মোহে-নির্মোহে নগ্নতা
খাজুরাহো থেকে কসমিক সেক্সের রি সেনের নগ্নতা, রি সেন থেকে থ্রিএক্স। নগ্ন-নারীর ছড়াছড়ি। শুধু নারীই কেন নগ্ন হয়? উত্তর খুঁজব। তার একটু গৌরচন্দ্রিকা সেরে নিই। শুরুতেই জানিয়ে রাখি, আমি নগ্ন (Nude) আর উলঙ্গ (Naked)-র মধ্যে কোনো পার্থক্য রাখছি না। আমার কাছে এই পার্থক্য অর্থহীন। আমার আলোচ্য বিষয় ‘পোশাকহীন শরীর’। Nude আর Naked-এর পার্থক্য খুঁজুন বিদগ্ধ পণ্ডিতেরা। যাই হোক, নগ্নতা বলতে কোন্ অবস্থাকে বুঝব? নগ্নতা বলতে কোনো পোশাকহীন শারীরিক অবস্থাকে বোঝায়, বিবস্ত্র অবস্থা। নৃতত্ত্ববিদরা মনে করেন, আদিম মানুষ নগ্ন অবস্থায় থাকত। তবে সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে জানা যায় যে সম্ভবত ৭২,০০০ বছর আগেই মানব সমাজে নগ্নতা নিবারণের জন্য পোশাকের ব্যবহার শুরু হয়। সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে প্রধানত মানুষ পোশাক পরিধান শুরু করল। পোশাক পরিধান করার প্রয়োজনীয়তা কার্যকরী চাহিদা থেকে উদ্ভূত। যেমন বাহ্যিক উপাদান, ঠান্ডা এবং তাপ থেকে সুরক্ষা, শরীরের চুলের ক্ষতি রোধ, এবং শীতপ্রধান অঞ্চলে বসবাস ইত্যাদি। পোশাক পরিধান সাধারণত উষ্ণতা থেকে সুরক্ষা এবং সামাজিক বিবেচনার উপর নির্ভর করে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ন্যূনতম পোশাক বা পোশাকহীন অবস্থা সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হতে পারে। সাধারণভাবে শালীনতাবোধ নগ্নতাকে সমর্থন করে না। তবে স্থান ও কাল ভেদে শালীনতাবোধের ধারণা বিভিন্ন। সভ্য সমাজে যা শালীন, আদিম সমাজে তা বিপরীত। কোনো কোনো নির্দিষ্ট সমাজব্যবস্থায় চিত্রে, ভাস্কর্যে ও সাহিত্যে নগ্নতাকে নান্দনিকতার এক বিশেষ উপাদান মনে করা হয়।
বাইবেলে বর্ণিত আদম ও ইভের কাহিনি অনুসারে, ঈশ্বর প্রথম নর ও নারীকে নগ্ন অবস্থায় সৃষ্টি করেছিলেন। এই নগ্নতার জন্য তাঁদের মনে কোনো লজ্জা ছিল না। পরে শয়তান কর্তৃক প্ররোচিত হয়ে ঈশ্বরের আজ্ঞা লঙ্ঘন করে তাঁরা, যখন জ্ঞানবৃক্ষের ফল ভক্ষণ করে, তখন তাঁদের জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত হয় এবং নিজেদের নগ্ন দেখে তাঁরা লজ্জিত হয়ে পড়েন। লজ্জিত হয়ে পড়লে কী হবে। তখন পোশাক কোথায় নগ্নতা ঢাকার জন্য? অতএব গাছের বড়ো বড়ো পাতা, ছাল-বাকলই ছিল শরীর ঢাকার উপাদান। শুরুতে শুধুই নিন্মাঙ্গ ঢাকা হত, তার অনেক পরে ঊর্ধ্বাঙ্গ (মেয়েরা) ঢাকা হতে থাকল।
যাই হোক, কোনো কোনো প্রাচীন সভ্যতায় নগ্নতাকে অপমানকর বলে মনে করা হত। আদি বাইবেলে ফ্যারাও-শাসনাধীন মিশর ও ইহুদিদের একটি বর্ণনা থেকে এই চিত্র পাওয়া যায়: “আসিরিয়ার সম্রাট এই দুই দে (মিশর ও সুদান) থেকে বন্দিদের বিবস্ত্র অবস্থায় নিয়ে যাবে। যুবা-বৃদ্ধ সকলকেই নগ্ন পদে বিবস্ত্র অবস্থায় পথ চলতে হবে, তাদের অনাবৃত নিতম্ব মিশরের লজ্জার কারণ হবে।” এখানেই শেষ নয়। প্রাচীন গ্রিক সভ্যতায় খেলাধুলা ও সংস্কৃতির জগতে পূর্ণবয়স্ক ও কিশোরদের নগ্নতার সৌন্দর্যের দিকটি বিশেষভাবে প্রশংসিত হত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বালক, নারী ও বালিকাদের নগ্নতাও প্রশংসা পেত। গ্রিকদের সৌন্দর্য চেতনায় প্রকৃতি, দর্শন ও শিল্পের পাশাপাশি মানবদেহেরও বিশেষ স্থান ছিল।
গ্রিক শব্দ ‘জিমন্যাসিয়াম’ কথাটির অর্থ ছিল “যেখানে নগ্ন অবস্থায় প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়”। সেসময় পুরুষগণ খেলোয়াড়রা নগ্ন অবস্থায় প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতেন। কিন্তু সে যুগে অধিকাংশ নগর-রাষ্ট্রেই নারীদের খেলাধুলায় অংশগ্রহণ, এমনকি দর্শকাসনে উপস্থিত থাকার অনুমতিও ছিল না। তবে স্পার্টা ছিল এর এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম, অবশ্যই। রোমানরা গ্রিক সংস্কৃতির অনেক রীতিনীতি গ্রহণ করলেও, নগ্নতা সম্পর্কে তাদের মানসিকতা পৃথক ছিল। সাধারণ স্নানাগার বা সাধারণ শৌচাগার ছাড়া অন্যত্র নগ্নতাকে অনুচিত আখ্যা দেওয়া হত।
খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে খ্রিস্টধর্ম রোমান সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রধর্ম ঘোষিত হলে নগ্ন গ্ল্যাডিয়েটর ক্রীড়া ধীরে ধীরে উঠে যায়। এবং প্রাপ্তবয়স্কদের নগ্নতা পাপের পর্যায়ে পর্যবসিত হত। খ্রিস্টধর্মের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে এটি একটি প্রথায় পরিণত হয়। যদিও অষ্টম শতাব্দী পর্যন্ত পশ্চিম ইউরোপে খ্রিস্টানরা নগ্ন অবস্থায় ব্যাপ্টাইজড হতেন। ষষ্ঠ শতাব্দীতে সেন্ট বেনেডিক্ট অফ নার্সিয়া তাঁর নিয়মাবলিতে সন্ন্যাসীদের তাঁদের ডরমিটরিতে সম্পূর্ণ পোশাক পরিহিত অবস্থায় ঘুমানোর পরামরুশ দেন। পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত ইউরোপীয় পুরুষেরা মূলত আলখাল্লা জাতীয় পোশাক পরতেন। তারপর কডপিস, টাইটস ও টাইট ট্রাউজার্সের প্রচলন হয়। এই পোশাকগুলি পুরুষাঙ্গকে ঢেকে রাখলেও তার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করত।
