৩. সাইকেল চালাচ্ছিল রোশন

তখন বিকেল। সাইকেল চালাচ্ছিল রোশন। গায়ে টি-শার্ট আর ব্লু জিনস। খুব ধীরে-ধীরে ও প্যাডেল করছিল। কারণ, চলার পথে এদিক-ওদিক তাকিয়ে আশাপুরের দৃশ্যগুলোকে ও শুষে নিচ্ছিল। ছোট-ছোট দোকানপাট, একটুকরো খেলার মাঠ, দুটো পুকুর, রাস্তার পাশে ফল কিংবা সবজির দোকান, টাইম-কলে জল নেওয়ার ভিড়, স্কুল ছুটি হওয়া ছেলেমেয়ের ঝাঁক হেঁটে বাড়ি ফিরছে—গায়ে সাদা-নীল পোশাক।

বিকেলের এই দৃশ্যগুলো রোশনকে ছুঁয়ে যাচ্ছিল। কারণ, দৃশ্যগুলো শান্ত, স্বাভাবিক—তাই সুন্দর। সবাই চায় তাদের জীবনধারা প্রশান্তরেখায় বয়ে চলুক। সেটাই তাদের কাছে সুন্দর। বিক্ষুব্ধ প্রবাহকে সবাই এড়িয়ে চলতে চায়। কিন্তু বিক্ষুব্ধ প্রবাহের যদি মোকাবিলা না করা যায় তা হলে প্রশান্তরেখায় বয়ে চলা জীবন পালটে যাবে অশান্তরেখায়। কিশোরীমোহন সামন্তের কথা মনে পড়ল রোশনের, মনে পড়ল সায়নের কথা।

একটু পরেই চৌরাস্তার মোড়ে পৌঁছে গেল। একটা চায়ের দোকানের পাশ ঘেঁষে সাইকেলটা স্ট্যান্ডে দাঁড় করাল। সামনেই বিবেকানন্দের মূর্তি। প্রায় আট-ন’ ফুট লম্বা। এককালে হয়তো সাদা ধবধবে ছিল—এখন ধুলো ধোঁয়ায় অফহোয়াইট হয়ে গেছে।

মূর্তিটাকে ঘিরে লোহার খাটো রেলিং। তার গায়ে লেপটে বসে আছে বুড়িমাসি—পাশে রঙিন কাপড়ের তালিমারা পুঁটলি।

চায়ের দোকান থেকে চা-বিস্কুট কিনল রোশন। তারপর রাস্তা পার হয়ে পৌঁছে গেল বুড়িমাসির কাছে। সামনে একটা ময়লা কাঁথা পেতে ছোটখাটো বুড়িমাসি বসে আছে। কাঁথার ওপরে আট-দশটা কয়েন পড়ে আছে : একটাকা, দু-টাকা, পাঁচটাকা। মাসি সবসময় একটা কথাই বলে, ‘দুটো টাকা দাও না, বাবা—চা খাব।’ আর মাঝে-মাঝে গানের মতো কী একটা গায়। এখন মাসি মিহি গলায় গানের মতো সেই কিছু একটা গাইছে :

‘আমার জীবন গেল, জনম গেল

শান্তি পাইলাম না।

শান্তির তরে ভ্রান্তি নিয়ে হলেম খ্যাপা—

তবু মন শান্তি পাইল না।’

মাসির গলায় সুর-টুর কিছু নেই, তবু ইনিয়েবিনিয়ে গেয়ে চলেছে।

রোশন ডাকল, ‘মাসি! ও বুড়িমাসি!’

বুড়িমাসি গান থামিয়ে চোখ তুলে তাকাল। চোখ সরু করে নজর তীক্ষ্ন করতে চাইল। রোশনকে চিনে নিল গলার স্বরে। স্নেহমাখানো নরম গলায় বলল, ‘কে? ভালো খোকা?’

‘মাসি, তোমার জন্যে চা-বিস্কুট এনেছি…।’ কথা বলতে-বলতে বুড়িমাসির দিকে চা-বিস্কুট বাড়িয়ে দিল রোশন।

বুড়ি কাঁপা হাতে সেটা নিল। বিড়বিড় করে বলল, ‘তোর ভালো হোক, ভালো খোকা। তোর ভালো হোক…।’

বিস্কুটে কামড় দিয়ে চায়ে চুমুক দিল মাসি। তেরছা আলো লোহার রেলিং-এর পিছন থেকে বুড়ির মাথায়, গালে এসে পড়েছে। পাকা চুলগুলো সোনালি রঙের দেখাচ্ছে। আর রেলিং-এর ছায়া এমনভাবে মাসির গায়ে পড়েছে, মনে হচ্ছে যেন জেলের গরাদের আড়ালে বন্দি।

রোশন পকেট থেকে একটা দশটাকার নোট বের করে বুড়িমাসির কাঁথার ওপরে ঝুঁকে পড়ল। নোটটা সেখানে রাখতে-রাখতে বলল, ‘মাসি, আজ আমি আসি—।’

রোশন আবার সাইকেলের কাছে ফিরে এল। সাইকেলে উঠে দু-চাকার গাড়িটা চালিয়ে দিল জগন্ময়ী কালীমন্দিরের দিকে।

সাইকেলটা রোশন ভাড়া নিয়েছে ‘মোহন সুইটস’-এর পাশের একটা দোকান থেকে। দোকানটার নাম ‘বাবুন সাইকেল মার্ট’। সাইকেল সারানোর দোকান—তার সঙ্গে সাইকেলের পার্টসও বিক্রি করে।

দোকানের মালিকের নাম বাবুন। মোটা মতন মাঝবয়েসি লোক। ‘মোহন সুইটস’-এ রোশন যে প্রায়ই সকালে লুচি-তরকারি খেতে আসে সেটা বাবুন লক্ষ করেছিল। তারপর সে রোশনের মার খাওয়ার ঘটনাটার কথা শুনেছে। এও শুনেছে যে, ছেলেটা কোন এক অচেনা-অজানা জায়গা থেকে ‘উড়ে এসে জুড়ে বসেছে’ এই আশাপুরে—আস্তানা গেড়েছে বিশ্বরূপ জোয়ারদারের ‘আশাপুর লজ’-এ। আর ক’দিনের মধ্যেই ছেলেটা পলানদের সঙ্গে ঝঞ্ঝাট-ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছে। এসব নিয়ে ‘মোহন সুইটস’-এর মালিকের সঙ্গে বাবুনের কয়েকবার কথাও হয়েছে।

তো সেই বিতর্কিত ছেলেটা তিনদিন আগে দুপুরবেলা বাবুনের সাইকেল মার্টে এল। বলল, একটা সাইকেল ভাড়া নিতে চায়—একমাসের জন্য।

বাবুনের দোকান টিন দিয়ে ঘেরা। মাথার ওপরে টালির ছাউনি। দোকানের একদিক ঘেঁষে সার দিয়ে বেশ কয়েকটা সাইকেল দাঁড় করানো। আর অন্য দিকটায় মেঝেতে বল বেয়ারিং, রিম, প্যাডেল এরকম নানান পার্টস ছড়ানো। তারই মাঝে একটা রোগামতন ছেলে হাফপ্যান্ট আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরে উবু হয়ে বসে কাজ করছে। দোকানের ভেতরে কোথাও একটা রেডিয়ো বাজছে। রেডিয়ো জকির নিপুণ একঘেয়ে বকবকানি শোনা যাচ্ছে।

‘একমাসের জন্যে!’ রোশনের কথায় অবাক হয়ে গিয়েছিল বাবুন।

‘হ্যাঁ—’ হেসে বলেছিল রোশন, ‘আশাপুরের এরিয়াটা অনেকটা বড়। পায়ে হেঁটে ঘুরে দেখাটা প্র্যাকটিক্যালি ইমপসিবল। আর গাড়ি-টারি চড়ে ঘুরে দেখার মতো ভলিয়ুম আমার নেই। তাই সাইকেলে চড়ে ঘোরাটাই সবচেয়ে ভালো। শুধু চালিয়ে যাও…কোনও তেল-টেল খরচা নেই…।’

‘আপনি কি আশাপুরে বেড়াতে এসেছেন?’ বাবুন ঠাট্টার গলায় জিগ্যেস করল।

‘হ্যাঁ—অনেকটা তাই। জায়গাটা আমার বেশ ভালো লেগে গেছে। গাছপালা, নদী, পুকুর, নানারকম মানুষ। সব মিলিয়ে দারুণ।’

বাবুন ছেলেটাকে দেখছিল। ফরসা, সুঠাম চেহারা। স্পষ্ট চোখ, চোখে স্বপ্ন মাখা। তার ওপরে টানা ভুরু। সামান্য কোঁকড়ানো চুল—ছোট করে ছাঁটা।

ছেলেটা অন্যরকম—ভাবল বাবুন। কিন্তু ওকে সাইকেল ভাড়া দেবে কী করে? যদি সাইকেল নিয়ে ভেগে যায়? মিনিমাম একজন তো গ্যারান্টার চাই!

সে-কথাই বলল বাবুন।

রোশন একপলকের জন্য একটু থমকে গেল। তারপর ওর বিশ্বরূপদার কথা মনে হল। ও বিশ্বরূপদার কথা বাবুনকে বলল, ‘আপনি বিশ্বরূপদার সঙ্গে ফোনে কথা বলতে পারেন। উনি আমার গ্যারান্টার হবেন—।’

এইভাবে কথাবার্তা পাকা হয়ে সাইকেলটা হাতে পেয়েছে রোশন। ভাড়া একটু কমসম করে শেষ পর্যন্ত ঠিক হয়েছে মাসে আড়াইশো টাকা। সাইকেলটা পুরোনো হলেও সেটা ভালো করে চেক-টেক করে দিয়েছে বাবুন। বেল ছিল না বলে নতুন একটা বেলও লাগিয়ে দিয়েছে।

এখন সাইকেল চালাতে-চালাতে সেই বেলটা বাজাল। সামনে দুজন লোক আর একটা গোরু রাস্তা পার হচ্ছে। সাইকেল-বেলের ‘টিং-টিং-টিং’ মিষ্টি আওয়াজে রোশন ছোটবেলায় ফিরে গেল। ওর সাইকেল চালানো শেখার দিনগুলো মনে পড়ে গেল। দোকান থেকে সাইকেল ভাড়া নিয়ে বাড়ির কাছাকাছি একটা ছোট মাঠে সাইকেল শিখত ও। ওর দুজন বন্ধু ছিল ওর ট্রেনার। সেইসব ভাড়ার সাইকেলগুলোর কোনওটার ব্রেক ছিল না, কোনওটার বেল ছিল না। তাই সাইকেল চালানোর সময় সামনে লোকজন পড়ে গেলে ক্রমাগত চেঁচাতে হত ‘সরে যান! সরে যান!’ বেশ কয়েকজন নিরীহ মানুষ শিক্ষানবিশ রোশনের সাইকেলে যেমন ধাক্কা খেয়েছিল, তেমন রোশনও দেওয়াল, কংক্রিটের পিলার, পুজো-প্যান্ডেলের খুঁটিতে অগুনতি ধাক্কা মেরেছিল। কিন্তু তারপর…এই দুর্ঘটনাবহুল ট্রেনিং পিরিয়ডের পর রোশন মোটামুটি উঁচুদরের সাইক্লিস্ট বনে গিয়েছিল।

এখন কাঁচা রাস্তা ধরে সাইকেল চালাতে-চালাতে পুরোনো অনেক কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল।

একটু পরেই জগন্ময়ী কালীমন্দিরের রাস্তায় এসে পড়ল রোশন। রাস্তা না বলে সেটাকে পথ বললেই বেশি মানায়। মেঠো পথের দুপাশে ছোট-বড় গাছপালা।

হঠাৎই একজায়গায় চোখে পড়ল একটা বাঁশের খুঁটিতে লাগানো একটা ছোট সাইনবোর্ড। তাতে হলদে রঙের ওপরে লাল হরফে লেখা : ‘শ্রীশ্রী জগন্ময়ী কালীমন্দির’। লেখাটার নীচে একটা তিরচিহ্ন আঁকা রয়েছে।

সাইকেলের চাকা আর কয়েক পাক গড়াতেই মন্দিরটা রোশনের চোখে পড়ল।

লালরঙের ছোট মন্দির। তার কোথাও-কোথাও হলদে রঙের ছোঁয়া। মন্দিরের পিছনে দুটো বড়-বড় গাছ। মন্দিরের চূড়া ছাড়িয়ে অনেকটা ওপরে উঠে গেছে। গাছের পাতায়-পাতায় সূর্যের পড়ন্ত আলো।

মন্দিরের কাছাকাছি গিয়ে সাইকেল থামাল রোশন। দুটো বড় ঝোপের গা ঘেঁষে সাইকেলটা একপাশে দাঁড় করাল। ওটা লক করে সামনে পা বাড়াল।

মন্দিরের সামনেটায় খানিকটা ফাঁকা জায়গা—অনেকটা উঠোনের মতন। উঠোনের মধ্যিখানে দুটো বড় মাপের বেলগাছ। সেই গাছদুটোর গুঁড়িতে তিন-চার ফুট করে লাল সালু জড়ানো। সেই সালুর গায়ে সিঁদুরের দাগ। তার ওপরে অসংখ্য লাল আর হলদে সুতো জড়ানো রয়েছে। তারই মাঝে-মাঝে রয়েছে ছোট-ছোট সাদা কড়ি। গাছদুটোর ডাল থেকেও সুতো বাঁধা অনেক কড়ি ঝুলছে।

বেলগাছের নীচ দিয়ে পা ফেলে মন্দিরের কাছে এগিয়ে গেল রোশন। মন্দিরের দরজার মাথায় একটা ঘণ্টা ঝুলছে। কিন্তু কোনও লোকজন চোখে পড়ল না। নিশ্চয়ই সন্ধেবেলা আরতির সময় ভক্তদের ভিড়-টির হয়।

মন্দিরটা দেখে রোশনের মনে হল, এটার পিছনে খরচ আর যত্নের বেশ খামতি রয়েছে। মন্দিরের দেওয়াল জায়গায়-জায়গায় ভাঙা আর ফাটল ধরা হলেও রঙের আস্তরটা বেশ নতুন এবং ঝকঝকে।

মন্দিরের দরজার ঠিক ওপরে দেওয়ালে লাল অক্ষরে লেখা ‘শ্রীশ্রী মাতা জগন্ময়ী’। দরজার সামনে কিছুটা জায়গা জুড়ে সিমেন্ট বাঁধানো চাতাল। চাতালের ওপরে গাড়িবারান্দার মতো ঢালাই ছাদ—ছ’টা পিলারের ওপরে দাঁড় করানো। চাতালে বসানো দুটো প্রণামীর বাক্স—একটা ছোট, আর একটা মাপে বেশ বড়। দুটো বাক্সই কাঠের তৈরি। দুটোতে তালা ঝুলছে। ছোট বাক্সটার গায়ে সাদা রং দিয়ে লেখা : ‘প্রণামী’, আর অন্যটার গায়ে বড়-বড় লাল হরফে লেখা : ‘মহাপ্রণামী’। সাদা লেখার রং জায়গায়-জায়গায় উঠে গিয়ে খানিকটা আবছা হয়ে গেলেও লাল লেখার হরফগুলো দিব্যি জ্বলজ্বল করছে।

দুটো প্রণামীর বাক্স দেখে রোশন একটু অবাক হল। ও মনে-মনে ‘প্রণামী’ ও ‘মহাপ্রণামী’-র তফাতটা আঁচ করার চেষ্টা করল।

ও জুতো খুলে চাতালে উঠল। আলতো পা ফেলে ধীরে-ধীরে মন্দিরের দরজায় গিয়ে দাঁড়াল। সামনেই কালো রঙের দেবীমূর্তি—তাঁর চোখ আর জিভ লাল। দেবীর পায়ের কাছে একটা প্রদীপ জ্বলছে। রোশন চোখ বুজে জোড়হাত করে প্রণাম জানাল। তারপর দরজার ঠিক ওপরে ঝোলানো ঘণ্টাটা হাত উঁচিয়ে একবার বাজাল।

মন্দিরের ভেতরটা আবছা অন্ধকার। এখনও কোনও আলো জ্বালানো হয়নি। তাই ভেতর থেকে একজন মানুষ যখন হঠাৎ করে বেরিয়ে এল তখন রোশন একটু চমকে গেল। ভদ্রলোক হয়তো ঘণ্টার শব্দ শুনে বেরিয়ে এসেছেন।

ভদ্রলোকের পোশাক দেখে বোঝা যায় তিনি এই মন্দিরের পুরুতমশাই। পরনে হাঁটু পর্যন্ত সাদা ধুতি, গায়ে গেরুয়া উড়ুনি, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, কপালে লাল টিপ পইতের ওপরে।

পুরুতমশাইয়ের গায়ের রং কালো, চেহারা অসম্ভব রোগা, মাথাজোড়া টাক। পাঁজরাসর্বস্ব বুকে কয়েক খাবলা কাঁচাপাকা লোম।

ভদ্রলোকের বাঁ-হাতে একটা ছোট পিতলের সরা—তাতে তেল-সিঁদুর মাখা। তিনি রোশনের কাছে এসে বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়ে ওর কপালে সিঁদুরের টিকা লাগিয়ে দিলেন। তারপর সরু চোখে ওর মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘তোমাকে তো, বাবা, এ-মন্দিরে আগে দেখিনি…।’

‘না, দেখেননি। জগন্ময়ী কালীমন্দিরে আমি এই প্রথম এলাম।’ একটু থেমে রোশন আরও যোগ করল, ‘আসলে আশাপুরে আমি নতুন…মাত্র পনেরো-কুড়ি দিন হল এসেছি। এখানে একটু কাজের খোঁজ-টোজ করছি—’ শেষ কথাটা রোশন বলল যাতে পুরুতমশাইয়ের মনে কোনওরকম সন্দেহ না তৈরি হয়।

আশাপুরে দু-আড়াই সপ্তাহ থাকার অভিজ্ঞতা থেকে রোশন দেখেছে, আশাপুর জায়গাটা স্রেফ ভালো লেগেছে বলে ও যে এখানে থাকছে এই সরল সত্যিটা কেউ বিনা সন্দেহে মেনে নিতে পারছে না। ভাবছে, রোশন মিথ্যে কথা বলছে। সেইজন্যেই ও ক’দিন ধরে এই কাজ-টাজ খোঁজার ব্যাপারটা লোকজনকে বলছে।

পুরুতমশাই রোশনের মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করলেন : ‘তোমার মনস্কামনা পূর্ণ হোক—।’

রোশন ওঁকে প্রণাম করে জিগ্যেস করল, ‘ঠাকুরমশাই, মন্দিরে কোনও লোকজন নেই কেন? ভক্তরা এখানে আসা-যাওয়া করে না?’

‘আসে—ওই সন্ধেবেলায়—পুজো-টুজো আর আরতির সময়।’ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘এই মন্দিরটা একশো উনতিরিশ বছরের পুরোনো—এটাই এর যত মানসম্মান। এ ছাড়া আর আছেটা কী! প্রাইভেট অনুদান-টনুদান থেকে কোনওরকমে খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে টিকে আছে। এই তো, একমাস আগে এক ভক্তের টাকায় একটু রং-টং করানো গেল। রিপেয়ার-টিপেয়ার করানোর জন্যে কতদিন ধরে মন্দির-কমিটিকে বলছি—কিন্তু তাতে কাজ-টাজ আর হচ্ছে কই! তা ছাড়া ডোনেশন-টোনেশনের টাকা-ফাকা সরাসরি হাতে পাওয়া খুব মুশকিল—।’

‘কেন? মুশকিল কেন?’

বিরক্তির তেতো হাসি হাসলেন পুরুতমশাই : ‘আছে, মুশকিল আছে। তুমি এখানে নতুন এসেছ—একটু পুরোনো-টুরোনো হও, সব জানতে-টানতে পারবে…।’

রোশন মুখে কিছু বলল না, কিন্তু মনে-মনে ব্যাপারটা বুঝতে চেষ্টা করল।

পকেট থেকে একটা পঞ্চাশটাকার নোট বের করল। তারপর এগিয়ে গেল প্রণামীর বাক্সের দিকে।

গিয়ে একটু থমকে দাঁড়াল। কোন বাক্সে দেবে প্রণামী? ছোট বাক্সটায়, না বড় বাক্সে?

পুরুতমশাইয়ের দিকে একবার তাকাল রোশন। তারপর মহাপ্রণামীর বাক্সে টাকাটা ফেলতে গেল।

‘ওটায় ফেলো না, বাবা!’ পুরুতমশাই যেন আর্ত আবেদন জানালেন।

রোশন চমকে ফিরে তাকাল পুরুতমশাইয়ের দিকে। চোখে প্রশ্ন।

‘ছোট বাক্সটায় প্রণামী দিলে সেটা মন্দিরের কাজে লাগবে…।’

‘আর বড় বাক্সটায় দিলে?’

‘সেটা আমাদের মায়ের সেবায় লাগবে না।’

‘কার সেবায় লাগবে তা হলে?’

পুরুতমশাই কিছু বলে ওঠার আগেই মোটরবাইকের শব্দ শোনা গেল।

পুরুতমশাই চাপা গলায় বললেন, ‘এসে গেছে—!’

