১. জ্যোতিষ : না শাস্ত্র, না বিজ্ঞান

জ্যোতিষ : না শাস্ত্র, না বিজ্ঞান

প্ল্যাটফর্মে ধাতুর আংটি বিক্রেতা অক্লান্ত চেষ্টা করে যাচ্ছে আংটিটি আঙুলে ঢোকানোর। শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হলেন। ব্যর্থ হবেন নাই-বা কেন! আঙুলগুলিতে তো আর আংটি ঢোকানোর জায়গাই নেই। দশ আঙুলে কুড়িটা রত্নখোচিত আংটির উপর ওই আড়াই প্যাঁচের তামার আংটি কোথায় ঢুকবে? পোখরাজ, গোমেদ, পান্না, চুনি, প্রবাল– কী নেই সেই দশ আঙুলে! ডাবল ডাবলও আছে। ‘রহিস আদমি’ পেয়ে জ্যোতিষীরা ওর দশ আঙুলে বিশটা আংটি ভজিয়ে দিয়েছে। ওই বিশটা আংটিতেও যে কাজ হয়নি, তা ওই আড়াই প্যাঁচের তামার আংটি পরার ব্যাকুলতাতেই আন্দাজ করা যায়।

আর-একটা ঘটনা বলি : বছর কুড়ি আগে আকাশবাণীর ‘বিজ্ঞানরসিকের দরবারে’ শিরোনামে অনুষ্ঠান হত। কোনো একদিনের অনুষ্ঠানে কলকাতার স্বনামখ্যাত পাঁচজন জ্যোতিষীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল একটি নির্দিষ্ট কোষ্ঠী বিচারের জন্য। পাঁচ জ্যোতিষীই জানতেন এই কাজটি করতে শুধুমাত্র তাঁকেই আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। যদিও ট্যবলেট বিক্রেতা এক স্বনামধন্য লাল জ্যোতিষী ছাড়া বাকি চারজন জ্যোতিষী আকাশবাণীতে গিয়েছিলেন নিজেকে যথার্থ ‘ভবিষ্যৎদ্রষ্টা’ প্রমাণ করতে। চারজন জ্যোতিষীকে চারটি ভিন্ন ঘরে বসতে দেওয়া হয়েছিল একই ব্যক্তির কোষ্ঠী দিয়ে। নির্দিষ্ট সময়ে চারজন জ্যোতিষীর কাছ থেকে একই ব্যক্তির চারটি কোষ্ঠী জমা নেওয়ার পর দেখা গেল চার ধরনের বিচার। কারোর সঙ্গে কারোর মিল নেই। এখানেই শেষ নয় বিস্ময়ের। সেই কোষ্ঠীর জাতক ছিলেন একজন মৃত শিশুর। সেই মৃত শিশুর কোষ্ঠী দেখে জ্যোতিষীরা বলেছিলেন যে জাতকের কবে বিয়ে হবে, কবে চাকরি হবে, কবে ফাড়াইত্যাদি ইত্যাদি হাস্যকর কথাবার্তা।

২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে যে কজন জ্যোতিষীর কাছে সাংবাদিকরা জিজ্ঞাসা করেছিল–নির্বাচনে জিতে কোন্ দল আসছে? সব জ্যোতিষী একবাক্যে বলেছিল –বিজেপিই বিপুল আসন নিয়ে ক্ষমতায় আসছে। জ্যোতিষীদের মিথ্যা প্রমাণ করিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস আসন নিয়ে ক্ষমতায় তৃতীয়বারের জন্য ক্ষমতা চলে এলো। বিশ্বজুড়ে করোনা ‘অতিমারি’-র কোনো পূর্বাভাস একজন জ্যোতিষীও দিতে পারেনি।

এরকম ঘটনার ঝুড়ি ঝুড়ি উল্লেখ করা যায়। তাতে লাভ কিছু নেই। মানুষ যেখানে ছিল সেখানেই থাকবে, জ্যোতিষ এবং জ্যোতিষী যেখানে ছিল সেখানেই থাকবে। আমরা বরং দেখার চেষ্টা করি জ্যোতিষ আসলে কী? জ্যোতিষ কি শাস্ত্র? নাকি বিজ্ঞান? প্রচুর বিতর্ক, প্রচুর লেখালেখি হয়েছে এ বিষয়ে। তবুও আমি আমার মতো চেষ্টা করি। বোঝার এবং বোঝাবার।

‘জ্যোতির্বিদ্যা’(Astronomy) আর ‘জ্যোতিষবিদ্যা’(Astrology) কি একই বিষয়? না, একই বিষয় নয় তো! যদিও উচ্চারণের দিক থেকে দুটি শব্দ খুবই কাছাকাছি। অর্থ কিন্তু সম্পূর্ণ বিপরীত। জ্যোতিষবিদ্যা যাঁরা চর্চা করেন, তাঁরা জ্যোতিষী এবং জ্যোতির্বিদ্যা যাঁরা চর্চা করেন তাঁরা জ্যোতির্বিদ। জ্যোতিষী হলেন কিরো, ভৃগু, পরাশর, অমুক সম্রাট, তমুক সমুদ্ররা। এঁরা ভবিষ্যৎদ্রষ্টা! অপরদিকে জ্যোতির্বিদ হলেন উইলিয়ম হার্শেল, ভেইনু বাপ্প, মেঘনাদ সাহা, জয়ন্ত বিষ্ণু নার্লিকার, আর্যভট্ট, গ্যালিলিও, কোপারনিকাস প্রমুখ। এঁরা ভবিষ্যৎদ্রষ্টা নন। জ্যোতির্বিদ্যার বিষয় সূর্য, চন্দ্র, গ্রহ, নক্ষত্র, গ্যালাক্সি, ছায়াপুঞ্জ, উল্কা, ধূমকেতু। জ্যোতিষবিদ্যার বিদ্যার বিষয় হাত-পা-মুখ-কপাল গুনে ব্যক্তির ভূত-ভবিষ্যত বলে দেওয়া। জ্যোতির্বিদ্যায় সূর্যের চারপাশে পৃথিবী সহ অন্যান্য গ্রহ-উপগ্রহরা ঘুরপাক খায়। জ্যোতিষবিদ্যায় পৃথিবীর চারপাশে সূর্য সহ অন্যান্য গ্রহরা ঘুরপাক খায়। পৃথিবী নামে কোনো গ্রহের অস্তিত্ব নেই। জ্যোতির্বিদ্যায় উপগ্রহ আছে, জ্যোতিষবিদ্যায় কোনো উপগ্রহ নেই। জ্যোতির্বিদ্যায় রাহু ও কেতুর কোনো অস্তিত্ব নেই, জ্যোতিষবিদ্যায় রাহু ও কেতুর অস্তিত্ব প্রবল। মানুষের জীবন উলটপালট করে দেওয়ার বিপুল ক্ষমতা রাখে! জ্যোতির্বিদ্যার গ্রহ বুধ, শুক্র, পৃথিবী, মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস, নেপচুন, প্লুটো ইত্যাদি। জ্যোতির্বিদ্যার গ্রহরা বালি-পাথর-গ্যাসীয় মহাজাগতিক নিথর বস্তু বিশেষ। জ্যোতিষবিদ্যার গ্রহ সূর্য বা রবি, চন্দ্র, মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র, শনি, রাহু এবং কেতু। জ্যোতিষবিদ্যার গ্রহরা সবাই দেবতা, তাঁদের কোপে মানুষের ‘সব্বোনাশ’ হয়। জ্যোতিষবিদ্যায় গ্রহরত্ন, গ্রহমূল, অষ্টধাতুর ব্যবহার আছে। জ্যোতির্বিদ্যায় এসবের কোনো ব্যবহারই নেই। জ্যোতিষবিদ্যায় মামলা-মোকদ্দমা জিতিয়ে দেওয়া, বিয়ে হওয়া, পরীক্ষায় পাশ করিয়ে দেওয়া, চাকরি পাইয়ে দেওয়ার দাবি করে। জ্যোতির্বিদ্যায় এসবের কোনো চর্চা নেই। জ্যোতির্বিদ্যায় পদার্থবিদ্যা, গণিত, দূরবীক্ষণ যন্ত্র প্রয়োজন হয়। জ্যোতিষবিদ্যায় কোনো বিদ্যাই লাগে না– লাগে ব্যক্তির দুর্বলতা খুঁজে বের করার ক্ষমতা, কৌশল-চাতুরতা, সম্মোহনী আর রত্ন-মাদুলি-কবচ গছানোর ক্ষমতা। গ্রহ-নক্ষত্র দেখতে দূরবীক্ষণ যন্ত্র লাগে না, দূরবীক্ষণ যন্ত্র ছাড়াই বহুদূরে থাকা ভবিষ্যত আর অতীত দেখাই জ্যোতিষীদের কর্মকাণ্ড।

ভারতে বৈদিক যুগের মাঝামাঝি মায় ব্রাহ্মণ সাহিত্যাদি রচনার যুগ থেকেই জ্যোতির্বিদ্যায় বিশেষ অগ্রগতি হয়েছিল। বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ রামশরণ শর্মা বলেন– প্রাচীন বৈদিক সাহিত্যে জ্যোতিষীর ভবিষ্যবিচারের কোনো ইঙ্গিত নেই। হস্তরেখা বিচারের প্রাচীনতম আলোেচনা গরুড়পুরাণে পাওয়া যায়। এ বিষয়ে প্রথম উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকের ‘বৃহৎসংহিতা’, যে গ্রন্থটির রচয়িতা বরাহমিহির। বরাহমিহির ছিলেন শক জাতিভুক্ত। সেসময় আফগানিস্তান, পাঞ্জাব, সিন্ধু ও রাজপুতানার নিয়ে গঠিত এক বিরাট এলাকা জুড়ে শকস্তান নামের এক রাজ্য ছিল। শকরা ছিল মূলত পূর্ব ইরান থেকে আগত একটি গোত্রগোষ্ঠী।

অন্য এক কাহিনিতে জানা যাচ্ছে তাঁর বাবার নাম আদিত্যদাস, আদিত্যদাস মানে এখানে সূর্যের দাস। বরাহমিহির ৪৯৯ খ্রিস্টাব্দে উজ্জয়নীর নিকটবর্তী গ্রাম কাপ্তিঠে ব্রাহ্মণদের পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর বাবা ছিলেন সূর্য দেবতার উপাসক এবং তিনিই বরাহমিহির জ্যোতিষ শিক্ষা দিয়েছিলেন। তবে বরাহমিহির একাধারে জ্যোতির্বিদ এবং জ্যোতিষী। কুসুমপুরা (পাটনা) সফরে যুবক বরাহমিহির জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং গণিতবিদ আর্যভট্টের সাথে দেখা করলেন। তিনি তাকে এতটাই অনুপ্রাণিত করেছিল যে তিনি জ্যোতিষশাস্ত্র এবং জ্যোতির্বিদ্যাকে আজীবন অনুসরণ হিসাবে গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

বিক্রমাদিত্যের এই রত্ন ‘বরাহ’ উপাধি পেলেন। কীভাবে পেলেন তার একটা গল্প প্রচলন আছে। রাজকীয় জ্যোতিষ মিহিরের ভবিষ্যদ্বাণী শুনে রাজা বিক্রমাদিত্য অশান্ত ছিলেন। তিনি সুসজ্জিত এবং জনাকীর্ণ আদালতের চারপাশে তাঁকিয়ে বললেন, “এটা কি সত্য হতে পারে?” কোনো উত্তর ছিল না। রাজকীয় জ্যোতিষীর ভবিষ্যদ্বাণীতে শব্দের বাইরে সবাই হতবাক হয়ে যাওয়ায় নীরবতা ছিল। নীরবতা ভঙ্গ করে এবং নিজেই দুঃখের সঙ্গে রাজকীয় জ্যোতিষ এই ভবিষ্যদ্বাণীটির সত্যতা নিশ্চিত করেছিলেন, “গ্রহগুলির অবস্থানটি ১৮ বছর বয়সে রাজপুত্রের মৃত্যুর পূর্বাভাস দেয়।” যদিও রাজা তাঁর আবেগ নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন। কিন্তু রানি নিজেকে আটকে রাখতে পারেনি এবং বলে ওঠেন– “প্রভু আপনাকে এই ভবিষ্যদ্বাণীটি মিথ্যা প্রমাণিত করতে হবে।” যদিও রাজা তাঁর জ্যোতিষী মিহিরের প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস রেখেছিলেন, তবে তিনি পুত্রকে রক্ষা এবং বাঁচাতে প্রতিটি সতর্কতা অবলম্বন করেছিলেন। কিন্তু পূর্বাভাসের দিন, একটি শুয়োর রাজপুত্রকে হত্যা করেছিল। সম্রাটের কাছে এই সংবাদ পৌঁছোলে তিনি মিহিরাকে তাঁর দরবারে ডেকে বললেন, “আমি পরাজিত, তুমি জিতেছিলে, তুমি জিতেছ।” জ্যোতিষী রাজার মতোই দুঃখিত ছিলেন এবং তিনি উত্তর দিলেন– “আমার প্রভু। আমি জিতিনি। এটি জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং জ্যোতিষবিজ্ঞানের জয়!” রাজা বললেন –“এটি যাই হোক না কেন, আমার শ্রদ্ধেয় জ্যোতিষী। এটি আমাকে নিশ্চিত করেছে যে, আপনার বিজ্ঞান সত্য ছাড়া কিছুই নয়। এবং এই বিষয়ে আপনার দক্ষতার জন্য, এখন আমি আপনাকে মাগধ রাজ্যের সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কার, বরাহর প্রতীক (শুয়োর) দেব। সুতরাং সেই সময় থেকেই মিহির বরাহমিহির নামে পরিচিতি লাভ করে।

অন্য আর-এক কাহিনি থেকে জানা যায় খনার স্বামী মিহির। সেই মিহিরের বাবা বরাহ। খনা জ্যোতির্বিদ্যায় পারদর্শী বিদূষী নারী। কথিত আছে, বিক্রমপুরের রাজা বিক্রমাদিত্যের রাজসভার প্রখ্যাত জ্যোতির্বিদ বরাহ তাঁর পুত্রের জন্ম গোষ্ঠী গণনা করে পুত্রের আয়ু এক বছর দেখতে পেয়ে শিশুপুত্র মিহিরকে একটি পাত্র করে সমুদ্রের জলে ভাসিয়ে দেন। পাত্রটি ভাসতে ভাসতে সিংহল দ্বীপে পৌঁছেলে সিংহলরাজ শিশুটিকে লালনপালন করেন এবং খনার সঙ্গে বিয়ে দেন। খনা, বরাহ ও মিহির সকলেই একাধারে জ্যোতির্বিদ ও জ্যোতিষবিদ ছিলেন। একদিন শ্বশুর বরাহ ও স্বামী মিহির আকাশের তারা গণনায় সমস্যায় পড়লে খনা সমস্যার সমাধান বের করে দেন। খনার দেওয়া পূর্বাভাসে রাজ্যের কৃষিজীবীরা উপকৃত হতেন বলে রাজা বিক্রমাদিত্য খনাকে দশম রত্ন হিসাবে নিযুক্ত করেন। এতে বরাহ ও মিহির প্রচণ্ড ঈর্ষাকাতর হয়ে পড়েন। রাজসভায় প্রতিপত্তি হারানোর ভয়ে প্রতিহিংসায় বরাহের আদেশে মিহির খনার জিভ কেটে দেয়, যাতে খনা কোনোদিন ভবিষ্যদ্বাণী তথা পূর্বাভাস দিতে না না পারে। জিভ কাটার ফলে কিছুকাল পরে খনার অকালমৃত্যু হয়। পরে বরাহ ও মিহিরের নাম একসঙ্গে উচ্চারিত হতে থাকে– বরাহমিহির।

ব্রাহ্মণ্য যুগে জ্যোতর্বিদ্যাকে একটি স্বতন্ত্র বিদ্যা হিসাবে গণ্য করত। ব্রাহ্মণ্য সাহিত্যে জ্যোতিষকে বলা হয়েছে ‘নক্ষত্রবিদ্যা’ এবং জ্যোতির্বিদকে ‘নক্ষত্র দর্শক’ বলা হয়েছে। আর্যভট্টই প্রথম ভারতীয় জ্যোতির্বিদ, যিনি পৃথিবীর আহ্নিক গতির কথা বলেন। গ্রিকদের অনেক আগে থেকেই ব্যাবিলনীয়, মিশরীয় এবং ভারতীয়রা ২০০০ বছর ধরে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় আত্মনিয়োগ করে এসেছে। সেই জ্ঞান চর্চা অর্থাৎ জ্যোতির্বিদ্যার ক্ষেত্রে গ্রহ-নক্ষত্র পর্যবেক্ষণের পরিপূর্ণ সদব্যবহার গ্রিক বিজ্ঞানীরা করেছেন। গ্রিক জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা কখনোই জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চায় ধর্ম এবং ফলিত জ্যোতিষের প্রতি বেশি গুরুত্ব আরোপ করেনি।

ভারতের যেমন বরাহ ও মিহিররা একাধারে জ্যোতির্বিদ ও জ্যোতিষবিদ ছিলেন, প্রাশ্চাত্যের কিরো কিন্তু আগ মার্কা জ্যোতিষবিদ। জ্যোতিষবিদ হিসাবেই তাঁর বিশ্বজোড়া খ্যাতি। বলতে গেলে এই কিরোই বিশ্বজুড়ে জ্যোতিষ ব্যাবসার জন্ম দিয়েছে। কিরো, বেনহ্যাম, সেন্ট জারমেইন, নোয়েন জ্যাকুইন এঁরা সকলেই পাশ্চাত্যের জ্যোতিষবিদ। তবে জানা যায়, কিরো ভারত ও মিশর থেকে জ্যোতিষশাস্ত্রের বিরাট জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। কিরোকে একটু জানার চেষ্টা করা যাক। কিরোর প্রকৃত নাম কাউন্ট-লুই হ্যামন। কিরোকে নিয়ে এক কৌতূহলোদ্দীপক গল্প চালু আছে। গল্পটি এরকম –কিরো যখন আমেরিকায় পা দিলেন, তখন তাঁকে যাচাই করার জন্য একটি বিখ্যাত আমেরিকান সংবাদপত্র তাঁর সামনে চারটি হাতের ছাপ রাখা হয় এবং বলা হয়– এই চারটি হাতের ছাপ দেখে তাঁদের সম্পর্কে সঠিক বলে দিতে পারলে আমেরিকায় তাঁর বিরাট খ্যাতি ছড়িয়ে পড়বে। আর বলতে না পারলে তাঁকে পরের জাহাজে ইংল্যান্ডে ফিরে যেতে হবে। কিরো সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন। এরপর একে একে চারটি হাতের ছাপ পর্যবেক্ষণ করেন এবং প্রথম তিনজনের পেশা, জীবনের উন্নতি অবনতি সম্পর্কে বিস্তৃতভাবে বললেন। চতুর্থ হাতের ছাপ দেখে বললেন– “ইনি একজন চিকিৎসক, কিন্তু বিরাট ক্রিমিনাল। তাঁর অপরাধের জন্য ধরা পড়ে জেলে যাবেন। কিন্তু তাঁর ফাঁসির হুকুম হলেও শেষপর্যন্ত ফাঁসি হবে না। জেলখানাতেই তাঁর মৃত্যু হবে।” শেষপর্যন্ত সেই ক্রিমিনাল চিকিৎসকের কী হয়েছিল, তা অবশ্য জানা যায়নি। দ্বিতীয় একটি ঘটনা প্রচলিত আছে। সেই ঘটনাটি এরকম –একবার এক বিখ্যাত নারী গোয়েন্দা মাতাহারির হাত দেখে কিরো বললেন –“তুমি অবিলম্বে এই পেশা ত্যাগ করো। তা না-হলে তোমার মৃত্যু অনিবার্য।” মাতাহারি বলেন– “তোমার কথা আমি মেনে নিতে প্রস্তুত কিরো। কিন্তু এইভাবে মৃত্যুবরণ করা ছাড়া আমার কাছে দ্বিতীয় কোনো উপায় নেই।” একথা সবাই জানেনে গোয়েন্দা, পুলিশ, সেনা সর্বদাই ঝুঁকির চাকরি, যাঁরা প্রাণ বাজি রেখে প্রতিপক্ষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। অনেকেরই মৃত্যু হয়। ঝড়ে কাক মরলে গুণিনের নাম তো ফাটবেই। চাইলে যে কেউ এমন গুণিন হতে পারেন।

আরিস্টটল মনে করতেন –“বিশ্ব দুটি ভাগে বিভাজিত। (১) পার্থিব, যেখানে পাপে পরিপূর্ণ এবং (২) গাগনিক বা স্বর্গীয়, যেখানে সবই নিখুঁত ও অপরিবর্তনীয়। বিশ্বের কেন্দ্রে আছে অনড় পৃথিবী, আর তাকে কেন্দ্র করে পূর্ব থেকে পশ্চিম ঘুরে চলেছে ৫৬টি গোলক, যেখানে আছে গাগনিক বস্তুগুলি। সবচেয়ে নীচের গোলকে আছে চাঁদ, এই চাঁদই পাপী পৃথিবী এবং পবিত্র স্বর্গীয় অঞ্চলের সীমারেখাকে নির্দেশ করছে।” অ্যারিস্টটলের এই ধারণাই চার্চের মতবাদ হিসাবে প্রচারিত হত। সাধারণ মানুষও এটাই জেনেছিল। এই মতবাদের বিরুদ্ধাচরণ করা মানে ধর্মদ্রোহিতার সমতুল। খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকে জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও গণিতজ্ঞ টলেমি চিন্তাবিদ দার্শনিক অ্যারিস্টটলের ধারণার উপর ভিত্তি করে ভূকেন্দ্রিক বিশ্বতত্ত্বের এক সম্পূর্ণ ছবি সামনে আনেন। তিনি বলেন –অনড় পৃথিবীকে কেন্দ্র করে সাতটি নিখুঁত গোলক (যথাক্রমে চাঁদ, বুধ, শুক্র, সূর্য, মঙ্গল, বৃহস্পতি এবং শনি) সুসম বৃত্তাকারে আবর্তিত হচ্ছে এবং অষ্টম গোলকে নক্ষত্রের অবস্থান করছে। বহু পরে জ্যোতির্বিজ্ঞানী কোপারনিকাস ১৫৪৩ সালে এক গ্রন্থে বললেন –“পৃথিবী নয়, বিশ্বের কেন্দ্রে আছে সূর্য। সূর্যকে কেন্দ্র করে সমস্ত গ্রহগুলো বৃত্তাকার পথে ঘুরছে।” ইতালির চিন্তাবিদ জিওনার্দো ব্রুনো কোপারনিকাসের এই সূর্যকেন্দ্রিক বিশ্বতত্ত্বকে ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায় প্রচার করতে থাকলেন। এটা প্রচার করার অপরাধে ব্রুনো অপরাধী সাব্যস্ত হলেন। দীর্ঘ সাত বছর ধরে বিচার চলল এবং বিচারে মৃত্যুদণ্ড আদেশ হল। প্রকাশ্যে জনসমক্ষে ব্রুনোকে দাউদাউ আগুনে পুড়িয়ে মারা হল। সাল ১৬০০। মারা গেলেন জ্যোতির্বিদ, কিন্তু সত্য আজও বেঁচে আছে। সৌরতত্ত্ব আজও সত্যে অটুট। সাল ১৬০৯, জার্মানির জ্যোতির্বিজ্ঞানী গ্যালিলিও বললেন– “কোপারনিকাসের সূর্যকেন্দ্রিক বিশ্বতত্ত্বটি সঠিক।”

সভ্যতার উষাকাল থেকে বহুকাল পর্যন্ত জ্যোতিষবিদ্যা এবং জ্যোতির্বিদ্যার মধ্যে কোনো ফারাক ছিল না। বিষ্ণুপুরাণে চতুর্দশ বিদ্যার কথা বলা হয়েছে– চার বেদ, ছয় বেদাঙ্গ, মীমাংসা, ন্যায়, ধর্মশাস্ত্র এবং পুরাণ। ছয় বেদাঙ্গের মধ্যে জ্যোতিষ অন্যতম। পাণিনীয় শিক্ষায় জ্যোতিষকে বেদপুরুষের দুই চক্ষুরূপে কল্পনা করা হয়েছে –“জ্যোতিষাময়নং চক্ষঃ”। শাস্ত্রজ্ঞরা বলেন –“যে শাস্ত্রের মাধ্যমে আমরা জ্যোতিষ্কসমূহের পরিভ্রমণকাল, তাদের স্বরূপ, সঞ্চার, অবস্থান এবং তৎসম্বন্ধীয় যাবতীয় ঘটনাবলি মানুষের জীবনে তাদের প্রভাব বৈজ্ঞানিকভাবে জানতে পারি তাই জ্যোতিষ।” বোঝাই যাচ্ছে এ জ্যোতিষের প্রবক্তা ব্রাহ্মণ্যবাদ। মানুষের ভূত-ভবিষ্যৎ বলে দেওয়ার অছিলায় ‘ভগবান সাজার শ্রেষ্ঠ উপায়। বিস্ময়াভূত মানুষদের কাছে জ্যোতিষের আসন ভগবান শ্রদ্ধার। তাই জ্যোতিষচর্চায় পোপ-পাদরি-ব্রাহ্মণদের একচেটিয়া অধিকার।

ভারতে জ্যোতিষচর্চার সূত্রপাত ঋগবেগের কাল থেকে। ক্রান্তদর্শী ঋষিগণ চন্দ্র সূর্য-গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান বৈচিত্র্য ও তাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক খুঁজতে চেয়েছেন। বৈদিক ধর্মকর্ম, যাগযজ্ঞের জন্য কাল নির্ধারণে জ্যোতিষের জ্ঞান থাকা একান্ত অপরিহার্য ছিল। ফলে সূর্য-চন্দ্রের গতি, উত্তরায়ণ-দক্ষিণায়ন বিভাগ, সূর্যগ্রহণ-চন্দ্রগ্রহণ নির্ণয়, মাস-পক্ষ-দিন-তিথি নির্ণয়, পূর্ণিমা-অমাবস্যা, ঋতুবিভাগ প্রভৃতি নির্ণয়ে জ্যোতির্বিদ্যায় জ্ঞান থাকা আবশ্যিক। জ্যোতিষবিদ্যায় হাত-পা-মুখ দেখে ভূত-ভবিষ্যৎ বলে দেওয়া নয়।

জ্যোতিষবিদ্যাকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা হয় –(১) গণিত জ্যোতিষ এবং (২) ফলিত জ্যোতিষ। গণিত জ্যোতিষে জ্যোতিষ্ক পরিবারের অন্তর্গত বিভিন্ন গ্রহ-নক্ষত্রের স্থান, তাদের গতি ও কার্যকলাপ এবং সে বিষয়ে গাণিতিক সূত্রাবলি অর্থাৎ পাটিগণিত, বীজগণিত, পরিমিতি প্রভৃতি আলোচিত হয়েছে। এই শাখার প্রাচীন এবং অন্যতম মনীষীগণ হলেন প্রথম আর্যভট্ট, বরাহমিহির (গ্রন্থ : পঞ্চসিদ্ধান্তিকা), ব্রহ্মগুপ্ত (গ্রন্থ : ব্ৰহ্মস্ফুটসিদ্ধান্ত), ভাস্করাচার্য (গ্রন্থ : সিদ্ধান্তচূড়ামণি) প্রমুখ। অপরদিকে ফলিত জ্যোতিষ হল গ্রহ-নক্ষত্রাদির জ্যোতিষ্ক পদার্থগুলির আবর্তন ও অবস্থান ভেদে মানবজীবনে তথা পৃথিবীর উপর তাদের অনুসন্ধান এবং তার জন্য শুভাশুভ ফল গণনা। ফলিত জ্যোতিষীর প্রাচীন মনীষীগণ হলেন বিষ্ণুগুপ্ত, জীবশর্মা, দেবস্বামী, যবনাচার্য, সত্যাচার্য, সিদ্ধসেন, পৃথু প্রমুখ। ফলিত জ্যোতিষীর গ্রন্থগুলি হল– বৃহৎবিবাহপটল, পল্লববিবাহপটল, বৃহজ্জাতক, লঘুজাতক, বৃহৎসংহিতা ইত্যাদি। বৃহৎবিবাহপটল, পল্লববিবাহপটল গ্রন্থদুটিতে জ্যোতিষবিদ্যা অনুসারে বিবাহের শুভাশুভ কাল বর্ণিত হয়েছে। ফলিত জ্যোতিষকে বরাহমিহির তিনটি শাখায় ভাগ করেছেন। যেমন–

(১) তন্ত্র : জ্যোতির্বিদ্যা ও গণিত। গ্রহগতির আলোচনা গণিতাংশে আছে।

(২) হোরা বা জাতক : কোষ্ঠী সম্পর্কিত বিভাগ। অহোরাত্র’ শব্দের আদি ও অন্ত্যাক্ষর বাদ দিয়ে ‘হোরা’ শব্দ উদ্ভূত হয়েছে। মানুষের ভাগ্য ও কর্মফল, গ্রহের প্রভাব প্রভৃতি আলোচনা হয়েছে।

(৩) সংহিতা : সাধারণ জ্যোতিষ বিষয়ক আলোচনা। যেমন –‘বৃহৎসংহিতা’।

বৃহৎসংহিতা বিষয়বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ এক উল্লেখযোগ্য ফলিত জ্যোতিষগ্রন্থ। এই গ্রন্থের আলোচ্য বিষয়গুলি কি তা দেখা যাক–

(১) রবি প্রভৃতি অষ্টগ্রহের এবং সপ্তর্ষি, ধূমকেতু প্রভৃতির রাশির স্থানান্তর হেতু শুভ ও অশুভ ফল।

(২) নতুন গ্রহের আগমনে তার প্রভাব, বর্ষফল, বৃষ্টিপাত, উল্কাপাত ও পরিবেশের প্রভাব।

(৩) বিভিন্ন রত্ন পরীক্ষার বিধান, স্ত্রী ও পুরুষের লক্ষণ, বৈবাহিক নক্ষত্র ও লগ্ন বিষয়ক আলোচনা।

(৪) পূর্তকর্ম, স্থাপত্য, জাতকশাস্ত্র, অঙ্গবিদ্যা, রাজব্যবহার, বাস্তুবিদ্যা, ভূবিদ্যা, প্রাণীবিদ্যা প্রভৃতি।

(৫) বিভিন্ন গ্রহ বক্র হলে তার খারাপ ফল কেমন হতে পারে তার বিস্তৃত আলোচনা।

(৬) গর্গ, পরাশর, কশ্যপ, ভৃগু, বশিষ্ঠ, বৃহস্পতি, মনু প্রমুখ মনীষীদের নাম ও তাঁদের মতামত আছে। পঞ্জিকাগুলি আসলে সেই জ্যোতিষবিদ্যার ফল।

অতএব জ্যোতিষশাস্ত্র বলতে যা বোঝায় একজন ব্যক্তির বা জাতকের জন্মপত্রিকা অনুশীলনসাপেক্ষে তাঁর চরিত্র ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে একটা আপাত ধারণা তৈরি করা এবং এই কাজে জাতকের জন্ম সময়ের চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ নক্ষত্রদের অবস্থান পর্যালোচনা করা। জ্যোতিষবিদ্যার এই সাম্প্রতিক সংস্করণ প্রকৃতপক্ষে সুমেরীয় যুগের অপরিণত জ্যোতিষবিদ্যারই ক্রমবিকাশ। জন্মপত্রিকা থেকে একজন ব্যক্তি বা জাতকের ভাগ্য আগাম বলে দেওয়ার ভাবনা জ্যোতিষীয় পদ্ধতি দৃশ্যমান কোনো ঘটনার উপর তৈরি হয়নি, এর উদ্ভব হয়েছিল জন্মকালে গ্রহ-নক্ষত্রদের সঙ্গে জাতকের তৈরি হওয়া এক অদৃশ্য বন্ধনের অলীক কল্পনা থেকে। বস্তুত জ্যোতিষশাস্ত্র গড়ে উঠেছে বিভিন্ন সভ্যতার ধর্মীয় ভাবনাকে ভিত্তি করে। প্রাচীন মিশর এবং মেসোপটেমিয়ায়

প্রতিটি গ্রহ-নক্ষত্রকে কোনো-না-কোনো ঈশ্বর বা অতিমানবের সঙ্গে সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছিল। তাঁরা মনে করতেন, ঐশ্বরিক শক্তিসম্পন্ন এইসব বস্তু সত্ত্বা পার্থিব জীবনের উপর প্রভাব ফেলতে পারে, তাই বুঝি পৃথিবীর প্রাণীজগত এক অদৃশ্য বন্ধনে মহাজাগতিক গ্রহ-নক্ষত্রদের সঙ্গে আবদ্ধ। অবশ্য এখানে প্রাণীজগত বলতে মানুষের জগত বুঝতে হবে। কেননা মানুষ ছাড়া আর কোনো প্রাণীদের ভাগ্য-গ্রহ-প্রতিকার নিয়ে বিন্দুমাত্রও মাথাব্যথা নেই।

অপরদিকে জ্যোতির্বিজ্ঞান হল মহাবিশ্ব, মহাবিশ্বের প্রশ্নোত্তর। মহাবিশ্বের অধিকাংশই ঘন অন্ধকারাচ্ছন্ন এবং শূন্যস্থান। তাপমাত্রা–২৭৩ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। এর মধ্যে অনেক দূরে দূরে ভেসে আছে গ্যালাক্সি (Galaxy)। চক্রাকার, ডিম্বাকৃতি, এরকম নানা আকৃতির জ্বলন্ত তারা, গ্যসের পুঞ্জ এবং ধুলোর মেঘের সমন্বয়ে গঠিত তারাজগত। এক একটি তারাজগতে ১০০ কোটি থেকে ৫০ হাজার কোটিরও বেশি তারা আছে। আছে ছায়াপথ, এই ছায়াপথে আছে প্রায় ১০ হাজার কোটি তারা। এই ছায়াপথ, অ্যান্ড্রোমিডা, কোলস্যাক, অশ্বমুণ্ড, বৃহৎ ও ক্ষুদ্র মাজেনিক ক্লাউড ইত্যাদি প্রায় ২৪ টি তারাজগত মিলে তৈরি করেছে একটি মহাতারাজগত। এরকম হাজার হাজার মহারাজগত মহাশূন্যের বিপুল নিকষ কালো অন্ধকারে পুঞ্জে পুঞ্জে অবস্থান করছে। তারাজগতের বিশাল বস্তুপুঞ্জগুলো তাদের নিজ নিজ কেন্দ্রের প্রচণ্ড অভিকর্ষ বলে সারাক্ষণ পাক খেয়েই চলেছে। যে বস্তু তারাজগতের কেন্দ্রের কাছাকাছি তার গতি দ্রুত এবং যে বস্তু প্রান্তবর্তী তার গতি মন্থর। সূর্য তার গ্রহমণ্ডলী নিয়ে ছায়াপথের কেন্দ্রের চারিদিকে প্রতি সেকেন্ডে ২৫০ কিলোমিটার বেগে ছুটে চলেছে। যাই হোক, এবার আমরা দেখে নিতে পারি জ্যোতিষবিদ্যার জ্যোতিষীবাবুদের গ্রহ আর জ্যোতির্বিদ্যার গ্রহদের চেহারা কেমন। প্রথমেই আসি সূর্যের প্রসঙ্গে। যেটি জ্যোতিষবিদ্যার নক্ষত্র বলা হয় না, বলা হয় গ্রহ।

সূর্য (Sun): সূর্য একটি জি-ধরণের প্রধান ধারার তারা যার ভর সৌরজগতের মোট ভরের শতকরা ৯৯.৮৬৩২ ভাগ। এর গঠন প্রায় নিখুঁত গোলকের মতো, কিন্তু উত্তর ও দক্ষিণ মেরুর দিকে কমলালেবুর মতো একটু চাপা। এই কমলাকৃতির পরিমাণ প্রতি ৯০ লক্ষ ভাগে এক ভাগ। অর্থাৎ সূর্যের মেরু অঞ্চলীয় ব্যস বিষুবীয় ব্যাসের চেয়ে মাত্র ১০ কিলোমিটার কম। যেহেতু সূর্য প্লাজমা তথা আয়নিত গ্যাস দিয়ে গঠিত, সেহেতু এটি বিষুবীয় অঞ্চলে মেরু অঞ্চলের চেয়ে বেশি বেগে ঘোরে। এই পরিবর্তনশীল বেগকে বলা হয় ব্যাবকলনীয় বেগ। এ ধরনের বেগের কারণ, সূর্যের মধ্যকার পরিচলন এবং কেন্দ্রের চেয়ে পৃষ্ঠের দিকে তাপমাত্রার ঢাল বেশি বাঁকা হওয়ায় ভরের স্থানান্তর। ভূকক্ষের উত্তর মেরু থেকে দেখলে সূর্যের যে বামাবর্তী কৌণিক ভরবেগ পর্যবেক্ষণ করা যায় তার কিছু অংশ এই ভর স্থানান্তরের কারণে পুনর্বণ্টিত হয়। অর্থাৎ এক স্থানের ভরবেগ কমে গিয়ে অন্য স্থানে বেড়ে যায়। এই প্রকৃত ঘূর্ণন বেগের মান হচ্ছে বিষুবীয় অঞ্চলে ২৫.৫ দিন এবং মেরু অঞ্চলে ৩৩.৫ দিন। তবে পৃথিবীর সাপেক্ষে সূর্যের অবস্থান প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হতে থাকায় আমরা এই আবর্তন বেগের মান পাই ২৮ পার্থিব দিন। দেখা যাচ্ছে, সূর্যের নিজ কক্ষের চারদিকে আবর্তন বেগ খুবই কম, এই ঘূর্ণন বেগ থেকে যে কেন্দ্রাতিগ বলের সৃষ্টি হয় তা সূর্যের পৃষ্ঠ অভিকর্ষের তুলনায় ১৮০ লক্ষ ভাগের এক ভাগ। গ্রহগুলির জোয়ার বলও এ তুলনায় এত নগণ্য যে তারা সূর্যের আকার-আকৃতির কোনো পরিবর্তন করতে পারে না।

সূর্য একটি পপুলেশন-১ তারা, অর্থাৎ এতে ভারী মৌলিক পদার্থের পরিমাণ বেশি। তারাটির উৎপত্তির পিছনে খুব সম্ভবত আশপাশের এক বা একাধিক অতিনব তারা বিস্ফোরণের ভূমিকা আছে। উল্লেখ্য অতিনব তারা বিস্ফোরণ বিশাল গ্যাসীয় মেঘকে সংকুচিত করার মাধ্যমে নতুন তারা সৃষ্টির সূচনা ঘটাতে পারে। সৌরজগতে সাধারণ পপুলেশন-২ তারার (যাদের মধ্যে ভারী পদার্থ কম থাকে) চেয়ে বেশি ভারী মৌল দেখা যায়। যেমন, ইউরেনিয়াম এবং স্বর্ণ। এই ভারী মৌলগুলো সম্ভবত অতিনবতারা বিস্ফোরণের সময় তাপহারী বিক্রিয়ার মাধ্যমে, অথবা কোনো বৃহৎ দ্বিতীয় প্রজন্ম তারার অভ্যন্তরে নিউট্রন শোষণ প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন হয়েছিল। পার্থিব গ্রহগুলোর মত সূর্যের কোন নির্দিষ্ট পৃষ্ঠসীমা নেই এবং এর গ্যাসের ঘনত্ব ব্যসার্ধ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সূচকীয় হারে হ্রাস পায়। তথাপি এর প্রায় সুনির্দিষ্ট একটি অভ্যন্তরীন গঠন রয়েছে যা নীচে বর্ণনা করা হবে। সূর্যের ব্যাসার্ধ নির্ণয় করা হয় কেন্দ্র থেকে আলোকমণ্ডলের শেষপ্রান্ত পর্যন্ত। আলোকমণ্ডল সূর্যের এমন একটি অঞ্চল যার বাইরে গ্যাস এত পাতলা হয়ে যায় যে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বিকিরণ নিঃসরণ করতে পারে না। এজন্যই দৃশ্যমান আলোয় আমরা সাধারণত সূর্যের আলোকমণ্ডলই দেখি। সূর্যের অভ্যন্তরভাগ সরাসরি দেখা যায় না, সূর্য তড়িচ্চুম্বকীয় বিকিরণের প্রতি অনচ্ছ। কিন্তু সৌরকম্পনবিদ্যার মাধ্যমে অভ্যন্তরভাগ সম্পর্কে ধারণা লাভ সম্ভব, ঠিক ভূকম্পনবিদ্যার মতো। ভূমিকম্পের কারণে সৃষ্ট তরঙ্গের মাধ্যমে যেমন পৃথিবীর অভ্যন্তরীন গঠন সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়, ঠিক তেমনই সূর্যের অভ্যন্তরভাগ দিয়ে চলমান অবশাব্দিক চাপ তরঙ্গের মাধ্যমে সূর্যের অভ্যন্তরীন গঠনও জানা সম্ভব। এছাড়া কম্পিউটার সিমুলেশনের মাধ্যমেও সূর্যের অদেখা ভুবন সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা যায়।

সূর্যের কেন্দ্র থেকে শুরু করে মোট ব্যাসার্ধের শতকরা ২০-২৫ ভাগ পর্যন্ত যে অঞ্চলটি আছে তার নাম কোর বা কেন্দ্রভাগ। এই অঞ্চলের ঘনত্ব ১৫০ গ্রাম/ঘনসেন্টিমিটার (জলের ঘনত্বের ১৫০ গুণ) এবং তাপমাত্রা প্রায় ১ কোটি ৩৬ লক্ষ কেলভিন। অথচ সূর্যের পৃষ্ঠের তাপমাত্রা মাত্র ৫৮০০ ডিগ্রি কেলভিন। সোহো মহাকাশ মিশন থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, সূর্যের কেন্দ্রভাগে ঘূর্ণন বেগ বিকিরণ অঞ্চলের অন্যান্য স্থানের তুলনায় বেশি। এই অঞ্চলে প্রোটন প্রোটন শিকলের মাধ্যমে হাইড্রোজেন সংযোজনের (ফিউশন) মাধ্যমে হিলিয়াম তৈরি হয়। এটিই সূর্যের শক্তির প্রধান উৎস। সূর্যে উৎপাদিত মোট হিলিয়ামের শতকরা মাত্র ২ ভাগ সিএনও চক্র থেকে আসে। কেন্দ্রভাগে সূর্যের মোট শক্তির প্রায় পুরোটাই উৎপাদিত হয়। ব্যাসার্ধের ২৪%–এর মধ্যে ফিউশন বিক্রিয়ার মাধ্যমে সূর্যের মোট শক্তির শতকরা ৯৯ ভাগ উৎপাদিত হয়, ৩০% এর পর আর কোনো ফিউশন বিক্রিয়া দেখাই যায় না। সুতরাং সূর্যের বাকি অংশ কেন্দ্রভাগের শক্তি দিয়েই চলে, কেন্দ্রভাগ থেকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় শক্তি বাইরের স্তরগুলির দিকে প্রবাহিত হয়। অনেকগুলি স্তর ভেদ করে অবশেষে এই শক্তি আলোকমণ্ডলে পৌঁছোয়, এরপর পদার্থ কণার গতিশক্তি বা সূর্যালোক হিসাবে মহাশূন্যে ছড়িয়ে পড়ে। প্রতি সেকেন্ডে ৯.২×১০^৩৭ টি প্রোটন-প্রোটন শিকল বিক্রিয়া ঘটে। প্রতিটি বিক্রিয়ায় যেহেতু ৪টি হাইড্রোজেন মিলে একটি হিলিয়াম তৈরি হয় সেহেতু বলা যায়, প্রতি সেকেন্ডে সূর্য ৩.৭x১০^৩৮ টি প্রোটনকে (প্রায় ৬.২×১০^১১ কিলোগ্রাম) আলফা কণা তথা হিলিয়াম কেন্দ্রিনে রূপান্তরিত করে। সূর্যে মোট মুক্ত প্রোটনের সংখ্যা প্রায় ৮.৯x১০^৫৬ টি। হাইড্রোজেনের সংযোজন বিক্রিয়ার মাধ্যমে সংযোজিত ভরের শতকরা ০.৭ ভাগ শক্তিতে পরিণত হয়। হিসাব করলে দেখা যায় ভরশক্তি রূপান্তরের মাধ্যমে সূর্যে প্রতি সেকেন্ডে ৪২ লক্ষ মেট্রিক টন শক্তি বিমুক্ত হয়। ভর ধ্বংস হয় না, বরং এই ভরশক্তিতে রূপান্তরিত হয়, যা বিকিরণ হিসাবে মহাশূন্য ছড়িয়ে পড়ে। আইনস্টাইনের ভরশক্তি সমতুল্যতা দিয়ে এটি ব্যাখ্যা করা যায়। তবে কেন্দ্রেভাগের সব স্থানে একই হারে বিক্রিয়াটি ঘটে না। কেন্দ্র থেকে দূরত্ব বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এটি পরিবর্তিত হয়। তাত্ত্বিক মডেল থেকে দেখা যায় সূর্যের কেন্দ্রে শক্তি উৎপাদনের পরিমাণ প্রতি ঘন মিটারে ২৭৬.৫ ওয়াট। পরিমাণটি কিন্তু মোটেই বেশি নয়। এই সংখ্যা পারমাণবিক বোমার বদলে আমাদেরকে সরীসৃপদের বিপাক ক্রিয়া ব্যবহৃত শক্তির কথা মনে করিয়ে দেয়। সূর্যের প্রতি একক আয়তনে উৎপাদিত সর্বোচ্চ শক্তিকে খাদ্যশস্যের বর্ধনে ব্যবহৃত সারের ব্যয়িত শক্তির সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। সূর্য থেকে যে আমরা এত শক্তি পাই তার কারণ এই নয় যে, এই গ্যাসপিণ্ডের প্রতি একক আয়তনে বিপুল পরিমাণ শক্তি উৎপাদিত হয়, বরং এইজন্যে যে সূর্যের আয়তন অনেক বেশি। একক আয়তনে শক্তির পরিমাণ অনেক কম হলেও সমগ্র আয়তনে সংখ্যাটি অনেক বড়ো হয়ে যায়।

কেন্দ্রভাগের সংযোজন বিক্রিয়া একটি আত্মসংশোধনযোগ্য সাম্যাবস্থায় আছে। বিক্রিয়ার হার যদি একটু বেড়ে যায় তাহলে কেন্দ্রভাগ উত্তপ্ত হয়ে সম্প্রসারিত হতে শুরু করে, এতে গ্যাসের ঘনত্ব কমে যায়, বিক্রিয়া হারও কমে যায়। আবার বিক্রিয়ার হার স্বাভাবিকের চেয়ে কমে গেলে কেন্দ্রভাগ সামান্য সংকুচিত হয়ে গ্যাসের ঘনত্ব বাড়িয়ে দেয়, যার ফলে বিক্রিয়ার হার আবার বেড়ে যায়। এভাবেই সাম্যাবস্থা রক্ষিত হয়। বিক্রিয়া যেসব উচ্চ শক্তির গামা রশ্মি উৎপন্ন হয় তারা বিকিরিত হওয়ার মাত্র কয়েক মিলিমিটারের মধ্যেই সৌর প্লাজমা দ্বারা আবার শোষিত হয়, এরপর সামান্য নিম্ন শক্তিতে আবার বিকিরিত হয়। এভাবে বিকিরিণ-শোষণের খেলা চলতেই থাকে। এজন্যই সূর্যের কেন্দ্র থেকে পৃষ্ঠে শক্তি পৌঁছোতে অনেক সময় লাগে। কেন্দ্র থেকে পৃষ্ঠে ফোটনের আসতে প্রায় ১০,০০০ থেকে ১৭০,০০০ বছর লাগে বলে অনুমান করা হচ্ছে। পৃষ্ঠমুখী যাত্রার পথে ফোটন পরিচলন অঞ্চল পার হয়ে শেষে আলোকমণ্ডলে পৌঁছোয়, এই স্তর পেরোলেই অবারিত মহাশূন্য, যাতে দৃশ্যমান আলো হিসাবে ফোটনগুলি ছড়িয়ে পড়ে। কেন্দ্রে উৎপাদিত প্রতিটি রশ্মি সূর্য থেকে পালানোর পূর্বে কয়েক মিলিয়ন দৃশ্যমান তরঙ্গদৈর্ঘ্যের ফোটনে রূপান্তরিত হয়। সংযোজন বিক্রিয়া গামা রশ্মির পাশাপাশি নিউট্রিনোও উৎপন্ন হয়, কিন্তু গামা রশ্মির মতো তারা পদার্থের সঙ্গে এত মিথস্ক্রিয়া করে না, আসলে মিথস্ক্রিয়া করে না বললেই চলে। সুতরাং উৎপাদিত নিউট্রিনোর প্রায় সবগুলিই তৎক্ষণাৎ সূর্য থেকে পালাতে সক্ষম হয়। অনেক বছর ধরে সূর্য থেকে যে পরিমাণ নিউট্রিনো পাওয়ার কথা তার চেয়ে প্রায় ৩ গুণ কম পাওয়া যাচ্ছিল। এই সমস্যার নাম দেয়া হয়েছিল সৌর নিউট্রিনো সমস্যা। কিন্তু ২০০১ সালে নিউট্রিনো স্পন্দন আবিষ্কৃত হওয়ার পর এর সমাধান হয়েছে। আসলে সূর্য থেকে অনেক নিউট্রিনো আসে, কিন্তু পৃথিবীতে দুরবিনের মাধ্যমে আমরা মাত্র ৩ ভাগের ২ ভাগ নিউট্রিনো সনাক্ত করতে পারি, কারণ পৃথিবীতে আসতে আসতে নিউট্রিনোগুলো স্বাদ পাল্টায়।

