৫. সকালের মেঘ গড়িয়ে দুপুর

সকালের মেঘ গড়িয়ে-গড়িয়ে দুপুর হল, তারপর দুপুর থেকে বিকেল। কিন্তু আকাশের মেঘ ক্রমশ পেখম মেলে বিকেলটাকে একেবারে সন্ধে করে দিয়েছে।

রোশনের মনখারাপ ভাবটা মেঘের মতোই ছড়িয়ে গিয়েছিল বুকের ভেতরে। কুশানের মুখটা ভেসে উঠছিল বারবার।

আনমনাভাবে সাইকেল চালাতে-চালাতে রোশন কখন যেন চলে এল কলাবতীর তীরে।

এখন বর্ষার সময়। তাই শীর্ণ নদী গায়েগতরে বেড়ে উঠেছে। কিন্তু খেয়াঘাটের বাঁশের মাচা এখনও জলের ওপরেই রয়েছে। তবে খেয়াঘাটে পৌঁছোনোর জন্য একগোছা বাঁশ বেঁধে সরু সাঁকো তৈরি করা হয়েছে—তার সঙ্গে রয়েছে বাঁশের রেলিং।

ঘাটে দুটো নৌকো বাঁধা রয়েছে, কিন্তু সেখানে কোনও মানুষজন চোখে পড়ছে না। কোনও আলোও জ্বলছে না। বিকেল পাঁচটায় শেষ খেয়া চলে গেছে।

ঘাটে নামার শুরুতে দুটো বাঁশের ডগায় যে-দুটো বালব রোশন আগে দেখেছিল তার মধ্যে একটা জ্বলছে, আর-একটা বোধহয় কেটে গেছে। মনে হচ্ছিল, জ্বলন্ত বালবটা একচোখ দিয়ে রোশনকে দেখছে। ওটার তেরছা আলো ছিটকে আসছিল রোশনের দিকে।

এলাকার লোকজনের মুখে রোশন শুনেছে এই খেয়াঘাটটাকে নাকি ঢেলে সাজানো হবে। এমনভাবে খেয়াঘাটটাকে নতুন করে তৈরি করা হবে যে, সবার একেবারে তাক লেগে যাবে। সেইসঙ্গে এ-কথাও শুনেছে, গত ছ’বছর ধরেই নাকি এলাকার বাসিন্দারা তাক লেগে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। এ এমন অপেক্ষা যে, চাতক পাখির চোদ্দোপুরুষও হার মেনে যাবে।

ব্লাইন্ড ফাইটের গোডাউনটার দিকে একবার তাকাল রোশন। গোডাউনের খুপরি জানলাগুলো অন্ধকার—সেখানে কোনও আলো জ্বলছে না। আজ বৃহস্পতিবার—সুতরাং কোনও ব্যস্ততা নেই। সব ব্যস্ততা তোলা রয়েছে শনিবারের জন্য।

এখন বৃষ্টি নেই। কলাবতীর দিক থেকে ছুটে আসা জোলো বাতাস রোশনকে অভ্যর্থনা জানাল। কিন্তু রোশনের মনে হল, ওর দুঃখে কলাবতীর বাতাস ওকে সমবেদনা জানাচ্ছে।

কলাবতীর পাড়ে খেয়াঘাটের ডানপাশটায় বেশ কয়েকটা বড়-বড় গাছ। তাদের গোড়াগুলো ছেয়ে আছে নালিঘাস আর ডুমুর গাছে। গাছপালার বৃষ্টিভেজা পাতা চকচক করছে।

সাইকেল থেকে নেমে পড়ল। দুটো ডুমুরগাছ পেরিয়ে সাইকেলটাকে একটা বড় গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড় করাল। তারপর একটা জায়গা বেছে নিয়ে ভেজা ঘাসের ওপরেই বসে পড়ল। জামাকাপড় ভিজলে ভিজুক। মনটাই ভিজে আছে তো জামাকাপড়!

চারপাশে তাকিয়ে দেখল রোশন : দ্বিতীয় কোনও মানুষকে চোখে পড়ছে না।

কলাবতীর দিকে চোখ মেলে একটা ঘোরের মধ্যে বসে রইল। ওর চারপাশে ওর অজান্তে চুপিচুপি অন্ধকার নামছিল। কখনও-কখনও তার সঙ্গে মিশে ছিল মিহি বৃষ্টি।

হঠাৎই হাওয়ার একটা ঝটকা এল। মাটিতে পড়ে থাকা ভিজে গাছের পাতায় কোনও আলোড়ন দেখা গেল না। ওরা মাটি আর জলের টানে আটকে আছে। তবে গাছ থেকে দু-তিনটে পাতা খসে পড়ছিল। সেগুলো হাওয়ার ঝাপটায় এদিক-ওদিক এলোমেলোভাবে উড়তে শুরু করল। ওরা কোথায় গিয়ে পড়বে, মাটি আর জলের টানে কোথায় আটকে যাবে কে জানে!

পাতাগুলোকে নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে ও ভাবল। খসে পড়া, বাতাসে ভেসে যাওয়া, পাতাগুলো কি আর গাছের খবর রাখে? কোনও পাতা কখনও চিরকাল বাতাসে ভেসে থাকতে পারে না—মাটিতে সেটাকে পড়তেই হবে। কোথাও না কোথাও সেটাকে আটকাতেই হবে। মাধ্যাকর্ষণকে কেউ এড়িয়ে চলতে পারে না।

রোশনও সম্পর্কের মাধ্যাকর্ষণকে এড়িয়ে চলতে পারেনি।

হঠাৎ টর্চের আলো ঝিলিক মারল। সেইসঙ্গে মোটরবাইকের শব্দ।

ও মুখ ফিরিয়ে তাকাল সেদিকে।

দুটো মোটরবাইক উঁচু-নীচু কাঁচা পথ ধরে লাফাতে-লাফাতে আসছে। বাইক দুটোর হেডলাইট জ্বলছে না। তার বদলে দুটো বাইক থেকে টর্চের আলো পড়েছে সামনে। বাইকের সওয়ারিরা জ্বলন্ত টর্চ বাগিয়ে বসে আছে। মাঝে-মাঝে সেই টর্চ নিভে যাচ্ছে। আবার জ্বলছে।

রোশনের মনে হল, ওরা নিজেদের হাজিরা খুব একটা জানান দিতে চায় না। তাই হেডলাইটের বদলে টর্চের আলো।

রোশন চট করে ওর জায়গা ছেড়ে উঠে পড়ল। একটা বড় গাছের গুঁড়ির আড়ালে চলে গেল। সেখান থেকে নজর রাখতে লাগল।

বাইকে চড়ে এরা কারা? পলানের লোকজন?

ঘাটে নামার বাঁশের সাঁকোর মুখে এসে বাইকদুটো থামল। বাইকের ইঞ্জিন বন্ধ হল। দুটো বাইক থেকে তিনটে ছেলে নেমে দাঁড়াল। মাথায় কোনও হেলমেটের বালাই নেই। তিনজনের মধ্যে দুজনকে চিনতে পারল রোশন : সুবু আর কানুয়া। তিননম্বর ছেলেটা বেশ লম্বা-চওড়া। ওর ডানহাতের মুঠোয় একটা মেশিন। তবে সেটা ওয়ান শটার না রিভলভার সেটা ঠিক বোঝা গেল না।

এ সময়ে এরা কী করতে নির্জন কলাবতীর তীরে এসেছে? কোন কুকীর্তির সন্ধানে এরা এসেছে এখানে? কোন মধু লুকিয়ে আছে কলাবতীর তীরে?

রোশন চুপচাপ লক্ষ করতে লাগল। একবার ওর মনে হল, চুপিচুপি এখান থেকে সরে যাবে। কিন্তু তারপরই মনে হল, না, দেখাই যাক না, কী হয়।

কানুয়া আর সুবু পালা করে নদীর দিকে টর্চের আলো ছুড়ে দিচ্ছিল। হঠাৎই দেখা গেল, নদীর দিক থেকে পালটা টর্চের আলো জ্বেলেছে কেউ।

এরপর টর্চের আলো দু-দিক থেকেই পালা করে জ্বলতে-নিভতে লাগল। অভিসারের স্ট্যান্ডার্ড সংকেত।

রোশন অপেক্ষা করতে লাগল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা ছোট নৌকো কলাবতীর ঘাটে এসে ভিড়ল। নৌকোটায় কোনও ছই নেই। একজন বইঠা নিয়ে চালাচ্ছে, আর-একজন নৌকোর মাঝামাঝি জায়গায় চুপটি করে বসে আছে।

নৌকো ঘাটে ভিড়তেই কানুয়া আর সুবু বাঁশের সাঁকো পেরিয়ে চলে গেল নৌকোটার কাছে। আর তিননম্বর ছেলেটা মেশিন হাতে সাঁকোর মুখে দাঁড়িয়ে পাহারা দিতে লাগল।

নৌকোয় মাঝামাঝি বসা ছেলেটা উঠে দাঁড়াল। আবছাভাবে দেখা যাচ্ছে ওর হাতে একটা ছোট চৌকোনা প্যাকেট। পলিথিনে মোড়া— চকচক করছে।

প্যাকেট হাতে ছেলেটা এগিয়ে এল। পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে কাকে যেন ফোন করল। তারপর পলিথিনের প্যাকেটটা সুবুর হাতে দিল।

সুবু কানুয়ার দিকে তাকাল। সঙ্গে-সঙ্গে কানুয়া পকেট থেকে মোবাইল বের করে পলান নস্করকে ফোন লাগাল।

‘পলানদা, কানুয়া বলছি…।’

‘বল—।’

‘মাল হাতে এসে গেছে।’

‘কতটা আছে বলছে?’

‘বলছে, নেট আড়াইশো গ্রাম আছে। হাতে নিয়েও আমার সেরকমই আইডিয়া হয়েছে…।’

‘ভাবা যায়! ওইটুকু মালের দাম সালা সাড়ে আট লাখ টাকা!…ঠিক আছে। এবারে চটপট কাজ সেরে স্পট থেকে কেটে পড়।’ এ-কথা বলে পলান ফোন কেটে দিল।

নৌকোটা ততক্ষণে রওনা দিয়েছে মাঝনদীর দিকে।

কানুয়া মোবাইল পকেটে রেখে সুবুকে তাড়া দিল : ‘সুবুদা, চলো, এবার বাকি কাজটা সেরে জলদি কেটে পড়া যাক…।’

সুবু ঘাড় নেড়ে সায় দিল। ও আর কানুয়া চটপট সাঁকো পার হয়ে ফিরে এল। একটা মোটরবাইকের কাছে গিয়ে ওরা দাঁড়াল। হাতের টর্চদুটো কায়দা করে সিটের ওপরে আড়াআড়িভাবে রাখল। তারপর কানুয়া বাইকের কেরিয়ারে হাত ঢোকাল। একটা লম্বা স্ক্রু-ড্রাইভার আর একটা খালি পলিব্যাগ বের করল। পলিব্যাগটার ওপরে ছাপা লেখা দেখে মনে হয়, প্যাকেটটা কোনও শাড়ি বা জামাকাপড়ের দোকানের হবে।

তারপর যে-কাজটা ওরা শুরু করল সেটা বেশ অবাক করে দেওয়ার মতো।

সাঁকো থেকে হাত আষ্টেক দূরে একটা কাদাটে জায়গায় উবু হয়ে বসে পড়ল সুবু আর কানুয়া। কানুয়া বড় পলিব্যাগটা সুবুর হাতে জমা দিয়ে স্ক্রু-ড্রাইভার বাগিয়ে ধরে মাটি খুঁড়তে লাগল। নরম মাটি—তাই চটপট একটা গর্ত তৈরি হয়ে যাচ্ছিল। মেশিন হাতে ছেলেটা চারপাশে তাকিয়ে নজর রাখছিল, আর মাঝে-মাঝে সুবু-কানুয়ার দিকে দেখছিল।

দশমিনিটের মধ্যেই একটা গভীর গর্ত তৈরি হয়ে গেল। তখন পলিথিনের ছোট প্যাকেটটা বড় পলিব্যাগে ঢুকিয়ে ভালো করে মুড়ে নিল সুবু। তারপর কানুয়ার সঙ্গে হাত লাগিয়ে প্যাকেটটা ভালো করে গুঁজে দিল গর্তের ভেতরে। এবং গর্তের মুখটা চটচটে কাদা-মাটি দিয়ে জম্পেশ করে ঠেসে দিল।

কাজ শেষ করে ওরা দুজনে উঠে দাঁড়াল। তারপর পালা করে পা ঠুকে জায়গাটাকে এমনভাবে দুরমুশ করে দিল যে, জায়গাটা দেখে সেখানে কোনও গর্ত খোঁড়া হয়েছে এমনটা বোঝার কোনও চিহ্ন রইল না।

এবার কানুয়া পকেট থেকে একটা মাপার ফিতে বের করল—গোল চাকতির ভেতরে লাটাইয়ের মতো গোটানো ফিতে।

সুবুকে কী যেন বলল কানুয়া। সঙ্গে-সঙ্গে সুবু ফিতের একটা প্রান্ত ধরে চলে গেল সাঁকোর প্রথম খুঁটির কাছে। খুঁটি থেকে গর্তের স্পটটার দূরত্ব দেখল কানুয়া। সেটা মোবাইল ফোন বের করে তাতে ‘লিখে’ নিল। তারপর একটা বড় গাছ দেখিয়ে সুবুকে সেদিকে যেতে বলল। সেই গাছের গুঁড়ি থেকে স্পটটার দূরত্ব নোট করল কানুয়া। দূরত্বটা মোবাইল ফোনে গেঁথে নিল। গাছটাকে ভালো করে আরও একবার দেখল। চিনে রাখল।

রোশন ব্যাপারটা স্পষ্ট বুঝতে পারল। দামি জিনিসের প্যাকেটটাকে গর্তে ‘কবর’ দিয়েছে ওরা। যাতে পরে কখনও এসে স্পটটাকে আবার ঠিকঠাক চিনে নিতে পারে তাই দু-দুটো রেফারেন্স পয়েন্ট থেকে স্পটটার ডিসট্যান্স নোট করে নিয়েছে।

কিন্তু কী আছে ওই প্যাকেটটাতে?

কাজ শেষ করে কাদামাখা হাত প্যান্টে ঘষছিল সুবু আর কানুয়া। স্ক্রু-ড্রাইভারটা পকেটে রেখে কানুয়া পলানকে আবার ফোন লাগাল।

‘পলানদা, কাজ কমপ্লিট।’

‘দুটো জায়গা থেকে স্পটটার ডিসট্যান্স ভালো করে নোট করে নিয়েছিস?’

‘হ্যাঁ, পলানদা—।’

‘তা হলে জলদি ওখান থেকে কেটে পড়।’

‘আচ্ছা।’ বলে রিসেট বোতাম টিপে মোবাইল ফোন পকেটে ঢোকাল কানুয়া।

তারপর ওরা তিনজন দুটো বাইকে চড়ে রওনা দিল। এবারও হেডলাইটের বদলে টর্চলাইট।

রোশন এসব দেখছিল আর ভাবছিল কী করা যায়।

ওরা তিনজন চলে যেতেই রোশন কাজে নেমে পড়ল।

চট করে আগাছার ঝাড়ের কাছে চলে এল ও। একটা জুতসই ডাল দেখে সেটাকে জোরে আঁকড়ে ধরল। তারপর মুচড়ে পেঁচিয়ে সেটাকে ভেঙে নেওয়ার চেষ্টা করতে লাগল।

কয়েকমিনিট পরেই ডালটা ভেঙে চলে এল রোশনের হাতে। সেটা নিয়ে ও একটা বড় গাছের গুঁড়ির কাছে গিয়ে দাঁড়াল। ওর কাছে মাপার কোনও ফিতে নেই, তাই হাতের ডালটা দিয়ে গাছের গুঁড়ির গায়ে জোরে-জোরে ঘষতে লাগল : একটা চিহ্ন তৈরি করা দরকার।

বৃষ্টি ভেজা গাছ, তাই কিছুক্ষণের চেষ্টাতেই একটা ক্ষতচিহ্ন তৈরি হয়ে গেল গাছের গুঁড়ির গায়ে। হ্যাঁ, এই চিহ্নটা দেখেই রোশন এই বিশেষ গাছটাকে চিনে নিতে পারবে। তা সত্ত্বেও গাছটার লোকেশন খুব মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করল ও। এবং সেই মানচিত্রটা মনের মধ্যে গেঁথে নিল।

এবার রোশন আসল কাজ শুরু করল।

সুবু আর কানুয়ার তৈরি করা স্পটের কাছে চলে গেল ও। উবু হয়ে বসে পড়ল। স্পটটা গুলিয়ে না যায় সেজন্য দু-খাবলা মাটি নিয়ে জায়গাটার ওপরে বসিয়ে দিল। একটা খুদে ঢিবি উঁচু হয়ে রইল সেখানে।

রোশন এবার উঠে দাঁড়াল। ছুটে চলে এল চিহ্ন দেওয়া বড় গাছটার কাছে। খুব তাড়াতাড়ি কাজ সারতে হবে। হুট করে যদি কেউ এদিকটায় চলে আসে! গাছটার গোড়ায় উবু হয়ে বসে পড়ল। হাতের ভাঙা ডালটা দিয়ে জলদি হাতে একটা গর্ত খুঁড়তে শুরু করল। চটপট—চটপট—চটপট!

গর্তটা ক্রমশ গভীর হতে লাগল। আর মাপেও এমন চওড়া হল যাতে সুবু আর কানুয়ার ‘কবর’ দেওয়া পলিথিনের প্যাকেটটা সহজেই তার মধ্যে ঢুকে যায়।

রোশন এবার ছুটে চলে গেল কানুয়াদের স্পটের কাছে। ভাঙা ডালটা দিয়ে আবার গর্ত খুঁড়তে শুরু করল। পলিথিনের প্যাকেটটা তাড়াতাড়ি বের করতে হবে।

গর্ত খুঁড়তে-খুঁড়তে যখন ও প্যাকেটটার কাছে প্রায় পৌঁছে গেছে তখনই ঝিরঝিরে বৃষ্টি শুরু হল। রোশন আকাশের দিকে একবার তাকাল। তারপর আরও তাড়াতাড়ি হাত চালাল। ডালটা দিয়ে দু-চার দফা খোঁড়াখুঁড়ির পর খাবলা দিয়ে সেই মাটি তুলে নিতে লাগল। তারপর আবার ডালটা চালাতে লাগল শাবলের মতো।

একটু পরেই প্যাকেটটার কাছে পৌঁছে গেল রোশন। থাবা মেরে ওটাকে তুলে নিল। প্যাকেটটা এখন কাদামাটিতে মাখামাখি।

গাছের ভাঙা ডালটা আগাছার ঝোপের দিকে ছুড়ে দিল। তারপর পলিথিনের প্যাকেটটা বাঁ-হাতে নিয়ে ডানহাতে গর্তটা বোজাতে শুরু করল।

মাঝে-মাঝে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিল। এ সময়ে এই বৃষ্টির মধ্যে কেউ যে এদিকে এসে পড়বে সেই চান্স খুবই কম। কিন্তু তবুও রোশনের টেনশন হচ্ছিল—তাই বারবার তাকাচ্ছিল।

গর্তটা বোজানো হয়ে গেলে রোশন তার ওপরে হাত বুলিয়ে মাটিটা সমান করে দিল। তারপর একছুটে চলে গেল ওর তৈরি নতুন গর্তটার কাছে। প্যাকেটটা গর্তে ঢুকিয়ে চটপট মাটি চাপা দিয়ে গর্তটা বুজিয়ে দিল। কাজ হয়ে গেলে উঠে দাঁড়িয়ে জায়গাটা ভালো করে পরখ করল। হ্যাঁ, পরে কখনও এলে স্পটটাকে সহজেই চিনে নিতে পারবে ও।

রোশনের হঠাৎই হাসি পেল। পলান কিংবা ওর চ্যালারা যখন সুবু আর কানুয়াকে নিয়ে ওই পলিথিনের প্যাকেটটা নিতে আসবে তখন দেখবে ওদের স্পটে মাল নেই : পাখি উড়ে গেছে। পলানের সাড়ে আট লাখ টাকা চোট হয়ে গেছে। তখন ওরা পাগলের মতো এদিক-সেদিক খোঁড়াখুঁড়ি করবে। তাতেও ওটা খুঁজে না পেয়ে পলান প্রথমে ভাববে সুবু আর কানুয়ার জায়গাটা চিনতে ভুল হচ্ছে। তারপর ও যেটা ভাববে সেটা খুব মারাত্মক : ভাববে সুবু, কানুয়া আর তিন নম্বর ছেলেটা পলানের সঙ্গে বৈঠকবাজি করেছে—মালটা গায়েব করে দিয়ে এখন ন্যাকাচৈতন সাজছে।

রোশনের ঠোঁটে আবার হাসির রেখা তৈরি হল। ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে ভিজতে ওর খারাপ লাগছিল না। মাটি মাখা হাত দুটো বৃষ্টির জলে ভিজিয়ে ও প্যান্টে ঘষে হাত দুটো যতটা পারা যায় পরিষ্কার করে নিল।

এবার গেস্টহাউসে ফিরতে হবে।

সাইকেলের কাছে গেল রোশন। বৃষ্টিটা তখন কমে গিয়ে হঠাৎ করেই থেমে গেল। সাইকেলের কাছে যেতে-যেতে এমনিই এপাশ-ওপাশ তাকিয়েছিল। তখনই একটা চকচকে জিনিস ওর চোখ টানল। কলাবতীর ঘাটের অল্প আলোতেও জিনিসটা চকচক করছে।

পায়ে-পায়ে জিনিসটার কাছে এগিয়ে গেল।

জল-কাদার মধ্যে ওটা পড়ে রয়েছে। দেখে একটা ঘড়ি বলে মনে হচ্ছে।

ঝুঁকে পড়ে ওটা হাতে তুলে নিল রোশন। বড় ডায়ালের একটা শৌখিন রিস্টওয়াচ। দেখে বেশ দামি বলে মনে হচ্ছে। হয়তো কারও হাত থেকে খুলে পড়ে গেছে।

এখন এটা নিয়ে কী করবে ও? আশাপুর ফাঁড়িতে জমা দিয়ে দেবে? নাকি এখানেই ফেলে রেখে দেবে?

এমন সময় বাইকের শব্দ শোনা গেল। একটা বাইক গোঁ-গোঁ করে তেড়ে আসছে কলাবতীর ঘাটের দিকে।

রোশন কী করবে ঠিক করে ওঠার আগেই একটা মোটরবাইক গরগর আওয়াজ তুলে হাই স্পিডে এবড়োখেবড়ো কাঁচা রাস্তার ওপরে লাফাতে-লাফাতে ওর একেবারে ঘাড়ের ওপরে চলে এল।

বাইকের হেডলাইট জ্বলছিল। সেই আলোর তেজ ডিঙিয়ে বাইকে বসা কালো ছায়াটাকে আবছাভাবে দেখতে পেল রোশন। ছায়ার আউটলাইন দেখেই ও বুঝতে পারল, এটা সেই তিন নম্বর ছেলেটা—যে কানুয়া গর্ত খোঁড়ার সময় মেশিন হাতে সুবু আর কানুয়াকে প্রোটেকশন দিচ্ছিল।

মোটরবাইকের হেডলাইটের আলো রোশনের ভেজা জামা-প্যান্টে পড়ে ঠিকরে যাচ্ছিল। হেডলাইটটা ওর শরীরের এত কাছে যে, রোশন তার উত্তাপও টের পাচ্ছিল। তা ছাড়া হেডলাইটের আলোর বৃত্তে রোশনের ঘড়ি ধরা হাতটাও ধরা পড়েছিল।

সপাটে একটা থাপ্পড় এসে পড়ল রোশনের গালে। ছায়াটার লম্বা ডানহাত রোশনের গালের নাগাল পেয়ে গেছে। একইসঙ্গে এক ঝটকায় ঘড়িটা ছিনিয়ে নিল ছেলেটা।

‘কী রে সালা, আমার ঘড়িটা ঘোরানোর ধান্দা করছিলি?’ রুক্ষভাবে ছায়া-ছায়া ছেলেটা প্রশ্নটা করল।

থাপ্পড় খেয়ে রোশনের মাথা ঝিমঝিম করছিল। ওর বাঁ-গালটা যেন চোখের পলকে জমাট পাথর হয়ে গেছে। এবং সেই পাথরে একটা জ্বালা টের পাচ্ছিল।

বাঁ-গালে হাত চলে গেল রোশনের। হাত বুলিয়ে গালের জ্বালাটা কমাতে চাইল।

বাইকে বসা ছেলেটা তখন নোংরা গালিগালাজে রোশনকে ভাসিয়ে দিচ্ছিল আর সেইসঙ্গে ওর প্রতি গনগনে রাগ উগরে দিচ্ছিল।

‘সালা পাতি চোর! ভদ্দরলোক সেজে আশাপুরে ঘুরে বেড়ানো হচ্ছে! হিরোগিরি করা হচ্ছে! তোর ছাল ছাড়িয়ে রোদ্দুরে টাঙিয়ে দেব। অন্যায় অবিচারের এগেনস্টে রুখে দাঁড়িয়ে বাজারে নাম কিনছিস আর রাতে ঘড়ি হরফ করছিস!’

এতক্ষণ পর রোশন বলল, ‘আমি ঘড়ি চুরি করিনি। ওটা কাদার মধ্যে পড়ে ছিল, ব্যান্ডটা চকচক করছিল। তাই হাতে তুলে নিয়ে দেখছিলাম জিনিসটা কী।’

‘তুই এই রাত্তিরবেলা কলাবতীর পাড়ে কী করতে এসেছিস?’

রোশন বুঝতে পারল ছেলেটা কী বুঝতে চাইছে। ও বুঝতে চাইছে, রোশন কলাবতীর পাড়ে ওদের প্যাকেট পুঁতে দেওয়ার ব্যাপারটা দেখে ফেলেছে কি না।

রোশন ভেবে পাচ্ছিল না, কী উত্তর দেবে। কোন উত্তরে সন্তুষ্ট হবে ছেলেটা।

‘আমি…আমি কলাবতীর তীরে এসে চুপচাপ বসেছিলাম…।’ রোশন থতিয়ে-থতিয়ে বলে উঠল।

বাইকে বসা অবস্থাতেই ছেলেটা পকেটে হাত ঢোকাল, একটা রিভলভার বের করে নিয়ে এল। হাতঘড়িটা আর-এক পকেটে ঢুকিয়ে রেখে একটা মোবাইল ফোন বের করল। বুড়ো আঙুলে ওটার কী-প্যাডের বোতাম টিপতে লাগল। ওর চোখের নজর রোশনকে পাহারা দিচ্ছিল।

মোবাইল ফোন কানে চেপে ধরল ছেলেটা। তারপর ওপাশ থেকে ‘হ্যালো’ শুনতেই কথা বলে উঠল, ‘পলানদা, চরকি বলছি..।’

‘হ্যাঁ, বল…।’

‘রোশন মালটাকে ধরেছি। এখানে কলাবতীর পাড়ে ঘুরঘুর করছিল— যেখানে একটু আগে সুবুদা আর কানুয়া আমাদের সাদা মালটা সাঁটিয়ে গেছে। আমার ঘড়িটা কী করে যেন হাত থেকে খুলে পড়ে গিয়েছিল…।’

চরকির সব কথা শোনার পর পলান বলল, ‘মালটা সাঁটানোর জায়গাটা রোশন দেখে ফেলেনি তো?’

‘কী করে বলব! জিগ্যেস করলে তো ব্যাটা ”না” বলবে—।’

‘হুঁ। কাল সকালে সুবু আর কানুয়াকে পাঠিয়ে আমি মালটা চেক করিয়ে নেব…।’

‘তা হলে কি রোশনকে ছেড়ে দেব? কিন্তু সালার হুলিয়া দেখে তো সন্দেহ হচ্ছে…ব্যাটা আমাদের সাঁটানো মালটা নিয়ে কিছু একটা লটরঘটর করেছে—।’

‘শুয়োরের বাচ্চাটাকে ধরে উদোম কেলিয়ে দে।’ পলান ক্ষিপ্তভাবে বলল, ‘কিন্তু তুই একা ওর সাথে পাঙ্গা নিতে পারবি তো? ব্যাটা খতরনাক মাল…।’

চরকি শব্দ করে হাসল। বলল, ‘নো প্রবলেম, পলানদা। আমার সঙ্গে মেশিন আছে…।’

রোশন ওদের কথাবার্তার গতিপথ আগে থেকেই আঁচ করতে পারছিল। চরকির শেষ কথাটা শোনার সঙ্গে-সঙ্গে ও ছুটতে শুরু করল।

কিন্তু কোনদিকে যাবে ও? ওর সামনে জল-কাদা, আগাছার ঝোপঝাড় আর অন্ধকার কলাবতী।

চরকির বাইক যেভাবে রোশনের সামনে দাঁড়িয়েছিল তাতে দৌড়োনোর জন্য কলাবতীর দিকটাই শুধু খোলা ছিল। তাই সেদিকেই ছুট লাগিয়েছে ও।

এদিক-ওদিক ছিটকে পড়া বালবের সামান্য আলো, আর ছোপ-ছোপ গাঢ় অন্ধকার—তারই মধ্যে রোশন এঁকেবেঁকে ছুটছিল। ওর ছোটা দেখে মনে হচ্ছিল ও যেন কোনও দিগভ্রান্ত অন্ধ মানুষ।

রোশনের আচমকা ছুটে পালানোর ব্যাপারটা সামলে নিতে চরকির কয়েকটা মুহূর্ত লেগেছিল। তারপরই ও বাইকে স্টার্ট দিয়ে দিয়েছে। এবং ওর বাইক গর্জন করে রোশনকে তাড়া করেছে। বাইকের হেডলাইটের আলো এদিক-ওদিক ঝাঁপিয়ে পড়ে ছুটন্ত রোশনকে খুঁজতে লাগল।

রোশন ভাবছিল, চরকি বোধহয় ফায়ার করতে পারে। তাই ও সাপের মতো এঁকেবেঁকে গাছপালার আড়াল রেখে ছুটোছুটি করছিল। আর একইসঙ্গে ওর চোখ সাইকেলটা খুঁজছিল। কোথায় সাইকেলটা? ওটা কোথায় রেখেছিল যেন?

চরকি ফায়ার করেনি, কারণ, ওর মনে হয়েছিল, ফায়ার করলে একটু বেশিরকম শোরগোল হতে পারে। তাই ওর বাইক এদিক-ওদিক এলোমেলোভাবে রোশনকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। হেডলাইটের আলো ‘চোখ’ বুলিয়ে যাচ্ছে গাছপালার ভিজে পাতার ওপরে—জল, কাদা, মাটির ওপরে। হেডলাইটের আলোর ঝলকে ওগুলো যেন ঝলসে উঠছে।

চরকির বাইকটা গর্জন করতে-করতে এমনভাবে এদিক-ওদিক করছিল যে, মনে হচ্ছিল, ঝোপঝাড়ের আড়ালে লুকিয়ে থাকা শিকারকে বাগে না পেয়ে ক্ষুধার্ত বাঘ ‘গ-র-র গ-র-র’ করছে আর ঝোপঝাড়ের চারপাশে অধৈর্যভাবে পায়চারি করছে।

অবশেষে সাইকেলটা খুঁজে পেল রোশন। কাত হয়ে পড়ে রয়েছে ভিজে ঝরাপাতা আর মাটির ওপরে।

জায়গাটা বেশ অন্ধকার। সাইকেলটা তুলে নিয়ে একটা গাছের আড়ালে দাঁড়াল। চরকির থাপ্পড়টা বেশ জোরে লেগেছে। বাঁ-গালটা এখনও জ্বালা করছে। চরকিকে এড়িয়ে রোশন সাইকেল চালিয়ে এখান থেকে পালাবে কেমন করে? কলাবতীর পাড় থেকে আশাপুরে ঢোকার তো একটাই পথ! আগে হোক, পরে হোক, চরকি ওকে দেখতে পাবেই। তারপর ওর ছুটন্ত সাইকেলকে ধরে ফেলতে বাইকটার কয়েক সেকেন্ডের বেশি লাগবে না।

তারপর?

আবার চরকির হাতে মার খাবে রোশন? এভাবে কি ও মার খেয়েই যাবে? আর প্রয়োজনে আত্মরক্ষা করবে? সেলফ ডিফেন্স?

রোশনের ভেতরে আর-একটা রোশন হঠাৎ বিদ্রোহ করে উঠল। কেন, কেন ভালোমানুষগুলো শুধু ডিফেন্সের কথা ভাববে? দেব-দেবীরা তো মহান, ভালোমানুষের চেয়েও লক্ষ-কোটি গুণ ভালো। তা হলে তাঁদের প্রায় সবার হাতে অস্ত্র কেন?

রোশনরা চিরকাল শুধু ডিফেন্স করে যাবে, আর পলান বা তার মতো গুন্ডারা অফেন্সের লাইফটাইম ঠেকা নিয়ে বসে থাকবে! না, এ হতে পারে না! দান এবার ওলটানো দরকার—যে করে হোক!

রোশনের ভেতরে একটা অদৃশ্য সুইচ যেন টিপে দিল কেউ।

চরকির মোটরবাইকটা গরগর গর্জন তুলে এপাশ থেকে ওপাশ ছুটে বেড়াচ্ছিল। রোশন হঠাৎই সেই বাইক লক্ষ করে ওর সাইকেলটা ছুটিয়ে দিল।

রোশনের সাইকেল হাউইয়ের মতো ছুটে গিয়ে চরকির বাইকের সামনের চাকায় আড়াআড়িভাবে ধাক্কা মারল। বাইকটা কাত হয়ে পড়ে গেল। এবং গতিজাড্যের জন্য ছেঁচড়ে স্লিপ কেটে গেল ভেজা মাটিতে।

চরকি ছিটকে পড়েছিল। ওর ডানপায়ের গোড়ালিতে কেউ যেন হাতুড়ি পেটা করল। অসহ্য ব্যথা। ওর হাতের মেশিনটা কোথায় ঠিকরে পড়ল কে জানে!

চরকি কিছুক্ষণ পড়ে রইল মাটিতে। ওর মাথা ঘুরছিল, চিন্তার স্রোত গুলিয়ে গিয়েছিল। ও শূন্য নজরে তাকিয়ে ছিল আকাশের দিকে। দেখতে পাচ্ছিল কালো আকাশ। গাছপালার ছায়া-ছায়া পাতা। সেই গাছের পাতা থেকে ওর মুখে-চোখে টপটপ করে জলের ফোঁটা ঝরে পড়ছিল।

রোশনের সাইকেলটা শূন্যে একটা ডিগবাজি খেয়েছিল। তারপর গাছপালা আর আগাছার ঝোপের মধ্যে গিয়ে ছিটকে পড়েছিল। রোশনের ব্যথা সেরকম লাগেনি, আর মাথাটাও ঠিক ছিল। কারণ, ও জানত যে, মোটরবাইকের সঙ্গে ওর সাইকেলের সংঘর্ষ হতে চলেছে—চরকি যেটা জানত না। ফলে রোশনের মন আগে থেকেই একটা সংঘর্ষের জন্য তৈরি ছিল।

সুতরাং রোশন উঠে দাঁড়াল চরকির আগেই। এবং এপাশ-ওপাশ তাকিয়ে পাগলের মতো একটা হাতিয়ার খুঁজতে লাগল। কিছু একটা! কিছু একটা!

