ট্রেজার – ক্লাইভ কাসলার
অনুবাদ : মখদুম আহমেদ
লেখকের বক্তব্য
আলেকজান্দ্রিয়া গ্রন্থাগারের অস্তিত্ব সত্যিই ছিল। যুদ্ধ এবং ধর্মীয় হানাহানির কারণে তা ধ্বংস না হলে প্রাচীন মিসর, গ্রিক এবং রোমান সাম্রাজ্যের বহু তথ্য আজ আমাদের জানা থাকত। শুধু তা-ই নয়, ভূমধ্যসাগরের তীর ছাড়িয়ে বহু দূরে একসময়ে প্রতিষ্ঠিত অনেক অজানা সভ্যতার কথাও জানা যেত। তিনশো একানব্বই খ্রিস্টাব্দে সম্রাট থিওড়োসিয়াস-এর নির্দেশে আলেকজান্দ্রিয়ার সমস্ত পুস্তক, শিল্পকর্ম, মহান গ্রিক দার্শনিকদের মূল্যবান বই পুড়িয়ে দেওয়া হয়। কথিত আছে, বেশ কিছু পরিমাণ সংগ্রহ গোপনে নিরাপদে সরিয়ে নেয়া হয়েছিল তখন। কী কী উপকরণ সরিয়ে নেয়া হয়েছিল, রাখাই বা হয়েছে কোথায়; আজ ষোলোশো শতাব্দী পরেও তা এক রহস্য।
.
.
পূর্বকথা
পনেরোই জুলাই, তিনশো একানব্বই খ্রিস্টাব্দ।
অজানা কোনো স্থান।
গভীর কালো সুড়ঙ্গপথে ছোট্ট, কাঁপা কাঁপা একটা আলো ভুতুড়ে আবহ তৈরি করেছে। লোকটার পরনে আঁটো জামা, উল দিয়ে বোনা, নেমে এসেছে হাঁটু পর্যন্ত। থামল সে, হাতের কুপিটা মাথার ওপর উঁচু করে ধরল। ছোট্ট শিখার আভায় আলোকিত হয়ে উঠল মানুষের একটা দেহ, স্বর্ণ আর স্ফটিকের তৈরি একটা বাক্সের ভেতর রয়েছে ওটা। পেছনের মসৃণ দেয়ালে নৃত্য করছে কিম্ভুতকিমাকার ছায়াগুলো। আঁটো জামা পরা জুনিয়াস ভেনাটর দৃষ্টিহীন চোখজোড়ার দিকে কয়েক মুহূর্ত নীরবে তাকিয়ে থাকলেন, তারপর কুপি নামিয়ে আরেক দিকে ঘুরলেন।
দীর্ঘ এক সারিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে নিশ্চল মূর্তিগুলো যেন মৃত্যুপুরীর নিস্তব্ধতার ভেতর; সংখ্যায় এত বেশি যে গুনে শেষ করা প্রায় অসম্ভব একটা কাজ।
হাঁটতে শুরু করলেন জুনিয়াস ভেনাটর, অমসৃণ মেঝেতে তার পায়ের ফিতে বাঁধা স্যান্ডেল খসখস আওয়াজ তুলল। ক্রমে চওড়া হয়ে বিশাল এক গ্যালারিতে মিশেছে। সুড়ঙ্গপথটা। গম্বুজ আকৃতির সিলিংটাকে অবলম্বন দেয়ার জন্য খিলান তৈরি করায় প্রায় ত্রিশ ফুট উঁচু গ্যালারি কয়েক ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। খানিক পর পর দেয়ালের চুনাপাথর কেটে একটা করে লম্বা ও গভীর দাগ টানা হয়েছে, ওগুলো দিয়ে ছাদের পানি নেমে এসে মেঝের চওড়া নর্দমায় পড়ে। দেয়ালের গায়ে বিভিন্ন আকৃতির গর্ত প্রতিটিতে অদ্ভুতদর্শন, গোলাকৃতি পাত্র, ব্রোঞ্জের তৈরি। খোদাই করা বিশাল এই গুহার মাঝখানে একই আকৃতির বড় বড় কাঠের বাক্সগুলো না থাকলে ভীতিকর জায়গাটাকে রোমের নিচে পাতাল সমাধিক্ষেত্র বলে ভুল হতে পারত।
শেষ প্রান্তে তামার পাতে মোড়া ফিতে রয়েছে প্রতিটি বাক্সের সাথে, পাতগুলোয় বাক্সের নম্বর লেখা। প্যাপিরাস খুলে কাছাকাছি একটা টেবিলে সমান করলেন ভেনাটর, তাতে লেখা নম্বর তামার পাতে লেখা নম্বরের সাথে মেলালেন। বাতাস শুকনো আর ভারী, ঘামের সাথে ধুলো মিশে কাদার মতো জমছে গায়ে। দুঘন্টা পর সম্রষ্ট বোধ করলেন তিনি, প্রতিটি জিনিসের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। প্যাপিরাসটা গুটালেন, কোমরে জড়ানো কাপড়ের ভাঁজে ঢুকিয়ে রাখলেন সেটা।
ঘুরে ঘুরে গ্যালারির চারদিকে সাজানো সংগ্রহগুলোর দিকে আরেকবার তাকালেন ভেনাটর, অতৃপ্তির একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল তার বুকের ভেতর থেকে। জানেন, এসব আর কোনো দিন তার দেখা বা ছোঁয়ার সুযোগ হবে না। ক্লান্ত ভঙ্গিতে ঘুরলেন তিনি, হাতের কুপিটা বাড়িয়ে ধরে এগোলেন ফিরতি পথে।
বয়স হয়েছে ভেনাটরের, কিছুদিনের মধ্যে সাতষট্টিতে পড়বেন। মুখের অনেক ভাঁজ আর রেখা ফুটেছে, ক্লান্ত চরণে আগের সেই ক্ষিপ্রতা নেই, বেঁচে থাকার আনন্দ এখন আর তিনি তেমন উপভোগ করেন না। তবে অনেক দিন পর আজ তার সত্যি ভারি আনন্দ হচ্ছে, তৃপ্তি আর সন্তুষ্টির একটা অনুভূতি প্রাণশক্তির নতুন জোয়ার বইয়ে দিয়েছে তাঁর শরীরে। বিশাল একটা কর্মসূচি সাফল্যের সাথে শেষ করেছেন তিনি। কাঁধ থেকে নেমে গেছে গুরুদায়িত্ব। বাকি আছে শুধু দীর্ঘ সমুদ্র পাড়ি দিয়ে রোমে ফিরে যাওয়া। কে জানে কী আছে ভাগ্যে, সমুদ্রযাত্রা নিরাপদ হবে কি না, তা শুধু নিয়তিই বলতে পারে।
আরও চারটে সুড়ঙ্গপথ ঘুরে পাহাড়ে বেরিয়ে এলেন ভেনাটর। ইতোমধ্যে একটা সুড়ঙ্গপথ পাথর ধসে বন্ধ হয়ে গেছে। ছাদ ধসে পড়ায় ওখানে বানোজন ক্রীতদাস পাথর চাপা পড়ে মারা গেছে। এখনও সেখানেই আছে তারা, চিড়েচ্যাপ্টা লাশগুলোর কবর হয়ে গেছে পাথরের তলায়। একটা দীর্ঘশ্বাস চাপলেন ভেনাটর। ওদের জন্য দুঃখ করা অযৌক্তিক মনে হলো তার। এখান থেকে ফিরে আবার তো সেই সম্রাটের খনিতেই কাজ করতে হতো ওদেরকে। আধপেটা খেয়ে, রোগ-শোকে ভুগে ধুকে ধুকে মরার চেয়ে এ বরং ভালোই হয়েছে। বেঁচে থাকাই ছিল ওদের জন্য অভিশাপ।
সুড়ঙ্গমুখটা এমনভাবে পাথর কেটে তৈরি যে বড় বাক্সগুলো ভেতরে ঢোকাতে কোনো অসুবিধা হয়নি। পাহাড়ে বেরিয়ে আসছেন ভেনাটর, এই সময় দূর থেকে একটা লোমহর্ষক আর্তচিৎকার ভেসে এল। কপালে উদ্বেগের রেখা নিয়ে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলেন তিনি, আলোয় বেরিয়ে এসে চোখ কোঁচকালেন। থমকে দাঁড়িয়ে ক্যাম্পের দিকে তাকালেন তিনি, ঢালু একটা প্রান্তর জুড়ে সেটার বিস্মৃতি। অসভ্য কয়েকটা যুবতী মেয়েকে ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে একদল রোমান সৈনিক। সম্পূর্ণ বিবস্ত্র একটা মেয়ে আবার চিৎকার করে উঠে ধস্তাধস্তি শুরু করে দিল। সৈনিকদের পাঁচিল ভেঙে প্রায় বেরিয়ে এল সে, কিন্তু সৈনিকদের একজন তার লম্বা কালো চুল ধরে হ্যাঁচকা টান দিল, ধুলোর ওপর ছিটকে পড়ল মেয়েটা।
দৈত্যাকার এক লোক ভেনাটরকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এল। ক্যাম্পের সবার চেয়ে লম্বা সে, বিশাল কাঁধ, আর শক্তিশালী বাহু, হাতের শেষ প্রান্ত ঝুলে আছে হাঁটুর কাছাকাছি।
গল জাতির লোক লাটিনিয়াস মাসার, ক্রীতদাসদের প্রধান ওভারশিয়ার সে। হাত নেড়ে অভ্যর্থনা জানাল ভেনাটরকে, কথা বলল অস্বাভাবিক তীক্ষ্ণ আর কর্কশ কণ্ঠে, সব দেখলেন?
মাথা ঝাঁকালেন ভেনাটর। হ্যাঁ, তালিকা মেলানো হয়েছে। সুড়ঙ্গমুখ বন্ধ করতে পারো।
ধরে নিন বন্ধ হয়েছে।
ক্যাম্পে কিসের হৈচৈ?
ঘাড় ফিরিয়ে সৈনিকদের দিকে একবার তাকাল মাসার, ঘন ভ্রু জোড়ার ভেতর তার লাল চোখ দপ করে জ্বলে উঠল যেন, একদলা থুথু ফেলে আবার তাকাল ভেনাটরের দিকে। তার কথা থেকে জানা গেল, বোকা সৈনিকরা অস্থির হয়ে পড়েছিল, এখান থেকে পাঁচ লীগ উত্তরের একটা গ্রামে হামলা চালিয়ে এইমাত্র ফিরে এসেছে। এই নির্মম রক্তপাতের কোনো মানে নেই। কম করেও চল্লিশজন অসভ্য মারা গেছে। তাদের মধ্যে পুরুষ ছিল মাত্র দশজন, বাকি সবাই শিশু আর নারী। লাভ কিছুই হয়নি, কারণ সোনা আর অন্যান্য জিনিস, যা সৈনিকরা লুট করে এনেছে তার মূল্য গাধার বিষ্ঠার সমানও নয়। আর এনেছে কুৎসিত দর্শন কিছু মেয়ে লোক।
চেহারা কঠোর হয়ে উঠল ভেনাটরের। আর কেউ বেঁচে গেছে?
শুনলাম দু’জন পুরুষ নাকি জঙ্গলে পালিয়েছে।
তারা তাহলে অন্যান্য গ্রামে আওয়াজ দেবে। সর্বনাশ, সেভেরাস দেখছি মৌমাছির চাকে ঢিল ছুঁড়েছে!
সেভেরাস! ঘৃণায় কুঁচকে উঠল মাসারের ঠোঁটের কোণ। ওই ব্যাটা সেঞ্চুরিয়ন আর তার দল শুধু ঘুমোয় আর আমাদের মদ সাবাড় করে! পাছায় গরম লোহার হ্যাঁকা দিন, তবে যদি ওদের কুঁড়েমি দূর হয়।
ওরা আমাদের রক্ষা করবে, সেজন্যই ভাড়া করা হয়েছে, মনে করিয়ে দিলেন ভেনাটর।
কার হাত থেকে রক্ষা করবে? ব্যঙ্গের সুরে জিজ্ঞেস করল মাসার। ধর্মহীন বর্বরদের হাত থেকে, যারা পোকা আর সাপ-ব্যাঙ খায়?
ক্রীতদাসদের এক জায়গায় জড়ো করো, তাড়াতাড়ি বন্ধ করে দাও সুড়ঙ্গমুখ। খুব সাবধান, মাসার, কাজে যেন কোনো খুঁত না থাকে। আমরা চলে যাবার পর অসভ্যরা যেন আবার খুঁড়তে না পারে।
সে ভয় করবেন না। যতটুকু দেখলাম, এই অভিশপ্ত দেশে এমন কেউ নেই যে ধাতুবিদ্যা জানে। মুখ তুলে সুড়ঙ্গপথের মাথার ওপর তাকাল মাসার, গাছের বিশাল কাণ্ড পাশাপাশি সাজিয়ে প্রকাণ্ড মাচা তৈরি করা হয়েছে, মাচার ওপর পাথর, বালি আর মাটির আকাশছোঁয়া স্তূপ। স্তূপটা হেলান দিয়ে রয়েছে পাহাড়ের গায়ে। মাচাটা সরিয়ে নেয়ার পর গোটা পাহাড় ধসে পড়বে, তখন যদি পাঁচশো হাতি থাকে নিচে, একটাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। আপনার মহামূল্য শিল্পকর্ম চিরকাল অক্ষতই থাকবে, ভেনাটর।
নতুন করে আশ্বস্ত বোধ করলেন ভেনাটর। ওভারশিয়ারকে বিদায় করে দিয়ে রাগের সাথে ঘুরে দাঁড়ালেন, সেভেরাসের তাবুর দিকে যাচ্ছেন।
সামরিক বাহিনীর একটা প্রতীক চিহ্নকে পাশ কাটালেন ভেনাটর, বর্শার মাথায় একটা রুপালি ষড়। একজন প্রহরী বাধা দিতে এগিয়ে এল, এক ধাক্কায় তাকে সরিয়ে দিয়ে তাঁবুর ভেতর ঢুকলেন তিনি।
তাঁবুর ভেতর একটা ক্যাম্প-চেয়ারে বসে রয়েছে সেঞ্চুরিয়ান, কোলের ওপর নগ্ন অসভ্য নারী। জীবনে বোধ হয় কখনও গোসল করেনি মেয়েটা। সেভেরাসের দিকে মুখ তুলে দুর্বোধ্য কিচিরমিচির শব্দ করছে সে। বয়স নেহাতই কম, পনেরোর বেশি হবে না। সেভেরাসের গায়ে শুধু বুক ঢাকা আঁটো জামা। তার নগ্ন বাহু একজোড়া ব্রোঞ্জের তৈরি বন্ধনী দিয়ে অলংকৃত, দুই বাইসেপ কামড়ে আছে। একজন বীর যোদ্ধার পেশিবহুল বাহু, ঢাল আর তলোয়ার ধরায় যার রয়েছে দীর্ঘকালের অভিজ্ঞতা।
ভেনাটরের আকস্মিক আগমনে মুখ ফিরিয়ে তাকাবারও প্রয়োজন বোধ করল না সেভেরাস।
তাহলে এভাবেই তোমার সময় কাটছে, সেভেরাস? তিরস্কার করলেন ভেনাটর, তার কণ্ঠে শীতল ব্যঙ্গ। বিধর্মী একটা মেয়েকে নষ্ট করে ঈশ্বরের ক্রোধ অর্জন করছো?
কঠিন কালো চোখ ধীরে ধীরে ঘুরিয়ে ভেনাটরের দিকে তাকাল সেভেরাস। দিনটা আজ এত গরম যে আপনার খ্রিস্টীয় প্রলাপ শোনার ধৈর্য হবে না। আমার ঈশ্বর আপনার ঈশ্বরের চেয়ে অনেক বেশি সহনশীল।
সত্যি, কিন্তু তুমি মূর্তি পূজা করো।
যাকে যার খুশি পূজা করতে পারে, প্রশ্নটা একান্তই বাছাইয়ের। আপনি বা আমি, কেউই আমরা নিজেদের ঈশ্বরকে মুখোমুখি কখনও দেখিনি। কে বলবে কারটা খাঁটি?
যিশু হলেন প্রকৃত ঈশ্বরের সন্তান।
হাল ছেড়ে দেয়ার ভঙ্গিতে মাথা দোলাল সেভেরাস। আপনি আমার ব্যক্তিগত সময় দখল করেছেন। সমস্যা কী, বলে বিদায় হোন।
তুমি যাতে বেচারি মেয়েটাকে নষ্ট করতে পারো?
জবাব না দিয়ে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়াল সেভেরাস। বুকে লেপ্টে থাকা মেয়েটাকে বস্তার মতো বিছানার ওপর ছুঁড়ে দিল সে। আমার সাথে যোগ দেয়ার ইচ্ছে আছে আপনার, ভেনাটর? থাকলে বলুন, আপনাকে প্রথম সুযোগ দেব।
সেঞ্চুরিয়নের দিকে তাকিয়ে থাকলেন ভেনাটর। ভয়ের একটা ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল তাঁর শরীরে। যে রোমান সেঞ্চুরিয়ন একটা পদাতিক বাহিনীকে নেতৃত্ব দেয় তাকে অবশ্যই কঠোর হতে হবে, কিন্তু এ-লোক নির্দয় পশু। এখানে আমাদের কাজ শেষ হয়েছে, বললেন ভেনাটর। ক্রীতদাসদের নিয়ে সুড়ঙ্গমুখ বন্ধ করে দিচ্ছে মাসার। তাঁবু গুটিয়ে জাহাজে উঠতে পারি আমরা।
মিসর ছেড়েছি আজ এগারো মাস। আনন্দ-ফুর্তির জন্য আরেকটা দিন দেরি করলে কোনো ক্ষতি নেই।
আমরা লুটপাট করতে আসিনি। অসভ্যরা প্রতিশোধ নেয়ার সুযোগ খুঁজবে। আমরা মাত্র কজন, তারা অনেক।
আমাদের বিরুদ্ধে যত অসভ্যই পাঠানো হোক, আমার সৈনিকরা তাদের সামলাতে পারব।
তোমার লোকজন দুর্বল হয়ে পড়েছে।
রণকৌশল তারা ভুলে যায়নি, আত্মবিশ্বাসের হাসি নিয়ে বলল সেভেরাস।
কিন্তু তারা কি রোমের মর্যাদা রক্ষার জন্য আত্মত্যাগ করবে?
কোন দুঃখে, কেন? সাম্রাজ্যের সুদিন এসে আবার চলে গেছে। আমাদের এককালের তিলোত্তমা টাইবার আজ নোংরা বস্তিতে পরিণত হয়েছে। আমাদের শিরায় যদি রোমান রক্ত থেকেও থাকে, তা খুবই কম। আমার বেশির ভাগ লোকজন প্রদেশগুলোর আদি বাসিন্দা। আমি একজন স্প্যানিয়ার্ড আর আপনি একজন গ্রিক, জুনিয়াস ভেনাটর। আজকের এই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে এমন একজন সম্রাটের প্রতি আধপোয়া বিশ্বস্ততাও থাকবে কেন, যে সম্রাট বহুদূর পুবের একটা শহর থেকে শাসন করেন? এমনকি শহরটাকে আমরা কেউ দেখিনি পর্যন্ত। না, জুনিয়াস ভেনাটর, না আমার সৈনিকরা যুদ্ধ করবে, কারণ তারা পেশাদার যোদ্ধা, কারণ তাদেরকে যুদ্ধ করার জন্য ভাড়া করা হয়েছে।
কিংবা অসভ্যরা তাদেরকে বাধ্য করবে।
যখনকার সমস্যা তখন। সত্যি যদি অসভ্যদের দুর্মতি হয়…
সংঘর্ষ এড়ানো গেলে সব দিক থেকে ভালো। আমি সন্ধ্যা ঘনাবার আগেই রওনা হতে চাই…
বিকট শব্দে বাধা পেলেন ভেনাটর, পায়ের নিচে থরথর করে কেঁপে উঠল মাটি। এক ছুটে তাবু থেকে বেরিয়ে পাহাড়ের ওপর দিকে তাকালেন তিনি। মাচার নিচ থেকে অবলম্বনগুলো সরিয়ে নিয়েছে ক্রীতদাসরা, বিশাল আকারে কয়েকশো টন পাথরসহ মাটি আর বালিতে ঢাকা পড়ে গেছে সুড়ঙ্গমুখ। ধুলোর প্রকাণ্ড মেঘ ক্ষীণস্রোত নালার ওপর ছড়িয়ে পড়ল। পতনের প্রতিধ্বনি এখনও শোনা যাচ্ছে, শব্দটাকে ছাপিয়ে উঠল সৈনিক আর ক্রীতদাসদের উল্লাসধ্বনি।
যিশুর কৃপায় কাজটা শেষ হলো, আপন মনে বিড়বিড় করলেন ভেনাটর, তাঁর প্রসন্ন চেহারা উদ্ভাসিত হয়ে উঠল কী এক পবিত্র আলোয়। বহু শতকের জ্ঞান রক্ষা পেল।
তাঁবু থেকে বেরিয়ে তার পাশে এসে দাঁড়াল সেভেরাস। দুঃখের বিষয়, কথাটা আমাদের সম্পর্কে খাটে না।
ঘাড় ফেরালেন ভেনাটর। নিরাপদে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে যদি ঘরে ফিরতে পারি, তারপর আর ভয় কিসের?
শারীরিক নির্যাতন আর মৃত্যু অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য, চাঁছাছোলা ভাষায় বলল সেভেরাস। আমরা সম্রাটের বিরুদ্ধাচরণ করেছি। সহজে ক্ষমা করার পাত্র থিয়োডোসিয়াস নন! সাম্রাজ্যের কোথাও আমাদের লুকোবার জায়গা থাকবে না। উচিত কাজ হবে বিদেশে কোথাও আশ্রয় খুঁজে নেয়া।
আমার স্ত্রী আর মেয়ে…এনটিওচ-এর ভিলায় তাদের সাথে আমার দেখা হওয়ার কথা…
ধরে নিন ইতিমধ্যে তাদেরকে সম্রাটের লোকজন বেধে নিয়ে গেছে। হয় মারা গেছে, নয়তো ক্রীতদাস হিসেবে বেঁচে দেয়া হয়েছে।
অসম্ভব! সবেগে মাথা নাড়লেন ভেনাটর, দুচোখে অবিশ্বাস। উঁচু মহলে বন্ধু বান্ধব আছে আমার, আমি না ফেরা পর্যন্ত ওদেরকে তারা রক্ষা করবে।
এমনকি উঁচুমহলের বন্ধুদেরকেও ভয় দেখিয়ে কাবু করা যায়। ঘুষ দিয়ে দুর্বল করাও সম্ভব।
অকস্মাৎ কঠোর হয়ে উঠল ভেনাটরের চেহারা। আমরা যা অর্জন করেছি তার তুলনায় কোনো ত্যাগই বড় নয়। এখন শুধু দেখতে হবে আমরা যাতে অভিযানের রেকর্ড আর চার্ট নিয়ে ফিরতে পারি, তা না হলে সবই নিষ্ফল হয়ে যাবে।
জবাবে কিছু বলতে যাচ্ছিল সেভেরাস, কিন্তু সে তার সেকেন্ড-ইন-কমান্ডকে ছুটে আসতে দেখে চুপ করে থাকল। ঢাল বেয়ে তীরবেগে ছুটে আসছে যুবক নোরিকাস, দুপুরের রোদে চকচক করছে তার ঘামে ভেজা মুখ, হাপরের মতো, হাপাচ্ছে সে, বার বার দূরবর্তী নিচু পাহাড়গুলোর দিকে হাত তুলে কী যেন দেখাবার চেষ্টা করছে।
কপালে হাত তুলে রোদ ঠেকালেন ভেনাটর, পাহাড়শ্রেণীর দিকে তাকালেন। শক্ত কিছু নতুন রেখা ফুটল তাঁর মুখে।
অসভ্যরা, সেভেরাস! বদলা নেয়ার জন্য ছুটে আসছে তারা!
পাহাড়গুলো যেন পিঁপড়েতে ঢাকা পড়ে গেছে। কয়েক হাজার অসভ্য পুরুষ ও নারী ওপরে দাঁড়িয়ে তাদের দেশে অনুপ্রবেশকারী নিষ্ঠুর লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। সবাই তারা তীর-ধনুক সজ্জিত, হাতে চামড়ার ঢাল আর বর্শা-বর্শাগুলোর ডগা তীক্ষ্ণ করা হয়েছে কালো কাঁচের মতো আগ্নেয় শিলার টুকরো দিয়ে। কারও কারও হাতে কাঠের হাতলসহ পাথরের কুঠার। পুরুষদের পরনে শুধু কৌপীন। মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে সবাই, যেন কার ইঙ্গিতের অপেক্ষায়, ভাবলেশহীন, ঝড়ের পূর্ব মুহূর্তের মতো, ভীতিকর, থমথমে।
আরেক দল অসভ্য জড় হয়েছে জাহাজ আর আমাদের মাঝখানে, হাঁপাতে হাঁপাতে বলল নোরিকাস।
ঘাড় ফেরালেন ভেনাটর, চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। তোমার বোকামির এই হলো ফল, সেভেরাস। রাগে কেঁপে গেল তার গলা। তুমি আমাদের সবাইকে খুন করলে। মাটিতে হাঁটু গেড়ে প্রার্থনা শুরু করলেন তিনি।
আপনার ঈশ্বরভক্তি অসভ্যদের ঘুম পাড়াতে পারবে না, শুরুদেব, ব্যঙ্গের সুরে বলল সেভেরাস। খেলা দেখাবে শুধুমাত্র তলোয়ার। নোরিকাসের দিকে ফিরে তার একটা বাহু আঁকড়ে ধরল সে, দ্রুত কয়েকটা নির্দেশ দিল, বাদককে বলল বাজনা বাজিয়ে সৈনিকদের জড় করুক। ক্রীতদাসদের হাতে অস্ত্র তুলে দিক লাটিনিয়াস মাসার। শক্ত চৌকো আকৃতি নেয়ার হুকুম দাও সৈনিকদের। নদীর দিকে আমরা ঝাক বেঁধে এগোব।
ক্ষিপ্র ভঙ্গিতে স্যালুট করল নোরিকাস, ক্যাম্পের কেন্দ্র লক্ষ্য করে ছুটল।
ষাটজন সৈনিক দ্রুত ফাঁপা একটা চৌকো আকৃতি নিল। সিরিয়ান তীরন্দাজরা থাকল আকৃতিটার দুপাশে, সশস্ত্র ক্রীতদাসদের মাঝখানে, বাইরের দিকে মুখ করে। রোমান সৈনিকরা থাকল আকৃতির সামনের আর পেছনে। সৈনিকদের তৈরি পাঁচিলের আড়ালে, চতুর্ভুজের ভেতর, মিসরীয় আর গ্রিক সহকারী ও মেডিকেল দলসহ থাকলেন ভেনাটর। পদাতিকদের জন্য প্রধান অস্ত্র হলো গ্লাডিয়াস-দুমুখো তীক্ষ্ণ ডগা তলোয়ার, বিরাশি সেন্টিমিটার লম্বা। আর আছে ছুঁড়ে মারার জন্য দুমিটার লম্বা বল্লম। শারীরিক নিরাপত্তার জন্য সৈনিকরা লোহার হেলমেট পরেছে, হেলমেটের কিনারা গালের দুপাশে ঝুলে আছে, দুটো প্রান্তকে বাঁধা হয়েছে চিবুকের কাছে। খাঁচা আকৃতির লোহার বেড় দিয়ে বুক, কাধ আর পিঠেরও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। হাঁটু থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত লম্বা হাড়টাকে রক্ষার জন্য লোহার গার্ড। তাদের ডালগুলো কাঠের তৈরি।
পাহাড় থেকে হুড়মুড় করে নেমে না এসে আস্তে ধীরে কলামটাকে চারদিকে থেকে ঘিরে ফেলল অসভ্যরা। হামলা করার সময়ও তারা ব্যস্ত হলো না। প্রথমে তারা অল্প কজন লোক পাঠিয়ে নিবিড় ঝাঁকটা ভাঙার জন্য একটা খোঁচা দিল। অনেকটা কাছাকাছি এসে দুর্বোধ্য ভাষায় চেঁচামেচি করল তারা, অঙ্গভঙ্গির সাহায্যে হুমকি দিল। কিন্তু সংখ্যায় নগণ্য হলেও শত্রুপক্ষ ভয় পেল না বা ছুটে পালাল না।
অভিজ্ঞতা মানুষকে নির্ভয় করে, আর সেঞ্চুরিয়ান সেভেরাসের অভিজ্ঞতার কোনো অভাব নেই। লাইন থেকে কয়েক পা এগিয়ে অসভ্য যোদ্ধায় গিজগিজ করা সামনের প্রান্তরটি খুঁটিয়ে পরীক্ষা করল সে। উপহাসের ভঙ্গিতে শত্রুদের উদ্দেশে হাত নাড়ল একবার। অসম যুদ্ধে আগেও বহুবার তাকে জড়িয়ে পড়তে হয়েছে। মাত্র ষোলো বছর বয়েসে স্বেচ্ছায় সেনাবাহিনীতে যোগ দেয় সে। সাধারণ সৈনিক থেকে ধীরে ধীরে উন্নতি করেছে, দানিয়ুবের তীরে গথদের সাথে আর রাইনের তীরে ফ্রাঙ্কদের সাথে যুদ্ধ করে বীরত্বের স্বীকৃতি হিসেবে অনেক পদক পেয়েছে। সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণের পর ভাড়াটে সৈনিক হয়েছে সে, যে বেশি টাকা দেবে তার পক্ষ নিয়ে লড়াই করতে আপত্তি নেই।
নিজের সৈনিকদের প্রতি অটল বিশ্বাস রয়েছে সেভেরাসের। তাদের খাপমুক্ত তলোয়ার আর হেলমেট রোদ লেগে ঝলমল করছে। সবাই তারা শক্তিশালী যোদ্ধা, যুদ্ধ করে অভিজ্ঞ হয়েছে, পরাজয় কাকে বলে জানে না।
বেশির ভাগ গৃহপালিত পশু, তার ঘোড়াটাসহ ঈজিপ্ট থেকে সমুদ্র অভিযানে বেরোনোর পরপরই মারা গেছে। কাজেই চৌকো আকৃতির ঝাঁকের সামনে থাকল সে-হাঁটছে, কয়েক পা এগিয়ে একবার করে ঘুরছে, যাতে চারদিকে দাঁড়ানো শত্রুপক্ষের ওপর নজর রাখা যায়।
পাহাড় প্রাচীর সমুদ্র আছড়ে পড়ার মতো বিকট গর্জন তুলে ধেয়ে এল অসভ্যরা, ঝাঁপিয়ে পড়ল রোমানদের ওপর। জনসমুদ্রের প্রথম ঢেউটাকে লম্বা বর্শা আর তীরের বাধা পেরিয়ে আছাড় খেল ঝাকের গায়ে। কাস্তে দিয়ে গম কাটার মতো সাফ করা হলো তাদের। অসভ্যদের লাল রক্তে তলোয়ালের চকচকে গেল লাটিনিয়াস মাসার ক্রীতদাসরা নিজেদের জায়গা ছেড়ে এক চুল নড়ল তো নাই-ই, শত্রু নিধনেও তারা যথেষ্ট কৃতিত্বের পরিচয় দিল।
চারদিক থেকে বৃত্তটা ছোটো করে আনল অসভ্যরা। লোক তারা যা হারিয়েছে, তার দশগুণ নেমে এল পাহাড় থেকে। বাঁধ ভাঙা পানির মতো আসছে তো আসছেই, বিরতিহীন। রোমানদের ঝকটা মন্থরগতিতে সামনে এগোল। অসভ্যদের তৃতীয় আক্রমণ শুরু হলো। সবুজ ঘাসমোড়া ঢালে আবার রক্তস্রোত বইল। অসভ্যদের একটা দল পেছন থেকে হামলা চালালো। সদ্য নিহত বা আহত সহযোদ্ধাদের গায়ে আছাড় খেল তারা, পড়ে থাকা অস্ত্রের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হলে খালি পা, নিজেদের কীভাবে রক্ষা করতে হয় জানে না। ঝাক থেকে বেরিয়ে এসে অপ্রস্তুত অসভ্যদের কচুকাটা করল রোমানরা, কাজ সেরে আবার তারা ফিরে গিয়ে চৌকো আকৃতি নিল।
এবার অন্যদিকে মোড় নিল যুদ্ধ। বিদেশিদের বল্লম, বর্শা আর তীরের বিরুদ্ধে সুবিধা করতে পারবে না বুঝতে পেরে পিছিয়ে গেল অসভ্যরা, জড় হলো নতুন করে। এরপর তারা ঝাঁক ঝাঁক ভোঁতা তীর আর বর্শা ছুঁড়তে শুরু করল, মেয়েরা ছুড়ল পাথর।
ঢাল তুলে মাথা বাঁচাল রোমানরা, মন্থর কিন্তু অবিচল ভঙ্গিতে এগিয়ে চলল নদী আর নিরাপদ আশ্রয় জাহাজের দিকে। অসভ্যরা দূরে সরে যাওয়ায় তাদের ক্ষতি যা করার তা শুধু সিরিয়ান তীরন্দাজরাই করতে পারছে। ক্রীতদাসদের জন্য ঢালের সংখ্যা যথেষ্ট নয়, অরক্ষিত অবস্থায় বর্শা আর তীরের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার চেষ্টা করে যাচ্ছে তারা। দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রায় এমনিতেই দুর্বল হয়ে পড়েছে বেচারিরা, তার ওপর গুহার ভেতর পাথর খোঁড়ার কাজ করতে হয়েছে। তাদের মধ্যে অনেকেই পড়ে যাবার পর আর উঠতে পারল না। ঝাক থেকে বেরিয়ে এসে সাহায্য করতে রোমানরা কেউ রাজি নয়। একটু পরই অসভ্যদের হাতে আহত ধরাশীয়দের শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল।
যুদ্ধ পরিস্থিতি ও শত্রুপক্ষের ভাবসাব লক্ষ করে নতুন একটা নির্দেশ দিল সেভেরাস। স্থির হয়ে গেল সৈনিকের ঝাঁক, সবাই তারা যে যার অস্ত্র মাটিতে ফেলে দিল। অসভ্যরা ধরে নিল, রোমানরা আত্মসমর্পণ করতে চাইছে। বিকট রণহুঙ্কার ছেড়ে তীরবেগে ছুটে এল তারা। একেবারে যখন কাছে চলে এসেছে অসভ্যদের বিশাল বাহিনী, শেষ মুহূর্তে আরেকটা নির্দেশ দিল সেভেরাস-হ্যাঁচকা টানে সৈনিকরা খাপমুক্ত করল তলোয়ার, পাল্টা হামলা শুরু করল।
দুটো বোল্ডারের ওপর দাঁড়িয়ে নিপুণ ভঙ্গিতে তলোয়ার চালালো সেঞ্চুরিয়ান, চারজন অসভ্য তার পায়ের সামনে ধরাশায়ী হলো। তরোয়ালের চওড়া দিকটার আঘাতে আরেকজন আছড়ে পড়ল, এক কোপে তার মাথাটা ধড় থেকে আলাদা করল সে। মাত্র অল্প কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে পিছু হটতে বাধ্য হলো অসভ্যরা, কয়েকশো নিহত সঙ্গীকে ফেলে নাগালের বাইরে চলে গেল আবার।
দম ফেলার ফুরসত পেয়ে হিসাবে মন দিল সেভেরাস। ষাটজন সৈনিকের মধ্যে বারোজন হয় মারা গেছে, নয়তে যেতে বসেছে। আরও চৌদ্দজন বিভিন্ন ধরনের আঘাত পেয়ে অচল হয়ে পড়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ক্রীতদাসরা। অর্ধেকের বেশি হয় মারা গেছে নয়তো নিখোঁজ।
দ্রুত পায়ে ভেনাটরের দিকে এগোল সে। জামা ছিঁড়ে বাহুর একটা ক্ষত বাধার চেষ্টা করছেন তিনি। কোমরে জড়ানো কাপড়ের ভাঁজে এখনও সাহিত্য ও শিল্পকর্মের তালিকাটা বহন করছেন গ্রিক পণ্ডিত। এখনও আমাদের সাথে আছেন তাহলে, গুরুদেব!
মুখ তুলে তাকালেন ভেনাটর, তার দুচোখে উপচে পড়ছে দৃঢ় প্রত্যয়। আমার চোখের সামনে মারা যাবে তুমি, সেভেরাস।
হুমকি, ঈর্ষা, নাকি দিব্যজ্ঞান?
কিছু আসে যায়? দেশে ফিরে যাওয়া আমাদের কারও পক্ষেই আর সম্ভব হবে না।
জবাব দিল না সেভেরাস। হঠাৎ করে আবার শুরু হয়ে গেল যুদ্ধ, সবাই মিলে অসভ্যরা এত বেশি পাথর আর বর্শা ছুড়ছে যে গোটা আকাশ কালো হয়ে গেল, ঢাল তুলে ঠেকাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল সৈনিকরা। এক ছুটে চৌকো ঝাকের সামনে পৌঁছে গেল সে।
রোমানরা সাহসের সাথে যুদ্ধ করল, কিন্তু সংখ্যায় তারা কমে গেল। প্রায় সব কজন সিরিয়ান ধরাশায়ী হয়েছে। বিরতিহীন পাথর আর বর্ষা-বৃষ্টি আকৃতিটাকে ছোট করে তুলল। যারা যুদ্ধ করছে তারা সবাই আহত ও ক্লান্ত, রোদ আর পিপাসায় কাতর। তলোয়ার ধরা হাতগুলো ঝুলে পড়তে লাগল, হাতবদল করল বারবার।
ক্লান্ত অসভ্যরাও, তারাও বিপুলহারে ক্ষগ্রিস্ত, তবু তারা নদীর পথে ঢাল ছেড়ে এক ইঞ্চিও নড়ল না। রোমান সৈনিকরা একজন যদি নিহত হয়, অসভ্যরা নিহত হয়েছে বারোজন। ভাড়াটে সৈনিকদের প্রতিটি লাশ পিনকুশনের মতো হয়েছে দেখতে, তীর বিদ্ধ।
দৈত্যাকার ওভারশিয়ার মাসার হাঁটু আর উরুতে দুটো তীর খেয়েছে। এখনও পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে থাকলেও, আঁকের সাথে এগোতে পারছে না সে। পিছিয়ে পড়ল, আর দেখতে না দেখতে বিশজনের একটা অসভ্য বাহিনী ঘিরে ধরল তাকে। ঘুরল সে, অলসভঙ্গিতে, তুলোয়ার চালিয়ে নিখুঁতভাবে দ্বিখণ্ডিত করল তিনজনকে। তার শক্তি দেখে পিছিয়ে গেল বাকি সবাই, নাগালের বাইরে দাঁড়িয়ে ইতস্তত করতে লাগল। চিৎকার করে তাদেরকে সামনে এসে পড়ার আহ্বান জানাল মাসার।
ঠেকে শিখেছে অসভ্যরা, এখন আর তারা হাতের নাগালে আসছে না। দূর থেকে মাসারকে লক্ষ্য করে বর্শা ছুড়ল তারা। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে মাসারের শরীরের পাঁচ জায়গা থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোল। বর্শাগুলো ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে খুলে ফেলল মাসার। সে যখন এই কাজে ব্যস্ত, একজন অসভ্য ছুটে কাছে চলে এল, তারপর ছুঁড়ে দিল হাতে বর্শা। সরাসরি মাসারের গলায় বিধল সেটা। ধীরে ধীরে ধুলোর মধ্যে লুটিয়ে পড়ল সে। অসভ্য নারী-বাহিনী উন্মাদিনীর মতো ছুটে এল, পাথর ছুঁড়ে ছাতু বানিয়ে দিল তাকে।
নদীর কিনারায় পৌঁছানোর পথে রোমানদের সামনে একমাত্র বাধা বেলে পাথরের একটা ঢাল। আরও সামনে, হঠাৎ করে দেখা গেল নীল আকাশ রং বদলে কমলা হয়ে গেছে। তারপর ধোয়ার একটা বিশাল স্তম্ভ মোচড় খেতে খেতে মাথাচাড়া দিল, কালো আর ভারী বাতাস বয়ে নিয়ে এল কাঠের পোড়া গন্ধ।
বিস্ময়ের ধাক্কা খেলেন ভেনাটর, তারপর হতাশায় মুষড়ে পড়লেন। জাহাজ! আর্তনাদ করে উঠলেন তিনি। জাহাজে ওরা আগুন ধরিয়ে দিয়েছে?
রক্তাক্ত সৈনিকরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ল, উন্মাদের মতো ছুটল নদীর দিকে। দুদিক থেকে হামলা চালালো এবার অসভ্যরা। বেশ কজন ক্রীতদাস অস্ত্র ফেলে দিয়ে আত্মসমর্পণ করল, সাথে সাথে তাদেরকে মেরে ফেলা হলো। বাকিরা একটা গাছের আড়াল থেকে পাল্টা আঘাত হানার চেষ্টা করল, কিন্তু পিছু ধাওয়ারত অসভ্যরা ঝাঁপিয়ে পড়ল তাদের ওপর, আপাতত প্রাণে বাঁচতে পারল মাত্র একজন।
সেভেরাস আর তার আহত সৈনিকরা যুদ্ধ করতে করতে ঢলের মাথায় পৌঁছল, তারপরই হঠাৎ তারা দাঁড়িয়ে পড়ল, খেয়াল নেই চারদিকে রক্তস্রোত বয়ে যাচ্ছে। ঢাল থেকে নিচে, নদীর দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল তারা।
আগুনের স্তম্ভগুলো পাক খেতে খেতে উঠে গিয়ে মিশছে কালো ধোয়ার সাথে। জাহাজের বহর, তাদের পালানোর একমাত্র বাহন, নদীর কিনারা ধরে সার সার পুড়ছে। মিসর থেকে নিয়ে আসা বিশাল আকৃতির জাহাজগুলো অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হয়েছে।
সৈনিকদের ঠেলে সামনে চলে এলেন ভেনাটর, দাঁড়ালেন সেভেরাসের পাশে। চুপ হয়ে গেছে সেঞ্চুরিয়ান, তার জামা আর লোহার বর্ম রক্ত ও ঘামে পিচ্ছিল। সর্বনাশা আগুনের আভায় জ্বল জ্বল করছে তার চোখ দুটো।
নদীর তীরে নোঙর ফেলা জাহাজগুলো অরক্ষিত অবস্থায় ছিল। অসভ্যদের বিশাল এক বাহিনী নাবিকদের এক জায়গায় জড় করে পায়ের তলায় পিষে মেরেছে, তারপর আগুন দিয়েছে জাহাজে। তাদের হামলা থেকে বেঁচে গেছে একটা মাত্র ছোট্ট বাণিজ্য জাহাজ। নাবিকরা যেভাবেই হোক অসভ্যদের আক্রমণ এড়িয়ে গেছে। চারজন নাবিক পাল তোলার কাজে ব্যস্ত, বাকি কয়জন দ্রুত বৈঠা চালিয়ে গভীর পানিতে সরে যাবার চেষ্টা করছে।
নিষ্ফল রাগে হাত দুটো শক্ত মুঠো করে দাঁড়িয়ে থাকলেন ভেনাটর। সহস্র বছরের জ্ঞান আর শিল্পকর্মের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হতে যাচ্ছে বলে তাঁর সেই আগের দৃঢ় বিশ্বাস কর্পূরের মতো উবে গেছে মন থেকে।
কাঁধে হাতের স্পর্শ পেয়ে মুখ ফেরালেন ভেনাটরন, দেখলেন তাঁর দিকে ফিরে সকৌতুকে হাসছে সেভেরাস।
চিরকালের আশা ছিল মারা যাব, বলল সেঞ্চুরিয়ান, কোলের ওপর সুন্দরী মেয়ে আর হাতে মদের পাত্র নিয়ে।
কে কীভাবে মরবে তা শুধু ঈশ্বরই বলতে পারেন, অস্পষ্টস্বরে বললেন ভেনাটর।
আমি বরং বলব ভাগ্যের একটা বিরাট ভূমিকা রয়েছে।
এত পরিশ্রম, এত সময় ব্যয়, সব বৃথা গেল!
অন্তত আপনার জিনিসগুলো নিরাপদে লুকানো থাকল, বলল সেভেরাস। কেউই পালাতে পারেনি তা তো নয়। নাবিকরা সাম্রাজ্যের সেরা পণ্ডিতদের জানিয়ে দেবে এখানে কী করেছি আমরা।
না, বললেন ভেনাটর। কেউ তাদের রূপকথা বিশ্বাস করবে না। ঘাড় ফিরিয়ে পাহাড়শ্রেণীর দিকে তাকালেন তিনি, ওগুলো চিরকালের জন্য হারিয়ে গেল।
আপনি সাঁতার জানেন?
সেভেরাসের ফিরে এল ভেনাটরের দৃষ্টি। সাঁতার?
আমার সেরা পাঁচজন লোককে আপনার সাথে দিচ্ছি। অসভ্যদের মাঝখানে দিয়ে পথ করে দেবে ওরা। সাঁতার জানলে জাহাজটায় আপনি পৌঁছবার চেষ্টা করতে পারেন।
আমি…আমি ঠিক জানি না।…পানির দিকে তাকালেন ভেনাটর, নদীর কিনারা আর জাহাজের মাঝখানে দূরত্ব ক্রমশ বাড়ছে।
পোড়া একটা কাঠ ভেলা হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন, ঝঝের সাথে বলল সেভেরাস। যা করার তাড়াতাড়ি করুন। সবাই আমরা আমাদের ঈশ্বরের কাছে পৌঁছে যাব আর কিছুক্ষণের মধ্যে।
তোমাদের কী হবে?
লড়ার বা দাঁড়বার জন্য ঢালের এই মাথাটা কী?
সেনটিউরিয়ানকে আলিঙ্গন করলেন ভেনাটর। ঈশ্বর তোমার সঙ্গে থাকুন।
তারচেয়ে বরং আপনার সাথে হাঁটুন তিনি। ঝট করে সৈনিকদের দিকে ঘুরল সেভেরাস, প্রায় অক্ষত পাঁচজন শক্তিশালী লোককে বাছাই করল, নির্দেশ দিয়ে বলল, নদীর কিনারা পর্যন্ত ভেনাটরের পথ নির্বিঘ্ন করার জন্য সম্ভাব্য সব কিছু করতে হবে তাদেরকে প্রয়োজনে প্রাণ দিতে হবে। তারপর বাকি সৈনিকদের নিয়ে নতুন করে ছোট্ট একটা ঝাক তৈরি করল। অসম যুদ্ধের শেষাংশে অভিনয় করার জন্য।
পাঁচজন সৈনিক ভেনাটরকে মাঝখানে নিয়ে ছোট্ট একটা বৃত্ত তৈরি করল। সময় নষ্ট না করে নদীর কিনারা লক্ষ্য করে ছুটল তারা। রণহুঙ্কার ছাড়ল, হতচকিত অসভ্যদের মধ্যে সামনে যাকে পেল তাকেই ঘায়েল করল তলোয়ালের আঘাতে। খেপে ওঠা ষাঁড়ের মতো তীরবেগে ছুটল তারা।
এতই ক্লান্ত যে সব রকম অনুভূতি হারিয়ে ফেলেছেন ভেনাটর, তবে তাঁর হাতে তলোয়ারটা মুহূর্তের জন্যও স্থির হলো না বা একবারও হোঁচট খেলেন না তিনি। একজন পণ্ডিত, রূপান্তরিত হয়েছেন যোদ্ধায়। তার ভেতর শুধু আশ্চর্য একটা জেদ কাজ করছে, মৃত্যুভয় ভুলে গেছেন।
অস্থির অগ্নিশিখার ভেতর দিয়ে যুদ্ধ করতে করতে এগোল তারা। মাংস পোড়ার গন্ধে বমি পেল ভেনাটরের। জামাটা আরেকবার ছিঁড়ে নাকে কাপড় চেপে ধরলেন তিনি। ধোঁয়ায় কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না, ঝর ঝর করে পানি ঝরছে চোখ থেকে।
এক এক করে ধরাশায়ী হলো সৈনিকরা, কিন্তু যতক্ষণ নিঃশ্বাস থাকল ততক্ষণ তারা রক্ষা করল ভেনাটরকে। হঠাৎ করে পায়ে ছোঁয়া পেলেন ভেনাটর। চোখে কিছুই দেখছেন না, লাফ দিলেন সামনে। ঝপাৎ করে পানিতে পড়লেন তিনি, সাথে সাথে সাঁতার কেটে দূরে সরে যাবার চেষ্টা করলেন। কাঠের একটা তক্তার স্পর্শ পাওয়া মাত্র আঁকড়ে ধরলেন সেটাকে। ধোয়ার ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন খোলা নদীতে। তক্তার ওপর উঠলেন তিনি, পেছনে তাকাবার সাহস হলো না।
ঢালের মাথায় দাঁড়িয়ে সৈনিকরা এখনও পাথর বর্শা ঠেকাবার ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছে। চারবার একত্রিত হয়ে রোমানদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার চেষ্টা করল অসভ্যরা, প্রতিবার সৈনিকদের প্রতিরক্ষা ভেদ করে ব্যর্থ হয়ে পিছিয়ে যেতে বাধ্য হলো। নিজেদের অবস্থানে অটল থাকলেও, রোমানদের সংখ্যা কমছে। চৌকা আকৃতিটা ভেঙে পড়ল, অসহায় কয়েকজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে ঢালের খোলা মাথায়, কাঁধে কাঁধ ঠেকিয়ে যুঝছে। তাদের চারপাশে আহতরা কাতরাচ্ছে, এখানে সেখানে স্তূপ হয়ে আছে লাশ। ঢাল বেয়ে গড়িয়ে নামছে রক্তের স্রোত। তবু লড়ে চলেছে রোমানরা।
এরপর আরও দুঘণ্টা ধরে চলল যুদ্ধ। এখন আগের মতোই শক্তি নিয়ে হামলা করছে অসভ্যরা। বিজয়ের গন্ধ পেয়েছে, শেষ একটা হামলা চালাবার জন্য আবার তারা জড় হলো।
মাংস থেকে ফলাটা বের করতে না পেরে তীরের বেরিয়ে থাকা অংশটা ভেঙে ফেলল সেভেরাস, অক্লান্তভাবে লড়ে যাচ্ছে সে। পাশে মাত্র অল্প কজন সৈনিক। তারারও এবার একে একে পড়ে যাচ্ছে। পাথর, বর্শা, বল্লম ঢেকে ফেলছে তাদেরকে।
সবার শেষে পতন হলো সেভেরাসের। শরীরের নিচে ভাঁজ হয়ে গেল পা দুটো, তলোয়ার ধরা হাতটা নড়াতে পারল না। মাটিতে গেড়ে রয়েছে সে, কাত হয়ে যাচ্ছে। শরীর, তার পরও দাঁড়াবার চেষ্টা করল সে, কিন্তু পারল না। মুখ তুলল আকাশে, বিড়বিড় করে বলল, মা, বাবা, তোমাদের হাতে তুলে নাও আমাকে।
যেন তার আবেদনে সাড়া দিয়েই, ছুটে এসে তার সারা শরীর বর্শা গাঁথল অসভ্যরা। সমস্ত জ্বালা-যন্ত্রণার ঊর্ধ্বে উঠে গেল সেভেরাস।
ওদিকে তক্তার ওপর শুয়ে দ্রুত হাত চালাচ্ছেন ভেনাটর পানিতে, মরিয়া হয়ে জাহাজটার কাছে পৌঁছতে চেষ্টা করছেন তিনি। কিন্তু ধীরে ধীরে হতাশা গ্রাস করল তাকে। স্রোত আর বাতাস বাণিজ্য জাহাজটাকে আরও দূরে সরিয়ে নিল।
নাবিকদের উদ্দেশে চিৎকার করলেন ভেনাটর, একটা হাত তুলে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলেন। নাবিকদের একটা দল আর ছোট্ট একটা মেয়ে, পাশে কুকুর নিয়ে, জাহাজের পেছন দিকের কিনারায় দাঁড়িয়ে রয়েছে, সবাই তারা তাকিয়ে রয়েছে তার দিকে নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে, জাহাজ ঘুরিয়ে তাকে উদ্ধারের কোনো চেষ্টাই তারা করছে না। ভাটির দিকে এগিয়ে চলল জাহাজ, যেন ভেনাটরের কোনো অস্তিত্বই নেই।
ওরা তাকে ফেলে যাচ্ছে, ভেনাটর উপলব্ধি করলেন। কেউ তাকে উদ্ধার করবে না। তক্তার ওপর ঘুষি মারলেন তিনি, নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে ফুঁপিয়ে উঠলেন, স্থির বিশ্বাসে পৌঁছেছেন ঈশ্বর তাকে পরিত্যাগ করেছেন। অবশেষে তিনি ঘাড় ফিরিয়ে তীরের দিকে তাকালেন।
যুদ্ধ শেষ। দুঃস্বপ্নের মতোই নেই হয়ে গেছে সব কিছু।
.
প্রথম পর্ব – নেবুলা ফ্লাইট ১০৬
১২ অক্টোবর, ১৯৯১। হিথরো এয়ারপোর্ট, লন্ডন।
০১.
ভিআইপি লাউঞ্জের ভেতর থেকে বাইরে উপচে পড়েছে ফটোগ্রাফার আর সাংবাদিকদের ভিড়টা। ভিড়ের কিনারা দিয়ে এগোলেও কেউ লক্ষ করল না পাইলটকে। চৌদ্দ নম্বর গেটের ওয়েটিং রুমে আরোহীরা অপেক্ষা করছে, তারাও কেউ খেয়াল করল না যে ব্রিফকেসের বদলে একটা ডাফল ব্যাগ রয়েছে লোকটার হাতে। মাথা সামান্য নিচু করে, চোখের দৃষ্টি নাক বরাবর সামনে, হন হন করে হেঁটে এল সে। বিশ-পঁচিশটা টিভি-ক্যামেরা সচল হয়ে রয়েছে, সতর্কতার সাথে সব কয়টাকে এড়িয়ে গেল। অবশ্য ক্যামেরাগুলোর লক্ষ্য লম্বা এক সুন্দরী। পালিশ করা চকচকে সোনার মতো রং তার গায়ের। আয়নার মতো মসৃণ। কয়লা-কালো চোখ দুটো একাধারে আদেশ ও আবেদন, দুটো ভাব প্রকাশেই সক্ষম। ফটোগ্রাফার, সাংবাদিক আর সিকিউরিটি গার্ডদের ভিড়টা তাকে ঘিরেই।
ঘেরা বোর্ডি র্যাম্প বেয়ে উঠে এল পাইলট, সাদা পোশাক পরা দু’জন এয়ারপোর্ট সিকিউরিটি এজেন্ট তার পথরোধ করে দাঁড়াল। ছ্যাৎ করে উঠল লোকটার বুক, মাত্র কয়েক ফুট দূরে প্লেনের দরজা, কিন্তু মাঝখানে গার্ড দু’জনকে মনে হলো নিরেট পাঁচলি। সহজভঙ্গিতে একটা হাত নেড়ে কাঁধের মৃদু ধাক্কায় তাদেরকে সরিয়ে দিয়ে সামনে এগোবার চেষ্টা করল সে, ঠোঁটে মিটিমিটি হাসি লেগে রয়েছে। কিন্তু কাজ হলো না, একটা হাত শক্ত করে তার বাহু আঁকড়ে ধরল। এক মিনিট, ক্যাপটেন।
থামল পাইলট, মুখে হাসি আর চোখে প্রশ্ন নিয়ে তাকাল সে, যেন তাকে বিব্রত করায় কৌতুক বোধ করছে সে। তার চোখের রং জলপাই আর খয়ের মেশানো, দৃষ্টি যেন অন্তর ভেদ করে যায়। নাকটা কয়েকবারই ভেঙেছে। ডান চোয়ালে সরু একটা কাটা দাগ। ক্যাপের নিচে কাঁচাপাকা ঘোট করে ছাঁটা চুল আর মুখের ভাঁজ দেখে বোঝা যায় পঞ্চাশের ওপরই হবে বয়স। লম্বায় সে ছয় ফুট দুইঞ্চি, মোটাসোটা, তবে ভুঁড়িটা বয়সের তুলনায় এখনও ছোটই। ইউনিফর্মের ভেতর কাঠামোটা ঋজু। দেখে মনে হবে, আন্তর্জাতিক প্যাসেঞ্জার জেট চালায় এমন দশ হাজার এয়ারলাইন পাইলটদেরই একজন সে।
ব্রেস্ট পকেট থেকে পরিচয়পত্র বের করে একজন এজেন্টকে দিল লোকটা। এট্রিপে বোধহয় ভিআইপি কেউ যাচ্ছেন?
কড়া ভাঁজের স্যুট পরা ব্রিটিশ গার্ড মাথা ঝাঁকাল। জাতিসংঘের একটা দল নিউ ইয়র্কে ফিরে যাচ্ছে। ওদের সাথে নতুন সেক্রেটারি জেনারেলও আছে।
হে’লা কামিল?
হ্যাঁ।
এ কি কোনো মেয়েলোকের কাজ!
মার্গারেট থ্যাচার বেলায় সেক্স কোনো বাধা হয়ে দেখা দেয়নি।
তা অবশ্য। কথাটায় যুক্তি আছে।
হে’লা কামিলের মতো বিচক্ষণ, এমন পুরুষই বা আপনি কজন পাবেন? দেখবেন, চমৎকার চালিয়ে নেবেন উনি।
মৃদু শব্দে হাসল পাইলট। তবে কথা কী জানেন, তার নিজের দেশের মুসলিম ধর্মান্ধরা তাকে বাঁচতে দিয়ে হয়। কথার সুরেই বোঝা গেল, পাইলট আমেরিকান।
আইডি কার্ডের ফটো থেকে চোখ তুলে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাল ব্রিটিশ সিকিউরিটি এজেন্ট, তবে কোনো মন্তব্য করল না। ফটোর দিকে আবার চোখ রেখে নামটা শব্দ করে পড়ল, ডেইল লেমকে।
কোন সমস্যা?
না, যাতে না হয় সে চেষ্টা করছি, ভারী গলায় বলল গার্ড।
হাত দুটো শরীর থেকে দূরে সরালো ডেইল লেমকে। আমাকে কি সার্চও করা হবে?
দরকার নেই। একজন পাইলট কেন তার নিজের প্লেন হাইজ্যাক করতে যাবে? তবে আপনার কাগজপত্র চেক না করে উপায় নেই, আপনি সত্যি ক্রুদের একজন কি না জানতে হবে।
ইউনিফর্মটা আমি ফ্যাশন শোতে দেখাব বলে পরিনি।
আমরা আপনার ব্যাগটা দেখতে পারি?
কেন নয়, বলে ব্যাগটা মেঝেতে রেখে খুলল পাইলট।
ফ্লাইট অপারেশনস ম্যানুয়ালগুলো তুলে নিয়ে পাতা ওল্টাল দ্বিতীয় এজেন্ট তারপর একটা মেকানিকাল ডিভাইস বের করে নেড়েচেড়ে দেখল, সাথে ছোট আকৃতির হাইড্রলিক সিলিন্ডার রয়েছে। কিছু যদি মনে করেন, এটা কী বলবেন?
অয়েল-কুলিং ভোর-এর জন্য ওটা একটা অ্যাকটিউয়েটর আর্ম। খোলা অবস্থায় আটকে গেছে। কেনেড়িতে আমাদের মেইন্টেন্যান্সের লোকেরা অনুরোধ করেছে আমি যেন হাতে করে নিয়ে যাই, কেন নষ্ট হলো ভালো করে বুঝে দেখা দরকার।
শক্ত প্যাকেট করা মোটাসোটা একটা জিনিসের গায়ে খোঁচা মারল দ্বিতীয় এজেন্ট। আরে, এখানে এটা আমরা কী দেখছি? মুখ তুলল সে, চোখে অদ্ভুত দৃষ্টি। এয়ারলাইন পাইলটরা কবে থেকে প্যারাসুট নিয়ে প্লেনে উঠছে?
হাসল ডেইল লেমকে। স্কাইডাইভিং আমার হবি। ছুটি পেলেই জাম্প করার জন্য বন্ধুদের সাথে ক্রয়ডনে চলে যাই।
আপনি নিশ্চয়ই একটা জেটলাইনার থেকে লাফ দেয়ার কথা ভাবেন না?
পঁয়ত্রিশ হাজার ফুট ওপরে উড়ছে, নিচে আটলান্টিক, গতিবেগ পাঁচশো নট-না! আতকে ওঠার ভান করল পাইলট।
সন্তুষ্ট হয়ে পরস্পরের সাথে দৃষ্টি বিনিময় করল এজেন্টরা। ডাফল ব্যাগ বন্ধ করা হলো, ফিরিয়ে দেয়া হলো আইডিকার্ড। আপনাকে দেরি করিয়ে দেয়ার জন্য দুঃখিত, ক্যাপটেন লেমকে।
আলাপটা আমি উপভোগ করেছি।
হ্যাভ আ গুড ফ্লাইট টু নিউ ইয়র্ক।
থ্যাঙ্ক ইউ।
প্লেনে চড়ল ডেইল লেমকে সরাসরি ককপিটে চলে এল। দরজা বন্ধ করে কেবিনের আলো নিভিয়ে দিল সে, এয়ারপোর্ট ভবনের জানালা থেকে কেউ যাতে তাকে দেখতে না পায়। ভালো করে রিহার্সেল দেয়া আছে, তার প্রতিটি নড়াচড়া জড়তাহীন। সিটগুলোর পেছনে হাঁটুগেড়ে বসল সে, পকেট থেকে ছোট একটা টর্চ বের করে খুলে ফেলল ট্র্যাপ-ডোরের ঢাকনি। ককপিটের নিচে ইলেকট্রনিকস বেতে পৌঁছানোর পথ এটা, কবে কে জানে কোনো এক ভঁড় ওটার নাম দিয়েছে হেল হোল। গাঢ় অন্ধকারের ভেতর মইটা নামিয়ে দিল সে। এই সময় ফ্লাইট অ্যাটেনড্যান্টদের চাপা গুঞ্জন ভেসে এল, তার সাথে লাগেজ টানা-হাচড়ার শব্দ। মেইন কেবিনটাকে আরোহীদের জন্য তৈরি করা হচ্ছে। ট্র্যাপ-ডোর দিয়ে খানিকটা নিচে নামল সে, ডাফল ব্যাগটা টেনে নিল। নিচে নেমে এসে পেনলাইটটা জ্বালল সে। হাতঘড়ি দেখে বুঝলো, ফ্লাইট ক্রুদের পৌঁছানোর আগে তার হাতে সময় আছে পাঁচ মিনিট। প্রায় পঞ্চাশবার অনুশীলন করেছে, প্রতিটি কাজ দ্রুত নিখুঁতভাবে সারতে অসুবিধা হলো না। ফ্লাইট ক্যাপের ভেতর শুকিয়ে নিয়ে আসা মিনিয়েচার টাইমিং ডিভাইসটার সাথে অ্যাকটিউয়েটরটা সংযুক্ত করল। জোড়া লাগানো ইউনিটটা ছোট একটা দরজার কজায় আটকে দিল। এই দরজা শুধু মেকানিকরা ব্যবহার করে। এরপর প্যাকেট থেকে প্যারাসুটটা বের করল সে।
ফাস্ট ও সেকেন্ড অফিসার এসে দেখল, তাদের ক্যাপটেন ডেইল লেমকে পাইলফের সিটে বসে আছে, মুখটা এয়ারপোর্ট ইনফরমেশন ম্যানুয়্যাল-এর আড়ালে। স্বাভাবিক কুশলাদি বিনিময়ের পরপরই তারা রুটিন চেকে ব্যস্ত হয়ে উঠল। কো পাইলট বা প্রকৌশলী, দু’জনের কেইউ খেয়াল করল না যে অন্যান্যবারের চেয়ে তাদের ক্যাপটেন আজ বেশ চুপচাপ ও নির্লিপ্ত। তারা যদি জানত এটাই তাদের জীবনের শেষ ফ্লাইট, তাহলে কি হতো বলা যায় না। অন্তত তাদের দৃষ্টি আর অনুভূতিগুলো যে আরও তীক্ষ্ণ হয়ে উঠত তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
ভিআইপি লাউঞ্জে চোখ-ধাঁধানো ক্যামেরার ফ্ল্যাশ আর ঝক ঝাক মাইক্রোফোনের দিকে মুখ করে রয়েছেন হে’লা কামিল। মনের অবস্থা যাই হোক, দৃঢ় ও ঋজু ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে, ধৈর্যের প্রতিমূৰ্তি, অনুসন্ধানী রিপোর্টারদের প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছেন তিনি।
গোটা ইউরোপজুড়ে ঝটিকা সফর শেষে নিউ ইয়র্কে ফিরছেন হে’লা কামিল, সরকারপ্রধানদের সাথে বিরতিহীন কথা বলেছেন, কিন্তু সে ব্যাপারে খুব কম প্রশ্নেরই উত্তর দিতে হলো তাকে। মৌলবাদী ধর্মীয় নেতারা তাঁর দেশের সরকারকে উৎখাত করার জন্য যে আন্দোলন শুরু করেছে সে সম্পর্কে তার মতামত জানতে চায় সবাই।
মিসরে এই মুহূর্তে ঠিক কী ঘটছে ভালো ধারণা নেই হেলা কামিলের। মৌলবাদীদের নেতৃত্ব দিচ্ছে আখমত ইয়াজিদ, ইসলামী শাসনব্যবস্থা ও আইন সম্পর্কে সে একজন পণ্ডিত। গোটা মিসরে ভয়াবহ ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করেছে লোকটা। অধিকারবঞ্চিত লাখ লাখ গ্রামবাসী, যারা নীল নদের তীরে বসবাস করে, আর কায়রো শহরের বস্তিবাসী, যারা মানবেতর জীবন যাপন করে, তাদের মনে কুসংস্কার আর হিংসার আগুন ভালোভাবেই জ্বলতে পেরেছে সে। আর্মি আর এয়ারফোর্সের বড় বড় অফিসাররা কোনো রকম রাখঢাক না করে মৌলবাদীদের সাথে সলাপরামর্শ করছে। কীভাবে সদ্য নির্বাচিত নতুন সরকারপ্রধান নাদাভ হাসানকে ক্ষমতাচ্যুত করা যায়। পরিস্থিতি যে ভয়াবহ তাতে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু সরকারের কাছ থেকে প্রতি মুহূর্তের বিবরণ হে’লা কামিল পাচ্ছেন না। কাজেই স্পষ্ট করে কিছু না বলে প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছেন তিনি।
দাঁড়ানোর বা কথা বলার ভঙ্গিতে যতই দৃঢ়তা থাকুক, মনে মনে ভীষণ অসহায় ও নিঃসঙ্গ বোধ করছেন তিনি।
এতই সুন্দরী তিনি, যেন রানী নেফারতিতির পুনর্জন্ম হয়েছে। বার্লিন মিউজিয়ামে রানীর যে পোর্টেটি আছে, একই ভঙ্গিতে পোজ দিলে হে’লা কামিল নিঃসন্দেহে উতরে যাবেন। দু’জনেরই মরালগ্রীবা, সরু নাক-আয়ত চোখ, তীক্ষ্ণ মুখাবয়ব-একবার দেখলে ভোলা যায় না। বয়স বিয়াল্লিশ বলা হলেও তাঁকে দেখে তা মনে হয় না। একহারা গড়ন। কালো চোখ। রেশমের মতো কালো চুল কোমর ছাড়িয়েছে। নারীজাতির সমস্ত সৌন্দর্য যেন তার ওপর ঢেলে দেয়া হয়েছে। পাঁচ ফুট এগারো ইঞ্চি লম্বা তিনি। এই মুহূর্তে ভাজবহুল স্কার্ট আর কোট পরে আছেন, কোটটার ডিজাইন শুধু তাঁর জন্য করা হয়েছে প্যারিসের বিখ্যাত একটা ডিজাইন সেন্টারে।
বিখ্যাত চারজন ব্যক্তিত্বকে প্রেমিক হিসেবে পেলেও হে’লা কামিল এখনও বিয়ে করেননি। স্বামী-সন্তান তার কাছে অনভিপ্রেত। দীর্ঘমেয়াদি কোনো কিছুর সাথে জড়িয়ে পড়াটাকে তিনি ভালো চোখে দেখেন না। ব্যালের টিকিট কাটার মতোই তার কাছে ভালোবাসার আনন্দ অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী।
কায়রো শহরেই মানুষ হয়েছেন, মা স্কুলশিক্ষয়িত্রী ছিলেন, বাবা ছিলেন ছায়াছবি নির্মাতা। বাড়ি থেকে সাইকেলে আসা-যাওয়া করা যায়, এমন দূরত্বে প্রাচীন ধ্বংসাবশেষের স্কেচ আর খননকাজে কেটেছে তার কৈশোরের অবসর সময়। অত্যন্ত পাকা রাঁধুনি, ছবি আঁকতে পারেন, ভালো গান জানেন, আর রয়েছে মিসরীয় প্রত্নতত্ত্বেও ওপর একটা পিএইচডি। প্রথম চাকরি করেন মিসরের মিনিস্ট্রি অব কালচারে, রিসার্চার হিসেবে। পরে ডিপার্টমেন্টাল হেড হন। তারপর তথ্যমন্ত্রী। প্রেসিডেন্ট মুবারকের নজরে পড়লে তাকে জাতিসংঘের সাধরণ সভায় মিসরের প্রতিনিধি হিসেবে প্রেরণ করেন তিনি। পাঁচ বছর পর জাতিসংঘের ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে মনোনয়ন দেয়া হয় তাকে। এক বছর পর তদানীন্তন মহাসচিব দ্বিতীয় দফার জন্য নির্বাচিত হতে না চাওয়ায় জাতিসংঘের মহাসচিবের পদটার জন্য বাছাই করা হয় হে’লা কামিলকে। তাঁর সামনে লাইনে আর যারা ছিলেন তাঁরা কেউ দায়িত্ব গ্রহণে রাজি না হওয়াতেই এই সুযোগটা পেয়ে যান তিনি।
কিন্তু সব কিছু এলোমেলো করে দিতে চাইছে তার দেশের উত্তপ্ত পরিস্থিতি। যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে যে তিনিই হবেন জাতিসংঘের প্রথম মহাসচিব, যার কোনো দেশ নেই।
একজন এইড এগিয়ে এসে তার কানে কানে কিছু বলল। মাথা ঝাঁকিয়ে সমবেত সাংবাদিকদের উদ্দেশে একটা হাত তুললেন তিনি। আমাকে বলা হলো, প্লেন টেক-অফ করার জন্য তৈরি, স্বভাবসুলভ হাসিমুখে বললেন তিনি। আমি আর একজনের প্রশ্নের উত্তর দেব।
সাথে সাথে কয়েক ডজন হাত উঁচু হলো, চারদিক থেকে ছুটে এল অসংখ্য প্রশ্ন। দোরগোড়ার কাছে দাঁড়ানো এক ভদ্রলোকের দিকে হাত তুললেন হে’লা কামিল, ভদ্রলোকের হাতে একটা টেপ রেকর্ডার রয়েছে।
লেই হান্ট, ম্যাডাম কামিল। বিবিসি থেকে। আখমত ইয়াজিদ যদি নাদাভ হাসানের গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত করে ইসলামিক রিপাবলিক প্রতিষ্ঠা করেন, আপনি কি দেশে ফিরে যাবেন?
আমি একজন মিসরীয় এবং মুসলিম। আমার দেশের সরকার, তা সে যে সরকারই ক্ষমতায় থাক, যদি চায় আমি দেশে ফিরি তাহলে অবশ্যই ফিরব।
এমনকি আখমত ইয়াজিদ আপনাকে পাপিষ্ঠা ও বেপর্দা মেয়েলোক বলে ঘোষণা করার পরও?
হ্যাঁ, শান্তভাবে জবাব দিলেন হে’লা কামিল।
যদি আয়াতুল্লাহ খোমেনির অর্ধেক পাগলামীও থাকে তার মধ্যে, আপনার দেশে ফেরা মানে আত্মহত্যা করা হতে পারে। কোনো মন্তব্য করবেন?
নিরুদ্বিগ্ন হাসির সাথে মাথা নাড়লেন হে’লা কামিল। এবার আমাকে যেতে হয়। ধন্যবাদ।
সিকিউরিটি গার্ডদের একটা বৃত্ত বোর্ডিং র্যাম্পের দিকে নিয়ে চলল তাকে। তার এইডরা আর ইউনেস্কোর বড়সড় প্রতিনিধিদলটা আগেই আসন গ্রহণ করেছে। বিশ্ব ব্যাংকের চারজন পদস্থ কর্মকর্তা প্যান্টিতে শ্যাম্পেনের বোতল নিয়ে বসেছেন, নিচু স্বরে আলাপ চলছে। বাতাসে জেট ফুয়েল আর বিফ ওয়েলিংটন-এর গন্ধ ভাসছে।
জানালার ধারে একটা শসোফায় বসে সিট বেল্ট বাঁধলেন তিনি। জুতা খুললেন, হেলান দিলেন সোফায়, চোখ বুজলেন। তাকে তন্দ্রায় ঢুলতে দেখে কফি নিয়ে এসেও ফিরে গেল একজন স্টুয়ার্ডেস।
.
জাতিসংঘের চার্টার ফ্লাইট একশো ছয় রানওয়ের শেষ মাথায় চলে এল। কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে টেকঅফ-এর অনুমতি পাবার পর থ্রাস্ট লিভার সামনে ঠেলে দিল পাইলট, ভেজা কংক্রিটের ওপর দিয়ে ছুটতে শুরু করল বোয়িং সেভেন-টু-জিরো/বি, হালকা কুয়াশার ভেতর উঠে পড়ল আকাশে।
সাড়ে দশ হাজার মিটার উঁচুতে উঠে এল প্লেন, অটোপাইলট এনগেজ করল ডেইল লেমকে। সিট বেল্ট খুলে সিট ছাড়ল সে। প্রকৃতির ডাক, বলে কেবিনের দরজার দিকে এগোল।
সেকেন্ড অফিসার অর্থাৎ প্রকৌশলী সোনালি চুল ভরা মাথাটা ঝাঁকাল, ইনস্ট্রুমেন্ট প্যানেল থেকে চোখ না তুলেই হাসল একটু। নিশ্চিন্ত মনে সাড়া দিয়ে আসুন, আমি তো আছি।
পাল্টা হেসে প্যাসেঞ্জার কেবিনে বেরিয়ে এল পাইলট। একটু পরই খাবার পরিবেশন করা হবে, তারই প্রস্তুতি নিচ্ছে ফ্লাইট অ্যাটেনড্যান্টরা। বিফ ওয়েলিংটন-এর গন্ধে জিভে জল এসে গেল লেমকের। হাত-ইশারায় রুবিনকে একপাশে ডাকল সে।
আপনাকে কিছু দেব, ক্যাপটেন?
শুধু এক কাপ কফি, বলল ডেইল লেমকে। তবে ব্যস্ত হয়ো না, আমি নিজেই নিতে পারব।
না, ঠিক আছে। প্যানট্রিতে ঢুকে কাপে কফি ঢালল।
শোনো হে।
স্যার।
কোম্পানি থেকে বলা হয়েছে, সরকার পরিচালিত একটা আবহাওয়া গবেষণায় আমাদেরকে ভূমিকা রাখতে হবে। লন্ডন থেকে আমরা যখন আটাশ হাজার কিলোমিটার দূরে থাকব, দশ মিনিটের জন্য পনেরো হাজার মিটারে নামিয়ে আনব প্লেনটাকে-বাতাস আর তাপমাত্রা রেকর্ড করা হবে। তারপর আবার স্বাভাবিক অলটিচ্যুড-এ উঠে যাব। ঠিক আছে?
বিশ্বাস করা কঠিন যে কোম্পানি রাজি হয়েছে। বাপরে বাপ, কী পরিমাণ ফুয়েল নষ্ট হবে ভেবে দেখেছেন, স্যার?
ভেবেছ ম্যানেজমেন্টের টপ বাস্টার্ডরা ওয়াশিংটনে মোটা একটা বিল পাঠাবে না?
সময় হলে আরোহীদের জানাব আমি, তা না হলে ভয় পাবেন ওঁরা।
ঘোষণায় এ কথাও জানিয়ে দিতে পারো যে জানালা দিয়ে কেউ যদি কোনো আলো দেখে, ধরে নিতে হবে ওগুলো আছে মাছ ধরার জাহাজ থেকে আসছে।
ঠিক আছে, স্যার।
চট করে একবার মেইন কেবিনের চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিল লেমকে, চঞ্চল দৃষ্টি পলকের জন্য স্থির হলো হে’লা কামিলের ঘুমন্ত মুখের ওপর। তোমার মনে হয়নি, সিকিউরিটি অস্বাভাবিক কড়া? আলাপের সুরে জিজ্ঞেস করল সে। রিপোর্টারদের একজন আমাকে বলল, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড নাকি সন্দেহ করছে মহাসচিবকে অপহরণ করা হতে পারে।
তাই নাকি?
ওদের ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে ধুলোর প্রতিটি কণায় সন্ত্রাসবাদীরা ওত পেতে আছে। আমার পরিচয়পত্র দেখে সন্তুষ্ট হয়নি, ব্যাগটাও সার্চ করল।
কাঁধ ঝাঁকাল চিফ স্টুয়ার্ড। খারাপটা কী। শুধু তো আরোহীদের নয়, আমাদের নিরাপত্তার প্রশ্নও জড়িত।
প্যাসেজের দুপাশে সিটে বসা আরোহীদের দিকে একটা হাত তুলল লেমকে। অন্তত ওদের কাউকে দেখে সন্ত্রাসবাদী বলে মনে হচ্ছে না।
চেহারা দেখে সবাইকে যদি চেনা যেত!
তা যা বলেছ। কাজেই একটু সাবধান হতে হয়। ককপিটের দরজা তালা দিয়ে রাখছি, বুঝলে। খুব যদি জরুরি কিছু বলতে চাও, ইন্টারকমে ডেকো আমাকে।
ঠিক আছে, স্যার।
কফিতে মাত্র একটা চুমুক দিয়ে কাপটা নামিয়ে রাখল লেমকে, ফিরে এল ককপিটে। ফার্স্ট অফিসার, তার কো-পাইলট, পাশের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ওয়েলস-এর আরো দেখছে, তার পেছনে কম্পিউটারের সাহায্যে ফুয়েলের খরচ ও মজুদ জেনে নিচ্ছে প্রকৌশলী।
তাদের দিকে পেছন ফিরে কোটের বুক পকেট থেকে ছোট একটা চামড়ার বাক্স বের করল লেমকে। বাক্স খুলে হাতে একটা সিরিঞ্জ নিল, নার্ভ এজেন্ট সারিন ভরল তাতে। ক্রুদের দিকে ফিরল আবার, হাঁটতে শুরু করে হোঁচট খেল, যেন ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে, সামলে নেয়ার জন্য খপ করে সেকেন্ড অফিসারের বাহু আঁকড়ে ধরল। দুঃখিত, ফ্রাঙ্ক, কার্পেটে পা বেধে গিয়েছিল।
ফ্রাঙ্ক হার্টলির গোঁফ জোড়া ঘন আর কালো, মাথায় কাঁচা-পাকা চুল, সুদর্শন চেহারা। সূচটা এতই সরু আর তীক্ষ্ণমুখ যে টেরই পেল না তার কাঁধে কিছু ঢুকছে। ইঞ্জিনিয়ারের প্যানেলে সাজানো এক গাদা আলো থেকে চোখ তুলে হাসল সে। বয়স হয়েছে, এবার কিন্তু আপনার মদ খাওয়া কমিয়ে দেয়া উচিত, ক্যাপটেন।
প্লেন তো সোজাই চালাই, হালকা সুরে বলল লেমকে। শুধু হাঁটার সময় তাল পাই না।
মুখ খুলল ফ্রাঙ্ক হার্টলি, যেন কিছু বলতে চায়, কিন্তু হঠাৎ করে ভাবলেশহীন হয়ে পড়ল তার চেহারা। মাথা ঝাঁকাল সে যেন দৃষ্টি পরিষ্কার করতে চাইছে। পরমুহূর্তে উল্টে গেল চোখ জোড়া, স্থির হয়ে গেল শরীর।
হার্টলির গায়ে হেলান দিয়ে থাকল লেমকে, সিট থেকে সে যাতে কাত হয়ে না পড়ে। সিরিঞ্জটা খুলে নিয়ে ব্যাগে ভরল, বের করল নতুন আরেকটা, দ্বিতীয়টাতে আগেই সারিন ভরে রেখেছে। আরে, ফ্রাঙ্কের কিছু হলো নাকি? অমন নেতিয়ে পড়ল কেন!
কো-পাইলটের সিটে ঝট করে ঘুরল প্রকাণ্ডদেহী ফাস্ট অফিসার জেরি অসওয়ার্ল্ড, চোখে প্রশ্ন। সে কি!
এসে দেখো না একবার।
সিট ছেড়ে উঠে এল জেরি অসওয়ার্ল্ড, ক্যাপটেনকে পাশ কাটিয়ে ঝুঁকে পড়ল সেকেন্ড অফিসারের দিকে। সূচ ঢুকিয়ে সিরিঞ্জের মাথায় চাপ দিল লেমকে, তবে জেরি অসওয়ার্ল্ড ব্যথাটা অনুভব করল।
উফ! কী ব্যাপার! ঝট করে ঘুরতেই ক্যাপটেনের হাতে সিরিঞ্জটা দেখতে পেল সে। ফ্রাঙ্ক হার্টলির চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী জেরি অসওয়ার্ল্ড, বিষটা সাথে সাথে কাজ শুরু করেনি। নগ্ন সত্য প্রকাশ পাবার সাথে সাথে তার চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠল, পরমুহূর্তে দুহাত সামনে বাড়িয়ে ক্যাপটেনকে লক্ষ্য করে ঝাঁপিয়ে পড়ল সে। কে তুমি? গলাটা দুহাতে ধরে ফেলে গর্জে উঠল। ডেইল লেমকে কোথায়? তার ছদ্মবেশ নিয়ে…
ইচ্ছে থাক বা না থাক, উত্তর দেয়ার উপায় নেই ছদ্মবেশী লোকটার, কারণ জেরি অসওয়ার্ল্ডের বিশাল দুটো হাত তার গলায় এমনভাবে চেপে বসেছে যে দম ফেলতে পারছে না সে। একটা বাল্কহেডের সাথে তাকে চেপে ধরল জেরি অসওয়ার্ল্ড। মারা যাচ্ছে বুঝতে পেরে মরিয়া হয়ে উঠল ছদ্মবেশী পাইলট। ভাঁজ করা হাঁটু দিয়ে জেরি অসওয়ার্ল্ডের তলপেটে প্রচণ্ড গুতো মারল সে। সামান্যই প্রতিক্রিয়া হলো, একবার শুধু গুঙিয়ে উঠল জেরি অসওয়ার্ল্ড। চোখে অন্ধকার দেখছে নকল পাইলট।
তারপর, ধীরে ধীরে, গলার ওপর থেকে কমে এল চাপটা, হোঁচট খেতে খেতে পিছিয়ে গেল জেরি অসওয়ার্ল্ড। মৃত্যু উপস্থিত বুঝতে পেরে আতঙ্কে বিকৃত হয়ে উঠেছে। তার চেহারা। চোখে দিশেহারা ভাব আর ঘৃণা নিয়ে পাইলটের দিকে তাকিয়ে আছে সে। শরীরের সমস্ত শক্তি এক করে শেষ একটা ঘুষি মাল পাইলটের পেটে।
হাঁটু ভাঁজ হয়ে গেল লেমকের, কুঁজো হয়ে গোঙাতে লাগল। সিধে হতে শুরু করে দেখল সামনেটা ঝাপসা লাগছে। পাইলটের সিটে ধাক্কা খেয়ে কার্পেটের ওপর পড়ে গেল জেরি অসওয়ার্ল্ড, আর নড়ল না। কয়েক সেকেন্ড ককপিটের মেঝেতে বসে থাকল লেমকে, সশব্দে হাঁপাচ্ছে, ব্যথা কমাবার ব্যর্থ চেষ্টা করছে পেটে হাত বুলিয়ে।
খানিক পর আড়ষ্ট ভঙ্গিতে দাঁড়াল সে। দরজা, ওদিক থেকে নানা ধরনের শব্দ ভেসে আসছে। মেইন কেবিনে কোনো হৈচৈ নেই বলে মনে হলো তার। ইঞ্জিনের শব্দকে ছাপিয়ে ককপিটের কোনো আওয়াজ দরজার ওদিকে পৌঁছায়নি।
জেরি অসওয়ার্ল্ডকে কো-পাইলটের সিটে বসিয়ে স্ট্র্যাপ দিয়ে বাঁধতে ঘেমে গোসল হয়ে গেল সে। ফ্রাঙ্ক হার্টলির সেফটি বেল্ট বাঁধাই আছে, কাজেই তাকে আর ছুঁলো না। অবশেষে পাইলটের সিটে বসে প্লেনের পজিশন দেখল সে।
পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর নির্ধারিত পথ থেকে প্লেনটাকে ঘুরিয়ে আরেক দিকে রওনা হলো ভুয়া পাইলট। নতুন পথটা সুমেরুর দিকে চলে গেছে।
.
০২.
দুনিয়ার সবচেয়ে বন্ধ্যা জায়গার একটা, এখানে কখনও ট্যুরিস্টদের আগমন ঘটেনি। গত কয়েকশো বছরে মুষ্টিমেয় কিছু এক্সপ্লোরার ও বিজ্ঞানী এই অভিশপ্ত এলাকায় মাঝেমধ্যে হাঁটাচলা করেছেন। উঁচু-নিচু তীর বরাবর সাগর দু এক সপ্তাহ বাদে বছরের বাকি সময় জমাট বেঁধে থাকে, শীতের শুরুতে তাপমাত্রা নেমে যায় ৭৩ ডিগ্রী ফারেনহাইটে। দীর্ঘ শীতের মাসগুলোয় ঠাণ্ডা আকাশটাকে গাঢ় অন্ধকার গ্রাস করে রাখে, এমনকি গরমের দিনেও চোখ ধাঁধানো রোদ এক ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে ভয়াবহ তুষার ঝড়ে অদৃশ্য হয়ে যায়।
জায়গাটা গ্রিনল্যান্ডের সর্ব উত্তরে। আরডেনক্যাপল ফিঅ্যারড-এর চারদিকে দাঁড়িয়ে আছে বরফ ঢাকা পাহাড়। বাতাস এখানে প্রতি মুহূর্তে ঝড়ের মতো বইছে। ভাবতে অবিশ্বাস্য লাগে যে প্রায় দুহাজার বছর আগেও এখনে একদল শিকারি বসবাস করত। ধ্বংসাবশে থেকে পাওয়া রেডিওকার্বন পরীক্ষা করে জানা গেছে দুশে থেকে চারশো খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত লোকবসতি ছিল এখানে। প্রত্নতাত্ত্বিক হিসেবে সময়টা তেমন লম্বা নয়, তবে তাদের রেখে যাওয়া গোটা বিশেক বাড়ি উৎসুক বিজ্ঞানীদের জন্য বিরাট কৌতূহল সৃষ্টি করেছে। হিমশীতল আবহাওয়ায় আজও প্রায় অক্ষত অবস্থায় রয়েছে বাড়িগুলো।
আগে থেকে তৈরি করা অ্যালুমিনিয়ামের কাঠামো হেলিকপ্টার থেকে রশি বেঁধে নামানো হয়েছে প্রাচীন গ্রামটার মাঝখানে, কাঠামোগুলো জোড়া লাগিয়ে নিজেদের জন্য নিরাপদ আস্তানা বানিয়ে নিয়েছে কলোরাডো ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানীরা। জবড়জং চেহারার হিটিং অ্যারেঞ্জমেন্ট আর ফোম-গ্লাস ইনসুলেশন রক্ত হিম করা ঠাণ্ডার সাথে অসম যুদ্ধে লিপ্ত। ঝোড়ো বাতাস বিরতিহীন গোঙালেও তাতে শুধু ভুতুড়ে হয়ে উঠেছে পরিবেশ, গ্রামের বাইরের পাঁচিল টপকে ভেতরে সহজে ঢুকতে পারে না। শীতের শুধুতে আর্কিওলজিকাল দলটিকে চারপাশে কাজ করার বিরাট একটা সুযোগ এনে দিয়েছে এই আশ্রয়।
লিলি শার্প, কলোরাডো ইউনিভার্সিটির একজন অধ্যাপিকা, অ্যানথ্রোপলজি পড়ায়। শীত বা তুষার ঝড় গ্রাহ্য করার মেয়ে নয় সে, দলের আর সবাই তাকে এস্কিমোদের বংশধর বলে ঠাট্টা করে। প্রাচীন শিকারিদের একটা ঘরের ভেতর মেঝের ওপর হাঁটুগেড়ে বসেছে সে, হাতে ছোট একটা তোয়ালে জড়িয়ে জমাট বাঁধা মাটি সতর্কতার সাথে আঁচড়াচ্ছে। ঘরের ভেতর সে একা, অতীত খুঁড়ে প্রাচীন যুগের নিদর্শন আবিষ্কারের কাজে মগ্ন।
লোকগুলো ছিল সি-ম্যামল শিকারি, শীতের সময়টা তারা নিজেদের ঘর-বাড়িতে কাটাত। ঘরগুলো আংশিক মাটির ভেতর গাঁথা, পাথরের তৈরি দেয়ালগুলো নিচু, ঘাস বা গাছের পাতা দিয়ে ছাওয়া ছাদ দাঁড়িয়ে আছে তিমির হাড় অবলম্বন করে। তেল দিয়ে কুপি জ্বেলে শরীর গরম রাখত তারা, দীর্ঘ অন্ধকার মাসগুলো ঘরের ভেতর অলস বসে না থেকে নদীর স্রোত থেকে তুলে নেয়া কাঠের টুকরো, হাতির দাঁত আর হরিণের শিং দিয়ে কুদে মূর্তি বানাত।
গ্রিনল্যান্ডের এই অংশে যিশুর জন্মের পর প্রথম শতাব্দীতে আস্তানা গেড়েছিল তারা। তারপর, তাদের সংস্কৃতির বিকাশ যখন তুঙ্গে, হঠাৎ করে পাততাড়ি গুটিয়ে বেমালুম অদৃশ্য হয়ে যায়। এর কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। তবে অদৃশ্য হলেও এখানে তারা নিজেদের বহু জিনিস ফেলে গেছে। ধ্বংসাবশেষ হিসেবে তা টিকে আছে আজও।
লিলির নিষ্ঠা আর শ্রম বৃথা গেল না। ডিনারের পর অ্যালুমিনিয়াম কাঠামোর ভেতর তার পুরুষ সঙ্গীরা বিশ্রাম নিচ্ছে, আবিষ্কারের আনন্দ থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত হলো তারা। ঝোড়ো বাতাস উপেক্ষা করে প্রাচীন গ্রামের ভেতর এসে কাজ করায় হরিণের শিংয়ের তৈরি একটা পাতিল পেয়ে গেল সে। হঠাৎ করে লিলির হাতের তোয়ালে কিসে যেন আটকে গিয়েই আবার মুক্ত হলো। একই জায়গায় ভোয়ালেটা আবার ঘষল সে, কান দুটো সজাগ। এবার একটা শব্দও শুনল। গর্তের ভেতর হাত গলিয়ে হাতড়াল, কিন্তু কিছুই পেল না। ভোয়ালে খুলে আঙুলের টোকা দিল মাটিতে। একটা আওয়াজ হলো। পাথরের আওয়াজ চেনা আছে, সে ধরনের নয়। আবার গর্তের ভেতরটা হাতড়াল সে। জিনিসটা একটু যে চ্যাপ্টা, তবে শব্দটা ধাতব। মাটির খানিকটা আবরণ সরাতেই এবার হাতে চলে এল।
সিধে হলো লিলি। ডানে বায়ে ঘুরে, আড়মোড়া ভাঙার ভঙ্গিতে, ঢিল করল পিঠের পেশি। কোলম্যান লণ্ঠনের আলোয়, উলেন ক্যাপের বাইরে, তার দীর্ঘ লাল চুল কোমল অগ্নিশিখার মতো জ্বলজ্বল করছে। মুঠোটা খুলল সে, নীল আর সুবজ মেশানো চোখে চিকচিক করে উঠল কৌতূহল। কয়লা-কালো মাটির প্রলেপ নিয়ে তালুতে পড়ে থাকা ছোট্ট জিনিসটা যেন তার বুদ্ধিমত্তাকে ব্যঙ্গ করল।
এখানে প্রাগৈতিহাসিক মানুষের নিজেকে মনে করিয়ে দিল লিলি শার্প। লোহা বা : তামার ব্যবহার তারা জানত না।
শান্ত থাকার চেষ্টা করলেও অবিশ্বাস আর বিস্ময়ের একটা জোয়ার গ্রাস করে ফেলল তাকে। তারপর এল উত্তেজনা, সবশেষে জরুরি তাগাদা। নখের হালকা আঁচড়ে মাটির আবরণ সরিয়ে ফেলল সে, লণ্ঠনের আলোয় চকচক করে উঠল জিনিসটা। হাঁ করে সেটার দিকে তাকিয়ে থাকল জেনি। আর কোনো সন্দেহ নেই। একটা স্বর্ণমুদ্রা আবিষ্কার করেছে সে।
অত্যন্ত পুরনো মুদ্রা, কিনারাগুলো ক্ষয়ে গেছে। মুদ্রার গায়ে খুদে একটা গর্ত রয়েছে, চামড়ার একটা ফিতে ঝুলছে সেটা থেকে। কিছুর সাথে ঝুলিয়ে রাখা হতো ওটা, সম্ভবত ব্যক্তিগত অলঙ্কার হিসেবে কারও গলায়।
পাঁচ মিনিট পর, এখনও মুদ্রাটাকে পরীক্ষা করছে লিলি, রহস্যের কিনারা পাবার চেষ্টা করছে, এই সময় ঘরের দরজা খুলে গেল, ভেতরে ঢুকলেন বিশালদেহী সদয় চেহারার এক ভদ্রলোক, সাথে এক গাদা তুষার কণা নিয়ে। তার নিঃশ্বাসের সাথে বেরিয়ে আসছে সাদা বাস্প। দাড়ি আর ভ্রু তুষারে সাদা হয়ে আছে।
ড. হিরাম গ্রোনকুইস্ট হাসলেন। চারজনের আর্কিওলজিস্ট দলের প্রধান তিনি। বাধা দেয়ার জন্য দুঃখিত, লিলি, ভারী গলায়, মৃদু কণ্ঠে বললেন তিনি। তবে বড় বেশি খাটাখাটুনি করছো তুমি। একটু বিশ্রাম নাও। শেলটারে চলো, তোমাকে ব্র্যান্ডি খাওয়াব।
ডক্টর গ্রোনকুইস্ট, বলল লিলি, উত্তেজনা চেপে রাখার চেষ্টা করলেও গলা কেঁপে গেল তার। আপনাকে আমি অদ্ভুত একটা জিনিস দেখাতে চাই।
এগিয়ে এসে লিলির পাশে দাঁড়ালেন হিরাম গ্রোনকুইস্ট। কী পেয়েছো দেখি?
তাঁর সামনে মুঠোটা খুলল লিলি। দেখুন!
পারকার ভেতর থেকে হাতড়ে চশমাটা বের করে চোখে পরলেন ড. গ্রোনকুইস্ট। মুদ্রাটার ওপর ঝুঁকে পড়লেন তিনি, নাকটা প্রায় ঠেকে গেল সেটার গায়ে। চারদিক থেকে নেড়েচেড়ে পরীক্ষা করলেন তিনি মুদ্রাটা। তারপর মুখ তুলে লিলির দিকে তাকালেন, কৌতুকে নাচছে চোখের মণি দুটো। আমার সাথে ঠাট্টা করছে, তাই না?
জেদ নিয়ে তাকাল লিলি, তারপর পেশি ঢিল করে দিয়ে মুচকি হাসল। ওহ গড! আপনি ভাবছেন আমি নিজেই এটা এখানে রেখে আবিষ্কারের ভান করছি!
তোমাকেও স্বীকার করতে হবে, ব্যাপারটা পতিতালয়ে কুমারী খুঁজে পাবার মতো।
কিউট।
লিলির কাঁধে মৃদু চাপড় মারলেন ড. গ্রোনকুইস্ট। কংগ্রাচুলেশন্স। দুর্লভ একটা আবিষ্কার।
কিন্তু কীভাবে এটা এল এখানে?
হাজার মাইলের মধ্যে সোনার কোনো মজুদ নেই এদিকে। প্রাচীন লোক যারা, এখানে ছিল তারা খনি থেকে সোনা উদ্ধার করেছিল, তা সম্ভব নয়। পাথুরে যুগের চেয়ে সামান্য উন্নতি করেছিল তারা। মুদ্রাটা অবশ্যই আরও অনেক পরে অন্য কোনো। উৎস থেকে এখানে এসেছে।
কিন্তু যেসব শিল্পকর্ম আমরা উদ্ধার করেছি তার সবই তিনশো খ্রিস্টাব্দের, সেগুলোর সাথে এটা থাকে কীভাবে-এর কী ব্যাখ্যা দেবেন আপনি?
কাঁধ ঝাঁকালেন ড. গ্রোনকুইস্ট। নিজেকে আমার বোকা লাগছে।
ঠিক আছে, বোকার মতোই না হয় একটা কিছু আন্দাজ করুন।
বুদ্ধিতে যতটুকু কুলাচ্ছে-কোন ভাইকিং এটা বিনিময় করে বা হারিয়ে ফেলে।
পূর্ব তীরে ধরে এত দূর দক্ষিণে জলদস্যুদের কোনো জাহাজ এসেছিল, এমন কোনো রেকর্ড নেই।
আচ্ছা, এমন হতে পারে না যে আরও কাছাকাছি সময়ের এস্কিমোদের সাথে দক্ষিণের নর্স বসতি স্থাপনকারীদের বিনিময় বাণিজ্যে হয়েছিল? শিকারের সময় এই প্রাচীন গ্রামটা হয়তো ব্যবহার করা হয়।
আপনি খুব ভালো করেই জানেন, ড. গ্রোনকুইস্ট, চারশো খ্রিস্টাব্দের পর এদিকে লোকবসতির কোনো প্রমাণ আমরা পাইনি।
ভ্রু কুঁচকে লিলির দিকে তাকালেন ড. গ্রোনকুইস্ট। তুমি দেখছি হাল ছাড়ার পাত্রী নও। মুদ্রাটায় তো এমনকি কোনো তারিখও দেখছি না।
মাইক গ্রাহাম প্রাচীন মুদ্রা বিশেষজ্ঞ, চলুন দেখি সে কী বলে।
পারকার হুড অ্যাডজোস্ট করে নিয়ে কোলম্যান লণ্ঠনটা নিভিয়ে দিল লিলি। টর্চ জ্বাললেন ড. গ্রোনকুইস্ট, দরজা খুলে আগে বেরোতে দিলেন লিলিকে। অন্ধকারে কবরস্থানের ভূতের মতো গোঙাচ্ছে বাতাস। মুখের খোলা অংশে ঠাণ্ডা বাতাস যেন মৌমাছির হুল ফুটাল। একটা রশি ধরে এগোল ওরা, শেষ প্রান্তটা অ্যালুমিনিয়াম শেলটারে বাঁধা আছে। হাঁটতে ওপরে মুখ তুলল জেনিত। পরিষ্কার আকাশ, কালো ভেলভেটের মতো লাগল দেখতে, তারাগুলো নকশা এঁকে রেখেছে। তারার আলোয় পশ্চিমের পাহাড় পরিষ্কার চেনা গেল। খাড়িতে নেমে আসছে তুষার আর বরফ সেখান থেকে উপচে বেরিয়ে আসছে খোলা সাগরে। আর্কটিকের সৌন্দর্য সুন্দরী রমণীর হাতছানির মতো। পুরুষরা কেন যে ভালোবেসে ফেলে বুঝতে তার অসুবিধা হলো না।
টর্চের আলোয় ত্রিশ গজ হেঁটে নিরাপদ আশ্রয়ের স্টর্ম করিডরে পৌঁছল ওরা, আরও দশ ফুট পেরিয়ে দ্বিতীয় দরজা খুলে লিভিং কোয়ার্টারে চলে এল। বাইরের ঠাণ্ডার তুলনায় ভেতরটা উত্তপ্ত তন্দুর মনে হলো লিলির, কফির গন্ধ নাকে পারফিউমের পরশ বুলিয়ে দিল। পারকা খুলে নিজের কাপটা ভরে নিল সে।
স্যাম হসকিন্সের সোনালি চুল কাঁধ পর্যন্ত নেমে এসেছে, পাকানো রশির মতো গোঁফ, একটা ড্রাফটিং বোর্ডের ওপর ঝুঁকে রয়েছে। নিউ ইয়র্কের একজন আর্কিটেক্স, আর্কিওলজির প্রেমে অন্ধ। দুনিয়ার এমন কোনো সম্ভাব্য জায়গা নেই যেখানে খোঁড়াখুঁড়ির কাজে যেতে রাজি নয় হসকিন্স, নিজের পেশা ছেড়ে প্রতি বছরই দুমাসের জন্য এই কাজে গায়ের হয়ে যায় সে। সতেরোশো বছর আগে প্রাচীন গ্রামটা ঠিক কী রকম দেখতে ছিল, তার আঁকা নকশা থেকে সেটা জানতে পেরেছে ওরা।
মাইক গ্রাহাম দলের চার নম্বর সদস্য। নিজের ছোট্ট খাটে শুয়ে অতি ব্যবহারে মলিন একটা পেপার ব্যাক পড়ছে সে। অ্যাডভেঞ্চার গল্পের পাগল। তার হাতে বা পকেটে একটা বই নেই, এমন কখনও ঘটেছে কি না মনে করতে পারল না লিলি। যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম সেরা আর্কিওলজিস্টদের একজন সে। অল্প বয়সেই মাথায় মস্ত টাক দেখা দিয়েছে।
ওহে, মাইক গ্রাহাম, ড. গ্রোনকুইস্ট বললেন, লিলি কী পেয়েছে দেখো। মুদ্রাটা তার দিকে ছুঁড়ে দিলেন তিনি। আঁতকে উঠল লিলি। তবে, সময় মতো বই থেকে মুখ তুলে খপ করে সেটা ধরে ফেলল মাইক গ্রাহাম।
কয়েক মুহূর্ত পর মুখ তুলল সে। আমাকে বোকা বানানোর মতলব?
মন খুলে হাসলেন ড. গ্রোনকুইস্ট। তারপর বললেন, না হে। গ্রামের একটা ঘর থেকে সত্যি ওটা খুঁড়ে পেয়েছে লিলি।
ম্যাগনিফাইং গ্লাসটা বের করল মাইক গ্রাহাম। লেন্সের তলায় ফেলে মুদ্রাটা ভালোভাবে পরীক্ষা করল সে।
কী হলো? লিলি ধৈর্য রাখতে পারছে না। একটা কিছু রায় দাও।
অবিশ্বাস্য, বিড়বিড় করল মাইক, হতভম্ব দেখল তাকে। স্বর্ণমুদ্রা! প্রায় সাড়ে তেরো গ্রাম। আগে কখনও দেখিনি আমি। অত্যন্ত দুর্লভ। একজন কালেক্টর সম্ভবত দশ থেকে পনেরো হাজার ডলারে কিনতে চাইবে।
চেহারাটা কার সাথে মেলে বলতে পারো?
মেলে মানে! রোমান আর বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের সম্রাট থিয়োডোসিয়াস দ্য গ্রেটের মূর্তি ওটা, দাঁড়িয়ে আছে। ঝাপসা হয়ে গেছে, কিন্তু ভালো করে তাকালে দেখতে পাবে সম্রাটের পায়ের কাছে বন্দিরা পড়ে আছে। লক্ষ করেছ সম্রাটের হাতে দুটো জিনিস-একটা গ্লোব আর একটা ব্যানার?
ব্যানার?
ব্যানারটায় পাশাপাশি দুটো গ্রিক অক্ষর রয়েছে, XP একটা মনোগ্রামের আকৃতিতে, যার অর্থ হলো-খ্রিস্টের নামে খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পর সম্রাট কনস্ট্যানটাইন মনোগ্রামটা গ্রহণ করেছিলেন, তারপর একে একে তার উত্তরাধিকারীরা এটা পেয়ে এসেছে।
উল্টোদিকের লেখাগুলো থেকে কী বুঝছ তুমি? প্রশ্ন করলেন ড. গ্রোনকুইস্ট।
আবার লেন্সে চোখ রাখল মাইক গ্রাহাম। তিনটে শব্দ। প্রথমটা মনে হচ্ছে… TRIVMFATOR বাকি দুটো পড়া যাচ্ছে না, মুছে প্রায় মসৃণ হয়ে গেছে। কালেক্টরস ক্যাটালগ থেকে বর্ণনা আর ল্যাটিন অনুবাদ পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু সভ্য জগতে ফেরার আগে খোঁজ করতে পারছি না।
সময়টা আন্দাজ করতে পারো?
চিন্তিতভাবে সিলিংয়ের দিকে তাকাল মাইক। থিয়োডোসিয়াসের শাসনকাল, যতদূর মনে হয়, তিনশো উনআশি থেকে তিনশো পঁচানব্বই খ্রিস্টাব্দ।
ঝট করে ড. গ্রোনকুইস্টের দিকে ফিরল লিলি। ঠিক বলেছে!
মাথা নাড়লেন তিনি। চতুর্থ শতাব্দীর এস্কিমোরা রোমান সাম্রাজ্যের সাথে যোগাযোগ করেছিল।
সম্ভাবনার কথা আমরা উড়িয়ে দিতে পারি না! জেদের সুরে বলল লিলি।
ব্যাপারটা জানাজানি হলে, দুনিয়াজুড়ে হৈচৈ পড়ে যাবে, বলল জোসেফ হসকিন্স, এই প্রথম মুদ্রাটা দেখছে সে।
ব্র্যান্ডির গ্লাসে ছোট্ট একটা চুমুক দিলেন ড. গ্রোনকুইস্ট। প্রাচীন মুদ্রা এর আগেও অদ্ভুত সব জায়গায় পাওয়া গেছে। কিন্তু মুদ্রার তারিখ বা কোথায় পাওয়া গেছে সে সম্পর্কে আর্কিওলজিস্ট মহলকে সন্তুষ্ট করতে পারে এমন প্রমাণ বিরল।
তা হয়তো সত্যি, মৃদুকণ্ঠে বলল মাইক। কিন্তু এটা এখানে কীভাবে এল জানার জন্য আমি আমার মার্সিডিজ কনভার্টিবলটা হারাতে রাজি আছি।
কিছুক্ষণ না বলে মুদ্রাটার দিকে তাকিয়ে থাকল ওরা, সবাই চিন্তিত। অবশেষে নিস্তব্ধতা ভাঙলেন ড. গ্রোনকুইস্ট, তার মানে একটা রহস্যের সামনে পড়েছি আমরা। শুধু এটুকুই জানি।
.
০৩.
মাঝরাতের খানিক পর প্লেন ত্যাগ করার প্রস্তুতি নিল ভুয়া পাইলট। স্বচ্ছ পরিষ্কার বাতাস, কালো মসৃণ সাগর তীরের ওপর স্নান একটা দাগের মতো মাথাচাড়া দিল আইসল্যান্ড। ছোট্ট দ্বীপদেশটার আকৃতি সবুজাভ সুমেরুপ্রভায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠল ধীরে ধীরে।
ছোটবেলা থেকেই রক্তদর্শনে অভ্যস্ত সে, লাশ দেখে তার চিত্তচাঞ্চল্য ঘটে না। ভাড়াটে খুনি হিসেবে অবিশ্বাস্য মোটা টাকা পায়, তার সাথে যোগ হয়েছে ধর্মীয় উন্মাদনা। কেউ তাকে অ্যাসাসিন বা আতঙ্কবাদী বললে ভয়ানক খেপে যায়। শব্দ দুটোর মধ্যে রাজনীতি গন্ধ আছে।
বহুরূপী বলতে যা বোঝায়, সে তা-ই। সমস্ত কলাকৌশল জানা আছে, দ্রুত চেহারা বদলানোয় তার জুড়ি মেলা ভার। নিখুঁত কাজ তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য, একজন পারফেকমনিস্ট। ভিড় লক্ষ করে ব্রাশ ফায়ার করা বা গাড়িতে বোমা ফিট করা তার কাছে হাস্যকর বোকামি বলে মনে হয়। তার পদ্ধতি আরও অনেক সূক্ষ্ম। আন্তর্জাতিক তদন্তকারীরা তার অনেক কীর্তিকে অ্যাক্সিডেন্ট নয় বলে প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
কামিলকে খুন করাটা টাকার বিনিময়ে একটা কাজ বলে ভাবছে না সুলমান আজিজ। জাতিসংঘের মহাসচিবকে খুন করা তার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। আয়োজনবহুল প্ল্যানটা নিখুঁত করতে পাঁচ মাস সময় নিয়েছে সে। তার পরও ধৈর্য ধরতে হয়েছে সুবর্ণ সুযোগটির জন্য।
প্রায় অপচয়ই বলা যায়, মুচকি হেসে ভাবল সে। হে’লা কামিল রাজরানীর সৌন্দর্য নিয়ে অকালে মারা যাচ্ছে। মেয়েলোকটা বিরাট একটা হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
ধীরে ধীরে থ্রটল পিছিয়ে আনল সে। একটু একটু করে নিচে নামছে প্লেন। আরোহীরা কিছু টের পাবে না। তাছাড়া, কেবিনের আরোহীরা ইতোমধ্যে নিশ্চয়ই ঘুমে ঢুলছে। এইবার নিয়ে বারো বার হেডিং চেক করল সে। কম্পিউটর আগেই রিপ্রোগ্রাম দিয়ে রেখেছে, যেখানে সে নামতে চায় সেখানকার দূরত্ব আর সময়ের হিসাব সবই সঠিকভাবে পাচ্ছে। পনেরো মিনিট পর আইসল্যান্ডের দক্ষিণ উপকূলরেখা পেরিয়ে ভেতর দিকে চলে এল প্লেন। কাছাকাছি কোথাও কোনো লোকবসতি নেই। নিচের দৃশ্য বলতে ধূসর রঙের পাথর আর সাদা তুষার। স্পিড় কমাল সুলেমান আজিজ। ঘণ্টায় তিনশো বাহান্ন কিলোমিটার গতিতে ছুটছে প্লেন।
হফসজোকাল গ্লেসিয়ারে একটা বিকন রাখা আছে, সেটা থেকে পাঠানো সঙ্কেত রেডিওতে ধরে, সরাসরি গ্লেসিয়ারের দিকে অটোপাইলট রিসেট করল সুলেমান আজিজ। দ্বীপের মাঝখান থেকে এক হাজার সাতশো সাঁইত্রিশ মিটার উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে হিমবাহ হফসজোকাল। এরপর অলটিচ্যুড সেট করল সে, সংঘর্ষটা যাতে চূড়ার দেড়শো মিটার নিচে ঘটে।
এক এক করে কমিউনিকেশন আর ডাইরেকশন ইন্ডিকেটরগুলো ভাঙল সে। সাবধানের মার নেই, তাই ফুয়েল বিসর্জন দেয়ার কাজটাও শান্তভাবে সারল। হাতঘড়ি দেখল, প্লেনে আর আট মিনিট আছে সে। ট্র্যাপ-ডোর গলে হেল হোল-এ নেমে এল, বিড়বিড় করে গান গাইছে নাকি কলমা পড়ছে সে-ই জানে। মোটা ইলাস্টিকের সোলসহ ফ্রেঞ্চ প্যারাবুট জোড়া আগেই পরে নিয়েছে। ডাফল ব্যাগ থেকে একটা জাম্পস্যুট বের করে ব্যস্ততার সাথে পরে ফেলল, স্কি মাস্ক আর স্টকিং ক্যাপ পরার পর মাথায় আর হেলমেট পরার সুযোগ থাকল না। ব্যাগ থেকে এরপর বেরোল দস্তানা, গগলস আর একটা অলটিমিটার, শেষেরটা কব্জির সাথে স্ট্র্যাপ দিয়ে বেঁধে নিল। প্যারাসুটের প্রধান অংশটি কোমরের কাছে থাকল, বাকিটুকু থাকল শোল্ডার ব্লেডের ওপর। তৈরি হয়ে নিয়ে আবার হাতঘড়ির দিকে তাকাল সে।
এক মিনিট বিশ সেকেন্ড।
এস্কেপ ভোর খুলল সে। সগর্জনে বাতাস ঢুকল হেল হোলে। সেকেন্ডের কাটার ওপর চোখ রেখে কাউন্ট ডাউন শুরু করল সে।
..পাঁচ, চার, তিন, দুই, এক, শূন্য। সরু ফাঁকাটা দিয়ে লাফ দিল সে, পা জোড়া সামনের বিমান যেদিকে ছুটছে সেদিকে মুখ। বাতাসের ঘূর্ণি ধেয়ে আসা বরফ ধসের মতো আঘাত করল মুখে, ছো দিয়ে কেড়ে নিল ফুসফুসের সমস্ত বাতাস। কানের পর্দা ফাটানো গর্জন তুলে এগিয়ে গেল প্লেনটা। পরমুহূর্তে হালকা হয়ে গেল শরীর, দীর্ঘ পতন শুরু হয়ে গেছে।
ব্যাঙের মতো হাত-পা ছড়িয়ে নামছে সুলেমান আজিজ, নিচে ঘোর অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখতে পেল না। সবচেয়ে খারাপ যেটা ঘটতে পারে সেটাই আন্দাজ করে নিল সে। সঠিক জায়গায় পৌঁছতে ব্যর্থ হয়েছে তার সহকারীরা। অন্ধকারে নির্দিষ্ট টার্গেট এলাকা না থাকায় বাতাস কতদূরে বা কোন দিকে তাকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে বোঝার কোনো উপায় নেই। নির্ধারিত জায়গা থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে গিয়ে পড়তে পারে সে, পড়তে চোখা কোনো বরফের মাথায়, কিংবা সরু কোনো গভীর ফাটলের ভেতর। কেউ হয়তো তাকে খুঁজেই পাবে না কোনো দিন।
দশ সেকেন্ডে প্রায় তিনশো ষাট মিটার নেমেছে। আলোকিত অলটিমিটারের ডায়ালে কাঁটা লাল ঘরে পৌঁছতে যাচ্ছে। আর তো দেরি করা যায় না। একটা পাউচ থেকে পাইলট শুটটা বের করে বাতাসে ছুঁড়ে দিল সে। আকাশে নোঙর ফেলল সেটা, মেইন প্যারাস্যুটটাকে টেনে খুলে ফেলল। হাত-পা ছড়ানো ব্যাঙের আকৃতি বদলে গেল, খাড়াভাবে নামছে এখন সুলেমান আজিজ।
হঠাৎ করে আলোর ছোট্ট একটা বৃত্ত তার ডান দিকে মাইলখানেক দূরে পিট পিট করে উঠল। তারপর আকাশে উঠে এল একটা ফ্লেয়ার, স্থির হয়ে ঝুলে থাকল বেশ কয়েক সেকেন্ড। বাতাসের গতি আর দিক বোঝার হলো তার। ডান দিকের স্টিয়ারিং টগল টেনে আলোটার দিকে নামতে শুরু করল সে।
আকাশে আরেকটা ফ্লেয়ার উঠল। মাটির কাছাকাছি বাতাস স্থির হয়ে আছে। এতক্ষণে সহকারীদের পরিষ্কার দেখতে পেল সে। আলোর এক জোড়া সরল রেখা তৈরি করেছে ওরা, আগে দেখা বৃত্তটার দিকে চলে গেছে। স্টিয়ারিং টগল টেনে একশো আশি ডিগ্রি বাঁক নিল সুলেমান আজিজ। মাটিতে নামার প্রস্তুতি শেষ করল। তার সহকারীরা জায়গাটা ভালোই বেছেছে। নরম তুন্দ্রায় পা দিয়ে পড়ল সে, বৃত্তের ঠিক মাঝখানে, খাড়াভাবে। কথা না বলে স্ট্র্যাপগুলো খুলল সে চোখ ধাঁধানো আলোর মাঝখান থেকে বেরিয়ে এসে মুখ তুলল আকাশে।
আকাশ ছোঁয়া হিমবাহের দিকে ছুটে চলেছে প্লেনটা। কী ঘটতে যাচ্ছে সে সম্পর্কে আরোহী বা ক্রুদের কারও কোনো ধারণা নেই। হিমবাহ আর ধাতব মেশিনের মাঝখানের দূরত্ব দ্রুত কমে আসছে।
নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকল সুলেমান আজিজ। জেট ইঞ্জিনের আওয়াজ ক্রমশ মিলিয়ে গেল দূরে। কালো রাতের সাথে মিশে অদৃশ্য হয়ে গেল নেভিগেশন লাইট।
.
০৪.
গ্যালির পেছনে মাথাটা একদিকে কাত করল একজন অ্যাটেনড্যান্ট। ককপিটে কিসের আওয়াজ বলো তো? শুনতে পাচ্ছ?
হাতের কাজ ফেলে প্লেনের নাকের দিকে ঘুরল চিফ স্টুয়ার্ড, গ্যারি রুবিন। ভেঁতা, অবিচ্ছিন্ন গর্জনের মতো একটা আওয়াজ, যেন কাছে পিঠে কোথাও গেল হেল হোলের হ্যাঁচ, সেই সাথে থেমে গেল শব্দটাও।
কই, আর তো কিছু শুনতে পাচ্ছি না!
কিসের শব্দ ছিল ওটা?
কী জানি। আগে কখনও শুনিনি। একবার মনে হলো, প্রেশার লিক কিনা। অ্যাটেনড্যান্ট তার কাঁধ ছোঁয়া সোনালি চুল নেড়ে মেইন কেবিনের দিকে এগোল। তুমি বরং ক্যাপটেনকে জিজ্ঞেস করে জেনে নাও।
ইতস্তত করতে লাগল। জরুরি কোনো ব্যাপার না হলে ক্যাপটেন তাকে বিরক্ত করতে নিষেধ করেছেন। তবে, ভাবল সে, আগে তাকে প্লেন আর আরোহীদের নিরাপত্তার দিকটা দেখতে হবে। ইন্টারকম ফোনের রিসিভার কানে তুলল সে, চাপ দিল বোতামে। ক্যাপটেন, বলছি। মেইন কেবিনের সামনে থেকে অদ্ভুত একটা শব্দ শুনলাম আমরা। ওখানে কোনো সমস্যা দেখা দিয়েছে?
কোনো জবাব এল না। তিনবার চেষ্টা করার পরও সাড়া না পেয়ে দিশেহারা বোধ করল, বারো বছরের চাকরিতে এটা তার কাছে সম্পূর্ণ নতুন একটা অভিজ্ঞতা। কী করবে ভাবছে, এই সময় প্রায় ছুটতে ছুটতে ফিরে এল ফ্লাইট অ্যাটেনড্যান্ট, কী যেন বলল তাকে। প্রথমে কান দেয়নি তার কথায়, তারপর ঝট করে তার দিকে ঘুরল। কী বললে?
আমাদের নিচে মাটি।
মাটি?
সরাসরি আমাদের নিচে, হাঁপাতে হাঁপাতে বলল মেয়েটা, চোখ পিটপিট করছে। একজন আরোহী আমাকে দেখল।
মাথা নাড়ল। অসম্ভব! সমুদ্রের মাঝখানে থাকার কথা আমাদের। সম্ভবত ফিশিং বোটের আলো দেখেছে সে। আবহাওয়া-সংক্রান্ত গবেষণার জন্য, ক্যাপটেন বলেছেন…
বিশ্বাস না হয় নিজেই দেখো না! তাকে থামিয়ে দিয়ে আবেদনের সুরে বলল অ্যাটেনড্যান্ট। নিচের মাটি দ্রুত উঠে আসছে। আমরা বোধ হয় ল্যান্ড করতে যাচ্ছি।
গ্যালির একটা জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়াল, নিচে তাকাল। আটলান্টিকের কালো পানির বদলে সাদা একটা উজ্জ্বল ভাব দেখতে পেল সে। প্লেনের নিচে বরফের বিশাল একটা বিস্তৃতি পেছন দিকে ছুটে যাচ্ছে, খুব বেশি হলে দুশো চল্লিশ মিটার নিচে, নেভিগেশন লাইটের প্রতিফলন পরিষ্কার দেখা গেল। আতকে উঠল, ঘুরে উঠল মাথাটা। এটা যদি ইমার্জেন্সি ল্যান্ডিং হয়, ক্যাপটেন মেইন কেবিনের ক্রুদের জানাননি কেন? সিট বেল্ট বাঁধার বা ধূমপান না করার নির্দেশ দেননি কেন? হতভম্ব চেহারা নিয়ে অ্যাটেনড্যান্টের দিকে ফিরল সে। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
জাতিসংঘের প্রায় সর আরোহীই জেগে রয়েছে, পত্রপত্রিকা পড়ছে বা কথা বলছে। শুধু হে’লা কামিল ঘুমিয়ে পড়েছেন। অর্থনৈতিক সেমিনার শেষ করে বিশ্বব্যাংকের হেডকোয়ার্টারে ফিরছে প্রতিনিধিদল, প্লেনের লেজে একটা টেবিলে জড় হয়েছে তারা সবাই। প্রতিনিধিদলের নেতা, অর্থ মন্ত্রণালয়ের সচিব নিচু গলায় কথা বলছেন, থমথম করছে তার চেহারা। মেক্সিকোর অর্থনীতি বিধ্বস্ত হয়ে গেছে, গোটা দেশ দেউলিয়া হতে আর বেশি দেরি নেই, অথচ আর্থিক সহায়তা লাভেরও কোনো আশা কেউ তাঁরা দেখতে পাচ্ছেন না।
ফ্লাইট অ্যাটেনড্যান্ট রুদ্ধশ্বাসে জিজ্ঞেস করল, ইমার্জেন্সি প্রসিডিওর শুরু করা উচিত নয়?
আরোহীদের কিছু জানিয়ো না। অন্তত এক্ষুনি নয়। আগে আমাকে ক্যাপটেনের সাথে যোগাযোগ করতে দাও।
কিন্তু তার কি সময় আছে?
না-জানি না। নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করে মেইন কেবিন ধরে হন হন করে এগোল, আরোহীদের কিছু বুঝতে না দেয়ার জন্য মুখের সামনে একটা হাত রেখে হাই তুলল। সামনের পর্দাটা হ্যাঁচকা টানে সরিয়ে ককপিটের দরজার সামনে থামল সে, হাতল ধরে মোচড় দিল। ভেতর থেকে তালা মারা।
নক করল সে। তারপর ঘুষি মারল। কোনো সাড়া নেই। ক্যাপটেনকে নিয়ে তিনজন রয়েছে ভেতরে, কী করছে তারা? মরিয়া হয়ে দরজার গায়ে লাথি মারল সে। দরজার কবাট হালকা বোর্ড দিয়ে তৈরি, বাইরের দিকে খোলে। দ্বিতীয় লাথিতে সেটা ভেঙে গেল। দোরগোড়া টপকে ভেতরে ঢুকল। ঢুকেই পাথর হয়ে গেল।
অবিশ্বাস, বিস্ময়, ভয় ও আতঙ্ক, বাঁধ ভাঙা পানির মতো একযোগে সবগুলো অনুভূতি গ্রাস করে ফেলল তাকে। ক্রুদের একজন মেঝেতে পড়ে আছে, আরেকজন তার প্যানেলে হুমড়ি খেয়ে রয়েছে। ক্যাপটেন ডেইল লেমকে অদৃশ্য। জেরি অসওয়ার্ল্ডকে টপকাতে গিয়ে তার গায়ে হোঁচট খেল, খালি পাইলটের সিটের ওপর ঝুঁকে উইন্ডশিল্ড দিয়ে বাইরে তাকাল।
পেন্নর নাকের সামনে বিপুল বিস্তার নিয়ে ঝুলে রয়েছে হসজোকাল গ্লেসিয়ারের চূড়া, খুব বেশি হলে মাইল দশেক দূরে। তারার আলোয় সবুজাভ দেখল বরফের গা। কী ঘটতে যাচ্ছে বুঝতে পেরে আতঙ্কে দিশেহারা বোধ করল স্টুয়ার্ড। প্লেন কীভাবে চালাতে হয় সে সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই তার, তবু পাইলটের সীটে বসে কন্ট্রোল কলামটাকে দুহাতে আঁকড়ে ধরল সে। নিজের কথা ভাবছে না, কিন্তু আরোহীদের বাঁচানোর শেষ একটা চেষ্টা তো করতেই হবে। হুলিটাকে নিজের বুকের দিকে টেনে আনার চেষ্টা করল সে।
কিছুই ঘটল না।
কলাম টিল হতে চাইছে না অথচ আশ্চর্য, অলটিমিটারে দেখা গেল প্লেন ধীরে ধীরে হলেও ওপর দিকে উঠছে। আবার হুইলটা নিজের দিকে টানল সে, এবার আরও জোরে। সামান্য একটু কাছে এল। দৃঢ় চাপ অনুভব করে বিস্মিত হলো সে। তার চিন্তাশক্তি স্বাভাবিক নিয়মে কাজ করছে না। অভিজ্ঞতা এতই কম যে বুঝতে পারছে না অটোমেটিক পাইলটের ওপর আসুরিক শক্তি খাটাচ্ছে সে, যেখানে মাত্র পঁচিশ পাউন্ড চাপ-ই ওটাকে নত করতে পারে।
স্বচ্ছ ঠাণ্ডা বাতাসে গ্লেসিয়ারটাকে এত কাছে মনে হলো যেন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে। থ্রটল সামনের দিকে ঠেলে দিয়ে কলামটাকে আবার কাছে টানল সে। থেমে থেমে, জেদ আর অনিচ্ছার ভাব নিয়ে কাছে এল বটে, কিন্তু আবার পিছিয়ে গেল খানিকটা। যেন যন্ত্রণাকাতর মন্থরতার সাথে ওপর দিকে নাক তুলল প্লেন, বরফ আর তুষার ঢাকা চূড়াটাকে টপকাল মাত্র একশো ফুট ওপর দিয়ে।
.
আসল ডেইল লেমকেকে তার লন্ডন ফ্ল্যাটে খুন করেছে সুলেমান আজিজ। ছদ্মবেশ নেয়ার ব্যাপারে সে একজন জাদুকর, বেচারা লেমকের ফ্ল্যাটে বসেই চেহারা বদলে নিয়েছে। এই মুহূর্তে বরফের রাজ্যে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে, চোখে একজোড়া নাইট গ্লাস তুলে তাকিয়ে রয়েছে দূরে। সুমেরুপ্রভা ম্লান হয়ে এলেও আকাশের গায়ে হক্সজোকালের কিনারাগুলো এখনও ঠাহর করা যায়।
উত্তেজনা আর প্রত্যাশায় টান টান হয়ে আছে পরিবেশ। দু’জন টেকনিশিয়ান আলো আর ট্রান্সমিটার বিকন তুলে একটা হেলিকপ্টারে ভরছে বটে, কিন্তু তারাও ঢালের ওপর দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে গ্লেসিয়ারের চূড়ার দিকে। পাথুরে মূর্তির মতো স্থির হয়ে রয়েছে সুলেমান আজিজ, এক দুই করে সেকেন্ড গুনছে, আশা যেকোনো মুহূর্তে আগুনের বিস্ফোরণ দেখতে পাবে। কিন্তু কিছুই ঘটল না।
চোখ থেকে বাইনোকুলার নামিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। গ্লেসিয়ারের নিস্তব্ধতা চারদিক থেকে ঘিরে ধরল তাকে, ঠাণ্ডা আর নির্বিকার। মাথার কাঁচা-পাকা পরচুলা খুলে বরফের ওপর ছুঁড়ে মারল সে। বুট জোড়া খুলল, বুটের ভেতর থেকে বের করল শক্ত মোটা স্পঞ্জ, দৈর্ঘ্য বাড়ানোর জন্য ব্যবহার করতে হয়েছিল। সচেতন, পাশে তার অন্ধভক্ত বন্ধু ইবনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আশ্চর্য মেকআপ, সুলেমান আজি, আপনাকে চেনাই যাচ্ছিল না। লম্বা সে, রোগাটে, পাকানো রশির মতো শরীর, মাথায় বাবরি।
ইকুইপমেন্ট সব তোলা হয়েছে?
জি। আমাদের মিশন কি সাকসেলফুল, সুলেমান আজিজ?
হিসেবে ছোট্ট একটা ভুল হয়েছে। যেভাবেই হোক চূড়া টপকে বেরিয়ে গেছে প্লেন। মহান করুণাময় আল্লাহ হে’লা কামিলকে আরও কয়েক মিনিট হায়াৎ দরাজ করেছেন।
সুলেমান আজিজ, সভয়ে বলছি, আখমত ইয়াজিদ কিন্তু মোটেও খুশি হবেন না।
প্ল্যান মোতাবেকই মারা যাবে হে’লা কামিল, আত্মবিশ্বাসের সাথে বল সুলেমান আজিজ। আমার কাজে কোনো ফাঁক থাকে না।
কিন্তু প্লেনটা যে এখনও উড়ছে!
এমনকি আল্লাহও ওটাকে অনন্তকাল আকাশে রাখতে পারবেন না।
আল্লাহর ব্যর্থতা নিয়ে পরে আলোচনা করা যাবে, নতুন একটা কণ্ঠস্বর শোনা গেল, আগে ব্যাখ্যা করো তুমি কেন ব্যর্থ হলে? চাপা, ক্রুদ্ধ গর্জনের মতো শোনাল কথাগুলো।
ঝট করে ঘুরল সুলেমান আজিজ, মোহাম্মদ ইসমাইলকে অদূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার পিত্তি জ্বলে গেল। শিশুসুলভ নিরীহ ভাব ফুটে আছে প্রায় গোল চেহারায়। কালো মুক্তোর মতো একজোড়া চোখ। শুধু ঘন ভ্রু জোড়া একজন পেশাদার খুনির চেহারাতেই যেন বেশি মানায়। দৃষ্টি কেমন যেন আচ্ছন্ন, যেন শুধু ছুঁয়ে যায়, গভীরে প্রবেশ করতে পারে না। সুলেমান আজিজের জানা আছে, এ লোক সহজে খুন করতে ভালোবাসে, কঠিন পরিশ্রমের মধ্যে যেতে চায় না, জানে না হত্যাকাণ্ডকে শিল্পের পর্যায়ে তোলা সম্ভব। সে আরও জানে, মোহাম্মদ ইসমাইলের বিরক্তিকর উপস্থিতি না মেনে নিয়ে তার কোনো উপায় নেই। কায়রো শহরের একজন মোল্লা সে, সুলেমান আজিজের ঘাড়ে প্রায় জোর করে তাকে চাপিয়ে দিয়েছে আখমত ইয়াজিদ। গোড়া মৌলবাদীকে বড় বেশি পছন্দ আর বিশ্বাস করে সে। অবিশ্বাস না করলেও সুলেমান আজিজকে নিয়ে চিন্তিত মনে হয় তাকে। সুলেমান আজিজ, মৌলবাদী রাজনৈতিক নেতাদের যথাযযাগ্য সম্মান দেয় না, তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সব সময় কড়া সমালোচনা করে, ইত্যাদি লক্ষ করে সতর্ক হবার প্রয়োজন বোধ করেছে সে। সেই সতর্কতারই ফলশ্রুতি মোহাম্মদ ইসমাইল। তার চোখের সামনে, তার পরামর্শ নিয়ে কাজ করতে হয় সুলেমান আজিজকে। কোনো রকম প্রতিবাদ না করেই মোহাম্মদ ইসমাইলকে গ্রহণ করেছে সুলেমান আজিজ। ছলচাতুরি তার মজ্জাগত, মোহাম্মদ ইসমাইল নিজেও জানে না সুলেমান আজিজের পক্ষে তথ্য সরবরাহকারী হিসেবে ভূমিকা রেখে যাচ্ছে সে।
শান্তভাবে পরিস্থিতিটা ব্যাখ্যা করল সুলেমান আজিজ। যান্ত্রিক ব্যাপারে অনেক ধরনের বিচ্যুতি ঘটতে পারে। তবে যা ঘটতে পারে সবই ধারণার মধ্যে ছিল। ঘাবড়াবার কোনো কারণ নেই। অটোমেটিক পাইলট মেরুর দিকে একটা কোর্সে লক করা আছে। আকাশ সময় খুব বেশি হলে আর মাত্র নব্বই মিনিট অবশিষ্ট আছে।
কিন্তু তার আগেই যদি ককপিটের লাশগুলো কেউ দেখে ফেলে? আর যদি আরোহীদের মধ্যে কেউ প্লেন চালাতে জানে? মোহাম্মদ ইসমাইল নাছোড়বান্দা।
আরোহীদের ব্যাকগ্রাউন্ড স্টাডি করা হয়েছে। প্লেন চালানোর অভিজ্ঞতা কারও নেই। তাছাড়া রেডিও আর নেভিগেশন ইনস্ট্রুমেন্ট চুরমার করে দিয়েছি আমি। কেউ যদি প্লেনটাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে চায়, কোথায় আছে বা কোথায় যাচ্ছে কিছুই টের পাবে না। চিরকালের জন্য আর্কটিক সাগরে হারিয়ে যাবে হে’লা কামিল আর তার জাতিসংঘের হোমরাচোমরা শয্যাসঙ্গীরা।
বলতে চাইছ ওদের বাঁচার কোনো উপায়ই নেই?
নেই, দৃঢ়কণ্ঠে বলল সুলেমান আজিজ। একেবারেই নেই।