৬০.
ধীরে সুলেমান আজিজ বুঝতে পারল, যেমন হওয়া উচিত, কোনো যেন ঘটনাবলি তেমন করে ঘটছে না।
পিট মারা যায়নি। এমনকি পড়েওনি। ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াল ও।
এর মুখে খোদ শয়তানের হাসি দেখতে পেল সুলেমান আজিজ।
বিস্ময়ে স্তম্ভিত সে। বুঝতে পারল, আজকের প্রতিযোগিতায় হার হয়েছে তার। ওকে যে পেছন থেকে কাপুরুষের মতো আক্রমণ করা হবে, আগেই আন্দাজ করেছিল পিট। মোটা স্কি জ্যাকেটের ভেতর বুলেটপ্রুফ শিল্ড পরে ক্রাশিং মিল থেকে বেরিয়েছে ও।
আতঙ্কের একটা ঢেউ বয়ে গেল সুলেমান আজিজের সারা শরীরে, দেখল আস্তিনের বাইরে ঝুলতে থাকা দস্তানা পরা হাত দুটো কৃত্রিম। জাদুকরের হাত সাফাই। আসল হাতের একটা বেরিয়ে এল জ্যাকেটের ভেতর থেকে, বড় কোল্ট ফরটিফাইভ অটোমেটিক নিয়ে।
আবার পিটের লক্ষ্যস্থির করল সুলেমান আজিজ। তবে আগে গুলি করল পিট।
পিটের প্রথম গুলিটা সুলেমান আজিজের কাঁধে লাগল, আড়াআড়িভাবে ঘুরিয়ে দিল তাকে। দ্বিতীয় বুলেট চোয়াল আর মুখের নিচের অংশ গুঁড়িয়ে দিল। মুখে একটা হাত তুলতেই তৃতীয় বুলেট চুরমার করে দিল কবজিটাকে। শেষ বুলেটটা মুখের একদিক দিয়ে ঢুকে আরেক দিক দিয়ে বেরিয়ে গেল।
কাঁকরের ওপর একটা গড়ান দিয়ে চিৎ হলো সুলেমান আজিজ। শরীরে গুলির বর্ষণ সম্পর্কে সচেতন নয়, জানে না তার লোজন ফায়ার ওপেন করার আগেই অক্ষত অবস্থায় লাফ দিয়ে দরজা টপকে ক্রাশিং মিলের ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেছে পিট।
আবছাভাবে শুধু বুঝতে পারল, টেনে-হিঁচড়ে তাকে একটা পানির ট্যাংকের পেছনে সরিয়ে নিয়ে এসেছে ইবনে। ক্রাশিং মিলের জানালা থেকে গুলিবর্ষণ হচ্ছে। ধীরে ধীরে একটা হাত তুলে ইবনের লোহার মতো শক্ত কাঁধ আঁকড়ে ধরল সুলেমান আজিজ। নিচের দিতে টেনে আনল বিশ্বস্ত ভক্তকে।
তোমাকে আমি দেখতে পাচ্ছি না, কর্কশকণ্ঠে বলল সুলেমান আজিজ, ধমকের সুরে।
কোমরের বেল্ট থেকে একটা প্যাকেট বের করল ইবনে, প্যাকেট থেকে বেরোল সার্জিক্যাল প্যাড। এক সময় যেখানে চোখ ছিল সুলেমান আজিজের, প্যাডটা সেখানে, গর্তের ভেতর বসিয়ে বেঁধে দিল। আল্লাহ আর আমি আপনার হয়ে দেখবো, জনাব। সান্ত্বনা দিল ইবনে।
কাশল সুলেমান আজিজ, গলার ভেতর থেকে ছলকে বেরিয়ে এল খানিকটা রক্ত। আমি চাই ওই শয়তান, ডার্ক পিট, আর জিম্মিদের সবাইকে কেটে টুকরো টুকরো করা থোক।
আমাদের হামলা শুরু হয়ে গেছে, জনাব। আর মাত্র কয়েক সেকেন্ড বেঁচে আছে ওরা।
আমি যদি মারাত্যাই … আখমত ইয়াজিদকে তুমি খুন কোরো।
আপনি মারা যাবে না।
কথা বলার আগে আবার কিছুক্ষণ কাশল সুলেমান আজিজ। যাই ঘটুক না কেন, শত্রুরা হেলিকপ্টারটা নষ্ট করবে। কিন্তু দ্বীপ থেকে পালাতেই হবে তোমাকে। চেষ্টা কোরো, পথ একটা পেয়ে যাবে। যাও, আমাকে রেখে চলে যাও। তোমার প্রতি এটা আমার নির্দেশ, ইবনে। আমার অসমাপ্ত কাজ শেষ করার জন্য তোমার বেঁচে থাকা একান্ত দরকার।
নিঃশব্দে, নির্দেশের উত্তরে কিছুই না বলে, সুলেমান আজিজতে দুহাতের ওপর তুলে নিয়ে সিধে হলো ইবনে। ধীরে ধীরে রণক্ষেত্র থেকে সরে যাচ্ছে সে।
নিরাপদ দূরত্বে সরে এসে শান্ত সুরে বলল ইবনে, মনটা শক্ত করুন, জনাব। আমাকে কড়া ধমক দিন। দু’জন আমরা একসাথে আলেকজান্দ্রিয়ায় পৌঁছুব।
লাফ দিয়ে দরজা দিয়ে মাত্র ভেতরে ঢুকল পিট, ক্ষিপ্র হাতে কোর্টের পেছন থেকে বুলেটপ্রুফ ভেস্ট জোড়া খুলল, একটা ধরিয়ে দিল হাতে, দ্বিতীয়টা নিজের বুকে আটকাল। অ্যালকে কিছু বলার আর সময় পাওয়া গেল না, শুরু হয়ে গেল ঝাঁক ঝাঁক বুলেটের বর্ষণ। পাতলা কাঠের দেয়াল ফুটো হয়ে যাচ্ছে।
ডাইভ দিয়ে মেঝেতে পড়ল পিট, জনান্তিকে খেদ প্রকাশ করল, এত দামি জ্যাকেটটাও গেছে।
বুকে গুলি করলে এতক্ষণে তুমি ঠাণ্ডা মাংস হয়ে যেতে, পাশ থেকে বলল জিওর্দিনো। বুঝলে কীভাবে, তুমি পেছন ফিরলে গুলি করবে?
ঢুলঢুলু চোখ দেখে। ব্যাটা ফ্যানাটিক, এবং কাপুরুষ।
হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে একটা করে জানালার নিচে থামছে ফিনলে, পিন খুলে বাইরে ছুঁড়ে দিচ্ছে গ্রেনেডগুলো।
ওরা এসে গেছে। চিৎকার করল সে।
কাঠের মেঝের ওপর দিয়ে গড়িয়ে গেল জিওর্দিনো, ওর ভর্তি একটা চাকা লাগানো ঐলির পেছন থেকে এক পশলা গুলি চালালো। একেবারে শেষ মুহূর্তে থম্পসনের মাজল ঘুরিয়ে দু’জন আতঙ্কবাদীকে থামালো পিট, ভাঙা সিঁড়ি বেয়ে কীভাবে যেন বিধ্বস্ত সাইড অফিসে উঠে এসেছে তারা। পাক খেতে খেতে পড়ে গেল। দু’জনেই।
ক্রাশিং মিলটাকে চারদিকে থেকে আক্রমণ করল সুলেমান আজিজের লোকেরা। গুলিবর্ষণে কোনো ছেদ পড়ল না, বিশ পঁচিশজন একনাগাড়ে গুলি করছে তারা। সবার হাতে স্মল-ক্যালিবারে এ-কে সেভেনটি ফোর।
ক্রাশিং মিলের মেঝেতে অনবরত গড়াগড়ি খেয়ে পিট আর ফিনলেকে কাভার দিল জিওর্দিনো, একসময় তিনজনই ওরা অস্থায়ী আশ্রয় মিকি মাউজ দুর্গে পৌঁছে গেল। তুমুল আক্রমণের মুখেও মাথার ওপর হাত তুলে ক্রাশিং মিল থেকে কেউ বেরিয়ে এল না দেখে মুহূর্তের জন্য হতভম্ব হয়ে পড়ল সন্ত্রাসবাদীরা।
আক্রমণের প্রথম ঢেউটাকে ঠেকিয়েছে ওরা, তবে সন্ত্রাসবাদীরা অসম্ভব একরোখা, অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নিতেও তাদের জুড়ি নেই। দ্বিতীয় আক্রমণ শুরু করল তারা এবার। একটানা গুলিবর্ষণের সাথে যোগ হলো গ্রেনেডের বিস্ফোরণ। ছোট দুটো দল গুলি করতে করতে ভেতরে ঢুকল, পিটের থম্পসন আর ফিনলের শটগান তাদেরকে ফেলে দিতেই লাশগুলোকে কাভার হিসেবে ব্যবহার করল পেছনের দুটো ছোট দল। ভীতিকর, বীভৎস একটা দৃশ্যের অবতারণা হলো। ক্রাশিং মিলের ভেতরে দশ-বারোটা আগ্নেয়াস্ত্র গর্জন করছে, একের পর এক গ্রেনেড ফাটছে, একাধিক ভাষায় চিৎকার করছে লোকজন। থরথর করে কাঁপছে গোটা ক্রাশিং মিল। শ্ৰাপনেল আর বুলেট বিশাল মেকানিকালে মিলের গায়ে লেগে পিছলে যাচ্ছে দিগ্বিদিক। বাতাসে ধোয়া আর গানপাউডারের গন্ধ।
আট-দশ জায়গায় আগুন ধরে গেল, কিন্তু সেদিকে খেয়াল দেয়ার সময় নেই কারও। একটা গ্রেনেডে ছুঁড়ে হেলিকপ্টারের টেইল রোটর উড়িয়ে দিল জিওর্দিনো। পালানোর শেষ সুযোগটা হাতছাড়া হয়ে গেছে দেখে দ্বিগুণ আক্রোশে আক্রমণের মাত্রা বাড়িয়ে দিল সন্ত্রাসবাদীরা।
হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেল পিটের হাতে পুরনো থম্পসনটা। পঞ্চাশ রাউন্ডের রোটারি ড্রাম ইজেক্ট করে আরেকটা ঢোকাল ও, এটাই শেষ। তিনজনের কেউই ওরা মৃত্যুকে ভয় পায় না, জানে পিছিয়ে যাবার সুযোগ অনেক আগেই হাতছাড়া হয়ে গেছে। কারও মধ্যে বিন্দুমাত্র ভাবাবেগ বা দ্বিধা দেখা গেল না, গভীর নিঠার সাথে লড়ে যাচেচ্ছ। বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে মৃত্যুভয়কে তুচ্ছ করে।
তিনবার পিছিয়ে গেল সন্ত্রাসবাদীরা, প্রতিবার ভেতর আনার চেষ্টা করল তারা। জানে, এটাই তাদের শেষ আক্রমণ হতে যাচ্ছে। সবাইকে বলে দেয়া হলো, এটা হবে সুইসাইড মিশন। ক্রাশিং মিলের চারদিকে বৃত্তটাকে এবার তারা ধীরে ধীরে ছোট করে আনল।
ধোঁয়া লেগে পিটের দুচোখ থেকে পানি গড়াচ্ছে। ওর আস্তিন ফুটো হয়েছে চার জায়গায়, দুচায়গায় মাংস পুড়ে গেছে, চামড়া ছড়েছে এক জায়গায়। দম ফেলার অবসর নেই ওদের কারও, কারণ বৃত্ত ছোট করে এসে আবার ক্রাশিং মিলের ভেতর ঢুকে পড়েছে সন্ত্রাসবাদীরা, এবার তারা খানিকটা এগিয়ে পেরিয়ে এসেছে জিওর্দিনো আর ফিনলের তৈরি ব্যারিকেডটা। গুলিবর্ষণ প্রতিযোগিতা দ্রুত রূপান্তরিত হলো ধস্তাধস্তিতে।
একপশলা গুলির একটা পেটে নিয়ে মেঝেতে নিচু হলো ফিনলে, হাঁটু গেড়ে খাড়া থাকার চেষ্টা করল সে, হাতের খালি শটগানটা মন্থরগতিতে ঘোরাচ্ছে।
জিওর্দিনো আহত হয়েছে পাঁচ জায়গায়। ট্রলি থেকে একটা ওর পাথর তুলে নিল সে ডান হাতে, বাঁ হাতটা শরীরের পাশে মরা সাপের মতো ঝুলছে, কাঁধের ক্ষতটা থেকে নেমে আসছে রক্তের একটা ধারা।
পিটের থম্পসন থেকে বেরিয়ে গেল শেষ কান্ট্রিজটা, হঠাৎ উদয় হয়ে একজন আরবের মুখের ওপর সেটা ছুঁড়ে মারল ও কোমর থেকে ছোঁ দিয়ে কোল্ট অটোমেটিকটা হাতে নিল ও, ধোয়ার ভেতর একটা মুখ দেখতে পেলেই ট্রিগার টানল।
ঘাড়ের গোড়ায় তীব্র চুলকানির একটা অনুভূতি হলো, বুঝল আহত হয়েছে ও। দেখতে দেখতে খালি হয়ে গেল কোল্ট, সেটা উল্টো করে ধরে সামনে যাকেই দেখল তারই মুখ আর মাথা লক্ষ্য করে বাড়ি মারল। পরাজয়ের তিক্ত স্বাদ পেতে শুরু করেছে।
পিটের মনে হলো, ঘটনাটা যেন বাস্তবে ঘটছে না। এভাবে মানুষ সম্ভবত শুধু দুঃস্বপ্নের ভেতর লড়ে। একটা গ্রেনেড ফাটল, এত কাছে যে প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়ল ও। ওর গায়ের ওপর ঢলে পড়ল এক লোক। নাকি একটা লাশ?,
স্টিলের একটা পাইপের সাথে মাথাটা ঠুকে গেছে পিটের। মগজের ভেতর যেন আগুন জ্বলে উঠল। খালি কোটার খোঁজে মেঝে হাতড়াচ্ছে ও, তারপর কী ঘটল জানে না।
.
৬১.
খনি আর বিল্ডিংগুলো থেকে খানিক দূরে পাহাড়ের মতো উঁচু হয়ে আছে অসংখ্য ওর স্তূপ; ল্যান্ড করার পর এক জায়গায় জড়ো হলো স্পেশাল ফোর্সের লোকজন, তারপর ছড়িয়ে পড়ে পজিশন নিল স্তূপগুলোর আড়ালে। খানিটাকে চারদিকে ঘিরে থাকল স্নাইপাররা, ঢালের গায়ে শুয়ে চোখ রাখল যে-যার স্কোপে।
কর্নেল হোলিস, পাশে জন ডিলিঞ্জার, একটা স্কুপের মাথায় উঠে এসে উঁকি দিয়ে সামনে তাকাল।
গোলাগুলি থেকে গেছে। শেষ সারির তিনটে বিল্ডিংয়ে আগুন জ্বলছে, নিচু মেঘে গিয়ে মিশছে কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলীগুলো। ক্রাশিং মিলটাকে পরিষ্কার দেখতে পেল ওরা। মিলের সামনের রাস্তায় অনেকগুলো লাশ পড়ে রয়েছে। মনে মনে গুনল জন ডিলিঞ্জার, বলল রাস্তাতেই শুধু চারটা লাশ দেখতে পাচ্ছি।
খারাপ কিছু ভাবতে চাই না, বিড়বিড় করল কর্নেল। তবে দেখে আমার ভালো মনে হচ্ছে না।
প্রাণের কোনো চিহ্ন নেই, সায় দিল জন ডিলিঞ্জার, তার চোখে শক্তিশালী বাইনোকুলার।
সতর্ক চোখে আরও পাঁচ সেকেন্ড বিল্ডিংগুলো পরীক্ষা করল কর্নেল, তারপর ট্রান্সমিটারে কথা বলল, ঠিক আছে, বুঝে-শুনে পা পেলে এগোনো যেতে পারে।
এক মিনিট, কর্নেল, যান্ত্রিক একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এল রিসিভারে।
হোল্ড দি অর্ডার, তাড়াতাড়ি বলল কর্নেল।
সার্জেন্ট বেকার বলছি, স্যার-ডান দিকের পজিশন থেকে। রেললাইন ধরে পাঁচজন লোককে এগিয়ে আতে দেখছি আমি।
সশস্ত্র?
না, স্যার! মাথার ওপর হাত তুলে।
ভেরি গুড। তোমার লোকদের নিয়ে ঘিরে ফেলো ওদের। ফাঁদ কি না লক্ষ রেখো। জন ডিলিঞ্জারকে নিয়ে আসছি আমি।
ওর স্তূপ থেকে নেমে রেললাইনে চলে এল ওরা, লাইন ধরে খাড়ির দিকে ছুটল। সত্তর মিটারের মতো ঘোটর পর দেখল, বৃষ্টির ভেতর লোকজনের ছোট্ট একটা ভিড় ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে।
ভিড়টা থেকে বেরিয়ে এসে রিপোর্ট করল সার্জেন্ট বেকার।
চারজন জিম্মি ও একজন আতঙ্কবাদীকে আমরা বন্দি করেছি, কর্নেল।
জিম্মিদের উদ্ধার করেছ? নিজের অজান্তেই চিত্ত র করে উঠল কর্নেল। চারজনকেই?
জি, স্যার, জবাব দিল সার্জেন্ট বাট। ওঁরা খুব ক্লান্ত, তাছাড়া বহাল তবিয়তেই আছেন সবাই।
নাইস ওঅর্ক, সার্জেন্ট! খুশিতে বেকারের সাথে সজোরে করমর্দন করল কর্নেল, ব্যথা হজম করে হাসতে লাগল লোকটা।
অফিসাররা দু’জন প্রেসিডেন্ট, মার্কিন প্রেসিডেন্টর বিশেষ বন্ধু সিনেটর পিট ও জাতিসংঘ মহাসচিব হে’লা কামিলের ফটো দেখেছে, ভার্জিনিয়া থেকে রওনা হবার আগেই। ব্যাকুল চেহারা নিয়ে হনহন করে এগোল তারা। লেডি ফ্ল্যামবোরোর ভিআইপি প্যাসেঞ্জারদের চিনতে পেরে আনন্দে নাচতে ইচ্ছে করল ওদের।
পরম স্বস্তিবোধ বিস্ময়ে পরিণত হলো যখন তারা জানতে পারল যে বন্দি আতঙ্কবাদী লোকটা আর কেউ নয়, তাদের পরিচিত নামার সদস্য রুডি গান।
এগিয়ে এসে কর্নেলের কাঁধে একটা হাত রাখলেন সিনেটর পিট। অবাক হয়ে বললেন, তোমাকে দেখে যে কী ভালো লাগছে!
দুঃখিত, দেরি করে ফেলেছি। তোতলে বললেন কর্নেল।
এগিয়ে এলেন হে’লা কামিল, কর্নেলকে আলিঙ্গ করলেন তিনি, তার পর প্রেসিডেন্ট হাসান ও প্রেসিডেন্ট লরেঞ্জোও আলিঙ্গন করলেন। এরপর রুডিকে আলিঙ্গন করার পালা, পাকা টমেটোর মতো লাল হয়ে উঠল সে।
আমাকে বলবেন, এখানে মূলত অবস্থাটা কী? রুডিকে জিজ্ঞেস করল কর্নেল।
খোঁচা দেওয়ার সুযোগটা ছাড়ল না রুডি। আপনি আমাদেরকে কঠিন একটা বিপদের মুখে ফেলে দিয়েছিলেন, কর্নেল হোলিস। খনিতে প্রায় বিশজন আতঙ্কবাদীকে দেখতে পাই আমরা, সাথে ছিল দ্বীপ থেকে পালানোর জন্য লুকানো একটা হেলিকপ্টার। কমিউনিকেশন সিস্টেমের সাথে গেঁথে নিতে আমাদেরকে আপনি যোগ্য মনে করেননি, কাজেই ছুটন্ত একটা ট্রেন পাঠিয়ে আপনাদেরকে সতর্ক করার চেষ্টা করে পিট।
মাথা ঝাঁকালো জন ডিলিঞ্জার। হেলিকপ্টারটাই ব্যাখ্যা করছে, মিসরীয়রা জাহাজ ছেড়ে কেন বেরিয়ে আছে।
ট্রেনটাকে নিয়ে যাবার জন্য লোক পাঠিয়েছিল ওরা, বলল রুডি। হেলিকপ্টারের কাছে পৌঁছানোর জন্য।
কর্নেল জানতে চাইল, আর সবাই কোথায়?
শেষ ওদের আমি দেখেছি ক্রাশিং মিলের ভেতর, বলল রুডিক্লিফ। জিম্মিদের সাথে মাত্র দু’জন গার্ড আছে দেখে পিটই তো আমাকে পাঠাল ওঁদেরকে উদ্ধার করার জন্য। ওরা তখন আতঙ্কবাদীদের সাথে গুলি বিনিময় করছিল।
চোখে সন্দেহ আর অবিশ্বাস নিয়ে রুডির দিকে ঝুঁকে পড়ল কর্নেল। আপনারা মাত্র চারজন পঁচিশ-তিরিশজনের মতো ট্রেনিং পাওয়া আতঙ্কবাদীকে ঘায়েল করেছেন, বলতে চান?
কাঁধ ঝাঁকাল রুডি। পিট আর অন্যরা আরবদের ঠেকিয়ে রাখছিল বেশ সফলতার সাথে।
আপনি শেষটা দেখে আসেনিনি, তাই না?
কিছু বলতে গিয়ে চুপ করে গেল রুডি।
একজনের বিরুদ্ধে প্রায় দশজন, বিড়বিড় করে বলল মেজর ডিলিঞ্জার।
শেষমেষ, হোলিন বললেন, চলো দেখা যাক, কী পাই ওখানে গিয়ে।
এগিয়ে এলেন সিনেটর পিট। কর্নেল, রুডি বলছে, খনিতে আমার ছেলে, পিটকে দেখে এসেছে ও। তোমার সাথে ওখানে আমি যেতে চাই।
দুঃখিত, সিনেটর। গোটা এলাকা দখলে না এনে ওদিকে ভিআইপি কাউকে আমি যেতে দিতে পারি না।
এক হাতে সিনেটরকে জড়িয়ে ধরল রুডি। ওদিকেটা আমি দেখব, স্যার। ডার্ককে নিয়ে চিন্তা করবেন না। আমাদের সবার চেয়ে বেশিদিন বাঁচবে ও।
কর্নেল অতটা আশাবাদী হতে পারল না। ওরা বোধ হয় কচুকাটা হয়ে গেছে, ডিলিঞ্জারের কানে কানে বলল সে।
সায় দিয়ে মাথা ঝাঁকানো জন ডিলিঞ্জার। সন্ত্রাসবাদীরা অভিজ্ঞ, সংখ্যায় সাত আট গুণ বেশি, মাত্র তিনজন লোক তাদের সাথে পারেই বা কীভাবে।
কর্নেলের সঙ্কেত পেয়ে তার লোকেরা ভূতের মতো নিঃশব্দে এগোল। কোনো তাড়াহুড়ো নেই, এক আড়াল থেকে বেরিয়ে আরেক আড়ালে পৌঁছুল, ভালো করে চারদিকে দেখে নিয়ে পরবর্তী আশ্রয়ের দিকে পা বাড়াল। যত এগোল, লাশের সংখ্যা ততই বাড়তে লাগল। ক্রাশিং মিলের বাইরে পাওয়া গেল তেরোটা মৃতদেহ।
ক্রাশিং মিল ভবনটা বুলেট আর গ্রেনেড বিস্ফোরণে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। একটা জানালাতেও কোনো কাঁচ নেই। প্রতিটি দরজা উড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
দেয়ালে তৈরি বিশাল একটা গর্ত দিয়ে ভেতরে ঢুকল কর্নেল, সাথে পাঁচজন লোক। এই সময় যেখানে মেইন ডোর ছিল, এখন সেখানে মুখ ব্যাদান করে আছে। বিশাল একটা গুহামুখ, সেটা দিয়ে ঢুকল জন ডিলিঞ্জার আরও কয়েকজনকে নিয়ে। চারদিক থেকে এখনও ধোয়া উঠছে, নিস্তেজ আগুন জ্বলছে এখানে-সেখানে।
মেঝেতে ছড়িয়ে রয়েছে লাশের স্তূপ। ওর-ক্রাশারের সামরে স্তূপটা সবচেয়ে বড়। একটার ওপর আরেকটা, লাশের গাদা গুনতে গিয়ে দুবার ভুল হলে কর্নেলের। চৌদ্দ, নাকি ষোলো? বিশাল ঘরটার ভেতর যেন একটা মহাযুদ্ধ ঘটে গেছে, অথচ অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা হেলিকপ্টারটা একদম নতুন আর ঝকঝকে দেখল, শুধু লেজের দিকটা বিধ্বস্ত হয়েছে ওটার।
বধ্যভূমিতে বেঁচে আছে শুধু তিনজন লোক। এতই রক্তাক্ত তারা, ধোঁয়া আর কালি মেখে এমনই ভূতের মতো দেখতে হয়েছে, কোনো মানুষ এ রকম করুণ আকৃতি পেতে পারে বলে বিশ্বাস হতে চাইল না কর্নেলের। একজন শুয়ে আছে মেঝেতে, তার মাথা আরেকজনের কোলের ওপর, দ্বিতীয় লোকটার একটা হাত রক্ত ভেজা স্লিংয়ে ঝুলছে। আরেকজন দাঁড়িয়ে আছে নিজের পায়ে; রক্ত ঝরছে পা, কাঁধ আর ঘাড়ের সংযোগস্থল, খুলির কিনারা আর মুখের পাশ থেকে।
একেবারে কাছে এসে ঝুঁকে পড়ার আগে ওদের কাউকে চিনতেই পারল না কর্নেল। বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে গেছে সে। ভেবে কূল পেল না, এই বিকৃত আকৃতি নিয়ে তিনজন লোক কীভাবে মনোবল বজায় রাখলো, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়ে কীভাবে পরাস্ত করল পেশাদার তিন ডজন খুনিকে।
এখানে সেখানে জড়ো হয়ে প্রশংসার দৃষ্টিতে চারদিকে চোখ বুলালো স্পেশাল ফোর্সের লোকজন। দুকান পর্যন্ত বিস্তৃত হলো রুডি গানের হাসি। কর্নেল হোলিস আর মেজর ডিলিঞ্জার দাঁড়িয়ে থাকল, একদম যেন বোবা।
তারপর ব্যথায় মুখ বিকৃত করে করে পুরোপুরি সিধে হলো পিট, বলল, ঠিক সময়েই পৌঁছেছেন আপনারা। কিছু করার থাকলে বলুন, আমাদের হাতে এই মুহূর্তে কোনো কাজ নেই।
.
চতুর্থ পর্ব – স্যামের রোমান সার্কাস
২৭ অক্টোবর, ১৯৯১, ওয়াশিংটন, ডি সি
৬২.
ডেইল নিকোলাস ও মারটিন ব্রোগান হোয়াইট হাউসের ভেতর সিঁড়ির একটা ধাপে দাঁড়িয়ে আছেন, হেলিকপ্টার থেকে নেমে সবুজ লনের ওপর দিয়ে ওঁদের দিকে হেঁটে এলেন প্রেসিডেন্ট। আমার জন্য কিছু আছে নাকি? করমর্দনের সময় জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
উত্তেজনা চেপে রাখতে ব্যর্থ হলেন ডেইল নিকোলাস। জেনারেল ডজের কাছ থেকে এইমাত্র একটা মেসেজ পেয়েছি আমরা। তার স্পেশাল অপারেশনস ফোর্স, দক্ষিণ চিলি থেকে অক্ষত অবস্থায় পুনরুদ্ধার করেছে লেডি ফ্ল্যামবোরোকে। সিনেটর পিট, হে’লা কামিল, প্রেসিডেন্ট হাসান ও দো লরেঞ্জো, সবাই তারা ভালো আছেন।
অটোয়ায় কানাডিয়ার প্রাইম মিনিস্টারের সাথে পরপর কয়েকটা বৈঠক করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন প্রেসিডেন্ট, তবু মেঘ থেকে বেরিয়ে আসা চাঁদের মতো উদ্ভাসিত হয়ে উঠল তার চেহারা। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। দারুণ ভালো খবর। কেউ হতাহত হয়নি তো?
স্পেশাল ফোর্সের কয়েকজন আহত হয়েছে, সিরিয়াস নয়। তবে নুমার তিনজন সদস্য শরীরের এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে আঘাত পায়নি, রিপোর্ট করলেন মার্টিন ব্রোগান।
নুমা দৃশ্যপটে ছিল নাকি?
প্রমোদতরী লেডিকে খুঁজে বের করেছে ডার্ক পিট। তিনজন সঙ্গীকে নিয়ে আতঙ্কবাদীদের বাধা দেয় সে, ফলে নিয়ে পালাতে পারেনি তারা।
তো, বাপকে নিজেই উদ্ধার করল বেটা।
দুই তালু একসাথে ঘষে মনের আনন্দ প্রকাশ করলেন প্রেসিডেন্ট।
প্রায় দুপুর হয়ে গেছে, জেন্টলমেন। লাঞ্চের আগে আমরা কেন একটা বোতল খুলে ওয়াইন পান করি না? সেই সুযোগে পুরো ঘটনাটাও শোনা যাবে।
.
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ডগলাস ওটস, প্রেসিডেন্টের ন্যাশনাল সিকিউরিটি উপদেষ্টা অ্যালান মারসিয়ার ও জুলিয়াস শিলারও যোগ দিলেন লাঞ্চে। লাঞ্চ শেষ করে ফল ও মিষ্টি খাছেন সবাই, জেনারেল ডুজের পাঠানো একটা রিপোর্ট প্রেসিডেন্টের সামনে টেবিলের ওপর রাখলেন অ্যালান মারসিয়ার!
পড়ার সময় হাতের ফর্কটা সারাক্ষণ নাড়াচাড়া করলেন প্রেসিডেন্ট। তারপর তিনি মুখ তুললেন, একাধারে আনন্দ ও বিস্ময় ফুটে উঠল চেহারায়। টপিটজিন।
ব্যাটারটার সাথে পুরোপুরি জড়িত সে, মার্টিন ব্রোগান বললেন : জেনারেল ব্রাভো আর মেক্সিকান আতঙ্কবাদীদের সে-ই তো পাঠিয়েছে।
তার মানে দুই ভাই আলোচনা করে লেডি ফ্ল্যামবোরোকে হাইজ্যাক করেছিল, বললেন প্রেসিডেন্ট।
মাথা ঝাঁকিয়ে ডেইল নিকোলাস বললেন, তবে ব্যাপারটা প্রমাণ করা সহজ হবে না।
অপারেশনের পেছনে মাস্টারমাইন্ড কে, তার পরিচয় জানা গেছে।
লোকটার ওপর আমরা একটা ফাইল তৈরি করেছি, মারটিন ব্রোগান জানালেন। ফাইলটা তিনি বাড়িয়ে দিলেন প্রেসিডেন্টের সামনে। হাইজ্যাক করার পর ক্যাপটেনের ছদ্মবেশ নিয়েছিল, তারপর মুশোখ পরে। তবে পিট তার চেহারা দেখেছে। সে তার নাম জানিয়েছে সুলেমান আজিজ ওমর।
জুলিয়াস শিলার বললেন, লোকটা সম্পর্কে যা শুনেছি, মনে হয় না ওটা তার আসল নাম।
মার্টিন ব্রোগান মাথা নাড়লেন। আসল বলেই মনে হয়। তার অতীত ইতিহাসও উদ্ধার করতে পেরেছি আমরা। ইন্টারপোলও তাকে এ-নামে চেনে। সুলেমান আজিজ নিশ্চিতভাবে ধরে নিয়েছিল, মি, পিট মারা যাচ্ছেন, তাই নামটা প্রকাশ করতে দ্বিধা করেনি সে।
ছোট হলো প্রেসিডেন্টের চোখ জোড়া। ফাইলে দেখছি, সরাসরি ও পরোক্ষভাবে পঞ্চাশটার ওপর খুনের সাথে জড়িত লোকটা, তার বেশির ভাগ শিকার খ্যাতনামা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। এ কীভাবে সম্ভব?
এই পেশায় ও সবার সেরা।
অকুতোভয় আতঙ্কবাদী।
আততায়ী, সংশোধন করলেন মারটিন ব্রোগান। সুলেমান আজিজ শুধু রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডে অভ্যন্ত। কোল্ড-ব্লাডেড মার্ডারার বলতে যা বোঝায়, সে তাই। গানটা আপনারা সবাই শুনেছেন, তাই না… নো বডি ডাজ ইট বেটার। বেশির ভাগ হত্যাকাণ্ড এত নিখুঁত যে দুর্ঘটনা বলে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। মুসলমান হলেও ফ্রেঞ্চ, জার্মান, এমনকি ইসরায়েলিদের হয়েও ভাড়া খাটে সে। তার পেশায় সে-ই সবচেয়ে বেশি টাকা পায়।
ধরা পড়েছে?
না, স্যার, স্নান গলায় বললেন মার্টিন ব্রোগান। নিহত বা আহতদের মধ্যে পাওয়া যায়নি তাকে।
পালিয়েছে? তীক্ষ্ণ কণ্ঠে জানতে চাইলেন প্রেসিডেন্ট।
এখনও যদি বেঁচে থাকে, বেশি দূর পালাতে পারেনি, তাকে আশ্বস্ত করলেন মারটিন ব্রোগান। ডার্ক পিটের ধারণা, তিনি অন্তত তিনটে বুলেট ডুবিয়েছেন তার শরীরে। অত্যন্ত জোরাল ম্যানহান্ট-এর আয়োজন করা হয়েছে, ওই দ্বীপ থেকে পালানো কারও পক্ষে সম্ভব নয়। তাকে আমরা কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ধরতে পারব।
তাকে দিয়ে যদি কথা বলানো যায়, রীতিমতো একটা ইন্টেলিজেন্স বিপ্লব ঘটে যাবে, প্রেসিডেন্ট বললেন।
সন্ত্রাসবাদীদের আর কেউ বেঁচে নেই?
আটজনকে ইন্টারোগেট করা যাবে, তবে তারা শুধু সুলেমান আজিজের ভাড়া করা মার্সেনারি, ইয়াজিদের ফ্যানাটিক অনুসারী নয়।
সুলেমান আজিজ যে আখমত ইয়াজিদ আর টপিটজিনের হয়ে কাজ করছিল সেটা প্রমাণ করার জন্য ওদের স্বীকারোক্তি দরকার হবে আমাদের, বললেন প্রেসিডেন্ট, তবে মোটেও আশাবাদী বলে মনে হলো না তাকে।
জুলিয়াস শিলার হতাশ হতে রাজি নন। ভালো দিকও কম নয়, মি, প্রেসিডেন্ট। জাহাজ ও জিম্মিদের অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট হাসান জানেন, আখমত ইয়াজিদই তাকে খুন করার চেষ্টা করেছিল। অস্তিত্ব রক্ষার জন্য এখন তিনি শয়তানটার বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লাগবেন।
অ্যালান মারসিয়ার সায় দিয়ে বললেন, প্রেসিডেন্ট হাসানকে গোবেচারা মনে করার কোনো কারণ নেই, তার সাথে কেউ বেঈমানি করলে কীভাবে সত্যিকার নোংরা হতে হয় তিনি জানেন।
ডগলাস ওটস্ ঘন ঘন মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, হাসান হয়তো বিদ্রোহের অভিযোগে ইয়াজিদের বিচার করার ঝুঁকি নেবেন না, কারণ তাতে দাঙ্গা বেঁধে যেতে পারে। তবে ইয়াজিদের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করার জন্য খুন ছাড়া বাকি সব কিছুই করবেন তিনি।
আখমত ইয়াজিদের রাজনৈতিক জীবন ধ্বংস করার জন্য সেটা যথেষ্ট হবে, ভবিষ্যদ্বাণী করলেন মারটিন ব্রোগান। মিসরে মৌলবাদীদের মধ্যেও দুটো ভাগ আছে, বেশির ভাগই মধ্যপন্থী, সন্ত্রাস পছন্দ করে না। সব ফাঁস হয়ে গেলে ইয়াজিদের দিকে পেছন ফিরবে তারা, ওদিকে প্রেসিডেন্ট হাসান পার্লামেন্ট থেকে পেয়ে যাবেন বিপুল সমর্থন। সামরিক বাহিনীও আইভরি টাওয়ার থেকে নেমে এসে আবার হাসানের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করবে।
ওয়াইনের গ্লাসে শেষ একটা চুমুক দিয়ে প্রেসিডেন্ট বললেন, শুনতে ভালোই লাগছে, স্বীকার করছি।
স্বরাষ্ট্রসচিব ওটস্ খুক করে কেশে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন।
গম্ভীর সুরে বললেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে না, এ প্রতিশ্রুতি কেউ কামরা দিতে পারি না। হয়তো কিছু সময়ের জন্য চাপা পড়ে যাবে ইয়াজিদের বিষয়টা, কিন্তু হাসানের অনুপস্থিতির সময়টাতে মৌলবাদী দলগুলো লেবার পার্টির সাথে একজোট হয়েছে। আমার ধারণা, হাসানের সরকার উচ্ছেদের পেছনে কাজ করবে এরা। আমার লোকেরা মনে করছে, আঠেরো থেকে চব্বিশ মাসের মধ্যে শান্তিপূর্ণ অভ্যুত্থান ঘটেতে যাচ্ছে মিসরে। আমার পরামর্শ হলো, আমরা বরঞ্চ হাত গুটিয়ে অপেক্ষা করি, মি. প্রেসিডেন্ট। অন্য কারো কথা ভাবি।
টেবিলে নিস্তব্ধতা নেমে এল।
প্রথম নড়ে উঠলেন প্রেসিডেন্ট, তাঁর ভ্রু প্রশ্নবোধক চিহ্নের মতো কুঁচকে আছে। কার কথা ভাবছ তুমি?
মিসরের প্রতিরক্ষামন্ত্রী আবু হামিদ।
তোমার ধারণা, তিনি ক্ষমতা দখল করবেন?
উপযুক্ত সময়ে, হ্যাঁ, ভরাট গলায় ব্যাখ্যা করলেন ডগলাস ওটস্। তার হাতে রয়েছে সামরিক বাহিনীর শক্তি। নরম ও মধ্যপন্থী মুসলিম মৌলবাদীদের সমর্থন আদায়ের জন্যও কৌশলে চেষ্টা করে যাচ্ছেন তিনি।
তা যদি ঘটেও অর্থাৎ আবু হামিদ যদি ক্ষমতা দখল করেন, বললেন মারটিন ব্রোগান, আমেরিকার স্বার্থে বিঘ্ন ঘটবে বলে আমি মনে করি না। মিসরে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছি আমরা, আর অনেকের মতো তিনিও তার কিছুটা ভাগ পাবার চেষ্টা করেননি, এমন নয়। মৌলবাদীদের শান্ত করার জন্য তিনি হয়তো মাঝে-মধ্যে আমেরিকাকে গালিগালাজ করবেন, তবে আমাদের সাথে সম্পর্ক ভালো না রেখে তার উপায় নেই।
ডেইল নিকোলাস বললেন, তাছাড়া, হে’লা কামিলের সাথে তার সুসম্পর্ক আমাদের জন্য সুসংবাদ।
হাতের গ্লাসটা উঁচু করে ধরলেন প্রেসিডেন্ট। মিসরের সাথে অব্যাহত বন্ধুত্বের উদ্দেশ্যে।
হিয়ার হিয়ার, অ্যালান মারসিয়ার ও মারটিন ব্রোগান একযোগে বলে উঠলেন।
মিসরের উদ্দেশ্যে, বিড়বিড় করলেন ডগলাস ওটস্।
এবং মেক্সিকোর উদ্দেশ্যে, জুলিয়াস শিলার নিজের গ্লাস উঁচু করলেন।
হাতঘড়ির ওপর চোখ বুলিয়ে চেয়ার ছাড়লেন প্রেসিডেন্ট, তার সহকর্মী ও উপদেষ্টারাও দাঁড়ালেন। বৈঠক ছোট করে আনার জন্য দুঃখিত, তবে ট্রেজারি। কর্মকর্তাদের সাথে জরুরি মিটিং আছে আমার। জিম্মিদের যারা উদ্ধার করেছেন, তাদের সবাইকে আমার অভিনন্দন জানাবেন। ওটস্-এর দিকে ফিরলেন তিনি। ফেরা মাত্র সিনেটর পিটের সাথে দেখা করতে চাই আমি, সাথে তুমিও থাকবে।
প্রেসিডেন্ট হাসানের সাথে তাঁর কী কথা হলো জানতে চান, মি. প্রেসিডেন্ট?
আমি বরং শুনতে আগ্রহী প্রেসিডেন্ট লরেঞ্জোর সাথে তার কী কথাবার্তা হলো। আমাদের দক্ষিণ সীমান্তে একটা সঙ্কট মাথাচাড়া দিচ্ছে, কেউ যেন অবহেলা না করি। মিসর আমাদের দ্বিতীয় সমস্যা, প্রথম সমস্যা মেক্সিকো। আখমত ইয়াজিদকে মোটামুটি একটা ব্যবস্থা হয়েছে। এখনও বিপজ্জনক হুমকি হয়ে রয়েছে টপিটজিন। তার ওপর নজর দিন, জেন্টলমেন। মেক্সিকোকে যদি শান্ত করতে না পারি, সামনে খারাপ দিন আসছে।
.
৬৩.
ধীরে ধীরে ঘুম ভেঙে অচৈতন্য অন্ধকার জগত থেকে চৈতন্যের আলোকিত জগতে প্রবেশ করল পিট। সারা শরীরে আড়ষ্ট ভাব আর ব্যথা অনুভব করে ইচ্ছে হলো আবার ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু নড়ে উঠে আপনা থেকেই খুলে গেল চোখের পাতা, পুরোপুরি সচেতন হয়ে উঠল ও। দেখল হাসিখুশি লাল একটা মুখ ঝুঁকে রয়েছে ওর মুখের ওপর।
দারুণ, দারুণ-উনি জ্যান্ত প্রাণিজগতে ফিরে এসেছেন। খুশিমনে চিৎকার করল ফাস্ট অফিসার মাইকেল ফিনি। যাই, ক্যাপটেনকে খবরটা দিই।
মাইকেল ফিনি দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাবার পর মাথা না ঘুরিয়ে এদিক-ওদিক তাকাল পিট। কাছেই একটা চেয়ারে বসে নিঃশব্দে হাসছেন এক ভদ্রলোক। চিনতে পারল ও, জাহাজের ডাক্তার। দুঃখিত, ডাক্তার সাহেব, আপনার নামটা আমার মনে পড়ছে না।
হেনরি ওয়েবস্টার, সহাস্যে বললেন ভদ্রলোক। কোথায় রয়েছেন বলুন তো? লেডি ফ্ল্যামবোরোর সবচেয়ে সুন্দর স্যুইটে। সাউন্ডার টো করে নিয়ে যাচ্ছে লেডি ফ্ল্যামবোরোকে, পান্টা অ্যারেনাসে পৌঁছুতে খুব বেশি দেরি নেই?
ধন্যবাদ, ডাক্তার সাহেব, কতক্ষণ ঘুমিয়েছি আমি?
কর্নেল হোলিসের সাথে আপনি কথা বলছিলেন, আমি আপনার ক্ষতগুলো পরীক্ষা করছিলাম। একটু পরই ইঞ্জেকশন দিয়ে ঘুম পাড়াই আপনাকে। হাতঘড়ি দেখলেন ডাক্তার। বারো ঘণ্টা।
তাই তো বলি, পেট চোঁ চোঁ করছে কেন!
চেয়ার ছাড়লেন ভদ্রলোক। আপনাকে পরিবেশনের জন্য তৈরি হয়ে আছে শেফ,
আমার বন্ধুরা কেমন আছে? জিজ্ঞেস করল পিট। জিওর্দিনো আর ফিনলে?
শরীর থেকে চারটে বুলেট বের করা হয়েছে, তবে তার কোনো অঙ্গহানি ঘটেনি, সেরে উঠতে খুব বেশি সময় নেবে না। ফিনলের ফুসফুস আর কিডনির কাছাকাছি আটকে আছে কয়েকটা বুলেট। যতটুকু করা সম্ভব করা হয়েছে, ওয়াল্টার রিড মেডিকেল সেন্টারে তার অপারেশন করা হবে।
পিটকে ইঞ্জেকশন দিয়ে ঘুম পাড়াবার পরপরই হেলিকপ্টারে তুলে পাল্টা অ্যারেনাসে পাঠানো হয় জিওর্দিনো আর ফিনলেকে, একট প্লেন তাদেরকে ওয়াশিংটনে নিয়ে গেছে। পিটের চেয়ে ওদের দু’জনের অবস্থা খারাপ, তাই ওদের সাথে রুডি গেছে।
কথা শেষ করে পিটের মুখে একটা ডিজিটাল থার্মোমিটার গুঁজে দিলেন হেনরি ওয়েবস্টার। রিডিংয়ে চোখ বুলিয়ে খুশি হয়ে উঠলেন তিনি। জ্বর নেই। প্রায় সেরে উঠেছেন বলা যায়। কেমন বোধ করছেন?
এক্ষুনি ম্যারাথনে যোগ দিতে পারব না, স্লান হাসল পিট। তবে বাড়িতে ডাকাত পড়লে ধাওয়া করতে পারব।
আপনি আসলে ভাগ্যবান, বললেন ওয়েবস্টার। একটা বুলেটও বোন, আর্টারি বা ইন্টারনাল অরগান স্পর্শ করেনি। আপনার ঘাড় আর পা সেলাই করে দিয়েছি আমি। চোয়ালের উপরটাও। তবে ওখানে প্লাস্টিক সার্জারি লাগবে, যদি না দাগটাকে বিউটি স্পট হিসেবে রেখে দিতে চান-অনেক মেয়ে কিন্তু পছন্দ করে।
হাসল পিট, সাথে সাথে আড়ষ্ট হয়ে উঠল ব্যথায়।
উদ্বিগ্ন হলেন ডাক্তার। দুঃখিত। বিছানার পাশে রসিকতা না করে আমি থাকতে পারি না।
পেশি ঢিল করল পিট, ধীরে ধীরে ব্যথা গেল।
ওঁরা সবাই অপেক্ষা করছেন, বলে ইঙ্গিতে দরজাটা দেখিয়ে দিলেন ওয়েস্টার। আমি তাহলে যাই এখন।
ধন্যবাদ, ড. ওয়েবস্টার।
চোখ মটকে মাথা ঝাঁকালেন ভদ্রলোক, দরজার কাছে পৌঁছে কবাট খুলে সরে দাঁড়ালেন একপাশে। হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকে পড়লেন সবাই।
প্রথমে ঢুকলেন সিনেটর পিট। তার পেছনে হে’লা কামিল, কর্নেল হোলিস ও ক্যাপটেন কলিন্স।
হে’লা চুমো খেল ওর কপালে।
আশা করি, আমার জাহাজে আপনার সেবা-যত্নের কোনো ত্রুটি হচ্ছে না, মি. পিট? জানতে চাইলেন কলিন্স।
স্বর্গে আছি, ক্যাপটেন…, শুরু করল পিট।
আর মাত্র নব্বই মিনিটের জন্য, ভারী গলায় বললেন সিনেটর পিট। তুমি, আমি আর মিস কামিল পান্টা অ্যারেনাস থেকে এয়ারফোর্সের একটা প্লেনে করে ওয়াশিংটন যাচ্ছি।
ওঁরা ভেতরে ঢোকার পর এক মিনিটও পেরোয়নি, নিজের গরজেই কাজের কথা পাড়ল কর্নেল হোলিস। সুলেমান আজিজকে আবার দেখলে আপনি চিনতে পারবেন, মি. পিট?
পারব, সংক্ষেপে বলল পিট। কেন, ঘুমিয়ে পড়ার আগে আপনাকে তো আমি সুলেমান আজিজের চেহারা সম্পর্কে বলছি। সে ধরা পড়েনি?
কর্নেল হোলিস ওর হাতে কয়েকটা ফটো ধরিয়ে দিল। জাহাজের ফটোগ্রাফার তুলেছে এগুলো, বন্দি ও নিহত হাইজ্যাকাদের লাশ। দেখুন তো, এদের মধ্যে আল সুলেমান আজিজ আছে কি না?
ফটোগুলো মনোযোগ দিয়ে দেখল নারা। না, নেই।
নিঃশব্দে আরও একটা ফটো পিটের দিকে বাড়িয়ে দিল কর্নেল। এটা দেখুন।
অন্যগুলোর চেয়ে আকারে বড় ফটোটা। একবার চোখ বুলিয়েই মুখ তুলল পিট। কী শুনতে চান আপনি?
ফটোর লোকটা কি সুলেমান আজিজ?
কর্নেলের হাতে ফটোটা ফিরিয়ে দিল পিট। আপনি খুব ভালো করেই জানেন, ওটা সুলেমান আজিজের ফটো। তা না হলে এমন নাটকীয় ভঙ্গিতে আমাকে দেখাতেন না।
হোলিস আসলে চেপে রাখার চেষ্টা করছে যে, বললেন সিনেটর, মৃত বা জীবিত সুলেমান আজিজকে এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি।
জেনারেল ফ্রাঙ্ক ডজ সুলেমান আজিজকে এই ফটোটা রেডিওতে পাঠিয়েছেন, বলল কর্নেল। আমার পরবর্তী অ্যাসাইনমেন্ট তাকে খুঁজে বের করা।
ধরা যখন পড়েনি, বলল পিট, নিশ্চয়ই তার লোকজন তাকে দ্বীপে কোথাও কবর দিয়েছে। লক্ষ্য ব্যর্থ হয়নি আমার। কাঁধে আর মুখে তিনটে গুলি লেগেছে। পড়ে যাবার পর তাকে নিরাপদ আড়ালে টেনে নিয়ে গেছে এক লোক। হাচার ক্ষমতা তার ছিল না।
মরে গিয়ে না থাকলে সুলেমান আজিজ আপনার জন্য একটা দুঃসংবাদ, মি. পিট, শান্ত গলায় বলল কর্নেল। কারণ, তা না হলে, সে তার পরবর্তী খুনের তালিকায় সবার উপরে লিখবে-ডার্ক পিট।
ডার্ক অত্যন্ত দুর্বল, দুহাত দুদিকে বাড়িয়ে পিটকে যেন আগলানোর চেষ্টা করলেন হে’লা কামিল। ভালো খাবার দরকার ওর, বিশ্রাম দরকার। মাত্র এক ঘণ্টার মতো সময় আছে, আমাদের উচিত ওকে একটু একা থাকতে দেয়া।
ফটোগুলো এনভেলাপে ভরে পিটের দিকে তাকাল কর্নেল। পিটের দিকে একটা হাত বাড়াল সে।
তাহলে এক্ষুনি আপনাকে শুভেচ্ছা জানাতে হয়, মি. পিট। সুলেমান আজিজকে খোঁজার জন্য সান্টা ইনেজ দ্বীপে যেতে হবে আমকে, একটা হেলিকপ্টার অপেক্ষা করছে।
মেজর ডিলিঞ্জারকে আমার ধন্যবাদ জানাবেন, বলল পিট।
জানাব। এক মুহূর্ত ইতস্তত করল কর্নেল, যেন অস্বস্তি বোধ করছে, তারপর বলল, আপনার ও আপনার বন্ধুদের কাছে আমি ক্ষমাপ্রার্থী, মি. পিট। খুবই দুঃখের বিষয় আপনাদেরকে আমি ছোট করে দেখেছিলাম। যদি কখনও নুমা থেকে স্পেশাল অপারেশনস ফোর্সে বদলি হতে চান, আইন বাধা না হলে, সবার আগে আমি সই করব সুপারিশে।
আমি ঠিক যোগ্য বলে বিবেচিত হব না, নিঃশব্দে হাসল পিট। ওই যে, অ্যালার্জি আছে-কারও হুকুম মানতে পারি না।
হ্যাঁ, তা আপনি প্রমাণ করেছেন, ক্ষীণ হেসে বলল কর্নেল।
পিটের ঘাড়ের ওপর প্রায় চড়াও হয়ে সিনেটর পিট জানালেন, তোমার সাথে ডেকে দেখা হচ্ছে আমার।
আমিও আপনাকে ওখানে বিদায় জানাব, বললেন কলিন্স।
হে’লা কামিল কিছুই বললেন না। দুদিকে দুহাত মেলে দিয়ে তিনি সবাইকে প্রায় তাড়িয়ে নিয়ে গেলেন দরজার দিকে। সুইট থেকে ওরা বেরিয়ে যাবার পর দরজাটা বন্ধ করে দিলেন তিনি, ফিরে এসে বিছানার পাশে দাঁড়ালেন।
একটা জিনিস দেওয়ার আছে আমার, ফিসফিস করে বললেন তিনি, স্কুলে পড়া মেয়ের মতো দুষ্টামিভরা হাসি খেলে গেল আয়ত চোখে।
পিট ভাবে, সেলাই কেটে গেলে ডাক্তার ওয়েবস্টার ওকে কাঁচা গিলে খাবে।
জ্ঞান ফেরার পর চারদিকে অন্ধকার দেখতে পেল সুলেমান আজিজ। তার কাঁধে যেন জ্বলন্ত একটুকরো কয়লা চেপে ধরা হয়েছে। হাত দুটো মুখে তোলার চেষ্টা করল সে, একটা হাত যেন বিস্ফোরিত হলো অসহ্য ব্যথায়। তারপর মনে পড়ল, কাধ আর কবজিতে বুলেট ঢুকেছে। অক্ষত হাতটা তুলল বটে, কিন্তু চোখের জায়গায় শক্ত করে বাধা কাপড়ে ঠেকলো আঙুলগুলো। চোখ, কপাল, মাথা, সবই ব্যান্ডেজে মোড়া।
জানে, চোখ দুটো রক্ষা পাবে না। অন্ধ হয়ে বেঁচে থাকা … না, সে তা মানবে না। যেকোনো একটা অস্ত্র দরকার তার। হাতড়াতে শুরু করল। আত্মহত্যা করা ছাড়া পথ নেই।
স্যাঁতসেঁতে, ঠাণ্ডা পাথুরে মেঝে ছাড়া কিছুই ঠেকল না হাতে।
বেপরোয়া হয়ে উঠল সুলেমান আজিজ, অসহায় জীবনকে সে ভীষণ ভয় করে। টলমল করতে কতে দাঁড়াল সে, কিন্তু পড়ে গেল। এই সময় তার দুই কাঁধ আঁকড়ে ধরল একজোড়া হাত।
নড়াচড়া করবেন না, হযরত। আওয়াজ করলে আমরা ধরা পড়ে যাব, ইবনের ফিসফিসে গলা। আমেরিকানরা আমাদেরকে হন্যে হয়ে খুঁজছে।
আশ্বস্ত হবার জন্য ইবনের হাত দুটো শক্ত করে খামচে ধরল সুলেমান আজিজ। কথা বলার চেষ্টা করল সে, কিন্তু অর্থপূর্ণ কোনো আওয়াজ বেরোলো না গলা থেকে। আহত পশুর মতো গুঙিয়ে উঠল সে। ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছে তার চোয়াল, রক্ত জমাট বেঁধে আছে গলার ভেতর আর দাঁতের গোড়ায়।
মাইন টানেলের ভেতর, ছোট একটা চেম্বারে রয়েছি আমরা, নিচু গলায় বলল ইবনে। ওরা খুব কাছাকাছি চলে এসেছিল, তবে তার আগেই একটা দেয়াল গেঁথে ফেলেছি আমি।
মাথা ঝাঁকাল সুলেমান আজিজ, ইবনের কথা বুঝতে পারছে সে।
ইবনে যেন তার মরে কথা টের পেলে গেছে। আপনি মরতে চান, হযরত? না, তা হতে পারে না। কাজ শেষ না করে, আপনি বা আমি, দু’জনের একজনও মরব না। একসাথে যাব আমরা, তবে আল্লাহ যখন চাইবেন তার এক মিনিটও আগে নয়।
হতাশায় নেতিয়ে পড়ল সুলেমান আজিজ। আগে কখনও এমন উদভ্রান্ত হয়নি সে। নিজের ওপর তার এক ফোঁটা নিয়ন্ত্রণ নেই। ব্যথায় পাগল হয়ে যাচ্ছে সে। তার ওপর দুঃস্বপ্নটা থেকে বেরোতে পারছে না-জেলখানার সেলে কড়া পাহারায় আটকে রাখা হয়েছে তাকে, পঙ্গু ও অন্ধ।
মনটাকে শান্ত করুন, জনাব, তার কানে কানে নরম সুরে বলল ইবনে দ্বীপ থেকে পালানোর সময় আপনার সবটুকু শক্তি দরকার হবে।
পাশ ফিরল সুলেমান আজিজ। টানেলের মেঝেতে কোথাও কোথাও পানি রয়েছে, কাঁধের ক্ষতটা ডুবে যাওয়ায় ঠাণ্ডা আরাম লাগল। না চাইলেও, চোখের সামনে ছবির মতো একের পর এক ভেসে উঠল ভীতিকর কয়েকটা দৃশ্য। ঠোঁটে ক্ষীণ হাসি নিয়ে তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ছে ডার্ক পিট। সে দেখতে পেল, তার সামনে পাহাড়ের মতো দৈর্ঘ্য নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে আখমত ইয়াজিদ, তাকে ভেংচাচ্ছে। আক্রোশে চিৎকার করতে ইচ্ছে হলো তা-তুমি আমার সাথে বেঈমানি করেছ। হঠাৎ এক ঝলক আলো দেখতে পেল সুলেমান আজিজ। সেই আলোয় মরে চোখে ধরা পড়ল ভবিষ্যৎ।
মৃত্যু সমাপ্তি নয়। মৃত্যুর পর মানুষের কীর্তি বেঁচে থাকে। সে বেঁচে থাকবে প্রতিশোধের মধ্য দিয়ে। আমি প্রতিশোধের মধ্যে বেঁচে থাকব, কথাটা মনে মনে আওড়াতে শুরু করল সে। একসময় সু-সংহত হরো আর চিন্তাধারা, মানসিক সুস্থতা প্রায় পুরোটাই ফিরে এল।
যে সিদ্ধান্তটা নিতে চেষ্টা করল সুলেমান আজিজ, সেটা হচ্ছে; তার নিজের হাতে প্রথমে কে মারা যাবে-পিট, নাকি আখমত ইয়াজিদ? একা তার পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়। দু’জনকে খুন করার মতো শারীরিক সামর্থ্য তার নেই। ধীরে ধীরে একটা প্ল্যান তৈরি হতে লাগল মাথার ভেতর। প্রতিশোধের ভাগ দিতে হবে ইবনেকেও।
ব্যাপারটা পছন্দ না হলেও, শেষ পর্যন্ত নিজের সাথে আপস করল সুলেমান আজিজ।
কয়োট আর সাপ-দু’জনের একজনকে নিজ হাতে হত্যা করবে সে। বাকি একজন মারা যাবে ইবনের হাতে।
.
৬৪.
স্ট্রেচারে শুয়ে আকাশভ্রমণে রাজি হয়নি পিট। আরামদায়ক একটা এক্সিকিউটিভ চেয়ারে বসে আছে ও, পা তুলে দিয়েছে প্লেনের একটা সিটের ওপর। জানালা দিয়ে চকচকে আন্দিজ পর্বতমালা দেখছে সে। কিছু সময় পর ক্যারিবিয়ান সাগরের ওপর দিয়ে উড়ে যেতে লাগল তারা।
ছোটখাটো বিমানে দীর্ঘদেহী পিটের এমনকি দাঁড়ানোর সুযোগ নেই। আরাম আয়েশের কোনো ব্যবস্থার অবশ্য কমতি নেই।
পিটের বাবা ঠিক কথা বলার মুডে নেই। ভ্রমণের বেশির ভাগ সময় একটা ব্রিফকেস খুলে প্যাডে নোট লিখতে ব্যস্ত থাকলেন সিনেটর পিট।
লেডি ফ্ল্যামবোরোর উনি কীভাবে গেলেন, পিটের এই প্রশ্নের জবাব দেয়ার সময় মুখ তুলে তাকালেন না। প্রেসিডেন্ট আমাকে একটা কূটনৈতিক দায়িত্ব দিয়েছিলেন।
নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকলেন হে’লা কামিলও। প্লেনের ইনফ্লাইট টেলিফোনটা সারাক্ষণ দখল করে রাখলেন তিনি, জাতিসংঘের নিউ ইয়র্ক বিল্ডিংয়ে তার এইডদের একের পর এক নির্দেশ দিয়ে গেলেন। পিটের উপস্থিতি সম্পর্কে তাঁকে সচেতন মনে হলো শুধু চোখাচোখি হবার সময়, প্রতিবার ছোট্ট করে হাসলেন।
কত দ্রুত ওরা ভুলতে পারে- দীর্ঘশ্বাস পেলে পিট ভাবে।
অগত্যা আলেকজান্দ্রিয়া গুপ্তধন নিয়ে চিন্তা করতে লাগল সে। হে’লা কামিল ফোনটা ছালে হেনরি ইয়েজারের সাথে কথা বলতে পারত ও। লাইব্রেরিটা সে খুঁজে পেল কি না কে জানে। তারপর ইচ্ছেটা বাতিল করে দিল, সশরীরে উপস্থিত হয়েই জানা যাবে সব।
আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরির অমূল্য সম্পদগুলো লুকানোর আগে কোনো নদী পাড়ি দিয়েছিলেন ভেনাটর? ইয়েজারের ধারণা, আজ যেটাকে নিউ জার্সি বলা হচ্ছে, সেখানে মেরামত করা হয়েছে সেরাপিসকে। অচেনা নদীটা দক্ষিণে হতে বাধ্য।
জাহাজ বহর নিয়ে গালফ অব মেক্সিকোয় পৌঁছেছিলেন ভেনাটর, সম্ভব? আজ যে স্রোত বইছে, ষোলোশো বছর আগের থেকে নিশ্চই আলাদা। এমন কি হতে পারে না, ভেনিজুয়েলার এরিনকোতে নেমেছিলেন ভেনাটর। নাকি আমাজন?
বেচারা এরিকসন ও কলম্বাসের নাম নেমে আসবে ফুটনোটে।
এনড্রস এয়ারফোঁস বেস্-এ নামল প্লেন। অ্যালুমিনিয়াম টিউবের ভেতর দিয়ে পিটকে নিয়ে নিচে নেমে এল হুইল লাগানো চেয়ারটা। সিঁড়ি বেয়ে নামলেন হে’লা কামিল, পিটকে শুভেচ্ছা জানাবেন। তাকে নিয়ে নিউ ইয়র্ক যাবে প্লেনটা। পিটের কাঁধে একটা হাত রেখে ভদ্রমহিলা বললেন, আমার জীবনে অত্যন্ত উজ্জ্বল একটা স্মৃতি হয়ে থাকবেন আপনি, ডার্ক পিট।
ডিনার খাওয়ার কথাটা কিন্তু বেমালুম ভুলে গেছেন।
সময় করে কায়রোতে একবার আসুন না, প্লিজ। আগেই বলে রাখছি, বিল কিন্তু আমি দেব।
ওদের কথা শুনতে পেয়ে এগিয়ে এলেন সিনেটর পিট। কায়রো, মিস কামিল, নিউ ইয়র্ক নয়?
হে’লা কামিলের নয়, হাসিটা যেন রানী নেফারতিতির। বললেন, না, নিউ ইয়র্কে নয়, কায়রোয়। মহাসচিবের পদে ইস্তফা দিয়ে দেশে ফিরে যাচ্ছি শীঘই। গণতন্ত্রের অপমৃত্যু ঘটতে যাচ্ছে মিসরে। ওটাকে রক্ষার জন্য নিজের লোকদের মধ্যে থেকে অনেক বেশি সাহায্য করতে পারব আমি।
কিন্তু আখমত ইয়াজিদ?
প্রেসিডেন্ট হাসান আমাকে কথা দিয়েছেন,তাকে গৃহবন্দি করা হবে।
চিন্তার রেখা ফুটল সিনেটর পিটের কপালে। সাবধান থাকবেন। গৃহবন্দি অবস্থায়ও বিপজ্জনক একটা পশু সে।
হয় আখমত ইয়াজিদ, নয়তো তার মতো আর কেই বা সব সময়েই আশপাশে থাকবে, হেলার হাসিতে দৃঢ় আত্মবিশ্বাস ফুটে উঠল। ওদেরকে ভয় করা কাজের লোকের সাজে না। মার্কিন প্রশাসনে আপনার অনেক বন্ধু আছেন, দয়া করে ওঁদের জানাবেন, মিসর কোনো দিনই মৌলবাদীদের খেলনার সামগ্রী হবে না।
ছোট্ট করে মাথা ঝাঁকালেন সিনেটর পিট।
আবার মাথা ঝাঁকাতে গিয়ে স্থির হয়ে গেলেন সিনেটর পিট। তিনি দেখলেন, পিটের চেয়ারের হাতল ধরে ওর দিকে ঝুঁকে পড়লেন হে’লা কামিল, চুমো খেলেন পিটের কপালে।
সিধে হলেন তিনি, একটা হাত বাড়িয়ে এলোমেলো করে দিলেন পিটের চুল। আমাকে ভুলে যাবেন না, বলে চেয়ারটাকে ঘুরে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করলেন প্লেনে। তাঁর গমনপথের দিকে তাকিয়ে থাকল পিট।
ওরা তোমার জন্য একটা অ্যাম্বুলেন্স পাঠিয়েছে, সিনেটরের কথায় সংবিৎ ফিরল পিটের।
অ্যাম্বুলেন্স? হাসপাতালে যেতে হবে? কিন্তু, … কথা শেষ না করে মুখ আর মাথার ব্যান্ডেজ খুলে ফেলে দিল ও। আমি তো সম্পূর্ণ সুস্থ বোধ করছি
বেশি বাড়াবাড়ি করছে বলে মনে হচ্ছে না?
জানি, গম্ভীর সুরে বললেন সিনেটর পিট। সেজন্যই তো ফেরত পাঠিয়েছি অ্যাম্বুলেন্স। তুমি নুমা হেডকোয়ার্টারে যাচ্ছ।
তুমি হোয়াইট হাউসে যাবে কীভাবে?
অপেক্ষারত একটা হেলিকপ্টারের দিকে ইঙ্গিত করলেন সিনেটর পিট। প্রেসিডেন্ট আমার যাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন।
যাবার পথে আমাকে একটু নামিয়ে দেবে নুমা হেডকোয়ার্টারে?
এসো, তোমাকে হেলিকপ্টারে তুলি, বলে পিটের চেয়ারটা নিজেই পেছন থেকে ঠেলতে শুরু করলেন সিনেটর পিট।
.
উত্তেজনা বাড়তে বাড়তে টান পড়া গিঁটের মতো অনুভূতি হলো পিটের তলপেটে। এলিভেটরে দাঁড়িয়ে আছে ও, সংখ্যাগুলোকে উঠে যেতে দেখছে নুমার কাম্পউটর কমপ্লেক্সে। দরজা খুলে গেল, খোঁড়াতে খোঁড়াতে বেরোবার সময় আউটার অফিসে লিলিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল ও। হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে আছে মুখ।
পিটের বিধ্বস্ত চেহারা দেকে ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে গেল হাসিটা। পিটের চোয়ালে এখনো প্লাস্টার লাগানো রয়েছে, বসের কাছ থেকে ধার করা সোয়েটারের ভেতর থেকে উঁকি দিচ্ছে সাদা ব্যান্ডেজ, হতে ছড়ি থাকলেও একটু একটু খোঁড়াচ্ছে। তারপর, পিটের কথা ভেবে, ওকে সাহস দেয়ার জন্য, উজ্জ্বল হাসিতে আবার চেহারাটা উদ্ভাসিত করে তুলল লিলি। ওয়েলকাম হোম, সেইলর!
সামনে এগিয়ে এসে হাত দুটো পিটের গলার দুপাশে ছুঁড়ে দিল সে। কুঁকড়ে গেল পিট, নিঃশ্বাসের সাথে গুঙিয়ে উঠল।
লাফ দিয়ে সের যাবার চেষ্টা করল লিলি। ওহ দুঃখিত।
তাকে আঁকড়ে ধরল পিট। হয়ো না, বলে তার ঠোঁটের ওপর নিজের ঠোঁট দুটো রাখল সে। লিলির নরম মসৃণ চামড়ায় খোঁচা খোঁচা শক্ত দাড়ি বিধে গেল, পুরুষ সুলভ গন্ধ ঢুকল নাকে।
ছাড়া পেয়ে, প্রথম সুযোগেই অভিযোগের সুরে লিলি বলল, যেসব পুরুষ সপ্তায় এতবার বাড়ি ফেরে তাদের সম্পর্কে কিছু বলার আছে।
আর যেসব মেয়েরা অপেক্ষা করে তাদের সম্পর্কেও কিছু বলার আছে। পিছিয়ে গেল পিট। চারদিকে তাকাল। আমি যাবার পর কী আবিষ্কার করলে তোমরা?
ইয়েজারের মুখ থেকেই শোনা, চাপা উত্তেজনার সাথে বলল লিলি, পিটের হাত ধরে টেনে নিয়ে বলল কম্পিউটর সেকশনের দিকে।
নিজের অফিস থেকে ছুটে বেরিয়ে এল ইয়েজার। পিটের চেহারা দেখে তার কোনো প্রতিক্রিয়া হলো না। অভিনন্দন বা সহানুভূতি জানানোর কথাও মনে থাকল না। প্রায় নাচতে শুরু করল সে, চিৎকার করে ঘোষণা করল, পেয়ে গেছি! পেয়ে গেছি!
নদীটা? ব্যগ্রতার সাথে জানতে চাইল পিট।
শুধু নদীটা নয়। যে গুহার ভেতর শিল্পকর্মগুলো রাখা আছে, তোমাকে আমি তার দু-মাইলের মধ্যে পৌঁছে দিতে পারি।
কোথায়?
টেক্সাস! ছোট্ট একটা সীমান্ত শহর রোমায়।
ইয়েজার আর লিলির কাঁধে ভর দিয়ে অফিসে ঢুকছে পিট, জানতে চাইল, ঠিক তো?
একশো ভাগ ঠিক, পিটের কানের কাছে মুখ এনে গলা ফাটাতে শুরু করল ইয়েজার। সাতটা পাহাড়ের নামকরণ করা হয় রোম। তেমন উঁচু নয় কোনোটাই, প্রায় কোনো গুরুতুই বহন করে না, স্বীকার করছি। কিন্তু রিপোর্ট আছে, অনেক দিন আগে থেকেই এলাকার মাটি খুঁড়ে রোমান শিল্পকর্ম উদ্ধার করা হচ্ছে। বড় বড় নামকরা আর্কিওলজিস্টরা ভুয়া বলে অগ্রাহ্য করেছেন, কিন্তু তারা কি জানেন?
তাহলে নদীটা হলো…?
রিয়ো ব্র্যাভো, স্প্যানিশ ভাষায় এই নামেই ডাকা হয়, মাথা ঝাঁকাল ইয়েজার। সীমান্তের এদিকে সবাই ওটাকে রিয়ো গ্র্যান্ড বলে।
রিয়ে গ্র্যান্ড। শব্দটা ধীরে ধীর কয়েকবার উচ্চারণ করল পিট। নদীটাকে খুঁজে বের করতে এত বেগ পেতে হয়েছে সে সত্যি ওটা পাওয়া গেছে বলে বিশ্বাস করতে পারছে না ও।
সত্যি অত্যন্ত দুঃখজনক একটা ঘটনা, হঠাৎ বিষণ্ণ সুরে বলল ইয়েজার।
কী ব্যাপার, এ কথা বলছ কেন?
মাথা নাড়তে নাড়তে ইয়েজার বলল, টেক্সানরা কেমন তা তো জানো তুমি। যখন জানবে ষোলোশো বছর ধরে আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরির ওপর বসে আছে ওরা, কোনো ভদ্রলোকের পক্ষে ওদের সাথে বসবাস করা সম্ভব হবে?