৪.২ জন্ম মৃত্যু বিবাহ
অনন্তর পূজা দেখা হইল না। ভিতরে যারা ঘুমাইয়া ছিল, ঘুম পাইলে তাদের দলে ভিড়িয়া অনন্তও এক সময়ে তাদের গাঁ ঘেঁষিয়া শুইয়া পড়িল। একসময়ে কাঁসি-ঘণ্টা বাজাইয়া পূজা হইয়া গিয়াছে। তারা উঠিয়া পূজা দেখিল, প্রণাম করিল, প্রসাদ পাইল। যে-সব ছেলে বাপ ভাই জেঠা খুড়ার সঙ্গে আসিয়াছিল, তারা তাদের সঙ্গে চলিয়া গিয়াছে। অনন্ত কারে সঙ্গে আসে নাই। তার ঘুমও কেউ ভাঙাইল না।
ঘুম যখন ভাঙিল তখন অনেক বেল। এঘরে একজনও শুইয়া নাই। কিন্তু যত ভিন-পাড়ার ভিন-গায়ের লোক বিহানের বাজার করিতে আসিয়াছিল, তারা এখন প্রতিমার নিকট ভিড় জমাইয়াছে।
ঐ-বাড়িতে মা ছিল। যদি সেখানে গিয়া মাকে পাওয়া যায়। এই ভাবিয়া চোখ মুছিতে মুছিতে সে-পথেই রওয়ান হইল।
মা সেখানেই আছে। আর সেখানে জমিয়াছে একপাল তারই মত বয়সের ছেলেমেয়ে। বড় একটা পিতলের গামলাতে সবগুলি নৈবেদ্যের প্রসাদ ঢালিয়া তার মা নিজ হাতে মাখিতেছে। চিনি বাতাসা সন্দেশ কলা আর আলোচাল। আরো নানা জিনিস। সব একসঙ্গে মাখিয়া মা প্রসাদ বানাইতেছে; যত ছেলের দল চুপ করিয়া চাহিয়া আছে সে প্রসাদের দিকে আর অনন্তর মার মুখের দিকে, প্রসাদ প্রস্তুতরত হাতখানার দিকে।
মার একেবারে সামনে গিয়া পড়া যুক্তিযুক্ত মনে হইল না। সেও ছেলের দলে মিশিয়া তাদেরই একজন হইয়া মাকে দেখিতে লাগিল।
প্রসাদ মাখা শেষ হইলে অনন্তর মা মাধুকরির মত বড় এক এক দলা করিয়া এক এক জনের হাতে প্রসাদ দিতে লাগিল। অন্য ছেলেদের মত অনন্তও একবার ভিড়ের ভিতরে হাত বাড়াইল। সেও তেমনি বড় একদলা প্রসাদ পাইল।
অনন্ত স্পষ্ট দেখিয়াছে, দিবার সময় মা তার দিকে চাহিয়াছে আর একটুখানি হাসিয়াছে। রাতজাগা চাঁদের স্বচ্ছ পাণ্ডুর মমতামাখা হাসি শুধু একটুখানি হাসিয়াছে।
তারপর থেকে চারদিন এখানে অপরূপ কাণ্ড হইল। এক নাগারে আট পালা যাত্রা গান আর কবি গান হইল।
চার দিন পর্যন্ত মালোর দিনে যাত্রা রাত্রে কবি শুনিল। চার দিনের জন্য নৌকাণ্ডলি ঘাটে বাঁধা পড়িল। জালগুলি গাবে ভিজিয়া রোদে শুকাইল। চারদিন তাদের না হইল আহার না হইল নিদ্রা।
কয়দিনের ধুমধামের পর মালোপাড়া ঝিমাইয়া পড়িয়াছে। অত্যধিক আনন্দের অবসানে অনিবার্যরূপে যে অবসাদ আসিয়া পড়ে, তারই কোলে ঝিমাইতে থাকিল মালোপাড়ার ঘেঁষাঘেঁষি ছোটবড় ঘরগুলি।
এর ব্যতিক্রম কেবল রামকেশবের ঘর। যার ঘরে নিত্য নিরানন্দ, আনন্দাবসানের দুঃখের আঁধার সে-ঘরে তুলিয়া উঠে না। ঘনাইয়া আসে না শ্রান্তির অবসন্ন কালে মেঘ। গরীব বলিয়া মাতব্বরের বলিয়াছিল, ‘রামকেশব, তোমার পাগলার চাঁদা বাদ দিলাম। তোমার চাঁদ দিয়া দেও।‘
তারা লণ্ঠন লইয়া উঠানে বসিয়াছে। দিবে-না বলা চলিবে না। তাদের হাতে হুকা দিয়া রামকেশব ডাক দিল, ‘মঙ্গলারে, অ মঙ্গলা, তুই না জাল কিনতে চাইছিলি, টাকা থাকে ত লইয়া আয়?’
