চৈত্রের মাঝামাঝি । বসন্তের তখন পুরা যৌবন। আসিল দোল পূর্ণিমা । কে কাকে নিয়া কখন দুলিয়াছিল। সেই যে দোলা দিয়াছিল তারা তাদের দোলনায়, স্মৃতির অতলে তারই ঢেউ। অমর হইয়া লাগিয়া গিয়াছে গগনে পবনে বনে বনে, মানুষের মনে মনে। মানুষ নিজেকে নিজে রাঙায়। তাতেও পূর্ণ তৃপ্তি পায় না। প্রিয়জনকে রাঙায়, তাতেও পূর্ণ তৃপ্তি পায় না – তখন তারা আত্মপর বিচার না করিয়া, সকলকেই রাঙাইয়া আপন করিয়া তুলিতে চায়।
তেমনি রাঙাইবার ধুম পড়িয়া গেল শুকদেবপুরের খলাতে
তারা ঘটা করিয়া দোল করিবে, দশজনকে নিয়া আনন্দ করিবে। শুকদেবপুর গ্রামের সকলকেই তারা নিমন্ত্রণ করিল। মোড়লের গাঙের রায়ত হিসাবে কিশোররাও নিমন্ত্রিত হইল। কাল সকাল থেকে রাত অবধি হোলি, গানবাজনা, রঙখেলা, খাওয়া-দাওয়া হইবে।
‘খলাতে দোল-পুন্নিমায় খুব আরব্বা হয়। মাইয়া লোকে করতাল বাজাইয়া যা নাচে! নাচেত না, যেন পরীর মত নিত্য করে। পায়ে ঘুঙরা, হাতে রাম-করতাল। এ নাচ যে না দেখছে, মায়ের গর্ভে রইছে।’
তিলকের এই কথায় সুবলের খুব লোভ হইল। কিন্তু তার মন অপ্রসন্ন। ধুতি গামছা দুইই তার ময়লা।
কিশোর সমাধান বাতলাইয়া দিলঃ নদীর ওপারে হাত বসে। সাবান কিনিয়া আনিলেই হয়।
কিন্তু এক টুকরা সাবানের জন্য এত বড় নদী পাড়ি দেওয়া চলেনা।
শেষে সমাধান আপনা থেকেই হইয়া গেল।
ভাটিতে বেদের বহর নোঙর করিয়াছে। বেদেনীরা আয়না চিরুনী সাবান বঁড়শি, মাথার কাঁটা, কাঁচের চুড়ি, পুঁতির মালা লইয়া নৌকা করিয়া শুকদেবপুরের ঘাটে ঘাটে বেসাত করিয়া যায়। সাপের ঝাঁপিও দুই একটা সঙ্গে থাকে।
কিশোরেরা মাছ ধরায় ব্যস্ত। বেলা বাড়িয়াছে। আর একটু বাড়িলে মাছেরা অতলে ডুব দিবে। এখনি যত ছাঁকিয়া তোলা যায় নদী হইতে। উঠিতেছেও খুব। এমন সময়ে এক বেদেনী ডাক দিল, ‘অ, দাদা, মাছ আছে?’
কিনিতে আসিয়া তারা বড় বিরক্ত করে। তিলক ঝান্নু লোক। বলিল, ‘না মাছ নাই।’
বেদেনীর বিশ্বাস হইল না। বৈঠা বাহিয়া তার বাবুই পাখির মাসার মত নৌকাখানা কিশোরদের নৌকার সঙ্গে মিশাইল। সে তার নৌকার দড়ি হাতে করিয়া লাফ দিয়া কিশোরের নৌকায় উঠিল, ডরার দিকে চাহিয়া বলিল, ‘কি জাল্লা, মাছ না নাই! চাইর পয়সার মাছ দেও।’
কিশোরের জালে অনেক মাছ উঠিয়াছে। বাঁশের গোঁড়ায় পা দিয়া, জালের হাতায় টান মারিয়া সে বুক চিতাইল; তার পিথ ঠেকিল বেদনীর বুকে।
বেদেনী তরুণী। স্বাস্থ্যবতী। তার স্তনদুইটি দুর্বিনীতভাবে উঁচাইয়া উঠিয়াছে। তার কোমল উন্নত স্পর্শ কিশোরের সর্ব-শরীরে বিদ্যুতের শিহরণ তুলিল। বাঁশের গুড়ি হইতে পড়িয়া গিয়া, হাত পা ভাঙ্গিয়া সে হয়ত একটা কাণ্ড করিয়া বসিত। বেদেনী এক হাত ডান বগলের তলায় ও অন্য হাত বাম কাঁধের উপরে দিয়া বুক পর্যন্ত বাড়াইয়া কিশোরকে নিজের বুকে চাপিয়া ধরিল। অবলম্বন পাইয়া কিশোর পড়িয়া গেল না। কিন্তু দিশা হারাইল। বেদেনীর বুকটা সাপের মত ঠাণ্ডা। তারই চাপ হইতে ধীরে ধীরে মুক্ত করিয়া দিয়া বলিল, ‘অ দাদা, পড় কেনে। আমারে ধরবার পার না?’
তিলক গলুই হইতে ডাকিয়া বলিল, ‘অ বাদ্যানী, তুমি তোমার নাওয়ে যাও।’
‘তুমি বুড়া মানুষ, তোমার সাথে আমার কি? আমার বেসাতি এই জনার সাথে।’ সে কিশোরের কাঁধের উপর হাত দিয়া আবার তার বুকখানা কিশোরের পিঠে ঠেকাইতে গেল।
‘এ জনা তোমার কোন্ জনমের কুটুম গো?’
‘শকুন্যা বুড়া, উকুইন্যা বুড়া, তুই কথা কইসনা, তুই কেমনে্ জানবি এজনা আমার কি?’
নিজের লোককে গাল দিতেছে। উভয়সঙ্কটে পরিয়া কিশোর বলিল, ‘অ বাদ্যানী, তুমি অখন তোমার নাওয়ে যাও।’
‘মাছ দিলেই যাই। বাস করতে কি আইচই?’
‘এই নেও চাইর পয়সার মাছ। এইবার যাও।’
‘মাছ পাইলাম, কিন্তু মানুষ ত পাইলাম না। তুমি মনের মানুষ।’
‘নাগরালি রাখ। আমার তিলকের বড় রাগ।’
‘রাগের ধার ধারি না। মনের মানুষ থুইয়া যাই, শেষে বুক থাপড়াইয়া কান্দি। অত ঠকাঠকির বেসাতি আমি করি না।’
কিশোরের হাসি পাইল। বলিল, ‘এক পলকে মনের মানুষ হইয়া গেলাম। তোমার আগের মনের মানুষ কই?’
‘উইড়া গেছে, সময় থাকতে বান্ধি নাই, তোমারে সময় থাকতে বান্ধতে চাই।’
‘কি তোমার আছে গো বাদ্যানী, বান্ধবা কি দিয়া?’
‘সাপ দিয়া। ঝাঁপিতে সাপ আছে –’
বেদেনী ঝাঁপি খুলিয়া দুই হাতে দুইটা সাপ বাহির করিয়া আনিল। আগাইয়া দিল কিশোরের গলার কাছে।
কিশোর ভয় পাইয়া বলিল, ‘অ বাদ্যানী, তুমি তোমার সাপ সরাও। বড় ডর করে।’
‘সরাইতে পাড়ি, যদি আমার কথা রাখ।’
‘কি কথা, কও না।’
‘আর দুইটা মাছ ফাও দেও – ’
‘এই নেও!’ কিশোর অপ্রসন্ন মুখে কতকগুলি মাছ তুলিয়া দিয়া বলিল, ‘এইবার তুমি যাও।’
‘যাই। তুমি বড় ভাল মানুষ। তুমি আমার নাতিন-জামাই।’
কিশোর সর্গের ইন্দ্রসভা হইতে একঠেলায় মাটিতে পরিয়া গেল!
বেদেনী বিজয়িনীর বেশে চলিয়া যাইতেছিল, এমন সময় সুবল ছুটিয়া আসিয়া বলিল, ‘অ বাদ্যানী, তোমার কাছে সাবান আছে? আমারে দুই পয়সার সাবান দিয়া যাও।’