৬. স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে

স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে আশাপুরে যে দুটো অনুষ্ঠান হচ্ছে সেটা পলান নস্কর পুরোপুরি জানতে পারল পনেরোই আগস্টের তিনদিন আগে—কারণ, সেদিনই একটা সস্তার ব্যানার টাঙানো হয়েছে বিবেকানন্দ মূর্তির রেলিঙে। তাতে লেখা :

স্বাধীনতা দিবস উৎসব

আয়োজনে ‘আমরা সবাই’

আর লেখার নীচে দুজন মানুষের নাম রয়েছে : ডাঃ সুধীরচন্দ্র পাঠক আর অবনীনাথ পাত্র। নামের পাশে দুজনের মোবাইল নম্বর লেখা।

সুধীরডাক্তার আর অবনীমাস্টারের উদ্যোগে কিছু ছেলেছোকরা আশাপুরের নানান জায়গায় ঘুরে-ঘুরে চাঁদা তুলছে। সে-চাঁদা তোলার স্লোগান ভারী অদ্ভুত : ‘আপনারা যে যা খুশি চাঁদা দিন।’ তাতে কেউ দিচ্ছে একটাকা, দু-টাকা, পাঁচটাকা—আবার কেউ দিচ্ছে দশটাকা কি কুড়িটাকা। কেউ আবার মুখ-চোখ কুঁচকে বলছে, ‘স্বাধীনতা দিবসের প্রোগ্রামে আবার চাঁদা কীসের? সকাল ন’টায় একটা ফ্ল্যাগ তুলে ছেড়ে দাও!’ কিন্তু এসব কথায় ছেলেপিলেদের চাঁদা তোলার উৎসাহে কোনও ভাটা পড়েনি। কারণ, অনেকদিন পর আশাপুরে একটা খোলামেলা উৎসবের আয়োজন করা হচ্ছে। অনেকদিন পর ওরা সবাই হইহই করে চাঁদা তুলতে নেমেছে।

আশাপুরের কিছু মানুষ ভয়ে অথবা ভক্তিতে নিয়মিত পলানের চর হিসেবে কাজ করে। ওকে হেলপও করে। পলান তাদের বাড়িতে ওর আর্মস লুকিয়ে রাখে। লুকিয়ে রাখে ওর দলের ছেলেপিলেদের চুরি, ডাকাতি অথবা ছিনতাই করা মাল। তার জন্য পলান সেইসব ‘রাজাকার’-দের কমবেশি মাসোহারা দেয়।

আশাপুরে কোথায় কী হচ্ছে তার খুঁটিনাটি খবর সবসময় পৌঁছে যায় পলানের কাছে। যেমন, এলাকায় কে-কে দু-নম্বরি কারবার করছে, কে জমি বিক্রি করতে চাইছে, কে চোরাই মালের ব্যাবসা করে, কার আলমারিতে ব্ল্যাক মানি ঠাসা আছে—এইরকম সব খবরই পলান পায়।

পলান খবর পেয়েছিল যে, এলাকায় কিছু একটা গুজুর-গুজুর ফুসুর-ফুসুর চলছে। রোশনকে যে মাঝে-মাঝেই ডাঃ সুধীর পাঠকের ‘সুনিরাময়’-এ দেখা যাচ্ছে সে-খবরও এসেছিল পলানের কাছে। ও মনে-মনে তৈরি হচ্ছিল কোনও একটা ক্যাচালের জন্য। তারই মধ্যে ঘটে গেল কিশোরীমোহনের কেসটা। পলানের কেন যে হঠাৎ টেম্পার চড়ে গেল কে জানে! তাতে কলাবতীর পাড়ে লপকে রাখা সাড়ে আটলাখ টাকার মালটা বোধহয় হাত থেকে হড়কে গেল।

সুরেন দাস হেলপ না করলে কিশোরীমোহনের কেসটা অনেক দূর গড়াত। কিশোরী সামন্ত এখনও সেবাকেন্দ্রে ভরতি রয়েছেন। সুধীরডাক্তাররা রোজ কিশোরীকে সেবাকেন্দ্রে দেখতে যান। দু-চারজন সঙ্গীসাথীকে নিয়ে রোশনও দু-বেলা কিশোরীমোহনকে দেখতে যায়। এই বেকার ছেলেটার কি আর কোনও কাজ নেই! ওকে যে করে হোক ঠিকানায় লাগাতে হবে।

‘আমরা সবাই’ নামটা আশাপুরের বেশিরভাগ মানুষের খুব মনে ধরেছে। এই নামটা শুনলেই মনে হয় স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানটা ‘আমাদের সবার অনুষ্ঠান’। ডাক্তারবাবু আর মাস্টারমশাই মিলে তিরিশপ্যাকেট বিস্কুট কিনেছেন, তার সঙ্গে লজেন্সের চারটে বড় প্যাকেট। পনেরোই আগস্ট অনুষ্ঠানের শেষে বাচ্চাদের মধ্যে লজেন্স আর বিস্কুট বিলি করা হবে। তবে বাচ্চাদের সঙ্গে বড়রাও সামিল হলে কোনও অসুবিধে নেই।

কলকাতা থেকে একহাজার ছোট-ছোট কাগজের পতাকা কিনে এনেছে রোশন। তার সঙ্গে পাটের সুতলির লাছি আর দুশো কাঠি। সুতলিতে আঠা দিয়ে কাগজের পতাকা লাগিয়ে ‘চেইন’ তৈরি করা হবে। সেই ‘চেইন’ স্কুলের মাঠের চারদিকে বাঁশের খুটি পুঁতে লাগানো হবে। আর দুশো কাঠিতে দুশো পতাকা আঠা দিয়ে আটকানো হবে। তারপর সেই ‘হাতলওয়ালা’ ছোট-ছোট পতাকা অনুষ্ঠানের দিন তুলে দেওয়া হবে বাচ্চা-বড় সবার হাতে।

সুতলি আর কাঠিতে পতাকা লাগানোর কাজটা রোশন নিতুকে দিয়েছিল। নিতু সেই কাজে সাবিত্রী আর আশপাশের তিন-চারজনকে জড়িয়ে নিল। তারপর ময়দার আঠা তৈরি করে ওরা কাজে নেমে পড়ল। বারো নম্বর বস্তিতে যেন উৎসব লেগে গেল। বহুদিন পরে ওরা সবাই একটা অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে হইহই করে মেতে উঠেছে। কাঠিতে আঠা দিয়ে পতাকা লাগানোর সময় ববিনও পিসির কাছে পতাকা লাগানোর বায়না করছিল। সাবিত্রী ওর বায়নায় বিরক্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত ওকে কয়েকটা পতাকা আর কাঠি দিয়েছে। সেইসঙ্গে সাবধান করে বলেছে, ‘দেখিস, একটাও পতাকা যেন নষ্ট না হয়! নষ্ট হলে মার খাবি!’

ববিন তাতে সায়ে দিয়ে ছোট-ছোট হাতে পতাকা লাগানোর কাজ শুরু করে দিয়েছে।

রোশন সাইকেল নিয়ে এদিক-সেদিক ছুটোছুটি করছিল। সবার সঙ্গে যোগাযোগ রেখে অনুষ্ঠানের নানান কাজের তদারকি করছিল। ঠিক হয়েছিল, স্কুলের মাঠের এককোণে একটা বড় স্টেজ তৈরি করা হবে। যেহেতু এখন বর্ষার সময়, তাই স্টেজের মাথায় একটা পলিথিনের শিট টাঙানোর জন্য ডেকরেটারকে বলা হয়েছে। আর বলা হয়েছে, দুশো প্লাস্টিকের চেয়ার মাঠে পেতে দেওয়ার জন্য।

আশাপুরের একটা ছোট ডেকরেটার ‘মাধব ব্রাদার্স’। তার মালিক মাধব দাসের সঙ্গে রোশন আর রতনমণি মাঝি যখন স্টেজ, চেয়ার আর পলিথিনের ব্যাপারে কথা বলেছিলেন তখন দাসবাবু শুধু যে রাজি হয়েছিলেন তা নয়, পাঁচশো টাকা অ্যাডভান্সও নিয়েছিলেন। কিন্তু হঠাৎই তেরো তারিখ রাতে তিনি বেঁকে বসলেন। বললেন, ‘এই কাজটা আমি করতে পারব না—রিক্স হয়ে যাবে। আপনারা আমার কাছ থেকে হাতভাড়া নিন—সব মাল আমি দিয়ে দেব, কিন্তু কাজটা করতে পারব না। আমাকে মাপ করবেন।’

রতনমণি জিগ্যেস করলেন, ‘পলান নস্কর কি আপনাকে থ্রেট করেছে?’

‘না, না, কেউ কিছু করেনি, কেউ কিছু করেনি—’ মাধব দাস তাড়াতাড়ি হাত-টাত নেড়ে বললেন, ‘কারও নাম-টাম নেওয়ার দরকার নেই। আপনারা বরং মালগুলো আমার কাছ হাতভাড়া নিয়ে নিন—তারপর…তারপর নিজেরা কাজটা করে নিন। শুধু একটা রিকোয়েস্ট : আমি যে আপনাদের হাতভাড়া দিয়েছি সে-কথাটা একটু সিক্রেট রাখবেন।’

মাধব দাসের ভয় পাওয়া মুখ দেখে রোশন আর রতনমণি সবই বুঝতে পারলেন। রতনমণি ফোন করে ডাক্তারবাবু আর মাস্টারমশাইকে সব জানালেন। কিছুক্ষণ আলোচনার পর ঠিক হল, মাধব দাস যা বলছেন তাই হবে। রোশনরা মাধব দাসের কাছ থেকে বাঁশ, চৌকি, পলিথিন, চেয়ার এসব ভাড়া নিয়ে নিজেরা সবকিছু করে নেবে। তারপর দেখা যাক…।

রোশন একটুও না দমে রতনমণিকে বলল, ‘রতনদা, কোনও চিন্তা করবেন না। আমি এখুনি বারো নম্বর বস্তিতে গিয়ে নিতুদাকে বলছি। তারপর ঘোষপাড়ায় গিয়ে রনিত আর অতুলকে বলছি। ব্যস, ওরা দলবল জোগাড় করে স্টেজের কাজ নামিয়ে দেবে। তারপর মাঠে চেয়ার সাজানোর ব্যাপারটা ছেলেপিলের দল হাতে-হাতে করে দেবে। আপনি একটুও ভাববেন না। ডাক্তারবাবু আর মাস্টারমশাইকে দুশ্চিন্তা করতে বারণ করবেন। আমি যাচ্ছি…।’

রোশন সাইকেল নিয়ে রওনা হয়ে গেল। তখন হঠাৎ করে ফোঁটা-ফোঁটা বৃষ্টি শুরু হল।

রনিত আর অতুল রোশনের কাছাকাছি বয়েসি দুটি ছেলে। আশাপুরের ঘোষপাড়ায় থাকে। রোশনের সঙ্গে ওদের পরিচয় হয়েছে মাসদুয়েক। পলানের ওপরে ওরা যাচ্ছেতাইরকম বিরক্ত। মনে-মনে বিশাল রাগ হলেও ওরা সাহস করে কিছু করে উঠতে পারেনি। রোশনের প্রতিবাদের কেসগুলো শুনে ওরা রোশনের একরকম ফ্যানই হয়ে গেছে। তাই স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানের খবর পেয়ে ওরা প্রবল উৎসাহে রোশনের সঙ্গে জুড়ে গেছে। রোশন ওদের কাছে হয়ে গেছে ‘রোশনদা’।

রোশন বৃষ্টির মধ্যেই সাইকেল নিয়ে চরকি কাটতে লাগল। প্রথমে নিতুয়া, তারপর রনিত আর অতুল। রোশন মাধব দাসের কেসটা ওদের খুলে বলল। বলল যে, মাধব দাস বাঁশ, চৌকি সব ভাড়া দেবে। ওদের নিজেদের স্টেজ তৈরি করতে হবে, মাঠে চেয়ার পাততে হবে।

‘তুমি চিন্তা কোরো না, রোশনদা। আমরা সব নামিয়ে দেব। ওসব কোনও ব্যাপার নয়—’ উৎসাহ দেখিয়ে বলে উঠল অতুল আর রনিত।

নিতুয়া যখন এ-খবরটা শুনল তখন হেসে বলল, ‘তুমি কি ভুলে গেছ যে, আমি ঘরামির কাজ করি? একটা স্টেজ দাঁড় করিয়ে দেওয়া তো খুব ইজি। কোনও টেনশন কোরো না ভাই, রোশন। তোমার নিতুদা এখনও আছে, না কী! তুমি পাশে থাকলে আমি পলান সালাকে পরোয়া করি না—।’

বৃষ্টিতে ভিজে গিয়েছিল রোশন। কিন্তু কাজটা এমার্জেন্সি—ফেলে রাখার উপায় নেই। নিতুয়া ওকে বসতে বলছিল। বলছিল এক কাপ চা খেতে। চা খেয়ে—বৃষ্টি ধরলে পরে তারপর রওনা হতে। কিন্ত রোশন বসল না। মাথার মধ্যে অনেক চিন্তা। এখনও ছোট-ছোট অনেক খুচরো কাজ বাকি।

রোশনের সাইকেল আবার চলতে শুরু করল।

কিশোরীদার কথা মনে পড়ল রোশনের। কিশোরীমোহন তো হাসপাতালে। স্বাধীনতা দিবসের হইহই উৎসব ওঁর আর দেখা হবে না। সামনের বছরের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।

কিশোরীমোহনের ঘটনার পর পলান নস্কর পুরো একটা দিন উধাও হয়ে গিয়েছিল আশাপুর থেকে। সাইকেল নিয়ে এদিক-ওদিক ঘোরার সময় রোশন দেখেছে, ‘জনপ্রিয় মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’-এর সামনে বটতলা খালি। সেখানে বসবার বেঞ্চিগুলোও নেই। ওগুলো মিষ্টির দোকানের ভিতরে থাকে—পলানের ছেলেরা রোজ সকালে বেঞ্চি দুটো বের করে বটতলায় বসায়, আবার রাতে দোকানের ভিতরে ঢুকিয়ে দেয়।

পলান কি তা হলে কিশোরী সামন্তের কেসটার জন্য উধাও হল?

কিন্তু এখন ‘জনপ্রিয়’-র পাশের রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় রোশন অবাক হয়ে দেখল দুটো বেঞ্চি বটতলায় পাতা রয়েছে। তবে বৃষ্টি পড়ছে বলে সেখানে কেউ বসে নেই।

তারপরই ও পলানকে দেখতে পেল। পাঁচটা ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে ‘জনপ্রিয়’-র শেডের নীচে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

রোশন সবে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে জোরে প্যাডেল করায় মন দিয়েছে, তখনই পিছন থেকে ডাকটা ভেসে এল।

‘অ্যাই রোশন!’

পলান ডাকছে।

সাইকেল থামাল। তাকাল পিছন ফিরে।

পলান ওকে হাত নেড়ে ডাকছে।

রোশন সাইকেল ঘোরানোর আগেই ‘জনপ্রিয়’-র কাছ থেকে একটা বাইক গরগর করে উঠেছে। একটা ছেলে বাইকটা নিয়ে পলকে চলে এসেছে রোশনের কাছে।

‘অ্যাই, পলানদা তোমাকে ডাকছে—।’

ছেলেটার মুখটা চেনা-চেনা হলেও রোশন ওর নাম জানে না।

রোশন ছেলেটার কথার কোনও জবাব না দিয়ে সাইকেল ঘুরিয়ে ‘জনপ্রিয়’-র দিকে চলল।

মিষ্টির দোকানের কাছে এসে সাইকেল থেকে নামতেই পলান ওকে ডাকল, ‘আয়—এই শেডের নীচে আয়। বৃষ্টি পড়ছে…।’

রোশন পায়ে-পায়ে দোকানের শেডের দিকে এগিয়ে গেল।

পলানের সঙ্গে যে আরও পাঁচটা ছেলে দাঁড়িয়ে রয়েছে তার মধ্যে তিনজনকে রোশন চেনে : নোনতা, নগেন আর সুবু। বাকি দুজনের কারওরই ও নাম জানে না।

‘অ্যাই, তুই নাকি ফিফটিন আগস্ট ফাংশান মানাচ্ছিস?’ পলান একটু বাঁকা সুরেই জিগ্যেস করল যেন।

রোশন বলল, ‘ফাংশান আমি করছি না—আশাপুরের লোক করছে।’

‘আমি তো একটা ফাংশান রেগুলার করি—তা হলে আবার সেকেন্ড ফাংশান কেন?’ পলানের চোখ রোশনের চোখের দিকে তাকিয়ে।

‘আমি তার কী জানি! হয়তো আশাপুরের মানুষ সেকেন্ড একটা ফাংশান চাইছে—। তুমি বরং সুধীরডাক্তারবাবু আর অবনীস্যারকে জিগ্যেস কোরো…।’

‘তুই তা হলে এর মধ্যে নেই?’

‘কেন থাকব না! এর মধ্যে আশাপুরের সবাই আছে…সব্বাই।’ রোশন পলানের দিকে ঠান্ডা চোখে তাকাল। এখন পলানকে পালটা দেওয়ার সময় এসে গেছে। কিশোরীদা এখনও সেবাকেন্দ্রের ময়লা বিছানায় শুয়ে আছে। পলানের জন্য।

‘এই ফাংশানে আশাপুরের সব্বাই আছে—’ আবার বলল রোশন, ‘শুধু তুমি ছাড়া, পলানদা। আর তোমার আমচা-চামচাগুলো ছাড়া…।’ কথা শেষ করার সময় পলানের পাঁচজন চ্যালার দিকে ইশারা করল ও।

ঠিক তখনই খেয়াল করল পলানের একজন চ্যালা চোখ সরু করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।

ছেলেটাকে আগে পলানের টিমে দেখেনি রোশন। কিন্তু তবুও ছেলেটার মুখটা ওর কেন জানি না চেনা-চেনা মনে হল।

ছেলেটা ঠিক ছেলে নয়—লোকের কাছাকাছি। বয়েস চল্লিশ-টল্লিশ হবে। গায়ের রং কালো। নাক, মুখ, চোখ ধারালো। মাথার চুল লম্বা, ব্যাক ব্রাশ করা। শক্তপোক্ত কাঠামো। দেখলে বোঝা যায়, এককালে চেহারা ভালো ছিল—এখন ভেঙে গেছে। চামড়ায় ভাঁজ পড়েছে। মাথায় পলানের সমানই বলা যায়।

পলান পকেট থেকে একটা রিভলভার বের করল। সেটা খুঁটিয়ে পরখ করতে-করতে বলল, ‘তুই সবে ছ’-সাত মাস হল আশাপুরে ঢুকেছিস। এর মধ্যেই আশাপুরের ঠেকা নিয়ে বসে আছিস?’

রোশন কোনও জবাব দিল না—চুপচাপ পলানের দিকে চেয়ে রইল। আর মাঝে-মাঝে ওর চোখ ছিটকে গিয়ে পড়ছিল পলানের হাতের ইস্পাত-নীল মেশিনটার দিকে। স্বাধীনতা দিবসের ফাংশানের আগে রোশন আর কোনও ঝামেলার ভেতরে ঢুকতে চায় না।

রোশন কোনও জবাব দিচ্ছে না দেখে পলান চিবিয়ে-চিবিয়ে বলল, ‘আমার পলিথিনের প্যাকেটটার কী হল? কলাবতীর পাড়ে যেটা চাম্পু করে দিয়েছিস? ওতে সাড়ে আটলাখ টাকার মাল আছে…।’

‘তোমার মাল তুমি পেয়ে যাবে, পলানদা। আগে আমাদের ফাংশানটা হয়ে যাক। বলেছি না, ওটা ইনশিয়োরেন্স।’

পলান কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। কী যেন ভাবল। তারপর গলার স্বরটা একটু নীচু করে বলল, ‘অ্যাই, বল তো, কিশোরীদা কেমন আছেন? শুনলাম কে না কে ওঁর হাতে গুলি করে দিয়েছে…।’

রোশন অবাক চোখে পলানের দিকে তাকাল। এই শয়তানটা বলে কী!

‘তার মানে!’ রোশন কী বলবে ভেবে পাচ্ছিল না।

পলান রিভলভারের বডিটা জামায় ঘষে পরিষ্কার করতে-করতে নির্বিকারভাবে বলল, ‘আমি সেদিন ভোরবেলা কলকাতা চলে গিয়েছিলাম। ফিরে এসে সাব-ইনস্পেকটর সুরেন দাসের মুখে শুনলাম, কে যেন আমাদের কিশোরীদার হাতে দানা ঠুকে দিয়েছে। পুলিশ লোকটাকে এখনও খুঁজছে। তুই কেসটার কিছু জানিস?’

পলান এবার প্রচার করে-করে হয়কে নয় করে ছাড়বে। হয়তো সুরেন দাসের সঙ্গে সাঁট করে রোশনকেই কেসটা খাইয়ে দেবে।

রোশন মাথা নাড়ল, বলল, ‘না, জানি না…!’

‘কিশোরীদা কেমন আছেন এখন? ভাবছি কাল সকালে কিশোরীদাকে একবার দেখতে যাব—ফল-টল দিয়ে আসব…।’

রোশনের এবার গা-রিরি করছিল। ও কোনওরকমে বলল, ‘আমি এখন আসি, পলানদা—।’

রোশনের সাইকেলের চাকা সামান্য ঘুরতেই পলানের পাশে দাঁড়ানো লোকজনের মধ্যে কে একজন যেন বলে উঠল, ‘আরে, রোশন বিশ্বাস না!’

রোশন চলে যেতে গিয়েও ফিরে তাকাল।

চল্লিশ বছরের কালো লোকটা ওর পুরো নাম ধরে ডেকে উঠেছে।

এই অচেনা লোকটা কী করে জানল ওর পুরো নাম?

লোকটা পায়ে-পায়ে এগিয়ে এল রোশনের সাইকেলের কাছে।

রোশন খুব খুঁটিয়ে লোকটাকে দেখতে লাগল। মুখটা কি সামান্য চেনা-চেনা লাগছে? স্মৃতির অতল থেকে অচেনা মুখটা কি পরিচয়ের তকমা নিয়ে ভেসে উঠতে চাইছে?

‘কী রে, রোশন, আমাকে চিনতে পারছিস না?’ অচেনা মানুষটা বেশ আবেগ মাখানো গলায় প্রশ্নটা ভাসিয়ে দিল ভেজা বাতাসে।

রোশন পাগলের মতো মনের ভেতরে হাতড়াতে লাগল।

কে তুমি? কে?

মিহি বৃষ্টি বিপন্ন রোশনের মাথায় মুখে ঝরে পড়ছিল।

‘রোশন, আমাকে চিনতে পারছিস না!’ লোকটা গভীর চোখে রোশনের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর আবার বলল, ‘আমি দুনুদা—দীনেশ সামন্ত। কী রে, এর মধ্যেই আমাকে ভুলে গেলি!’

পলানের ভুরু কুঁচকে গিয়েছিল। ও পায়ে-পায়ে এগিয়ে এল দীনেশের কাছে। ওর পিঠে হাত রেখে বলল, ‘কী দীনেশদা, তুমি রোশনকে চেনো নাকি?’

পলানের দিকে ঘুরে তাকাল দীনেশ : ‘চিনব না! দমদম জেলে রোশন আমার সঙ্গে তিন-তিনটে বছর কাটিয়েছে…।’

পলান যেন একটা ধাক্কা খেল। রোশন জেল খেটেছে! রোশন দাগি আসামি!

রোশনের চোখের সামনে বৃষ্টি-ভেজা রাতের পৃথিবীটা লাট্টুর মতো পাক খেতে শুরু করেছিল। হ্যাঁ, এবার মনে পড়েছে। দীনেশ সামন্ত। দুনুদা। দমদম জেলে ওর সঙ্গে ছিল। শিলিগুড়ি থেকে কলকাতায় ড্রাগ পাচার করতে গিয়ে ধরা পড়ে গিয়েছিল। পাঁচবছরের সাজা হয়েছিল দুনুদার। সেই পাঁচবছরের তিনবছর কেটেছিল রোশনের সঙ্গে।

লাট্টুর মতো পাক খাওয়া পৃথিবীটার আর. পি. এম. ধীরে-ধীরে কমে এল। তারপর একসময় ওটা থামল।

হ্যাঁ, মনে পড়েছে। ও চিনতে পেরেছে দুনুদাকে।

রোশন সাইকেল থেকে নেমে দাঁড়াল।

‘দুনুদা!’

দীনেশ রোশনের কাঁধ চাপড়ে বলল, ‘কী দারুণ বডি বানিয়েছিস! জেলে যখন ছিলি তখন তো শুকনো রোগাপটকা ছিলি!’

রোশন অল্প হাসল। জিগ্যেস করল, ‘তুমি কেমন আছ, দুনুদা?’

‘ভালো। চলে যাচ্ছে।’

রোশন লক্ষ করল, দীনেশের চেহারা আগের চেয়ে অনেক শুকিয়ে গেছে। চল্লিশেই মুখের চামড়ায় ভাঁজ পড়েছে। কী একটা অস্বস্তিতে চোয়ালে হাত বোলাচ্ছে বারবার। দেখে মনে হচ্ছে, মুখে ‘ভালো’ আছে বললেও দুনুদা আসলে ভালো নেই।

পুরোনো কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল রোশনের।

বাবা মারা যাওয়ার পর টুকটাক কাজের খোঁজ করছিল ও। সেই সময়েই একটা ড্রাইভিং লাইসেন্স বের করার চিন্তা ওর মাথায় ঢোকে। পাড়ার এক সিনিয়ার দাদা মদনমোহন পাল ট্যাক্সি চালাতেন। তিনি ওকে রাতের দিকে গাড়ি চালানো শেখাতে শুরু করেন। আর পাশাপাশি ওকে একটা মোটর ট্রেনিং স্কুলে পরিচয় করিয়ে দেন : ‘মহাদেব মোটর ট্রেনিং স্কুল’।

দিন কুড়ি-পঁচিশ মদনদার কাছে গাড়ি চালানো শেখার পর রোশন ‘মহাদেব মোটর ট্রেনিং স্কুল’-এ ‘হাফ লাইসেন্স’-এর জন্য ভরতি হয়ে যায়।

লাইসেন্স হাতে পাওয়ার পর মদনদা রোশনকে এক ট্যাক্সি মালিকের সঙ্গে ইনট্রোডিউস করিয়ে দেন। ব্যস, রোশন তাঁর ট্যাক্সি চালাতে শুরু করে।

দেখতে-দেখতে সাড়ে তিন-চার বছর কেটে গেল। রোশনের ট্যাক্সির চাকা ঘুরতে লাগল। দিন-রাত পরিশ্রম করে ও টাকা রোজগার করতে লাগল, যদি মা-কে নিয়ে আরও একটু ভালোভাবে থাকা যায়।

এরকম একটা সময়ে হঠাৎই একদিন রোশনের ভাগ্যের চাকা ঘুরে গেল। ঘুরে গেল কোনও নোটিস না দিয়েই। ঘুরে গেল খারাপ দিকে।

পলান রোশনের দিকে চোখ মটকে তাকাল। ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল, ‘কী রে সালা যুধিষ্ঠিরের বাচ্চা! নিজে সালা জেলখাটা দাগি মাল হয়ে আশাপুরে এসে জ্ঞান আর নীতি চমকাচ্ছিস!’

রোশন এতটুকুও ঘাবড়াল না। মুখে হাত বুলিয়ে বৃষ্টির জল মুছে নিল। তারপর পলানের চোখে চোখ রেখে বলল, ‘আমি কোনও অন্যায় করিনি। দীনেশদা সব জানে।’

পলান রোশনের কথায় ভ্রূক্ষেপ না করে চিবিয়ে-চিবিয়ে বলল, ‘দাঁড়াও সালা, এবার তোমার ফাইনাল খবর নিচ্ছি। আশাপুরের ঘরে-ঘরে তোমার আসলি স্টোরি এবার হোম ডেলিভারি করে দেব…।’

দীনেশ সামন্ত পলানের কথার মাঝখানে কথা বলতে চেষ্টা করল : ‘পলানবাবু, রোশন কিন্তু কোনও ক্রিমিনাল অ্যাকটিভিটিতে ডায়রেক্টলি জড়িয়ে ছিল না। মানে…।’

একটা হাত তুলে পলান দীনেশকে থামতে ইশারা করল।

সঙ্গে-সঙ্গে দীনেশ সামন্ত চুপ করে গেল। কারণ, দীনেশ পলানের ইয়ার-দোস্ত নয়। পলানের সঙ্গে ওর যা কিছু রিলেশন সবটাই বিজনেসের ব্যাপারে।

দীনেশ সামন্ত বরাবরই ট্রান্সপোর্টের ব্যাবসা করে। সেই ব্যাবসার ফাঁকফোকরে মাঝে-মাঝে দু-নম্বরি কারবার করে। যেমন, বাংলাদেশ, নেপাল, ভূটান থেকে কখনও-কখনও ড্রাগ পাচার করে দীনেশ। পলানের মালও মাঝে-মাঝে আনা-নেওয়া করে। এই ছ’মাসে পলানের আশেপাশে দুনুদাকে কখনও দেখেনি রোশন। আর যদিও বা দেখে থাকে তা হলে চিনতে পারেনি। এখন দুনুদা নিজেকে চিনিয়ে দিল বলে ও চিনতে পারল।

রোশন আর দাঁড়াল না। পলানের সঙ্গে কথা না বাড়িয়ে সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দিল।

বৃষ্টি একটু বেড়েছে, কিন্তু ও সেটা গায়ে মাখল না। ও সাইকেল চালাতে লাগল। ওর মনটা চঞ্চল হয়ে উঠল। ও জেলফেরত দাগি আসামি এই কথাটা আশাপুরের ঘরে-ঘরে প্রচার করে পলান নস্কর কি ওকে আশাপুর থেকে তাড়াতে চায়?

এই চ্যালেঞ্জে পলান যদি জিতে যায় তা হলে আশাপুরে ওর নোংরা উৎপাত তো কম করে পাঁচ গুণ বেড়ে যাবে!

সাইকেল চালাতে-চালাতে রোশন আপনমনে এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়ল : না, এটা হতে দেওয়া যায় না।

ও ঠিক করল, গেস্টহাউসে ফিরে ও সবার আগে বিশ্বরূপদাকে সব খুলে বলবে। তারপর নিতুদাকে। তারপর রতনমণি মাঝি, সুধীরডাক্তারবাবু, অবনীস্যার, বাবুনদা—সবাইকে।

যে-কথা এতদিন ধরে কাউকে বলেনি ও সে-কথাই মন খুলে বলবে সবাইকে। পলান নস্করকে কিছুতেই ও ‘জিততে’ দেবে না।

দুনুদার সাতবছর আগের মুখটা মনে পড়ছিল রোশনের। তেল চকচকে মুখ, পেটানো চেহারা, গালে চাপদাড়ি, চোখে সুরমা। গায়ের রং কালো বলে প্রথম নজরে সুরমাটা বোঝা যায় না।

জেলের যে-খোপে রোশনকে ঢোকানো হয়েছিল সেখানে দীনেশ সামন্ত ছিল বস। সরু-সরু চোখে তেরছা নজরে তাকাত সবার দিকে। মনে-মনে মেপে নিত সবাইকে।

রোশনকে নিয়ে মোট চারজন ছিল সেই খুপরিতে। কারণ, জেলে তখন খুপরি খালি ছিল না।

রোশনকে দেখে আলাপ-টালাপ করার পর দীনেশ জিগ্যেস করেছিল, ‘কী রে বাচ্চা, কোন লাফড়ায় ঢুকলি?’

রোশন দেওয়ালের কোণ ঘেঁষে উবু হয়ে বসেছিল। হাঁটুতে মাথা রেখে কাঁদছিল। মায়ের কথা খুব মনে পড়ছিল ওর। কী কষ্টটাই না মা-কে দিয়েছে ও!

আদালতে দাঁড়িয়ে ও মা-কে বারবার বলেছিল, ‘মা, বিশ্বাস করো—আমার কোনও দোষ নেই। আমি কিচ্ছু করিনি—কোনও অন্যায় করিনি আমি!’

মা ওর গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিল, ‘আমি জানি, বাবু, তুই কোনও পাপ করিসনি। কিন্তু আমরা তো সবরকম চেষ্টা করেও হেরে গেলাম। হেরে গেলাম রে, বাবু—হেরে গেলাম…।’

সর্বনাশা পাপী দিনটার কথা ভীষণভাবে মনে আছে রোশনের।

রোদ ঝকঝকে দিন ছিল সেটা। ঘড়িতে সকাল প্রায় ন’টা। রোশন খোশমেজাজে ট্যাক্সি নিয়ে বেরিয়েছিল রাস্তায়। বালিগঞ্জ ফাঁড়ির কাছে একটা ফাঁকা জায়গা দেখে ও ট্যাক্সিটাকে দাঁড় করিয়ে বউনির কাস্টমারের জন্য অপেক্ষা করছিল।

রাস্তা দিয়ে গাড়ি ছুটে যাচ্ছিল। হর্ন বাজছিল। লোকজন ব্যস্তভাবে হেঁটে যাচ্ছিল এদিক-ওদিক। অফিস টাইমে যেমনটা দেখা যায় আর কী!

রোশনের সঙ্গে আরও একটা ট্যাক্সি দাঁড়িয়েছিল। সেটার বয়স্ক পাইলট গাড়ির বনেটের কাছে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে চঞ্চল চোখে চারপাশে তাকাচ্ছিল। বেশ বোঝা যাচ্ছিল, সেও একজন সওয়ারি পাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। রোশন মনে-মনে মা-কালীকে ডাকছিল, যেন ওর ভাগ্যে আগে শিঁকে ছেঁড়ে। আর একইসঙ্গে বলছিল, আজ যেন কমসেকম হাজার টাকা ভাড়া পকেটে আসে।

হঠাৎই রোশন একটা অদ্ভুত ব্যাপার দেখতে পেল।

ও ট্যাক্সি নিয়ে যেখানটায় দাঁড়িয়েছিল তার পাশেই খানিকটা ফাঁকা জমি ছিল। জমিটার কোথাও ঘাস আছে, আবার কোথাও টাক। তার একপাশে কিছুটা আগাছা আর জংলা ঝোপ। ঝোপের গা ঘেঁষে আবর্জনার স্তূপ।

একটা বিশ-বাইশের ছেলে হঠাৎ কোথা থেকে এসে ওই আবর্জনার স্তূপের পাশে দাঁড়াল। গায়ে সাধারণ জামাকাপড়। চুলগুলো খাড়া-খাড়া। রং তামাটে। নাকের ওপরে হালকা গোঁফ। পায়ে স্পোর্টস শু। কাঁধে একটা কালো রঙের বড়সড় ডাফল ব্যাগ।

ছেলেটা পকেট থেকে একটা ছোট মাপের মোবাইল ফোন বের করল। তারপর কার সঙ্গে যেন ফোনে কথা বলল—দু-দু-বার। মনে হল যেন একই লোকের সঙ্গে কথা বলল। তারপর শেষ কথাটা বলল, ‘জলদি আয়, আমি ওয়েট করছি—।’

শেষ কথাটা একটু জোরে বলেছিল ছেলেটা। তাই রোশন সেটা শুনতে পেল।

একজন খদ্দের এসে রোশনকে কোথাও একটা ভাড়া যাওয়ার জন্য বলল। কিন্তু রোশন একটু আনমনা থাকায় তক্ষুনি জবাব দিতে পারল না। ফলে ভদ্রলোক বিরক্তির একটা শব্দ করে সটান রোশনের সামনের ট্যাক্সিটার দরজা খুলে উঠে পড়ল। পাইলটও তাড়াহুড়ো করে উঠে বসল গাড়িতে। গাড়ি ছুটিয়ে দিল।

রোশনের ভীষণ আপশোশ হল। হাত কামড়াতে ইচ্ছে করল ওর।

আর ঠিক তখনই বিচিত্র ব্যাপারটা ওর চোখে পড়ল।

মোবাইলের পিছনের কভারটা খুলে ফেলল ছেলেটা। আঙুল দিয়ে কসরত করে সিমকার্ডটা বের করে নিল। তারপর সেটা মুখে পুরে দিয়ে দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে কষে চিবোতে লাগল।

ট্যাক্সির ড্রাইভিং সিটে বসে রোশন অবাক হয়ে দৃশ্যটা দেখতে লাগল। ছেলেটা সিমকার্ডটাকে বাবল গামের মতো চিবোচ্ছে কেন!

একটু পরেই চিবোনো সিমকার্ডটা মুখ থেকে বের করে নিল ছেলেটা। দোমড়ানো মোচড়ানো বস্তুটার দিকে একপলক তাকিয়ে হাসল। তারপর সেটা ছুড়ে ফেলে দিল আগাছার ঝোপে। তারপর…।

সিমকার্ডের পর মোবাইল ফোন।

আবর্জনার স্তূপের পাশে বেশ কয়েকটা আধলা ইট পড়ে ছিল। সেগুলোর কাছে গেল ছেলেটা। কাঁধের ডাফল ব্যাগটা মাটিতে নামিয়ে রেখে উবু হয়ে বসে পড়ল। মোবাইল ফোনটা একটা ইটের ওপরে রেখে আর-একটা আধলা ইট দিয়ে সেটাকে পাগলের মতো পেটাতে লাগল।

আবর্জনার পরিসীমাতে তিন-চারটে কাক ঘোরাফেরা করছিল, মাঝে-মধ্যে আবর্জনা ঠোকরাচ্ছিল। ছেলেটার ‘কাণ্ড’ শুরু হতেই ওরা লাফিয়ে খানিকটা পিছিয়ে গেল। বারবার ছেলেটার দিকে সাবধানী নজরে দেখতে লাগল।

মোবাইলটাকে থেঁতলে কয়েক টুকরো করে তারপর থামল ছেলেটা। ব্যাক কভারটাকেও রেহাই দিল না। শেষে সমস্ত টুকরোগুলো ফেলে দিল আগাছার ঝোপে।

ছেলেটা হাত-টাত ঝেড়ে ডাফল ব্যাগটা সবে কাঁধে ঝুলিয়েছে, তখনই আরও দুটো ছেলে ওর কাছে এসে হাজির হল। ওরা তিনজনে খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে কীসব কথা বলতে লাগল—রোশন একটুও শুনতে পেল না।

নতুন যে-দুজন এসে হাজির হয়েছে তাদের একজন বেশ মোটা, মুখটা ফোলা-ফোলা, ঠোঁটে সিগারেট। আর অন্যজন ফ্যাকফ্যাকে ফরসা, সামনের দাঁতগুলো উঁচু, গায়ে একটা বাদামি রঙের টি-শার্ট।

রোশনের যেটা অবাক লাগল, বাকি দুজনের কাঁধেও কালো রঙের একইরকম দুটো ডাফল ব্যাগ।

ও আর বেশি কিছু ভেবে ওঠার আগেই দেখল, ছেলে তিনটে ওর ট্যাক্সির দিকেই এগিয়ে আসছে। মোটা ছেলেটা সিগারেটের শেষ টুকরোটা ছুড়ে ফেলে দিল।

ট্যাক্সির পিছনের দরজা দুটো খুলে গেল। ছেলে তিনটে উঠে বসল ট্যাক্সিতে। দড়াম-দড়াম করে দরজা বন্ধ হল।

রোশন রিয়ার ভিউ মিরারে তাকিয়ে ওদের লক্ষ করছিল। ডাফল ব্যাগগুলো ওরা যে-যার কোলে নিয়ে বসেছে।

ফরসা ছেলেটা বলল, ‘আমরা অনেকগুলো জায়গায় যাব। তার মধ্যে কোথাও-কোথাও একটু ওয়েট করতে হতে পারে…।’

রোশন কিছু বলার আগেই চুল খাড়া-খাড়া প্রথম ছেলেটা বলল, ‘টাকা দিয়ে আমরা তোমার ওয়েটিং চার্জ পুষিয়ে দেব…।’

কথা শেষ করার সঙ্গে-সঙ্গে মোটা ছেলেটা একটা হাজার টাকার নোট রোশনের সামনে বাড়িয়ে ধরল : ‘এই নোটটা অ্যাডভান্স রেখে দাও।’

টাকাটা নিয়ে রোশন ওপরওয়ালার উদ্দেশে কৃতজ্ঞতা জানাল। বউনির কাস্টমারের কাছ থেকেই চলে এল এক হাজার টাকা! ভাবা যায়! এরা কত জায়গায় ঘুরে বেড়াবে কে জানে! হয়তো এই প্রথম কলকাতায় এসেছে—কলকাতা ঘুরে-টুরে দেখবে। কিন্তু তাই যদি হয় তা হলে সঙ্গে বড়-বড় ব্যাগগুলো বয়ে বেড়াবে কেন?

রোশন গাড়িতে স্টার্ট দিয়েছিল। আয়নার দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করল, ‘কোনদিকে যাব, দাদা?’

মোটা ছেলেটা বলল, ‘ঠিক আছে, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের দিকে আপাতত চলো—।’

রোশন কোনও কথা না বলে গাড়ি ঘোরাল হাজরা রোডের দিকে।

হাজরা রোডে ব্যস্ত কলকাতার ছবি। দোকানপাট, গাড়ি-বাস, এদিক-ওদিক হেঁটে চলা ব্যস্তবাগীশ সব মানুষ।

মাতঙ্গিনী হাজরার কথা মনে পড়ল রোশনের। এই রাজপথটা যারা রোজ ব্যবহার করে তারা কি জানে মাতঙ্গিনী হাজরার নামে এই রাস্তাটার নাম হাজরা রোড রাখা হয়েছে?

পিছনের সিটে ছেলে তিনটে নিজেদের মধ্যে অল্প-সল্প কথা বলছিল। রোশন খেয়াল করল, কথাবার্তার মধ্যে ওরা কোনও নাম ব্যবহার করছে না। কোনও একজন মানুষের পরিচয় ওদের কারও বুঝতে অসুবিধে হলে তখন তাঁর চেহারার ডেসক্রিপশন দেওয়া হচ্ছে।

এ আবার কী অদ্ভুত ধরনের কথাবার্তার স্টাইল!

চুল খাড়া ছেলেটা নিজের মোবাইল ফোন এবং সিম কার্ড ‘খতম’ করার গল্পটা সঙ্গী দুজনকে শোনাল। ওরাও বলল, কীভাবে ওরা ওদের মোবাইল ফোন দুটো সিমসমেত অকেজো করেছে।

রোশন ভাবছিল, নিজেদের মোবাইল ধ্বংস করার জন্য এদের এত উৎসাহ কেন?

কিন্তু হাজার টাকা অ্যাডভান্স পাওয়ার আনন্দ ওর সব সন্দেহ আর কৌতূহলকে চাপা দিয়ে দিল।

রোশন একমনে গাড়ি চালাতে লাগল। আর মাঝে-মাঝে রিয়ার ভিউ মিরারে আড়চোখে ছেলেগুলোকে দেখতে লাগল।

রোশনের ট্যাক্সি ছুটে চলল ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের দিকে।

ছেলে তিনটির হুকুম মতো রোশন গোটা কলকাতা চষে বেড়াতে লাগল। মনে-মনে বেশ আনন্দ হচ্ছিল ওর। এরা যেরকম দরিয়াদিল কাস্টমার তাতে সারাটা দিন যদি ওরা রোশনের ট্যাক্সি নিয়ে টো-টো করে ঘুরে বেড়ায় তা হলে শেষ পর্যন্ত হয়তো হাজার তিনেক টাকা রোশনের কপালে জুটে যেতেও পারে।

কলকাতা আর তার আশেপাশে নানা জায়গায় ঘুরপাক খেয়ে বেলা দেড়টা নাগাদ ওরা সোদপুরের কাছাকাছি বি. টি. রোডে ট্যাক্সিটা দাঁড় করাতে বলল।

রোশন যেখানে গাড়িটা দাঁড় করাল সেখানে ফুটপাথ বলে কিছু নেই। সামনেই দুটো বড়-বড় গাছ। তার পাশে একটা ইলেকট্রিকের পোল। দুটো গাছের মাঝে একটা পুঁচকে চায়ের দোকান। সেটা থেকে দু-পা পিছিয়ে পাশাপাশি দুটো টায়ারে হাওয়া দেওয়ার দোকান। দুটো দোকানেরই গা ঘেঁষে পুরোনো টায়ার একটার ওপরে একটা সাজানো—ঠিক যেন টায়ারের পিলার। তার পাশ দিয়ে চোখে পড়ছে কালচে হয়ে যাওয়া হাওয়া মেশিন।

ঘোর দুপুর। রাস্তায় গাড়ি অনেক কম। চায়ের দোকানদার একটা অ্যালুমিনিয়ামের থালায় রুটি-তরকারি নিয়ে খেতে বসেছে। ডানদিকের হাওয়ার দোকানটার সামনে ঝলঝলে হাফপ্যান্ট পরা একটা বছর পনেরো-ষোলোর ছেলে খালি গায়ে বসে ঝিমোচ্ছে।

সবমিলিয়ে একটা অলস দুপুর।

ওরা তিনজনেই গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। সঙ্গে ওদের কালো ডাফল ব্যাগ। ট্যাক্সি থেকে নামার সময় ওদের ব্যাগগুলো যেভাবে ভাঁজ-টাজ খেয়ে যাচ্ছিল তাতে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিল ওগুলো খালি।

গাড়িটা দাঁড় করিয়ে রোশন স্বাভাবিকভাবেই ইঞ্জিন বন্ধ করেছিল। গাড়ি থেকে নামার পর মোটা ছেলেটা ওর জানলার সামনে এসে ঝুঁকে পড়ে বলল, ‘গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ইঞ্জিন চালু রাখো। তেল খরচের চিন্তা কোরো না—টাকায় পুষিয়ে দেব।’

রোশন বেশ অবাক হল।

ইঞ্জিন চালু রাখতে বলল কেন?

সে যাই হোক, মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই ভেবে রোশন গিয়ার নিউট্রালে নিয়ে গাড়িতে স্টার্ট দিল।

ওরা তিনজন পা চালাল। রোশন ট্যাক্সির জানলা দিয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে রইল।

তারপর যা দেখল তাতে ওর ভুরু কুঁচকে গেল।

কাছেই নীল-সাদা রং করা একটা তিনতলা বাড়ি। তার একতলাটা জুড়ে একটা সরকারি ব্যাংক। ব্যাংকের কোলাপসিবল গেট খোলা।

সেই গেট থেকে তিন ধাপ সিঁড়ি উঠলেই অ্যালুমিনিয়াম ফ্রেম লাগানো কাচের দরজা।

ছেলে তিনটে কাচের দরজা ঠেলে ব্যাংকে ঢুকল।

ছোট ব্যাংক। তাই কর্মীর সংখ্যা কম, কাস্টমারের সংখ্যাও বেশি নয়।

দরজার কাছে বছর তিরিশের একজন সিকিওরিটি গার্ড দাঁড়িয়ে। গায়ে নীল রঙের ইউনিফর্ম, হাতে রাইফেল। সে একজন কাস্টমারকে হাত নেড়ে বোঝাচ্ছিল, কোন কাউন্টারে গেলে চেক ডিপোজিট স্লিপ পাওয়া যাবে।

গার্ড ছেলেটি দেখতে-শুনতে স্মার্ট, চোখ চনমনে, রং ফরসা। তবে ওর ইউনিফর্ম থেকে ঘামের গন্ধ বেরোচ্ছিল।

কালো ব্যাগ কাঁধে তিনজন ছেলে পায়ে-পায়ে গার্ডের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। চেক কোন কাউন্টারে জমা নেয়, উইথড্রয়াল স্লিপ কোন কাউন্টারে রাখা আছে, চেক ফেলার ড্রপ বক্সটা কোথায়—এইসব মামুলি প্রশ্ন করতে লাগল।

ওদের কাঁধের কালো ব্যাগগুলো দেখে গার্ডের ভুরু কুঁচকে গেল। সে দেখল ছেলে তিনজন তাকে প্রায় ঘিরে ধরেছে। তখন সে তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘যান, যান, ওদিকে যান—এক নম্বর আর দু-নম্বর কাউন্টারে জিগ্যেস করুন।’

সিকিওরিটি গার্ডের কথা শেষ হতে-না-হতেই ফরসা দাঁত উঁচু ছেলেটা পকেট থেকে একটা ওয়ান শটার বের করে গার্ডের কোমরের কাছে চেপে ধরেছে।

সেটা দেখতে পেয়ে টাকা তুলতে আসা একজন মহিলা কাস্টমার চিল চিৎকার শুরু করে দিলেন। অন্য দু-চারজন কাস্টমার চমকে ফিরে তাকাল ভদ্রমহিলার দিকে এবং তাঁর নজর অনুসরণ করে সিকিওরিটি গার্ডের দিকে, তারপর তাকে ঘিরে থাকা তিনটে ছেলের দিকে।

ওয়ান শটারটা ওরা সবাই দেখতে পেল।

দুটো ছেলে দৌড়ে চলে গেল কাউন্টারের ভেতর দিকে যাওয়ার খাটো সুইং দরজার দিকে। চোখের পলকে পাল্লা ঠেলে ঢুকে পড়ল ব্যাংক কর্মীদের বসবার এলাকায়।

দাঁত উঁচু ছেলেটা গার্ডের কোমরে ওয়ান শটারটা ঠেসে ধরে দাঁড়িয়েই রইল।

গোঁফওয়ালা চুলখাড়া ছেলেটা কখন যেন একটা ওয়ান শটার হাতের মুঠোয় বাগিয়ে ধরেছে। লোকজনকে ভয় দেখাতে সেটা এদিক-সেদিক তাক করে ভয়ংকরভাবে নাচাচ্ছে।

‘খবরদার! যে যেখানে আছিস সেখানেই ছবি হয়ে যা! নইলে সালা পারমানেন্টলি ছবি করে গলায় মালা ঝুলিয়ে দেব!’

একজন রোগা বেঁটে-খাটো কাস্টমার পা টিপে-টিপে ব্যাংকের দরজার দিকে এগোতে চেষ্টা করছিল, সেটা লক্ষ করে চুল খাড়া ছেলেটা ফয়ার করল। টিপটা ঠিকঠাক না থাকায় বেঁটে লোকটার বাহু ছুঁয়ে বেরিয়ে গেল গুলিটা। লোকটা হাঁউমাউ করে চিৎকার করে শূন্যে একলাফ দিয়ে সটান শুয়ে পড়ল মেঝেতে। একইসঙ্গে অন্যান্য কাস্টমার ভয়ে চেঁচাতে শুরু করল।

হইচই চিৎকার চেঁচামেচি শুনে ব্যাংকের ম্যানেজার ততক্ষণে তাঁর চেম্বার থেকে বাইরে বেরিয়ে এসেছেন এবং ঠকঠক করে কাঁপতে শুরু করেছেন।

মোটা ছেলেটা তখন টপাটপ ক্যাশ লুঠ করে ওর কালো ব্যাগটায় ভরছিল। সেই কাজ করতে-করতেই ও দাঁত খিঁচিয়ে চুল খাড়া ছেলেটাকে কাছে ডাকল, ‘আবে অ্যাই গোঁফু! চটপট এদিকে আয়। ব্যাগে মাল তোল! জলদি! টাইম চলে যাচ্ছে—।’

চুল খাড়া তখন ওয়ান শটারটা শূন্যে উঁচিয়ে জনগণকে প্রবল খিস্তিসমেত হুমকি দিল। বলল যে, জায়গা থেকে একটু নড়লেই গুলি করে উড়িয়ে দেবে।

ওর পিস্তলে আর গুলি ছিল না। কিন্তু পাবলিক সেটা বুঝলে তো!

ওরা দুজনে দু-মিনিটের মধ্যে ওদের কালো ব্যাগ দুটো যতটা পারল ভরতি করে নিল। তারপর ছুট লাগাল ব্যাংকের দরজার দিকে।

ব্যাংকের ম্যানেজার ততক্ষণে চেম্বারে ঢুকে গিয়ে ইমার্জেন্সি অ্যালার্মের বোতাম টিপে দিয়েছেন। এবং তখনই আকাশ থেকে বৃষ্টি নামল।

দু-বন্ধুর সঙ্গে তাল মিলিয়ে দাঁত উঁচু ছেলেটাও ব্যাংকের দরজা দিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল বাইরের বৃষ্টিতে। তারপর তিনজনেই ছুটতে লাগল রোশনের ট্যাক্সির দিকে।

ছেলে তিনটে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ব্যাংকের দিকে রওনা হওয়ার পর রোশন ট্যাক্সিতে বসে অপেক্ষা করছিল। চাপা গরগর শব্দ করে গাড়ির ইঞ্জিন চলছিল। ও ভাবছিল, ওদের ফিরে আসতে কতক্ষণ লাগবে। ক্লান্তিতে ওর ঝিমুনি আসছিল, দু-চোখ বুজে আসতে চাইছিল। হাওয়া-বাতাস বন্ধ হয়ে চারপাশটা কেমন গুমোট ধরে গেছে। চায়ের দোকানের লাগোয়া গাছের কোনও একটা ডালে বসে একটা কাক ‘কা-কা’ করে ডাকছিল। ডাকটা রোশনের কানে ক্লান্ত বিষণ্ণ শোনাল। কর্কশ স্বর যে কখনও বিষণ্ণ শোনাতে পারে ও সেটা আগে কোনওদিনও ভাবেনি। হঠাৎই সেই বিষণ্ণতার সুরে সুর মিলিয়ে আকাশ থেকে বৃষ্টি নামল। সোঁদা গন্ধ ভেসে এল রোশনের নাকে। ওর ঝিমুনি কেটে গেল। বৃষ্টি ক্রমশ সুর তুলতে লাগল উঁচু পরদায়।

বৃষ্টির ঝালরের মধ্যে দিয়ে রোশন আচমকাই তিনটে কালো ব্যাগকে ওর দিকে ছুটে আসতে দেখল। তার সঙ্গে ছেলে তিনটে পড়িমড়ি করে ছুটে আসছে। একজনের হাতে খোলা পিস্তল—ওয়ান শটার।

খালি ব্যাগটা ওরা ছুলে ফেড়ে দিল রাস্তায়। রোশন লক্ষ করল, ব্যাংকের সিকিওরিটি গার্ড ছেলেটি কখন যেন ব্যাংকের দরজা দিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে এসেছে। রাইফেল তুলে তাক করছে ছুটন্ত ছেলেগুলোর দিকে।

আর তার পরের মুহূর্তেই ফায়ারিং-এর শব্দ হল : ক্র্যাক।

ফরসা দাঁত উঁচু ছেলেটা ছুটতে-ছুটতেই ছিটকে পড়ল ভিজে রাস্তায়। ওর হাতের অস্ত্র ছিটকে গেল দূরে। বাকি দুজন কিন্তু তাদের দৌড় থামাল না।

রোশন ব্যাপারটা এবার স্পষ্ট বুঝতে পারল : তিনজন ব্যাংক-ডাকাতকে ও আজ ট্যাক্সিতে তুলেছে।

ও কেমন যেন হতভম্ব হয়ে গেল। সবকিছু বুঝতে পারার পরেও ও এখন কী করবে সেটা বুঝে উঠতে পারছিল না। এদিকে দুটো ছেলে ততক্ষণে ওর ট্যাক্সির কাছে এসে পড়েছে।

দরজা খুলে ওরা ট্যাক্সিতে উঠে পড়ল। কালো ব্যাগ দুটোকে টেনে-হিঁচড়ে ভেতরে ঢুকিয়ে নিল। মোটা ছেলেটা হাঁপাতে-হাঁপাতে হুকুম দিল, ‘চালাও—!’

গাড়িতে স্টার্ট দেওয়া ছিল, কিন্তু রোশন ক্লাচ চেপে গিয়ার দিতে পারল না। কেমন একটা ঘোরের মধ্যে ডুবে গেল। কারণ, জানলা দিয়ে ও দেখতে পেয়েছে তৃতীয় ছেলেটি টলতে-টলতে কোনওরকমে ওর গাড়ির দিকে এগিয়ে আসছে। যেভাবে ও আসছে সেটাকে হাঁটা আর দৌড়োনোর মাঝামাঝি কিছু একটা বলা যায়।

ছেলেটার টি-শার্টের বাঁ-দিকের খানিকটা জায়গা জুড়ে কালচে লাল ছোপ। বোধহয় গার্ডের রাইফেলের গুলিটা ওর পিঠের একপাশে লেগেছে।

মোটা ছেলেটা আবার ধমকে চেঁচিয়ে উঠল, ‘আবে ডাব্বু, চালা—! জলদি গাড়ি চালা!’

রোশনের ঘোর তাতেও কাটল না। ও তৃতীয় ছেলেটির দিকে তাকিয়েই রইল।

ছেলেটার মুখ যন্ত্রণায় কুঁচকে গেছে। হাঁ করে হাঁপাচ্ছে। ওর চোখ দুটো কেমন ঘোলাটে দেখাচ্ছে।

মোটা ছেলেটা আবার চেঁচিয়ে ওঠার সঙ্গে-সঙ্গে রোশনের ঘোর কাটল। কারণ, ফরসা দাঁত উঁচু ছেলেটা তখন ট্যাক্সির পিছনদিকের একটা দরজা খুলে ফেলেছে। ওর মুখে যন্ত্রণার আর্ত গোঙানি। ঘোলাটে চোখ প্রায় বুজে আসছে। মুখের সব পেশি কুঁচকে কেমন যেন বিকৃত হয়ে গেছে। ছেলেটা পিছনের সিটে বলতে গেলে জাস্ট টলে পড়ে গেল। বিড়বিড় করে বলতে লাগল, ‘হাসপাতাল। আ-আ আমাকে হাসপাতালে নিয়ে চল। হেভি পেইন। হে-হেভি রক্ত। হাসপাতাল…।’

রোশন তার মধ্যেই গাড়ি চালাতে শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু ও শহরের এদিকটা চেনে না। কাছাকাছি হাসপাতাল কোথায় আছে সেটা ওর জানা নেই।

ও আয়নার দিকে তাকিয়ে মোটা ছেলেটার মুখ দেখতে পেল। ছেলেটা কুলকুল করে ঘামছে।

আয়নার মধ্যে দিয়ে ওর সঙ্গে রোশনের চোখাচোখি হল। রোশন ওকে জিগ্যেস করল, ‘এদিকে…এদিকে হসপিটাল কোথায় আছে?’

রোশন বেশ টের পেল ওর গলা কাঁপছে।

মোটা ছেলেটার চোখে ভয়। মুখ দেখে মনে হচ্ছে, ওর ব্রেন আর কাজ করছে না।

ও কোনওরকমে বলল, ‘হ-হসপিটাল না, হসপিটাল না—স্টেশনে চল, ব্যারাকপুর স্টেশন। তোকে অনেক টাকা দেব।’

রোশনের ভারী তাজ্জব লাগল। ওদের এক বন্ধুর প্রাণ নিয়ে টানাটানি, আর মোটা ছেলেটা টাকার কথা বলছে!

রোশন বলল, ‘ব্যারাকপুর স্টেশন কোনদিকে আমি চিনি না।’

কথাটা সত্যি, কারণ, কলকাতার এদিকটায় ও গাড়ি নিয়ে আগে প্রায় আসেইনি বলা যায়।

কিন্তু মোটা ছেলেটা রাগে ফেটে পড়ল : ‘চিনিস না! ক্যালানে কার্তিক! রাস্তাঘাট চেনে না সালা কলকাতায় ট্যাক্সি নিয়ে মারাচ্ছে!’

খাড়া চুল ছেলেটা মোটাকে ঠান্ডা করার চেষ্টা করল। ওর পিঠ আলতো করে দুবার চাপড়ে দিয়ে বলল, ‘কুল ডাউন ইয়ার। কুল ডাউন…।’ তারপর রোশনকে বলল, ‘সোজা চল—জোরসে…।’

রোশন সামনের দিকে তাকাল। উইন্ডশিল্ডের ওপারে বৃষ্টি। ঝমঝমে না হলেও ঝুমঝুম ছন্দে চলছে। একটা ওয়াইপার উইন্ড শিল্ডের ওপরে এদিক-ওদিক ছুটোছুটি করছে। রোশন যতটা জোরে পারা যায় বি. টি. রোড ধরে গাড়ি ছুটিয়ে দিল। অ্যাক্সিলারেটর আরও চেপে ধরল। খাড়া চুল ছেলেটা পিছনের সিট থেকে গলা বাড়িয়ে রোশনের কানের কাছে মুখ নিয়ে এল। দাঁতে দাঁত চেপে হিংস্র গলায় বলল, ‘আমি যেভাবে বলব টো-টো সেভাবে চালাবি। নইলে সব কাম তামাম করে দেব…।’

মোটা ছেলেটা উত্তেজিত গলায় বলল, ‘জোরে চালা, সালা…আরও জোরে…।’

আহত ফরসা ছেলেটা ওর দু-বন্ধুর মাঝে ভেজা ন্যাকড়ার মতো নেতিয়ে পড়ে আছে। ভাঙা গলায় বিড়বিড় করে বলছে, ‘তোরা আমাকে…আমাকে ভাই হাস…হাসপাতালে নিয়ে চল। হেভি…হেভি পেইন হচ্ছে…ওঃ!’ ওর বড়-বড় শ্বাস হাপরের শব্দ তুলছে, রোগা বুক উঠছে-নামছে। ওর বাদামি টি-শার্টের অনেকটাই রক্তে ভিজে গেছে। বাদামি আর লাল মিশে এক অদ্ভুত কালচে রং তৈরি হয়েছে।

খাড়া চুল ছেলেটা রাস্তার ডিরেকশন দিচ্ছিল। বেশ বোঝা যাচ্ছিল, এদিককার রাস্তা-ঘাট ওর ভালো করেই চেনা।

ছেলেটা থেকে-থেকেই ‘ডাইনে’, ‘বাঁয়ে’, ‘সোজা’—এইসব ছোট-ছোট শব্দ বলছিল, আর ওর মুখ থেকে ছিটকে আসা গরম বাতাস রোশনের কানে ঝাঁপিয়ে পড়ছিল।

পিছনের সিট থেকে আহত ছেলেটার কথাবার্তা আর গোঙানি ক্রমশ ঝিমিয়ে আসছিল। রোশন বেশ বুঝতে পারছিল, সময় ফুরিয়ে আসছে। কিন্তু ওর কিছু করার নেই। এই ছেলে দুটো সাংঘাতিক। ওরা ওদের ‘বন্ধু’-কে বাঁচাতে চায় না।

কিছুক্ষণ পর খাড়া চুল ছেলেটার ডিরেকশন মতো ট্যাক্সিটা একটা সরু রাস্তায় ঢোকাল রোশন। সেখানে জল, কাদা, ছাতা মাথায় লোকের ভিড়, রাস্তার একপাশে বাজার বসেছে। বাজারের দিকটায় ফ্লাই-ওভারের উঁচু পাঁচিল। পাঁচিলের গায়ে ছেঁড়াখোঁড়া পোস্টার সাঁটানো। তার আশেপাশে ঘুঁটের ছাপ।

ট্রেনের হুইসল শুনতে পেল রোশন। মনে হল স্টেশন খুব কাছেই।

মোটা ছেলেটা হঠাৎই কর্কশ গলায় খেঁকিয়ে উঠল, ‘অ্যাই, থামা! গাড়ি থামা!’

রোশন আচমকা ব্রেক কষে গাড়ি থামাল। সঙ্গে-সঙ্গে দুটো হাজার টাকার নোট ওর পাশে সিটের ওপর এসে পড়ল। এবং রোশনকে হতবাক করে দিয়ে মোটা আর চুল খাড়া চটপট ট্যাক্সি থেকে নেমে পড়ল। হাতে ওদের কালো ডাফল ব্যাগ। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, ব্যাগগুলো এখন কোনও কিছুতে ঠাসা।

বৃষ্টি এখনও পড়ছে। কিন্তু ছেলে দুটো সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করেই ব্যাগ কাঁধে ছুট লাগাল। এবং কয়েকসেকেন্ডের মধ্যেই ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেল।

রোশনের চিন্তাগুলো কেমন জট পাকিয়ে গেল।

বন্ধুকে ট্যাক্সিতে ফেলে রেখে ছেলে দুটো কেমন অনায়াসে চলে গেল! অথচ ফরসা ছেলেটার যেভাবে ব্লিডিং হচ্ছে তাতে শেষ পর্যন্ত ওকে বাঁচানো যাবে কিনা সন্দেহ।

গাড়ির ভেতরে কেমন যেন একটা চাপা গুমোট। তার মধ্যে মিশে আছে ঘামের গন্ধ, রক্তের আঁশটে গন্ধ। ফরসা ছেলেটা হাত-পা অদ্ভুতভাবে ভাঁজ করে ট্যাক্সির সিটে এলিয়ে পড়ে আছে। চোখ দুটো বড়-বড় করে খোলা—শূন্য দৃষ্টিতে ট্যাক্সির সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে। মুখ হাঁ করে ফোঁস-ফোঁস করে শ্বাস নিচ্ছে।

আর কতক্ষণ বাঁচবি তুই? আর কতক্ষণ? রোশন মনে-মনে মরণাপন্ন ছেলেটাকে জিগ্যেস করল।

হঠাৎই ছেলেটা রোশনের দিকে তাকাল। কী অদ্ভুত দৃষ্টি ওর চোখে! ও বাঁচতে চাইছে। বাঁচতে চাওয়ার প্রবল আকুতি নিয়ে দেখছে রোশনকে। নীরব চিৎকারে বলছে, ‘আমাকে বাঁচাও! আমাকে বাঁচতে দাও! প্লিজ…!’

রোশনের বুকের ভেতরে ওর আত্মা ভীষণভাবে ছটফট করছিল। কোথায় হসপিটাল? কোথায়? রাস্তার পথচলতি লোকজনকে জিগ্যেস করা যায়। কিন্তু তারপর? তারপর রোশনের কী হবে! থানা, পুলিশ, অ্যারেস্ট, এবং সব শেষে সাজা।

মনে-মনে হিসেব কষে রোশন বেশ বুঝতে পারছিল যে, ওর থানা-পুলিশ করে সাজা হওয়ার চেয়ে এই অল্পবয়েসি ছেলেটার জানের দাম অনেক বেশি। কিন্তু তবুও ওর মনের ভেতরে দোটানা চলতে লাগল। সেই দোটানায় নৃশংসভাবে ক্ষত-বিক্ষত হতে লাগল রোশন।

হঠাৎই ও একটা যন্ত্রণার চিৎকার করে উঠল। লড়াইয়ে আহত কোনও পশুর মরিয়া হয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চিৎকার।

সেই চিৎকারের সঙ্গে-সঙ্গে রোশন এক ঝটকায় ট্যাক্সির দরজা খুলে নেমে এল ভিজে রাস্তায়। দু-হাত শূন্যে তুলে ‘বাঁচাও! বাঁচাও!’ বলে যক্ষ্মা পাগলের মতো চিৎকার করতে লাগল।

দুটো কমবয়েসি ছেলে খানিকক্ষণ আগেই পিছনের সিটে এলিয়ে থাকা রক্ত মাখা ফরসা ছেলেটাকে লক্ষ করেছিল। ওরা পায়ে-পায়ে ট্যাক্সির পিছনের একটা জানলার কাছে এগিয়ে এসেছিল। জানলার কাচের ওপরে বৃষ্টির ছোট-ছোট ফোঁটা ঠিকরে পড়ে সাপের মতো গড়িয়ে-গড়িয়ে নামছে।

ছেলে দুটো কাচের ওপরে চোখ প্রায় ছুঁইয়ে ফেলেছে। দু-হাতের তালু বাঁকিয়ে আশপাশ থেকে ছিটকে আসা আলো আড়াল করেছে। তারপর নজর তীক্ষ্ম করে ট্যাক্সির ভেতরটা দেখতে চাইছে।

কে যেন আলুথালু হয়ে পড়ে আছে না!

তার গায়ের জামায় রক্তের বড়-বড় ছোপ!

ঠিক সেই সময়েই রোশনের পাগল করা চিৎকার ওদের কানে এল।

কয়েকসেকেন্ডের মধ্যেই রোশনের ট্যাক্সিটা ঘিরে জনতার ভিড় জমে গেল!

‘হাসপাতাল! হাসপাতাল! বাঁচাও! হসপিটালে না নিয়ে গেলে ছেলেটা এখনই মরে যাবে! বাঁচাও!’ রোশনের চিৎকার কিছুতেই থামতে চাইছিল না।

রোশনের ভেতর থেকে আর একটা রোশন কখন যেন বাইরে বেরিয়ে এসেছিল। অবাক হয়ে সে প্রথম রোশনকে দেখছিল।

একটা ছেলে…তাকে রোশন চেনে না, জানে না…তার ওপরে ছেলেটা ব্যাংক-ডাকাত…অথচ তাকে বাঁচানোর জন্য রোশন পাগলের মতো চিৎকার করছে, ওর গলার শিরা ফুলে উঠেছে, ভোকাল কর্ড চিরে গিয়ে গলার ভিতরে রক্তের সরু রেখা ফুটে উঠল কি না কে জানে!

প্রথম রোশনকে দেখে দ্বিতীয় রোশন অবাক হচ্ছিল। কারণ, প্রথম রোশনকে দেখে মনে হচ্ছিল, কোনও অচেনা ব্যাংক-ডাকাত নয়, ওর ভাই কুশান মারা যাচ্ছে।

এরপর যা হওয়ার তাই হল।

লোকজনের ভিড় ক্রমশ বাড়তে লাগল। কিছু পাবলিক উঠে পড়ল রোশনের ট্যাক্সিতে। ট্যাক্সি চলতে শুরু করল। রোশনের হাতে স্টিয়ারিং। ওর পাশে গাদাগাদি করে বসে দুজন। তাদেরই একজন পথের ডিরেকশন দিচ্ছে। রোশনের ট্যাক্সি ছুটে চলেছে একটা বেসরকারি হাসপাতালের দিকে।

বৃষ্টি বৃষ্টির মনে পড়ছিল। ওয়াইপার কাচের ওপরে এপাশ-ওপাশ যাতায়াত করছিল। ট্যাক্সির হেডলাইটের আলোয় বৃষ্টির ফোঁটাগুলো চিকচিক করছিল। আর রোশন যেন একটা ঘোরের মধ্যে গাড়ি চালাচ্ছিল।

হাসপাতালে পৌঁছে রোশন যখন আহত ছেলেটিকে ভরতি করার জন্য রিসেপশনে কথা বলছে, তখন তারা কিছু টাকা জমা করতে বলল।

টাকার কথা শুনে সঙ্গের লোকজন মুখচাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। দেরি হয়ে যাচ্ছে দেখে রোশন পকেট থেকে ডাকাতদের দেওয়া দু-হাজার টাকা বের করে দিল। মনে-মনে বলল, ‘টাকা যাক, কিন্তু ছেলেটা বেঁচে যাক…।’

হাসপাতালের যত্ন আর চিকিৎসায় ছেলেটা শেষ পর্যন্ত বেঁচে গেল। তবে ব্যাপারটা নিয়ে পুলিশ কেস হল।

তারপর ক্রিমিনাল কেসে মাসছয়েক ধরে বিচারের টানাপোড়েনের পর রোশনের তিনবছরের জেল হয়ে গেল।

***

রোশন যখন লজে ঢুকল তখন রাত প্রায় সওয়া দশটা।

মনটা অস্থির হয়ে উঠেছিল বলে ও বৃষ্টির মধ্যেই সাইকেল নিয়ে এলোমেলো ঘুরে বেড়িয়েছে। পুরোনো কথাগুলো পাগলের মতো ছুটোছুটি করছিল ওর মাথার ভেতরে।

খেতে ইচ্ছে করছিল না রোশনের। তাই রুটি-তরকারি কিনতে পাইস হোটেলে আর গেল না। এদিক-ওদিক সাইকেলের চাকা গড়িয়ে একসময় পৌঁছে গেল বিশ্বরূপদার ‘আশাপুর লজ’-এ।

বিশ্বরূপ সাড়ে ন’টার পর সামনের ঘরের টেবিল-চেয়ারে আর থাকেন না। আলো নিভিয়ে নিজের একতলার ছোট্ট ঘরে ঢুকে যান। তারপর সামান্য খাওয়া সেরে নিয়ে ঘুম।

আজ কিন্তু সেটা পারেননি। রাত সাড়ে ন’টা পেরিয়ে দশটা বাজতে চলল, অথচ রোশন এখনও ফিরল না—দুশ্চিন্তায় ভালোমানুষটার কপালে ভাঁজ পড়ে গিয়েছিল। এত দেরি হচ্ছে কেন রোশনের? ও কি এত রাতে পলানের সঙ্গে কোনও ঝুটঝামেলায় জড়িয়ে পড়ল? তার ওপর আবার বৃষ্টি নেমেছে। ছাদে জমে ওঠা বৃষ্টির জল ছরছর করে ঝরে পড়ছে একতলার কলতলা আর চৌবাচ্চায়। সেই শব্দে বাইরে থেকে ভেসে আসা বৃষ্টির শব্দ চাপা পড়ে গেছে।

বাইরের ঘরে, মানে লজের ‘রিসেপশান’-এ বসে বিশ্বরূপ অনাত্মীয় ছেলেটার জন্য চিন্তা করছিলেন। ওঁর কপালের ভাঁজ কিছুতেই মসৃণ হচ্ছিল না। রোশন সাড়ে ছ’মাসের বোর্ডার হলেও বিশ্বরূপের মনে হচ্ছিল সময়টা সাড়ে ছ’মাস নয়—সাড়ে ছ’বছর।

বিশ্বরূপ কখনও চেয়ারে বসছিলেন, আবার কখনও পায়চারি করছিলেন। শেষ পর্যন্ত যখন ভাবছেন নিজের সাইকেলটা নিয়ে বেরোবেন, ঠিক তখনই সদর দরজায় ঠকঠক এবং দরজা খুলতেই রোশন।

রোশন সাইকেলটা টেনে নিয়ে ভেতরে ঢুকল। ও ভালোরকম ভিজেছে বৃষ্টিতে। ভেজা চুল কপালে লেপটে আছে। চোখের পাতায়, নাকের ডগায় জলের ফোঁটা।

‘কী ব্যাপার, রোশন? এত রাত করলে!’

রোশন সাইকেলটা নিয়ে ভেতরের দিকে যেতে গিয়েও থমকে দাঁড়াল। অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাল বিশ্বরূপ জোয়ারদারের দিকে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তারপর বলল, ‘পরশুদিনের ফাংশানের সব ব্যবস্থা করতে গিয়ে দেরি হয়ে গেল।’

হাত দিয়ে মাথার জল ঝাড়ল। মুখ মুছল। তারপর সাদা-সরল ভালোমানুষটার মুখের দিকে তাকাল। মানুষটার মুখে কেমন একটা মায়া জড়িয়ে আছে। ছোটভাইয়ের জন্য বড় ভাইয়ের মুখে যেমন মায়া জড়িয়ে থাকে।

রোশন অন্যদিকে চোখ সরিয়ে বলল, ‘কাল রাতে আপনাকে ক’টা কথা বলব, বিশ্বরূপদা…।’

‘কী কথা?’

‘কাল রাতে বলব—।’ হেঁয়ালির খানিকটা ধোঁয়া শূন্যে ভাসিয়ে রেখে রোশন সাইকেল নিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল।

মনে-মনে ভাবল, ‘ওর জেল খাটার কথা শোনার পর বিশ্বরূপদা ওকে আগের মতন ভালোবাসবেন তো?’

রোশনের মনটা বসে গিয়েছিল। ও কোনও পাপ করেনি জেনেও এক অদ্ভুত বিষণ্ণতা ভিজে চাদরের মতো ওর হৃদয়টাকে জড়িয়ে ধরেছিল। ওর কোনও কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না। মনে হচ্ছিল, কথা বলতে গেলেই ওর কান্না পেয়ে যাবে।

সাধারণত রাতে খাওয়াদাওয়া সেরে ফেরার পর রোশন বিশ্বরূপদার সঙ্গে একটু গল্পসল্প করে—তারপর নিজের ঘরে চলে যায়। অথচ আজ ছেলেটা কেমন যেন চুপচাপ। বিশ্বরূপের মনে হল, ছেলেটার ভেতরে কোনও চাপা দুঃখ নড়াচড়া করছে।

রোশন চলে এল নিজের ঘরে। রোবটের মতো জামাকাপড় ছেড়ে টুকিটাকি কাজ সেরে ঘরের আলো নিভিয়ে দিল—শুয়ে পড়ল বিছানায়।

অন্ধকারে নিজেকে নিয়ে ভাবতে লাগল।

জেলের দিনগুলো অসহ্য ছিল রোশনের কাছে। একে তো বিনা দোষে ওকে জেল খাটতে হচ্ছিল, তার উপর জেলের জঘন্য পরিবেশ আর জেলের অন্যান্য কয়েদিদের হিংস্র ব্যবহার।

রোশনের বেশ মনে আছে, সেইসব অসহ্য দিনে দীনেশ সামন্ত—দুনুদা ওকে কাছে টেনে নিয়েছিল। মা-পাখির মতো ডানা দিয়ে ওকে আগলে রাখত সবসময়। দুনুদার সাহস আর বডি—এই দুয়ের কম্বিনেশন ছিল মারাত্মক। ওর কাছে এগোনোর আগে যে-কোনও পাবলিক অন্তত দুবার কি তিনবার ভাবত।

দীনেশ সামন্ত রোশনকে অনেক কিছু শিখিয়েছিল। সবসময় ওকে বলত, ‘শোন, রোশন—লড়াই করে বাঁচতে গেলে তোর দুটো জিনিস দরকার—সাহস আর বডি। তোর এই ল্যাকপ্যাকে খাঁচায় না আছে জোর, না আছে সাহস। তাই এই দুটো জিনিস তোকে কবজা করতে হবে, বুঝলি?’

ব্যস, তারপর থেকেই দুনুদার ‘কোচিং ক্লাস’-এ রোশনের পাঠ শুরু। দুনুদা ওকে শিখিয়েছিল কী করে নানারকম আটপৌরে জিনিস দিয়ে ব্যায়াম করা যায় : দেওয়াল, পাঁচিল, লোহার গরাদ, বালি, স্টোনচিপস, জলের বোতল—সবই ব্যায়ামের হাতিয়ার।

দুনুদা ওকে এও শিখিয়েছিল, কী করে শত্রুকে ব্যথা দিতে হয়, ব্যথায়-ব্যথায় কাবু করতে হয়।

সব মিলিয়ে দীনেশ সামন্ত ওকে শিখিয়েছিল, জেলের ভিতরে কীভাবে ইজ্জত আর সমীহ নিয়ে বাঁচতে হয়।

রোশন নিজের কথা সবই বলেছিল দুনুদাকে।

সব শুনে দুনুদা বলেছিল, ‘শোন, তুই বিনা দোষে জেল খাটছিস এটা খুব দুঃখের ব্যাপার। কিন্তু পাশাপাশি এটা ভেবে দ্যাখ, তোর চেষ্টায় একটা মরো-মরো ছেলের জান বেঁচে গেল। কারও জান ফিরিয়ে দেওয়া কি চাট্টিখানি ব্যাপার? আমরা চাইলেও একটা পিঁপড়ের জানও ফিরিয়ে দিতে পারি না—পারি, বল? তা হলে সেটা কি আনন্দের ব্যাপার নয়?’

রোশন চুপচাপ শুধু মাথা নেড়েছে। হ্যাঁ, দুনুদা ঠিকই বলছে।

‘তা হলে, এই দুটো ব্যাপার কমপেয়ার করে দ্যাখ, তোর দুঃখটা কত ছোট, আর আনন্দটা কত বড়…।’

সবকিছু রোশনের মনে পড়ে যাচ্ছিল।

দীনেশ সামন্তের তিন বছরের ‘কোচিং ক্লাস’ রোশনকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। শিখিয়েছে, অন্যায়ের প্রতিবাদ করে কীভাবে আনন্দ পেতে হয়। শিখিয়েছে, আনন্দ মাপে যত বড় হয়, দুঃখের মাপ কীভাবে তত ছোট হতে থাকে।

মনে পড়ে যাচ্ছে বাবার কথাও। বাবা বলতেন, ‘অন্যায় করা যেমন পাপ, অন্যায় সওয়াটাও তেমনই পাপ। তাই তুমি অন্যায়ের প্রতিকার করতে পারো আর না পারো, অন্তত প্রতিবাদটুকু করতে ভুলো না। প্রতিবাদ করলে দেখবে, আনন্দের কয়েকটা কণা কোথা থেকে যেন উড়ে এসে তোমার বুকের ভেতরে প্রজাপতির মতো ভেসে বেড়াচ্ছে। এই আনন্দের কোনও তুলনা হয় না। এই আনন্দ পয়সা দিয়ে কেনা যায় না।’

কিন্তু আজ রাতে অন্ধকারের আঁচল মুড়ি দিয়ে চুপচাপ শুয়ে-শুয়ে রোশনের কান্না পাচ্ছিল। এই সাড়ে ছ’মাস ধরে আশাপুরের ‘নাগরিক’ হয়ে ও প্রতিবাদের যে-সম্মান আর মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছে তার সবটাই মিথ্যে হয়ে যাবে একটা মিথ্যে অভিযোগে? পলানের অভিযোগই শেষ পর্যন্ত বড় হয়ে দাঁড়াবে? আশাপুরের মানুষ বিশ্বাস করবে যে, রোশন একজন ক্রিমিনাল—জেল খাটা দাগি আসামি? রোশনের সত্যি কথাগুলো কেউ বিশ্বাস করবে না?

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে অন্ধকারে ছিন্নভিন্ন হচ্ছিল রোশন। আর ওর চোখ ভাসিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল।

যত কষ্টই হোক, এই প্রশ্নের উত্তর ওকে খুঁজে পেতেই হবে।

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *