মনু, মনুসংহিতা এবং হিন্দুবাদের ভারতবর্ষ
ঋগবেদে মনুকে মানবজাতির পিতা বলা হয়েছে। তিনি আদিত্য বিবস্বতের পুত্র বলে বিবস্বান, স্বয়ম্ভু ব্ৰহ্মার পুত্র বলে স্বায়ম্ভুব মনু, যাস্কের নিরুক্তে মনু দুস্থানীয় দেবতা, তৈত্তিরীয় সংহিতায় মনু এক পরিবারের পিতা, শুক্ল যজুর্বেদের শতপথ ব্রাহ্মণে সুপ্রসিদ্ধ মনুমৎস্যকথা অংশে তিনি মানবজাতির সৃষ্টিকর্তা। তিনি মানবজাতির পিতা, তাই তিনি নৈতিক ও সামাজিক আদর্শের প্রবর্তক –মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি, যজ্ঞানুষ্ঠানের সৃষ্টিকর্তা, শাসক ব্যবহার বিষয়ে প্রামাণ্য ব্যক্তি, মহর্ষি, বেদবিদ্যায় বিদ্বান, পৃথিবীর উৎপত্তি-স্থিতি-প্রলয়ের কারণ তিনি জানেন।
পুরাণ মত অনুযায়ী মনু ব্ৰহ্মার দেহ থেকে তৈরি হয়েছেন। সুতরাং, পৃথিবীতে ভগবান ব্রহ্মার একমাত্র প্রতিনিধি ছিলেন মনু। যাকে স্বায়ম্ভব মনু বলা হয়। তবে জানা গেছে ব্রহ্মার ইচ্ছায় ১৪ জন মনু [স্বায়ম্ভব (ব্রহ্মা ও গায়ত্রী থেকে সম্ভূত),স্বরোচিষ, উত্তম, তামস, রৈবত, চাক্ষুষ, বৈবস্বত বা সত্যব্রত,সাবর্ণি, রোচ্য, ভৌত, মেরূ সাবৰ্ণি,ঋভু, ঋতুধামা, বিস্বব] জন্ম নিয়েছেন এবং এদের সবাই ধর্মশাস্ত্র রচনা করেছেন। স্বায়ম্ভুব মনু ব্ৰহ্মার কাছ থেকে স্মৃতিশাস্ত্র পাঠ করা শিখে তা তার শিস্যদের তা পাঠ করান। পরবর্তীতে ভৃগু নামে একজন মনুর আদেশে এই ধর্মশাস্ত্র ঋষিদের কাছে ব্যাখা করেন। যা এখন ‘মনুসংহিতা নামে পরিচিত। এই মনুসংহিতাই ব্রাহ্মণ্যবাদের আকরগ্রন্থ, প্রাণভোমরা। বলা হয় বেদের পরে মনুসংহিতা সৃষ্টি হয়েছে। ভগবান ব্রহ্মার পুত্র স্বায়ম্ভুব মনুর দেখানো পথ অনুসরণ করে বাকি ১৪ জন মনু এই শাস্ত্র ধারণ ও পরিবর্ধন করেছেন। মুলত “ভগবান ব্রহ্মার পুত্র স্বায়ম্ভুব মনু” এর বর্ণিত শ্লোকগুলিই বাকি মনুরা সম্পাদনা ও টীকা বা ব্যাখ্যা যোগ করেছেন এবং কিছু কিছু আইন ও আচরণ পদ্ধতির প্রবর্তন করেছেন। এরকমই একটা পরিচয় অনেকেই বিশ্বাস করেন।
এখন প্রশ্ন হল মনু কি সত্যিই ‘ভগবান’ ছিলেন? আমরা এ লেখার পরতে পরতে দেখতে চেষ্টা করব মনু কেমন ভগবান ছিলেন। মনুসংহিতার পাতাতেই এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে পারি। উত্তর সেখানেই লুকিয়ে আছে। বস্তুত মনু ছিলেন একজন শাসক বা রাজা, ব্রাহ্মণ-শাসক –ভগবান কখনোই নয়। ভগবান যে নয়, তার প্রমাণ মনুর সৃষ্টিতত্ত্ব। সৃষ্টিতত্ত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি তিন জায়গায় তিন রকম বর্ণনা করেছেন। পড়ুন–
(১) মনুসংহিতার প্রথম অধ্যায়ের পঞ্চম থেকে উনিশতম শ্লোকে সৃষ্টিতত্ত্বে। বলছেন, আদিতে এই বিশ্ব অন্ধকারময় ছিল, তার অস্তিত্ব বোঝা যেত না, কোনো কিছুরই লক্ষণ বা বৈশিষ্ট্যসূচক চিহ্ন ছিল না, প্রমাণগ্রাহ্য ছিল না। সব কিছু ছিল অবিজ্ঞেয়। যেন সবদিকে প্ৰসুপ্ত, তারপর অপ্রতিরোধ্য শক্তিসম্পন্ন অন্ধকারনাশক ভগবান স্বয়ংভূ স্বয়ং অব্যক্ত থেকে পঞ্চমহাভূতাদি সকল পদার্থকে ব্যক্ত করলেন। ইন্দ্রিয়ের অগোচর সূক্ষ্ম, সনাতন, সর্বভূতময়, অচিন্তনীয় তিনি নিজেই উদ্ভূত হলেন। তিনি নিজের শরীর থেকে বিবিধ জীব সৃষ্টি করতে ইচ্ছুক হয়ে ভেবে ভেবে প্রথমে জল সৃষ্টি করে তাতে তাঁর বীজ আরোপিত করলেন। সেই বীজ সূর্যতুল্য প্রভাবিশিষ্ট স্বর্ণডিম্বে পরিণত হল। তাতে সমগ্র জগতের পিতামহ ব্রহ্মা স্বয়ং জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর প্রথম বাস ছিল জলে, জলকে যেহেতু নারা বলে অভিহিত করা হত সেইহেতু তাঁকে বলা হত নারায়ণ (নারা + অয়ন বা আশ্রয়)। সেই-ই প্রথম কারণ, যা অব্যক্ত এবং যা সৎও বটে, অসৎও বটে। তার থেকে উদ্ভূত পুরুষকেই লোকে ব্ৰহ্মা বলে। সেই অণ্ড বা ডিম্বে ভগবান এক বছর বসবাস করে তাকে দ্বিধা বিভক্ত করলেন, সেই দুই ভাগ থেকে তিনি সৃষ্টি করলেন স্বর্গ এবং মর্ত। তাদের মাঝখানে অন্তরিক্ষ, আট দিক্ এবং সমুদ্র [আধুনিক ভূতত্ত্ববিদদের মতে একদা পৃথিবী দু-ভাগে বিভক্ত ছিল– (i) সমুদ্র বা জলভাগ, যা ‘প্যানথালাসা’ নামে চিহ্নিত এবং (ii) স্থলভাগ, যা ‘প্যানজিয়া’ নামে চিহ্নিত]। নিজের থেকেই তিনি মন উদ্ধৃত করলেন– তা সৎ বটে, অসৎও বটে। মন থেকে উদ্ভূত হল অহংকার এবং মহাত্মা, সত্ত্বাদি ত্রিগুণাত্মক সবকিছু, পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয়। অহংকার ও পঞ্চতন্মত্রের সূক্ষ্ম উপাদান নিজের অংশের সঙ্গে মিশিয়ে তিনি সমস্ত জীব সৃষ্টি করলেন। পঞ্চমহাভূত সকল জীবের স্রষ্টার মধ্যে প্রবিষ্ট হন।
(২) মনুসংহিতা বা মনুস্মৃতির প্রথম অধ্যায়ে বত্রিশতম থেকে একচল্লিশতম শ্লোকে মনু বলছেন, ব্রহ্মা স্বদেহকে দ্বিধা বিভক্ত করলেন –একভাগ হল পুরুষ, অপরভাগ নারী। সেই নারীর থেকে তিনি সৃষ্টি করলেন বিরাজ। এই বিরাজ তপস্যা করোন্তর একটি পুরুষ সৃষ্টি করলেন; এই পুরুষই “মনুসংহিতা”-র প্রবক্তা মনু। জীবসিসৃক্ষু মনু প্রথমে সৃষ্টি করলেন প্রজাপতি স্বরূপ দশজন মহামুনিকে। তাঁরা সৃষ্টি করলেন সপ্তমনু, বিভিন্ন শ্রেণির দেবগণ, মহান ঋষি, যক্ষ, রাক্ষস, গন্ধর্ব, অপ্সরা, সর্প, বিহঙ্গ, বিভিন্ন শ্রেণির পিতৃগণ, বিদ্যুৎ, মেঘ, ক্ষুদ্র-বৃহৎ নক্ষত্ররাজি, বানর, মৎস্য, গোমহিষাদি, হরিণ, মানুষ, কীট, মক্ষিকা ও স্থাবর বৃক্ষাদি।
