অনেক দিন বাদে আমার বাবাকে খানিকটা উত্তেজিত এবং খুশি দেখা গেল। ব্যাপারটা আর কিছুই নয়। উনি আমার জন্য একটা চাকরি জোগাড় করে ফেলেছেন প্রায়।
ইদানীং বাবা-মা দুজনেই আমার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। সন্তানের জীবনের সুসামঞ্জস্য সম্পর্কে বাবা-মায়ের তো চিন্তা থাকবেই। আমাদের মতন পরিবারের ছেলেরা লেখাপড়া শেষ করে চাকরিতে ঢোকে, তারপর চাকরি পাকা হলেই বিয়ে করে, ক্রমে সে-ও সংসারী হয়। আর একজন বাবা হয়ে গিয়ে আবার নিজের ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করতে থাকে। কিন্তু আমার ব্যাপারে এটা ঠিক মিলছিল না। আমার পড়াশুনো মাঝপথে থেমে গেল, কিছু দিন কবিতাটবিতা লেখা, কিছুদিন রাজনীতি নিয়ে মেতে রইলাম–কোনওটাতেই বেশি দিন লেগে থাকতে পারি না। চাকরির ব্যাপারেও কোনও আগ্রহ নেই। দুটো-একটা টিউশানি করি, বাড়ির কাছ থেকে হাতখরচ চাইতে হয় না, এই যা।
বাবা আর মা ধরেই নিয়েছিলেন যে রেণুকে আমি বিয়ে করব–সেই জন্যই আমাকে একটা চাকরি খুঁজতে হবে মরীয়া হয়ে। কিন্তু চাকরির জন্য কখনও আমি গা করিনি এ-দিকে যখন বাবা-মা শুনতে পেলেন যে রেণুর বিয়ের জন্য ওর মা চেষ্টা করছেন। ইদানীং–তখন তারা রীতিমতন হতভম্ব হয়ে পড়লেন। আসলে, বাবা-মায়েরা তাদের যুবক সন্তানদের সম্পর্কে খুবই কম জানেন।
ইদানীং দেখতাম, বাবা প্রত্যেক দিন সকালবেলা খবরের কাগজে চাকরি খালির বিজ্ঞাপনগুলি খুব মনোযোগ দিয়ে পড়তেন। সে রকম বিজ্ঞাপন অবশ্য ক্রমেই কমে আসছে। মাঝে মাঝে বাবা কোনও একটা বিজ্ঞাপনের পাশে লাল দাগ দিয়ে আমার পড়ার টেবিলের ওপর কাগজটা ফেলে রাখতেন, কিন্তু তা নিয়ে আমি কখনও কোনও উচ্চবাচ্য করিনি। আমার বাবা নিজে কখনও চাকরিজীবনে সার্থক হতে পারেননি, এখানে-সেখানে টুকটাক কাজ করেছেন মাত্র। তবু শেষ জীবনে চাকরির ওপর তাঁর অগাধ বিশ্বাস দেখা গেল।
অবশ্য, এর একটা কারণও ছিল। দারিদ্র্যের ছায়া আস্তে আস্তে ঘনিয়ে আসছিল এ-সংসারে। আমরা পরের বাড়িতে থাকি। বাবার এখন নিজস্ব আর কোনও আয় নেই। একতলার দুটি ঘর ভাড়া দেওয়া হয়েছে, সেই টাকা খরচ হচ্ছে আমাদের সংসারে যদিও আইনত সে টাকা সূর্যদার প্রাপ্য। সূর্যদার পাত্তা নেই বহু দিন, ওই ঘর দু’খানা ভাড়া দেবার কথাও সে জানে না। আমার বাবার এই পরভৃতিক জীবনে সব সময় শঙ্কা লেগেই থাকে। প্রতিদিনই মনে হয়, আগামীকাল একটা সাঙ্ঘাতিক কিছু বিপদ ঘটবে। শেষ জীবনটাই বা কী ভাবে কাটবে? সূর্য বাইরে কোথাও থাকে, নিয়মিত ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলে নেয়। সেই ভাবেই যদি বাইরে থেকে হঠাৎ বিক্রি করে দেয় বাড়িটা? তখন কি পথে বসতে হবে? কাটার মতন এই চিন্তাটা বাবাকে সব সময় বিদ্ধ করে।
আমার হিসেবটা ছিল অন্য রকম। সূর্যদা আর কোনও দিন ফিরবে কি ফিরবে না, তার ঠিক নেই। যদি কখনও ফেরেও, বাবা-মাকে কখনও এ বাড়ির আশ্রয়চ্যুত করবে না। কারণ, বড়বাবু নিজে আমার বাবা-মাকে ডেকে এনেছিলেন। সুতরাং বাবা-মায়ের থাকার। জায়গার জন্য কোনও চিন্তা নেই। আর কীসের চিন্তা? বড়বাবু বাবার নামেও কিছু টাকা রেখে গিয়েছেন উইলে, ঠিক কত আমি জানি না-সাত হাজার বা দশ হাজার। এ ছাড়া বাবার একটা ইনসিয়োরেন্স ও মায়ের কিছু গয়না আছে–এ দিয়ে ওঁদের বাকি জীবনটা চলে যাবে। দিদি বিয়ের পর এখন বেশ ভালোই আছে, পর পর দুটি সন্তান হবার পর মাথার গোলমাল একেবারে সেরে গেছে। বাকি রইলাম আমি। আমি পৃথিবীর ভিড়ে মিশে যাব–আমার জন্য কারোকে ভাবতে হবে না। তা ছাড়া আমি তো এ-দেশে থাকছিই না।
বাবা নিজেই একটি চাকরির দরখাস্ত টাইপ করে এনে আমাকে বললেন, সই করে রাখ। সার্টিফিকেটগুলোও গুছিয়ে রাখিস। সন্ধ্যাবেলা তোকে নিকুঞ্জবাবুর বাড়িতে নিয়ে যাব।
নিকুঞ্জবাবু কে?
বাবা বললেন, দাদার বাড়িতে পূর্ণবাবু বলে একজন কাজ করত তার কথা তোর মনে আছে তো? সেই পূর্ণবাবুই নিকুঞ্জবাবুর সন্ধান দিলেন। পূর্ণবাবুর ছেলের চাকরি ও-ই করে দিয়েছে। নিকুঞ্জবাবুর হাত দিয়ে অনেক ছেলের চাকরি হয়েছে রেল কোম্পানিতে।
রেল এখন আর কোম্পানির নেই, সরকারের–তবু সেকথা পুরনো লোকদের মনে থাকে না। রেলের চাকরি এখনও নাকি দারুণ লাভজনক। বাবা যে চাকরির সন্ধান এনেছেন, সেটা কেরানিগিরি–কিন্তু উপরি আছে, তা ছাড়া আরও কত সুবিধে।
বাবার মুখের ওপর কিছুনা বললেও মাকে গিয়ে আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম, বাবা এসব কী শুরু করেছেন? এ-চাকরি আমি কিছুতেই করব না।
মা শুনে একেবারে আঁতকে উঠলেন। করবি না কী? আজকাল কেউ মাথা খুঁড়েও চাকরি পায় না আর এমন সোনার চাকরি তুই
সোনার চাকরি না ছাই! একটা কেরানিগিরি কি আমি নিজে চেষ্টা করলেও জোগাড় করতে পারতাম না?
পারলি কোথায়? এতদিন তো দেখলাম—
আমি কেরানিগিরি করতে চাই না।
কেরানিগিরি আবার কী? একশো সাতান্ন টাকা মাইনে হলেও নিকুঞ্জবাবু বলেছেন, মাস গেলে সাত-আট শো টাকা হাতে আসে।
এটা চাকরি, না চুরির ব্যবসা?
বাজে কথা বলিস না। আজকাল সবাই এই করে। তা ছাড়া, রেলের পাস—পাবি মা-বাবার জন্যও পাস দেয়–কোথাও তো কখনও বেড়াতে যাইনি–কতকালের ইচ্ছে একবার হরিদ্বার ঘুরে আসব।
মা, আমি তোমাকে একদিন না একদিন ঠিক হরিদ্বার ঘুরিয়ে নিয়ে আসব, কিন্তু তুমি আমাকে এ-চাকরি নিতে বোলো না!
মা আর কথা না বলে কাঁদতে বসলেন। কান্নার কাছে আর কোনও যুক্তি নেই। মায়ের কান্নার সময় যত রাজ্যের পুরনো কথা মনে পড়ে। কেন তার এই পরিবারে বিয়ে হয়েছিল, সেই আপশোস থেকে শুরু করে, কেন তার আজও মরণ হল না–এইখানে এসে থামে। আমি চুপ করে বসে রইলাম। কান্নার মধ্য দিয়ে মা এই কথাও জানালেন যে, আমি যদি বাবার সঙ্গে নিকুঞ্জবাবুর কাছে না যাই, তা হলে বাবা ভীষণ দুঃখ পাবেন মনে। একেই তো ওঁর শরীর আর মন দিন দিন ভেঙে যাচ্ছে। তা ছাড়া নিকুঞ্জবাবুকে এক হাজার টাকা ঘুষ দিতে হবে–কত কষ্ট করে সেই টাকা জোগাড় করেছেন–।
মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরা দুটি ব্যাপারে বাঁধা পড়ে যায়। এইসব পরিবারের মেয়েরা যতই প্রগতিশীলা হোক, বিয়ের সম্বন্ধের সময় মেয়ে-দেখার আসরে তাকে হাজিরা দিতেই হয়। তার কোনও আপত্তিই টেকে না। বরপক্ষের লোকের সামনে তাকে একবারনা-একবার সং সেজে দাঁড়াতেই হবে, না হলে তার মা বাবা যে মনে দুঃখ পাবেন।
ছেলেদের ব্যাপারেও তাই। বাবা যদি নিজে থেকে কারোকে ধরাধরি করে ছেলের জন্য চাকরির ব্যবস্থা করেন, ছেলেকে সেখানে একবার অন্তত যেতেই হবে। না হলে মা-বাবার মনে দুঃখ দেওয়া হয়।
মায়ের কান্না থামাবার জন্য আমাকে রাজি হতেই হল। নিকুঞ্জবাবু নামক লোকটিকে একবার অন্তত চোখে দেখবার লোভও আমি সামলাতে পারলাম না। লোকটি এক হাজার টাকা ঘুষ চায় চাকরি করে দেবার জন্য? গল্পেটল্পে এইসব লোকের কথা পড়েছি, কিন্তু সত্যি সত্যি কি এ রকম কেউ থাকে? এরা কী রকম মানুষ! বাইশ-তেইশ বছরেও ন্যায়-নীতি সতোর ওপর অগাধ বিশ্বাস থাকে। কোনও মানুষকেই কিছুতেই ঠিক অসৎ বলে মানতে ইচ্ছে করে না।
নিকুঞ্জবাবুর বাড়ি বন্ডেল রোড দিয়ে গিয়ে একেবারে রেললাইনের ধারে। বাড়িটি দোতলা এবং নতুন। ইনিও রেলের কেরানি–নতুন বাড়ি বানিয়েছেন। সে বাড়ির দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বাবা আমাকে সপ্তম বার মনে করিয়ে দিলেন যে নিকুঞ্জবাবুকে দেখামাত্রই যেন আমি প্রণাম করি। কারণ, উনি ব্রাহ্মণ। বড়বাবুর প্রভাবে বাবা একসময় অনেকখানি সংস্কারমুক্ত হয়েছিলেন–এখন বার্ধক্যের দুর্বলতায় আবার সব মিলিয়ে যাচ্ছে।
নিকুঞ্জবাবু ঘরে ঢুকেই বললেন, এ হে হে, আপনারা বড় দেরি করে ফেললেন। সাড়ে ছ’টার সময় আসতে বলেছিলাম আপনাকে।
বাবার মুখটা ম্লান হয়ে গেল। তখন সাতটা বাজতে দশ। বাবা শুকনো গলায় বললেন, এ-দিককার বাস এত দেরি করে আসে–তার ওপর আবার জ্যাম–
একটু আগেই আর একজন এসেছিল, তার একেবারে কান্নাকাটি করার মতন অবস্থা।
কিন্তু আমাকে কথা দিয়েছিলেন–
ঘরে সোফাসেট ছিল, কিন্তু নিকুঞ্জবাবু আমাদের বসতে বলেননি। মানুষটি বেঁটে ও রোগা–খুবই ছোটখাটো চেহারা, শরীরের তুলনায় মুখখানা আরও ছোট্ট মনে হয়। আমি ওঁর মুখখানা তন্ন তন্ন করে দেখতে চাইছিলাম, কিন্তু উনি কারওর চোখের দিকে সোজাসুজি তাকাতে পারেন না। এইসব মানুষ রাস্তায়ঘাটে খুবই অকিঞ্চিৎকর, ভিড়ের মধ্যে নগণ্য, পৃথিবীতে এদের ভূমিকা সম্পর্কেই সংশয় জাগে। সেই জন্যই এরা নানা রকম ষড়যন্ত্র ও পাঁচ কষে নিজেদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত করে। আমার বাবার মতন একজন মানুষকে কৃপাপ্রার্থী করতে পেরেছেন তো!
বাবা আমার দিকে বার বার চোখের ইশারা করছিলেন ওঁকে প্রণাম করার জন্য। আমি বাবার দিকে আর না তাকিয়ে একটা সোফায় বসলাম। তখন নিকুঞ্জবাবু বাবাকে বললেন, দাঁড়িয়ে আছেন কেন, বসুন না।
বাবা বিগলিত ভাবে বললেন, আপনি আমার ছেলেকে দেখতে চেয়েছিলেন, এই যে আমার ছেলে–
নিকুঞ্জবাবু আমার দিকে তাকালেন না। কিংবা উনি আমাকে আগেই দেখে নিয়েছেন। বাবাকে বললেন, আপনাকে কথা দিয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু একটু আগে আর একজন এসে পড়ল–সে আবার আমার ভায়রাভাইয়ের বন্ধুর ছেলে, এমন কান্নাকাটি করতে লাগল–।
বাবা বোধহয় চিন্তা করতে লাগলেন, তিনিও কান্নাকাটি করবেন কিনা। একটু ধরাধরা গলায় বললেন, আমি অনেক আশা করে এসেছিলুম–
তা তো ঠিক। কিন্তু একটা মাত্র পোস্ট খালি আছে। সেই কথাই তো চিন্তা করছি–
পূর্ণবাবু আমাকে বলেছিলেন, আপনি ইচ্ছে করলে ঠিকই পারেন। দরখাস্ত টরখাস্ত সবই নিয়ে এসেছি। বাদল, বার কর না।
আমি চুপ করে বসে রইলাম। নিকুঞ্জবাবু এবার আমার দিকে একপলক তাকালেন। তারপর বাবাকে আবার জিজ্ঞেস করলেন, ছেলের বিয়ে দিয়েছেন?
আজ্ঞে না। একটা চাকরি বাকরি না জুটলে—
আপনার তো এই একটিই ছেলে। বিয়ে দেবেন না? আমার হাতে ভালো সম্বন্ধ আছে–
নিকুঞ্জবাবুর কথার মধ্যে কোনও রকম ভদ্রতা সভ্যতার সম্পর্ক নেই। নিছক চাচাছোলা কাজের কথা ছাড়া আর অন্য কোনও কথাই উনি জানেন না। পৃথিবীতে আহে এই রকম এক ধরনের মানুষ, যারা চাকরি বা ব্যবসা, বাড়ি বানানো, ছেলেমেয়ের বিয়ে দেওয়া ছাড়া আর কিছুই জানে না।
বাবাও বুঝতে পেরেছিলেন যে, আমার সামনে ওই বিয়ের প্রসঙ্গটা তোলা একেবারেই ঠিক হয়নি। সেই জন্যই তাড়াতাড়ি প্রসঙ্গ পালটে ফেললেন।
বাবা বললেন, আপনার বাড়িতে মন্দির প্রতিষ্ঠা করবেন শুনছিলাম? পূর্ণবাবু বলছিলেন…
হ্যাঁ। মন্দির মানে কী, তিনতলায় একটা ঠাকুরঘর করে রাধামাধবের প্রতিষ্ঠা করব– আমাদের বংশের বিগ্রহ, এখন পড়ে আছে আমার ছোটকাকার কাছে। কিন্তু বাড়িটার দোতলা তুলতেই সব পয়সা খরচ হয়ে গেল। তাই লোকের কাছে চেয়েচিন্তে যদি জোগাড় করে ঠাকুরঘরটা তুলতে পারি–একটা ভালো কাজ তো, লোকে দেয়ও
তা তো বটেই, তা তো বটেই। ঠাকুর প্রতিষ্ঠা করবেন–এ রকম একটা ভালো কাজ উপলক্ষে সবাই যথাসাধ্য দেবে
কেউ কেউ দিচ্ছে—
আমিও এনেছিলাম হাজারখানেক—
নিকুঞ্জবাবু এবার একটু উৎসাহিত হয়ে উঠলেন মনে হল। আমার দিকে আবার একপলক তাকিয়ে বললেন, তা আপনাদের শুভেচ্ছায় যদি ঠাকুরের একটা জায়গা হয়–শুনুন, আপনার ছেলের চাকরি হয়তো হয়ে যাবে, তারপর ছেলের বিয়ে দেবেন।
বিয়ের কথা তো এখনও কিছু ভাবিনি—
ভাবুন, এখন থেকে ভাবুন বাবার জন্য আমার কষ্ট হতে লাগল। বাবা খুবই অসহায় অবস্থায় পড়েছেন। এই লোকটিকে আমার সামনেই ঘুষ দিতে যে তিনি মরমে মরে যাচ্ছেন, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। এদিকে, বাবা কিংবা মা ঘুণাক্ষরেও জানেন না যে, আমার বাইরে চলে যাবার ব্যাপারে অনেকখানি ঠিকঠাক হয়ে গেছে। পাসপোর্ট পর্যন্ত তৈরি।
নিকুঞ্জবাবু বললেন, ঠিক আছে, কাল ঠিক দশটায় ছেলেকে নিয়ে আসুন অফিসে। ঠিক কাঁটায় কাঁটায় দশটায়। আমেরি সাহেবের সঙ্গে দেখা করিয়ে দেব। আর একটা কথা। আপনিও বামুন, আমিও বামুন। আমেরি সাহেবকে বলব, এ-ছেলেটি আমার ভাইপো। ভেরি নিডি। চাকরি না হলেই নয়। আমেরি সাহেব যখন কিছু জিজ্ঞেস করবেন, তখন আপনার ছেলে যেন আমার ভাইপো হিসেবেই পরিচয় দেয়। ভাইপো ইংরেজি জানে তো?
সেই মুহূর্তে আমি কী করছিলাম, তা জানতে পারলে নিকুঞ্জবাবু আঁতকে উঠতেন। সোফার পাশেই জানলার বেদিতে আমি একটা ব্লেড পড়ে থাকতে দেখেছিলাম। সেখানে কে এবং কেন ওই ব্লেডটা ফেলে রেখেছে, আমি তা জানি না। কিন্তু ওটা দেখেই আমার কল্পনাশক্তি বেড়ে যায়। ব্লেডটা একসময় চলে এসেছে আমার হাতে। সম্প্রতি আমি ব্লেডটা দিয়ে ফালা ফালা করে চিরে দিচ্ছিলাম নিকুঞ্জবাবুর সোফার গদি। তবু আমার রাগ কমছিল না। আমি মনে মনে ঠিক করে রাখলাম, ঘুষের টাকায় নিকুঞ্জবাবুর তিন তলায় ঠাকুরঘর যে-দিন উঠবে–সে-দিন যে-কোনও উপায়ে এসে আমি লাথি মেরে ওর ঠাকুরকে উলটে ফেলে দিয়ে যাব।
ওর বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে বাস স্টপে দাঁড়িয়ে বাবা আমাকে উৎসাহের সঙ্গে বললেন, চাকরি শেষ পর্যন্ত হয়ে যাবে মনে হচ্ছে, না রে? কাল সকালে যখন যেতে বললেন–
আমি নীরস গলায় বাবাকে প্রশ্ন করলাম, আপনি টাকাটা ওকে দিয়ে দেননি তো?
না। কেন?
কাল সকালে আমি যাব না!
যাবি না? কী বলছিস কী, যাবি না?
না। এ-চাকরি আমি করব না।
বাবার সঙ্গে আমি কোনও দিন ঝগড়া করিনি, মুখে মুখে তর্কও করিনি। সেই প্রথম। আমার বাবা পৃথিবীর সব মানুষকে যেমন ভয় পান, সেই রকম আমাকেও ভয় পান। আমার শান্ত বিদ্রোহ দেখে তিনি রেগে উঠলেন না। স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে রইলেন শুধু। তারপর আস্তে আস্তে বললেন, তা হলে আমাকে এতদূর নিয়ে এলি কেন?
আমি কোনও উত্তর দিলাম না।
বাস এসে গেছে। আমি হাত দেখিয়ে বাস থামালাম। বাবা উঠে পড়ার পর আমি বললাম, আপনি যান, আমি একটু পরে যাচ্ছি।
বাস ছেড়ে দিয়েছে বলে বাবা আর নামতে পারলেন না। অনেকক্ষণ পর্যন্ত অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে।
আমার ইচ্ছে করছিল আবার নিকুঞ্জবাবুর বাড়িতে ফিরে যেতে। আমার শরীর রাগে জ্বলছিল। কিন্তু আমার রাগ বেশি হলেও মারামারি করার অভ্যাস নেই আমার। আমি হঠাৎ অন্ধের মতন ছুটে গিয়ে কারোকে আঘাত করতে পারি না। একা একা নিকুঞ্জবাবুর বাড়িতে ফিরে গিয়ে আমি কী বলব?
অনেকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়েছিলাম সেখানে। বাড়ি ফিরে আবার মায়ের কান্নাকাটির সম্মুখীন হওয়ার একটুও ইচ্ছে নেই। সমস্ত পৃথিবীর ওপর ঘৃণা বোধ হচ্ছে।
টো-টো করে বহুক্ষণ ঘুরে বেড়ালাম রাস্তায় রাস্তায়। যেন আমি শেষ বার কলকাতা শহরটাকে দেখে নিচ্ছি। তোমাকে ছেড়ে চলে যাব, তোমাকে ছেড়ে চলে যাব। আমি আর এখানে থাকব না, আমার কথা কেউ মনেও রাখবে না।
হাজরার মোড়ে এসে একজন মহিলাকে দূর থেকে দেখে বুকের মধ্যে ধক করে উঠল। মহিলার হাতে দু-তিনটে জামাকাপড়ের প্যাকেট, কোনও রকমে হাত তুলে ট্যাক্সি থামাবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হচ্ছেন। দীপ্তিদি না? হ্যাঁ, দীপ্তিদিই তো। দ্রুত এগিয়ে গেলাম সেদিকে।
দীপ্তিদিকে দেখে আমার বুক কেঁপে ওঠবার কারণ কী? জানি না। তবু কী রকম যেন একটা দুঃখ মুচড়ে মুচড়ে উঠতে লাগল। দীপ্তিদি যেন আমার অনেক দুর্ভাগ্যের জন্য দায়ী। আমার তো না, সূর্যদার। অথচ, মনে হয় যেন আমারও।
দীপ্তিদি সেই রকম আগেকার মতন সুন্দর আছেন। বয়স বাড়লেও এক একজন নারীর রূপ অম্লান থাকে। খুব সাধারণ সাজগোজেও কী অপরূপ লাবণ্যময়ী দেখাচ্ছে দীপ্তিদিকে। দীপ্তিদির পা দু’খানাও সুন্দর বার বার তাকাতে ইচ্ছে করে।
দীপ্তিদি।
আরে, বাদল না? কী খবর তোমার?
আপনি কলকাতায় কবে এলেন। আপনি তো জলপাইগুড়িতে থাকতেন।
কয়েক মাস ধরে কলকাতাতেই আবার চলে এসেছি।
সেই বাড়িতেই আছেন? আপনার হাতে এতগুলো প্যাকেট, দিন না, আমি ধরছি, পৌঁছে দিচ্ছি আপনার বাড়িতে।
না, বাদল, আমি সে বাড়িতে থাকি না। তোমাকে পৌঁছে দিতে হবে না, আমি ট্যাক্সি নেব। আমি এখন থাকি বালিগঞ্জ প্লেসে, একদিন এসো আমার বাড়িতে।
ট্যাক্সি ডেকে দেব আমি?
এই সময় আর একজন লোক এসে দীপ্তিদির হাতে একটা বিস্কুটের টিন দিয়ে বললেন, এটা ধরো। ট্যাক্সি পেলে না এখনও? ট্যাক্সি দাঁড় করাও, আমি আসছি, আর একটা জিনিস বাকি আছে।
লোকটিকে আমি চিনতে পেরেছি। ইলেকশানের দিন দেখেছিলাম, সেই শংকর বোস। একসময় সূর্যদাদের দলে ছিলেন, এখন কংগ্রেসের বড় ওয়াকার। ইলেকশানের সময় খুব নাম করেছেন। শুনেছি, কাশীপুরের বাই-ইলেকশানে উনি নিজেই এবার দাঁড়াবেন। জিতলে নির্ঘাত মন্ত্রী হবেন–এ রকম জোর গুজব। দীপ্তিদি শংকর বোসের সঙ্গে যাবেন।
আমি দৌড়োদৌড়ি করে একটা ট্যাক্সি দাঁড় করালাম। দীপ্তিদি জিনিসপত্র নিয়ে তার মধ্যে উঠে বসে বললেন, তুমি কোন দিকে যাবে, বাদল? তোমাকে নামিয়ে দিতে পারি।
না, আমি অন্য দিকে।
ট্যাক্সির পাশ থেকে সরে এসেছিলাম। আবার ফিরে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, দীপ্তিদি, আপনি সূর্যদার কোনও খবর জানেন?
দীপ্তিদি ভারী নরম ভাবে তাকালেন আমার দিকে। তারপর আস্তে আস্তে বললেন, আমিও তোমাকে সেই কথাটা জিজ্ঞেস করব ভাবছিলাম। কেন, সূর্য কলকাতায় নেই বুঝি?
না, সূর্যদা তো অনেক দিন কলকাতায় নেই। কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন– চিঠিও লেখেন না। আপনাকে চিঠি লেখেননি?
না–আমাকে লিখবে কেন?
দীপ্তিদি আর কোনও কথা না বলে মুখটা নিচু করলেন। দীপ্তিদি আমাকে ছেলেমানুষ ভাবেন। তাই আমার কাছে কিছু বলবেন না। উনি যেন সূর্যদাকে ভুলেই গেছেন, এই রকম ভাব দেখালেন। অথচ আমি তো সব জানি। এই সময় শংকর বোস এসে গেলেন, আমার দিকে একপলক তাকালেন, চিনতে পারলেন না। আমি সরে দাঁড়ালাম। আর কোনও কথা হল না, ট্যাক্সি ছেড়ে দিল।