৪. ব্রাহ্মণ্যবাদ এবং ভারতীয় সমাজ

ব্রাহ্মণ্যবাদ এবং ভারতীয় সমাজ

ব্রাহ্মণ কে বা কারা? ব্রাহ্মণ কেন? ব্রাহ্মণ্যবাদই-বা কী– এরকম হাজারো প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছিল আমাকে। সোস্যাল মিডিয়াগুলিতে সারাদিন ব্রাহ্মণ্যবাদের পোস্ট দিচ্ছে বর্ণবাদে ক্ষিপ্ত মানুষ। তাঁদের কাছে ব্রাহ্মণ ও ব্রাহ্মণ্যবাদ সমার্থক। সেই মুহূর্তে আমি উত্তর দিতে পারিনি– এতগুলি প্রশ্নের উত্তর এককথায় দেওয়া সম্ভবও ছিল না সেদিন। কিন্তু উত্তর তো খুঁজতে হবে। অতএব গাঁইতি-শাবল নিয়ে ইতিহাস খননের অভিযানে হাঁটতে হবে। আমরা সাধারণত দুটি ক্ষেত্রে ‘ব্রাহ্মণ’ শব্দটির অস্তিত্ব জানতে পারি। একটি বেদের অংশ ব্রাহ্মণ (যা ব্রাহ্মণ সাহিত্য হিসাবে পরিচিত), অন্যটি বর্ণাশ্রমের প্রথম সারির বর্ণ ব্রাহ্মণ। ব্রাহ্মণ হল হিন্দু শ্রুতি শাস্ত্রের অন্তর্গত গ্রন্থরাজি। এগুলি বেদের ভাষ্য। ব্রাহ্মণ গ্রন্থাবলির মূল উপজীব্য যজ্ঞের সঠিক অনুষ্ঠানপদ্ধতি। প্রত্যেকটি বেদের নিজস্ব ব্রাহ্মণ রয়েছে। যোড়শ মহাজনপদের সমসাময়িককালে মোট কতগুলি ব্রাহ্মণ প্রচলিত ছিল তা জানা যায় না। মোট ১৯টি পূর্ণাকার ব্রাহ্মণ অদ্যাবধি বিদ্যমান: এগুলির মধ্যে দুটি ঋগবেদ, ছয়টি যজুর্বেদ, দশটি সামবেদ ও একটি অথর্ববেদের সঙ্গে যুক্ত। এছাড়াও কয়েকটি সংরক্ষিত খণ্ডগ্রন্থের সন্ধান পাওয়া যায়। ব্রাহ্মণগুলির আকার বিভিন্ন প্রকারের। শতপথ ব্রাহ্মণ ‘সেক্রেড বুকস অফ দি ইস্ট’ গ্রন্থের পাঁচ খণ্ড জুড়ে বিস্তৃত হয়েছে; আবার বংশ ব্রাহ্মণের দৈর্ঘ্য মাত্র এক পৃষ্ঠা। বেদোত্তর যুগের হিন্দু দর্শন, প্রাক বেদান্ত সাহিত্য, আইন, জ্যোতির্বিজ্ঞান, জ্যামিতি, ব্যাকরণ (পাণিনি), কর্মযোগ, চতুরাশ্রম প্রথা ইত্যাদির বিকাশে ব্রাহ্মণ গ্রন্থগুলির ভূমিকা অনস্বীকার্য। কোনো কোনো ব্রাহ্মণের অংশগুলি আরণ্যক বা উপনিষদের মর্যাদাপ্রাপ্ত। ব্রাহ্মণের ভাষা বৈদিক সংস্কৃত থেকে পৃথক। এই ভাষা সংহিতা (বেদের মন্ত্রভাগ) অংশের ভাষার তুলনায় নবীন, তবে এর অধিকাংশই সূত্র সাহিত্যের ভাষার তুলনায় প্রবীন। ব্রাহ্মণগুলি লৌহযুগ অর্থাৎ খ্রিষ্টপূর্ব নবম, অষ্টম ও সপ্তম শতাব্দীতে রচিত। কয়েকটি নবীন ব্রাহ্মণ (যেমন শতপথ ব্রাহ্মণ) সূত্র সাহিত্যের সমসাময়িক, অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে রচিত। ঐতিহাসিকভাবে ব্রাহ্মণ গ্রন্থাবলির রচনাকাল পরবর্তী বৈদিক যুগের উপজাতীয় রাজ্যগুলির ষোড়শ মহাজনপদ রূপে উত্তরণের কাল। বৈদিক মন্ত্রের নানাপ্রকারের ব্যাখ্যাসহ বেদের যে অংশে যাগযজ্ঞাদির বিবরণ পাওয়া যায় তাকেই ব্রাহ্মণ সাহিত্য বলে। অন্যভাবে বললে মন্ত্র-ব্রাহ্মণাত্মক বেদের অংশ হল ব্রাহ্মণ (অন্যটি সংহিতা)।

ব্রাহ্মণ শব্দটি ‘ব্ৰহ্মণ’ শব্দ থেকে উৎপন্ন। যার অর্থ গূঢ়শক্তিসম্পন্ন শব্দ। বলবর্ধক এবং আরোগ্যকর মন্ত্রগুলি যাঁরা উচ্চারণ করতেন তাঁদের ব্রহ্ম বলা হত। ব্রহ্ম-উক্তির যোগফল হল ব্রাহ্মণ সাহিত্য। অর্থাৎ পুরোহিত ব্রাহ্মণদের যজ্ঞ সংক্রান্ত বিভিন্ন উক্তি যেখানে লিপিবদ্ধ আছে তার নাম ব্রাহ্মণ। কারোর মতে বেদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বলেই এই গ্রন্থ ব্রাহ্মণ সাহিত্য। এবার চতুর্বেদের ব্রাহ্মণগুলি জেনে নিতে পারি–

(১) ঋকবেদের ঐতরেয় এবং কৌষিকী (বা সাংখ্যায়ন) ব্রাহ্মণ,

(২) সামবেদের পঞ্চবিংশ, ষড়বিংশ, সামবিধান, আর্যেয়, দৈবত, ছান্দোগ্য, সংহিতোপনিষৎ, বংশ, শাট্যায়ন, জৈমিনীয় বা তলবকার ব্রাহ্মণ,

(৩) কৃষ্ণযজুর্বেদে তৈতিরীয় এবং শুক্লযজুর্বেদের শতপথ ব্রাহ্মণ,

(৪) অথর্ববেদের গোপথ ব্রাহ্মণ।

পণ্ডিত আপস্তম্ব বেদের ব্রাহ্মণভাগের বিস্তৃত বিবরণ দিয়ে বলেছেন প্রধানত ছয়টি বিষয় ব্রাহ্মণে আলোচনা করা হয়েছে–

(১) বিধি : বিশেষ বিশেষ যজ্ঞকর্ম অনুষ্ঠানের জন্য যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তাকে বিধি বলে।

(২) অর্থবাদ : বেদমন্ত্রের অর্থ এবং বিবিধ ক্রিয়াকাণ্ড সম্পর্কে ব্রাহ্মণগুলিতে যে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে দর্শনগত, ব্যাকরণগত এবং ভাষা সংক্রান্ত আলোচনা হয়েছে।

(৩) নিন্দা ও বিরোধী মতের সমালোচনা তার খণ্ডন ও পরিহারকে বলে নিন্দা।

(৪) প্রশংসা : ব্রাহ্মণগুলিতে কোনো কোনো ক্রিয়ার অনুমোদনের জন্য সেগুলির স্তুতি বা প্রশংসা করা হয়েছে।

(৫) পুরাকল্প : অতি প্রাচীনকালে যেসব যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়েছে বা দেবতাগণের (?) অনুষ্ঠিত যাগযজ্ঞাদির যেসব কাহিনি ব্রাহ্মণগুলিতে উল্লিখিত হয়েছে সেইসব বৃত্তান্ত পুরাকল্পের মধ্যে পড়ে।

(৬) পরকৃতি : যজ্ঞকর্মে অভিজ্ঞ খ্যাতনামা পুরোহিতগণের কীর্তি, বিখ্যাত রাজাদের যাগযজ্ঞ, দান, দক্ষিণা প্রভৃতি বিবরণই প্রকৃতি।

ব্রাহ্মণ সাহিত্যে বৈশিষ্টগুলি লক্ষ্যণীয়। দেখা যাক–

(১) ঋগবেদের ব্রাহ্মণে হোতা, যজুর্বেদের ব্রাহ্মণে অধ্বর্য, সামবেদের ব্রাহ্মণে উদগাতার করণীয় বিষয়ের উপর অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

(২) ব্রাহ্মণ সাহিত্যের অধিকাংশ গদ্যে লেখা।

(৩) ব্রাহ্মণগ্রন্থগুলিতে বিভিন্ন বিষয়ের আলোচনা প্রসঙ্গে আখ্যায়িকার অবতারণা করা হয়েছে। কিছু কিছু বৈদিক ভাষা ব্যাখ্যা এবং বিশেষ বিশেষ বৈদিক শব্দের ব্যুৎপত্তি পাওয়া যায়।

(৪) ব্রাহ্মণের অর্থবাদ বাক্যের মধ্যে পরবর্তীকালে দর্শন, ব্যাকরণ ও ভাষাতত্ত্বের বীজ নিহিত ছিল।

(৫) প্রতিটি ব্রাহ্মণে বিভিন্ন যজ্ঞের খুঁটিনাটি বর্ণনার সঙ্গে যজ্ঞকর্মে পুরোহিতের প্রাধান্যই বর্ণিত।

এখন প্রশ্ন ব্রাহ্মণ সাহিত্যে প্রয়োজনীয়তা বা উপযোগিতা কি কিছু আছে? প্রয়োজনীয়তা বা উপযোগিতা আছে কি না সেটা আপনারাই বিচার করুন। আমি শুধু উল্লেখ করব–

(১) যদি সমাজচিত্রটা দেখি, তাহলে দেখব বৈদিক ভারতের জাতিভেদ, ক্ষত্রিয় ও ব্রাহ্মণের মধ্যে শক্তির দ্বন্দ্ব, প্রত্যেক বর্ণের জীবিকা, শিক্ষা, স্ত্রীশিক্ষা, বিবাহসংস্কার, কৃষিবাণিজ্য, খাদ্য প্রভৃতি বর্ণিত আছে।

(২) ঐতিহাসিক মূল্যের দিকটা যদি দেখি, তাহলে দেখব ভারতের পরবর্তীকালের ধর্ম ও দার্শনিক তত্ত্বের ইতিহাসে ব্রাহ্মণ সাহিত্যের মূল্য অপরিসীম।

(৩) আখ্যানভাগের দিকটা যদি বলি, তা অবশ্য যারপরনাই রোমাঞ্চকর এবং বহুমাত্রিক। যেমন –(ক) শতপথ ব্রাহ্মণের পুরূরবা-উর্বশীর কাহিনি (১১.৫.১), (খ) মনুমৎস্যকথা (১.৮.১), (গ) ঐতরেয় ব্রাহ্মণে শুনঃশেপ আখ্যান (৭/১৩ ১৮)।

(৪) নীতিবোধ শিক্ষাও পাওয়া যায়। যেমন –(ক) শতপথ ব্রাহ্মণের নীতিবোধে বিশেষত যৌন সম্পর্কিত নীতির আভাস পাই। সেখানে এক ব্যক্তির স্ত্রীর পক্ষে অপর ব্যক্তির সহবাস পাপজনক বিবেচিত হত। (খ) আমরা হরিশ্চন্দ্রপুর রোহিতের উদ্দেশ্যে ইন্দ্রের মুখে শুনি চরিষ্ণু মানবজীবনের এগিয়ে চলার মন্ত্র– “চরৈবেতি” অর্থাৎ “চল চল”।

(৫) ব্রাহ্মণ সাহিত্য বহুমুখী সভ্যতা ও কৃষ্টির আকর বলে পরিগণিত হয়েছে। এতে আমরা পাই নৃত্যবাদ্যাদি, ললিতকলা, রাজনীতি, যুদ্ধবিদ্যা, স্থাপত্যবিদ্যা, ব্যাকরণ, ভাষাতত্ত্ব, অপরাধশাস্ত্র, নৌবিদ্যা, পশুপক্ষী ও ভেষজবিজ্ঞান প্রভৃতি।

(৬) তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণে ইন্দ্র-ভরদ্বাজের কাহিনিতে (৩/১০) ব্রহ্মচর্যের মহিমা কীর্তন বর্ণিত হয়েছে।

আর্যরা ভারতের মানুষকে চারটি জাতিকে ভাগ করেছে। শ্রীকৃষ্ণ ভগবদ্গীতায় বলা হয়েছে– প্রকৃতির তিনটি গুণ ও কর্ম অনুসারে আমি মানবসমাজকে চারটি বর্ণবিভাগ সৃষ্টি করেছি। আমি এই প্রথার স্রষ্টা হলেও আমাকে অকর্তা এবং অব্যয় বলে জানবে।

“চাতুবর্ণং ময়া সৃষ্টং গুণকর্মবিভাগশঃ।
তস্য কর্তারমপি মাং বিদ্ধ্যকর্তারমব্যয়ম।।”

ভাগবদগীতার সিদ্ধান্ত অনুসারে বর্ণবিন্যাস জন্মসূত্রে নয়, বরং গুণ অনুসারে নির্ণীত হয়। উপরের শ্লোক অনুসারে বর্ণবিভাগ যে জন্মানুসারে নয়, বরং কর্মানুসারে তা শতভাগ নিশ্চিত। তাই একই গোত্রের কর্ম ও গুণ অনুসারে চারটি বর্ণ থাকতে দেখা যায়। কেউ যদি শাস্ত্র অধ্যায়ন তথা বুদ্ধিভিত্তিক কাজে পারদর্শী হন এবং সেভাবে জীবিকা অর্জন করে তবে সে ব্রাহ্মণ। পরিচালনায় দক্ষ হলে ক্ষত্রিয়। ব্যাবসা-বাণিজ্যে জীবিকা নির্বাহ করলে সে বৈশ্য এবং সকল পেশার লোক পেশার লোকদের সেবাকারীর কোনো বৃত্তি হলে সে শূদ্র বলে গণ্য হবে।

ব্রাহ্মণ কে? মনুসংহিতায় বলা হয়েছে–

“লোকানান্তু বিবৃদ্ধ্যর্থং মুখবাহ্রুপাদতঃ।
ব্রাহ্মণং ক্ষত্রিয়ং বৈশ্যং শূদ্রঞ্চ নিরবর্তয়ৎ।।”

অর্থাৎ লোকবৃদ্ধির জন্য (স্রষ্টা) মুখ, বাহু, ঊরু ও পদ থেকে যথাক্রমে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ এবং শূদ্র সৃষ্টি করলেন।

ঋগ্বেদ বলছে–

“ব্রাহ্মণোহস্য মুখমাসীদ বাহু রাজন্য কৃতঃ।
উরু তদস্য যদ্বৈশ্যঃ পদভ্যাং শুদ্ৰো অজায়ত।।”

অর্থাৎ ব্রাহ্মণেরা মানবসমাজের মুখ স্বরূপ, ক্ষত্রিয় বাহু স্বরূপ, বৈশ্য উরু স্বরূপ এবং শূদ্র পাদ স্বরূপ।

শাস্ত্র অনুসারে ব্রাহ্মণদের কয়েকটা ভাগ পাওয়া যায়। যেমন– (১) সারস্বত ব্রাহ্মণ (২) পঞ্চদ্রাবিড় ব্রাহ্মণ (৩) পঞ্চগৌড় ব্রাহ্মণ (৪) বৈদ্যব্রাহ্মণ (৫) চক্রবর্তী (পদবী) ব্রাহ্মণ (৬) রাঢ়ীয় কুলীন ব্রাহ্মণ এবং (৭) বারেন্দ্রীয় কুলীন ব্রাহ্মণ।

(১) সারস্বত ব্রাহ্মণ : সারস্বত ব্রাহ্মণরাই মূল বৈদিক শ্রেণি। এঁরা শাকদ্বীপ (ইউরোপ) থেকে এসে ঋগ্বেদে উল্লেখিত সরস্বতী নদী বিধৌত অঞ্চল গান্ধার (আফগানিস্তান), আর্য (ইরান), পাকিস্তান অঞলে বসে বেদ দৃষ্ট হন। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে এই অঞ্চল গ্রিক রাজ্যের অধিনে যায় এবং ব্যাকট্রিয়া রাজধানী হয়। তাঁরা আস্তে আস্তে জম্বুদ্বীপ (বর্তমান ভারত) আসেন এবং বেদ প্রচার চালিয়ে যান। দ্বিতীয় শতাব্দীতে একজন সারস্বত ব্রাহ্মণ বিন্ধ্যাচল থেকে দাক্ষিণাত্য পর্যন্ত রাজা হন, যা ‘বাকাটক রাজবংশ হিসাবে পরিচিত। এঁরাই সর্বপ্রথম পদবি হিসাবে ‘সেন’ ব্যবহার শুরু করেন। পুরাণে এঁদের ‘মূর্ধাভিষিক্ত ব্রাহ্মণ’ বা ‘ব্ৰহ্মক্ষত্রিয়’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এঁরা বৈদিক জাতির ‘মূর্ধা’ বা মস্তকে অভিষিক্ত এবং মনুসংহিতায় বলা হয়েছে, ব্রহ্মার মস্তকের সর্বোচ্চ স্থান থেকে এঁদের জন্ম হয়েছে। এই বংশের দ্বিতীয় রুদ্রসেনের সঙ্গে গুপ্ত রাজবংশের প্রভাবতী গুপ্তের বিবাহ হয় এবং দুই রাজবংশের মিত্রতা হয়। ফলে সারস্বত ব্রাহ্মণরা পুরো ভারতবর্ষ জুড়ে বেদ প্রচারের সুযোগ পান এবং সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়েন। এই সময়কে বৈদিকধর্ম ও সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের স্বর্ণযুগ হিসেবে ধরা হয়। কৌলিন্য ও বর্ণ সমীকরণের অধিকার শুধুমাত্র সারস্বত ব্রাহ্মণদের ছিল। এঁরা বিভিন্ন অঞ্চলের নাম অনুযায়ী ব্রাহ্মণ সমাজের নামকরণ করেছিলেন। দাক্ষিণাত্য শাসনের সুবাদে সবচেয়ে বেশি সারস্বত ব্রাহ্মণ দাক্ষিণাত্য ও বিন্ধ্যপর্বত অঞ্চলে বসবাস করে। পাল শাসনকালের সময় গৌড় এবং কামরূপের নিকটাধীন একটি অঞ্চলে এঁরা বাস করত বলে ষষ্ট শতাব্দীর ভাস্করবর্মার তাম্রশাসনে ব্রাহ্মণ জমিদানে এঁদের নাম দেখা যায়। পরবর্তীতে বরেন্দ্রসেন একটি ক্ষুদ্র রাজ্য গড়ে তোলেন, যা ‘বরেন্দ্রভূমি’ হিসাবে পরিচিত। এটি পাল সাম্রাজ্যের সময় সামন্ত রাজ্য হিসাবে পরিচিত ছিল। পরবর্তীতে এই রাজ্যের সারস্বত ব্রাহ্মণ বীরসেনের ঔরসে এবং গৌড় সারস্বত ব্রাহ্মণ কন্যা সোমটা দেবীর গর্ভজাত বংশধরেরা পাল সাম্রাজ্য অধিকার করে এবং আসমুদ্রহিমাচল সেন সাম্রাজ্যের সূচনা করে। বৌদ্ধ প্রধান। বাংলায় হিন্দু প্রাধান্য সৃষ্টি করে। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ব্রাহ্মণ ডেকে আনেন। বিভিন্ন অঞ্চলে বৈদিকধর্ম প্রচারের জন্য দূত প্রেরণ করে। বেদানুসারে বর্ণ ও কৌলিন্য সমীকরণ করে। তিন যুগ বা ৩৬ বছর পরপর এই সমীকরণ হত এবং কর্মানুযায়ী বর্ণ ও কৌলিন্য নির্ধারণ হত। এই সমীকরণের কারণে সারস্বত সমাজে সম্প্রদায়ের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। আধুনিক হিসাব অনুযায়ী ৪৬০ প্রকারের সারস্বত শ্রেণি আছে।

(২) পঞ্চদ্রাবিড় ব্রাহ্মণ : পঞ্চদ্রাবিড় ব্রাহ্মণরা হল ভারতের হিন্দুধর্মের দুটি বৃহত্তর ব্রাহ্মণগোষ্ঠীর একটি। পঞ্চদ্রাবিড় ব্রাহ্মণ ছাড়া দ্বিতীয় প্রকার গোষ্ঠীটি পঞ্চগৌড় ব্রাহ্মণ নামে পরিচিত। খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীতে কলহণের কাশ্মীরের ইতিহাস বিষয়ে রচিত ‘রাজতরঙ্গিনী’ গ্রন্থে বিন্ধ্য পর্বতের দক্ষিণভাগে অবস্থিত পাঁচটি পঞ্চদ্রাবিড় ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের কথা উল্লেখ করা রয়েছে। এগুলি হল– (১) কর্ণাটক (কন্নড়ভাষী সহ তৎসংলগ্নভাষী ব্রাহ্মণ), (২) তৈলঙ্গ (তেলুগু ব্রাহ্মণ), (৩) দ্রাবিড় (তামিলনাড়ু ও কেরালা অঞ্চলের ব্রাহ্মণ), (৪) মহারাষ্ট্রক (মহারাষ্ট্রীয় ব্রাহ্মণ) এবং (৫) গুর্জর (গুজরাট ও রাজস্থানের দক্ষিণাঞ্চলের ব্রাহ্মণ)

মারাঠা সাম্রাজ্যের সময়কালে দক্ষিণাত্যের মারাঠাদের অঞ্চলে আমলাতান্ত্রিক জমি জরিপ ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। নথি অনুসারে ব্রাহ্মণদের মধ্যে পাঁচ প্রকার পঞ্চগৌড় ব্রাহ্মণের উল্লেখ রয়েছে। সেগুলি হল –(১) অন্ধ্র পূর্ব ব্রাহ্মণ, (২) অন্ধ্র-পশ্চিম ব্রাহ্মণ, (৩) কর্ণাটক ব্রাহ্মণ, (৪) দ্রাবিড় ব্রাহ্মণ এবং (৫) দেশাষ্ট ব্রাহ্মণ।

আমলাতান্ত্রিক সম্প্রদায়ভিত্তিক নথি ‘কৈফিয়ৎ’ অনুসারে গুর্জর ব্রাহ্মণরা পঞ্চগৌড় ব্রাহ্মণদের অন্তর্গত। নথিটিতে এই পঞ্চদ্রাবিড়দের ১৬ টি উপবিভাগে ভাগ করা হয়েছে, সেগুলি হল– (১) কোঙ্কণাষ্ট, (২) কহাড়ে, (৩) বড়কারি, (৪) মধ্যদিন, (৫) বনাস, (৬) কর্ণাটক, (৭) ষষ্টিক, (৮) নন্দবংশিক, (৯) তৈলঙ্গ, (১০) শ্রীবৈষ্ণব, (১১) শখিকন্থ, (১২) কীবন্ত, (১৩) সিহাবসৈ, (১৪) নুরচের, (১৫) সেনবী/সেনই/সেন এবং (১৬) গোবলকোণ্ডে।

(৩) পঞ্চগৌড় ব্রাহ্মণ : পঞ্চগৌড় ব্রাহ্মণরা হল ভারতের হিন্দুধর্মের দুটি বৃহত্তর ব্রাহ্মণগোষ্ঠীর একটি। পঞ্চগৌড় ব্রাহ্মণ ছাড়া দ্বিতীয় প্রকার গোষ্ঠীটি ‘পঞ্চদ্রাবিড় ব্রাহ্মণ’ নামে পরিচিত। আগেই আলোচনা করেছি। খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীতে কলহণের কাশ্মীরের ইতিহাস বিষয়ে রচিত ‘রাজতরঙ্গিনী’ গ্রন্থে বিন্ধ্য পর্বতের উত্তরভাগে অবস্থিত পাঁচটি পঞ্চগৌড় ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের কথা উল্লেখ করা রয়েছে। স্কন্দপুরাণেও এই গোষ্ঠীবিভাগগুলির বিন্যাস রয়েছে। এগুলি হল– (১) সারস্বত ব্রাহ্মণ, (২) গৌড় ব্রাহ্মণ, (৩) কান্যকুজ ব্রাহ্মণ, (৪) মৈথিল ব্রাহ্মণ এবং (৫) উকল ব্রাহ্মণ।

স্কন্দপুরাণের একটি অংশ হিসাবে বিবেচিত সহ্যাদ্রিখণ্ডেও উপরোক্ত শ্রেণিবিন্যাসেরই উল্লেখ আছে। মারাঠা সাম্রাজ্যের সময়কালে দক্ষিণাত্যের মারাঠাদের অঞ্চলে আমলাতান্ত্রিক জমি জরিপ ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। নথি অনুসারে ব্রাহ্মণদের মধ্যে পাঁচ প্রকার পঞ্চগৌড় ব্রাহ্মণের উল্লেখ আছে। সেগুলি হল –(১) কান্যকুজ ব্রাহ্মণ, (২) কামরূপী ব্রাহ্মণ, (৩) উৎকল ব্রাহ্মণ, (৪) মৈথিল ব্রাহ্মণ এবং (৫) গুর্জর ব্রাহ্মণ। আমলাতান্ত্রিক সম্প্রদায়ভিত্তিক নথি ‘কৈফিয়ৎ’ অনুসারে পঞ্চগৌড় ব্রাহ্মণরা সাধারণত স্মার্ত, বৈষ্ণব কিংবা ভাগবতের অনুসারী হয়ে থাকেন।

(৪) বৈদ্য ব্রাহ্মণ : বৈদিক সময়ে বঙ্গ-বিহার ও নেপালের দক্ষিণাঞ্চল নিয়ে গঠিত ছিল বিদেহ রাজ্য, বিদেহ রাজ্যের ব্রাহ্মণরা বৈদহ ব্রাহ্মণ বা বৈদ্য ব্রাহ্মণ হিসাবে পরিচিত ছিলেন। তাঁরা বৈদিক যজ্ঞাদি এবং বৈদিক চিকিৎসাশাস্ত্র চর্চা করতেন। বৈদ্য অর্থ বেদজ্ঞ হলেও কালক্রমে এটি চিকিৎসক বোঝাতে বেশি ব্যবহৃত হয়। আধ্যাত্মিক ভারতীয় চিকিৎসা শাস্ত্র ‘আয়ুর্বেদ অনুশীলনকারী সম্প্রদায় বৈদ্য ব্রাহ্মণ হিসাবে পরিচিত। এঁদেরকে ‘ত্রিজ’ বলেও অভিহিত করা হত। বিদেহ রাজ্যে ‘ত্রিজভূক্তি’ নামে একটি অঞ্চল ছিল, যা এখনও বিদ্যমান নেপালের ত্রিরাই নামক জায়গায়। বাংলাতেই সবচেয়ে বেশি বৈদ্য ব্রাহ্মণ দেখা যায়। সেন, গুপ্ত, সেনশর্মা, সেনগুপ্ত ইত্যাদি পদবির সম্প্রদায় বৈদ্য ব্রাহ্মণ বলে পরিচিত। যদিও সেনরা রাজশাসনে যুক্ত হলে ‘ব্ৰহ্ম-ক্ষত্রিয়’ বা ‘রাজন্য-ব্রাহ্মণ বলে আত্মপ্রকাশ করে।

প্রবীণ অনুশীলনকারী বা শিক্ষকদের সম্মানের চিহ্ন হিসাবে ‘বৈদ্যরাজ’ বলা হত। কিছু অনুশীলনকারী যাঁদের গ্রন্থগুলির সম্পূর্ণ জ্ঞান ছিল এবং অনুশীলনে দক্ষ ছিলেন তাঁরা প্রাণাচার্য’ নামে পরিচিত ছিলেন। ভারতের কিছু রাজপরিবারের ব্যক্তিগত বৈদ্য ছিল এবং তাঁদের রাজবৈদ্য (রাজার চিকিৎসক)। হিসাবে উল্লেখ করা হত। প্রচলিত একটি মতে দেবাসুরের সমুদ্র মন্থনকালে ধন্বন্তরীর জন্ম হয় এবং বৈদ্যরা তাঁর উত্তরপুরুষ। অন্য মতে ধন্বন্তরীর জন্ম হয়

জনৈক মুনির বৈদিক মন্ত্র জপের মাধ্যমে খড়ের গাদা থেকে, তাই তিনি বৈদ্য নামে পরিচিত হন। যেহেতু তাঁর পিতা ছিল না এবং তিনি এক পালিকা মায়ের আদর-যত্নে বড়ো হন, সেহেতু তাঁকে বলা হয় ‘অম্বষ্ঠ’। বৈদ্য ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের মধ্যে এমন একটি মতও প্রচলিত আছে যে, অম্বষ্ঠ নামে সিন্ধুনদের তীরে একটি অঞ্চল ছিল। সেখান থেকে বৈদ্যদের একটি দল দক্ষিণ ভারতে এবং অপর দলটি বাংলায় আসেন।

(৫) চক্রবর্তী (পদবি) ব্রাহ্মণ : বৈদিক যুগে ব্রাহ্মণদের কোনো পদবি ছিল না। ব্রাহ্মণরা সবসময়ই সদাচারী, সত্যান্বেষী এবং সৎ ছিলেন। ব্রাহ্মণদের পুজো অর্চনা, বেদপাঠ ও যোগসাধনা ছিল প্রধান কর্ম। তা ছাড়া ব্রাহ্মণরা শিক্ষানুরাগী ছিলেন। প্রাচীন বৈদিক যুগ থেকে শিক্ষার গুরু দ্বায়িত অর্পিত ছিল ব্রাহ্মণদের উপর, তাই টোলের শিক্ষকতা ছিল তাঁদের অন্যতম পেশা। ব্রাহ্মণরা নিজেদের সংকল্পার্থে নিজিদের পদবি ‘দেবশর্মা ব্যবহার করতেন। কালক্রমে পুন্ড্র শাসন ব্যবস্থায় ব্রাহ্মণদের ‘আচার্য’ বা ‘শাস্ত্রী’ উপাধি প্রদান করা হয়। পরবর্তীতে ‘দেবশর্মা’ পদবিটি হারাতে বসে। পাল সম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ধর্মপালের শাসনকালে বিভিন্ন অঞ্চলে ব্রাহ্মণদের মধ্যে অনেকেই রাজকার্যে যোগদান করেন। তাই ব্রাহ্মণদের সম্রাট হিসাবে ‘চক্রবর্তী’ পদবির উদ্ভব হয়। চক্রবর্তী শব্দটি সংস্কৃত ভাষা থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে। চক্রবর্তী শব্দের অর্থ সম্রাট। চক্রবর্তীর ভাবার্থ হচ্ছে রাজ্যাধিপতি, অর্থাৎ রাজার রাজা। সহজভাবে বলতে গেলে চক্র অর্থ হচ্ছে ‘চাকা’ এবং বর্তী অর্থ হচ্ছে ‘সুশাসন’ চালিয়ে যাওয়া।

(৬) রাঢ়ীয় কুলীন ব্রাহ্মণ : চোলরাজা দেবেন্দ্রবর্মনের ছয় শতকের শিলালিপিতে উত্তর রাঢ় সম্পর্কে প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। রাঢ়ের এ অংশটিকে রাজেন্দ্র চোলের এগারো শতকের তিরুমুলাই শিলালিপিতে সুস্পষ্টরূপে একটি স্বতন্ত্র ভৌগোলিক এলাকা হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। ভোজবর্মনের বেলাভ তাম্রলিপিতে উত্তর রাঢ়ের সিদ্ধলা গ্রামকে ভট্টভবদেবের জন্মস্থান হিসাবে নির্দেশ করা হয়েছে। সিদ্ধলাকে পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান বীরভূম জেলার সিদ্ধলা গ্রামের সঙ্গে এবং নৈহাটি লিপিতে উল্লিখিত বল্লহিহ গ্রামকে বর্ধমান জেলার উত্তর প্রান্তের বালুটিয়ার সঙ্গে শনাক্ত করা হয়েছে। শাণ্ডিল্য গোত্রীয় বন্ধ্যঘাটি গ্রামবাসী, কাশ্যপ গোত্রীয় চট্টগ্রামবাসী, ভরদ্বাজ গোত্রীয় মুখুটিগ্রামী, সাবর্ণী গোত্রীয় গাঙ্গুলি ও কুন্দলাল গ্রামী এবং বাৎস্য গোত্রীয়, ঘোষাল, কাঞ্জিলাল এবং পুতিতুন্ড– এই আট গ্রামীরা রাঢ়ীয় কুলীন ব্রাহ্মণ।

(৭) বারেন্দ্রীয় কুলীন ব্রাহ্মণ : বরেন্দ্রভূমির নামকরণের পিছনে একাধিক পৌরাণিক কাহিনি প্রচলিত রয়েছে। বর’ শব্দের অর্থ হচ্ছে আশীর্বাদ এবং ‘ইন্দ্র’ শব্দের অর্থ দেবতাদের রাজা। অর্থাৎ ইন্দ্রের বর বা ইন্দ্রের আশীর্বাদ থেকে যে রাজার জন্ম। ‘অদ্ভুৎসাগর’ গ্রন্থে রাজা বরেন্দ্রসেনে এর উল্লেখ আছে, ইন্দ্রের বরে যাঁর জন্ম (পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে) এবং তাঁর রাজ্যটি বরেন্দ্র নামে পরিচিত ছিল। বরেন্দ্রসেন পালরাজা গোপালের সমসাময়িক ছিলেন। সমস্ত বাংলা বৌদ্ধ অধ্যুষিত ছিল, কিন্তু এই রাজ্যটি হিন্দু অধ্যুষিত ছিল। সামন্ত রাজারা একজন রাজাকে মহারাজা হিসাবে নির্বাচন করতে সভা করেন। পরাক্রমশালী রাজা বরেন্দ্রসেন যোগ্য হলেও হিন্দু হওয়ায় বৌদ্ধ সামন্তরাজারা তাঁকে নির্বাচন না করে গোপালকে মহারাজা নির্বাচন করেন। কিন্তু সেনরাজারা নিজেদের শক্তি ক্রমাগত বৃদ্ধি করে পাল সাম্রাজ্যকে নিজেদের হিন্দু সাম্রাজ্যে পরিণত করেন। বৌদ্ধদের পুনরায় হিন্দু সংস্কারে ফিরিয়ে এনে বর্ণ-কৌলিন্য সংস্কার করেন। বিভিন্ন জায়গা থেকে ব্রাহ্মণ ডেকে আনে। এই কাহিনির অনুসারীরা বিশ্বাস করেন যে, বরেন্দ্রভূমি ইন্দ্রের পক্ষ থেকে আশীর্বাদস্বরূপ। কৌলিন্য বিচারে সেনরাজারা কুলশ্রেষ্ঠ রাজন্য-ব্রাহ্মণ ছিলেন। রামায়ণ ও মহাভারত গ্রন্থদ্বয়ে বরেন্দ্রভূমিকে ‘পুন্ড্র’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। পুন্ড্র অঞ্চলে বসবাসকারী ব্রাহ্মণ লাহিড়ী, সান্যাল, সরখেল, মৈত্র ও ভাদুড়ী পদবি ব্যবহার করেন।

প্রথম যে ব্রাহ্মণগোষ্ঠী বাংলায় ঘাঁটি গেড়েছিল, তাঁরা খ্রিস্টীয় পঞ্চম/ষষ্ঠ শতকে উত্তর ভারত থেকে এসেছিল। মধ্যদেশ থেকে ব্রাহ্মণদের এই আগমন ধারা অব্যাহত ছিল। অষ্টম শতাব্দী থেকে ব্রাহ্মণ অভিবাসীদের সংখ্যা বাড়তে থাকল। ব্রাহ্মণরা উত্তর ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে এসেছিল। এমনকি গুজরাটের লাত অঞ্চলের মতো দূরের দেশ থেকেও আসত। সেসময় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পালরাজারা বাংলা শাসন করতেন। এইসব ব্রাহ্মণরা এসে পালরাজাদের শাসনবিভাগের উচ্চবিভাগে নিযুক্ত হত। এইসব ব্রাহ্মণরা বহিরাগত ছিলেন বলেই হয়তো তাঁরা বেশি মান্যতা পেত। এইসব ব্রাহ্মণদের যাবতীয় বিবরণ আমরা কুলজি গ্রন্থগুলি থেকে পেতে পারি। এখানেই আছে বাংলার ব্রাহ্মণদের বংশবৃত্তান্ত। যেমন– ধ্রুবানন্দ মিশ্রের ‘মহাবংশাবলী’, নুলো পঞ্চাননের ‘গোষ্ঠীকথা’, বাচস্পতি মিশ্রের ‘কুলরাম’, ধনঞ্জয়ের ‘কুলপ্রদীপ’, হরি মিশ্র ও এড় মিশ্রের ‘কারিকা’, সর্বানন্দ মিশ্রের ‘কুলতত্ত্বার্ণব’, বরেন্দ্র কুলপঞ্জিকা ইত্যাদি। তবে কুলজি গ্রন্থগুলির লেখকরা যেসব বর্ণনা করেছেন, তা প্রায়ই পরস্পরবিরোধী ও অসংগতিতে পূর্ণ। আদিশূরের কাহিনি ছাড়া কোনো তথ্যের সঙ্গে কোনো তথ্য মেলে না। তবে অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন আদিশূরের কাহিনির কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। সমসাময়িক কোনো পুথিপত্র ও লেখমালাতেও আদিশূর নামে কোনো রাজার উল্লেখ পাওয়া যায় না। ঐতিহাসিক নৃপেন্দ্রকুমার দত্ত বলেছেন, আদিশূরের কাহিনি কল্পিত ও বিভিন্ন টুকরো টুকরো অংশ জোড়াতালি দিয়ে পরে রচিত হয়েছিল। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেছেন, এই কাহিনির ঐতিহাসিকতা নিয়ে এতটাই সন্দেহের অবকাশ আছে যে, এটাকে বাংলার সামাজিক ইতিহাসের উপাদান হিসাবে একেবারেই গ্রহণ করা যায় না।

কুণাল চক্রবর্তী তাঁর ‘বহিরাগত’ প্রবন্ধে লিখেছেন– “মধ্যযুগ পর্যন্ত বাংলায় ব্রাহ্মণদের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে কয়েকটি তথ্য অনস্বীকার্যভাবে উঠে আসে। প্রথম, বাংলায় ব্রাহ্মণরা বহিরাগত। দ্বিতীয়, এদের অধিকাংশেরই শিক্ষাগত যোগ্যতা যথেষ্ট ছিল না। তৃতীয়, এদের অভ্যন্তরীণ বিভিন্নতা এতই ব্যাপক ও প্রকট ছিল যে এদের ব্রাহ্মণ– এই একটিমাত্র অভিধায় চিহ্নিত করাই কঠিন ছিল। তবু ব্রাহ্মণরা বাঙালি হিন্দুর ধর্মীয়-সামাজিক জীবনে দীর্ঘদিন তাঁদের কর্তৃত্ব বজায় রেখেছিলেন। তা কী করে সম্ভব হয়েছিল, সেই ইতিহাস অনুসন্ধানের সময় এসেছে।”

যাই হোক, ব্রাহ্মণ হল হিন্দু বর্ণচতুষ্টয়ের প্রথম এবং উচ্চতম বর্ণ। হিন্দুধর্মানুসারে এই বর্ণজাত ব্যক্তিগণই সমাজে শিক্ষক, আধ্যাত্মিক গুরু, শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত এবং বিধানকর্তার ভূমিকা পালন করার অধিকারপ্রাপ্ত। সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি মনে করেন, “সেই চরম সম্মানের জায়গাটা তাঁদের নির্ভুল বেদমন্ত্র উচ্চারণের মাহাত্ম্য থেকেও আসেনি, যাগযজ্ঞের আড়ম্বরে একটা মহান গভীরতা তৈরি করে সমাজকে ম্যাজিক দেখিয়েও এই সম্মান আসেনি। এই সম্মান এবং এই ব্রাহ্মণ্য ভারতবর্ষের সর্বোত্তম শিক্ষালাভের মাধ্যমে তৈরি হয়েছিল এবং সেই শিক্ষাও এসেছে ত্যাগ-বৈরাগ্য-তপস্যার চরম অনুশীলন থেকে।” শাস্ত্রানুসারে ব্রাহ্মণকুলজাত ব্যক্তিগণ বিপ্র (অর্থাৎ জ্ঞানী) এবং দ্বিজ (অর্থাৎ দু-বার জাত) হিসাবেও অভিহিত হয়ে থাকেন। ব্রাহ্মণ শব্দটা এসেছে ব্ৰহ্ম থেকে,এক অর্থে, যার রয়েছে ব্রহ্মজ্ঞান সেই ব্রাহ্মণ। বর্ণপ্রথা পাকাঁপোক্ত হয়ে সনাতন ধর্মে চেপে বসার আগে মন্ত্র রচনা করে ব্রাহ্মণ হতে পারতেন যে কেউ। এমনকি জন্মসুত্রে ব্রাহ্মণরা উপাসনার দায়িত্ব ছেড়ে বেছে নিতে পারত অন্য যে-কোনো পেশাও। মহাভারতের বশিস্ট তীর্থ, অর্ধকীল তীর্থ, বিশ্বামিত্র নামক তীর্থস্থানে গেলে ব্রাহ্মণ হতে পারে যে কেউ। পুরাণ মতেও ব্রহ্মজ্ঞান প্রাপ্ত হলেই কেবল ব্রাহ্মণত্ব অর্জিত হয়। ঋগ্বেদের দশম মন্ডলে নববই সংখ্যক পুরুষসূক্তের বর্ণনা অনুসারে ব্রাহ্মণের জন্য পুরুষের (স্রষ্টার) মুখ থেকে। মহাভারতের শান্তিপর্বে উল্লিখিত হয়েছে যে, ব্রহ্মা প্রথমে সমগ্র জগৎ ব্রাহ্মণময় করেছিলেন, পরে কর্মানুসারে সকলে নানা বর্ণত্ব প্রাপ্ত হয়; কেউ হয় ব্রাহ্মণ, কেউ ক্ষত্রিয়, কেউ বৈশ্য এবং কেউ বা শূদ্র। মহাভারতে আরও বলা হয়েছে। যে, যিনি সদাচারী ও সর্বভূতে মিত্রভাবাপন্ন, যিনি কাম-ক্রোধ-লোভ-মোহ ত্যাগ করেছেন, যিনি সন্তোষকারী, সত্যবাদী, জিতেন্দ্রিয় ও শাস্ত্রজ্ঞ, তিনিই ব্রাহ্মণ; অর্থাৎ গুণ ও কর্মানুসারে ব্রাহ্মণাদি চতুর্বর্ণের সৃষ্টি, জন্মানুসারে নয়। পরবর্তীকালে অবশ্য জন্মসূত্রে বর্ণ নির্ধারণ-ব্যবস্থা প্রচলিত হয়। ব্রাহ্মণদের মধ্যে নানা শ্রেণিভেদ আছে। অনেকের মতে এই শ্রেণির সংখ্যা ২০০০। এক সারস্বত ব্রাহ্মণদের মধ্যেই ৪৬৯টি শাখা আছে। শ্রেণি অনুযায়ী ব্রাহ্মণদের সামাজিক মর্যাদা নির্ধারিত হয়। বাংলায় আচার্য বা গণক এবং শাকদীপি ব্রাহ্মণেরা পতিত বলে গণ্য হয়। নিম্নবর্ণের পৌরোহিত্য করে বলে বর্ণ ব্রাহ্মণরাও পতিত। তেমনি অগ্রদানী, ভাট ও পিরালি ব্রাহ্মণরাও সমাজে হীনরূপে দেখা হয়। বাংলার বাইরে মন্দিরের পূজারী হওয়ার জন্য তামিল ও কর্ণাট ব্রাহ্মণরা সমাজে অপাঙক্তেয়। নাম্বুদ্ৰী ব্রাহ্মণরা সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার। নৃতাত্ত্বিক বিচারে বাংলার ব্রাহ্মণদের সঙ্গে ভারতের অন্যান্য প্রদেশের ব্রাহ্মণদের মিলের চেয়ে অমিলই বেশি। সবচেয়ে বড়ো অমিল বাংলার ব্রাহ্মণরা আমিষাশী, বাংলার বাইরের ব্রাহ্মণরা নিরামিষাশী। বাংলার ব্রাহ্মণরা খুব কম সংখ্যকই আর্য বংশোদ্ভূত। তাঁরা চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ শতকে বাংলায় আসেন এবং তাঁদের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি করে। তবে পাল আমলে বৌদ্ধধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়া এবং যাগ-যজ্ঞ ভুলে যাওয়ার ফলে তাঁদের পতিত ও শাস্ত্র অনুযায়ী শূদ্রে পরিণত হওয়ার ঘটনাও ঘটে। মধ্যযুগীয় সমাজে ব্রাহ্মণরা সকল বর্ণ বা সম্প্রদায়ের মানুষের হাতে জল গ্রহণ করত না। তবে তিলি, তাঁতি, মালাকার প্রভৃতি মাত্র নয়টি সম্প্রদায়ের হাত থেকে জলগ্রহণের রীতি চালু ছিল। ধর্মশাস্ত্রে ব্রাহ্মণদের অধিকার সম্পর্কে বলা হয়েছে–

(১) ব্রাহ্মণ গুরু এবং সকলের কাছে শ্রদ্ধেয় ও প্রণম্য।

(২) তারা অপর জাতির কর্তব্য নির্ধারণ করবে।

(৩) রাজা সকলের প্রভু কিন্তু ব্রাহ্মণের প্রভু নয়।

(৪) বেত্রাঘাত, বন্ধন, অর্থদণ্ড, নির্বাসন, বাকদণ্ড এবং পরিত্যাগ– এই ছয় প্রকারের সাজা ব্রাহ্মণকে দেওয়া যাবে না।

(৫) শ্রোত্রিয় ব্রাহ্মণরা করমুক্ত।

(৬) তাঁদের ঘরে গুপ্তধন পাওয়া গেলেও রাজা তার সবটাই গ্রহণ করতে পারবে না।

(৭) আগে যাওয়ার জন্য তাকে পথ ছেড়ে দিতে হবে।

(৮) অন্য বর্ণের তুলনায় ব্রাহ্মণরা লঘুদন্ড পাবে।

(৯) তাকে সাক্ষ্য দিতে ডাকা যাবে না।

(১০) তারা মৃতাশৌচ পালন করবে দশদিন।

(১১) তারা সুদ গ্রহণ করতে পারবে না।

(১২) আপদকালে তারা বৈশ্যদের বৃত্তি গ্রহণ করতে পারবে, প্রভৃতি।

পূজার্চনাসহ হিন্দুদের যে-কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠানে পৌরোহিত্য করা ব্রাহ্মণদের একটি সাধারণ পেশা। তবে বর্তমানে শিক্ষা-দীক্ষা, ব্যাবসা-বাণিজ্য, রাজনীতি, চাকরি ইত্যাদি ক্ষেত্রেও তাঁরা অন্যদের চেয়ে অগ্রগণ্য। যদিও ব্রাহ্মণদের যজমানি করা ছাড়া অন্য পেশা গ্রহণ করার অধিকার শাস্ত্র দেয়নি।

সাধারণত বঙ্গীয় ব্রাহ্মণগণ সুশিক্ষিত পণ্ডিত হয়ে থাকেন এবং কীর্তিমান ব্যক্তিত্ব বঙ্গীয় ব্রাহ্মণকুলে জন্মগ্রহণ করেছেন। কলহণ বিরচিত ‘রাজতরঙ্গিণী’-র শ্লোকানুসারে ব্রাহ্মণগণ মূলত পঞ্চ-গৌড় এবং পঞ্চ-দ্রাবিড়, এই দুই ভাগে বিভক্ত। কলহন কর্তৃক রচিত শ্লোকটি উল্লেখ করা হল–

“কর্ণাটকাশ্চ তৈলঙ্গা দ্রাবিড়া মহারাষ্ট্রকাঃ, গুর্জরাশ্চেতি পঞ্চৈব দ্রাবিড়া বিন্ধ্যদক্ষিণে।
সারস্বতাঃ কান্যকুজা গৌড়া উৎকলামৈথিলাঃ, পঞ্চগৌড়া ইতি খ্যাতা বিনেস্যাত্তরবাসিনঃ।।”

ব্রাহ্মণের মর্যাদাই-বা কতটা– এ ব্যাপারে ‘মনুসংহিতা’-য় মনু পরিষ্কারভাবে বলেছেন —

(১) “ভূতানাং প্রাণিনঃ শ্রেষ্ঠাঃ প্রাণিনাং বুদ্ধিজীবিনঃ।
বুদ্ধিমৎসু নরাঃ শ্রেষ্ঠা নরেষু ব্রাহ্মণাঃ স্মৃতাঃ।।”(১/৯৬)

অর্থাৎ, সৃষ্ট (স্থাবর জঙ্গমাদির মধ্যে) প্রাণী শ্রেষ্ঠ, প্রাণীদের মধ্যে বুদ্ধিজীবীরা শ্রেষ্ঠ, বুদ্ধিমানদের মধ্যে মানুষ এবং মানুষের মধ্যে ব্রাহ্মণ শ্রেষ্ঠ বলে কথিত।

(২) “উৎপত্তিরেব বিপ্রস্য মূর্তিধর্মস্য শাশ্বতী।
স হি ধর্মার্থমুৎপন্নো ব্রহ্মভূয়ায় কল্পতে।।”(১/৯৮)

অর্থাৎ, ব্রাহ্মণের দেহই ধর্মের সনাতন মূর্তি। তিনি ধর্মের জন্য জাত এবং মোক্ষলাভের যোগ্য পাত্র।

(৩) “ব্রাহ্মণো জায়মানো হি পৃথিব্যামধিজায়তে।
ঈশ্বরঃ সর্বভূতানাং ধর্মকোষস্য গুপ্তয়ে।।”(১/৯৯)

অর্থাৎ, জাতমাত্রেই ব্রাহ্মণ পৃথিবীতে সকল লোক অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হন এবং সকল সৃষ্ট পদার্থের ধর্মসমূহ রক্ষার জন্য প্রভু হন।

(৪) “সর্বং স্বং ব্রাহ্মণেসেদ্যং যৎকিঞ্চিৎজ্জগতীগতম।
শ্রৈষ্ঠ্যেনাভিজনেনেদং সর্বং বৈ ব্রাহ্মণোহহতি।।” (১/১০০)

অর্থাৎ, পৃথিবীতে যা কিছু আছে, সেই সব ব্রাহ্মণের সম্পত্তি। শ্রেষ্ঠত্ব ও আভিজাত্য হেতু ব্রাহ্মণ এই সবই পাওয়ার যোগ্য।

(৫) “স্বমেব ব্রাহ্মণ্যে ভুঙতে স্বং বস্তে স্বং দদাতি চ।
আনৃশংস্যাদব্রাহ্মণস্য ভুঞ্জতে হীতরে জনাঃ।।”(১/১০১)

অর্থাৎ, ব্রাহ্মণ নিজের অন্নই ভক্ষণ করেন, নিজের বস্ত্র পরিধান করেন এবং নিজের দ্রব্য দান করেন। অন্য লোকেরা যা ভোগ করে, তা ব্রাহ্মণের দয়া হেতু

সেনযুগে ব্রাহ্মণ্যবাদের পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়। এই পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয় বৌদ্ধদের বিলীন করে এবং বৌদ্ধদের অনুসরণ ও অনুকরণ করে। কথিত হয় যে, কর্ণাট থেকে পঞ্চ ব্রাহ্মণ এনে সেন রাজারা যজ্ঞক্রিয়া সম্পন্ন করেন। লক্ষ্মণসেনের রাজসভায় ‘পঞ্চরত্ন’ নামে পরিচিত পঞ্চ ব্রাহ্মণ সংস্কৃত কবি ছিলেন। সেযুগের কবি-শাস্ত্রকারদের অধিকাংশই ছিলেন ব্রাহ্মণ; রাজপদোপজীবী ব্রাহ্মণ কর্মচারীর সংখ্যাও কম ছিল না। এ সময় সমাজে ব্রাহ্মণদের আধিপত্য বিস্তৃত হয়। স্মৃতিশাস্ত্রের বিধি অনুযায়ী ব্রাহ্মণরা সমাজের বিধান দিতে থাকে। বল্লালসেন রাজ্যে কৌলীন্য প্রথা প্রচলন করেন। ব্রাহ্মণদের মধ্যে বন্দ্য (বন্দ্যোপাধ্যায়), চট্ট (চট্টোপাধ্যায়), মুখটী (মুখোপাধ্যায়), ঘোষাল, পুততুন্ড, গাঙ্গুলী (গঙ্গোপাধ্যায়), কাঞ্জীলাল ও কুন্দলাল হচ্ছে মুখ্য কুলীন। আর রাঢ়ী, গুড়, মহিন্ত, কুলভী, চৌতখন্ডী, পিপ্পলাই, গড়গড়ি, ঘণ্টাশ্বরী, কেশরকোণা, দিমসাই, পরিহল, হাড়, পিতমুন্ডী ও দীর্ঘতি গৌণ কুলীন হিসেবে পরিগণিত। কিংবদন্তি অনুযায়ী বল্লালসেনের আমলে কুলীন বলে স্বীকৃত হয় লাহিড়ী, বাগচী, মৈত্র, সান্যাল ও ভাদুড়ী এই পাঁচটি গোত্র।

বৌদ্ধমতে, ব্রাহ্মণ বলতে অনাসক্ত, রজঃমুক্ত, লোভ-দ্বেষ-মোহবিহীন এবং ব্রতপরায়ণ, শীলবান, বীতৃষ্ণ, সংযত ও অন্তিম দেহদারী ব্যক্তি ব্রাহ্মণ বলে কথিত হন। যিনি গৃহস্থ ও অনাগারিক উভয়ের প্রতি অসংশ্লিষ্ট, অল্পে ও আলয়বিহীন তিনিই ব্রাহ্মণ। বুদ্ধের জন্মের পূর্বে ভারতে ব্রাহ্মণেরা তাঁদের নিজ মাহাত্ম প্রচারছলে জাতি অভিমান প্রকাশ করত মানুষের মধ্যে ব্রাহ্মণ শ্রেষ্ঠ। কিন্তু বুদ্ধের সঙ্গে তেবিজ্জের আলোচনায় প্রতীয়মান হয় যে, কেবল ত্রিবেদ জ্ঞাত হলে প্রকৃত ব্রাহ্মণত্ব অর্জন করা যায় না। ব্রাহ্মণত্ব লাভ করার জন্য অসমার্থক তর্ক ও বেদ, মৈত্রী, করুণা, মুদিতা ভাবনা করা দরকার। যাঁরা এরূপ ভাবনার অধিকারী হয়ে অনাসক্ত নিষ্কলুষ, রজঃমুক্ত, লোভ-দ্বেষ-মোহবিহীন হয় এবং যিনি পাপ পঙ্কিল দুরতিক্রম্য মোহপূর্ণ সংসারাবর্ত মুক্ত হয়েছেন তিনিই প্রকৃত ব্রাহ্মণ। হিন্দুদের বিশ্বাস জাতি দ্বারাই প্রকৃত ব্রাহ্মণ অধিকারী হয় অর্থাৎ প্রকৃত ব্রাহ্মণ হতে হলে ব্রাহ্মণ জাতিতে জন্ম কিংম্বা ব্রাহ্মণীর গর্ভজাত হতে হবে। কিন্তু বুদ্ধ মতে, ব্রাহ্মণ জাতিতে জন্ম কিংবা ব্রাহ্মণীর গর্ভজাত হয়ে পাপ মল ত্যাগ না করলে তাঁকে প্রকৃত ব্রাহ্মণ বলা যাবে না। তাঁকে কেবল ব্রাহ্মণ বলে সম্বোধন করা যায়। বংশগৌরব অথবা উচ্চ বংশে জন্ম লাভ করেও শীল গুণে বিভূষিত না-হলে কেউ ব্রাহ্মণ হতে পারে না। বহুলোক নীচু কুলে জন্মগ্রহণ করেও শীলাচার সম্পন্ন হয়ে পরিশ্রমের দ্বারাই সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করে স্বর্গে গমন করতে পারে। তাই বুদ্ধ বলেছেন, জন্মের দ্বারা কেউ চণ্ডাল বা ব্রাহ্মণ হয় না, কর্মের দ্বারাই চণ্ডাল বা ব্রাহ্মণ হয়। যিনি বন্ধনমুক্ত কৃতঃকৃত্য অনাশ্রব, কামচিন্তা বিরহিত তিনিই তৃষ্ণামুক্ত ব্রাহ্মণ নামের যোগ্য। ব্রাহ্মণ ধ্যানী, একক বিচরণশীল, বস্তুকাম ও ক্লেশকাম পরিহার করে চলেন। যিনি সর্ব সংযোজন ছিন্ন করে ভয়মুক্ত, অনাসক্ত, শৃংখলামুক্ত তিনিই তৃষ্ণাক্ষয়ী ব্রাহ্মণ। ক্রোধপূর্ণ, জটধারী, অজিনচর্ম পরিহিত ব্যক্তি ব্রাহ্মণের যোগ্য হতে পারে না। ক্রোধবিহীন, ব্রতপরায়ণ, শীলবান, সংযমী ও অন্তিম দেহদারী ব্যক্তি তৃষ্ণামুক্ত ব্রাহ্মণ বলে যোগ্য হন। যিনি গৃহস্থ ও অনাগরিক উভয়ের প্রতি অসংশ্লিষ্ট অল্পেচ্ছু ও আলয় বিহীন তিনিই তৃষ্ণামুক্ত ব্রাহ্মণ। যিনি ছোট-বড় সর্বপ্রকার অদত্ত গ্রহনে বিরত, যাহার কোন প্রকার তৃষ্ণা বিদ্যমান নাই যিনি সংশয়মুক্ত ও নির্বাণ প্রাপ্ত তিনিই ব্রাহ্মণ। তৎকালীন সময়ে ব্রাহ্মণেরা অভিমান বা অহংকার করে নিজের গৌরব করে বলত তারাই মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠ জাতি। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে জাতি অভিমান ব্রাহ্মণের কাজ নয়। কারণ জাতি হিসেবে মানুষ সঙ্গে মানুষের কোনো পার্থক্য নেই। তৎকালিন মানব জাতির মধ্যে ব্রাহ্মণ, বৈশ্য, শুদ্রের পদচিহৃ একই ধরনের। প্রাণীদের মধ্যে স্ত্রী, পুরুষ, বর্ণ, শারীরিক গঠন, লোম, চঞ্চু, প্রভৃতি পার্থক্য আছে। কিন্তু মানুষ মানুষে তেমন পার্থক্য দেখা যায় না। বুদ্ধ মতে, যে-কোন ব্যক্তি সকর্ম করলে ব্রাহ্মণের পর্যায়ে উন্নীত হতে পারেন। সম্ভব ও কৃচ্ছসাধনের দ্বারা যে-কোনও লোক ব্রাহ্মণত্ব অর্জন করতে পারেন। বনের প্রাণীরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে। ঠিক তেমনি প্রকৃত শ্রমণ বা ব্রাহ্মণ ধ্যানপরায়ণ হলে শোভা পায় এবং অনাসক্ত, নিষ্কলুষ, রজঃযুক্ত লোভ দ্বেষ-মোহবিহীন হয়। অবশ্য ২০০২ সালের ৫ অক্টোবর দিল্লির সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক প্রদত্ত ঐতিহাসিক রায়টির কথাটি স্মর্তব্য। কেরালার আলাঙ্গাদ গ্রামের শিবমন্দিরে জন্মের ভিত্তিতে অব্রাহ্মন এক ব্যক্তিকে পুরোহিত করা নিয়ে স্থানীয় ব্রাহ্মণ্যবাদীদের করা মামলায় সুপ্রিম কোর্টের দুই বিচারপতি এস রাজেন্দ্র ও ডুরাই স্বামীর বেঞ্চ রায় দেয় যে যে-কোনও মন্দিরে যে-কোনও বর্ণ বা গোত্রের মানুষ পুজারী হতে পারবেন। কোর্ট আরও আদেশ দেয় যে “শাস্ত্রীয় আচার অনুষ্ঠানে অনভিজ্ঞ এবং শাস্ত্রজ্ঞানহীন অযোগ্য জন্মসুত্রে কোনো ব্রাহ্মণ বেদপাঠ করতে বা মন্দিরের পুজারী হতে পারবে না। সেখানে বলা হয় যে, “বেদপাঠ,শাস্ত্রজ্ঞান যে-কোনো সাধারণ হিন্দুর থাকলেই সে পুরোহিত বা ব্রাহ্মণ হতে পারবেন। ভারতের সকল হিন্দু ধর্ম প্রতিষ্ঠান ও মন্দিরের ক্ষেত্রে এই আদেশ প্রযোজ্য হবে।” পবিত্র বেদ অনুযায়ী যে-কোনো কেউ-ই যদি শাস্ত্রপাঠের মাধ্যমে জ্ঞানী হতে পারে, তবে সে যজ্ঞ করতে সক্ষম। পবিত্র বেদের বর্ণাশ্রম কর্ম ও গুণভিত্তিক, জন্মভিত্তিক নয়। আর সেটাই আইন করে প্রতিষ্ঠিত করল দিল্লির সুপ্রিম কোর্ট। আর এই রায়ের মাধ্যমে পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্যবাদ ও মূর্খদের বর্ণপ্রথার দর্প চূর্ণ হল, বিজয় লাভ করল পৃথিবীর কোটি কোটি তথাকথিত দলিত, পদাহত, শূদ্র সনাতন ধর্মালম্বী মহৎ প্রাণগণ।

শাস্ত্র বলছে ব্রাহ্মণ-ঘরে জন্মালেই কেউ ব্রাহ্মণ হয়ে যায় না, যেমন মুসলমান ঘরে জন্মালেই কেউ মুসলমান হয় না। বিশেষ নিয়মের মধ্যে দিয়ে যেমন মুসলমান হতে হয়, তেমনই ব্রাহ্মণ হয়ে ওঠার জন্য বেশ কিছু নিয়ম করার বিধান দিয়েছে শাস্ত্র। বল্লালচরিত্র ধৃত পূর্ব খণ্ডের ১৩ অধ্যায়ে বলা হয়েছে–

“জন্মনা জায়তে শূদ্রঃ সংস্কারাদ্বিজ উচ্যতে।
বেদ পাঠী ভবেদ্বিপ্রঃ ব্রহ্ম জানাতি ব্রাহ্মণঃ।।”

অর্থাৎ, জন্মমাত্রেই সবাই শূদ্র। সংস্কারে দ্বিজ পদবাচ্য হয়। বেদ পাঠেই বিপ্র হন এবং ব্রহ্মকে জানলেই ব্রাহ্মণ পদবাচ্য।

ধর্মশাস্ত্রে বর্ণিত দশ প্রকার সংস্কারের কথা বলা হয়েছে। যার একটি হল চূড়াকর্ম। চূড়াকর্ম বা চূড়াকরণ শ্রুতির বিধান অনুসারে ধর্মলাভের জন্য দ্বিজাতিগণের (ব্রাহ্মণ) উচিত এবং আবশ্যিক কর্ম। “চূড়া’ মানে শিখা বা টিকি। মনুর মতে শিশুর চূড়াকরণ বা প্রথম কেশচ্ছেদন/মস্তকমুণ্ডনের অনুষ্ঠান দুই সময়ে করা যায়। শিশুর এক বছর বয়সে বা তিন বছর বয়সে, এ বিষয়ে কোনো কঠোর বিধান নেই। কিন্তু “কুমারা বিশিখা ইব” এই বেদবচন অনুসারে চূড়াকরণ অবশ্য কর্তব্য। এই সংস্কারে শিখা বা টিকি রেখে মাথার অবশিষ্ট চুল কেটে ফেলা হয়, একে চৌলকর্মও বলে। এরপরের সংস্কারটি হল উপনয়ন, একেই পৈতে বা পইতা গ্রহণের অনুষ্ঠান বলে। ‘উপ’ মানে নিকটে বা কাছে এবং ‘নয়ন’ মানে নিয়ে যাওয়া। অর্থাৎ বেদ শিক্ষার জন্য বালককে আচার্যের কাছে নিয়ে যাওয়ার অনুষ্ঠান। এটি হল দ্বিজাতির অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যের ব্রহ্মচর্যাশ্রমের প্রারম্ভিক সংস্কার, এতে উপবীত বা যজ্ঞসূত্র ধারণ করতে হয়। বিধান অনুসারে ব্রাহ্মণদের আট বছর বয়সে, ক্ষত্রিয়দের এগারো বছর বয়সে এবং বৈশ্যদের দ্বাদশ বছর বয়সে উপনয়ন কর্তব্য। অবশ্য উপনয়নের ঊর্ধ্বসীমা ব্রাহ্মণের ষোলো বছর, ক্ষত্রিয়ের বাইশ বছর এবং বৈশ্যের চব্বিশ বছর নিদান আছে। শূদ্রের উপবীত ধারণের কোনো অধিকার নেই। ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্যদের উপবীত ধারণের অধিকার দেওয়া হলেও আসলে উপবীত ধারণের অধিকারটা ব্রাহ্মণগণই আত্মসাৎ করে নিয়েছিল। কারণ ব্রাহ্মণ ছাড়া আর কারোরই পূজা-পার্বণ করার অধিকার ছিল না, যাঁরা পূজা পার্বণ করার অধিকার কায়েম করলেন, তাঁদেরই পৈতে ধারণের প্রয়োজন হয়ে পড়ল, কারণ পূজা-পার্বণে পৈতার ভূমিকা সংযোজন করা হল। শাস্ত্রে আরও বলা হল ষোলো বছরে ব্রাহ্মণদের, বাইশ বছরে ক্ষত্রিয়দের এবং চব্বিশ বছরে যদি উপনয়ন সংস্কার না-হলে তাঁরা ব্রাত্য পরিগণিত হবে। ব্রাত্যরা আচার অনুষ্ঠানে কোনো অধিকার থাকে না। তাঁদের সঙ্গে ব্রাহ্মণদের অধ্যয়ন সংক্রান্ত এবং বৈবাহিক কোনো সম্পর্ক স্থাপন করা যায় না। তবে হ্যাঁ, যথাবিধি প্রায়শ্চিত্ত করলে তবেই সমাজে তারা স্থান পায়। এইসব কথা অথর্ববেদের পঞ্চদশ কাণ্ডে বলা হয়েছে। আর-একটি সংস্কার হল কেশান্ত সংস্কার। ব্রাহ্মণাদি বর্ণের মধ্যে প্রচলিত এই প্রাচীন সংস্কারে উপনয়নের শেষ ঊর্ধ্বসীমায় চুল কাটা ও দাড়ি কামানোর অনুষ্ঠানই কেশান্ত সংস্কার। এই অনুষ্ঠানে গোরু দান করা হয় বলে আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্রে (১/১৮) একে গোদান বলা হয়েছে।

উপরে যে সংস্কারগুলি আলোচনা করা হল সেগুলি ব্রাহ্মণগণের অবশ্য কর্তব্য। এবার আমরা দেখে নেব ব্রাহ্মণগণের কর্ম-বিভাজনের কারণে শ্রেণি-বিভাজন।

(১) আচার্য : মনুর মতে যে ব্রাহ্মণ শিষ্যের উপনয়ন করিয়ে তাকে কল্প। (যজ্ঞবিদ্যা) ও রহস্য (উপনিষদ) সহ বেদ অধ্যয়ন করান তাকে আচার্য বলা হয় (যেমন –ভট্টাচার্য = ভট্ট + আচার্য)। কল্প ও রহস্যবিদ্যা না জানলে বেদাধ্যয়ন সম্পূর্ণ হবে না। তবে আগে শিষ্যকে উপনয়নের সময় সাবিত্রীমন্ত্র তার কানে কানে পড়বেন। ফলে সেই শিষ্যের দ্বিজাতিত্ব প্রাপ্তি ঘটবে। তখন সে বেদাধ্যয়ন করার অধিকার পাবেন। প্রায় সমস্ত স্মৃতিশাস্ত্রে এই কথা উল্লেখ আছে।

(২) উপাধ্যায় : মনুর মতে যে ব্রাহ্মণ জীবিকার জন্য বেদের অংশমাত্র বা বেদাঙ্গ অধ্যয়ন করান তিনিই উপাধ্যায় (বন্দ্যোপাধ্যায় = বন্দ্য + উপাধ্যায়, মুখোপাধ্যায় = মুখ + উপাধ্যায় ইত্যাদি)। সমগ্র বেদ নয়, বেদের অংশ যেমন– সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক, উপনিষদ প্রভৃতির যে-কোনো একটি। আর বেদাঙ্গ যেমন –শিক্ষা, নিরুক্ত, ব্যাকরণ, ছন্দ ও জ্যোতিষ, কল্প প্রভৃতি। উপাধ্যায়ও শিক্ষক, তবে আচার্যের থেকে কিছু পার্থক্য আছে। উপাধ্যায় অর্থের বিনিময়ে বেদের অংশ বা বেদাঙ্গ পড়ান। কিন্তু আচার্য কোনোরকম দক্ষিণা গ্রহণ করবেন না। তাই উপাধ্যায় অপেক্ষা আচার্য মান্যতর।

(৩) গুরু : মনুর মতে যে ব্রাহ্মণ শাস্ত্রের বিধান অনুসারে গর্ভাধান প্রভৃতি কর্ম সম্পাদন করেন এবং অন্নের দ্বারা প্রতিপালন করেন সেই ব্রাহ্মণ গুরু হিসাবে পরিগণিত হন। এখানে ‘নিষেক’ শব্দের দ্বারা দশবিধ সংস্কারের কথা বলা হয়েছে, দশটি সংস্কারের মধ্যে গর্ভাধান অন্যতম। ভবিষ্যতের বা হবু পিতাই তাঁর পত্নীর জন্য এই সংস্কার সম্পাদন করেন। পিতাই অন্নের দ্বারা সন্তানদের প্রতিপালন করেন, ফলে পিতাই প্রকৃতপক্ষে গুরু।

(৪) ঋত্বিক : কোনো ব্যক্তি যাঁকে যজ্ঞের জন্য বরণ করে নেওয়ার তিনি ওই ব্যক্তির জন্য অগ্ন্যাধান, অর্থাৎ যজ্ঞকালে মন্ত্রসহকারে অগ্নি উৎপাদন ও স্থাপন, পাকযজ্ঞ এবং অগ্নিষ্টোম প্রভৃতি যজ্ঞ সম্পাদন করেন তাঁকে বলে। আচার্য প্রভৃতির মতো ঋত্বিকও যে সম্মানীয় তা দেখানোর জন্যই এই পদ। বৈদিক যজ্ঞে ঋত্বিকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। মনুসংহিতায় দ্বিতীয় অধ্যায়ের ১৪৩ সংখ্যক শ্লোকে যে ঋত্বিকদের কথা বলা হয়েছে তিনি শুধু বৈদিক নন, স্মার্ত বা লৌকিক ক্রিয়াকর্ম সম্পাদন করেন। গায়ত্রী মন্ত্র : যিনি যেই মুহূর্তে ব্রাহ্মণে উন্নীত হলেন, সেই মুহূর্ত থেকে তিনি প্রণব বা ওংকার এবং গায়ত্রী মন্ত্র উচ্চারণের অধিকার অর্জন করলেন। উপনয়ন প্রাপ্ত ব্রহ্মচারীর কর্তব্য বিষয়ে উপদেশ দিতে গিয়ে মনু প্রণব বা ওংকার কথাটি ৭৬ সংখ্যক শ্লোকে বলেছেন, বেদপাঠের আগে ও পরে বেদপাঠার্থী শিষ্য প্রণব বা ওংকার উচ্চারণ করলে মনের একাগ্রতা, পবিত্রতা আছে। ওংকারহীন পাঠ কোনো কাজে আসে না। প্রণব বা ওংকারে আছে তিনটি অক্ষর। — ‘অ’, ‘উ’, ‘ম’– তিনটি অক্ষর মিলে উচ্চারণ হয় “ওঁ”– উচ্চারণ করলে ‘অউম’ হয়। গায়ত্রী মন্ত্রের তিনটি প্রয়োজনীয় বিভাগ আছে, সেগুলি হল –(ক) প্রণব বা ওংকার, (খ) ব্যাহতি এবং (গ) সাবিত্রী ঋক্‌। ব্যাহৃতি শব্দের আক্ষরিক অর্থ হল– উক্তি, কথন, উচ্চারণ, বি-আ-হৃ + ক্তি = ব্যাহৃতি। ভূঃ, ভুবঃ, স্বঃ –এগুলি গায়ত্রী মন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত সাবিত্রী বচন, এগুলিকে ব্যাহৃতি বলে। অনেকে ব্যাহৃতি মানে শব্দ (word) বা স্থান বলেছেন। তিনটি ব্যাহৃতি-র মধ্যে ‘ভুঃ’ হল পৃথিবীলোক, অগ্নিদেবতা, ঋগ্বেদ ও প্রাণবায়ুস্বরূপ। ’ভুবঃ’ হল অন্তরিক্ষলোক, বায়ুদেবতা, সাম ও অপানস্বরূপ। স্বঃ হল দ্যুলোক, আদিত্যদেবতা, যজুঃ ও ব্যানবায়ুস্বরূপ। যেহেতু বেদ অধ্যয়নের আগে প্রণব, ভূঃ, ভুবঃ স্বঃ ব্যাহৃতি ও সাবিত্রী বা গায়ত্রী মন্ত্রপাঠ করতে হয়, সেহেতু এগুলিকে বেদের মুখ বা প্রবেশদ্বার বলা হয়েছে। ঋকের দেবতা সবিতা, কিন্তু মন্ত্রটি গায়ত্রী ছন্দে গ্রথিত। তাই সাধারণভাবে একে গায়ত্রী মন্ত্র বলা হয়। সাবিত্রী শব্দের দ্বারা গায়ত্রীকেই বোঝায়। সাবিত্রী হল ত্রিপাদযুক্ত গায়ত্রী মন্ত্র ব্রহ্মা ঋক্, সাম, যজুঃ– এই তিনটি বেদ থেকে গায়ত্রীর তিনটি পাদ –(ক) তৎসবিতুর্বরেণ্যং, (খ) ভর্গো দেবস্য ধীমহি, (গ) ধিয়ো যো নঃ প্রচোদ্দয়াৎ। অর্থাৎ প্রকাশমান (দেব) সবিতার সেই বরেণ্য তেজঃ (ভগ) আমরা ধ্যান করি, যিনি আমাদের বুদ্ধিসমূহকে প্রেরণ করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ করতে হয় ওংকার (অ = ব্রহ্মা, উ = বিষ্ণু, ম = মহেশ্বর) এবং গায়ত্রী মন্ত্র উচ্চারণ করার অধিকার অব্রাহ্মণদের নেই, এ অধিকার শুধুমাত্র ব্রাহ্মণগণের। অবশ্য শাস্ত্রানুযায়ী বর্তমানে ‘ব্রাহ্মণ’ বলে যদি কোনো অস্তিত্ব থাকে! বেদ পাঠ তো দূরের কথা– ঋক্, সাম, যজুঃ বা সাম বেদ বেশিরভাগ ব্রাহ্মণগণ চোখেই দেখেননি। আর ব্রহ্মজ্ঞান? দেড় টাকা দিয়ে উপবীত বা পইতে পরে নিলেই ব্রহ্মজ্ঞান হয়ে যায় না। শাস্ত্রকার রঘুনন্দন বলেছেন– “বিপ্রাঃশূদ্র সমাচারাঃ ভবিষ্যন্তি কলিযুগে”। অর্থাৎ, “ভবিষ্যতে কলিযুগে বিপ্র এবং শূদর সবাই সমান আচার সম্পন্ন হবে”। তবে ‘ওঁ’ শব্দের পরিবর্তে অব্রাহ্মণগণকে সহজ মন্ত্র ‘নমঃ’ শব্দ উচ্চারণ করার ঢালাও অধিকার দেওয়া হয়েছে।

ভারতে কোন্ ব্রাহ্মণ কোথায় থাকতেন সেটা একবার দেখে নেব। মনুসংহিতার দ্বিতীয় অধ্যায়ে ধর্মানুষ্ঠানের পক্ষে উপযুক্ত দেশরূপে ব্রহ্মাবর্তের কথা বলা হয়েছে–

(১) সরস্বতী এবং দৃষদ্বতী –এই দুটি দেবনির্মিত পবিত্র নদীর মধ্যবর্তী প্রদেশ ব্ৰহ্মাবর্ত বলে পরিচিত ছিল। এই স্থান ধর্মানুষ্ঠানের পক্ষে উপযুক্ত স্থান বলে কথিত। ব্ৰহ্মনিষ্ঠ ব্রাহ্মণগণ অধিক সংখ্যায় এই স্থানে বাস করতেন। এই ব্ৰহ্মাবর্তের ব্রাহ্মণাদি বর্ণের আচার-আচরণই মনু সদাচার বলেছেন।

(২) মনু কুরুক্ষেত্র, মৎস্য, পঞ্চাল ও শূরসেন– এই চারটি প্রদেশকে ব্রহ্মর্ষিদেশ বলা হয়েছে। উৎকর্ষের বিচারে ব্রহ্মাবর্তের পরেই ব্রহ্মর্ষিদেশ। ব্রহ্মর্ষিদেশের ব্রাহ্মণগণ পণ্ডিত, শাস্ত্রজ্ঞ, ধার্মিক এবং শ্রুতি ও স্মৃতি প্রতিপাদিত কর্মসমূহের অনুষ্ঠানে দক্ষ। তাই এঁদের কাছ থেকে অন্যান্য দেশের লোকেরা যথার্থ আচার-আচরণ শিক্ষা করবে।

(৩) মনু বলেন যে দেশে কৃষ্ণসার মৃগ স্বভাবত বাস করে অর্থাৎ যেখানে এইরকম মৃগ জোর করে অন্য জায়গা থেকে আনা হয় না বা এখানে কেউ কারোকে হিংসা করে না বলে কৃষ্ণসার মৃগ স্বচ্ছন্দে ঘুরে বেড়ায়, সেই দেশকে যজ্ঞীয় দেশ বলে। এবার দেখব উত্তরীয়, মেখলা, উপবীত, দণ্ড, ভিক্ষা প্রার্থনা ব্রাহ্মণ সহ বর্ণভেদে (শূদ্র ব্যতীত) কার কেমন (বিভাজন) হওয়া আবশ্যক।

উত্তরীয় : ব্রহ্মচারীর উত্তরীয় বা ঊধ্বসন হবে– ব্রাহ্মণদের কৃষ্ণমৃগের, ক্ষত্রিয়দের রুরু হরিণের এবং বৈশ্যদের ছাগের চামড়ায় তৈরি হবে। তেমনই অধোবসন হবে যথাক্রমে শণ, রেশম এবং পশমের তৈরি বস্ত্র পরিধান করবে।

মেখলা : ব্রাহ্মণ ব্রহ্মচারীর মেখলা (কোমরবদ্ধ) হবে মুথা ঘাসের তৈরি, ত্রিগুণিত, সমান ও চিক্কণ। ক্ষত্রিয় ব্রহ্মচারীর মেখলা হবে তৈরি এবং ধনুকের গুণের মতো। বৈশ্য ব্রহ্মচারীর মেখলা হবে শণসূত্রে নির্মিত এবং ত্রিগুণিত (তিনটি সমান মোটা সুতোয় প্রস্তুত)।

উপবীত : ব্রহ্মচারীর উপবীত (পইতা) বাম কার্ধের উপর থেকে ডানদিকে ঝোলানো থাকবে এবং তিনটি সুতোর গোছায় তিন গোছা সুতোয় তৈরি হবে। অবশ্য ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্যের ক্ষেত্রে সুতোর উপাদান হবে যথাক্রমে কাঁপাস, শণ ও পশম। অপরদিকে শরীরের যাজ্ঞাপবীতের অবস্থান অনুসারে ব্রাহ্মণদের তিনভাগে ভাগ করা হয়েছে।

(১) ব্রাহ্মণের উপবীত বাম কাঁধের উপর থেকে ডান হাতের নীচে পর্যন্ত ঝোলানো থাকলে তাঁকে উপবীতি বলে। কখন? দৈব কার্য ও যাজ্ঞ্যজ্ঞাদির সময় ব্যবহার হয়।

(২) ডান কাঁধ থেকে বাম হাতের নীচ পর্যন্ত উপবীত থাকলে প্রাচীনাবীতী বলে। কখন? পিতৃকার্যে বা শ্রাদ্ধাদিতে ব্যবহার হয়।

(৩) উপবীত গলায় হারের মতো লম্বমান থাকলে নিবীতী বলে। কখন? মনুষ্য কার্যের বা প্রাত্যহিক কাজের সময় ব্যবহার হয়।

দণ্ড : উপনয়নের পর ব্রহ্মচারীকে দণ্ড ধারণ করতে হয়। ব্রাহ্মণের দণ্ড হবে তার চুল পর্যন্ত লম্বা এবং বেল বা পলাশ কাঠের তৈরি। ক্ষত্রিয়ের দণ্ড হবে তার কপাল পর্যন্ত লম্বা এবং বট বা খয়ের কাঠের তৈরি। বৈশ্য ব্রহ্মচারীর দণ্ড হবে তার নাক পর্যন্ত লম্বা এবং পীলু বা ডুমুর কাঠের তৈরি। দণ্ডগুলি হবে সরল, অক্ষত, সুদর্শন, বল্কলযুক্ত এবং অগ্নিতে অদগ্ধ।

ভিক্ষা প্রার্থনা : উপনয়নের পর ব্রহ্মচারী দণ্ডধারণ ও অগ্নি প্রদক্ষিণ করে প্রথমে সে মা, বোন কিংবা মাসি অথবা এঁদের অভাবে যে তাকে অবজ্ঞা বা প্রত্যাখ্যান করবেন না এমন ব্যক্তির কাছে ভিক্ষা প্রার্থনা করবে। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য ব্রহ্মচারী যথাক্রমে প্রর্থনা বাক্যে প্রথমে, মধ্যে ও অন্তে “ভবৎ” শব্দ গঠিত সম্বোধন পদ ব্যবহার করে ভিক্ষা প্রার্থনা করবে। হিন্দুসমাজে চতুর্বর্ণের সম্মান কাদের কোথায় দেখে নেব ছোট্টো করে। ধন, বন্ধু, বয়স, কর্ম ও বিদ্যা –এই পাঁচটি হল মান্যস্থান।

“বিত্তং বন্ধুয়ঃ কর্ম বিদ্যা ভবতি পঞ্চমী।
এতানি মান্যস্থানানি গরীয়ো য যদুত্তরম”।। (মনুসংহিতা ২/১৩৬)

এই পাঁচটির মধ্যে আগেরটির চেয়ে পরেরটি বেশি সম্মানযুক্ত। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য– এই তিন বর্ণের অন্তর্গত কোনো ব্যক্তির মধ্যে যদি ধন প্রভৃতি পাঁচটির আধিক্য ও উৎকর্ষ থাকে, তবে তিনি সকলের সম্মানের যোগ্য হবেন। কিন্তু শূদ্রের ক্ষেত্রে নব্বই বছরের বেশি বয়স হলে তিনিও সম্মানের যোগ্য হবেন। ব্রাহ্মণ বিদ্যার জন্য, ক্ষত্রিয় বীরত্বের জন্য, বৈশ্য ধনসম্পদের জন্য এবং শূদ্র বয়সে বড় হলেই শ্রেষ্ঠ হবেন। বুঝুন! শূদ্রের শুধু বয়সেই সম্মান, তাও আবার নব্বইয়ের অধিক হতে হবে। অর্থাৎ ধন, বন্ধু, কর্ম এবং বিদ্যার কোনো অধিকার নেই, অর্জন করলেও স্বীকৃতি নেই। মনুসংহিতায় মনুবাবু বলছেন, শূদ্রকে শিষ্য করবে না এবং শূদ্রের শিষ্য হবে না(মনুসংহিতা– ৩/১৫৬)। সে কারণেই দ্রোণ কর্তৃক নিষাদপুত্র একলব্যকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ হারিয়ে তুণ্ড হয়ে যেতে হয়, সে কারণেই রামচন্দ্র কর্তৃক শূদ্র শম্বুককে অকারণে (তপস্যা করার অপরাধে!) মৃত্যুবরণ করতে হয়। এ ঘটনা অস্বাভাবিক নয়, কেন-না এটা মনুসংহিতার মনুর নির্দেশ–

“নাবি স্পষ্ট মধীয়ীত ন শূদ্র জন সন্নিধ্য।
ন নিশান্তে পরিশ্রান্তো ব্রাহ্মাধীত্য পুনঃ স্বপেৎ”।

অবশ্য এক শ্রেণির ব্রাহ্মণগণ মিথ্যা একটা প্রচার চালালেন। ভাবটা এমন যেন তাঁরা কত উদার! কী বললেন? বললেন– শূদ্র যদি ব্রাহ্মণের বা ক্ষত্রিয়ের মতো কাজে পারদর্শী হয় তবে তাকে ব্রাহ্মণত্বে বা ক্ষত্রিয়ত্বে উন্নীত করা যাবে। কার্যে তার কোনো প্রমাণ আছে নাকি? বিশ্বামিত্রের কথা বলবেন বুঝি? প্রথমত বিশ্বামিত্র শূদ্রপুত্র নয়, ক্ষত্রিয়। দ্বিতীয়ত ক্ষত্রিয়রাজ বিশ্বামিত্রকে ক্ষমতায় রুখতে না-পারার কারণে ব্রাহ্মণগণ বাধ্য হয়েই ব্রাহ্মণ বলে মেনে নিয়েছিলেন। যে ব্রাহ্মণগণ মনুসংহিতা রচনা করে–

“সহাসনমভিপ্রেক্ষ্ণরুকৃষ্টস্যাপকৃষ্টজঃ।
কট্যাং কৃতাঙ্কো নিৰ্বাস্যঃ স্কিচং বাস্যাব কৰ্তয়েৎ”

অর্থাৎ ব্রাহ্মণেতর অধম জাতি যদি ব্রাহ্মণের সঙ্গে একাসনে উপবেশন করে তবে রাজা ওই তার কটিদেশে গরম লোহার দাগ দিয়ে দেশ থেকে বিতাড়িত করবেন অথবা যেন না মরে এমনভাবে তার পাছা কেটে দেবে।

বলেন সেই ব্রাহ্মণগণ মঙ্গলদায়ক আর কী করতে পারে! অব্রাহ্মণ শিক্ষকতা করলেও সে অব্রাহ্মণই থাকে, তাকে কেউ ব্রাহ্মণ বলে অতিরিক্ত সম্মান করে না। কারণ ‘মনুস্মৃতি’ নিদান দিয়ে দিয়েছেন —

(১) ১০ বছরের ব্রাহ্মণ এবং ১০০ বছরের এক ক্ষত্রিয়ের সম্পর্ক যদি পিতা-পুত্র হয়, তাহলে এদের মধ্যে ব্রাহ্মণ হচ্ছে পিতা।

(২) একজন ব্রাহ্মণের গৃহে কোনো ক্ষত্রিয়, বৈশ্য অথবা শূদ্রকে অতিথি বলা যাবে না। একজন ব্রাহ্মণের গৃহে শুধু ব্রাহ্মণেরই অতিথি হওয়ার অধিকার আছে।

(৩) একজন ব্রাহ্মণ নিশ্চিন্ত মনে একজন শূদ্রের জিনিস নিয়ে নিতে পারে, কারণ শূদ্রের নিজের বলে কিছুই নেই।

মনুসংহিতায় শ্রীমান মনু বলছেন, কারা কাদের পিতা ব্রাহ্মণ হলেও কে ব্রাহ্মণ নয়। যিনি জাতিতে ব্রাহ্মণ হয়েও আচার-আচরণে ব্রাহ্মণ নন, তাঁরা ব্রাহ্মণব্রুব হিসাবে পরিগণিত হবেন। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় বা বৈশ্য বর্ণের কোনো বালকের উপনয়নের বয়সের ঊর্ধ্বসীমা যথাক্রমে ষোলো, বাইশ এবং চব্বিশ বছর অতিক্রম করে গেলেও যদি তার উপনয়ন সংস্কার অনুষ্ঠিত না-হয় সে ব্রাত্য হিসাবে চিহ্নিত হয়। এই ব্রাত্যদের কোনো ব্রাহ্মণের সঙ্গে যাজন, অধ্যাপনা প্রভৃতি বেদসম্বন্ধ ছিল না এবং সংশ্লিষ্ট বর্ণের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্কও নিষিদ্ধ ছিল। অবশ্য শাস্ত্র বলছে মূর্খ ব্রাহ্মণগণ শূদ্রের অধম। অতএব সাধু সাবধান! মূর্খ ব্রাহ্মণগণ দূর হোঠো। নারায়ণ-শিলা স্পর্শ করবেন না।

তাহলে এই যে এত এত ব্রাহ্মণ সৃষ্টি হল কিংবা সৃষ্টি করা হল ভারতে, তাতে কার কী কাজে লাগল, তারাই-বা কী করল সমাজে, কী রাখল সমাজে? মনুসংহিতা’-য় মনু ব্রাহ্মণদের জন্য বললেন —

“অধ্যাপনমধ্যয়নং যজনং যাজনং তথা।
দানং প্রতিগ্ৰহঞ্চৈব ব্রাহ্মণানামকল্পয়ৎ”। (১/৮৮)।

অর্থাৎ, ব্রাহ্মণদের জন্য সৃষ্টি করলেন অধ্যাপনা, অধ্যয়ন, যজন, যাজন, দান, প্রতিগ্রহ।

ব্রাহ্মণগণের আশ্চর্যজনক এবং অদ্বিতীয় আবিষ্কার ঈশ্বর বা দেবতা বা ভগবান। এটাই ব্রাহ্মণগণের একমাত্র পুঁজি বা মূলধন। এবং ঈশ্বরকে সামনে রেখে স্বর্গ নরক, পাপ-পূণ্য, আত্মা, ইহকাল-পরকাল, জন্মান্তর, কর্মফল ইত্যাদি মানুষের জীবন-মরণের সঙ্গে সংযোজন করে দিলেন। সাধারণ মানুষের মনে কোনো অদৃশ্য শক্তির ধারণাটা ছিলই, সেই সভ্যতার ঊষাকাল থেকে। কীভাবে এই ধারণা জন্মালো? বিধ্বংসী ঝড়, অনর্গল ভারী বর্ষণ, কড়কড়িয়ে মরণ বজ্রপাত, মুহুর্মুহু বিদ্যুতের ঝলকানি, নিথর মৃত-শরীর, দাবানল, প্লাবনই মানুষের মনে দানা বেঁধেছে কোনো অদৃশ্য শক্তির। প্রাকৃতজনের দেবদেবীদের উৎপত্তিস্থল ভীতি। তাই মনসা, চণ্ডী, শিব, ষষ্ঠি ইত্যাদি দেবদেবীদের জন্ম। তুর্কি আক্রমণের পরবর্তী সময়ে উন্নাসিক ব্রাহ্মণরা নীচু শ্রেণির মানুষদের সঙ্গে মেলবন্ধনের প্রয়োজন উপলব্ধি করেন নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য। তাই বৈদিক দেবদেবীদের সঙ্গে লৌকিক দেবদেবীদের একটা মনগড়া যোগ কল্পনা করে সংস্কৃত ছেড়ে লৌকিক ভাষায় মন্ত্র রচনায় মনোনিবেশ করেন।

দক্ষিণ রায়, বনদেবী, মারাংবুরু, ভাদু, টুসু, ইতু, মনসা, ওলাউঠা, শীতলা প্রভৃতি লৌকিক দেবতাগণও পেলাম কালে কালে, বিভিন্ন সময়ে। বেদের যুগে অগ্নি, বরুণ, ইন্দ্রও লৌকিক দেবতা। এমনকি বেদের যুগের আগেও পশুপতি (যা পরে ব্রাহ্মণগণ আত্মসাৎ করে শিব তথা মহেশ্বরে রূপান্তরিত করে নেয়) লৌকিক দেবতা। লক্ষ করুন এই দেবতারা ব্রাহ্মণদের সৃষ্ট দেবদেবী নয়, সাধারণের আত্মীয়। সংস্কৃত মন্ত্র নেই, ব্রাহ্মণ-পুরোহিত নেই। এই দেবতারা শান্ত, নরম, সন্তানসম, আদরের। ব্রাহ্মণদের দেবতারা ক্ষতিকর, হিংস্র, ত্রাস সৃষ্টিকারী, অসহিসষ্ণু, কামুক, কামার্ত, প্রতিহিংসাপরায়ণ, ছিদ্র অন্বেষক– দুষ্টের দমন শিষ্টের পালনের নামে খুনোখুনি করে। এরা নরকের ভয় দেখায়, স্বর্গের লোভ দেখায়।

এ ছাড়া মানুষ যা যা করতে অক্ষম, ঈশ্বরের মধ্যে সেই গুণগুলিই আরোপিত হয়েছে। এর থেকেই স্পষ্ট যে মানুষের দুর্বলতা এবং অসহায়তাই ঈশ্বরের আঁতুরঘর। লক্ষ করুন, এইসব প্রাকৃতিক ঘটনাগুলি সবই উপরের শূন্য থেকে মানে আকাশ থেকেই পতন হয়। অর্থাৎ এইসব অঘটনের ধারণা হল স্রষ্টা আকাশেই থাকেন এবং অবশ্যই নিরাকার। সে কথা লিপিবদ্ধ হল হিন্দুদের প্রধান এবং একমাত্র ধর্মগ্রন্থ বেদে। বেদে আমরা ঈশ্বরের নিরাকার রূপই পাই। একমেবাদ্বিতীয়। ঈশ্বর এক বেদে বর্ণিত বেশিরভাগ দেবতাকল্পই প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেবতা (অগ্নি আগুনের দেবতা, বরুণ বৃষ্টির দেবতা, ইন্দ্ৰ বজ্রের দেবতা ইত্যাদি। ) এবং এরা বেদের যুগে কেউ কেউ পুজো পেলেও পুরাণোত্তর যুগে ব্রাত্য হয়েছে। সে কথায় পরে আসছি। আগে দেখে নেব বেদে বর্ণিত দেবতা কারা।

শতপথ ব্রাহ্মণ (১৪.৫)-এ যাজ্ঞবল্ক্য ঋষি শাকল্যকে বলছেন– দেব ৩৩টি যা পরমেশ্বরের মহিমার প্রকাশক। ৮ বসু, ১১ রুদ্র, ১২ আদিত্য, ইন্দ্র, প্রজাপতি। শতপথ ব্রাহ্মণ, মনুসংহিতা ও বৃহদারণ্যক উপনিষদে এর বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া আছে– বিদগ্ধ শাকল্য যাজ্ঞবল্ক্যকে জিজ্ঞেস করলেন, হে যাজ্ঞবল্ক্য দেব (শক্তি) কয়টি? যাজ্ঞবল্ক্য বললেন ৩৩টি। তখন শাকল্য আবার বললেন, হে যাজ্ঞবল্ক্য দেব কয়টি? তখন তিনি আবার বললেন ৬টি। শাকল্য আবার বললেন, হে যাজ্ঞবল্ক্য দেব কয়টি? তখন যাজ্ঞবল্ক্য উত্তর দিলেন ৩টি। আবার শাকল্য জিজ্ঞেস করায় তিনি উত্তর দিলেন দুইটি। তখন শাকল্য আবার জিজ্ঞেস করলেন, হে যাজ্ঞবল্ক্য দেব কয়টি? তখন যাজ্ঞবল্ক্য বললেন দেড়টি। শাকল্য আবার জিজ্ঞেস করলেন, হে যাজ্ঞবল্ক্য দেব কয়টি? তখন তিনি বললেন একটি! তখন শাকল্য জিজ্ঞেস করলেন, এই ৩৩টি দেব কী? যাজ্ঞবল্ক্য বললেন ৮ বসু যা হল অগ্নি, পৃথিবী, বায়ু, অন্তরিক্ষ, আদিত্য, দ্যৌ, চন্দ্র, নক্ষত্র, ১১ রুদ্র যা হল প্রাণ (নিঃশ্বাস), অপান (প্রশ্বাস), ব্যন, সমান, উদাম, নাগ, কুৰ্ম্ম, কৃকল, দেবদত্ত, ধনঞ্জয় এবং জীবাত্মা, ১২ আদিত্য হল ১২ মাস, ইন্দ্র, প্রজাপতি অর্থাৎ মোট ৩৩টি। ইন্দ্র হল বিদ্যুৎ আর প্রজাপতি হল যজ্ঞ (যে কোনো শুভ কর্ম )। তখন শাকল্য আবার জিজ্ঞেস করলেন, তাহলে ৬টা দেব কী কী? তখন তিনি। উত্তর দেন– অগ্নি, পৃথিবী, বায়ু, অন্তরিক্ষ, আদিত্য, দ্যুঃ। তখন তিনি বললেন, তাহলে ৩টি দেব কী? তখন যাজ্ঞবল্ক্য বললেন, তিনলোক (ভ, দ্যু, অন্তরিক্ষ)। তারপর শাকল্য আবার বললেন, সেই দুইটি দেব কী কী,? খাদ্য এবং প্রাণ– উত্তর দিলেন যাজ্ঞবল্ক্য। তখন আবার শাকল্য জিজ্ঞেস করলেন, সেই দেড়টি কী? তখন যাজ্ঞবল্ক্য উত্তর দিলেন যিনি প্রবাহিত হন। তখন শাকল্য বললেন সেই এক এবং অদ্বিতীয় যিনি প্রবাহিত হন তাঁকে আপনি কীভাবে দেড় বললেন? তখন যাজ্ঞবল্ক্য বললেন যখন তা প্রবাহিত হয় তখনই সবকিছু উৎপন্ন হতে শুরু করে। তাহলে কে সেই এক? প্রাণ! হ্যাঁ প্রাণ (পরমাত্মা) সেই এক এবং অদ্বিতীয় দেব যাকে সবাই তৎ বলে জানে।”

অসাধারণ এই শৈল্পিক ও গভীর দার্শনিক কথোপকথন ব্যখ্যা করছে সেই এক এবং অদ্বিতীয় পরব্রহ্ম থেকে সবকিছু উৎপন্ন হতে শুরু করে। একে একে অগ্নি, বায়ু, আদিত্য, ভু, দ্যু এবং অন্তরীক্ষলোক, বিদ্যুৎশক্তি সবকিছুই তার থেকে তৈরি হয় যাদেরকে ৩৩টি ভাগে ভাগ করা হয় এবং এদেরকে বলা হয় দেব অর্থাৎ শক্তি। আর দিন শেষে শক্তি একটাই যা থেকে সকল কিছু আপাতশক্তিপ্রাপ্ত হয়। আর এই শক্তিই এক এবং অদ্বিতীয় পরমাত্মা।

কী বুঝলেন? আপনি যাই-ই বুঝুন, অবশেষে ব্রাহ্মণগণ বুঝলেন বেদের দেবতাদের খাঁটিয়ে ধান্ধাপানি করা এক্কেবারেই অসম্ভব। অতএব বিকল্প পথের খোঁজে ব্রাহ্মণগণ কর্তৃক রচিত হল ১৮টি মহাপুরাণ, ১৮টি উপপুরাণ এবং অবশ্যই মনুসংহিতা। এই গ্রন্থগুলির মূল উপজীব্য বিষয় ক্ষত্রিয়-ইতিহাস সংরক্ষণ, ব্রাহ্মণগণের চরম আধিপত্য বিস্তার এবং অবশ্যই রগরগে আদিরসাত্মক ভরপুর কাহিনি (ঈশ্বরিক নয়, মানবিক বৈশিষ্ট্যের সবকটি দোষগুণই প্রকট হয়েছে কাহিনির পরতে পরতে। মানবজাতির সবরকম অবদমিত ইচ্ছা পুরাণগুলিতে লিপিবদ্ধ হয়েছে)। সেই থেকেই ব্রাহ্মণ এবং ক্ষত্রিয়ের গাঁটছড়া। অর্থাৎ রাজনীতি আর ধর্মের সহবাস আদিকাল থেকেই। একে অপরের পরিপূরক। একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। ধর্ম ছাড়া রাজনীতি অচল, রাজনীতি ছাড়া ধর্ম অচল। পতাকার রং যাই-ই হোক, ধর্মই তাঁদের তুরুপের তাস।

বেদ এবং উপনিষদে একেশ্বরবাদ বর্ণিত হলেও পুরাণে যেন দেবতাদের মিছিল চলতে লাগল। কাড়ি কাড়ি দেবতা। দেবতার দেবতা এবং তার দেবতার তস্য দেবতা। গৌণ দেবতা এবং মুখ্য দেবতা। প্রধান দেবতা এবং অপ্রধান দেবতা। দেবতারা কী ভয়ানক এবং একই সাথে কত করুণাময় সেটা বোঝাতে আমদানি করা হল দৈত্য, দানব, রাক্ষস-খোক্ষস, অসুরের প্রতিদ্বন্দ্বিতা। অবশ্য সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে ত্রিমূর্তিবাদ, অর্থাৎ ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর। ক্রমশ হিন্দুধর্ম হয়ে উঠল পুরাণভিত্তিক ধর্ম। সারা ভারতে হিন্দুগণের পূজার্চনা, ব্রত, নিয়ম সবকিছুই পুরাণ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে গেল। বৈদিক অগ্নি, বরুণ, ইন্দ্র দেবতার পরিবর্তে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর ইত্যাদি ঈশ্বরগণ প্রতিষ্ঠা পেল। চিন্ময়ী উপাসনা মৃন্ময়ী মূর্তিতে চলার জন্য পুরাণেই ব্যবস্থা হল। হিন্দুধর্মে প্রবেশ ঘটল বহুত্ববাদিতার স্বরূপ পৌত্তলিকতার। এই পৌত্তলিকতা এবং পুরাণ কাহিনিগুলিকে আশ্রয় করে কায়েম হল ব্রাহ্মণ্যবাদ। দেবতাদের মূর্তি কল্পনা করে পুজো করতে থাকল বুদ্ধের মৃত্যুর পর। কারণ বুদ্ধের মৃত্যুর তাঁর শিষ্যরাই প্রথম মূর্তি কল্পনা করে। সেটাই ব্রাহ্মণ্যবাদীরা অনুকরণ ও অনুসরণ করে অস্তিত্বের বিপন্নতা থেকে।

ব্রাহ্মণগণের দ্বিতীয় মহার্ঘ আবিষ্কার হল সংস্কৃত ভাষা। এই সেই ভাষা যা দেবভাষা তথা দেবনাগরী বলে তকমা পেল। অর্থাৎ এ ভাষায় দেবতারা কথা বলেন– দেবতারা কথা বলেন, তাই ব্রাহ্মণগণ সেই ভাষায় কথা বলেন। অতএব দেবতাগণই ব্রাহ্মণ; ব্রাহ্মণগণই ঈশ্বর। ৩৬টি পুরাণ, একটি মনুসংহিতা এবং বেদ-পুরাণ-রামায়ণ-মহাভারত অনুসরণে শত-সহস্র সাহিত্য লিখিত হল সংস্কৃত ভাষায়। এমন ভাষা, যা নিজেরাই লিখলেন, নিজেরাই পড়লেন, নিজেরাই বুঝলেন। ব্রাহ্মণগণের তৃতীয় আবিষ্কার আত্মা, স্বর্গ-নরক, পাপ-পুণ্য, জন্মান্তর, কর্মফলের ধারণা ইত্যাদি।

ব্রাহ্মণগণের চতুর্থ আবিষ্কার অভিসম্পাত এবং আশীর্বাদ।

একদা ব্রাহ্মণগণের মুখ হইতে কী অগ্নি নিঃসৃত হইত? এমন কথা অবশ্য অনেককে বুক ফুলিয়ে বলতে শুনেছি– “আগে ব্রাহ্মণদের মুখ দিয়ে আগুন বেরুত”। কী মনে হয় পাঠকবন্ধু? উঁহু, ব্রাহ্মণদের মুখ দিয়ে আগুন কোনোদিন নিঃসৃত হত না, এগুলি ব্রাহ্মণদের ভয়-সঞ্চারের কৌশল– গল্পকথা। মুখ দিয়ে যা বেরত, তা হল অভিসম্পাত। কথায় কথায় অভিশাপ আর ক্রোধ বর্ষণ হত। এই অগ্নিরূপ অভিসম্পাতই ব্রাহ্মণের প্রতি ভীতির কারণ। পুরাণগুলিতে পরতে পরতে ব্রাহ্মণগণ কখন অভিশাপ দেন এবং কী অভিশাপ দেন এবং অভিশাপের ফলে কী পরিণতি হয় সেই কাহিনিই বর্ণিত হয়েছে। দুর্বাশার অভিশাপে দুষ্যন্তের স্ত্রী শকুন্তলাকে ভুলে যাওয়া, ভরতমুনির অভিশাপে অপ্সরা উর্বশীর পৃথিবীতে পতন, এমনকি সব অসুর-দৈত্যরাই অভিশাপের পরিণাম ভোগ এবং অবশেষে মুক্তি– ইত্যাদি হাজারো সন্ত্রাস সৃষ্টিকারী কাহিনি। শুধু পুরাণই নয়, প্রাচীনকালে সংস্কৃত সাহিত্যগুলিতে ব্রাহ্মণের রোষে কী পরিণাম হতে পারে তার বর্ণনা পাওয়া যায়। মহাকবি কালিদাস বিরচিত ‘রঘুবংশম্’-এ দেখছি পূজ্য ব্যক্তিদের (পড়ুন ব্রাহ্মণদের) কোনোভাবেই অসম্মান করা উচিত নয়। পূজনীয় ব্যক্তির পূজার্চনায় বিঘ্ন ঘটলে শ্ৰেয়লাভের নানা বিঘ্ন এসে উপস্থিত হয়। প্রাচীন ভারতে রাজাদের মধ্যে নিমি, নহুষ প্রমুখ প্রবল পরাক্রান্ত রাজা হওয়া সত্ত্বেও পূজনীয় ব্রাহ্মণদের অপমান করার জন্য তাঁরা বিনাশপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। বাচ্চা ব্রাহ্মণ পূজনীয়, বৃদ্ধ ব্রাহ্মণও পূজনীয়। পুরাণগুলি পাঠ করলেই স্পষ্ট হয়। ব্রাহ্মণগণ মোটেই ষড়রিপুমুক্ত ছিলেন না; কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য –সবই বিদ্যমান ছিল। অত্যন্ত অন্যায়ভাবে অযাচিত মায় আগ বাড়িয়ে ব্রাহ্মণ বাল্মীকি অভিসম্পাত করলেন শিকারি নিষাদকে (ব্যাধ)। প্রণয়মিলনে মত্ত এক ক্রৌঞ্চমিথুনের পুরুষটিকে তীরবিদ্ধ করে জনৈক ব্যাধ হত্যা করে। পুরুষ সঙ্গীর মৃত্যুশোকে নারী ক্রৌঞ্চীর করুণ বিলাপ আকাশ-বাতাস মুখরিত হল। এটা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু বাল্মীকির মনে হল শিকারি নিষাদ অত্যন্ত গর্হিত এবং নিষ্ঠুর কাজ করেছে। তখন তাঁর মুখ থেকে স্বভাবসিদ্ধ আচরণে শাপবাণী তীব্র গরলের মতো নির্গত হল —

“মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ।
যৎ ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবধীঃ কামমোহিত”।

অর্থাৎ, ক্রৌঞ্চযুগলের থেকে প্রেমবিবশ একটি পাখিকে অন্যায়ভাবে হত্যা করে সে যে পাপকর্ম করেছে তার ফলে সেই ব্যাধ চিরকালের জন্য কলঙ্কিত হয়ে থাকবে। কোনোদিন সুখৈশ্বর্য, গৌরব, প্রতিপত্তি কোনোরকম প্রতিষ্ঠা সে পাবে না, অর্থাৎ সে নির্বংশ থাকবে।

ওঃ, ভাবা যায় না। ‘রামায়ণম্‌’ নামক একটি মহাকাব্য শুরুই হল অভিসম্পাত দিয়ে। এই সেই রামায়ণম্‌, যা পবিত্র– যেখানে এক উচ্চজাতি তথা ব্রাহ্মণ দ্বারা অভিসম্পাত বর্ষিত হল এক অন্ত্যজ ব্যাধের জীবনে। এটিই বোধহয় সর্বকালের বিখ্যাত অভিসম্পাত।

মজার ব্যাপার হল পুরাণ-রামায়ণ-মহাভারতের ক্ষত্রিয়গণ কেউ যৌনক্ষম, কেউ বা জন্মদানে অক্ষম। অক্ষম পুরুষে ছড়াছড়ি। বীর্যহীন পুরুষের কাহিনি। অথচ ব্রাহ্মণগণ দেখুন কেমন বীর্য বিতরণে সক্রিয়! ব্রাহ্মণগণ ঘোষণা দিলেন “পুত্রার্থে ভার্যা”। বললেন অপুত্রক রাজার মুখ দেখা অশুভ। রাজাগণও সন্তান নয়, পুত্রলাভের জন্য অস্থির। বিচিত্রবীর্য, ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু, দশরথ, দিলীপ প্রমুখ। অসংখ্য ক্ষত্রিয় রাজাগণ অপুত্রক ছিলেন। ব্রাহ্মণদের শয্যাসুখেই তাঁরা পুত্রবান হলেন। কীভাবে? সবার কথা এখানে আলোচনা করার পরিসর নেই। কালিদাস বিরচিত মহাকাব্য ‘রঘুবংশ’ থেকে অমিত পরাক্রমশালী বীর রাজা দিলীপের অপুত্রক থেকে পুত্রবান হওয়ার পুরাণকথা শুনব।

সন্তানলাভের উপায় অন্বেষণের জন্য চড়ে এক সন্ধ্যায় সমবেত হয়ে ব্রহ্মার মানসপুত্র গুরু বশিষ্ঠ এবং গুরুপত্নী অরুন্ধতীর চরণ বন্দনা করেন। এরপর পরস্পর কুশল বিনিময়ের পর রাজা দিলীপ আসল কথাটি বলে ফেললেন। বললেন, রাজ্ঞী সুদক্ষিণার গর্ভে পুত্র না-হওয়ায় অনন্ত রত্নপ্রসবিনী বিশাল পৃথিবীও তাঁকে সুখদান করছে না। তাঁর পিতৃপুরুষগণ পিণ্ডলোপের আশঙ্কায় ভুগছেন। তাই কুলগুরু বশিষ্ঠ যেন তাঁর পিতৃঋণ মোচনের জন্য সন্তানলাভের ব্যবস্থা করে দেন। ব্রাহ্মণ শিরোমণি বশিষ্ঠ প্রত্যুত্তরে বললেন, সেবার দ্বারা নন্দিনীকে (স্বর্গের কামধেনু, বশিষ্ঠের হোমধেনু) প্রসন্ন করলে দিলীপের পুত্রলাভের যাবতীয় প্রতিবন্ধকতা দূর হবে। কেমন সেই সেবা? অভ্যাস দ্বারা যেভাবে বিদ্যাকে আয়ত্ত করতে হয়, সেইভাবে ফলমূলাদি (বন্যবৃত্তি অবলম্বনের দ্বারা) আহার করে ব্রহ্মচর্য পালনের দ্বারা এবং সর্বদা অনুগমনের মধ্য দিয়ে নন্দিনীকে প্রসন্ন করতে হবে। অর্থাৎ নন্দিনী প্রস্থান করলে রাজাও প্রস্থান করবে, সে অবস্থান করলে রাজাও অবস্থান করবেন। নন্দিনী জলপান করলে রাজাও জলপান করবেন। তপোবনের সীমান্ত পর্যন্ত নন্দিনীকে করতে হবে। যেই কথা সেই কাজ। নন্দিনী চরতে চরতে এমনভাবে প্রতিদিনই সীমান্ত অতিক্রম করে এবং রাজাও বশিষ্ঠের কুঠির ত্যাগ করে বহুদূর চলে আসে। সেইসময় এই অবকাশে সুদক্ষিণার সঙ্গে বশিষ্ঠের সম্ভোগ-সুখ বিনিময় হতে থাকে দীর্ঘদিন ধরে। অবশেষে পুত্রলাভের আশীর্বাদ। সুদক্ষিণা গর্ভবতী হলেন। বাকিটা অনুমেয়।

পুরাণে উল্লেখ্য ছিল ব্রাহ্মণ ছাড়া অন্য সব বর্ণের মানুষ শংকর, তাঁরাই শুধু আদি অবিমিশ্র রক্তধারার আর্য এবং সেই কারণেই তারা শ্রেষ্ঠতম। তৈত্তিরীয় সংহিতায় বলা হয়েছিল রাজাদের পুরোহিতদের সহায়তা অবশ্য প্রয়োজনীয়, এমন কি রাজার পক্ষে সঠিক পথে চলার নিমিত্ত পুরোহিতদের প্রয়োজন। পুরোহিত ক্ষত্রিয়ের আত্মা, কারণ পুরোহিত ব্যতীত রাজার অন্ন দেবতারা গ্রহণ করে না কিনা! অর্থাৎ, ক্ষত্রিয়রা শাসক সম্প্রদায় হলেও ব্রাহ্মণদের আধিপত্য অক্ষুণ্ণ রেখেই রাজ্যশাসন করতে থাকবে। শরভঙ্গ, সুতীক্ষ্ণ, অগস্ত্যভ্রাতা ইধ্ববাহ, অগস্ত্য নামক ব্রাহ্মণদের প্ররোচনায় ঐন্দ্রধনু, খ, অক্ষয় বাণ, তূর্ণী দ্বারা ক্ষত্রিয় ভগবান (?) শ্ৰীমান রামচন্দ্র দণ্ডকারণ্যে প্রায় চোদ্দো হাজার অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষদের (যাঁদেরকে রামায়ণে রাক্ষস-খোক্ষস বলে চিহ্নিত করা হয়েছে) নির্বিচারে হত্যা করেছিলেন। “রক্ষসাং নিহতান্যাসন্ সহস্রাণি চতুর্দশ” (রামায়ণ–বালকাণ্ড–প্রথম সর্গ, ৪৯তম শ্লোক)। প্রাচীনকালে রাজারা সজ্ঞানেই ব্রাহ্মণদের কখনও ঘাটতে যাননি, কারণ শাস্ত্র সম্পর্কে অজ্ঞ মানুষের কাছে ব্রাহ্মণরা ঈশ্বর এবং ধর্মের নামে নিজেদের চূড়ান্ত শ্রেষ্ঠ প্রতিপন্ন করতে সক্ষম হয়েছিলেন তার অনেক আগে থেকেই। তাই রাজারা ব্রাহ্মণদের হোশামোদ করেই প্রজাদের শাসন-শোষণ নিরবচ্ছিন্নভাবে করতে চাইতেন। ঠিক এই সময়েই ব্রাহ্মণরা নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের কীর্তন-গাঁথা রচনায় মনোযোগ দেন। তাতেও যখন কাজ হচ্ছিল না তখন তাঁরা কর্মফল, পুনর্জন্ম, আত্মা-পরমাত্মা, জন্মান্তরবাদ ইত্যাদি তত্ত্ব রচনাতে মনোনিবেশ করেন। পার্থিব ব্রাহ্মণ হত্যাকে ‘ব্রহ্মহত্যা পাপ’ নামে স্বর্গীয় পাপের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে আরও কঠোর করা হল ব্রাহ্মণদের অস্পৃশ্যবাদী প্রকল্পের চূড়ান্ত।

ভারতবর্ষে প্রতিষ্ঠিত হিন্দুধর্মটি আসলে ব্রাহ্মণ্যধর্মের শোরুম। বেদ বা বৈদিক আশ্রিত নয়, পুরাণ বা পৌরণিক আশ্রিত। অনেক বছরের বিবর্তনের মধ্য দিয়ে ব্রাহ্মণদের মতবাদই ব্রাহ্মণ্যবাদ কায়েম হয়ে গেল। এ এমন এক মতবাদ, যা মোট জনসংখ্যার ৯০ শতাংশ শূদ্রদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করল। শুধু শূদ্রদের নয়, ক্ষত্রিয়-বৈশ্যদেরও কবজা করে ফেলেছিল ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়গণ। ক্ষত্রিয়দের অস্ত্রশিক্ষাও তাঁরা নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছিলেন জটিল কৌশলে। পরশুরাম, দ্রোণাচার্য প্রমুখ ব্রাহ্মণগণ ক্ষত্রিয়দের অস্ত্রগুরু হিসাবে খুবই প্রসিদ্ধ হয়েছেন। এমনকি রাজকার্য পরিচালনাতেও ক্ষত্রিয়দের অভিভাবক এই ব্রাহ্মণই। বৃহস্পতি, শুক্রাচার্য, বশিষ্ঠ প্রমুখ ক্ষত্রিয়দের গুরু ছিলেন। আর তাই বশিষ্ঠের নির্দেশেই ক্ষত্রিয় রামচন্দ্র শূদ্র-তপস্বী শম্বুককে নিজের হাতে হত্যা করেছিলেন। ক্ষত্রিয়গণ বহুবার চেষ্টা করেছিলেন ব্রাহ্মণ্য প্রভাব থেকে মুক্ত হতে। পারেনি। যতবারই চেষ্টা করেছে ততবারই ব্রাহ্মণগণ নির্মমভাবে শাস্তিবিধান করেছেন। ব্রাহ্মণ পরশুরামের কথা মনে পড়ছে? ইনি পৃথিবীকে একুশবার নিঃক্ষত্রিয় করেছিলেন। মানে ক্ষত্রিয়দের ধরে কচুকাটা করেছিলেন।

অপরদিকে ক্ষত্রিয়-সন্তান বুদ্ধদেবের আবির্ভাবের পূর্ব পর্যন্ত জনসাধারণের উপর ব্রাহ্মণ-সম্প্রদায়ের একচেটিয়া আধিপত্য ছিল অপ্রতিরোধ্য। ধর্মচিন্তাকে সুসংঘবদ্ধ করতে সমাজের প্রভাবশালী শ্রেণি নিজেদের আধিপত্য অব্যাহত রাখতে তৈরি করেছিলেন উপাসনালয় এবং এর কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য নিয়োগ করতে হয়েছিল উপাসক বা পুরোহিত সম্প্রদায়। প্রাচীন ভারতে উপাসকদের মনোনীত করতে হত। ক্রমশ এই উপাসক বা পুরোহিতদের শক্তি বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং এই সুবাদে তাঁরা হস্তগত করে ফেলেন উপাসনা পদ্ধতি প্রণয়নের অধিকারও। যাঁদের কাজ ছিল বিশ্বাসীদের জন্য বিশেষ বিশেষ প্রথার জন্ম দিয়ে ঈশ্বর এবং তার কল্পিত অনুচরদের তুষ্টি বিধানের পাশাপাশি নিজেদের তুষ্টি এবং পুষ্টিসাধন। উপাসনার নেতৃত্ব দিতে উপাসক বা পুরোহিতরা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কাজটি করেছিলেন সেটি হচ্ছে দৈবশক্তির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের দুর্বোধ্য সংস্কৃত ভাষায় ভাষ্যরচনা সৃষ্টি, যাকে বলা হয় ‘মন্ত্র’। প্রথমদিকে বৈদিক ধর্মগুরুরা ছিলেন মন্ত্র রচয়িতা। এরপর মূলত ব্রাহ্মণ এবং শাস্ত্রকাররা সনাতন ধর্মের সাংগঠনিক রূপ দেন। এদের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালীরা শাসক সম্প্রদায়ের ক্ষত্রিয়দের সঙ্গে আঁতাত করে চতুর্বর্ণ প্রথার জন্ম দেন। এই বর্ণপ্রথার বর্ণপ্রধান হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন ব্রাহ্মণগণ এবং স্বাভাবিকভাবেই উপাসনার জন্য মন্ত্র-স্তোত্র-স্তব রচনা করার ক্ষমতা অধিকার করেন। সম্ভবত ব্রাহ্মণরাই একমাত্র পূজারী শ্রেণি যাঁরা জন্ম সুত্রে এই অধিকার পান (যদিও এ ব্যাপারটি অশাস্ত্রীয়)। অবশ্য শুরুর দিকে ব্রাহ্মণরা উত্তরাধিকার সূত্রে পুরোহিতের দায়িত্ব পালন করতে পারতেন না। এজন্য বিশেষ গুণের উপর গুরুত্ব দেওয়া হত। বর্ণপ্রথা পাকাপাকিভাবে প্রতিষ্ঠিত হলে সনাতন ধর্ম চেপে বসার আগে মন্ত্র রচনা করে ব্রাহ্মণ হতে পারতেন যে কেউ। এমনকি জন্মসুত্রে ব্রাহ্মণরা উপাসনার দায়িত্ব ছেড়ে বেছে নিতে পারত অন্য যে-কোনো পেশাও।

সমাজের সুবিধাবাদী মন্ত্র-রচয়িতা ব্রাহ্মণরা খুব সহজেই আন্দাজ করতে পেরেছিলেন ধর্মীয় কাজ মায় ঈশ্বরের উপাসনা কর্মটি একাধারে আধ্যাত্মিক এবং পার্থিব প্রাধান্য বিস্তারে একটি শক্তিশালী নিয়ামক হয়ে উঠতে পারে এবং এই চিন্তাসুত্রে ক্রমশ শাসক এবং মন্ত্র-রচয়িতা সম্প্রদায় নিজ নিজ স্বার্থের তাগিদে তৈরি করতে থাকে উপাসনা প্রকল্প। মগধীয় যুগ এবং মৌর্য যুগ– এসময়ই ব্রাহ্মণরা নিজেদের শ্রেষ্ঠতর দাবি করে শাস্ত্র রচনা শুরু করেন। এরপর আবিষ্কার করা হল বারো মাসে তেরো পার্বণ। জন্ম থেকে মৃত্যু– কোথায় নেই তাঁরা, এঁটুলি পোকার মতো আষ্টেপৃষ্টে রইলেন! আবিষ্কার করা হল কোটি কোটি দেব-দেবতার কোটি কোটি পুজো-পার্বণ– সারা বছর, প্রতিদিন এবং প্রতি মুহূর্তের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। মানুষকে স্বর্গে পৌঁছে দেওয়ার এইরকম বিশাল এবং সফল ইন্ডাস্ট্রি পৃথিবীতে আর কোথাও আছে বলে আমার জানা নেই।

ব্রাহ্মণগণ সবচেয়ে বেশি লাভবান হতেন শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে। প্রচুর সম্পদ সংগ্রহ হত। কেমন ছিল সেই সেকালের শ্রাদ্ধানুষ্ঠান? তার আগে জেনে নিই হিন্দুদের আদি বা মূল ধর্মগ্রন্থ বেদ হিন্দুদের শ্রাদ্ধানুষ্ঠান নিয়ে কী নির্দেশ দিয়েছেন প্রাঙ্গণ। বৈদিক সংস্কারে মৃতের শেষকৃত্য সমাপনে যে মন্ত্রাদি ব্যবহৃত হয় তা পৌরাণিক নিয়ম অর্থাৎ হিন্দুদের বর্তমানে প্রচলিত নিয়ম বা মন্ত্র থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। বৈদিক নিয়মে মৃতের শেষকৃত্য সম্পন্ন করতে দুই থেকে তিনদিন লাগে। মানুষ মারা গেলে তাকে দাহ করার নাম “অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া। অন্ত্যা’ অর্থে অন্তিম, চরম বা সর্বশেষ এবং ইষ্টি’ অর্থে যজ্ঞ, শুভকর্ম বা সংস্কারকে বোঝায়। বৈদিক পণ্ডিত শ্রীমদ্ দয়ানন্দ সরস্বতী তাঁর রচিত “সংস্কার বিধি”-তে বলেছেন, “এখানে ‘ইষ্টি’ বলিতে যজ্ঞ বা শুভকর্ম বোঝয় বলিয়া অন্ত্যেষ্টি কর্মে পুণ্যই হইয়া থাকে। ইহাতে পাপ বা অশৌচ হইলে ইহার নাম ‘ইষ্টি’ হইত না। ‘অন্ত্যেষ্টি’ শব্দ স্বয়ং ঘোষণা করিতেছে যে, মৃতদেহ দাহ করাই পুণ্যের কাজ”। বড়োজোর, স্বামী দয়ানন্দ বলেছেন, শব দাহান্তে যে গৃহে মৃত্যু হয়েছে সেই গৃহ মার্জন, লেপন ও প্রক্ষালন করে বিশুদ্ধ করে নেওয়া যেতে পারে। এমনকি স্বস্তি বাচন ও শান্তি প্রকরণাদি মন্ত্র দ্বারা ঈশ্বরের উপাসনা করা যেতে পারে। কিন্তু পুরাণগুলির (বিশেষ করে গরুড়পুরাণ) ছত্রে ছত্রে যজমানদের নিঙড়ে কামানোর ফরমান। সবৎস্য গোরু দান, ভূমিদান, স্বর্ণদান, ষোড়শদান (১৬টি দ্রব্য –ভূমি বা ভূমিমূল্য, আসন, শয্যা, অন্ন, বস্ত্র, গোরু, জল, প্রদীপ, তাম্বুল, ছত্র বা ছাতা, গন্ধ, মাল্য বা মালা, ফল, পাদুকা, সোনা, রুপো। এগুলি দান করলে মৃত ব্যক্তি ৯৬০ হাজার বছর স্বর্গে সুখে কাল কাটাতে পারবে। মৃতের আত্মীয়গণ যত ভালো ভালো দ্রব্যাদি ব্রাহ্মণকে দান করতে পারেন তত ভালো ভালো দ্রব্যাদি মৃত ব্যক্তি স্বর্গে পাবেন। ), মৃতের পছন্দের জিনিসপত্র, ব্রাহ্মণভোজন ইত্যাদি কঠোর বিধান। সামর্থ্য থাক-বা-থাক, প্রয়োজনে ভিক্ষা করে এসবের আয়োজন করতে হবে। এইসব ব্রাহ্মণগণ মৃত আত্মীয়ের স্বর্গে পাঠানোর বাহানায় সমগ্র হিন্দুজাতিকে ভিখিরি করে ছেড়েছে। তবে বহুদিন হল ওইসব নিয়মের অনেক কাটছাঁট হয়ে গেছে। মৃত আত্মীয়ের বুকে ‘গীতা’ রাখলেই তিনি স্বর্গে চলে যাচ্ছেন। কেউ কেউ আবার গীতাপাঠও করান। যদিও যাঁর উদ্দেশে পাঠ করা হচ্ছে তিনি কিছুই শুনতে পান না। কারণ তিনি মৃত, জড়বস্তু মাত্র।

কিন্তু ব্রাহ্মণগণ বুঝেছিলেন এই বেদ অনুসরণ করলে ব্যাপক কোনো ফায়দা হবে না। অথচ মৃতের পরিবারের কাছ থেকে ব্যাপক ফায়দার সম্ভাবনা রয়েছে। পরিবারের কোনো সদস্যের মৃত্যু একটি বেদনাদায়ক অধ্যায়। কোন্ পরিবার -চায় তাঁর মৃত সদস্য স্বর্গসুখ পাক? অতএব মৃত সদস্যের স্বর্গের সমস্ত রকম সুখ দেওয়ার সবরকম ব্যবস্থার বিধি সৃষ্টি করতে হবে। অতঃপর ব্রাহ্মণগণ পুরাণের মতো গ্রন্থগুলি রচনার কাজে হাত দিলেন। রচিত হল ১৮টি প্রধান পুরাণ এবং ১৮টি উপপুরাণ নামক আকর গ্রন্থ। এই পুরাণগুলির পাতায় পাতায় বর্ণিত ব্রাহ্মণ ও ব্রাহ্মণ বিষয়ক ভয়ংকর সব বক্তৃতা এবং স্ববিরোধী নিয়ম-বিধি-বিধান। এই পুরাণগুলিই হল ব্রাহ্মণ্যবাদের রক্ষাকবচ। ব্রাহ্মণ্যবাদের আলোচনায় পরে আসছি। এখন ফিরে যাই শ্রাদ্ধের প্রসঙ্গে। নিয়ম করলেন শোকার্ত পরিবারের কাছ থেকে কীভাবে কতটা চুষে খাওয়া যায়। এ প্রসঙ্গে চার্বাক সম্প্রদায়ের বাণী মনে পড়ছে– বেদ ভণ্ড, ধূর্ত, ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের রচনা। জীবিকা অর্জনের স্বার্থে তাঁরা স্বর্গ, নরক, পাপ, পুণ্য, ঈশ্বর, কর্মবাদ, কর্মফল, জন্মান্তরবাদ, আত্মা ইত্যাদি মিথ্যা অলৌকিক ধারণা প্রচার করে সাধারণ অসহায় মানুষদের যাগযজ্ঞ বাধ্য করে।

নিয়ামক– হ্যাঁ, সেই নিয়ামকের মিশনে পৌঁছে যেতে ব্রাহ্মণরা কুলশ্রেষ্ঠের মর্যাদাটি দখল করে নেয়। তাঁরা রচনা করতে থাকে দুর্বোধ্য সব মন্ত্রাদি, বেছে নেন সংস্কৃত ভাষার মতো দুর্বোধ্য এবং অপ্রচলিত কৃত্রিম ভাষা। যে ভাষা ওরা ছাড়া কেউ বুঝত না, বোঝার অধিকারও কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। সমাজের মাঝে প্রধান হয়ে উঠার জন্য এটিই ছিল অমোঘ হাতিয়ার। মন্ত্রের ঐন্দ্রজালিক মোহ দিয়ে তাঁরা ব্যাপক প্রভাব সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। মন্ত্রকে ঈশ্বরের বাণী বলে প্রচার করতে থাকেন এবং সমাজের প্রায় সবার সমর্থনে আসন গেঁড়ে বসেন সমাজের শিখরে। সেখান থেকে যাতে কোনোভাবেই প্রত্যাবর্তন না-করতে হয় সেইজন্য দ্বিতীয় কুলশ্রেষ্ঠ ক্ষত্রিয় বা রাজা-শাসকদের সঙ্গে বজায় কূটনীতিক সদ্ভাব অব্যাহত রাখা হত। পুরাণে উল্লেখ্য ছিল ব্রাহ্মণ ছাড়া অন্য সব বর্ণের মানুষ শংকর, তারাই শুধু আদি অবিমিশ্র রক্তধারার আর্য এবং সেই কারণেই তাঁরা শ্রেষ্ঠতম। তৈত্তিরীয় সংহিতায় বলা হয়েছে, রাজাদের পুরোহিতদের সহায়তা অবশ্য প্রয়োজনীয়, এমনকি রাজার পক্ষে সঠিক পথে চলার জন্য পুরোহিতদের প্রয়োজন। পুরোহিত ক্ষত্রিয়ের আত্মা (রাজার আত্মা) কারণ পুরোহিতবিহীন রাজার অন্ন (দেবতাদের সন্তুষ্টির জন্য তুলে দেওয়া প্রাসাদ) দেবতারা গ্রহণ করে না। সে সময়ে ব্রাহ্মণগণ ক্ষত্রিয়দের পিঠ চাপড়াতেন, ক্ষত্রিয়ের সপক্ষে কাব্য-মহাকাব্য লিখতেন –অন্যদিকে ক্ষত্রিয়গণ ব্রাহ্মণদের পিঠ চাপড়াতেন, প্রশংসা করতেন, উপাধি দিতেন, অর্ধেক রাজ্য দিতেন ইত্যাদি– এভাবেই ধীরে ধীরে আম-আদমিদের অভিশাপ-আশীর্বাদের ভয়-ভরসা প্রদর্শন করে গড়ে তোলা হয়েছিল সনাতন ধর্মীয় সাম্রাজ্যবাদ, যা আরও অনেক পরে হিন্দুধর্ম হিসাবে প্রকাশিত হয়। অপরদিকে ক্ষত্রিয়রা শাসক সম্প্রদায় হলেও ব্রাহ্মণদের আধিপত্য অক্ষুণ্ণ রেখেই রাজ্যশাসন করবে –এই হল অদৃষ্ট, নিয়তি।

ব্রাহ্মণকে হত্যা করা যায় না, হাজার গর্হিত অন্যায় কাজ করলেও নয়– পার্থিব ব্রাহ্মণ হত্যাকে ‘ব্রহ্মহত্যা পাপ’ নামে স্বর্গীয় পাপের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে আরও কঠোর করা হল ব্রাহ্মণদের অস্পৃশ্যবাদী প্রকল্পের চূড়ান্ত। চাউর করে দেওয়া হল ব্রাহ্মণ হত্যা করলে বেহ্মদত্যি হয়। বলা হল ৬৪ লক্ষ যোনি ভেদ করে ব্রাহ্মণের জন্ম হয়। ইতিহাসবিদ এবং পর্যটক মেগাস্থিনিসের বিবরণ থেকে জানা যায়, মৌর্যযুগে ধর্ম এবং ধর্মীয় কাজে ব্রাহ্মণদের প্রাধান্য ছিল। অপ্রতিরোধ্য। রাজ-দরবার এবং আইন-আদালত সর্বত্র প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার কারণে এবং সব শ্রেণির কাছ থেকে দানদাক্ষিণ্য পেয়ে এক বিশাল বিত্তশালী শ্রেণীতে পরিণত হয় ব্রাহ্মণগণ। অনেকে আবার সরাসরি রাজকর্মও নির্বাহ করতেন। একসময় মগধ এবং মৌর্য রাজ্যগুলিতে রক্ষণশীল ব্রাহ্মণদের সঙ্গে তুলনামূলক ভাবে অরক্ষণশীল ব্রাহ্মণদের চিন্তাগত দ্বন্দ্ব দেখা যায়।

বৌদ্ধধর্ম মতে ব্রাহ্মণের বেশ কিছু ব্যাখ্যা এবং সংজ্ঞা পাওয়া যায়। আসুন, আমরা একটু অনুধাবন করার চেষ্টা করি। কিছুই ফেলা যায় না।

প্রকৃত ব্রাহ্মণ : বুদ্ধের জম্মের পূর্বে ভারতে ব্রাহ্মণেরা তাদের নিজ মাহাত্ম্য প্রচারছলে জাতি অভিমান প্রকাশ করত মানুষের মধ্যে ব্রাহ্মণ শ্রেষ্ঠ। কিন্তু বুদ্ধের সঙ্গে তেবিজ্জের আলোচনায় প্রতীয়মান হয় যে, কেবল ত্রিবেদ জ্ঞাত হলে প্রকৃত ব্রাহ্মণত্ব অর্জন করা যায় না। ব্রাহ্মণত্ব লাভ করার জন্য অসমার্থক তর্ক ও বেদ, মৈত্রী, করুণা, মুদিতা ভাবনা করা প্রয়োজন। যাঁরা এরূপ ভাবনার অধিকারী হয়ে অনাসক্ত নিষ্কলুষ, রজঃমুক্ত, লোভ-দ্বেষ-মোহবিহীন হয় এবং যিনি পাপ পঙ্কিল দূরতিক্রম্য মোহপূর্ণ সংসারাবর্ত মুক্ত হয়েছেন তিনিই প্রকৃত ব্রাহ্মণ।

জাতি দ্বারাই প্রকৃত ব্রাহ্মণ : হিন্দুদের বিশ্বাস জাতি দ্বারাই প্রকৃত ব্রাহ্মণ অধিকারী হয়। অর্থাৎ, প্রকৃত ব্রাহ্মণ হতে হলে ব্রাহ্মণ জাতিতে জন্ম কিংবা ব্রাহ্মণীর গর্ভজাত হতে হবে। কিন্তু বুদ্ধ মতে, ব্রাহ্মণ জাতিতে জন্ম কিংবা ব্রাহ্মণীর গর্ভজাত হয়ে পাপ মলত্যাগ করতে না করলে তাঁকে প্রকৃত ব্রাহ্মণ বলা যাবে না। তাঁকে কেবল ব্রাহ্মণ বলে সম্বোধন করা যায়। বংশগৌরব অথবা উচ্চবংশে জন্ম লাভ করেও শীল গুণে বিভূষিত না-হলে কেউ ব্রাহ্মণ হতে পারে না। বহুলোক নীচু কুলে জন্মগ্রহণ করেও শীলাচার সম্পন্ন হয়ে পরিশ্রমের দ্বারাই সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করে স্বর্গে গমন করতে পারে। তাই বুদ্ধ বলেছেন, জন্মের দ্বারা কেউ চণ্ডাল বা ব্রাহ্মণ হয় না, কর্মের দ্বারাই চণ্ডাল বা ব্রাহ্মণ হয়।

প্রকৃত ব্রাহ্মণ তৃষ্ণামুক্ত : যিনি বন্ধনমুক্ত, অনাশ্রব, কামচিন্তা বিরহিত তিনিই তৃষ্ণামুক্ত ব্রাহ্মণ নামের যোগ্য। ব্রাহ্মণ ধ্যানী, একক বিচরণশীল, বস্তুকাম ও ক্লেশকাম পরিহার করে চলেন। যিনি সর্ব সংযোজন ছিন্ন করে ভয়মুক্ত, অনাসক্ত, শৃংখলামুক্ত তিনিই তৃষ্ণাক্ষয়ী ব্রাহ্মণ। ক্রোধপূর্ণ, জটাধারী, অজিনচর্ম পরিহিত ব্যক্তি ব্রাহ্মণের যোগ্য হতে পারে না। ক্রোধবিহীন, ব্রতপরায়ণ, শীলবান, সংযমী ও অন্তিম দেহদারী ব্যক্তি তৃষ্ণামুক্ত ব্রাহ্মণ বলে যোগ্য হন। যিনি গৃহস্থ ও অনাগরিক উভয়ের প্রতি অসংশ্লিষ্ট অল্পেচ্ছ ও আলয়বিহীন তিনিই তৃষ্ণামুক্ত ব্রাহ্মণ। যিনি ছোটো-বড়ো সর্বপ্রকার অদত্ত গ্রহণে বিরত, যার কোনো প্রকার তৃষ্ণা বিদ্যমান নেই যিনি সংশয়মুক্ত ও নির্বাণ প্রাপ্ত তিনিই ব্রাহ্মণ।

জাত্যাভিমানী প্রকৃত ব্রাহ্মণ : তৎকালীন সময়ে ব্রাহ্মণেরা অভিমান বা অহংকার করে নিজের গৌরব করে বলত তারাই মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠ জাতি। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে জাতি অভিমান ব্রাহ্মণের কাজ নয়। কারণ জাতি হিসাবে মানুষ মানুষের কোনো পার্থক্য নেই। তঙ্কালীন মানবজাতির মধ্যে ব্রাহ্মণ, বৈশ্য, শুদ্রের পদচিহৃ একই ধরনের। কিন্তু হাতি, ঘোড়া, বাঘ প্রভৃতি প্রাণীদের মতো মানুষ মানুষের মতো পার্থক্য দেখা যায় না। প্রাণীদের মধ্যে স্ত্রী, পুরুষ, বর্ণ, শারীরিক গঠন, লোম, চঞ্চু, প্রভৃতি পার্থক্য আছে। কিন্তু মানুষ মানুষে তেমন পার্থক্য দেখা যায় না। বুদ্ধ মতে, যে-কোনো ব্যক্তি সৎকর্ম করলে ব্রাহ্মণের পর্যায়ে উন্নীত হতে পারেন। সভাব ও কৃচ্ছসাধনের দ্বারা যে-কোনো লোক ব্রাহ্মণ অর্জন করতে পারেন।

ধ্যানীপরায়ণ প্রকৃত ব্রাহ্মণ : পণ্ডিতগণ বলেছেন, বনের প্রাণীরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে। ঠিক তেমনি প্রকৃত শ্ৰমণ বা ব্রাহ্মণ ধ্যানপরায়ণ হলে শোভা পায় এবং অনাসক্ত, নিষ্কলুষ, রজযুক্ত লোভ-দ্বেষ-মোহবিহীন হয়। দিনেরবেলায় সুর্য আলো দিয়ে দিনের শোভা বৃদ্ধি করে, রাতের বেলায় চন্দ্র প্রদীপ্ত হয়ে রাতের শোভা রক্ষা করে এবং সৈন্য, সামন্ত, অস্ত্র-শস্ত্রে সুসজ্জিত হলে রাজার সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায়। সেরূপ প্রকৃত শ্ৰমণ বা ব্রাহ্মণ ধ্যানপারয়ণ হলে শোভিতক হয়। বুদ্ধ নিজের জ্ঞানের প্রতিভায় দিন-রাত্রি প্রদীপ্ত হন। শ্রমণ বা ব্রাহ্মণ পাপ পুণ্য ধ্যানরত হয়ে প্রকৃত প্রব্রজিত নামে অভিহিত হন।

পুরাণ মতেও ব্রহ্মজ্ঞান প্রাপ্ত হলেই কেবল ব্রাহ্মণত্ব অর্জিত হয়। তারপরও সনাতন ধর্ম যুগ যুগ ধরে চতুর্বর্ণভেদ টিকে ছিল প্রায় হাজার বছর ব্যাপী। তবে ব্রাহ্মণদের ধর্মীয় চাতুরি কার্যকারিতা হারাতে থাকে উনিশ শতকের শেষের দিকে। ব্রাহ্মণ্যবাদ থেকে উদ্ভূত কয়েকটি কদাচার-কুৎসিত সংস্কারের পর থেকেই এই অবরোহণের শুরু। রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সহ প্রমুখ প্রগতিশীল ব্যক্তিত্বের সংস্কার আন্দোলনে ব্রাহ্মণরা ক্ষমতা হারাতে শুরু করেন। এই শতকে নেওয়া দেবদাসী প্রথার আইনানুগ অবসান, সতীদাহ প্রথা নিবারণ, বিধবা-বিবাহের প্রচলন, কৌলীন্য প্রথার বিলোপ, ব্রাহ্মধর্ম প্রবর্তন এবং ছুৎমার্গের বাড়াবাড়ি অনেকটা কমে আসা থেকে ব্রাহ্মণদের খর্বতা শুরু হয়েছিল। কেন ব্রাহ্মণদের এরকম খর্ব শুরু হয়েছিল? কেন ব্রাহ্মণদের সম্মান নষ্ট হতে শুরু করল? কবে থেকে?

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘ব্রাহ্মণ’ প্রবন্ধে লিখছেন, “ব্রাহ্মণও যখন আপন কর্তব্য পরিত্যাগ করিয়াছে, তখন কেবল গায়ের জোরে পরলোকের ভয় দেখাইয়া সমাজের উচ্চতম আসনে আপনাকে রক্ষা করিতে পারে না। কোনো সম্মান বিনামূল্যের নহে। যথেচ্ছ কাজ করিয়া সম্মান রাখা যায় না।”

অপরদিকে প্রাজ্ঞ পণ্ডিত নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী একটি প্রবন্ধে বলেছেন– “ত্যাগ বৈরাগ্য-কৃচ্ছতা নেই, ঋজুতা নেই, তপস্যা নেই, অথচ অর্থগুঘ্নতা আছে, আত্মম্ভরিতা আছে, মাতব্বরি আছে, ভয় দেখানো আছে, এমন ব্রাহ্মণ্য সামাজিক মানুষের সম্মান লাভ করতে পারে না। …..প্রথাগত ব্রাহ্মণ্যের বিরুদ্ধে, জন্মব্রাহ্মণ্যের বিরুদ্ধে অথবা ব্রাহ্মণ্য-প্রদর্শনের মাধ্যমে অর্থোপার্জন করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং গুপ্ত সমালোচনা কিন্তু অনেকদিনই আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল এবং সেটা ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের মধ্যেই হয়েছিল। শুধুমাত্র শুষ্ক আচার দেখিয়ে, গুরুর গৌরব দেখিয়ে, পিতার গৌরব দেখিয়ে অধস্তন বর্ণকে অপমান করার একটা আদত ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের মধ্যে এমনভাবে নিহিত হয়ে গিয়েছিল যে, গৌরবযুক্ত পিতামাতার পুত্র-কন্যারা এবং অনুপযুক্ত শিষ্যরাও সমাজভুক্ত অধর বর্ণকে কথায় কথায় অপমান করে বসত। একদা ক্ষত্রিয়ের ক্ষাত্রবৃত্তি যেমন ব্রাহ্মণকে আশ্রয় করে উজ্জীবিত থাকতেন, ঠিক তেমনিই ব্রাহ্মণের ব্রাহ্মণ্যও ক্ষত্রিয়ের দয়া-দাক্ষিণ্য-উপঢৌকন-উপাধি প্রাপ্তের উপরই নির্ভর ছিল। ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় দুই বর্ণই পরস্পরের পরিপূরক– সংসৃষ্টং ব্ৰহ্মণা ক্ষত্রং ক্ষত্রেণ ব্ৰহ্ম সংহিতম। অবশ্য কালের নিয়মে একদিন কার্তবীর্য বললেন, ব্রাহ্মণরা ক্ষত্রিয়দের আশ্রয় করে আছেন, এটা ঠিক। কিন্তু কোনোভাবেই ক্ষত্রিয়রা ব্রাহ্মণদের আশ্রয় করে নেই– “ব্রাহ্মণাঃ সংশ্ৰিতাঃ ক্ষত্রং নক্ষত্রং ব্রাহ্মণাশ্রিতম”।

অথচ ভাবুন ব্রাহ্মণদের ধর্মীয় রাজনীতি থেকে উদ্ভূত প্রভাব প্রবল বাধাগ্রস্ত হয়েছিল সপ্তম থেকে নবম শতকের মধ্যে। এ পর্বে ‘ভক্তিবাদ আন্দোলন গড়ে উঠে গোটা ভারতবর্ষে। ভক্তিবাদীরা প্রত্যাখ্যান করেন ব্রাহ্মণদের বর্ণবাদী শ্রেষ্ঠতের ধারণা। এতে ধ্বনিত হয় সামাজিক প্রতিবাদের সুর। হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসা ব্রাহ্মণ্য রাজনীতির সঙ্গে শেষপর্যন্ত টিকতে না-পারলেও “ভক্তিবাদ’ আন্দোলনই সনাতন ভক্তদের মনে জন্ম দেয় বর্ণবাদ এবং বর্ণশ্রেষ্ঠতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার।

বললে অত্যুক্তি হবে না যে, ভারতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধর্মের আগ্রাসনে আক্রমণে-অত্যাচারে বারবার বিপন্ন-বিপর্যস্ত হয়েছে সনাতন ধর্ম তথা ব্রাহ্মণ্যধর্ম তথা হিন্দুধর্ম। ব্রাহ্মণগণ বিপন্নতা থেকে মুক্তি পেতে ধর্মীয় অনুশাসনগুলিকে আরও কঠোর থেকে কঠোরতম করতে গিয়ে হিন্দুধর্মের সর্বনাশ করেছে। ব্রাহ্মণগণের অমানবিক বিধানে জর্জরিত হয়ে তথাকথিত নীচুতলার মানুষগুলো দলে দলে কেউ মুসলমান, কেউ খ্রিস্টান, কেউ বৌদ্ধ হয়ে গেছে। কখনো শুনিনি অন্য কোনো ধর্মের মানুষ হিন্দুধর্মকে ভালোবেসে হিন্দু ধর্মাচরণ করছে। খানখান হয়েছে ব্রাহ্মণ্যবাদ কঠোরতার কারণেই। বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো। পরবর্তীকালে কেরলিয়ান ব্রাহ্মণ শঙ্করাচার্য (আদি) নরমে-গরমে একবার চেষ্টা করেছিলেন এবং সফল হলেন ভারতে ব্রাহ্মণ্যশাসন কায়েম করতে। এ ছাড়া বিভেদনীতির মাধ্যমে ক্ষত্রিয়শক্তিকে দুর্বল করে তোলেন। ফলে অতি সহজেই মুসলমান শক্তি ভারতে দ্রুত প্রসার লাভ করে। ব্রাহ্মণ্যবাদীরা বৌদ্ধধর্মকে প্রায় শেষ করে দিতে সক্ষম হলেও অষ্টাদশ শতাব্দী নাগাদ ব্রাহ্মণদের চক্রান্তে এবং সহায়তায় মুসলমান শক্তিকে পরাভূত করতে ভারতে ব্রিটিশ শাসন কায়েম হয়। বিংশ শতাব্দীর শুরুতেই বেনিয়া-নেতা গান্ধিজিকে সামনে রেখে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা ভারতের শাসনক্ষমতা পুনরুদ্ধার করতে প্রয়াসী হন। সেই বিষয়টি ব্রিটিশপুঙ্গবগণ আন্দাজ করতে পেরে তার সদব্যবহার করেছিল। দ্বিজাতিতত্ত্বের আঁতুরঘর এখান থেকেই। মোদ্দা কথা, ব্রাহ্মণ্যবাদের জাঁতাকলে পড়ে হিন্দুধর্ম আজ বিপন্ন, বিপর্যস্ত, ছিন্নভিন্ন। প্রাচীন যুগ থেকেই ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়েছে। জন্ম নিয়েছে বৌদ্ধধর্ম, জৈনধর্মের মতো ধর্মবাদ। ব্রাহ্মণ্যবাদের অস্পৃশ্যতা এবং প্রাণীহত্যাকে হাতিয়ার করে ব্রাহ্মণ্যবাদকে নিকেশ করতে উঠেছিল বৌদ্ধধর্ম। বিশেষ করে ভারতবর্ষের অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষরা ব্রাহ্মণ্যবাদের অনুশাসনের নামে অত্যাচারের হাত থেকে মুক্তি পেতে দলে দলে বৌদ্ধধর্মে চলে আসতে থাকলেন। ভীত-সন্ত্রস্ত ব্রাহ্মণবাদের পুরোধারা কখনো বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে অস্ত্র শানালেন, কখনো-বা কৌশল অবলম্বন করে বৌদ্ধদের ভারত থেকেই প্রায় উৎখাত করে দিলেন। এই বৌদ্ধদের ঠান্ডা করতে ডাণ্ডা হাতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন কেরলের ব্রাহ্মণ শংকরাচার্য এবং তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গো-শাগরেদরা। বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে ব্রাহ্মণ্য-সন্ত্রাস চালিয়েও বৌদ্ধদের যখন দমানো গেল না তখন কৌশলে ঘোষণা করে দেওয়া হল বৌদ্ধধর্মও যা, হিন্দুধর্মও তাই এমন একটা অবস্থা তৈরি করে নিল। কারণ ভগবান বুদ্ধদেব বিষ্ণুর দশমাবতারের এক অবতার (যথাক্রমে মৎস্যাবতার, কূর্মাবতার, বরাহ অবতার, নৃসিংহ অবতার, বামনাবতার, পরশুরাম, শ্রীরাম, কৃষ্ণাবতার, বুদ্ধদেব, কল্কি)। এরপর বেশ কিছুকাল ভালোই কাটছিল ব্রাহ্মণ্যবাদের অনুশাসন। শুরু হয়ে গেল সুদূর আরব থেকে মুসলিমদের ভারতে আগমন এবং আগ্রাসন। একে একে হিন্দু রাজাদের পরাস্ত এবং সিংহাসনচ্যুত করে মুসলিম শাসন শুরু হয়ে যায়। তারপর ৭০০ বছর ব্রাহ্মণ্যবাদ কোণঠাসা। চরম অবক্ষয় দৃশ্যমান হয়। ব্রাহ্মণ্যবাদকে অস্বীকার করা শুরু হল গোটা ভারতবর্ষ জুড়ে। অন্ত্যজ শ্রেণি তো বটে, উচ্চবর্ণের অনেক মানুষও ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলিম হতে থাকল। আবার অস্তিত্বের বিপন্নতা। আরবি-ফারসি ভাষা শিখতে বাধ্য হল সবাই। ভারতবর্ষে মুসলিমদের সংখ্যা বাড়তেই থাকল। দ্বিতীয় প্রধান ধর্মীয় শক্তি হয়ে উঠল। এরই মধ্যে ভারতবর্ষে পোর্তুগিজ, ফরাসি, ব্রিটিশদের বণিকরূপে আবির্ভূত হয়ে অবশেষে হাতে উঠে এল শাসকের দণ্ড। শুরু হয়ে গেল নতুন অধ্যায়– ব্রিটিশশাসন। সেইসঙ্গে খ্রিস্টধর্মের আবির্ভাব– মিশনারিদের প্রভাবে আবার ধর্মান্তরকরণ। তবে খ্রিস্টধর্ম নয়, ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রধান প্রতিবন্ধক হয়ে রইল ইসলাম ধর্ম। অতএব খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে পীড়িত বাড়িয়ে মুসলিম বিরোধিতায় পরোক্ষে-প্রত্যক্ষে ব্রিটিশদের ইন্ধন জোগানো। দ্বিজাতিতত্ত্ব খাঁড়া করে টুকরো টুকরো হয়ে গেল আমাদের সাধের স্বাধীন ভারত, ধর্মের ভিত্তিতে। কিন্তু ব্রাহ্মণ্যবাদ আর উঠে দাঁড়াতে পারল না। শত বিভক্ত হয়েই রইল। এই ব্রাহ্মণবাদকে উৎখাত না-করলে হিন্দুধর্মের পুনঃপ্রতিষ্ঠা হবে না। হিন্দুত্ববাদীরা শূদ্র, দলিত, অন্ত্যজদের হিন্দুভুক্তি করে না, যারা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ। এই সংখ্যাগরিষ্ঠ গোষ্ঠীকে বাইরে রেখে কখনো কোনো ধর্ম শক্তিশালী হতে পারে? একদা যে দেশ বৌদ্ধদের ছিল, সেই দেশ ব্রাহ্মণ্যবাদীরা কজা করে নিলেও একছত্র হতে পারল না। ভারতের সকল মতবাদকে এক ছাতার তলায় আনতে পারল না, যেটা আরবে হজরত মোহম্মদ সফলতার সঙ্গে পেরেছিল।

ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধে যে বদনামগুলি সর্বজনবিদিত, সেগুলি কি অনর্থক?– (১) লাখ টাকার ব্রাহ্মণ ভিখারি। (২) খাদ্য-লোভী ব্রাহ্মণ। এ কথাগুলি ব্রাহ্মণদের কতটা সম্মান প্রদর্শন করে! যজমানদের বাড়িতে গিয়ে ব্রাহ্মণদের হামলা হামলি করাই লাখ টাকার ভিখারি প্রতিপন্ন হল। কিছু সুবিধাবাদী ধান্ধাবাজ ব্রাহ্মণ রাজানুগত্য পেয়ে রসেঘিয়ে থাকলেও অধিকাংশ ব্রাহ্মণদের হাল মোটেই ভালো ছিল না। কারণ শাস্ত্রানুযায়ী ব্রাহ্মণগণ যজন-যাজন, অধ্যয়ন-অধ্যাপনা নিয়ে থাকবে, পরের চাকরি করবে না, কৃষিকার্য করবে না এবং রাজবাড়ি বা ধনীদের গৃহে-দপ্তরে খিদমদগারির মাধ্যমে অর্থোপার্জন করবে না। ব্রাহ্মণ হয়ে অন্য উপায়ে টাকাপয়সা করলে সমাজ নিন্দা করে। সবচেয়ে ঘৃণা করা হত রাজবাড়ির অর্থপুষ্ট ব্রাহ্মণকে। তা সত্ত্বেও ব্রাহ্মণগণও অন্য পেশায় নিযুক্ত না হয়ে নিজেদের রক্ষা করতে পারল না। পেট বড়ো বালাই। বামনাইগিরির নিকুচি করেছে! অবশেষে মরা পোড়ানোর (ডোমের চাকরি!) চাকরি হলেও আবেদনপত্র প্রেরণ। রিক্সা চালানো, মোট বওয়া, জুতো পালিশ করা –এরকম সব কাজেই ব্রাহ্মণদের উপস্থিতি লক্ষ করা যাচ্ছে।

ব্রাহ্মণদের খাওয়াতে পারলে যজমানরা যেমন খুশি হন, তেমনি ব্রাহ্মণগণও যারপরনাই খুশি হন। সঙ্গে সন্তুষ্টজনক দক্ষিণা তো আছেই। তাই আজও তুচ্ছ তাচ্ছিল্য এবং অবজ্ঞা-ভরে হলেও কোনো অনুষ্ঠানে ব্রাহ্মণভোজন করানোর রীতি চালু আছে। কেননা —

“মুখ না থাকায় প্রেতাত্মা ব্রাহ্মণের মুখে করে যে ভোজন।
ব্রাহ্মণ ভোজন না করালে প্রেতাত্মা করে যে রোদন।।

মনুসংহিতার ১/৯৫ নং শ্লোকে যে বিধান আছে, তা দেখব —

“যস্যাস্যেন সদাশ্নতিহব্যানি ত্রিদিবৌকনঃ।
কব্যানি চৈব পিতরঃ কিস্তুতমধিকং ততঃ”।

অর্থাৎ, বাস্তবিক স্বর্গবাসী দেবগণও যাঁর মুখে হবনীয় দ্রব্য সামগ্রী সবসময় ভোজন করে থাকেন, শ্রাদ্ধাদিতে প্রদত্ত অন্নাদি পিতৃগণ যাঁর মুখে গ্রহণ করেন,সেই ব্রাহ্মণ অপেক্ষা অধিকতর শ্রেষ্ঠ এই পৃথিবীতে আর কেই-বা আছেন। তাই “তুষ্যন্তি ভোজনৈর্বিপ্রা ময়ূরাঃ ঘনগর্জিতৈঃ” এবং অবশ্যই “নৃত্যন্তি ভোজনৈর্বিপ্রা”।

শাস্ত্রমতে কর্মের ভিত্তিতে চার বর্ণে ভাগ করা হয়েছে। ব্রহ্ম সম্পর্কে জ্ঞান। অর্জনকারীরাই ব্রাহ্মণ। এখনকার সব পুরোহিতকে কে ব্রাহ্মণ বলছেন! আর বললেও কোন্ যুক্তিতে বলছেন? সব ব্রাহ্মণ কিন্তু পুরোহিত নয়। পুরোহিত এবং ব্রাহ্মণ আলাদা ব্যাপার। তবে আপনি যদি কোনো পুরোহিতকে জিজ্ঞাসা করেন তবে দেখবেন তাঁরা নিজেদের ব্রাহ্মণ বলে পরিচয় দেন। আর তাঁরা তাঁদের বর্ণের পরিচয় এমন এক পর্যায়ে নিয়ে গেছেন যে, কারও হাতের অন্নগ্রহণকে পাপ বলে মনে করেন। যা হাস্যকর একটি ব্যাপার! একজন জ্ঞানী ব্যক্তির কাছ থেকে কেউই এই ধরনের ব্যবহার আশা করে না। আগেই বলেছি, জন্মগতভাবে তো কেউ ব্রাহ্মণ হতে পারে না। এটা শুধুমাত্র একটা পদ বলতে পারেন। যেমন শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার এরকম! যোগ্যতার ভিত্তিতে! রামায়ণ, মহাভারত গ্রন্থগুলিতে লক্ষ করলেই আমরা তা জানতে পারব। ব্রাহ্মণ হল ব্ৰহ্ম সম্পকে জ্ঞান অর্জনকারী। আমি যতটুকু জানি, কোনো নির্দিষ্ট দু-একটি গ্রন্থ পড়ে ব্ৰহ্ম সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন সম্ভব নয়। যাঁরা একটি ধর্মের শাস্ত্রীয় গ্রন্থের নাম বলতে অক্ষম, তাঁদের ব্রাহ্মণ বলার যুক্তি কোথায় আমি বুঝি না!

হলায়ুধ, যিনি লক্ষ্মণসেনের সমসাময়িক এবং তাঁর যুগের প্রধান স্মৃতিকার ছিলেন। তাঁর ব্রাহ্মণসর্বস্ব গ্রন্থরচনার সমর্থনে যুক্তি দিয়েছিলেন যে, রাঢ় ও বরেন্দ্র ব্রাহ্মণরা বেদ পাঠ করে না। ফলে তাঁরা বৈদিক যজ্ঞানুষ্ঠানের নিয়মাবলির সঙ্গে পরিচিত নয়। তাতে কী হয়েছে? ব্রাহ্মণ্যবাদ জাঁকিয়ে বসেছে এখানেও।

ব্রাহ্মণ্যবাদ মুক্ত একটা সমাজ চাই। পৌরহিত্যই ভারতের সর্বনাশের মূল। পুরোহিতগিরি পেশাকে নির্মূল করতে না-পারলে তোক ঠকাবার ব্যাবসা বন্ধ হবে না। সমাজ থেকে পুরোহিতগিরি বর্জন করতে হবে। পুরোহিতদের প্রত্যাখ্যান করেই বিয়ে, অন্নপ্রাশন, শ্রাদ্ধাদি অনুষ্ঠান করা শুরু করতে হবে। সংস্কৃত ভাষার মোহ ত্যাগ করে বাংলায় প্রার্থনা করুন। ঈশ্বর অবশ্যই শুনবেন এবং মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হবে। ডঃ আম্বেদকরের বক্তব্য যথার্থ –“ধূর্ত ব্রাহ্মণরা শাস্ত্র রচনা করে হিন্দুদেরকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে বেঁধে একেবারে বোকা বানিয়ে ফেলেছে।” অতএব পুরোহিত বর্জন।

এ প্রবন্ধ ব্রাহ্মণ-বিদ্বেষকে প্রশ্রয় দেয় না এবং অবশ্যই ব্রাহ্মণ্যবাদের তীব্র বিরোধিতা করছি। যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞানমনস্ক ব্যক্তিগণ প্রচলিত শ্রাদ্ধ না করে শুধু শ্রদ্ধাই জানান, বাকি সব বর্জন করুন। স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর বাণী ও রচনার দশম খণ্ডে লিখলেন, “মৃত্যুর পর মানুষ স্বর্গে যায় এটা কল্পনামাত্র। সজ্জন ব্যক্তি মৃত্যুর পর স্বর্গে গিয়া অনন্ত সুখময় জীবনযাপন করে– এই ধারণা স্বপ্নমাত্র। স্বর্গ ও নরক এসব আদিম ধারণা।” ঈশ্বরে বিশ্বাস থাকলে আপনার মাতৃভাষায় নিজেরাই তার কাছে প্রার্থনা জানানো যায়। হিন্দুধর্মকে রক্ষা করতে চাইলে অবিলম্বে ব্রাহ্মণ্যবাদের নিষ্পত্তি করতে হবে। স্বামী বিবেকানন্দের নাম ভাঙিয়ে যাঁরা নানা কিছু করেন, তাঁরা সোচ্চারে বলুন এবং অক্ষরে অক্ষরে পালন করুন। কী বলবেন? পড়ন, স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর “জাতি, সংস্কৃতি ও সমাজ” গ্রন্থে যা বলেছেন– “পৌরহিত্যই ভারতের সর্বনাশের মূল। যেখানেই পুরোহিততন্ত্রের আবির্ভাব, সেখানেই ধর্মের গ্লানি। …এসো মানুষ হও। প্রথমে দুষ্টু পুরুতগুলোকে দূর করে দাও। কারণ এই মস্তিষ্কহীন লোকগুলো কখনও শুধরোবে না। …আগে তাঁদের নির্মূল করো।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *