অধ্যায় : ৭ – ‘অপারেশন সিকিম’
‘Special Operation : Sikim’
‘অপারেশন বাংলাদেশ’ শেষ। এক মাস পর একজন ঊর্ধ্বতন বেসামরিক কর্মকর্তা ‘র’ প্রধানের অফিসের বারান্দা দিয়ে হেঁটে (যাচ্ছিলেন) সভাকক্ষের দরজার নিকটে এসে থামলেন। টোকা দেয়ার পূর্বেই তাঁকে সাদরে ভিতের নিয়ে যাওয়া হলো।
সেখানে চারজন লোক নীরবে বসে চায়ে চুমুক দিচ্ছেন। শান্ত নীরব পরিবেশ তপ্ত চঞ্চল হয়ে উঠলো মুহূর্তে, “ভালো দেখিয়েছেন, কাজটা ভালোভাবেই হয়েছে (পাকিস্তান দ্বিখণ্ডীকরণ), এখন আমাদের পরবর্তী কাজ নিয়ে চিন্তা করতে হবে।” বাকি চারজন বিস্মিত হয়ে ভেবেই পেলেন না ‘এরপর আবার কি?’ “সিকিম, ভদ্রমহোদয়গণ সিকিম, দেখুন এটা নিয়ে কি বের করতে পারেন। আপনারা এ ব্যাপারে সিদ্ধান্তে আসতে ২৪ মাস সময় পেতে পারেন, অবশ্য সরকার যদি আদৌ কোনো ব্যবস্থা নেয়ার পরিকল্পনা নেয়”। বাকি আলোচনায় সকলেই একটার পর একটা আশ্চর্য অথচ সাংঘাতিক গুরুত্বপূর্ণ কথাই শুনলেন আর নতুন চিন্তার সূত্রগুলো সাজাতে লাগলেন গোয়েন্দা মস্তিষ্কের গ্রন্থিতে। অবশ্য ওই ক্ষমতাবান কর্মকর্তার এটা কোনো অফিসিয়াল সভা ছিল না বটে তবুও সিকিম নিয়ে আনঅফিসিয়াল চিন্তাভাবনা এভাবেই শুরু।
ক। ‘অস্থিতিশীল সিকিম’ (Turbulent Sikim)
তিব্বত, নেপাল, ভুটান এবং পশ্চিম বাংলা দ্বারা বৃত্তাবদ্ধ হিমালয়ের পূর্বে অবস্থিত সিকিম একটি মনোমুগ্ধকর রাষ্ট্র। এর ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব নির্ভর করে তিব্বতের (চীন) ও সিকিমের মধ্যবর্তী ভারতের অবস্থানের উপর (১৯৬২ সালে যুদ্ধে সিকিম চীনাদের কাছে ভারতকে দু’ভাগে ভাগ করে ফেলার একটি চমৎকার স্থান বলে বিবেচিত হয়েছিল, ১৯৭১ এর যুদ্ধেও ভারতের ভয় ছিল যে পাকিস্তান আর্মি হয়তো পূর্ব পাকিস্তানে তেঁতুলিয়া সীমান্ত হয়ে সিকিমের মাধ্যমে ভারতকে ভাগ করে ফেলবে, যার ফলশ্রুতিতে ভারতের পূর্বাঞ্চল হবে সরবরাহশূন্য আর সে অবস্থায় পূর্ব-পাকিস্তানকে ঘিরে পশ্চিম ও পূর্ব উভয় পাশে যুদ্ধ চালনা করা হবে অসম্ভব-অনুবাদক)।
চারটি প্রাচীন সম্প্রদায় সিকিমের আদি ও মূল অধিবাসী, এগুলো হলো লেপচা, ভুটিয়া, নেপালিজ ও সন্স। সবচেয়ে পুরনো বাসিন্দা হলো লেপচারা, যারা আবার রঙ্গ-পা বা গিরিখাদের উপজাতি বলেও পরিচিত। এরা সকলেই আসাম থেকে এসে সিকিমে সর্বপ্রথম বসিত স্থাপন করে। তারপর চৌদ্দশ শতাব্দীতে তিব্বত থেকে আসে ভুটিয়ারা, যাদের অনুসরণ করে আঠার উনিশ শতাব্দীতে নেপালীরা এসে বসবাস শুরু করে। সিকিমের শাসনকর্তা ছিল লেপচা-ভুটিয়া জাতিভুক্ত, যারা নীতির জন্য নেপালীদেরকে শাসনকার্য থেকে দূরে সরিয়ে রাখতো, যদিও নেপালীদের সংখ্যা ছিল উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। এই স্বজনপ্রীতিই হয়ে দাঁড়িয়েছিল শাসকগোষ্ঠী ও সংখ্যাগুরু শ্রেণীর মধ্যে অবিরত রেষারেষির অন্যতম কারণ।
সিকিমের ইতিহাস জাতিগত দ্বন্দ্ব ও অস্থিতিশীলতার ইতিহাস। এর সাথে ছিল পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলোর সাথে ক্রমাগত হানাহানি ও দীর্ঘস্থায়ী কোন্দল। ভারতে বৃটিশ রাজশক্তির অনুপ্রবেশের পর সিকিমও বৃটিশ রাজনৈতিক কূটচালে পতিত হয়। প্রথম বড় ধরণের ধাক্কাটি আসে ১৮৩৫ সালের সম্পাদিত চুক্তির মাধ্যমে যেখানে উল্লেখ ছিল “গভর্ণর জেনারেল মহাশয় দার্জিলিং পার্শ্ববর্তী পাহাড়শ্রেণী অধিগ্রহণের আকাঙ্ক্ষা ব্যাক্ত করিয়াছেন-এ জন্য যে, ইহার ঠাণ্ডা মনোরম আবহাওয়া সরকারি চাকুরেদের রোগমুক্তি লাভে সহায়ক হইবে। আমি- সিকিমের রাজা, সদাশয় গভর্নর জেনারেলের সহিত বন্ধুত্বের সম্মানে, দার্জিলিংকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী বরাবর উপহারস্বরূপ প্রদান করিলাম।”
১৮৫৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি সম্পাদিত এ চুক্তির প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সিকিম রাজা বিশেষ কিছুই ভাবেননি, যা ২৬ বছর পর সিকিমকে ভাবনায় ফেলেছিল।
এরপর অবিরাম সংঘর্ষ চলতে থাকে। যার ফলশ্রুতিতে ১৮৫০ সালে ‘দণ্ড বিধায়ক’ সমন্বয়ে একটি বৃটিশ অভিযাত্রীদল পাঠানো হয় যার অনুসরণ করে ১৮৬১ সালে আরো বড় একটি দল সিকিমকে ১৮৬১ সালের চুক্তিতে আসতে বাধ্য করে। এ চুক্তির প্রস্তাবনায় উল্লেখ করা হয়, “সিকিমে মহারাজার রাজ কর্মকর্তা ও পারিষদবর্গ অবিরাম দুর্ব্যবহার ও লুটতরাজ চালাইতেছে এবং মহারাজার বৃটিশ সরকারকে স্বাচ্ছন্দ্য প্রদানে অমনোযোগিতা-বৃটিশ সরকারের সহিত প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করিয়াছে, যাহা পূর্বের মধুর সম্পর্কের অবনতির কারণ; এ সমস্ত দিক বিবেচনা করিয়া বৃটিশ বাহিনী অবশেষে সিকিম দখল করিতে বাধ্য হইলো।”
এদিকে সিকিম-তিব্বত বৈরীতার অবসান হয় ১৮৯০ সালের এ্যাংলো-চাইনিজ কনভেনশনের মাধ্যমে। সিকিম, বৃটিশ সরকারের একটি ‘আশ্রিত রাজ্য’ হিসেবে চীনের স্বীকৃতিও লাভ করে। ১৮৮৯ সালে ক্লড হোয়াইট প্রথম বৃটিশ রাজনৈতিক অফিসার হিসেবে সিকিমে মনোনয়ন লাভ করেন, যিনি পরবর্তীতে সিকিমের শাসকে পরিণত হন। এরপর ১৯১৮ সালে আবার মহারাজার নিকট রাষ্ট্রক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়, কিন্তু সিকিম বৃটিশের ‘আশ্রিত রাজ্য’ হিসেবেই থেকে যায় এবং ১৯৩৫ সালের ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী বৃটিশ ভারতের একটি রাজ্যে পরিণত হয়।
১৯৪৬ সালে ভারতের ভাইসরয় লর্ড ওয়াভেল ঘোষণা করলেন “একদিকে রাজ্যসমূহ অন্যদিকে বৃটিশ রাজ এবং বৃটিশ ভারতের মাঝে রাজনৈতিক বিধি ব্যবস্থা নিরূপণে এখানেই ইতি টানা প্রয়োজন। ওই রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণ করার জন্য রাজ্যগুলোকে ক্রমানুযায়ী ফেডারেল সরকারের ব্যবস্থাধীনে আনা হইবে অথবা এর ব্যর্থতায় ওই সমস্ত রাজ্য বৃটিশ রাজ বা বৃটিশ-ভারত ও বৃটিশ রাজ উভয়ের সহিত নির্দিষ্ট কোন রাজনৈতিক ব্যবস্থাধীনে আনীত হইবে।” স্বাধীনতার পরপরই ১৯৫০ সালের মার্চ মাসে সিকিমের মর্যাদা-সিকিমের প্রতিনিধিদের কাছে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা হয়। এখানে চুক্তি সাধিত হয় এ শর্তে, “সিকিম ভারতের আশ্রিত রাজ্য হিসেবেই থাকিবে। ভারতীয় সরকার সিকিমের পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা ও যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য দায়ী থাকিবেন এ বিবেচনায় অভ্যন্তরীণ সরকার স্বায়ত্তশাসন ভোগ করিবেন, যে প্রকৃত প্রস্তাবে ভারতীয় সরকার আভ্যন্তরীণ আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থা তদারকের মূল দায়িত্বপ্রাপ্ত হইবেন।”
১৯৪৭ সাল পর্যন্ত, সিকিমের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, স্বাধীন ভারতের একটি অঙ্গরাষ্ট্র হিসেবেও একটি দায়িত্ববান সরকারের জন্য আন্দোলন করে আসছিল। এ সব দলগুলোর মধ্যে প্রধানতম ছিল ‘সিকিম স্টেট কংগ্রেস’। দ্বিতীয় জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল ‘সিকিম ন্যাশনাল পার্টি”, বৃটিশ রাজের সাথে পূর্বের অনুসৃত সম্পর্কের ন্যায় ভারতের সাথে অনুরূপ সম্পর্ক দাবি করছিল। তবে, ‘প্রজা সম্মেলন পার্টি’ মোটামুটি স্টেট কংগ্রেসের ন্যায় ভারতের সাথে মিলিত হবার আকাঙ্ক্ষাই পোষণ করে। এ তিন দলের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে জনরোষ বৃদ্ধি পাওয়ায় সিকিম সরকার এ পর্যায়ে কয়েকজন ‘স্টেট কংগ্রেস’ নেতাকে গ্রেপ্তার করেন ও একটি নির্বাচিত প্রতিনিধি সমন্বয়ে মধ্যবর্তী সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত নেন। এই পর্যায়ে পর্যাপ্ত প্রতিনিধিত্বের জন্য গোলমাল পাকিয়ে উঠে ও পরিস্থিতি হয়ে পড়ে বিশৃঙ্খল।
