৩.৩ নয়া বসত
‘ঠাকুর-সকল, আমার একখান কথা।‘
রামপ্রসাদ ফিরিয়া দেখে তার ঠিক পিঠের কাছেই রেশমি চাঁদর গায়ে একজন কথা কহিয়া উঠিয়াছে।
‘কি কইতে চাও কও না।’
যারা এখান হইতে মাছ কিনিয়া শহরে গিয়া বিক্রি করে তাদের সামনে এক নতুন সমস্যা দেখা দিয়াছে। সে সমস্তার সে একজন ভুক্তভোগী। মোড়লের আশ্বাস পাইয়া জানাইল আনন্দবাজারের মাছ বিক্রেতাদের কাছে এখন জমিদারের লোকে মাশুল চাহিতে শুরু করিয়াছে। মাছের ভার পিছু তুই আনা করিয়া মাশুল না দিলে বলিয়া দিয়াছে মালোদিগকে বাজারে বসিতে দিবে না।
রামপ্রসাদের চোখে মুখে একটা কঠোরতার ছায়া পড়িল। সে বাজারের ইতিহাসখান চকিতে তার মনের পরদায় ছায়া ফেলিল। জগৎবাবু আর আনন্দবাবু শহরের এই ছজন গণ্যমান্ত জমিদার একই সময়ে নিজ নিজ নামে দুইটি বাজার বসায়। দুইজনেই চায় নিজেরটা জমুক, অন্তেরটা না জমুক। দুইজনেরই লোকে মালোদের ধরিয়া পড়িল। মালোরা কার কথা মান্ত করিবে ভাবিয়া পায় না। রামপ্রসাদের কাছে সকালে আসিল জগৎবাবুর লোক, বিকালে আসিল আনন্দবাবুর লোক। সে যার পক্ষে টলিবে, মালোর তারই বাজার জমাইবে। সকালে যারা আসিল, গোপনে জানাইল, বাবু তোমাকে তিনশ টাকা দিবে, তুমি কথা কও। সে কথা কহিল না। বিকালে যারা আসিল, তারা জানাইল, বাবু মালোদের প্রত্যেককে পচিশ টাকা নগদ দিবে, আর একখানা করিয়া ধুতি দিবে। রামপ্রসাদ তাহাদিগকে পানতামাক খাওয়াইল।
পরের দিন মালোরা দলে দলে মাছের ভার লইয়া আনন্দবাজারে পশরা সাজাইল। যারা বেপারী তারা ত গেলই, যারা বেপারী নয়, তারাও নৌকা ঘাটে বাঁধিয়া এক এক ভার মাছ লইয়া বাজার আলো করিল। কি জমাটাই না জমিয়াছিল সেদিনকার বাজার। সেদিন হইতে জগৎবাজার কানা। আনন্দবাবুর সেদিন মুখে হাসি ধরিতেছিল না। সে আনন্দবাবু আজ নাই। তাঁর লোকেরা আজ গোকর্ণঘাটের মালোদের কাছে খাজনা চায়।
‘শুন বেপারি, বাবুরে সাফ কথা কইয়া দিও, মালোরা মাছ বেচ্তে কোনো সময় মাশুল দেয় নাই, দিবেও না। জায়গা দেউক আর নাই দেউক। মালোরা বাজার জমাইতে যেমুন জানে, ভাঙ্তেও জানে। তারা যেখানে যায়, আ-পথে পথ হয়, আ-বাজারে বাজার হয়।’
তামসীর বাপের কানে এসকল কথা ঢুকিতেছিল না। সে নিজের কথা ভাবিতেছিল। এই বৈঠকে তার কথা ও উঠিবে। মনে মনে সে নিজেকে অপরাধী স্থির করিয়া রাখিল। সত্যই ত, পাড়ার মধ্যে ঐক্য রাখা এবং পাড়ার স্বার্থ দেখাই সর্বাগ্রে কর্তব্য। তারা আমার কে? তারা মালোদের ঘরে নেয় না, মালোরা কোনো জিনিস ছুইলে সে জিনিস তারা অপবিত্র মনে করে। পূজাপার্বণে মালোরা তাদের বাড়ির প্রসাদ খাইলে এঁটো পাতা নিজে ফেলিয়া আসিতে হয়। সে-পাত ওরা ছোয় না, জাত যাইবে। এরা মালোদের কত ঘৃণা করে। মালোর লেখাপড়া জানে না, তাদের মত ধুতি-চাঁদর পরিয়া জুতা পায়ে দিয়া বেড়ায় না। কিন্তু তাই বলিয়া কি তারা ছোঁওয়ারও অযোগ্য? মালোর মালো বলিয়া কি মানুষ নহে।
এমন সময় তার ডাক পড়িল।
ডাকিল দয়ালচাঁদ, ‘তামসীর বাপ শুনছ নি?’
‘হ কাকা, শুনছি, কও।‘
দয়ালচাঁদ বলিয়া চলিল, বাজারের কাছে তোমার বাড়ি। বাজারের কায়েতরা তোমার বাড়ি আসিয়া নাকি তবলা বাজায় আর মেয়েদের দিকে নজর দেয়। ভাবিয়া দেখ, কায়েতের সঙ্গে মিশিতেছ বলিয়া তারা তোমাকে কায়েত বানাইবেন। তুমি মালোই থাকিবে। তারা তোমার বাড়ি আসিলে যদি সিংহাসনও দেও, তুমি তাদের বাড়ি গেলে বসিতে দিবে ভাঙ্গা তক্তা। তুমি রূপার হুকাতে তামাক দিলেও, তোমাকে দিবে শুধু কলকেখানা। না না, কাজখানা তুমি ভাল করিতেছ না।
অনুতপ্ত তামসীর বাপ শুধু এই কথা কয়টি বলিতে পারিল ‘দশজন পরমেশ্বর, অনেক কাঁদছি, আর আমারে কাঁদাইও না।’
সব শেষে উঠিল অনন্তর-মার কথা। তার বুক দুরদুর করিতে লাগিল।
একথাটাও ভারতকেই তুলিতে হইল, নতুন যে লোক আসিয়াছে, আপনারা সকলেই শুনিয়াছেন। তারে নিয়া কিভাবে সমাজ করিতে হইবে আপনার বলিয়া যান। তারে কার সমাজে ভিড়াইবেন, কিষ্টকাকার, না দয়ালকাকার, না বসন্তর বাপকাকার—
কৃষ্ণচন্দ্র বলিল, ‘কোন্ গুষ্টির মানুষ আগে জিগাইয়া দেখ্, কোন্ কোন্ জাগায় জ্ঞেয়াতি আছে জান্।‘
আদেশমত সুবলার বৌ তাকে জিজ্ঞাসা করিল।
অনন্তর মা কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল, ‘ভইনসকল গুষ্টিজ্ঞিয়াতির কথা আমি কিছু জানি না।’
শুনিয়া সকলেই নিরুৎসাহ হইল। কেহই তাহাকে নিজের সমাজে লইতে আগ্রহ দেখাইল না।
কৃষ্ণচন্দ্র বলিল, ‘আমার সমাজ বিশ ঘরের। ঘর আর বাড়াইতে চাই না।’
দয়ালচাঁদের সমাজও দশ ঘরের। প্রত্যেকটাই বড় ঘর। তার সমাজেও ঠাঁই হওয়া অসম্ভব।
মঙ্গলা বসিয়াছিল সকলের পশ্চাতে। ঠেলিয়াঠুলিয়া আগাইয়া আসিয়া সে বলিল, ‘আমার সমাজ মোটে তিন ঘরের?’
রামপ্রসাদ জিজ্ঞাসা করিল, ‘কারে কারে লইয়া তোর সমাজ?’
‘সুবলার শ্বশুর আর কিশোরের বাপেরে লইয়া।’
‘তা হইলে নতুন মানুষ লইয়া তোর সমাজ হইল চাইর ঘর।‘
‘হ কাকা।‘
কৃষ্ণপক্ষের রাত। দশমী কি একাদশী হইবে। কালিঢালা আঁধারের ভিতর দিয়া রামপ্রসাদ চলিয়াছে।
তার সারা দেহে বার্ধক্য যেন জোর করিয়া ছাপ মারিয়াছে। অঙ্গপ্রত্যঙ্গের গ্রন্থিবন্ধন যেন অনেক কষ্টে শিথিল হইতে পারিয়াছে। আবেশায়ত চোখদুটি হইতে কিঞ্চিৎ দৃষ্টিশক্তি যেন সবলে অপসৃত হইয়াছে। রামপ্রসাদের আজ যেন কি হইয়াছে। রামপ্রসাদ পথ হারাইয়া ফেলিল।
যে পথ চিনিয়া চলে তার পথ একটি, আর যে দিশাহার হইয়া চলে তার পথ শত শত। মালীবাড়ির পথের পর আরেকটা পথে পা দিয়া তার আত্মকেন্দ্রিক চিন্তার স্তব্ধতায় সহসা ঢেউ জাগাইল এই মালিনী। অনেক সময় এক একটা চিন্তা মানুষের মনে আসিয়া ঢোকে আকস্মিকভাবে, আগে একটুও খবর না দিয়া। তার অবচেতন মনের চিন্তার সঙ্গে সে-চিন্তা যোগ রাখিয়া আসেনা, একেবারে আকাশ ফাঁড়িয়া আবিভূত হয়,—সে মীমাংসা মনস্তাত্ত্বিকের কাজ। আমরা দেখিতে পাই, সে-চিন্তা আকস্মিক আসিলেও আগের চিন্তাগুলির তাহা অনুপূরক। তাই মালিনী তার মনে আকস্মিক হইলেও, সঙ্গে সঙ্গেই জানা গেল সে একটা প্রসঙ্গের আবছা তরীতে ভর করিয়াই আসিয়া নামিয়াছে তার চিন্তার জোয়ারে। হয়ত রামগতির উঠানে জড়ানো জাল দেখিয়া মনে হইয়াছিল বিভ্রান্ত রামপ্রসাদের, যে এটা মালিনীর বাঁশের ঝাড়। হয়ত পথ চলিতে চলিতে এও মনে হইয়াছিল, আমার পথের একটু ডানদিকেই একটা বাড়ি আছে, সেটাকে বলে মালীবাড়ি। সে বাড়ি এখন পোড়ে। তার পাশ দিয়া যে পথ গিয়াছে রাতে সেপথে কেউ হাঁটে না। বেঘোরে মরা মালিনীর প্রেতাত্মা এখানে মূর্তি ধরিয়া পথিককে ভেংচায়। আর নানারকমের সাপ এপথে ঘুরিয়া ঘুরিয়া ব্যাঙ ধরে।
কিন্তু এবাড়ি আগেত এমন ছিল না। এর চারিদিকে মালঞ্চঘেরা ছিল। একদিকে ফুলবাগান, একদিকে বেগুন ক্ষেত, একদিকে বাঁশঝাড়, আমগাছ, আর পূর্বদিকে পুষ্করিণী। ফুলগুলিতে মৌমাছি গুনগুন করিত। আমগাছে বসন্তের কোকিল ডাকিত। বাঁশঝাড়ে রাতদিন পাখপাখালিতে কলরব করিত। মালিনীর যখন বয়ঃসন্ধি সে তখন কলাপাত৷ লইয়া এই পথ দিয়া পাঠশালায় গিয়াছে। ভরা যৌবনেও মালিনীকে দেখিয়াছে। এখনো মনে পড়ে, দাওয়ায় বসিয়া মালী ও মালিনীতে ধুচনি বুনিতেছে, শেষে একদিন মালী মরিয়া গেল। তখনও মালিনীর ভরা যৌবন। সেই আবারণ যৌবনভার আগলাইয়া বহুদিন সে কাটাইয়া দিল। বাড়ির চারিদিকে মালঞ্চের বেড়া তখনো ছিল। তার মনের বাঁধন যতই আলগা হইতেছিল, মালঞ্চের বাঁধনকে ততই সে শক্ত করিয়া তুলিতেছিল। সেখানে ঢুকিয়া কিন্তু ফুলে হাত দিবার সাধ্য কারো ছিল না। মুখে প্রণয়ের মধুভাণ্ড ধারণ করিয়াও সে-বাড়িতে পা ফেলিতে অনেকের বুক শঙ্কায় সস্কুচিত হইত। আজ মুখে কালকূটের বোঝা লইয়া জাতকেউটের অসঙ্কোচে ঘুরিয়া বেড়ায়।
এরকম হইল কেন? কেন মালিনীর যৌবনের ছেলেপুলেগুলি, বাধক্যের নাতি-নাতনিগুলি এবাড়ির আঙ্গিনায় খেলাইতে নামিল না। তার থেকে কেন আরো দশটা জোয়ান পুরুষ-নারী ঘর্মক্লান্ত দেহে এই বাড়ির ফলফুলের ভার সাজাইতে আজ এখানে কর্মব্যস্ত নয়। সংখ্যায় বাড়িয়া, এই বাড়িতে স্থানের অকুলান দেখিয়া, আরো জঙ্গল কাটিয়া, খানায় মাটি ফেলিয়া তারা কেন আরো দুই চারিটা মালীবাড়ির গোড়াপত্তন করিল না? ইহাতে বাধা জন্মাইল কিসে? এসকল সহজপস্থার বিরাট সম্ভাবনা কেন এক মালিনীর বুকের কানাচে শুখাইয়া মিলাইয়া গেল। এমন করিয়া কেন বাড়ি খালি হইয়া পড়ে। একদা যারা বাস করে, পরে তারা কোথায় চলিয়া যায়। কেন আবার নতুন মানুষ আসে না। মালিনী অনেকবার বাঁশের মাচাতে লাউকুমড়ের গাছ লতাইয়া দিয়াছে। তাতে ধরিয়াছে অজস্র লাউকুমড়া। সে নিজে কেন একটা শক্ত মাচাকে আশ্রয় করিয়া ফলবতী হইয়া উঠিতে পারিল না। তবেত এ বাড়ির চেহারা আগের মতই আমান থাকিয়া যাইত। নূতন যুগের সম্ভাবনা লইয়া নূতন মানুষ এর আঙ্গিনায় খেলিয়া বেড়াইত। নূতন শিল্পীরা যুগের চাহিদা পূরণ করিয়া, নূতন চাহিদ জাগাইয়া নূতন রকমের শিল্পরচনা করিয়া যাইত। কেউটে সাপ এ-বাড়ির ত্রিসীমায় ঘেঁসিত না।
শরীয়তুল্লা বাহারুল্লা তুই ভাই শহরে গিয়াছিল। ফিরিতে রাত হইয়া গিয়াছে। গ্রামের অন্ধকার পথগুলি একসঙ্গে অতিক্রম করিয়া বাড়ির কোণে আসিয়া ছাড়াছাড়ি হইল। পাশাপাশি তুই বাড়ি। মাঝখানে বেড়া। তারা যার যার পরিবার নিয়া আলাদা থাকে। ছোটভাই শরীয়তুল্লা ঘরে না ঢোকা পর্যন্ত বাহারুল্লা দাঁড়াইয়া রহিল, তারপর ঘুরিয়া কয়েক পা হাঁটিয়া নিজের হিস্তায় পা দিল। দিয়া, চমকাইয়া উঠিল। উঠানের কোণে ধানসিদ্ধ করার যে কু-মুখে উনান আছে সেখানে একটা ছায়ামূর্তি নত হইয়া কি যেন হাতড়াইতেছে। কাঁধের লাঠি হইতে আস্ত গজার মাছটা খুলিয়া লাঠিখানা বাগাইয়া একেবারে তার মুখোমুখি হইয়া দাঁড়াইল। তখন তাহাকে চিনিতে পারিয়াছে।
মাত্বর তুমি। অত রাইতের পর ইখানে।
‘বাহারুল্লা ভাই, আমি পথ বিস্মরণ হইয়া গেছি। গেছলাম সমাজের বৈঠকে। এমন ভুল ত হয় না আমার।’
বাহারুল্লা তাহাকে হাত ধরিয়া বারান্দায় উঠাইল।
তার পরিবার ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল, ডাকিতেই উঠিয়৷ লণ্ঠন জ্বালিয়া দরজা খুলিল। সে ঘরে ঢুকিয়া গামছা-বাঁধা পুঁটলিটা মাটিতে রাখিল। একটা পিঁড়ি হাতে বারান্দায় আসিতে আসিতে পরিবারকে উদ্দেশ করিয়া বলিল, ‘একটু তামুক নি খাওয়াইতে পারে।‘
পরিবার বৌ নয়, গিন্নি। তার তিন ছেলের তিন বৌ স্বামী লইয়া তিনি ঘরে তখন ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। গিন্নি ক্ষিপ্ৰহাতে হুক। ধরাইয়া কপাটের কোণে ঠেকাইয়া, বাহরুল্লার ভাতের জন্য পাকঘরে গেল। মাঝঘরের বিছানাট বারান্দা হইতে দেখা যায়। এই বাড়ির গৃহিণী একটু আগে এখান হইতেই উঠিয়া গিয়াছে। অনেকগুলি ছেলেপুলে বুকে পিঠে লইয়া ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল। রামপ্রসাদ তামাক টানিতে টানিতে একবার সেদিকে আর একবার বাহারুল্লার দিকে চাহিল। বাহারুল্লার বয়স তারই কাছাকাছি। তার ভরপুর সংসার। জমিগুলি সব নিজের। তিন ছেলেকে লইয়া চারজোড়া বলদ দিয়া চারখানা হাল চালায়। যত ধান ঘরে ওঠে, গিন্নি বৌদের নিয়া ভানিয়া ডোল ভরতি করে। এবার অনেক ধান উঠিয়াছে। কাটার বাকিও রহিয়াছে অনেক। ভোর হইলেই ছেলেদের ডাকিয়া মাঠে পাঠাইয়া দিবে, বৌদের ডাকিয়া তুলিবে আর চারজনে মিলিয়া ধান সিদ্ধ করিতে বসিবে। রাধে দুমুখে উনানে, কিন্তু ধানসিদ্ধ করে চারমুখে৷ ছ’মুখে উনানে। একসঙ্গে চার-ছ হাঁড়ি সিদ্ধ হইয়া যায়। মোরগডাকার আগে সিদ্ধ শুরু করিয়া রোদ ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সে-ধান উঠানময় ছড়াইয়া দিবে। সারাদিন রোদ লাগিবে ধানে।
লণ্ঠনের আলোতে সাদা মাটির উঠানটা চক্চক্ করিয়া উঠিল। হুকাটা ফিরাইয়া দিতে দিতে রামপ্রসাদ বলিল, ‘ধান ত এইবার খুব ফলছে।’
‘হ মাত্বর।’
‘জারি গাইবা না?’
‘না, এইবার ক্ষেমা দিলাম। ধান যেরকম গম্গমাইয়া পাক্তে লাগছে, জারির উস্তাদের খোজে ঘোরার সময় কই?
একমুখ ধোঁয়া ছাড়িয়া রামপ্রসাদ উঠানের দিকে একবার চাহিল। এ উঠানে কত জারিগান হইয়াছে। মুল্লুকের সেরা ওস্তাদ আনা হইত। একমাস ধরিয়া সে-ওস্তাদ পাড়ার ছেলেদের শিখাইত। তারপর নিমন্ত্রণ করিয়া পাল্টা দল আনা হইত। দুই দলে হইত প্রতিযোগিতা। ছেলে ও যুবার দল কাঁধে-কাঁধে কোমরে-কোমরে ধরিয়া বীরের নাচ নাচিত। সারা উঠান কাঁপিয়া উঠিত। গান যা জমিত!
‘বাহারুল্লা ভাই, গানগুলি কি ভাল লাগত। এই দুইটা গানের সুর আখনো মরমে গাঁথা হইয়া আছে—‘মনে লয় উড়িয়া যাই কারবালার ময়দানে, আর ‘জয়নালের কান্দনে, মনে কি আর মানে রে, বিরিক্ষের পত্র ঝরে।‘
‘হ মাত্বর, এই সগল গানই খুব জমত। আরেকট। গানও বেশি জমত, মনে পড়ে নি মাত্বর,—”বাছা তুমি রণে যাইওনা, চৌদিকে কাফিরের দেশ, জহর মিলে ত পানি মিলে না। এই সগল গান ক বছর শুনি না। আমার এই উঠানে জারিগান কতবার হইছে।’
সে গানে মালোরাও নিমন্ত্রণ পাইত। রামপ্রসাদ কতদিন এই উঠানেই বসিয়া শুনিয়াছে। বীররস করুণরসের এসকল গান শুনিতে বসিলে ওঠা যায় না। কয়েক বৎসর ভাল ফসল হয় না। চাষীরা কেবলই দেনায় জড়াইয়া যাইতেছে। লোনকোম্পানীর টাকা আনিয়া কত চাষী আর শোধ করিতে পারে নাই বলিয়া প্রতি কিস্তিতে কত শাসানি কত ধমক খাইয়া মরিতেছে। জারি গাহিবে তারা কোন আনন্দে? এবার ভাল ধান হইয়াছে। সে ধান তুলিয়াই সারা হইতেছে। জারিগান গাহিবার সময় কই?
‘মালোগুষ্টির কালীপূজার দেরি কি, মাত্বর?’
‘বেশি দেরি নাই। সামনের আমাবস্যায়।’
‘এইবার গান দিবা না?’
‘হ, আট পালা। চাইর পালা যাত্রা আর চাইর পালা কবি।‘
‘আ—ট পালা? এই টেকা দিয়া তারা মলোপাড়ায় যদি একটা ইস্কুল দিত।‘
‘আর ইস্কুল। মালোর পুলকে বাঁচে না, তারা দিব ইস্কুল!’
‘দেখ মাত্বর, নিজেত আঞ্জি ক খ শিখলাম না। কিন্তু ‘কালা আখর’ যে কি চিজ অখন কিছুকিছু টের পাই। মজিদের কিনারে এজমালির যে মক্তব জমাইছি, বেহানে তার কাছ দিয়া যাইতে যাইতে খাড়া হইয়া থাকি, তারা পড়া করে, আমার কানে মধু বরিষণ করে।‘
‘বাহারুল্লা ভাই, উচিত কথা কইলে মালোরা লাঠি মারতে চায়। এই দুঃখেইত গাও ছাইড়া দেশান্তরী হইলাম।‘
জোরে একটা টান দিয়া হুকাটা রাখিতে রাখিতে বাহারুল্লা বলিল, ‘মালোগুষ্টি সুখে আছে। মরছি আমরা চাষারা। ঘরে ধান থাকলে কি, কমরে একখান গামছা জুটেনি? পাট বেচবার সময় কিছু টেকা হয়। কিন্তু খাজনা আর মাহাজন সামলাইতে সব শেষ। কত চাষায় তখন জমি বেচে। তোম্রা-তারার দোয়ায় অখন অবধি আমার জমিতে হাত পড়ছে না। পরে কি হইব কওন যায় না?’
‘এই কামও কইর না বাহারুল্লা ভাই। জান থাকতে জমি ছাইড় না। মালোগুষ্টির কথা আল্গা। তারা জলের উপরে জলটুঙ্গি বাইন্ধা আছে। জোয়ারে বাড়ে ভাটায় কমে, জলের আবার একটা বিশ্বাস। মাটির সাথে সম্বন্ধ-ছাড়া মানুষের জীবনের কোন বিশ্বাস নাই, বাহারুল্লা ভাই।’
‘চল মাত্বর, তোমারে আগাইয়া দেই।’
রামপ্রসাদ উঠানে নামিয়া দেখে, চাঁদ উঠিয়াছে। বড় তেজালো চাঁদ। সামনের দিকে যেন রথ ছুটাইয়া আসিতেছে।
‘জোছনা উঠছে বাহারুল্লা ভাই, তুমি ঘরে যাও, খাও গিয়া। অখন আমি একলাই যাইতে পারমু।‘
যে-শিশু আকাশ-কোণে হামাগুঁড়ি দিয়া উঠিয়াছিল, সে এখন ধাপে ধাপে আগাইয়া আসিতেছে। সুনীল স্বচ্ছ আকাশখান দূরের না-দেখা-জগৎ হইতে অনেকখানি নিচে যেন নামিয়া আসিয়া ঘুমন্ত মালোপাড়ার উপর চাদোয়া ধরিয়াছে। গায়ে-গায়ে লাগানো ছনের ঘরগুলি বিমল আলোর ধারায় স্নান করিয়া এককালে মাথা তুলিয়া আছে। কানাচে কানাচে পড়িয়াছে ছোট ছোট ছায়া। তাই মাড়াইয়া চলিতে লাগিল রামপ্রসাদ। মালোপাড়ায় জোৎস্নার এমন অজস্রতা। এর প্রতিঘরের উপর গলিয়া-পড়া রূপলোকের এমন পরিপূর্ণ হাসি। নির্মল আকাশের স্বচ্ছতার সঙ্গে মাথা-উচুকর ঘরবাড়িগুলির এমন আবেগময় আলিঙ্গন। এ দৃশ্য পাড়ার আর কেউ দেখিল না, দেখিল কেবল রামপ্রসাদ।
আরো একজন দেখিতেছিল। কিন্তু সে দেখা অর্থহীন, অনুভূতিহীন। রামপ্রসাদ গিয়া রামকেশবের উঠানে পা দিতেই দেখে, সে ধাঁ করিয়া উঠানের একধার হইতে অন্যধারে চলিয়া যাইতেছে।
রামকেশবের উঠানে আলোর তেজ কম। সারা উঠান ঢাকিয়া বাঁশের আগায় জাল ছড়াইয়া রাখিয়াছে। মাটির উপর তার ছায়া পড়িয়াছে। জালের খোপের ভিতর দিয়া মাছেরা মাথা গলাইতে পারে না, কিন্তু চাঁদের আলোরে আটকায় কার সাধ্য। প্রতি খোপের ফাঁক দিয়া সে আলো উঠানের স্বচ্ছ মাটিতে পড়িয়াছে। কোন্ সুচতুর মালোর মেয়ে বুঝি অপার্থিব ক্ষমতায় আলোর জাল বুনিয়া রামকেশবের উঠানের মাটিতে বিছাইয়া দিয়াছে।
উত্তরের ভিটির ঘর রামকেশবের। দুইচালের ঘর। সামনে একফালি বারান্দা। অনুচ্চ ভিটির কিনারাগুলি স্থানে স্থানে ভাঙ্গিয়া গিয়াছে। ঘরের পুবের অংশ অন্দরমহল। এককালে আবরু-বেড়া ছিল। ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে অনেক দিন। আগে ছেঁড়া জাল দিয়া ভাঙ্গ জায়গাগুলি ঢাকিবার চেষ্টা হইত। এখন আর সেরূপ চেষ্টা নাই, দেখিলেই মনে হইবে এ বাড়ির আবরুরক্ষার প্রয়োজন ফুরাইয়া গিয়াছে।
বারান্দার উপরে একপাশে চালের সঙ্গে ঝুলাইয়া রাখিয়াছে কতকগুলি এলোমেলো দড়াদড়ি। তার পাশে কয়েকটা ছেঁড়াজালের পুটুলি উপরি-উপরি মাটিতে ফেলিয়া রাখিয়াছে। তারই উপরে কুকুর-কুণ্ডলী দিয়া বোধ হয় লোকটা শুইয়াছিল। ধণ করিয়া উঠানে নামিয়া রামপ্রসাদের সামনা দিয়া ভৌতিক ক্ষিপ্রতায় তিন লাফে উঠান পার হইয়া গেল। খালি গা। পরনে একখানি গামছা। মাথায় এক বোঝা আলুথালু চুল। মুখ ভরতি দাড়ি। যাইবার সময় জালের নিচেকার বুনানো আলোছায়ায় তার মাটিমাখা কালো শরীরটা চিক্চিক্ করিয়া উঠিল। একটু অস্বাভাবিক ফোলা শরীর।
রামপ্রসাদ দেখিয়া চিনিল!
সে বুলানো হাত ছটি ঘনঘন নাড়িতে নাড়িতে মুখ বাড়াইয়া আক্রমণের ভঙ্গিতে আগাইয়া আসিল। রামপ্রসাদের মুখের কাছে মুখ আনিয়া বিকৃতমুখে মান একটু হাসিয়া বিজ্ঞের মত আস্তে বলিল, ‘অ, মাত্বর, অতদিন পরে। আচ্ছা বারিন্দায় উঠ, দেখ কি কাণ্ডখান হইয়া আছে।’
‘কি কাণ্ড হইয়া আছে। আরে শালা কি কাণ্ড।’
‘দেখ না গিয়া? হাত ধরিয়া বারান্দায় তুলিয়া নিয়া দেখাইল। দা দিয়া মাটিতে তিন চারটা গর্ত খুড়িয়াছে। লম্বা গর্ত। একটার মুখ খুঁড়িতে খুঁড়িতে আরেকটার গায়ের উপর তুলিয়া দিয়াছে। সেইখানে আঙ্গুল ঠেকাইয়া বলিল, ‘দেখ চাইয়া, কি হইতাছে। মাইয়া চুরি হইতাছে। এই তোমার মেঘনা গাঙ, অইখানে খাড়ি। খাড়িতে আছিল নাও, বড় গাঙে কি কইরা গেল। জাইগ্যা দেখি মাইয়াচুরি হইতাছে। বাইরে জোছনা ফট্ফট্ করে, ভিতরে আন্ধাইরে মাইয়া চুরি হয়। তুমি কি কও মাত্বর।’
রামপ্রসাদ কিছুই কহিল না। তিতাসের শুশুক মাছগুলি যেমন সন্ধ্যার ছায়া পাইয়া ভাসিয়া নিঃশ্বাস ছাড়ে, জালের পুটুলিগুলির উপর বসিতে বসিতে তেমনি ফোস করিয়া একটা নিঃশ্বাসের শব্দ তার নাক দিয়া বাহির হইল।
ঘরের ভিতর রামকেশব অকাতরে ঘুমাইতেছে। নাকডাকার শব্দ শোনা যায়। শেষরাতে জালে যাইবে। এখন তাকে ডাকিয়া জাগান মর্মান্তিক। ঘুমভাঙা মানুষ মাথা ঠিক রাখিয়া জাল ফেলিতে পারে না। তার রোজগারটাই মাটি হইবে। শেষরাতের আর দেরি কত।
রামপ্রসাদ অধিক ভাবিতে পারিল না। চিন্তাতে বিমনা, ক্লান্তিতে অবশ রামপ্রসাদকে জালের উষ্ণতাটুকুর মাঝে ঘুম একেবারে কাত করিয়া ফেলিয়া দিল।
রাত শেষ হইবার আগেই একবার ঘুম ভাঙিয়াছিল। পাগল তাহার একান্ত কাছে। হাতের কাছে মাটি খুড়িবার একটা দা রাখিয়াছে। একটা কিছু করিয়া ফেলা স্বাভাবিক। চোখ মেলিবার সঙ্গে সঙ্গে এ-ভয়ই সে করিতেছিল। চোখ খুলিয়া দেখে, একজন তার অতি কাছে বসিয়া, মুখখানা তারই মুখের কাছাকাছি। ভয় পাইবার আগে জড়তাগ্রস্ত চোখ কচলাইয়া আবার দেখিল-—রামকেশব। তাকে আগলাইয়া রাখিয়াছে। বুড়ার দাড়িগুলি তার দাড়িগুলির একান্ত কাছে। প্রশস্ত লোমশ বুকখানাও তার বুকের অতি নিকটে। তার লোমশ বুকের উষ্ণতা রামপ্রসাদের বুকেও লাগিতেছে।
রামকেশবের বয়স তার চাইতে আরো বেশি। শরীর তার মতই শক্তির পরিচয় দিলেও, তার চাইতে বেশি ভাঙিয়া পড়িয়াছে। চুল দাড়ি চোখের ভ্রূ কানের লোম এখনো কাঁচাপাকা। রামপ্রসাদের শণের মত শাদা চুলদাড়ির নিকট তাকে আকাশের পথে কাত-হইয়া-দৌড়-দেওয়া চাঁদের বারান্দায়-ঢুকিয়া-পড়া আলোতে নাবালকের মত দেখাইতেছে। যেন দুইটি প্রাগৈতিহাসিক শিশুর অপার্থিব সমন্বয় ঘটিয়াছে, যার ইতিহাস স্তব্ধ রাত্রি ছাড়া আর কেউ জানে না। আর একজন যে জানে, তার কোনো অনুভূতি নাই।
দুইজনের মধ্যে এই রকম কথাবার্তা হইল—
—মাতবরের ছেলে, ডাক দিলে না, কোন সময়ে আসিয়াছ জানিলাম না। শীতে কষ্ট পাইলে।
—না মালোর ছেলে, শীতে কষ্ট বেশি পাই নাই। ঘুমাইয়া পড়িলে আবার কষ্ট কি। ভাবিলাম তুমি যখন শেষরাতে নদীতে যাইবে, তোমার নৌকায় আমি যাইব। তুমি আমাকে যাত্রাবাড়িতে নামাইয়া দিবে।
—সারা রাতে একবার বাহির হইয়াছিলাম। বাহির হইয়া দেখি একটা মানুষ। কাছে আসিয়া দেখি তুমি। জাগাইলাম না। পাগলট কাছে। তাই বসিয়া গেলাম শিয়রে। রাতের জালে যাওয়া আর বাবা আমারে দিয়া কুলাইবে না। খেউ তুলিয়া জালে হাত দিলে হাত ঠক ঠক করিয়া কাপে। গাঙের বাতাসে কান-কপাল ভাঙ্গিয়া নামায়। বুক যেন ভের্ণতা ছুরি দিয়া কাটে। আমার কি আর বাবা মাছ ধরার সময় আছে। আমার এখন গুফার মধ্যে বসিয়া বসিয়া তামাক টানিয়া কাটাইবার দিন। বিধি তারে কোন পাগল বানাইল। কত পাগল ভাল হয়, আমার পাগল আর ভাল হইল না। ঘরে আসিয়া বস, আমি তামাক জ্বালাই।
মাটির গাছাতে কেরোসিনের আলো মিটমিট করিতেছে। বাহির হইবার সময়েই রামকেশব জালিয়াছিল। তারই মলিন আলোতে ঘরখানার মলিনতা অধিকতর স্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছে। ভাঙা চাটাইর উপর ময়লা ছেঁড়া কাঁথা পাতিয়া বিছানা। দুইটি বালিশের একটিতে তুলা বাহির হইয়াছে। সেটিতে রামকেশব শুইয়াছিল, চুলে দাড়িতে একটু একটু তুলা এখনো লাগিয়া রহিয়াছে। অন্য বালিশটিতে মাথা রাখিয়া যে শুইয়া আছে, খুব ভারী রোঁয়াওঠা কাঁথাতে তার পা থেকে মাথার বালিশ অবধি ঢাকা। সে রামকেশবের পরিবার।
‘অ বুড়ি, উঠ, চাইয়া দেখ্ —’
কাঁথার পুঁটুলি নড়িয়া উঠিল। মলিন কন্থাবরণের অন্তরাল হইতে উন্মোচিত হইয়া ততোধিক মলিন মুখখানা প্রশ্ন করিল, ‘অত রাইতে বাড়িতে কোন কুটুমের পাড়া।‘
‘বজ্জাত বুড়ি, কথা কইস না। জামাই!’
জামাই! জীর্ণ স্মৃতির ছেঁড়া সূতাগুলি মিলাইতে অনেকবার চেষ্টা করিল। কিন্তু তার বাড়িতে জামাই কে আসিতে পারে হিসাবে মিলাইতে পারিল না। পিচুটি-পড়া চোখে ঘুমের ঘোর। ছাপপড়া খড়িওঠা চামড়ার মুখমণ্ডলে
ঘুমের জড়-প্রলেপ। তার উপর ফাঁকে ফাঁকে দাত না থাকায় মুখের ইঁ। —এ সকল মিলাইয়া বুড়ির হতবুদ্ধির মত তার দিকে চাহিয়া থাকাকে রামকেশবের নিকট এত কুৎসিৎ মনে হইল যে, আর সহ করিতে পারিল না। হাত ধরিয়া তাকে এক টানে তুলিয়া বসাইল। খুলিয়া-যাওয়া কটির ও বুকের কাপড় অশেষ চেষ্টায় ঠিক করিতে করিতে বুড়ি জিজ্ঞাসা করিল, ‘জামাই আইল কোন খান থাইক্যা, না কইলে কেমনে বুঝি কও।‘
‘যাত্রাবাড়ির জামাই। বসন্তর বাপ।‘
ভাগ্নী-জামাই। দেশদেশান্তরে মান্য করে। ভাগ্নী মরিয়া গিয়াছে। তাই এবাড়িতে আর আসা-যাওয়া নাই।
বুড়ির মাথা কিঞ্চিৎ পরিষ্কার হওয়ার পর ঘোমটা টানিয়া দেওয়ার কথা মনে পড়িল।
রাতের স্তব্ধতা ভেদ করিয়া অনেক দূরে মোরগ ডাকিয়া উঠিল। যারা খাটিয়া খায় ইহা তাদের নিকট ব্রাহ্মমুহূর্ত। এই সময়ে চাষীর মেয়ের ধানসিদ্ধ করিবার জন্য উনুনের মুখে আগুন দেয়। মালোর মেয়ের চোখে মুখে জল দিয়া শণস্থত। কাটিতে বসে। পুরুষেরা যারা আগ-রাতে যায় নাই, এই সময়ে জাল-কাঁধে রওনা হয়।
কাঁধে জাল হাতে হুকা রামকেশব বাহিরে পা দিতে দিতে বলিল, ‘মাত্বরের পুত, আইজ কিন্তু যাইও না।’
প্রতিটি ঘরের আঙ্গিনাতে রোদ নামিয়াছে। সকালের সোনালি রোদ। কারো বৌ-ঝি বসিয়া নাই। কারো ছেলেমেয়ে বিছানায় পড়িয়া নাই। তারা আঙ্গিনায় নামিয়া পড়িয়াছে। মায়েদের শাড়ি দুই ভণজ করিয়া গা ঢাকিয়া গলাতে বাধা ছিল। রোদ পাইয়া খুলিয়া দিয়াছে। খালি গায়ে এখন খেলাতে মগ্ন। কালোতে ফরসাতে মেশা সুন্দর স্বাস্থ্যোজ্জ্বল শিশুর দল।
রামপ্রসাদ তাহাই দেখিতে দেখিতে নদীর দিকে চলিল। তার চোখে আজ রোদের সোনা মিশিয়া চারদিক সোনাময় হইয়া গিয়াছে। আজ এরা যেন সব সোনার শিশু। সোনার খেলন হাঁড়িখুঁড়ি লইয়া রূপার বালিতে ভাত চাপাইয়া চাঁদসুরুজের দেশে নিমন্ত্রণ পাঠাইয়াছে। তবে নেহাৎই খাইবার স্থূল নিমন্ত্রণ।
অনন্তও আঙ্গিনাতে নামিয়া খেলায় মাতিয়াছে। মায়ের শাদাপাড়ের কাপড়খানা দুই ভাঁজ করিয়া গলায় বাঁধা।
রামপ্রসাদ তার কাছে গিয়া দাঁড়াইল। সেও এই শাদাচুল দাড়িওয়ালা লোকটার দিকে চাহিয়া রহিল, তারপর সহসা কি ভাবিয়া বারান্দার উপর উঠিয়া ডাকিল, ‘মা।‘
মা বারান্দায় নামিয়া, এমন মানুষকে তার তাঙ্গিনায় এমন বিহবলভাবে দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখিয়া এত বিস্মিত হইল যে, না পারিল ভিতরে চলিয়া যাইতে না পারিল মাথার ঘোমটা টানিয়া দিতে।
রামপ্রসাদ আরও অগ্রসর হইয়া অনন্তর একখানা হাত ধরিয়া হাসিমুখে বলিল, আমাকে দেখিয়া তোর ভয় করে? আমি তো তোর এখানে কোন বিচার করিতে আসি নাই। আসিয়াছি কেবল তোকে দেখিবার জন্য। ভিন্ন গ্রামের মানুষ আমি। আমার বাড়িতে তোর মার মত মা নাই। আমার আঙ্গিনাতে তোর মত ছোট দাতৃভাইয়েরা খেলা করে না। মা যদি এ গায়ে না উঠিয়া আমার গায়ে গিয়া উঠিত, এক ঘর আছি, আমার গায়ে তাহা হইলে দুই ঘর হইত।