হিমানী বললেন, তুই আমার গা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা কর।
বাদল এসে হাঁটু গেড়ে বসল খাটের পাশে। হিমানীর হাতের ওপর হাত রেখে বলল, মা, এই তো আমি তোমাকে ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করছি, আর এক মাসের মধ্যে আমরা অন্য বাড়িতে উঠে যাব। সূর্যদার বাড়িতে আর থাকব না।
বাড়ি খুঁজে পাবি?
হ্যাঁ, ঠিক পেয়ে যাব। আজ থেকেই খুঁজতে শুরু করছি।
বাদল আমি আর বেশি দিন বাঁচব না রে। শেষ ক’টা দিন আমাকে একটু শান্তি দে। আমার নিজের মনের মতন আলাদা একটা বাড়ি, নিজের সংসার সারা জীবনে কখনও পেলাম না। তুই এবার বিয়ে করবি না?
এখনও সময় হয়নি।
আর দেরি করিস না। আমাকে দেখে যেতে দে। আমিই এবার রেণুকে বলব। হারে, রেণুর মা নাকি ওর অন্য কোথায় বিয়ে দেবার চেষ্টা করছে?
কে বলল তোমায়?
বিছানায় শুয়ে থাকলেও অনেক কথাই আমার কানে আসে। কিন্তু রেণু লক্ষ্মী মেয়ে, ও কক্ষনও অন্য কোথাও বিয়ে করতে রাজি হবে না। রেণু ওই সুয্যিটার সঙ্গে এত মেলামেশা করে কেন? তুই বারণ করতে পারিস না? আজই বারণ করে দিবি।
আচ্ছা।
হিমানী আপন মনেই বলতে লাগলেন, কতদিন মেয়ে-জামাইকে ডাকতে পারিনি। নিজের একটা বাড়ি, সেখানে মেয়ে-জামাই আসবে, নাতি-নাতনি, ছেলে-ছেলের বউ থাকবে পাশে–মানুষ এইটুকু সুখ চায়, আমি তাও পেলাম না।
মা, এবার তুমি সব পাবে।
আলাদা সংসার হলে তুই খরচ চালাতে পারবি?
পারব। দুটো টিউশানি নিয়েছি!
বাদল মায়ের মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। হিমানীর মুখের রংটা যেন কেমন বদলে গেছে। ঠিক ফ্যাকাশে নেই আর, বরং খানিকটা অস্বাভাবিক রকমের উজ্জ্বল। কোনও সন্দেহ নেই মৃত্যু খুব কাছে এসে গেছে। আগে মায়ের গুরুতর অসুখের সময়ও বাদলেও একথা মনে হয়নি, কিন্তু এখন সে চিনতে পারছে মৃত্যুর ছায়া। মৃত্যু পথযাত্রিীকে যে-কোনও মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া যায়, এতে কোনও পাপ নেই। ভোগ করার জন্য যে বেঁচে থাকবে না, তার জন্য স্তোকবাক্যই তো যথেষ্ট।
মনের অনেক অনেক ভেতরে যেখানে কোনও প্রশ্ন পৌঁছোয় না, সেখানে বাদল টের পেয়ে গেছে যে তার মা-বাবা দুজনেই আর বেশিদিন থাকবেন না। কিছু দিনের মধ্যেই সে একা হয়ে যাবে। এই উপলব্ধি তাকে বিষণ্ণ করে না, বরং যেন একটা স্বস্তি দেয়। সে কি সন্ন্যাসীর মতন একা হয়ে যেতেই চাইছে না? রেণুও সেখানে নেই, তাই সে একাকীত্ব এত বিশাল। নিজেও সে অনুভবের মধ্যে বিশাল হয়ে ওঠে, অহংকারীর মতন উঁচু করে মাথা, একাকীত্বে সে স্রষ্টা হতে পারে। বাদলের সাজপোশাকে কোনও আড়ম্বর নেই, চেহারায় কোনও বৈশিষ্ট্য নেই, ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে যাবার মতন মানুষ, তবু সাংসারিক বন্ধন কেটে যাবার উপক্রম হওয়ায় সে মনে মনে গিয়ে দাঁড়ায় এক আদিগন্ত নির্জনতার মধ্যে, তার চিত্ত প্রশান্ত হয়ে যায়, কিছুই চাইবার কিংবা ত্যাগ করার নেই বলে সে অত্যন্ত শক্তিমান মনে করে নিজেকে। অসুস্থ মায়ের খাটের পাশে বসে বাদল হঠাৎ আপন মনে একটু হাসে।
রেণুর সঙ্গে দেখা হয় পরদিন সকালবেলা। বাদল তখন বেরোচ্ছিল, সিঁড়িতে পা দিয়েছে, নীচে দেখল রেণুকে। কয়েক মুহূর্তের জন্য সে থমকে দাঁড়াল। বিদ্যুৎচমকের মতন একটা কথা তার মনে আসে। রেণুদের বাড়িতে সে বহু বার রেণুকে সিঁড়ির ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে। সেই ছেলেবেলা থেকে। রেণুর কথা ভাবলেই একটা সিঁড়িতে-দাঁড়ানো মূর্তির ছবি তার চোখে ভাসে। কখনও ফ্রক পরা, কখনও শাড়ি। সিঁড়ির ওপর থেকে যেন ঝাঁপ দিয়ে উড়ে এসেছে তার কাছে। আজ রেণু নীচে দাঁড়ানো, সে সিঁড়ির ওপরে। এর কি কোনও তাৎপর্য আছে? কিছুই না, অত্যন্ত সাধারণ ব্যাপার–তবু এইসব নিয়েই বাদল চিন্তা করে।
রেণু জিজ্ঞেস করল, তুমি বেরোচ্ছ?
বাদল বলল, হ্যাঁ।
খুব জরুরি কোনও কাজ আছে?
হ্যাঁ, একটু।
বাদল কি আগে বহু বার বলেনি যে রেণুর সঙ্গে দেখা হলে পৃথিবীতে তার আর কোনও কাজ থাকে না। তা ছাড়া সে এমন কী কাজের মানুষ, যাতে তার জরুরি কাজ থাকবে? তবু এ-কথা সে কেন বলল, নিজেই জানে না।
এই সময় ওপরের সিঁড়িতে জুতোর শব্দ হল। বাদল দেখল সূর্যদা নেমে আসছে। সে পথ দেবার জন্য একটু দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়াল।
রেণু সূর্যকে জিজ্ঞেস করল, আপনিও এক্ষুনি বেরোচ্ছেন?
সূর্য বলল, হ্যাঁ।
একটু দাঁড়ান না, আপনার সঙ্গে আমার কয়েকটা দরকারি কথা আছে।
আমার সঙ্গে আবার কী কথা?
দশ মিনিট সময় দিতে পারবেন না?
রেণু বাদলকে থাকবার জন্য বলেনি, সূর্যকেই একটু অপেক্ষা করার জন্য অনুরোধ করছে। এজন্য কি বাদল দুঃখিত হবে? বাদল জানে, রেণু বিশেষ কিছু চিন্তা করে কথা বলে না। যত রাজ্যের চিন্তা শুধু বাদলেরই মাথায়।
বাদল একবার ভাবল, রেণুকে সে বলবে, তুমি আমার সঙ্গে বড়রাস্তা পর্যন্ত চলো, যেতে যেতে তোমার সঙ্গে কথা বলব। শুধু বড়রাস্তা কেন, বাদল রেণুকে সঙ্গে নিয়েই যেতে পারে তার জরুরি কাজে, অর্থাৎ ডাক্তারখানায় কিংবা পার্কে কিংবা চায়ের দোকানে। এই ভাবে সে রেণুকে সরিয়ে নিয়ে যেতে পারে সূর্যদার কাছ থেকে। সে তো পারেই। সে একদিন দেখেছিল, রেণু সূর্যদার বাহু চেপে ধরে মিনতি করছে। রেণু ছেলেমানুষ, সে সূর্যদাকে ভালো করতে চায়। রেণুকে কি ঠিক সময় সাবধান করে দেওয়া উচিত নয়?
বাদল রেণুকে কিছুই বলল না। ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল সূর্যদার দিকে। হঠাৎ সে দারুণ চমকে উঠল। সূর্যদার মুখের রংটাও বদলে গেছে না? অস্বাভাবিক রকমের উজ্জ্বল, ঠিক যেমন বাদল তার মায়ের মুখের রং বদলাতে দেখেছে! না, না, না, এই দুজনের মধ্যে কোনও মিল থাকতেই পারে না। সূর্যদা দীপ্তিদির সন্ধান পেয়ে গেছে, তাই উত্তেজনায় তার মুখচোখ অন্য রকম, বাদল তাই ভুল দেখেছে।
বাদল সূর্যকে কিছুই বলল না। সূর্য একদিন খুব অপমান করার পর বাদল তার সঙ্গে কথা বন্ধ রেখেছে। সে হালকা গলায় রেণুকে বলল, তুমি গল্প করো, আমি তা হলে বেরোচ্ছি, অ্যাঁ?
তরতর করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল সে। রেণু তার পাশ দিয়ে ওপরে উঠে এল।
রেণু সূর্যকে বলল, আপনি আপনার ঘরে চলুন।
রেণুর কণ্ঠস্বর পরিষ্কার, তার কথা আদেশের মতন। সে যা ভালো বোঝে, সেটাই জোর দিয়ে বলে। অন্য কে কী ভাবল না ভাবল, গ্রাহ্যই করে না।
সূর্য খানিকটা বিস্মিত, খানিকটা বিরক্ত ভাবে বলল, কেন।
রেণুর হাতে একটা ব্রাউন কাগজের প্যাকেট, সেটা এগিয়ে দিয়ে বলল, আপনার জন্য। একটা জামা এনেছি, চলুন একবার পরে দেখবেন, আপনাকে ঠিক ফিট করেছে কি না।
জামা? আমার জন্য? কেন?
আমি কদিন ধরেই আপনার একটা জামা কেনার কথা ভাবছিলাম।
তুমি আমার জামা নিয়ে ভাবছিলে?
আপনি সব সময় এই রকম একটা বিচ্ছিরি, নোংরা জামা পরে থাকেন কেন? আপনার বুঝি আর জামা নেই? আমি যে কদিন এসেছি, এই একটাই জামা দেখেছি।
দরকার হলে আমি কি জামা কিনতে পারি না! তোমার কাছ থেকে নেব কেন?
কেন, আমি দিলে নেওয়া যায় না? পরে দেখুন ঠিক হয়েছে কিনা, না হলে আজই বদলে আনব।
আমার সময় নেই।
রেণু সূর্যর হাত ধরে টান দিয়ে ধমকের সুরে বলল, একটা জামা পরে দেখারও সময় নেই? আসুন আমার সঙ্গে। এই দাড়িগোঁফের জঞ্জালও কেটে ফেলতে হবে আজ।
রেণুর পথটাই ঠিক। সূর্য যদি রেণুর কথা শুনে ওপরে উঠে আসত, তবে তার জীবন অন্য রকম হতে পারত। কিন্তু তার মুখের রং বদলে গেছে, সে চলে যাবেই। সে রেণুর কাধ আঁকড়ে ধরে নিষ্ঠুরের মতন বলল, দেখো খুকি, তুমি আর এ রকম কক্ষনও করবে না! আমি তোমার জন্য নয়!
স্বচ্ছ দিঘির জলে একটা বিরাট পাথর পড়েছে যেন। রেণু কেঁপে উঠে বলল, এ কী বলছেন আপনি?
আমি তোমার জন্য নই।
কে আবার কার জন্য?
