৭০.
প্রথম দিন তারা এক হাজার দুহাজার করে এল, পরদিন এল দশ হাজার বিশ হাজার করে। গোটা উত্তর মেক্সিকোর মানুষ উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটছে, শুরু হয়ে গেছে ব্যানার আর ফেস্টুন নিয়ে কে কার আগে যোগ দেবে তারই তীব্র প্রতিযোগিতা। প্রতিটি ব্যানারে আটেক দেবতার পাশে রয়েছে টপিটজিনের বিশাল প্রতিকৃতি, নিচে লেখা-দেবতাদের আশীর্বাদ পুষ্ট মেক্সিকোর ত্রাণকর্তা টপিটজিনের ডাকে সাড়া দিন, দেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে যোগ দিন। সীমান্তের দিকে মানুষের যেন ঢল নেমেছে। হাজার হাজার বাস আর ট্রাকভর্তি লোকজন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে রওনা হয়ে গেছে। সমস্ত যানবাহন আর মিছিলের একটাই গন্তব্য-রোমার উল্টোদিকে, নদীর আরেক ধারে, ধুলো ঢাকা মিগুয়েল এলমান শহর। রাস্তায় রাস্তায় যানজট লেগে গেল। ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা অচল হয়ে পড়ার রিজার্ভ পুলিশ বাহিনীকে ডেকে পাঠানো হলো, কিন্তু সংখ্যায় কম বলে মিছিলের স্রোতে খড়কুটোর মতো ভেসে গেল তারাও। সীমান্তরক্ষীরা সংখ্যায় আরও কম, নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করা ছাড়া তাদেরও কিছু করার থাকল না।
জরুরি মিটিং ডাকলেন প্রেসিডেন্ট দো লরেঞ্জো। সিদ্ধান্ত হলো, যেকোনো ভাবে এই জনস্রোতকে থামাতে হবে। সেনাবাহিনীকে তিনি নির্দেশ দিলেন, রাস্তা বন্ধ করো। কিন্তু সেনাবাহিনী দেখল, এর চেয়ে বরং জলোচ্ছাস থামানো অনেক সহজ। সমস্ত প্রচেষ্টা যখন ব্যর্থ হলো, বাধ্য হয়ে গুলি চালাল সৈনিকরা। সামনের মিছিল থেকে পঁয়তাল্লিশজন মানুষ লুটিয়ে পড়ল রাস্তার ওপর, বেশির ভাগই নারী ও শিশু। লাশের ওপর দিয়ে ধেয়ে এল উত্তেজিত জনতা, যেন মৌমাছির চাকে ঢিল পড়েছে।
টপিটজিনের কালো হাতে খেলনা পুতুল হয়ে উঠলেন দো লরেঞ্জো। দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল খবরটা, সেনাবাহিনী নিরীহ নারী ও শিশুদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে। আর যায় কোথায়, রাজধানী মেক্সিকো সিটিসহ বড় বড় সব শহরে আগুন জ্বলে উঠল। পুলিশ, সরকার সমর্থক আর সেনাবাহিনীর সাথে দাঙ্গা বেঁধে গেল উত্তেজিত জনতার। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে বাধ্য হয়ে সেনাবাহিনীকে প্রত্যাহার করে নিলেন প্রেসিডেন্ট। হোয়াইট হাউসে বিশেষ বার্তা পাঠিয়ে নিজের অক্ষমতার কথা জানিয়ে দিলেন তিনি। দুঃখ করে বললেন, সেনাবাহিনীর অনেক লোকও মিছিলে যোগ দিয়েছে।
সমস্ত বাধা নির্মূল করে নিয়ে রিয়ো গ্ল্যান্ডের দিকে ছুটল উন্মত্ত জনতা।
গোটা অপারেশনটা সূচারুভাবে পরিচালনা করার জন্য প্রফেশনাল প্ল্যানারদের ভাড়া করেছে ক্যাপেসটার পরিবার। রবার্ট ক্যাপেসটারের অনুসারী ও কর্মীবাহিনী পাঁচ বর্গকিলোমিটার জায়গা নিয়ে একটা তাবু শহর তৈরি করল, সারি সারি রান্নাঘর থাকল সেখানে, খাবার পরিবেশনের জন্য নিয়োগ করা হলো কয়েক হাজার লোকে। পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থায় কোনো ত্রুটি থাকল না, ভিড়ের চাপে ও সক দুর্ঘটনায় আহতদের চিকিৎসা করার জন্য রাস্তার ঘারে তাবুর ভেতর তৈরি থাকল মেডিকেল ইউনিটগুলো। লাখ লাখ মানুষের মিছিল ও সমাবেশের কথা মনে রেখে সম্ভাব্য সমস্ত সদস্য সুরাহা করার ব্যবস্থায় কোনো ত্রুটি নেই। জনতার স্রোতে এমন মানুষের সংখ্যাও কম নয়, যারা এত উন্নতমানের খাবার জীবনে আর কখনও খায়নি বা এ ধরনের সযত্ন চিকিৎসা পায়নি। শুধু রাস্তার ধুলো আর গাড়ির ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণ করা গেল না।
নদীর কিনারা ব্যানার দিয়ে সাজানো হয়েছে। সেগুলোর লেখা, আমেরিকা আমাদের মাটি চুরি করেছে,
আলেজকান্দ্রিয়া লাইব্রেরির মালিক মেক্সিকানরা ইত্যাদি। শ্লোগানগুলো ইংরেজি, স্প্যানিশ ও প্রাচীন নাহুয়াটল ভাষায় উচ্চারিত হলো। জনসমুদ্রের ভেতর উপস্থিত হলো টপিটজিন, বজ্রকণ্ঠে আমেরিকার বিরুদ্ধে বিষোদগার করল সে। প্রচণ্ড আবেগ ও উত্তেজনায় ফুঁসে উঠল জনতা।
রোমা শহরে জড়িয়ে পড়ল আতঙ্ক। শহরের অধিবাসীরা ভয়ে রাজ্যের ভেতর দিকে সরে গেল। বিভিন্ন সংবাদ সংস্থা ও টিভিনেটওয়ার্কের কর্মীরা ভিড় করল সীমান্তে। চব্বিশটা টিভি-ক্যামেরা নিয়ে ভ্যান ও ট্রাকের একটা বহর থেমেছে নদীর কিনারায়, সীমান্তের ওপারে যা ঘটছে তার ছবি তুলতে ব্যস্ত ক্যামেরাম্যানরা।
মেক্সিকোর দিকেও, সমাবেশের ছবি তোলা হচ্ছে, সাক্ষাৎকার নেয়া হচ্ছে লোকজনের। সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে কী বলতে হবে, প্রত্যেক পরিবারপ্রধানকে ভালোভাবে শিখিয়ে-পড়িয়ে রেখেছে টপিটজিনের রাজনৈতিক কর্মীরা। চোখে পানি নিয়ে পরিবারের কর্তারা বলছে, তারা ক্যালিফোর্নিয়া, আরিজোনা, নিউ মেক্সিকো আর টেক্সাসে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে চায়। কর্তার সুরে সুর মেলাল ক্রন্দনরতা স্ত্রী ও কন্যা। সারা দুনিয়ার টিভি নিউজে দেখানো হলো সেসব দৃশ্য।
গম্ভীর আর অচঞ্চল থাকল শুধু মার্কিন সীমান্ত টহল-বাহিনী। গুজব আগেই ছড়িয়ে পড়েছিল, তারা জানত একটা হুমকি মোকাবিলা করতে হতে পারে। তাদের সবচেয়ে বড় ভয়টাই বাস্তব চেহারা নিয়ে সামনে হাজির হয়েছে। নিজেদের দায়িত্ব থেকে তারা বিচ্যুত হবে না, অপেক্ষা করছে নির্দেশের।
সীমান্ত টহল-বাহিনীকে অস্ত্র তাক করার নির্দেশ দেয়া একটা দুর্লভ ঘটনা। বেআইনি অনুপ্রবেশকারীর সাথে মানবিক আচরণ করে তারা, সীমান্ত রেখার ওপারে আবার তাকে চলে যেতে বলার সময় ভদ্র ব্যবহার করে। আজ তারা নদীর কিনারায় অবস্থান গ্রহণ করেছে। তাদের অটোমেটিক রাইফেল ও বিশটা ট্যাংক নদীর ওপারে, মেক্সিকোর দিকে তাক করা।
সৈনিকরা সবাই তরুণ হলেও সম্মুখযুদ্ধে যথেষ্ট অভিজ্ঞ। মুশকিল হলো, তারা কেউ নিরস্ত্র সিভিলিয়ানদের সাথে যুদ্ধ করেনি। অস্বস্তি বোধ করার সেটাই কারণ।
কমান্ডিং অফিসার, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কার্টিস চ্যান্ডলার, ট্যাংকে ও আমারড কার দিয়ে ব্যারিকেড তৈরি করেছেন ব্রিজের ওপর। তবে এ-ধরনের বাধা সম্পর্কে আগেই ধারণা করেছিল টপিটজিন। নদীর কিনারায় গিজ গিজ করছে নানা আকৃতির ছোট বোট, কাঠের ভেলা, ট্রাকের টিউব। দুশো মাইলের মধ্যে ছোট নৌ-যান, যা পাওয়া গেছে সব জড়ো করা হয়েছে সীমান্ত বরাবর। নদীর ওপর রশি ফেলা হয়েছে, যারা সাঁতরে পার হবে তাদের জন্য। আর আছে বাঁশের তৈরি সাঁকো। জনতার প্রথম মিছিলটা ওগুলো বয়ে নিয়ে যাবে ওপারে।
প্রথম ধাক্কায় জেনারেল কার্টিসের ইন্টেলিজেন্স অফিসাররা হিসাব করল, বিশ হাজার লোক নদী পেরোবে। এই হিসেবে শুধু জল্যানে করে যারা আসবে তাদের সংখ্যা ধরা হয়েছে। সাঁতার কেটে কত আসবে বলা সম্ভব নয়। তার একজন মেয়ে এজেন্ট একটা ডাইনিং ট্রেইলারে ঢুকে টপিটজিনের সহকারীদের কথাবার্তা শুনেছে। রেডিওযোগে পাঠানো মেসেজে জানিয়েছে সে, সন্ধ্যার পর জনতার উদ্দেশে ভাষণ দেবে তাদের আধুনিক আযটেক দেবতা। টপিটজিনের সেই ভাষণ শুনে মেক্সিকানরা উন্মাদ হয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ভাষণ থামার পরপরই শুরু হবে সীমান্ত পেরোনোর কাজ। তবে কোনো দিন সন্ধ্যার পর তা সে জানতে পারেনি।
ভিয়েতনামে তিনবার দায়িত্ব পালন করেছেন কার্টিস। বিনা নোটিশে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসা উন্মত্ত নারী ও পুরুষদের হত্যা করার তিক্ত অভিজ্ঞতা আজও ভুলে যাননি তিনি। মেক্সিকানরা নদী পেরোতে শুরু করলে তাদের মাথার ওপর ফাঁকা গুলি করার নির্দেশ দিয়েছেন সৈনিকদের।
তাতে যদি তারা না থামে, সৈনিক হিসেবে নিজের দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে পালন করবেন কার্টিস চ্যান্ডলার। যতই রক্তপাত ঘটুক না কেন, মারা যাক নারী ও শিশু, নির্দেশ পেলে নির্বিচারে গুলিবর্ষণের আদেশ দেবেন তিনি।
.
টেলিস্কোপটা শখের জিনিস, ছাদে শুয়ে মাঝেমধ্যে তারা দেখে স্যাম ট্রিনিটি। সেটা চেয়ে নিয়ে তার দোকানের ছাদে উঠে পড়েছে পিট।
পশ্চিম পাহাড় সারির পেছনে ঢলে পড়েছে সূর্য, দ্রুত অন্ধকার নেমে আসছে চারদিকে। হঠাৎ করে রিয়ো গ্র্যান্ডের অপর তীর উদ্ভাসিত হয়ে উঠল উজ্জ্বল আলোর বন্যায়। একসাথে জ্বলে উঠল অসংখ্য বহুরঙা ফ্লাডলাইট, কোনোটা অন্ধকার আকাশের গায়ে নকশা তৈরি করল, কোনোটা শহরের মাঝখানে খাড়া করা উঁচু টাওয়ারের গায়ে স্থির আলো ফেলল।
রঙচঙে কাপড় ও পাখির পালক দিয়ে মাথা ঢাকা একটা মূর্তির ওপর স্থির হলো পিটের দৃষ্টি। নল ঘুরিয়ে মূর্তিটাকে আকারে বড় করল ও। টাওয়ারের মাথায়, সরু একটা প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছে সে। পরনে হাঁটু ঢাকা সাদা আলখেল্লা। তার হাত না আর লাফঝাঁপ লক্ষ করে পিট অনুমান করল, বক্তৃতা দিচ্ছে।
কে হতে পারে লোকটা? জিজ্ঞেস করল পিট, নির্দিষ্ট কাউকে উদ্দেশ করে নয়। সার্ভের ফলাফল, আন্ডারগ্রাউন্ড প্রোফাইল রেকডিং পরীক্ষা করছেন অ্যাডমিরাল স্যানডেকার ও লিলি।
অদ্ভুত কাপড় পরে আছে, ভাব দেখে মনে হচ্ছে লোকজনকে উত্তেজিত করার চেষ্টা করছে সে।
মুখ তুলে পিটের দিকে তাকালেন অ্যাডমিরাল। কে আবার হবে, নিশ্চয়ই ভুয়া টপিটজিন।
লিলি জানতে চাইল, লক্ষণ দেখে কী বুঝছ, আজ রাতে ওরা সীমান্ত পেরোবে?
টেলিস্কোপ থেকে চোখ সরিয়ে মাথা নাড়ল পিট। সব কিছু গুছিয়ে আনার জন্য অমানুসিক পরিশ্রম করছে ওরা। আমার ধারণা, আরও আটচল্লিশ ঘণ্টা সময় নেবে। কাঁচা কাজ করার লোক টপিটজিন নয়।
টপিটজিন ওর আসল নাম নয়, পিটকে জানালেন অ্যাডমিরাল। ওর আসল নাম রবার্ট ক্যাপেসটার।
ব্যবসাটা ভালোই ধরেছে, মন্তব্য করল পিট।
দুটো আঙুল খাড়া করলেন অ্যাডিমিরাল, দুটো মাঝখানে এক ইঞ্চির মতো ব্যবধান। এটুকু দূরত্ব পেরোতে পারলেই মেক্সিকো দখল করে নেবে রবার্ট।
নদীর ওপারে ওই সমাবেশ যদি কোনো লক্ষণ হয়, লোকটা আমেরিকার গোটা দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল দাবি করে বসবে।
দাঁড়াল লিলি, কোমরে হাত রেখে আড়মোড়া ভাঙল। কাজ ছেড়ে দিয়ে এইভাবে বসে থাকা, একদম ভাল্লাগছে না। সব কাজ আমরা করলাম, আর কৃতিত্ব চলে যাচ্ছে সামরিক প্রকৌশলীদের ভাগে। খোঁড়াখুঁড়ির কাজ দেখতে দিতেও আপত্তি ওদের, স্যাম সাহেবের সম্পত্তি থেকে সরে আসতে বাধ্য করল। ওরা মানুষকে যেন মানুষ বলেই গণ্য করে না।
পরস্পর দৃষ্টি বিনিময় করে হাসল পিট ও অ্যাডমিরাল, কেউ কোনো মন্তব্য করার ঝুঁকি নিল না।
কলমের মাথাটা চিবাচ্ছে লিলি। সিনেটর সাহেব, তোমার বাবা, তিনিই বা কেন যোগাযোগ করছেন না?
কী জানি? কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন অ্যাডমিরাল, পিট কী চায় আমি তাকে জানিয়েছি। বলল, যা হোক একটা ব্যবস্থা করবে সে।
হোয়াইট হাউসে কী ঘটছে জানতে পারলে ভালো হতো, বিড়বিড় করল লিলি।
অ্যাপ্রন পরে ছাদে উঠে এল স্যাম ট্রিনিটি।
স্যুপ যে ঠাণ্ডা হয়ে এল। উত্তরে কেউ কিছু বলার আগে ঘাড় ফিরিযে তাকাতেই সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারে রাস্তার ওপর এক সার আলো দেখতে পেল সে।
সন্দেহ নেই, আরেকটা আর্মি কনভয়, ঘোষণার সুরে বলল সে। দাড়িওয়ালা জেনারেল
রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে, গাড়ি বা ট্রাকের এ-পথে আসার কথা নয়।
পাঁচটা ট্রাক দেখতে পেল ওরা, সামনে একটা জিপ। পেছনের ট্রাকটা টেনে আনছে ইকুইপমেন্ট বোঝাই লম্বা এক ট্রেইলরকে, ক্যানভারস দিয়ে ঢাকা। কনভয়টা বাঁক নিয়ে গনগোরা হিলে প্রকৌশলীদের ক্যাম্পের দিকে বা সোজা পথে রোমার দিকে গেল না। জিপের পিছু পিছু ট্রাকগুলো চলে এল স্যামস মিউজিয়ামের ড্রাইভওয়েতে, থামল গ্যাস পাম্প আর দোকানের মাঝখানে। জিপ থেকে নিচে নেমে চারদিকে তাকাল আরোহীরা, কাকে যেন খুঁজছে।
তিনটে চেনামুখ দেখতে পেল পিট। দু’জন ইউনিফর্ম পরে আছে, অপরজন পরেছে সোয়েটার আর ডেনিম। ছাদের কার্নিস থেকে সানশেডে নামল পিট, অত্যন্ত সতর্কতার সাথে। সানশেডের কিনারা ধরে ঝুলে পড়ল ও। কোনো শব্দ করেনি। কিনারা ছেড়ে দিতেই লোকগুলোর মাঝখানে ঝুপ করে পড়ল, আহত পায়ে ব্যথা লাগায় গুঙিয়ে উঠল। পিট যেমন ওদেরকে এখানে দেখে অবাক হয়েছে, ওরাও তেমনি হঠাৎ করে পিটকে দেখে বিস্মিত হলো।
আকাশ থেকে পড়ার অভ্যেসটা দেখছি তোমার গেল না! দুকান বিস্তৃত হাসি নিয়ে বলল অ্যাল জিওর্দিনো। ফ্লাডলাইটের আলোয় রক্তশূন্য, স্নান দেখার তার চেহারা, সিলিংয়ে ঝুলছে একটা হাত। তবে হাসিখুশি ভাব আর মনের জোর আগের মতোই অটুট আছে তার।
সে অভিযোগ তো আমারও।
সামনে এগিয়ে এল কর্নেল হোলিস। ভাবিনি এত তাড়াতাড়ি আবার দেখা হবে আমাদের।
আমিও না, যোগ করল জন ডিলিঞ্জার।
ওদের বাড়ানো হাতগুলো এক এক করে মুচড়ে দেয়ার সময় আকস্মিক স্বস্তির একটা পরশ অনুভব করল পিট।
যদি বলি তোমাদের দেখে খুশি হয়েছি, তালকে তিল করার একটা উদাহরণ হবে সেটা জানতে পারি, আপনারা এখানে কেন?
আপনার বাবা, সিনেটর তার প্রভাব খাঁটিয়েছেন হোয়াইট হাউসে। লেডি ফ্ল্যামবোরো মিশন সম্পর্কে রিপোর্ট দেয়া মাত্র শেষ করেছি, ব্যাখ্যা করল কর্নেল, এই সময় অর্ডার হলো, দল রেডি করে এখানে হাজিরা দিতে হবে, মেঠোপথ ধরে। গোটা ব্যাপারটা চুপিচুপি সারার জন্য বারবার সতর্ক করা হয়েছে। ক্লাসিফায়েড, ক্লাসিফায়েড! আমাকে বলা হয়েছে, আমি রিপোর্ট করার পর শুধু আমাদের উপস্থিতি সম্পর্কে জানতে পারবেন ফিল্ড কমান্ডার।
পিট বলল, এখানে ফিল্ড কমান্ডার কে জানেন?
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কার্টিস চ্যান্ডলার।
জানি, স্টিল-ট্রাপ চ্যান্ডলার। আট বছর আগে ন্যাটোয় তার অধীনে কাজ করেছি। এখনও তার ধারণা, শুধু আমার দিয়েই যুদ্ধে জেতা যায়।
আপনার ওপর দায়িতুটা কী?
আপনার ও ড. শার্পের প্রজেক্ট যাই হোক, আপনাদের অ্যাসিস্ট করা। অ্যাডমিরাল, সিনেটরের সাথে পরামর্শ করে সরাসরি পেন্টাগনে রিপোর্ট করবেন। ব্যস, এইটুকুই জানি আমি।
হোয়াইট হাউসের কথা উঠছে না?
কাগজে কিছু লেখা হয়নি, অ্যাডমিরাল ও লিলির দিকে তাকাল কর্নেল, সিঁড়ি বেয়ে এইমাত্র নেমে এসেছেন ওরা।
অ্যাল জিওর্দিনোকে আলিঙ্গন করল লিলি, অ্যাডমিরালকে নিজের পরিচয় জানাল জন ডিলিঞ্জার। পিটকে একপাশে টেনে নিয়ে গেল কর্নেল।
এখানে আসলে ঘটছেটা কী বলুন তো? নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল সে। সার্কাস?
ঠোঁট টিপে হাসল পিট। খুব একটা ভুল বলেননি।
আমার স্পেশাল ফোর্সের কাজটা কী হবে?
ওরা যখন এসে পড়বে, বলল পিট, হঠাৎ গম্ভীর হয়ে উঠল ও, আপনার কাজ হবে পাহাড়টা উড়িয়ে দেয়া।
.
৭১.
ভার্জিনিয়া থেকে মাটি কাটার বিরাট এক যন্ত্র ব্যাক-হো নিয়ে এসেছে স্পেশাল অপারেশনস ফোর্স। মার্কার পতাকা গাঁথা ঢালের ওপর উঠে এল সেটা। দশ মিনিট চেষ্টা করার পর যন্ত্রটা কীভাবে চালাতে হয় শিখে ফেলল পিট। আড়াই মিটার চওড়া বালতিতে করে পাথর আর মাটি সরানোর কাজ আরম্ভ হয়ে গেল।
এক ঘণ্টাও লাগল না, ছমিটার গভীর, বিশ মিটার লম্বা একটা ট্রেঞ্চ তৈরি করা হলো পাহাড়টার পেছন দিকের ঢালে। এই সময় বাধা পড়ল কাজে। তীর বেগে আগে আগে এল একটা স্টাফ কার, পেছনে ট্রাক ভর্তি সশস্ত্র সৈনিকের দল।
স্টাফ কারের ঢাকা পুরোপুরি থামেনি, লাফ দিয়ে নিচে নামল খাড়া মেরুদণ্ড নিয়ে একজন ক্যাপটেন। এটা একটা নিষিদ্ধ এলাকা, চিবুক উঁচু করে ধমকের সুরে বলল সে। কাল আমি নিজে আপনাদের এদিকে আসতে নিষেধ করেছি। ইকুইপমেন্ট নিয়ে চলে যান, এক্ষুনি চলে যান।
ব্যাক-হো-র সিট থেকে ধীরে সুস্থে নামল পিট, ট্রেঞ্চের কিনারায় দাঁড়িয়ে বুকে। ভেতরে তাকাল, ক্যাপটেন বা সৈনিকদের উপস্থিতি সম্পর্কে যেন সচেতন নয়।
লাল হয়ে উঠল ক্যাপটেনের চেহারা। সার্জেন্টের উদ্দেশে হুঙ্কার ছাড়ল সে, সার্জেন্ট ও হারা, তোমার লোকজনকে তৈরি হতে বললো, এলাকা থেকে সিভিলিয়ানদের সরিয়ে দিতে হবে।
ধীরে ধীরে ঘুরল পিট, মৃদু হাসল। দুঃখিত, আমরা কোথাও যাচ্ছি না।
হাসল ক্যাপটেনও, তবে সেটা তাচ্ছিল্যের হাসি। তিন মিনিট, মিস্টার। ইকুইপমেন্ট নিয়ে কেটে পড়ার জন্য তিন মিনিট সময় দেয়া হয়েছে আপনাদের।
কাগজপত্র দেখবেন না? এখানে আমাদের থাকার অধিকার আছে কি না জানতে চান না?
কাগজটা জেনারেল কার্টিসের সই করা না হলে, আমি বলব, আপনি অযথা সময় নষ্ট করছেন।
আপনার জেনারেলের চেয়েও ক্ষমতাবান একজন সই করেছেন যে।
তিন মিনিট, উপহাসের সুরে বলল ক্যাপটেন। তারপর আপনাদেরকে আমি জোর করে সরিয়ে দেব।
লিলি, জিওর্দিনো আর অ্যাডমিরাল বসে আছেন ছায়ার ভেতর, স্যামের জিপে } ঘটনাটা উপভোগ করার জন্য এগিয়ে এল সবাই। শুধু হল্টার আর টাইট শর্টস পরে আছে লিলি। এক লাইনে দাঁড়ানো সৈনিকদের চোখের সামনে সুস্বাদু পাকা ফলের মতো হাঁটাহাঁটি শুরু করল সে। প্রতিটি সৈনিক গিলছে তাকে।
ধীরে ধীরে মেজাজ গরম হচ্ছে পিটের।
আপনারা মাত্র বারোজন, ক্যাপটেন। বারোজন প্রকৌশলী, সব মিলিয়ে একশো ঘন্টা কমব্যাট ট্রেনিংও পাননি। আমাকে সাহায্য করছে চল্লিশজন, তাদের যেকোনো দু’জন ত্রিশ সেকেন্ডেরও কম সময়ে আপনাদের সব কটাকে শুইয়ে দিতে পারবে। আমি আবেদন করছি না, ওদের নিয়ে আপনাকে ফিরে যেতে বলছি।
শান্তভাবে এদিক-ওদিক তাকাল ক্যাপটেন। পিটের এক পাশে লিলিকে সৈনিকদের সামনে হাঁটাহাঁটি করতে দেখল সে। আকাশের দিকে তাকিয়ে নির্লিপ্তভঙ্গিতে বড় একটা চুরুট ফুকছেন অ্যাডমিরাল। তার পাশে গোবেচারা চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে আরেকজন, সিলিংয়ের সাথে ঝুলছে একটা হাত।
লোকগুলোকে এই মুহূর্তে ঝেটিয়ে বিদায় করো! গলার রগ ফুলে উঠল তার।
সৈনিকরা দুপা এগোবার আগেই, যেন ভোজবাজির মতো উদয় হলো কর্নেল হোলিস। আশাপাশের কালচে সবুজ ও পাথুরে ধূসর পরিবেশের সাথে তার ক্যামোফ্লেজল্ড ব্রাটল ড্রেস ও গ্রিজ মাখানো হাত দুটো বিশ্বস্ততার সাথে প্রায় হুবহু সঙ্গতি বজায় রেখেছে। মাত্র পাঁচ মিটার দূরে দাঁড়িয়ে আছে সে, ঝোঁপঝাড়ের ভেতর প্রায় গোটা শরীরটাই আড়াল করা।
আমরা কি কোনো সমস্যায় পড়েছি? ক্যাপটেনকে জিজ্ঞেস করল সে, খোশগল্পের সুরে।
মুখ ঝুলে পড়ল ক্যাপটেনের, তার সৈনিকরা স্থির হয়ে গেল। কয়েক পা সামনে বাড়ল সে, কর্নেলকে ভালো করে দেখল। কিন্তু এমন কোনো চিহ্ন চোখে পড়ল না যা দেখে পদ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। কে আপনি? কড়া সুরে জিজ্ঞেস করল সে। কোন আউটফিটের?
কর্নেল মরটন হোলিস, স্পেশাল অপারেশনস ফোর্স।
ক্যাপটেন লুইস ক্রেনস্টোন, স্যার-চারশো পাঁচ ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যাটালিয়ন।
স্যালুট বিনিময় হলো। বাগিয়ে ধরা অটোমেটিক অস্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা প্রকৌশলীদের দিকে ইঙ্গিত করল কর্নেল।
তুমি ওদেরকে স্ট্যান্ড-অ্যাট-রেস্ট-এর অর্ডার দিতে পারো।
আকাশ থেকে পড়া চেনা একজন কর্নেলকে কীভাবে গ্রহণ করবে, ঠিক বুঝতে পারল না ক্যাপটেন।
জিজ্ঞেস করতে পারি, কর্নেল স্পেশাল ফোর্সের একজন অফিসার এখানে কী করছে?
ওরা আর্কিলজিক্যাল সার্ভে চালাচ্ছে, আমরা লক্ষ রাখছি কেউ যাতে ওদেরকে বিরক্ত না করে।
আপনাকে মনে করিয়ে না দিয়ে উপায় নেই, স্যার, যে নিষিদ্ধ ঘোষিত মিলিটারি জোনে সিভিলিয়ানদের প্রবেশ করার অনুমতি নেই।
ধরো, যদি বলি, এখানে থাকার পূর্ণ অধিকার ওদের আছে?
দুঃখিত, কর্নেল। জেনারেল কার্টিস চ্যান্ডলার সরাসরি অর্ডার করেছেন আমাকে। তার নির্দেশে কোনো অস্পষ্টতা নেই। ব্যাটালিয়নের সদস্য নয়, এমন কেউ এই এলাকায় প্রবেশ করতে পারবে না, তাদের মধ্যে আপনিও পড়েন, স্যার।
তার মানে ধরে নিতে পারি, আমাকেও তুমি ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে চাও?
জেনারেল কার্টিসের সই করা অনুমতিপত্র যদি দেখাতে না পারেন, নার্ভাস ভঙ্গিতে বলল ক্যাপটেন লুইস। নির্দেশ দেয়া হলে, সেটা আমি পালন করি।
গোয়ার্তুমি করলে তোমার বিপদ হবে, ক্যাপটেন। কিসে নিজের ভালো হবে, সেটা আরেকবার চিন্তা করে দেখো।
প্লিজ, নো ট্রাবল, কর্নেল।
তাহলে যা বলছি করো। লোকদের নিয়ে বেসে ফিরে যাও, পেছন ফিরে তাকাবার কথা চিন্তা পর্যন্ত কোরো না।
বিতর্কটা উপভোগ করছিল পিট, তবে চেহারায় অনিচ্ছার একটা ভাব নিয়ে ওদের দিকে পেছন ফিরল ও, ঢাল বেয়ে নেমে গেল ট্রেঞ্চে। পায়ের নিচের আলগা মাটি সরাতে শুরু করল। অলস পায়ে এগিয়ে এসেট্রেঞ্চের কিনারায় দাঁড়ালেন অ্যাডমিরাল, তার পাশে জিওর্দিনো। দু’জনেই পিটের কাজ দেখছে।
এখনও ইতস্তত করছে ক্যাপটেন লুইস। পদের দিক থেকে অনেক ছোট সে, কিন্তু তাকে দেয়া নির্দেশটা পরিষ্কার। সিদ্ধান্ত নিল, সে যে ভূমিকা নিয়েছে সেটাই সঠিক। তদন্ত হলে জেনারেল কার্টিস তাকে সমর্থন করবেন।
এলাকাটা খালি করার জন্য সার্জেন্টকে নির্দেশ দিতে যাচ্ছে সে, তার আগেই ঠোঁটে হুইসেল তুলে বাজিয়ে দিল কর্নেল হোলিস।
হরর ফিল্মেই শুধু এ ধরনের দৃশ্য দেখা যায়, কবর থেকে একযোগে উঠে দাঁড়ায় অতৃপ্ত আত্মারা। এতক্ষণ যেগুলোকে ঝোঁপ-ঝাড় বলে মনে হচ্ছিল, হঠাৎ সেগুলো সটান দাঁড়িয়ে পড়ল খাড়া হয়ে। সচল ঝোঁপগুলো দ্রুত ক্যাপটেন আর তার সৈনিকদের ঘিরে ফেলল এটা অর্ধবৃত্তের ভেতর।
অগ্নিদৃষ্টি হানল কর্নের হোলিস। বুমম, তুমি মারা গেছ!
ক্যাপটেন লুইসের জেদ চুরমার হয়ে গেল। আমি… আমি অবশ্যই রিপোর্ট করব.. জেনারেল কার্টিসের কাছে …, হাঁপাতে শুরু করল সে।
করবে বৈকি, ঠাণ্ডা সুরে বলল কর্নেল। তাকে তুমি আরও রিপোর্ট করবে, আমি যে নির্দেশ পেয়েছি সেটা এসেছে জয়েন্ট চিফস-এর জেনারেল মেটক্যাফের কাছ থেকে। পেন্টাগনের সাথে যোগাযোগ করে সত্যতা যাচাই সম্ভব। সিভিলিয়ান না আমরা, গনগোরা হিলে তোমরা যে কাজ করছে তাতে বাধা দিতে আসিনি এখনও। বা, নদীর কিনারায় জেনারেল যে দায়িত্ব পালন করছেন, তাকেও নাক গলাবার কোনো ইচ্ছে আমাদের নেই। আমাদের কাজ হলো রোমান সারফেস আর্টিফ্যাক্টস খুঁজে বের করা ও সংসরক্ষণ করা, হারিয়ে বা চুরি হয়ে যাওয়ার আগে। ডু ইউ রিড, ক্যাপটেন?
বুঝেছি, স্যার, জবাব দিল ক্যাপটেন হিল, চঞ্চল দৃষ্টিতে স্পেশাল ফোর্সের ঝোঁপ ঢাকা সদস্যদের দেখছে। রং লাগানো মুখগুলোয় কোনো ভাব ফোটেনি।
পেয়েছি! আরেকটা পেয়েছি! ট্রেঞ্চ থেকে পিটের চিৎকার ভেসে এল।
সবাইকে হাতছানি দিয়ে ডাকলেন অ্যাডমিরাল। কিছু একটা আবিষ্কার করেছে।
অধিকার নিয়ে ঝগড়াটা ভুলে যাওয়া হলো, দুদলের সব কজন ভিড় করল ট্রেঞ্চের কিনারায়। ট্রেঞ্চের মেঝেতে হামাগুড়ি দেয়ার ভঙ্গিতে রয়েছে পিট, লম্বা একটা ধাতব বস্তুর গা থেকে আলগা মাটি পরিষ্কার করছে। কাজটা শেষ করতে প্রায় দুমিনিট সময় নিল ও। তারপর, অত্যন্ত সতর্কতার সাথে ধরিয়ে দিল লিলির হাতে।
রাগ বা রেষারেষি দূর হয়েছে, সবাই আগ্রহের সাথে তাকিয়ে থাকল লিলির দিকে। গভীর মনোযোগের সাথে জিনিসটা পরীক্ষা করছে ড. শার্প। চতুর্থ শতাব্দীর তলোয়ার, সমস্ত রোমান, বৈশিষ্ট্য উপস্থিত, ঘোষণা করল সে।
সামান্য মরচের ছাপ, প্রায় অক্ষতই বলা যায়।
মে আই? জিজ্ঞেস করল কর্নেল।
তলোয়ারটা তার দিকে বাড়িয়ে দিল লিলি, দুহাত দিয়ে সেটার হাতলটা শক্ত করে ধরল কর্নেল, ফলাটা মাথার ওপর খাড়া করে তুলল। ভেবে দেখো, একাবার শুধু কল্পনা করো, শেষ যে লোক এটা ধরেছিল সে ছিল রোমান সেনাবাহিনীর একজন সৈনিক। সতর্কতার সাথে তলোয়ারটা ক্যাপটেনের হাতে ধরিয়ে দিল সে। অটোমেটিক ফায়ার আর্মের বদলে এটা দিয়ে যুদ্ধ করতে কেমন লাগবে তোমার?
বুলেট খেতে রাজি, চিন্তিত সুরে বলল লুইস, কচুকাটা হতে আপত্তি আছে।
.
কাছাকাছি ক্যাম্পে ফিরে গেল প্রকৌশলীরা। তারা অদৃশ্য হতেই কর্নেলের দিকে ফিরল পিট। আপনাদের ক্যামোফ্লেজ সত্যি দারুণ। গোটা টিমের মধ্যে আমি মাত্র তিনজনকে চিনতে পেরেছি।
আমার রীতিমতো ভৌতিক লাগছিল পরিবেশটা, বলল লিলি। জানি আপনারা সবাই চারপাশে আছেন অথচ কাউকে দেখতে পাচ্ছি না!
নির্ভেজাল লজ্জা পেল কর্নেল, কাঁধ দুটো আড়ষ্ট হয়ে গেল।
সত্যি নিখুঁত, কর্নেলের হাত মুচড়ে দিয়ে বললেন অ্যাডমিরাল।
এখন শুধু বেচারা ক্যাপটেনের রিপোর্ট জেনারেল কার্টিস গিললে হয়, মন্তব্য করল জিওর্দিনো।
যদি শোনার মতো সময় দিতে পারেন, বলল পিট। তাঁর সামনে লাখ খানেক শত্রু নদী পেরোবার জন্য প্রস্ততি নিচ্ছে। আমাদের সাথে লাগালাগি করার সময় কোথায় তার?
রোমান তলোয়ারটা নিয়ে কী করা হবে? আবার সেটা মাথার ওপর খাড়া করে ধরল কর্নেল।
যেখান থেকে এসেছে সেখানে ফিরে যাবে, আঙ্কেল স্যামের মিউজিয়ামে।
ঝট করে পিটের দিকে তাকাল কর্নেল, চোখ বিস্ফারিত।
এটা আপনি ট্রেঞ্চে পাননি?
না।
মাই গড! আপনি দেখছি আমাকেও বোকা বানিয়েছেন।
পিট ভাব দেখাল, কথাটা নে শুনতে পায়নি। সামান্য হেঁটে চূড়ার ওপর উঠে এল ও, ঢাল ছাড়িয়ে মেক্সিকোর দিকে নেমে গেল ওর দৃষ্টি। ষোলো ঘণ্টা আগে যেমন দেখেছিল, তাবুর সংখ্যা আজ তার দ্বিগুণ হয়েছে। কাল রাতে, ভাবল ও। ঝড়ের লাগাম কাল রাতে ছাড়বে টপিটজিন। বাঁ দিকে ঘুরল ও, একটু বেশি উঁচু গনগোরা হিলের দিকে তাকাল।
চারদিন আগে লিলি যেখানে আন্দাজ করেছিল, ঠিক সে-জায়গাতেই মাটি খুঁড়ছে আর্মি প্রকৌশলীরা। দুটো আলাদা জায়গায় খুঁড়ছে ওরা। মাথায় ঝুলপাথরের ছাদ নিয়ে একটা টানেল আগে থেকেই আছে, সেটার বন্ধ মুখ থেকে মাটি কাটা হচ্ছে। দ্বিতীয়টা খোলা একটা মানি, পাহাড়ের পাশে গভীর একটা গর্ত, ভেতরে ঢোকার জন্য আবর্জনা পরিষ্কার ও পথটা চওড়া করা হচ্ছে। খুবই ঢিলে তলে এগোচ্ছে কাজ, কারণ বেশির ভাগ প্রকৌশলীকে সীমান্তে ডেকে নিয়েছেনে জেনারেল কার্টিস।
ঢাল বেয়ে নেমে এল পিট। থামল কর্নেলের সামনে। আপনার সেরা ডিমোলিশন এক্সপার্ট কে?
গোটা আর্মিতে সেরা এক্সপ্লাসিভ এক্সপার্ট জন ডিলিঞ্জার। কেন?
জবাব না নিয়ে পিট বলল, দুকিলোগ্রাম সি-সিক্স নাইট্রোগ্লিসারিন জেল চাই। আমার।
অবাক দৃষ্টিতে পিটকে দেখল কর্নেল। দুকিলো সি-সিক্স? দশ কিলোর একটা যুদ্ধজাহাজ ডুবিয়ে দেয়া যায়। কী চাইছেন আপনি জানেন? জানেন নাইট্রোজেন সিক্স শক-বিপজ্জনক?
আরও চাই অনেকগুলো স্পটলাইট, বলে গেল পিট। ওগুলো আমরা কোনো রক-কনসার্ট গ্রুপের কাছ থেকে ধার করতে পারব। স্পটলাইট, স্ট্রোবলাইট আর কান ফাটানো অডিও ইকুইপমেন্ট। এরপর লিলির দিকে ফিরল ও। তোমার কাজ হলো, একজন কাঠমিস্ত্রী জোগাড় করা, তাকে একটা বাক্স বানাতে হবে।
ফর গডস সেক, এসব দিয়ে কী করবে তুমি? কৌতূহলে হাঁপিয়ে উঠল লিলি।
সে তুমি বুঝবে না, গুঙিয়ে ওঠার সুরে টিটকারি মারল জিওর্দিনো।
পরে আমি ব্যাখ্যা করব, এড়িয়ে গেল পিট।
শুনে আমার পাগলামি মনে হচ্ছে, ভ্রু কুঁচকে বলল লিলি।
কমিয়ে বলেছে লিলি, ভাবল পিট। ওর প্ল্যানটা পাগলামিরও বেশি। তবে, আপাতত সবাইকে অন্ধকারে রাখতে হবে। ও যে মঞ্চে অভিনয় করতে চায়, সে কথা বলার সময় এখনও আসেনি।
.
৭২.
গায়ে ট্যাক্সি লেখা ভলভো গাড়িটা আলেকজান্দ্রিয়ার কাছাকাছি ইয়াজিদের প্রাসাদতুল্য ভিলার গাড়ি-পথে থামল। প্রেসিডেন্ট হাসানের ব্যক্তিগত নির্দেশে মিসরীয় আর্মি গার্ডরা পাহারায় রযেছে গেছে। গাড়িটা থেকে কাউকে নামতে না দেখে সতর্ক হয়ে উঠল তারা।
পেছনের সিটে বসে আছে সুলেমান আজিজ, তার চোখ আর চোয়ালে মোটা ব্যান্ডেজ। নীল সিল্কের আলখেল্লা পরে আছে সে, মাথায় ছোট আকারের লাল পাগড়ি। সান্টা ইনেজ দ্বীপ থেকে পালাবার পর আর্জেন্টিনার মার ডেল প্লাটা শহরের একজন সার্জেনের হাতে দুঘণ্টার জন্য নিজেকে ছেড়ে দিয়েছিল সে। তারপর একটা প্রাইভেট জেট ভাড়া করে মহাসাগর পেরিয়ে চলে এসেছে শহরের বাইরে ছোট একটা এয়ারপোর্টে।
খালি চোখের কোটরে কোনো ব্যথা নেই, কাজ হয়েছে ওষুধে। তবে গুঁড়িয়ে যাওয়া চোয়াল নিয়ে কথা বলতে এখনও তার জান বেরিয়ে যাবার উপক্রম হয়। গোটা অস্তিত্বে আচ্ছন্ন, ঘুমঘুম ভাব থাকলেও তার মন আর মাথা আগের মতোই নির্দয় দক্ষতার সাথে কাজ করছে।
আমরা পৌঁছে গেছি, ড্রাইভারের সিট থেকে বলল ইবনে।
কল্পনার চোখে ইয়াজিদের ভিলাটা দেখতে পেল সুলেমান আজিজ, এত পরিষ্কারভাবে, যেন চক্ষুস্মান একজন লোক টিলার ভেতর দিয়ে হাটছে।
জানি, মৃদুকণ্ঠে বলল সে।
এ-কাজ আপনার না করলেও চলে, হযরত।
আর কোনো ভয় নেই আমার, আর কোনো আশা নেই, শান্ত গলায়, ধীর ধীরে বলল সুলেমান আজিজ, প্রতিটি শব্দ উচ্চারণ করতে নরকযন্ত্রণা ভোগ করল। এ আল্লাহরই ইচ্ছা।
দরজা খুলে নিচে নামল, ইবনে সুলেমানকে নামতে সাহায্য করল। গাড়ি পথ ধরে কয়েক পা সামনে এসে দাঁড় করাল তাকে।
আপনার পাঁচ মিটার সামনে গেট জনাব, থেমে থেমে, আবেগে বুজে আসা গলায় বলল। সুলেমান আজিজকে বুকে টেনে নিয়ে আলিঙ্গন করল সে।
বিদায়, হযরত। আপনার কথা আমি কখনও ভুলব না।
প্রতিজ্ঞা রক্ষা কোরো, বিশ্বস্ত বৎস। শিষ্যদের মধ্যে তুমিই আমার সবচেয়ে প্রিয়। বেহেশতের বাগানে আবার আমাদের দেখা হবে।
দ্রুত ঘুরল ইবনে, হন হন করে ফিরে এল গাড়ির কাছে। স্থির পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকল সুলেমান আজিজ, একসময় দূরে মিলিয়ে গেল ইঞ্জিনের আওয়াজ। এবার সে ধীর পায়ে গেটের দিকে এগোল।
এই যে, অন্ধ, থামো ওখানে! নির্দেশ দিল একজন গার্ড।
আমি আমার ভাগ্নের সাথে দেখা করতে এসেছি। আমার ভাগ্নে, আখমত ইয়াজিদ।
গার্ড তার এক সঙ্গীর উদ্দেশে মাথা ঝাঁকাল। গার্ডহাউসে ঢুকে আবার বেরিয়ে এল সঙ্গী, হাতে বিশজনের একটা তালিকা।
বলছেন মামা। কী নাম আপনার?
ছদ্মবেশী হিসেবে জীবনের শেষ অভিনয়টা উপভোগ করছে সুলেমান আজিজ। পুরনো উপকারের শোধ চেয়ে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক কর্নেলের কাছ থেকে কিছু লোকের একটা তালিকা পেয়েছে সে, ইয়াজিদের ভিলায় যাদের প্রবেশাধিকার আছে। তালিকা কে এমন একজনকে বেছে নিয়েছে, সাথে সাথে তার সাথে যোগাযোগ করার উপায় নেই।
মোস্তফা মাহফুজ।
এখানে আপনার নাম আছে তা ঠিক, তবে পরিচয়পত্র দেখাতে হবে। সুলেমান আজিজের জাল করা কাগজপত্র পরীক্ষা করল গার্ড, ব্যান্ডেজ ঢাকা চেহারার সাথে ফটোর মিল খোঁজার ব্যর্থ চেষ্টা করল সে।
আপনার মুখের এই অবস্থা হলো কী করে?
আল মনসুরা বাজারে একটা গাড়ি-বোমা ফেটেছে, শোনোনি?
শুনব না কেন! রাগের সাথে গার্ড। ফাটিয়েছে তো আপনার ভাগ্নের লোকেরাই। সঙ্গীর দিকে ফিরল সে, মেটাল ডিটেকটর আওয়াজ না করলে, পথ দেখিয়ে বাড়ির ভেতর দিয়ে এসো।
মেটাল ডিটেকটরে কিছু ধরা পড়ল না।
সামনের দরজা, তৃপ্তির সাথে ভাবল সুলেমান আজিজ। আখমত ইয়াজিদের সাথে দেখা করার জন্য আজ তাকে পেছনের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকতে হবে না। দুঃখ এই যে তাদের দেখা হবার সময় ইয়াজিদের চেহারাটা সে দেখতে পাবে না।
বড় হলঘরে নিয়ে আসা হলো সুলেমান আজিজকে। পাথরের একটা বেঞ্চে বসল
অপেক্ষা করুন এখানে।
সুলেমান শুনতে পেল, গেটে ফিরে যাবার আগে কার সাথে যেন নিচু গলায় ফিসফিস করল গার্ড। কয়েক মিনিট চুপচাপ বসে থাকল সে। তারপর পায়ের আওয়াজ ঢুকল কানে। শব্দটা এগিয়ে আসছে।
হঠাৎ তীক্ষ্ণ, কঠিন একটা গলা শোনা গেল, আপনি?
গলার আওয়াজটা সাথে সাথে চিনতে পারল সুলেমান আজিজ। হ্যাঁ, সহজ সুরে জবাব দিল সে। তোমাকে আমি চিনি?
আমাদের দেখা হয়নি। আমার নাম খালেদ ফৌজি, জনাব ইয়াজিদের বৈপ্লবিক কাউন্সিলের নেতা।
আপনার সম্পর্কে অনেক কথা শুনেছি আমি, সাথে সাথে বলল সুলেমান আজিজ।
ভাবল, তুমি চিরকাল আমার পেছনে লেগে আছ। আমার ভাগ্য ভালো যে চিনতে পারোনি। আপনার সাথে পরিচিত হয়ে গর্ববোধ করছি।
আসুন, সুলেমান আজিজের একটা হাত ধরে বলল খালেদ ফৌজি। আপনাকে আমি জনাব ইয়াজিদের কাছে নিয়ে যাই। তার ধারণা, এখনও আপনি বাগদাদে রয়েছেন মিসরের কাজে। আপনি যে আহত হয়েছেন তিনি বোধ হয় জানেন না।
তিন দিন আগে আমার ওপর হামলা করা হয়েছে, অবলীলায় মিথ্যে বলে গেল সুলেমান আজিজ। আজই সকালে হাসপাতাল থেকে বেরিয়েছি, প্লেন ধরে সোজা চলে এসেছি ভাগ্নের সাথে দেখা করার জন্য।
আপনার এই অবস্থা দেকে দুঃখ পাবেন জনাব ইয়াজিদ। তবে অসময়ে এসেছেন আপনি।
তার সাথে আমার দেখা হবে না?
তিনি নামাজে দাঁড়িয়েছেন।
এত ভোগান্তির মধ্যেও গলা ছেড়ে হেসে উঠতে ইচ্ছে করল সুলেমান আজিজের। ধীরে ধীরে সচেতন হলো সে কামরায় আরেকজন উপস্থিত রয়েছে। কিন্তু তার সাথে আমার দেখা না করলেই যে নয়।
যা বলার আমাকে বলতে পারেন, মাহফুজ। নামটা ব্যঙ্গের সুরে উচ্চারণ করল খালেদ ফৌজি। আপনার কথা জনাব ইয়াজিদের কাছে পৌঁছে দেব আমি।
আখমতকে বলুন, আমি তার মিত্র সম্পর্কে একটা খবর নিয়ে এসেছি?
মিত্র? কে?
টপিটজিন।
নামটা যেন ঘরের বাতাসে অনন্তকাল ধরে ঝুলে থাকল। জমাট বাঁধল নিস্তব্ধতা। তারপর, হঠাৎ সেটা খান খান হলো নতুন একটা কণ্ঠের ভারী আওয়াজে।
মরে গিয়ে দ্বীপটাতেই ভূত হয়ে থাকা উচিত ছিল তোমার, সুলেমান আজিজ, তিরস্কার করল আখমত ইয়াজিদ।
স্থির থাকল সুলেমান আজিজ। আক্রোশ আর ক্রোধের লাগামে ছিল পড়তে দিল, বৃদ্ধি আর সর্বশেষ শক্তিটুকু এই মুহূর্তের জন্য ধরে রেখেছে সে। মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করার কোনো ইচ্ছে তার নেই। এগিয়ে গিয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করবে সে। পঙ্গু, অসহায়, অন্ধকারময় জীবন তার জন্য নয়। প্রতিশোধই হতে পারে জীবনের শেষ অর্জন।
কী করে মরি, জনাব? আপনার সামনে দাঁড়িয়ে শেষবার ক্ষমা না চেয়ে কী করে মরি!
বন্ধ করো তোমার প্রলাপ! ন্যাকামি তোমাকে মানায় না। আবার ব্যান্ডেজ জড়িয়ে আসা হয়েছে। খোলো ওসব! মাহফুজের ছদ্মবেশ নিতে গিয়ে কী কাণ্ড করেছ তুমি নিজেও জানো না। রীতিমতো হাস্যকর লাগছে তোমাকে।
সুলেমান জবাব দিল না। ধীরে ধীরে ব্যান্ডেজটা খুলতে শুরু করল সে। সবটুকু খুলে ফেলে দিল মেঝেতে।
আঁতকে উঠল আখমত ইয়াজিদ। নিজের অজান্তেই এক পা কিছু হটল সে, সুলেমান আজিজের বিকৃত চেহারায় চুম্বকের মতো আটকে থাকল তার দৃষ্টি।
খালেদ ফৌজির গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেল। রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত মানুষের শরীর আগেও তাকে অদ্ভুত এক শিহরণ উপহার দিয়েছে।
আপনার সেবা করতে গিয়ে, ধীরে ধীর বলল সুলেমান আজিজ, এই মূল্য দিতে হয়েছে আমাকে।
তুমি বেঁচে আছ কী করে? জিজ্ঞেস করল আখমত ইয়াজিদ, তার গলা কেঁপে গেল।
আমার বিশ্বস্ত ভক্ত ইবনে দ্বীপটায় দুদিন লুকিয়ে রাখে আমাকে। নিজের হাতে কাঠের একটা ভেলা তৈরি করে সে। স্রোত আমাদের টেনে নিয়ে যায় একটানা দশ ঘণ্টা। আল্লাহ মেহেরবান, চিলির একট ফিশিং বোট আমাদের তুলে নিয়ে নামিয়ে দেয় তীরে, সেখান থেকে প্লেনে করে চলে আসি ডেল পান্টায়। ওখান থেকে প্লেন চার্টার করে মিসরে পৌঁছুতে তেমন অসুবিধা হয়নি।
মৃত্যু তোমার সাথে পেরে উঠছে না, বিড়বিড় করে বলল আখমত ইয়াজিদ।
কিন্তু বুঝতে পারছ তো, ব্যঙ্গের সুরে প্রশ্ন করল খালেদ ফৌজি, এখানে এসে নিজের মৃত্যু পরোয়ানায় সই করেছ তুমি?
আমি অন্ধ হলেও, বুদ্ধি হারাইনি।
সুলেমান আজিজ, বিষণ্ণ সুরে বলল আখমত ইয়াজিদ। তার সময়ের শ্রেষ্ঠ আততায়ী, যাকে যমের মতো ভয় করত সিআইএ আর কেজিবি। অসমসাহস আর অতুলনীয় চাতুর্যের পরিচয় দিয়ে গত দুই দশকের বহুল আলোচিত অন্তত পঞ্চাশটা রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, তার কৃতিত্ব ও দাপটের এখানেই সমাপ্তি। কৃতিত্ব ও দাপটের, তবে অস্তিত্বের নয়। নাম-ঠিকানা বদলে তোমাকে ঠাই নিতে হবে ফুটপাতে, মেনে নিতে হবে অন্ধ ভিক্ষুকের অসহায় জীবন। সত্যি, অত্যন্ত দুঃখজনক। আমার কথা বুঝতে পারছ, সুলেমান আজিজ?
কী বলছেন আপনি, জনাব? অবাক হয়ে জকিয়ে থাকল খালেদ ফৌজি।
হ্যাঁ, লোকটা আগেই মারা গেছে। ইয়াজিদের চেহারায় ধীরে ধীরে তৃপ্তির ভাব ফুটে উঠল। আমাদের ফিইন্যানশিয়াল এক্সপার্টরা ওর বিষয় সম্পত্তি আর ইনভেস্টমেন্ট আমার নামে লিখিয়ে নেবে। ওকে রাস্তার মোড়ে বসিয়ে দিয়ে, ওর ওপর চব্বিশ ঘণ্টা নজর রাখার ব্যবস্থা হবে। জীবনের বাকি কয়টা দিন ভিক্ষা করে কাটবে ওর। আকস্মিক মৃত্যুর চেয়ে অনেক বেশি কঠিন শান্তি সেটা।
আখমত ইয়াজিদের মুখের ওপর হাসল সুলেমান আজিজ। যা শোনাব, আপনি আমাকে সাথে সাথে খুন করবেন, জনাব।
কী শোনাবে।
লেডি ফ্ল্যামবোরা অপারেশন সম্পর্কে ত্রিশ পাতার একটা রিপোর্ট লিখেছি আমি। তাতে আপনার সাথে টপিটজিনের সম্পর্ক, আপনাদের পারিবারিক ইতিহাস ইত্যাদি সবই আছে। রিপোর্টের অনেকগুলো কপি তৈরি করেছি, এই মুহূর্তে সেগুলো বিভিন্ন ইন্টেলিজেন্স হেডকোয়ার্টার ও নিউজ সেন্টারে পড়া হচ্ছে। আমাকে নিয়ে আপনি যাই করুন না কেন, জনাব আখমত ইয়াজিদ, ওরফে মি, পল ক্যাপেসটার, আপনার দিনও শেষ হয়ে এসেছে
হঠাৎ থামল সুলেমান আজিজ,, তার গোটা মাথা যেন প্রচণ্ড ব্যথায় বিস্ফোরিত হলো। খালেদ ফৌজি নিজেকে সামলাতে না পেরে বেমক্কা একটা ঘুসি বসিয়ে দিয়েছে। তার মাথায়। টলতে টলতে পিছিয়ে এল সুলেমান আজিজ প্রায় জ্ঞান হারাবার মতো অবস্থা। আবার তাকে খালেদ আঘাত করতে যাচ্ছে দেখে চিৎকার করল আখমত ইয়াজিদ, থামো, বুঝতে পারছ না, লোকটা মরতে চায়? মিথ্যে ভয় দেখাচ্ছে ও, এই মুহূর্তে যাতে ওকে আমরা খুন করি।
ধীরে ধীরে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে আনল সুলেমান আজিজ। ধীরে ধীরে ঘুরল সে, ইয়াজিদের গলার আওয়াজ লক্ষ করে। খালেদ ফৌজির ঘন ঘন নিঃশ্বাসের শব্দও শুনতে পেল সে।
সামনের দিকে সামান্য ঝুঁকল সুলেমান আজিজ, আচমকা বা হাত বাড়িয়ে খপ করে খামচে ধরল আখমতের ডান হাত। খালি হাতটা উঠে গেছে পিঠের ওপর, ঘাড়ের পেছনে।
খুনির নিচে, শিরদাঁড়ার সাথে সাদা সার্জিক্যাল টেপ দিয়ে আটকানো ছুরিটা তার হাতে চলে এল। গুপ্তঘাতকরাই এ ধরনের ছুরি ব্যবহার করে, এমনভাবে তৈরি করা হয়, যাতে মেটাল ডিটেকটরের ধরা না পড়ে। বিদ্যুৎবেগে ছুরি ধরা হাতটা নামিয়ে আনল. সে, তারপর ঢুকিয়ে দিল ছুরিটা ইয়াজিদের বুকে, আঠারো সেন্টিমিটার লম্বা ব্লেডটা আমুল গেঁথে গেল বুকের খাঁচার নিচে।
ধাক্কা খেয়ে মেঝে থেকে শূন্যে উঠে পড়ল আখমত ইয়াজিদ। বিস্ময় ও আতঙ্কে বিস্ফারিত হয়ে উঠল পল ক্যাপেসটারের চোখ জোড়া। গলা থেকে বেরোল আহত পশুর গোঙানি।
বিদায়, নরকের কীট!! হ্যাঁচকা টানে ছুরিটা বের করল সুলেমান আজিজ, খালেদ ফৌজির নিঃশ্বাসের শব্দ লক্ষ করে ঝট করে ঘুরল। ছুরিটা জায়গা মতো লাগল না, প্রতিপক্ষের নাকের পাশে মাংস দুভাগ করে দিল।
সুলেমান আজিজ জানে, খালেদ ফৌজি ডান-হাতি, সাথে সব সময় একটা আগ্নেয়াস্ত্র রাখে, বাম বগলের নিচে পুরনো একটা নাইন মিলিমিটার ব্লগার। তার গায়ে ঢলে পড়ল সে, মৌলবাদী আতঙ্কবাদী নেতাকে আঁকড়ে ধরে থাকল, সেই সাথে চেষ্টা করল মোক্ষম কোথাও ছুরিটা ঢোকাতে।
অন্ধ বলে দেরি করে ফেলল সে। ল্যগারটা খালেদ ফৌজির হাতে চলে এসেছে। তার হৃৎপিণ্ডে সুলেমান আজিজের ছুরি ঢোকার পূর্ব মুহূর্তে লুগারের মাজল থেকে আগুনের ফুলকি ছুটল। পেটে দুটো বুলেট নিয়ে খালেদকে ছেড়ে দিল সুলেমান আজিজ। টলতে টলতে পিছিয়ে এল খালেদ, বুকে বিদ্ধ ছুরিটার হাতল ধরে আছে দুহাতে। চোখ উল্টে পেল তার, ধপাস করে পড়ল মেঝের ওপর ইয়াজিদের দেহ থেকে সামান্য দূরে।
ধীরে ধীরে হাঁটু দুটো ভাজ হলো সুলেমান আজিজের। মেঝের ওপর শুয়ে পড়ল সে। আশ্চর্য, কোথাও কোনো ব্যথা নেই তার।
এক লোকের সাথে অল্প সময়ের জন্য দেখা হয়েছিল তার, সেই লোকটাই তার নিয়তি নির্ধারণ করে দিয়েছে। লম্বা, ঘন সবুজ চোখের সেই লোকটা ঠোঁটে ব্যঙ্গের হাসি।
ঘৃণায় তার সারা শরীর কেঁপে উঠল। ডার্ক পিট তোমাকে আমি… এর বেশি কিছু ভাবতে পারল না সুলেমান আজিজ। মারা গেল সে, তবে একটা আশা নিয়ে। ইবনেকে সব বলে গেছে সে, তার হয়ে ইবনেই করবে যা করার।
.
৭৩.
লেদার আর্মচেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে টেলিভিশন মনিটরগুলোর দিকে তাকালেন প্রেসিডেন্ট। প্রথম শ্রেণীর নেটওয়ার্ক-এর টিউন করা হয়েছ তিনটে, অপরটা সরাসরি রোমার একটা আর্মি কমিউনিকেশন ট্রাক থেকে খোরাক সংগ্রহ করছে। ক্লান্তি বোধ করছেন তিনি, তবে চকচকে চোখে ফুটে আছে তীব্র দৃষ্টি। পালা করে এক মনিটর থেকে আরেক মনিটরে তাকাচ্ছেন।
বিশ্বাস করা কঠিন এত অল্প জায়গায় এত বেশি লোক জড় হতে পারে, মৃদুকণ্ঠে বললেন তিনি।
ওদের খাবার প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। সিআইএ তাজা একটা রিপোর্ট থেকে মুখ তুললেন জুলিয়াস শিলার। খাবার পানির সঙ্কট চলছে। প্রায় অচল হয়ে পড়েছে পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা।
আমার ধারণা আজ রাতেই। রুদ্ধশ্বাসে বললেন ডেইল নিকোলাস। টপিটজিন আর সময় নেবে না।
কত লোক দেখা যাচ্ছে? জানতে চাইলেন প্রেসিডেন্ট। সংখ্যাটা আসলে কত হতে পারে?
এরিয়ার ফটোগ্রাফ থেকে কম্পিউটর মাথা শুনেছে-চার লাখ পঁয়ত্রিশ হাজার, জবাব দিলেন জুলিয়াস শিলার।
এক কিলোমিটারেরও কম চওড়া একটা করিডর ধরে হুড়মুড় করে বেরিয়ে আসবে। গম্ভীর হলেন ডেইল নিকোলাস।
ড্যাম দ্যাট মার্ডারিং বাস্টার্ড। হাঁটুর ওপর মৃদু ঘুষি মেরে বললেন প্রেসিডেন্ট। হারামজাদা বুঝতে পারছে না, ধাক্কাধাক্কিতেই মারা যাবে কয়েক হাজার লোক। আর ডুবে যে কত মরবে….
বেশির ভাগ মহিলা আর শিশু, ডেইল নিকোলাস যোগ করলেন।
এখনও দেরি হয়ে যায়নি, মার্টিন ব্রোগান বললেন, ওকে আমরা শেষ করার কথা ভাবতে পারি।
কিন্তু আপনার আততায়ীকে ওর যথেষ্ট কাছাকাছি পৌঁছাতে হবে তো, বললেন ডেইল নিকোলাস। তারপর কী ঘটবে? ওর ভক্তরা ছিঁড়ে টুকরো করে ফেরবে আপনার লোককে।
চারশো মিটার দূরে থেকে হাই পাওয়ারড রাইফেলের কথা বলছি আমি।
জুলিয়াস শিলার মাথা নাড়লেন। এটা কোনো সমাধান নয়। উঁচু কোথা থেকে গুলি করা হয়েছে, বুঝতে পারবে ওরা। টের পেয়ে যাবে, আমরা দায়ী। শান্তিপূর্ণ সমাবেশ বা মিছিলের বদলে জেনারেল কার্টিসকে সামলাতে হবে বিশাল উন্মত্ত জনতাকে। সত্যিকার যুদ্ধের মোকাবিলা করতে হবে আমাদের।
আমি একমত, ডেইল নিকোলাস জানালেন। আমেরিকান নাগরিক ও সৈনিকেঁদের বাঁচাবার জন্য মেক্সিকানদের ওপর ফায়ার ওপেন করা ছাড়া জেনারেল কার্টিসের আর কোনো উপায় থাকবে না।
হাঁটুর ওপর আবার মৃদু ঘুষি মেরে প্রেসিডেন্ট জানতে চাইলেন, পাইকারি হত্যাকাণ্ড ছাড়া আর কোনো সমাধান নেই?
আছে। ওদেরকে শান্তিপূর্ণ মিছিল নিয়ে সীমান্ত পেরোতে দেয়া।
আর যদি আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরি প্রেসিডেন্ট লরেঞ্জোর হাতে তুলে দিই? জিজ্ঞেস করলেন প্রেসিডেন্ট। তাতে অন্তত লাইব্রেরির ওপর টপিটীজনের নোংরা হাত পড়বে না।
টপিটজিন তো আসলে লাইব্রেরিটাকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করছে, মার্টিন ব্রোগান বললেন। আমাদের ইন্টেলিজেন্স সোর্স রিপোর্ট করেছে, এই একই ধরনের জন-সমাবেশের আয়োজন করতে যাচ্ছে সে সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া আর আরিজোনা সীমান্তে।
চারটে টেলিফোন, একটা বেজে উঠল। রিসিভার তুলে শুনলেন ডেইল উইলপোর্স। জেনারেল কার্টিস মি. প্রেসিডেন্ট। মনিটরে আসছেন তিনি।
প্রায় সাথে সাথে মনিটরে ফুটে উঠল জেনারেল কার্টিসের ছবি। বয়স পঞ্চাশ, বাঘের মতো চেহারা, মাথা জোড়া প্রকাণ্ড চকচকে টাক। নীল চোখে কঠোর দৃষ্টি।
গুড মর্নিং, জেনারেল, বললেন প্রেসিডেন্ট। দুঃখের বিষয় আপনাকে আমি দেখতে পেলেও, আপনি আমাকে দেখতে পাচ্ছেন না। এদিকে কোনো ক্যামেরা নেই।
বুঝতে পারছি, মি. প্রেসিডেন্ট।
পরিস্থিতিটা কী?
এইমাত্র তুমুল বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বেচারা মেক্সিকানদের জন্য আশীর্বাদ বলা যায়। পানির সঙ্কট কিছুটা ঘুচবে, ধুলো থাকবে না।
ওদিক থেকে কোনোভাবে প্ররোচিত করার চেষ্টা হয়েছে?
আপত্তিকর স্লোগান শুনছি, ব্যানারের লেখাগুলোও গা জ্বালিয়ে দেয়ার মতো, তবে কোনো ভায়োলেন্সের লক্ষণ এখনও দেখছি না।
হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছে লোকজন, এমন ঘটনা দুএকটা ছোখে পড়েনি?
না, স্যার। উৎসাহ বরং প্রতি মুহূর্তে বাড়ছে। সবার ধারণা ওদের আধুনিক আটেক দেবতা বৃষ্টি আনিয়েছে। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে নিজের বুকে চাপড় মারতে মারতে সেই দাবি করছে টপিটজিন।
আমার উপদেষ্টাদের ধারণা, জনতাকে নিয়ে আজ রাতেই সীমান্ত পেরোবে সে।
আমার ইন্টেলিজেন্স রিপোর্টও তাই বলে। খানিক ইতন্তত করে জেনারেল কার্টিস : চ্যান্ডলার জানতে চাইলেন, স্যার, আগের নির্দেশই কি বহাল থাকবে? যেকোনো মূল্যে ওদেরকে হটিয়ে দেব আমি?
যতক্ষণ না নতুন নির্দেশ দিই, জেনারেল।
আপনি স্যার, আমাকে উভয় সঙ্কটে ফেলে দিয়েছেন। নির্দেশ দিলেও আমার লোকেরা নিরীহ শিশু আর মহিলাদের ওপর নির্বিচারে গুলি করবে কি না আমি জানি না।
নিয়তি আপনাকে এই ভূমিকা দান করেছে, প্রেসিডেন্ট বললেন। কিন্তু রোমায় যদি ওদেরকে ঢুকতে দেয়া হয়, মেক্সিকানরা মনে করবে বিনা বাধায় অন্যান্য সীমান্ত দিয়েও অনায়াসে ঢুকতে পারে তারা। তখন কয়েক মিলিয়ন মেক্সিকানকে সামলাতে হবে আমাদের।
আপনার নির্দেশ নিয়ে তর্ক চলে না, আমি জানি, মি. প্রেসিডেন্ট বললেন। কিন্তু পাঁচ লাখ লোক কাঁধে কাঁধ ঠেকিয়ে এগিয়ে এলে, আমাকে যদি তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়তে হয়, ইতিহাসে মানবতার বিরুদ্ধে ভয়ঙ্কর অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে সেটা।
এখন মনে হচ্ছে বটে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ কিন্তু সীমান্ত পেরিয়ে ভেতরে ঢোকার পর মিছিলগুলো শান্তিপূর্ণ থাকবে না, বললেন প্রেসিডেন্ট। উন্মত্ত জনতা আমেরিকানদের যাকেই সামনে পাবে, নির্মমভাবে খুন করবে। কোনো আমেরিকান মেক্সিকান নাগরিক আজ আর নিরাপদ নয়।
ঝাড়া বিশ সেকেন্ড চুপ করে থাকলেন জেনারেল কার্টিস। কামরার প্রতিটি লোক বুঝতে পারছে, কী দ্বিধা কাজ করছে জেনারেলের মনে।
আমি চাই কমিউনিকেশন লাইন সারাক্ষণ খোলা থাকুক।
থাকবে।
ধন্যবাদ, প্রেসিডেন্ট।
তো, শিলার মন্তব্য করলেন, যতটা সম্ভব চেষ্টা আমরা করেছি। এখন শুধু অপেক্ষা।
.
৭৪.
সন্ধ্যার এক ঘণ্টা পর রওনা হলো ওরা।
জনস্রোতের সামনের অংশে থাকল মহিলা, শিশু, পুরুষ। সবার হাতে জ্বলন্ত মোমবাতি। বৃষ্টি থেমে যাবার পরও আকাশে ইতস্তত করছে মেঘ, অগণিত মোমবাতির শিখা গোলাপি আভা দান করল মেঘের গায়ে।
বিশাল একটা ঢেউ-এর মতো নদীর তীর লক্ষ্য করে এগোল তারা, লাখো জনতার সম্মিলিত কণ্ঠ থেকে ধর্মীয় সঙ্গীতের সুর প্রথমে গুঞ্জনের মতো শোনাল, ক্রমশ বদলে গিয়ে হয়ে উঠল গুরুগম্ভীর গর্জন। পাহাড়ের গায়ে লেগে ফিরে এল প্রতিধ্বনিগুলো, থরথর করে কাঁপতে শুরু করল রোমার জানালা দরজা।
নদীর পাড়ের দিকে পথটা কাদায় থকথক করছে। শুধু আছাড় খেয়ে পড়ে নয়, অনেক শিশু ভয়েও কেঁদে উঠছে, গ্রাম্য মায়েরা বুকে তুলে নিয়ে আদর করছে বাচ্চাদের। বড়দের কারো চেহারায় ভয় বা উদ্বেগের চিহ্নমাত্র নেই। বেশিরভাগ তারা বস্তিবাসী, আধপেটা খেয়ে জীবন ধারণ করছে যুগের পর যুগ। আধুনিক আযটেক দেবতা টপিটজিন তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, সীমান্ত পেরিয়ে পূর্ব-পুরুষদের হাপিট শহরগুলো দখল করতে পারলে গরিব মানুষের ভাগ্য রাতারাতি বদলে যাবে। দখলদার আমেরিকানদের তাড়িয়ে দেয়া কোনো সমস্যা নয়, এতো লোককে একসাথে সীমান্ত পেরুতে দেখলে ভয়েই তারা লেজ গুটিয়ে পালাবে। সরল, নিরীহ মেক্সিকানরা বিশ্বাস করেছে তার কথা। নদীর পাড় থেকে ধীরে ধীরে, সতর্কতার সাথে পানিতে নামল তারা, পরস্পরকে যথাসম্ভব সাহায্য করল। দেখতে দেখতে হাজার হাজার নৌকো, ইঞ্জিনচালিত বোট আর ভেলা ভর্তি হয়ে গেল। নদীর পাড়ে তারপরও দাঁড়িয়ে থাকতে রাজি নয় অনেকে, কাঁধে বাচ্চাকে নিয়ে পানিতে নামল তারা, সাঁতার কেটে নদী পেরুবে। জনস্রোতের আরেকটা অংশ ব্রিজের দিকে এগোল। কিছু লোকের নদীতে নামার ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু পেছন থেকে ভিড়ের প্রচণ্ড চাপ নামতে বাধ্য করল তাদেরকে।
ভয়ার্ত চিৎকার শোনা গেল। আছাড় খেয়ে পড়ার পর সঙ্গীদের পায়ের তলায় চ্যাপ্টা হলো বহু লোক। অনেক নৌকো উল্টে গেল, ডুবে গেল সাঁতার না জানা বহু শিশু ও বৃদ্ধ। তবু, জনস্রোতের অগ্রযাত্রা থামল না। কয়েক মিনিটের মধ্যে বহু শিশু আর বৃদ্ধ। তবু, জনস্রোতের অগ্রযাত্রা থামল না। কয়েক মিনিটের মধ্যে গোটা নদীতে ছড়িয়ে পড়ল ছোটো ছোটো জলযানগুলো।
মার্কিনীদের আর্মি সার্চলাইট আর টেলিভিশন ক্রুদের ফ্লাডলাইট নদীর ওপর বিশৃঙ্খল দৃশ্যটাকে আলোকিত করে রেখেছে। আনাড়ি লোকজনের করুণ পরিণতি এবং সচল মানব-পাঁচিলের অগ্রযাত্রা বিস্ময়-বিস্ফারিত চোখে দেখতে সৈনিকরা।
রাফ-এর মাঝখানে রোমার পুলিশ স্টেশন, তার ছাদে দাঁড়িয়ে রয়েছেন জেনারেল নিউগল কার্টিস। উজ্জ্বল আলোয় ফ্যাকাসে দেখায় তার চেহারা, চোখে উদভ্রান্ত দৃষ্টি। কপালের সাথে ক্লিপ দিয়ে আটকানো খুদে মাইক্রোফোনে কথা বললেন তিনি,
দেখতে পাচ্ছেন, মি. প্রেসিডেন্ট? দেখতে পাচ্ছেন কী রকম পাগলামি?
সাবইকে নিয়ে সিচ্যুয়েশন রুমে রয়েছেন প্রেসিডেন্ট, একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন বিশাল মনিটরের দিকে।
হ্যাঁ, ট্রান্সমিশন পরিষ্কার আসছে। লম্বা একটা টেবিলের মাথায় বসে আছেন তিনি, সাথে রয়েছেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও উপদেষ্টারা এবং চারজন জয়েন্ট চিফস অব স্টাফ-এর দু’জন।
তীরে পৌঁছাল প্রথম দ্রুতগামী বোটগুলো। ঝটপট নেমে পড়ল আরোহীরা। হাজার হাজার নৌকা ও বোট তীরে ভেড়ার পর জনস্রোতের প্রথম ঢেউটা ধীরে ধীরে বিশাল এক মিছিলের আকৃতি পেল। আরোহীদের নামিয়ে দিয়েই ফিরতি পথে রওনা হয়ে গেছে জনযানগুলো।
নারী ও শিশুদের সাথে অল্প কিছু পুরুষ এ পারে এসেছে, মিছিলের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল তারা, সবার মুখে একটা করে বুলহন, মহিলা নেত্রীদের উৎসাহ ও নির্দেশ দিচ্ছে।
মহিলাদের এক হাতে জ্বলন্ত মোমবাতি, অপর হাত বুকের সাথে চেপে ধরে আছে। দুগ্ধপোষ্য শিশুকে, মুখে প্রাচীন আযটেক গান, ব্লাফটাকে ঘিরে চক্কর দিতে শুরু করল। ব্লাফের নিচের ঢালগুলোতে উঠে পড়ল অনেকে, সার সার বসানো কামান আর সৈনিকদের হাতে ধরা রাইফেলের মাজল তাক করা হয়েছে দেখে ভয় পেয়ে কেঁদে উঠল বাচ্চারা। মায়েদের মনে কোনো ভয় নেই, কারণ আযটেক অবতার টপিটজিন আশ্বাস দিয়েছে, তার আধ্যাত্মিক শক্তিই রক্ষা করবে তাদেরকে।
গুড লর্ড! আঁতকে উঠলেন ডগলাস ওটস। প্রথমে শুধু দেখছি মহিলা আর শিশুদের পাঠিয়েছে।
কেউ কোনো কথা বললেন না, কারণ মনিটরে দেখা যাচ্ছে ব্রিজের ওপর ব্যারিকেডের দিকে এগোচ্ছে বিশাল একটা মিছিল। তাদের সামনে বড় বড় ট্যাংকে আর আর্মারড কার, পথরোধ করে দাঁড়িয়ে আছে।
জেনারেল, ওদের মাথার ওপর ফাঁকা গুলি করতে পারেন? জিজ্ঞেস করলেন প্রেসিডেন্ট।
ইয়েস, স্যার, জবাব দিলেন জেনারেল কার্টিস।
ব্ল্যাঙ্ক রাউন্ড লোড করার জন্য আগেই নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
ফাইন, জয়েন্ট চিফস-এর জেনারেল মেটকাফ বললেন, কার্টিস তার কাজ বোঝে।
এইডদের একজনের দিকে ফিরলেন জেনারেল কার্টিস। এক পশলা ফাঁকা গুলি করার নির্দেশ দাও।
এইড, একজন মেজর, রেডিও রিসিভারে গর্জে উঠল, ব্ল্যাঙ্ক ফায়ার।
বিকট আওয়াজের সাথে রাতের আকাশে লাল শিখার একটা চাদর উড়ল। কানের পর্দা ফাটানো কামানের শব্দগুলো ফিরে এল পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে। শকওয়েভে নিভে গেল অনেক মোমবাতি। বিরতিহীন আওয়াজে কেঁপে উঠল উপত্যকা।
মাত্র দশ সেকেন্ড পর নির্দেশ হলো সিজ ফায়ার।
নিশ্চয় অনারণ্যে নেমে এল অটুট নিস্তব্ধতা। পরমুহূর্তে সম্মিলিত নারীকণ্ঠের তীক্ষ্ণ চিৎকার শোনা গেল, শুরু হলো শিশুদের গলা ফাটানোর প্রতিযোগিতা। অনেকেই আতঙ্কে শুয়ে পড়েছিল, কোথাও ব্যথা লাগেনি বা রক্ত ঝরছে না দেখে আবার তারা দাঁড়াল।
সীমান্তের ওপারে হঠাৎ জ্বলে উঠল সার সার স্পটলাইট। সাদা আলখেল্লা পরা কিছু লোক কাঁধে একটা প্ল্যাটফর্ম নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, যিশুর মতো হাত তুলে ছোট্ট প্ল্যাটফর্মে স্থির হয়ে রয়েছে টপিটজিন, লাউডস্পিকারের মাধ্যমে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে তার ভাষণ। হোক গুলি, কিন্তু প্রিয় শিষ্যরা আমার পবিত্র আধ্যাত্মিক শক্তিবলে তোরা কেউ আহত হবে না। এক ফোঁটা রক্ত, দেখাতে পারো কেউ। কেউ কি তোমরা আহত হয়েছ? আমার ওপর বিশ্বাস রাখো, মা ও বোনেরা।
উন্মাদিনীর মতো হেসে উঠল অনেক মহিলা। দুলে উঠল জনসমুদ্র।
কার্টিসের আর কোনো উপায় থাকল না, বিষণ্ণ কণ্ঠে বললেন ডেইল নিকোলাস।
মাথা ঝাঁকালেন জেনারেল মেটক্যাফ। হ্যাঁ, সমস্ত দায়িত্ব এখন ওকেই কাঁধে নিতে হবে।
.
থমথমে চেহারা নিয়ে ব্লাফের মাথায় দাঁড়িয়ে আছেন জেনারেল কার্টিস। সীমান্ত পেরিয়ে মেক্সিকানদের দ্বিতীয় স্রোতটা হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকছে। প্রথম স্রোতটা এরই মধ্যে পৌঁছে গেছে ট্যাংক বহরের কাছে।
স্যার, গুলি করার অর্ডার? একজন এইড জিজ্ঞেস করল।
অসহায় শিশুদের কান্না শুনতে পাচ্ছেন জেনারেল, দেখতে পাচ্ছেন আদর করে মায়েরা চুমো খাচ্ছে তাদের। মা ও শিশু, দু’জনেই হাঁ করে তাকিয়ে আছে ট্যাংকার কামানগুলোর দিকে।
জেনারেল, আপনার অর্ডার? প্রায় চিৎকার করে উঠল এইড।
বিড়বিড় করে কী যেন বললেন জেনারেল, কিন্তু মেক্সিকানদের মহা হৈচৈ-এর মধ্যে এইড তা শুনতে পেল না।
স্যার! দুঃখিত, স্যার, আমি কী শুনলাম … ফায়ার?
ঘাড় ফিরিয়ে তাকালেন জেনারেল, চোখ দুটো চকচক করছে। ওদের আসতে দাও।
স্যার?
আমার অর্ডার তুমি শুনতে পেয়েছে, মেজর। শিশু হত্যাকারী হিসেবে নাম কেনার কোনো ইচ্ছে আমার নেই। ফর গডস সেক, ভুলে এমনকি ডোন্ট ফায়ার শব্দ দুটো উচ্চারণ কোরো না। হাঁদা কোনো প্লাটুন কমান্ডার ভুল করতে পারে।
দ্রুত মাথা ঝাঁকায়ে ব্যস্ত সুরে মাইক্রোফোনে কথা বলল এইড।
মাফ করবেন, মি. প্রেসিডেন্ট, ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে বললেন জেনারেল কার্টিস, জানি, কমান্ডার ইন-চিফ-এর সরাসরি নির্দেশ অমান্য করে ক্যারিয়ারের বারোটা বাজিয়েছি। কিন্তু সব দিক বিবেচনা করে আমি বুঝেছি… চিন্তা করবেন না, জেনারেলকে থামিয়ে দিয়ে বললেন প্রেসিডেন্ট। সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছেন আপনি।
জেনারেল মেটক্যাফের দিকে ফিরলেন তিনি। সিনিয়রিটি তালিকায় জেনারেল কার্টিস কোথায় রয়েছেন আমি জানতে চাই না, দেখতে চাই আরেকটা স্টার পেয়েছেন উনি।
ওটা সত্যিই ওর পাওনা হয়েছে। আমি আপনার সাথে একমত, মি, প্রেসিডেন্ট।
কার্টিস আর আমি, মৃদু স্বরে বললেন প্রেসিডেন্ট। কোরিয়ায় একসঙ্গে লড়েছি। কোনো দিনও আর নারী, শিশুদের ওপর গুলি বর্ষণ করব না।
জেনারেল মেটক্যাফে অবশ্য খারাপ দিকটাও দেখলেন। এখন তো আমেরিকার জনতার কাছে আপনাকে জবাবদিহি করতে হবে।
মাথা ঝাঁকালেন প্রেসিডেন্ট।
তবে মানবিক দিকটা বিচার করে দেখতে হবে তাদেরও। ঠিকমতো ব্যাখ্যা করতে পারলে, শুধু দেশে নয়, ল্যাটিন আমেরিকাতেও আপনার জনপ্রিয়তা ও গুরুত্ব অনেক বেড়ে যাবে, মি. প্রেসিডেন্ট।
অ্যালান মারসিয়ার বললেন, দাঙ্গা বেঁধে যাবার আগে মেক্সিকান পুরুষগুলোকে ঘিরে ফেলবে আমাদের বাহিনী, ঘাড় ধাক্কা দিয়ে সীমান্তের ওপারে পাঠিয়ে দেয়া হবে ওদের।
এটা কথা বোধ হয় আমরা সবাই ভুলে যাচ্ছি।
ইয়েস, জেনারেল? জেনারেল মেটক্যাফের দিকে ফিরলেন প্রেসিডেন্টভ।
আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরি। শিল্পকর্মগুলো লুট করে দেবে টপিটজিন।
বিদেশি একজন অতিথির দিকে ফিরলেন প্রেসিডেন্ট, ভদ্রলোক টেবিলের আরেক প্রান্তে চুপচাপ বসে আছেন।
সিনেটর, তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন তিনি। দেখতেই পাচ্ছেন, আমেরিকান সৈনিকরা নিরুপায়। প্লিজ, আপনি কি বিকল্প প্ল্যানটা সম্পর্কে সবাইকে অবহিত করবেন? উপস্থিত সবার দিকে পালা করে তাকালেন তিনি।
টেবিলের দিকে তাকিয়ে সিনেটর পিট বললেন, প্ল্যানটা কী, অল্প সময়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়, মি. প্রেসিডেন্ট। পুরো ব্যাপারটা আমার ছেলে, ডার্ক পরিকল্পনা করেছে। সব যদি ঠিকঠাক মতো ঘটে তাহলে টপিটজিন অর্থাৎ রবার্ট ক্যাপেসটার আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরিতে হাত লাগাতে পারবে না, এইটুকু প্রতিশ্রুতি আপনাদের আমি দিতে পারি। তবে, প্ল্যানটা যদি ব্যর্থ হয়, ক্যাপেসটার পরিবার চিরকাল শাসন করবে মেক্সিকোকে এবং চিরকালের জন্য হারিয়ে যাবে আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরি।