অধ্যায় : ২ – যাত্রা হলো শুরু
From The Beginning
বৃটিশ সরকারের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী সিমলার সচিবালয়ে তিন দিন হ’লো অনবরত আগুন জ্বলছে। এটি ছিল বৃটিশ রাজনৈতিক বিভাগ ও অধিদপ্তরের অফিস। এখানে বৃটিশদের বছরের পর বছর ধরে সংগৃহীত মহারাজাদের ‘ব্যক্তিগত জীবনের’ গোপন নথিপত্র ধ্বংস করতে দেখা যায়। ওই সব গোপনীয় তথ্য বৃটিশদের বিভিন্ন রাজ্যের শাসকদের ‘ব্ল্যাকমেইল’ করতে সহায়তা করে এবং তাঁরা (মহারাজারা) তাদের অঙ্গুলি হেলনে চলতে বাধ্য হন। মহারাজাদের জন্য ‘বিশেষ ব্যবস্থার’ উল্লেখ্য ছাড়াও ওই দলিলপত্রে বৃটিশদের বিশেষ অনুগত ‘তথ্যসরবরাহকারী’ ও ‘দালালদের’ সম্পর্কে তথ্যপ্রমাণ মজুদ ছিল। তারা (বৃটিশরা) এখন ভালয় ভালয় বিদায় নিচ্ছে। কিন্তু পুরানো দলিলপত্র হস্তান্তর করা তাদের জন্য ছিল অত্যন্ত বিপজ্জনক। সারা ভারতে যেখানেই বৃটিশদের ওই ধরণের কোনো সংবেদনশীল দলিলপত্র রক্ষিত ছিল সেখানেই ‘সিমলার ন্যায় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়’। আগুন নিভে যাবার সাথে সাথে ভারতের জাতীয় সংগ্রামে বৃটিশদের পক্ষাবলম্বনকারী গুপ্তচর ও সমর্থকদের নাম চিরতরে মুছে যায়। যখন সঞ্জীব পিল্লাই ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার প্রথম পরিচালকরূপে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন তখন এ সংস্থা ছিল ‘মাথা ও মাংসপেশী ছাড়া হাড্ডিচর্মসার একটি সংস্থা মাত্র’। ভারতীয়দের মধ্যে যারা ছিল সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য সেই মুসলমানরা ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট বৃটিশদের চলে যাবার সাথে সাথে নব্যস্বাধীন পাকিস্তানে চলে যায়। বৃটিশ শাসনাধীনে পরিচালিত গোয়েন্দা দপ্তরের কার্যক্রম সম্পর্কে যাঁর সবচেয়ে বেশি অভিজ্ঞতা ছিল সেই গোলাম মোহাম্মদ ভারতীয় গোয়েন্দা দপ্তর ছেড়ে একে প্রতিহত করার জন্য পাকিস্তান গোয়েন্দা দপ্তরের প্রথম পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত হন।
ক। বৃটিশ গুপ্তচরবৃত্তির স্বার্থ (British Intelligence Interests)
ভারতে বৃটিশ গোয়েন্দা বাহিনীর স্বার্থ মুখ্যত দুটি বিষয় ঘুরে আবর্তিত হয়েছিল। উত্তর- পশ্চিম সীমান্তব্যাপী আফগান ও উপজাতিদের সাথে স্থায়ী যুদ্ধবিগ্রহ এবং সীমান্তের ওপারে রাশিয়ার অবস্থান-বৃটিশদের এদিকে মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করতে বাধ্য করে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ তৃতীয়াংশ জুড়ে রাশিয়ার সম্প্রসারণবাদী আগ্রাসী তৎপরতার আশঙ্কা ‘খাঁটিসত্য’ বলেই প্রতিভাত হয়ে ওঠে ও উপমহাদেশের কর্তৃত্ব নিয়ে একটি ‘এ্যাংলো রাশিয়ান’ যুদ্ধ শুধু আশঙ্কা নয় বরং অবশ্যম্ভাবী রূপ ধারণ করে। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ব্রিটিশ গোয়েন্দা বাহিনী (MI-6) এবং বৃটিশ ভারতের অন্তর্গত ‘গোয়েন্দা দপ্তর’ অত্যন্ত কর্মতৎপর হয়ে ওঠে। যখন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জাপানের অনুপ্রবেশ ঘটে তখন গোয়েন্দা দপ্তরকে বৃটিশ ভারতের উত্তর-পূর্ব সীমান্ত এলাকায় মনোনিবেশ করতে আদেশ দেয়া হয় এবং সীমান্তের বাইরে ‘বার্মা’ ও ‘সিঙ্গাপুর’ নিয়ে MI-6 ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
ইতোমধ্যে ভারতীয় জাতীয় সংগ্রাম গতি লাভ করতে সক্ষম হয় ও মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে পরিচালিত ‘অহিংস’ আন্দোলন অন্যান্য জাতীয়তাবাদী সংস্থার অংশগ্রহণে সহিংসরূপ পরিগ্রহ করে। এ সমস্ত আন্দোলন বৃটিশ সরকারকে অত্যন্ত বিচলিত করে তোলে এবং গোয়েন্দা দপ্তর ভারতীয় জাতীয় সংগ্রামের বিভিন্ন নেতৃবর্গের ওপর গুপ্তচরবৃত্তি কেন্দ্রীভূত করতে বাধ্য হয়।
গোয়েন্দা দপ্তরের প্রাথমিক কাজ ছিল বৃটিশ ভারতের সব রাজনৈতিক দলের ওপর বিশেষ ফাইল বা রেকর্ড রাখা। এদিকে ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলন গতি লাভ করে। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোসের নেতৃত্বে ‘ভারতীয় জাতীয় সেনাবাহিনী’ (Indian National Army) গঠন করা হয়। এর নিজস্ব গোয়েন্দা সংস্থা ছিল এবং ‘নেতাজী’ বৃটিশদের ভারত ছাড়তে বাধ্য করার চেষ্টায় জাপানী ও জার্মান কর্তৃপক্ষের সাথে ক্রমাগত যোগাযোগ বৃদ্ধি করতে থাকেন। গোয়েন্দা দপ্তর এ সব কার্যক্রম মোকাবিলা করার জন্য ভারতের বিভিন্ন শহরে বিশেষ গোয়েন্দা সেল গঠনের উদ্যোগ নেয়। এ সব সেলের দায়িত্বে ছিলেন উপ- পরিচালক পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা, যার অফিস ছিল গোয়েন্দা সদর দপ্তরে। যে সব ভারতীয় ওখানে কাজ করতেন তারা বৃটিশদের প্রতি অত্যন্ত বিশ্বস্ত ও অনুরক্ত ছিলেন।
সীমান্তের বাইরে গোয়েন্দাবৃত্তির কাজ সামরিক ধাঁচের হওয়ায় ওগুলোর দায়িত্ব ‘MI-6’ এর ওপর ন্যস্ত করা হয়। ‘MI-6’ তখন অনেকের কাছে বৃটিশ রাজের গোপন সংস্থারূপেই পরিচিত ছিল। বৃটিশরা নিজেরাই ভালো বলতে পারবে কি কারণে তারা এখন পর্যন্ত অনবরত এ ধরণের একটি সংস্থার কথা অস্বীকার করে আসছে? বৃটিশ আইন অনুযায়ী ‘অফিসিয়াল সিক্রেট অ্যাক্টের’ আওতায় কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী ওই ‘সংস্থা প্রধানের’ নাম পর্যন্ত উল্লেখ্য করতে পারেন না।
খ। নব যাত্রা (Building Up De Novo)
বৃটিশ ‘গোয়েন্দা বাহিনীর’ ছেড়ে যাওয়ার তথ্যের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ্য না করেও এটা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, তাদের ফেলে যাওয়া দলিলপত্র ও তথ্যাদি নব্য প্রতিষ্ঠিত ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনীর (IB=Intelligence Bureau) কোনো উপকারে আসেনি। বরং যা অবশিষ্ট ছিল তা হলো ‘তলাহীন ঝুড়িতে’ সংরক্ষিত অপ্রয়োজনীয় রেকর্ডপত্র। সুতরাং বাস্তব অবস্থা বিবেচনা করেই আবার ‘প্রথম থেকে’ যাত্রা শুরু হয়। মূলত: একটি কার্যকর অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থার (IB) প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে এবং সে অনুযায়ী রূপরেখা প্রণয়ন করায় বৈদেশিক গোয়েন্দা দপ্তরের ফাইলপত্র সরকারের টেবিলে অবহেলায় পড়ে থাকে।
দু’বছর পর ১৯৪৯ সালের প্রথমদিকে পিল্লাই একটি ছোটখাটো বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা সংগঠিত করেন। তিনি তাঁর ব্যক্তিগত উদ্যোগে পাকিস্তান, জার্মানি ও ফ্রান্সের দূতাবাসে ‘ফার্স্ট সেক্রেটারী’ পদমর্যাদার একটি পদ সৃষ্টির জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দেনদরবার চালিয়ে যান।
প্রথম ভারতীয় বৈদেশিক গোয়েন্দা কর্মকর্তারা ওই সব দেশে নিয়োগ লাভ করেন। জার্মানী ও ফ্রান্সে নির্বাচিত কর্মকর্তারা নিয়মিত গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্য ছিলেন না বা তাদের অন্যান্য সংস্থা থেকে সংগ্রহ করায় তাঁদের পরিচয় শেষ পর্যন্ত পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে প্রকাশ হয়ে পড়ে।
গ। অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব (Internal Feuds)
এক বছর পর, ১৯৫০ সালের শেষদিকে পিল্লাই স্বরাষ্ট্র সচিব আর, এন, ব্যানার্জির সাথে বিবাদে জড়িয়ে পড়েন। স্বরাষ্ট্র সচিবকে তার সমসাময়িক সকলেই ‘নিজস্ব তৈরি আইনে বাচাল কাজে পারদর্শী’ বলে ভাবতেন, যিনি (স্বরাষ্ট্র সচিব) সবসময় তাঁর সাথে প্রধানমন্ত্রী নেহরু ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বল্লভভাই প্যাটেলের বিশেষ সুসম্পর্কের কথা ফলাও করে প্রচার করতে ভালোবাসতেন। পিল্লাই ও ব্যানার্জীর ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব দিন দিন বাড়তে থাকে ও এ ব্যাপারে সরব আলোচনার সূত্রপাত হয়, যখন পিল্লাই যুক্তরাষ্ট্রের (U.S.A) শিক্ষা সফরের ওপর রিপোর্ট পেশ করতে দেরি করে ফেলেন, যেখানে সি আই-এর ওপর বিশেষ পর্যালোচনা সম্পর্কিত তথ্যাদি সন্নিবেশিত ছিল। এ দেরি করে ফেলাই শেষ পর্যন্ত সঠিক চিন্তার উপযুক্ত ব্যক্তিটির’ দুর্ভাগ্যের কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং শীঘ্রই পিল্লাই অপসারিত হন ও বি এন মালিক গোয়েন্দা দপ্তরের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।
ঘ। বি এন মালিকের দায়িত্ব গ্রহণ (B.N. Malik Takes Over )
ভারতীয় পুলিশ বিভাগের বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তির গোয়েন্দা বাহিনীর (IB) প্রধান পদে নিযুক্তির রীতি ভঙ্গ করে বি এন মালিককে তড়িঘড়ি নিয়োগ দান করা হয়। এ জন্য তিনি এক বছর অত্যন্ত দুশ্চিন্তার মধ্যে ছিলেন। ততোদিনে মালিক পিল্লাই প্রবর্তিত পদ্ধতির ভালো দিকগুলোর যৌক্তিকতা স্পষ্ট বুঝতে পারলেও ইতোমধ্যে গৃহীত ব্যবস্থায় কিছুটা পরিবর্তন আনতে সচেষ্ট হন। তাঁর গৃহীত প্রথম ‘পুনঃ মেরামত করা’র পরিকল্পনা মতে পিল্লাইয়ের বিদেশে পাঠানো প্রথম দু’জন গোয়েন্দা কর্মকর্তাকে দেশে ডেকে আনা হয়। তিনি এভাবে “পূর্বসূরি সিনড্রোমের” প্রচলন করেন এবং আজ পর্যন্ত ওই ধারাই সকলে অনুসরণ করে আসছে। ভালো হোক আর মন্দ হোক ‘পূর্বসূরির’ হাতে নিয়োগ পাওয়া কোনো ব্যক্তিকে নতুন প্রধান আসার সাথে সাথেই বদল করা হয়।
ওই বিশেষ ‘দু’জন’ কর্মকর্তাকে সরিয়ে আনার পর, তিনি প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোয় গোয়েন্দা বৃত্তির জাল ছড়িয়ে দেয়ার জন্য আরো অনেক লোককে নতুন নতুন জায়গায় নিযোগ করেন- বিশেষ করে চীনে নজর রাখার জন্য তিব্বত ও সিকিমের ‘আউটপোস্ট’ দুটো ব্যবহার করা হয়। বৃটিশ পরিত্যক্ত এ ‘আউটপোস্ট’ দুটো তখন পর্যন্ত অব্যবহৃত ছিল। ১৯৫২ ও ১৯৫৩ সালে পাকিস্তান (করাচী, লাহোর, ঢাকা), বার্মা ও সিলোনে (বর্তমান শ্রীলংকা) আরো নতুন ‘আউটপোস্ট’ খোলা হয়। অন্যদিকে মাঠ পর্যায়ে সংগৃহীত তথ্যাদির বিশ্লেষণের প্রয়োজনে বৈদেশিক ডেস্কের’ সংখ্যা বৃদ্ধি করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে দাঁড়ায়।
ঙ। ১৯৬৫ থেকে ১৯৬৮ (১৯৬৫-১৯৬৮)
১৯৬৫ থেকে ১৯৬৮ সালের মধ্যবর্তী বছরগুলোয় গোয়েন্দা সংস্থায় (IB) এস পি ভারমা ও এম এম এল হোজা নামে আরো দু’জন পরিচালক রূপে নিয়োজিত হন। এদিকে কর্মক্ষেত্রও দিনদিন প্রসারিত হতে থাকে। অভ্যন্তরীণ সমকেন্দ্রিক বৃত্তছোয়া বার্মা, আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও নিকট পরিমণ্ডলে অবস্থিত দেশগুলো নিয়ে আরেকটি নতুন ক্ষেত্র সৃষ্টি করা হয়। যার প্রান্ত ছুঁয়ে ছিল মধ্যপ্রাচ্যের বিশাল অঞ্চল।
চ। পৃথক বৈদেশিক গোয়েন্দা এজেন্সির জন্ম (Birth of Separate Foreign Intelligence Agency)
এর দ্রুত বৃদ্ধিলাভ সত্ত্বেও বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বিশেষ করে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে ধারণা করা হয় যে, ‘ভারতীয় বৈদেশিক গোয়েন্দা ডেস্ক’ একটি ‘হতাশাপূর্ণ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে’। কারণ এ সংস্থা ভারতের নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় পর্যাপ্ত তথ্য, বিশেষ করে পাকিস্তানের অভিপ্রায় সম্পর্কে সম্যক ধারণা দিতেও ব্যর্থ হয়েছে। এ ছাড়া প্রয়োজনের অতিরিক্ত অনেক বেশি কর্মকর্তাকে বিদেশে পাঠানো হয়েছে এবং গোয়েন্দা সংস্থায় অতি আবশ্যকীয় সমন্বয় ও উপযুক্ত প্রশিক্ষণ বৈদেশিক ডেস্কে’ নেই বললেই চলে।
১৯৬৮ সালের মধ্যে ভারতে একটি উপযোগী ও আলাদা বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থার প্রয়োজন তীব্রভাবে অনুভূত হয়। ইতোমধ্যে ১৯৪৭-৪৮ সালে পাকিস্তানের সাথে সংঘর্ষে এরূপ সংস্থার অনুপস্থিতি প্রচণ্ড বিপর্যয় ডেকে আনে; অবশ্য তখন ‘অভ্যন্তরীণ’ ও বৈদেশিক’ কোনো গোয়েন্দা সংস্থার আদৌ কোনো অস্তিত্ব ছিল না। এর পরপরই ১৯৬২ সালে চীনের আগ্রাসন ও তারপর পাকিস্তানের সাথে ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে পৃথক বৈদেশিক গোয়েন্দা এজেন্সি না থাকায় বিশেষ অসুবিধার মধ্যে পড়তে হয়। ১৯৬৭ সালে সিকিমের ‘নাথুলা’য় গোলন্দাজ গোলা বিনিময়ের সময়ও এরূপ পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল (চীনের সাথে সংঘর্ষ)।
১৯৬৫ সালে পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধে চীনা সীমান্ত সচল হয়ে ওঠে এবং চীন-ভারত সীমান্তে সৈন্য সমাবেশের হুমকি দেয়। অবশ্য পরে চীন এ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হতে বিরত থাকে। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান বিরোধের সময় আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ভারতে হতাশাব্যঞ্জক অপ্রতিভ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল। অতঃপর ভারতীয় চিন্তাবিদরা অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে একটি পৃথক বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা গঠনের চিন্তা-ভাবনা আরম্ভ করেন।
পৃথক বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা গঠনের সিদ্ধান্তে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা একে অপরের ওপর দোষ/দায়িত্ব চাপিয়ে দেন। দু’সংস্থার লড়াইয়ের এক পর্যায়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধান স্বয়ং এই বলে প্রচারে অংশ নেন যে, “প্রয়োজনীয় গোয়েন্দা তথ্য সহজলভ্য নয়।” কিন্তু এ সব লোকদেখানো সম্মুখ সমরের পশ্চাতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সশস্ত্র বাহিনীর কিছু কিছু অংশ নিজেদের আওতায় বৈদেশিক গোয়েন্দা বাহিনী গঠনের তদ্বির চালিয়ে যায়। বিষয়টির নিষ্পত্তি ও কর্তব্যে অবহেলার দোষারোপ তদারকের জন্য অবশেষে প্রতিরক্ষা সচিব পি ভি আর রাও এবং স্বরাষ্ট্র সচিব এল পি সিং সমন্বয়ে দু’সদস্যের একটি কমিশন’ গঠন করা হয়।
কে. শংকর নায়ার তখন গোয়েন্দা সংস্থার (IB) পাকিস্তান ডেস্কে নিয়োজিত ছিলেন। তাঁকে ৬০টির অধিক গোয়েন্দা রিপোর্ট (পাকিস্তান ও অন্যান্য স্থান থেকে এজেন্টদের পাঠানো বিভিন্ন রিপোর্ট) সঠিকভাবে সন্নিবেশিত/সংকলিত করার আদেশ দেয়া হয়। দু’সদস্যের কমিশন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও সশস্ত্র বাহিনীর বিভিন্ন অভিযোগের সুষ্ঠু জবাব দিতে গোয়েন্দা সংস্থাকে (IB) নির্দেশ দেয়। নায়ার পরে এ ব্যাপারে উল্লেখ্য করেন যে, তিনি ও তাঁর সকল কর্মকর্তারা সে রাতে দু’টা পর্যন্ত যেসব রেকর্ডপত্র খুঁজে পাওয়া যায়, তা সংগ্রহ করতে ফিলিং রোডের অস্থায়ী অফিসে (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নির্মিত কেন্দ্রীয় সচিবালয় সন্নিকটস্থ ব্যারাক) কর্মব্যস্ত থাকেন। সমস্ত রিপোর্ট সংকলিত করার পর নায়ার মন্তব্য করেন, (যা পরে তাঁর অধীনস্থ এক কর্মকর্তা উল্লেখ্য করেছিলেন) “জন্ম বুদ্ধ ও হাবাগঙ্গারাম ছাড়া এ সব এড়িয়ে যাওয়া বা বুঝতে না পারা কারো পক্ষে সম্ভব নয়।” নায়ার এ ক্ষেত্রে রিপোর্টে উল্লেখিত ভারতের পশ্চিম সীমান্তে পাকিস্তানী সমাবেশের প্রাপ্ত গোয়েন্দা তথ্যের উল্লেখ করেছিলেন। শীঘ্রই একটি বিশ্বস্তসূত্রে জানা যায় যে, রাও ও সিং দু’জনই নায়ারের প্রদত্ত ‘জবাবের’ সাথে একমত পোষণ করেন। কমিশন অতঃপর প্রাপ্ত তথ্যাদির ওপর ভিত্তি করে মন্তব্য করেন, “আনীত অভিযোগসমূহ ব্যাপক অর্থে সঠিক নয়, গোয়েন্দা তথ্যাদি সঠিকভাবে সংগ্রহ করা হয়, কিন্তু ওই সমস্ত তথ্যাদির সঠিক বিশ্লেষণ করা হয়নি, যদি তা করা হত তবে প্রাপ্ত গোয়েন্দা সূত্র সমূহই ধাঁধার উপযুক্ত জবাব দিতে পারতো। গোয়েন্দা সংস্থা ও এর বৈদেশিক গোয়েন্দা ডেস্ক ভালোভাবেই তাদের মাল-মশলা সরবরাহ করছিল।”
এদিকে ১৯৬৬ সালের শেষ থেকে ১৯৬৭ সালের শুরুর মধ্যবর্তী সময়েই পৃথক বৈদেশিক গোয়েন্দা এজেন্সি গঠনের ধারণা বাস্তবরূপ লাভ করে। প্রাথমিক পর্যায়ে এই সংস্থাকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতায় সেনাবাহিনীর মাধ্যমে পরিচালনা করার পরিকল্পনা নেয়া হয়। এ ধারণা ইতোমধ্যেই যুদ্ধকালীন প্রচারণা “প্রয়োজনীয় গোয়েন্দা তথ্য সহজলভ্য নয়” এ যুক্তিকে লালন করেছে ও যার ফলশ্রুতিতে দু’সদস্যের কমিশন গঠন করা হয়। এ লক্ষ্যকে আরো সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য জেনারেল চৌধুরী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী ওয়াই বি চ্যবনের তত্ত্বাবধানে ব্রিগেডিয়ার এম এন ভদ্রের পেশকৃত একটি রিপোর্টের পর্যালোচনা করার পর প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা গঠনের সুপারিশ করা হয়। কিন্তু বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হলেও তাকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে দেয়ার প্রতিবাদ করা হয়। এ সিদ্ধান্ত স্বরাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মধ্যে যথেষ্ট বাদানুবাদ ও মনকষাকষির সৃষ্টি করে ও দুই মন্ত্রণালয়ই গোয়েন্দা সংস্থার একক দাবিদার বলে ধারণা পোষণ করতে থাকে।
এরপর সদ্য প্রতিষ্ঠিত এ সংস্থাটিকে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণে আনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। নতুন গঠিত বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থার স্থপতি ছিলেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী স্বয়ং ও তার প্রধান মুখ্য সচিব পি এন হাকসার। তাঁরা উভয়েই বিস্তৃত পরিসরে, ভারতের বৈদেশিক নীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিলেন।
১৯৬৮ সালে এ সংস্থার জন্ম ও এর চূড়ান্ত অবকাঠামো তৈরির সময় কিছু জটিলতার সৃষ্টি হয়েছিল। জনগণ ক্রমান্বয়ে অভিযোগ করতে থাকে, এ সংস্থা শ্রীমতী গান্ধীর “গোপন পুলিশ বহর” বই আর কিছুই নয় এবং সম্ভবত শ্রীমতী গান্ধী ও শ্রী চ্যবনের অতীত মতদ্বৈততার কারণেই (প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি নিয়ন্ত্রণে নেয়ার ব্যাপারে) এ ধরণের জটিলতার উদ্ভব হয়েছে। কিন্তু খুব কম জনগণই তখন এটা বুঝতে সক্ষম ছিল যে, চ্যবনের মতামত ও অনুমোদন নিয়েই বৈদেশিক গোয়েন্দাবৃত্তি তদারকে পৃথক সংস্থা প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে।
অন্যান্য আর যে কারণ ‘বিকৃত চিত্র অঙ্কনে’ সাহায্য করে, তা হলো, ভারত আর দশটা উন্নয়নশীল (কিছু কিছু উন্নত দেশও) দেশের মতো বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থাকে বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা’ হিসেবে উল্লেখ করতে ইতস্তত করে আসছিলো।
ছ। নতুন নামের সন্ধানে (Search For A New Name)
এরপর নতুন সংস্থার জন্য উপযুক্ত নাম খোঁজার পালা। সম্ভবত কেবিনেট সচিবের দেয়া দীর্ঘ তালিকা থেকে রিসার্চ এন্ড অ্যানালিসিস উইং নামটি বাছাই করা হয় এবং এভাবেই ভারতের প্রথম বৈদেশিক গোয়েন্দা বাহিনীর জন্ম হয়।
প্রথমে “R. & A. W. “ হিসেবে উল্লেখ করা হলেও পরবর্তিতে সাংবাদিক সমাজ এ সংস্থাকে “R AW” নামে উল্লেখ করা আরম্ভ করে, যা আজকের বিশ্বে ব্যাপকভাবে পরিচিত ও প্রচলিত।