কৃষ্ণনগর শহরের রাস্তা দিয়ে জোরে জোরে হাঁটছে সূর্য। অনেক রাত হয়ে গেছে। রাস্তায় মানুষজন খুব কম, এক-আধটা পানের দোকানের সামনে অলস লোকের জটলা দেখা যায়। তাদের দেখলেই সূর্য এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করছে, সার্কিট হাউসটা কোথায়?!
লোকেরা হাত তুলে রাস্তা নির্দেশ করে, তবু সূর্যর দিকভ্রম হয়। কিছুদূর গিয়ে আবার কারোকে জিজ্ঞেস করলে, সে সম্পূর্ণ উলটো দিক দেখায়। কিছুক্ষণ বাদে সূর্য একটা সাইকেল রিকশা পেয়ে গেল। রিকশাওয়ালা এত রাত্রে ভাড়া যেতে চায় না, তাকে অনুনয়বিনয় করতে লাগল, মোড়ের মাথা থেকে দু’-চার জন লোক সেই কথা শুনে আকৃষ্ট হয়ে এসে তারাও রিকশাওয়ালাকে বলল, আরে ভাই নিয়ে যাও না, উনি বলছেন। যখন বিশেষ দরকার–।
বিশাল মাঠের মধ্যে সার্কিট হাউস, বেশ খানিকটা দূরে গেট। এখন সেই গেট বন্ধ, সেখানে পাহারা দিচ্ছে শান্ত্রী। সে সাইকেল রিকশাকে কিছুতেই গেট দিয়ে ঢুকতে দেবে না। সেখানে একটা বচসা বেধে গেল। সার্কিট হাউসের বাইরের সিঁড়িতে বসে থাকা দু’জন সেপাইও ছুটে এল সেদিকে।
সারাদিন বহু স্মারকলিপি, বিক্ষুব্ধ কর্মীদের সঙ্গে আলোচনা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য কমিটি স্থাপন এবং দুটি জনসভা সেরে মন্ত্রী শংকর বসু খুব ক্লান্ত হয়ে এই একটু। আগে ঘুমিয়েছেন। মাথার কাছে এক কাপ দুধ ঢাকা রয়েছে, ভোরবেলা উঠে তিনি ঠান্ডা দুধ খান। ঘুমের মধ্যেও চিন্তাক্লিষ্ট তার মুখভঙ্গি।
দীপ্তি জেগেই ছিলেন। ঘুম আসছিল না কিছুতেই, তিনি যেন উৎকর্ণ হয়ে ছিলেন কিছুর অপেক্ষায়। তার হৃৎস্পন্দন এখন দ্রুত, হাতের তালুতে জ্বালা জ্বালা করছে। দীপ্তি ঘুমন্ত স্বামীর পাশ থেকে উঠে পড়লেন। একটা পাতলা শাল জড়িয়ে নিয়ে বসবার ঘর পেরিয়ে এসে দাঁড়ালেন বারান্দায়।
সামনের বাগানে ফুটে আছে একঝাড় চন্দ্রমল্লিকা। বিরাট বিরাট আকাশিরা গাছগুলির চিকন পাতায় হাওয়ার সরসর শব্দ শোনা যায়। পাতলা জ্যোৎস্না ছড়িয়ে আছে। চরাচরে। সেই জ্যোৎস্না পড়েছে দীপ্তির মুখে। তার মুখোনি বিবর্ণ।
দীপ্তি তাকালেন গেটের দিকে। ওখানে কী হচ্ছে তিনি খুব ভালো ভাবেই জানেন। তবু তিনি অনুচ্চ কণ্ঠে বললেন, রামরতন, কী হয়েছে? ওখানে গোলমাল হচ্ছে কেন?
রামরতন এসে জানাল যে সাইকেল রিকশা চেপে একজন আদমি এত রাত্রে ভেতরে ঢুকতে চাইছে। সে বলছে, সাহেবের সঙ্গে তার জরুরি দরকার। বোধহয় মাতোয়ালা টাতোয়ালা হবে।
দীপ্তি বললেন, এখন দেখা হবে না, ওকে চলে যেতে বলো।
দূর থেকে সূর্য ডেকে উঠল, দীপ্তিদি—
দীপ্তি আবার বললেন, ওকে চলে যেতে বলল। বলল, কাল সকালে আসতে–
এইকথা বলার পর দীপ্তির মুখখানা কুঁকড়ে গেল। চোখ বুজে রইলেন কয়েক মুহূর্ত। তারপর আবার চোখ খুলে দেখলেন, রামরতন এগিয়ে যাচ্ছে গেটের দিকে। তিনি বললেন, না, না, রামরতন, তাড়িয়ে দিয়ো না, ওকে ভেতরে আসতে দাও।
গেট খোলা পেয়ে সূর্য সাইকেল রিকশা থেকে নেমে প্রায় দৌড়ে চলে এল বারান্দার কাছে। তারপর উত্তেজিত অভিযোগের সুরে বলল, তুমি আমাকে ভেতরে ঢুকতে দিতে বারণ করেছিলে?
সেই উত্তেজনা দীপ্তিকে স্পর্শ করল না। তিনি নিষ্প্রাণ গলায় জিজ্ঞেস করলেন, সূর্য, তুমি কেন এসেছ?
জ্যোৎস্নায় দীপ্তির হালকা ছায়া পড়েছে সিঁড়িতে। সূর্য সেই ছায়াতে দাঁড়িয়ে। তার দীর্ঘ শরীর দীপ্তির চোখের সামনে থেকে দূরের বাগানটা আড়াল করে দেয়।
সূর্য বলল, আমি থাকতে পারলাম না। ট্রেন খুব লেট ছিল, তাই আমার এত দেরি হল।
দীপ্তি দেখলেন রামরতন অদূরে দাঁড়িয়ে, তার সন্দেহ মেটেনি, সে সরু চোখে দেখছে। সূর্যকে। দীপ্তি অত্যন্ত সংকুচিত বোধ করলেন। চাকরবাকর-দেহরক্ষী-পাহারাদার এরা তার সম্পর্কে কী ভাবছে কে জানে। তিনি আড়ষ্ট ভাবে বললেন, ওঁর সঙ্গে যদি তোমার দরকার থাকে–উনি তো রাত্রে আর উঠবেন না, সকালবেলা আসতে পারো কিংবা বসবার ঘরের সোফায় যদি রাতটা কাটাতে চাও…
তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে।
আমি এখন শুতে যাব।
এক্ষুনি? একটু দাঁড়াও–
দীপ্তি অন্য দিকে তাকিয়ে বললেন, ঠিক আছে রামরতন, তুমি শুতে যাও–। তিনি সেদিকেই কিছুক্ষণ চেয়ে রামরতনের চলে যাওয়া দেখলেন, তারপর মুখ ফিরিয়ে অত্যন্ত ম্লান গলায় বললেন, সূর্য, তুমি আমার দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখো। আমি একটা সামান্য মেয়ে। আমার কিছুই নেই। আমার মনের জোর ছিল না, আমি মাথা ঠিক রাখতে পারিনি, আমি হেরে গেছি। আমি একেবারেই হেরে গেছি। তুমি আমার ওপর রাগ করতে পারো, আমাকে ঘেন্নাও করতে পারো, কিন্তু তুমি নিজেকে নষ্ট কোরো না। তোমার শক্তি আছে, তুমি এখনও অনেক কিছু পারবে।
সূর্য বলল, সুন্দর জ্যোৎস্না উঠেছে, চলো ওই মাঠের মধ্যে একটু বেড়িয়ে আসি।
তা হয় না।
কেন? তুমি তোমার স্বামীকে ভয় পাও?
ওর সঙ্গে আমার ভয়ের সম্পর্ক নয়!
তা হলে?
তুমি কিছুই বুঝতে পারো না! তুমি কি ভাবো, তুমি যা চাও, তাই হবে? তোমার ভালোর জন্যই আমি তোমাকে চলে যেতে বলছি।
তুমি আমার ভালো চেয়ে চেয়েই আমার সর্বনাশ করেছ।
কী বললে?
কত দিন তোমাকে দেখিনি, কত দিন যে তোমার আঙুলগুলোতে চুমু খাইনি।
দীপ্তি দু’কানে হাত চাপা দিলেন। তার সারা মুখটা কাঁপছে। অতি কষ্টে কান্না সামলে তিনি বললেন, ছিঃ, ওসব বোলো না! কেন আমাকে কষ্ট দিতে চাও? আমি খুবই সাধারণ একটা মেয়ে। তুমি যাও–
সূর্য এগিয়ে এসে দীপ্তির একখানা হাত শক্ত করে চেপে ধরে বলল, আমি কোথাও যাব না। এবার আমাকে অত সহজে তাড়াতে পারবে না।
দীপ্তি ত্রাসের সঙ্গে চাপা গলায় বললেন, ছাড়ো আমাকে, শিগগির ছাড়ো!
আমি তোমাকে এক্ষুনি নিয়ে চলে যাব।
এ ভাবে তুমিও বাঁচতে পারবে না, আমিও বাঁচতে পারব না!
দীপ্তিদি, আমার কোথাও আর যাবার জায়গা নেই। আমি তো তোমার কাছ থেকে অনেক দূরেই চলে গিয়েছিলাম। কোনও জায়গায় আমি শান্তি পাইনি। সবাই আমাকে ছেড়ে চলে যায়। আমার জীবনটা কি এই রকম ভাবে নষ্ট হবে? তোমার কথা চিন্তা করলেই একমাত্র আনন্দ পাই, আমার আবার ভালো ভাবে বাঁচতে ইচ্ছে করে তোমাকে পেলে আবার আমি অনেক কাজ করতে পারব, সব মানুষকে ভালোবাসতে পারব।
লক্ষ্মীটি হাত ছাড়ো—
না।
তোমার পায়ে পড়ি, সূর্য, আমাকে ছেড়ে দাও। এখানে অনেক মানুষজন আছে। আমি যদি ওদের বলতাম তোমাকে ঢুকতে না দিতে?
তুমি তা পারতে?
আমি তা পারি না বলেই কি তুমি জোর করবে?
জোর করব না। তুমি আমার সঙ্গে স্বেচ্ছায় চলে এসো। এক্ষুনি। সামনেই রাস্তা খোলা আছে। আবার আমাদের নতুন জীবন শুরু হোক।
ভুল করি আর ঠিক করি, আমার বিয়ে হয়ে গেছে অন্য একজনের সঙ্গে।
এটা নকল বিয়ে। সেই যে রকম চন্দননগরে–
না, না, এটা তা নয়।
দীপ্তিদি, একটা কথা সত্যি করে বলো তো, তুমি আমাকে কোনও দিন ভালোবাসোনি? আমাকে কখনও চাওনি?
হাত ছাড়ো, বলছি–
সূর্য হাতটা ছেড়ে দিতেই দীপ্তি কয়েক পা পিছিয়ে গেলেন। জ্যোৎস্নাটা সরে গেল তার মুখ থেকে। শাড়িটা ঠিক করার জন্য তিনি আঁচল সমেত বাঁ হাতটা একবার তুললেন। সেই আবছা অন্ধকারে এক মুহূর্তের জন্য আঁচল-ছড়ানো বাঁ হাত সমেত তার সম্পূর্ণ দেহটা ভারতের মানচিত্রের মতন মনে হয় যেন। সূর্যর চোখে ধাঁধা লেগে যায়।
দীপ্তি কঁপা কাঁপা গলায় বললেন, আমি যদি সত্যি কথাটা বলি, তারপর তুমি এখান থেকে চলে যাবে বলো? কথা দাও?
আগে বলো। সত্যি কথাটা বলো–
সূর্য, তোমাকে আমি কখনও ভালোবাসিনি। তোমাকে আমি কখনওই চাইনি। আমি খুব খারাপ–
কথাটা শেষ করেই দীপ্তি দ্রুত ঢুকে যাচ্ছিলেন ভেতরে, সূর্য দৌড়ে এল সে-দিকে। ড্রয়িংরুমে ঢুকে দীপ্তি দরজাটা বন্ধ করার চেষ্টা করেও পারলেন না, সূর্য জোর করে ভেতরে ঢুকে পড়ল। দীপ্তির শরীর তখন কান্নায় দুলে দুলে উঠছে, তিনি দেওয়ালে ঠেস দিয়ে না দাঁড়ালে পড়েই যেতেন।
সূর্য তার পিঠে হাত দিয়ে শান্ত গলায় বলল, আমার চোখের দিকে তাকিয়ে ওই কথাটা আর একবার বলো–
দীপ্তি কান্না থামাতে পারলেন না। সেই অবস্থাতেই বললেন, ও এক্ষুনি জেগে উঠবে।
উঠুক।
সবই আমার দোষ। আমি তোমাকেও নষ্ট করলাম।
এখনও সবকিছু করার সময় আছে।
দীপ্তি ভেজা মুখখানা ফেরালেন। তারপর হঠাৎ শান্ত হয়ে গিয়ে বললেন, আমি মরে গেলেই সবকিছু ঠিক হয়ে যায়, তাই না?
না। এই বিয়ে ভেঙে দিয়ে এক্ষুনি যদি আমরা এখান থেকে চলে যাই, তা হলেই সব ঠিক হয়ে যেতে পারে।
বিয়ে ভাঙা যায় না। সমাজ থেকে পালিয়ে পালিয়ে কিছুতেই আমি বাঁচতে পারব না। আজ থেকে কুড়ি-তিরিশ বছর বাদে হয়তো এসবই স্বাভাবিক হয়ে যাবে, কিংবা অন্য কোনও দেশে, কিন্তু আমাদের নিয়তি অন্য রকম। আমি তোমার সঙ্গে কোথাও যাব না–এটা আমার শেষ কথা।
তা হলে আমার কথাও শুনে রাখো, আমি তোমাকে আর শংকরদাকে কিছুতেই একসঙ্গে থাকতে দেব না। আমি ত্যাগ জানি না।
সূর্য, শান্ত হও! একটু চিন্তা করে দেখো। শুধু রাগারাগি করলেই সব পাওয়া যায় না!
আমি শান্ত হতে পারছি না।
তুমি ভালো হয়ে ওঠো, তোমার এসব পাগলামি সেরে যাক। তোমার একটা সুখী জীবন দেখলে পৃথিবীতে আমার চেয়ে আর কেউ বেশি সুখী হবে না।
আমার সব সুখ তোমার কাছে জমা আছে।
সূর্য, তুমি শুধু শুধু আমাকে বেশি মূল্য দিচ্ছ। আমার যে কিছুই নেই।
তোমার কী আছে তা আমি জানি না। কিন্তু আমি তোমাকে যতটা ভালোবাসি, দশ হাজার শংকর বোসও ততটা ভালো বাসতে পারবে না। আমি তোমাকে চাই আমরা। একটা পাহাড়ের ওপর বাড়ি করে থাকব, অনেক উঁচু পাহাড়, মেঘ এসে লাগবে তোমার…
এইসময় শংকর বসুর শয়নকক্ষে খুট করে একটা শব্দ হল। দীপ্তির পিঠে তখনও সূর্যর হাত, তিনি বিদ্যুৎগতিতে সরে যেতে চাইলেন। সূর্য তবু তাঁকে সবলে ধরে রইল।
দীপ্তি আকুল ভাবে বললেন, কী করছ কী, ছাড়ো, ও জেগে উঠেছে। সূর্য কোনও কথা না বলে সেই দরজার দিকে তাকিয়ে রইল।
দীপ্তি নিচু হয়ে সূর্যর পা ছোঁয়ার চেষ্টা করে বললেন, আমায় ছেড়ে দাও, আমি তোমার কেউ না, কোনও দিনই আমি তোমার কাছে যাব না–
সূর্য চেয়েছিল, সেই মুহূর্তেই চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়ে যাক। শংকরবাবু মধ্য রাত্রে ঘুম ভেঙে এসে দেখবেন তার স্ত্রী পরপুরুষের আলিঙ্গনে। সূর্যর এজন্য কোনও লজ্জা নেই। সে শংকর বসুকে স্পষ্ট বলবে, এই নারী আমার। তুমি এই দেশ নাও, যত ইচ্ছে কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা নাও, কিন্তু এই নারীকে পাবে না। কিন্তু দীপ্তি যখন বললেন, কোনও দিনই আমি তোমার কাছে যাব না, তখন তার কণ্ঠস্বরে এমন একটা কিছু ছিল যা সূর্যকে আমূল নাড়িয়ে দেয়। তার যুক্তিহীন উত্তেজিত হৃদয়ও যেন অনুভব করতে পারে যে এরপরে আর কোনও জোর চলে না। সূর্য হঠাৎ অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়ল। সে গভীর মনোযোগের সঙ্গে দীপ্তির দিকে তাকাল আর একবার। মনে হল, এই মুখ তার অচেনা। বুক খালি করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
সূর্য দীপ্তিকে এবার ছেড়ে দিয়ে কয়েক পা এগিয়ে ডাকল, শংকরদা–
ড্রয়িং রুমের পর বিরাট ডাইনিং রুম, তার ডান দিকে শোবার ঘর। সেই ঘরের দরজা খুলে এসে দাঁড়ালেন শংকর বসু। পাজামা-পাঞ্জাবি পরেই শুয়েছিলেন, সেই অবস্থায় উঠে এসেছেন, চুল অবিন্যস্ত, এখন তাঁকে নিজের বয়সের চেয়েও বেশি বয়স্ক দেখাচ্ছে। চোখে লেগে আছে ঘুম, চিবুকের কাছে শ্রান্তি।
তিনি বললেন, কে ওখানে? সূর্য?
সূর্য উত্তর দেবার আগেই দীপ্তি তাঁর স্বামীর দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন, সূর্য হঠাৎ এসে উপস্থিত হয়েছে। তুমি ঘুমিয়ে পড়েছিলে–
শংকরবাবু মাথার চুলের মধ্যে আঙুল চালাতে চালাতে হাই তুলে বললেন, কী ব্যাপার, সূর্য? হঠাৎ চলে এলে যে?
সূর্য বলল, আমি তো বলেই ছিলাম আমি আপনাদের সঙ্গে আসব। আপনারা নিয়ে এলেন না, তাই আমি নিজেই এলাম।
এখানে তো আমাদের অনেক কাজ। তুমি এখানে কী করবে? আমরা তো আর। প্রমোদ ভ্রমণে আসিনি।
আপনার সঙ্গেও আমার অনেক কাজের কথা আছে।
সময় তো আর ফুরিয়ে যাচ্ছে না। তা বলে এখানে–
শংকরবাবু হঠাৎ হাসলেন। দীপ্তির দিকে ফিরে বললেন, সূর্য বুঝি তোমাকে খুব কষ্ট দিয়েছে? আমাকে ডাকলে না কেন?
দীপ্তি কোনও উত্তর দিলেন না।
শংকরবাবু সেই রকম হাসিমুখেই সূর্যকে বললেন, দীপ্তির সঙ্গে যদি তোমার আলাদা কিছু বলার থাকে, তুমি অনায়াসেই তা বলতে পারো, আই ডোন্ট মাইন্ড। কিন্তু এত রাত্রে, এই রকম জায়গায়–ব্যাপারটা ভালো দেখায় না–
সূর্য চুপ করে রইল।
শংকর বসু ডাইনিং রুমের একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে সূর্যকে বললেন, বোসো, এখানে এসে বোসো। দীপ্তি তুমি–
দীপ্তি ততক্ষণে ঘরের মধ্যে ঢুকে গেছেন। বাথরুমে জলের শব্দ হচ্ছে।
শংকরবাবু হাত বাড়িয়ে বললেন, দাও, একটা সিগারেট দাও। আছে?
সূর্য পকেট থেকে সিগারেট প্যাকেট বার করল। দু’জনেই ধরাল সিগারেট। শংকরবাবু থুতনিতে বাঁ হাতের তালু ঘষতে ঘষতে বললেন, সূর্য, তুমি এখন আর ছেলেমানুষটি নেই। বড় হয়ে উঠতে শেখো। ঝোঁকের মাথায় কিছু একটা তো করলেই হয় না। সবকিছুর দায়িত্ব নিতে হয়। দীপ্তিকে যে তুমি শুধু শুধু কষ্ট দিচ্ছ, এতে তোমার কী লাভ?
এসব যুক্তিতর্কের কথা। সূর্য যুক্তিতর্ক কিছুই বোঝে না। সে বকুনি খাওয়া গোঁয়ার বালকের মতোই গুম হয়ে রইল।
শংকরবাবু আবার শুরু করলেন, তোমার আর দীপ্তির মধ্যে কী হয়েছিল, আমি তা জানি। আমাকে ও সব বলেছে। স্বাধীনতার ঠিক আগে সবাই যখন ছত্রভঙ্গ, বিশেষত তোমাদের মতন যাদের কোনও পার্টি ছিল না, তাদের নিজস্ব কোনও দাঁড়াবার জায়গাও ছিল না–সেই সময় তোমরা কয়েক জন কাছাকাছি এসেছিলে। তোমার তখন বয়স কম–তাই তুমি আঁকড়ে ধরেছিলে দীপ্তিকে। দীপ্তি সত্যিই মানুষকে শান্তি দিতে পারে– শুধু ওর রূপ নয়, চরিত্রটাই অসাধারণ। তার ফলে তোমার দিক থেকে খানিকটা ইনফ্যাচুয়েশন হয়েছিল। তুমি হয়তো তাকে লাভ বলে ভেবেছিলে, কিন্তু আমি ইনফ্যাচুয়েশনই বলব। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তো এটা কেটে যাবার কথা। তুমি কি চিরশিশু হয়ে থাকতে চাইছ নাকি! তোমার মতন বয়সে আমি প্রেম-ভালোবাসা টাসার কথা চিন্তা করারই সময় পাইনি। দীপ্তিকে আমি বহুকাল ধরে চিনি–কোনও দিন অন্য রকম কিছু ভাবিনি–এখন বুঝতে পারছি, প্রেম-ভালোবাসার চেয়ে পরস্পরকে বুঝতে পারাই বড় কথা। আমরা দু’জনকে যে রকম…
সূর্য অপ্রাসঙ্গিক ভাবে বলল, শংকরদা, আগস্ট আন্দোলনের সময় আমি নিজের হাতে তিন জন মানুষকে খুন করেছিলাম। কেন করেছিলাম?
শংকরবাবু একটু চমকে গিয়ে বললেন, হঠাৎ একথা কেন?
এই মুহূর্তে আমার মনে পড়ল।
ওসব পুরনো কথা এখন একেবারে ভুলে যাও। ওসব আর মনে স্থান দিয়ো না।
আমার দোষ এই, আমি কোনও পুরনো কথাই ভুলতে পারি না। তার বদলে কি আমি কিছুই পাব না?
তোমাকে তো কত বার বললাম, একটা কোনও কাজ নিতে। আমি তো রাজিই আছি।
আমি চাকরি করব, আর আপনি মন্ত্রিত্ব করবেন?
মন্ত্রিত্বটা বুঝি খুব আরামের! নাঃ, তোমার দেখছি মাথাটা এখনও গরম হয়ে আছে।
শংকরবাবু গলা চড়িয়ে ডাকলেন, দীপ্তি!
দীপ্তি দরজার কাছে এসে দাঁড়াতে শংকরবাবু বললেন, তোমার এই আদরের ছোট ভাইটি দেখছি সব সময় রেগে টং হয়ে আছে। একে নিয়ে কী করা যায় বলো তো!
সূর্য দীপ্তির দিকে তাকিয়ে প্রায় ধমকের সুরে বলল, দীপ্তিদি, তুমি এখানে একটাও কথা বলবে না!
শংকরবাবু বললেন, আরে এ কী! সূর্য, তুমি আমার স্ত্রীকে এখনও দিদি বলে ডাকো, অথচ সম্মান দিয়ে কথা বলো না, এটা ঠিক না। ব্যবহার ট্যাবহার একটু ঠিক করো। যাক শোনো, অনেক রাত হয়েছে, এখন আর কথাবার্তা বলে লাভ নেই। এসেই যখন পড়েছ, তখন রাতটা কাটিয়ে যাও এখানে। দীপ্তি তুমি ওর একটা শোওয়ার ব্যবস্থা করে দাও উত্তরের ঘরটা বোধহয় খালি আছে।
সূর্য বলল, আমার জন্য কোনও ব্যবস্থা করার দরকার নেই।
শংকরবাবু বললেন, দরকার নেই মানে? তুমি ঘুমোবে না? আমাদের তো ঘুমোতেই হবে।
দীপ্তিও খুব কোমল গলায় বললেন, সূর্য, এবার শুয়ে পড়ো। অনেক রাত হয়ে গেছে, প্রায় একটা।
দীপ্তির কণ্ঠস্বর এখন স্বাভাবিক। একটু আগে তিনি যে ব্যাকুল ভাবে কেঁদেছিলেন, তার কোনও চিহ্নই নেই। এই সংযমের জন্য তার মুখখানা যে রক্তশূন্য হয়ে গেছে, সূর্য। তা লক্ষই করল না।
শংকরবাবু উঠে এসে সূর্যর কাঁধে হাত রেখে বললেন, আরে চলো, চলো, আবার কাল সকালে কথা হবে। দীপ্তি, দেখো তো বিছানা পাতা আছে কিনা।
শংকরবাবু সূর্যকে ধরে দরজার পাশে দাঁড়ালেন। দীপ্তি ঘরের মধ্যে ঢুকে ঠিকঠাক করে দিলেন বিছানার চাদর বালিশ। বেরিয়ে এসে বললেন, যদি রাত্তিরে তোমার জলতেষ্টা পায়–এই ডাইনিং রুমে জল আছে।
যে কারণেই হোক, সূর্য আর আপত্তি করল না। ঘরে ঢুকে সে খাটের ওপর বসল। সেখান থেকে সে দেখল, শংকরবাবু আর দীপ্তিদি ঢুকে গেলেন তাদের ঘরে। দরজা বন্ধ হয়ে গেল। সূর্যর শরীরটা জ্বলছে তখন, হাতদুটো শক্ত হয়ে গেছে, চোখ দুটি বিস্ফারিত। তার মুখটা দেখলে এখন চেনাই যায় না। অন্তত দশ জন মানুষের সারা জীবনের রাগ সে অনুভব করছে এই মুহূর্তে। যে-নারীকে পেলে সে পূর্বজীবনের সবকিছু ভুলতে পারে, যে-নারীর জন্য সে আবার সব কোমলতা, দয়া মায়া, ফিরে পেতে পারে–সেই নারী আজ তারই চোখের সামনে অপর পুরুষের সঙ্গে শয়নকক্ষে চলে গেল।
ক্রোধ মানুষকে অসহায় করে দেয়। সূর্য নিশ্চল হয়ে বসে রইল সেখানে। সমস্ত ইন্দ্রিয় সজাগ করে শুনতে চাইল, ও-ঘর থেকে কোনও শব্দ আসে কিনা। ও-ঘরের আলো নিবে গেছে, কোনও শব্দ নেই।
সূর্য সেখানে কতক্ষণ বসে আছে, তার খেয়াল নেই। দরজা খোলা, সে খরচক্ষে চেয়ে আছে দরজার দিকে। তার মনে হচ্ছে, যে-কোনও সময় দরজার কাছে দীপ্তিদির চুম্বকময় শরীরখানি দেখতে পাবে। সূর্য ঘুমিয়ে পড়েছে কিনা দীপ্তিদি কি তা দেখতে আসবে না, দীপ্তিদি যে বলেছিল, সূর্যর ঘুমন্ত মুখের পাশে তার বসে থাকার খুব সাধ ছিল। সে কি মিথ্যে? আজ এত কাছে–সেই জন্যই কি সূর্য এ-ঘরে শুতে আসার জন্য সহজে রাজি হয়নি? এই বিছানায় আছে দীপ্তিদির হাতের স্পর্শ…
কত অনুপল, পল, দণ্ড, প্রহর কেটে গেল সূর্য জানে না। বাইরে ঝিমঝিম করছে রাত। কোথাও একটাও শব্দ নেই। সূর্যর কানে এসে লাগছে নৈঃশব্দের অসহ্য শব্দ।
পৃথিবীতে আর সবাই ঘুমন্ত। শুধু সে একা জেগে আছে। সবাই সব পুরনো কথা ভুলে। যেতে পারে, শুধু সে পারে না। তার চোখের সামনে বার বার ভেসে উঠছে হাজরা রোডের একখানা ঘর, সেখানে সে আর দীপ্তিদিবাইরে দাঙ্গা-হাঙ্গামা, দীপ্তিদি তার বুকের মধ্যে ছটফট করতে করতে বলেছিলেন, সূর্য, তুমি আমাকে নাও, তুমি আমাকে নাও, আরও জোরে চেপে ধরো–তারপর মনে পড়ল যোগানন্দর কথা, সে বলেছিল, এবার সব ছেড়েছুঁড়ে দিয়ে ভালো করে বাঁচব বুঝলি, তোর বোনের বাড়িতে গিয়ে ভালো করে খাব–
এই সময় যোগানন্দর কথা মনে পড়ায় সূর্য নিজেই একটু অবাক হয়। যোগানন্দর মৃত মুখোনি তার চোখের সামনে ভাসে। সমস্ত মৃত সহকর্মীদের জন্য শোক অনুভব করে সে। ব্রজগোপালদা বলেছিলেন, যে ভাবেই হোক বিশ্বাসঘাতক যোগানন্দকে খুঁজে বার করতেই হবে। সূর্য খুঁজে বার করেছিল। তার স্ত্রীর কাছ থেকে যোগানন্দকে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। যোগানন্দর সঙ্গে কি আজকের শংকর বসুরও মিল নেই?
সূর্য উঠে দাঁড়াল। সে বুঝে গেছে, কেউ আসবে না। এক-একদিন নিস্তব্ধতার মধ্যেই বোঝা যায়, এর মধ্যে কোনও সম্ভাবনা নেই। সূর্য কি এখন চলে যেতে পারে এখান থেকে? সেও কি অন্য রকম ভাবে বাঁচতে পারে? অন্য রকম কী ভাবে বাঁচা যায়, সে জানে না, এখন তার আর কিছুই মনে পড়ছে না। আর কোনও দিকে রাস্তা নেই।
সূর্য পায়ে পায়ে এসে দাঁড়াল শংকর বসুর ঘরের দরজার সামনে। চোরের মতন কান পেতে শুনতে চাইল কোনও শব্দ। কিছুই নেই। এখনও সূর্য ফিরে যেতে পারে। কিন্তু তার ফিরে যাবার সাধ্য নেই। সে প্রচণ্ড জোরে ধাক্কা দিল দরজায়।
ভেতর থেকে শংকর বসু বললেন, কে?
আমি সূর্য, দরজা খুলুন।
কী চাই?
শিগগির দরজা খুলুন।
আঃ, কী চাও এখন? যাও, ঘুমোও—
শিগগির দরজা খুলুন।
শংকর বসু ভীরু মানুষ নন। তিনি দরজা খুলে বিরক্ত মুখে দাঁড়ালেন। আগেকার সব ভদ্রতার চিহ্ন মুছে গেছে।
সূর্য উঁকি দিয়ে ভেতরে দীপ্তিকে একবার দেখবার চেষ্টা করল তৃষ্ণার্তের মতন। শংকরবাবু দরজা আড়াল করে কড়া গলায় জিজ্ঞেস করলেন, আবার কী হল? একটু শান্তিতে ঘুমোতেও দেবে না?
আপনি বাইরে আসুন, আপনার সঙ্গে দরকারি কথা আছে।
শংকরবাবু এবার প্রচণ্ড এক ধমক দিয়ে বললেন, এসব কী পাগলামি হচ্ছে? তোমার সঙ্গে আমার কোনও কথা নেই। যত সব ন্যাকামি।
শংকর বসু ধমক দিয়ে একটু ভুল করলেন। ধমকে ভয় পাবার ছেলে তো এ নয়। সূর্য শংকর বসুর হাত ধরে এক হ্যাঁচকা টান দিয়ে বাইরে বার করে এনে ভয়ংকর মুখ করে বলল, আপনি চলুন আমার সঙ্গে।
সূর্য, বড় বাড়াবাড়ি হচ্ছে কিন্তু। তুমি আমার বন্ধু হিসেবে কিংবা দীপ্তির ছোট ভাই হিসেবে যত বার ইচ্ছে আমাদের বাড়িতে আসতে পারো কিন্তু এ রকম যদি করো–
আমি আর কোনও দিন আসব না। আপনাকে আমার সঙ্গে যেতে হবে।
দীপ্তি উঠে এসেছেন। দু’জনের মাঝখানে হাত রেখে বললেন, এ কী! সূর্য এ কী করছ? ছেড়ে দাও। আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি।
সূর্য তার সেই অস্বাভাবিক হিংস্র মুখটা দীপ্তিকে দেখিয়ে বলল, তুমি এর মধ্যে এসো না। তোমার সঙ্গে আর আমার কোনও দরকার নেই। কিন্তু আমি একেও এখানে থাকতে দেব না।
শংকরবাবু ঠোঁট বেঁকিয়ে বললেন, এ তো একেবারে পাগল হয়ে গেছে। এখন একে আটকে রাখা ছাড়া–
সূর্য শংকরবাবুর কথা শেষ করতে দিল না। তার হাত ধরে হিড় হিড় করে টেনে দৌড় করিয়ে সোজা নিয়ে এল বাইরে। দীপ্তি চেঁচিয়ে উঠলেন, রামরতন, রামরতন– তারপরই নিজের মুখে হাত চাপা দিলেন। তিনিও ছুটে এলেন বাইরে।
সূর্য ততক্ষণে শংকরবাবুকে নিয়ে মাঠে নেমে পড়েছে। শংকরবাবু প্রাণপণে চাঁচাচ্ছেন ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও। তিনি দুর্বল মানুষ না হলেও সূর্যর গায়ে এখন অসুরের মতন। শক্তি। সে শংকরবাবুকে কোথায় নিয়ে যাবে জানে না, নিজে কোথায় যাবে তাও জানে না, শুধু জানে দীপ্তিদির কাছ থেকে এই লোকটাকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যেতেই হবে। সে দূরে সরে যাবে, এই লোকটাকেও এখানে রেখে যেতে পারবে না। সে একা সবকিছু ছাড়বে কেন। সেপাই সান্ত্রীরা জেগে উঠেছে, সূর্যর ভ্রূক্ষেপ নেই।
শংকরবাবু হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, তুমি কি আমাকে মেরে ফেলতে চাও?
সূর্য বলল, চুপ! আমি যদি গ্রামে গিয়ে মাটি কোপাবার কাজ করি, আপনাকেও তাই। করতে হবে।
সেই সময় রামরতন পেছন থেকে জাপটে ধরল সূর্যকে। সূর্য যন্ত্র-মানুষের মতন প্রচণ্ড ধাক্কায় তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিল মাটিতে। রামরতন এত জোরে আছড়ে পড়ল যে তার নাকটা ঘষটে গিয়ে রক্ত বেরোতে লাগল গলগল করে। নিজের রক্ত-দর্শনে রামরতন দিশেহারা হয়ে যায়। সেই অবসরে একটু আলগা পেয়ে শংকর বসু ছুটতে লাগলেন। ফুলবাগানের দিকে।
সূর্য বাঘের মতন তাড়া করে গেল তার দিকে। ফুলবাগান লন্ডভন্ড করে সে যখন শংকর বসুকে প্রায় ধরে ফেলেছে, তিনি মাটিতে বসে পড়ে চিৎকার করলেন, মেরো না, আমাকে মেরো না-ভয়ে তার মুখ সম্পূর্ণ ব্যক্তিত্বহীন।
রামরতনের প্রথম গুলিই সূর্যর পিঠে লাগে। কিন্তু সূর্য যেন টেরই পায়নি। তখনও সে শংকরবাবুর দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, মারব না, উঠে আসুন।
সেইটাই সূর্যর শেষ কথা। রামরতনের দ্বিতীয় গুলি লাগবার সঙ্গে সঙ্গে সূর্য পড়ে গেল মাটিতে। কয়েকবার উলটেপালটেই তার শরীরটা স্থির হয়ে গেল।
রামরতন ততক্ষণে কাছে এসে গেছে। শংকরবাবু বিহ্বল ভাবে একবার তার দিকে আর একবার সূর্যর দিকে তাকালেন। তারপর ঠাস করে রামরতনের গালে এক থাপ্পড় মেরে বললেন, উল্লুক, একী করলি?
দীপ্তি ছুটতে ছুটতে এসে বললেন, সূর্য গুলি করেছে! তোমার লেগেছে?
শংকরবাবু বললেন, না। ওই দেখো।
দীপ্তি নিচু হয়ে সূর্যর গায়ে হাত দিয়ে বলল, এ কী, ও উঠছে না কেন? অজ্ঞান হয়ে গেছে?
শংকরবাবু বললেন, সব শেষ।
দীপ্তিকে যেন কেউ চুলের মুঠি ধরে হ্যাঁচকা ভাবে টানল। তিনি সূর্যর বুকের ওপর হাতটা রাখলেন, আর একটাও কথা বলতে পারলেন না। সেই সময় তার চোখে কান্না এল না। সমস্ত শরীরের মধ্যে এলেমেলো গরম হাওয়া ঘুরছে। একটা চিন্তাই তার মাথায় গেঁথে গেল, আমি কেন জন্মেছিলাম? এই ব্যর্থ ভিতু জীবন নিয়ে আমি কী করব?
শংকরবাবু বিহ্বল ভাবটা হঠাৎ কাটিয়ে উঠলেন। অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে পড়ে বললেন, দারুণ কেলেংকারি হয়ে যাবে। আমার মান-সম্মান–খবরের কাগজে যদি…দীপ্তি, শিগগির ওঠো, ঘরে যাও, সূর্যর সঙ্গে তোমার আজ দেখা হয়নি, ও জোর করে এখানে ঢুকে আমাকে মারতে এসেছিল, থানায় খবর দাও, এই রামরতন, দৌড়ে যাও যে রিকশায় করে এসেছিল, সেই রিকশাওয়ালাকে ধর, সে সাক্ষী দেবে–এই তোমরা কেউ ওর বডি এখন ছোঁবে না–
শংকরবাবু দীপ্তিকে ধরে তুললেন। তারপর সান্ত্বনা দেবার জন্য বললেন, ছেলেটা একেবারে পাগল হয়ে গিয়েছিল, চলো, তুমি শুয়ে পড়বে চলো–। তোমার যতটা কষ্ট হচ্ছে, আমারও তার চেয়ে কম নয়…
দীপ্তিকে ধরে ধরে তিনি নিয়ে গেলেন ভেতরে। কয়েকটা ফুলগাছ দলিত করে সূর্যর দেহটা পড়ে রইল সেখানে। রক্তের গন্ধ পেয়ে একটা কুকুর কাছাকাছি আসবার চেষ্টা করছিল, দু’জন সেপাই সেটাকে তাড়াচ্ছে।
দূরে একটা রাতচরা পাখি হঠাৎ অলৌকিক ভাবে ডেকে ওঠে। আরও দূরে শোনা যায় একটি শিশুর কান্না। হাওয়ায় বড় বড় গাছগুলি থেকে টুপটাপ করে পাতা ঝরে। নির্জন রাস্তায় ভয় তাড়াবার জন্য একজন লোক জুতোর শব্দ তুলে ও গান গাইতে গাইতে যায়। গির্জায় ঘণ্টা বাজে। বোঝা যায়, জীবন ঠিক বয়ে চলেছে।
সূর্যর মুখখানা আকাশের দিকে ফেরানো। ফিকে জ্যোৎস্নাতেও স্পষ্ট দেখা যায়, এখনও সেখানে রাগ আর অভিমানের আঁকাবাঁকা রেখা পড়ে আছে। আর কোনও দিন মুছবে না।