মহীশূরে সুব্রতদাদের বাড়িতে থাকার বদলে আমি যদি কোচিনের কোনও হোটেলে উঠতাম, তা হলে আমার ভবিষ্যৎ জীবনটা অন্য রকম হত। মায়ের অসুখের খবর কোনও ক্রমে আমার কাছে পৌঁছোত না, আমি বিদেশের পথে পাড়ি জমাতাম। আর কোনও দিন ফিরতাম কিনা কে জানে! কোচিনে কোনওক্রমে আমার কাছে খবর পৌঁছোলেও সেখানে আমি অন্য রকম সিদ্ধান্ত নিতে পারতাম, একা হোটেলের ঘরে নিজেকে প্রশ্ন করতে পারতাম আমি। কিন্তু এখানে সুব্রতদা, সুধাদি, যমুনা ও সরস্বতী তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
সুব্রতদা জিজ্ঞেস করলেন, তা হলে কী করবে? আমার তো মনে হয়, তোমার ফিরে যাওয়াই উচিত।
আমার মুখে কোনও উত্তর এল না। ওরা কেউ দেখতে পাচ্ছে না, আমার পা কাঁপছে, গলা শুকিয়ে এসেছে। একতাল ছানা কাপড়ে জড়িয়ে নিংড়ে নিংড়ে যেমন জল বার। করে, সেই রকম ভাবে আমার ভেতরটা কেউ নিংড়োচ্ছে। মায়ের অসুখ, আমার উচ্চাকাঙ্খ এবং সুব্রতদারা কী মনে করেছেন, এই তিন রকমের চিন্তা আমাকে দিশেহারা করে দেয়। আমি এত ভাবতে পারি না, এত দায়িত্ব, এমনকী নিজের সম্পর্কেও, নেবার অভ্যাস নেই আমার।
সুধাদি কিংবা যমুনাসরস্বতী আমার টেলিফোনের বৃত্তান্ত জানে না। যমুনা বলল, কী হল? বাদলদা, আপনার বিলেত যাওয়া হবে না?
আমি দু’দিকে মাথা নাড়লাম। অর্থাৎ, আমার আর কিছুই হবে না।
এরপর সকলে মিলে ঝাঁকে ঝাঁকে প্রশ্ন করতে লাগল আমাকে। সুধাদি যখন জানলেন যে আমি বাড়িতে কারোকে কিছু না জানিয়ে চলে এসেছি, তখন রেগে গেলেন খুব। আমাকে আশ্রয় দেবার জন্য যেন তিনিও অপরাধী। তৎক্ষণাৎ সুব্রতদাকে বললেন, তুমি ট্রেনের খোঁজ করো। ওর এক্ষুনি বাড়ি ফিরে যাওয়া উচিত।
সুব্রতদা একটা উপায়ান্তর খুঁজে বার করলেন। তিনি জাহাজ কোম্পানিকে টেলিফোন করে দেখবেন, টিকিটি ক্যানসেল করা যায় কিনা। সেটা সম্ভব হলে তিনি দু’-তিন মাস পরে আবার কোনও জাহাজে সিট বুক করে রাখবেন। ইতিমধ্যে আমি বাড়ি থেকে ঘুরে আসব এবং মায়ের অসুখ নিশ্চয়ই সেরে যাবে।
ট্রেন রাত তিনটেয়। সুব্রতদাদের বাড়ির সকলে মিলে আমাকে তুলে দিতে এল স্টেশনে। যমুনা আর সরস্বতীর সঙ্গে এই ক’দিনে আমার বেশ একটা বন্ধুত্বের মতন হয়ে গিয়েছিল। ওদের মুখ দেখে বোঝা যায়, আমার বিদেশ যাওয়া হল না বলে ওরা খুব দুঃখিত হয়েছে। আন্তরিক দুঃখ। কেউ কোথাও আমার জন্য দুঃখ পেয়েছে–এটা টের পেলেই মনের মধ্যে অসম্ভব একটা মায়া জেগে ওঠে কেন?