রোশন পঞ্চাশটাকার নোটটা হাতে নিয়ে জলছবির মতো দাঁড়িয়ে রইল।

কয়েকসেকেন্ডের মধ্যেই একটা মোটরবাইক গরগর করতে করতে মন্দিরের উঠোনে ঢুকে পড়ল। ওটার পিছনে তাড়া করে এল মেঠো পথের ধুলো।

বাইকটা বেলগাছের নীচ দিয়ে এসে একবারে গাড়িবারান্দা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়ল।

লাল আর কালো রঙের মোটরবাইক। বাইকের গায়ে যেরকম ধুলো আর কাদা লেগে আছে তাতে বোঝা যায় গাড়িটা নিয়মিত ঝাড়পোঁছ হয় না। ওটার যত্ন নেওয়ার কেউ নেই।

মোটরবাইক থেকে যে-দুটো ছেলে নেমে দাঁড়াল ওদের অবস্থাও ওদের বাহনের মতন। জামাকাপড় ময়লা। মলিন চেহারা। চুল উসকোখুসকো। দেখে মনে হয়, ‘ঝাড়পোঁছ’-এর ব্যাপারটা বহুদিন ধরে পেন্ডিং হয়ে আছে।

ছেলে দুটোকে দেখেই রোশনের টিভিতে কার্টুন নেটওয়ার্কে দেখা ‘মোটু-পাতলু’-র কথা মনে পড়ল।

বাইক যে-চালাচ্ছিল সে যথেষ্ট মোটা, মাথায় টাক, চোখে চওড়া কালো ফ্রেমের চশমা। বয়েস পঁয়ত্রিরিশ কি চল্লিশও হতে পারে। ফলে ওকে ‘ছেলে’ না বলে ‘লোক’ বললেই ব্যাপারটা মানানসই হয়।

লোকটার গায়ে সবুজ রঙের একটা রাউন্ড নেক ময়লা টি-শার্ট। টি-শার্টটা এত টাইট যে, তার ভেতরে লোকটার বডি ফুলে-ফুলে রয়েছে। এবং ভুঁড়িটা বিশেষভাবে চোখে পড়ার মতো। হঠাৎ করেই ছোটবেলায় ভূগোল বইয়ে পড়া পামীরের মালভূমির কথা রোশনের মনে পড়ল।

লোকটার পায়ে হদ্দ ময়লা একটা জিনসের প্যান্ট—তার আবার নানান জায়গা ছেঁড়া। প্যান্টের শেষে একজোড়া ময়লা স্পোর্টস শু।

লোকটার গায়ের রং কালো। তার ওপরে কোথাও-কোথাও গাঢ় কালচে ছোপ। গলায় একজোড়া চেন—একটা সোনার, একটা রুপোর। বাঁ-হাতে একটা স্টিলের বালা, ডানহাতের কবজিতে বাঁধা বিপত্তারিণীর পুজো দেওয়া লাল সুতো।

মোটার পিছনে যে-শাগরেদটি বাইক থেকে নেমে দাঁড়িয়েছে ওকে দেখে প্যাঁকাটিও লজ্জায় মুখ লুকোবে। ছোটবেলা জ্যামিতি বইয়ে পড়া সরলরেখার কথা মনে পড়ল রোশনের। এবং ছেলেটির মাথা ওর শরীরে তুলনায় এতই বড় যে, রোশনের আলুর দমের কথাও মনে পড়ল।

প্যাঁকাটির বয়েস ছাব্বিশ-সাতাশ কি বড়জোর আটাশ হতে পারে। মাথায় ঝাঁকড়া চুল। চুলের একপাশটা লালচে রং করা। গায়ে হালকা নীল আর হলদে চেক কাটা একটা ঢোলা হাফশার্ট। সেটা প্যান্টের মধ্যে গুঁজে পরেছে। প্যান্টটা কালো রঙের, সরু। পায়ে সস্তার চপ্পল। তবে ময়লা জামা-প্যান্টের সঙ্গে চপ্পলজোড়া দিব্যি মানিয়ে গেছে।

প্যাঁকাটির মুখটা বড়, ছড়ানো। চোখদুটো ড্যাবাড্যাবা, দাঁতগুলো চওড়া, হলদেটে।

মোটু বাইকটাকে স্ট্যান্ডে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। তারপর ‘ঠাকুরমোসাই! ঠাকুরমোসাই!’ বলে ডাকতে-ডাকতে মন্দিরের চাতালে উঠে পড়েছিল। পা থেকে জুতো না খুলেই।

পাতলু মোটুর পিছন-পিছন আসছিল। ও কখন যেন পকেট থেকে একটা রিংসমেত চাবি বের করে নিয়েছে। সেটা আঙুলে ঘোরাচ্ছে।

মোটুর জুতো পায়ে চাতালে উঠে পড়াটা পুরুতমশাইয়ের ভালো লাগেনি। কিন্তু কী আর করা! ওরা ওইরকম।

পুরুতমশাই মন্দিরের দরজার পাশ ঘেঁষে কাঁচুমাচু মুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন। মোটু আর পাতলুর দিকে তাকিয়ে ছিলেন। দু-সপ্তাহ পরপর ওরা দুজন বাইক নিয়ে আসে। ‘মহাপ্রণামী’-র বাক্সটা খুলে টাকাপয়সা সব নিয়ে যায়। তবে বাক্সটা একেবারে খালি না করে একটা দু-টাকার কয়েন বাক্সে রেখে যায়।

মোটুর ‘ঠাকুরমোসাই’ ডাক শুনে পুরুতমশাই দরজার পাশ ছেড়ে সামনের চাতালে কয়েক পা এগিয়ে এলেন। মোটু-পাতলুর দিকে ওঁর নজর থাকলেও রোশনের দিকে একপলক দেখে নিলেন।

পাতলু জুতো পায়ে চাতালে উঠল। পুরুতমশাইয়ের দিকে হাসিমুখে তাকাল। জিগ্যেস করল, ‘কী ঠাকুরমোসাই, সব খবর-সমাচার ঠিকঠাক আছে তো?’

পুরুতমশাই প্রায় ষাট ডিগ্রি ঘাড় হেলিয়ে বোঝালেন, সব ঠিকঠাক আছে। একটু হাসার চেষ্টাও করলেন। রোবটের হাসি। পানের ছোপধরা দাঁত দেখা গেল।

রোশন সবকিছু খুঁটিয়ে লক্ষ করছিল। স্লো মোশনে গড়িয়ে চলা একটা সিনেমা দেখছিল যেন।

বিকেল ক্রমে হেলে পড়েছিল সন্ধের দিকে। বেলগাছ থেকে কাকের কোলাহল শোনা যাচ্ছিল। সন্ধের মুখে ঘরে ফিরে পাখিদের রোজকার সাংসারিক কথাবার্তা আর ঝগড়াঝাঁটি।

মোটু এবার কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়াল। পাতলুকে লক্ষ করে বলল, ‘লে-লে, জলদি মাল খালাস কর…।’

পাতলু গুনগুন করে হিন্দিগানের একটা সস্তা সুর ভাঁজছিল। ‘মহাপ্রণামী’-র বাক্সের কাছে দাঁড়িয়ে ও পকেট থেকে লাল রঙের একটা মোটা পলিথিনের প্যাকেট বের করে ফেলেছে। তারপর চাবি ঘুরিয়ে খুলে ফেলল বাক্সের তালা। বাক্সের ভারী ঢাকনাটা তুলে হেলিয়ে দিল পিছনদিকে।

মোটু এবার রোশনকে লক্ষ করে হাত নেড়ে বলল, ‘আবে, তোর নোটটা ধরে পাঁচুর মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? বাসকে ফ্যাল!’

 .

রোশন পঞ্চাশটাকার নোটটা হাতে নিয়ে ফ্রিজশটের মতো দাঁড়িয়ে ছিল। ছেলেদুটোর এই লেভেলের হরকত ওর একেবারেই পছন্দ হচ্ছিল না। মোটু আর পাতলুকে রোশন আগে না দেখলেও আন্দাজ করতে পারল ওরা নিশ্চয়ই পলানের ছেলে। কারণ, আশাপুরে পলানের একচেটিয়া রাজত্বে কেউ এখনও কামড় বসাতে পারেনি। এ-কথাটা ও প্রথম জানতে পারে বিশ্বরূপ জোয়ারদারের কাছে। তারপর ‘মোহন সুইটস’-এর কাউন্টারে দাঁড়িয়ে সকাল কি সন্ধেবেলা জলখাবার খাওয়ার সময় লোকজনের নানান টুকরো কথা ওর কানে এসেছে—তার মধ্যে পলান যে আশাপুরে রাজ করে সে-খবরও ছিল।

মোটু আর পাতলুর দিকে তাকিয়ে রোশনের গা ঘিনঘিন করে উঠল। পলান এত নোংরা! ওর চ্যালারা জুতো পরেই মন্দিরের চাতালে উঠে পড়ছে! মন্দিরের প্রণামীর নাম করে ওরা পাবলিকের কাছ থেকে তোলা আদায় করছে! তারপর হয়তো এই টাকা দিয়েই দলবল নিয়ে রাতবিরেতে মওজ-মস্তি করবে।

রোশনের খুব রাগ হল। ও মনে-মনে ওর শরীরের মাসলগুলোর সঙ্গে কথা বলল। ওরা জানাল যে, কিছুদিন আগে পাবলিক প্লেসে ওরা যে দিনদাহারে মার খেয়েছিল তার জন্য সেরকম কোনও ব্যথা ওদের গায়ে আর নেই। ওরা নতুনভাবে মার খাওয়ার অথবা দেওয়ার জন্য তৈরি।

ঠিক এরকম একটা সময়ে পাতলু গুনগুন গান থামিয়ে রোশনকে লক্ষ করে দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বলে উঠল, ‘কী বে ক্যালানে কাত্তিক! সুবুদা কী বলল শুনতে পাসনি? নোটটা বাসকে ডাল—জলদি!’

রোশন কেমন একটা ঘোরের মধ্যে পাতলুর দিকে তাকাল। মা কালীর এই অসম্মান ও দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে সহ্য করবে!

ঠিক তখনই পাতলু ওর সামনে এসে আঙুল তুলে চেঁচিয়ে বলল, ‘এ কানে কালা ন্যাকাচৈতন! নোটটা ছাড়…!’

কথাগুলো বলার সঙ্গে-সঙ্গে পাতলু পঞ্চাশটাকার নোটটা রোশনের হাত থেকে ছোঁ মেরে নিয়ে নিয়েছে এবং ‘মহাপ্রণামী’-র বাক্সে টাকাটা ফেলে দিয়েছে।

রোশনের ডানহাত বিদ্যুৎগতিতে বাতাস কাটাল। পলকে পৌঁছে গেল প্যাঁকাটির মাথার কাছে। ওর চুলের মুঠি খামচে ধরে এমন ঝাঁকুনি দিতে লাগল যে, ওর হাত-পা-শরীর ন্যাকড়ার পুতুলের মতো ল্যাক-প্যাক করতে লাগল। ওর হাত থেকে লাল পলিথিনের প্যাকেটটা খসে পড়ল।

রোশন যে আচমকা এমন প্রতিক্রিয়া দেখাবে সেটা পাতলু বা সুবু কেউই আঁচ করতে পারেনি। ওরা দুজনেই হতবাক হয়ে গিয়েছিল। পাতলু মোটেই কথা বলার মতো অবস্থায় ছিল না, আর সুবু কথা বলার মতো অবস্থায় থাকলেও কথা বলতে পারছিল না। শুধু হাঁ করে ওর শাগরেদের হেনস্থা দেখছিল।

প্রায় পাঁচ-ছ’সেকেন্ড পর রোশন ঝাঁকুনি থামাল, কিন্তু ঝাঁকড়া চুলের মুঠি ছাড়ল না।

রোশন ঠান্ডা গলায় বলল, ‘পঞ্চাশটাকার নোটটা তুলে আমার হাতে দে—এক্ষুনি। নইলে তোর প্যাংলা বডি চার ভাঁজ করে একেবারে ইস্তিরি করে ছেড়ে দেব। তোল নোটটা!’

প্যাঁকাটির মাথা ঝিমঝিম করছিল। ও সাপোর্টের আশায় ওর ‘সুবুদা’-র দিকে তাকাল। একইসঙ্গে দাঁত খিঁচিয়ে বলে উঠল, ‘অ্যাই শুয়োর, চুল ছাড় বলছি! নইলে চব্বিশঘণ্টার মধ্যে তোর লাশ নামিয়ে দেব! ছাড়!’

উত্তরে রোশন অল্প হাসল। প্যাঁকাটির চুলের মুঠি ধরে আবার একদফা রামঝাঁকুনি দিল। রোগা ছেলেটার ড্যাবা-ড্যাবা চোখ আরও বড় হয়ে ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইল। ওর মুখ দিয়ে গোঙানির মতো আওয়াজ বেরোতে লাগল।

রোশন এবার জোরালো গলায় বলল, ‘পঞ্চাশটাকার নোট। এক্ষুনি!’

সুবু এতক্ষণে নিজের চরিত্র আর কর্তব্য বোধহয় খুঁজে পেয়েছিল। ও ওর মোটা শরীর নিয়ে ছুটে এল রোশনের দিকে।

রোশনের কাছে এসে মোটু ডানহাতটা শূন্যে তুলেছিল রোশনকে মারবে বলে। কিন্তু রোশন সে সুযোগ দিল না। শরীরটাকে ডানদিকে সামান্য হেলিয়ে বাঁ-হাত দিয়ে ও সুবুকে আক্রমণ করল। বাঁ-হাতটাকে শক্তভাবে মুঠো করে বুড়ো আঙুলটাকে ছুরির ছোট ফলার মতো সামনে বাড়িয়ে ধরল। তারপর ব্ল্যাক মাম্বা সাপের ক্ষিপ্রতায় ছোবল মারল সুবুর গলায়।

সুবুর মুখ থেকে ‘উঁক’ করে একটা শব্দ বেরোল। কিন্তু ওর মোটা শরীরের ভরবেগ যথেষ্ট থাকায় ওর শরীরটা পলকের জন্য থমকে গিয়ে সামনের দিকেই মুখ থুবড়ে পড়ল। চশমা ছিটকে গেল চোখ থেকে। ও চাতালে পড়ে গলায় হাত চেপে ছটফট করতে লাগল।

পাতলুর চুলের মুঠি তখনও রোশনের হাতে বন্দি ছিল। সুবুর হাল দেখে পাতলু কঁকিয়ে উঠল।

রোশন ওর মাথাটাকে এবার হালকা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, ‘পঞ্চাশ টাকা! জলদি!’

এরপর আর দেরি করার কোনও মানে হয় না। প্যাঁকাটি ঝুঁকে পড়ল ‘মহাপ্রণামী’-র বাক্সের ওপরে। রোশনের পঞ্চাশটাকার নোটটা তুলে নিয়ে ওর দিকে বাড়িয়ে ধরল।

রোশন পাতলুর চুলের মুঠি ছেড়ে দিয়ে নোটটা ছিনিয়ে নিল। তারপর দু-পা ফেলে পৌঁছে গেল ‘প্রণামী’ লেখা বাক্সটার কাছে। বাক্সের ডালার লম্বাটে গর্ত দিয়ে টাকাটা ফেলে দিল বাক্সের ভেতরে।

পুরুতমশাই মন্দিরের দরজার গায়ে প্রায় লেপটে দাঁড়িয়ে ছিলেন। মুখে স্পষ্ট ভয়ের ছাপ। একইসঙ্গে মানুষটা যেন বিব্রত হয়ে রয়েছে। যেন রোশনের সঙ্গে গুন্ডাদুটোর হাতাহাতি মারপিট দেখে সে পাপের বোঝা যথেষ্ট বাড়িয়ে ফেলেছে।

পুরুতমশাইয়ের হাত-পা অল্প-অল্প কাঁপছিল। রোশনকে ‘মহাপ্রণামী’ লেখা বাক্সে পঞ্চাশটাকার নোটটা ফেলতে তিনিই বারণ করেছেন। বলেছেন, ছোট বাক্সটায় প্রণামী দিলে সেটা মন্দিরের কাজে লাগবে।

যদি এসব কথা গুন্ডাগুলো জানতে পারে?

এর আগেও তিনি এই দুরকম প্রণামীর বাক্সের ‘মহিমা’-র কথা মন্দিরে পুজো দিতে আসা কয়েকজনকে বলেছেন, কিন্তু তারা কথাগুলো শুনে চুপচাপ হজম করে নিয়েছে। ‘প্রতিবাদ’ শব্দটার ‘প’-ও তাদের অন্তর থেকে বেরোয়নি। কিন্তু এই ছেলেটা? এই নাম-না-জানা ছেলেটা? এই ছেলেটা অন্যরকম। ওর মধ্যে ভক্তিও আছে, শক্তিও আছে।

পুরুতমশাই জগন্ময়ী মায়ের মূর্তির দিকে তাকালেন। কয়েক মুহূর্ত চোখ বুজে মায়ের কাছে প্রার্থনা জানালেন, আশাপুরে আসা এই নতুন ছেলেটা যেন হেরে না যায়। কিছুতেই যেন না হেরে যায়।

আকাশের দিকে তাকালেন পুরুতমশাই। সন্ধ্যাদেবী মাটিতে পা রাখলেন বলে। আর পাঁচ-দশমিনিটের মধ্যেই ভক্তরা একে-একে ভিড় করবে মন্দিরে। কিন্তু তার আগেই যদি গুন্ডাদুটো ছেলেটার ওপরে আবার ঝাঁপিয়ে পড়ে! প্রথম রাউন্ডে রোশন জিতে গেছে বটে, কিন্তু দ্বিতীয় রাউন্ডে? রোশনের কাছে কোনও হাতিয়ার নেই, কিন্তু গুন্ডাদুটোর কাছে তো ছুরি-চাকু অথবা অন্য কোনওরকম অস্ত্রশস্ত্র থাকতেও পারে!

পুরুতমশাই এক ধর্মসংকটে পড়লেন যেন।

একদিকে পলানের ভয়। মনে-মনে ওঁর যা-ই থাক বাইরে পলানের বা তার দলবলের বিরোধিতা করা চলবে না। নিজেকে প্রাণে বাঁচতে হবে তো!

আবার অন্যদিকে পুরুতমশাইয়ের বিবেক চাইছে, রোশন এই মোকাবিলার সব রাউন্ডেই জিতে যাক। অহিংসা পরম ধর্ম। কিন্তু হিংসাকে প্রতিরোধ করতে গেলে কখনও-কখনও হিংসার ব্যবহার জরুরি। তা না হলে, মা-দুর্গার হাতে ত্রিশূল কেন? মা-কালীর হাতে কেনই বা খড়গ?

কয়েকসেকেন্ড ধরে চলল রোগা ভিতু মানুষটার অন্তর্দ্বন্দ্ব। অস্থিরতা। তারপরই কী এক শক্তি যেন খুঁজে পেল সে।

পুরুতমশাই মন্দিরের ভেতরে ঢুকে মন্দিরের, চাতালের, সব আলো জ্বেলে দিলেন। তারপর ঘণ্টার কাছে এসে ঘণ্টাটা হঠাৎ করে পাগলের মতো বাজাতে শুরু করলেন।

চারপাশের গোধূলি-নিস্তব্ধতা চুরমার করে জগন্ময়ী কালীমন্দিরের ঘণ্টা বাজতে লাগল। বাজতেই লাগল।

ঢং ঢং ঢং ঢং!

রোজ সন্ধ্যায় পুজো শুরুর আগে পুরুতমশাই ঘণ্টা বাজান। ওঁর বিশ্বাস, পুজোর সময় মা-কালী জাগ্রত হন। ঘণ্টাধ্বনি তারই ইঙ্গিত। এখন এই রোগা জিরজিরে মানুষটা চাইছিল, ওর ঘণ্টাধ্বনিতে মা জেগে উঠুন। নিয়মিত হয়ে চলা এই অন্যায়ের একটা বিহিত হোক। এই অচেনা-অজানা নতুন ছেলেটা যেন হেরে না যায়।

পুরুতমশাই যেভাবে ঘণ্টা বাজাচ্ছিলেন তাতে মনে হচ্ছিল, মন্দিরের ঘণ্টা নয়—জেলের পাগলাঘণ্টি বাজছে।

পুরুতমশাই খুব চাইছিলেন, ওঁর এই ঘণ্টার আওয়াজে আশপাশ থেকে ভক্তজন ছুটে আসুক।

সত্যি-সত্যিই লোকজন আসতে শুরু করল। একজন…দুজন… তিনজন। তারা ঘণ্টার শব্দ শুনে ভাবছিল, আজ বোধহয় মন্দিরে মায়ের আরাধনা একটু তাড়াতাড়ি শুরু হবে।

একটু পরেই পুরুতমশাই ঘণ্টা বাজানো থামিয়ে হাঁফাতে লাগলেন।

ইতিমধ্যে সুবু সোজা হয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। চশমা নেই বলে চোখ পিটপিট করে দেখছে। বাঁ-হাতে গলায় হাত বোলাচ্ছে, আর ডানহাতটা ঢুকিয়ে দিয়েছে পকেটে।

এবং পরের সেকেন্ডেই ওর হাতটা একটা সুইচব্লেড সমেত বেরিয়ে এসেছে বাইরে।

পকেট-ছুরিটার মেটাল সুইচ টিপল সুবু। স্প্রিং-এর টানে একঝটকায় খুলে গেল ছুরির ফলা। ছ’ইঞ্চি লম্বা, চকচকে, ধারালো।

‘অ্যাই শুয়োরের বাচ্চা!’ হিংস্র স্বরে গর্জে উঠল সুবু, ‘এবার তোকে কোতল করব! আয়…আয় এবার…।’

ছুরির ফলাটা রোশনের দিকে বাড়িয়ে অস্ত্রটা ও নাচাচ্ছিল। পাতলু ততক্ষণে পলিথিনের প্যাকেটটা মেঝে থেকে কুড়িয়ে নিয়ে তাতে ‘মহাপ্রণামী’ বাক্সের টাকাপয়সা সব ভরতি করে ফেলেছে। বাক্সটার মেঝেতে পড়ে আছে শুধু একটা দু-টাকার কয়েন।

রোশন পাতলুর দিকে আঙুল দেখিয়ে সুবুকে বলল, ‘এগুলো মা-কালীর প্রণামীর পয়সা। সেগুলো নিতে তোমাদের লজ্জা করে না?’

সুবু হাসল। সে হাসিতে কোনও শব্দ হল না, তবে দাঁত দেখা গেল। রোশনের দিকে দু-পা এগিয়ে এল ও। ‘এক্স’ চিহ্নের মতো সাঁইসাঁই করে বাতাসে ছুরি টানল।

‘হারামজাদা, আমাদের লজ্জা শেখাতে এসেছে!’

সুবুর এই কথায় একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা পাতলু হেসে উঠল। তারপর জিগ্যেস করল, ‘সুবুদা, গামা-লিলুয়া-পরানি, ওদের ডাকব? ফোন লাগাব?’

