অধ্যায় ৮০
মেন্দাসিয়াম-এর উপরের ডেকে পালিশ করা সেগুন কাঠের রেলিংটা শক্ত করে ধরে রেখেছে রবার্ট ল্যাংডন, টলতে থাকা পা দুটোর স্থির রেখে নিঃশ্বাস স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে সে। সমুদ্রের বাতাস আরো বেশি ঠাণ্ডা হয়ে উঠেছে, খুব কাছে ভেনিস এয়ারপোর্টে উঠতে-নামতে থাকা বিমানের গর্জন শোনা যাচ্ছে। এখন।
মিস ব্রুকসের ব্যাপারে আপনাকে আমার কিছু কথা বলা দরকার।
তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা প্রভোস্ট আর ডা: সিনস্কি চুপ মেরে আছে তবে তারা বেশ উদগ্রীব, তকে ধাতস্থ হবার জন্য সময় দিচ্ছে। নীচের ডেকে তারা যে কথা বলেছে সেটা শুনে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলো ল্যাংডন, তাই মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নেবার সুযোগ করে দেয়ার জন্য তাকে এখানে নিয়ে এসেছে তারা।
সমুদ্রের বাতাস খুবই মনোরম কিন্তু ল্যাংডনের মাথা পরিস্কার হলো না। ফ্যালফ্যাল করে সমুদ্র দেখে যাচ্ছে সে। এইমাত্র যা শুনেছে সেগুলো হজম করার চেষ্টা করে যাচ্ছে।
প্রভোস্টের মতে সিয়েনা আর বারট্রান্ড জোবরিস্ট দীর্ঘদিন ধরে প্রেমিকযুগল ছিলো। এক ধরণের আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রান্সহিউম্যানিস্ট আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলো এরা দু’জন। তার পুরো নাম ফেলিসিটি সিয়েনা ব্রুকস, তবে সে তার কোডনেম এফএস-২০৮০ ব্যবহার করতো…এটা তার নামের আদ্যক্ষর আর যে। বছর তার একশতম জন্মদিন হবে সেটার সমম্বয়ে রাখা হয়েছিলো।
মাথামুণ্ডু কিছুই বোঝা যাচ্ছে না!
“আমি সিয়েনা ব্রুকসকে চিনি ভিন্ন একটি সোর্সের মাধ্যমে,” ল্যাংডনকে বলেছিলো প্রভোস্ট। “আমি তাকে বিশ্বাসও করেছিলাম। তাই গত বছর যখন সে আমার কাছে এসে বললো এক ধনাঢ্য ক্লায়েন্ট আমার সাথে দেখা করতে চায় তখন আমি রাজি হয়ে যাই। সেই ক্লায়েন্টটি ছিলো জোবরিস্ট। সে আমার কাছে। নিরাপদ একটি আশ্রয় চাইলো যাতে করে তার মাস্টারপিস’-এর কাজকর্ম নির্বিঘ্নে চালিয়ে যেতে পারে। আমি ধরে নেই এটা কোনো টেকনোলজিক্যাল ব্যাপার হবে, সে চাইছে না কাজটা পাইরেসি হয়ে যাক…কিংবা সে হয়তো অত্যাধুনিক জেনেটিক গবেষণা করছে যা বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার নীতিমালার পরিপন্থী…আমি তাকে এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন করি নি, কিন্তু বিশ্বাস করুন, কখনও কল্পনাও করতে পারি নি সে আসলে…প্লেগ তৈরি করছে।”
উদাসভাবে চেয়ে থেকে সায় দিয়েছিলো ল্যাংডন…তার বিস্ময়ের সীমা ছিলো না।
“জোবরিস্ট একজন দান্তে ফ্যানাটিক,” প্রভোস্ট বলতে থাকে, “সেজন্যে লুকানোর জায়গা হিসেবে সে ফ্লোরেন্সকে বেছে নেয়। আমার সংগঠন তার প্রয়োজনীয় সব কিছু সেটআপ করে দেয় ওখানে-গোপন একটি ল্যাব, থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা, অনেকগুলো ছদ্মনাম, নিরাপদ যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং একজন ব্যক্তিগত অ্যাটাশে, যে তার সবকিছু দেখাশোনা করতো, প্রয়োজনীয় সবকিছু সরবরাহ করতো। জোবরিস্ট কখনও তার নিজের ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে নি, জনসম্মুখেও আসে নি, তাই তাকে ট্র্যাকডাউন করাটা অসম্ভব ছিলো। আমরা তাকে ছদ্মবেশ, ভুয়া নাম আর বিকল্প কাগজপত্র সরবরাহ করতাম যাতে করে সে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে দেশবিদেশ ঘুরে বেড়াতে পারে।” একটু থেমে আবার বলতে শুরু করে প্রভোস্ট। “এটা সে ভালোমতোই সদ্ব্যবহার করেছে, পানিতে দ্রবীভূত হওয়া প্লাস্টিকের ব্যাগটি স্থাপন করার মধ্য দিয়েই বোঝা যায়।”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে সিনস্কি, নিজের হতাশা লুকানোর কোনো চেষ্টা করে নি। “গত বছর থেকে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা তাকে কড়া নজরে রাখার চেষ্টা করেছিলো কিন্তু মনে হচ্ছিলো সে যেনো এ পৃথিবী থেকে একেবারে উধাও হয়ে গেছে।”
“এমন কি সিয়েনার কাছ থেকেও সে লুকিয়ে ছিলো,” বলে প্রভোস্ট।
“বুঝলাম না?” মুখ তুলে তাকায় ল্যাংডন। “একটু আগে না বললেন তারা দু’জন প্রেমিক-প্রেমিকা ছিলো?”
“অবশ্যই, কিন্তু আচমকা তার সাথেও যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিলো সে। যদিও সিয়েনা তাকে আমাদের কাছে নিয়ে এসেছিলো কিন্তু মনে রাখবেন আমাদের চুক্তি হয়েছিলো তার সাথে, সুতরাং সে যখন লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যেতে চাইলো তখন বুঝে নিতে হবে এরমধ্যে সিয়েনাও পড়ে। আত্মগোপনে যাবার পর সিয়েনার কাছে একটি বিদায়ি চিঠি লিখেছিলো সে, বলেছিলো সে খুব অসুস্থ, বছরখানেকের মধ্যে মারা যাবে, নিজের করুণ অবস্থা তাকে দেখাতে চাইছে না।”
জোবরিস্ট সিয়েনাকে পরিত্যাগ করেছিলো?
“তার ব্যাপারে জানার জন্য সিয়েনা আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলো,” বলে প্রভোস্ট। “কিন্তু আমি তার কল রিসিভ করি নি। ক্লায়েন্টের চাওয়া-পাওয়াকে আমি সম্মান দেই।”
“দু’সপ্তাহ আগে,” সিনস্কি বলতে লাগলো এবার, “জোবরিস্ট ছদ্মনামে ফ্লোরেন্সের একটি ব্যাঙ্কে গিয়ে সেফ-ডিপোজিট বক্স ভাড়া নেয়। ওখান থেকে বের হবার পর পরই আমাদের ওয়াচ-লিস্ট জানতে পারে ব্যাঙ্কের নতুন ফেসিয়াল-রিকগনিশন সফটওয়্যার বারট্রান্ড জোবরিস্টকে আইডেন্টিফাইড করেছে। আমার টিম সঙ্গে সঙ্গে ফ্লোরেন্সে চলে যায়, ওখানে তার সেফ-হাউজটি খুঁজে বের করতে এক সপ্তাহের মতো সময় লাগে, কিন্তু এখানে তারা কাউকে খুঁজে পায় নি। তবে সে যে উচ্চমাত্রার প্রাণঘাতি জীবাণু তৈরিতে ব্যস্ত ছিলো সে ব্যাপারে যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় ওখানে। জীবাণুটি নিয়ে সে সটকে পড়ে অন্য কোথাও।”
একটু থেমেছিলো সিনস্কি। তাকে খুঁজে বের করার জন্য আমরা মরিয়া হয়ে উঠি। পরের দিন সকালে সূর্য ওঠার আগে আরনো নদীর তীরে তাকে হাঁটতে দেখে আমাদের লোকজন। সঙ্গে সঙ্গে তাকে ধাওয়া করা হয়। তখনই সে বাদিয়া টাওয়ার থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করে।”
“যেভাবেই হোক সে হয়তো এ কাজটা করতেই,” যোগ করে প্রভোস্ট। “আগেই বুঝে গিয়েছিলো বেশিদিন বাঁচবে না।”
“দেখা গেলো,” সিনস্কি বলে ওঠে, “সিয়েনাও তাকে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছিলো। কিভাবে যেনো সে টের পেয়ে গেছিলো আমরা ফ্লোরেন্সে অভিযান চালাচ্ছি। সে আমাদের পিছু নেয়। ধরে নেয় আমরা তার অবস্থান জানতে পেরেছি। দুঃখজনক ব্যাপার হলো জোবরিস্ট যখন লাফ দেয় তখন সে ওখানেই উপস্থিত ছিলো।” দীর্ঘশ্বাস ফেললো সিনস্কি। “আমার ধারণা প্রেমিককে ওভাবে মরতে দেখে সে মানসিকভাবে যথেষ্ট ভেঙে পড়েছিলো।”
ল্যাংডন এসব শুনে অসুস্থ বোধ করতে লাগে। এসব কথাবার্তা বুঝতে বেশ বেগ পাচ্ছিলো সে। বর্তমানের এই পরিস্থিতিতে সে কেবলমাত্র সিয়েনাকেই বিশ্বাস করেছিলো। আর এখন কিনা তার সম্পর্কে এসব শুনছে? তারা যা-ই বলে থাকুক না কেন, সিয়েনা যে জোবরিস্টের প্লেগ তৈরি করার মতো কাজকর্মকে সমর্থন দিয়েছে এটা সে বিশ্বাস করতে পারলো না।
নাকি সে সত্যি এসবের সাথে জড়িত?
তুমি কি এ পৃথিবীর অর্ধেক জনসংখ্যা মেরে ফেলবে, সিয়েনা তাকে বলেছিলো, আমাদের মানবজাতিকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য?
হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসে ল্যাংডনের।
“জোবরিস্ট মারা যাবার পর,” সিনস্কি বলতে তাকে, “আমি আমার প্রভাব খাঁটিয়ে ব্যাঙ্ককে বাধ্য করি জোবরিস্টের সেফ-ডিপোজিট বক্সটা খুলে দেখতে। পরিহাসের বিষয় হলো ওটাতে আমার উদ্দেশ্যে লেখা একটি চিঠিও ছিলো…সেইসাথে ছিলো অদ্ভুত একটি ডিভাইস।”
“প্রজেক্টরটি, ল্যাংডন কথা শেষ হবার আগেই বলে দিয়েছিলো।
“একদম ঠিক। চিঠিতে সে লিখেছিলো সে চায় আমি যেনো তার গ্রাউন্ড জিরো’তে প্রথম ভিজিট করি, আর ওটা তার ম্যাপ অব হেল ছাড়া কারো পক্ষেই খুঁজে বের করা সম্ভব হবে না।”
ক্ষুদ্র প্রজেক্টরটিতে বত্তিচেল্লির বিকৃত করা ছবিটা ভেসে উঠলো ল্যাংডনের চোখে সামনে।
প্রভোস্ট বলতে লাগলো, “জোবরিস্টের সাথে আমাদের চুক্তি ছিলো সেফ ডিপোজিটের ভেতরে থাকা জিনিসটি আমরা যেনো ডা: সিনস্কির কাছে ডেলিভারি দেই, তবে সেটা আগামীকাল সকালের আগে নয় কোনোভাবেই। কিন্তু তার আগেই ডা: সিনস্কি যখন ওটা পেয়ে গেলেন তখন আমরা বেশ ভড়কে গেছিলাম, ওটা উদ্ধার করার জন্য মাঠে নেমে পড়ি।”
ল্যাংডনের দিকে তাকালো সিনস্কি। “অল্প সময়ে এই ম্যাপটি আমার পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়, এটা আমি আগেই বুঝে গেছিলাম। তাই আপনাকে রিক্রুট করি আমাকে সাহায্য করার জন্য। এসব কথা কি আপনার মনে আছে?”
মাথা ঝাঁকালো ল্যাংডন।
“সবার অগোচরে আমরা আপনাকে ফ্লোরেন্সে নিয়ে আসি বিমানে করে, এখানে আপনি অন্য আরেকজন লোকের সাথে দেখা করেন এ কাজে সাহায্য পাবার আশায়।”
ইগনাজিও বুসোনি।
“গতরাতে তার সাথে আপনি দেখা করেন,” বলে সিনস্কি। “তারপর থেকে আপনি লাপাত্তা হয়ে যান। আমরা ভেবেছিলাম আপনার কিছু একটা হয়েছে।”
“সত্যি বলতে কি,” প্রভোস্ট বলে, “আপনার আসলেই কিছু হয়েছিলো। প্রজেক্টরটি ফিরে পাবার জন্য আমরা ভায়েন্থা নামের আমাদের এক এজেন্টকে মাঠে নামাই। সে এয়ারপোর্ট থেকে আপনার পিছু নিয়েছিলো। কিন্তু পিয়াজ্জা দেল্লা সিনোরিয়ার আশেপাশে আপনাকে হারিয়ে ফেলে সে।” অসম্ভষ্ট দেখায় তাকে। “আপনাকে এভাবে হারিয়ে ফেলাটা মারাত্মক ভুল ছিলো। ভায়েন্থা এজন্যে সামান্য একটি পাখিকে দায়ি করে।”
“কী বললেন?”
“কবুতরের একটা ডাক। ভায়েন্থার মতে সে একটি অন্ধকারাচ্ছন্ন অ্যালকোভ থেকে আপনার উপর নজর রাখছিলো কিন্তু একদল পর্যটক তার সামনে দিয়ে যাবার সময় নাকি তার মাথার উপর বসে থাকা একটি কবুতর ডেকে ওঠে। এরফলে পর্যটকের দল থমকে দাঁড়ায় ভায়েন্থার সামনে, এই ফাঁকে আপনি উধাও হয়ে যান।” তিক্ততার সাথে মাথা ঝাঁকায়। যাইহোক, কয়েক ঘণ্টার জন্য সে আপনাকে হারিয়ে ফেলে। অবশেষে আবারো আপনার নাগাল পেয়ে যায় সে-তখন আপনার সাথে আরেকজন লোককে দেখা যায়।”
ইগনাজিও, ভেবেছিলো ল্যাংডন। নিশ্চয় সে আর আমি তখন মুখোশটি নিয়ে পালাজ্জো ভেচিও থেকে বের হচ্ছিলাম।
“সে বেশ সফলভাবেই আপনাদের দুজনকে পিয়াজ্জা দেল্লা সিনোরিয়ার পর্যন্ত অনুসরণ করতে পেরেছিলো কিন্তু আপনারা দু’জন তাকে দেখে দু’দিকে পালিয়ে যান।”
এবার তাহলে বোঝা গেলো, ভেবেছিলো ল্যাংডন। ইগনাজিও মুখোশ নিয়ে। পালায়, হার্ট অ্যাটাকে মারা যাবার আগে সেটাকে লুকিয়ে রাখে ব্যাপ্টিস্ট্রিতে।
“এরপর ভায়েন্থা মারাত্মক একটি ভুল করে বসে,” বলে ওঠে প্রভোস্ট।
“ও আমার মাথায় গুলি করে?”
“না, সে একটু আগেভাগে কাজ করে ফেলেছিলো। আপনি কোনো কিছু জানার আগেই সে আপনাকে ধরে ইন্টেরোগেট করে। আমাদের জানা দরকার। ছিলো আপনি ঐ ম্যাপটির মর্মোদ্ধার করতে পেরেছেন কিনা, কিংবা ডা: সিনস্কি যা জানতে চান সেটা তাকে জানিয়েছেন কিনা। কিন্তু আপনি কোনো কিছু বলতে অস্বীকার করেন। আপনি বলেন, আপনি মারা গেলেও এটা বলবেন না।”
আমি একটি প্রাণঘাতি প্লেগের খোঁজ করছিলাম। হয়তো ভেবেছিলাম আপনারা মার্সেনারি, একটি জীবাণু অস্ত্র হাতিয়ে নেবার চেষ্টা করছেন!
জাহাজের বিশাল ইঞ্জিনটা হঠাৎ করে উল্টো দিকে ঘুরতে শুরু করলো এবার। এয়ারপোর্টের ডকের কাছে এগিয়ে যেতে লাগলো ধীরগতিতে। দূরে সি ১৩০ বিমানটি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো ল্যাংডন। ফুয়েলিং করছে। ফিউজলেজে লেখা বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা।
এ সময় ব্রুডার এসে হাজির হলো, তার চোখেমুখে তিক্ততা। “আমি জানতে পেরেছি গন্তব্যের সবচাইতে কাছাকাছি আমাদের যে টিমটি আছে সেটা ওখানে পৌঁছাতে পাঁচঘণ্টা লেগে যাবে। তার মানে আমাদেরকেই কাজটা করতে হবে।”
সিনস্কি সঙ্গে সঙ্গে তাড়া দিয়ে বলে উঠলো, “স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সাথে কো অর্ডিনেট করুন?”
ব্রুডারকে খুশি মনে হলো না। এখন সেটা করা ঠিক হবে না। এটা আমার সাজেশন। কারণ আমরা এখনও ওটার নির্ভুল লোকেশন জানি না। তাই আমাদের কিছু করার নেই। তাছাড়া এরকম ভয়ঙ্কর জীবাণুর অপারেশনে তাদের কোনো অভিজ্ঞতাই নেই। তাদেরকে জড়িত করলে ভালোর চেয়ে খারাপই বেশি। হবে।”
“প্রিমাম নন নোশেয়ার,” মাথা নেড়ে সায় দিয়ে চাপাস্বরে বললো সিনস্কি। চিকিৎসাবিদ্যার মৌলিক একটি নীতির কথা আওড়ালো সে : প্রথম কথা হলো, ক্ষতি কোরো না।
“আর শেষ কথা হলো,” বললো ব্রুডার, “সিয়েনা ব্রুকসের কোনা খবর পাওয়া যায় নি এখন পর্যন্ত। প্রভোস্টের দিকে তাকালো সে। “আপনি কি এমন কারোর কথা জানেন যার সাথে সিয়েনা ভেনিসে যোগাযোগ করতে পারে সাহায্য পাবার জন্য?”
“এরকম কারোর সাথে যোগাযোগ করলে আমি মোটেও অবাক হবো না, জবাবে বললো প্রভোস্ট। “সবখানেই জোবরিস্টের শিষ্য রয়েছে, আর আমি যদি সিয়েনাকে চিনে থাকি তাহলে সে তার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনের জন্য সব। ধরণের রিসোর্সই ব্যবহার করবে।”
“ওকে ভেনিস থেকে বের হতে দেবেন না,” বললো সিনস্কি। “ঐ ব্যাগটা বর্তমানে কি অবস্থায় আছে সে সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণাই নেই। কেউ যদি ওটা খুঁজে পায় তাহলে বিরাট সর্বনাশ ঘটে যাবে। সামান্য একটু স্পর্শ পেলেও ওটা ফেটে যাবে, পানির সাথে মিশে যাবে জীবাণু।”
সবাই চুপ মেরে গেলো এ কথা শুনে।
“আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি আরো খারাপ খবর আছে আমার কাছে,” বললো ল্যাংডন। “পবিত্র জ্ঞানের স্বর্ণালী মওজিওন।” একটু থামলো সে। “সিয়েনা জানে ওটা কোথায়। সে জানে তাকে কোথায় যেতে হবে।”
“কি?!” আৎকে উঠলো সিনস্কি। “আপনি কিন্তু বলেছিলেন আপনি কী খুঁজে পেয়েছেন সে কথাটা সিয়েনাকে বলার সুযোগই পান নি! আপনি শুধু তাকে। বলেছিলেন ভুল দেশে খোঁজ করছেন!”
“সত্যি,” বললো ল্যাংডন। “কিন্তু সে জানে এনরিকো দান্দোলোরর সমাধি কোথায় খুঁজতে হবে। ওয়েবে সার্চ দিলেই এটা জেনে যাবে সে। একবার সে দান্দোলোর সমাধির খোঁজ পেলে…ঐ ব্যাগটি খুঁজে পেতে বেশি সময় লাগবে।। কবিতায় বলা আছে, পানির শব্দ অনুসরণ করে ডুবন্ত প্রাসাদে যেতে হবে।”
“অসহ্য!” ব্রুডার রেগেমেগে বলে উঠলো।
“ও আমাদের আগে ওখানে যেতে পারবে না,” বললো প্রভোস্ট। “আমরা তার থেকে বেশ এগিয়ে আছি।”
ভারি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো সিনস্কি। “আমি নিশ্চিত হতে পারছি না। আমাদের ট্রান্সপোর্ট খুব ধীরগতির, আর মনে হচ্ছে সিয়েনা ব্রুকস খুবই চটপটে একটি মেয়ে।”
মেন্দাসিয়াম ডকে ভিড়ে গেলে ল্যাংডন অস্বস্তির সাথে দূরের রানওয়েতে দাঁড়িয়ে থাকা সি-১৩০ বিমানটির দিকে তাকালো। ওটার কোনো জানালা নেই। এটাতে আমি এরইমধ্যে চড়েছি? ল্যাংডনের কোনো কিছু মনে করতে পারলো না।
ডকে জাহাজ ভেড়ার সময় মুদৃ ঝাঁকি কিংবা জানালাবিহীন আবদ্ধ একটি বিমানে চড়ার আশংকা, যাইহোক না কেন ল্যাংডনের মনে হলো সে বমি করে দেবে।
সিনস্কির দিকে তাকালো সে। “আমার মনে হচ্ছে না আমি বিমানে করে ফ্লাই করতে পারবো। আমার খুব খারাপ লাগছে।”
“আপনি একদম ঠিক আছেন,” বললো সে। “এটা ঠিক যে, আজ আপনার উপর দিয়ে অনেক ধকল গেছে, আর আপনার শরীরে টক্সিনও রয়েছে।”
“টক্সিন?” ভড়কে গিয়ে এক পা পিছিয়ে গেলো ল্যাংডন। “আপনি এসব কী বলছেন?”
সিনস্কি মুখ সরিয়ে নিলো, বোঝাই যাচ্ছে যা বলতে চেয়েছিলো তারচেয়ে বেশিই বলে ফেলেছে। “প্রফেসর, আমি দুঃখিত। দুভার্গ্যক্রমে আমি একটু আগে জানতে পেরেছি মাথার আঘাতটি ছাড়াও আপনার মেডিকেল কন্ডিশন আরেকটু জটিল।”
ব্যাসিলিকায় ঢলে পড়ার পর ফেরিসের বুকে কালচে দাগের ছবিটা ভেসে উঠলো ল্যাংডনের চোখে, সঙ্গে সঙ্গে তীব্র এক ভীতি জেঁকে বসলো তার মধ্যে।
“আমার কি হয়েছে?” জানতে চাইলো সে।
ইতস্তত করলো সিনস্কি, যেনো কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। “আগে প্লেনে উঠুন, তারপর বলছি।”
.
অধ্যায় ৮১
ফ্রারি চার্চের পুবদিকে অবস্থিত আতেলিয়ার পিয়েত্রো লঙ্গি ভেনিসের ঐতিহাসিক কস্টিউম, উইগ আর অ্যাকসেসরি সরবরাহের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান। তাদের ক্লায়েন্টের তালিকায় রয়েছে বড়বড় ফিল্ম কোম্পানি, থিয়েটার গ্রুপ আর হোমরাচোমরা ব্যক্তিবর্গ, যারা কার্নিভালের সময় এখানকার পোশাক পরে থাকে।
ক্লার্ক মাত্র দরজা বন্ধ করতে যাবে অমনি দেখতে পেলো সোনালি চুলের পনিটেইল করা এক অপরূপ সুন্দরী মেয়ে হন্তদন্ত হয়ে ঢুকে পড়েছে। দম ফুরিয়ে হাফাচ্ছে, যেনো বেশ কয়েক মাইল দৌড়ে চলে এসেছে এখানে। কাউন্টারের সামনে এসে ব্যস্তচোখে তাকাতে লাগলো সে।
“আমি গিওর্গিও ভেঞ্চির সাথে কথা বলতে চাই,” দম ফুরিয়ে বললো মেয়েটি।
আমরা সবাই তার সাথে কথা বলতে চাই, মনে মনে বললো ক্লার্ক।
গিওর্গিও ভেঞ্চি-আতেলিয়ার চিফ ডিজাইনার-পর্দার অন্তরাল থেকেই উনার জাদু দেখান, ক্লায়েন্টদের সাথে খুব কমই কথা বলেন, আর যদি বলেনও সেটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়া নয়। বিশাল ধনী আর প্রভাবশালী একজন ব্যক্তি হিসেবে গিওর্গিও সব সময়ই নীরবে নিভৃতে থাকতে পছন্দ করেন। খাওয়া-দাওয়া, বিমানে চড়া সবই করেন একা একা। ভেনিসে দিন দিন পর্যটকের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে বলে অনুযোগ করেন সব সময়। মানুষের সঙ্গ পছন্দ নয় তার।
“আমি দুঃখিত,” বহুলচর্চিত হাসি দিয়ে বললো ক্লার্ক। “সিনর ভেঞ্চি এখানে নেই। এছাড়া আর কোনো সাহায্য করতে পারি আপনাকে?”
“গিওর্গিও এখানেই আছে,” দৃঢ়ভাবে বললো সে। “উপরতলায় তার ফ্ল্যাট। আমি বাইরে থেকে বাতি জ্বলতে দেখেছি। আমি তার বন্ধু। তার সাথে দেখা করাটা খুব জরুরি।”
মেয়েটার মধ্যে বেশ তাড়া দেখতে পেলো ক্লার্ক। বন্ধু? মেয়েটা তো তাই বলছে, নাকি? আমি কি গিওর্গিওকে আপনার নামটা বলবো?”
মেয়েটি এক টুকরো কাগজ নিয়ে তাতে কিছু অক্ষর আর সংখ্যা লিখলো।
“ওকে এটা দিলেই হবে,” কাগজের টুকরোটা ক্লার্কের হাতে দিয়ে বললো সে। “দয়া করে একটু জলদি করবেন। আমার হাতে সময় নেই।” ক্লার্ক তড়িঘড়ি করে উপরতলায় এসে লম্বা টেবিলের উপর কাগজের টুকরোটা রেখে দিলো, গিওর্গিও উপুড় হয়ে সেলাই মেশিন দিয়ে কাজ করছেন।
“সিনোর,” ফিসফিসিয়ে বললো সে। “একজন আপনার সাথে দেখা করতে এসেছে। মেয়েটি বলছে খুব নাকি জরুরি।”
কাজ থেকে চোখ না সরিয়ে, ক্লার্কের দিকে ফিরে না তাকিয়েই কাগজের টুকরোটা হাতে নিয়ে পড়লেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে তার সেলাই মেশিনটি বন্ধ হয়ে গেলো।
“ওকে এক্ষুণি উপরে পাঠিয়ে দাও,” কাগজের টুকরোটা ছিঁড়তে ছিঁড়তে বললেন গিওর্গিও।
.
অধ্যায় ৮২
বিশাল আকারের সি-১৩০ বিমানটি অ্যাড্রিয়াটিক সাগরের উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে, এটার গন্তব্য দক্ষিণ-পূর্ব দিকে। ভেতরে রবার্ট ল্যাংডনের দম বন্ধ হয়ে আসছে কোনো জানালা নেই বলে, সেইসাথে মাথার ভেতরে ঘুরতে থাকা অসংখ্য প্রশ্নের কারণে।
মাথার আঘাতটি ছাড়াও, সিনস্কি বলেছিলো তাকে, আপনার মেডিকেল কন্ডিশন আরেকটু জটিল।
এ কথা বলার পর মহিলা যখন তার এসআরএস টিমের সাথে জীবাণু উদ্ধারের বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো তখন ল্যাংডনের নাড়িস্পন্দর বেড়ে গেছিলো। কাছেই ব্রুডার ফোনে কোনো সরকারী এজেন্সির সাথে সিয়েনার ব্যাপারে কথা বলছে। তাকে লোকেট করার ব্যাপারে আপ্রাণ। চেষ্টা করে যাচ্ছে সে।
সিয়েনা…
মেয়েটি যে এসবের সাথে জড়িত সেটা মেনে নিতে এখনও তার কষ্ট হচ্ছে। প্লেনটা আকাশে থিতু হলে প্রভোস্ট নামের ছোটোখাটো লোকটি তার সামনে এসে বসলো। গাল চুলকাতে চুলকাতে ঠোঁট কামড়ালো সে। “ডা: সিনস্কি আমাকে বললেন আপনাকে যেনো সব খুলে বলি…মানে পুরো পরিস্থিতিটা।”
ল্যাংডন বুঝতে পারলো না এ লোকটি সব খুলে বলার পর পরিস্থিতিটা তার কাছে আরো বেশি ঘোলাটে বলে মনে হবে কিনা।
“একটু আগেই বলেছি,” প্রভোস্ট বলতে লাগলো, “এসব কিছুর শুরু হয় আমার এজেন্ট ভায়েন্থার একটি ভুল থেকে। সে আগেভাগেই আপনাকে পাকড়াও করে ফেলে। আমরা অবশ্য জানতাম না ডা: সিনস্কির হয়ে আপনি কতোদূর পর্যন্ত এগিয়ে গেছিলেন, কিংবা উনাকে কতোটুকু বলতে পেরেছিলেন। তবে আমরা ভয় পাচ্ছিলাম উনি যদি আমাদের ক্লায়েন্টের প্রজেক্টের লোকেশন সম্পর্কে জেনে যান তো সব নষ্ট করে ফেলবেন। অথচ আমরা তার প্রজেক্টটা রক্ষা করার জন্যই চুক্তিবদ্ধ ছিলাম। সুতরাং তার আগে আমাদেরকে ওটা খুঁডো বের করতে হবে। তাই আপনাকে সিনস্কির বদলে আমাদের হয়ে কাজ করানোর দরকার।” একটু থামলো প্রভোস্ট। কিন্তু দুভাগ্যের বিষয় হলো আমরা আমাদের কার্ডগুলো দেখিয়ে ফেলেছিলাম…আর আপনিও আমাদেরকে বিশ্বাস করবেন না।”
“তাই আপনারা আমার মাথায় গুলি করলেন?” রেগেমেগে বললো ল্যাংডন।
“আমরা একটা পরিকল্পনা করলাম যাতে করে আপনি আমাদেরকে বিশ্বাস করেন।”
ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো প্রফেসর। “কিভাবে একজন মানুষকে বাধ্য করবেন আপনাদেরকে বিশ্বাস করাতে? বিশেষে করে তাকে কিডন্যাপ করে ইন্টেরোগেট করার পর?”
একটু নড়েচড়ে বসলো প্রভোস্ট। “প্রফেসর, আপনি কি বেনজোডায়াজেপিন্স নামের কেমিকেলের কথা শুনেছেন?”
মাথা ঝাঁকালো ল্যাংডন।
“এটা ব্যবহার করা হয় পোস্ট-ট্রমাটিক ট্রেসের চিকিৎসায়। কেউ যখন প্রচণ্ড ভয়ঙ্কর আর বাজে ঘটনা কিংবা দুর্ঘটনার শিকার হয়, যেমন যৌননির্যাতন, তখন তার দীর্ঘমেয়াদী স্মৃতি স্থায়ীভাবে দুর্বল হয়ে যেতে পারে। নিওরো সায়েন্টিস্টরা আজকাল পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেসের রোগীদের উপর এই বেনজোডায়াজেপিন্স ব্যবহার করে। এরফলে রোগীর মনে হয় ঘটনাটা আদৌ ঘটেই নি।”
চুপচাপ শুনে গেলো ল্যাংডন, সে বুঝতে পারছে না এসব কথাবাতার গন্তব্য কোথায়।
“নতুন স্মৃতি যখন তৈরি হয়, প্রভোস্ট বলতে লাগলো আবার, “তখন সেগুলো প্রথমে জমা হয় স্বল্পকালীন স্মৃতি ভাণ্ডারে, আটচল্লিশ ঘণ্টা পর ওগুলো চলে যায় দীর্ঘমেয়াদী স্মৃতি ভাণ্ডারে। বেনজোডায়াজেপিন্স ব্যবহার করে। স্বল্পকালীন স্মৃতি ভাণ্ডারকে পুরোপুরি রিফ্রেশ করা সম্ভব…দীর্ঘমেয়াদী স্মৃতিতে ওগুলো জমা হবার আগেই মুছে ফেলা যায়। কোনো ভিক্টিমকে তার উপর আক্রমণ কিংবা ঘটনা ঘটার পর পর যদি এটা দেয়া হয় তাহলে তার দীর্ঘ মেয়াদী স্মৃতিতে ঐ ঘটনাটা আর সংরক্ষিত থাকবে না। ফলে ঐ বাজে ঘটনার যে মানসিক চাপ সেটাও থাকবে না। এর একটা মাত্রই কুফল আছে, আর সেটা হলো কয়েক দিনের স্মৃতি হারিয়ে ফেলবে সে।”
লোকটার দিকে অবিশ্বাসে চেয়ে রইলো ল্যাংডন। “আপনি আমাকে অ্যামনেসিয়া দিয়েছেন!”
ক্ষমাসুলভভাবে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললো প্রভোস্ট। “বলতে বাধ্য হচ্ছি, হ্যাঁ। কেমিকেলের সাহায্যে। তবে খুব নিরাপদ পদ্ধতি ছিলো ওটা। মানতেই। হচ্ছে এরফলে আপনার স্বল্পমেয়াদী স্মৃতি নষ্ট হয়ে গেছে।” থামলো সে। “আপনাকে যখন মুক্ত করে দেয়া হলো তখন বিড়বিড় করে প্লেগ নিয়ে কী যেনো বলছিলেন, আমরা ধরে নিয়েছিলাম এটা হয়তো ঐ প্রজেক্টরের ছবি দেখার কারণে হচ্ছে। জোবরিস্ট যে প্লেগ তৈরি করেছে সেটা আমাদের কল্পনায়ও ছিলো না।” আবারো থামলো সে। “আপনি বিড়বিড় করে আরো কিছু বলেছিলেন। অনেকটা, ‘ভেরি সরি, ভেরি সরি’ এ জাতীয় কথা।”
ভাসারি। ঐ সময়ে হয়তো সে প্রজেক্টরের ছবি দেখে Cerca trova শব্দটি বের করতে পেরেছিলো। “কিন্তু…আমি তো ভেবেছিলাম আমার অ্যামনেসিয়ার কারণ মাথার আঘাতটি। মানে কেউ আমার মাথায় গুলি করেছিলো।”
মাথা ঝাঁকালো প্রভোস্ট। “আপনাকে কেউ গুলি করে নি, প্রফেসর। আপনার মাথায় কোনো আঘাতও নেই।”
“কি?!” আনমনেই তার হাত চলে গেলো মাথায় সেলাই করা জায়গাটিতে। “তাহলে এখানে সেলাই কেন!”
“এটা ইলিউশনের একটি অংশ। আমরা আপনার মাথায় ছোট্ট একটু জায়গা কেটে আবার সেলাই করে দিয়েছি। যাতে আপনি বিশ্বাস করেন আপনার উপর আক্রমণ করা হয়েছিলো।”
এটা বুলেটের আঘাত না?!
“আমরা চেয়েছিলাম আপনি যখন জ্ঞান ফিরে পাবেন,” প্রভোস্ট বললো, “তখন যেনো আপনি বিশ্বাস করেন আপনাকে খুন করার জন্য কেউ চেষ্টা করছে…আপনি খুব বিপদের মধ্যে আছেন।”
“আমাকে আসলেই খুন করার চেষ্টা করেছে কিছু লোক!” চিৎকার করে বলে উঠলো ল্যাংডন। প্লেনের সবাই তার দিকে তাকালো। “হাসপাতালে আমার চোখের সামনে ডাক্তার মারকোনিকে খুন করা হয়েছে ঠাণ্ডা মাথায়!”
“আপনি এমনটিই দেখেছেন, নির্বিকারভাবে বললো প্রভোস্ট। “কিন্তু আসলে ঘটনা ছিলো অন্যরকম। ভায়েন্থা আমার হয়ে কাজ করেছে। এ ধরণের কাজকর্মে তার অসাধারণ দক্ষতা ছিলো।”
“খুনখারাবি করা?”
“না,” শান্তকণ্ঠে বললো প্রভোস্ট। “খুনখারাবির নাটক করা।”
দীর্ঘক্ষণ ধরে লোকটার দিকে চেয়ে রইলো ল্যাংডন। তার চোখে ভেসে উঠলো, ডাক্তার মারকোনি বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে মেঝেতে পড়ে কাতরাচ্ছেন। তার বুক থেকে গলগল করে বের হচ্ছে তাজা রক্ত।
“ভায়েন্থার পিস্তলে কোনো বুলেট ছিলো না,” বললো প্রভোস্ট। “ওটা দিয়ে আসলে লাল রঙের একধরণের বল বের হতো। যেমনটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে হলিউডের ছবিতে। ডাক্তার মারকোনির বুকে সেই বল লাগার পরই ওটা ফেঁটে লাল রঙ বের হলে আপনি ধরে নিয়েছেন রক্ত বের হচ্ছে। ভালো কথা, উনি আসলে পুরোপুরি ঠিক আছেন।”
চোখ বন্ধ করে ফেললো ল্যাংডন। এসব কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেছে সে। “আর হাসপাতালের রুমটি?”
“দ্রুত বানানো একটি সেট,” প্রভোস্ট বললো। “প্রফেসর, আমি জানি এসব কথা হজম করা আপনার জন্য বেশ কষ্টকর। আমাদেরকে খুব তাড়াহুড়ার মধ্যে কাজ করতে হচ্ছিলো, আর আপনিও একধরণের ঘোরের মধ্যে ছিলেন, তাই খুব নিখুঁতভাবে করার কোনো দরকার ছিলো না। আমরা যা চেয়েছি আপনি জ্ঞান ফিরে তাই দেখেছেন-হাসপাতালের আসবাব, যন্ত্রপাতি, কিছু অভিনেতা অভিনেত্রি আর কোরিওগ্রাফি করা আক্রমণের দৃশ্য।”
ল্যাংডনের মাথা ঘুরতে লাগলো যেনো।
“আমার কোম্পানি এটাই করে থাকে,” বললো প্রভোস্ট। “ইলিউশন তৈরি করতে আমাদের জুড়ি নেই।”
“আর সিয়েনার ব্যাপারটা কি?” চোখ ডলতে ডলতে বললো ল্যাংডন।
“পরিস্থিতির কারণে তার সাথে আমাকে কাজ করতে হয়েছে। আমার কাছে। অগ্রাধিকার ছিলো ক্লায়েন্টের প্রজেক্টটি ডা: সিনস্কির হাত থেকে রক্ষা করা। সিয়েনা আর আমি এক্ষেত্রে একই পথের পথিক ছিলাম। সেও চেয়েছিলো তার প্রেমিকের কাজটা যেনো ভালোমতো এগিয়ে যায়। আপনার বিশ্বাস অর্জন করার জন্য সিয়েনা আপনাকে খুনির হাত থেকে রক্ষা করে, আপনাকে নিয়ে পেছনের গলি দিয়ে পালিয়ে যায়। যে ট্যাক্সিতে আপনারা উঠেছিলেন সেটাও আমাদেরই ছিলো। ট্যাক্সির উইন্ডশিল্ড ভাঙা হয়েছিলো রেডিও-কন্ট্রোল্ড গুলি দিয়ে। ট্যাক্সিটা যে অ্যাপার্টমেন্টে আপনাদের নামিয়ে দেয় সেটাও আমরা দ্রুত ব্যবস্থা। করে রেখেছিলাম।”
সিয়েনার নিম্নমানের অ্যাপার্টমেন্ট, ভাবলো ল্যাংডন। এখন বুঝতে পারছে কেন ওটা দেখে তার মনে হয়েছিলো পুরনো ফার্নিচারের দোকান থেকে কিনে আনা আসবাবে সাজানো হয়েছে। আর সিয়েনার তথাকথিত প্রতিবেশীর পোশাক কাকতালীয়ভাবে তার গায়ে ফিট হয়েছিলো কেন সেটাও বোঝা যাচ্ছে এখন।
সব কিছুই ছিলো সাজানো নাটক।
এমনকি সিয়েনার বান্ধবী যে তাকে ফোন করেছিলো সেটাও ছিলো সাজানো।
সিয়েনা, আমি দানিকোভা বলছি!
“আপনি যখন ইউএস কনসুলেটে ফোন করেছিলেন, প্রভোস্ট বললো, “তখন সেটা রিসিভ করেছিলাম মেন্দাসিয়াম-এ বসে। নাম্বারটা আমরাই সিয়েনাকে দিয়েছিলাম।”
“আমি কনসুলেটে ফোন করি নি…”
“না, করেন নি।”
যেখানে আছেন সেখানেই থাকুন, ভুয়া কনসুলেট কর্মচারী তাকে তাগাদা দিয়ে বলেছিলো। আমি এক্ষুণি আপনার কাছে একজন লোক পাঠাচ্ছি। এরপরই ভয়েন্থাকে রাস্তার ওপারে দেখে ফেলে সিয়েনা, দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে নেয়। সে। রবার্ট, তোমার নিজের দেশের সরকার তোমাকে খুন করতে চাইছে! তুমি কোনো কর্তৃপক্ষকে জড়াতে পারো না! তোমার একমাত্র আশা, প্রজেক্টরের ছবিটির মর্মোদ্ধার করা।
প্রভোস্ট আর তার রহস্যময় সংগঠন-সেটা যা-ই হোক না কেন-ল্যাংডনকে সিনস্কির হয়ে কাজ করানো থেকে বিরত করতে পেরেছিলো। তাদের ইলিউশন বেশ সফল বলা যায়।
সিয়েনা আমার সঙ্গে ভালোই চাতুরি করতে পেরেছে, ভাবলো সে। রাগের চেয়ে দুঃখই বেশি হলো তার। মেয়েটির সাথে অল্প সময় থেকেই অনুরক্ত হয়ে পড়েছিলো। সবচেয়ে হতাশার ব্যাপার হলো সিয়েনার মতো অসম্ভব মেধা আর ভালো মনের একটি মেয়ে কি করে জোবরিস্টের উন্মাদগ্রস্ত চিন্তাভাবনাকে সমর্থন করতে পারলো।
আমি নিশ্চিত, বলেছিলো সিয়েনা তাকে, কঠিন কোনো পদক্ষেপ না নিলে আমাদের মানবজাতি বিলুপ্তি হয়ে যাবে…হিসেবটা একেবারে তর্কাতীত।
“আর সিয়েনার আইকিউ সম্পর্কে যে আর্টিকেলগুলো ছিলো?” জিজ্ঞেস করলো ল্যাংডন।
“ওগুলো সব সত্যি,” জবাব দিলো প্রভোস্ট। “সবচেয়ে সেরা ইলিউশন তখনই সম্ভব যখন এরমধ্যে বাস্তবতা বেশি থাকবে। আমাদের হাতে খুব বেশি সময় ছিলো না সব কিছু সেটআপ করার জন্য, তাই আমরা সিয়েনার কম্পিউটার, সত্যিকারের জীবনের ফাইলগুলো ব্যবহার করেছি। আমরা ধরে নিয়েছিলাম। ওগুলো আপনি খতিয়ে দেখবেন না যদি না খুব বেশি সন্দিহান হয়ে ওঠেন।”
“তার কম্পিউটার ব্যবহার করবো সেটাও নিশ্চয় আশা করেন নি?”
“সত্যি। আর সেজন্যেই আমরা নিয়ন্ত্রণ হারাই। সিয়েনা কখনও ভাবে নি এসআরএস টিম তার অ্যাপার্টমেন্টটি খুঁজে পাবে। তাই সৈনিকেরা তার ওখানে হানা দিলে সে ভড়কে যায়। তখন বাধ্য হয়ে ইপ্রোভাইজ করতে হয় তাকে। আপনাকে নিয়ে ট্রিকি’তে করে পালিয়ে যায় সে। চেষ্টা করে আমাদের তৈরি ইলিউশনটা বাঁচিয়ে রাখতে। পুরো মিশনটি তালগোল পাকিয়ে গেলে বাধ্য হয়ে ভায়েন্থাকে আমি অস্বীকার করি, যদিও সে প্রটোকল ভেঙে আপনার পেছনে লেগে থাকে।”
“ওই মেয়েটা আমাকে প্রায় মেরেই ফেলেছিলো,” বললো ল্যাংডন। তার মনে পড়ে গেলো পালাজ্জো ভেচ্চিও’র অ্যাটিকে ভায়েন্থা তার দিকে অস্ত্র তাক করেছিলো। অল্প সময়ের জন্য একটু যন্ত্রণা হবে…এছাড়া আমার কিছু করার নেই। কিন্তু গুলি করার আগেই সিয়েনা তাকে ধাক্কা মেরে নীচে ফেলে দিলে মেয়েটি মারা যায়।
শব্দ করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো প্রভোস্ট। “আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে ভায়েন্থা আপনাকে সত্যি সত্যি খুন করার চেষ্টা করেছিলো…তার পিস্তলে কোনো বুলেট ছিলো না। আমাদের এখানে তার আগের অবস্থানে ফিরে আসার একমাত্র আশা ছিলো আপনার উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়ার মধ্যেই। সে হয়তো আশা করেছিলো আপনাকে ওভাবে ভুয়া গুলি করে এটা প্রমাণ করতে পারবে যে সে কোনো খুনি নয়।”
একটু থেমে ভেবে নিলো প্রভোস্ট। “সিয়েনা ভায়েন্থাকে খুন করার জন্যই ওটা করেছিলো নাকি তাকে গুলি করতে বাধা দিতে চেয়েছিলো সে ব্যাপারে আমি কোনো অনুমাণ করবো না। আমি বুঝতে শুরু করেছি, সিয়েনাকে আমি চিনতে পারি নি।”
আমিও না, ল্যাংডন একমত পোষণ করলো। যদিও ঐ ঘটনার পর সিয়েনার চোখেমুখে অনুতপ্ত আর অনুশোচনা দেখেছে সে, তাতে করে তার মনে হয়েছে মেয়েটি ইচ্ছে করে স্পাইক চুলের ভায়েন্থাকে হত্যা করে নি।
ল্যাংডনের খুব একাকী মনে হলো নিজেকে…জানালা দিয়ে বহু নীচের পৃথিবী দেখার আশায় তাকালো সে কিন্তু সে কেবল ফিউজলেজের দেয়াল দেখতে পেলো।
আমাকে এখান থেকে বের হতে হবে।
“আপনি কি ঠিক আছেন?” জানতে চাইলো প্রভোস্ট। ল্যাংডনের দিকে চিন্তিতভাবে তাকালো সে।
“না,” জবাব দিলো সে। “মোটেও ঠিক নেই।”
সব ঠিক হয়ে যাবে, ভাবলো প্রভোস্ট। সে তার নতুন বাস্তবতা হজম করার চেষ্টা করছে।
আমেরিকান প্রফেসরকে দেখে মনে হচ্ছে তাকে যেনো টনের্ডো উড়িয়ে নিয়ে গেছে অজানা কোনো দেশে। কী হয়েছে, কিভাবে হয়েছে কিছুই বুঝতে পারছে না।
কনসোর্টিয়ামের টার্গেট হওয়া ব্যক্তি খুব কমই সাজানো নাটকের পেছনে আসল সত্যিটা বুঝতে পারে, তারা যদি বুঝতে পারে তাহলে প্রভোস্ট কখনই ঘটনার পর সেখানে উপস্থিত হয় না। আজ, ল্যাংডনের বিস্ময়-বিমূঢ় অবস্থা দেখে নিজেকে তার অপরাধী বলে মনে হলো। এ মুহূর্তে বর্তমান সঙ্কটের জন্য তার দায়দায়িত্ব অপরিসীম।
আমি ভুল ক্লায়েন্টের সাথে কাজ করেছি। বারট্রান্ড জোবরিস্ট। আমি ভুল মানুষকে বিশ্বাস করেছি। সিয়েনা ব্রুকস।
প্রভোস্ট এখন ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্রের দিকে উড়ে যাচ্ছে-সারাবিশ্বে মহাবিপর্যয় ডেকে আনবে যে প্রাণঘাতি প্লেগ সেটার মূল উৎসের দিকে। এসবের পরে সে বেঁচে থাকতে পারলেও তার কনসোর্টিয়াম কোনোভাবেই টিকে থাকতে পারবে না। এ ব্যাপারে তার মনে বিন্দুমাত্রও সন্দেহ নেই। সীমাহীন অনুসন্ধান আর। অভিযোগ উত্থাপিত হবে। এভাবেই কি আমার সমাপ্তি হবে?
.
অধ্যায় ৮৩
আমার দরকার বাতাস, ভাবলো রবার্ট ল্যাংডন। একটি খোলা জায়গা…খোলামেলা একটি দৃশ্য।
জানালাবিহীন বিমানের ভেতরে বসে থেকে তার মনে হচ্ছে চারপাশটা যেনো তার দিকে চেপে আসছে।
আজ তাকে নিয়ে যে অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটে গেছে সেটা তাকে মোটেও সাহায্য করছে না এরকম পরিস্থিতিতে। যেসব প্রশ্নের জবাব পায় নি সেগুলো তার মাথার ভেতরে দপদপ করছে…এর বেশিরভাগই সিয়েনাকে নিয়ে।
অদ্ভুত ব্যাপার হলো মেয়েটাকে সে মিস করছে।
সে আমার সাথে অভিনয় করছিলো, নিজেকে মনে করিয়ে দিলো। আমাকে ব্যবহার করেছে।
কোনো কথা না বলে প্রভোস্টের সামনে থেকে উঠে প্লেনের সামনে চলে গেলো ল্যাংডন। ককপিটের দরজাটা ভোলাই আছে, ওটার ভেতরে যে প্রাকৃতিক আলো দেখতে পেলো সেটা স্বস্তি দিলো তাকে। পাইলটের অগোচরে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থেকে সূর্যের আলো নিজের মুখে মেখে নিলো সে। তার সামনে বিশাল খোলা জায়গাটি যেনো স্বর্গ থেকে আসা মান্নার মতো। পরিস্কার নীল আকাশটাকে বেশ শান্তির বলে মনে হচ্ছে…একেবারে চিরস্থায়ী শান্তি।
কোনো কিছুই চিরস্থায়ী নয়, নিজেকে স্মরণ করিয়ে দিলো সে, এখনও মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে বিশাল একটি বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে তারা।
“প্রফেসর?” পেছন থেকে শান্ত একটি কণ্ঠ বলে উঠলে ঘুরে তাকালো সে।
চমকে দুয়েক পা পিছিয়ে গেলো ল্যাংডন। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে ডা: ফেরিস। তাকে শেষ দেখেছিলো সেন্ট মার্কস ব্যাসিলিকার মেঝেতে পড়ে আছে। শ্বাস নিতে পারছে না। এখন এই বিমানের ভেতরে বেইসবল ক্যাপ পরে আছে, তার মুখে হালকা গোলাপি ক্রিম মাখানো। তার বুক আর ঘাড়ে শক্ত করে ব্যান্ডেজ লাগানো, তার শ্বাসপ্রশ্বাসও একদম আস্তে আস্তে হচ্ছে। ফেরিসের যদি প্লেগ হয়ে থাকে তাহলে মনে হচ্ছে এটা ছড়িয়ে পড়া নিয়ে কেউ চিন্তিত নয়।
“আপনি…বেঁচে আছেন?” লোকটার দিকে চেয়ে বললো ল্যাংডন।
ক্লান্তভাবে মাথা নেড়ে সায় দিলো ফেরিস। “কোনোভাবে আছি আর কি।” তার আচার-আচরণ একেবারে পাল্টে গেছে। এখন অনেক বেশি রিল্যাক্স বলে মনে হচ্ছে তাকে।
“কিন্তু আমি ভেবেছিলাম-” আর বলতে পারলো না সে, থেমে গেলো। “আসলে…বুঝতে পারছি না কী বলবো।”
সহমর্মিতার হাসি দিলো ফেরিস। “আপনি আজ অনেক মিথ্যে কথা শুনেছেন। ভাবলাম আপনার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেবো এজন্যে। যেমনটি আন্দাজ। করেছেন, আমি বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার হয়ে কাজ করি না, আর আমি আপনাকে রিকুট। করার জন্য কেমব্রিজেও যাই নি।”
সায় দিলো ল্যাংডন, এসব কথা শুনে আর অবাক হচ্ছে না। আপনি প্রভোস্টের হয়ে কাজ করেন।”
“হ্যাঁ। উনি আমাকে পাঠিয়েছিলেন সিয়েনা এবং আপনাকে জরুরি ভিত্তিতে সাহায্য করার জন্য…মানে এসআরএস টিমের হাত থেকে আপনাকে পালাতে সহযোগীতা করার জন্য।”
“তাহলে বলতেই হচ্ছে আপনি আপনার কাজ ভালোমতোই করতে পেরেছেন,” বললো ল্যাংডন। “তাহলে এটাও ঠিক, আপনি কোনো ডাক্তার নন।”
মাথা ঝাঁকালো ভদ্রলোক। “না, তবে আজকে আমি সেই অভিনয়টাই করেছি। আমার কাজ ছিলো সিয়েনাকে সাহায্য করে যাওয়া যাতে করে সে ইলিউশনটা ঠিকমতো বজায় রাখতে পারে, আর আপনিও প্রজেক্টরের মর্মোদ্ধার। করতে সক্ষম হন। প্রভোস্টের উদ্দেশ্য ছিলো ডা: সিনস্কির কাছ থেকে জোবরিস্টের সৃষ্টিকর্মটি রক্ষা করা।”
“আপনাদের কোনো ধারণাই ছিলো না ওটা আসলে প্লেগ?” ল্যাংডন এখনও ফেরিসের লালচে গোটা আর ইন্টারনাল ব্লিডিং নিয়ে কৌতূহলী।
“অবশ্যই না! আপনি যখন প্লেগের কথা বললেন তখন আমি ধরে নিয়েছিলাম ওটা আপনাকে বলা সিয়েনার একটি গল্প। মানে আপনাকে মোটিভেট করার জন্য সে এটা বলেছে। তাই আমিও সেটার সাথে তাল মিলিয়ে গেছি। আমরা সবাই ট্রেনে করে ভেনিসে যাওয়ার সময়ই সব বদলে যায়।”
“কিভাবে?”
“প্রভোস্ট জোবরিস্টের উদ্ভট ভিডিওটি দেখে ফেলেছিলেন।”
এটা হতে পারে। “উনি তখন বুঝতে পারেন জোবরিস্ট একজন বদ্ধ। ৮ উন্মাদ।”
“ঠিক। সঙ্গে সঙ্গে প্রভোস্ট বুঝে যান কনসোর্টিয়াম কতো বড় ভুল কাজের সাথে জড়িয়ে পড়েছে। তিনি খুব আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। জোবরিস্টকে ভালোমতো চেনে এরকম একজন, মানে এফএস-২০৮০-এর সঙ্গে তিনি কথা। বলতে চান তখন-জোবরিস্ট আসলে কি করেছে সেটা তার কাছ থেকে জানার। জন্য।”
“এফএস-২০৮০?”
“মানে সিয়েনা ব্রুকস। এই কোডনেমটাই সে অপারেশনের জন্য ব্যবহার করেছে। এটা আসলে ট্রান্সহিউম্যানিস্টদের একটি স্টাইল। ওদের অনেকেই এরকম কোডনেম ব্যবহার করে। আর আমি ছাড়া সিয়েনার সাথে প্রভোস্টের যোগাযোগ করা সম্ভব ছিলো না।”
“ট্রেনে ফোনকলটির কথা বলছেন?” বললো ল্যাংডন। “আপনার অসুস্থ মা।”
“বুঝতেই পারছেন, আমি আপনার সামনে প্রভোস্টের কল রিসিভ করতে পারতাম না। তাই আমি কেবিন থেকে বের হয়ে যাই। উনি আমাকে ভিডিওটার ব্যাপারে বলেন তখন আমিও ভড়কে যাই। উনার ধারণা ছিলো সিয়েনাকে বোকা বানানো হয়েছে, এসবের কিছু জানে না। কিন্তু আমি যখন উনাকে বললাম আপনি আর সিয়েনা প্লেগ নিয়ে কথা বলছেন এবং এই মিশনে ক্ষান্ত দেবার কোনো উদ্দেশ্য তার নেই তখন তিনি বুঝতে পারলেন সিয়েনা আর জোবরিস্ট একসাথেই কাজ করেছে। সঙ্গে সঙ্গে সিয়েনা হয়ে ওঠে আমাদের শত্রু। তখন আমাকে বললেন আমরা যেনো ভেনিসে একসাথেই থাকি…তিনি একটি টিম পাঠাচ্ছেন সিয়েনাকে গ্রেফতার করার জন্য। এজেন্ট ব্রুডারের টিম সেন্ট ব্যাসিলিকায় তাকে প্রায় ধরেই ফেলেছিলো কিন্তু মেয়েটি পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।”
প্লেনের মেঝের দিকে চেয়ে রইলো ল্যাংডন। এখনও তার চোখে ভাসছে পালিয়ে যাবার আগে সিয়েনার বাদামী চোখ দুটো।
আমি দুঃখিত, রবার্ট। সবকিছুর জন্য।
“মেয়েটা খুবই জাঁদরেল,” বললো ফেরিস। “আপনি সম্ভবত দেখেন নি ব্যাসিলিকায় সে আমাকে আক্রমণ করেছিলো।”
“আপনাকে আক্রমণ করেছিলো?”
“হ্যাঁ। যখন সৈনিকেরা ওখানে ঢুকে পড়লো তখন আমি চিৎকার করে তাদেরকে জানাতে গেছিলাম সিয়েনার অবস্থান, কিন্তু সে আগেভাগেই টের পেয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে সে আমার বুকে আঘাত করে বসে হাত দিয়ে।”
“কি?!”
“আমি বুঝতেই পারি নি আমাকে কি দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। ওটা এক ধরণের মাশাল-আর্টের টেকনিক হবে। দম ফিরে পেতে কয়েক মিনিট লেগে গেছিলো আমার। কি ঘটেছে সেটা কেউ দেখে ফেলার আগেই সিয়েনা আপনাকে নিয়ে বেলকনি থেকে সটকে পড়ে।”
হতভম্ব হয়ে গেলো ল্যাংডন। তার মনে পড়ে গেলো বয়স্ক এক ইটালিয়ান মহিলা সিয়েনার উদ্দেশ্যে চিৎকার কলে বলছিলো-”লাই কলপিতো আল পেতো!”-তারপর নিজের বুকের উপর জোরে জোরে ঘুষি দিয়ে কী যেনো বোঝাতে চাইছিলো তাকে। আমি পারবো না! জবাবে বলেছিলো সিয়েনা। সিপিআর দিলে সে মরে যাবে! তার বুকটা দেখুন!
ঐ ঘটনাটা মনে করতেই ল্যাংডন বুঝতে পারলো সিয়েনা কতো তাড়াতাড়ি চাতুর্যের সাথে ইটালিয়ান বৃদ্ধমহিলার কথাগুলো ভুলভাবে অনুবাদ করেছিলো তার কাছে। লাই কলপিতে আল পেত্তো মানে বুকে চাপ দিয়ে হৃদপিণ্ড সচল করার কথা ছিলো না…ওটা ছিলো ক্ষুব্ধ অভিযোগ : তুমি তার বুকে ঘুষি মেরেছো!
ঐ সময়ে তুমুল হট্টগোলের মধ্যে ল্যাংডন এটা খেয়ালই করে নি।
তিক্ত হাসি দিলো ফেরিস। “আপনি হয়তো শুনেছেন, সিয়েনা ব্রুকস দারুণ বৃদ্ধিমতি এক মেয়ে।”
সায় দিলো ল্যাংডন। জানি।
সিনস্কির লোকজন আমাকে মেন্দাসিয়াম-এ নিয়ে এসে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে। প্রভোস্ট আমাকে তাদের সঙ্গে আসতে বলে ইন্টেল সাপোর্ট পাবার জন্য, কারণ আপনি ছাড়া আমিই একমাত্র ব্যক্তি যে সিয়েনার সাথে আজ ছিলাম।”
আবারো সায় দিলো ল্যাংডন। লোকটার লালচে গোটা দেখে বললো, “আপনার মুখে…আর বুকে যে দাগগুলো আছে…ওগুলো …”
“প্লেগ কিনা?” হাসতে হাসতে মাথা ঝাঁকালো ফেরিস। “আমি জানি না আপনাকে কথাটা বলা হয়েছে কিনা, আসলে আজকে আমি দু দু’জন ডাক্তারের ভূমিকায় অভিনয় করেছি।”
“কী বললেন?”
“আপনি যখন আমাকে ব্যাপ্টিস্ট্রিতে প্রথম দেখলেন তখন বলেছিলেন আমাকে কেমনজানি চেনা চেনা লাগছে।”
“হ্যাঁ। আসলেই তাই লাগছিলো। মানে আপনার চোখ দুটো দেখে মনে হয়েছিলো আমার। আপনি বলেছিলেন কেমব্রিজে গিয়ে আপনি নাকি আমাকে রিক্রুট করেছিলেন…” একটু থামলো ল্যাংডন। “এখন অবশ্য বুঝতে পারছি ওটা সত্যি ছিলো না…”।
“আমাকে দেখে আপনার চেনা চেনা লাগছিলো কারণ এর আগেই আমার সাথে আপনার দেখা হয়েছিলো, তবে সেটা কেমব্রিজে নয়।” একটু থামলো সে, ল্যাংডন ব্যাপারটা ধরতে পেরেছে কিনা দেখার জন্য। “আসলে আজ সকালে আপনি যখন হাসপাতালে জ্ঞান ফিরে পেলেন তখন আমাকেই প্রথম দেখেছিলেন।”
হাসপাতালের ছোট্ট ঘরটা তার চোখে ভেসে উঠলো। জ্ঞান ফিরে পাবার পর তার মাথাটা ঝিমঝিম করছিলো, চোখেও কেমন ঝাপসা দেখছিলো, তবে তার স্পষ্ট মনে আছে একজন বৃদ্ধ, দাড়িওয়ালা আর মোটা ভুরুর ইটালিয়ান ডাক্তারকে সে দেখেছিলো চোখের সামনে।
“না,” জোর দিয়ে বললো ল্যাংডন। “আমি প্রথমে দেখি ডাক্তার মারকোনিকে–”
“স্কুজি, প্রফেসর, লোকটি নিখুঁত ইতালিতে বলে উঠলো। “মা নন সি রিকোদা দি মি?” বৃদ্ধদের মতো একটু কুঁজো হয়ে দেখালো সে। কল্পিত দাড়িতে হাত বোলালো। “সোনো ইল দোত্তোর মারকোনি।”
ল্যাংডনের মুখ হা হয়ে গেলো। “ডাক্তার মারকোনি…আপনিই ছিলেন?”
“এজন্যেই আমার চোখ দেখে আপনার মনে হয়েছিলো চেনা চেনা। এর আগে কখনও নকল দাড়ি আর ভুরু লাগাই নি তাই কোনো ধারণাই ছিলো না। ওগুলোতে কেমন অ্যালার্জি হতে পারে। ফলাফল তো দেখতেই পাচ্ছেন। আমি নিশ্চিত, আমাকে প্রথম যখন দেখলেন বেশ ঘাবড়ে গেছিলেন…হয়তো প্লেগের কথা ভেবেই ভড়কে গিয়ে থাকবেন।”
লোকটার দিকে চেয়ে রইলো ল্যাংডন। বোঝার চেষ্টা করলো আসলেই সে ডাক্তার মারকোনি ছিলো কিনা।
“পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়,” বুকের ব্যান্ডেজের দিকে ইশারা করলো এবার, “ভায়েন্থার রঙের-গুলিটা যখন ছোঁড়া হয় তখন আমি ঠিকমতো পজিশন। নিতে পারি নি, ফলে বেকায়দা লেগে গেলে আমার পাঁজরের একটি হাঁড় ভেঙে যায়। সে কারণে সারাটা দিন আমার শ্বাসকষ্ট হচ্ছিলো।”
আর আমি কিনা ভেবেছি আপনার প্লেগ হয়েছে।
লোকটা গভীর করে শ্বাস নিলে ভুরু কুচকে ফেললো। “সত্যি বলতে কি, আমার মনে হচ্ছে আমাকে এখন বসতে হবে আবার।”
চলে যাবার সময় ল্যাংডনের পেছনে ইঙ্গিত করে সে বললো, “মনে হচ্ছে আরেকজন আপনার সাথে এখন কথা বলবে।”
ল্যাংডন ঘুরে দেখতে পেলো ডা: সিনস্কি কেবিন থেকে তার দিকে এগিয়ে। আসছে। তার লম্বা সাদা-চুল দুলছে। “এই যে প্রফেসর, আপনি এখানে!”
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার ডিরেক্টরকে বেশ ক্লান্ত মনে হলেও অদ্ভুত রকমের আশান্বিত বলেও মনে হচ্ছে। সে কিছু খুঁজে পেয়েছে।
“সরি, আপনাকে একা রেখে চলে যেতে হয়েছিলো,” ল্যাংডনের পাশে এসে বললো সে। “আমরা কো-অর্ডিনেটিং আর কিছু রিসার্চ করেছি।” ককপিটের খোলা দরজার দিকে ইশারা করলো। মনে হচ্ছে সূর্যের আলো গায়ে মাখছেন?”
কাঁধ তুললো ল্যাংডন। “আপনার প্লেনের জানালা থাকা দরকার।”
মুচকি হাসলো সে। “আশা করি প্রভোেস্ট আপনাকে পুরো ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত জানিয়েছে?”
“হ্যাঁ, যদিও এসব শুনে আমার মোটেও ভালো লাগে নি।”
“আমারও ভালো লাগে নি,” আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো কেউ তাদের কথা শুনছে কি না। আমার কথা শুনে রাখুন,” ফিসফিসিয়ে বললো এবার, “তার এবং তার সংগঠনের খবর আছে। আমি এটা এমনি এমনি ছেড়ে দেবো না। এ মুহূর্তে আমাদের একটাই কাজ, প্লেগের ঐ কন্টেইনারটা পানিতে মিশে যাবার আগে খুঁজে বের করা।”
অথবা সিয়েনা ওখানে গিয়ে পানিতে মেশানোর কাজটা করার আগেই যেতে হবে।
“দান্দোলোর সমাধিটি যেখানে অবস্থিত সেই ভবন সম্পর্কে আপনার সাথে আমার কিছু কথা বলা দরকার।
অসাধারণ স্থাপত্যের ভবনটির ছবি ভেসে উঠলো ল্যাংডনের চোখে, কখনও ভাবে নি এরকম একটি ঘটনার জন্য তাকে ওখানে যেতে হবে। পবিত্র জ্ঞানের মওজিওন।
“আমি একটু আগে খুবই চাঞ্চল্যকর কিছু তথ্য জানতে পেরেছি,” বললো সিনস্কি। “ওখানকার এক ইতিহাসবিদের সাথে ফোনে কথা বলছিলাম। উনি অবশ্য জানেন না আমরা দান্দোলোর সমাধির ব্যাপারে কেন এতো খোঁজখবর নিচ্ছি। তাকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম ঐ সমাধির নীচে কি আছে। আন্দাজ করতে পারেন সে কি জবাব দিয়েছে,” মুচকি হাসলো সে। “পানি।”
অবাক হলো ল্যাংডন। “তাই নাকি?”
“হ্যাঁ। ভবনটির নীচের স্তর নাকি পানিতে পরিপূর্ণ। কয়েক শ’ বছর ধরে ভবনটির নীচে পানির স্তর বেড়ে গিয়ে অন্ততপক্ষে দুটো স্তর ডুবিয়ে দিয়েছে। তিনি বলেছেন ওখানে অবশ্যই কিছুটা ফাঁপা জায়গা আর বাতাসের পকেট রয়েছে।”
হায় ঈশ্বর। জোবরিস্টের ভিডিওটার কথা মনে পড়ে গেলো ল্যাংডনের, অদ্ভুত একটি ভূগর্ভস্থ গুহা, স্যাঁতস্যাঁতে দেয়াল আর আধিভৌতিক আলো। দেয়ালে পিলারের ছায়া। “ওটা পানিতে ডুবে যাওয়া একটি ঘর।”
“ঠিক ধরেছেন।”
“কিন্তু জোবরিস্ট ওখানে কিভাবে যেতে পারলো?”
সিনস্কির চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠলো এবার। “এটা খুবই বিস্ময়কর একটি ঘটনা। আমরা একটু আগে কি জানতে পেরেছি সেটা আপনি বিশ্বাসও করতে পারবেন না।”
.
ঠিক এই মুহূর্তে ভেনিসের উপকূল থেকে এক মাইলেওর কম দূরে লিডো নামের একটি দ্বীপে সেসনা সিটেশন বিমানটি নিসেলি এয়ারপোর্টের টারমার্ক ছেড়ে গোধূলীর আকাশে উড়ে গেলো।
এই জেটটির মালিক খ্যাতনামা ডিজাইনার গিওর্গিও ভেঞ্চি বিমানে নেই তবে তিনি তার পাইলটদেরকে অর্ডার দিয়েছেন বিমানের একমাত্র যাত্রি সুন্দরী আকর্ষণীয় তরুণী যেখানে যেতে চাইবে সেখানেই যেনো নিয়ে যাওয়া হয় তাকে।
.
অধ্যায় ৮৪
প্রাচীন বাইজান্টাইন রাজধানীর উপর রাত নেমে এসেছে।
মারমারা সমুদ্রের তীর জুড়ে ফ্লাডলাইগুলো জ্বলে উঠতেই স্কাইলাইনের চকচকে মসজিদ আর মিনারগুলো আলোকিত হয়ে উঠেছে এক এক করে। এখন আকসাম-এর সময়, শহর জুড়ে থাকা মসজিদ থেকে ভেসে আসছে প্রার্থনার। আহবান জানানো আযানের ধ্বনি।
আল্লাহু আকবার হবে।
আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ।
[মূল বইয়ে ড্যান ব্রাউন ভুলবশত আজানের প্রথম লাইন হিসেবে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ দিয়েছিলেন, ব্যাপারটি মারাত্মক ভুল বলে সংশোধন দেয়া হলো-অনুবাদক মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন।]
ধর্মবিশ্বাসীরা মসজিদে ছুটে গেলেও শহরের বাকি সবাই সেদিকে ভ্রূক্ষেপ করছে না। হৈহল্লা করতে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বিয়ার খেয়ে মাতাল, ব্যবসায়ীরা নিজেদের প্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে শুরু করে দিয়েছে, মসলা আর কার্পেটের হকাররা এখনও বিক্রিতে ব্যস্ত। পর্যটকের দল সব কিছুই বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে দেখে যাচ্ছে।
এটি বিভক্ত একটি দুনিয়া, বৈপরীত্বের একটি শহর-ধার্মিক, সেকুলার, প্রাচীন, আধুনিক, পূর্ব আর পশ্চিম। এমনকি ভৌগলিকভাবেও ইরোপ-এশিয়ার মাঝখানে জুড়ে রয়েছে এর সীমানা। এই চিরসবুজ শহরটি আক্ষরিক অর্থেই প্রাচীনকাল আর মধ্যযুগের সাথে সেতুবন্ধ গড়ে তুলেছে।
ইস্তাম্বুল।
বর্তমানে এটি তুরস্কের রাজধানী না হলেও শত শত বছর ধরে তিন তিনটি। সাম্রাজ্যের প্রাণন্দ্রে হিসেবে ছিলো এই শহরটি-বাইজান্টাইন, রোমান আর অটোমান। একারণে ইস্তাম্বুল ঐতিহাসিকভাবে এ পৃথিবীর সবচাইতে বৈচিত্রপূর্ণ। একটি শহর। টপকাপি প্রাসাদ থেকে নীল মসজিদ আর সাত মিনারের দূর্গের এই শহরটি যুদ্ধবিগ্রহ, বিজয় আর পরাজয়ের রূপকথায় সমৃদ্ধ।
আজ রাতে ব্যস্ত আর ঘনবসতি শহরের আকাশে একটি সি-১৩০ বিমান প্রবেশ করে কামাল আতাতুর্ক বিমানবন্দরে অবতরণ করার জন্য ছুটে চললো। প্লেনের ককপিটে রবার্ট ল্যাংডন পাইলটের পেছনে একটি সিটে বসে সিটবেল্ট বেধে নিয়েছে। উইন্ডশিল্ড দিয়ে তাকিয়ে দেখলো সে। জানালার পাশে বসতে পেরে যারপরনাই স্বস্তি পাচ্ছে।
এখন বেশ ফুরফুরে লাগছে তার। একটু আগে খাবার খেয়ে প্লেনের পেছনের সিটে টানা একঘণ্টা ঘুমিয়ে নিয়েছে। এটা খুব দরকার ছিলো তার।
উপর থেকে কালচে রঙে মারমারা সাগরের উপর শিয়ংয়ের আকৃতির দ্বীপতুল্য আর জ্বলজ্বলে আলোর ইস্তাম্বুল দেখতে পেলো ল্যাংডন। এটা ইউরোপিয় অংশ, অন্ধকারাচ্ছন্ন আঁকাবাঁকা একটি রিবন দিয়ে এশিয়ান অংশ থেকে বিভক্ত।
বসফরাস প্রণালী।
এক ঝলক দেখলে মনে হবে বসফরাস প্রণালীটি কাটা দাগের মতো ইস্তাম্বুলের বুক চিরে শহরটাকে দু’ভাগে ভাগ করে ফেলেছে। যদিও ল্যাংডন জানে এই প্রণালীটি ইস্তাম্বুলের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র। বসফরাস প্রণালী দিয়ে জাহাজ ও নৌযান খুব সহজেই ভূ-মধ্যসাগর থেকে কৃষ্ণসাগরে চলে যেতে পারে। প্রণালীটি কাজ করে দুই বিশ্বের মধ্যেকার সংযোগ হিসেবে।
কুয়াশা ভেদ করে বিমানটি অবতরণ করতে থাকলে ল্যাংডন নীচের দিকে চেয়ে দেখলো যে জায়গার খোঁজে তারা এখানে এসেছে সেটা দেখা যায় কিনা।
এনরিকো দান্দোলোর সমাধিক্ষেত্র।
তারা এখন জেনে গেছে বিশ্বাসঘাতক ডজ এনরিকো দান্দোলোকে ভেনিসে সমাহিত করা হয় নি, তাকে সমাহিত করা হয়েছিলো ১২০২ সালে যে ভূ-খণ্ডটি জয় করেছিলেন সেখানকার মাটিতে। উপযুক্তভাবেই তার করায়ত্ত করা শহরের সবচেয়ে চোখ ধাঁধানো ধর্মীয়স্থানেই তাকে চিরশায়িত করা হয়েছে-ভবনটি আজো আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় এটি এ অঞ্চলের মাথার মুকুট।
হাজিয়া সোফিয়া।
৩৬০ খৃস্টাব্দে এটি প্রথম নির্মাণ করা হয় ইস্টার্ন অথোডক্স ক্যাথেড্রাল হিসেবে, ১২০৪ সালে চতুর্থ ক্রুসেডের সময় এনরিকো দান্দোলো শহরটি জয় করে নিলে এটিকে ক্যাথলিক চার্চে রূপান্তর করা হয়। পনেরো শতকের শেষের দিকে ফাতিহ সুলতান মেহমেদ তৎকালীন কন্সট্যান্টিনোপল জয় করে নিলে এটিকে তিনি মসজিদে রূপান্তর করেন। ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত এটি মুসলমানদের প্রার্থনাস্থল হিসেবেই টিকে ছিলো, তারপর এটিকে সেকুলারাইজ করে জাদুঘরে পরিণত করা হয়।
পবিত্র জ্ঞানের স্বণালী মওজিওন, ভাবলো ল্যাংডন।
কেবল যে সেন্ট মার্কসের চেয়ে বেশি স্বর্ণের টাইলস আছে বলেই হাজিয়া সোফিয়াকে এ নামে ডাকা হয় তা নয়, বরং আক্ষরিক অর্থেই হাজিয়া সোফিয়া। মানে ‘পবিত্র জ্ঞান।
বিশালাকারের ভবনটি ল্যাংডনের চোখের সামনে ভেসে উঠলো, এর নীচে অন্ধকার জলাধারে ভাসছে একটি জীবাণু ভর্তি ব্যাগ, আস্তে আস্তে সেটা পানির সাথে মিশে যাবার জন্য অপেক্ষা করছে। আর তারপরই ওটার ভেতরে যে মারাত্মক জিনিস আছে সেগুলো ছড়িয়ে পড়বে দ্রুত।
মনে মনে প্রার্থনা করলো সে, তাদের যেনো খুব বেশি দেরি না হয়ে যায়।
“ভবনটির নীচের স্তর পুরোপুরি পানিতে নিমজ্জিত,” একটু আগে সিনস্কি বলেছিলো তাকে। তারপর তার সাথে প্লেনের ভেতরে একটি কেবিনে আসতে বলে। “আপনি বিশ্বাসই করতে পারবেন না, একটু আগে আমরা কি আবিষ্কার করেছি। আপনি গকসেল গুলেনসয় নামের এক লোকের ডকুমেন্টারি ফিল্মের কথা শুনেছেন?”
মাথা ঝাঁকায় ল্যাংডন।
“হাজিয়া সোফিয়ার উপর রিসার্চ করার সময়,” সিনস্কি বলে, “আমি জানতে পারি এর উপরে একটি ডকুমেন্টারি তৈরি করা হয়েছিলো। এটা কয়েক বছর আগের ঘটনা।”
“হাজিয়া সোফিয়া নিয়ে কয়েক ডজন ফিল্ম বানানো হয়েছে।”
“হ্যাঁ, কিন্তু কোনোটাই এটার মতো নয়। কেবিনে এসে পড়ে তারা। সিনস্কি নিজের ল্যাপটপটি ঘুরিয়ে দেয় তার দিকে যাতে সে দেখতে পারে। “পড়ুন।”
চেয়ারে বসে আর্টিকেলটার উপর চোখ বোলায় ল্যাংডন-হুঁরিয়েট ডেইলি নিউজ নামের একটি পত্রিকায় ছাপানো প্রবন্ধ-গুলেনসয়ের নতুন ফিল্ম নিয়ে আলোচনা : হাজিয়া সোফিয়ার গভীরে।
লেখাটা পড়তে গিয়েই ল্যাংডন বুঝে ফেলে সিনিস্কি কেন এতো উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। লেখাটার প্রথম দুটো শব্দই ল্যাংডনকে অবাক করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট ছিলো। সে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার পরিচালকের দিকে তাকায়। স্কুবা ডাইভিং?
“আমি জানি,” বলেছিলো সিনস্কি। “পুরোটা পড়ুন।”
আর্টিকেলের দিকে আবার চোখ রাখে সে।
হাজিয়া সোফিয়ার নীচে স্কুবা ডাইভিং : ডকুমেন্টারি ফিল্মমেকার গকসেল গুলেনসয় আর তার স্কুবা টিম ইস্তাম্বুলের সবচেয়ে বিখ্যাত ধর্মীয় স্থাপত্যের একশ’ ফুট নীচে জলমগ্ন একটি স্তরের সন্ধান পেয়েছে।
এই অভিযানে তারা অসংখ্য স্থাপত্য বিস্ময়ও আবিষ্কার করেছে, যার মধ্যে। রয়েছে ৮০০ বছরের পুরনো শহীদ শিশুদের জলমগ্ন কবরস্থান এবং ডুবন্ত কিছু টানেল, যার সাথে হাজিয়া সোফিয়ার সাথে টপকাপি প্রাসাদ, টেকফুর প্রাসাদের সংযোগ রয়েছে। গুজব আছে, এনেমাস ডানগিওন-এর একটি ভূ-গর্ভস্থ বাড়তি অংশও আছে এরমধ্যে।
“আমি বিশ্বাস করি হাজিয়া সোফিয়ার নীচে যা আছে সেটা উপরের চেয়ে কোনো অংশে কম উত্তেজনাকর নয়,” গুলেনসয় বলেছেন, বহু আগে এক অভিযাত্রিদলের তোলা ছবি দেখে কিভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে হাজিয়া সোফিয়ার নীচে জলমগ্ন স্তর এবং আংশিকভাবে পানিতে ডুবে থাকা একটি বিশাল হলের। সন্ধান পেয়েছেন সেটা বিবৃত করেছেন তিনি।
“আপনি একেবারে সঠিক ভবনটিই খুঁজে বের করেছেন!” সিনস্কি উচ্ছ্বাসে বলেছিলো। “সব পড়ে মনে হচ্ছে ঐ ভবনের নীচে অসংখ্য পকেট রয়েছে, আর তার মধ্যে অনেকগুলোর ভেতরেই প্রবেশ করা যায় কোনো রকম স্কুবা গিয়ার ছাড়া…জোবরিস্টের ভিডিওতে আমরা যা দেখেছি সেটার ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে এখন।”
তাদের পেছনেই দাঁড়িয়ে ছিলো এজেন্ট ব্রুডার, সে মনোযোগ দিয়ে ল্যাপটপের পদার দিকে চেয়েছিলো। “আমার মনে হচ্ছে ঐ ভবনের নীচে যে পানির ধারা রয়েছে সেটা আশেপাশের এলাকায় মাকড়ের জালের মতো চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। আমরা পৌঁছানোর আগে ব্যাগটা যদি পানিতে মিশে যায় তাহলে কনটেন্টগুলো ছড়িয়ে পড়া থামানো যাবে না।”
“কনটেন্টগুলো…” ল্যাংডন কথার মাঝখানে ঢুকে পড়েছিলো। “আপনাদের কি কোনো ধারণা আছে ওটা আসলে কি? মানে জিসিটা আসলে কি? আমি জানি আমরা জীবাণু উৎপাদন করতে পারে এরকম প্যাথোজেন নিয়ে কথা বলছি, কি-”
“আমরা ফুটেজটি বিশ্লেষণ করে দেখেছি,” বলে ব্রুডার। “তাতে মনে হয়েছে ওটা অবশ্যই বায়োলজিক্যাল, কেমিকেল জাতীয় কিছু না…তার মানে জীবন্ত কিছু আর কি। ব্যাগের ভেতরে অল্প পরিমাণ জিনিস দেখে ধারণা করতে পারি ওগুলো খুবই উচ্চমাত্রার সংক্রামক জীবাণু এবং প্রতিরূপ তৈরি করার ক্ষমতা সম্পন্ন। এটা পানিবাহিত ব্যাকটেরিয়ার মতো হতে পারে কিংবা বাতাসবাহিত ভাইরাসের মতো, একবার ছড়িয়ে পড়লে থামানো মুশকিল।”
সিনস্কি বলে, “ঐ এলাকার ওয়াটার-টেবিল তাপমাত্রার ডাটা জোগার করছি এখন আমরা, চেষ্টা করছি ঐরকম ভূ-গর্ভস্থ জায়গায় কি ধরণের সংক্রামক জীবাণু ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেতে পারে সেটার হিসেব বের করতে। কিন্তু মনে রাখতে হবে জোবরিস্ট অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী ছিলো, খুব সহজেই সে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করে একেবারে নতুন ধরণের কিছু তৈরি করতে পারে। যার সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণাই নেই। আমার সন্দেহ, এ কারণেই জোবরিস্ট ওরকম একটি জায়গা বেছে নিয়েছে।”
ব্রুডার এমনভাবে মাথা ঝাঁকায় যেনো এটার সাথে একমত নয় সে। দ্রুত একটি ভিন্নধর্মী মেকানিজমের কথা তুলে ধরলো সে। পানির নীচে থাকা প্লাস্টিকের ব্যাগটি সম্পর্কে তারা বুঝতে শুরু করেছে মাত্র। ভূ-গর্ভস্থ পানির নীচে একটি ভেসে থাকা ব্যাগের সাহায্যে জোবরিস্ট তৈরি করেছে একেবারেই অনন্যসাধারণ একটি পরিবেশ, যেখানে নির্বিমে জীবাণুগুলো বৃদ্ধি পেতে পারে : পানির তাপমাত্রা, সূর্যের বিকিরণ, কাইনেটিক বাফারবিহীন এবং পুরোপুরি দৃষ্টির আড়ালে। সঠিক সময়সীমার ব্যাগ বেছে নেয়ার মাধ্যমে জোবরিস্ট ঐ জীবাণুর আধারটি কোনোরকম তদারকি ছাড়াই নির্ধারিত সময়ের রিলিজ দেবার আগে পরিপক্ক করার ব্যবস্থা করে গেছে।
এমন কি জোবরিস্ট ওখানে আর ফিরে না গেলেও কোনো সমস্যা হবার কথা নয়।
ঠিক তখনই প্লেনটা ঝাঁকি দিয়ে উঠলে বাস্তবে ফিরে এলো ল্যাংডন। ককপিটের একটি সিটে বসে থেকে দেখতে পেলো পাইলট ব্রেক করে হ্যাঁঙ্গারের কাছে ভেড়াতে চাইছে বিমানটি।
মনে মনে ল্যাংডন আশা করলো বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার কিছু কর্মচারী হয়তো হ্যাঁজম্যাট সুট পরে তাদেরকে অভ্যর্থনা জানাবে।
অদ্ভুত ব্যাপার হলো একজন ড্রাইভার ছাড়া সেখানে আর কেউ নেই। বিশাল বড় সাদা রঙের একটি ভ্যান নিয়ে সে অপেক্ষা করছে তাদের জন্য। সেই ভ্যানের গায়ে লাল রঙে একটি সমবাহু ক্রস।
এখানে রেডক্রস কেন এসেছে? আবারো ভালো করে তাকালো ল্যাংডন, বুঝতে পারলো আরো একটি সংস্থা এরকম লাল ক্রস ব্যবহার করে। সুইস অ্যাম্বাসি।
সবাই নামার জন্য প্রস্তুত হতে থাকলে সে সিটবেল্ট খুলে ডা: সিনস্কির কাছে গেলো। “সবাই কোথায়?” জানতে চাইলো ল্যাংডন। “মানে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা টিমের কথা বলছি, তারা কোথায়? তুরস্কের সরকারী কর্মকর্তারা। তারা সবাই কি ইতিমধ্যে হাজিয়া সোফিয়াতে চলে গেছে?”
অস্বস্তির সাথে তাকালো সিনস্কি। “আসলে আমরা ঠিক করেছি স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে এ ব্যাপারে কিছু জানাবো না। আমাদের সঙ্গে ইসিডিসি’র দক্ষ এসআরএস টিম রয়েছে, এ মুহূর্তে বিরাট আতঙ্ক তৈরি না করে অপারেশনটি নীরবে আর চুপিসারে করাটাই সবথেকে ভালো হবে।”
কাছেই ল্যাংডন দেখতে পেলো ব্রুডার আর তার টিম বড় বড় ডাফেল ব্যাগ গোছাতে শুরু করেছে, ওগুলোতে আছে সব ধরণের হ্যাঁজম্যাট গিয়ার-বায়োসুট, রেসপিরেটর এবং ইলেক্ট্রনিক ডিটেকশন যন্ত্রপাতি।
ব্রুডার একটি ব্যাগ কাঁধে তুলে নিয়ে তার কাছে এগিয়ে এলো। “আমরা নামছি। ঐ ভবনে ঢুকে দান্দোলোর সমাধি খুঁজে বের করে কবিতায় যেভাবে বলা আছে, পানির শব্দ শুনে সিদ্ধান্ত নেবো অন্য কর্তৃপক্ষ কিংবা স্থানীয় কর্মকর্তাদেরকে ডাকবো কিনা সাপোর্টের জন্য।”
এই পরিকল্পনায় যে সমস্যা আছে সেটা ল্যাংডনের কাছে এরইমধ্যে পরিস্কার। “হাজিয়া সোফিয়া বন্ধ হয় সূর্য ডোবার পর, সুতরাং স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ছাড়া আমরা ওখানে ঢুকতেই পারবো না।”
“এ নিয়ে আপনাকে চিন্তা করতে হবে না,” বললো সিনস্কি। “আমি সুইস অ্যাম্বাসির সাথে যোগাযোগ করেছি, ওরা হাজিয়া সোফিয়া জাদুঘরের কিউরেটরের সাথে কথা বলে একটি প্রাইভেট ভিআইপি টুরের ব্যবস্থা করে ফেলবে আমরা ওখানে পৌঁছানোর আগেই। কিউরেটর ইতিমধ্যেই রাজি হয়েছেন।”
ল্যাংডন প্রায় হেসেই ফেলতে যাচ্ছিলো। “বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার পরিচালকের জন্য একটি ভিআইপি টুর? যার সাথে হ্যাঁজম্যাট সুট পরা একদল সেনাবাহিনী রয়েছে? আপনারা মনে করছেন এ নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলবে না?”
“এসআরএস টিম এবং তাদের গিয়ারগুলো গাড়িতেই থাকবে, ব্রুডার, আমি আর আপনি পরিস্থিতি বিবেচনা করে ব্যবস্থা নেবো,” সিনস্কি বললো। “ভালো কথা, আমি কিন্তু ভিআইপি নই। ভিআইপি হলেন আপনি।”
“কী বললেন?!”
“আমরা জাদুঘর কর্তৃপক্ষকে বলেছি একজন বিখ্যাত আমেরিকান প্রফেসর হাজিয়া সোফিয়ার সিম্বলের উপর আর্টিকেল লেখার জন্য তার রিসার্চ টিম নিয়ে ইস্তাম্বুলে এসেছেন, কিন্তু তার প্লেন পাঁচ ঘণ্টা ডিলে করে ফেলেছে, ফলে ভবনটি দেখার সুযোগ মিস করেছেন তিনি। যেহেতু তিনি এবং তার টিম আগামীকাল সকালেই চলে যাচ্ছেন তাই
“ঠিক আছে,” বললো ল্যাংডন। “যা বোঝার বুঝে গিয়েছি।”
“জাদুঘর কর্তৃপক্ষ একজন কর্মকর্তাকে ওখানে পাঠিয়েছে আমাদের সাথে সহযোগীতা করার জন্য। জানা গেছে ঐ লোক আপনার ইসলামিক আর্টের উপর লেখাগুলোর বিরাট ভক্ত।” ক্লান্তভঙ্গিতে হাসলো সিনস্কি। “আমাদেরকে আশ্বস্ত করে বলা হয়েছে আপনি ঐ ভবনের সব জায়গায় ঢু মারতে মারতে পারবেন।”
“সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা,” ব্রুডার বললো, “আমরা পুরো জায়গাটা আমাদের মতো করে পাচ্ছি।”
.
অধ্যায় ৮৫
আতাতুর্ক এয়ারপোর্ট থেকে সেন্ট্রাল ইস্তাম্বুলে যাবার পথে ভ্যানের জানালা দিয়ে উদাসভাবে চেয়ে আছে রবার্ট ল্যাংডন। সুইস অ্যাম্বাসির কর্মকর্তারা কোনোভাবে কাস্টমস প্রসেসটাকে একটু প্রভাবিত করেছিলো তাই মাত্র মিনিটখানেকের মধ্যেই ল্যাংডন, সিনস্কি আর বাকিরা এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে যেতে পারে।
।প্রভোস্ট আর ফেরিসকে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার কিছু কর্মকতার সাথে সি-১৩০ বিমানে থেকে যাবার নির্দেশ দিয়েছে সিনস্কি, ওখানে বসেই তারা সিয়েনাকে ট্র্যাক-ডাউন করার কাজ চালিয়ে যাবে।
কেউ আসলে মনে করছে না সিয়েনা তাদের আগে ইস্তাম্বুলে পৌঁছাতে পারবে কিন্তু সে হয়তো তুরস্কে জোবরিস্টের যেসব শিষ্য রয়েছে তাদেরকে ফোন করে সাহায্য চাইতে পারে। বলে দিতে পারে সিনস্কির টিম জোবরিস্টের পুরো পরিকল্পনাটি ভেস্তে দেবার চেষ্টা করছে।
সিয়েনা কি আসলেই গণহত্যা চালাতে যাবে? আজ যা কিছু ঘটেছে তার সব কিছু মেনে নিতে এখনও ল্যাংডনের বেশ কষ্ট হচ্ছে। এটা করতে গিয়ে তাকে যথেষ্ট যন্ত্রণা সহ্য করতে হলেও সে জানে সত্যকে মেনে নিতেই হবে। তুমি কখনও তাকে চিনতে না, রবার্ট। সে তোমার সাথে খেলেছে।
শহরের উপর হালকা বৃষ্টি নেমে এলে গাড়ির ওয়াইপারের হিস হিস শব্দ শুনে আচমকা ল্যাংডনের ক্লান্ত বোধ হলো। তার ডান দিকে মারমারা সাগর, দূরে অসংখ্য লাক্সারি ইয়ট আর বড় বড় ট্যাঙ্কার বন্দরের দিকে এগিয়ে আসতে দেখলো সে। ওয়াটারফ্রন্ট জুড়ে উঁচু উঁচু আলোকিত মিনার আর মসজিদের গম্বুজ স্মরণ করিয়ে দেয় ইস্তাম্বুল একটি আধুনিক আর সেকুলার শহর হলেও এর শেকড় প্রোথিত আছে ধর্মের মধ্যে।
এই দশ মাইল দীর্ঘ হাইওয়েটি ল্যাংডনের কাছে মনে হয় ইউরোপের সবচাইতে চমৎকার আর মনোরম ড্রাইভ। ইস্তাম্বুলের নতুন আর পুরাতনের যে সংঘর্ষ তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ এটি। সড়কটির কিছু অংশ জুড়ে আছে কন্সট্যান্টিনের দেয়াল, যার নির্মাণ হয়েছিলো বর্তমানে যে লোকটির নামে এই এভিনু তার জন্মের মোলো শ’ বছর আগে-জন এফ কেনেডি। পতিত সাম্রাজ্য তুরস্ককে ধ্বংসস্তূপ থেকে একটি আধুনিক রিপাবলিকে প্রতিষ্ঠিত করার যে স্বপ্নদ্রষ্টার ভূমিকা পালন করেছিলেন কামাল আতাতুর্ক তার একজন বিশাল ভক্ত ছিলেন এই আমেরিকান প্রেসিডেন্ট।
কেনেডি এভিনুর সামনে কিছুটা পথ যাবার পর একটি ঐতিহাসিক পার্কের ভেতর দিয়ে চলে গেছে, তারপর গোল্ডেন হর্ন পেরিয়ে শহরের অনেক উপরে উঠে গেছে যেখানে এক সময় অটোমানদের শক্তিশালী ঘাঁটি টপকাপি প্রাসাদ অবস্থিত। বসফরাস প্রণালীর চমৎকার দৃশ্য দেখা ছাড়াও এই প্রাসাদটি পর্যটকদের কাছে বেশ আকর্ষণীয় একটি জায়গা কারণ এখানে সংরক্ষিত আছে। অটোমানদের বিপুল পরিমানের সম্পদ, হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)-এর একটি আলখেল্লা এবং তলোয়াড়।
আমাদেরকে অবশ্য অতো দূরে যেতে হবে না, ল্যাংডন জানে তাদের গন্তব্য হাজিয়া সোফিয়া আরেকটু পথ এগোলেই দেখা যাবে।
কেনেডি এভিনু থেকে শহরের ঘনবসতি এলাকায় ঢুকে সাপের মতো এঁকেবেঁকে চলতে লাগলো তাদের গাড়িটা। ল্যাংডন জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে পথেঘাটে, ফুটপাতে হেঁটে বেড়ানো অসংখ্য লোকজনের দিকে তাকাতেই আজকের একটা কথা মনে পড়ে গেলো।
বিপুল এবং বাড়তি জনসংখ্যা।
প্লেগ।
জোবরিস্টের অশুভ উচ্চাভিলাষি পরিকল্পনা।
ল্যাংডনের মনে আরেকটি চিন্তা ঘুরপাক খেতে লাগলো। আমরা গ্রাউন্ড জিরো’তে যাচ্ছি। চোখের সামনে ভেসে উঠলো পানির নীচে বাদামী-হলুদ রঙের ভাসমান একটি ব্যাগের ছবি। অবাক হয়ে ভাবতে লাগলো কিভাবে নিজেকে এরকম একটি অবস্থানে নিয়ে এলো সে।
দান্তের মৃত্যু-মুখোশের পেছনে যে কবিতাটি আছে ল্যাংডন আর সিয়েনা তার মমোদ্ধার করেছে। এরফলেই তারা এখন ইস্তাম্বুলে।
পবিত্র জ্ঞানের স্বর্ণালী মওজিওনে হাটু গেড়ে বসে
মাটিতে কান পেতে শোনো
পানি পড়ার শব্দ।
ঢুকে পড়ো ঐ ডুবন্ত প্রাসাদে…
ওখানে অন্ধকারে থানিক দানব প্রতীক্ষায় আছে,
রক্ত-লাল পানিতে ডুবে আছে সেটা…
যে পানিতে প্রতিফলিত হয় না আকাশের তারা।
ল্যাংডন এটা ভেবে খুব উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলো যে দান্তের শেষ ক্যান্টোটি শেষ হয়েছে ঠিক এরকমই একটি দৃশ্য দিয়ে : ভূ-গর্ভের অনেক নীচে ভ্রমণ করে দান্তে আর ভার্জিল অবশেষে চলে আসে নরকের শেষ চক্রে। এখানে বের হবার কোনো পথ নেই। পায়ের নীচে পানি পড়ার শব্দ শুনতে পায় তারা। ফাঁটল আর চুঁইয়ে পড়া পানি অনুসরণ করে…অবশেষে নিরাপদ জায়গা খুঁজে পায়।
দান্তে লিখেছেন : “নীচে একটি জায়গা আছে…ওটা দেখে চেনা যায় না, তবে পাথরের ফাঁক গলে চুঁইয়ে পড়া পানির শব্দ অনুসরণ করে…সেই গোপন পথে ঢুকে পড়ি আমি আর আমার পথপ্রদর্শক, এই চমৎকার পৃথিবীতে ফিরে আসার জন্য।”
দান্তের এই দৃশ্যটি জোবরিস্টের কবিতার জন্য অনুপ্রেরনা জোগালেও এক্ষেত্রে জোবরিস্ট পুরো ব্যাপারটাকেই উল্টে দিয়েছে। ল্যাংডন এবং বাকিরা পানি পড়ার শব্দ অনুসরণ করবে, তবে তারা দান্তের মতো ইনফার্নো থেকে বের হবার জন্য এটা করবে না, বরং সরাসরি ওখানে ঢুকে পড়বে।
সঙ্কীর্ণ রাস্তা আর ঘনবসতি এলাকা দিয়ে তাদের গাড়িটা ছুটে চললে ল্যাংডন বুঝতে পারলো বিশ্বব্যাপী মহামারির কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে ইস্তাম্বুলের মতো শহরকে বেছে নেয়ার জোবরিস্টের বিকৃত যুক্তিটা।
পুর্ব মিশেছে পশ্চিমে।
এ বিশ্বের ক্রসরোড।
ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে ইস্তাম্বুল শহরটি অনেকবারই প্লেগের ছোবলে বিপর্যস্ত হয়েছে, হারিয়েছে এর জনসংখ্যার বিরাট অংশ। সত্যি বলতে, শেষবার প্লেগের প্রাদুর্ভাব এতোটাই তীব্র ছিলো যে, এই শহরকে সবাই বলতো ‘প্লেগের। আস্তানা। প্রতিদিন গড়ে দশ হাজার করে লোক মারা যেতো তখন। বেশ কয়েকটি বিখ্যাত অটোমান পেইন্টিংয়ে দেখা যায় শহরের লোকজন তাকসিম নামের একটি প্রান্তরে হন্যে হয়ে মাটি খুড়ছে শত শত লাশ কবর দেয়ার জন্য।
ল্যাংডন আশা করলো কার্ল মার্ক্সসের ঐ কথাটা যেনো ভুল প্রমাণিত হয় : “ইতিহাসের পুণরাবৃত্তি ঘটে।”।
বৃষ্টি ভেজা পথঘাটে লোকজন নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে, সুন্দরী তুর্কি মেয়েরা বাচ্চাদের ডাকছে রাতের খাবার খাওয়ার জন্য। উন্মুক্ত ক্যাফেতে বসে কফি পান করছে দু’জন বৃদ্ধ। দুই তরুণ-তরুণী হাতে-হাত ধরে হেঁটে চলেছে এক ছাতার নীচে। টাক্সিডো পরা এক লোক বাস থেকে নেমেই দৌড়ে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজছে বৃষ্টির হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে, তার সুটের ভেতর বেহালার কেস লুকিয়ে রাখা। বোঝাই যাচ্ছে কনসার্টে বাজাতে যাচ্ছে সে।
ল্যাংডন আবিষ্কার করলো প্রতিটি মানুষের চেহারা দেখে যাচ্ছে সে, তাদের একেক জনের জীবনের বৈচিত্র আর জটিলতা কল্পনা করার চেষ্টা করছে।
জনসংখ্যার এই ঘনত্ব তৈরি করেছে মানুষ।
চোখ বন্ধ করলো সে, জানালা থেকে মুখ সরিয়ে নিলো। অসুস্থ চিন্তাভাবনা থেকে নিজেকে বিরত রাখার চেষ্টা করলো সে। কিন্তু ক্ষতি যা হবার তা হয়ে গেছে। তার মনের সুগভীর অন্ধকারে একটি ছবি ভেসে উঠলো-ব্রুয়েজেলের ট্রায়াম্ফ অব ডেথ-এর ঊষড় ল্যান্ডস্কেপ-পচা-গলা, দুর্দশাগ্রস্ত আর নির্যাতিত মানুষ পড়ে আছে সমুদ্রতীরবর্তী এক শহরে।
টরুন এভিনুতে তাদের ভ্যান ঢুকে পড়লে কয়েক মুহূর্তের জন্য ল্যাংডনের মনে হলো তারা গন্তব্যে চলে এসেছে। কিন্তু বাম দিকে যে বিশাল মসজিদটি আছে সেটা হাজিয়া সোফিয়া নয়।
নীল মসজিদ, সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পারলো সে। পেন্সিল আকৃতির ছয়টি মিনার দাঁড়িয়ে আছে।
আমরা এসে পড়েছি, কাবাসাকাল এভিনুতে তাদের গাড়িটা ঢুকে পড়লে মনে মনে বললো ল্যাংডন। এভিনুটা পার হতেই সুলতানাহমেট পার্ক চোখে পড়লো। এটা নীল মসজিদ আর হাজিয়া সোফিয়ার মাঝখানে অবস্থিত।
সামনে তাকিয়ে হাজিয়া সোফিয়া দেখার চেষ্টা করলো কিন্তু বৃষ্টি আর গাড়ির হেডলাইটের কারণে সেটা সম্ভব হলো না। তারচেয়ে বড় কথা, আশেপাশের সব গাড়ি থেমে আছে।
সামনে তাকিয়ে শুধুমাত্র জ্বলতে থাকা ব্ৰেকলাইট দেখতে পেলো ল্যাংডন।
“কোনো অনুষ্ঠান হবে হয়তো,” ড্রাইভার বললো। “আমার মনে হয় একটা কনসার্ট হচ্ছে। পায়ে হেঁটে গেলেই দ্রুত পৌঁছানো যাবে ওখানে।”
“কতো দূর?” সিনস্কি জানতে চাইলো।
“এই পার্কের ভেতর দিয়ে গেলে তিন মিনিটের মতো লাগতে পারে। খুবই নিরাপদ এটা।”
ব্রুডারের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লো সিনস্কি, তারপর এসআরএস টিমের দিকে ফিরলো সে। “আপনারা এই ভ্যানেই থাকবেন। যতোটা সম্ভব ওই জায়গার কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করবেন। এজেন্ট ব্রুডার খুব জলদি আপনাদের সাথে যোগাযোগ করবে।”
এর পর পরই সিনস্কি, ব্রুডার আর ল্যাংডন নেমে পড়লো ভ্যান থেকে।
সুলতানাহমেট পার্কের বড়বড় গাছপালাগুলো তাদেরকে বৃষ্টির হাত থেকে কিছুটা রক্ষা করলো। পার্কের ভেতরে মিশরীয় অবিলিস্ক, ডেলফির অ্যাপোলো মন্দিরের সাপের মতো পেচানো কলম আছে, ওটা পর্যটকদের কাছে দর্শণীয় একটি বস্তু। একটু এগোতেই চোখে পড়লো বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের স্থাপত্যটি।
হাজিয়া সোফিয়া।
এটা নিছক কোনো ভবন নয়…এ যেনো পর্বততুল্য একটি স্থাপনা।
বৃষ্টির কারণে বিশাকালাকারের হাজিয়া সোফিয়া চকচক করছে। দেখে মনে হয় ওটাই আস্ত একটি শহর। এর মাঝখানের গম্বুজটি-অসম্ভব রকমের প্রশস্ত আর ধূসর-রূপালীর রিবগুলো-যেনো আশেপাশের আরো কতোগুলো গম্বুজের মাঝখানে বসে আছে। চারটি সুউচ্চ মিনার দাঁড়িয়ে আছে ভবনটির চারকোণায়। মাঝখানের গম্বুজ থেকে ওগুলো এতোটাই দূরে দূরে অবস্থিত যে মনে হবে তারা বুঝি আলাদা কোনো স্থাপনা।
সিনস্কি আর ব্রুডার প্রায় জগিংয়ের মতো করে এগোচ্ছিলো, কিন্তু উপরের দিকে তাকাতেই তাদের গতি কমে এলো…যেনো সুবিশাল এই স্থাপত্যটির উচ্চতা আন্দাজ করতে হিমশিম খাচ্ছে।
“হায় ঈশ্বর।” অবিশ্বাসে বলে উঠলো ব্রুডার। “আমরা এখানে খোঁজাখুঁজি করবো…ওটা?”
.
অধ্যায় ৮৬
আমি এখন বন্দী, পার্ক করে রাখা সি-১৩০ বিমানের ভেতরে পায়চারি করতে করতে ভাবলো প্রভোস্ট। নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবার আগে এই দুর্যোগটি মোকাবেলা করতে সিনস্কিকে সাহায্য করার জন্য তার সাথে ইস্তাম্বুলে যেতে রাজি হয়েছিলো সে।
নিজের আর কনসোর্টিয়ামর লাভ-ক্ষতি চিন্তা না করে এ কাজে সহায্য করার কথা ভেবেছিলো যাতে করে কিছুটা অনুকম্পা পাওয়া যায় কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে পরিস্থিতি একেবারেই অন্যরকম। সিনস্কি আমাকে তার কাস্টডিতে নিয়ে নিয়েছে।
আতাতুর্ক এয়ারপোর্টে বিমানটি অবতরণ করার সাথে সাথে সিনস্কি আর তার টিম প্লেন থেকে নামার আগে বলে যায় প্রভোস্ট এবং কনসোর্টিয়ামের কিছু স্টাফ যেনো বিমানের ভেতরেই থাকে।
ওরা চলে যাবার পর বিমানের বাইরে গিয়ে একটু তাজা বাতাস নিতে চেয়েছিলো প্রভোস্ট কিন্তু পাথর-মুখের পাইলট তাকে বাধা দেয়।
মোটেও ভালো না, ভাবলো প্রভোস্ট। নিজের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভাবতে ভাবতে সিটে বসে পড়লো সে
দীর্ঘদিন ধরে একজন পাপেট মাস্টারের ভূমিকা পালন করে গেছে প্রভোস্ট, এ কাজেই সে অভ্যস্ত, তার সূতার টানে অন্যেরা নেচেছে, কিন্তু হঠাৎ করেই তার সমস্ত ক্ষমতা যেনো কেড়ে নেয়া হয়েছে।
জোবরিস্ট, সিয়েনা, সিনস্কি।
তারা সবাই তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে…এমনকি তাকে ব্যবহারও করেছে।
এখন জানালাবিহীন বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার বিমানে বসে ভাবছে তার সৌভাগ্য কি ফুরিয়ে গেলো, নাকি বর্তমানের এই সঙ্কটটি তার সারাজীবনের অসততার কর্মফল।
বেঁচে থাকার জন্য আমি মিথ্যে বলি।
আমি বিকৃত তথ্যের উদগাতা।
এ পৃথিবীতে প্রভোস্টই একমাত্র ব্যক্তি নয় যে মিথ্যের বেসাতি করে কিন্তু এটাও ঠিক, এ জগতে সে একজন রাঘব-বোয়াল। ছোটো মাছগুলো একেবারেই অন্য প্রজাতির, ওদের সাথে কাজ করতেও সে দারুণ অপছন্দ করে।
অনলাইনে অ্যালিবাই কোম্পানি কিংবা অ্যালিবাই নেটওয়ার্ক নামের অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যারা বিশ্বব্যাপী টাকা কামিয়ে যাচ্ছে অবিশ্বাসী স্বামী-স্ত্রীকে এমন সব আইডিয়া, পরামর্শ আর সমর্থন দিয়ে যাতে করে তারা ধরা না পড়েই একজন আরেকজনকে প্রতারণা করতে পারে। ভুয়া বিজনেস মিটিং, কনভেশন, ডাক্তারের সাথে অ্যাপয়েন্টমেন্ট, এমনকি ভুয়া বিয়ের অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করে দেয় তারা সেইসাথে ভুয়া আমন্ত্রণপত্র, ব্রশিউর, প্লেনের টিকেট, হোটেলের ফর্ম, বিশেষ বিষেশষ কিছু ফোন নাম্বারও তারা সরবরাহ করে, ঐসব ফোনকল রিসিভি করে অ্যালিবাই কোম্পানিগুলোই। ওখানে যারা থাকে তারা বেশ প্রশিক্ষিত। যেকোনো অনুসন্ধানের জন্য সর্বদা প্রস্তত থাকে।
প্রভোস্ট কখনও এরকম তুচ্ছ আর ফালতু মিথ্যের বেসাতি করে নি। তার কাজকারবার এরচেয়ে অনেক বিশাল। বিরাট মাপের ধোঁকা আর বিভ্রম তৈরিতে কাজ করে সে। মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার দিতে পারবে যারা তাদের হয়ে কাজ করে তার কনসোর্টিয়াম।
সরকার।
বড়বড় কপোরেশন।
মাঝেমধ্যে অসম্ভব রকমের ধনী ভিআইপি ব্যক্তিবর্গ।
এদের সাথে কাজ করাটা অনেক বেশি নিরাপদ। কারণ এরা নিজেরা যেমন ঝুঁকি নেয় না তেমনি এদের হয়ে যারা কাজ করবে তাদেরকেও ঝুঁকিতে ফেলে না।
স্টক মার্কেটের ব্যাপার, অন্য দেশের সাথে যুদ্ধ বাধানো জায়েজ করা, নির্বাচনে জেতা, কিংবা গোপন আস্তানা থেকে কোনো সন্ত্রাসীকে টোপ দিয়ে ধরিয়ে দেয়া হোক না কেন, এসব কাজের জন্য বিশ্বনেতাদের চাই প্রচুর ভুল আর বিকৃত তথ্য, যা দিয়ে তারা জনগণের মনোভাব পাল্টে দিতে পারে।
এসব কাজের জন্য দরকার পড়ে তাদের মতো লোকজনের।
ষাটের দশকে রাশিয়া একটি ভুয়া স্পাই-নেটওয়ার্ক তৈরি করে, তারা আজেবাজে ইন্টেলিজেন্স সরবরাহ করে যায় আর বছরের পর বছর ধরে বৃটিশরা সেগুলো ইন্টারসেপ্ট করতে ব্যস্ত থাকে। ১৯৪৭ সালে আমেরিকান এয়ারফোর্স নিউ মেক্সিকোতে একটি বিমান দুর্ঘটনা আড়াল করার জন্য উড়ন্ত সসারের গল্প ছড়িয়ে দেয়। আর সেটা বিশ্বব্যাপী দারুণ সাড়া ফেলে। অতি সাম্প্রতিক সময়ে সারা দুনিয়াকে বিশ্বাস করানো হয়েছিলো ইরাকে গণবিধ্বংসী মারণাস্ত্র রয়েছে। পরবর্তীতে দেখা গেছে এটা পুরোপুরি ভুয়া একটি অভিযোগ।
প্রায় তিন দশক ধরে প্রভোস্ট ক্ষমতাশালী লোকজনকে রক্ষা করে গেছে, ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য সাহায্য করে গেছে, কখনও কখনও তাদের ক্ষমতা বাড়াতেও সাহায্য করেছে। এ কাজ করার সময় অনেক সতর্ক থাকলেও প্রভোস্টের আশংকা ছিলো একদিন না একদিন তার ভুল হয়ে যাবেই।
এখন সেই দিনটি এসে গেছে।
প্রভোস্ট বিশ্বাস করে বড়বড় মহাবিপর্যয়গুলো সামান্য সব ভুলের কারণে হয়ে থাকে-হঠাৎ করে দেখা হয়ে যাওয়া, একটা মাত্র বাজে সিদ্ধান্ত, কিংবা একটু অসতর্কতা।
এক্ষেত্রে অবশ্য তার ভুলটির শেকড় গাঁড়া হয়েছিলো আজ থেকে বারো বছর আগে। মেডিকেল কলেজের এক অল্পবয়সী মেয়ে বাড়তি কিছু আয়রোজগার করার জন্য তার কাছে এসেছিলো, সেও তাকে কাজে নিয়োগ দিয়ে দেয়। মেয়েটি ছিলো অসম্ভব বুদ্ধিমতি, অনেক ভাষায় কথা বলতে পারার ক্ষমতা আর যেকোনো পরিস্থিতিতে চট করে সিদ্ধান্ত নেবার স্বাভাবিক প্রবণতার কারণে কনসোর্টিয়ামে তার জায়গা হয়ে যায় দ্রুত।
সিয়েনা ব্রুকস জন্মগতভাবেই এরকম।
তাদের কাজকর্ম কি রকম সেটা খুব দ্রুত বুঝে গিয়েছিলো সিয়েনা। প্রভোস্টও আঁচ করতে পেরেছিলো গোপনীয়তা বজায় রাখার ব্যাপারে মেয়েটির প্রতিভা আছে। প্রায় দু’বছর তাদের সাথে কাজ করে মেয়েটি, বেশ মোটা অঙ্কের টাকা কামায় সে, ঐ টাকা দিয়ে মেডিকেল কলেজের পড়াশোনা শেষ করে। তারপর বলা নেই কওয়া নেই একদিন এসে জানায় সে আর এ কাজ করবে না। এ পৃথিবীকে রক্ষা করতে চায় সে। তাদের সাথে থাকলে এ কাজ করা সম্ভব হবে না।
প্রভোস্ট কখনও কল্পনাও করতে পারে নি প্রায় দশ বছর পর মেয়েটি আবার উদয় হবে, সঙ্গে করে নিয়ে আসবে বিরাট ধনী আর স্বনামখ্যাত এক ক্লায়েন্টকে।
বারট্রান্ড জোবরিস্ট।
এসবের জন্য সিয়েনাই দায়ি।
জোবরিস্টের পরিকল্পনার সাথে সেও জড়িত ছিলো।
সি-১৩০ বিমানের ভেতরে, তার কাছেই এক কনফারেন্স টেবিলে বসে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার কিছু কর্মকর্তা টেলিফোনে উত্তপ্ত বাকবিতণ্ডা করে যাচ্ছে।
“সিয়েনা ব্রুকস?!” ফোনে চিৎকার করে বললো একজন। “আপনি নিশ্চিত?” ফোনের অপরপ্রান্তের কথা শুনে তার ভুরু কপালে উঠে গেলো। “ঠিক আছে। আমাকে ডিটেইলগুলো দিন। আমি লাইনেই আছি।”
রিসিভারে হাতচাপা দিয়ে সে তার কলিগদেরকে বললো, “মনে হচ্ছে আমাদের একটু আগেই সিয়েনা ব্রুকস ইটালি ছেড়ে চলে গেছে।”
টেবিলে বসা সবাই বরফের মতো জমে গেলো কথাটা শুনে।
“এটা কিভাবে সম্ভব?” এক মহিলা স্টাফ জানতে চাইলো। “আমরা তো এয়ারপোর্ট, ব্রিজ, ট্রেনস্টেশন সবখানেই নজরদারি করছি…”
“নিসেলি এয়ারফিল্ড,” জবাব দিলো সে। “লিড়ো দ্বীপের।”
“এটা সম্ভব নয়,” মাথা ঝাঁকিয়ে বললো মহিলা। “নিসেলি খুবই ছোট্ট একটি দ্বীপ। ওখান থেকে কোনো ফ্লাইট যাওয়া আসা করে না। স্থানীয় হেলিকপ্টার টুরের জন্য কিছু কপ্টার আছে ওখানে
“যেভাবেই হোক, নিসেলির এয়ারফিল্ড হ্যাঁঙ্গারে একটি প্রাইভেট জেট বাগাতে পেরেছে সিয়েনা। তারা এখনও ওটাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।” রিসিভার থেকে হাত সরিয়ে বললো সে। “হা, আছি। বলুন কি পেলেন?” ওপাশের কথা শুনে ধপাস করে চেয়ার বসে পড়লো সে। “বুঝতে পেরেছি। ধন্যবাদ আপনাকে।” লাইনটা কেটে দিলো।
তার সব কলিগ চেয়ে আছে তার দিকে।
“সিয়েনার জেটটার গন্তব্য তুরস্ক,” লোকটা বললো।
“তাহলে ইউরোপিয়ান এয়ার ট্রান্সপোর্ট কমান্ডকে কল করুন!” কেউ একজন তাড়া দিয়ে বললে তাকে। “তারা যেনো ঐ জেটটাকে পথ বদলাতে বাধ্য করে!”
“আমি এটা করতে পারবো না, লোকটা বললো। “বারো মিনিট আগে হেজারফেন প্রাইভেট এয়ারফিল্ডে ওটা ল্যান্ড করেছে। ওই জায়গা থেকে মাত্র পনেরো মিনিট দূরে। সিয়েনা ব্রুকস হাওয়া হয়ে গেছে।”
.
অধ্যায় ৮৭
হাজিয়া সোফিয়ার প্রাচীন গম্বুজের উপর অঝোরে বৃষ্টি নামছে এখন।
প্রায় হাজার বছর ধরে এটি ছিলো এ বিশ্বের সর্ববৃহৎ একটি চার্চ। এখনও এটাকে দেখলে একটা কথাই শুধু মনে আসে-সুবিশাল। স্থাপত্যটিকে আবারো দেখতে পেয়ে ল্যাংডনের মনে পড়ে গেলো সম্রাট জুস্টিনিয়ান এটি তৈরি করার পর কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে গর্বসহকারে বলে উঠেছিলেন, “সলোমন, অবশেষে আমি তোমাকে ছাড়িয়ে গেলাম!”
সিনস্কি আর ব্রুডার হনহন করে এগিয়ে যাচ্ছে বিশাল ভবনটির দিকে।
এখানকার ওয়াকওয়েগুলো মেহমেট দ্য কনকোরারের সামরিকবাহিনীর ব্যবহৃত কামানের গোলা দিয়ে তৈরি করা হয়েছে-এ যেনো স্মরণ করিয়ে দেয় ভবনটির রয়েছে রক্তাক্ত ইতিহাস। বিজয়ীর দখলে চলে যাবার পর এটিকে ধর্মীয় উপাসনালয় হিসেবে পুণরায় গড়ে তোলা হয়।
তারা সবাই দক্ষিণ দিকের ফ্যাকাডের কাছে আসতেই ল্যাংডন ডান দিকের তিনটি গম্বুজের দিকে তাকালো। এগুলো সুলতানদের সমাধি, বলা হয়ে থাকে এদের মধ্যে একজন-তৃতীয় মুরাদ-একশ’ সন্তানের পিতা ছিলেন।
সেলফোনের রিং বেজে উঠলে ব্রুডার সেটা বের করে কলার আইডি দেখে নিলো আগে তারপর কলটা রিসিভ করলো সে। “কিছু পেলে?”
মনোযোগ দিয়ে ওপাশ থেকে শুনে গেলো এজেন্ট, মাথা ঝাঁকাতে লাগলো অবিশ্বাসে। “এটা কিভাবে সম্ভব হলো?” আবারো কথা শুনে গেলো, তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। “ঠিক আছে। আমাকে জানাতে থাকো সব কিছু। আমরা ভেতরে ঢুকছি এখন।”
“কি হয়েছে?” সিনস্কি জিজ্ঞেস করলো।
“কড়া নজর রাখবে,” চারপাশে তাকিয়ে বললো ব্রুডার। “প্রতিপক্ষের কেউ এখানে আছে।” এবার সিনস্কির দিকে তাকালো সে। মনে হচ্ছে সিয়েনা ব্রুকস ইস্তাম্বুলে আছে।”
লোকটার দিকে চেয়ে রইলো ল্যাংডন। সিয়েনা শুধু ভেনিস থেকে সফলভাবে পালাতেই পারে নি, তুরস্কেও চলে আসতে পেরেছে বলে সে যারপরনাই বিস্মিত। মেয়েটি ধরা পড়ার ভয় পরোয়া না করে, জীবনবাজি রেখে জোবরিস্টের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে চলে এসেছে এখানে।
সিনস্কিকে ঘাবড়ে যেতে দেখা গেলো, গভীর করে দম নিয়ে ব্রুডারকে আরো কিছু জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করলো না, বরং ল্যাংডনের দিকে ফিরলো সে।
“কোন্ দিকে?”
ভবনের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের বাম দিকে ইঙ্গিত করলো। “পবিত্র ফোয়ারাটি ওখানে।”
এই চমৎকার নক্সাসংবলিত জলাধারটি আসলে এক সময় মুসলমানদের নামাজের সময় ওজু করার জন্য ব্যবহৃত হতো।
“প্রফেসর ল্যাংডন!” একটু এগোতেই এক লোক চিৎকার করে ডেকে উঠলো।
হাসিমুখের এক তুর্কি একটু দূরে মিনারের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। উত্তেজিত হয়ে হাত নাড়ছে সে। “প্রফেসর, এই যে এখানে!”
ল্যাংডন এবং বাকিরা তার দিকে এগিয়ে গেলো।
“হ্যালো, আমার নাম মিসরাত, ইংরেজিতে বললো সে। তার কণ্ঠে উচ্ছ্বাস। হালকা পাতলা গড়ণের এক লোক, মাথার চুল পাতলা, ধূসর রঙের সুট আর চোখে পাণ্ডিত্যের ছাপ আছে এমন চশমা পরা। “আমার পরম সৌভাগ্য।”
“সৌভাগ্য তো আমাদের,” ল্যাংডন হেসে জবাব দিয়ে করমর্দন করলো তার সাথে। “এতো অল্প সময়ের মধ্যে আমাদেরকে এখানে ঢোকার ব্যবস্থা করে দেয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।”
“কী যে বলেন!”
“আমি এলিজাবেথ সিনস্কি, মিসরাতের সাথে হাত মিলিয়ে ব্রুডারের দিকে ফিরলো। “আর এ হলো ক্রিস্টোফার ব্রুডার। আমরা প্রফেসর ল্যাংডনকে সহযোগীতা করার জন্য এসেছি। আমাদের বিমান ডিলে হওয়াতে খুবই দুঃখিত। আপনার এই সহযোগীতার জন্য আবারো ধন্যবাদ।”
“প্লিজ! এভাবে বলবেন না!” আন্তরিকমাখা কণ্ঠে বললো মিসরাত। “প্রফেসর ল্যাংডনের জন্য আমি যেকোনো সময় এখানকার দরজা খুলে দিতে পারি। তার বই ক্রিশ্চিয়ান সিম্বলস ইন দি মুসলিম ওয়ার্ল্ড আমাদের জাদুঘরের গিফটশপে দারুণ বিক্রি হয়।”
তাই নাকি? মনে মনে বললো ল্যাংডন। তাহলে এ দুনিয়াতে একটি জায়গা আছে যেখানে বইটা ভালো চলে।
“আসুন তাহলে?” মিসরাত সবাইকে তার সঙ্গে আসতে বললো।
ছোট্ট একটি খোলা জায়গা দিয়ে তাদের দলটি পেরিয়ে গেলো পর্যটকদের জন্য নির্ধারিত প্রবেশপথটি। ভবনের মূল যে প্রবেশপথ আছে সেখানে চলে এলো তারা-ব্রোঞ্জের দরজাসহ বড় বড়ইতনটি খিলানযুক্ত পথ।
দু’জন সশস্ত্র প্রহরী তাদেরকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য সেখানে অপেক্ষা করছে। মিসরাতকে আসতে দেখে তারা একটি দরজার তালা খুলে দিলো।
“সাগ ওলান,” বললো মিসরাত। ল্যাংডন জানে এটা তুর্কিতে ধন্যবাদ বলার সমতুল্য।
তাদের দলটি ভেতরে ঢুকে পড়লে প্রহরীরা দরজা বন্ধ করে দিলো।
ল্যাংডন আর বাকিরা এখন দাঁড়িয়ে আছে হাজিয়া সোফিয়ার লবিতে।
তাদের দলটি এবার বেশ কয়েকটি দরজার দিকে এগিয়ে গেলো, মিসরাত ওইসব দরজার একটি খুলে ফেললে ল্যাংডন আরেকটি লবি দেখতে পেলো, সে অবশ্য আশা করেছিলো কোনো স্যাঙ্কচুয়ারি দেখবে। যাইহোক এই লবিটি আগের চেয়ে একটু বড়।
অন্দর মহলের লবি, বুঝতে পারলো ল্যাংডন। ভুলে গেছিলো হাজিয়া সোফিয়ার স্যাঙ্কচুয়ারিটি বাইরের দুনিয়া থেকে দুই স্তরের সুরক্ষার মধ্যে অবস্থিত।
যেনো দর্শনার্থীদের জন্যই অন্দরমহলের লবিটা চমৎকারভাবে সাজানো, এর দেয়ালগুলো বার্নিশ করা পাথরের, ঝুলে থাকা ঝারবাতির আলোয় সেগুলো জ্বলজ্বল করছে। দূরে ফাঁকা আর নিরিবিলি জায়গাটার কাছে চারটি দরজা দেখা যাচ্ছে, প্রত্যেকটার উপরে চোখ ধাঁধানো মোজাইকের কারুকাজ। সপ্রশংস দৃষ্টিতে দেখলো ল্যাংডন।
সবচেয়ে বড় দরজাটার দিকে এগিয়ে গেলো মিসরাত-বিশালাকৃতির ব্রোঞ্জের পাতে মোড়ানো দরজা। “রাজকীয় প্রবেশপথ,” চাপাস্বরে কিন্তু প্রবল উত্তেজনা নিয়ে বললো মিসরাত। “বাইজান্টাইন আমলে এই দরজাটি দিয়ে শুধুমাত্র রাজা প্রবেশ করতেন। পর্যটকেরা এটা দিয়ে যাওয়া আসা করতে পারে না, কিন্তু আজকের রাতটি স্পেশাল তাই এটা খুলে দিচ্ছি।”
দরজা খুলতে গিয়ে মিসরাত থেমে গেলো। “আমরা এটা দিয়ে ঢোকার আগে বলছি,” চাপাস্বরেই বললো সে, “আপনারা কি ভেতরের নির্দিষ্ট কিছু জায়গা দেখতে চান?”
ল্যাংডন, সিনস্কি আর ব্রুডার একে অন্যের দিকে তাকালো।
“হ্যাঁ,” বললো প্রফেসর। “দেখার মতো এখানে অনেক কিছুই আছে তবে আমরা যদি এনরিকো দান্দোলোর সমাধিটি দিয়ে শুরু করতে পারি তাহলে ভালো হয়।”
মিসরাতের ঘাড় উঁচু হয়ে গেলো, যেনো কথাটা বুঝতে পারে নি। “কী। বললেন? আপনারা…দান্দোলোর সমাধি দেখতে চাইছেন?”
“হ্যাঁ।”
মিসরাতকে হতাশ হতে দেখা গেলো। কিন্তু স্যার…দান্দোলোর সমাধিটি তো খুবই সাদামাটা। ওটাতে কোনো সিম্বলই নেই। আমাদের এখানে যেসব জিনিস আছে ওটা তার মধ্যে একেবারেই অখ্যাত।”
“আমি বুঝতে পারছি,” ভদ্রভাবে বললে ল্যাংডন। “আসলে আপনি যদি আমাদেরকে ওখানে নিয়ে যান তাহলে খুবই কৃতজ্ঞ থাকবো।”
দীর্ঘক্ষণ ধরে ল্যাংডনকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে গেলো মিসরাত, তারপর একটু আগে যে দরজা দিয়ে তারা এখানে ঢুকেছে সেটার উপরে মোজাইকের কারুকাজের দিকে তাকালো সে। এই মোজাইকটিতে রয়েছে নবম শতকের খৃস্টের একটি ছবি-বাম হাতে নিউ টেস্টামেন্ট আর ডান হাতে আর্শীবাদ করা জিশুর আইকনিক ইমেজ।
তারপর মিসরাত যেনো কিছু একটা ধরতে পেরেছে এমন ভঙ্গি করে ঠোঁট বাঁকালো।”আপনি খুব চালাক! খুবই চালাক।”
ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো ল্যাংডন। “কী বললেন?”
“ঘাবড়াবেন না, প্রফেসর,” ইঙ্গিতপূর্ণভাবে ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো মিসরাত। “আমি কাউকে বলবো না আপনি আসলে কেন এখানে এসেছেন।”
সিনস্কি আর ব্রুডার হতভম্ব হয়ে তাকালো ল্যাংডনের দিকে।
মিসরাত দরজা খুলে তাদেরকে ভেতরে যাবার জন্য ইশারা করলে ল্যাংডন কেবল কাঁধ তুললো।
.
অধ্যায় ৮৮
অনেকেই এটাকে এ বিশ্বের অষ্টমাশ্চার্য বলে থাকে। এ মুহূর্তে এটার ভেতরে দাঁড়িয়ে ল্যাংডনের মনে হলো এই মূল্যায়নের ব্যাপারে কোনো তর্ক করা চলে না।
তাদের দলটি বিশালাকারের স্যাঙ্কচুয়ারিতে প্রবেশ করলে ল্যাংডনের মনে পড়ে গেলো হাজিয়া সোফিয়াতে ঢোকার সাথে সাথেই কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই। দর্শনার্থীরা এর বিশালত্ব আর নান্দনিকতায় মুগ্ধ হয়ে যায়।
এই ঘরটা এতোই বড় যে এর সামনে ইউরোপের বড়বড় ক্যাথেড্রালগুলোকে বামন মনে হবে। ল্যাংডন জানে এই বিশালত্বের একটি কারণ এর আকারের সাথে সম্পর্কিত ন, বরং বাইজান্টাইন ফ্লোর-প্ল্যানের ডিজাইনটিই এমন যে এক ধরণের বিভ্রম তৈরি হয়। অন্যসব ক্যাথেড্রালের মতো চার বাহুর কুশ আকৃতির হয়ে এটার মেঝে একেবারেই বগীকার।
এই ভবনটি নটরডেম-এর চেয়েও সাতশ বছরের বেশি পুরনো, ভাবলো ল্যাংডন। ঘরের বিশালত্ব উপলব্ধি করতে কিছুটা সময় লেগে গেলো তার। এরপর উপরের দিকে তাকালো। কমপক্ষে একশ’ পঞ্চাশ ফুট উঁচুতে রয়েছে এর বিশাল স্বণার্লি গম্বুজটি। এর কেন্দ্রবিন্দু থেকে চল্লিশটি রিব ছড়িয়ে পড়েছে চতুরদিকে, অনেকটা সূর্যের আলোর মতো। এগুলো শেষ হয়েছে চল্লিশটি খিলানযুক্ত জানালাতে গিয়ে। জানালাগুলো গম্বুজের বেইজের চারপাশ জুড়ে আছে। দিনের বেলায় এসব জানালা দিয়ে আলো প্রবেশ করলে ভেতরে থাকা কাঁচ আর স্বর্ণের টাইলগুলো দ্যুতি ছড়াতে থাকে, সৃষ্টি করে সোফিয়ার বিখ্যাত ‘আধ্যাত্মিক আলো।
ল্যাংডন এ ঘরের স্বণালি আবহটি কেবলমাত্র একবারই দেখেছে আর সেটা পেইন্টিংয়ে। জন সিঙ্গার সার্জেন্ট। হাজিয়া সোফিয়ার উপরে তার বিখ্যাত পেইন্টিংটা আঁকতে গিয়ে তিনি কেবল একটি রঙের প্রাধান্যই দিয়েছিলেন।
সোনালি।
চকচক করতে থাকা সোনালি গম্বুজটাকে প্রায়শই বলা হয়ে থাকে স্বর্গের গম্বুজ’ বলে। এই বিশালাকারের গম্বুজটি স্থাপন করা হয়েছে চারটি অসাধারণ খিলানের উপর।
গম্বুজ থেকে তারের সাহায্যে ঝুলে আছে জ্বলজ্বল করতে থাকা বেশ কয়েকটি চোখ ধাঁধানো ঝারবাতি। এগুলো মেঝে থেকে এতোটাই কম উঁচুতে ঝুলে আছে যে, একটু লম্বা দর্শনার্থীদের পক্ষে সেগুলো ধরা সম্ভব। সত্যি বলতে এটাও এক ধরণের বিভ্রম। বিশাল আকারের জায়গায় ঝারবাতিগুলো আসলে মেঝে থেকে বারো ফুট উপরে ঝুলে আছে।
আর সব মহান স্থাপত্যের মতোই হাজিয়া সোফিয়ার বিশাল আকৃতির উদ্দেশ্যে দুটো। প্রথমত, ঈশ্বরের কাছে মানুষের প্রার্থনার বিশালত্বকে তুলে ধরা। দ্বিতীয়ত, প্রার্থনাকারীদেরকে এটা হকচকিয়ে দেবার কাজও করে-যেনো এখানে। ঢোকার পর পরই নিজেকে অনেক ক্ষুদ্র বলে মনে হয়, তার অহংবোধ যেনো উবে যায়, ঈশ্বর আর তার মহাবিশ্বের কাছে সে কতোটা তুচ্ছ সেটা যেনো উপলব্ধি করতে পারে সৃষ্টিকর্তার হাতে সে পরমাণুর মতোই ক্ষুদ্র।
একজন মানুষ কিছুই না যতোক্ষণ না ঈশ্বর তার মধ্য থেকে কিছু বের করে আনেন। ষোড়শ শতকে মার্টিন লুথার কিং এটা বলেছিলেন, তবে এই কনসেপ্টটি তারও বহু আগে ধর্মীয় উপাসনালয়ের স্থপতিদের কাছে সুপরিচিত ছিলো।
ব্রুডার আর সিনস্কি উপর থেকে চোখ নামিয়ে নীচের দিকে তাকালে ল্যাংডন তাদের দিকে ফিরলো।
“জিসাস,” ব্রুডার বললো।
“হ্যাঁ!” উত্তেজিত কণ্ঠে বললো মিসরাত। “আল্লাহ এবং মোহাম্মদও আছে!”
বেদীর উপরে মোজাইক করা জিশুর দিকে চেয়ে আছে ব্রুডার, সেই ছবির দু’পাশে নক্সা করা ক্যালিওগ্রাফিতে মোহাম্মদ আর আল্লাহু লেখা আছে। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে তাদের গাইড এটা বলতেই ল্যাংডনের ঠোঁটে মুচকি হাসি দেখা গেলো।
“এই জাদুঘরটি,” বললো মিসরাত, “দর্শনার্থীদেরকে এর বৈচিত্রপূর্ণ ব্যবহারের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এটা যখন খৃস্টানদের ব্যাসিলিকা ছিলো তখনকার আইকনোগ্রাফি আর পরবর্তীতে মসজিদ হিসেবে ব্যবহৃত হবার সময় ইসলামিক আইকনোগ্রাফিগুলো পাশপাশি অবস্থান করছে এখানে। গর্বিত হাসি ফুটে উঠলো তার মুখে। বাস্তব জীবনে এ দুই ধর্মের মানুষের মধ্যে যতো সংঘাত আর দ্বন্দ্বই থাকুক না কেন আমরা মনে করি তাদের সিম্বলগুলো এখানে চমৎকারভাবেই সহাবস্থান করছে। আমি জানি আমার এ কথার সাথে আপনি একমত, প্রফেসর।”
আন্তরিকভাবেই মাথা নেড়ে সায় দিলো ল্যাংডন। খৃস্টিয় সিম্বলগুলোর পাশাপাশি মুসলিম সিম্বলগুলো এক ধরণের মনোমুগ্ধকর আবহ তৈরি করেছে। এর কারণ তাদের স্টাইল এবং ধ্যানধারণা একেবারেই বিপরীতমুখী।
খৃস্টান ঐতিহ্যে ঈশ্বর আর সেন্টদের ছবি বেশ ভালোমতোই গ্রহণযোগ্য, কিন্তু ইসলামে এটা নিষিদ্ধ বিষয়। তারা বরং ক্যালিওগ্রাফি আর জ্যামিতিক প্যাটার্নের মাধ্যমেই ঈশ্বরকে তুলে ধরে। ইসলাম বলে শুধুমাত্র সৃষ্টিকতইি প্রাণের সৃষ্টি করতে পারেন তাই মানুষের উচিত নয় প্রাণীর ছবি আঁকা-সৃষ্টিকতা, মানুষ এমনকি জীবজন্তুর ছবিও নয়।
ল্যাংডনের মনে পড়ে গেলো একবার তার ছাত্রছাত্রিদেরকে এই বিষয়টা বোঝানোর চেষ্টা করেছিলো সে : “উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একজন মুসলিম মাইকেলাঞ্জেলো কখনই সিস্টিন চ্যাপেলের ছাদে ঈশ্বরের ছবি আঁকতেন না, তিনি বরং ঈশ্বরের নামটি লিখে দিতেন। ঈশ্বরকে ছবির মাধম্যে তুলে ধরাটা হতো ব্লাসফেমি সমতুল্য অপরাধ।”
এর কারণও ব্যাখ্যা করেছিলো ল্যাংডন।
“খৃস্টান আর ইসলাম ধর্ম হলো লোগোসেন্ট্রিক,” ছাত্রছাত্রিদেরকে বলেছিলো সে, “এর মানে তারা জোর দেয় ঈশ্বরের বাণীতে। খৃস্টানধর্মে এই বাণী হয়ে ওঠে রক্তমাংসের মনুষে, বুক অব জন-এ আছে : ঈশ্বরে বাণী মানুষ আকারে উপস্থিত হয়, আর তিনি আমাদের মাঝেই বিচরন করেন। এজন্যে ঈশ্বরের বাণীকে মানবিক আকৃতিতে ফুটিয়ে তোলাটা গ্রহণযোগ্য। কিন্তু ইসলামে সৃষ্টিকর্তার বাণী মানুষ হিসেবে প্রতিভাত হয় না, সেজন্যে বাণীকে বাণীর আকারেই রাখতে হয়…বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ক্যালিওগ্রাফিতে ইসলামের মহান ব্যক্তিদের নাম অঙ্কিত হয়।”
ল্যাংডনের এক ছাত্র এই জটিল বিষয়টিকে সহজ-সরল আর ছোট্ট একটি বাক্যে বর্ণনা করেছিলো : “খৃস্টানরা মুখ পছন্দ করে, মুসলমানেরা শব্দ।”
“এখানে আপনারা দেখতেই পাচ্ছেন,” ঘরের দিকে ইঙ্গিত করে বললো। “ইসলামের সঙ্গে খৃস্টান ধর্মের একটি অনন্য সংমিশ্রণ।”
বিশাল আকৃতির বেদীর দিকে ইঙ্গিত করলো সে। কুমারিমাতা এবং তার সন্তান মিহরাব-এর উপর থেকে চেয়ে আছে। মসজিদের ইমাম সাহেব যেখানে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করেন সেই পশ্চিম দিকের খিলানসদৃশ্য জায়গাটিকে মুসলিম ঐতিহ্যে মিহরাব বলে। কাছেই কয়েকটি ধাপের একটি সিঁড়ি আছে, ওটা উঠে গেছে মিনবার-এর দিকে। এই মিনবার-এ বসে জুম্মার দিন ইমাম সাহেব খুতবা পাঠ করেন। এটা অনেকটা খৃস্টিয় সারমন দেবার জন্য চার্চ কিংবা ক্যাথেড্রালে যে ধরণের প্লাটফর্ম ব্যবহৃত হয় সেরকম দেখতে। তার কাছেই ডায়াসসদৃশ্য একটি স্থাপনা আছে, ওটার সাথে আবার খৃস্টান কয়্যার স্টলের বেশ মিল, তবে এখানে এটা মুয়াজ্জিন মাহফিল-মুয়াজ্জিনের জন্য বরাদ্দকৃত জায়গা।
“মসজিদ আর ক্যাথেড্রালের মধ্যে অসম্ভব মিল রয়েছে, মিসরাত বলতে লাগলো। “পূর্ব আর পশ্চিমের ঐতিহাকে আপনারা যতোটা ভিন্নধর্মী মনে করেন আসলে ততোটা কিন্তু নয়!”
“মিসরাত?” অধৈর্য হয়ে বলে উঠলো ব্রুডার। “আমরা দান্দোলোর সমাধি দেখতে চাচ্ছিলাম।”
একটু বিরক্ত হলো মিসরাত, যেনো এভাবে তাড়া দিয়ে পবিত্র এই স্থাপনাকে অপমান করা হয়েছে।
“হ্যাঁ,” ল্যাংডন বললো। “তাড়াহুড়া করার জন্য আমরা সত্যি দুঃখিত কিন্তু আমাদের হাতে সময় খুব বেশি নেই।”
“ঠিক আছে তাহলে,” বললো মিসরাত, ডান দিকের একটি উঁচু বেলকনির দিকে ইঙ্গিত করলো সে। “উপরে চলুন। ওটা এখানে আছে।”
“উপরে?” চমকে উঠলো ল্যাংডন। “এনরিকো দান্দোলোর সামাধিটি কি মাটির নীচে ক্রিপ্টে থাকার কথা নয়?”
ল্যাংডনের শুধু সমাধিটির কথা মনে আছে, কিন্তু সেটা এই ভবনের কোথায় অবস্থিত সে জানে না। ভুলে গেছে। তার কেবল মনে আছে অন্ধকারাচ্ছন্ন একটি আন্ডারগ্রাউন্ডের কথা।
মিসরাতকে দেখে মনে হলো সে একটু অবাকই হয়েছে। “না, প্রফেসর, এনরিকো দান্দোলোর সমাধিটি অবশ্যই উপরতলায়।”
এসব কি হচ্ছে? অবাক হয়ে মনে মনে বললো মিসরাত।
ল্যাংডন যখন দান্দোলোর সমাধি দেখতে চাইলো তখন মিসরাত আঁচ করতে পেরেছিলো এটা আসলে এক ধরণের ছুতো। কেউ দান্দোলোর সমাধি দেখতে চায় না। মিসরাত বুঝতে পারছে ল্যাংডন আসলে দান্দোলোর সমাধির পাশে যে রহস্যময় দিসিস মোজাইক আছে সেটা দেখার জন্য এ কথা বলেছে। এই জিনিসটা আসলে জিশু খৃস্টের বহু প্রাচীন একটি মোজাইকের ছবি। সবাই মনে করে এটা এই ভবনের সবচাইতে রহস্যময় শিল্প।
ল্যাংডন সাহেব আসলে মোজাইকটি রিসার্চ করতে এসেছেন, চেষ্টা করছেন ব্যাপারটা যেনো গোপন থাকে, আন্দাজ করলো মিসরাত। সম্ভবত প্রফেসর দিসিস-এর উপর গোপন কিছু লিখছেন।
কিন্তু মিসরাত একটু অবাক এজন্যে যে ল্যাংডন ভালো করেই জানে দিসিস মোজাইকটি দ্বিতীয় তলায়, তাহলে খামোখা কেন এই না জানার ভান করা হচ্ছে?
যদি না সে আসলেই দান্দোলোর সমাধিটি দেখতে চায়? মিসরাত তাদেরকে সিঁড়ির দিকে নিয়ে গেলো, যাবার সময় তারা অতিক্রম করে গেলো হাজিয়া সোফিয়ার দুটো বিশাল আকারের পাত্র-অখণ্ড মার্বেলে তৈরি ৩৩০ গ্যালনের নক্সা করা এক একটি দানবীয় পাত্র। হেলেনিস্টিক আমলে এগুলো তৈরি করা হয়েছিলো।
সিঁড়ি দিয়ে চুপচাপ ওঠার সময় মিসরাতের মনে হলো ল্যাংডনের কলিগদেরকে দেখে ঠিক একাডেমিক বলে মনে হচ্ছে না। একজনকে তো রীতিমতো সৈনিক বলেই মনে হচ্ছে। পেশীবহুল আর কাঠখোট্টা টাইপের। পরে আছে কালো পোশাক। আর সাদা-চুলের মহিলাকে মনে হচ্ছে আগে কোথাও দেখেছে সে। সম্ভবত টিভিতে?
এই ভিজিটের উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ করতে শুরু করলো সে। তারা আসলে কী জন্যে এখানে এসেছে?
“আরেকটা সিঁড়ি উঠতে হবে,” ল্যাডিংয়ে আসার পর বললো মিসরাত। “উপরতলায় আমরা দান্দোলোর সমাধিটি দেখতে পাবো-” একটু থেমে ল্যাংডনের দিকে তাকালো সে-”সেই সাথে বিখ্যাত দিসিস মোজাইকটি।
একটুও ভাবান্তর দেখা গেলো না তার মধ্যে। মনে হলো ল্যাংডন এখানে দিসিস মোজাইক দেখতে আসে নি। সে আর তার সাথে থাকা দু’জনের যতো আগ্রহ ঐ দান্দোলোর সমাধিটি নিয়ে।
.
অধ্যায় ৮৯
মিসরাতের সাথে সিঁড়িয়ে দিয়ে উপরে ওঠার সময় ব্রুডার আর সিনস্কির চেহারা দেখে ল্যাংডন বুঝতে পারলে তারা কী ভাবছে। এর কোনো মানেই হয় না। জোবরিস্টের ভূ-গর্ভস্থ গুহার ছবিটা ভেসে উঠলো তার চোখে…সেইসাথে হাজিয়া সোফিয়ার নীচে জলমগ্ন স্তরের উপর ডকুমেন্টারি ফিল্মটি।
আমাদের তো নীচে যাওয়া দরকার!
এখানে যদি দান্দোলোর সমাধি থেকেও থাকে তারপরও তাদেরকে জোবরিস্টের নির্দেশিত পথেই অগ্রসর হতে হবে। পবিত্র জ্ঞানের স্বর্ণালী মউজিওনে হাটু গেড়ে মেঝেতে কান পেতে শোনো গড়িয়ে পড়া পানির শব্দ।
দ্বিতীয় তলায় আসার পর মিসরাত তাদেরকে ডান দিকের বেলকনির কাছ ঘেষে নিয়ে যেতে লাগলো। এখান থেকে নীচের স্যাঙ্কচুয়ারিটা আরো অদ্ভুত দেখায়। মুখ সরিয়ে নিলো ল্যাংডন। তার এখন এসব দিকে মনোযোগ না দেয়াই ভালো।
দিসিস মোজাইক নিয়ে হরবর করে কথা বলে যাচ্ছে মিসরাত, সেসবে ল্যাংডন কর্ণপাত করছে না মোটেও। এখন সে তার টার্গেটটাকে দেখতে পাচ্ছে।
দান্দোলোর সমাধি।
তার যেমনটি স্মরণে ছিলো ঠিক সেরকমই দেখতে পেলো-পালিশ করা। মেঝেতে আয়তক্ষেত্রের সাদা মার্বেলের সমাধি। চারপাশে শেকল দিয়ে ঘেরা।
ওটার কাছে ছুটে গিয়ে পাথরে খোদাই করা লেখাটা পড়লো ল্যাংডন।
হেনরিকাস ডাভোলো।
বাকিরা তার পেছনে এসে দাঁড়াতেই ল্যাংডন কাজে নেমে পড়লো। শেকলটা ডিঙিয়ে সমাধির কাছে হাটু গেড়ে বসে পড়লো সে, যেনো প্রার্থনা করবে এখন।
মিসরাত চিৎকার করে বাধা দিলেও ল্যাংডন তাতে ভ্রূক্ষেপ করলো না। বিশ্বাসঘাতক ডজ-এর সামনে প্রার্থনায়রত সে।
এরপর ল্যাংডন সমাধির উপরে তার হাত রেখে মাথা নীচু করতেই মিসরাতের ভেতর থেকে আরেকটি আর্তনাদ বেরিয়ে এলো। মাথা নীচে নামিয়ে মেঝেতে চোখ রাখতেই ল্যাংডনের মনে হলো সে মক্কার দিকে কেবলা করে আছে। এটা দেখে মিসরাত বিস্ময়ে চুপ মেরে গেলে সঙ্গে সঙ্গে।
গভীর করে দম নিয়ে ডান দিকে মাথা ঘুরিয়ে বাম কানটা আস্তে করে রাখলো সমাধির মার্বেলের উপরে। পাথরের শীতলতা টের পেলো সে।
যে শব্দ শুনতে পেলো সেটা একেবারে দিনের আলোর মতোই পরিস্কার।
হায় ঈশ্বর।
মনে হচ্ছে দান্তের ইনফার্নো নীচ থেকে প্রতিধ্বনি করে উপরে উঠে আসছে।
আস্তে করে মাথা তুলে ব্রুডার আর সিনস্কির দিকে তাকালো সে।
“আমি ওটা শুনতে পাচ্ছি,” ফিসফিসিয়ে বললো। “পানি পড়ার শব্দ।”
ব্রুডার শেকলটা ডিঙিয়ে ল্যাংডনের পাশে বসে কান পাতলো। কয়েক মুহূর্ত পর মাথা নেড়ে সায় দিলো সে।
এখন তারা নীচে পানি প্রবাহের শব্দ শুনতে পাচ্ছে, বাকি রইলো শুধু একটি প্রশ্ন। কোথায় প্রবাহিত হচ্ছে?
হঠাৎ করেই ল্যাডনের চোখে জলমগ্ন গুহার ছবিগুলো ভেসে উঠলো, আধিভৌতিক লালচে আলোয় আলোকিত…নীচ থেকে জ্বলে উঠছে।
অনুসরন করে চলে যাও ঐ ডুবন্ত প্রাসাদের সুগভীরে
ওখানে অন্ধকারে থানিক দানব প্রতীক্ষায় আছে,
ডুবে আছে সেই রক্ত-লাল জলাধারে…
যে জলাধারে প্রতিফলিত হয় না আকাশের তারা।
ল্যাংডন উঠে দাঁড়াতেই দেখতে পেলো মিসরাত তার দিকে কটমট চোখে চেয়ে আছে, যেনো তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে। এই তুর্কি গাইডের চেয়ে ল্যাংডন কমপক্ষে একফুট লম্বা।
“মিসরাত,” বললো সে। “আমি দুঃখিত। আপনি দেখতেই পাচ্ছেন, এটা খুবই অন্য রকম একটি পরিস্থিতি। সবটা খুলে বলার মতো সময় আমাদের নেই। তবে এই ভবনের ব্যাপারে আপনার কাছে গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন করবো আমি।”
দুর্বলভাবে সায় দিলো তুর্কি। “ঠিক আছে।”
“এই দান্দোলোর সমাধির নীচে আমরা পানি প্রবাহের শব্দ শুনতে পেয়েছি। আমাদেরকে জানতে হবে এই পানি কোথায় প্রবাহিত হচ্ছে।”
মাথা ঝাঁকালো মিসরাত। “আমি বুঝতে পারছি না। তবে এখানকার সব মেঝেতে কান পাতলেই পানি প্রবাহের শব্দ শোনা যায়।”
সবাই শক্ত হয়ে গেলো।
“হ্যাঁ,” জোর দিয়ে বললো মিসরাত। “বিশেষ করে বৃষ্টির সময়। হাজিয়া সোফিয়ার রয়েছে প্রায় একলক্ষ বর্গফুট আয়তনের ছাদ, ছাদ থেকে বৃষ্টির পানি পড়তে কখনও কখনও কয়েক দিন লেগে যায়। প্রায়ই দেখা যায় পানি পুরোপুরি পড়ার আগে আবার বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। সুতরাং পানি পড়ার শব্দ এখানে সাধারণ ঘটনা। সম্ভবত আপনারা জানেন হাজিয়া সোফিয়া বিশাল বড় একটি পানির গুহার উপর অবস্থিত। এ নিয়ে তো একটা ডকুমেন্টারিও হয়েছে, যেখানে-”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ,” বললো ল্যাংডন, “কিন্তু আপনি কি জানেন দান্দোলোর সমাধির নীচে যে পানির শব্দ হয় সেটা ঠিক কোথায় প্রবাহিত হয়েছে?”
“অবশ্যই জানি,” বললো মিসরাত “হাজিয়া সোফিয়ার থেকে সব পানি যেদিকে প্রবাহিত হয় সেদিকে-শহরের জলাধারে।”
“না,” ব্রুডার বললো। “আমরা জলাধারের খোঁজ জানতে চাচ্ছি না। আমরা জানতে চাচ্ছি বিশাল ভূ-গর্ভস্থ কোনো জায়গার কথা, সম্ভবত ওখানে পিলারও আছে?”
“হ্যাঁ,” মিসরাত বললো। “এ শহরের প্রাচীন জলাধারটি এরকমই বিশাল আর অনেকগুলো পিলার রয়েছে সেখানে। জায়গাটা দেখতে খুবই সুন্দর। ষষ্ঠ শতাব্দীতে ওটা বানানো হয়েছিলো শহরের পানি সরবরাহের আধার হিসেবে। এখন ওই জায়গাটাতে কেবল চার ফুটের মতো পানি থাকে, তবে-”
“সেটা কোথায়!” ব্রুডারের আর তর সইলো না।
“ঐ জলাধারটির কথা বলছেন?” একটু ভীতকণ্ঠে জানতে চাইলো মিসরাত। “এক ব্লক দূরে হবে। এই ভবনের পূর্ব দিকে।” বাইরে দিকে আঙুল তুলে দেখালো সে। “জায়গাটার নাম ইয়েরেবাতান সারায়ি।”
সারাই? অবাক হলো ল্যাংডন। টপকাপি সারাই-এর মতো? “কিন্তু…সারাই মানে কি ‘প্রাসাদ’ নয়?”
মিসরাত মাথা নেড়ে সায় দিলো। “হ্যাঁ। আমাদের প্রাচীন জলাধারটির নাম ইয়েরিবাতান সারায়ি। এর মানে-ডুবন্ত প্রাসাদ।”