পনেরোই আগস্টের সকালটা ভারী সুন্দর হয়ে দেখা দিল। আকাশের এক দিকে ছাই আর সাদাটে রঙের জলদ মেঘ। আর অন্যদিকে ভোরের আলোর আভায় সিঞ্চিত অপূর্ব এক কোমল রং ছেয়ে আছে।
সকাল সাতটা বাজতে না বাজতেই রোশন প্রাইমারি স্কুলের মাঠে চলে এসেছিল। এসে দ্যাখে, রনিত, অতুল, নিতুয়া সবাই মাঠে হাজির। শুধু তাই নয়, ওদের সঙ্গে রয়েছে আরও অনেক ছেলের দল। তার মধ্যে বারো নম্বর বস্তির অনেকগুলো চেনা মুখ নজরে পড়ল।
রোশন অবাক হয়ে দেখল, অবনীমাস্টারমশাই এই সাতসকালেই মাঠে এসে হাজির হয়েছেন। পরনে খদ্দরের পাঞ্জাবি আর সাদা পাজামা। হাতে একটা পুরোনো ফোল্ডিং ছাতা—এখন বৃষ্টি পড়ছে না, তাই ছাতা বন্ধ।
রোশন মনে-মনে শুধু এটাই প্রার্থনা করছিল, আজ সকালটা যেন বৃষ্টির হাত থেকে বেঁচে যায়।
ছ’জন ছেলে মাঠে চেয়ার সাজাচ্ছে। সাদা আর সবুজ রঙের প্লাস্টিকের চেয়ার। মাধব দাস তাঁর কথা রেখেছেন—ভোর ছ’টার সময় একটা ঠেলাগাড়ি করে দুশো চেয়ার স্কুল-মাঠে পাঠিয়ে দিয়েছেন।
মাস্টারমশাই চেয়ার সাজানোর ব্যাপারটার তদারকি করছিলেন। বন্ধ ছাতাটা লাঠির মতো সামনে বাড়িয়ে হাঁকডাক পেড়ে কীভাবে চেয়ার সাজাতে হবে তার নির্দেশ দিচ্ছিলেন।
রোশন নিতুয়ার কাছে গেল।
নিতুয়ার চুল উসকোখুসকো, চোখ লাল। চারটে ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে কাল সারা রাত ধরে ও স্টেজ তৈরি করেছে। এ ছাড়া রোশন আরও ছ’জন ছেলেকে মাঠে রাত-পাহারায় থাকতে বলেছিল, কারণ, পলান ওদের উৎসব পণ্ড করার জন্য রাতে স্কুল-মাঠে আচমকা হামলা চালাতে পারে। একই কারণে মাঠে সারা রাত ধরে চারটে মেটাল ল্যাম্প জ্বেলে রাখার ব্যবস্থাও হয়েছিল।
নিতুয়া রিপোর্ট দিল রোশনকে : রাতে নানা সময়ে কয়েকটা বাইক এই স্কুল-মাঠকে চক্কর দিয়ে গেছে। বাইকে যারা ছিল তাদের মধ্যে কাটা নগেন, নোনতা, কালুয়া আর সুবুকে নিতুদা চিনতে পেরেছে। তবে বাইকগুলো শুধু চক্কর কেটেছে—কোনও ঝঞ্ঝাট করেনি।
এই স্কুল-মাঠে ফাংশান হবে বলে রোশনরা মিউনিসিপ্যালিটি আর লোকাল থানার পারমিশনের জন্য অ্যাপ্লাই করেছিল—সেসব পারমিশন ওরা পেয়েও গেছে। পারমিশনের নানা চিঠিচাপাটি, দৌড়ঝাঁপ ইত্যাদি হ্যাপা সামাল দিয়েছেন ডাক্তারবাবু, মাস্টারমশাই আর রতনদা—রতনমণি মাঝি। সাব-ইনস্পেকটর সুরেন্দ্রনারায়ণ দাস নানা ফ্যাঁকড়া তুললেও শেষ পর্যন্ত অফিশিয়াল পারমিশন দিতে বাধ্য হয়েছেন।
নিতুয়ার সঙ্গে কথা বলতে-বলতে রোশন মাঠের চারপাশে চোখ বোলাচ্ছিল। হ্যাঁ, সত্যিই উৎসবের মাঠ বলে মনে হচ্ছে মাঠটাকে, যদিও মাঠ সাজানোর ব্যাপারটা খুবই সাধারণ।
মাঠের চারপাশে বাঁশ পুঁতে দড়ি বেঁধে ছোট-ছোট কাগজের পতাকার চেন লাগানো হয়েছে। তাতেই উৎসবের মূল সুরটা বেজে উঠেছে। তার সঙ্গে রয়েছে নিতুয়ার তদাররিকে তৈরি সাদামাঠা মঞ্চ। মঞ্চের মাথায় কোনও ছাদ নেই। পিছনে একটা নীল-সাদা কাপড়ের ‘দেওয়াল’। তার ওপরে পিন দিয়ে আটকানো কাপড়ের তৈরি একটা বড় মাপের জাতীয় পতাকা। তার নীচে একটা সালু। তাতে লেখা : ‘স্বাধীনতা দিবস উৎসব / আয়োজনে ”আমরা সবাই”।’ এই ব্যানারটাই বিবেকানন্দ মূর্তির রেলিঙে ক’দিন ধরে টাঙানো ছিল—স্টেজে লাগানোর জন্য কাল রাতে সেটা খুলে আনা হয়েছে।
সবকিছু দেখে রোশনের খুব ভালো লাগছিল। মনে পড়ছিল, ছোটবেলায় ওদের ঘরের সামনে ছোট্ট গলিতে ও আর কুশান স্বাধীনতা দিবসে একটা লাঠির ডগায় পতাকা লাগিয়ে লাঠিটা কয়েকটা ইটের সাপোর্টে দাঁড় করাত। গলিটা ভীষণ সরু বলে লোকজন যাতায়াতের যথেষ্ট অসুবিধে হত। অনেকে বিরক্ত হয়ে রাগারাগি করত, কিন্তু ওরা সেসব গ্রাহ্য করত না। পতাকার সামনে দাঁড়িয়ে ‘জনগণমন’ গাইত। তারপর কবিতা শেষ হলে পতাকার দিকে তাকিয়ে সেলাম ঠুকে সম্মান, শ্রদ্ধা ইত্যাদি জানাত। যদিও ওইটুকু বয়েসে শ্রদ্ধা বা সম্মানের কিছুই ঠিকঠাক বুঝত না ওরা। ওরা শুধু জানত, সেলাম ঠোকার পরই ওরা ‘প্রসাদ’ খাবে। কারণ, পতাকার সামনে একটা ছোট্ট পিতলের থালায় সাজানো রয়েছে কয়েকটা বাতাসা আর নকুলদানা। মায়ের কাছে বায়না করে এই ‘প্রসাদ’-এর ব্যবস্থা করেছে দু-ভাই। এবং ‘প্রসাদ’ খাওয়ার পরই ওদের ‘অনুষ্ঠান’ শেষ হত।
পুরোনো কথা মনে পড়ে একচলিতে হাসির ছোঁয়া ফুটে উঠল রোশনের ঠোঁটে। একইসঙ্গে দুঃখের একটা আলপিন হৃদয়ে বিদ্ধ হল। কুশান! কুশানের জায়গাটা শূন্যস্থান হয়ে গেছে—সেটা আর পূরণ করা সম্ভব নয়।
বেলা আটটা বাজতে না বাজতেই রোশনদের মাইক মুখ খুলল। ‘আমরা সবাই’ আয়োজিত স্বাধীনতা উৎসবে সবাইকে আন্তরিক আহ্বান জানাতে লাগল।
মাঠে দু-চারজন মানুষের ভিড় এমনিতে ছিলই। মাইক সক্রিয় হওয়ার পর সেই ভিড়টা বাড়তে লাগল। ছোট-বড় সবাই এসে জড়ো হতে লাগল। মাইক তখন আশাপুরের সবাইকে স্কুল-মাঠে আসার জন্য লাগাতার আহ্বান জানাচ্ছে।
মঞ্চের সামনে বিশাল মাপের কয়েকটা নীল প্লাস্টিক পাতা হয়েছে। এখানে ছোট-ছোট বাচ্চাকাচ্চারা বসবে।
প্লাস্টিকের পর থেকে সাজানো হয়েছে সারি-সারি চেয়ার। চেয়ারের সারির মাঝবরাবর যাতায়াতের একটা অলিপথ রাখা হয়েছে।
ঘড়ির কাঁটা গড়াতে-গড়াতে ন’টার দাগে পৌঁছোল। ততক্ষণে ছোট-ছোট ছেলেমেয়েরা প্লাস্টিকের ওপরে বসে পড়েছে। চেয়ারগুলোও আধাআধি ভরতি হয়ে গেছে।
মাইকে যে-ছেলেটি ঘোষণা করছিল, সে তখন বারবার বলে চলেছে, ‘আমাদের অনুষ্ঠান আর কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হচ্ছে। আপনারা দয়া করে আসন গ্রহণ করুন। ছোটদের বলছি, তোমরা শান্ত হয়ে বোসো—গোলমাল কোরো না…।’
এই অনুষ্ঠানে বড় মাপের কোনও মানুষকে বিশেষভাবে নেমন্তন্ন করা হয়নি। তাই মঞ্চের আশেপাশে আশাপুরের সাধারণ মানুষজনের ভিড়। এরকম অনুষ্ঠান আশাপুরের মানুষ এই প্রথম দেখছে, যেখানে কোনও রাজনৈতিক নেতা নেই, নামকরা গায়ক-গায়িকা নেই, কোনও অভিনেতা বা অভিনেত্রীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। এটা শুধুই আশাপুরের সাধারণ মানুষের অনুষ্ঠান—মঞ্চের ওপরে কিংবা নীচে শুধুই সাধারণ মানুষ।
মঞ্চ খুব সাদামাঠাভাবে সাজানো হয়েছে। একটা সারিতে পাশাপাশি দশটা প্লাস্টিকের চেয়ার। তার সামনে একটা খাটো টেবিল। আলোচনা করে এটা ঠিক হয়েছে যে, আশাপুরের দশজন প্রবীণ মানুষ এই দশটি চেয়ারে বসবেন। তার মধ্যে সুধীরডাক্তারবাবু, অবনীমাস্টারমশাই আর রতনমণি মাঝি থাকবেন।
ওঁরা সবাই এসে গেছেন। মঞ্চে উঠে চেয়ারে বসেছেন।
মঞ্চের একপাশে খানিকটা দূরত্বে একটা লম্বা বাঁশ খাড়াভাবে মাটিতে পোঁতা রয়েছে। তার সঙ্গে লাগানো রয়েছে দড়ি আর একটা জাতীয় পতাকা। অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই অবনীমাস্টারমশাই পতাকা তুলবেন। কারণ, উদ্যোগী মানুষদের মধ্যে উনিই বয়েসে সবচেয়ে প্রবীণ।
রোশন চারপাশে চোখ বুলিয়ে সবকিছু দেখছিল আর ওর মনে হচ্ছিল, ও একটা স্বপ্নের ঘোরের মধ্যে রয়েছে। আশাপুরে সত্যি-সত্যিই যে এরকম একটা অনুষ্ঠান হতে পারে সেটা ও ভাবতেও পারছিল না। এটা সাধারণ মানুষের এমন একটা অনুষ্ঠান যার মধ্যে পলান নস্কর বা তার দলবলের কোনও ভূমিকা নেই। এতদিন ধরে পলান আশাপুরের মানুষকে একজোট হতে দেয়নি—তাদের ভাগ-ভাগ করে রেখেছে। ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ পলিসি। তো আজ সেই ‘পলিসি’ ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। এত মানুষ এখানে জড়ো হয়েছে, চারপাশে এত হইচই-গুঞ্জন-চেঁচামেচি—অথচ কেউই ‘পলানদা জিন্দাবাদ!’ স্লোগান দিচ্ছে না। এই ঘটনা আশাপুরে সত্যিই নতুন।
তৃপ্তির একটা নাম-না-জানা সুবাস রোশনের বুকের ভেতরে ছড়িয়ে পড়ছিল। এখন ওর শুধু একটাই চাহিদা : পলান যেন ওর দলবল নিয়ে এখানে কোনও গন্ডগোল তৈরি না করে।
রোশন কোনও চান্স নেয়নি। পলানরা যাতে কোনও গোলমাল করে অনুষ্ঠান পণ্ড না করতে পারে তার জন্য ও দশজনের একটা ভলান্টিয়ার টিম তৈরি করেছে। সেই টিমের ‘ক্যাপ্টেন’ হচ্ছে নিতুয়া। রাত জেগে কাজ করেছে বলে রোশন সাড়ে সাতটার সময় নিতুয়াকে শুতে পাঠিয়ে দিয়েছিল। এখন ন’টা বাজার আগেই ও অল্পস্বল্প ঘুমিয়ে ফ্রেশ হয়ে মাঠে আবার ফিরে এসেছে।
নিতুয়ার নির্দেশে ন’জন ছেলে স্কুল-মাঠের নানান জায়গায় গিয়ে পোস্টিং হয়ে গেছে। ওরা তীক্ষ্ন নজরদারির কাজ চালাচ্ছে। ওদের হাতে কোনও হাতিয়ার নেই। তবে ইমার্জেন্সি সিচুয়েশনের জন্য রোশন আর নিতুয়া আটটা বাঁশের লাঠি জোগাড় করে এনেছে। সেগুলো এখন মাঠের কিনারায় আগাছার ঝোপের মধ্যে সকলের চোখের আড়ালে ‘ঘুমিয়ে’ আছে। সেগুলো সত্যি-সত্যি দরকার পড়বে বলে রোশনের মনে হয় না।
অবনীমাস্টারমশাইয়ের কথা দিয়ে অনুষ্ঠানের সূচনা হল। তিনি আশাপুরের মানুষের এই পবিত্র উদ্যোগকে অভিনন্দন জানালেন। বললেন যে, এই উদ্যোগের একজন সক্রিয় অংশীদার হিসেবে তিনি গর্বিত। তারপর সেই বর্ষীয়ান মানুষটি নিজেই অনুষ্ঠান সঞ্চালনার দায়িত্ব নিলেন। বললেন, ‘এখন আপনাদের সামনে উদ্বোধন সঙ্গীত গেয়ে শোনাবে আশাপুরের ছোট্ট মেয়ে কমলকলি জানা।’
তখন একটি বছর দশেকের মেয়ে স্টেজে উঠে ‘ধনধান্য পুষ্প ভরা…’ গানটি গাইল। তার গানের সঙ্গে একজন দিদি হারমোনিয়াম বাজিয়ে সহযোগিতা করলেন, আর একজন কাকু কমলকলির গানের সঙ্গে তবলা বাজালেন।
ধীরে-ধীরে অনুষ্ঠান সামনে এগিয়ে যেতে লাগল।
রোশন ভিড়ের মধ্যে সাধারণ একজন হয়ে অনুষ্ঠান দেখছিল। ওর খুব ভালো লাগছিল। এই অনুষ্ঠানটাকে সফল করার জন্য আশাপুরের বহু মানুষ আন্তরিকভাবে পরিশ্রম করেছে। এখানকার স্কুলের দুজন দিদিমণি, মালিনী আর স্মৃতি ম্যাডাম, অনুষ্ঠানের সাংস্কৃতিক দিকটা অনেক পরিশ্রমে তৈরি করেছেন। আজ যত গান বা আবৃত্তি হবে তার সবগুলোই ওঁদের দুজনের পরিকল্পনা এবং পরিচালনায়।
রোশনকে অল্প কিছু বক্তব্য রাখার জন্য সুধীরডাক্তারবাবু আর রতনমণিদা অনেক চাপাচাপি করেছিলেন, কিন্তু রোশন কিছুতেই রাজি হয়নি। লজ্জা, সংকোচ আর অযোগ্যতা ওর সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। বরং এখন ‘ভিড়ের মধ্যে একজন’ হয়ে দূর থেকে অনুষ্ঠান দেখতে ওর বেশ ভালো লাগছে।
একটা ছোট কাঁটা রোশনের বুকের ভেতরে খচখচ করছিল। গতকাল অনেকবার চেষ্টা করেও ও বিশ্বরূপদাকে নিজের জেল খাটার ব্যাপারটা বলে উঠতে পারেনি। বারবারই ওর মনে হয়েছে, কথাটা মুখ থেকে বের করলেই যেন আশাপুরে ওর অস্তিত্বের সুর কেটে যাবে। ঠিক মনে হবে যেন সুন্দর শান্তভাবে বয়ে চলা একটা নদীতে কেউ একটা প্রকাণ্ড পাথর ছুড়ে মারল। এখন সেই পাথরটা রোশনের গলার ভেতরে আটকে রয়েছে।
রোশন যদি ওই আহত ছেলেটাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কথা না ভাবত এবং ট্যাক্সি ছেড়ে স্রেফ পালিয়ে যেত তা হলে হয়তো শেষ পর্যন্ত ওর কোনও সাজা হত না। কিন্তু ও সেরকমটা করতে পারল কোথায়! ওর চোখের সামনে একটা তাজা প্রাণ ছটফটিয়ে মরে যাবে এটা ও সইতে পারছিল না। ওর বাবা যদি বেঁচে থাকতেন তা হলে ওকে বলতেন, ‘শিগগির উন্ডেড ছেলেটির চিকিৎসার ব্যবস্থা করো— যাও…।’
রোশন তাই করেছে। বাবার কাছ থেকে শেখা সহজপাঠ ও বুকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায়। কারণ, তার মধ্যে আনন্দ আছে।
ও আকাশের দিকে তাকাল। কোথাও মেঘ, কোথাও রোদ।
‘হে ভগবান! আজ কিছুতেই যেন বৃষ্টি না হয়।’ মনে-মনে প্রার্থনা জানাল।
মঞ্চে সুধীরডাক্তারবাবু তখন বলছেন, ‘আপনারা অন্যায়ভাবে কাউকে টাকা-পয়সা দেবেন না। অন্যায়ের কাছে মাথা নোয়াবেন না। অন্যায় দেখলে প্রতিবাদ করুন। ভুলে যাবেন না, ভারতের স্বাধীনতা এইভাবেই এসেছিল। আজ থেকে আমরা সবাই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের শপথ নিলাম। জয় ভারতমাতার জয়!’
দর্শকদের মধ্যে থেকে পালটা জিগির উঠল, ‘জয় ভারতমাতার জয়!’
ডাক্তারবাবুর বলা শেষ হল।
তারপর জাতীয় পতাকা উত্তোলনের পালা। অবনীমাস্টারমশাই পতাকা তুললেন। তারপর মঞ্চে উঠে এসে মাইকে ঘোষণা করলেন, ‘সামনের দিকে প্লাস্টিকের ওপরে যেসব ছোট্ট-ছোট্ট ভাই-বোনেরা বসে আছ, তোমাদের বলছি। তোমাদের সব্বাইকে এখন লজেন্স-বিস্কুট বিলি করা হবে। তার সঙ্গে দেওয়া হবে একটা করে জাতীয় পতাকা। তোমরা চুপটি করে বোসো—হইচই কোরো না…।’
চারটে ছেলে বিলি করার কাজ শুরু করে দিল। বাচ্চারা কাড়াকাড়ি চেঁচামেচি করে লজেন্স, বিস্কুট আর পতাকা নিতে লাগল। ওদের অনেকেই পতাকা নিয়ে শূন্যে এপাশ-ওপাশ দোলাতে লাগল।
এই অনুষ্ঠানের শেষে বাচ্চা-বড় সব্বাইকে নিয়ে একটা র্যালি বেরোবে। সেই র্যালি আশাপুরের নানান রাস্তায় ঘুরে আবার এই স্কুল-মাঠে এসে শেষ হবে।
সামনের দৃশ্যটা রোশনের দারুণ লাগছিল। ছোট-ছোট কাগজের পতাকা এপাশ-ওপাশ দুলছে। আর মাইকে তখন ‘আমরা করব জয় নিশ্চয়…’ গানটির সুর বাজছে। ওঃ, দারুণ!
আর ঠিক তখনই স্কুল-মাঠের কোথাও পরপর দুটো বোম পড়ল।
বোমের শব্দে সবাই চমকে উঠল। অনেকে চেয়ার ছেড়ে উঠে তড়িঘড়ি বড় রাস্তার দিকে রওনা দিল। বেশ কয়েকজন ছোট-ছোট ছেলেমেয়ে পলিথিন ছেড়ে উঠে ছুট লাগাল। উৎসবের সুর মুছে গিয়ে একটা ভয়ের আবহ নেমে এল পলকে।
কারণ, বোমের শব্দ এবং ধোঁয়া আশাপুরের মানুষের খুব চেনা। পলান ও তার দলবল বহুকাল আগেই আশাপুরের মানুষজনকে এ-দুটি জিনিসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয় করিয়ে দিয়েছে।
বোমের শব্দে রোশনও চমকে উঠেছিল। যে-ভয়টা সকাল থেকে ওর মনের ভেতরে আঁচড় কাটছিল সেটা আচমকা তার ধারালো নখ বিঁধিয়ে দিল। বোমের ধোঁয়া যে-দু-জায়গায় দেখা গেছে, সেই জায়গা দুটো খুব কাছাকাছি। রোশন সেইদিক লক্ষ্য করে ছুটতে শুরু করল। একইসঙ্গে চিৎকার করে বলতে লাগল, ‘ভয় পাবেন না—সবাই বসে থাকুন! ভয় পাবেন না…!’
রোশন যতই বলুক, জনগণ সে-কথা শুনলে তো!
ও ছুটছিল, কিন্তু ওর মনে হচ্ছিল পথের দূরত্ব কিছুতেই কমতে চাইছে না।
অবনীমাস্টারমশাই মঞ্চ থেকে হালহকিকত খেয়াল করছিলেন। তিনি বুঝতে পারছিলেন, ভয় পাওয়া মানুষজনকে ধরে রাখতে হলে এক্ষুনি কিছু একটা করা দরকার।
মুখে জোর করে হাসি ফুটিয়ে তিনি মাইকের সামনে এসে বললেন, ‘বাজির শব্দে আপনারা ভয় পাচ্ছেন? আজ স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে আমাদের আশাপুরের ছেলেরা পটকা ফাটানো শুরু করে দিয়েছে। আপনারা কেউ যাবেন না। একটু পরে আমরা আরও বাজি ফাটাব। বাজির শব্দে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আপনারা স্থির হয়ে যার-যার জায়গায় বসে পড়ুন।’
অবনীস্যারের কথায় অনেকটা কাজ হল। বেশিরভাগ লোকজন শান্ত হয়ে যে-যার জায়গায় বসে পড়ল। তবে আওয়াজ দুটো যে বাজি কিংবা পটকার নয় সেটা বেশ কিছু মানুষ বুঝতে পেরেছিল।
রোশন ছুটে যখন অকুস্থলে পৌঁছোল তখন সেখানে ধোঁয়া-টোয়া কিছু নেই। তবে দুটো জায়গায় পোড়া বারুদের স্পট রয়েছে। আর সেই দুটো অপচিহ্ন ঘিরে উত্তেজিত মানুষের জটলা। অনেকেই বলছে, ‘ভাগ্য ভালো যে, পেটোদুটো কারও গায়ে লাগেনি।’
রোশন এটুকু বুঝতে পারল, বোম যে-ই ছুড়ে থাকুক সে কাউকে আহত করার জন্য ছোড়েনি। বোম দুটো ছোড়া হয়েছে শুধুমাত্র সন্ত্রাস তৈরির জন্য। এবং এটা অবশ্যই পলান অ্যান্ড কোম্পানির কাজ। এ ছাড়া আর আছেটা কে!
মঞ্চে খানিকটা অস্থিরতা দেখা দিয়েছিল। বয়স্ক মানুষদের পাঁচ-ছ’জন তাড়াহুড়ো করে মঞ্চ থেকে নেমে গিয়েছিলেন। অবনীমাস্টারমশাই, রতনমণি মাঝি আর সুধীরডাক্তারবাবু মাইকে পালা করে ঘন-ঘন অভয় দিতে লাগলেন।
‘আপনারা কেউ যাবেন না। নিজের-নিজের জায়গায় স্থির হয়ে বসুন—।’
এইসব আশ্বাসে কিছুটা কাজ হচ্ছিল, তবে পুরোপুরি যে হচ্ছিল না সেটা মঞ্চের ওপর থেকে তিনজন প্রৌঢ় বেশ বুঝতে পারছিলেন। কারণ, ওঁরা দেখছিলেন, এদিক-ওদিক থেকে দু-চারজন করে মানুষ মাঠ ছেড়ে ব্যস্তভাবে সরে পড়ছে।
মাঠে যথেষ্ট ভিড় হয়েছে। সব চেয়ার তো ভরতি হয়ে গেছেই, তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে আরও অসংখ্য মানুষ।
নিতু ওর দলবল নিয়ে সেই ভিড়ের মধ্যে খোঁজাখুঁজি করছিল—যদি পলানের কোনও চ্যালাকে দেখতে পায়।
হঠাৎ দুটো চেনা মুখকে দেখতে পেল নিতু। পলানের দলে ওদেরকে ও অনেকবার দেখেছে। তাই নাম না জানলেও মুখ দুটোকে চিনতে ওর অসুবিধে হয়নি। দুটোরই চেহারা রোগা, কালো—চোখে দু-নম্বরি ছাপ।
খপ করে একজনের হাত চেপে ধরল নিতু : ‘অ্যাই, তোরা এখানে কী করছিস রে!’
সঙ্গে-সঙ্গে ছেলেটা কোনও কথা না বলে নিমেষে পকেট থেকে একটা চাকু বের করে নিতুর হাত লক্ষ্য করে চালিয়ে দিল।
যে-হাত দিয়ে ছেলেটার হাত চেপে ধরেছিল আঘাতটা সেই হাতেই লাগল। কনুইয়ের ওপরে ইঞ্চিদুয়েক ফাঁক হয়ে গেল। সাদা মাংস দেখা গেল। তারপর সূক্ষ্ম অদৃশ্য পথ ধরে অসংখ্য রক্তবিন্দু চুঁইয়ে বেরিয়ে আসতে লাগল।
যন্ত্রণায় নিতুয়ার মুখ কুঁচকে গেল। ব্যথার একটা ছোট্ট চিৎকার করে ও চাকুওয়ালাকে জাপটে ধরল। নিতুর সঙ্গে যে-তিনজন ছেলে ছিল তারা মুহূর্তের মধ্যে ছেলে দুটোর ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল। মাঠের সেই জায়গাটায় জটলা আর হইচইয়ের একটা নিউক্লিয়াস তৈরি হয়ে গেল। কিন্তু তারই মধ্যে থেকে পলানের চ্যালাদুটো কীভাবে যেন পিছলে পালিয়ে গেল।
রোশন কোনদিকে যাবে বুঝতে পারছিল না। ও কি মঞ্চে ছুটে গিয়ে মাইকে কথা বলে সবাইকে ভরসা দেবে? নিতুদাকে সাহায্য করতে ছুটে যাবে? নাকি অগতির গতি নক্কাছক্কা অফিসার সুরেন দাসকে এই ‘অশান্তি’-র খবর দেবে?
মনের মধ্যে বিপন্নতা তৈরি হলেও রোশনের মনের একটা অংশ জেদিভাবে বলছিল, ‘যে-কোনও দামে এই অনুষ্ঠানকে সফল এবং সম্পূর্ণ করতে হবে।’
ঠিক সেইসময় একটা গুলির শব্দে স্কুল-মাঠে হাজির সবাই চমকে উঠল। এবং শব্দ লক্ষ্য করে তাকিয়ে যে-দৃশ্য সবাই দেখল তাতে চমকটা একটা বিপজ্জনক মাত্রা পেল।
মঞ্চের ওপরে দাঁড়িয়ে রয়েছে পলান নস্কর। ওর দুপাশে দুজন চ্যালা। তাদের হাতে খোলা তরোয়াল।
পলানের হাতে একটা পিস্তল—সেটার নল থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। কারণ, একটু আগেই পলান আকাশের দিকে তাক করে ওটা থেকে একটা গুলি ছুড়েছে।
পলানের গায়ে লাল রঙের রাউন্ড নেক টি-শার্ট, পায়ে কালো ট্রাউজার্স। টি-শার্টটা ট্রাউজার্সের ভেতরে ইন করে পরা। ওর ডানহাতের স্টিলের বালা, ডানকানের সোনার মাকড়ি চকচক করছে।
অবনীস্যার তখন মাইকের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন, কিছু একটা বলছিলেন। পলানের কাণ্ড দেখে তিনি হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন। অবাক হওয়ার ঘোরটা কাটিয়ে তিনি পলানকে বকুনির সুরে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু সেটা আর হয়ে উঠল না। কারণ, সবাইকে অবাক করে দিয়ে পলান বাঁ-হাতে মাস্টারমশাইয়ের গালে সপাটে একটা থাপ্পড় কষিয়ে দিল। থাপ্পড়ের নোংরা শব্দটা মাইকে শোনা গেল।
মাস্টারমশাই টলে গেলেন। গালে হাত দিয়ে অবাক বিস্ময়ে পলানের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ওঁর চোখে জল এসে গেল। গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল।
এই পলানকে কত ছোট দেখেছেন! চিলড্রেন্স পার্কে খেলা করত। একটু লাজুক ধরনের ছিল। তারপর দিনের পর দিন পালটাতে-পালটাতে এরকম হয়েছে! এই পালটে যাওয়ার সুতো কি উলটো দিকে গোটানো যায়?
মঞ্চের ওপরে এইরকম নোংরা কাণ্ড দেখে সুধীরডাক্তারবাবু, রতনমণি মাঝি ও অন্যান্য সিনিয়াররা কী করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না।
সামনে বসে থাকা দর্শকদের মধ্যে অনেকেই ধাক্কা খেয়ে চমকে উঠেছিল—কারণ, মাস্টারমশাই আশাপুরের সম্মানিত মানুষ, আর পলান নস্কর নর্দমার পোকা। সে কি না এরকমভাবে সবার সামনে মাস্টারমশাইকে অপমান করল!
মানুষজন ফিসফাস করছিল, গুনগুন করছিল, প্রতিবাদের কথাও ভাবছিল। কিন্তু শুধুই ভাবছিল, করছিল না কেউ।
অবনীমাস্টারমশাই হাতের পাতা দিয়ে চোখের জল মুছলেন। তারপর বৃদ্ধ মানুষটি চোয়াল শক্ত করে মাইক্রোফোনের দিকে পা বাড়ালেন। কিন্তু সঙ্গে-সঙ্গে পলানের লাথি এসে পড়ল ওঁর গায়ে। মাস্টারমশাই স্টেজের ওপরেই ছিটকে পড়লেন।
সুধীরডাক্তার এবার চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘পলান, তুমি কী করছ! তুমি কিন্তু লিমিট ছাড়িয়ে যাচ্ছ!’
রতনমাণি মাঝি ও আর-একজন প্রৌঢ় মাস্টারমশাইকে সাহায্য করতে ছুটে গেলেন। ওঁকে ধরে সাবধানে দাঁড় করালেন। ওঁকে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন। কিন্তু সেগুলো ওঁদের নিজেদের কানে কেমন যেন ফাঁপা শোনাচ্ছিল।
সুধীরডাক্তারের দিকে তাকিয়ে দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে উঠল পলান, এবং একইসঙ্গে খিস্তি-খেউরের বন্যায় স্টেজ ভাসিয়ে দিল। তার কিছু-কিছু টুকরো লাউডস্পিকার গোটা স্কুল-মাঠে ছড়িয়ে দিল।
মাঠে নিতুয়া তখন চিৎকার করছিল। হাতের কাটা জায়গায় ও একটা ছেঁড়া কাপড়ের টুকরো বেঁধে নিয়েছে। সেই অবস্থাতেই ও চেঁচিয়ে ওর ‘কমরেড’-দের ছুটে গিয়ে স্টেজে ওঠার জন্য বলছিল। মাস্টারমশাই আর ডাক্তারবাবুর হেনস্থা ওর ভেতরে জ্বালা ধরিয়ে দিচ্ছিল। তার ওপর পলানের ছেলে দুটো ওদের হাত ছাড়িয়ে পিছলে পালিয়েছে বলে নিতুর ভেতরে একটা চাপা রাগ ফুটছিল।
পলান ওর রিভলভারটা কখন যেন পকেটে ঢুকিয়ে ফেলেছে। স্ট্যান্ড মাইকের রডটা চেপে ধরে মাইকের কাছে মুখ নিয়ে এসে চেঁচিয়ে কথা বলতে শুরু করেছে।
‘আসাপুর আমাদের জন্মভূমি। আসাপুর একটাই অঞ্চল। সেই অঞ্চলকে আমি জান থাকতে ভাগ হতে দেব না। আসাপুরে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান বরাবর একটাই হয়—যেটা আমি করি—চিলড্রেন পার্কে। সেখানে দুটো পোগ্রাম করার মানে আসাপুরকে ভাগ করার চেস্টা। সেটা আমি কিছুতেই বরদাস্ত করব না।
‘আমি জানি, আসাপুরের মানুস হেব্বি ভালো। কিন্তু আসাপুরের বাইরে থেকে আসা একটা পচা মাল গোটা আসাপুরকে পচিয়ে দিচ্ছে। আসাপুরের এই বিপদের দিনে আমাকে তো রুখে দাঁড়াতেই হবে, কড়া মোকাবিলা করতে হবে। আসাপুরের ক্ষতি আমরা কিছুতেই হতে দেব না…।’
দর্শকের আসন থেকে একজন মাঝবয়েসি লোক উঠে দাঁড়িয়ে বাঁকা হাসি হেসে চেঁচিয়ে জিগ্যেস করল, ‘সেই পচা মালটা কে?’
‘রোশন বিশ্বাস !’ পলান যেন গর্জন করে উঠল, ‘ওই সুয়ারের বাচ্চাটা সুধু যে পচা মাল তা নয়—ব্যাটা একনম্বরের জেলখাটা দাগি মাল। এখন সালা এই স্কুল-মাঠেই কোথাও ছুপে রয়েছে…।’
নিতু ওর দলবল নিয়ে পলানের জঘন্য অন্যায় দেখছিল, ওর লম্বা-চওড়া কথা শুনছিল।
নিতুয়ার রক্ত টগবগ করে ফুটছিল। কিন্তু স্টেজের দু-পাশে সোর্ড হাতে দুটো চ্যালা দাঁড়িয়ে থাকায় ও চুপ করে দাঁড়িয়েছিল। ভাবছিল, কী করা যায়।
ওর সঙ্গী একটি ছেলে বলল, ‘নিতুদা, পুলিশে খবর দিলে হয় না?’
তাতে নিতুর পাশে দাঁড়ানো আর-একটি ছেলে জবাব দিল, ‘কোনও লাভ নেই। এখানকার পুলিশ সবসময় পলান নস্করের নাম-কেত্তন করে—।’
নিতুর গায়ে জ্বালা ধরে গিয়েছিল। ও হঠাৎই দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘পলান সালা লিমিট ছাড়িয়ে যাচ্ছে। তোরা এক্ষুনি ছোট—ঝোপ থেকে খেটোগুলো নিয়ে স্টেজের দু-পাশ থেকে অ্যাটাক কর—সুয়ারের বাচ্চাদের এক্ষুনি অ্যাটাক কর…!’
দর্শকদের মধ্যে থেকে নানান কথা উঠে আসছিল। রোশনের এগেইনস্টে পলান উলটোপালটা কথা বলায় অনেকে প্রতিবাদের আওয়াজ তুলছিল। রোশনের হয়ে অনেকে কথা বলছিল। কেউ-কেউ আবার প্রশ্ন তুলল, ‘রোশন কোথায়? কোথায় গেল রোশন?’
রোশন ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে পলানের নোংরামো দেখছিল। পলানের শেষ কথাগুলো এমন যে, মাঠে হাজির পাবলিকের সামনে এর একটা জবাব দেওয়া দরকার। এবং এক্ষুনি।
এসব কথা ভাবতে-ভাবতেই রোশন দেখল, স্টেজের দু-পাশ থেকে চার-চারটে তেজিয়ান ছেলে হঠাৎ করে হনুমানের মতো লাফিয়ে উঠে এল স্টেজে—হাতে তাদের লাঠি। একটি সেকেন্ডও নষ্ট না করে তাদের লাঠি গিয়ে পড়ল পলানের দুই চ্যালার পিঠে, তাদের তরোয়াল ধরা হাতে, হাঁটুতে, কোমরে—এবং পড়তেই থাকল।
স্টেজে সিঁটিয়ে দাঁড়ানো বয়স্করা ‘কী করছ! কী করছ! থামো! থামো!’ বলে পরিস্থিতি সামাল দিতে চাইলেন, কিন্তু অবস্থা তখন সামাল দেওয়ার জায়গায় আর ছিল না। পলানের চ্যালাদুটো হুমড়ি খেয়ে পড়েছে স্টেজের ওপরে। ওদের ওপরে লাঠির ঝড় তখনও চলছে।
ঘটনাগুলো এত আচমকা ঘটে গিয়েছিল যে, পলান চটপট রিয়্যাক্ট করতে পারেনি। ও ভুলেই গিয়েছিল যে, ওর পকেটে একটা রিভলভার রয়েছে। সেটার কথা যখন ওর মনে পড়ল তখন ও পকেটের দিকে হাত বাড়ানোর আগেই ওর যক্ষ্মাশত্রু লাফিয়ে উঠে পড়ল স্টেজের ওপরে।
রোশন স্টেজে উঠল একটু অদ্ভুতভাবে।
পাঁচ-সাত সেকেন্ড আগে চেয়ারের সারির মাঝের অলিপথ ধরে ও স্টেজ লক্ষ্য করে ছুটতে শুরু করেছিল। পেস বোলাররা বল করার আগে গতিবেগ বাড়ানোর জন্য যেরকমভাবে ছুটে যায়, অনেকটা সেইরকম।
রোশনের লক্ষ্য ছিল স্টেজের মাঝবরাবর—যেখানটায় পলান মাইক্রোফোনের স্ট্যান্ডের রডটা ধরে দাঁড়িয়েছিল। পলানের চোখ ভিড়ের মধ্যে রোশনের মুখটা খুঁজে বেড়াচ্ছিল। হঠাৎই ও দেখল, চেয়ারের সারির মাঝের অলিপথ ধরে রোশন পাগলের মতো ছুটে আসছে স্টেজের দিকে।
মাঠে তখন শৃঙ্খলা আর ততটা নেই। অনেকেই চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়েছে, সরে যাচ্ছে নিরাপদ দূরত্বে। কারণ, গোলমাল বেশ জোরালোভাবে শুরু হয়ে গেছে, শুরু হয়ে গেছে অস্ত্রের ব্যবহার।
ঠিক তখনই বৃষ্টি যে নামতে পারে সেই খবরটা জানান দিয়ে মেঘ ডেকে উঠল আকাশে।
হরিণের মতো ছুটে গিয়ে স্টেজের কিনারায় হাতের ভর দিয়ে একলাফে স্টেজে উঠে পড়ল রোশন। এবং গতি বজায় রেখেই প্রচণ্ড ভরবেগে পলানের বুকে ঢুঁ মারল মাথা দিয়ে। পলান ছিটকে গিয়ে পড়ল স্টেজের পিছনদিকের কাপড়ের দেওয়ালে। ওর মুখ থেকে একটা ‘আঁক’ শব্দ বেরিয়ে এল শুধু। কাপড় খানিকটা ছিঁড়ে গিয়ে পলানের বডি তার ভেতরে কিছুটা ঝুলে পড়ল থলের মতো।
নিতুয়ার লেঠেলরা পলানের জোড়া চ্যালার তরোয়ালদুটো সরিয়ে দিয়েছিল নিরাপদ জায়গায়—চ্যালাদের নাগালের বাইরে। এখন পলানকে পড়ে যেতে দেখেই ওরা দৌড়ে গেল পলানের কাছে। ওকে টেনে তুলল, সোজা করে দাঁড় করাল। দুজন ওর পকেট সার্চ করে মেশিনটা খুঁজে পেল। একজন সেটা টেনে বের করে নিয়ে এল পকেট থেকে। তারপর ওটা ওদের হাতে-হাতে এগিয়ে গেল জোড়া তরোয়ালের পথে।
নিতুর চারজন ‘ক্যাডার’ পলানকে চেপে ধরে রেখেছিল। আর সেই বাঁধনে বাঁধা পড়ে পলান ফুঁসছিল। ঘেন্না আর রাগ নিয়ে তাকিয়ে ছিল রোশনের দিকে। একটু আগে ঢুঁ খেয়ে ওর বুকে ব্যথা টনটন করছিল।
রোশন চট করে মাইকের কাছে চলে এল। বারবার বলতে লাগল, ‘আপনারা কেউ যাবেন না। প্লিজ। আর কোনও ভয় নেই—আর কোনও গোলমাল হবে না। আপনারা সবাই শান্ত হয়ে বসুন। প্লিজ, যাবেন না। আমার কথাগুলো শুনে যান—জেনে যান, আমি জেল-খাটা দাগি আসামি কি না…। প্লিজ, আপনারা বসুন…’
রোশন বলতে শুরু করল, ‘তখন আমার বয়েস বাইশ বছর। কলকাতায় ট্যাক্সি চালিয়ে সামান্য কিছু রোজগার করি। সেই রোজগারে আমি আর আমার বিধবা মা কোনওরকমে দিন চালাই—।’
এমন সময় ভিড়ের কিনারা থেকে একটা লোক হাত তুলে চিৎকার করে উঠল, ‘রোশন! রোশন! চুপ করো—আমি যাচ্ছি—আমি সবাইকে জানাচ্ছি সব কথা—।’
দুনুদা। দীনেশ সামন্ত।
দীনেশের কালো মুখ ঘামে ভেজা। চোখে উৎকণ্ঠা। ভিড়ের মধ্যে থেকে গলা লম্বা করে রোশনের দিকে তাকিয়ে আছে। দীনেশ খেয়াল করেনি, অন্যান্য বহু মানুষ কৌতূহলে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।
দীনেশ সামন্ত ভিড় ঠেলে এগোতে লাগল স্টেজের দিকে। ওর মুখটা আশাপুরে অচেনা। তাই অনেকেই নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগল, ‘লোকটা কে? একে তো আশাপুরে আগে দেখিনি!’
স্টেজের ডানদিকের সিঁড়ির কাছে এগিয়ে গেল দীনেশ। তক্তা ঠুকে তৈরি তিনটে সিঁড়ির ধাপ। সিঁড়ি পেরিয়ে স্টেজ। তারপর রোশনের পাশে। মাইকের সামনে।
সুরেন দাসের মোবাইলে খবর চলে গিয়েছিল বেশ কিছুক্ষণ আগেই। কিন্তু তিনি থানা থেকে বেরোননি। তিনি খবর পেয়েছিলেন যে, প্রাইমারি স্কুলের মাঠে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানকে ঘিরে লোকজন বেশ ভালোই জড়ো হয়েছে। এবং দাঁড়িপাল্লা ঝুঁকে পড়েছে পলানের উলটোদিকে। সুতরাং জায়গাটাকে এখন এড়িয়ে চলাই ভালো। একটা হেস্তনেস্ত আগে হয়ে যাক—তারপর সুরেন দাস ঠিক করবেন যে, কোনদিকে যোগ দেবেন। তবে ওঁর মোবাইল ফোনে ঘন-ঘন ফোন আসছিল—যদিও সুরেন একটা ফোনও রিসিভ করছিলেন না।
রোশনের কাঁধে স্নেহের হাত রেখে দীনেশ সামন্ত মাইকে বলতে শুরু করল, ‘পলানবাবু রোশনের নামে এতক্ষণ যা-যা বলেছেন সেগুলো মোটেই সত্যি নয়। রোশনকে জেল খাটতে হয়েছিল, কারণ, ও একটা অচেনা ছেলের জান বাঁচিয়েছিল। আমি ওর সব ঘটনা জানি—কারণ, আমি ওর সঙ্গে জেলে ছিলাম…।’
দীনেশ সামন্ত বলেই চলল, বলেই চলল। মনে হচ্ছিল, ওর ওপরে কিছু একটা ভর করেছে। মঞ্চ আর মাঠে হাজির লোকজন দীনেশের কথা শুনতে লাগল, আর মাঝে-মাঝেই হইহই করে উঠতে লাগল।
পলান নিতুর ভলান্টিয়ারদের সঙ্গে যুঝছিল, নিজেকে ছাড়ানোর জন্য হাত-পা মোচড়াচ্ছিল। বলতে গেলে পলান ওদের সঙ্গে ধস্তাধস্তিই করছিল, কিন্তু নিজেকে ছাড়াতে পারছিল না। তাই ওর মুখ চলছিল। আকথা-কুকথার জঘন্য স্রোত বেরিয়ে আসছিল ওর মুখ থেকে।
স্টেজে দাঁড়ানো সিনিয়ার মানুষরা আশঙ্কায় কাঁপছিলেন। স্টেজে থাকবেন, না কি স্টেজ থেকে নেমে যাবেন, সেটা বুঝে উঠতে পারছিলেন না।
রোশন মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে ছিল। দীনেশ সামন্তর কথা শুনতে-শুনতে ওর চোখ ভিজে আসছিল। ওর মনে হচ্ছিল, দুনুদা ওর ভালোটাকে বেশ কয়েকগুণ বাড়িয়ে-টারিয়ে বলছে। সত্যিই কি ও বেশ কিছু ভালো কাজ করেছে, মানুষের কাজে লেগেছে? ওর জীবনটা তা হলে পৃথিবীর বুকের ওপরে অর্থহীন ফালতু বোঝা নয়?
হাতের পিঠ দিয়ে চোখের জল মুছল। ঠিক তখনই পিঠের ওপরে দুনুদা ছাড়াও আরও কয়েকটা হাতের ছোঁয়া পেল। সেই ছোঁয়াগুলোয় বাবার আন্তরিক মমতা মাখানো।
পিছন ফিরে তাকাল রোশন।
চারজন বয়স্ক মানুষ দু-পাশ থেকে ওর কাছে এগিয়ে এসেছেন।
হাত রেখেছেন ওর পিঠে।
শিরা ওঠা, চামড়ায় ভাঁজ পড়া হাত। সেই হাতগুলোর কোনও-কোনও আঙুলে রঙিন আংটি। নখের রং হলদেটে। অথচ এই পুরোনো হাতগুলো থেকে স্নেহ, ভালোবাসা আর আশীর্বাদ অলৌকিক স্রোতে ভেসে চুঁইয়ে-চুঁইয়ে ঢুকে পড়েছিল রোশনের দুঃখ-ভেজা অপমানিত শরীরে। রোশনের পিছন থেকে সেই হাতগুলোর চারজন মালিক যেন একসঙ্গে কোরাসে বলে উঠলেন, ‘রোশন, আমরা তোমাকে ভালোবাসি। আশাপুর তোমাকে ভালোবাসে…।’
রোশন একরাশ আবেগ নিয়ে ঘুরে দাঁড়াল। সঙ্গে-সঙ্গে একজন বৃদ্ধ ওকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।
জনগণের হইহই চিৎকার কয়েক পরদা চড়ে গেল।
‘রোশন! রোশন!’ বলে চেঁচিয়ে উঠল কমবয়েসি ছেলের দল।
প্রথম আলিঙ্গন থেকে মুক্ত হতে-না-হতেই সুধীরডাক্তারবাবু রোশনকে বুকে টেনে নিলেন। ওঁর চোখে জল। ধরা গলায় বললেন, ‘তুই আমাদের ছেলে। আশাপুর তোকে ভালোবাসে।’
মাইকে কথাগুলো শোনা যাচ্ছিল। রোশনের বুকের ভেতরে একটা চাপা আবেগ অন্তঃসলিলা নদীর ঢেউয়ের মতো ওর হৃদয়ের একূল-ওকূল দু-কূল ভাসিয়ে দিচ্ছিল।
দীনেশ সামন্ত আপনমনে এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়ছিল আর বলছিল, ‘না, না—মিথ্যে কথা বলতে পারব না—।’
বিশ্বরূপ জোয়ারদার একটু দেরি করে মাঠে এসে হাজির হয়েছিলেন। একটা চেয়ার জোগাড় করে বসে-বসে দেখছিলেন স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান। দেখতে-দেখতে ওঁর মনে হচ্ছিল, আশাপুরে রোশনের মতো একটা টগবগে তাজা ছেলে ভীষণ দরকার।
অবনীমাস্টারমশাই খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে মাইকের কাছে এগিয়ে এলেন। পলানের চড় আর লাথি ওর সারা শরীরে অসহ্য ব্যথা ধরিয়ে দিয়েছিল। কোনওরকমে তিনি বললেন, ‘আমাদের অনুষ্ঠান আবার শুরু হচ্ছে—’ পলানের দিকে আঙুল দেখিয়ে আরও বললেন, ‘পলান নস্করের মতো এই নোংরা জানোয়ারটার জন্য আমাদের অনুষ্ঠানের মাঝে এরকম বিঘ্ন ঘটে গেল…।’
কথাটা শুনে ভয়ংকর জ্বালায় জ্বলে উঠল পলান। ভলান্টিয়ারদের হাতে প্রচণ্ড এক হ্যাঁচকা টান দিয়ে পশুর মতো গর্জে উঠল। ভলান্টিয়াররা ওর শক্তির সঙ্গে আর এঁটে উঠতে পারছিল না। পলানের এক-এক টানে ওরা বারবার এদিক থেকে ওদিকে টলে যাচ্ছিল।
নিতুয়া কখন যেন ভিড় ঠেলে স্টেজের কাছে চলে এসেছিল। ও পলানকে জোরে ধমকে উঠল। একইসঙ্গে স্টেজের সিঁড়ি বেয়ে উঠে পড়ল ওপরে। উত্তেজিত হয়ে ছুটে গেল পলানের কাছে। ওর গালে সপাটে এক থাপ্পড় কষিয়ে দিল।
তার পরের ঘটনাটা মুহূর্তের মধ্যে ঘটে গেল।
বন্দি পলান কেউটের ছোবলের মতো নিমেষে গলা বাড়িয়ে খ্যাঁক করে নিতুয়ার টুটি কামড়ে ধরল।
***
টিভিতে দেখা ছবি চোখের সামনে ভাসছিল।
খোলা মাঠের ওপর দিয়ে জেব্রার দল ছুটে চলেছে। ওদের ছুটন্ত শরীর যেন অসংখ্য কালো বিদ্যুতের রেখা। দলের মধ্যে একটি জেব্রাকে বেছে নিয়ে ধাওয়া করেছে একটি ক্ষিপ্র চিতা। লম্বা-লম্বা লাফে শিকারের সঙ্গে নিজের দূরত্ব ক্রমশই কমিয়ে ফেলছে। দূরত্ব কমতে-কমতে শেষে ছুটন্ত চিতা জেব্রাটির প্রায় পাশাপাশি। তারপর নিখুঁত একটি লাফ। জেব্রার গলা কামড়ে ধরেছে চিতা। পায়ের নখ বিঁধিয়ে দিয়েছে জেব্রার শরীরে। চিতাকে বয়ে নিয়ে জেব্রা তখনও ছুটে চলেছে। তার গতি ক্রমশ কমে আসছে। চিতার কামড়ের পাশ দিয়ে রক্ত চুঁইয়ে বেরিয়ে আসছে গলা থেকে।
একটামাত্র মুহূর্ত, কিন্তু তার মধ্যেই স্লো মোশনে ওপরের দৃশ্যটা দেখছিল পলান। হিংস্র চিতার মতো নিতুয়ার টুটি কামড়ে ধরেছে ও। প্রথমে ঘামের গন্ধ পেয়েছে পলান। তারপর জিভে নোনতা স্বাদ। আর সবশেষে রক্তের গন্ধ—রক্তের আঁশটে গন্ধ।
নিতুয়া, একটা থার্ড ক্লাস উঠাইগিরা, আশাপুরের নর্দমার পোকা! ওর এত বড় সাহস যে, পলানের গায়ে হাত তোলে! আগে পলানকে দেখলেই যে-শুয়োরের বাচ্চাটার হাতে-পায়ে কাঁপুনি ধরত, তার এত বড় আস্পর্ধা!
রোশন হারামিটার জন্যই এই দুঃসাহস হয়েছে নিতুয়ার। শুধু নিতুয়া কেন, রোশন আশাপুরে আসার পর থেকে আরও অনেকেরই সাহস গজিয়েছে ধীরে-ধীরে।
পলান জিভে রক্তের স্বাদ পাচ্ছিল। বহু বছর পর এই স্বাদ আবার পেল ও। ছোটবেলায় একবার একটা বড় ক্যাডবেরি চকোলেট বায়না করে ভীষণ জেদ করছিল পলান। বাবা কিংবা মা, কারও কথাতেই শান্ত হচ্ছিল না ও। শেষমেশ পিসি এগিয়ে আসে ওকে শান্ত করার জন্য। তখন তুমুল খেপে গিয়ে ও পিসির হাতে কামড়ে দিয়েছিল। এত জোরে কামড়েছিল যে, চামড়া, মাংস ইত্যাদি ফুটো হয়ে পলানের দাঁত চলে গিয়েছিল অনেক গভীরে। পলান তখন রক্তের স্বাদ পেয়েছিল। এখন, এত বছর পরে, সেই স্বাদটা আবার ফিরে এল যেন।
পলানের এই কাণ্ড দেখে সবাই স্তম্ভিত হয়ে গেল। ও যে জানোয়ার সেটা সবাই জানলেও ও যে এতটা জানোয়ার সেটা বোধহয় কেউ কল্পনাও করেনি। অনেকেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। আতঙ্কের চিৎকারও করছে কেউ-কেউ।
নিতুয়া কিন্তু চিৎকার করতে পারছিল না। অসহ্য ব্যথা আর যন্ত্রণা ভালোমতন টের পাচ্ছিল ও। তবে সেগুলোকে ছাপিয়ে গিয়েছিল ওর শ্বাসকষ্ট। পলান ওর টুটি কামড়ে ধরায় নিতুয়ার শ্বাসনালী সাঁড়াশির চাপে পড়ে গিয়েছিল। ওর মনে হচ্ছিল, যেন এখুনি দম বন্ধ হয়ে মারা যাবে। ওর চোখের সামনে অন্ধকার নেমে আসছিল, দু-কানে শোঁ-শোঁ শব্দ শুনতে পাচ্ছিল। ও দু-হাতে পলানকে ঠেলে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিল কিন্তু পেরে উঠছিল না।
রোশনের ভলান্টিয়াররাও কিছুতেই পলানকে কবজা করতে পারছিল না। পলানের গায়ে যেন বুনো মোষের শক্তি। ধস্তাধস্তি করতে-করতে পলানের ঘামে ভেজা বাঁ-হাতটা হঠাৎই ভলান্টিয়ারদের বাঁধন থেকে স্লিপ কেটে ছিটকে গেল। তখন পলান নিতুর ডানহাত খামচে ধরে শিকারকে আরও কাছে টেনে নিল।
পরিস্থিতি যে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে সেটা বুঝতে পারল রোশন। ও এটাও বুঝতে পারল, পলানকে কথা বলে বোঝানোর চেষ্টা করে আর লাভ নেই। জানোয়ার জানোয়ারের ভাষা বোঝে—সে মানুষের ভাষা বোঝে না।
অদ্ভুত ক্ষিপ্রতায় পলানের ঠিক পিছনে চলে এল রোশন। একপলক দেখল ওর নিতুদার দিকে। ওর চোখ বুজে এসেছে, মুখের মাংসপেশি ঢিলে হয়ে ঝুলে পড়েছে। এখুনি হয়তো দম বন্ধ হয়ে যাবে।
রোশনের ডানহাত পিছন থেকে ছোবল মারল পলানের নাকে। আর বাঁ-হাতে মুঠো করে ধরল পলানের চুল। রোশনের হাতের বজ্রটানে পলানের মাথা হেলে গেল পিছনে। কিন্তু নিতুয়ার গলা থেকে পলানের দাঁত একচুলও ঢিলে হল না। ফলে নিতুয়ার মাথাটা ঝুঁকে এল রোশনের দিকে। নিতুয়ার যন্ত্রণা আর কষ্ট বেড়ে গেল বেশ কয়েক গুণ। ওর মনে হচ্ছিল, এই বুঝি ওর দম আটকে গেল, এই বুঝি চির-অন্ধকার নেমে এল চোখে।
ঠিক সেই মুহূর্তে রোশনের তর্জনী আর মধ্যমা ঢুকে গেল পলানের নাকের ফুটোয়। এবং রোশন প্রাণপণে সেই দুটো আঙুল টানতে লাগল পলানের কপালের দিকে।
প্রথমত, নাকের ফুটো দুটো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পলান শ্বাস নিতে পারছিল না। ফলে ওকে মুখ খুলতে হল শ্বাস নেওয়ার জন্য। তখনই ওর দাঁতের পাটি নিতুর গলার মাংস ছেড়ে দিল। পলানের ঠোঁট আর দাঁত তখন লালে লাল।
পলান কামড় ছেড়ে দেওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে নিতুয়ার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল এক মর্মান্তিক আর্তচিৎকার—যে-চিৎকারটা এতক্ষণ ওর গলায় বন্দি হয়ে ছিল। তারপর চিৎকারটা চলতেই লাগল।
নিতুয়ার টুটির কাছটা রক্তে লালে লাল। ভালো করে ঠাহর করলে দেখা যাচ্ছে গভীর দাঁতের দাগ। পলানের ধারালো দাঁতের কয়েকটা নিতুর চামড়া-মাংস ভেদ করে ঢুকে গেছে ভেতরে। দুজন ভলান্টিয়ার ছুটে এসে নিতুয়াকে জাপটে ধরল।
রোশনের আক্রমণের দ্বিতীয় অ্যাডভানটেজ ছিল, শত্রুর শরীরে সবচেয়ে নাজুক অংশে ও ওর কবজা পত্তন করেছে। নাকের ফুটোয় দু-আঙুল ঢুকিয়ে কপালের দিকে টেনে এনে শত্রুকে নিজের নোকর বানিয়ে ছেড়েছে রোশন।
নাকের মাংসে অসহ্য যন্ত্রণা কমাতে পলান চিত হয়ে হেলে পড়েছিল রোশনের গায়ে। একইসঙ্গে দু-হাতে খামচে ধরেছিল রোশনের ডানহাত। যন্ত্রণার গোঙানি বেরিয়ে আসছিল ওর মুখ থেকে।
না, আর কোনও ক্ষমা নেই। এ-লড়াই জঙ্গলে দুই হিংস্র পশুর লড়াই। রোশনকে পশু অবতার হয়ে এই লড়াইয়ের হেস্তনেস্ত করতে হবে।
একসেকেন্ডও দেরি করল না রোশন। পলকে সামনে গলা বাড়িয়ে দিল ও। পলানের বাঁ-হাতের কবজির নাগাল পেয়েও গেল। আর তারপরই সেই কবজিতে বসিয়ে দিল ভয়ংকর এক কামড়। ওর দাঁতগুলো যেন নিমেষে বদলে গেল হায়নার দাঁতে।
চোখের বদলে চোখ, দাঁতের বদলে দাঁত, কামড়ের বদলে কামড়।
পলান ডাক ছেড়ে চিৎকার করে উঠল। ওর মুখ হাঁ হল। সঙ্গে-সঙ্গে এক হ্যাঁচকায় ওর নাকের ফুটোয় আঙুলের টান দশ কি বিশ নিউটন বেড়ে গেল। নাকের মাংস খানিকটা ছিঁড়ে উঠে এল ওপরদিকে।
ওই অবস্থাতেই পলানের বডিটাকে টান মেরে স্টেজের ওপরে পেড়ে ফেলল রোশন। পলানের তখন হাওয়া বেরিয়ে গেছে।
ওর চিত হয়ে পড়ে থাকা শরীরের দিকে তাকিয়ে হাঁপাতে-হাঁপাতে রোশন বলল, ‘পলানদা, তোমার কালো রঙের খেলা সব শেষ। এবার সাদা রঙের খেলা শুরু। দ্যাখো, তোমার এখন কী হাল করি!’
স্টেজের ওপরে ভিড় জমে গিয়েছিল। আহত নিতুয়াকে নিয়ে চার-পাঁচজন ছেলেপিলে তড়িঘড়ি করে রওনা হল হেলথ সেন্টারের দিকে।
মাঠে দর্শকদের অবস্থা প্রায় ছত্রখান বলাটাই ভালো। তবে বহু মানুষ পলান আর রোশনের মোকাবিলা দেখার জন্য আগ্রহ আর কৌতূহল নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তাদের সকলেই মনে-মনে চাইছিল এই দ্বন্দ্বযুদ্ধে রোশন জিতুক। কারণ, ওদের কাছে পলান একরকম অসহ্য হয়ে উঠেছে।
মঞ্চে দাঁড়ানো সিনিয়াররা বারবার রোশনের নাম ধরে ডাকছিলেন। রোশন পলকের জন্য ফিরে তাকাল ওঁদের দিকে। বড়-বড় শ্বাস টানতে-টানতে বলল, ‘ডাক্তারবাবু, মাস্টারমশাই—আর দু-পাঁচ মিনিট—তারপরই আমাদের প্রোগ্রাম আবার শুরু হবে…।’
দু-চারজন ছেলেকে কাছে ডাকল রোশন। রোশনের ইশারায় সাড়া দিয়ে চার-পাঁচজন ছেলে চটপট ওর কাছে এগিয়ে এল।
রোশন পলানের দিকে তাকাল। ওর মুখ রক্তে মাখামাখি। যন্ত্রণায় গোঙাচ্ছে। নাকের মাংস ছিঁড়ে গেছে। দু-চোখে ভয় নিয়ে তাকিয়ে আছে রোশনের মুখের দিকে। ওর বাঁ-হাতের কবজি থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। একইসঙ্গে পলানকে বীভৎস এবং করুণ দেখাচ্ছে। ওর ঠোঁট আর গালের পেশি তিরতির করে কাঁপছে।
ছেলেগুলো রোশনের কাছে এসে পলানের দিকে একবার ঘেন্নার চোখে তাকাল, তারপর রোশনকে জিগ্যেস করল, ‘একে কি ট্রিটমেন্টের জন্যে কোথাও নিয়ে যাব?’
পলানের দিকে তাকিয়ে চোখ রেখে রোশন ঠান্ডা গলায় বলল, ‘কোথায় আর নিয়ে যাবে? আমাদের এখানে তো আর জানোয়ারদের হাসপাতাল নেই। ওর ট্রিটমেন্ট এখানেই হবে—।’
কয়েকসেকেন্ড চুপ করে থেকে রোশন আবার বলল, ‘একে তুলে নিয়ে যাও। স্টেজের সামনে দাঁড় করিয়ে পিছমোড়া করে দড়ি দিয়ে কষে বেঁধে দাও। দেখবে, ওর বডিটা যেন একদম খাড়া হয়ে থাকে—যাতে যে-কেউ এসে ওকে সহজে চড়-থাপ্পড় মারতে পারে।’ হাত দিয়ে মুখ মুছল রোশন। টের পেল, গলা শুকিয়ে গেছে, খুব জলতেষ্টা পাচ্ছে।
ছেলেগুলো যখন পলানকে বাগিয়ে ধরে চাগিয়ে তুলছে তখন রোশন বলল, ‘যদি কোনওরকম নক্কাছক্কা করে তা হলে ধরে বেধড়ক ক্যালাবে। একেবারে ফ্রি স্টাইলে ক্যালাবে। কোথায় রক্ত বেরোল কি হাড় ভাঙল সেসব নিয়ে ভাববে না। তোমরা বরং দু-একটা আধলা ইট হাতে নিয়ে নাও—।’
পাঁচজন ছেলে পলানকে নিয়ে চলে গেল।
ওরা স্টেজ থেকে নেমে যেতেই রোশন দুজন ভলান্টিয়ারকে কাছে ডাকল। বলল, স্টেজটাকে একটু ঠিকঠাক করে গুছিয়ে দিতে। কারণ, একটু আগের হাতাহাতি আর ধস্তাধস্তিতে দুটো চেয়ার উলটে পড়ে গেছে। খাটো টেবিলে চারটে ছোট-ছোট জলের বোতল দাঁড় করানো ছিল, তার মধ্যে দুটো কাত হয়ে গড়িয়ে পড়েছে স্টেজের সাদা চাদরের ওপরে।
ডাক্তারবাবু, মাস্টারমশাই ও আরও চারজন সিনিয়ার এগিয়ে এলেন রোশনের কাছে।
একজন রোশনকে জিগ্যেস করলেন, ‘এখন কী করব আমরা? মাঠের তো এই অবস্থা!’
রোশন মাঠের দিকে তাকাল।
দর্শকরা অনেকেই চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়েছে। এখানে-সেখানে ভিড় জমিয়ে জটলা করছে। ছোটদের কেউ-কেউ এখনও বসে আছে পলিথিনের ওপরে—বাকিরা এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে।
ফাংশান শেষ হয়ে যাওয়ার পর মাঠের যেরকম বিশৃঙ্খল অবস্থা হয় মোটের ওপর স্কুল-মাঠের চেহারাটা অনেকটা সেইরকম।
রোশনের খুব তেষ্টা পাচ্ছিল। ও অবনী মাস্টারমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে অনুমতি চাওয়ার ঢঙে বলল, ‘মাস্টারমশাই, খুব তেষ্টা পাচ্ছে। এই বোতল থেকে একটু জল খাব?’ টেবিলে রাখা জলের বোতলের দিকে দেখাল রোশন।
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ—খাও…খাও…।’ তড়িঘড়ি বলে উঠলেন মাস্টারমশাই।
রোশন একটা বোতল তুলে নিয়ে ঢকঢক করে জল খেল। তারপর হাত দিয়ে মুখ মুছে নিয়ে মাইকের সামনে গিয়ে দাড়াল আবার।
‘আপনারা সবাই যার-যার জায়গায় বসে পড়ুন। আমাদের ফাংশান সত্যি-সত্যি আবার শুরু হচ্ছে। প্লিজ, যার-যার জায়গায় বসে পড়ুন….প্লিজ, বসে পড়ুন…।’
দর্শকরা মুখ ফিরিয়ে রোশনের দিকে তাকাল। এত কাণ্ডের পর ফাংশান আবার শুরু হবে!
ওদের অনেকেই স্টেজের কাছে এসে ভিড় করে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। পলান নস্করকে পাঁচ-সাতজন ছেলে-ছোকরা স্টেজের সঙ্গে যে পিছমোড়া করে বাঁধছিল সেটা ওরা সবাই মনোযোগ দিয়ে দেখছিল। ওরা অবাক হয়ে ভাবছিল, এরকমটাও তা হলে করা যায়! যে-পলান নস্কর এলাকার ত্রাস, যার মুখোমুখি হলেই অনেকের হাত-পা কাঁপত, তাকে সাধারণ ছেলের দল পিছমোড়া করে বাঁধছে!
অনেকেই মোবাইল ফোন বের করে পটাপট ছবি তুলতে লাগল।
পলানের নাকে-মুখে রক্তের ধারা। কী বীভৎস দেখাচ্ছে ওকে! সেই অবস্থাতেই নোংরা ছেলেটা নোংরা গালিগালাজ করে চলেছে।
রোশন স্টেজের ওপরে দাঁড়িয়ে পলানকে স্টেজের সঙ্গে বাঁধার ব্যাপারটা মনোযোগ দিয়ে দেখছিল। পলানের শরীর দুর্বল হয়ে এসেছিল, কিন্তু তা সত্ত্বেও ও মাঝে-মাঝে ফুঁসে উঠছিল, বাধা দেওয়ার চেষ্টা করছিল।
রোশন চেঁচিয়ে বলল, ‘ঝামেলা করলেই ওকে কেলিয়ে দাও—কিল, চড়, লাথি, ঘুসি যা পারো…।’
রোশনের কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে দু-খানা থাপ্পড় সপাটে এসে আছড়ে পড়ল পলান নস্করের দু-গালে। ক্যাপ ফাটার মতো শব্দ হল। পলানের মাথাটা একবার ডানদিকে একবার বাঁ-দিকে ছিটকে গেল। ছেলেদের মধ্যে দুজন হাত চালিয়ে দিয়েছে।
রোশন মাঠের মধ্যে পলানের চ্যালাদের খুঁজছিল। কোথায় গেল ওরা? নোনতা, কাটা নগেন, সুবু, কানুয়া ওরা সব গেল কোথায়? ওদের হিরো বেধড়ক মার খাচ্ছে অথচ তাকে বাঁচাতে ওরা অস্ত্র নিয়ে ছুটে আসছে না!
মাঠের এখানে-সেখানে নজর চালিয়ে রোশনের চোখ পলানের চ্যালাচামুণ্ডাদের কাউকে খুঁজে পেল না। পাবলিকের ধোলাইয়ের ভয়ে নিশ্চয়ই ওরা সব পালিয়েছে।
পলানকে স্টেজের সঙ্গে বাঁধার কাজ হয়ে গিয়েছিল। ওর পেটানো শরীরটা অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওর দু-হাতের কবজি দড়ি দিয়ে বাঁধা। দু-পায়ের গোড়ালিকে ঘিরে নিষ্ঠুর দড়ির প্যাঁচ। এ ছাড়া পেটে, বুকে, গলায় শক্ত দড়ি ওকে সাপের মতো সাপটে ধরেছে।
পলানকে কাছ থেকে দেখার জন্য মাঠের পাবলিক ওকে ঘিরে জড়ো হয়েছে। সেই আগ্রহী ভিড়ে বাচ্চা, বুড়ো, পুরুষ, মহিলা কেউ বাদ নেই।
কয়েকজন সিনিয়ার রোশনের কাছে এগিয়ে এলেন। তার মধ্যে সুধীর ডাক্তারবাবুও ছিলেন।
ডাক্তারবাবু রোশনকে জিগ্যেস করলেন, ‘এখন কি প্রোগ্রাম আবার স্টার্ট হবে?’
রোশন সায় দিয়ে মাথা নেড়ে বলল, ‘হ্যাঁ। আমি মাইকে একটু বলে দিই—। আপনারা আমার পাশে থাকুন…।’
আবার মাইকের কাছে এল রোশন। ওর দুপাশে ডাক্তারবাবুরা কয়েকজন দাঁড়ালেন।
‘আপনারা যার-যার জায়গায় বসে পড়ুন। আমাদের প্রোগ্রাম আবার শুরু হচ্ছে। আমাদের প্রোগ্রামের প্রধান আকর্ষণ পলান নস্কর…।’
এই কথায় সুধীর ডাক্তারবাবুরা চমকে উঠলেন।
প্রোগ্রামের প্রধান আকর্ষণ পলান নস্কর!
‘হ্যাঁ, পলান নস্কর। কারণ, আজ পলান নস্করের ওপর গোটা আশাপুরের প্রতিশোধের পালা। বছরের পর বছর ধরে পলান নামের এই মাফিয়া জানোয়ারটা আশাপুরের ওপরে টরচার করে চলেছে। আশাপুরের মানুষ মুখ বুজে সেই অত্যাচার সহ্য করে এসেছে। কিন্তু আর নয়—এবার প্রতিশোধের পালা। আজ থেকে দান ঘুরে গেছে। আশাপুরের মানুষ আজ দেখিয়ে দেবে তারা কিছু কম নয়। আশাপুরের মানুষ পলান নস্করের ওপরে আজ এমন বিচিত্র প্রতিশোধ নেবে যে, সেই প্রতিশোধ পলান নস্কর চিরকাল মনে রাখবে।
‘এবার মন দিয়ে শুনুন!’ রোশন ওর মুখটাকে মাইকের আরও কাছে নিয়ে এল। মাইকের স্ট্যান্ডটাকে আঁকড়ে ধরে বলে চলল, ‘পলান নস্করকে আপনাদের সামনে আমরা আজ পেশ করেছি। হাত-পা বাঁধা অবস্থায় গুন্ডাটা আপনাদের সামনে দাঁড়িয়ে। যেসব মানুষের পলানের ওপরে রাগ আছে, ক্ষোভ আছে, তাঁরা সবাই এগিয়ে আসুন পলানের দিকে—ওর গায়ে থুতু দিন, লাথি-চড়-ঘুসি যা খুশি বসিয়ে দিন ওই জানোয়ারটার শরীরে। পুরোনো সব দিনগুলোর কথা মনে করুন, তারপর নির্ভয়ে এগিয়ে আসুন আপনার রাগ নিয়ে। আপনার রাগ আর ঘেন্না উগরে দিন পলান নস্করের ওপরে।
‘এটাই আমাদের প্রোগ্রামের আজ মেন অ্যাট্রাকশন। থুতু, লাথি, চড়, কিল, ঘুসি—যার যা খুশি—।’
রোশন বেশ কয়েকবার শেষ লাইনটা রিপিট করল। রিপিট করার সময় লাইনটাতে একটা ছন্দের আভাস পাওয়া যাচ্ছিল।
মাঠের জনগণের মধ্যে থেকে হইহই আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল।
হঠাৎই দুটো হাওয়াই চটি উড়ে এল পলানকে লক্ষ্য করে। তারপরই কিছু খুচরো গালিগালাজ ভেসে এল বাতাসে।
রোশন ডাক্তারবাবুকে বলল, ‘এবার আমাদের প্রোগ্রাম স্টার্ট করুন, ডাক্তারবাবু—।’
‘এরকম অবস্থায় প্রোগ্রাম শুরু করা যায়?’ সুধীরডাক্তার খানিকটা যেন অসহায়ভাবেই রোশনের দিকে তাকালেন।
রোশন বলল, ‘প্লিজ, প্রোগ্রাম শুরু করুন, ডাক্তারবাবু। কারণ, পুলিশ যদি এসে ঝামেলা করে তা হলে আমরা বলতে পারব পলান নস্কর আমাদের প্রোগ্রামে গণ্ডগোল করছিল বলে আমরা ওকে এভাবে বেঁধে রেখেছি।’ অবনী মাস্টারমশাইয়ের দিকে তাকাল রোশন : ‘প্লিজ, মাস্টারমশাই, প্রোগ্রাম শুরু করুন শিগগির!’
সঙ্গে-সঙ্গে মাস্টারমশাই মাইকের সামনে এসে বক্তৃতা শুরু করে দিলেন। দেখতে-দেখতে অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেল। কয়েকজনের বক্তৃতা আর গানের পরই ‘বন্দে মাতরম’ আর ‘জয় হিন্দ’ জিগির তুলে জাতীয় পতাকা তোলা হল। মাইকে বাজতে লাগল জাতীয় সঙ্গীত।
ঠিক সেই সময়ে দুটো ছেলে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব মেশানো পায়ে এগিয়ে এল পলান নস্করের কাছে। তারপর ‘থু—থু—’ করে ওর মুখে থুতু ছুড়ে দিল।
উত্তরে পলান নোংরা গালাগাল দিলেও ছেলে দুজন সেটা গায়ে মাখল না। বরং আবার থুতু দিল পলানের মুখে।
এই ছেলে দুজনের দুটো ছোট-ছোট দোকান আছে আশাপুরে। একজনের জামাকাপড় ইস্তিরির দোকান, আর-একজনের তেলেভাজার দোকান। পলান এই দুজনের কাছ থেকেই নিয়মিত তোলা তুলত।
ব্যস, জনতার দ্বিধা আর সংকোচ কেটে গেল। অনেকেই এবার সাহস করে এগিয়ে আসতে লাগল পলান নস্করের কাছে। তারপর পালা করে শুরু হয়ে গেল থুতু, লাথি, চড়, কিল, ঘুসি—যার যা খুশি।
তখন মাইকে ঘোষণা করা হচ্ছে : ‘ছোটরা, মন দিয়ে শোনো। এবার তোমাদের জন্যে বিলি করা হচ্ছে লজেন্স, বিস্কুট আর ছোট-ছোট ফ্ল্যাগ। হুড়োহুড়ি না করে তোমরা শান্তভাবে লজেন্স, বিস্কুট আর পতাকা নাও। লজেন্স, বিস্কুট তোমরা খাবে, আর পতাকাটা হাতে নিয়ে নানা জায়গায় ছুটোছুটি করে বেড়াবে। আজ স্বাধীনতা দিবস। মনে রাখবে, আমরা সবাই স্বাধীন ভারতের স্বাধীন নাগরিক। নাও, হুড়োহুড়ি না করে তোমরা সবাই লজেন্স, বিস্কুট আর পতাকা নাও…।’
এরপর লজেন্স, বিস্কুট আর পতাকা বিলি করা শুরু হল। ছোট-ছোট ছেলেমেয়েরা ছোট-ছোট হাত বাড়িয়ে সেগুলো নিতে লাগল।
মাইকে তখন দেশাত্মবোধের নানান গান বাজছে। আর উৎসাহী জনগণ পলানের কাছে এসে তাদের পুরোনো অপমান সুদে-আসলে ফেরত দিচ্ছে।
সবমিলিয়ে এক অদ্ভুত দৃশ্য।
এই অদ্ভুত অনুষ্ঠানের কথা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল আশাপুরের আনাচেকানাচে। যেভাবে রক্ত পৌঁছে যায় শিরায়-শিরায়, ঠিক সেইভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল খবরটা। তাই দলে-দলে মানুষ হেঁটে আসছিল স্কুল-মাঠের দিকে।
হঠাৎই দেখা গেল একজন রোগা মানুষকে। দুটো ছেলের শরীরে ভর দিয়ে সে হেঁটে আসছে।
মানুষটার ডানহাতে ব্যান্ডেজ। গুলির ক্ষত এখনও পুরোপুরি সেরে ওঠেনি।
কিশোরীমোহন সামন্ত।
পলানের হেনস্থার খবর পেয়ে একরকম জেদ করেই অসুস্থ শরীরে চলে এসেছেন স্কুল-মাঠে।
কিশোরীমোহন আগের চেয়ে আরও অনেক রোগা হয়ে গেছেন। বলতে গেলে প্রায় কঙ্কালসার চেহারা এখন। মুখ ভরতি কাঁচাপাকা দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল। তবে চোখ দুটো এখনও উজ্জ্বল ভেদী দৃষ্টি ছুড়ে দিচ্ছে। মনে হয়, দুটো বর্শার ফলা যেন তাকিয়ে আছে।
কিশোরী ওঁর সঙ্গী ছেলে দুটোকে কিছু একটা বলছিলেন। ওঁকে বেশ উত্তেজিত দেখাচ্ছিল।
ওরা তিনজনে ধীরে-ধীরে এগিয়ে এল পলানের কাছে।
পলানের দড়ি বাঁধা বিধ্বস্ত চেহারাটা ভালো করে দেখলেন কিশোরী। চোখের দৃষ্টি বুলিয়ে নিলেন বন্দি জানোয়ারটার মাথা থেকে পা, পা থেকে মাথা পর্যন্ত। তারপর একগাল হাসলেন।
‘কী পলান, কেমন আছ? বোম-টোম আর তৈরি করছ না?’ কিশোরীমোহন মুখে হাসি নিয়ে জিগ্যেস করলেন। ওঁর গলার স্বর বেশ দুর্বল। বোঝা যায় পলানের গুলি আর চিকিৎসার ধকলে মানুষটার জীবনীশক্তি অনেকটাই ক্ষয়ে গেছে।
কিশোরীমোহনকে ঘিরে মানুষজনের ভিড় জমে গিয়েছিল। অনেকেই জানে যে, পলান কিশোরীমোহনের হাতের পাতায় গুলি করেছিল। এই দুর্ঘটনার আগে থেকেই ওরা কিশোরীকে চিনত। কিন্তু ওই ঘটনার পর আশাপুরের আরও অনেক মানুষ ওঁকে চিনে গেছে।
স্টেজের এক কোণে দাঁড়িয়ে রোশন কিশোরীমোহনকে দেখছিল। অসহায় পলানকেও দেখছিল। এলোমেলোভাবে ভিড় করে থাকা লোকজনকে দেখছিল। তাদের হইচই, খুশি, উত্তেজনা সবকিছুই রোশনকে ছুঁয়ে যাচ্ছিল। মাইকে গান বাজছে : ‘ও আমার দেশের মাটি, তোমার পায়ে ঠেকাই মাথা…।’
ডাক্তারবাবু, মাস্টারমশাইরা স্টেজের মাঝখানে জটলা করে দাঁড়িয়ে আছেন। ওঁদের চোখে-মুখে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব। এরপর কী হবে? কী করা উচিত এরপর? মাঝে-মাঝেই রোশনের দিকে তাকাচ্ছেন ওঁরা। কিন্তু রোশন কীরকম এক সমাহিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে স্কুল-মাঠের দিকে—যেন পাখির চোখে মাঠটাকে দেখছে।
কিশোরীমোহনের প্রশ্নের কোনও উত্তর দেয়নি পলান। কীই-বা উত্তর দেবে আর! আজ ওকে অপমানে-অপমানে পথের ধুলোরও অধম করে দিয়েছে রোশন। আশাপুরের চরণতলেও ওর আর ঠাঁই নেই। ও এখন আশাপুরের চরণতলাশ্রয়ছিন্ন।
‘কী আশ্চর্য দ্যাখো, পলান! কাল রাতে সায়ন এসেছিল। কী করে পেটো বাঁধতে হয় আমাকে শেখাচ্ছিল। তারপর কান্নাকাটি করছিল। বলছিল, আমাকে ছেড়ে থাকতে ওর ভালো লাগছে না। সেসব কথা বলতে-বলতে ও হঠাৎ চলে গেল।
‘তারপর কী কাণ্ড দ্যাখো! সায়ন আবার দেখা দিল আজ সকালে। তোমার কথা বলল। বলল, আশাপুরের পাবলিক তোমাকে শাস্তি দিচ্ছে। বলেই আমার কাছে বায়না করতে লাগল। বারবার বলতে লাগল, ”বাপি, তুমি কিন্তু ওই জানোয়ারটাকে শাস্তি দিয়ো! তিনজনের জন্যেই শাস্তি দেবে—আমার, মায়ের আর তোমার জন্যে…।”
‘সেইজন্যেই তো কষ্ট করে এলাম, পলান—’ কথাটা বলেই কিশোরীমোহন পলানের বাঁ-ঊরুতে এক লাথি মারলেন। বললেন, ‘এটা আমার জন্যে।’
তারপর, দু-চার সেকেন্ড গ্যাপ দিয়ে, দ্বিতীয় লাথিটা মারলেন একই জায়গায় : ‘এটা আমার স্ত্রীর জন্যে। পলান, তোমার মনে আছে তো, সায়ন মারা যাওয়ার পর আমার বউ গায়ে কেরোসিন ঢেলে সুইসাইড করেছিল?’
পলান একরাশ ঘেন্না আর রাগ নিয়ে কিশোরীমোহনকে দেখছিল, ওঁর ব্যান্ডেজ বাঁধা ডানহাতের পাতা দেখছিল।
‘আর এবারের লাথিটা সায়নের জন্যে—।’
কথাটা শেষ হতে না হতেই কিশোরীর রোগা পায়ের লাথি এসে পড়ল পলানের পটকায়।
আগের দুটো লাথি খেয়ে পলানের মুখ দিয়ে যন্ত্রণার এককণা শব্দও বেরোয়নি। কিন্তু এবারে একটা আর্তনাদ বেরিয়ে এল। ওর মুখও যন্ত্রণায় কুঁচকে হয়ে গেল।
কিশোরী হঠাৎ কাঁদতে শুরু করলেন। দু-পাশ থেকে দুজন ছেলে ওঁকে শান্ত করার চেষ্টা করতে লাগল। ওঁকে নিয়ে ফেরার পথ ধরল। কিশোরী চোখের জল মুছছিলেন না। ঝাপসা চোখে শূন্য দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে ছিলেন সামনের দিকে। ওঁর শুকনো দু-গাল জলে ভেসে যাচ্ছিল। পলানকে লাথি মেরে ওঁর ডান পা টনটন করছিল, আর সেইসঙ্গে বুকটাও। সায়ন আর সায়নের মায়ের কথা মনে পড়ছিল যে!
পলানের ওপরে খুচরো চড়-থাপ্পড়ের ব্যাপারটা চলতেই লাগল। তবে পাবলিক যে ক্রমশ উগ্র হয়ে উঠছে সেটা সুধীরডাক্তারবাবুরা বেশ বুঝতে পারছিলেন।
ডাক্তারবাবু ভেতরে-ভেতরে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছিলেন। এরপর যদি বাড়াবাড়িরকম কিছু হয়ে যায়! মাস্টারমশাইও ভাবছিলেন, ব্যাপারটা কন্ট্রোল করার জন্য কিছু একটা করা দরকার।
তিনি রোশনকে লক্ষ করে বললেন, ‘রোশন, চড়-থাপ্পড়ের কেসটা বাড়তে-বাড়তে মব লিঞ্চিং না হয়ে যায়—।’
রোশন কথাটার ঠিকঠাক মানে বুঝতে পারল না। ওর মুখ দেখে সুধীরডাক্তার সেটা বুঝতে পারলেন। তাই তিনি বললেন, ‘মাস্টারমশাই গণধোলাইয়ের কথা বলছেন। পাবলিক আরও এক্সাইটেড হয়ে পড়লে শেষ পর্যন্ত খারাপ কিছু একটা না হয়ে যায়।’
রোশনের খুব ক্লান্ত লাগছিল, খিদেও পাচ্ছিল। চারপাশে তাকিয়ে আশাপুরের কেমন একটা ঘোর লাগছিল ওর। প্রথম দিন আশাপুরে আসার পর থেকে যেসব ঘটনা ঘটেছে সেগুলো সিনেমার মতো পরপর ভেসে উঠছিল ওর মনের পরদায়।
ও ডাক্তারবাবুকে বলল, ‘ডাক্তারবাবু, আমার ভীষণ টায়ার্ড লাগছে। আপনারা এই জানোয়ারটাকে নিয়ে কী করবেন করুন। আমি যাই…।’
রোশনের কথাতেই ক্লান্তি ছিল। ডাক্তারবাবুরা সেটা বুঝতে পারলেন।
মাস্টারমশাই ওকে বললেন, ‘ঠিক আছে, তুমি যাও—ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নাও…।’
রোশন স্টেজ থেকে নেমে হাঁটা দিল। দু-তিনজন ভলান্টিয়ার ওর কাছে দৌড়ে এল। উতলা হয়ে জিগ্যেস করল, কী ব্যাপার? রোশনদা চলে যাচ্ছে কেন? রোশন বলল যে, ওর খুব ক্লান্ত লাগছে। একটু বিশ্রাম নিতে ইচ্ছে করছে।
আহত নিতুদার কথা ভাবতে-ভাবতে রোশন পিচ-রাস্তায় উঠে এল। মাইকে তখন ‘ঊর্ধ্বগগনে বাজে মাদল’ বাজছে।
রোশন চলে যাওয়ার পর সিনিয়াররা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে লাগলেন। পলানকে নিয়ে এখন কী করা যায়?
বেশ কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলার পর ওঁরা ঠিক করলেন, পলানকে এবার পুলিশের হাতে হ্যান্ডওভার করা যেতে পারে। কারণ, এখানে বেশিক্ষণ এইরকম চলতে থাকলে ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত হয়তো মব লিঞ্চিং-এর দিকেই যাবে।
মাঠে উত্তেজিত পাবলিক তখন রীতিমতো হইহই করছে। পলানকে চড়-থাপ্পড় মারার জন্য বেশ কয়েকজন লোক পলানকে ঘিরে হুড়োহুড়ি করছে।
মাইকের গান থামাতে বললেন ডাক্তারবাবু। তারপর মাইকে বললেন, ‘একটি বিশেষ ঘোষণা! একটি বিশেষ ঘোষণা!’
জনতার হইচই অনেকটা কমে গেল। সবাই স্টেজে মাইকের সামনে দাঁড়ানো ডাক্তার সুধীর পাঠকের দিকে তাকাল।
‘পলান নস্করকে এবারে আমরা পুলিশের হাতে তুলে দেব। আমরা ওকে আপাতত যতটুকু শাস্তি দেওয়ার দিয়েছি। এবার পুলিশ পুলিশের কাজ করুক। তারপর আবার আসবে আমাদের পালা।’
ডাক্তারবাবু মাইকের কাছ থেকে একটু সরে গিয়ে বয়স্ক মানুষদের সঙ্গে চাপা গলায় কীসব আলোচনা করলেন। তারপর আবার ফিরে এলেন মাইকের কাছে।
‘বন্ধুগণ, একটু মন দিয়ে শুনবেন। প্লিজ, একটু মন দিয়ে শুনুন—’ একটু থামলেন ডাক্তারবাবু। তারপর : ‘আমরা এই পাঁচ-ছ’জন সিনিয়ার মানুষ আলোচনা করে একটা প্রস্তাব আপনাদের সামনে রাখছি। যদি আপনারা সবাই সমর্থন করেন তা হলে সেই প্রস্তাবটাকে আমরা বাস্তবে রূপায়িত করব…’ আবার থামলেন সুধীরডাক্তার। এপাশ-ওপাশ মুখ ঘুরিয়ে একবার সবার ওপরে চোখ বুলিয়ে নিলেন। তারপর জোরালো গলায় বললেন, ‘পলান নস্করকে আমরা আশাপুরে আর ঠাঁই দেব না। আমাদের আশাপুরকে আমরা শান্তিপূর্ণ রাখব। এখানে পলান নস্করের মতো খুনি, গুন্ডা, বদমাইশের কোনও জায়গা নেই।’
মাঠের জনতা উল্লাসে চিৎকার করে উঠল, ‘জায়গা নেই! জায়গা নেই!’
‘শুধু পলান নস্কর নয়—ওর দলের যত গুন্ডা, শাগরেদ, তাদেরও আমরা আর আশাপুরে জায়গা দেব না। আমরা, আশাপুরের আমরা সবাই, ওদের আশাপুর থেকে তাড়িয়ে দেব—।’
জনতার চিৎকার শোনা গেল, ‘তাড়িয়ে দেব! তাড়িয়ে দেব!’
‘আমরা সবাই মিলে আশাপুরে ”শান্তি কমিটি” গড়ে তুলব। এখানে কোনওরকম অশান্তি আমরা হতে দেব না—।’
মাস্টারমশাই তখন আশাপুরের পুলিশ ফাঁড়িতে ফোন করছিলেন। কয়েকবার রিং বাজতেই সাব-ইনস্পেকটর সুরেন দাস ফোন তুললেন।
‘হ্যালো, সাব-ইনস্পেকটর দাস বলছি—।’
অবনীমাস্টার সংক্ষেপে ওঁকে ঘটনা জানালেন। বললেন যে, এক্ষুনি এসে পলানকে অ্যারেস্ট করে হেফাজতে না নিলে পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যেতে পারে। তিনি যেন ইমার্জেন্সি বেসিসে থানা থেকে লোকজন নিয়ে এসে পলান নস্করের দায়িত্ব নেন। এক্ষুনি।
ডাক্তারবাবু তখনও মাইকে শান্তি কমিটির কথা বলছিলেন। শান্তি কমিটির কাজ কী-কী হবে তার একটা আভাস দিচ্ছিলেন।
এই শান্তি কমিটি নিয়ে ডাক্তারবাবুরা নিজেদের মধ্যে আগে বহুবার আলোচনা করেছেন। সে-আলোচনায় রোশন তো ছিলই, তা ছাড়া আশাপুরের কয়েকটা ক্লাবের চার-পাঁচজন করে তরুণ সদস্যও হাজির ছিল। সেই আলোচনার সময় তরুণরা বলেছিল, পলান নস্করের কোনও অত্যাচারই ওরা আর মুখ বুজে সহ্য করবে না। পলান কিংবা ওর ছেলেপিলেরা যদি আশাপুরের কারও গায়ে হাত তোলে তা হলে খবরটা পাওয়ামাত্রই ওরা রাস্তায় বেরিয়ে পড়বে। হাতের কাছে যে যা পাবে— লাঠি, রড, ক্রিকেট ব্যাট, হকিস্টিক—তাই নিয়ে পলানের ছেলেদের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়বে। মার দিলে পালটা মার খেতে হবে ওদের। মুখ বুজে পলানদের টরচার অনেকদিন সওয়া গেছে—আর নয়।
সিনিয়াররা ছোটদের অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, শান্ত করার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু তাতে কোনও কাজ হয়নি। ওদের একরোখা জঙ্গি জেদ শেষ পর্যন্ত জিতে গেছে। ওরা এখন সেই মুহূর্তটার অপেক্ষা করছে—পলান কিংবা ওর চ্যালারা আশাপুরের কোনও নিরীহ মানুষের ওপরে একবার টরচার করে দেখুক। ওরা এখন তৈরি। রোশনদা ওদের চোখ খুলে দিয়েছে।
ডাক্তারবাবু তখন মাইকে বলছিলেন, ‘আজ ঠিক বিকেল চারটেয় আমরা সবাই এই স্কুল-মাঠে আবার জড়ো হব। আপনারা সবাই আসবেন। এইখান থেকে আমাদের শান্তি মিছিল বেরোবে। একঘণ্টা ধরে আমরা আশাপুরের নানান পথ পরিক্রমা করব। পলানের মতো দুষ্কৃতীরা আমাদের শান্তি মিছিল দেখে সাবধান হয়ে যাবে। ওরা আমাদের শান্তি নষ্ট করতে আর সাহস পাবে না।
‘আপনাদের কাছে আবার অনুরোধ করছি, আপনারা সবাই আজ বিকেল চারটেয় এই মাঠে এসে জড়ো হন। দলে-দলে আমাদের শান্তি মিছিলে যোগ দিন।’
ডাক্তারবাবু এবার একটা হাত শূন্যে তুলে চিৎকার করে বললেন, ‘আমাদের শান্তি কমিটি জিন্দাবাদ!’
স্টেজ থেকে, মাঠ থেকে, অনেকের চিৎকার একসঙ্গে শোনা গেল : ‘জিন্দাবাদ! জিন্দাবাদ!’
‘আশাপুর শান্তি কমিটি জিন্দাবাদ!’
‘জিন্দাবাদ! জিন্দাবাদ!’
রোশন তখন পায়ে-পায়ে ‘আশাপুর লজ’-এর কাছাকাছি। বহুদূর থেকে ভেসে আসা শব্দগুলোর একটা চাপা সংস্করণ রোশনের কানে পৌঁছে যাচ্ছিল। সেই শব্দগুলোর প্রতিধ্বনি তুলল ও। বিড়বিড় করে বলল, ‘আশাপুর জিন্দাবাদ…।’
এমন সময় হঠাৎ করেই বৃষ্টি শুরু হল। সকাল থেকে আকাশে মেঘ আর বিদ্যুৎ-চমকের সাজসজ্জা ছিল। এখন ঝিরঝির করে জলের রেখা নেমে এল। মনে হচ্ছিল, একটা প্রকাণ্ড মাপের ঝারি নিয়ে আকাশ থেকে কেউ শান্তির জল ছড়িয়ে দিচ্ছে।
আকাশের দিকে মুখ তুলে রোশন সেই অদৃশ্য ঝারির দিকে একবার তাকাল। ওর সারা শরীরে ব্যথা, কোথাও-কোথাও কেটে গিয়ে জ্বালা করছে। তারই মধ্যে ‘জিন্দাবাদ!’ ধ্বনি যেন তৃপ্তি আর আনন্দের প্রলেপ লাগিয়ে দিচ্ছে। আশাপুর জেগে উঠেছে—আর সহজে ঘুমোবে না।
খিদে পেলেও রোশনের আর খেতে ইচ্ছে করছিল না। আজকের পুণ্য দিনে উপোস করলে ক্ষতি কী!
ও পায়ে-পায়ে চলে এল ‘আশাপুর লজ’-এর দরজায়। পুরোনো জীর্ণ দরজার পাল্লা দুটো ভেজানো রয়েছে।
দোতলার দিকে তাকাল। দুটো জানলা খোলা রয়েছে।
ওর মনটা কোনওরকমে ওর ঘরে পৌঁছতে চাইছিল…তারপর বিছানা আর বালিশ ওকে টানছিল।
লজের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল। দেখল, বিশ্বরূপদা নেই। নিশ্চয়ই এখনও স্কুল-মাঠে রয়েছেন, ‘স্বাধীনতা’-র উৎসবে মেতে আছেন।
রোশন ধীরে-ধীরে পা ফেলে ওর দোতলার ঘরের দিকে এগোল।
ঘরে ঢুকে প্রথমেই ফ্যান চালাল। তারপর ঘরের একমাত্র জানলাটা খুলে দিল। বাইরে মোলায়েম বৃষ্টি পড়ছে। স্কুল-মাঠ থেকে ভেসে আসছে মাইকের আওয়াজ।
জানলার কাছ থেকে সরে এল রোশন। কোনওরকমে জামা-জুতো ছেড়ে মেঝেতে রাখা জলের জগ থেকে ঢকঢক করে জল খেল। ঘরের কোণে গিয়ে হাতে অল্প জল ঢালল। তারপর সেই জল মুখে ছিটিয়ে ভেজা হাতের পাতা মুখের ওপরে বুলিয়ে নিল। আ—ঃ!
চোখ জ্বালা করছে, মাথার একটা পাশ দপদপ করছে। বিছানায় শরীর এলিয়ে দিল।
চোখ বুজতেই ও মা, বাবা আর কুশানকে দেখতে পেল। ওরা তিনজনে রোশনের গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। মা যেন কিছু একটা বলছে। ঠোঁট নড়ছে, কিন্তু কোনও শব্দ বেরোচ্ছে না। মায়ের ঠোঁটের কোণে ছোট্ট হাসির ছোঁয়া।
মায়ের ঠোঁট নড়া দেখে কথাগুলো বুঝতে চাইল রোশন। কী বলছে মা? কপালে ভাঁজ ফেলে অবাক চোখে ও মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল। তাকিয়ে থাকতে-থাকতে কখন যে চোখে ঘুম লেগে গেছে সেটা ও টেরই পেল না।
ওর ঘুম ভাঙল বাজ পড়ার শব্দে। খোলা জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকাল। আকাশে মেঘ আছে, তবে বৃষ্টি থেমে গেছে।
রোশন বিছানায় উঠে বসল। দু-চোখে হাত ঘষল। একটু আগে কি ও স্বপ্ন দেখছিল? কে যেন ডাকছে ওকে। বলছে, ‘ওঠ! জেগে ওঠ! আশাপুর জেগে উঠেছে—!’
আবার তা হলে শুরু হোক পথ চলা।
রোশনের মনে হল, এবার পথ ওকে ডাকছে। বৃষ্টির ফোঁটা ওকে ডাকছে। আকাশের মেঘ ওকে ডাকছে।
বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল রোশন। ওর কানে এল দূর থেকে ভেসে আসা কথাগুলো। অনেকের গলা একসঙ্গে একই ছন্দে ধ্বনিত হচ্ছে।
‘আশাপুর জিন্দাবাদ!’
‘জিন্দাবাদ! জিন্দাবাদ!’
‘সমাজবিরোধী দূর হঠো—!’
‘দূর হঠো! দূর হঠো!’
‘আশাপুর শান্তি কমিটি জিন্দাবাদ!’
‘জিন্দাবাদ! জিন্দাবাদ!’
বালিশের পাশে রাখা হাতঘড়ির দিকে চোখ গেল রোশনের। সাড়ে চারটে। বোধহয় শান্তি কমিটি কোনও মিছিল বের করেছে।
চটপট তৈরি হয়ে নিল ও। জামা-জুতো পরে পিঠে তুলে নিল ব্যাকপ্যাক। এবার পথে নামতে হবে। পথেই হবে পথ চেনা।
রোশনের ভেতরে তৃপ্তির ছোট-ছোট তরঙ্গ ঢেউ তুলে খেলা করছিল। ও কেমন একটা ঘোরের মধ্যে সিঁড়ি নামতে লাগল।
সিমেন্ট চটা এবড়োখেবড়ো সিঁড়ির ধাপগুলোতে পা ফেলে নামার সময় ওর মনে হল ‘ওদের’ সঙ্গে রোশনের আর দেখা হবে না। ও খুব আলতো করে সিঁড়ির ধাপে পা ফেলতে লাগল। চাইল যে, এক কণা হলেও মায়ার ছোঁয়া ‘ওরা’ যেন টের পায়।
একতলায় এসে দেখল বিশ্বরূপ জোয়ারদার তখনও ফেরেনি। বোধহয় এখনও স্কুল-মাঠের ওখানে রয়েছেন, কিংবা হয়তো শান্তি মিছিলে পা মিলিয়েছেন।
রোশন পকেটে হাত ঢোকাল। একটা ছোট সাদা খাম বের করে নিল। তার মুখটা আঠা দিয়ে সাঁটা। এর ভেতরে কিছু টাকা রয়েছে—বিশ্বরূপদার লজের পনেরো দিনের ভাড়া।
একজন বোর্ডার বেঞ্চিতে বসে সকালের বাসী খবরের কাগজে চোখ বোলাচ্ছিলেন। তাঁকে লক্ষ করে রোশন বলল, ‘বিশ্বরূপদার টেবিলের ড্রয়ারে এই খামটা রাখলাম। উনি ফিরলে একটু বলে দেবেন?’
বোর্ডার ভদ্রলোক মাথা নেড়ে বোঝালেন, হ্যাঁ, তিনি বলে দেবেন।
রোশন বিশ্বরূপদার টেবিলের কাছে গেল, ড্রয়ার খুলে খামটা রেখে দিল।
তারপর ওর চোখ গেল দরজার পাশে দেওয়ালে ঠেস দেওয়া সাইকেলটার দিকে। বাবুনদার কাছ থেকে ভাড়া নেওয়া সাইকেল। ওটার এ মাসের ভাড়া অ্যাডভান্স দেওয়া আছে—শুধু সাইকেলটাই যা ফেরত দিতে হবে।
সাইকেলটার কাছে গিয়ে পকেট থেকে চাবি বের করল। লক খুলে ওটা নিয়ে সোজা ‘আশাপুর লজ’-এর বাইরে। গত পাঁচ-ছ’ মাস ধরে চালিয়ে-চালিয়ে এই মেশিনটার ওপরে কেমন যেন মায়া পড়ে গেছে। ওটার কলকবজার সঙ্গে রোশনের বেশ ভালোরকম পরিচয় হয়ে গেছে। কিন্তু উপায় নেই। একদিন না একদিন পান্থজনকে পা বাড়াতেই হয়।
বাবুনদার দোকানে সাইকেল জমা করে দিল রোশন। বাবুনদা দোকানে ছিলেন না। ভালোই হল। তিনি থাকলে হয়তো রোশনকে অনেক প্রশ্ন করতেন, বিব্রত করতেন।
দোকানের একটি ছেলে—রোশনের মুখ-চেনা—সাইকেলটা রোশনের কাছ থেকে জমা নিল। টাকা যে অ্যাডভান্স পেমেন্ট করা আছে, সেটা ছেলেটা জানত।
ও শুধু জিগ্যেস করল, ‘দাদা, আর লাগবে না?’
‘না—।’ অন্যদিকে তাকিয়ে বলল রোশন, এবং বাবুনদার দোকান ছেড়ে হাঁটা দিল। ওর চোখ জ্বালা করছিল।
ও এখন আশাপুরকে দেখতে-দেখতে এলোমেলো হেঁটে হাইরোডের দিকে যাবে।
বৃষ্টি থেমে গেছে। আকাশের মেঘ পাতলা হয়ে গেছে—কোথাও-কোথাও সরে গেছে। সেই ফাঁক দিয়ে নীলচে আকাশ দেখা যাচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে, শরৎ আর বেশি দূরে নেই।
রাস্তা বৃষ্টির জলে ভেজা। কোথাও-কোথাও রাস্তার গর্তে জল জমে রয়েছে। তারই পাশ দিয়ে, ওপর দিয়ে, গাড়ি, মোটরবাইক, সাইকেল রিকশা ছুটে চলেছে।
কোথাও-কোথাও রাস্তার পাশে ছোট-বড় গাছ। বৃষ্টির জলে ধুয়ে তাদের পাতাগুলো চকচকে সবুজ। মাথা তুলতেই চোখ পড়ছে ওভারহেড লাইন। সেই তারে বসে ডানা ঝাপটাচ্ছে দুটো ভিজে কাক।
রোশন সবকিছু দেখছিল, অন্তর থেকে শুষে নিচ্ছিল। আর পথহারানো এক টুরিস্টের মতো আশাপুরের রাস্তায় হাঁটছিল। আশাপুরকে নতুন চোখে দেখছিল।
এটা ওর চোখে পড়ল যে, রাস্তার পাশে জায়গায়-জায়গায় মানুষের জটলা। তারা বেশ আগ্রহ নিয়ে উত্তেজিতভাবে কীসব যেন আলোচনা করছে।
কী নিয়ে আলোচনা চলছে সেটা রোশন বেশ ভালোই আন্দাজ করতে পারল।
ভিজে রাস্তায় হাঁটতে-হাঁটতে ও একসময় চলে এল বিবেকানন্দের মূর্তির কাছে। বুড়িমাসি লোহার রেলিং-এর গায়ে লেপটে বসে আছে। সামনে পেতে রাখা ময়লা কাঁথাটা বৃষ্টির জলে ভেজা। বুড়িমাসির গায়ের শাড়িটাও।
বুড়িমাসি ইনিয়েবিনিয়ে গাইছে :
.
‘আমার জীবন গেল, জনম গেল
শান্তি পাইলাম না।
শান্তির তরে ভ্রান্তি নিয়ে হলেম খ্যাপা—
তবু মন শান্তি পাইল না।’
.
আকাশে শেষ বিকেলের আলো ফুটেছে। সূর্য দেখা যাচ্ছে।
রোশন আস্তে-আস্তে পা ফেলে বুড়িমাসির কাছে গেল। পকেট থেকে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট বের করে বুড়িমাসির কাঁথার ওপরে ফেলল। বুড়িমাসি সেটা টেরও পেল না। আপন খেয়ালে গান গেয়ে চলল।
রোশন চুপচাপ সরে এল। তারপর আবার হাঁটতে শুরু করল।
হাঁটতে-হাঁটতে একসময় ফাঁকা জায়গায় চলে এল। রাস্তার দু-পাশে গাছপালা, চাষের খেত, ছোট-বড় পুকুর। অনেকটা দূরে হাইরোড চোখে পড়ছে। একটা সবুজ রঙের বাস ছুটে গেল হাইরোড দিয়ে।
রোশন সামনের দিকে তাকিয়ে যত হাঁটছিল আশাপুর ততই পিছনে সরে যাচ্ছিল।
যদি কাউকে ভালোবেসে কেউ গভীর মায়ায় জড়িয়ে পড়ে, তা হলে সেই সময়ে তাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলে তারা একে অপরকে সারাজীবন ভুলতে পারে না। রোশন আর আশাপুরের ব্যাপারটাও বোধহয় তাই।
দূরে, হাইরোডের ওপারে, লাল সূর্যকে দেখতে পেল। অস্ত যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু করেছে। কিন্তু রোশনের হঠাৎ মনে হল, ওটা সূর্যাস্ত নয়—সূর্যোদয়। সেই ‘সূর্যোদয়’-এর দিকে এগিয়ে চলল ও।
হঠাৎই দুটো কচি গলার চিৎকারে চমকে উঠল।
‘আশাপুর জিন্দাবাদ! আশাপুর জিন্দাবাদ!’
মুখ ফিরিয়ে তাকাল রোশন।
বাঁ-দিকে, বেশ খানিকটা দূরে, দুটো সবুজ খেতের মাঝের সরু পথ ধরে ছুটে চলেছে দুটো বাচ্চা ছেলে। ওদের হাতে একটা করে ছোট ন্যাশনাল ফ্ল্যাগ। সরু কাঠির মাথায় আঠা দিয়ে লাগানো কাগজের রঙিন পতাকা। যে-পতাকা স্কুল-মাঠের প্রোগ্রামে রোশনরা বিলি করেছে।
হাসিখুশি মুখে ওরা ছুটছে আর কচি গলায় জিগির তুলছে। ওদের পতাকা হাওয়ায় উড়ছে।
রোশনের বুকটা ভরে গেল। বাচ্চা দুটোকে দেখতে-দেখতে ও হাই রোডে উঠে এল। একবার তাকাল লাল সূর্যের দিকে। তারপর হাইরোড বরাবর তাকাতেই দূরে একটা বাস দেখতে পেল।
এই বাসটা এলেই রোশন উঠে পড়বে। তা সে-বাসটা যেদিকেই যাক না কেন। পিছনে পড়ে থাকবেন চায়ের দোকানের যোগেনদা, সুধীরডাক্তারবাবু, অবনীমাস্টারমশাই, চিন্তামণি মাঝি, কিশোরীমোহন সামন্ত, বুড়িমাসি—আরও অনেকে। পড়ে থাকবে বিবেকানন্দের মূর্তি, জগন্ময়ীর কালীমন্দির, স্কুল-মাঠ—আরও অনেক কিছু।
আর পড়ে থাকবে আশাপুর।
রোশন বাসটার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।