আমার নিয়তি ঠিক হয়ে গেছে। তুমি আমার চোখের সামনে কখনও আর এসো না, তা হলে তোমাকে আমি ধ্বংস করে ফেলব।
রেণুর কাঁধটা সূর্য প্রায় খামচে ধরে আছে। রেণু শান্ত গলায় বলল, আপনি আমায় ছেড়ে দিন, আপনি পাগল হয়ে গেছেন।
সূর্য তবু রেণুকে ধরে ঝাঁকুনি দিতে দিতে বলল, আমি চাই না, আমি আর কারোকে চাই না, আমার কাছে কক্ষনও আসবে না–
রেণুর হাত থেকে জামার প্যাকেটটা নিয়ে সে ছুঁড়ে ফেলে দিল সিঁড়ির নীচে। চিররঞ্জন ঠিক সেই সময় বাড়িতে ঢুকছিলেন, জামাটা আর একটু হলে তার গায়ে লাগত। এই দৃশ্যের মধ্যে এসে পড়ে তিনি চোরের মতন সংকুচিত হয়ে দাঁড়ালেন। লজ্জায়, রাগে কেঁদে ফেলল রেণু। সেদিকে আর না তাকিয়ে সূর্য হনহন করে বেরিয়ে গেল।
বরানগরের বাড়িতে গেটের সামনে দাঁড়াতেই একজন পুলিশ সূর্যকে জানাল যে শংকরবাবু বা দীপ্তি কেউই বাড়িতে নেই। সূর্য প্রত্যেক দিনই আসে বলে প্রহরীরা তাকে। চিনে গেছে। তারা এ কথা বলল, যে পি. এ. বাবু অবশ্য আছেন, সূর্য ইচ্ছে করলে বসতে পারে।
সূর্য ভেতরে ঢুকে দাঁড়িয়ে রইল বারান্দায়। মন্ত্রীমশাই কখন ফিরবেন তার ঠিক নেই, কিন্তু দীপ্তি স্কুল ছুটি হলে ফিরবেনই। দীপ্তি কিছুতেই তাকে একা কথা বলার সুযোগ দিচ্ছে না।
একসময় রাখাল চট্টরাজ তাকে দেখতে পেয়ে বলল, আরে, আপনি বাইরে দাঁড়িয়ে কেন, ভেতরে এসে বসুন!
তার মালিকের সঙ্গে সূর্যর কী সম্পর্ক তা রাখাল চট্টরাজ এখনও ঠিক বুঝতে পারেনি, কিন্তু যেহেতু সূর্য দোতলায় উঠে যায়, তাই তাকে একটু খাতির দেখাতেই হয়।
সূর্য বলল, না, আমি এখানেই ঠিক আছি।
আপনার কি শরীর অসুস্থ নাকি?
না।
মুখচোখ কী রকম যেন দেখাচ্ছে। চা-টা কিছু খাবেন?
না।
রাখাল চট্টরাজ একটা দুর্বোধ্য মুখভঙ্গি করে আবার নিজের ঘরে ফিরে গেল। সূর্য সম্পর্কে তার কৌতূহল বাড়ছে। লোকটা আলাপ করতে গেলেও একটা-আধটার বেশি কথা বলে না।
সরকারি গাড়িতে শংকরবাবু দীপ্তিকে সঙ্গে নিয়েই ফিরলেন। সূর্যকে দেখে বললেন, কতক্ষণ এসেছ। শোনো, তোমার জন্য একটা কাজ ঠিক করেছি। দীপ্তি, তুমি সূর্যকে নিয়ে ওপরে যাও, আমি নীচে কাগজপত্তরগুলো একটু দেখে আসছি।
দীপ্তি বললেন, তোমাকে এখন আর কাগজপত্র দেখতে হবে না। ওপরে গিয়ে একটু বিশ্রাম নেবে চলো।
আমি তো ক্লান্ত হইনি।
একঘণ্টা ধরে বক্তৃতা করলে, তারপর এক্ষুনি ফিরে এসে কাজ নিয়ে আর বসতে হবে না। আবার তো বিকেলেই বেরোতে হবে।
শংকরবাবু হেসে বললেন, ঠিক আছে, চলো তা হলে, সূর্যর সঙ্গেই কাজের কথাটা সেরে ফেলা যাক।
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে তিনি নিচু গলায় সূর্যকে বললেন, সি. ডি. পি.-তে একটা ভালো কাজ খালি আছে, তুমি নেবে?
সূর্য জিজ্ঞেস করল, সি. ডি. পি. কী?
কমুইনিটি ডেভেলাপমেন্ট প্রজেক্ট। মাইনে ভালোই, কাজটাও খারাপ না।
চাকরি?
তোমার বুঝি চাকরি করতে ইচ্ছে করে না? স্বাধীন দেশের সরকারি কাজটাও এক হিসেবে দেশেরই সেবা করা।
শংকরদা—
কিছু বলতে গিয়েও সূর্য থেমে গেল। শংকরবাবু একটুক্ষণ উৎসুক ভাবে তাকিয়ে রইলেন তার দিকে। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, কী, বলো?
আপনি কি সুখী?
তার মানে?
আপনি কি সত্যিই ভাবছেন, আপনি দেশের জন্য কিছু করতে পারছেন?
একথা জিজ্ঞেস করছ কেন?
আমি তো সব ছেড়েছুঁড়ে দিয়ে চলেই গিয়েছিলাম। কিন্তু আপনার এখানে পর পর কয়েক দিন এসে আমার কী রকম খটকা লাগছে। আমাদের আমলের লোকেরা সত্যি কী করছে দেশের জন্য? তারা তো কেউ ভণ্ড ছিল না।
আমার যতটা সাধ্য আমি তা করছি। এক একটা রাতে আমার ঘুম আসে না। দীপ্তি জানে, আমি মাঝরাত্রে জেগে উঠে বসে থাকি। আমি ভাবি, এই দেশের এত সমস্যা, ভাষার সমস্যা, ধর্মের সমস্যা, সবচেয়ে বড় সমস্যা হল মানুষকে দু’বেলা দুটো খেতে দেওয়াকী করে এর সমাধান হবে–তবু আমাদের যার যতটুকু সাধ্য–
শংকরবাবুর মুখে একটা আন্তরিক দুঃখের ছায়া পড়ে, কিন্তু সূর্যর মুখে স্পষ্ট বিদ্রূপ।
শংকরদা এটা কি স্বাধীন দেশ? এ-দেশের মানুষ কী পেয়েছে?
আরে, আস্তে আস্তে সব হবে। এটা একটা শিশু রাষ্ট্র, মাত্র ছ’ বছর বয়স।
যুদ্ধে যে-সব দেশ ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছিল, যেমন জার্মানি, জাপান, চিনতারা এই কয়েক বছরেই–
আমাদের দেশটার সমস্যা আরও অনেক জটিল।
কথা বলতে বলতে ওরা দোতলার বারান্দায় এসে বসে। শংকরবাবু বিশ্রাম নেবার ভঙ্গিতে ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে বসে পা ছড়িয়ে দিয়েছেন। দীপ্তি তিনটি গেলাসে লেবুর শরবত বানাচ্ছেন! সূর্য দীপ্তির দিকে একবারও তাকায়নি, সে তীব্র চোখে চেয়ে আছে শংকরবাবু দিকে। সে আবার বলল, শংকরদা, সেই দিনের কথা আপনার মনে। আছে? খিদিরপুরে সিয়াজুল তারিখ সাহেবের দোকানঘরে বসে আপনি আমাকে বিদ্রূপ করে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আমি অ্যাকশনে যেতে ভয় পাব কিনা? আমি ভয় পাইনি। আমি এখনও তৈরি আছি, আপনি আমাকে আবার অ্যাকশনে পাঠান।
শংকরবাবু হো হো করে হেসে উঠলেন। তারপর বললেন তুমি কি স্বপ্নের ঘোরে আছ। নাকি? সেসব দিন কবে চুকেবুকে গেছে। এখন অ্যাকশন বলতে কী বোঝাচ্ছ তুমি? এখন কি খুনোখুনির সময়? এখন দেশ গড়ার সময়।
না, এখন ভাঙার সময়।
কী ভাঙবে?
কুমিরের বাসা। যে-সব কুমিররা দেশের সবকিছু গিলে গিলে খাচ্ছে, তাদের বাসাগুলো আগে চুরমার করে দিতে হবে!
এসব সস্তা কথা। অ্যাকচুয়াল কাজ হাতে নিয়ে আমরা দেখছি…
আপনারা কোনও কাজই হাতে নেননি। আপনারা শুধু পারমিটের কারবার করছেন।
দীপ্তি মৃদু গলায় বললেন, সূর্য, তুমি বড্ড জোরে কথা বলছ। চঁচামেচি করলেই সবকিছুর সমাধান হয় না। তা ছাড়া তুমি তো রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামাতে না, তুমি তো সব ছেড়ে দিয়েছিলে।
তা হলে শংকরদারও ছেড়ে দেওয়া উচিত।
শংকরদা হাত উঁচু করে দীপ্তিকে থামার ইঙ্গিত করে বললেন, শোনেনা সূর্য, গণতন্ত্রে পার্টিই প্রধান। পার্টিকে শক্ত না করতে পারলে কোনও কাজই করা যায় না। তুমি একবার পার্টিতে ঢুকে দেখো, সবাইকে সামলে কাজ করা কত শক্ত। বিধানবাবু পর্যন্ত সব সময় পার্টিকে সামলাতে পারেন না। যাই হোক, তুমি কী কাজ করতে চাও সেটা বলো। তোমার জন্য আমি কিছু একটা ব্যবস্থা করে দিতে পারব।
আমি ফাইটার। আমি লড়াই করতে চাই।
কী মুশকিল, এখন কার সঙ্গে লড়াই করবে? হাওয়ার সঙ্গে? পুরনো সেসব কথা মাথা থেকে একেবারে তাড়িয়ে দাও! সে-আমলে দু’চারটে খুনোখুনি করে আমরা দেশের কী উপকার করতে পেরেছি?
জানি, এই কথাই এখন আপনারা বলবেন। সেই জন্যই হরদা, ব্রজগোপালদা, যোগানন্দ–এদের নামও কেউ আজকাল উচ্চারণ করে না। ওরা জীবন নষ্ট করেছে।
তুমি এখনও তোমার জীবনটা অন্তত ঠিক করতে পারো চাকরি নিয়ে?
তা হলে কী করতে চাও? বেশ তো গ্রামে যাও না—
শংকরদা, আপনি হাতের আঙুল কেটে একসময় প্রতিজ্ঞা করেননি?
দীপ্তি আবার বাধা দিয়ে বললেন, এসব এখন থাক।
শংকরবাবু প্রশ্রয়ের সুরে বললেন, আহা কী বলতে চায়, বলুক না। ছেলেটা আজ বড্ড রেগে আছে।
সূর্য হঠাৎ চুপ করে গেল। তারপর সে একটা দুঃসাহসিক কাজ করল। সিগারেট ধরিয়ে দূরের অ্যাশট্রেতে দেশলাইয়ের কাঠিটা ফেলার ছলে উঠে গিয়ে দীপ্তির কাঁধে হাত রাখল। দু’-এক মুহূর্তের জন্য। দীপ্তি একেবারে শিউরে উঠলেন। শংকরবাবুর মুখটা তখন অন্য দিকে ফেরানো ছিল, তিনি কিছুই টের পেলেন না।
দেশের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে করতে সে কোন অতর্কিতে উঠে এসে দীপ্তিকে স্পর্শ করে, তা ঠিক বোঝা যায় না। হয়তো এই বিশাল দেশটির মর্ম সে এখনও ঠিক বুঝতে পারছে না বলেই দীপ্তিকে ছুঁয়ে সে বাস্তবে ফিরে আসে। শংকরবাবু এই দেশ এবং দীপ্তি নামক এই নারী–দু’জনের ব্যাপারেই বেশ নিশ্চিন্ত এবং তৃপ্ত–আর সূর্যর চোখে বিশাল মরুভূমির মতন অতৃপ্তি হা হা করে জ্বলে।
শংকরবাবু একটা হাই তুলে বললেন, আজ বিকেলেই নদিয়ায় যেতে হবে। কৃষ্ণনগরে একটা কনফারেন্স আছে কাল সকালে।
সূর্য সঙ্গে সঙ্গে বলল, আমাকেও সেখানে নিয়ে চলুন।
তুমি যাবে? তুমি গিয়ে কী করবে?
এমনিই যাব।
জরুরি সব সরকারি কাজ, তার মধ্যে তুমি, মানে তোমারই ভালো লাগবে না।
দীপ্তি মাথা নেড়ে বললেন, না, তা হয় না। আমাদের ওখানে তিন-চার দিন থাকতে হতে পারে।
নীচে থেকে একজন পরিচারক এসে শংকরবাবুর হাতে একটা স্লিপ দিল। দু’জন এম. এল. এ. এসেছেন দেখা করতে, এঁদের বসিয়ে রাখা যায় না। শংকরবাবু ব্যস্তসমস্ত হয়ে নেমে গেলেন।
শংকরবাবু যাবার সঙ্গে সঙ্গে দীপ্তিও উঠে দাঁড়িয়েছেন। গম্ভীর ভাবে তিনি বললেন, সূর্য, তুমি রাজনীতি নিয়ে আর আলোচনা কোরো না। ওসব তোমার জন্য নয়। তোমার মাথা গরম। তুমি তো ওসব ছেড়েই দিয়েছিলে।
হ্যাঁ দিয়েছিলাম।
তা হলে আবার…
এখানে কয়েক দিন এসে আবার বুঝতে পারলাম তো, কী সব কাণ্ড কারখানা চলছে।
তা হলে এখানে আর না আসাই ভালো—
এখানে আসব না? আমি কোথায় যাব।
তা তুমিই জানো।
তুমি আমাকে এখানে আসতে বারণ করছ?
সূর্য, আমরা শান্তিতে আছি, কেন তুমি তা ভেঙে দিতে চাও।
হ্যাঁ, আমি ভেঙে দিতেই এসেছি। সবাই সব কিছু পাবে, আর আমি বুঝি কিছুই পাব না? আর আমি আমার অধিকার ছাড়ব না।
কী তোমার অধিকার?
আমি তোমাকে চাই, অথবা শংকরদাকে চাই। তোমরা একসঙ্গে কিছুতেই থাকতে পারবে না। কিছুতেই না।
এসব কী বলছ পাগলের মতন?
মোটেই পাগলের মতন নয়। আমরা হরদার সামনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম দেশের জন্য প্রাণ দেব। রাইটার্স বিল্ডিংসয়ের গদিতে বসে বাবুগিরি করার তো কথা ছিল না! একসময় আমি ভেবেছিলাম, দেশের স্বাধীনতা এলেই আমাদের কাজ শেষ। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি, স্বাধীনতা আজও আসেনি, নানা চক্রান্তের জালে মানুষকে আরও বেঁধে ফেলা হচ্ছে। আমি শংকরদাকে ওই গদি থেকে টেনে নামাব।
তুমি এখনও ছেলেমানুষ আছ। তুমি কিছুই পারবে না। আমার স্বামী সত্যিই খাঁটি লোক, তিনি তার মতন এ-দেশের উন্নতির জন্যই কাজ করে যেতে চান। তিনি যে। তোমার সঙ্গে এতটা ভালো ব্যবহার করছেন…
ভালো ব্যবহার নয়, দয়া করছেন, কৃপা করছেন। উনি তোমাকে কেন কেড়ে নিয়েছেন আমার কাছ থেকে?
কেড়ে তো নেননি? আমি স্বেচ্ছায়—
সূর্য চিৎকার করে উঠল, দীপ্তিদি–।
তারপর চোখ বুজে রইল কিছুক্ষণ। তার সেই চিৎকার নিশ্চয়ই নীচতলা থেকে শুনতে পাওয়া গেছে। তবু শংকরবাবু তৎক্ষণাৎ উঠে এলেন না।
সূর্য চোখ খুলে ধীর স্বরে বলল, তোমার স্বামী যদি এইসব মন্ত্রিত্ব ফন্ত্রিত্ব ছেড়েছুঁড়ে না দেন, তা হলে ওঁকে আমি খুন করব। নিশ্চিত খুন করব–এ-বিষয়ে মনে কোনও সন্দেহ রেখো না।
দীপ্তি কেঁপে উঠলেন। কয়েক পা এগিয়ে এসে ব্যাকুল ভাবে বললেন, তুমি এসব কী বলছ? সূর্য, আমার দিকে তাকাও–
দীপ্তি ভয় পেয়েছেন। সূর্যকে তিনি ভালো ভাবেই চেনেন। সে একটা গোঁয়ার, এ রকম কিছু করে ফেলা তার পক্ষে মোটেই অসম্ভব নয়। দীপ্তি সূর্যর পিঠে হাত রাখলেন।
সামান্য একটা ছোঁয়ায় কী হয় মানুষের? শান্ত শরীরে হঠাৎ কেন মনে হয় এত লক্ষ লক্ষ স্নায়ু সত্যিই ছিল। এত শান্তি, এত আকাঙ্ক্ষা, এত অতৃপ্তি। নদীর ওপরে পড়েছে জ্যোস্নার আলো, যেন সেইখানে কেউ ডাক দিয়েছে।
সূর্য সেই হাতটা ধরে ফেলে বলল, ওকে আমি ছেড়ে দিতে পারি মাত্র একটা শর্তে–যদি তোমাকে ফিরিয়ে দেয় আমার কাছে। আমাকেও তো কিছু পেতে হবে। সবাই সবকিছু পাচ্ছে, আর আমি কিছু পাব না?
দীপ্তি হাতটা আবার সরিয়ে নিলেন। বললেন, তা হয় না।
তারপর একটু থেমে আবার বললেন, আমি একটা সামান্য মেয়ে, তার জন্য তুমি এ রকম করছ কেন? তুমি তো ইচ্ছে করলে অনেক কিছুই পেতে পারো।
আমি তোমাকেই চাই।
আমি কেউই না।–
দীপ্তি নিজেকে কঠোর করে বললেন, সূর্য, তুমি এ বাড়িতে আর এসো না। আমি বলছি, তুমি কক্ষনও আসবে না।
আমি আসবই!
না, আসবে না। পাহারাদারদের বলে দিলে তোমাকে আর ঢুকতেই দেবে না ওরা। সেটা কি তোমার পক্ষে খুব সম্মানজনক হবে?
ভিখিরির আবার মানসম্মান কী। কিন্তু তুমি জেনে রেখো, আমি আসবই, কেউ আমাকে আটকাতে পারবে না।
আমরা এখান থেকে চলে যাব। কলকাতাতেই থাকব না।
তুমি যেখানেই যাও–
না। আমি মিনতি করছি, এ রকম কোরো না।
বললাম না, আমি আর আমার অধিকার ছাড়ব না।
তোমার কোনও অধিকার নেই।
তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে সূর্য দীপ্তির থুতনিটা ধরে উঁচু করে বলল, আমার চোখের দিকে তাকাও, তাকিয়ে বলো তো, কোনও অধিকার নেই? একদিন তুমি বলোনি যে তুমি আমাকে ভালোবাসো? বলোনি, যে তোমার আর আমার জীবন এক হয়ে গেছে? তুমি আমার বুকে মাথা রাখোনি? তুমি বলোনি, মাঝ রাত্রে আমার ঘুমন্ত মাথার পাশে এসে বসে থাকতে তোমার ইচ্ছে করে? তবে তুমি কেন আমার জন্য অপেক্ষা করলে না?
দীপ্তি আর কথা বলতে পারলেন না। সূর্যর উন্মাদের মতন দৃষ্টিও সহ্য করতে পারলেন না তিনি। মুখ ফেরালেন। চোখ দিয়ে অজস্রধারে জল পড়তে লাগল। এই অশ্রুময় মুখের কোনও উপমা নেই।
সূর্য দীপ্তির কোমরের দিকে হাত বাড়াল। মুহূর্তের মধ্যে সে বোধহয় দীপ্তিকে আঁকড়ে এনে বুকে চেপে ধরত। ওই শরীরের রমণীটি তার জীবনসর্বস্ব। জিভ দিয়ে ওই মুখের অশ্রু মুছে নেবার জন্য তার এক জীবনব্যাপী সাধ। তবু এই সময়েই সিঁড়িতে পায়ের শব্দ ওঠে। সূর্যকে সরে যেতে হয়। চাপা গলায় সে বলে, আমি নষ্ট হয়ে যাব, আমি কুকুরের মতন মার খেয়ে পালাব–আর তোমরা এখানে আরামে থাকবে–শান্তিতে থাকবে তা আমি সহ্য করব ভেবেছ? কিছুতেই না।
দীপ্তি চোখের জল মুছে ফেলার কোনও চেষ্টা করলেন না। তার স্বামী এসে তাকে। দেখতে পেলেন সেই অবস্থায়। ঈষৎ ঠাট্টার সুরে তিনি বললেন, কী, সূর্য বুঝি তোমাকে পুরনো সব কথা মনে পড়িয়ে দিয়েছে?
যেন হাসির কথা, এই ভাবে তিনি শুকনো গলায় হাসলেন এর পরে।
সূর্য শংকরবাবুর দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল, এই দয়ালু, উদার, পরোপকারী, দেশের সেবকটিকে আমি খুন করব। নিশ্চিত খুন করব। এ দীপ্তিদিকে ছুঁয়েছে। আমার কথা জানার পরেও ছুঁয়েছে। এই লোকটি তার মাথার পেছনে দেশ নামক একটা ছবি টাঙিয়ে রাখে সব সময়। দেশ মানে ভণ্ডামি, দেশ মানে অহংকারে সুড়সুড়ি–এসব আমি জেনে গেছি।