এ রকম পরিস্থিতিতে তিনটি দলের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়- প্রথমতঃ জনগণের সমর্থনে রাষ্ট্রীয় কার্য পরিচালনা ও সামাজিক, অর্থনৈতিক উন্নয়নে উদ্বিগ্ন ভারতীয় সরকার, দ্বিতীয়ত নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির দাবিতে উচ্চকিত জনগণ ও তৃতীয়ত অন্য একদল যারা পূর্বোক্ত দুই দলের মাঝামাঝি নির্বিরোধী ভূমিকা পালনেই সন্তুষ্ট।
আসন সংখ্যা বিতরণ ও ‘চোগিয়ালের’ (Chogyal-ধর্মরাজা) মনোনীত প্রার্থীদের মধ্যে বিতর্ক একটি জনপ্রিয় মন্ত্রিপরিষদ গঠনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। অবশেষে একজন ভারতীয় ‘দেওয়ানের’ নিযুক্তি প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ২০ মার্চ ১৯৫০ সালে মন্ত্রণালয়ের প্রেসনোটে উল্লেখ করা হয় যে, “বর্তমান সময়ের জন্য একজন ভারতীয় কর্মকর্তা রাজ্যের দেওয়ান হিসেবে রাজ্যের কার্যাদি পরিচালনা করিবেন”। ৫ ডিসেম্বর ১৯৫০ সালে সিকিম মহারাজা ‘তাসি নামগয়াল’ ও সিকিমের ভারতীয় কর্মকর্তা হরিম্বর দয়ালের’ মধ্যে আনুষ্ঠানিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তাসি নামগয়াল ১৯৬৩ সালের ২ ডিসেম্বর পরলোকগমন করেন ও ‘পালদেন থনদুপ’ তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন, যিনি ১৯৫৭ সালে প্রথম স্ত্রী মারা যাবার পর ১৯৬৪ সালে ‘হোপ কুক’ নামের একজন আমেরিকান মহিলাকে বিয়ে করেন। ১৯৬৫ সালের এপ্রিলের মধ্যে ভারতীয় সরকার রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ‘মহারাজার’ স্থলে ‘চোগিয়াল’ (ধর্ম রাজা) ও মহারাণীর জায়গায় ‘গিয়ালমো’ (Gyalmo) উপাধিকে স্বীকৃতি দান করেন।
১৯৬৭ সালের নির্বাচনের পর দেখা যায় যে, ১৮টি নির্বাচিত আসনের মধ্যে ‘সিকিম ন্যাশনাল কংগ্রেস’ ৮টি, সিকিম ন্যাশনাল পার্টি ৫টি, সিকিম স্টেট কংগ্রেস ২টি ও অন্যান্য দল ৩টি আসন লাভ করে। ১৮টি নির্বাচিত আসনের সাথে সাথে ‘চোগিয়াল’ জন সদস্য মনোনীত করেন (তিনজন সরকারি কর্মকর্তা ও তিনজন দল নিরপেক্ষ ব্যক্তি)। এবার পরিবেশ হয়ে ওঠে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের জন্য চমৎকার তীর্থভূমি।
খ। সি আই এ’র টোপ ( CIA – “Baiting Game” )
‘র’-এর রিপোর্ট অনুযায়ী ছোট্ট রাজ্য সিকিমে সি আই এ’র অনাকাঙ্ক্ষিত হস্তক্ষেপ স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে। এতোদিন অবশ্য সি, আই, এ সিকিমে কোনোবার নাক গলায়নি, কিন্তু সি আই-এর কলকাতার ‘রেসিডেন্ট এজেন্টকে’ সম্প্রতি হরহামেশাই সিকিমের বিভিন্ন গ্রুপের সাথে আড্ডা মারতে’ অর্থাৎ যোগাযোগ করতে দেখা যায়। এটিও সন্দেহ করা হয় যে, ‘চোগিয়ালকে’ একটি নিজস্ব পতাকা ও জাতীয় সঙ্গীতসহ স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য উস্কানি দেয়া হয়। ‘চোগিয়ালকে’ জাতিসংঘে সদস্যপদ লাভে উত্তেজিত করার লক্ষণ সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। সিকিম নিয়ে সি আই এ’র টোপ ফেলা এখানেই শুরু। চোগিয়াল যাতে প্রস্তাবিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেন, সেজন্য চীনা আক্রমণের অজুহাত খাড়া করে সি আই এ ‘পরিস্থিতি সৃষ্টিতে’ সচেষ্ট হয়ে ওঠে। যদিও ‘র’ এ ক্ষেত্রে চীনা আক্রমণের সম্ভাবনার কথা নাকচ করে দেয়।
গ। ‘র’-এর মৌলিক তথ্য সংগ্ৰহ (RAW Gathers Basic Data)
সিকিম বাংলাদেশ নয়। এ ক্ষেত্রে যে কোনো সামরিক পদক্ষেপ অনতিক্রম্য সমস্যার সৃষ্টি করবে বলেই অনুমান করা যায় (ভিতরে ও বাইরের জনসমর্থন ও আন্তর্জাতিক চাপ)। বিশ্ব জনমত বাংলাদেশ অপারেশনের মতো পক্ষে নাও থাকতে পারে। তাই এর সমাধান হতে হবে রাজনৈতিক। নয়তো ভারতকে হয় অস্থিতিশীল সিকিমের বোঝা কাঁধে নিতে হবে, না হয় সিকিমে বিদেশী হস্তক্ষেপ মেনে নিয়ে চলতে হবে।
অতঃপর সিকিমের চারটি জেলা সদর গ্যাংটক, মাঙ্গান, নামচিও, গিয়ালসিং-এ ‘র’-এর এজেন্টদের অনুপ্রবেশ করার নির্দেশ দেয়া হয়। তারা ধীরে ধীরে অপারেশনাল তথ্যাদি সংগ্রহ করতে আরম্ভ করে এবং ভারতকে যদি মাঠে নামতেই হয় তবে যেন সবকিছু গুছানো পাওয়া যায় সে ব্যবস্থা করার চেষ্টায় থাকে। আগন্তুকের সাথে ‘র’ সদর দপ্তরে ‘চারজন’ কর্মকর্তার আলাপচারিতার (এ প্রবন্ধের প্রথমে উল্লেখিত) আঠার মাসের মধ্যে ‘র’-এর ‘সব প্রস্তুতি শেষ হয়’, এখন শুধু মাঠে নামার পালা। এ সবের পরে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে ‘সিকিম অপারেশন’ সম্পর্কে আলোকাপাত করা হয় এটা অবশ্য নিশ্চিতই ছিল যে, সিকিমে স্বৈরতন্ত্র কায়েমে সি আই এ’র প্রচেষ্টা সফল হবে না এবং যদি সে ধরণের কোনো চেষ্টা হয়ও তবে তা হবে রক্তক্ষয়ী প্রচেষ্টা। ভারত বরাবরই সিকিমের শাস্তি ও উন্নয়নের ব্যাপারে আগ্রহী এবং সে মনে করে অস্থিতিশীল প্রতিবেশী সব সময়ই তার নিরাপত্তার ব্যাপারে আতঙ্কস্বরূপ।
এদিকে সিকিমের পরিস্থিতি ক্রমান্বয়ে খারাপের দিকে যেতে থাকে। সংখ্যাগরিষ্ঠ নেপালীরা ইতোমধ্যেই সরকারে সংখ্যালঘুতে পরিণত হয় যা তাদের মিথ্যাবাদী ‘চোগিয়ালের’ বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বিদ্রোহে ইন্ধন জোগায়। এমতাবস্থায় ‘র’ পুরোপুরি মাঠে নামার সবুজ সংকেত লাভ করে। (এটা জানা যায়, ‘র’-এর ২৪ ঘন্টার মধ্যে অপারেশন শুরু করার কথা জানতে পেরে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আশ্চর্য হয়ে যান)।
ঘ। নেতাদের হত্যা ষড়যন্ত্র (Conspiracy to Murder Leaders )
ক্রমান্বয়ে ঘটে যাওয়া ঘটনায় পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়, ষড়যন্ত্র দানা বেঁধে উঠছে; ‘চোগিয়ালের’ অপসারণ ও ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রে সম্পূর্ণ অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারে অনুষ্ঠিত গণভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ ‘হ্যাঁ’ ভোট প্রদান করায় ষড়যন্ত্রের পথ উন্মুক্ত হয় এবং ‘সোনম শেরিং’ (নিযুক্ত খুনি) এর গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে তা আরো দৃঢ় ভিত্তি লাভ করে। জিজ্ঞাসাবাদে সোনম শেরিং স্বীকার করে, ‘সিকিম গার্ডস গ্রুপের’ ক্যাপ্টেন সোনাম ইয়ংদা তাকে অস্ত্র, গোলাবারুদ ও ছয়শত টাকা দিয়ে বিখ্যাত নেতাদের হত্যার জন্য নিযুক্ত করেছিল। ক্যাপ্টেন ইংয়দা পূর্বে ‘চোগিয়ালের’ এ ডি সি হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন ও সম্প্রতি চোগিয়ালের সফরসঙ্গী হিসেবে নেপাল সফর করেন। ক্যাপ্টেন ইয়ংদাকে অতঃপর সিকিমের ২ কি. মি. দূরে উত্তর সিকিমের একটি রাস্তা হতে গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিশের কাছে দেয়া স্বীকারোক্তিতে ক্যাপ্টেন ইয়ংদা উল্লেখ করেন, বিখ্যাত নেতাদের হত্যা ষড়যন্ত্রের মূল হোতা ‘চোগিয়াল’ স্বয়ং এবং দু’মাস পূর্বেই এ সবের পরিকল্পনা করা হয়। সিকিমে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে এ সব গুপ্তহত্যা ঘটনানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবং পরিপূর্ণ সাফল্যের নিশ্চয়তা বিধানে একই সাথে বোমা বিস্ফোরণ, লুটতরাজ ও আগুন লাগানোর ব্যবস্থাও করা হয়। ক্যাপ্টেন ইয়ংদা আরো প্রকাশ করেন যে, “মি. এম, রাসাইল’ (সাময়িকভাবে বরখাস্ত অডিটর জেনারেল ও প্রেস সেক্রেটারি) ও ‘সিকিম গার্ডসের’ অ্যাডজুটেন্ট ‘ক্যাপ্টেন রাওলান্দ চেটরি’ এ পরিকল্পনা সম্পাদনে জড়িত এবং গ্যাংটকের জন্য বারোজন ও বাকি সিকিমের জন্য আটজন এজেন্টকে তাঁরা নিয়োগ করেন।
‘সিকিম গার্ডস’ থেকে নেয়া অস্ত্র গোলাবারুদ এজেন্টদের সরবরাহ করা হয় ও ‘মি. রাসাইল’ অগ্রিম ২০০০.০০ টাকাও তাদের প্রদান করেন। তিনি অন্তর্ঘাতী কাজের জন্য কলকাতা থেকে বিস্ফোরক নিয়ে আসেন। জরুরি অবস্থায় সিকিম হতে পালানোর জন্য ভূয়া কাগজপত্রও তাদের সাথে দেয়া হয়।
‘ক্যাপ্টেন ইয়ংদার’ স্বীকারোক্তি রেকর্ড করার চারদিন পর পুলিশ ‘চোগিয়ালের’ প্রাসাদে অস্ত্র, গোলাবারুদ বোঝাই একটি গুপ্তভাণ্ডারের সন্ধান পায়। এ সব অস্ত্রশস্ত্র সরকারি অস্ত্রাগার থেকে অপসারিত বলে প্রমাণিত হয়। (যদিও ‘চোগিয়ালের’ ব্যাখা ছিল যে, এ সব অস্ত্র যাতে মন্দলোকের হাতে না পরে সে জন্যই তিনি তাঁর গুপ্তভাণ্ডারে অস্ত্র লুকিয়ে রেখেছিলেন যা সরকার ‘চরম মিথ্যাবাদিতা’ বলে নাকচ করে দেয়)।
গু। ‘র’-এর বাধা প্রদান (RAW Counteracts)
‘র’ অপারেটররা গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠায় সাহায্যকারী ব্যক্তিদের সাথে যোগাযোগ স্থাপনে সক্ষম হয়। দেশে একটি পবিরর্তন ও প্রশাসনে জনগণের অংশগ্রহণের তীব্র আকাঙ্ক্ষা ‘র’ এজেন্টদের সবচেয়ে বেশি সাহায্যে আসে। ‘চোগিয়াল’ অপসারণ ও সিকিমের ভারত ভুক্তির বিরুদ্ধে পরিচালিত বিদেশী প্রচারণা ‘র’ এজেন্টদের প্রতি সহানুভূতিশীল জনগণের দ্বারা বাধা প্রাপ্ত হয়। মূলত: এই কারণেই এক লক্ষ চৌত্রিশ হাজার নেপালী, পঁচিশ হাজার লেপচা, তেইশ হাজার ভুটিয়া ও অন্যান্য সংখ্যালঘিষ্ট সম্প্রদায়ের মিলিত সিকিমে ‘চোগিয়াল’কে অপসারণ করার মতো একটি অতি প্রচলিত ধারণাকে উস্কে দেয়া ‘র’-এর জন্য কোনো কঠিন কাজই ছিল না। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নির্বাচিত নেতাদের ‘চোগিয়াল’ বিরোধী এ প্রচার আরো জোরদার করার জন্য বলা হয় এবং এ জন্য নির্দিষ্ট তহবিল এমনকি ঝুঁকি ভাতা’র (Danger Money) ব্যবস্থাও করা হয়।
‘র’-এর সূত্র মতে, সি আই এ’র সিকিম নিয়ে তৎপরতা ও ‘চোগিয়ালের’ হোপ কুক নামের আমেরিকান মহিলাকে বিয়ে করা একই সময়ে ঘটা দুটো ব্যাপার। এদিকে জনরোষ ও বিক্ষোভ দিন দিন বাড়তেই থাকে এবং অবশেষে ১৯৭৩ সালের এপ্রিলে ‘চোগিয়াল’কে রক্ষার জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনীকে হস্তক্ষেপ করতে হয়। ১৯৭৩ সালের ৮ মে ‘চোগিয়াল’ ‘একজন এক ভোটের’ নীতিতে প্রতি চার বছর পরপর নির্বাচিত প্রতিনিধি পরিষদ সমন্বয়ে একটি জনপ্রিয় সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য একটি সাংবিধানিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।
চুক্তি অনুযায়ী ১৯৭৪-এর ২৩ এপ্রিল নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ‘সিকিম স্টেট কংগ্রেস’, ‘সিকিম ন্যাশনাল পার্টি’ ও ‘প্রজা সম্মেলন’ এ নির্বাচনে অংশ নেয়। নির্বাচনের ফলাফল অনুযায়ী ‘সিকিম স্টেট কংগ্রেস’ ৩২টির মধ্যে ৩১টি আসন দখল করে এবং ‘কাজী লেন্দুপ দোর্জির’ নেতৃত্ব গ্রহণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সিকিম জাতীয় পরিষদ ভারতের সাথে অন্তরঙ্গ সম্পর্কের কথা ঘোষণা করে এবং ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রে সহযোগিতামূলক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব উত্থাপন করে। সিকিম জাতীয় পরিষদের এই প্রস্তাব অনুযায়ী ভারতীয় পার্লামেন্টে সিকিমকে সহযোগী রাষ্ট্র হিসেবে গ্রহণের জন্য সাংবিধানিক সংশোধনী ১৯৭৪ (৩৬তম সংশোধনী) গৃহীত হয়। কিন্তু এ সব কিছুই পরিস্থিতির পরিবর্তনে কোনো বিশেষ ভূমিকা রাখেনি, বরং ‘চোগিয়াল’ ও জাতীয় পরিষদের মধ্যে আরেকটি সংঘর্ষ আসন্ন বলেই অনুমিত হয়।
চ। গণভোট (The Referendum )
১০ এপ্রিল ১৯৭৫, সিকিম জাতীয় পরিষদে পাসকৃত এক প্রস্তাবে বলা হয়, “এখন হইতে ‘চোগিয়ালের’ পদ বিলোপ করা হইল ও এই মুহূর্ত হইতে সিকিম ভারতের সাংবিধানিক অংশ হিসেবে পরিগণিত হইবে”। এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের কয়েক মিনিটের মধ্যে কাজী লেন্দুপ দোর্জি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে’ এ ব্যাপারে অবহিত করেন ও তিনি স্বয়ং দিল্লি গিয়ে ইন্দিরা গান্ধী’ ও ভারতীয় প্রেসিডেন্টকে জাতীয় পরিষদে গৃহীত বিলের পূর্ণ বিবরণ পেশ করার অনুমতি প্রার্থনা করেন। লেন্দুপ দোর্জি ভারতীয় সরকারকে আরো অনুরোধ করেন, “অবস্থাভেদে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের”, যাতে এই সিদ্ধান্তকে নির্বিঘ্নে যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব কাজে পরিণত করা যায়। বিশেষ নির্বাচনে নির্বাচকমণ্ডলীর ৬০% ভাগ এই ব্যাপারে গণভোট অনুষ্ঠানের পক্ষে মত প্রদান করেন।
সিকিমের এরূপ কোলাহলপূর্ণ পরিস্থিতি ও তদনুযায়ী গৃহীত ভারতীয় সরকারের সিদ্ধান্ত ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী চ্যবনের বিবৃতিতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যেখানে তিনি বলেন, “আমি সম্মানিত সংসদ সদস্যগণকে সিকিমের পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা দিতে চাই”…
“যেহেতু এই সংসদ অবগত আছেন যে, ভারতীয় সরকার- ৮ মে ১৯৭৩-এর চুক্তি ও সিকিম সরকারের ১৯৭৪ সালের বিধান অনুযায়ী, যা গণতন্ত্রসম্মতভাবে সম্পাদিত বলে ধারণা করা যায়, সেই মতে সিকিমের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত আস্তরিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন”।
“উভয় চুক্তিতেই ‘চোগিয়াল’ ও সিকিমের জাতীয় নেতৃবৃন্দের সম্মতি ও সমর্থন রয়েছে। যা হোক, একদিকে একটি সাংবিধানিক উপায়ে নির্বাচিত দায়িত্বশীল সরকার ও অন্যদিকে সাংবিধানিক প্রধান হিসেবে ‘চোগিয়ালের’ মর্যাদা নির্ধারণ করেই সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন করা হয়েছিল, যার সফলতা পুরোপুরি নির্ভরশীল ছিল ‘চোগিয়ালের’ সদিচ্ছা ও এ চুক্তির ব্যবহারিক প্রয়োগের ওপর, সেখানে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে তাঁর একচেটিয়া ক্ষমতাভোগের পরিসমাপ্তি হবে, যা তিনি গত দুই দশক হতে ভোগ করে আসছেন।”
“সম্মানিত সাংসদগণ অবশ্যই অবগত আছেন যে, বিগত ২০ বছর ধরে সিকিমের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও জনগণ বিভিন্ন সময় ভারতীয় সরকারকে ‘চোগিয়াল’ পদের বিলুপ্তির জন্য অনুরোধ করে আসছেন। ভারতীয় সরকারের এ পর্যন্ত লক্ষ্য ছিল এই পদটিকে রক্ষা করার, যদিও বর্তমানে রাজা শাসিত রাজ্যগুলোতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের পর ‘রাজ আদেশ’ ব্যবস্থার উচ্ছেদ হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আমাদের গৃহীত ব্যবস্থা ছিল একটু অন্যরকম, যেখানে আমরা ‘চোগিয়ালের’ প্রতি একটু বিশেষ ছাড় দিয়েছিলাম এ আশায় যে, তিনি দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করবেন। এমতাবস্থায় বর্তমান সিকিম সরকার ও জাতীয় পরিষদ যা ‘একজন এক ভোটের’ ভিত্তিতে একটি অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়েছে, তারা চোগিয়ালের পদটির বিলুপ্তি চান এবং বিগত কয়েকমাস ধরে তাদের এই দাবির পুনরুল্লেখ করেন। গত বছর সেপ্টেম্বরের শুরুতে সিকিমের মুখ্যমন্ত্রী সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন যে, যদি সিকিমে গণতন্ত্রকে টিকে থাকতে হয় তবে চোগিয়ালকে অবশ্যই পদত্যাগ করতে হবে। আমাদের পক্ষ থেকে আমরা ধৈর্য্য ধারণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি এ আশায় যে, চোগিয়াল সাংবিধানিক দায়িত্ব নিয়ে সন্তুষ্ট থাকবেন ও আরো অধিক দায়িত্বজ্ঞানের পরিচয় দিবেন। যা হোক, আমরা চোগিয়ালকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছি, যখন আমরা চোগিয়ালের পদ রক্ষার্থে বিগত কয়েক বছর ধরে উদ্বিগ্ন, তখন আমাদের স্বাভাবিকভাবেই সাধারণ জনগণ ও তাদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও স্বার্থ রক্ষা করা প্রথম ও প্রধান আবশ্যিক দায়িত্ব। আমাকে অবশ্যই বলতে হবে, সিকিমের বর্তমান পরিস্থিতি একটি উদ্বেগপূর্ণ অবস্থায় পৌঁছেছে।”
“যদিও, নতুন ব্যবস্থা প্রয়োগের দিন থেকেই চোগিয়ালের বিবৃতি ও কার্য হতে এটাই স্পষ্ট হয়েছে যে, তিনি শুধুমাত্র তার সাংবিধানিক দায়িত্ব নিয়ে সুখী নন ও এই বিধি ব্যবস্থা প্রবর্তনে বাধা দিতে তিনি তাঁর সম্পূর্ণ ক্ষমতা নিয়ে এগিয়ে আসবেন।
“গত কয়েক মাস যাবত সিকিমের মুখ্যমন্ত্রী, তাঁর মন্ত্রীবর্গ ও সাংসদগণ ভারতীয় সরকারের নিকট দাবি পেশ করেছেন যে, যে পর্যন্ত ‘চোগিয়াল’ পদটি বর্তমান থাকবে ততোদিন পর্যন্ত সিকিমে গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখা দুষ্কর হবে। আমরা সিকিমের রাজনৈতিক নেতৃবর্গকে ধৈর্য্য ধারণের পরামর্শ প্রদান করেছি কারণ আমরা আশা করেছিলাম যে, শেষ পর্যন্ত ‘চোগিয়াল’ সিকিমের জনগণের বৃহত্তর স্বার্থ ও মঙ্গল চিন্তা করে সুবুদ্ধি ও সুবিবেচনা প্রসূত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। কিন্তু নিয়তির পরিহাস এই যে, এ সব আশা নিরাশায় পরিণত হয়েছে। চোগিয়ালের বিগত কয়েকমাসের কার্যক্রম সরাসরি সমস্যা সৃষ্টি করেছে। এবং সিকিমের নির্বাচিত নেতৃত্ব এ সবের দৃঢ় প্রতিবাদ করছেন ও ন্যায়সঙ্গতভাবে গণতন্ত্রের স্থায়িত্বে কয়েকমাস পূর্বে চোগিয়ালের স্বাক্ষরিত ও প্রচারিত ‘সিকিম এ্যাক্টের’ বৈধতার ব্যাপারে প্রশ্ন উত্থাপন করছেন। নেতৃবর্গের এ সব দাবি প্রচার প্রচারণার মাধ্যমে দাবিয়ে রাখা হয়, যাতে চোগিয়াল নিজে ব্যাপৃত ছিলেন অথবা প্রকাশ্যে উস্কানি দিয়েছেন। ভারতীয় সরকার অত্যন্ত ব্যথিত চিত্তে গত কয়েক সপ্তাহ যাবত লক্ষ্য করছেন যে, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানো, সরকারের কার্যাবলীতে বিঘ্ন সৃষ্টি ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতি ধ্বংস সাধনের জন্য সিকিমের রাজনৈতিক নেতৃবর্গ ও সাধারণ জনগণকে ভয়ভীতি প্রদর্শন, সন্ত্রস্ত করা, এমনকি শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা হচ্ছে, মুখ্যমন্ত্রীকে (লেন্দুপ দোর্জি) বিস্ফোরকের সাহায্যে হত্যার প্রচেষ্টা হয়েছে, চোগিয়ালের উপস্থিতিতেই তাঁর একজন পারিষদ কর্তৃক নিরস্ত্র সাংসদকে ছুরি মারা হয় এবং আরো অনেক হতাশাব্যঞ্জক তথ্যাদি নির্বাচিত সাংসদগণের বিরুদ্ধে ব্যাপক সন্ত্রাসী কার্যকলাপ পরিচালনার অল্প কয়েকদিন পূর্বে জানতে পারা যায়।”
“চোগিয়াল ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটার পরিপ্রেক্ষিতে আমি গত সপ্তাহে সর্বশেষ অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য পররাষ্ট্র সচিবকে গ্যাংটক যাবার নির্দেশ প্রদান করি। বিশেষ করে পররাষ্ট্রসচিব ‘চোগিয়ালকে’ সন্তুষ্ট করতে সবিশেষ চেষ্টা করেন। আমরা সব সময় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ধৈর্য্য ধারণ করার সনির্বন্ধ অনুরোধ করে এসেছি এই আশায় যে, চোগিয়াল সরকারের সাথে দ্বন্দ্বের পরিবর্তে সহযোগিতা করবেন। কিন্তু যদি সরকারকে কাজ করতে বাধা দেয়া হয়, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অপমান করা হয় এবং বিভিন্ন উপায়ে তাদের ভয়ভীতি প্রদর্শন করা অব্যাহত থাকে, তবে পরিস্থিতি জটিল সমস্যায় রূপ দিতে পারে। এই অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, এই প্রচেষ্টা আশানুরূপ ফল লাভে ব্যর্থ হয়েছে।”
“ক্রম অবনতিশীল আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও জনপ্রতিনিধিদের ওপর আসন্ন হামলার পরিপ্রেক্ষিতে মুখ্যমন্ত্রী অতিসত্বর সিকিম গার্ডসকে নিরস্ত্র ও নিষিদ্ধ করার জন্য আমাদের জরুরি অনুরোধ জানিয়েছেন। এমনকি এটার পূর্বে মুখ্যমন্ত্রী আমাদের নিকট প্রস্তাব করেছেন যে, তিনি জনগণের টাকায় গড়ে ওঠা কয়েকশ সশস্ত্র ব্যক্তিকে শুধুমাত্র চোগিয়ালের একান্ত ব্যবহারের জন্য সমর্থন করতে পারেন না। সম্মানিত সংসদ সদস্যগণ আপনারা অবশ্যই এটা মেনে নেবেন না যে, চারশত ব্যক্তিগত সশস্ত্ররক্ষী ‘চোগিয়ালের’ আওতাধীনে রাজপ্রাসাদে থাকবে কিন্তু তাদের ভরণ-পোষণ করা হবে জনগণের টাকায়। মুখ্যমন্ত্রী (লেন্দুপ দোর্জি) ও তাঁর সহকর্মীগণের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র সফল করার চেষ্টায় সিকিম গার্ডসের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে যা ভারতীয় সরকারকে আরো জরুরি ভিত্তিতে মুখ্যমন্ত্রীর আবেদন বিবেচনার তাগিদ দিয়েছে। কারণ সিকিমের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করা ভারত সরকারের দায়িত্ব। সরকার ৯ই এপ্রিল বিকালে সিকিম গার্ডসকে নিরস্ত্র করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। শেষ করার পূর্বে আমি সিকিমের রাজনৈতিক নেতৃবর্গের আরেকটি দাবির উল্লেখ করতে চাই যা তাঁরা বিভিন্ন সময়ে ও বিগত কয়েক সপ্তাহ ধরে পূনঃপুনঃ করে আসছেন। তা হলো যে, নির্বাচিত সরকার হিসেবে তাদের অধিকার ও দায়িত্ব হচ্ছে ভারতীয় ইউনিয়নের সাথে সাংবিধানিক অংশ হিসেবে সমমর্যাদা লাভের ইচ্ছা। এই অনুরোধ ভারতীয় জীবনধারার মূলস্রোতের সাথে পুরোপুরি অংশগ্রহণের জন্য সিকিমের জনদাবি, যা উৎসারিত হয়েছে ঐতিহ্যগত ভাবালুতার সচেতন প্রকাশভঙ্গির মাধ্যমে। এখানে আবারো উল্লেখ করা যাচ্ছে যে, সিকিম গণপরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত ১০ এপ্রিলের বিধান মতে ‘চোগিয়ালের’ পদ বিলোপকরণ দাবীর যথার্থতা সম্পর্কে ভারতীয় সরকার গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করেন। (এশিয়ান রেকর্ডার, মে ২১, ১৯৭৫)। এই প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে, ভারতীয় সংসদ ২৬ এপ্রিল ১৯৭৫ সালে সিকিমকে ভারতের ২২তম প্রদেশ রূপে গ্রহণের জন্য সংবিধান সংশোধনী বিল (৩৮তম সংশোধনী) পাস করে। ‘র’ একটি ‘রাজা শাসিত’ রাষ্ট্রকে ভারতের গণতান্ত্রিক প্রদেশে পরিণতকরণে এভাবেই সাহায্য করেছিলো। ‘চোগিয়াল’ রাজনৈতিক নেতৃত্ব নির্মূল করে সিকিমে পূর্ণ কর্তৃত্ব স্থাপনে কতটুকু অগ্রসর হয়েছিলেন তা এখনো রহস্যই রয়ে গেছে। এতো সবের পরেও অবস্থা বিশৃঙ্খলই রয়ে যায়। একদিকে যে কোনো মূল্যে ‘চোগিয়ালের’ পদ রক্ষার জন্য বিদেশী এজেন্সিগুলো ও কায়েমি স্বার্থবাদীরা সর্বশক্তি নিয়োগ করে আর অন্যদিকে অবস্থান নেয় জনসমর্থিত নির্ভীক রাজনৈতিক নেতৃত্ব। ‘র’-এর দু’পক্ষের মাঝে হস্তক্ষেপ করে এবং সাফল্যের সাথে জনস্বার্থ পরিপন্থী পরিকল্পনার মোকাবেলা করে।
চার বছর পরেও ‘র’ সিকিমে গণতন্ত্রায়নে বাধাদানকারীদের সম্পূর্ণ ধ্বংস সাধনে ব্যস্ত ছিল। তখনও কিছু কিছু স্থানীয় নিয়োগকৃত এজেন্টদের পয়সা দিয়ে পুষতে হয়। তারা ‘র’-এর সাথে জড়িত থাকায় সিকিমকে ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের ২২তম প্রদেশ হিসেবে পরিপূর্ণভাবে যুক্তকরণে বিশেষ সুবিধা হয় ও তাড়াতাড়ি গণতন্ত্রায়নের কাজ সমাপ্ত হয়। এ পর্যায়ে উল্লেখ্য যে, কংগ্রেস সরকরের পতন ও জনতা দলের ক্ষমতা গ্রহণের কারণে এ সব স্থানীয় এজেন্টদের নতুনভাবে টাকা বরাদ্দ করতে দেরি হয়ে যায় এবং শেষে জনতা দলের (প্রধানমন্ত্রী মোরারজী দেশাই-এর বিশেষ অনাগ্রহের কারণে) ক্ষমতাকালীন এ ক্ষেত্রে কোনো নতুন টাকা বরাদ্দ করা হয়নি।
এভাবেই ‘র’-এর সিকিমে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি প্রবর্তনের জন্য পরিচালিত ‘অপারেশন সিকিমের’ ইতি ঘটে। ‘র’ এজেন্ট ও অন্যান্য যারা এ ব্যাপারে জড়িত ছিল তাদের সকলের কার্যাবলী ‘র’ দপ্তরে ‘অতি গোপনীয়’ হিসেবে রক্ষিত আছে এবং রক্ষিত থাকবে যতক্ষণ পর্যন্ত না সরকার তা জনসমক্ষে প্রকাশের অনুমতি প্রদান করেন। তবে এটা নিশ্চয়ই বলা যায় যে, বিভিন্ন বিদেশী সংস্থার গণতন্ত্রায়নে বাধা দান প্রক্রিয়া ‘র’-এর সঠিক সিদ্ধান্তের কারণে মুকুলেই বিনষ্ট হয়ে যায়।