গেস্টহাউসের ঘরের মেঝেতে বাবু হয়ে বসে ছিল রোশন। ওর সামনে কাঠের স্ট্যান্ডে ল্যামিনেট করে সাঁটা একটা রঙিন ফটো। ফটোটা সময়ের ছাপে কিছুটা মলিন। ফটোর সামনে মেঝেতে রাখা পিতলের ছোট্ট ধূপদানি। ধূপদানিতে একটা ধূপকাঠি বসানো। তার ডগাটা লাল—জ্বলছে। ধূপকাঠির আলসে ধোঁয়া খুব ধীরে ভেসে যাচ্ছে ওপরে। রোশনের নাকে সুগন্ধের ছোঁয়া।
রোশন একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল ফটোটার দিকে। ফটোতে ওর মা আর বাবা। ওদের দুজনের মাঝে ছোট্ট ফুটফুটে কুশান। কুশানের বয়েস তখন ছ’-সাত বছর।
রোশনের বাবার একটা ক্যামেরা ছিল। সুযোগ পেলেই বালক রোশন সেটা নিয়ে খুটুরখাটুর করত। নিজের পছন্দসই ফটো তুলত। ফটো যে তেমন একটা ভালো উঠত তা নয়, তবে উঠত। রোশনের ফেভারিট সাবজেক্ট ছিল ভোরবেলার সূর্য, শেষ বিকেলের সূর্য, কাক, পায়রা, মা, বাবা আর কুশান। বাবার ক্যামেরায় ছোটভাইয়ের অনেকরকমের ফটো তুলেছে ও। তবে মা, বাবার সঙ্গে কুশানকে নিয়ে এই একটা ছবিই ও তুলেছিল। রোশনের বয়েস তখন বারো-তেরো হলেও ফটোটা খারাপ ওঠেনি।
এই ফটোটা ওর বাবা কাঠের ফ্রেমে সেট করে ল্যামিনেট করে নিয়ে এসেছিলেন। ফটোটা দেখে রোশনের খুব ভালো লেগেছিল, আবার দুঃখও হয়েছিল। ওর বারবার মনে হত এই ছবিতে ও নেই কেন। সেটাই ছিল ওর দুঃখ। ও বাবাকে প্রায়ই বলত, ‘ফটোয় আমি নেই কেন? চলো, আমরা চারজন মিলে একটা ফটো তুলি। চলো না, বাবা!’
সেই ফটো আর তোলা হয়নি। তার আগেই ফটোর ওই তিনটে মানুষ সত্যি-সত্যিই ফটো হয়ে গেল।
রোশনের বাবা বড় ছেলের বায়না শুনে বলতেন, ‘শোন, আমার এই ক্যামেরাটা নেহাতই সস্তা দামের মডেল। এটাতে অটোমেটিক সিস্টেম নেই। আমরা চারজন একসঙ্গে ছবি তুলতে চাইলে এ-ক্যামেরায় পারা যাবে না—স্টুডিয়োয় যেতে হবে…।’
‘আজ যাব, কাল যাব’ করে সেটা আর যাওয়া হয়নি। রোশন চিরকাল ওদের ফ্যামিলি গ্রুপ ফটোর বাইরেই রয়ে গেল। বাবা, মা আর কুশান একে-একে ফটোর দেশে চলে গেল। রোশনকে একা ফেলে গেল ফটোর বাইরে। একেবারে একা।
রোশনের ভেতরে একটা দুঃখের ঢেউ উথলে উঠল। ও চোখ বুজে ফেলল। ওর বাঁ-চোখের কোণ থেকে এক ফোঁটা জল গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল।
চোখ মুছল ও। তারপর একটু সময় নিয়ে সামলে নিল নিজেকে।
না, ওরা সব আছে। রোশনকে ওরা ছেড়ে যায়নি মোটেই। মা, বাবা, কুশান—ওরা মনে-মনে রোশনের সঙ্গে কথা বলে। রোশনকে ওরা ভালোবাসার ছোঁয়া দিয়ে ঘিরে রেখেছে।
রোশন ধীরে-ধীরে চোখ খুলল। ওই তো ওরা! রোশনের দিকে তাকিয়ে আছে।
‘বাবু, কী হয়েছে তোর? কাঁদছিস কেন?’ মা জিগ্যেস করল।
‘খোকা, চোখে জল কেন তোমার?’ বাবা ওকে ‘খোকা’ বলে ডাকতেন।
‘অ্যাই, দাদা! শিগগির চোখের জল মোছ! নইলে সব্বাইকে বলে দেব, এত বড় ছেলে, ভেউভেউ করে কাঁদছে!’ এরকম কথা কুশান ছাড়া আর কে বলতে পারে!
রোশন চোখ মুছল আবার। ফটোটার দিকে তাকিয়ে একবার নমস্কার করল। বিড়বিড় করে কী বলল। তারপর ফটোটা তুলে নিয়ে ওর ব্যাকপ্যাকে ঢুকিয়ে রাখল।
এবার ধূপদানিটা তুলে নিল রোশন। ধূপকাঠিটা মাপে অনেক ছোট হয়ে এসেছে, কিন্তু এখনও জ্বলছে। ধূপদানি হাতে নিয়ে ঘরের বাইরে এল। দেওয়ালে ঘষে কাঠিটা নিভিয়ে দিল। তারপর ওটা কপালে ঠেকিয়ে সরু বারান্দায় রাখা প্লাস্টিকের লিটার বিনে ফেলে দিল। ধূপদানিটা ভালো করে ঝেড়ে নিল।
তখনই ও যেন টের পেল, খিদে পেয়েছে।
ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে ছিটকিনি আটকে দিল। যেমন দরজার ফাটল ধরা কাঠ, তেমনই জং ধরা লোহার ছিটকিনি। দুটোরই বেশ বয়েস হয়েছে।
ঘরের একপাশে মেঝেতে রাখা রোশনের ব্যাকপ্যাক। রোশন ব্যাকপ্যাকের কাছে এল। ওটার একটা সাইড চেন খুলে ধূপদানিটা সেই ফাঁক দিয়ে ঢুকিয়ে দিল। তারপর চেন টেনে দিল।
এই ব্যাকপ্যাকটাই ওর সংসার। এর ভেতরেই থাকে ওর জামা-প্যান্ট, টি-শার্ট, টাকা-পয়সা, ব্যাঙ্কের এটিএম কার্ড, ভোটার কার্ড, দুটো প্লাস্টিক প্যাকেটে মোড়া হাওয়াই চপ্পল, আর স্নিকার—তার সঙ্গে টুকিটাকি আরও অনেক কিছু। এই সংসারটাই ও পিঠে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। যেদিকে মন চায় সেদিকে চলে যায়। যেমন, এখন ও চলে এসেছে আশাপুরে। যে-ক’টা দিন ভালো লাগে এখানে থাকবে। সেরকমটাই প্রথমে ও ভেবেছিল। কিন্তু এখন ভালো লাগার সঙ্গে-সঙ্গে সম্পর্কের টান জড়িয়ে যাচ্ছে। নইলে বিশ্বরূপ জোয়ারদার ওর কে হয়? কে হয় গনিরাম আর ববিন? কে-ইবা নিতুদা!
শর্টস আর গেঞ্জি ছেড়ে জিনসের প্যান্ট আর টি-শার্ট পরে নিল। তারপর খাটে বসে স্নিকার বেঁধে নিল পায়ে। ব্যাগ হাতড়ে গোটা পঞ্চাশ টাকা বের করে পকেটে গুঁজে নিল। তারপর বেরিয়ে এল ঘরের বাইরে। দরজায় তালা দিয়ে চাবিটা পকেটে ভরে নিল। এই তালা-চাবির সেটটা বিশ্বরূপদার। প্রত্যেক বোর্ডারের ঘরের জন্যই তিনি এইরকম তালা-চাবির ব্যবস্থা রেখেছেন।
একতলায় নেমে এল রোশন। রিসেপশনের জায়গাটা এখন সাফ করে পরিষ্কার। বোঝা গেল, ছোটকু এসে হাত-টাত লাগিয়েছে।
বিশ্বরূপ জোয়ারদার ওঁর চেয়ারে বসে খবরের কাগজ পড়ছেন—ওই পুরোনোটাই। রোশনের পায়ের আওয়াজ পেয়ে কাগজ থেকে চোখ ফিরিয়ে তাকালেন।
রোশন বলল, ‘একটু বেরোচ্ছি। খিদে পাচ্ছে…।’
‘সাবধানে যাও। চোখ-কান খোলা রেখো।’
উত্তরে রোশন একচিলতে হাসল শুধু।
রাস্তায় বেরিয়ে রোশন রোদে মাখামাখি হয়ে গেল। আহা রোদ! সব জায়গায় সমান। রাস্তা দিয়ে কত মানুষ যাতায়াত করছে। ওরা যদি সবাই সমান হত! এই রোদের মতন!
রাস্তাটা নামেই পাকা রাস্তা। সর্বত্র খানাখন্দে ভরা। তারই ওপর দিয়ে সাইকেল রিকশা, অটো, প্রাইভেট কার এপাশ-ওপাশ টাল খেয়ে ছুটে চলেছে। তার সঙ্গে রয়েছে সাইকেল, আর কখনও-কখনও প্রাইভেট কার।
গাড়ির চাকায় ধুলো উড়ছে। রোশন নাকের ওপরে হাত চাপা দিল। তাতে দুটো কাজ হল : ধুলোর হাত থেকে বাঁচা গেল, আর রাস্তার পাশ ঘেঁষে চলা কাঁচা ড্রেনের দুর্গন্ধও অনেকটা কমে গেল।
রোশন রাস্তায় পথচলা মানুষদের খুঁটিয়ে দেখছিল। ছোট-ছোট পড়ুয়ারা বাক্স-ভ্যানরিকশা চড়ে স্কুলের দিকে চলেছে। কোনও-কোনও মানুষ ব্যস্তভাবে হেঁটে চলেছে—হয়তো অফিসের তাড়া, কিংবা জরুরি কোনও কাজের তাড়া। একটা সাইকেল ভ্যান কলার কাঁদি বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কেউ রঙিন চাদরের মোট বয়ে নিয়ে চলেছে। কেউ বা বন্ধুর সঙ্গে জোর গলায় তর্ক করতে-করতে এগিয়ে যাচ্ছে।
কাকের ডাক শুনে ওপরদিকে তাকাল রোশন। ওভারহেড তারে তিন-চারটে কাক বসে আছে। উলটোদিকের তেলেভাজার দোকানের দিকে জুলজুল করে তাকিয়ে জোর গলায় ডেকে চলেছে।
রোশনের কী খেয়াল হল, ও হাঁটতে-হাঁটতে অনেকটা দূরে চলে গেল। আশাপুরের চারপাশটা একমনে দেখতে লাগল। মানুষ আর প্রকৃতি থেকে ওর পছন্দের বিষয়গুলো বেছে নিয়ে ব্লটিং পেপারের মতো শুষে নিতে লাগল। খিদের অনুভূতিটা তখন কোথায় যেন তলিয়ে গেল।
এইভাবে অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরির পর একসময় পায়ে-পায়ে ‘মোহন সুইটস’-এ পৌঁছে গেল। কাচের বাক্সের ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা দোকানদার রোশনকে দেখে মুখ-চেনা হাসি হাসল। ছেলেটা ক’দিন ধরে তার দোকানে খেতে আসছে।
‘আজ কী দেব?’
‘লুচি-তরকারিই দিন—।’ রোশন বলল।
কাগজের ছোট থালায় চারটে গরম-গরম লুচি আর আলু-কুমড়োর তরকারি এগিয়ে দিল দোকানদার। একহাতে থালাটা নিয়ে পকেট থেকে কুড়ি টাকা বের করে তাকে দিল রোশন। তারপর দোকানের শো-কেসের একপাশে দাঁড়িয়ে রাস্তার চলমান জীবনের দিকে তাকিয়ে লুচি-তরকারি খেতে শুরু করল।
বাঃ, দারুণ! লুচিগুলো হাতে গরম। আর তরকারিটাও কালো জিরে দেওয়া, ঝাল-ঝাল। ব্যাপক টেস্ট।
দুটো লুচি শেষ করে রোশন যখন তিন নম্বর লুচির অপারেশন স্টার্ট করেছে, তখনই ঠিক ম্যাজিকের মতো কাটা নগেন ওর সামনে আবির্ভূত হল। সাদা ফুলশার্ট, সাদা প্যান্ট—তবে সাদা রং ময়লা হয়ে অফ হোয়াইট হয়ে গেছে।
কাটা নগেনের চোখে মজার হাসি চকচক করছে।
রোশন কিছু বুঝে ওঠার আগেই রোগা টিংটিঙে বেঁটে ছেলেটা ওর গালে এক থাপ্পড় কষাল। এবং দ্বিতীয় থাপ্পড়টা বসাল ওর লুচি-তরকারির থালায়।
থালাটা ছিটকে পড়ল রাস্তায়। পলকে দুটো কাক উড়ে এসে জুড়ে বসল সেখানে। লুচি-তরকারিতে ঠোকর বসাল।
হতচকিত রোশন কাটা নগেনের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। কী বলবে, কী করবে ভেবে পেল না।
কাটা নগেন টেনে-টেনে বলল, ‘কাম, হিরো—পলানদা কলিং ইউ…।’
গালে হাত চলে গিয়েছিল রোশনের। না, ব্যথার জন্য নয়—নেহাতই একটা প্রতিবর্তী ক্রিয়ায়।
‘কাম, কাম। পলানদা কলিং…।’
রোশন লক্ষ করল, রাস্তার ওপারে দুটো ছেলে সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওর দিকে দেখছে।
আজ ভোরবেলা এই দুটো ছেলেই তোলাবাজি নিয়ে বিশ্বরূপ জোয়ারদারের ‘আশাপুর লজ’-এ হুজ্জুতি করেছিল। একজন দাঁত উঁচু, কালো হাফশার্ট, জিনসের প্যান্ট। আর-একজন স্টিলের মাকড়ি, নীল টি-শার্ট, বাদামি প্যান্ট।
‘কোথায় পলানদা?’ হাতে হাত ঘষল রোশন। পকেট থেকে রুমাল বের করে হাত মুছল, মুখ মুছল।
‘গেস্টহাউসের নিয়ার।’ বলল কাটা নগেন। তারপর জোরকদমে হাঁটা দিল ‘আশাপুর লজ’-এর দিকে।
রোশনকে থাপ্পড় মারার ব্যাপারটা বেশ কয়েকজনের নজরে পড়েছিল, ‘মোহন সুইটস’-এর দোকানদার, দোকানের দুজন খদ্দের, আর রাস্তার চার-পাঁচজন লোক। কিন্তু ওই দেখা পর্যন্তই! কারও মুখ থেকে কোনও আওয়াজ বেরোয়নি—প্রতিবাদ তো দূরের কথা!
রোশন মাথা নীচু করে হাঁটতে শুরু করল। কাটা নগেন তখন অনেকটা এগিয়ে গেছে। লক্ষ করল, সাইকেল নিয়ে অপেক্ষা করা দুটো ছেলে ওর পিছন-পিছন আসছে।
পাঁচ-সাত মিনিটের মধ্যেই ‘আশাপুর লজ’-এর সামনে চলে এল। দেখল সেখানে লজের সদর দরজার কাছে চার-পাঁচটা ছেলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওদের চেহারা নানারকম হলেও একটা মিল রয়েছে : ওরা সবাই রোশনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
.
ওদের হাতে শক্ত মুঠোয় ধরা বাঁশের খেটো, হকি স্টিক, লোহার রড, এ ছাড়া একজনের ডানহাতের চার আঙুলে ফিট করা রয়েছে স্টিলের পাঞ্চ।
কিন্তু পলান কোথায়? কাটা নগেন যে বলল, পলানদা ওকে ডাকছে!
এদিক-ওদিক নজর চালাল রোশন। ওই তো কাটা নগেন! এবং পলান।
‘আশাপুর লজ’-এর উলটোদিকে পাশাপাশি দুটো লেদ কারখানা। তার সামনে বাঁশের খুঁটিতে বাঁধা প্লাস্টিকের ছাউনি। সেই ছাউনির নীচে ছায়াতে দাঁড়িয়ে পলান এবং পলানের মোটরবাইক। তার পাশে কাটা নগেন।
রোশন আঁচ করতে পারল কী হতে চলেছে। ও পলানের দিকে এগিয়ে গেল।
পলান হাসছে। ওর একটা হাত কোমরে, আর-একটা হাত মোটরবাইকের হ্যান্ডেলের ওপরে। ডানকানে মাকড়ি, ডানহাতে বালা, হাতের আঙুলে তিনটে আংটি : পলানের ট্রেড মার্ক।
পলানের বাইকের পাশে দাঁড়িয়ে নগেনও হাসছিল। ওর হাসির ধরনটা যেন বলছিল, ‘দ্যাখো, এবার কী হয়।’
রোশন পলানের কাছে গিয়ে দাঁড়াল : ‘পলানদা, আমাকে ডেকেছেন?’
‘গুড মর্নিং, হিরো—।’ পলান বলল।
‘গুড মর্নিং—।’ পালটা উইশ করল রোশন।
ও বুঝতে চেষ্টা করছিল, প্রথম আঘাতটা কীভাবে কোনদিক থেকে আসবে।
‘যা, ওপারে লজের দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়া…।’ পলান ভারী গলায় অর্ডার দিল।
রোশন এদিক-ওদিক দেখে রাস্তা পার হল। মনকে কী এক প্রতিজ্ঞায় শক্ত করে ধীরে-ধীরে পা ফেলে গেস্টহাউসের দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। দরজাটা বন্ধ, তবে দোতলার জানলাগুলো খোলা। ওগুলো বোর্ডারদের ঘরের জানলা। তার মধ্যে ডানদিকের ঘরটা রোশনের।
রোশন গেস্টহাউসের দরজার কাছে এসে দাঁড়াতেই শত্রুরা ওকে ঘিরে নিল। ওকে কেন্দ্র করে আট-ন’ ফুট ব্যাসের একটা বৃত্ত তৈরি হল।
ওপারে চোখ গেল রোশনের। পলান খইনি ডলছে। আর কাটা নগেন একটা সিগারেট ধরিয়েছে। ওরা দুজন এখন সিনেমা দেখার জন্য রেডি। ওদের খুব কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে সকালের দুই হানাদার। চোখে মজা নিয়ে তাকিয়ে আছে ‘সিনেমার পরদা’র দিকে। ওদের সাইকেল দুটো স্ট্যান্ডে দাঁড় করানো।
সিনেমা শুরু হল।
খেটো হাতে একজন শত্রু প্রথম এক পা বাড়াল রোশনের দিকে। সঙ্গে-সঙ্গে সেই জায়গা বরাবর ব্যাসার্ধটা ছোট হয়ে গেল।
ছেলেটা খেটো চালাল রোশনের বুক লক্ষ্য করে। সেই আঘাতটা রোখার জন্য রোশন সামনে দু-হাত বাড়াল। কিন্তু ছেলেটা এসব ব্যাপারে অভিজ্ঞ এবং পেশাদার। কারণ, মাঝপথেই ও অস্ত্রটাকে থামাল এবং রোশনকে অবাক করে দিয়ে দিক পালটে খেটোটা শেষ পর্যন্ত চালাল ওর কোমর লক্ষ্য করে।
এই আকস্মিক আঘাতটা রোশন আটকাতে পারল না। ওর পেটের পেশি, কোমরের হাড় যেন হাই ভোল্টেজ শক খেল। যন্ত্রণার কেন্দ্রবিন্দু তৈরি হয়ে গেল সেখানে। আর সেই কেন্দ্র থেকে যন্ত্রণার অনুভব তরঙ্গ ওর শরীরের নানান জায়গায় ছড়িয়ে পড়তে লাগল।
রোশন দাঁতে দাঁত চেপে এই যন্ত্রণার মোকাবিলা করতে চেষ্টা করছিল। আর ঠিক তখনই একটা হকি স্টিক পিছন থেকে এসে আছড়ে পড়ল ওর শিরদাঁড়ার ওপরে।
আক্রমণের এই ‘সিনেমা’-টা চলছিল রাস্তার একপাশে, লজের দরজার কাছে। ব্যস্ত রাস্তার মানুষজনের কেউ-কেউ নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে ‘সিনেমা’ দেখা শুরু করলেও রাস্তায় কোনও অবরোধ তৈরি হয়নি। বরং বলা যায়, সামান্য যানজট তৈরি হয়েছিল।
পথচারী দর্শক ক্রমশ সংখ্যায় বাড়ছিল। তাই রাস্তার ওপার থেকে পলানরা ‘সিনেমা’-টা আর দেখতে পাচ্ছিল না। ওরা চটপট রাস্তা পেরিয়ে গেস্টহাউসের কাছে চলে এল। পলানকে দেখে লোকজন তাড়াতাড়ি পিছনে সরে গিয়ে পথ করে দিল। পলানের ঠোঁটের একটা কোণ উঁচু হয়ে রয়েছে। বোঝাই যায়, ওর হাতে ডলা খইনিটা ওখানে গিয়ে সেটল করেছে।
রোশনকে মারার কাজটা তখনও চলছে। অপারেশনের আগে পলান শাগরেদদের বলে দিয়েছিল, ‘শুয়োরের বাচ্চাটাকে বেধড়ক মার মারবি, তার খেয়াল রাখবি মালকড়িতে যেন চোট না পায়। আর হ্যাঁ, মাথায় মারবি না। তবে সারা বডিতে রামপালিশ দিবি—।’
আক্রমণকারীরা সর্দারের অর্ডার অক্ষরে-অক্ষরে পালন করছিল। সর্দারের বিধিনিষেধ মেনে রোশনকে আগাপাশতলা পালিশ দিচ্ছিল।
হকি স্টিক এসে পড়ল ঊরুতে। খেটো এসে পড়ল পায়ের গোছে। লোহার রড এসে পড়ল পাছায়।
রোশন তখনও সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেও ওর মাথা টলছিল। মনে হচ্ছিল, এই বুঝি ও অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে পড়বে রাস্তায়। কিন্তু তবুও ও দাঁতে দাঁত চেপে মার খেয়ে যাচ্ছিল। না, ও প্রতিজ্ঞা ভাঙবে না। প্রতি-আক্রমণ কখনওই এই সমস্যার সমাধান করতে পারবে না। অন্তত এখনও ওর তাই বিশ্বাস।
পাবলিক চুপচাপ দাঁড়িয়ে বিনিপয়সার এই সিনেমা উপভোগ করছিল। কারও মুখে কোনও প্রতিবাদ নেই।
বিশ্বরূপ জোয়ারদার বাড়ির ভেতর থেকেই ব্যাপারটা বুঝতে পারছিলেন, কিন্তু একবারের জন্যও দরজা খোলেননি। ওঁর ভীষণ খারাপ লাগছিল। বোকা ছেলেটা ওঁকে বাঁচাতে গিয়েই এই বিপদের মুখে পড়ল!
বোর্ডারদের ঘরের একটা জানলা দিয়ে বিশ্বরূপ ঘটনাটা দেখছিলেন। অন্যান্য ঘরের জানলাতেও কয়েকজন বোর্ডার দর্শকের ভূমিকা নিয়েছিলেন। কিন্তু ওভারহেড ইলেকট্রিকের তারে পাশাপাশি বসে থাকা অনেকগুলো কাক তারস্বরে চিৎকার করছিল। হয়তো ওদের মতন করে প্রতিবাদ করছিল।
এমনসময় একটা পুলিশের জিপ কোথা থেকে এসে ভিড়ের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়ল।
***
পুলিশের জিপ দেখে পাবলিক তাড়াহুড়ো করে বেশ খানিকটা দূরে সরে গেল। তাদের অনেকেরই নজর রোশনের দিক থেকে সরে গিয়ে পড়ল পুলিশের জিপের দিকে। কিন্তু সেটা মাত্র কয়েক সেকেন্ডের জন্য। তারপর তারা আবার ‘সিনেমা’-র দিকে নজর ফেরাল।
জিপের স্টিয়ারিং-এ খাকি পোশাক পরা মোটাসোটা একজন কনস্টেবল। মাথায় মিহি লোমের মতো চুল—হয়তো বিশ-পঁচিশ দিন আগে নেড়া হয়েছিল। তবে তার কেশরাশির ঘাটতি পুষিয়ে দিয়েছে তার গোঁফরাশি—যাকে মোচ বললেও যথেষ্ট কম বলা হয়।
জিপের প্যাসেঞ্জার সিটে যিনি বসে আছেন তাঁর হ্যাট এবং খাকি ইউনিফর্ম বলে দিচ্ছে তিনি একজন সাব-ইনস্পেকটর। রোগা, কালো, চোয়াড়ে, পোড়খাওয়া চেহারা। গলায় কালো কারে ঝোলানো একটা ছোট্ট রুপোর লকেট।
সাব-ইনস্পেকটরসাহেব জিপ থেকে নেমে পড়লেন। জিপের সামনে দিয়ে ঘুরে পলানের কাছাকাছি এসে দাঁড়ালেন।
‘কী, পলানদা, খবর-টবর কী? সব কুশল-মঙ্গল তো?’
সাব-ইনস্পেকটরসাহেবের বয়েস পলানের চেয়ে অন্তত দশ কি বারো বছর বেশি হবে। তাঁর দু-রগের কাছে চুলে পাক ধরেছে। তবুও তিনি পলানকে ‘পলানদা’ বলে ডেকেছেন এবং তাঁর চোখ-মুখে একটা গদগদ আহ্লাদী ভাব ফুটে উঠেছে।
পলান হাসল, বলল ‘হ্যাঁ সুরেনদা, সব কুশল-মঙ্গল। আপনার সব ফিট তো?’
‘একদম ফিট—’ বলে একগাল হাসলেন সাব-ইনস্পেকটর সুরেন্দ্রনারায়ণ দাস—পলানদের দলের কাছে ‘সুরেনদা’। হাসির সঙ্গে-সঙ্গে ওঁর দু-গালে কয়েকটা ভাঁজ পড়ল। একটা চোখ ছোট করে ধূর্তামির ইঙ্গিত দিলেন।
রোশনের মারধোরের ব্যাপারটা তখনও চলছিল। ভিড় করে থাকা লোকজনের মনোযোগ সেদিকেই। কারণ, তারা জানে, পলানদের কাছে ‘পুলিশের গাড়ি’-র গুরুত্ব অন্য আর-পাঁচটা গাড়ির মতোই—এমনকী সেই গাড়িটা ঠেলাগাড়ি কিংবা সাইকেল ভ্যানও হতে পারে।
রোশনের দিকে ইশারা করে সুরেন জিগ্যেস করলেন, ‘কেসটা কী?’
পলান কান চুলকে শব্দ করে থুতু ফেলল মাটিতে। তারপর বলল, ‘সালা পকেটমার! আর লোক পায়নি আমারই মানিব্যাগটা হিপ পকেট থেকে তুলে নিয়েছিল—ওই ”মোহন সুইটস”-এর সামনে। আস্পর্ধাটা একবার ভেবে দেখুন! দু-চারদিন হল এরিয়াতে এসেছে তার মধ্যেই এতটা বাড় বেড়ে গেছে। আমি পিকপকেট হয়েছে টের পেয়েই খপ করে জানোয়ারটাকে লপকে নিয়েছি…।’
কাটা নগেন পাশে দাঁড়িয়ে সুরেন আর পলানের কথা শুনছিল। পলানের কথা শেষ হতে না হতেই তার খেই ধরে নিয়ে বলল, ‘সেইজন্যেই স্যার আমরা মালটাকে একটু এডুকেশন দিচ্ছি—হালকা এডুকেশন…।’
কথাটা শুনে সুরেন্দ্রনারায়ণ একটু হাসলেন। ভিড়ের মাথা ডিঙিয়ে রোশনের দিকে একবার দেখলেন। তারপর পলানকে বললেন, ‘আপনি বলেন তো তুলে নিয়ে গিয়ে ভেতরে করে দিই…।’
‘না, না—তার আর দরকার নেই। আমিও কেসটা সালটে দিচ্ছি। আপনি তো জানেন, বিনা কারণে আমি আপনাদের কোনও ট্রাবল দিই না। যে ঝামেলাগুলো আমি নিজেই সালটাতে পারি সেগুলোর জন্যে আপনাদের কখনও ডিসটার্ব করি না। আমি চাই, আশাপুরে শান্তি থাকুক…।’
‘হ্যাঁ, সে তো জানি—’ হাসলেন সুরেন। তারপর একটু ইতস্তত করে বললেন, ‘পলানদা, একটা কথা ছিল…।’
‘বলুন না—।’
সুরেন কাটা নগেনের দিকে একবার তাকালেন।
পলান ইশারাটা বুঝতে পেরে বলল, ‘ও নিয়ে চিন্তা করবেন না। ওদের কানের সঙ্গে মুখের কোনও কানেকশন নেই। ওরা কান দিয়ে যা শোনে সেটা কখনও ওদের মুখ দিয়ে বেরোয় না…।’ নগেনকে দেখিয়ে পলান যোগ করল : ‘আপনি তো ওকে চেনেন…ওর নাম নগেন…।’
সুরেন হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ, চিনি। কাটা নগেন—।’
‘কাটা’ বিশেষণটা শুনে নগেনের কপালে বিরক্তির ভাঁজ পড়ল।
সুরেন্দ্রনারায়ণ পলানের প্রায় কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বললেন, ‘পলানদা, আমার মান্থলি পেট্রল খরচাটা নিয়ে একটু ভাবুন-টাবুন। চারপাশে জিনিসপত্রের দাম যা বেড়েছে সামথিং ইনক্রিমেন্ট না হলে আর চলছে না…।’
কথাটা শুনে পলান চোখ ছোট করল। কিছুক্ষণ বোধহয় নিজের মনেই কী ভাবল। তারপর বলল, ‘হয়ে যাবে। খুব কিছু বেশি করতে পারব না—তবে সামথিং কিছু করে দেব। আপনাকে প্রমিস করলাম, সুরেনদা—।’
‘ব্যস, ব্যস—এর বেশি আর কিছু চাই না। থ্যাংক ইউ, পলানদা।’
সুরেন দাস চটপটে পায়ে জিপে উঠে পড়লেন। জিপ স্টার্ট দিতে না দিতেই পলান প্রায় ছুটে গিয়ে হাজির হল জিপের কাছে, ড্রাইভারের পাশে। পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে দুটো একশো টাকার নোট বের করল। নোট দুটো ড্রাইভারের হাতে গুঁজে দিয়ে বলল, ‘পান্ডেজি, জরা মওজ-মস্তি করনা…।’
কনস্টেবলটি মেগা সাইজের দাঁতের সারি বের করে হাসল, পলানকে একটা আধা-সেলাম ঠুকল। তারপর মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে জিপের চাবি ঘুরিয়ে স্টার্ট দিল।
জিপটা চলে যেতেই একটা গুঞ্জন কানে এল পলানের। সেইসঙ্গে কান্নার শব্দ।
পলান ভিড় ঠেলে ভেতরে ঢুকে এল। ব্যাপারটা কী? কে অমন ইনিয়ে-বিনিয়ে কাঁদছে?
মারপিটের বৃত্তের পরিধিতে এসে থমকে দাঁড়াল পলান। পিছনে কাটা নগেন। ও তখন থেকে পলানের সঙ্গে-সঙ্গে ছায়ার মতো সেঁটে আছে।
রোশন রাস্তার ওপরে নেতিয়ে পড়ে আছে। চোখ আধখোলা, হাঁপাচ্ছে। কপালের ডানপাশে রক্ত লেগে আছে। ঠোঁটের ডানকোণ থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। গায়ের পোশাক ধুলোমাখা। ওর শরীরে রোদ এসে পড়েছে।
রোশনকে যারা মারধোর করছিল তারা যার-যার অস্ত্র হাতে নিয়ে ছবির মতন দাঁড়িয়ে আছে। চোখমুখে হতভম্ভ ভাব—বুঝতে পারছে না এখন কী করবে।
পলানকে সামনে দেখতে পেয়ে ওরা পলানের দিকে তাকাল। ওদের চোখে প্রশ্ন : ‘এখন কী করব?’
সুরেন দাসের সঙ্গে কথাবার্তায় ব্যস্ত ছিল বলে এই চাপা কান্নার শব্দ পলানের কানে যায়নি। এখন সেই শব্দটাই ওর কানে ঢুকছিল, আর দৃশ্যটাও দেখতে পাচ্ছিল সরাসরি।
রোশনের কাহিল শরীরের পাশে রাস্তায় লেপটে বসে আছে একজন ভদ্রমহিলা। কালো-কোলো ছোটখাটো চেহারা। গায়ের শাড়িটা অতি ব্যবহারে ময়লা। কোথাও-কোথাও ছিঁড়েও গেছে। মাথার চুলের অনেকটাই পাকা।
ভদ্রমহিলার পাশে রাখা একটা ছোট পুঁটলি। পুঁটলিটা নানান রঙের কাপড়ের টুকরো জুড়ে তৈরি।
এই পুঁটলিটাকে আশাপুরের সবাই চেনে। চেনে পুঁটলির মালিককেও। তাকে সবাই ‘বুড়িমাসি’ বলে ডাকে। মাসি জগন্ময়ী কালীমন্দিরের চাতালের এক কোণে থাকে। সকালে-বিকেলে চৌরাস্তার মোড়ের বিবেকানন্দের মূর্তির কাছে বসে ভিক্ষে করে। মাথায় ভালোরকম গোলমাল আছে।
পলান বুড়িমাসির মুখটা দেখতে পাচ্ছিল না, কিন্তু পুঁটলিটা দেখেই তাকে চিনে নিতে পারল।
বুড়িমাসি তখন রোশনের গায়ে-মাথায় হাত বোলাচ্ছে আর আপনমনে কথা বলছে, ইনিয়েবিনিয়ে কাঁদছে।
‘আমার খোকাকে মারছ কেন তোমরা? কেন মারছ? ও খুব ভালো খোকা। রোজ বিকেলে আমারে চা-বিস্কুট খাওয়ায়। ভালো খোকাকে মেরো না গো, মেরো না। ও মরে গেলে কে আমারে রোজ চা-বিস্কুট খাওয়াবে?’
রোশনের গায়ে হাত বোলাতে-বোলাতে ওকে ডাকছিল বুড়িমাসি : ‘ওঠ, ভালো খোকা, ওঠ। উঠে পড়, বাবা—।’
রোশন এপাশ-ওপাশ একটু নড়ল। সারা শরীরে ব্যথা, কিন্তু যন্ত্রণার একটুকরো চিৎকারও ওর মুখ দিয়ে বেরোয়নি। দাঁতে দাঁত চেপে ও নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল। বুড়িমাসির কথাগুলো যেন বহুদূর থেকে ওর কানে ভেসে আসছিল। ওর মনে হচ্ছিল, মা ওর গায়ে-মাথায় হাত বোলাচ্ছে, ডাকছে, ‘বাবু, ওঠ-ওঠ! আর ঘুমোসনি। বেলা হয়ে গেছে—।’
রোশন চোখ খুলল, কিন্তু সঙ্গে-সঙ্গে চোখ কুঁচকে বন্ধ করে ফেলল। সূর্য সরাসরি ওর চোখে এসে পড়েছে।
মুখ ফিরিয়ে আবার চোখ খুলল। এবার চোখে পড়ল চোখের জল। বুড়ি মাসির চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে। মাসি কাঁদছে আর রোশনের চা-বিস্কুট খাওয়ানোর কথা বলছে।
গত তিনদিন বিকেলের দিকে আশাপুরের এদিক-সেদিক লক্ষ্যহীনভাবে ঘুরতে বেরিয়েছিল রোশন। বিবেকানন্দের রেলিং ঘেরা মূর্তির কাছে রোজই ও বুড়িমাসিকে ভিক্ষে করতে দেখেছে। ডানহাত সামনে পেতে মাসি শুধু একটা কথাই বলে, ‘দুটো টাকা দাও না, বাবা—চা খাব।’ আর মাঝে-মাঝে মিহি গলায় বেসুরো গানের মতো কী একটা গায়।
প্রথম দিন মাসিকে দেখেই রোশনের মনটা কেমন যেন করে উঠেছিল। ও কাছাকাছি একটা চায়ের দোকান থেকে চা আর দুটো নোনতা বিস্কুট কিনে এনেছিল। বুড়িমাসির হাতে চা-বিস্কুট ধরিয়ে দিয়ে বলেছিল, ‘নিন, মাসি—চা খান।’
তার পর থেকে ব্যাপারটা রোজকার নিয়মে দাঁড়িয়ে গেছে। বুড়িমাসির কাছে এটাই বোধহয় অনেক—তাই বারবার সে-কথা বলছে।
পলান বুঝতে পারছিল, পরিস্থিতিটা কেমন করে যেন অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে। ভিড় করে থাকা লোকজন তখন টুকরো-টুকরো কথা বলছে। টুকটাক প্রশ্ন তুলছে।
‘ছেলেটাকে ওরা এভাবে মারছে কেন?’
‘এমনভাবে কেউ মারে।’
‘পুলিশ তো এল আর চলে গেল—।’
‘চলে যাবে না তো কী করবে। দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে তামাশা দেখবে?’
‘হুঁঃ! আমাদের পুলিশ খুব ভালো। ”বাবুরাম সাপুড়ে”-র সাপের মতো। ছোটে না কি হাঁটে না, কাউকে যে কাটে না…।’
কথাটা শুনে দু-চারজন হেসে উঠল।
পলান কাটা নগেনকে চাপা গলায় বলল, ‘সবাইকে বল, ছেলেটা আমার পকেট মেরেছে। তাই একটু শাস্তি দেওয়া হচ্ছে…।’
পলানের নির্দেশ পাওয়ামাত্র নগেন একটা হাত শূন্যে তুলে চেঁচিয়ে উঠল : ‘এই ছেলেটার নাম রোশন। একে সবাই চিনে রাখুন। এ আমাদের আশাপুরে নিউ এসেছে। ওনলি তিন-চারদিন। বেটা আসলে পকেটমার। এই হাফ অ্যান আওয়ার এগো ওই ”মোহন সুইটস”-এর সামনে এই উঠাইগিরা মালটা পলানদার পকেট থেকে মানিব্যাগ তুলে নিয়েছে। আমরা কেসটা ক্যাচ করে ফেলেছি। একেবারে রেড হ্যান্ডেড। তাই তার পানিশমেন্ট দেওয়া হচ্ছে।’ একটু থেমে দম নিল। তারপর : ‘আবার বলছি, এই উটকো ছেলেটা পকেটমার। আমাদের পিসফুল আশাপুরের পিস নষ্ট করতে এসেছে। এইরকম লোকের জন্যে আশাপুরে কোনও জায়গা নেই। নো স্পেস।’
কাটা নগেন একই কথা বারবার বলতে লাগল। মনে হচ্ছিল, ও যেন ট্রেনের কামরায় দাদের মলম বিক্রি করছে।
নগেনের কথায় পাবলিকের মধ্যে তেমন একটা হেলদোল দেখা গেল না।
একটা রোগাপটকা লোক তার পাশে দাঁড়ানো মোটামতন একজনকে চাপা গলায় বলল, ‘কাটা নগেন ঢপ দিচ্ছে— হান্ড্রেড পার্সেন্ট। আধঘণ্টা আগে আমি ওই ”মোহন সুইটস”-এ বসে কচুরি আর জিলিপি খাচ্ছিলাম। তখন এই রোশন ছেলেটা এল। লুচি-তরকারি কিনে দোকানের বাইরেটায় দাঁড়িয়ে খেতে লাগল। তার কিছু পরেই ওই কাটা নগেন এসে ছেলেটার গালে থাপ্পড় মারল, ওর খাবারের থালা এক থাবড়া মেরে ছিটকে ফেলে দিল। তারপর ”পলানদা ডাকছে” বলে ওকে ডেকে নিয়ে গেল। তা হলে ছেলেটা পলানের পকেট মারল কখন?’
মোটামতন ছেলেটা হাত নেড়ে প্রায় থামিয়ে দিল রোগা বন্ধুকে : ‘চেপে যা—কিচ্ছু বলার দরকার নেই। এসব বলতে গেলে তোকে ধরে উদ্যোম ক্যালাবে…।’
রোগা লোকটা মুখে কুলুপ আঁটল।
রোশনকে লাঠিসোটা দিয়ে মারার দৃশ্যটা তিন-চারজন লোক মোবাইলে তুলছিল। তার মধ্যে একজনকে কাটা নগেন দেখতে পেল।
ও বলতে গেলে নেকড়ের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল লোকটার ওপরে। নোংরা খিস্তি দিয়ে মোবাইল ফোনটা ছিনিয়ে নিল।
হকি স্টিক বাগিয়ে ধরা চ্যালাটাকে ইশারা করল পলান। সঙ্গে-সঙ্গে সে মোবাইল ‘ফটোগ্রাফার’-এর পায়ে সপাটে খেটো চালাল। লোকটা ‘ওরে বাবা গো!’ বলে মুখ থুবড়ে পড়ল সামনে। ওর পড়ে যাওয়ার ভঙ্গি দেখে পলান হেঁচকি তোলার মতো শব্দ করে অদ্ভুতভাবে হেসে উঠল। বোঝা গেল, মুখে খইনি থাকার জন্য ওর হাসিটা তেমন খোলামেলা হল না।
আরও তিনজন লোক মোবাইলে ফটো তুলেছিল। একজন ‘ফটোগ্রাফার’ এর দুরবস্থা দেখে তারা নিজেদের মোবাইল ফোন চটপট লুকিয়ে ফেলল।
ইতিমধ্যে রোশন কোনওরকমে উঠে দাঁড়িয়েছে। ওর গা-হাত-পা টনটন করছে। চোখের নজর ঝাপসা। শত্রুরা অস্ত্র বাগিয়ে থাকলেও সেগুলো এই মুহূর্তে চালাতে পারছে না। কারণ, বুড়িমাসি রোশনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। কাঁদতে-কাঁদতে কী যে সব বলছে তার একটি বর্ণও বোঝা যাচ্ছে না।
এমন সময় পলানের মোবাইল ফোন বেজে উঠল। ও পকেট থেকে ফোন বের করে বোতাম টিপে কানে লাগাল।
সাব-ইনস্পেকটর সুরেন দাসের ফোন।
‘পলানদা, এখনও কি আপনারা স্পটে রয়েছেন?’
‘হ্যাঁ—কেন?’
‘ব্যাপারটা গোটা আশাপুরে চাউর হয়ে গেছে। থানায় তিনজন ফোন করেছে। ন্যাচারালি ওরা নাম-টাম কিছু বলেনি। তবে বাজার গরম হয়ে উঠেছে। আমাকে বড়বাবু ফোন করে ব্যাপারটা ইমিডিয়েটলি দেখতে বলছেন। আমি স্পটে আবার যাচ্ছি। এবার অফিশিয়ালি। আপনি আপনার ভাই-টাইদের নিয়ে পুরো হাওয়া হয়ে যান। দেরি করবেন না…।’
‘ও. কে.—।’
পলান ফোন কেটে দিল। তারপর হাত নেড়ে দলের ছেলেগুলোকে চলে যেতে ইশারা করল। কাটা নগেন ওর কাছাকাছিই ছিল। পলান নীচু গলায় ওকে বলল, ‘এক্ষুনি সবাইকে কেটে পড়তে বল। পুলিশ স্পটে আসছে। কেসটা থানায় খবর হয়ে গেছে—।’
পলানের কথা শেষ হতে না হতেই নগেন কাজ শুরু করে দিল। দলের ছেলেগুলোকে নানান নামে ডেকে-ডেকে পাতলা হয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিল।
ওরাও আর দেরি করল না। মুহূর্তের মধ্যে উধাও হয়ে গেল।
পলান চটজলদি রাস্তা পেরিয়ে চলে এল ওর বাইকের কাছে। পিছন-পিছন নগেন। বাইক স্টার্ট দিয়ে ওরা দুজনে চড়ে বসল। তারপর বিকট আওয়াজ তুলে হাইস্পিডে বাইক ছুটিয়ে দিল পলান।
‘সিনেমা’ শেষ। তাই বেশিরভাগ মানুষই ভিড় ছেড়ে বেরিয়ে তাদের কাজে-কর্মে রওনা হয়ে গেল। দু-চারজন যারা পড়ে রইল তাদের কাজের তাড়ার চেয়ে কৌতূহল অনেক বেশি। কেউ-কেউ রোশনের কাছে এগিয়ে গেল। একজন ভালো করে ওর হাত-পা-মুখ দেখতে লাগল। খুঁজতে লাগল, কোথায়-কোথায় কেটে-ছড়ে গেছে, রক্ত বেরোচ্ছে। আরও দুজন লোক রোশনকে নানান প্রশ্ন করতে লাগল।
‘তুমি এখানে নতুন এসেছ শুনলাম। তা কী কাজে এসেছ?’ একজন জিগ্যেস করল।
রোশন, যে এতক্ষণ মুখ দিয়ে একটা আওয়াজ পর্যন্ত বের করেনি, এইবার কথা বলল : ‘আমি আশাপুরে কোনও কাজে আসিনি। জায়গাটা আমার ভালো লেগেছে—তাই আমি এখানে থাকতে এসেছি…।’
ও থেমে-থেমে কথাগুলো বলছিল, আর সেইসঙ্গে হাঁপাচ্ছিল। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল, ওর শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।
‘তুমি কি সত্যিই পলানদার পকেট মেরেছ?’ আর-একজন জানতে চাইল।
রোশন হাসল। ঠোঁটে চোট থাকার জন্য ঠোঁট বেশি চওড়া করতে পারল না। ও ধীরে-ধীরে বলল, ‘আমার বলার কিছু নেই। আপনার যেটা মনে হয়, সেটাই আসল সত্যি…।’
লোকটা একটু অবাক হয়ে গেল। রোশনের কথা ওর কাছে কেমন হেঁয়ালির মতো লাগল। কী বলতে চাইল ছেলেটা? ‘আপনার যেটা মনে হয়, সেটাই আসল সত্যি।’
তার মানে?
রোশন জড়ানো হোঁচট খাওয়া গলায় বুড়িমাসিকে বলল, ‘মাসি, তুমি এখন যাও। আমি বিকেলে বিবেকানন্দের স্ট্যাচুর কাছে যাব—তোমাকে চা-বিস্কুট খাওয়াব…।’
‘খাওয়াবি তো?’ চা-বিস্কুট খাওয়ার কথায় বুড়িমাসির চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল। হাতের পিঠ দিয়ে চোখের জল মুছে আশাভরা নজরে তাকাল রোশনের দিকে। ঘাড় হেলিয়ে আবার জানতে চাইল, ‘খাওয়াবি তো?’
রোশন আবার বলল, ‘হ্যাঁ—খাওয়াব। বিকেলে আমি যাব তোমার কাছে…।’
বুড়িমাসি বলল, ‘বেঁচে থাক, ভালো খোকা। ভগবান তোর সঙ্গে থাকুক।’
আপনমনে কয়েকবার ঘাড় নাড়ল বুড়িমাসি। তারপর রাস্তা থেকে তালিমারা পুঁটলিটা তুলে নিয়ে হাঁটা দিল।
রোদের তেজ অনেকটা বেড়ে গেছে। রোশনকে ঘিরে থাকা ভিড় একেবারে ফিকে হয়ে গেছে। চলে যাওয়ার সময় কেউ-কেউ আলোচনা করতে-করতে গেছে, রোশন কেন মুখ বুজে মার খেল। কেন ও পালটা আঘাতের পথে গেল না?
বিশ্বরূপ জোয়ারদার দোতলার জানলা থেকে সবই দেখছিলেন। দেখছিলেন, ওঁকে হেনস্থা থেকে বাঁচানোর মাশুল গুনছে একজন তরতাজা নিষ্পাপ যুবক। বিশ্বরূপের খুব খারাপ লাগছিল। একটা অদ্ভুত গ্লানিতে ওঁর মনটা ছেয়ে গিয়েছিল। সেইসঙ্গে বুকের ভেতরে একটা কষ্ট।
দোতলার জানলা থেকে খানিকটা দূরেই ইলেকট্রিকের তার। সেখানে ছ’-সাতটা কাক এখনও সার বেঁধে বসে আছে। ‘কা-কা’ করে ডাকছে। হয়তো ওদের প্রতিবাদ এখনও ফুরোয়নি।
বিশ্বরূপের হঠাৎই যেন ঘোর কাটল। তিনি তাড়াহুড়ো করে বোর্ডারের ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। তাড়াতাড়ি পা চালালেন সিঁড়ির দিকে। এক্ষুনি ওঁকে যেতে হবে রোশনের কাছে। রোশনের এখন সাপোর্ট দরকার। ও নিশ্চয়ই সাংঘাতিকরকম চোট পেয়েছে। ওকে ইমিডিয়েটলি ডাক্তারখানায় নিয়ে যেতে হবে।
বিশ্বরূপ যখন লজের বাইরে বেরোলেন তখন রোশন সদর দরজার কাছাকাছি চলে এসেছে। ছেলেটা বেশ খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে হাঁটছে। একজন লোক পাশ থেকে এগিয়ে এসে রোশনের হাত ধরে ওকে সাহায্য করতে যাচ্ছিল, কিন্তু রোশন হাতের ইশারায় তাকে বারণ করল। ও একাই গেস্টহাউসে যেতে পারবে, দোতলায় নিজের রুমে পৌঁছতে পারবে। ওর শরীরকে ভরসা দেওয়ার জন্য ওর কারও সাহায্যের প্রয়োজন নেই। তবে পলান আর তার দলবলের অন্যায় কাজ-কারবারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য ওর সাপোর্ট দরকার। অনেক সাপোর্ট।
বিশ্বরূপ জোয়ারদার দু-পা এগিয়েই রোশনকে পেয়ে গেলেন। রোশন ইশারা করে বারণ করা সত্ত্বেও বিশ্বরূপ সেই বারণ শুনলেন না। রোশনের বাঁ-হাতটা আঁকড়ে ধরলেন। ইস, কী মারটাই না মেরেছে ছেলেটাকে!
বিশ্বরূপের বুকের ভেতরে কষ্টটা বাড়ছিল। চোখের কোণও ভিজে গিয়েছিল। নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হচ্ছিল। পলান আর ওর দলবলের ওপরে রাগও হচ্ছিল খুব। ওঁর যদি গায়ে সেরকম জোর-টোর থাকত তা হলে সবক’টা শয়তানকে ধরে কষে পিটিয়ে দিতেন। রোজই তো ভাবেন এই কথাটা, কিন্তু কাজে সেটা আর হচ্ছে কই!
রোশনকে সঙ্গে করে গেস্টহাউসের রিসেপশন রুমে ঢুকলেন। টেবিলের কাছে গিয়ে একটা প্লাস্টিকের চেয়ারে ওকে বসালেন। মাথাটা হেলিয়ে দিলেন চেয়ারের পিঠের দিকে। তারপর ছুটলেন কলতলায়।
একটু পরেই একটা ভেজা তোয়ালে নিয়ে ফিরে এলেন। রোশনের কপাল আর ঠোঁটের রক্ত মুছে দিলেন। তারপর তোয়ালের পরিষ্কার অংশে দিয়ে মাথা মুছে দিলেন বারবার। একইসঙ্গে বিড়বিড় করে বলছিলেন, ‘আমার ব্যাপারে জড়িয়েই তোমার এই সর্বনাশ হল। আমার ব্যাপারে জড়িয়েই তোমার এই সর্বনাশ হল…।’
রোশন মাথা হেলিয়ে চুপচাপ বসে ছিল। দু-চোখ বোজা। বড়-বড় শ্বাস পড়ছে। কপাল আর ঠোঁটের পাশটায় অল্প-অল্প জ্বালা করছে। মাথার ভেতরে একটা দপদপানি। আর বুকের ভেতর একটা অচেনা শক্তি নিষ্ফল আক্রোশে ফুঁসছে।
একটু পরে তোয়ালেটা টেবিলে রেখে পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করলেন বিশ্বরূপ। তারপর ছোটকুকে ফোন করলেন।
দুবার রিং বাজতেই ছেলেটার সাড়া পাওয়া গেল। বিশ্বরূপ ওকে বললেন, ‘শোন, ”ভবানী মেডিকেল” থেকে একটা স্যাভলন, খানিকটা তুলো, আর চারটে ব্যথা মরার ট্যাবলেট আমার নাম করে নিয়ে আয়—সন্ধেবেলা আমি দাম মিটিয়ে দেব। জলদি নিয়ে আয়…।’
‘হ্যাঁ—জানি। এমার্জেন্সি। পলানের গুণ্ডাগুলো রোশনদাকে বহুত মার মেরেছে—ফর নাথিং…।’
বিশ্বরূপ বুঝলেন, রোশনকে বিনা কারণে মারার খবরটা চারদিকে চাউর হয়ে গেছে।
‘ছোটকু, তুই জিনিসগুলো নিয়ে জলদি গেস্ট হাউসে চলে আয়—।’
‘দু-মিনিটের মধ্যে আসছি, কাকু….।’ ফোন ছেড়ে দিল ছোটকু।
চারমিনিটের মধ্যে ছোটকু স্যাভলন, তুলো আর ট্যাবলেট নিয়ে গেস্টহাউসে চলে এল। দেখল, বিশ্বরূপ জোয়ারদার রোশনের ওপরে ঝুঁকে পড়ে পরিচর্যায় ব্যস্ত। ওর কাছাকাছি লজের বাকি দুজন বোর্ডার মুখে উৎকণ্ঠা আর কৌতূহল নিয়ে দাঁড়িয়ে।
ছোটকু ঢোকার ঠিক সাতমিনিট পর গেস্টহাউসে ঢুকল নিতুয়া আর ববিন। বাচ্চা ছেলেটা একটা কোরা থান লুঙ্গির মতন করে পরে আছে। গায়ে ছোট একটা কোরা উড়ুনি। গলায় কাছা—তাতে লোহার চাবি ঝুলছে।
রেল লাইনের ধারে বারো নম্বর বস্তিতেও রোশনের মার খাওয়ার খবরটা পৌঁছে গেছে।
***
রেললাইনের ধারে গড়ে ওঠা বারো নম্বর বস্তিটাকে দেখলে হঠাৎ করে মনে হতে পারে ঝুলনযাত্রার সাজানো রঙিন ‘খোকা’ ঘরবাড়ি।
বস্তির সামনে দিয়ে চলে গেছে মরচে ধরা রেললাইন। লাইনের লোহার জং ধরা বাদামি রং দেখেই বোঝা যায় এ-লাইন দিয়ে শেষ কবে ট্রেন চলেছিল সে-কথা কারও আজ মনে নেই।
এরকম বাতিল একজোড়া লাইন পাশাপাশি শুয়ে আছে। তার ওপরে সকালের রোদ এসে পড়েছে। কিন্তু জং ধরা বিবর্ণ লোহা থেকে এককণাও আলো ছিটকে আসছে না চোখে।
সেই লাইনের ওপরে এখানে-ওখানে অলসভাবে বসে কিংবা দাঁড়িয়ে আছে কম-বেশি বয়েসের কয়েকজন মানুষ। একজন রোগা প্রৌঢ় খালি গায়ে লুঙ্গি পরে উবু হয়ে বসে দাঁত মাজছে। একজন মাঝবয়েসি মহিলা কাচা জামাকাপড় ছড়িয়ে দিচ্ছে রেললাইনের ওপরে। দুটো ছোট বাচ্চা বাতিল লাইনের ক্ষয়ে যাওয়া কাঠের স্লিপারের ওপরে লাফিয়ে-লাফিয়ে এক্কা-দোক্কা গোছের কিছু একটা খেলছে। একজন সাদা-চুল বুড়ো মানুষ খালি গায়ে দাঁড়িয়ে হাতে চাপড় মারার শব্দ করে গায়ে তেল মাখছে।
বাতিল রেললাইনের পাশ ঘেঁষে বারো নম্বরের সারি-সারি ঘর। ঘরগুলো মাপে ছোট-ছোট খুপরির মতো। কোনওটা উঁচু, কোনওটা নীচু। কোথাও শ্যাওলা ধরা টালির ছাউনি, কোথাও বিজ্ঞাপনের বাতিল ফ্লেক্স, কোথাও আবার সবুজ, নীল অথবা গোলাপি পলিথিন দিয়ে চাল ছাওয়া।
ঘরগুলোর দেওয়াল ঘেঁষে কোথাও-কোথাও ছোট-ছোট টব বসানো। সেই টবে বেড়ে উঠেছে ফুলগাছ। তাতে ফুটফুটে সাদা আর গোলাপি ফুল। কোনও ঘরের চালে ছেয়ে রয়েছে লতানে লাউ অথবা কুমড়ো গাছ। আবার কোনও-কোনও চালে বসানো রয়েছে টিভির ডিশ অ্যানটেনা।
বারো নম্বর বস্তির সামনে রয়েছে বেশ কয়েক সারি রেললাইন। তার মধ্যে দু-সারি জং ধরা বাতিল হলেও বাকি চার সারি লাইন বেশ ঝকঝকে চকচকে। সেইসব চকচকে লাইন দিয়ে রোজ নানারকমের ট্রেন অথবা মালগাড়ি যাতায়াত করে। তাদের ঘটাঘট খটাখট শব্দের চঞ্চল ছন্দ বারো নম্বর বস্তির মানুষজনের জীবনের ছন্দের সঙ্গে বিনুনির মতো জড়িয়ে গেছে।
বস্তির ঘরগুলো এলোমেলো ছন্নছাড়াভাবে দাঁড়িয়ে আছে। তারই ফাঁকফোকর দিয়ে তৈরি হয়ে গেছে সরু-সরু পথ। সেইসব পথ দিয়ে দুজন মানুষ পাশাপাশি যাতায়াত করতে পারে। তবে কোথাও-কোথাও পথগুলো আরও সরু হয়ে গেছে। বস্তির ছোট-ছোট বাচ্চারা গোলকধাঁধার মতো বিছিয়ে থাকা এইসব গলিগালায় লুকোচুরি কিংবা চোর-পুলিশ খেলতে-খেলতে বড় হয়ে ওঠে। তারপর—তাদের মধ্যে যারা ক্রিমিনাল তৈরি হয়—তারা পুলিশের তাড়া খেয়ে এই ‘ভুলভুলাইয়া’র মধ্যে ঢুকে পড়ে এবং পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে গা-ঢাকা দেয়।
বারো নম্বর বস্তির একটা ভীষণ সরু গলির মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল রোশন। সূর্য মাথার ওপরে উঠলে তবেই তার আলো সরাসরি গলিগুলোর মেঝেতে এসে পৌঁছয়। এখন সবে সাড়ে আটটা—তাই গলিগুলো সব ছায়াগলি।
গনিরামের একচিলতে ঝুপড়ি-ঘরের কাছে এসে দাঁড়াল রোশন। ঘরের দরজা হাট করে খোলা। সামনে ফাটল ধরা মেঝে। তার একপাশে উবু হয়ে বসে গনিরামের বিধবা দিদি সাবিত্রী আনাজপাতি কুটছে। আনাজপাতির বেশিরভাগটাই আলু, তার সঙ্গে মিশেছে বেগুনের দু-চারটে টুকরো।
রোশনকে দেখে সাবিত্রী উঠে দাঁড়াল। রোগা, কালো চেহারা। চোখগুলো বেশ বড়। মাথার চুলে পাক ধরেছে। কানে রুপোর দুল। এ ছাড়া আর কোনও অলঙ্কার নেই—প্রসাধনের তো প্রশ্নই ওঠে না!
‘এসো—ভেতরে এসো…।’ আটপৌরে ডুরে শাড়িতে হাত মুছে রোশনকে ভেতরে আসতে বলল সাবিত্রী। গনিরাম মারা যাওয়ার পর রোশন এ-ঘরে এতবার এসেছে যে, বলতে গেলে গনিরামের পরিবারের একজন হয়ে গেছে। অনেকটা নিতুয়ার মতো।
রোশন ঘরের ভেতরে ঢুকল।
দিনের বেলাতেও অন্ধকার-অন্ধকার ঘর। নীচু ছাদ। ঘরে কোনও জানলা নেই। তবে সামনের আর পিছনের দেওয়ালে বড়-বড় তিনটে ঘুলঘুলি রয়েছে।
ঘরে আসবাবপত্র বলতে একটা ‘কোনওরকম’ খাট। খাটটা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি উঁচু। উঁচু কেন বোঝা যায় খাটের নীচে গাদা করা দুনিয়ার জিনিসপত্র দেখে।
খাট ছাড়া ঘরে রয়েছে দুটো ছোট টুল, একটা ছোট টিভি, আর মেঝেতে বসানো একটা টেবিল ফ্যান। ফ্যানটা কড়কড় আওয়াজ করে ঘুরছে। রোশনের পায়ে হাওয়া লাগছে।
ঘরের একদিকের দেওয়ালে গনিরামের একটা ফটো। ভোটার কার্ডের ফটো থেকে বড় করে নিয়ে রোশন বাঁধিয়ে দিয়েছে। এই বাঁধানো ফটোটা গনিরামের শ্রাদ্ধের সময় ব্যবহার করা হবে।
সামনের একটা টুল দেখিয়ে সাবিত্রী রোশনকে বসতে বলল।
রোশন না বসে ঘরের ভেতরে আরও একটু ঢুকে এল, জিগ্যেস করল, ‘কত টাকা উঠল?’
‘মাত্র সাড়ে চারশো।’ সাবিত্রী ঠোঁট উলটে বলল, ‘ভেবেছিলাম তোমাকে কল করে জানাব, তা তোমার তো আবার মোবাইল নেই…।’ খোলা দরজা দিয়ে বাইরের দিকে তাকাল সাবিত্রী। ওর দৃষ্টি ফাঁকা। আলতো করে বলল, ‘ভাইটা মরেও আমার ঘাড়ে ঝামেলা দিয়ে গেল…।’
রোশন চিন্তায় ঠোঁট কামড়াল। বিড়বিড় করে বলল, ‘মাত্র সাড়ে চারশো!’
সাবিত্রী ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল, ‘এই বস্তি থেকে আর কত চাঁদা উঠবে! আমি তো তোমাকে প্রথম থেকেই বলেছিলাম। একে মড়া পোড়ানোর সময় কেউ-কেউ টাকাপয়সা দিয়েছে…তারপর আবার…।’
সাবিত্রী কিছু ভুল বলেনি। গনিরামের সৎকারের সময় মোট যা-যা খরচ হয়েছিল তার সবটা পলানের টাকায় মেটেনি। নিতুয়া টাকা দিয়েছে, রোশন টাকা দিয়েছে। এ ছাড়া বারো নম্বরের আরও অনেকে কিছু-কিছু করে টাকাপয়সা দিয়েছে।
কিন্তু এখনও তো গনিরামের শ্রাদ্ধ বাকি! সাবিত্রীর খুব ইচ্ছে, বেশ নিয়ম-টিয়ম মেনে ওর ভাইয়ের শ্রাদ্ধ হোক। কিন্তু তার জন্য খরচ আছে! তার ওপরে লোক খাওয়ানোর খরচ। সেই খরচ তুলতেই নিতুয়া কয়েকজন ছেলেপিলে সঙ্গে নিয়ে বস্তিতে চাঁদা তুলছে। তুলতে-তুলতে বস্তি এলাকার বাইরেও চলে গেছে ওরা।
ব্যাপারটা রোশনের ভালো লাগেনি। ওর মনে হয়েছিল, ব্যাপারটা যেন ছদ্মবেশে ভিক্ষাবৃত্তি। তাই ও অন্যরকম কিছু একটা ভেবেছে।
সে-কথা মনে রেখেই ও একটা হাত তুলে সাবিত্রীকে ভরসা দিতে চাইল। একইসঙ্গে হাসতে চেষ্টা করল।
কিন্তু কাঁধের কাছে একটা ব্যথা ওর হাত তোলার কাজটা পুরোপুরি করতে দিল না। হাসিটাও ঠিকঠাক হল না—মুখটা একটু কুঁচকে গেল যন্ত্রণায়।
‘কী হল, রোশন? তোমার ব্যথা এখনও মরেনি?’ সাবিত্রীর গলায় উদ্বেগ।
‘না, দিদি—ও কিছু নয়।’
রোশন মনে-মনে হিসেব করল। পলানের গুন্ডাগুলো ওকে মেরেছে আটদিন আগে। ওর মনের জোর আর বিশ্বরূপ জোয়ারদারের যত্ন-আত্তি সেই মারধোরের ব্যথা আটদিনে অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছে। তবে কমিয়ে দিলেও শরীরের কোথাও-কোথাও কমবেশি অসুবিধের ছোঁয়া রয়ে গেছে। যদিও ব্যথা কিছুটা কমতেই ও অল্পস্বল্প ব্যায়াম শুরু করে দিয়েছে।
এমন সময় সামনের রেললাইন দিয়ে হুড়মুড় করে একটা লোকাল ট্রেন ছুটে গেল। গনিরামদের ঘরের মেঝেটা থরথর করে কাঁপতে শুরু করল। টালির চালের টালির সেটিং কোথাও ঢিলে থাকায় কাঁপুনির তালে-তালে খটাখট শব্দ হতে লাগল।
ট্রেন চলে যেতেই সব আবার কেমন চুপচাপ হয়ে গেল।
রোশন একটু অস্বস্তি নিয়ে হাসল। তারপর সাবিত্রীকে বলল, ‘দিদি, তুমি চিন্তা কোরো না—টাকা ঠিক উঠে যাবে। ববিন কোথায়? আমি ওকে নিয়ে একটু বেরোব…।’
‘ও পায়খানায় গেছে। আমি নিজে গিয়ে ওকে লাইনে দাঁড় করিয়ে এসেছি। নইলে বাচ্চা ছেলে বলে ওকে হাটিয়ে দিয়ে সবাই টপকে যায়…।’
বস্তির লোকজনের জন্য সরকার থেকে হাফডজন পায়খানা আর বড় বাঁধানো কলতলা তৈরি করে দিয়েছে। রোজ সকালে সেখানে লাইন পড়ে। তবে কেউ-কেউ এখনও পুরোনো অভ্যাস ছাড়তে পারেনি। তারা রেললাইনের ধারের ঝোপঝাড়ে কাজ সারতে চলে যায়।
‘ববিনকে নিয়ে কোথায় যাবে?’ সাবিত্রী জানতে চাইল।
‘চাঁদা তুলতে বেরোব। শ্রাদ্ধের খরচের জন্যে—।’
রোশন ঘরের বাইরে বেরিয়ে এল। যে-গলি দিয়ে ববিন ফিরে আসবে সেদিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ববিনকে নিয়ে ও ঠিক কোথায় যাবে সেটা ও সাবিত্রীকে বলল না। ইচ্ছে করেই একটু এড়িয়ে গেল।
রোশন ববিনের পথ চেয়ে তাকিয়ে আছে দেখে সাবিত্রী বলল, ‘এখুনি চলে আসবে। অনেকক্ষণ আগে ওকে লাইনে দিয়ে এসেছি…।’
সাবিত্রীর কথা শেষ হতে না হতেই ববিনকে দেখা গেল। খালি গা, খালি পা—কোমরে একটা গামছা। গলায় সাদা কাপড়ের টুকরোয় বাঁধা একটা চাবি ঝুলছে।
ছেলেটা তরতর করে হেঁটে আসছে। রোগা, মাঝারি রং, মাথায় অনেক চুল।
সাবিত্রী রোশনকে দেখছিল। ববিনকে নিয়ে এই সকালবেলায় কোথায় যাবে ও? ফিরতে দেরি হবে কি না কে জানে! দেরি হলে খবর নেওয়ারও কোনও উপায় নেই। কারণ, রোশন মোবাইল ফোন ব্যবহার করে না। কেন ব্যবহার করে না সে-কথা জিগ্যেস করলে রোশন বলে, ‘কার জন্যে মোবাইল রাখব! যাদের জন্যে রাখা দরকার ছিল তারা সবাই আমাকে ছেড়ে চলে গেছে…। তাই এখন মোবাইল ছাড়াই বেশ আছি।’
এ-কথা সাবিত্রীকে আগে বলেছে রোশন। বিশ্বরূপদা আর নিতুয়াও জানে এ-কথা।
ববিন রোশনকে পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকছিল। রোশন ওকে বলল, ‘চট করে রেডি হয়ে নে—আমার সঙ্গে একটু বেরোবি…।’
ববিন সঙ্গে-সঙ্গে ঘাড় কাত করে রাজি : ‘এক্ষুনি আসছি, কাকু—।’
মিনিট দুয়েকের মধ্যেই ববিন বেরিয়ে এল। কোনওরকমে ধুতি আর উড়ুনি পরে নিয়েছে। পায়ে হাওয়াই চটি। ওর কোরা ধুতি আর উড়ুনি এর মধ্যেই বেশ ময়লা হয়ে গেছে।
সাবিত্রী তাড়াহুড়ো করা ছেলেটার মাথা আঁচড়ে দিচ্ছিল। রোশনকে বলল, ‘দেখো, বেশি দেরি কোরো না। ছেলেটা সকাল থেকে শুধু দুটো বিস্কুট খেয়েছে। ও ফিরে এসে চানাচুর মুড়ি খাবে। তখন তুমিও একটু চা খেয়ে যেয়ো…।’
রোশন ববিনকে নিয়ে এগোল। এখন ও পলানের কাছে টাকা চাইতে যাবে। চাঁদা—গনিরামের শ্রাদ্ধের জন্য। পলান কিছুতেই ওর দায় এড়াতে পারে না। রোশনের বিশ্বাস, কাছা নেওয়া বাচ্চা ছেলেটাকে দেখলে পলানের হয়তো একটু দয়া-মায়া হবে। যদিও কোনও গুন্ডার দয়া কিংবা মায়ার ওপরে রোশনের কোনও শ্রদ্ধা নেই। তবে পলানের দায়ের ব্যাপারটা কিছুতেই ও মাথা থেকে সরাতে পারছে না।
পলানের কাছে যাওয়ার কথা ও সাবিত্রীকে বলেনি। কারণ, বললে পর সাবিত্রী হাঙ্গামা শুরু করে দিত। আর ববিন এই কয়েকদিনে এই নতুন ‘কাকু’-টার এতটাই ন্যাওটা হয়ে পড়েছে যে, কাকুর সঙ্গে রাস্তায় বেরোতে পারলেই ও খুশি। বাবা চলে যাওয়ার দুঃখটা এই কাকুটা এর মধ্যেই অনেকটা ভুলিয়ে দিয়েছে। তবে বাবার ফটোটার দিকে চোখ পড়লে ববিনের খুব কান্না পায়। তাই যতক্ষণ ও ঘরে থাকে ততক্ষণই ও বাবার ফটোর দিক থেকে নজর সরিয়ে রাখতে চেষ্টা করে।
ববিনকে সঙ্গে করে এ-গলি সে-গলি দিয়ে হেঁটে চলল রোশন। হাঁটতে-হাঁটতে একসময় বেরিয়ে এল রেললাইনের ধারে। এখানে রেললাইনের পাশাপাশি পায়ে হাঁটা স্ট্রেইটকাট পথ। এই রাস্তা ধরে গেলে সময় কিছুটা বাঁচবে।
রোশন আর ববিন হাঁটতে লাগল। রোশনের নাকে দুর্গন্ধের ছোঁয়া আসছিল। ওর পাশে-পাশে চলেছে জং ধরা বাতিল রেললাইন। লাইন ডিঙিয়ে ওদিকটায় তাকালে ঝকঝকে রেললাইনের সারি চোখে পড়ে। তার পরে রয়েছে আগাছার ঝোপঝাড়। সেই ঝোপ-জঙ্গল পেরোলেই উঁচু পাঁচিল। সেই পাঁচিলের ওপাশে সুন্দর-সুন্দর কয়েকটা ফ্ল্যাটবাড়ি। বাড়ি তো নয়, রংচঙে হাইরাইজ!
সত্যি, রেললাইনের এপার-ওপার কী ভীষণ দুরকম! জং ধরা রেললাইনের পাশে অভাবের লালা মাখানো জং ধরা পোকামাকড়ের জীবন। আর ঝকঝকে রেললাইনের দিকে বার্নিশ করা ঝকঝকে উষ্ণ জীবন।
রোশন ববিনের হাত চেপে ধরল। ছেলেটা যা দুরন্ত! আচমকা রেললাইনের দিকে ছুট না লাগায়।
চলার পথে দু-একটা টাইম কল চোখে পড়ল। এই কলগুলোর লাইন বে-আইনিভাবে টানা। বস্তির লোকরাই মিউনিসিপ্যালিটির ট্যাপ থেকে পাইপ লাগিয়ে মাটির নীচ দিয়ে নিজেদের পছন্দমতন এদিকে-ওদিকে লাইন টেনে নিয়ে গেছে। সেইসব কলের জল সরু হলেও কাজ চলে যায়।
একটু পরেই বাঁ-দিকে বাঁক নিয়ে অন্য রাস্তা ধরল রোশন। ঘড়ি দেখল, প্রায় ন’টা বাজে। এই সময় থেকে প্রায় ঘণ্টা তিনেক পলানকে ‘জনপ্রিয় মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’ দোকানটার সামনে পাওয়া যায়। সেখানে দুটো বেঞ্চি পেতে ও সাঙ্গোপাঙ্গদের নিয়ে আড্ডা দেয়। সকালবেলা ওটাই পলানের ঠেক।
চৌরাস্তার বিবেকানন্দর মূর্তির কাছে গিয়ে বাঁ-দিকের রাস্তা ধরে মিনিট চার-পাঁচেক হেঁটে গেলেই ‘জনপ্রিয় মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’। একটা বড় রাস্তা, আর একটা গলির কাটাকুটির এক কোনায় কর্নার প্লটে দাঁড়িয়ে আছে দোকানটা। আশাপুরের ব্যস্ত জায়গায় থাকার ফলে মিষ্টির দোকানটা বেশ চালু। তা ছাড়া পলান বহু মানুষকে এই দোকান থেকে মিষ্টি কেনার জন্য ‘অনুরোধ’ করে থাকে। আর পলানের ‘অনুরোধ’ মানে সেটা আদেশের খুব কাছাকাছি।
পলান ‘জনপ্রিয়’-র পাবলিসিটি করে বলে ও এবং ওর শাগরেদরা এই দোকান থেকে সারা মাস ধরে খেয়াল-খুশি মতো নোনতা আর মিষ্টি খায়, আর মাস গেলে পলান থোক পাঁচশো টাকা মালিক নবকান্ত ঘোষের হাতে ধরিয়ে দেয়। গড়ে প্রতি মাসে হাজার কি দু-হাজার টাকা লোকসান হচ্ছে জেনেও নবকান্ত চুপচাপ থাকেন। কারণ, ওঁকে আর হপ্তায়-হপ্তায় আলাদা করে ‘পলান চ্যারিটি ফ্যান্ড’-এ ডোনেশান দিতে হয় না।
বস্তির গোলকধাঁধা থেকে বেরিয়েই রোশন একটা সাইকেল রিকশা ধরে নিয়েছিল। সেখানে ও আর ববিন পাশাপাশি বসে রিকশার ঘোমটা তুলে দিল। কারণ, রোদ ক্রমশ চড়া হচ্ছে।
রাস্তাঘাট শান্ত, স্বাভাবিক। দেখে মনেই হয় না এই শান্ত এলাকায় কোনওরকম অশান্তি থাকতে পারে। আটদিন আগে রোশনকে যে দিনের আলোয় খোলা রাস্তায় আমজনতার চোখের সামনে বেধড়ক পেটানো হয়েছে সেটাও এখন মনে হচ্ছে স্বপ্ন অথবা কল্পনা।
রাস্তার একটা গর্তে চাকা পড়তেই রিকশাটা ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল। রোশনের শরীরও ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল। ও গায়ের ব্যথা টের পেল। ও ববিনের হাত আঁকড়ে ধরে বসেছিল, যাতে রিকশার ঝাঁকুনিতে ছেলেটা সিট থেকে পড়ে না যায়। এখন হাতের বাঁধনটাকে আরও শক্ত করল।
ববিন হঠাৎ বলে উঠল, ‘কাকু, আমাকে একটা বড় বল কিনে দেবে?’
রোশনের নজরে পড়ল, রাস্তার পাশ ঘেঁষে একজন ভদ্রলোক হেঁটে যাচ্ছেন—সঙ্গে ববিনের বয়েসি একটি ছেলে। ছেলেটার হাতে একটা সাদা-কালো নকশা কাটা ফুটবল।
রোশন ববিনের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘কিনে দেব—আগে পরশুদিন তোর বাবার পুজোটা মিটে যাক…।’
‘পুজো’ মানে শ্রাদ্ধ। ববিনকে এটাই বুঝিয়েছে রোশন। গনিরামের শ্রাদ্ধ-শান্তি মিটে গেলে ববিন আর সাবিত্রীর ব্যাপারটা নিয়ে ওকে ভাবতে হবে। কী করে এই দুটো প্রাণীর পেট চলবে? এর-ওর-তার কাছে হাত পেতে বা চাঁদা তুলে দু-চারদিন চলতে পারে, তার বেশি তো নয়!
তখনই ওর মনে পড়ল, এটিএম বুথ থেকে টাকা তুলতে হবে। এটিএম কার্ডটা যে ওর সঙ্গেই আছে সেটা যাচাই করতে প্যান্টের পকেটের ওপর দিয়ে হাত রাখল রোশন। অনুভবে বুঝল, কার্ডটা ওর সঙ্গে আছে।
রিকশা গতি কমিয়ে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়ল। ‘জনপ্রিয় মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’ এসে গেছে। ওই তো, পলান আর তার দলবল দোকানের এক সাইডে দুটো বেঞ্চি পেতে মুখোমুখি বসে আছে। ওদের সামনেই ফুটপাথের ওপরে একটা বড় বটগাছ। তারই ছায়ায় বসে আছে ওরা। ছায়া সরে গেলে ওরা বেঞ্চিগুলোকে সেইমতো সরিয়ে নেয়।
বেঞ্চি দুটোর কাছাকাছি চারটে বাইক স্ট্যান্ডে দাঁড় করানো। তার মধ্যে লাল রঙের বড় বাইকটা পলানের।
রিকশা থেকে নেমে দাঁড়াল রোশন আর ববিন। রিকশাওয়ালা ভাড়া নিয়ে চলে গেল।
রোশন পলানের দিকে তাকাল। ট্রেড মার্কগুলো আগে চোখে পড়ল ওর। মাকড়ি, বালা, আংটি। গায়ে রাউন্ড নেক জামরঙা টি-শার্ট, পায়ে রং চটা জিনস আর স্ট্র্যাপ দেওয়া চপ্পল।
পলানের শাগরেদদের মধ্যে কানুয়া আর কাটা নগেনকে চিনতে পারল রোশন—বাকিদের চেহারা অচেনা। তবে তাদের চরিত্র বোধহয় অচেনা নয়। এদের দু-একজন হয়তো ওকে পেটানোর সময় অ্যাক্টিভ ছিল। রোশনের মুখগুলো মনে নেই।
কিন্তু ববিনকে নিয়ে পলানের দিকে এগোতে গিয়ে থমকে গেল ও।
পলানের হাতে খবরের কাগজের একটা পোঁটলা ছিল—সেটা ধীরে-ধীরে ও খুলছিল। কাগজের মোড়ক সরাতেই বেরিয়ে পড়ল একটা চকচকে রিভলভার।
পলানের মুখোমুখি বসে একজন মোটা মতন লোক হাত নেড়ে পলানকে রিভলভারটা সম্পর্কে নানান কথা বলছিল, বোঝাচ্ছিল।
‘পলানদা, এটা স্প্যানিশ মাল। ”লামা-মডেল থ্রি-এ”। অনেক কষ্টে জোগাড় করেছি। মালটা একেবারে আপনার হাতসই। মাত্র ছ’শো-সাড়ে ছ’শো গ্রাম ওয়েট। সিঙ্গল অ্যাকশন। সাত রাউন্ড ফায়ার করতে পারবেন। এ-ওয়ান মাল—তবে দাম একটু বেশি…।’
‘কত?’ পলান জিগ্যেস করল। রিভলভারটা হাতে বাগিয়ে ধরে পরখ করে দেখতে লাগল।
‘আপনার জন্যে, দাদা, সাড়ে তিন লাখ—।’ চোখ ছোট করে হেসে বলল লোকটা।
রিভলভারটা দেখামাত্রই রোশন ববিনকে নিজের পিছনে টেনে নিয়েছিল—যাতে ছোট ছেলেটা অস্ত্রটা দেখতে না পায়।
‘সাড়ে তিন লাখ!’ চোখ কপালে তুলল পলান : ‘রেটটা বড্ড হাই হয়ে যাচ্ছে…।’ কথা বলতে-বলতে রিভলভারটা আবার খবরের কাগজে মুড়ে ফেলল।
‘তা জিনিসটাও তো হাই-ফাই, দাদা—।’
কিছুক্ষণ দরাদরির পর তিন লাখ বিশ হাজারে দামের সেটলমেন্ট হল।
পলান কাগজে মোড়া অস্ত্রটা কানুয়ার হাতে দিয়ে বলল, ‘মালটা জায়গা মতো রেখে আয়—।’ তারপর আর্মস ডিলারের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কাল সকালে এরকম সময়ে এখানে এসে নোট নিয়ে যাবেন…।’
মোটা মতন লোকটা যাবতীয় দাঁত বের করে হাসল। প্রায় নব্বই ডিগ্রি ঘাড় কাত করে বলল, ‘নো প্রবলেম, পলানদা, নো প্রবলেম। কাল এরকম সময়ে চলে আসব।’
লোকটা চলে যেতেই ববিনের হাত ধরে পলানের বেঞ্চির আরও কাছে এগিয়ে গেল রোশন। ততক্ষণে কানুয়া একটা বাইকে চড়ে রওনা হয়ে গেছে।
পলান রোশনদের দিকে কোনও নজরই দিচ্ছিল না। শাগরেদদের সঙ্গে কথাবার্তায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। রোশনের মনে হল, পলান যেন ওদের দেখেও না দেখার ভান করছে। তাই আর কোনও উপায় না দেখে ও ডেকে উঠল।
‘পলানদা—।’
পলানের কথাবার্তা থমকে গেল। ভুরু কুঁচকে অচেনা চোখে তাকাল রোশনের দিকে। ওপরদিকে মাথা ঝাঁকিয়ে জিগ্যেস করল, ‘কে তুই?’
রোশন হাসল : ‘এর মধ্যে ভুলে গেলেন? সেই যে আটদিন আগে ”আশাপুর লজ”-এর সামনে সকালবেলা আমাকে চার-পাঁচজন মিলে পেটাল। আপনি দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে দেখছিলেন। পুলিশ এল। আপনার সঙ্গে হেসে-হেসে কথা বলে চলে গেল। মনে পড়ছে?’
পলানের উলটোদিকের বেঞ্চি থেকে একটা রাফ ছেলে ধমকে উঠল, ‘অ্যাই সালা, চোপ! ঠুকে-ঠুকে কথা! লাথি মেরে মুখ ভেঙে দেব…।’
রোশন ছেলেটার দিকে ঘুরে তাকাল : ‘অ্যাই, ভদ্রভাবে কথা বল। আমার সঙ্গে একটা বাচ্চা ছেলে রয়েছে। ওর সামনে গালাগাল দিবি না।’
রোশনের কথা শেষ হতে-না-হতেই ছেলেটা ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর ওপরে।
ঝাঁপিয়ে পড়ার পর যে-কাণ্ডটা ঘটল তাতে ছেলেটার মনে হল, ঝাঁপিয়ে না পড়লেই বোধহয় ভালো ছিল—অন্তত ওর স্বাস্থ্যের পক্ষে।
চোখের পলকে রোশন ওর ডানহাতটা টানটান করে সামনে বাড়িয়ে দিয়েছিল। গোটা হাতটা দেখাচ্ছিল শক্ত কাঠের মতো। আর সেই কাঠের প্রান্তে হাতের আঙুলগুলো বেঁকে গিয়ে একটা অর্ধচন্দ্র তৈরি করে ফেলেছিল।
ঝাঁপিয়ে পড়া ছেলেটার গলা রোশনের তৈরি অর্ধচন্দ্রের ফাঁদে পা দিল। এবং রোশন ওর টুঁটি টিপে ধরল।
ছেলেটা যেসব গালিগালাজ শুরু করেছিল সেগুলো আর শেষ করে উঠতে পারল না। রোশনের হাতের চাপে সেগুলো আচমকাই থমকে গেল। ছেলেটা রোশনের কাঠের মতো অনমনীয় হাতটাকে দু-হাত দিয়ে পাগলের মতো খামচাতে লাগল। রোশনের হাত ছড়ে যেতে লাগল নখের আঁচড়ে। রক্তের ফোঁটা দেখা যাচ্ছিল, জ্বালাও করছিল বেশ—কিন্তু কাঠের হাতটা কাঠেরই রইল, রক্ত-মাংসের হল না।
শ্বাসনালী বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ছেলেটার চোখ বড়-বড় গোল-গোল হয়ে গিয়েছিল। ও কেমন অদ্ভুত অবাক ভঙ্গিতে রোশনের দিকে তাকিয়ে রইল। যেন কোনও অবাক ভয় পাওয়া পুতুল।
কিন্তু রোশনের দৃষ্টি নরম এবং ঠান্ডা। ও ছেলেটাকে পিছনদিকে ঠেলছিল। ছেলেটা ইচ্ছে না থাকলেও এক পা দু-পা করে পিছু হটছিল।
এইভাবে ছেলেটাকে ঠেলতে-ঠেলতে বেঞ্চির কাছে নিয়ে গেল রোশন—যে-বেঞ্চিতে রাফ অ্যান্ড টাফ ছেলেটা বসে ছিল।
ছেলেটা এখন আর প্রতিরোধ করার কোনওরকম চেষ্টা করছিল না। শুধু ক্লান্ত হাতের আলতো আঙুলে রোশনের ‘কামড়’ খোলার এলেবেলে চেষ্টা করছিল।
রোশনের হাতের চাপে ছেলেটার প্রতিরোধহীন শরীর ধীরে-ধীরে বসে পড়ল বেঞ্চিতে। এবং রোশন সঙ্গে-সঙ্গে ওর টুঁটি থেকে আঙুল সরিয়ে নিল। তারপর নিজের ঠোঁটজোড়ার ওপরে খাড়াভাবে তর্জনী ছুঁইয়ে ইশারায় বোঝাল, একদম চুপ। টুঁ শব্দটি কোরো না…।
ছেলেটা কাত হয়ে টলে পড়ে যাচ্ছিল, কিন্তু দুপাশ থেকে ওর দুজন দোস্ত ওকে আঁকড়ে ধরল। ‘নোনতা…নোনতা’ বলে ভরসা দেওয়ার ডাক ডাকতে লাগল। একজন নোনতার মাথায় হাত বোলাতে লাগল। আর-একজন ‘জনপ্রিয় মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’-এর একজন সেলস বয়ের কাছে তাড়াহুড়ো করে একটা জলের বোতল চাইল। দোকানের আরও দুজন লোক কাচের কাউন্টারের ওপর দিয়ে গলা তুলে রোশনের ঘটনাটা দেখছিল। পলানের ছেলেটা জলের বোতল চাইতেই সেই দুজন লোক ভয় পাওয়া টিকটিকির মতো ভেতর দিকে সটকে গেল।
নোনতা তখন শূন্য দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে। ওর গলার কাছটা লাল।
রোশন নোনতার টুঁটি টিপে ধরামাত্রই পলান বেঞ্চি ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু ঘটনাটা এত আচমকা ঘটে গেছে যে, ও কী করবে ঠিক করে উঠতে পারছিল না।
এখন সময় পৌনে দশটা। সামনের রাস্তায় ব্যস্ততার যথেষ্ট ভিড়। সাইকেল রিকশা, গাড়ি, হেঁটে চলা মানুষজন, সাইকেল, সব এদিক-ওদিক যাতায়াত করছে। এখন যদি রোশনকে ধরে ও পালিশ দেয় তা হলে এখানে পলকে ভিড় জমে যাবে। লোকজন রোশনকে মারধোর করার কারণ জানতে চাইবে। পাবলিকের কৌতূহল। তখন বানিয়ে-বানিয়ে কোনও মিথ্যা বলা যাবে না। কারণ, গনিরামের ওই বাচ্চা ছেলেটা। কী যেন নাম? ও সব দেখেছে, শুনেওছে। ও পাবলিককে সব বলে দেবে। একে বাচ্চা ছেলে, তার ওপর গায়ে ওর অশৌচের পোশাক। পাবলিক ওর কথাই বিশ্বাস করবে।
তারপর কথায়-কথায় ওর বাবা কীভাবে মারা গেল সে-কথা উঠবে। সেখান থেকে চলে আসবে গোডাউন ফাইটের কথা। তারপর…।
নাঃ, ব্যাপারটা পলানের ফর-এ যাবে না। পরে অসুবিধে হতে পারে।
পলান দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে এসবেরই তোলমোল করছিল।
তবে রোশন ছেলেটার আস্পর্ধা দেখে তাজ্জব লাগছে। এই সেদিন রাস্তার ওপরে পাবলিক প্লেসে ওকে ওরকমভাবে মারা হল, তাতেও ওর ধক কমেনি!
পলান দেখল, নোনতা মোটামুটি সামলে উঠেছে। ওর মুখে মাথায় জলের ছিটে দিচ্ছে পলানের দুজন চ্যালা—সোমেন আর তাতান। নোনতা গলায় হাত বোলাচ্ছে, তাকিয়ে আছে পলানের দিকে। চোখের নীরব আকুতি যেন বলতে চাইছে, ‘পলানদা, বদলা নাও। কিছু একটা তো করো…।’
পলান আঙুলের ইশারায় রোশনকে কাছে ডাকল, বলল, ‘অ্যাই, শোন। সাতসকালে এখানে কী লাফড়া পাকাতে এসেছিস?’
রোশন পলানের কাছে এগিয়ে এল : ‘আমি তো কোনও ঝামেলা পাকাইনি—।’ ওর মুখ-চোখ শান্ত। একটু আগের এনকাউন্টারের কোনও এফেক্ট সেখানে নেই।
‘তুই আমার ছেলের গায়ে হাত দিস কোন সাহসে?’
‘আমি তো ওর গায়ে হাত তুলিনি। ও-ই তো আমার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাকে মারতে আসছিল। আমি শুধু ওকে ববিনের সামনে নোংরা গালিগালাজ করতে বারণ করেছিলাম। বাচ্চাদের সামনে গালাগাল দেওয়াটা ঠিক নয়।’
রোশন যেখানে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল, তার একটু দূরেই বড় মাপের কাঁচা ড্রেন। সেখানে কালো রঙের থকথকে নোংরা জল। সেই জলে মশার লার্ভা সাঁতরাচ্ছে। রোশনের মনে হল, নোনতার মুখ নর্দমার এই জলের চেয়েও নোংরা।
কাটা নগেন কখন যেন বেঞ্চি ছেড়ে উঠে পলানের পাশে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। ও হঠাৎ বলে উঠল, ‘তুই নোনতাকে সাডেনলি হিট করলি কেন?’
রোশন শান্ত গলায় বলল, ‘হিট করিনি। এটাকে বলে সেলফ ডিফেন্স। তুমি তো গুড ইংলিশ জানো। নিশ্চয়ই এর মিনিং আন্ডারস্ট্যান্ড?’
পলান বুঝল, রোশন কাটা নগেনের ইংরেজি বলার বাতিককে ‘টোন’ করছে। তবে নগেন সেটা বুঝতে পারল বলে মনে হল না। ও দাঁত খিঁচিয়ে বলে উঠল, ‘যা-যাঃ, আর জ্ঞান দিতে হবে না। পলানদা, লাগাও তো মালটাকে দু-ঝাঁপড়—তা হলেই সব তেল ড্রাই হয়ে যাবে…।’
রোশন পলানের চোখের দিকে তাকাল, বলল, ‘আপনি আমাকে মারতে পারেন। আমি কোনও বাধা দেব না। আমি জানি, ওই একটা জিনিসই আপনি পারেন। এ ছাড়া আপনার আর কোনও গুণ নেই। তা ছাড়া আপনার দলের হাতে মার খাওয়াটা আমার ধীরে-ধীরে অভ্যেস হয়ে যাচ্ছে। তো সেটাই বা খারাপ কী!’
পলান একটা তাচ্ছিল্যের ভঙ্গি করল। তারপর ভুরু কুঁচকে বিরক্তভাবে জিগ্যেস করল, ‘বল, কী চাই? কীজন্যে এসেছিস আমার কাছে?’
রোশন তখন সংক্ষেপে গনিরামের কথা বলল। বলল, গনিরাম কীভাবে ব্লাইন্ড ফাইটে মারা গেছে। তারপর ববিনকে কাছে ডাকল। ওর মাথায় হাত রেখে বলল, ‘গনিরামের ছেলে। ববিন। চারবছর আগে ওর মা অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে…।’
‘তো আমি কী করব?’
‘পলানদা, চারদিন পর গনিরামের শ্রাদ্ধ—’ রোশনের গলা নরম হল। একটু ইতস্তত করে ও বলল, ‘শ্রাদ্ধের খরচের জন্যে আপনার কাছে হেলপ চাইতে এসেছি…মানে ডোনেশন…।’
‘আমি হঠাৎ ডোনেসন দিতে যাব কেন? ওর বস্তিতে চাঁদা তোল—।’
‘সে তো তুলছি। কিন্তু সে আর কইটুকু! আপনি যদি একটু বেশি ডোনেশন দেন তো শ্রাদ্ধটা উতরে যায়। প্লিজ, পলানদা।’
পলান রোশনকে ভালো করে দেখল। তারপর ববিনকে। কিছুক্ষণ কী চিন্তা করল। শেষমেশ পকেটে হাত ঢুকিয়ে একগাদা নোট বের করে নিল। পাঁচশো টাকা আর একশো টাকার নোট। তবে পাঁচশো টাকার নোটই বেশি। সেখান থেকে তিনটে একশো টাকার নোট বেছে নিয়ে রোশনের দিকে এগিয়ে ধরল : ‘নে—।’
রোশন যেমন দাঁড়িয়ে ছিল তেমনই দাঁড়িয়ে রইল। অল্প হেসে বলল, ‘আপনার কাছ থেকে অনেক বেশি আশা করেছিলাম, পলানদা। অন্তত সাতহাজার টাকা…।’
‘সাতহাজার টাকা!’ পলানের চোখ কপালে উঠল : ‘টাকা কি গাছ নেড়ে আসে?’
‘ ”আশাপুর লজ”-এর বিশ্বরূপদার কাছ থেকে আপনার ছেলেরা যেভাবে মাসে চারহাজার টাকা করে চাইছে তাতে এটাই তো মনে হয় যে, টাকা সত্যি-সত্যিই গাছ নেড়ে আসে। তা আপনার কী মনে হয়?’
কাটা নগেন এবং পলানের অন্য চ্যালাদের মনে হল, রোশন এসব বেহুদা কথা বলে ওদের ‘পলানদা’-কে চাটছে।
নগেন দাঁতে দাঁত চেপে চাপা গলায় পলানকে বলল, ‘পলানদা হিট ট্রিটমেন্ট স্টার্ট করে দাও…।’
পলান হাতের ইশারায় ওকে চুপ করতে বলল। নিজেও চুপ করে রইল। বোধহয় কী বলবে ভেবে পাচ্ছিল না।
রোশন বলল, ‘গনিরাম কীভাবে মারা গেছে মনে আছে? ব্লাইন্ড ফাইট লড়তে-লড়তে। আপনি তো ওই ফাইটের অর্গানাইজার। তা হলে তো আপনার একটা দায় থাকছে, নাকি?’
‘ও মারা যাওয়ার পর আমি অনেক টাকা দিয়েছি—’ পলান যে নিজেকে বেশ চেষ্টা করে শান্ত রাখছিল সেটা ওর মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল।
‘তা দিয়েছেন…’ রোশন স্বীকার করল, ‘কিন্তু শ্রাদ্ধ-শান্তির কাজটা উতরে না দিলে হয়! একবার এই অনাথ বাচ্চাটার কথা ভাবুন তো!’ ববিনকে দেখাল রোশন : ‘বলুন, পলানদা, এই বাপ-মা মরা ছেলেটার ভবিষ্যৎ কী?’
পলান ববিনের দিকে তাকাল। সরল চোখ, নিষ্পাপ মুখ—অথচ ভবিষ্যৎ অন্ধকার। শেষ পর্যন্ত হয়তো অন্ধকার জগতের দিকেই চলে যাবে ছেলেটা।
‘ওর ভবিষ্যৎ কী তা জানি না, তবে সাতহাজার টাকাটা দেওয়া একেবারে অসম্ভব। ম্যাক্সিমাম শ’পাঁচেক টাকা দিতে পারি…।’
‘পলানদা, আপনি এমনভাবে বারগেন করছেন যেন এটা দুর্গাপুজো বা শিবরাত্রির চাঁদা।’ কয়েক সেকেন্ড চুপ করে রইল রোশন। তারপর বলল, ‘ঠিক আছে। আমি তা হলে যাই। ববিনকে সঙ্গে করে ওর বাবার শ্রাদ্ধের জন্যে চাঁদা তুলি। বাজারের কাছে, বিবেকানন্দের স্ট্যাচুর কাছে, জগন্ময়ীর কালীমন্দিরের কাছে, হাইরোডের কাছে, সব জায়গায় ঘণ্টাখানেক করে দাঁড়াই। লোকজনকে বলি গনিরামের কথা, বলি কীভাবে ও ব্লাইন্ড ফাইটের সময় হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছে। তার সঙ্গে এও বলব, পলানদা পাঁচশো টাকার বেশি দিতে পারবে না বলেছে। তাই আমি আর এই বাপ-মা মরা ছেলেটা আপনাদের কাছে হাত পেতে সাহায্য চাইছি। আমাদের সাত হাজার টাকা তুলতে হবে। আপনারা সবাই দয়া করে হেলপ করুন…।’
রোশনের কথায় পলানের কনফিডেন্স নড়ে গেল। এই নতুন ছেলেটা বলে কী! গনিরামের শ্রাদ্ধের খরচ জোগাড় করতে ও এখন ববিনকে নিয়ে আশাপুরের সব জায়গায় ভিক্ষে করে বেড়াবে! তাহলে তো পলানের গোডাউন ফাইটের নেগেটিভ প্রচারের আর কিছু বাকি থাকবে না!
এমনিতেই রোশনকে মারার ঘটনাটা অনেকে জেনে গেছে। রোশন নিজেই বিনা কারণে ওর মার খাওয়ার ব্যাপারটা একে-তাকে বলে বেড়িয়েছে। পলানের কাছে সে-খবর এসেছে। এর ফলে অনেক প্রশ্ন উঠেছে। তার মধ্যে প্রধান প্রশ্ন : একটা নির্দোষ ছেলেকে পলানরা শুধু-শুধু মারল কেন?
আসলে পলানের পকেট মারার গল্পটা শেষ পর্যন্ত ধোপে টেকেনি।
না, রোশনকে খুব সাবধানে সাইজ করতে হবে। এমনভাবে ওর ইমেজটাকে দাঁড় করাতে হবে যাতে পাবলিকের সিমপ্যাথি ওর দিকে না যায়। বরং পাবলিক যেন এই অচেনা ছেলেটাকে অপছন্দ করতে শেখে। ঘেন্না করতে শেখে। আশাপুরে এসে আলটপকা গজিয়ে ওঠা ওই অজ্ঞাতকুলশীল ছেলেটা যেন কিছুতেই ওর পায়ের তলায় শক্ত জমি তৈরি করতে না পারে।
পলান রোশনের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল অথচ রোশনকে দেখছিল না। ওর মনের কোণে কোথায় যেন একটা কাঁটা খচখচ করছিল। বুঝতে পারছিল, বুদ্ধি দিয়ে এই শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে।
হঠাৎই পলান বলে উঠল, ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে! আর ঝামেলা বাড়াতে হবে না। আমি সাতহাজার টাকাই দিচ্ছি—এ নিয়ে আর কোনও ক্যাজরা করিস না।’
পলান টাকা গুনতে শুরু করল। সাতহাজার টাকা হতেই টাকাটা রোশনের দিকে বাড়িয়ে ধরল : ‘এই নে—পুরো সাতহাজার আছে…।’
রোশন টাকাটা নিল। ওর পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা ববিনের দিকে একবার তাকাল। তারপর ছেলেটাকে বলল, ‘অ্যাই, পলানকাকুকে প্রণাম কর…।’
পলান কিছু বুঝে ওঠার আগেই ববিন বাধ্য ছেলের মতো ওকে টকাটক প্রণাম করে ফেলল।
রোশন বলল, ‘বৃহস্পতিবার গনিরামের ঘাটকাজ, শুক্রবার শ্রাদ্ধ। শ্রাদ্ধের দিন দুপুরে বারো নম্বরে ববিনদের ঘরে আসবেন। আপনার নামে হিসেবে তিনজন গেস্ট ধরলাম…।’
পলান সামান্য ঠোঁট চওড়া করে হাসল। বলল, ‘যাব…।’
ঠিক তখনই রোশনের পিঠের কাছে জামাটা কে যেন খামচে ধরল।
রোশন ঘুরে তাকাল। নোনতা। ওর দু-চোখ রাগে জ্বলছে। ঠোঁট সরে গিয়ে হলদেটে দাঁত দেখা যাচ্ছে। ওর দুপাশে দাঁড়িয়ে আছে সোমেন আর তাতান।
রোশন চট করে ঘুরে দাঁড়াল। সেই ঝটকায় জামাটা নোনতার হাত থেকে ছুটে গেল।
পলান কিছু একটা আঁচ করেছিল। তাই তাড়াহুড়ো করে ধমকে উঠল, ‘অ্যাই, নোনতা! না, একদম না! সরে যা! সরে যা!’
নোনতা হিংস্র রাগে হাউমাউ করে চেঁচিয়ে উঠল।
‘না, পলানদা! এই জানোয়ারের বাচ্চাটা আমার গায়ে হাত তুলেছে। একে আমি ছাড়ব না…।’
এরপর নোনতা যেসব নোংরা শব্দ ব্যবহার করতে লাগল তাতে কাঁচা ড্রেনের কালো থকথকে নোংরা জলও লজ্জা পাবে।
রোশন কিন্তু প্রতিক্রিয়া দেখাতে একটুও দেরি করল না। শূন্যে হাত ঘুরিয়ে সপাটে এক রাম থাপ্পড় বসিয়ে দিল নোনতার বাঁ গালে।
বোমা ফাটার মতো তীব্র শব্দ হল একটা। নোনতার শরীরটা দুবার লাট খেয়ে ছিটকে পড়ল রাস্তায়।
রোশন ওর শরীরটার দিকে ঘেন্নার চোখে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বলল, ‘একবার তো বললাম, বাচ্চা ছেলের সামনে গালাগাল দিবি না। আর যখন-তখন যার-তার গায়ে হাত তোলার অভ্যেসটা ভালো না। তাতে শরীর খারাপ হতে পারে।’
রোশন এমনভাবে কথাবার্তা বলছিল যেন চড় খেয়ে নোনতার রাস্তায় ছিটকে পড়ার ঘটনাটা খুবই স্বাভাবিক।
পলান রোশনের স্পর্ধা আর হিম্মত দেখে ভেতরে-ভেতরে অবাক হচ্ছিল। কোথা থেকে উড়ে এসে আশাপুরে জুড়ে বসা একটা আনচাক্কা ছেলে…সে কি না পলানের ছেলের গায়ে হাত তুলছে!
মারপিটের এই ঘটনার ঝলক দু-চারজন লোকের চোখে পড়েছিল। তারা ‘জনপ্রিয় মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’-এর সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল।
রোগা মতন একজন ভদ্রলোক একটা ঝরঝরে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিলেন। নোনতার পড়ে যাওয়া দেখে পলানদের বেঞ্চি ঘেঁষে, পলানের একেবারে কাছে, সাইকেল দাঁড় করিয়ে দিলেন। এক পা প্যাডেলে, অন্য পা রাস্তায়।
ভদ্রলোকের মুখে খোঁচা-খোঁচা দাড়ি। শার্ট-প্যান্ট যথেষ্ট ময়লা। দু-এক জায়গায় তালিমারা। ওঁর চোখ দুটো বড়-বড় কিন্তু ছলছলে, ঘোলাটে। মুখ থেকে বাজে গন্ধও বেরোচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে, সাতসকালে চড়িয়ে এসেছেন।
রোশন তখন পলানকে বলছে, ‘পলানদা, আজ চলি। শুক্রবারে আপনারা আসবেন কিন্তু…।’
রোশনের আচরণ একেবারে স্বাভাবিক—যেন কিছুই হয়নি।
পলান অল্প হেসে ঘাড় নাড়ল : ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ—নিশ্চয়ই যাব।’
একইসঙ্গে মনে-মনে বলল, ‘দাঁড়াও, তোমাকে ঠিকানায় লাগানোর বন্দোবস্ত করছি। এমন বন্দোবস্ত, যাতে পাবলিক তোমাকে ধরে পেটায়…।’
রোশন ববিনের হাত ধরে হাঁটা দিল।
নোনতা তখন বন্ধুদের হাতে ভর করে রাস্তা থেকে উঠে দাঁড়াচ্ছে। একইসঙ্গে বাঁ-গালে হাত বোলাচ্ছে। পলানদার ওপরে ওর খুব রাগ হচ্ছিল। বাইরের একটা উটকো ছেলেকে পলানদা এইভাবে টলারেট করছে!
সাইকেল-আরোহী ভদ্রলোক একদৃষ্টে পলানের দিকে চেয়েছিলেন। পলান সে-দৃষ্টির মোকাবিলা করতে পারছিল না। বারবার চোখ সরিয়ে নিচ্ছিল।
ভদ্রলোক হঠাৎ হাসলেন। তারপর বললেন, ‘কী পলান, কেমন আছ? বোম-টোম আর তৈরি করছ না?’
ভদ্রলোকের এই অদ্ভুত প্রশ্নে পলান কিংবা ওর দলের কেউ অবাক হল না। কারণ, ভদ্রলোককে ওরা ভালো করে চেনে। ওঁর নাম কিশোরীমোহন সামন্ত। ওঁর একটিমাত্র ছেলে ছিল—সায়ন। সায়ন তিনবছর আগে অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে।
সায়ন লেখাপড়া ছেড়ে পলানের দলে ভিড়ে গিয়েছিল। বাবা-মায়ের শত বারণ শোনেনি। কতই বা বয়েস তখন ওর? চোদ্দো কি পনেরো। পলান তখন ওর হাতে নিয়মিত হাতখরচের পয়সা দিচ্ছে। কখনও-কখনও রেস্তোরাঁ থেকে ফ্রায়েড রাইস আর চাউমিন আনিয়ে খাওয়াচ্ছে। এ ছাড়া হাতে তুলে দিচ্ছে রোমাঞ্চকর অস্ত্রশস্ত্র। নেপালা, ভোজালি, চপার, এমনকী রিভলভার পর্যন্ত।
অস্ত্রগুলো হাতে নিয়ে সায়নের গায়ে কাঁটা দিত। নিজেকে দশফুট লম্বা মনে হত। মনে হত, ওর শরীরে কীভাবে যেন এক মারাত্মক শক্তি সঞ্চারিত হয়েছে। ওর কথায় এখন বাঘে-গোরুতে একঘাটে জল খাবে। ওর কথাই এখন শেষ কথা।
তখন সায়ন একটা ঘোরের মধ্যে ঢুকে পড়েছিল। তখন ওর মাথায় শুধু পলানদা, পলানদা আর পলানদা। বাবা-মায়ের যে-কোনও কথাতেই ওর বিরক্ত লাগত। বাড়ির বাইরে-বাইরে ওর দিন কাটত। কখনও-কখনও খেতে আসত, আবার কখনও-কখনও আসত না। তবে রাতে কখনও সায়ন বাইরে থাকত না।
সায়নকে ওর মা অনেক বোঝাতেন। পলানের দলের সঙ্গে আড্ডা না মেরে লেখাপড়ায় মন দিতে বলতেন। কিশোরীও ছেলেকে কিছু কম বোঝাতেন না। কিন্তু সেসব কথা সায়নের কানে ঢুকত না।
এরপর সায়ন বোমা বাঁধার কাজ শুরু করল। পলান ওকে যখন এই দায়িত্ব দিল তখন সায়ন যেন খুশিতে আকাশে পা ফেলে হাঁটছে।
আশাপুরে চাল-ডালের বড়-বড় তিনটে পুরোনো গোডাউন ছিল। গোডাউনগুলো টিনের তৈরি। কালো রং করা। শোনা যায়, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় সেগুলো নাকি মিলিটারিদের রসদের গোডাউন ছিল। তারপর টানা সত্তর বছর বিনা ব্যবহারে পড়ে থেকে-থেকে ওগুলোর অবস্থা এখন ভূতুড়ে বাড়ির চেয়েও ভয়ংকর। সেই গোডাউনগুলোর একটার ভেতরে চলে পলানের ‘বোমার কারখানা’।
সায়ন খুব তাড়াতাড়ি সব শিখে নিচ্ছিল। পলানের দেওয়া ‘রোমাঞ্চকর’ শিক্ষা ও মন-প্রাণ দিয়ে একেবারে শুষে নিচ্ছিল। অল্প সময়ের মধ্যেই ও জেনে গেল, হাতবোমার আর-এক নাম ‘পেটো’। ওগুলো তৈরি করতে দুটো কেমিক্যাল লাগে : পটাশিয়াম ক্লোরেট আর আর্সেনিক সালফাইড—যাদের সংক্ষেপে বলা হয় পটাশ আর মোমছাল। এ ছাড়া পটাশিয়াম ক্লোরেটের কোড-নেম ‘সাদা’ আর আর্সেনিক সালফাইডের কোড-নেম ‘লাল’।
বোমা তৈরি করতে গেলে এই দুটো কেমিক্যালের সঙ্গে লাগে স্টোনচিপস, পেরেক, লোহার বাবরি, কাগজ আর পাটের দড়ি। কেরোসিন তেলে ডুবিয়ে খুব সাবধানে বোমা বাঁধতে হয়। তা ছাড়া বোমা বাঁধতে গেলে চাই ধৈর্য আর হানড্রেড পারসেন্ট মনোযোগ।
বোমা বাঁধার সময় সায়ন এই নিয়ম মেনে চলত। পলান প্রায়ই ওর কাজের প্রশংসা করত। বলত, সায়নের বাঁধা বোমা কোনওদিনও ‘মিসফায়ার’ হয়নি। এসব কথায় সায়নের বুক চওড়া হয়ে যেত।
কিন্তু একদিন…।
একদিন সায়নের ধৈর্য আর মনোযোগের অঙ্কে ভুল হয়ে গেল।
যখন ও একটা বোমা বাঁধছিল তখন বোমাটা ওর মুখের সামনে ফেটে গেল।
এক ঝলক সাদা আলো সায়নকে পলকের জন্য অন্ধ করে দেয়। একইসঙ্গে গোডাউনের জং ধরা টিনের দেওয়ালের খানিকটা অংশ উড়ে গিয়েছিল।
‘জানো তো, পলান, পেটো তৈরি করতে গেলে পটাশ আর মোমছাল লাগে। সাদা আর লাল। এ দুটো ভালো করে মেশালে কমলা রঙের দেখায়। তারপর ওই পাউডারের মধ্যে খুচরো নাট-বোলটু, কাচের টুকরো, স্টোনচিপস, পেরেক, লোহার বাবরি দিতে হয়। ওগুলো সপ্লিনটার। বোমা ফাটলে ওগুলো ছিটকে গিয়ে পাবলিকের গায়ে-মুখে-মাথায় লাগবে…’ কিশোরীমোহন উত্তেজিতভাবে কথাগুলো বলে যাচ্ছিলেন। চোখ বড়-বড় করে পলান, কাটা নগেন, নোনতা, সোমেন, তাতান ওদের দিকে পালা করে তাকাচ্ছিলেন। হাতের আঙুল ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে অদৃশ্য একটা বোমা বাঁধার ভঙ্গি করছিলেন। আর ঠোঁট চওড়া করে নিঃশব্দে হাসছিলেন।
‘দ্যাখো তো, পলান, বাঁধাটা ঠিক হচ্ছে কি না—’ মাথা ঝাঁকিয়ে পলানের এক্সপার্ট ওপিনিয়ান চাইলেন কিশোরীমোহন। তারপর : ‘সায়নটা একেবারে অপদার্থ! ঠিকমতো বোমা বাঁধতে পারে না। দ-ড়া-ম! ব্যস, মরেই গেল। ছেলেটা আমার মরেই গেল…।’
হঠাৎই হাউহাউ করে কেঁদে উঠলেন কিশোরী। রোগা-রোগা দু-হাতে নিজের বুক চাপড়াতে লাগলেন।
একজন দুজন করে লোক জমতে শুরু করল। ময়লা শার্ট-প্যান্ট পরা কান্নাকাটি করা লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। সামনের ব্যস্ত রাস্তায় এদিক-ওদিক ছুটে চলেছে গাড়ি, সাইকেল, সাইকেল-রিকশা, মিনি ট্রাক, মোটরভ্যান। শুকনো রাস্তায় ধুলো উড়ছে। এতক্ষণ বেশ রোদ ছিল, কিন্তু এখন সূর্য মেঘে ঢাকা পড়েছে। মেঘের চেহারা দেখে মনে হচ্ছে ব্যাপারটা বৃষ্টির দিকে এগোলেও এগোতে পারে।
পলান আর দেরি করেনি। বেঞ্চি ছেড়ে উঠে এসেছে কিশোরীমোহনের কাছে। লোকটা দিনদাহারে এরকম ক্যাচাল করলে তো মুশকিল! সায়নের কেসটা আরও বড় সাইজে বিলা হয়ে যাবে!
পকেট থেকে পাঁচশো টাকা বের করল পলান। টাকাটা কিশোরীর হাতে দিয়ে পিঠে হাত রাখল। দরদ মাখা গলায় বলল, ‘কিশোরীদা, এবার বাড়ি যান। ভালো করে খাওয়াদাওয়া করুন। আস্তে-আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে। ভগবান সব ঠিক করে দেবেন…।’
কিশোরীমোহনের উত্তেজনা পাগলামো একটু শান্ত হল। কিন্তু তিনি তখনও মরা ছেলের জন্য ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন। পলান যখন বলল, ‘ভগবান সব ঠিক করে দেবেন…’ তখন কিশোরী মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকালেন। বিড়বিড় করে বললেন, ‘সব ঠিক হয়ে যাবে…সব ঠিক হয়ে যাবে…।’
কিশোরী চোখের জল মুছলেন। পলানের দিকে বড়-বড় সরল চোখে তাকিয়ে বললেন, ‘পলান, সায়ন ভালো আছে তো?’
পলান কিশোরীর পিঠে আলতো দুটো চাপড় মেরে বলল, ‘হ্যাঁ, কিশোরীদা, ভালো আছে। খুব ভালো আছে।’
‘আর সায়নের মা?’
‘সায়নের মা ভালো আছে। সায়নের কাছেই আছে।’
সায়ন মারা যাওয়ার চারদিন পর শোক-তাপে উদভ্রান্ত সায়নের মা গায়ে কেরোসিন তেল ঢেলে নিজেকে দাহ করেছিলেন।
তার পরই কিশোরীমোহন পাগল হয়ে যান। পলানের সঙ্গে দেখা হলেই সবসময় বোমা বাঁধার কথা বলেন।
পলান কিশোরীকে শান্ত করে পিঠ-ফিট চাপড়ে সাইকেলে করে রওনা করিয়ে দিল। ভাঙাচোরা মানুষটা ভাঙাচোরা সাইকেল চালিয়ে পলানদের কাছ থেকে ক্রমশ দূরে চলে যেতে লাগল।
কিশোরীমোহনকে দেখলেই পলানের মধ্যে কেমন একটা পাপবোধ জেগে ওঠে। যেন ও চুরিচামারি করতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়ে গেছে।
সায়ন ছেলেটা খুব ভালো ছিল। চোখ দুটো কিশোরীদার মতোই বড়-বড়। আর সেই চোখের মধ্যে ছিল কিশোর বয়েসের প্রাণবন্ত উজ্জ্বলতা। ছেলেটা কথা বলত ধীরে-ধীরে, নীচু গলায়। সবসময় নতুন কিছু একটা করতে চাইত—নতুন-নতুন এক্সপেরিমেন্ট। কে জানে ‘বল’ বাঁধার সময় নতুন ধরনের কোনও এক্সপেরিমেন্ট করতে গিয়েছিল কি না। তারপরই ‘দ-ড়া-ম’!
পলান সায়নকে খুব ভালোবাসত। ছেলেটা তাতানের সঙ্গে একই স্কুলে একই ক্লাসে পড়ত। গত বছরে স্বাধীনতা দিবসের ফ্ল্যাগ তোলার ফাংশানে সায়ন এসেছিল। বিবেকানন্দ মূর্তির মোড় থেকে বাঁ-দিকে শ’খানেক মিটার গেলেই চিলড্রেন্স পার্ক। সেখানে সকাল-বিকেল বাচ্চারা খেলে। পার্কের এক কোণে সিমেন্টের সিঁড়িভাঙা বেদিতে একটা জি-আই পাইপ পারমানেন্টলি গাঁথা আছে। তার মাথায় লোহার আংটা ঝালাই করা। আংটার ভেতর দিয়ে তার গলিয়ে পাইপের গোড়ায় পেঁচিয়ে রাখা আছে। সারা বছর নানান কারণে এখানে নানান ফ্ল্যাগ তোলা হয়। কখনও ন্যাশনাল ফ্ল্যাগ, কখনও ইস্টবেঙ্গল বা মোহনবাগানের ফ্ল্যাগ, আবার ফুটবল ওয়ার্ল্ড কাপের সময় আর্জেন্টিনা কিংবা ব্রাজিলের পতাকা। তবে যখন যে-পতাকাই তোলা হোক না কেন সেই পতাকা-উদ্যোগের পিছনে থাকে পলান আর তার চ্যালারা। পতাকা যেদিন তোলা হয় সেদিন রাতে খাওয়াদাওয়ার আয়োজনও করে পলানরা।
তো স্বাধীনতা দিবসের পতাকা তোলার অনুষ্ঠানে সায়ন এসেছিল। রাতে খাওয়াদাওয়ার আসরে তাতান ওকে নেমন্তন্ন করেছিল। সেই রাতেই সায়নের সঙ্গে পলানের প্রথম আলাপ। পলানের ছেলেটাকে ভালো লেগেছিল। কিন্তু তখন ও সায়নকে দলে টানার কথা ভাবেনি।
পলান জানে, একটা দল চালাতে গেলে দু-একটা করে লোকাল ছেলেকে নিয়মিতভাবে দলে টানা দরকার। এই ছেলেগুলোই দলের ভিতটাকে ধরে রাখে। কিন্তু সায়নকে সেরকম মেটিরিয়াল বলে পলানের মনে হয়নি। তবে সায়নের খুব কৌতূহল ছিল। তাতানকে আর পলানকে নানান প্রশ্ন করত। পলানের ফাইফরমাশ খাটার জন্য সবসময় এক পা বাড়িয়েই থাকত ছেলেটা।
পলান তখন খুব সিগারেট খেত। ওর সিগারেটের প্যাকেট কিনে আনার জন্য সায়ন হয়ে উঠল এক নম্বর লোক।
একদিন পলান মুচকি হেসে ওকে জিগ্যেস করেছিল, ‘কী রে, সায়ন—সিগারেট টানতে ইচ্ছে করে?’
সায়ন এপাশ-ওপাশ মাথা নেড়েছিল : ‘না—।’
‘কেন? ইচ্ছে করে না কেন?’
‘আমার বাপি সিগারেট খায়। খুব কাশে। মাঝে-মাঝে রক্ত পড়ে মুখ দিয়ে। মা বাপিকে সিগারেট খেতে মানা করে…।’
পলান মুচকি হাসিটাকে মুখ থেকে সরিয়ে নিয়েছিল। ওর কপালে ভাঁজ পড়েছিল। কিশোরীদার কি তা হলে টিবি হয়েছে? সেইজন্যই কি ওঁর চেহারাটা অমন রোগা?
পলান পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করল। প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট নিয়ে লাইটার দিয়ে ধরাল। পরপর দুটো টান মেরে খুকখুক করে কাশল। কাশিটাকে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ও খেয়াল করেছে। পলান মনে-মনে ভাবল, ‘না, না—এটা নরমাল কাশি। এর সঙ্গে মুখ দিয়ে ব্লিডিং হওয়ার কোনও রিলেশান নেই।’
তারপর ধোঁয়া ছাড়ল। এপাশ-ওপাশ হাত নেড়ে ধোঁয়া তাড়াল। সায়নের বড়-বড় উজ্জ্বল চোখের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল, ‘তোর তা হলে কী ইচ্ছে করে?’
সায়ন কয়েক সেকেন্ড চুপ করে রইল। তারপর পলানের কোমরে উঁচু হয়ে থাকা একটা জায়গার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ‘ওটা—ওটা খুব টাচ করতে ইচ্ছে করে। একবার…একবার টাচ করতে দেবে, পলানদা?
জিনসের প্যান্টের ওপরে একটা লাল রঙের রাউন্ড নেক টি-শার্ট পরেছিল পলান। টি-শার্টের নীচে কোমরে গোঁজা ছিল একটা স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন মডেল সিক্স নাইন ফোর সিক্স ডাবল অ্যাকশন রিভলভার। ক্যালিবার নাইন এম-এম, বারো রাউন্ড গুলি ছোড়া যায়। ওজন সাড়ে সাতশো গ্রাম মতন। আমেরিকান জিনিস। এসব বিদেশি মাল পলান অনেক কষ্ট করে, অনেক খরচ করে জোগাড় করে। এই অস্ত্রটা ওকে আশাপুরের শাসন কায়েম রাখতে সাহায্য করে। এই আমেরিকান জিনিসটাকে সবাই ভয় পায়। আর এই ভয়টাকে পলান সবসময় জিইয়ে রাখে।
এই ছোট ছেলেটা সেই ভয়ংকর অস্ত্রটাকে টাচ করতে চায়!
পলান টি-শার্ট তুলে কোমর থেকে মেশিনটা বের করে নিল। আঙুলের চাপে ম্যাগাজিন ক্যাচ খুলে গুলি ভরতি ম্যাগাজিনটা বের করে মেশিনটা বাড়িয়ে দিল সায়নের দিকে।
‘নে, হাতে নে—ভালো করে টাচ করে দেখ…।’
সায়ন কাঁপা দু-হাত বাড়িয়ে রিভলভারটা নিল। অস্ত্রের হাতলটা মুঠো করে ধরতেই ওর গায়ে কাঁটা দিল। শিরায়-শিরায় বিদ্যুৎ খেলে গেল যেন। ওর বিশ্বাসই হচ্ছিল না ওর হাতের মুঠোয় একটা গোটা আসল রিভলভার।
পলান চোখ নাচিয়ে বলল, ‘একেবারে সাচ্চা আমেরিকান আইটেম। অনেক নোট খসিয়ে কিনতে হয়েছে। বুলেটও একসঙ্গে অনেকগুলো কিনে নিয়েছি—পরে পাওয়া যাবে না বলে…।’
সায়ন অস্ত্রটা হাতে নাচিয়ে ওটার ওজন আঁচ করার চেষ্টা করছিল। ওর কিশোর মুঠোয় অস্ত্রটা বেশ ভারীই লাগছিল। তাও তো পলানদা ম্যাগাজিনটা খুলে নিয়েছে!
পলানের হাতে ধরা ম্যাগাজিনটার দিকে আকাঙ্ক্ষার চোখে তাকাল সায়ন। ওটা রিভলভারে বাঁটের ভেতরে ঢুকিয়ে তালু দিয়ে ঠুকে সেট করে নিলে কেমন হয়? তারপর পলানদার পারমিশান নিয়ে একবার—মাত্র একটিবার—ফায়ার করবে ও। আচ্ছা, ঠিক আছে, ও না হয় আকাশের দিকেই ফায়ার করবে।
ব্যাপারটা ভাবতেই সায়ন শরীরে রোমাঞ্চ টের পেল। রিভলভারটার ট্রিগারে বারকয়েক আঙুলের চাপ দিল ও।
পলান সায়নের অবস্থাটা লক্ষ করেছিল। বোধহয় বুঝতেও পারল খানিকটা। তাই হেসে জিগ্যেস করল, ‘কীরে, ফায়ার করতে ইচ্ছে করছে তো?’
‘হ্যাঁ, পলানদা…।’ কেমন একটা ঘোর লাগা গলায় বলল চোদ্দো-পনেরোর কিশোর।
‘কোনও চিন্তা করিস না। সময় হোক, সব শিখিয়ে দেব।’
সায়ন তৃষ্ণার্ত চোখে পলানদার দিকে তাকিয়েছিল। মনে-মনে ভাবছিল, কবে? কবে? কবে?
কিশোর ছেলেগুলোকে ওর কাছাকাছি নিয়ে এসে এভাবেই ‘ক্ষমতা’ হাতের মুঠোয় তুলে দেওয়ার লোভ দেখায় পলান।
ও সায়নের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছিল। চপার, নেপালা, ভোজালি এবং রিভলভার—তবে লোডেড নয়। সায়ন অস্ত্রগুলো হাতে নিয়ে শুধু স্পর্শের রোমাঞ্চটুকু অনুভব করেছিল—কাউকে ও কখনও আঘাত করেনি। একইসঙ্গে ও বোমা তৈরির প্রথম পাঠ নেওয়া শুরু করেছিল এবং ‘ট্রেনিং পিরিয়ড’ দ্রুত শেষ করে সরাসরি বোমা তৈরির কাজে নেমে পড়েছিল। বোমা শুধু ও তৈরিই করত—কাউকে লক্ষ্য করে ও কখনও বোমা ছোড়েনি।
সায়নের এই ব্যাপারটা কিশোরীমোহনকে দু-একদিনের জন্য হলেও মিথ্যে সান্ত্বনা জুগিয়েছিল। ওঁর ছেলে কখনও কাউকে আঘাত করেনি। একফোঁটাও রক্ত ঝরায়নি কারও। শুধুমাত্র বোমা তৈরির অপরাধের দাগ লেগেছিল ছেলেটার গায়ে। কিশোরী আর ওঁর স্ত্রী সায়নকে ঠিক পথে ফিরিয়ে আনার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু একটা অ্যাক্সিডেন্ট সব ওলট-পালট করে দিল।
পলানের দলের সবাই সায়নের ব্যাপারটা জানে। তাই ওরা কিশোরীমোহনকে দেখলেই কম-বেশি অপরাধবোধে ভুগতে থাকে। ওদের মধ্যে তাতান কষ্ট পায় সবচেয়ে বেশি। কারণ, সায়ন ওর খুব ভালো বন্ধু ছিল।
মেঘের ফাঁক দিয়ে সূর্য আবার উঁকি মেরেছে। একটা মোলায়েম মিঠে রঙের রোদ ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে। সেই রোদের একফালি এখন কিশোরীমোহনের মুখে।
কিশোরীর জন্য পলানের একটু-একটু খারাপ লাগছিল। মানুষটার সঙ্গে যখনই দেখা হয় তখনই পলানের এই খারাপ লাগাটা শুরু হয়। সায়নের মুখটা স্পষ্ট মনে পড়ে যায়। মনে হয়, পলান যেন ছেলেটাকে জিগ্যেস করছে, ‘কীরে, তোর কী ইচ্ছে করে?’
আর শুনতে পায়, সায়ন যেন বড়-বড় উজ্জ্বল চোখ মেলে ওপার থেকে বলছে, ‘বাঁচতে ইচ্ছে করে, পলানদা—আমার খুব বাঁচতে ইচ্ছে করে…।’
খারাপ লাগাটা কাটাতে পলান পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করল। একটা সিগারেট নিয়ে ধরাল। সেটায় লম্বা টান দিয়ে সিগারেটের প্যাকেটটা সোমেন আর নোনতার দিকে এগিয়ে দিল : ‘নে, তোরা কে খাবি খা—।’
পলান সিগারেটে টান দিল আবার। হঠাৎই ওর কাশির দমক এল। মাথা ঝুঁকিয়ে কয়েকবার কাশল। ওয়াক তুলে থুতু ফেলল রাস্তায়। তারপর কী ভেবে থুতুর দলাটার দিকে তাকাল। মাথা এপাশ-ওপাশ করে খুব খুঁটিয়ে দলাটাকে দেখতে লাগল। কোমর থেকে শরীরটা ভাঁজ করে মাথা নামিয়ে চোখের নজর জোরালো করতে চাইল।
তাতান জিগ্যেস করল, ‘অমন করে কী দেখছ, পলানদা?’
পলান থুতুর দলাটার দিকে চোখ রেখেই মাথা নাড়ল, বলল, ‘না, কিছু না।’
পলান আবার সিগারেট টানতে লাগল। চোখ মেলে দিল সামনের ব্যস্ত রাস্তা ছাড়িয়ে দু-চারটে বাড়ির ফাঁক দিয়ে অনেক দূরের গাছপালা আর আকাশের দিকে।
মনে-মনে ভাবল, সিগারেট খাওয়াটা ছাড়তে হবে।
***
ববিনকে নিয়ে হেঁটে বারো নম্বর বস্তির দিকে ফিরছিল রোশন। নোনতার টুঁটি টিপে ধরতে ওর ভালো লাগেনি, ওকে থাপ্পড় মারতেও ভালো লাগেনি—বিশেষ করে ববিনের সামনে। কিন্তু প্রতিঘাতের এই ভাষা ছাড়া অন্য কোনও ভাষা কি নোনতা বুঝত? হয়তো বুঝত না, কিন্তু তা সত্ত্বেও রোশনের খারাপ লাগছিল।
ববিন হঠাং বলল, ‘কাকু, খুব জলতেষ্টা পেয়েছে—’
রোশন একটা টিউবওয়েলের খোঁজে এদিক-ওদিক তাকাল। না, নেই।
মিউনিসিপ্যালিটির একটা কল দেখতে পেল ববিন। একজন লোক বালতি আর মগ নিয়ে স্নান করছে সেখানে। ওলটানো ‘জ্র’ অক্ষরের মতো বাঁকানো একটা লোহার পাইপ। সেই পাইপের মুখ দিয়ে জল পড়ছে বালতিতে। জলের প্রেশার কমে যাবে বলে পাইপটাকে আরও উঁচু না করে বালতি বসানোর জায়গাটাকে এক ফুট ডিপ একটা চৌকো গর্ত মতন করা হয়েছে।
ববিন রোশনের দিকে মুখ তুলে বলল, ‘কাকু, ওই যে কল—কল থেকে জল খাব—।’
রোশন বকুনি দিল ওকে : ‘না, ওই কলের জল খেতে হবে না!’
‘কেন? কেন খাব না?’
ওর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে রোশন বলল, ‘চল, তোকে একটা কোল্ড ড্রিংক কিনে দিচ্ছি। তুই হাফ খাবি, আমি হাফ খাব।’ একটা পান-সিগারেটের দোকানের দিকে আঙুল তুলে দেখাল।
দোকানের একপাশে ফ্রিজ। তার ভেতরে সুন্দর করে সাজানো কোল্ড ড্রিংকের বোতল।
আঃ, দেখলেই তেষ্টা বেড়ে যায়! অন্তত ববিনের তাই হল। সেইজন্যই ও একটু আগের প্রশ্নটা ভুলে গেল।
মিউনিসিপ্যালিটির কলের জল কেন খাওয়া যাবে না সেটা বুঝিয়ে বললেও ববিনের মতো বাচ্চা ছেলে বুঝবে না। ওই জলের পাইপের নানান জায়গায় লিক আর ছোট-ছোট ফাটল রয়েছে। যখন পাম্প চালিয়ে মিউনিসিপ্যালিটি প্রথমবারের জন্য জল সাপ্লাই করেছিল, তখন কোনও সমস্যা হয়নি। কিন্তু সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে সেই পাইপে দেখা দিয়েছে অনেক লিক আর ফাটল। পাইপগুলো পাম্প হাউস থেকে বেরিয়ে মাটির তলা দিয়ে নানান দিকে গেছে। তার মধ্যে বেশ কিছু পাইপ গেছে কাঁচা ড্রেনের মধ্যে দিয়ে। তাই এখন যেই জল পাম্প করা বন্ধ হয় তখন বিভিন্ন নালার নোংরা জল হরেক ফুটো আর ফাটল দিয়ে ঢুকে যায় ফাঁকা পাইপের ভেতরে। পরে আবার যখন পাম্প চালু করা হয় তখন সেইসব নোংরা জল ভালো জলের সঙ্গে মিশে যায়। তাই আশাপুরের সবাই মিউনিসিপ্যালিটির কলে স্নান করে, কাপড় কাচে, বড়জোর হাত-টাত ধোয়—কিন্তু সেই জল খায় না, কিংবা রান্নার কাজে ব্যবহার করে না।
এখানকার লোকজনের মুখে রোশন শুনেছে, বহুবছর ধরেই নাকি কথা চলছে, খারাপ সব পাইপ পাল্টানো হবে। টাকা স্যাংশান হয়ে গেছে। কিন্তু বাস্তবে সেসব কাজ আর হয়নি।
পান-সিগারেটের দোকানটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল রোশন আর ববিন। দোকানে পান-সিগারেট, কোল্ড ড্রিংক ছাড়াও বিস্কুট আর লজেন্সের কৌটো সাজানো রয়েছে।
দোকানে আর কোনও খদ্দের-টদ্দের ছিল না। রোশন একটা কোল্ড ড্রিংকের বোতল চাইল। এই দোকানটায় রোশন আগেও এসেছে—তাই দোকানদার মুখ-চেনা।
লোকটির মাথায় কদমছাঁট চুল। মাথার পিছনে টিকি। মোটা গোঁফ। ফরসা নাদুসনুদুস শরীর। একটা লুঙ্গি পরে বাবু হয়ে বসে আছে। গায়ে লাল রঙের একটা গামছা জড়ানো।
দোকানদার রোশনের দিকে তাকিয়ে একচিলতে হাসল। তারপর একটা ঠান্ডা বোতলের ছিপি খুলে তাতে একটা স্ট্র ফেলে ওর দিকে বাড়িয়ে দিল। রোশন একটু হেসে বোতলটা নিয়ে ববিনের হাতে দিল।
‘আমি পুরোটা খেয়ে নেব? তুমি যে বললে হাফ খাবে—।’ ববিন বোতলের গায়ে হাত বুলিয়ে ঠান্ডা ভাবটা অনুভব করছিল।
‘তুই আগে হাফ তো খা। পারলে পুরোটা খেয়ে নে…।’
ববিন তাড়াতাড়ি স্ট্র-তে টান দেওয়া শুরু করল।
‘এই খোকার বাবা না মা মারা গেছে?’ দোকানদার ববিনের অশৌচের পোশাকের দিকে দেখিয়ে জিগ্যেস করল।
‘বাবা—ওর বাবা, গনিরাম। গোডাউন ফাইটের সময় হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছে…।’
‘হাঁ—অ্যায়সা হি সুনেছিলাম যে বারা নম্বর বস্তির কে একজন মারা গেছে।’
‘হ্যাঁ। শুক্রবার শ্রাদ্ধ। এই তো, আমরা পলানদার কাছে গিয়েছিলাম। গনিরামের শ্রাদ্ধের জন্যে পলানদা ডোনেশন দিয়েছে…।’
দোকানদার অবাক চোখে তাকিয়ে চাপা গলায় বলল, ‘পোলান পয়সা দিয়েছে! আমার তো তাজ্জব লাগছে। পোলান তো সহজে কাউকে টাকা-পয়সা দেয় না। উপরসে সুনেছিলাম কে কুছু দিন আগে ”আশাপুর লজ”-এর সামনে আপনাকে…।’
রোশন দোকানদার লোকটিকে হাতের ইশারায় থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, আমাকে ওর দলের গুন্ডাগুলো রাস্তার ওপর ধরে পিটিয়েছিল…।’
রোশন গড়গড় করে সবিস্তারে বলে গেল ওর মার খাওয়ার কাহিনি। সেইসঙ্গে মার খাওয়ার কারণটাও বলল। বলল, ‘বিশ্বরূপ জোয়ারদার সপ্তাহে-সপ্তাহে পলানকে টাকা দেন। প্রোটেকশন মানি—যার ডাকনাম হল ”তোলা”।’
‘আমিও তো টাকা দিই—’ দোকানদার বলল।
ছোট দোকান বলে এই দোকানদার লোকটি সপ্তাহে একশো টাকা করে দেয়।
ববিন স্ট্র-তে ঠোঁট চেপে টান দিচ্ছিল আর রোশনদের কথা চোখ বড়-বড় করে শুনছিল।
বোতলটার দিকে তাকিয়ে রোশন দেখল, বোতলে ক্লোল্ড ড্রিংক আর খুব বেশি পড়ে নেই। ও ববিনের হাত থেকে বোতলটা নিয়ে সেটুকু শেষ করল। ওর খিদে পাচ্ছিল। তখনই ওর হঠাৎ খেয়াল হল, ববিনটাও অনেকক্ষণ কিছু খায়নি। ও দোকানদারের কাছে চারটে বিস্কুট চাইল। দুটো নিজে নিল, দুটো ববিনকে দিল। বলল, ‘এ দুটো এখন খেয়ে নে। পরে ঘরে গিয়ে চানাচুর-মুড়ি খাবি—।’
ববিন কোনও কথা না বলে বিস্কুট দুটো খেতে শুরু করল।
কোল্ড ড্রিংক আর বিস্কুটের দাম মিটিয়ে রোশন ববিনকে নিয়ে হাঁটা দিল আবার।
এই রাস্তাটা সরু। লোকজনের চলাচল কম। বাঁ-দিকটায় গাছপালা আর আগাছার জঙ্গল। দূরে-দূরে ছাড়া-ছাড়া কয়েকটা ঘর-বাড়ি। তার মধ্যে দুটো দোতলা পাকা বাড়ি, আর বাকিগুলো একতলা—টিন অথবা টালির চালে ছাওয়া।
আকাশের দিকে তাকাল রোশন। মেঘটা আগের চেয়ে আরও গাঢ় হয়েছে। বৃষ্টি হলে পরই মুশকিল। ববিনটা ভিজে যাবে। তখন ওর ঠান্ডা না লেগে যায়!
রোশন তাড়াতাড়ি পা চালাল। ববিনের হাত ধরে টান দিল : ‘একটু তাড়াতাড়ি পা চালা। বৃষ্টি আসতে পারে—।’
সাইকেল রিকশা নিয়ে ফেরা যেত, কিন্তু বারবার রিকশা ভাড়ার ব্যাপারটা বড় গায়ে লাগে। আচ্ছা, কিছুদিনের জন্য একটা সাইকেল ভাড়া করে নিলে কেমন হয়? রোশন ভালোই সাইকেল চালায়। আর আশাপুরে বেশ কয়েকটা সাইকেল সারানোর দোকান আছে—সেগুলো আবার সাইকেলও ভাড়া দেয়। নাঃ, কাল থেকেই রোশন একটা সাইকেল ভাড়া নিয়ে নেবে। তা হলে ওর এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরির কাজটা অনেক সহজ হয়ে যাবে।
ওরা একটা বড় বাগানের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। বাগানটা পুরোনো, তার পাঁচিল এখানে আছে তো ওখানে নেই। বাগানের ভেতরে এলোমেলো গাছগাছালি। চারপাশটা মোটামুটি চুপচাপ। শুধু কয়েকটা পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে।
তারই মধ্যে একটা অদ্ভুত আওয়াজ ভেসে এল। আওয়াজটা রোশনের চেনা লাগল। আর সেই আওয়াজটা ভেসে আসছিল বাগানের ভেতর থেকেই।
রোশন থমকে দাঁড়াল। সঙ্গে ববিনও। আওয়াজটা কীসের খতিয়ে দেখা দরকার।
রোশন আড়চোখে আকাশের দিকে তাকাল। নাঃ, বৃষ্টি আসে তো আসুক। বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়ার চেয়ে আওয়াজটা খতিয়ে দেখা অনেক বেশি জরুরি।
রোশনের অন্তত তাই মনে হল।
ববিনকে সঙ্গে নিয়ে ভাঙা পাঁচিলের ফাঁক দিয়ে বাগানটার ভেতরে ঢুকে পড়ল ও। কান পেতে আঁচ করতে চাইল, আওয়াজটা ঠিক কোন দিক থেকে আসছে।
ভেতরে ঢুকতেই ছোট্ট একটু ফাঁকা জায়গা চোখে পড়ল রোশনের। মাটিতে এখানে-ওখানে ঘাস গজিয়ে রয়েছে। তার ওপরে ছড়িয়ে রয়েছে গাছের শুকনো পাতা। জায়গাটাকে ঘিরে রয়েছে কয়েকটা বড়-বড় গাছ। সেই গাছগুলোর গণ্ডি পেরিয়ে বেশ খানিকটা বড় জায়গা। জায়গাটা মাঠের মতো দেখতে হলেও তার মাঝখানটা নীচু—অনেকটা বাটির মতো। হয়তো এককালে ডোবা ছিল, পরে সেটা শুকিয়ে এরকম হয়ে গেছে।
সেই শুকনো ডোবার মধ্যিখানে সাত-আটটা ছেলে জড়ো হয়েছে। তাদের বয়েস বারো থেকে বড়জোর পনেরো-ষোলোর মধ্যে। পোশাক আধময়লা শার্ট বা টি-শার্ট, আর বারমুডা কিংবা ফুলপ্যান্ট। তবে দুজন ছেলের গায়ে লাল রঙের ময়লা হাতকাটা গেঞ্জি। চোখের ওপরে ছেঁড়া গামছার টুকরো দিয়ে পটি বাঁধা। ওরা ‘বাটি’-র ঠিক মাঝখানটায় মুখোমুখি দাঁড়িয়ে লড়ছে। একজন মুখে ‘হুঃ!’, ‘হুঃ!’ শব্দ করছে—কারণ, তার এখন মার খাওয়ার পালা। আর অন্যজন তখন মাটিতে পড়ে যাওয়া অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করছে।
বাগানের বাইরে থেকে ‘হুঃ!’, ‘হুঃ!’, আওয়াজটাই শুনতে পেয়েছিল রোশন।
লম্বা মতন একটা ছেলে ফাইটারদের কাছে দাঁড়িয়ে রেফারির কাজ করছে। বাকি চার-পাঁচজন ছেলে একটু দূরে বসে ব্লাইন্ড ফাইট দেখছে আর নিজেদের মধ্যে কথা বলছে, হাসাহাসি করছে।
রোশন একটা বড় গাছের আড়াল থেকে বালক অথবা কিশোরদের ব্লাইন্ড ফাইট দেখছিল। ওর শরীরের ভেতরে কতকগুলো ঠান্ডা স্রোত হিলহিলে সাপের মতো নানান দিকে বয়ে যাচ্ছিল। একবার ও ভাবল, পাশে দাঁড়ানো ববিনের চোখে হাত চাপা দেবে—কিন্তু তারপরই ওর মনে হল, ও কতক্ষণ হাত চাপা দেবে? ক’দিন হাত চাপা দেবে?
ব্লাইন্ড ফাইটের অসুখ মহামারীর মতো আশাপুরকে দখল করে নিয়েছে। এলাকার কিশোর ছেলেরা ধীরে-ধীরে শক্তির এই জুয়াখেলার নেশার ফাঁদে জড়িয়ে যাবে। তারপর দেখতে-দেখতে ক্ষয়ে যাবে।
এই এলাকাটা যত ক্ষয়ে যায় পলানের ততই লাভ। ওর দল ক্রমশ মাপে বড় হবে। তা ছাড়া, এই যে ছেলেরা নিজেদের মধ্যে আয়োজন করে ব্লাইন্ড ফাইট প্র্যাকটিস করছে, হয়তো এদের মধ্যে থেকেই উঠে আসবে আগামীদিনের ফাইটাররা। তারা পলানের গোডাউন ফাইটে নাম লেখাবে। তাদের লড়াকু চেহারা আর লড়াইয়ের কলাকৌশল দেখে দর্শকরা তারিফ করবে এবং তাদের পয়সা উশুল হবে।
পলানের ওপরে রোশনের খুব রাগ হল। একইসঙ্গে ওর মনে হল, আশাপুর প্রকৃতির তৈরি করা একটা কোমল শরীর। সেই শরীরের ধমনী, শিরা-উপশিরায় নিয়মিত বিষদাঁতের কামড় বসাচ্ছে পলান। ওর বিষে কোমল শরীরটা ক্রমশ নীল থেকে আরও নীল হয়ে যাচ্ছে।
রোশন স্তম্ভিত হয়ে দেখছিল। ওর ভাবনা গড়াতে-গড়াতে খারাপ দিকে চলে যাচ্ছিল। ও যেন কল্পনায় দেখতে পাচ্ছিল, কলাবতী নদীর তীরে ওই হতচ্ছাড়া গোডাউনের ভিতরে টগবগে তরুণ ববিন ব্লাইন্ড ফাইট লড়ছে।
ও ববিনের হাত ধরে টান মারল, বলল, ‘চল, বাড়ি চল—দেরি হয়ে যাচ্ছে…। এরপর পিসি খুব বকাবকি করবে।’
রোশন যখন ববিনকে নিয়ে আবার রাস্তায় বেরিয়ে এল তখন ওর মনে হল, ছোটদের এই ব্লাইন্ড ফাইট দেখে ওর বোধহয় জ্বর এসেছে।
ও আনমনাভাবে পথ হাঁটতে লাগল।
ওর মনের পরদায় এলোমেলো সিনেমা চলছিল। কখনও সেখানে কুশানকে দেখতে পাচ্ছিল, কখনও মা-কে কিংবা বাবাকে। কখনও দেখতে পাচ্ছিল জেলে ওর সঙ্গী কয়েদিদের—তার মধ্যে কিছু বন্ধু, কিছু শত্রু। আবার কখনও দেখতে পাচ্ছিল ওর আশাপুরের জীবন, দেখতে পাচ্ছিল আচমকা বম্ব ব্লাস্টে সায়নের শরীরটা ছিন্নভিন্ন হয়ে ছিটকে যাচ্ছে চারিদিকে।
হঠাৎই শিসের শব্দে ঘোর কাটল রোশনের। সামনেই একটা ডুমুর গাছ। সেটার একটা সরু ডালে বসে রয়েছে দুটো সিপাহি বুলবুল। হালকা-পলকা শরীর, দু-গালে লাল রং, মাথায় ছুঁচলো ঝুঁটি। ওরা পালা করে শিস দিচ্ছে। ছটফট করছে। ওদের ভারে ডুমুরের চিকণ ডালটা মৃদুমন্দ দুলছে।
ও ববিনকে দৃশ্যটা দেখাল : ‘দেখ, দেখ—কী সুন্দর!’
কাকুর কথায় ববিন তাকাল পাখিদুটোর দিকে। মুগ্ধ চোখে দেখতে লাগল।
প্রকৃতির এইসব সুন্দর ‘ছবি’-ই রোশন দেখতে চায়। সবাইকে দেখাতে চায়।
ওরা গাছটার খুব কাছাকাছি এসে পড়তেই পাখিদুটো চট করে উড়ে কোথায় যেন চলে গেল।
ববিনকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ামাত্রই রোশনের ওপর দিয়ে ছোটখাটো একটা ঝড় বয়ে গেল। ঝড়ের নাম ‘সাবিত্রী’।
‘এইটুকু একটা বাচ্চা সেই সকাল থেকে না খেয়ে না দেয়ে তোমার সঙ্গে টো-টো করে ঘুরছে! তোমার একটা আক্কেল নেই। বললাম, তাড়াতাড়ি ফিরে এসো, তো সে-কথা কে আর কানে তোলে! গনিটাও এইরকম ছিল। এই দিদিটা কিছু বললে সে-কথা ওর এক কান দিয়ে ঢুকত, আর এক কান দিয়ে বেরিয়ে যেত। পলানের ওই গোডাউনে গিয়ে মারপিট করতে ওকে কম বারণ করেছি! শেষ পর্যন্ত ওই গোডাউনই ওকে খেল। গোঁয়ার শয়তানটা আমাকে আর ববিনকে ফেলে রেখে পালিয়ে গেল। একবারও কি ভাবল আমাদের কথা!’ একটানা কথা বলতে-বলতে সাবিত্রী কেঁদে ফেলল। কান্না চাপতে শাড়ির আঁচল গুঁজে দিল মুখে। ফোঁপাতে লাগল।
রোশন ছোট্ট ধমক দিল, ‘দিদি কী হচ্ছে! ববিনের সামনে এমনি কোরো না। দাও, ওকে তাড়াতাড়ি খেতে দাও—।’
সাবিত্রী নিজেকে সামলে নিল। চোখ-টোখ মুছে ওদের ঘরের ভেতরে আসতে বলল। তাড়াতাড়ি হাত চালিয়ে ববিনের জলখাবারের আয়োজন করতে লাগল।
রোশন একটা টুলে বসল। পলানের দেওয়া টাকাটা সাবিত্রীর দিকে বাড়িয়ে ধরে বলল, ‘দিদি, এটা রাখো। সাতহাজার টাকা আছে—পলানদা দিয়েছে…।’
সাবিত্রী কী একটা কাজের মাঝে থমকে গেল। চট করে ঘুরে তাকাল রোশনের দিকে : ‘পলান সাতহাজার টাকা দিয়েছে!’
সাবিত্রী ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে পারছিল না। ও অবাক চোখে তাকিয়ে রইল। হাত বাড়িয়ে টাকাটা নিল। তারপর গনিরামের ফটোর দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলল, ‘আমার…আমার ভাইটার শেষ কাজ এবার ভালো করে করা যাবে…।’
***