নগ্নতা শারীরিক শাস্তির অংশও হতে পারে। জমায়েত মানুষর সামনে কারোকে অপমান করার প্রয়োজন হলে সেক্ষেত্রেও অনেকসময়ই এই ধরনেরশাস্তির ব্যবহার করা হয়ে থাকে। নাৎসিরা তাদের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে বন্দিদের জোর করে নগ্ন করে রাখত। স্টিভেন স্পেলবার্গের ‘Schindler’s List’ নামক মুভিটি যাঁরা দেখেছেন তাঁরা নিশ্চয় মনে করতে পারছেন। এমনকি কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষ ডাইনি শিকারের সময় অভিযুক্ত ডাইনিদের সম্পূর্ণ নগ্ন করে তথাকথিত ‘ডাইনি চিহ্ন’গুলি পরীক্ষা করা হত। এইসব চিহ্ন নাকি তাদের বিরুদ্ধে বিচারের প্রমাণ হিসাবে পেশ করা হত এবং শাস্তি প্রদান করা হত। ২০০৩ সালে ইরাকের আবু গারিব কারাগারে কুখ্যাত মার্কিন সেনা-কর্মচারীরা এখানে বন্দিদের নগ্ন করে কখনও বেঁধে ও ভীত-সন্ত্রস্ত করে তাদের ফোটো তুলে রাখত।
নগ্নতা একটি চর্চার নাম। তাই নগ্নতাবাদ একটি আন্দোলনের পরিচয়। নগ্নতাবাদ এক দর্শনের নব্যমার্গ। নগ্নতাবাদ বা প্রকৃতিবাদ হচ্ছে এক ধরনের সামাজিক নগ্নতার ব্যক্তিগত ও জনপ্রকাশ্যরূপ লাভের উদ্দেশ্যে একপ্রকার রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলন। এটি প্রাত্যহিক বা ব্যক্তিগত, পারিবারিক বা সামাজিক জীবনের ক্ষেত্রে নগ্নতার ব্যবহারকে সংজ্ঞায়িত করতেও ব্যবহৃত হতে পারে। নগ্নতাবাদ ইংরেজি ভাষাতে যেসব পরিভাষায় উচ্চারিত হয়, সেগুলি হল– ‘Social nudity’, ‘Public nudity’, এবং সাম্প্রতিক কালের ‘clothes-free’। কিন্তু কোনোটিই পুরোনো ও সর্বাধিক ব্যবহৃত পরিভাষা ‘Naturism’ (যুক্তরাষ্ট্রে Nudism নামেই বেশি পরিচিত)-এর সমান বিস্তৃতি পায়নি।
নগ্নতাবাদ কেমন দর্শন? পণ্ডিতরা বলেন, নগ্নতাবাদীদের দর্শন বিভিন্ন সূত্র থেকে আমদানি হয়েছে। এহেন দর্শনের অনেকগুলি এসেছে স্বাস্থ্য ও শারীরিক সামর্থ্য সংক্রান্ত, যা এসেছে বিশ শতকের জার্মানি থেকে। এর পিছনে আছে। প্রকৃতির কাছে ফিরে যাওয়ার ধারণা। এছাড়া সাম্যতার সৃষ্টিও এর পিছনে একটি স্পৃহা হিসাবে কাজ করে। অবশ্য পরে জার্মানি থেকে পরবর্তীতে এই ধারণা ইংল্যান্ড, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি দেশে দ্রুত বিস্তার লাভ করে। জার্মান নগ্নতাবাদীদের সংগঠন জার্মানিতে পারিবারিক ক্ষেত্রে ও বিনোদনমূলক খেলাধুলায় নগ্নতার প্রসারে কাজ করছে। এই কাজের একটি প্রয়াস হিসাবে তারা জার্মান অলিম্পিক স্পোর্টস ফেডারেশনের সদস্যপদ লাভ করেছে। ফরাসিরা নগ্নতাবাদের প্রসারে দীর্ঘমেয়াদি ছুটিতে নগ্নতা উপভোগের উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট স্থানে বড়ো কমপ্লেক্স নির্মাণ করেছে। এই ধারণা পরবর্তীতে কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রেও প্রসারিত হয়েছে। এছাড়া নগ্নতাবাদী পর্যটকদের জন্য বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্র বা রিসর্ট তৈরি হয়েছে। এই ধারণাটি সবচেয়ে বেশি দেখা যায় ক্যারিবীয় অঞ্চলে। নগ্নতাবাদের চর্চা নানাভাবে করা হয়। মার্ক অ্যালাইন ডেসকাম্পস নগ্নতাবাদকে বিভিন্ন প্রকারে ভাগ করেছেন। যেমন –(১) ব্যক্তিগত নগ্নতাবাদ, (২) পারিবারিক নগ্নতাবাদ, (৩) বুনো পরিবেশে নগ্নতাবাদ, (৪) সামাজিক নগ্নতাবাদ। এছাড়াও (৫) সামরিক নগ্নতাবাদ, (৬) ক্যাম্পেইনিং ইত্যাদি।
ব্যক্তিগত ও পারিবারিক নগ্নতাবাদ : ঘরে ও বাগানে প্রায় সময়ই নগ্নতাবাদের চর্চা করা হয়। এটি হতে পারে একাকী বা পরিবারের সদস্য সহকারে। কানাডীয় এক সমীক্ষায় যে চিত্রটি নজরে আসে, তা চমকে যাওয়ার মতো। শতকরা ৩৯ ভাগ কানাডিয়ান ঘরে নগ্ন অবস্থায় হাঁটাচলা করেন এবং ব্রিটিশ কলাম্বিয়ায় এই হার শতকরা ৫১ ভাগ। ব্যক্তিগত নগ্নতার মধ্যে আছে নগ্ন অবস্থায় ঘুমোনো। যদিও কিছু ক্ষেত্রে এটি স্বাস্থ্যগত উপকারের জন্যও করা হয়। কারণ দেখা গেছে নগ্ন অবস্থায় ঘুম আসতে সুবিধা হয় এবং অনেক্ষণ। ঘুমোনো সম্ভব। অবশ্য সেই সঙ্গে এটি আরামের কারণেও হতে পারে। তবে অনেকে মনে করেন, কাপড়চোপড় পরে ঘুমোনোর চাইতে না-পরে ঘুমোনোর উপকার বেশি। দাম্পত্য-জীবনে স্বামী-স্ত্রীর নগ্ন হয়ে ঘুমোনো নাকি ভালো। ইউএসএ কটন ২০১৪ সালে এক জরিপ চালিয়ে দেখেছে, জরিপে অংশ নেওয়াদের মধ্যে যাঁরা নগ্ন হয়ে ঘুমোতে অভ্যস্ত তাঁদের মধ্যে শতকরা ৫৭ ভাগই মনে করেন যে তাঁরা সুখী। পাজামা পরে যাঁরা ঘুমোন তাঁদের মধ্যে সুখী দম্পতি ছিল ৪৮ ভাগ। নিউরোলজিস্ট রাচেল সালাস ওয়াল স্ট্রিট জার্নালকে ২ বছর আগে বলেছিলেন, গুহামানবের মতো আধুনিক ফ্যাশন সচেতন মানুষের গায়ে সুতো না-রেখে ঘুমোনো ভালো। তিনি বলেন– “আমাদের পূর্বসূরীরা একসময় নগ্নই ঘুমোতেন। মাংসাশী প্রাণীদের হাত থেকে বাঁচার জন্য তাঁরা মূলত গুহায় ঘুমোতেন এবং নগ্ন হয়েই। তাই নগ্ন হয়ে ঘুমোলে আজও আমরা কিছুটা নিরাপদ বোধ করি। অর্থাৎ, ঘরের তাপমাত্রা বেশি হলে নগ্ন হয়ে ঘুমোনো খুবই ভালো। শরীরের ভারী পোশাক ঘুমে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। ঘুম বিশেষজ্ঞরা বলেন, শরীরের তাপমাত্রা ঘুমের গভীরতায় প্রভাব ফেলে। ফলে নগ্ন হয়ে ঘুমোলে শরীর অতিরিক্ত তাপ থেকে মুক্ত থাকতে পারে। স্পর্শ অক্সিটোসিন নামক হরমোনের নিঃসরণ ঘটায়। নিঃসন্দেহে নগ্ন হয়ে ঘুমালে আপনার শরীর তুলনামূলভাবে বেশি স্পর্শ পাবে। এতে শরীরে অক্সিটোসিন হরমোনের ক্ষরণ বেড়ে যাবে। যৌন কামনা, বন্ধন দৃঢ় করার জন্য অক্সিটোসিন হরমোন বিশেষভাবে পরিচিত। এছাড়া এই হরমোন মানসিক চাপ কমান, বিশ্বাস-আস্থা বৃদ্ধি করে, হৃদযন্ত্রের চাপ স্বাভাবিক রাখা ও যৌন-প্রক্রিয়াকে স্বাভাবিক রাখার কাজ করে। নগ্ন হয়ে ঘুমোলে শরীর থেকে বুড়িয়ে যাওয়া প্রতিরোধক মেলাটোনিনের নিঃসরণ সহজ হয়। ফলে এইভাবে ঘুমোনো তারুণ্য ধরে রাখতে সাহায্য করে। ভালো ও গভীরভাবে ঘুমোতে সাহায্য করে নগ্ন ঘুম। ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণে রাখে ও শরীরের অতিরিক্ত চর্বি পুড়িয়ে ফেলতে সাহায্য করে। ওয়ারউইক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা যায়, পর্যাপ্ত ঘুম না-হলে শরীরে ঘার্লিন হরমোনের প্রবাহ বেড়ে যায়, যা ক্ষুধা বাড়ায় ও ইনসুলিনের প্রবাহকে বৃদ্ধি করে। ফলে বহুমূত্র ও হৃদরোগ সৃষ্টি হতে পারে। গলা ও কোমরবন্ধ পোশাক শরীরের নিন্মাঙ্গে স্বাভাবিক রক্ত চলাচলে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। এতে নানান রোগ সৃষ্টির আশঙ্কা থাকে। কিন্তু নগ্নভাবে ঘুমে শরীরের রক্ত চলাচলকে স্বাভাবিক থাকে। যা শরীরের পেশি ও গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন অঙ্গকে সতেজ ও স্বাস্থ্যবান রাখতে সাহায্য করে। নগ্ন ঘুম দম্পতিদের সম্পর্কের মধ্যকার বাধা দূর করে। সম্পর্কে আরও নিবিড় করে তোলে। নগ্ন ঘুম সঙ্গীর প্রতি যৌন সম্পর্কের জন্য উন্মুক্ত আহ্বান। চাইলেও কোনো দম্পতি একে অন্যকে পাশ কাটিয়ে ঘুমোতে পারেন না। অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্য যে, নগ্ন ঘুম নিজের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাসের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। আত্মবিশ্বাসী করে তোলে। যৌনসঙ্গীর সামনে নগ্নতা সামাজিকভাবে অনুমোদিত– তবে সবক্ষেত্রে নয়। উদাহরণস্বরূপ, কেউ কেউ কেবলমাত্র যৌনসংগমের সময়ই আলোতে বা অন্ধকারে নগ্নতাকে অনুমোদন করেন। এছাড়া সঙ্গীর সঙ্গে স্নানের সময় বা স্নানের পরে, চাদর বা কম্বলের আবরণের অন্তরালে, অথবা ঘুমোনোর সময় সঙ্গীর সামনে নগ্নতা অনুমোদিত।
সামাজিক নগ্নতাবাদ : সামাজিক নগ্নতাবাদ হল সামাজিক প্রেক্ষাপটে নগ্নতার প্রসার। হতে পারে নিজের বাড়িতে নিজের ঘরে বন্ধুদের নিয়ে একটি নগ্ন অনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমে। হতে পারে নগ্নতা চর্চার জন্য বিশেষভাবে কোনো স্থান তৈরির মাধ্যমে। যেমন– নগ্নতাবাদীদের জন্য ক্লাব, সেন্টার, রিসর্ট, অন্য কোনো সুবিধাজনক স্থান স্থাপনের মাধ্যমে। এই পারিভাষিক ব্যাখ্যাটি অবশ্য স্থানভেদে পরিবর্তিত হয়। কোনো নগ্নতাবাদী অনুষ্ঠান বা কর্মকাণ্ডে পোশাক পরিধান সাধারণত ঐচ্ছিক। ব্যতিক্রম হল সুইমিং পুল ও সূর্যস্নানের স্থান। কারণ অনুমতি সাপেক্ষে এসব জায়গায় সম্পূর্ণ নগ্নতা আশা করা হয়। কিছু নগ্নতাবাদীদের কাছে এই নিয়মটি কিছুক্ষেত্রে বিতর্কের উৎস। স্বাস্থ্যগত ও নিরাপত্তাজনিত কারণে নগ্নতাবাদীদের জন্য নির্মিত স্থানে কর্মরত কর্মচারীদের জন্য কিছু ক্ষেত্রে পোশাক পরা বাধ্যতামূলক।
শালীনতার যে প্রচলিত ধারাটি ব্যক্তিগত, পারিবারিক বা সামাজিক নগ্নতার বিরোধী নগ্নতাবাদীরা তা প্রত্যাখ্যান করে থাকেন। পরিবর্তে তাঁরা এমন এক সামাজিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে চান যেখানে মানুষে নগ্ন মানুষের সাহচর্যে অথবা অন্যান্য নগ্নতাবাদী বা সাধারণ মানুষের সামনে নগ্ন হয়ে থাকতে অস্বস্তিবোধ করবে না। এই প্রথানুযায়ী ইউরোপের অনেক দেশে (বিশেষত জার্মানি, ফিনল্যান্ড ও নেদারল্যান্ড) উভয় লিঙ্গের মানুষেরই দলবদ্ধ অবস্থায় নগ্ন হয়ে স্নান স্বীকৃত। অধিকাংশ জার্মান স্পা-তে মিশ্র নগ্ন স্নানের অনুমতি দেওয়া হয়। জার্মানি, ফ্রান্স, স্পেন ও গ্রিসের সৈকত ও সুইমিং পুলগুলিতে নগ্ন হয়ে স্নান অনুমোদিত। উল্লেখ্য, মহাদেশীয় ইউরোপে নগ্নতাকে অ্যাংলো-স্যাক্সন জগতের রক্ষণশীলতার তুলনায় অনেক লঘু করে দেখা হয়। ‘সনা’ ব্যবস্থার উৎস ফিনল্যান্ডে। এই দেশে এবং স্ক্যান্ডিনেভিয়া ও ইউরোপের অন্যান্য জার্মানভাষী রাষ্ট্রে সনায় নগ্ন অবস্থান অনুমোদিত। সনা বর্তমান ফিনল্যান্ডে অতি সুপরিচিত। এখানে বর্তমানে প্রতি তিন জন নাগরিকের জন্য একটি করে সনা রয়েছে। বিগত কয়েক দশকে সমগ্র ইউরোপেই সনা অত্যন্ত জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।
নগ্নতার আরও কয়েকটি প্যাশন আছে। সেগুলিও আলোচনা করব।
প্রকাশ্য নগ্নতা : প্রকাশ্য নগ্নতা (Public nudity) বলতে ব্যক্তিগত পরিবেশ ছাড়া অন্য কোনো পরিবেশে কোনো ব্যক্তির নগ্ন অবস্থায় অবলীলায় অবস্থান করাকে নির্দেশ করে। এর দ্বারা কোনো ব্যক্তিকে লোকালয়ে বা প্রকাশ্যে নগ্নভাবে বিচরণ বা অবস্থান করাকে বোঝানো হয়। কোনো ব্যক্তির বাড়িতে বা ব্যক্তিগত স্থান বা পরিবেশে নগ্ন অবস্থায় বিচরণ করাকে প্রকাশ্যে নগ্নতা হিসাবে ধরা হয় না। এইসব ব্যক্তিগত স্থান বা বিশেষ পরিবেশের মধ্যে আছে সুইমিং পুল, ব্যায়ামাগার, নগ্নতাবাদীদের জন্য তৈরি ক্লাব বা রিসোর্ট ইত্যাদি। কারণ এসক স্থান নগ্নতাবাদীদের জন্যই বিশেষভাবে স্থাপিত। নগ্নতাবাদ সামাজিক নগ্নতার প্রচার করে, কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তা ব্যক্তিগত বা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ঘোষিত বিশেষ স্থানের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হয়।
কিছু ক্ষেত্রে প্রকাশ্য নগ্নতা বৈধ হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বিশ্বে বহু দেশ আছে যেখানে নগ্ন সৈকতগুলোতে, বা অন্য কিছু স্থানে অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে হলেও প্রকাশ্য নগ্নতাকে বৈধ ধরা হয়। সেসকল স্থানে কোনো ব্যক্তি নগ্নভাবে বিচরণ করার জন্য কোনো আইনত হুমকির স্বীকার হবে না কেউ। সেসব জায়গা ব্যতীত বিভিন্ন সমাজে প্রকাশ্য নগ্নতার গ্রহণযোগ্যতা সমাজ হিসাবে গুরুতপূর্ণভাবে পরিবর্তিত হয়। কারও প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য নগ্নতা ব্যবহৃত হলে, অথবা কোনো কারণে এই ব্যাপারটি ঘটলে তা এক্সিবিশনিজম নামে পরিচিত হতে পারে। কিছু মানুষ জনসম্মুখে নিজেদেরকে নগ্ন করে প্রচারণা আকর্ষণ করেন, যাঁরা ‘স্ট্রিকার’ নামে পরিচিত। সাধারণত খেলাধুলা বা সামাজিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে স্ট্রিকিং দেখা যায়।
বীরোচিত নগ্নতা : এ এক পৌরণিক নগ্নতা। বীরোচিত নগ্নতা আদর্শ নগ্নতা ধ্রুপদি বিদ্যায় বর্ণিত ধ্রুপদী ভাস্কর্যে নগ্নতার প্রয়োগের একটি আদর্শ। এই আদর্শের প্রয়োগ হত, ভাস্করের বিষয়বস্তু যে নশ্বর মানবিক, অর্থাৎ বীর বা অর্ধদৈব কোনো সত্ত্বা, তা বোঝাতে। এই প্রথার সূচনা প্রাচীন ও ধ্রুপদি গ্রিসে। পরবর্তীকালে হেলেনীয় ও রোমান ভাস্কর্যেও এই আদর্শ গৃহীত হয়েছিল। এই ধারণা নারী ও পুরুষ উভয় প্রকার ভাস্কর্যই নির্মিত হয়েছে। নারী ভাস্কর্যগুলি রূপ পেয়েছে ভেনাস ও অন্যান্য দেবীদের মূর্তিনির্মাণ শিল্পে। তিভোলি জেনেরাল বা ডেলোজ ‘সিউডো-অ্যাথলেট’ প্রভৃতি রোমান উদাহরণের ক্ষেত্রে রোমান অতি-বাস্তব গ্রিক দেবতার মতো দেহবিশিষ্ট আবক্ষমূর্তি নির্মাণশৈলীর এক বিপরীত রীতি লক্ষিত হয়। ধারণাটির প্রবর্তনের পর এর মধ্যে নানা পরিবর্তন এসেছে। ধ্রুপদি ভাস্কর্যে নগ্নতার অন্যান্য শৈলীও উদ্ভূত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, পরাজিত বীর অথচ বর্বর শত্রুর মূর্তি ডাইং গল নির্মিত হয়েছে প্যাথেটিক নগ্নতা শৈলীতে। টোনিও হোলকারের মতে, খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী বা তারও পূর্বের গ্রিক শিল্পরীতি বলে উল্লেখ করেছেন এই শৈলীটিকে। সেই কারণে লক্ষ করবেন গ্রিক দেবদবীরা নগ্নই।
নগ্নতাবাদীরা বিশ্বাস করেন মানবদেহ কাপড়ের আড়ালে ঢেকে রাখার জন্য সৃষ্টি হয়নি। আর এ বিশ্বাস থেকেই তাঁরা জীবন যাপন করেন নগ্ন হয়ে। কাজেই এটা আশ্চর্যের কিছু নয় যে, কিছু নগ্নতাবাদী তাদের জীবনের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ দিন, বিয়ের দিনটিতে গায়ে কিছু চাপিয়ে থাকতে চাইবেন না। ব্রিটেনের নগ্নতাবাদী যে গোষ্ঠী রয়েছে তাঁদেরকে সাধারণত স্বাচ্ছন্দেই থাকতে দেয় বাকিরা। দ্য ওয়েডিং ফেইরি’ খ্যাত বিয়ের অনুষ্ঠান বিশেষজ্ঞ জর্জ ওয়াটস হাফিংটন পোস্টকে জানিয়েছেন, নগ্ন বিয়ের ধারণাকে তিনি সমর্থন করেন। তিনি বলেন, বিয়েটা শেষপর্যন্ত আপনাকে নিয়ে, যেখানে আপনার আগ্রহ আর পছন্দের বিষয়গুলোর প্রতিফলন হওয়া উচিত। পরিবার ও বন্ধুদের সেখানে সমর্থন থাকা উচিত। আর এর অর্থ যদি এটা হয় যে, পোশাক পরিহার করে নগ্ন হয়ে আপনি স্বীকার করে বলবেন –“তবে তেমনটাই হোক”। হাফিংটন পোস্টের প্রতিবেদনের শেষে বলা হয়, আমাদের মতে যদি দুজন মানুষ একে-অন্যকে ভালোবাসেন আর প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ হতে চান তাহলে তাঁরা কী পরছে আর কী পরছে না তাতে কী এসে যায়!