ঝড়ের ঢেউ বুকে করিয়া জালটা বাহির করিলে যার হাতে চাঁদার কাগজ ছিল সে বলিল, ‘জালটা অখন বেইচ্চ না কিশোরের বাপ। তোমার চান্দা ছাড়াও পূজা হইব, কিন্তু জাল বেচলে আবার জাল করতে দেরি লাগব। আমি মাত্বররারে সামঝামু।’
এ জন্য রামকেশবের মনে একটা সঙ্কোচ ছিল। চাঁদ দিবে না অথচ পূজার প্রসাদ খাইবে। পরের চাঁদায় গান হইতেছে। সে গান যে বসিয়া বসিয়া শুনিবে, লোকে তার দিকে চাহিয়া কি মনে করিবে।
পূজার একরাত ও গানের চারদিন চাররাত সে পাগলকে ঘরে বাঁধিয়া রাখিল। এবং নিজে না দেখিল পূজা, না পাইল প্রসাদ, না শুনিল গান। চাররাত ধরিয়া খালের মুখে একটানা জাল পাতিয়া রাখিল। তাহাতে সে প্রচুর মাছ পাইল এবং চড়া দামে বেচিয়া কিছু টাকা পাইল। কিন্তু গরীবের হাতে টাকা পড়িলে উড়িবার জন্য ছটফট করে। পরিবারকে জানাইল, পাগলের মঙ্গলের জন্য ‘আলন্তির’ দিনে সে কয়েকজন লোককে খাওয়াইবে।
বুড়ি বলিল, ‘ঐ দিন ত ঘরে ঘরে খাওয়ার আরব্ব, তোমার ঘরে কেডায় খাইতে আইব কও।’
‘কথাটা ঠিক?’
কালীপূজার সময় গান বাজনায় আমোদ আহ্লাদে মালোর অনেক টাকা খরচ করে সত্য, কিন্তু খাওয়া-দাওয়ার জন্য খরচ করে এই উত্তরায়ণ সংক্রান্তির দিনে। এই দিন পৌষ মাসের শেষ। পাঁচ ছদিন আগে থেকেই ঘরে ঘরে গুঁড়ি-কোটার ধুম পড়ে। মুড়ি ভাজিয়া ছাতু কুটিবার তোড়জোড় লাগে। চাউলের গুঁড়ি রোদে শুখাইয়া খোলাতে টালিয়া পিঠার জন্য তৈরী করিয়া রাখে। পরবের আগের দিন সারারাত জাগিয়া মেয়েরা পিঠা বানায়। পিঠা রকমে যেমন পিচিত্র, সংখ্যায়ও তেমনি প্রচুর। পরের দিন সকাল হইতে লাগে খাওয়ার ধুম। নারী পুরুষ ছেলে বুড়া অতি প্রত্যুষে জাগিয়া তিতাসের ঘাটে গিয়া স্নান করে। যারা জালে যায় তারাও নৌকায় উঠিবার আগে গামছা পরিয়া ডুব দেয়। ঠকঠক করিয়া কাঁপিতে থাকায় মাছ ধরার কাজে সুবিধা হয় না। তুত্তোর, পরবের দিনে কিসের মাছ ধরা, এই বলিয়া তুই চার খেউ দিয়াই জাল খুলিয়া ফেলে। ঘরে থাকিয়া নারীরা আর ঘাটে যাইয়া ছেলেপিলেরা নদীর উপর চোখ মেলিয়া রাখে, কার নৌকা কত সকালে আসিয়া ভিড়ে। যারা যত সকালে ভাসিবে তারা তত সকালে খাইবে। এবং সকলে যত সকালে আসিয়া খাওয়া শেষ করিবে, গ্রামের নগর-কীর্তনও তত সকালে আরম্ভ হইবে। সারাটা গ্রাম ঘুরিয়া কীর্তন করার জন্য সকলের আগে বাহির হয় মালোপাড়ার দল। সাহাপাড়া আর যোগীপাড়া হইতেও দেখাদেখি দল বাহির হয়। কিন্তু মালোদের মত কীর্তনে অত জৌলুস হয় না। তারা কীর্তন করে ঝিমাইয়া আর মালোর করে নাচিয়া কুঁদিয়া লাফাইয়া ঝাঁপাইয়া। তাই কদমা বাতাসাও ধরিতে পারে তারাই বেশি। সে যে কি আনন্দের! সে সময় পুরুষেরা কীর্তন করিয়া বাড়ি বাড়ি লুট ধরিতে যায় আর মেয়ের ঘরে বসিয়া নানা উপকরণের পঞ্চান্ন-ব্যঞ্জন রান্না করে।
ঘরে ঘরে এত প্রাচুর্যের দিনে রামকেশবের বাড়িতে খাইতে আসিবে কে।
তবু তার সাধ দুর্বার হইয়া উঠিল। সে স্থির করিল রাধামাধবের বাড়িতে একটা ‘সিধা’ দিবে আর খাইতে নিমন্ত্রণ করিবে যাত্রাবাড়ির রামপ্রসাদ জামাইকে, বাড়ির পাশের মঙ্গলা আর তার ছেলে মোহনকে আর সুবলার শ্বশুরবাড়ির সব কয়জনকে। আরো একজনের কথা তার মনে জাগে, সে গ্রামের নূতন বাসিন্দা, অনন্তর মা। তার ছেলেটাকে বড় আদর করিতে ইচ্ছা করে। সে কি আসিবে। কালোর-মা হয়ত এতক্ষণে তাকে নিমন্ত্রণ করিয়া বসিয়াছে। সে বাড়িতে খাইবেও অনেক ভাল।
নিমন্ত্রণ পাইয়া সুবলার শাশুড়ী মায়ে-ঝিয়ে অনেক চাউলের গুঁড়ি কুটিয়া রামকেশবের বাড়ি দিয়া আসিল। নিজেদের জন্য আগে যত গুঁড়ি কুটিয়া রাখিয়াছিল তাহাও পাঠাইয়া দিল। এবারের পরব তাদের বাড়িতে না হইয়া ঐ বাড়িতেই হোক।
রামকেশব যে সাধ মুখ ফুটিয়া প্রকাশ করারও সাহস পায় নাই, সে সাধ পূর্ণ করিল সুবলার বৌ। গুঁড়ি গোলার প্রাথমিক কাজ মায়ে-ঝিয়ে শেষ করিয়া সন্ধ্যা সময়ে সে গিয়া অনন্তর মাকে ধরিয়া বসিল, ‘পিঠা বানাইতে হইব দিদি, চল।‘
‘কই?’
‘ঐ বাড়তি্ যে বাড়তি্ একটা পাগলা থাকে।‘
অনন্তর মার বুকটা ছাঁৎ করিয়া উঠিল, ‘ন না ভইন, অচিনা মানুষ তারা। কোনদিন তারাও কিছু কয় নাই, আমিও যাই নাই। আমি দিদি যাইতে পারি না।’
‘দিদি, তুমি মনে কইরা দেখ, আমিও অচিন আছ্লাম, চিনা হইলাম। মানুষের কুটুম আসা-যাওয়ায় আর গরুর কুটুম লেহনে-পুছনে। তুমি দিদি, না কইর না। বুড়া মানুষ। কোন দিন মইরা যায়। তার মনে সাধ হইছে, লোকসেবা করাইব। এই পরবের দিনে লোক পাইব কই? এক লোক পাওয়া গেছে মন্দিরের রাধামাধবেরে, আর লোক পাওয়া গেছে আমার বাপেরে আর বড় মাত্বরেরে। আরেক লোক তোমার অনন্ত। তুমি-আমি কেবল পিঠা বানানোর লাগি, বুঝ্ছ নি।‘
অনন্তর মাকে কিছু বলার অবকাশ না দিয়া সে অনন্তকে লইয়া রামকেশবের রান্নাঘরে ঢুকিল এবং প্রথম খোলার প্রথম পিঠাখানা রাধামাধবের জন্য তুলিয়া রাখিয়া পরের পিঠাখানা অনন্তর হাতে দিল, তাকে চৌকিতে বসাইয়া, খোলা হইতে পিঠা তুলিবার ফাঁকে ফাঁকে তার খাওয়া দেখিতে লাগিল।
অনন্তর মা ঘরে সন্ধ্যাদীপ জ্বালাইয়া একটু পরেই সে দীপ নিভাক্টল, এবং দরজা বন্ধ করিয়া নিমন্ত্রণ-বাড়িতে গিয়া চুকিল। অনন্ত তখন মুবলার বৌর ঠিক পাশটিতে বসিয়া মনোরম ভঙ্গিতে পিঠা খাইতেছে।
স্বামীপুত্রকে নদীতে পাঠাইয়া একটু পরে মঙ্গলার বৌও আসিয়া তাহদের সঙ্গে মিলিত হইল। অতঃপর তিনজনে মিলিয়া খুব তোড়ের সহিত পিঠা বানাইতে লাগিল। এক বুড়ি কিশোরের মা আরেক বুড়ি সুবলার শাশুড়ী তাদের সঙ্গে কিছুতেই আঁটিয়া উঠিতে না পারিয়া কাজে ভুল করিতে লাগিল। রাত আরেকটু অধিক হইতে দুই বুড়িষ্ট ঢুলিতেছে দেখিয়া তিনজনেই তাহাদিগকে ছুটি দিলে, তার মাঝঘরে গিয়া ঘুমাইয়া পড়িল। অনন্তও হইল তাদের শয্যার সঙ্গী। তখন তিনজনেই রহিল সমান সমান। তারা এমনভাবে কাজ করিয়া চলিল যে, যেন এ রাতের জন্য তারাই এ বাড়ির মালিক।
পাগলটার রাতে ঘুম নাই। আজ রাতে আবার পাগলামি বাড়িয়াছে। একটু আগে এ ঘরের মহিলাদিগকে অকারণে দেখিয়া গিয়াছে। তারপর বারান্দায় বসিয়া গান করিয়াছে, প্রলাপ বকিয়াছে এবং দা দিয়া মাটি কোপাইয়াছে। এত করিয়াও তৃপ্ত না হইয়া আবার মহিলাদের ঘরের দিকে আসিতেছে দেখিয়া মঙ্গলার বৌ দরজা বন্ধ করিয়া দিল। বন্ধ দুয়ার দেখিয়া সে আর দাঁড়াইল না, বারান্দায় গিয়া চুপ করিয়া বসিয়া রহিল।
মঙ্গলার বৌয়ের সহসা নিশি রাতে গল্প শুনিবার সাধ হইল। অনন্তর মাকে ধরিয়া বসিল, ‘একখান পরস্তাব কও ভইন। নতুন দেশের নতুন মানুষ তুমি। অনেক নতুন পরস্তাব তুমি শুনাইতে পারবা।’
অনন্তর মা একটু ভাবিয়া দেখিল; তার নিজের জীবনে এত বেশি ‘পরস্তাব’ জমিয়া আছে, আর সে ‘পরস্তাব’ এত বিচিত্র যে, ইহা ফেলিয়া কানে-শোনা ‘পরস্তাব’ না বাধিবে দানা, না লাগিবে ভাল, না পরিবে দরদ দিয়া বলিতে। তার নিজের জীবনের বিরাট কাহিনীর নিকট আর যত সব কাহিনী তো নিতান্ত তুচ্ছ। কিন্তু এ কাহিনী তো এখানে বলিবার নয়। শুধু এখানে কেন, কোনোখানেই বলিবার নয়। এ কাহিনী নিজে যেমন কুলকিনারাহীন, এর ভবিষ্যৎও তেমনি কুলকিনারাহীন। এ কাহিনী সহজে কাউকে খুলিয়া বলা যায় না, কিন্তু গোপন করিয়া সহিয়া থাকিতে অসীম ধৈর্য, কঠোর আত্মসংযম লাগে। তাকে না বলিয়া মনের গোপনে লুকাইয়া রাখার জন্য মনের উপর অনেক বল প্রয়োগ করিতে হয়। তবু মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিয়া রাখিয়াছে, যদি কোন দিন চূড়ান্ত সময় আসে সেদিন বলিবে, তার আগে বুক যতই মুচড়াইয়া দুমড়াইয়া ভাঙ্গিয়া চুরিয়া থাক সেখানেই উহাকে সযত্নে সংগোপনে লুকাইয়া রাখিবে।
তার অন্যমনস্কতাকে নির্মমভাবে আঘাত দিল মঙ্গলার বৌ ‘কি গ বিন্দাবনের নারী, কোন কালোচোরা লড়দা গেছে মাইরা বাঁশির বাড়ি। পরস্তাব শুনাইবা ত শুনাও ভইন। ভাল লাগে না। না জানলে না কর, জানলে কও।‘
কড়ার টগবগে তেলে হাত দিয়া গোলা ছাড়িতে ছাড়িতে অনন্তর মা বলিল, ‘আমি একখান পরস্তাব জানি, এক মাইয়ারে দেইখ্যা এক পুরুষ কেমুন কইরা পাগল হইল, কয় এরে বিয়া করুম?’
‘বিয়া করল?’
একটু ভাবিয়া অনন্তর মা বলিল, ‘করল?’
‘তার পর কি হইল?’
‘তারপর আর মনে নাই।’
‘কপাল আমার। এই বুঝি তোমার পরস্তাব। কেবল একজন পুরুষ কি কইল, সংসারের সব পুরুষইত মাইয়া দেইখ্যা পাগল হয়, বিয়া না কইরা ছাড়ে না। কিন্তু বিয়া করার পরে কি হয় সেই খানইত আসল কথা। তুমি ভইন আসল কথাই শুনাইলা না, চাইপ্যা গেল।
‘জানি না দিদি, জানলে কইতাম।‘
এইবার কথা কহিল সুবলার বৌ। অনন্তর মার কথায় সে চমকাইয়া উঠিয়াছিল। এ মেয়ে একথা জানে কি করিয়া। কথার পিঠে সে কথা দিল, ‘আমি জানি ঐ মাইয়া-পাগল কি কইরা সত্যের পাগল হইয়া গেল, আর তার বন্ধু কি কইরা মারা গেল। কিন্তুক কমুনা।‘
সুবলার বউ একটু থামিয়া আবার বলিতে লাগিল—
পাগল আর বন্ধু যখন ছোট ছিল একজনের মা তখন তাদের দুজনকেই খুব ভালবাসিত। একজন তখন ন’দশ বছরের মেয়ে। মাঘমণ্ডলের দিনে দুষ্ট বন্ধু তার চৌয়ারি বানাইয়া দিয়াছিল। সেইদিন মা ঠিক করিয়া রাখিল দুইজনের যে-কোন জনকে মেয়ে সঁপিয়া দিবে। শেষে স্থির করিল বড়জনই বেশি ভাল, তাকেই মেয়ে দিবে। সে যেদিন পাগল হইয়া ফিরিয়া আসিল সেদিন মত গেল বদলাইয়া। মেয়ের বাপ তখন পাগলের বাপকে খালি এড়াইয়া চলিতে চায়। পাগলের বাপ ডাকিয়া বলে, তুমি আমাকে এড়াইয়া চল কেন। বাজারে যাইতে আমার উঠান দিয়া না গিয়া রামগতির উঠান দিয়া ঘুরিয়া যাও কেন। আমি কি জানি না, আমার কপাল ভাঙ্গিয়াছে। পাগলের নিকট বিয়া দিতে আমি কেন তোমাকে বলিব। তারপর একদিন ঢোলঢাক বাজাইয়া মেয়ের বিয়া হইয়া গেল। কার সঙ্গে হইল জানি, কিন্তু বলিব না।
—আরও জানি। বিয়ার পর বন্ধু গেল জিয়লের ক্ষেপ দিতে। বড় নদীতে একদিন রাত্রিকালে তুফান উঠিল। নৌকা সাঁ সাঁ করিয়া ছুটিয়াছে, মানাইতে পারে না। মালিকেরা চতুর মানুষ। তারা নিজে কিছু না করিয়া, যাকে জন খাটাইতে নিয়াছে বিপদ আপদের কাজগুলি সব তাকে দিয়াই করায়। নৌকা তীরে ধাক্কা খাইয়া চৌচির হইবে। তার আগেই ত নৌকার পাঁচজনে তীরে ঝাঁপাইয়া পড়িয়া হাত দিয়া, কাঁধ লাগাইয়া পিঠ ঠেকাইয়া নৌকার গতিরোধ করিবে। এই ঠিক করিয়া সকলে নামিবার জন্য প্রস্তুত হইল। কিন্তু কার্যকালে শুধু এক ঐ বন্ধু নামিল, আর কেউ নামিল না। তারা বিশ্বাসঘাতকতা করিল। শেষে ঐ বন্ধু নৌকার ধাক্কায় চিত হইয়া পড়িয়া গেল। এক সে। না পড়িয়া উপায় আছে। নৌকা তার বুকখানা মথিয়া পিণ্ড করিয়া দিল। আর সে-নৌকা কার-নৌকা সবই জানি। কিন্তু বলিব না।
‘জান যদি, তবে কইবা না কেনে? ‘
‘চোখে জল আইয়া পড়ে দিদি। কইতে পারি না।’
‘একজনের কথা যে কইল, সে মাইয়া কে?’
‘তার নাম বাসন্তী। সে অখন নাই। মারা গেছে?’
আবহাওয়া বড় করুণ ও ভারাক্রান্ত হইয়া উঠিল। মঙ্গলার বে এই রকম আবহাওয়া সহিতে পারে না। হালকা করিবার জন্য কথা খুঁজিতে খুঁজিতে সহসা বলিয়া উঠিল—
‘আমিও জানি?’
মঙ্গলার বৌ বিজ্ঞের ভঙ্গিতে কথাটা বলিয়া খোলার একখানা পিঠার প্রতি এমন মনোযোগ দিল যেন তুই জনে পায়ে ধরিয়া সাধিলেও যা জানে তা খুলিয়া বলিবে না।
মঙ্গলার বৌর রসাল গল্পটা স্থরু না হইতেই আবহাওয়া আবার থমথমে হইয়া পড়িল। আজ দুইটি নারীর মনের কোথায় যে কাঁটা বিঁধিতেছে কে বলিবে। পাগল চুপ করিয়া আছে দেখিয়া তাদের মন আরো বেশি দোলা খাইতে লাগিল। হয়ত সে ভাবিতেছে। কি ভাবিতেছে। সে যে ভাবিতে পারিতেছে ইহা কল্পনা করিয়া তাদের বুকে কোন্ সুদূরের ঢেউ আসিয়া আছড়াইয়া পড়িতেছে।
অনন্তর মার মন উদাম হইয়া উঠিল, ‘কও না গো ভইন, তোমার কথাখান বিস্তারিৎ কইরা, শুনি, পরাণ সার্থক করি।’ কিন্তু মুখের শ্লেষে বুকের বেদন ঢাকা পড়ে না। যে-কাহিনীর বিয়োগান্তিকা নায়িকা সে নিজে, সখীর সে কাহিনী আগাগোড়া জানা আছে কিন্তু যাকে নিয়া এত হইল সেই যে শ্রোতা, একথা সে জানে না, এর চাইতে আর বিচিত্র কি হইতে পারে।
অনন্তর মার নির্বন্ধাতিশয্যে সুবলার বৌ প্রবাস-খণ্ডে কিশোরের পত্নীলাভ এবং পত্বি-অভাবে পাগল হওয়ার বিবরণ বর্ণনা করিয়া কহিল, ‘কন্যা, এই বর্তের নি এই কথা।‘
অনন্তর মা অশ্রু গোপন করিয়া বলিল, ‘হ।‘
‘তবে ঘটে দেও বেলপাতা।‘
তার পরের যেটুকু অনন্তর মার জানা ছিল না, সে কাহিনী আরও করুণ। কিশোরকে বঞ্চিত করিয়া বাসন্তীর কি ভাবে বিবাহ হইল এবং সুবল কি করিয়া মারা গেল।
সুবলার বউ ঘটনা কয়টি আর একবার বলিল—
তারপর পাগল তো বাড়ি আসিল। বাপ মনে করিয়াছিল আনিবে টাকা, সেই টাকায় বাসন্তীরে আনিব ঘরে। কিন্তু তার বাড়াভাতে পড়িল ছাই। সে আসিল পাগল হইয়া।
বাসন্তীর বাপ দীননাথ। সে এখন রামকেশবকে এড়াইয়া চলে। আগে তুই জনে ভাব ছিল। পরে বাসন্তীকে কিশোরের সঙ্গে বিবাহ দিবার কানাযুষ যখন চলিতে লাগিল, ভাবট তখন খুবই বাড়িয়াছিল। এখন দীননাথ এ বাড়ির উঠানও মাড়ায় না। ঘাটে দেখা হইলে পাছে কিছু জিজ্ঞাসা করে এই ভয়ে সে পাশ কাটাইয়া যায়।
একদিন কিন্তু কিছুতেই পাশ কাটাইতে পারিল না। রামকেশব তাহাকে হাত ধরিয়া শুনাইয়া দিল, ‘আসমানে চান্দ উঠলে পর লোকে জানে। আমার কিশোর পাগল হইছে বেবাক লোকেই জানে। আমি কি আর ঘুর-চাপ দিয়া রাখছি?’
দীননাথ চুপ করিয়া থাকে।
‘আমি কি মাথার কিরা দিয়া কই যে, বাসন্তীরে আমার পাগলের সাথে বিয়া দেও।’
‘কি যে তুমি কও দাদা। সেই কথা তুমি কি কইতে পার। তোমারে আমরা চিনি না?’
‘তবে এমন এড়াইয়া বেড়াইয়া চল কেনে ভাই।’
‘এড়াইয়া চলি, তোমার কষ্ট দেইখ্যা বুক কান্দে, তাই।’
‘আমার কষ্ট নিয়া আমি আছি। তার জন্যে তোমরা কেনে কান্দ?’
দীননাথের বুক বেদনায় টনটন করিয়া উঠে! একমাত্র ছেলে। পাগল হইয়া গিয়াছে। ঘর তুয়ার ভাঙ্গে। জিনিসপত্ৰ লণ্ডভণ্ড করে। গলা ফাটাইয়া কাঁদে। বুড়া তাকে নিয়া কি বিপদেই পড়িয়াছে। একে শেষ বয়স। তার উপর এই দাগ। এই কয়মাসে তাকে দ্বিগুণ বুড়া বানাইয়াছে। আর বুড়ি। তার দিকে আর চাওয়াই যায় না। অনেক কান্না জমাট বাঁধিয়া তাকে বোবা বানাইয়াছে। ইহাদিগকে সান্তনা দিবার চেষ্টা করা অপেক্ষ ইহাদিগকে এড়াইয়া চলা অনেক সহজ।
‘বাসন্তীর বিয়া কোনখানে ঠিক কর্লা?’
