অধ্যায় : ১ – গুপ্তচর প্রতিষ্ঠান
The Institute of Spies
‘আমি গুপ্তচর,’ ‘তুমি গুপ্তচর’-এ ধরণের লুকোচুরি খেলা বহুদিন যাবত পৃথিবী জুড়ে চলছে। ‘পাতলা বা অকিঞ্চিৎকর’ আবরণে সত্য পরিচয় ঢেকে রেখে গুপ্তচরবৃত্তি চালানো ইন্টেলিজেন্স জগতে বহুল আলোচিত একটি পদ্ধতি, যদিও এ ‘ঢেকে রাখা’ স্বীকৃত নৈতিকতার মানদণ্ডে বড় ধরণের প্রশ্নসাপেক্ষ কোনো ব্যাপার নয়। অন্যদেশের গুপ্তচর নিজদেশে প্রায় খোলাখুলিভাবে শুধু ‘যৎকিঞ্চিৎ পাতলা আবরণের’ (Cover, কূটনৈতিক পরিচয়) আড়ালে গুপ্তচরবৃত্তিতে নিয়োজিত থাকে। কিন্তু যখনই ঐ ‘পাতলা আবরণ’টি খসে যায় তখন নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, সে গ্রেপ্তার হতে চলেছে।
সকলের মনেই একটি মৌলিক প্রশ্ন জাগতে পারে “গুপ্তচর কেন?” এ ক্ষেত্রে সহজ স্বাভাবিক উত্তর হচ্ছে “টিকে থাকার জন্য”।
ক। প্রাচীন যুগে গুপ্তচরবৃত্তি (Spies in Ancient Times )
টিকে থাকার সংগ্রাম, পৃথিবীতে প্রাণ বা জীবন উদ্ভবের দিনের মতোই পুরানো। প্রাচীন প্রস্তর, লৌহ ও তাম্র যুগে আমরা পাথর ও ধাতব অস্ত্রের সন্ধান পাই। এ সব অস্ত্র-শস্ত্র শুধু খাদ্য সংগ্রহের জন্য নয় বরং হিংস্র প্রাণীর আক্রমণ ও পরবর্তীতে সহযোগী মানুষের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার জন্যও ব্যবহৃত হয়েছে। টিকে থাকার সংগ্রাম শুধু অস্ত্রের গুণগত মান ও তার ব্যবহারের প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল ছিল না বরং শত্রুর চরিত্র সম্পর্কে জ্ঞানের ওপর অর্থাৎ কখন, কোথায় এবং কিভাবে শত্রু আক্রমণ চালাবে এ সমস্ত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে আবর্তিত হয়েছে।
এ ধরণের তথ্য সংগ্রহের উপর টিকে থাকা ও বিজয় ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং তথ্যের অভাব ও দুষ্প্রাপ্যতা পরাজয় ও মৃত্যু ডেকে আনার জন্য যথেষ্ট। সুতরাং টিকে থাকার এ সংগ্রামে কিছু লোক নিজেদের তথ্য সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত করলো যারা ‘জাসুস’ (Spy) অর্থাৎ ‘গুপ্তচর’ হিসেবে পরিচিত। এ পদ্ধতি ধীরে ধীরে উন্নতি লাভ করে এবং বর্তমানে যাকে আমরা ‘এসপায়োনেজ’ বলে জানি সে অভিধায় ভূষিত হয়। প্রাচীন ভারতীয় পুঁথিপত্রেও গুপ্তচরবৃত্তির বিভিন্ন কাহিনীর উপস্থিতি লক্ষণীয়। ‘মনুর’ চরিতাবিধানে এ ব্যাপারে স্পষ্ট উল্লেখ্য যে, “রাজা বা শাসনকর্তা অবশ্যই নিজদেশে ও তার শত্রুদেশে গুপ্তচরের মাধ্যমে খবরাখবর সংগ্রহ করবেন।” বেদ, মহাভারত, রামায়ণেও এরূপ বিভিন্ন বর্ণনা পাওয়া যায়; রামায়ণে বিদেশি দেশগুলোয় গুপ্তচর মারফত লক্ষ্য রাখার জন্য বলা হয়েছে। তদ্রুপ মহাভারতে দুর্যোধনের গুপ্তচরবৃত্তির উদাহরণ পাওয়া যায়। বাইবেলে হজরত মূসা (আ.) এর জাজের-এ গুপ্তচর পাঠানোর উল্লেখ্য আছে। (Nam xxi 32 )।
খ। সান জু (San Tzu)
কখন এবং কোথায় একটি পূর্ণাঙ্গ এসপায়োনজ নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠে তা বলা আজ অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার; বিশেষ করে আমরা যখন যিশু খ্রিষ্টের জন্মের শত শত বছর পূর্বের ঘটনাবলী নিয়ে অনুসন্ধান করি। রিচার্ড ডিকেন তাঁর ‘A History of the Chinese Secret Service’-এ উল্লেখ করেছেন, যিশু খ্রিষ্টের জন্মের ৫১০ বছর পূর্বে ‘সান জু’, ‘পিং ফা’ (Pin Fa) বা ‘Principle of War’ শীর্ষক বইয়ে জানামতে সর্বপ্রথম যুদ্ধের কলাকৌশল ও এসপায়োনেজ সম্পর্কে সাধারণ ধারণা দেয়ার চেষ্টা করেন। ওই বইটিতে বিশেষভাবে একটি গুপ্তচর সংস্থার সংগঠন সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়। যদিও এ ব্যাপারে দৃঢ়ভাবে কিছু বলা সম্ভব নয় তথাপি একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, গুপ্তচরবৃত্তি সম্বন্ধীয় ওই গ্রন্থটিই সবচেয়ে পুরোনো লিখিত নথি হিসেবে স্বীকৃতি পাবার দাবিদার।
‘Principle of War’ বইয়ে ‘সান জু’ পাঁচ প্রকার গুপ্তচরবৃত্তি ও পাঁচ ধরণের ‘গুপ্তচর’ সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। এরা হচ্ছে যথাক্রমে-
স্থানীয় গুপ্তচর (Local Spy)
শত্রুদেশে ভালো আচরণ ও সহৃদয় ব্যবহারের মাধ্যমে জনগণের মন জয় করে গুপ্তচরবৃত্তিতে নিয়োজিত থাকে এমন ব্যক্তি।
অভ্যন্তরীণ গুপ্তচর (Internal Spy)
শত্রুদেশের বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তাদের ‘তথ্যের সূত্র’ হিসেবে ব্যবহার করার মাধ্যমে তদের গুপ্তচর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা।
রূপান্তরিত গুপ্তচর (Converted Spy)
শত্রুদেশীয় গুপ্তচরদের ঘুষের মাধ্যমে তাঁর নিজ সংস্থায় ভুল তথ্য পাচারে প্ররোচিত করা ও তাঁর নিজ জনগণের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তি পরিচালনা করা।
অনুপযুক্ত বা বাতিল গুপ্তচর (Condemned Spy)
যে সমস্ত গুপ্তচর শত্রু দ্বারা বন্দী হয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল তথ্য প্রদান করে।
সাধারণ গুপ্তচর (Ordinary Spy)
সাধারণ নিয়মিত ক্যাডারভুক্ত সশস্ত্র বাহিনীর গুপ্তচর।
গ। কৌটিল্য’র আর্থশাস্ত্র (Kautilya’s Arthashastra)
ভারতে কৌঠিল্যের “আর্থশাস্ত্র’ গুপ্তচরবৃত্তি সম্পর্কিত লেখনীর জগতে সবিশেষ উল্লেখ্যযোগ্য। কৌটিল্য ইতিহাসে ‘বিষ্ণুগুপ্ত’ ও ‘চাণক্য’ নামেও সমধিত পরিচিত। শ্যামসাস্ত্রী তাঁর ‘আর্থশাস্ত্রে’র অনুবাদে এ বইটির রচনাকাল ৩২১ খ্রিষ্টপূর্ব সাল হতে ৩০০ শত খ্রিষ্টপূর্ব সালের মধ্যে বলে মত প্রকাশ করেছেন।
কৌটিল্য অত্যন্ত সুন্দর লৈখিক বর্ণনার মাধ্যমে ‘মৌর্য’ও ‘মৌর্য পরবর্তী’ রাষ্ট্র শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে তাঁর বইয়ে বিভিন্ন ঘটনার উল্লেখ্য করেছেন।
কৌটিল্যের মতানুযায়ী গুপ্তচরদের প্রাথমিকভাবে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। যারা ‘স্থানীয় এজেন্ট’ ও ‘পরিব্রাজক বা ভ্রাম্যমাণ এজেন্ট’ (এরা আবার তত্ত্বাবধায়ক এজেন্ট রূপে ও চিহ্নিত) হিসেবে পরিচিত। ‘স্থানীয় এজেন্ট’ তার কর্তৃত্বাধীনে যাদের নিয়োজিত করবেন তারা বিভিন্ন আবরণে ভিন্ন ভিন্ন নামে চিহ্নিত। এরা হলো ‘শঠ/অসৎ শয্য’, ‘সন্ন্যাসী’, ‘গৃহস্বামী/গৃহস্থ’, ‘ব্যবসায়ী’ এবং তপশ্চর্যায় নিয়োজিত ‘যোগী/তাপস’ শ্রেণীর ব্যক্তিত্ব। আবার ‘পরিব্রাজক’ বা ‘ভ্রাম্যমাণ এজেন্টের’ আওতায় আসা গুপ্তচররা হচ্ছেন ‘সতীর্থ/সহযোগী গুপ্তচর’, ‘জনরোষ প্রজ্জ্বলনকারী গুপ্তচর’, ‘বন্দী গুপ্তচর’ এবং ‘যাদুকর মহিলা গুপ্তচর’। কৌটিল্য এ সবের সাথে পুরোহিত ও সন্ন্যাসিনী গুপ্তচরের বিবরণও তাঁর বইয়ে উল্লেখ্য করেছেন; যা, তাঁর গুপ্তচর হিসেবে বিভিন্ন ও ব্যাপক প্রকৃতি বা পেশার লোকদের নিয়োজিত করার চাতুর্যপূর্ণ ইচ্ছার প্রকাশ ঘটায়।
যদিও কৌটিল্য একটি সুশৃঙ্খল রাষ্ট্রব্যবস্থায় বিশ্বাসী ছিলেন কিন্তু জনগণের ‘ধর্মীয় অনুভূতির’ নীতিজ্ঞান বর্জিত যত্রতত্র ব্যবহারে তাঁকে যথেষ্ট প্ররোচণা দিতে দেখা যায়। আবার গুপ্তচররা অসংখ্য অগণিত ছদ্মাবরণে লুকিয়ে কাজে নিয়োজিত থাকায় একে অন্যের সাথে বাস্তবসম্মত উপায়ে যতদূর সম্ভব অপরিচিত থাকাই বিধেয় বলে কৌটিল্য মনে করেন।
রাজা কৌটিল্য সবসময় শুধু একজন গুপ্তচরের সংগৃহীত তথ্যের উপর নির্ভর করতে নিষেধ করতেন। তিনি এসপায়োনজে পাঁচটি স্তম্ভের বর্ণনা দিয়েছেন যা বিভিন্ন সূত্র হতে প্রাপ্ততথ্যাদি পরীক্ষণ ও যাচাইয়ের মাধ্যমে সম্পূর্ণ ইন্টেলিজেন্স বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করবে এবং ‘সাইফার’ (গোপন লিপি) ও ‘বহনকারী কবুতর’-এর মাধ্যমে গুপ্তচররা ইন্টেলিজেন্স তথ্যাদি প্রেরণ করবে।
গুপ্তচরদের অসংখ্যা দায়িত্ব পালন করতে হয়। তাদের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সর্বনিম্ন পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের চালচলন, কর্তব্য সম্পাদন ইত্যাদি যাবতীয় বিষয়ে লক্ষ্য রাখতে হয়। রাজ্য ও রাজা সম্পর্কে জনোপলব্ধি রাজাকে জানাতে হয় এবং তাঁরা বর্বরতা ও অপরাধ শনাক্ত করার মাধ্যমে ন্যায়বিচার ও প্রশাসনকে সহায়তা করে থাকেন। সর্বশেষ কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, তারা পার্শ্ববর্তী দেশের রাষ্ট্রীয় ঘটনাবলীর উপর নিখুঁত তথ্য সংগ্রহ করবেন ও তাদের কৌশল শনাক্ত করে ধ্বংসের মাধ্যমে শত্রুর সাফল্যকে অকার্যকর করে দেবেন।
বিদেশী রাষ্ট্রসম্পর্কিত এসপায়োনেজ ব্যাপকভাবে তিনটি স্তরের ওপর নির্ভরশীল, যা বিশেষভাবে রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও সামরিক বিষয়াদির সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। রাজনৈতিক ইন্টেলিজেন্স পরিচালনার ক্ষেত্রে সাধারণ শত্রুদেশে প্রেরিত গোপন দূত, অসন্তুষ্ট ও বিশ্বাসঘাতক শ্রেণীর সাহায্য নেয়া হয় এবং পরবর্তীতে শত্রুদেশের ধ্বংস সাধনে এদের সহায়তার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। কূটনৈতিক ইন্টেলিজেন্স বা এসপায়োনেজ পরিচালিত হয় বিদেশে প্রেরিত রাষ্ট্রদূত ও কূটনীতিকদের মাধ্যমে। শান্তিকালীন শুধু আলাপ-আলোচনা চালানোই এদের একমাত্র কাজ নয় বরং যে দেশে তাঁরা দূত হিসেবে প্রেরিত সে দেশের সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণও তাঁদের একটি অত্যন্ত গুরুতপূর্ণ কাজ। এ ক্ষেত্রে যে সব তথ্য সরাসরি বা পরোক্ষভাবে তাঁদের নিজ দেশের স্বার্থের সাথে সম্পৃক্ত তা সংগ্রহ করায় বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়।
এটা দিবালোকের মতো পরিষ্কার যে, প্রাচীন ভারতের রাষ্ট্রদূতগণ (বর্তমানকালের দূতগণও) শুধু তাঁদের রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্বই করেননি বরং সাথে সাথে প্রচলিত আইনের ছাতার নিচে একজন সম্মানিত (1) গুপ্তচর হিসেবেও কাজ করেছেন।
অন্যদিকে সামরিক ইন্টেলিজেন্সে কিছু গুপ্ত এজেন্টকে প্রশিক্ষণদান শেষে নিয়োগ করা হতো- শত্রুদের সশস্ত্র বাহিনীর প্রকৃত ও নিখুঁত সম্পদ (অস্ত্রশস্ত্র) সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ, তাদের পরিকল্পনা, চলাচলের দিকে নজর রাখা এবং সর্বোপরি নিজ সশস্ত্র বাহিনীকে শত্রুর বিষাক্ত গোয়েন্দা তৎপরতা থেকে মুক্ত রাখার জন্য।
এরপরও কৌটিল্য অগ্রসর বিভিন্ন শিবিরে ও অগ্রবর্তী সীমান্তে গুপ্তচর নিয়োগের পরামর্শ দিয়েছেন। এ সব গুপ্তচরের একটি অবশ্যকরণীয় কাজ ছিল ‘নিজেদের সমরসজ্জার সাফল্যকীর্তন করা ও শত্রুর ক্রমাগত ব্যর্থতার’ প্রচারণা চালিয়ে নিজ সেনাবাহিনীর মনোবল চাঙ্গা রাখা ও শত্রুর বিরুদ্ধে প্রবল মানসিক বা স্নায়বিক যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া। এছাড়াও তারা শত্রুকে বিব্রত, তাঁদের মধ্যে ভেদাভেদ সৃষ্টি ও শত্রু দেশের রাজাকে তাঁর দূর্গ পতন কিংবা পুড়ে যাওয়া, রাজপরিবারে বিদ্রোহ অথবা অন্যকোনো শত্রু বা জংলি রাজার আন্দোলনের সংবাদ দিয়ে হতচকিত করার কাজে ব্যাপৃত থাকতো।
এসপায়োনেজ পরিচালনার ক্ষেত্রে যে কোনো প্রক্রিয়া গ্রহণ করা ‘জায়েজ’ বলে স্বীকৃত- যেমন- গুপ্তচরবৃত্তি, মিথ্যা কথা, ঘুষ, বিষ প্রয়োগ, নারীর ছলনা ও গুপ্তঘাতকের ছুরি। শক্তিশালী প্রতিবেশীর শাসানিতে ভীত ছোট রাষ্ট্রের রাজার প্রতি কৌটিল্য মূলত গুপ্তচরদের ওপর নির্ভর করতে ও ‘ষড়যন্ত্র যুদ্ধ’ (Batte of Intrigues) এবং ‘গোপন যুদ্ধ’ পরিচালনার উপদেশ দিয়েছেন। গুপ্তচরদের সাফল্য লাভের জন্য তাদের সর্বপ্রকার জালিয়াতি, চাতুরী, আগুন লাগানো ও চুরি-ডাকাতি করার প্রয়োজন আছে বলে তিনি মনে করতেন। এ ক্ষেত্রে গুপ্তচরদের উদ্দেশ্য হচ্ছে মিথ্যা সংবাদ প্রচারের মাধ্যমে শত্রুসেনাদের হতাশ করা ও মন্ত্রী এবং সেনাপ্রধানদের আনুগত্যে ফাটল ধরানো। এ সব করার অন্তর্নিহিত রহস্য হলো শক্তিশালী প্রতিবেশীকে তার অভ্যন্তরীণ সমস্যায় সর্বদা ব্যতিব্যস্ত রাখা, যাতে সে কোনো ‘বিদেশ অভিযানে’ বের হবার কল্পনাবিলাসে ব্যাপৃত হতে না পারে।
ঘ। গুপ্তচরবৃত্তির ধারাবাহিকতা (The Game Continues)
‘সান জু’ ও ‘কৌটিল্যের’ যুগ থেকে বর্তমানকাল পর্যন্ত গুপ্তচরবৃত্তির কলাকৌশলের বিশেষ করে মৌলিক নীতিমালায় তেমন কোনো পরিবর্তন সাধিত হয়নি। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতি, আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ব্যবস্থা ও সম্পর্কের পরিবর্তন ও উন্নয়নের সাথে সাথে ‘বহু পেশাভিত্তিক’ ইন্টেলিজেন্স সংগঠনের জন্ম হয়েছে। বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে ‘ইন্টেলিজেন্স’ শব্দটি বিভিন্ন সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত। বেশিরভাগ লোকের নিকট গুপ্তচর, এজেন্ট, এসপায়োনেজ ও ইন্টেলিজেন্স প্রভৃতি ‘নোংরা শব্দ’ হিসেবেই পরিচিত। তাই ইন্টেলিজেন্স, বিশেষ করে বৈদেশিক ইন্টেলিজেন্সের বিস্তৃত পরিধিতে যাবার আগে ‘ইন্টেলিজেন্স’ শব্দটিকে সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করা আমাদের সর্বপ্রথম দায়িত্ব।
যদিও কৌটিল্যের ব্যাখ্যায় আমরা এ সম্পর্কে মোটামুটি একটি ভালো ধারণা পাই তবুও সহজ ভাষায় বলতে গেলে, ‘র’-এর একজন প্রশিক্ষকের উদ্ধৃতি মতে “নির্জলা বা অপরিণত তথ্যের প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে সেগুলোতে পরিণত তথ্যে রূপান্তরই” ইন্টেলিজেন্স। তিনি এ ব্যাপারে আরো উল্লেখ্য করেন, “এটা বলা ভুল হবে যে, আমরা যে কোনো সূত্র থেকে অনেক ইন্টেলিজেন্স সংগ্রহ করেছি, কারণ প্রকৃত ইন্টেলিজেন্স তখনই পাওয়া যায় যখন কেবল প্রাপ্তনির্জলা তথ্যসমূহকে বিশ্লেষণ করা হয় এবং এ ক্ষেত্রে সঠিকভাবে বলতে গেলে শুধু সদর দপ্তরই ইন্টেলিজেন্সের মূল আধার, প্রস্তুতকারী ও প্রক্রিয়াজাতকারী।”
তথ্য সংগ্রহ ও তার বিশ্লেষণ কোনো সহজ কাজ নয়। যে কোনো দেশ এসপায়োনেজের জন্য বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত, অভিজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের ব্যক্তিদের সমন্বয়ে তার ইন্টেলিজেন্স কর্মকাণ্ড পরিচালিত করে। ভারতের বৈদেশিক গুপ্তচর সংস্থার প্রথম পরিচালক আর, এন কাও-এর মতে “একটি বৈদেশিক ইন্টেলিজেন্স সংস্থা একটি দেশের বা সরকারের চোখ ও কান বিশেষ। এর কার্যকলাপ সরকারের বিভিন্ন নীতিমালার প্রতিফলন যা ব্যতীত একটি দেশ তার আঁতুড়ঘরে আবদ্ধ থাকে।”
তাই এ কথা দৃঢ়ভাবে বলা যায়, কাও-এর মন্তব্য প্রমাণ করার জন্য কারো ‘সান জু’ বা ‘কৌটিল্যের’ উদ্ধৃতি টানার কোনো প্রয়োজন নেই।