কোনো কোনো দেশে অল্পসময়ের জন্য আবশ্যকীয় নগ্নতাকে (যেমন সমুদ্রসৈকতে পোশাক পরিবর্তন) অশালীন মনে করা হয় না। তবে সৈকতে দীর্ঘক্ষণ নগ্ন অবস্থায় থাকাটা অশালীন বলে বিবেচিত হয়। যদিও নগ্ন সৈকত (Nudist Zone)-গুলিতে নগ্নতা গ্রহণযোগ্য। পাশ্চাত্য সমাজে নারীদের প্রকাশ্যে স্তন্যপান করানোয় অনেক ক্ষেত্রে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। ২০০৭ সালের জুন মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ব্রুক রায়ান নামে জনৈক মহিলা একটি রেস্তোরাঁয় তাঁর সাত মাসের শিশুপুত্রকে স্তন্যপান করাতে গেলে রেস্টুরেন্টের মালিক আপত্তি জানান। সেদেশে প্রকাশ্যে স্তন্যপান করানো যে আইনসংগত সেই সংক্রান্ত একটি নথি দেখিয়েও তিনি মালিকের অনুমতি পাননি। অগত্যা তাঁকে গাড়ির মধ্যে পুত্রকে স্তন্যপান করাতে হয়। পরে তিনি ওই রেস্তোরাঁর বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠিত করেন। উল্লেখ্য, অধিকাংশ মার্কিন অঙ্গরাজ্যেই (২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসের হিসেব অনুযায়ী ৪০টি) মায়েদের প্রকাশ্যে সন্তানকে স্তন্যপান আইনসংগত করে। অনেক পাশ্চাত্য দেশে এবং সূর্যস্নানের মতো কয়েকটি ক্ষেত্রে মহিলাদের স্তন অনাবৃত রাখাকে অশালীন বলে মনে করা হয় না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অনেক রাজ্যে অবশ্য প্রকাশ্যে মহিলাদের স্তনবৃন্ত প্রদর্শন ফৌজদারি অপরাধের মধ্যে পড়ে এবং প্রকাশ্য স্থানে স্তনবৃন্ত প্রকাশ করার উপরেও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। যুক্তরাজ্যে পাবলিক অর্ডার অ্যাক্ট অফ ১৯৮৬ অনুসারে নগ্নতাকে হয়রানি, সতর্কীকরণ বা যন্ত্রণা প্রদানের জন্য ব্যবহার করা যায় না। কয়েকটি বিচারের রায় থেকে পাশ্চাত্য সমাজে ‘মুক্তস্তন সমতা’ বা ‘টপফ্রি ইকুয়ালিটি’ আন্দোলনের সূচনা হয়। এই আন্দোলনের মূল বক্তব্য ছিল পুরুষেরা যেমন কোমরের ঊর্ধ্বাংশ অনাবৃত রাখে, মহিলাদেরও তেমনই অধিকার পাওয়া উচিত। এই সূত্রে ইংরেজিতে ‘টপলেস’ শব্দটির যৌন-অনুষঙ্গ এড়াতে ‘টপ-ফ্রি’ শব্দটির প্রচলনও হয়।
কেউ কেউ নিজের শরীরটাকে নগ্নভাবে প্রকাশ করার জন্য ব্যগ্র হলেও, অনেকেই নিজ শরীরটাকে জনসমক্ষে উন্মুক্ত করতে চায় না। কারণ বাধ সাধে লজ্জাবোধ। সব জাতি এবং সংস্কৃতিতে নারী-পুরুষ খোলামেলা চললেও সম্পূর্ণ নগ্নতা সবসময়ই কটু দৃষ্টিতে দেখা হয়। কিন্তু পৃথিবীতে এমনও কিছু আচার অনুষ্ঠান চলে আসছে, যার শর্তই নগ্নতা। “ক্ষীণকোটিপীনোন্নতপয়োধরা” নারীকে দর্শন করতে শুধু পুরুষরাই নন, নারীরাও বেশ উপভোগ করে। এখানে দেখে নিন এমনই কিছু খেলা ও উৎসবের তথ্য। বিবস্ত্র হয়ে এসব উদযাপিত হয় আয়োজন। যেমন–
(১) ফিলিপাইনের স্টেট ইউনিভার্সিটিতে বার্ষিক দৌড়ের আয়োজন হয়, যেখানে ছেলেরা নগ্ন হয়ে অংশগ্রহণ করে।
(২) ওয়াশিংটনের সিয়াটলে প্রতিবছর বেশ ঝড় তোলে ‘এলিমন্ট সোলাস্টিক প্যারেড’-এর আয়োজন। সেই ১৯৮৯ সাল থেকে এর আয়োজন চলছে। দেহে রং দিয়ে নানা আঁকিবুকি করে সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় সাইকেল চালান অংশগ্রহণকারীরা।
(৩) ভিয়েনার লিওপোল্ট জাদুঘরে ছবি প্রদর্শনীর আয়োজন থাকে, যার নাম ‘নুড মেন ফ্রম ১৮০০ টু টুডে’। এখানে ৩০০টিরও বেশি বিশাল আকারের ছবি আছে। সবই পুরুষের উলঙ্গ ছবি প্রদর্শিত হয়।
(৪) হাজার হাজার নারী-পুরুষও অংশ নেন। কিন্তু মাত্র ৩০ জনের সুযোগ হয় নগ্ন হয়ে বরফে স্লাইডিং খেলার। এতে বিজয়ী পান এক হাজার ব্রিটিশ পাউন্ড। ২০০৯ সাল থেকে জার্মানিতে এটি আয়োজিত হয়ে আসছে।
(৫) ‘দ্য অ্যানুয়েল রস্কিল্ড ফেস্টিভ্যাল’-এর অন্যতম একটি আয়োজন ‘নগ্ন দৌড়’। এতে নারী-পুরুষ নগ্ন হয়ে প্রায় সাত কিলোমিটারের একটি ট্র্যাক পাড়ি দেন।
(৬) নর্দার্ন নেভাদার ব্ল্যাক রক ডেজার্ট-এর চরমতম খরতাপে অনুষ্ঠিত হয় সপ্তাহব্যাপী আয়োজন বার্নিং ম্যান’। প্রায় ৫০ হাজার মানুষের আগমন ঘটে এই মেলায়। এখানে নগ্নতা উন্মুক্ত।
(৭) ইউরোপিয়ান ফেস্টিভ্যাল অব ন্যুড ফোটোগ্রাফি এক বিশাল প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। এখানে নগ্ন মানুষের শৈল্পিক ছবিগুলি প্রদর্শিত হয়। ফ্রাঞ্চ এবং ইউরোপে নগ্ন ছবির সবচেয়ে বড় প্রদর্শনী এটি।
(৮) জাপানে বড় মাপের একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়, যার নাম ‘সাইদাই জি ইয়ো হাদাকা মাতসুরি’। প্রতি ফেব্রুয়ারির তৃতীয় শনিবার ‘সাইদাই-জি টেম্পল’-এ নগ্ন হয়ে অংশ নেন পুরুষরা।
(৯) এটি এমন এক গণবিবাহের আয়োজন যেখানে সবাই নগ্ন হয়ে বিয়ে করেন।
(১০) নিউজিল্যান্ডে আয়োজিত হয় ‘নুড রাগবি ইন্টারন্যাশনাল’। অল ব্ল্যাকস এবং ফ্রান্সের খেলার আগে উত্তাপ ছড়ানোর একটি আয়োজন নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে রাগবি খেলা (সূত্র : ইন্ডিয়া টাইমস)।