ফেরার পথ সম্পূর্ণ অন্য রকম। আমার চিন্তাশক্তিও যেন অসাড় হয়ে গেছে। বার বার একটা ছবিই ভেসে আসছে চোখের সামনে। আমি ফিরে গিয়ে মাকে আর দেখতে পাব। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, শ্মশান থেকে ফিরে সবাই নিশ্ৰুপ হয়ে বসে আছে সিঁড়ির ওপরে। আমাকে দেখে বাবা বললেন, যদি এত দেরিই করলি, তা হলে আর এলি কেন?
বাঙ্কের ওপর শুয়ে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। একজন সহযাত্রী আমাকে ঠ্যালা দিয়ে জাগিয়ে তুলে জিজ্ঞেস করল, ও ভাই, কী হয়েছে আপনার? অসুখ করেছে?
আমি কোনও উত্তর দিতে পারলাম না।
ছোটখাটো একটা ভিড় জমে গেছে আমার কাছে। নানা প্রাদেশিক ভাষায় নানা প্রশ্ন। আমি ঘুমের মধ্যে কাঁদছিলাম ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। সেই জন্যই সহযাত্রীরা আমার সম্পর্কে উদ্বিগ্ন হয়েছে। আমার অসম্ভব লজ্জা করতে লাগল। ইস, এরা কী ভাবছেন–এত বড় একটা ছেলে ঘুমের মধ্যে কাঁদে? অনেকেই অবশ্য ধরে নিয়েছেন, আমি কোনও অসুখের কষ্ট পাচ্ছি। এঁরা কেউ জানেন না, আমি সদ্য-মাতৃহীন। একজন মাদ্রাজি ভদ্রলোক অতি সহৃদয় ভাবে প্রশ্ন করলেন, আপনার কি পেটব্যথা করছে? আমার কাছে ভালো ওষুধ আছে।
আমি পেটের ব্যথার কথাই স্বীকার করলাম। মানুষের মনের কষ্টের কথা অন্য কারোকে বোঝানো যায় না, তাই শারীরিক কষ্টের কথাই সকলে জানতে চায়। মাদ্রাজি। ভদ্রলোক একটা টিনের কৌটো থেকে কী একটা কালো গুঁড়ো মশলার মতন বার করে। দিলেন, খেয়ে ফেললাম বিনা দ্বিধায়। জিনিসটা বেশ সুস্বাদু। হাত বাড়িয়ে বললাম, আর একটু দিন।
দু’দিন ট্রেন জার্নির পর অস্নাত রুক্ষ চেহারায় পৌঁছোলাম কলকাতায়। ট্যাক্সি যখন বাড়ির সামনে থামল, তখন পর্যন্ত আমার বুকের মধ্যে কঁপুনি ছিল। কিন্তু বাড়ির দিকে একবার তাকিয়েই আমার মনে হল, এটা শোকের বাড়ি নয়। এখানে মৃত্যুর গন্ধ নেই। যদিও সদর দরজা বন্ধ, বাইরে কেউ নেই, দু-এক দিন আগে কোনও ঘটনা ঘটে গেলে বাড়ি এ রকমই থাকবে–তবু শোকের বাড়ি দেখলে চেনা যায়। মৃত্যু যেখানে একবার আসে, সেখানে দরজায় চিহ্ন থাকে।
তখন আমার মনে হল, মায়ের অসুখের কথাটাই পুরোপুরি মিথ্যে। খবরের কাগজের ‘খোকা ফিরে এসোর বিজ্ঞাপনের মতন! সামান্য মিথ্যে কথায় আমার বিদেশ যাত্রা বন্ধ করে দেওয়া হল? আমি কাল-পরশুই আবার তা হলে ফিরে যাব।
একটু জোরেই দরজায় ধাক্কা দিয়েছিলাম। দরজা খুলে দিলেন বাবা। শুধু বললেন, এসেছিস?
এখানকার সব খবর ভালো তো?
এই এক রকম।
আমি তখনও দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে। দরজার ওপাশে বাবা। ট্যাক্সির ভাড়া মেটানো হয়নি। আমি আবার ছুটে গিয়ে ট্যাক্সিতে উঠে পড়ব? এ বাড়ির সঙ্গে আমার আর সম্পর্ক কী? আমি এ বাড়ির কেউ না–আমি এত কষ্ট করে ফিরে এলাম, বাবা যেন সেটা গ্রাহ্যই করছেন না। শুধু আমার দিকে অপলক ভাবে তাকিয়ে আছেন।
ট্যাক্সিওয়ালা হর্ন দিতেই আমি সজাগ হলাম। হঠাৎ নাটকীয় কিছু করে ফেলা আমার ধাতে নেই। ট্যাক্সিভাড়া মিটিয়ে সুটকেসটা নামিয়ে নিলাম। বাবা দরজার সামনে থেকে। সরে দাঁড়িয়েছেন। একবার শুধু বললেন, সুটকেসটা আমাকে দে।
আমি বললাম, না ঠিক আছে। আমিই নিচ্ছি।
সিঁড়ি দিয়ে বাবার পেছনে পেছনে ওঠবার সময় আর একটাও কথা হল না। দোতলায় ওঠার ঠিক আগেই মনে হল, বাবাকে আমার প্রণাম করা উচিত ছিল। বরাবরই তো এ। রকম হয়ে এসেছে, বাইরে থেকে ফিরেই বাবাকে-মাকে প্রণাম করেছি। দরজা খোলার পরই বাবা সেই জন্যই বোধহয় আর কোনও কথা না বলে আমার প্রণামের অপেক্ষায় ছিলেন। আমি ভুলে গিয়েছিলাম। এসব আর এখন আমার মনে থাকে না। মাত্র বছর। খানেকের মধ্যে বাবার সঙ্গে আমার কতটা দূরত্ব তৈরি হয়ে গেল। এখনও সুটকেসটা। নামিয়ে রেখে প্রণামটা সেরে ফেলা যায়। সুটকেসটা নামিয়েও রাখলাম কিন্তু বাবা তখন বারান্দা দিয়ে অনেকখানি এগিয়ে গেছেন। প্রণাম করার জন্য কেউ কি গুরুজনদের ডাকে?
মায়ের ঘরে বড়মামা আর বড়মামিমা বসে আছেন। বিছানার ওপর মা, চোখ বোজা। মা’র সত্যিই অসুখ। আমি মাথার কাছে বসলাম। মা’র অসুখের জন্যই বেলেঘাটা থেকে।
বড়মামিমাদের আনানো হয়েছে। বাইরের লোকের উপস্থিতির জন্যই আবহাওয়া অনেক সহজ হল। নইলে, বাবা বোধহয় আর আমার সঙ্গে কথা বলবেনই না ঠিক করেছিলেন।
বড়মামা বললেন, এসেছিস? ওঃ, যা চিন্তায় ফেলেছিলি! এ রকম ভাবে কেউ যায়? ইডিয়েট, একফোঁটা বুদ্ধি নেই মাথায়।
বড়মামিমা বললেন, থাক, ছেলেটাকে এখন বোকো না। হিমানীকে ডাকব?
এখন ডেকো না। এইমাত্র তো ঘুমোল।
একবার ঘুম ভাঙালে কিছু হবে না। সারাক্ষণ ছেলেটার নাম করছিল!
আস্তে, আস্তে। হঠাৎ না চমকে ওঠে। চিররঞ্জন নিজে টেলিফোন করেছে, ছেলেটার গলার আওয়াজ শুনেছে–তাও হিমানী বিশ্বাস করে না। মায়ের মনে কষ্ট দিয়ে এ রকম ভাবে কেউ যায়?
আমি কাচুমাচু হয়ে বসে রইলাম। ঠিক ভেবে পেলাম না, এ-ক্ষেত্রে কষ্ট দেওয়া না কষ্ট পাওয়া, কোনটা অপরাধ?
বড়মামিমা বললেন, যা বাদল, হাতমুখ ধুয়ে জামাকাপড় ছেড়ে আয়। চেহারার কী ছিরি হয়েছে তোর?
আমি তবু বসেই রইলাম। বাবা জানলার কাছে দাঁড়িয়ে বাইরের দৃশ্য দেখছেন। যেন এ-ঘরের কোনও ব্যাপারের সঙ্গে তার কোনও সংযোগই নেই।
বড়মামিমা মায়ের গায়ে হাত রেখে আস্তে আস্তে ঠেলা দিয়ে ডাকলেন, হিমানী, ও হিমানী।
মা চোখ না খুলেই বললেন, উঃ?
এখনও ব্যথা আছে?
আছে।
খুব!
কী জানি!
শোনো, বাদল এসেছে।
মা সঙ্গে সঙ্গে চোখ খুলে উঠে বসবার চেষ্টা করলেন। ব্যাকুল ভাবে বললেন, কই? কই?
এর পরের দৃশ্য বর্ণনার কোনও প্রয়োজন নেই। মায়ের চোখের জল দেখে আমাকেও আবার কাঁদতে হল। এরই মধ্যে একটা কথা ভেবে সান্ত্বনা পেলাম। আমার ফিরে আসা সঠিক হয়েছে। আমি চলে যাবার পরদিনই মায়ের হার্ট স্ট্রোক হয়েছিল, ডাক্তারের মতে মাইল্ড ধরনের হলেও প্রাণ সংশয় ছিলই। এখন, মায়ের বিছানার পাশে বসে থেকে বুঝতে পারি, মায়ের মৃত্যুর বিনিময়ে আমার কোথাও যাওয়া চলে না। আমার সম্পর্কে আমার মায়ের টানটা সম্পূর্ণ জৈবিক, এখানে যুক্তির কোনও প্রশ্ন নেই।
কান্নাকাটি ও বিষণ্ণ পরিবেশই রইল বাড়িতে। বড়মামা চলে গেলেন, বড়মামিমা ক’দিন ধরেই এখানে থাকছেন। আমার মামারবাড়িতে সকলেরই ধারণা, আমার বাবা নিতান্তই অকর্মা এবং অপদার্থ। মাকে তারা বেলেঘাটায় নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু এখন মাকে নড়াচড়া করানো ঠিক নয় এবং মা যেতেও চাননি।
বড়মামিমাই খাওয়াদাওয়ার পর দুপুরে আমাকে জোর করে ঘুমোতে পাঠালেন। একটা লম্বা ঘুম দিলাম। জেগে ওঠার পর আবার মনখারাপ হয়ে গেল। এই মনখারাপের নির্দিষ্ট কোনও কারণ নেই। চুপচাপ দু-তিনটে সিগারেট শেষ করে আবার এসে বসলাম মায়ের বিছানার পাশে। মা এখন আবার অনেকটা নিস্তেজ হয়ে পড়েছেন।
রেণু এল সন্ধ্যার দিকে। আমিই দরজা খুলে দিয়েছিলাম। আমাকে দেখে রেণু চমকে উঠল না, উচ্ছ্বাস প্রকাশ করল না, শুধু জিজ্ঞেস করল, মাসিমা কেমন আছেন?
আমি অপরাধী। সকলের চোখেই আমি তাই। সকলে মিলে শুধু একজনকে বার বার বিদ্ধ করলে তার ফল কি ভালো হয়? রেণু এ রকম না করলেও পারত।
এরপর আমিও একটা ভুল করলাম। আমার জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল, তুমি কেমন আছ? কিংবা, তুমি আমার ওপর খুব রাগ করেছ? কিংবা, তুমি আমাকে ক্ষমা করতে পারো না? কিংবা, রেণু আমার চোখের দিকে তাকাও, আমাকে চিনতে পারছ না?
কিন্তু, এ রকম কোনও ব্যক্তিগত কথায় বদলে আমি জিজ্ঞেস করলাম, তোমাদের থিয়েটার কেমন হল?
রেণুর বুদ্ধি খুব তীক্ষ্ণ। ও নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছে, আমি ওর থিয়েটার করা পছন্দ করিনি। এবং এখনও সেই রাগ পুষে রেখেছি। রেণুও রাগের সঙ্গেই বলল, খুব ভালো। হয়েছে।
তারপর আর একটাও কথা না বলে উঠে এল দোতলায়। বেশ কয়েক দিন পরে আমি জানতে পেরেছিলাম যে আমি হঠাৎ কলকাতা ছেড়ে চলে গেছি এই খবর পেয়ে থিয়েটারের আসল অভিনয়ের দিন রেণু বলেছিল, ও পার্ট করবে না। সর্বক্ষণ কান্নাকাটি করেছে। শো ভন্ডুল হয়ে যাবার আশঙ্কায় অনেকে মিলে প্রায় জোর করেই রেণুকে ধরে নিয়ে গিয়ে তুলে দিয়েছিল স্টেজে। কেন জানি না, এই কথাটা শুনেও আমার রাগ হয়েছিল।
রেণু মায়ের ঘরে বসে রইল। কথা বলতে লাগল বড়মামিমার সঙ্গে। আমার সঙ্গে আলাদা কথা বলার কোনও আগ্রহই নেই ওর। আমার দিকে তাকাচ্ছেও না। আমি সিগারেট খাবার ছলে কয়েক বার উঠে গেলাম নিজের ঘরে। সেখানে গিয়ে অধীর ভাবে প্রতীক্ষা করতে লাগলাম, রেণু যে-কোনও মুহূর্তে চলে আসবে আমার কাছে। রেণু এল, না। একথাও আমার মাথায় আসে না যে, আমি নিজে না-ডাকলে রেণু আসবে না। বরং আমার অভিমান হয়, আমি এত দূরে গিয়েও আবার ফিরে এলাম, তবু রেণু এক বারও। আমার হাতে হাত রেখে জিজ্ঞেস করল না, তোমার কোনও কষ্ট হয়নি তো?
এরপর আরও একদঙ্গল আত্মীয়স্বজন এসে পড়লেন। প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলাতেই এঁরা আসেন। আজ এঁরা দাদামশাইকেও নিয়ে এসেছেন। দাদামশাই প্রায়ই কঠিন অসুখে ভোগেন, আবার সকলকে অবাক করে দিয়ে সুস্থ হয়ে উঠে হাঁটাচলা করতে শুরু করেন। বয়স হয়ে গেলেও চেহারাটি এখনও সোজা আছে। মামাবাড়ির গ্রামে যে দোর্দন্ডপ্রতাপ মানুষটিকে দেখেছিলাম, এখন আর তার কিছুই অবশিষ্ট নেই, বেলেঘাটার জবর দখল কলোনির সামান্য পরিবেশে এই মানুষটিকে আঁটানো যায় না। প্রায় সারা জীবন যিনি সকলের ওপর হুকুম চালিয়ে এসেছেন আজ তাঁকে অর্থকষ্ট ভোগ করতে হচ্ছে। তার বেশ কিছু টাকা তিনি কলকাতার একটি ব্যাঙ্কে রেখেছিলেন, পঞ্চম দশকে একাধিক ব্যাঙ্কের সঙ্গে সেই ব্যাঙ্কটিও হঠাৎ একদিন গণেশ উলটেছে।
অন্যদের নিষেধ সত্ত্বেও দাদামশাই আজ দেখতে এসেছেন তার ছোটমেয়েকে। সিঁড়ি দিয়ে তাকে ধরে ধরে ওঠানো হল। মেয়ের কপালে হাত রেখে বললেন, হিমু, কেমন আছিস মা? সব ঠিক হয়ে যাবে।
তারপর আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তুই কোথায় গিয়েছিলি?
কী তীব্র সেই চোখের দৃষ্টি, আমি বেশিক্ষণ চোখ রাখতে পারি না। বড়মামিমাই আমাকে বাঁচিয়ে দেবার জন্য বললেন, ও তো ওর ক্লাবের ছেলেদের সঙ্গে বাইরে বেড়াতে গিয়েছিল। ও কিছুই জানত না।
বুঝলাম, দাদামশাইকে সব কথা জানানো হয়নি। দাদামশাই আমার আপাদমস্তক দেখে নিয়ে আবার বললেন, অনেক দিন তোকে দেখি না কেন?
আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে আমার সম্পর্ক প্রায় ঘুচেই গেছে! কিন্তু দাদামশাইরা যে-কালের মানুষ, তা তো ওঁদের কাছে বয়ঃকনিষ্ঠ আত্মীয় মানেই অনুগত প্রজার মতন, নিয়মিত হাজিরা দেওয়া তাদের কাজ।
এই বৃদ্ধ তার ব্যক্তিত্বে ঘরের সবাইকে চুপ করিয়ে রেখেছেন। রেণুকেও উনি দু-তিন বার দেখলেন। তারপর সস্নেহে বললেন, তোমার মা এখন একটু ভালো আছেন তো দিদি?
রেণু একটু অবাক হল। তারপর ঘাড় নেড়ে বলল, হ্যাঁ।
তুমি তো দিদি, এ-বুড়োকে এক দিনও দেখতে গেলে না!
রেণু বুঝতে না পারলেও ঘরের আর সবাই বুঝতে পেরেছে যে দাদামশাই রেণুকে আমার জ্যাঠামশাইয়ের কোনও মেয়ে বলে ধরে নিয়েছেন। অসুস্থ কারোকে দেখতে এসেও উপস্থিত অন্য সকলের কুশল প্রশ্ন করাও পুরনো প্রথা।
মা কথা না বলে চুপ করে শুয়ে আছেন। কথা বলতে গেলেই কষ্ট হয়। দাদামশাই আবার তাঁর মেয়ের দিকে ফিরে বললেন, তোর কোনও চিন্তা নেই মা। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার কোনও ছেলেমেয়ে আমার আগে মরে যাবে না। বুঝলি?
দাদামশাই আমার কাধ ধরে এক পাশে টেনে নিয়ে গিয়ে বললেন, ভালো করে চিকিৎসা করাবি, বুঝলি? সেরা ডাক্তার দেখাবি। আমার তো এখন আর কিছুই করার সাধ্য নেই। এই দুটো রাখ, এই দুটো বেচে চিকিৎসাপত্তর করাবি।
দাদামশাই তার ফতুয়ার পকেট থেকে বার করলেন দুটি মোহর। আমি দেখলাম, আমার সব মামা-মামিমা ও মাসিদের বিস্মিত চোখ পড়ল সে দুটোর দিকে। দাদামশাইয়ের এই গুপ্ত সম্পদের কথা ওঁরা কেউ জানতেন না, বোঝাই যায়। দাদামশাই কারোকে গ্রাহ্য না করে আমার হাতে সে দুটো তুলে দিয়ে বললেন, নে! সাবধানে রাখবি।
মোহর দুটো বাবাকে দেবার বদলে আমার হাতে দেবার মধ্যে যে একটা তীব্র তাচ্ছিল্য ও অপমান আছে, তা আমিও বুঝতে পারি। আমি তক্ষুনি মোহরদুটো বাবার সামনে টেবিলের ওপরে রাখলাম। বাবা সেদিকে তাকিয়েও দেখলেন না।
আত্মীয়স্বজনরা চলে যাবার পর আমি রেণুকে বড়রাস্তা পর্যন্ত পৌঁছে দেবারও সুযোগ পেলাম না। এর মধ্যেই পঙ্কজ এসে গেল। রেণু চলে গেল একা।
দিন দশেকের মধ্যে মায়ের অসুখের সংকট অনেকটা কাটল বলা যায়। এখন দীর্ঘ চিকিৎসার দরকার। আমার বিদেশে যাবার সম্ভাবনা মুছে গেল একেবারে। তবু মহীশূর পর্যন্ত যাওয়ার একটা উপকারিতা পাওয়া গেল শেষ পর্যন্ত। সুব্রতদা ওখান থেকে নিয়মিত খোঁজখবর নিচ্ছিলেন–এক মাসের মধ্যে আমার জন্য একটা চাকরি জোগাড় করে দিলেন ওঁদের কোম্পানির কলকাতা শাখায়। সে-চাকরি প্রত্যাখ্যান করার কোনও যুক্তিই রইল না আমার। চাকরিতে জয়েন করার দিন মাকে যেন আরও অনেক সুস্থ মনে। হল। অনেক দিন বাদে বাবা আমার সঙ্গে কয়েকটা কথা বললেন। বাবা-মাকে খুশি করার জন্য সুযোগ্য সন্তানরা যা করে, আমিও শেষ পর্যন্ত তাই করলাম বলা যায়।
কয়েক দিনের মধ্যেই প্রায় রুটিন বাঁধা হয়ে গেল আমার জীবনটা। সকালবেলা প্রায় ঘুম থেকে উঠেই অফিস যাওয়ার জন্য তৈরি হতে হয়। বিলিতি কোম্পানি, সুতরাং সেখানে হাজিরা দিতে যাতে আমার এক মিনিটও দেরি না হয়, সে জন্য বাবা আর মা-ই বেশি ব্যস্ত হয়ে থাকেন। একজন রাঁধুনি রাখা হয়েছে, মা বিছানায় শুয়ে থেকেই তাকে নির্দেশ দেন। দাড়ি কামিয়ে, ফিটফাট জামা-প্যান্ট জুতো পরে আমি গরম গরম ভাত খেয়েই দৌড়োই বাস ধরবার জন্য। বাবা পরামর্শ দিয়েছিলেন, একটু আগে বেরিয়ে আমি। যেন উলটো দিকের ট্রাম ধরে শ্যামবাজার চলে যাই, তা হলে সেখান থেকে বসবার জায়গা পাব। সে পরামর্শ মানা হয় না, ভিড়ের বাসে কোনওক্রমে হ্যাঁন্ডেল ধরে ঝুলতে ঝুলতে ডালহৌসি পৌঁছে যাই। অফিসটাতে অধিকাংশ বাঙালি কর্মচারী হলেও যেহেতু এখনও কয়েক জন ইংরেজ আছে, তাই সবকিছুই চলে সাহেবি কায়দায়। অফিসে ঢোকার মুখে অন্যদের সঙ্গে দেখা হলেই গুড মর্নিং বলতে হয়। আমি টাই পরি না বলে ইতিমধ্যেই একজন শুভার্থী আমাকে মৃদু ধমক দিয়েছেন।
একটা বড় হলঘরের মধ্যে আমার ডেস্ক। টেবিলে অনেক কাগজপত্র, তবু আমাদের সকলের মুল কাজ, বেল বাজিয়ে কোনও সাহেব ডেকে পাঠালেই অতি দ্রুত তার ঘরে গিয়ে তটস্থ হয়ে দাঁড়াননা। টেবিলে বসে এক এক সময় অন্যমনস্ক হয়ে যাই। বড় বড় নিশ্বাস পড়ে। সাধারণ চাকুরিজীবীদের মতন জীবন কাটাব–এ রকম কখনও ভাবিনি। অথচ সেই জীবনই আমাকে নিতে হল। এ ছাড়া আর উপায়ই বা কী? মাত্র একটি দিনের ব্যবধান। আর একটি দিন খবর পেতে দেরি হলেই আমি সমুদ্রে ভেসে পড়তাম। এতদিনে আমি জার্মানিতে–
অফিস থেকে বেরিয়ে প্রায় প্রত্যেক দিনই ডাঃ নলিনীরঞ্জন সেনগুপ্তর চেম্বারে যেতে হয়। মায়ের অসুখের রিপোর্ট দেওয়া ও নির্দেশ নেওয়া। অপেক্ষা করতে হয় অনেকক্ষণ। বড় ডাক্তারের কাছে ভিড় হয়ই, তা ছাড়া ইদানীং উনি পয়সা নিচ্ছেন না।
বাড়ি ফিরে কিছুক্ষণ মায়ের দেখাশুনো করা। কোনও কোনও দিন পঙ্কজ কিংবা অন্য কোনও বন্ধুবান্ধব আসে। কিছুক্ষণ আড্ডা। তারপরই খাবার খেয়ে নিয়ে একটা বই হাতে নিয়ে শুয়ে পড়া। কখনও বা বই মুড়ে রেখে সিগারেট ধরিয়ে আবোলতাবোল চিন্তা।
জীবনটা যখন এই রকম প্রায় ছকে বাঁধা হয়ে এসেছিল, সেই সময় হঠাৎ আবার সূর্যদার আবির্ভাব। সূর্যদা কলকাতায় এসে আবার সবকিছু তছনছ করে দিল।