গোহত্যা, গোমাংস ও গোমাতার ইতিবৃত্ত
সম্প্রতি স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা সমগ্র পড়ে আমি চমকে গেলাম। গ্রন্থের একটি অংশে স্বয়ং বিবেকানন্দ বলেছেন, একদা হিন্দুগণ গো-মাংস ভক্ষণ করত। পৈতে, উপনয়ন অনুষ্ঠানে বৃষ বা ষাঁড় বলি দেওয়ার প্রথাই করে একদা গোমংস খেত। যদিও এখন আর এ অনুষ্ঠানে এসব বলি-টলি না-হলেও প্রতিকী হিসাবে জালি লাউ/কুমড়ো চারটে কাঠি পুঁতে দাঁড় করিয়ে রাখা অনুষ্ঠানে। এটা সম্ভবত মনুর যুগেই গো-সম্পদ রক্ষার তাগিদেই নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সংস্কৃত ভাষায় ‘গোঘ্ন’ বলে একটা শব্দ পাই। এই শব্দটির অর্থ গোহত্যাকারী। আবার অতিথির একটি প্রতিশব্দ। অর্থাৎ প্রাচীন ভারতে অতিথি। কেউ গৃহে এলে তাঁকে গোহত্যা করে আপ্যায়ন করা হত।
ঋগ্বেদের যুগে আর্যদের কাছে গোরু ছিল খুব মূল্যবান অর্থনৈতিক সম্পদ। বিত্তবানদের ‘গোমত’ এবং গোষ্ঠীপতিদের ‘গোপ’ বা ‘গোপতি’ নামে ডাকা হত। গোরু নিয়ে আর্যদের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষ হত। সেই সংঘর্ষকে বলা হত ‘গভিষ্টি’, ‘গব্যু’ বা ‘গবেষণ’ নাম দেওয়া হয়েছে। প্রাচীন পৌরাণিক উপাখ্যানগুলিতে গোরুর দেবত্ব ও তার সঙ্গে অনেক অলৌকিক ঘটনার উল্লেখ আছে। মহেঞ্জোদারোর সিলে ভীমকায় ষাঁড় বা বৃষের চিত্র আমরা পেয়েছি।
অথর্ব বেদের দশম কাণ্ডে অবধনীয় গোরুর গৌরবকথা আছে। এটা থেকেই প্রমাণ হয় যে, প্রাচীন ভারতে গোরু অবধ্য মানা হত। গোরুকে শুধু ‘অগ্ন’ বা ‘অগ্ন’ বলা হত তা নয়, বেদে আরও অনেক গৌরবজনক নামে ডাকা হয়েছে। ঋগ্বেদে ‘অগ্ন’ ও ‘অম্লা’ কথাগুলি চারবার উল্লেখ আছে। অথর্ব বেদে স্ত্রীলিঙ্গে ও পুংলিঙ্গে আরও ৪০ বার উল্লেখ আছে। গৌ, উস্র, ধেনু, সুদুগ্ধা, বৃষ ইত্যাদি গোরুর মোট ২১টি সমার্থক শব্দ পাওয়া যায়। বিভিন্ন শব্দরূপ ও সমার্থক মিলিয়ে ঋগ্বেদে গোরু প্রায় ৭০০ বার উল্লেখিত হয়েছে।
বৈদিক যুগের পশুপালন ও কৃষিভিত্তিক সমাজের কেন্দ্রে গোরুর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। গোরুই ছিল মুদ্রা। গোরুর বিনিময়ে কেনাকাটা হত। গোরুই ছিল অর্থনীতি। ঋগ্বেদে আছে, “পণি’ বলে একদল মানুষ ইন্দ্রের গোরু চুরি করেছিল। তাতে ইন্দ্ৰ ক্ষেপে গিয়ে সরমা নামে এক কুকুরকে পাঠিয়ে পণিদের ধমক দেন –“গোরু ফেরত দাও। না-হলে ইন্দ্র এসে তোমাদের মজা দেখিয়ে দেবে।” এটা থেকে বোঝা যায় ইন্দ্রের মতো মহাশক্তিধরও গোরু ছাড়া শক্তিহীন।
বৈদিক যুগের ভারতীয়রা গোরুকে শুধুমাত্র পশু হিসাবেই দেখতেন তা নয়। তৎকালীন যুগে সমাজ, অর্থনীতি ও ধর্মে গোরুর একটা বিরাট স্থান ছিল। গোরুই ছিল সম্পদশালীর মাপকাঠি। তাই গোরুকে বৈদিক সাহিত্যে অনেক গৌরবজনক বিশেষণে অভিহিত করা হয়েছে। যেমন ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের পঞ্চম সূক্তে অগ্নিকে বলা হয়েছে– ‘বৃষভশ্চ ধেনুঃ’, অর্থাৎ তিনি বৃষ ও গাভী দুই-ই। নবম মণ্ডলের ৭২ সূক্তে সোমকে বলা হচ্ছে ‘প্রিয়ঃ পতিগৰ্বাৎ’, অর্থাৎ গাভীর স্বামীস্বরূপ (Lord of Cows)। অন্যত্র সূর্যকে বলা হয়েছে এক উজ্জ্বল। বর্ণধারী বৃষ বা ষাঁড়, ইন্দ্রকে সুদুগ্ধা ধেনুর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। গোদুগ্ধকে তুলনা করা হয়েছে উজ্জ্বল রশ্মির সঙ্গে। গোরুকে অভিহিত করা হয়েছে রুদ্রের মাতা, বসুগণের দুহিতা ও আদিত্যের ভগ্নী বলে। আহ্লাদ করে ডাকা হয়েছে ‘অদিতি’, ‘ঋত’, বাক’ এরকম বিভিন্ন নামে। বৃহস্পতিকে বলা হয়েছে ‘গোপতি’, মরুৎকে বলা হয়েছে ‘গোবন্ধু’।
প্রাচীন ভারতে যে গোরু অবধ্য ছিল সে বিষয়ে প্রথম ও অকাট্য প্রমাণ হল ঋগ্বেদের প্রথম মণ্ডলে ১৬৪ সূক্তের ৪০ ঋকে গোরুকে ‘অগ্ন’ অর্থাৎ ‘অবধনীয়’ বলা হয়েছে। আবার ৪৩ নম্বর ঋকে বৃষ মাংস ভক্ষণের কথা আছে। পঞ্চম মণ্ডলের ২৯ সূক্তের ৮ নম্বর ঋকে মহিষের মাংস ভক্ষণের কথা আছে। অথর্ব বেদের দ্বাদশ কাণ্ডের চতুর্থ ও পঞ্চম সূক্তে গোবধের বিরুদ্ধে কড়া ভাষায় লেখা এবং কেউ গোবধ করলে সে ‘মৃত্যু পাশেমু বধ্যতাম’ হবে। এছাড়াও ওই সূক্তেরই ২২ ঋকে গোরুকে আবার ‘অঘ্না’ বলা হয়েছে।
ঋগ্বেদে দুই ধরনের তথ্যের উল্লেখ পাওয়া যায়। একটি ধরন হল গোরুকে ‘অঘ্নেয়’ নামে উল্লেখ করা হয়েছে। ঋগ্বেদে ‘অঘ্নেয়’ কথাটির অর্থ হল যাকে হত্যা করা অনুচিত। কাঠহিন্দুরা এটা থেকেই যে যুক্তিটা খুঁজে পায়, সেটা হল গোহত্যা সম্পর্কে নিষেধাজ্ঞা। বলা হয় গোমাংস ভক্ষণ করা তো দূরের কথা, গোহত্যাও করা যেত না। না, ‘অগ্নেয়’ কথাটি সারসত্য হয়ে যায়নি। বৈদিক যুগেও নয়। শতপথ ব্রাহ্মণে (তৃতীয়–১:২: ২১) দুটি জায়গায় প্রাণী উৎসর্গ ও গোমাংস ভক্ষণ সম্পর্কে বলা হয়েছে– “অর্ধ্বেয়ু তখন তাঁকে গৃহাভ্যন্তরে নিয়ে এলো। তাঁকে বলা হল সে যেন গাভী ও ষাঁড়ের মাংস না খায়। কারণ গাভী ও ষাঁড় পৃথিবীতে অনেক উপকার করে। দেবতারা বললেন –গাভী ও ষাঁড় জগতের অনেক উপকার করে, তাই গাভী ও ষাঁড় যথেষ্ট পরিমাণ খাদ্য গ্রহণ করে। এজন্য সে গাভী ও ষাঁড়ের মাংস খেতে ইচ্ছুক।” ঋগ্বেদে বলা হয়েছে আর্যরা খাদ্য হিসাবে গোহত্যা করত এবং গোমাংসকে উত্তম খাদ্য হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছে। ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলে ৮৫ : ১৪ শ্লোকে ইন্দ্র বলছেন–“তাঁরা ১৫/২০ টি গোরুর মাংস রান্না করেছে। ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের ৭২ : ৬ শ্লোকে তরবারি বা কুঠার দ্বারা গোহত্যার উল্লেখ আছে। অপস্তম্ভ ধর্মসূত্রের ১৪, ১৫ ও ২৯ শ্লোকে বলা হয়েছে –“গাভী এবং ষাঁড় হচ্ছে পবিত্র। সুতরাং তাদের মাংস অবশ্য ভক্ষ্য।”
আপস্তম্ভ ধর্মশাস্ত্রের একটি পরিচ্ছেদে কোন্ কোন্ খাদ্যদ্রব্য ভক্ষণ করা উচিত বা অনুচিত, তার তালিকা আছে। ওই সূত্রটিতে উল্লেখ আছে এক ক্ষুরবিশিষ্ট উট, শূকর, শরভ ও গায়ল নামের এক ধরনের পশু খাওয়া নিষিদ্ধ। কিন্তু তার পরের ঋষি বলেছেন গোরু ও ষাঁড়ের মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ নয়। আপস্তম্ভ ঋষি ওই অধ্যায়েই পেঁয়াজ, রসুন, মাশরুম এবং মুরগি ভক্ষণে নিষেধ করেছেন।
সংস্কৃতে একটা প্রাচীন শব্দ হল ‘গো-সঙ্খ্য’। এই শব্দটার অর্থ হল ‘গো পরীক্ষক’। কেন গোরু পরীক্ষার প্রয়োজন হত? কারণ যে গোরু বা ষাঁড় বা বলদ কর্তন করা হবে, তার স্বাস্থ্য পরীক্ষা। অর্থাৎ সব গোরু চোখ বুঝে ভক্ষণ করা যেত না। নিরোগ শরীর হতে হবে। ডাঃ রাজেন্দ্রপ্রসাদের প্রণীত ‘Beef in Ancient’ ও প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের ‘জাতি গঠনে বাধা’ গ্রন্থে বৌদ্ধযুগের আগে হিন্দুরা যে প্রচুর গোমাংস ভক্ষণ করত, তার উল্লেখ আছে। এসব গ্রন্থ থেকে জানা যায়, বৌদ্ধযুগের আগে গোহত্যা ও গোমাংস ভক্ষণ মোটেই নিষিদ্ধ ছিল না। মধু ও গোমাংস না খাওয়ালে তখনকার সময়ে অতিথি আপ্যায়নই অপূর্ণ থেকে যেত। সেই কারণেই অতিথির আর-এক নাম ‘গোঘ্ন’। রামপ্রসাদের গুরু কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ তাঁর ‘বৃহৎ তন্ত্রসার’ গ্রন্থে অষ্টবিধ মহামাংসের মধ্যে গোমাংসের উল্লেখ প্রথমেই আছে।
বৈদিক যুগে বিভিন্ন যজ্ঞে দেবতাদের উদ্দেশ্যে যে পশুবলি উৎসর্গ করা হত, সেখানে অন্যান্য পশুদের সঙ্গে গোরুর কথাও উল্লেখ আছে অনেকবার। ঋগ্বেদে দশম মণ্ডলের ১৬৯ সূক্তটির দেবতাই হচ্ছেন ‘গাবঃ’। কিন্তু সেখানেও এক জায়গায় বলা হয়েছে যে, গোরুরা দেবতাদের যজ্ঞের জন্য নিজেদের শরীর সমর্পণ করে থাকে। দশম মণ্ডলেরই ৮৬ সূক্তে ইন্দ্র বড়াই করে ইন্দ্রাণীকে বলছেন–“আমি পনেরো বা বিশ বৃষের মাংস খেতে পারি।” অষ্টম মণ্ডলের ৪১ সূক্তে ঋগ্বেদের আর-এক মুখ্য দেবতা অগ্নিকে ঘিয়ের সঙ্গে যেসব মাংস আহুতি দেওয়া হত, তার মধ্যে অশ্ব, ঋষভ (বলদ), উক্ষ (ষাঁড়), মেষ এবং ভশা। এই ভশা শব্দটি যে গোরু সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ না-থাকলেও এটি কোন্ ধরনের গোরু তা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে যথেষ্ট বিতর্ক আছে। অনেক পণ্ডিতদের মতে ভশা হল বন্ধ্যা বা দুগ্ধবতী নয় এমন গোরু।
যজুর্বেদের তৈত্তিরীয় সংহিতাতে অশ্বমেধ যজ্ঞের শেষে যেসব প্রাণী উৎসর্গ করার কথা উল্লেখ আছে, তার মধ্যে গোরুও আছে। যজুর্বেদের শতপথ ব্রাহ্মণে রাজসূয় ও বাজপেয় যজ্ঞের ‘গোসভ’ নামে যে অংশটি আছে, তাতেও একই কথা লেখা। আরও অন্যান্য যজ্ঞগুলিতেও (অগ্নিষ্টোম যজ্ঞ, দর্শপূর্ণমাস যজ্ঞ, চতুর্মাস্য যজ্ঞ, সৌত্ৰামণি যজ্ঞ) ‘পশুবন্ধ’ অংশে গোরু বা বৃষ উৎসর্গের উল্লেখ পাই। কোনো সন্দেহ নেই যে, বিভিন্ন যজ্ঞে অন্য পশুর সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়া, গোরু, বলদ এবং ষাঁড়ের বলি দেওয়া হত।
বৈদিক যুগে শুধুমাত্র যে যজ্ঞের উপলক্ষ্যে গোমাংস ও অন্যান্য পশুমাংস খাওয়া হত তা নয়। ‘গবাময়ন’ নামে একটি সামাজিক অনুষ্ঠান ছিল, যে অনুষ্ঠানের শেষে বন্ধ্যা গোরু মিত্রবরুণ ও অন্যান্য দেবতাকে উৎসর্গ করা হত। সে যুগে মধুপর্কের প্রচলন ছিল। বাড়ি অতিথিরা এলে তাঁদের অর্ঘ বা মধুপর্ক খেতে দেওয়ার নিয়ম ছিল। প্রাচীনকালে মধুপর্কে দই-মধুর সঙ্গে গোমাংস দেওয়া হত। আপস্তম্ব, সাখ্যায়ণ, গোভিল, খাদির, পারস্কার, হিরণ্যকেশী প্রমুখ ঋষিদের রচনা গৃহ্যসূত্রে মধুপর্কে গোমাংসের কথা স্পষ্ট উল্লেখ আছে। শ্রাদ্ধে পিতৃপুরুষকে তৃপ্ত করতে যে গোমাংস দেওয়া হত তারও উল্লেখ আছে। এ বিষয়ে আরও জানতে ‘ভারতরত্ন’ পণ্ডিত পাণ্ডুরঙ্গ কাণের ‘History of Dharmasastra’ পড়ে দেখতে পারেন।
ঐতরেয় ব্রাহ্মণের সপ্তম অধ্যায়ে বলি দেওয়া পশুটি যজ্ঞের পুরোহিতদের মধ্যে কে, কীভাবে, কোন্ ভাগটা পাবে তারও উল্লেখ আছে। তৈত্তিরীয় সংহিতাতে বলির পশুর শরীর কেমনভাবে কাটা হবে তার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। অথর্ব বেদের গোপথ ব্রাহ্মণে ‘সমিতার’ অর্থাৎ যিনি পশু বলি দেন, তিনি কীভাবে ছত্রিশ ভাগে পশুটি কাটবেন সেই হিসাবও দেওয়া হয়েছে। যজ্ঞে যে পশু বলি বা উৎসর্গ করা হত, তা খাদ্য হিসাবেও ব্যবহার করা হত। যজ্ঞের পশু যে খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করা হত, সে কথা শতপথ ব্রাহ্মণের তৃতীয় ও পঞ্চম উল্লেখ আছে– “পশ্বে বৈ অনুম” এবং “অন্নম বৈ পশ্বঃ”। তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণের তৃতীয় অধ্যায়ের একটি শ্লোকে স্পষ্টভাবে লেখা আছে –“অথো অন্নং বৈ গৌঃ”। অতএব গোমাংস খাদ্যই। শতপথ ব্রাহ্মণের তৃতীয় কাণ্ডে ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য বলছেন যে, তিনি গোমাংস খেতে ভালোবাসেন, যদি তা অংসল (নরম) হয়। যজ্ঞের মাংস যে খাওয়া হত এবং গোমাংস খাদ্যবিশেষ ছিল এ বিষয়ে কোনো প্রশ্নচিহ্ন থাকছে না। বৃহদারণ্যক উপনিষদে উল্লেখ আছে– কেউ যদি জ্ঞানী, সর্ববেদবিদ্ ও দীর্ঘ পরমায়ুযুক্ত সন্তান চায়, তাহলে সেই দম্পতি ঘি দিয়ে বৃষমাংস বেঁধে খেতে হবে। তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণে ‘পঞ্চশারদীয় সেবা’ নামে একটি ভোজন অনুষ্ঠানের কথা জানা যায়, সেই ভোজনানুষ্ঠানের বৈশিষ্ট্য হল –১৭টি পাঁচ বছরের নিচে গোবৎস কেটে রান্না করে অতিথিদের পরিবেশন করা। ঋগ্বেদ সংহিতাতেও ‘বিবাহসূক্ত’-এ কন্যার বিবাহ উপলক্ষ্যে সমাগত অতিথি-অভ্যাগতদের গোমাংস পরিবেশনের জন্য একাধিক গোরু বলি দেওয়ার বিধান আছে। (১০ : ৮৫ : ১৩)
ধর্মশাস্ত্র ছাড়াও প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যেও গোমাংস ভক্ষণের কথা জানতে পারি। সাহিত্য সমাজের দর্পণ, ইতিহাসও। বাল্মীকির রামায়ণে উল্লিখিত রামচন্দ্রের খাদ্যতালিকায় ছিল তিন প্রকার মদ (আসব) ছিল– (১) গৌড়ী : এটা গুড় থেকে তৈরি হত। (২) পৌষ্টি : পিঠে পচিয়ে তৈরি হত। (৩) মাধ্বী : মধু থেকে তৈরি হত। এই মদের সঙ্গে থাকত শূলপক্ক গোবৎসের মাংস। ভবভূতির ‘উত্তররামচরিত’ নাটকের চতুর্থ অঙ্কে বাল্মীকির দুই শিষ্যের মধ্যে একটি কথোপকথন এখানে উল্লেখ করা যাক। বশিষ্ঠ ঋষি বাল্মীকির আশ্রমে এসেছেন। ফলে বাল্মীকির এক শিষ্য অন্য এক শিষ্যকে জিজ্ঞাসা করছেন –“এই দাড়িওয়ালা বুড়োটা কে রে, বাঘ নাকি? উনি এসেই মেটে রঙের বেচারা বাছুরটিকে খেয়ে ফেললেন।” অন্য শিষ্য সতীর্থকে শাস্ত্র মনে করিয়ে দিয়ে বললেন –“সমাংস মধুপর্ক দিয়ে অতিথি সৎকার করতে হয়, এটা ধর্মশাস্ত্রে লেখা আছে।” বরাহমিহিরের ‘ভরতসংহিতা’-য় বিভিন্ন পশুর মাংসের পাশাপাশি গোমাংসের কথাও উল্লেখ আছে। মহাভারতের বনপর্বে আছে রাজা রন্তিদেবের হেঁশেলে রোজ ২০০০ গোরু রান্না করা হত। মহাকবি কালিদাসের মেঘদূত কাব্যের পূর্বমেঘ পর্বে ৪৬ নম্বর শ্লোকে যক্ষ মেঘকে বলছে –“গো-নিধনের রক্তে যিনি নদী বইয়েছিলেন, সেই রন্তিদেবকে তোমার যাত্রাপথে যোগ্য সম্মান দিও।” প্রাচীন তামিল সাহিত্যে প্রায় ২০০০ বছর পুরোনো সঙ্গম সাহিত্য ‘অকানানুরু’ গ্রন্থের ২৪৯ ও ২৬৫ পদদুটিতে একদল দস্যুর মোটাসোটা বাছুরের মাংস খাওয়ার বিবরণ আছে।
ডঃ আম্বেদকর তাঁর ‘why Did The Brahmins Give Up Beef-Eating’ গ্রন্থে বেদ-স্মৃতি-পুরাণ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন– তৎকালে ব্রাহ্মণরা প্রতিদিন বিপুল পরিমাণে গোমাংস ভক্ষণ করত। সেইজন্য ব্রাহ্মণদের বলা হত ‘গোঘ্ন’। গোয় মানে গোহত্যাকারী। কশাইকে গোমাংসের অংশ বঞ্চিত করার জন্য ব্রাহ্মণরা নিজেরাই নিজ হাতে গোরু কাটত। মহভারতের অনুশাসন পর্বের ৮৮ অধ্যায়ে শ্রাদ্ধাদি কাজে অতিথিদের গোমাংস ভক্ষণ করালে পূর্বপুরুষ এক বছর পেতে পারে। এই উপদেশ যুধিষ্ঠিরকে দিচ্ছেন পিতামহ ভীষ্ম। বিরাট রাজার গোশালায় অজস্র গোহত্যা করা হত, তার উল্লেখ আছে। আগেই বলেছি রামায়ণের রাম গোমাংসের সঙ্গে মদ্যপান করতে পছন্দ করতেন। বনবাসকালে রাম তাঁর মায়ের কাছে আক্ষেপ করে বলছেন, সে চোদ্দো বছর গোমাংস ভক্ষণ করতে পারবেন না, সোমরস পান করতে পারবেন না এবং স্বর্ণ পালঙ্কে শয়ন করতে পারবেন না। পৌরাণিক যুগে গোমাংস ভক্ষণের প্রত্যক্ষ এবং বিস্তারিত প্রমাণ রামায়ণের তুলনায় মহাভারতে অনেক বেশি। বলা হয়েছে –(১) “বশিষ্ঠ মুনি মদ্য ও গোমাংস প্রভৃতি দিয়া বিশ্বামিত্রকে তাঁহার সেনাগণের সহিত ভোজন করাইয়াছিলেন।” হুইলার প্রমুখ সাহেবরা রামায়ণের যুগে যে গোমাংস ভক্ষণের ব্যবস্থা ছিল, সেকথা উল্লেখ করতে দ্বিধা করেননি। (২) “ভরদ্বাজ মুনি ভরতকে গোমাংসাদি দিয়া পরিতুষ্ট সহকারে ভোজন করাইয়াছিলে এবং তৎকালে বিশ্বামিত্রের যজ্ঞে ব্রাহ্মণেরা দশ সহস্র গোভক্ষণ করিয়াছিলেন।” বেদব্যাস বিরচিত মহাভারতের শান্তিপর্বে (১২ : ২৬৬) ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে যে রাজা বিচষ্য গো-মেধ যজ্ঞে একদিকে অসংখ্য গোরুর আর্তনাদ এবং ছিন্ন দেহ, আর অন্যদিকে ব্রাহ্মণদের নিষ্ঠুরতা প্রত্যক্ষ করে অত্যন্ত ব্যথিত হয়েছিলেন।
মহর্ষি পাণিনি কী বললেন, দেখা যাক–“অতিথি আগমন করলে তাঁহার জন্য গো-হত্যা করবে।” কৃষ্ণ যজুর্বেদের মৈত্ৰায়ণীয় শাখার অন্তর্ভুক্ত মানবগৃহ্যসূত্রে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, “বাড়িতে অতিথি এলে তাকে আপ্যায়ন করতে গোরুর মাংস দিতে হবে এবং গৃহস্থের কর্তব্য হচ্ছে অতিথির সঙ্গে আরও চারজন ব্রাহ্মণকে গোমাংস ভোজনে আমন্ত্রণ জানানো।” (পৃ: ২৮) মহাত্মা গান্ধী 261694, “I know there are scholars who tell us that cow sacrifice is mentioned in the Vedas. … read a sentence in our Sanskrit text-book to the effect that Brahmins of old (period) used to eat beef.” ( M.K.Gandhi, Hindu Dharma, New Delhi, 1991, p. 120). অর্থাৎ, “আমি জানি (কিছু সংখ্যক পণ্ডিত আমাদের বলেছেন) বেদে গো-উৎসর্গ করার কথা উল্লেখ আছে। আমি আমাদের সংস্কৃত বইয়ে এরূপ বাক্য পড়েছি যে,পূর্বে ব্রাহ্মণরা গো-মাংস ভক্ষণ করতেন।” (হিন্দুধর্ম, এম.কে. গান্ধী, নিউ দিল্লি, ১৯৯১,পৃ. ১২০)।
একবার দেখা যাক ‘বৃহদারণ্যকোপনিষদ’ কী বলছে। বলছে –“কোনো ব্যক্তি যদি এমন পুত্র লাভে ইচ্ছুক হন, যে পুত্র হবে প্রসিদ্ধ পণ্ডিত, সভাসমিতিতে আদৃত, যার বক্তব্য শ্ৰতিসুখকর, যে সর্ববেদে পারদর্শী এবং দীর্ঘায়ু, তবে তিনি যেন বাছুর অথবা বড়ো বৃষের মাংসের সঙ্গে ঘি দিয়ে ভাত রান্না করে নিজের স্ত্রীর সঙ্গে আহার করেন” (বৃহদারণ্যকোপনিষদ ৬/8/১৮)। বিভিন্ন স্মৃতিশাস্ত্রে গো-মাংস ভক্ষণের সমর্থন পাওয়া যায়। বশিষ্ঠস্মৃতি’-তে বলা হয়েছে– ব্রাহ্মণ, রাজা, অভ্যাগতদের জন্য বড়ো ষাঁড় কিংবা বড়ো পাঁঠার মাংস রান্না করে আতিথেয়তা করা বিধেয় (বশিষ্ঠস্মৃতি ৪/৮)। মনু অবশ্য কোনো কোনো প্রাণীর মাংস খেতে বারণ করেছেন। বলার বিষয় হল, তার মধ্যে গোরু পড়ে না। কারণ, যেসব প্রাণী এক খুর বিশিষ্ট তাদের মাংস খাওয়া বিশেষ বিধান ছাড়া বারণ (মনুস্মৃতি ৫/১২)। এই শ্রেণিতে গোরু পড়ে না। অন্যদিকে, যেসব প্রাণীর শুধু এক পাটি দাঁত আছে তাদের মাংস খাওয়া যেতে পারে (মনুস্মৃতি ৫/১৮)। এখানেই শেষ নয়, মনুস্মৃতি বলছে– অতিথিদের খেতে দেওয়ার জন্য, পোষ্যদের প্রতিপালনের জন্য, অথবা ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য প্রয়োজনে যে-কোনো মাংস বিধিসম্মত (মনুস্মৃতি ৫/২২)। চাণক্য বা কৌটিল্য কী বলেছেন তাঁর ‘অর্থশাস্ত্র’-এ, সেটি জানবেন না? জানুন– (১) গোপালকেরা মাংসের জন্য ছাপ দেওয়া গোরুর মাংস কাঁচা অথবা শুকিয়ে বিক্রি করতে পারে (অর্থশাস্ত্র ২/২৯/১২৯)। (২) মাংসের জন্য ছাপ মারা গোরু ছাড়া অন্য কোনো শ্রেণীর গোরু হত্যা নিষিদ্ধ (অর্থশাস্ত্র ২/২৬/১২২)। (৩) রাজ্যের গবাদি পশুর তত্ত্বাবধায়কের পদে একজন সরকারি কর্মচারী থাকবেন। তিনি গোরুদের ছাপ দিয়ে বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত করবেন। যেমন– দুগ্ধবতী গাভী, হালটানা বা গাড়িটানা বলদ, প্রজননের উদ্দেশ্যে সংরক্ষিত ষাঁড় এবং মাংসের জোগানের জন্য অন্যান্য গোরুসমূহ (অর্থশাস্ত্র ২/২৯/১২৯)। গৃহ্যসূত্রগুলির সুরও প্রায় এক। বৈদিক সাহিত্যের অন্তর্গত গৃহ্যসূত্রগুলিতে গোরু বলি এবং গোমাংস। ভক্ষণের সুস্পষ্ট নির্দেশ আছে। অধিকাংশ গৃহ্যসূত্রে ব্রাহ্মণ, আচার্য, জামাই বা জামাতা, রাজা, স্নাতক, গৃহস্থের প্রিয় অতিথি, অথবা যে-কোনো অতিথির জন্য মধুপর্ক অনুষ্ঠানের বিধান আছে। আর সেইসব অনুষ্ঠানে গোমাংস পরিবেশন করাই ছিল সাধারণ বিধান ও রীতি। বিভিন্ন পুরাণেও গোরুর মাংস ভক্ষণ এবং বিশেষ করে ব্রাহ্মণদের পরিবেশন করার স্পষ্ট নির্দেশ এবং প্রশংসা আছে। বিষ্ণুপুরাণে গোরু, শূকর, গন্ডার, ছাগ, ভেড়া প্রভৃতি বিভিন্ন পশুর মাংস খাইয়ে ব্রাহ্মণদের হবিষ্য করার বিধান দিয়ে সেই সঙ্গে কোনো মাংস ব্রাহ্মণদের ভক্ষণ করালে পিতৃপুরুষেরা কতদিন পরিতৃপ্ত থাকবেন তার একটা পরিসংখ্যানের উল্লেখ আছে। বিষ্ণুপুরাণ বলছে, ব্রাহ্মণদের গোমাংস খাইয়ে হবিষ্য করালে পিতৃগণ ১১ মাস পর্যন্ত তৃপ্ত থাকেন। আর এ স্থায়িত্বকালই সবচেয়ে দীর্ঘ (বিষ্ণুপুরাণ ৩/১৬)। গোরুর প্রশংসায় পঞ্চমুখ আয়ুর্বেদাচার্য চরক এবং সুশ্রুত। চরক বলছেন– গোমাংস বাত, নাক ফোলা, জ্বর, শুকনো কাশি, অত্যাগ্নি (অতিরিক্ত ক্ষুধা বা গরম), কৃশতা প্রভৃতি অসুখের প্রতিকারে বিশেষ উপকারী (চরকসংহিতা ১/২৭/৭৯)। সুশ্রুতও একই সুরে বলেছেন– গোমাংস পবিত্র এবং ঠান্ডা। হাঁপানি, সর্দিকাশি, দীর্ঘস্থায়ী জ্বর, অতি ক্ষুধা এবং বায়ু বিভ্রাটের নিরাময় করে (সুশ্রুতসংহিতা ১/৪৬/৪৭)। এত গেল অতীতে, অর্থাৎ প্রাচীন ভারতে হিন্দুগণের গোমাংস ভক্ষণ প্রসঙ্গে তথ্যসূত্র সংবলিত আলোচনা।
এত কিছু আলোচনার পর হিন্দুরা গোমাংস ভক্ষণ করত কি না সে প্রশ্ন অবান্তর। হ্যাঁ, ঠিক। একটা ছোট্ট অংশের হিন্দু আজও গোমাংস ভক্ষণ করলেও বড় অংশের হিন্দুরা বহুকাল গোমাংস ভক্ষণ করে না। সে ব্যাপারে বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই। কিন্তু কোনোকালেই হিন্দুরা গোমাংস ভক্ষণ করত না, একথা বলা মানে ইতিহাসকে অস্বীকার করার সামিল। বিশেষ করে ব্রাহ্মণরা যখন বলেন তাঁরা কখনোই গোমাংস ভক্ষণ করতেন না, সেটাকে মিথ্যাচার অথবা অজ্ঞানতা বলে। হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থগুলি কিন্তু গোমাংস ভক্ষণের পক্ষেই সাক্ষ্য দিচ্ছে।
ইসলাম ধর্মে শুয়োয়ের মাংস ভক্ষণে কঠোর নিষেধাজ্ঞার মতো হিন্দু ধর্মশাস্ত্রে গোমাংস ভক্ষণের বিরুদ্ধে ফতোয়া না থাকলেও হিন্দুরা কেন গোমাংস ভক্ষণের অভ্যাস ত্যাগ করল? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে আমাদের জানতে হবে হিন্দুদের বিভিন্ন শ্রেণির খাদ্যাভ্যাস তাঁদের গোষ্ঠী অনুসারে স্থিরীকৃত করা হয়েছিল। হিন্দুদের গোষ্ঠীবিভাজনের সঙ্গে সঙ্গে খাদ্যাভ্যাসও বদলে গেল। একটি গোষ্ঠী হল শিবভক্ত শৈব, অন্যটি হল বিষ্ণুভক্ত বৈষ্ণব। একটি মাংসাহারী আমিষভোজী এবং অন্যটি শাকাহারী নিরামিষভোজী। আর-একটু পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিচার করলে মাংসাহারীদের দুটি উপবিভাগে ভাগ করা যায়– (১) যাঁরা মাংস খায় বটে, কিন্তু গোমাংস ভক্ষণ করে না। (২) যাঁরা গোমাংসসহ সব মাংসই ভক্ষণ করে। অনুরূপভাবে হিন্দুসমাজকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন –(১) ব্রাহ্মণ, (২) অ-ব্রাহ্মণ এবং (৩) অস্পৃশ্য।
ব্রাহ্মণদের মধ্যে একটা শ্রেণি আছে যাঁরা নিরামিষভোজী। কারণ ভারতের ব্রাহ্মণরা দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত। যেমন– পঞ্চ দ্রাবিড় ও পঞ্চ গৌড়। পঞ্চ দ্রাবিড়েরা নিরামিষভোজী। পঞ্চ গৌড়রা আমিষভোজী। অব্রাহ্মণরা মাংসভোজী হলেও গোমাংস ভক্ষণ করে না। তবে তথাকথিত অস্পৃশ্যরা গোমাংস সহ সব ধরনের মাংস ভক্ষণ করে।
যাঁরা মাংসভোজী তাঁরা কেন গোমাংস ছাড়লেন? সেইসব বিধিনিষেধের সাক্ষাৎ পাওয়া যায় বৌদ্ধ-সম্রাট অশোকের বিধানে। বোঝাই যায় হিন্দুধর্মের উপর বৌদ্ধধর্মের ব্যাপক প্রভাব পড়েছিল। অশোকের বিধান স্তম্ভের গাত্রে ও পর্বতগাত্রে ঘোষিত নির্দেশ পাওয়া যায়। সেখানে বলা হয়েছে –“এইসব নির্দেশ মহামান্য রাজার আদেশে লিখিত হয়েছে। রাজধানীর মধ্যে কেউ কোনো প্রাণীকে বলি দিতে পারবে না, বা কোনো পবিত্র ভোজ দিতে পারবে না। কারণ মহামান্য রাজার নিকট ওসব আপত্তিকর।” যদিও কোন্ কোন্ ক্ষেত্রে মহামান্য রাজা এমন ভোজকে আপত্তিকর বলে মনে করেন না, সেটারও উল্লেখ আছে– “পূর্বে মহামান্য রাজার রসুই ঘরে হাজার হাজার প্রাণী রান্নার জন্য হত্যা করা হত। কিন্তু যখন এই পবিত্র নির্দেশ ঘোষিত হয়েছিল তখন বলা হয়েছিল তখন বলা হয়েছিল সারাদিনে কেবলমাত্র তিনটি প্রাণী খাদ্যের উদ্দেশে হত্যা করা যেতে পারে। যেমন –দুটি ময়ুর ও একটি হরিণ, অবশ্য যদি প্রয়োজন হয়। এখন থেকে এই তিনটি প্রাণীও হত্যা করা যাবে না।” সম্রাট অশোক বিশেষ করে যেসব প্রাণীদের হত্যা ও ভক্ষণ নিষিদ্ধ করেছিলেন, তার একটা তালিকা পাওয়া যায়। যেমন –টিয়া পাখি, হরবোলা পাখি, হাড়গিলা পাখি, পাতিহাঁস, মণ্ডিমুখ, গেলটাস, বাদুড়, বড়ো পিঁপড়ে, মেয়ে কচ্ছপ, অস্থিহীন মাছ, বেদবেয়াক, গঙ্গাপুপুটক, শঙ্কর মাছ, নদী কচ্ছপ, সজারু, কাঠবিড়ালি, বড়ো শিংওয়ালা হরিণ, ষাঁড়, বানর, গণ্ডার, ঘুঘু, পায়রা, সব প্রজাতির চতুষ্পদ প্রাণী, ভেড়ী, গাভী ইত্যাদি।
এছাড়া অশোকের বিধানে আছে– মোরগকে খাসি করা যাবে না। জীবন্ত প্রাণীসহ ভূষি পোড়ানো চলবে না। জঙ্গলে আগুন লাগিয়ে প্রাণী হত্যা করা যাবে না। কোনো প্রাণীকে দিয়ে কোনো প্রাণীকে হত্যা করা যাবে না। তিষ্যা মাসের পূর্ণিমা, প্রথম পক্ষের চতুর্দশ ও পঞ্চদশ দিবসে, দ্বিতীয় পক্ষের প্রথম দিনে মাছ ধরা বা বিক্রয় করা যাবে না। এইসব দিনে অন্য প্রাণীও হত্যা করা যাবে না। পক্ষের অষ্টম, চতুর্দশ ও পঞ্চদশ দিবসে এবং তিষ্য ও পুনর্বাসা দিবসে এবং উৎসবের দিনে ষাঁড়, পাঁঠা বা শূকরের মুষ্ক ছেদন করা যাবে না। তিষ্যা, পুনর্বাসা, পূর্ণিমার দিনে কোনো ঘোড়া এবং ষাঁড়কে গরম লৌহ বা জ্বলন্ত কাষ্ঠখণ্ড দ্বারা দাগানো যাবে না।
মনু কিন্তু গোমাংস করতে নিষেধ করেননি। বরং ভক্ষণের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি কোনো কোনো অনুষ্ঠানে গোমাংস ভক্ষণ বাধ্যতামূলক করেছেন। মনুসংহিতার পঞ্চম অধ্যায়ের অষ্টাদশ শ্লোকে বলেছেন —
“শ্বাবিধং শল্যকং গোধাং খঙ্গকূর্মশশাংস্তথা।
ভক্ষ্যান্ পঞ্চনখেহুরনুষ্ঠাংশ্চৈকতোদতঃ।।”
অর্থাৎ সজারু, গোসাপ, কচ্ছপ ও খরগোশ প্রভৃতি পঞ্চ নখবিশিষ্ট প্রাণীগুলি খাওয়া যায়। উষ্ট্র ব্যতীত এক পাটি দন্তবিশিষ্ট গৃহপালিত প্রাণীর মাংস ভোজন করা যেতে পারে। গোরু, মোষ এরা সকলেই এক পাটি দন্তবিশিষ্ট।
বাবাসাহেব বলেন– “এই যে গোমাংস ভক্ষণ বন্ধ হল এবং গো-পুজো শুরু হল, এটা অপেক্ষাকৃত নিকৃষ্ট অব্রাহ্মণদের দ্বারা উৎকৃষ্ট ব্রাহ্মণকে অনুকরণ ছাড়া আর কিছু নয়। … অব্রাহ্মণদের জীবনে একটা বিপ্লব ঘটে গেল। গোমাংস ত্যাগ করা একটা বিপ্লব বইকি। যদি অব্রাহ্মণরা একটা বিপ্লব করত, তবে ব্রাহ্মণরা দুটি বিপ্লব করত। একটি বিপ্লব হল গোমাংস ত্যাগ, দ্বিতীয়টি হল মাংস ত্যাগ করে একেবার নিরামিষাশী হয়ে যাওয়া।” এটা কী যে সে বিপ্লব! অথচ এই– “ব্রাহ্মণরা ছিল সবচেয়ে বড়ো গোমাংস ভক্ষণকারী। অব্রাহ্মণরা গোমাংস ভক্ষণ করলেও তাঁরা সব দিন গোমাংস পেত না। গোরু ছিল মূল্যবান সম্পদ এবং হত্যার জন্য গোরু পাওয়া অব্রাহ্মণদের পক্ষে সবসময় সম্ভব হত না। এটি তাঁদের পক্ষে তখনই সম্ভব হত যখন কোনো ধর্মীয় ধর্মীয় বিশেষ অনুষ্ঠানে দেবদেবীর তুষ্টি সাধনার্থে তাঁরা গোরু উৎসর্গ করতে বাধ্য হত। কিন্তু ব্রাহ্মণদের ক্ষেত্রে এটা ছিল অন্যরকম। তাঁরা ছিলেন পুরোহিত। সে সময় এত বেশি ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করা হত যে, এমন কোনো দিন থাকত না যেদিন কোনো গোরু উৎসর্গের অনুষ্ঠান হত না। ব্রাহ্মণদের পক্ষে প্রতিদিনই গোমাংস লাভের দিন। তাই ব্রাহ্মণরা ছিল সবচেয়ে অধিক গোমাংসভোজী। ব্রাহ্মণদের যজ্ঞ ছিল নিরীহ প্রাণীহত্যার একটা বাহানা। আসলে যজ্ঞ ব্রাহ্মণদের গোমাংসের ক্ষুধা মেটানোর একটা ধর্মীয় কলাকৌশল মাত্র।” খুব নিষ্ঠুরভাবে হোতর নির্দেশে গোরু হত্যা করতেন যজ্ঞের নামে। সেই নিষ্ঠুর হত্যার বর্ণনা ‘আত্রেয়ী ব্রাহ্মণ’ পাঠ করলেই পেয়ে যাবেন। আত্রেয়ী ব্রাহ্মণের বর্ণনায় ব্রাহ্মণরা কেবল গোমাংস ভক্ষণ করতেন তা নয়, তাঁরা নিজেরাই হত্যা করতেন।
বৌদ্ধ-সম্রাট অশোকের নিযেধাজ্ঞাকে ব্রাহ্মণরা মেনে নিয়েছিল, একথা মোটেই মেনে নেওয়া যায় না। দোর্দণ্ডপ্রতাপ ব্রাহ্মণদের কাছ থেকে এটা আশাই করা যায় না যে বৌদ্ধধর্মের কোনো এক রাজার আদেশ ব্রাহ্মণ শিরোমণিরা মাথা নীচু করে মেনে নেবেন। তবে মনুর কয়েকটা নির্দেশে ব্রাহ্মণরা গোমাংস খাওয়া থেকে সরে দাঁড়িয়েছিল কি না, সেটা ভেবে দেখা যেতে পারে।
পঞ্চম অধ্যায়ের ৪৬ নম্বর শ্লোকে মনু বলছেন– “যিনি প্রাণীদের বন্ধন ও বধের দ্বারা ক্লেশ দিতে চান না, তিনি সকলের হিতকামী, তিনি অনন্ত সুখ ভোগ করেন।” ৪৭ নম্বর শ্লোকে বলছেন–“যিনি কাউকে হত্যা করেন না, তিনি যা কিছু ধ্যান করেন বা যা কিছু ধর্মীয় অনুষ্ঠান করেন এবং যে বিষয়ে মনঃসংযোগ করেন, তাতেই সিদ্ধিলাভ করেন।” ৪৮ নম্বর শ্লোকে বলেছেন –“প্ৰাণীহত্যা না করে মাংস পাওয়া যায় না। প্রাণীহত্যা স্বর্গলাভের কারণ হতে পারে না। সুতরাং মাংসাহার ত্যাগ করো।” ৪৯ নম্বর শ্লোকে বলেছেন –“মাংসের উৎস প্রাণীবধ ও বন্ধন যন্ত্রণার কথা বিবেচনা করলে সকল প্রকার মাংস ভক্ষণ থেকে নিবৃত্ত থাকতে হয়।”
মনুর এইসব কথাগুলো নির্দেশ বলা যায় না, বরং উপদেশ বলা যায়। উপদেশ মানা না-মানা ঐচ্ছিক, বাধ্যতামূলক নয়। কারণ মনুর পরের শ্লোকগুলো অনুধাবন করুন। একই অধ্যায়ের ২৮ নম্বর শ্লোকে বলছেন–“পৃথিবীতে যা কিছু সৃষ্টি হয়েছে সবই প্রজাপতি জীবের অন্নস্বরূপ সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং স্থাবর-জঙ্গম সবই জীবের খাদ্য।” ২৯ নম্বর শ্লোকে আরও পরিষ্কার করে বলেছেন– “স্থাবর-জঙ্গম সবই জঙ্গমদের খাদ্য। দন্তহীন প্রাণী দন্তবান প্রাণীদের খাদ্য। হস্তহীন প্রাণীরা হস্তবান প্রাণীদের খাদ্য এবং ভীরু প্রাণীরা বলবান প্রাণীদের খাদ্য।” ৩০ নম্বর শ্লোকে বলছেন– “ভক্ষ্য জীবকে প্রত্যহ ভক্ষণ করলে ভোক্তার কোনো পাপ হয় না। কারণ ঈশ্বর কোনো কোনো প্রাণীকে ভোজ্য এবং কোনো কোনো প্রাণীকে ভোক্তা করে সৃষ্টি করেছেন।”
যজ্ঞে পশু উৎসর্গ করে তা ভক্ষণ করার সমর্থন রয়েছে মনুর। পঞ্চম অধ্যায়ের ৩১ নম্বর শ্লোকে বলছেন– “যজ্ঞের প্রসাদস্বরূপ যে মাংস, তা বৈধ। আর
প্রবৃত্তির বশবর্তী হয়ে যে মাংস ভক্ষণ করে তাঁকে রাক্ষসাচার বলা যায়।” ৩৯ নম্বর শ্লোকে– “যজ্ঞের নিমিত্ত ব্রহ্মা পশুদের সৃষ্টি করেছেন। সমগ্র বিশ্বের কল্যাণের জন্য যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। সুতরাং যজ্ঞে পশুবধকে হত্যা বলা চলে না। বা কাজে কোনো পাপ হয় না।” ৪২ নম্বর শ্লোকে –“বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ কর্তৃক মধুপর্ক বা যজ্ঞ প্রভৃতি কার্যে যেসব প্রাণী বধ করা হয় তাতে নিজের এবং প্রাণীর উভয়েরই কল্যাণ সাধিত হয়।”
এখানেই শেষ নয়, মনু বলেছেন “যজ্ঞ প্রভৃতি পবিত্র অনুষ্ঠানে যে ব্যক্তি মাংস ভক্ষণ করে না, সে পরবর্তী ২১ বার পশুরূপে জন্মগ্রহণ করবে” (৫ : ৩৫)। অতএব মনু তাঁর মনুসংহিতার কোথাও মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ করেছেন এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। গোমাংস ভক্ষণ নিষিদ্ধ করেছেন, এমন কোনো তথ্যও পাওয়া যাচ্ছে না।
মনুসংহিতার একাদশ অধ্যায়ের ৫৫ নম্বর শ্লোকে যে মহাপাপগুলির কথা উল্লেখ করেছেন, গোহত্যা নেই। তিনি বলছেন–“ব্রাহ্মণ হত্যা, সুরাপান, ব্রাহ্মণের স্বর্ণহরণ, গুরুপত্নী গমন এবং এইসব পাপে পাপীদের সংসর্গ হল মহাপাপ।” ৬০ নম্বর শ্লোকে গোহত্যা নিন্দাজনক বলা হলেও জঘন্য অপরাধ নয়। বলছেন– “গোহত্যা, অযাজ্য যাজন, পরস্ত্রীগমন, আত্মবিক্রয়, গুরু-পিতা-মাত-পুত্র ত্যাগ, বেদ অধ্যায়ন না করা এবং অগ্নিত্যাগ –এগুলি লঘুপাপ।”
তাহলে ব্রাহ্মণ তথা হিন্দুদের গোমাংস ভক্ষণ না করার কোনো সমর্থনই ধর্মীয় শাস্ত্রগুলিতে মিলছে না। মনুসংহিতার মতো মহাধর্মশাস্ত্রও নিযেধ করেনি। তাহলে? বাবাসাহেব বলছেন– “দুটি ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে। গোরুকে দেবতারূপে গণ্য করার অন্যতম কারণ হল ‘অদ্বৈত দর্শন’। এই দর্শনে বলা হয়েছে যে, সমস্ত বিশ্বই পরমাত্মার প্রকাশ। ফলে সমস্ত প্রাণীর মধ্যেই তাঁর অস্তিত্ব বিদ্যমান। এই মতবাদ গ্রহণযোগ্য নয়। প্রথমত, এটার সঙ্গে বাস্তবের কোনো মিল নেই। যে বেদান্তসূত্র সমস্ত প্রাণীকে এক বলে বর্ণনা করেছে, তা কিন্তু যজ্ঞের বলি হিসাবে প্রাণী হত্যা বন্ধ করতে বলেনি। দ্বিতীয়ত, যদি এই পরিবর্তন অদ্বৈত দর্শনকে উপলব্ধি করে হত, তাহলে কেবলমাত্র গোরুর ক্ষেত্রে নয়, তা সব প্রাণীর ক্ষেত্রেই কার্যকর হত। অন্য একটি ব্যাখ্যা পাওয়া যায়, যা প্রথমটির চেয়ে অধিকতর যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয়। এটা হল আত্মার দেহান্তরের দর্শন। এই দর্শনটা ঘটনার সঙ্গে তেমন মেলে না। বৃহদারণ্যক উপনিষদ আত্মার দেহান্তর গ্রহণের দর্শনের প্রবক্তা। এতে বলা হয়েছে যে, যদি কেউ জ্ঞানীপুত্র লাভ করতে ইচ্ছুক হয়, তবে সে ষাঁড়ের মাংস চাল ও ঘি সহযোগে রান্না করবে। এই মতবাদটা যা উপনিষদে প্রচার করা হয়েছে তা ৪০০ বছর ধরে অর্থাৎ মনুস্মৃতি কার্যকরী হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ব্রাহ্মণ সমাজে কোনোই প্রভাব ফেলতে পারেনি।”
স্বামী বিবেকানন্দ এই গোহত্যা বা গোমাংস ভক্ষণ বন্ধের অর্থনৈতিক কারণের দিকেই অঙ্গুলি নির্দেশ করেছেন। তাঁর মতে, “কালক্রমে দেখা গেল যে আমরা যেহেতু কৃষিজীবী জাতি, অতএব সবচেয়ে ভালো ষাঁড়গুলিকে মেরে ফেলা জাতিকে হত্যা করারই সমার্থক। সুতরাং, এই সব প্রথা বন্ধ করা হল এবং গো-হত্যার বিরুদ্ধে একটি মত গড়ে উঠল”। এই আর্থিক কারণের সঙ্গে সঙ্গে সম্ভবত কিছ সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক কারণও যুক্ত হয়েছিল। কারণ– (১) ভারত ইতিহাসে প্রাচীন যুগের শেষ ভাগ থেকে মধ্যযুগের প্রথমার্ধ পর্যন্ত এ-দেশে বৌদ্ধধর্ম এবং অনেক ক্ষেত্রেই জৈনধর্ম ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিল। বৌদ্ধধর্মে এবং জৈনধর্মে সবরকম প্রাণীহত্যা নিষিদ্ধ এবং সর্বজীবে অহিংসাকে শ্রেষ্ঠ নীতি বলে গণ্য করা হত। এই বিষয়টি হিন্দুগণের কাছে চ্যালেঞজ হিসাবে উপস্থাপিত হল, উদয় হল সমূহ হিন্দুদের অস্তিত্বের সংকট। অতঃপর এই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে গিয়ে হিন্দুসমাজকে অনেক ক্ষেত্রেই অনেক কিছুর সঙ্গেই আপস করতে হয়েছিল। আর্থিক কারণের সঙ্গে যুক্ত হয়ে এই সাংস্কৃতিক কারণও সম্ভবত গো-হত্যা এবং গো-মাংস ভক্ষণের উপর নিষেধাজ্ঞায় শক্তি সঞ্চারিত হয়েছিল। এভাবেই গো-হত্যা এবং গো-মাংস ভক্ষণ বন্ধের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কারণগুলি ক্রমে ক্রমে দানা বেঁধে মিথ্যা ধর্মীয়তার আধারে ঢাকা পড়ে গেল। কালে কালে গোরু হল গো-মাতা, তেত্রিশ কোটি দেবতার অধিষ্ঠান এবং মলমূত্র হল ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের পবিত্র উপকরণ। বেড়ে গেল গোরুর গুরুত্ব। মহাভারত রচনার শেষ পর্যায়ে গোরুর একটা অর্থনৈতিক পুনর্মূল্যায়ন আরম্ভ হয়েছিল। আনুমানিক খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে মহাভারতে সংযোজিত অনুশাসন পর্বে সমকালীন অর্থব্যবস্থায় গোরুর। বিশেষ গুরুত্বের নিরিখে খাদ্যদ্রব্য হিসাবে তার মূল্যের চেয়ে দীর্ঘমেয়াদি ধন বা ক্যাপিটাল হিসাবে অধিকতর মূল্যের স্বীকৃতির ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এ সময়ে গোরুর বিশেষ অর্থনৈতিক উপযোগিতা এবং দীর্ঘমেয়াদি ধন হিসাবে এর গুরুত্ব ক্রমে ক্রমে স্বীকৃতি লাভ করেছিল। এহেন আর্থিক প্রয়োজনকে স্বীকার করে নিয়ে ধর্মীয় তত্ত্বের আধারে উপস্থাপন করা হল। কারণ স্বর্গ-নরকের লোভ বা ভয় না দেখালে গোরুর মতো সহজলভ্য এবং পুষ্টিকর খাদ্যের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলা সম্ভব ছিল না।
বাবা সাহেব স্পষ্টভাবে বলেছেন –“আমার মনে হয় এটা একটা কৌশল, যার দ্বারা ব্রাহ্মণরা গোমাংস ত্যাগ করে একেবারে নিরামিষাশী হয়ে গেল এবং গোরুর পুজো করতে আরম্ভ করল। গোরুকে পুজোর আসল রহস্য হল, ব্রাহ্মণরা বৌদ্ধদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় উত্তীর্ণ হওয়ার উদ্দেশ্যে গোমাংস খাওয়া তো দূরের কথা, গোরুকে পুজো করতে আরম্ভ করল। বৌদ্ধ মতবাদ ও ব্রাহ্মণ্যবাদের লড়াই ভারতের ইতিহাসে একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। … ভারতে ৪০০ বছর ধরে এই দুটি মতবাদের মধ্যে প্রাধান্য লাভের যে লড়াইটা চলছিল তা সমাজ, ধর্ম, রাজনীতির উপর যথেষ্ট পরিবর্তন এনেছে। … বৌদ্ধ মতবাদ একসময় ভারতের বেশিরভাগ মানুষের ধর্ম ছিল। এটা শত শত বছর ধরে জনগণের ধর্ম হিসাবে ভারতে প্রচলিত ছিল। এটা ব্রাহ্মণ্যধর্মকে এমনভাবে আক্রমণ করেছে, যা পূর্বে কখনো ঘটেনি। ব্রাহ্মণ্যধর্ম তখন ব্যাপকভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছিল এবং তাকে আত্মরক্ষার জন্য সর্বশক্তি দিয়ে লড়তে হচ্ছিল। বৌদ্ধধর্মের দ্রুত প্রসারের ফলে ব্রাহ্মণ্যধর্ম কী রাজসভায় কী জনসাধারণের কাছে সর্বত্র মর্যাদাচ্যুত হয়ে পড়েছিল। পরাজয়ের তীব্র যন্ত্রণা তাঁরা প্রতিমুহূর্তে অনুভব করছিল। কীভাবে তাঁদের শক্তি ও মর্যাদা ফিরে পেতে পারে তার জন্য বিভিন্ন প্রকারের পথ খুঁজতে লাগল।”
সেই পথ কেমন? বাবাসাহেব বলছেন–“বুদ্ধের মৃত্যুর পর তাঁর অনুগামীরা তাঁর মূর্তিস্থাপন ও স্তূপ তৈরি করতে আরম্ভ করে। ব্রাহ্মণরাও তাঁদের অনুসরণ করতে শুরু করল। তাঁরা মন্দির তৈরি করতে শুরু করল এবং তার মধ্যে শিব, বিষ্ণু, রাম ও কৃষ্ণের মূর্তি স্থাপন করতে থাকল। এইভাবে তাঁরা বৌদ্ধমূর্তির ভক্তদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে থাকে। পূর্বে হিন্দুদের কোনো মন্দির বা দেবদেবীর মূর্তি ছিল না। বৌদ্ধদের অনুকরণে ব্রাহ্মণরা এগুলি শুরু করল। বৌদ্ধরা ব্রাহ্মণ্যধর্মের যজ্ঞ এবং গোহত্যা পরিত্যাগ করেছিল। কারণ গোরু ছিল জনগণের জন্য একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় প্রাণী। জনসাধারণ ব্রাহ্মণদের প্রবলভাবে ঘৃণা করতে থাকে। … বৌদ্ধধর্মের প্লাবন থেকে আত্মরক্ষার জন্য ব্রাহ্মণদের যজ্ঞ এবং গোহত্যা দুটি রীতিকেই সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করল। .. ব্রাহ্মণদের গোমাংস খাওয়া বন্ধ করার অন্যতম উদ্দেশ্য হল, বৌদ্ধ ভিক্ষুগণ সমাজে যেরূপ সম্মান লাভ করেছিল সেটা যাতে পেতে পারে।”
বর্তমানে সময় বদলেছে। ব্রাহ্মণরা যেমন বদলে গেছে, তৎসহ হিন্দুরা বদলেছে। এখনকার ব্রাহ্মণরা গোমাংস ভক্ষণ না করলেও মোটেই নিরামিষাশী নয়। এক-আধজন না খেলেও অনেক ব্রাহ্মণ কচ্ছপ, মুরগি, খাসি সবই ভক্ষণ করে। কিছু ব্রাহ্মণ অবশ্য লুকিয়ে হলেও গোমাংস ভক্ষণ করে থাকেন। ২০১৫ সালে প্রকাশ্যে ধর্মতলার কার্জন পার্কে আইনজীবী বিকাশ ভট্টাচার্যকে তো আমরা সবাই দেখেছি গোমাংস ভক্ষণ করতে। সেদিন গোমাংস ভক্ষণ করেছিলেন প্রখ্যাত কবি সুবোধ সরকারও। এছাড়াও বেশকিছু বুদ্ধিজীবীও এদিন গোমাংস ভক্ষণ করেছিলেন। বর্তমান ভারতে যদি নিখাত নিরামিষাশী গোষ্ঠী বুঝতে হয়, সেটা হল বৌদ্ধ ও বৈষ্ণব। এঁরা গোমাংস তো অনেক দূরের কথা, ভক্ষণের উদ্দশ্যে কোনো প্রাণীই তাঁরা হত্যা করে না। এমনকি অন্যের হত্যা করা প্রাণীও তাঁরা ভক্ষণ করেন না।
অতীতে, অর্থাৎ প্রাচীন ভারতে ব্রাহ্মণ তথা হিন্দুগণেরা গো-মাংস ভক্ষণ করত একথা তো তথ্যপ্রমাণ দিয়ে জানানো গেল। ভারতের কেরল, পশ্চিমবঙ্গ, অসম ও উত্তর-পূর্ব ভারতে কয়েকটি রাজ্য বাদ দিয়ে বাইশটি রাজ্যে গো-হত্যা বেআইনি। তৎকালীন কৃষিমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ একটি (গোরুর প্রতি নিষ্ঠুরতা প্রতিরোধ বিল-২০০৩) বিল উপস্থিত করার চেষ্টা করেছিলেন। বিলটির উদ্দেশ্য ছিল গোহত্যা ও গোমাংসের রপ্তানি নিষিদ্ধ করা, গোমাংস বিক্রি করা, গোরুকে আঘাত করা জামিন অযোগ্য অপরাধ। ব্যাঙ্গালোর ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্টের প্রাক্তন ফ্যাকাল্টি সদস্য অধ্যাপক এন এস রামস্বামী একটি প্রবন্ধে লিখেছেন, গোরুর দুঃখে জর্জরিত হয়ে যদি গোহত্যা বন্ধের সিদ্ধান্ত হয়, তবে ওই প্রাণীটির দুর্দশা আরও বাড়বে। তা ছাড়া যতক্ষণ সেটি কোনো সম্প্রদায়ের খাদ্য ততক্ষণ নিষিদ্ধ করে দেওয়াটা অমানবিক, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলা যায়। সেক্ষেত্রে ধর্মীয় সংকট (?) ছাড়া অন্য কোনো কারণ তো দেখি না, তাই না? গোরু তো আর বিরল প্রজাতি নয়! গোহত্যা বন্ধ হলেও বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে গোরুর চালান হতে থাকবে।
এখনও পর্যন্ত ভারতে পৌরসভা অনুমোদিত ৩০০০ শ্লটার হাউস আছে। তা সত্ত্বেও মাংস খাওয়ার উপযুক্ত এমন ২ কোটি পশু বেআইনিভাবে হত্যা করা হয় দেশ জুড়ে। গবেষক রামস্বামী বলেছেন, পূজ্যপাদ ও প্রয়োজনীয় বলদগুলি আমাদের দেশে পাঁচনের আঘাত হজম করে ৫০ কোটি বার। দেবতাকে এভাবে কোনো ভক্ত মারতে পারে! হিন্দুভক্তগণ বলতে পারেন গোরু যদি মাতাই হয় তাহলে প্রয়োজন ফুরালে বাড়িতে না রেখে রাস্তায় ছেড়ে দেন কেন? কেন মুসলিম বা দলিতদের কাছে বিক্রি করে দেন যখন সে আর দুধ দিতে পারে না?
আপনি জানেন কি ১৯৮০ সালে মাংসের জন্য গোরু ও মোষ মারা হয়ে ছিল ১ কোটি ৫৬ লক্ষ, এই ভারতে। ২০০০ সালে সেটা বেড়ে দাঁড়ায় ২ কোটি ৪৩ লক্ষ। আদতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও গবাদি পশুর বাজারের শতকরা ৮০ ভাগই হল গোমাংস। ইন্ডিয়ান ভেটেরেনারি কাউন্সিলের হিসাব অনুযায়ী ভারতে মাত্র ৬০ ভাগ গবাদি পশুকে খাওয়ানোর মতো সংগতি আছে। বাকিরা নির্মমভাবে পরিত্যক্ত হয়। তাদের ভবিষ্যৎ অনাহারে মৃত্যু, পথ দুর্ঘটনায় অথবা বিষাক্ত খাবার অথবা খিদের তাড়নায় অখাদ্য খেয়ে মৃত্যু হয়। ধর্মীয় বিধানে এমন কিছু যজ্ঞ আছে যা করতে হলে পঞ্চগব্য খেয়ে পবিত্র হতে হবে। পঞ্চগব্য কী? পঞ্চগব্য হল গোরুজাত পাঁচটি দ্রব্য– দই, দুধ, ঘি, গোবর এবং গো-মূত্র। ব্রাহ্মণ্যবাদীরা বলেন, গো-মূত্রের ভিতর নাকি গঙ্গা বসত করে। তার মানে গো-মূত্র সেবন করলেই গঙ্গাপ্রাপ্তি সুনিশ্চিত!
ভারতে প্রায় ৫০ কোটি গবাদি পশু আছে। পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি, মোষের সংখ্যা ২ কোটি– সারা পৃথিবীর অর্ধেক। পৃথিবীর সাড়ে আট কোটি গোরু, বাচ্চা বলদ, ষাঁড়। বলদের মধ্যে ভারতে আছে শতকরা ১৫ ভাগ।
একটি সাক্ষাৎকারে মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রী ডি ডি লাপাং বলেছেন, “মিজোরাম, মেঘালয়, নাগাল্যান্ডে শতকরা ৮০ ভাগ মানুষই গোরুর মাংস খেয়ে থাকে, উত্তর-পূর্ব ভারতের মাথাপিছু আয় এমনিতেই কম। এখানকার মানুষের পক্ষে বিকল্প খাদ্য হিসাবে মুরগি কেনা সম্ভব নয়।” প্রসঙ্গত বলি, মণিপুরের অধিবাসীদের বক্তব্য হল, গোরুর মাংস যে শুধু সস্তা তাই নয়, এখানকার ঠান্ডা আবহাওয়ায় বেশ মানানসই।
কেরল রাজ্য দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গোমাংস ভোজন করে। ২০০৩ সালের একটা হিসাবে দেখতে পাচ্ছি, সেই বছরে ২ লক্ষ ৪৯ হাজার টন গোমাংস একমাত্র কেরলেই বিক্রি হয়েছে। সরকারি একটি প্রতিষ্ঠানই নাকি ১৩০ টন গোমাংস বিক্রি করেছে। কেরলে গোমাংসের চাহিদা এত বেশি যে প্রতি বছর প্রতিবেশী রাজ্যগুলি থেকে ৫ লক্ষ গোরু আমদানি হয়। কেরল আবার গোহত্যা বেআইনি এমন রাজ্যগুলিতে গোমাংস রপ্তানি করে। তাই অনেকেই মনে করেন, গোহত্যা বন্ধ হলে কেরলের মানুষ ও পশু দুটোরই স্বাস্থ্য বিপন্ন হবে। কারণ গোমাংস হল সবচেয়ে সস্তা মাংস। কেরলের মাংস বিক্রির শতকরা ৪০ ভাগই হল গোমাংস। হিন্দু, মুসলিম, সন্ত, খ্রিস্টানরা গোমাংস খেয়ে থাকেন। দক্ষিণ ভারতে তপসিল জাতি এবং তপসিল উপজাতির বেশিরভাগ মানুষই গো-মাংস খেয়ে থাকেন।
পশ্চিমবাংলার করিডর দিয়ে সারা ভারত থেকে লক্ষ লক্ষ গোরু বাংলাদেশে প্রতিবছর পাচার হয়। বাংলাদেশের মানুষ সেই গোরুগুলির মাংস তো খানই, উপরন্তু বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বিদেশি মুদ্রা আয় করেন।
মুসলিমরা যখন ভারতবর্ষ আক্রমণ করে দিল্লিতে ঘাঁটি গেড়ে বসল, তখন শুধু শাসনযন্ত্র করায়ত্ত করেই ক্ষান্ত হল না; বিজিত দেশে নিজেদের ধর্ম ও সংস্কৃতি চাপিয়ে দিয়ে নিজেদের প্রভাব স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল। গ্রামের পর গ্রাম আক্রমণ করে মন্দির ভেঙে মসজিদ বানিয়ে, পুরুষদের হত্যা করে নারীদের বন্দি করে ধর্মান্তর করে জবরদস্তি বিবাহ করে বংশবিস্তারে মনোযোগী হয়েছিল কোনো কোনো শাসক। সেই সময়ে আমাদের ব্রাহ্মণকুল ধর্মীয় ‘পবিত্রতা রক্ষার নামে, নিজেদের জ্ঞান জাহির করার তাগিদে, নিদান হাঁকতে শুরু করলেন, যে বা যারা গোমাংস ভক্ষণ করেছেন (জবরদস্তি করে খাওয়ানো হলেও), বা এমনকি পেঁয়াজ বা রসুনের গন্ধ শুঁকেছেন; তাঁরা সবাই স্বধর্মচ্যুত হয়েছেন! ব্রাহ্মণকুলের অজ্ঞতার কারণে আক্রমণকারী মুসলিম শাসকদের হাত শক্ত হল; নিমেষে গ্রামকে গ্রাম হিন্দুসম্প্রদায় মুসলিমে পরিণত হয়েছিল। আজ ভারতবর্ষ সহ পাকিস্তান এবং বাংলাদেশে যে বিপুল সংখ্যক মুসলমান আছেন তাঁদের প্রায় অনেকেই শিকড় হিন্দু! নানা সামাজিক, রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় কারণে রূপান্তরিত।
তবে অতি প্রাচীনকালে অর্থাৎ অতীতে সনাতনধর্মীরা যে গোমাংস ভক্ষণ করত তা নয়, বর্তমানেও হিন্দুদের মধ্যে গোমাংস ভক্ষণের রীতি আছে। বিশ্বের একমাত্র হিন্দুরাষ্ট্র নেপালে প্রতি পাঁচ বছর অন্তর গাধীমাই মন্দিরে পশুবলি দেওয়া হয় এবং ভক্ষণ করা হয়। এই উৎসবে লাখো লাখো গোরু, মহিষ, শূকর, ছাগল, মুরগি, পায়রা এবং এমনকি ইঁদুর প্রাণী বলি দেওয়া হয়। মহিষই বেশি পছন্দ। সত্যি কথা বলতে এইরকম নৃশংস বলি পৃথিবীতে আর কোথাও হয় বলে আমার জানা নেই। বলি না বলে হত্যালীলা বলা যায়। দাঁড়িয়ে থাকা প্রাণীগুলিকে অতর্কিতে গলায় কোপ বসিয়ে নামিয়ে দেওয়া হয়। একপ্রকার কচুকাটা যাকে বলে। ২০০৯ সালে প্রায় ২,৫০,০০০ পশু হত্যা করা হয়। ভারত থেকেও প্রচুর গবাদি পশু চলে যায় নেপালে গাধীমাইয়ের সেবার জন্য। এ ঘটনায় সারা বিশ্ব প্রতিবাদে মুখর হচ্ছে। জনমত গঠন করা হচ্ছে। নেপালে বলি বন্ধ হবে কি না জানি না, তবে ভারত থেকে পশু রপ্তানি বন্ধ হবে আশা করি।
বর্তমান ভারত গোহত্যা, গোমাংস নিয়ে উত্তাল হয়ে উঠেছে। গোমাংস ঘরে রাখার কারণে মুসলিমদের হত্যা করা হচ্ছে। এটা কি গোরুর প্রতি প্রেম? নাকি রাজনীতির উদ্দেশ্যে মুসলিম বিদ্বেষ? আমরা সবাই জানি গোরু ও মুসলিম বিদ্বেষ ছড়িয়ে রাজনীতি করে আরএসএস তথা বিজেপি নামে একটি রাজনৈতিক দল। আমাদের দেশে অহিংস বেচারা একটি প্রাণীকে নিয়ে সহিংস রাজনীতি ভয়াবহ আকার নিয়েছে। ২০১৫ সালে গোরক্ষার নামে আখলাক খানকে গণপিটুনি দিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল। স্বাধীন ভারতের এক জন নাগরিক আখলাক খাসি খাবেন, না গোরু খাবেন তার বিচার সমাজ বা রাজনৈতিক নেতারা করতে পারেন না। যদি সেই অজুহাতে কোনো নাগরিককে হত্যা করা হয়, তা হলে আমাদের সমাজ অসভ্য এবং বর্বর আখ্যা পাবে।
প্রথমটি আর্যাবর্তে, মানে গো-বলয়ে সাম্প্রদায়িক অসম্প্রীতির মাথাচাড়া দেওয়া নিয়ে। আশঙ্কাটা খুবই তাড়াতাড়ি সত্য হয়ে যায়। লোকজন খামাখা খুন হয়। টেনশন বেড়ে যায়। মানুষ মানুষকে সন্দেহ করতে শুরু করে। ঘৃণাও। বহু বছরের চেনা এলাকা থেকে ঠাঁইনাড়া হয় বহু সাধারণ মানুষ। এই উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িকতার সাপটা সবসময় কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে থাকে। দ্বিতীয় আশঙ্কাটা ছিল অর্থনীতিকে ঘিরে। বিজেপির ক্ষমতায়নের ফলে রাজ্যে রাজ্যে গোহত্যা যেভাবে নিষিদ্ধ হতে থাকে এবং সেই সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতার ঝাঁপটা শুরু হয়, তাতে আশঙ্কা হচ্ছিল, এই অশান্তির ফলে ভারতের গোমাংস রপ্তানি না মার খায়। পৃথিবীতে ভারত থেকে গোমাংস (‘বিফ’ বললেও অধিকাংশই অবশ্য মহিষ বা বলদের মাংস) ও গোপণ্য রপ্তানি হয় বছরে ৩৩ হাজার কোটি টাকার। ভারতের পরেই স্থান ব্রাজিল ও অস্ট্রেলিয়ার। দ্বিতীয় আশঙ্কাটাও যদি সত্যি হয়ে ওঠে, তাহলে ব্রাজিল-অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে পোয়াবারো চিনেরও। এ দুই আশঙ্কা চূড়ান্ত সত্যি হলে কট্টর হিন্দুত্ববাদীরা হয়তো আনন্দে দু-হাত তুলে নাচবে, কিন্তু ভারতের মতো দ্রুত উন্নয়নশীল একটা দেশের পক্ষে সেটা মোটেই ভালো বিজ্ঞাপন হবে না। বিজেপি দিল্লি ও অন্যান্য রাজ্য দখলের পর থেকে গো-হত্যা বন্ধে ও গো-সংরক্ষণের নামে যা চলেছে, তাতে রপ্তানির এই বিপুল বাণিজ্য ইতিমধ্যে ভয় পেতে শুরু করেছে। দেশে মোট ২৪টি মিট প্রসেসিং কারখানা রয়েছে, যেগুলোর মধ্যে ১৩টি ১০০ শতাংশ রপ্তানি করে থাকে। এগুলোর অধিকাংশই উত্তরপ্রদেশ, অন্ধ্রপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র ও পাঞ্জাবে। উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের দৌরাত্মে এই কারখানাগুলোতে সরবরাহ কমতে শুরু করেছে। ফলে কমছে মাংস রপ্তানি। মাংস রপ্তানি কমার পাশাপাশি মার খেতে শুরু করেছে। চামড়াশিল্প। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে দৈনন্দিন জীবিকার প্রশ্নও। গোরু মারা গেলে যাঁরা তার চামড়া ছাড়ানোর কাজ করেন অথবা গোমাংস বিক্রির সঙ্গে জড়িত, মার খেতে শুরু করেছেন তাঁরাও। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হতে শুরু করেছেন সাধারণ চাষিও। যে গোরু আর কাজে লাগছে না, সেগুলো রাখতে হচ্ছে, খাওয়াতে হচ্ছে। এদের বিক্রি করে আগে চাষিদের কিছুটা অর্থ সাশ্রয় হত। একটা হিসাবে দেখা যাচ্ছে, এর ফলে দেশে অকর্মণ্য ও ছেড়ে দেওয়া গোরুর সংখ্যা বেড়ে হয়েছে প্রায় ৫৫ লাখ।
গোরু, মহিষ, ভেড়া বা ছাগলের চামড়া ছাড়ান যাঁরা, যাঁদের অনেকেই চামড়াশিল্পের সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের সংখ্যা কমবেশি ৮ লাখ। এই শ্রেণির মানুষ সাধারণত মুসলমান ও দলিত হিন্দু। বংশপরম্পরায় তাঁরা এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। তিন দশক ধরে এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত মানুষদের যিনি খুব কাছ থেকে দেখছেন, তিনি দিল্লি সায়েন্স ফোরামের ডি রঘুনন্দন। তাঁর কথায়, এই পেশার সঙ্গে যুক্ত মানুষেরা সমাজের একেবারে দরিদ্র শ্রেণির। ক্রমবর্ধমান ভয়, হুমকি ও জবরদস্তির ফলে এঁরা যে শুধু রোজগার হারাচ্ছেন তা নয়, গরিব মানুষদের সস্তার প্রোটিন (গোমাংস) থেকেও তাঁরা বঞ্চিত হচ্ছেন। এই মানুষজনের সংখ্যা কত? একটি সরকারি হিসাবও ওই সংবাদপত্রে দাখিল করা হয়েছে। ভারতের প্রায় ৫ কোটি ২০ লাখ দরিদ্র মানুষ শুধু গোরু-মহিষের মাংস থেকে প্রয়োজনীয় প্রোটিন সংগ্রহ করেন। এঁদের সবাই কিন্তু মুসলমান নন। হিন্দু আছেন, খ্রিস্টান আছেন, উপজাতি আছেন, বৌদ্ধ আছেন, আছেন সব মতাবলম্বীরাই। মিল তাঁদের এক ক্ষেত্রেই, সবাই অতি দরিদ্র। গোরু নিয়ে বিতর্ক এঁদেরই পেটে কষিয়ে লাথি মেরেছে সবচেয়ে বেশি। গোরু-বিতর্কের জের ভারতকে শেষ পর্যন্ত যেখানে দাঁড় করাবে, সেটা যে দেশের পক্ষে মোটেই ভালো নয়।
হিন্দুত্ববাদের শিরোমণি সাভারকার বলেছিলেন– “গোরু হিন্দু জাতির প্রতীক হওয়া উচিত নয়। গোরু কিন্তু হিন্দু জাতির দুগ্ধ প্রতীক। কোনো উপায়েই এটিকে হিন্দুত্বের প্রতীক হিসাবে বিবেচনা করা উচিত নয়। হিন্দুত্বের প্রতীক গোরু নয়, নৃসিংহ (নৃসিংহের উল্লেখ, ভগবান বিষ্ণুর চতুর্থ অবতার হিসাবে বিবেচিত)। গোরুকে ঐশী হিসাবে বিবেচনা করে এবং তাঁর উপাসনা করার সময় গোটা হিন্দু জাতি গোরুর মতো সহজবশ্যে পরিণত হয়েছিল। গোটা জাতি যেন ঘাস খাওয়া শুরু করে। আমরা যদি এখন কোনো প্রাণীর আদলে আমাদের জাতিকে খুঁজে পেতে চাই, তবে সেই প্রাণীটিকে সিংহ হতে দিন। আমাদের এখন নরসিংহ পুজো করা দরকার এবং গোরুর খুর হিন্দুত্বের চিহ্ন নয়।” নৃসিংহ অবতারের হিংস্র ভয়াল মৃর্তি সাভারকার প্রতিটি হিন্দুর মনে গেঁথে দিতে চেয়েছিলেন যারা প্রতিপক্ষের পেট চিরে রক্তপান করবে। গৌতম বুদ্ধের অহিংসার শক্তি উপলব্ধির ক্ষমতা সাভারকারের ছিল না। নেহাতই জান্তব ও মাংসল হিংস্র দর্শনের প্রতীক করে তোলেন বিষ্ণুর নৃসিংহ রূপকে। যদিও তাঁর অনুগামীরা নৃসিংহের বদলে গোরুতেই আটকে থাকেন, কেন-না তুলে ধরার পক্ষে সিংহের চাইতে গোরুই আদর্শ।
হায় হিন্দু! গোরু যতদিন দুধ দেয় ততদিনই মা। দুধ দেওয়া বন্ধ করলেই গোরু খেদাও। মাতার মাংস পরিণতির নিমিত্ত মুসলিমদের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়। বলদেরও যতদিন গতর ততদিনই কদর। ষাঁড় না-হলে বংশবৃদ্ধির ক্রিয়া জারি রাখবে কে? তাই ষাঁড় দু-একটা রেখে বাকিটা ধর্মের নামে উৎসর্গ করা হয়। ওরা হাটেবাজারে তোলা তুলে খায় আর বেগরবাই করলে পিটানি খায়। তোমাদের সীমাহীন গোভক্তি দেখে চমকিত হই!
সহায়ক গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা :
(১) The Sanctity of the Cow in Hinduism– W Normal Brown, The Economic Weekly, Feb 1964, Madras
(২) The Myth of the Holy Cow– D N Jha, Verso, London
(৩) Science and Society in Ancient India– Debiprasad Chattopadhyay
(৪) Concept of Cow in the Rigveda– Doris Meth Srinivasan
(৫) Why did the Brahmins give up Beef-Eating– BR Ambedkar
(৬) মহাকাব্য ও মৌলবাদ –জয়ন্তানুজ বন্দ্যোপাধ্যায়
(৭) ফ্রন্টলাইন (২০০৩)
(৮) আউটলুক (২০০৩)
(৯) সাহারা টাইমস (২০০৩)
(১০) গোরু ও ত্রিশূল– শ্যামল চক্রবর্তী