রেণু এল পরদিন সকালবেলা। বাদল তখন খেতে বসেছে। নীচে সদর দরজায় একজন ভিখিরি সেই সময় গান করছিল খঞ্জনি বাজিয়ে। গরম ডাল আর ভাত মাখতে মাখতে বাদল মনোযোগ দিয়ে শুনছিল সেই গান। ভিখিরিটি অনেককাল ধরেই আসে, ভাঙা ভাঙা গলায় গায়:
নিম খাওয়ালে চিনি বলে
কথায় করে ছল-ও-ও–
মিঠার লোভে তিতো মুখে
সারা দিনটা গেল-ও-ও—
বাদল এইসব গান শুনতে ভালোবাসে। ভিখিরিটিকে একটা পয়সা দেওয়া দরকার। কিন্তু কে দেবে? চিররঞ্জন বেরিয়ে গেছেন, হিমানী স্নানের ঘরে। রাঁধুনিটি কানে ভালো শোনে না, তা ছাড়া এত বেশি বুড়ি যে তাকে নীচে পাঠাতে মায়া হয়। বাদল নিজেই খাওয়া ছেড়ে উঠে গিয়ে পয়সা দিয়ে আসবে ভাবছিল, এই সময় দেখতে পেল, দোতলার সিঁড়ি দিয়ে রেণু উঠে আসছে।
বাদল রেণুকেই বলল, আমার জামার পকেট থেকে পয়সা নিয়ে নীচে ওই লোকটাকে দিয়ে এসো না!
রেণু বাদলের কাছ থেকে পয়সা নিল না, নীচে নেমে গেল। নিশ্চয়ই অনেক বেশি পয়সা দিয়েছে। বাদল উপর থেকেই শুনতে পেল, লোকটি রেণুকে আশীর্বাদ করছে, বেঁচে থাকো, সুখে থাকো মা। ধনে-পুত্রে সৌভাগ্যবতী হও, রাজরাজেশ্বরী হও
বাদল একটু হাসল এবং একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর সে গুন গুন করতে লাগল গানটা। এক একটা গানের লাইন হঠাৎ বিনা কারণে মাথায় গেঁথে যায়। বেগুনভাজাতে কামড় দিয়েও বাদল গাইছে, মিঠার লোভে তিতো মুখে সারা দিনটা গেল-ও-ও-ও
রেণু ফিরে এসে বলল, তুমি এরই মধ্যে খেতে বসে গেছ? কটায় বেরোতে হয়?
বাদল বলল, ন’টা কুড়ি। এখন ক’টা বাজে? ন টা পাঁচটাচ হবে বোধহয়।
মাসিমা কোথায়?
চান করছেন। বোসো না এখানে। তুমি কিছু খাবে?
না, আমি কিছু খাব না। আমার সামনে খেতে তোমার লজ্জা করবে না তো? ছেলেদের এ রকম হয় শুনেছি।
বাদল হঠাৎ অনুভব করল, রেণু আর ছেলেমানুষ নেই। বয়সের তুলনাতেও সে এখন অনেক বেশি পরিণত। তার চলা ও দাঁড়ানোর ভঙ্গিতে ফুটে ওঠে ব্যক্তিত্ব, সে একটি পরিপূর্ণ যুবতী। এক নিমেষের জন্য রেণুকে বাদলের খুব অচেনা লাগে।
বাদল খুব তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করছে আর রেণু দেখছে তাকে। দাঁড়িয়েই আছে। প্রায় দিনই সকালে মাছটাছ রান্না হয় না, বাদলের সে জন্য একটু লজ্জার ভাব এসেছিল, কিন্তু রেণু সে-সম্পর্কে কোনও মন্তব্য করল না। জিজ্ঞেস করল, তোমাদের বাড়িটা এত চুপচাপ কেন? সূর্যদা কোথায়?
সূর্যদা ঘুমোচ্ছে এখনও।
এত বেলা অবধি? সূর্যদা না আগে ভোরবেলা উঠে এক্সারসাইজ করতেন?
সে-সব কতকাল আগেকার কথা।
সূর্যদাকে আমি ডাকব?
বাদল কিছু উত্তর দিল না। সূর্যদা কাল কত রাত্রে ফিরেছেন, বাদলও তা জানে না। কেউ ডাকে না ওকে, যখন খুশি ওঠে, যখন খুশি স্নান-খাওয়া করে।
রেণু সূর্যকে ডাকবার জন্যই চলে যাচ্ছিল। আবার ফিরে এল। জিজ্ঞেস করল, কাল। আমার মা তোমাকে ডেকে নিয়ে কী বললেন?
বাদল ভাতের থালার দিকে মনোনিবেশ করে বলল, কিছু না তো! ও এমনিই। জিজ্ঞেস করছিলেন আমার মায়ের অসুখের কথা
আর কিছু বলেননি?
বাদল মুখ তুলল না। থালার ওপর দাগ কাটতে কাটতে বলল, না তো। আর কী বলবেন?
তুমি আর ভাত নেবে না? এইটুকু মোটে খাও?
অনেক খেয়েছি। এক্ষুনি দৌড়োদৌড়ি করে যেতে হবে।
বারান্দার বেসিনে হাত ধুতে ধুতে বাদল আবার সেই গানটা গাইতে লাগল মুখ বুজে। সে যে গান গাইছে তার নিজেরই খেয়াল নেই।
জুতোর ফিতে বেঁধে, শোওয়ার ঘরের ঘড়িতে উঁকি মেরে দেখে বলল, এখনও পাঁচ-সাত মিনিট সময় আছে।
এই সময় ওপর থেকে সূর্যর গলা ভেসে এল, বাদল, এক কাপ চা পাঠিয়ে দিতে বল তো।
সূর্য এখন দোতলার নিজের ঘরটা ছেড়ে তিনতলার বড়বাবুর ঘরটাতেই পাকাপাকি আশ্রয় নিয়েছে। তার খাবারটাবার ওখানেই পাঠাতে হয়।
বাদল বলল, সূর্যদা জেগে উঠেছে, তুমি দেখা করবে বলছিলে তো, চলো–
রেণু একটু অবাক চোখে বাদলের দিকে তাকায়। বাদলের কিছু একটা হয়েছে আজ। তার ব্যবহারে যেন খানিকটা শুকনো ভদ্রতার ছাপ। তিনতলার সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বাদল বলল, সূর্যদা, রেণু এসেছে তোমার সঙ্গে দেখা করবার জন্য।
যদিও বাতাসে শীতের আমেজ রয়েছে, তবু সূর্য তিনতলার বারান্দায় একটা খাকি রঙের প্যান্ট পরে খালি গায়ে দাঁড়িয়ে ছিল। মাথার ঝকড়া আঁকড়া চুল ও দাড়ি-গোঁফের জন্য তাকে পশ্চিমি সৈন্যের মতন দেখায়। অল্প নিদ্রার ক্লান্তিতে চোখের নীচে গভীর কালো দাগ।
ভরাট গম্ভীর গলায় সূর্য বলল, ও, এই রেণু। চিনতেই পারিনি, এর মধ্যে এত বদলে গেছে।
রেণু বলল, আমিও আপনাকে চিনতে পারিনি। এ কী বিশ্রী চেহারা হয়েছে আপনার!
বিশ্রী চেহারা। তাই বুঝি!
শেষ বার যখন আপনাকে দেখি, তখন আপনার মাথা ন্যাড়া ছিল, ঠিক বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর মতন দেখাচ্ছিল।
সূর্য হেসে উঠে বলল, বৌদ্ধ সন্ন্যাসী? হ্যাঁ, মনে আছে বটে, তুমি তাই বলেছিলে আমাকে। তখন ন্যাড়া ছিলাম, এখন পাঁচ-ছ’মাস চুলই কাটিনি।
কেন কাটেননি কেন?
কী দরকার? বেশ তো আছে।
মোটেই বেশ নেই। এ রকম চেহারায় থাকতে কারওর ভালো লাগে বুঝি? আজই চুল কেটে আসুন।
এই কথাটা বাদল এবং তার বাড়ির সকলে সূর্যকে অনেক বার বলবে ভেবেছে। কিন্তু বলতে পারেনি। রেণু অনায়াসে বলতে পারে। সূর্য তার কথাটা হেসে উড়িয়ে দেয়। ঘরে ঢুকে একটা বোতামহীন শার্ট পরে নিয়ে বলল, বোসো!
কোথায় বসবে রেণু। ঘরটা নোংরা হয়ে আছে। খাটের ওপর এলোমেলো বিছানা পাতা। মেঝেতে কার্পেটের ওপর ছেঁড়া কাগজ, দেশলাই কাঠি, সিগারেটের প্যাকেট। দরজার পাশেই গড়াচ্ছে দুটো খালি মদের বোতল।
বড়বাবুর ইজিচেয়ারটা হাত দিয়ে খানিকটা পরিষ্কার করে বাদল রেণুকে বলল, তুমি এখানে বোসো। সূর্যদার সঙ্গে কথা বলো, আমি চলি তা হলে?
সূর্য জিজ্ঞেস করল, তোকে এক্ষুনি যেতে হবে। তোর কী অফিস রে? কোন কোম্পানি?
গত বারো দিনের মধ্যে এ-প্রশ্ন করার অবকাশ বা ইচ্ছে হয়নি সূর্যর। বাদল সংক্ষেপে অফিসের কথা জানাল। সূর্য বলল, আমাকেও একটু বাদে বেরোতে হবে।
বাদল বলল, রেণু ততক্ষণ বসুক। আমি দুকাপ চা পাঠিয়ে দিতে বলছি এককড়ির মাকে।
রেণু বলল, মাসিমার স্নান হয়ে গেলে আমি মাসিমার সঙ্গে দেখা করে তারপর যাব।
বাদল আর অপেক্ষা করল না। বেরিয়ে পড়ল। রাস্তার মোড়ে এসেই সে লাফিয়ে উঠে পড়ল একটা চলন্ত বাসে। তখনও সে গুন গুন করছে সেই গানের লাইনটা, ‘মিঠার লোভে তিতো মুখে সারা দিনটা গেল–ও–ও–। সারা দিনেও এই লাইনটা তার মাথা ছাড়ল না, অফিসে প্রায় সর্বক্ষণ, এমনকী, সাহেবের ঘরে গিয়েও সে মনে মনে লাইনটা নিয়ে খেলা করতে লাগল।
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে সূর্য রেণুকে জিজ্ঞেস করল, তুমি এখন কী করছ। পড়াশুনো?
হ্যাঁ।
যথেষ্ট বড় হয়ে গেছ তো। আর পড়াশুনো করার কী দরকার?
বাঃ, পড়ব না? বড় হওয়ার সঙ্গে পড়াশুনোর কী সম্পর্ক?
হুঁ। তোমার কী সাবজেক্ট? আর্টস না সায়েন্স!
আর্টস। আমি ইকনমিকসে অনার্স নিয়েছি। আপনার কাছে আমার একটা প্রশ্ন ছিল। আপনার সম্পর্কে আমার ক্লাসের ছেলেমেয়েদের কাছে গল্প করেছিলাম। তখন তারা আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে বলেছিল। কিন্তু আপনাকে তো কত দিন খুঁজেই। পাওয়া যায়নি।
আমার কাছে আবার কী প্রশ্ন?
আপনারা এই যে দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করলেন, এত কষ্ট সহ্য করলেন, তারপর একদিন স্বাধীনতা এল–কিন্তু তাতে আমাদের কতটুকু লাভ হল! দেশ কতটা বদলাল?
আমি স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিলুম নাকি? ভুলে গেছি সেসব কথা।
আপনি ভোলার চেষ্টা করলেও আমরা তো ভুলব না।
যারা এখন দেশটা চালাচ্ছে, তাদের গিয়ে জিজ্ঞেস করো।
তারা তো আছেই। কিন্তু আপনারাই বা দায়িত্ব অস্বীকার করবেন কী করে? শুধু স্বাধীনতা এনেই কি আপনাদের দায়িত্ব শেষ হয়ে গেল? অবশ্য আমার অনেক বন্ধুরা বলে, দেশে এখনও আসল স্বাধীনতা আসেইনি। একটা নকল স্বাধীনতার নাম করে আমাদের ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা হচ্ছে।
রেণুর কণ্ঠস্বরে একটু উত্তেজনা ছিল, সূর্য তা গ্রাহ্য করল না। সে দু’হাত ছড়িয়ে আড়মোড়া ভেঙে বলল, আমি স্নান করতে যাব। তুমি এবার নীচে যাও।
লালচে হয়ে গেল রেণুর মুখ। ঝট করে অপমানের ছোঁয়া লেগেছে। তীব্র চোখে সূর্যর দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি আমাকে চলে যেতে বলছেন; আপনি আমার এসব কথার উত্তর দেবেন না?
সূর্য নিরাসক্ত ভাবে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ল। তারপর বলল, আমার ওসব কিছু মনে নেই। প্লিজ, আমার কাছে এসব প্রশ্ন তুলো না। আমি নিরিবিলিতে থাকতে চাই।
আপনি যে এতদিন পাহাড়ে না জঙ্গলে কোথায় পালিয়ে ছিলেন, সেখানে আপনাকে কেউ এসব প্রশ্ন করতে যাবে না ঠিকই। কিন্তু কলকাতায় থাকলে আপনাকে এ-প্রশ্নের উত্তর দিতেই হবে।
আমি পালিয়ে গিয়েছিলাম বুঝি?
নিশ্চয়ই।
সূর্য কয়েক পলক রেণুর দিকে স্থির ভাবে তাকিয়ে রইল। নতুন যৌবনে ঝকমক করছে রেণুর শরীর, মুখে-চোখে একটুও মালিন্য নেই, দ্বিধা নেই। সূর্যর দৃষ্টিতে ফুটে উঠল মুগ্ধতা। সে বলল, মেয়েদের সঙ্গে কী ভাবে কথা বলতে হয়, তা আমি জানি না। আমি দুঃখিত, রেণু, তোমাকে কোনও কথাই আমি ঠিক মতন বলতে পারব না।
মেয়েদের আবার কী! আপনি আমাকে কতদিন ধরে চেনেন, সহজ ভাবে কথা বলতে পারেন না?
তোমাকে কি আমি খুব বেশি দিন চিনি?
বাঃ চেনেন না? মনে নেই, সেই কত দিন আগে, প্রথম যেদিন আপনি আমাদের বাড়িতে এলেন–আপনার মাথা ফেটে গিয়েছিল, বাদলদা আপনাকে সঙ্গে করে নিয়ে এল!
গিয়েছিলাম বুঝি? আমার তো মনে পড়ে না।
আমার সব মনে আছে।
তোমার নিশ্চয়ই অত্যাশ্চর্য স্মৃতিশক্তি। সেই তুলনায় আমি একটা গবেট।
আমি বুঝতে পেরেছি, আপনি সব কথা এড়িয়ে যেতে চাইছেন। আপনার কী হয়েছে। বলুন তো?
সূর্য উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমার মাথা ধরে আছে। স্নান করে দুটো অ্যাসপ্রো না খেলে সারবে না।
নীচে গিয়ে বাদলের মায়ের সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করার পর রেণু রাস্তায় বেরিয়ে দেখল, সূর্য বাস স্টপের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। রেণুর সঙ্গে চোখাচোখি হতেও সূর্য অন্যমনস্ক ভাবে মুখ ফিরিয়ে নিল। রেণু ওর কাছে পৌঁছোবার আগেই সূর্য উঠে পড়ল একটা ট্যাক্সিতে। রেণুর মুখে একটা দুঃখের ছাপ পড়ল! কোনও মানুষের কাছেই সে এ রকম ব্যবহার আশা করে না। রেণুর নিজস্ব জগতে প্রত্যেক মানুষই সহজ, স্বাভাবিক এবং সুস্থ।
বাদল অফিস ছুটির পর বাড়ি ফেরা বন্ধ করে দিয়েছে। মায়ের অসুখটায় একঘেয়েমি এসে গেছে। হিমানী কখনও একটু ভালো হয়ে ওঠেন, আবার কিছুটা অনিয়ম করলেই শয্যাশায়ী হতে হয়। সম্পূর্ণ সেরে ওঠার আর বুঝি কোনও আশা নেই। মায়ের বিছানার পাশে বাদল এখন কদাচিৎ বসে, কারণ, বসলেই হিমানীর মুখে একটানা-একটা অভিযোগ শুনতে হবে। চিররঞ্জন বাড়ি খোঁজা শুরু করেছেন, হিমানী এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার জন্য বদ্ধপরিকর। সূর্যর ব্যবহার দিন দিন তার কাছে অসহ্য হয়ে উঠছে।
অফিস ছুটির পর বাদল ন্যাশানাল লাইব্রেরিতে চলে যায় ইদানীং। প্রথম কয়েক দিন এলোমেলো বই পড়ছিল, তারপর সে সুনির্দিষ্ট ভাবে সৃষ্টিতত্ত্ব সম্পর্কে পড়াশুনো শুরু করে। পৃথিবী ও প্রাণের সৃষ্টি সম্পর্কে নানা মুনির নানা মত তাকে আকৃষ্ট করতে লাগল খুব।
ন্যাশানাল লাইব্রেরি বন্ধ হয় ন’টার সময়। সেখান থেকে বেরিয়ে তার কোনও তাড়াহুড়ো নেই বাড়ি ফেরার জন্য। বাসে না উঠে সে ময়দানের মধ্য দিয়ে হাঁটতে আরম্ভ করে। অলস, মন্থর তার গতি, আপনমনে সিগারেট টানে কিংবা বাদামভাজা কিনে চিবোয়।
বাড়ি সম্পর্কে কোনও আগ্রহ নেই বাদলের, অথচ তার অন্য কোথাও যাবার জায়গাও নেই। তার বয়সি ছেলেরা রাজনীতি অথবা নাটক করে, রবীন্দ্রসংগীত গায় অথবা সাহিত্য নিয়ে তর্ক করে কিংবা স্রেফ আড্ডা দিয়ে সময় কাটায়।বাদল এর সবক’টা দল থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরলে তার মেজাজ গরম হয়ে যায়। সূর্য সত্যিই খুব বাড়াবাড়ি শুরু করেছে। বাড়িতেই এখন তার মূল আড্ডা। কী সব অদ্ভুত চেহারার নোক আসে তার। কাছে, কারওর মাথা কামানো, কারওর গলায় রুমাল বাঁধা, এদের মধ্যে অনেকের চাউনির ধরনধারণ দেখলে ভয় লাগে। সূর্য যেন প্রতিজ্ঞা করেছে, কোনও শিক্ষিত ভদ্রলোকের সঙ্গে আর মিশবেই না। ওই লোকগুলোর বাড়িতে আনাগোনার একটি কারণ, সূর্য নাকি ওদের সঙ্গে কী একটা সাপ্লাইয়ের ব্যবসা শুরু করবে ঠিক করেছে। ‘ভাদুড়ী ট্রেডার্স’ নামে একটা সাইনবোর্ডও লাগানো হয়েছে বাড়ির সামনে।
সূর্যর এখন টাকায় টান পড়েছে বলেই বোধহয় কলকাতায় ফিরে আসতে বাধ্য হয়ে পড়েছিল। বড়বাবুর জমানো টাকাপয়সার প্রায় সবটাই সে উড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। চিররঞ্জনের সঙ্গে টাকাপয়সা সংক্রান্ত আলোচনায় সূর্য একবার একথাও বলেছে যে, তার ব্যবসায়ের বিনিয়োগের প্রয়োজনে তাকে হয়তো বাড়িটাই বিক্রি করতে হবে। তা হলেই আর কিছু বাকি থাকে না! এ-কথা সকলেই জানে, সূর্যর দ্বারা কোনও দিনই ব্যবসা হবে না। সে সবকিছু উড়িয়ে পুড়িয়ে দেবে। সূর্যর কাছে যে-সব লোকেরা আসে, তারা। ব্যবসা নিয়ে কতটা আলোচনা করে তা বোঝা যায় না, শুধু মদ খায় আর হইহল্লা করে, এক একদিন মাঝ রাত্তিরেও সূর্যকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে যায়!
রেণু সন্ধ্যাবেলা বাড়িতে এসে পড়লে আরও মুশকিল হয়। রেণু দেখা করতে চায় সূর্যর সঙ্গে। বাদলরা কেউ আর এখন সূর্যর ঘরে যায় না। ওপরের ঘরে খাবার পাঠিয়ে দেওয়া ছাড়া বাড়ির কারওর আর কোনও সম্পর্ক নেই তার সঙ্গে। কিন্তু রেণু যেতে চাইলে বাদলকেও সঙ্গে যেতে হয়। সে এক অস্বস্তিকর অবস্থা। সূর্য রুক্ষ ভাবে অপমান করে কথা বললেও রেণু তার সঙ্গে তর্ক করতে চায়। আগে দেশের অবস্থা কিংবা রাজনীতি সম্পর্কে রেণুর কোনও আগ্রহ ছিল না। কলেজে ভরতি হবার পর সে এসব ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে। কলেজে তোতা রাজনীতিই এখন প্রধান আলোচ্য বিষয়। মাত্র তিন-চার বছরের মধ্যে প্রতিবেশী চিনের অগ্রগতি দেখে সবাই মুগ্ধ, পদে পদে ভারতের সঙ্গে তুলনা এসেই যায়।
বাদল হাঁটতে হাঁটতে এসে একটা রেইনট্রির নীচে দাঁড়াল। রাত্রের দিকে ময়দানের মধ্যে একা একা হাঁটা খুব নিরাপদ নয়। ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। কেপমারি গ্যাঙের অত্যাচারের কথা খুব শোনা যায়। প্রায়ই মাঠের মধ্যে রেস খেলায় জেতা লোকদের লাশ পড়ে থাকে। কিন্তু বাদলের মাথায় কোনও চিন্তা নেই। সে আত্মবিস্মৃতের মতন গাছটায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানতে লাগল কিছুক্ষণ। তারপর সে গাছের গুঁড়িতে হাত দিয়ে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস কবল, বলো তো, কেন আমি রেণুর টেলিফোন ধরিনি?
অনেকক্ষণ থেকেই একটু একটু হাওয়া দিচ্ছে। বাদল ওই প্রশ্নটা করার পর রেইনট্রি থেকে কয়েকটি পাতা খসে পড়ল তার গায়ে-মাথায়। বাদল আগ্রহের সঙ্গে পাতাগুলো তুলে নিল হাতে। তার মনে হল, গাছটি তার প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে। পাতা ঝরানোই তো গাছের ভাষা। কিন্তু বাদল সে-ভাষা জানে না। তা ছাড়া অন্ধকার।
সে-দিনই দুপুরবেলা বাদলের অফিসে রেণু ফোন করেছিল। বাদলের নিজের টেবিলে টেলিফোন নেই। তা ছাড়া সেই সময় সে বারান্দার এক কোণে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছিল। কোনও নিষেধ না থাকলেও সে অফিসে বয়স্ক লোকদের সামনে সিগারেট টানতে লজ্জা পায়, তাই তাকে উঠে যেতে হয়। একটি বেয়ারা এসে তাকে খবর দিল যে বড়বাবুর টেবিলে তার একটি টেলিফোন এসেছে, একজন মেয়েছেলে তাকে ডাকছে।
বাদলের বুকটা ধক করে উঠেছিল। নিশ্চয়ই রেণু। রেণু ছাড়া আর কোন মেয়েছেলে তাকে ফোন করবে? এক রকমের খুশির চাঞ্চল্যে তার মুখটা রক্তাভ দেখায়। কয়েক দিন রেণুর সঙ্গে দেখা হয়নি, তাই রেণু খোঁজ নিচ্ছে। সিগারেটটা ফেলে দিয়ে বাদল এগিয়ে গিয়েছিল বড়বাবুর টেবিলের দিকে। তিনি তখন চেয়ারে ছিলেন না, সুতরাং বাদলের কথা বলার কোনও অসুবিধে ছিল না। রিসিভারটা হাতে তুলে নেবার আগের মুহূর্তেও বাদল ভাবেনি সে এ রকম কিছু করবে। হঠাৎ তার মাথার মধ্যে কী হয়ে গেল, সে রিসিভারটা তুলে গম্ভীর গলায় বলল, বাদলবাবু অফিসে নেই। এবং কোনও উত্তরের অপেক্ষা না করেই রেখে দিল রিসিভারটা। কেন সে এ রকম করল, নিজেই জানে না। রেণু হয়তো তার গলা চিনতে পারবে না–এর আগে রেণুর সঙ্গে কখনও টেলিফোনে কথা বলেনি সে। তবু সে নিজেই রেণুকে–কী এর মানে! মানুষ কেন এ রকম করে? যাকে সে ভীষণ ভাবে চায়, তাকেও কেন এক-এক সময় ফিরিয়ে দেয়? কোনও সৃষ্টিতত্ত্বের বইতে এর ব্যাখ্যা নেই।
বাদল আবার গাছটাকে প্রশ্ন করল, তুমিও বলতে পারলে না? হাতের শুকনো পাতাগুলো মুড়মুড়িয়ে ভেঙে বাদল গন্ধ শুঁকে কিছু বোঝবার চেষ্টা করল।
রেণুর সঙ্গে দেখা হল রবিবার সকালে। রেণুর মুখ-চোখে রাগ। সে অভিমান কিংবা রাগ মনের মধ্যে চেপে রাখে না। বাদল নিজের ঘরে শুয়ে শুয়ে কাগজ পড়ছিল। রেণু সেখানে এসে প্রথমেই বলল, তোমার ব্যাপার কী বলো তো?
একটা লাল রঙের শাড়িতে রেণুকে জ্বলজ্বলে দেখাচ্ছে। ফাঁকা ঘর। বাদলের প্রথম প্রতিক্রিয়া হল, এক লাফে উঠে রেণুকে জড়িয়ে ধরা। রেণুর চেহারার মধ্যে এমন একটা টাটকা ভাব আছে যে স্পর্শ না করলে যেন সবটুকু দেখা হয় না। কিন্তু বাদল আশ্চর্য ভাবে নিজেকে দমন করে অত্যন্ত নিরুত্তাপ গলাতেই বলল, কত দিন তোমার দেখা পাই না।
তোমার কী হয়েছে বলো তো সত্যি করে?
কিছু হয়নি তো।
নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে। কদিন ধরেই তোমার কী রকম যেন আলগা আলগা ভাব দেখছি। তোমাকে কেউ কিছু বলেছে?
কে কী বলুবে আমাকে? বোসো, বসবে না?
রেণু চেয়ারটা একটু দূরে টেনে নিয়ে বসল। রেণুরও অভিজ্ঞতা এই যে তাকে নিরালায় পেলেই বাদল বড় ছেলেমানুষ হয়ে যায়, চুমু খাওয়ার জন্য অন্ধের মতন ঠোঁট খোঁজে। রেণু এখন আর এসব ব্যাপারকে অসভ্যতা কিংবা খারাপ ব্যাপার বলে মনে করে না ঠিকই, তবু মেয়েদের প্রাথমিক সতর্কতা থাকে, অন্য কেউ যেন দেখে না ফেলে।
বাদল আজ সে রকম কোনও চেষ্টাই করল না দেখে রেণু সামান্য একটু অবাক হল। খুশিও হল বোধহয়। রাগের ভাবটা সরিয়ে ফেলে বলল, এখনও শুয়ে আছ কেন, ওঠো! ক’টা বাজে জানো?
বাদল হাতের খবরের কাগজখানা সযত্নে ভাঁজ করে রেখে দিল বালিশের তলায়। তারপর উঠে বসল। রেণুর দিকে তাকিয়ে ভাবল, এ রকম একটা দিন আসা উচিত ছিল, যখন সে আর রেণু এক বিছানায় শুয়ে রাত কাটাবে। সকালে রেণু আগে ঘুম থেকে উঠবে, তারপর তার গায়ে ঠ্যালা দিয়ে বলবে, এখনও শুয়ে আছ কেন, ওঠো!
আঙুলগুলো মাথার চুলের মধ্য দিয়ে চিরুনির মতন চালিয়ে বাদল বলল, তোমার সবকিছুই সুন্দর। কিন্তু আমি এর যোগ্য নই।
রেণু ধমক দিয়ে বলল, ওসব আজেবাজে কথা অনেক শুনেছি। তুমি সাত দিন আমার সঙ্গে দেখা করোনি কেন? আমি তোমার অফিসে টেলিফোন করেছিলাম।
অফিসের কাজটা আমার একটুও ভালো লাগছে না। আমি পড়াশুনো করতে চাই। অনেক দিন বাদে আমার কিছু লিখতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু তার সময় নেই।
চাকরিটা ছেড়ে দাও।
তা সম্ভব না। বাড়িতেও নানা রকম অশান্তি চলছে।
কী অশান্তি?
তোমার তা শোনার দরকার নেই। অশান্তির কথা, দুঃখের কথা অন্যকে বলতে নেই।
শুধু শুধু বিব্রত করা।
আমি কিছু করতে পারি না?
পারো।
কী?
যে রকম ভাবে দু’আঙুল দিয়ে নুন তোলে, বাদল আঙুলের সেই রকম ভঙ্গি করে বলল, আমাকে এইটুকু ভালোবাসবে? এইটুকু ভালোবাসাই আমার পক্ষে যথেষ্ট। বাসবে?
উত্তর না দিয়ে রেণু হেসে ফেলল। পরিষ্কার নির্ভেজাল হাসি। ভালোবাসার কথা শুনলে সে হাসে।
অফিসে কিংবা বাড়িতে ঝাট থাকলেই কি একেবারে হাল ছেড়ে চুপচাপ বসে থাকতে হবে? আমি লক্ষ করছি, তুমি দিন দিন আরও বেশি মুখচোরা আর গম্ভীর হয়ে যাচ্ছ। এসব চলবে না। তোমাকে লোকের সঙ্গে মিশতে হবে, তোমার যেটুকু গুণ আছে, তা প্রকাশ করতে হবে।
ইন্দ্রানী দেবী, আপনি আজ প্রচুর উৎসাহ নিয়ে এসেছেন মনে হচ্ছে? আপনি বুঝি অধঃপতিত মানুষদের উদ্ধার করার দায়িত্ব নিয়েছেন?