সূর্যের বয়স বের করার কোনো সরাসরি উপায় না-থাকলেও পরোক্ষভাবে তা করা হয়েছে। যেমন পৃথিবীতে প্রাপ্ত সবচেয়ে প্রাচীন প্রস্তর ও উল্কাপিণ্ডের বয়স হচ্ছে ৪৬০ কোটি বৎসর। ধারণা করা হয়, সমগ্র সৌরজগতের সৃষ্টি একই সময়ে। সেক্ষেত্রে সূর্যেরও বয়স হয় একই। সূর্যের ভরের শতকরা ৭৪ ভাগই হাইড্রোজেন, বাকি অংশের মধ্যে ২৫% হিলিয়াম। এছাড়াও আছে উচ্চ ভরসম্পন্ন কিছু বিরল মৌলিক পদার্থ। সূর্যের নাক্ষত্রিক শ্রেণিবিন্যাস অনুসারে এর শ্রেণি হচ্ছে জি২ভি (G2v)। “জি২’ দ্বারা বোঝায় এর পৃষ্ঠতলের তাপমাত্রা ৫,৫০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের চেয়ে বেশি K দ্বারা বোঝায় এর বর্ণ সাদা, অবশ্য পৃথিবীর পরিবেশে বিচ্ছুরণের কারণে এর বর্ণ হলুদ দেখায়। এর বর্ণালি রেখা বিশ্লেষণ করে দেখা যায় তাতে আয়নিত ও নিষ্ক্রীয় উভয় ধরনের ধাতুর বর্ণালি রয়েছে, এছাড়াও রয়েছে খুব দূর্বল হাইড্রোজেন রেখা। V-বর্ণটি দ্বারা বোঝায়, অন্যান্য অধিকাংশ তারার মতোই সূর্য একটি প্রধান ধারার তারা। অর্থাৎ সূর্য তার প্রয়োজনীয় শক্তি হাইড্রোজেন কেন্দ্রীনকে কেন্দ্রীন সংযোজন প্রক্রিয়ায় হিলিয়াম কেন্দ্রীনে পরিণত করার মাধ্যমে উৎপাদন করে। এছাড়া প্রধান ধারার তারায় hydrostatic balance লক্ষ করা যায়, তথা এরা সম্প্রসারিত বা সংকুচিত হয় না। আমাদের ছায়াপথে ১০০ মিলিয়নেরও বেশি G2 শ্রেণির তারা রয়েছে। সূর্যের সমগ্র আকারের লগারিদমভিত্তিক বিন্যাসের কারণে এই ছায়াপথের ৮৫% তারার চেয়ে এর উজ্জ্বলতা বেশি। অবশ্য আমাদের আকাশগঙ্গার অনেকগুলি তারাই লাল বামন পর্যায়ে রয়েছে। সূর্যের অবস্থান আকাশগঙ্গা ছায়াপথের কেন্দ্র থেকে ২৫,০০০– ২৮,০০০ আলোক বর্ষ, আর এই দূরত্বে থেকেই এটি অবিরত ছায়াপথের কেন্দ্রকে প্রদক্ষিণ করছে। একবার কেন্দ্রের চারদিক দিয়ে সমগ্র পথ ঘুরে আসতে সূর্যের সময় লাগে ২২৫– ২৫০ মিলিয়ন বছর। এর কক্ষপথীয় দ্রুতি ২১৭ কিমি/সে; এ থেকে দেখা যায় সূর্য ১,৪০০ বছরে এক আলোক বর্ষ দূরত্ব এবং ৮ দিনে এক জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক একক (AU) দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে। সূর্য একটি তৃতীয় প্রজন্মের তারা, কাছাকাছি কোনো একটি অতি নব তারা থেকে উদ্ভূত অভিঘাত তরঙ্গ এর উৎপত্তিতে একটি চালিকাশক্তি হিসাবে কাজ করেছিল। পুরো সৌরজগতে স্বর্ণ বা ইউরেনিয়ামের মতো ভারী মৌলসমূহের প্রাচুর্য লক্ষ করে চালিকাশক্তি হিসাবে এই ঘটনাটি প্রস্তাব করা হয়েছে। খুব সম্ভবত একটি অতি নব তারার বিবর্তনের সময় ক্রিয়াশীল endergonic কেন্দ্রীন বিক্রিয়া অথবা দ্বিতীয় প্রজন্মের একটি বৃহৎ তারার অভ্যন্তরে নিউট্রন শোষণের ফলে উদ্ভূত ট্রান্স্যুটেশন বিক্রিয়ার মাধ্যমে এই মৌলসমূহ সৃষ্টি হয়েছে। এই সূর্যকে বশে রাখার জন্য জ্যোতিষীরা চুনি (রত্ন Ruby) বা তামা/সোনা (ধাতু) বা স্টার রুবি (উপরত্ন) বা বিল্বমূল (মূল) বা মাতঙ্গী (কবচ) বা ১ মুখী/১০ মুখী রুদ্রাক্ষ) ধারণ করার নিদান দিয়ে থাকেন।

চন্দ্র বা চাঁদ (Moon) : চাঁদ পৃথিবীর একমাত্র প্রাকৃতিক উপগ্রহ এবং সৌর জগতের পঞ্চম বৃহত্তম উপগ্রহ, কোনোভাবেই গ্রহ নয়। পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে চাঁদের কেন্দ্রের গড় দূরত্ব হচ্ছে ৩৮৪,৩৯৯ কিলোমিটার, যা পৃথিবীর ব্যাসের প্রায় ৩০ গুণ। চাঁদের ব্যাস ৩,৪৭৪.২০৬ কিলোমিটার, যা পৃথিবীর ব্যাসের এক-চতুর্থাংশের চেয়ে সামান্য বেশি। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে, চাঁদের আরতন পৃথিবীর আয়তনের ৫০ ভাগের ১ ভাগ। এর পৃষ্ঠে অভিকর্ষ বল পৃথিবী পৃষ্ঠে অভিকর্ষ বলের এক-ষষ্ঠাংশ। অর্থাৎ, পৃথিবী পৃষ্ঠে কারও ওজন যদি ১২০ পাউন্ড হয় তাহলে চাঁদের পৃষ্ঠে তার ওজন হবে মাত্র ২০ পাউন্ড। বেরিকেন্দ্র নামে পরিচিত একটি সাধারণ অক্ষের সাপেক্ষে পৃথিবী এবং চন্দ্রের ঘূর্ণনের ফলে যে মহাকর্ষীয় আকর্ষণ এবং কেন্দ্রবিমুখী বল সৃষ্টি হয় তা পৃথিবীতে জোয়ারভাটা সৃষ্টির জন্য অনেকাংশে দায়ী। জোয়ার-ভাটা সৃষ্টির জন্য যে পরিমাণ শক্তি শোষিত হয় তার কারণে বেরিকেন্দ্রকে কেন্দ্র করে পৃথিবী-চাঁদের যে কক্ষপথ রয়েছে তাতে বিভব শক্তি কমে যায়। এর কারণে এই দুইটি জ্যোতিষ্কের মধ্যে দূরত্ব প্রতি বছর ৩.৮ সেন্টিমিটার করে বেড়ে যায়। যতদিন-না পৃথিবীতে জোয়ারভাটার উপর চাঁদের প্রভাব সম্পূরণ প্রশমিত হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত চাঁদ দূরে সরে যেতেই থাকবে এবং যেদিন প্রশমনটি ঘটবে সেদিনই চাঁদের কক্ষপথ স্থিরতা পাবে। চাঁদই একমাত্র জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক বস্তু যাতে মানুষ ভ্রমণ করেছে এবং যার পৃষ্ঠতলে মানুষ অবতরণ করেছে। চাঁদের আবর্তনের পর্যায়কাল এবং তার কক্ষপথের পর্যায়কাল একই হওয়ায় আমরা পৃথিবী থেকে চাঁদের একই পৃষ্ঠ সবসময় দেখতে পাই। চাঁদ পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করতে ২৭ দিন, ৭ ঘন্টা, ৪৩ মিনিট এবং ১১ সেকেন্ড সময় নেয়, কিন্তু সমসাময়িক আবর্তনের ফলে পৃথিবীর পর্যবেক্ষকরা প্রায় ২৯.৫ দিন হিসাবে গণনা করে। একটি ঘণ্টা আবর্তনের পর্যায়কাল অর্ধেক ডিগ্রি দূরত্ব অতিক্রম করে। চাঁদ পৃথিবীকে যে অক্ষরেখায় পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে আবর্তন করছে, সে অক্ষরেখায় চাঁদ একদিন বা ২৪ ঘন্টায় ১৩° কোণ অতিক্রম করে। সুতরাং পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ চাঁদের সময় লাগে ২৭ দিন, ৭ ঘণ্টা, ৪৩ মিনিট এবং ১১ সেকেন্ড। এই জন্য আমরা পৃথিবী থেকে চাঁদের একই পৃষ্ঠ দেখে থাকি। পৃথিবী থেকে আমরা চাঁদের শতকরা প্রায় ৫৯ ভাগ দেখতে পেয়ে থাকি। চাঁদ আকাশের সবসময় একটি অঞ্চল থাকে তাকে জোডিয়াক বলে। যা ক্রান্তিবৃত্তের প্রায় ৮ ডিগ্রি নীচে এবং গ্রহণরেখা উপরে অবস্থান করে। চাঁদ প্রতি ২ সপ্তাহে একে অতিক্রম করে। পৃথিবী-চন্দ্র সমাহারের অবিরত পরিবর্তন হচ্ছে। চাঁদের আকর্ষণে চাঁদের দিকে অবস্থিত সমুদ্রের জল তার নীচের মাটি অপেক্ষা বেশি জোরে আকৃষ্ট হয়। এ কারণে চাঁদের দিকে অবস্থিত জল বেশি ফুলে উঠে। আবার পৃথিবীর যে অংশে অবস্থিত জল চাঁদের বিপরীত দিকে থাকে, সেদিকের সমুদ্রের নীচের মাটি তার উপরের জল অপেক্ষা চাঁদ কর্তৃক অধিক জোরে আকৃষ্ট হয়। কারণ এই মাটি জল অপেক্ষা চাঁদের বেশি নিকটবর্তী। ফলে সেখানকার জল মাটি থেকে দূরে সরে যায়, অর্থাৎ ছাপিয়ে উঠে। এক্ষেত্রে ফুলে উঠার কাহিনিটিই ঘটে। পৃথিবী যে সময়ের মধ্যে নিজ অক্ষের চারদিকে একবার আবর্তন করে (একদিনে) সে সময়ের মধ্যে পৃথিবীর যে-কোনো অংশ একবার চাঁদের দিকে থাকে এবং একবার চাঁদের বিপরীত দিকে থাকে। এ কারণে পৃথিবীর যে-কোনো স্থানে দুইবার জোয়ার এবং দুইবার ভাটা হয়। তবে জোয়ারভাটার জন্য সূর্যের আকর্ষণও অনেকাংশে দায়ী। তবে অনেক দূরে থাকায় সূর্যের আকর্ষণ চাঁদের আকর্ষণের থেকে কম কার্যকর। সূর্য এবং চাঁদ যখন সমসূত্রে পৃথিবীর একই দিকে বা বিপরীত দিকে অবস্থান করে তখন উভয়ের আকর্ষণে সর্বাপেক্ষা উঁচু জোয়ার হয়, জোয়ারের জল বেশি ছাপিয়ে পড়ে। এই চন্দ্রকে বশে রাখার জন্য মুক্তো (রত্ন Pearl) বা মুন স্টোন (উপরত্ন) বা রূপো (ধাতু) বা ক্ষীরিকা (মূল) বা কমলা (কবচ) বা ২ মুখী (রুদ্রাক্ষ) জ্যোতিষীরা ধারণ করার নিদান দিয়ে থাকেন।

মঙ্গল (Mars): সৌরজগতের চতুর্থতম গ্রহ হচ্ছে মঙ্গল। মঙ্গল সৌরজগতের শেষ পার্থিব গ্রহ। অর্থাৎ এরও পৃথিবীর মত ভূত্বক আছে। এর অতি ক্ষীণ বায়ুমণ্ডল রয়েছে, এর ভূত্বকে আছে চাঁদের মতো অসংখ্য খাদ, আর পৃথিবীর মতো আগ্নেয়গিরি, মরুভূমি এবং মেরুদেশীয় বরফ। সৌরজগতের সর্ববৃহৎ পাহাড় এই গ্রহে অবস্থিত। এর নাম অলিম্পাস মন্‌স। সর্ববৃহৎ গভীর গিরিখাতটিও এই গ্রহে যার নাম ভ্যালিস মেরিনারিস। মঙ্গলের ঘূর্ণন কাল এবং ঋতু পরিবর্তনও অনেকটা পৃথিবীর মতো। মঙ্গলের ব্যাসার্ধ পৃথিবীর অর্ধেক এবং ভর পৃথিবীর এক দশমাংশ। এর ঘনত্ব পৃথিবী থেকে কম এবং ভূপৃষ্ঠের ক্ষেত্রফল পৃথিবীর শুষ্ক ভূমির মোট ক্ষেত্রফল থেকে সামান্য কম। মঙ্গল বুধ গ্রহ থেকে বড় হলেও বুধের ঘনত্ব মঙ্গল থেকে বেশি। এর ফলে বুধের পৃষ্ঠতলের অভিকর্ষীয় শক্তি তুলনামূলকভাবে বেশি। মঙ্গল দেখতে অনেকটা লাল রঙের কমলার মতো। এর কারণ মঙ্গলের পৃষ্ঠতলে প্রচুর পরিমাণে আয়রন (৩) অক্সাইডের উপস্থিতি। এই যৌগটিকে সাধারণভাবে রাস্ট বলা হয়। মঙ্গলের পৃষ্ঠ মূলত ব্যাসল্ট দ্বারা গঠিত। মঙ্গলের কিছু কিছু অংশে ব্যাসল্টের চেয়ে সিলিকা জাতীয় পদার্থ বেশি রয়েছে। এই অঞ্চলটি অনেকটা পৃথিবীর অ্যান্ডেসাইট (এক ধরণের আগ্নেয়শিলা) জাতীয় পাথরের মতো। পৃষ্ঠের অনেকটা অংশ সূক্ষ্ণ আয়রন (৩) অক্সাইড যৌগ দ্বারা আবৃত। ধূলিকণা নামে পরিচিত এই যৌগটি অনেকটা ট্যালকম পাউডারের মতো। মঙ্গলের কোনো অভ্যন্তরীণ চৌম্বক ক্ষেত্র নেই। কিন্তু কিছু পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে এর ভূত্বকের কিছু অংশ চুম্বকায়িত হয়ে আছে। চুম্বকীয়ভাবে susceptible খনিজ পদার্থের কারণে সৃষ্ট এই চৌম্বকত্বকে প্যালিওম্যাগনেটিজম বলা হয়। এই প্যালিওম্যাগনেটিজমের ধরন অনেকটা পৃথিবীর মহাসাগরীয় গৰ্ভতলে প্রাপ্ত অলটারনেটিং ব্যান্ডের মতো। গ্রহটির কেন্দ্রীয় অংশটির (core) ব্যাসার্ধ প্রায় ১,৪৮০ কিলোমিটার। এই কেন্দ্রভাগ মূলত লোহা দিয়ে গঠিত, অবশ্য লোহার সঙ্গে ১৫ থেকে ১৭% সালফার রয়েছে বলে জানা যায়। এ হিসাবে মঙ্গলের কেন্দ্রভাগ আয়রন সালফাইড দ্বারা গঠিত, যা অনেকাংশে তরল। এই পদার্থগুলোর ঘনত্ব পৃথিবীর কেন্দ্রে অবস্থিত পদার্থের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। কেন্দ্রের চারদিক ঘিরে সিলিকেট দ্বারা গঠিত একটি ম্যান্টল আছে, যা গ্রহটির অনেকগুলি শিলাসরণ এবং আগ্নেয় প্রকৃতির কাঠামো তৈরিতে মূল ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু বর্তমানে ম্যান্টলটি নিষ্ক্রিয় অবস্থায় রয়েছে। মঙ্গলের ভূত্বকের গড় পুরুত্ব ৫০ কিলোমিটার। তবে এই পুরুত্ব সর্বোচ্চ ১২৫ কিলোমিটার পর্যন্ত হতে দেখা যায়। অন্যদিকে পৃথিবীর ভূত্বকের পুরুত্ব গড়ে ৪০ কিলোমিটার। পৃথিবী এবং মঙ্গল এই গ্রহ দুটির আকৃতির অনুপাত বিবেচনায় আনলে পৃথিবীর ভূত্বক মঙ্গলের ভূত্বক থেকে মাত্র তিনগুণ পুরু। মঙ্গলকে বশে রাখার জন্য জ্যোতিষীরা লাল প্রবাল (রত্ন Coral) বা তামা (ধাতু) বা অনন্ত (মূল) বগলা (কবচ) বা ৩ মুখী (রুদ্রাক্ষ) ধারণ করার নিদান দিয়ে থাকেন।

বুধ (Mercury): বুধ সৌরজগতের প্রথম এবং ক্ষুদ্রতম গ্রহ। এটি সূর্যের সর্বাপেক্ষা নিকটতম গ্রহ। এর কোনো উপগ্রহ নেই। এটি সূর্যকে প্রতি ৮৮ দিনে একবার প্রদক্ষিণ করে। এর উজ্জ্বলতার আপাত মান–২.০ থেকে ৫.৫ পর্যন্ত হয়ে থাকে। কিন্তু একে পৃথিবী থেকে সহজে দেখা যায় না। কারণ সুর্যের সঙ্গে এর বৃহত্তম কৌণিক পার্থক্য হচ্ছে মাত্র ২৮.৩ ডিগ্রি। কেবল সকাল ও সন্ধ্যার ক্ষীণ আলোয় একে দেখা যায়। গ্রহটি সম্বন্ধে তুলনামূলক অনেক কম তথ্য জানা গেছে। ভৌত বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়ে বুধ অনেকটা চাঁদের মতো। কারণ এই গ্রহেও রয়েছে প্রচুর খাদ। গ্রহটির কোনো স্থিতিশীল বায়ুমণ্ডল নেই, নেই কোনো প্রাকৃতিক উপগ্রহ। এর একটি সুবৃহৎ লৌহকেন্দ্র আছে। এই কেন্দ্র কর্তৃক উৎপাদিত চৌম্বক ক্ষেত্র পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রের তুলনায় ০.১ শতাংশের বেশি শক্তিশালী। বুধের পৃষ্ঠতলের তাপমাত্রা ৯০ থেকে ৭০০ কেলভিনের মধ্যে থাকে। সবচেয়ে উত্তপ্ত স্থান হচ্ছে অর্ধসৌর বিন্দু এবং শীতলতম স্থান হল এর মেরুর নিকটে অবস্থিত খাদসমূহের নিম্ন বিন্দু। বুধ চারটি পার্থিব গ্রহের একটি অর্থাৎ এরও পৃথিবীর মতো কঠিন পৃষ্ঠভূমি আছে। চারটি পার্থিব গ্রহের মধ্যে এর আকার সবচেয়ে ছোটো; বিষুবীয় অঞ্চলে এর ব্যাস ৪৮৭৯ কিলোমিটার। বুধের গাঠনিক উপাদানসমূহের মধ্যে ৭০ শতাংশ ধাতব এবং বাকি ৩০ শতাংশ সিলিকেট জাতীয়। এর ঘনত্ব সৌরজাগতিক বস্তসমূহের ঘনত্বের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ, ৫.৪৩ গ্রাম/সেমি; পৃথিবী থেকে সামান্য কম। মহাকর্ষীয় সংকোচনের প্রভাব সম্পূর্ণ উদ্ধার করতে পারলে বুধের গাঠনিক উপাদানসমূহের ঘনত্ব আরও বেশি হত। বুধের অভ্যন্তরীণ গঠন বোঝার ক্ষেত্রে এর ঘনত্ব ভাল ভূমিকা রাখতে পারে। পৃথিবীর উচ্চ ঘনত্বের মূল কারণ হচ্ছে মহাকর্ষীয় সংকোচন যার পরিমাণ কেন্দ্রে সবচেয়ে বেশি। বুধ অনেক ছোটো এবং এর কেন্দ্র পৃথিবীর মতো অতটা দৃঢ় ও সংকুচিত নয়। তাহলে বুধের এত উচ্চ ঘনত্বের মূল কারণ হতে পারে, এর কেন্দ্র অনেক বড়ো এবং লৌহসমৃদ্ধ। আধুনিককালে ভূতত্ত্ববিদরা আবিষ্কার করেছেন যে বুধের সমগ্র আয়তনের ৪২ শতাংশই হল এর কেন্দ্র। যেখানে পৃথিবীর কেন্দ্র মাত্র ১৭ শতাংশ কেন্দ্রের চারপাশে ৬০০ কিমি অঞ্চল জুড়ে রয়েছে ম্যানটেল। ধারণা মতে বুধের ভূত্বকের পুরুত্ব ১০০ থেকে ২০০ কিলোমিটারের মধ্যে। এর পৃষ্ঠতলের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এতে প্রচুর সরু ridge রয়েছে যার কয়েকটি প্রায় কয়েকশো কিলোমিটার পর্যন্ত প্রলম্বিত। আমাদের সৌর জগতের অন্যান্য বৃহৎ গ্রহগুলোর যে কোনটির তুলনায় বুধে লৌহের পরিমাণ বেশী। বুধ গ্রহের পৃষ্ঠতলের গড় তাপমাত্রা হচ্ছে ৪৫২ কেলভিন (৩৫৩.৯° ফারেনহাইট, ১৭৮.৯° সেলসিয়াস)। তবে এই মান স্থানভেদে ৯০ কেলভিন থেকে ৭০০ কেলভিনের মধ্যে উঠানামা করে। দেখা যাচ্ছে বুধ পৃষ্ঠের তাপমাত্রা ৬১০ কেলভিন পর্যন্ত উঠানামা করে যেখানে পৃথিবীতে পৃষ্ঠের তাপমাত্রা সর্বোচ্চ ৮০ কে পর্যন্ত উঠানামা করতে পারে। এর মূল কারণ বুধের কোন বায়ুমণ্ডল নেই। পৃথিবীর তুলনায় বুধ পৃষ্ঠে সূর্য রশ্মির তীব্রতা ৬.৫ গুণ বেশী। তবে এই সমানুপাতিক সম্পর্কের মধ্যে একটি সৌর ধ্রুবক রয়েছে যার মান ৯.১৩ কিলোওয়াট/বর্গমি.। যদিও বুধ দীর্ঘ ১৭৬ দিনে একবার নিজ অক্ষে আবর্তন করে তথাপি এর একটি অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী এবং আপাতভাবে আঞ্চলিক চৌম্বক ক্ষেত্র আছে। এটি পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রের ০.১ শতাংশ। বুধের চৌম্বক ক্ষেত্রের উৎপত্তির কারণ পৃথিবীর মতো হতে পারে। বুধ গ্রহের চৌম্বক ক্ষেত্র এর চারপাশের সকল সৌরবায়ুকে বিক্ষিপ্ত করার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী। প্রকৃতপক্ষে এই চৌম্বক ক্ষেত্র গ্রহটির চারপাশে চুম্বক গোলক নামক একটি আস্তরণের সৃষ্টি করেছে, সৌরবায়ু যাকে অতিক্রম করতে পারে না। চাঁদের সঙ্গে বুধের মূল পার্থক্য এখানেই। চাঁদের চৌম্বক ক্ষেত্র বেশ দুর্বল হওয়ায় কোনো চুম্বক গোলক নেই, যার ফলে সৌরবায়ু চন্দ্রপৃষ্ঠে চলে আসে অতি সহজেই। এহেন বুধকে বশে রাখার জন্য পান্না (রত্ন Emerald) বা ওনেক্স (উপরত্ন) বা রূপো (ধাতু) বা বৃহদ্বারক (মূল) বা ত্রিপুরেশ্বরী (কবচ) বা ৪ মুখী (রুদ্রাক্ষ) জ্যোতিষীরা নিদান দিয়ে থাকেন।

বৃহস্পতি (Jupiter) : বৃহস্পতি গ্রহ সূর্য থেকে দূরত্বের দিক দিয়ে পঞ্চম এবং আকার আয়তনের দিক দিয়ে সৌরজগতের বৃহত্তম। বৃহস্পতি ব্যতিত সৌরজগতের বাকি সবগুলি গ্রহের ভরকে একত্র করলেও বৃহস্পতির ভর তা থেকে আড়াই গুণ বেশি হবে। বৃহস্পতিসহ আরও তিনটি গ্রহ অর্থাৎ শনি, ইউরেনাস এবং নেপচুনকে একসঙ্গে ‘গ্যাসদানব’ বলা হয়। পৃথিবী থেকে দেখলে বৃহস্পতির আপাত মান পাওয়া যায় ২.৮। এটি পৃথিবীর আকাশে দৃশ্যমান তৃতীয় উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। কেবল চাঁদ এবং শুক্র গ্রহের উজ্জ্বলতা এর থেকে বেশি। অবশ্য কক্ষপথের কিছু বিন্দুতে মঙ্গল গ্রহের উজ্জ্বলতা বৃহস্পতির চেয়ে বেশি হয়ে থাকে। সুপ্রাচীনকাল থেকেই গ্রহটি জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও জ্যোতিষীদের কাছে পরিচিত ছিল। বিভিন্ন সংস্কৃতির প্রচুর পৌরাণিক কাহিনী। এবং ধর্মীয় বিশ্বাসও আবর্তিত হয়েছে বৃহস্পতিকে কেন্দ্র করে। রোমানরা গ্রহটির নাম রেখেছিল পৌরাণিক চরিত্র জুপিটারের নামে। জুপিটার রোমান পুরাণের প্রধান দেবতা। এই নামটি প্রাক-ইন্দো-ইউরোপীয় ভোকেটিভ কাঠামো থেকে এসেছে যার অর্থ ছিল আকাশের পিতা। গ্রহটিকে ঘিরে এবটি দুর্বল গ্রহীয় বলয় এবং শক্তিশালী ম্যাগনেটোস্ফিয়ার রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে কমপক্ষে ৬৩টি উপগ্রহ যাদের মধ্যে চারটি উপগ্রহ বৃহৎ আকৃতির। এই চারটিকে গ্যালিলীয় উপগ্রহ বলা হয়। বৃহস্পতির বায়ুমণ্ডলের উৰ্দ্ধাংশের গাঠনিক উপাদানের মধ্যে পরমাণু সংখ্যার দিক দিয়ে ৯৩ শতাংশ হাইড্রোজেন ও ৭ শতাংশ হিলিয়াম আছে। আর গ্যাস অণুসমূহের ভগ্নাংশের দিক দিয়ে ৮৬ শতাংশ হাইড্রোজেন এবং ১৩ শতাংশ হিলিয়াম। হিলিয়াম পরমাণুর ভর যেহেতু হাইড্রোজেন পরমাণুর ভরের চারগুণ সেহেতু বিভিন্ন পরমাণুর ভরের অনুপাত বিবেচনায় আনা হলে শতকরা পরিমাণটি পরিবর্তিত হয়। সে হিসাবে বৃহস্পতির বায়ুমণ্ডলের গাঠনিক উপাদানের অনুপাতটি দাঁড়ায় ৭৫ শতাংশ হাইড্রোজেন, ২৪ শতাংশ হিলিয়াম এবং বাকি ১ শতাংশ অন্যান্য মৌল। অন্যদিকে অভ্যন্তরভাগ খানিকটা ঘন। এ অংশে রয়েছে ৭১ শতাংশ হাইড্রোজেন, ২৪ শতাংশ হিলিয়াম এবং ৫ শতাংশ অন্যান্য মৌল। বৃহস্পতির ৬৩টি নামকরণকৃত উপগ্রহ রয়েছে– (১) মেটিস (২) অ্যাডরাস্টে (৩) অ্যামালথে (৪) থিব (৫) আয়ো (৬) ইউরোপা (৭) গ্যানিমেড (৮) ক্যালিস্টো (৯) থেমিস্টো (১০) লেডা (১১) হিমালিয়া (১২) লিসিথে (১৩) এলারা (১৪) এস/২০০০ জে ১১ (১৫) কার্পো (১৬) এস/২০০৩ জে ১২ (১৭) ইউপপারি (১৮) এস/২০০৩ জে ৩ (১৯) এস/২০০৩ জে ১৮ (২০) থেলজিনো (২১) ইউয়ান্থে (২২) হেলিকে (২৩) ওর্থোসাই (২৪) লোকাস্টে (২৫) এস/২০০৩ জে ১৬ (২৬) প্র্যাক্সিডাইক (২৭) হার্পালাইক (২৮) মিরিনেমে (২৯) হারমিপ্পে (৩০)। থাইয়োনি (৩১) আনাকে (৩২) হার্সে (৩৩) অ্যাল্টনে (৩৪) কেল (৩৫) টাইগেটে (৩৬) এস/২০০৩ জে ১৯ (৩৭) চালডেনে (৩৮) এস/২০০৩ জে ১৫ (৩৯) এস/২০০৩ জে ১০ (৪০) এস/২০০৩ জে ২৩ (৪১) এরিনোম (৪২) এওয়েডে (৪৩) ক্যালিচোরে (৪৪) ক্যালাইক (৪৫) কারমে বা কার্মে (৪৬) ক্যালিরহ (৪৭) ইউরিডোম (৪৮) প্যাসিথি (৪৯) কোর (৫০) সাইলিন (৫১) ইউকেল্যাড (৫২) এস/২০০৩ জে ১৪ (৫৩) প্যাসিফাই (৫৪) হেজেমোনি (৫৫) আর্কে (৫৬) আইসোনো (৫৭) এস/২০০৩ জে ৯ (৫৮) এস/২০০৩ জে ৫ (৫৯) সিনোপে (৬০) স্পোন্ডে (৬১) অটোনো (৬২) মেগাক্লাইট (৬৩) এস/২০০৩ জে ২। বৃহস্পতিকে বশে রাখার জন্য পীত পোখরাজ (রত্ন Topaj বা Sapphire) বা ইয়োলো টোপাজ (উপরত্ন) সোনা (ধাতু) বা ব্ৰহ্মষষ্ঠী (মূল) বা তারা (কবজ) ৫ মুখী (রুদ্রাক্ষ) জ্যোতিষীরা নিদান দিয়ে থাকেন।

শুক্র (Venus) : শুক্র গ্রহ সূর্য থেকে দূরত্বের দিক দিয়ে সৌরজগতের দ্বিতীয়। এই পার্থিব গ্রহটিকে অনেক সময় পৃথিবীর ‘জমজ বোন গ্ৰহ’ বলে আখ্যায়িত করা হয়, কারণ পৃথিবী এবং শুক্রের মধ্যে গাঠনিক উপাদান এবং আচার আচরণে বড়ো রকমের মিল আছে। বাংলায় সকালের আকাশে একে ‘শুকতারা এবং সন্ধ্যার আকাশে একে ‘সন্ধ্যাতারা’ বলে ডাকা হয়ে থাকে। শক্রের কোনো উপগ্রহ শুক্রগ্রহে বিশাল পাহাড়, সমতলভূমি ও অনেক আগ্নেয়গিরি আছে। গ্রহটির অন্তঃসংযোগের সময় শুক্র অন্য যে-কোনো গ্রহের তুলনায় পৃথিবীর সবচেয়ে কাছে আসে, তখন এ থেকে পৃথিবীর দূরত্ব হয় চাঁদ থেকে পৃথিবীর গড় দূরত্বের প্রায় ১০০ গুণ। ১৮০০ সালের পর থেকে শুক্র গ্রহ পৃথিবীর সবচেয়ে কাছে পৌঁছেছিল ১৮৫০ সালের ১৬ ডিসেম্বর তারিখে। কখন তাদের মধ্যে দূরত্ব ছিল ০.২৬৪১৩৮৫৪ জ্যোতির্বিজ্ঞান একক = ৩৯,৫৪১,৮২৭ কিলোমিটার। ২১০১ সালের ডিসেম্বর ১৬ তারিখের পূর্ব পর্যন্ত এটিই হবে শুক্র থেকে পৃথিবীর সর্বনিম্ন দূরত্ব। উক্ত তারিখে গ্রহদ্বয়ের মধ্যবর্তী দূরত্ব দাঁড়াবে ০.২৬৪৩১৭৩৬ জ্যোতির্বিজ্ঞান একক = ৩৯,৫৪১,৫৭৮ কিলোমিটার। শুক্রকে বশে রাখার জন্য হিরা (রত্ন Daimond) বা হোয়াইট জারকন (উপরত্ন) রূপো (ধাতু) বা রামবাসক (মূল) বা ভুবনেশ্বরী (কবচ) ৬ মুখী/১৩ মুখী (রুদ্রাক্ষ) জ্যোতিষীরা নিদান দিয়ে থাকেন।

শনি (Saturn) : শনি সৌরজগতের ষষ্ঠতম গ্রহ। এটি সৌরজগতের দ্বিতীয় বৃহত্তম গ্রহ। সূর্যের দিক থেকে এর অবস্থান ষষ্ঠ। হিন্দু পৌরাণিক দেবতা শনির নামানুসারে এই গ্রহের নামকরণ করা হয়েছে। রোমান দেবতা Saturn নামানুসারে ইংরেজি নামটি গ্রহণ করা হয়েছে। নিরক্ষীয় এলাকায় এর ব্যাস ১২০৮০ কিলোমিটার। সূর্য থেকে এর গড় দূরত্ব ১৪৭,২০,০০,০০০ কিলোমিটার। মেরু অঞ্চলের ব্যাস ১০৯০০০। এর ঘনত্ব জলের ০.৬৮ গুণ। সূর্যপ্রদক্ষিণকাল ২৯.৪৬ পার্থিব বৎসর। এটি নিজ অক্ষের উপর একবার আবর্তিত হতে সময় নেয় ১০ ঘণ্টা ৩৯ মিনিট ২৪ সেকেন্ড। এই গ্রহের কেন্দ্রে রয়েছে পাথুরে উপকরণ। মধ্য ও উপরিভাগের অধিকাংশই হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম দিয়ে তৈরি। এর সঙ্গে আছে জল, মিথেন এবং অ্যামোনিয়া। আর এই গ্রহকে ঘিরে রয়েছে বিস্তৃত বলয়। শনির উপরিভাগের ৭০০০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত মেঘরাশির উপর থেকে এই বলয়ের শুরু এবং তা প্রায় ৭৪০০০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। এই বলয়রাশির ভিতর বিভিন্ন পরিমাপের ফাঁকা জায়গা আছে। এই ফাঁকা স্থানের বিচারে এর বলয়গুলিকে কয়েকটি নামে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই ভাগগুলি হলো- ডি, সি, বি, এ, এফ, জি, ই। এর সবচেয়ে বড় ফাঁকা স্থানের নাম ক্যাসিনি বিভাজন, এর বিস্তৃতির পরিমাণ প্রায় ১২০,৬০০ কিলোমিটার। পক্ষান্তরে এ এবং বি বলয়ের মধ্যকার দূরত্ব প্রায় ৪৮০০ কিলোমিটার। বলয়টি এতটাই বিশাল যে, এর ভেতর একশ কোটি পৃথিবী ভরে রাখার মতো জায়গা আছে। বলয়টির মধ্যে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বরফ, ধুলাবালি ইত্যাদি ধরা পড়ে। মূলত শনি গ্রহের রয়েছে ১৫০ টিরও বেশি উপগ্রহ, কিন্তু এর মধ্যে নাম দেওয়া হয়েছে মাত্র ৫৩ টি উপগ্রহের এবং আকার বিবেচনায় ১৮টি উপগ্রহকে মূল উপগ্রহ ধরা হয়। (১) প্যান, (২) ড্যাফনিস, (৩) অ্যাটলাস, (৪) প্রমিথিউস, (৫) প্যান্ডোরা বা প্যানডোরা, (৬) এপিমেথিউস, (৭) জ্যানাস, (৮) এগিয়ন, (৯) মাইমাস, (১০) মেথোনে, (১১) এন্থে, (১২) প্যালেন, (১৩) এনসেলাডাস, (১৪) টেথিস, (১৫) টেলেস্টো, (১৬) ক্যালিপ্সো, (১৭) ডাইয়োনে, (১৮) হেলেন, (১৯) পলিডিউসেস, (২০) রিয়া, (২১) টাইটান, (২২) হাইপেরিয়ন, (২৩) আইয়াপেটাস, (২৪) কিভিউক, (২৫) ইজিরাক, (২৬) ফোবে, (২৭) পালিয়াক, (২৮) স্কাথি, (২৯) অ্যালবাইয়োরিক্স, (৩০) এস/২০০৭ এস ২, (৩১) বেভিওন, (৩২) এরিয়াপাস, (৩৩) স্কল, (৩৪) সিয়ারনাক, (৩৫) তাকেক, (৩৬) এস/২০০৪ এস ১৩, (৩৭) গ্রেয়িপ, (৩৮) হাইরোক্কিন, (৩৯) জারুনসাক্সা, (৪০) তারভোস, (৪১) মানডিলফারি, (৪২) এস/২০০৬ এস ১, (৪৩) এস/২০০৪ এস ১৭, (৪৪) বার্গেলমির, (৪৫) নার্ভি, (৪৬) এস/২০০৪ এস ১২, (৪৭) ফারবাউটি, (৪৮) গ্রাই, (৪৯) এজির, (৫০) এস/২০০৭ এস ৩, (৫১) বেস্টলা, (৫২) এস/২০০৪ এস ৭, (৫৩) এস/২০০৬ এস ৩, (৫৪) ফেনরির, (৫৫) সুরতুর, (৫৬) কারি, (৫৭) ইমির, (৫৮) লোগে, (৫৯) ফোনজোট। সাধারণ মানুষ শনিগ্রহকে খুব ভয় করে। ভয় করার কারণ পুরাণে ভয়ংকর ভয়ংকর সব শনিকে ঘিরে কাহিনি। শনিকে বশে রাখার জন্য নীলা (রত্ন Blue Supphire) বা এমিথিস্ট (উপরত্ন) বা রূপো (ধাতু) বা শ্বেতবেড়েলা (মূল) বা দক্ষিণাকালী (কবচ) বা ৭ মুখী/১৫ মুখী (রুদ্রাক্ষ) জ্যোতিষীরা নিদান দিয়ে থাকেন।

রাহু (Rahu or Dragon’s head) ও কেতু (Ketu or Dragon’s tail) : জ্যোতিষীরা অবশ্য ‘রাহুর দশা’ ‘কেতুর দশা’ এসব বলে বটে! তাতেই মানুষ থরহরি কম্প! যদিও এখনও পর্যন্ত জ্যোতির্বিদরা রাহু ও কেতুর কোনো অস্তিত্বের কথা বলেননি। তবে এই রাহু-কেতু ব্যাপারটা কী? আমরা জানি যেমন পৃথিবীর কক্ষতলকে বলা হয় পৃথিবীর কক্ষতল, তেমনই চাঁদের কক্ষপথের তলকে বলা হয় চাঁদের কক্ষতল। এই দুই কক্ষতল পরস্পরের সঙ্গে ৫ ডিগ্রি কোণ করে আছে। যার কারণে চাঁদের কক্ষপথ পৃথিবীর কক্ষতলকে দুটি বিন্দুতে ছেদ করে। এই বিন্দু দুটিকে বলে রাহু ও কেতু, জ্যোতিষীরা একে গ্রহ হিসাবে কল্পনা করেন কেন কে জানে! হিন্দু পৌরাণিক কাহিনিতে রাহু জনৈক দানববিশেষ। বলা হয়েছে দানব বিচিত্তির ঔরসে ও সিংহিকার গর্ভে এঁর জন্ম হয়। উল্লেখ্য, সমুদ্রমন্থন শেষে উত্থিত অমৃত অসুরদের বঞ্চিত করে দেবতারা পান করেছিল। ইনি কৌশলে গোপনে অমৃতপান করতে থাকলে চন্দ্র ও সূর্য এঁকে চিনতে পেরে অন্যান্য দেবতাদের জানান। এই সময় বিষ্ণু সুদর্শন চক্রের রাহুর মাথা কেটে দেন। কিছুটা অমৃত পান করায় এই দানব ছিন্নমস্তক হয়ে অমরত্ব লাভ করেন। এঁর মস্তকভাগ ‘রাহু’ (Head) ও দেহভাগ ‘কেতু’ (Tail) নামে পরিচিত। সেই থেকে রাহু এবং চন্দ্র ও সূর্যের সঙ্গে চিরশত্রুতা শুরু হয়। এরপর থেকে সুযোগ পেলেই রাহু চন্দ্র ও সূর্যকে গ্রাস করার জন্য অগ্রসর হয়। কিছুটা গ্রাস করতে সক্ষম হলেও তার কর্তিত দেহ থেকে চাঁদ বা সূর্য বেরিয়ে আসে। রাহুর এই গ্রাসকালীন সময়ে গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয় বলে অনেকে বিশ্বাস করেন। অর্থাৎ রাহু যখন সূর্যকে গ্রাস করে তখন সূর্যগ্রহণ হয়। অন্যদিকে রাহু যখন চন্দ্রকে গ্রাস করে তখন চন্দ্রগ্রহণ হয়। জ্যোতিষীরা এই মতই বিশ্বাস করেন এবং বিশ্বাস করান। কিন্তু জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বলেন সৌরজগতে সূর্যকে ঘিরে উপবৃত্তাকার পথে আবর্তিত হচ্ছে পৃথিবী, আবার পৃথিবীকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে চন্দ্র। চন্দ্র এবং পৃথিবীর এই আবর্তন চলার সময় কখনো-কখনো পৃথিবী, চন্দ্র ও সূর্যের মাঝখানে একই সরল রেখায় অবস্থান নেয়। এই সময় পৃথিবীর মানুষেরা চন্দ্রের আলো দেখতে পায় না। অর্থাৎ, পৃথিবীর ছায়ায় চাঁদ ঢাকা পড়ে যায়। পৃথিবী চাঁদের চেয়ে বড়ো হওয়ায় পৃথিবীর ছায়া চন্দ্রপৃষ্ঠকে পুরোপুরি ঢেকে ফেলে। এই কারণে চন্দ্রগ্রহণের সময় পৃথিবীর কোনো কোনো অংশে পূর্ণগ্রাস চন্দ্রগ্রহণ দেখা যায়। যেখানে সূর্যগ্রহণ পৃথিবীর খুব অল্প জায়গা থেকেই দেখা যায়, সেখানে চন্দ্রগ্রহণ পৃথিবীর সর্বত্র থেকেই দেখা যায়। রাহু গোমেদ (রত্ন Gomed) বা গোয়া গোমেদ (উপরত্ন) বা রূপো (ধাতু) বা শ্বেতচন্দন (মূল) বা ছিন্নমস্তা (কবচ) বা ৮ মুখী/১৫ মুখী (রুদ্রাক্ষ) এবং কেতুকে বৈদুর্যমণি (Cats eye) বা সিসা/রূপো (ধাতু) বা অশ্বগন্ধা (মূল) বা ধূমাবতী (কবচ) বা ৯ মুখী/১৬ মুখী রুদ্রাক্ষ) বশে রাখার জন্য জ্যোতিষীরা নিদান দিয়ে থাকেন।

জ্যোতিষীগণ মনে করেন এইসব গ্রহদের রশ্মিও আছে। তবে এই রশ্মি নাকি দেখা যায় না। দেখা যায় না, কিন্তু আছে –আধ্যাত্মিক বা Spiritual রশ্মি বলে কথা! দেখা যায় না বটে, কিন্তু জ্যোতিষীরা সেই রশ্মি আবার গুণেও ফেলেছেন। যেমন– রবির ২০টি রশ্মি, মেষের ৮টি, মঙ্গলের ১০টি, বুধের ১০টি, বৃহস্পতির ১২টি, শুক্রের ১৪টি, শনির ১৬টি ইত্যাদি। এমন রশ্মির কথা জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বলেন না। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বলেন আলফা, বিটা, গামা, কসমিক ইত্যাদি মহাজাগতিক রশ্মির কথা। আরও আছে জ্যোতিষীদের ব্যাপার স্যাপার। যেমন গ্রহদের স্বক্ষেত্র বা বাসস্থান বা জন্মভূমিও আছে। যেমন ধরুন–(১) সূর্য বা রবির স্বক্ষেত্ৰ কলিঙ্গ (বর্তমানে ওডিশা), (২) চন্দ্রের যবন দেশ (গ্রিস?), (৩) মঙ্গলের অবন্তী, (৪) বুধের মগধ (পাটনা ও গয়া), (৫) বৃহস্পতির সিন্ধুদেশে, (৬) শুক্রের ভোজকটকে, (৭) শনির সৌরাষ্ট্রে (বর্তমানে গুজরাট), (৮) রাহুর অম্বর অথবা সিংহল (বর্তমানে শ্রীলঙ্কা) এবং (৯) কেতুর (না, জন্মভূমির খোঁজ পাওয়া যায়নি)। মহাকাশের বেশির ভাগ গ্রহদের জন্মস্থান ভারতেই? মহাকাশের বাকি অংশে শূন্য কেন?

জ্যোতিষীয় ব্যাবসার ক্ষেত্রে মূল যে চারটি বিষয় জ্যোতিষীরা মাথায় রাখেন, সেগুলি হল– (১) গ্রহ, (২) নক্ষত্র, (৩) গণ (৪) রাশি এবং (৫) লগ্ন। একটু দেখে নেওয়ার চেষ্টা করব এগুলি কী বস্তু। জ্যোতিষীদের জন্য খুবই প্রয়োজন জন্মরাশি, জন্মলগ্ন, জন্মনক্ষত্র। এতেই জাকতের আমৃত্যু হালহকিকৎ বলে দেওয়া সম্ভব– এটা জ্যোতিষীদের দাবি এবং মানুষের প্রশ্নহীন বিশ্বাস। জন্মরাশি, জন্মলগ্ন, জন্মনক্ষত্র –এগুলি কী? নবজাতকের জন্মক্ষণে চন্দ্র যে রাশিতে থাকে তাকে জন্মরাশি বলে। নবজাতকের জন্মক্ষণে পূর্ব আকাশে যে রাশি দেখা যায় তাকে জন্মলগ্ন বলে। নবজাতকের জন্মক্ষণে চন্দ্রের সবচেয়ে কাছাকাছি উজ্জ্বলতম নক্ষত্রকে জন্মনক্ষত্র বলে।

আগেই উল্লেখ করেছি জ্যোতিষীদের গ্রহের কথা। রবি, চন্দ্র, মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র। শনি, রাহুও গ্রহ হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে। আবার ইউরেনাস, নেপচুন, প্লুটো মায় পৃথিবী গ্রহ নয়। রইল এখন নক্ষত্র– যে বারটি রাশির কথা আগে বলা হয়েছে, সেগুলি বেষ্টন করে ২৭ টি নক্ষত্র রয়েছে। ৩৬০ ডিগ্রিতে যদি ২৭ টি নক্ষত্র থাকে তবে এক-একটি নক্ষত্রের ব্যপ্তি ১৩ ডিগ্রি ২০ মিনিট করে অর্থাৎ মেষরাশির শুরু থেকে ১৩ ডিগ্রি ২০ মিনিট অন্তর পর পর একটি করে নক্ষত্র রয়েছে। ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞান অনুসারে নক্ষত্র হল চন্দ্রপথের ২৭টি ভাগের প্রতিটির নাম। নক্ষত্রগুলির নাম ও সংখ্যা হল– (১) অশ্বিনী, (২) ভরণী, (৩) কৃত্তিকা, (৪) রোহিণী, (৫) মৃগশিরা, (৬) আদ্রা, (৭) পুনর্বসু, (৮) পুষ্যা, (৯) অশ্লেষা, (১০) মঘা, (১১) পূর্বফাল্গুনী, (১২) উত্তরফাল্গুনী, (১৩) হস্তা, (১৪) চিত্রা, (১৫) স্বাতী, (১৬) বিশাখা, (১৭) অনুরাধা, (১৮) জ্যেষ্ঠা, (১৯) মূলা, (২০) পূর্বাষাঢ়া, (২১) উত্তরাষাঢ়া, (২২) শ্ৰবণা, (২৩) ধনিষ্ঠা, (২৪) শতভিষা, (২৫) পূৰ্ব্বভাদ্রপদ, (২৬) উত্তরভাদ্রপদ এবং (২৭) রেবতী। এই ২৭টি নক্ষত্রের প্রত্যেকটির একটি করে অধিপতি গ্রহ আছে। এই গ্রহগুলির ক্রম হল– কেতু, শুক্র, রবি, চন্দ্র, মঙ্গল, রাহু, বৃহস্পতি, শনি ও বুধ। অর্থাৎ অশ্বিনীর অধিপতি গ্রহ কেতু, ভরণী নক্ষত্রের অধিপতি গ্রহ শুক্র, কৃত্তিকার অধিপতি গ্রহ রবি ইত্যাদি।

বিয়ের ব্যাপারে একটা কথা প্রায়ই শোনা যায়। পাত্র বা পাত্রীর কী গণ। বস্তুত এই গণ তিন রকমের হয়– (১) দেবগণ, (২) নরগণ, (৩) দেবারিগণ বা রাক্ষসগণ। কী গণ সেটা নির্ভর করবে পাত্র বা পাত্রীর কোষ্ঠীতে চন্দ্র কোন্ নক্ষত্রে আছে তার উপরে। চন্দ্র যে যে নক্ষত্রে থাকলে ঐ তিন গণ হয় সেটা নীচে দেওয়া হল–

(১) দেবগণ : অশ্বিনী, মৃগশিরা, পুনর্বসু, পুষ্যা, হস্তা, স্বাতী, অনুরাধা, শ্রবণা ও রেবতী।

(২) নরগণ : ভরণী, রোহিণী, আদ্রা, পূর্বফাল্গুনী, উত্তরফাল্গুনী, পূৰ্বাষাঢ়া, উত্তরাষাঢ়া, পূর্বভাদ্রপদ ও উত্তরভাদ্রপদ।

(৩) রাক্ষসগণ : কৃত্তিকা, অশ্লেষা, মঘা, চিত্রা, বিশাখা, জ্যেষ্ঠা, মূলা, ধনিষ্ঠা ও শতভিষা।

সূর্যের গতিপথকে যেমন ১২ ভাগে ভাগ করে প্রতি ভাগের নাম রাখা হয়েছে রাশি, তেমনই চন্দ্রপথকে ২৭ ভাগে ভাগ করে প্রতি ভাগের নাম রাখা হয়েছে। নক্ষত্র। বিভিন্ন দেশে এই চন্দ্রনিবাসসমূহের নাম বিভিন্ন। যেমন গ্রিসে এই ধরনের কোনো চন্দ্রনিবাসের কল্পনাও করা হয়নি। সাধারণত দেখা যায় ২.২৫ নক্ষত্রে এক রাশি হয়। আগেই বলা হয়েছে যে ১২টি রাশি ২৪ ঘণ্টায় ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরে আসছে। অর্থাৎ একটি রাশি সরে গিয়ে পরের রশিটি উদয় হতে সময় লাগে ২ ঘণ্টা। এই রাশিগুলি মেষ থেকে শুরু হয় এবং এক-একটি রাশির ব্যাপ্তি ৩০ ডিগ্রি করে। সাধারণত পূর্ব ভারতে যে পদ্ধতি অনুসরণ করে এই রাশিগুলিকে সাজানো হয় মেষ থেকে শুরু করে বামাবর্তে (anti clockwise) পরপর এগিয়ে যেতে হবে। রাশিগুলি হল– মেষ (Aries), বৃষ (Taurus), মিথুন (Gemini), কর্কট (Cancer), সিংহ (Leo), কন্যা (Virgo), তুলা (Libra), বৃশ্চিক (Scorpio), ধনু (Sagittarius), মকর (Capricorn), কুম্ভ (Aquarius) ও মীন (Pisces)। এই রাশিগুলির প্রত্যেকটির একটি করে অধিপতি গ্রহ বা lord আছে। যেমন– মেষ ও বৃশ্চিকের অধিপতি মঙ্গল, বৃষ। ও তুলার অধিপতি শুক্র, মিথুন ও কন্যার অধিপতি বুধ, কর্কটের অধিপতি চন্দ্র, সিংহের অধিপতি রবি, ধনু ও মীনের অধিপতি বৃহস্পতি এবং মকর ও কুম্ভের অধিপতি শনি। যেটা দাঁড়াল তা হল মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র ও শনি– এদের প্রত্যেকটির দুটি রাশির উপর আধিপত্য আছে। কিন্তু চন্দ্র ও রবি কেবল একটি করে রাশিরই অধিপতি। রাহু ও কেতু কোনো রাশির অধিপতি নয়। তবে তাদের বলাবল নির্ণয়ের জন্য কয়েকটি রাশিকে তাদের স্বক্ষেত্র, মূলত্রিকোণ ও তুঙ্গস্থান হিসাবে ধরা হয়। আকৃতি ও গুণ অনুযায়ী রাশিগুলিকে অগ্নি, পৃথ্বী, বায়ু, জল এই চারভাগে ভাগ করা হয়। আবার চর, স্থির ও দ্যাত্মক এই তিন ভাগে ভাগ করা হয়। মেষ থেকে শুরু করে রাশিগুলিকে অগ্নি, পৃথ্বী, বায়ু, জল অথবা চর, স্থির, দ্যাত্মক হিসাবে পর পর ভাগ করে যেতে হবে। অর্থাৎ মেষ, সিংহ, ধনু হল অগ্নি রাশি (Fiery Signs); বৃষ, কন্যা, মকর পৃথ্বী রাশি (Earthly Signs); মিথুন, তুলা, কুম্ভ বায়ু রাশি (Airy Signs) এবং কর্কট, বৃশ্চিক ও মীন জল রাশি (Watery Signs)। অন্য রকম বিভাগে, মেষ, কর্কট, তুলা, মকর চর রাশি (Movable Signs); বৃষ, সিংহ, বৃশ্চিক, কুম্ভ স্থির রাশি (Fixed Signs) এবং মিথুন, কন্যা, ধনু ও মীন দ্যাত্মক রাশি (Common Signs)। ফলাফল বিচারে জ্যোতিষীরা রাশিগুলির এই বৈশিষ্ট্যগুলিকে অনেক সময় কাজে লাগায়। রাশিগুলির অন্য একটি শ্রেণিবিভাগ হল পুরুষ রাশি (Masculine Signs) ও স্ত্রী রাশি (Feminine Signs)। বিজোড় সংখ্যার যে রাশিগুলি অর্থাৎ মেষ, মিথুন, সিংহ, তুলা, ধনু, কুম্ভ– এই ছয়টি পুরুষ রাশি এবং বৃষ, কর্কট, কন্যা, বৃশ্চিক, মকর ও মীন– এই ছয়টি স্ত্রী রাশি। জ্যোতিষশাস্ত্র অনুযায়ী একজন জাতকের রাশি নির্নয় করা হয় তার জন্মমূহুর্তে সূর্য যে রাশিতে অবস্থান করে। তাদের মতে এই রাশি অনুযায়ী নাকি মানুষের ভাগ্য নিয়ন্ত্রিত হয়। তাহলে ভুলটা কোথায়! দৈনিক-সাপ্তাহিক পত্রিকায় রাশিফল বিভাগে প্রথম যে রাশিটি আমরা দেখি সেটি হল মেষ রাশি (২১ মার্চ থেকে ২০ এপ্রিল সময়ে জন্মগ্রহণকারীরা এই রাশির জাতক)। বর্তমান শতকে তথা এই সময়ে সূর্য মেষ রাশিতে নয়, মীন রাশিতে অবস্থান করে। এই গোলমাল অবশ্যই অন্য রাশির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এই গোলমালের মূল কারণ হল পৃথিবীর ‘অয়নচলন’। বিষুববৃত্ত ও ক্রান্তিবৃত্ত ২৩.৫ ডিগ্রি কোণে পৃথক এবং এই বৃত্ত দুটি পরস্পরকে দুটি বিন্দুতে ছেদ করে। এই বিন্দু দুটিকে বলা হয় মহাবিষুব এবং জলবিষুব বিন্দু। আরও সহজ করে যদি বলি, তা হল ‘খ’ গোলকে এই দুটি বিন্দু হচ্ছে বছরে দু-দিন বিষুববৃত্তের উপর সূর্যের অবস্থান। এই দুই দিন হল ২১ মার্চ (দিন ও রাত্রি সমান) এবং ২৩ সেপ্টেম্বর। মহাবিষুব বিন্দুকে ক্রান্তিবৃত্তের শূন্য ডিগ্রি বিন্দু বা প্রারম্ভ বিন্দু ধরা হয়। এই কারণেই ২০০০ বছর আগে ২১ মার্চ এই মহাবিষুব বিন্দু হতে পরবর্তী ৩০ ডিগ্রি পর্যন্ত সূর্য মেষ রাশিতে অবস্থান করত বলেই মেষ রাশিকে রাশিচক্রের প্রথম রাশি ধরা হয়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল প্রতিবছর এই বিষুব বিন্দুদ্বয় তাদের অবস্থান পরিবর্তন করছে। প্রতি ৭২ বছরে এই বিন্দু দুটির ১ ডিগ্রি করে অগ্রগমন ঘটে এবং বর্তমান অবস্থায় ফিরে আসতে তাদের লাগবে ঠিক ২৬ হাজার বছর। বিষুব বিন্দুদ্বয়ের এই চলনকেই বলে ‘অয়নচলন’ কেন এমনটি ঘটে? এর কারণ হল পৃথিবীর ঘূর্ণন অক্ষের স্বল্প গতির ঘূর্ণন। পৃথিবী যেমন নিজ অক্ষে ঘুরে চলছে, তেমনই এর ঘূর্ণন অক্ষটিও নিজ অবস্থান থেকে নিয়মমতোই সরে যাচ্ছে। এই ঘূর্ণন অক্ষটি প্রতি ২৬ হাজার বছরে একবার পূর্ণ ঘূর্ণন সম্পন্ন করে। পৃথিবীর ঘূর্ণন অক্ষের এই সরণের ফলে ক্রান্তিবৃত্তেরও সরণ ঘটছে এবং এর ফলেই বিষুব বিন্দুদ্বয়ের “অয়নচলন ঘটছে। ঘূর্ণন অক্ষের সরণের ফলে কিছু চমকপ্রদ ঘটনাও ঘটে। যেমন উত্তর আকাশে বর্তমানে যে স্থানে ধ্রুবতারা। দেখি ১৩ হাজার বছর পর সেখানে বীণা মণ্ডলের অভিজিৎ নক্ষত্রটিকে দেখা যাবে এবং এরও ১৩ হাজার বছর পর সেখানে পুনরায় ধ্রুবতারাকে দেখা যাবে। তাহলে এখন প্রশ্ন হল অয়নচলনের সঙ্গে রাশিচক্রের রাশির অবস্থান পরিবর্তনের সম্পর্কটা কী? আজ থেকে ২০০০ বছর আগের কোনো একসময় রাশিচক্র তৈরি হয় তখন সূর্য ২১ মার্চ তারিখে সূর্য মেষ রাশিতে প্রবেশ করত, যা টলেমির ‘টেট্রাবিবলস’ থেকে জানা যায়। টলেমে তাঁর ‘টেট্রাবিবলস’-এ। বলেছেন “সূর্য তখন ২১ মার্চ তারিখে মেষ রাশিতে প্রবেশ করে এবং ২২ এপ্রিল পর্যন্ত সেখানেই অবস্থান করত। কিন্তু আজ ২০০০ বছর পর মহাবিষুব বিন্দুর প্রায় ২৭ ডিগ্রি সরণের ফলে সূর্য এখন ২১ মার্চ মীন রাশিতে (নক্ষত্রমণ্ডল) প্রবেশ করে ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত সেখানেই অবস্থান করে এবং ১৪ এপ্রিলে গিয়ে সূর্য মেষ রাশিতে প্রবেশ করে। রাশিচক্রের অন্যান্য রাশির ক্ষেত্রে একই অবস্থা এবং রাশিগুলিতে সূর্যের অবস্থানের সময় কালেরও ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। যেমন সূর্য কন্যা রাশিতে অবস্থান করে ৪৪ দিন, আবার বৃশ্চিক রাশিতে অবস্থান করে মাত্র ৭ দিন। জ্যোতিষ মতে জন্মমুহূর্তে সূর্যের অবস্থানই মানুষের রাশি নির্ণয় করে। এই শাস্ত্র (?) মতে ১ আগস্ট জন্মগ্রহণকারী হবে সিংহ রাশির, তবে বর্তমানে এইদিন সূর্য অবস্থান করে কর্কট রাশিতে। জ্যোতিষের সব্বোনাশ এখান থেকেই, অর্থাৎ একই ব্যক্তি একই সঙ্গে আলাদা-আলাদাভাবে দু-ধরনের ভাগ্যর অধিকারী হবেন। এমনকি কারও জন্ম যদি ২৯ নভেম্বর থেকে ১৮ ডিসেম্বরের মধ্যে হয়, তাহলে তার জন্য বর্তমানে রাশিচক্রের কোনো রাশিই বরাদ্দ নেই। কারণ এইসময় সূর্য সর্পধারী নক্ষত্রমণ্ডলে (ophiucus) অবস্থান করে। তাই কারও সঙ্গে যদি পত্রিকার রাশিফল বা কোনো জ্যোতিষীর ভবিষৎবাণী কাকতালীয় ভাবে মিলেও যায়, তাহলে তৃপ্তির পাওয়ার কিছু নেই, কারণ আপনি নিজেকে যে রাশির জানেন আদতে আপনি মোটেও সেই রাশির নন।

জ্যোতিষীদের ভাগ্যগননার আর-একটি বড় উপাদান হল গ্রহ ও তাদের অবস্থান। জ্যোতিষ মতে গ্রহ-নক্ষত্রদের সময় ভেদে অবস্থানের উপরেই নাকি অর্থপ্রাপ্তি, ব্যাবসার লাভ-ক্ষতি, মামলা-মোকদ্দমায় হারা-জেতা, সংসারে শান্তি ফিরিয়ে আনা, স্বামীর পরস্ত্রীতে অনাসক্ত হওয়া, বিদেশ গমন, দুরারোগ্য অসুখ নিরাময়, প্রেমে জয়ী হওয়া, না-হওয়া বিয়ে হওয়া, পরীক্ষায় পাশ/ফেল ছাড়াও ইহ জাগতিক সকল কর্মই নির্ভর করে। তাহলে এখন খালি চোখে তাদের দাবিগুলির আসড়তাটা স্পষ্ট হয়। এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত গ্রহের সংখ্যা হাজারেরও উপরে। আর সেখানে জ্যোতিষীদের গণনায় আছে শুধুমাত্র প্রাচীন পৃথিবীর আবিষ্কৃত সেই ৫টি গ্রহ। আর ইউরেনাস ও নেপচুনকে তাদের এই গণনায় খুঁজে পাওয়া না গেলেও রাহু কেতু নামে দুটি কাল্পনিক গ্রহকে তাদের গণনায় পাওয়া যায়, সে তো আগেই বলেছি। মহাবিশ্বের এত গ্রহের মাঝে জ্যোতিষীরা গ্রহ স্বল্পতায় পরে সূর্যকে একটি গ্রহ হিসেবেই বিবেচনা করে! বাস্তবিক অর্থে গ্রহনক্ষত্রগুলির কোনো শক্তি বা বলের এমন কোনো প্রভাবই নেই, যা মানুষের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে। আর পৃথিবীর উপর যদি কোনো বলের প্রভাব থেকে থাকে, তা হল মহাকর্ষীয় বল। তবে গ্রহনক্ষত্রগুলি পৃথিবী থেকে এত দূরে যে তারা পৃথিবীর উপর মহাকর্ষীয় বা অভিকর্ষজনিত যে বল বা শক্তি প্রয়োগ করে তার পরিমাণ অতি নগণ্য। তাই কারও জন্মমুহূর্তে গ্রহনক্ষত্রের আকর্ষণ বলের ক্রিয়া জন্মগ্রহণকারীর ভবিষ্যৎ নিয়ন্ত্রণ করছে। এমনটি ভাবার কোনো যুক্তি নেই। প্রাচীনকালে মানুষ আকাশের বিভিন্ন অংশের এলোমেলো নক্ষত্রগুলির মাঝে তাদের ঘটমান জীবনের পরিচিত বিষয়ের সঙ্গে সাদৃশ্য খোঁজ করত বলেই কোনো নক্ষত্রমণ্ডলকে মেষের মতো আবার কোনো নক্ষত্রমণ্ডলকে কন্যা ইত্যাদি রূপে কল্পনা করেছিল। তাই বর্তমান সময়ে নক্ষত্রমণ্ডলগুলির নাম ও কল্পিত চিত্রগুলি তাদের মতোই রয়ে গিয়েছে। অবশ্য অন্য কিছু খুঁজেও পেতে পারি।

বাকি রইল লগ্ন। প্রতিটি লগ্নের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে জ্যোতিষের বইগুলিতে অনেক বিস্তৃত ভাবে লেখা আছে। কোষ্ঠী বিচারের ক্ষেত্রে জ্যোতিষীরা লগ্ননির্ণয়কে অত্যন্ত গুরুত্ব দেন। জ্যোতিষীদের মতে বারোটি পরপর পূর্ব দিগন্তে উদিত হয় এবং ক্রমাগত পশ্চিমগামী হয়ে অবশেষে পশ্চিম দিগন্তে অস্ত যায়। আসলে পৃথিবীর আবর্তনের জন্যই এরকম মনে হয়। যেহেতু পৃথিবী ২৪ ঘণ্টায় একবার আবর্তন সম্পূর্ণ করে। সেই কারণেই পূর্বদিকে এক-একটি রাশির স্থায়িত্বকাল ২ ঘণ্টা। সকাল ৬ টায় পূর্বদিকে যদি মেষ রাশি উদয় হয় তবে সেটি ৮ টা পর্যন্ত থাকবে, ৮ টা থেকে ১০ টা পর্যন্ত পূর্বদিকে থাকবে বৃষরাশি, ১০ টা থেকে ১২ টা পর্যন্ত পূর্বদিকে থাকবে মিথুন রাশি– এইভাবে দুই ঘণ্টা অন্তর একটি করে রাশি মিলবে, মোট ১২ রাশি। জ্যোতিষ মতে, বৈশাখ মাস থেকে শুরু করে চৈত্রমাস পর্যন্ত সূর্যোদয় মেষ থেকে শুরু করে মীন রাশিতে হবে। যেটি দাঁড়াল– বৈশাখ মাসে সূর্যোদয়ের সময় পূর্বদিকে থাকবে মেষ রাশি, জ্যৈষ্ঠ মাসে সূর্যোদয়ের সময় পূর্বদিকে বৃষ রাশি থাকবে ইত্যাদি। জাতকের জন্মের সময় যে রাশিটি থাকে, সেটিই হল জাতকের লগ্ন, জন্মলগ্ন। তবে এগুলি যে সবার ক্ষেত্রে নির্ভুল ভাবে মিলবে এমন কোনো কথা নয়। গ্রহের বল ও অবস্থান অনুযায়ী বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন হতে পারে বলে জ্যোতিষীরা বলে থাকেন। তাই মিলতেও পারে, আবার নাও মিলতে পারে। কারণ কোনো জাতকের চেহারা বা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য শুধু লগ্ন কোন রাশিতে তার উপর নির্ভর করে না। বিভিন্ন গ্রহের বল ও অবস্থানের উপর সেটা অনেকাংশেই নির্ভরশীল বলে জ্যোতিষীরা মনে করেন। বস্তুত এই নক্ষত্র, রাশি, মাসই হল জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের বিষয়-আশয়। আর জ্যোতিষীরা এইসব গ্রহনক্ষত্র দিয়ে ছলনার কাজে লাগান, প্রতারণার কাজে লাগান, বুজরুকির কাজে লাগান। মানুষজনদের মাথা মোড়াতে সুবিধা হয়। বোঝাতে চায় –দেখো, আমরা কেমন বিজ্ঞানের উপর দাঁড়িয়ে ভবিষ্যদ্রষ্টা। প্রতারণার অভিযোগে চিটফান্ডের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের গ্রেফতার করা হলে জ্যোতিষীদের গ্রেফতার করা হবে না কেন?

জ্যোতিষীবাবুদের গ্রহ, নক্ষত্র, রাশি, লগ্নের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে।

(১) ১৮ ডিগ্রির এক টুকরো আকাশে যদি ১২ টি রাশি থাকে, তাহলে ৩৬০ ডিগ্রি আকাশে ডিগ্রির আকাশে কত লক্ষ রাশি থাকতে পারে ভাবুন। তবে তো খুব ভয়ানক ব্যাপার, এত লক্ষ লক্ষ রাশির প্রভাব হিসাবে উচিত নয়? জ্যোতিষীবাবুরা কী বলেন এ ব্যাপারে? নিরুত্তর থাকেন।

(২) জন্মকালে চন্দ্র যে রাশিতে থাকে সেটিই জাতকের রাশি বলা হয়। শুধু চন্দ্র কেন, সৌরজগতে তো আরও অসংখ্য গ্রহ আছে উপগ্রহ আছে –সেগুলি বিচার্য নয় কেন? জ্যোতিষীবাবুরা কী বলেন এ ব্যাপারে? নিরুত্তর থাকেন।

(৩) জাতকের জন্মসময় কোনটি? এটা বড় গোলমেলে ব্যাপার! কেউ মনে মনে করেন মাতৃজঠরে জ্বণের প্রথম দিন, কেউ মনে করেন মাতৃজঠরে থাকাকালীন যেদিন শরীরে প্রাণসঞ্চার হয়, কেউ মনে করেন যেদিন শিশু মাতৃগর্ভ ত্যাগ বেরিয়ে আসে, আবার কেউ মনে করেন শিশুর নাড়ি কাটার সময়, কেউ আবার এত ঝামেলায় না-গিয়ে চিকিৎসকের দেওয়া সার্টিফিকেটের জন্মসময় গ্রাহ্য করে –এক্ষেত্রে আবার সংশয়, চিকিৎসক বা চিকিৎসা-কর্মীরা যে সময় নথিভুক্ত করেছেন সেটা কতটা অথেনটিক! যাই হোক, জ্যোতিষীবাবুরা কোন জন্মসময় বিচার করে জাতকের কোষ্ঠী বিশ্লেষণ করবেন? ভিন্ন ভিন্ন। সময়কে জন্মসময় ধরলে ভিন্ন কোষ্ঠী বিচার হবে না? হবেই তো। রাশির অবস্থান পালটালে নির্ণয়ও পালটাতে বাধ্য। এক্ষেত্রে অবশ্য জ্যোতিষীবাবুরা বলেন, লগ্ন পরিবর্তনের সন্ধিকাল ব্যতীত লগ্ন-মধ্যবর্তী সময়ে গ্রহ-নক্ষত্রের সন্নিবেশের এমন কিছু তারতম্য হয় না, ফলে রাশি পালটে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। ও মা, সে কি কথা! যদি জমজ সন্তান হয়? তাদের কোষ্ঠীবিচার তো একই হবে। মানে তারা একই সময়ে পটি করতে যাবে, একই শিক্ষকের কাছে পড়বে, একইরকম বিদ্বান হবেন, একই ক্লাসে পড়া শেষ করবে, একই জায়গায় একই চাকরি করবে, একই মেয়ে বা ছেলেকে বিয়ে করবে, একই দিনে একই সময়ে একই কারণে মরবে –তাই-ই হবে, জ্যোতিষ বিজ্ঞান হলে। হয় কী? অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় জন্মানোর পরপরই একটি সন্তান মারা যায়। তাহলে একই লগ্ন, একই গ্রহস্থান, একই রাশিচক্র হওয়া সত্ত্বেও দুইজন জাতকের আয়ুষ্কাল দুই রকমের হবে কেন? তাহলে কী পৃথিবীর সকল জমজ জাতকই লগ্ন পরিবর্তনের সন্ধিকালে জন্ম নেয়? জ্যোতিষীবাবুরা কী বলেন এ ব্যাপারে? অবশ্যই নিরুত্তর থাকেন।

(৪) পুব আকাশে রাশি উদয় হয়–এই বিষয়টি এক্কেবারেই আপেক্ষিক। বস্তুত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে স্থানীয় সূর্যোদয়কাল বিভিন্ন হওয়ার ফলে পুবদিকে উদিত রাশিটি ভিন্ন হবে। ফলে একই সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জন্মানো জাতকের লগ্ন বিভিন্ন রকমই হবে, কোষ্ঠীও হবে বিভিন্ন। অতএব একই সময়ে জন্মানো সত্ত্বেও আলাদা আলাদা জাতকের আলাদা লগ্নফল এবং কোষ্ঠীচক্র হবে না, তাই তো? জ্যোতিষীবাবুরা কী বলেন এ ব্যাপারে? নিরুত্তর থাকেন।

(৫) জ্যোতিষীদের যে শাস্ত্র, তা ভূকেন্দ্রিক বিশ্বতত্ত্বকে মেনে চলে। অর্থাৎ পৃথিবীকে কেন্দ্র করে সূর্য সহ সমস্ত গ্রহ-নক্ষত্ররা ঘুরপাক খাচ্ছে। এ তত্ত্ব তো অচল তত্ত্ব, আস্তাকুড়ে তার ঠিকানা। এই ধরনের তত্ত্ব কে. সি. পালের মতো বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করতে পারেন, যারা ভাঙা রেকর্ডের মতো এখনও চলেছেন ‘সূর্য পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে’। এই তত্ত্বের উপর দাঁড়িয়ে থাকলে জ্যোতিষকে বিজ্ঞান বলতে অসুবিধা আছে। ভুল হবে রাশি-গ্রহের অবস্থান। সঠিক হবে না রাশিচক্র, কোষ্ঠী-ঠিকুজি। এ তত্ত্ব সঠিক হলে গ্রহ-উপগ্রহগুলিতে মহাকাশযান কিংবা কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠানো সম্ভব হত না। ওই তত্ত্ব ভুল, তাই জ্যোতিষ ভুল। জ্যোতিষীবাবুরা কী বলেন এ ব্যাপারে? নিরুত্তর থাকেন।

(৬) কোষ্ঠী দেখে জ্যোতিষীবাবুরা যোটক বিচার করে। অর্থাৎ পাত্রপাত্রীদের রাজযোটক হলে দাম্পত্যজীবন বড়োই সুখময় হয়!!! যোটক বিচার কাকে বলে? এককথায় –“বিবাহের পূর্বে পাত্র এবং পাত্রীর পরস্পরের জন্মরাশ্যাদি থেকে যে শুভাশুভ বিচার করা হয়, তাকে রাজযোটক বলে”। এই বিচার আট প্রকার, অর্থাৎ আট প্রকারের কূট। কূট’ কথাটির অর্থ জটিল। জ্যোতিষীবাবুরা প্রবল কূট বলে দু-হাতেই আট প্রকারের কূট’ সামাল দিতে পারেন। এই কূটগুলি হল– বর্ণকূট, বশ্যকূট, তারাকূট, যোনিকূট, গ্ৰহমৈত্রীকূট, গণমৈত্রীকূট, রাশিকূট এবং ত্রিনাড়িকূট। এদের আবার ‘গুণ’ আছে। বর্ণকূট’ থেকে ‘ত্রিনাড়িকূট’ পর্যন্ত গুণ হবে ১,২,৩ ইত্যাদি। মোট নম্বর ৩৬-এর মধ্যে ১৮ নম্বর পেতেই হবে, আর তা না-হলে ডাহা ফেল। যদি ৩০-এর উপর নম্বর হয় তাহলে লেটার মার্কস হবে। একটু ‘যোনিকূট’ নিয়ে বিশ্লেষণ করা যাক –যোনি চোদ্দ প্রকার। দুটি করে নক্ষত্র নিয়ে এক-একটি যোনি। অভিজিৎ নক্ষত্রকে ধরে নক্ষত্রের সংখ্যা ২৮। অবশ্য সবকটি যোনিই ইতর-যোনি, অর্থাৎ ঘোড়াযযানি, মোষযযানি, বাঘযোনি, সিংহযোনি, হাতিযোনি, কুকুরযোনি, বেড়ালযোনি, ইঁদুরযোনি, বানরযোনি ইত্যাদি। না, মানুষের জন্য মনুষ্যযোনি নেই। তামাম মনুষ্যকুল ইতর-যোনির অংশ। ছাগল, কুমির, হাঙ্গর, গোরিলা, গোসাপ, শিম্পাঞ্জি, টিকটিকিদের কি যোনি নেই!

আমার বিয়ের সময় আমার শ্বশুরবাড়ির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিস পাত্রের কোষ্ঠী দেখাতে হবে। বড়ই বিপদে পড়ে গেল আমার অভিভাবক। কারণ আমার কোনো কোষ্ঠী-ঠিকুজি ছিল না। অতএব জ্যোতিষে শরণাপন্ন। জ্যোতিষীকে বলে আমার একটা ‘রাজযোটক’-এ মিল হয়েছে এমন একটা কিছু করিয়ে আনা হল। কেল্লা ফতে, বিয়ে পাক্কা। আদতে আমার রাশি, লগ্ন, কোষ্ঠী কিছুই নেই– তার আবার রাজযোটক! আমার ১২ বছরের সংসার দিব্য চলছে। সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বড়ো মেয়ের বিয়ে ছিল রাজযোটক। ভাটপাড়ার জনৈক জ্যোতিষী মেয়ে আর হবু জামাইয়ের কোষ্ঠীবিচার করে সেটাই বলেছিলেন। রাজযোটকের বিয়ে, তা সত্ত্বেও বিয়ের দুই বছরের মধ্যেই বঙ্কিমচন্দ্রের বড়ো মেয়ে বিধবা হয়ে যান। এরকম হাজার হাজার দৃষ্টান্ত উপস্থিত করা যায়, যেখানে রাজযোটক হওয়া সত্ত্বেও বিয়ে অকালে নষ্ট হয়ে গেছে। জ্যোতিষীবাবুরা কী বলেন এ ব্যাপারে? নিরুত্তর থাকেন।

(৭) একদা, মানে দেড়শো বছর আগে পর্যন্ত জ্যোতিষীবাবুরা বলবান সপ্তমপতি কেন্দ্রে কোণে থাকলে বাল্যবিবাহের নিদান দিতেন। তাই ওই সময় প্রায় সকল মেয়েদেরই বলবান সপ্তমপতি কেন্দ্রে কোণে থাকার ফলে বাল্যবিবাহ হত। ১৯৯৯ সালে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ১৯৯৯’ চালু হওয়ার পর থেকে বাল্যবিবাহ বন্ধ হয়ে গেল। বলবান সপ্তমপতি গেল কোথায়? কেন্দ্রের কোণে আর থাকেন না? গেছে। ভুল। জ্যোতিষীবাবুরা কী বলেন এ ব্যাপারে? নিরুত্তর থাকবেন।

“পৃথিবীর ১০জন সেরা মনীষীকে আমন্ত্রণ জানিয়ে তাঁদের দেখা সবচেয়ে অপদার্থ জিনিসটিকে নিয়ে আসতে বলুন। দেখবেন, সবাই একজন করে জ্যোতিষীকে ধরে এনেছেন।” –বলেছেন গটিনগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতজ্ঞ ডেভিড হিলবার্ট। না-হলে কয়েকশো কোটি বছর সৃষ্ট গ্রহ-নক্ষত্রকে দিয়ে মানুষের ভাগ্য নির্ণয় করে! মানুষের সৃষ্টি তো কয়েকশো কোটি বছর নয়!!! বর্তমানে সূর্যের বয়স প্রায় ৫০০ কোটি বছর। চন্দ্র বা চাঁদের বয়স পৃথিবীর বয়সের প্রায় সমান, যা প্রায় ৪.৬ কোটি বছর। পৃথিবীতে প্রাপ্ত উল্কার বয়স ৪.৩ কোটি থেকে ৫ কোটি। মহাবিশ্বে এরকম ব্রহ্মাণ্ডের সংখ্যা কম নয়। এখনও পর্যন্ত ১০০টি ব্রহ্মাণ্ডের সন্ধান পাওয়া গেছে। আমাদের ব্রহ্মাণ্ড ছাড়া খালি চোখে আর মাত্র ৩টি ব্রহ্মাণ্ড দেখা সম্ভব। এই ৩টির মধ্যে ২টি দক্ষিণ গোলার্ধে, আর-একটি মাত্র উত্তর গোলার্ধে। ২০ লক্ষ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত শেষের ব্রহ্মাণ্ডটির নাম দেওয়া হয়েছে অ্যানড্রোমিডা (Andromeda)। একটি ব্ৰহ্মাণ্ড থেকে আর-একটি ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যবর্তী অংশের নাম ‘আন্তব্রহ্মাণ্ড মহাকাশ’। এই শতাধিক ব্ৰহ্মাণ্ড ও আন্তর্বহ্মাণ্ড মহাকাশ নিয়েই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড। নানা পর্যবেক্ষণে জানা গেছে, ব্রহ্মাণ্ড জোটবদ্ধ অবস্থায় আছে। প্রতিটি ব্ৰহ্মাণ্ড জোট অপর প্রতিটি জোট থেকে ক্রমাগত দূরে সরে যাচ্ছে। দূরত্ব বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বেগও বৃদ্ধি পায়। ব্রহ্মাণ্ডের এহেন অস্থির গ্রহ-নক্ষত্র নিয়েই জ্যোতিষীবাবুদের কারবার। জ্যোতিষীবাবুরা এখানেই থেমে থাকেননি –তাঁরা রাজা-উজির, জীবজন্তু, জীবজন্তু, পশুপাখি, বৃক্ষলতা, পাহাড়-পর্বত– এমনকি ভারতের ভাগ্য, পশ্চিমবঙ্গের ভাগ্যও বলে দেওয়ার সাহস রাখে –আবার দিল্লির সিংহাসনে কে বসবেন, পশ্চিমবঙ্গের মসনদের কে উপবেশন করবেন তাও বলে থাকেন –অনেকটা সাপ মরবে লাঠি ভাঙবে না কায়দায়– যদিও এ যাবৎকাল পর্যন্ত সবই ভুলভাল বলেছেন। জ্যোতিষীবাবুরা জানেন লাগলে রাতারাতি বিখ্যাত, না-লাগলে কেউ ফাঁসি তো দূরের কথা, কেউ কৈফিয়তই নেবে না।

জ্যোতিষীর জ্যোতিষী সেরা জ্যোতিষী হলেন বি. ভি. রমন। ইনি ‘অ্যাস্ট্রোলজিক্যাল ম্যাগাজিন’ নামে পত্রিকাও করেন। এহেন জ্যোতিষীর কয়েকটি ঐতিহাসিক ভাগ্যনির্ণয় এখানে উল্লেখ করার লোভ সামলাতে পারছি না। ১৯৭৯ সালে অ্যাস্ট্রোলজিক্যাল ম্যাগাজিনে লিখলেন, “জনতা দল সরকারের উপর এখন বৃহস্পতির কোনো ক্রোধ নেই। ফলে জনতা সরকার এবারের মতো টিকে যাবে।” দেশের রাজনীতির খবর যাঁরা রাখেন তাঁরাই জানেন জনতা সরকারের কী হাল হয়েছিল। ১৯৮০ সালে লেখা হল, “তিন গ্রহের যা অবস্থান দেখছি তাতে দিল্লিতে পাকাঁপোক্ত সরকার হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।” সেবার ইন্দিরা গান্ধি নির্বাচনে দাঁড়িয়ে জিতলেন। তাঁর দল ব্যাপক ফল করল। সরকার হল পাকাঁপোক্তই। রাজনীতির এলেম না-থাকলে এরকম ভুলভাল ভবিষ্যৎ বাণীই হয়। ২০১৬ সালে পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল সরকারের ভবিষ্যৎ কী যদি আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, তাহলে বিনা জ্যোতিষ গণনায় বলে দেওয়া যায়– “২০১৬ সালে বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলই দ্বিতীয়বার সরকার গড়বে, কোনো অঘটন ছাড়াই। আসন সংখ্যা গতবারের থেকে বাড়ার সম্ভাবনা।” এটা বলার জন্য জ্যোতিষবিদ্যা-গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান জানার প্রয়োজন নেই। এমনকি এও বলা যায় –“আগামী লোকসভা নির্বাচনে দিল্লির মসনদে বিজেপি সরকারের দ্বিতীয়বার সরকার গঠন করার সম্ভাবনা, যদি কোনো অঘটন না ঘটে।” বলা যায়– “আগামী বছর অতি বর্ষণের সম্ভাবনা। মুম্বাই, কলকাতার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জলমগ্ন হতে পারে। আগামী বছর বেশ কিছু নক্ষত্রপতনের যোগ আছে” ইত্যাদি। ফললে নিশ্চয় আমার পসার বাড়বে, না ফললে কে মনে রাখবে! মানুষের ক্ষেত্রেও প্রায় ৮০% মিলিয়ে দেওয়া সম্ভব বিনা জ্যোতিষবিদ্যায়। এ বিষয়ে পরে বিস্তারিত আলোচনার ইচ্ছা আছে। যে ভবিষ্যদ্বাণীটি আমি উল্লেখ করলাম, সেটিতে তথাকথিত কোনো অ্যাস্ট্রোলজিক্যাল ক্যালকুলেশন নেই, আছে পলিটিক্যাল ক্যালকুলেশন। এইভাবে অনেক কিছুরই ক্যালকুলেশন করে বলা সম্ভব হতে পারে। তার জন্য জ্যোতিষ, জ্যোতিষবিদ্যা, জ্যোতিষ-গণনার প্রয়োজন পড়বে না। তবে মিলতে পারে, নাও মিলতে পারে। বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু বলেছিলেন–”যেটা মেলে সেটাই বিশ্বাস করি। আর যেটা মেলে না সেগুলি ভুলে যাই।” এ প্রসঙ্গে আরও একটু বলতে পারি। বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথের জন্য তাঁর বাড়িতে একটা কোষ্ঠী করা হয়েছিল। সেই কোষ্ঠীতে বলা হয়েছিল– মঙ্গলের যা অবস্থান, তাতে সত্যেন্দ্রনাথের পড়াশোনা হবে না। কোষ্ঠীকে উড়িয়ে দিয়ে হিন্দু স্কুলের অঙ্কের শিক্ষক তাঁকে ১০০-র মধ্যে ১১০ দিয়েছিলেন। এই মহাবিশ্বের মৌলকণা তাঁর নামেই ‘বোসন’ হিসাবে চিহ্নিত হয়ে আছে। পরের ঘটনা তো ইতিহাস, সবাই জানেন। সাহিত্যসম্রাট ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যয় বলেছেন– “জ্যোতিষশাস্ত্রের গণনার উপর কিছুমাত্র বিশ্বাস করিবে না। আমি উহার অনেক পরীক্ষা করিয়া এক্ষণে ইহাতে বিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়াছি।” একদা জ্যোতিষী বিশ্বাসী বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর সংগ্রহের সমস্ত জ্যোতিষ বিষয়ক বইপত্র আগুনে পুড়িয়ে দেন।

জ্যোতিষীবাবুদের ভবিষ্যত বাণী যে বহুবার মিথ্যা হয়েছে তার ঝুড়ি ঝুড়ি প্রমাণ আছে। মানুষ সেসব ভুলে যাবে কেন?! জ্যোতিষীবাবুরা অনেক সময় অনেক প্রমাণ-ট্রমাণ দিয়ে আমাদের বিশ্বাস করতে বাধ্য করে যে আসলেই পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। যে যত যুক্তি দিক, আর না-দিক– সত্যি কিন্তু পৃথিবী একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে। সেটা জ্যোতিষীবাবুরা বাণী না-ছাড়লেও হবে। এখন এমন দশটি ভবিষ্যৎ বাণীর কথা বলব যেগুলি বিশ্বজুড়ে আতঙ্কিত এবং আলোড়িত হয়েছে, অথচ মিথ্যা প্রতিপন্ন হয়েছে।

(১) অপ্রামাণ্য রচনা (The Apocrypha), এই ভবিষ্যৎ বাণীটি করা হয়েছিল ১০০০ সালে। ইঞ্জিল শরিফের কয়েকটা লাইনের উৎস ধরে সবার মধ্যে আতঙ্ক ভাইরাল হয়ে যায় যে, ঈসার মৃত্যুর পর এক প্রজন্ম পরে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। কী ছিল ইঞ্জিল শরিফের সেই লাইনটি?– “Christ would be back in generation and that the genetation shall not pass.” opette, “জিশু আবার ফিরে আসবেন আগামী প্রজন্মে। এবং সেই প্রজন্ম পরিত্রাণ পাবে না“। তৎকালীন সময়ে প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী চার্চ থেকে অর্থের বিনিময়ে মানুষেরা নিজেদের জন্য স্বর্গে জমি কিনে রাখতে পারতেন এবং মানুষজন সংশ্লিষ্ট চার্চে অর্থ প্রদান পাপ থেকে মুক্তি পেলেন বলে বিশ্বাস করতেন। যেহেতু সেসময় পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে এমন ভবিষ্যৎ বাণী করা হয়েছে, সেইহেতু অনেকেই নিজেদের সর্বস্ব সম্পদ বিক্রিবাটা করে চার্চে অনুদান দিয়ে পাপমুক্তির হিড়িক পড়ে গেল। সেই সুযোগে এক লপ্তে চার্চগুলিতে কোটি কোটি টাকা রোজগার হয়েছিল, বলাই বাহুল্য। যেহেতু সেসময়ে ঘড়ি বা ক্যালেন্ডার সহজলভ্য ছিল না, তাই সাধারণ মানুষ ধ্বংসের দিন হিসাবের জন্য মহান চার্চের উপরই নির্ভর করত। তখনকার দিনে পোপ/পাদরিদের বাণী বা ঘোষণাই ছিল শেষ কথা। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে পৃথিবী ধ্বংসের ভবিষ্যৎ বাণী। শুনিয়ে প্রচুর অর্থ কামিয়ে নয়েছিল বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন। এখন ২০২১ সাল, পৃথিবী যেখানে ছিল সেখানেই আছে। ধ্বংস যে হয়নি সেটা নিশ্চয় বোঝানোর জন্য প্রমাণ চাইবেন না!

(২) “The Watchtower Society” এক ধরনের অদ্ভুত সোসাইটি। এরা অনেকবার পৃথিবী ধ্বংসের তারিখ নির্ধারণ করছে। বারবার মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে, তবুও নিয়ম করে ভবিষ্যৎ বাণী আওড়াতে কখনো কার্পণ্য করেনি। আর এমন প্ররোচনাকারী সোসাইটিকে মানুষ বিশ্বাস করে এবং মানুষের এই অটুট বিশ্বাসের জন্য সোসাইটিটি আজও টিকে আছে। ১৮৭৪ সাল, ১৯৪১ সালে পৃথিবী ধ্বংসের ঘোষণা দিয়েছিলেন, নির্দিষ্ট দিন-তারিখ উল্লেখ করেই। আর বারবার সেই ভবিষ্যৎ বাণী ভণ্ডুল হয়েছে। অবশ্য এখন আর দিন-তারিখ নির্দিষ্ট করে ঘোষণা দেন না, একটু সুর পালটে শুধু “পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে”– এটুকু বলে ছেড়ে দেন। এখন ২০২১ সাল, পৃথিবী যেখানে ছিল সেখানেই আছে। ধ্বংস যে হয়নি সেটা নিশ্চয় বোঝানোর জন্য প্রমাণ চাইবেন না!

(৩) “Heavens Gate’ বা স্বর্গের দরজা বলে পরিচিত এটি এমন একটি সংস্থা, যাঁরা মনে করত পৃথিবীটা সম্পূর্ণ ভিন গ্রহের বাসিন্দা বা এলিয়েন দ্বারা পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। এমন কি সরকারের বেশির ভাগ মনুষই নাকি এলিয়েন! তারা মনে করেছিলেন, ১৯৯৭ সালে এক উল্কাকে অনুসরণ করে এলিয়েনরা পৃথিবীতে আসবে এবং পৃথিবীর সমস্ত মানুষদের ক্রীতদাসে পরিণত করবে। এই দাসত্ব থেকে মুক্তি পেতে একমাত্র উপায় হল আত্মহত্যা করা। এইসব ধারণা বিশ্বাস করে শতাধিক মানুষ আত্মহত্যা করেছিল সে সময়ে। না, ১৯৯৭ সালে পৃথিবীতে একজন এলিয়েন এসেও একজন মানুষকেও দাস করতে পারেনি। এখন ২০২১ সাল, পৃথিবী যেখানে ছিল সেখানেই আছে। ধ্বংস যে হয়নি সেটা নিশ্চয় বোঝানোর জন্য প্রমাণ চাইবেন না!

(৪) নস্ত্রাদামুস ছিলেন একজন বিখ্যাত গণক, যিনি তাঁর জীবনে অনেক ভবিষ্যৎ বাণী লিপিবদ্ধ করেছেন। তিনি অনেক বড়ো বড়ো ঘটনার ভবিষ্যৎ বাণী আগেই করে দিতেন অনেকে বিশ্বাস করেন। এনার লিপিবদ্ধ হেঁয়ালি পাঠ করে জ্ঞানীরা (?) মর্মোদ্ধার করেছিলেন, ১৯৯৯ সালে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। এখন ২০২১ সাল, পৃথিবী যেখানে ছিল সেখানেই আছে। ধ্বংস যে হয়নি সেটা নিশ্চয় বোঝানোর জন্য প্রমাণ চাইবেন না! নস্ত্রাদামুসের তথাকথিত ভবিষ্যৎ বাণী মুখ থুবড়ে পড়ে।

(৫) ওয়াই টু কে (Y2K) মনে পড়ছে? সালটা তখন ২০০০। ২০০০ সালে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে এই আশঙ্কা এবং আতঙ্ক নিয়েই জন্ম হল Y2K ধারণা। কোন ভবিষ্যৎদ্রষ্টা এই ভবিষ্যৎ বাণীর ঘোষক ছিলেন মনে পড়ছে না। যেটা মনে পড়ছে সেটা হল তৎকালীন সময়ে কম্পিউটারে ৯৯ সালের পরে পরের সাল, অর্থাৎ ২০০০ সাল উল্লেখ করা ছিল ০০ দিয়ে। অনেকে ধরে নেন ২০০০ সালে পৃথিবীর সব কম্পিউটার আপনা-আপনি অচল হয়ে যাবে। সযত্নে গচ্ছিত রাখা নিউক্লিয়ার বোমাগুলি এই বিগরে যাওয়া কম্পিউটারের জন্য নিক্ষেপিত হতে থাকবে। এই আতঙ্ক এতটাই ছিল যে, সাধারণ মানুষ তো বটেই, খোদ আমেরিকা সরকার খাদ্য মজুতকরণ, অস্তর মজুত, বিকল্প বিদ্যুৎ ব্যবস্থা, নিউক্লিয়ার বোমা দুর্ঘটনার পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবিলার সরঞ্জাম মজুত, পর্যাপ্ত অর্থ জমিয়ে ফেলা যাতে পরবর্তীতে দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা করা যায় ইত্যাদি। এত শ্রম সবই পণ্ড হল। ২০০০ সাল অতিক্রান্ত হয়ে এখন ২০২১ সাল, পৃথিবী যেখানে ছিল সেখানেই আছে। ধ্বংস যে হয়নি সেটা নিশ্চয় বোঝানোর জন্য প্রমাণ চাইবেন না!

(৬) ২০১৫ সালের ২৪ সেপ্টেম্বরে ধ্বংস হবে পৃথিবী। এমনটাই দাবি ছিল কন্সপিরাসি তাত্ত্বিকদের। তারা দাবি করছেন, তিন মাসের মধ্যেই ধ্বংস হতে চলেছে মানব সভ্যতা। ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৫ হয়ত আমাদের শেষ দিন। বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও ব্লগে প্রকাশিত হয়েছে পৃথিবী ধ্বংসের নতুন তথ্য। তাঁদের দাবি, ২০১৫ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর মহাকাশে পৃথিবীর সঙ্গে ধাক্কা লাগতে পারে একটি বড়ো গ্রহাণুর। আর এই আঘাতেই শুরু হবে প্রলয়। ধ্বংস হবে পৃথিবীর সাজানো বাগান। পৃথিবী ধ্বংসের এই খবর নাকি আছে পৃথিবীর শক্তিশালী রাষ্ট্রসমূহের কাছেও ছিল। এই বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচার জন্য সেইসব দেশের বেশকিছু ক্ষমতাবান ব্যক্তি ঘর গুছিয়ে নিচ্ছিলেন। এ বিষয়ে ফ্রান্সের পররাষ্ট্র মন্ত্রী লরেন্ত ফ্যাবিয়াস জানান, একটি বড়ো গ্রহাণু পৃথিবীকে আঘাত হানতে পারে। এর ধ্বংসযজ্ঞ হবে কল্পনাতীত। তবে এটি পৃথিবীতে আঘাত হানার আগেই এটিকে ভেঙে ছোটো ছোটো টুকরো করে ফেলার চেষ্টা করা হবে, যেন ক্ষতির পরিমাণ কমানো যায়। তিনি আরও জানান, এই গ্রহাণুটি আটলান্টিক মহাসাগরে আঘাত হানতে পারে। তবে এই তথ্য সম্পূর্ণরূপে উড়িয়ে দিয়েছিলেন নাসা। তারা সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন– “তাদের কাছে। পৃথিবীর সঙ্গে কোনো গ্রহাণু বা ধূমকেতুর সংঘর্ষ হওয়ার কোন খবর নেই। এমনকী আগামী একশো বছরেও এইরকম কিছু ঘটবে না।” এখন ২০২১ সাল, পৃথিবী যেখানে ছিল সেখানেই আছে। ধ্বংস যে হয়নি সেটা নিশ্চয় বোঝানোর জন্য প্রমাণ চাইবেন না!

(৭) এই তো সেদিনের কথা, ২০১২ সালের ২১ ডিসেম্বর– এ পর্যন্ত পৃথিবীর ধ্বংসের শেষতম দিন ঘোষণা হল। দামামা বেজে উঠল সমগ্র পৃথিবী জুড়ে। ফেসবুকের কল্যানে এমন একজন মানুষ ছিল না যে জানেন না। পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে এ সংবাদ ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে গেল। সেকি তুলকালাম কাণ্ড!!! এ নিয়ে আবার অনেকে কোরান শরিফের সঙ্গে সংখ্যার গুণ/ভাগ করে কত কিছুই-না বানিয়েও ফেলেছিল। এ নিয়ে “২০১২ এবং ইসলাম তথা ইসলাম তথা ১৪৩৩ আরো কিছু অজানা তথ্য” শিরোনামের লেখায় বিস্তর আলোচনাও হল। সব দোষ কিন্তু ওই মায়ানদের। তাদের ক্যালেন্ডার ২০১২ পর্যন্তই ছিল, অর্থাৎ ২০১২ সালের পরে আর কোনো সাল নেই। ২০১২ সালে পৃথিবী নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবেই বলেই পরের সালগুলি নেই। অবশ্য মায়ানদের এই ভবিষ্যৎ বাণী নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ ছিলই। অতএব এদের ভবিষ্যৎ বাণীও মিথ্যা প্রমাণিত হল।

(৮) ২০১৫ সাল। কেয়ামতের ঘড়িতে (ডুমসডে ক্লক) পৃথিবী ধ্বংস হতে আর মাত্র তিন মিনিট বাকি রয়েছে –এমনই খবর ছড়িয়ে পড়ল সারা পৃথিবীতে। ওই ঘড়ির কাঁটা তিন মিনিট পার হয়ে মধ্যরাতে, অর্থাৎ ১২টায় পৌঁছোলে মহাপ্রলয়ের মাধ্যমে নিশ্চিহ্ন হবে এ পৃথিবী! একই অবস্থানে রয়েছে কেয়ামতের ঘড়ির কাঁটাটি। সময়টা খুব কম, তা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। এ সময়ের মধ্যে পৃথিবীকে রক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না-নিলে, ঘড়ির কাঁটা পেছনে ফিরিয়ে

আনা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছিল বিশেষজ্ঞরা। বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানে দুটি পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপের দুই বছর পর ১৯৪৭ সালে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বুলেটিন অব দ্য অ্যাটমিক সাইন্টিস্ট’ ‘কেয়ামতের ঘড়িটি তৈরি করে। বুলেটিনের পরিচালক পর্ষদ এর দেখভাল করে। এ ঘড়িতে মধ্যরাত হতে যত সময় বাকি, সেটা দিয়ে পরমাণু অস্ত্র, পরিবেশ ও প্রযুক্তিগত হুমকির তীব্রতা বিবেচনা করা হয়। মধ্যরাত হওয়ার অর্থ পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়া। পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার ব্যাপারে ঐশ্বরিক কোনো প্রভাব এখানে বিবেচনা করা হয় না। ঘড়িটির নিয়ন্ত্রণকারীরা জানিয়েছিলেন, ঘড়ির কাঁটা মধ্যরাতের দিকে এগিয়ে আসছে, যা মানবজাতির ধ্বংসকে নির্দেশ করে। এটা সত্যিই মানুষের কবর রচনার মতো সংবাদ। বুলেটিন অব দ্য অ্যাটমিক সাইন্টিস্ট’-এর গবেষক লরন্সে ক্রায়াস বলেছিলেন, “আমরা যদি আমাদের পন্থা পরিবর্তন না করি, তাহলে আমরা মনে করি, মানবজাতি মারাত্মক বিপদের মধ্যে রয়েছে।” ওয়াশিংটন থেকে তিনি ঘোষণা দেন, কার্যকরী পদক্ষেপ এসব হুমকি কমাতে পারে। কিন্তু আমরা যদি সেগুলোকে (হুমকিগুলোকে) স্বীকৃতি দিই, তাহলে সত্যিই আমাদের সেগুলোর মুখোমুখি হতে হবে অচিরেই। ’ ‘বুলেটিন অব দ্য অ্যাটমিক সাইন্টিস্ট’-এর ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, ঘড়িটি স্থাপনের সময় মহাপ্রলয়ের সাত মিনিট বাকি ছিল। কিন্তু পরে পরমাণু ও মানুষের তৈরি হুমকি মোকাবিলায় বিশ্ব জোরালো পদক্ষেপ নেওয়ায় এর অবস্থান পিছনে চলে আসে বেশ কয়েকবার। কিন্তু বিশ্বে পরমাণুশক্তির ব্যবহার ও জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব বৃদ্ধি পাওয়ায় ‘কেয়ামতের ঘড়ির কাঁটা ফের সামনের দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করে। ওয়েবসাইট থেকে জানা গেছে, ২০১০ সাল পর্যন্ত ঘড়ির কাঁটা মধ্যরাতে পৌঁছাতে বাকি ছিল মাত্র পাঁচ মিনিট। কিন্তু ওই বছর মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভ পরমাণু অস্ত্র ধ্বংসের ব্যাপারে অঙ্গীকার ব্যক্ত করায় ঘড়ির কাঁটা এক মিনিট পিছিয়ে চলে আসে। তবে পারমাণবিক অস্ত্রাগার ও জলবায়ু পরিবর্তন রোধ করতে না-পারায় ২০১২ সালে ফের আগের অবস্থায় ফিরে আসে এটি। ২০১৫ সালে জলবায়ু পরিবর্তন ও যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়ার পারমাণবিক অস্ত্রের আধুনিকীকরণের ফলে ঘড়ির কাঁটা চলে আসে ১১টা ৫৭ মিনিটে। এখনও পৃথিবী যেখানে ছিল সেখানেই আছে।

(৯) ২১ মে ২০১১ সাল। পৃথিবীর আজই শেষ দিন। কারণ আজই পৃথিবী ধ্বংস হতে চলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের কিছু সংখ্যালঘু খ্রিষ্টান ধর্মপ্রচারক বাইবেলের উদ্ধৃতি দিয়ে এই ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। তাদের মতে ২০১১ সালের ২১ মে সন্ধ্যা ৬টায় পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। নিউইয়র্কজুড়ে ধর্মযাজক ও ধর্ম প্রচারকরা টি-শার্ট পরে ও ব্যানার-ফেস্টুন, বাইবেল, পোস্টার নিয়ে সমাবেশ করে সবাইকে সতর্ক করছেন। সমাবেশে অংশ নেওয়া ধর্ম প্রচারক ম্যানি বলেন, ‘বাইবেলের বুক অব রেভুলেশন’ অনুসারে ২১ মে সারা বিশ্ব প্রলয়ংকরী এক ভূমিকম্পে ধ্বংস হয়ে যাবে। তিনি বলেন, বিশ্বের সব স্থানে একই সময়ে ভূমিকম্পটি আঘাত হানবে কি না সে ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত নই। কারণ, পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে সময়ের তারতম্য রয়েছে। তবে তা একই সময়ে সংঘটিত হওয়ার কথা রয়েছে। ওদিকে বাইবেলের নানা সংখ্যাতাত্ত্বিক বিষয় বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করার পর হারল্ড ক্যাম্পিং (৮৯) পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার ব্যাপারে এ ভবিষ্যদ্বাণীটি করেছেন। তিনি এর আগেও ১৯৯৪ সালে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। তবে সেবার তার গণনা ভুল হয়েছিল বলে ক্ষমা চেয়েছিলেন তিনি। হারল্ডের অনুসারীরা আমেরিকার বিভিন্ন জায়গায় বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে পৃথিবী ধ্বংসের প্রচারণা চালাচ্ছেন। আর এ ঘটনায় বিশ্বাসীদের দলে যোগ দিয়েছেন ১ লাখ ২৫ হাজারেরও বেশি মানুষ। এদিকে পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার ক্যাম্পিং শেষ দিনটি তার উত্তর ক্যালিফোর্নিয়ার বাড়িতে স্ত্রীর সঙ্গে কাটানোর পরিকল্পনা করছেন। তিনি বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন জায়গার খবর দেখতে আমি টেলিভিশনে চোখ রাখব সেদিন। হারল্ড ক্যাম্পিং ভবিষ্যদ্বাণীর পিছনে কিছু যুক্তি দাঁড় করিয়েছেন। যার মধ্যে আছে সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণও। খ্রিস্ট ধর্মানুসারীদের ধর্মগ্রন্থ বাইবেলে একটি খণ্ড জেনেসিসে উল্লেখ রয়েছে, খ্রিস্টপূর্ব ৪৯৯০ অব্দে নূহের সময়কালে পৃথিবীতে একটি মহাপ্লাবন সংঘটিত হয়েছিল। ঈশ্বর সে সময় নূহকে বলেছিলেন, ৭ দিনে তিনি পৃথিবী ধ্বংস করবেন। এদিকে বাইবেলের অপর একটি খণ্ড ২ পিটার ৩:৮ এ বলা হয়েছে, পৃথিবীর এক হাজার বছর ঈশ্বরের এক দিনের সমান। ক্যাম্পিং এ যুক্তি দেখিয়ে বলেন, মহাপ্লাবনের সময় থেকে এ পর্যন্ত ৭ হাজার বছর পার হয়ে গেছে। আর ঈশ্বর ৭ দিনে পৃথিবী ধ্বংসের ঘোষণা দিয়েছিলেন। সে হিসাবে ১ হাজার বছর ঈশ্বরের ১ দিনের সমান হলে ৭ হাজার বছর নিশ্চয়ই ৭ দিনের সমান হবে। খ্রিস্টপূর্ব ৪৯৯০ অব্দের সঙ্গে ২০১১ খ্রিস্টাব্দ যোগ করলে দাঁড়ায় ৭ হাজার বছর। আরও এক জটিল গণনার হিসাবে হারল্ড ক্যাম্পিং আজই অর্থাৎ ২১ মে ২০১১ সালকেই পৃথিবী ধ্বংসের দিন বলে চিহ্নিত করেন। তবে বহু খ্রিস্টান ধর্মযাজক ও অনুসারীকে তার এ গণনাকে অমূলক বলে দাবি করেছিলেন। এখন ২০২১ সাল, পৃথিবী যেখানে ছিল সেখানেই আছে। ধ্বংস যে। হয়নি সেটা নিশ্চয় বোঝানোর জন্য প্রমাণ চাইবেন না!

(১০) সুদূরের জন্য একটি ভবিষ্যৎ বাণী উচ্চারিত হয়ে আছে। এতদিন আমি অবশ্যই বেঁচে থাকব না, যাঁরা ভবিষ্যৎ বাণী শোনাচ্ছেন তাঁরাও বেঁচে থাকবেন না। ৩৭৯৭ সাল। ধ্বংস হবে পৃথিবী! অন্য গ্রহে বাসা বাঁধবে মানুষ। এই ভবিষ্যদ্বাণীটি অবশ্য জনৈক ‘বাবা ভাঙা’-র। তাঁকে নাকি বলা হয় ‘এ যুগের নস্ত্রাদামুস’। ২০ বছর আগে তিনি মারা গিয়েছেন। কিন্তু আইএস-এর উত্থান বা টুইন টাওয়ারের হামলার কথা নাকি তিনি বলে গিয়েছিলেন। বাবা ভাঙা যা বলে গিয়েছেন, তার মধ্যে থেকেই তুলে ধরা হল কয়েকটি। মিলিয়ে নিন।

(১) বারাক হুসেন ওবামাই হবেন আমেরিকার শেষ প্রেসিডেন্ট।

(২) ২০১৬ সালেই ইউরোপ শেষ হয়ে যাবে। রাসায়নিক অস্ত্রে ইউরোপকে শেষ করে দেবে সন্ত্রাসীরা।

(৩) ইউরোপ ছেয়ে ফেলবে মুসলিম জঙ্গিরা। আর এই সন্ত্রাসের সূত্রপাত হবে সিরিয়ায়।

(৪) ২০১৮ সালের মধ্যে সুপারপাওয়ার হিসাবে উত্থান হবে চিনের। পর্যন্ত হবে আমেরিকা।

(৫) ২০২৫ থেকে ২০২৮ সালের মধ্যে পৃথিবী থেকে ক্ষুধা দূর হবে।

(৬) শুক্র গ্রহে বাসা বাঁধবে মানুষ।

(৭) ২০৪৫ সালের মধ্যে মেরু অঞ্চলের আইসক্যাপ গলে যাবে।

(৮) ২০৭৬ সালে কমিউনিজম ফিরবে পুরোদস্তুর।

(৯) ২১৩০ সালের মধ্যে জলের তলায় বসবাস শুরু করবে মানুষ।

(১০) ৩৭৯৭ সালে ধ্বংস হবে পৃথিবী। ততদিনে অবশ্য অন্য গ্রহে থাকতে শুরু করবে মানুষ। সত্য/মিথ্যার সাক্ষী থাকুন আপনি। সময় তো আছেই।

হাত দেখা বা হস্তরেখা বিচার সম্ভবত জ্যোতিষীবাবুদের মধ্যে সবচেয়ে জয়প্রিয়তম ব্যবস্থা। জাতকরাও কেউ হাত দেখতে জানে জানতে পারলে তার দিকে নিজের হাত বাড়িয়ে দিতে এক সেকেন্ডও দেরি করেন না। অবশ্য এই ‘হস্তরেখা বিচার’ পদ্ধতির পুষ্টিলাভ খুব বেশিদিনের কথা নয়। পঞচদশ শতকে হস্তরেখা বিদ্যার উপর কিছু পরিমাণ বিক্ষিপ্তভাবে লেখালেখি হলেও মূলগতভাবে এই বিদ্যার রমরমা শুরু ঊনবিংশ শতাব্দীতে। মহাভারতের যুগেও অনুমান করেই ভবিষ্যৎ বাণী করা হত। শকুন্তলাকে দুর্বাসাও ভবিষ্যৎ বাণী দিয়েছিল, যা অভিশাপ বলেই বিদিত। দুর্বাসা জানতেন রাজা দুষ্যন্ত জন্ম-পরিচয়হীন শকুন্তলাকে স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করবে না। করার কথাও নয়। কারণ একজন বনবাসীকে কিছুতেই রাজপরিবারে জায়গা দিতে পারে না। সামাজিক অবস্থান তো ভিন্ন মেরুতে।

যাই হোক, হাত দেখার মহিমাই অপরিসীম। বন্ধুমহলে বেশ কদর পাওয়া যায়। অফিসের বসকেও খুব সহজে কবজা করা যায় হাত দেখে পজিটিভ বাণী শুনিয়ে। বিনা মূলধনে বিনা পরিশ্রমে টু-পাইস কামানোর সুযোগ হাতছাড়া করা যায়! কী আছে হাতে? কী দেখা হয় হাতে? হাতে কী অতীত-বর্তমান ভবিষ্যৎ লেখা থাকে? জ্যোতিষীবাবুরা তো সেটাই বলে, হাতে লেখা থাকে! শুধু হাতেই নয়– কপাল, হাতের কবজি, শরীরের তিল, পায়ের রেখা সবেতেই নাকি অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ লেখা থাকে। গতকাল এবং আগামীকাল, ভূত এবং ভবিষ্যৎ– যত গণ্ডগোল তো এখান থেকেই, আদিকাল থেকেই। ‘ভূত’ শব্দটি বস্তুত দুটি অর্থে ব্যবহৃত হলেও ব্যঞ্জনা প্রায় কাছাকাছিই। একটি অর্থ। ‘অতীত’, অন্যটি হল ‘প্রেত-প্রতিনী’, ‘প্রেত-প্রতিনী’ তো যিনি অতীত বা মৃত হয়েছেন তার অশরীরী। আমরা ভূত জেনে অবাক হই, বর্তমান জেনে খুশি হই এবং ভবিষ্যৎ জেনে আতঙ্কিত হতে ভালোবাসি। পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে না হলেও অতীত আমাদের মনে থাকে অনেকটাই, আমরা তাই জন্য স্মৃতিচারণ করতে পারি। আমার অতীত জানতে আমি জ্যোতিষবাবুর কাছে যাব কেন! জ্যোতিষীবাবুরা মানুষের সেই অতীতই বলে থাকেন, সেগুলি সকলের জন্য খুবই কমন (Common)। আপনার মনে হয় উনি আপনার ‘অতীত’ বলতে পারলেন। আপনি ভয়ে সিঁটিয়ে থাকলেন, এই বুঝি অতীতে করা আপনার অপকর্মগুলিও বলে ফেলল! তবুও বারাবার জ্যোতিষীর কাছে যাই, গিয়ে একবার ঝালিয়ে নিই। আপনার মতে না মিললে সেই জ্যোতিষী খারাপ, অন্য ‘বিখ্যাত’ জ্যোতিষীর শরণাপন্ন হবেন নিশ্চয়। আর মতে মিললে তো ভগবান– আপনি সব উজার করে দিতে রাজি হয়ে যান। বস্তুত সব জ্যোতিষীর মধ্যে ওই ‘মেলানোর’ পারদর্শিতা বা অভিজ্ঞতা বা দক্ষতা থাকে না।

কীভাবে? বলব। আমি তো আমার কথা বলব, যুক্তিবাদীদের কথা বলব, বিজ্ঞানের কথা বলব। তার আগে জ্যোতিষীবাবুদের বক্তব্য শুনব না কি করে হবে?

জ্যোতিষীবাবুরা বলেন– “জ্যোতিষ একটি ঐশ্বরিক ব্যাপার। আসলে এটা কোন মত পোষণ করা বা বিশ্বাসের ব্যাপার নয়। জ্যোতিষে এমন কিছু বিষয় আছে, যা চট করে দেখলে একেবারেই মন-গড়া, বা বানানো মনে হয়। অথচ সেগুলিই বাস্তবে খুব ভালো মতো কাজ করে বা ফল দেয়। যেমন, রাশিচক্রের বিন্যাসের (Arrangement) ব্যাপারটি বলা যেতে পারে। জ্যোতিষে ৯টি গ্রহ বিশ্লেষণ করা হয়। এর মধ্যে আসল গ্রহ ৫টি– বুধ, শুক্র, মঙ্গল, শনি, এবং বৃহস্পতি। সূর্য ও চাঁদকেও ‘গ্রহ’ নামে ডাকা হয়। এছাড়া রাহু ও কেতু নামে দুটো অবস্থানগত বিন্দুকেও (Positional Points) গ্রহ ধরে মোট ৯টি ‘গ্রহ’ পাওয়া যায়। এদেরকে ‘নবগ্রহ’ বলা হয়। এই নবগ্রহের মধ্যে সূর্য ও চাঁদের অবশ্যই একটা আলাদা অবস্থান বা গুরুত্ব আছে। কেননা সূর্য আসলে গ্রহ নয়, বরং নক্ষত্র। সব গ্রহগুলির চেয়ে বহুগুণ বড়ো হওয়াতে এর একটা আলাদা প্রভাব আছে। সৌরজগতের সব গ্রহগুলি সূর্যকে কেন্দ্র করেই ঘুরছে। তাছাড়া পৃথিবীতে দিন-রাত, ঋতু পরিবর্তন ইত্যাদিতে সূর্যের এমন প্রভাব আছে, যা অন্য কারও নেই। আবার চাঁদ গ্রহদের থেকে ছোটো হলেও, পৃথিবীর সবচেয়ে কাছে হওয়ার জন্য এর আলাদা এক রকম প্রভাব আছে, যা জোয়ারভাটা, মানুষের শরীরের বাত, আরও বিভিন্ন বিষয়ে কাজ করে। সুতরাং সূর্য ও চাঁদের এমন একটা অবস্থান বা প্রভাব আছে, যা বুধ, শুক্র, শনি ইত্যাদির নেই। রাশিচক্রে ১২টি রাশির প্রত্যেকটি রাশি কোন না-কোন গ্রহের মালিকানাধীন। আপনার যে রাশিই হোক না-কেন, তার একটি মালিক বা অধিপতি (owner) আছে বলে রাশিচক্রের বইয়ে বা পত্রিকাতে পাবেন। রাহু কেতু অবস্থানগত বিন্দু, তাদের আসলে কোনো দৃশ্যমান কাঠামো (Physical Structure) নেই। তাই তারা সেভাবে কোনো রাশির মালিক নয়। বাকি ৭টা গ্রহ এই ১২টি রাশির মালিক। আবার, রাহু-কেতু বাদে এই ৭টা গ্রহ, সপ্তাহের ৭টা দিনেরও মালিক। এবং সেই সেই দিনে সেই সেই গ্রহের প্রভাব, বাস্তব জীবনে খুব পরিষ্কারভাবে দেখা যায়। ১২টি রাশিকে কীভাবে ৭টি গ্রহের মধ্যে ভাগ করা যায়? প্রত্যেক গ্রহ ২টি করে রাশি পেলে রাশি দরকার ১৪টি, আবার ১টি করে হলে ৭টি গ্রহের ৭টি রাশি পাওয়ার পর আরও ৫টি থেকে যায়। তাহলে? জ্যোতিষে বিষয়টির সুরাহা করা হল এভাবে– সূর্য ও চাঁদ যেহেতু ৭টি গ্রহের মধ্যে একটু আলাদা (Special), এদেরকে ১২টি রাশি থেকে ১টি করে রাশি দেওয়া হোক (মোট ২টি)। আর বাকি থাকল ১০টা, এই ১০টা রাশি বাকি ৫টি গ্রহের মধ্যে ২টি করে ভাগ করে দেওয়া হোক। তাহলে সূর্য ও চাঁদ = ১ + ১ = ২, আর বাকি ৫টি গ্রহ ২টি করে = ৫ x ২ = ১০, মোট ২ + ১০ = ১২, মিলে গেল। বিষয়টি খুব সাধারণ, মনে হয় কোন একটা ঘরোয়া আলোচনায় ভাগ-বাটোয়ারা করা হয়েছে। কিন্তু এটাই বাস্তব জীবনে খেটে যায়। কেননা এটাই জ্যোতিষের ভিত্তি, আর সব হিসাব-নিকাশ এর উপর ভিত্তি করেই করা হয়। তাই এটা ঠিক না-হলে, কোনো কিছুই মিলত না। এখন, রাশির বিন্যাস (Positioning/Arrangement) কীভাবে করা হবে? এটাও এমন একটা ব্যাপার, দেখলে মনে হবে কারও বানানো বা কল্পনাপ্রসূত, কিন্তু এটাই বাস্তবে খেটে যায়। কীভাবে দৃশ্যমান ভৌত শরীর (physical body) -থাকায় রাহু-কেতুকে রাশির মালিকানা না-দেওয়া, এরপর বাকি ৭টি গ্রহের মধ্যে সূর্য ও চাঁদকে আলাদা বিবেচনা করে ১টি করে রাশি দিয়ে এরপর দু-পাশে একই গ্রহের ১টি করে রাশি বসিয়ে বসিয়ে সম্পূর্ণ রাশিচক্রটি (Zodiac) সাজানো বা বিন্যাস করা (Arrange) একেবারেই মানুষ বা অন্য কারও বানানো মনে হয়, যা খুব সাধারণ বিবেচনা নিয়ে (Casually) করা হয়েছে। এতে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, গণিত, ইত্যাদির মতো কোনো জটিলতা নেই। তাই দেখে যদিও মনগড়া মনে হয়, এই জিনিসটাই বাস্তবে মিলে যায়, বা খেটে যায়। এটা অবশ্যই একটা ঐশ্বরিকত্ব।” আধুনিক তত্ত্বের সঙ্গে জ্যোতিষের তত্ত্বকে মেলানোর ব্যর্থ চেষ্টা করেছেন। ইনি বাংলাদেশে বসবাসকারী বহু প্রচারিত এক জ্যোতিষীবাবু। এনার একটি ওয়েব সাইটও আছে বটে, জ্যোতিষের সমর্থনে প্রবন্ধ-ট্রবন্ধও লেখেন লেখকের নাম-পরিচয় ছাড়াই।

ভারত তথা হিন্দুধর্মের মানুষদের মধ্যেই জ্যোতিষচর্চা খুব বেশি প্রচলন। বস্তুত ব্রাহ্মণ তথা মুনিঋষিরাই ভবিষ্যৎ বলার কাজটা করতেন। ভারতে জ্যোতিষচর্চা মূলত ব্রাহ্মণ্যবাদের হাত ধরেই এসেছে। একটু নজর রাখলেই জানতে পারবেন জোতিষীদের একটা বড়ো অংশই ব্রাহ্মণসম্প্রদায়ের। একমাত্র ভারতেই ঘরে ঘরে জ্যোতিষী পাওয়া যায়। পশ্চিমবঙ্গে তো জ্যোতিষ-ব্যাবসা কুটিরশিল্প পর্যায়ে চলে গেছে। যিনি হাত-পা দেখেন তিনিও জ্যোতিষী, যিনি হাত-পা দেখান তিনিও জ্যোতিষী। খ্রিস্টানদের মধ্যেও এ বিদ্যা চর্চা অল্পবিস্তর আছে। তবে মুসলিমদের মধ্যে ধর্মীয়ভাবে জ্যোতিষচর্চা নিষিদ্ধ। নক্ষত্র ও গ্রহ সংক্রান্ত গণনা অর্থাৎ জ্যোতিষচর্চাকে পূর্ববর্তী মুসলিম পণ্ডিতেরা সামগ্রিকভাবে ‘তানজিম’ বলে অভিহিত করেন। সমগ্র বিশ্ব যেহেতু জ্যোতিষ্কমণ্ডলীর প্রভাবে প্রভাবিত, তাই ভবিষ্যতে ঘটবে এমন সব ঘটনাসমূহ সংঘটিত হওয়ার পূর্বে জ্যোতিষ্কমণ্ডলীর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করে প্রকাশ করা সম্ভব। এটা বিশ্বাস করা সর্বসম্মতিক্রমে বড়ো ধরনের কুফরি এবং ইব্রাহিম এর জাতির শিরকের মতো শিরক। “যে ব্যক্তি কোনো গণক তথা ভবিষ্যদ্বক্তার কাছে গেল, অতঃপর তাকে (ভাগ্য সম্পর্কে) কিছু জিজ্ঞেস করল অমনি ৪০ দিন পর্যন্ত তার সালাত কবুল হবে না।” (সহিহ মুসলিম ২২৩, মুসনাদ আহমাদ ৪/৬৭)। গণক বা জ্যেতিষীদের কথা বিশ্বাস করা আল্লাহর সঙ্গে কুফরি করার নামান্তর জাদুবিদ্যা শিক্ষা করা, শিক্ষা দেওয়া কুফরি গোনাহ বা পাপ। যে সাতটি জিনিস মানুষকে ধ্বংস করে তার মধ্যে একটি হচ্ছে জাদু। আল্লাহ বলেন, “যে বিষয়ে তোমার নিশ্চিত কোনো জ্ঞান নেই, তার পিছনে ধাবিত হোয়য়া না। নিশ্চয়ই কান, চোখ ও অন্তঃকরণ এদের প্রত্যেকটি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে।” (বনি ইসরাঈল ৩৬)। আল্লাহ আরও বলেন –“জাদুকর যেখানেই থাকুক সফল হবে না।” (ত্বহা ৬৯)। পক্ষান্তরে কেউ সত্যায়ন না করে, তাদের নিকট অভিজ্ঞতা লাভের জন্য বা পরখ করার জন্য গেলে এটা কুফরের পর্যায়ভূক্ত নয়, কিন্তু ৪০ দিন পর্যন্ত তার নামাজ ও ইবাদ কবুল হবে না। এ সম্পর্কে রাসুলাল্লাহ বলেছেন– “যারা গণক কিংবা এই জাতীয় লোকের নিকট গিয়ে কোনো কিছু জানতে চাইবে, ৪০ দিন পর্যন্ত তাদের নামাজ কবুল হবে না।” (মুসলিম শরিফ) জ্যোতিষীর কাছে যাওয়া, হাত দেখানো তাঁর কথা বিশ্বাস করা একেবারে নাজায়েজ।

ইসলাম মতে, গ্রহ-নক্ষত্রের প্রভাবে বৃষ্টি হওয়ার কথা বিশ্বাস করা যেমন কুফরি, তেমনি পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত রাশিফলের আশ্রয় নেওয়াও কুফরি। যে ব্যক্তি রাশিফলের উপর গ্রহ-নক্ষত্রের প্রভাবের কথা বিশ্বাস করবে, সে সরাসরি মুশরিক হয়ে যাবে। পত্র-পত্রিকা ও বইপত্রে রাশিফলের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে সেগুলি পাঠ করা শিরক। তবে বিশ্বাস না-করে কেবল মানসিক সান্ত্বনা অর্জনের জন্য পড়লে তাতে শিরক হবে না বটে, কিন্তু সে গোনাহগার হবে। কেন-না শিরকি কোনো কিছু পাঠ করে সান্ত্বনা লাভ করা বৈধ নয়। তা ছাড়া শয়তান কর্তৃক তার মনে উক্ত বিশ্বাস জন্মিয়ে দিতে কতক্ষণ? তখন এ পড়াই তার শিরকের মাধ্যম হয়ে দাঁড়াবে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন– “গণকের নিকটে কোনো ব্যক্তি গমন করে যদি তাকে কিছু সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে, তাহলে ৪০ দিন ও ৪০ রাত পর্যন্ত তাঁর সলাত কবুল হবে না।” (সহিহ মুসলিম)। “যদি কেউ গণকের বা জ্যোতিষীর নিকট গমন করে তাঁর কথায় বিশ্বাস করল, তাহলে সে মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর অবতীর্ণ বিষয়কে অবিশ্বাস করল।” (সুনান আবু দাউদ)। হাদিসগুলিতে দৈব জ্ঞানের দাবিদার, গণক, জাদুকর ও তদনুরূপ লোকদের কাছে আসতে এবং তাদেরকে কোনো কিছু জিজ্ঞেস করতে ও তাদের বক্তব্য সত্য বলে বিশ্বাস করতে নিষেধ করা হয়েছে এবং এ ব্যাপারে ভয় প্রদর্শন ও করা হয়েছে। সুতরাং শাসকবর্গ ও মানুষকে সৎ কাজের আদেশদানের এবং অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখার দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ –যাদের হাতে ক্ষমতা ও শক্তি রয়েছে, তাদের প্রত্যেকেরই উচিত গণক, দৈব জ্ঞানের দাবিদার ও অনুরূপ পেশাজীবীদের কাছে আসতে লোকদের নিষেধ করা, হাটে-বাজারে ও অন্যত্র যেকোনো ধরনের দৈবজ্ঞান আদানপ্রদান নিষিদ্ধ করা, দৈবজ্ঞ ও তাদের কাছে যারা আসে সবার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা। তাদের কথা কোনো কোনো ব্যাপারে সত্য বলে প্রমাণিত হওয়ার ফলে এবং এক শ্রেণির লোক তাদের কাছে বেশি আনাগোনা করার ফলে তাদের দ্বারা কারও প্রতারিত হওয়া ঠিক নয়। কারণ ওই শ্রেণির লোকেরা মূলত মূর্খ। তাই তাদের দ্বারা প্রতারিত হওয়া অনুচিত। কেননা এতে গুরুতর পাপ, মহাবিপদ ও খারাপ পরিণতি থাকায় এবং যারা এসব কাজে লিপ্ত তারা মিথ্যাবাদী ও দুষ্ট প্রকৃতির লোক হওয়ায় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের কাছে আসতে, প্রশ্ন করতে এবং তাদেরকে সত্যবাদী হিসাবে প্রতিপন্ন করতে নিষেধ করেছেন। অনুরূপভাবে আলোচ্য হাদিসগুলিতে এও প্রমাণিত হয় যে, গণক ও জাদুকররা কাফির। কেননা তারা অদৃশ্য জ্ঞানের অধিকারী হওয়ার দাবি করছে, যা কি না কুফুরি। তদুপরি তারা আল্লাহকে ছেড়ে জিনের সেবা ও ইবাদাঁতের মাধ্যমেই তাদের উদ্দেশ্য সাধন করছে। অথচ এ কাজও কুফুরি এবং আল্লাহর সঙ্গে শরিক করারই নামান্তর। যে ব্যক্তি তাদের অদৃশ্য জ্ঞানের দাবিকে সত্য প্রতিপন্ন করে সে ও তাদেরই অনুরূপ। আর যেসব ব্যক্তি এ বিষয়গুলি এমন লোকদের কাছ থেকে গ্রহণ করে, যারা তা পরস্পর আদানপ্রদান করে থাকে, সে সব ব্যক্তির সঙ্গে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোনো সম্পর্ক নেই। এসব লোক যাকে চিকিৎসা বলে ধারণা করে থাকে, তাকে মেনে নেওয়া ও গ্রহণ করা কোনো মুসলিমের জন্য জায়েজ নেই। যেমন বিড়বিড় করে মন্ত্রোচ্চারণ কিংবা জলে ইস্পাত চুবানো ইত্যাদি আরও অনেক কুসংস্কার যা তারা করে থাকে, তার কোনোটাই জায়েজ নয়। কেননা তা দৈবকর্ম চর্চা ও মানুষকে বিভ্রান্ত করারই নামান্তর। এসব ব্যাপারগুলোকে যারা মেনে নেয়, তারা মূলত এ লোকদেরকে তাদের বাতিল ও কুফুরি কাজে সহযোগিতা করল। অনুরূপভাবে কোনো মুসলিম ব্যক্তির জন্য জ্যোতিষী ও দৈবজ্ঞানের দাবিদারদের কাছে গিয়ে একথা জিজ্ঞেস করা জায়েজ নেই যে, তার ছেলে কিংবা তার কোন আত্মীয় কাকে বিয়ে করবে? কিংবা স্বামী-স্ত্রী ও তাদের উভয়ের পরিবারে ভালবাসা ও মিল-মহব্বত হবে নাকি শত্রুতা ও দূরত্বের সৃষ্টি হবে ইত্যাদি। কেন-না এসব সে গায়েবি ও অদৃশ্য জ্ঞানেরই অন্তর্গত যা শুধু মহান আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না। সকল মুসলিম মনীষীদের সর্বসম্মত মতানুযায়ী চিকিৎসা গ্রহণ বৈধ। আর যে কোনো মুসলিম ব্যক্তিরই অধিকার রয়েছে যে, সে অভ্যন্তরীণ রোগের ডাক্তার কিংবা শৈল চিকিৎসক অথবা মানসিক রোগের ডাক্তার কিংবা অনুরূপ যে কারও কাছে যেতে পারে, যাতে তিনি তার রোগব্যাধি চিহ্নিত করে চিকিৎসাশাস্ত্রে তার জ্ঞান অনুযায়ী শরিয়ত কর্তৃক অনুমোদিত পথ্য দ্বারা তার চিকিৎসা করেন। কেননা এটা সাধারণ বৈধ পন্থাগুলিরই অবলম্বনেরই অন্তর্গত। উপরন্তু এ ধরনের পন্থাবলম্বন আল্লাহর উপর নির্ভরতার পরিপন্থী নয়। কারণ আল্লাহ রোগ দিয়েছেন এবং সে রোগ নিরাময়ের ঔষধও বাতলে দিয়েছেন। যার জানার সে তা জেনেছে এবং যে জানেনি, এ পথ্য তার অজ্ঞাতই থেকে গেছে। অবশ্য আল্লাহ বান্দার উপর হারাম করেছেন এমন কোনো বস্তুকে তার রোগ নিরাময়ের উপায় নির্ধারণ করেননি। সুতরাং অসুস্থ ব্যক্তির জন্য সেই সব গণক, জ্যোতিষী ও দৈবজ্ঞদের কাছে যাওয়া বৈধ নয়, যারা দাবি করে যে, তাদের কাছে অসুস্থ ব্যক্তির রোগ চিহ্নিত করার গায়েবি জ্ঞান আছে। অনুরূপ অসুস্থ ব্যক্তির জন্যও এসব গণক ও দৈবজ্ঞদের দেওয়া তথ্য ও সংবাদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা বৈধ নয়। কেননা তারা গায়েবি বিষয়ে অনুমানের উপর ভিত্তি করেই এসব বলে থাকে কিংবা তারা তাদের ঈপ্সিত বিষয়ে সাহায্য নেওয়ার জন্য জিনদের হাজির করে থাকে। তার মানে এই নয় যে মুসলিমরা জ্যোতিষচর্চা করেন না। জ্যোতিষীদের চেম্বারে মুসলিম জাতকরাও গ্রহশান্তির জন্য আসেন। রত্ন ধারণও করেন। মুসলিম দেশে হয় কি না আমার জানা নেই। তবে ভারতে এক-আধজন মুসলিম জ্যোতিষী পাওয়া যায়। পিরবাবাদের আমি ভবিষ্যৎ বাণী শোনাতে দেখেছি। ধর্ম ধর্মের জায়গায় আছে, ব্যাবসা ব্যাবসার জায়গায়।

জ্যোতিষশাস্ত্র চর্চায় মুসলমানদের বেশ সুনাম অদ্যাবধি কাল থেকেই আছে। পেশাগত জীবনযাপনের তাগিদে এবং স্থল ও জলপথে বাণিজ্য কার্যক্রম পরিচালনার জন্য তাদের প্রয়োজন হত আকাশের গ্রহ-তারকাদের অবস্থান জানার। মুসলমানদের বিজ্ঞানে অগ্রসরতা এবং সপ্তম শতক হতে পনেরো শতক পর্যন্ত যে সকল মুসলমান বিদূষী জ্ঞান-বিজ্ঞানের শাখায় প্রভূত অবদান রেখেছেন তারা আর যে বিষয়ই নিয়েই পড়ে থাকুন না-কেন, তারা সবাই কিছু-কিছু অবদান রেখেছেন এই জ্যোতিষশাস্ত্র বিজ্ঞানে। তারা গবেষণা করে গেছেন আর লিখেছেন একের পর এক বই।

আত্মবিশ্বাসহীন মানুষ আত্মনিবেদন করতে শেখে। আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে গর্ব অনুভব করে, দুঃখ-যন্ত্রণা-বঞ্চনাকে ভুলে থাকতে শেখে। এরা লড়াই জানে না, লড়াই দেখলে ভীত হয়। এমতাবস্থায় অদৃষ্ট বা নিয়তির শরণাপন্ন হয়। জেগে ওঠে জ্যোতিষ এবং জ্যোতিষীবাবুরা। হাত বড়িয়ে দেয়– একপক্ষে

জ্যোতিষীবাবুর হাত, অপরপক্ষে জাতকের হাত। কী আছে হাতে? রেখা? রেখায় কী আছে? আছে স্বল্প রেখাযুক্ত পরিষ্কার হাত এবং বহু সূক্ষ্ম রেখাযুক্ত হাত। লালচে হাত, গোলাপি হাত, সাদাটে হাত, হলদেটে হাত। আছে চওড়া তালু, বেঁটে ও মোটা আঙুল, কুশ্রী নখ। আছে চৌকো হাত, চৌকো হাতে লম্বা আঙুল, দার্শনিক হাত, শিল্পী হাত, আধ্যাত্মিক হাত। আছে নমনীয় বুড়ো আঙুল, অনমনীয় বুড়ো আঙুল। খুব লম্বা নখ, খুব লম্বা ও সরু নখ, খুব লম্বা নীলচে অথবা মলিন বর্ণের চোখ, ছোটো নীলচে নখ, ছোটো গোলাকার নখ, ছোটো অথচ নখের তলার দিকটা চ্যাপটা, ছোটো অথচ নখের তলার দিকে সাদা। চাঁদ, শরীরের ভিতর গভীরভাবে চেপে বসা চ্যাপটা নখ, নখে সাদা দাগ ইত্যাদি।

এমন কোনো মানুষ নেই যাঁর হাতে ভাঁজ বা কোঁচকানো দাগ বা রেখা নেই। কারোর ঘন দাগ, কারোর-বা অনেকটা ফাঁকা ফাঁকা। এইসব দাগগুলি আবার বিভিন্ন নামে পরিচয় আছে। যেমন–আয়ুরেখা, হৃদয়রেখা, ভাগ্যরেখা, রবিরেখা, বিবাহরেখা ইত্যাদি। এছাড়া হাতের উঁচুনীচু অংশগুলিতে আছে গ্রহস্থল– মানে কোথায় রবি অবস্থান করছে, কোথায় মঙ্গল অবস্থান করছে, কোথায় রাহু অবস্থান করছে ইত্যাদি। হাতের রং দেখেও জ্যোতিষবাবুরা ভাগ্যগণনা করে থাকেন। আছে তারা চিহ্ন, ক্রশ চিহ্ন, চতুষ্কোণ, যব বা দ্বীপ চিহ্ন, বৃত্ত বা চক্র চিহ্ন, ত্রিশূল, জাল চিহ্ন ইত্যাদি– এইসব চিহ্নগুলিও অনেক ভবিষ্যৎবার্তা দেয় বলে জ্যোতিষবাবুরা নিদান দেন।

মানুষের হাতের তালুতে থাকা যেসব ছাই-ছাতার উপর জ্যোতিষবাবুরা ভূত-ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারেন বলে দাবি করেন সেগুলি আসলে কী? মানুষই একমাত্র প্রাণী যারা হাতের তালু মুঠো করতে পারে। হাতের তালু মুঠো করতে পারার কারণ তালুর এই ভাঁজগুলি। এই ভাঁজগুলি (গভীর রেখা ও সূক্ষ্ম রেখা) প্রাথমিকভাবে মানুষের মাতৃগর্ভে থাকাকালীনই তৈরি হয়। শিশু মায়ের গর্ভে যখন থাকে তখন তার হাত মুষ্ঠিবদ্ধ অবস্থায় থাকে। ভ্রূণ অবস্থায় শিশুর চামড়া ও মাংসপেশি সাত/আট সপ্তাহ নাগাদ তৈরি হয়। এই অবস্থায় মাংসপেশিতে জলের পরিমাণ যথেষ্ট বেশি থাকে। এরপর আস্তে আস্তে যতই মাংসপেশিগুলিতে জলের পরিমাণ কমতে থাকে ততই সংকোচনের ফলে মাংসপেশির উপর টান হয়ে এঁটে থাকা চামড়া ক্রমশ শিথিল হতে থাকে এবং কুঁচকে যেতে থাকে। ফলে হাতের তালুর চামড়ার বিভিন্ন জায়গায় ভাঁজ পড়ে যায়। শিশুর বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শিশুর মুষ্ঠিবদ্ধ হাতে এই কোঁচকানো চামড়াই দাগ হিসাবে দেখি। এ দাগ ব্যক্তির মৃত্যু পরও থাকে। পেশিতন্তুর সংকোচনে। তৈরি হয় সূক্ষ্মরেখা এবং দুটি পেশি-অংশের সংযোগস্থলে সৃষ্টি হয় গভীর রেখা। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হাতের তালুতে চামড়ার নীচের মাংসপেশির সংকোচন প্রসারণের উপর নির্ভর করে হাতের তালুতে ছোটো ছোটো রেখা তৈরি হয়। মানুষের শরীরের যে অংশ সবচেয়ে বেশি ফোল্ড হয় এবং নড়াচড়া হয়, তা হল হাতের তালু, সে কারণে হাতের তালুতেই এত ভাঁজ সৃষ্টি হয়। যদি হাতের তালুর মতো পায়ের তালুও ভাঁজ করার প্রয়োজন হত, তাহলে পায়েও এরকম দাগ আমরা পেতাম। মানুষ ছাড়াও গেরিলা, বাঁদর, শিম্পাঞ্জী গোত্রীয় প্রাণীদের হাতের তালুতে ভাঁজ লক্ষ করা যায়। তবে মানুষের তালুর মতো বৈচিত্র্যপূর্ণ নয়। এই রেখা মানুষের কিছুই নিয়ন্ত্রণ করে না, করতে পারে না। নানা কারণে মানুষের হাতের কবজি বা আঙুল কেটে বাদ হয়ে যায়, কিংবা দুর্ঘটনায় দুটো হাতই বাদ চলে যায়– এই যে যাদের হাত বা কবজি বা আঙুল কেটে বাদ হয়ে যায়, তাদের ভূত-ভবিষ্যৎ কোথায় লেখা থাকে ভেবে দেখব না আমরা! যেমন ধরুন, কোনো ব্যক্তির বুড়ো আঙুলটা যদি না থাকে, তবে তো তার আয়ুরেখাও নেই– আয়ুরেখা নেই মানে, মৃত্যুও নেই। তাই হয় নাকি! জ্যোতিষবিদ্যার সবচেয়ে বেশি প্রচলিত হচ্ছে কিনোর বই। কিয়োর বই আমিও পড়েছি। তবে কলকাতায় ভৃগু প্রণীত জ্যোতিষ শিক্ষার বইও পাওয়া যায়। এই ভৃগু একাধারে জ্যোতিষজ্ঞ, যৌনবিষয়ক লেখক, গোয়েন্দা গল্পকার। এই কিতাব পড়েও অনেকে জ্যোতিষী ফলায় গ্রামেগঞ্জে। যাই হোক, কিরোর বই আপনিও পড়ে দেখতে পারেন। হাতের রেখা কীরকম হলে সেই হাতের মালিক কেমন ভাগ্যের অধিকারী হবেন, সেগুলিই উল্লেখ করা আছে। কিন্তু কার্যকারণ নেই। কোনো সংগতি তথ্য নেই। আশাও করবেন না। কোনো কেনর উত্তর নেই। কারণ হস্তরেখাবিদদের সেই দায় আছে বলে তাঁরা মনে করেন না। বরং বেশি লাফালাফি করলে মাসলম্যানদের দিয়ে কিমা করে দিতে পারে আপনাকে।

জ্যোতিষীদের আর-একটি ভাগ্যগণনার পদ্ধতি হল সংখ্যাতত্ত্ব বা নিউমেরোলজি। অনেকে সংখ্যা-জ্যোতিষ বা অংক জ্যোতিষও বলে। তা অংকটা কী? অবশ্য বলার চেষ্টা করব। সংখ্যাতাত্ত্বিক বা জ্যোতিষ মতে, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনের প্রতিটি মূহূর্তেই মানুষ নিজেকে, নিজের পরিমণ্ডলকে, সময়কে এককথায় সবকিছুকে একমাত্র সংখ্যা দ্বারাই পরিচিত করে। আর তা করে প্রায় অসচেতন থেকেই। যেমন– ব্যক্তি বা বস্তুর নাম, স্থানের নাম, বিষয়ের নাম বা দিন, তারিখ, সময় ইত্যাদি যা কিছুই বলি না-কেন সব কিছুর মাঝেই লুকিয়ে আছে সংখ্যা। সংখ্যার সেই আধিভৌতিক দিক নিয়েই আলোচনা করে সংখ্যাতত্ত্ববিদ্যা। জগতের সকল কর্মকাণ্ডই সংখ্যা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সংখ্যার যে। একটি আধিভৌতিক (Mistrious) ভূমিকা জীবনে ও জগতে আছে। সংখ্যার এই অতিন্দ্রীয় প্রভাবই আধুনিক সংখ্যাতত্ত্ববিদ্যার (Modern Numerology) আলোচ্য বিষয়।

জ্যোতিষ মতে, সংখ্যাতত্ত্ববিদ্যা বস্তুত জ্যোতিষবিদ্যার চেয়েও প্রাচীন। জগতের প্রাচীনতম ধর্মগ্রন্থসমূহে এর উল্লেখ আছে বলে দাবি করেন। বেদ, বাইবেল প্রভৃতিতে যেমন এর উল্লেখ দেখা যায়, তেমনি পবিত্র কোরান শরিফের সুরাগুলিতেও নাকি সংখ্যায়িত লিখন পদ্ধতি দেখতে পাওয়া যায়। তাবিজ-কবজ লেখকগণ প্রায়শ সংখ্যায়ন পদ্ধতিতে লিখে থাকেন। সংখ্যাতত্ত্বের আবিষ্কার মানুষকে জ্যোতিষবিদ্যা (Astrology) এবং জ্যোতির্বিদ্যার (Astronomy) প্রতি আকৃষ্ট করেছে। গ্রিক দার্শনিক পিথাগোরাসকে (খ্রিস্টপূর্ব ৫৮২-৬০৭) আধুনিক সংখ্যাতত্ত্বের জনক বলা হয়ে থাকে। অবশ্য তারও বহু পূর্বে ধ্বংসপ্রাপ্ত ব্যাবিলনীয় সভ্যতার যুগেও এই বিদ্যার অনুশীলন হত বলে প্রমান পাওয়া গেছে। জ্যোতিষবিদরা মনে করেন, পিথাগোরাসের অনুসারী ফিলোলাস, নিকোমাকাস ছাড়াও হেরোডোটাস, সক্রেটিস, প্লেটো, এরিস্টটল প্রমুখ গ্রিক পণ্ডিতগণ, এমনকি আইনস্টাইন সহ অন্যান্য খ্যাতিমান পণ্ডিতগণ এই বিদ্যার অনুশীলন করেছেন। সংখ্যাতত্ত্বের সঙ্গে ফলিত জ্যোতিষের (Applied Astrology) সম্পর্ক অতি নিবিড়। ফলিত জ্যোতিষে ১২টি রাশি আছে এবং ৯টি গ্রহ তাদের অধিপতি (Ruling Planet)। অঙ্কের জগতে মৌলিক সংখ্যা ৯টি (১ থেকে ৯)। শূন্য কোনো সংখ্যা নয়, তবে সংখ্যার পাশে বসে তার মান বৃদ্ধি করে মাত্র। তা পৃথিবী (Univers) এর প্রতীক। গাণিতিক অঙ্ক যত বড়ই হোক তার পারস্পরিক যোগফল মৌলিক একক সংখ্যায় রূপান্তর করা যায়। আর এই মৌলিক রূপান্তরই হচ্ছে সংখ্যাতত্ত্বের প্রতিপাদ্য বিষয়। যেমন ৯৮৭৬ সংখ্যাটি পরস্পর যোগ করলে হয় ৯ + ৮ + ৭ + ৬ = ৩০। আবার ৩০ কে পরস্পর যোগ করলে হয় ৩ + ০ = ৩। অর্থাৎ যতক্ষণ-না একক সংখ্যায় আসবে ততক্ষণ পরস্পরকে যোগ করতে হবে। এক সময় তা ১ থেকে ৯ এর মধ্যে আসবেই। আর এই ১ থেকে ৯ সংখ্যা হল ৯টি প্রধান গ্রহের আধিভৌতিক বা অতিন্দ্রীয় প্রতিভূ যার প্রভাব মানব জীবনে অপরিসীম।

সংখ্যাতাত্ত্বিকগণ (Numerologist) প্রতিটি ব্যক্তি, বস্তু বা নামকে ইংরেজি বর্ণমালার ক্রমানুসারে সংখ্যায়িত করে মূল্যায়ন করেছে। কিন্তু অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কোনো সংখ্যাতত্ত্বভিত্তিক গণনা পাওয়া যাবে না, পাওয়া যাবে ANIRBAN BANDYOPADHYAY নামে। প্রশ্ন দেখা দিতে পারে পৃথিবীতে এত ভাষা থাকতে ইংরেজি ভাষাকে বেছে নেওয়া হল কেন? এ প্রশ্নের উত্তর সংখ্যাতাত্ত্বিকগণই দিয়েছেন, বলছেন– প্রাচীনকালের বিভিন্ন প্রতীকই মূলত কালের পরিক্রমায় বিভিন্ন প্রাচীন ভাষায় সংখ্যাতত্ত্ব বর্ণিত হলেও আধুনিক সংখ্যাতত্ত্ববিদ্যা ইংরেজিকে বেছে নিয়েছেন এর আন্তর্জাতিক আবেদনের কথা বিবেচনা করেই। কেননা এটি একটি আন্তর্জাতিক ভাষা এবং পৃথিবীর সকল গোলার্ধে এই ভাষা কমবেশি চর্চা হয়। অপরদিকে অন্যান্য প্রধান ভাষাগুলির আ-কার, ই-কার প্রভৃতি অথবা অক্ষর সংখ্যার প্রাচুর্যে বর্ণমালা অত্যন্ত জটিল। তাই ইংরেজিকে মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়া পৃথিবীর আলাদা আলাদা ভাষায় আলাদা আলাদা সংখ্যাতাত্ত্বিক ভাগ্যবিচার ভিন্ন ভিন্ন হয়ে যাবে। কারণ সর্বশেষ যোগফল সংখ্যা একেক রকম হবে। সে ব্যাপারটা হবে বড়োই বিভ্রান্তকর।

তাহলে আসুন জেনে নেওয়া যাক আমাদের প্রত্যেকের সংখ্যাগুলি। সংখ্যা দুই প্রকারে নির্ণয় করা যায়– একটি জন্মসংখ্যা, অপরটি নামসংখ্যা। সঠিক জন্মতারিখ জানা থাকলেই শুধু জন্মসংখ্যায় নির্ণয়, নতুবা নামসংখ্যাই ধরতে হবে। জন্মসংখ্যার মতো নামসংখ্যা অতটা ভূমিকা রাখতে পারে না বলে জন্মসংখ্যার গুরুত্বই বেশি। আবার জন্মসংখ্যাও দুই প্রকারের, একটি জন্মদিনের সংখ্যা, অপরটি জন্মতারিখের সংখ্যা। আমরা জানি একক সংখ্যা হল ১ থেকে ৯। শূন্য কোনো সংখ্যা নয়। বাকি সংখ্যাগুলি এই ১ থেকে ৯ এরই পুনরাবৃত্তি শুধু বা যৌগিক সংখ্যা। অতএব পুনরাবৃত্তির সংখ্যাগুলিকে পরস্পর যোগ করে একক সংখ্যায় আনতে হবে যতক্ষণ-না একক সংখ্যায় আসে। যেমন, ২৪ জানুয়ারি ২০১৬ এর জন্মতারিখের সংখ্যা ৭ হল যেভাবে। ২ + ৪ + ১ (জানুয়ারি মাসের সংখ্যা) + ২ + ০ + ১ + ৬ = পরস্পর যোগ করে হয় ১৬। যেহেতু ১৬ কোনো একক সংখ্যা নয়, তাই এটিকেও পরস্পর যোগ করতে হবে। যেমন, ১ + ৭ = ৮। আর জন্মদিনের সংখ্যা ৬ হল ২ আর ৪ এর যোগফল (২ + ৪ = ৬)। জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মাসকে ১ থেকে ১২

ধরতে হবে। অর্থাৎ যাদের জন্ম যে-কোনো মাসের ১, ১০, ১৯ ও ২৮ তারিখে, তাদের ১ হল জন্মদিনের সংখ্যা। যাদের জন্ম যে-কোনো মাসের ২, ১১, ২০ ও ২৯ তারিখে, তাদের ২ হল জন্মদিনের সংখ্যা। যাদের জন্ম যে-কোনো মাসের ৩, ১২, ২১ ও ৩০ তারিখে, তাদের ৩ হল জন্মদিনের সংখ্যা। যাদের জন্ম যে কোনো মাসের ৪, ১৩, ২২ ও ৩১ তারিখে, তাদের ৪ হল জন্মদিনের সংখ্যা। যাদের জন্ম যে-কোনো মাসের ৫, ১৪ ও ২৩ তারিখে, তাদের জন্মদিনের সংখ্যা ৫। যাদের জন্ম যে-কোনো মাসের ৬, ১৫ ও ২৪ তারিখে, তাদের জন্মদিনের সংখ্যা ৬। যাদের জন্ম যে-কোনো মাসের ৭, ১৬ ও ২৫ তারিখে, তাদের জন্মদিনের সংখ্যা ৭। যাদের জন্ম যে-কোনো মাসের ৮, ১৭ ও ২৬ তারিখে, তাদের জন্মদিনের সংখ্যা ৮। যাদের জন্ম যে-কোনো মাসের ৯, ১৮ ও ২৭ তারিখে তাদের জন্মদিনের সংখ্যা ৯।

নামসংখ্যা নির্ণয়ের সূত্র হল– ইংরেজি বর্ণমালার ২৬টি বর্ণ আছে। এই ২৬টি বর্ণকে ১ থেকে ৯ সংখ্যায় আনতে হবে এইভাবে–

A, I, J, Q, Y এর মান হল ১

B, K, R এর মান হল ২

C, G, L, S এর মান হল ৩

D, M, T এর মান হল ৪

E, H, N, x এর মান হল ৫

U, V, W এর মান হল ৬

০, z এর মান হল ৭

F, P এর মান হল ৮। এই হল ২৬টি বর্ণের মান।

এবার নির্ণয় করি কারও নাম। ধরুন ANIRBAN নাম হলে তার নামসংখ্যা কত? A ১ + N ৫ + ১ + R 2 + B ২ + A ১ + N ৫ = ১৭ অর্থাৎ ১ + ৭ = ৮ এবং B ২ + A ১ + N ৫ + D ৪ + Y ১ + ০ ৭ + P ৮ + A ১ + D ৪ + H ৫+ Y ১ + A ১ + Y ১= ৪২। অর্থাৎ ৪ + ২ = ৬। পূর্ণ নামের সংখ্যা ৮ + ৬ = ১৪ অর্থাৎ ১ + ৪ = ৫। তাহলে দেখা যাচ্ছে ৮ ও ৫ দুটি সংখ্যাই এক্ষেত্রে প্রভাব রাখছে। এভাবেই সমস্ত নামের সংখ্যা নির্ণয় করা হয়।

সংখ্যা তো হল। কিন্তু সংখ্যা দিয়ে কী হবে? সংখ্যা দিয়ে ভাগ্যগণনা কীভাবে হবে? সব উল্লেখ করব না। কলেবর বৃদ্ধি না-করে দু-চারটে উল্লেখ করছি। যে জাতকের নাম সংখ্যাতত্ত্ব বিচারে ১ হয়, তাহলে তাকে ধীরস্থির ও গম্ভীর মনে হলেও দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে জানে, কর্মে সক্রিয়, তেজি, নির্ভীক, পরাক্রমশালী, আত্মবিশ্বাসী, অহংকারী, চতুর, বাস্তববাদী এবং উচ্চাকাঙ্খী। উচ্চাকাঙ্খ বাস্তবায়নে সচেষ্ট থাকে। সহজে হার স্বীকার করে না। মনোবল প্রচুর বলে ভয় পেয়ে পিছু হটে না। প্রবল বিপর্যয়ের মধ্যেও ধীরস্থিরভাবে কুটিল বুদ্ধির দ্বারা এগিয়ে যেতে পারে। অন্যকে বোকা বানাতে পারে। নিজের অবস্থান দৃঢ় করার জন্য যা করা দরকার করতে পারে। চেহারায় আকর্ষণীয় শক্তি থাকায় সহজেই অন্যেরা আকৃষ্ট হয়। ব্যক্তিত্বসম্পন্ন বলে সবসময় নিজেকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করে। কথাবার্তায় শাণিতভাব প্রকাশ পায়। নিজের ঢোল নিজে পেটায়। চাটুকাররা মন জয় করতে পারে। কোন্ কাজ কখন করতে হবে তা বোঝে। সব বিষয়ে সূক্ষ্ম দৃষ্টি রাখে। একরোখা স্বভাবের জন্য নিজের পছন্দমত না-হলে কারও কথা শুনে না। সব বিষয়ে সবার উপর কর্তৃত্ব করতে চায়। কারও অধীনে থাকা পছন্দ নয়। যে-কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী। হঠাৎ রেগে যাওয়ার প্রবণতা আছে। সাংগঠনিক দক্ষতা থাকায় অন্যকে পরিচালনা করা, নেতৃত্ব দেওয়া এবং বড় বড়ড়া পরিকল্পনা ও চিন্তাধারার জন্য জনমনে

প্রাধান্য বিস্তার করতে পারে। সম্মান এবং উচ্চপদও পেতে পারে। আবার নিজেই সব ভালো বুঝে এই খামখেয়ালির জন্য অনেক সময় মাশুলও দিতে হতে পারে। গ্রহ অশুভ কালে বড়ো ধরনের পতনও ঘটতে পারে। দীর্ঘস্থায়ী কাজে মন না দিয়ে যে-কোনো মুহূর্তে কাজে উৎসাহী। উদারতা, মানবতা, বিচক্ষণতা, ন্যায়পরায়ণতা, ধর্মভীরুতা এবং প্রতিভা যেমন আছে– তেমনি ক্রুরতা, নিষ্ঠুরতাও অসম্ভব নয়। ভ্রমণে সদা উৎসুক বলে বন, জঙ্গল, শহর ও বিদেশ ভালোবাসে। সন্তানদের প্রতি স্নেহপ্রবণ। ভাবপ্রবণতা থাকলেও বাস্তবতার বাইরে যায় না। প্রেমের ব্যাপারে কোনো চিন্তা না-করেই হৃদয় দিতে পারে। আবার সামান্য আঘাতে ভালবাসার মানুষটিকে চিরতরে ত্যাগ করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করেনা। কারো ক্ষেত্রে একাধিক প্রেমে জড়িয়ে পড়াও অসম্ভব নয়।

আবার কোনো জাতকের নাম সংখ্যাতত্ত্ব বিচারে ২ হয়, তাহলে আবেগপ্রবণ, অনুভূতিশীল, কোমল হৃদয়, কল্পনাপ্রিয়, ভদ্র, নম্র, লাজুক, বৈচিত্র্যপ্রিয় ও শিল্পীমনা। তারা ভাবপ্রকাশে কুণ্ঠিত এবং তাদের মন ও চিন্তা দ্বি-ধারায় প্রবাহিত হয়। তাদের মনের স্থিরতা নেই বলে ভাবধারায় দ্রুত পরিবর্তন আসে। তাদের আত্মসম্মান জ্ঞান প্রচণ্ড। তাই আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে তারা কোনো কিছু করতে পারে না। তারা সামাজিক রীতি-নীতির প্রতি আকৃষ্ট। জীবন ও ঘর-সংসার তাদের কাছে প্রিয়। তারা আত্মত্যাগী বলে প্রিয়জনদের জন্য ত্যাগ স্বীকার করতে জানে। তাদের জীবনের ট্র্যাজেডি হল তবুও মানুষ তাদের ভুল বুঝতে পারে! তারা সহজেই ভুল স্বীকার করতে পারে। তারা খুব অল্পতেই কষ্ট পায় এবং খুব সহজেই ভেঙে পড়ে। অন্যের বক্তব্য শোনার জন্য আগ্রহী।

কোনো জাতকের নাম সংখ্যাতত্ত্ব বিচারে ৩ হয়, তাহলে এটি বৃহস্পতির প্রতীক। চাকরি, ব্যাবসা বা ধর্মীয় বিষয়ে তারা কর্মদক্ষতা প্রমাণ করতে পারে। তারা ধীর স্থির, নিয়মানুবর্তী, বিবেক বুদ্ধিসম্পন্ন ও ধার্মিক। সবার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে চেষ্টা করে। তাদের জীবনে উত্থান-পতনজনিত জীবননাট্যের ক্লাইমেক্স খুব কমই দেখা যায়। তবে অনেক ক্ষেত্রে লোভনীয় নেতা হওয়ার সুযোগ এলেও অনেকে অনাগ্রহ প্রকাশ করে থাকে। তাদের মধ্যে বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে একটা আধ্যাত্মিক চেতনা বৃদ্ধি পায়। এরা বিশিষ্ট সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী, ধর্ম প্রচারক, শিক্ষক ও কর্মক্ষেত্রে বড়ো কর্তা হতে পারেন। কর্মক্ষেত্রে দ্রুত পদোন্নতির দৌড়ে তারাই এগিয়ে থাকেন। তাদের উচ্চাকাঙ্খা তীব্র, বুদ্ধি তীক্ষ্ণ এবং তারা পরিশ্রমী বলেই সাফল্য ধরতে তাদের দেড়ি হয়না। অনেক সময় টুকরো কথা দিয়ে তারা ঠাট্টা করতে পারে। অনেক সময় অনেক ক্ষেত্রে বেশি। কথা বলার জন্য সব কথার মধ্যে সামঞ্জস্য নাও থাকতে পারে। কেউ কেউ আবার অন্তঃমুখীও হতে পারে। তাদের যারা শত্রু হয় তারা সবাই প্রায় বুদ্ধিমান শত্রু। অনেক ক্ষেত্রে ব্যর্থতার বোঝা তাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলতে পারে ইত্যাদি।

সংখ্যাতত্ত্ব শুধু মানবজীবনেই নয়, সমাজ ও রাষ্ট্রের নানা ক্ষেত্রেই সংখ্যার প্রভাব আছে বলে জ্যোতিষবাবুরা দাবি করেন। মনে করুন, ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর। বিশ্ব বিস্ময়ে হতবাক হয়ে দেখে যুক্তরাষ্ট্রের উপর হামলার এক মর্মান্তিক দৃশ্য। ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার, অর্থাৎ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার টুইন টাওয়ারটি তাসের ঘরের মতো মাটিতে মিশে গেল। গোটা বিশ্ব কেঁপে উঠল। তারপর থেকে বিশ্বের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বদলে যেতে থাকে। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সামাজ্যবাদীদের সর্বাত্মক যুদ্ধের ঘোষণা হল। আর আমরা দেখতে পাই এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে বিশ্বজুড়ে এক সর্বগ্রাসী দানবের সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করতে। সবাই যখন নাচছে, তখন জ্যোতিষীবাবুরাই-বা বসে থাকবেন কেন! তাঁরা নেচে উঠলেন, নেমে পড়লেন কোমর বেঁধে। ঘোলা জলে মাছ ধরার ফন্দি সম্বল করে। বললেন– রাষ্ট্রপতি George W. Bush–এর মোট অক্ষর সংখ্যা হল ১১টি। ১১ সংখ্যাটি হল দারুণ অশুভ সংখ্যা। সমস্ত কিছুর মূলেই আছে এই ১১।

এক নজরে তাহলে সেটাই দেখি :

(১) হামলার তারিখ ১১ সেপ্টেম্বর,

(২) হামলার তারিখ ৯/১১, অর্থাৎ ৯ + ১ + ১ = ১১,

(৩) ১১ সেপ্টেম্বর হল বছরের ২৫৪ তম দিন = ২ + ৫ + ৪ = ১১,

(৪) ১১ সেপ্টেম্বেরের পরে বছর শেষ হতে আর ১১১ দিন বাকি ছিল,

(৫) টুইন টাওয়ার পাশাপাশি দাঁড়ানো, যা দেখতে ১১,

(৬) প্রথম বিমান যেটি আঘাত হানে, সেটি ১১ নম্বর ফ্লাইট,

(৭) American Airlines মানে AA, অর্থাৎ A হচ্ছে ইংরেজি বর্ণমালার প্রথম অক্ষর, মানে American Airlines = AA = ১১,

(৮) নিউইয়র্ক স্টেট হচ্ছে ইউনিয়নে যুক্ত হওয়া ১১ নাম্বার স্টেট,

(৯) New York City, এখানেও ১১টি অক্ষর,

(১০) Afghanistan, এখানেও ১১ টি অক্ষর,

(১১) The Pentagon, এখানেও ১১ টি অক্ষর,

(১২) ফ্লাইট ১১– ৯২ অন বোর্ড –৯ + ২ = ১১,

(১৩) ফ্লাইট ৭৭– ৬৫ অন বোর্ড– ৭৭ = ১১ x ৭– ৬ + ৫ = ১১,

(১৪) Air Force One = ১১ অক্ষর,

(১৫) Saudi Arabia = ১১ অক্ষর,

(১৬) ww terrorism = ১১ অক্ষর,

(১৭) ইউ এস স্টেট সেক্রেটারি Colin Powell = ১১ অক্ষর,

(১৮) ১১ নভেম্বর হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের Remembrance day, আবার নভেম্বর হল ১১তম মাস,

(১৯) বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় আঘাত হানা বিমানের পাইলট ছিল Mohamed Atta, Mohamed Atta = ১১ অক্ষর।

উল্লিখিত আলোচনা থেকে আমরা কোন্ সিদ্ধান্তে আসতে পারি দেখা যাক– সিদ্ধান্ত : ১১ একটি অলৌকিক সংখ্যা, তাই ১১ সেপ্টম্বরের ঘটনাটি একটি অলৌকিক ঘটনা। বাইবেল ও বিভিন্ন প্রাচীন মিথে শয়তানের চিহ্নের সঙ্গে ১১ সংখ্যার একটা যোগ পাওয়া যায়। নিউ টেস্টামেন্টে শয়তানের চিহ্ন ৬৬৬, যা ১১ দ্বারা বিভাজ্য। ধর্মকথা শব্দটি ইংরেজি বর্ণমালা বা রোমানে লিখি, তবে দেখা যায় ‘dharmakatha’, গুনে দেখুন ১১টি অক্ষর।

১১ তে মিল পেলেন অনেক, ১১ তে অমিলও পাবেন অনেক। টুইন টাওয়ারের দুর্ঘটনায় এমন অসংখ্য বিষয়-পূর্বাপর পাওয়া যাবে যার সঙ্গে ১১ সংখ্যার বা অক্ষরের কোনো সম্পর্ক নেই। দেখুন–

(১) হামলার বছর ২০০১ = ২ + ০ + ০ + ১ = ৩– ১১ নয়।

(২) এরোপ্লেনগুলি আঘাত হানে সকাল ৯টার দিকে– ১১ টার দিকে নয়।

(৩) ৪টি বিমান হামলা করেছে– ১১ নয়।

(৪) এরোপ্লেনে লোকের সংখ্যা ২৬৬ = ২ + ৬ + ৬ = ১৪– ১১ নয়।

(৫) একটি এরোপ্লেনের নম্বর ৭৬৭ = ৭ + ৬ + ৭ = ২০– ১১ নয়।

(৬) আরেকটি এরোপ্লেনের নম্বর ৭৫৭ = ৭ + ৫ + ৭ = ১৯– ১১ নয়।

(৭) ৭৫৭ নম্বর এরোপ্লেনের ফুয়েল ক্যাপাসিটি ২০,০০০ গ্যালন– ১১ হাজার

গ্যালন নয়।

(৮) ৭৫৭ নম্বর এরোপ্লেনের ডানার দৈর্ঘ্য ১২৪ ফুট = ১ + ২ + ৪ = ৭– ১১

নয়।

(৯) ৭৫৭ নম্বর এরোপ্লেনের ডানার দৈর্ঘ্য ১৫৬ ফুট = ১ + ৫ + ৬ = ১২– ১১

নয়।

(১০) একটি টাওয়ারের উচ্চতা ১৩৬২ ফুট = ১ + ৩ + ৬ + ২ = ১২– ১১

নয়।

(১১) অন্যটির উচ্চতা ১৩৬৮ = ১ + ৩ + ৬ + ৮ = ১৮– ১১ নয়।

(১২) অন্য ফ্লাইটগুলি UA ৯৩ = ৯ + ৩ = ১২– ১১ নয়।

(১৩) UA ১৭৫ = ১ + ৭ + ৫ = ১৩– ১১ নয়।

(১৪) ফ্লাইট ১১ এর প্যাসেঞ্জার ছিল ৮১ জন = ৮ + ১ = ৯– ১১ নয়।

(১৫) Boston = ৬টি অক্ষর– ১১ নয়।

(১৬) Massachusetts = ১৩টি অক্ষর– ১১ নয়।

(১৭) Pennsylvania = ১২টি অক্ষর– ১১ নয়।

(১৮) Washington D.C. = ১২টি অক্ষর– ১১ নয়।

(১৯) Los Angeles = ১০ অক্ষর– ১১ নয়।

(২০) হাইজ্যাকারদের সংখ্যা ১৯ = ১ + ৯ = ১০– ১১ নয়।

(২১) Tony Balair = ১০ অক্ষর– ১১ নয়।

একই ঘটনাকে অন্য সংখ্যা দিয়েও প্রমাণ করা যাবে আরেকটি অলৌকিক সংখ্যা দিয়ে। ২ সংখ্যা দিয়েও কিছু ঘটনা মেলানো যাচ্ছে। দেখুন–

(১) হামলার তারিখ ১১/৯ = ১১– ৯ = ২,

(২) হামলার তারিখ ১১ সেপ্টেম্বর = ১ + ১ = ২,

(৩) ১১ সেপ্টেম্বর হচ্ছে বছরের ২৫৪ তম দিন =

২ + ৫ + ৪ = ১১ = ১ + ১ = ২,

(৪) বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা => ২ টি টাওয়ার,

(৫) World Trade Center কে আঘাত হেনেছে ২ টি বিমান,

(৬) প্রতি বিমানে ২ টি ডানা আছে,

(৭) প্রথম আঘাতকারী বিমানের ফ্লাইট নাম্বার ১১ = ১ + ১ = ২,

(৮) New York = ২টি শব্দ,

(৯) The Pentagon = ২ টি শব্দ।

অনেকে ১৯ সংখ্যাটিকে খুব গুরুত্ব দেন। অথচ অনেক কিছুই আছে যা ১৯ সংখ্যার সঙ্গে খাপ খায় না। ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরানের সংখ্যা দেখা যেতে পারে। যেমন দেখুন–

(১) কোরানে পারা ৩০, যা ১৯ দিয়ে বিভাজ্য নয়।

(২) কোরানে রুকু ৫৫৮ টি, যা ১৯ দ্বারা বিভাজ্য নয়।

(৩) সিজদাহ ১৫টি, যা ১৯ দ্বারা বিভাজ্য নয়।

(৪) মাক্কি সুরা ৮৬, মাদানি সুরা ২৬টি, কোনোটিই ১৯ দ্বারা বিভাজ্য নয়।

(৫) নোকতা ১,০৫,৬৮৪টি, যা ১৯ দ্বারা বিভাজ্য নয়।

(৬) ‘আল্লাহ’ শব্দটি সংখ্যা ১৯ দ্বারা বিভাজ্য ধরে নিলেও (আসলে নয়)– রসুল, মোহাম্মদ সা, জিব্রাইল, মানুষ প্রভৃতি অসংখ্য শব্দ আছে যার সংখ্যা ১৯ দ্বারা বিভাজ্য নয়।

(৭) বিসমিল্লায় ১৯টি অক্ষর থাকলেও কলেমা তাইয়েবা (“লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ..”), কলেমা শাহাদাত, আউজুবিল্লাহ., এমন অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ বাক্যের অক্ষর ১৯টি নয়।

(৮) সুরা ৯৬ এর অক্ষর সংখ্যা ৩০৪টি, যা ১৯ দ্বারা বিভাজ্য হলেও সুরা ১, ২, ….., এমনকি ১১০ বা অন্য সুরাগুলি অক্ষর সংখ্যা ১৯ দ্বারা বিভাজ্য নয়।

(৯) ১১০ নম্বর সুরায় শব্দের সংখ্যা ১৯টি, বাকি সুরাগুলির শব্দসংখ্যা ১৯ নয়।

৪ সংখ্যা দিয়েও অলৌকিক তত্ত্ব দেওয়া যেতে পারে। দেখুন–

(১) আল্লাহ শব্দটিতে অক্ষর ৪টি।

(২) ৪ নম্বর সুরায় আয়াত ১৭৬ = ৪ x ৪৪ = ১৭৬।

(৩) সুরা এখলাসের আয়াত সংখ্যা ৪।

(৪) সুরা এখলাসের প্রথম আয়াত যেখানে আল্লাহর একত্ব সম্বন্ধে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে (কুলহু আল্লাহু আহাদ), প্রথম আয়াতটিতে শব্দ সংখ্যা ৪টি।

(৫) সুরা এখলাস ১১২ নম্বর সুরা, যা ৪ দ্বারা বিভাজ্য =

১১২/৪ = ২৮ = ২ + ৮ = ১০ = ১ + ০ = ১ অর্থাৎ আল্লাহ এক।

(৬) কোরানে আয়াত সংখ্যা ৬২৩৬, যা ৪ দ্বারা বিভাজ্য।

(৭) আসমানি কিতাবের সংখ্যা ৪টি।

(৮) আসমানি কিতাব নাজিলকৃত রসুল ৪ জন।

(৯) প্রধান ফেরেশতা ৪ জন। অতএব প্রমাণিত হল যে কোরান অলৌকিক এবং এই ৪ সংখ্যাটি একটি অলৌকিক সংখ্যা। প্রকৃতিতেও এরকম ‘অলৌকিক’ সংখ্যার উদাহরণ হাজার হাজার পাওয়া যাবে।

নিউমেরোলজিস্টরা ১ থেকে ৯ পর্যন্ত প্রতিটি সংখ্যার জন্য আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য লিপিবদ্ধ করে গেছেন। এই বৈশিষ্ট্য উল্লেখের ব্যাপারে নিউমেরোলজিস্টদের মতামতও ভিন্ন, স্ববিরোধিতায় ভরপুর। এ ব্যাপারে অবশ্য নিউমেরোলজিস্টদের কোনো ব্যাখ্যা নেই। নিউমেরোলজি বিজ্ঞানের কোনো শর্তকেই তোয়াক্কা করে না। সংখ্যা কীভাবে মানুষকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখে, সে বিষয়ে প্রশ্ন করলে নিউমেরোলজিস্টরা বলেন –“প্রত্যেকটি সংখ্যার একটি করে তড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ আছে। সেই তরঙ্গই মানুষের ভাগ্যকে নিয়ন্ত্রণ করে”। মনে রাখতে হবে, তড়িৎ ও চুম্বকত্ব পদার্থের দুটি মৌলিক ধর্ম, এটি পদার্থের বিশেষ অবস্থায় প্রকাশ পায়। কিন্তু সংখ্যা কোনো পদার্থ নয়, এটি একটি গাণিতিক ধারণা। অতএব সংখ্যায় তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ থাকার ব্যাপারটা হল একটি লোক ঠকানো উদ্ভট কল্পনা। আমি একজন কমুনিস্ট তথা বামপন্থী

প্রাবন্ধিককে চিনতাম, যার পিতৃদত্ত নাম ছিল জ্যোতির্ময় ঘোষ– তিনি নিউমেরোলজিস্টের পরামর্শে নাম বদলে করলেন জ্যোতি ঘোষ। তিনি পেশায় ফিজিক্সের অধ্যাপক ছিলেন। নামের বানান থেকেই যদি ভাগ্য নির্ধারিত হয়। তাহলে যে ব্যক্তিরা একাধিক নামেই বিখ্যাত, তাদের ক্ষেত্রে কোন নামটি সঠিক বলে ধরবেন? দেখুন– মানিক, সত্যজিৎ রায়; রীনা, অপর্ণা সেন; রমা, সুচিত্রা সেন; মোহর, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়; বুম্বা, প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়; সুভাষচন্দ্র বসু, নেতাজি, নেতাজি সুভাষ; গান্ধিজি, বাপুজি, মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধি; মার্ক টোয়েন, স্যামুয়েল ল্যাংহর্ন ক্লিমেন্স; এপিজে আবদুল কালাম, আবুল ফকির জয়নুলাবউদ্দিন আবদুল কালাম; পিভি নরসিংহ রাও, পামুলাপ্রতি ভেঙ্কটনরসিমহা রাও; পিটি উষা, পিলাভুল্লাকান্দি থেক্কেপরম্বিল উষা; রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ টেগোর ইত্যাদি। নিউমেরোলজিস্টরা যদি এদের ভাগ্যগণনা করতে নামে তাহলে তো ন্যাজে আর গোবরে হয়ে যাবেন। নাম ভিন্ন, সংখ্যাও ভিন্ন– অতএব ভাগ্যবিচারও ভিন্ন হবে। তাহলে হলটা কী! আর-একটা মোক্ষম উদাহরণ দিয়ে সংখ্যাতত্ত্বের আলোচনা শেষ করব। আডলফ হিটলার, এই ব্যক্তিকে চেনেন না এমন কোনো শিক্ষিত ব্যক্তি আছেন বলে মনে হয় না। সেই বিশ্বাস হিটলার, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মহানায়ক হিটলার– জন্মেছিলেন ১৮৮৯ সালে ২০ এপ্রিল। হিটলারের জন্মসংখ্যা হল ২ + ০ + ০ + ৪ + ১ + ৮ + ৮ + ৯ = ৩২ = ৩ + ২ = ৫। নিউমেরোলজিস্টদের বিচারে ৫ জন্মসংখ্যা ব্যক্তিরা দয়া ও ন্যায়নিষ্ঠায় ভরপুর হয়ে থাকেন। ইতিহাস কাঁদবে, না হাসবে?

জ্যোতিষীবাবুরা মানুষের ভাগ্য বলে দেওয়ার জন্য আরও একটি পথ খুঁজে পেয়েছেন। সেই পদ্ধতিটি হল ‘তিল’। আমি আগে কখনো শুনিনি যে মানুষের শরীরে যে তিল দেখতে পাওয়া যায়, সেই তিল দেখে নাকি ভাগ্য বলে দেওয়া যায়। বছর পঁচিশ আগে হাবড়ায় এক জ্যোতিষালয়ে বিশাল গণ্ডগোল এবং জ্যোতিষবাবুকে উত্তমমধ্যম কেলানো। জ্যোতিষীবাবু তাঁর খরিদ্দার এক তরুণীর ডান স্তনে তিল আছে বলে দাবি করেন। তরুণীটি যতই বলে তাঁর ডান স্তনে কোনো তিল নেই, জ্যোতিষবাবু ততই বলতে থাকেন তাঁর ডান স্তনে তিল আছে, থাকতেই হবে। লক্ষণ তাই-ই বলছে। তিনি আরও একবার স্তন খুলে যাচাই করতে বলে। তরুণীটি মেজাজ ঠিক রাখতে না-পারে জ্যোতিষীবাবুর ফর্সা টুকটুকে গালে সপাটে চড় কষিয়ে লাল করে দেয়। চেম্বারে নারীঘটিত গন্ধ পেয়ে বাইরে লোকজনও চলে আসে এবং জ্যোতিষীবাবুর চেম্বার তুলে দেয়। এরপর থেকে তিলের উপর আমারও বেশ আগ্রহ জন্মালো। কারণ আমার শরীরেও যে গোটা কয়েক তিল আছে! বইপত্রও কিছু ঘাঁটাঘাঁটি করতে হল। যত্তসব!

প্রাচীন সমুদ্র শাস্ত্রে তিল দেখে ভাগ্য নির্ধারণের পদ্ধতি বর্ণনা করা আছে। মানুষের দেহে তিলের উপস্থিতি নিয়ে অনেকেই অনেক কথা বলে থাকেন।

তিল দেখে ভাগ্য নির্ধারণের প্রথা প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে। এখনও অনেকে এ প্রথাতে বিশ্বাসী। শরীরের বিভিন্ন অংশে তিলের উপস্থিতি, রং, আকৃতি প্রভৃতি দেখে মানুষের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ধারণা করা। বলা হয়– পুরুষের শরীরে ডান দিকে এবং নারীদের শরীরে বাঁ দিকে তিল থাকা শুভ। আবার কোনো ব্যক্তির শরীরে ১২টির বেশি তিল হওয়া শুভ বলে মনে করা হয় না। ১২টার কম তিল হওয়া শুভ ফলদায়ক। দেশের একেক অংশে তিল একেক অর্থ বহন করে।

ভ্রূ : যাদের ভ্রুতে তিল থাকে তারা প্রায়ই ভ্রমণ করেন। ডান ভ্রুতে তিল থাকলে ব্যক্তির দাম্পত্য জীবন সুখী হয়। আবার বাঁ ভ্রুর তিল দুঃখী দাম্পত্য জীবনের সঙ্কেত দেয়।

মাথা : মাথার মাঝখানে তিল থাকলে তা নির্মল ভালোবাসার প্রতীক। ডান দিকে তিল থাকা কোনো বিষয়ে নৈপুণ্য বোঝায়। আবার যাদের মাথার বাঁ দিকে

তিল আছে তারা অর্থের অপচয় করেন। মাথার ডান দিকের তিল ধন ও বুদ্ধির চিহ্ন। বাঁ দিকের তিল নিরাশাপূর্ণ জীবনের সূচক।

চোখের মণি : ডান চোখের মণিতে তিল থাকলে ব্যক্তি উচ্চ বিচারধারা পোষণ করেন। বাঁ দিকের মণিতে যাদের তিল থাকে তাদের বিচারধারা ভালো নয়। যাদের চোখের মণিতে তিল থাকে তারা সাধারণত ভাবুক প্রকৃতির হন।

চোখের পাতা : চোখের পাতায় তিল থাকলে ব্যক্তি সংবেদনশীল হন। তবে যাদের ডান পাতায় তিল থাকে তারা বাঁ পাতায় তিলযুক্ত লোকের তুলনায় বেশি সংবেদনশীল।

কান : কানে তিল থাকা ব্যক্তি দীর্ঘায়ু হন।

মুখ : স্ত্রী বা পুরুষের মুখমণ্ডলের আশপাশের তিল তাদের সুখী ও ভদ্র হওয়ার সঙ্কেত দেয়। মুখে তিল থাকলে ব্যক্তি ভাগ্যে ধনী হন। তার জীবনসঙ্গী খুব সুখী হন।

নাক : নাকে তিল থাকলে ব্যক্তি প্রতিভাসম্পন্ন হন এবং সুখী থাকেন। যে নারীর নাকে তিল রয়েছে তারা সৌভাগ্যবতী হন।

ঠোঁট : যাদের ঠোঁটে তিল রয়েছে তাদের হৃদয় ভালোবাসায় ভরপুর। তবে তিল ঠোঁটের নিচে থাকলে সে ব্যক্তির জীবনে দারিদ্র্য বিরাজ করে।

গাল : গালে লাল তিল থাকা শুভ। বাঁ গালে কালো তিল থাকলে, ব্যক্তি নির্ধন হয়। কিন্তু ডান গালে কালো তিল থাকলে তা ব্যক্তিকে ধনী করে।

থুতনিঃ যে স্ত্রীর থুতনিতে তিল থাকে তিনি সহজে মেলামেশা করতে পারেন না। এরা একটু রুক্ষ স্বভাবের হন।

কাঁধ : ডান কাঁধে তিল থাকলে সে ব্যক্তি দৃঢ়চেতা। আবার যাদের বাঁ কাঁধে তিল থাকে তারা অল্পেই রেগে যান।

হাত : যার হাতে তিল থাকে তারা চালাক-চতুর হন। ডান হাতে তিল থাকলে ব্যক্তি শক্তিশালী হন। আবার ডান হাতের পেছনে তিল থাকলে তারা ধনী হয়ে থাকেন। বাঁ হাতে তিল থাকলে সে ব্যক্তি অনেক বেশি টাকা খরচ করতে পছন্দ করেন। আবার বাঁ হাতের পেছনের দিকে তিল থাকলে সে ব্যক্তি কৃপণ স্বভাবের হন।

বাহু : যে ব্যক্তির ডান বাহুতে তিল থাকে তারা প্রতিষ্ঠিত ও বুদ্ধিমান। বাঁ বাহুতে তিল থাকলে ব্যক্তি ঝগড়াটে স্বভাবের হন। তার মাথায়ও খারাপ চিন্তাভাবনা থাকে।

আঙুল : যাদের আঙুলের তর্জনীতে তিল থাকে তারা বিদ্বান, ধনী এবং গুণী হয়ে থাকেন। তবে তারা সব সময় শত্রুদের কারণে সমস্যায় থাকেন। বৃদ্ধাঙ্গুলে তিল থাকলে ব্যক্তি কর্মঠ, সদ্ব্যবহার এবং ন্যায়প্রিয় হন। মধ্যমায় তিল থাকলে ব্যক্তি সুখী হন। তার জীবন কাটে শান্তিতে। যে ব্যক্তির কনিষ্ঠায় তিল রয়েছে তারা ধনী হলেও জীবনে অনেক দুঃখ-কষ্ট সহ্য করতে হয়। অনামিকায় তিল থাকলে ব্যক্তি জ্ঞানী, যশস্বী, ধনী ও পরাক্রমী হন।

গলা : গলার সামনের দিকে তিল থাকলে ব্যক্তির বাড়িতে বন্ধু-বান্ধবের আনাগোনা লেগে থাকে। গলার পিছনে তিল থাকলে সে ব্যক্তি কর্মঠ হন। কোমর : যে ব্যক্তির কোমরে তিল থাকে, তার জীবনে সমস্যার আনাগোনা লেগেই থাকে।

বুক : ডান দিকের বুকে তিল থাকা শুভ। এমন স্ত্রী খুব ভালো হয়। পুরুষ ভাগ্যশালী হয়। বাঁ দিকের বুকে তিল থাকলে স্ত্রীপক্ষের তরফে অসহযোগিতার সম্ভাবনা থাকে। বুকের মাঝখানের তিল সুখী জীবনের সঙ্কেত দেয়।

পা : যে জাতকের পায়ে তিল রয়েছে তারা অনেক ভ্রমণ করেন।

পেট : যে ব্যক্তির পেটে তিল আছে তারা খুব খাদ্যরসিক হয়। মিষ্টি তাদের অত্যন্ত প্রিয়। তবে তারা অন্যকে খাওয়াতে খুব একটা পছন্দ করে না।

হাঁটু : ডান হাঁটুতে তিল থাকলে গৃহস্থজীবন সুখী হয়। বাঁ হাঁটুতে তিল থাকলে দাম্পত্য জীবন দুঃখময় হয়।

উঃ, ভাবা যায় না। জ্যোতষীবাবুদের কী সৃজনশীলতা! তিলকে তাল করা জ্যোতিষীবাবুদের তিল প্রসঙ্গে কী বলছেন চিকিৎসা বিজ্ঞান? তিল কখনোই মানুষের ভাগ্য নির্ণায়ক ও নিয়ন্ত্রক নয়। মানুষের শরীরের তিল আদতে আপাতনিরীহ স্কিন ডিজিজ। তিল আমরা সবাই কম বেশি ফ্রিকেলস শব্দটির সঙ্গে পরিচিত। যার বাংলা প্রতিশব্দ হচ্ছে তিল বা ক্ষুদ্র চিহ্ন। এটি এমন ধরনের দাগ যার বর্ণ বাদামি, আকারে ২ থেকে ৪ মিলিমিটারের মত গোলাকার, ত্বকের সমান স্তরে অবস্থান করে এবং মূলত ত্বকের কোনো ক্ষতিসাধন করে না। তবুও সবাই এর থেকে পরিত্রাণ চেয়ে থাকেন। যদিও এটা কোনো রোগ বা শারীরিক সমস্যা নয়, এটি অনেকের কাছেই বিব্রতকর। ফর্সা ত্বকে এ দাগ বেশি পরিলক্ষিত হয়। এটা অনেকটাই বংশগত, পরিবারের কারও এ সমস্যা থেকে থাকলে আপনার হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। ফ্রিকেলস সূর্য রশ্মিতে আরও বেশি প্রকট আকার ধারণ করে তাই সান এক্সপোজড জায়গাগুলিতে বেশি হতে দেখা যায়। এছাড়া সারা শরীরেই ফ্রিকেলস হতে পারে। বাজারে অনেক ব্র্যান্ডের ফ্রিকেলস আউট ক্রিম পাওয়া যায়, যার সবই কম-বেশি ব্লিচিং উপাদান দিয়ে তৈরি। আর ব্লিচিং পদার্থ আমাদের স্পর্শকাতর ত্বকের জন্য হুমকি স্বরূপ।

তিল বা ফ্রিকেলস সাধারণত দুই ধরনের হয়–

(১) এফিলাইডস এরা সমতল এবং লালচে বাদামি রঙের হয়ে থাকে। মূলত গ্রীষ্মকালে দেখা দেয় এবং শীত এলেই চলে যায়। এই রকমের ফ্রিকেলস বংশগত হতে পারে।

(২) লেনটিজাইন্স লেনটিজাইন্স সম্ভবত ছোটো ছোটো ট্যানের দাগের মতো বাদামি বা কালো রঙের হতে দেখা যায়। এ ধরনের তিল এফিলাইডস থেকেও গাঢ় রঙের হয়। আর শীতকালে চলেও যায় না। সারা বছর ব্যাপী এটি আপনার সুন্দর ত্বকে রাজত্ব করে বেড়ায়। এটিও অনেকটা বংশগত সমস্যা।

ফ্রিকেলস প্রধানত কালো বা বাদামি দাগ যা মুখের ত্বকেই বেশি হয়ে থাকে, বিশেষ করে নাকের দুই পাশের জায়গাগুলিতে। ফর্সা বা ফ্যাকাসে ত্বক এতে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। রোদের আলোতে ফ্রিকেলস আরও স্পষ্ট ও তীব্রভাবে পরিলক্ষিত হয়। এর আসল কারণ জেনিটিকাল। কারও পরিবারে বাবা-মা দুই জনের তিল থাকলে তার হওয়ার সম্ভবনা ৮০ %। আর যে-কোনো একজনের থাকলেও এ মাত্রা ৬০ থেকে ৬৫ %। রোদ ফ্রিকেলসের প্রধান শত্রু। অতিরিক্ত সূর্য রশ্মিতে ঘোরাঘুরির ফলেও হতে পারে। অনেকে আছেন গাড়িতে চলাফেরা করেও ফ্রিকেলস কবলিত হন এবং ভাবেন গাড়িতে থাকার কারণে তাঁর ত্বক হয়তো সূর্যরশ্মির দ্বারা আক্রান্ত হয়নি। এটা ভুল ধারণা। গাড়ির কাঁচ ভেদ করে খুব সহজেই সূর্যরশ্মি পৌঁছে যেতে পারে আপনার ত্বকে এবং তৈরি করতে পারে ফ্রিকেলস।

এই তিল বা ফ্রিকেলস শরীর থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া সম্ভব, প্রয়োজন হলে। মুখের অতিরিক্ত তিল দূর করার কতকগুলি উপায় —

(১) প্রতিদিন টক দই ব্যবহার করুন। এটি ধুয়ে ফেলবেন না, ময়েশ্চারাইজারের মতো করে লাগান এবং রেখে দিন ত্বকে।

(২) লেবুর রসে যদি আপনার এলার্জি না থাকে তবে নিয়মিত লেবুর রস লাগান। দিনে যতবার ইচ্ছা ব্যবহার করুন। দ্রুত ফল পাবেন।

(৩) মৌসুমি ফল ও সবজি দিয়ে ফেসপ্যাক বানিয়ে ব্যবহার করুন। এতে থাকতে পারে আলু, শশা, গাজর, লাউ, বাঁধাকপি, এপ্রিকট, স্ট্রবেরি, টমেটো ইত্যাদি।

(৪) দুধ দিয়ে মুখ ধুতে পারেন।

(৫) মধু সামান্য গরম করে আক্রান্ত স্থানে লাগালেও উপকার পাবেন।

(৬) পার্সলি রসের সঙ্গে লেবুর রস, কমলার রস এবং গাজরের রস মিশিয়ে নিন সমান পরিমাণে। এটি ব্যবহার করতে পারেন আপনার রেগুলার ক্রিম ব্যবহার করার ঠিক আগে। এতে ফ্রিকেলস দেখা যাবে না।

(৭) চিনি ও লেবুর রসের স্ক্রাব ভালো কাজে দেয়।

(৮) কাঁচা হলুদের রস ও তিলের গুঁড়ো একসঙ্গে মিশিয়ে নিন। জল দিয়ে পেস্টের মতো তৈরি করে আক্রান্ত জায়গায় লাগান।

(৯) নিয়মিত তরমুজের রস ব্যবহারে ফ্রিকেলসের দাগ হালকা হয় অনেকটাই।

অতিরিক্ত তৈলাক্ত থাকা, বয়সের প্রভাব, রোদে পোড়া, ড্রাগ নেওয়া, হরমোনের প্রভাব বা ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে মুখের ত্বকে কালো বা ফ্যাকাশে অগণিত তিল দেখা যায়। এর কোনোটি সামান্য উঁচু হয়, আবার কোনোটি চামড়ার উপর অযাচিত তিলের রং ধরে। এই স্কিন পিগমেন্টেশন তৈলাক্ত ত্বকের ক্ষেত্রে বেশি দেখা যায়। লোমকূপের ফাঁকে ফাঁকে তেল জমে থেকে একসময় সমস্যাটি হতে পারে। এই সমস্যা সমাধানে নিজেই নিতে পারেন। আরও কয়েকটি কার্যকরী ব্যবস্থার মাধ্যমে। শিখে নেওয়া যাক, প্রাকৃতিকভাবে স্কিন পিগমেন্টেশন সারিয়ে তোলার সহজ উপায়।

(১) টমেটো মাস্ক; এক চামচ পাকা টমেটোর রসের সঙ্গে এক চামচ ভেজানো ওটস ও আধা চামচ টকদই ভালোভাবে মিশিয়ে নিন। এবার মিশ্রণটি আক্রান্ত স্থানে ভালোভাবে লাগিয়ে ১৫ মিনিট অপেক্ষা করুন। এরপর কুসুম গরম জলে মুখ ধুয়ে হালকা মশ্চারাইজার লাগিয়ে নিন। টমেটোর রস পিগমেন্টেশনের বিরুদ্ধে খুব দ্রুত কাজ করে থাকে। তাই সপ্তাহে কমপক্ষে ৪ দিন নিয়মিত ব্যাবহার করলে দ্রুত পিগমেন্টেশন দূর হবে।

(২) হলুদের মাস্ক : রোদে পোড়ার জন্য যে তৈরি পিগমেন্টেশন সারাতে হলুদ গুড়ো অনেক উপকারী। এক টেবিল চামচ হলুদ গুড়োর সঙ্গে এক টেবিল চামচ লেবুর রস দিয়ে পেস্ট তৈরি করে নিন। এবার ঘুমানোর আগে আক্রান্ত স্থানে লাগিয়ে ১৫ মিনিট অপেক্ষা করে কুসুম গরম জলে মুখ ধুয়ে নিন। এই প্যাকটি দিনেও ব্যাবহার করা যাবে। কিন্তু এটা লাগিয়ে কখনো রোদে মুখ শুকানো যাবে না, এতে করে স্কিন কালো হয়ে যেতে পারে।

(৩) এলোভেরা জেল : শুধু এলোভেরা জেল সম্পূর্ণ মুখে ৩০ মিনিট অথবা সারারাত লাগিয়ে রাখুন। এরপর সকালে ঘুম থেকে উঠে অথবা লাগানোর ৩০ মিনিট পর কুসুম গরম জলে মুখ ধুয়ে নিন। যে-কোনো ধরনের পিগমেন্টেশনের জন্য এলোভেরা জেল খুবই উপকারী। সবচেয়ে ভালো ফলাফল পাওয়ার জন্য এটি প্রতিদিন রাতে ব্যাবহার করতে পারেন।

(৪) কমলার মাস্ক : স্কিন পিগমেন্টেশন থেকে মুক্তি পেতে আরেকটি প্রাকৃতিক পদ্ধতি হচ্ছে কমলার রস। এক্ষেত্রে ১ চামচ কমলার রসের সঙ্গে ১ টেবিল চামচ লেবুর রস ও আধা চামচ গোলাপ জল মিশিয়ে আক্রান্ত স্থানে ১৫ থেকে ২০ মিনিটের জন্য লাগিয়ে রাখুন। ফ্রেশ কমলার রশ না-পাওয়া গেলে কমলার শুকনো খোসা গুড়ো করেও এই ফেসপ্যাকটি তৈরি করা যায়। এটা সপ্তাহে দুই থেকে তিন বার করলে অনেক উপকার পাওয়া যাবে।

তিল বিশ্বাসীরা এবার নিশ্চয় খুব চিন্তায় পড়ে গেলেন! ভাবছেন তিল ভ্যানিশ করে দিলে কী হবে ভাগ্যের ভবিষ্যৎ? আপনি ভাগ্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতেই পারেন, কিন্তু আমি ভাবব গবেষকদের নিদান। ব্রিটেনের প্রায় তিন হাজার জনের উপর সমীক্ষা চালিয়ে এ তথ্য পাওয়া গেছে। ব্রিটিশ জার্নাল অব ডার্মাটোলজিতে প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনটিতে বলা হচ্ছে, তিল বা আঁচিলের যে-কোনো অস্বাভাবিকতাই ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে। গবেষকদের মতে, শরীরে তিল বা আঁচিলের সংখ্যা থেকে ত্বকের ক্যান্সারের বিষয়ে ধারণা করা যায়। কিংস কলেজ লন্ডনের গবেষকেরা প্রায় আট বছর ধরে নারীদের ওপর গবেষণা চালিয়েছেন এবং সেসব নারীদের ত্বকের ধরন, তিল ও আঁচিলের সংখ্যা সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য জোগাড় করেন। এর পাশাপাশি ত্বকের বিশেষ এক ধরনের ক্যানসার যেটিকে মেলানোমা বলা হয় ওই মেলানোমায় আক্রান্ত চারপোজন নারী ও পুরুষের ওপর গবেষণা চালান গবেষক দল। গবেষণা ফলাফলে দেখা যায়, যেসব নারীর ডান হাতে সাতটির বেশি তিল বা আঁচিল রয়েছে, তাদের ত্বকের ক্যানসারের ঝুঁকি বেশি। আর যাদের ডান হাতে ১১টির বেশি তিল বা আঁচিল আছে এবং সারা শরীরে একশোটির বেশি তিল বা আঁচিল আছে, তাদের মেলানোমার ঝুঁকি অনেক বেশি। গবেষকদের মতে, শরীরে কোনো তিল বা আঁচিল দেখে অস্বাভাবিক মনে হলে বা ব্যথা হলে অবশ্যই তাড়াতাড়ি কোনো ত্বকের ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। প্রয়োজনে সতর্ক ব্যবস্থা নিতে হবে।

বর্তমানে জ্যোতিষবাবুরা জ্যোতিষকে শাস্ত্র বলে চালাতে চায়, অনেকে আবার একটু দুঃসাহসিক হয়ে বিজ্ঞানও বলে থাকেন। বেদে জ্যোতিষশাস্ত্রের কথা নেই। বৈদিক যুগে জ্যোতিষ বলতে বোঝাত দিন, বছর, ঋতু ইত্যাদির গণিতসিদ্ধ বিচার পদ্ধতি। সেখানে আছে গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থানের সঙ্গে বৃষ্টি ও কৃষি সম্বন্ধীয় বিষয়। এই গ্রহ-নক্ষত্রদের সঙ্গে মানুষের ভাগ্য যুক্ত করা হয়নি। এই জ্যোতিষে ভবিষ্যকথন নেই, ভাগ্যকথা নেই, গ্রহ-নক্ষত্রের অহেতুক রাগরোষের কথা নেই। শুভাশুভ বিচার মুখ্য নয়। সংখ্যার রহস্যে আরোপ নেই। এই জ্যোতির্বিজ্ঞান গ্রিস যাযাবরদের হাত ধরে জ্যোতিষ হয়ে গেল। বস্তুত ভারতে গ্রিক শাসনের অবসানের পর রেখে গেছে মূর্তিপুজোর ধারণা, গণিত এবং অবশ্যই জ্যোতিষ। গ্রিকদের এই জ্যোতিষের মধ্যেই যেমন জ্যোতির্বিদ্যা ছিল, ছিল ঋতুকাল নির্ণয়। তেমনই গ্রহ-নক্ষত্র ইত্যাদি মানুষের ভাগ্যকে নিয়ন্ত্রণের আজগুবি বকওয়াস। এই বকওয়াসের জনক ছিলেন ব্যাবিলনের রাজারা, যাঁরা একইসঙ্গে পুরোহিত। তৎকালীন সমাজে ধর্মযাজকরাই শাসক হতেন। সম্ভবত ইরানের আয়াতোল্লা খোমেইনিই ছিলেন সর্বশেষ ধর্মীয় শাসক। যাই হোক, ব্যাবিলন থেকে গ্রিস, গ্রিস থেকে ভারতে সংক্রামিত হল জ্যোতিষ ভণ্ডামি। আলেকজান্ডারের আগমনের পর থেকে ষষ্ঠ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দীর্ঘ সময়কাল ফলিত-জ্যোতিষ’, অর্থাৎ মানুষের ভাগ্য গণনার বকওয়াস পদ্ধতি ভারতে টিমটিম করত– যত দিন যাচ্ছে, মানুষের চাহিদা বাড়ছে, না-পেয়ে হতাশ হচ্ছে ততই জ্যোতিষীবাবুদের রমরমা বাড়ছে। গলিতে গলিতে এখন জ্যোতিষী গড়াচ্ছে। হোর্ডিংয়ে ছড়াছড়ি। কত জ্যোতিষবাবু সরকারি চাকরিও করছেন, তৎসহ অতিরিক্ত রোজগার করছেন হাত দেখে, পাথর বেচে। অফিসের কলিগদের কাছেও পাথর বেচছেন। অথচ তৎকালীন সময়ে এইসব গ্রিক যাযাবর সম্প্রদায়ের মানুষরা ব্রাত্য বা পতিত বলে বিবেচিত হত (‘বৃহৎসংহিতা’ পড়ুন)। বৈদিক যুগে যে ভাগ্য বিচার ছিল ব্রাত্য, সেই ব্রাত্য সমাজের উঁচুস্তরে উঠে এসেছে এক শ্রেণির অন্ধ মানুষদের জন্য।

ভারতীয় জ্যোতিষীদের কাছে বরাহমিহিরই ভারতীয় জ্যোতিষশাস্ত্রের জনক। তিনিই ভারতীয় ফলিত-জ্যোতিষের, অর্থাৎ গ্রহ-নক্ষত্রের সঙ্গে ভাগ্যযুক্ত তত্ত্ব আদলটি সৃষ্টি করেন। কোন্ গ্রহদোষ কাটাতে কোন্ রত্ন ধারণ করতে হবে সেটাও বরাহমিহিরের মস্তিষ্কপ্রসূত। বরাহমিহিরের সময়কালে ফলিত জ্যোতিষকে ‘যবনশাস্ত্র বলা হত। আর্যরা এদেরকে ঘৃণা করতেন। গ্রিক যাযাবরেরাই মানুষের ভূত-ভবিষ্যৎ বলে রোজগার করত, পেট চালাত। বস্তুত সমাজে ভাগ্য-গণকদের কোনো মর্যাদা ছিল না। ম্লেচ্ছ’ বলে অবজ্ঞা করা হত। অবশ্য ভাগ্য-গণকদের হয়ে বরাহমিহিরই এগিয়ে এলেন। বরাহমিহির বুঝলেন মানুষের ভূত-ভবিষ্যৎ বলে দিলে মানুষ খুব খুশি হয়। মানুষকে খুশি করলে রোজগারও মন্দ হয় না। অতএব বরাহমিহিরই ভাগ্য-গণকদের জাতে তুলতে উঠেপড়ে লাগলেন। কিছু বইপত্রও লিখে ফেললেন। মনে রাখতে হবে, এই বরাহমিহিরই আর্যভট্টের আহ্নিক গতি তত্ত্ব মানতেন না। আর্যভট্টের সূর্যগ্রহণ, চন্দ্রগ্রহণ তত্ত্বও বিশ্বাস করতেন না। আমরাও কি আর্যভট্টের সিদ্ধান্ত বা তত্ত্ব মানলাম! যদি মানতাম তাহলে আর্যভট্টের চাইতে বরাহমিহির কিংবদন্তি হতে পারত না। ভারতে আজ আর্যভট্ট চরম উপেক্ষিত, অপরদিকে বরাহমিহিরের পুজো হচ্ছে। বরাহমিহিরের মতো ব্রহ্মগুপ্তও আর্যভট্টকে মানতেন না। ব্রহ্মগুপ্ত আর্যভট্টের গ্রহণতত্ত্বকে না-মেনে রাহু-কেতুর গল্পকেই বিশ্বাস করতেন। ভাবা যায়, ইনিই নাকি ষষ্ঠ শতকে ভারতীয় বিজ্ঞান চর্চায় বিশিষ্ট ব্যক্তি!

বিজ্ঞানের কিছু প্রাচীন শাখার মতো জ্যোতির্বিজ্ঞানও একটি সময় পর্যন্ত জ্যোতিষশাস্ত্রের মতো অপ-বিজ্ঞানের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। ভেবে দেখুন তো, কেমিস্ট্রি মানে রসায়ন ছিল অ্যালকেমি বিদ্যার সঙ্গে সম্পৃক্ত। কারণ প্রাচীনকালে পর্যবেক্ষণের সীমাবদ্ধতা ও গাণিতিক হিসাব পদ্ধতি অনুন্নত থাকার ফলে সে সময় ব্যক্তি বিশ্বাসের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ তালগোল পাকিয়ে এ ধরনের অপ-বিজ্ঞানের জন্ম নেয়। যাই হোক, সেই সময়কার মানুষজন রাতের আকাশ দেখে বুঝতে পেরেছিল যে, বছরের বিভিন্ন সময়ে কিছু নিদিষ্ট নক্ষত্রমণ্ডলের আবির্ভাব ঘটে। এসব পর্যবেক্ষণ তাদেরকে শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা সম্পর্কে বেশ আগে থেকেই পূর্বাভাস দিতে পারত। যেমন মিশরের প্রাণ নিলনদের বন্যা বছরের একটি নিদিষ্ট সময়ে হত এবং বন্যায় ভেসে আসা পলিতে উর্বর জমিতে ভালো চাষ হত। একটি নিদিষ্ট নক্ষত্রমণ্ডলে সূর্যের অবস্থানই তাদের বন্যার আগমনের কথা জানান দিত। এইভাবে ক্রমেই তারা চন্দ্র-সূর্য-নক্ষত্রের নিয়মবদ্ধ চলাচল আবিষ্কার করেছিল এবং আকাশে চন্দ্র-সূর্য-নক্ষত্রের অবস্থান ধীরে ধীরে তাদের ধর্মীয়, সামাজিক রীতিনীতিতে প্রভাব ফেলতে শুরু করে। আকাশে চন্দ্র-সূর্য-নক্ষত্রের নিয়মবদ্ধ চলাচল আবিষ্কার হওয়ার ফলে বর্ষপঞ্জি তৈরি হয়। কোথাও তৈরি হয় সৌর বর্ষপঞ্জি, আবার কোথাও চন্দ্র বর্ষপঞ্জি। সুমেরীয়রা ও ব্যাবিলনীয়ানরাই প্রথম বছরকে ১২ টি মাসে ভাগ করে। জ্ঞাত তথ্য অনুযায়ী বিভিন্ন মাসে বিভিন্ন নক্ষত্র মণ্ডলের উপস্থিতি দেখে ব্যাবিলনীয়ানরাই ৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সর্বপ্রথম রাশিচক্র প্রণয়ন করে। পরে তা মহাবীর আলেকজান্ডারের হাত ধরে মিশর, গ্রিসে, ভারতে আসে। এছাড়া ব্যাবিলনীয়ানরা ৭৮৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দেই তখনকার আবিষ্কৃত পাঁচটি গ্রহের সুশৃঙ্খল ও ধারাবাহিক তালিকা প্রণয়ন করেন। এর প্রায় ৯০০ বছর পর এই তালিকা ব্যবহার করে টলেমি গণিত সহযোগে ভূকেন্দ্রিক মানে পৃথিবী কেন্দ্রিক বিশ্ব মডেলের ধারণা দেন। কোপার্নিকাসের পূর্ব পর্যন্ত জ্যোতির্বিজ্ঞানে এই মডেলের ব্যাপক প্রভাব ছিল। আর এটিই এখন জ্যোতিষশাস্ত্রের প্রামাণ্য মডেল। এই টলেমিতেই জ্যোতির্বিজ্ঞান আর জ্যোতিষশাস্ত্র মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল। একদিকে তার ‘আলমেজেস্ট’ বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এক অনন্য গ্রন্থ, অপরদিকে তাঁর ‘টেট্রাবিবলস’ জ্যোতিষশাস্ত্রের একটি প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসাবে ব্যবহৃত হয়, বলতে গেলে এটি জ্যোতিষীদের কাছে বাইবেলের মতো। অর্থাৎ, সে সময় একই ব্যক্তি একসঙ্গে জ্যোতির্বিজ্ঞান ও জ্যোতিষশাস্ত্র চর্চা করত। আর সে। সময়ের রাজা বাদশাহদের জ্যোতির্বিজ্ঞানের বদলে জ্যোতিষশাস্ত্রে পৃষ্ঠপোষকতা এর অন্যতম একটি কারণ। তবে জ্যোতিষশাস্ত্র থেকে জ্যোতির্বিজ্ঞান আলাদা বা স্বতন্ত্র হতে শুরু করল ষোড়শ শতকে কোপার্নিকাসের সূর্যকেন্দ্রিক সৌর মডেলের আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে। এর ফলে টলেমির ভূকেন্দ্রিক মডেল বাতিল হয়ে যায়। তবে মোটা দাগে বলতে গেলে কেপলারের (১৫৭১-১৬৩০) পর থেকেই এই দুটি বিষয় পৃথকভাবে চর্চা হতে শুরু করে। কেপলারের সকল কাজ জ্যোতির্বিজ্ঞানের উপর হলেও তাঁর মাঝে জ্যোতিষশাস্ত্রের ভালো রকমের চর্চা লক্ষ করা যায়। পর্যবেক্ষণ ও গাণিতিক হিসাব পদ্ধতির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে কোপার্নিকাস, টাইকো, কেপলার, গ্যালিলিওদের হাত ধরে ধারাবাহিক ক্রমবিকাশের মাধ্যমে জ্যোতির্বিজ্ঞান তাঁর আজকের অবস্থানে এসেছে। অপরপক্ষে ধীরে ধীরে রাজতন্ত্র বিলোপ এবং জ্যোতিষীদের রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় উপস্থিতি, কদর হ্রাস পেতে থাকলে এই শাস্ত্রটির ব্যাপক ভাবে সামাজিকীকরণ ঘটে।

কাকে বলবেন! ভূত তো সরষের মধ্যেই ঢুকে বসে আছে। আমাদের দেশে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে তাবড় তাবড় শিক্ষিতজন বিজ্ঞানীরা পর্যন্ত জ্যোতিষ বিশ্বাস করে, এরাও কোনো যুক্তি-ব্যাখ্যা-কার্য-কারণের ধার ধারে না। এ যেন আর্ক লাইটের নীচে দাঁড়িয়ে নিজেই নিজের গায়ে কালি ঢেলে দেওয়া। সেই কারণে এরাও দিন-ক্ষণ-তিথি-নক্ষত্র বিচার করেই বিয়ে-শ্রাদ্ধ-অন্নপ্রাশন গৃহপ্রবেশ করে থাকেন। আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রীও দিন-ক্ষণ মেনেই প্রধানমন্ত্রীর সিংহাসনে বসেন। চলচ্চিত্রের পরিচালক- অভিনেতাও দিন-ক্ষণ দেখেই শুভ মহরৎ করেন। এমনকি সেই মুভি যদি জ্যোতিষ ও জ্যোতিষীদের বিরুদ্ধেও হয়, সেটাও দিন-ক্ষণ দেখেই হবে। দিন-ক্ষণ-তিথি-নক্ষত্রের কথাই যখন উঠল, তাহলে বাঙালিদের একমাত্র প্রিয় গ্রন্থ ‘পঞ্জিকা’ নিয়ে আলোকপাত করা যাক। এমন একটি বাঙালি হিন্দুঘর পাওয়া যাবে না, যাঁর ঘরে ‘পঞ্জিকা নেই। অবশ্য শুধু বাঙালি-হিন্দু নয়, ভারতের অন্যান্য প্রদেশেও ‘শুভদিন’ দেখার প্রথা আছে।

বর্ষপঞ্জি বা পঞ্জিকাকে বাদ দিয়ে ধর্মপ্রাণা ভিতু মানুষদের এক দণ্ডও চলে না। জ্যোতিষবাবুদের মতে ‘পঞ্জিকা বছরের প্রতিদিনের তারিখ, তিথি, শুভাশুভ ক্ষণ, লগ্ন, যোগ, রাশিফল, বিভিন্ন পর্বদিন ইত্যাদি সংবলিত গ্রন্থ। একে পঞ্জি বা পাঁজিও বলা হয়। প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে একে বলা হয়েছে ‘পঞ্চাঙ্গ। ভারতের অন্যান্য অঞ্চলেও এটি এই নামে পরিচিত। এর কারণ এতে বার, তিথি, নক্ষত্র, যোগ ও করণ প্রধানত এই পাঁচটি অঙ্গ থাকে। বাংলায় অবশ্য এটি ‘পঞ্জিকা’ নামেই সুপরিচিত। সভ্যতা বিকাশের শুরু থেকেই সমাজসচেতন ব্যক্তিদের চিন্তা-চেতনায় কালবিভাগের ধারণাটি আসে। প্রয়োজনের তাগিদে তখন বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন উপায়ে বছর, মাস, দিন ও তারিখ গণনার কৌশল আবিষ্কৃত হয়। কালক্রমে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন প্রয়োজনের পাশাপাশি পূজা-পার্বণের সময় নিরূপণও পঞ্জিকা প্রণয়নের অন্যতম লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। কালনিরূপণে বিভিন্ন দেশে ভিন্নরকম পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়েছে। বৈদিক যুগের ঋষিরা বিভিন্ন ঋতুতে নানারকম পূজা-পার্বণ করতেন। সেই কারণে তাঁরা বিশেষ ঋতুবিভাগের প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভব করেন। এসব উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে তাঁরা ঋতুভিত্তিক বছর হিসাব করে বছরকে উত্তরায়ণ ও দক্ষিণায়ন এই দু-ভাগে ভাগ করতেন। সূর্য উত্তরদিকে আগমন করা থেকে উত্তরায়ণ এবং দক্ষিণদিকে যাত্রা করা থেকে দক্ষিণায়ন গণনীয় হত। প্রাচীন মনীষিগণ বছরকে বারো ভাগে বিভক্ত করেন। যেমন– তপঃ, তপস্যা, মধু, মাধব, শুক্র, শুচি, নভস্, নভস্য, ইষ, ঊর্জ, সহস্ ও সহস্য। তপঃ থেকে শুচি পর্যন্ত উত্তরায়ণ এবং নভস্ থেকে সহস্য পর্যন্ত দক্ষিণায়ন। অনুমান করা হয় যে, এরূপ সময়বিভাগ যর্জুবেদের কালে (১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে) প্রচলিত ছিল। তিথির প্রচলন হয় অনেক পরে। শুধু সেই সময়কালে পূর্ণিমা, অমাবস্যা ও অষ্টকা ব্যবহৃত হত। কৃত্তিকা নক্ষত্র থেকে গণনা করে ২৭টি বা ২৮টি নক্ষত্রে ভূচক্রকে বিভক্ত করা হত। এটাই এতদঞ্চলের পঞ্জিকা গণনার আদিরূপ। বৈদিক সাহিত্যে ফাল্গুনী পূর্ণিমার উল্লেখ পাওয়া যায়। এতে অনুমিত হয় যে, তখন চান্দ্রমাস গণনার প্রচলন ছিল, যা পূর্ণিমান্ত মাস নামে পরিচিত।

১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের কাছাকাছি পঞ্জিকায় বছর আরম্ভ হত উত্তরায়ণ দিবস থেকে এবং তাতে ১২টি চান্দ্রমাস ব্যবহৃত হত। এই পঞ্জিকায় ৩০টি তিথি এবং ২৭টি নক্ষত্র গণনার নিয়ম ছিল। তখন প্রতি পাঁচ বছরে একটি যুগ গণনা করা। হত এবং এক যুগ পরপর এই পঞ্জিকা গণনার পদ্ধতি আবর্তিত হত। ওই সময় সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম তিথ্যন্ত প্রভৃতি কাল গণনার পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়নি। মাত্র মধ্যমমানে প্রতিদিন এক তিথি এক নক্ষত্র এই হিসেবে তিথ্যাদি নির্ণয় করা হত এবং মাঝে মাঝে এক-একটি তিথি হিসাব থেকে বাদ দেওয়া হত। পঞ্চবর্ষাত্মক যুগ ব্যতীত কোনো অব্দ গণনার প্রথা তখনও প্রবর্তিত হয়নি। দেড় হাজার বছর ধরে কালগণনা ও পূজা-পার্বণের সময় নিরূপণের কাজে এরূপ বেদাঙ্গজ্যোতিষ পঞ্জিকা খুবই সমাদৃত ছিল। গবেষকরা খ্রিস্টীয় চতুর্থ বা পঞ্চম শতকে তাঁরা সূক্ষ্ম গণনার কৌশল আয়ত্ত করেন। এসব বিষয়ে যাঁরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন তাঁরা হলেন আর্যভট্ট, বরাহমিহির, ব্ৰহ্মগুপ্ত প্রমুখ। তাঁরা পঞ্জিকার গণনাকে জ্যোতির্বিদ্যার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করেন এবং তিথ্যাদির সূক্ষ্ম কালগণনার সূত্রাদি দ্বারা দৈনিক গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান, লগ্ন, ক্ষণ, তিথি প্রভৃতির পূর্তিকাল পঞ্জিকার মধ্যে পরিবেশনের ব্যবস্থা করেন। এতে প্রয়োজনীয় তথ্যাদি সহজেই পঞ্জিকা থেকে পাওয়া যেত। এক্ষেত্রে সূর্যসিদ্ধান্ত জ্যোতির্বিদ্যার একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ও মূল্যবান গ্রন্থ। পরে সূর্যসিদ্ধান্তের ভিত্তিতেই পঞ্জিকার সবকিছু গণনা করা হত। পঞ্জিকার মধ্যে তখন স্থান পেত বার, তিথি, নক্ষত্র, যোগ ও করণযুক্ত প্রতিদিনের পঞ্চাঙ্গ এবং তা তালপাতায় লিপিবদ্ধ করে গণকঠাকুর বা ব্রাহ্মণরা বছরের প্রারম্ভে গ্রামে-গঞ্জে গিয়ে মানুষদেরকে অবহিত করতেন বা জনগণের সুবিধার্থে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে এর অনুলিপি সংরক্ষণ করতেন। এসবের ভিত্তিতে পূজা-পার্বণাদি বা ধর্মকৃত্য সাধনের কালও নির্ণয় করা হত।

সিদ্ধান্ত জ্যোতিষশাস্ত্রের উদ্ভবের আগে পঞ্জিকায় দৈনন্দিন গ্রহাবস্থান লেখা হত না। ক্রমে ক্রমে পঞ্চাঙ্গের সঙ্গে গ্রহসঞ্চারকালও পঞ্জিকায় লিপিবদ্ধ হতে থাকে। বিগত ১০০ বছরের অধিককাল যাবৎ বাংলা পঞ্জিকা মুদ্রিত হচ্ছে। পঞ্জিকায় এখন ফলিত জ্যোতিষের অনেক কিছু অর্থাৎ গ্রহ-নক্ষত্রের দৈনিক অবস্থানসমূহও পাওয়া যাচ্ছে। এখনকার পঞ্জিকায় ফলিত জ্যোতিষও বিশেষ স্থান দখল করেছে। জনগণের চাহিদার দিকে দৃষ্টি রেখে এখন পঞ্জিকায় বর্ষফল, মাসফল, রাষ্ট্রফল, দৈনিক রাশিফল প্রভৃতি মুদ্রিত হচ্ছে।

প্রাচীনের মধ্যে স্মার্ত রঘুনন্দন সম্পাদিত নবদ্বীপ পঞ্জিকার নাম পাওয়া যায়। রঘুনন্দনের পরে এর গণনার দায়িত্ব পালন করেন যথাক্রমে রামরুদ্র বিদ্যানিধি (রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সময়ে) এবং বিশ্বম্ভর জ্যোতিষার্ণব। কিছুদিন পরে এর গণনাকার্য বন্ধ হয়ে যায়। ইংরেজ আমলে কৃষ্ণনগরের জনৈক সমাহর্তার প্রচেষ্টায় বিশ্বম্ভর পুনরায় পঞ্জিকা প্রকাশের কার্যক্রম আরম্ভ করেন। এটি তখন পুথির আকারে লিখিত হত। ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে পঞ্জিকাটি মুদ্রিতাকারে প্রকাশিত হতে থাকে। তখন এটিই ছিল প্রথম মুদ্রিত পঞ্জিকা। পরবর্তীকালে ১২৯৭ বঙ্গাব্দ (১৮৯০) থেকে বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা প্রকাশিত হতে থাকে। অনুরূপ পঞ্জিকা বোম্বাই ও পুনা থেকেও প্রকাশিত হয়। পঞ্জিকার সর্বশেষ সংস্কার করা হয় ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে ভারত সরকারের তত্ত্বাবধানে। প্রখ্যাত বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার সভাপতিত্বে একটি পঞ্চাঙ্গ শোধন সমিতি (ক্যালেন্ডার রিফর্ম কমিটি) গঠন করে প্রচলিত পঞ্জিকাগুলির গণনাপদ্ধতির নিরীক্ষা ও প্রয়োজনবোধে সংস্কারের জন্য সুপারিশ করা হয়। এই সমিতির পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে পঞ্জিকা প্রকাশনার দায়িত্ব গ্রহণ করা হয়। সে মতে ভারতে ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে পঞ্জিকা প্রকাশিত হতে থাকে। বর্তমানে তা ১২টি ভাষায় প্রকাশিত হচ্ছে। বাংলা পঞ্জিকায় বাংলা, ইংরেজি ও হিজরি সনের তারিখ, মাস ও বছরের উল্লেখ থাকে। বাংলা বর্ষপঞ্জি গণনার সনাতন নিয়মে কোন্ বছরের কোন্ মাস কত দিনে হবে তা আগে থেকে নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। তা ছাড়া উক্ত গণনাপদ্ধতিতে কোনো মাস ২৯ দিনে আবার কোনো মাস ৩২ দিনে হয়ে থাকে। এ বিষয়টিকে জীবনের সর্বত্র বাংলা সন ব্যবহারের প্রধান অন্তরায় হিসাবে বিবেচনা করে ১৯৬৩ সালে বাংলা একাডেমির উদ্যোগে মোহম্মদ শহিদুল্লাহর সভাপতিত্বে একটি সংস্কার কমিটি গঠন করা হয়। উক্ত সংস্কার কমিটির প্রস্তাব অনুসারে বছরের প্রথম ৫ মাস ৩১ দিনের এবং পরবর্তী ৭ মাস ৩০ দিনের করা হয়। ১৯৮৮ সাল থেকে সরকারিভাবে খ্রিস্টীয় সনের পাশাপাশি বাংলা সন লেখার রীতি চালু হয় এবং তখন থেকে শহিদুল্লাহ কমিটির প্রস্তাবিত গণনাপদ্ধতি গ্রহণ করা হয়। বাংলাদেশের ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক জীবনের সঙ্গে বাংলা বর্ষপঞ্জির সম্পৃক্তির বিষয়টি মনে রেখে এবং প্রস্তাবিত গণনাপদ্ধতিকে সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত ও গ্রেগরীয় বর্ষগণনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার লক্ষ্যে একই বছর বাংলা একাডেমিতে একটি শক্তিশালী বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়। পঞ্জিকাকে আরও উন্নত ও ত্রুটিমুক্ত করার জন্য ১৯৯৫ সালে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রেরণায় একটি ‘টাস্ক ফোর্স’ গঠন করা হয়। পঞ্জিকা সংস্কারের জন্য তাদের সুপারিশ ছিল এরকম– (১) সাধারণভাবে বাংলা বর্ষপঞ্জি বৈশাখ থেকে ভাদ্র মাস পর্যন্ত প্রতিমাস ৩১ দিনে এবং আশ্বিন থেকে চৈত্র পর্যন্ত প্রতিমাস ৩০ দিনে গণনা করা হবে।

(২) গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জির অধিবর্ষে যে বাংলা বছরের ফাল্গুন মাস পড়বে, সেই বাংলা বছরকে অধিবর্ষরূপে গণ্য করা হবে এবং সেই বছরের ফাল্গুন মাস ৩১ দিনে গণনা করা হবে।

(৩) ১৪০২ সালের ১ বৈশাখ থেকে এটি কার্যকর হবে এবং তারিখ পরিবর্তনের সময় হবে আন্তর্জাতিক রীতি অনুসারে রাত ১২টায়। জনকল্যাণে গৃহীত এ পদক্ষেপ সর্বত্র প্রশংসিত হয়।

পঞ্জিকার ক্ষেত্রে চাঁদের তিথি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভাবা হয়। পূর্ণ চান্দ্রমাসের স্থায়িত্ব ২৯ দিন ১২ ঘণ্টা, ৪৩ মিনিট ১২ সেকেন্ড বা ২৯.৫ দিন। চাঁদ ৩৬০ ডিগ্রি অতিক্রম করে ২৯.৫ দিনে, তা হলে এক দিনে অতিক্রম করে ৩৬০ + ২৯.৫ = ১২.২০ ডিগ্রি, অর্থাৎ ২৪ ঘণ্টায় অতিক্রম করে ১২.২০ ডিগ্রি। তার মানে এক দিনের চাঁদ পশ্চিম দিগন্তের ১২.২০ ডিগ্রি ওপরে ওঠে। আবার চাঁদ যখন অস্ত যায় তখন ১ ডিগ্রি অতিক্রম করতে সময় লাগে ৪ মিনিট, তা হলে ১২.২০ ডিগ্রি অতিক্রম করতে লাগে ১২.২০ x ৪ = ৪৮.৮০ মিনিট এবং সর্বোচ্চ ৫০.৫২ মিনিট বা ৫১ মিনিট। অর্থাৎ প্রথম দিনের চাঁদ ৫১ মিনিটের বেশি পশ্চিম আকাশে থাকতে পারে না।

এই হল পঞ্জিকা। বস্তুত তিথি ও দিনের অংশকে বিভিন্ন করণ এবং যোগ নাম দিয়ে, তাদের শুভ অথবা অশুভ হিসাবে নির্ণয় করা সম্পূর্ণভাবে কল্পনাবিলাস, অবৈজ্ঞানিক জ্যোতিষগিরি! একটু আলোচনা করা যাক। মূলগতভাবে ভারতে দুই প্রকারের পঞ্জিকা দেখা যায়। একটি দৃকসিদ্ধ, অপরটি অদৃকসিদ্ধ। বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত, রাষ্ট্রীয় পঞ্চাঙ্গ ইত্যাদি হল দৃকসিদ্ধান্ত। অন্যটি গুপ্তপ্রেস, পি এম বাগচি ইত্যাদি পঞ্জিকাগুলি অদৃকসিদ্ধ (বাংলাদেশের হিন্দু বাঙালিরা ‘লোকনাথ ডাইরেক্টরি পঞ্জিকা’ এবং মুসলিম বাঙালিরা মোহাম্মদী পকেট পঞ্জিকা অনুসরণ করেন)। দূরবীন দিয়ে দেখা জ্যোতিষ্কদের অবস্থানের সঙ্গে গণিতের অবস্থানের সমন্বয় সাধনের নিরন্তর প্রক্রিয়ার ফলে অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল এফিমেরিসে অবস্থানগত নির্ভুল তথ্যাদি পাওয়া যায়। দৃকসিদ্ধ পঞ্জিকা জ্যোতিষ্কদের অবস্থান সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল এফিমেরিস থেকে সংগ্রহ করা হয়। প্রতিনিয়ত সব তথ্য আপডেট হয়ে থাকে। অপরদিকে, আনুমানিক ৪০০

খ্রিস্টাব্দে রচিত ‘সূর্যসিদ্ধান্ত’ গ্রন্থের উপর ভিত্তি করেই অদৃকসিদ্ধান্ত পঞ্জিকার প্রণেতাদের যত দৌড়াদৌড়ি। সূর্যসিদ্ধান্ত যে সময় রচিত হয়েছিল তখনও পর্যন্ত দূরবীন আবিষ্কার হয়নি। খালি চোখে জ্যোতিষ্কদের কতটুকু দেখা যায়! বস্তুত অদৃকসিদ্ধ পঞ্জিকার প্রণেতারা সূর্যসিদ্ধান্ত অনুসারে যে গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান। গণনা করেন তা প্রকৃত অবস্থানের সঙ্গে এক্কেবার মেলে না। কারণ বিশাল মহাকাশে গ্রহদের নির্ভুল অবস্থান জানার জন্য জ্যোতির্বিজ্ঞানের ‘অয়নচলন’ সূর্যসিদ্ধান্ত গ্রন্থে নেই। অদৃকসিদ্ধান্ত অনুসারে সূর্যগ্রহণ এবং চন্দ্রগ্রহণ নির্ণয় করলে সব গুবলেট হয়ে যাবে। তাই এঁরা সূর্যগ্রহণ এবং চন্দ্রগ্রহণ নির্ণয় জ্যোতির্বিজ্ঞানের নিয়ম অনুসারেই করে থাকেন। এসব ক্ষেত্রে অদৃকসিদ্ধান্তের প্রণেতাদের একমাত্র অবলম্বন ‘বাণবৃদ্ধিরসক্ষয়’। বাণবৃদ্ধিরসক্ষয়’ সূত্র অনুসারে তিথি বৃদ্ধি ৬৫ দণ্ডের বেশি এবং তিথি হ্রাস ৫৪ দণ্ডের কম হবে না, জ্যোতির্বিজ্ঞান এ সংজ্ঞা মেনে চলে না।

আমাদের পঞ্জিকায় যেন দেবতার বাণী। পঞ্জিকা ছাড়া এক পা-ও চলতে পারে না। কতটুকু মানেন? ঠিক যতটুকু ব্যক্তিগতভাবে কোনো অসুবিধা হয় না ততটুকুই। সামান্যতম অসুবিধা থাকলে নিকুচি করেছে পঞ্জিকার! অতএব নৈব নৈব চ। পঞ্জিকা বলছে –রবিবারের পঞ্চম, সোমবারের দ্বিতীয়, মঙ্গলবারের ষষ্ঠ, বুধবারের তৃতীয়, বৃহস্পতিবারের সপ্তম, শুক্রবারের চতুর্থ, শনিবারের যামাৰ্দ্ধ এগুলিকে বলে কালবেলা। কালবেলা মানে, এ সময় যাত্রা করলে মৃত্যু হয়, বিবাহ দিলে কন্যার মৃত্যু হয়, মাথা ন্যাড়া করলেও মৃত্যু অনিবার্য। কে আছেন? কোন্ নিকম্ম মেনে চলেন এসব নিষেধাজ্ঞা? ভাবুন তো, বলছে আপনি যদি এমন কোনো বারে সেই বারের অধিপতির দিকে পিছন ফিরে যাত্রা শুরু করে, তাহলে তার মৃত্যু ঠেকায় কে! কে ঠেকায় জানি না। তবে আমি নিজে বহুবার এ ধরনের যাত্রা করেছি। কিন্তু এখনও পর্যন্ত বহাল তবিয়তেই আছি। দিকশূলের বিধান শুনবেন নাকি? শুনুন– রবিবার ও শুক্রবারে পশ্চিমদিক, মঙ্গলবার ও বুধবারে উত্তরে, সোমবার ও শনিবারে পূর্বে এবং বৃহস্পতিবারে দক্ষিণে যাত্রা করলে ভয়ানক বিপদ। যাত্রা নাস্তি’ বলছে যে! বিবাহ প্রকরণে বলছে– দিনের বেলা বিয়ে করা চলবে না। দিনের বেলায় বিয়ে করলে কন্যা পুত্রকন্যাবিবর্জিত হন, বিরহানলদগ্ধা ও স্বামীঘাতিনী হয়, উচ্চবর্ণের কোনো মেয়েকে যদি নিম্নবর্ণের ছেলে বিয়ে করে তাহলে নির্ঘাত মৃত্যু। আমি প্রত্যন্ত গ্রামে-গঞ্জে দেখেছি রাত্রিবেলা অভ্যাগত অতিথিদের জন্য নিরাপদ নয় বলে দিনেরবেলাতেই বিয়ে সহ সমস্ত মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। অন্যান্য ধর্মেও বিয়ে অনুষ্ঠান দিনেরবেলাতেই হয়। এ নিয়ম এ বিধান যদি বুজরুকি না-হয়, তাহলে তো গ্রাম-গঞ্জ-অন্য ধর্মের সমাজ তো বিধবায় ভরে যেত, পুত্রকন্যাহীনা কন্যায় ভরে যত সেসব অঞ্চল। এখানেই শেষ নয়, পঞ্জিকা বলছে– “সুখপ্রসবমন্ত্র অশথপত্রে লিখিয়া প্রসূতির কেশের সহিত বাধিয়া দিলে প্রসবে কষ্ট হয়না।” হয়েছে নাকি এমন কোনো মিষ্টিমধুর অভিজ্ঞতা, কোনো অভিজ্ঞতা? এমন ঘটনা কি ঘটেছে কারোর, কখন আপনার সন্তান যন্ত্রণাহীন ভূমিষ্ঠ হয়ে গেছে আপনি বুঝতেই পারেননি?

সাহা পঞ্জিকা কমিটির প্রস্তাব অনুসারে ভারত সরকার বাংলা দৃকসিদ্ধ পঞ্জিকা ‘রাষ্ট্রীয় পঞ্চাঙ্গ’ রচিত হয়। রাষ্ট্রীয় পঞ্চাঙ্গতেও সংযোজিত হয়েছে পৈতে, অন্নপ্রাশন, বিয়ের দিনক্ষণ, গণ-দশা, শুভাশুভ বিচার। দৃকসিদ্ধ পঞ্জিকা ‘বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত’-এ পাওয়া যাবে শুভদিনের নির্ঘণ্ট, তর্পণবিধি, নিত্যপূজাবিধি, জ্যোতিষ বচনার্থ, শবদাহ ব্যবস্থা, ব্যক্তিগত বর্ষফল, রাষ্ট্রগত বর্ষফল, স্তব-কবচ প্রকরণ, ব্রত প্রকরণ ইত্যাদি। ভাষাচার্য সুকুমার সেন পঞ্জিকা বা পাঁজি প্রসঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেন –প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের পাঁজির মূল পার্থক্য হল, আমাদের পাঁজি ধর্মকর্ম করার জন্য। ওদের পাঁজি জ্যোতির্বিজ্ঞানের চর্চা করে। পাওয়া যায় কবে জোয়ারভাটা হবে, কোনদিন চাঁদের আলো পাওয়া যাবে, কোনদিন চাঁদের আলো পাওয়া যাবে না ইত্যাদি। অপরদিকে আমাদের পাঁজি জ্যোতিষবিজ্ঞানের চর্চা করে। তার সঙ্গে শ্রাদ্ধ-শান্তি জাতীয় পারফরমেন্স মিলেছে। তাই বলি আমাদের পাঁজিটা বুজরুকি।

আমি কালিদাস নামে এক জ্যোতিষবাবুকে জানতাম তিনি হাত-পা দেখতেন না, তিনি কেবলই রাশি রাশি কোষ্ঠী তৈরি করতেন। বেশিরভাগ হাত-পা দেখা জ্যোতিষবাবুরা কোষ্ঠী তৈরি করেন না। ওটা করা নাকি খুবই হ্যাপা! তাই অন্য কোনো অভিজ্ঞ জ্যোতিষবাবুকে দিয়ে অল্প কিছু অর্থের বিনিময়ে করিয়ে নেন। কোষ্ঠীর বিজ্ঞান-অপবিজ্ঞান নিয়ে আলোচনার আগে জ্যোতিষবাবুরা কী বলছেন সেটা দেখে নিই।

কোষ্ঠী হল জন্মপত্রিকা। এতে নবজাতকের জন্মসময়ে গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান ও সঞ্চরণ অনুযায়ী তার সমগ্র জীবনের শুভাশুভ নির্ণয় করা হয়। খ্রিস্টপূর্বকালে ভারতবর্ষে কোষ্ঠী গণনার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। গ্রিক বীর আলেকজান্ডারের পরে শাকদ্বীপ (পারস্য-কান্দাহার-সাইথিয়া-কাশ্মীরের উত্তরের দেশ) থেকে আগত জনগোষ্ঠী এ দেশে কোষ্ঠী গণনা পদ্ধতি প্রবর্তন করে বলে মনে করা হয়। খ্রিস্টীয় ছয় শতকের ভারতীয় জ্যোতিষী বরাহমিহিরের গ্রন্থে কোষ্ঠীপদ্ধতির প্রথম পরিচয় পাওয়া যায়। তাই অনুমান করা হয়, এর দু-তিনশ বছর পূর্বে ভারতবর্ষে কোষ্ঠী গণনা শুরু হয়। কোষ্ঠী গণনা পাশ্চাত্যের অনেক দেশেও প্রাচীনকাল থেকেই প্রচলিত আছে। কোষ্ঠী গণনার ক্ষেত্রে রাশি, গ্রহ ও লগ্ন তিনটি প্রধান বিষয়। মেষ, বৃষ, মিথুন, কর্কট, সিংহ, কন্যা, তুলা, বৃশ্চিক, ধনু, মকর, কুম্ভ ও মীন– এই বারোটি রাশি এবং রবি, চন্দ্র, মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র, শনি, রাহু ও কেতু– এই নয়টি গ্রহকে একটি চক্র বা ছকে বারোটি প্রকোষ্ঠে এ রাশিগুলি দেখানো হয়। পরে পঞ্জিকা অনুযায়ী জাতকের জন্মকালে গ্রহগুলির রাশিভিত্তিক অবস্থান নির্ণয়পূর্বক উক্ত চক্র বা ছকে রাশি অনুযায়ী গ্রহগুলির নামের আদ্যক্ষর লেখা হয়। এরপর লগ্ন নির্ণয় করে লগ্নবোধক রাশিটিকে ‘লং’ শব্দ দ্বারা নির্দেশ করলেই জন্মপত্রিকা তৈরি হয়ে যায়।

কোষ্ঠী গণনার এই চক্র বা ছকের অঙ্কনপদ্ধতি সর্বত্র একরকম নয়। ভারতবর্ষেই তিন রকম এবং পাশ্চাত্যে অন্যরকম। দক্ষিণ ভারত ব্যতীত অন্য সব স্থানের চক্রের গতি বামাবর্তী। বঙ্গদেশ ও দক্ষিণ ভারতের রাশিচক্র স্থির– মেষ রাশি থাকে সর্বদা শীর্ষদেশে এবং লগ্ন পরিবর্তনশীল। কিন্তু উত্তর ভারত ও পাশ্চাত্যে রাশিচক্র স্থির নয়, যে-কোনো স্থানে রাশি অবস্থান করতে পারে, তবে লগ্ন সর্বদাই একটি নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করে। উত্তর ভারতের ছকে লগ্ন থাকে শীর্ষদেশে এবং পাশ্চাত্যে থাকে বাম পাশে। প্রতিটি রাশির নির্দিষ্ট অধিপতি গ্রহ থাকে, যেমন মকর ও কুম্ভ রাশির অধিপতি শনি, মীন ও ধনু রাশির বৃহস্পতি, মেষ ও বৃশ্চিক রাশির মঙ্গল, বৃষ ও তুলা রাশির শুক্র, মিথুন ও কন্যা রাশির বুধ, কর্কট রাশির চন্দ্র এবং সিংহ রাশির রবি। লগ্ন হল সূর্য কর্তৃক মেষাদি রাশি সংক্রমণের মুহূর্ত, অর্থাৎ সূর্য যখন যে রাশিতে অবস্থান করে তখন লগ্নও হয় সে রাশির নামানুসারে। যেমন সূর্যের মেষ রাশিতে অবস্থানকালে যদি কারও জন্ম হয় তাহলে তার লগ্ন হবে মেষলগ্ন। লগ্নের মেয়াদ হল দুই ঘণ্টা, অর্থাৎ দুই ঘণ্টা পরপর লগ্ন পরিবর্তিত হয়। কোষ্ঠী তৈরির সময় এ রাশি, গ্রহ ও লগ্ন নির্ণয়ে কোনোরূপ ভুল হলে জাতকের ভবিষ্যৎ গণনাও ভুল হবে। কোষ্ঠী অনুযায়ী কারও ভবিষ্যৎ গণনার সময় তার জীবনের বিভিন্ন ঘটনা বারোটি ভাগে ভাগ করা হয়, যার নাম ‘ভাব’। বারোটি ভাব হচ্ছে তনু (শরীর), ধন, সহজ (সহোদর), বন্ধু (এবং মাতা), পুত্র (এবং বিদ্যা), রিপু (এবং রোগ), জায়া (বা স্বামী), নিধন (মৃত্যু), ধর্ম (এবং ভাগ্য), কর্ম (এবং পিতা), আয় ও ব্যয়। যে রাশিতে লগ্ন অবস্থিত সেখান থেকে তনুর বিচার শুরু হয়, তারপর পর্যায়ক্রমে অন্যান্য ভাব গণনা করা হয়। কোষ্ঠীবিচারের এসব মূল সূত্র প্রাচ্য-পাশ্চাত্য সর্বত্রই প্রায় একরকম। তবে ভারতীয় জ্যোতিষে একটি বিশেষ বিষয় হল দশা গণনা পদ্ধতি। জাতকের ভবিষ্যৎ জীবনে কখন কী ঘটবে তা এ পদ্ধতিতে নির্ণয় করা হয়। জাতকের জন্মনক্ষত্র অনুযায়ী দশা নির্ণীত হয়। দশা গণনার ৪২ রকম পদ্ধতি থাকলেও অষ্টোত্তরী ও বিংশোত্তরী পদ্ধতি দুটিই বেশি ব্যবহৃত হয়। অতীতে সম্ভ্রান্ত পরিবারে নবজাতকের কোষ্ঠী তৈরি একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ছিল। কোষ্ঠী তার জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে, বিশেষত বিবাহের ক্ষেত্রে গুরুত্ব সহকারে বিচার করা হত। পাত্রপাত্রী উভয়ের কোষ্ঠী বিচার করে কোনো বিষয়ে কোনো অশুভযোগ দেখা না-গেলে তবেই তাদের মধ্যে বিবাহ অনুষ্ঠিত হত। বর্তমানে কোষ্ঠী তৈরির তেমন প্রচলন না-থাকলেও জন্মানোর ও জন্মক্ষণ অনুযায়ী রাশি নির্ণয় করে হস্তরেখাবিদগণ মানুষের ভাগ্যগণনা করে থাকেন এবং হস্তরেখাবিদ্যা এখন একটি প্রায়োগিক বিদ্যা হিসেবে সমাজে প্রচলিত। (কৃতজ্ঞতা : দুলাল ভৌমিক)

জটিলতা এবং অনিশ্চয়তায় ভরা আমাদের জীবন। জীবন ছোটোই হোক কিংবা বড়ো –অনেক চড়াই-উৎড়াই পথ বেয়ে চলতে হয় সকলকে। অনেক ঘটনার স্রষ্টা আমরা নিজেরা হলেও, সব ঘটনাই আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। তবে আপনি আমগাছ পুঁতলে কখনোই সেই গাছে আম না-ফললেও জাম ফলতে পারে না। ফলাতেও পারবেন না। যেমনভাবে জীবন গড়বেন ফল পাবেন। তেমনই। খুব বেশি অন্যথা হয় না, যদি ফাঁকি না-থাকে। কোষ্ঠীতে যাই-ই লেখা থাক, সব বদলে যাবে আপনার অধ্যবসায়ে। কত বদলে যায় এরকম! কোষ্ঠীতে লেখা অনেক কিছুই মেলে না। আমরা মেলানোর ভান করি। ছল করি। যা মেলে তাতে মানুষের কিছু যায় আসে না। কোষ্ঠীতে হয়তো আছে ২৩ বছর বয়সে জাতক/জাতিকা মাথার কোনো সমস্যা হতে পারে। দেখা গেল ২৩ বছর বয়সে জাতকের পিতৃবিয়োগ হওয়ার দরুন মস্তক মুণ্ডন করতে হল। কোষ্ঠী পিতৃবিয়োগের সংবাদ আগাম না-জানাতে পারলেও মাথার মুণ্ডন অবস্থাকে ‘মাথার সমস্যা’ বলে মিলিয়ে দেওয়া যাবে।

সিন্ধুলিপি এখনও পড়তে পারিনি ঠিকই, কিন্তু মানুষের বিধিলিপি পড়ে ফেলতে জ্যোতিষবাবুরা খুবই পটু। আপনার মৃত্যু পর্যন্ত জ্যোতিষবাবুরা দেখতে পান কোষ্ঠী-কোডে। চ্যানেলে চ্যানেলে কী আওয়াজ তাঁদের! সব ভেক ধরে বসে আছে ছক হাতে ছকবাজিতে। কোষ্ঠী যে সম্পূর্ণ ভাঁওতা তা আমি প্রবন্ধের শুরুতেই আকাশবাণীর ঘটনাতেই (দুর্ঘটনাই বলতে পারেন) জানিয়েছি।

শুধু হাত-পা দেখলেই কি জ্যোতিষবাবুদের পেট মানবে! শুধু হাত দেখে বেড়ানো মানে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো বোঝায়। তাই হাত দেখে জাতককে খুশি করার জন্য যতই ভালো ভালো কথা বলি-না কেন, মন্দ কথা তো বলতেই হবে। আপনাকে ভয় পাইয়ে দিতে না-পারলে আমার রোজগার আসবে কোত্থেকে! পাথর বেচতে না-পারলে ফায়দা কীসের? আপনি ভিখারি হবেন, আমার অট্টালিকা। সেটা অবশ্য আপনার আর্থিক অবস্থা কেমন সেটা আঁচ করে নেওয়া হবে। তারপর রবি, মঙ্গল, বৃহস্পতি, শুক্র, রাহু, কেতু– যেকোনো একটার অবস্থা খুব খারাপ এবং খারাপ থাকার জন্য আপনার ভয়ংকর হতে পারে। যদি পাথরের ব্যবস্থা নেন– তবে আপনি মামলা মোকদ্দমায় জিতে যাবে, আপনার বা আপনার ছেলের বা মেয়ের চাকরি হয়ে যাবে, স্বামী বা স্ত্রী পরকীয়া ছেড়ে ঘরে ফিরে আসবে ইত্যাদি। ঘরের সোনা বিক্রি করেই হোক বা জমি জমি বিক্রি করেই হোক, পাথর যে আপনাকে ধারণ করতেই হবে। জ্যোতিষবাবু বলেছেন! কত রকম ভয় দেখিয়ে যে জ্যোতিষবাবুরা পাথর বেচেন, তা বলে শেষ করা যাবে না। সত্যিই পাথর পারে এসব করে দিতে? পাথর কী?

রত্নের প্রতি মানুষের আকর্ষণ চিরদিনের। সুপ্রাচীন কাল হতে রত্ন-পাথর ব্যবহৃত হয়ে আসছে। মানুষ বিশেষ ভাবে মূল্য দিয়েছে রত্নকে আজও দিচ্ছে। পান্না, হীরা, মুক্তা, পোখরাজ, ওপ্যাল, গোমেদ ইত্যাদি রত্ন-পাথরগুলোর বেশীর ভাগই খনিজ পদার্থ। যুগ যুগ ধরে প্রচন্ড চাপ ও তাপে ভূগর্ভে সৃষ্টি হয়ে থাকে রত্ন-পাথর। সে কারণেই প্রাকৃতিক বা খাঁটি রত্নগুলো দুষ্প্রাপ্য ও মূল্যবান। অনেক সাধারণ মানুয়ের ক্রয়ক্ষমতা ও ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। আসল রত্নের মূল্য প্রচুর। রাজা-বাদশারাই সেগুলি ব্যবহার করতে পারে। যেমন কোহ-ই-নুর বা কোহিনুর হিরে। একরকম বহু মূল্যবান রত্ন মণিমাণিক্য দিয়ে রাজা-বাদশা রানিদের মুকুট, কোমরবন্ধ, বাজুবন্ধে খোচিত করে বারফাট্টাই দেখাত। কোন্ রাজা কত শৌখিন কত তাঁর রত্নভাণ্ডার আছে তা দেখানোর আয়োজন চলত পোশাকে-মুকুটে। কোহিনুর হিরে ছিল শাহজাহানের অহংকার, এখন ব্রিটেনের রানি এলিজাবেথের অহংকার।

সেই মহামূল্যবান রত্নের মর্যাদা এখন গ্রহশান্তির জন্য তলানিতে এসে ঠেকেছে। এখন ঠগ-প্রতারক জ্যোতিষীবাবুদের রুজিরোজগারের পথ দেখাচ্ছে। রত্ন (Gems) এখন পাথরে (Stone) এসে জলের দামে বিকোচ্ছে। মামলা মোকদ্দমা জিতিয়ে দিচ্ছে, সন্তানের চাকরি পাইয়ে দিচ্ছে, মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে, অশান্ত সংসারে শান্তি ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে। মুরগি, থুড়ি রোগীদের মহামূল্যের রত্ন ব্যবহার করতে বললে তো সব অজ্ঞান হয়ে যাবে। তাই ভুখা থেকে চোখা –সকলেই যাতে পাথর কিনে ব্যবহার করতে পারে তার ব্যবস্থা হল। আধুনিক প্রযুক্তি আজ এগিয়ে এসেছে রত্নকে সুলভ করার কাজে। যাতে জ্যোতিষবাবুরা খেয়েপড়ে বেঁচে থাকে। কৃত্রিম উপায়ে রত্ন-পাথর তৈরি করতেও সক্ষম হয়েছে মানুষ। ফলে তৈরি করা সম্ভব হয়েছে কৃত্রিম রত্ন, যেগুলি সৌন্দর্যে প্রাকৃতিক রত্নের মতোই। কৃত্রিম রত্ন তৈরি হওয়ার ফলে রত্ন পাথর চলে এসেছে সাধারণের ক্রয় ক্ষমতার নাগালের ভিতর এবং পাওয়া যাচ্ছে দেশে দেশে। কৃত্রিম রত্ন তৈরির প্রচেষ্টাটি প্রচীনকালেও ছিল। প্রাচীন মিশরীয় এবং রোমানদের তৈরি বিভিন্ন রকম নমুনা জাদুঘরে দেখা যায়। তবে সেগুলি গুণগত মানে ও রূপে অক্ষম। কৃত্রিমভাবে তৈরি রত্ন-পাথরকে কয়েকটি সম্পূর্ণ আলাদা দলে বিভক্ত কর যায়। যেমন —

(১) ইমিটেশন অর্থাৎ নকল রত্ন।

(২) সিনথেটিক অর্থাৎ সংশ্লেষিত রত্ন এবং

(৩) কৃত্রিম ভাবে তৈরি ডাবলেট রত্ন।

(i) ইমিটেশন বা নকল রত্ন প্রাকৃতিক রত্নের অনুকরণেই করা হয়। চোখে দেখার মিলটুকু ছাড়া আর কোনো অর্থেই এরা প্রাকৃতিক বা আসল রত্নের মতো সাধারণত হয় না। এতে একই রকম দেখতে অন্য জিনিসকে সুকৌশলে রত্নের মতো করে তোেলা হয়। কিছুটা আসলের মতোই এই রত্ন প্রচুর তৈরি করে সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে। এদিক থেকে এদের উপযোগিতা আছে বৈকি। ইমিটেশন বা নকল রত্নের অধিকাংশ তৈরি হয় বিশেষ ধরনের কাঁচ থেকে। এ কাঁচ যেন খুব বিশুদ্ধ হয়, ক্ষুদ্র বাবলস বা বুদবুদ ইত্যাদি থেকে মুক্ত হয়, সে ব্যাপারে বিশেষ যত্ন নেওয়া হয় প্রাকৃতিক বা খাঁটি রত্নের মতো অনুরূপ রং দেওয়ার জন্য গলিত অবস্থায় এ কাঁচের সঙ্গে বিভিন্ন রকম ধাতব অক্সাইড মেশানো হয়। যেমন নীলের জন্য– কোবালট অক্সাইড, সবুজের জন্য– কুৎপ্রিক অক্সাইড, বেগুনির জন্য– ম্যাঙ্গানিজ অক্সাইড ইত্যাদি। কাঁচকে বিভিন্ন তলে ঘষে কাটা প্রাকৃতিক রত্নের রূপ ও ঔজ্জ্বল্য দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। এ সব কাটা তলের নিম্ন পৃষ্ঠগুলিতে অনেক সময় আয়নার মতো প্রতিফলকের ব্যবস্থা করা হয় যাতে প্রাকৃতিক বা আসল রত্নের দীপ্তিও খানিকটা আসে। এ ধরনের নকল রত্নকে অবশ্য প্রাকৃতিক রত্ন থেকে আলাদা করা মোটেই কোনো কঠিন কাজ নয়। এরা কম শক্ত বলে অনায়াসে এদের গায়ে আঁচড় কাটা যায়। খনিজ বা প্রাকৃতিক রত্নের তুলনায় এদেরকে স্পর্শে উষ্ণ অনুভূত হয়। আলোর প্রতিসরণাঙ্কের ক্ষেত্রেও এদের সঙ্গে প্রাকৃতিক রত্নের অনেক তফাত। তা ছাড়া এক্সরে ছবি নিলেই বোঝা যায় যে নকল রত্নের সত্যিকার কোনো কেলাসিত রূপ নেই।

(ii) অপরদিকে সংশ্লেষিত রত্ন সব অর্থেই প্রাকৃতিক রত্নের অনুরূপ। প্রকৃতিতে ধীরে ধীরে তৈরি না-হয়ে এটি বিভিন্ন উপাদানের সংশ্লেষণে যন্ত্রপাতির মাধ্যমে তৈরি হয়, এই অর্থেই শুধু এটি কৃত্রিম। বস্তুগত দিক থেকে, যেমন রাসায়নিক গঠন, কেলাসন, আলোকগুণ এবং অন্যান্য সব ভৌত গুণে এরা প্রাকৃতিক রত্নের সঙ্গে অভিন্ন। সংশ্লেষিত রত্ন তৈরি অনেক বেশি ব্যয়সাপেক্ষ, তাই শুধু দামি রত্নগুলির ক্ষেত্রেই এটি করা হয়। আজকাল সংশ্লেষিত হিরে, চুনি, নীলা, পান্না সবই পাওয়া যাচ্ছে। সংশ্লেষিত হিরের একটি সুবিধা হল একে ইচ্ছামতো রঙিন করা সম্ভব নানা রকম বিজাতীয় পদার্থের স্বল্প অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে। প্রথমদিকে কৃত্রিম হিরের আকার এত ছোটো হত যে তা রত্ন-পাথর হিসাবে ব্যবহারের উপযুক্ত ছিল না। কিন্তু সত্তরের দশক থেকে আকারে ও সৌন্দর্যে রত্ন হওয়ার উপযুক্ত হিরে সংশ্লেষিত হচ্ছে, এদের উৎপাদন ব্যয়ও ধীরে ধীরে কমে আসছে। চুনি ও নীলা আসলে একই রত্ন-পাথর, শুধু এদের রংটুকু ছাড়া অক্সিজেন ও হাইড্রোজেনের প্রবাহের মাধ্যমে সৃষ্ট তীব্র উত্তাপে অ্যালুমিনিয়াম অক্সাসাইডের গুঁড়োকে গলিয়ে এবং পরে তাকে কেলাসিত হতে দিয়ে চুনি ও নীলা সংশ্লেষিত করা হয়। তৈরির সময় সঙ্গে পরিমাণমতো ক্রোমিয়াম অক্সাইড মেশালে তা চুনির লাল রং হয়। আবার এর বদলে টিটানিয়াম অক্সাইড দেওয়া হলে সৃষ্টি হয় নীল রঙের নীলা। ১৯৩০ সালে প্রথম পান্না তৈরি সম্ভব হয়।

(iii) কৃত্রিম ডাবলেট রত্নগুলি হল এতে উপরে সত্যিকার রত্নের পাতলা করে কাটা একটু আবরণ থাকলেও তাকে জুড়ে দেওয়া হয় নকল অথবা নিকৃষ্ট রত্নের ব অংশের সঙ্গে। ডাবলেট রত্ন তৈরি করার কৌশলটিও কিন্তু বেশ লক্ষণীয়। এতে উপরের পাতলা দামি রত্নের অংশ নীচের নকল অংশের সঙ্গে উপযুক্ত আঠা দিয়ে জুড়ে দেওয়া হয়। হিরের ডাবলেটের ক্ষেত্রে পাতলা আসল হিরে, জারকন অথবা রক ক্রিস্টালের মতো অপেক্ষাকৃত সস্তা। কিন্তু অনুরূপ কেলাসের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়। অন্যান্য দিক থেকে একইরকম দেখতে হলেও চুনি, নীলা বা পান্নার ডাবলেটের জন্য সাধারণত উপরে এলমেডাইন নামক স্বচ্ছ কেলাসের পাতলা আবরণ এবং নীচে সঠিক রঙের কাঁচ ব্যবহৃত হয়।

কৃত্রিম রত্ন আধুনিক প্রযুক্তির একটি চমৎকার সুকৌশল। ইমেটেশন বা নকল রত্ন ও কৃত্রিম ভাবে তৈরি ডাবলেট রত্ন-পাথরগুলি বিচার-বিশ্লেষণের অনুপযুক্ত।

যদিও আসল রত্ন আপনি কোনোদিন দেখতে পাবেন না দু-একটা ছাড়া (কারণ সেগুলি পাথর নয়), তবুও সুযোগ পেলে রত্ন-পাথর আসল কি নকল কীভাবে বুঝবেন সেটা জেনে নেওয়া যেতেই পারে। বাজারে নানারকম রত্ন-পাথর পাওয়া যায়। চোখ ধাঁধিয়ে যায় তাদের রং আর উজ্জল বর্ণচ্ছটার আভা দেখলে। জ্যোতিষবাবু কিংবা জুয়েলারি থেকে যে রত্ন-পাথরটি কিনছেন হাজার হাজার টাকা গাঁটগচ্ছা দিয়ে, সেসব রত্ন-পাথরের ভিড়ে কী করে চেনা যাবে কোনটা আসল। রত্ন-পাথর আসল কি নকল বোঝার জন্য অভিজ্ঞ চোখ প্রয়োজন। প্রথমত, রত্ন-পাথরের আকৃতি, রং, স্বচ্ছতা ও এর ভিতর সুক্ষ যেসব অবাঞ্চিত পদার্থ থাকে, তার বিন্যাস দেখে প্রাথমিক ধারণা তৈরি করতে হবে। এ ব্যাপারে সঠিক ধারণা পাওয়ার জন্য অনুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্য নিতে হবে। তবে রত্ন পাথর যাচাই করার সব চেয়ে ভাল উপায় হল রত্ন-পাথরের প্রতিসরণাংক (Refractive Index)যাচাই করা। রত্ন-পাথরের প্রতিসরণাংক জানা থাকলে তালিকার সঙ্গে মিলিয়ে রত্ন-পাথরের সঠিক পরিচয় পাওয়া সম্ভব। কারণ কোনো বিশেষ রত্ন-পাথরের প্রতিসরণাঙ্ক নির্দিষ্ট, এর হেরফের বিশেষ দেখা যায় না। যেমন হিরের প্রতিসরণাংক ২.৪১৭। এ ছাড়া বিচ্ছুরণ (Dispersion) ধর্ম যাচাই করেও রত্ন-পাথর আসল কিংবা নকল তা যাচাই করা সম্ভব। তাছাড়া রত্ন-পাথরের কাঠিন্যতা (hardness), আপেক্ষিক গুরুত্ব (Specific gravity) ইত্যাদি ধর্ম যাচাই করে সহজেই নকল ও আসল রত্ন-পাথর চেনা যায়।

আসল রত্ন রাসায়নিক বিশ্লেষণ করলে —

(১) চুনি বা Ruby : লাল রঙের এই রত্নটির বৈজ্ঞানিক নাম কোরান্ডাম (Corundum), অ্যালুমিনিয়াম এবং অক্সিজেনই হল এর মূল উপাদান।

(২) নীলা বা Blue Sapphire : নীল বা হলুদ রঙের এই রত্নটির বৈজ্ঞানিক নামও কোরান্ডাম (Corundum), অ্যালুমিনিয়াম এবং অক্সিজেনই হল এর মূল উপাদান।

(৩) পান্না বা Emerald : সবুজ বা স্বচ্ছ রঙের এই রত্নটির বৈজ্ঞানিক নাম বেরিল (Beryl)। বেরিলিয়াম, সিলিকন, অক্সিজেন এবং অ্যালুমিনিয়াম হল মূল উপাদান।

(৪) বৈদুর্যমণি বা Cats Eye : হলুদ বা সবুজ বা খয়েরি রঙের রত্নটির বৈজ্ঞানিক নাম ক্রাইসোবেরিল (Chrysoberyl)। বেরিলিয়াম, অক্সিজেন, অ্যালুমিনিয়াম এই রত্নটির মূল উপাদান।

(৫) গোমেদ বা Garnet : লাল বা বাদামি বা কমলা রঙের এই রত্নটির বৈজ্ঞানিক নাম গারনেট (Garnet) লোহা, ম্যাগনেসিয়াম, ক্যালসিয়াম, অ্যালুমিনিয়াম, সিলিকন এবং অক্সিজেনই মূল উপাদান।

(৬) চন্দ্রকান্ত বা Moon Stone : ধূসর রঙের এই রত্নটির বৈজ্ঞানিক নাম ফেলসপার (Feldspar) পটাশিয়াম, সোডিয়াম, ক্যালসিয়াম, অ্যালুমিনিয়াম, সিলিকন এবং অক্সিজেন এই রত্নটির মূল উপাদান।

(৭) সূর্যকান্তমণি বা Sun Stone; স্বচ্ছ এই রত্নটির বৈজ্ঞানিক নাম কোয়ার্টজ (Quartz) মূল উপাদান সিলিকন, অক্সিজেন।

(৮) সন্ধ্যামণি বা Amethyst : স্বচ্ছ এই রত্নটির বৈজ্ঞানিক নাম কোয়ার্টজ (Quartz) মূল উপাদান সিলিকন, অক্সিজেন।

(৯) পোখরাজ বা Sapphire : স্বচ্ছ বা হালকা হলুদ বা হালকা নীল রঙের এই রত্নটির বৈজ্ঞানিক নাম টোপাজ (Topaz) মূল উপাদান অ্যালুমিনিয়াম, সিলিকন, অক্সিজেন, হাইড্রোজেন এবং ফ্লোরিন।

(১০) নীলকান্তমণি বা Tarquous : অস্বচ্ছ নীল বা নীলাভ সবুজ রত্নটির বৈজ্ঞানিক নাম টারকোয়েস (Tarquous)। কপার, ফসফরাস, অক্সিজেন, হাইড্রোজেন, ফ্লোরিন হল মূল উপাদান।

(১১) বৈক্ৰান্তমণি বা Zircon : অস্বচ্ছ এই রত্নের বৈজ্ঞানিক নাম জারকন। (Zircon) মূল উপাদান জার্কনিয়াম, সিলিকন ও অক্সিজেন।

(১২) মুক্তা বা Pearl : এটি খনিজ পদার্থ নয়, প্রাণীজ পদার্থ। স্বাভাবিক মুক্তা ঝিনুকের মাংসল শরীরের ভিতর পাওয়া যায়। সাদা রঙের এই জৈব রত্নটির বৈজ্ঞানিক নাম Organic Gems। মূল উপাদান হল ক্যালসিয়াম, কার্বন ও অক্সিজেন।

(১৩) প্রবাল বা Corel : এটি খনিজ পদার্থ নয়, প্রাণীজ পদার্থ। এক ধরনের ক্ষুদ্র জীবের মৃতদেহ। শুধুমাত্র সমুদ্রের নীচেই পাওয়া যায়। গাঢ় রক্তবর্ণ বা হলুদাভ রক্তবর্ণ, গেরুয়া সাদা রঙের রত্নটির বৈজ্ঞানিক নামও Organic Gems। মূল উপাদান হল ক্যালসিয়াম, কার্বন ও অক্সিজেন।

রত্নগুলি কীরকম ভাটের জিনিস দেখুন :

(১) চুনি এবং নীলার মূল উপাদান একই। অথচ গ্রহ আলাদা। অথচ গ্রহরোষও আলাদা। অথচ রবি খারাপ হলে চুনি দেওয়া হয় এবং শনি খারাপ হলে নীলা ধারণ করতে বলা হয়। মানে আমার হার্টের সমস্যা হলে যে ওষুধ নেব, আমাশয় হলেও সেই একই কন্টেন্টের ভিন্ন নামেরওষুধ নেব?

(২) সূর্যকান্তমণি এবং সন্ধ্যামণি রত্নের উপাদান একই। গ্রহ আলাদা। গ্রহরোষও আলাদা। রবি খারাপ হলে সূর্যকান্তমণি এবং শনি খারাপ হলে সন্ধ্যামণি। চুনি ও নীলার উপাদান এবং সূর্যকান্তমণি ও সন্ধ্যামণির উপাদান একেবারেই এক নয়। তাহলে ভিন্ন উপাদানে একই গ্রহের মাথা ঠান্ডা হয় কী করে? জ্যোতিষবাবুরা উত্তর দিতে পারেন না। কোনো জ্যোতিষীবাবু উপর চালাকি করতে গিয়ে বা ওভার স্মার্ট ন্যাজে-গোবরে হয়ে যান।

রত্ন আসল হোক কিংবা নকল হোক– জ্যোতিষবাবুরা সেগুলি ব্যবহার করার নিদান দেন গ্রহশান্তির জন্য। এই রত্নগুলি কীভাবে ক্রোধী গ্রহদের মাথা ঠান্ডা রাখার দায়িত্ব নেয়! জ্যোতিষবাবুরা কী বলেন সেটা আগে জেনে নিই– “মানবদেহের প্রতিটি অঙ্গ পরমাণুর সমন্বয়ে সৃষ্ট। সৌরমণ্ডলের গ্রহগুলিও পরমাণুর সমষ্টি। আর বিভিন্নপ্রকার রত্নগুলি এমন সব পদার্থের সমন্বয়ে সৃষ্ট যার উপস্থিতি মানবদেহেও বিদ্যমান। বিভিন্ন প্রকার রত্ন সরাসরি মানবদেহের ত্বককে স্পর্শ করে শরীরের উপর ইলেকটো ম্যাগনেটিক (Electro Magnetic) প্রভাব বিস্তার করে, মানবদেহের বিদ্যমান যে-কোনো পদার্থের অসামঞ্জস্যপূর্ণ উপস্থিতির সামঞ্জস্য রক্ষা করে বিভিন্নপ্রকার রত্ন বিভিন্ন গ্রহের রশ্মি অতিমাত্রায় আকর্ষণ বা বিকর্ষণ করতে পারে। তাই রত্ন ধারণ করে স্নায়ুর উপর বিশেষ বিশেষ গ্রহের রশ্মি যোগ বা বিয়োগ করে শক্তিশালী করা সম্ভব। ফলে স্নায়ুগুলি শক্তিশালী হবে ও নতুন চিন্তা চেতনায় জীবন প্রবাহের ক্ষেত্রে সুশৃঙ্খলভাবে এগিয়ে নেবে। আলোকরশ্মি, বায়ুমণ্ডল ভেদ করে পৃথিরীর ভূভাগের উপর পতিত হয়। গ্রহদের যেমন নিজস্ব তেজ বিকিরণের ক্ষমতা আছে, প্রতিটি রত্মেরও তেমনই পৃথক পৃথক তেজ আহরণের ক্ষমতা আছে। সূর্য এবং গ্রহমণ্ডল থেকে বেরিয়ে আসা এই আলোকরশ্মিই আমাদের উপর নানাভাবে কাজ করে। ভুগর্ভে বা সমুদ্রগর্ভে যে সকল রত্ন-পাথর সৃষ্টি হয় তাহাও ওই সৌররশ্মিরই রাসায়নিক ক্রিয়ার ফল। মানবদেহের উপর কসমিক রশ্মির (Cosmic Ray) প্রভাব বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকৃত। সূর্যের আন্ট্রাভায়োলেট রশ্মি (Ultra-Violet Ray) ও অপরাপর রং বিভিন্ন প্রকার রত্ম-পাথর এবং এর অভ্যন্তরীণ প্রচ্ছন্ন শক্তির উপর পরোক্ষ ও প্রত্যেক্ষভাবে ক্রিয়াশীল হয়ে মানবদেহে সংক্রামিত বিভিন্ন প্রকার ব্যাধির প্রতিকার করতে পারে। উল্লেখ্য, রত্নগুলিতেও বিভিন্ন রং বিদ্যমান। প্রাচীন জ্যোতিষবিগদগণ হাতের বিভিন্ন স্থানে বিবিধ গ্রহের অবস্থান ধরে সে স্থানগুলিকে বিবিধ রঙের Reflection উল্লেখ করেছেন। আর বিভিন্ন প্রকার রত্ন-পাথরের রং যে ভিন্ন ভিন্ন তার সঙ্গে গ্রহ ও নক্ষত্রের রঙর সাদৃশ্যও তাঁরা এভাবে পেয়েছেন। সুতরাং জ্যোতিষে রত্নের ব্যবহার অভ্রান্ত নয় বলেই মনে হয়। তবে রত্ন-পাথরের যথাযথ প্রয়োগ কৌশল। সম্পর্কে খুব অল্প সংখ্যক মানুষ অবহিত। একথা মনে রাখতে হবে যে, ভুল ঔষধ সেবনের কারণে বা প্রয়োজন ব্যতিত ঔষধ ব্যবহারে যেমন জীবননাশ বা ক্ষতি হতে পারে, তেমনই প্রয়োজন ছাড়া রত্ন ব্যবহার বা যথার্থ রত্নের ভুল ব্যবহারের কারণেও মারাত্বক ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনাও প্রচুর। তাই রত্ন-পাথর ব্যবহারে বিশেষজ্ঞ বা অভিজ্ঞ জ্যোতিষের পরামর্শ একান্ত কর্তব্য। ভুললে চলবে না যে অণুর সমম্বয়েই রত্নের উৎপত্তি আর দ্রব্য গুণ অনস্বীকার্য।”

এই হল জ্যোতিষবাবুদের রত্ন-পাথরের সপক্ষে বিবৃতি। পশু বা মানুষের রক্ত গায়ে মাখলে মানুষের শরীরের রক্তাল্পতা কমে যায়? যদি কেউ বলেন –হ্যাঁ, যায়। মাফ করবেন, তবে তার মানসিক সুস্থতা নিয়ে সন্দেহ জাগছে। তাহলে কি আপনি আয়রন ট্যাবলেট বা কুলেখাড়া শাকের রস না-খেয়ে পাথর বা ধাতু বা শিকড় ধারণ করবেন? তাই কি করেন? মানবদেহে অল্প বা নির্দিষ্ট পরিমাণে বিভিন্ন ধরনের মৌলিক দ্রব্যের বা ধাতুর উপস্থিতি আছে, শরীরে তার প্রভাবও আছে। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে সেইসব ধাতুর সঠিক ভারসাম্য রাখতে পরোক্ষভাবে প্রয়োগ করা হয়। সরাসরি লোহা চিবিয়ে চিবিয়ে খেলে বা শরীরে টন টন লোহা বাঁধলেও রক্তাল্পতা সারবে না।

তবে রত্নগুলির সৌন্দর্য অস্বীকার করা যায় না। রত্ন দিয়ে শরীরের বিভিন্ন অংশ সাজিয়ে নিতে কার না ভালো লাগে। সে তো অন্য কথা। পাঁচ রতি ছয় রতি নয়, শয়ে শয়ে রতি রত্ন দিয়ে শরীর সাজিয়ে ফেলুন না। কে বারণ করেছে? কিন্তু গ্রহশান্তির নামে নীলা-পোখরাজ মানুষকে পরিয়ে দেবেন মাথায় বাড়ি দিয়ে, সেটি হবে না। ভয় দেখিয়ে, রত্ন কিনতে বাধ্য করানো মানুষের জন্য আমরা লড়াই করব। মানুষের শরীরে রত্ন-পাথরের কোনো ভূমিকা নেই। রত্ন পাথরের কোনো ক্ষমতা নেই। ভালো কিছু করার ক্ষমতাও নেই, খারাপ কিছু করারও ক্ষমতা নেই। দুষ্ট প্রভাব বলতে যেমন কিছু নেই, তেমনি দুষ্ট প্রভাব হটানোরও কোনো ক্ষমতা রত্ন-পাথরের। রত্ন-পাথর আমাদের কোনো অবস্থা থেকেই বিচ্যুত ঘটাতে পারে না। রত্ন-পাথর মানুষের শরীরে কোনো বিক্রিয়া করে না। সারা শরীরে যেখানেই আপনি রত্ন-পাথর বাঁধুন-না কেন, একটাই কাজ করবে– সৌন্দর্য বৃদ্ধি। বেশ বিজ্ঞের মতো জ্যোতিষবাবুরা চরম আত্মবিশ্বাসের উপর ভর দিয়ে বলে থাকেন –রত্ন-পাথর বিভিন্ন ক্ষতিকারক রশ্মি শোষণ করে মানুষের শরীরকে রক্ষা করে। সেকি, কীসের রশ্মি? সেই রশ্মি আমাদের কী ক্ষতি করে? মামলা-মোকদ্দমায় হারিয়ে দেয়? আমার মেয়ের পরীক্ষায় পাস আটকে দেয়? আমার ছেলের চাকরি হতে বাধা দেয়, আমার পরকীয়ায় কাঠি দেয়? আমার জীবনের জীবনের দীর্ঘ সময় কাটিয়ে দিলাম কোনোরকম রত্ন-পাথর ছাড়াই। আমার পুরো জীবনটাই কুসুমাস্তীর্ণ। কণ্টক এলে দু-হাতে উপড়ে ফেলে দিয়েছি। যে ক্ষতিকারক রশ্মির কথা জ্যোতিষবাবুরা বলে থাকেন সেগুলি কী ওই গ্রহগুলি আসে? নাকি অন্য কোথা থেকে? গ্রহদের নামে যখন রত্ন-পাথর দেওয়া হয়, তাহলে ধরে নিতেই রশ্মি গ্রহগুলি থেকেই আসে। নানারকম মহাজাগতিক রশ্মি আছে বইকি। সেগুলি সত্যিই ক্ষতিকর। সেইসব ক্ষতিকর কোনোভাবেই পৃথিবীতে আসতে পারে না। বাস্তবে মহাজাগতিক রশ্মি হল এক ধরনের তড়িৎকণার অদৃশ্য বিকিরণ। শব্দ বা বিদ্যুতের মতোই অদৃশ্য এই বিকিরিত তড়িৎকণা বর্ণহীন। মহাকাশ থেকে নেমে আসা এই মহাজাগতিক রশ্মির অনেকটাই পৃথিবীতে পৌঁছোবার আগে বাধা পায় পৃথিবীকে ঘিরে রাখা চৌম্বক ক্ষেত্রে। এরপর যেটুকু মহাজাগতিক রশ্মি এসে পড়ে আমাদের পৃথিবীতে তা ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়া পৃথিবীর ওজোনস্তর পেরিয়ে সরাসরি পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসা অসম্ভব। এক-আধটু রশ্মি যে পৃথিবীতে আসে না, তা নয়। সেই রশ্মি রত্ন-পাথর কেন– পৃথিবীতে এখনও পর্যন্ত এমন কিছু আবিষ্কার হয়নি, যা দিয়ে ওইসব রশ্মি আটকে মামলা-মোকদমা ইত্যাদি জিতিয়ে দেওয়া যায়। অনেক জ্যোতিষবাবু বলেন– বিভিন্ন রত্ন-পাথরের মধ্য দিয়ে সূর্যরশ্মি প্রতিসৃত হয়ে শরীরে প্রবেশ করে গ্রহশান্তির কাজ করে। তাই নাকি? প্রতিসৃত হয়ে শরীরে প্রবেশ করে? প্রবাল বা পলা, মুক্তা, সূর্যকান্তমণি ইত্যাদি রত্নগুলি তো অস্বচ্ছ। অস্বচ্ছ বস্তুর মধ্য দিয়ে রশ্মি প্রতিসৃত কোনো সম্ভাবনা নেই। কোনো কোনো জ্যোতিষবাবুদের (জেম থেরাপিস্ট!!!) মতে– মানবদেহের নানা রোগের কারণ নাকি রং রামধনুর সাতটি রং নাকি মানবদেহে বিদ্যমান সাতটি স্নায়ুচক্রকে নিয়ন্ত্রণ করে। মানবদেহের সমস্ত অসুখবিসুখের নিয়ন্ত্রক নাকি ওই রং। কোন্ রঙের অভাবে কোন অসুখ হবে সেটা তাদের জানা। যেমন হলুদ রঙের অভাবে অর্শ, নীল রঙের অভাবে মৃগী হয়। এই রংগুলি শরীরে গুঁজে দিতে পারলে রোগমুক্তি। কীভাবে খুঁজবে? কেন? লাল রঙের জন্য চুনি পরিয়ে দেওয়া হবে, নীল রঙের জন্য নীলা বা নীলকান্তমণি বা পোখরাজ, খয়েরি বা সবুজ রঙের জন্য বৈদুর্যমণি বা পান্না, কমলা বা বাদামি রঙের জন্য গোমেদ ইত্যাদি। নাঃ, বিজ্ঞানে এসব ধান্দাবাজির কোনো জায়গা নেই।

জ্যোতিষ বিষয়ক বইগুলিতে দেখলাম কেতু খারাপ হলে ক্ষয়রোগ ও শুচিবাই আনে। কেতুর সঙ্গে শনিও যদি খারাপ হয় তবে অর্শ, ক্যান্সার ইত্যাদি হতে পারে। তা বৈদুর্যমণি রত্ন বা ক্যাটস আই ধারণ করালে ক্যান্সার ইত্যাদি সেরে যাবে? নীলা ধারণ করলেও ক্যান্সার সেরে যাবে। হিরে বা পীত পোখরাজ ধারণ করলে ডায়াবেটিস থেকে মুক্তি হবে। পীত পোখরাজ ধারণ করে বৃহস্পতিকে খুশি করতে পারলেই বন্ধ্যা নারীও গর্ভবতী হবে। নেতা-মন্ত্রীও হওয়া যায়। এরকম কঠিন কঠিন রোগ সারাতে পারে রোগীরা। তাহলে আর দরকার কী চিকিৎসা আর চিকিৎসকের?

জুয়েলারির মালিক, রত্ন-পাথরের ভেন্ডার-বিক্রেতা, উৎপাদনকারী, খননকারী, উত্তোলনকারীদের একমাত্র ভরসা এই জ্যোতিষবাবুরা। জ্যোতিষবাবুরাই একমাত্র সক্ষম নিন্মবিত্ত মধ্যবিত্ত সাধারণদের রত্ন-পাথর বিক্রি করা। রত্ন-পাথর বিক্রির বাজার তৈরি করে দিয়েছেন এই জ্যোতিষবাবুরাই। নাহলে একচেটিয়াভাবে ধনীরাই শুধুমাত্র রত্ন ব্যবহার করত। ব্যাবসা কী জমত? গ্রহরত্ন বা অন্য কোনো যদি মানুষের ভাগ্যকে বদলে দিতে পারে, তবে তো বলতে হবে মানুষের ভাগ্য এক্কেবারেই পূর্বনির্ধারিত নয়। প্রচেষ্টা এবং পরিবেশই মানুষের ভাগ্যের নির্ণায়ক।

গ্রহশান্তির জন্য জ্যোতিষবাবুরা রত্ন-পাথর ছাড়াও গাছের মূল বা শিকড় ও ধাতু বা মেটাল ব্যবহারের নিদান দেন। নাকের বদলে নরুন আর কী! কী আছে শিকড়-বাকড়ে? শরীরে শিকড়-বাকড় বাঁধলে দুষ্ট গ্রহরা পালিয়ে যায়? শিকড় বাকড়ের দোকানে লোকজন দেখি ভিড় করে থাকে, বিশেষ করে শনি মঙ্গলবারে। মূল-বিক্রেতারা মূল-ক্রেতাদের একটা কার্যকরী আপ্তবাক্য শুনিয়ে থাকে, তা হল– গাছ কথা বলে। গাছ তো কথা বলেই। কিন্তু জ্যোতিষবাবু, গাছকে কথা বলানোর ক্ষমতা আপনাদের নেই। মানে গাছদের কথা বলিয়ে গ্রহদের খেদাতে পারবেন না। ওটা চিকিৎসকদের কাজ, চিকিৎসকরাই পারেন। চিকিৎসকরাই পারেন চিকিৎসা পদ্ধতিতে। দেখুন কীভাবে পারে– জ্যোতিষবাবুদের মতে সূর্য বা রবি গ্রহের কোপ থেকে মুক্তি পেতে চাইলে বিল্বমূল অর্থাৎ বেলের শিকড় হাতে-গলায় বাঁধতে হবে। আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য বলছেন

(১) বেলের শিকড়ের ছাল ৩/৪ গ্রাম মাত্রায় গরম জলে ৪/৫ ঘণ্টা ভিজিয়ে ছেকে তার সঙ্গে একটু বার্লি বা খইয়ের মণ্ড ও অল্প চিনি মিশিয়ে খাওয়ালে শিশুদের বমি ও অতিসার বন্ধ হয়ে যায়।

(২) বেলের মূলের ছালচূর্ণ ৬ থেকে ১২ মাত্রায় দুধের সঙ্গে মিশিয়ে খেলে হৃদ্দৌর্বল্য দূর হয়। এছাড়া অনিদ্রা ও ঔদাসীন্যভাবও কেটে যায়।

(৩) বিল্বমূলের ছাল ১২ থেকে ১৪ গ্রেনের সঙ্গে ৬ গ্রেন জিরে বেটে গাওয়া ঘিয়ের সঙ্গে মিশিয়ে খেলে ধাতুতারল্যে বা শুক্রতারল্যে উপকার পাওয়া যায়। জ্যোতিষবাবুরা বলেন রবির প্রকোপে হৃদরোগ, শিরঃপীড়া হয়। আয়ুর্বেদশাস্ত্র এ অসুখগুলি সারবে বলেনি যে। তাহলে বিল্বমূল ব্যবহার করবেন কেন? ভেবেছেন?

জ্যোতিষবাবুদের মতে চন্দ্র বা চাঁদ গ্রহের কোপ থেকে মুক্তি পেতে চাইলে ক্ষীরিকা বা ক্ষীরা বা শশার মূল হাতে-গলায় বাঁধতে হবে। আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য বলছেন–

(১) সৌন্দর্য পিপাসু নারী-পুরুষেরা শশা ত্বকের যত্নে ব্যবহার করতে পারেন।

(২) পরিপাকতন্ত্র সুস্থ রাখতে এবং শরীরের অতিরিক্ত মেদ ঝরাতে শশার বিকল্প নেই।

(৩) জলশূন্যতা দূর করে সারাদিন কাজের ব্যস্ততার কারণে পর্যাপ্ত জল পান করা হয় না অনেকেরই। এই জল ঘাটতি দূর করতে শশার তুলনা হয় না। শোয় ৯০ ভাগ জল থাকায় শরীরের প্রয়োজনীয় জলের অভাব দূর করে শরীর সুস্থ রাখে।

(৪) শশা আমাদের শরীরের তাপ নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম। বাইরে রোদে ঘুরা ফেরা করার কারণে সূর্যের তাপে শরীরের চামড়ায় যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে তা থেকে শশা আমাদেরকে অনেকটাই স্বস্তি দিতে পারে। এজন্য শশা চাক চাক করে কেটে শরীরের রোদে পোড়া অংশে লাগালে উপকার পাওয়া যায়।

(৫) শশার ভিতরের জলীয় অংশ শরীরের অপ্রয়োজনীয় বর্জ্য শরীর থেকে বের করে দিতে সক্ষম। নিয়মিত শশা খেলে কিডনিতে পাথর হওয়া থেকে মুক্ত থাকা যায়।

(৬) সুস্থ থাকার জন্য আমাদের শরীরে প্রতিদিন যে পরিমাণ ভিটামিন দরকার হয় তার অধিকাংশের অভাব পূরণ করে থাকে শশা। ভিটামিন এ, বি ও সি– যেগুলি শরীরে শক্তি উৎপাদন ও শরীরের স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থাকে সক্রিয় রাখে, তার অধিকাংশই পূরণ করে থাকে শশা।

(৭) শোয় রয়েছে উচ্চ মাত্রায় পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ও সলিকন। তাই শরীরে এসবের অভাবজনিত সমস্যার মূল সমাধান হলো শশা।

(৮) শোয় রয়েছে প্রচুর পরিমাণে জল এবং অত্যন্ত কম পরিমাণে ক্যালরি। তাই আমার যারা শরীরের ওজন কমানোর ব্যাপারে সচেতন তাদের জন্য শশা বা ক্ষীরিকার একটি প্রধান উপাদান।

আয়ুর্বেদশাস্ত্র তন্নতন্ন করে তালাশ করেও শিকড় বা মূলের সন্ধান পেলাম না। জ্যোতিষবাবুরা বলেন চন্দ্রের প্রকোপে অতি আবেগপ্রবণতা, মানসিক অসুস্থতা, বাত, শ্লেষ্ম হয়। আয়ুর্বেদশাস্ত্র এ অসুখগুলি সারবে বলেনি যে। তাহলে ক্ষীরিকা মূল ব্যবহার করবেন কেন? ভেবেছেন?

জ্যোতিষবাবুদের মতে মঙ্গল গ্রহের কোপ থেকে মুক্তি পেতে চাইলে অনন্তমূল হাতে-গলায় বাঁধতে হবে। আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য বলছেন–

(১) ৩ গ্রাম আন্দাজ অনন্তমূল জলে বেটে দুধের সঙ্গে জ্বাল দিয়ে সেই দুধ দই পেতে পরের দিন সকালে খেতে হবে। অর্শে ভালো কাজ করে।

(২) অনন্তমূল ৩ গ্রাম আন্দাজ জলে বেটে অল্প সৈন্ধব লবণ মিশিয়ে সরবতের মতো দু-বেলা খেলে একজিমা ও হাঁপানি সেরে যায়।

(৩) ৩ গ্রাম আন্দাজ অনন্তমূল বেটে সকালে ও বিকালে দুধ বা জল সহ খেলে অনিয়মিত ঋতুস্রাবে উপকার হয়।

(৪) অনন্তমূল বেটে অল্প ঘি মিশিয়ে গায়ে মেখে কিছুক্ষণ বাদে স্নান করে নিলে গায়ের দুর্গন্ধ দূর হয়।

(৫) অনন্তমূলের কাথ সেবনে স্তনে দুধ বাড়ে।

(৬) গোরুর দুধে অনন্তমূল বেটে খাওয়ালে পাথুরি রোগে যন্ত্রণার উপশম হয়। জ্যোতিষবাবুরা বলেন মঙ্গল প্রকোপে অর্শ, রক্তপাত, ফোঁড়া, হাম, বসন্ত হয়।

আয়ুর্বেদশাস্ত্র কিছু কিছু অসুখ সারবে বললেও সেগুলি নির্দিষ্টভাবে তৈরি করে সেবন করতে হবে, বাঁধতে বলেনি। তাহলে অনন্তমূল ব্যবহার করবেন কেন? ভেবেছেন?

জ্যোতিষবাবুদের মতে রাহু গ্রহের কোপ থেকে মুক্তি পেতে চাইলে শ্বেতচন্দন মূল হাতে-গলায় বাঁধতে হবে। আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য বলছেন–

(১) যাদের ঋতুস্রাবে দুর্গন্ধ, পুঁজ বা মজ্জাবৎ স্রাব হতে থাকে, সেক্ষেত্রে চন্দন ঘষা অথবা ওই কাঠের গুঁড়ো গরম জলে ভিজিয়ে রেখে হেঁকে নিয়ে দুধে মিশিয়ে খেতে হবে।

(২) ঘামাচি নিশ্চিহ্ন করতে শ্বেতচন্দন ঘষার সঙ্গে হলুদবাটা ও অল্প একটু কর্পূর মিশিয়ে অথবা চন্দন ও দারুহরিদ্রা একসঙ্গে ঘষে মাখতে হবে।

(৩) হিঞ্চে শাকের রসে শ্বেতচন্দন ঘষা মিশিয়ে খেতে দিলে গুটি তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়ে এবং ভয়াবহতার উপশম হয়।

জ্যোতিষবাবুদের মতে কেতু গ্রহের কোপ থেকে মুক্তি পেতে চাইলে অশ্বগন্ধা মূল হাতে-গলায় বাঁধতে হবে। আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য বলছেন–

(১) শ্বেতী রোগে অশ্বগন্ধার মূল চূর্ণ করে দেড় বা দুই গ্রাম মাত্রায় সকালে ও বিকালে দু-বেলা দুধসহ খেতে হবে।

(২) অশ্বগন্ধার মূল চূর্ণ এক বা দেড় গ্রাম মাত্রায় নিয়ে গাওয়া ঘি এক চা-চামচ ও মধু আধ চা-চামচ মিশিয়ে সকালের একবার এবং বিকালে দিকে একবার একটু একটু করে চেটে খেলে ক্রনিক বঙ্কাইটিস সারে।

জ্যোতিষবাবুদের মতে বুধ গ্রহের কোপ থেকে মুক্তি পেতে চাইলে বৃহদ্বারক বা বিদ্যাধারক মূল, বৃহস্পতি গ্রহের কোপ থেকে মুক্তি পেতে চাইলে ব্ৰহ্মষষ্ঠী মূল এবং শুক্র গ্রহের কোপ থেকে মুক্তি পেতে চাইলে রামবাসক মূল হাতে-গলায় বাঁধতে হবে। আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য রচিত ‘চিরঞ্জীব বনৌষধি’ গ্রন্থে এই গাছটি সম্বন্ধে কিছু পাইনি। যা পাওয়া গেছে তাতে কোথাও বলা নেই মূলগুলি হাতে-পায়ে শনি/মঙ্গলবার বাঁধতে হবে। তা ছাড়া এই বিশেষ নিয়মে কিছু অসুখ-বিসুখ সারে বইকি, গ্রহ তুষ্ট হয় বলে কোথাও কিছু উল্লেখ নেই। নিমের ডাল বা শিকড় হাতে-পায়ে বাঁধলে যদি কারর তেতো স্বাদ অনুভূত হয় তাহলে মানবো শ্বেতচন্দনের মূল হাতে-পায়ে বাঁধলে রাহু তুষ্ট হবে।

জ্যোতিষবাবুরা ধাতু বা মেটাল ব্যবহার করতে বলেন। এইসব ধাতু ফুটপাথে বিক্রি হয়, জ্যোতিষবাবুদের কাছে থাকে না। এইসব ধাতুবিক্রেতারাও আবার অল্পবিস্তর জ্যোতিষী হাতফাতও দেখেন। রবির জন্য তামা বা সোনা ব্যবহার, চন্দ্রের জন্য রূপো, মঙ্গলের জন্য রূপো ইত্যাদি। মানবদেহে বিভিন্ন পরিমাণে ধাতুর উপস্থিতি আছে। ধাতুর কম/বেশি উপস্থিতিতে নানা ধরনের অসুখ-বিসুখ হয়। আয়ুর্বেদ, হোমিওপ্যাথ, অ্যালাপ্যাথিতে ওষুধ প্রস্তুতিতে ধাতুর প্রয়োগ হয়, ধাতুর ভারসাম্য রক্ষা হয়। মানুষ এবং অন্যন্য প্রাণীরা তাদের আহার্য ফল-মূল সবজি-মাছ-মাংস-ডিম খাওয়র মাধ্যমে তার শরীরের ধাতুর চাহিদা মেটায়। ফল-মূল-সবজি-মাছ-মাংস-ডিমে নির্দিষ্ট পরিমাণে লোহা, ম্যাগনেসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, জিংক সালফেট, দস্তা, সোনা, রূপা থাকে। এইসব ধাতুর অভাবে বা ধাতুর প্রাবল্যে মানুষের নানাবিধ অসুখবিসুখ হয়। সরাসরি কোনো ধাতু খাওয়া যায় না। তাই ওষুধ তৈরি করতে সেইসব ধাতুর প্রবেশ ঘটাতে হয়। ওষুধের স্ট্রিপ বা প্যাকেটে Composition পড়ে দেখুন। আয়ুর্বেদে স্বর্ণভস্ম, রৌপ্যভস্ম প্রয়োগ করা হয় নিশ্চয়। তাই বলে তামা-লোহা-সোনা-রূপা হাতে-পায়ে বাঁধলে অসুখবিসুখ সেরে যাবে? গ্রহরা সব পালিয়ে যাবে? তা কোনোদিন হয়? তাহলে দিল্লিতে উনুন জ্বালিয়ে কলকাতায় বসে ভাত রান্না করা যায় বিশ্বাস করতে হবে!

ভেবেছিলাম ধাতুর কথা লেখার পর উপসংহারে চলে যাব। হঠাৎই আমার এক বন্ধু রুদ্রাক্ষের কথা মনে করিয়ে দিলেন। রুদ্রাক্ষও নাকি গ্রহশান্তিতে করিৎকর্মা। দেখা যাক– আয়ুর্বেদের সংহিতাগ্রন্থে রুদ্রাক্ষ নামের কোনো বস্তুর ব্যবহার, এমনকি নামোল্লেখ পর্যন্ত পাওয়া যায় না। তবে অন্য নামে এটি ব্যবহৃত হয়েছে কি না সেটা আজও আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। রাজনিঘণ্ট’ নামে এক বৈদ্যক দ্রব্যাভিধানে এই গাছটির গুণাগুণের বর্ণনা দেওয়া আছে– এটি উষ্ণগুণসম্পন্ন; বাত, কৃমি, শিরোরোগ, ভূতগ্রহ, বিষনাশক এবং রুচিৎকারক। অসুখবিসুখের ব্যাপারে পরে আসছি। তার আগে দেখে নিই রুদ্রাক্ষের মাহাত্ম্য কতটা? একমুখী থেকে শুরু করে আটত্রিশমুখী পর্যন্ত রুদ্রাক্ষের সন্ধানও পাওয়া যায়। সহজলভ্য নয় বলে চোদ্দোমুখী থেকে একুশমুখী রুদ্রাক্ষের মূল্যও বেশি। গৌরীশঙ্কর, ত্ৰিযুতি– রুদ্রাক্ষ জগতে অত্যন্ত সুবিদিত হলেও সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। “গৌরীশঙ্কর রুদ্রাক্ষ” দেখলে মনে হয় দুটি রুদ্রাক্ষ বীজ একসঙ্গে জোড়া দেওয়া হয়েছে– যাকে শিব ও পার্বতীর প্রতীক বলে মনে করা হয়। যাঁরা বৌদ্ধ অনুসারী তাঁদের মধ্যে কলাবতীর শক্ত বীজের সঙ্গে রুদ্রাক্ষের দানা মিশিয়ে সংকর মালা তৈরি করতে দেখা যায়। রুদ্রাক্ষের মধ্যে সবচেয়ে দুর্লভ বোধ হয় সুশ্রী এবং গোলাকার একমুখী রুদ্রাক্ষ, যা আজকাল অতিশয় দুর্লভ। শোনা যায়, টাটা কোম্পানি ৭০ লক্ষ টাকা মূল্যের একটি একমুখী রুদ্রাক্ষ বংশপরম্পরায় রক্ষা করে আসছে।

জ্যোতিষবাবুদের ব্যাবসায়িক প্রবণতার কারণে প্রচার হয়েছে, রুদ্রাক্ষ যে-কোনো ধর্মের এবং যে-কোনো বয়সের নারী-পুরুষই ধারণ করতে পারে। গলায়, বাজুতে এবং কবজিতে। প্রচার হয়েছে গাছের তলায় পড়ে থাকা রুদ্রাক্ষ ব্যবহার্য নয়, গাছ থেকে চয়ন করতে হবে তবেই কাজে দেবে। রুদ্রাক্ষের লাল কালো হলুদ ধূসর নানা রং এবং এর সঙ্গে গ্রহ নক্ষত্রের প্রভাব, পাপস্খলন, দাম্পত্য জীবনে সুখ, ব্যাবসায়িক সাফল্য ইত্যাদি বিষয়গুলিকেও সম্পৃক্ত করা হয়েছে, যার পরিপূর্ণ বৈজ্ঞানিক ভিত্তি সম্পর্কে আমরা অজ্ঞাত।

অভিজ্ঞ ব্যক্তি ছাড়া রুদ্রাক্ষ ও ভদ্রাক্ষ নির্ণয় করা কঠিন ব্যপার। বাজারে নকল রুদ্রাক্ষ প্রায় ৯৮ শতাংশ। ২ শতাংশ খাঁটি রুদ্রাক্ষ ব্যবহার উপযোগী, তাও অনেক মূল্য। বিশেষ প্রক্রিয়ায় কাঠের গুড়ার সঙ্গে লোহা, সিসা, গ্যালিলিথ নামক রাসায়নিক পদার্থ মিশ্রণ করে রুদ্রাক্ষ তৈরি করা হয়, যার বড়ো বাজার হচ্ছে নেপাল, বোম্বে ও বাঙ্গালোরে সহ গোটা বিশ্বে। যেহেতু নেপালে রুদ্রাক্ষ বৃক্ষ জন্মে, তাই বিদেশিরা মনে করে থাকেন নেপালেই খাঁটি রুদ্রাক্ষ পাওয়া যায়। নেপালে ব্যবসায়ীরা ৩/৪ হাজার টাকায় খাঁটি রুদ্রাক্ষের একটি পিসও সরবরাহ করতে পারেন না অপরদিকে ৮/৯ টাকায় নকল পেয়ে যাবেন। আগে নকল জিনিস চেনার চেষ্টা করতে হবে, কারণ নকল না চিনলে নকল সম্পর্কে জ্ঞান না থাকলে আসল চেনা যায় না। খাঁটি রুদ্রাক্ষের দানাতে ৫০.০৩১% কার্বন, ০.৯৫% নাইট্রোজেন, ১৭.৮৯% হাইড্রোজেন এবং ৩০.৫৩% অক্সিজেন বিদ্যমান। ভালো বা আসল রুদ্রাক্ষ চেনার উপায় বা লক্ষণ– যে রুদ্রাক্ষ সবদিকে সমান, কোথাও বিকৃত, বাঁকা, উঁচু-নীচু বা ভাঙ্গা-চোরা নেই সেই রুদ্রাক্ষ সব থেকে ভালো। এর কিনারাগুলি বেশ স্পষ্ট থাকবে আর গায়ের কাঁটা কাঁটা দাগগুলি বাইরে বেরিয়ে থাকে। যে রুদ্রাক্ষ জলে ডুবে যায়, দুটো তামার টুকরোর মধ্যে রাখলে ঘুরতে থাকে উজ্জল ও ভারী হয় এমন রুদ্রাক্ষ সবচেয়ে ভাল। একে সর্বোত্তম বলে মানা হয়। এই রুদ্রাক্ষ সবচেয়ে বেশি উপকারী। হিসাবে বলা যায়। কবিরাজি মতানুসারে যে ব্যক্তি রুদ্রাক্ষ সঠিক নক্ষত্র, তিথি, সময় অনুযায়ী ধারণ করেন তার কোনো রোগ হতে পারে না। সেকি, পৃথিবীর ৭০০ কোটি মানুষ যদি সকলেই রূদ্রাক্ষ ধারণ করে বসে থাকে তবে তো সব চিকিৎসকদের চিকিৎসা ছেড়ে আকাশের তারা গুণতে হবে! বিশ্বাসীদের ধারণা– রুদ্রাক্ষের ক্ষমতা, ধারণ করার নিয়ম, পুজো মন্ত্র যা সঠিকভাবে অনুসরণ করলে মানুষের জীবনে শান্তি আসবেই। বাপ রে, এদের তো ধরে দশ-পাঁচটা নোবেল দিয়ে দেওয়া দরকার।

জ্যোতিষবাবুরা বলেন যেমন মুখ, তেমন ফল। এটাই মানুষের বিশ্বাস। যেমন ধরুন–

(১) সপ্তমুখী রুদ্রাক্ষ: এই শ্রেণির রুদ্রাক্ষের নাম ‘অনন্ত মাতৃকা’। এ রুদ্রাক্ষ ধারণে সামাজিক প্রতিষ্ঠা, অর্থ মান, যশ ও প্রতিপত্তি লাভের পথ সুগম হয়ে থাকে। রাশিচক্রে রাহুগ্রহ রবি ও চন্দ্র যুক্ত হয়ে লগ্নে দ্বিতীয়ে, চতুর্থে, পঞ্চমে, ষষ্ঠে, সপ্তম, অষ্টমে, নবম, দশমে এবং দ্বাদশে অবস্থান করলে বা কোনোভাবে অশুভ হলে এ গ্রহের শান্তির নিমিত্ত উক্ত রুদ্রাক্ষ উজ্জীবন করতে হয়। ১০৮ বার মন্ত্র জপ করে উক্ত রুদ্রাক্ষ কণ্ঠে ধারণ করলে রাহু গ্রহের সমস্ত কুফল বিনষ্ট হয় অনেকের বিশ্বাস।

(২) অষ্টমুখী রুদ্রাক্ষ: এই রুদ্রাক্ষের দুটি নাম ‘বিনায়ক’ ও ‘বটুকভৈরব’। শনিগ্রহ ও রাহুর অশুভ প্রভাব খর্ব করে। এ রুদ্রাক্ষ ধারণে হঠাৎ আঘাত পাওয়া থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। দুষ্কৃতকারীদের হাতে আক্রান্ত হওয়া থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। রাশিচক্রে শনি ও রাহু অশুভ থাকলে উক্ত রুদ্রাক্ষ যথাবিধি সংস্কারপূর্বক পুরুষের ডান বাহুতে এবং স্ত্রীলোকের বাম বাহুতে ধারণীয়। এ রূপে বিনায়ক মন্ত্র পাঠ করে বা বটুক ভৈরব মন্ত্র এ মন্ত্রে বটুক ভৈরবের পুজো করে এবং পরে জপ করে ও পরে বীজমন্ত্র জপ করে উক্ত রুদ্রাক্ষ ধারণ করলে সমস্ত অশুভ প্রভাব দূরীভূত হয়।

(৩) নবমুখী রুদ্রাক্ষ: এই রুদ্রাক্ষের অন্য নাম ‘মহাকাল ভৈরব’। ধারণে জীবনে উন্নতির সূচনা যায়, সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও জয়লাভ করা হয়। দুর্ঘটনা ও হঠাৎ মৃত্যুর হাত থেকেও রক্ষা পাওয়া যায়। ধারণের পূর্বে মন্ত্র উচ্চারণ করে এ রুদ্রাক্ষের উজ্জীবন বা প্রাণসঞ্চার করে নিতে হয়। মন্ত্র পাঠের পর উচ্চারণ করতে হয়। বুদ্ধিবৃত্তিজনিত কাজকর্মের ক্ষেত্রে নানাভাবে প্রচুর সুফল দান করে এ রুদ্রাক্ষ। রাশিচক্রে বৃহস্পতি গ্রহ মকরে নীচস্থ, মকরস্থানে অবস্থান করলে, বা মারকস্থ হলে এবং ষষ্ঠ, অষ্টম, দ্বাদশ স্থানে অবস্থান করলে কিংবা কোনোভাবে অশুভ হলে এ গ্রহের শান্তির নিমিত্ত উপরোক্ত রুদ্রাক্ষ যথাবিধ সংস্কার পূর্বক ধারণের পর মন্ত্র জপ করে ‘বৃহস্পতয়ে’ এ বীজমন্ত্র জপের পর পুরুষের দক্ষিণ বাহুতে এবং স্ত্রীলোকের বামবাহুতে ধারণ করলে সকল অশুভ বিনাশ হয়।

(৪) দশমুখী রুদ্রাক্ষ: এ শ্রেণির রুদ্রাক্ষ দুর্লভ। এর অন্য নাম ‘মহাবিষ্ণু’। মর্যাদা, প্রতিষ্ঠা, সুনাম, খ্যাতি, সম্মান, পার্থিব সমৃদ্ধি, কর্মদক্ষতা এবং ব্যাবসায়িক সাফল্য অর্জনে সহায়ক এ রুদ্রাক্ষ। প্রেতাদি কর্তৃক অনিষ্টকর প্রভাব থেকেও মুক্ত হওয়া যায়। রাশিচক্রে বুধ গ্রহ নীচস্থ শযুক্ত ও শত্রুক্ষেত্রগত, দ্বিতীয়, ষষ্ঠ, অষ্টম ও দ্বাদশ স্থানে অবস্থান করলে বা কোনোভাবে পীড়িত হলে উক্ত রুদ্রাক্ষ যথাবিধি মন্ত্রোচ্চারণপূর্বক সংস্কার করে ধারণ করতে হয়। মন্ত্র পাঠ ও জপ করে জপের পর উক্ত রুদ্রাক্ষ কণ্ঠে ধারণ করলে সমস্ত অশুভ দূরীভূত হয়।

৫) একাদশমুখী রুদ্রাক্ষ: এটি একটি বিশেষ জাতের রুদ্রাক্ষ। এর অন্য নাম ‘মহামৃত্যুঞ্জয়’। মেয়েদের নানা অসুখের ক্ষেত্রে একান্তভাবেই সুফল প্রদানকারী, আত্মবিশ্বাসের অভাব ঘটলে, আত্মহনন চিন্তা এসে মনকে ও মেজাজ খিটখিটে স্বভাবের হয়ে উঠলে এ রুদ্রাক্ষ ধারণে তার উপশম হয়। মন্ত্র উচ্চারণযোগে রুদ্রাক্ষ উজ্জীবিত করে ধারণ করা প্রয়োজন। রাশিচক্রে শুক্র ও মঙ্গল অশুভ থাকলে মন্ত্রে যথাবিধি সংস্কার করে মন্ত্র জপ করে ডান হাতে ধারণ করলে সমস্ত অশুভ প্রভাব নাশ হয়।

(৬) দ্বাদশমুখী রুদ্রাক্ষ: এর অন্য নাম ‘অর্ক’ বা ‘আদিত্য’। এ রুদ্রাক্ষ রবি ও রাহুর অশুভ প্রভাবকে প্রশমিত করে। রবি যখন মকরে বা কুম্ভরাশিতে অবস্থিত হয়ে অশুভদশা প্রাপ্ত হয় তখন এ রুদ্রাক্ষ ধারণ করলে সকল কুফল নষ্ট হয়। ব্যাবসায়িক মন্দা বা অসাফল্য নিবারণ করতে মন্ত্র সহযোগে এ রুদ্রাক্ষকে উজ্জীবন করে ধারণ করতে হয়। মন্ত্র উচ্চারণ করে ১০৮ বার জপের পর রুদ্রাক্ষটি কণ্ঠে ধারণ করলে সমস্ত অশুভ বিনষ্ট হয়।

(৭) এয়োদশমুখী রুদ্রাক্ষ: এর অপর নাম কাম। এর ধারণে সর্বভাবেই কামনীয় বিষয়ের প্রাপ্তিযোগ ঘটে। এ রুদ্রাক্ষ ধারণে উচ্চাকাঙ্ক্ষার পরিপূরণ হয়। চিন্তামণি মন্ত্র সহযোগে এ রুদ্রাক্ষ উজ্জীবন করতে হবে। অতঃপর মন্ত্র ১০৮ বার বীজমন্ত্র জপ করে ডান হাতে ধারণ করলে সমস্ত পাপ দূর হয় ও সকল মনোরথ সিদ্ধি হয়। এর ধারণে চন্দ্র ও শুক্রের অশুভ প্রভাব নাশ হয়ে থাকে।

(৮) চতুর্দশমুখী রুদ্রাক্ষ: এই রুদ্রাক্ষ ‘শ্রীকণ্ঠ’ নামে পরিচিত। এই রুদ্রাক্ষ ইন্দ্রিয় সংযমে সাহায্য করে। পঞ্চমুখ হনুমানমন্ত্র সহযোগে একে উজ্জীবিত করতে হয়। মন্ত্র পাঠ করে বীজমন্ত্র জপ করে ধারণ করলে শুক্রগ্রহের সমস্ত অশুভ বিনষ্ট হয়। মন্ত্র ১০৮ বার জপ করে ধারণ করলে বৃহস্পতি ও রবির সমস্ত অশুভ প্রভাব নষ্ট হয়ে থাকে।

রুদ্রাক্ষ মৃগীরোগীদের জন্যেও উৎকৃষ্ট। সংক্রামক রোগ, বিশেষত বসন্তরোগ প্রতিষেধক বলে বহু মানুষ শরীরে ধারণ করে। রাজস্থানের বৈদ্য সম্প্রদায় এই রোগে রুদ্রাক্ষ ঘষে গায়ে লাগাতে দিয়ে থাকেন। শ্লেষ্মর আধিক্যে যেসব রোগ বিসুখ সৃষ্টি হয়, কোনো কোনো প্রদেশে এটি ঘষে খাওয়ানো হয়। যক্ষারোগের প্রথমাবস্থায় তুলসীমঞ্জরীর সঙ্গে রুদ্রাক্ষ ঘষে খাওয়ালে চমৎকার ফল দেয় শুনেছি। এছাড়া রোগীর নাড়ী ক্ষীণ হয়ে আসতে থাকলে হৃদযন্ত্র সক্রিয় রাখতে গ্রামবাংলার প্রাচীন বৈদ্যকুলের ‘কোরামিন’ ছিল, রুদ্রাক্ষ ঘষা ও মধু দিয়ে মকরধ্বজ খাওয়ানো হত। ভারতীয় চিকিৎসা শাস্ত্রকে যাঁরা প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন তাঁদেরই উত্তরসূরি আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য। আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য এ বিষয়ে বলেন– আয়ুর্বেদের মূল সিদ্ধান্ত হল, প্রতি দ্রব্যের মধ্যে চারটি জিনিসের অস্তিত্ব বর্তমান। যেমন– রস, বীর্য, বিপাক ও প্রভাব। প্রথমোক্ত তিনটির প্রত্যক্ষতা প্রমাণ করা যায়, শেষোক্ত ‘প্রভাব’-টি কিন্তু দ্রব্যগুণাদির সম্পর্কশূন্য নয়। কারণ প্রতিটি দ্রব্যের প্রভাবের ক্ষেত্রটিও বিশেষ গুণান্বিত। অর্থাৎ শ্লেম্মানাশক দ্রব্যের প্রভাব কখনো বাত-পিত্তকে প্রকুপিত করে হয় না, বিরোধীও হয় না।

এতক্ষণ নিশ্চয় আপনি হাজারো সংশয় নিয়ে ভাবছিলেন– জ্যোতিষ যদি অযৌক্তিকই হবে তবে এত মানুষ যে এতকাল ধরে জ্যোতিষ এবং জ্যোতিষীদের পিছনে ছুটছে, কেন? আপনার উত্তর নিশ্চয় এরকম –তারা জ্যোতিষের অভ্রান্ততার প্রমাণ পেয়েছেন বলেই-না জ্যোতিষীদের কাছে যাচ্ছে। শুধু আপনি নন, জ্যোতিষীবাবুদের যুক্তিও এরকমই হয়। এর বেশি কুলায় না যে! বড়ো রকমের ফাঁপড়ে পড়ে গেলে মাসলম্যান তো আছেই। মাসলম্যান অবশ্য সবার নেই। যাঁদের নেই ন্যাজে-গোবরে হন, অথবা ত্যাদোর পাবলিকের ধোলাই খান। আর যাঁদের মাসলম্যান আছে তাঁরা হলেন জ্যোতিষজগতের রাঘববোয়াল। সাংবাদিকদের ক্যামেরার ‘দেখে নেব’ বলে হুমকি দিতে ছাড়েন না। ট্যাবলেট-জ্যোতিষীর এহেন হুমকি নিশ্চয় অনেকেই নিশ্চয় দূরদর্শনে দেখেছেন।

১৯৯৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি। কাঁকুড়গাছির শ্রমিক কল্যাণ কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত তথাকথিত প্রাচ্য-পাশ্চাত্য জ্যোতিষ সম্মেলনে “ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি”-র সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। উদ্দেশ্য : উদ্যোক্তাদের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে খোলামেলা চ্যালেঞ্জের আবেদন। আবেদন : ‘ভবিষ্যদ্বক্তা’ জ্যোতিষীরা পাঁচজন বিখ্যাত ব্যক্তির মৃত্যুদিন আগাম গণনা করে বলে দিন। আর সেই গণনার ফলগুলি আলাদা আলাদাভাবে খামবন্দি করে একটি নিরপেক্ষ জায়গায় সংরক্ষণ করে রাখা হবে। ওই পাঁচজন ব্যক্তির মধ্যে যে দিন যিনি মারা যাবেন সেসময় সেই ব্যক্তির নামাঙ্কিত খামটি খুলে দেখা হবে জ্যোতিষীদের ভবিষ্যদ্বাণী মিলেছে কি না। এই পদ্ধতিতে যদি কমপক্ষে চারজনের ভবিষ্যদ্বাণী মিলে যায়, তাহলে “ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি” জ্যোতিষীদের হাতে চ্যালেঞ্জের টাকা (ভারতীয় রূপিতে ৫০,০০০ টাকা) তুলে দেবে এবং সমিতির পক্ষ থেকে জ্যোতিষবিরোধী সমস্ত আন্দোলন বন্ধ করে দেবে।

জ্যোতিষ-বিশ্বাসীরা কী ভাবছেন? জ্যোতিষীবাবুরা চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছেন? না, জ্যোতিষীবাবুরা চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেননি। উলটে সম্মেলনের কক্ষটির সমস্ত বন্ধ করে দেওয়া হল, যাতে যুক্তিবাদী সমিতির সদস্যরা ঘরের বাইরে বেরোতে না পারে। এরপর জনাকয়েক মাসলম্যান এসে প্রচণ্ড প্রহার করল। বাধা দিতে গিয়ে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের সাংবাদিক, দ্য টেলিগ্রাফের সাংবাদিকরাও লাঞ্ছনা ও নিগ্রহের শিকার হন। এ ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে স্থানীয় এক যুবকও প্রহৃত হন। এক্কেবারে রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটেছিল সেদিন। জ্যোতিষীদের ফাঁদে ফেলতে চাইলে জ্যোতিষবাবুরা এভাবেই উত্তর ফেরত দিয়ে থাকে। পরীক্ষা প্রার্থনীয়।

পদার্থ বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা তাঁর এক প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন। একটি হল– “গণয়তি গণনে গণকশ্চন্দ্ৰেন সমাগমং বিশাখায়া। বিবিধ-ভুজঙ্গ-ক্রীড়াসক্তাং গৃহিণীংন জানাতি।।”– গণক আকাশে বিশাখা নক্ষত্রে চন্দ্রের সমাগম গণনা করছে। (ওদিকে) নানান উপপতির সঙ্গে ক্রীড়ায় আসক্ত (নিজের) গৃহিণীকে (অর্থাৎ তার খবর) সে জানে না। অপরটি হল– “গণিকা গণকৌ সমান ধর্মে নিজপঞ্চাঙ্গ-নিদৰ্শকাবুভৌ। /জনমানস মোহকারিনৌ তৌ বিধিনা বিত্তহরৌ বিনির্মিতৌ।।” গণিকা আর গণক– দুয়েরই এক ধর্ম। দুজনেই নিজের পঞ্চাঙ্গ দেখায়। দুজনেই লোকের মনকে মোহগ্রস্ত করে। বিধাতা এই বিত্তহরণকারীদের তৈরি করেছেন। পঞ্চাঙ্গ হল দুটি হাত, দুটি পা ও মাথা (গণিকা পক্ষে)। বার, তিথি, নক্ষত্র, যোগ, করণ– এই পাঁচ (গণক পক্ষে)। গণক লোকের সত্য মিথ্যা ঠিকুজি তৈরি করার পর যদি ফলে যায় তাহলে নিজের কেরামতি জাহির করে। না ফললে সেটাকে বলে লগ্নদ্রষ্টার ভুল। না মিললে বলে –“জ্যোতিষীরা ভুল করেন, তাঁদের গণনা ভুলও হতে পারে অনেক সময়। নামী ডাক্তারদেরও তো ভুল হয়। অঙ্কের ভালো শিক্ষকরাও অঙ্ক ভুল করে। বানান সংশোধকরাও (Proof Reader) বানান ভুল করেন। প্যাথোলজিস্টরা ভুল রিপোর্ট দেয়। বিশ্বের এক নম্বর ইঞ্জিনিয়ারদের তৈরি ব্রিজও ভেঙে পড়ে। তার মানে কি সেই বিদ্যা বা শাস্ত্রগুলি মিথ্যা? তা ছাড়া জ্যোতিষ গণনা-পদ্ধতি ভুল না ঠিক সেটা একমাত্র জ্যোতিষীরাই বলতে পারবেন, আপনি নন।” ভণ্ড গণকরা এভাবেই মানুষকে ঠকিয়ে তাদের টাকা পয়সা হাতিয়ে নেয়।

আপাতদৃষ্টিতে জ্যোতিষীবাবুদের যুক্তিগুলি সঠিক মনে হতেই পারে। কিন্তু জ্যোতিষবাবুদের ভুলের সঙ্গে অন্য ভুলগুলির কিছু মৌলিক পার্থক্য আছে। ডাক্তার অথবা শিক্ষকদের ভুলটা বিমূর্ত নয়, সম্পূর্ণটাই চোখে আঙুল দিয়ে প্রমাণিত। জ্যোতিষবাবুদের ভুলটি বিমূর্ত, প্রমাণ করা যায় না। ভুলটা প্রমাণ করা গেলেও ঠিকটা প্রমাণ করা যায় না। যেমন ধরুন আপনার বর্তমান বয়স ৩০। আপনাকে বলা হল ৪০ বছর বয়সে গিয়ে আপনার বড় একটা দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, এমনকি মৃত্যু হওয়ারও আশঙ্কা আছে। আপনি আর আপনার পরিবার খুব ভয় পেয়ে গেলেন এবং মুক্তির উপায় জানতে চাইলেন। জ্যোতিষবাবু আপনাকে পাঁচ রতির একটা নীলা ব্যবহার করতে বললেন। ৪০ বছর বয়সে গিয়ে আপনার কোনো দুর্ঘটনা ঘটল না, মৃত্যুও হল না। কিংবা ওই সময় আপনি এমনভাবে হোঁচট খেয়ে পড়লেন যে আপনার সামনের দুটো দাঁত ভেঙে গেল। জ্যোতিষীবাবু বলবেন– সঠিক ভবিষ্যদ্বাণীই উনি করেছিলেন ও বিধানও সঠিক দিয়েছিলেন। পাথর কথা বলে। সেদিন পাথরটি ব্যবহার না করলে মৃত্যু ঠেকানো যেত না। আপনার ৪০ বছর বয়সে দুর্ঘটনা বা মৃত্যু হত কি না, সেটা আর প্রমাণ করা গেল না। কিন্তু যদি উলটোটা হত, অর্থাৎ ৩৫ বছর বয়সে আপনি কোনো দুরারোগ্য অসুখে মারা গেলেন। তখন কি আপনার পরিবার ভুল বলার জন্য জ্যোতিষবাবুর বিরুদ্ধে অ্যাকশন নেবেন? এরকম ঘটনা আকছার ঘটে থাকে। কিন্তু আমাদের চরম উদাসিনতার জন্য জ্যোতিষবাবুদের এই বুজরুকির ব্যাবসা চালিয়ে যেতে একেবারেই বেগ পেতে হয় ন। জ্যোতিষবাবুরা যখন ভবিষ্যদ্বাণী করেন এবং ভাগ্য বদলানোর কথা বলেন, তা এমনই অস্পষ্ট ও অর্থহীন যে তার ঠিক-ভুল বিচারের কোনো মানেই হয় না। বিজ্ঞানের তত্ত্বকে নির্দিষ্টভাবে ভুল প্রমাণ করা যায়, তাই ভুল বলে প্রমাণিত না-হলে সেটি ‘ঠিক’-এর মর্যাদা পায়। জ্যোতিষবাবুদের ক্ষেত্রে সেই সুযোগ নেই, কাজেই ‘ঠিক’-এর মর্যাদাও প্রাপ্য নয়।

অদ্বৈত আশ্রম থেকে প্রকাশিত “কমপ্লিট ওয়ার্কস অফ স্বামী বিবেকানন্দ, বার্থ সেন্টিনারি এডিশন”- এর অষ্টম খণ্ডে “ম্যান দি মেকার অফ হিজ ডেস্টিনি” 91567 791 oncs– I have seen some astrologers who predicted wonderful things; but I have no reason to believe they predicted them only from the stars, or anything of the sort. In many cases it is simply mind-reading some times wonderful predictions are made, but in many cases it is arrant trash. অর্থাৎ, “আমি কোনো কোনো জ্যোতিষীকে দারুণ দারুণ ভবিষ্যদ্বাণী করতে দেখেছি; কিন্তু একথা মনে করার কোনো কারণ নেই যে, তারা শুধুমাত্র নক্ষত্র বা ওই জাতীয় জিনিস থেকে ভবিষ্যদ্বাণী করে। অনেকক্ষেত্রেই এ হচ্ছে নিছক মনের কথা আঁচ করার ব্যাপার। কখনো-কখনো চমৎকার ভবিষ্যদ্বাণী হয়, কিন্তু অনেকক্ষেত্রেই সেগুলি পুরোপুরি ভূষিমাল।”

যৌবনের প্রারম্ভে আমিও বইপত্র কিনে জ্যোতিষগিরি শুরু করেছিলাম। বইপত্র পড়ে দেখলাম এ বিদ্যা কোনো কাজে আসবে না। শুধু টার্মসগুলি আয়ত্ব করে নিলাম। প্রত্যেক পেশারই একটা নির্দিষ্ট স্টাইল থাকে, এক্ষেত্রেও সেটা আয়ত্ব করলাম। কথায় বলে ভেক না থাকলে ভিখ মেলে না। ভেকও বদলে ফেললাম। মুখে মুখে প্রচার চালাতে লাগলাম, যাকে বলে বিজ্ঞাপন করা। প্রথম প্রথম বিনাপয়সাতেই ভবিষ্যদ্বাণী করে দিতাম। লিখিতভাবেই ভবিষ্যদ্বাণী করতাম। বেশ পসার হল। পারিশ্রমিক নিতে শুরু করলাম। আমি ঠিক বলতে পারি সেটা সবাই বলতে থাকল। পূর্ণ উদ্যোমে কাজে লেগে পড়ার আগে বিবেকের ডাকে থমকে গেলাম। লোক ঠকানোর এ কাজ করাটা কি ঠিক! আমি তো জানি এসব বলায় কোনো ভিত্তি নেই। পুরোটাই ‘মন পড়া’ ব্যাপার। ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে রোগীকে পড়ে ফেলা। ব্যস, কেল্লা ফতে। আপনিও পারবেন মানুষের অতীত ও ভবিষ্যৎ বলে দিতে। কোনো জ্যোতিষবিদ্যার পাঠ নিয়ে সাগর-সম্রাট হওয়ার প্রয়োজন নেই। কৌশলটুকু আয়ত্ব করলেই হবে। কীভাবে?

আমি যেভাবে কিছুদিন জ্যোতিষগিরিতে পসার জমিয়ে জমিয়ে ছিলাম, সেটা তো আপনাদের শেয়ার করবই, এর সঙ্গে যুক্তিবাদী প্রবীর ঘোষেরও কিছু মূল্যবান টিপস দেব। তার আগে বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ : এটি একটি মানুষকে প্রতারণা, অর্থাৎ প্রতারক হওয়ার টিপস। প্রতারক হতে চাইলে নিজের দায়িত্বেই হবেন। এই টিপস সচেতন ও যুক্তিনির্ভর ব্যক্তিদের স্বার্থেই নিবেদিত হচ্ছে।

টিপস–১; আমি মনে করি জ্যোতিষ ব্যাবসায় শিখরে উঠতে চাইলে জ্ঞানী অবশ্যই হতে হবে। জ্যোতিষ ব্যাবসা অজ্ঞানী বা মূর্খদের জন্য নয়। মনে রাখতে হবে আপনার জ্ঞানবুদ্ধি দিয়েই আপনার প্রতি জাতক-জাতিকাকে আকৃষ্ট করতে হবে। “বিদ্বান সর্বত্র পূজতে”, জ্ঞানেই নারীপুরুষনির্বিশেষে মুগ্ধ হয়। ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞানের কিছু শাখায় জ্ঞান থাকলে উত্তম। ইংরেজি ভাষাটাকে ভালোভাবে আয়ত্ত করা প্রয়োজন। মানুষ ইংরেজি ভাষাকে সমীহ করে। জানতে হবে সংস্কৃত ভাষাও। আমাদের সমাজে এ ভাষাও সমীহ আদায় করে নেয়। জাতক বা জাতিকার সঙ্গে কথা বলার সময় ঠিকঠাক সংস্কৃত বাক্য বা শ্লোক গুঁজে দিতে পারলে কেল্লা ফতে। আপনি দোষেগুণে মানুষ থেকে ঈশ্বর বা ক্রান্তিদর্শীতে উন্নীত হবেন খুব সহজেই।

টিপস– ২ : ফোর টোয়েন্টিগিরি (ভারতীয় দণ্ডবিধির ৪২০ ধারায় প্রতারণার দায়ে শাস্তির বিধান) করে এভাবে বাকিজীবন চালিয়ে যেতে পারবেন, এরকম মানসিক জোর ও আত্মবিশ্বাস চাই।

টিপস –৩: দূরদর্শী, নির্লজ্জ, দুঃসাহসী, তুখোড় বুদ্ধি, ধূর্ত এবং বিচক্ষণ হতে

হবে।

টিপস– ৪: সাগর, সম্রাট ইত্যাদি সার্টিফিকেট নিয়ে নিন কোনো জ্যোতিষ সংস্থা থেকে। সার্টিফিকেট দেনেওয়ালে সংস্থা ভুড়ি ভুড়ি আছে। নগদ রেস্তো খরচ করে কিনে নিন ডিগ্রি, পদক, পি এইচডি ইত্যাদি।

টিপস– ৫: স্পেশালিস্ট হিসাবে নিজেকে প্রচার করুন। বিদ্যার জন্য সরস্বতী কবচ, বিয়ের জন্য প্রজাপতি কবচ, ব্যাবসার উন্নতির জন্য বিশ্বকর্মা কবচ ইত্যাদির ব্যবস্থাও রাখুন।

টিপস– ৬: ৫০০ বছরের কিংবা ২০০ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন পারিবারিক জ্যোতিষী বলে বিজ্ঞাপন দিন।

টিপস –৭: আপনার নামের সঙ্গে শাস্ত্রী, আচার্য, আনন্দ জুড়তে ভুলবেন না।

টিপস –৮ : আপনার নামে ওজন না থাকলে পালটে ফেলুন।

টিপস– ৯ : আপনার নামের শেষে প্রথম বন্ধনীর ভিতর ‘তন্ত্রসিদ্ধ’, ‘অলৌকিক মাতা’, ‘কামাখ্যাসিদ্ধ’, ‘বাকসিদ্ধ’ ইত্যাদি প্রচারে রাখবেন।

টিপস– ১০: ভালো কপি রাইটারদের একটা জুতসই বিজ্ঞাপন তৈরি করান।

টিপস– ১১ : কোনো চ্যানেলের সঙ্গে যুক্ত থাকুন। এমন প্রচুর জ্যোতিষের চ্যানেল আছে। স্লট কিনুন। চ্যানেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বললে তারাই আপনাকে বলে দেবে কী করতে হবে, কীভাবে করতে হবে, কত দিতে হবে ইত্যাদি।

টিপস –১২ : ভেক বদলান। কথায় বলে ভেক না-হলে ভিখ মেলে না।

টিপস– ১৩ : বাড়িতে বড়ো করে পূজো দিন। বাড়িতে মন্দির থাকলে ভালো। আপনি যে দেবতাকে জড়িয়ে জ্যোতিষ ব্যাবসা চালাবেন সেই দেবতার পুজো করবেন বছরের নির্দিষ্ট সময়ে। খুব ভালো কাজ দেয় কালীপুজো করলে। টিভিতে সম্প্রচারের ব্যবস্থা করুন আপনার পুজো।

টিপস– ১৪: বিপদের হাত থেকে বাঁচতে স্থানীয় থানা এবং ক্লাবের সঙ্গে যোগাযোগ রাখুন।

টিপস –১৫ : আপনার ব্যাবসা রমরমিয়ে চললে দু-একটি মাসলম্যান পুষবেন। দুঃসময়ে কাজে দেবে।

টিপস –১৬ : বাজারে প্রচুর জ্যোতিষবিদ্যার বই পাওয়া যায়। কিনে জ্যোতিষী ভাষা বা টার্মগুলি রপ্ত করুন। প্রতিটি পেশার নিজস্ব ভাষা আছে, জ্যোতিষেও আছে।

টিপস –১৭ : আবহাওয়া তথা রাজনীতিতে ভবিষ্যদ্বাণী করতে হলে সে বিষয়ে এলেম না থাকলে বিষয়টি এড়িয়ে যওয়াই শ্রেয়। যেমন আগামী লোকসভায় কোন দল সরকার গড়বে? পশ্চিমবঙ্গে আগামী বিধানসভা নির্বাচনে কে মুখ্যমন্ত্রী হবেন? ভবিষ্যতে ভারতবর্ষ হিন্দু রাষ্ট্র হবে কি না? ইত্যাদি।

টিপস –১৮ : অবশ্যই পাথর বেচুন। পাথরই আপনাকে ধনী করবে। “বিফলে মূল্য ফেরত’ বলে দিন। পাবলিক এটা খুব খায়। ঘাবড়াবেন না, মূল্য ফেরত দিতে হয় না। কেউ দাবিও করে না। যদি কেউ মূল্য ফেরত নিতেও আসে, সেটা বুদ্ধি খরচ নিজের নিয়ন্ত্রণে আনুন। সবাই পারে, আপনিও পারবেন।

টিপস– ১৯ : আপনি যদি আপনার বা অন্য মন্দিরে বসতে পারেন, তাহলে হাত দেখার জন্য কোনো পয়সা নেবেন না। পাশে প্রণামীর বাক্স দেখিয়ে দেবেন। বলবেন– মায়ের পুজোর জন্য আপনার সাধ্য অনুযায়ী দিলেই হবে।

টিপস– ২০ : বিখ্যাত মানুষদের হাত দেখার সুযোগ পেলে অনুমতি সাপেক্ষে ফোটো তুলে রাখতে ভুলবেন না। ওটা বিজ্ঞাপনে দারুন কাজে দেবে।

টিপস– ২১ : মানুষের কিছু কমন জিজ্ঞাস্য বা জানাবার কৌতূল থাকে, সেগুলিই সে জানতে আগ্রহী। একজন অবিবাহিত মেয়ে এবং একজন অবিবাহিত ছেলে জিজ্ঞাস্য ভিন্ন, একজন বিবাহিত মহিলা এবং একজন বিবাহিত পুরুষের জিজ্ঞাস্য আলাদা। একজন অবিবাহিতের প্রেম বিষয়ক, চাকরি বিষয়ক, বিয়ে বিষয়ক প্রশ্ন থাকে। অপরদিকে একজন বিবাহিতের স্বামী/স্ত্রী বিষয়ক, সন্তান বিষয়ক ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তর জানে আগ্রহী। প্রশ্ন যেমনই হোক, উত্তর দিতে হবে বিচক্ষণতার সঙ্গে। হবেই এমন কথা কখনোই বলবেন না, ‘সম্ভাবনা’ উল্লেখ করে বলুন। ‘সম্ভাবনা’ শব্দটির মানে হতেও পারে, হতে পারে।

টিপস– ২২ : ভয় দেখাতে ভুলবেন না। না-হলে পাথর/কবচ বেচতে পারবেন না। পাথর/কবচই আপনার ভবিষ্যৎ যে!

টিপস– ২৩ : সব বয়সের মেয়েদের ‘মা’ বলে সম্বোধন করে কথা বলুন।

অবশ্যই সকলকে ‘তুই’ সম্বোধন করাটা রপ্ত করে নেবেন।

টিপস– ২৪ : মানুষ নিজের সম্বন্ধে ভালো ভালো কথা শুনতে ভালোবাসে। প্রথম দর্শনেই সেই ভালো ভালো কথাগুলি বলুন। যেমন –আপনি খুব দয়ালু, আপনি খুব উদার, আপনি মানুষকে হৃদয় দিয়ে ভালোবাসেন কিন্তু আপনি তেমন ভালোবাসা পান না ইত্যাদি। খুব বেশি বেশি পজিটিভ কথা বলুন। দু একটা নেগেটিভ কথা বলবেন পেটের জন্য।

টিপস– ২৫ : আপনার ‘মুরগি’-কে যে মোক্ষম বাণীগুলি শোনাতেই হবে। ৯৯%ভাগ মিলে যাবে, আপনি অব্যর্থ হয়ে যাবেন। দুটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে– (১) মানুষ নিজের সম্বন্ধে যে কথাগুলি শুনতে ভালোবাসে এবং (২) প্রতিটি মানুষ সে যে স্তরেই অবস্থান করুক না-কেন কিছু বিষয় আছে যেগুলি সকলের সঙ্গেই মিলে যাবে। যেমন এই পয়েন্টগুলো বলুন– আপনি স্পষ্টবক্তা, দৃঢ়চেতা। আপনি অনুসন্ধিৎসু মনের অধিকারী। স্পষ্টবাদিতার জন্য আপনি অপ্রিয় হন, কিন্তু আপনি আপনার জ্ঞানতৃষ্ণার জন্য অনেকের কাছে শ্রদ্ধাভাজনও হন। সংসারের জন্য আপনি অনেক করেন, কর্মক্ষেত্রেও আপনি অনেক করেন– কিন্তু আপনার মূল্যায়ন কেউ করতে পারে না। জীবনে যত বিপদেই পড়েছেন শেষপর্যন্ত আপনি উদ্ধার পেয়েছেন আপনার কনফিডেন্সের জন্য। আপনি খুব তাড়াতাড়ি মানুষের সঙ্গে মিশতে পারেন। আপনি মানুষকে খুব বিশ্বাস করেন, বিশ্বাস করে কখনো-কখনো ঠকেনও, তবু বিশ্বাস হারান না। আপনি রেগে গেলে সাংঘাতিক হয়ে ওঠেন, কিন্তু রেগে গেলেও আপনার বুদ্ধিভ্রম হয় না। আপনি সাধারণভাবে জীবনযাপন করতে চাইলেও বাঁকা পথ ধরতেও বাধ্য হন। সুশ্রী-সুন্দরী জাতিকা হলে বলুন– আপনার কাছে অনেক পুরুষই প্রেম নিবেদন করতে চায়। আপনি পাত্তা দেন না। আপনার গুণমুগ্ধ পুরুষের সংখ্যা বেশ ভালো। পুরুষরা অবলীলায় আকৃষ্ট হয়ে পড়ে, সান্নিধ্য প্রত্যাশা করে। আপনি চাইলেই যে-কোনো পুরুষকেই দখলে নিতে পারেন, কিন্তু আপনি খুবই ক্যালকুলেটেড। বিভ্রান্ত হন না। ইত্যাদি– দেখবেন আপনার ‘মুরগি’ কী খুশি। আসলে সাধারণত মানুষ তোষামোদে খুব খুশি হয়। নিজের সম্বন্ধে ভালো ভালো কথা শুনতে কার-না ভালো লাগে! মানুষ স্বীকৃতি চায়। আবিষ্কার চায়। নিজেকে জানতে চায়। পিঠ চাপড়ানো মানুষের মন্দ লাগে না।

এবার মিলতেও পারে, না-ও মিলতে পারে এমন কিছু বলুন। তবে মেলার সম্ভাবনা বেশি। বলুন –মাঝেমধ্যেই আপনাকে একাকীত্বে পেয়ে বসে। আপনার প্রচুর ভালো বন্ধু আছে, শত্রুও আছে ঘাপটি মেরে। সন্মান আপনি পেয়েছেন, কিন্তু যতটুকু আপনার প্রাপ্য ততটুকু আপনি পান না। গোপন প্রণয় আপনার অজ্ঞাতসারে সংসারে অশান্তি সৃষ্টি করতে পারে। পেট ও অম্বল নিয়ে মাঝে মাঝে সমস্যা দেখা দিতে পারে। ইত্যাদি। অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করলে জ্যোতিষী হিসাবে সফল হবেনই।

টিপস– ২৬; কোনো বিবাহিত এসে আপনার কাছে এসে জানতে চাইত পারেন– তার বিয়ে হবে কি না, হলে কবে হবে? কোনো সরকারি চাকুরে এসে আপনার কে এসে জানতে চাইতে পারে তার চাকরি হব কি না, হলে কবে হবে? এমন ফাঁপড়ে পড়লে ধূর্ততার সঙ্গে উত্তর দিতে হবে। না-হলে কেলানি একটাও মাটিতে পড়বে না। অবশ্য তাবড় তাবড় জ্যোতিষীবাবুরা এ পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে পারেন না।

টিপস– ২৭: সবশেষে সবাইকে একথা বলতে ভুলবেন না– “আপনার হাতখানি খুব সুন্দর। এমন অপূর্ব হাত খুব একটা পাওয়া যায় না। পাওয়া গেলেও কোটিতে গুটি। যাকে তাকে এ হাত দেখাবেন না। নষ্ট করে দেবে।”

দেশের রোজকার দৈনিক পত্রিকাগুলোয় দিনের অনেক গুরুত্বপুর্ণ খবর বাদ গেলেও “আপনার দিনটি কেমন যাবে” বা “আপনার রাশিফল” বিভাগটি কখনো বাদ যায় না। আবার কিছু কিছু টিভি চ্যানেলে সকালের বিশেষ আয়োজন থাকে এই রাশিফল নিয়ে। অথচ এমন অনেক পত্রিকা রয়েছে যাদের বিজ্ঞান নিয়ে সাপ্তাহিক আয়োজনটুকুও নেই। বরঞ্চ বিজ্ঞাপন কম আসে বলে কোনো কোনো পত্রিকা সেই সাপ্তাহিক আয়োজনটুকুও বাদ দিয়ে দেয়। কিন্তু এই বিশেষ বিভাগ চালু রাখতে তাদের কোনো সমস্যা নেই। কারণ একটাই এদেশে তো এই কু-খাদ্যের ভোক্তার অভাব নেই। হয়তো কেউ কেউ বলতে পারেন তাদের কাছে বিষয়টি নিছক বিনোদনের। হ্যাঁ, সেটা হতেই পারে। কিন্তু বিষয়টি যদি শুধু বিনোদনের জায়গায় থাকত তাহলে কি জ্যোতিষীদের চেম্বার, পাথরের দোকান বড়ো বড়ো শপিং মলে কি দেখা যেত? রাস্তার মোড়ে মোড়ে পত্রিকার দোকানগুলিতে কি দেখা যেত মাসিক, বাৎসরিক ভাগ্যলিপির পঞ্জিকা? আর টিভি চ্যানেলগুলিতেই-বা কি দেখা যেত এদের রমরমা বিজ্ঞাপন? না, মোটেই দেখা যেত না।

কোনো কোনো জ্যোতিষীবাবু জ্যোতিষকে বিজ্ঞান বলে প্রমাণ করতে চায়, কোনো কোনো জ্যোতিষবাবু আবার শাস্ত্র বলে প্রমাণ করতে চায়, কাউকে আবার শাস্ত্রও বলতে শুনেছি বিজ্ঞানও বলতে শুনেছি। যাঁরা বিজ্ঞানের তর্কে পর্যদস্ত হয়, তাঁরা বলেন জ্যোতিষকে শাস্ত্র বলে মেনে নিতে অসুবিধা কোথায় আপনাদের! যেন শাস্ত্র হলেই অব্যর্থ, দৈব কিছু! বিজ্ঞানের প্রথম শর্ত হল ‘স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন’। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ধারাবাহিক পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষার পর। সেইসব পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের ফলাফল। সুনির্দিষ্টভাবে নথিভুক্ত ও প্রকাশ করা হয়। যে কেউ তা যাচাই করে দেখে নিতে পারে। বিজ্ঞানে দ্ব্যর্থকতার কোনো জায়গা নেই। পটাশিয়াম সায়ানাইড শরীরে প্রবেশ করালে মৃত্যু অবধারিত। যে এটি করবেন তারই এ ঘটনা ঘটবে। অন্যথা হবে না। এটাই বিজ্ঞান, ফল সবসময় সকলের জন্য একই হবে। নিমপাতা চিবালে তেতো লাগবে সকলের, কারোর মিষ্টি লাগবে না –এটাই বিজ্ঞান। বারবার একই ফল পাওয়ার নামই বিজ্ঞান। যুক্তির কাছে অন্ধবিশ্বাস বা ব্যক্তিবিশ্বাসের কোনো জায়গা নেই, মূল্যও নেই। যুক্তি সিদ্ধান্তে পৌঁছায় পরীক্ষার পথ ধরে, পর্যবেক্ষণের পথ অতিক্রম করতে করতে।

জ্যোতির্বিদা বাস্তবিকই জ্যোতির্বিজ্ঞান হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে জ্যোতির্বিজ্ঞান ও জ্যোতিষশাস্ত্রের মধ্যে অবিরাম গতিতে বিশ্লেষিত হয়ে চলল পার্থক্যের ব্যাপকতা। বহু পরীক্ষানিরীক্ষা এবং নিয়ত গবেষণার মধ্য দিয়ে জ্যোতির্বিদ্যা প্রতিষ্ঠা পেল বিজ্ঞানের অলিন্দে। তৎসহ জ্যোতিষশাস্ত্র অবিজ্ঞান হিসাবে ডাস্টবিনে পরিত্যক্ত হল।

ভারতে দারিদ্যসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা ৪০%, অতি নিম্নবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের সংখ্যাও ৪০%। মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত মানুষ বাকি শতংশের মধ্যে পড়ে। ৫% উচ্চবিত্ত ধরলে ১৫% মধ্যবিত্ত –এরা বেশ সচ্ছল প্রজাতির। দেখা যায় মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তরাই মূলত জ্যোতিষের সমর্থক। বহু বছর আগে ‘ফলিত জ্যোতিষ’ শিরোনামে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী লিখেছেন –“কোনও একটা ঘটনার খবর পাইলে সেই খবরটা কি না এবং ঘটনাটা প্রকৃত কি না তাহা ……জানিবার অধিকার বিজ্ঞানবিদদের প্রচুর পরিমাণে আছে। এই অনুসন্ধান। কার্যই বোধ করি তাঁর প্রধান কার্য। প্রকৃত তথ্য নির্ণয়ের জন্য তাঁহাকে প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়। … তিনি অতি সহজে অত্যন্ত ভদ্র ও সুশীল ব্যক্তিকেও বলিয়া বসেন, তোমর কথায় আমি বিশ্বাস করিলাম না। … নিজের উপরেও তাঁর বিশ্বাস অল্প। … কোথায় কোন্ ইন্দ্রিয় তাঁহাকে প্রতারিত করিয়া ফেলিবে …… এই ভয়ে তিনি সর্বদা আকুল। …..ফলিত জ্যোতিষে যাঁহারা অবিশ্বাসী তাঁহাদিগের সংশয়ের মূল এই। তাঁহারা যতটুকু প্রমাণ চান ততটুকু পান না। তাহার বদলে বিস্তর কুযুক্তি পান। …. একটা ঘটনার সহিত মিলিলেই দুন্দুভি বাজাইব। আর সহস্র ঘটনার যাহা না মিলিবে তাহা চাপিয়ে যাইব, অথবা গণকঠাকুরের অজ্ঞতার দোহাই দিয়া উড়াইয়া দিব এরূপ ব্যাবসাও প্রশংসনীয় নহে। …একটা সোজা কথা বলি। ফলিত জ্যোতিষকে যাঁহারা বিজ্ঞানবিদ্যার পদে উন্নীত দেখিতে চাহেন তাঁহারা এইরূপ করুন। প্রথমে তাঁহাদের প্রতিপাদ্য নিয়মটা খুলিয়া বলুন। মানুষের জন্মকালে গ্রহনক্ষত্রের স্থিতি দেখিয়া কোন্ নিয়মে গণনা হইতেছে তাহা স্পষ্ট ভাষায় বলিতে হইবে। … ধরি মাছ না ছুঁই পানি হইলেও চলিবে না। তাহার পর হাজার খানেক শিশুর জন্মকাল ঘড়ি ধরিয়া দেখিয়া প্রকাশ করিতে হইবে; এবং পূর্বের প্রদত্ত নিয়ম অনুসারে গণনা করিয়া তাহার ফলাফল স্পষ্ট ভষায় নির্দেশ করিতে হইবে। ….. পূর্বে প্রচলিত ফলাফলের সহিত প্রত্যক্ষ ফলাফল মিলিয়া গেলেই ঘোর অবিশ্বাসীও ফলিত জ্যোতিষে বিশ্বাসে বাধ্য হইবে। হাজারখানা কোষ্ঠীর মধ্যে যদি নয়শো মিলিয়া যায় তবে মনে করিতে হইবে যে ফলিত জ্যোতিষে অবশ্য কিছু আছে। যদি পঞ্চাশখানা মার মেলে তবে মনে করিতে হইবে, তেমন কিছু নাই। হাজরের বলে যদি লক্ষটা মিলাইতে পারো, আরও ভালো। সহস্র পরীক্ষাগারে ও মানমন্দিরে বৈজ্ঞানিকেরা যে রীতিতে ফলাফল গণনা ও প্রকাশ করিতেছেন সেই রীতি আশ্রয় করিতে হইবে। কেবল নেপোলিয়নের ও বিদ্যাসাগরের কোষ্ঠী বাহির করিলে অবিশ্বাসীর বিশ্বাস জন্মিবে না। চন্দ্রের আকর্ষণে জোয়ার হয়, তবে রামকান্তের জজিয়তি কেন হইবে না, এরূপ যুক্তিও চলিবে না।”

জ্যোতিষী নিয়ে স্বামী বিবেকানন্দের অভিমত : “জ্যোতিষে বিশ্বাস সাধারণত দুর্বল মনের লক্ষণ। সুতরাং মনে এরকম দুর্বলতা এলেই আমাদের উচিত সুচিকিৎসক দেখিয়ে ভালোভাবে ওষুধ খাওয়া, ভালো পথ্য খাওয়া। আর বিশ্রাম করা।” বলেছেন –“In many cases it is simply mind-reading some times wonderful predictions are made, but in many cases it is arrant trash.”

এহেন বিষয়কেই ইউজিসি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাসে রেখে যুবকযুবতীদের স্বনির্ভরতার সন্ধান দিতে আগ্রহী হয়ে পড়েছে। এরপর কি ডাইনি বিদ্যা, ভূত প্রেত-জিন চর্চা, ডাকিনী চর্চা, ওঝা-গুণিন বিদ্যা, কালাজাদু, ঝাড়ফুঁক বিদ্যা, তেল-পড়া, জল-পড়া, বাটি চালান, ক্ষুর চালান, বশীকরণ বিদ্যাও সিলেবাসে আনবেন? অবাক হব না। কারণ আদি যুগ থেকে রাষ্ট্রই এইসব বিষয়ের পৃষ্ঠপোষক। রাষ্ট্রকে নির্বিঘ্নে থাকতে হলে নিয়তী বা অদৃষ্টবাদকে প্রতিপালন করতে হবে। তাই পৃথিবীর কোনো রাষ্ট্রই অবিশ্বাসী বা নাস্তিকদের সুরক্ষা দেয় না, আস্তিকদের মদত জোগান। নাস্তিকরা এইসব অবৈজ্ঞানিক বিষয়গুলোর সমালোচনা করলে সবক শেখাতে চান। বলেন– অনুভূতিতে আঘাত করে এমন কথা নাস্তিকদের বলা উচিত হয়নি। আস্তিকরা নাস্তিকদের উপর হামলা করলে রাষ্ট্র প্রায় নির্লিপ্ত থাকে। এবার ইউজিসির কথা একটু উল্লেখ করা যাক ইউজিসি (University Grant Commission) বলছেন–জ্যোতিষ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে তিন বছরের স্নাতক পাঠক্রম এবং দুই বছরের স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি পর্যায়ে গবেষণাভিত্তিক পাঠক্রম চালু করবেন। আর এই জ্যোতিষচর্চায় নতুন নামকরণ করা হবে জ্যোতির্বিজ্ঞান। অ্যা, হাসবেন না কাঁদবেন! আরও শুনুন –উৎসাহী বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে দেওয়া হবে এককালীন ১৪ লক্ষ টাকা। দেওয়া হবে জ্যোতিষবিদ্যার উপযুক্ত সরঞ্জাম কেনার জন্য। ইউজিসির পরিসংখ্যান অনুযায়ী সেইসব জ্যোতিষ বিভাগে একজন অধ্যাপক, দুইজন লেকচারার, একজন লাইব্রেরিয়ান এবং একজন কম্পিউটার চালক থাকবেন। এর ফলে যদি দেশে কুড়িটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এই পাঠক্রম চালু করা হয় তাহলে এই পাঁচজনের জন্য বাৎসরিক খরচ হবে ১ কোটি টাকা। বুজরুকি জারি রাখার জন্য এত অর্থের অপচয়! এ সংবাদ শুনে ভারতের অগ্রগণ্য পদার্থবিদ ও ইউজিসির প্রাক্তন চেয়ারম্যান অধ্যাপক যশপাল ক্ষোভ করে বললেন–”এ খবর শুনে আমি মর্মাহত। এ এক নিদারুণ লজ্জা, এক কলঙ্ক। অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করছি ইউজিসির সভ্যদের মতোই আজ এদেশে মশা মাছির মতো অজ্ঞানদের অভাব নেই।” বেঙ্গালুরু রামন রিসার্চ সেন্টারের বৈজ্ঞানিকগণও একসুরে বললেন– “পশ্চাদে এগিয়ে চলার এ এক বিরাট পদক্ষেপ। এরপরে ভারতের বৈজ্ঞানিক গবেষণার আর কোনো মূল্যই রইল না।” ইন্ডিয়ান ডেমোক্র্যাটিক টিচার্স ফ্রন্টের বক্তব্য– “এই প্রস্তাব অবান্তর, হাস্যকর এবং ভয়ংকরও।”

আত্মপক্ষসমর্থনে ইউজিসি কী বলছেন বিজ্ঞপ্তি জারি করে, একটু দেখে নেব–

(১) বৈদিক জ্যোতিষবিদ্যা শুধু আমাদের জ্ঞানার্জনের শাস্ত্র নয়, বরং এটি এমন এক বিদ্যা যা আমাদেরকে সুশৃঙ্খলভাবে চলার পথ দেখায়। জ্যোতিষবিদ্যা আমাদের জানায় জীবনে ও বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে প্রতিনিয়ত কেমন করে ঘটনাগুলি ঘটে চলেছে।

(২) বিভিন্ন সময়ে যে ঘটনাগুলি ঘটে তা আমাদের জীবনের উপর কীভাবে প্রভাব ফেলে এ বিষয়ে আমাদের অবহিত করে। সাহায্য করে প্রতিকূল অবস্থাকে অনুকূলে আনতে।

(৩) এটি এমন এক বৈদিক শাস্ত্র যার থেকে আমরা জানতে পারি কীভাবে কখন আমাদের জীবন হতাশা, দুঃখ, অস্থিরতা আসে। যা আমরা আমরা বুঝতে পারি না সে সম্বন্ধে অবহিত করা।

(৪) বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্যোতিষচর্চা শুধু মানুষের জ্ঞান বৃদ্ধি ঘটাবে তা নয়– বৈদিক গণিত, বাস্তুশাস্ত্র, কৃষিবিজ্ঞান, মহাকাশবিজ্ঞান ইত্যাদি সম্পর্কেও একটা পরিপূর্ণ ধারণা দেবে।

(৫) এই মূল্যবান পাঠক্রম থেকে একদিকে যেমন শিক্ষক ও ছাত্র উপকৃত হবেন– অপরদিকে চিকিৎসক, ইঞ্জিনিয়ার, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ সহ সকল পেশার মানুষজন সুফল লাভ করবে ইত্যাদি। রামা রামো!!

বাকি রইল এবার বশীকরণবিদ্যার পাঠক্রম, তাবিজ-কবচবিদ্যার পাঠক্রম, ঝাঁড়ফুকবিদ্যার পাঠক্রম, জল-পড়া আর তেল-পড়াবিদ্যার পাঠক্রম, ধর্ষণ-খুনের পাঠক্রম ইত্যাদি। গেরুয়া-সংস্কৃতি নিশ্চয় সেই স্বপ্ন পূর্ণ করবে। নিষ্পাপ প্রতারকরাই রাষ্ট্র চালাবেন, এবার থেকে প্রতারকরাই রাষ্ট্রের নাগরিকরা কী করবেন কী করবেন না ঠিক করে দেবেন? প্রতারকরা ফলাও করে বিজ্ঞাপন দেবেন, বলবেন –“আসুন, সাক্ষাৎ ধর্ষণ-খুন করলেও অকাট্য সাক্ষ্যসবুত থাকলেও মামলায় জিতিয়ে দেব। পরস্ত্রীতে আসক্ত? বিছানায় আনতে পারছেন না কিছুতেই? পাঁচ মিনিটে অব্যর্থ বশীকরণের মাধ্যমে স্বর্গসুখ অনুভব করুন। আপনার সন্তানকে সৌরভ গাঙ্গুলি কিংবা শচীন তেণ্ডুলকর কিংবা কল্পনা চাওলা কিংবা সানিয়া মির্জা কিংবা সানি লিওনে বানাতে চান? খাঁটি গ্রহরত্ন ব্যবহার করে অব্যর্থ ফল পান।”

এ পোড়া দেশে আইন আছে প্রচুর। কিন্তু আইন রক্ষা করার কেউ নেই। আইন প্রয়োগ করার কেউ নেই। প্রতারক জ্যোতিষীদের বিরুদ্ধে কি মামলা করা যায় এমন আইন আছে? বুজরুকির বিরুদ্ধে কি ভারতে কোনো আইন নেই? গোখলে বলেছিলেন– “what Bengal thinks today, India think tomorrow.” বেঙ্গল, মানে পশ্চিমবঙ্গ কি এইসব অপবিজ্ঞানের বিরুদ্ধে নেতৃত্ব দিতে? দিল্লি হাইকোর্টের এক বেঞ্চ দিল্লি সরকারকে নোটিস পাঠিয়ে নির্দেশ দিয়েছেন– অলৌকিক ক্ষমতা বলে অসুখ বা কোনো সমস্যার সমাধানের প্রলোভন দেখালে তান্ত্রিক, জ্যোতিষী, বিজ্ঞাপনদাতা ও বিজ্ঞাপন, প্রকাশক ও প্রচার মাধ্যমের বিরুদ্ধে যেন ‘ড্রাগস অ্যান্ড ম্যাজিক রেমেডিজ (অবজেকশনাবল অ্যাডভার্টাইজমেন্ট) অ্যাক্ট, ১৯৫৪’ অনুসারে অভিযুক্ত করে মামলা দায়ের করা হবে। (দৈনিক বর্তমান ১ মে, ২০০৩) এই নোটিস জারি করা হয় ২৮ নভেম্বর ২০০১ সালে। বলা হয়েছে –ম্যাজিক বা অলৌকিক ক্ষমতাবলে অসুখ সারানো বা মানসিক কোনো সম্যা সমাধানের প্রলোভন দেখানো শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এসবের বিজ্ঞাপন দেওয়াও বেআইনি। এই আইন চালু আছে ১৯৫৪ সাল থেকেই। এই আইন প্রথমবার ভাঙলে ছয় মাসের জেল ও ১০০০ টাকা জরিমানা হতে পারে। পরবর্তী অপরাধের জন্য এক বছর কারাদণ্ড হতে পারে। এই আইনের ঠ্যালায় যেসব স্বনামধন্য জ্যোতিষীরা দিল্লিতে জ্যোতিষগিরি করতে যেতেন তাঁদের ক্ষমতা হল খতম। দিল্লির তল্পিতল্পা গুটিয়ে জ্যোতিষীবাবুরা কলকাতায় পিছটান দিলেন। যাবে কোথায়! আইনের হাত অনেক লম্বা। ১৯৯৭ সালের ১৮ জানুয়ারি, The Indian Express’ পত্রিকায় যে খবরটি প্রকাশিত হয়েছিল তা দেখে তাবড় তাবড় জ্যোতিষী এবং জ্যোতিষবিশ্বাসীদের চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গিয়েছিল, তা হল –“Gang of six impostors arrested”। এরা হলেন পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত ছয় জ্যোতিষী। অপরাধ অবশ্যই ‘দ্য ড্রাগস অ্যান্ড ম্যাজিক রিমেডিস (অবজেকশনাল অ্যাডভার্টাইজমেন্ট) অ্যাক্ট, ১৯৫৪ আইনের ৪, ৫, ও ৭ ধারা ভঙ্গ। তবু আজও জ্যোতিষচর্চা আর জ্যোতিষবাবুদের লোক ঠকানোর ব্যাবসা বহাল তবিয়তে চলছে। পাশাপাশি চলছে এই বুজরুকি ব্যাবসার অবলুপ্তির আন্দোলন। নিষিদ্ধ হোক প্রতারণা, জ্যোতিষ ব্যবসা। কঠোর থেকে কঠোরতর হোক আইন।

আমার এই লেখা পড়ে কোনো জ্যোতিষবাবু যদি বলেন জ্যোতিষ শাস্ত্র জ্যোতিষ বিজ্ঞান জ্যোতিষ চাঁদ-সূর্যের মতো সত্য, তবে তাঁদের জন্য আমার কাছে সুখবর আছে। রেইকি গ্রান্ডমাস্টার, ফেং শুই ক্ষমতার দাবিদার, জ্যোতিষ ও অলৌকিক ক্ষমতার দাবিদারদের জন্য ২০ লক্ষ ভারতীয় টাকার চ্যালেঞ্জ ঘোষণা করেছেন যুক্তিবাদী প্রবীর ঘোষ। এই চ্যালেঞ্জ ওনার মৃত্যু পর্যন্ত বলবৎ থাকবে, যতদিন প্রথম অলৌকিক ক্ষমতাবানের সাক্ষাৎ না হবে। অংশগ্রহণকারীরা কীভাবে তাঁদের সত্যতা প্রমাণ করবেন, তার বিস্তারিত প্রবীরবাবুর কাছেই পাবেন। প্রবীরবাবু আপনার জন্য আপনার অলৌকিক ক্ষমতা দর্শন করার জন্য অপেক্ষা করে আছেন। যোগাযোগের ঠিকানা : প্রবীর ঘোষ, ৭২/৮ দেবীনিবাস রোড, কলকাতা –৭০০০৭৪।

কৃতজ্ঞতা সূত্র : (১) রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী– ফলিত জ্যোতিষ (২) বিজ্ঞান বার্তা প্রকাশনী– জ্যোতিষের জালিয়াতি (৩) অমলেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়– জ্যোতিষ কি আদৌ বিজ্ঞান? (৪) রত্নজিজ্ঞাসা– পীযূস দাস (৫) অর্জুন রায়– জ্যোতিষ সম্পর্কে কয়েকটি অপ্রিয় প্রশ্ন (৬) ডাঃ পার্থসারথী গুপ্ত– বিজ্ঞানের আলোয় জ্যোতিষ (৭) গৌরীপ্রসাদ ঘোষ– মহাবিশ্বে মহাকাশে (৮) নন্দলাল মাইতি– ইতিহাসে জ্যোতিষ এবং জ্যোতির্বিজ্ঞান (৯) অরূপরতন ভট্টাচার্য– প্রাচীন ভারতে জ্যোতির্বিজ্ঞান (১০) প্রবীর ঘোষ –জ্যোতিষীর কফিনে শেষ পেরেক (১১) প্রবীর ঘোষ –অলৌকিক নয়, লৌকিক (তৃতীয় খণ্ড)।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *