৫.২ রামধনু
বিরাট আকাশের ধনু। আকাশের দুই কোণ ছুঁইয়া বাকিয়া উঠিয়াছে। মোটা তুলির যেন সাত রঙের সাতটি পোঁচ। রঙগুলি সব আলাদা আলাদা, আর কি স্পষ্ট! পিছনের আকাশ হঠতে খসিয়া যেন আগাইয়া আসিয়াছে। যত অস্পষ্টতা যত আবছায়া অনেক পিছনে পড়িয়া রহিয়াছে, দিক উজ্জ্বল করিয়া বঁকা হইয়া উঠিয়াছে এই রামধনুট। কি উজ্জ্বল বর্ণ। কি স্নিগ্ধ আর সামঞ্জস্যপূর্ণ তার রঙের ভাজ। কোন কারিগর না জানি এই রঙের ভাজ করিয়াছে! চোখে কি ভালো লাগে; কি ঠাণ্ডা লাগে। কোথায় ছিল এতক্ষণ লুকাইয়া! কোথাও তো ছিল না। এখন কোথা হইতে কেমন করিয়া আসিল। চাঁদস্থরুজের দেশ এটা। তারা নিত্য উঠে, নিত্য অস্ত যায়। পশ্চিমে ডুবিয়া ঘুমাইয়া থাকে, আবার সকালে পূবে উদয় হয়। কিন্তু রামধনু থাকে কোথায়। বড় একটা ত দেখা যায় না। অনেকদিন পর দেখা যায় একদিন উঠিয়াছে। কতদিন ঘুমায় এ! কুম্ভকর্ণের মত! উঠিবারও তাল-বেতাল নাই। ইচ্ছা হইলে একদিন উঠিলেই হইল। কিন্তু, কি বড়! বোন ঠিকই বলিয়াছিল তার ছড়াতে—রামের হাতেরই ধনু এট। যে-ধনু অমন যে রাক্ষস, দশমাথা কুড়ি হাতের রাক্ষস,—জোর করিয়া সে ধনু তুলিতে গিয়া তারও মুখে রক্ত উঠিয়াছিল। রামায়ণের বইয়ের সে কথা বনমালী শুনিয়াছে সীতার বিবাহের পালা গানে ছুট-কীৰ্তনিয়ার মুখে। শেষে রাম তাকে হাতে তুলিয়া নেয়। হরধনু না কি বলিয়াছিল—তাই রামের হাতের ধনু। কিন্তু সীতা সে ধনু রোজই বাঁ হাতে তুলিয়া লইয়া ডানহাতে তলাকার জায়গাটুকু লেপিয়া পুছিয়া শুদ্ধ করিয়া দিত। তারপর সীতার বিবাহ হইয়া গেল। রাম তাকে নিয়া অযোধ্যাতে আসিল। তারপর সীতা আর বাপের বাড়ি ফিরিয়া আসে নাই। নাঃ, বোনটাকে দেখিতে যাইতেই হইবে। কতদিন তাকে নেওয়া হয় নাই।
কতক্ষণ পরে রামধনু মিলাইয়া গেল আকাশে। কিন্তু রাখিয়া গেল অনন্তর মনে একটা স্থায়ী ছাপ। কোনোদিন দেখে নাই। মায়ের কাছে গল্প শুনিয়াছিল; মানুষের অগম্য এক দ্বীপ-চরে এক জাহাজ নোঙর করিয়াছিল। খাইয়া দাইয়া লোকগুলি ঘুমাইয়াছে, অমনি চারিদিক কাঁপাইয়া ধপাস ধপাস শব্দ হইতে লাগিল। আকাশ হইতে পড়িল কয়েকটা দেওদৈত্য। এরা ছাড়াও আরও কত কিছু আছে, যারা মানুষ নয়; মামুষের মধ্যে, মানুষের বাসের এই দুনিয়ার মধ্যে যাদের দেখিতে পাওয়া যায় না। দেও-দৈত্য তো ভয়ের জিনিস। কত ভালো জিনিসও আছে তাদের মধ্যে। সকলেই তারা এই আকাশেই থাকে। এই চন্দ্র, সূর্য, তারা। তাহারাও আকাশেই থাকে; নিত্য উঠে নিত্য নামে, দেখিতে দেখিতে চোখে প্রায় পুরানো হইয়া গিয়াছে। কিন্তু এদেরই রহস্য ভেদ এখনও করা হয় নাই। অলৌকিক রহস্যভর অনন্তর আকাশ-ভুবন। আজও তাদেরই একটা অদেখা রহস্যজনক বস্তু তার চোখের সামনে নামিয়া আসিয়াছিল পিছনের অনেক দূরের আকাশ হইতে, অদেখার কোল হইতে একেবারে নিকটে, আমিনপুরের জামগাছটার প্রায় মাথার কাছাকাছি।
বনমালীর মন হইতেও কল্পনার রামধনু মুছিয়া গেল; কেউ বুঝি নামাইয়া দিল তাকে বাস্তবের মুখে। ছেলেটার গায়ের রঙ ফস। কিন্তু খড়ি জমিয়া বর্ণলালিত্য নষ্ট করিয়া দিয়াছে। এক চিলত সাদা মাঠ-কাপড় কটিতে জড়ানো। আর এক চিলত কাঁধে। বিঘৎ পরিমাণ একখানা কুশাসন ডানহাতের মুঠায় ধরা। নৌকা গড়িবার সময় তক্তায়-তক্তায় জোড়া দেয় যে দুইমুখ সরু চ্যাপ্ট লোহা দিয়া, তারই একটা দুইমুখ এক করিয়া কাপাস সূতায় গলায় ঝুলানো। পিতামাতা মারা যাওয়ার পর মাসাবধি হবিষ্য করার সন্তানের এই সমস্ত প্রতীক।
বনমালী দরদী হইয়া বলে, ‘তোর নাম কি রে।‘
‘অনন্ত? ‘
‘অনন্ত কি? যুগী, না পাটনী, না সাউ, না পোদ্দার?’
অনন্ত এ প্রশ্নের কোন উত্তর দিতে পারিল না।
‘তোর মা মরছে না বাপ মরছে?’
‘মা।‘
‘কোন হাটি বাড়ি তোর?’
আঙ্গুল দিয়া মালোপাড়া দেখাইয়া দিল।‘
‘জাতে তুই মালো? আমরার স্বজাতি?’
অনন্ত ভালে করিয়া কথাটা বুঝিল না। আবছাভাবে বুঝিল, তার মাসীর মত, এও তারই একটা কেউ হইবে। তা না হইলে অত কথা জিজ্ঞাসা করিতেছে কেন?
‘তোর বাড়িত লইয়া যাইবি আমারে?’
গলার ধড়ার সূতাটা দাঁতে কামড়াইতে কামড়াইতে ঘাড় কাৎ করিয়া অনন্ত জানাইল, হাঁ, নিয়া যাইবে।
‘বাজার জমছে। চল্ তোরে লইয়া বাজারটা একবার ঘুইরা দেখি।‘
বাজারের তখন পরিপূর্ণ অবস্থা। কাদিরের দোকানের চারিপাশে অনেক আলুর দোকান বসিয়াছে। গণিয়। শেষ করা যায় না। ক্রেতাও ঘুরিতেছে অগণন। হাতে খালি বস্ত লইয়া তাহারা দরদস্তুর করিতেছে আর কিনিয়া বস্তাবন্দী আলু মাথায় তুলিয়। ভিড় ঠেলিয়া বাজারের বাহির হইতেছে। একটানা একটা কলরব শুরু হইয়া গিয়াছে। কাছের মানুষকে কথা বলিতে হইলেও জোরগলায় বলিতে হয়, কানের কাছে মুখ নিয়া।
কাদির বড় এক পাইকার পাইয়াছে। খুচরা বিক্রিতে ঝামেলা। অবশ্য দর তুই চারি পয়সা করিয়া মণেতে বেশি পাওয়া যায়। কিন্তু মণামণি হিসাবের বিক্রি তার চাইতে অনেক ভাল। আগেভাগে শেষ করিয়া উঠিয়া পড়া যায়। বয়স্কদের ভিড়ে আর ঠেলাঠেলিতে তিষ্ঠিতে না পারিয়া অনন্তর সঙ্গীরা হাট ঘন হইয়া জমার মুখেই সরিয়া পড়িয়াছে। অনন্ত চাহিয়া দেখে সচল চঞ্চল এক জনসমুদ্রের মধ্যে সে একা। বালক অনন্তর ইচ্ছা করে বনমালীর একখানা হাত ধরিতে।
কাদির শক্তহাতে দাড়িপাল্লা তুলিয়া ধরিল, একদিকে চাপাইল দশসের বাটখারা, আর একদিকে ডুবাইয়া তুলিল আলু। আর মুখে তুলিল কারবারীদের একটা হিসাবের গৎ : আয়, লাভে রে লাভে রে লাভে রে লাভে, আরে লাভে! আয়, হয়ে রে দুয়ে রে দুয়ে রে দুয়ে, আরে দুয়ে! আয়, তিনে রে তিনে রে তিনে রে তিনে, আরে তিনে—
বেচাবিক্রি চুকাইয়া কাদির বলিল, ‘বাবা বনমালী, যাইও একবার বিরামপুরে, কাদির মিয়ার নাম জিগাইলে হালের গরুতে অবধি বাড়ি চিনাইয়া দিব। যাইও।
গুণ-টানা নৌকার মতন বনমালী অনন্তর হাত ধরিয়া টানিয়া চলিয়াছে। এই বাজারের ভিতর দিয়া অনন্ত রোজ দুই চারিবার করিয়া হাটে। কিন্তু ভরা হাটের বেলা সে কোনদিন এখানে ঢোকে নাই। আজ দেখিয়া মুগ্ধ হইয়া গেল। একজায়গায় বসিয়াছে পানের দোকান। দোকানের পর দোকান। বড় বড় পান গোছায় গোছায় ডালার উপর সাজানো। কাছে একটা হাঁড়িতে জল; দোকানীরা বার বার হাত ডুবাইয়া জল পানের উপর ছিটাইয়া দিতেছে, আর যত বেচিতেছে পয়সা সেই হাঁড়িটার ভিতর ডুবাইয়া রাখিতেছে। বনমালী খুব বড় দেখিয়া এক বিড়া পান কিনিয়া অনন্তর হাতে দিল। হাতে লইয়া অনন্তর চোখ জলে ভরিয়া আসিতে থাকে। বনমালীকে বুক খুলিয়া শুনাইতে চায় : হাটের দিন দুপুরের আগে এই দোকানীটা নৌকা হইতে পান তুলিয়া ভাজ করিতে বসে। একখানা চৌকির উপর বসিয়া পানের গোছা হাতে করিয়া তার মধ্য হইতে পচা আধ-পচা পানগুলি ফেলিয়া দেয়। সঙ্গীদের লইয়া সে কতদিন এই ছেঁড়াকোড়া পচা পানগুলি কুড়াইয়া নিয়াছে। মা কোনদিন পয়সা দিয়৷ পান কিনিয়া খাইতে পারে নাই। তার হাতের কুড়ানো পচা-পান পাইয়া মা কত খুশি হইয়াছে। একদিন অনন্ত তিতাস হইতে সেই লোকটাকে এক হাঁড়ি জল তুলিয়৷ দিয়াছিল। দোকানী সেদিন পচা-পান তো দিলই, সামান্য একটু দাগী হইয়াছে, একটু ছিঁড়িয়া ভাল পানের সঙ্গে মিশাইয়া দিলে কেহ ধরিতে পারিবে না, এমন পানও তার দিকে ছুড়িয়া ফেলিয়াছে। সেও অভ্যাসবশে ধরিয়াছে, কিন্তু তখন আর তাহার মা নাই। এই রকম ভাল ভাল পান ফেলিয়া দিবার কিছুদিন আগেই একদিন মা মরিয়া গেল। মাসী পান বড় একটা খায় না। দিলেও খুশি হয় না, না দিলেও রাগ করে না। মাসীর মা খায়—দিলে খুশি হয় না, না দিলে মারে।
কিন্তু এ সকল কথা এ লোকটাকে কি বলা যায়! মোটে একদিনের দেখা। আর দোকানীটা নিশ্চয়ই আমাকে মনে রাখিয়াছে। তারপাশে কত ঘুরিয়াছি আধ-পচা পানের জন্য। মনে কি আর রাখে নাই? সব সময়ই তো মনে ভাবিয়াছে এ ছেলেটা খালি আধ-পচা পানই নিবে। ফেলিয়া দেওয়া পান। কোনদিন পয়সা দিয়া কিনিতে পারিবে না। আজ সে দেখুক তার ডালার সব চাইতে দামী পানের বড় একটা গোছা তার হাতে। পয়সা দিয়া কেন।
সুপারির গলি হইতে বনমালী কিছু কাটা-সুপারিও কিনিল।
আরেক জায়গাতে কতকগুলি গেঞ্জির দোকান। মলাটের বাক্স খুলিয়া মাটির উপর বিছানো চটে সাজাইয়া রাখিয়াছে। বুকে ফুলকাটা একটা গেঞ্জি কিনিল বনমালী। গলা হইতে বুক পর্যন্ত বোতামের এলাকায় লম্বা একটা সবুজ লতা, তাতে লালফুল ধরিয়াছে। এতক্ষণ খালি গাঁ ছিল। এবার নূতন গেঞ্জিতে বনমালীকে রাজপুত্রের মত মানাইয়াছে বলিয়া অনন্ত মনে মনে আন্দাজ করিল। লতাটাও কত সুন্দর।
আরও সুন্দর বাজারের এদিকটা। মাঝখানে পায়ে চলার জায়গা খালি রাখিয়া দুইপাশে তারা পসরা সাজাইয়াছে। চলতি কথায় ইহাদিগকে বেদে বলে, কিন্তু সাপুড়ে নয়। অত্যন্ত লোভনীয় তাদের দোকানগুলি। একধারে অনেকগুলি কোমরের তাগা। পোষমানা সাপের মত শোয়াইয়া রাখিয়াছে। কতক কালো, আর কতক হলদে লালে মিশানো। মাথায় এক একটা জগজগার টোপর। একদিকে এলাইয়া রাখিয়াছে কতকগুলি আরসি। একদিকে নানা রঙের ও নানা আকারের সাবান। আর একখানে পুতির মালা, রেশমী ও কাচের চুড়ি। আরও অনেক কিছু। এক একটা দোকানে এত সামগ্রী। বনমালী পাশে বসিয়া দুই তিনটা সাবানের গন্ধ শুকিয়া বলিল, জলেভাসা সাবান আছে? আছে শুনিয়া গন্ধ শুকিয়া দর করিয়া রাখিয়া দিল। র্কাচের চুড়ির মধ্যে তিন আঙ্গুল ঢুকাইয়া মাপ আন্দাজ করিল, তারপর রাখিয়া দিল। কিনিল না। কিনিল খালি কয়েকটা বড়শি। এক কোণে কতকগুলি বাল্যশিক্ষা, নব-ধারাপাত বই। অনন্ত ইত্যবসরে বসিয়া পাতা উল্টাইতে শুরু করিয়া দিল। দুইটা গরু নিয়া এক কৃষক চাষ করিতেছে ছবিটাতে চোখ পড়িতে না পড়িতে দোকানী ঝঙ্কার দিয়া উঠিল। অনন্তর আর দেখা হইল না।
বনমালী অনন্তর হাত ধরিয়া টানিতে টানিতে ধনঞ্জয়কে বলিল, গাওয়ের নাপিতে চুল ছাটেন, যেমুন কচু কাটে। আর হাটের নাপিতে চুল কাটেন, যেমুন রান্দা দিয়া পালিশ করে। নাওয়ে গিয়া থাইক্য, চুল কাটাইতে গেলাম।
নাপিতের উঁচু ভিটিখানাতে গিয়া দেখা গেল কতক নাপিতের হাতের কাঁচি, চিরুণির উপর দিয়া কাচুম কাচুম করিয়া বেদম চলিয়াছে, আর কতক নাপিত ক্ষুর কাঁচি চিরুণি এবং নরুণ লইয়া চুপ করিয়া বসিয়া আছে। মাথায় অগোছাল লম্ব চুল দেখিয়া বনমালীর উদ্দেশ্ব তারা বুঝিল। বুঝিয়া নানা জনে নানা দিক হইতে তাহাকে ডাকিতে লাগিল। অনন্তর মাথার চুলও বেশ লম্বা হইয়াছে, কিন্তু তাহার গলায় ধড়া দেখিয়া কেহ তাহাকে ডাকিল না।
চুলকাটা শেষ করিয়া দেখে বেলা ডুবিয়া গিয়াছে। নাপিত একখানা ছোট আয়না বনমালীর হাতে তুলিয়া দিল, কিন্তু তার ভিতর দিয়া তখন কিছুই দেখা যায় না। অপ্রসন্ন মনে উঠিয়া পড়িল বনমালী। আবার অনন্তকে হাতে ধরিয়া বাজারসমুদ্র পার করিয়া ঘাটের কিনারায় আনিল। হাট তখন ভাঙ্গিয়া পড়িতেছে। ধনঞ্জয় একছালা গাব, দুইটা বাঁশ, সপ্তাহের মত হলুদ লঙ্কা লবণ জিরা মরিচ কিনিয়া তৈরী হইয়া আছে।
বনমালী মনে মনে বলিল, আজ আর ও-পাড়ায় যাইব না। রাত হইয়া গিয়াছে, আর একদিন আসিলে যাইব। প্রকাশ্যে বলিল, হেই পুল, তুই আমার নাওয়ে যাইবি? আমি খালেবিলে জাল লইয়া ঘুরি, মাছ ধরি মাছ বেচি, নাওয়ে রান্ধি নাওয়ে খাই। সাত দিনে একদিন বাড়িত যাই। যাইবি তুই আমার নাওয়ে?
অনন্ত ঘাড় কাত করিয়া জানাইল, হাঁ। যাইবে।
‘চল তা হইলে।‘
অনন্ত নৌকায় উঠিবার জন্য জলে নামিল।
‘আরে না না, অখনই তোরে নেমু না। তোর বাড়ির মানুষেরে না জিগাইয়া নিলে, তারা মারামারি করতে পারে।’
অনন্ত ঘাড় তুলাইয়া বলিতে চাহিল, না কেহ মারামারি করিবে না।
‘না না, তুই বাড়ি যা।‘
অনন্ত জোর করিয়া নৌকার গলুই আঁকড়াইয়া ধরিল। ধমঞ্জয়ের ধমক খাইয়া বনমালী নৌকায় গিয়া উঠিল, কিন্তু ছেলেটার জন্য তার বড় মায়া লাগিল। তাকে বাড়িতে আগাইয়া দিয়া আসা উচিত। এতক্ষণ সঙ্গে করিয়া ঘুরাইয়াছে।
ধনঞ্জয় লগি ফেলিয়া ঠেলা মারিলে, অনন্তর ছোট দুইখান। হাতের বাঁধন ছিন্ন করিয়া গলুই ডানদিকে ঘুরপাক খাইল এবং দেখিতে দেখিতে নৌকা অন্ধকারের মাঝে কোথায় চলিয়া গেল, আর দেখা গেল না। বুকভরা একটা দীর্ঘশ্বাস মোচন করিয়া অনন্ত ডাঙ্গায় উঠিয়া দাঁড়াইয়া রহিল।
চারিদিক অন্ধকার। কিছুই দেখা যায় না। কিন্তু বাড়ির পথ তার চেনা। ভয়-ডরেরও কিছু নাই। তবু সে যেন দেহে মনে নিরুৎসাহ হইয়া গিয়াছে। পা যেন তার বাড়ির দিকে চলিতে চায় না। বনমালীর শেষ কথা কয়টি রহিয়া রহিয়া তার কানে বার বার বাজিয়া উঠিতে লাগিল। তুই এখন বাড়ি যা। তোদের পাড়া আমি চিনি। আমার বোন বিয়া দিয়াছি তোদের পাড়াতে। আবার আমি আসিব। কোন ভাবনা করিস না তুই। আবার আমি আসিব।
তুমি বলিয়াছিলে আবার আসিবে, কিন্তু কখন আসিবে! আমার যে আর বাড়িতে যাইতে পা চলিতেছে না। কখন তুমি আসিবে —ভাবিতে ভাবিতে অনন্ত বাড়ির উঠানে পা দিল।
একটা পরিচিত গলার আওয়াজের আশঙ্কা সে করিতেছিল। শীঘ্রই সেটি শোনা গেল, ‘তেলে-মরা বাতির মত নিম-ঝিম করে,—মরেও না। আইজ ত নিঁখোঁজ দেইখ্যা মনে করছিলাম, বুঝি পেরেতে ধরছে, অখন দেখি চান্দের ছটার মত হাজির। মনে লয় পোড়া কাঠ মাথায় মাইরা খেদাইয়া দেই, পোড়ামুখি মাইয়া আমার কাল করছে।’
সুবলার বৌ বাসন্তী একটু আগে নদীর পাড় হইতে খুঁজিয়া আসিয়া কাজে হাত দিয়াছিল। কিন্তু হাতে কাজ উঠিতেছিল না। দৌড়াইয়া আসিয়া বলিল, ‘কি কও গে৷ ম। তুমি। মা-মরা, হাতে আগুন, মুখে হবিষ। তুমি কি সগল কথা কও। শক্ত রেও তো এমুন কথা কয় না!’
‘শত্তুর শত্তুর। ইটা আমার শত্তুর। অখনই মরুক। সুবচনীর পূজা করুম।‘
সুবলার বউ এবার রণচণ্ডী হইয়া উঠিল, ‘ইটা মরব কোন দুঃখে? তার আগে আমি মরি,—আমি ঘরের বাইর হই।’
মা হঠাৎ নরম হইয়া বলিল, ‘অখন আর কিছু করলাম না। দিমু খেদাইয়া একদিন চেলাকাঠ পিঠে মাইরা!’
মাসী শুইয়া শুইয়া অনন্তকে আজ কতকগুলি নূতন কথা শুনাইল : মা যদি মরিয়া যায়, তবে সে মা আর মা থাকে না, শত্তুর হইয়া যায়। মরিয়া যেখানে চলিয়া গিয়াছে, ছেলেকে সেখানে লইয়া যাইবার জন্য সব সময়েই তার লক্ষ্য থাকে। অন্তত শ্রাদ্ধশাস্তি না হওয়া পর্যন্ত একমাস তো খুব ভয়ে ভয়ে কাটাইতে হয়। তার আত্মা তখন ছেলের চারিপাশে ঘুরিয়া বেড়ায় কি না। এক পাইলে, কিংবা আঁধারে, কি বট বা হিজল গাছের তলায় পাইলে, কিংবা নদীর পারে পাইলে, কাছে কেউ না থাকিলে লইয়া যায়। নিয়া মারিয়া ফেলে। সেই রাত্রিতে অনন্ত মাকে স্বপ্ন দেখিল। মা কতকগুলি ছেঁড়া কাথায় জড়াইয়া কোথা হইতে আসিয়া খালের পাড়ে হুমড়ি খাইয়া পড়িয়াছে। অনন্তকে যে লইয়া যাইবার জন্য আসিয়াছে তাহাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু কই, মারিয়া ফেলিবার মত জিঘাংসা, ক্রোধ কিছুইত তার মধ্যে নাই, ম৷ চাহিয়া আছে তার মুখের পানে বড় করুণ চোখে, বেদনায় কি মলিন মার মুখখান! হা, মা নিয়া যাইতে চায়; কিন্তু মারিয়া ফেলিবার জন্য নহে, কাছে কাছে রাখিবার জন্য। মার জন্য বড় করুণা জাগিল অনন্তর মনে।
হবিষ্য সাজাইতে সাজাইতে অনেক বেলা হইয়া যায়। কচি ছেলে। ক্ষুধায় আরও নেতাইয়া পড়ে। সুবলার বউ সবই বুঝে। কিন্তু কিছু করিবার নাই তার। বিধবা সে। বাপের সংসারে গলগ্ৰহ হইয়া আছে। তার উপর রক্তমাংসের সম্পর্কের লেশ নাই এমন একটা মা-মরা হবিষ্যের ছেলেকে আনিয়া ঝঞ্জাট পোহাইতেছে। শুধু কি নিজে ভুগিতেছে। বাপমাকেও ভোগাইতেছে। তার বাপ রাতে জাল বাইস করিয়া সকালে বাড়ি আসে। একঝাক মাছ আনে। কাটিয়া কুটিয়া কতক জালের তলায় রোদে দিতে হয়, কতক ধুইয়া হাঁড়িতে চাপাইতে হয়। মা কেবল হুকুম চালাইয়া খালাস। এত সব করিয়া বাপকে খাওয়াইলে, তবে বাপ ঠাণ্ডা হয়; তারপর তার পয়সায় তারই হাতে বাজার হইতে কিছু আলো চাল আর দুই একটা কলা আনাইতে পারা যায়। সে চাল দিয়া সুবলার বউ মালসায় জাউ রাধিয়া দেয়। কলার খোল কাটিয়া সাতখানা ডোঙ্গা বানায়। তাতে জীউ আর কলা দিয়া তুলসীতলায় সারি সারি সাজায়। অনন্ত স্নান করিয়া আসিয়া তাতে জল দেয়। সরিয়া পড়িলে কাকেরা আসিয়া উহা ভক্ষণ করে। যেদিন কাক আসে না, সেদিন অনন্ত ডোঙ্গা হাতে করিয়া আ আ করিয়া ডাকিয় বেড়ায়—তারা বলিয়াছে, মা নাকি কাকের রূপ ধরিয়া আসিয়া অনন্তর দেওয়া জাউ-কলা খাইয়া যায়। অনন্ত যাহা কিছু শোনে, কিছুই অবিশ্বাস করে না। যে কাকগুলি খাইতে আসে, একদৃষ্টে তাদের দিকে চাহিয়া চাহিয়া দেখে—এর মধ্যে কোনটা তার মা হইতে পারে। এখন আর মানুষ নয় বলিয়া কথা বলিতে পারে না, কিন্তু খাইতে খাইতে ঘাড় তুলিয়া চাহিয়া থাকে –বোধ হয় ঐটাই তাহার মা! কিন্তু বেশিক্ষণ থাকিতে চায় না, খাওয়া শেষ না করিয়াই এক ফাঁকে উড়িয়া যায়!
অনন্তর কথা শুনিয়া ঘাটের নারীদের কেউ হাসিল, কেউ দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল। খোলের ডোঙ্গাগুলি পরিষ্কার করিয়া ধুইয়া সেগুলি হাতে লইয়াই সে ডুব দিয়া স্নান করিল। তারপর মাটির ছোট একটি ঘড়াতে জল ভরিয়া যাইতে উদ্যত হইল। একজন স্ত্রীলোক তাহাকে ডাকিয়া ফিরাইল, বলিল, ‘তা হইলে, তোর মা কাউয়া হইয়া আইয়ে?
‘খাওয়া শেষ না কইরা উইড়া যায়।‘
‘হ।’
‘খাইয়া যায় না কেনে?’
‘পাছে আমি তার লগে কথা কইতে চাই, এই ডরে বেশিক্ষণ থাকে না। যারা মইরা যায়, তারা ত জীয়ন্ত মানুষের সাথে কথা কইতে পারে না। তার লাগি মানুষের কথা শুনতেও চায় না, মনে মনে বুইঝ্যা চইল্যা যায়।’—অনন্ত মমতায় বিগলিত হইয়া পড়ে।
মা যখন বাঁচিয়া ছিল, অনন্ত সব সময়ে মার জন্য গর্ব অনুভব করিয়াছে। মার তুলনায় নিজেকে ভাবিয়াছে অকিঞ্চিৎকর। মা মরিয়া গিয়া লোকের কাছে যেন অনন্তর মাথা হেঁট করিয়া দিয়া গিয়াছে। এমন মার ছায়ায় ছায়ায় থাকিতে পারিলে অনন্ত যেন অনেক কিছু অসাধ্য সাধন করিতে পারিত। এখন, মা নাই, তার যে আর কিছুই নাই; লোকের কাছে এখন তার দাম কানাকড়িও না। সে এখন মরিয়া গেলে কারো কিছু হইবে না। কেউ তার কথা মুখেও আনিবে না। কিন্তু মা? একমাস হইতে চলিল মরিয়াছে, এখনও তার কথা কি কেউ ভুলিতে পারিয়াছে? ঘাটে জমিলে মেয়েরা তার মার কথা আলোচনা করে; দুঃখ করে, দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে। বিশেষ করিয়া অনন্তকে দেখিলে তারা তখন তখনই তার মার কথা শুরু করিয়া দেয়। মার প্রতি কৃতজ্ঞতায় অনন্তর বুক ভরিয়া উঠে।
ঘাটে আসিয়া যে-বধূট সকলের চেয়ে বেশি দেরি করে, বেশি কথা বলে, আর কথায় কথায় ছড়া কাটে, তুনিয়ায় তার পরিচয় দিবার উপলক্ষ্য মাত্র দুইটি—এক, সাদকপুরের বনমালীর বোন বলিয়া, আর দুই, লবচন্দ্রের বউ বলিয়া। তবে এখানে প্রথমোক্ত নামে তার পরিচয় বেশি নাই, শেষোক্ত নামেই সে মালোপাড়ায় অভিহিত। কথার মাঝে মাঝে সুন্দর ছড়া কটিতে পারে বলিয়া সকল নারীরা তাকে একটু সমীহ করে; সে যেন দশজনের মাঝে একজন। শ্রাদ্ধের দিন অনেক নারী দেখিতে আসিল। সেও আসিল। নাপিত আসিয়া অনন্তর মস্তক মুণ্ডন করিয়া গেল। অনন্ত কতকগুলি খড়ের উপর শুইত, সেই খড়গুলি, হাতের আধছোঁড়া নিত্যসঙ্গী কুশাসনখানা, কাঁধের ও কটিদেশের মাঠ-কাপড়ের চিলত দুইখানা সেই নারীর কথামত নদীতীরে ঘাটের একটু দূরে কাদায় পুতিয়া না করিয়া আসিল। পুরোহিত চাউলভরা পাঁচটি মালসাতে মন্ত্র পড়িয়া অনন্তর মাতৃশ্ৰাদ্ধ সমাধা করতঃ একটা সিকি ট্যাকে গুঁজিয়া চলিয়া গেলে, সেই স্ত্রীলোকটি তাড়া দিল, ভতি বাড়নের কত দেরি। কড়া র্ডিগ মানুষ। ভুখে মরতাছে!’
সুবলার বউর এক হাতে সব কাজ করিয়া উঠিতে দেরি হইল। তবু সে পরিপাটি করিয়া পাঁচটি ব্যঞ্জন রণধিল। অনন্ত এক স্থানে বসিয়া পড়িয়াছিল। মাসীর মা খেকাইয়া উঠিল, ‘নিষ্কর্ম গোঁসাই, আরে আমার নিষ্কর্ম গোঁসাই, একটা কলার খোল কাইট্যা আনতে পারলে না!’
সেই নারী প্রতিবাদ করিল, ‘চিরদিন গালি দিও মা, আইজের দিনখান সইয়া থাক। দাও দেও, আমি খোল কাইট্যা আনি।’
লম্বা একটা খোলে ভাতব্যঞ্জন সাজাইয়া সুবলার বউ বলিল, ‘রাঁড়িরে শেষ খাওন খাওয়াইয়া দেই, আর ত কোনদিন খাইতে আইব না।’
খোলের এককোণে একটু পান সুপারি, একটু তামাক টিকাও দেওয়া হইল।
সেই নারী সুবলার বৌকে বলিল, ‘তোমার সাথে ত কত ভাব আছিল দিদি! তুমি যাইও না। আমি যাই তারে লইয়া।’
অনন্ত ভাত ব্যঞ্জন ভরতি খোলটা হাতে করিয়া নদীর পারের দিকে চলিল, সঙ্গে চলিল সেই স্ত্রীলোকটি। সে নির্দেশ দিল, না-জল না-শুকনা, এমুন জায়গাত, রাইখ্যা পাছ ফির আইয়া পড়, আর পিছের দিকে চাইস না।’
অনন্ত জন্মের মত মাকে শেষ খাবার দিয়া স্ত্রীলোকটির পিছু পিছু বাড়ি চলিয়া আসিল।
লোকে তেপথা পথে রোগীকে স্নান করায়, ফুল দিয়া রাখে। যে পা দিবে সেই মরিবে। এ আপদ একদিন কেন সেই পথ দিয়া আসে না!–হবিষ্যের সময় একবার করিয়া খাইত, এখন খায় তিনবার করিয়া। কোথা হইতে আসেত এত খাওয়া?
—বুড়ির এই কথাটা ভাবিবার মত। বুড়া চিন্তা করে, এক মানুষ সে। তিন পেট চালায় তার উপর এই অবাঞ্ছিত পোষ্য। কিন্তু কি করা যায়!
একদিন বুড়ি প্রস্তাব করিল, ‘ছরাদ্দ শান্তি হইয়া গেছে। অখন কানে ধইরা নিয়া জাল্লার নাওয়ে তুল।‘
বুড়া ইন্ধন জোগাইল, ‘হ। জগতারের ডহরের গহীন পানিত একদিন কানে ধইরা তুইল্যা দিমু ছাইড়া। আপদ যাইব।’
নদীর উপর নৌকাতে ভাসিয়া মাছ ধরার আনন্দ অনন্তর মনে দমকা হাওয়ার মত একটা দোলা জাগাইয়া দিল, কিন্তু বুড়া-বুড়ির কথার ধরণ দেখিয়া উহা উবিয়া গেল।
তাহা সত্ত্বেও একদিন সন্ধ্যাবেলা জাল কাঁধে লইয়া বুড়া যখন হুকুম করিল, ‘এই অনন্ত, হুঙ্কা-চোঙ্গা হাতে নে, আজ তোরে লইয়া জালে যামু।‘ অনন্ত তখন বিদ্যুতের বেগে আদিষ্ট দ্রব্যগুলি হাতে লইয়া পরম বাধিতের মত আদেশকারীর পাছে পাছে চলিল।
মাসী দৌড়াইয়া আসিয়া বাধা দিল। বাপ তার অত্যন্ত রাগী মানুষ। রাগ হইয়া যখন মারিতে আরম্ভ করিবে, এক নৌকায় অনন্তকে তখন বাঁচাইবে কে?
‘হাতের আগুন নিব তে না নিব তে তুমি তারে জালে নিওনা বাবা। ছোট মানুষ। জলে পইড়া মরে, না সাপে খাইয়া মারে, কে কইব। অখন তারে নিওনা, আরেকটু বড় হইলে নিও।’
মাসীর কথায় অনন্ত অপ্রসন্ন মুখে নিরস্ত হইল। এবং বুড়াবুড়ি নিরস্ত হইল আরো অপ্রসন্ন মুখে, ভবিষ্যতের এক প্রবল ঝড়ের আভাষ দিয়া।