ফোটোগ্রাফির আবিষ্কারের প্রায় শুরু থেকেই নগ্নতার ব্যবহার প্রচলিত। বস্তুত ফোটোগ্রাফিতে নগ্নতার মধ্যে সবসময় শৈল্পিক মেধা বিকশিত না-হলেও, নগ্ন ফটোগ্রাফি (Nude Photography)-তে হয়ে থাকে। ফোটোগ্রাফিতে নগ্নতা সাধারণত স্ন্যাপশট। কিন্তু নগ্ন ফোটোগ্রাফি কোনো ব্যক্তির স্থির অবস্থায় তোলা ছবি। শিল্পকৃতি হিসাবে, নগ্ন ফোটোগ্রাফি হল নগ্ন দেহের শৈল্পিক প্রদর্শন। এখানে মানবদেহের রেখা ও রূপই প্রধান উদ্দেশ্য। অনেক ফোটোগ্রাফারই একটি আর্ট ন্যুড ফটোগ্রাফকে ব্যক্তির বদলে মানবদেহের পাঠ মনে করেন। ব্যক্তির ফোটোগ্রাফ, যেখানে তাঁকে হুবহু চেনার উপায় থাকে, তাকে পোর্ট্রেট বলা চলে। কিন্তু অনেক ন্যুড ফটোগ্রাফে ব্যক্তির মুখই দেখা যায় না। ফোটোগ্রাফারেরা অনেক সময় আলোছায়ার চরম ব্যবহার, তৈলাক্ত ত্বক অথবা দেহের গঠন বোঝাতে ছায়ার ব্যবহার করে থাকেন।
প্রথম যুগের ফোটোগ্রাফাররা অনেক সময়ই নারীদের নগ্নতা ফটোগ্রাফিতে ফুটিয়ে তুলতেন। এঁদের মধ্যে ফেলিক্স-জ্যাক মলিন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এডওয়ার্ড ওয়াটসন, রুথ বার্নার্ড ও জেরি অ্যাভেনেইম প্রমুখ ফোটোগ্রাফাররা শিল্পকর্ম হিসবে দেহের রেখা প্রদর্শন করতে পছন্দ করতেন। ইরোটিক ফোটোগ্রাফি ও পর্নোগ্রাফিতেও অনেক সময় নগ্ন বা অর্ধনগ্ন মডেলদের শৈল্পিক চিত্র বিস্তৃত হয়ে থাকে। স্পেনসার টিউনিক নির্মিত সারা বিশ্বের নানা প্রকাশ্য স্থানে এক দঙ্গল নগ্ন লোকের স্থিতিস্থাপক ফটোগ্রাফি উচ্চ মানের শিল্পমেধার জন্য নন্দিত।
তথাকথিত সভ্য মানুষ ছাড়া পৃথিবীর সব প্রাণীই নন বিচরণ করে। তবে মানুষও সৃষ্টির শুরু থেকে আর পাঁচটা প্রাণীর মতো নগ্নভাবে বিচরণ করত। লজ্জার নিবারণের জন্য নয়, মানুষ শরীর ঢাকতে শুরু করেছিল নানা প্রাকৃতিক কারণে। চরম প্রতিকূল আবহাওয়া থেকে বাঁচতেই মানুষ শরীর ঢাকতে থাকে। পরবর্তী সময়ে পোশাকে বৈচিত্র্য আনা হয় শরীরকে সাজাতে। মানুষ যখন নগ্ন ছিল তখন শরীর নিয়ে এমন অদম্য কৌতূহল ছিল না। কৌতূহল ছিল না বলে শরীরের ভাঁজ-বিভঙ্গ দেখার জন্য অস্থিরতাও ছিল না। সারা পৃথিবী জুড়ে অসংখ্য ‘আনসিভিলাইজড’ ও ‘আনকনটাকটেড’ নরনারী গোষ্ঠী আছেন যাঁরা এই একবিংশ শতাব্দীতে আজও কেউ সম্পূর্ণ নগ্ন, কেউ-বা প্রায়-নগ্ন জীবনযাপন করেন। তথাকথিত সভ্য দুনিয়ার সঙ্গে তাঁদের কোনো সম্পর্ক নেই। যেমন– ভারতের ‘জাড়োয়া উপজাতি, ঘানার ‘ক্রোবো’ উপজাতি ইত্যাদি। নিউ গিনির পাপুয়ার এক উপজাতি গোষ্ঠীর কম বয়সি মেয়েরা উদ্ধাঙ্গ অনাবৃত করে পুরুষ-সঙ্গীদের সঙ্গে দেখা করতে যান। অপরদিকে সভ্য দুনিয়ার যেসব নরনারী বিভিন্ন দেশে ন্যুডিস্ট জোনে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে বিচরণ করেন। তাঁদের মধ্যে শরীর নিয়ে ন্যূনতম আঁতলেমি নেই। তাঁরা অবলীলায় ভাবলেশহীনভাবে নগ্ন হয়ে ঘোরাফেরা করেন। শুয়ে থাকেন যেমন খুশি, বসে থাকেন যেমন খুশি। আট থেকে আশি– সব বয়সের নরনারী একত্রে নগ্ন হয়ে থাকেন। কারোকে নগ্ন অবস্থায় দেখে কারোর উত্তেজনা হয় না। কেউ কারোর দিকে ঘুরেও দেখে না। জাপানের বহুল আলোচিত লিঙ্গ-উৎসব প্রতিবছর এপ্রিলের প্রথম রবিবার জাপানের কাওয়াসাকি অঞ্চলের লোকেরা সাড়ম্বরে পালন করে একটি ধর্ম অনুষ্ঠান যার নাম কানামারা মাৎসুরি (Kanamara Matsuri)। জাপানের কাওয়াসাকির একটি মন্দিরে এটি অনুষ্ঠিত হয়। এই উৎসবটি প্রধানত ধর্ম বিশ্বাসের অনুষ্ঠান, যার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে পুরুষাঙ্গসদৃশ উত্থিত লিঙ্গ।
সমস্যা হয় যেসব দেশে নগ্ন হয়ে বিচরণ করার অনুমতি নেই। যেসব দেশে নগ্ন হওয়া অপরাধ, নগ্নতা অপরাধ। সেখানে নগ্নতার আকর্ষণ অদম্য, অপ্রতিরোধ্য। সেখানে নগ্ন শরীর পুঁজিতে রূপান্তরিত হয়। নগ্ন শরীর প্রদর্শনে মধ্য দিয়ে কোটি কোটি ডলার আমদানি হয়। যদিও প্রকৃতির নিয়মে পৃথিবীতে মানুষ নগ্ন হয়েই আসে। কারণ এক অনিবার্যতায় মানুষ তার জন্মলগ্নের নগ্নতা এড়াতে পারে না। শিশু যতই পরিণত হতে থাকে, নগ্নতাও ততটা ঢাকা পড়ে যেতে থাকে। তবে মানবসমাজ পুরোপুরি নগ্নতামুক্ত নয়। পরিণত বয়সের নগ্নতা প্রদর্শন একদিকে যেমন নেতিবাচক ও নিন্দনীয়, অপরদিকে তেমন আকর্ষণীয় ও ‘লাভজনক’। নগ্নতার প্রতি মানুষের চিরন্তন আগ্রহ ও আকর্ষণের কারণে শোবিজের সঙ্গে এটা যেন বাই ডিফল্ট একটা ব্যাপার। এখানে নগ্নতা শুধু ‘শিল্প’ ই নয়, খুব বড় মাপের বাণিজ্যও বটে। অভিনেত্রী পাউলি দাম সিনেমায় এসে শুধু নগ্ন হয়েই তার দাম অনেক বাড়িয়ে ফেলেছেন কি না বলতে পারব না। ‘টেক ওয়ান’-এ স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায় সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে শরীরের সামনের অংশ নির্দ্বিধায় উন্মোচন করেছেন ক্যামেরার সামনে। তবে পাওলি আর স্বস্তিকার নগ্নতা উড়িয়ে নস্যি করে দিয়েছে ঋতুপর্ণা (রি) সেন এবং ইন্দিরা ভার্মারা।
নগ্নচিত্র, নগ্ন মূর্তি, নগ্ন স্কাল্পচার, নগ্ন ভাস্কর্য, নগ্ন ফোটোগ্রাফি, নগ্ন প্রদর্শন, নগ্ননৃত্য, নগ্ন প্রতিবাদ– পৃথিবীব্যাপী এখন নগ্নতা ও নগ্নতা সংশ্লিষ্ট কর্মকাণ্ডের আর্থিক দিকটা অনেক বড়। নগ্নতা বন্ধ হলে কয়েকটি দেশের কিংবা শহরের ট্যুরিজম ব্যাবসা মুখ থুবড়ে পড়বে। যে-কোনো আইনে নগ্নতা ও নগ্নতাকেন্দ্রিক সব কিছু নিষিদ্ধ হলে পৃথিবীতে কত হাজার কোটি ডলারের ব্যাবসা বন্ধ হয়ে যাবে তা বলা কঠিন। তবে এমন হলে থাইল্যান্ড, লাটভিয়া ও কোস্টারিকাসহ অনেক দেশের জিডিপি কমে যাবে, অনেক প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হয়ে যাবে এবং কয়েক মিলিয়ন মানুষ পথে বসবে। নগ্নতা এখন মাল্টি-বিলিয়ন ডলার ইন্ডাস্ট্রি। নগ্নতার জয়জয়কার এ সময়ে এর ব্যাপ্তি এখন এতটাই বেড়ে গেছে, এটা বন্ধ হলে উচ্চশিক্ষাও প্রভাবিত বা বাধাগ্রস্ত হবে। সম্প্রতি খবরে প্রকাশিত হয়েছে, ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্রছাত্রী শিক্ষা খরচ মেটানোর জন্য নগ্ন ফোটো সেশন দিয়ে মোটা অর্থ রোজগার করছেন। সম্প্রতি এক গবেষণা থেকে এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে। ব্রিটেনের লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ের এ প্রতিবেদনে বলা হয়, নগ্ননৃত্য ক্লাবের এক-তৃতীয়াংশের বেশি সদস্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার আগেই উচ্চশিক্ষার খরচ তুলে নিতে অনেকে নগ্ননৃত্যের চর্চা করা শুরু করে। এক শ্রেণির মানুষ যখন নানা কারণে তথা লজ্জা ঢাকতে পোশাকে শরীর ঢাকছে, অপরদিকে আর-এক শ্রেণির মানুষ নগ্ন হতে এবং নগ্ন করাতে ব্যস্ত হয়ে আছেন। কতক্ষণে সংশ্লিষ্ট সেই মানুষটিকে নগ্ন করে তাঁর শরীরটি দর্শন করবেন এবং করাবেন, সেই আনন্দে তাঁরা আটখানা হয়ে থাকেন –আর তিনি যদি নারী হন তাহলে তো কথাই নেই। নগ্ন পুরুষের শরীরের চাইতে নগ্ন নারীর শরীরই চড়া দামে বিকোয়।
আমাদের কয়েকজনের মধ্যে আর-একটি আচরণ লক্ষ করা যায়। তা হল, কেউ কোনো অপরাধ করলে সেই অভিযুক্ত ব্যক্তিকে নগ্ন করে গ্রাম ঘোরানো। এর ফলে মানুষকে নগ্ন দৌড় করালে ঠিক কেমন দেখায়, সেটা প্রত্যক্ষ করার জন্যই এই ধরনের ফতোয়া দেওয়া হয়। এও এক ধরনের যৌনতা, ধর্ষকাম। কয়েকটা ঘটনা উল্লেখ করি :
ঘটনা ১: ভারতে এক নারীর মাথা মুড়িয়ে, মুখে চুনকালি মাখিয়ে, নগ্ন করে গাধার পিঠে চড়িয়ে ঘোরানো হয়েছে পুরো গ্রাম। নিজের ভাগ্নেকে হত্যা করার অভিযোগে গ্রাম পঞ্চায়েতের রায়ে তাঁকে এই ‘শাস্তি দেওয়া হয়। ঘটনাটি রাজস্থানের রাজধানী জয়পুর থেকে সাড়ে ৩০০ কিলোমিটার দূরে রাজসমন্দ জেলার কুম্ভলগড় এলাকায় ঘটে। (১৭ নভেম্বর, ২০১৪)
ঘটনা ২ : পশ্চিমবঙ্গের লাভপুর থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে রামপুরহাটে অন্য জাতের লোকের জমিতে মজুর খাটার ‘অপরাধে’ গ্রামের মোড়ল তার সঙ্গীদের নিয়ে এক তরুণীর জামাকাপড় ছিঁড়ে বেধড়ক মারধর এবং যৌন নিগ্রহ করেছে। গ্রামের আরো দুই মোড়ল অর্জুন ও শ্রীকান্ত হাঁসদা তরুণীকে নগ্ন করে বেধড়ক মারধর করেন। নগ্ন করেই ঘোরানো হয় গ্রাম। যন্ত্রণায়, লজ্জায় ওই তরুণী মাটিতে পড়ে গেলেও তাকে রেহাই দেওয়া হয়নি। মাটিতে পড়ে থাকা তরুণীর গায়ে প্রস্রাব করে দেন অর্জুন। পরে সেটা চেটে খেতে বাধ্য করান তিনি। (২৩ নভেম্বর, ২০১৪)
ঘটনা ৩: ভারতে এক নারীকে গণধর্ষণের পর নগ্ন করে গ্রামের মধ্যে ঘুরানো হয়েছে বলে অভিযোগ। জমি সংক্রান্ত এক বিবাদকে কেন্দ্র করে দশজন মিলে ওই সাঁওতাল নারীকে ধর্ষণ করা হয়। অভিযুক্ত দশজনের মধ্যে রয়েছে নারীর স্বামীও। তারপর তাকে গ্রামের মধ্যে নগ্ন করে ঘোরানো হয়। শেষে আক্রান্ত নারীর ছোট ছেলের সামনেই তাকে মূত্র পান করতে বাধ্য করা হয়। (১৩ জুন, ২০১৪)
ঘটনা ৪ : প্রতিবেশীর স্ত্রীর সঙ্গে সহবাসের অভিযোগে ছেলেকে না-পেয়ে তার মাকে সবার সামনে নগ্ন করে ঘোরানো হল। পাকিস্তানের সংবাদ মাধ্যম ‘ডন’ এর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। ঘটনাটি ঘটেছে পাকিস্তানের উত্তর-পূর্বের বালা গ্রামে। এক গ্রাম্য শালিসে ছেলের মাকে অভিযুক্ত করে তাকে নগ্ন করে ঘোরানো হয়। মহিলা যখন নগ্ন হয়ে হাঁটছিলেন তখন তাকে ঘিরে ছিল চারজন সশস্ত্র ব্যক্তি। (১৫ জুন, ২০১১)
ঘটনা ৫: ভারতের ছত্তিশগড় রাজ্যের জশপুর জেলার পাঠালগাঁও এলাকার এক উপজাতি শিক্ষিকাকে (৩৫) মারধরের পর জনসমক্ষে নগ্ন করে ঘুরিয়েছে গ্রামের খাপ পঞ্চায়েতরা। ওই শিক্ষিকা জানিয়েছেন, একইগ্রামে একই জাতির একটি মেয়ের সঙ্গে তার ভাইপোর প্রেমের সম্পর্ক ছিল। যখন ওই মেয়ের অন্য ছেলের সঙ্গে বিয়ের কথা চলছিল তখন মেয়েটি তার বাড়িতে এসে ওঠে। এখানে তার ভাইপো বিজেন্দ্রও থাকত। পরে ওই শিক্ষিকা মেয়েটিকে অনেক বোঝালে সে সেখান থেকে চলে যায়। তারপর ওই গ্রামের সরপঞ্চ (গ্রাম পরিষদ প্রধান) শিক্ষিকার বাড়িতে মেয়েটির সন্ধানে আসে। এসময় তিনি অভিযোগ করেন, ওই শিক্ষিকা মেয়েটিকে ভুল পথে পরিচালিত করেছে ও তার ভাইপো মেয়েটি ধর্ষণ করেছে। গ্রামের মাতব্বরা ওই শিক্ষিকাকে গণহারে পিটুনি দেওয়ার নির্দেশ দেয় ও প্রকাশ্য দিবালোকে সবার সামনে নগ্ন করে।
বিস্ময়াভূত হলেও সত্যি, একমাত্র নগ্ন হতে রাজি হলেই আপনি কিনতে পারবেন জমি। অন্যথায় জমিও মিলবে না, মিলবে না বাড়ি-ঘর বা বসবাসের সুযোগ। যুক্তরাজ্যের হার্টফোর্ডশায়ারে অবস্থিত স্পিলপ্লাজ নামক গ্রামে এমনই রীতি। কারণ ওই গ্রামে কেউ কোনো কাপড়ই পরে না। তাই সেখানে থাকতে চাইলে তাঁদের মতো করেই থাকতে হবে সকলকে। দক্ষিণ আমেরিকায় ঘনজঙ্গলে কিছু আদিবাসী আছে যাঁরা এখনও তথাকথিত সভ্যতার ছোঁয়া পায়নি। তাঁদের ব্যাপার হলে ভিন্ন কথা ছিল। কিন্তু সভ্যতার পথপ্রদর্শক বলে যাঁরা নিজেদের দাবি করে সেই যুক্তরাজ্যে এমন গ্রামের কথা শুনলে অনেকেই হয়তো অবাক হবেন। তবে গ্রামবাসী অবশ্য নগ্নতার মধ্যে অসভ্যতার কিছু দেখেন না। আর যেখানে ইউরোপ-আমেরিকার সামনের সারির সভ্য দেশগুলির শিক্ষিতরা নগ্নতার দাবিতে আন্দোলন করছেন, রাস্তার মধ্যে কাপড় খুলে ব্যানার হাতে টিভি ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন সেখানে ওই গ্রামবাসীকে অসভ্য বলার সুযোগই-বা কোথায়? তাঁরা তো নিজেদের মতো করে থাকছেন, কারও বাড়া ভাতে তো ছাই দিচ্ছেন না। এটা ওই গ্রামেরই মানুষের কথা। তাঁরা গায়ে কাপড়ের কোনো পোশাক না পরলেও রোদ থেকে চোখ বাঁচাতে সানগ্লাস ঠিকই ব্যবহার করেন। গলায় সোনার চেন, এমনকি আঙ্গুলে আংটিও পরেন শখ করে। গ্রামের ভিতর বেশ সমৃদ্ধ বারও আছে। শুধু পোশাকই নেই গায়ে। এই গ্রামের বাসিন্দারা গ্রামটিকে যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে পুরনো নগ্নতাবাদী অঞ্চল বলে দাবি করেন। তাঁরা এতটাই নগ্নতাবাদী যে আপনি যদি তাঁদের মতের সঙ্গে একমত না হন তাহলে সেই গ্রামের কেউ আপনার কাছে জায়গা-জমি, বাড়ি-ঘর কিছুই বিক্রি করবে না।
নগ্ন হওয়া এবং নগ্ন করানো মনুষ্যজাতির একটি আদিম এবং অনিবার্য প্রবৃত্তি। ছলে-বলে-কৌশলে অথবা নানাবিধ বাহানা ও অজুহাতে মানুষ নগ্ন হয়, নগ্ন করে। দুর্বল নারী থেকে দুর্বল দলিত –সবাইকেই নগ্ন করানো যায়। নগ্ন করে হাসি বা মজাক ওড়ানো যায়। সেই নগ্ন শরীর ভিডিও বা স্টিলে বন্দি করে অতি দ্রুত সোস্যাল নেটওয়ার্কগুলিতে ছড়িয়ে দিয়ে চব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয় স্বাদ নেওয়া যায়। তথাকথিত সভ্যসমাজে নারীদের একটা অংশ শিল্পের নামে আর্টের নামে চিত্রনাট্যের ডিমান্ড পূরণে ঝপাঝপ নগ্ন হয়ে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির লোভে নগ্নতা, যৌনমিলন সবই চলে আসছে আমজনতার অন্দরমহলে। অতঃপর স্বীকৃতি তো দূরে থাক, তাকে পরে আর দূরবিন দিয়েও খুঁজে পাওয়া যায় না।
শুধু শারীরিক নগ্নতাই নয়, আমাদের সমাজে ও রাজনীতিতেও বিভিন্নমুখী নগ্নতা রয়েছে। নগ্ন হামলা, নগ্ন হস্তক্ষেপ, নগ্ন আচরণ এসবই শরীরের বাইরের নগ্নতা বা নির্লজ্জতার পরিভাষা। প্রকৃতপক্ষে সব ধরনের নগ্নতার সঙ্গে মিশে থাকে নির্লজ্জতা। তবে এখানে তফাত হল, যে উলঙ্গ হয় তাঁর লজ্জাবোধ থাকে না। কারণ উলঙ্গতা এবং নির্লজ্জতা সবসময় সহাবস্থান করে। দু-কান কাটা। একই সঙ্গে একই মানুষ প্রকাশ্যে উলঙ্গ ও লজ্জাবোধসম্পন্ন হতে পারে না। তবে নগ্নতার প্রধান উপাদান নির্লজ্জতা নয়, প্রাপ্তিই মূল বিষয়। রাজনীতিতে যত ধরনের নগ্নতা সবকিছুর পিছনেই আছে অর্থ এবং ক্ষমতা। যেমন নির্বাচনে নগ্ন হামলা ও নগ্ন হস্তক্ষেপের এ এক ‘সাইড ইফেক্ট’ মাত্র।
ন্যুড থেরাপি, বর্তমানে একটি আকর্ষণীয় থেরাপি। বেশিরভাগ মানুষ এই ধরনের থেরাপির কথা কখনো হয়তো শোনেনি। নগ্ন থেরাপির সত্যিকারের ধারণা অর্জনের জন্য এর শিকড়ে ফিরে যেতে হবে। মনস্তাত্ত্বিক অধ্যয়নের এই ক্ষেত্রটি ১৯৩০-এর দশকে ফিরে এসেছিল। মনোবিজ্ঞানীদের গোষ্ঠীগুলি মানুষের জীবনে সামাজিক নগ্নতার প্রভাবগুলি অধ্যয়ন শুরু করেন। বিশেষ করে একজন মনোবিজ্ঞানী খুব মনোযোগ সহকারে নগ্নতা করেছিলেন। তাঁর নাম হাওয়ার্ড ওয়ারেন। এই মনোবিজ্ঞানী ১৯৩২ সালে পর্যবেক্ষণ করার জন্য একটি জার্মান নুডিস্ট শিবিরে কিছু সময় অতিবাহিত করেছিলেন। এই অভিজ্ঞতা অর্জনের এক বছর পর তিনি সামাজিক নগ্নতা এবং ‘দেহাবরণ’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। অবশেষে নগ্ন থেরাপির আসল অনুশীলনটি পপ আপ হতে করে। ষাটের দশকের শেষে এবং সত্তর দশকের শেষদিকে কিছু সাইকোথেরাপিস্ট নগ্ন সাইকোথেরাপি অনুশীলন করে। নগ্ন থেরাপিস্টদের মতে, নগ্ন থেরাপি মানুষের আত্মবিশ্বাস, নম্নস্তরের বাধা, অন্যের কাছে উন্মুক্ত করার একটি উন্নত ক্ষমতা এবং অন্যন্য অনেক ইতিবাচক সুবিধা ভোগ করতে সাহায্য করে।
অবশেষে মনে হচ্ছে আমরা কি ক্রমশ আদিম যুগে ফিরে যাচ্ছি? প্রকৃতি যাকে উলঙ্গ শরীর দিয়ে জন্ম দিয়েছে তাঁকে কেন আগাপাছতলা আবরণে মুড়ে পথ চলতে হবে? তবে কি শরীরের সমস্ত পোশাক খুলে ফেলে দিয়ে নগ্ন হতে চাইছি? একসময় কি সারা পৃথিবীই ন্যুডিস্ট জোন হয়ে যাবে? ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি? আমার তো মনে হয় সেদিন বেশিদূর নয়। শুরু কিন্তু হয়ে গেছে!
সমাপ্ত