৭৫. ধর্মীয় উন্মাদনা

৭৫.

সবাই এই ভেবে কৃতজ্ঞ বোধ করল যে লাখো মানুষের ধর্মীয় উন্মাদনা এবং টপিটজিনের ক্ষমতা দখলের লোভ এখনও কোনো রক্তপাত ঘটায়নি। বুলেটের আঘাতে মারা যায়নি কেউ। শুধু প্রথমবার নদী পেরোতে গিয়ে কিছু লোক ডুবে মারা গেছে।

মিছিলের পর মিছিল আর্মি ইউনিটগুলোকে পাশ কাটিয়ে এল, রোমা শহরের ভেতর দিয়ে ধীরগতিতে গনগোরা হিলের দিকে এগোচ্ছে জনস্রোত। গান থেমে গেছে, শুরু হয়েছে আযটেক ভাষার শ্লোগান, বেশির ভাগ মেক্সিকান দর্শক বা আমেরিকানরা তার কিছুই বুঝল না।

পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উঠতে শুরু করল মিছিলগুলো, নেতৃত্ব দিচ্ছে টপিটজিন। সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে আত্মবিশ্বাস বহুগুণ বেড়ে গেছে তার। মিসরীয় গুপ্তধন হাতের নাগালে চলে আসছে। লাইব্রেরির দলিল, নকশা, শিল্পকর্ম ইত্যাদি সবই নগদ টাকায় রূপান্তর করা হবে। হাতে অঢেল টাকা থাকলে তার রাজনৈতিক সংগঠনের ভিত সারা দেশে শক্তিশালী করা কোনো সমস্যা নয়। ইলেকশনের জন্য অপেক্ষা করার দরকার কী, পেশাদার ও সুসংগঠিত কর্মিবাহিনীকে দিয়ে, পেশিশক্তির সহায়তায়, দো লরেঞ্জো সরকারকে উৎখাত করলেই তার স্বপ্ন সার্থক হবে। আর, একবার যদি ক্ষমতা পায় সে, মেক্সিকোকে ক্যাপেসটার পরিবারের সাম্রাজ্য ঘোষণা করা সময়ের ব্যাপার মাত্র।

মিসরে তার ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদ এখনও তার কানে আসেনি। তুমুল উত্তেজনার মুহূর্তে তার উপদেষ্টা আর ঘনিষ্ঠ সহকারীরা কমিউনিকেশন ট্রাক ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিল, ফলে জরুরি বার্তাটা শুনতে পায়নি। হাতে ধরা প্ল্যাটফর্মের পিছু পিছু আসছে তারা, গুপ্তধন দেখার লোভ সামলাতে পারেনি।

সাদা আলখেল্লা পরেছে টপিটজিন, মাথা আর কাঁধ থেকে ঝুলে আছে একটা বাঘের ছাল। তার হাতে, কাপড় পেঁচানো সরু বাঁশের মাথায় এটা ব্যানার, তাতে সাপ ও ঈগলের ছবি আঁকা। এক গাদা পোর্টেবল স্পটলাইটের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে আছে। প্ল্যাটফর্মটা। হাত-ইশারায় সামনের ঢালে আলো ফেলার নির্দেশ দিল সে।

ভারী কিছু ইকুইপমেন্ট ছাড়া দেখার মতো কিছু নেই। খোঁড়াখুড়ির কাজ ফেলে চলে গেছে সবাই। গভীর গর্তটায় বা টানেলে কাউকেই দেখা গেল না। পরিবেশটা পছন্দ হলো না টপিটজিনের। একটা হাত তুলে মিছিলগুলোকে থামার নির্দেশ দিল সে।

আচমকা পাহাড়ের চূড়া থেকে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল নারীকণ্ঠের সূতীক্ষ্ণ বিলাপধ্বনি। তীব্র থেকে তীব্রতর হলো আধিভৌতিক আওয়াজটা, যেন কোনো বিদেহী আত্মা বা বাস্তপরী আর্তনাদ করে। চিৎকারটা এতই জোরাল, এতই কর্ণবিদারক যে মিছিলে উপস্থিত নারী ও পুরুষরা কানে হাত চাপা দিতে বাধ্য হলো।

 এরপর হঠাৎ করেই অনেকগুলো স্ট্রোবলাইটের অত্যুজ্জ্বল আলো সরাসরি মেক্সিকান জনতার মুখের ওপর ঘুষির মতো আঘাত করল। আরেকটা আলোর টানেল, নিঃসঙ্গ উত্তর আকাশের কালো গায়ে বিচিত্র আকৃতির নকশা বোনায় ব্যস্ত। হতভম্ব, সম্মোহিত জনতা নির্বাক তাকিয়ে থাকল আলোটার দিকে।

প্রতি মুহূর্তে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হলো আলোর প্রদর্শনী। বাতাসে চাবুক মারার সাথে প্রায় হুবহু মিল রেখে অদৃশ্য নারীকণ্ঠের আর্তনাদ বিরতিহীন অত্যাচার হয়ে দাঁড়াল।

তারপর হঠাৎ করেই নিভে গেল স্ট্রোবলাইট, থেমে গেল বিলাপধ্বনি।

তারপরও ঝাড়া প্রায় এক মিনিট ধরে সেই লোমহর্ষক চিৎকার শুনতে পেল জনতা, চোখে লেগে থাকল আলোর বিস্ফোরণ। তারপর, অজানা, উৎস থেকে তাক করা এক টুকরো আলো ধীরে ধীরে উদ্ভাসিত করে তুলল দীর্ঘদেহী এক ছায়ামূর্তিকে, দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়-চূড়ায়। দৃশ্যটা নিখাদ ভৌতিক। ছায়ামূর্তিকে ঘিরে থাকা ধাতব আবরণে লেগে বিচ্ছুরিত হলো আলো, পাহাড়ের ঢালে দাঁড়িয়ে থাকা জনতার মধ্যে অনেকের চোখ ধাধিযে গেল।

 দীর্ঘদেহীর সারা শরীর আলোকিত হয়ে উঠল। এখন তাকে চেনা যাচ্ছে। যোদ্ধার পোশাকে একজন রোমান সৈনিক। তার কোমরে রয়েছে দুফলা তলোয়ার, একহাতে বর্শা, অপর হাতে গোল ঢাল।

হতচকিতভাব নিয়ে তাকিয়ে থাকল টপিটজিন। খেলা, নাকি কৌতুক? আমেরিকানদের ফন্দিটা কী? আলোকিত রোমান সৈনিকের দিক থেকে আটক দেবতার দিকে ফিরল জনতা, প্রত্যাশায় অধীর হয়ে অপেক্ষায় থাকল তিনি কী করেন দেখার জন্য।

মরিয়া হয়ে ধোঁকা দেয়ার চেষ্টা করতে আমেরিকানরা, সিদ্ধান্ত নিল টপিটজিন। মিছিল নিয়ে গুপ্তধনের কাছে তাকে পৌঁছাতে না দেয়ার হাস্যকর অপচেষ্টা।

ব্যাপারটা ফাঁদ হতে পারে, তার উপদেষ্টাদের একজন মন্তব্য করলেন, আপনাকে কিডন্যাপ করে জিম্মি রাখতে চায়।

ঘৃণার সাথে তার দিকে তাকাল টপিটজিন।

চালাকি হতে পারে। বাট কিডন্যাপ, নো আমার গায়ে হাত দিলে জনতা খেপে উঠবে, আমেরিকানরা জানে। ওরা আসলে আমার সাথে আলোচনায় বসতে চাইছে। স্টেট ডিপার্টমেন্টে অফিসারদের সাথে বৈঠক করার অনেক প্রস্তাব আগে আমাকে দিয়েছে ওরা, কান দিইনি আমি। ভৌতিক পরিবেশটা তৈরি করা হয়েছে স্রেফ আমার সাথে মুখোমুখি বসার শেষ একটা চেষ্টা হিসেবে। কী বলার আছে ওদের শুনতে পেলে মন্দ হয় না।

প্ল্যাটফর্ম নিচে নামাতে বলল টপিটজিন। উপদেষ্টারা কথা বলতে চাইলেও, ইশারায় তাদের থামিয়ে দিল সে। প্ল্যাটফর্ম থেকে নেমে ঢাল বেয়ে উঠতে শুরু করল একা, স্পটলাইটের উজ্জ্বল আলো উদ্ভাসিত করে রাখল তাকে। আলখেল্লার নিচে তার পা দেখা যাচ্ছে না, মনে হলো উড়ে হলেছে সে।

মাপা পদক্ষেপে এগোল টপিটজিন, কোল্ট পাইথন ৩৫৭ রিভলভারটা আলখেল্লার ভেতর বেল্টে রয়েছে, হাত দিয়ে ছুঁয়ে আছে সেটা। আরেক হাতে রয়েছে একটা স্মোক বম্ব।

কাছাকাছি পৌঁছে টপিটজিন দেখল রোমান সৈনিক জ্যান্ত নয় বা রোমান সৈনিকও নয়, ওটা একটা ম্যানিকিন, ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে এ ধরনের অনেক ডামি সাজিয়ে রাখতে দেখেছে সে। ডামির মুখে স্থির হয়ে আছে বিদ্রুপাত্মক এক চিলতে হাসি, রং করা চোখে নিষ্প্রাণ দৃষ্টি, প্লাস্টার করা হাত আর মুখ নিস্প্রভ।

ডামিটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কৌতূহল আরও বেড়ে গেল টপিটজিনের, তবে প্রতিপক্ষের উদ্দেশ্য বুঝতে না পারায় অস্বস্তিও বোধ করছে সে। এরই মধ্যে ঘাম ফুটে উঠেছে তার কপালে।

তারপর একটা ঝোঁপের আড়াল থেকে সিধে হলো দীর্ঘদেহী এক লোক। তার পায়ে রেঞ্চ বুট, পরনে ডেনিম আর সাদা টার্টল নেক সোয়েটার। এগিয়ে এসে আলোর বৃত্তে দাঁড়াল সে। ঘন সবুজ চোখ তার, আর্কটিক বরফের মতো ঠাণ্ডা দৃষ্টি। ম্যানিকিনের ঠিক পাশে দাঁড়িয়েছে সে।

তার কৌতূহলের জয় হয়েছে ভেবে খুশি হয়ে উঠল টপিটজিন। ইংরেজিতে কথা বলল সে, ডামি আর আলোর আয়োজন থেকে কী পেতে চাও তোমরা?

তোমার মনোযোগ।

দেখা যাচ্ছে সফল হয়েছ। এবার বলো, কী বরতে চায় তোমার সরকার?

 তোমাকে দেখতে ভীষণ বমিজাগানিয়া লাগছে।

দপ করে জ্বলে উঠল টপিটজিনের চোখ দুটো। সরাসরি ঈশ্বরের সাথে যে অবতার কথা বলেন, তাঁর প্রতি অসম্মান দেখিয়ে বহুলোক নিজেদের সর্বনাশ ডেকে এনেছে।

আমার নাম, পিট- ডার্ক পিট। আমি আমেরিকার যোগ্য নাগরিক। তুই ব্যাটা গোল্লায় যা!

মুখ সামলে কথা বলল।

কথা যদি বলতেই হয়, তবে শোনো, পিট বলে, তোমার এই অহেতুক ভাব বাদ দাও। তোমার এবং তোমার পয়গম্বর ভাইটির কথা জানি আমরা। লেডি ফ্ল্যামবোরোকে হাইজ্যাক করে আরোহীদের খুন করার জন্য যাকে তোমরা ভাড়া করেছিলে, সে কী করেছে শুনবে? হেসে উঠল পিট। যে সাম্রাজ্য তোমরা গড়ে তুলতে পারোনি, সেই সাম্রাজ্যের ভাবি সম্রাট পল ক্যাপেসটারকে খুন করেছে সে।

আমার ভাই…,

পল ক্যাপেসটার মারা গেছে শব্দ দুটো উচ্চারণ করতে পারল না টপিটজিন।

তোমার কথা আমি বিশ্বাস করি না।

এখনও তাহলে জানো না? একটু অবাকই হলো পিট।

চব্বিশ ঘণ্টা হয়নি তার সাথে কথা হয়েছে আমার, জেদের সুরে বলল টপিটজিন। পল… আখমত ইয়াজিদ অবশ্যই সুস্থ শরীরে বেঁচে আছে।

তোমার ভাই তো ছদ্মবেশে রাজা, তাই না? লাশের ছদ্মবেশ নিয়ে আছে কি না, দেখলে বলতে পারবে?

এই সব মিথ্য কথা বলে তোমার সরকার কী করতে চাইছে?

 ভালোই হলো, তুমি নিজে থেকে কথাটা তুললে, পিট বলল, আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরি। তোমার অনুসারীরা ডিপোজিটরি চেম্বারে একবার ঢুকলে সব তছনছ করে ফেলবে। মূল্যবান নকশা, দলিল, পাণ্ডুলিপি সব নষ্ট হবে। চুরি হতে শিল্পকর্মগুলো…

আমি যা বলি, আমার অনুসারীরা তো শোনে।

তাহলে ওদের বলো, সবাই যেন সীমান্ত পেরিয়ে মেক্সিকোয় ফিরে যায়। মার্কিন সরকারের পক্ষ থেকে বলছি, ওয়াশিংটনের সাথে আলোচনায় বসতে হলে তোমাকে কথা দিতে হবে আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরিকে একটা সাইন্টিফিক প্রজেক্ট হিসেবে গণ্য করবে তুমি।

তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে পিটর মুখে কী যেন খুঁজল টপিটজিন। টান টান করল শিরদাঁড়া। লম্বায় পিটের চেয়ে দশ সেন্টিমিটার ছোট সে। ফণা তোলা কেউটের মতো মৃদু দুলছে শরীরটা।

 কথা দিতে হবে, তাই না? কর্কশ স্বরে হেসে উঠল সে। আমেরিকানদের স্পর্ধা দেখে অবাক হচ্ছি আমি। শর্ত তো যা দেয়ার আমি দেব। পাঁচ লাখ লোক নিয়ে সীমান্ত পেরিয়েছি আমি, আমেরিকান সেনাবাহিনী ঠেকাতে পারেনি। সমস্ত ভালো তাস এখন আমার হাতে। মিসরীয় গুপ্তধন আমার। গোটা সাউথওয়েস্টার্ন স্টেটস আমার হতে যাচ্ছে। আমার ভাই পল শাসন করবে মিসরকে। আমাদের ছোট ভাইও একদিন ক্ষমতা দখল করবে ব্রাজিলে। আমেরিকানদের জানিয়ে দাও, আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরি মেক্সিকোয় তুলে নিয়ে যাচ্ছি আমরা। বাধা দেয়া হলে পাঁচ লাখ লোককে লেলিয়ে দেব আমি। আগুন ধরিয়ে দেব লাইব্রেরিতে।

বলতে বাধ্য হচ্ছি, তোমার চিন্তাভাবনা অত্যন্ত উন্নাসিক, ক্যাপেসটার। নিজেকে কি নেপোলিয়ন ভাবব নাকি?

পিটের শান্ত, নিরুদ্বিগ্ন হাবভাব লক্ষ করে অস্বস্তিবোধ করছে টপিটজিন। গুডবাই, মি, পিট। ফালতু আলাপ করার সময় নেই আমার হাতে। চিন্তা কোরো না, তোমার ছাল ছাড়িয়ে পাঠিয়ে দেয়া হবে হোয়াইট হাউসে।

দুঃখের বিষয়, আমার চামড়ায় কোনো উল্কি নেই-কেউ চিনবে ওটাকে।

টপিটজিনের অস্বস্তি বাড়ল আরও। এমন নির্লিপ্ত তাচ্ছিল্যের সাথে কেউ তার সাথে কথা বলে না। পিটের দিকে পেছন ফিরল সে, নিচে দাঁড়ানো জনসমুদ্রের উদ্দেশে হাত দুটো তুলতে শুরু করল। আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরি লুট করার সময় হয়েছে।

বিশাল সম্পদ, সব কিছুর মালিক তুমি হতে যাচ্ছ, জনতার মধ্যে বিলিয়ে দেয়ার আগে নিজের চোখে একবার দেখবে না? আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের সোনার কফিন রয়েছে ওখানে। রয়েছে….

ধীরে ধীর শরীরের দুপাশে নেমে এল টপিটজিনের হাত দুটো। তার মুখ লালচে হয়ে উঠল উত্তেজনায়।

 কী বললে? আলেকজান্ডারের কফিন? সত্যি ওটার অস্তিত্ব আছে?

 অবশ্যই আছে। শুধু তাই নয়, আলেকজান্ডারের দেহাবশেষ দেখাতে পারি তোমাকে। যদি ভয় না পাও, আমি তোমার গাইড হতে রাজি আছি।

ভ্রু কুঁচকে পিটের দিকে তাকিয়ে থাকল টপিটজিন। জনতার দিকে পেছন ফিরে রয়েছে সে, আলখেল্লার ভেতর থেকে রিভলভারটা বের করে আস্তিনের একটা পকেটে রাখল ভক্তরা জানে, আধ্যাত্মিক শক্তিই রক্ষা করবে তাকে, তাদের আযটেক অবতার সাথে কোনো রকম অস্ত্র রাখেন না। অপর হাতে স্মোক বমটা শক্ত করে ধরল সে।

যদি ভেবে থাকো আমার কোনো ক্ষতি করবে, ভুলে যাও। টানেলে আর কেউ যদি থাকে, দেখামাত্র প্রথমে তোমার শিরদাঁড়ায় গুলি করব আমি।

চেহারায় কৃত্রিম গোবেচারা ভাব ফুটিয়ে পিট বলল, তোমার ক্ষতি করে আমার কী লাভ? ভেবেছে জানি না, তোমার ক্ষতি হলে মেক্সিকান জনতা আমাকে টুকরো টুকরো করবে?

প্রকৌশলীরা কোথায়, টানেলে যারা কাজ করছিল?

সবাইকে ডেকে নেয়া হয়েছে নদীর ধারে।

 কথাটা সত্যি বলে বিশ্বাস করল টপিটজিন।

তোমার শার্ট ভোলো, আমাকে দেখাও বগলের নিচে বা শোল্ডার ব্লেডের মাঝখানে কিছু লুকিয়ে রখেছ কি না।

এত লোকের সামনে?

 যা বলছি করো, ধমক দিল টপিটজিন। বুট দুটোও খুলবে।

কাঁধ ঝাঁকিয়ে তাই করল পিট। লুকানো ট্রান্সমিটার বা অস্ত্র, কিছুই টপিটজিনের চোখে পড়ল না।

মাথা ঝাঁকাল সে। শ্যাফটের প্রবেশমুখের দিকে ইঙ্গিত করল। তুমি আগে থাকো, আমি অনুসরণ করব।

ডামিটা ভেতরে বয়ে নিয়ে গেলে তুমি কিছু মনে করবে? অস্ত্রগুলো সত্যি রোমান যুগের।

ভেতরে ঢোকার পর একপাশে নামিয়ে রাখবে ওগুলো, অনুমতি দিল টপিটজিন। পিটের দিকে পেছন ফিরে উপদেষ্টাদের সঙ্কেত দিল সে, জানাল সব ঠিক আছে।

কাপড়চোপড় ঠিকঠাক করে নিয়ে তৈরি হলো পিট। ডামি থেকে অস্ত্রগুলো খুলে নিয়ে শ্যাফটের ভেতর ঢুকল।

 ছাদটা দুমিটারের চেয়ে কম উঁচু, হাঁটার সময় মাথা নিচু করে রাখতে হলো পিটকে। বর্শা আর তলোয়ারটা টানেলের দেয়াল ঘেঁষে নামিয়ে রাখল ও, শুধু ঢালটা সাথে থাকল। মাথার ওপর আড়াল হিসেবে ধরে রাখল সেটাকে, যেন ভয় করছে ছাদ থেকে পাথর খসে পড়তে পারে।

ব্যাপারটা দেখেও গুরুত্ব দিল না টপিটজিন। .৩৫৭ ম্যাগনাম হ্যান্ডগানের একটা বুলেটের সামনে ঢালটা একটা পাতলা কাগজ ছাড়া আর কী।

টানেলের মেঝে প্রথম বারো ফুট চালু হয়ে নেমে গেছে। ছাদ থেকে ঝুলে আছে খানিক পর পর একটা করে ফ্লাডলাইট। আর্মি প্রকৌশলীরা। দক্ষতার সাথে পরিচ্ছন্ন কাজ করেছে, মেঝে ও দেয়াল প্রায় সমতল ও মসৃণ। হাঁটতে কোনো অসুবিধা হলো না ওদের। তবে ভাপসা একটা গন্ধ আছে বাতাসে। আর পায়ের চারধারে উড়ছে ধুলো।

.

ছবি আর শব্দ রিসিভ করছেন, মি. প্রেসিডেন্ট? জিজ্ঞেস করলেন জেনারেল কার্টিস চ্যান্ডলার।

সব ঠিক আছে, জেনারেল। ওদের কথাবার্তা পরিষ্কার শ্যোনা যাচ্ছে। তবে টানেলে ঢোকার পর ক্যামেরার নাগাল থেকে বেরিয়ে গেছে।

কফিন চেম্বারে আবার ওদেরকে দেখতে পাব আমরা, ওখানেও আমাদের লুকানো ক্যামেরা আছে।

পিটের সাথে যোগাযোগের কী ব্যবস্থা করা হয়েছে? মার্টিন ব্রোগানের প্রশ্ন।

প্রাচীন ঢালের ভেতর ঢোকানো আছে মাইক্রোফোন আর ট্রান্সমিটার।

উনি কি সশস্ত্র?

সিচ্যুয়েশন রুমে নেমে এল নিস্তব্ধতা। উপস্থিত সবার দৃষ্টি সরে গেল দ্বিতীয় মনিটরে, গনগোরা হিলের নিচের একটা সদ্য খোঁড়া চেম্বার দেখা যাচ্ছে সেটায়। ক্যামেরা তাক করা রয়েছে চেম্বারের মাঝখানে রাখা সোনালি ক্যাসকিটের ওপর।

ও আবার কে? কঠিন সুরে জিজ্ঞেস করলেন ডেইল নিকোলাস।

 চোখ সরু হয়ে গেল ব্রোগানের। কার কথা বলছেন?

টানেলে ঢোকার প্রবেশমুখে তাক করে থাকা ক্যামেরার ছবি প্রথম মনিটরে এখনও ফুটে রয়েছে, সেটার দিকে হাত তুললেন ডেইল নিকোলাস। পরিষ্কার দেখলাম ক্যামেরার সামনে দিয়ে একটা ছায়া সরে গেল। টানেলে ঢুকেছে কেউ।

আমি কিছু দেখিনি, বললেন জেনারেল মেটকাফ।

আমিও দ্বিতীয় মনিটরের দিকে তাকিয়েছিলাম, বললেন প্রেসিডেন্ট। সামনে ঝুঁকে মাইক্রোফোনের বোতামে চাপ দিলেন তিনি।

জেনারেল কার্টিস?

 মি, প্রেসিডেন্ট, তাড়াতাড়ি সাড়া দিলেন জেনারেল।

ডেইল নিকোলাস বলছেন, পিট ও টপিটজিনের পিছু পিছু আরেকজন কেউ টানেলে ঢুকেছে।

আমার এইডদের একজনও তাই বলছে।

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলেন ডেইল নিকোলাস, আমি তাহলে ভূত দেখিনি।

কোনো ধারণা আছে, কে হতে পারে লোকটা?

যে-ই হোক, বললেন জেনারেল কার্টিস, উদ্বেগ ফুটে উঠল তার চেহারায়, লোকটা আমাদের কেউ নয়।

.

৭৬.

তুমি দেখছি খোঁড়াচ্ছ, বলল রবার্ট। কেন?

ও কিছু না, সামান্য চোট পেয়েছি, বলল পিট। বিনিময়ে রক্ষা পেয়েছে দু’জন প্রেসিডেন্ট আর মহাসচিব হে’লা কামিলের প্রাণ।

পিটের প্রতিটি নড়াচড়ার ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখছে রবার্ট। মনে প্রশ্ন ও কৌতূহল থাকলেও, এ প্রসঙ্গে আলোচনাটা বাড়তে দিল না সে।

 আরও খানিকটা সামনে চওড়া হয়ে গেছে টানেল, মিশেছে বৃত্তাকার একটা গ্যালারিতে। চারটে পায়ার ওপর রয়েছে সোনালি কফিনটা, পায়াগুলো দেখতে অনেকটা চাইনিজ ড্রাগনের মতো। মাথার ওপর থেকে আলো পড়ায় সোনালি রং চকচক করছে। একদিকে দেয়ালে কাত করে রাখা হয়েছে রোমান সৈনিকদের বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রশস্ত্র।

আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট, ঘোষণার সুরে বলল পিট। শিল্প আর প্যাপিরাস রয়েছে পাশের চেম্বারে।

মুগ্ধ চেহারা নিয়ে ধীরে ধীরে এগোল রবার্ট, একটা চোখ পিটের ওপর। ক্যাসকিটের পাশে গিয়ে দাঁড়াল সে। হাত বাড়িয়ে ছুঁলো। তারপর, হঠাৎ ঝট করে হাতটা তুলে নিয়ে পিটের দিকে পুরোপুরি ঘুরল সে। আমার সাথে চালাকি, তাই না? দুহাজার বছরের পুরনো কফিন এটা, তাই না? রাগে, আক্রোশে হাঁপাচ্ছে সে। এখনও রং পর্যন্ত শুকায়নি।

গ্রিক বিজ্ঞানীরা অত্যন্ত অ্যাডভান্সড….

শাট আপ! গর্জে উঠল রবার্ট, ডান আস্তিন থেকে হাতে চলে এল রিভলভারটা। আর একটা কথাও শুনতে চাই না। আমি জানতে চাই, গুপ্তধনগুলো কোথায়?

পিছু হটতে শুরু করল পিট, চেহারায় কৃত্রিম আতঙ্ক।

আমাকে মেরো না, রবার্ট। প্রাচীন বর্শা আর তলোয়ার ঝুলে থাকা দেয়ালে পিঠ ঠেকল তোমাকে আমি সত্যি কথাটা বলে দিচ্ছি। মেইন ডিপোজিটরি চেম্বার এখনও পাইনি আমরা। পিটের দৃষ্টি প্রতি মুহূর্তে সোনালি কফিন আর রবার্টর মুখে ওঠানামা করছে, যেন ওটা থেকে হঠাৎ কেউ বেরিয়ে আসবে বলে ভয় পাচ্ছে ও।

 পিটের চোরাদৃষ্টি লক্ষ করে হাসতে শুরু করল রবার্ট। কফিনটার দিকে রিভলভার তাক করল সে। ট্রিগার টেপার সময় তার চোখে পলক পড়ল না। চারটে ফুটো তৈরি হলো কফিনের গায়ে। পাথুর চেম্বারের ভেতর কামান দাগার শব্দ হলো।

চালাকিটা ধরল রবার্ট। তোমার ব্যাক আপ, মি. পিট? খেঁকিয়ে উঠল সে। তুমি দেখছি একটা রামছাগল।

ওকে লুকিয়ে রাখার আর কোনো জায়গা পাইনি, হতাশ সুরে বলল পিট।

এক ঝটকায় কফিনের চাকনিটা তুলে ভেতরে তাকাল রবার্ট। আচমকা রক্তশূন্য দেখাল তাকে। আতঙ্কে কেঁপে উঠল গোটা শরীর, হাত থেকে খসে গিয়ে সশব্দে বন্ধ হলো ঢাকনিটা। ঠোঁটের ফাঁক গলে বেরিয়ে এল অস্পষ্ট গোঙানির শব্দ।

সামান্য একটু ঘুরল পিট, ফলে ঢালের আড়ালে ওর ডান হাতের নড়াচড়া ধরা পড়ল না রবার্টর চোখে। চেম্বারের দেয়াল ঘেঁষে সরে যাচ্ছে ও, একসময় রবার্টর বাম দিকে মুখ করল। অস্বস্তির সাথে চোখ বুলালো একবার হাতঘড়ির ওপর। ওর জন্য নির্দিষ্ট করা সময় এরই মধ্যে পেরিয়ে গেছে।

কাঁপা হাতে আরেকবার কফিনের ঢাকনিটা ধরল রবার্ট। এবার ঢাকনিটা পুরোপুরি তুলল সে, ফলে ছেড়ে দেয়ার সাথে সাথে উল্টো দিকে পড়ল সেটা, খোলা তাকল কফিন। ভেতরে তাকিয়ে বিড়বিড় করে উঠল সে,

 পল….সত্যি পল ও… শোকে ও বিস্ময়ে পাথর হয়ে গেছে লোকটা।

 প্রেসিডেন্ট হাসান চাননি আখমত ইয়াজিদকে মিসরে কবর দেয়া হোক, মৃদুকণ্ঠে বলল পিট। মৌলবাদীরা তাকে শহীদ বানিয়ে ফেলতে পারে। সেজন্যই লাশটা এখানে পাঠানো হয়েছে, তোমরা দু’জনেই যাতে এক জায়গায় শুয়ে থাকতে পারো।

কফিনের দিক থেকে চোখ তুলল রবার্ট। উদ্ভ্রান্ত দুষ্টি। এসবের সাথে তোমার কী সম্পর্ক?

 যে দলটা লাইব্রেরি আর ট্রেজার খুঁজে বের করেছে, আমি সেই দলের নেতা, মৃদু হাসল পিট। লেডি ফ্ল্যামবোরোকেও আমি খুঁজে পেয়েছি। টানেলে আমারই সাথে গোলাগুলিতে মারা গেছে আখমতের ডান হাত, সুলেমান। দুঃখিত, এবারে তোমার মরণ এসে গেছে।

তুই মরার আগে নয়! বলেই লাফ দেয়ার ভঙ্গিতে নিচু হলো রবার্ট, রিভলভার ধরা হাতটা লম্বা করল পিটের দিকে।

তৈরি ছিল পিট। দেয়াল থেকে আগেই একটা তলোয়ার নিয়েছে ও। ইতোমধ্যে মাথার ওপর তুলেও ফেলেছে। গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে নামিয়ে আনল সেটা।

গুলি হলো। মাত্র এক মিটার দূর থেকে পিটের মাথা লক্ষ্য করে দুহাতে ধরা রিভলভারের ট্রিগার টেনেছে রবার্ট। ঢালে লেগে পিছলে গেল বুলেট। পরমুহূর্তে বিকট আর্তনাদ বেরিয়ে এল তার গলা চিরে। অবিশ্বাসে বিস্ফারিত চোখে কনুই থেকে বিচ্ছিন্ন জোড়া হাতের দিকে তাকিয়ে আছে সে, ছিটকে খানিকটা ওপরে উঠে এসেছে। সেগুলো।

শূন্যে ডিগবাজি খেয়ে নিচে নামলে জোড়া হাত, এখনও এক হয়ে আছে, দুই তালুর মাঝখানে আটকে রয়েছে রিভলভারটা। লাইমস্টোন মেঝেতে পড়ার পরও দুটো হাত আলাদা হলো না।

রবার্টের গলা ফাটানো চিৎকারে চেম্বারে টেকা দায় হয়ে উঠল। ধীরে ধীরে হাঁটু দুটো ভাঁজ হলো তার বিকৃত চেহারা নিয়ে তাকিয়ে আছে হাত দুটোর দিকে যেন বিশ্বাস করতে পারছে না ওগুলো এখন আর তার শরীরের অংশ নয়।

মেঝেতে হাঁটু গেড়ে থাকল রবার্ট, এদিক-ওদিক দুলছে। ধীরে ধীরে মুখ তুলে পিটর দিকে কাতাল সে। চোখে ঢুলু ঢুলু দৃষ্টি।

এটা কেন? ফিসফিস করে জানতে চাইল সে। একটা বুলেট নয় কেন?

তোমাকে দিয়ে ছোট্ট একটা ঋণ শোধ করানো হলো, বলল পিট। গাই রিভাসের কথা মনে পড়ে?

রিভাস তোর পরিচিত?

মাথা নাড়ল পিট। তার বন্ধুদের কাছে শুনছি, কীভাবে তুমি তাকে কষ্ট দিয়েছ। শুনেছি, আত্মীয়স্বজনরা জানত না যে তারা শুধু তার চামড়াটুকু কবর দিচ্ছে।

 বন্ধু? বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করল রবার্ট।

আমার নয়, আরেক ভদ্রলোকের, যিনি হোয়াইট হাউসে বাস করেন, ঠাণ্ডা সুরে বলল পিট। আরেকবার হাতঘড়ির ওপর চোখ বুলালো তারপর তাকাল রবার্ট ক্যাপেসটারর দিকে। লোকটার করুণ পরিণতি দেখে বিন্দুমাত্র সহানুভূতি জাগল না মনে। দুঃখিত, জায়গাটা পরিষ্কার করার কাজে তোমাকে আমি সাহায্য করতে পারছি না। আমাকে কেটে পড়তে হবে। ঘুরল পিট, পা বাড়াল এগজিট টানেলের দিকে।

দুপা এগিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল পিট। বেঁটেখাটো, স্থূল এক লোক চেম্বারে ঢোকার মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে, হাতে একটা শটগান-পিস্তল, সরাসরি পিটের তলপেট লক্ষ্য করে ধরা।

তাড়াহুড়োর কোনো দরকার নেই, মি. পিট। কর্তৃত্বের সুরে থমথমে গলায় বলল সে। কেউ আপনারা কোথাও যাচ্ছেন না।

.