রোশনের দিকে নজর স্থির রেখে এপাশ-ওপাশ মাথা নড়ল সুবু : ‘কোনও দরকার নেই। এ-মালকে আমি একা লিপটে নেব…।’

সুবুর ছুরির দিকে চোখ রেখেও রোশন দেখতে পেল মন্দিরের চাতাল ঘিরে আট-দশজন দাঁড়িয়ে রয়েছে। পুরুতমশাইয়ে ঘণ্টা বাজানো শুনে এরাই তাড়াহুড়ো করে চলে এসেছে মন্দিরে।

তাদের দিকে না তাকিয়ে রোশন সেইসব মানুষজনকে উদ্দেশ করে বলল, ‘আপনারা সবাই জেনে রাখুন, মন্দিরের ওই ”প্রণামী” লেখা বাক্সের…’ বাক্সটার দিকে আঙুল দেখাল : ‘…টাকাপয়সা মন্দিরের কাজে খরচ হয়। কিন্তু তার পাশে রাখা ”মহাপ্রণামী” লেখা বাক্সের টাকা কিন্তু মন্দিরের কাজে খরচ হয় না। পুরুতমশাই নিজে আমাকে একটু আগে এ-কথা বলেছেন। সেই টাকা-পয়সাগুলো কারা নেয় সেটা আপনারা নিজের চোখে দেখুন…’ রোশন সুবুর দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ‘এই যে, এই লোকটার নাম সুবু। আর ওর শাগরেদ—ওই রোগা ছেলেটার নাম…’ পাতলুর দিকে আঙুল দোখাল রোশন : ‘…ওর নাম আমি জানি না। এই দুজন ওই মোটরবাইক চেপে…’ আবার আঙুল দেখাল : ‘…ওই ”মহাপ্রণামী”-র বাক্সের টাকা নিতে এসেছে—।’

জমা হওয়া লোকজনের মধ্যে দুজন মহিলাও ছিলেন। তাদেরই একজন সুবুর দিকে আঙুল তুলে চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘অ্যাই, তুই শ্যাম মল্লিকের মোটর কারখানায় কাজ করিস না? এসব কী হচ্ছে? জুতো পায়ে চাতালে ওঠা! মন্দিরের মধ্যে মারামারি!’

একজন মোটাসোটা বয়স্ক ভদ্রলোক সুবুকে পলানের দলের ছেলে বলে চিনতে পারলেন। তাই বেশ মোলায়েম গলায় বললেন, ‘ভাই, এসব ছোরা-ছুরির কী দরকার! নিজেদের মধ্যে ডিসকাস করে মিটিয়ে নাও না!’

লোকজন জড়ো হয়ে যাওয়াতে পাতলু একটু নার্ভাস হয়ে পড়েছিল। রোশনের হাতে হেনস্থা হওয়ার অপমান ভুলে গিয়ে ও সুবুকে লক্ষ করে বলল, ‘অ্যাই সুবুদা, চলো ফুটে যাই। পাবলিকের ক্যাওড়া ক্যাচাল হয়ে গেলে পলানদার কাছে আবার ঝাড় খাব।’

সুবু পাতলুর পরামর্শ কানে তুলল না। ছুরিটা সামনে বাগিয়ে ধরে রোশনের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। রোশন পলকে শরীরটাকে কাস্তের মতো অবতল রেখায় বাঁকিয়ে নিল। ওর কোমরটা পিছিয়ে গেল। আর সুবুর ছুরি টার্গেট মিস করে বাতাস কেটে বেরিয়ে গেল।

রোশন লক্ষ করল, মন্দিরের চাতালের পাশে জমির ওপরে চার-পাঁচটা পুরোনো ইট পড়ে রয়েছে। তার মধ্যে দু-একটা আবার আধলা ইট। বাঁ-দিকে চারহাত ঝাঁপিয়ে পড়লেই ওগুলোর নাগাল পাওয়া যেতে পারে।

পাবলিকের গুঞ্জন বাড়ছিল। পুরুতমশাই মন্দিরের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে কাঁপছিলেন। মিনমিনে স্বরে বলছিলেন, ‘তোমরা থামো—থামো। মায়ের থানে পাপ করতে নেই—।’

রোশন আচমকা ইটগুলোর দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ল—যেভাবে গোলকিপার ঝাঁপিয়ে বল ধরে গোল আটকায়।

বডিটা কুঁকড়ে গুটিয়ে রোল করে পৌঁছে গেল ইটগুলোর পাশে। একটা আধলা ইট আঁকড়ে ধরে যুযুধান ভঙ্গিতে ইটটা উঁচিয়ে দাঁড়াল। এই বুঝি আধলা ইটটা ও ছুড়ে দেবে সুবুর দিকে।

রোশনকে হঠাৎ ওভাবে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখে সুবু একটু হকচকিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সেটা পলকের জন্য। তারপরই ও সামনে ঝুঁকে ছুরিটা বাড়িয়ে ধরল। এপাশ-ওপাশ চালাল এলোমেলো রেখায়। রোশন চেষ্টা করেও এবার নিজেকে বাঁচাতে পারল না।

ওর টি-শার্ট চিরে গেল। চিরে গেল পেটের চামড়া।

রোশন এক পা পিছিয়ে গেল। দু-চার সেকেন্ডের মধ্যেই টের পেল জ্বালা শুরু হয়েছে। রক্তের ছোপ লাগছে টি-শার্টে।

রোশনের মাথায় ভেতরে আগুন জ্বলে গেল। ও চোখের নিমেষে সুবুর হাঁটু লক্ষ করে ঝাঁপিয়ে পড়ল চিতাবাঘের মতো। আধলা ইটটা সপাটে বসিয়ে দিল মোটুর বাঁ-পায়ের হাঁটুতে।

নোংরা শব্দ হল একটা। মোটুর মালাইচাকি ফেটে চৌচির হয়ে গেল কি না কে জানে! মোটু গোড়া কাটা কলাগাছের মতো কাত হয়ে খসে পড়ল মন্দিরের চাতালে। তবে ওর স্প্রিং-ছুরিটা ধরা রইল ডানহাতের শক্ত মুঠোয়।

রোশনের টি-শার্টে রক্ত দেখে পুরুতমশাইয়ের মাথাটা গোলমাল হয়ে গেল। তিনি পাগলের মতো ‘বাঁচাও! বাঁচাও!’ বলে চিৎকার করতে লাগলেন আর একইসঙ্গে মন্দিরের ঘণ্টার কাছে গিয়ে আবার পাগলাঘণ্টি বাজানো শুরু করলেন।

ঢং ঢং ঢং ঢং ঢং!

জমায়েত লোকজনের মধ্যে তিনজন মোবাইল ফোন বের করে ক্রমাগত ফটো তুলছিল। আবার কেউ-কেউ চিৎকার করে মারামারি থামানোর জন্য বলছিল।

‘সুবুদা’ পড়ে যেতেই পাতলু ভয় পেয়ে গেল। কারণ, পলানের চ্যালাদের মধ্যে হাট্টাকাট্টা শক্তিমান বলে সুবুর খ্যাতি আছে। ওর শরীরে যেমন রস আছে, তেমনই কষ আছে।

পাতলু ‘সুবুদা’ বলে চেঁচিয়ে উঠল। ছুটে এল মোটুর কাছে। কিন্তু ততক্ষণে লড়াইখ্যাপা রোশন ওর হাতের আধলা ইটটা আবার ব্যবহার করা শুরু করে দিয়েছে। ও সুবুর গায়ের ওপর হামলে পড়েছে। ওর ছুরি ধরা ডানহাতের মুঠোর ওপরে আধলা ইটটা আছাড় মারছে বারবার। যেন কেউ নোড়া দিয়ে পাথরের শিলের ওপরে কচি আদা থেঁতো করছে।

সুবুর গলা থেকে যন্ত্রণার যে-চিৎকার বেরোচ্ছিল সেটা এতই বিকৃত যে, সেটা কোনও মরণাপন্ন শুয়োরের চিৎকার বলে মনে হচ্ছিল।

রোশন যেন একটা ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিল। ও প্রবল হাঁফাচ্ছিল আর চাপা গর্জন করে বলছিল, ‘মহাপ্রণামী! ইয়ারকি করার আর জায়গা পাওনি! মা-কালীর নাম করে সবাইকে ঠকানো! আশাপুরের মানুষ কি এতই বোকা! মহাপ্রণামীর নাম করে চুরি!’

সুবু বাঁ-হাত দিয়ে রোশনকে গায়ের ওপর থেকে ঠেলে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করছিল, কিন্তু পারছিল না। দুটো লড়াকু শরীর জট পাকানো অবস্থায় এলোমেলোভাবে ছটফট করছিল।

পাতলু ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না, ও ‘সুবুদা’-র জন্য দাঁড়িয়ে থাকবে, না পালাবে। একইসঙ্গে এটাও ভাবছিল, ও পালিয়ে গেলে ‘সুবুদা’-র কী হবে, ‘সুবুদা’-র মোটরবাইকটার কী হবে।

এই নতুন ছেলেটার জন্য এতবড় একটা ক্যাচাল বেধে যাবে পাতলু ভাবেনি। এই ক্যাচালের কথা শুনলে পলানদাও হয়তো সুবু আর পাতলুকে একহাত নেবে।

পুরুতমশাইয়ের ঘণ্টার আওয়াজে আরও লোকজন এসে জড়ো হচ্ছিল মন্দিরে। তাদের মধ্যে দু-পাঁচজন ফটো তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেও চার-পাঁচজন লোক ছুটে এল রোশন আর সুবুর কাছে। জোর করে দুটো শরীরকে আলাদা করল।

সুবুর হাত থেকে ছুরি অনেক আগেই খসে পড়েছিল। ওর ডানহাতটা থেঁতলানো, রক্তাক্ত। ওর সবুজ টি-শার্টে রোশনের রক্তের ছোপ।

রোশনের হাত থেকে আধলা ইটটা কেউ একজন কেড়ে নিয়ে ছুড়ে ফেলে দিল।

সুবুকে তিনজন শক্ত করে ধরে রেখেছে। সেই হাতের বাঁধনে সুবু হাঁফাচ্ছে, ফুঁসছে, যন্ত্রণায় গোঙাচ্ছে। বাঁ-হাত দিয়ে ডানহাতের কবজিটাকে চেপে ধরেছে।

হাঁফাচ্ছিল রোশনও। বড়-বড় শ্বাস নিচ্ছিল। ওর গায়ে রক্ত। পেটের কাছটায় জ্বালা করছে।

জনতার কেউ-কেউ বলছিল পুলিশে খবর দেওয়ার কথা। কেউ-কেউ আবার পলানকে খবর দেওয়ার কথা বলছিল। একজন থানায় ফোন করেও দিয়েছিল।

পাতলু পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে পলানকে ফোন করল।

সুবু রোশনের দিকে আঙুল তুলে শাসাল, ‘তোর বড্ড বেশি চর্বি জমে গেছে। পলানদা এসে তোর চর্বি খালাস করবে! কোত্থেকে শুয়োরটা উড়ে এসে জুড়ে বসেছে আশাপুরে!’

রোশন এখন অনেকটা শান্ত হয়ে গিয়েছিল। ও ঠান্ডা গলায় বলল, ‘আমি উড়ে এসে জুড়ে বসিনি—মা-কালী বোধহয় আমাকে এখানে টেনে নিয়ে এসেছেন—।’

কথাটা বলে মন্দিরের দরজার দিকে ঘুরল রোশন। হাতজোড় করে মা-কালীকে প্রণাম করল।

পুরুতমশাই তখনও মন্দিরের ঘণ্টা বাজাচ্ছিলেন।

রোশন মন্দিরের মূর্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল পায়ে-পায়ে। বাঁ-হাতটা পেটের ওপরে চেপে ধরা। জ্বালা করছে, তবে রক্ত বেশি বেরোচ্ছে না। ওর বেশ খারাপ লাগছিল। সুবুকে আধলা ইটটা দিয়ে ওভাবে না মারলেই ভালো হত। কিন্তু ছুরির ছোবল খেয়ে রোশনের মাথাটা হঠাৎ কেমন গরম হয়ে গিয়েছিল। তাই রাগের মাথায় হিংসা দিয়ে হিংসার মোকাবিলা করে ফেলেছে।

মাথাটা একটু ঝিমঝিম করছিল রোশনের। ও মন্দিরের দরজায় এসে দাঁড়াল। তাকাল মায়ের মূর্তির দিকে। একহাতে খড়্গ, একহাতে ছিন্নমুণ্ড। চোখ লাল, জিভ লাল। মা-কালীও তো প্রয়োজনে খড়্গ ব্যবহার করেন!

হাতজোড় করে মা-কালীকে আবার প্রণাম করল রোশন। ও টের পাচ্ছিল, জমা হওয়া লোকজনের ভিড় ওর কাছ থেকে খানিকটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে উত্তেজিতভাবে আলোচনা করছে।

‘আমি নিজের চোখে দেখেছি, ওই চশমা পরা টাকমাথা লোকটা ওই ছেলেটাকে ছুরি নিয়ে অ্যাটাক করল।’

‘ছেলেটাকে এখুনি ডাক্তারখানায় নিয়ে যাওয়া দরকার। কতটা ডিপ হয়ে কেটেছে কে জানে!’

‘অতক্ষণ আগে ফোন করলাম…কই, পুলিশ তো এখনও এল না!’

‘আসবে কী করে? আগে পলানদার পারমিশন নিক, আসবে কি না!’

‘ওই টাকমাথা লোকটা কি পলানের গ্যাঙে আছে, নাকি….?’

‘আছে, আছে! আমি সাইকেল নিয়ে ”জনপ্রিয়”-র পাশ দিয়ে যাতায়াতের সময় লোকটাকে তো প্রায়ই দেখি বেঞ্চে বসে আছে…।’

রোশনের মাথাটা হঠাৎ একটু টলে উঠল। ও চট করে মন্দিরের দরজার ফ্রেম ধরে ফেলল। পুরুতমশাই ঘণ্টা বাজাচ্ছিলেন। কিন্তু তাকিয়ে ছিলেন রোশনের দিকে। ভাবছিলেন, ‘একটা অচেনা অজানা ছেলে কোথা থেকে এসে…কী আশ্চর্য!’

রোশনকে হঠাৎ বেসামাল হয়ে যেতে দেখেই তিনি ঘণ্টা বাজানো থামিয়ে ছুটে গেলেন ওর কাছে। ওকে একেবারে জাপটে ধরলেন। উদ্বিগ্ন হয়ে জিগ্যেস করলেন, ‘কী হল, ভাই, মাথা ঘুরছে?’

‘সেরকম ঠিক না। মাথাটা একটু চক্কর কাটল যেন…।’

‘তোমাকে এখুনি ডাক্তারের চেম্বারে নিয়ে যেতে হবে। সুধীরডাক্তারের চেম্বারে। ডাক্তার সুধীর পাঠক…ভালো ডাক্তার। মূর্তির মোড় থেকে পঞ্চাশ-ষাট হাত দূরে ওনার চেম্বার…।’

রোশন মাথা নেড়ে আপত্তি জানাতে গেল, কিন্তু পুরুতমশাই শুনলেন না। ভিড়ের মধ্যে চেনা দু-চারজনকে বললেন, রোশনকে সুধীরডাক্তারের চেম্বারে নিয়ে যেতে।

সঙ্গে-সঙ্গে উৎসাহী লোকজন জুটে গেল। রোশনকে সাবধানে জড়িয়ে ধরে ওরা মন্দিরের চাতাল পেরিয়ে বড় রাস্তার দিকে হাঁটা দিল।

রোশন একটু-আধটু আপত্তি করতে যাচ্ছিল। বলতে যাচ্ছিল, ‘আমার সেরকম কিছু হয়নি—’ কিন্তু রোগা-সোগা পুরুতমশাই ওকে একেবারে দাবড়ে দিলেন : ‘কোনও আপত্তি-টাপত্তি শুনব না। ঠিকমতো ট্রিটমেন্ট-ঠিটমেন্ট না করলে পরে ঘা-টা হয়ে যেতে পারে। তা ছাড়া সুধীরডাক্তার খুব ভালো ডাক্তার। পয়সার খাঁই নেই। ভিজিটের টাকা থাকলে-টাকলে দিয়ো, না থাকলে দিয়ো না। ওতে ডাক্তারবাবু কিছু মনে-টনে করেন না। মানুষটা বড় ভালো…।’

লোকজন রোশনকে হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। তাদের মধ্যে একজন বলল, ‘তুমি ভাই পেটের ওপরটা শক্ত করে হাত দিয়ে চেপে রাখো। বড় রাস্তার দিকে যেতে-যেতেই আমরা রিকশা পেয়ে যাব—।’

রোশন পেটের কাটা জায়গাটার ওপরে আরও জোরে হাত চেপে ধরল। এখন জায়গাটা একটু বেশি জ্বালা করছে। পুরুতমশাই ঠিকই বলেছেন। কাটা জায়গাটা ঠিকমতো ট্রিটমেন্ট না করলে ইনফেকশন হয়ে যেতে পারে।

কাঁচা রাস্তা ধরে একটু এগোতেই রোশন ওর সাইকেলটা দেখতে পেল।

‘ওই যে আমার সাইকেল!’ মাথা নেড়ে ইশারায় সাইকেলটা দেখাল রোশন। দুটো ঝোপের পাশে দাঁড় করানো। ও সঙ্গী-সাথীদের বলল, ‘ওটা যদি ”আশাপুর লজ”-এ কেউ পৌঁছে দেয় তা হলে খুব ভালো হয়। আমি বিশ্বরূপদার লজে থাকি…।’

‘ও তুমি চিন্তা কোরো না—তোমার সাইকেল বিশুর লজে পৌঁছে যাবে।’ একজন বয়স্ক ভদ্রলোক জবাব দিলেন। তাঁর মাথার সব চুল সাদা। চোখে চশমা। সামনের দুটো দাঁত ভাঙা। রোগা চেহারা। গায়ে রঙিন টি-শার্ট আর টেরিকটনের প্যান্ট। চোখের মণিতে টগবগে উৎসাহ ফুটছে। রোশনের বলতে গেলে পাশে-পাশেই তিনি হাঁটছেন।

তিনি লোকজনের জটলার দিকে তাকিয়ে হাঁক দিয়ে বললেন, ‘অ্যাই ডিলন, আমাদের ভাইটির এই সাইকেলটা বিশুর লজে গ্যারেজ করে দিবি। এক্ষুনি অ্যাকশান নে—।’

রোশন ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল, কিন্তু ডিলন কে সেটা বুঝতে পারল না। ও কোনওরকমে পকেট থেকে সাইকেলের চাবিটা বের করে ভদ্রলোকের হাতে দিল। তারপর সেটা ওঁর হাত থেকে রিলে রেসের মতো এ-হাত সে-হাত হয়ে কোথায় পৌঁছে গেল কে জানে!

ওকে আঁকড়ে ধরে থাকা ভরসার হাতগুলোর উষ্ণতা টের পাচ্ছিল রোশন। এই হাতগুলোর মালিকদের ও চেনে না। অথচ সেই অচেনা মানুষগুলো চেনা উষ্ণতা দিয়ে ওকে ঘিরে ধরেছে।

রোশনের ভেতরে একটা বিচিত্র অনুভূতি তৈরি হয়ে যাচ্ছিল। ও অচেনা হাতগুলোর কাছে নিজেকে সঁপে দিল।

রোশনকে যেমন কয়েকজন সুধীরডাক্তারের চেম্বারে নিয়ে যাচ্ছিল, ঠিক তেমনই সুবুকে কয়েকজন ঘিরে ধরেছিল ডাক্তারখানায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু সুবু কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না। ওইরকম আহত অবস্থাতেই ও কোণঠাসা বেড়ালের মতো দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে চেঁচাচ্ছিল, ‘অ্যাই, সরে যা…সর…সর! ছেড়ে দে আমায়…।’

ওর দাঁতখিঁচুনিতে সাহায্যের হাত যারা বাড়িয়ে দিতে চাইছিল তারা সরে গেল। খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে ভয়ের চোখে সুবুকে দেখতে লাগল।

সুবু তাকিয়ে ছিল পাতলুর দিকে। দেখছিল, ও ফোনে কথা বলছে। নিশ্চয়ই পলানদার সঙ্গে কথা বলছে।

সুবুর ডানহাতটা এমনভাবে জ্বলছিল যেন কাঠের আগুনে ওটাকে ঝলাসানো হচ্ছে। বাঁ-পায়ের হাঁটুটা দপদপ করছিল। ওর বেশ বুঝতে পারছিল, ও ভালোই চোট পেয়েছে। ডাক্তার দেখানো দরকার এক্ষুনি। কিন্তু পলানদা কী ইনস্ট্রাকশন দেয় সেটা না জেনে এইসব ফালতু পাবলিকের কথায় ডাক্তারখানায় যাওয়া যায় না।

পাতলুর ফোন শেষ হতেই ও সুবুর দিকে তাকিয়ে হাত তুলে ইশারা করল। বলল, ‘অ্যাই সুবুদা, বাইক নিয়ে জলদি চলো। পলানদা ঠেক-এ ডাকছে…কুইক!’

সুবু আর দেরি করল না। খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে হাঁটা দিল বাইকের দিকে। পাতলু বাইক চালাতে জানে না—জানলে ও-ই বাইকের সামনে বসত। এখন ও প্যাসেঞ্জার সিটের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। এমন সময় সুবুর হাত থেকে খসে পড়া সুইচব্লেডটার ওপরে পাতলুর নজর পড়ল। অস্ত্রটা কিছুতেই এখানে ফেলে যাওয়া ঠিক হবে না। ওটা হাতে পেলে থানার সাব-ইনস্পেকটর দাসবাবুর কেসটা হাপিস করতে প্রবলেম হবে।

পাতলু ছুটে চলে গেল ছুরিটার কাছে। ওটা তুলে নিয়ে ভাঁজ করে পকেটে ঢোকাল। তখনই খেয়াল করল, ছুরিটার ডগায় রক্ত লেগে রয়েছে।

 .

‘সুবুদা’ ততক্ষণে বাইকে বসে ডানপায়ে কোনওরকমে কিকস্টার্ট দিয়েছে।

পাতলু চটপট গিয়ে ‘সুবুদা’-র পিছনে বসে পড়ল। বাইক গরগর আওয়াজ তুলে অন্ধকার কাঁচা রাস্তা ধরে এগোল। পাতলু ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, জগন্ময়ী কালীমন্দিরের আলো ক্রমশ পিছনদিকে চলে যাচ্ছে।

***

বিবেকানন্দের মূর্তির মোড়ের কাছে এসে রোশনের সাইকেল রিকশা বাঁ-দিকে ঘুরে গেল। ওর সাইকেল রিকশার পিছন-পিছন আসছে আরও তিনটে সাইকেল। সেইসব সাইকেলের আরোহীরা রোশনের সঙ্গে-সঙ্গে ডাক্তারখানায় চলেছে। ওরা মন্দিরের ঘটনার সময় হাজির ছিল।

রাস্তায় লোকজনের সেরকম ভিড় নেই, যানবাহনের ব্যস্ততাও নেই। চোখে পড়ছে এদিক-ওদিক চলে যাওয়া সাইকেল, কয়েকটা সাইকেল রিকশা, কখনও-কখনও স্কুটার কিংবা মোটরবাইক, আর কদাচিৎ একটা কি দুটো গাড়ি। গাড়ির হর্নের আওয়াজের তুলনায় সাইকেল রিকশার ‘প্যাঁক-প্যাঁক’ কিংবা সাইকেলের ‘কি-রি রিং, কি-রি রিং’ শব্দগুলোই বেশি কানে আসছে।

রাস্তাটা বেশ সরু এবং যথেষ্ট অন্ধকার। রাস্তায় আলো বলতে একপায়ে খাড়া হয়ে থাকা কংক্রিটের পিলারের মাথায় বসানো মলিন টিউবলাইট। তারা এমনিতেই নিজেদের মধ্যে অনেকটা দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়ে, তার মধ্যে কয়েকটা আবার খারাপ।

রাস্তার দুপাশে ছোট-ছোট একতলা বাড়ি। তারই মাঝে-মাঝে কয়েকটা দোতলা কাঠামো। সেইসব ঘরবাড়ির ফাঁকে-ফাঁকে মাথা তুলে রয়েছে নারকেলগাছ অথবা সুপুরিগাছ। অন্ধকার আকাশের পটভূমিতে আরও-অন্ধকার গাছগুলোর ওপরদিকটা ঝাঁকড়াচুলো মাথার মতো দেখাচ্ছে। সেদিকে তাকাতেই চাঁদের দিকে চোখ পড়ে গেল রোশনের। আর একইসঙ্গে ও চাঁদের আশেপাশে আলোর ফুটকির মতো দু-একটা তারা দেখতে পেল। সবচেয়ে বড় মাপের যে-তারাটা, সেটাকে ‘বাবা’ বলে ভাবল রোশন। মাঝারি তারাটা ওর ‘মা’। আর সবচেয়ে ছোট যে কুট্টি তারাটা, সেটা নিশ্চয়ই ‘কুশান’। রোশন চোট পেয়েছে, ডাক্তারখানায় যাচ্ছে—তাই মা, বাবা আর কুশান ওর পাশে-পাশে ভেসে চলেছে।

রোশনের পেটে জ্বালা করছিল, তবে রক্ত সেরকম আর বেরোচ্ছিল না। ওর পাশে বসেছেন সেই বয়স্ক ভদ্রলোক, যাঁর মাথার সব চুল সাদা, চোখে চশমা, গায়ে রঙিন টি-শার্ট। ভদ্রলোকের নাম রতনমণি মাঝি। এখান থেকে বেশ খানিকটা দূরে, ‘মহামায়া কটন মিল’-এর কাছে, ওঁর স্টেশনারি দোকান আছে। উনি আর ওঁর ছেলে মিলে চালান। অনেক ঠেলাঠেলি আর চেষ্টা করা সত্ত্বেও ছেলেটা লেখাপড়ার লাইনটা ধরে রাখতে পারেনি। তাই রতনমণি ওকে শেষমেশ দোকানেই লাগিয়ে দিয়েছেন।

আশাপুরের প্রায় সবজায়গাতেই ছোট-ছোট দোকান। রোশন এটা এই ক’দিনে লক্ষ করেছে। স্টেশনারি দোকান, লুচি-পরোটা ভাজার দোকান, তেলেভাজার দোকান, চায়ের দোকান, মিষ্টির দোকান—এরকম নানানধরনের দোকান, তবে মাপে আর ব্যাবসার ভলিয়ুমে সেগুলো খাটো।

রতনমণি রোশনের পরিচয় জিগ্যেস করেছিলেন শুরুতেই। রোশন সংক্ষেপে যা বলার বলেছে। তার সঙ্গে এও বলেছে যে, আশাপুরে ও একটা কাজ-টাজের খোঁজে এসেছে। ও গাড়ি চালাতে জানে। ও একসময় ট্যাক্সি চালাত—ওর ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে।

রতনমণি বললেন, ‘ঠিক আছে। যদি আমার কাছে কেউ ড্রাইভার-টাইভার খোঁজে আমি তোমাকে ফোন করে দেব। তোমার ফোন-নাম্বারটা আমাকে বলো…।’ এ-কথা বলে রতন নিজের মোবাইল ফোনটা পকেট থেকে বের করলেন।

রোশন কিন্তু-কিন্তু করে জানাল যে, ওর কোনও মোবাইল ফোন নেই।

এতে রতনমণি একটুও দমে গেলেন না। একইরকম উৎসাহ নিয়ে বললেন, ‘নো প্রবলেম। আমি বিশুকে, মানে বিশ্বরূপকে ফোন করে জানিয়ে দেব।’

সাইকেল রিকশায় রোশনের পাশে বসার পর থেকেই রতনমণি মাঝি ওর সঙ্গে টুকটাক কথাবার্তা শুরু করে দিয়েছেন। ও আগে কোথায় থাকত, বাড়িতে আর কে-কে আছে, এসব খবরও প্রশ্ন-টশ্ন করে জেনে নিয়েছেন। তারপরই এসেছে কালীমন্দিরের বিশ্রী ঘটনার প্রসঙ্গ।

রোশন রতনমণিকে সব বলেছে। তারপর জিগ্যেস করেছে, ‘আশাপুরের সবাই পলান আর ওর দলবলের এইসব টরচার সহ্য করছে কেমন করে?’

উত্তরে হাসলেন। হতাশার তেতো হাসি : ‘সহ্য করছি কারণ, আমরা সহ্য করার ট্রেনিং নিয়ে-নিয়ে অসহ্য জিনিসও সহ্য করতে শিখে গেছি।’

রোশন অবাক হয়ে রতনমণির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। সহ্য করার ট্রেনিং! সেটা আবার কী!

রতন মাঝি বললেন, ‘তুমি অবাক হচ্ছ বুঝতে পারছি। তা হলে শোনো, কী করে পলান আশাপুরের ”দাদা” হয়ে বসল। শুরু-শুরুতে ছেলেটা খারাপ ছিল না। ভদ্রঘরের ছেলেরা যেমন হয় সেরকমই ছিল। কিন্তু তারপর…।’

পলান নস্কররা আশাপুরের মিত্তিরবাগান অঞ্চলের বাসিন্দা। ও বাপ-মায়ের একমাত্র সন্তান। তাই ছোটবেলা থেকেই আদরে আশকারায় মানুষ হয়েছে। ওদের টাকা-পয়সা ভালোই ছিল। তাই যখন যা বায়না করত তাই পেত। পলান যখন ক্লাস এইটে পড়ে তখন ওর বাবা হঠাৎ করেই গুলেনবেরি সিনড্রোমে মারা যায়। পলানের মা বরাবর রুগ্ন ছিল। স্বামী চলে যাওয়ার বছর খানেকের মধ্যে সেও চলে যায়। পরিবারে ওর মা-বাবা ছাড়া ছিল এক বিধবা পিসি। পলান অনাথ হওয়ার পর সেই পিসিই ওকে কমবেশি মানুষ করার চেষ্টা করেছে। তার কী রেজাল্ট হয়েছে সেটা তো সবাই জানে।

পলান লেখাপড়ায় ততটা ভালো ছিল না, তবে খেলাধুলোয় রীতিমতো চ্যাম্পিয়ান ছিল। স্কুলের অ্যানুয়াল স্পোর্টসে তিন-চারটে করে মেডেল পাওয়াটা ওর কাছে বলতে গেলে একটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। একশো মিটার রেস, দুশো মিটার, চারশো মিটার, হাইজাম্প, লংজাম্প—কোনটাতে ও ফার্স্ট-সেকেন্ড হয়নি বা মেডেল পায়নি!

সেই স্পোর্টসম্যান পলান একদিন ঝামেলায় জড়িয়ে গেল।

পলান ‘আশাপুর হাই স্কুল’-এ পড়ত। যখন ও ক্লাস টেন-এ পড়ে তখনই ঝামেলাটা হয়েছিল। ক্লাস নাইনে ওঠার পথে দু-দুবার ফেল করায় পলানের বয়েসটা ক্লাসের তুলনায় একটু বেশিই ছিল। সে আজ প্রায় ষোলো কি সতেরো বছর আগের কথা।

আশাপুরের পরেই সাতঘড়িয়া—চলতি কথায় সবাই সাতঘড়া বলে। সাতঘড়ার ‘কেশবচন্দ্র বিদ্যালয়’-এর সঙ্গে ‘আশাপুর হাই স্কুল’-এর ফুটবল ম্যাচ ছিল। ছোটবেলা থেকেই পলানের চেহারা বেশ গাট্টাগোট্টা, আর ফুলব্যাক পজিশনে ওর খেলা ছিল দেখার মতো। বলতে গেলে দলের দশজন প্লেয়ার ওই একটা ফুলব্যাকের ঠিকঠাক খেলার ওপরে ভরসা করে থাকত।

যে-খেলায় ঝামেলাটা হয় সেটা ছিল সাতঘড়ার মাঠে—জুনিয়র স্কুল লিগের একেবারে ফাইনাল খেলা। তা ছাড়া ‘কেশবচন্দ্র বিদ্যালয়’-এর সঙ্গে ‘আশাপুর হাই স্কুল’-এর বরাবর একটা রেষারেষি ছিল। তো সেই ম্যাচে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়েছিল। রতনমণি মাঝি সেদিন খেলা দেখতে গিয়েছিলেন।

খেলায় প্রচণ্ড মারামারি হয়। ‘কেশবচন্দ্র’-এর ছেলেরা প্রথম থেকেই অল আউট মেরে খেলতে থাকে। খেলায় শেষ পর্যন্ত ওরা দুই-এক গোলে জিতেও যায়। রেফারির কাছে বারবার কমপ্লেন করেও ‘আশাপুর’-এর কোনও লাভ হয়নি। ফলে যা হওয়ার তাই হল। খেলার শেষে দু-দলের মধ্যে ভয়ংকর হাতাহাতি শুরু হয়ে যায়।

ওদের গোলকিপার ছিল জনাই। জনাই আবার ক্যাপ্টেন। তার সঙ্গে পলানের মারপিট লেগে যায়। সেসময়ে স্কুলের নাম তুলে ওরা নাকি একজন আর-একজনকে গালিগালাজ করছিল। সাংঘাতিক জেদ নিয়ে পশুর মতো লড়াই করছিল দুজনে।

জনাই একসময় ‘আশাপুর হাই স্কুল’-এ পড়ত। যখন ও ক্লাস সিক্সে তখন ও কী একটা কারণে একজন টিচারের মাথা ফাটিয়ে দেয়। ফলে স্কুল থেকে ওকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। সেই থেকে ‘আশাপুর’ স্কুলের ওপরে জনাইয়ের রাগ ছিল।

সাতঘড়িয়ার জনাইয়ের বাজে টাইপের ছেলে বলে বেশ বদনাম ছিল। ও নাকি নানান ধরনের কুকাজে বেশ পোক্ত হয়ে উঠেছিল। ওর সঙ্গে আট-দশজনের একটা দলও ছিল। আর ওর স্বভাব ছিল খুব হিংস্র ধরনের।

লড়াইটা শেষ পর্যন্ত দুটি স্কুলের টিচারদের চেষ্টায় মিটে গিয়েছিল।

কিন্তু ভেতরে-ভেতরে যে মেটেনি সেটা বোঝা গেল দু-সপ্তাহ পর।

দিনটা ছিল দোলের আগের দিন। সেদিন গভীর রাতে কোনও একসময় কেউ বা কারা ‘আশাপুর হাই স্কুল’-এর বাড়িটায় আগুন লাগিয়ে দেয়। আশপাশের লোকজন সেটা টের পাওয়ার আগেই আগুন অনেকটা ছড়িয়ে পড়ে। আশাপুরের সবচেয়ে কাছাকাছি দমকলের ঘাঁটি ছিল বাইশ কিলোমিটার দূরে। পাড়ার লোকজন জল, বালতি আর বালি নিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা শুরু করে দিয়েছিল—সেটা শেষ করল দমকলের দুটি ইঞ্জিন এসে।

আগুন নিভে গেলেও স্কুল-বাড়িটার অনেকটাই ক্ষতি হয়েছিল। অফিসের বহু কাগজপত্র, খাতা, ফাইল সব পুড়ে গিয়েছিল। তবে কোনও মানুষের কোনও ক্ষতি হয়নি, কারণ, সে-রাতে বাড়িটায় কেউ ছিল না।

দোলের পরের দিনটা ছিল রবিবার। সেদিন খবর পাওয়া গেল যে, স্কুল-বাড়িটায় আগুন লাগার ব্যাপারে নাকি সাতঘড়ার জনাইয়ের হাত রয়েছে।

মুখে-মুখে খবরটা আশাপুরে রটে গেল।

এর প্রায় দিনদশেক পর সবাই খবর পেল যে, জনাই জলে ডুবে মারা গেছে।

যেটুকু জানা গেল সেটা হল, সাতঘড়ার একটা ঝিলের ধারে পলানের সঙ্গে জনাইয়ের মুখোমুখি দেখা হয়ে যায় এবং পুরোনো রাগ থেকে হাতাহাতি মারপিট শুরু হয়ে যায়। এমনই হিংস্র ছিল সেই লড়াই যে, পলানের দুজন সঙ্গী আর জনাইয়ের একজন শাগরেদ রীতিমতো ভয় পেয়ে যায়। অনেক চেষ্টা করেও তারা সেই লড়াই থামাতে পারেনি।

কিছুক্ষণ পর আপনাথেকেই পলান আর জনাইয়ের লড়াই থেমে যায়। কারণ, শেষ পর্যন্ত পলান হেরে গিয়েছিল। ঘাস-পাতা ছাওয়া জমিতে চিত হয়ে পড়ে ছিল, হাঁপাচ্ছিল। ওর ঠোঁট ফুলে গেছে, ঠোঁটের কোণে রক্ত, বাঁ-দিকের ভুরুর শেষদিকটা ফেটে গেছে—রক্ত বেরোচ্ছে।

জনাই তখন আঙুল তুলে পলানকে শাসাচ্ছিল। বলছিল, আর কোনওদিন রোয়াবি দেখাতে এলে ও পলানের বডিটা নেপালার কোপে কুচিকুচি করে কলাবতী নদীতে ভাসিয়ে দেবে।

তখন পলান নাকি জনাইয়ের পায়ে ধরে ক্ষমা চায়, কান্নাকাটি করে। এমনকী জনাইকে ‘জনাইদা’ বলে ডাকতে থাকে। বলে যে, ওরকম ভুল আর কখনও ও করবে না।

যখন সবকিছু একটা মিটমাটের চেহারা নিয়েছে তখন পলান উঠে দাঁড়িয়ে জনাইয়ের সঙ্গে হাসিমুখে হ্যান্ডশেক করে এবং সেই সময়েই জনাইকে আচমকা এক ধাক্কা দিয়ে ঝিলের জলে ফেলে দেয়।

জনাই সাঁতার জানত না। সেটা জনাইয়ের বন্ধুটি জানত, কিন্তু পলান বা ওর বন্ধুরা জানত না। অন্তত পুলিশকে ওরা তাই বলেছিল। ওরা ভেবেছিল জনাই সাঁতার জানে।

জনাইকে বাঁচাতে পলান ঝিলের জলে ঝাঁপ দিয়েছিল। ডুবে যাওয়া ছেলেটাকে বাঁচানোর জন্য অনেক চেষ্টা করেছিল—কিন্তু শেষ পর্যন্ত জনাইকে বাঁচানো যায়নি।

ব্যাপারটা নিয়ে পুলিশি তদন্ত শুরু হয়েছিল। কিছুদিন চলেও ছিল ব্যাপারটা। তারপর প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী থিতিয়ে পড়ে। পলানের বিরুদ্ধে কোনও কেস পুলিশ দাঁড় করাতে পারেনি। তা ছাড়া এজাহার দেওয়ার সময় পলান এবং ওর বন্ধুরা শুরু থেকে সেই এককথা বলে গেছে : ‘জনাই যে সাঁতার জানে না সেটা আমরা জানতাম না’ এবং ‘মারপিট করতে-করতে জনাই আচমকা জলে পড়ে গেছে। এটা একটা অ্যাক্সিডেন্ট।’

জনাইয়ের বন্ধুটি বিতর্ক তুলে বারবার বলেছিল, ‘পলান ছেলেটা ঝগড়া মিটমাট করে জনাইয়ের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করার পর হঠাৎই জনাইকে ধাক্কা দিয়ে জলে ফেলে দেয়।’ কিন্তু তাতে কোনও কাজ হয়নি। ‘বেনিফিট অফ ডাউট’ পলানের ফরে গিয়েছিল।

পুলিশের কেস-টেস মিটে যাওয়ার বেশ কিছুদিন পর পলান বন্ধুদের আড্ডায় বড়াই করে বলে যে, পুলিশকে ও কেমন বুরবাক বানিয়েছে। জনাইয়ের কেসটা আসলে মার্ডার। পলান আগে থেকেই ভালো করে জানত যে জনাই সাঁতার-টাতার জানত না। পলান খবর পেয়েছিল, ‘আশাপুর হাই স্কুল’-এ দোলের আগের দিন রাতে জনাইরাই আগুন লাগিয়েছিল। তাই জনাইকে মার্ডার করে পলান বদলা নিয়েছে।

ব্যাপারটা ‘হুইসপারিং ক্যাম্পেইন’-এ ধীরে-ধীরে আশাপুরে ছড়িয়ে গেল। এবং আশাপুরের মানুষ মনে-মনে দু-ভাগে ভাগ হয়ে গেল। একদল পলানকে ‘খুনি’ ঠাওরাল। আর-একদল ভাবল পলান ‘বীর’, ‘বিপ্লবী’—’আশাপুর হাই স্কুল’-এর ওপরে অন্যায় আক্রমণের বদলা নিয়েছে।

এইভাবেই শুরু হয়ে গিয়েছিল পলান নস্করের ক্রাইম-জীবন।

জনাইয়ের ঘটনার পরই ও লেখাপড়া পুরোপুরি ছেড়ে দিয়েছিল, আর খারাপ কাজের দিকে বিশেষভাবে মনোযোগ দিয়েছিল। ওর সঙ্গীসাথী যারা ছিল তারা ওর কুকাজের শাগরেদ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

লেখাপড়া না শিখলে কী হবে, পলানের যথেষ্ট বুদ্ধি আছে—বুদ্ধি মানে কুবুদ্ধি। এই যেমন ধরা যাক, ওর নিয়মিত তোলা আদায়ের ব্যাপারটা। আশাপুরে যার-যার কাছ থেকে ও তোলা তোলে তাদের প্রত্যেককে ও বিল কেটে দেয়। বিলে লেখা থাকে ‘আশাপুর উন্নয়ন সমিতি’। আরও লেখা থাকে যে, আশাপুরের উন্নয়নের কাজে চাঁদা হিসেবে টাকাটা নেওয়া হচ্ছে।

বোঝাই যাচ্ছে, ‘আশাপুর উন্নয়ন সমিতি’ একটা ঢপের সংস্থা এবং পলান নস্করই এর সব। অর্থাৎ, পলানই হচ্ছে এর সেক্রেটারি, প্রেসিডেন্ট, ক্যাশিয়ার—সব। সুতরাং, যখন কেউ ‘স্বেচ্ছায়’ আশাপুরের উন্নয়নের কাজে চাঁদা দিচ্ছে তখন পুলিশের কিছু বলার থাকতে পারে না। তা ছাড়া পলানও তো পুলিশকে মাসে-মাসে ‘চাঁদা’ দেয়। তাই পুলিশ আশাপুরের স্রেফ অঙ্গসজ্জা হয়ে বেঁচে রয়েছে। পলানের ‘ব্লাইন্ড ফাইট’ গেম নিয়েও পুলিশের কোনও মাথাব্যথা নেই। ওটা তো নিছকই একটা গেম—তার বেশি তো কিছু নয়!

সাইকেল রিকশায় যেতে-যেতে রতনমণি মাঝি রোশনকে পলানের ‘সংক্ষিপ্ত জীবনকাহিনি’ শোনাচ্ছিলেন। রোশন একমনে শুনছিল। শুনতে-শুনতে ও এমন ঘোরের মধ্যে ঢুকে গেল যে, পেটের কাটা জায়গাটার জ্বালা কিছুক্ষণের জন্য ভুলে গেল।

সাইকেল রিকশা চলতে-চলতে বাঁ-দিকে ঘুরেছে আবার। একটা সরু রাস্তায় ঢুকে পড়েছে। আগের রাস্তাটার তুলনায় এই রাস্তাটা আরও বেশি অন্ধকার এবং বেশ ফাঁকা-ফাঁকা। কয়েকটা মাঠ আর একটা পুকুর চোখে পড়ল রোশনের। কোত্থেকে যেন হাওয়া ছুটে আসছিল—রোশেনের মুখ ছুঁয়ে যাচ্ছিল বারবার।

একটু পরেই রিকশা থামল। ডক্টর সুধীর পাঠকের চেম্বার এসে গেছে। সামনে কয়েক ধাপ সিঁড়ি। তারপর চেম্বার। চেম্বারের মাথায় সাইনবোর্ড। তাতে লেখা : ‘সুনিরাময়’। তার নীচে ডাক্তারবাবুর নাম লেখা রয়েছে ‘ডক্টর সুধীর চন্দ্র পাঠক, এম. বি. বি. এস.’।

রোশনের সাইকেল রিকশা থেমে যাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে রিকশার অনুসারী হয়ে আসা তিনটে সাইকেলও দাঁড়িয়ে পড়ল।

সুধীরডাক্তারের চেম্বারে টিউবলাইট জ্বলছে। ঘরটা বেশ বড়। দু-পাশে দুটো লম্বা-লম্বা বেঞ্চি পাতা রয়েছে। সেখানে চারজন পেশেন্ট বসে রয়েছে। ঘরের পিছনের দেওয়াল ঘেঁষে ডাক্তারবাবু বসে রয়েছেন। ফরসা, মোটাসোটা চেহারা। কালো চুল ব্যাকব্রাশ করে আঁচড়ানো। চোখে মোটা ফ্রেমের সেকেলে চশমা।

ডাক্তারবাবুর সামনে একটা ছোট টেবিল। ওঁর মুখোমুখি চেয়ারে একজন পেশেন্ট বসে রয়েছে। পেশেন্টের মুখ কাচুমাচু। ডাক্তারবাবু মাথা নীচু করে নিজের প্যাডে একটা প্রেসক্রিপশন লিখছেন। সেই অবস্থাতেই জোরালো গলায় বললেন, ‘এই ট্যাবলেটটা সাতদিন একটা করে খাবেন। দু-চারদিন খেয়ে ছেড়ে দেবেন না।’

ডাক্তারবাবুর পাশে দেওয়ালে একটা ইংরেজি ক্যালেন্ডার ঝুলছে—তাতে বড়-বড় হরফে তারিখ লেখা। ক্যালেন্ডারের পাশেই ঠাকুরের ফটো। ফটোর সামনে ঠাকুরের আসনে ছোটমাপের দুটো ধূপকাঠি জ্বলছে। ধূপের গন্ধ ছড়িয়ে আছে চেম্বারে।

সুধীরডাক্তারের চেম্বারটা বেশ মলিন। দেওয়ালে অনেকদিন কলি পড়েনি। ফার্নিচারগুলোও বেশ পুরোনো। ডাক্তারবাবুর পাশে একটা খাটো আলমারি দাঁড়িয়ে ছিল। তার পাল্লায় কাচ বসানো। সেটা দেখে বেশ নতুন বলে মনে হয়। তার পাশটিতে একটি সরু খাটে বিছানা পাতা রয়েছে—পেশেন্টদের চেক-আপের জন্য।

রতনমণি রোশনের কাঁধে হাত রেখে ওকে সঙ্গে নিয়ে সিঁড়ির ধাপগুলো উঠলেন। ওঁদের পিছনে তিনজন সঙ্গী।

পেশেন্টরা সকলে রোশনদের দিকে তাকাল। ডাক্তারবাবুও প্রেসক্রিপশন লেখা থামিয়ে মুখ তুলে তাকালেন।

রতনমণি মাঝি বললেন, ‘ভাই সুধীর, একটা এমার্জেন্সি কেস নিয়ে এসেছি। এই ছেলেটি—রোশন—চোট পেয়েছে। কালীমন্দিরের ওখানে। তুমি শিগগিরই একটু দ্যাখো…।’

সুধীরডাক্তার চেয়ার ছেড়ে চট করে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘আসুন রতনদা, এদিকে নিয়ে আসুন। একটু আগে আমি ফোনে খবর পেয়েছি। আমার একজন পেশেন্ট স্পটে ছিল। সে সব দেখেছে…আমাকে ফোনে সব বলেছে…।’

ডাক্তারবাবুর সামনের চেয়ারের রুগিটিও উঠে দাঁড়াল। রোশনকে জায়গা করে দিতে চাইল।

রতনমণি মাঝি রোশনকে আগলে নিয়ে গিয়ে সুধীরডাক্তারের সামনের চেয়ারটায় বসিয়ে দিলেন।

ডাক্তারবাবু বললেন, ‘না, না—চেয়ারে না। ওর তো পেটে উন্ড আছে। ওকে এই বেডটায় শুইয়ে দিন—।’

রতনমণি রোশনকে বিছানায় শুয়ে পড়তে বললেন। ওর কাঁধের কাছটা ধরে শুতে সাহায্যও করলেন।

সুধীরডাক্তার এগিয়ে এসে রোশনের ওপরে ঝুঁকে পড়লেন। চাপা গলায় বললেন, ‘পলানটা বড্ড বেড়েছে…।’

***

ঠিক সেই সময় পলান দুজন শাগরেদকে নিয়ে কালীমন্দিরে পৌঁছে গেছে।

পুরুতমশাই আরতি করছিলেন। বাইকের আওয়াজে আরতি করতে-করতেই পিছনদিকে তাকালেন।

দুটো মোটরবাইক মন্দিরের চাতাল ঘেঁষে এসে দাঁড়িয়েছে। তাদের ইঞ্জিন গরগর করছে। তারই একটায় বসে আছে পলান। দু-হাত বাইকের দু-হাতলে। গায়ে লাল রঙের রাউন্ড নেক টি-শার্ট। টি-শার্টের দু-হাতার নীচে পলানের পেশি অহংকারে টগবগ করে ফুটছে।

পলান বাইকের ইঞ্জিন অফ করল।

মন্দিরে হাজির ভক্তের দলকে চমকে দিয়ে ছোটলোকের মতো চেঁচিয়ে উঠল।

‘এ ঠাকুরমোসাই! ঠাকুরমোসাই! কয়েকটা পেন্ডিং কাজ সারতে চলে এলাম।’ পলান জনগণের দিকে মুখ ফিরিয়ে তাকাল। পকেট থেকে একটা রিভলভার বের করে উঁচিয়ে ধরল। তারপর : ‘অ্যাই, সব ফোট! পুরুতমোসাই ছাড়া সব পাতলা হয়ে যা! ফোট, সব ফোট…!’

পলানের কথায় পুরুতমশাইয়ের আরতি থমকে গেল। একজন মাঝবয়েসি মানুষ মন্দিরের ঝোলানো ঘণ্টাটা বাজাচ্ছিলেন—তাঁর হাতের আন্দোলন থেমে গেল। বেশ কয়েকজন মন্দিরের দরজার কাছে গিয়ে ঠাকুরমশাইয়ের পাশে জড়ো হয়ে গেল।

ঠাকুরমশাইয়ের একহাতে পঞ্চপ্রদীপ—তার পাঁচটা শিখা জ্বলছে। বাঁ-হাতে ধরা ছোট ঘণ্টাটা থেমে থাকলেও তার ছোট ধাতুর পেন্ডুলামটা তিরতির করে দুলছে। মন্দিরের ভেতরে দুটো জ্বলন্ত ধুনুচি মেঝেতে রাখা ছিল। সেগুলো থেকে ধোঁয়া বেরিয়ে ওপরে উঠছে। ধোঁয়ার সঙ্গে-সঙ্গে ধুনোর গন্ধ ছড়িয়ে যাচ্ছিল বাতাসে। কারও-কারও চোখ অল্প-অল্প জ্বালা করছিল।

পলান বাইক থেকে নেমে বাইকটাকে স্ট্যান্ডে দাঁড় করাল। ওর দুজন শাগরেদ দ্বিতীয় বাইকটায় বসে ছিল। ওদের বাইকের ইঞ্জিন তখনও গরগর করছিল। শাগরেদদের একজনের চোয়াল নড়ছিল। বোধহয় চুইংগামজাতীয় কিছু চিবোচ্ছিল।

‘এ তুমি কী করছ, পলান!’ পুরুতমশাই আহত গলায় বলে উঠলেন, ‘ভুলে যেয়ো না এটা মন্দির—জাগ্রত মা-কালীর মন্দির। তুমি তো এই আশাপুরেরই ছেলে! জগন্ময়ী কালীমন্দিরকে শ্রদ্ধা বা সম্মান করতে শেখোনি!’

পলান ঠাকুরমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসল। কুমির যদি হাসতে পারত তা হলে বোধহয় এমনটাই দেখাত।

পুরুতমশাইয়ের কথার পিঠে আরও দু-তিনজন বলে উঠল, ‘কালীমন্দিরে এসব রক্তারক্তি ব্যাপার…এসব কি ভালো হচ্ছে?’

পলান সেসব কথায় কোনও পাত্তা না দিয়ে টুসকি দিয়ে বলল, ‘অ্যাই, বললাম না, সব ফোট—সোজা ন’ দো গিয়ারা হো যা…!’

পলানের হুমকিতে দু-চারজন করে ভিড় পাতলা হতে লাগল।

পলান এবার পুরুতমশাইয়ের দিকে কয়েক পা এগিয়ে গেল। দাঁত খিঁচিয়ে বলল, ‘আবে কেলে চিংড়ি, অনেক জ্ঞান দিয়েছিস—এবার শাটার বন্ধ কর! এখানে কিচ্ছু হয়নি! পুলিশ ছানবিন করতে এলে ভাট বকবি না—যা সত্যি তাই বলবি। এখানে কিচ্ছু হয়নি—সব ঠিকঠাক আছে…।’

‘কী বলছ? কিচ্ছু হয়নি!’ পুরুতমশাইয়ের মুখটা সামান্য হাঁ হয়ে গেল। অসহায় মানুষটা মা-কালীর মুখের দিকে তাকাল।

তখনও যে-কয়েকজন ভক্ত পুরুতমশাইয়ের চারপাশে এদিকে-ওদিকে দাঁড়িয়ে ছিল তারা অবাক ভয়ে পলানকে দেখছিল।

পলান শাগরেদদের দিকে তাকিয়ে হুকুম দিল, ‘অ্যাই, নে, অ্যাকশন শুরু কর…।’

সঙ্গে-সঙ্গে দ্বিতীয় বাইকটার ইঞ্জিন থেমে গেল। শাগরেদ দুজন বাইক থেকে নেমে পড়ল। বাইকটাকে স্ট্যান্ডে দাঁড় করিয়ে দিল একজন। তারপর বাইকের কেরিয়ারের ডালা খুলে দুটো ন্যাকড়া আর একটা জলের বোতল বের করে নিল।

এবার যা শুরু হল তা সত্যিই অবাক করার মতো। পলানের একজন চ্যালা বোতলের ছিপি খুলে মন্দিরের চাতালে এদিক-ওদিক বেশ ভালো করে জল ছিটিয়ে দিতে লাগল। আর অন্যজন একটা ন্যাকড়া দিয়ে চাতালের ওপরে হুমড়ি খেয়ে হাঁটুগেড়ে বসে পড়ল এবং চটপটে হাতে চাতালটা মুছতে লাগল।

বোতালের জল খালি হয়ে যেতে দ্বিতীয়জন খালি বোতলটা ওদের বাইকের কেরিয়ারে ঢুকিয়ে দিল। তারপর দ্বিতীয় ন্যাকড়াটা দিয়ে চাতাল মোছার কাজ শুরু করে দিল।

চাতালের যে-অংশে রোশন আর সুবুর সংঘর্ষ হয়েছিল সেখানে রক্তের কয়েকটা ফোঁটা পড়ে ছিল। এ ছাড়া ছিল ইটের ছোট-ছোট দু-তিনটে টুকরো আর ধুলো, মাটি, রক্তের দাগ। পলানের চ্যালা দুজন মুখ বুজে ক্ষিপ্র হাতে চাতালটা মুছে পরিষ্কার করতে লাগল।

পাঁচ-সাত মিনিটের মধ্যেই ওদের কাজ শেষ। চাতালটা এখন ঝকঝকে তকতকে। লড়াইয়ের কোনও চিহ্নই সেখানে আর নেই।

কাজ শেষ হতে ওরা উঠে দাঁড়াল। প্রশ্ন নিয়ে তাকাল পলানের দিকে। যার অর্থ : ‘দাদা, দ্যাখো তো, ঠিকঠাক সাফা হয়েছে কি না—।’

পলান চোখ সরু করে সেই নজর দিয়ে চাতালটা একবার চেটে নিল। তারপর বলল, ‘নে, জলদি এপিসোড শেষ কর…।’

এ-কথা বলামাত্রই শাগরেদ দুজন ভিজে ন্যাতা দুটো বাইকের কেরিয়ারে গুঁজে দিল। একজন বাইকটা স্ট্যান্ড থেকে নামিয়ে তাতে চড়ে বসল। দু-হাতের মুঠোয় হাতল দুটো ধরে কিক স্টার্ট দিল।

অন্যজন ‘মহাপ্রণামী’ লেখা বাক্সটা চাগিয়ে তুলে নিল।

সেটা দেখে ভক্তদের একজন মোবাইল ফোন বের করে ক্যামেরা তাক করল তার দিকে।

পলান দু-লাফে লোকটির কাছে পৌঁছে গেল। সপাটে এক থাপ্পড় কষাল তার গালে।

লোকটা ছিটকে পড়ল মেঝেতে। আর হাতের মোবাইল ফোনটাও কোথায় যেন ছিটকে পড়ল।

‘সুয়োরের বাচ্চা!’ চোখ কটমটিয়ে চিবিয়ে-চিবিয়ে বলল পলান, ‘তোর সাহস তো কম নয়! ফটো তোলা একেবারে কামফুট করে দেব। অ্যাই, সবাই কান খুলে শুনে রাখ—কারও ফোনে যেন আজকের ক্যাচাল কেসকামারির কোনও ফটো-টটো না থাকে। সব ফটো ডিলিট করে দিবি। নইলে আমি সবক’টা হারামির অওলাদকে দুনিয়া থেকে ডিলিট করে দেব!’ মারার ভঙ্গিতে হাত তুলে শরীরের একটা ঝটকা দিল পলান : ‘ফোট—ফোট এখান থেকে!’

পলানের হুমকিতে সবাই তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে সটকে গেল। ভাগশেষ হিসেবে পড়ে রইলেন শুধু পুরুতমশাই।

ততক্ষণে মোটরবাইক রওনা হওয়ার জন্য রেডি। চুইংগাম চিবোনো ছেলেটা পাইলটের সিটে বসে হাতল ঘুরিয়ে ইঞ্জিনের গর্জন ওঠা-নামা করাচ্ছে, আর দ্বিতীয়জন তার পিঠে পিঠ লাগিয়ে বাইকের উলটোমুখী সওয়ারি হয়ে বসেছে। মহাপ্রণামীর বাক্সটা তার দু-হাতে ধরা—তার কোলের ওপরে বাক্সের লোডটা ব্যালান্স করা।

পলান চ্যালা দুজনের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে বলল, ‘হাঁ করে দেখছিস কী! কেটে পড় তোরা। বাক্সটাকে আমাদের তিননম্বর ঠেকে ছুপে লে। তারপর দেখি পুলিস কী কেস করে।’

ওদের বাইক গর্জন তুলে মন্দির থেকে রওনা হয়ে গেল।

পলান পুরুতমশাইয়ের কাছে গেল। মিষ্টি গলা করে বলল, ‘ও ঠাকুরমোসাই—তাকিয়ে দ্যাখো ওই চাতালটার দিকে—একেবারে সাফসুফ থুতুপালিশ করা। এখানে কোনও ক্যাজরা হয়নি, কোনও মারপিট হয়নি, কেউ চোট পায়নি, কারও ব্লাড-ফাড খরচা হয়নি। আর পুলিস এলে দেখবে, এখানে প্রণামীর বাক্স ওই একটাই—”মহাপ্রণামী” লেখা কোনও বাক্স কোনওদিন এখানে ছিল না—কী বলো, ঠাকুরমোসাই?’ বাঁকা সুরে প্রশ্নটা করে ‘হ্যা-হ্যা’ করে হেসে উঠল পলান। যেন বেশ উঁচুদরের একটা জোক মেরেছে।

পুরুতমশাই তোতলাতে শুরু করলেন। ওঁর রোগা শরীরটা রাগে কাঁপছিল। কিন্তু ওই কাঁপা পর্যন্তই। অসহায় মানুষটা মা-কালীর মুখের দিকে তাকাল। তার চোখের কোণ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। কয়েকবার ঢোঁক গিলে পুরুতমশাই কোনওরকমে বললেন, ‘মা-কালী সব দেখেছেন। তুমি যতই মিথ্যে বল, সত্যিটাকে কিছুতেই ঢাকা দিতে পারবে না…।’

পলান ঠাকুরমশাইয়ের খুব কাছে এগিয়ে গেল। ঠাকুরমশাইয়ের মুখের ওপরে মুখ এনে বলল, ‘চুপ কর, সালা!’ রিভলভারটা রোগা থরোথরো মানুষটার মুখের সামনে নিয়ে এল : ‘এখুনি একটা দানা ঠুকে দিলে তোর লাইট অফ হয়ে যাবে!’

কথাগুলো বলার সঙ্গে-সঙ্গে এক ফুঁয়ে ঠাকুরমশাইয়ের হাতের পঞ্চপ্রদীপের একটা শিখা নিভিয়ে দিল পলান।

ঠাকুরমশাই ভয়ে পিছনে সরতে গিয়ে প্রায় পড়েই যাচ্ছিলেন। ওঁর শরীরের আন্দোলনে হাতের ছোট ঘণ্টাটা টুং-টুং করে বেজে উঠল।

পলান চারপাশে একবার দেখল। কেউ নেই—সব ফাঁকা। ওর হুমকিতে ভালোই কাজ হয়েছে। এবার পুলিশে ফোন করে দেওয়া যাক।

রিভলভারটা পকেটে ঢুকিয়ে মোবাইল ফোন বের করল পলান। তারপর সাব-ইনস্পেকটর সুরেন্দ্রনারায়ণ দাসকে ফোন করল।

‘অ্যাই, সুরেনদা—পলান বলছি…।’

‘হ্যাঁ-হ্যাঁ, বলুন পলানদা। এতক্ষণ আপনার ফোনটার জন্যেই ওয়েট করছিলাম।’

‘জগন্ময়ী কালীমন্দিরে একবার চলে আসুন। এখানকার ঠাকুরমোসাইয়ের সঙ্গে একবার কথা বলুন। মালটা কীসব ভুলভাল বকছে…।’

‘আর বলবেন না, পলানদা—’ একেবারে ইয়ারদোস্তের সুরে বলল সুরেন দাস, ‘তখন থেকে কয়েকটা পাবলিক বারবার থানায় ফোন করে একেবারে জ্বালিয়ে মারছে। বলছে, মন্দিরের চাতালে নাকি দু-দুটো প্রণামীর বাক্স—সে নিয়ে কীসব ফ্রিকশন লেগেছে। আমি তো গাড়ি নিয়ে বেরোইনি। আপনার গ্রিন সিগন্যাল না পেলে তো আমি বেরোই না আপনি জানেন। তাই আপনার ফোনটার জন্যেই ওয়েট করছিলাম…।’

পলান হেসে বলল, ‘ওসব কিচ্ছু নয়। পুরোটাই বলতে গেলে গুজব। কে একজন ফোন করে আমাকে খবর দিয়েছিল…তো এসে দেখছি হান্ড্রেড পার্সেন্ট ভুল খবর। এখানে সবকিছু ঠিকঠাক…ঠাকুরমোসাইও তাই বলছেন। তবুও আপনি একবার রাউন্ড দিয়ে যান, কথা বলে যান…।’

‘হ্যাঁ-হ্যাঁ, এখুনি যাচ্ছি। আর…মানে, আমার ভিজিটের টাকাটা…।’

‘কোনও চিন্তা করবেন না, সুরেনদা। ও-টাকা কালকের মধ্যেই আপনার ডানপকেটে পৌঁছে যাবে।’

ফোন শেষ করল পলান। ফোনটা পকেটে রেখে সিগারেটের প্যাকেট বের করল। একটা সিগারেট ধরিয়ে কয়েকবার টান দিল। ধোঁয়া ছাড়তে গিয়ে কাশল দুবার। ঠাকুরমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট বেঁকিয়ে একবার নিঃশব্দে হাসল। তারপর বাইকের কাছে গিয়ে চড়ে বসল। একহাতে স্টিয়ারিং ধরে কিক স্টার্ট দিল। গরর গরর গর্জন তুলে পলানের বাইক চলতে শুরু করল।

রোশন ছোকরাটা ধীরে-ধীরে যেন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সুবু আর পানকো—মানে, প্যাঁকাটির থেকে—এপিসোডের সব খবরই পেয়েছে পলান। বারবার ‘মহাপ্রণামী’-র বাক্সের টাকা পানকো আর সুবুই কালেকশন করে। কখনও এ নিয়ে কোনও লাফড়া হয়নি। কিন্তু এবারে রোশন ছেলেটা কী করে যেন মাঝখানে ঢুকে পড়েছে। ঢুকে পড়েই একটা ঝামেলা বাধিয়েছে।

রোশনের সঙ্গে এতদিনে যে-ক’বার ঝামেলা হয়েছে প্রত্যেকবারই ব্যাপারটা বেশ ভালোরকম চাউর হয়ে গেছে। আজকের ঝামেলাটাও এতক্ষণে ছড়িয়ে গেছে আশাপুরে। এটা পলানের পক্ষে মোটেই ভালো হচ্ছে না। কারণ, সবসময় পাবলিক সিমপ্যাথি রোশনের দিকে যাচ্ছে। এর ফলে একটা সময় এমন আসবে যে, পাবলিক আর পলানের ভয় দেখানো শাসন মানবে না।

নিজের ওপরে রাগ হচ্ছিল পলানের। একটা অচেনা অজানা অজ্ঞাতকুলশীল ছেলে কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসল আশাপুরে আর পলানের সলিড পাথরের দুর্গে চিড় ধরতে শুরু করল।

রোশন! রোশন! রোশন!

পলানের মাথার ভেতরে আগুন জ্বলে উঠল হঠাৎ। ছেলেটাকে আর বরদাস্ত করা যাচ্ছে না।

ও কোথা থেকে এল? ওর ব্যাকগ্রাউন্ড কী? পলানকে সেসব জানতে হবে। ছেলেটার পাস্ট হিস্ট্রি খোঁড়াখুঁড়ি করে ওর গল্পটাকে বের করে আনতে হবে। তারপর…তারপর এমন একটা কিছু করতে হবে যাতে আশাপুরের মানুষের কাছে রোশন অসহ্য হয়ে ওঠে। তা হলে এখানকার মানুষরাই রোশনকে হেনস্থা করবে, অপমান করবে, এমনকী গায়েও হাত তুলতে পারে।

হাতের সিগারেটটা অনেক ছোট হয়ে গিয়েছিল। পলানের বাইক তখন একটা অর্ধেক তৈরি হওয়া আধাখ্যাঁচড়া বাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। বাইক বেশ জোরে ছুটছিল। ওর মুখে মাথায় হাওয়ার ঝাপটা লাগছিল। সিগারেটের টুকরোটা এক টুসকিতে বাড়িটার দিকে ছিটকে দিল পলান। আগুনের বিন্দুটা বাতাসে সাঁতার কেটে উড়ে গেল। একটু পরেই মাটিতে পড়ল। আগুনের ফুলকি ঠিকরে গেল এদিক-ওদিক।

পলানের মনে পড়ল, সাত-আটমাস আগে রেললাইনের ধারে ও একটা ছেলের লাশ নামিয়ে দিয়েছিল। ছেলেটার বয়েস কত ছিল? পঁচিশ কি ছাব্বিশ। ছেলেটা গোডাউন ফাইটের এগেইনস্টে পাবলিসিটি করছিল। দলবাজি করছিল। বলছিল, পলান আর ওর দলবলকে পাবলিক চিরকাল বরদাস্ত করবে না।

ছেলেটার নাম ছিল সুভাষ। আশাপুরের দক্ষিণদিকে রয়েছে একটা গ্রাম, বইজুপুর। ছেলেটা সেই বইজুপুরে থাকত। ফরসা রোগা চেহারা ছিল ওর। নিজেকে বোধহয় নেতাজি সুভাষ ভাবত। তাই বড্ড বাড়াবাড়ি করছিল।

গোডাউন ফাইট নিয়ে মিউচুয়াল করার জন্য একদিন রাতে সুভাষকে রেললাইনের ধারে ডেকে এনেছিল পলান।

তারপর ওকে ঠুকে দিয়েছিল।

রোশনকেও সেরকম একটা কিছু করলে হয়।

***

বারো নম্বর বস্তির ভেতরের ‘লুকোচুরি’-গলি ধরে নিতু ওর জীর্ণ সাইকেলটাকে ‘হাঁটিয়ে’ নিয়ে যাচ্ছিল। কোথাও-কোথাও গলির বাঁকগুলো এমন যে, সাইকেলটাকে পাস করাতে দুবার আগুপিছু করাতে হয়।

সকাল সবে সাড়ে সাতটা পেরিয়েছে। কিন্তু এর মধ্যেই বস্তির অনেক ঘর থেকেই রান্নার গন্ধ আর ছ্যাঁকছোঁক আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। গন্ধগুলো নিতুয়ার খুব ভালো করে চেনা। আর এই বস্তিতে যারা থাকে তাদের রান্নার দৌড় কতটুকু সেটাও নিতুয়ার ভালো করে জানা। ভাত, জলের মতন একটু ডাল, আর আলুসেদ্ধ অথবা ডাঁটাচচ্চড়ির মতন কিছু একটা।

নিতুর রান্নাবান্নার পাট নেই। একা মানুষ—রোশনের মতোই। তাই রাস্তার ধারের ঝুপড়ি হোটেলে ডাল-ভাত খেয়েই দিন কাটে। আর রাতে তিনটে রুটি, সঙ্গে একটু আলুভাজা। সারাদিনে নিতু যে এসব ছাড়া আর কিছু খায় না তা নয়। রোজ ওর বরাদ্দ একপ্যাকেট বিড়ি আর দু-চার ঢোঁক সস্তার নেশা। প্রায়ই ভাবে ওই ‘এইচ টু ও’-র নেশাটা ছেড়ে দেবে—অনেক চেষ্টাও করেছে ছেড়ে দেওয়ার—কিন্তু এখনও পর্যন্ত পেরে ওঠেনি। তবে চেষ্টাটা ছাড়েনি।

নিতুর নাকে রান্নার ঝাঁজ এল, ফোড়নের গন্ধ এল। ওর খিদে পেল, জিভে জল চলে এল। কিন্তু না, এখন খিদে পেলে চলবে না। নিজেকে শাসন করল নিতু : সকালে ও না একপিস পাঁউরুটি আর চা খেয়েছে! আবার সেই বেলা একটা-দুটোয় খাবে।

অভাব—অভাবটা বড় চেপে ধরেছে। অথচ যখন ও বাসে-ট্রেনে ভিড়ের মধ্যে নিজেকে মিশিয়ে চুপিসাড়ে পকেট কাটার অপারেশন চালাত তখন ওর আয় নেহাত মন্দ ছিল না। ঠিকমতো ‘কাজ’ হলে হাতে ভালো টাকাই থাকত। বেশ ফুটানি করে দিন কাটত, ভালোমন্দ খেত। কিন্তু একটা সময়ে ওর ক্ষমতা কমতে লাগল। যে-ক্ষমতা পকেটমারদের জন্য সবচেয়ে জরুরি। মার খাওয়ার ক্ষমতা, মার খেয়ে মার সহ্য করার ক্ষমতা।

পকেটমার কখনও না কখনও ধরা পড়বেই। তখন তার কপালে পাবলিক ধোলাই অনিবার্য। নিতু সেই ধোলাই দিব্যি সহ্য করতে পারত। এ ব্যাপারে বস্তিতেও ওর বেশ নামডাক ছিল। কিন্তু গত তিন-চারবছর ধরে ওর শরীর সেই ধকল আর নিতে পারছে না। একবার ও পয়সা খরচ করে ডাক্তারও দেখিয়েছিল। ডাক্তারবাবু যা বলেছিলেন তাতে ও ভয় পেয়ে গিয়েছিল। ওর শিরদাঁড়ায় নাকি বেশ গোলমাল রয়েছে। যদি কখনও সেরকম চোট লাগে তা হলে স্রেফ বিছানায় শুয়ে বাকি জীবনটা কাটাতে হবে।

সে-কথা শুনে নিতু ভয় পেয়ে গিয়েছিল। বলতে গেলে প্রায় পরদিন থেকেই লাইন ছেড়ে দিয়েছিল। এবং সেই থেকেই অভাব ওকে জড়িয়ে ধরতে শুরু করেছিল।

এ-গলি সে-গলি করে সাবিত্রীর ঘরের দরজায় এল নিতু। সাবিত্রী তখন উবু হয়ে বসে ঘর মুছছে। নিতুকে দেখে কাজ থামিয়ে তাকাল।

নিতু জিগ্যেস করল, ‘বউদি, ববিন কোথায়?’

‘কোথায় আবার? মাঠে—রোশনের সঙ্গে রোজ যেমন যায়…।’

‘আমি তা হলে মাঠেই যাই। সকালের হাওয়া টানলে শরীরটা ভালো থাকবে।’

সাইকেল ‘হাঁটিয়ে’ রওনা হয়ে গেল নিতুয়া। ও আসলে জানতে চাইছিল রোশন ববিনকে নিয়ে মাঠে ফুটবল খেলাতে গেছে কি না।

কিছুদিন হল রোশন কয়েকটা ছোট-ছোট বাচ্চাকে নিয়ে মাঠে ফুটবল খেলা শুরু করেছে। বাচ্চাদের সেই লিস্টে ববিনও আছে। ববিনকে নিয়েই রোশন ব্যাপারটা শুরু করেছিল—পরে বারো নম্বর বস্তির আরও চারটে বাচ্চা ছেলে সঙ্গে জুটে যায়।

ববিনকে সুন্দর একটা ফুটবল কিনে দিয়েছিল রোশন—তার গায়ে লাল আর সাদা রঙের ছ’কোনা খোপ-খোপ নকশা। তারপর ওকে বলেছিল, ‘তুই রোজ সকালে আমার সঙ্গে ফুটবল প্র্যাকটিস করবি…।’

ববিন তো ঘাড় হেলিয়ে এককথায় রাজি।

আশাপুরে একটা প্রাইমারি স্কুল আছে। তার সঙ্গে লাগোয়া একটা বিশাল ফাঁকা মাঠ। মাঠের জায়গায়-জায়গায় ঘাস থাকলেও বাকিটায় ঘাসের আস্তর নেই। মাঠের তিনদিকের সীমানার কাছাকাছি লম্বা-লম্বা ঘাস আর আগাছা। চার-পাঁচটা বড়-বড় গাছও আছে। একটা গাছের গা ঘেঁষে রংচটা একটা ঘরের মতন। ঘরটা জরাজীর্ণ, ভাঙাচোরা। এককালে একটা টয়লেট তৈরির চেষ্টা হয়েছিল—এটা তারই অবশেষ। মাঠে খেলতে এসে ছোট-বড় সবাই নিরুপায় হলে এটাকেই ব্যবহার করে।

মাঠের তিনদিকের রাস্তা কাঁচা হলেও একদিকে রয়েছে সরু পিচরাস্তা। সেই রাস্তা দিয়ে গাড়ি, মোটরবাইক, সাইকেল আর সাইকেল-রিকশা যাতায়াত করে। কখনও-কখনও বালি কিংবা স্টোনচিপ লোড করা লরিও যায়। সেইসব লরির চাপে রাস্তাটা জায়গায়-জায়গায় বসে গেছে, ফাটল ধরেছে। রাস্তার দুপাশে কোথাও-কোথাও খুচরো দোকানপাট—মুদিখানা দোকান, হার্ডওয়্যারের দোকান, মোবাইল ফোন রিচার্জের দোকান। এসবের মাঝে বেমানানভাবে একটা ব্যাংকও রয়েছে : সেন্ট্রাল ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া, আশাপুর ব্রাঞ্চ। ব্যাংকটা খেলার মাঠের ঠিক উলটোদিকে—একটা বড়সড় দোতলা বাড়ির গোটা একতলাটা জুড়ে। ব্যাংকে দু-দুটো টিনের সাইনবোর্ড লাগানো রয়েছে : একটা হরাইজন্টাল, আর-একটা ভার্টিক্যাল। দুটো সাইনবোর্ডই পুরোনো ধাঁচের, ফ্রেমের কোনা ভাঙা, টিন সামান্য তোবড়ানো।

নিতু সাইকেল চালিয়ে মাঠের কাছে চলে এসেছিল। একটা সরু নালা। তার ওপরে চওড়া কালভার্ট। সেটা পেরিয়ে ও রাস্তা থেকে ঢুকে পড়ল মাঠে। সাইকেল থামিয়ে নেমে পড়ল। সাইকেলটাকে স্ট্যান্ডে দাঁড় করিয়ে দিল। তারপর রোশন আর ববিনের দিকে দেখল।

সকালের রোদ এসে পড়েছে মাঠে। মাঠের কিনারায়, যেখানে কয়েকটা গাছপালার আড়াল রয়েছে, সেখানে গাছের পাতার ফাঁকফোকর দিয়ে এসে রোদের টুকরো খুচরো পয়সার মতন ছড়িয়ে পড়েছে মাঠের ওপরে। আর ফাঁকা জায়গায় রোদের চাদর মোলায়েমভাবে বিছিয়ে আছে।

মাঠের মাঝখানে ববিন ওর বয়েসি আরও চারটে ছেলের সঙ্গে ছুটোছুটি করছে। ওদের পায়ে-পায়ে ঘুরছে একটা ফুটবল—লাল আর সাদা রঙের।

গনিরামের শেষ কাজের সময় ববিন নেড়া হয়েছিল। সেইজন্যই ওর মাথায় এখন ছোট-ছোট মিহি চুল।

বাচ্চাগুলো খেলছে আর কচি গলায় চেঁচামেচি করছে। ওদের ‘কোচ’ রোশন তখন বালি নিয়ে ব্যায়াম করছে।

মাঠের একপাশে বালির স্তূপ। তার পাশেই থাকে-থাকে সাজানো কয়েকশো নতুন ইট। মাঠ পেরিয়ে দেখা যাচ্ছে, একটু নতুন বাড়ি তৈরি হচ্ছে। হয়তো তারই ইট আর বালি মাঠের এক পাশ ঘেঁষে রাখা হয়েছে।

রোশন ব্যায়াম করছিল।

বালির স্তূপের সামনে ঝুঁকে দাঁড়িয়েছিল ও। হাতের চেটো দুটোকে লোহার পাতের মতো শক্ত করে ও একবার ডানচেটোটা বালির মধ্যে প্রচণ্ড জোরে গেঁথে দিচ্ছিল, আর-একবার বাঁ-চেটোটা ঢুকিয়ে দিচ্ছিল বালির ভেতরে। এই কাজের সঙ্গে তাল মিলিয়ে রোশনের মুখ থেকে ছোট-ছোট শব্দের টুকরো ছিটকে বেরোচ্ছিল।

ওর খালি পা। গায়ে পোশাক বলতে ছাই রঙের শর্টস আর নীল রঙের একটা পোলো নেক টি-শার্ট। টি-শার্টটা ঘামে ভিজে গেছে। হাতে ঘামের ফোঁটা, কপালে, গলায় ঘামের প্রলেপ। হাতের পেশি যেন পাকানো দড়ি। তার ওপর দিয়ে নীলচে শিরা এঁকেবেঁকে চলে গেছে।

নিতুয়া পায়ে-পায়ে রোশনের কাছে এগিয়ে এল। ওর শরীরচর্চা দেখতে লাগল।

এই মাসখানেকের মধ্যেই ছেলেটা কী করে যেন আপনজন হয়ে গেছে। সবসময় সবাইকে হেলপ করার জন্য এগিয়ে যায়, অন্যায় দেখলে প্রোটেস্ট করে। অবশ্য তার জন্য ওকে হেনস্থাও কম হতে হয় না!

রোশন ব্যায়াম করতে-করতে নিতুয়ার দিকে একবার তাকাল, একটু হাসল।

নিতুয়াও হাসল। হাসিটা কেমন যেন অপরাধীর মতো দেখাল। আসলে ও রোশনের কাছে ক’টা টাকা ধার চাইতে এসেছে। সাবিত্রীর কাছে ও এইজন্যেই ববিনের খোঁজ করার ছলে জানতে চেয়েছিল রোশন আজ মাঠে বেরিয়েছে কি না।

পকেটমারি লাইন ছেড়ে দেওয়ার পর থেকে নিতু বেশ টানাটানির মধ্যে দিন কাটায়। তাই কিছু পয়সা সৎ পথে আয় করার জন্য ও যে-কোনও কাজের সুযোগ পেলেই সেটা আঁকড়ে ধরে। কারও বাগানের আগাছা সাফ করার কাজ, রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ, কুয়োর বেড় বসানোর কাজ বা কারও বাড়ির টালি ছাওয়ার কাজে হেলপারি, কিংবা রং করার ছোটখাটো কোনও কাজ।

এককথায় নিতু এখন ‘অড জব ম্যান’। ক’দিন হল ওর হাতে কোনও কাজ নেই, তাই সবকিছুতেই টান পড়েছে।

কিছুদিন আগে ওর টানাটানি অবস্থাটা টের পেয়ে রোশন নিজে থেকেই ওকে একশো টাকা দিয়েছিল। নিতু মিনমিন করে বলেও ছিল, ‘কোনও কাজ-টাজ পেলেই টাকাটা আমি শিয়োর শোধ করে দেব…।’ কিন্তু সেটা আর শোধ করে উঠতে পারেনি। আর রোশনও কখনও টাকাটা ফেরত চায়নি।

নিতু জোর করে জড়তা কাটিয়ে হেসে জিগ্যেস করল, ‘কী রোশন, তোমার পেটের কী অবস্থা?’

রোশন বুঝতে পারল নিতুদা ওর পেটের চোটের কথা জানতে চাইছে।

ও এক্সারসাইজ থামিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল, বলল, ‘সেরে গেছে, তবে এখনও একটু ব্যথা আছে। ইনফেকশন হয়ে গেলে প্রবলেম হত—সেটা হয়নি বলে বাঁচোয়া।’

একটু পরে ও নিতুকে জিগ্যেস করল, ‘নিতুদা, তোমার পেটের কী অবস্থা?’

নিতু প্রথমে একটু হকচকিয়ে গেল। তারপর বুঝল, রোশনের কাছে ও ধরা পড়ে গেছে। একটু কিন্তু-কিন্তু করে বলল, ‘হ্যাঁ, ভীষণ টানাটানি…।’

রোশন বলল, ‘হুঁ—বুঝেছি।’

দু-হাতে কয়েকবার তালি বাজিয়ে হাতে হাত ঘষে তালুতে লেগে থাকা বালি ঝেড়ে ফেলল রোশন। বালির স্তূপের একপাশে ওর একটা জিনসের প্যান্ট পড়ে ছিল। ও নিতুয়াকে ইশারা করে প্যান্টটা দিতে বলল। নিতু প্যান্টটা দিতেই ও প্যান্টের পকেটে হাত চালিয়ে দুটো একশো টাকার নোট বের করে নিয়ে এল। তারপর নিতুর দিকে এগিয়ে দিল : ‘এই নাও, নিতুদা। এই দিয়ে এখনকার মতো চেপেচুপে চালাও…।’

নিতু সংকোচের মলিন হাসি হাসল। টাকাটা নিয়ে পকেটে ঢোকাল।

‘ঠিকমতো দু-চারটে কাজ-টাজ পেলেই তোমার এই টাকাটা শোধ দিয়ে দেব…।’

রোশন বলল, ‘সে যখন হয় দিয়ো। তুমি বরং মন লাগিয়ে কাজ খোঁজার চেষ্টা করো। আর দেখো তো, আমার জন্যে কোনও প্রাইভেট কার চালানোর চাকরি জোটাতে পারো কি না।’

কথা বলতে-বলতে রোশন জিনসের প্যান্টটা শর্টসের ওপর দিয়ে পরে নিল। তারপর ববিনদের দিকে তাকিয়ে হাঁক পাড়ল : ‘অ্যাই, তোরা সব বলটা নিয়ে এদিকে আয়। জলদি আয়! আয় শিগগির!’

ববিনরা খেলা থামাল। ওদের একজন ফুটবলটা হাতে তুলে নিল। তারপর ওরা পাঁচজন ছুটে চলে এল রোশনের কাছে।

রোশন ওদের দেখছিল। পাঁচটা বাচ্চার মধ্যে অনেক মিল। ওদের প্রত্যেকের বয়েস দশ থেকে বারোর মধ্যে—কিংবা তার সামান্য এপাশ-ওপাশ। ওদের গায়ের রং মলিন। চোখগুলো বড়-বড়—সে-চোখে অনেক স্বপ্ন। ওরা হাসলেই সাদা দাঁতের সারি দেখা যাচ্ছে। ওদের গায়ে ময়লা স্যান্ডো গেঞ্জি অথবা ফতুয়া, কিংবা রাউন্ড নেক টি-শার্ট। আর কোমরে বাঁধা একটু-আধটু ছেঁড়া ময়লা হাফপ্যান্ট।

বারো নম্বর বস্তি থেকে শ’তিনেক মিটার দূরে রয়েছে আশাপুর চিলড্রেন’স পার্ক। সেখানে এলাকারই দুজন পড়ুয়া ছেলে দুপুরবেলা বাচ্চাদের পড়ায়। গোটাদশেক বাচ্চা নিয়ে দুপুর-স্কুল। এই পাঁচটা বাচ্চাই সেই স্কুলে পড়ে। সেখানে খোলা আকাশের নীচে স্কুল চলে। তাই বর্ষাকালে স্কুল বন্ধ থাকে। আর স্কুল চলার সময় যদি আচমকা অকালবৃষ্টি শুরু হয় তা হলেও স্কুল বন্ধ হয়ে যায়।

রোশনের তেতো হাসি পেল। বাচ্চাগুলো এতই গরিব যে, ওদের ভাগ্যে বিনাপয়সায় যেটুকু পড়াশোনা জোটে সেটুকুই অনেক।

ববিন ছাড়া বাকি চারটে বাচ্চার নাম রোশনের মনে আছে : রেমো, পটকা, পিনু, আর মুনিয়া। কিন্তু কে কোনটা সেটা এখনও ও নির্ভুলভাবে রপ্ত করতে পারেনি।

ছেলেবেলায় ফুটবল রোশনের পছন্দের খেলা ছিল। তাই ক’দিন ধরে ও এই পাঁচটা বাচ্চাকে নিয়ে ফুটবল প্র্যাকটিস শুরু করিয়েছে। বাচ্চাগুলোরও ফুটবল খেলায় যথেষ্ট ইন্টারেস্ট আছে। আর, একটা বাচ্চার পায়ের কাজ তো বেশ নজরে পড়ার মতো। কী যেন নাম ওর? পিনু, না রেমো?

পাখির ডাক শুনতে পেল রোশন। ‘চোখ গেল’ পাখি ডাকছে। পাখিটা মনে হয় মাঠের প্রান্তের কোনও একটা গাছে পাতার আড়ালে বসে আছে। পাখিটার ডাকের মধ্যে একলা থাকার একটা আর্তি ছিল। ডাকটা কেমন যেন লক্ষ্যহীন শূন্যতায় ভরা।

রোশন ওর বুকের ভেতরে ‘একলা পাখি’-র নিঃসঙ্গতার ছোঁয়া টের পেল। পাখিটাকে ওর বন্ধু বলে মনে হল।

রোশনের মনটা কোথায় যেন চলে যাচ্ছিল। ও মনটাকে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে পাঁচটা বাচ্চার দিকে ফেরাল। ওদের আর-এক দফা প্র্যাকটিস শুরু করাল। প্র্যাকটিসের মধ্যে রয়েছে বল পায়ে নিয়ে দৌড়োনো—সোজা ছুটে গিয়ে আবার ফিরে আসা, খানিকটা দূরে-দূরে সাজানো আধলা ইটের ফাঁক দিয়ে বল পায়ে সাপের মতো এঁকেবেঁকে দৌড়োনো, বলে শট মারা, হেড প্র্যাকটিস। এসব ছাড়া রয়েছে ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ আর দৌড় প্র্যাকটিস।

রোশনের প্র্যাকটিস চলছিল। নিতু ওর সাইকেলের পাশটিতে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ওদের দেখছিল। ওর ছেলেবেলার কথা মনে পড়ছিল। ফুটবল খেলতে নিতুও ভালোবাসত। স্কুলেও পড়াশোনা করতে যেত। তারপর কী করে যেন ঘুঁটিগুলো এলোমেলো হয়ে গেল। সাদামাঠা লাইফটা রঙিন হওয়ার বদলে কালো হয়ে গেল। নিতুয়া সেটার রং আর পালটাতে পারল না।

ছেলেগুলো বল শট মেরে প্র্যাকটিস করছিল। প্র্যাকটিস করার সময় বলটা কখনও-কখনও ছিটকে চলে যাচ্ছিল পিচরাস্তায় অথবা রাস্তার ওপারে—ব্যাংকের কাছে, হার্ডওয়্যারের দোকানের কাছে, নয়তো মোবাইলের দোকানের সামনে। সেই বল কুড়িয়ে নিয়ে আসছিল হয় নিতুয়া নয়তো রোশন। কারণ, রাস্তাটায় যানবাহনের ব্যস্ততা রয়েছে—যত বেলা বাড়ছে সেই ব্যস্ততা ততই বাড়ছে। পিনু, মুনিয়া, ববিনরা বলটা নিয়ে আসার জন্য ছুট্টে রাস্তার ওপারে যেতে চাইছে, কিন্তু রোশন ওদের ধমকে বারণ করেছে। হুট করে যদি কোনও অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে যায়!

পাঁচটা বাচ্চার সঙ্গে কিছুদিন মেশার পর রোশন বুঝতে পেরেছে, বয়েসের তুলনায় ছেলেগুলো অনেক বেশি ওস্তাদ আর চটপটে। অন্তত নিজের বারোবছর বয়েসের অবস্থাটা মনে করে রোশনের সেরকমই মনে হল। তবে ছেলেগুলো যদি লেখাপড়ার ব্যাপারটাকে রেগুলার চালু রাখতে পারত তা হলে আরও ভালো হত।

ব্যাংকের দেওয়ালের গা থেকে ফুটবলটা কুড়িয়ে নিয়ে রোশন ফিরে আসছিল। তখনই জেনারেটরের শব্দ কানে এল। দূরে কোথাও জেনারেটর চলছে। তার মানে সকালবেলাতেই লোডশেডিং। এই দেড়মাস ধরে রোশন দেখছে, আশাপুরে লোডশেডিং এখনও বেশ টিঁকে আছে। তাই ছোটখাটো সব দোকানেই—মানে, পানের দোকান হোক কি চায়ের দোকান হোক, কিংবা মুদিখানা দোকান হোক—মোমবাতি আর হাতপাখা বিক্রি করার চল রয়েছে।

রোশন ফুটবল হাতে রাস্তা পার হচ্ছিল। গাড়ি যাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে ধুলো উড়ছে। সাইকেল-রিকশার প্যাঁকপ্যাঁক শোনা যাচ্ছে। তার সঙ্গে বাইকের গর্জন।

বাইক দেখে পলানের কথা মনে পড়ল রোশনের।

সেই শুরুর দিন থেকেই পলানের সঙ্গে ওর গতিপথ বিপরীতমুখী। সংঘর্ষ গতিপথে ওরা যেন একে অপরের দিকে এগিয়ে চলেছে। কিন্ত রোশনের তো কোনও উপায় নেই। যেমন, শনিবারের গোডাউন ফাইট পলানের কাছে জরুরি—কিছু কাঁচা পয়সা রোজগার করার জন্য। আবার রোশনের কাছে গোডাউনের ব্লাইন্ড ফাইট বন্ধ করার চেষ্টা করাটা জরুরি—আশাপুরের মানুষের ভালোর জন্য। তারপর রয়েছে পলানের তোলাবাজি। এটার হাত থেকে ছোট, বড়, মাঝারি—কোনও ব্যবসায়ীরই নিস্তার নেই। এ ছাড়া দুর্গাপুজো, কালীপুজো, স্বাধীনতা দিবস ইত্যাদি বিশেষ উৎসবকে ছুতো করে পলানের জোরজুলুম করে চাঁদা আদায়। সে-টাকার কতটা উৎসবে যায়, আর কতটা পলানের পকেটে সে-হিসেবটা কেউ জানে না। তারপর জগন্ময়ী কালীমন্দিরের ‘প্রণামী’ আর ‘মহাপ্রণামী’-র দ্বন্দ্ব। সেদিন রাতে রতনমণি মাঝি পলানের অনেক কথাই রোশনকে বলেছেন।

পেটের কাছ সামান্য জ্বালা করে উঠল।

সুবুর ছুরি এখনও জানান দিচ্ছে। সুধীরডাক্তারবাবু অবশ্য বলেছেন, সেরকম কোনও চোট লাগেনি। ছুরির ডগায় স্কিনটা পারফোরেটেড হয়েছে শুধু। তা সত্ত্বেও ডাক্তারবাবু সেদিন চারটে স্টিচ করে দিয়েছিলেন। সে-সেলাই পাঁচদিন পর কাটাও হয়ে গেছে। তারপরেও ডাক্তারবাবুর কথা মতো কাটা জায়গাটায় দিনে দুবার করে মলম লাগায় রোশন। জায়গাটা এখন মাঝে-মাঝে ব্যথা করে, বা একটু জ্বালাও করে—তার বেশি কিছু নয়।

কালীমন্দিরের ঘটনার দু-দিন পর এক দুপুরে পলান সুবুকে সঙ্গে করে ‘আশাপুর লজ’-এ এসেছিল। পলানের মুখ গম্ভীর। সুবুর মুখ কাচুমাচু। তারপর বিশ্বরূপদার টেবিল ঘিরে বসেছিল ওরা চারজন : একদিকে পলান আর সুবু, আর অন্যদিকে রোশন আর বিশ্বরূপ জোয়ারদার।

পলান খুব ধীরে-ধীরে শান্তভাবে কথা বলছিল। রোশন অবাক হয়ে পলানকে দেখছিল। এই পলানকে ও চিনতেই পারছিল না।

পলানের গায়ে খাদির পাঞ্জাবি, আর পায়ে পাজামা। ও মাথা নীচু করে কথা শুরু করেছিল।

‘রোশন, আমি সুবুকে নিয়ে তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি কেন জানো? আমার মনে হয়েছে, সুবু সেদিন মন্দিরে যা করেছে সেটা একদম ঠিক করেনি। ও তোমার কাছে এখন ক্ষমা চাইতে এসেছে। আর আমিও সেদিন ওকে দু-চার ঝাপ্পড় কষিয়েছি। তা ছাড়া তোমাকেও ”থ্যাংক ইউ” বলতে হয়, কারণ, তুমি সুবুর নামে কোনও এফ. আই. আর. করোনি।’ বিশ্বরূপ জোয়ারদারের দিকে হাতের ইশারা করল পলান : ‘আর বিশ্বদা তো আমাকে চেনেন—আমি অন্যায় বরদাস্ত করি না। অন্যায় করেছ কি ক্ষমা চাইতে হবে…এই হল আমার বিচার…।’

কথা বলতে-বলতেই আচমকা সুবুকে দু-থাপ্পড় কষিয়ে দিল পলান : ‘চুপ করে আছিস কী? নে, ক্ষমা চা!’

সুবু পলানের থাপ্পড় খেয়ে তেমন অবাক হল না। ও বরং চট করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর একেবারে পুকুরে ঝাঁপ দেওয়ার ঢঙে ঝাঁপিয়ে পড়ল রোশনের পায়ে।

‘আমাকে মাপ করে দাও, ভাইটি। ভুল হয়ে গেছে। আর কখনও হবে না। প্লিজ, মাপ করে দাও…।’

সুবু যখন রোশনের পায়ে পড়ে ক্ষমা চাইছিল, পলান তখন ওর মোবাইল ফোন বের করে সেই ক্ষমা চাওয়ার ভিডিয়ো তুলছিল।

বিশ্বরূপ জোয়ারদার কেমন যেন জড়দগবের দৃষ্টিতে গোটা দৃশ্যটা দেখছিলেন; কী বলবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না।

রোশন অপ্রস্তুতভাবে সুবুকে নিরস্ত করার চেষ্টা করছিল : ‘কী হচ্ছে? কী হচ্ছে? ছাড়ুন, ছাড়ুন! যা হয়ে গেছে, হয়ে গেছে। সব ভুলে যান…।’

একটু পরে, ক্ষমা চাওয়ার এপিসোড শেষ করে, সুবুকে নিয়ে চলে গেল পলান। বিশ্বরূপ জোয়ারদার তখনও ওদের চলে যাওয়ার পথের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে। ব্যাপারটা যে ঠিক কী হল সেটা তখনও তিনি ঠাহর করে উঠতে পারছিলেন না। এই নতুন পলানকে তিনি আগে কখনও দেখেননি। তাই বিশ্বরূপের চোখ সরু হল, কপালে ভাঁজ পড়ল।

পরদিন সকাল সাড়ে ন’টা-দশটা নাগাদ কনস্টেবল পান্ডেজি একটা সাইকেল নিয়ে ‘আশাপুর লজ’-এ এসেছিল। তারপর সদর দরজার বাইরে থেকেই ‘এ রওশনবাবু! রওশনবাবু—!’ বলে হেঁড়ে গলায় হাঁক পেড়েছিল।

বিশ্বরূপ জোয়ারদার দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে দেখেন একটা ছোট সাইকেলের ওপরে পান্ডেজি তার নাদুসনুদুস বডিটা ব্যালান্স করে বসে আছে। একটা পা প্যাডেলে, আর-একটা পা মাটিতে। পান্ডেজির গোলগাল মুখ ঘামছে। গালদুটো কমলালেবুর মতো ফোলা। তার মধ্যিখানে মানুষটার বিখ্যাত মোচ। সবমিলিয়ে যেন কোনও মজার কমিকসের চরিত্র।

বিশ্বরূপকে দেখে কনস্টেবলজি জানাল, ‘রওশনবাবুকো সাব-ইনিসপেক্টারসাবনে বুলায়া…আজহি…। জরুরি পুছতাছ করনা হ্যায়। সাথ মে ভোটার কার্ড লে জানেকো বোলিয়েগা।’

রোশন তখন লজে ছিল না। বারো নম্বর বস্তিতে গিয়েছিল—নিতুয়ার কাছে। গাড়ি চালানোর কাজের কোনও খবরটবর এসেছে কি না জানতে।

ও ফেরামাত্রই বিশ্বরূপ ওকে খবরটা দিয়েছিলেন : ‘সাব-ইনস্পেকটর সুরেন দাস ওকে ফাঁড়িতে ডেকে পাঠিয়েছেন।

রোশন ভাবল একটা সাইকেল-রিকশা নিয়ে থানায় চলে যাবে। কারণ, সাইকেল প্যাডেল করতে গেলে পেটে বেশ টান লাগছে, ব্যথা করছে। একইসঙ্গে এটাও ভাবল, ও যে থানায় যাচ্ছে সেটা অনেককে জানিয়ে যাবে। ও বিশ্বরূপদাকে বলল, ও যে থানায় সাব-ইনস্পেকটর সুরেন দাসের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে সেই খবরটা যেন জনে-জনে জানিয়ে দেওয়া হয়।

বিশ্বরূপ নিজের হাতের মোবাইল ফোনটা দেখিয়ে বললেন, ‘আমি ছোটকু আর নিতুয়াকে খবর করে দিচ্ছি। তা হলেই বারো নম্বর বস্তি আর নানানদিকে খবর ছড়িয়ে যাবে। এ ছাড়া রতনমণিদাকে ফোন করে দিচ্ছি। সুধীরডাক্তারবাবুকেও জানিয়ে দিচ্ছি—।’

রোশন বলল, ‘দাদা, ”মোহন সুইটস”-এ খবরটা দেবেন। আর ”বাবুন সাইকেল মার্ট”-এর বাবুনদাকেও জানাবেন। সকলের খবরটা জানা দরকার। কারণ, সুরেন দাস যদি অন্যায়ভাবে আমাকে অ্যারেস্ট করার চেষ্টা করেন তা হলে সবাই মিলে একজোট হয়ে সেই অন্যায়ের এগেইনস্ট-এ প্রোটেস্ট করতে পারবে…।’

বিশ্বরূপ চেয়ারে বসেছিলেন। চেয়ার ছেড়ে চট করে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন : ‘তুমি চিন্তা কোরো না। আমি এখুনি সাইকেল নিয়ে বেরোচ্ছি। চারদিকে খবর করে দিচ্ছি। থানার সঙ্গে হাত মিলিয়ে পলানের জুলুমবাজি বড্ড বেড়েছে।’ হঠাৎ খেয়াল হওয়াতে তিনি রোশনকে জিগ্যেস করলেন, ‘তোমার ভোটার কার্ডটা সঙ্গে নিয়ে নিয়েছ তো?’

রোশন ওর প্যান্টের ডানপকেট আলতো করে চাপড়াল। ভোটার কার্ডটা অনুভবে টের পেল। মাথা নেড়ে জানাল, হ্যাঁ, নিয়েছে। তারপর রাস্তায় নেমে একটা সাইকেল-রিকশা ডেকে তাতে উঠে বসল। রিকশা চলল থানার দিকে।

থানার চত্বরের কাছে এসে রোশন রিকশা থেকে নেমে পড়ল। মাথার ওপরে বেলা সাড়ে এগারোটার রোদ। হাওয়া ক্রমশ গরম হয়ে উঠছে।

থানার চেহারা দেখে থানা বলে বোঝা দায়। কারণ, একে তো একতলা পুরোনো বাড়ি, তার ওপরে থানার চত্বরে বাঁশের মাথায় দড়ি টাঙিয়ে প্রচুর ভিজে জামাকাপড় শুকোতে দেওয়া হয়েছে। ডানদিকের বাউন্ডারি ওয়াল ঘেঁষে কলতলা। সেখানে টিউবওয়েল রয়েছে, আর তার পাশেই একটা ছোট চৌবাচ্চা—চৌবাচ্চার পাড়ে দুটো প্লাস্টিকের মগ—একটা লাল, একটা নীল।

কলতলায় একজন রোগামতন লোক খালি গায়ে আন্ডারপ্যান্ট পরে স্নান করছে। তার গায়ে পইতে। চোখ বুজে একটা চটুল হিন্দি গান প্রবল বেসুরো গাইছে, আর নিজের নি-কেশ মাথায় একটা ছোট বালতি করে জল ঢালছে।

থানার বাউন্ডারি ওয়ালে কোনও সদর গেট নেই। তার জায়গায় খানিকটা খোলা অংশ হাঁ করে রয়েছে। সেটাই থানায় ঢোকার পথ। ঢোকার পথের মুখে একপাশে একটা পান-বিড়ি-সিগারেটের দোকান। দোকানের সামনে নানা রঙের পানমশলার পাউচ চিকের মতো ঝুলছে।

থানার সাইনবোর্ডটা মাপে বড়, চকচকে এবং নতুন। বোধহয় বেশিদিন হল লাগানো হয়নি। টিনের ফ্রেমে বাঁধানো গাঢ় নীল রঙের গ্লো-সাইন : ‘আশাপুর পুলিশ ফাঁড়ি’।

রোশন সটান পা ফেলে ঢুকে গেল থানার ভেতরে। দেখল, খোলা চত্বরের বাঁ-দিকে দাঁড়িয়ে আছে একটা জিপ আর দুটো সাইকেল। আর ডানদিকে একটা বাইক।

খানিকটা উঠোন পেরিয়ে উঁচু চাতাল। চাতালে ওঠার জন্য তিন ধাপ সিঁড়ি। সিঁড়ি উঠলেই বড় দরজা। দরজায় চকোলেট রঙের পাতলা কাপড়ের পরদা ঝুলছে।

দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে রোশন সাব-ইনস্পেকটর সুরেন দাসকে দেখতে পেল। চেয়ারে হেলান দিয়ে সিগারেট টানছেন। তাঁর সামনে বড় একটা টেবিলে পুরোনো আমলের কালো রঙের একটা টেলিফোন। কয়েকটা ফাইলপত্র। দুটো ডটপেন। আর তিনটে খালি চায়ের কাপ।

সুরেন দাসের উলটোদিকে তিনটে চেয়ার। তার মধ্যে দুটো চেয়ারে দুজন লোক বসে রয়েছে। দুজনকেই চিনতে পারল রোশন।

একজন কাটা নগেন। আর-একজন পলান। পলান সিগারেট টানছে।

রোশনকে দেখামাত্রই সুরেন দাস একগাল হেসে রীতিমতো অভ্যর্থনা জানালেন।

‘আরে, রোশনবাবু! এসে গেছেন? বসুন, বসুন…।’ ইশারা করে খালি চেয়ারটা দেখালেন সুরেন।

ওঁর হাসি আর কথার টোনে কোথায় যেন একটা ব্যঙ্গের ছোঁয়া রয়েছে বলে রোশনের মনে হল।

রোশন কোনও কথা না বলে খালি চেয়ারটায় বসে পড়ল। তারপর ঘরটাকে চোখ বুলিয়ে দেখল।

কোনওরকমে খাড়া করে তোলা পাকা ঘর। মাপে দশ বাই বারো কি তেরো ফুট হতে পারে। নাকি মা বলেছে, ‘আও কম’?

ঘরের সিলিং-এ লাগানো একটা ফ্যান মাঝারি স্পিডে ঘুরছে। দেওয়ালগুলো ময়লাটে—বহুদিন কলি পড়েনি। সিলিং-এর কাছে দেওয়ালের কোণে ঝুল-টুল জমে আছে। দুটো বড়সড় ঘুলঘুলি—তার ভেতরে বোধহয় চড়ুইপাখির বাসা, কারণ, চড়ুইয়ের কিচকিচ ডাক শোনা যাচ্ছে। তা ছাড়া বাসা থেকে সরু-সরু ঘাস-পাতা উপচে এসে বাইরে ঝুলছে। ফ্যানের হাওয়ায় সেগুলো দুলছে।

ঘরের বাঁ-দিকে দুটো বড়-বড় জানলা। জানলা দিয়ে ঘরে রোদ এসে পড়েছে। বাইরে দেখা যাচ্ছে দু-একটা গাছ, আর একটা পুকুর।

ঘরের পিছনের দেওয়াল ঘেঁষে পাশাপাশি দাঁড় করানো রয়েছে দুটো স্টিলের আলমারি। তারই একটার পাল্লা খুলে উর্দি পরা রোগা-ভোগা একজন কনস্টেবল আলমারির ভেতরে কী যেন খুঁজছে। কনস্টেবল মানুষটির বডির পাশ দিয়ে যেটুকু রোশন দেখতে পাচ্ছিল তাতে অনেকগুলো ফাইল ওর চোখে পড়ছিল।

ডবল সিগারেটের ধোঁয়ার চাপে রোশনের বেশ কষ্ট হচ্ছিল। একসময় যখন ও ট্যাক্সি চালাত তখন ও বিড়ির নেশা ধরেছিল। তারপর একটা ঝঞ্ঝাট-ঝামেলার কেসে ওকে জেলে যেতে হয়। সেখানে থাকার সময়েও ও লুকিয়েচুরিয়ে বিড়ি জোগাড় করে নেশাটাকে বজায় রেখেছিল। তারপর, জেল থেকে বেরোনোর পর, আচমকাই একদিন ‘ধুত্তেরি!’ বলে জ্বলন্ত বিড়ি ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল। ঠিক করেছিল, আর কখনও ও বিড়ি-সিগারেট ছোঁবে না।

সেই থেকে রোশন সিগারেট কিংবা বিড়ির কাছে আর কাবু হয়নি।

সেইজন্যই সুরেন দাস আর পলানের সিগারেটের ধোঁয়ায় ওর শ্বাস টানতে কষ্ট হচ্ছিল। ও নাকের ওপরে হাত চাপা দিল।

পলান আড়চোখে রোশনকে একবার দেখল শুধু—কিছু বলল না।

কাটা নগেন ঠোঁট বেকিয়ে হাসল। পলানের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বলল, ‘পলানদা, সিগারেট স্মোকে মাস্টারজির প্রবলেম হচ্ছে…।’

পলান কোনও কথা বলল না। মনোযোগ দিয়ে সিগারেটটা শেষ করতে লাগল।

রোশন নগেনের কথাকে পাত্তা না দিয়ে নাকে হাত চাপা দিয়েই রইল। সেই অবস্থাতেই সুরেন দাসের দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করল, ‘স্যার, আমাকে দেখা করতে বলেছিলেন?’

সুরেন দাস চোখ সরু করে রোশনকে দেখলেন। ওঁর ডানহাতে সিগারেট। বাঁ-হাতে গলায় ঝোলানো ছোট্ট রুপোর লকেটটা নাড়াচাড়া করছিলেন।

কিছুক্ষণ রোশনকে পর্যবেক্ষণ করার পর মেঝের দিকে মুখটা ঘুরিয়ে থুথু করে কণাজাতীয় কিছু একটা মুখ থেকে ছিটকে দিলেন। তারপর যথেষ্ট সিরিয়াস ঢঙে জিগ্যেস করলেন, ‘অ্যাই, তোর পুরো নামটা কী রে?’

‘পুরো নাম জেনে তুই কী করবি?’

রোশনের জবাবে সুরেন দাসের সিগারেটে টান দেওয়া মুহূর্তে বন্ধ হয়ে গেল। রুপোর লকেট নাড়াচাড়া করা আঙুল স্থির। মানুষটা স্ট্যাচু হয়ে গেল পলকে।

‘কী বললি!’ সাব-ইনস্পেকটর সুরেন দাস সাপের ছোবলের ক্ষিপ্রতায় চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। ওঁর কালো মুখে বেগুনি আভা ছড়িয়ে পড়েছে। পুলিশি চোখ কটমট করে তাকিয়ে আছে রোশনের দিকে ।

রোশন চেয়ারে বসেই রইল। সুরেন দাসের দিকে শান্তভাবে তাকিয়ে ও পালটা প্রশ্ন করল, ‘কেন, শুনতে পাসনি?’

সুরেন কিছু একটা বলতে চাইছিলেন, কিন্তু বলতে পারছিলেন না—ওঁর গলা কাঁপছিল। সিগারেট ধরা ডানহাত কাঁপছিল । রোশনের আস্পর্ধা ওঁকে স্তম্ভিত করে দিয়েছে।

পরিস্থিতি বেগতিক দেখে পলান ওর সিগারেটটা একটা খালি চায়ের কাপে ফেলে দিল । চট করে উঠে দাঁড়িয়ে সুরেন দাসের বাঁ-হাত চেপে ধরল : ‘অ্যাই সুরেনদা, মাথা গরম করছেন কেন? বসুন…বসুন…। আরে রোশন ইয়ং ছেলে…ভুল করে ফেলেছে…।’

কটমটে নজরটা রোশনের দিকে স্থির রেখে সুরেন ধীরে-ধীরে চেয়ারে আবার বসলেন।

রোশন পলানকে লক্ষ করে আবার বলল, ‘আমি কোনও ভুল করিনি, পলানদা। আমাকে আননোন কেউ তুই-তোকারি করলে আমার মুখ দিয়েও তুই-তোকারি বেরিয়ে যায়…।’

পলান চেয়ারে আবার বসে পড়েছিল। রোশনের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে ও বলল, ‘রোশন , আমিও তো তোমাকে ”তুই-তুই” করে কথা বলি। তুমি কিছু মাইন্ড করো না তো?’ পলানের স্বরটা একটু যেন বেশি মোলায়েম শোনাল।

রোশন হেসে জবাব দিল, ‘না, পলানদা, আপনি আমাকে যেমন বলেন সেরকম ”তুই-তুই” করেই বলবেন। আপনার সঙ্গে আমার পরিচয় তো দেড়-দু-মাস হতে চলল! আর এই পুলিশ অফিসার ভদ্রলোক…’ সুরেন দাসের দিকে হাতের ইশারা করল রোশন : ‘ইনি তো আননোন লোক—আমার কাছে। ওঁর সঙ্গে আমার কখনও পরিচয়ই হয়নি…।’

সুরেন দাস ধাক্কাটা এতক্ষণে সামলে নিয়েছেন। হাতের সিগারেটটা ফেলে দিয়েছেন চায়ের কাপে। একটু সময় নিয়ে নিজের মর্যাদা আর গাম্ভীর্য ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন। গায়ের ইউনিফর্মটাকে অকারণেই এখানে-সেখানে হাত বুলিয়ে ঠিকঠাক করলেন।

পলান রোশনকে বলল, ‘ঠিক আছে, আমি পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি। রোশন, ইনি সাব-ইনস্পেকটর সুরেন দাস—আমাদের সবার কাছে সুরেনদা। এ-থানায় বড়বাবু সমীর মাইতিসাহেব থাকলেও আশাপুরের সবকিছু সুরেনদাই কন্ট্রোল করেন । আর, সুরেনদা, এ হল রোশন। আশাপুরে নতুন এসেছে। বিশ্বনাথদার লজে উঠেছে…।’

‘পুরো নাম কী?’ রোশনের চোখে তাকিয়ে সুরেন জিগ্যেস করলেন।

‘রোশন বিশ্বাস—।’

‘ভোটার কার্ড দেখি…।’

রোশন পকেট থেকে ভোটার কার্ডটা বের করল। তারপর সেটা সাব-ইনস্পেকটরসাহেবের হাতে দিল।

সুরেন দাস কার্ডটা হাতে নিয়ে এমনভাবে উলটেপালটে দেখতে লাগলেন যেন কোনও ম্যাপ খুঁটিয়ে দেখে তা থেকে গুপ্তধনের লোকেশন খুঁজে বের করতে চাইছেন।

ভোটার কার্ডটা খুঁটিয়ে দেখতে-দেখতে সুরেন দাস আচমকা হাঁক পাড়লেন, ‘মাদল! মাদল! ফাইলটা খুঁজে পেলি?’

সুরেন দাসের বিকট হাঁকডাকে রোশনরা চমকে উঠল।

একইসঙ্গে স্টিলের আলমারির ভিতরে ফাইল খুঁজতে থাকা মাদল নামের রোগা কনস্টেবলটিও চমকে উঠল। বলল, ‘ইয়েস, স্যার। পে-পে-পেয়েছি।’

‘জলদি এইদিকে নিয়ে আয়—।’

আলমারি থেকে একটা হলদে রঙের ফাইল বের করে নিল মাদল। তারপর ধনুকের মতো বাঁকা পা ফেলে সুরেন দাসের টেবিলের কাছে এগিয়ে এল।

‘এ-এ-এই যে, স্যার। আ-আ-হাপনার ফাইল…।’

সুরেন ফাইলটা মাদলের হাত থেকে ছোঁ মেরে নিলেন। তারপর ভুরু কুঁচকে ফাইলের পাতা ওলটাতে লাগলেন। আপনমনে বিড়বিড় করে বললেন, ‘এই দু-মাসেই ফাইল বেশ মোটা হয়ে গেছে…।’

রোশনের দিকে চোখ তুলে তাকালেন : ‘আপনার ফাইল। শুধু ফার্স্ট নেম দিয়েই ফাইল খুলে ফেলেছি আমি—।’

‘আপনার’ শব্দটার ওপরে অনেকটা বাড়তি জোর দিলেন সুরেন। বিরক্ত চোখে সিলিং ফ্যানটার দিকে একবার তাকালেন। বিড়বিড় করে একবার মন্তব্য করলেন, ‘সালা পাখা না ঠেলাগাড়ি কে জানে!’

‘হ্যাঁ, যা বলছিলাম…’ একটু কেশে নিয়ে সুরেন দাস আবার শুরু করলেন। কথা বলার টোনে ব্যঙ্গের মোলায়েম প্রলেপ লাগিয়ে রোশনের দিকে তাকালেন : ‘তা রোশনবাবু, আপনার অ্যাক্টিভিটির ফাইল মোটা হলেও কেউ এখনও আপনার নামে অভিযোগ-টভিযোগ করেনি। তাই আপনাকে, স্যার, অ্যারেস্ট করে খাঁচায় এখনও পুরিনি। পলানদা আপনার নামে অভিযোগ করতেই পারতেন, কিন্ত করেননি। পলানদা ভালোমানুষ টাইপের লোক। খুব বড় মাপের দিল। সবার উপকার করেন। তাই এখনও আপনি বাইরে আছেন, স্বাধীনভাবে ঘোরাফেরা করছেন। হেসে-খেলে বেড়াচ্ছেন। আমি কিন্তু, স্যার, আপনার মুভমেন্টের খোঁজখবর রাখছি—।’

সুরেন ফাইলটা বন্ধ করে টেবিলের একপাশে রাখলেন। চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলেন।

পলান চুপচাপ বসে সুরেন দাসের কথাবার্তা শুনছিল। ভেতরে-ভেতরে অধৈর্য হয়ে উঠলেও ওর মুখ দেখে সেটা বোঝা যাচ্ছিল না। ও মনে-মনে ভাবছিল, ‘সুরেনদা কেন এখনও কাজের কথায় আসছেন না?’

‘স্যার, আমাকে এখন কী করতে হবে?’ ‘স্যার’ শব্দটার ওপরে জোর দিয়ে রোশন জিগ্যেস করল। কথার টোনে ও সুরেন দাসের ব্যঙ্গ কিছুটা হলেও ফেরত দিতে পারল।

কাটা নগেন উসখুস করছিল। ভুরু কুঁচকে বারবার পলানের দিকে তাকাচ্ছিল—যার অর্থ : ‘পলানদা, তুমি কিছু একটা তো বলো!’

পলান চোখ বুজে আবার খুলল। এই ইশারা করে নগেনকে বোঝাতে চাইল, ‘এখন চেপে যা…।’

সুরেন দাস কিছুক্ষণ ঠোঁট টিপে রইলেন। তারপর রোশনের ভোটার কার্ডটা আবার হাতে নিয়ে গভীর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে লাগলেন। মনে হচ্ছিল যেন কোনও জীবাশ্মবিজ্ঞানী নতুন কোনও প্রজাতির প্রাণীর জীবাশ্ম খুঁজে পেয়েছেন।

প্রায় মিনিট পাঁচেক ধরে চলল মহা-ইনস্পেকশন। তারপর : ‘আপনার বাড়ির ঠিকানা তো দেখছি কলকাতায়—পার্ক সার্কাসে। তা কলকাতা ছেড়ে হঠাৎ এই আশাপুরে কেন?’

রোশন স্থির চোখে তাকিয়ে রইল দাসসাহেবের দিকে। ধীরে-ধীরে স্পষ্ট উচ্চারণে বলল, ‘আশাপুরের দুটো জিনিস বিখ্যাত—জগন্ময়ী কালীমন্দির, আর প্রতি শনিবার রাতে কলাবতী নদীর ধারে গোডাউনের ব্লাইন্ড ফাইট, সেগুলো দেখতে এসেছি—।’

সুরেন দাসের কপালে ভাঁজ পড়ল। পলানের দিকে একবার তাকালেন। তারপর ঠোঁট উলটে ব্যাজার মুখে বললেন, ‘কালীমন্দিরটা তো না হয় বুঝলাম, কিন্তু ব্লাইন্ড ফাইট ব্যাপারটা কী?’

সঙ্গে-সঙ্গে রোশনের মুখ দিয়ে ‘ন্যাকাচৈতন্য’ শব্দটা বেরোতে চাইছিল, কিন্তু রোশন খুব জোর সেটাকে সামলে নিল। তারপর বলল, ‘দাসবাবু, আপনি ব্লাইন্ড, তাই ওই ফাইটের খবর জানেন না। কিন্তু আশাপুরের আর সবাই জানে—’ রোশন পলানের দিকে মুখ ফিরিয়ে তাকাল : ‘কী পলানদা, ঠিক বলছি তো?’

পলান একটু মুচকি হাসল। তারপর একটা হাত নেড়ে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গি করে বলল, ‘রোশন, ওসব কথা থাক। সুরেনদার আর জরুরি কী-কী বলার আছে শুনে নে…।’

রোশন সুরেন দাসের জরুরি কথা শোনার জন্য ওঁর দিকে তাকাল। রোশনের থুতনিটা সামান্য উঁচু হয়ে থাকায় ওকে একটু উদ্ধত মনে হল।

সুরেন একটা ডটপেন তুলে নিয়ে সেটা টেবিলে ঠুকছিলেন। ওই ‘ঠক-ঠক’ আওয়াজ করতে-করতেই বললেন, ‘গোডাউনের ওই ব্লাইন্ড ফাইট নিয়ে আশাপুরের কেউ এখনও থানায় রিপোর্ট করেনি, এফ. আই. আর. করেনি। তার মানে ওটা নিয়ে আশাপুরে কারও কোনও প্রবলেম হচ্ছে না। বরং আমি বলব, এখানকার জনগণের অনেকেই ওটা থেকে কম-বেশি বেনিফিট পাচ্ছে। কাঁচা পয়সার একটু-আধটু হাতবদল হচ্ছে। তা সে খারাপ কী! যদি কখনও ওটার এগেইনস্টে কোনও রিপোর্ট পাই তখন ভেবে দেখব।’ পলানের দিকে তাকালেন সুরেন : ‘কী বলেন, পলানদা?’

রোশন জিগ্যেস করল, ‘আমি কি এবার আসতে পারি?’

সুরেন রোশনের দিকে তাকালেন। ঠোঁটের কোণে হাসলেন : ‘আসবেন কী! আসল কথাটাই তো এখনও বলা হয়নি…’ কথা বলতে-বলতে পিছন ফিরে তাকালেন সুরেন। দেওয়ালের কাছে মাদল নামের কনস্টেবলটি স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়েছিল। রোগা দুটো হাত আঙুলে-আঙুলে প্যাঁচ খাওয়া অবস্থায় সামনে ঝুলছে।

মাথার ইশারায় ওকে কাছে ডাকলেন সুরেন : ‘এদিকে আয়…।’

মাদল ওঁর কাছে এসে অ্যাটেনশনের ভঙ্গিতে দাঁড়াতেই বললেন, ‘এই ভোটার কার্ডটা গজাননের দোকান থেকে চট করে জেরক্স করে নিয়ে আয়…দু-কপি করবি। সাইকেল নিয়ে যা—।’

রোশনের ভোটার কার্ডটা মাদলের হাতে দিলেন সুরেন।

কার্ডটা হাতে নিয়ে মাদল কাঁচুমাচু মুখে বলল, ‘প-প-প-হয়সা?’

‘তোর থেকে দিয়ে দিস…আমি পরে তোকে দিয়ে দেব।’ সুরেন হাত নেড়ে ওকে ডিসমিস করে জবাব দিলেন।

মাদল তবু দাঁড়িয়ে রইল। কিন্তু-কিন্তু করে বলল, ‘আ-আ-হাগের এ-এ-হ্যাগারো টাকা বাকি আ-হাছে…।’

‘পরে সব পেয়ে যাবি। এখন জলদি যা…।’

সুরেন দাসের কাণ্ড দেখে পলান আর নগেন মজা পেয়ে হাসছিল। আর রোশনের ভেতরে রাগ হচ্ছিল। এই সাব-ইনস্পেকটরের বাচ্চাটাকে ঠাঁটিয়ে একটা চড় মারতে পারলে ভালো হত।

মাদল চলে যেতেই সুরেন দাস আবার শুরু করলেন, ‘হ্যাঁ, যা জিগ্যেস করছিলাম। আপনি হঠাৎ এই আশাপুরে কেন? আমাদের আশাপুর তো টুরিস্টদের বেড়ানোর স্পট নয়। এখানে না আছে পাহাড়, না আছে সমুদ্র। আর আপনার কথায় বিখ্যাত জিনিসগুলো তো আপনার দু-দিনেই দেখা হয়ে গেছে…তা হলে আর আশাপুরে পড়ে আছেন কেন?’ প্রশ্নটা করে সুরেন জিভ দিয়ে একটা অদ্ভুত শব্দ করলেন।

রোশন জানলার দিকে তাকাল। গাছের পাতারা রোদে যেন ডানা মেলে দিয়েছে—বোঁটা থেকে মুক্তি পেলেই খোলা হাওয়ায় উড়ে চলে যাবে। তারপর যে যেখানে যায়।

রোশন সুরেনের দিকে মুখ ফেরাল। ধীরে-ধীরে বলল, ‘আমার তিন কুলে কেউ নেই। তাই যেখানে মন চায় সেখানেই ঘুরে বেড়াই। আপনাদের আশাপুরে এসে আমার ভালো লেগে গেছে। তো এখানে আমার থাকতে অসুবিধে কোথায়!’

‘আপনি তো এখানকার লোকাল কেউ না—বাইরের লোক। তাই চলে গেলেই ভালো। আপনি এখানে আসার পর থেকেই নানান ঝামেলা হচ্ছে। শান্তি নষ্ট হচ্ছে, সিস্টেমে গোলমাল হচ্ছে, আশাপুরের সুনামে কালি লাগছে। তাই আমি আপনাকে সাতদিন টাইম দিচ্ছি—আশাপুর ছেড়ে চলে যান।’

রোশন হেসে ফেলল, যেন মুচমুচে একটা হাসির কথা শুনে ফেলেছে।

তারপর ঠান্ডা গলায় বলল, ‘আপনি আমাকে সাতদিন টাইম দেওয়ার কে? আমি চোর-ছ্যাঁচোড় বা গুন্ডা বদমাস নই…’ শেষ কথাগুলো পলানের দিকে তাকিয়ে বলল, তারপর আবার মুখ ফেরাল সুরেন দাসের দিকে : ‘আমি আপনার কাছে স্পষ্ট করে জানতে চাই, আশাপুরে আমি থাকতে পারব না কেন। এখানকার আকাশ, বাতাস, খেলার মাঠ, রাস্তা-ঘাট, নদীর জল এসবের কোনও প্রাইভেট মালিকানা আছে নাকি, যে আমি সেগুলো ব্যবহার করতে পারব না? এই জায়গার নাম তো আশাপুর, ”আশাপুর প্রাইভেট লিমিটেড” তো নয়! স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক আমি। তো আমি কেন দেশের যে-কোনও জায়গায় গিয়ে ভদ্রভাবে থাকতে পারব না, সেটাই আমি বুঝতে পারছি না!’

রোশনের গলার স্বর আবেগে কাঁপছিল। ওর ফরসা মুখে এখন লালচে আভা ছড়িয়ে পড়েছে।

সুরেন দাস কিছুক্ষণ থম মেরে রইলেন। সাড়ে বারো বছরের পুলিশি চাকরিতে এরকম ঠ্যাটা এবং গোঁয়ার পাবলিক তিনি দেখেননি। এর দাওয়াইয়ের একটা ব্যবস্থা করতে হবে। ভোটার কার্ডের ইনফরমেশনগুলো নিয়ে কলকাতায় বেশ ভালো করে ছানবিন করতে হবে। দেখতে হবে, এই গোঁয়ার পাগলটার কোনও পুরোনো ক্রিমিনাল রেকর্ড আছে কি না। পার্ক সার্কাস থানা থেকেই খোঁজখবরের কাজটা শুরু করতে হবে।

সুরেন দাস একটু উসখুস করলেন। মাথার ওপরে ঘুরতে থাকা সিলিং ফ্যানটার দিকে একবার তাকালেন। দু-হাতের তালু দিয়ে গাল আর কপালের ঘাম মুছলেন। একইসঙ্গে তিনি ভাবছিলেন, রোশনের কথার জবাবে কী বলা যায়।

ঠিকঠাক এবং যুতসই একটা উত্তরের আশায় দাসবাবু পলানের দিকে তাকালেন। দেখলেন, ওঁর চোখের ইশারা অ্যাভয়েড করার জন্য পলান নির্বিকার মুখে ঘরের টেবিল, চেয়ার, আলমারি ইত্যাদি খুঁটিয়ে দেখছে।

সুরেন দাসের রাগ হচ্ছিল। কিন্তু বুঝতে পারলেন, রোশনের কথাগুলো মিথ্যে নয়। আশাপুরের নাম মোটেই ‘আশাপুর প্রাইভেট লিমিটেড’ নয়। তা হলে কী বলা যায় ছেলেটাকে?

এমন সময় মাদল ঘরে এসে ঢুকল। রোশনের ভোটার কার্ড আর দু-কপি জেরক্স দাসবাবুর সামনের টেবিলের ওপরে রাখল।

‘স্যার, এই যে…মোট পনেরো টাকা হল।’

‘হুঁ…মনে থাকবে আমার।’

মাদল ব্যাজার মুখ করে ওর বসের কাছ থেকে সরে গেল।

সুরেন দাস লম্বা একটা শ্বাস ফেলে রোশনের চোখে চোখ রেখে চাপা শাসানির টোনে বললেন, ‘আমার সহজ কথাটা তা হলে আপনি বুঝতে পারছেন না?’

রোশন মাথা নাড়ল : ‘না, বুঝতে পারছি না। কারণ, আপনিও তো আমার সহজ কথাটা বুঝতে চাইছেন না।’

সুরেন দাস ভুরু কোঁচকালেন : ‘কী সহজ কথা?’

রোশন টেবিলের ওপরে একটু ঝুঁকে পড়ে ওর মুখটাকে সুরেনের আরও একটু কাছে নিয়ে গেল। শান্ত গলায় বেশ থেমে-থেমে বলল, ‘এই আকাশ, বাতাস, জল, মাটি—এগুলো কারও বাপের সম্পত্তি নয়। এগুলো সবার জন্য।’ রোশন পলানের দিকে ঘুরে তাকাল : ‘পলানদা, আপনি একটু এনাকে বুঝিয়ে বলুন তো। আশাপুরে আমি থাকতে এসেছি, চলে যাওয়ার জন্যে নয়।’

সুরেন দাসের মুখের চেহারায় বিভ্রান্তির ছায়া পড়ল। তারপরই তিনি অসহায় চোখে পলানের দিকে তাকালেন।

‘পলানদা, কেসটা এখন কী করা যায় বলুন তো?’

সুরেনের মুখে কাতর শরণার্থীর হাবভাব দেখে রোশনের মনে হল, ওঁর নামটা সুরেন দাস না হয়ে সুরেন ক্রীতদাস হলে অনেক বেশি মানানসই হত।

পলান রোশনের দিকে তাকাল। ও আশাপুরে থাকতে এসেছে—চলে যাওয়ার জন্য নয়। তা ছাড়া ওকে থানায় ডেকে পাঠানো হয়েছে বলে ও যে খুব একটা ঘাবড়ে-টাবড়ে গেছে তেমনটাও নয়।

পলান রোশনের কথাগুলো ভাবছিল।

ছেলেটা ভুল কিছু বলেনি। আশাপুরের আকাশ-বাতাস কারও বাপের সম্পত্তি নয়। জল বা মাটির কিছু-কিছু অংশ ব্যক্তিগত মালিকানার দখলে আছে বটে, কিন্তু সবটাই নয়।

আরও কতকগুলো কথা মনে হল পলানের। রোশন এ-কথাগুলো বলেনি, কিন্তু পলানের মনে হল। আগে কখনও ও এভাবে ভাবেনি।

সূর্য যখন আলো দেয়, রোদ্দুর দেয়—তার ওপর কারও ব্যক্তিগত মালিকানা নেই। সবাই ইচ্ছেমতো সেগুলো ভাগাভাগি করে নিতে পারে। ঠিক তেমনই বাতাসের অক্সিজেনের ওপরে কিংবা আশাপুরের বৃষ্টির ওপরেও সকলের সমান অধিকার।

তাই আশাপুরের নাম কখনওই ‘আশাপুর প্রাইভেট লিমিটেড’ হয়ে যাবে না।

পলান একটু নতুন চোখে রোশনকে দেখছিল।

পলানের রাজত্বে রোশন থাবা বসিয়েছে বটে, কিন্তু সেটা নিজের জন্য নয়। সাধারণ মানুষের প্রতি অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে রোশন প্রতিবাদের জিগির তুলেছে শুধু।

নাঃ, পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য পলান এক্ষুনি কিছু ভেবে উঠতে পারছে না। সুরেন দাসকেও দেওয়ার মতো কোনও পরামর্শ খুঁজে পাচ্ছে না।

পলান সুরেন দাসকে ইশারা করে বলল, ‘ওকে এখন ছেড়ে দিন—।’

সে-ইশারা পাওয়ামাত্রই দাসবাবু রোশনকে ওর ভোটার কার্ডটা ফেরত দিয়ে বললেন, ‘আপনি এখন আসুন। সাবধানে থাকতে চেষ্টা করবেন—কোনও ঝঞ্ঝাট-ঝামেলায় জড়াবেন না।’

ভোটার কার্ডটা নিয়ে রোশন উঠে দাঁড়াল। সুরেনকে বলল, ‘আসছি, স্যার।’ তারপর পলানের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘পলানদা, এলাম। পরে দেখা হবে।’

পলান হাত তুলে ‘ঠিক আছে।’ গোছের একটা ভঙ্গি করল।

সাব-ইনস্পেকটরসাহেবের ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে রোশন অবাক হয়ে গেল। থানার ঢোকার পথের মুখে একটা ছোটখাটো জটলা। সেখানে ওর চেনা অনেকগুলো মানুষ ভিড় করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বিশ্বরূপদা, নিতুদা, ববিন, ছোটকু, রতনমণি মাঝি, ‘বাবুন সাইকেল-মার্ট’-এর বাবুনদা, ‘মোহন সুইটস’-এর দুজন চেনা মুখ, এ ছাড়া আরও কয়েকজন মানুষ যাদের মুখগুলো রোশনের ঠিকঠাকভাবে মনে পড়ছে না। ওদের কাছাকাছি অনেকগুলো সাইকেল দাঁড় করানো।

রোশনের বিপদে পাশে দাঁড়ানোর জন্য এতগুলো মানুষ থানায় চলে এসেছে!

রোশনের চোখে জল এসে গেল। দুপুরের রোদে সেই জল চিকচিক করে উঠল।

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *