে দর্শনার্থীদের প্রবেশের সুযোগ করে দেবার জন্য। দু’পাশের দুটি করে চারটি প্রবেশদ্বার একই আকারের তবে মাঝখানেরটি সামান্য বড়।
ইউরোপে যেসব বাইজেন্টাইন স্থাপত্য টিকে আছে তার মধ্যে সেন্ট মার্কস সবচেয়ে প্রসিদ্ধ, তবে নটরডেম আর শরত্রের মতো নয় এটি। বরং সেন্ট মার্কসকে দেখে অনেক বেশি মতেরি বলে মনে হয়। চওড়ার চেয়ে এটি লম্বায় বেশি বড়, চার্চটির শীর্ষে রয়েছে পাঁচটি সাদা গম্বুজ, দেখে মনে হতে পারে। ওয়েডিং কেকের মতো।
মাঝখানের গম্বুজের উপরে সেন্ট মার্কের একটি মূর্তি আছে, নিজের নামে যে স্কয়ারটি আছে সেদিকে চেয়ে আছে সেটা। তার পা দুটো রাখা আছে খিলানের ঠিক শীর্ষবিন্দুর উপর। সেই খিলানের মধ্যে আছে সোনালি রঙের ডানাবিশিষ্ট সিংহ। তার পেছনে ব্যাকড্রপ হিসেবে আছে নীল রঙের উপর কতোগুলো সোনালি তারা। এর ঠিক নীচে স্থান পেয়েছে সেন্ট মার্কসের সবচেয়ে বিখ্যাত। সম্পদটি-তামার তৈরি চারটি বিশাল আকারের ঘোড়া-এ মুহূর্তে সূর্যের আলোয় চকচক করছে সেগুলো।
সেন্ট মার্কসের ঘোড়া।
এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে যেনো এক্ষুণি লাফ দিয়ে নেমে পড়বে নীচের স্কয়ারে। ভেনিসের আরো অনেক সম্পদের মতো এই চারটি অমূল্য ঘোড়া ক্রুসেডের সময় কন্সট্যান্টিনোপল থেকে লুট করে আনা হয়েছিলো। এরকমই আরেকটি লুট করা শিল্পকর্ম স্থান পেয়েছে ঘোড়াগুলোর নীচে, চার্চের দক্ষিণ পশ্চিম কোণে-দ্য তেত্রাকস নামের একটি মূর্তি, ত্রয়োদশ শতকে লুট করে নিয়ে আসার সময় ওটার একটি পা ভেঙে যায়। অলৌকিকভাবে ১৯৬০ সালে ঐ হারানো পাটি খুঁজে পাওয়া যায় ইস্তাম্বুলে। ভেনিসের কর্তৃপক্ষ পাটি ফেরত চেয়ে আবেদন করলেও তুর্কিরা সহজ ভাষায় এর জবাব দিয়েছিলো : তোমরা আমাদের মূর্তি চুরি করেছে-আমরা আমাদের পা রেখে দিচ্ছি।
“মিস্টার, আপনি কিনবেন?” এক নারীকণ্ঠ শুনে ল্যাংডন নীচের দিকে তাকালো।
ভারিক্কি শরীরের এক জিপসি মহিলা লম্বা একটি লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে, সেই লাঠিতে অনেকগুলো ভেনিশিয় মুখোশ। বেশিরভাগই ভলতো ইনতেরো স্টাইলের-সাদা মুখায়বের মুখোশ, যা কিনা ভেনিসের কার্নিভালির সময় মেয়েরা পরে থাকে। মহিলার কাছে কিছু অর্ধেক মুখের কলম্বিয়ান মুখোশও রয়েছে। অবশ্য এতোগুলো মুখোশের মধ্যে ল্যাংডনের নজর গেলো একেবারে উপরে থাকা পাখির ঠোঁটসদৃশ্য মুখোশটির দিকে, দুই চোখে ঠিক যেনো চেয়ে আছে তার দিকে।
প্লেগের ডাক্তার। সঙ্গে সঙ্গে চোখ সরিয়ে নিলো সে। এই ভেনিসে কি খুঁজতে এসেছে সেটা বার বার তাকে স্মরণ করিয়ে দেবার দরকার নেই।
“কিনবেন?” জিপসি আবারো বললো তার উদ্দেশ্যে।
কোনোরকম হেসে মাথা ঝাঁকিয়ে না করে দিলো ল্যাংডন। “সোনো মলতো বেল্লে, মা নো, গ্র্যাজি।”
মহিলা চলে যাবার সময় লাঠির উপরে থাকা মুখোশটি লোকজনের ভীড়ের মধ্যে থেকে মাথা উঁচু করে দেখছে যেনো। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দ্বিতীয় তলার বেলকনিতে রাখা তামার ঘোড়াগুলোর দিকে তাকালো আবার।
চট করে তার মাথায় একটা জিনিস খেলে গেলো।
অনেকগুলো বিষয় ঘুরপাক খেতে লাগলো ল্যাংডনের মাথায়-সেন্ট মার্কসের ঘোড়া, ভেনিশিয়ান মুখোশ আর কন্সট্যান্টিনোপল থেকে লুট করা সম্পদ।
“হায় ঈশ্বর, বিড়বিড় করে বললো সে। “এটাই তো!”
.
অধ্যায় ৭২
রবার্ট ল্যাংডন বরফের মতো জমে গেলো।
সেন্ট মার্কসের ঘোড়া!
এই চারটি মুননামুগ্ধকর ঘোড়া-তাদের অভিজাত গ্রীবা আর শক্তিশালী পেশী-ল্যাংডনের মধ্যে অপ্রত্যাশিত এক স্মৃতির স্ফুলিঙ্গ উসকে দিলো, সে এখন বুঝতে পারছে এটা দান্তের মুখোশের পেছনে যে জটিল আর রহস্যময় কবিতাটি রয়েছে তার ব্যাখ্যা দিতে পারবে।
অনেকদিন আগে, কেন্টাকির ডার্বি বিজয়ী ড্যান্সারের শহর নিউ হ্যাঁম্পশায়ারের ঐতিহাসিক রুনিমিড ফার্মে এক সেলিব্রেটির বিয়ের আসরে গিয়েছিলো ল্যাংডন। বিনোদনের বিপুল আয়োজনের অংশ হিসেবে অতিথিদেরকে প্রসিদ্ধ ইকুইন থিয়েট্রিক্যাল টুপ ‘মুখোশের আড়ালে’ নামে একটি পারফর্ম করে দেখায়-ঘোড়সওয়াররা ভেনিসের ভলতো ইনাতো মুখোশ পরে ঘোড়ার নৃত্য পরিবেশন করে। ঐ টুপে ফ্রিসিয়ান ঘোড়াগুলোর মতো বিশাল আকৃতির ঘোড়া ল্যাংডন জীবনেও দেখে নি। যেমন আকারে বিশাল তেমনি পেশীতে সমৃদ্ধ ঘোড়াগুলো মাঠে দাপিয়ে বেড়াতে শুরু করলে তাদের পদভারে মাটিও কেঁপে উঠেছিলো।
ঘোড়াগুলোর সৌন্দর্য ল্যাংডনকে এতোটাই মুগ্ধ করেছিলো যে বাড়ি ফিরে এসে নেটে সার্চ দিয়ে তাদের সম্পর্কে রীতিমতো রিসার্চ করতে শুরু করে দেয়। সে জানতে পারে মধ্যযুগে এই প্রজাতির ঘোড়াগুলো রাজ-রাজাদের যুদ্ধের অশ্বারোহী বাহিনীতে ব্যবহৃত হতো। একটা সময় প্রজাতিটি প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেলে সাম্প্রতিক সময়ে সেগুলো প্রজনন করে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। আগে নাম ছিলো ইকাস রোবাস্তাস, তবে আধুনিক সময়ে এর নাম করা হয়েছে তাদের আদিবাসভূমি হল্যান্ডের একটি অঞ্চল ফ্রিসল্যান্ডের নামানুসারে ফ্রিসিয়ান। এই অঞ্চলটি আবার প্রখ্যাত ডাচ গ্রাফিক আর্টিস্ট এম.সি এসৃচারেরও জন্মভূমি।
ল্যাংডন আরো জানতে পারে এইসব পেশীবহুল ফ্রিসিয়ান ঘোড়াই সেন্ট মার্কসের ঘোড়াগুলো সৃষ্টি ও নান্দনিকতায় অনুপ্রাণিত করেছিলো। একটি ওয়েবসাইটের মতে সেন্ট মার্কসের ঘোড়াগুলো এতোটাই সুন্দর যে তারা হয়ে উঠেছে ‘ইতিহাসের সবচাইতে বেশি চুরি করা শিল্পকর্ম।
ল্যাংডন অ্যাসোসিয়েশন ফর রিসার্চ ইনটু ক্রাইমস অ্যাগেইনস্ট আর্ট, সংক্ষেপে ARCA নামের সংগঠনের সাথে যোগাযোগ করে এ ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু জানতে না পারলেও এটুকু অন্তত জেনেছে এই ভাস্কর্যটি সৃষ্টির পর থেকেই লুট আর চুরির শিকার হয়েছে অনেকবার।
চিওস নামের এক দ্বীপের অজ্ঞাত এক গ্রিক ভাস্কর এই তামার ভাস্কর্যটি সৃষ্টি করে চতুর্থ শতকে। দ্বিতীয় থিওদোসিয়াস কন্সটান্টিনোপলের হিপ্পোড্রোমে এটা নিয়ে আসার আগ পর্যন্ত ঐ দ্বীপেই ভাস্কর্যটি রাখা হয়েছিলো। তারপর ১২৫৪ সালে চতুর্থ ক্রুসেডের সময় যখন ভেনিশিয় বাহিনী কন্সট্যান্টিনোপল ধ্বংস করে তখন ক্ষমতাসীন ডওজ চারটি ঘোড়াকে জাহাজে করে ভেনিসে নিয়ে আসার নির্দেশ দেন, কিন্তু ভাস্কর্যটির বিশাল আকার আর ওজনের কারণে জাহাজে করে পরিবহন করা সম্ভব ছিলো না। তাই গলা থেকে কেটে প্রতিটি ঘোড়া দুই খণ্ডে বিভক্ত করে জাহাজে পরিবহণ করা হয়েছিলো। ভেনিসে নিয়ে আসার পর ওগুলোর ঠাঁই হয় সেন্ট মার্কসের ব্যাসিলিকায়।
এরপর প্রায় পাঁচ শ’ বছর পর ১৭৯৭ সালে নেপোলিওন ভেনিস জয় করলে ঘোড়াগুলো প্যারিসের আর্ক দ্য ব্রায়াম্ফ-এ নিয়ে আসেন। ১৮১৫ সালে নেপোলিওন ওয়াটারলু যুদ্ধে হেলে গেলে নির্বাসিত হন। এরপর ঘোড়াগুলোকে প্যারিস থেকে আবার ভেনিসে এনে সেন্ট মার্কসের ব্যাসিলিকার বেলকনিতে স্থাপন করা হয়।
বর্তমানে ঘোড়াগুলোর গলায় যে নক্সা করা কলারগুলো দেখা যায় সেগুলো আসলে কাটা অংশের জোড়াগুলো ঢাকার জন্য লাগানো হয়েছে-এই চমকে যাবার মতো তথ্যটি ল্যাংডন জানতে পেরেছিলো ARCA সাইট থেকে।
সেন্ট মার্কসের ঘোড়াগুলোর গলা কেটে ফেলার আদেশ দিয়েছিলেন সেই ডওজ?
“রবার্ট?!” সিয়েনা ডেকে উঠলো।
সম্বিত ফিরে পেয়ে ল্যাংডন দেখতে পেলো সিয়েনা আর ফেরিস লোকজনের ভীড় ঠেলে তার কাছে এগিয়ে আসছে।
কবিতার ঘোড়াগুলো!” উত্তেজিত কণ্ঠে চিৎকার করে বললো ল্যাংডন। “আমি ওটা বের করতে পেরেছি!”
“কি?” সিয়েনাকে একটু হতবুদ্ধি দেখালো।
“আমরা একজন বিশ্বাসঘাতক উওজ’কে খুঁজছি যে ঘোড়াগুলোর মাথা কেটেছিলো!”
“হ্যাঁ?”
“কবিতায় আসলে জীবন্ত ঘোড়ার কথা বলে নি।” সেন্ট মার্কসের বেলকনিতে থাকা চারটা ঘোড়ার দিকে আঙুল তুলে দেখালো ল্যাংডন। “কবিতায় আসলে ঐ ঘোড়াগুলোর কথা বলা হয়েছে!”
.
অধ্যায় ৭৩
মেন্দাসিয়াম-এ প্রভোস্টের স্টাডিতে বসে আছে ডা: এলিজাবেথ সিনস্কি, তার হাত রীতিমতো কাঁপছে। ভিডিওটা দেখছে এখনও। জীবনে অনেক ভীতিকর জিনিস দেখেছে সে কিন্তু আত্মহত্যা করার আগে জোবরিস্ট যে দুর্বোধ্য মুভিটা বানিয়ে গেছে সেটা দেখে মৃত্যুর হিম-শীতলতা গ্রাস করলো তাকে।
পর্দায় এখনও পাখির ঠোঁটসদৃশ্য মুখোশ পরা লোকটি কথা বলে যাচ্ছে। আবছায়া অবয়বটি গর্বসহকারে নিজের মাস্টারপিসের বর্ণনা দিচ্ছে-ইনফার্নো নামের সৃষ্টিকর্ম-এটা বিরাট সংখ্যক জনসংখ্যা নির্মূল করার মাধ্যমে পৃথিবীকে রক্ষা করবে।
ঈশ্বর আমাদের রক্ষা করুন, মনে মনে বললো সিনস্কি। “আমাদেরকে…” কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললো সে। “আমাদেরকে এই আন্ডারগ্রাউন্ড লোকেশনটি খুঁজে বের করতে হবে। হয়তো এখনও খুব বেশি দেরি হয়ে যায় নি।”
“দেখতে থাকুন,” জবাবে বললো প্রভোস্ট। “এটা আরো বেশি অদ্ভুত লাগবে।”
হঠাৎ করেই মুখোশটির ছায়া দেয়ালে আরো বড় হতে হতে একজন মানুষের অবয়বে পরিণত হলো।
হলিশিট।
সিনস্কি দেখতে পাচ্ছে প্লেগ ডাক্তারের পোশাক পরা একজনকে-কালো আলখেল্লা আর পাখির ঠোঁটের মতো নাক। ক্যামেরার সামনে হেঁটে এলো প্লেগ ডাক্তার। তার মুখোশটি পুরো পদ দখল করে ফেললো এবার। একেবারে ভীতিকর দৃশ্য।
“ ‘নরকের সবচাইতে অন্ধকারাচ্ছন্ন জায়গাটি তাদের জন্য বরাদ্দ রয়েছে যারা ভালো আর মন্দের সংঘাতের সময় নিজেদের নিরপেক্ষতা বজায় রাখে।’ ”
সিনস্কি টের পেলো তার ঘাড়ের পশম দাঁড়িয়ে গেছে। এক বছর আগে। নিউইয়র্কের এয়ারপোর্ট কাউন্টারে জোবরিস্ট ঠিক এই কোটেশনটিই মেসেজ আকারে দিয়েছিলো তাকে।
“আমি জানি,” প্লেগ ডাক্তার বলতে লাগলো, “আমাকে দানব বলার মতো কিছু লোক আছে।” একটু থামলো সে, সিনস্কি বুঝতে পারলো কথাটা তাকে উদ্দেশ্য করেই বলা। “আমি এও জানি এমনও লোক আছে যারা মনে করে আমি হৃদয়হীন এক পশু, যে মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থাকে। আবারো থামলো সে। ক্যামেরার আরো কাছে এগিয়ে এলো। “কিন্তু না আমি মুখ দেখাতে ভয় পাই, না আমি হৃদয়হীন।”
এ কথা বলার সাথে সাথে জোবরিস্ট তার মুখোশ খুলে মাথার হুডটা নামিয়ে ফেললো-তার মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই। সিনস্কি দেখতে পেলো অন্ধকারে তার সবুজ চোখ দুটো জ্বল জ্বল করছে। ঠিক সেদিনের মতোই তীব্র আকাঙ্খা আর আগুন জ্বলছে যেনো। কিন্তু এ মুহূর্তে সেই চোখে আরো কিছু আছে-উন্মাদের বন্য উন্মাদনা।
“আমার নাম বারট্রান্ড জোবরিস্ট, ক্যামেরার দিকে চেয়ে বললো সে। “এ হলো আমার মুখ। পৃথিবীর কাছে উন্মুক্ত করে দিলাম যেনো সবাই আমাকে। দেখতে পায়। আমি যদি আমার জ্বলন্ত হৃদয়কে তুলে ধরি, যেমনটি করেছিলেন। প্রভু দান্তে তার ভালোবাসার বিয়েত্রিচের জন্য, তাহলে দেখতে পাবে আমিও ছিলাম ভালোবাসায় সিক্ত এক হৃদয়। এটা গভীরতম ভালোবাসা। তোমাদের সবার জন্য। তারচেয়ে বড় সত্য, তোমাদের একজনের জন্য।”
আরো একটু কাছে এসে অপলক চোখে ক্যামেরার দিকে চেয়ে রইলো জোবরিস্ট, কথা বললো বেশ নরম সুরে, যেনো তার প্রেমিকার সাথে কথা বলছে।
“আমার ভালোবাসা,” ফিসফিসিয়ে বললো সে। “আমার অমূল্য ভালোবাসা। তুমি আমার পরমসুখ। আমার সমস্ত দূর্বল নৈতিকতার বিনাশকারী, আমার সমস্ত সদ্বগুনের বাহক, আমার মোক্ষ। তুমি এমন একজন যে আমার পাশে নগ্ন হয়ে শুয়ে থেকেছে, কোনো চিন্তাভাবনা না করেই আমাকে অন্ধকার গহ্বর থেকে বের করে আনতে সাহায্য করেছে, এখন আমি যা করেছি তা করার শক্তি দিয়েছো আমায়।”
ভীতির সাথেই দেখতে লাগলো সিনস্কি।
“আমার ভালোবাসা, জোবরিস্ট বিষণ্ণভাবে ফিসফিসিয়ে বলতে শুরু করলে তার কথাগুলো ভুতুরে গুহায় প্রতিধ্বনিত হলো। “তুমি আমার প্রেরণা, আমার পথপ্রদর্শক, আমার ভার্জিল এবং আমার বিয়েত্রিচ, একের ভেতরে সব। এই মাস্টারপিসটি যেমন আমার তেমনি তোমারও। তুমি আর আমি বিচ্ছেদি প্রেমিক যুগলের মতো মিলিত হবো না কখনও, আমি আমার শান্তি খুঁজে নেবো এটা জেনে যে, তোমার সুকোমল হাতে আমি ভবিষ্যৎ রেখে যাচ্ছি। মাটির নীচে আমার কাজটা আমি শেষ করেছি, এখন সময় হয়েছে আবারো পৃথিবীর পৃষ্ঠে উঠে আসার…আবারো দু’চোখ ভরে দেখবো আকাশের তারা।
জোবরিস্ট কথা থামাতেই তারা’ শব্দটি গুহার ভেতরে প্রতিধ্বনি তুললো। তারপর বেশ শান্তভাবে সে ক্যামেরার দিকে হাত বাড়ালে ট্রান্সমিশন শেষ হয়ে গেলো সঙ্গে সঙ্গে।
‘আন্ডারগ্রাউন্ড লোকেশনটি,” মনিটর থেকে চোখ সরিয়ে প্রভোস্ট বললো, “আমরা চিনতে পারছি না। আপনি কি চিনতে পেরেছেন?”
মাথা ঝাঁকালো সিনস্কি। এরকম জিনিস আমি জীবনে কোনোদিন দেখি নি। রবার্ট ল্যাংডনের কথা মনে করলো সে। ভাবলো, সে কি জোবরিস্টের কু ধরে কোনো কিছু মর্মোদ্ধার করতে পেরেছে কিনা।
“হয়তো আপনার সাহায্যে আসতে পারে, সেজন্যে বলছি,” প্রভোস্ট বললো, “আমার মনে হয় আমি জোবরিস্টের প্রেমিকাকে চিনি।” থামলো সে। “তার কোডনেম হলো এফএস-২০৮০।”
উঠে দাঁড়ালো সিনস্কি। “ এফএস-২০৮০!” হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো প্রভোস্টের দিকে।
প্রভোস্টও সমানভাবে চমকে গেছে ডাক্তারের আচরণে। “আপনি কি তাকে চেনেন?”
অবিশ্বাসে মাথা নেড়ে সায় দিলো সিনস্কি। “একভাবে তো চিনিই।”
সিনস্কির হৃদস্পন্দন বেড়ে গেলো। এফএস-২০৮০। এই ব্যক্তির পরিচয় না জানলেও সে জানে এই কোড-নেমের মানে কি। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা অনেক বছর ধরেই এই এই নামের ব্যক্তিকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।
“ট্রান্সহিউম্যানিস্ট আন্দোলন,” বললো সে। “এ ব্যাপারে আপনার কোনো ধারণা আছে?”
মাথা ঝাঁকালো প্রভোস্ট।
“সহজ কথায় বললে,” সিনস্কি বোঝতে শুরু করলো, “ট্রান্সহিউম্যানিজম একটি দর্শন, যার মূল বক্তব্য হলো মানুষের উচিত সব ধরণের প্রযুক্তি আর টেকনোলজি ব্যবহার করে নিজের প্রজাতিকে আরো বেশি উন্নত আর শক্তিশালী করা। যোগ্যতরের টিকে থাকার জন্য।”
প্রভোস্ট কিছু বুঝতে না পেরে কাঁধ তুললো।
“সাধারণভাবে বলতে গেলে,” বলতে লাগলো ডাক্তার “ট্রান্সহিউম্যানিস্ট আন্দোলনের জন্ম দিয়েছে বিশেষ এক ধরণের ব্যক্তিবর্গ-বিজ্ঞানী, ভবিষ্যদ্রষ্টা আর দুরদর্শী ব্যক্তিরা-তবে অন্যসব আন্দোলনের মতোই এখানেও ক্ষুদ্র একটি মিলিট্যান্ট গোষ্ঠী গড়ে উঠেছে যারা বিশ্বাস করে আন্দোলনটি খুব একটা দ্রুতগতিতে এগোচ্ছে না। তারা সবাই মহাবিপর্যয়ের চিন্তাবিদ, বিশ্বাস করে খুব। জলদিই পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে তাই মানবজাতিকে রক্ষা করার জন্য কাউকে না কাউকে কঠিন একটি পদক্ষেপ নিতে হবে।”
“আমার অনুমাণ,” বললো প্রভোস্ট, “বারট্রান্ড জোবরিস্ট তাদেরই একজন ছিলো?”
“অবশ্যই,” বললো সিনস্কি। “এই আন্দোলনের একজন নেতা। তার উপর অসম্ভব মেধাবী একজন ব্যক্তি ছিলো সে, একজন ক্যারিশমেটিক বক্তা হওয়ার ফলে তার লেখা প্রবন্ধগুলো ট্রান্সহিউম্যানিস্ট আন্দোলনকারীদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। বর্তমানে তার অনেক উগ্রশিষ্য এরকম কোড-নেম ব্যবহার করে, সবগুলোই একই ধরণের-দুটো অক্ষর আর চারটা সংখ্যার সমম্বয়ে গঠিত-উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে ডিজি-২০৬৪, বিএ-২১০৫, কিংবা। আপনি যেটা একটু আগে বললেন।”
“এফএস-২০৮০।”
সায় দিলো সিনস্কি। “এটা অবশ্যই ট্রান্সহিউম্যানিস্টদের একটি কোড।”
“এইসব সংখ্যা আর অক্ষরগুলোর কি কোনো মানে আছে?”
কম্পিউটারের দিকে ফিরলো সিনস্কি। “আপনি ব্রাউজ করুন, আমি দেখিয়ে দিচ্ছি।”
কিছু বুঝতে না পারলেও প্রভোস্ট কম্পিউটারের কাছে গিয়ে সার্চ ইঞ্জিন চালু করলো।
“এফএস-২০৩০ সার্চ করুণ,” বললো সিনস্কি। তার পেছনে এসে দাঁড়ালো সে।
প্রভোস্ট টাইপ করার পর হাজার হাজার ওয়েবপেজ আবির্ভূত হলো।
“যেকোনো একটায় ক্লিক করুন,” বললো সিনস্কি।
উপরের একটা ‘হিট-’এ ক্লিক করলো প্রভোস্ট, সঙ্গে সঙ্গে উইকিপিডিয়ার একটি পেজে চলে গেলো, দেখা গেলো হ্যান্ডসাম এক ইরানী ভদ্রলোকের ছবি-ফেরেদৌন এম. এসফান্দিয়ারি-তার সম্পর্কে বলা আছে তিনি একজন লেখক, দার্শনিক, ভবিষদ্রষ্টা এবং ট্রান্সহিউম্যানিস্ট আন্দোলনের প্রবাদপুরুষ। ১৯৩০ সালে জন্ম নেয়া এই ব্যক্তিকে বলা হয়ে থাকে ট্রান্সহিউম্যানিস্ট দর্শনের প্রবক্তা হিসেবে। তিনিই এই মতবাদটিকে ব্যাপক সংখ্যক মানুষের কাছে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। এই ভদ্রলোক বৈজ্ঞানিকভাবে কৃত্রিম প্রজনন ব্যবস্থা, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এবং গ্লোবালাইজেশন সম্পর্কে ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন।
উইকিপিডিয়া মতে এসফান্দিয়ারির সবচাইতে সাহসী দাবি ছিলো টেকনোলজি তাকে একশ’ পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখতে পারবে। তার আমলে এটা খুবই বিরল ব্যাপার ছিলো। ভবিষ্যৎ টেকনোলজির প্রতি তার আস্থার নিদর্শন হিসেবে নিজের নাম বদলে রাখেন এফএস-২০৩০। এই কোড-নেমটি সে গঠন করেছিলো নিজের নামের দুটো আদ্যক্ষর আর যে সময় তার বয়স একশ’ হবে সেই সালটি মিলিয়ে। দুঃখের বিষয় হলো ক্ষুদ্রান্তের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে সতুর বছর বয়সে তিনি মারা যান। একশ’ বছর বাঁচার সাধ পূর্ণ না হলেও ট্রান্সহিউম্যানিস্ট অনুসারীরা তার স্মৃতির প্রতি সম্মান দেখিয়ে তার টেকনিক ব্যবহার করে নিজেদের কোডনেম রেখে থাকে।
লেখাটা পড়ে উঠে দাঁড়ালো প্রভোস্ট, জানালার সামনে দিয়ে উদাস হয়ে দীর্ঘক্ষণ পর্যন্ত চেয়ে থাকলো বাইরের সমুদ্রের দিকে।
“তাহলে,” অবশেষে বিড়বিড় করে বললো সে। “বারট্রান্ড জোবরিস্টের প্রেমিকা-এই এফএস-২০৮০-অবশ্যই একজন ট্রান্সহিউম্যানিস্ট।”
“এতে কোনো সন্দেহ নেই,” জবাবে বললো সিনস্কি। “তবে আমি দুঃখিত, আমি আসলেই জানি না কে এই এফএস-২০৮০, তবে-”
“এটা আমি জানি,” সমুদ্রের দিকে চেয়েই বললো প্রভোস্ট। “সে আসলে কে আমি তা জানি।”
.
অধ্যায় ৭৪
বাতাসেও মনে হয় স্বর্ণের আবহ।
এ জীবনে রবার্ট ল্যাংডন অসংখ্য ক্যাথেড্রাল পরিদর্শন করলেও সেন্ট মার্কসের চিয়েসা দো’রোর পরিবেশ তার কাছে সব সময়ই অনন্য বলে মনে হয়। শত শত বছর ধরে দাবি করা হতো সেন্ট মার্কসের বাতাসে নিঃশ্বাস নিলেও তুমি ধনী লোক বনে যাবে। এটা কেবলমাত্র রূপকার্থে নয় বরং আক্ষরিক অর্থেই বলা হতো।
ভেতরের সাজসজ্জায় ব্যবহৃত হয়েছে কয়েক লক্ষ প্রাচীন স্বর্ণের টাইলস, তাই এখানকার বাতাসে ভেসে বেড়ানো ধূলোর মধ্যে আসলে স্বর্ণের গুঁড়ো রয়েছে। এই ভেসে বেড়ানো স্বর্ণের ধূলোর সাথে পশ্চিমের বিশাল জানালা দিয়ে আসা সূর্যের আলো মিশে এমন একটি আবহ তৈরি করে যে ধর্মপ্রাণ মানুষ আধ্যাত্মিকতার পাশাপাশি সত্যিকারের স্বর্ণও বুক ভরে নিতে পারে।
এ সময় নীচু হয়ে আসা সূর্যের আলো পশ্চিম জানালা দিয়ে এমনভাবে ল্যাংডনের মাথার উপর দুকেছে, মনে হবে বিরাট বড় আর জ্বলজ্বলে একটি ফ্যান কিংবা সিল্কের তৈরি নৌকা ভাসছে শূন্যে। ল্যাংডন সম্ভ্রমের সাথে বুক ভরে নিঃশ্বাস না নিয়ে পারলো না, সে টের পেলো সিয়েনা এবং ফেরিসও একই কাজ করছে তার পাশে দাঁড়িয়ে।
“কোন দিকে?” ফিসফিসিয়ে বললো সিয়েনা।
উপরের দিকে উঠে যাওয়া একটি সিঁড়ির দিকে ইঙ্গিত করলো ল্যাংডন। চার্চের জাদুঘরটি উপর তলায় অবস্থিত, সেন্ট মার্কসের ঘোড়াগুলো ওই তলার বেলকনিতেই স্থাপিত করা আছে। হারভার্ডের প্রফেসরের বিশ্বাস খুব দ্রুতই জানা যাবে সেই রহস্যময় ডজ-এর পরিচয় যিনি ঘোড়াগুলোর মাথা কেটে দেবার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় সে দেখতে পেলো ফেরিস দম ফুরিয়ে হাপাচ্ছে, ঠিক তখনই সিয়েনার সাথে তার চোখাচোখি হয়ে গেলে আবার। ব্যাসিলিকার সামনে তাদের দেখা হবার পর থেকেই মেয়েটি চোখের ইশারায় তাকে কিছু বলার চেষ্টা করে যাচ্ছে। তার অভিব্যক্তি এমনই যে ফেরিসের ব্যাপারে ইঙ্গিত করে যেনো কিছু বলার চেষ্টা করছে তবে সেটা কি ল্যাংডন ধরতে পারছে না। মেয়েটাকে পরিস্কার করে বলার জন্য যে-ই না জিজ্ঞেস করতে যাবে অমনি ফেরিস পেছন ফিরে তাকালো, সঙ্গে সঙ্গে চোখ সরিয়ে নিলো সিয়েনা কিন্তু একটু দেরি হয়ে গেলো। ব্যাপারটা সামলে নেবার জন্য ফেরিসের দিকে তাকালো এবার।
“আপনি ঠিক আছেন তো, ডাক্তার?” জানতে চাইলো সে।
মাথা নেড়ে সায় দিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগলো ফেরিস।
প্রতিভাময়ী অভিনেত্রী, মনে মনে বললো ল্যাংডন, কিন্তু মেয়েটা আসলে কী বলতে চাচ্ছে আমাকে?
দ্বিতীয় তলায় ওঠার পর তারা দেখতে পেলো নীচে ছড়িয়ে আছে পুরো ব্যাসিলিকাটি। এই উপাসনালয়টি তৈরি করা হয়েছে গ্রিক ক্রশ আকারে, সেন্ট পিটার আর নটরডেমের তুলনায় অনেক বেশি বগাকৃতি।
চার্চের বেদী একটি পদার কলামের পেছনে অবস্থিত, ওটার উপর একটি ক্রুশবিদ্ধ ছবি আঁকা আছে। ওটার পাশেই আছে একটি রাজকীয় পানপাত্র। বেদীর পেছনে আছে একটি অমূল্যবান পালা দোরো-সিলভারের ব্যাকড্রপ। এটাকে বলা হয় ‘গোল্ডেন ক্লথ। বাইজেন্টাইন আমলের এই জিনিসটি এখানে একমাত্র গোথিক ফ্রেম। তেরোশত মুক্তা, চারশত মণি, তিনশত স্যাফায়ারের সাথে এমারেল্ড, অ্যামেথিস্ট আর রুবি দিয়ে এটি সাজানো হয়েছে। সেন্ট মার্কসের ঘোড়াগুলো সাথে সাথে এই পালা দোরো’কেও মনে করা হয় ভেনিসের সবচাইতে সূক্ষ্ম আর মূল্যবান সম্পদ।
স্থাপত্যকলার দিক থেকে বলতে গেলে ব্যাসিলিকা শব্দের মানে ইউরোপ কিংবা পশ্চিমের বুকে দাঁড়িয়ে থাকা বাইজেন্টাইন স্টাইলের চার্চ। কন্সট্যান্টিনোপলে অবস্থিত হলি অ্যাপোস্টেলের জাস্টিনিয়ানের ব্যাসিলিকার অনুকরণে নির্মিত বলে সেন্ট মার্কস পুরোপুরি প্রাচ্য ঘরানার। এমন কি অনেক গাইডবুকে বলা হয়ে থাকে এখানে ভ্রমণ করাটা তুরস্কের কোনো মসজিদে ভ্রমণ করার বিকল্প হতে পারে, কারণ ওখানকার অনেক মসজিদই বাইজেন্টাইন ক্যাথেড্রালগুলোকে রূপান্তর করে বানানো হয়েছিলো।
ল্যাংডন অবশ্য সেন্ট মার্কসকে তুরস্কের জমকালো মসজিদ হিসেবে কখনও বিবেচনা করতো না। সে জানে এখানে ডান দিকের কিছু গোপন রুমে তথাকথিত সেন্ট মার্কসের সম্পদগুলো লুকিয়ে রাখা আছে-২৮৩টি বহু মূল্যের আইকন, জুয়েল আর চ্যালিস। এসবই কন্সট্যান্টিনোপল থেকে লুট করে আনা।
এ সময়ে ব্যাসিলিকাটি অপেক্ষাকৃত নিরিবিলি দেখতে পেয়ে ল্যাংডন খুশিই হলো। প্রচুর লোকজন ঘুরে বেড়ালেও নির্বিঘ্নে চলাচল করার মতো পরিবেশ বজায় আছে এখনও। সিয়েনা আর ফেরিসকে পশ্চিম দিকের জানালার কাছে নিয়ে গেলো ল্যাংডন, যেখান থেকে দর্শনার্থীরা ঘোড়াগুলো কাছ থেকে দেখার জন্য বেলকনিতে যেতে পারে। যে উওজ-এর পরিচয় তারা জানতে চাইছে সেটা এখান থেকে পেয়ে যাবার ব্যাপারে ল্যাংডন বেশ আত্মবিশ্বাসী হলেও এরপর কী পদক্ষেপ নেবে সেটা নিয়ে ভীষণ চিন্তিত-ঐ উওজ-এর অবস্থান খুঁজে বের করা। তার সমাধি? কিংবা মূর্তি? এটা করতে গেলে অন্য কারোর সাহায্য ছাড়া প্রায় অসম্ভব, কারণ এই চার্চে শত শত মূর্তি, ক্রিপ্ট আর সমাধিকক্ষ রয়েছে।
এক তরুণী ডোসেন্টকে দেখলো পর্যটকদের ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাচ্ছে, তার কাছে গিয়ে ভদ্রভাবে কথা বললো ল্যাংডন। “ক্ষমা করবে,” বললো সে। “এ মুহূর্তে কি ইত্তোরে ভিও এখানে আছে?”
“ইত্তোরে ভিও?” ল্যাংডনের দিকে অদ্ভুত চোখে তাকালো মেয়েটি। “সি, সাতো, মা-” থমকে দাঁড়ালো সে, তার চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। “লেই এ রাবাট ল্যাংডন, ভেরো?!” আপনি রবার্ট ল্যাংডন না?
ধৈর্যসহকারে হাসলো ল্যাংডন। “সি, সোনো, আইও। ইত্তোরের সাথে কথা বলা কি সম্ভব?”
“সি, সি!” মেয়েটি তার টুর গ্রুপকে অপেক্ষা করতে বলে চলে গেলো হনহন করে।
ল্যাংডন এবং জাদুঘরের কিউরেটর ইত্তোরে ভিও এক সময় এই ব্যাসিলিকার উপর নির্মিত একটি ডকুমেন্টারি ফিল্মে অংশ নিয়েছিলো। এরপর থেকে তাদের দুজনের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ অব্যাহত আছে। “এই ব্যাসিলিকার উপর ইত্তোরে বই লিখেছেন,” সিয়েনাকে বললো সে। “সত্যি বলতে কি, একটা না, অনেকগুলো।”
ফেরিসের উপস্থিতিতে সিয়েনাকে কেমন জানি অদ্ভুত লাগলো ল্যাংডনের। তাদের দুজনকে পশ্চিম দিকের জানালায় নিয়ে এলো সে। এখান থেকে ঘোড়াগুলো খুব কাছ থেকে দেখা যায়। বেলকনিতে থাকা দর্শকেরা ঘোড়াগুলোর পাশাপাশি সেন্ট মার্কস স্কয়ারের প্যানোরামাও দেখে নিচ্ছে।
“এই তো তারা!” বেলকনির দিকে যেতে যেতে বললো সিয়েনা।
“ঠিক তা নয়,” বললো ল্যাংডন। “বেলকনিতে আমরা যে ঘোড়াগুলো দেখতে পাচ্ছি সেগুলো আসলে রেপ্লিকা। সত্যিকারের সেন্ট মার্কসের ঘোড়াগুলো চার্চের ভেতরে নিরাপদে সংরক্ষণ করা আছে।”
ল্যাংডন তাদেরকে করিডোর দিয়ে একটি আলোকিত অ্যালকোভে নিয়ে এলো। ওখানে ঠিক একই রকম দেখতে চারটি ঘোড়া রাখা আছে।
ঘোড়াগুলোর দিকে সম্ভ্রমের দৃষ্টিতে তাকিয়ে ইশারা করলো প্রফেসর। “এগুলো হলো সত্যিকারের।”
যতোবারই ঘোড়াগুলোকে কাছ থেকে দেখে ততোবারই মুগ্ধ হয়ে যায় সে। পেশী, চামড়া আর ভঙ্গিগুলো এতো নিখুঁত যে অবিশ্বাস্য ঠেকে তার কাছে। এই চারটি অসাধারণ ভাস্কর্য টালমাটাল অতীত পেরিয়ে আজো টিকে আছে। মহান শিল্পকর্মের সংরক্ষণ কতোটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা আবারো মনে পড়ে গেলো তার।
“তাদের কলারগুলো,” ঘোড়াগুলোর গলায় নক্সা করা কলার দেখিয়ে বললো সিয়েনা। “তুমি বলেছো ওগুলো পরে যোগ করা হয়েছে? কাটা দাগগুলো আড়াল করার জন্য?”
সিয়েনা আর ফেরিসের কাছে ARCA ওয়েবসাইট থেকে ঘোড়াগুলো গলা কাটার যে ইতিহাস সে জেনেছে সেটা বিস্তারিত বলেছিলো ল্যাংডন।
“ঠিক ধরেছো,” কাছে একটি তথ্য নির্দেশিকার দিকে যেতে যেতে বললো ল্যাংডন।
“রবাতো!” তাদের পেছন থেকে আন্তরিক একটি কণ্ঠ ডাক দিলো। “তুমি আমাকে অপমান করেছো!”
ল্যাংডন ঘুরে দেখতে পেলো সাদা-চুলের প্রাণোচ্ছল ইত্তোরে ভিও নীল রঙের সুট আর গলায় চেইন পরে লোকজনের ভীড় ঠেলে এগিয়ে আসছে তার দিকে। “তোমার কতো বড় আস্পর্ধা, আমার শহরে এসেছে আমাকে না জানিয়ে! একটা ফোনও করো নি!”
মুচকি হেসে ভদ্রলোকের সাথে করমর্দন করলো ল্যাংডন। “আমি আসলে তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম, ইত্তোরে। তোমাকে দেখে কিন্তু দারুণ লাগছে। এরা আমার বন্ধু ডাক্তার ব্রুকস এবং ডাক্তার ফেরিস।”
তাদের দুজনের সাথে করমর্দন করে ল্যাংডনের দিকে আবার ফিরলো ইত্তোরে। “দু দু’জন ডাক্তারকে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছো? তুমি কি অসুস্থ নাকি? আর তোমার এরকম পোশাক কেন? তুমি কি ইটালিয়ান হতে চাইছো?”
“কোনোটাই না,” মুচকি হেসে বললো ল্যাংডন। “এই ঘোড়াগুলোর ব্যাপারে কিছু তথ্য জানার জন্য এসেছি আমি।”
ইত্তোরে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকালো। “এখানে এমন কী আছে যে তোমার মতো বিখ্যাত প্রফেসর এখনও জানে না?”
জোরে হেসে ফেললো ল্যাংডন। “ক্রুসেডের সময় ঘোড়াগুলো পরিবহণ করার প্রয়োজনে গলা কেটে ফেলা হয়েছিলো সে সম্পর্কে জানতে চাই।”
ইত্তোরে এমনভাবে তাকালো যেনো ল্যাংডন কোনো নিষিদ্ধ বিষয় নিয়ে কথা বলছে। “হায় ঈশ্বর!” বিড়বিড় করে বললো সে। “আমরা এসব ব্যাপার নিয়ে কথা বলি না। তুমি যদি কাটা মাথাগুলো দেখতে চাও তাহলে বিখ্যাত কাৰ্মানোলা কিংবা—”
“ইত্তোরে, আমি জানতে চাই কোন্ ভেনিশিয়ান ডওজ ঘোড়াগুলো মাথা কেটেছিলো।”
“এরকম কোনো ঘটনা ঘটেই নি,” আত্মপক্ষ সমর্থন করে বললো ইত্তোরে। “এসব গাল-গল্প আমিও শুনেছি, তবে ঐতিহাসিকভাবে কোনো ডওজ এরকম কোনো ঘটনা ঘটিয়েছেন বলে-”
“ইত্তোরে, প্লিজ। তামাশা কোরো না,” বললো ল্যাংডন। “এইসব গাল-গল্পে কোন ডওজু-এর কথা বলা আছে?”
চোখে চশমা পরে নিলো ইত্তোরে। “গুজব আছে আমাদের প্রিয় ঘোড়াগুলো ভেনিসে নিয়ে এসেছিলেন সবচাইতে চতুর আর প্রতারক এক ডজ।”
“প্রতারক?”
“হ্যাঁ। যে ডজ ক্রুসেডের সময় সবার সাথে চালাকি করেছিলেন। একটু থেমে আবার বললো, “যে ডওজ রাজ কোষাগার থেকে টাকা নিয়ে মিশরে পাড়ি দেন…কিন্তু গন্তব্য বদলে তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে কন্সট্যান্টিনোপল ধ্বংস করে দিয়েছিলেন।”
বিশ্বাসঘাতক বলেই মনে হচ্ছে, মনে মনে বললো ল্যাংডন। “তার নামটা কি?”।
ভুরু তুললো ইত্তোরে। “রবার্ট, আমি তো জানি তুমি বিশ্বইতিহাসের একজন ছাত্র ছিলে।”
“হ্যাঁ, তা ছিলাম, কিন্তু বিশ্বটা অনেক বড় আর ইতিহাস বেশ সুদীর্ঘ। আমার একটু সাহায্য নিতে হবে।”
“ঠিক আছে, তাহলে শেষ একটা কুঁ দেই।”
ল্যাংডন বাধা দিতে গিয়েও দিলো না, সে বুঝতে পারছে এতে কাজ হবে না। আদতে।
“এই ডওজ প্রায় একশ’ বছর বেঁচে ছিলেন,” বললো ইত্তোরে। “ঐ যুগে এটা অলৌকিক ঘটনাই বটে। তার এই দীর্ঘ জীবন নিয়ে লোকে একটা কথা বলাবলি করতো। কন্সট্যান্টিনোপল থেকে সেন্ট লুসিয়ার হাঁড়গোর ভেনিসে নিয়ে। আনার মতো সাহসী কাজ করেছিলেন বলে তিনি নাকি দীর্ঘ জীবনের অধিকারী হতে পেরেছিলেন। সেন্ট লুসিয়া তার চোখ-”
“উনি অন্ধের কঙ্কাল তুলে এনেছিলেন!” সিয়েনার মুখ দিয়ে কথাটা বের হয়ে গেলো। ল্যাংডনের দিকে তাকালো সে।
অদ্ভুত চোখে সিয়েনার দিকে তাকালো ইত্তোরে। “এক দিক থেকে বলতে গেলে সেরকমই।”
হঠাৎ করেই ফেরিসের মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেলো।
“আমি আরো বলছি,” ইত্তোরে বললো। “ঐ ডজ সেন্ট লুসিয়াকে এতো ভালোবাসার কারণ তিনি নিজেও অন্ধ ছিলেন। নব্বই বছর বয়সে চোখে কিছু না দেখলেও উনি এই স্কয়ারে দাঁড়িয়ে ক্রুসেডারদের উদ্বুদ্ধ করেছেন।”
“আমি জানি কার কথা বলছো,” ল্যাংডন বললো।
“আমিও সেরকমই আশা করি!” মুচকি হেসে বললো ইত্তোরে।
ল্যাংডনের অসাধারণ স্মৃতিশক্তি টেক্সটের চেয়ে ইমেজই বেশি মনে রাখতে পারে, তাই তার চোখের সামনে একটি আর্টওয়ার্ক ভেসে উঠলো-গুস্তাভ দোরের বিখ্যাত একটি শিল্পকর্ম, যেখানে এক অন্ধ ডজ দু’হাত প্রসারিত করে ক্রুসেডে, যোগ দিতে যাওয়া সমবেতদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দিচ্ছেন। দোরে’র ছবিটার নাম তার পরিস্কার মনে আছে : দান্দোলো প্রিচিং দ্য ক্রুসেড।
“এনরিকো দান্দোলো,” বললো ল্যাংডন।
“ফিনালমেন্তে!” ইত্তোরে বললো। “আমার আশংকা, তোমার মনের বয়স বেড়ে যাচ্ছে, বন্ধু।”
“শুধু মনের না, সবকিছুর বয়সই বেড়ে যাচ্ছে। আচ্ছা, উনি কি এখানেই সমাহিত?”
“দান্দোলো?” মাথা ঝাঁকালো সে। “এখানে না।”
“তাহলে কোথায়?” জানতে চাইলো সিয়েনা। “ডওজ-এর প্রাসাদে?”
চশমা খুলে ভাবতে লাগলো ইত্তোরে। “দাঁড়াও, একটু ভেবে নেই। এখানে এতো ডওজ আছে যে সবার কথা মনে করতে হিমশিম-”
ইত্তোরে কিছু বলার আগেই ভয়ার্ত এক ডোসেন্ট ছুটে এসে তাকে একটু পাশে নিয়ে গিয়ে কানে কানে কী যেনো বললো। ইত্তোরের ভাবভঙ্গি বদলে গেলো মুহূর্তে, নার্ভাসভাবে রেলিংয়ের দিকে দৌড়ে গেলো সে, নীচের স্যাঙ্কচুয়ারির দিকে তাকালো। কয়েক মুহূর্ত পর ফিরলো ল্যাংডনের দিকে।
“আমি আসছি,” চিৎকার করে বললো ইত্তোরে, তারপর কোনো কথা না বলে তড়িঘড়ি চলে গেলো।
হতভম্ব ল্যাংডন রেলিংয়ের কাছে গিয়ে নীচের দিকে তাকালো। ওখানে হচ্ছেটা কি? প্রথমে সে কিছুই দেখতে পেলো না, পর্যটকেরা এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। একটু পরই বুঝতে পারলো অনেক পর্যটকই প্রধান প্রবেশদ্বারের দিকে চেয়ে আছে। সেখান দিয়ে কালো পোশাকের একদল সৈনিক প্রবেশ করছে এখন। সবগুলো প্রবেশপথ ব্লক করে দিয়েছে তারা।
কালো ইউনিফর্মের সৈনিক। আনমনে রেলিংটা শক্ত করে ধরে ফেললো ল্যাংডন।
“রবার্ট!” পেছন থেকে ডাকলো সিয়েনা।
ল্যাংডনের চোখ সৈনিকদের উপর আঁটকে আছে যেনো। তারা আমাদেরকে কিভাবে খুঁজে পেলো?!
“রবার্ট,” তাড়া দিয়ে বললো সিয়েনা। “কিছু একটা হয়েছে! আমাকে সাহায্য করো!”
মেয়েটার এ কথা শুনে আরো বেশি হতভম্ব হয়ে রেলিং থেকে ঘুরে দাঁড়ালো ল্যাংডন।
ও কোথায় গেলো?
কয়েক মুহূর্ত পরই সিয়েনা আর ফেরিসকে খুঁজে পেলো সে। সেন্ট মার্কসের ঘোড়াগুলোর সামনে মেঝেতে হাটু গেঁড়ে বসে আছে সিয়েনা, তার সামনে পড়ে আছে ডাক্তার ফেরিস…বুকের একপাশ ধরে ঢলে পড়েছে সে।
.
অধ্যায় ৭৫
“আমার মনে হচ্ছে উনার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে!” সিয়েনা চিৎকার করে বললো।
ল্যাংডন দৌড়ে গেলো ডা: ফেরিসের কাছে।
লোকটা হাসফাস করছে, নিঃশ্বাস নিতে পারছে না।
তার হয়েছে কি?! ল্যাংডনের মাথায় সবকিছু একমুহূর্তে জড়ো হলো। নীচের তলায় সৈনিকদের আগমন আর ডা: ফেরিসের এভাবে পড়ে যাওয়া, কয়েক মুহূর্তের জন্য প্যারালাইজ হয়ে গেলো সে, বুঝতে পারলো না কোন্ দিকে যাবে।
সিয়েনা উপুড় হয়ে ডাক্তারের নেকটাইটা আলগা করে দিয়ে শার্টের উপরের দিকে বোতামগুলো দ্রুত খুলে ফেললো যাতে করে শ্বাস নিতে পারে কিন্তু শার্টটা ওভাবে খুলে ফেলার পরই সে আৎকে উঠে গগনবিদারী চিৎকার দিলো। মুখে হাত চাপা দিয়ে পিছিয়ে গেলো কয়েক পা। নগ্ন বুকের দিকে বিস্ফারিত চোখে চেয়ে রইলো।
ল্যাংডনও দেখতে পেলো সেটা।
ডা: ফেরিসের বুকের চামড়া কালচে হয়ে আছে। নীলচে-কালো একটি বৃত্ত ফেঁটে যেনো বুকের পাঁজর বের হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে কামানের গোলা আঘাত হেনেছে লোকটার বুকে।
“ইন্টারনাল ব্লিডিং হচ্ছে,” আতঙ্কের সাথে ল্যাংডনের দিকে তাকিয়ে বললো সিয়েনা। “সারাটা দিন যে নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট পেয়েছে তাতে অবাক হবার কিছু নেই।”
মাথা তোলার চেষ্টা করলো ফেরিস, বোঝা যাচ্ছে কথা বলার চেষ্টা করছে কিন্তু অস্ফুট কিছু আওয়াজ ছাড়া তার মুখ দিয়ে কিছু বের হচ্ছে না। আশেপাশে যতো পর্যটক আছে তারা ফেরিসের চারপাশে জড়ো হতে শুরু করেছে। ল্যাংডন। আঁচ করতে পারলো পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠছে ক্রমশ।
“নীচে সৈন্যরা এসে পড়েছে,” সিয়েনাকে বললো ল্যাংডন। “আমি জানি না তারা কি করে আমাদেরকে খুঁজে পেলো।”
সিয়েনা রেগেমেগে তাকালো ফেরিসের দিকে। “আপনি আমাদের সাথে মিথ্যে বলেছেন, তাই না?”
ফেরিস চেষ্টা করেও কিছু বলতে পারলো না। সিয়েনা ডাক্তারের পকেট হাতরে ফোন আর ওয়ালেট বের করে দেখলো, ফোনটা নিজের পকেটে ঢুকিয়ে ফেললো সে। লোকটার দিকে কটমট চোখে তাকালো এবার।
ঠিক তখনই বয়স্ক এক ইতালিয়ান মহিলা ভীড় ঠেলে তাদের সামনে চলে এসে সিয়েনার উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলতে লাগলো, “লাই কলপিতো আল পেতো!” নিজের বুকে বেশ জোরে ঘুষি মারলো সে।
“না!” রেগেমেগে বললো সিয়েনা। “সিপিআর দিলে উনি মারা যাবেন! তার বুকের দিকে তাকান!” ল্যাংডনের দিকে ফিরলো সে। রবার্ট, আমাদেরকে এখান থেকে বের হতে হবে। এক্ষুণি।”
মাটিতে শুয়ে থাকা ফেরিসের দিকে তাকালো ল্যাংডন, লোকটা তার দিকে তাকিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করছে, যেনো অনুনয় করে কিছু বলতে চাচ্ছে তাকে।
“তাকে এভাবে ফেলে রেখে চলে যেতে পারি না!” উদভ্রান্তের মতো বললো ল্যাংডন।
“আমাকে বিশ্বাস করো,” বললো সিয়েনা। “এটা হার্ট অ্যাটাক নয়। আমাদেরকে এক্ষুণি চলে যেতে হবে।”
লোকজনের ভীড়টা বাড়তে থাকলো, সাহায্যের জন্য চিৎকার চেঁচামেচি করতে লাগলো তারা। সিয়েনা শক্ত করে ল্যাংডনের হাত ধরে তাকে টেনে বেলকনির একপাশে নিয়ে এলো।
কয়েক মুহূর্তের জন্য ল্যাংডনের চোখ ঝলসে গেলো সূর্যের আলোয়। সিয়েনা তাকে দ্বিতীয় তলার টেরাসের দিকে নিয়ে এলো এবার। পিয়াজ্জা আর সেন্ট মার্কসের রেপ্লিকা ঘোড়াগুলো মুগ্ধ হয়ে দেখতে থাকা পর্যটকদের ভীড় ঠেলে এগিয়ে গেলো আরো সামনে। তারা ব্যাসিলিকার সম্মুখ দিকে চলে আসতেই দেখতে পেলো ঠিক সামনেই আছে লেগুনটা। জলরাশিতে অদ্ভুত একটি জিনিস দেখতে পেলো ল্যাংডন-অত্যাধুনিক একটি ইয়ট, দেখে মনে হচ্ছে এক ধরণের ফিউচারিস্টিক যুদ্ধজাহাজ।
দ্বিতীয় কোনো চিন্তা করার আগেই সিয়েনা আর সে বেলকনি দিয়ে দক্ষিণ পশ্চিম দিকে ব্যাসিলিকার ‘পেপার ডোর’-এর দিকে পা বাড়ালো-এই সংলগ্ন ভবনটি ব্যাসিলিকার সাথে উওজ-এর প্রাসাদের সংযোগ ঘটিয়েছে-এর এমন নামকরণের কারণ ডওজরা এখানে তাদের ডিক্রিগুলো ঝুলিয়ে দিতো জনসাধারণের জন্য।
হার্ট অ্যাটাক নয়? ল্যাংডনের চোখে ফেরিসের বুকের নীলচে-কালো দাগটার ছবি গেঁথে আছে। সিয়েনা যে লোকটার অসুখের ব্যাপার ধরতে পেরেছে সেটা বুঝতে পেরে হঠাৎ করেই তার মধ্যে একটা ভীতি জেঁকে বসলো। তারচেয়ে বড় কথা, সিয়েনা এখন আর লোকটাকে বিশ্বাস করতে পারছে না। এজন্যে কি একটু আগেও মেয়েটা আমাকে চোখের ইশারায় কিছু বলার চেষ্টা করে গেছিলো?
সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ে যে রেলিং আছে সেখানে এসে সিয়েনা আচমকা থমকে দাঁড়ালো, নীচের সেন্ট মার্কস স্কয়ারের দিকে উঁকি মেরে দেখলো সে।
“ধ্যাত্,” বললো সিয়েনা। “যতোটুকু ভেবেছিলাম তারচেয়ে অনেক বেশি উঁচু।”
মেয়েটার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইলো ল্যাংডন। তুমি এখান থেকে লাফ দেবার কথা ভাবছো?!
সিয়েনাকে খুব ভীত দেখালো এখন। “তাদের হাতে ধরা পড়া যাবে না, রবার্ট।”
পেছন ফিরে ল্যাংডন ব্যাসিলিকার রট-আয়ারনের ভারি দরজা আর কাঁচের দিকে তাকালো। পর্যটকের দল ওখান দিয়ে ঢুকছে বের হচ্ছে। ল্যাংডনের হিসেব যদি সঠিক হয়ে থাকে তাহলে ঐ দরজাটা পার হলেই চার্চের পেছনে জাদুঘরে চলে যেতে পারবে আবার।
“তারা সবগুলো এক্সিট আঁটকে রেখেছে,” বললো সিয়েনা।
পালানোর উপায়গুলো নিয়ে ভেবে একটামাত্র সিদ্ধান্তে আসতে পারলো ল্যাংডন। “আমার মনে হয় ভেতরে একটা জিনিস দেখেছি, সেটাই আমাদের সমাধান দিতে পারবে।”
কী করতে যাচ্ছে সে সম্পর্কে পরিস্কার ধারণা না থাকা সত্ত্বেও সিয়েনাকে নিয়ে ব্যাসিলিকার ভেতরে ঢুকে পড়লো সে। জাদুঘরের এলাকাটি এড়িয়ে লোকজনের ভীড়ে মিশে থাকার চেষ্টা করলো তারা। ফেরিস যেখানে পড়ে আছে পর্যটকদের বেশিরভাগ সেখানে তাকিয়ে আছে। ভীড়ের মধ্যে লুকিয়ে থেকে। ল্যাংডন দেখতে পেলো বৃদ্ধ ইতালিয়ান মহিলা দু’জন সৈন্যের কাছে বলেছে তারা দু’জন কোন দিক দিয়ে পালিয়েছে।
যা করার দ্রুত করতে হবে, ভাবলো লাংডন। দেয়ালের দিকে তাকালো সে, অবশেষে যা খুঁজছিলো তা পেয়ে গেলো ডিসপ্লে করা বিশাল বড় একটি ট্যাপেস্ট্রি।
দেয়ালে কটকটে হলুদ আর লাল রঙের সতর্কতার চিহ্নের একটি স্টিকার আছে : আলার্মে আনতিনসেন্দিও।
“ফায়ার অ্যালাম?” বললো সিয়েনা। “এই তোমার পরিকল্পনা?”
“এটা করলে আমরা লোকজনের হৈহল্লার মধ্যে বাইরে চলে যেতে পারবো।” অ্যালার্ম লিভারটা টেনে নীচে নামাতেই দেখতে পেলো ছোট্ট একটি কাঁচের দরজা ভেঙে গেলো, ওটার ভেতরে একটি সিলিন্ডার।
কিন্তু ল্যাংডন যেরকমটি আশা করেছিলো, সাইরেন বাজবে, হৈহল্লা হবে, তেমন কিছুই হলো না।
নীরবতা।
আবারো টান দিলো লিভারটা।
সিয়েনা তার দিকে এমনভাবে তাকালো যেনো সে পাগল হয়ে গেছে। “রবার্ট, আমরা পাথরের একটি ক্যাথেড্রালের ভেতরে পর্যটকদের ভীড়ের মধ্যে। আছি! তুমি কি মনে করো এইসব ফায়ার অ্যালার্ম অ্যাক্টিভ করে রাখা আছে? তারা কি জানে না, যেকোনো লোক তামাশা করার জন্য এটা টেনে দিলে-”
“অবশ্যই! ইউএস-এর ফায়ার ল’জে-”
“তুমি এখন ইউরোপে আছে। আমাদের এখানে তোমাদের মতো গণ্ডায় গণ্ডায় আইনজীবি নেই, বুঝলে?” ল্যাংডনের কাঁধের পেছনে ইঙ্গিত করলো সে। “আর আমাদের হাতেও একদম সময় নেই।”
ল্যাংডন ঘুরে দাঁড়ালো, একটু আগে যে কাঁচের দরজাটা দিয়ে তারা এখানে এসেছে সেটা দিয়ে দেখতে পেলো দু’জন সৈন্য বেলকনি থেকে দ্রুত নীচে নেমে আসছে। তাদের সতর্ক চোখ ঘুরে বেড়াচ্ছে আশেপাশে। একজনকে সে চিনতে পারলো, পেশীবহুল শরীরের এক সৈনিক। তারা যখন সিয়েনার অ্যাপার্টমেন্ট থেকে ট্রিকি’তে করে পালাচ্ছিলো তখন এই সৈন্যটি তাদের লক্ষ্য করে গুলি করেছিলো।
অন্য কোনো উপায় না দেখে কাছের একটি পেচানো সিঁড়িতে ঢুকে পড়লো তারা দুজন, এটা চলে গেছে গ্রাউন্ড ফ্লোরে। ল্যান্ডিংয়ে পৌঁছানোর পর তারা অন্ধকারে ঘাপটি মেরে রইলো। চার্চের ভেতরে বেশ কয়েকজন সৈন্য এক্সিটগুলো পাহারা দিচ্ছে। তাদের চোখও সতর্ক, ঘুরে বেড়াচ্ছে সবত্র।
“আমরা যদি এই সিঁড়ি থেকে বের হই তাহলে ওরা আমাদের দেখে ফেলবে,” ল্যাংডন বললো।
“এই সিঁড়িটা আরো নীচে চলে গেছে,” চাপাস্বরে বললো সিয়েনা। সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ের উপরে অ্যাকসেসো ভিয়েতাতে লেখা একটি ঝুলন্ত ব্যানারের দিকে ইঙ্গিত করলো সে। এই ব্যানারের পরে সিঁড়িটা চলে গেছে ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে মধ্যে।
মোটেও ভালো আইডিয়া নয়, মনে মনে বললো ল্যাংডন। নীচে আছে ভূ গর্ভস্থ ক্রিপ্ট, ওখানে কোনো এক্সিট নেই।
তততক্ষণে সিয়েনা সিঁড়ি দিয়ে নীচের অন্ধকারে ঢুকে পড়েছে।
“এটা ভোলা আছে,” নীচ থেকে সিয়েনার কণ্ঠটা বলে উঠলো।
অবাক হলো না ল্যাংডন। সেন্ট মার্কসের ক্রিপ্ট অন্য সব ক্রিপ্টের চেয়ে একটু আলাদা কারণ এটা এখনও চ্যাপেল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সেন্ট মার্কের কঙ্কালের উপস্থিতিতে নিয়মিত সার্ভিস হয় এখানে।
“আমার মনে হচ্ছে আমি সূর্যের আলো দেখতে পাচ্ছি ওখান দিয়ে!” ফিসফিসিয়ে বললো সিয়েনা।
এটা কি করে সম্ভব? এর আগে এখানে কী দেখেছিলো সেটা মনে করার চেষ্টা করলো, ধারণা করলো মেয়েটি বোধহয় লাক্স ইতারনা দেখেছে-স্টে মার্কসের সমাধির উপরে একটি ইলেক্ট্রিক বাতি জ্বলে থাকে সব সময়। মাথার উপরে পায়ের আওয়াজ শুনে ল্যাংডন আর ভাবার সময় পেলো না। সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলো নীচে।
সিঁড়ির নীচে সিয়েনা তার জন্য অপেক্ষা করছে। তার পেছনে অন্ধকারে ক্রিপ্টটা প্রায় দেখাই যাচ্ছে না। পাথরে তৈরি নীচু ছাদের একটি কক্ষ। অসংখ্য পিলার আর খিলান রয়েছে সেখানে। এইসব পিলারই ব্যাসিলিকার পুরো ওজন বহন করছে, ভাবলো ল্যাংডন, এরইমধ্যে তার ক্লস্ট্রোফোবিয়া শুরু হয়ে গেছে।
“বলেছিলাম না,” চাপাস্বরে বললো সিয়েনা। মৃদু প্রাকৃতিক আলোয় তার সুন্দর মুখটি আলোকিত হয়ে আছে। দেয়ালের উপরে বেশ কয়েকটি ছোটো ছোটো ফোকরের দিকে ইঙ্গিত করলো সে।
বাতির কুয়ো, ল্যাংডন বুঝতে পারলো। এগুলোর কথা সে ভুলে গেছিলো। এই কুয়োগুলো ডিজাইন করা হয়েছে আবদ্ধ ক্রিপ্টের ভেতরে আলো-বাতাসের জন্য-সেন্ট মার্কস স্কয়ারের উপর থেকে এখানে আলো-বাতাস প্রবেশ করে। জানালাগুলোর কাঁচ শুধুমাত্র ভেতর থেকে খোলা যায় কিন্তু অতো উপরে ওঠাটা সহজ কাজ হবে না। আর উঠতে পারলেও ওটা দিয়ে বের হওয়া প্রায় অসম্ভব, কারণ শ্যাফটগুলো দশ ফিটের মতো গভীর, আর উপরে মুখগুলো শক্ত গ্রিল দিয়ে আঁটকানো।
উপরের ফোকরগুলো দিয়ে সেন্ট মার্কসের ক্রিপ্টের উপর যে আলো এসে পড়েছে সেটা যেনো অরণ্যের মধ্যে পূর্ণিমার আলোর মতো। মাঝখানের ক্রিপ্টটার দিকে তাকালো ল্যাংডন, সেন্ট মার্কসের সমাধির উপরে একটা ইলেক্ট্রিক বাতি জ্বলছে। তারপরে একসারি ক্রিপ্টে শুয়ে আছে ভেনিসের শুরুর দিককার খৃস্টান ধর্মের প্রবক্তারা।
হঠাৎ করেই ছোট্ট একটা আলোক বিন্দু জ্বলে উঠলো তার পাশে, ল্যাংডন পাশ ফিরে দেখতে পেলো সিয়েনার হাতে ফেরিসের মোবাইলফোনটি। ওটার ডিসপ্লে জ্বলজ্বল করছে।
অবাক হলো ল্যাংডন। “ফেরিস না বলেছিলো ওর ফোনের ব্যাটারির চার্জ নেই!”
“মিথ্যে বলেছিলো সে,” বাটনে টাইপ করতে করতে বললো সিয়েনা। “অনেক কিছুর ব্যাপারেই সে মিথ্যে বলেছে।” ফোনের দিকে তাকিয়ে ভুরু কুচকে মাথা ঝাঁকালো। “সিগন্যাল নেই। ভাবলাম এনরিকো দান্দোলো’র লোকেশনটি খুঁজে বের করবো।” বাতির কুয়োর সামনে চলে গেলো সিয়েনা, ফোনটা উপরে তুলে ধরলো এবার। চেষ্টা করলো সিগন্যাল পাবার।
এনরিকো দান্দোলো, ভাবলো ল্যাংডন। বিশ্বাসঘাতক একজন ডজ আর ঘোড়ার মাথা কাটার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি। অন্ধের কঙ্কাল তুলে আনার কাজটাও করেছিলেন একই ব্যক্তি। সবটাই মিলে যায় কবিতার সাথে কিন্তু দুঃখের বিষয়, তার সমাধিটি কোথায় সে সম্পর্কে ল্যাংডনের কোনো ধারণাই নেই, এমনকি ইত্তোরেরও সেটা অজানা।
সে এই ব্যাসিলিকার প্রতিটি ইঞ্চি চেনে…সম্ভবত ডওজ-এর প্রাসাদও। কিন্তু দান্দোলোর সমাধির কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে ইত্তোরে সেটার কথা বলতে পারে নি…তার মানে সমাধিটি সেন্ট মার্ক কিংবা ওজ-এর প্রাসাদে সেটা নেই। তাহলে কোথায়?
সিয়েনার দিকে তাকালো, মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে একটি ক্রিপ্টের উপরে বাতির কুয়োর নীচে। জানালার গ্রিল খুলে ফেরিসের ফোনটা উপরে তুলে ধরে সিগন্যাল পাবার চেষ্টা করে যাচ্ছে এখনও।
উপরে সেন্ট মার্কস স্কয়ার থেকে কিছু শব্দ ভেসে আসছে। হঠাৎ করে ল্যাংডনের মনে হলো এখান থেকে আসলে বের হবার একটা উপায় হয়তো আছে। ক্রিপ্টগুলোর পেছনে বেশ কিছু ফোল্ডিং চেয়ার রয়েছে। তার মনে হলো ওগুলো একটার উপর আরেকটা বসিয়ে হয়তো বাতির কুয়ো দিয়ে উপরে ওঠা যাবে। সম্ভবত বাতির কুয়োর উপরের মুখটা ভেতর থেকে খোলা যেতে পারে।
ল্যাংডন অন্ধকারের মধ্যে দৌড়ে সিয়েনার দিকে ছুটে গেলো, বড়জোর তিন চার পা সামনে এগোতেই মাথায় আঘাত পেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো সে। উঠে বসার চেষ্টা করার সময় ভাবলো কেউ বুঝি তাকে আঘাত করেছে। কিন্তু দৃষ্টি
পরিস্কার হয়ে উঠতেই বুঝে গেলো কী ঘটেছে।
এই ভূগর্ভস্থ কক্ষটি প্রায় হাজার বছর আগে নির্মিত হয়, তখনকার দিনে মানুষের গড়পরতা উচ্চতার কথা ভেবেই ছাদের উচ্চতা নির্ধারণ করা হয়েছিলো, কিন্তু ল্যাংডনের ছয় ফুটের দীর্ঘদেহ নিয়ে এরকম জায়গায় নিশ্চিন্তে চলাচল করা মোটও উপযুক্ত নয়।
পাথরের মেঝেতে হাটু গেড়ে বসতেই চোখের সামনে একটি লেখা দেখতে পেলো।
Sanctus Marcus
কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইলো সে। সেন্ট মার্কসের নামের কারণে নয়, সে চেয়ে আছে যে ভাষায় ওটা লেখা হয়েছে তার জন্য।
লাতিন।
আধুনিক ইটালিতে সারাদিন ধরে পালিয়ে বেড়াবার পর সেন্ট মার্কসের নাম লাতিনে দেখতে পেয়ে একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো সে। মনে পড়ে গেলো সেন্ট মার্কসের মৃত্যুর সময় রোমান সাম্রাজ্যের লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা ছিলো লাতিন ভাষা।
এরপরই দ্বিতীয় আরেকটি চিন্তা তার মাথায় ঘুরপাক খেলো।
ত্রয়োদশ শতকের শুরুর দিকে-এনরিকো দান্দোলো এবং চতুর্থ ক্রুসেডের সময়কালে-এই লাতিন ভাষার প্রভাব তখনও বেশ শক্তিশালী ছিলো। কন্সট্যান্টিনোপল জয় করা একজন ভেনিশিয় ডওজ কখনও এনরিকো দান্দোলো নামে সমাহিত হবে না…সমাহিত হবে তার লাতিন নামে।
হেনরিকাস ডাভোলো।
বিশ্রুত হওয়া একটি ছবি ভেসে উঠলো তার মনের পর্দায়। একটা চ্যাপেলের ভেতরে হাটু গেড়ে বসে থাকার সময় এটা তার মধ্যে উদয় হলেও সে জানে এরমধ্যে কোনো স্বর্গীয় ব্যাপার নেই। যে ছবিটা ভেসে উঠলো সেটা এনরিকো দান্দোলোর লাতিন নামটি…নক্সা করা টাইলসের মেঝেতে প্রোথিত করা মার্বেলের স্ল্যাবের উপর খোদিত।
হেনরিকো দান্দোলো।
ডওজ-এর সমাধির এই সামান্য নামটির ছবি মনের পর্দায় ভেসে উঠতেই ল্যাংডনের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো। এর আগে আমি ওখানে গেছি। কবিতায় যেমনটি বলা আছে, এনরিকো দান্দোলো স্বর্ণের জাদুঘরেই সমাহিত আছেন-পবিত্র জ্ঞানের স্বর্ণালী মওজিওন-তবে সেটা সেন্ট মার্কস ব্যাসিলিকায় নয়।
আস্তে করে উঠে দাঁড়ালো সে।
“আমি সিগন্যাল পাচ্ছি না,” বললো সিয়েনা। ক্রিপ্টের উপর থেকে নেমে এলো সে।
“তার কোনো দরকারও নেই, কোনোমতে বলতে পারলো ল্যাংডন। “পবিত্র জ্ঞানের স্বর্ণালী মওজিওন…” গভীর করে দম নিয়ে নিলো সে। “আমি…একটা ভুল করে ফেলেছি।”
সিয়েনার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। “এটা বোলো না আমরা ভুল জাদুঘরে চলে এসেছি।”
“সিয়েনা,” বিষণ্ণবদনে ফিসফিসিয়ে বললো ল্যাংডন। “আমরা আসলে ভুল দেশে খোঁজ করছি।”
.
অধ্যায় ৭৬
সেন্ট মার্কস স্কয়ারের বাইরে যে জিপসি মহিলা ভেনিশিয়ান মুখোশ বিক্রি করছিলো সে এখন বিক্রি-বাট্টায় বিরতি দিয়ে ব্যাসিলিকার সীমানা প্রাচীরে হেলান দিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে। আর সব দিনের মতো দুটো লোহার গেটের মাঝখানের জায়গায় বসে সূর্যাস্ত দেখছে সে।
অনেক বছর ধরে সেন্ট মার্কস স্কয়ারে অসংখ্য ঘটনা দেখেছে কিন্তু এখন স্কয়ারে যে উদ্ভট ঘটনা ঘটছে সেটা আগে কখনও দেখে নি…আসলে এটা ঘটছে। স্কয়ারের নীচে। তার পায়ের কাছে জোরে শব্দ হলে কাছে থাকা কুয়োর মতো একটা ভোলা জায়গা দিয়ে উঁকি দিলো। এটার গভীরতা কমপক্ষে দশ ফিটের মতো হবে। নীচের জানালাটা খোলা, সেখানে একটা ফোল্ডিং চেয়ার দেখা যাচ্ছে।
জিপসি মহিলা দারুণ অবাক হলো, এবার চেয়ারটার কাছে দেখা গেলো সোনালি চুলের এক সুন্দরীকে, মেয়েটির সাথে জিপসি মহিলার চোখাচোখি হতেই কিছুটা চমকে গেলো সে। মুখের কাছে আঙুল তুলে চুপ থাকার ইশারা করলো জিপসি মহিলাকে, সেই সাথে চওড়া একটা হাসি দিলো।
তুমি এতো লম্বা হও নি যে এভাবে উঠতে পারবে, মনে মনে বললো জিপসি মহিলা। ভালো কথা, তুমি ওখানে করছেটা কি?
সোনালি চুলের মেয়েটি চেয়ার থেকে নেমে ভেতরে কারোর সাথে কথা বললো। একটু সরে যেতেই তার জায়গায় দেখা গেলো দ্বিতীয় ব্যক্তিকে-লম্বা, কালো চুল আর জমকালো সুট পরা এক লোক-চেয়ারের উপর উঠে কুয়োর শ্যাফটের ভেতর দিয়ে উপরে তাকালো সে।
জিপসি মহিলার সাথে তারও চোখাচোখি হয়ে গেলো। এই লোকটি বেশ লম্বা, চেয়ারের উপর উঠে পায়ের পাতায় ভর দিতেই কুয়োর উপরের খোলা মুখে যে গ্রিলটা আছে সেটার নাগাল পেয়ে গেলো। নীচ থেকে উপরে দিকে ধাক্কা দিলে গ্রিলটা একটুখানি নড়লো।
“পুয়ো দারসি উনা মানো?” নীচ থেকে জিপসি মহিলাকে বললো সোনালি চুলের মেয়েটি।
তোমাদের একটু সাহায্য করবো? ভাবলো জিপসি মহিলা, এসব কাজে জড়ানোর কোনো ইচ্ছে তার নেই। তোমরা করছোটা কি?
সোনালি চুলের মেয়েটি পুরুষ মানুষের মানিব্যাগ হাতে নিয়ে সেখান থেকে একশ’ ইউরোর একটি নোট বের করে দেখালো তাকে। তিন দিন মুখোশ বিক্রি করলেও এই পরিমাণ টাকা কামাতে পারে না। কিন্তু অপরিচিত কারোর সাথে এ কাজ করা একটু ঝুঁকিপূর্ণাই বটে। মাথা ঝাঁকিয়ে দুই আঙুল তুলে ধরলো সে। সোনালি চুলের মেয়েটি আরেকটি নোট বের করে দেখালো তাকে।
নিজের সৌভাগ্যকে যেনো বিশ্বাস করতে পারলো না জিপসি মহিলা, কাঁধ তুলে এমন ভঙ্গি করলো যেনো অনিচ্ছা সত্ত্বেও কাজটা করতে রাজি হচ্ছে। আস্তে করে উপুড় হয়ে কুয়োর মুখে গ্রিলের যে বারটা আছে সেটা ধরে লোকটার দিকে তাকালো।
নীচ থেকে লোকটি ঠেলা দিতেই জিপসি মহিলা গ্রিল ধরে টান দিলো। দীর্ঘদিন ধরে যে দু’হাতে মুখোশ ফেরি করেছে সেই হাত যথেষ্ট শক্তিশালী, তাই একবারের চেষ্টাতেই গ্রিলটা খুলে গেলো অর্ধেক। যেই না মনে করলো কাজটা হয়ে গেছে অমনি প্রচণ্ড শব্দ হলো নীচে। লোকটা চেয়ার থেকে নীচের মেঝেতে পড়ে গেলো।
লোহার গ্রিলটা একা ধরে রাখতে হিমশিম খেলো জিপসি মহিলা। একবার ভাবলো ছেড়ে দেবে কিন্তু দুশো ইউরো কথা ভাবতেই গায়ের শক্তি বেড়ে গেলো, গ্রিলটা কোনোরকমে টেনে ব্যাসিলিকার দেয়ালের পাশে রেখে দিলো সে।
দম ফুরিয়ে হাপাতে হাপাতে কুয়োর নীচে তাকালো জিপসি, ভাঙা চেয়ারসহ লোকটা মেঝেতে পড়ে আছে। লোকটা উঠে দাঁড়াতেই উপর থেকে সে হাত বাড়ালো টাকাটা নেবার জন্য।
সোনলি চুলের মেয়েটি মাথা নেড়ে সায় দিয়ে দুটো নোট উপরে তুলে ধরলো। জিপসিও হাত গলিয়ে দিলো কুয়োর ভেতরে কিন্তু নাগাল পেলো না।
আরে টাকাটা ঐ লোকের হাতে দাও।
হঠাৎ করে শ্যাফটের ভেতরে লোকজনের হৈহল্লা শোনা গেলো এ সময়-ব্যাসিলিকার ভেতরে ক্ষুব্ধ কণ্ঠের চিৎকার ভেসে এলো। ভয়ে চমকে উঠে ঘুরে তাকালো নীচে থাকা দু’জন নারী-পুরুষ। এরপর শুরু হয়ে গেলো হাউকাউ।
কালো চুলের লোকটি একটু নীচু হয়ে মেয়েটাকে তার দু’হাতের পাঞ্জার উপর পা রাখতে বললো। কথামতো কাজ করলো মেয়েটি, সঙ্গে সঙ্গে তাকে উপরের দিকে ঠেলে দিলো সে।
দুশো ইউরোর নোট দুটো দাঁতে চেপে খালি হাত দুটো দিয়ে শ্যাফটের প্রান্তসীমা ধরার চেষ্টা করলো মেয়েটি। নীচের লোকটি আপ্রাণ চেষ্টা করে গেলো তাকে উপরে তোলার জন্য।
অনেক কষ্টে মেয়েটি কুয়ো থেকে স্কয়ারের উপরে উঠে এলো। জিপসির হাতে টাকাটা তুলে দিয়ে কুয়োর পাশে হাটু গেড়ে বসে পড়লো সে। উপুড় হয়ে
নীচের লোকটিকে দেখলো এবার।
কিন্তু দেরি হয়ে গেছে।
কালো পোশাকের কয়েকটি হাত তার পা দুটো ধরে ফেলেছে, টেনে নামানোর চেষ্টা করছে তারা।
“পালাও, সিয়েনা!” লোকটা চিৎকার করে বললো। “এক্ষুণি!
জিপসি খেয়াল করলো তাদের দুজনের মধ্যে করুণ দৃষ্টি বিনিময় হলো কয়েক মুহূর্তের জন্য…তারপরই লোকটাকে টেনে সরিয়ে দিলো কালো হাতগুলো।
হতভম্ব হয়ে সোনালি চুলের মেয়েটি অশ্রুসজল চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো। কুয়োর নীচে। “আমি দুঃখিত, রবার্ট, ফিসফিসিয়ে বললো সে। তারপরই একটু থেমে আবার বললো, “সবকিছুর জন্য।
মুহূর্তেই সোনালি চুলের মেয়েটি দৌড়ে লোকজনের ভীড়ের মধ্যে মিশে গেলো, মার্সেরিয়া দেল ওরোলজিও’র সঙ্কীর্ণ গলি দিয়ে ছুটে যাবার সময় তার পনিটেইলটি দুলতে দেখলো জিপসি…উধাও হয়ে গেলো ভেনিসের কেন্দ্রস্থলে।
.
অধ্যায় ৭৭
পানির ছলাৎ ছলাৎ শব্দে ধীরে ধীরে রবার্ট ল্যাংডনের জ্ঞান ফিরে এলো। অ্যান্টি সেপটিক আর নোনা বাতাসের গন্ধ নাকে লাগলো তার। মনে হলো পৃথিবীটা যেনো আস্তে আস্তে দুলছে।
আমি কোথায়?
তার কাছে মনে হচ্ছে কিছুক্ষণ আগে শক্তিশালী কিছু হাত তাকে টেনে হিঁচড়ে ক্রিপ্টের কুয়ো থেকে নামিয়ে দিয়েছিলো, চেপে ধরেছিলো মেঝেতে কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো এ মুহূর্তে সেন্ট মার্কসের পাথরের মেঝে অনুভূত হচ্ছে না তার কাছে…বরং মনে হচ্ছে সে শুয়ে আছে নরম ম্যাট্রেসের উপর।
চোখ খুলে চারপাশটা দেখে নিলো ল্যাংডন-ছোটোখাটো পরিপাটী একটি ঘর, একটিমাত্র জানালা আছে তাতে। দুলুনিটা এখনও টের পাচ্ছে সে।
আমি একটা জাহাজে আছি?
জ্ঞান হারানোর আগে তার মনে আছে কালো পোশাকের সৈন্যরা তাকে ক্রিপ্টের মেঝেতে চেপে ধরে রাগতস্বরে বলেছিলো, “পালানোর চেষ্টা করবেন না!”
ল্যাংডন প্রাণপণে চিৎকার দিয়ে বাঁচার জন্য সাহায্য চাইতে গেলে সৈন্যরা তার মুখ চেপে ধরে।
“তাকে এখান থেকে দ্রুত নিয়ে যাওয়া দরকার,” এক সৈনিক বলেছিলো অন্য এক সৈনিককে।
জবাবে সৈনিকটি অনিচ্ছুকভাবে সায় দিয়ে বলেছিলো, “ঠিক আছে। তাই করো।”
সঙ্গে সঙ্গে তার ঘাড়ের উপর প্রচণ্ড জোরে আঙুলের চাপ অনুভব করে ল্যাংডন। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে তার দৃষ্টি ঝাপসা হতে শুরু করে, ঘুমে ঢলে যেতে থাকে সে।
তারা আমাকে খুন করছে, ভেবেছিলো ল্যাংডন। সেন্ট মার্কসের সমাধির পাশে।
অন্ধকার হয়ে আসতে থাকে তার জগত তবে সেটা পুরোপুরি গ্রাস করে নি। তখনও। কানে কিছু শব্দও শুনতে পাচ্ছিলো।
ঠিক কতোক্ষণ সময় পেরিয়ে গেছে সে সম্পর্কে ল্যাংডনের কোনো ধারণা নেই তবে সবকিছু এখন ধাতস্থ হতে শুরু করেছে। বুঝতে পারছে সে এখন ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে আছে। ঘরের মধ্যে অ্যান্টি-সেপটিক আর অ্যালকোহলের গন্ধ সেটাই বলছে তাকে।
এবার সিয়েনার কথা মনে পড়ে গেলো তার। মেয়েটি নিরাপদে আছে কিনা সে জানে না। তার স্পষ্ট মনে আছে কুয়োর উপর থেকে চেয়ে আছে তার দিকে। তার চোখে ছিলো অনুতাপ আর ভীতি। ল্যাংডন প্রার্থনা করলো মেয়েটা যেনো পালিয়ে গিয়ে থাকে, ভেনিস থেকে নিরাপদে চলে যেতে পারে।
আমরা আসলে ভুল দেশে খোঁজ করছি, ল্যাংডন তাকে বলেছিলো। কবিতায় যে রহস্যময় মওজিওনের কথা বলা আছে সেটা ভেনিসে অবস্থিত নয়…অনেক দূরে কোথাও। দান্তে ঠিকই বলেছিলেন, তার হেয়ালিপূর্ণ কবিতার গুপ্ত অর্থ রয়েছে। অস্পষ্ট পংক্তিগুলোর আড়ালে।
ক্রিপ্ট থেকে বের হতে পারলেই সিয়েনাকে ল্যাংডন সব খুলে বলতো, কিন্তু সে সুযোগ আর পায় নি।
মেয়েটা চলে যাবার সময় জেনে গেছে আমি ব্যর্থ হয়েছি।
ল্যাংডন টের পেলো তার পেটে একটা গিট পাকাচ্ছে।
প্লেগটা এখনও আছে…বহু দূরে কোথাও।
ঘরের বাইরে ভারি পায়ের আওয়াজ শুনতে পেলো সে। ঘুরে তাকালো ল্যাংডন, দেখতে পেলো কালো পোশাকের সেই সৈনিককে যে তাকে টেনে মেঝেতে চেপে ধরেছিলো। তার চোখ দুটো বরফ-শীতল। লোকটাকে দেখে আৎকে উঠলেও এ ঘর থেকে পালানোর কোনো উপায় নেই জেনে চুপ মেরে থাকলো সে। এরা আমার সাথে যা করতে চায় তাই করতে পাবে এখন।
“আমি কোথায় আছি?” জানতে চাইলো ল্যাংডন। চেষ্টা করলো না ঘাবড়াতে।
“ভেনিসে নোঙর করা একটা ইয়টে।”
লোকটার ইউনিফর্মে সবুজ রঙের মেডেলের দিকে তাকালো সে-পৃথিবীর একটি ভূ-গোলক, তার চারপাশ জুড়ে আছে ECDC অক্ষরগুলো। এরকম সিম্বল জীবনে কখনও দেখে নি ল্যাংডন।
“আপনার কাছ থেকে আমাদের তথ্য জানা দরকার,” সৈনিকটি বললো, “আমাদের হাতে খুব বেশি সময় নেই।”
“আমি কেন আপনাদের কাছে এসব বলবো?” পাল্টা বললো সে। “আপনি তো আমাকে প্রায় মেরেই ফেলেছিলেন।”
“মোটেই না। আমরা জুডোর একটি কৌশল প্রয়োগ করেছি আপনাকে অচেতন করার জন্য। এটাকে বলে শিমে ওয়াজা। আপনার কোনো ক্ষতি করার ইচ্ছে আমাদের ছিলো না।”
“আজ সকালে আপনি আমাকে গুলি করেছিলেন! ট্রিকি’তে করে সিয়েনার অ্যাপার্টমেন্ট থেকে পালানোর সময় তাকে লক্ষ্য করে যে গুলি করা হয়েছিলো সেটার কথা বললো। “আরেকটুর জন্য আপনার গুলি আমার কোমরে লাগতো!”
ভুরু কুচকে ফেললো লোকটি। “আমি যদি চাইতাম তাহলে আপনাকে খুব সহজেই গুলি করতে পারতাম। আমি আসলে আপনাদের বাইকের চাকায় গুলি করেছিলাম যাতে বাইকটা অচল করে দিতে পারি। আপনারা যাতে পালাতে না পারেন। আমার উপর অর্ডার ছিলো আপনার সাথে যোগাযোগ করে যেনো জেনে নেই আপনি কেন অদ্ভুত আচরণ করছেন।”
ল্যাংডন কিছু বলার আগে আরো দু’জন সৈনিক ঘরে ঢুকলো। তাদের মাঝখানে এক মহিলা।
ভুতুরে ব্যাপার।
অপার্থিব আর আধিভৌতিক।
মহিলাকে দেখামাত্রই ল্যাংডন চিনতে পারলো। তার হেলুসিনেশনে একেই দেখেছে! অপূর্ব সুন্দরী এক নারী। দীর্ঘ সাদা চুল আর নীল রঙের শাপিস লাজুরির নেকলেস। যেহেতু এর আগে অদ্ভুত এক পরিবেশে হেলুসিনেশানে দেখেছে তাই মহিলার উপস্থিতির ব্যাপারে তার মধ্যে কিছুটা সন্দেহ তৈরি হলো।
“প্রফেসর ল্যাংডন, মহিলা আন্তরিকভাবে হেসে বললো তার বিছানার পাশে এসে। “আপনি ঠিক আছেন দেখে আমি কী যে শান্তি পাচ্ছি বোঝাতে পারবো না।” বিছানার পাশে বসে ল্যাংড়নের পালস দেখলো সে। “আমি জানতে পেরেছি আপনার অ্যামনেসিয়া হয়েছে। আপনি কি আমাকে চিনতে পেরেছেন?”
মহিলার দিকে ভালো করে চেয়ে দেখলো ল্যাংডন। “আমি অবশ্য…আমার হেলুসিনেশনে আপনাকে দেখেছি, কিন্তু আপনার সাথে আমার আসলেই দেখা হয়েছিলো কিনা মনে করতে পারছি না।”
মহিলা সহমর্মিতার সাথে তার দিকে তাকালো। “আমার নাম এলিজাবেথ সিনস্কি। আমি বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার ডিরেক্টর। আমিই আপনাকে রিক্রুট করেছিলাম যাতে আপনি খুঁজে বের করতে পারেন
“প্লেগ,” কথা শেষ হবার আগেই বলে উঠলো ল্যাংডন। “বারট্রান্ড জোবরিটের তৈরি করা।”
সায় দিলো সিনস্কি। তাকে খুব আশাবাদীও মনে হলো। “মনে করতে পেরেছেন তাহলে?”
“না। আমি জ্ঞান ফিরে দেখি এক হাসপাতালে আছি, আমার সাথে একটি প্রজেক্টর, আর হেলুসিনেশানে আপনাকে…আপনি বলে যাচ্ছেন খুঁজলেই পাবো। আমি সেটাই করে যাচ্ছিলাম আর এই লোকগুলো তখন আমাকে খুন করার চেষ্টা করে গেছে।” সৈনিকদের দিকে ইশারা করলো সে।
ব্রুডার কিছু বলতে যাবে অমনি এলিজাবেথ সিনস্কি হাত তুলে বিরত করলো তাকে।
“প্রফেসর,” আস্তে করে বললো মহিলা। “আপনি যে খুব কনফিউজ সে ব্যাপারে আমার কোনো সন্দেহ নেই। আপনাকে এসবের মধ্যে টেনে নিয়ে আসার জন্য আমি খুবই অনুতপ্ত। আপনি নিরাপদ আছেন বলে আমি কী যে খুশি হয়েছি বলে বোঝাতে পারবো না।”
“নিরাপদে আছি?” বলে উঠলো ল্যাংডন। “আমি একটি জাহাজে বন্দী হয়ে আছি!” আপনিও আমার মতোই বন্দী!
সাদা-চুলের মহিলা মাথা নেড়ে সায় দিয়ে তাকে আশ্বস্ত করলো। “আপনার অ্যামনেসিয়ার কারণে আমার বলা অনেক কথাই আপনার কাছে খাপছাড়া বলে মনে হবে। কিন্তু আমাদের হাতে সময় খুব কম। আর আপনার সাহায্য খুবই দরকার, শুধু আমাদের নয়, অনেকের।” একটু ইতস্তত করলো সিনস্কি। কিভাবে বলবে বুঝে উঠতে পারলো না। প্রথমেই বলে রাখি, এজেন্ট ব্রুডার আর তার দল আপনার কোনো ক্ষতি করার চেষ্টা করে নি। তাদেরকে অর্ডার দেয়া হয়েছিলো যেভাবেই হোক আপনার সাথে যেনো পুণরায় যোগাযোগ স্থাপন করা হয়।”
“পুণরায় যোগাযোগ?” আমি-”
“প্লিজ, প্রফেসর। আমার কথা শুনুন, তাহলে সব কিছু পরিস্কার হয়ে যাবে।”
ল্যাংডন একটু উঠে বসলো বিছানায়।
“এজেন্ট ব্রুডার এবং তার দলটি আসলে এসআরএস টিম-সার্ভিলেন্স অ্যান্ড রেসপন্স সাপোর্ট। তারা কাজ করে ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর ডিজিজ প্রিভেনশন অ্যান্ড কন্ট্রোল-এর অধীনে।”
সৈনিকদের ইউনিফর্মে ইসিডিসি মেডেলের দিকে তাকালো ল্যাংডন। ডিজিজ প্রিভেনশন অ্যান্ড কন্ট্রোল?
“তার গ্রুপটি,” বলতে লাগলো এলিজাবেথ, “মারাত্মক সংক্রামক জীবাণু কন্টেইন এবং ডিটেক্টিং করার কাজে দক্ষ। এক্ষেত্রে তারা SWAT টিমের মতোই কাজ করে। স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হুমকিগুলো মোকাবেলা করে তারা। জোবরিস্টের তৈরি করা জীবাণুটির অবস্থান খুঁজে বের করার ব্যাপারে আপনিই হলেন আমাদের একমাত্র আশা। তাই আপনি যখন লাপাত্তা হয়ে। গেলেন তখন আমি এসআরএস টিমকে দায়িত্ব দিলাম আপনাকে খুঁজে বের করার জন্য…আমাকে সহায়তা করার জন্য তাদেরকে ফ্লোরেন্সে ডেকে আনি।”
ল্যাংডন হতবাক হয়ে গেলো। “এরা আপনার হয়ে কাজ করে?”
মাথা নেড়ে সায় দিলো সে। “ইসিডিসি থেকে ধরে নিয়েছি। গতরাতে আপনি যখন উধাও হয়ে গেলেন, আমাদের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিলেন তখনই ভেবেছিলাম আপনার কিছু একটা হয়েছে। তবে আজ সকালে আমাদের টেক-টিম জানায় আপনি আপনার হারভার্ডের ই-মেইলে ঢুকেছেন। বুঝতে পারলাম আপনি বেঁচে আছেন। আমরা আপনার অদ্ভুত আচরণের কারণটা বুঝতে পারছিলাম না তখনও। মনে হচ্ছিলো, আপনি বোধহয় পক্ষ বদলে ফেলেছেন…অন্য কেউ হয়তো প্রচুর পরিমাণের টাকা দিয়েছে আপনাকে ঐ জীবাণুর অবস্থান খুঁজে বের করার জন্য।”
মাথা ঝাঁকালো ল্যাংডন। “এটা তো একেবারেই হাস্যকর কথা!”
“হ্যাঁ, তা অবশ্য ঠিক। তবে এটাই একমাত্র যৌক্তিক ব্যাখ্যা বলে মনে হচ্ছিলো-এর পরিণাম অনেক মারাত্মক বলে আমরা কোনো ঝুঁকি নিতে চাই নি। তবে আমরা কল্পনাও করতে পারি নি আপনি অ্যামনেসিয়াতে ভুগছেন। টেক-টিম আপনার অবস্থান খুঁজে বের করলেও আপনি এক তরুণীর সাথে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। এতে করে আমাদের সন্দেহ আরো গাঢ় হয়, আপনি হয়তো অন্য কারোর হয়ে কাজ করছেন।”
“আমরা আপনার পাশ দিয়েই চলে গেছি!” মুচকি হেসে বললো ল্যডন। “কালো রঙের ভ্যানের পেছনের সিটে দেখেছি আপনাকে। দু’পাশে সৈনিকেরা ছিলো। ভেবেছিলাম আপনি ওদের হাতে বন্দী। আপনাকে বেসামালও মনে হয়েছিলো। যেনো ওরা আপনাকে ড্রাগ দিয়েছে।”
“আপনি আমাদেরকে দেখেছেন?” অবাক হলো ডা: সিনস্কি। “অদ্ভুত তো…আপনি ঠিকই বলেছেন, ওরা আমাকে মেডিসিন দিয়েছিলো।” একটু থামলো সে। “তবে সেটা আমার নির্দেশেই।”
ল্যাংডন একেবারে হতভম্ব হয়ে গেলো। এই মহিলা ওদেরকে বলেছে ড্রাগ দিতে?
“আপনার হয়তো মনে নেই,” বললো সিনস্কি, “আমাদের সি-১৩০ বিমান ফ্লোরেন্সে অবতরণ করার পর পর প্যারোক্সিসমাল পজিশনাল ভার্টিগো সমস্যা দেখা দিয়েছিলো-এটা খুবই সাময়িক একটি সমস্যা তবে খুব ভোগায়। একটা ঘোরের মধ্যে চলে যাই তখন বমি বমি ভাব হয়। সাধারণত অন্য সময় হলে আমি বিছানায় শুয়ে বিশ্রাম নিতাম কিন্তু জোবরিস্টের সঙ্কটটার কারণে সেটা আর সম্ভব হয় নি। তাই ওদেরকে বলেছি আমাকে যেনো মেটোক্লোপরামাইড ইনজেকশন দেয়। এসআরএস টিম আমাকে হাসপাতালে নিতে চেয়েছিলো কিন্তু আমি রাজি হই নি। বুঝতেই পারছেন আমাদের সঙ্কটটা কতো গুরুতর।
ল্যাংডন হাত-পা ছড়িয়ে বসলো বিছানার উপর। আমি সারাটা দিন বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার হাত থেকে পালিয়ে বেড়িয়েছি-যারা কিনা আমাকে রিকুট করেছিলো তাদের হয়ে কাজ করার জন্য।
“এখন আমাদেরকে সম্পূর্ণ মনোযোগ দিতে হবে, প্রফেসর,” সিনস্কি তাড়া দিয়ে বললো। “জোবরিস্টের প্লেগের উপর…আপনার কি কোনো ধারণা আছে ওটা কোথায়?” তার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে রইলো মহিলা। আমাদের হাতে সময় খুব কম।”
ওটা অনেক দূরে, কথাটা বলতে গিয়েও বললো না ল্যাংডন। ব্রুডারের দিকে তাকালো সে। পরিস্থিতি এতো দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে যে ল্যাংডন বুঝতে পারছে না কাকে বিশ্বাস করবে।
সিনস্কি তার দিকে ঝুঁকে আছে এখনও। তার চোখেমুখে উত্তেজনা। “আমাদের কাছে মনে হচ্ছে ঐ জীবাণুটি এই ভেনিসেই আছে। কথাটা কি সত্যি? আমাদেরকে বলুন, ওটা কোথায়, আমরা দ্রুত একটা টিম পাঠিয়ে দেবো।”
ইতস্তত করলো ল্যাংডন।
“স্যার!” অধৈর্য হয়ে বললো ব্রুডার। “আপনি অবশ্যই কিছু একটা জানেন…বলুন, সেটা কোথায়! আপনি কি বুঝতে পারছেন না কি ঘটতে যাচ্ছে?”
“এজেন্ট ব্রুডার?” ধমকের সুরে বললো সিনস্কি। “আপনি থামুন। তারপর আবার ল্যাংডনের দিকে ফিরে শান্তকণ্ঠে বললো, “আপনার উপর দিয়ে অনেক বিরাট ধকল গেছে, এটা আমি বুঝি। কাকে বিশ্বাস করবেন সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারছেন না, জানি।” একটু থামলো সে। স্থিরদৃষ্টিতে তাকালো ল্যাংডনের দিকে। কিন্তু আমাদের হাতে একদম সময় নেই। আমি বলবো আমাকে বিশ্বাস করুন।”
“ল্যাংডন কি দাঁড়াতে পারে?” নতুন একটি কণ্ঠ জানতে চাইলো।
ছোটোখাটো, রোদে পোড়া এক লোক দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বহুল চর্চিত মেজাজে শান্তভাবে ল্যাংডনকে সে দেখলো। তবে ল্যাংডন তার চোখে বিপদ দেখতে পেলো।
ল্যাংডনকে উঠে দাঁড়াতে ইশারা করলো সিনস্কি। “প্রফেসর, এই লোকটার সাথে কাজ করতে আমার কোনো ইচ্ছে ছিলো না কিন্তু পরিস্থিতি এমনই এছাড়া আমার আর কোনো উপায়ও নেই।”
উঠে দাঁড়ালো ল্যাংডন, তারপর কয়েক মুহূর্ত সময় নিয়ে ভারসাম্য ফিরে পেলো।
“আমার সাথে আসুন,” লোকটা বললো দরজার দিকে যেতে যেতে। “একটা জিনিস আপনার দেখা দরকার।”
ল্যাংডন জায়গা থেকে নড়লো না। “আপনি কে?”
লোকটা থেমে আঙুল মোচড়াতে লাগলো। নাম জানাটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। আপনি আমাকে প্রভোস্ট বলে ডাকতে পারেন। আমি একটি সংগঠন চালাই…কী আর বলবো, আমরা বিরাট একটি ভুল করে ফেলেছি।”
“আপনি আমাকে কি দেখাতে চাইছেন?” জানতে চাইলো ল্যাংডন।
স্থিরদৃষ্টিতে প্রফেসরের দিকে চেয়ে রইলো সে। “এমন কিছু যা দেখার পর আপনার মনে আর কোনো সন্দেহ থাকবে না আমরা সবাই এখন একই দলে আছি।”
.
অধ্যায় ৭৮
ছোটোখাটো লোকটিকে অনুসরণ করে কতোগুলো গোলকধাঁধাতুল্য আবদ্ধ করিডোর পেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নীচের ডেকে চলে এলো ল্যাংডন, সিয়েনা আর ইসিডিসি’র সৈনিকেরা।
জাহাজের নীচের ডেকে অসংখ্য কাঁচের কিউবিকল আছে-কিছু কাঁচ ঘোলাটে, কিছু স্বচ্ছ। কিউবিকলগুলোর ভেতরে লোকজন কম্পিউটারে কাজ করছে, টেলিফোনে কথা বলছে। ঐসব কর্মরত লোকজন তাদের দলটিকে দেখে বিস্মিত আর চিন্তিত হয়ে পড়লো। প্রভোস্ট মাথা নেড়ে তাদেরকে আশ্বস্ত করলো যেতে যেতে।
এই জায়গাটা কিসের? যেতে যেতে ল্যাংডন ভাবলো।
অবশেষে তাদেরকে বিশাল একটি কনফারেন্স রুমে নিয়ে এলো প্রভোস্ট। তারা সবাই বসে পড়লে সে বাটন টিপে দিলো, সঙ্গে সঙ্গে হিস হিস শব্দ করে ঘঘালাটে হয়ে গেলো কাঁচের দেয়ালগুলো। চমকে উঠলো ল্যাংডন, এরকম জিনিস জীবনে কখনও দেখে নি।
“আমরা কোথায়?” জানতে চাইলো প্রফেসর।
“এটা আমার জাহাজ-মেন্দাসিয়াম।”
“মেন্দাসিয়াম?” ল্যাংডন জিজ্ঞেস করলো। “সুইডোললাগোসের লাতিন প্রতিশব্দ যেটি-ছলচাতুরির গ্রিক দেবতা?”
মনে হলো লোকটি মুগ্ধ হয়েছে। “খুব বেশি লোক এটা জানে না।”
এটা জানার জন্য নিশ্চয় নোবেল পুরস্কার পাওয়ার দরকার পড়ে না, ভাবলো ল্যাংডন। মেন্দাসিয়াম হলো একটি রহস্যময় দেবতা যে সমস্ত সুইডোলগোইতে রাজত্ব করে-এই দেবতা বিশেষভাবে পারদর্শী মিথ্যাচার, জালিয়াতি আর বানোয়াট কাজকর্মে।
লাল টকটকে একটি মেমোরি স্টিক বের করে কম্পিউটারে ঢোকালো প্রভোস্ট। ঘরের এককোণে রাখা বিশাল বড় একটি এলসিডি মনিটর সজীব হয়ে উঠলো সঙ্গে সঙ্গে আর মাথার উপরের বাতিগুলোর আলো কমে এলো।
ঘরের নীরবতার মধ্যে ল্যাংডন শুনতে পেলো পানির ছলাৎ ছলাৎ শব্দ। প্রথমে সে ভাবলো বাইরে থেকে ওটা আসছে কিন্তু একটু পরই টের পেলো শব্দটা আসছে স্পিকার থেকে। আস্তে আস্তে মনিটরে একটা ছবি ভেসে উঠলো-পানি চুঁইয়ে পড়া একটি গুহার দেয়াল। লালচে আলোয় আলোকিত জায়গাটি।
“বারট্রান্ড জোবরিস্ট এই ভিডিওটা তৈরি করেছে,” প্রভোস্ট বললো। “সে আমাকে এটা আগামীকাল রিলিজ দিতে বলেছিলো।”
অবিশ্বাস্য নীরবতার মধ্যে ভিডিওটা দেখে গেলো ল্যাংডন। পানির নীচে একটি ফলকে লেখা কথাটা তাকে ভাবিয়ে তুললো :
এই জায়গায়, আজকের তারিখে, এ পৃথিবী বদলে গেছিলো চিরতরের জন্য।
ফলকটিতে স্বাক্ষর করা আছে : বারট্রান্ড জোবরিস্ট।
তারিখটি আগামীকালের?
হায় ঈশ্বর! অন্ধকারেই সিনস্কির দিকে তাকালো ল্যাংডন, কিন্তু মহিলা উদাস হয়ে মেঝের দিকে চেয়ে আছে। বোঝাই যাচ্ছে এই ভিডিওটা সে আগেই দেখেছে, জঘন্য জিনিসটা এখন আর দেখার ইচ্ছে নেই।
মনিটরে এবার দেখা যাচ্ছে বাদামি-হলুদ রঙের থলথলে তরলের একটি স্বচ্ছ প্লাস্টিকের ব্যাগ, বেলুনের মতোই সেটা ভাসছে। থলথলে গোলকটি মেজের সাথে তার দিয়ে আঁটকানো।
এটা আবার কী জিনিস? ব্যাগটা ভালো করে দেখলো ল্যাংডন। জ্বলজ্বলে জিনিসগুলো যেনো ব্যাগের ভেতরে আস্তে আস্তে ঘূর্ণিপাক খাচ্ছে…প্রায় যেনো ফুঁসছে।
যখন বুঝতে পারলো ল্যাংডনের দম বন্ধ হয়ে গেলো। জোবরিস্টের প্লেগ।
“বন্ধ করুন,” বলে উঠলো সিনস্কি।
ছবিটা জমে গেলো পর্দায়।
“আমার মনে হয় আপনি বুঝতে পারছেন এটা কি,” বললো সিনস্কি। “প্রশ্ন হলো ওটা কতোক্ষণ কন্টেইন থাকবে?” এলসিডি মনিটরের কাছে গিয়ে স্বচ্ছ ব্যাগের গায়ে ক্ষুদ্র একটি জায়গা দেখালো সে। “দুঃখের বিষয় হলো এটা বলে দিচ্ছে এই ব্যাগটা কি দিয়ে তৈরি। আপনি কি এটা পড়তে পারছেন?”
নাড়িস্পন্দন বেড়ে গেছে ল্যাংডনের, সে ব্যাগটির ম্যানুফেকচারের ট্রেডমার্ক নোটিশটি পড়লো :
Solublon®
“পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ওয়াটার-সলিউবল প্লাস্টিক নির্মাতা,” বললো সিনস্কি। “এরা পানির সাথে দ্রবীভূত হয় এমন প্লাস্টিকের ব্যাগ তৈরি করে।”
ভয়ের শীতল একটি প্রবাহ বয়ে গেলো ল্যাংডনের শিরদাঁড়া বেয়ে। “আপনি বলতে চাচ্ছেন…এই ব্যাগটা পারি সাথে মিশে যাবে?!”
মাথা নেড়ে সায় দিলো সিনস্কি। “এর নিমার্তার সাথে আমরা যোগাযোগ করেছি, তাদের কাছ থেকেই জেনেছি, বিভিন্ন গ্রেডের প্লাস্টিকের ব্যাগ তৈরি করে থাকে তারা, দশ মিনিট থেকে দশ সপ্তাহ পর্যন্ত সময়ে এগুলো মিশে যায়, ব্যাপারটা নির্ভর করে প্রয়োগের উপরে। আমাদের কোনো সন্দেহ নেই জোবরিস্ট খুব হিসেবে করেই এটা স্থাপন করেছে পানির নীচে।” একটু থামলো সে। “আমাদের বিশ্বাস, এটা পানির সাথে মিশে যাবে”।
“আগামীকালের মধ্যে,” কথার মাঝখানে বলে উঠলো প্রভোস্ট। “আমার ডেস্ক ক্যালেন্ডারে জোবরিস্ট আগামীকালের তারিখেই দাগ দিয়ে গেছিলো। এই তারিখটিই ফলকে লেখা আছে।”
বাকরুদ্ধ হয়ে অন্ধকারে বসে রইলো ল্যাংডন।
“উনাকে বাকিটা দেখান,” বললো সিনস্কি।
আবারো সচল হয়ে উঠলো মনিটরের ছবি। ক্যামেরা এবার জ্বলজ্বলে পানি আর গুহার অন্ধকারে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কবিতায় যে এই জায়গার কথাই বলা হয়েছে সে ব্যাপারে ল্যাংডনের মনে কোনো সন্দেহ নেই। যে পুকুরে প্রতিফলিত করে না আকাশের তারা।
দান্তের নরকের দৃশ্যগুলোর সাথে এই ছবির মিল আছে…ওখানকার নদী কউসিতাস মাটির নীচ দিয়ে প্রবাহিত হয়।
এই জলাধারটি যেখানেই থাকুক না কেন সঙ্কীর্ণ আর অভদ্র দেয়ালের মাঝখান দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। ল্যাংডনের ধারণা এটা প্রাকৃতিক নয়, মানুষের তৈরি। সে আরো বুঝতে পারলো ক্যামেরা শুধুমাত্র বিশাল জায়গার নির্দিষ্ট একটি অংশই দেখিয়েছে। এটার পক্ষে যুক্তি হলো, দেয়ালে একটি হালকা খাড়া ছায়া পড়েছে, ছায়াটি বেশ চওড়া, কতোগুলো কলামের হতে পারে সেটি।
পিলার, বুঝতে পারলো ল্যাংডন।
গুহার ছাদটা অনেকগুলো পিলারের সাপোর্টে আছে।
এই লেগুনটা কোনো গুহা নয়, এটা বিশাল বড় কোনো ঘর।
ঐ ডুবন্ত প্রাসাদে ঢুকে পড়া…
সে কোনো কিছু বলার আগেই তার মনোযোগ চলে গেলো মনিটরে। সেখানে দেখা যাচ্ছে গুহার দেয়ালে একটি ছায়ার অবয়ব…মনুষ্যআকৃতির, তবে পাখির ঠেটিসদৃশ্য নাক আছে।
হায় ঈশ্বর…
ছায়ার অবয়বটি এখন কথা বলছে, তার কণ্ঠ ফ্যাসফ্যাসে, চাপা।
“আমি তোমাদের মোক্ষ। আমি সেই ছায়া।”
পরবর্তী কয়েক মিনিট ল্যাংডন যে ভীতিকর ছবি দেখলো সেটা এ জীবনে কখনও দেখে নি। বোঝাই যাচ্ছে জিনিয়াস বারট্রান্ড জোবরিস্ট প্লেগ ডাক্তারের বেশে হাজির হয়েছে, দান্তের ইনফার্নোর রেফারেন্স দিচ্ছে। তার বক্তব্য খুবই পরিস্কার : মানুষের বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রনহীন হয়ে পড়েছে, মানবপ্রজাতির টিকে থাকা এখন দুষ্কর।
পর্দায় কণ্ঠটি বলছে :
“হাতপা গুটিয়ে বসে থাকা মানে দান্তের নরককে স্বাগত জানানো…গাদাগাদি করে, না খেয়ে, পাপে আকণ্ঠ ডুবে যাওয়া। তাই আমি সাহসী একটি পদক্ষেপ নিয়েছি। অনেকে হয়তো ভয়ে আৎকে উঠবে, কিন্তু মূল্য চুকানো ছাড়া কোনো মুক্তি আসে না। একদিন এ দুনিয়া আমার আত্মত্যাগের সৌন্দর্য উপলব্ধি করতে পারবে।”
জোবরিস্ট যখন প্লেগ মুখোশটি হঠাৎ করে খুলে ফেললো তখন আৎকে উঠলো ল্যাংডন। তার সবুজ চোখের দিকে চেয়ে রইলো সে। বুঝতে পারলো এই সঙ্কটের কেন্দ্রে যে ব্যক্তিটি আছে অবশেষে তার মুখ দেখা হলো তার। জোবরিস্ট এবার খোলাখুলিভাবে তার ভালোবাসার মানুষটির কথা বলছে, তাকে সে প্রেরণাদাত্রী বলে অভিহিত করছে।
“আমি আমার ভবিষ্যৎ তোমার কোমল হাতে তুলে দিলাম। আমার নীচের কাজ সমাপ্ত। এখন সময় এসেছে মাটির উপরে উঠে আসার…আবারো দু’চোখ ভরে দেখবো আকাশের তারা।
ভিডিওটা শেষ হলে ল্যাংডন বুঝতে পারলো জোবরিস্টের শেষ কথাটি হুবহু দান্তের ইনফার্নোর শেষ লাইন।
কনফারেন্স রুমের অন্ধকারে বসে ল্যাংডন আরো বুঝতে পারলো আজ যেসব ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা সে অর্জন করেছে তার সবই একটিমাত্র বাস্তবতায় জমাট বেধেছে এখন।
বারট্রান্ড জোবরিস্ট এখন প্রকাশিত…তার কণ্ঠও উচ্চারিত।
রুমের বাতি জ্বলে উঠলো, ল্যাংডন দেখতে পেলো সবার চোখ তার দিকে নিবদ্ধ।
এলিজাবেথ সিনস্কির অভিব্যক্তি যেনো বরফের মতো জমে আছে, মহিলা দাঁড়িয়ে নাভাসভাবে তার নেকলেসে আঙুল বোলাতে লাগলো। “প্রফেসর, আমাদের হাতে একদম সময় নেই। একমাত্র সুখবর হলো এখন পর্যন্ত আমরা কোনো জীবাণু আক্রান্ত রোগী পাই নি, এরকম কোনো কিছু ডিটেক্ট করা হয় নি। তাই ধরে নিচ্ছি পানির নীচে ঐ ব্যাগটি এখনও অক্ষত আছে। কিন্তু সমস্যা হলো ওটা কোথায় খুঁজতে হবে সেটা আমরা জানি না। আমাদের একটাই উদ্দেশ্য, ঐ ব্যাগটা ফেটে যাবার আগেই ওটাকে উদ্ধার করতে হবে। আর এটা করতে হলে ওটার লোকেশন জানা খুবই জরুরি। এছাড়া আমাদের আর কোনো পথ নেই।”
এজেন্ট ব্রুডার উঠে দাঁড়িয়ে ল্যাংডনের দিকে চেয়ে রইলো। “আমরা অনুমাণ করছি আপনি ভেনিসে এসেছেন জোবরিস্টের প্লেগের খোঁজেই। তার মানে আপনি জানতে পেরেছেন ওটা এখানেই আছে।”
ল্যাংডন তার দিকে চেয়ে থাকা ভয়ার্ত মুখগুলো দেখলো। সবাই একটা অলৌকিকের জন্য অপেক্ষা করছে যেনো। তারও ইচ্ছে ভালো কোনো খবর থাকলে সেটা সানন্দে দিতো এদেরকে।
“আমরা ভুল দেশে খোঁজ করছি,” বললো ল্যাংডন। “আপনারা যেটা খুঁজছেন সেটা এখান থেকে হাজার মাইল দূরে।”
.
মেন্দাসিয়াম ঘুরে ভেনিস এয়ারপোর্টের কাছে বন্দরের দিকে যেতে থাকলে। ল্যাংডনের ভেতরটাও পাক খেলো। জাহাজের ভেতরে যেনো হট্টগোল শুরু হয়ে গেছে। প্রভোস্ট তার ক্রুদের চিৎকার করে বিভিন্ন কাজের অর্ডার দিচ্ছে। এলিজাবেথ সিনস্কি ফোনে কথা বলছে তার বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার ট্রান্সপোের্ট প্লেনের পাইলটের সাথে, তাকে বলছে সে যেনো যতো দ্রুত সম্ভব তার বিমান নিয়ে ভেনিস এয়ারপোর্টে চলে আসে। এজেন্ট ব্রুডার ল্যাপটপ নিয়ে বসে পড়েছে, তারা এখন যেখানে যাবে সেখানে কোনো অ্যাডভান্স টিম পাঠানো যায় কিনা খতিয়ে দেখছে।
অনেক দূরের একটি দেশ।
প্রভোস্ট কনফারেন্স রুমে ফিরে এলো এবার, ব্রুডারকে জরুরি তাগাদা দিলো সে। “ভেনিশিয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে আর কিছু শোনা গেছে?”
মাথা ঝাঁকালো ব্রুডার। “কোনো ট্রেস নেই। তারা এখনও খুঁজছে কিন্তু সিয়েনা ব্রুকস উধাও হয়ে গেছে।”
আৎকে উঠলো ল্যাংডন। তারা সিয়েনাকে খুঁজছে?
সিনস্কিও ফোন কল শেষ করে তাদের সাথে যোগ দিলো। “তাকে খুঁজে পাওয়া যায় নি?”
মাথা ঝাঁকালো প্রভোস্ট। “আপনি যদি চান তাহলে আমার মনে হয় মেয়েটাকে ধরে আনার জন্য বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার উচিত প্রয়োজনীয় ফোর্সের অনুমতি দেয়া।”
লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালো ল্যাংডন। “কেন?! সিয়েনা ব্রুকস এসবের সাথে মোটেও জড়িত নয়!”
প্রভোস্টের গভীর চোখ দুটো ল্যাংডনের দিকে নিবদ্ধ হলো। “প্রফেসর, মিস ব্রুকসের ব্যাপারে আপনাকে আমার কিছু কথা বলা দরকার।”
.
অধ্যায় ৭৯
রিয়ালতো ব্রিজের উপর ঘুরে বেড়ানো পর্যটকদের ঠেলেঠুলে পার হয়ে আবারো দৌড় শুরু করলো সিয়েনা ব্রুকস। ফন্দামেস্তা ভিন কাস্তেল্লোর ওয়াকয়ে দিয়ে প্রাণপণে ছুটে চলছে সে।
তারা রবার্টকে ধরে ফেলেছে।
কুয়োর উপর থেকে ক্রিপ্টের নীচে থাকা তার চোখ দুটো সে দেখেছে, সৈনিকেরা জাপটে ধরে রেখেছে তাকে। টেনে হিচরে নিয়ে যাচ্ছে বাতির কুয়োর নীচ থেকে। ঐ লোকগুলো যে তার কাছ থেকে সব তথ্য জেনে নেবে এ ব্যাপারে তার মধ্যে কোনো সন্দেহ নেই।
আমরা ভুল দেশে খোঁজ করছি।
তারচেয়েও বড় ট্র্যাজিক ঘটনা হলো, তাকে যারা ধরেছে তারা কোনো সময় নষ্ট না করেই ল্যাংডনের কাছে পরিস্থিতির সত্যিকারের ধরণটা সম্পর্কে অবহিত করবে।
আমি দুঃখিত, রবার্ট।
সবকিছুর জন্য।
দয়া করে জেনে রেখো, এছাড়া আমার আর কিছু করার ছিলো না।
অদ্ভুত ব্যাপার হলো সিয়েনা তাকে এইরমধ্যে মিস করতে শুরু করেছে। ভেনিসের এই জনাকীর্ণ লোকারণ্যেও অতিপরিচিত একাকীত্বের অনুভূতিটা তার মধ্যে জেঁকে বসলো।
এটা তার জন্য মোটেও নতুন নয়। সেই শৈশব থেকেই সিয়েনা ব্রুকস নিজেকে এরকম একাকী অনুভব করে আসছে।
অসম্ভব প্রতিভা নিয়ে জন্মানোর পর সিয়েনার মনে হতো সে অদ্ভুত এক দেশে অচেনা এক মানুষ…নিঃসঙ্গ এক পৃথিবীতে কোনো বৰ্হিজীব যেনো ফাঁদে পড়ে আছে। বন্ধু বানানোর অনেক চেষ্টা করেছে কিন্তু তার প্রতি ওদের মনোভাব আর তামাশাপূর্ণ আচরণ বাধা হয়ে দাঁড়ায়। বন্ধু বানানোর আগ্রহ হারিয়ে ফেলে সে। বড়দের শ্রদ্ধা করার চেষ্টা করেছিলো কিন্তু বেশিরভাগ বয়োজ্যেষ্ঠরাই বয়স্ক শিশু ছাড়া আর কিছু না, তাদের চারপাশের যে জগতটা আছে সেটা বোঝার ব্যাপারে সাধারণ কোনো ধারণাও তাদের ছিলো না, তারচেয়েও বড় কথা কৌতূহল কিংবা এ নিয়ে কোনো চিন্তাভাবনাও ছিলো না তাদের।
আমার মনে হতো আমি শূন্যতার একটি অংশ।
সেজন্যে তাকে শিখতে হয়েছে কিভাবে ভুতে পরিণত হতে হয়। কিভাবে বহুরূপী হতে হয়, পারফর্ম করতে হয়, লোকজনের ভীড়ে মিশে যেতে হয়। শৈশবে তার অভিনয় করার তীব্র বাসনাটির পেছনে আসলে নিজেকে অন্য একজনে বদলে ফেলার আকাঙ্খা ছাড়া আর কিছু ছিলো না।
স্বাভাবিক একজন মানুষে।
শেক্সপিয়ারের অ্যা মিডনাইট সামার নাইটস ড্রিম-এ অভিনয় করতে গিয়ে তার দারুণ উপকার হয়, সে বুঝতে পারে কিছু একটার অংশ হতে পেরেছে। বয়স্ক অভিনেতারা বেশ সহযোগীতাপরায়ণ ছিলো। তবে তার এই আনন্দ খুবই ক্ষণস্থায়ী হয়। ওপেনিং নাইটে মঞ্চ ত্যাগ করে সে মুখোমুখি হয় একগাদা মিডিয়ার সামনে, অন্যদিকে তার সহঅভিনেতারা তখন অপেক্ষা করছিলো কখন তাদের মঞ্চে উঠতে হবে।
এখন তারাও আমাকে ঘৃণা করে।
তবে মাত্র সাত বছর বয়সে সিয়েনা নিজের এই বিষণ্ণতা রোগের চিকিৎসা করার জন্য যথেষ্ট পড়াশোনা করে ফেলে। এ কথা যখন তার বাবা-মাকে বলে তারা থ বনে যায়, ঠিক যেমনটি সিয়েনার প্রতিটি কাজকর্মে তারা হতো। তাসত্ত্বেও মেয়েকে তারা সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যায়। ঐ ভদ্রলোক তাকে অনেক প্রশ্ন করেছিলো, কিন্তু মজার বিষয় হলো এসব প্রশ্ন সে নিজেকে অসংখ্যবার করে ফেলেছে ততোক্ষণে। মনোবিজ্ঞানী তাকে অ্যামিট্রিপটিলাইন আর ক্লোরডিয়াজিপোক্সাইড প্রেসক্রাইব করে।
রেগেমেগে সোফা থেকে উঠে বসে সিয়েনা। “অ্যামিট্রিপটিলাইন??” প্রতিবাদ করে বলে ওঠে সে। “আমি সুখি হতে চাই-জোম্বিদের মতো জীবন্ত লাশ হতে চাই না!”
মনোবিজ্ঞানী ভদ্রলোক খুবই শান্তভাবে তার রাগের মোকাবেলা করে দ্বিতীয় সাজেশন দেয়। “সিয়েনা, তুমি যদি ওষুধ না খেতে চাও তাহলে ব্যাপারটা সার্বিকভাবে খতিয়ে দেখার চেষ্টা করে দেখতে পারি।” একটু থেমে আবার বলেছিলো সে, “সব শুনে মনে হচ্ছে তুমি নিজেকে নিয়ে এক চিন্তার বৃত্তের ফাঁদে পড়ে গেছো, তুমি ভাবো তুমি এ পৃথিবীর কেউ না।”
“এটা ঠিক,” জবাবে বলেছিলো সিয়েনা। “আমি এই চিন্তাটা বাদ দেবার অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু পারি নি!”
ভদ্রলোক শান্তভাবে হেসেছিলো। “অবশ্যই তুমি বাদ দিতে পারবে না। মানুষের পক্ষে চিন্তা না করে থাকাটা শারিরীকভাবেই অসম্ভব ব্যাপার। আত্মা। আবেগ চায়, আর এটা বিরামহীনভাবেই সেই আবেগের জ্বলানী সরবরাহ। করে-ভালো-মন্দ যাইহোক না কেন। তোমার সমস্যা হলো তোমাকে ভুল জ্বালানী দেয়া হচ্ছে।”
সিয়েনা কখনও কাউকে এভাবে মানুষের মনের ব্যাপারে মেকানিক্যাল টার্মের সাহায্যে কথা বলতে শোনে নি। সঙ্গে সঙ্গে সে কৌতূহলী হয়ে ওঠে। “আমি কিভাবে অন্যরকম জ্বালানী দিতে পারি?”
“তোমার বুদ্ধিবৃত্তিক ফোকাসটা বদলানো দরকার,” বলে ডাক্তার। “বর্তমানে তুমি আসলে নিজেকে নিয়েই শুধু ভাবো। তুমি ভাবো কেন তুমি খাপ খাইয়ে নিতে পারো না…তোমার সমস্যা কি।”
“সত্যি,” বলেছিলো সিয়েনা। “তবে আমি সমস্যাটি সমাধান করার চেষ্টা করছি। খাপ খাইয়ে নেবার চেষ্টা করছি। আমি যদি এটা নিয়ে না-ই ভাবি তাহলে সমস্যার সমাধান করতে পারবো না।”
মুচকি হেসেছিলো ডাক্তার। আমার বিশ্বাস সমস্যা নিয়ে চিন্তা করাটাই তোমার সমস্যা।” ডাক্তার তাকে উপদেশ দেয় তার উচিত নিজেকে নিয়ে চিন্তা
করে অন্যকে নিয়ে ভাবা, অন্যের সমস্যা নিয়ে চিন্তা করা…তার চারপাশে যে জগত আছে, তার যেসব সমস্যা আছে সেসবের প্রতি মনোযোগ দেয়া।”
ঠিক তখন থেকেই সব কিছু বদলে গেছিলো।
নিজের সমস্ত শক্তি একত্র করে ভাবতে শুরু করে নিজের জন্য সে মোটেও দুঃখিত নয়…বরং অন্য মানুষের জন্য তার হৃদয় কাঁদে। জনকল্যাণমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ে সে। গৃহহীনদের শেল্টারে সুপের ক্যান সরবরাহ আর অন্ধদের জন্য বই পড়ে শোনানোর মতো কাজে নিয়োজিত করে। অবিশ্বাস্য ব্যাপার হলো যেসব লোকজনকে সে সাহায্য করতে শুরু করে তারা কেউই টের পায় নি সিয়েনা অন্যদের চেয়ে আলাদা। তারা শুধু তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকতো।
প্রতি সপ্তাহে বেশ পরিশ্রম করতো সিয়েনা, রাতে ঘুমাতেও পারতো না ঠিকমতো কারণ ততোদিনে সে বুঝে গেছিলো অসংখ্য মানুষ আছে যাদেরকে সাহায্য করা দরকার।
“সিয়েনা, আস্তে!” লোকজন তাকে বলতো। “তুমি একা একা এ পৃথিবীকে বাঁচাতে পারবে না!” কী ভয়ঙ্কর কথা।
জনসেবায় নিয়োজিত হবার পর স্থানীয় অনেক হিউম্যানিটারিয়ান গ্রুপের সদস্যদের সাথে তার পরিচয় ঘটে। তারা যখন এক মাসের জন্য ফিলিপাইনে যাবার প্রস্তাব করে তখন সে সানন্দে রাজি হয়ে যায়।
সিয়েনা মনে করেছিলো তারা ওখানকার গ্রামের গরীব কৃষক আর জেলেদের খাদ্য সংস্থানের ব্যবস্থা করবে। সে পড়েছিলো জায়গাটা প্রাকৃতিকভাবে খুবই সুন্দর আর মনোরম। চার দিকে সাগরে ঘেরা একটি দেশ। কিন্তু তাদের দলটি যখন এ পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতি শহর ম্যানিলায় গিয়ে হাজির হয় তখন সে ভয় পেয়ে গেছিলো। এরকম চরম দারিদ্র জীবনেও সে দেখে নি।
একজন মানুষ কতোটুই বা করতে পারে?
একজনকে খাওয়াতে গেলে সিয়েনা দেখতো আরো একশ’ জন অভূক্ত তার দিকে চেয়ে আছে। ম্যানিলায় ছয় ঘণ্টার ট্রাফিক জ্যাম, দম বন্ধ করা দূষণ আর ঘাবড়ে দেবার মতো সেক্সট্রেড চলতো। এর শিকার বেশিরভাগই অল্পবয়সি ছেলেমেয়ে। তাদের মধ্যে অনেকেরই বাবা-মা বেশ্যার দালালদের হাতে নিজের সন্তানকে তুলে দিতো এ আশায় যে তারা অন্তত দিনে দু’বেলা খেতে পারবে।
এইসব নারকীয় বেশ্যাবৃত্তির ঘটনা, ভিক্ষুক আর পকেটমার সিয়েনাকে একদম প্যারালাইজ করে ফেলেছিলো। তার চারপাশে মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রাম, আর সেই সংগ্রামে জয়ি হবার জন্য পশুর মতো লড়াই করছে তারা। তারা যখন বেঁচে থাকার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে…তখন আর মানুষ থাকে না, পশুতে পরিণত হয়।
সিয়েনার কাছে পুরনো সেই বিষণ্ণতা নতুন করে ফিরে আসে আবার। হঠাৎ করেই সে বুঝতে পারে মানুষের ভবিষ্যৎ খুবই অন্ধকার-এই প্রজাতি টিকে থাকতে পারবে না।
আমার ধারণা ভুল ছিলো, মনে মনে বলেছিলো সে। আমি এ পৃথিবী রক্ষা করতে পারবো না।
উন্মাদের মতো হয়ে উঠলো সিয়েনা। রাস্তায় নেমে উদভ্রান্তের মতো ছুটতে শুরু করলো একদিন। লোকজনের ধাক্কাধাক্কিতে পাগলপ্রায়। তার দম বন্ধ হয়ে এলো। একটু খোলা জায়গার জন্য হাসফাস করতে লাগলো সে।
মানুষের গাদাগাদিতে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে!
তাদের মধ্য দিয়ে চলাচল করার সময় বুঝতে পারলো সে একটুও মিশে যেতে পারে নি। ওদের চাইতে তার উচ্চতা অনেক বেশি, সোনালি চুল আর শ্বেতাঙ্গ পরিচয়টি কোনোভাবেই আড়াল করা সম্ভব নয়। লোকজন তার দিকে এমনভাবে তাকাতে লাগলো যেনো সে নগ্ন হয়ে পথেঘাটে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
তার পা যখন আর চলতে চাইলো না তখন সে এটাও জানে না কতোটা দূর চলে এসেছে কিংবা কোথায় এসে পড়েছে। চোখের জল মুছে চারপাশটা ভালো করে তাকিয়ে দেখলো এক ধরণের শান্তিটাউন-টিনের ছাদ আর কার্ডবোর্ড দিয়ে তৈরি বস্তিতুল্য একটি এলাকা। তার চারপাশে ক্রন্দনরত বাচ্চা আর মানুষের। হাগামুতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। বাতাসে তার গন্ধ।
আমি নরকের দরজা দিয়ে ঢুকে পড়েছি।
“তুরিস্তা,” তার পেছন থেকে একটা গম্ভীর কণ্ঠ বলে উঠলো। “মাগকানো?” রেট কতো?
সিয়েনা ঘুরে তাকিয়ে দেখে তিন যুবক এগিয়ে আসছে, যেনো নেকড়ের মতো তাদের মুখের লালা ঝরছে। সঙ্গে সঙ্গে সে বুঝে যায় বিপদে পড়ে গেছে, চেষ্টা করে ওখান থেকে পালাতে কিন্তু তিন যুবক তাকে ঘিরে ধরে, যেনো শিকারী পশু তার শিকার খুঁজে পেয়েছে।
বাঁচার জন্য চিৎকার দেয় সিয়েনা কিন্তু তাতে কেউ কর্ণপাত করে না। মাত্র পনেরো ফিট দূরে এক বৃদ্ধ মহিলা টায়ারের উপর বসে আছে। চাকু দিয়ে পেঁয়াজ কাটছে। মহিলা এমনকি সিয়েনার দিকে ফিরেও তাকায় নি।
যুবকেরা যখন তাকে টেনে হিচরে একটা ঝুপরি ঘরের ভেতরে নিয়ে যাবার চেষ্টা করে তখন আতঙ্ক গ্রাস করে তাকে। আপ্রাণ চেষ্টা করে তাদের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে কিন্তু শক্তিতে কুলিয়ে উঠতে পারে না। যুবকেরা তাকে চেপে ধরে পুরনো একটি ম্যাট্রেসের উপর।
এক টানে ছিঁড়ে ফেলে তার শার্ট, তার নরম শরীরে থাবা বসায়। চিৎকার দিলে তারা তার মুখে ছেঁড়া শার্ট দলা পাকিয়ে ঢুকিয়ে দেয়। দম বন্ধ হয়ে মারা যাবার অবস্থা হয় তার। এরপর তাকে উপুড় করে দেয়।
যারা চরম দুর্দশার মধ্যে থেকেও ঈশ্বরে বিশ্বাস করে এরকম মূর্খদের প্রতি সব সময়ই এক ধরণের করুণা বোধ করতো সিয়েনা, তারপরও এরকম। পরিস্থিতিতে পড়ে সে প্রার্থনা করলো…একেবারে অন্তরের অন্তস্থল থেকে।
হে ঈশ্বর, আমকে শয়তানের হাত থেকে রক্ষা করো।
প্রার্থনা করার সময়ও সে শুনতে পেয়েছিলো লোকগুলো হাসছে। তাদের নোংরা হাত ঘুরে বেড়াচ্ছে তার দেহে, জিন্স প্যান্টটা টেনে নামাতে ব্যস্ত তারা। তাদের একজন তার উপর চড়ে বসলো এ সময়। ঘর্মাক্ত আর ভারি শরীরের একজন, তার ঘাম পড়ছিলো সিয়েনার শরীরের উপর।
আমি একজন কুমারি, ভেবেছিলো সে। আর আমার সাথে এটা এভাবে হতে যাচ্ছে।
আচমকা তার উপরে চড়ে বসা লোকটি সটকে পড়লো যেনো, আর্তনাদ করে উঠলো সেইসাথে। সিয়েনা টের পেলো তার পিঠে উষ্ণ তরল গড়িয়ে পড়ছে। পুরো ম্যাট্রেসটা ভিজে গেলো লাল রক্তে।
চিৎ হয়ে সিয়েনা দেখতে পেলো আসলে কী ঘটেছে। চাকু হাতে সেই বৃদ্ধা দাঁড়িয়ে আছে, পায়ের কাছে পড়ে আছে তার উপরে চড়ে বসা লোকটি। তার পিঠ থেকে গলগল করে রক্ত পড়ছে।
বৃদ্ধা অগ্নিমূর্তি হয়ে বাকিদেরকে হুমকি দিলো, হাতের চাকুটা বাতাসে ছুঁড়তে লাগলো উদভ্রান্তের মতো, যতোক্ষণ না তিন যুবক পালালো সেখান থেকে।
কোনো কথা না বলে সিয়েনাকে তার জামা-কাপড় পরতে সাহায্য করলো বৃদ্ধা।
“সালামাত, কান্নাজড়িত কণ্ঠে ফিসফিসিয়ে বললো সে। “ধন্যবাদ আপনাকে।”
বৃদ্ধা নিজের কানে টোকা মারলো, বোঝাতে চাইলে সে বধির।
দু’হাত জড়ো করে চোখ বন্ধ করলো সিয়েনা, মাথাটা নীচু করে সম্মান জানালো বৃদ্ধাকে। কিন্তু চোখ খুলে দেখে মহিলা নেই।
তক্ষুণি ফিলিপাইনস ছেড়ে দেশে ফিরে গিয়েছিলো সিয়েনা, এমনকি দলের বাকিদেরকে বিদায় না জানিয়েই। এই ব্যাপারটা নিয়ে আর কারোর সাথে কোনো কথা বলে নি সে। তার ধারণা ছিলো ব্যাপারটা ভুলে থাকলে আস্তে আস্তে স্মৃতি থেকে মুছে যাবে কিন্তু ঘটলো উল্টোটা। কয়েক মাস পরও রাতের বেলা সে ঘুমাতে পারতো না ঐ ঘটনা মনে করে, কোথাও নিজেকে নিরাপদ মনে করতো না সে। মার্শাল আর্ট শিখে নেয়, দিম মাক-এ দক্ষ হয়ে ওঠে দ্রুত। এটা খুবই মারাত্মক একটি আর্ট। তারপরও যেখানেই যেতো মনে করতো সে ঝুঁকির মধ্যে আছে।
তার বিষণ্ণতা ফিরে এলো আরো দশগুন হয়ে, রাতের বেলায় আর ঘুম। আসততা না। মাথার চুল আচড়ালেই চিরুণীতে প্রচুর চুল উঠে আসতে শুরু করে। দিনে দিনে মাথার চুল পড়তে পড়তে প্রায় ন্যাড়া হয়ে যেতে থাকে। সে নিজে নিজেই বের করেছিলো তার এই রোগটা হলো টেলিজেনিক এফ্লাভিয়াম-মানসিক-চাপ সংশ্লিষ্ট একটি অ্যালোপেশিয়া, অর্থাৎ চুল পড়ে যাওয়ার রোগ। আয়নায় যতোবারই নিজের টেকো মাথা দেখতে তার হৃদস্পন্দন বেড়ে যেতো।
আমি দেখতে একেবারে বুড়ি হয়ে গেছি।
শেষ পর্যন্ত উপায় না দেখে সে তার চুল ফেলে দেয়। অন্তত তাকে আর অতোটা বুড়ি দেখাতো না। দেখে মনে হতো সে অসুস্থ। কিন্তু তাকে ক্যান্সার। রোগীদের মতো দেখাক এটা চায় নি বলে একটা সোনালি চুলের পনিটেইলের উইগ কিনে আনে। ওটা পরার পর থেকে তাকে আবার তরুণী বলে মনে হতে থাকে।
তবে ভেতরে ভেতরে সিয়েনা ব্রুকস বদলে গিয়েছিলো।
আমি একটি বাতিল মাল।
নতুন জীবনের আশায় সে আমেরিকায় গিয়ে সেখানকার মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়। চিকিৎসাবিজ্ঞানের উপর বরাবরই তার আগ্রহ ছিলো, সে আশা করেছিলো একজন ডাক্তার হলে তার নিজের কাছেও মনে হবে মানবতার সেবায়। নিয়োজিত হতে পেরেছে…এতে করে তার নিজের যন্ত্রণাও কিছুটা লাঘব হবে।
দীর্ঘ সময় ধরে ক্লাশ হলেও সিয়েনার কাছে এটা খুব সহজই মনে হতো, তার ক্লাসমেটরা যখন পড়াশোনায় ব্যস্ত সে তখন পার্ট-টাইম অভিনয় করে বাড়তি রোজগার করা শুরু করে। অভিনয়গুলো অবশ্যই শেক্সপিয়ারের কোনো নাটকের ছিলো না তবে ওসব নাটকে অভিনয় করতে বেশ সাচ্ছন্দে, নিজের পরিচয় ভুলে অন্য এক পরিচয়ে ডুবে যেতো খুব সহজে।
যেকোনো একজনে।
বলতে গেলে কথা বলা শুরু করার পর থেকেই সিয়েনা তার পরিচয় বদলানোর চেষ্টা করে গেছে। একজন শিশু হিসেবে সে তার মধ্য নাম ফেলিসিটি পাল্টে সিয়েনা রাখে। ফেলিসিটি মানে সৌভাগ্যবান। ভালো করেই জানতো আর যা-ই হোক সে ওটা নয়।
নিজের সমস্যা থেকে মনোযোগ সরিয়ে ফেলো, নিজেকে বলতো সিয়েনা। এ বিশ্বের সমস্যা নিয়ে ভাবো।
জনবহুল ম্যানিলার রাস্তায় তার উপর যে আক্রমণ হয়েছিলো সেই ভীতিটা। গভীর রেখাপাত করে সিয়েনার মনে। বিশ্বের জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ে সে চিন্তিত হয়ে পড়ে। ঠিক তখনই জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ার বারট্রান্ড জোবরিস্টের কলামগুলো তার চোখে পড়ে। জনসংখ্যা বিষয়ক কিছু প্রস্তাবনা আর তত্ত্ব হাজির করে সে।
লোকটা আসলেই একজন জিনিয়াস, লেখাগুলো পড়ার পর বুঝতে পারে সিয়েনা। তার মনে হয় এই লোকের মতো করে কখনও ভাবে নি সে। এরপর যতোই জোবরিস্টের লেখা পড়তে থাকে ততোই মনে হতে থাকে তার একজন সোল-মেট পেয়ে গেছে। তার আর্টিকেল তুমি পৃথিবীকে বাঁচাতে পারবে না’ সিয়েনাকে স্মরণ করিয়ে দেয় এ কথাই প্রত্যেকে তার সন্তানদের বলে থাকে…কিন্তু জোবরিস্ট বিশ্বাস করে ঠিক তার উল্টোটা।
তুমি পৃথিবীকে বাঁচাতে পারবে না, জোবরিস্ট লিখেছিলো। যদি তুমি না করো তাহলে কে করবে? যদি এখনই না করো তাহলে কখন করবে?
জোবরিস্টের গাণিতিক সমীকরণগুলো ভালোভাবে পড়ে দেখে সিয়েনা, ম্যালথাসীয় বিপর্যয় আর মানবজাতির বিলুপ্তির উপরও প্রচুর পড়াশোনা করে সে। তার বুদ্ধিমত্তা উচ্চস্তরের অনুমাণ-বিশ্লেষণ ভালোবাসে কিন্তু এ ভবিষ্যতের চিত্রটা দেখার পাশাপাশি তার মধ্যে মানসিক চাপও বাড়তে শুরু করে…অঙ্ক দিয়েই এটা প্রমাণ করা যায়…একেবারেই অনিবার্য…এড়িয়ে যাবার কোনো উপায় নেই।
আর কেউ এই ভবিষ্যতা দেখতে পাচ্ছে না কেন?
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারের আইডিয়াগুলো তাকে ভড়কে দিলেও সিয়েনা জোবরিস্টের প্রতি মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। তার ভিডিও প্রেজেন্টেশন দেখা, বইপত্র আর কলামগুলো পড়া, কোনো কিছুই বাদ দিতো না। যখন শুনতে পেলো। জোবরিস্ট আমেরিকায় এসে বক্তৃতা দেবে তখন সে ঠিক করলো সশরীরে সেখানে উপস্থিত থাকবে।
আর সেই একটা রাতেই বদলে গেলো তার দুনিয়া।
ঐ রাতে জাদুময় অনুষ্ঠানে গিয়ে তার মুখে ফুটে উঠেছিলো হাসি, যা তার জীবনে খুবই বিরল ব্যাপার…ঐ মুহূর্তগুলোর কথা ল্যাংডন আর ফেরিসের সাথে ট্রেনে করে যাবার সময় সে স্মরণ করেছিলো।
শিকাগোতে। প্রচণ্ড তুষারপাতের সময়।
ছয় বছর আগে জানুয়ারি মাসে…কিন্তু মনে হয় এই তো সেদিনের ঘটনা। বরফের স্তূপ ডিঙিয়ে আমি যাচ্ছিলাম, প্রচণ্ড তুষারপাতের কারণে কলার তুলে দিতে হয়েছিলো। এরকম আবহাওয়া সত্ত্বেও আমি নিজেকে বলেছিলাম, কোনো কিছুই আমার নিয়তি থেকে আমাকে সরাতে পারবে না। আজরাতে মহান বারট্রান্ড জোবরিস্টের কথা শোনার সুযোগটি হাতছাড়া করার কোনো ইচ্ছে আমার নেই…তাও আবার একান্তে!
এই লোকটি এ পর্যন্ত যা যা লিখেছে তার সবই আমি পড়েছি। আর নিজেকে খুব সৌভাগ্যবান মনে হচ্ছে মাত্র পাঁচশত জন লোকের মধ্যে আমি আছি বলে। আজকের অনুষ্ঠানের জন্য এই পরিমাণ টিকেটই ছাড়া হয়েছে।
হলে যখন পৌঁছালাম তখন প্রায় অসাড় হয়ে পড়েছি প্রচণ্ড ঠাণ্ডায়। ঘরটা প্রায় খালি দেখে একটু ভড়কে গেছিলাম আমি। তার বক্তৃতাটি কি বাতিল করা। হয়েছে?! বাজে আবহাওয়ার কারণে শহরের সব কিছুই বন্ধ ঘোষণা করা। হয়েছে…এজন্যে কি জোবরিস্ট আজরাতে আসতে পারেন নি?!
তারপরই দেখতে পেলাম উনি সেখানে আছেন।
পর্বতের মতোই অভিজাত ভঙ্গি নিয়ে উঠেছেন মঞ্চে।
উনি অনেক লম্বা…চোখ দুটো উজ্জ্বল সবুজ, যেনো সেই চোখের গভীরতায় এ বিশ্বের সব রহস্য ধরে রেখেছেন। ফাঁকা হলের দিকে তিনি তাকালেন-হাতে গোনা এক ডজনের মতো ভক্ত জড়ো হয়েছে সেখানে-হলটা প্রায় খালি বলে আমি খুব লজ্জিত বোধ করলাম।
ইনি বারট্রান্ড জোবরিস্ট!
উনি আমাদের দিকে যখন তাকালেন তখন সুকঠিন নীরবতা নেমে এলো ঘরে। তারপর কথা নেই বার্তা নেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন তিনি। তার সবুজ চোখ দুটো জ্বলজ্বল করতে লাগলো। “জাহান্নামে যাক এই ফাঁকা অডিটোরিয়াম।” ঘোষণা দিলেন যেনো। “আমার হোটেল খুব কাছেই। আসুন, সেখানকার বারে চলে যাই!”
উৎফুল্ল ধ্বনি শোনা গেলো, ছোটোখাটো দলটি সানন্দে হোটেলের বারে রওনা দিলো একসঙ্গে। সবার জন্য মদের অর্ডার দেয়া হলো। জোবরিস্ট আমাদেরকে তার গবেষণা, সেলিব্রেটি হিসেবে তার উত্থানের কাহিনী এবং ভবিষ্যতের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে কথা বলে গেলেন। মদ পরিবেশিত হবার পর পর কথাবর্তার বিষয় বদলে গেলো জোবরিস্টের নতুন ঝোঁক ট্রান্সহিউম্যানিস্ট দর্শনের দিকে।
“আমি বিশ্বাস করি ট্রান্সহিউম্যানিজম মানবজাতির দীর্ঘদিন টিকে থাকার জন্য একমাত্র আশাভরসা,” সবাইকে বোঝাতে শুরু করলেন জোবরিস্ট। নিজের শার্ট সরিয়ে H+ কাঁধে থাকা ট্যাটুটা দেখালেন তিনি। “আপনারা দেখতেই পাচ্ছেন, আমি কতোটা নিবেদিতপ্রান এ বিষয়ে।”
আমার কাছে মনে হচ্ছিলো কোনো রকস্টারের সাথে একান্তে কথা বলছি। কখন কল্পনাও করি নি জেনেটিক্স ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের এরকম একজন জিনিয়াস এতোটা ক্যারিশমেটিক ব্যক্তি হতে পারেন। জোবরিস্ট যখনই আমার দিকে তাকাচ্ছিলেন এক অনির্বচনীয় অনুভূতিতে আক্রান্ত হচ্ছিলাম…মনের সুগভীরে থাকা যৌনাকাঙ্খ জেগে উঠেছিলো আমার।
রাত গম্ভীর হতে থাকলে আমাদের দলটি পাতলা হতে শুরু করে। মাঝরাতে আমি আর জোবরিস্ট সম্পূর্ণ একা হয়ে পড়ি।
“আজকের রাতটার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ,” তাকে বলি আমি। মদ্যপানের ফলে একটু ঝিমুনিও চলে এসেছিলো আমার মধ্যে। “আপনি একজন অসাধারণ শিক্ষক।”
“পাম দিচ্ছো?” আমার কাছে ঝুঁকে এসে বললেন জোবরিস্ট। তার হাটুর সাথে আমার হাটু স্পর্শ করলো। “এরকম পাম আমি সবখানেই পাই।”
আমার ঐ কথাটা নিশ্চয় ঠিক ছিলো না, কিন্তু রাতটা ছিলো তুষারপাতের, আমরা শিকাগোর একটি ফাঁকা হোটেলে বসে আছি। মনে হচ্ছিলো পুরো দুনিয়াটা থেমে আছে।
“তাহলে তুমি কি ভাবছো?” বলেছিলেন জোবরিস্ট। “আমার ঘরে মদ নিয়ে বসবো দু’জনে?”
আমি বরফের মতো জমে গেলাম কথাটা শুনে। যেনো বুনো হরিণের বাচ্চা গাড়ির হেডলাইটের আলোর সামনে পড়ে গেছে।
আন্তরিকতার সাথে জোবরিস্ট চোখ টিপলেন। “আচ্ছা, আমাকে অনুমান করতে দাও,” চাপাস্বরে বলেছিলেন তিনি। “জীবনে কখনও বিখ্যাত মানুষের সান্নিধ্যে আসে নি।”
আমি আরক্তিম হয়ে উঠলাম। তীব্র আবেগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করলাম-বিব্রত, উত্তেজিত আর ভীত।
“সত্যি বলতে কি,” তাকে বলেছিলাম। “আমি আসলে কোনো পুরুষের সাথেই এভাবে একান্তে সময় কাটাই নি।”
মুচকি হেসে আরো কাছে এগিয়ে এলেন জোবরিস্ট। “আমি জানি না তুমি কিসের জন্য অপেক্ষা করে আছো এতোদিন, তবে আমি শুধু বলবো, আমাকে তোমার প্রথমজন করে নাও।”
ঠিক সেই মুহূর্তে আমার শৈশবের অদ্ভুত যৌনভীতি আর হতাশা নিমেষে উবে গেলো…বরফ-শীতল রাতে যেনো হাওয়া হয়ে গেলো সেসব।
জীবনে প্রথম তীব্র আকাঙ্খর কারণে লজ্জিত বোধ করলাম না।
আমি তাকে চাইলাম।
দশ মিনিট পর আমি জোবরিস্টের হোটেল রুমে। দুজনেই নগ্ন, একে অন্যের বাহুলগ্ন হয়ে। সময় নিয়ে ধৈর্যসহকারে এগোলো সে। তার আঙুলের স্পর্শ আমার অনভিজ্ঞ শরীরে অনির্বচনীয় এক শিহরণ বয়ে দিলো। এটা আমি বেছে নিয়েছি, সে আমাকে জোর করে নি।
জোবরিস্টের দু’হাতের মধ্যে নিজেকে সপে দিয়ে আমার মনে হচ্ছিলো এ বিশ্বের সবকিছুই ঠিক আছে। তার সঙ্গে বিছানায় শুয়ে থেকে জানালা দিয়ে তুষারপাতের দৃশ্য দেখতে দেখতে ভাবলাম এই মানুষটিকে আমি সর্বত্র অনুসরণ করবো।