ওই তো! হঠাৎ করে একটা আধলা ইটের টুকরো হাতে পেয়ে গেল ও। অস্ত্র হিসেবে এটা কম কী!

তিন লাফে রোশন ছিটকে চলে এল চরকির কাছে। চরকি তখন উঠে বসার চেষ্টা করছিল। রোশন প্রচণ্ড শক্তিতে আধলা ইটটা চরকির পিঠে বসিয়ে দিল।

‘ওঁক’ শব্দ করে চরকি সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। কিন্তু প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই শরীরটাকে আধপাক ঘুরিয়ে রোশনের প্যান্ট খামচে ধরে এক হ্যাঁচকা টান মারল।

টাল সামলাতে পারল না রোশন—পড়ে গেল মাটিতে। কিন্তু পড়তে-পড়তেই চরকির মুখ লক্ষ করে ঘুসি চালাল।

ঘুসির অভিঘাতে চরকি পিছনে হেলে পড়ল। কিন্তু চট করে বাঁ-হাতের কনুইয়ে ভর দিয়ে ও শরীরটাকে পুরোপুরি পড়ে যাওয়ার হাত থেকে রুখে দিল।

রোশন আবার উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করছিল। তখনই ও চরকির কাত হয়ে পড়ে থাকা বাইকটাকে দেখতে পেল। বাইকের সাইলেন্সার পাইপটা চকচক করছে।

রোশন চোর! রোশন শুয়োরের বাচ্চা! ও সৎ মানুষের ভেক ধরে আশাপুরে হিরোগিরি করে বেড়াচ্ছে!

রাগে শরীরটা গরম হয়ে গেল রোশনের। ডিফেন্স ছেড়ে এবার একটু অফেনসিভ হওয়া দরকার। পলানদা বুঝুক, রোশনের সঙ্গে পাঙ্গা নেওয়া খুব সহজ নয়। পাঙ্গা নিতে গেলে ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণটা গায়ে লাগতে পারে।

রোশনের মাথায় আগুন জ্বলে উঠল। ও খ্যাপা চিতার মতো চরকির পায়ের ওপরে আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়ল। ওর একটা পা শক্ত মুঠোয় চেপে ধরে ওর বডিটাকে হিড়হিড় করে টানতে-টানতে নিয়ে এল বাইকের কাছে। লম্বা পা ফেলে বাইকটা একলাফে ডিঙিয়ে গেল আর চোখের পলকে চরকির পা-টা চেপে ধরল সাইলেন্সারের গরম ধাতুর গায়ে।

যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল চরকি। এক প্রবল ঝটকা দিয়ে পা-টা সাইলেন্সার থেকে সরিয়ে নিতে চাইল। কিন্তু পারল না। রোশন ভয়ংকর শক্তিতে শত্রুর পা-টা সাইলেন্সারের গায়ে চেপে ধরে রইল।

চরকির যন্ত্রণার চিৎকার থামছিল না। ও পাগলের মতো দাপাদাপি করছিল। স্বাধীন পা-টা ছুড়ে রোশনকে লাথি মারার চেষ্টা করছিল, কিন্তু পারলে তো!

চরকি কোনওরকমে উঠে বসতে চেষ্টা করল। হাত বাড়িয়ে রোশনের জামা, চুল খামচে ধরতে চাইল। রোশন একটুও দেরি না করে একটা পাওয়ার পাঞ্চ বসিয়ে দিল চরকির মুখে। চরকির মুখটা পিছনে ছিটকে গেল। রোশন চরকির আহত পা-টাকে মোচড় দিয়ে সেটাকে হাঁটু দিয়ে চেপে ধরল। তারপর পায়ের পাতাটাকে মোচড় দিয়েই চলল। আর ব্যথা এবং যন্ত্রণার সমানুপাতে চিৎকার করেই চলল চরকি।

একসময় ওর চিৎকার থেমে গেল। শরীর এলিয়ে পড়ল। বোধহয় অজ্ঞান হয়ে গেল।

রোশন হাঁপাতে-হাঁপাতে উঠে দাঁড়াল। এদিক-ওদিক তাকিয়ে ওর সাইকেলটা খুঁজতে লাগল।

ঠিক তখনই একটা মোবাইল ফোন বাজতে শুরু করল।

চরকির মোবাইল ফোন।

ঝুঁকে পড়ে চরকির পকেট হাতড়ে মোবাইল ফোনটা খুঁজে পেল। ওটা পকেট থেকে বের করে নিয়ে দেখল : পলানের ফোন—ফোনের পরদায় ইংরেজি হরফে ছোট-বড় অক্ষরে ‘পলান দা’ লেখাটা ফুটে উঠেছে।

রোশন মোবাইল ফোন ব্যবহার না করলেও কী করে ফোন করতে হয় বা ধরতে হয় সেটা ভালোই জানে।

ফোনটা ধরে কিছু বলার আগেই পলানের রাগি গলা শুনতে পেল রোশন।

‘ফোন ধরতে এত লেট করছিস কেন? রোশন হারামজাদাটার কী করলি বল…।’

রোশন চুপ করে রইল। কোনও কথা বলল না।

পলান আরও অধৈর্য হয়ে উঠল। ক্ষিপ্ত গলায় কিছু খুচরো গালাগাল দিয়ে চিৎকার করে উঠল, ‘কী বে, চরকি! চুপ করে আছিস কেন? জিভে ফেভিকুইক সাঁটিয়েছিস নাকি? বল রোশন হারামিটার কী হল? বল!’

রোশন এবার ঠান্ডা গলায় বলল, ‘পলানদা, অত চেঁচিয়ো না—হার্টে প্রবলেম হবে। তুমি শিগগির কলাবতীর ঘাটে তোমার পা চাটা কুত্তাগুলোকে পাঠাও—ওরা চরকি আর চরকির মোটরবাইক—দুটোকেই কুড়িয়ে নিয়ে যাবে…।’

রোশনের কথা কেটে পলান চিৎকার করে উঠল, ‘রোশন! রোশন!’

রোশন হাসল। তারপর বলল, ‘মাইরি, পলানদা! সবকিছু বুঝেও লেডিজের মতো ন্যাকামো কোরো না…।’

‘শিগগির বল, চরকিকে তুই কী করেছিস!’ পলান পাগলের মতো চিৎকার করে উঠল আবার, ‘তোকে কুচিকুচি করে কলাবতীর জলে ভাসিয়ে দেব!’

‘তুমি কিছুই করতে পারবে না, পলানদা—’ রোশন ঠান্ডা গলায় বলল, ‘তোমার আড়াইশো গ্রাম মাল এখন আমার কবজায়। সুবু আর কানুয়া যেখানে মালটাকে গর্ত করে লুকিয়েছিল আমি সেখান থেকে ওটা বের করে অন্য জায়গায় লুকিয়ে ফেলেছি। এখন আমি ছাড়া আর কেউ জানে না মালটা কোথায়। আর আমাকে যতই চমকাও বা টরচার করো না কেন, আমার মুখ থেকে তুমি লুকোনো জায়গার খবর কিছুতেই বের করতে পারবে না…।’

‘চরকি কোথায়? চরকিকে তুই কী করেছিস বল! বল কী করেছিস!’

‘চরকির একটা পা ওর বাইকের গরম সাইলেন্সারে সাঁটিয়ে দিয়েছি। পা-টা পুরো বেগুনপোড়া হয়ে গেছে। এখন ও সেন্সলেস হয়ে বাইকটার কাছে পড়ে আছে। তুমি চ্যালাদের ভেজিয়ে চরকির বডি আর বাইক তুলে নিয়ে যাও…।’

‘দাঁড়া, কাল বিশ্বরূপ জোয়ারদারের লজে গিয়ে তোর খবর নিচ্ছি। দেখি কী করে তুই আমার লাখ-লাখ টাকার মাল হজম করিস!’

রোশন আবার হাসল, বলল, ‘তুমি বড্ড ছেলেমানুষ, পলানদা। তোমার লাখ-লাখ টাকার মাল আমার কবজায়, আর তুমি বলছ আমার খবর নেবে! বরং তুমি আমার সঙ্গে উলটো-সিধে নকশা করলেই আমি আশাপুরের সব পাবলিককে ডেকে দিনদুপুরে তোমার ওই দু-নম্বরি মাল পুলিশের কাছে হ্যান্ডওভার করে দেব। তখন তোমার দোস্ত সুরেন দাসও তোমাকে সেভ করতে পারবে না। তুমি স্ট্রেট গারদে ঢুকে যাবে। সেখান থেকে কবে বেরোবে তার ঠিক নেই। তাই বুঝে-শুনে স্টেপ ফেলো, পলানদা। হাওয়া এখন উলটোদিকে বইছে। কেয়ারফুল!’

কেয়ারফুল! একটা উড়ে এসে জুড়ে বসা অচেনা ছোঁড়া পলানকে বলছে ‘কেয়ারফুল’! আস্পর্ধা তো কম নয়!

***

পরদিন সকাল সওয়া ন’টা নাগাদ রোশন যখন ‘আশাপুর লজ’-এর বাইরে এসে রাস্তায় পা রাখল তখন লজের দরজার দু-পাশে তিনটে-তিনটে ছ’টা মোটরবাইক দাঁড়িয়ে।

বাইকগুলোর আকার-প্রকার নানারকমের : কোনওটা নতুন, কোনওটা পুরোনো, কোনওটা আবার একটু বেশি পুরোনো। তবে সবমিলিয়ে যে-বাইকটা চোখে পড়ার মতো সেটার রং লাল, আর মাপেও সেটা বেশ বড়। সেই বাইকের ওপরে বসে আছে পলান নস্কর।

ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে নিয়মমাফিক ছাদে চলে গেছে রোশন। তারপর ওর ব্যায়াম শুরু করেছে। রেডিয়ো নেই বলে কোনও গান বাজছে না বাতাসে। তাই ব্যায়ামের ছন্দ মেলাতে ওর একটু অসুবিধে হচ্ছিল।

ছাদের উচ্চতায় দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকাল। চোখে ঘুমজড়ানো আশাপুর বিছিয়ে আছে চারিদিকে। কিন্তু বেলা বাড়লেও তো আশাপুর ঘুমিয়ে থাকে। শত অন্যায়-অবিচার দেখেও জেগে ওঠে না। ফলে অন্যায়ের উদ্দাম অশালীন নৃত্যনাচন চলতে থাকে।

মনে-মনে একটা লোহার রড উঁচিয়ে ধরল রোশন। ‘জয় মা!’ বলে সেই রডের বাড়ি বসিয়ে দিল নাচিয়ের পায়ে। ব্যস, নাচ শেষ।

না, নাচ শেষ হবে না। পলান নস্করের নাচন শেষ হলেও কয়েক মাস কি কয়েক বছরের মধ্যেই পলান নস্করের বদলে অন্য কেউ মাথাচাড়া দেবে এবং অন্যায়ের প্রলয়নাচন আবার শুরু করে দেবে। এই নাচ চিরকালের মতো বন্ধ করতে পারে একমাত্র মানুষ—আশাপুরের মানুষ! প্রায় ছ’মাস ধরে রোশন দেখছে তাদের। সবাই না হলেও অনেকেই জেগে উঠেছে এই ছ’-মাসে। মনে-মনে সেই জেগে ওঠা মানুষগুলোকে সেলাম করল রোশন।

গতকাল রাতের কথা মনে পড়ল ওর। চরকিকে অমন ভয়ংকর শাস্তি দিয়ে এখন একটু খারাপ লাগছিল। কিন্তু উপায় নেই। এখন টাফ টাইম। পারমানেন্ট অথবা সেমিপারমানেন্ট ড্যামেজের সময়। এখন সব মোকাবিলাতেই স্থায়ী ছাপ ফেলতে হবে।

এই স্থায়ী ছাপের কথা ভাবতে-ভাবতেই একতলায় নেমেছে ও। বিশ্বরূপদাকে বলে ব্রেকফাস্ট খাওয়ার জন্য লজ থেকে রাস্তায় বেরিয়েছে। আর তখনই ও হাফডজন বাইকের মুখোমুখি হয়েছে। বাইকগুলোর ইঞ্জিন অধৈর্যভাবে গরগর করছে।

পলানের দিকে তাকাল রোশন।

পলানের চোয়াল শক্ত। চোখ সরু। মুখ থমথম করছে। কপালে ঘাম। সেখানে দু-জায়গায় খানিকটা করে চুল লেপটে আছে।

পলানের বাঁ-গালের পেশি খুব সামান্য তিরতির করে কাঁপছে। মাথাটা মাঝে-মাঝে ঝাঁকাচ্ছে—দু-হাত জোড়া অবস্থায় মুখে মশা কিংবা মাছি বসলে লোকে যেভাবে মাথা ঝাঁকিয়ে সেটাকে তাড়ানোর চেষ্টা করে, সেইরকম।

পলানের পর বাকি মুখগুলোর ওপরে চোখ বুলিয়ে নিল রোশন। পাঁচটা মুখে একটা কমন ফ্যাক্টর খুঁজে পাওয়া গেল : রাগ। মুখগুলোর কয়েকটা চেনা, কয়েকটা অচেনা।

আকাশ থেকে তেরছা রোদ এসে পড়েছে ছ’টা বাইক আর তার আরোহীদের ওপরে। চাকার কাছে লুটিয়ে রয়েছে ছ’ সেট ছায়া।

রোশন ভাবছিল, এই বুঝি পলান আর তার চ্যালারা ওদের বাইক থেকে নেমে পড়বে এবং লুকোনো লাঠিসোটা অস্ত্রশস্ত্র বের করে রোশনকে সেই আগের মতো রাস্তায় ফেলে নির্মমভাবে টরচার করবে।

রোশনের চোয়াল শক্ত হল। ওর পেশিগুলো ভেতরে-ভেতরে লড়াইয়ের জন্য তৈরি হল। চোখের সামনে যেন ছ’জন চরকিকে দেখতে পাচ্ছিল ও।

কিন্তু রোশন যা ভাবছিল সেটা হল না। হলে পর কলাবতীর তীরে মাটির নীচে পুঁতে রাখা সাড়ে আট লাখ টাকা দামের পলিথিনের প্যাকেটটার কথা পলান নস্করকে ভুলে যেতে হত।

‘আমার বাইকে উঠে পড়…জলদি!’ পলান রক্ষ গলায় বলল। একইসঙ্গে ওর বাইকের পিলিয়নে ওঠার জন্য রোশনকে ইশারা করে মাথা ঝাঁকাল।

রোশন পায়ে-পায়ে পলানের বাইকের দিকে এগোল। আড়চোখে তাকিয়ে গেস্টহাউসের দরজায় বিশ্বরূপদাকে দেখতে পেল ও। তারপর গেস্টহাউসের দোতলার দিকে একপলক তাকাল। দু-জানলায় দুটো কৌতূহলী মুখ—মানে, মজা দেখতে চাওয়া ‘জনগণ’।

পলানের বাইকের পিলিয়নে চড়ে বসল রোশন।

ছ’টা বাইক চলতে শুরু করল। সবার আগে পলানের বাইক, আর তার পিছন-পিছন লাইন দিয়ে বাকি পাঁচটা। ছ’টা বাইকের গরগর আওয়াজ কানে তালা ধরিয়ে দিচ্ছে। রাস্তার লোকজন আর দোকানিরা চমকে তাকাচ্ছে এই বাইক-মিছিলের দিকে। এটা ওদের চেনা মিছিল।

রোশন একটুও ভয় পায়নি। পলানের বাইকের পিছনের সিটে বসে ও শুধু আঁচ করার চেষ্টা করছিল এরপর কী হতে পারে। এটা শিয়োর যে, পলান ওকে ওই সাড়ে আট লাখ টাকার মালটার খবর আগে জিগ্যেস করবে। জানতে চাইবে, ওটা কোথায় লুকোনো আছে। তার পরে হয়তো চরকিকে ঘায়েল করার হিসেব নেবে।

কয়েক মিনিটের মধ্যে বাইকগুলো এসে থামল ‘জনপ্রিয় মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’-এর সামনে।

বড় বটগাছটার পাশ ঘেঁষে বাইকগুলো একে-একে থমকে দাঁড়াল। ওদের ইঞ্জিনের আওয়াজ বন্ধ হল। সবাই নেমে পড়ল বাইক থেকে। পলান আর রোশনও।

পলানের আরও চারজন চ্যালা আড্ডা মারার ঢঙে ওদের বেঞ্চিতে এলোমেলোভাবে বসে ছিল। পলানের বাইক দেখামাত্রই ওরা উঠে দাঁড়িয়েছিল। এখন পলান বাইক থেকে নামতেই ওরা অ্যাটেনশানের ভঙ্গিতে পলানকে ঘিরে দাঁড়াল।

রোশন চুপচাপ দশজনকে লক্ষ করছিল। সাধারণত ‘জনপ্রিয়’-র সামনে পলানের ঠেকে এতগুলো ছেলেকে একসঙ্গে দেখা যায় না। আজ এই ‘ভিড়’ দেখে মনে হতে পারে এখানে কোনও উৎসব আছে।

দলের কয়েকজন রোশনের দিকে রাগী হিংসা নিয়ে তাকিয়ে ছিল। বাকিরা পলানের মুখের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করছে ওর আদেশের প্রত্যাশায়। পলানদা শুধু একবার বললেই হল। ওরা তখন রোশনকে নিয়ে প্রতিহিংসার উৎসব করবে।

‘তোরা সব বসে যা—’ শাগরেদদের দিকে তাকিয়ে পলান বলল।

সঙ্গে-সঙ্গে কাটা নগেন, কানুয়া, নোনতা সবাই দুটো বেঞ্চিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে পড়ল।

এখন বটগাছের ছায়ায় শুধু দুজন দাঁড়িয়ে : রোশন আর পলান।

পলানের মুখে রাগ আর বিরক্তির বিবিধ নকশা। পলানের কানের মাকড়ি, হাতের বালা সেই নকশাগুলোকে যেন আরও জোরদার করেছে।

পলান এখন হয়তো ভয়ংকর কিছু একটা করতে পারে। কারণ, সাড়ে আট লাখ টাকা তো নেহাত কম নয়! ওই পলিথিনের প্যাকেটটা হাতছাড়া হয়ে গেলে পলানের নিশ্চয়ই ভালোরকম ‘ব্যথা’ লাগবে।

পলানের চোখে চোখ রেখে রোশন অপেক্ষা করতে লাগল।

কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ কেটে যাওয়ার পর পলান ভুরু উঁচিয়ে জিগ্যেস করল, ‘কী রে, শুয়ার, মালটা কোথায় সাঁটিয়েছিস?’

‘আপনি গালাগালি ছাড়া বোধহয় কথা বলতে জানেন না, তাই না? আপনার মা-বাবার সঙ্গেও কি এইভাবে কথা বলেন?’

রোশন কথাটা বলল বটে, কিন্তু ও আগেই শুনেছে, স্কুলের পড়া শেষ করার আগেই পলানের মা-বাবা সবার নাগালের বাইরে চলে গেছে।

পলান রোশনের কথাটা মাথায় নিল না। রোশনের চোখে চোখ রেখে ও আবার জানতে চাইল, ‘আমার প্যাকেটটা কোথায় লুকিয়েছিস?’

রোশন বলল, ‘প্যাকেটটা পাবেন—তবে একটা শর্তে।’

‘শর্তে? কোন সাহসে তুই শর্ত দিচ্ছিস?’

হাসল রোশন : ‘শর্ত দিতে আবার সাহস লাগে না কি?’

পলানের সারা শরীর জ্বলছিল। রাগের ঢেউ পাগলের মতো ছুটে বেড়াচ্ছিল শিরায়-শিরায়। রোশনের গালে সপাটে একটা থাপ্পড় মারার জন্য হাত নিসপিস করছিল। কিন্তু চারপাশে অনেক লোকজন, সকালের ব্যস্ততা। হুট করে কিছু করে বসলে সেটাকে নিয়ে রোশন ছেলেটা হয়তো ড্রামা করে বসবে। না, একটু ঠান্ডা মাথায় ব্যাপারটা হ্যান্ডেল করতে হবে।

‘কী শর্ত বল…।’ পলান সতর্ক গলায় বলল।

‘আশাপুরে তোমাকে তোলাবাজি বন্ধ করতে হবে। শনিবার-শনিবারে গোডাউন ফাইট বন্ধ করতে হবে। আর ছোট-ছোট ছেলেদের লোভ দেখিয়ে তোমার দলে টানার চেষ্টাটা বন্ধ করতে হবে…।’

পলান দাঁত বের করে হিংস্রভাবে হাসল। লক্ষ করল, রোশন সম্বোধনের ব্যাপারে ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’-তে নেমে এসেছে।

পলান অনেক চেষ্টায় ভেতরের ফুটন্ত রাগকে পোষ মানিয়ে নিয়ন্ত্রণে রাখল। তারপর ব্যঙ্গ করে বলল, ‘শুধু এইটুকু? আর কিছু বন্ধ করতে হবে না?’

‘না—আপাতত এইটুকু…।’ শান্তভাবে বলল রোশন, ‘এগুলো বন্ধ করলে তবেই তোমাকে ওই প্যাকেটটা ফেরত দেব। কিন্তু তার সঙ্গেও একটা কন্ডিশান আছে : ওই প্যাকেটের জিনিসটা তুমি আশাপুরের কোথাও ইউজ করতে পারবে না।’

‘আশাপুরে আমি ওই পাউডার ইউজ করি না করি তাতে তোর কী? তোর সঙ্গে তো আমার কোনও লেনাদেনা নেই…।’

‘তুমি ঠিক বলেছ, পলানদা। আমার সঙ্গে তোমার যখন কোনও লেনাদেনা নেই তখন আমি কেন তোমার কাজে মাথা গলিয়ে এত চাপ নিচ্ছি?’

একটু চুপ করে রইল রোশন। লক্ষ করল, বেঞ্চিতে বসা পলানের চ্যালারা অধৈর্য হয়ে উঠেছে, উশখুশ করছে।

‘শোনো, পলানদা—আমরা, জেনারেল পাবলিকরা, যদি এরকম মাথা গলিয়ে চাপ না নিই তা হলে চারপাশে তোমার মতো পচা মাল অনেক গজিয়ে উঠবে। পরিবেশ দূষণের প্রবলেম অনেক বেড়ে যাবে। তাই জেনারেল পাবলিককেই সেটা রুখতে হবে…।’

রোশনের কথা শেষ হতে না হতেই পলান একটা ভয়ংকর চিৎকার করে উঠল। তবে চিৎকার না বলে সেটাকে কোনও জন্তুর গর্জন বললেই ভালো মানায়।

আর সেই গর্জনের রেশ কাটতে না কাটতেই পলান সপাটে একটা থাপ্পড় কষিয়ে দিল রোশনের বাঁ-গালে।

সংঘর্ষের যে-মারাত্মক শব্দটা হল সেটা গাড়ির ব্যাকফায়ারের মতো শোনাল। রোশন ছিটকে পড়ল রাস্তায়। ওর গালে, হাতে, চুলে রাস্তার ধুলো লেপটে গেল।

রোশনের গাল জ্বালা করছিল, মাথা দপদপ করছিল, চোখের সামনে ছোট-ছোট হলদে ফুল পাগলের মতো ওড়াউড়ি করছিল।

কয়েক সেকেন্ড পর ঝাপসাভাবে পলানকে দেখতে পেল রোশন। পা ফাঁক করে লোহার পিলারের মতো দাঁড়িয়ে আছে। ওর তিন-চারজন চ্যালা উত্তেজনায় বেঞ্চি ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। ওদের মুখে আউট অফ ফোকাস হাসি : রোশন শুয়োরের বাচ্চাটাকে দিনদুপুরে রাস্তায় ফেলে পেটানোর পুরোনো তামাশা আবার শুরু হয়ে গেছে।

শরীরের সমস্ত শক্তিকে একজায়গায় জড়ো করে ধীরে-ধীরে সোজা হয়ে দাঁড়াল রোশন। স্পষ্ট বুঝতে পারছে ওর বাঁ-গালটা ফুলে উঠেছে। তার সঙ্গে নিশ্চয়ই গোলাপি আভাও দেখা যাচ্ছে ওর ফরসা গালে।

গাল তখনও জ্বালা করছিল, কিন্তু তা সত্ত্বেও গালে একটিবারও হাত বোলাল না। চড়চড়ে জ্বালাটা চুপচাপ সহ্য করতে লাগল।

দেখল, পলান বেশ একটা বীরত্বের অহংকার নিয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।

এখন পলান বা ওর চ্যালাদের চেহারাটা আর ঝাপসা নয়—রোশন দিব্যি ফোকাস করতে পারছে। আর সেটা পারছে বলেই পলানের শাগরেদদের উল্লাসও কটকট করে চোখে পড়ছে।

পলানের ঠেকে কিছু যে একটা লাফড়া চলছে সেটা ‘জনপ্রিয়’-র দুজন কর্মী অনেকক্ষণ ধরেই আঁচ করেছিল। কিন্তু ঝামেলাটা সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল পলান রোশনকে থাপ্পড়টা মারার পর।

শুধু ‘জনপ্রিয়’-র কর্মী দুজনই নয়, পথচলা মানুষজনও একটা ‘সিনেমা’-র গন্ধ পেয়ে বারবার তাকাচ্ছিল বটতলার দিকে। তাদের বেশিরভাগই নিজেকে ঝামেলায় না জড়ানোর তাগিদে সুড়সুড় করে তফাতে সরে যাচ্ছিল। তবে কেউ-কেউ একটা নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে বিনিপয়সার ‘সিনেমা’ দেখার জন্য থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। কেউ-কেউ মোবাইল ফোন বের করে ফটোও তুলছিল।

এটুকু তফাত বাদ দিলে আশাপুরের বাকি সকালটুকু তার নিজের ছন্দেই চলছিল।

রোশন চারপাশটা আলতো করে চোখ বুলিয়ে নিয়েছিল। আর একইসঙ্গে ভাবছিল, ‘সিনেমা’-টা আর একটু লম্বা হলে কেমন হয়!

ও শান্তভাবে পলানের দিকে তাকাল। মাস্তানটা অহংকারে টগবগ করছে।

মনে-মনে ‘এক-দুই-তিন’ বলল রোশন। তারপর বিড়বিড় করে বলল, ‘অফেন্স—অফেন্স—অফেন্স।’

এবং পলানের গালে সপাটে একটা থাপ্পড় মারল।

পলান টলে পড়ে যাচ্ছিল, কিন্তু পড়ে যাওয়ার আগেই রোশন পা তুলে ওর বুকে প্রবল জোরে একটা লাথি বসিয়ে দিল।

পলান পিছনদিকে উলটে পড়ে গেল রাস্তায়। ওর মাথাটা অল্পের জন্য ফুটপাথের কিনারায় চোট পাওয়ার হাত থেকে বেঁচে গেল।

পলানকে সামাল দিতে ওর চ্যালারা পড়িমরি করে ওর কাছে ছুটে গেল। ওকে ধরে খানিকটা তুলতেই পলান ‘ছাড়! ছাড়!’ বলে ঝটকা মেরে ওদের হাতগুলো সরিয়ে দিয়ে নিজেই সোজা হয়ে দাঁড়াল।

রোশনের থাপ্পড় আর লাথি খেয়ে পলান স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল। কারণ, পলান নস্কর এলাকার ‘পলানদা’ হয়ে ওঠার পর কেউ ওর গায়ে হাত তোলেনি। ও ছিল ‘আনটাচেবল’—অস্পৃশ্য। কিন্তু আজ রোশন ওকে ‘টাচেবল’ করে দিয়েছে। উটকো ছেলেটা প্রমাণ করে দিয়েছে পলান ধরা-ছোঁয়ার বাইরে নয়।

থাপ্পড়ের জ্বালায় যতটা নয় তার চেয়ে ঢের বেশি অপমানের জ্বালায় জ্বলতে লাগল পলান। কারণ, চারপাশে বেশ কয়েকজন পাবলিক দাঁড়িয়ে পড়েছে। ‘জনপ্রিয় মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’-এর চারজন কর্মী দোকানের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। এমনকী দুজন সাইকেল রিকশাওয়ালা তাদের রিকশা নিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে। তাদের সকলের মুখে-চোখে এমন বিস্ময় যেন কোনও সুপার-ম্যাজিশিয়ানের সুপার-ম্যাজিক দেখছে। পলানের গায়ে ‘রোশন’ নামের ছেলেটা হাত তুলেছে, এই ব্যাপারটা কেউই যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। কিন্তু ওদের ভালো লাগছে।

রোশন লক্ষ করল, পলানের শাগরেদদের তিনজনের হাতে কখন যেন অস্ত্র উঠে এসেছে : একটা কানপুরিয়া, একটা চপার আর একটা জং ধরা সোর্ড। সশস্ত্র তিনটে ছেলে দু-তিনটে পা ফেলে পলানের দু-পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।

ওদের মধ্যে কে যেন বলতে শুরু করেছিল, ‘দাদা, মালটাকে এখানেই কুচিয়ে…।’

‘না!’ পলান চিৎকার করে উঠল। রাগে ফোঁসফোঁস করতে-করতে এপাশ-ওপাশ তাকাল। বটতলা ঘিরে এখন অনেকেই দাঁড়িয়ে।

পলান মনে-মনে খুব তাড়াতাড়ি ক্যালকুলেশন করতে লাগল।

ইচ্ছে করলেই কোমর থেকে ছ’-ঘরা বের করে ছেলেটার সিনায় তিন-তিনটে দানা ভরে দিতে পারে পলান। দিলেই রোশনের লাশ খালাস হয়ে যাবে। কিন্তু তার সঙ্গে-সঙ্গে কলাবতীর পাড়ের ওই সাড়ে আট লাখ টাকার প্যাকেটটাও খালাস হয়ে যাবে।

সেইজন্যই পলান ‘না!’ বলে চিৎকার করে উঠেছে, শাগরেদদের থামতে বলেছে।

রোশন পলানের কাছে এগিয়ে এল। বেশ সংকোচের সঙ্গে বলল, ‘পলানদা, সরি। তোমার সেরকম লাগেনি তো? আমি তোমার গায়ে হাত তুলতে চাইনি। কিন্তু…কিন্তু তুমি যেরকম পট করে আমার গায়ে হাত তুলে দিলে তাতে আমার মাথাটাও ঝট করে গরম হয়ে গেল।’ একটু থামল রোশন। কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থাকার পর বলল, ‘তা ছাড়া বলো, সবসময় কি চুপচাপ দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে মার খেতে কারও ভালো লাগে? মাঝে-মাঝে পালটা দু-এক ঘা দিতেও তো ইচ্ছে করে। ব্যাপারটা হিট অফ দি মোমেন্টে হয়ে গেছে—তুমি কিছু মাইন্ড কোরো না, প্লিজ…।’

পলান চুপচাপ দাঁড়িয়ে রোশনকে দেখছিল। ওকে মাপছিল।

এটা কী হচ্ছে? ন্যাকামো?

ও আড়চোখে চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিল। অনেকেই কৌতূহলী চোখে সকালবেলার এই অভিনব তামাশা দেখছে। হয়তো ওরা অবাক হয়ে ভাবছে, পলানদার গায়েও তা হলে হাত তোলা যায়! ওদের কারও-কারও হাতে মোবাইল ফোন। কে ক’টা ছবি তুলেছে কে জানে!

রোশন যে পলানকে ছকে ফেলেছে সেটা পলান বেশ বুঝতে পারল। ওর গাল জ্বালা করছিল। বাঁ-হাতের কনুই আর পাছার হাড়ে ব্যথা করছিল।

কী করবে এখন ও?

মনে-মনে রোশনের কূটবুদ্ধির তারিফ করল পলান। না, রোশনকে এখন যক্ষ্মা পালিশ দিয়ে সাড়ে আট লাখ টাকাকে মায়ের ভোগে পাঠাতে পারবে না ও। টাকাটা ওর দরকার। নতুন যে সাদা গুঁড়োর ব্যাবসা ও শুরু করেছে তাতে সাড়ে আট লাখ টাকা বিশ-পঁচিশ দিনে ডবল-রিডবল হয়ে যাবে।

না, রোশনকে এখন ডিসটার্ব করলে চলবে না। কলাবতীর পাড়ের ওই সাদা গুঁড়োর প্যাকেটটা পলানের চাই।

রোশনের চোখের দিকে তাকিয়ে রইল পলান। প্রায় দশ সেকেন্ড ওর চোখের পলক পড়ল না। রোশনও পলকহীনভাবে পলানের চোখে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে রইল।

পলান লক্ষ করল, রোশনের চোয়ালের হাড় কাঠের মতো শক্ত হয়ে রয়েছে। না, ছেলেটার জেদ নেহাত ঠুনকো নয়। সুতরাং উটকো ছেলেটার শর্তে রাজি হয়ে গেল পলান। রোশনকে ও কিছুতেই বুঝতে দেবে না যে, শর্তে রাজি হওয়াটা ওর বাইরের খোলস—ভেতরে-ভেতরে ও রোশনকে শেষ করার ছক কষে চলেছে।

পলান মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ‘তোর সব শর্তে আমি রাজি। আশাপুরে তোলাবাজি বন্ধ, গোডাউন ফাইট বন্ধ, ছোট-ছোট ছেলেদের আমি আর কখনও দলে টানব না। আর তুই ওই প্যাকেটটার ইনফরমেশন দিলে, তোকে কথা দিচ্ছি, ওই প্যাকেটের মাল আশাপুরে ডাউনলোড করব না। আমার মায়ের দিব্যি—’ বলে নিজের টুটি টিপে ধরল পলান। তারপর সামনে দুটো পা ফেলে এগিয়ে রোশনের হাত চেপে ধরল : ‘মা কালীর কিরে—তোর সব কন্ডিশনে আমি রাজি…।’

কথা বলতে-বলতে একটু পিছনে দাঁড়ানো তিনজন শাগরেদের দিকে আড়চোখে তাকাল পলান। ওদের তিনজনের হাতে তিনটে অস্ত্র : কানপুরিয়া, চপার আর জং ধরা সোর্ড। ওগুলো হাতে নিয়ে ওপেন রাস্তায় ওরা দাঁড়িয়ে।

পলান চাপা গলায় ধমক দিয়ে বলল, ‘আরে, মালগুলো ছুপে নে। পাবলিক হাঁ করে দেখছে…।’

চ্যালারা চটপটে পায়ে বটগাছের কাছে চলে গেল, হাতিয়ারগুলো লুকিয়ে রাখল গাছের আড়ালে।

শাগরেদদের হুকুম দেওয়ার পরের সেকেন্ডেই রোশনের দিকে নরম চোখে তাকিয়ে পলান বলল, ‘বস, বললাম তো, মা কালীর কিরে। এবার তো মালটার ঠিকানা দাও…।’

রোশন কিছুক্ষণ ধরে কী যেন ভাবল। তারপর বলল, ‘কোনও চিন্তা কোরো না, পলানদা। ইনডিপেন্ডেন্স ডে-র প্রোগ্রামটা হয়ে যাক—তারপর তুমি তোমার মাল পেয়ে যাবে। ওই প্রোগ্রামের আগে তোমাকে ওই গুঁড়োর প্যাকেটটা দেওয়া যাবে না। ওটা আমার ইনশিয়োরেন্স। যাতে প্রোগ্রামে তোমাদের কেউ কোনওরকমে ঝঞ্ঝাট কিংবা গোলমাল করতে না পারে।’

‘তার মানে?’ মুখ খিঁচিয়ে রোশনের দিকে আরও এক পা এগিয়ে এল পলান।

‘চোখ গরম কোরো না, পলানদা।’ ঠান্ডা গলায় রোশন বলল, ‘গরমকে কী করে নরম করতে হয় সেটা আমি ভালো করেই জানি…।’

ব্যাপারটা অনেকটা ব্ল্যাকমেল বলে মনে হল পলানের।

এমন সময় একটু ভাঙা এবং ফ্যাঁসফেঁসে গলায় কে যেন চেঁচিয়ে ডাকল, ‘পলান! ও পলান!’

সবাই সেই ডাক লক্ষ করে ফিরে তাকাল।

কিশোরীমোহন সামন্ত।

একটা ঝরঝরে সাইকেল পাশে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।

রোগা চেহারা, মুখে খোঁচা-খোঁচা দাড়ি। ময়লা শার্ট-প্যান্টে বেশ কয়েকটা তালি মারা।

সাইকেলটা স্ট্যান্ডে দাঁড় করালেন কিশোরীমোহন। বড়-বড় চোখ আরও বড় করে পলানের দিকে বেশ কয়েক পা এগিয়ে এলেন।

ঠোঁট চওড়া করে হেসে বললেন, ‘কী, পলান? রোশনের হাতে মার খাচ্ছ? বেশ, বেশ—।’ বলে রোশনের কাছে গিয়ে ওর পিঠে চাপড়ে দিলেন।

সারা গা জ্বলে গেল পলানের।

রোশনের ব্ল্যাকমেল ওর হাত-পা বেঁধে দিয়েছে। নইলে ও দেখে নিত কত ধানে কত চাল।

কিশোরীমোহন তখন দু-হাতে রোশনের হাত চেপে ধরে ঝাঁকাচ্ছেন আর উল্লাসে প্রাণ খুলে হাসছেন।

‘বুঝলে, রোশন, সায়ন আজ এখানে থাকলে তোমার পা ছুঁয়ে প্রণাম করত। তোমার নাম তো রোশন, তাই না?’

রোশন এর আগে ভদ্রলোককে একবার মাত্র দেখেছিল—এখানে, ‘জনপ্রিয় মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’-এর সামনে। ওঁর হাবভাব দেখে আর কথাবার্তা শুনে ওর মনে হচ্ছিল ভদ্রলোক যেন ঠিক স্বাভাবিক নন। তার ওপরে মুখ থেকে নেশার গন্ধ বেরোচ্ছে।

‘আমি দূর থেকে তোমার কাণ্ড দেখছিলাম—’ কিশোরী চারপাশটা একবার দেখে নিয়ে বলতে শুরু করলেন, ‘তুমি আজ দেখিয়ে দিলে কে বাঘের বাচ্চা আর কে শুয়োরের বাচ্চা।’ পলানের দিকে ফিরে কথা শেষ করলেন।

অপমানের পর অপমান, তার ওপরে অপমান—এই অপমানের পাহাড় পলান নস্কর আর সইতে পারছিল না। ও কিশোরীমোহনের জামার কলার লক্ষ করে ছোবল মারল। এবং এক হ্যাঁচকায় পলকা রোগা মানুষটাকে নিজের একেবারে কাছে টেনে নিয়ে এল।

কলার খামচে ধরে প্রবল ঝাঁকুনি দিল কিশোরীর কাঠামোটাকে। ওর স্বভাব অনুযায়ী সেইসঙ্গে কাঁচা খিস্তির বন্যা বইয়ে দিল।

কিশোরীমোহনকে বাঁচানোর জন্য রোশন সামনে এগিয়ে গেল। পলানের হাতের মুঠো থেকে কিশোরীর জামাটাকে ছাড়াতে চেষ্টা করল।

আশপাশে দাঁড়ানো লোকজন কিশোরীমোহনের হেনস্থা দেখে সহানুভূতির নানান শব্দ করছিল, নানান কথা বলছিল।

‘ইসস’, ‘উঃ’, ‘কী হচ্ছে এটা!’, ‘পলানটা সীমা ছাড়িয়ে গেছে।’, ‘ছোট-বড় জ্ঞান নেই—’।

কিছুক্ষণ চেষ্টার পর কিশোরীকে ছাড়াতে পারল রোশন। তারপর ওঁকে ঠেলে একটু দূরে সরিয়ে দিল।

কিশোরীমোহনের জামা ছিঁড়ে গেছে। বড়-বড় শ্বাস নিচ্ছেন। হাড়জিরজিরে পাঁজর উঠছে নামছে। কিন্তু জলন্ত চোখে তাকিয়ে আছেন পলানের দিকে।

রোশন পলানের কাছ থেকে সরে আসতেই কিশোরীমোহন একলাফে পৌঁছে গেলেন পলানের সামনে। রোগা হাতে ঠাঁটিয়ে একটা চড় মারলেন পলানের গালে।

‘শুয়োরের বাচ্চা! বড্ড বাড় বেড়েছিস, না?’ ধমকের সুরে বলে উঠলেন কিশোরী।

পলান কী করবে ভেবে ওঠার আগেই চারপাশে দাঁড়ানো লোকজন হাততালি দিয়ে হইহই করে উঠল।

পলান আর সইতে পারল না। অপমানে ওর মুখ গোলাপি হয়ে গেছে। পকেট থেকে রিভলভার বের করে ভিড় করা লোকজনের দিকে তাক করে গালিগালাজ করতে লাগল।

‘ভাগ সালা, ভাগ। ফোট এখান থেকে—নইলে মাথা ফুটো করে দেব…।’

পলানের হুমকির সঙ্গে-সঙ্গে পলানের চ্যালারা উঠে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে আর গালিগালাজ করে পাবলিক তাড়াতে লাগল।

পলান রিভলভার বের করায় ভালো কাজ হল। ওটা দেখামাত্র সব লোকজন নিমেষের মধ্যে হাওয়া হয়ে গেল। জায়গাটা একেবারে সুনসান ফাঁকা হয়ে গেল। পড়ে রইল শুধু রোশন, কিশোরীমোহন আর কিশোরীমোহনের সাইকেল।

পলান রিভলভারটা সামনে উঁচিয়ে কিশোরীমোহনের কাছে এগিয়ে গেল। রিভলভারের নলটা রোগা মানুষটার পেটে চেপে ধরে হিংস্রভাবে হেসে উঠল। তারপর দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘কী রে সালা, দু-চারটে দানা ভরে দেব নাকি?’

কিশোরীমোহনের শরীরটা থরথর করে কাঁপতে লাগল। ওঁর বড়-বড় চোখে ভয়ের ছাপ পড়ল।

‘কী করছ, পলান? কী করছ!’ ভয়ার্ত কিশোরী বলে উঠলেন।

রোশন চেঁচিয়ে উঠল, ‘কী হচ্ছে, পলানদা—রিভলভার সরাও! পলিথিনের প্যাকেটটার কথা ভুলে যাচ্ছ?’

পলান রোশনের দিকে তাকাল। ওর মাথার ভিতরে একটা শিরা দপদপ করছে।

কিশোরীমোহনের মুখের দিকে কয়েক লহমা তাকিয়ে রইল পলান। মনে-মনে একটা হিসেবনিকেশ করতে চাইল।

নাঃ, এই খ্যাঁচা লোকটার দাম কখনওই সাড়ে আট লাখ টাকা হতে পারে না। তার অনেক-অনেক কম। তার চেয়ে…।

মাথা ঝাঁকাল পলান। রিভলভারটা কিশোরীমোহনের পেট থেকে সরিয়ে নিল। তারপর আচমকা খপ করে চেপে ধরল কিশোরীমোহনের ডানহাতের কবজি।

‘এই হাত দিয়ে আমাকে চড় মেরেছিস, না?’

ক্ষিপ্তভাবে কথাটা বলার সঙ্গে-সঙ্গে কিশোরীর ডানহাতের ঠিক মাঝখানে রিভলভারের নলটা চেপে ধরল পলান।

এবং গুলি করল।

‘পলানদা!’ বলে চেঁচিয়ে উঠল রোশন।

গুলির শব্দ আর রোশনের চিৎকারে কিছুটা দূরত্বে হেঁটে চলা পথচারীদের কয়েকজন বটতলার দিকে ঘুরে তাকাল।

‘জনপ্রিয় মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’-এর মালিক আর দুজন কর্মী দোকানের দরজা আর কাউন্টারের কাছে এসে গলা লম্বা করে বটতলার দিকে দেখতে লাগল।

কিশোরীমোহন তখন ডানহাতের তালু চেপে ধরে যন্ত্রণার চিৎকার শুরু করে দিয়েছেন। একইসঙ্গে পাগলের মতো লাফাচ্ছেন, ছটফট করছেন।

কিশোরী কঁকিয়ে উঠে চিৎকার করে বললেন, ‘রোশন, বাঁচাও! বাঁচাও! গুলি করে দিয়েছে! শুয়োরের বাচ্চাটা গুলি করে দিয়েছে!’ ওঁর রোগা শরীরটা টলছিল। মনে হচ্ছিল এখুনি পড়ে যাবে।

হাতের তালুতে গুলি লাগার সঙ্গে-সঙ্গে কিশোরীমোহন কোনও যন্ত্রণা টের পাননি, কারণ, ওঁর ডানহাতটা কিছুক্ষণের জন্য অসাড় হয়ে গিয়েছিল। তিনি শুধু দেখেছিলেন, ওঁর হাতের তালুর মাঝখানে একটা ছোট ফুটো—গুলিটা তালু এফোঁড় ওফোঁড় করে বেরিয়ে গেছে! আর সেই গর্তের পরিধি থেকে চুঁইয়ে-চুঁইয়ে বেরিয়ে আসছে রক্ত।

রোশন ছুটে গিয়ে কিশোরীকে জাপটে ধরল। টের পেল, ওঁর রোগা পলকা শরীরটা থরথর করে কাঁপছে। মানুষটা তখনও ভয় আর যন্ত্রণায় হাঁউমাউ করে চিৎকার করে চলেছে।

পলান বোধহয় বুঝল, হিট অফ দ্য মোমেন্টে ও একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে। এই ওপেন রাস্তায় কিশোরীমোহনের হাতে ওভাবে গুলি করাটা মোটেই ঠিক হয়নি। কারণ, কিশোরীমোহন যদি আশাপুর পুলিশ চৌকিতে ওর নামে একটা এফ. আই. আর. করে দেন তা হলে সুরেন দাস সেটাকে দু-নম্বরি করে ধামাচাপা দিতে পারবেন কি না তা নিয়ে পলানের যথেষ্ট সন্দেহ আছে। তা ছাড়া কিশোরীমোহন তো এখন একা নন, ওঁর সঙ্গে রোশন হারামজাদাটা আছে, আর তার পিছনে আছে রতনমণি মাঝি, অবনীমাস্টার, সুধীরডাক্তার, এবং এলাকার আরও অনেক লোক।

ফলে সুরেন দাস শেষ পর্যন্ত হয়তো পলানকে লক আপে ঢোকাতে বাধ্য হবে।

সেরকম যদি কিছু হয়, তা হলে আশাপুরে পলানের কি আর ইজ্জত বলে কিছু থাকবে?

পলান হঠাৎ যেন কেমন ভয় পেয়ে গেল। ও চট করে নিজের বাইকে চেপে বসল। বাইকে স্টার্ট দিয়ে চ্যালাদের লক্ষ্য করে চেঁচিয়ে বলল, ‘তোরা সব যে-যেখানে পারিস ফুটে যা! জলদি! এই কেসটা নিয়ে পুলিশের ল্যাঠা-লাফড়া হতে পারে…।’

অনেকগুলো বাইক একসঙ্গে স্টার্ট নিল। তারপর গরগর আওয়াজ তুলে বাইকগুলো নানান দিকে ছিটকে গিয়ে উধাও হয়ে গেল।

পলান আর ওর দলবল পালিয়ে যাওয়ার পর রোশন আর কিশোরীকে ঘিরে একজন-দুজন করে ভিড় জমতে লাগল। কেউ-কেউ কিশোরীমোহনকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য বলল। আবার কেউ-কেউ পুলিশে খবর দেওয়ার জন্য বলতে লাগল, ‘পুলিশ! পুলিশ!’ বলে চেঁচাতে লাগল।

রোশন পকেট থেকে রুমাল বের করে কিশোরীর ডানহাতে চেপে ধরেছিল। রুমালটা রক্তে ভিজে একেবার লাল। সেটা থেকে টপটপ করে রক্তের ফোঁটা ঝরে পড়ছিল রাস্তায়। দুটো ছেলে মোবাইল ফোন তাক করে আহত কিশোরীমোহনের ফটো তুলছিল, রক্তে ভেজা রাস্তার ফটো তুলছিল।

রোশন চিৎকার করে সবাইকে একটা সাইকেল রিকশা ডেকে দেওয়ার জন্য বলছিল। কিন্তু ভিড় জমানো লোকজনের হইহট্টগোলে সে-কথা কারও কানে পৌঁছোচ্ছিল না।

কিছুক্ষণ পর রোশনের চিৎকার বোধহয় কারও কানে ঢুকল, কারণ, দেখা গেল, একটা সাইকেল রিকশা রোশনদের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে।

আশাপুরে হাসপাতাল বলে কিছু নেই। তার বদলে আছে একটা হেলথ সেন্টার। রোশন কিশোরীমোহনকে নিয়ে কোনওরকমে সাইকেল রিকশাটায় উঠল। কিশোরী তখনও যন্ত্রণা আর আতঙ্কে চিৎকার করছেন। রিকশা রওনা হতেই রোশন দেখল চারটে সাইকেল ওর রিকশার পিছু নিয়েছে।

রোশন ওদের দিকে হাতের ইশারা করে চেঁচিয়ে বলল, ‘তোমাদের মধ্যে দুজন এক্ষুনি সুধীর ডাক্তারবাবুর চেম্বারে চলে যাও। ডাক্তারবাবুকে কেসটা সব খুলে বলবে। বলবে যে, আমি কিশোরীদাকে নিয়ে হেলথ সেন্টারে যাচ্ছি। সেখানে ট্রিটমেন্ট করিয়ে তারপর ওঁকে থানায় নিয়ে যাব। সেখানে কিশোরীদা পলান নস্করের নামে একটা এফ. আই. আর. করবেন। তারপর…তারপর ওঁকে হয়তো আবার হেলথ সেন্টারে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে হবে। খুব ব্লিডিং হচ্ছে। সুধীর ডাক্তারবাবু চেক আপ করে যদি বলেন, সদর হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে, তা হলে তাই যাব। তোমরা জলদি যাও…সুধীরডাক্তারবাবুকে একটা খবর দাও…।’

দুটো সাইকেল তখনই অন্য দিকে স্টিয়ারিং ঘোরাল। আর বাকি দুটো সাইকেল রোশনের সাইকেল রিকশার পিছন-পিছন চলল।

‘জনপ্রিয় মিষ্টান্ন প্রতিষ্ঠান’-এর সামনে পলানদের বটতলা ঘিরে তখন অনেক মানুষের ভিড়। তারা রাগ আর বিরক্তিতে হইচই করছে, নানান মন্তব্য করছে। কারণ, কিশোরীমোহন সামন্ত আশাপুরের খুব পরিচিত মুখ। সবাই জানে, ওঁর ছেলে সায়ন আর ওঁর স্ত্রী কীভাবে মারা গেছে। পাগল এই মানুষটা নেশা করে, একটা ভাঙা লজঝরে সাইকেল নিয়ে আশাপুরে খেয়ালখুশি মতো ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু মানুষটা কখনও কারও ক্ষতি করেনি। শুধু পলান নস্করের ওপরে কিশোরীমোহনের রাগ ছিল। তবে সেই রাগ ছিল নিষ্ফলা রাগ। অথবা, দুর্বলের আস্ফালন কিংবা অক্ষমের বদলা নেওয়ার সাধ।

কিশোরীমোহন নিতান্ত নিরীহ ভালোমানুষ। আশাপুরের অনেকেই ওঁকে পছন্দ করে। সেই নিরীহ মানুষটাকে পলান এমন নৃশংসভাবে গুলি করেছে শুনে অনেকেই রাগে একেবারে খেপে উঠল। কেউ-কেউ বলল, ‘চলো, পলানের বাড়ি ঘেরাও করব আমরা!’

জবাবে চার-পাঁচজন ক্ষিপ্ত মানুষ বলে উঠল, ‘ঘেরাও কেন? ওর বাড়ি জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে একেবারে ছারখার করে দাও। ওকে জ্যান্ত জ্বালিয়ে খতম করে দাও!’

একদল বয়স্ক মানুষ নিজেদের মধ্যে উত্তেজিতভাবে আলোচনা করছিল। তারা পুলিশে খবর দেওয়ার কথা বলছিল। তাদের মধ্যে একজন বলছিল, ‘থানায় খবর দিয়ে কোনও লাভ নেই। কারণ, সুরেন দাস পলানের থেকে মান্থলি পায়। ও কেসটা পুরো ঘুরিয়ে দেবে। হয়তো খাতায় লিখবে কিশোরী সামন্ত নিজেই নিজের ডানহাতের পাতায় গুলি করে সুইসাইড করার চেষ্টা করেছেন…।’

রোশনরা সেবাকেন্দ্রের দিকে রওনা হয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর আট-দশজন মানুষ নিজেদের মধ্যে কথা বলতে-বলতে সেদিকে হাঁটা দিল। কিশোরীমোহনের আঘাত কতটা সিরিয়াস সেটা নিয়ে তাদের দুশ্চিন্তা হচ্ছিল।

পুলিশে খবর দেওয়া উচিত কি উচিত নয় সে নিয়ে তর্কবিতর্ক তখনও চলছিল। শেষ পর্যন্ত একজন বয়স্ক ভদ্রলোক থানায় ফোনই করে ফেললেন।

‘হ্যালো, আশাপুর থানা?’

‘হ্যাঁ, বলুন—।’

‘সাব-ইনস্পেকটর সুরেন দাস আছেন?’

ও-প্রান্ত কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পরে শোনা গেল : ‘হ্যাঁ—বলছি।’

তখন বয়স্ক ভদ্রলোক ফোনে নিজের পরিচয় দিয়ে কিশোরীমোহন সামন্তের আহত হওয়ার ঘটনাটা উত্তেজিতভাবে গড়গড় করে বলে গেলেন।

সুরেন দাস ভদ্রলোকের সবকথা ধৈর্য ধরে শুনলেন। তারপর একটা লম্বা হাই তুললেন। বাঁ-হাতের কড়ে আঙুলটা বাঁ-কানের গর্তে ঢুকিয়ে দিলেন। সেটাকে বারকয়েক ক্লকওয়াইজ আর অ্যান্টি-ক্লকওয়াইজ প্যাঁচ দিয়ে কানকে সন্তুষ্ট করলেন। তারপর :

‘শুনুন। আপনি যা বললেন, সব শুনলাম। কিন্তু শোনার বেশি আর কিছু করতে পারব না। কারণ, প্রথম কথা আপনি থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার। আপনার কথায় কিছু করা যাবে না। তার ওপরে ফোনে কমপ্লেন করছেন। যিনি উন্ডেড হয়েছেন তাঁকে নিয়ে থানায় আসুন। সামনাসামনি এফ. আই. আর. নিয়ে নেব। তা ছাড়া আরও একটা কথা বলি : পলান নস্কর কী করে ওখানে গোলমাল করলেন জানি না। তিনি তো আজ ভোরবেলা থানায় রিপোর্ট করে ওনার ব্যাবসার কীসব কাজে কলকাতায় গেছেন।’

যিনি থানায় ফোন করেছিলেন তিনি ফ্যালফ্যাল চোখে আউট অফ ফোকাস দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে রইলেন। ভদ্র মানুষটার ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে একটা বাজে গালাগাল বেরিয়ে এল। তিনি মনে-মনে ভাবলেন, ‘জগন্নাথ মার্কা পুলিশ এ ব্যাপারে কিছুই করবে না। যা করার পাবলিককেই করতে হবে।’

সকাল গড়িয়ে দুপুর হল, দুপুর গড়িয়ে বিকেল। কিন্তু পাবলিকের জটলা, আলোচনা ইত্যাদি চলতেই লাগল। আগে যারা পলান নস্করের বিরুদ্ধে মুখ খুলত না, তারা এবার মুখ খুলতে লাগল। কে পলানকে কতবার কত টাকা করে দিয়েছে সেসব খোলাখুলি বলতে লাগল।

একদল পলানের খোঁজে ওর বাড়ির দিকে রওনা দিল। আর একদল লোক রওনা দিল আশাপুর সেবাকেন্দ্রের দিকে।

সুধীর ডাক্তারবাবু, রতনমণি মাঝি, অবনী মাস্টারমশাই খুব তাড়াতাড়ি খবরটা পেয়ে গেলেন। ওঁরা আরও অনেক মানুষকে জড়ো করে প্রথমে গেলেন সেবাকেন্দ্রে, তারপর সেখান থেকে থানায়।

সেখানে সাব-ইনস্পেকটর সুরেন দাসের সঙ্গে ওঁদের কথাকাটাকাটি শুরু হয়ে গেল। দাসবাবুর সেই এক কথা : পলান নস্কর সকালবেলা থানায় রিপোর্ট করে কলকাতায় গেছেন; উনি গোলমালের স্পটে ছিলেন না; ওঁর নাম করে কেউ গুজব ছড়াচ্ছে।

পলানের নামে আগেকার কতকগুলো খুচরো কেস আছে। সেগুলোর সবক’টাতেই ও জামিন পেয়ে গেছে। তবে থানা থেকে ওকে বলা হয়েছিল, রোজ থানায় হাজিরা দিতে। সেটা ও নিয়মিতভাবে মেনে চলে—একদিনও হাজিরায় বাদ দেয় না। সেইজন্যই আজ সকালে থানায় হাজিরা দিয়ে ও কলকাতায় গেছে।

সুধীরডাক্তারবাবুদের চাপে শেষ পর্যন্ত সুরেন দাস ডায়েরি নিল। তবে ডায়েরির পাতায় লিখল, ‘অজ্ঞাত কোনও আততায়ী কিশোরীমোহন সামন্তকে হাতে গুলি করেছে।

সুধীরডাক্তার বললেন, ‘জানতাম এরকম হবে। পলানের এগেইনস্টে আমাদের লোকাল থানা কোনও এফ. আই. আর. নেবে না। আমাদের বোধহয় ওপরের লেভেলে যেতে হবে।’

অবনীমাস্টার উত্তেজিতভাবে বললেন, ‘ব্যাপারটার একটা হেস্তনেস্ত হওয়া দরকার। আশাপুর আর কতদিন পলানের কাছে পড়ে-পড়ে মার খাবে?’

রতনমণি ওঁদের সঙ্গী মানুষগুলোর দিকে একবার তাকালেন। দু-চারজন চেনামুখ থাকলেও বেশিরভাগই অচেনা। তা সত্ত্বেও ওরা সবাই রতনমণিদের সঙ্গে পা মিলিয়ে চলেছে। একজোট হয়েছে।

রতনমণি মনে-মনে ভাবলেন, ‘আমরা সংখ্যায় অনেক। পলান আর ওর দলবল সংখ্যায় কতজন হবে? বড়জোর পনেরো কি কুড়িজন। অথচ আমরা এতদিন ধরে পলানের গুন্ডারাজ দিব্যি মাথা নীচু করে মেনে নিয়েছি! আশ্চর্য! আবার আমরাই চারদিন পর স্বাধীনতা দিবসের ফাংশান করতে চলেছি! ছিঃ!’

ধিক্কার আর লজ্জায় মাথা নোয়ালেন রতনমণি।

হা ভগবান! এই মেকি স্বাধীনতার গ্লানি মাথায় নিয়ে আর কতদিন পথ চলতে হবে?

আর কতদিন?

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *