ইনফার্নো – ড্যান ব্রাউন
অনুবাদ: মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন
সিম্বলজিস্ট রবার্ট ল্যাংডন জ্ঞান ফিরে নিজেকে আবিষ্কার করলো ফ্লোরেন্স শহরে। তার কি হয়েছে, কি ঘটেছে কিংবা কিভাবে এখানে এলো সে-সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই। স্মৃতিভ্রষ্ট ল্যাংডনের মাথায় প্রতিধ্বণিত হতে থাকে একটি কথা : ‘খুঁজলেই পাবে।’ তার জামার পকেটে পাওয়া যায় অদ্ভুত আর ভীতিকর একটি জিনিস। এটা কোত্থেকে এলো তাও সে জানে না। তারপর ঘটতে থাকে একের। পর এক সহিংসতা। ঘটনাচক্রে তার সাথে জড়িয়ে পড়ে অদ্ভুত এক মেয়ে। তারা দু’জন জীবন বাঁচাতে পালিয়ে বেড়ায়, সেইসঙ্গে রহস্যের সমাধান করতে থাকে একটু একটু করে। অবশেষে সত্যটা যখন জানতে পারে তখন বুঝতে পারে শুধু তাদের জীবনই নয়, পুরো মানবজাতি মারাত্মক এক হুমকির মুখে নিপতিত। দ্য দা ভিঞ্চি কোড আর লস্ট সিম্বল-এর পর পাঠকের সামনে আবারো উপস্থিত জনপ্রিয় চরিত্র রবার্ট ল্যাংডন। ড্যান ব্রাউনের ইনফার্নো পাঠককে আরো একবার জড়িয়ে ফেলবে কোড, সিম্বল, ইতিহাস আর গোলকধাঁধাতুল্য ষড়যন্ত্রের জালে।
.
‘ট্রিকসে ভরপুর…সমস্ত বইজুড়ে অ্যাডভেঞ্চার আর অভিযান ছড়িয়ে আছে যা মি: ব্রাউন বেশভালোভাবেই সৃষ্টি করতে পেরেছেন’
–নিউইয়র্ক টাইমস
‘দ্রুতগতির, চাতুর্যপূর্ণ, তথ্যসমৃদ্ধ…ড্যান ব্রাউন বুদ্ধিদীপ্ত গ্লারের মাস্টার’
–দ্য ওয়াল স্টৃট জার্নাল
‘প্রাচীন ইতিহাস আর বৈশ্বিক ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে ব্রাউনই সেরা… তবে এবার কোনো গুপ্ত ইতিহাস নয়…নিকট ভবিষ্যতের গা শিউরে ওঠার মতো একটি দুর্যোগের কথা…যার ব্যাপারে আমরা বালিতে মুখ গুঁজে আছি’
–ওয়াশিংটন পোস্ট
‘ব্রাউন আমাদেরকে প্রচুর ইতিহাস আর সংস্কৃতির সাথে পরিচিত করান…তবে গল্পটাই সব সময় প্রাধান্য পায় তার কাছে। ইনফানের বেলায়ও এ কথা প্রযোজ্য’
–দ্য বোস্টন গ্লোব
‘ভয়ঙ্কর আনন্দ…ইনফানের জাল বোনা হয়েছে কোডেড মেসেজ, শিল্প-ইতিহাস, বিজ্ঞান আর ডুমস ডে’র উপর ভিত্তি করে’
-ডেইলি নিউজ
.
সর্বকালের সেরা বিক্রিত বই দ্য দা। ভিঞ্চি কোড-এর লেখক ড্যান ব্রাউন এর জন্য আমেরিকায়। সম্প্রতি টাইম ম্যাগাজিনের নির্বাচনে বিশ্বের সবচাইতে প্রভাবশালী ১০০ ব্যক্তির তালিকায় তার নাম স্থান পেয়েছে।
দ্য দা ভিঞ্চি কোড উপন্যাসটি এ পর্যন্ত বাংলা ভাষাসহ ৪১টি ভাষায় অনুদিত হয়েছে আর বিক্রি হয়েছে ১১০ মিলিয়ন কপিরও বেশি। ড্যান আমহার্স্ট থেকে গ্র্যাজুয়েশন। করে ইংরেজি শিক্ষক হিসেবে কিছুদিন চাকরি করেছেন। প্রেসিডেন্ট পদক পাওয়া গণিতের অধ্যাপক এবং ধর্মীয় সঙ্গীতকার মায়ের সন্তান হিসেবে বিজ্ঞান আর ধর্মের বিরোধপূর্ণ দর্শনের মধ্যে বেড়ে ওঠেছেন ড্যান ব্রাউন।
কোড ব্রেকিং আর ছদ্মবেশি সরকারি এজেন্সির প্রতি তার প্রচণ্ড আগ্রহের জন্যই দ্য দা ভিঞ্চি কোড লিখেছেন। বর্তমানে তিনি আর্ট হিস্টোরিয়ান এবং চিত্রশিল্পী স্ত্রী কেইট ব্লাইথের সাথে। আমেরিকার নিউ ইংল্যান্ডে বসবাস করছেন।
২০১০ সালে দ্য দা ভিঞ্চি কোড-এর বহুল প্রতীক্ষিত সিকুয়েল দ্য লস্ট সিম্বল প্রকাশিত হলে যথারীতি জনপ্রিয়তা লাভ করে।
.
মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন-এর জন্ম ঢাকায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটে এক বছর পড়াশোনা করলেও পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন।
বিশ্বমানের অসংখ্য জনপ্রিয় গৃলার অনুবাদ করার পর অবশেষে তার পর পর পাঁচটি মৌলিক গৃলার নেমেসিস, কন্ট্রাক্ট, নেক্সাস, কনফেশন এবং জাল প্রকাশিত হলে বিপুল পাঠকপ্রিয়তা লাভ করে। সেই অনুপ্রেরণা থেকে বর্তমানে তিনি বেশ কয়েকটি মৌলিক গৃলার লেখার কাজ করে যাচ্ছেন। তার পরবর্তী থৃলার উপন্যাস ১৯৫২. পহেলা বৈশাখ, নেক্সট, এবং ম্যাজিশিয়ান প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে।
সাড়া জাগানো উপন্যাস দ্য দা ভিঞ্চি কোড, লস্ট সিম্বল, ইনফার্নো, গডফাদার, বর্ন আইডেন্টিটি, বর্ন আলটিমেটাম, দ্য ডে অব দি জ্যাকেল, দ্য সাইলেন্স অব দি ল্যাম্ব, রেড ড্রাগন, ডিসেপশন পয়েন্ট, আইকন, মোনালিসা, পেলিকান বৃফ, এ্যাবসলিউট পাওয়ার, ওডেসা ফাইল, ডগস অব ওয়ার, অ্যাভেঞ্জার, দান্তে ক্লাব, দ্য কনফেসর, স্লামডগ মিলিয়নেয়ার, দ্য গার্ল উইথ দি ড্রাগন টাটু, ফায়ারফক্স এবং দ্য এইটসহ বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ অনুবাদও করেছেন তিনি।
.
ইনফার্নো – ড্যান ব্রাউন
অনুবাদ : মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন
[নরকের সবচাইতে অন্ধকারাচ্ছন্ন জায়গাটি তাদের জন্য বরাদ্দ রয়েছে যারা ভালো আর মন্দের সংঘাতের সময় নিজেদের নিরপেক্ষতা বজায় রাখে।]
.
তথ্য:
এ বইয়ে উল্লেখিত সমস্ত শিল্পকর্ম, সাহিত্য, বিজ্ঞান। এবং ঐতিহাসিক ঘটনাসমূহ সত্যি।
‘দ্য কনসোর্টিয়াম’ একটি বেসরকারী সংগঠন, বিশ্বের সাতটি দেশে এর অফিস রয়েছে। আসল নামটি নিরাপত্তা এবং প্রাইভেসির কারণে বদলে দেয়া হলো।
দান্তে অলিঘিয়েরির মহাকাব্য ‘দ্য ডিভাইন কমিডি’তে ইনফার্নো হলো ভূগর্ভস্থ একটি জগৎ, যেটাকে নরক হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে, ছায়া নামের কিছু অস্তিত্ব সেখানে বিরাজ করে-তারা জীবিত এবং মৃতের মাঝখানে ফাঁদে পড়ে যাওয়া আত্মা।
.
মুখ বন্ধ
আমি সেই ছায়া।
বিচরণ করি বিষাদময় শহরে।
আজন্ম বিষাদের মধ্য দিয়ে আমি ঘুরে বেড়াই সেখানে।
.
আরনো নদীর তীর ধরে আমি দম ফুরিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি…বাম দিকে ভায়া দেই কাস্তেলানির দিকে মোড় নিয়ে ছুটে চললাম উত্তরে, উফিজ্জির অন্ধকারের ভেতর দিয়ে।
তারপরও ওরা আমার পিছু ছাড়ছে না।
বিরামহীন দৃঢ়তার সাথেই ওরা আমাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে, ক্রমশ বাড়ছে ওদের পায়ের আওয়াজ।
অনেক বছ ধরে ওরা আমার পিছু নিচ্ছে। ওদের এই কর্মকাণ্ডের জন্য মাটির নীচে থাকতে হয়েছে আমাকে…বাধ্য হয়ে বেছে নিতে হয়েছে প্রায়শ্চিত্তের জীবন…মাটির নীচে খেটে মরতে হয়েছে থানিক দানবের মতো।
আমি সেই ছায়া।
এখানে মাটির উপর উঠে এসে উত্তর দিকে দৃষ্টি মেলোম কিন্তু ভোরের আলো বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে অ্যাপেনাইন পাহাড়, তাই মুক্তির পথ খুঁজে পেলাম না।
সুউচ্চ মিনার আর এক কাটার ঘড়ির পালাজ্জো অতিক্রম করলাম আমি…খুব সকালে পিয়াজ্জা দি সান ফিরেনজিতে সুস্বাদু খাবার বিক্রেতা আর তাদের কর্কশ কণ্ঠের মাঝে দিয়ে সাপের মতো এঁকেবেঁকে ছুটে চললাম। বারগেশ্লোর সামনে এসে পশ্চিম দিকে গেলাম বাদিয়ার সর্পিল গলি ধরে, তারপর হাজির হলাম সিঁড়ির গোড়ায় থাকা লোহার দরজার সামনে।
এখানে এসে সমস্ত দ্বিধা ঝেড়ে ফেলতে হয়।
হাতলটা ঘুরিয়ে ঢুকে পড়লাম ভেতরে, জানি ফিরে যাবার কোনো উপায় নেই। আমার ভারি পা দুটোকে তাড়া দিলামস সঙ্কীর্ণ আর সর্পিলভাবে উপরের দিকে উঠে যাওয়া ক্ষয়িষ্ণু মার্বেলের সিঁড়িগুলো দিয়ে ওঠার জন্য।
নীচ থেকে কণ্ঠস্বরগুলো প্রতিধ্বনি করলো। আকুতি জানালো।
তারা আমার পেছনেই, অনড় আর ক্রমশ কাছে এগিয়ে আসছে।
তারা যেমন জানে না কি ঘনিয়ে আসছে…তেমনি জানে না আমি তাদের সাথে কী করেছি!
অকৃতজ্ঞের দেশ!
উপরে উঠতেই হিমশিম খেয়ে দেখতে পেলাম…কামার্ত দেহগুলো কুকড়ে আছে অগ্নিবৃষ্টিতে, স্ফীত আত্মাগুলো ভাসছে জঘন্য মূত্রে, অবিশ্বস্ত খলেরা শয়তানের বরফশীতল হাতে বন্দী।
কোনোমতে শেষ ধাপ পেরিয়ে যখন উপরে উঠে এলাম তখন গুমোট ভোরে মৃতপ্রায় আমি।
মাথা সমান উঁচু দেয়ালের দিকে দৌড়ে গিয়ে ফুটোয় রাখলাম চোখ। নীচে, বহু দূরে সেই প্রিয় শহর যেখানে আমি আমার শান্তির নীড় নির্মাণ করেছিলাম সবার অগোচরে, যেখান থেকে ওরা আমাকে নির্বাসন দিয়েছে।
কণ্ঠস্বরগুলো ডাকলো আমায়, ওরা প্রায় চলে এসেছে আমার নাগালে। “কী পাগলের মতো কাণ্ড করছো তুমি!”
পাগলামি জন্ম দেয় পাগলামির।
“ঈশ্বরের দোহাই লাগে,” চিৎকার করে বললো ওরা, “ওটা কোথায় লুকিয়ে রেখেছো আমাদের বলো?”
ঈশ্বরের দোহাই, আমি তা বলবো না।
থমকে দাঁড়ালাম এককোণে, হিমশীতল পাথরের দেয়ালে পিঠ দিয়ে। ওরা আমার সবুজ চোখের দিকে তাকালো, ওদের অভিব্যক্তি বদলে গেলো মুহূর্তে, আর কোনো আকুতির বালাই নেই, শুধুই হুমকি। “তুমি আমাদের পদ্ধতিগুলো জানো। ওটা কোথায় আছে তা বলার জন্য তোমাকে বাধ্য করতে পারি।”
এ কারণেই আমি স্বর্গে আরোহন করছি।
হুট করে ঘুরে প্রান্তসীমা খামচে ধরে হাটুর উপর ভর দিয়ে সঙ্কীর্ণ খাঁজে কোনোরকমে নিজেকে দাঁড় করালাম। আমাকে এই ফাঁকা জায়গায় পথ দেখাও, প্রিয় ভার্জিল।
ওরা সামনে এগিয়ে এসে অবিশ্বাসে চেয়ে রইলো, আমার পা ধরতে চাইলো কিন্তু ভরসাম্য হারিয়ে পড়ে যাবে এই ভয়ে বিরত রাখলো নিজেদেরকে। মরিয়া হয়ে ওরা আমার কাছে কাকুতি-মিনতি জানালো, কিন্তু আমি ওদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলাম। আমি জানি আমাকে কি করতে হবে।
আমার অনেক নীচে, অসীম গহ্বরের মতো দেখাচ্ছে লাল রঙের টাইলের ছাদটা, যেনো দাবানলের মতো সমভূমিকে প্রজ্জ্বলিত করে রেখেছে, যেখানে একসময় গিওত্তো, দোনাতেল্লো, ব্রুনেলেশি, মাইকেলাঞ্জেলো আর বত্তিচেল্লি নামের দৈত্যেরা ঘুরে বেড়াতেন।
একটু একটু করে পা বাড়িয়ে প্রান্তসীমা দিয়ে এগিয়ে গেলাম আমি।
“নেমে এসো!” চিৎকার করে বললো ওরা। “এখনও সময় আছে!”
ওহে মূর্খের দল! তোমরা কি ভবিষ্যৎ দেখতে পাও না? তোমরা কি আমার সৃষ্টির মহিমা অনুধাবন করতে পারছে না। অনুধাবন করতে পারছে না অপরিহার্যতাকে?
আমি খুশিমনেই এই চুড়ান্ত আত্মত্যাগ করবো…এর মাধ্যমেই আমি ধূলিসাৎ করে দেবো তোমাদের খুঁজে পাবার সমস্ত আশা।
আর কখনওই তোমরা ওটা খুঁজে পাবে না।
শত শত ফুট নীচে পিয়াজ্জার নুড়ি পাথরগুলো শান্ত সমুদ্রের মতোই বিকিরিত করছে। আমি আর কতোটা সময় টিকে থাকতে পারবো…কিন্তু সময় এমনই এক পণ্য যা আমার বিশাল ঐশ্বর্যের বিনিময়েও কেনা সম্ভব নয়। শেষ মুহূর্তগুলোতে আমি নীচের পিয়াজ্জার দিকে তাকিয়ে যা দেখতে পেলাম সেটা আমাকে ঘাবড়ে দিলো।
আমি দেখতে পেলাম তোমার মুখ।
অন্ধকার থেকে তুমি আমার দিকে চেয়ে আছো। তোমার চোখ দুটো শোকগ্রস্ত তারপরও আমি যা করেছি তার জন্যে সেই দু’চোখে এক ধরণের শ্রদ্ধার আভাস। তুমি বুঝতে পেরেছো আমার কোনো উপায় ছিলো না। মানবজাতিকে ভালোবাসি বলেই আমার মাস্টারপিসটাকে রক্ষা করতে হবে।
এখনও ওটা বাড়ছে…অপেক্ষা করছে…এক রক্তলাল জলাধারের নীচ থেকে জ্বলজ্বল করছে…যেখানে প্রতিফলিত হয় না আকাশের তারা।
আর তাই আমি তোমার থেকে আমার চোখ সরিয়ে ফেললাম, তাকালাম দিগন্তের পানে। এই ভারাক্রান্ত পৃথিবীর অনেক উপরে আমি আমার শেষ প্রার্থনা করবো ঈশ্বরের কাছে।
প্রাণপ্রিয় ঈশ্বর, আমি প্রার্থনা করি এই দুনিয়া যেনো আমাকে মহাপাপী হিসেবে স্মরণ না করে, তারা যেনো আমাকে স্মরণ করে একজন ত্রাতা হিসেবে, তুমি তো জানো আমি সত্যি তাই। প্রার্থনা করি, আমি যা রেখে যাচ্ছি মানবজাতি যেনো সেটা অনুধাবন করতে পারে।
আমার এই দান হলো ভবিষ্যৎ।
আমার এই দান মোক্ষ।
আমার দান ইনফার্নো।
এই বলে আমি বিড়বিড় করে আমেন বলে অতল গহ্বরের দিকে পা বাড়ালাম।
.
অধ্যায় ১
স্মৃতিগুলো ধীরে ধীরে উদ্ভাসিত হলো… যেনো সুগভীর কোনো কুয়োর গহ্বর থেকে উঠে আসা বুদবুদের মতো।
ঘোমটা দেয়া এক নারী।
প্রবাহমান লাল টকটকে রক্ত-নদীর ওপার থেকে রবার্ট ল্যাংডন ঐ নারীর দিকে তাকালো। নদীর ওপারে তার মুখোমুখি নিশ্চল আর সম্ভ্রমের সাথে দাঁড়িয়ে আছে, একটা চাদরে ঢেকে রেখেছে মুখ। তার হাতে নীল রঙের টাইনিয়া কাপড়, পায়ের কাছে থাকা লাশের সমুদ্রকে সম্মান জানানোর জন্য ওটা তুলে ধরেছে সে। চারপাশে ভেসে বেড়াচ্ছে মৃতের গন্ধ।
খুঁজুন, ফিসফিস করে বললো সেই নারী। তাহলেই পাবেন।
কথাগুলো ল্যাংডন এমনভাবে শুনতে পেলো যেনো তার মাথার ভেতরে উচ্চারিত হয়েছে। “আপনি কে?” চিৎকার করে বললেও তার মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হলো না।
সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে, ঐ নারী আবারো ফিসফিসিয়ে বললো, খুঁজলেই পাবেন।
নদীর দিকে এক পা বাড়ালো ল্যাংডন কিন্তু দেখতে পেলো পানির রঙ রক্তবর্ণের আর এতোটাই গভীর যে পার হতে পারবে না।
মহিলা তার দিকে এগিয়ে এলো, বাড়িয়ে দিলো সরু দু’হাত, যেনো সাহায্যের ইঙ্গিত।
“আপনি কে?” আবারো চিৎকার করে বললো ল্যাংডন।
এর প্রতিক্রিয়ায় মহিলা আস্তে করে তার ঘোমটা খুলে মুখ দেখালো। অসম্ভব সুন্দর একজন নারী, অবশ্য ল্যাংডন যেমনটি আশা করেছিলো তারচেয়ে একটু বেশি বয়স্ক-সম্ভবত ষাটের কোঠায়, তবে অবিনশ্বর কোনো মূর্তির মতোই ঋজু আর শক্তিশালী। তার মুখের চোয়াল বেশ সুদৃঢ়, চোখ দুটো ভীষণ আবেগময়, কাঁধ পর্যন্ত ছড়ানো সাদা চুলগুলো হালকা কোকড়ানো। তার গলায় জড়ানো নীল রঙের একটি অলংকার-চিকন একটি সাপ।
ল্যাংডনের মনে হলো এই মহিলাকে সে চেনে…তাকে বিশ্বাস করতে পারে। কিন্তু কিভাবে চেনে? কেন বিশ্বাস করবে?
এক জোড়া বাঁকানো পায়ের দিকে ইশারা করলো মহিলা, কোনো এক অভাগাকে মাথা থেকে কোমর পর্যন্ত উপুড় করে মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়েছে, শুধু পা জোড়া বের হয়ে আছে মাটির উপরে। লোকটার ফ্যাকাশে উরুতে একটা অক্ষর কাদা দিয়ে লেখা-R।
R? ল্যাংডন বুঝতে না পেরে ভাবলো। এ দিয়ে কি রবার্ট বোঝানো হয়েছে? “এটা কি…আমি?”
মহিলার অভিব্যক্তি দেখে কিছুই বোঝা গেলো না। আবারো বলে উঠলো, খুঁজলেই পাবে।
বলা নেই কওয়া নেই আচমকা সেই মহিলার সারা শরীর সাদা আলো বিকিরন করতে শুরু করলো…উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বল হতে লাগলো সেই আলো। তার সমস্ত শরীর প্রচণ্ডভাবে কাঁপছে, তারপর বজ্রপাতের মতোই হাজার হাজার আলোর টুকরোয় বিস্ফোরিত হলো সে।
ঘুম থেকে জেগে সোজা হয়ে বসলো ল্যাংডন। চিৎকার দিলো।
ঘরটা আলোকিত। সে ছাড়া আর কেউ নেই। হাসপাতালের অ্যালকোহলের কটু গন্ধ বাতাসে। ঘরের এককোণে কোথাও একটা মেশিন তার হৃদস্পন্দনের সাথে সাথে পিপ-পিপ করে শব্দ করছে। ডান হাতটা নড়ানোর চেষ্টা করলো কিন্তু তীক্ষ্ণ যন্ত্রণার কারণে বিরত রইলো সে। হাতটার দিকে তাকাতেই দেখতে পেলো বাহুতে স্যালাইনের উঁচ লাগানো।
তার নাড়িস্পন্দন বেড়ে গেলে মেশিনের আওয়াজটাও দ্রুতলয়ের হয়ে উঠলো।
আমি কোথায়? আমার হয়েছেটা কি?
ল্যাংডনের মাথার পেছন দিকটা দপদপ করে ব্যথা করছে। বাম হাতটা দিয়ে সেখানটা ধরে দেখলো ঠিক কোথায় ব্যথা হচ্ছে। টের পেলো জমাট বেধে থাকা চুলের মাঝখানে এক ডজনের মতো সেলাই করা আছে।
চোখ বন্ধ করে স্মরণ করার চেষ্টা করলো দুর্ঘটনাটার কথা।
কিছুই মনে পড়লো না। একেবারে ফাঁকা।
ভাবো।
শুধুই অন্ধকার।
ল্যাংডনেরে হার্ট-মনিটরের শব্দ শুনে স্ক্রাব পরা এক লোক ছুটে এলো। উসকোখুশকো দাড়ি, ভারি গোঁফ আর মোটা ভুরুর নীচে বুদ্ধিদীপ্ত চোখ জোড়া জ্বলজ্বল করছে।
“কি হয়েছে?” কোনোমতে বলতে পারলো ল্যাংডন। “আমার কি কোনো দুর্ঘটনা হয়েছে?”
দাড়িওয়ালা লোকটি তাকে চুপ করে থাকার ইশারা করেই ঘর থেকে দ্রুত বের হয়ে গেলো কাউকে ডেকে আনার জন্য।
ল্যাংডন ঘাড় ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করতেই মাথায় তীব্র ব্যথা টের পেলো। গভীর করে দম নিয়ে ব্যথাটা সহ্য করলো সে। তারপর খুব আস্তে আস্তে চারপাশে তাকালো।
হাসপাতালের একটি রুম। একটাই বেড। কোনো ফুল নেই। কার্ড নেই। কাছে একটা কাউন্টারের উপর প্লাস্টিকের ব্যাগের ভেতরে নিজের জামাকাপড়গুলো দেখতে পেলো। সেগুলোতে রক্ত লেগে আছে।
হায় ঈশ্বর। খুব খারাপ কিছু হয়েছিলো তাহলে!
মাথা ঘুরিয়ে বেডের পাশে জানালার দিকে তাকালো ল্যাংডন। বাইরে গভীর অন্ধকার। রাত। জানালার কাঁচে শুধু নিজের প্রতিফলনই দেখতে পেলো-ফ্যাকাশে মুখ। ক্লান্ত। শরীরে টিউব আর মেডিকেল ইকুইপমেন্ট লাগানো।
হল থেকে ভেসে আসা মানুষের কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে ঘরের দিকে ফিরে তাকালো ল্যাংডন। ডাক্তার এক মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে এসেছে।
মেয়েটির বয়স বড়জোর ত্রিশ হবে। নীল রঙের স্ক্রাব পরা, চুলগুলো পনি টেইল করে বাধা। হাটার সময় ঝুটিটা দোল খায়।
“আমি ডাক্তার সিয়েনা ব্রুকস,” ঘরে ঢুকেই সুন্দর করে হেসে বললো মেয়েটি। “আমি আজ রাতে ডাক্তার মারকোনির সাথে কাজ করবো।”
দুর্বলভাবে মাথা নেড়ে সায় দিলো ল্যাংডন।
লম্বা আর হালকা পাতলা। অ্যাথলেটদের মতোই ডাক্তার ব্রুকস হাটাচলা করে। ল্যাংডন আরো দেখতে পেলো কোনো রকম মেকআপ ছাড়াই তার ত্বক বেশ মসৃণ দেখাচ্ছে। শুধুমাত্র ঠোঁটের উপরে ছোট্ট একটা বিউটি স্পট আছে। তার বাদামী চোখ দুটো অস্বাভাবিকরকম অন্তর্ভেদী, যেনো এই বয়সেই অসংখ্য বিরল ঘটনা প্রত্যক্ষ করে ফেলেছে।
“ডাক্তার মারকোনি খুব একটা ইংরেজি বলতে পারেন না,” বেডের পাশে বসতে বসতে বললো সে, “উনি বললেন আপনার অ্যাডমিটেন্স ফর্মটা ফিল-আপ করে দিতে।” মুচকি হাসলো আবারো।
“ধন্যবাদ,” বললো ল্যাংডন।
“ওকে,” এবার কাজের কথা চলে এলো সে। “আপনার নাম কি?”
কথাটা বুঝতে কয়েক মুহূর্ত লেগে গেলো। “রবার্ট… ল্যাংডন।”
ল্যাংডনের চোখে একটা পেনলাইট ধরলো মেয়েটি। “পেশা?”
আস্তে করে জবাব দিলো সে। “প্রফেসর। শিল্প-ইতিহাস আর সিম্বলজির। হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি।”
ডাক্তার ব্রুকস চমকে উঠে পেনলাইটটা নামিয়ে ফেললো। ডাক্তার মারকোনিও ভুরু তুলে বিস্ময় প্রকাশ করলেন।
“আপনি…একজন আমেরিকান?”
ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো ল্যাংডন।
“মানে…” ইতস্তত করে বললো মেয়েটি। আজ রাতে আপনাকে যখন এখানে নিয়ে আসা হয় তখন আপনার সাথে কোনো পরিচয়পত্র ছিলো না। আপনার পরনে ছিলো হ্যারিস টুইড আর সমারসেট লোফার, তাই আমরা ধরে নিয়েছিলাম আপনি একজন বৃটিশ।”
“আমি একজন আমেরিকান, তাকে আশ্বস্ত করে বললো ল্যাংডন। এতোটাই ক্লান্ত যে নিজের জামা-কাপড় নিয়ে ব্যাখ্যা দেবার কোনো ইচ্ছে নেই।
“যন্ত্রণা হচ্ছে?”
“মাথায়,” উজ্জ্বল পেনলাইটের কারণে তার মাথা ব্যথাটা আরো বেড়ে গেছে।
ভালো যে মেয়েটি পকেটে ভরে ফেললো সেটা। ল্যাংডনের হাত নিয়ে পাস চেক করতে লাগলো এবার।
চিৎকার করে ঘুম থেকে উঠে গেছেন আপনি, মেয়েটি বললো। “কেন এমন করেছেন সেটা কি মনে আছে?”
চারপাশে দোমড়ানো মোচড়ানো লাশের মাঝখানে ঘোমটা দেয়া মহিলার কথা মনে পড়লো ল্যাংডনের। খুঁজলেই পাবেন। “একটা দুঃস্বপ্ন দেখছিলাম।”
“কি নিয়ে?”
মেয়েটাকে খুলে বললো সে।
ক্লিপবোর্ডে নোট নেবার সময় ডাক্তার ব্রুকসের অভিব্যক্তি একদম নির্বিকার রইলো। “এরকম ভয়ঙ্কর দৃশ্য কেন দেখলেন সে ব্যাপারে কি কোনো ধারণা আছে আপনার?”
স্মৃতি হাতরে বিফল হলো ল্যাংডন। মাথা দোলালো সে।
“ঠিক আছে, মি: ল্যাংডন,” লিখতে লিখতে বললো মেয়েটি, “আপনাকে কিছু রুটিন প্রশ্ন করবো। আজ সপ্তাহের কোন্ দিন?”
কয়েক মুহূর্ত ভাবলো সে। “আজ শনিবার। মনে আছে, ক্যাম্পাসে হাটছিলাম…দুপুরে একটা লেকচার দিতে যাচ্ছিলাম আর কি, তারপর…এ পর্যন্তই। মনে আছে। আর কিছু মনে করতে পারছি না। আচ্ছা, আমি কি পড়ে গেছিলাম?”
“আমরা সেটা নিয়ে পরে কথা বলবো। আপনি কি জানেন এখন কোথায় আছেন?”
আন্দাজে বললো ল্যাংডন, “ম্যাসাচুসেটসের জেনারেল হাসপাতালে?”
ডাক্তার ব্রুকস টুকে নিলো কথাটা। “এমন কেউ কি আছে যাকে ডাকা যেতে পারে? মানে আপনার স্ত্রী? ছেলেমেয়ে?”
“এরকম কেউ নেই, সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলো ল্যাংডন। নিজের একাকী ব্যাচেলর জীবনটা সে ভালোই উপভোগ করে। যদিও এখন এই পরিস্থিতিতে পরিবারের কোনো সদস্য কাছে থাকলে সে খুশিই হতো। আমার কিছু কলিগ আছে যাদেরকে ডাকা যেতে পারে তবে আমি ভালো আছি। ওদেরকে ডাকার কোনো দরকার নেই।”
ডাক্তার ব্রুকস নোট টুকে নেবার পর বয়স্ক ডাক্তার কাছে এগিয়ে এলেন। পকেট থেকে ছোট্ট একটা ভয়েস রেকর্ডার বের করে ডাক্তার ব্রুকসকে দেখালেন তিনি। মেয়েটা বুঝতে পেরে মাথা নেড়ে সায় দিয়ে আবার রোগির দিকে ফিরলো।
“মি: ল্যাংডন, আজরাতে আপনাকে যখন এখানে নিয়ে আসা হয় তখন বার বার বিড়বিড় করে কী যেনো বলছিলেন।”
ডাক্তার মারকোনির দিকে তাকালো সে। ভদ্রলোক রেকর্ডারটার বাটন টিপে ধরে রাখলেন। একটু পরই রেকর্ড করা একটি টেপ বেজে উঠলে ল্যাংডন বুঝতে পারলো এটা তার নিজেরই কণ্ঠস্বর, যেনো প্রলাপ বকছে। বার বার একই কথা বলছে সে : “ভে…সরি। ভে…সরি।”
“বুঝতে পারছি আপনি আসলে বলতে চাচ্ছিলেন, ভেরি সরি! ভেরি সরি! বোঝাই যাচ্ছে কোনো একটা ব্যাপারে আপনি খুবই দুঃখিত ছিলেন।”
সায় দিলো ল্যাংডন কিন্তু কখন এটা বলেছে মনে করতে পারলো না।
চোখমুখ শক্ত করে ডাক্তার ব্রুকস স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। “এ কথা কেন বলছিলেন সে ব্যাপারে কি আপনার কোনো ধারণা আছে?”
স্মৃতির অন্ধকার গহ্বর থেকে কিছু একটা মনে করার চেষ্টা করলো সে কিন্তু ঘোমটা দেয়া মহিলার দৃশ্যটাই আবার ভেসে উঠলো মনের পর্দায়। চারপাশে লাশ আর লাশ। তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে।
আচমকা বিপদের আশংকা জেগে উঠলো ল্যাংডনের মনে…তার নিজের জন্যে নয়, সবার জন্যে। তার হার্ট-মনিটরের পিপ পিপ শব্দটাও বেড়ে গেলো সেই সঙ্গে। মাংপেশী শক্ত হয়ে উঠলো, উঠে বসার চেষ্টা করলো সে।
ডাক্তার ব্রুকস শক্ত করে ধরে তাকে শুইয়ে দিলো আবার। দাড়িওয়ালা ডাক্তারের দিকে চকিতে তাকালো সে। ভদ্রলোক কাউন্টারের সামনে গিয়ে কিছু একটা প্রস্তত করতে শুরু করে দিয়েছেন।
ল্যাংডনের দিকে ঝুঁকে ডাক্তার ব্রুকস ফিসফিসিয়ে বললো, “মি: ল্যাংডন, মস্তিষ্কের আঘাতের ঘটনায় উদ্বিগ্নতা বেড়ে যাওয়া সাধারণ ব্যাপার। কিন্তু আপনার দরকার হৃদস্পন্দন নিয়ন্ত্রণে রাখা। একদম নড়াচড়া করবেন না। একটুও উত্তেজিত হবে না। শুয়ে শুয়ে বিশ্রাম নিন, পুরোপুরি সেরে উঠবেন। আপনার স্মৃতিও ফিরে আসবে খুব জলদি।”
ডাক্তার ভদ্রলোক একটা সিরিঞ্জ বাড়িয়ে দিলো ব্রুকসের দিকে। সিরিঞ্জটা হাতে নিয়ে ল্যাংডনের আইভি’তে ইনজেক্ট করে দিলো মেয়েটি।
“আপনার উত্তেজনা প্রশমিত করার জন্য একটু সিডেটিভ দিয়ে দিলাম, বললো সে। “এটা আপনার ব্যথাও কমিয়ে দেবে।” চলে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালো ডাক্তার। “আপনি দ্রুত সেরে উঠবেন, মি: ল্যাংডন। শুধু ঘুমানোর চেষ্টা করুন। কোনো কিছু দরকার লাগলে বিছানার পাশে একটা বাটন আছে সেটা চাপবেন।”
বাতি নিভিয়ে দাড়িওয়ালা ডাক্তারকে নিয়ে বের হয়ে গেলো সে।
অন্ধকারে ল্যাংডনের মনে হলো এইমাত্র তার শরীরে যে ড্রাগ দেয়া হয়েছে সেটা দ্রুত কাজ করতে শুরু করেছে। যে সুগভীর কুয়ো থেকে উঠে এসেছিলো সেখানেই যেনো ফিরে যেতে শুরু করলো আবার। এই অনুভূতিটাকে তাড়ানোর চেষ্টা করলো সে, জোর করে ভোলা রাখলো চোখ দুটো। এমনকি উঠে বসারও চেষ্টা করলো কিন্তু তার শরীরটা যেনো সিমেন্টের মতো শক্ত হয়ে আছে।
মুখটা সরাতেই জানালার দিকে চোখ গেলো। বাতি নেভানোর কারণে কাঁচের উপর তার নিজের প্রতিফলন উধাও হয়ে গেছে, তার বদলে দেখা যাচ্ছে বহু দূরের আলোকিত স্কাইলাইন।
সুউচ্চ মিনার আর গম্বুজের মাঝখানে আটকে রইলো রাজকীয় একটি ভবনের উপর ল্যাংডনের দৃষ্টি। ভবনটি পাথরে তৈরি দূর্গের মতো, এর তিনশ’ ফিট উঁচু মিনার সহজেই চোখে পড়ে।
বিছানায় সোজা হয়ে বসতেই ল্যাংডনের মাথা ব্যথাটা যেনো বিস্ফোরিত হলো। প্রচণ্ড যন্ত্রণাটাকে আমলে না নিয়ে সেই মিনারের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখলো সে।
মধ্যযুগের স্থাপত্যগুলোর ব্যাপারে ল্যাংডনের বেশ ভালো ধারণা আছে।
এটা এ বিশ্বের মধ্যে একেবারেই অনন্য।
দুভাগ্যের ব্যাপার হলো, এটা ম্যাসাচুসেটস থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে অবস্থিত।
.
জানালার বাইরে ভায়া তোরেগাল্লির অন্ধকারে লুকিয়ে রাখা বিএমডব্লিউ বাইকটা থেকে নেমে প্যান্থারের মতো নিঃশব্দে শিকারের জন্য এগিয়ে যেতে লাগলো ভায়েন্থা। তার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। ছোটো ছোেটো করে ছাটা চুলগুলো জেল দিয়ে স্পাইক করা। কালো চামড়ার রাইডিং সুটের কলার তুলে রাখা হয়েছে। সাইলেন্সর পিস্তলটি চেক করে দেখে ল্যাংডনের জানালার দিকে তাকালো সে। বাতি নেভানোর কারণে কোনো আলো আসছে না।
আজকে তার মিশনটা পুরোপুরি গুবলেট পাকিয়ে গেছিলো।
একটা সামান্য কবুতরের বাকবাকুম আওয়াজও সব কিছু বদলে দিতে পারে।
এখন সে আবার ফিরে এসেছে কাজটা ঠিকঠাকভাবে করতে।
.
অধ্যায় ২
আমি ফ্লোরেন্সে আছি!?
রবার্ট ল্যাংডনের মাথা দপদপ করছে। এখন হসপিটাল বেডে সোজা হয়ে বসে আছে সে, কল-বাটনটা চেপে যাচ্ছে উদভ্রান্তের মতো। একটু আগে সিডেটিভ দেয়া হলেও তার হৃদস্পন্দন রীতিমতো হাতুড়ি পেটা করছে।
ডাক্তার ব্রুকস আবার ছুটে এলো তার পনিটেইল দোলাতে দোলাতে। “আপনি ঠিক আছেন তো?”
হতভম্ব ল্যাংডন মাথা ঝাঁকালো। “আমি…আমি ইটালিতে!?”
“ভালো,” মেয়েটি বললো। “আপনার স্মৃতি কাজ করতে শুরু করেছে।”
“না!” জানালা দিয়ে দূরের মিনারটা দেখালো আঙুল তুলে। “আমি পালাজ্জো ভেচ্চিওটা দেখে চিনতে পেরেছি।”
ডাক্তার ব্রুকস ঘরের বাতি জ্বালিয়ে দিতেই জানালার কাঁচ থেকে ফ্লোরেন্সের স্কাইলাইন উধাও হয়ে গেলো। বিছানার পাশে এসে নীচুস্বরে বললো সে, “মি: ল্যাংডন, ঘাবড়াবার কোনো দরকার নেই। আপনি অল্পবিস্তর অ্যামনেসিয়ায় ভুগছেন। তবে ডাক্তার মারকোনি নিশ্চিত করেছেন, আপনার মস্তিষ্ক পুরোপুরি ঠিকভাবেই কাজ করছে।”
দাড়িওয়ালা ডাক্তার ভদ্রলোকও ছুটে এলেন রুমে। ল্যাংডনের হার্ট-মনিটর চেক করার পর ডাক্তার ব্রুকসের সাথে ইতালিতে কথা বলতে লাগলেন-ল্যাংডন যে ইটালিতে আছে সেটা জানার পর কি রকম আজিতাতো হয়ে উঠেছে সে ব্যাপারে।
ক্ষেপে গেছি? রেগেমেগে ভাবলো ল্যাংডন। এটা তো বাকরুদ্ধের চেয়েও বেশি কিছু! তার শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল একটি প্রবাহ বয়ে গেলো। আমার কি হয়েছে?” জানতে চাইলো সে। “আজ কি বার?”
“সব কিছু ঠিক আছে,” মেয়েটা বললো। “এখন সোমবার। রাত বারোটার কিছু বেশি বাজে। মার্চ মাসের আঠারো তারিখ।”
সোমবার। শেষ যে স্মৃতিটা তার মনে আছে সেটা জোর করে স্মরণ করার চেষ্টা করলো ল্যাংডন-ঠাণ্ডা আর অন্ধকার-শনিবার রাতে লেকচার সিরিজ দেবার জন্য হারভার্ড ক্যাম্পাসে হেঁটে যাচ্ছে। এটা তো দুদিন আগের ঘটনা?! তার মধ্যে একটা ভয় জেঁকে বসলো মুহূর্তে। লেকচারের সময়টা আর তার পরবর্তীতে কি ঘটেছিলো সব স্মরণ করার চেষ্টা করলো, কিছুই মনে করতে পারলো না। হার্ট-মনিটরটার বিপ দ্রুত হয়ে উঠলো আবার।
বয়স্ক ডাক্তার ইকুইপমেন্ট অ্যাডজাস্ট করতে লাগলেন আর ডাক্তার ব্রুকস এসে বসলো ল্যাংডনের পাশে।
“আপনি সুস্থ হয়ে উঠবেন,” খুব মোলায়েমস্বরে বললো সে। “আমরা আপনার অ্যামনেসিয়ার ডায়াগনসড করছি। মাথার আঘাতে এটা খুবই সাধারণ ঘটনা। বিগত কয়েক দিনের স্মৃতি গুলিয়ে ফেলেছেন কিংবা বলা যায় ওগুলো হারিয়ে গেছে। তবে আপনার স্মৃতির স্থায়ী কোনো ক্ষতি হয় নি।” একটু থামলো মেয়েটি। “আমার নামটা কি আপনার মনে আছে? একটু আগে সেটা বলেছিলাম আপনাকে।”
একটু ভেবে নিলো ল্যাংডন। “সিয়েনা।” ডাক্তার সিয়েনা ব্রুকস।
হাসি দিলো মেয়েটি। “দেখলেন তো? আপনার স্মৃতিশক্তি আবার কাজ শুরু করেছে।”
ল্যাংডনের মাথার যন্ত্রণা অসহ্য পর্যায়ে চলে গেলো। দৃষ্টিও ঝাপসা ঝাপসা। “কি হয়েছিলো আমার? আমি এখানে এলাম কি করে?”
“আমার মনে হয় আপনার একটু বিশ্রাম নেয়া উচিত, হয়তো
“আমি এখানে কি করে এলাম?!” চিৎকার করে জানতে চাইলো সে। তার হার্ট-মনিটর আবারো দ্রুত বিপ করছে।
“ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস নিন, ঠিক আছে,” ডাক্তার ব্রুকস নার্ভাস ভঙ্গিতে তার কলিগের দিকে চকিতে তাকালো। আমি আপনাকে বলছি।” এবার তার কণ্ঠ খুবই সিরিয়াস। “মি: ল্যাংডন, তিন ঘণ্টা আগে আপনি আমাদের ইমার্জেন্সি রুমে হুরমুর করে ঢুকে পড়েন, আপনার মাথায় সাংঘাতিক আঘাত ছিলো, সেখান থেকে গলগল করে রক্ত পড়ছিলো। ঢোকার পর পরই আপনি জ্ঞান হারান। কেউ বলতে পারে নি আপনি কে, কোত্থেকে এখানে এলেন। ইংরেজিতে বিড়বিড় করে কথা বলছিলেন তাই ডাক্তার মারকোনি আমাকে বললেন তাকে যেনো আমি সহযোগীতা করি। আমি বৃটেন থেকে ছুটি নিয়ে এখানে এসেছি।”
ল্যাংডনের মনে হলো সে বুঝি ম্যাক্স আনতেঁর পেইন্টিংয়ের ভেতর থেকে জেগে উঠেছে। আমি ইটালিতে কি করতে এসেছি? সাধারণত প্রতিবছর জুন মাসে আর্ট কনফারেন্সে এখানে আসে সে, কিন্তু এখন তো মার্চ মাস।
সিডেটিভ কাজ করতে শুরু করলে তার মনে হলো মধ্যাকর্ষণ শক্তি যেনো ক্রমশ বেড়ে চলেছে। শক্তিশালী হচ্ছে প্রতি মুহূর্তে, তাকে টেনে নিয়ে যেতে চাচ্ছে বিছানার ভেতর। জোর করে নিজেকে ঠিক রখার চেষ্টা করলো সে।
কোনো অ্যাঞ্জেলের মতোই তার দিকে ঝুঁকে তাকালো ডাক্তার ব্রুকস। “প্লিজ, মি: ল্যাংডন, ফিসফিসিয়ে বললো সে। “প্রথম চব্বিশ ঘণ্টায় মাথার আঘাতগুলো খুবই নাজুক হয়ে থাকে। আপনার দরকার বিশ্রামের। নইলে মারাত্মক ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।”
রুমের ইন্টারকমটা আচমকা বেজে উঠলো এ সময়। “ডাক্তার মারকোনি?”
দেয়ালে রাখা ইন্টারকমের সুইচ টিপে দিলেন ডাক্তার। “সি?”
ইতালিতে কণ্ঠটা হরবর করে কিছু বলে গেলো। এসব কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারলো না ল্যাংডন। তবে দু’জন ডাক্তার যে অবাক হয়ে চোখাচোখি করলো সেটা তার দৃষ্টি এড়ালো না। অবাক হয়েছে নাকি ভড়কে গেছে তারা?
“মোমেস্তো,” বলেই মারকোনি তার কথা শেষ করলেন। “কি হয়েছে?” জিজ্ঞেস করলো ল্যাংডন।
ডাক্তার ব্রুকসের চোখ দুটো কুচকে আছে।
“আইসিইউ’র রিসেপশনিস্ট বললো আপনাকে কেউ দেখতে এসেছে।”
ঝিমঝিম অবস্থায় আশার আলো দেখতে পেলো ল্যাংডন। “এটা তো ভালো খবর! হয়তো এই লোক জানে আমার কি হয়েছিলো।”
মেয়েটাকে দেখে মনে হলো সে কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। “আপনাকে দেখতে একজন ভিজিটর এসেছে, এটা তো একেবারেই অস্বাভাবিক ব্যাপার। আপনার নাম-পরিচয় এখনও হাসপাতালে রেজিস্টারই করা হয় নি।”
ঘোর ঘোর ভাব কাটিয়ে উঠে বিছানার উপর সোজা হয়ে বসলো ল্যাংডন। “কেউ যদি জেনে থাকে আমি এখানে আছি তার মানে সে এও জানে আমার কি হয়েছিলো!”
ডাক্তার মারকোনির দিকে তাকালো ব্রুকস। ভদ্রলোক মাথা ঝাঁকিয়ে তার হাতঘড়িতে টোকা মারলেন। ল্যাংডনের দিকে ফিরলো মেয়েটি।
“এটা আইসিইউ। সকাল ন’টার আগে কাউকে এখানে আসতে দেয়া হয় না। ডাক্তার মারকোনি গিয়ে দেখে আসবেন ভিজিটর কে, তিনি কি চান।”
“আর আমি কি চাই সে-ব্যাপারটার কি হবে?” জোর দিয়ে বললো ল্যাংডন।
স্মিত হেসে তার দিকে ঝুঁকে নীচুস্বরে বললো ডাক্তার ব্রুকস, “মি: ল্যাংডন, আজ রাতে আপনার কি হয়েছিলো সে সম্পর্কে আপনি এখনও তেমন কিছু জানেন না। অন্য কারোর সাথে কথা বলার আগে আপনার উচিত সব কথা জেনে নেয়া। কিন্তু দুঃখের বিষয়, ওসব কথা শোনার মতো মানসিক অবস্থা-
“আমি কি জানি না!?” বেশ জোরে বললো ল্যাংডন। “আমি শুধু জানি আমি এখন ফ্লোরেন্সের হাসপাতালে আছি। বিড়বিড় করে বলেছি, ভেরি সরি…’ “ মুহূর্তেই একটা ভীতি জেঁকে বসলো তার মধ্যে। “আমি কি কোনো গাড়ি দুর্ঘটনা ঘটিয়েছি? কাউকে মেরে ফেলেছি?!”
“না, না,” বললো মেয়েটি। “এরকম কিছু হয় নি।”
“তাহলে কি হয়েছে?” চেঁচিয়ে বললো সে। ডাক্তার দু’জনের দিকে উদভ্রান্তের মতো তাকালো। “কি হয়েছে না হয়েছে সে সম্পর্কে জানার অধিকার নিশ্চয় আমার রয়েছে!”
লম্বা নীরবতা নেমে এলো ঘরে। তারপর ডাক্তার মারকোনি তার তরুণী কলিগের দিকে তাকিয়ে অনিচ্ছায় মাথা নেড়ে সায় দিলেন। হাফ ছেড়ে আরো কাছে এগিয়ে এলো ডাক্তার ব্রুকস। “ঠিক আছে, তাহলে বলছি…কথা দিতে হবে আপনি শান্ত হয়ে সবটা শুনবেন। রাজি?”
মাথা নেড়ে সায় দিলো ল্যাংডন। তীব্র মাথা ব্যথা টের পেলো আবারো। তবে ব্যথাটা আমলে না নিয়ে উন্মুখ হয়ে রইলো কথা শোনার জন্য।
“প্রথম কথা হলো…আপনার মাথার আঘাতটি কোনো দুর্ঘটনার কারণে হয় নি।”
“শুনে খুব শান্তি পেলাম।”
“অতোটা খুশি হবে না। আপনার আঘাতটি আসলে বুলেটের।”
ল্যাংডনের হার্ট-মনিটর আবারো ক্ষেপে গেলো। “কী বললেন!?”
সহজভাবেই বললো ডাক্তার, “একটা বুলেট আপনার মাথায় বিদ্ধ হয়েছে। ভাগ্যক্রমে আপনি বেঁচে আছেন। আর এক ইঞ্চি নীচু দিয়ে ঢুকলে…” মাথা ঝাঁকালো সে।
অবিশ্বাসে চেয়ে রইলো ল্যাংডন। আমাকে গুলি করেছে?
হল থেকে হৈহল্লার শব্দ ভেসে এলো। মনে হলো ল্যাংডনকে দেখতে যে ভিজিটর এসেছে সে আর অপেক্ষা করতে চাইছে না। পর মুহূর্তেই ল্যাংডন শুনতে পেলো হলওয়ের দরজাটা সশব্দে খুলে গেলো। দেখতে পেলো করিডোর দিয়ে একটা অবয়ব ধেয়ে আসছে।
মেয়েটির শরীরে কালো চামড়ার পোশাক। বেশ শক্তসামর্থ্য আর খাড়া খাড়া কালো চুল। এতো দ্রুত আর ক্ষিপ্ত ভঙ্গিতে ছুটে এলো যেনো তার পা মাটিতে পড়ছে না।
দেরি না করে ভোলা দরজার সামনে বাধা হয়ে দাঁড়ালেন ডাক্তার মারকোনি। “ফার্মা!” পুলিশের লোকদের মতো হাত তুলে আদেশের ভঙ্গিতে বললেন তিনি।
আগন্তুক মেয়েটি একটুও থমকে দাঁড়ালো না। সাইলেন্সর লাগানো পিস্তল বের করে ডাক্তারের বুকে গুলি চালিয়ে বসলো।
গুলির ভোতা শব্দ শোনা গেলো কেবল।
ল্যাংডন দেখতে পেলো গুলির আঘাতে ডাক্তার মারকোনি কয়েক পা পেছনে ছিটকে পড়ে গেলেন, তার সাদা ল্যাব কোট রক্তে ভেসে যাচ্ছে। ধরাশায়ী ডাক্তার মেঝেতে পড়ে বুকের একপাশ চেপে রেখেছেন হাত দিয়ে।
.
অধ্যায় ৩
ইটালির উপকূল থেকে পাঁচ মাইল দূরে ২৩৭ ফুট দীর্ঘ লাক্সারি ইয়ট মেন্দাসিয়াম ভোরের আগেভাগে অ্যাড্রিয়াটিক সাগরের ঢেউ ডিঙিয়ে ছুটে চলেছে। জাহাজটির গায়ের রঙ করা হয়েছে মিলিটারি অস্ত্রের রঙে।
৩০০ মিলিয়ন ডলারের দামি এই তরীটিতে রয়েছে স্পা, সুইমিংপুল, সিনেমা, ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহারের জন্য একটি সাব-মেরিন এবং একটি হেলিপ্যাড। জাহাজে আরামদায়ক করার দিকে এর মালিকের খুব কমই আগ্রহ ছিলো, পাঁচ বছর আগে এটি কেনার পর পরই এর ভেতরে বেশিরভাগ জায়গায়। স্থাপন করা হয় লিড-লাইন, মিলিটারি-গ্রেড, ইলেক্ট্রনিক কমান্ড সেন্টার।
তিন তিনটি স্যাটেলাইট থেকে ফিড পাওয়ার ব্যবস্থা আর যথেষ্ট পরিমাণে টেরেস্টেরিয়াল রিলে স্টেশন রয়েছে এখানে। এর কন্ট্রোল রুমে কাজ করে প্রায় দুই ডজন স্টাফ-টেকনিশিয়ান, অ্যানালিস্ট আর অপারেশন কো-অর্ডিনেটর। এরা সবাই সার্বক্ষণিক জাহাজেই থাকে, সংস্থাটির অসংখ্য দেশে অবস্থিত অপারেশন-সেন্টারের সাথে যোগাযোগ বজায় রাখে সব সময়।
জাহাজে রয়েছে নিজস্ব সিকিউরিটি, এরা সবাই মিলিটারি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈনিক। দুটো মিসাইল ডিটেকশন সিস্টেম এবং অত্যাধুনিক সব মারণাস্ত্রের সমাহার রয়েছে এখানে। বাকি সাপোর্ট স্টাফ যেমন, বাবুর্চি, ক্লিনার আর। সার্ভিসম্যান মিলিয়ে জাহাজের মোট জনসংখ্যা প্রায় চল্লিশ জনের মতো হবে। মেন্দাসিয়াম-এর মালিক এটিকে তার সাম্রাজ্য পরিচালনার ভ্রাম্যমান অফিস হিসেবে ব্যবহার করে। কর্মচারীদের কাছে নিজেকে শুধুমাত্র প্রভোস্ট’ হিসেবে পরিচয় দেয় সে। দেখতে ছোটোখাটো আর সাদামাটা একজন মানুষ, গায়ের চামড়া রোদে পোড়া, চোখ দুটো বেশ গভীর। তার এমন সাধারণ গড়ন আর সহজ-সরল আচার ব্যবহার সমাজের বাইরে থাকা অন্ধকারময় ছদ্মবেশী একটি প্রাইভেট সংস্থা পরিচালনা করার জন্য বেশ সহায়ক।
তাকে অনেক নামেই ডাকা হয়-হৃদয়হীন মার্সিনারি, পাপ কার্যের উদগাতা, শয়তানের দোসর-কিন্তু আদতে সে এসবের কিছুই না। প্রভোস্ট শুধুমাত্র তার ক্লায়েন্টদের অভীষ্ট লক্ষ্য আর উচ্চাশা অর্জনে সহায়তা করে, এরফলে কি হবে না। হবে এসব ভেবে দেখে না। মানবজাতির স্বভাবই হলো জঘন্য, এটা তার সমস্যা নয়।
তার ক্লায়েন্টদের অনৈতিকতা আর অধর্ম সত্ত্বেও প্রভোস্টের নৈতিক কম্পাসটি কিন্তু এক জায়গাতেই স্থির থাকে। সে তার নিজের এবং কনসোর্টিয়ামের সুনাম তৈরি করেছে দুটো অলঙ্ঘনীয় নিয়মের উপর ভিত্তি করে।
যে প্রতীজ্ঞা তুমি রাখতে পারবে না সেটা কখনও করবে না।
ক্লায়েন্টের কাছে কখনও মিথ্যে বলা যাবে না।
পেশাদার ক্যারিয়ারে প্রভোস্টের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করার কোনো রেকর্ড নেই, কিংবা কোনো ডিলের বরখেলাপও সে করে নি। তার কথার কোনো নড়নচড়ন হয় না। কখনওই না। তবে কিছু কিছু কন্ট্রাক্টের ব্যাপারে নিজের অনুশোচনা তৈরি হলেও চুক্তি সম্পাদনের ক্ষেত্রে পিছু হটার ইতিহাস তার নেই।
আজ সকালে ইয়টের স্টেটরুমের প্রাইভেট বেলকনিতে দাঁড়িয়ে উজ্জ্বল সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে নিজের ভেতরে জমে থাকা অস্থিরতাকে প্রশমিত করার চেষ্টা করলো সে।
অতীতের সিদ্ধান্তগুলোই ভবিষ্যত নির্মাণ করে দেয়।
প্রভোস্টের অতীতের সিদ্ধান্তগুলো তাকে এমন অবস্থায় উপনীত করেছে যে, মাইনফিল্ডের উপর দিয়ে হেঁটে যেতেও কার্পন্য করে না। তবে আজ বহু দূরের ইটালির উপকূলের দিকে তাকিয়ে নিজের মধ্যে অস্বাভাবিক উদ্বিগ্নতা টের পেলো।
এক বছর আগে এই ইয়টে বসে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো সে, আর নানান ঘটনা-পরিক্রমার পর সেটার ফলশ্রুতিতে আজ তার সৃষ্ট সব কিছু ভেস্তে যেতে বসেছে। ভুল মানুষের সাথে আমি চুক্তি করেছিলাম।
ঐ সময়ে সব কিছু জানা প্রভোস্টের পক্ষে সম্ভবও ছিলো না। সেই ভুলের খেসারত হিসেবে এখন আচমকাই চ্যালেঞ্জের ঝড়ের মুখোমুখি হতে হচ্ছে তাকে। বাধ্য হয়ে নিজের সেরা এজেন্টদেরকে মাঠে নামিয়ে অর্ডার দেয়া হয়েছে। তার নৌকা ডুবে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য যা দরকার তা-ই যেনো করে তারা।
এ মুহূর্তে প্রভোস্ট একজন ফিল্ড এজেন্টের কাছ থেকে খবর শোনার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। ভায়েন্থা, মনে মনে বললো সে। স্পাইক করা চুলের এজেন্টের ছবিটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো। এই মিশনের আগপর্যন্ত ভায়েন্থা অসাধারণ সার্ভিস দিয়েছে তাকে। কিন্তু গতরাতে তার একটা ভুলের জন্য বিশাল। বিপর্যয় নেমে এসেছে। বিগত ছয়টি ঘণ্টা কেটেছে খুবই পেরেসানির মধ্যে, পরিস্থিতির উপর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাবার জন্য মরিয়া হয়ে কাজ করতে হয়েছে তাদেরকে।
ভায়েন্থা দাবি করেছে তার ভুলটি নিছক মন্দভাগ্য ছাড়া আর কিছু–অসময়ে একটি কবুতরের ডাক। প্রভোস্ট অবশ্য ভাগ্যে বিশ্বাস করে না। সে যা করে তার সবটাই পরিকল্পনামাফিক। কাকতালীয়, ঘটনাচক্র এসব তিরোহিত করেই কাজ করে। নিয়ন্ত্রণ হলো প্রভোস্টের একটি দক্ষতা-প্রতিটি সম্ভাব্যতা দিব্য চোখে দেখা, প্রতিটি প্রতিক্রিয়া অনুমাণ করতে পারা, কাঙ্খিত ফলাফল লাভের জন্য বাস্তবতাকে পরিচালিত করে সে। সফলতা আর গোপনীয়তার অসাধারণ রেকর্ড রয়েছে তার। এ কারণে তার ক্লায়েন্টের তালিকা খুবই বিস্ময়কর-বিলিয়নেয়ার, রাজনীতিক, শেখ, এমনকি কখনও কখনও পুরো সরকার।
পূর্ব দিকে সকালের প্রথম আলো দিগন্তের নীচ থেকে উদ্ভাসিত হতে শুরু করেছে। ডেকে দাঁড়িয়ে প্রভোস্ট ধৈর্যসহকারে অপেক্ষা করছে মিশনটা যে পরিকল্পনামতোই এগিয়ে যাচ্ছে সে-খবর ভায়েন্থার কাছ থেকে পাবার জন্য।
.
অধ্যায় ৪
কয়েক মুহূর্তের জন্য ল্যাংডনের মনে হলো সময় যেনো থমকে গেছে।
মেঝেতে নিশ্চল পড়ে আছে ডাক্তার মারকোনি, তার বুক থেকে গলগল করে বের হচ্ছে তাজা রক্ত। সিডেটিভের প্রভাব এড়িয়ে স্পাইক-চুলের গুপ্তঘাতকের দিকে চোখ তুলে তাকালো সে। মেয়েটি এখনও হল দিয়ে এগিয়ে আসছে তার দিকে। কাছে এসেই ল্যাংডনের দিকে তাকালো। সঙ্গে সঙ্গে দেরি না করে অস্ত্রটা তাক করলো তার মাথা বরাবর।
আমি শেষ, বুঝতে পারলো ল্যাংডন। এখানেই আমি শেষ।
হাসপাতালের ছোট্ট রুমে কানফাটা শব্দ হলো।
পিছু হটে গেলো ল্যাংডন, সে নিশ্চিত তার গুলি লেগেছে কিন্তু শব্দটা আক্রমণকারীর অস্ত্র থেকে আসে নি। রুমের ভারি লোহার দরজা বন্ধ করার শব্দ ছিলো ওটা। ডাক্তার ব্রুকস ঝাঁপিয়ে পড়ে সেটা বন্ধ করেই লক্ করে দিয়েছে।
ভয়ে তার চোখ দুটো কোটর থেকে যেনো বের হয়ে যাচ্ছে। হামাগুঁড়ি দিয়ে রক্তাক্ত কলিগের কাছে গিয়ে পালস দেখলো ব্রুকস। ডাক্তার মারকোনি কাশি দিয়ে রক্ত বমি করলে তার দাড়ি আর গাল রক্তে একাকার হয়ে গেলো। এরপরই নিথর হয়ে গেলো তার দেহ।
“এনরিকো, না! তাই প্রেগো!” চিৎকার করে বললো মেয়েটি।
বাইরে থেকে মুহূর্মুহূ গুলি করা হচ্ছে লোহার দরজা লক্ষ্য করে। অ্যালার্মের শব্দে প্রকম্পিত চারপাশ।
যেভাবেই হোক ল্যাংডন সিডেটিভের প্রতিক্রিয়া অগ্রাহ্য করে বিছানা থেকে নেমে যেতে পারলো। টের পেলো ডান হাতে প্রচণ্ড ব্যথা হচ্ছে। প্রথমে তার মনে হলো সে বুঝি গুলিবিদ্ধ হয়েছে। হয়তো কোনো বুলেট দরজা ভেদ করে ঢুকে পড়ে ভেতরে কিন্তু হাতের দিকে তাকাতেই বুঝতে পারলো আইভি’র টিউবটা তার হাতে লাগানো ক্যাথিটার থেকে খুলে যাওয়ায় সেখান থেকে রক্ত পড়ছে।
ল্যাংডন এখন পুরোপুরি সজাগ।
মারকোনির দেহের পাশে হামাগুঁড়ি দিয়ে ডাক্তার ব্রুকস অশ্রুসজল চোখে পাল্স দেখে যাচ্ছে। তারপর যেনো হঠাৎ করেই ধাতস্থ হয়ে উঠে দাঁড়ালো সে, ফিরে তাকালো ল্যাংডনের দিকে। মেয়েটার অভিব্যক্তি দ্রুত পাল্টে গেলো, বয়সে তরুণ হলেও চোখেমুখে যে কাঠিন্য চলে এলো সেটা যেনো বহু বছর ধরে সঙ্কট মুহূর্তে কাজ করা ইমার্জেন্সি রেসকিউ ডাক্তারের।
“আমার সাথে আসুন,” আদেশের সুরে বললো সে।
ডাক্তার ব্রুকস ল্যাংডনের হাত ধরে তাকে টেনে রুমের অন্যদিকে নিয়ে গেলো। ঘরের দরজায় সমানে গুলি করা হচ্ছে। বিপদ সম্পর্কে সচেতন থাকলেও ভারি শরীরটা নিয়ে দৌড়াতে বেগ পেলো সে। ফ্লোরের ঠাণ্ডা মেঝে টের পেলো এবার। তার গায়ে হাসপাতাল থেকে সরবরাহ করা পাতলা একটি জামা। ছয় ফুট দীর্ঘ দেহ ঢেকে রাখার জন্য বেশ অপ্রতুল। টের পেলো ডান হাতের বাহু থেকে রক্ত ঝরে পড়ছে।
ঘরের দরজায় অবিরাম গুলির মাঝখানেই ডাক্তার ব্রুকস ল্যাংডনকে ছোট্ট একটি বাথরুমের দিকে ঠেলে দিলো। কিন্তু সে নিজে ঢুকলো না, বরং ঘুরে ফিরে গেলো ঘরের কাউন্টারের দিকে। ওটার উপরে রাখা রক্তাক্ত হ্যারিস টুইড জ্যাকেটটা ছো মেরে নিয়ে নিলো।
আরে, এই বালের জ্যাকেটের কথা বাদ দাও!
জ্যাকেটটা হাতে নিয়ে বাথরুমে ফিরে এসেই দরজা লক করে দিলো ব্রুকস আর ঠিক তখনই ঘরের দরজাটা সশব্দে খুলে গেলো।
তরুণী ডাক্তার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিলো এবার। দ্বিতীয় আরেকটি দরজা খুলে ছোট্ট বাথরুম থেকে বের হয়ে পাশের রিকভারি রুমে ঢুকে পড়লো তারা। ডাক্তার ব্রুকস হলওয়ের দিকে উঁকি মারতেই তাদের পেছনে গুলির শব্দ আরো প্রকট হলো। ল্যাংডনের হাত ধরে তাকে নিয়ে দৌড়ে চলে এলো করিডোরের সিঁড়ির কাছে। এভাবে দৌড়াতে গিয়ে প্রফেসরের মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো। তার মনে হলো যেকোনো মুহূর্তে জ্ঞান হারাবে সে।
পরবর্তী পনেরো সেকেন্ড একেবারে ঝাপসা দেখলো…সিঁড়ি দিয়ে নামা…হোঁচট খাওয়া…পড়ে যাওয়া। ল্যাংডনের মাথার ভেতরে যেনো হাতুড়ি পেটা চলছে এখন। সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। তার দৃষ্টি আরো ঝাপসা হয়ে উঠলো এবার। মাংসপেশীগুলো আড়ষ্ট হওয়ার কারণে পা দুটোকে অনেক ভারি। মনে হলো। এরপরই অনুভূত হলো ঠাণ্ডা বাতাস।
আমি এখন বাইরে।
হাসপাতাল ভবন থেকে বের হয়ে ল্যাংডনকে নিয়ে একটা অন্ধকারাচ্ছন্ন গলিতে ঢুকে পড়লো ডাক্তার ব্রুকস। এ সময় পায়ে ধারালো কিছু লেগে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলো প্রফেসর। তাকে তুলে দাঁড় করাতে বেশ বেগ পেলো মেয়েটি। কেন যে সিডেটিভ দিয়েছে সেজন্যে নিজেকে ভর্ৎসনা করে চেঁচিয়ে উঠলো।
গলির শেষ মাথায় আসার আগেই আবারো হোঁচট খেলো ল্যাংডন। এবার আর তাকে মাটি থেকে না তুলে মেয়েটি রাস্তায় নেমে কাউকে ডাক দিলো। হাসপাতালের সামনে একটি পার্ক করা ট্যাক্সির মৃদু সবুজ আলো দেখতে পেলো ল্যাংডন। গাড়িটা নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছে। ড্রাইভার নির্ঘাত ঘুমাচ্ছে গাড়ির ভেতরে। ডাক্তার ব্রুকস চিৎকার করে উদভ্রান্তের মতো হাত ছুঁড়তে লাগলো। অবশেষে হেডলাইট জ্বলে উঠলে আস্তে আস্তে তাদের দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো সেটা।
ল্যাংডনের পেছনের গলিতে একটি দরজা সশব্দে খুলে গেলো, সঙ্গে সঙ্গে পায়ের আওয়াজ ভেসে আসতে লাগলো সেখান থেকে। তাদের দিকেই ধেয়ে আসছে! ঘুরে তাকালো সে। কালচে অবয়বটি ছুটে আসছে। নিজের পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করলো ল্যাংডন কিন্তু তার আগেই ডাক্তার ব্রুকস তাকে টেনে তুলে ফিয়াট ট্যাক্সির পেছনের সিটে ঠেলে ঢোকালো। কোনোমতে সিটের উপর হুমরি খেয়ে পড়তেই টের পেলো ডাক্তার তার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তারপরই ট্যাক্সির দরজা বন্ধ করার শব্দ কানে গেলো।
তাদের দুজনের দিকে ঘুমকাতুর চোখে চেয়ে আছে ড্রাইভার-স্ক্রাব পরা এক তরুণী আর রক্তাক্ত হাতের হাসপাতালের পোশাক পরা এক লোক। যেই না বলতে যাবে তার ট্যাক্সি থেকে এক্ষুণি নেমে যেতে অমনি তার গাড়ির সাইড মিররটা গুড়ো গুড়ো হয়ে গেলো। কালো পোশাকের মেয়েটি গুলি চালিয়েছে ট্যাক্সি লক্ষ্য করে। দৌড়ে ছুটে আসছে সে, হাতের পিস্তল সামনের দিকে তাক করা। ডাক্তার ব্রুকস ল্যাংডনের মাথাটা ধরে নীচু করে দিতেই গুলির ভোতা শব্দ শোনা গেলো আবার। পেছনের সিটের জানালার কাঁচ ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো সঙ্গে সঙ্গে। কাঁচের গুঁড়ো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লো তাদের দু’জনের উপর।
ড্রাইভার আর সময়ক্ষেপন করার কোনো কারণ দেখতে পেলো না। ঝটপট দরজা লাগিয়ে এক্সেলেটরে চাপ দিতেই গাড়িটা ছুটতে শুরু করলো।
ল্যাংডন কেঁপে উঠলো। কেউ আমাকে খুন করার চেষ্টা করছে?
গাড়িটা রাস্তার মোড়ে চলে এলে ডাক্তার ব্রুকস ল্যাংডনের রক্তাক্ত হাতটা ধরলো। তার হাতের মাংস ভেদ করে ক্যাথিটার বের হয়ে আছে।
“জানালার দিকে তাকান,” আদেশের সুরে বললো সে।
কথামতোই কাজ করলো ল্যাংডন। বাইরে ভুতুরে অন্ধকার আর অসংখ্য এপিটাফ দেখতে পেলো। বুঝতে পারলো তারা কোনো গোরস্থানের পাশ দিয়ে যাচ্ছে। ল্যাংডন টের পেলো ব্রুকস এক ঝটকায় তার হাত থেকে ক্যাথিটারটা খুলে ফেলেছে।
প্রচণ্ড ব্যথা অনুভূত হলো ল্যাংডনের মাথায়। মনে হলো তার চোখ দুটো উল্টে যাচ্ছে, তারপরই সব কিছু নিকষ কালো হয়ে গেলো।
.
অধ্যায় ৫
অ্যাড্রিয়াটিক সাগরের উপর বহমান শান্ত কুয়াশা থেকে প্রভোস্টের দৃষ্টি সরে এলো ফোনের তীক্ষ্ণ রিংয়ের শব্দে। সঙ্গে সঙ্গে নিজের স্টেটরুম অফিসে ফিরে গেলো সে।
সময় হয়েছে, সংবাদটা শোনার জন্য ব্যাকুল হয়ে ভাবলো।
তার ডেস্কের কম্পিউটারের মনিটর দেখে বুঝতে পারলো কলটি এসেছে একটি সুইডিশ সেক্ট্রা টাইগার এক্সএস পার্সোনাল ভয়েস-এনক্রিপ্টিং ফোন থেকে, এই জাহাজের সাথে কানেক্টেড হবার আগে চার-চারটি আনট্রেসেবল রাউটারে রিডাইরেক্ট হয়ে এসেছে এটা। হেডফোন চাপালো সে। “প্রভোস্ট বলছি,” হিসেব করে ধীরস্থির কণ্ঠে বললো কথাটা। “বলে যাও।”
“ভায়েন্থা বলছি,” কণ্ঠটা জবাব দিলো।
মেয়েটার কণ্ঠে অস্বাভাবিক নাভাসনেস আঁচ করতে পারলো প্রভোস্ট। ফিল্ড এজেন্টরা সচরাচর সরাসরি প্রভোস্টের কাছে কল করে না, তারচেয়েও বিরল ব্যাপার হলো গতরাতের বিব্রতকর ব্যর্থতার পর খুব কম এজেন্টের চাকরিই বহাল থাকে। তাসত্ত্বেও, সঙ্কটটা কাটিয়ে ওঠার জন্য ঘটনাস্থলে একজন এজেন্টের দরকার হয়েছিলো প্রভোস্টর, আর এক্ষেত্রে ভায়েন্থাই সবচেয়ে। সেরা।
“আমার কাছে একটি আপডেট আছে,” বললো ভায়েন্থা।
চুপ করে রইলো প্রভোস্ট, ইঙ্গিতটা স্পষ্ট, মেয়েটা যেনো তার কথা চালিয়ে যায়।
সে যখন কথা বললো তখন তার কণ্ঠে কোনো আবেগ থাকলো না, একদম পেশাদার। “ল্যাংডন পালিয়েছে,” বললো সে। “তার কাছে ওই জিনিসটা আছে।”
নিজের ডেস্কে অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইলো প্রভোস্ট। “বুঝেছি,” অবশেষে বললো সে। “অনুমাণ করতে কষ্ট হয় না, সুযোগ পাওয়া মাত্রই সে কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করবে।”
.
প্রভোস্টের দুই ডেক নীচে জাহাজের সিকিউর কন্ট্রোল সেন্টারে সিনিয়র ফ্যাসিলিটেটর লরেন্স নোলটন নিজের প্রাইভেট চেম্বারে বসে দেখতে পেলো প্রভোস্টের এনক্রিপ্টেড কলটি শেষ হয়ে গেছে। সে আশা করলো ভালো সংবাদই হবে। বিগত দুদিন ধরে প্রভোস্ট খুব টেনশনে আছে। জাহাজে থাকা সব কর্মচারীই টের পেয়েছে এক ধরণের মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ অপারেশন চলছে।
ঝুঁকিটা মারাত্মক, আর ভায়েন্থাকে এবার ঠিকঠাকভাবেই সেটা করতে হবে।
গোড়া থেকে সতর্কতার সাথে গেম প্ল্যান তৈরি করার ব্যাপারে নোলটন অভ্যস্ত কিন্তু এই বিশেষ ঘটনাটি একেবারে লেজেগোবরে হয়ে গেছে, তাই প্রভোস্ট নিজেই এটা তত্ত্বাবধান করছে এখন।
আমরা অজ্ঞাত এক ভুবনে প্রবেশ করেছি।
সারাবিশ্বে এ মুহূর্তে আধডজন মিশন অব্যাহত আছে আর সেগুলো কনসোর্টিয়ামের বিভিন্ন ফিল্ড অফিস থেকেই তদারকি করা হচ্ছে। ফলে প্রভোস্ট আর তার মেন্দাসিয়ামে অবস্থিত কর্মকর্তাদেরকে এই বিশেষ মিশনে মনোযোগ দিতে বেশ সাহায্য করছে।
কয়েক দিন আগে ফ্লোরেন্সে তাদের ক্লায়েন্ট সুউচ্চ ভবনের উপর থেকে লাফিয়ে মৃত্যুবরণ করেছে, তবে কনসোর্টিয়ামের এখনও এই বিষয়ে কাজ করার জন্য অসংখ্য এজেন্ডা রয়ে গেছে। ঘটনা যাইহোক না কেন, লোকটি এই সংগঠনের উপর কিছু বিশেষ কাজের দায়িত্ব অর্পণ করে গেছে, তার মৃত্যুতে এর কোনো ব্যত্যয় হবে না-এটাই কনসোর্টিয়ামের ধরণ। এভাবেই তারা কাজ করে।
আমাকে কিছু অর্ডার দেয়া আছে, ভাবলো নোলটন। এটা মান্য করার ব্যাপারে তার মধ্যে কোনো সংশয়-সন্দেহ নেই। সাউন্ডপ্রুফ কাঁচের কিউবিকল থেকে বের হয়ে এলো সে। হাঁটতে হাঁটতে আধ ডজনের মতো চেম্বার অতিক্রম করে গেলো। এগুলোর কিছু কিছু স্বচ্ছ কাঁচের, কিছু অস্বচ্ছ। এসবের মধ্যে এই মিশনের ডিউটি অফিসারেরা কাজ করে যাচ্ছে।
মেইন কন্ট্রোল রুমের ভেতর দিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলো নোলটন। এখানকার বাতাস বেশ হালকা। টেক-ক্রুর দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে সায় দিয়ে ছোট্ট একটা ভল্টে প্রবেশ করলো। এখানে লোহার তৈরি ছোটো ছোটো কয়েক ডজন বাক্স রয়েছে। একটা বক্স থেকে উজ্জ্বল লাল রঙের মেমোরি স্টিক বের করে আনলো সে। এর সাথে যে টাস্ক কার্ডটা অ্যাটাচড করা আছে সেটা বলছে এই মেমোরি স্টিকে একটি ভিডিও ফাইল রয়েছে, তাদের ক্লায়েন্ট নির্দেশ দিয়ে গেছে আগামীকাল সকালে উল্লেখযোগ্য সব মিডিয়ায় এই ভিডিওটা আপলোড করতে হবে।
আগামীকালের নামবিহীন আপলোডটি খুবই সহজ একটি ব্যাপার হবে কিন্তু সব ধরণের ডিজিটাল ফাইলের প্রটোকল সংরক্ষণ করার জন্য যে ফ্লাগচার্ট আছে তাতে এই ফাইলটাকে আজকের জন্য রিভিউ করতে বলা আছে-ডেলিভারি দেবার চব্বিশ ঘণ্টা আগে-যাতে করে নির্দিষ্ট সময়ে আপলোড করার আগে কনসোর্টিয়াম প্রয়োজনীয় ডিক্রিপশন, ব্যবস্থা এবং প্রস্তুতি নিতে পারে।
ভুল হবার কোনো সুযোগই রাখা হবে না।
নিজের স্বচ্ছ কাঁচের কিউবিকলে ফিরে এসে দরজাটা বন্ধ করে দিলো নোলন।
দেয়ালের একটি সুইচ টিপে দিতেই মুহূর্তে কিউবিকলটা অস্বচ্ছ হয়ে গেলো। প্রাইভেসির জন্যে মেন্দাসিয়াম-এর সব অফিসের দেয়ালই ‘সাসপেন্ডেড পার্টিক্যাল ডিভাইস’ কাঁচ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। এসপিডি’র কাঁচ খুব সহজেই ইলেক্ট্রিক প্রবাহের সাহায্যে নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
গোপনীয়তা হলো কনসোর্টিয়ামের সফলতার আসল ভিত্তি।
শুধু নিজের মিশন সম্পর্কে জানো। অন্য কিছু সম্পর্কে নয়।
এখন নিজের প্রাইভেট অফিসে বসে কম্পিউটারে মেমোরি স্টিকটা ইনসার্ট করে ফাইলটি চালু করে দিলো সে।
সঙ্গে সঙ্গে তার কম্পিউটারের পদা কালো হয়ে গেলো…আর স্পিকার থেকে ভেসে এলো পানির ছলাৎ ছলাৎ শব্দ। ধীরে ধীরে পদায় ভেসে উঠলো একটি ছবি…আকৃতিবিহীন আর কালচে। অন্ধকার থেকে উদ্ভাসিত একটি দৃশ্য যেনো আকৃতি পেতে শুরু করলো আস্তে আস্তে…কোনো গুহার ভেতরের দৃশ্য অথবা এক ধরণের বিশাল কক্ষ। গুহাসদৃশ্য জায়গাটির মেঝে পানিতে পরিপূর্ণ, অনেকটা ভূগর্ভস্থ হ্রদের মতো।
অদ্ভুতভাবেই সেই জল নীচ থেকে আলো বিকিরণ করছে।
এরকম জিনিস নোলটন কখনও দেখে নি। আধিভৌতিক লালচে আলোয় জ্বলজ্বল করছে গুহাসদৃশ্য জায়গাটি। বিবর্ণ দেয়ালগুলোতে লালচে পানির প্রতিফলন পড়ছে। এটা কোন জায়গা? ক্যামেরা এবার সোজা নীচের দিকে নামতে শুরু করে আলোকিত পানি ভেদ করে ঢুকে পড়লো নীচে। পানির ছলাৎ ছলাৎ শব্দটা মিইয়ে গেলো, তার বদলে পানির নীচে অপার্থিব হিসহিস শব্দ। ক্যামেরাটি পানির নীচে কয়েক ফুট চলে গিয়ে গুহার মেঝের কাছে এসে থামলো।
উজ্জ্বল টাইটানিয়ামের একটি আয়তক্ষেত্রের ফলক মেঝেতে গাঁথা। সেই ফলকের উপর কিছু লেখা আছে :
এই জায়গায়, এই তারিখে এ বিশ্ব চিরকালের জন্য বদলে গেছিলো।
ফলকটির নীচে নাম আর তারিখ দেয়া।
নামটা তাদের ক্লায়েন্টের।
আর তারিখটা…আগামীকাল!
.
অধ্যায় ৬
ল্যাংডনের মনে হলো শক্ত একটা হাত তাকে টেনে তুলছে…তাড়া দিচ্ছে ধাতস্থ হবার জন্য, ট্যাক্সি থেকে বের হতে সাহায্য করছে। নগ্ন পায়ে রাস্তার পিচ খুবই ঠাণ্ডা অনুভূত হলো।
ডাক্তার ব্রুকসের সাহায্যে কোনো রকমে হাঁটতে পারলো ল্যাংডন। তারা এখন দুটো অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের মাঝখানের সরু গলি দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। ভোরের বাতাস বইছে আর তার প্রভাবে হাসপাতালের ফিনফিনে গাউনটা উড়ছে। খুবই শীত শীত লাগছে তার কিন্তু সে জানে অতোটা ঠাণ্ডা পড়ে নি।
হাসপাতালে দেয়া সিডেটিভের কারণে তার দৃষ্টি যেমন ঝাপসা হয়ে গেছে। তেমনি মাথাটাও কাজ করছে না ঠিকমতো। কেমন এক ঘোরের মধ্যে ডুবে আছে। মনে হচ্ছে পানির নীচে আছে, চেষ্টা করছে উপরে ওঠার। সিয়েনা ব্রুকস তাকে ধরে রেখেছে শক্ত করে, ফলে সে হাঁটতে পারছে। মেয়েটার গায়ের শক্তি দেখে অবাক হলো ল্যাংডন।
“সিঁড়ি,” মেয়েটা বললো। ল্যাংডন বুঝতে পারলো তারা কোনো ভবনের পাশ দিয়ে যে প্রবেশদ্বার আছে সেখানে পৌঁছে গেছে। সিঁড়ির রেলিং শক্ত করে ধরে আস্তে আস্তে ধাপগুলো পেরোতে লাগলো সে। নিজের শরীরটা খুবই ভারি মনে হচ্ছে তার। সিয়েনা ব্রুকস এবার তাকে প্রায় ঠেলে ঠেলে সিঁড়ি দিয়ে। তোলার চেষ্টা করছে। ল্যান্ডিঙে পৌঁছার পর মেয়েটি পুরনো একটি কি-প্যাডে টাইপ করতেই শব্দ করে দরজা খুলে গেলো।
ভেতরের বাতাস খুব একটা উষ্ণ নয়, তবে মেঝেটা নরম কার্পেটের মতো মনে হলো, অন্তত বাইরের রাস্তার পিচের তুলনায়।
ডাক্তার ব্রুকস একটা ছোট্ট এলিভেটরের দিকে নিয়ে গেলো ল্যাংডনকে। দেখতে একেবারে ফোনবুথের মতো। ভেতরে সিগারেটের গন্ধ-এই তেতো গন্ধটা টাটকা এসপ্রেসোর মতোই ইটালির সর্বত্র পাওয়া যায়। ল্যাংডনের মাথা কিছুটা পরিস্কার হয়ে গেলো এই গন্ধে। সিয়েনা ব্রুকস একটা বোতাম চাপলে কিছু কলকজা ঘোরার শব্দ শোনা গেলো।
উপরের দিকে…
ধাতব দেয়ালের লিফটটা নীচে মেনে এলো। নিজেকে লিফটের ভেতরে আবিষ্কার করার পর পরই আধো-অচেতন অস্থায়ও কুয়োর মধ্যে পড়ে যাওয়ার সেই পুরনো ভীতিটা জেঁকে বসলো তার মধ্যে।
তাকিয়ো না।
দেয়ালে হেলান দিয়ে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলো সে। তার ডান হাতের বাহুতে এখনও ব্যথা হচ্ছে। সেদিকে তাকাতেই দেখতে পেলো হ্যারিস টুইড জ্যাকেটের হাতা অদ্ভুতভাবে তার হাতে ব্যান্ডেজের মতো পেচিয়ে রাখা হয়েছে।
প্রচণ্ড মাথা ব্যথা সত্ত্বেও চোখ বন্ধ করতেই অন্ধকার তাকে গ্রাস করে ফেললো। পরিচিত দৃশ্যটা আবার ভেসে উঠলো মনের পদায়-ঘোমটা দেয়া এক নারী, মাথার চুল সাদা। আগেরবার যেমনটি দেখেছিলো, রক্তলাল নদীর তীরে দাঁড়িয়ে আছে সে। তার চারপাশে দোমড়ানো মোচড়ানো মৃতদেহ। ল্যাংডনকে সে আকুতি জানিয়ে বলছে, খুঁজুন, তাহলেই পাবেন!
ল্যাংডনের মনে হলো মহিলাকে রক্ষা করতে হবে…তাদের সবাইকে রক্ষা করতে হবে। মাটিতে পুঁতে রাখা মানুষগুলোর পা নিস্তেজ হয়ে পড়ছে…এক এক করে।
আপনি কে!? নিঃশব্দে চিৎকার করে বললো সে। কি চান?!
উত্তপ্ত বাতাসে মহিলার সাদা চুলগুলো উড়ছে। আমাদের সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে, ফিসফিসিয়ে বললো সে। আস্তে করে গলার নেকলেসটা স্পর্শ করলো। তারপর বলা নেই কওয়া নেই মহিলা চোখ ঝলসানো আগুনের স্তম্ভে বিস্ফোরিত হলো মুহূর্তে। ওটার ঢেউ নদী পার হয়ে তা গ্রাস করলো।
চিৎকার করে উঠলো ল্যাংডন। ঝট করে খুলে গেলো তার চোখ।
উদ্বিগ্ন হয়ে তার দিকে চেয়ে আছে ডাক্তার ব্রুকস। “কি হয়েছে?”
“আমার হেলুসিনেশান হচ্ছে!” বললো ল্যাংডন। “ঐ একই দৃশ্য দেখছি।”
“সাদা চুলের মহিলা? চারপাশে লাশ?”
মাথা নেড়ে সায় দিলো সে। কপালে ঘাম জমতে শুরু করেছে।
“ঠিক হয়ে যাবে, চিন্তা করবেন না, তাকে আশ্বস্ত করে বললো ডাক্তার যদিও তার কণ্ঠ কাঁপছে। “অ্যামনেসিয়া হলে বার বার একই দৃশ্য দেখাটা স্বাভাবিক ব্যাপার। মস্তিষ্কের যে অংশটা আপনার স্মৃতি সংরক্ষণ আর থরে থরে সাজানোর কাজ করে সেখানে সাময়িক সমস্যা হয়েছে তাই ওটা সব কিছু একটা ছবিতেই নিক্ষেপ করছে বার বার।”
“ছবিটা খুব প্রীতিকর কিছু নয়, কোনোমতে বললো সে।
“জানি, কিন্তু সুস্থ হবার আগপর্যন্ত আপনার স্মৃতি বিক্ষিপ্তভাবে অতীত, বর্তমান আর কল্পনার মিশ্রণে কাজ করবে। ঠিক একই ব্যাপার ঘটে স্বপ্নে।”
এলিভেটরটা থামলে ডাক্তার ব্রুকস দরজা খুলে দিলো। এবার অন্ধকারাচ্ছন্ন একটি করিডোর দিয়ে এগোতে লাগলো তারা দুজন। একটা জানালা পেরিয়ে যাবার সময় ল্যাংডন দেখতে পেলো সেখান থেকে ফ্লোরেন্স শহরটা দেখা যাচ্ছে। এখনও অন্ধকার পুরোপুরি কাটে নি।
হলের শেষপ্রান্তে গিয়ে উপুড় হয়ে একটা ফুলের টবের নীচ থেকে চাবি বের করে আনলো সিয়েনা ব্রুকস।
অ্যাপার্টমেন্টটা বেশ ছোটোখাটো। ভেতরের বাতাস ভ্যানিলার সুগন্ধিযুক্ত মোমবাতি আর পুরনো কার্পেটের গন্ধ মিলেমিশে আছে। ঘরের আসবাবপত্র আর আর্টওয়ার্ক খুবই সাদামাটা-যেনো পুরনো আসবাব বিক্রির দোকান থেকে কিনে। এনে ঝাড়ামোছা করা হয়েছে। ডাক্তার ব্রুকস হিটার আর রেডিয়েটার চালু করে। দিলো।
কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে চোখ বন্ধ করে নিজেকে ধাতস্থ করে নিলো ব্রুকস। এরপর ল্যাংডনের দিকে ফিরে তাকে নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকলো। সেখানে কিচেন টেবিলে দুটো কাঠের চেয়ার রয়েছে।
ল্যাংডন যেই না একটা চেয়ারে বসতে যাবে অমনি সিয়েনা ব্রুকস তার একটা হাত ধরে ফেললো, অন্য হাত দিয়ে খুলে ফেললো ক্যাবিনেটের দরজা। ক্যাবিনেটটা বলতে গেলে প্রায় ফাঁকা, কিছু ক্র্যাকার্স, পাস্তা, কোকের ক্যান আর এক বোতল নোডোজ।
নোডোজ বোতল থেকে ছয়টি ট্যাবলেট বের করে ল্যাংডনের হাতে ধরিয়ে দিলো। “ক্যাফেইন,” বললো সে। “রাতের বেলায় যখন ডিউটি থাকে তখন এগুলো খুব কাজে দেয়।”
ল্যাংডন ট্যাবলেটগুলো মুখে পুরে আশেপাশে তাকালো পানি খাওয়ার জন্য।
“চিবোতে থাকুন,” সিয়েনা বললো। “খুব দ্রুত আপনার শরীর গরম করে ফেলবে, সিডেটিভের বিরুদ্ধে ভালো কাজ করবে।”
ট্যাবলেটগুলো চিবোতেই চোখমুখ কুচকে গেলো তার। খুবই তেতো। এগুলো আসলে পানির সাহায্যে গিলে ফেলার কথা। সিয়েনা ব্রুকস ফ্রিজ খুলে আধা বোতল সান পেলেগ্রিনো দিলো তাকে। কৃতজ্ঞচিত্তে পান করলো ল্যাংডন।
পনিটেইল ডাক্তার এবার ল্যাংডনের ডান হাতে জ্যাকেটের হাতা দিয়ে যে ব্যান্ডেজ করেছিলো সেটা খুলে ফেললো। হাতের ক্ষতটি ভালো করে পরীক্ষা করে দেখলো সে। ল্যাংডন টের পেলো মেয়েটার শক্তিশালী হাত কাঁপছে।
“আপনার তেমন কিছু হয় নি।”
ল্যাংডন আশা করলো মেয়েটি যেনো ঠিক হয়ে ওঠে। একটু আগে যা ঘটে গেলো তা পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারছে না তারা কেউই। “ডাক্তার ব্রুকস, সে বললো। “আমাদের উচিত কাউকে কল করা। কনসুলেট…পুলিশ। এরকম কাউকে।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো ডাক্তার। সেই সাথে আমাকে ডাক্তার ব্রুকস ডাকাও বন্ধ করুন-আমার নাম সিয়েনা।”
মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো ল্যাংডন। ধন্যবাদ, আমার নাম রবার্ট।” যেনো এইমাত্র জীবন নিয়ে পালিয়ে আসার পর তাদের দুজনের মধ্যে যে বন্ধনটা তৈরি হয়েছে সেটার আসল লক্ষ্য হলো নিজেদের নামের প্রথম অংশ ব্যবহার করে সম্বোধন করা। “তুমি বলছো তুমি একজন বৃটিশ?”
“জন্মসূত্রে বৃটিশ।”
“আমি অবশ্য তোমার উচ্চারণ শুনে বুঝতে পারি নি।”
“ভালো,” জবাব দিলো সে। “এটা কাটিয়ে ওঠার জন্য অনেক কষ্ট করেছি আমি।”
ল্যাংডন সবেমাত্র বলতে যাবে কেন, তার আগেই সিয়েনা তার সাথে আসার জন্য ইশারা করলো। সঙ্কীর্ণ করিডোর দিয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন একটি বাথরুমে নিয়ে গেলো তাকে। সিঙ্কের উপর রাখা আয়নায় নিজের চেহারা দেখলো ল্যাংডন।
মোটেও সুবিধার নয়। তার ঘন কালো চুল এলোমেলো। চোখ দুটো রক্তলাল আর ক্লান্ত। গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি।
সিঙ্কের ট্যাপ ছেড়ে দিয়ে ল্যাংডনের আহত হাতটা বরফ-শীতল পানির নীচে রাখলো সিয়েনা। ক্ষতস্থানে পানি লাগতেই খুব জ্বালাপোড়া করলো তারপরও চোখমুখ খিচে সহ্য করলো সে।
একটা হাত মোছার কাপড় নিয়ে তাতে তরল অ্যান্টিবায়োটিক সাবান মাখিয়ে নিলো সিয়েনা। “এটা তোমার না দেখাই ভালো।”
“সমস্যা নেই। এটা আমি সহ্য-”
কাপড়টা দিয়ে জোরে জোরে ক্ষতস্থানে ঘষা মারতেই তীব্র ব্যথায় চোখমুখ কুচকে গেলো ল্যাংডনের। কোনোমতে চিৎকার করা থেকে নিজেকে বিরত রাখলো।
“তুমি নিশ্চয় চাও না তোমার ইনফেকশন হোক,” ঘষতে ঘষতে বললো সে। “তাছাড়া, কর্তৃপক্ষকে ডাকতে গেলে তোমার দরকার নিজেকে অনেক বেশি ধাতস্থ রাখা। শারীরিক যন্ত্রণার চেয়ে আর কোনো জিনিস আমাদের অ্যাড্রেনালাইনকে এতো বেশি চাঙ্গা করতে পারে না।”
এভাবে টানা দশ সেকেন্ড ধরে চললো, তারপরই জোর করে হাতটা সরিয়ে নিলো ল্যাংডন। যথেষ্ট হয়েছে। তবে মনে মনে স্বীকার করতে বাধ্য হলো, আগের চেয়ে অনেক বেশি ধাতস্থ হতে পেরেছে। তার হাতের যন্ত্রণা মাথা ব্যথাটাকে ভুলিয়ে দিয়েছে আপাতত।
“ভালো,” ট্যাপটা বন্ধ করে পরিস্কার তোয়ালে দিয়ে তার হাতটা মুছতে মুছতে বললো সিয়েনা। এরপর ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ করে দিলো সে কিন্তু এটা করার সময় অন্য একটা চিন্তায় ডুবে গেলো ল্যাংডন। ব্যাপারটা টের পেতেই মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো। প্রায় চার দশক ধরে সে মিকি মাউস হাতঘড়িটা ব্যবহার করে আসছিলো, এটা তার বাবা-মা উপহার দিয়েছিলো তাকে। হাস্যোজ্জ্বল মিকি মাউসকে দেখে প্রাত্যহিক জীবনকে অনেক বেশি হালকা করে নেবার প্রেরণা পেতে। সব সময় হাসিমুখে থাকতো।
“আমার হাতঘড়িটা…” আক্ষেপে বলে উঠলো ল্যাংডন। “ওটা নেই!” এই ঘড়িটা ছাড়া নিজেকে কেমন জানি অপূর্ণ বলে মনে হচ্ছে তার। “হাসপাতালে যখন এসেছিলাম তখন কি ওটা আমার হাতে ছিলো?”
অবিশ্বাসভরা চোখে তাকালো সিয়েনা। এরকম তুচ্ছ জিনিস নিয়ে কেউ উদ্বিগ্ন হতে পারে দেখে যারপরনাই বিস্মিত সে। “তোমার হাতে কোনো ঘড়ি ছিলো কিনা জানি না। হাত-মুখ ধুয়ে নাও। কিছুক্ষণ পর আমি ফিরে আসছি তারপর তোমাকে কিভাবে সাহায্য করা যায় সেটা নিয়ে ভাবা যাবে।” দরজার কাছে গিয়ে থেমে গেলো ডাক্তার। আয়নার মধ্য দিয়ে তাকালো ল্যাংডনের দিকে। “এই ফাঁকে তুমি ভেবে দেখো কেন তোমাকে খুন করতে চাইবে ওরা। আমার ধারণা কর্তৃপক্ষের কাছে গেলে তারা এই প্রশ্নটাই সবার আগে তোমাকে করবে।”
“দাঁড়াও, তুমি কোথায় যাচ্ছো?”
“এই অর্ধনগ্ন অবস্থায় নিশ্চয় পুলিশের কাছে যেতে পারবে না। তোমার জন্য কিছু জামাকাপড় নিয়ে আসি। আমার এক প্রতিবেশি আছে ঠিক তোমার সাইজের। সে এখন দেশের বাইরে, তার বেড়ালটাকে আমিই খাবার-দাবার দিচ্ছি আপাতত। এরজন্যে সে আমার কাছে ঋণী।”
এ কথা বলেই চলে গেলো সিয়েনা।
রবার্ট ল্যাংডন আয়নায় নিজের মুখ দেখে চিনতেই পারলো না। কেউ আমাকে খুন করতে চাইছে। তার মাথার মধ্যে রেকর্ড করা নিজের কণ্ঠস্বরটা বেজে উঠলো। ঘোরের মধ্যে বিড়বিড় করে যে কথা বলেছিলো সে।
ভেরি সরি। ভেরি সরি।
স্মৃতি হাতরে কিছু খুঁজে পাবার চেষ্টা করলো…যেকোনো কিছু। কিন্তু কিছুই স্মরণ করতে পারলো না। ল্যাংডন শুধু জানে সে এখন ফ্লোরেন্সে আছে, মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে সেখানকার একটি হাসপাতালে গিয়েছিলো।
নিজের ক্লান্ত-শ্রান্ত চোখের দিকে তাকিয়ে তার মনের কোণে ক্ষীণ আশা জেগে উঠলো, সম্ভবত এক্ষুণি সে ঘুম থেকে উঠে দেখবে রিডিং চেয়ারে বসে আছে। হাতে মার্টিনির খালি গ্লাস আর ডেড সোলস বইটি। আর তখন নিজেকে সুধাবে বম্বে স্যাফায়ার এবং গোগল কখনও একসাথে গেলা যাবে না।
.
অধ্যায় ৭
হাসপাতাল থেকে দেয়া রক্তাক্ত গাউনটা খুলে কোমরে একটা তোয়ালে পেচিয়ে নিলো ল্যাংডন। মুখে পানির ঝাঁপটা দেবার পর মাথার পেছনে সেলাইর উপর হাত বোলালো সে। ক্ষতস্থানের চামড়া ফুলে আছে। অবিন্যস্ত চুলগুলো ঠিকঠাকভাবে আচড়ানোর পর সেলাইয়ের জায়গাটা ঢাকা পড়ে গেলো। ক্যাফেইনের কর্মকাণ্ড শুরু হতেই ঘোর লাগা ভাবটা কেটে গেলো দ্রুত। ভাবো, রবার্ট। মনে করার চেষ্টা করো।
জানালাবিহীন বাথরুমে হঠাৎ করেই ক্লসট্রোফোবিয়ায় আক্রান্ত হলে সঙ্গে সঙ্গে ওখান থেকে বের হয়ে চলে এলো হলে। করিডোরের একটি আধখোলা দরজার কাছে এসে দাঁড়ালো। দেখে মনে হলো ঘরটা স্টাডিরুম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সস্তা কাঠের ডেস্ক, পুরনো একটি সুইভেল চেয়ার, মেঝেতে অসংখ্য বই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, আর সবথেকে ভালো কথা…একটা জানালা রয়েছে সেখানে।
ল্যাংডন সেই জানালার দিকে এগিয়ে গেলো।
বহু দূরে টুসকানের সূর্যটা জেগে ওঠা শহরের সবচেয়ে বিখ্যাত ইমারত ক্যাম্পানিলি, বাদিয়া, বারগেশ্লোকে চুম্বন করতে শুরু করেছে মাত্র। শীতল কাঁচের উপর কপাল ঠুকলো ল্যাংডন। মার্চের বাতাস ঠাণ্ডা আর আদ্র, পাহাড়ের উপর দিয়ে আসা সূর্যরশ্মিকে আরো বেশি বিবর্ধিত করে তুলেছে যেনো।
এটাকে তারা বলে চিত্রকরের আলো।
স্কাইলাইনের মাঝখানে লাল টাইলসের বিশাল আর সুউচ্চ গম্বুজ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। গম্বুজের উপরে সোনালি রঙের পিতলের গোলক থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে আলো। ইল দুমো। ব্রুনেলেশি এই ব্যাসিলিকার বিশালাকৃতির গম্বুজটি নির্মাণ করে স্থাপত্যকলায় ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন। পাঁচশ’ বছরেরও বেশি আগে ৩৭৫ ফুট উঁচু এই স্থাপত্যটি নির্মাণ করার পর থেকে আজো মাথা উঁচু করে সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে পিয়াজ্জা দেল দুমোর উপর।
আমি কেন ফ্লোরেন্সে আসবো?
জীবনভর ল্যাংডন ইতালিয় শিল্পকলার একজন ভক্ত, সারা ইউরোপের মধ্যে ফ্লোরেন্স হলো তার সবচাইতে প্রিয় জায়গা। এই শহরের পথেঘাটে মাইকেলাঞ্জেলো শৈশবে খেলাধূলা করে বেড়াতেন, যার স্টুডিওগুলোতেই ইতালিয়ান রেনেসাঁর সূচনা হয়েছিলো। এই সেই ফ্লোরেন্স যেখানকার গ্যালারিগুলোতে লক্ষ-লক্ষ পর্যটক হুমরি খেয়ে পড়ে বত্তিচেল্লির বার্থ অব ভেনাস, লিওনার্দোর আনুনসিয়েশন এবং এখানকার গর্বের ধন ইল ডাভিদ দেখার জন্য।
স্বয়ং লিওনাদো তার শৈশবে আকাঁদেমিয়া দেল্লে বেল্লে আর্তিতে প্রথমবারের মতো মাইকেলাঞ্জেলোর ডেভিড দেখে মন্ত্রমুগ্ধ হয়েছিলেন…মাইকেলাঞ্জেলোর অপেক্ষাকৃত কম সূক্ষ্ম কাজ পিরিগিওনি দেখার পর হঠাৎ করেই তিনি উপরের দিকে তাকিয়ে সতেরো ফুট উঁচু মাস্টারপিসটাকে দেখে যারপরনাই বিস্মিত হন। ডেভিড-এর অসাধারণ নিখুঁত কাজ আর পাথরের সুনিপুন খোদাই দেখে প্রথমবার সব দর্শনার্থীই চমকে যায়। তারপরও ল্যাংডনের কাছে ডেভিড-এর ভঙ্গিটিই অসম্ভব মন্ত্রমুগ্ধকর বলে মনে হয়। ডান দিকে ঝুঁকে থাকা ডেভিড-এর ক্ষেত্রে ক্লাসিক্যাল ট্র্যাডিশন কাঁপোস্তো স্টাইল ব্যবহার করে এক ধরণের ইলিউশান তৈরি করেছিলেন মাইকেলাঞ্জেলো। তার বাম পা-টা বলতে গেলে কোনো ওজনই বহন করছে না, কিন্তু ডান পা-টা কয়েক টন ওজনের মার্বেল বহন করে আছে।
মহান ভাস্কর্য কতোটা শক্তিশালী হতে পারে সেটা প্রথমবার ডেভিড দেখেই ল্যাংডন বুঝতে পেরেছিলো। এখন সে ভাবছে, কয়েকদিন আগে এই মাস্টারপিসটা দেখতে গিয়েছিলো কিনা, কিন্তু জেগে উঠে হাসপাতালে নিজেকে আবিষ্কার করা এবং চোখের সামনে একজন ডাক্তারের হত্যাকাণ্ডের স্মৃতি ছাড়া আর কিছুই মনে করতে পারলো না। ভেরি সরি। ভেরি সরি।
সুতীব্র এই অপরাধবোধের কারণে বমি করার উপক্রম হলো তার। আমি করেছিটা কি?
জানালার সামনে দাঁড়িয়ে থেকেই তার চোখের কোণ দিয়ে কিছু একটা দেখতে পেয়ে তাকিয়ে দেখলো তার পাশে ডেস্কের উপর একটি ল্যাপটপ রাখা আছে। হঠাৎ করেই বুঝতে পারলো গতরাতে যা-ই ঘটে থাকুক না কেন সেটা নিশ্চয় সংবাদে ঠাঁই পেয়েছে।
ইন্টারনেটে ঢুকতে পারলে এর জবাব হয়তো পাবো।
দরজার দিকে ফিরে ডাক দিলো ল্যাংডন : “সিয়েনা?!”
কোনো সাড়াশব্দ নেই। মেয়েটা এখনও তার প্রতিবেশির বাড়িতেই আছে, তার জন্যে কাপড়চোপড় খুঁজছে।
বিনা অনুমতিতে ল্যাপটপ ব্যবহার করার বিষয়টা সিয়েনা নিশ্চয় বুঝতে পারবে, এই ভেবে ল্যাপটপটা চালু করে দিলো।
ল্যাপটপের পদা সজীব হয়ে উঠলো চিরচেনা উইন্ডোজের নীল রঙের ব্যাকগ্রাউন্ডে। দেরি না করে গুগল ইটালিয়ার সার্চ পেইজে গিয়ে রবার্ট ল্যাংডন টাইপ করলো সে। আমার ছাত্ররা যদি এখন আমাকে দেখতে পেতো, সার্চ শুরু করার সময় ভাবলো ল্যাংডন। তার ছাত্রছাত্রিদেরকে প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে গুগল ব্যবহার করার তীব্র সমালোচনা করে থাকে সে। আমেরিকান যুব সমাজকে এই গুগল যেনো গ্রাস করে ফেলেছে।
সার্চের ফলাফল ভেসে উঠলো একটি পেইজেশত শত হিট। ল্যাংডনের লেখা বই, তার লেকচার। আমি তো এসব খুঁজছি না।
সীমাবদ্ধ পরিসরে সার্চ করার জন্য নিউজ বাটনটা সিলেক্ট করলো।
নতুন একটি পেইজ হাজির হলো এবার : নিউজ রেজাল্ট ফর ‘রবার্ট ল্যাংডন।
বইয়ে স্বাক্ষর : রবার্ট ল্যাংডন উপস্থিত হবেন…
রবার্ট ল্যাংডনের গ্র্যাজুয়েশনের ঠিকানা…
রবার্ট ল্যাংডন প্রকাশ করেছেন সিম্বল প্রাইমার ফর…
তালিকাটি কয়েক পেইজ দীর্ঘ, কোনোটাতেই সাম্প্রতিক সময়ের সংবাদ নেই-তার বর্তমান কঠিন সময়ের কোনো সংবাদই নেই সেখানে। গতরাতে কি হয়েছিলো? ল্যাংডন এতো সহজে হাল ছেড়ে দিলো না, ফ্লোরেন্স থেকে প্রকাশিত দ্য ফ্লোরেন্টাইন নামের একটি ইংরেজি পত্রিকার ওয়েব সাইটে ঢুকলো। প্রধান শিরোনাম, ব্রেকিং নিউজ আর পুলিশের ব্লগ, একটি অ্যাপার্টমেন্টে আগুন লাগার খবর, সরকারের তহবলি তছরুপ কেলেংকারি, ছোটোখাটো অপরাধের খবর, সব পড়ে দেখলো সে।
কিছুই নেই?
একটা ব্রেকিং নিউজে তার চোখ গেলো : গতরাতে শহরের ক্যাথেড্রালের বাইরের প্রাজা’তে এক সরকারী কর্মকর্তা হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছে। লোকটার নাম প্রকাশ করা না হলেও তার মৃত্যু নিয়ে কোনো রকম সন্দেহ প্রকাশ করা হয় নি।
কী করবে বুঝতে না পেরে অবশেষে হারর্ভাডের ই-মেইল অ্যাকাউন্টে প্রবেশ করে মেসজ চেক করে দেখলো ল্যাংডন। তার মনে ক্ষীণতম আশা, হয়তো ওখান থেকে কোনো কিছু জানা যাবে। কিন্তু সাধারণ মেইল ছাড়া আর কিছুই পেলো না। তার কলিগ, বন্ধুবান্ধব, ছাত্রছাত্রিরা সামনের সপ্তাহে তার সঙ্গে দেখা করার জন্য সময় চেয়ে মেইলগুলো করেছে।
মনে হচ্ছে আমি যে ওখানে নেই সে-কথা কেউ জানেই না।
হতাশ হয়ে ল্যাপটপটা বন্ধ করে দিলো সে। ডেস্ক থেকে উঠতে যাবে অমনি তার চোখে কিছু একটা ধরা পড়লো। সিয়েনার ডেস্কের এক কোণে পুরনো মেডিকেল জার্নালের স্তূপের উপর একটি পোলারয়েড ছবি রাখা আছে। ছবিটা সিয়েনা ব্রুকস আর তার দাড়িওয়ালা ডাক্তার কলিগের, হাসপাতালের হলওয়েতে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে তারা।
ডাক্তার মারকোনি, ছবিটা হাতে নিতেই এক ধরণের অপরাধবোধে আক্রান্ত হলো ল্যাংডন। বইয়ের স্তূপের উপর ছবিটা রাখতে গিয়ে অবাক হয়ে খেয়াল করলো উপরে একটি হলুদ রঙের বুকলেট আছে-লন্ডনের গ্লোব থিয়েটারের বহু পুরনো একটি প্লেবিল। কভারের উপরে লেখা আছে, এটা শেক্সপিয়ারের একটি প্রডাকশন অ্যা মিডসামার নাইট’স ড্রিম…প্রায় পঁচিশ বছর আগে মঞ্চস্থ হয়েছিলো।
প্লেবিলের উপরে ম্যাজিক মার্কার কলম দিয়ে হাতে লেখা একটি মেসেজও আছে :
সুইটহার্ট, কখনও ভুলে যেয়ো না তুমি যে অলৌকিক একজন।
প্লেবিলটা হাতে তুলে নিতেই স্তূপ থেকে একগাদা পেপার ক্লিপিং ডেস্কের উপর পড়ে গেলো। সেগুলো তুলতে গিয়ে থমকে গেলো সে।
ল্যাংডন চেয়ে রইলো নাটকের একজন অভিনয় শিল্পীর ছবির দিকে, যে শেক্সপিয়ারের ছোট্ট এক দুষ্টু পরী পুক-এর চরিত্রে অভিনয় করছে। মেয়েটির বয়স পাঁচের বেশি হবে না। সোনালি চুলগুলো অতি পরিচিত পনিটেইল করা।
ছবির নীচে লেখা : এক তারকার আবির্ভাব।
জীবন বৃত্তান্তটি এক বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারী শিশু মঞ্চাভিনেত্রীর উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় ভরপুর-মেয়েটি আর কেউ নয়, সিয়েনা ব্রুকস। তার আইকিউ অনন্য সাধারণ, নাটকের প্রতিটি চরিত্রের ডায়লগ সে এক রাতেই মুখস্ত করতে পারে। রিহার্সেলের সময় তাকে প্রম্পট করার দরকার পড়ে না। এই পাঁচ বছরের মেয়েটির শখের মধ্যে রয়েছে বেহালা বাজানো, দাবা খেলা আর রসায়নশাস্ত্র। লন্ডনের উপকণ্ঠে ব্ল্যাকহিদের এক ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান সে। এরইমধ্যে বৈজ্ঞানিক সার্কেলে মেয়েটি একজন সেলিব্রেটি হয়ে উঠেছে। চার বছর বয়সে একজন গ্র্যান্ড মাস্টারকে হারিয়ে দিয়েছিলো দাবা খেলায়, তিন তিনটি ভাষায় পড়তে পারে সে।
ওহ্ ঈশ্বর, মনে মনে বললো ল্যাংডন। সিয়েনা। কিছু বিষয় তাহলে বোঝা গেলো।
সল ক্রিপকি নামের হারভাডের এক প্রোডিজি বাচ্চার কথা স্মরণ করলো সে। অল্প বয়সেই গ্র্যাজুয়েট হতে পেরেছিলো ছেলেটা। মাত্র ছয় বছর বয়সে হিব্রু ভাষা শিখেছিলো, আর বারো বছর বয়সে পড়ে ফেলেছিলো দেকার্তের সমগ্র রচনা। সাম্প্রতিক সময়ে ল্যাংডন পত্রিকায় পড়েছিলো মোশে কাই ক্যাভালিন। নামের আরেক প্রোডিজির কথা। এগারো বছর বয়সে ৪.০ গ্রেড-পয়েন্ট নিয়ে কলেজ ডিগ্রি অর্জন করে এবং মার্শাল আর্টে ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ন হয় সে। চৌদ্দ বছর বয়সে উই ক্যান ডু শিরোনামে একটি বই লিখে ফেলে।
ল্যাংডন আরেকটি পেপার ক্লিপিং হাতে তুলে নিলো। সিয়েনার সাত বছর বয়সের ছবি আর সেই সঙ্গে তার উপর লেখা একটি আর্টিকেল। সিয়েনা ব্রুকস একজন দক্ষ বেহালা বাদক, এক মাসের মধ্যে যেকোনো ভাষা শিখে ফেলে এবং নিজে নিজে অ্যানাটমি আর ফিজিওলজির উপর পড়াশোনা করতে পারে।
এবার একটি মেডিকেল জার্নালের ক্লিপিংয়ের দিকে নজর গেলো তার : চিন্তার ভবিষ্যৎ : সব মস্তিষ্ক সমানভাবে সৃষ্টি হয় না।
সিয়েনার দশ বছর আগের একটি ছবি দেয়া আছে সেখানে। বিশাল একটি মেডিকেল যন্ত্রপাতির সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে। আর্টিকেলে একজন ডাক্তারের ইন্টারভিউ রয়েছে, যিনি সিয়েনার মস্তিষ্কের পিইটি স্ক্যানের ফলাফল ব্যাখ্যা করেছেন। তাতে বলা আছে, সিয়েনার মস্তিষ্ক জন্মগতভাবেই অন্যদের চেয়ে আলাদা, অর্থাৎ একটু বড়। সাধারণ মানুষের চেয়ে তার মাথার স্ট্রিমলাইন অগ্যান অনেক বেশি, এরফলে আট-দশজনের তুলনায় ভিজুয়াল-স্প্যাশিয়াল কন্টেন্ট অনেক বেশি ধারণ করতে সক্ষম হয় সে যা কারো পক্ষেই বোধগম্য নয়। সিয়েনার ফিজিওলজিক্যাল সুবিধাকে অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়া ক্যান্সারের কোষের সাথে তুলনা করেছেন ডাক্তার। পার্থক্য হলো, ক্যান্সারের বেলায় বিপজ্জনক কোষের বৃদ্ধি ঘটে আর সিয়েনার বেলায় ঘটে তার মস্তিষ্কের কোষের বৃদ্ধি।
মফশ্বলের সংবাদপত্রের একটি ক্লিপিং খুঁজে পেলো ল্যাংডন। অসাধারণ হবার অভিশাপ
এই ক্লিপিংয়ে কোনো ছবি নেই, তবে খবরটা শিশু সিয়েনা ব্রুকসের উপর, যেকিনা সরকারী স্কুলের সাথে মানিয়ে নেবার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলো কিন্তু অন্য ছাত্রদের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারে নি বলে হয়রানির শিকার হয়েছে সে।
বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারী শিশুদের নিঃসঙ্গতা নিয়ে লেখা হয়েছে আর্টিকেলটি। তারা অনন্য প্রতিভার অধিকারী হলেও সমাজের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে ব্যর্থ হয়। ফলে প্রায়শই তাদেরকে সমাজচ্যুত হবার মতো নির্মম ঘটনারও শিকার হতে হয়।
আর্টিকেলটি আরো বলছে, মাত্র আট বছর বয়সে সিয়েনা বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে দশ দিন একা একা কাটাতে সক্ষম হয়। তাকে পাওয়া যায় লন্ডনের একটি ব্যয়বহুল হোটেলে। ওখানে এক গেস্টের মেয়ে হিসেবে নিজেকে পরিচয় দেয় সে, একটি চাবি চুরি করে অন্যের একাউন্ট ব্যবহার করে রুম সার্ভিসে অর্ডার দেয়। ওখানে থাকার সময় পুরো একটা সপ্তাহ সে ব্যয় করে ১৬০০ পৃষ্ঠার গ্রেস অ্যানাটমি বইটি পড়ে। পুলিশ যখন তাকে জিজ্ঞেস করে কেন সে এরকম মেডিকেল বই পড়েছে তখন জবাবে সিয়েনা জানায়, তার মস্তিষ্কে কী সমস্যা আছে সেটা জানার জন্যই বইটি পড়েছে।
ছোট্ট মেয়েটির জন্য ল্যাংডনের হৃদয় আদ্র হয়ে উঠলো। অন্যদের চেয়ে আলাদা হবার কতো যাতনা সইতে হয় সেটা সে কল্পনাও করতে পারলো না। আর্টিকেলগুলো ভাঁজ করে পুক-এর চরিত্রে অভিনয় করা পাঁচ বছর বয়সের ছবিটার দিকে আরেকবার তাকালো সে। ল্যাংডনের মনে হলো আজকে সিয়েনার সাথে তার সাক্ষাতের ঘটনাটি খুবই পরাবাস্তবধর্মী, এর সাথে স্বপ্নে আবির্ভূত হওয়া পুকের চরিত্রের সাথে যেনো অদ্ভুতভাবেই মিলে যায়। ল্যাংডনের আরো মনে হলো ঐ নাটকের মতোই সে জেগে উঠে যদি দেখতে পেতো এখন পর্যন্ত ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো আসলে দুঃস্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই না তাহলে কী দারুণই হতো।
পেপার ক্লিপিংগুলো সাবধানে রেখে দিতেই প্লেবিলের উপরে লেখা মেসেজটা চোখে পড়লো আবার, সঙ্গে সঙ্গে এক ধরণের অপ্রত্যাশিত বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হলো ল্যাংডন : সুইটহার্ট, কখনও ভুলে যেয়ো না তুমি যে অলৌকিক একজন।
প্লেবিলের উপর পরিচিত একটি সিম্বল চোখে পড়লো তার। প্রাচীন গ্রিকের একটি পিক্টোগ্রাম, বিশ্বের বেশিরভাগ প্লেবিলের উপরেই এটা অঙ্কিত থাকে-সিম্বলটি ২৫০০ বছরের পুরনো, থিয়েটারের সমার্থক হয়ে উঠেছে এখন।
লে মাশকেয়ার।
কমেডি আর ট্র্যাজেডির আইকনিক মুখ দুটোর দিকে তাকালো ল্যাংডন, হঠাৎ করেই অদ্ভুত একটি গুঞ্জন শুনতে পেলো-যেনো তার মাথার ভেতরে থাকা কোনো তার আস্তে আস্তে টানা হচ্ছে। মাথার ভেতরে চাকুর আঘাতের মতো যন্ত্রণা অনুভূত হলো এরপর। চোখের সামনে ভাসতে দেখলো মুখোশের দৃশ্যগুলো। আর্তনাদ করে উঠলো ল্যাংডন, দু’হাত উপরে তুলে ধরলো। ডেস্কের চেয়ারে বসে দু’চোখ বন্ধ করে মাথাটা শক্ত করে ধরে রাখলো সে।
অন্ধকারে সেই বীভৎস দৃশ্যটা আবার ফিরে এলো প্রচণ্ড ভয়ের সাথে।
সাদা চুলের মহিলা রক্তলাল নদীর ওপারে দাঁড়িয়ে তাকে ডেকে যাচ্ছে। তার মরিয়া চিৎকার বিদীর্ণ করছে ভারি গন্ধের বাতাস। নির্যাতন আর মৃত্যুপথযাত্রিদের আর্তনাদের মধ্যেই পরিস্কার শোনা যাচ্ছে সেই কণ্ঠ। সীমাহীন যন্ত্রণার মধ্যে নিপতিত সে। মাথা নীচে পা উপরে তুলে শরীরের অর্ধেক মাটিতে পুতে রাখা দেহটা আবারো দেখতে পেলো। এক পায়ের ঊরুতে ইংরেজি R অক্ষরটি লেখা। সেই পা দুটো উদভ্রান্তের মতো শূন্যে ছোঁড়া হচ্ছে।
খুঁজলেই পাবেন? মহিলা বলছে ল্যাংডনকে। সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে!
ল্যাংডন সেই মহিলাকে…সবাইকে সাহায্য করার সুতীব্র তাড়না অনুভব করলো আবার। উদভ্রান্তের মতো সেও চিৎকার করে বললো : আপনি কে?!
আবারো সেই একই দৃশ্য-মহিলা ঘোমটা খুলে ফেললে তার সুন্দর মুখটা দেখা গেলো।
আমি জীবন, বললো সে।
হুট করে মহিলার উপরে আকাশে ভেসে উঠলো বিশাল একটি ছবি-ভয়ঙ্কর দেখতে একটা মুখোশ পরে আছে, মুখোশের নাকটা ঈগল পাখির নাকের মতোই লম্বা, চোখ দুটো তীব্র সবুজ রঙের, চেয়ে আছে ল্যাংডনের দিকে।
আর আমি…মৃত্যু! গমগম করে বলে উঠলো কণ্ঠটি।
.
অধ্যায় ৮
চট করে ল্যাংডনের চোখ খুলে গেলো, হরবর করে নিঃশ্বাস নিলো সে। সিয়েনার ডেস্কের চেয়ারে বসে আছে, মাথার পেছনে দু’হাত, হৃদপিণ্ডটা লাফাচ্ছে।
আমার হচ্ছেটা কি?
সাদা চুলের মহিলা আর লম্বা নাকের মুখোশ তার মাথায় যেনো গেঁথে আছে। আমি জীবন। আমি মৃত্যু। মাথা ঝাঁকিয়ে দৃশ্যটা ঝেড়ে ফেলতে চাইলো কিন্তু মনে হলো ওটা তার মাথায় চিরস্থায়ীভাবে জেঁকে বসেছে। ডেস্কের উপর রাখা প্লেবিলের দুটো মুখোশ চেয়ে আছে তার দিকে।
আপনার স্মৃতিগুলো বিক্ষিপ্ত আর অবিন্যস্ত, সিয়েনা তাকে বলেছিলো। অতীত, বর্তমান আর কল্পনার মিশ্রণে একাকার হয়ে গেছে।
ল্যাংডনের মনে হলো তার মাথা ঝিমঝিম করছে।
অ্যাপার্টমেন্টের কোথাও একটা ফোনের রিং বাজছে এখন। একেবারে তীক্ষ্ণ আর পুরনো দিনের একটা রিংটোন। রান্নাঘর থেকে আসছে।
“সিয়েনা??” চেয়ার থেকে উঠে ডাকলো ল্যাংডন।
কোনো সাড়াশব্দ নেই। মেয়েটা এখনও ফিরে আসে নি। দু’বার রিং হবার পরই অ্যালারিং মেশিন কলটা রিসিভ করলো।
“চিয়াও, সোননা ইও,” সিয়েনার রেকর্ড করা কণ্ঠ বলে উঠলো। “লাসিয়েতেমি উন মেসাজ্জিও এ ভি রিচিয়ামেরো।”
একটা বিপ্ হবার পরই ভয়ার্ত এক নারীকণ্ঠ পূর্ব ইউরোপিয়ান টানে মেসেজ রাখতে শুরু করলো। হল পর্যন্ত প্রতিধ্বনিত হলো তার কণ্ঠ।
“সিয়েনা, আমি দানিকোভা! তুমি কোথায়?! ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে গেছে! তোমার বন্ধু মারকোনি মারা গেছে! লঙ্কাকাণ্ড হয়ে গেছে হাসপাতালে! এখানে। পুলিশ এসেছিলো! ওরা বলছে তুমি একজন রোগিকে বাঁচানোর জন্য তাকে নিয়ে পালিয়ে গেছো?! কেন!? তুমি তো তাকে চেনো না! পুলিশ এখন তোমার সাথে কথা বলতে চাইছে! তারা সব কর্মচারীর ফাইল নিয়ে গেছে! আমি জানি সব তথ্য ভুল-ঠিকানাও ভুল, কোনো নাম্বারও নেই। ওয়াকিং ভিসাটা জাল-তাই ওরা তোমাকে আজ খুঁজে পায় নি। কিন্তু খুব জলদিই পেয়ে যাবে। আমি তোমাকে সতর্ক করে দিলাম। খুবই দুঃখিত, সিয়েনা।”
কলটা শেষ হয়ে গেলো।
প্রচণ্ড অনুশোচনা গ্রাস করলো ল্যাংডনকে। মেসেজের কথা, সিয়েনাকে ডাক্তার মারকোনি তার সাথে কাজ করতে দেয়া। আর এখন ল্যাংডনের কারণে মারকোনির জীবনাবসান, সিয়েনা তাকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের বিপদ ডেকে আনা, সব কিছুর জন্যে সে-ই দায়ি।
এমন সময় অ্যাপার্টমেন্টের দরজা বন্ধ করার শব্দ হলো।
সিয়েনা ফিরে এসেছে।
কিছুক্ষণ পরই অ্যালারিং মেশিনটা বাজতে শুরু করলো। “সিয়েনা, আমি দানিকোভা! তুমি কোথায়?!”
ল্যাংডনের চোখমুখ তিক্ততায় ভরে উঠলো, ভালো করেই জানে সিয়েনা কি শুনতে যাচ্ছে। মেসেজ চলার সময় ল্যাংডন দ্রুত প্লেবিলটা রেখে দিলো জায়গামতো, ডেস্কের সবকিছু ঠিকঠাক করে চলে গেলো হলের বাথরুমে। সিয়েনার অতীত জীবন সম্পর্কে জানতে পেরে এক ধরণের অস্বস্তি বোধ করছে সে।
দশ সেকেন্ড পর বাথরুমের দরজায় আলতো করে টোকা পড়লো।
“দরজার কাছে আমি কিছু কাপড়চোপড় রেখে যাচ্ছি,” বললো সিয়েনা। তার কণ্ঠ আবেগে কাঁপছে।
“অনেক ধন্যবাদ তোমাকে,” জবাব দিলো ল্যাংডন।
“জামাগুলো পরা শেষ হলে রান্নাঘরে চলে আসবে,” বললো মেয়েটি। “কাউকে কল করার আগে তোমাকে গুরুত্বপূর্ণ একটি জিনিস দেখানো দরকার।”
.
ক্লান্ত পায়ে অ্যাপার্টমেন্টের হল দিয়ে নিজের বাথরুমের দিকে এগিয়ে গেলো সিয়েনা। ড্রেসার থেকে একটা নীল রঙের জিন্স আর সোয়েটার নিয়ে ঢুকে পড়লো বাথরুমে।
আয়নায় নিজের চেহারাটা দেখে গেলো কয়েক মুহূর্ত, তারপর সোনালি চুলের ঝুটিটা শক্ত করে ধরে এক টানে খুলে ফেললো। বেরিয়ে এলো তার ন্যাড়া মাথা।
আয়নার ভেতর থেকে চুলবিহীন বত্রিশ বছরের এক নারী তার দিকে চেয়ে আছে। এ জীবনে অসংখ্য চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেছে সে, চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার সহ্য ক্ষমতা রয়েছে তার। কঠিন সময় অতিক্রম করার জন্য সব সময়ই নিজের বুদ্ধিমত্তার উপর নির্ভর করে তারপরও বর্তমান পরিস্থিতিতে পড়ে সুগভীর আবেগে কেঁপে উঠলো।
সোনালি চুলের উইগটা পাশে রেখে মুখ আর হাত ধুয়ে নিলো পানিতে। হাত-মুখ মুছে জামা-কাপড় পাল্টে আবারো উইগটা মাথায় চাপালো। নিজেকে করুণা করার মতো জঘন্য ব্যাপারটি বেশিরভাগ সময়ই সহ্য করতে পারে না সে, কিন্তু এখন বুকের ভেতর থেকে কান্নার দমক বের হয়ে আসতে চাইলে সে আর বাধা দিলো না।
নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না যে জীবন তার জন্যে কাঁদলো।
সে কাঁদলো চোখের সামনে তার মেন্টরকে মরে যেতে দেখেছে বলে।
তার সমস্ত হৃদয় জুড়ে যে একাকীত্ব জুড়ে আছে তার জন্যে কাঁদলো।
তবে সবকিছু ছাপিয়ে নিজের ভবিষ্যতের জন্য কাঁদলো সে…হঠাৎ করেই যেনো সেটা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
.
অধ্যায় ৯
মেন্দাসিয়াম-এর নীচের ডেকে ফ্যাসিলিটেটর লরেন্স নোলটন নিজের কাঁচের রুমে বসে কম্পিউটার মনিটরের দিকে অবিশ্বাসভরা চোখে চেয়ে আছে। তাদের ক্লায়েন্টের দেয়া ভিডিও এইমাত্র দেখেছে সে।
এই ভিডিওটা আগামীকাল বড় বড় মিডিয়াতে আপলোড করতে হবে আমাকে?
কনসোর্টিয়ামে তার দশ বছর চাকরির সময়কালে এমন অনেক ধরণের কাজ সে করেছে যেগুলোর কোনো কোনোটা অসৎ এবং অবৈধও বটে। নীতির দিক থেকে ধূসর এলাকায় কাজ করাটা কনসোর্টিয়ামে অবশ্য সাধারণ ঘটনা-এটি এমন এক সংগঠন যার একমাত্র নীতি হলো ক্লায়েন্টের কাছে দেয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করার জন্য যা করার দরকার তা-ই করতে হবে।
আমরা শুধু তা-ই অনুসরণ করি। ঘটনা যা-ই হোক না কেন, কোনো প্রশ্ন করা যাবে না।
তবে এই ভিডিওটা আপলোড করার ফলাফল কি হতে পারে সে-ব্যাপারে নোলটন নিশ্চিত হতে পারছে না। অতীতে অনেক উদ্ভট আর অবিশ্বাস্য সব কাজ করেছে সে, ওসব করার সময় বুঝতে পারতো কাজটার উদ্দেশ্য আর কাঙ্খিত ফলাফল কি হতে পারে।
কিন্তু এই ভিডিওটা একেবারেই হতবুদ্ধিকর।
এটা একেবারেই অন্যরকম কিছু।
পুরোপুরিই অন্যরকম।
ভিডিওটা আবারো চালু করলো নোলন। তার মনে ক্ষীণতম আশা, দ্বিতীয়বার দেখার সময় হয়তো আরেকটু বোধগম্য হবে বিষয়টা। ভলিউমটা বাড়িয়ে দিয়ে নয় মিনিটের ভিডিওটা আবার দেখতে শুরু করলো সে।
যথারীতি পানির ছলাৎ ছলাৎ শব্দ দিয়ে শুরু। গুহাতুল্য একটি জায়গা। মেঝেতে পানি। সেখান থেকে ভুতুরে লালচে আলো উদগীরিত হচ্ছে। ক্যামেরা সেই লালচে পানির নীচে চলে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। পানির নীচে গিয়ে দেখা যাচ্ছে একটা নামফলকের মতো জিনিস :
এই জায়গায়, এই তারিখে এ বিশ্ব বদলে গিয়েছিলো চিরতরের জন্যে।
কনসোর্টিয়ামের ক্লায়েন্টের স্বাক্ষর করা এই লেখাটি একেবারেই অস্বস্তিকর। যে তারিখের কথা বলা হয়েছে সেটা আগামীকালের…এটা দেখে নোলটন চিন্তিত হয়ে উঠলো। এক ধরণের অস্থিরতায় আক্রান্ত হলো সে।
এবার পানির নীচে থাকা ক্যামেরাটি বাম দিকে ঘুরতেই অদ্ভুত একটি জিনিস দেখা গেলো। ধাতব ফলকটির পাশেই সেটা ভাসছে।
মেঝে থেকে কোনো চিকন তার দিয়ে পাতলা স্বচ্ছ প্লাস্টিকের গোলকটি আটকানো। দেখে মনে হচ্ছে খুবই নাজুক, টালমাটাল অবস্থায় আছে, অনেকটা বিশাল আকৃতির সাবানের বুদবুদের মতো। এই স্বচ্ছ গোলকটি পানির নীচে কোনো বেলুনের মতোই ভাসছে…এর ভেতরে হিলিয়াম নয়, এক ধরণের হলুদ বাদামি গেলাটিনের মতো তরল পদার্থ রয়েছে। এই থলথলে ব্যাগটি ভেতরের চাপে ক্রমশ স্ফীত হচ্ছে যেনো। এর পরিধি এক ফুটের মতো হবে। ভেতরের বস্তুটা মনে হচ্ছে ধীরে ধীরে ঘুরপাক খাচ্ছে, অনেকটা নিঃশব্দে বেড়ে ওঠা ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্রের মতো।
হায় ঈশ্বর, হতবুদ্ধিকর নোলটন মনে মনে বললো। ভাসমান এই ব্যাগটি দ্বিতীয়বার দেখতে গিয়ে আরো বেশি ভীতিকর বলে মনে হচ্ছে তার কাছে।
ধীরে ধীরে ছবিটা মিইয়ে গিয়ে অন্ধকারে হারিয়ে গেলো।
নতুন একটি ছবি ভেসে উঠলো এবার-গুহাতুল্য জায়গাটির ভেজা দেয়াল দেখা যাচ্ছে। পানির প্রতিফলন পড়েছে সেখানে। দেয়ালে একটি অবয়ব দেখা গেলো…একজন মানুষের…সোজা দাঁড়িয়ে আছে।
কিন্তু লোকটার মাথার আকৃতি বলতে গেলে খুব বাজেভাবে বিকৃত।
তার নাকের জায়গায় ঈগলপাখির লম্বা ঠোঁট…যেনো সে আর্ধমানব অর্ধপক্ষী।
সে যখন কথা বললো তার কণ্ঠ ফ্যাসফ্যাসে শোনালো…অদ্ভুত এক ভঙ্গিতে কথা বললো…যেনো হিসেব করে মেপে মেপে…কোনো মহাকাব্য পাঠরত আবৃত্তিকারের মতো।
নিশ্চল হয়ে বসে রইলো নোলটন। পাখির ঠোঁটযুক্ত লোকটি কথা বলতে শুরু করলে নিঃশ্বাস নিতে ভুলে গেলো সে।
.
আমি সেই ছায়া।
তোমরা যদি এটা দেখে থাকো তাহলে বুঝবো আমার আত্মা
অবশেষে শান্তিতে ঘুমাচ্ছে।
মাটির নীচ থেকে আমি কথা বলছি সারাবিশ্বকে শোনানোর জন্য,
এখানে এই গুহায় আমি নির্বাসিত, যেখানকার রক্তলাল পানিতে
আকাশের তারা প্রতিফলিত হয় না।
কিন্তু এটাই আমার স্বর্গ…আমার নাজুক সন্তানের আদর্শ জরায়ু।
ইনফার্নো।
খুব জলদিই তোমরা জানতে পারবে আমি কি রেখে গেছি তোমাদের জন্য।
এমনকি এখানেও আমি আঁচ করতে পারি আমাকে তাড়িয়ে বেড়ানো মূৰ্থ আত্মাদের পদধ্বনি…আমার কর্মকাণ্ডকে থামিয়ে দেবার জন্য তারা মরিয়া।
তুমি হয়তো বলবে, তাদেরকে ক্ষমা করে দিন, কারণ তারা জানে। না তারা কি করছে। কিন্তু দুনিয়াতে এমনও সময় আসে যখন মূর্খদের আর ক্ষমা করে দেয়া যায় না…তখন কেবলমাত্র প্রজ্ঞারই থাকে মুক্ত করার ক্ষমতা।
বিবেকের বিশুদ্ধতার সাথে মৃত্যুর আগে আমি তোমাদের জন্য আশার আলো, মুক্তি আর ভবিষ্যৎ দান করে গেছি।
অথচ এখনও এমন লোক রয়েছে যারা আমাকে কুকুরের মতোই শিকার করে বেড়াচ্ছে, নিজেদের মনগড়া বিশ্বাসে তারা বিশ্বাস করে আমি একজন উন্মাদ। এক সাদা চুলের অপরূপা আছে, যে আমাকে দানব বলে ডাকে! কোপার্নিকাসের মৃত্যুর জন্যে যে অন্ধ যাজক দেনদরবার করেছিলো ঠিক তার মতোই ঐ নারী আমাকে শয়তান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে বদ্ধপরিকর, আমার কাছে যে সত্যের দর্শন আছে সেজন্যে সে যারপরনাই ভীত।
তবে আমি কোনো পয়গম্বর নই।
আমি তোমাদের মোক্ষ।
আমি সেই ছায়া।