শোনো। আমাদের ক্লাসের ছেলেমেয়েরা মিলে একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করছি।
আবার নাটক?
না, নাটক নয়। আলোচনা, কিছু গান, আবৃত্তি। তোমাকে যেতে হবে।
আমি গিয়ে কী করব? তোমার কলেজের বন্ধুরা আমাকে পাত্তা দেবে কেন? আমি সামান্য একটা কেরানি।
তুমি একজন কবি।
ছিলাম, তাও খুব এলেবেলে ভাবে।
এখনও তুমি কবি এবং থাকবেও। মোট কথা তোমাকে যেতেই হবে এবং অনেক সাহায্য করতে হবে। আচ্ছা, সূর্যদাকে নিয়ে যাওয়া যায় না?
সূর্যদার কথা ছেড়ে দাও। হি ইজ লস্ট!
কেন, ছেড়ে দেব কেন? একটা লোক শুধু শুধু নিজেকে এ রকম ভাবে নষ্ট করবে, আর আমরা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখব?
রেণু, তুমি কি আজ ত্রাণকীর ভূমিকায় নেমেছ নাকি?
চলো, সূর্যদার সঙ্গে দেখা করে আসি।
সূর্যদা এখনও ঘুমোচ্ছে।
দশটা বেজে গেছে, এখনও ঘুম? এই করলে কারওর স্বাস্থ্য থাকে? চলো ডেকে তুলব।
বাদল আজকাল পারতপক্ষে সূর্যর সঙ্গে দেখা করতে চায় না। সূর্য সম্পর্কে যে উজ্জ্বল ছবিটা তার মনের মধ্যে ছিল সেটা আস্তে আস্তে নষ্ট হয়ে যাওয়ায় সেই দুঃখ পেয়েছে বেশি। কিন্তু রেণুকে এ কথা বলা যায় না।
রেণু প্রবল উৎসাহে টেনে নিয়ে গেল অনিচ্ছুক বাদলকে। সূর্যর ঘরের দরজা বন্ধ ছিল, বাদল ডাকল বাইরে থেকে।
সূর্য রুক্ষ ভাবে বলল, কে? দরজা খোলাই আছে, ধাক্কা দে।
সূর্য টান টান হয়ে শুয়ে আছে খাটের ওপর। ঘুমোচ্ছিল না। তার বুকের ওপর একটা বই ভোলা। দরজা খুলতেই উগ্র অ্যালকোহলের গন্ধ। বাদল ভাবল, সূর্যদা কি সকাল থেকেই মদ খাচ্ছে? কিংবা কাল বোধহয় অনেক রাত পর্যন্ত চলেছে।
সূর্যর চোখদুটো নেশাগ্রস্তর মতন। রেণুকে দেখেও সে কোনও ভাবান্তর দেখাল না। বাদলকে বলল, টেবিলের ওপর থেকে সিগারেট দেশলাই দে তো!
রেণু বলল, এখনও শুয়ে আছেন কেন? উঠুন! ঘরের জানলা টানলাও খোলেননি!
সূর্য খানিকটা জড়ানো গলায় বলল, না, আমি এখন উঠব না। সারা রাত আমার ঘুম হয়নি, এখনও ঘুম আসছে না।
রেণু তাদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সূর্যকে নিয়ে যাবার কথা বলতেই সূর্য হঠাৎ খুব রেগে উঠল। বাদলের দিকে তাকিয়ে বলল, এই মেয়েটা আমাকে প্রায়ই জ্বালাতন করতে আসে কেন? বারণ করতে পারিস না? আমি এসব পছন্দ করি না।
বাদল আড়ষ্ট ভাবে বলল, ও তো অন্যায় কথা কিছু বলেনি!
বলছি তো আমি এসব পছন্দ করি না। ওকে অন্য জায়গায় যেতে বল। দেশে অনেক বড় বড় নেতা আছে, যারা দেশের জন্য একসময় জেল খেটেছে, এখন তারাই ক্ষমতা নিয়ে দেশটা চালাচ্ছে-ও তাদের কাছে যাক না! আমাকে বিরক্ত করা কেন? আমি এসব পছন্দ করি না।
রেণু কোমর বেঁধে লেগে গেল ঝগড়া করতে। সূর্যর আজ আর মাথার ঠিক নেই, নেশাগ্রস্ত অবস্থায় সে রেণুর সামনেই খারাপ ভাষা ব্যবহার করছে। সমস্ত পৃথিবীর ওপরেই তার একটা ঘৃণার ভাব। অন্যান্য মাতালদের মতনই তার মুখ দিয়ে ইংরেজির স্রোত বইছে। পৃথিবীতে সবাই বাস্টার্ড কিংবা সন অব এ বিচ! সকলেই নরকে যাবার যোগ্য।
বাদল বিরক্ত বোধ করতে লাগল। সূর্যদাকে নিয়ে বেশি বেশি বাড়াবাড়ি করা হচ্ছে। একসময় গোয়ারের মতন টেররিস্ট মুভমেন্টে গিয়েছিল, এখনও গোয়ারের মতন নিজেকে নষ্ট করতে চাইছে। একে আর পাত্তা দেওয়া উচিত নয়। রেণুকে অপমান করার কোনও অধিকার নেই সূর্যদার।
তবু পুরনো দুর্বলতায় বাদলের বুকটা মুচড়ে উঠল একবার। তার মনে হল, সূর্যদার জন্যই সে নিজেও কিছু করতে পারল না জীবনে। তার অনেক দিনের বিশ্বাস ছিল, সূর্যদা আর সে একসঙ্গে মিলে কোনও কাজে নামলে দারুণ কিছু করতে পারত! সে আবেগের সঙ্গে বলে ফেলল, সূর্যদা, কেন নিজেকে নষ্ট করছ। এখনও সময় আছে। আমরা একটা কিছু করতে পারি না? কোনও একটা কাজের মধ্যে না থাকলে তুমি শান্তি পাবে না! কী ব্যবসাট্যবসার কথা ভাবছ–এসব কি তোমাকে মানায়! তুমি আরও অনেক বড় কিছু করতে পারো। তোমার সঙ্গে যারা কাজ করেছে, যারা জেল খেটেছে–দেখো, তারা আজ অনেকেই দেশের হর্তাকর্তা–তুমি এখনও যদি একবার তাদের কাছে যাও, তাদের কিছু বুঝিয়ে বলো–
সূর্য উগ্র মুখ করে প্রচণ্ড জোরে বলল, হোয়াট? আমি কাদের কাছে যাব?
এখন যারা মিনিস্টার, তারা তোমার…
বাদল কথাটা শেষ করতে পারল না, সূর্য সারা মুখটা কুঁচকে বলল, শ্যাল আই, হু স্ট্রাক দা লায়ন, পে দা উলভস হোমেজ? বাস্টার্ডস! অল বাস্টার্ডস! তুই চাকরি করিস, তুই ওদের পা চাট গিয়ে!
অপমানে রক্তশূন্য হয়ে গেল বাদলের মুখ। সে রেণুর দিকে তাকিয়ে বলল, চলো, এখানে আর বসে থেকে কোনও লাভ নেই।
সূর্য হুংকার দিয়ে বলল, গেট দা হেল আউট অব হিয়ার! আমাকে আর কক্ষনও বিরক্ত করতে আসবি না আমি সাবধান করে দিলাম!
অন্য দিন সূর্য বেশি কথা বলে না কিংবা প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যায়। আজ নেশাগ্রস্ত অবস্থায় তার মাথায় রাগ চড়ে গেছে। বাদল আর রেণু চলে আসবার পরেও সে উন্মত্তের মতন চাচাতে লাগল। কীসের ওপর যেন সে দুম দুম করে ঘুষি মারছে। সারা বাড়ি কেঁপে উঠছে তার চিৎকারে।
সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে রেণু কম্পিত গলায় বলল, এ রকম করলে তো উনি পাগল হয়ে যাবেন!
সকালবেলা কোনও মাতালের চিৎকার শোনার অভিজ্ঞতা নেই রেণুর। তার অস্তিত্ব ও জগতে বড় রকমের একটা ধাক্কা লেগেছে। তার দু’চোখে ঘনিয়ে এসেছে করুণা।
রেণু বলল, আমাদের উচিত ওঁকে সাহায্য করা।
বাদল নীরস গলায় বলল, তুমি যাও–।
রেণু আবার ঢুকে গেল ঘরের মধ্যে। সূর্যর বাহুতে হাত রেখে বলল, সূর্যদা, একী করছেন? শান্ত হোন। আমরা ওই সব কথা আর কখনও বলব না।
বাদল আশঙ্কা করেছিল, সূর্য বোধহয় রাগের মাথায় রেণুকে ধাক্কা দেবে কিংবা চড় মেরেই বসবে। সূর্য তা করল না, রেণুর হাত সরিয়ে দিয়ে বলল, তুমি যাও।
রেণু দৃঢ় গলায় বলল, না, আমি যাব না। আপনি শান্ত না হলে আমি যাব না।
বাদল একটুক্ষণ স্থির ভাবে তাকিয়ে রইল ওদের দিকে। তারপর নীচে নেমে গেল। নিজের ঘরে গিয়ে বালিশের তলা থেকে টেনে বার করল খবরের কাগজটা। শেষ পৃষ্ঠার একটা ছবির দিকে চেয়ে রইল। সূর্যদার মন ফেরাবার জন্য এই একটাই মাত্র উপায় আছে বোধহয়। বারাসাতে একটি হাসপাতালের উদ্বোধন করছেন নতুন মন্ত্রী শংকরলাল বসু। তার পাশে দাঁড়ানো দীপ্তিদিকে স্পষ্ট চেনা যায়। সূর্যদা কি জানে, প্রায় দু’মাস আগে দীপ্তিদির সঙ্গে শংকরলাল বসুর বিয়ে হয়ে গেছে; কারওর কাছে থেকেও কি শোনেনি?
বাদল খবরের কাগজটা নিয়ে আবার ওপরে উঠে আসছিল, সিঁড়িতে পা দিয়েও ফের মত পালটাল। তার মুখ রাগে গনগন করছে। তবু সে খবরের কাগজটা ছিঁড়ে ফেলল টুকরো টুকরো করে।