দীননাথ অপরাধীর মত বলে, ‘আমি ত চুপ কইরা আছিলাম। গোলমাল লাগাইয়াছে আমার পরিবার। কয়, সুবল খুব ভাল পাত্র। তারেই ডাক দিয়া বাসন্তীরে পার কর।‘
একদিন সুবলের সঙ্গে বাসন্তীর বিবাহ হইয়া গেল। সেই এক রাত। আকাশে চাঁদ আছে তারা আছে। দীননাথের উঠানে কলাগাছের তলায় বাসন্তীকে সুবল হাতে হাত দিয়া বউ করিতেছে। মেয়ের গীত গাহিতেছে হুলুধ্বনি দিতেছে। জোরে জোরে বাজনা বাজিতেছে। এত জোরে বাজিতেছে যেন রামকেশবের কানের পর্দা ছিঁড়িয়া যাইবে। একটা টিমটিমে আলোর সামনে রামকেশব তামাক টানিতেছে। হুকার শব্দে বাজনার শব্দ ঢাকিবার বৃথা চেষ্টা করিতেছে। তার পাশে বুড়ি বসিয়া বসিয়া ঝিমাইতেছে। গভীরভাবে কিছু বুঝিবার মত বোধশক্তি তার আর অবশিষ্ট নাই। আর বোধশক্তি নাই পাগলটার। সে অর্থহীন ভাবে একটা পুরোনো জাল টানিয়া ছিঁড়িতেছে।
অনেক রাত অবধি সে বাজনা চলিল। তারপর এক সময় উহাও নিস্তব্ধ হইয়া গেল। তখন বুঝি বিবাহবাড়ির সকলেই ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। কিন্তু বুড়াবুড়ির চোখে সে রাতে আর ঘুম আসিল না।
তারপর একটি দুইটি করিয়া পাঁচটি বছর গত হইল। এই পাঁচ বছরে অনেক কিছুই ঘটিয়াছে। যেমন তিলক মারা গিয়াছে। কিন্তু কে মনে রাখিয়াছে!
তবে একটি ঘটনা মালোপাড়ার অনেকেই মনে রাখিয়াছে। সে হইতেছে সুবলের মৃত্যু। বড় মর্মান্তিকভাবে মরিয়াছে সুবল। কালোবরণের বড় নৌকায় করিয়া জিয়লের ক্ষেপ দিতে গিয়াছিল। সুবল বলিয়াছিল আমাকে ভাগীদার হিসাবে নেও। তারা বলিয়াছিল নৌকা আমাদের পুজি আমাদের। ভাগীদার হিসাবে নিব কেন? মাসিক বেতনে নিব। শুনিয়া সুবলের বৌ বলিয়াছিল, তবে গিয়া কাম নাই। কিন্তু বিবাহ করিয়াছে, লোকজন খাওয়াইয়াছে। হাতের টাকাকড়ি খরচ হইয়া গিয়াছে। সামনে তুরন্ত আষাঢ় মাস। এই দুঃসময়ে সে নিজে কি খাইবে বৌকে কি খাওয়াইবে! কাজেই বেতনধারী হইয়া না গিয়াই বা সে কি করে!
এখন, লোক যদি হয় বেতনধারী, পুঁজিদার হয় তার মালিক, তাকে সেই মালিক তখন চাকরের মত জ্ঞান করে!
মেঘনা নদীর মাঝখান দিয়া কালোবরণ বেপারির নৌকা চলিতেছিল। এমন সময় আসিল তুফান। ঈশান কোণের বাতাস নৌকাটাকে ঝাটাইয়া তীরের দিকে নিয়া চলিল। সকলে প্রস্তুত হইল তীরে ধাক্কা লাগিবার আগেই তারা লাফাইয়া নামিয়া পড়িবে এবং একযোগে ঠেলিয়া নৌকার গতিবেগ কমাইয়া আসন্ন তুর্ঘটনা নিবারণ করিবে। আগে সুবলের উপর আদেশ হইল, শীঘ্র লগি হাতে লাফাইয়া তীরে গিয়া পড়, পড়িয়া, লগি ঠেকাইয়া নৌকাটাকে বাঁচা। তোর সঙ্গে আমরাও লাফ দিতেছি। বেতনধারী লোকের মনে মুনিবের প্রতি প্রবল একটা বাধ্যবাধকতাবোধ থাকে। তাই সুবল ফলাফল না ভাবিয়া মালিকের আদেশমত লাফাইয়া তীরে নামিল কিন্তু আর কেউ ভয়ে নামিল না। সুবল লগিটার গোড়াটা নৌকার তলার দিকে ছুড়িয়া, মাঝখানটাতে কাঁধ লাগাইতে গেল, তাহাতে নৌকার বেগ যদি একটু কমে। বেগ কমিল না। ঢালু তীর। সবেগে নৌকা তীরে উঠিয়া আসিল। সুবল নৌকার তলায় চাপ৷ পড়িল, আর উঠিল না।
বাসন্তীর হাতের শাখা ভাঙ্গিল, কপালের সিঁদুর মুছিল। কিন্তু জাগিয়া রহিল একটা অব্যক্ত ক্রোধ।
চারি পাঁচ বছরে সে অনেক কিছু ভুলিয়াছে। স্বামীর জন্য আর তার কষ্ট হয় না। স্বামী বড় নিদারুণ মৃত্যু মরিয়াছে। একথা মাঝে মাঝে মনে হয়। কল্পনা করিতে চেষ্টা করে একটা মনিবের অসঙ্গত আদেশ আর একটা নিরুপায় ভূত্যের তাহা পালনের জন্য মৃত্যুর মুখে বাপাইয় পড়ার দৃশ্যটা।
একটা পড়ার পুঁথির মত পাগলের মনের উপর দিয়া তার পাগলামির ইতিহাসখানা পাতার পর পাতা উল্টাইয়া গেল। পূর্বস্মৃতি হয়ত তাকে খানিকক্ষণের জন্য আত্মস্থ করিয়া দিল, সে নিজের দিকে, জগতের দিকে তাকাইবার সহজাত ক্ষমতা ফিরিয়া পাইল। না, হয়ত পাইল না। দুইটি নারী তার রান্নাঘরে পিঠা বানাইতেছে। দুইটির সহিতই তার জীবনের সম্পর্ক সুগভীর। ইহাদিগকে কাছে পাইয়া হয়ত ক্ষণকালের জন্য তার বুক ভরিয়া উঠিয়াছে। হয়ত ভরিয়া উঠে নাই। পাগলের মনের হদিস পাওয়া স্বাভাবিক মানুষের কাজ নয়। তবু মনে হয়, দুটি নারীর এতখানি কাছে অবস্থান তার মনে আলোড়ন জাগাইয়া থাকিবে, তাহা না হইলে, হাঁড়িখুড়ি না ভাঙ্গিয়া, জাল দড়ি না ছিঁড়িয়া ভাল মানুষের মত সে স্থির হইয়া বসিয়া কাঁদিবে কেন?
এ ঘরে সুবলার বউ কাহিনী শেষ করিয়া আনিয়াছে। আর এ ঘর হইতেই শোনা যাইতেছে বারান্দাতে পাগল ফোঁপাইতেছে তার শব্দ। অনন্তর মা অনেক করিয়াও মনের বেদন চাপিতে পারিতেছে না। বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়া উঠিতেছে। বুঝি এখনই কান্নায় ফাটিয়া পড়িবে। কিন্তু সব কিছু চাপিতে চাপিতে এমনই অভ্যাস হইয়া গিয়াছে যে, মনের জোরে সে পাথরের মতই শক্ত হইয়া যাইতে পারে।
কেরোসিনের আলোতে তার পাণ্ডুর মুখের দিকে চাহিয়া সুবলার বৌ শিহরিয়া উঠিল। নিশীথ রাত্রির স্তব্ধতার মাঝে মুখখান একেবারে অপার্থিব আকার ধারণ করিয়াছে। ক্ষণেকের জন্য তার মনে একটা সন্দেহ উঁকি দিয়া গেল, এ কি সেই, নয়া গাঙ্গের বুকে যাহাকে ডাকাতে লইয়া গিয়াছিল!
দিনের আলোতে যাকে সত্য ও বাস্তব মনে করা যাইত, রাতের গহনে তাকেই অবাস্তব রহস্তে রূপায়িত করিয়া দেয়। সুবলার বৌর বাস্তববুদ্ধি লোপ পাইল। নিশার গহনত তার কল্পনার দূরত্বকে অস্পষ্ট করিয়া দিল। তার মনে হইল, হাঁ সে-ই। তবে রক্তমাংসের মানুষ সে নয়। তার প্রেতাত্মা।
মঙ্গলার-বৌ কাছে না থাকিলে সুবলার বৌ চিৎকার করিয়া উঠিত।
মঙ্গলার বৌ তার ভাবান্তর লক্ষ্য করিয়া মনে করিল, ছেমড়ির ঘুম পাইয়াছে। বলিল, ‘যা লা সুবলার বৌ, অনন্তর পাশে গিয়া শুইয়া থাক?’
শুইয়া, ঘুমন্ত অনন্তকে বুকে চাপিয়া ধরিয়া সুবলার বৌ বুঝিতে পারিল এতক্ষণে সে বাস্তবের মৃত্তিক-স্পর্শ পাইয়াছে।