(৩) মনুসংহিতা বা মনুস্মৃতির প্রথম অধ্যায়ে চুয়াত্তরতম থেকে আটাত্তরতম শ্লোকে মনু বলছেন, সুপ্তোত্থিত ব্রহ্মা তাঁর মন সৃষ্টি করলেন। ব্রহ্মার সিসৃক্ষার প্রেরণায় উদ্ভূত হল শব্দগুণ আকাশ, আকাশের বিকৃতি থেকে সৃষ্ট হল স্পর্শগুণ বায়ু, বায়ু থেকে উদ্ভব দীপ্তিময় আলোকের, যার থেকে প্রাদুর্ভাব হল জলের, জল থেকে উৎপত্তি হল গন্ধযুক্ত ক্ষিতি বা মাটির।
অতএব ‘ভগবান’ হলে এমন তথ্যগত ভুল কখনোই হত না। মানুষ বলেই এমনটা হয়। ভুল মানুষের হয়। সময়ে পরিপ্রেক্ষিতে সে সময়ে মানুষের জ্ঞান ছিল সীমিত। তথাকথিত ধর্মগ্রন্থগুলি মানুষের লেখা বলেই এত ভুল আর বিভ্রান্তি। ঈশ্বর বা ভগবানের নামে চালালেই তো হল না। নির্ভুল হতে হয়। মানুষের পক্ষে কখনোই নির্ভুল হওয়া সম্ভব নয়। সেই সময়ে মানুষের যেটুকু জ্ঞানের পরিধি ছিল, সেই জ্ঞানের পরিধিতেই লিখেছে। মনুও ব্যতিক্রম নয়। আসল উদ্দেশ্য শোষণ ও শাসন করা। সেটা সফলতার সঙ্গে করতে পেরেছে, সেটাই বড়ো কথা।
সে যাই-ই হোক, প্রভূত স্ববিরোধিতা থাকলেও বলা যায় মনুই হলেন (সম্ভবত) ভারতবর্ষের প্রথম সুশৃঙ্খল এবং বিচক্ষণ প্রজাপালক বা শাসক, যিনি সুসংগঠিত রাষ্ট্রতন্ত্রের স্রষ্টা বা জনকও। রাষ্ট্রপরিচালনার লক্ষ্যে প্রাচীন ভারতবর্ষের প্রথম সংবিধানটি ইনিই প্রণয়ন করেছেন, যা মনুসংহিতা’ নামে পরিচিত। মনুসংহিতা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে মনুবাবু খুব উঁচুতে রেখেছেন ক্ষত্রিয় বা শাসক বা রাজাকে এবং ব্রাহ্মণদের। সবচেয়ে নীচে রেখেছেন শূদ্র এবং নারীদের। ক্ষত্রিয় বা শাসক বা রাজাকে এবং ব্রাহ্মণদের উঁচুতে রাখার কারণ তিনি একাধারে ব্রাহ্মণ ও রাজা। শূদ্র এবং নারীদের নীচে রাখার রাখার কারণ শূদ্ররা ভারতবর্ষের বৃহৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ গোষ্ঠী এবং নারীদের শক্তি উনি আন্দাজ করতে পেরেছিলেন। উনি বুঝতে পেরেছিলেন নারী অপ্রতিরোধ্য, দুর্দমনীয়, বিধ্বংসী। শূদ্র ও নারীদের মধ্যে অনুশাসনের ভীতি সঞ্চার করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করাই ছিল শাসক তথা আইন-প্রণেতার উদ্দেশ্য। সেটাই স্বাভাবিক। প্রজাদের মনে ভীতি সঞ্চার করে রাষ্ট্র পরিচালনা করাই রাষ্ট্রপ্রধান মনুর কৌশল। সংশ্লিষ্ট দেশের নাগরিকগণ দেশের আইন মানতে বাধ্য, ঠিক তেমনই মনুর যুগেও মনুসংহিতা নামক অনুশাসন বা আইন মানা বাধ্যতামূলক ছিল। অমান্য করলে হাত কেটে নেওয়া, পা কেটে নেওয়া, চোখ উপড়ে নেওয়া, শূলে চড়িয়ে হত্যা করা, হিংস্র পশুকে দিয়ে খাইয়ে দেওয়া ইত্যাদি পুরস্কার জুটত কপালে। বিদ্রোহ? এখনও হয়, তখনও হত। বিদ্রোহ দমনও হত অকথ্য পীড়ন দ্বারা। কেমন ছিল মনুর সংবিধান? এই সংবিধান যাতে সকলে অক্ষরে অক্ষরে মান্য করেন সেজন্য অনুশাসন যাঁরা প্রয়োগ করবেন তাঁরা কে সে বিষয়ে মনু নিপুণ হস্তে বর্ণনা করেছেন। প্রথমে আসি ব্রাহ্মণদের কথায়। কারণ মনু প্রথমে ব্রাহ্মণ, পরে রাজা। ব্রাহ্মণ কে সে বিষয়ে মনু কী জানিয়েছেন আমরা দেখব। মনুসংহিতার কাঠামো দ্বারা তিনি ব্রাহ্মণকে প্রকৃতপক্ষে দেবতার আসনে বসিয়ে একটি স্থায়ী বৈষম্যপূর্ণ ধর্ম প্রতিষ্ঠার প্রয়াস পেয়েছেন। প্রতিটি বিধানের কেন্দ্রবিন্দুতে ব্রাহ্মণ। তাঁর স্বার্থকে রক্ষা, সংহত করার নিরঙ্কুশ করাই হচ্ছে মনুর একমাত্র উদ্দেশ্য। এর জন্য যত ধরনের নিষ্ঠুরতা দরকার মনু তা অনায়সেই করেছেন। শুরু করেছেন চারবর্ণের অলৌকিক ও অবিশ্বাস্য জন্ম কাহিনি দিয়ে। মনু বলছেন–
(১) “উত্তমাঙ্গোদ্ভবাজ্জৈষ্ঠ্যাদব্ৰহ্মণশ্চৈব ধারণাৎ।
সর্বস্যৈবাস্য সর্গস্য ধর্মততা ব্রাহ্মণঃ প্রভুঃ”(১/৯৩)।
অর্থাৎ, ব্রহ্মার উত্তমাঙ্গ বা মুখ থেকে উৎপন্ন বলে বর্ণচতুষ্টয়ের মধ্যে বলে এবং বেদ ধারণের কারণে ধৰ্মত ব্রাহ্মণ এই সমগ্র সৃষ্টির প্রভু।
(২) “ভূতানাং প্রাণিনঃ শ্ৰেষ্ঠাঃ প্রাণিনাং বুদ্ধিজীবিনঃ।
বুদ্ধিমৎসু নরাঃ শ্ৰেষ্ঠা নরেষু ব্রাহ্মণাঃ স্মৃতাঃ”।। (১/৯৬)
অর্থাৎ, সৃষ্ট (স্থাবর জঙ্গমাদির মধ্যে) প্রাণী শ্রেষ্ঠ, প্রাণীদের মধ্যে বুদ্ধিজীবীরা শ্রেষ্ঠ, বুদ্ধিমানদের মধ্যে মানুষ এবং মানুষের মধ্যে ব্রাহ্মণ শ্রেষ্ঠ বলে কথিত।
(৩) “উৎপত্তিরেব বিপ্রস্য মূর্তিধর্মস্য শাশ্বতী।
স হি ধর্মার্থমুৎপন্নো ব্রহ্মভূয়ায় কল্পতে”।। (১/৯৮)
অর্থাৎ, ব্রাহ্মণের দেহই ধর্মের সনাতন মূর্তি। তিনি ধর্মের জন্য জাত এবং মোক্ষলাভের যোগ্য পাত্র।
(৪) “ব্রাহ্মণো জায়মানো হি পৃথিব্যামধিজায়তে।
ঈশ্বরঃ সর্বভূতানাং ধর্মকোষস্য গুপ্তয়ে”।। (১/৯৯)
অর্থাৎ, জাতমাত্রেই ব্রাহ্মণ পৃথিবীতে সকল লোক অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হন এবং সকল সৃষ্ট পদার্থের ধর্মসমূহ রক্ষার জন্য প্রভু হন।
(৫) “সর্বং স্বং ব্রাহ্মণেসেদ্যং যৎকিঞ্চিৎজ্জগতীগতম।
শ্রৈষ্ঠেনাভিজনেনেদং সর্বং বৈ ব্রাহ্মণোহহতি”। (১/১০০)
অর্থাৎ, পৃথিবীতে যা কিছু আছে, সেই সব ব্রাহ্মণের সম্পত্তি। শ্রেষ্ঠত্ব ও আভিজাত্য হেতু ব্রাহ্মণ এই সবই পাওয়ার যোগ্য।
(৬) “স্বমেব ব্রাহ্মণ্যে ভুঙতে স্বং বস্তে স্বং দদাতি চ।
আনৃশংস্যাদব্রাহ্মণস্য ভুঞ্জতে হীতরে জনাঃ”।। (১/১০১)
অর্থাৎ, ব্রাহ্মণ নিজের অন্নই ভক্ষণ করেন, নিজের বস্ত্র পরিধান করেন এবং নিজের দ্রব্য দান করেন। অন্য লোকেরা যা ভোগ করে, তা ব্রাহ্মণের দয়া হেতু করে।
কী বুঝলেন বন্ধু? ব্রাহ্মণদের আসন পাকা, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। আসুন, এবার। দেখব রাজা কে? রাজার চিরস্থায়ী বন্দোবস্তটা কেমন সেটাও দেখে নিতে পারি। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের যাঁরা ছাত্র তাঁরা জানেন রাষ্ট্রর উৎপত্তির বিষয়ে ঐশ্বরিক মতবাদ। যাঁরা জানেন না তাঁদের জন্য বিষয়টি পুনরায় উল্লেখ করলে অত্যুক্তি হবে না বোধকরি। প্রাচীনকালে রাষ্ট্রের ঐশ্বরিক মতবাদ বহুল প্রচলিত ছিল। মধ্যযুগে সেন্ট অগাস্টাইন, সেন্ট পল, সেন্ট টমাস অ্যাকুইনাসের লেখনীতে এই মতবাদের উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে ১৬৮৮ সালের ইংল্যান্ডের গৌরবময় বিপ্লবের পর থেকে এই মতবাদের গুরুত্ব হ্রাস পেতে শুরু করে। ঐশ্বরিক মতবাদের মূল বক্তব্য ছিল —
(১) রাষ্ট্র ঈশ্বর সৃষ্টি করেছেন। এই সৃষ্টির পিছনে মানুষের কোনো ভূমিকা নেই।
(২) রাজা হলেন ঈশ্বরের প্রতিনিধি। তাই ঈশ্বরের ইচ্ছা রাজার মাধ্যমেই বাস্তবায়িত হয়। সেইজন্য রাজার আদেশ বা নির্দেশ, যা আইনরূপে গণ্য হয়ে থাকে, তা মান্য করা সকল মানুষের একান্ত কর্তব্য। রাজার আইন মান্য না করার অর্থ হল ঈশ্বরকে অবমাননা করা।
(৩) ঈশ্বরের বিধান অনুসারে রাজপদ উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করা যায়। রাজার মৃত্যু হলে তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র রাজা হবেন।
(৪) রাজা যেহেতু ঈশ্বরের প্রতিনিধি সেইহেতু তিনি কখনোই অন্যায় করতে পারেন না। ঈশ্বর ছাড়া তিনি আর কারও কাছে তাঁর কাজের জন্য জবাব দিতে বাধ্য নন।
(৫) ঈশ্বরের প্রতিনিধি এই রাজার বিরুদ্ধে কোনো বিদ্রোহ করা যায় না।
এই ধারণা বা তত্ত্ব শুধু ভারতবর্ষের হিন্দুধর্মেই নয়– এই তত্ত্ব মুসলিম, খ্রিস্টান, ইহুদি ইত্যাদি সব ধর্মেই প্রচার করা হয়েছে। যেহেতু আমি এই রচনায় শুধুমাত্র মনু এবং মনুসংহিতা নিয়ে আলোচনা করব, সেইহেতু অন্য ধর্মের আলোচনা এখানে অপ্রাসঙ্গিক।
মনুর বলছেন রাজা কে? রাজশূন্য এই জগতকে রক্ষার জন্য ইন্দ্র, বায়ু, যম, সূর্য, অগ্নি, বরুণ, চন্দ্র এবং কুবের– এই দেবতার সারভূত অংশ নিয়ে পরমেশ্বর রাজাকে সৃষ্টি করেছেন। যেহেতু এই শ্রেষ্ঠ দেবগণের অংশ থেকে রাজার সৃষ্টি হয়েছিল সেইজন্য তিনি সকল জীবকে তেজে অভিভূত করেন।
“অরাজকে হি লোকেহস্মিন্ সর্বতো বিদ্রুতে ভয়াৎ।
রক্ষার্থমস্য সর্বস্য রাজানমসৃজৎ প্রভুঃ।।
ইন্দ্রানিলমার্কাণামগ্নেশ্চ বরুণস্য চ।
চন্দ্রবিত্তেশয়োশ্চৈব মাত্রা নিত্য শাশ্বতীঃ।।
যম্মাদেং সুরেন্দ্রাণাং মাত্রাভ্যো নির্মিত নৃপঃ।
তস্মাদভিভবত্যেষ সর্বভূতানি তেজসা”। (মনুসংহিতা, ৭: ৩-৪-৫)
রাজা কী? মনু বলছেন–
(১) তিনি সূর্যের মতো চোখ ও মন সন্তপ্ত করেন। পৃথিবীতে কেউ তাঁকে মুখোমুখি অবলোকন করতে পারে না।
(২) বালক হলেও রাজাকে মানুষ মনে করে অবজ্ঞা করা উচিত নয়। ইনি মানুষের রূপে মহান দেবতা।
(৩) অতি নিকটে গেলে আগুন একমাত্র সেটাই দগ্ধ করে, কিন্তু রাজারূপ আগুন বংশ-পশু-সম্পত্তি সহ দগ্ধ করে।
(৪) রাজার অনুগ্রহে বিশাল সম্পত্তি লাভ হয়, যাঁর বীরত্বে জয়লাভ হয়, যাঁর ক্রোধে মৃত্যু বাস করে, তিনি প্রকৃতই সর্বতেজোময়। ইত্যাদি ইত্যাদি। রাজার নিষ্কন্টক সিংহাসনও পাক্কা। কারণ মনু শাসক তথা রাজাও ছিলেন। তদুপরি নিজেই যেহেতু ব্রাহ্মণ, তাই ব্রাহ্মণদের প্রতি রাজাদের কী করণীয় কর্তব্য সেটা উল্লেখ করতে তিনি ভোলেননি। বিশেষ করে দানকর্ম। যেমন– (i) অব্রাহ্মণকে দান সমফল, ব্রাহ্মণব্রুবকে (যিনি ব্রাহ্মণ বংশে জন্মগ্রহণ করেও ব্রাহ্মণের আচার-আচরণ পালন করেন না এবং নিজেকে ব্রাহ্মণ বলে শ্লাঘা করেন, তিনিই ব্রাহ্মণব্রুব) দানে দ্বিগুণ ফল, যে বেদাধ্যয়ন শুরু করেছে তাকে দানের ফল লক্ষগুণ, বেদে পারদর্শী ব্রাহ্মণকে দানের ফল অনন্ত। (ii) যুদ্ধে পরাজুখ না। হওয়া, প্রজাপালন ও ব্রাহ্মণ শুশ্রূষা রাজাদের যারপরনাই শ্রেষ্ঠ কাজ।
তাহলে এবার হাতে রইল নারী এবং শূদ্র। পৃথিবীর সব সুখ নিজেরাই যাতে ভোগ করতে পারেন তার জন্য যা যা করা উচিত সবই ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ক্ষত্রিয় এবং ব্রাহ্মণ যেমন পালকের ভূমিকায়, তেমনিই নারী এবং শূদ্র শোষিতের ভূমিকায়। যাতে নারী এবং শূদ্রেরা মাথা-চোখ তুলে দাঁড়াতে না পারে, বিদ্রোহ করতে না পারে সেইসব ব্যবস্থাই বহাল রেখেছিলেন। অল্পকিছু নমুনা আমরা দেখে নিতে পারি। প্রথমেই নারীকে দেখে নেব মনুর চোখে। মনুর চোখে নারীগণ মানুষ পদবাচ্য নন। নারী সম্পর্কেও মনুর বিধান কঠোর ও বৈষম্যমূলক। যেমন– (ক) স্ত্রীলোক পতিসেবা করবে। তাঁর স্বাধীন কোনো সত্তা নেই। (খ) নারীকে কুমারী অবস্থায় পিতা, যৌবনে স্বামী, ও বার্ধক্যে পুত্র রক্ষা করবে। (গ) স্ত্রীলোকের পৃথক কোনো যজ্ঞ, ব্রত বা উপবাস বিধান নেই। (ঘ) স্ত্রীলোকের সাক্ষী হওয়ার বা স্বাধীনভাবে ঋণ করার অধিকার নেই। (ঙ) বিধবা সাধ্বী নারী ব্রহ্মচর্য পালন করবে। পড়ুন–
(১) স্ত্রী, পুত্র, ভৃত্য, শিষ্য এবং কনিষ্ঠ সহোদর ভ্রাতা অপরাধ করলে সূক্ষ্ম দড়ির দ্বারা কিংবা বেতের দ্বারা শাসনের জন্য প্রহার করবে।
“ভার্যা পুত্ৰশ্চ দাসশ্চ প্রেষ্যো ভ্রাতা চ সোদরঃ।
প্রাপ্তাপরাধাস্তাড্যাঃ স্যূ রজ্জ্বা বেণুদলেন বা।।” (৮/২৯৯)।
(২) পুত্র ও দাস– এরা তিনজনই ধনহীন; এরা তিনজনেই যা কিছু অর্থ উপার্জন করবে তা তাদের যে মালিক তারই হয়।
“ভার্যা পুত্ৰশ্চ দাসশ্চ ত্রয় এবাধনাঃ স্মৃতাঃ।
যৎ তে সমধিগচ্ছন্তি যস্য তে তস্য তদ্ধনম্।।” (৮/৪১৬)
(৩) বেশি নিদ্রা যাওয়া, কেবল বসে থাকার ইচ্ছা, শরীরকে অলংকৃত করা, কাম অর্থাৎ পুরুষকে ভোগ করার আকাঙ্ক্ষা, অন্যের প্রতি বিদ্বেষ, নীচ হৃদয়তা, অন্যের বিরুদ্ধাচরণ করা এবং কুচৰ্মা অর্থাৎ নীচ পুরুষকে ভজনা করা– স্ত্রীলোকদের এই সব স্বভাব মনু এদের সৃষ্টিকালেই করে গিয়েছে।
“শয্যাসনমলঙ্কারং কামং ক্রোধমনার্জ।
দ্রোহভাবং কুচৰ্য্যাঞ্চ স্ত্রীভ্যো মনুরকল্পয়ৎ।।” (৯/১৭)।
(৪) টাকাকড়ি ঠিকমতো হিসাব করে জমা রাখা এবং খরচ করা, গৃহ ও গৃহস্থালী শুদ্ধ রাখা, ধর্ম-কর্ম সমূহের আয়োজন করা, অন্নপাক করা এবং শয্যাসনাদির তত্ত্বাবধান করা- এই সব কাজে স্ত্রীলোকদের নিযুক্ত করে অন্যমনস্ক রাখবে।
“অর্থস্য সংগ্রেহে চৈনাং ব্যয়ে চৈব নিযোজয়েৎ।
শৌচে ধর্মেংন্নপ্যাঞ্চ পারিণাহ্যস্য বেক্ষণে।।” (৯/১১)।
এরকম অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া যায়। দিলে রচনাটি অত্যন্ত ভারাক্রান্ত হয়ে যাবে। যাঁরা আরও বেশি জানতে কৌতূহলী তাদের মনুসংহিতার নবম অধ্যায়টি মন দিয়ে পড়তে অনুরোধ করব। একই সঙ্গে এটাও উল্লেখ চাই, মনু তাঁর গ্রন্থে নারীদের বিষয়ে যেটুকু ভালো ভালো আপাত মঙ্গলদায়ক নির্দেশ দিয়েছেন, সেগুলি কোনোটাই নারীদের কথা ভেবে নয়, পুরুষদের কথা ভেবে। কারণ মনু পুরুষ ছিলেন। পক্ষপাতিত্বের শিরোমণি।
মনু যেটা ছিলেন না, তা হল শূদ্র– কারণ মনু ছিলেন ব্রাহ্মণ। আর তাই শূদ্র জনজাতির প্রতি মনু এত নির্দয়তা, নিষ্ঠুরতা। এঁরা সংখ্যায় বৃহৎ হলেও, মর্যাদায়-অধিকারে অতি ক্ষুদ্র করে দেওয়া হল, ঘৃণ্য করে দেওয়া হল। এবার দেখি শূদ্র সম্পর্কে মনু কী বলেন —
(১) শূদ্র বা দাসদের নিজস্ব কোনো সম্পত্তি রাখার অধিকার নেই।
(২) দাস ও শূদ্রের ধন ব্রাহ্মণ অবাধে নিজের কাজে প্রয়োগ করবেন।
(৩) শূদ্র অর্থ সঞ্চয় করতে পারবে না। কারণ তাঁর সম্পদ থাকলে সে গর্বভরে ব্রাহ্মণের উপর অত্যাচার করতে পারে।
(৪) প্রভু কর্তৃক পরিত্যক্ত বস্ত্র, ছত্র, পাদুকা ও তোষক প্রভৃতি শূদ্র ব্যবহার করবে।
(৫) প্রভুর উচ্ছিষ্ট তাঁর ভক্ষ্য।
(৬) দাস বৃত্তি থেকে শূদ্রের কোনো মুক্তি নেই।
(৭) যজ্ঞের কোনো দ্রব্য শূদ্র পাবে না।
(৮) ব্রাহ্মণের পরিবাদ বা নিন্দা করলে শূদ্রের জিহ্বাছেদন বিধেয়।
(৯) ব্রাহ্মণ শূদ্রের নিন্দা করলে যৎসামান্য জরিমানা দেয়।
(১০) ব্রাহ্মণ কর্তৃক শূদ্ৰহত্যা সামান্য পাপ। এই রূপে হত্যা পেঁচা, নকুল ও বিড়াল ইত্যাদি হত্যার সমান।
(১১) শূদ্র কর্তৃক ব্রাহ্মণ হত্যার বিচার মৃত্যুদণ্ড।
(১২) শূদ্র সত্য কথা বলছে কি না তাঁর প্রমাণ হিসাবে তাকে দিব্যের আশ্রয় নিতে হবে। এতে তাকে জলন্ত অঙ্গারের উপর দিয়ে হাঁটতে হয় অথবা জলে ডুবিয়ে রাখা হয়। অদগ্ধ অবস্থায় অথবা জলমগ্ন না-হয়ে ফিরলে তাঁর কথা সত্য বলে বিবেচিত হবে।
(১৩) দ্বিজকে (ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য) প্রহার করলে শূদ্রের হাত কেটে ফেলা বিধেয়।
(১৪) ব্রাহ্মণের সঙ্গে একাসনে বসলে তাঁর কটিদেশে তপ্তলৌহ দ্বারা চিহ্ন একে তাকে নির্বাসিত করা হবে অথবা তাঁর নিতম্ব এমনভাবে ছেদন করা হবে যাতে তাঁর মৃত্যু হয়।
(১৫) দ্বিজের ন্যায় উপবীত বা অন্যান্য চিহ্ন ধারণ করলে শূদ্রের মৃত্যুদণ্ড বিধেয়।
(১৬) যে পথ দিয়ে উচ্চ বর্ণের লোকেরা যাতায়াত করেন, সেই পথ শূদ্রের মৃতদেহও বহন করা যাবে না।
(১৭) ব্রাহ্মণের গায়ে থুথু দিলে তার ওষ্ঠছেদন হবে। মূত্রপুরীষ নিক্ষেপ করলে যথাক্রমে যৌনাঙ্গ ছেদন করা হবে এবং অধোবায়ু ত্যাগ করলে গুহ্যদেশ ছেদন করা হবে।
(১৮) শূদ্র যদি হিংসার বশবর্তী হয়ে ব্রাহ্মণের চুল, চিবুক, পা, দাড়ি, ঘাড় এবং অণ্ডকোষে হাত দেয় তাহলে নির্বিচারে তাঁর দুটি হাতই কেটে দেওয়া হবে। ভগবানের নির্দেশ বলে কথা!
এখানেই শেষ নয়। চমকে যাওয়ার মতো নির্দেশ। আরও পড়ুন–
(১) সবর্ণা স্ত্রী বিবাহ না করে শূদ্রা নারীকে প্রথমে বিবাহ করে নিজ শয্যায় গ্রহণ করলে ব্রাহ্মণ অধধাগতি (নরক) প্রাপ্ত হন; আবার সেই স্ত্রীতে সন্তানোৎপাদন করলে তিনি ব্রাহ্মণত্ব থেকে ভ্রষ্ট হয়ে পড়েন। অর্থাৎ সমান। জাতীয় নারী বিবাহ না করে দৈবাৎ শূদ্রা বিবাহ করলেও তাতে সন্তান উৎপাদন করা ব্রাহ্মণের উচিত নয়।
“শূদ্রাং শয়নমারোপ্য ব্রাহ্মণে যাত্যধোগতিম্।
জনয়িত্বা সুতং তস্যাং ব্রাহ্মণ্যাদেব হীয়তে।।” (৩/১৭)
(২) কোনও দ্বিজাতি-নারী (অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ত্রিয় ও বৈশ্য নারী স্বামীর দ্বারা রক্ষিত হোক বা না-ই হোক, কোনও শূদ্র যদি তার সাথে মৈথুন ক্রিয়ার দ্বারা উপগত হয়, তাহলে অরক্ষিতা নারীর সাথে সঙ্গমের শাস্তিস্বরূপ তার সর্বস্ব হরণ এবং লিঙ্গচ্ছেদনরূপ দণ্ড হবে, আর যদি স্বামীর দ্বারা রক্ষিতা নারীর সাথে সম্ভোগ করে তাহলে ওই শূদ্রের সর্বস্বহরণ এবং মারণদণ্ড হবে।
“শূদ্রো গুপ্তমগুপ্তং বা দ্বৈজাতং বর্ণমাবস।
অগুপ্তমঙ্গসর্বস্বৈগুপ্তং সর্বেণ হীয়তে।।” (৮/৩৭৪)
(৩) ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য এই দ্বিজাতিরা যদি মোহবশত (ধনলাভজনিত অবিবেকবশতই হোক অথবা কামপ্রেরিত হয়েই হোক) হীনজাতীয় স্ত্রী বিবাহ করেন, তাহলে তাদের সেই স্ত্রীতে সমুৎপন্ন পুত্রপৌত্রাদির সঙ্গে নিজ নিজ বংশ শীঘ্রই শূদ্রত্ব প্রাপ্ত হয়।
“হীনজাতিস্ত্রিয়ং মোহাদুঘহন্তো দ্বিজাতয়ঃ।
কুলান্যেব নয়ন্ত্যাশু সসন্তানানি শূদ্ৰতাম্।।” (৩/১৫)
(৪) শূদ্রা স্ত্রী বিবাহ করলেই ব্রাহ্মণাদি পতিত হন– এটি অত্রি এবং উতথ্যতনয় গৌতম মুনির মত। শৌনকের মতে, শূদ্রা নারীকে বিবাহ করে তাতে সন্তানোৎপাদন করলে ব্রাহ্মণাদি পতিত হয়। ভৃগু বলেন, শূদ্রা স্ত্রীর গর্ভজাত সন্তানের সন্তান হলে ব্রাহ্মণাদি দ্বিজাতি পতিত হয়। (মেধাতিথি ও গোবিন্দরাজের মতে, কেবলমাত্র ব্রাহ্মণের শূদ্রা স্ত্রীর ক্ষেত্রেই এই পাতিত্য বুঝতে হবে। কুল্লুক ভট্টের মতে, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য- এই তিনজাতির শুদ্রা স্ত্রী সম্বন্ধেই এই পাতিত্য হবে)।
“শূদ্রাবেদী পতত্যত্রেরুতথ্যতনয়স্য চ।
শৌনকস্য সুলতাৎপত্তা তদপত্যতয়া ভূগোঃ।।” (৩/১৬)।
(৫) সবর্ণা স্ত্রী বিবাহ না করে শূদ্রা নারীকে প্রথমে বিবাহ করে নিজ শয্যায় গ্রহণ করলে ব্রাহ্মণ অধধাগতি (নরক) প্রাপ্ত হন; আবার সেই স্ত্রীতে সন্তানোৎপাদন করলে তিনি ব্রাহ্মণত্ব থেকে ভ্রষ্ট হয়ে পড়েন অতএব সমানজাতীয় নারী বিবাহ না করে দৈবাৎ শূদ্রা বিবাহ করলেও তাতে সন্তান উৎপাদন করা ব্রাহ্মণের উচিত নয়]।
“শূদ্রাং শয়নমারোপ্য ব্রাহ্মণণা যাত্যধোগতিম্।
জনয়িত্বা সুতং তস্যাং ব্রাহ্মণ্যাদেব হীয়তে।।” (৩/১৭)
(৬) শূদ্রা ভার্য্যা গ্রহণের পর যদি ব্রাহ্মণের দৈবকর্ম (যেমন– দর্শপূর্ণমাস যজ্ঞ প্রভৃতি এবং দেবতার উদ্দেশ্যে যে ব্রাহ্মণভোজনাদি হয়, তা), পিত্রকর্ম (পিতৃপুরুষের প্রতি করণীয় কর্ম, যথা, শ্রাদ্ধ, উদক-তর্পণ প্রভৃতি) এবং আতিথেয় কর্ম (যেমন– অতিথির পরিচর্যা, অতিথিকে ভোজন দান প্রভৃতি) প্রভৃতিতে শূদ্রা ভার্যার প্রাধান্য থাকে অর্থাৎ ঐ কর্মগুলি যদি শূদ্রা স্ত্রীকর্তৃক বিশেষরূপে সম্পন্ন হয়, তাহলে সেই দ্রব্য পিতৃপুরুষগণ এবং দেবতাগণ ভক্ষণ করেন না এবং সেই গৃহস্থ ঐ সব দেবকর্মাদির ফলে স্বর্গেও যান না (অর্থাৎ সেই সব কর্মানুষ্ঠান নিষ্ফল হয়)।
“দৈবপিত্যাতিথেয়ানি তৎপ্রধানানি যস্য তু।
নান্তি পিতৃদেবাস্তং ন চ স্বর্গং স গচ্ছতি।।” (৩/১৮)
(৭) কোনো হীনজাতীয় পুরুষ যদি কোনও উচ্চবর্ণের কন্যাকে তার ইচ্ছা অনুসারেও সম্ভোগ করতে থাকে, তাহলে সেই পুরুষের বধদণ্ড হবে। কিন্তু নিজের সমানজাতীয় কন্যার সাথে ঐরকম করলে সে ঐ কন্যার পিতাকে শুল্ক দেবে, যদি তার পিতা ঐ শুল্ক নিতে ইচ্ছুক হয়।
“উত্তমাং সেবমানস্তু জঘন্যো বধমহতি।
শুল্কং দদ্যাৎ সেবমানঃ সমামিচ্ছেৎ পিতা যদি।।” (৮/৩৬৩)।
(৮) কোনও দ্বিজাতি-নারী স্বামীর দ্বারা রতি হোক বা না-ই হোক, কোনও শূদ্র যদি তার সাথে মৈথুন ক্রিয়ার দ্বারা উপগত হয়, তাহলে অরক্ষিতা নারীর সাথে সঙ্গমের শাস্তিস্বরূপ তার সর্বস্ব হরণ এবং লিঙ্গচ্ছেদনরূপ দণ্ড হবে; আর যদি স্বামীর দ্বারা অরক্ষিতা নারীর সাথে সম্ভোগ করে তাহলে ঐ শূদ্রের সর্বস্বহরণ এবং মারণদণ্ড হবে।
“শূদ্রো গুপ্তমগুপ্তং বা দ্বৈজাতং বর্ণমাবস।
অগুপ্তমঙ্গসর্বস্বৈগুপ্তং সর্বেণ হীয়তে।।” (৮/৩৭৪)।
(৯) শূদ্র পুরুষ থেকে প্রতিলোমক্রমে জাত অর্থাৎ শূদ্র পুরুষের ঔরসে বৈশ্যা স্ত্রীতে জাত আয়োগব, ক্ষত্রিয়া স্ত্রীতে জাত ক্ষত্তা এবং ব্রাহ্মণী স্ত্রীতে জাত চণ্ডাল–এই তিন জাতি পুত্ৰকাজ করার অযোগ্য। এই জন্য এরা অপসদ অর্থাৎ নরাধম বলে পরিগণিত হয়। এদের মধ্যে চণ্ডাল হলো অস্পৃশ্য।
“আয়োগবশ্চ ক্ষত্তা চ চাণ্ডালশ্চাধমো নৃণাম্।
প্রাতিলোম্যেন জায়ন্তে শূদ্রাদপসদাস্ত্রয়ঃ।।” (১০/১৬)
(১০) চণ্ডাল, শ্বপচ প্রভৃতি জাতির বাসস্থান হবে গ্রামের বাইরে। এইসব জাতিকে ‘অপপাত্র করে দিতে হয়; কুকুর এবং গাধা হবে তাদের ধনস্বরূপ।
“চণ্ডালশ্বপচানাং তু বহির্গামাৎ প্রতিশ্রয়ঃ।
অপপাত্রাশ্চ কর্তব্যা ধনমেষাং শ্বগর্দভম্।।” (১০/৫১)
বলা হয়েছে, নারীর কোনো জাত নেই। ব্রাহ্মণ-ঘরে জন্মালেও সে ব্রাহ্মণ নয়। নারীর উপনয়ন নেই, তাই উপবীতও নেই। নারী কখনোই দ্বিজ নয়। নারীর পৌরহিত্যের অধিকার নেই। নেই কেবল নারী ও শূদ্রদের। যা আছে সব ব্রাহ্মণদের। যে দেশের নাগরিকের বৃহৎ অংশ (নারী এবং শূদ্র) বঞ্চিত, অবহেলিত, অধিকারহীন, ঘৃণিত, ধিকৃত, অশিক্ষিত থাকে –সে দেশ কখনোই অগ্রবর্তী হতে পারে না। হয়ওনি। মনু চেয়েছেন অগ্রবর্তী হোক কতিপয় ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় তথা রাজা এবং বৈশ্যদের (যদিও বৈশ্যদের জন্য তেমন কোনো নিদান নেই। কারণ বৈশ্যরা নিজগুণেই প্রতিষ্ঠিত)।
মনুসংহিতার ছত্রে ছত্রে এঁদেরই সমৃদ্ধর কথা ভেবেছেন। মনুর এই মনুসংহিতার অনুশাসনই পরবর্তীতে হিন্দু বা হিন্দুত্ববাদ রূপে প্রকাশিত হয়েছে। হিন্দুধর্মের জাতপাত এর একটা বড়ো সমস্যা। এই সমস্যা এখনও গর্বের সঙ্গে হিন্দুরা অনুসরণ করে থাকে। আধুনিক এবং স্বাধীন ভারতবর্ষে রাষ্ট্রীয় আইন বা সংবিধান থাকলেও বহুকাল ধরে বিনা প্রতিবাদে চালু থাকায় রাষ্ট্রের আইনের চেয়ে ‘মনুর বিধান অনেক বেশি শক্ত ও দৃঢ়মূল হয়ে আছে। স্বাধীন ভারতের সংবিধান প্রণেতা ড. বি আম্বেদকরও খুব বেশি মনুবাদকে নড়াতে পারেননি। হরিজনদের উপরে উঠিয়ে প্রয়াসে তাদের সংরক্ষণ করা ছাড়া বিশেষ কিছু করেছেন বলে জানা নেই। সেই সংরক্ষণও এমনভাবে প্রয়োগ হয়, যেখানে হরিজনেরা যেই তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই আছে, এগিয়ে আছে এগিয়ে থাকারাই। মনুর এই ধরনের মানসিক বৈশিষ্ট্য মনুষ্যচিত, ভগবানোচিত নয়। মানুষই ভোগলিপ্সায় এইসব বিভাজন, বৈষম্য, নিষ্ঠুরতা নির্মাণ করে থাকবে, দেবতা বা ভগবান নয়। দেবতা বা ভগবান পরম করুণাময়, ক্ষতিকর হতে পারে না। অতএব মনু ভগবান নয়, মানুষ– দোষেগুণে তমোগুণসম্পন্ন মানুষ, মাননীয় শাসকমাত্র।
ড. আম্বেদকর ভারতের গরিব ‘মহর’ পরিবারে (তখন অস্পৃশ্য জাতি হিসাবে গণ্য হত) জন্মগ্রহণ করেন। সেই কারণেই হয়তো তফসিলি জাতি এবং উপজাতিদের সংরক্ষণ করেছিলেন। উনি হয়তো চেয়েছিলেন আরও পরিবর্তন, কিন্তু ভারতবর্ষের অস্পৃশ্য (Untouchables or Untouchables community) প্রথার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে গেলেন। তিনি বৌদ্ধ ধর্মে ধর্মান্তরিত হন এবং হাজারো শত (Hundreds of Thousands) অস্পৃশ্যদের থেরবাদী বৌদ্ধধর্ম (Theravada Buddhism) স্ফুলিঙ্গের মতো রূপান্তরিত করে সম্মানিত হয়েছিলেন।
১৯২৭ সালে আম্বেদকর অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে সক্রিয় আন্দোলন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি গণ-আন্দোলন শুরু করেন এবং সুপেয় জলের উৎসদানে সংগ্রাম চালিয়ে যান (উল্লেখ্য, সে সময় হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দিরে নিন্মবর্ণের প্রবেশের অধিকার ছিল না)। মহদে সত্যগ্রহ নামের অস্পৃশ্যদের (অন্ত্যজ জাতির) জন্য সংগ্রাম করে সুপেয় জল পানের অধিকার আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। তাঁকে ১৯২৫ সালে বোম্বে প্রেসিডেন্সি কমিটিতে নিয়োগ করা হয়েছিল, যাতে করে তিনি সমস্ত ইউরোপীয় সিমন কমিশনের সঙ্গে কাজ করতে পারেন। সমগ্র ভারতজুড়ে স্ফুলিঙ্গের আকারে ব্যাপক আন্দোলন ছড়িয়ে পরে এবং যখন এই তালিকাটি অধিকাংশ ভারতীয় কর্তৃক ত্যাগ করা হয়েছিল, আম্বেদকর নিজে ভবিষ্যৎ সাংবিধানিক সুপারিশের জন্য একটি পৃথক সুপারিশ নামা লিখিত দেন।
অপরদিকে আম্বেদকর অস্পৃশ্যদের পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীর কথা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু মহাত্মা গান্ধি অস্পৃশ্যদের জন্য গঠিত পৃথক নির্বাচকমন্ডলীর প্রচণ্ডভাবে বিরোধিতা করেন, যদিও তিনি অন্য সকল সংখ্যালঘুদের যেমন মুসলমানদের ও শিখদের পৃথক নির্বাচকমন্ডলী (Separate Electorate) বিনা দ্বিধায় মেনে নেন এই বলে যে, তিনি অস্পৃশ্য সম্প্রদায়ের গঠনকৃত নির্বাচকমন্ডলী হিন্দুসমাজকে ভবিষ্যতে বিভক্ত এবং উচ্চশ্রেণীর ক্ষমতা কমিয়ে দিতে পারে। ১৯৩২ সালে যখন ব্রিটিশরা আম্বেদকরের সাথে একমত হন এবং পৃথক নির্বাচকমন্ডলীদের ঘোষণা করেন, তখন মহাত্মা গান্ধী পূনের এরোদা কেন্দ্রীয় কারাগারে (Yerwada central jail) শুধুমাত্র অন্ত্যজ সম্প্রদায়ের পৃথক নির্বাচকমন্ডলীর প্রতি উপবাস শুরু করেন। গান্ধীর এই উপবাস (fast) ভারতজুড়ে বেসামরিকদের মাঝে প্রবল বিক্ষোভের উদ্দীপনা জোগায় এবং ধর্মীয় গোঁড়াবাদী নেতারা (Orthodox Politicians), কংগ্রেস নেতারা কর্মীদের মধ্যে মদনমোহন মালোভি ও পালঙ্কর বালো ও তাঁর সমর্থকরা আম্বেদকরের সঙ্গে এরাভাদে (Yeravada) যৌথ বৈঠক করেন। গান্ধিবাদীদের প্রবল চাপের মুখে (Massive coercion) 422 sypoginta sfocate (Communal reprisal) ও অস্পৃশ্য সম্প্রদায়কে নির্মূলীকরণের আশঙ্কায় আম্বেদকর পৃথক নির্বাচকমন্ডলী বাতিল করতে সম্মত হন। এই চুক্তির পরে গান্ধি উপবাস পরিত্যাগ করেন, ইতিহাসে এটি “পুনে চুক্তি” নামে পরিচিত। চুক্তির ফলশ্রুতিতে আম্বেদকর পৃথক নির্বাচকমন্ডলী গঠনের দাবি ছেড়ে দেন যা আম্বেদকর গান্ধীর সঙ্গে বৈঠকের আগে ব্রিটিশ সাম্প্রদায়িক কর্তৃক শর্তসাপেক্ষে মঞ্জুর করে প্রতিশ্রুতি বদ্ধ হন। একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক আসন অস্পৃশ্যদের জন্য সংরক্ষিত হয়। এই চুক্তিতে যাকে বলা হয় অস্পৃশ্য সম্প্রদায় (Depressed Class)। আম্বেদকর হিন্দুবাদকে কর্কশ ভাষায় সমালোচনা করেন তাঁর “দ্য আটাচেব্যলস : এ থিসিস অন দ্য অরিজিনস অব আটাচেব্যলিটি” রচনায়–The Hindu Civilisation…. is a diabolical contrivance to suppress and enslave humanity. Its proper name would be infamy. What else can be said of a civilisation which has produced a mass of people…. who are treated as an entity beyond human intercourse and whose mere touch is enough to cause pollution? (হিন্দু সভ্যতা… হচ্ছে মানবতাকে দমন এবং পরাভূত করতে একটি পৈশাচিক কৌশল। এর প্রকৃত নাম হবে সামাজিক কুখ্যাতি। কাকে সভ্যতা বলে ডাকা যায়, যার একগাদা মানুষ…., যাদের সত্ত্বা মানব সম্পর্কের নিচে গণ্য হয় ও শুধু যাদের ছোঁয়া দূষণের জন্য যথেষ্ট?)।
ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসন-শোষণে নিপীড়িত নিম্নশ্রেণির মানুষের সামনে ভীমরাও রামজি আম্বেদকর আলোর মশাল নিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন। জাতপাত থেকে দলিত সম্প্রদায়কে চিরতরে মুক্তি দিতে তিনি বৌদ্ধধর্মের পুনর্জাগরণে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। নৃতত্ত্বের ছাত্র হিসেবে আম্বেদকর আবিষ্কার করেন মহরেরা আসলে প্রাচীন ভারতীয় বৌদ্ধ। আম্বেদকর তাঁর সারাজীবনে বৌদ্ধ ধর্ম অধ্যয়ন করেন, ১৯৫০ এর সময়ে তিনি এই ধর্মে তাঁর সম্পূর্ণ মনোযোগ দেন এবং শ্রীলঙ্কা ভ্রমণ করেন (তারপর শিলং) বৌদ্ধ পণ্ডিতদের ও ভিক্ষুদের একটি সম্মেলনে যোগ দিতে। যখন তিনি পুনের কাছাকাছি একটি নতুন বৌদ্ধমন্দির অর্পণ করেন, তখন আম্বেদকর ঘোষণা দেন যে, তিনি বৌদ্ধধর্মের উপর একটি বই লিখেছেন, যত শীঘ্রই তিনি বইটি শেষ করবেন, তিনি সাদামাটাভাবে এই ধর্মে গ্রহণ করবেন। অর্থাৎ যন্ত্রণার দীর্ঘ ৫৯ বছর বাবাসাহেব হিন্দুধর্মে যাপন করলেও, বাকি শেষ ৬ বছর তিনি বৌদ্ধধর্মেই ছিলেন। আম্বেদকর তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী সভিতা আম্বেদকর (বিবাহ পূর্ব নামঃ সাদা কবির), তাঁর স্বামীর সঙ্গে তিনিও বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন এবং ২০০২ সালে বৌদ্ধাবলম্বী হিসাবেই মারা যান।
বর্তমানে মনুস্মৃতি প্রথম থেকেই এরূপ ছিল না। আদি সংহিতায় এক লক্ষ শ্লোক ছিল, কিন্তু এখন মাত্র ২৬৯৪ টা শ্লোক পাওয়া যায়। প্রথম অধ্যায়ের ৫৮ নম্বর শ্লোকে বলা হয়েছে, ব্রহ্মা এই শাস্ত্র প্রস্তুত করে মনুকে শিখিয়েছিলেন। মনু, মরীচি প্রভৃতি মুনিগণকে শিখিয়েছিলেন। প্রথম অধ্যায়ের ৫৯ নম্বর শ্লোকে বলা হয়েছে, ভৃগু এই শাস্ত্র মুনিগণকে শোনাবেন। এর থেকে বোঝা যায়, অন্তত তিনটি স্তরের মধ্য দিয়ে এই গ্রন্থ বর্তমান আকার ধারণ করেছে। এই গ্রন্থের রচনাকাল নির্ণয় করা অত্যন্ত দুরূহ কাজ। পণ্ডিতপ্রবরগণ কেউ কেউ বলেন, আনুমানিক ২০০ খ্রিস্টপূর্ব থেকে ২০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তীকালে রচিত হয়েছে। স্যর উইলিয়াম জোনসের মতে খ্রিস্টপূর্ব ত্রয়োদশ শতক, শ্লেগেলের মতে খ্রিস্টপূর্ব দশম শতক, এলফিনস্টোনের মতে খ্রিস্টপূর্ব নবম শতক, বুহলারের মতে খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকে খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকে মনুসংহিতা রচিত হয়েছিল। অদ্যাপি মনুর নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হয়। তাঁর স্মৃতির দোহাই দিয়ে পণ্ডিত সমাজ পদে পদেই দেওয়া হয়। স্মৃতিনিবন্ধগুলোতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে মনুর বচনের বিশদ ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। মনুর প্রভাব ভারতের চতুঃসীমাতেই আবদ্ধ নয়– ব্রহ্মদেশ বা মায়ানমার, সিংহল বা শ্রীলঙ্কা, পারস্য বা ইরান, চিন, জাপান এবং সুদূর প্রাচ্যের কিছু দেশে তাঁর প্রভাব ব্যাপক এবং সুগভীর। মায়ানমারের কিছু আইনের গ্রন্থে মনুর ঋণ স্পষ্টই স্বীকৃত হয়েছে। শ্রীলঙ্কার ‘চুলবংশ’ নামক গ্রন্থে মনুর রাজধর্মের উল্লেখ বারবার করা হয়েছে। চিনে প্রাপ্ত একটি পুথিতে মনুর আইনকানুনের উল্লেখ পাওয়া যায়। জাপানে উপনিবেশ স্থাপনকারী কিছু আর্য সেই দেশে মনুর ধর্মশাস্ত্র প্রবর্তিত করেছিলেন বলে মনে হয়। প্রাচীন পারস্য ইরানের দেবগোষ্ঠীর মধ্যে আছেন বৈবস্বত মনু।
বলা হয় হিন্দুদের প্রধান ধর্ম গ্রন্থ বেদ। মনুসংহিতাও হিন্দু পৌরাণিক গ্রন্থ। এই গ্রন্থকে হিন্দু আইনের ভিত্তিস্বরূপ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। হিন্দুধর্মের অবশ্য পালনীয় কর্তব্যসমূহ, আচার-আচরণ, ধর্মীয় ও সামাজিক ক্রিয়াকলাপের বিধিবিধান সম্পর্কে এই গ্রন্থে আলাপ করা হয়েছে। মনু কর্তৃক সংকলিত বলে এর নাম মনুসংহিতা। কথিত আছে, এই গ্রন্থটি প্রথম স্বায়ম্ভুব মনু রচনা করেছিলেন। বেদ হিন্দুদের আদি গ্রন্থ এবং এই গ্রন্থের কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেই ‘মনুসংহিতা’ বা ‘মনুস্মৃতি’ রচিত হয়েছে একথা বলা যায়। অতএব হিন্দুধর্ম মূলত মনুসংহিতা-নির্ভর। হিন্দু এবং হিন্দুবাদের আগাপাছতলাই মনু এবং মনুসংহিতা। মনুকে যদি আদি মানব বলা হয়, তাহলে হিন্দুদের কাছে ইনি প্রাতঃস্মরণীয় হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু তা হয়নি কোনো এক অজানা কারণে। মনুকে আদি মানব বলা হলেও নিশ্চয় অন্য ধর্মের মানে পৃথিবীর অন্য মানুষদের তিনি আদি নন, তিনি শুধু হিন্দুমানবদেরই আদি মানব, তাই নয় কি?
মনুস্মৃতি ও মহাভারত গ্রন্থদুটিতে কতকগুলি শ্লোকের হুবহু মিল পাওয়া যায়। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরিমার্জন হলেও একইরকম। বস্তুত মনুর গ্রন্থ আমাদের কাছে আদিরূপে পৌঁছোয়নি। বর্তমান মহাভারত বহুদিন যাবৎ বিবর্তনেরই রূপ। সুতরাং মহাভারতের কাছে মনুসংহিতা ঋণী, নাকি মনুসংহিতার কাছে মহাভারত ঋণী– তা বলা প্রায় অসম্ভব। এই দুই গ্রন্থে এমন কিছু শ্লোক আছে যেগুলিতে শব্দগত সাদৃশ্য না-থাকলেও ভাবগত সাদৃশ্য বিদ্যমান।
‘মনুসংহিতা’-য় কী কী আছে? ২৬৯৪ টি শ্লোকে সন্নিবেশিত গুরুত্বপূর্ণ বিধানগুলো হল– (ক) পৃথিবীর উৎপত্তি (খ) বিভিন্ন সংস্কারের নিয়ম (গ) ব্রতচারণ (ঘ) বিবাহের নিয়মাবলি (ঙ) অপরাধের শাস্ত্রীয় বিধি (চ) শ্রাদ্ধবিধি (ছ) খাদ্যাখাদ্য বিধি (জ) বিভিন্ন বর্ণের কর্তব্য (ঝ) বর্ণাশ্রম বিধি (ঞ) স্ত্রী পুরুষের পারস্পরিক ধর্ম (ট) সম্পত্তি বন্টনের বিধি (ঠ) সংকর বর্ণের বিবরণ
(ড) জাতিধর্ম (ঢ) কুলধর্ম (ণ) ব্রাহ্মণের অধিকার ও করণীয় এবং (ত) রাজা প্রজার পারস্পরিক কর্তব্য ইত্যাদি।
হিন্দুদের ধর্মভিত্তিক আইন ও সামাজিক রীতি নীতি পরিচালিত হয় আরেকটি গ্রন্থ ‘মনুসংহিতা’ বা ‘মনুস্মৃতি’র উপর ভিত্তি করে। বেদের নির্যাস নিয়েই আরোপিত এই ধর্মটির প্রচারিত সংবিধান হয়ে উঠল মনুস্মৃতি বা মনুসংহিতা। এর মাধ্যমে যে সমাজ-কাঠামোর নির্মাণ যজ্ঞ চলতে থাকল তার ভিত্তি এক আজব চতুর্বর্ণ প্রথা। যেখানে আদিনিবাসী অনার্যরা হয়ে যায় নিম্নবর্ণের শূদ্র, যারা কেবলই উচ্চতর অন্য তিন বর্ণ ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্যের অনুগত সেবাদাস। কোনো সমাজ-সংগঠনে বা কোনো সামাজিক অনুষ্ঠান যজ্ঞে অংশগ্রহণের অধিকার শূদ্রদের জন্য নিষিদ্ধ হয়ে যায়। আর যারা এই ব্যবস্থার বাইরে গিয়ে প্রতিবাদী-বিদ্রোহী হয়ে উঠতে চাইল, এদেরকেই সুকৌশলে করা হল অচ্ছুৎ, দস্যু, অসুর, দৈত্য, সমাজচ্যুত বা অস্পৃশ্য সম্প্রদায়। পৃথিবীতে যতগুলো কথিত ধর্মগ্রন্থ আছে তার মধ্যে মনে হয় অন্যতম বর্বর, নীতিহীন, শঠতা আর অমানবিক প্রতারণায় পরিপূর্ণ গ্রন্থটির নাম হচ্ছে ‘মনুস্মৃতি’ বা ‘মনুসংহিতা’।
এ পর্যন্ত পাঠ করে যাঁরা ভাবছেন মনু খুবই নৃশংস ধরনের আইনপ্রণেতা ছিলেন, তাঁদের বলব ভুল ভাবছেন। ১২ টি অধ্যায়ের ২৬৯৪ টি শ্লোক জুড়ে মনু কেবলই নৃশংসতার পরিচয় লিপিবদ্ধ করেননি, অসংখ্য উদার এবং কল্যাণকর মানসিকতার বিধানও সংযোজন করেছেন। দুর্ভাগ্য এই যে সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালকগণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেইসব কল্যাণকর বিধানগুলির পথ মাড়াননি এবং অত্যন্ত সচেতনভাবেই এড়িয়ে গেছেন। প্রচুর উদাহরণ দেওয়া যায়, তাতে প্রবন্ধটির কলেবর বৃদ্ধি হোক আমি তা চাই না। দুটি উদাহরণই উল্লেখ করব–
(১) “যদি কোনো ব্যাক্তির স্ত্রী অথবা সন্তান না থাকে তাহলে তার সম্পত্তি তার ভাই-বোনদের মাঝে সমান ভাগে ভাগ করে দেবে। যদি জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা তার ভাই-বোনদের মাঝে প্রাপ্য অংশ প্রদান করতে অস্বীকৃত জানায় তাহলে আইন অনুযায়ী সে শাস্তি পাওয়ার যোগ্য” (৯/২১২)।
(২) “নারীর সুরক্ষা বিধান নিশ্চিত করার জন্য মনু আরও কঠোরতর শাস্তি বিধানের পরামর্শ দিয়েছেন তাদের উপর যারা নারীর সম্পত্তি হনন করার চেষ্টা করবে, এমনকি সে তার নিকট-আত্মীয় হলেও তাকে শাস্তির আওতায় আনা হবে” (৯/২১৩) অথচ নারীকে বহুকাল সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে, আজ তক। নানা কৌশলে নারীকে পিতামাতার সম্পত্তি থেকে দূরে রাখা হয়েছে। নারীর সম্পত্তির অধিকার বিষয়ে আইন আছে বটে, কিন্তু ওই পর্যন্তই। হাজার হাজার বছর ধরে মনুর বিধান যেমন মনুসংহিতায় বন্দি হয়েছিল, আধুনিক আইনও ওইভাবেই প্রায়-অপ্রাসঙ্গিক হয়ে আছে। দাবি করলে পাওয়া যায় বটে, না দাবি করলে কিছুই নেই।
পরিশেষে বলব– ব্রাহ্মণ্যবাদের আকর গ্রন্থ শ্রুতি বা ‘বেদ’-এর নির্যাসকে ধারণ করে যেসব স্মৃতি বা শাস্ত্রগ্রন্থ রচিত হয়েছে বলে কথিত, তার শীর্ষে অবস্থান করছে মনুস্মৃতি বা মনুসংহিতা। তাই মনুসংহিতা ও ব্রাহ্মণ্যবাদকে আলাদা করে দেখার উপায় নেই। সাধারণত ব্রাহ্মণ্যবাদীরা নিজেদেরকে হিন্দু বলে পরিচয় দেয়। ব্রাহ্মণ্যবাদীরা ছাড়া কেউই হিন্দু নয়। ব্রাহ্মণ্যবাদে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার অদম্য চেষ্টা করে যাচ্ছে একশ্রেণির মূলনিবাসী। হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দলগুলিকে অক্সিজেন জোগাচ্ছে। কারণ মুসলিম-বিদ্বেষ। মুসলিমদের ভারত থেকে উৎখাত করাই এঁদের মূল স্বপ্ন। ওরা এটা বুঝতে পারছে না, সত্যিই যদি ভারত থেকে মুসলিমরা উৎখাত হয়ে যায়, তখন ওদেরও উৎখাত শুরু হয়ে যাবে। ব্রাহ্মণ্যবাদীদের মতাদর্শে শূদ্র ও মুসলিম সমান ঘৃণ্য।
ভারতীয় দর্শনের ছয়টি আদি মতবাদ ছাড়াও চার্বাকের অবিমিশ্র নিরীশ্বরবাদ, আচার্য রামানুজের দ্বৈতবাদ, আচার্য শংকরের সর্বেশ্বরবাদ, রাজা রামমোহন রায়ের একেশ্বরবাদ এবং বহুদেবত্ববাদও হিন্দুধর্মের অন্তর্ভুক্ত। এভাবে হিন্দুধর্ম হল কতকগুলো পরস্পরবিরোধী ধর্মীয় মতবাদ ও দর্শনের সমষ্টি। হিন্দুবাদ হচ্ছে কঠোর বর্ণাশ্রমভিত্তিক একটি সমাজব্যবস্থা, যাতে মানুষের মর্যাদা, সাম্য, ভ্রাতৃত্ব ও সামাজিক সুবিচারের কোনো স্বীকৃতি নেই। যেখানে শুধু ব্রাহ্মণ্যবাদীরাই থাকবে। অন্য কেউ নয়। হিন্দুবাদের প্রাচীন ভাবধারার প্রভাব এখনও সুদূরপ্রসারী। সমাজের বহিরঙ্গে দৃশ্যমান হিন্দুদের তথাকথিত উদারনৈতিকতা তাঁদের সমাজের সত্যিকার পরিচয় নয়। এই উদারনৈতিকতার অন্তরালে লুকিয়ে আছে আর্যসমাজের সত্যিকার রূপ। অর্থাৎ যোগফল মনুসংহিতা মানেই ব্রাহ্মণ্যবাদ, ব্রাহ্মণ্যবাদ মানেই মনুসংহিতা, মনুসংহিতা মানে হিন্দুবাদ।
আমি একজন জাতি গত ক্ষত্রীয়. আমি জন্মভিত্তিক বর্ণ বিভাগ মানি না. কর্মে বর্ণ থাকা উচিত.
যে যেকাজের উপযুক্ত, তাকে তা করা উচিত.
মনুসংহিতা বইটি কোথায় পাওয়া যাবে?
অর্ধ সত্য মিথ্যার থেকেও সাংঘাতিক হয়ে ওঠে ৷ এখানে নিজের মতবাদ প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য বাছাই করা শ্লোকের উদাহরন দিয়ে বাকী গুরুত্বপুর্ণ তথ্য গুলি এড়িয়ে চলে যাওয়া হয়েছে ৷
ধন্যবাদ অসংখ্য ধন্যবাদ।