৭৭.

তৃতীয় পক্ষের উপস্থিতি সম্পর্কে ধারণা থাকলেও লোকটাকে আচমকা উদয় হতে দেখতে সিচ্যুয়েশন রুমের দর্শকরা প্রায় সবাই আঁতকে উঠলেন। গনগোরা হিলের গভীর পাতালে উত্তেজনাকর নাটকটা বিপজ্জনক মোড় নিতে যাচ্ছে।

জেনারেল কার্টিস, তীক্ষ্ণকণ্ঠে প্রশ্ন করলেন প্রেসিডেন্ট, কী ঘটছে ওখানে? কে এই লোক?

 মনিটরে আমরাও ওকে দেখতে পাচ্ছি, মি. প্রেসিডেন্ট। ঠিক বুঝতে পারছি না, সম্ভবত টপিটজিনের লোকই হবে।

পিটকে সাহায্য করার জন্য একটা দল পাঠান, নির্দেশ দিলেন জেনারেল মেটকাফ।

 প্রতিবাদ করলেন জেনারেল কার্টিস, স্যার, জনতা বাধা দেবে। ভিড়ের ভেতর দিয়ে ছাড়া ওখানে ওঠার আর কোনো পথ নেই।

উনি ঠিকই বলছেন, সায় দিলেন জুলিয়াস শিলার। জনতা খেপে উঠলে সামলানো যাবে না।

 আগন্তক গেল কীভাবে? জিজ্ঞেস করলেন জেনারেল মেটক্যাফ। সে যদি পারে, তোমরা দু’জন লোক পাঠাতে পারবে না কেন?

সেটা দশ মিনিট আগের ঘটনা, এখন আর সম্ভব নয়, স্যার। টপিটজিনের লোকেরা আরও ফ্লাডলাইটের ব্যবস্থা করেছে। গোটা এলাকায় গিজ গিজ করছে। মেক্সিকানরা। ঢালগুলোয় পা ফেলার জায়গা নেই। গাড়ি নিয়ে এগোনো তো অসম্ভব।

সিনেটরের দিকে তাকালেন প্রেসিডেন্ট কথা বলার আগে বড় করে দম নিলেন তিনি। জর্জ, মেক্সিকানরা যদি পাহাড়ের ওপর উঠতে শুরু করে, আপনার ছেলে বেরিয়ে আসার আগেই অপারেশনের ইতি ঘটাতে হবে আমাদের।

চোখের ওপর একবার হাত বোলালেন সিনেটর পিট। তারপর মনিটরের দিকে তাকালেন। ডার্ক পারবে, ছোট্ট করে বললেন তিনি।

আচমকা চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন ডেইল নিকোলাস। মনিটরের দিকে একটা হাত লম্বা করে দিয়ে চিৎকার করে উঠলেন তিনি, পাহাড় বেয়ে উঠছে ওরা!

.

আড়াই হাজার কিলোমিটার দূরে সবাই যখন ওর প্রাণরক্ষার সম্ভাবনা নিয়ে তর্ক করছেন, ঠিক সেই মুহূর্তে পিটের প্রধান মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়িয়েছে শটগান পিস্তলের কালো মুখ। অস্ত্রটা বাগিয়ে ধরার ভঙ্গি দেখেই বুঝতে পারল এ লোক আরও বহুবার খুন করেছে। অস্ত্রের পেছনে লোকটার মুখ ম্লান, চোখে উৎসাহহীন দৃষ্টি, সব মিলিয়ে যেন একঘেয়েমির শিকার। আরেকজন জাতখুনি, ভাবল

কে তুমি?

ইবনে তেলমুক। সুলেমান আজিজ আমাকে তার বিশ্বস্ত ভক্ত হিসেবে চিনতেন।

হ্যাঁ, ভাবল পিট। কল্পনার চোখে ক্রাশিং মিলের সামনের রাস্তায় আতঙ্কবাদীদের দেখতে পেল ও তোমরা দেখছি প্রতিশোধ নেয়ার কথা ভোলো না।

তার শেষ ইচ্ছে ছিল আমি যেন তোমাকে খুন করি।

ডান হাতটা অত্যন্ত ধীর নিচে নামাল পিট, তলোয়ারের ডগাটা চেম্বারের মেঝের দিকে তাকল করল। তার এই ভঙ্গি, সাহসী লোকের পরাজয় মেনে নেয়ার ভঙ্গি। পেশি শিখিল করে দিল ও, ঝুলে পড়ল কাঁধ, সামান্য বাঁকা হলো হাঁটু দুটো।

সান্টা-ইনেজে ছিলে তুমি।

 হ্যাঁ, সুলেমান আজিজ আর আমি একসাথে মিসরে পালিয়ে যাই।

পিটের ঘন কালো ভ্রু দুটো এক হলো। গুলি খাবার পর সুলেমান আজিজ তাহলে বেঁচে গিয়েছিল? নাহ, আর বোধ হয় পালাবার সময়ও হাতে নেই। কথার জবাব না দিয়ে লোকটার উচিত ছিল ওকে লক্ষ্য করে গুলি করা। লোকটা ওকে নিয়ে খেলছে, বিড়াল যেমন ইঁদুরকে নিয়ে খেলে। পঞ্চাশটা পেলেট ছুটে আসবে কথার মাঝখানে হঠাৎ।

সময় নষ্ট করলেও পুরস্কার পাওয়ার কোনো উপায় নেই। ইবনের দিকে তাকিয়ে দূরত্বটা আন্দাজ করার চেষ্টা করল পিট। কোন দিকে লাফ দেয়া যায়, যখন গুলি হলে? সহজ ভঙ্গিতে ঢালটা শরীরের সামনে আনল।

রক্তাক্ত দুই কনুইয়ে আলখেল্লা, জড়ানো শেষ করল রবার্ট ক্যাপেসটার। সারাক্ষণ ফোঁপাচ্ছে সে। রক্তে ভিজে আলখেল্লার একটা অংশ লালে লাল। ইবনের দিকে তাকাল সে।

মারো ওকে! নিস্তেজ গলা থেকে চিচি আওয়াজ বেরোল। দেখো আমার কী অবস্থা করেছে ও! মারো! গুলি করো।

তুমি কে? জিজ্ঞেস করল ইবনে, পিটের ওপর চোখ।

আমি টপিটজিন।

 ওর আসল নাম রবার্ট ক্যাপেসটার, বলল পিট। শাল এক নম্বরের ভন্ড।

ক্রল করে ইবনের দিকে এগোল রবার্ট, তার পায়ের কাছে এসে থামল। কাঁদছে, হাঁপাচ্ছে, মুখ তুলে তাকিয়ে আছে ইবনের দিকে। ওর কথায় কান দিয়ো না, আবেদনে কাঙালের সুর। এই ব্যাটা ছিঁচকে চোর একটা।

 এই প্রথম নিঃশব্দে হাসল ইবনে। তা কী করে হয়। ওর ফাইল আমি পড়েছি। কোনো ব্যাপারেই ছিঁচকে নয় ও।

পরিস্থিতি অনুকুল, ভাবল পিট। মুহূর্তের জন্য হলেও ইবনের মনেযোগ কেড়ে নিতে পেরেছে রবার্ট। এক পাশে সরতে শুরু করল ও, প্রতিবার এক সেন্টিমিটারের বেশি নয়, চেষ্টা করছে ওর এবং ইবনের মাঝখানে যেন চলে আসে রবার্ট।

সুলেমান আজিজ কোথায়? হঠাৎ জিজ্ঞেস করল পিট।

উনি মারা গেছেন, জানাল ইবনে। হঠাৎ জ্বলে উঠল তার চোখ দুটো। শুয়োরের বাচ্চা আখমত ইয়াজিদটাকে খুন করার পর উনি মারা গেছেন।

চেম্বারে যেন বোমা ফাটল, অন্তত রবার্টকে চমকে উঠতে দেখে তাই মনে হলো পিটের। নিজের অজান্তেই রবার্টর দৃষ্টি ছুটে গেল সোনালি কফিনটার ওপর। আবার সেই চিচি, অস্পষ্ট গলায় বলল সে, তার মানে আমার ভাই নিজের লোকের হাতে খুন হয়েছে। ওই লোককেই তো পল, লেডি ফ্ল্যামবোরো হাইজ্যাক করার দায়িত্ব দিয়েছিল।

আরেক সেন্টিমিটার সরল পিট।

ভ্রু কপালে তুলে মিসরীয় আততায়ী জিজ্ঞেস করল, আখমত ইয়াজিদ তোমার ভাই ছিল?

দেখলে তুমি আখমত ইয়াজিদকে চিনতে পারবে? জিজ্ঞেস করল পিট।

পিটের দিকে ফিরে নিঃশব্দে মাথা ঝাঁকাল ইবনে। মিসরে কে তাকে চেনে না?

মরিয়া হয়ে ভাবল পিট, কিছু সুবিধা সে পাচ্ছে, কিন্তু সময় মতো কাজে লাগাতে পারবে তো? আখমত ইয়াজিদকে দেখার পর ইবনের কী প্রতিক্রিয়া হয় তার ওপর নির্ভর করছে সব।

তাহলে কফিনটার ভেতর উঁকি দাও।

নোড়ো না, পিট। নড়ার কথা ভাবতেও নিষেধ করছি তোমাকে, বলতে বলতে কফিনটার দিকে এগোল ইবনে। পিটের দিকে তাকিয়ে আছে সে, পা ফেলছে ধীরে ধীরে, প্রতিবার একটা করে। তার ডান নিতম্বে কফিনের একটা কোণ ঠেকল। হাতের শটগান পিটের দিকে স্থির রেখে কফিনের ভেতর একবার তাকাল সে, পরমুহূর্তে পিটের দিকে ফিরল।

এক চুলও নড়েনি পিট।

এ এক ধরনের জুয়া খেলা। অপ্রত্যাশিত কিছু দেখলে একবার নয়, অন্তত দুইবার তাকায় মানুষ। প্রথমবার ইবনে শুধু চোখ বুলিয়েছে। আরেকবার ভালো করে দেখার একটা তীব্র ইচ্ছে তার অজান্তেই মনের ভেতর মাথাচাড়া দিচ্ছে। পিটের বিশ্বাস, দ্বিতীয় বার কফিনের ভেতর তাকাতেই হবে ইবনেকে। ঠিক তাই করল সে।

.

গনগোরা পাহাড়ের আধ কিলোমিটার পশ্চিমে রয়েছে স্পেশাল অপারেশনস ফোর্সের কমান্ড ট্রাক। টিভি মনিটরের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছেন অ্যাডমিরাল স্যানডেকার, তার দুপাশে বাকি সবাই।

অনড় মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে লিলি, মুখ রক্তশূন্য।

অস্থির পায়ে পায়চারি করছে কর্নেল হোলিস। তার একহাতে ছোট একটা আলট্রা হাই-ফ্রিকোয়েন্সি ডিটোনেশন ট্রান্সমিটার, অপর হাতে শক্ত করে ধরা ফোনের রিসিভার। রিসিভার চিৎকার করছে সে, জেনারেল কার্টিসের একজন এইডের উদ্দেশে,

বললেই আমি ডিটোনেট করব? সবদিক আমাকে ভেবে দেখতে হবে না? মেক্সিকানরা আগে ডেঞ্জার পেরিমিটার পেরুক, তারপর দেখা যাবে।

এইড, একজন কর্নেল, বলল, ঢাল বেয়ে প্রায় উঠে পড়েছে লোকজন।

আরও ত্রিশ সেকেন্ড পর। তার আগে নয়! হুঙ্কার ছাড়ল কর্নেল হোলিস।

জেনারেল কার্টিস চাইছেন এই মুহূর্তে আপনি উড়িয়ে দিন পাহাড়টা। পাল্টা হুঙ্কার ছাড়ল এইড। আপনার প্রতি এটা একটা অর্ডার, স্বয়ং প্রেসিডেন্টের তরফ থেকে।

আপনি টেলিফোনে একটা কণ্ঠস্বর ছাড়া কিছু নন, কর্নেল, প্রায় বিদ্রুপের সুরে বলল কর্নেল হোলিস। অর্ডারটা আমি সরাসরি প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে পেতে চাই।

আপনি কোর্ট মার্শালের ঝুঁকি নিচ্ছেন, কর্নেল স্যার।

এই প্রথমবার নয়।

ভয়ে আর অস্থিরতায় হাঁপাচ্ছেন অ্যাডমিরাল স্যানডেকার। পারবে না। ডার্ক পারবে না।

আপনারা শুধু বসে বসে চিৎকার করবেন আর মাথার চুল ছিঁড়বেন। কিছু করতে পারেন না? আবেদনভরা দৃষ্টিতে অ্যাডমিরালের দিকে তাকাল লিলি। ওর সাথে কথা বলুন। টিভি-ক্যামেরার সাথে লাগানো স্পিকারে আপনাদের গলা শুনতে পাবে পিট।

ওর মনোযোগ নষ্ট করলে সর্বনাশ ঘটে যাবে, জবাব দিল কর্নেল। স্পিকার থেকে আওয়াজ বেরোলেই চমকে উঠবে পিট, সাথে সাথে ওকে খুন করবে ইবনে।

 পেয়েছি! হ্যাঁচকা টানে কমান্ড ট্রাকের দরজা খুলে নিচে লাফ দিয়ে পড়ল সে, ছুটল স্যামের জিপ লক্ষ্য করে। কর্নেল হোলিসের লোকজন বাধা দেয়ার আগেই তীরবেগে রওনা হয়ে গেল জিপটা গনগোরা হিলের উদ্দেশে।

.

দ্রুত লাফ দিল পিট, যেন কুণ্ডলী খুলে ছোবল দিল একটা সাপ। আবার ঝিক করে উঠল তলোয়ারের ফলা।

ওর পেশিবহুল হাতটা কাঁধের সমস্ত শক্তি নিয়ে নিচে নামল। অনুভব করল, শুনতেও পেল, তলোয়ারের ফলা নরম কিছুতে সেঁধোবার আগে কঠিন কিছুর সাথে ঘষা খেয়েছে। একটা বিস্ফোরণ ঘটল, ঠিক যেন ওর মুখের ওপর। বিস্ফোরণের ধাক্কা প্রায় সবটুকু ঢালের মাঝখানে লাগল, পিছলে সিলিংয়ের দিকে উঠে গেল পেলেটগুলো। প্রাচীন ঢালের গায়ে শক্ত কাটের আবরণ লাগিয়েছে আজ দুপুরে জন ডিলিঞ্জার, সেটায় গর্ত হলেও ফুটো হলো না তলোয়ার ধরা রার হাত বৃত্ত রচনা শেষ করল। দেরি না। করে আবার সেটাকে হ্যাঁচকা টানে ওর ওপর দিকে তুলল পিট।

ইবনে যথেষ্ট ক্ষিপ্র, তবে আখমত ইয়াজিদকে কফিনের ভেতর দেখে, বিস্ময়ের ঘোর কাটতে এক সেকেন্ড দেরি হলো তার। চোখের কোণ থেকে পিটকে লাফ দিতে দেখতে পেয়ে ঠিকমতো লক্ষস্থির না করেই শটগানের টিগার টেনে দেয়, পরমুহূর্তে ঘটগনের ব্রিচে ঘষা খেয়ে কব্জির কয়েক ইঞ্চি নিয়ে আঘাত করল তলোয়ারের ফলা। পাঁচটার মধ্যে চারটে আঙুলই হাত থেকে খসে মেঝেতে পড়ে গেল।

এমনভাবে গোঙাতে শুরু করল ইবনে, যেনে বিষম খেয়েছে। রবার্ট ক্যাপেসটারের জোড়া হতে এখনও ধরা রয়েছে কোল্ট পাইথন, ঠিক সেটার পাশে ছিটকে পড়েছে শটগানটা। তবে নিচের দিক থেকে উঠে আসা পিটের দ্বিতীয় আঘাতটা এগিয়ে গেল ইবনে ছোট্ট একটা লাখ দিয়ে। পরমুহূর্তে, দমকা বাতাসের মতো শরীরে মোচড়া দিয়ে পিটকে লক্ষ্য করে ঝাঁপিয়ে পড়ল সে।

 সরে যেতে গিয়ে বিপদটা টের পেল পিট। লাফ দিল, কিন্তু ভাজ হয়ে গেল ডান হাঁটু। দেরিতে হলেও, কারণটা বুঝতে পারল ও। শটগানের একটা কি দুটো পেলেট ওর পায়ের ঢুকেছে। আহত পা-টাই জখম হয়েছে আবার।

ভাঁজ করা হাত-পা নিয়ে পিটের ওপর আছড়ে পড়ল ইবনে। তাল সামলাতে গিয়ে তলোয়ারটা হাতছাড়া হয়ে গেল পিটের। অপর হাতটা ঢালের ভেতর দিকে স্ট্র্যাপের সাথে আটকে গেছে। ধীরে ধীরে, সচেতনভাবে, অক্ষত হাতটা দিয়ে পিটের গলা চেপে ধরল ইবনে।

কিল হিম! উন্মাদের মতো চিৎকার জুড়ে দিল রবার্ট ক্যাপেসটার। এই সুযোগ ছেড়ো না! খুন করো ওকে! কিল হিম! কিল হিম!

ইবনের ভারী শরীর বুকে নিয়ে ঘড়ির কাঁটার মতো ঘুরতে চেষ্টা করল পিট, হাতের কিনারা দিয়ে কোপ মারল শত্রুর কণ্ঠায়। এ ধরনের আঘাতে বেশির ভাগ মানুষ দম আটকে মারা যায়, অন্তত জ্ঞান না হারিয়ে পারে না। ইবনে শুধু ঘর্ঘর ঘর্ঘর আওয়াজ ছেড়ে দুহাতে চেপে ধরল নিজের গলাটা, গড়িয়ে নেমে গেল পিটের বুক থেকে।

 মাতালের মতো টলতে টলতে দু’জনেই দাঁড়াল ওরা। এক পায়ে এই জায়গায় লাফাচ্ছে পিট, বাতাসের অভাবে হাঁপাচ্ছে ইবনে, মাত্র একটা আঙুল নিয়ে তার ডান হাতটা ঝুলে আছে শরীরের পাশে। পরস্পরের দিকে তাকিয়ে আছে ওরা।

প্রথম হামলাটা এল তৃতীয় পক্ষ থেকে। হঠাৎ মেঝের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল রবার্ট তার কোল্ট লক্ষ্য করে। বগল আর বাহুর মাঝখানে ফোল্টটা আটকাতে চেষ্টা করছে। সে। সন্দেহ নেই, অস্ত্রটা ইবনেকে দেয়ার ইচ্ছে তার। কিন্তু তার নিজের বিচ্ছিন্ন হাত শক্ত হয়ে আটকে গেছে, বগলের নিচে আটকে টান দিতেও কোল্টটা বেরোল না আঙুলগুলো থেকে টানটা আরও জেকারে না হলে বেরোবে না।

পিট আর ইবনে, দু’জনেই ওরা আশপাশে তাকাল অস্ত্রের খোঁজে।

হার হলো পিটের। শটগানটা ইবনের দিকে পড়ে রয়েছে। তার পাশে রোমান তলোয়ারটাও। ঝড়ের সময় যেকোনো বন্দরে নোঙর ফেলা যায়, ভাবল পিট! ঢালসহ হাতটা ইবনের দিকে ছুড়ল ও, আহত ডান পা দিয়ে সরাসরি লাথি মারল রবার্টের বুকে। শটগানটা ভোলার জন্য ঝুঁকতে যাচ্ছিল ইবনে, ঢালের বাড়িটা কাঁধে লাগল তার। ভারসাম্য রক্ষার জন্য অস্থির হয়ে উঠল সে। ঝুঁকল পিট রবার্টর বিচ্ছিন্ন হাতে আটকে থাকা কোল্টটা ধরে হ্যাঁচকা টান দিল। জোড়া হাতসহ উঠে এল সেটা।

লাথি খেয়ে ত্রাহি চিৎকার জুড়ে দিয়েছে রবার্ট। জোড়া হাত থেকে কোল্টটা ছাড়াতে চেষ্টা করছে পিট। মুক্ত হলো, কিন্তু আঙুল থেকে পিছলে বেরিয়ে গেল সেটা, শূন্যে ডিগবাজি খেয়ে উঠে যাচ্ছে ওপর দিকে। লাফ দিয়ে ধরে ফেলল পিট।

ট্রিগার গার্ড রক্তে পিচ্ছিল হয়ে আছে।

তাল সামলে শটগানের দিকে বাম হাতটা বাড়িয়ে দিয়েছে ইবনে। ধরল। তুলছে। এই সময় গুলি করল পিট।

 পরবর্তী রিকয়েলের জন্য মুঠো শক্ত করল পিট। চেম্বারের দেয়ালে বাড়ি খেয়ে ধপাস করে মেঝেতে পড়ে গেল ইবনে।

দুসারি দাঁতের ফাঁক দিয়ে শিসের মতো শব্দ করে বাতাস ছাড়ল পিট। এতক্ষণে ওর খেয়াল হলো, টিভি ক্যামেরায় সংযুক্ত স্পিকার থেকে কর্নেল হোলিসের চিৎকার ভেসে আসছে, বেরিয়ে আসুন, ফর গডস সেক, বেরিয়ে আসুন।

দিগভ্রান্ত হয়ে পড়েছে পিট। অস্তিত্ব রক্ষার যুদ্ধে এতই মগ্ন ছিল, এখন মনেই করতে পারছে না কোন পথ ধরে টানেল থেকে বেরোতে হবে। অনেকগুলো সুড়ঙ্গ, মাত্র একটা দিয়ে বেরোনো সম্ভব।

শেষবার রবার্ট ক্যাপেসটারের দিকে একবার তাকাল পিট। ভয়ে নয়, রক্তক্ষরণে সাদা হয়ে গেছে মুখটা। অর্ধনিমীলিত নেত্রে পিটের দিকে তাকিয়ে আছে সে, দৃষ্টিতে রাজ্যের ঘৃণা। ক্লান্ত, মৃদু হেসে বলল পিট, নরকের পথে যাত্রাটা উপভোগ করো!

জবাবে স্মোক বমটা ফাটিয়ে দিল রবার্ট। যেভাবেই হোক, পিনটা খুলে ফেলেছে সে। এক পলকে ঘন কমলা রঙের ধোঁয়ায় ঢাকা পড়ে গেল চেম্বারটা।

.

কী ঘটল? জিজ্ঞেস করলেন প্রেসিডেন্ট। কমলা রঙের কুয়াশায় ক্যামেরা কোনো ছবি পাঠাতে পারছে না।

 রবার্ট সম্ভবত একটা স্মোক বোমা ফাটিয়ে দিয়েছে, জেনারেল কার্টিস রুদ্ধশ্বাসে বললেন।

এক্সপ্লোনিভগুলো এখনও ফাটছে না কেন?

এক সেকেন্ড, স্যার। রাগের সাথে একজন এইডের দিকে ফিরলেন জেনারেল। কথা বলে ক্যামেরার দিকে তাকালেন আবার।

কর্নেল হোলিস বলছেন সরাসরি আপনি অর্ডার দিলে তবে সে বিস্ফোরণ ঘটাবে।

যোগাযোগ চাই! ধমকের সুরে বললেন প্রেসিডেন্ট।

 চার সেকেন্ড পর একটা মনিটরে দেখা গেল কর্নেল হোলিসকে।

আপনি আমাকে দেখতে পাচ্ছেন না, কর্নেল হোলিস, প্রেসিডেন্ট বললেন। আশা করি, আমার গলা চিনতে পারছেন?

 পারছি, প্রেসিডেন্ট।

আপনার কমান্ডার ইন-চিফ হিসেবে, আপনাকে আমি অর্ডার দিচ্ছি, পাহাড়টা উড়িয়ে দিন-এই মুহূর্তে।

ঢাল বেয়ে প্রায় চূড়ায় উঠে পড়েছে জনতা, ডেইল নিকোলাস বললেন। আতঙ্কের সাথে সবাই মনিটরে দৃশ্যটা দেখলেন। আবার মিছিল শুরু হয়েছে। পাহাড়ের নিচ থেকে হাজার হাজার লোক বেয়ে উঠছে চূড়ার দিকে, সবার মুখে টপিটজিনের নাম, সুর করে উচ্চারণ করছে।

 এরপরও যদি অপেক্ষা করো, কর্নেল হোলিস, থমথমে গলায় বললেন জেনারেল মেটকাফ, কয়েক হাজার লোককে খুব করবে তুমি। ফাটিয়ে দাও।

সুইচের ওপর স্থির হয়ে আছে কর্নেল হোলিসের একটা আঙুল। ট্রান্সমিটারে ঘোষণা করল সে, ডিটোনেশন!

তারপরও সুইচটা টিপল না সে। হুকুম মানতে রাজি না হলে বিচার হবে। কিন্তু যদি হুকুম মানতে দেরি করা হয় বা দেরি হয়ে যায়? কোর্ট মার্শাল হলেও, অযোগ্যতা প্রমাণ করা ভারি কঠিন কাজ।

সুইচ টিপবে কর্নেল, কিন্তু তার আগে যতটা পারা যায় সময় দেবে সে পিটকে।

.

ধোঁয়া নয়, যেন গভীর আর ভারী পানির তলায় রয়েছে পিট। চোখ বুজে আছে ও, দম বন্ধ করে রেখেছে। ইচ্ছাশক্তির জোরে পা দুটো নাড়তে চাইছে, ইচ্ছে হচ্ছে দৌড় দেয় বা হামাগুড়ি দিয়ে এগোয়। আতঙ্কভরা চেম্বার থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দূরে সরে যেতে চায়। একটা প্যাসেজে বেরিয়ে এসেছে বটে, কিন্তু জানে না এটাই ঠিক পথ কি না। ছোটার ক্ষমতা নেই, দেয়াল ধরে এক পা এক পা করে এগোচ্ছে। হয় টানেলের মুখে বেরোতে হবে, নয়তো মাইনের মুখে। দুটোই যদি হারিয়ে ফেলে, মাটি খুঁড়ে ওর লাশ বের করতে হবে।

ম্যাসেজের মেঝে ক্রমশ উঁচু হতে শুরু করল। কমলা রঙের ধোঁয়া এখনও আছে, তবে আগের চেয়ে অনেক হালকা। একটু কি বাড়ল তাপমাত্রা? গায়ে কি মৃদু বাতাসের ছোঁয়া পেল? প্রথমে অস্পষ্ট, তারপর উজ্জ্বল লাগল চোখে আলোটা। টানেল থেকে বেরিয়ে এল পিট। সামনে তারা জ্বলছে, ফ্লাডলাইটের আলোয় স্নান দেখাচ্ছে।

পিট জানে, বিপদ এখনও কাটেনি। মাইনের মুখ থেকে বাইরে বেরিয়ে এসেছে। ও। ক্রমশ উঁচু হয়ে আরও পাঁচ মিটারের মতো উঠে গেছে সামনের মেঝে। উঠতে গিয়ে পিছলে নেমে আসছে শরীরটা। মাত্র একটা পা ব্যবহার করতে পারছে, ডান পা বোঝা হয়ে আছে পিছলে। গর্তের মুখটা এত কাছে অথচ কত দূরে। মাত্র পাঁচ মিটার। ঢালু মেঝের নিচে মৃত্যু, ওপরে জীবন।

চুপ মেরে গেছে কর্নেল হোলিস। তার আর কিছু বলার নেই। তৃতীয়বার ঢল থেকে নিচে খসে পড়ে পিট উপলব্ধি করল, নিজের হাতে সাজানো মৃত্যু ফাঁদে ধরা পড়ে গেছে ও। বিস্ফোরকগুলো সাজাবার সময় ডিলিঞ্জারের সাথে সে-ও ছিল।

প্ৰায় যখন হাল ছেড়ে দিয়েছে পিট, গর্তের খোলা মুখে একটা ছায়ামূর্তি উদয় হলো। গর্তের কিনারায় শুয়ে একটা হাত পিটের দিকে লম্বা করে দিল সে। শত্রু না মিত্র? না জেনেই হাতটা ধরল পিট। ওকে টেনে গর্তের মুখে তুলল লোকটা। সমতল মাটিতে পৌঁছে হাঁপাতে লাগল পিট।

 লোকটা দুহাতে ধরল পিটকে, অনায়াস ভঙ্গিতে তুলে নিল বুকে। ছুটতে ছুটতে এগোল জিপের দিকে।

 জিওর্দিনোকে চিনতে পেরেছে পিট। কৃতজ্ঞতায় চোখে পানি এসে গেল ওর। স্টার্ট নিল জিপ, একশো মিটারও এগোতে পারেনি, বিস্ফোরিত হলো গনগোরা হিল।

বিশাল মিছিল প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়ল মাটির ওপর। প্রথমে থরথর করে কাপল পাহাড়টা। তারপর আগ্নেয়গিরির নিক্ষিপ্ত লাভার মতো মাটি আর পাথর সবেগে ছুটল আকাশের দিকে। গনগোরা হিলের গোটা চূড়াটা লাফ দিয়ে দশ মিটার শূন্যে উঠে পড়ল। চারদিকে এখন শুধু পাথর আর ধুলো।

.

৫ নভেম্বর, ১৯৯১, রোমা, টেক্সাস

৭৮.

পাঁচ দিন পর, মাঝরাত হতে আর মাত্র তিন মিনিট বাকি, রোমার কয়েক মাইল দূরে ছোট্ট একটা এয়ারপোর্টে নামল প্রেসিডেন্টের হেলিকপ্টার। তাঁর সফর সঙ্গীদের মধ্যে সিনেটর পিট ও সিনেটর পিট রয়েছেন। ওঁদেরকে অভ্যথনা জানালেন অ্যাডমিরাল স্যানডেকার।

কনগ্রাচুলেশন্স, অ্যাডমিরাল, সহাস্যে বললেন প্রেসিডেন্ট। তবে স্বীকার করতে আপত্তি নেই, বিশ্বাস করতে পারিনি নুমা এত নিখুঁতভাবে করতে পারবে কাজটা।

ধন্যবাদ, মি. প্রেসিডেন্ট। আপনি আমাদের প্ল্যান অনুমোদন করায় আমরা সবাই আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ।

আমাকে রাজি করানোর জন্য আপনার ধন্যবাদ দেয়া উচিত সিনেটরকে, জর্জ পিটের কাঁধে একটা হাত রেখে বললেন প্রেসিডেন্ট। উনি, সত্যি কথা বলতে কি, আমার একেবারে ঘাড়ে চেপে বসেছিলেন।

দশটা চাকা লাগানো বিরাট একটা ট্রাকে উঠে পড়লেন ওঁরা। ড্রাইভারের পাশে আগেই দু’জন সিক্রেট সার্ভিস এজেন্ট উঠে বসেছে। ট্রাক রওনা হয়ে গেল, পিছু নিল একটা ডুজ ভ্যান।

 গোটা এলাকায় মৌমাছির মতো হেলিকপ্টার উড়ে বেড়াচ্ছে, বললেন অ্যাডমিরাল, ব্যাপারটা গোপন রাখার স্বার্থে এই ট্রাক ছাড়া উপায় ছিল না। ভেতরে ছয়টা চেয়ার রয়েছে। ট্রাকের দুই পাশ ও মাথার দিকটা মোটা ক্যানভাস দিয়ে ঢাকা।

খানিক পর প্রেসিডেন্ট বললেন, আমরা আসলে ভাগ্যবান। টপিটজিন মারা গেছে জানার পর মেক্সিকান জনতা দাঙ্গা বাধিয়ে দিলে আমরা সামলাতে পারতাম না।

 পাহাড়টা ভেঙে পড়ার পর চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে লোজন, বললেন অ্যাডমিরাল বাচ্চা আর মেয়েরা ছিল বলে দাঙ্গা বাধেনি। তাছাড়া, জনতাকে উত্তেজিত করার জন্যও কেউ ছিল না। টপিটজিনের ঘনিষ্ঠ অনুসারীরা অবস্থা সুবিধার নয় বুঝতে পেরে সীমান্ত পেরিয়ে পালিয়ে যায়। খিদে, পরিশ্রম, আর হতাশায় ক্লান্ত হয়ে নদীর দিকে হাঁটা ধরে সবাই।

সিনেটর পিট বললেন, সীমান্তের ওপারে মেক্সিকান পুলিশ টপিটজিনের বেশির ভাগ অনুসারীকে গ্রেফতার করেছে।

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন প্রেসিডেন্ট। নিরীহ মানুষজনের রক্তপাত ঘটেনি তাতেই আমি খুশি।

কিন্তু ক্যাপেসটার পরিবার? প্রশ্ন করলেন অ্যাডমিরাল।

 এদেশে ওদের কোনো সম্পত্তি আছে কি না খোঁজ নিয়ে দেখছে বিচার বিভাগ, প্রেসিডেন্ট বললেন। কর্নেল হোলিস তার স্পেশাল ফোর্সকে নিয়ে ক্যারিবিয়ানের একটা দ্বীপে হানা দেয়ার প্ল্যান করছে। ক্যাপেসটার পরিবারের কেউ যদি ওখানে থাকে, তার কপালে খারাপি আছে।

সিনেটর পিট হেসে বললেন, ইয়াজিদ আর টপিটজিন মারা যাওয়ায় আমাদের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ বেশ নাকে তেল দিয়ে ঘুমাবে এবারে।

মাথা নেড়ে অসম্মতি জানালেন শিলার। মনে হয় না। কেবল দুটো আবর্জনা গিয়েছে। আরো বহু বহু বাকি।

আরে, এত বাজে চিন্তা করো না তো, জুলিয়াস। বললেন প্রেসিডেন্ট। মিসর আপাতত শান্ত। স্বাস্থ্যগত কারণে প্রেসিডেন্ট নাদাভ হাসান পদত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, ক্ষমতা ছেড়ে দিচ্ছেন আবু হামিদের হাতে। মুসলিম মৌলবাদীরা দারুণ চাপে আছে ওখানে।

 হে’লা কামিল, আবু হামিদকে বিয়ে করার ফলে পরিস্থিতি আরো স্বাভাবিক হচ্ছে। বললেন সিনেটর পিট।

 ট্রাক দাঁড়িয়ে পড়ল, খুলে গেল দরজা, সিঁড়ি বেয়ে সবাই নামতে শুরু করলেন।

 নিচে নেমে ওঁরা দেখলেন, সাধারণ তারের বেড়া দিয়ে ঘেরা হয়েছে জায়গাটা। গেটে একটা সাইনবোর্ড ঝুলছে। তাতে লেখা স্যাম ট্রিনিটি স্যান্ড অ্যান্ড গ্র্যাভেল কোম্পানি। বড় আকারের কিছু বালতি, একটা ট্রাক, গোটা দশের কোদাল আর বেলচা ছাড়া গোটা এলাকা খালি পড়ে আছে।

সিকিউরিটি গার্ড ইউনিট, ইলেকট্রনিক ডিটেকশন ইকুইপমেন্ট ইত্যাদি সবই আছে, তবে চোখের আড়ালে।

 মি. স্যাম ট্রিনিটির সাথে আমার দেখা হতে পারে? জিজ্ঞেস করলেন প্রেসিডেন্ট। মাথা নাড়লেন অ্যাডমিরাল। খুব ভালো মানুষ। স্বেচ্ছায় সরকারকে তার সম্পত্তি লিখে দেয়ার পর গলফ খেলার জন্য ওয়ার্ল্ড ট্যুর করতে বেরিয়েছে সে।

আশা করি তাকে ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়েছে, তাই না?

ট্যাক্সমুক্ত দশ মিলিয়ন ডলার, বললেন অ্যাডমিরাল। নিতে রাজি করার জন্য রীতিমতো হাতে-পায়ে ধরতে হয়েছে। কয়েকশো মিটার দূরে গভীর একটা গর্ত দেখালেন অ্যাডমিরাল, গনগোরা হিলের ওই হলো অবশিষ্ট। এখন ওটা নুড়ি পাথর আর কাকরের খনি। ওগুলো বিক্রি করেও লাভের মুখ দেখব আমরা।

প্রেসিডেন্ট জিজ্ঞেস না করে পারলেন না, টপিটজিন আর ইয়াজিদের লাশ দুটো কি আপনারা খুঁজে পেয়েছেন?

মাথা ঝাঁকালেন অ্যাডমিরাল। দুদিন আগে। যতটুকু পাওয়া গেছে আর কী। সব রক ক্রাশারে ঢেলে দেয়া হয়েছে। আমার বিশ্বাস দু’জনেই তারা রাস্তার উপকরণ হয়ে আছে।

প্রেসিডেন্টকে সন্তুষ্ট দেখাল, যার যা প্রাপ্য।

 টানেলটা কোথায়? চারদিকে তাকালেন মার্টিন ব্রোগান।

 এই যে, এদিকে। ইঙ্গিতে একটি মোবাইল ট্রেইলর দেখালেন অ্যাডমিরাল, ওটাকে একটা অফিসে রূপান্তর করা হয়েছে। জানালায় বড় বড় অক্ষরে লেখা ডিসপ্যাচার।

মোবাইল অফিসে উঠে এলেন ওঁরা, আরেক দরজা দিয়ে নেমে পড়লেন সবাই সমতল টানেলের মেঝেতে। শুরু হলো আধুনিক ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতির প্রদর্শনী। একাদিক টিভি ক্যামেরা রয়েছে সিলিং আর দেয়ালে। দরজায় মেটাল ডিটেকটর মেশিন। জেনারেটরের আওয়াজ শোনা গেল। সিলিংয়ের সার সার টিউব লাইট জ্বলছে। খানিক দূর এগিয়ে এলিভেটরে চড়লেন ওঁরা।

সারফেস থেকে ত্রিশ মিটার নেমে এল এলিভেটর। টানেলে বেরিয়ে এসে সার সার দাঁড় করানো ভাস্কর্য দেখতে পেলেন ওঁরা, দেয়াল ঘেঁষে রাখা হয়েছে।

একজন তরুণী এগিয়ে এসে অভ্যর্থনা জানাল ওদের।

মি. প্রেসিডেন্ট, অ্যাডমিরাল বললেন, আপনার সাথে পরিচয় করিয়ে দিই। ইনি ড. শার্প, ক্যাটালগিং প্রোগ্রামের ডিরেক্টর।

ড, শার্প, আমরা আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ।

লালচে চেহারা নিয়ে লিলি বলল, আমার অবদান খুবই সামান্য…

সবার সাথে করমর্দনের পর অতিথিদের নিয়ে রওনা হলো লিলি। আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরি দেখানোর জন্য তাকেই গাইড নির্বাচিত করা হয়েছে।

 চারশো পঁচিশ ধরনের স্কাল্পচার ক্যাটালগে তুলেছি আমরা, ব্যাখ্যা করল সে। তার মধ্যে খ্রিস্টা-পূর্ব তিন হাজার সালের ব্রোঞ্জমূর্তিও আছে। শেষ দিকের, অর্থাৎ চতুর্থ শতাব্দীর মূর্তিও অনেক। সামান্য দাগ ছাড়া ওগুলোর কোনো ক্ষতি হয়নি, দাগগুলোও কেমিক্যালের সাহায্যে তোলা যাবে।

দীর্ঘ প্যাসেজ ধরে নিঃশব্দে হাঁটছেন প্রেসিডেন্ট। মূর্তিগুলোর দিকে তাকিয়ে বিস্ময় বাধ মানছে না তার। কোনো কোনোটা পাঁচ হাজার বছরের পুরনো। মূর্তির সংখ্যা দেখেও অবাক হলেন। প্রতিটি যুগের, প্রতিটি সাম্রাজ্যের শিল্পকর্ম স্থান পেয়েছে আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরিতে যা চোখে দেখতে পাব।

বিস্ফোরণে কোনো ক্ষতিই হয়নি লাইব্রেরির, বলল লিলি। টানেলের ভেতর সামান্য মাটি খসে পড়েছিল শুধু।

 একটানা দুঘন্টা দরে প্রদর্শনী দেখার পর সর্বশেষ শিল্পকর্মটির পাশে এসে দাঁড়ালেন ওঁরা। সবাইকে নিয়ে এবার প্রধান গ্যালারিতে ঢুকবে লিলি। হাত বাড়াল সে, ফিসফিস করে বলল, ওই যে, আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট-এর স্বর্ণের কফিন।

প্রেসিডেন্টর অনুভূতি হলো, তার সাথে যেন ঈশ্বরের দেখা হতে যাচ্ছে। দুনিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ নেতাদের একজন, মহাবীর আলেকজান্ডার। কাঁপা পায়ে এগোলেন প্রেসিডেন্ট।

কফিনটা খোলা রয়েছে। আলেকজান্ডারের বর্ম ও হেলমেট খাঁটি সোনার তৈরি। পারস্যের সিল্ক দিয়ে তৈরি হয়েছিল তার টিউনিক, বেশির ভাগই অদৃশ্য হয়েছে, প্রায় চব্বিশ শতাব্দীর পর অবশিষ্ট আছে সামান্য কিছু গঁড়ো। মহাবীর আলেকজান্ডারের অবশিষ্ট বলতেও রয়েছে শুধু কখানা হাড়।

 ক্লিওপেট্রা, জুলিয়াস সিজার, মার্ক অ্যান্টনি, সবাই শ্রদ্ধাবনত মস্তকে দাঁড়িয়েছেন। এই মহানায়কের কফিনের পাশে, লেকচার দিল লিলি।

প্রায় ত্রিশজন লোক কঠোর পরিশ্রম করছে। গ্যালারির মাঝখানে জড় করা কাঠের বাক্সের ভেতর কী আছে দেখার কাজে একদল লোক ব্যস্ত। একদিকের দেয়ালে সার সার সাজানো রয়েছে পেইন্টিং। হাতির দাঁত, মার্বেল, সোনা, রুপা ও তামা দিয়ে অদ্ভুত সব খেলনা, মূর্তি, ব্যবহারিক উপকরণ ইত্যাদি বানানো হয়েছে। শ্রেণীবিভাগের কাজ চলছে, কাজ চলছে নতুন বাক্সে ভরার। পার্চমেন্ট ও প্যাপিরাসগুলো পাঠিয়ে দেয়া হবে মেরিল্যান্ডে, বিশ্লেষণ ও সংরক্ষণের জন্য।

হাত নেড়ে গ্যালারির চারদিকটা দেখাল লিলি। এই হলো প্রাচীন দুনিয়ার জ্ঞান আর শিল্প, আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরি। এরই মধ্যে হোমারের সমস্ত রচনা উদ্ধার করেছি আমরা। যেসব গ্রিক দার্শনিকদের দর্শন হারিয়ে গিয়েছিল, বেশির ভাগই রয়েছে। এখানে। আদি হিব্রু সাহিত্য পাবার পর খ্রিস্টধর্মের ওপর নতুন আলোকপাত সম্ভব হবে। কিছু ম্যাপ থেকে অজানা মন্দির, প্রাচীন রাজা ও রানীদের সমাধি, নাম-না-জানা বাণিজ্যিক শহর, সোনা আর হীরের খনি, তেলখনি ইত্যাদির ঠিকানা জানা যাচ্ছে। ইতিহাসের মাঝখানে যেসব সভ্যতার কথা আমরা কখনও শুনিওনি, সহজবোধ্য রূপকথার গল্পের মতো সমস্ত কিছু পড়ে ফেলছেন আমাদের বিশেষজ্ঞরা।

মুহূর্তের জন্য বাকশক্তি হারিয়ে ফেললেন প্রেসিডেন্ট। আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরির তাৎপর্য এত বিরাট, ধারণার মধ্যে আনতে হিমশিম খেয়ে গেলেন তিনি। শিল্প হিসেবে এগুলোর প্রতিটি অমূল্য। জ্ঞান হিসেবে এগুলোর মূল্য অপরিসীম। অবশেষে অস্পষ্ট কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, এখানে কাজ শেষ করতে কত দিন লাগবে আপনাদের?

 প্রথমে আমরা প্যাপিরাস সরাব, তারপর শিল্পকর্ম, জানাল লিলি। প্রথমে যাবে স্কালচার। শেষ না হওয়া পর্যন্ত দিনে চব্বিশ ঘণ্টা করে কাজ চলবে। ধরুন, আগামী বছরের জানুয়ারি নাগাদ শেষ করতে পারব আমরা।

তারমানে প্রায় ষাট দিন, বললেন অ্যাডমিরাল।

 স্ক্রোল আর সাহিত্য?

আসলে, অনুবাদ বেশ কষ্টসাধ্য কাজ। প্রায় পঁচিশ বছর কিংবা তার বেশি লেগে যেতে পারে। এছাড়া অর্থ-কড়ির ব্যাপারটাও আছে। লিলি জানাল।

বাজেট নিয়ে ভাববেন না, প্রেসিডেন্ট নিজে আশ্বস্ত করলেন। ওটাকে এক নম্বর গুরুত্ব দেয়া হবে।

অস্বস্তিভরে লিলি বলল, যদি কিছু মনে না করেন, সব কিছু খোলাসা করার আগে দশ দিন সময় চাই আমি। ততদিনে আমি এবং আমার দলের সদস্যরা একটা চমৎকার ভিডিও টেপ প্রস্তুত করে ফেলতে পারব।

 সিনেটর পিট প্রেসিডেন্টের উদ্দেশে ফিরলেন। ডক্টর শার্প চমৎকার একটা ফিলের মাধ্যমে পুরো দুনিয়াকে চমকে দেবেন, হোয়াইট হাউসের পক্ষ থেকে। কী বলেন?

 লিলির হাত নিজের হাতে নিয়ে নিলেন প্রেসিডেন্ট। ধন্যবাদ, ডক্টর শার্প। আপনি আমাকে চিন্তা মুক্ত করলেন।

অতিথিদের নিয়ে আরেক দিকে এগোল লিলি। ওদিকে একজন বিশেষজ্ঞ, গ্রিক ল্যাটিন অনুবাদক, একটা প্যাপিরাস পরীক্ষা করছেন। তাঁর দুই কাঁধের ওপর হুমড়ি খেয়ে রয়েছে পিট আর জিওর্দিনো। ওদেরকে চিনতে পেরে তাড়াতাড়ি পা বাড়ালেন প্রেসিডেন্ট।

আপনি সুস্থ শরীরে বেঁচে আছেন দেখে আমি ভারি আনন্দিত, ডার্ক, বললেন তিনি, আন্তরিক হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল তার মুখ। গোটা আমেরিকান জাতি আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ। আমেরিকানদের পক্ষ থেকে আমি ব্যক্তিগতভাবে আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

যতটা সম্ভব সিধে হলো পিট, একটা ছড়িতে ভর দিয়ে। ভাগ্যের একটা ভূমিকা, আর বন্ধুদের অবদান আছে, মি. প্রেসিডেন্ট, স্মিত হেসে বলল পিট। আমার বন্ধু অ্যাল জিওর্দিনো আর কর্নেল হোলিস যদি না থাকত, এখনও আমি গনগোরা হিলের নিচে থাকতাম।

 রহস্যটা পরিষ্কার করবেন, প্লিজ? জিজ্ঞেস করলেন জুলিয়াস শিলার। এই ছোট পাহাড়টার নিচে আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরি আছে, আসলে গনগোরা হিলে নেই, আপনি জানলেন কীভাবে?

ভুল করে আপনি লাইব্রেরিটাই উড়িয়ে দিচ্ছেন কিন, এই ভয়ে সবাই আমরা রীতিমতো অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম, ডার্ক। প্রেসিডেন্ট স্বীকার করলেন।

তখন সব কিছু ব্যাখ্যা করার সময় ছিল না, বলল পিট। আপনারা আমার ওপর বিশ্বাস রেখেছিলেন, সেজন্য আমি কৃতজ্ঞ। তবে, আসলে কোনো সন্দেহ ছিল না। পাথরে যে সূত্র দিয়ে গেছেন জুনিয়াস ভেনাটর, সেটা অত্যন্ত পরিষ্কার, ভুল বোঝার অবকাশ নেই বললেই চলে। তিনি লিখেছেন, উত্তরে দাঁড়িয়ে দক্ষিণে তাকিয়ে আমি কী দেখলাম? দেখলাম আধ কিলোমিটার দূরে, আমার ডান অর্থাৎ পশ্চিম দিকে রয়েছে রোমা-ব্লাফ। নদীর দিকে তাকাতে বলেছেন ভেনাটর, তারমানে পাহাড়টা নদীর সবচেয়ে কাছে হবে। গনগোরা হিল নদীর সবচেয়ে কাছে নয়, রোমা ব্লাফ-ও নয়। কাজেই খানিকটা পশ্চিম দিকে এবং সামান্য উত্তর দিকে সরে গেলাম আমি, ফলে প্রথম যে পাহাড়টা গেলাম সেটা আকারে তত বড় না হলেও, নদীর সবচেয়ে কাছাকাছি।

পাহাড়টার নাম কী, ডার্ক জিজ্ঞেস করলেন সিনেটর।

এই পাহাড়টার? কেউ কোনো নাম বলতে পারছে না। বোধ হয় রাখা হয়নি।

রাখা হয়েছে, সহাস্যে বললেন প্রেসিডেন্ট। এইমাত্র। যে মুহূর্তে ডক্টর শার্প আর তার দল আমাকে পুরো আবিষ্কার ঘোষণার ব্যাপারে সবুজ সংকেত দেবেন, ওটার নাম হবে নাম-নেই পাহাড়।

.

জ্ঞানের বিপুল সমারোহ দেখে আচ্ছন্ন প্রেসিডেন্টের বাহিনী যখন ওয়াশিংটনে পৌঁছলেন, ততক্ষণে রাত পেরিয়ে ভোর হতে চলল। রিও গ্রান্ড নদী কুয়াশার অবগুণ্ঠন খুলছে।

নাম-নেই পাহাড়ের চূড়ায় বসেছিল পিট আর লিলি। ভ্যাপসা বাতাসে বসে রোমার আলো নিভে যেতে দেখছে ওরা।

ওর চোখে তাকিয়ে হাসল লিলি। নরম, আদুরে একটা ভঙ্গি ওর দৃষ্টিতে প্রথম সূর্যের আলো পড়ছে পিটের মুখে, কিন্তু লিলি জানে, ব্যাপারটা সম্পর্কে সচেতন নয় দুরন্ত এই পুরুষ, তার মন ঘুরে ফিরছে অতীতের কোনো এক সময়ে।

গত কয়েক দিনে লিলি জেনেছে, কোনো মেয়ের পক্ষেই একে সম্পূর্ণভাবে পাওয়া সম্ভব নয়। দিগন্তের ওপারে, অজানা কোনো স্থানে, ঘোর রহস্য ওর একমাত্র ভালোবাসা। আবেগঘন প্রেম করা যেতে পারে এর সাথে, বিয়ে নয়। লিলি জানে, ওর এই প্রেম ভাঙল বলে। হঠাৎ একদিন হারানোর আগে এখনই ওর প্রাপ্যটুকু আদায় করে নিতে চাইছে মেয়েটা।

 ডার্কের কাঁধে মাথা রেখে হেলান দিল লিলি। আচ্ছা, বলো তো, ওই টুকরোটাতে কী লেখা ছিল?

টুকরো?

ওই যে, যে স্ক্রোলটা নিয়ে তুমি আর অ্যাল খুব উত্তেজিত ছিলে।

আরো অনেক মহামূল্যবান আটিফ্যাক্টের অবস্থানের জোরাল সূত্র, ধীরে, শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে মন্তব্য করল পিট।

কোথায়?

সাগরের নিচে। স্ক্রোলটার নাম, মূল্যবান মালামালসহ ডুবে যাওয়া জাহাজের সন্ধান।

পিটের দিকে তাকায় লিলি। পানির তলায় পড়ে থাকা ট্রেজারের মানচিত্র?

 সব সময়ই কোথাও না কোথাও ট্রেজার থাকবেই। দূরাগত গলায় বলল পিট।

 আর তুমি ওগুলো খুঁজে বের করবে?

হাসল পিট। খুঁজে দেখতে কী ক্ষতি। দুর্ভাগ্য হলো, আঙ্কল স্যাম আমাকে সময়ই দিতে চায় না। সোনালি শহর, এল ভোরাডো খুঁজে দেখতে পারলাম না এখনো, ব্রাজিলের জঙ্গলে।

চিৎ হয়ে শুয়ে আকাশের বিলীন হতে থাকা তারাদের দিকে তাকিয়ে রইল লিলি। ভাবছি, কোথায় মাটি চাপা দেওয়া হয়েছে ওঁদের?

ধীরে, যেন বাস্তবে ফিরে এল পিট। কাদের?

সাহিত্যকর্মগুলো রক্ষা করার জন্য যে অভিযাত্রীরা সাহায্য করেছিল ভেনাটরকে।

মাথা নাড়ল পিট। জুনিয়াস ভেনাটর অত্যন্ত চালাক লোক। হতে পারে, নিজের বাইজেন্টাইন সহযাত্রীদের এইখানে আর–

এক হাত দিয়ে পিটকে ধরে ওর ওপর উঠে আসে লিলি। পরস্পরকে খুঁজে নেয় ওদের ঠোঁটজোড়া। মাথার উপরে অযথাই চিৎকার করে উঠে একটা শিকারি বাজ। চোখ খুলে, পিটকে সরিয়ে দেয় লিলি।

কী মনে হয়, ওরা মাইন্ড করবে না তো?

অবাক হয়ে ওর দিকে তাকায় পিট। মাইন্ড করবে মানে?

অভিযাত্রীরা। যদি ওঁদের কবরের উপরে প্রেম করি আমরা। জোরাল সম্ভাবনা আছে, এই মুহূর্তে ওঁরা আমাদের নিচে চিরনিদ্রায় শুয়ে আছেন।

 এক ঝটকায় লিলিকে নিজের শরীরের নিচে নিয়ে এল পিট। ওর চোখে চোখে তাকিয়ে রইল, ঠোঁটে শয়তানি হাসি।

মনে হয় না, এতে উনাদের কিছু আসে যায়। আমার অন্তত কিছু যায় আসে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *