৮.২ ভাসমান
দুই তীরের উচ্চতা ডিঙ্গাইয়া একদিন দূরদূরাস্তের কৃষকের লাঠি-লাঠা লইয়া চরের মাটিতে ঝাঁপাইয়া পড়িল। পরস্পর লাঠালাঠি করিয়া চরটিকে তারা দখল করিয়া লইল। জেলেরা তীর হইতে কেবল তামাসা দেখিল। এ জায়গা যতদিন জলে ছিল ডোবানো, ততদিনই ছিল মালোদের। যেই জল সরাইয়া ভাসিয়া উঠিয়াছে, তখনি হইয়া গেল চাষাদের। এখানে তারা বীজ বুনিবে, ফসল কাটিয়া ঘরে তুলিবে। তাদের এ দখল চিরকাল বর্তাইয়া রহিবে, কোনোদিন কেউ এ দখল হরণ করিয়া লইবে না। তাদের এ দখল যে বাস্তবের উপর; তা যে মাটির গভীরে অনুপ্রবিষ্ট। আর মালোদের দখল ছিল জলে; তরলতার নিরবলম্ব নিরবয়বের মধ্যে। কোনোদিন সেটা বাস্তবের গভীর স্পর্শ খুঁজিয়া পাইল না। পাইল না শক্ত কোনো অবলম্বন। কঠিন কোনো পা রাখিবার স্থান। তাই তারা ভাসমান। পৃথিবীর বুকে মিশিয়া যতই তারা, জেলেরা, গাছপালা বাড়িঘরের সঙ্গে মিতালি করুক, তারা বাম্পের মত ভাসমান। যতই তারা পৃথিবীর বুক আঁকড়াইয়া ধরিয়া থাকুক, ধরার মাটি তাহাদিগকে সর্বদা দুই হাতে ঠেলিয়া দিতেছে, আর বলিতেছে, ঠাঁই নাই, তোমাদের ঠাঁই নাই। যতদিন নদীতে থাকে জল, ততদিন তারা জলের উপর ভাসে। জল শুখাইলে তারা জলের সঙ্গে বাম্প হইয়া উড়িয়া যায়।
এখনো জোয়ার আসে। চরটা তখন ডুবিয়া যায়। সার তিতাস তখন জলে জলময়। নদীর দিকে দৃষ্টি প্রসারিত করিয়া মালোরা ভাবিতে চেষ্টা করে; এই তো জলে-ভরা নদী। ইহাই সত্য। একটু আগে যাহা দেখা গিয়াছিল ওটা দুঃস্বপ্ন। কিন্তু ভাঁটা আসিলেই সত্যটা নগ্ন হইয় উঠে। মালোদের এক একটা বুক জোড়া দীর্ঘনিশ্বাস বাহির হয়। তিতাস যেন একটা শত্রু। নির্মম নিষ্ঠুর হইয়া উঠিয়াছে সেইশত্রু। এতদিন ভালবাসিয়া আসিয়াছে। আজ সম্পূর্ণ অনাত্মীয় হইয়া গিয়াছে। এতদিন সোহাগে আহ্লাদে বুকে করিয়া রাখিয়াছিল। আজ যেন ঠেলিয়া কোন গহীন জলে ফেলিয়া দিতেছে। যেন মালোদের সঙ্গে তার সব সম্পর্ক চুকাইয়া নিক্ষরুণ কণ্ঠে বলিয়া দিতেছে, আমার কাছে আর অtসিও না। আমি আর তোমাদের কেউ না। বর্ষাকালে আবার সে কানায় কানায় পূর্ণ হইয় উঠে। সুদূরবর্তী স্থান হইতে ভাসিয়া আসে তার ঢেউ। তখন তার স্রোতের ধারা কলকল করিয়া বহিতে থাকে। আবার প্রাণচঞ্চল মাছের সেই স্রোতের তরী বাহিয়া পুলকের সঙ্গে উজাইয়া চলে। নূতন জলে মালোর প্রাণ ভরিয়া ঝাপবাপি করে। গাঁ ডোবায়, গাঁ ভাসায়। নদীর শীতল আলিঙ্গনে আপনাদের ছাড়িয়া দিয়া বলে, তবে যে বড় শুখাইয়া গিয়াছিলে। বলিতে বলিতে চোখে জল আসিয়া পড়ে, বড় যে তোমাকে পর পর লাগিত; এখন ত লাগে না। এত যদি স্নেহ, এত যদি মমতা, তবে কেন সেদিন নির্মম হইয়া উঠিয়াছিলে। এ কি তোমার খেলা! এ খেলা আর যার সঙ্গে খুশি খেলাও, কিন্তু জেলেদের সঙ্গে নয়। তারা বড় অল্পেতে অভিভূত হইয়া পড়ে। তোমার ক্ষণিকের খেয়ালকে সত্য বলিয়া মানিয়া নিয়া তারা নিজেরাই আত্মনির্যাতন ভোগ করে। তারা বড় দীন। দয়াল তুমি, তাদের সঙ্গে ঐ খেলা খেলাইও না। ঐ রূপ দেখাইও না। তারা তোমার প্রসন্ন দৃষ্টি দেখিয়াই অভ্যস্ত।
বিধির বিধানে বর্ষার স্থায়িত্বের একটা সীমারেখা আছে। তার দিন ফুরাইলে তিতাস আবার সেই রকম হইয়া গেল। তার বুকের চরটা নগ্ন হইয়া জাগিয়া উঠিল। এবার সেটা আয়তনে আরো বাড়িয়াছে। উজানের দূরদূরান্তর হইতে একেবারে মালোপাড়ার ঘাট পর্যন্ত সেটা প্রসারিত হইয়া পড়িয়াছে।
এবারও কৃষকেরা লাঠি লইয়া দখল করিতে আসিবে। রামপ্রসাদ ঘুরিয়া ঘুরিয়া জেলেদের উত্তেজিত করিতে চেষ্ট৷ করিল, ওরা কৃষক। ওদের জমি আছে। ওরা আরো দখল করিবে। যতদিন জল ছিল, আমাদের ছিল দখল। এখন জল গিয়াছে। তার মাটিও এখন আমাদেরই। ওরা অতদূর হইতে আসিয়া দখল করিয়া নিবে, আর এত নিকটে থাকিয়া আমরা জেলেরাই বা নিশ্চেষ্ট থাকিব কেন।
নিজেদের মধ্যে দীর্ঘকাল দলাদলির ফলে তারা একযোগে কাজ করার ক্ষমতা একেবারেই হারাইয়া ফেলিয়াছিল। তাই মারামারির নাম শুনিয়া আঁতকাইয়া উঠিল। বলিল; গাঙ শুখাইয়া জল গিয়াছে, তার সঙ্গে আমরাও গিয়াছি, এখন মাটি নিয়া কামড়াকামড়ি করিতে আমরা যাইব না। তোমার সাধ হইয়াছে তুমি একলা যাও।
রামপ্রসাদ একলাই গিয়াছিল। তার বাড়ি-সোজা চরের মাটি দখল করিবার জন্য নিশ্চিত মৃত্যু জানিয়াও ঝাঁপাইয়া পড়িল। জোয়ান ভাইদের পাশে রাখিয়া লড়াই করিতে করিতে বৃদ্ধ সেই মৃত্যুও বরণ করিল। করম আলি বন্দে আলি প্রভৃতি ভূমিহীন চাষীরাও আসিয়াছিল, কিন্তু মার খাইয়া ফিরিয়া গিয়াছে। কেহ এক খামচা মাটিও পাইল না। তবে পাইল কে। দেখা গেল, যারা অনেক জমির মালিক, যাদের জোর বেশি, তিতাসের বুকের নয়-মাটির জমিনের মালিকও হইল তারাই।
তাতে জেলেদের কিছু যায় আসে না। কারণ যেদিন
থেকে জল গিয়াছে সেদিন থেকে তারাও গিয়াছে।
উপরি উপরি কয়েকটা বছর ঘুরিয়া গেল। এবারের বর্ষার পর নবীনাগর গ্রামের জেলেদেরও টনক নড়িল। ভাসমান চরটা ভাসিতে ভাসিতে তাদের গ্রাম পর্যন্ত ছড়াইয়া গিয়াছে। অনন্তবালার বাপ বিষম ভাবনায় পড়িয়াছে। একদিন বনমালীকে ডাকিয়া বলিল, ‘একবার দেখনা, তার নি খোঁজ পাও।’
অনন্তবালার বয়স বাড়িয়াছে। তার বয়সের অন্যান্য মালোর মেয়েরা সকলেই স্বামীর ঘর করিতে চলিয়া গিয়াছে। সে এখনো মাঘমণ্ডলের পুজা করে। অনন্ত নাকি তাকে বলিয়া গিয়াছে। লেখাপড়া শিখিয়া সে যেদিন ফিরিয়া আসিবে, সেদিন সে যাহা বলিবে অনন্ত তাহাই করিবে। ‘আমি আর কি বলিব। মা খুড়িমা যে-কথা অহৰ্নিশি বলে, আমিও সে কথাই বলিব, বলিয়াছিল অনন্তবালা। সেটা ছিল অবোধ বয়সের ছেলেমানুষি। এখন বয়স বাড়িয়া সে চিন্তাটা আরো প্রবল হইয়াছে। তার বয়সের অন্য মেয়েদের যখন একে একে বর আসিল, অনন্তবালা দেখিয়াছে, কিন্তু মনে করিয়া রাখিয়াছে, তারও একদিন বর আসিবে। সে বর আর কেউ নয়। সে অনন্ত।
দিনদিনই তাকে একটু একটু করিয়া বড় দেখায়। শেষে মা খুড়িমাদের চোখেও সে দৃষ্টিকটু হইয়া পড়িল। তার চাইতে ছোট মেয়েরা দেখিয়া মাঝে মাঝে ছড়া কাটে, ‘অনন্তবালা ঘরের পালা, তারে নিয়া বিষম জ্বালা।‘ তার মা একদিন তার বাপকে তিরস্কার করিয়া বলিয়াছিল, ‘মাইয়া রে যে বিয়া দেও না, সে কি কাঠের পালা যে ঘরে লাগাইয়া রাখবা।‘
‘কথা শুন, বনমালী। তোমারে রেলের ভাড়া দেই, তুমি কুমিল্লা শহরে যাও, দেখ গিয়া, তার নি খোঁজ পাওয়া যায়।‘
বনমালী গিয়াছিল। দুইদিন হোটেলে বাস করিয়া রাস্তায় রাস্তায় ঢুঁড়িয়াছে। কোন হদিস মিলে নাই।
হদিস মিলিয়াছিল সাত বছর পরে। অনন্তবালা তখন ষোল ছাড়াইয়া সতরোয় পা দিয়াছে। মালোর ঘরে অত বড় আইবুড়ে মেয়ে কেউ দেখে নাই বলিয়া সকলেই তার বাপখুড়াকে ছি ছি করিত। বয়স যতদিন কম ছিল, ভাল বর আসিলে অনন্তর আশায় তার প্রত্যাখ্যান করিয়াছে। এখন অনন্তর আশা গিয়াছে; বর আসে তৃতীয় কিংবা চতুর্থ পক্ষ। তার উপর মূর্খ, দেখিতে কদাকার। তারই একটার সঙ্গে জুড়িয়া দিব, আর উপায় নাই, বলিয়া তার বাপ একদিন নিৰ্মম হইয়া উঠিলে, সে দুঃখে অপমানে মরিতে চাহিল এবং বিস্তর কাঁদিয়া মা খুড়িমাদের তিরস্কারে ও অনুরোধে মন স্থির করিল। এমন সময় খবর নিয়া আসিল বনমালী।
—গাড়ি যখন কুমিল্লার ইষ্টিশনে লাগিল, তখন সন্ধ্যা হইতেছে। এদিক দিয়া চেকার উঠিতেছে দেখিয়া আমি ওদিক দিয়া নামিয়া গেলাম। কাঁধে পোনার ভার। দৌড়াইতে পাড়ি না। হাঁড়ি দুইটা ভাঙ্গিয়া গেলে তুলেমূলে বিনাশ। ইষ্টিশনের পশ্চিমে ময়দান। ঠাকুর ডুবিতেছে। লুকাইতে গিয়া দেখি অনন্ত। আরো তিনজনের সঙ্গে ঘাসের উপর বসিয়া তর্ক করিতেছে। পরণের ধুতি ফরসা, জামা ফরসা। পায়ের জুতা পর্যন্ত পালিশ করা। আমার এ বেশ লইয়া তার সামনে দাঁড়াইতে ভয়ানক লজ্জা করিতে লাগিল। তবু সামনে গিয়া দাঁড়াইলাম। চিনিল না। শেষে পনার হাঁড়ির দিকে মুখ রাখিয়া নিজে নিজে বলিলাম, আমাদের অনন্ত না জানি কোথায় আছে। সে কি জানে না তিতাস নদী শুকাইয়া গিয়াছে, মালোর জল ছাড়া মীনের মত হইয়াছে। খাইতে পায় না। মাথারও ঠিক নাই। অনন্ত লেখাপড়া শিখিয়াছে। সে কেন আসিয়া গরমেন্টের কাছে চিঠি লিখিয়া মালোদের একটা উপায় করিয়া দেয় না। হায় অনন্ত, যদি তুমি একবার আসিয়া দেখিতে তিতাস-তীরের মালোদের কি দশা হইয়াছে। দেখি অষুধে ধরিয়াছে। উঠিয়া কাছে আসিল। মুখের দিকে কতক্ষণ চাহিয়া রহিল। চিনিতে পারিয়া বুকে জড়াইয়া ধরিয়া কহিল, বনমালী দা, তুমি এই রকম হইয়া গিয়াছ। আমি একলা হই নাই রে ভাই, সব মালোরাই এইরকম হইয়া গিয়াছে। তবু ত আমি বাঁচিয়া আছি, মাছের পোনার ভার কাঁধে লইয়া ঘোরাফেরা করিতে পারি; কত মালো যে মরিয়া গিয়াছে; কত মালো যে খাইতে না পাইয়া একেবারে বলবুদ্ধি হারাইয়া ঘর-বৈঠক হইয়া গিয়াছে। সে দেখি ধ্যানস্থ হইয়া গেল। ধ্যান ভাঙ্গিলে বলিল, বনমালী দা, তুমি কি কর আজ কাল। বলিলাম, নদী শুকাইয়াছে, মালোদের মাছ ধরাও উঠিয়াছে। ব্যবসা ছাড়িয়া তারা দলেদলে মজুরি ধরিয়াছে। আমিও মজুরি ধরিয়াছি। একদিন চাঁটগাও হইতে এক মহাজন গেল মালোপাড়ায়। নাম কমল সরকার। বলিল, আমি এদেশে মাছের পোনা চালান দিব। এখানে দালাল থাকিবে। নানা গ্রামের পুকুরে সে পোনা ফেলিবে। তোমরা ত আর কোনো কালে মাছ ধরিতে পারিবে না। মজুরি কর। হাঁড়িতে জল দিয়া পোনা জিয়াইয়া ভার কাঁধে তুলিয়া দেয়, গামছায় বাঁধিয়া চিড়া দেয়, একখানা টিকেট কাটিয়া দেয়। দেশে গিয়া দালালকে বুঝাইয়া দেই। ক্ষেপ-পিছে একটা করিয়া টাকা দেয়। আমার গায়ে জোর আছে আমি পারি। অন্য মালোরা কি তা পারে। এবার আবার টিকেট কাটিয়া দিল না, বলিল, তোর পরণে ছোড়া গামছা, কাঁধে ছোড়া গামছা; মুখে লম্বা লম্বা দাড়ি। তোকে ঠিক ভিখারীর মত দেখায়। চেকারবাবু তোকে কিছুই বলিবে না। তুই বিনা টিকেটেই যা। একটাকার জায়গাতে না হয় পাঁচসিক দিব। এতদূর আসিয়াছিলাম। কিন্তু এখানে আসিয়া এত ভয় করিতে লাগিল যে নামিয়া পড়িলাম। আমার শরীরের দিকে কাপড়চোপড়ের দিকে, দাড়ির দিকে, চুলের দিকে চাহিয়া রহিল। এক সময়ে বলিল, বনমালী দা, তোমার একখানা ভাল গামছাও নাই। বলিলাম, আছে রে ভাই আছে। ভাল ধুতিও একটা আছে, কিন্তু তুলিয়া রাখিয়াছি। আর বিদেশ চলিতে এই পোষাকই ভাল। আমাকে হোটেলে নিয়া খাওয়াইল। দোকান হইতে আমাকে একটা, গোকনঘাটের তার মাসী সুবলার বউকে একটা আর উদয়তারাকে একটা কাপড় কিনিয়া দিল। নিজের কাছে নিজের বিছানায় শোয়াইল। পরদিন সকালে টিকেট কাটিয়া গাড়িতে তুলিয়া দিয়া গেল। বলিয়া দিল, বি-এ পরীক্ষার আর ছমাস বাকি। পরীক্ষা দিয়াই আমাদের দেখিতে আসিবে।
অনন্তবালা চুপি চুপি তাকে আসিয়া বলিল, ‘অ বনমালী দা, কাপড় দিল তোমারে একখান, মাসীরে একখান, উদি বোনদিরে একখান, আমারে একখান দিল না?’
—নিশ্চয়ই দিত। আমি যে তোমার কথা তাকে বলিই নাই।
— বল নাই। কেন বল নাই।
—চিনিতে পারিবে না যে। আমারেই কত কষ্টে চিনিয়াছে।
—চিনিতে পারিবে না কেন। আমার কি তোমার মত দাড়ি হইয়াছে, না, আমি তোমার মত বুড়া হইয়া গিয়াছি।
বনমালীর বোন উদয়তারারও বয়স বাড়িয়াছে। শরীরের লাবণ্য গিয়াছে। কিন্তু মনের রঙ মুছিয়া যায় নাই। নূতন বর্ষায় তিতাসে আবার নূতন জল আসিয়াছে। স্বপ্নের মত অভাবিত এই জল। কি স্বচ্ছ। বুকজলে নামিয়া মুখ বাড়াইলে মাটি দেখা যায়। এই মাটিটাই সত্য। এই মাটিই যখন জাগিয়া উঠিত প্রথম প্রথম দুঃস্বপ্ন বলিয়া মনে হইত। এখন ঐ মাটিই স্বাভাবিক। জল যে আসিয়াছে ইহা একটা স্বপ্নমাত্র। মনোহর। কিন্তু যখন চলিয়া যাইবে ঘোরতর মরুভূমি রাখিয়া যাইবে। সে মরুভূমি রেণু রেণ, করিয়া খুঁজিলেও তাতে একটি মাছ থাকিবে না। তবু সেই জলেই গাঁ ডুবাইয়া উদয়তারার খুশি উপছাইয়া উঠিল। সেই ঘাটে অনন্তবালাও গাঁ মেলিয়া ধরিয়াছে। ছোট ঢেউগুলি তার চুলগুলিকে নাড়াচাড়া করিতেছে দেখিয়া উদয়তারা বলিয়া উঠিল, ‘জিলাপির পেচে-পেচে রসভরা, মগু কি ঠাণ্ডা লাগে জল ছাড়া। যতই দেখ মেওয়া-মিছরি কিছু এই জলের মতন ঠাণ্ডা লাগে না। অনন্তর ত অস্ত নাই। জলের তবু অস্ত আছে। লও, ভইন ডুব দেই।’
‘কেন গো দিদি। আমরা কি বাজারের গামছা না সাবান যে ডুইব্যা তলায় পইড়া ক্ষয় হমু। তোমার যদি জ্বালা হইয়া থাকে, জুড়াইতে চাও, তবে তুমি ডোব।’
‘আমার ত ভইন কেশটি পড়িল দন্তটি নড়িল যৈবনে পড়িল ভাটি। আমার আবার জ্বালা কি?’
এইবার কথায় তার বয়সের খোঁটা আসিয়া পড়িবে আশঙ্কা করিয়া অনন্তবালা জল হইতে উঠিয়া পড়িল। কাপড়খানা বুকের উপর দুই তিন ভাজে বিছাইয়া বাড়িমুখে হইল।
‘আহা আমি যেন মারছি না ধরছি’ বলিয়া উদয়তারাও উঠিয়া পড়িল।
ভিজা কাপড়। আলুলায়িত চুল। কয়েক পা যাইতেই পাশের ঘাট হইতে দুইজনের কথাবার্তা তার কানে গেল। একটা লোক নৌকা ভিড়াইয়া খুঁটি পুতিল এবং দড়ি দিয়া নৌকা বাধিল। অন্য লোকটি ঘাটে দাঁড়াইয়া বলিতেছে, নিতে আসিয়াছ বুঝি? হাঁ। না দেখিলে বুঝি অন্তর দাহনি করে? করে। তা বেশ। বুদ্ধিমানের মতই কাজ করিয়াছ। গাঙে জল থাকিতে থাকিতে নিয়া যাও। সুদিনে গাঙ যতদিন শুকনা ছিল, ততদিন তুমি আস নাই। জল শুকাইবার সঙ্গে সঙ্গে তোমার প্রেমও শুকাইয়া গিয়াছিল, কেমন কহিলাম? হা, কথা কিছু মিছা বল নাই। তা শুক্না গাঙে তুমি কেমন করিয়াই আসিতে! নৌকা ত আর কাঁধে করিয়া আনিতে পারিতে না? না। তা তুমি যাই কও আর তাই কও, আমি কিন্তু সাঁচা কথাখান কই, ‘যদি থাকে বন্ধুর মন, গাঙ পার হইতে কতক্ষণ?’ মনে থাকিলে গহীন গাঙে কি করিবে। মনে থাকিলে মরাগাঙেও আটকাইতে পারে না; গানে আছে না, ‘ভেবে রাধারমণ বলে, পিরিতের নাও শুকনায় চলে।‘ কেমন কহিলাম। হাঁ, কথা তুমি কিছু মিছা কও নাই।
উদয়তারাকে তার স্বামী নিতে আসিয়াছে।
আজ বনমালীর দিকে সে নূতন করিয়া চাহিল। নূতন এক রূপে তাহাকে দেখিতে পাইল। যতবার চায় তার বুক সমবেদনায় ভরিয়া উঠে। দাদাকে জড়াইয়া ধরিয়া হু হু করিয়া কাঁদিতে চায় সে।
বনমালী দিন দিন শুকাইয়া যাইতেছে। কিই বা তার বয়স। তবু ইহারই মধ্যে তাহাকে অনেক বুড়া দেখাইতেছে। তার উপর একমাথা চুল একমুখ দাড়ি। কটিতে ছেঁড়া গামছা, কাঁধে ছেঁড়া গামছা। গাঙ ত তার একার জন্য শুকায় নাই। সব জেলের জন্যই শুকাইয়াছে। তারা বুঝি আর চিন্তা করে না। না কি দাদা সমস্তের চিন্তা একলা মাথায় করিয়া তারই ভারে নুইয়া পড়িতেছে। এখনো ত কিছু কিছু রোজগার হয়; পেটে দুইটা দানা পড়ে। পরে যখন রোজগারে আরো ভাঁটা পড়িবে, তখন কি সকলে না মরিতে দাদাই আগে মরিবে। দাদার প্রতি স্নেহে ও করুণায় বুক ভরিয়া উঠে; কিন্তু তারই আড়ালে জাগিয়া থাকে একটা অস্ফূট হাহাকার।
‘দাদা, তুমি একটা ফুলের নাম কও ত!’
বনমালী মলিন মুখে একটু হাসিল, ‘আমার লাগি তুই দিশা চাইবি বুঝি। আছিলি জামাই-ঠকানী, অখন হইলি গণকঠাকুরাইন।‘
‘ঠিসারা রাখ। তুমি অত শুকাইয়া যাইতাছ কেনে? গাঙে জল ত অখনো আছে।’
—-আছে টুনির মুত। বছরের পাঁচ রকম জো-এ পাঁচ কিসিমের জাল ফেলিতাম। রাজার হালে মাছ ধরিতাম। সেই দিন গেছে। তার কথা এখন স্বপ্নে দেখিলেও বিশ্বাস হয় না। স্বাধীনভাবে জাল ফেলিতাম জাল তুলিতাম। এখন করি পরের গোলামি। পোনার ভার বহিতে বহিতে কাঁধে কড়া বাঁধিয়াছে, কোমরও কুঁজা হইয়া আসিতেছে। কিন্তু তার জন্যও ভাবি না। আমি ভাবি, সামনের সুদিনে মালোগুষ্টির কি অবস্থা হইবে।
ধৈর্যহীন স্বামীর তাগিদে কাতর হইয়া উদয়তারা বনমালীর গলা জড়াইয়া কাঁদিয়া ভাসাইল। বনমালী তার হাত ছাড়াইতে ছাড়াইতে বলিল, ‘পাগলামি করিস না। কথা রাখ। অখন বুঝি তর কান্দবার বয়স আছে!’
উদয়তারা ফোঁপাইতে ফোঁপাইতে বলিল, ‘দাদা, তোমার মাথায় বুঝি আর শোলার মটুক উঠল না।’
‘শোলার মটুক উঠব। মড়াপোড়ার টেকে গিয় উঠব। তুই কান্দিস না।’
বনমালীর সঙ্গে উদয়তারার এই শেষ দেখা।
বড় ভালো লাগলো।